পণ্ডিত ওয়ারাকার আক্ষেপ
বিশ্ব জগতের রহমত নবুওয়াতের আলোক ধারায় স্নাত হলো হেরা গিরিগুহা! নবুওয়াত লাভ করলেন মহানবী। অভূতপূর্ব আবেগ-উত্তেজনায় অভিভূত হযরত ফিরে এলেন হেরা গিরিগুহা থেকে খাদিজার কুটিরে। সহধর্মিণী খাদিজাও উদ্বেগাকুল। শুনলেন তিনি মহানবীর কাছ থেকে হেরা গিরিগুহার সব কথা। তারপর সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “আপনি নিশ্চিত হোন, আনন্দিত হন, আল্লাহ আপনাকে কখনই বিপর্যস্ত করবেন না। স্বজনদের চির শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু আপনি, পর দুঃখভার বহনকারী মহাজন আপনি, দরিদ্রের সেবক আপনি, যার কেউ নেই টার আপনজন আপনি- আল্লাহ আপনাকে কখনও বিপর্যস্ত করবেন না।”
কিন্তু সান্ত্বনা দেয়ার পর খাদিজাও যেন সান্ত্বনা পেতে চাইলেন। তাই মহানবীকে সাথে নিয়ে খাদিজা (রা) এলেন চাচাত ভাই খৃষ্টান শাস্ত্র বিশেষজ্ঞ ওয়ারাকা ইবন নওফলের কাছে। এসে বললেন, “ভাই, তোমার ভ্রাতুষ্পুত্র কি বলছেন শুন।” ওয়ারাকা সব কথা শুনলেন নবীর কাছ থেকে। শুনে তিনি উচ্ছসিত স্বরে বলে উঠলেন, “কুদ্দুসুন কুদ্দুসুন, মুসার কাছে আল্লাহ যে ‘নামুস’ পাঠিয়েছিলেন, এ সেই নামুস।” বৃদ্ধ ওয়ারাকা একটু দম নিলেন। বোধ হয় ভাবনার গহিনে একটু ডুব দিলেন। তারপর বলে উঠলেন, “হায় হায়, আজ যদি আমি যুবাবস্থায় থাকতাম! যখন তোমার স্বজাতীয়রা তোমাকে দেশান্তরিত করবে, তখন যদি আমি বেঁচে থাকতাম!”
ওয়ারাকার কথা শুনে বিস্মিত মোহাম্মাদ বললেন, “আমাকে কি তারা দেশ থেকে বের করে দেবে?” ওয়ারাকা জবাব দিলেন। বললেন, “নিশ্চয়ই, আর এটা শুধু তোমার ব্যাপার নয়। তুমি যে সত্য পেয়েছ, তা যারাই পেয়েছে তারা দেশবাসীর কোপানলে পড়েছে। হায়, আমি যদি ততদিন বেঁচে থাকি, তাহলে আমি নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবো।”

উত্থিত হলো হিংস্র প্রতিক্রিয়ার কণ্ঠ
মক্কার রেওয়াজ ছিল কোন ভয়ঙ্কর বিপদের আশংকা করলে অথবা কোন গুরুতর বিষয়ে বিচারপ্রার্থী হলে কোন পর্বতের উপরে উঠে বিশেষ কতগুল শব্দ উচ্চারণ করা। মহানবী মক্কাবাসীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এই পথই অনুসরণ করলেন।
আল্লাহর ঘর কাবার অতি নিকটের সাফা পর্বতে মহানবী উঠলেন একদিন অতি প্রত্যুষে। গম্ভীরে- করুণে সেই বিশেষ আহবান ধ্বনিত হলো মহানবীর কণ্ঠে। ভোরের নীরবতা ভেঙে সে আহবান ছড়িয়ে পড়লো মক্কার ঘরে ঘরে। মানুষ এসে সমবেত হলো সাফা পাহাড়ে। মক্কার সব গোত্র, সব মানুষ এসে হাজির হলে মহানবী প্রত্যেক গোত্রের নাম ধরে ধরে বলতে লাগলেনঃ “হে কোরেশ বংশীয়গণ, আজ আমি যদি তোমাদের বলি, পর্বতের অপর পাশে প্রবল এক শত্রু বাহিনী তোমাদের যথাসর্বস্ব লুণ্ঠন করার জন্য অপেক্ষা করছে, তাহলে কি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে?”
