ভূমিকা

‘ছুহবাত’ শব্দের অর্থ সাহচর্য।
‘ছাহাবী’ শব্দটি ‘ছুহবাত’ শব্দ থেকে উৎসারিত।
‘আছহাব’ শব্দটি ‘ছাহাবী’ শব্দের বহুবচন।
‘ছাহাবী’ বলা হয় এমন ব্যক্তিকে যিনি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবদ্দশায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন, কম হোক বেশি হোক তাঁর ‘ছুহবাত’ বা সাহচর্য লাভ করেছেন এবং ইসলামের ওপর অটল অবিচল থেকে মৃত্যু বরণ করেছেন।
পরবর্তী কালের ছালিহ ব্যক্তিদের তুলনায় তাঁদের মর্যাদা অনেক উর্ধে।
অবশ্য মর্যাদার ক্ষেত্রে তাঁদের নিজেদের মধ্যে তারতম্য ছিলো।
ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মাতের মধ্যে সার্বিক বিবেচনায় সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি আবু বাকর আছ্ ছিদ্দিক (রা)। তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)। তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি উসমান ইবনু আফফান (রা)। তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি আলী ইবনু আবী তালিব (রা)।
ছাহাবীদের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন।
তবে মনে হয়, তাঁদের সংখ্যা ছিলো কম-বেশি সোয়া এক লাখ।
তাঁদের প্রত্যেকের মাঝে বহুমুখী গুণের বিকাশ ঘটেছিলো।
এক একজন ছাহাবী ছিলেন এক একটি ইনস্টিটিউশন।

তাঁদের জীবনের কয়েকটি বৈশিষ্ট তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

১। আছহাবে রাসূল ছিলেন আল কুরআন ও আস্ সুন্নাহর একনিষ্ঠ অনুসারী
আছহাবে রাসূল হক আদায় করে আল কুরআন তিলাওয়াত করতেন।
তাঁরা ধীরে সুস্থে স্পষ্ট উচ্চারণে মধুর কণ্ঠে আল কুরআন তিলাওয়াত করতেন।

 আবু বাকর আছ ছিদ্দিক (রা), উমার ইবনুল খাত্তাব (রা), উসমান ইবনু আফফান (রা),
এবং আলী ইবনু আবী তালিব (রা) হৃদয়গ্রাহীভাবে আলকুরআন তিলাওয়াত করতেন।

 আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘উদের (রা) তিলাওয়াত।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘‘আল কুরআন যেমন নাযিল হয়েছে তেমন বিশুদ্ধভাবে তা তিলাওয়াত করে কেউ যদি পরিতৃপ্ত হতে চায় সে যেন ইবনু উম্মে আবদের মতো তিলাওয়াত করে।’’
কেউ কোন প্রশ্ন করলে তাৎক্ষণিকভাবে আল কুরআনের কোন আয়াত বা আয়াতাংশ দ্বারা তিনি তার জওয়াব দিতে পারতেন।

 আবু আবদিল্লাহ সালেমের (রা) তিলাওয়াত।
একদিন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়িশা আছ্ছিদ্দিকার (রা) ঘরে আসেন।
আয়িশা আছ্ছিদ্দিকা (রা) আসতে বিলম্ব করলেন।
বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে তিনি জানালেন যে মাসজিদে এক ব্যক্তি আল কুরআন তিলাওয়াত করছেন।
এক স্থানে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর তিলাওয়াত শুনছিলেন।
আয়িশা আছ্ছিদ্দিকার (রা) তিলাওয়াতও ছিলো চমৎকার। কার তিলাওয়াত শুনে তিনি বিলম্ব করলেন তা জানতে কৌতুহলী হয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাসজিদের দিকে যান।
দূরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আবু আবদিল্লাহ সালেমের (রা) তিলাওয়াত শুনে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলে ওঠেন, ‘‘সেই আল্লাহর জন্য সব প্রশংসা যিনি আমার উম্মাতের মধ্যে তোমার মতো ব্যক্তি সৃষ্টি করেছেন।’’
 উসাইদ ইবনু হুদাইরের (রা) তিলাওয়াত।
একরাতে ঘরে বসে তিনি আল কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন।
এক সময় তাঁর ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ শুনে তিনি তিলাওয়াত বন্ধ করে বাইরে আসেন।
উপরের দিকে তাকিয়ে তিনি এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে পান।
আলোর ঝালরের মতো একটা কিছু উপরের দিকে উঠে যাচ্ছিলো।
পরদিন সকাল বেলা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করে তিনি জানতে পেলেন যে তাঁর তিলাওয়াত শুনার জন্য আসমান থেকে একদল ফেরেশতা নেমে এসেছিলেন।
তিনি আল কুরআন তিলাওয়াত বন্ধ করলে তাঁরা ফিরে যাচ্ছিলেন।
সেই দৃশ্যই তিনি দেখতে পেয়েছেন।
নিশ্চয়ই এটি একটি মাত্র ঘটনা ছিলোনা। আমাদের অবগতির জন্য আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন একটি ঘটনাকে দৃশ্যমান করেছেন।
 আবু মূসা আল্ আশ‘আরীর (রা) তিলাওয়াত।
একদিন মুয়ায ইবনু জাবাল (রা) আবু মূসা আল আশ‘আরীকে (রা) জিজ্ঞেস করেন, ‘‘আপনি কিভাবে আল কুরআন তিলাওয়াত করেন?’’ জওয়াবে তিনি বলেন, ‘‘আমি বসে, দাঁড়িয়ে, সওয়ারীর উপর চলা অবস্থায় থেমে থেমে আল কুরআন তিলাওয়াত করি।’’
অর্থাৎ তিনি যেই কোন সুযোগে আল কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং অর্থের দিকে দৃষ্টি রেখে ধীরে সুস্থে তিলাওয়াত করতেন।
তাঁর তিলাওয়াত মানুষের মন কেড়ে নিতো।
মাসজিদে বসে তিনি আল কুরআন তিলাওয়াত শুরু করলে তাঁর চারদিকে লোকের ভীড় জমে যেতো।

আল কুরআন মৌল বিধান।
আস্ সুন্নাহ আল কুরআনের প্রায়োগিক রূপ।
আছহাবে রাসূল শুধু জানার জন্য আল কুরআন অধ্যয়ন করতেন না, তাঁরা তা অধ্যয়ন করতেন মানার জন্য।
তদুপরি আল কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা কিছু বলতেন তাঁরা তা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করতেন।
অর্থাৎ তাঁরা আল কুরআন ও আস্ সুন্নাহর রঙে নিজেদের জীবনকে রাঙিয়ে নিয়েছিলেন।

২। আছহাবে রাসূল ছিলেন সেরা দা‘য়ী ইলাল্লাহ
তখন যিনিই ঈমান আনতেন তিনিই হয়ে যেতেন দীনের মুবাল্লিগ বা দা‘য়ী ইলাল্লাহ।
 আবু বাকর আছ্ছিদ্দিক (রা)।
ইসলাম গ্রহণ করার পরই তিনি দা‘ওয়াতী কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ইসলাম গ্রহণ করেন উসমান ইবনু আফফান (রা), তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ (রা), আযযুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা), সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রা), উসমান ইবনু মাযউন (রা), আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা), আবদুর রহমান ইবনু আউফ (রা), আবু সালামা ইবনু আবদিল আসাদ (রা) ও আল আরকাম ইবনু আবিল আরকাম (রা)।
উল্লেখ্য যে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নিকট দা‘ওয়াত পৌঁছিয়েছিলেন।
কিন্তু তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না।
আবুৃ বাকর আছ্ছিদ্দিক (রা) তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে তাঁদেরকে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট নিয়ে আসেন।
এবার তাঁরা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণ করেন।

 তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ (রা)।
তাঁর ওপর নজরদারি ছিলো। সুযোগ করে তিনি বেরিয়ে পড়তেন।
তিনি মাঝে মধ্যে দূর দূরান্তে মরুবাসী বেদুইনদের মাঝে চলে যেতেন।
কখনো কখনো ঘোড়ায় চড়ে মাক্কার চারদিকে ঘুরতেন। কোন কাফিলা দেখলে এগিয়ে গিয়ে কথা বলতেন এবং দীনের দা‘ওয়াত দিতেন।
 আবু মূসা আল আশ‘আরী (রা)।
তিনি ছিলেন ইয়ামানের অধিবাসী।
মাক্কায় এক ব্যক্তি নতুন দীনের কথা বলছেন জানতে পেরে তিনি অনতিবিলম্বে মাক্কায় আসেন। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সাক্ষাত করেন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণ করে আদ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহর কাজ করার জন্য ইয়ামান ফিরে যান।
বেশ কয়েক বছর পর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে দেখা করার জন্য আবু মূসা আল আশ‘আরী (রা) আল মাদীনায় পৌঁছেন।
তখন তাঁর সাথে ছিলেন তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্য থেকে বাছাই করা পঞ্চাশ জন ব্যক্তি।
 তুফাইল ইবনু আমর আদ্ দাওসী (রা)।
তিনি তিহামা অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন।
তিনি ছিলেন একজন কবি ও ব্যবসায়ী।
মাক্কায় এলে তিনি মাক্কার নেতাদের মেহমান হতেন।
একবার মাক্কায় এলে তাঁকে জানানো হলো যে মুহাম্মাদ নামে একজন যাদুকরের আবির্ভাব ঘটেছে।
তার উচ্চারিত কথাগুলো মানুষের চিন্তা-চেতনা বিগড়ে দেয়।
মুশরিক নেতারা তাঁকে তাওয়াফের জন্য দুই কানে তুলা পুরে যাওয়ার পরামর্শ দেয় যাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথাগুলো তাঁর কানে না যায়।
কা‘বার চত্বরেই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন।
তাওয়াফকালে কানে তুলা থাকা সত্বেও আল কুরআনের কিছু কিছু কথা তুফাইল ইবনু আমর (রা) শুনতে পান।
এতে তাঁর মনে দারুন কৌতুহল সৃষ্টি হয়।
কিছুক্ষণ পর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ঘরে চলে যান।
তাওয়াফ শেষে তুফাইল ইবনু আমর (রা) কান থেকে তুলা ফেলে দিয়ে মুশরিক নেতাদের দৃষ্টি এড়িয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে আসেন এবং তিনি কী পড়ছিলেন তা জানতে চান।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে আল কুরআনের দুইটি ছোট্ট অংশ পড়ে শুনান।
কবি তুফাইল (রা) বুঝতে সক্ষম হন অবশ্যই এটি মানুষের কথা নয়।
তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
অতপর দা‘য়ী ইলাল্লাহ হিসেবে ভূমিকা পালনের জন্য তাঁর নিজের এলাকা তিহামা অঞ্চলে চলে যান।
বহু সংখ্যক লোককে তিনি মুসলিম বানান।
এঁদের মধ্যে অতি বিশিষ্ট একজন ছিলেন আবু হুরাইরা (রা) মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীস সংরক্ষণে যাঁর স্থান সকলের উর্ধে।
বেশ কয়েক বছর পর তিনি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে দেখা করার জন্য আল মাদীনায় পৌঁছেন।
তখন তাঁর সাথে ছিলেন নও মুসলিমদের আশিটি পরিবারের সদস্যবৃন্দ।

 উমাইর ইবনু ওয়াহাব (রা)।
উমাইর ইবনু ওয়াহাব বদর যুদ্ধে মুশরিক বাহিনীর একজন সৈনিক ছিলেন।
বদর যুদ্ধে মাক্কার বড়ো বড়ো মুশরিক নেতা নিহত হয়।
এতে তাঁর মনে দারুণ ব্যথা ছিলো।
একদিন কা‘বার চত্বরে তাঁর বন্ধু সাফওয়ান ইবনু উমাইয়ার সাথে গোপনে পরামর্শ করে তিনি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অতর্কিত হামলা চালিয়ে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আলমাদীনায় আসেন।
মাসজিদে নববীতে এসে তিনি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব কাছে গিয়ে বসেন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কা‘বার চত্বরে সাফওয়ান ইবনু উমাইয়ার সাথে তাঁর কী কী কথা হয়েছিলো তা তাঁকে বলে দেন।
এতে উমাইর ইবনু ওয়াহাব বিস্মিত হন।
সংগে সংগে তাঁর মনে এই দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হয়ে যায় যে এই কথাগুলো নিশ্চয়ই আল্লাহ-ই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানিয়েছেন।
কেননা সেখানে তো তৃতীয় কোন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলো না।
তিনি বুলন্দ কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘আশহাদু আন্নাকা রাসূলুল্লাহ’ (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, অবশ্যই আপনি আল্লাহর রাসূল)।
মুমিন উমাইর ইবনু ওয়াহাব (রা) কিছু দিন আল মাদীনায় থাকেন।
অতপর দা‘য়ী ইলাল্লাহ হিসেবে ভূমিকা পালনের জন্য মাক্কায় ফিরে যান।
বলিষ্ঠভাবে দা‘ওয়াতী কাজ করতে থাকেন।
তাঁর প্রচেষ্টায় মাক্কার বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করেন।
কিছুদিন পর তিনি নও মুসলিমদের একটি দল নিয়ে আল মাদীনায় পৌঁছেন।

 খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ (রা)।
শুধু যোদ্ধা হিসেবেই নয়, দা‘য়ী ইলাল্লাহ হিসেবেও খালিদ ইবনুল ওয়ালীদের (রা) রেকর্ড খুবই উজ্জ্বল।
বহু সংখ্যক লোক তাঁর প্রচেষ্টায় ইসলাম গ্রহণ করেন।
হিজরী নবম সনে তাঁর প্রচেষ্টায় ইসলাম গ্রহণ করে বানু জুজাইমা এবং হিজরী দশম সনে ইসলাম গ্রহণ করে বানু আবদিল মাদ্দান।
 দিমাম ইবনু সা‘লাবা (রা)।
তিনি ছিলেন নাজদ অঞ্চলের অধিবাসী।
বানু সা‘দের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি।
শেষ নবীর আগমনের খবর শুনে তিনি আল মাদীনা আসেন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সাক্ষাত করে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
আল মাদীনা থেকে ফিরে গিয়ে তিনি আত্ তাওহীদের ওপর এমন হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য রাখেন যা শুনে বানু সা‘দের সকল সদস্য ইসলাম গ্রহণ করেন।
 খাদীজা বিনতু খুয়াইলিদ (রা)।
তিনি ছিলেন বানু আসাদ-এর এক নেক সন্তান।
তিনি ছিলেন একজন পবিত্রা মহিলা।
লোকেরা তাঁর নাম দিয়েছিলো আত্ তাহিরা।
ইতোপূর্বে তিনি দুইবার বিধবা হন।
আল আমীন মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই আত্ তাহিরাকে বিয়ে করেন।
তিনি প্রথম মুসলিম হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন।
ওই সময় বানু আসাদে পনর জন খ্যাতিমান পুরুষ ছিলেন।
সেই পনর জন ব্যক্তির মধ্যে দশজন খাদীজার (রা) প্রচেষ্টায় ইসলাম গ্রহণ করেন।
 উম্মু শুরাইক (রা)।
তিনি মাক্কার অধিবাসী ছিলেন।
ইসলাম গ্রহণ করেই তিনি দা‘য়ী ইলাল্লাহ হিসেবে ভূমিকা পালন শুরু করেন।
মাক্কার মুশরিকদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তিনি মহিলাদের মধ্যে দা‘ওয়াতী কাজ করতেন।
 মুস‘য়াব ইবনু উমাইর (রা)।
ইসলাম গ্রহণ করায় তাঁকে একটি কুঠরিতে বন্দী করে রাখা হয়।
একদিন তিনি বের হতে সক্ষম হন। চলে যান হাবশা।
কিছুকাল পর সেখান থেকে ফিরে এলে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুস‘য়াব ইবনু উমাইরকে (রা) দা‘য়ী ইলাল্লাহ হিসেবে ইয়াসরিব পাঠান।
ইয়াসরিবের উসাইদ ইবনু হুদাইর (রা), সা‘দ ইবনু মুয়ায (রা), সা‘দ ইবনু উবাদা (রা)সহ বহু সংখ্যক লোক তাঁর প্রচেষ্টায় ইসলাম গ্রহণ করেন।
আল মাদীনায় ইসলামী গণভিত্তি রচনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

সেই যুগে কোন প্রিন্ট মিডিয়া বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ছিলোনা। এককভাবে কিংবা যুথবদ্ধভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে ছাহাবীগণ দশ লক্ষ সাতাশ হাজার বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট আরব দেশের সর্বত্র দীনের আওয়াজ পৌঁছিয়ে দেন।

৩। আছহাবে রাসূলের ঈমানী দৃঢ়তা ছিলো অসাধারণ
তখন ঈমানের ঘোষণা দেওয়া মানেই ছিলো জীবনের ঝুঁকি নেওয়া।
ঈমানের বলে বলীয়ান আছহাবে রাসূল কোন বাধা-প্রতিবন্ধকতার কাছে হার মানেননি।
নির্যাতিত নিপীড়িত হয়েও তাঁরা আল্লাহর একত্ব ও সার্বভৌমত্বের কথাই উচ্চারণ করে গেছেন।
 উসমান ইবনু আফফান (রা)।
ইসলাম গ্রহণ করায় তিনি তাঁর চাচা আল হাকামের হাতে নির্যাতিত হন।
বার বার দৈহিক নির্যাতনের শিকার হয়েও তিনি বলেন, ‘‘আপনাদের যা ইচ্ছা তা-ই করুন। এই দীন আমি কখনো ত্যাগ করবো না।’’
একবার তাঁকে একাধারে কয়েকদিন কিছু খেতে বা পান করতে দেওয়া হয়নি।
তিনি ক্ষুধা ও পিপাসায় দারুণ কষ্ট পান। কিন্তু ইসলাম ত্যাগ করতে রাজি হননি।
এক পর্যায়ে ঘরদোর, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভেড়া-ঘোড়া-উট সব কিছু পেছনে ফেলে তিনি হাবশায় হিজরাত করেন।
 মুস‘য়াব ইবনু উমাইর (রা)।
তিনিও তাঁর গোত্রের লোকদের দ্বারা নির্যাতিত হন।
বেশ কিছু দিন তিনি কুঠরিতে বন্দী অবস্থায় দিন কাটান।
অতপর কোন প্রকারে সেখান থেকে বেরিয়ে ঈমানের ঐশ্বর্য বুকে নিয়ে মাক্কা ত্যাগ করে হাবশা চলে যান।
 ইয়াসির (রা)।
তিনি ছিলেন ইয়ামানের অধিবাসী।
আবু হুজাইফা ইবনুল মুগীরা আল মাখযুমীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তিনি মাক্কায় অবস্থান করতে থাকেন।
তিনি ছিলেন প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের একজন।
সারাদিন রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখে তাঁকে শাস্তি দেওয়া হতো।
দিনের পর দিন তিনি এই শাস্তি ভোগ করেছেন। কিন্তু ইসলাম ত্যাগ করতে রাজী হননি।
একদিন আবু জাহল একটি লাঠি দিয়ে তাঁকে অনবরত পিটাতে থাকে।
পিটুনি খেতে খেতে তিনি শহীদ হয়ে যান।
 সুমাইয়া বিনতু খুববাত (রা)।
তিনি ছিলেন ইয়াসির (রা)-এর স্ত্রী।
স্বামীর সাথে তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন।
তাঁকেও সারাদিন রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে শাস্তি দেওয়া হতো।
একদিন দিনভর শাস্তি ভোগের পর তিনি ক্লান্ত দেহে শ্লথ গতিতে তাঁর ডেরার দিকে ফিরছিলেন।
পথে তিনি আবু জাহলের সামনে পড়েন।
আবু জাহল তাঁকে ইসলাম ত্যাগ করতে বলে।
তিনি সম্মত হলেন না।
ক্রুদ্ধ হয়ে আবু জাহল তাঁকে লক্ষ্য করে তার হাতের বল্লমটি ছুঁড়ে মারে।
সেই বল্লম তাঁর লজ্জাস্থান ভেদ করে বেরিয়ে যায়।
সুমাইয়া (রা) ঈমানের ঐশ্বর্য বুকে ধারণ করে শাহাদাত বরণ করেন।

 আবদুল্লাহ ইবনু ইয়াসির (রা)।
আববা আম্মার সাথে তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন।
ইসলাম ত্যাগ করার নির্দেশ উপেক্ষা করায় আবু জাহল তাঁকে একটি লাঠি দিয়ে অনবরত পিটাতে থাকে।
আঘাতে আঘাতে জর্জরিত শরীর নিয়ে এক সময় তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

 বিলাল ইবনু রাবাহ (রা)।
তিনি ছিলেন পাষন্ড উমাইয়া ইবনু খালাফের একজন ক্রীতদাস।
ইসলাম গ্রহণ করায় তাঁর ওপর অত্যাচারের স্টীম রোলার চালানো হয়।
রাতের বেলা তাঁকে খুঁটির সাথে বেঁধে তাঁর সারা শরীরে চাবুক মারা হতো।
শরীরের চামড়া ফেটে গিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তো।
দিনের বেলা তাঁকে কা‘বার চত্বরে রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো।
একদিন আবু জাহলের নির্দেশে তাঁকে উদোম করে গরম বালির ওপর শোয়ানো হয়।
পিঠে চাপানো হয় এক খন্ড ভারি পাথর।
শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিলো তাঁর।
এমতাবস্থায় আবু জাহল নিকটে এসে বলে, ‘বাঁচতে যদি চাস মুহাম্মাদের দল ত্যাগ কর।’
এই কঠিন পরীক্ষায় নিপতিত হয়ে বিলাল ইবনু রাবাহ (রা) ক্ষীণ কণ্ঠে, ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ উচ্চারণ করে তাঁর নিখাদ ঈমানের প্রমাণ পেশ করেন।