মক্কার কে না তাদের আল আমিনকে চিনে? আজন্ম সত্যবাদী তাদের প্রিয় আল আমিন কোন মিথ্যা বলতেই পারেন না। মক্কাবাসীরা সমস্বরে বলে উঠলো, “নিশ্চয়ই বিশ্বাস না করার কোন কারণ নেই।”
আল্লাহর নবী তখন গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন, “তবে শোন, আমি তোমাদের (পাপ ও খোদাদ্রোহিতার) অবশ্যম্ভাবী কঠোর দণ্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। হে আব্দুল মুত্তালিবের বংশধরগণ, হে আব্দ মনাফের বংশধরগণ, হে জোহরার বংসধরগন......আমার আত্মীয়জনকে উপদেশ দেয়ার জন্য আমার প্রতি আল্লাহর আদেশ এসেছে। তোমাদের ইহকালের মঙ্গল ও পরকালের কল্যাণ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ না বল।” মহানবী থামলেন।
দ্বীনে হকের বুলন্দ আওয়াজ যুগযুগান্তের নীরবতা ভেঙে ইথারের কণায় কণায় কাঁপন জাগিয়ে ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। কিছু দূরে দাঁড়ানো জাহেলিয়াতের অক্টোপাসে বন্দী আল্লাহর ঘর কাবায় তা প্রতিধ্বনিত হলো। প্রতিধ্বনিত হলো পাহাড়ে পাহাড়ে। বহুশত বর্ষ পরে দ্বীনে হকের দাওয়াত তার নতুন এবং চূড়ান্ত যাত্রা শুরু করলো। পৃথিবীব্যাপী জাহেলিয়াতের জমাট অন্ধকারে এ আলোর বিস্ফোরণ সাফা পর্বতের সানুদেশে দাঁড়িয়ে দুনিয়াবাসির পক্ষে মক্কাবাসী যারা এ দাওয়াত শুনছিল তারা নীরব নিস্পন্দ।
নীরবতা ভেঙে প্রতিক্রিয়ার কণ্ঠ জাগ্রত হলো। আবু লাহাব বলল, “তোর সর্বনাশ হোক, এ জন্যই কি আমাদের ডেকেছিলে!” প্রতিক্রিয়ার এ কণ্ঠে যেন হিংস্রতা ঝরে পড়লো।

প্রথম বিজয় নিশান উড়লো
নবুওয়াতের গুরু দায়িত্ব নিয়ে ধীর যাত্রা শুরু হয়েছে মহানবীর(সা)। গোটা ধরণীটাই অন্ধকারে নিমজ্জিত, তিনিই মাত্র আলোর এক শিখা। সমূলে জেঁকে বসা ঐ অন্ধকার তার আপ্রাণ হিংস্রতা নিয়ে আলোর অস্তিত্ব বিনাশে উদ্যত। এরই মধ্যে শুরু হলো আলোর সন্তর্পণ যাত্রা। তিন বছর ধরে প্রচার চললো সংগোপনে। আলোর কাফিলায় এসে শামিল হলো খাদিজা, আলী, জায়েদ, উম্মে আয়মান, আবুবকর সিদ্দিক, উসমান, জোবায়ের, তালহা, আবু উবায়দা, আব্দুল্লাহ ইবনে মসউদ (রা) প্রমুখ। কিন্তু প্রকাশের জন্যই যে আলোর আগমন তার আত্মগোপন আর কত? প্রতিক্রিয়ার মুকাবিলা এবং বাঁধার পাহাড় ডিঙ্গানোই যে পথের স্বভাবধর্ম তা কি আত্মপ্রকাশ না করে পারে? পারে কি আপোষ করে চলতে? এল অবশেষে সে প্রকাশের দিন। নাযিল হলো আল্লাহ তাআলার নির্দেশ...... “তোমার প্রতি যে আদেশ তা তুমি স্পষ্ট করে শুনিয়ে দাও এবং মুশরিকদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করো না।”
প্রকাশ্য দাওয়াতের প্রথম সম্মেলন মহানবী (সা) ডাকলেন তাঁর বাড়িতেই। মহানবীর দাওয়াতে বনু হাশিম বংশের প্রায় ৪০ জন প্রধান ব্যক্তি হাজির হলেন তাঁর গৃহে। গোপন প্রচারের খবর কেউ কেউ জানতেন, জানতো আবু লাহাবও। সে আঁচ করতে পেরেছিল নবী কি বলতে চান এ সম্মেলনে। তাই খাওয়া-দাওয়া শেষে যেই বলতে শুরু করলেন, হট্টগোল বাঁধালো আবু লাহাব। বললো সে, “দেখ মুহাম্মাদ, তোমার চাচা, চাচাত ভাই সকলেই এখানে উপস্থিত, চপলতা ত্যাগ কর। তোমার জানা উচিত, তোমার জন্য সমস্ত আরব দেশের সাথে শত্রুতা করার শক্তি আমাদের নেই। তোমার আত্মীয়-স্বজনের পক্ষে তোমাকে ধরে কারারুদ্ধ করে রাখা উচিত। তোমার ন্যায় স্ববংশের এমন সর্বনাশ কেউ করেনি।”
সেদিনের সম্মেলন ভেঙে গেল। মহানবী(সা) তাঁর বাড়িতে ইসলামের বাণী প্রচারের জন্য আবার সম্মেলন ডাকলেন- দাওয়াতের দ্বিতীয় সম্মেলন। বনু হাশিমের প্রধানবর্গ আবার হাজির হলেন। হাজির হলেন আবু লাহাবও। এবার মহানবী(সা) আবু লাহাবকে কোন কূটনীতির সুযোগ দিলেন না। খানা পিনার পরই উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর দাওয়াত পেশ করলেন। তিনি বলেন, “সমবেত ব্যক্তিগণ, আমি আপনাদের জন্য ইহকাল- পরকালের এমন কল্যাণ এনেছি যা আরবের কোন ব্যক্তি তাঁর স্বজাতির জন্য আনেনি। আমি আল্লাহর আদেশে সেই কল্যাণের দিকে আপনাদের আহবান করছি। সত্যের এ মহা সাধনায়, কর্তব্যের কঠোর পরীক্ষায় আপনাদের মধ্য থেকে কে কে আমার সহায় হবেন, কে আমার সাথী হবেন?”
মজলিশে কারো মুখে কোন কথা নেই। একক এক ব্যক্তির কণ্ঠ থেকে আসা সত্যের বজ্র নির্ঘোষ বনু হাশিমের শক্তিমান প্রবীণদের যেন হতবাক করে দিয়েছে। বাচাল আবু লাহাবও সে মৌনতা ভাঙতে পারলো না, পারলো না সশব্দে সে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করতে। হকের এ কণ্ঠের দাওয়াত যেন শত কণ্ঠের শক্তি নিয়ে ছড়িয়ে পড়লো।
অবশেষে মৌনতা ভাঙল। ভাঙলেন আবু তালিব পুত্র মহানবীর চাচাতো ভাই বালক আলী। সবাইকে শুনিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে তিনি বললেন, “এই মহাব্রত গ্রহণের জন্য আমি প্রস্তুত আছি।”
বনু হাশিমের কোনও প্রধানের মুখে কোন কথাই আর জোগাল না। শুধু আবু লাহাবই প্রকাশ্য দাওয়াতের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার প্রথম রপকাশ ঘটিয়ে, রাসূলকে নয়, আবু তালিবকে বললেন, “দেখছেন আপনের ভ্রাতুষ্পুত্রের কল্যাণে এখন আপনাকে স্বীয় বালকপুত্রের অনুগত হয়ে চলতে হবে।” কিন্তু আবু লাহাবের এ প্রতিক্রিয়া বিজয়ীর নয়, বিজিতের। দাওয়াতে হকের নিশান উড়ল এইভাবেই।

জাগতিক কোন অবলম্বনই যখন মহানবীর রইলনা
সব বাধা ডিঙিয়ে মহানবীর(সা) ইসলাম প্রচার চলছেই অবিরাম। সব দেখে কুরাইশ প্রধানেরা অধৈর্য হয়ে উঠলো। অনেক সলাপরামর্শের পর তারা একযোগে এসে আবু তালিবকে বললো, “দেখুন, আপনার বয়স, আপনার বংশ গৌরব এবং আপনের সম্ভ্রমের প্রতি আমরা সকলেই সম্মান প্রদর্শন করি। এ জন্যই আপনের ভাতিজা সম্পরকে আপনাকে পূর্বেই সতর্ক করে দিয়েছিলাম। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন আপনার ভাতিজার অত্যাচার আর আমরা কিছুতেই নীরবে সহ্য করবোনা। আপনি তাকে নিবৃত্ত করুন নতুবা তার সাথে আপনাকেও আমরা একদল হিসেবে দেখব- দুদলের মধ্যে একদল ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হবো না।”
বৃদ্ধ আবু তালিব কুরাইশ প্রধানদের এ চরমপত্র নীরবে গ্রহণ করলেন। এই কুরাইশদের একজন হিসেবে তিনি সবাইকে ভালভাবেই চিনেন। জানেন তিনি তাদের হিংসার আগুন কতদূর পোড়াতে পারে। আরও তিনি বুঝলেন, তারা এবার আট-ঘাট বেঁধেই এসেছে। সান্ত্বনা দিয়ে আর তাদের ফেরানো যাবেনা। এই প্রথমবারের মত আবু তালিব নিজেকে সত্যই বিচলিত বোধ করলেন। ভাবলেন। ভেবে নিয়ে তিনি ভাতিজাকে ডেকে পাঠালেন তাঁর কাছে এই দরবারে।
দরবার নীরব নিস্তব্ধ। আবু তালিবের বিষণ্ণ মুখে চিন্তার কালো রেখা। বোধহয় কুরাইশ প্রধানদের মনের কোণায় আত্মতৃপ্তির হাসিঃ এবার আবু তালিবকে ওষুধে ধরেছে। সবার আক্রোশকে চ্যালেঞ্জ করার সাধ্য বুড়ো আবু তালিবের নেই। দরবারের এমন পরিবেশেই মহানবী এসে হাজির হলেন।
কুরাইশ প্রধানরা এখন উদগ্রীব আবু তালিব তাঁর ভাতিজাকে কি বলেন তা শোনার জন্য। বৃদ্ধ আবু তালিব মহানবীকে কুরাইশদের কঠোর সংকল্প এবং ভয়াবহ পরিণতির কথা বুঝিয়ে বলার পর সস্নেহে বললেন, “বাবা একটু বিবেচনা করে কাজ করো, যে ভার বইবার শক্তি আমার নেই আমার উপর তা চাপিয়ে দিও না।”
চাচা আবু তালিব কি বলতে চান, মহানবী তা বুঝলেন। তিনি আরও বুঝলেন, জাগতিক যে আশ্রয়টুকু তাঁর ছিল তার ভিতও আজ নড়ে উঠেছে।
কিন্তু তিনি বিচলিত হলেন না একটুকুও। তিনি বললেন, “চাচা, আমার প্রতি এমন কঠোর না হয়ে এরা আমার কথা মেনে নিক তাহলে সমস্ত আরব বেহেস্তি ধর্ম বন্ধনে আবদ্ধ হবে, সমস্ত আজম আরবের পদতলে লুটিয়ে পরবে।”