 উম্মু শুরাইক (রা)।
তিনি মুশরিকদের স্ত্রীদের কাছে চলে যেতেন।
তাদের সাথে আলাপ করতেন। মাঝে মধ্যে আল কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে তাদেরকে দীনের দা‘ওয়াত দিতেন।
বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়।
তাঁর জন্যও সারাদিন রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।
রোদের প্রচন্ডতায় দারুণ পিপাসায় কাতর হয়ে তিনি ‘পানি’ ‘পানি’ বলে চিৎকার করতেন।
কিন্তু মুশরিক নেতাদের ভয়ে কেউ এক পেয়ালা পানি নিয়ে এগুতো না।
তৃতীয় দিন তাঁর অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়ে।
তিনি নির্বোধের মতো হয়ে যান।
ঐ সময় এক ব্যক্তি আকার ইংগিতে তাঁকে বুঝাতে চাইলো, ‘তুমি যে এক আল্লাহর ওপর ঈমান নিয়ে বসে আছ, সেই জন্যই তো তোমার এই শাস্তি। তুমি যদি সেই চিন্তা থেকে সরে আস তাহলে তোমাকে মুক্তি দেওয়া হবে।’
লোকটি আকার ইংগিতে তাঁকে যা বুঝাতে চেয়েছে তিনি তা বুঝতে সক্ষম হন এবং চিৎকার দিয়ে বলে ওঠেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি তো এখনো সেই ঈমানের ওপরই অটল আছি।’

 লুবাইনা (রা)।
তিনি ছিলেন উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) ক্রীতদাসী।
উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) তখনো ইসলামের কট্টর দুশমন।
তিনি ছিলেন খুবই বলবান পুরুষ।
তাঁর ক্রীতদাসী লুবাইনা (রা) ইসলাম গ্রহণ করেছেন বুঝতে পেরে তিনি তাঁকে চাপ দেন ইসলাম ত্যাগ করতে।
কোন ফলোদয় হলো না।
এবার তিনি একটি চাবুক এনে লুবাইনাকে (রা) পিটাতে শুরু করেন।
অনেকক্ষণ পিটিয়ে তাঁর শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে তিনি তাঁকে ইসলাম ত্যাগ করতে বলেন।
লুবাইনা (রা) রাজি হলেন না।
তাঁকে আবারো পিটানো হলো। এতেও উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) লক্ষ্য হাছিল হলো না।
বার বার পিটিয়ে উমার ইবনুল খাত্তার (রা) ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েন এবং বলেন, ‘লুবাইনা, তোকে পিটাবার শক্তি আর আমার গায়ে নেই।’
রক্তাক্ত ও বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে ঈমানের বলে বলীয়ান লুবাইনা (রা) বলে ওঠেন, ‘আপনি যদি ইসলাম গ্রহণ না করেন আল্লাহ আপনার কাছ থেকে এর প্রতিশোধ নেবেন।’

 খাববাব ইবনুল আরাত (রা)।
তিনি ছিলেন উম্মু আন্মার নামক এক মহিলার ক্রীতদাস।
উম্মু আন্মারের একটি কারখানা ছিলো যেখানে লোহা দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা হতো।
খাববাব (রা) ঐ কারখানায় কাজ করতেন।
তিনি ছিলেন প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের একজন।
তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন জানতে পেরে উম্মু আন্মার কয়েকজন পুরুষ সাথী নিয়ে কারখানায় আসে।
ওরা বলে, ‘তুমি নাকি ধর্মত্যাগী হয়েছো?’
দৃঢ় কণ্ঠে খাববাব (রা) বললেন, ‘না, আমি ধর্মত্যাগী হইনি। আমি লা শারীক আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছি।’
তিনি যেনো ভিমরুলের চাকে ঢিল ছুঁড়লেন।
কিল, ঘুষি, লাথি ও লাঠি পেটা শুরু হয়।
দারুণ আহত হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
তাঁকে পদ দলিত করা হয়।
এরপর প্রতিদিনই তাঁকে শাস্তি দেওয়া হতে থাকে।
কখনো কখনো উম্মু আন্মার হাপরে লোহার পাত গরম করে তাঁর শরীরে সেঁকা দিতো।
চামড়া পুড়ে যেতো।
রক্ত গড়িয়ে পড়তো।
একদিন উম্মু আন্মার হাপরে কতগুলো পাথর খন্ড গরম করে বিছিয়ে দেয়।
তার নির্দেশে লোকেরা খাববাবকে (রা) উদোম করে সেই গরম পাথর খন্ডগুলোর ওপর শুইয়ে দেয়।
একজন লোক তাঁর বুকের ওপর দাঁড়িয়ে যায়।
গরম পাথরের উত্তাপে তাঁর পিঠের চামড়া পুড়ে যায়।
রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে।
এমন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েও খাববাব ইবনুল আরাত (রা) ঈমানের ওপর অটল থাকেন।
ঈমানের খাটিত্বের প্রমাণ পেশ করেন।

৪। আছহাবে রাসূল ছিলেন ত্যাগী মানুষ
দা‘ওয়াতের কাজে, জিহাদের কাজে, অভাবী মানুষের প্রয়োজন পূরণে এবং জনহিতকর কাজে তাঁরা অকাতরে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করতেন।
 আবু বাকর আছ্ ছিদ্দিক (রা)।
ইসলাম গ্রহণের সময় তাঁর সঞ্চয় ছিলো ৪০ হাজার দিরহাম। হিজরাতের সময় ছিলো মাত্র ৫ হাজার দিরহাম।
প্রধানত নও মুসলিমদের পুনর্বাসন ও নির্যাতিত দাস-দাসীদেরকে ক্রয় করে মুক্তির ব্যবস্থায় ব্যয় হয় এই অর্থ।
তাবুক অভিযানের প্রাক্কালে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আহবানে সাড়া দিয়ে তিনি তাঁর সমুদয় সম্পদ এনে জমা দেন।
পরিবার সদস্যদের জন্য তিনি কিছুই রেখে আসেন নি।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক প্রশ্নের জওয়াবে তিনি বলেন, ‘‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই তাদের জন্য যথেষ্ট।’’
 আবদুর রহমান ইবনু আউফ (রা)।
তাবুক অভিযানের প্রাক্কালে তিনিও সমুদয় সম্পদ এনে জমা দেন।
 উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)।
তাবুক অভিযানের প্রাক্কালে তাঁর সমুদয় সম্পদের ৫০ ভাগ জমা দেন।
 উসমান ইবনু আফফান (রা)।
আল মাদীনায় অনেকগুলো কূপ ছিলো। কিন্তু সুপেয় পানি পাওয়া যেতো শুধু রুমা কূপে।
এক ইয়াহুদী ছিলো সেই কূপের মালিক। সে বিনা পয়সায় কাউকে এক গ্লাস পানি দিতোনা।
উসমান ইবনু আফফান (রা) আঠার হাজার দিরহামের বিনিময়ে সেই ইয়াহুদী থেকে রুমা কূপ কিনে নিয়ে সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য ওয়াকফ করে দেন।
মুছাল্লীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মাসজিদে নববীতে ছালাত আদায় করা কষ্টকর হয়ে ওঠে।
উসমান ইবনু আফফান (রা) পার্শ্ববর্তী জমি কিনে তা মাসজিদে নববীর জন্য ওয়াকফ করে দেন।
তিনি তাবুক অভিযানে ১০ হাজার মুজাহিদের বাহন ও যাবতীয় সরঞ্জামের ব্যবস্থা করেন।
 আবু তালহা যায়িদ ইবনু সাহল আল আনছারী (রা)।
‘‘তোমরা প্রকৃত পুণ্য পেতে পারো না যেই পর্যন্ত না তোমাদের প্রিয় বস্ত্তগুলো আল্লাহর পথে ব্যয় কর।’’
(আলে ইমরান -৯২ আয়াত) নাযিল হলে আবু তালহা ভাবতে থাকেন।
তাঁর মন বলে ওঠে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্ত্ত একটি বাগান। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট গিয়ে তিনি এটি দান করে দেওয়ার ঘোষণা দেন।

 আবুদ্ দাহদাহ ছাবিত আল আনছারী (রা)।
‘‘এমন কে আছে যে আল্লাহকে করযে হাসানা দেবে যা তিনি বহু গুণ বাড়িয়ে ফেরত দেবেন।’’
আল হাদীস-১১।
এই আয়াত নাযিল হলে তা নিয়ে ছাহাবীদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা চলতে থাকে।
এই আয়াত আবুদ্ দাহ্দাহর (রা) নিকট পৌঁছলে তিনি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট গিয়ে তাঁর হাতে হাত রেখে বলেন, ‘‘আমি আমার বাগানটি আমার রবকে করযে হাসানা হিসেবে দিয়ে দিলাম।’’
সেই বাগানে ছিলো ছয়শত খেজুর গাছ।
গাছগুলোতে প্রচুর খেজুর ধরতো।
সেইগুলো বিক্রয় করে তিনি মোটা অংকের অর্থ লাভ করতেন।
বাগানের একাংশে ছিলো তাঁর বসত বাড়ি।
ফিরে এসে স্ত্রীকে বললেন, ‘‘উম্মুদ দাহ্দাহ, আমি তো এই বাগানটি আমার রবকে করযে হাসানা হিসেবে দিয়ে এসেছি।’’
যেমন স্বামী তেমন স্ত্রী।
তিনি বললেন, ‘‘আপনি খুব লাভজনক ব্যবসাই করেছেন।’’
 তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ (রা)।
একবার হাদরামাউত থেকে ব্যবসার মুনাফা হিসেবে তাঁর হাতে আসে ৭০ হাজার দিরহাম।
রাতে বিছানায় শুয়ে তিনি ছটফট করছিলেন।
স্ত্রীর প্রশ্নের জওয়াবে তিনি বলেন, ‘‘সেই সন্ধ্যা থেকে আমি ভাবছি, এতোগুলো দিরহাম ঘরে রেখে ঘুমুলে একজন মানুষের তার রবের প্রতি কী ধারণা পোষণ করা হয়?’’
স্ত্রী তাঁকে রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে সকাল বেলা সেইগুলো বিতরণের পরামর্শ দেন।
তিনি স্ত্রীর কথায় আশ্বস্ত হয়ে রাত কাটান।
সকালে অনেকগুলো থলে সংগ্রহ করে দিরহামগুলো ভাগ করে কম বিত্তবান লোকদের মাঝে বিতরণ করে দেন।
 আবদুর রহমান ইবনু আউফ (রা)।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওফাতের পরবর্তী কোন এক সময়ের ঘটনা।
আল মাদীনায় হৈ চৈ পড়ে গেলো।
সাতশত উটের কাফিলা ঢুকছে শহরে।
প্রতিটি উটের পিঠে খাদ্যশস্য ভর্তি অনেকগুলো বস্তা।
আয়িশা আছ্ছিদ্দিকা (রা) এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এই বাণিজ্য কাফিলা কার?’’ লোকটি জানালো যে এটি আবদুর রহমান ইবনু আউফের (রা)।
আয়িশা আছ্ছিদ্দিকা (রা) বললেন, আমি রাসূলুল্লাহকে বলতে শুনেছি, ‘‘আমি যেন আবদুর রহমান ইবনু আউফকে পুলছিরাতের ওপর একবার হেলে গিয়ে আবার সোজা হয়ে উঠতে দেখলাম।’’
সেই ব্যক্তির মাধ্যমে কথাগুলো আবদুর রহমান ইবনু আউফের (রা) কানে গেলো।
তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলে ওঠলেন, ‘‘ইনশাআল্লাহ, আবদুর রহমান সোজা হয়েই জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’
অতপর তাঁর নির্দেশে তাঁর কর্মচারিরা সাতশত উটের পিঠের বস্তাগুলো আল মাদীনার অধিবাসীদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়।
এক বর্ণনা মতে, সাতশত উটও একইভাবে বণ্টন করে দেওয়া হয়েছিলো।


৫। আছহাবে রাসূল ছিলেন অল্পে তুষ্ট মানুষ
আছহাবে রাসূল ভোগবাদী ছিলেন না।
তাঁরা বিলাসী ছিলেন না।
তাঁদের চাহিদার তালিকা দীর্ঘ ছিলো না।
তাঁরা অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন।
অল্পে তুষ্টি ছিলো তাঁদের জীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
 আবু বাকর আছ ছিদ্দিক (রা)।
রাষ্ট্র প্রধান হয়েও তিনি বছরে মাত্র আড়াই হাজার দিরহাম ভাতা নিতেন।
বাইতুল মাল থেকে বছরে দুই সেট পোশাক পেতেন।
তিনি সাদামাটা জীবন যাপন করতেন।
 উমার উবনুল খাত্তাব (রা)।
রাষ্ট্র প্রধান হয়েও তিনি বছরে পাঁচ হাজার দিরহাম ভাতা নিতেন।
তিনি সাদামাটা জীবন যাপন করতেন।

 উসমান ইবনু আফফান (রা)।
উসমান ইবনু আফফান (রা) একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন।
ব্যবসার মুনাফার একাংশ দিয়ে তিনি সংসার চালাতেন।
মুনাফার বাকি অংশ এবং বাইতুলমাল থেকে প্রাপ্ত ভাতা তিনি জনগণের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন।
তিনি তুলনামূলক ভালো খেতেন, ভালো পোশাক পরতেন।
তবে বিলাসিতা করতেন না।