আধিপত্যের গন্ধ পেয়ে আবু লাহাব ও অন্যান্যরা একবাক্যে বলল, ‘কি কি সে কথা, খুলে বল।একটা কেন, তোমার দশটা কথা আমরা শুনতে প্রস্তুত আছি।’ মহানবী গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলুন, এতে বিশ্বাস স্থাপন করুন।”
মহানবীর এ কথায় বারুদের মত জ্বলে উঠলেন কুরাইশ প্রধানরা। যে মুখ, যে কথা তারা বন্ধ করতে এসেছে, একেবারে তাদের মুখের উপরেই সেই কথা। অবস্থাদৃষ্টে আবু তালিবও নবীকে(সা) কয়েকটি ভীতি ও বিষাদপূর্ণ উপদেশ দিলেন।
ভীষণ এক পরিস্থিতি তাঁর সামনে। মারমুখো কুরাইশরা একদিকে, অন্যদিকে পিতৃব্য আবি তালিবেরও আজ অসহায় সুর। জাগতিক কোন অবলম্বনই তাঁর সামনে আর থাকলো না। কিন্তু তিনি কোন দিকেই ভ্রূক্ষেপ করলেন না। পিতৃব্যের দিকে তাকিয়ে তেজোদীপ্ত কণ্ঠে তিনি বললেন, “চাচা, এরা যদি আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চাঁদ এনে দেয়, তাহলেও আমি এ মহাসত্য ও নিজের কর্তব্য থেকে এক মুহূর্তের জন্যও সরে দাঁড়াবো না। হয় আল্লাহ একে জয়যুক্ত করবেন, না হয় আমি ধ্বংস হয়ে যাব। কিন্তু আপনি নিশ্চিত জানুন, মুহাম্মাদ কখনই নিজের কর্তব্য পরিত্যাগ করবে না।” মহানবী থামলেন। এক পবিত্র ভাব ও আবেগে তাঁর চোখ দুটি অশ্রু সজল হয়ে উঠলো।
কুরাইশ প্রধানদের মিশন ব্যর্থ হলো। নানা প্রকারের হুমকি দিতে দিতে তারা সদল বলে আবু তালিবের বাড়ি থেকে চলে গেল।
আবু তালিব নীরব ছিলেন। ভাতিজার তেজদিপ্ত কথায় চোখ দুটি তাঁর উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আগের সেই বিষণ্ণতা, দুর্বলতা তাঁর কেটে গেছে। তিনি ভাতিজাকে বললেন, প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র, নিজের কর্তব্য পালন করে যাও, আল্লাহর শপথ আমি কোন অবস্থাতেই তোমাকে পরিত্যাগ করবোনা।

হারিসের শাহাদাত দিয়ে শুরু হলো রক্তরঞ্জিত পথের
মক্কার ঘরে ঘরে এখন তাওহীদের দাওয়াত মুখ্য আলোচনার বিষয়। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে ইসলামের দাওয়াত মক্কার সমাজ -জীবনের গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করতে লাগলো। সেই সাথে বিস্তার ঘটতে লাগলো প্রতিক্রিয়ারও। ইসলামের ধীর গতি বিস্তার আবু লাহাবদের দৃষ্টি এরালো না। শক্তির জোরে বাধা দেয়ার একটা মানসিকতা তাদের মাঝে দানা বেঁধে উঠলো। কিন্তু আল্লাহর নবী এই ইবলিসী প্রতিক্রিয়ার ভ্রূক্ষেপ করবেন কেন? হকের দাওয়াত অবিরাম পৌছিয়েই চলতে হবে- মানুষের ঘরে ঘরে প্রতিটি কানে কানে।
মহানবী সাফা পর্বতে দাঁড়িয়ে দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু সমাজের মিলন কেন্দ্র আল্লাহর ঘর কাবায় গিয়ে মানুষের কাছে তাঁর দাওয়াত পৌঁছান হয়নি এখনও।
একদিন কতিপয় মুসলিম সাথী নিয়ে তিনি কাবায় এলেন। সেখানে অনেক মানুষ- কাবার চারদিকের বাসিন্দা। সবাই নবীর(সা) স্বজন- স্বগোত্র। মহানবী(সা) সেখানে হাজির হয়ে ইসলামের কথা, তাওহীদের দাওয়াত উচ্চারণ করছিলেন। প্রতিক্রিয়ার আগুন জ্বলে উঠলো সঙ্গে সঙ্গেই।
প্রথমে কানা কানি, তারপর শোরগোল। প্রতিক্রিয়ার শক্তি এই প্রথমবারের মত সঙ্ঘবদ্ধভাবে নবীর(সা) উপর দৈহিক আক্রমণের ঔদ্ধত্য নিয়ে ছুটে এল। খাদিজার সন্তান (পূর্বস্বামীর) তরুণ মুসলিম হারিস ইবন আবিহালাহ তাদের সামনে দাঁড়ালেন। প্রতিবাদ করলেন। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সমস্ত ক্রোধ গিয়ে তাঁর উপর পড়লো। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হলেন হারিস। তাঁর দেহের লাল রক্তের স্রোত রঞ্জিত করলো কাবার চত্বরকে। হারিস শহীদ হলেন- ইসলামের প্রথম শহীদ।
আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার ছোট্ট কাফিলা এই প্রথম এক জীবনের কুরবানি দিল। শুরু হলো প্রতিক্রিয়ার সাথে সেই চিরন্তনী সংঘাত আর রক্তরঞ্জিত পথযাত্রার।

নিপীড়ন আনলো নিপীড়িতের সাফল্য
একদিন মহানবী কাবার চত্বরে একাকী বসে আছেন। তিনি আপন ভাবে বিভোর। আবু জাহেল গিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো। নানা প্রকার ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে মহানবীর (সা) ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু অনেক চেষ্টাতেও তাঁর মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারলো না। অবশেষে নবীকে(সা) লক্ষ্য করে সে অনেক গালমন্দ করে। আবু জাহেলের এই মূঢ়তায় মহানবী ব্যথিত হলেন। ফিরে এলেন তিনি বাড়িতে।
মক্কার একজন ক্রীতদাস সব ঘটনা দেখল। সব কথা সে এসে মহানবীর পিতৃব্য হামজাকে বলে দিল। হামজা সবে শিকার থেকে ফিরেছেন। ভ্রাতুষ্পুত্রের প্রতি আবু জাহেলের আচরণের কথা শুনে ক্রোধে জ্বলে উঠলেন। প্রশ্ন তার মনে তার সৎ ও সাধু সজ্জন ভাতিজা কি দোষ করেছে যে সবাই তার উপর অত্যাচার করবে? সে কোন কথাটি খারাপ বলে?
হামজা শিকারের ধনুক কাঁধে নিয়ে আবু জাহেলের সন্ধানে বের হলেন। কাবা ঘরে তাকে পেয়ে সক্রোধে ধনুক দিয়ে তার মাথায় আঘাত করতে লাগলেন এবং হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলেন, “পাষণ্ড! আর তুই মুহাম্মাদের উপর অত্যাচার করবি? আচ্ছা, আমিও মুহাম্মাদের ধর্ম গ্রহণ করেছি, কি করবি কর।”
অতঃপর হামজা চলে এলেন মহানবীর কাছে। মহানবীকে বললেন, “আনন্দিত হও ভাতিজা, আবু জাহেলকে শায়েস্তা করেছি।”
মহানবী সব বুঝলেন। কিন্তু আনন্দ কিংবা কৃতজ্ঞতার কোন ভাবই তাঁর মুখে প্রকাশ পেল না। তিনি বললেন, “চাচা, এতে আনন্দের কিছুই নেই। যদি শুনতাম যে আপনি সত্যকে গ্রহণ করেছেন, তাহলে তা আমার জন্য আনন্দের ব্যাপার হত।”
হামজার হৃদয় দুলে উঠলো। আরও মনে পড়লো, মুহাম্মাদের ধর্ম গ্রহণের কথা তিনি আবু জাহেলকে বলেই এসেছেন। এবার অন্তর থেকে তাঁর সাক্ষ্য বেরিয়ে এলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু। এইভাবে কুরাইশদের প্রতিদিনের অত্যাচার ইসলামের নতুন নতুন সাফল্যই এনে দিতে লাগলো।

তাহলে মুহাম্মাদের যাদু তোমাকেও ধরেছে
কুরাইশ প্রধানরা শলাপরামর্শ করে ঠিক করলো মুহাম্মাদকে তাঁর বাঞ্ছিত কিছু দিয়ে নিরস্ত্র করাই বুদ্ধিমানের কাজ। সকলে মিলে মক্কার বিখ্যাত ধনী ও সর্দার উৎবাকে দূত হিসেবে ঠিক করলো।
সে সময় মহানবী(সা) কাবা গৃহে একাকী বসেছিলেন। এই সুযোগে কুরাইশ প্রধানদের দূত হিসেবে উৎবা এসে তাঁর কাছে উপবেশন করলেন। তারপর রাসুলুল্লাহকে(সা) লক্ষ্য করে নরম সুরে বলতে লাগলেন, “দেখ বাছা, তুমি আমাদের পর নও,কিন্তু যে বিপ্লব নিয়ে আসছ তা কি, তুমি জান। পূর্ব- পুরুষের ধর্ম থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে নতুন এক অভিনব ধর্ম সৃষ্টি করছ...। এরূপ করার উদ্দেশ্য কি আজ তুমি আমাকে খুলে বল। ধন যদি চাও তাহলে আমরা তোমার পদপ্রান্তে স্বর্ণ ও রৌপ্যের স্তূপ এনে দিব। সম্মান যদি চাও তাহলে আমরা সকলে একবাক্যে তোমাকে প্রধান হিসেবে মেনে নেব। রাজত্ব করার আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে তাহলে আমাদের বল , তোমাকে গোটা আরবের অধিপতি পদে অভিষিক্ত করবো...। সব কিছুর বিনিময়ে তোমার কাছে আমাদের শুধু প্রার্থনা তোমার ঐ অভিনব ধর্মের কথা একেবারে ভুলে যাও।”