 আলী ইবনু আবী তালিব (রা)।
তিনি বছরে পাঁচ হাজার দিরহাম ভাতা নিতেন।
তিনি সাদামাটা জীবন যাপন করতেন।
 আয্যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা)।
তিনি ছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের একজন।
ব্যবসার মুনাফার একাংশ দিয়ে তিনি সংসার চালাতেন।
মুনাফার বাকি অংশ এবং এক তাঁর মালিকানাধীন এক হাজার দাসের আয়কৃত সমুদয় অর্থ মানুষের মাঝে বিতরণ করে দিতেন।
তিনি সাদামাটা জীবন যাপন করতেন।
 আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা)।
তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, ঢাল, তলোয়ার এবং ঘোড়ার পিঠে তাঁর বসার আসন ঠিকঠাক পেলেই তিনি সন্তুষ্ট থাকতেন।
তিনি সাদামাটা জীবন যাপন করতেন।
 আবু যার আলগিফারী (রা)।
তিনি খুবই সাদামাটা জীবন যাপন করতেন।
একবার এক ব্যক্তি তাঁর বাসস্থানে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘‘আপনার আসবাবপত্র কোথায়? তিনি বললেন, ‘‘আখিরাতে আমার একটি ঘর আছে। আমি আমার আসবাবপত্র সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি।’’

 সায়ীদ ইবনু আমের আল জুমাহী (রা)।
উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) তাঁকে হিম্স নামক স্থানে গভর্ণর নিযুক্ত করেন।
একবার হিম্স থেকে একদল লোক আল মাদীনায় এসে আমীরুল মুমিনীন উমার উবনুল খাত্তাবের (রা) সাথে সাক্ষাত করেন।
আলাপচারিতার এক পর্যায়ে উমার (রা) হিম্সের অভাবী মানুষদের একটি তালিকা তৈরি করে তাঁকে দিতে বলেন।
হিম্সবাসীরা একস্থানে বসে মত বিনিময় করে একটি তালিকা তৈরি করে তা নিয়ে এসে উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) হাতে দেন।
তালিকার প্রথমেই সায়ীদ ইবনু আমের নামটি দেখে আমীরুল মুমিনীন জিজ্ঞেস করেন, ‘‘এ কোন সায়ীদ?’’
তাঁরা তাঁকে অবহিত করেন যে ইনি তাঁদের গভর্ণর।
তাঁরা জানান যে কখনো কখনো এমনও দিন যায় যে তাঁর চুলার ওপর পাতিল বসেনা।
এই কথা শুনে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) কেঁদে দিলেন।
অতপর তিনি হিমসবাসী বিভিন্ন ব্যক্তির জন্য বিভিন্ন অংকের অর্থ বরাদ্দ করেন।
সায়ীদ ইবনু আমেরের (রা) জন্য তিনি বরাদ্দ করেন এক হাজার দীনার (স্বর্ণমুদ্রা)।
হিম্সবাসীরা ফিরে গিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিদেরকে তাদের অর্থ পৌঁছে গভর্ণরের কাছে এসে তাঁর থলেটি তাঁকে বুঝিয়ে দেন।
থলের মুখ খুলে দীনারগুলো দেখেই সায়ীদ বলেন উঠেন, ‘‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’’
ভেতর থেকে স্ত্রী বলেন, ‘‘কি হয়েছে, আমীরুল মুমিনীন কি মারা গেছেন?’’
সায়ীদ বললেন, ‘‘না, তার চেয়েও বড়ো কিছু।’’
স্ত্রী বললেন, ‘‘মুসলিমদের ওপর কি কোন মুছীবাত আপতিত হয়েছে?’’
সায়ীদ বললেন, ‘‘না, বরং তার চেয়েও বড়ো কিছু।’’
স্ত্রী বললেন, ‘‘ সেই বড়ো কিছুটা কী?’’
সায়ীদ বললেন, ‘‘আমার আখিরাত বরবাদ করার জন্য দুনিয়া আমার ঘরে ঢুকে পড়েছে। আমার ঘরে বিপদ এসে পড়েছে।’’
স্ত্রী বললেন, ‘‘বিপদটা দূর করে দিন।’’
সায়ীদ বললেন, ‘‘এই ব্যাপারে আপনি কি আমাকে সহযোগিতা করবেন?’’
স্ত্রী বললেন, ‘‘অবশ্যই।’’
অতপর সায়ীদ দীনারগুলো কতগুলো থলেতে বিভক্ত করে হিম্সের অভাবী মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন।
আছহাবে রাসূল জীবন ধারনের প্রকৃত প্রয়োজন পূরণ হলেই পরিতৃপ্ত থাকতেন।
দুনিয়ার প্রতি তাঁরা ছিলেন নির্মোহ।
দুনিয়ার ওপর আখিরাতকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন বলেই তাঁরা অল্পে তুষ্ট মানুষের সর্বোচ্চ নমুনা হতে পেরেছিলেন।


৬. আছহাবে রাসূল ছিলেন বীর যোদ্ধা
 উমাইর ইবনুল হুমাম আল আনছারীর (রা) বীরত্ব।
উমাইর ইবনুল হুমাম (রা) একজন লড়াকু ব্যক্তি ছিলেন।
বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ৩১৩ জনের তিনি ছিলেন একজন।
যুদ্ধের প্রাক্কালে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুজাহিদদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন।
সেই ভাষণে তিনি বলেন, ‘‘এবার তৈরি হয়ে যাও জান্নাতের জন্য, যার বিস্তৃতি আসমান ও পৃথিবীর বিস্তৃতির সমান।’’
এই কথা শুনে উমাইর ইবনুল হুমাম আল আনছারী (রা) জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, জান্নাতের বিস্তৃতি আসমান ও পৃথিবীর বিস্তৃতির সমান?’’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘‘হ্যাঁ।’’
উমাইর ইবনুল হুমাম (রা) বলে ওঠলেন,‘‘বাহ্ বাহ!’’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘‘এতে অবাক হয়ে বাহ্ বাহ্ বলার কী আছে?’’
উমাইর ইবনুল হুমাম (রা) বললেন, ‘‘না, আল্লাহর কসম, আমি এই কথা এই আশায় বলেছি যাতে আমি এর অধিবাসী হতে পারি।’’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘‘হ্যাঁ, তুমি অবশ্যই জান্নাতের অধিবাসী হবে।’’
এই কথা শুনে উমাইর ইবনুল হুমাম (রা) তুনীর থেকে কিছু খেজুর বের করে খেতে শুরু করেন।
হঠাৎ তিনি বলেন ওঠেন, ‘‘এই খেজুরগুলো শেষ করা পর্যন্ত যদি আমি বেঁচে থাকতে চাই সে তো দীর্ঘ সময়।’’
এই কথা বলে তিনি অবশিষ্ট খেজুরগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেন।
তিনি তলোয়ার মুক্ত করে বীর বিক্রমে শত্রু সেনাদের দিকে এগিয়ে চলেন।
নির্ভীকচিত্তে শত্রু সেনাদের মাঝে ঢুকে পড়েন।
ডানে বাঁয়ে তলোয়ার চালাতে থাকেন।
এক সময় এক শত্রু সেনার আঘাতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন।
রক্তক্ষরণে নির্জীব হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
পৌঁছে যান সেই আকাংখিত মানযিলে যার বিস্তৃতি আসমান ও পৃথিবীর বিস্তৃতির সমান।

 আবু দুজানা সিমাকের (রা) বীরত্ব।
আবু দুজানা সিমাক আল আনছারী (রা) একজন বীর যোদ্ধা ছিলেন।
বদর যুদ্ধে তিনি অংশ গ্রহণ করেন।

উহুদ যুদ্ধের প্রাককালে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি তলোয়ার হাতে নিয়ে বলেন, ‘‘এটি কে নেবে?’’
উপস্থিত সকলেই হাত বাড়িয়ে বলেন, ‘‘আমি, আমি।’’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘‘কে পারবে এর হক আদায় করতে?’’
এবার সবাই চুপ।
আবু দুজানা (রা) জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, এর হক কী?’’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘‘এর হক হচ্ছে, এর দ্বারা কোন মুসলিমকে হত্যা না করা এবং এটি নিয়ে কাফিরদের ভয়ে পালিয়ে না যাওয়া।’’
আবু দুজানা (রা) বললেন, ‘‘আমি পারবো এর হক আদায় করতে।’’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তলোয়ারটি তাঁর হাতেই তুলে দেন।

যুদ্ধ শুরু হলে আবু দুজানা (রা) বীর বিক্রমে শত্রু সেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।
যেই দিকেই তিনি এগুতেন সেই দিকেই ত্রাস ছড়িয়ে পড়তো।

যুদ্ধের এক পর্যায়ে কুরাইশ অশ্বারোহী বাহিনীর আক্রমণে মুসলিমরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
উহুদের পাদদেশে যেই কয়জন মুসলিম মুজাহিদ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিলেন আবু দুজানা (রা) ছিলেন তাঁদের একজন।
শত্রু সেনাদের তীরের আঘাতে তাঁর পিঠ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিলো।
কিন্তু তিনি স্থান ত্যাগ করেননি।
কোন শত্রু সেনা খুব কাছে এসে গেলে রক্তাক্ত শরীর নিয়েই তিনি তলোয়ার চালিয়ে তাকে হটিয়ে দিতেন।

 আন্ নু‘মান ইবনু মালিক আল আনছারীর (রা) বীরত্ব।
আন্ নু‘মান ইবনু মালিক (রা) মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে বদর যুদ্ধে অংশ নেন।
জানবাজ সৈনিকরূপে লড়াই করেন।

হিজরী তৃতীয় সনে সংঘটিত হয় উহুদ যুদ্ধ।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে মুসলিম মুজাহিদগণ উহুদ প্রান্তরে অবস্থান গ্রহণ করেন।
আন্ নু‘মান (রা) ছিলেন তাঁদের একজন।

যুদ্ধ শুরুর আগে আন্ নু‘মান ইবনু মালিক (রা) মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে এসে বললেন, ‘‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহর কসম, আমি অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবো।’’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তা কিভাবে?’’
আন্ নু‘মান ইবনু মালিক (রা) বললেন, ‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই।
আপনি আল্লাহর রাসূল। আর আমি যুদ্ধের ময়দান থেকে পালাবো না।’’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘‘তুমি সত্য বলেছো।’’

অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
আন্ নু‘মান ইবনু মালিক (রা) বীর বিক্রমে শত্রু সেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।
ডানে বাঁয়ে তলোয়ার চালাতে চালাতে সামনে এগিয়ে চলেন।
শত্রুদের ওপর আঘাত হানতে থাকেন।
নিজেও আহত হন।
কিন্তু এক কদমও পিছে হটেননি।
একদল শত্রু সেনা তাঁকে ঘিরে ফেলে।
আঘাতের পর আঘাত হেনে তাঁর শরীর ঝাঁঝরা করে ফেলে।
প্রতিটি জখম থেকে ঝরতে থাকে তাজা খুন।
তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
তিনি তাঁর অংগীকার সত্যে পরিণত করে জান্নাতের ঠিকানায় চলে যান।

 আনাস ইবনু নাদারের (রা) বীরত্ব।
উহুদ যুদ্ধে প্রথম দিকে মুসলিমরা বিজয়ী হন।
কিন্তু কিছু সংখ্যক পাহারাদারের ভুলের কারণে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়।
মুসলিম যোদ্ধাদের মধ্যে বিশৃংখলা দেখা দেয়।
এই সময় গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শহীদ হয়ে গেছেন।
হতোদ্যম হয়ে পড়েন অনেকেই।
আনাস ইবনু নাদার (রা) কয়েকজন মুসলিমকে নিষ্ক্রিয় দেখে কারণ জানতে চান।
তাঁরা বলেন, ‘‘রাসূলুল্লাহ তো শহীদ হয়ে গেছেন।’’
তিনি বলেন, ‘‘রাসূলুল্লাহ যদি শহীদ হয়ে গিয়েই থাকেন তাহলে আপনারা বেঁচে থেকে কী করবেন?
আসুন, রাসূলুল্লাহ যেই পথে জীবন দিয়েছেন আমরাও সেই পথে জীবন দিই।’’
এই কথা বলে আনাস ইবনু নাদার (রা) কোষমুক্ত তলোয়ার নিয়ে শত্রু সেনাদের দিকে এগিয়ে যান।
তিনি বলেন, ‘‘হে আল্লাহ, মুসলিমরা এখন যা করছে তার জন্য আমি আপনার নিকট ক্ষমা চাই। আর মুশরিকরা যা করছে তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’’
এই সময় সা‘দ ইবনু মুয়াজ (রা) তাঁর সামনে পড়েন।
তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘‘কোথায় যাচ্ছেন, আনাস?’’
আনাস ইবনু নাদার (রা) বলেন, ‘‘সা‘দ, আল্লাহর কসম, আমি উহুদের দিক থেকে জান্নাতের খুশবু পাচ্ছি।’’
তাঁকে অগ্রসর হতে দেখে শত্রু সেনারা তাঁর দিকে তীর ও বল্লম ছুঁড়তে থাকে।

অকুতোভয় আনাস (রা) দ্রুত সামনে এগিয়ে শত্রু সেনাদের ওপর আঘাত হানতে থাকেন।
শেষাবধি শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তীর ও বল্লম তাঁর শরীর ঝাঁঝরা করে ফেলে।
তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
চলে যান জান্নাতের ঠিকানায়।