উৎবার দীর্ঘ বক্তব্য শেষ হলে মহানবী(সা) হা-মীম আস সাজদাহ সূরা থেকে পাঠ করতে শুরু করলেনঃ “হা-মীম,দয়ালু করুণাময়ের পক্ষ থেকে এই গ্রন্থ, যার বাণীগুলো বিজ্ঞ লোকদের জন্য স্পষ্ট আরবি ভাষায় বিশদরূপে বিবৃত হয়েছে এবং যা (পুণ্যের পুরষ্কারের) সুসংবাদ দান করে ও পাপের (দণ্ড সম্পর্কে) সতর্ক করে থাকে। অনন্তর তাদের অধিকাংশই মুখ ফিরিয়ে নিল, তারা (উপদেশ) শ্রবণ (গ্রহণ) করে না। তারা বলে, যে (তাওহীদের) দিকে আমাদের আহবান করছে, আমরা তার ধারণা করতে পারিনা, তোমার কথা আমাদের কর্ণে প্রবেশও করে না। আর আমাদের ও তোমার মধ্যে একটা যবনিকা পড়ে আছে। অতএব তুমি চেষ্টা করতে থাক, আমরা চেষ্টায় রইলাম......।” এইভাবে মহানবী(সা) সূরার পাঁচটি রুকু তেলাওয়াত করলেন। অবশেষে সিজদার আয়াতে সিজদা করে তেলাওয়াত শেষ করলেন।
উৎবা মন্ত্রমুগ্ধের মত সবকিছু শুনলেন। কুরআনের সুললিত ছন্দ ও কথা তাঁকে একেবারে অভিভূত করলো। এত সম্পদ, এত সম্মান, এত বড় রাজ সিংহাসনের লোভ এমন অবলিলাক্রমে প্রত্যাখ্যান করতে দেখে উৎবা স্তম্ভিত হলেন। তিনি আনন্দ ও বিষাদে পূর্ণ এক মানসিক অবস্থা নিয়ে কুরাইশ সর্দারদের মজলিসে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সকলের সাগ্রহ প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, “সেখানে যা শুনলাম আল্লাহর শপথ তেমন আর কখনও শুনিনি, আল্লাহর শপথ, ভাষার দিক দিয়ে তা কখনই কবির রচনা নয় এবং ভাবের দিক দিয়ে কখনই তা জাদুমন্ত্র নয়। হে কুরাইশ সমাজ, আমার উপদেশ, এই ব্যক্তি যা করে করুক তা নিয়ে তোমরা আর গণ্ডগোল করো না।”
উৎবার কথা কুরাইশ প্রধানদের চমকে দিল। তারা বলে উঠলো, “তাহলে মুহাম্মাদের যাদু তোমার উপরও কাজ করতে শুরু করেছে।”

বিদ্রুপ ও বৈরিতার ঝড়ে অটল পাহাড় মহানবী
কুরাইশ প্রধানরা ঠিক করল, মুহাম্মাদকে(সা) সমাবেশে হাজির করে সকলে মিলে তাঁকে বুঝাতে হবে, বুঝাপড়া তার সাথে একটা করে ফেলতে হবে। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে মহানবীর কাছে একজন দূত পাঠানো হলো।
দূত গিয়ে মহানবীকে কুরাইশ দরবারে হাজির হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলল, ‘আপনার স্বজাতিয় ভদ্রজনরা আপনার সাথে দু একটা কথা বলতে চান।’
মহানবী এ খবর পাওয়ার পর বিন্দু মাত্র দ্বিধা করলেন না। উপস্থিত হলেন গিয়ে কুরাইশ দরবারে। শত্রু সমাবেশে তিনি হাজির হয়েছেন, এনিয়ে চিন্তার সামান্য লেশও তাঁর মধ্যে ছিল না। আরও অনেকের কাছে তিনি আল্লাহর দাওয়াত পৌঁছাতে পারবেন, এই মুহূর্তে এই আনন্দই তাঁর কাছে বড়।
কুরাইশ প্রধানরা উৎবার মত তাঁকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলো, সম্মান, সম্পদ, সিংহাসন যা চাও দিতে প্রস্তুত আছি। তুমি আমাদের উপদেশ গ্রহণ কর,”............ইত্যাদি।
তাদের সব কথা শুনে মহানবী বললেন, “আমি আপনাদের কাছে সম্পদের ভিখারি নই, রাজা হবার আকাঙ্খা আমার নাই।...... প্রকৃত কথা এই যে,আল্লাহ সত্য ও জ্ঞানের আলোক দিয়ে ইহ-পরকালের মুক্তির পথ দেখানোর জন্য আমাকে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছেন। এই বাণী গ্রহণ করলে এর দ্বারা আপনারাই ইহ-পরকালে সুফল পাবেন। আর যদি একে অস্বীকার করেন আমি ধৈর্য ধারণ করে থাকব- আল্লাহর যা ইচ্ছা তাই হবে।”
অনুরোধে-প্রলোভনে কোন ফল হলো না দেখে কুরাইশ প্রধানরা মহানবীকে ভীষণ ব্যঙ্গ –বিদ্রুপ করতে লাগলো। কই, তোমার আল্লাহকে বলে আমাদের মরুভূমিতে ইরাকের ন্যায় নদ-নদী করে দাও দেখি, সুজলা সুফলা করে দাও দেখি। অন্তত তোমার জন্য কিছু কর। তোমার আল্লাহ দেবাত্মাকে তোমার সহচর করে দিক, বৃহৎ প্রাসাদ, স্বর্ণ-রৌপ্যের ভাণ্ডার তোমার জন্য এনে দিক,......ইত্যাদি। তাদের সব কথার উত্তরে মহানবী ধীর স্বরে বললেন, “এই পার্থিব ধন-সম্পদের জন্য আমি প্রার্থনা করতে পারি না, তা আমার কর্তবের অন্তর্ভুক্ত নয়। আমি বিশ্ববাসীর কাছে এক মহাসত্যের প্রচারক রূপে প্রেরিত হয়েছে।”
পর পর ব্যর্থতায় এবং মহানবীর অচল অটল দৃঢ়তায় কুরাইশ প্রধানরা ভীষণভাবে খেপে গেল। তারা কঠোর ভাষায় বলল, “মুহাম্মাদ, আমাদের সব কথা তোমাকে বলে দিয়েছি। অতঃপর সাবধান, নিশ্চিতরূপে স্মরণ রেখো আমরা আর তোমাকে অধর্মের কথাগুলো প্রচার করতে দেব না- দেহে প্রাণ থাকতে না। এতে হয় আমরা ধ্বংস হয়ে যাব, না হয় তুমি।” এই কথার পর সভাকক্ষে হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। নানা দিক থেকে অসহ্য বিদ্রুপ বাণ বর্ষিত হতে লাগলো। কিন্তু কোন কিছুই মহানবীর মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারলো না। ‘আপন কর্তব্য সম্পন্ন হয়েছে’- এমন প্রসন্নতা নিয়ে মহানবী ধীর পদক্ষেপে অটল পাহাড়ের ন্যায় সভা ক্ষেত্র চলে গেলেন।

সত্যের শক্তি
আদ দাউস গোত্রের সর্দার তুফাইল ইবন আমর মক্কায় এলেন। তিনি ছিলেন কবি। বিজ্ঞতার জন্যেও বিখ্যাত। মক্কাবাসীরা নগরীর গেটে তাঁকে স্বাগত জানাল।
মক্কার সর্দাররা তুফাইল ইবন আমরকে মুহাম্মাদের(সা) সাথে দেখা না করার জন্যে সাবধান করে দিল। তারা জানালো, মুহাম্মাদের(সা) কথা মক্কায় ভীষণ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে। সর্বত্র সে একটা খারাপ আবহাওয়া সৃষ্টি করেচ।
তদনুসারে তুফাইল ইবন আমর মহানবীর(সা) সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে লাগলেন। কখনও তিনি মহানবীর(সা) মুখোমুখি হলে চোখ বুজতেন এবং কান বন্ধ করতেন।
ঘটনাক্রমে একদিন যখন মহানবী(সা) কাবায় নামাজ পড়ছিলেন, তখন তাঁর কণ্ঠ নিঃসৃত কুরআন শরীফের কতগুলো আয়াত তুফাইলের কানে প্রবেশ করলো। আয়াতগুলো তাঁর হৃদয়ে দারুন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলো। কবি তুফাইল মহানবীর(সা) পিছু পিছু তাঁর বাড়ি গেলেন এবং তাঁকে ঐ আয়াতগুলো পুনরায় পাঠ করতে বলেন। মহানবী(সা) ঐ আয়াতগুলো পাঠ করলেন।
অভিভূত তুফাইল ইবন আমর সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেন।

যাদুকর জামাদের কুরআন শোনা
জামাদ নামে ইয়ামেনে একজন যাদুকর মক্কায় এলো। সে কুরাইশদের আশ্বাস দিল মুহাম্মাদের(সা) উপর দুষ্ট দেবতার যে আছর তা সে ছাড়িয়ে দিবে। কুরাইশরা খুব খুশি হলো।
জামাদ মহানবীর(সা) কাছে গিয়ে হাজির হলো এবং বলল যে, সে তাঁকে ভাল করে দিবে। মহানবী(সা) তাকে বললেন, তাহলে আগে আমার কিছু কথা শুনুন। তারপর মহানবী(সা) কুরআন থেকে কয়েকটি আয়াত পাঠ করলেন। জামাদ আয়াতগুলো শুনে চমৎকৃত হলো এবং আয়াতগুলো পূনরায় পাঠ করার জন্যে অনুরোধ করলো।