 আলবারা’ ইবনু মালিকের (রা) বীরত্ব।
আবু বাকর আছ্ ছিদ্দিকের (রা) শাসন কালে ভন্ড মুসাইলামাকে শায়েস্তা করার জন্য খালিদ ইবনুল ওয়ালীদের (রা) সেনাপতিত্বে একদল সৈন্য প্রেরিত হন।
তাঁরা ইয়ামামা পৌঁছেন।
তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
মুসাইলামা একটি উঁচু প্রাচীর ঘেরা বাগান বাড়িতে অবস্থান করছিলো।
গেইটে ছিলো কড়া পাহারা।
মুসলিমরা ভেতরে ঢুকতে পারছিলেন না।
আলবারা’ ইবনু মালিক (রা) দ্রুত পৌঁছেন প্রাচীরের কাছে।
উচ্চস্বরে তিনি বলেন, ‘‘ওহে লোকেরা, আমি আলবারা ইবনু মালিক, তোমরা আমার দিকে আস, তোমরা আমার দিকে আস।’’
একদল মুজাহিদ তাঁর দিকে এগিয়ে আসেন।
তিনি তাঁদেরকে বলেন, ‘‘তোমরা আমাকে উঁচুতে তুলে বাগানে ছুঁড়ে দাও।’’
তাঁরা বললেন, ‘‘তা কি করে হয়?’’
তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর কসম, তোমরা অবশ্যই আমাকে ভেতরে ছুঁড়ে দাও।’’
সহযোদ্ধারা তাঁকে উঁচুতে তুলে ধরেন।
তিনি প্রাচীরের উপরিভাগ ধরতে সক্ষম হন।
অতপর প্রাচীরে ওঠে হঠাৎ লাফিয়ে পড়েন নিচে।
একদল শত্রু সেনা এগিয়ে আসে।
তিনি তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।
শত্রু সেনারা কাবু হয়ে পড়ে।
এবার তিনি গেইট খুলে দেন।
দ্রুত ভেতরে ঢুকে পড়েন মুসলিম সেনারা।
আলবারা’ ইবনু মালিকের (রা) বীরত্ব মুসলিমদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জনে সাহায্য করে।
অভিশপ্ত মুসাইলামা এই বাগানেই নিহত হয়।
 সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাসের (রা) বীরত্ব।
অগ্নি পূজক ইরানীদের সম্রাটকে বলা হতো ‘কিসরা’।
কিসরা ইয়াজদিগিরদ মুসলিমদের সাথে লড়াই করার জন্য এক বিশাল সৈন্য বাহিনী গড়ে তোলে।
সেনাপতি রুস্তমের নেতৃত্বে ইরানী বাহিনী অগ্রসর হয়।
তাদের মুকাবিলার জন্য সা‘দ ইবনু আবী ওয়াককাস (রা) মুসলিম সৈনিকদেরকে নিয়ে কাদেসিয়া
প্রান্তরে পৌঁছেন।
এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
মুসলিমরা বিজয় লাভ করেন।
খবর আসে, কিসরা ইয়াজদিগিরদ বহুসংখ্যক ঘোড়া ও গাধার পিঠে মূল্যবান সামগ্রী বোঝাই করে রাজধানী মাদাইন থেকে পালাবার প্রস্ত্ততি নিচ্ছে।
মুসলিম সেনা ছাউনী এবং রাজধানী মাদাইনের মাঝে ছিলো তাইগ্রিস নদী।

সা‘দ (রা) ইয়াজদিগিরদকে পালাবার সুযোগ দিতে চাইলেন না।
তিনি মুসলিম সৈন্যদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন।
ভাষণে তিনি বলেন, ‘‘ওহে আল্লাহর বান্দারা, ওহে দীনের সৈনিকরা, সাসানী শাসকরা আল্লাহর বান্দাদেরকে দাসত্ব শৃংখলে আবদ্ধ করে বানোয়াট কথার দ্বারা ধোঁকা দিয়ে আগুন ও সূর্যের পূজা করতে বাধ্য করেছে। তাদের ঘামঝরা কষ্টোপার্জিত সম্পদ নিজেদের জন্য পুঞ্জিভূত করেছে। তোমরা যখন তাদের মুক্তিদাতা রূপে উপস্থিত হয়েছো, তখন জনগণের মূল্যবাণ অর্থ-সম্পদ ঘোড়া ও গাধার পিঠে চাপিয়ে পালাবার চেষ্টা করছে। আমরা তাদেরকে এই সুযোগ দেবো না। আমরা যেনো তাদের নিকট পৌঁছতে না পারি সেই জন্য তারা পুল ভেংগে দিয়েছে। কিন্তু ইরানীরা আমাদেরকে চেনেনা। তারা জানে না আল্লাহর ওপর ভরসাকারীরা, মানবতার সেবকেরা, পুল বা নৌকার ওপর ভরসা করে না।
আমি পরম করুণাময় আল্লাহর নামে আমার ঘোড়াটি নদীতে নামিয়ে দিচ্ছি। তোমরা আমার অনুসরণ কর। একজনের পেছনে একজন, একজনের পাশে একজন থেকে তাইগ্রিস নদী পার হও।
আল্লাহ আমাদের সহায়।’’
ভাষণ শেষে সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রা) ‘‘বিসমিল্লাহ’’ বলে নদীর অথৈ পানিতে ঘোড়া নামিয়ে দিলেন।
তাঁকে অনুসরণ করেন অন্য সব মুজাহিদ।
নদী পাড়ি দিয়ে তাঁরা দ্রুত পৌঁছে যান মাদাইন।
রাজধানী মাদাইন মুসলিম বাহিনীর পদানত হয়।
কিসরা ইয়াজদিগিরদ পালিয়ে যায়।

 খালিদ ইবনুল ওয়ালীদের (রা) বীরত্ব।
খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ (রা) একজন লড়াকু ব্যক্তি ছিলেন।
যোদ্ধা হিসেবে তিনি ছিলেন জানবাজ।
সেনাপতি হিসেবে তিনি ছিলেন বিচক্ষণ।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে ‘‘সাইফুল্লাহ’’(আল্লাহর তলোয়ার) উপাধি দিয়েছিলেন।
তাঁর জীবনের বেশিরভাগ কেটেছে যুদ্ধের ময়দানে।

যুদ্ধের ময়দানে তিনি রাতে ঘুমাতেন না।
লোক পাঠিয়ে শত্রু পক্ষের তথ্য সংগ্রহ করতেন।
আর তাঁবুতে বসে যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতেন।
তাঁর সংগীরা বলতেন, ‘‘খালিদ নিজে ঘুমান না, অন্যদেরকেও ঘুমাতে দেন না।’’
খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ (রা) বলতেন, ‘‘নব বধুর সাথে রাত কাটানো কিংবা রাতে কোন পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার খবর পাওয়ার চেয়ে কোন প্রচন্ড শীতের রাতের শেষে একটি বাহিনী নিয়ে মুশরিক বাহিনীর ওপর হামলা চালানো আমার নিকট অধিক প্রিয়।’’

খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ (রা) বেপরোয়া হয়ে যুদ্ধ করতেন।
নির্ভয়ে তিনি শত্রু বাহিনীর মধ্যে ঢুকে যেতেন।
বিদ্যুৎ গতিতে তলোয়ার চালাতেন।
তাঁর হাতে নিহত হয়েছে বহু সংখ্যক শত্রু সেনা।
যুদ্ধে তিনি বারবার আহত হয়েছেন।
তাঁর শরীরের প্রতিটি অংশেই ছিলো আঘাতের চিহ্ন।
তবে যুদ্ধের ময়দানে তিনি নিহত হননি।
শহীদ হতে না পারার বেদনায় মৃত্যুকালে তিনি কাঁদতে থাকেন।

উপসংহার
জীবনের সকল ক্ষেত্রেই আছহাবে রাসূল অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ স্থাপন করে গেছেন। তাঁদের সম্পর্কে তাঁদের প্রশিক্ষক মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা হচ্ছে ‘‘খাইরুল কুরুনে কারনী’’ (আমার জেনারেশনই সর্বোত্তম জেনারেশন)।
আমাদের চলার পথের বাঁকে বাঁকে এই সর্বোত্তম জেনারেশনের দিকে ফিরে তাকানো আমাদের কর্তব্য।

--০--