মহানবী(সা) আয়াতগুলো দ্বিতীয়বার যখন সমাপ্ত করলেন, তখন জামাদ চিৎকার করে বলে উঠলো, “আমি বহু ভবিষ্যৎবক্তা , যাদুকর ও কবির কথা শুনেছি, কিন্তু আল্লাহ সাক্ষি, এই কথা গুলোর কোন তুলনা নেই। অতলগভীর এই কথাগুলো।”
তারপর সে বলল, “হে মুহাম্মাদ, আপনার হাত এগিয়ে দ্বীন। আমি আপনের আনুগত্যের শপথ করছি।”

পোকা ধ্বংস করলো বয়কটের দলিল
নববী ষষ্ঠ সনে কুরাইশরা মহানবী ও তাঁর গোত্রকে বয়কট করে সকলকে একসাথে ধ্বংস করে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। এজন্য মক্কার সকল গোত্র একত্রিত হয়ে একটি দলিল সম্পাদন করলো। দলিলে বলা হলোঃ “মক্কার কোন ব্যক্তি বনু হাশিম গোত্রের সাথে আত্মীয়তা করবেনা, তাদের কাছে কোন বস্তু ক্রয় বিক্রয় করবেনা, তাদের কাছে খাদ্য প্রেরণ করবে না। যতদিন পর্যন্ত তারা অর্থাৎ বনু হাশিম রাসুলকে(সা) হত্যার জন্য কুরাইশদের হাতে সমর্পণ না করবে ততদিন পর্যন্ত এই চুক্তি বলবৎ থাকবে।”
মহানবী বনু হাশিমের সমস্ত লোকজন সহ শি’আবে আবু তালিব গিরি উপত্যকায় আশ্রয় গ্রহণ করলেন। সুদীর্ঘ তিন বছর তাঁরা অবরুদ্ধ অবস্থায় এই উপত্যকায় অবস্থান করলেন। এই বন্দী জীবন এত কঠোর ছিল যে, জঠরজ্বালা নিবারণের জন্য তাদেরকে গাছের পাতা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে হয়েছে। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস এক দিনের ঘটনা বলেছেনঃ সেদিন রাত্রিতে তিনি একটি শুকনা চামড়া আগুনে ঝলসিয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করেছিলেন।
ছোট ছোট শিশুরা যখন ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে চিৎকার করত, তখন বাহির থেকে কুরাইশরা তা শুনে আনন্দ নৃত্য করত। আবার কোন কোন সহৃদয় ব্যক্তি এতে দুঃখিত হত।
একদিন হযরত খাদিজার(রা) ভ্রাতুষ্পুত্র হাকিম ইবনে হিজাম স্বীয় দানের মাধ্যমে হযরত খাদিজার(রা) নিকট সামান্য পরিমাণ গম পাঠাচ্ছিল। কিন্তু পথের মধ্যে আবু জাহল তা দেখতে পেয়ে ছিনিয়ে নেবার উপক্রম করলে ঘটনাক্রমে আবুল বুখতারি সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি যদিও কাফির ছিলেন, তবু অন্তরে তার দয়ামায়া ছিল। তিনি বললেন, ফুফুর কাছে সামান্য খাবার পাঠাচ্ছে তাতে তুমি বাধা দিচ্ছ কেন?
ধীরে ধীরে খোদ কুরাইশদের মধ্যেই চুক্তিভঙ্গের জন্য আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। হিশাম ইবনে আমর নামক জনৈক ব্যক্তি বনু হাশিমের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন এবং স্বীয় গোত্রের মধ্যেও অত্যন্ত বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি গোপনে তাদের কাছে খাদ্য পাঠাতেন। তিনিই একদিন আবদুল মুত্তালিবের দৌহিত্র জুহাইরের নিকট গমন করলেন, “কি হে জুহাইর! তোমার কি পছন্দ হয় যে, তুমি প্রচুর পরিমানে পানাহার করবে ও যাবতীয় আনন্দ উপভোগ করবে, আর তোমার মামার ভাগ্যে এক দানাও জুটবে না।”
জুহাইর বললেন, “কি করবো? আমি একা, যদি আমাকে সমর্থন করবার মত একজন লোকও পেতাম, তাহলে ঐ অন্যায় চুক্তিপত্র অবশ্যই ছিড়ে ফেলতাম।” হিশাম বললেন, “আমি তোমাদের সাথে আছি।”
অতঃপর তারা উভয়ে মিলে মুত’ইম ইবনে আদির কাছে উপস্থিত হলেন। অপরদিকে আবুল বুখতারি ইবনে হিশাম এবং যুম’আ ইবনুল আসওয়াদও তাঁদেরকে সমর্থন দান করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। একদিন সকলে মিলে কাবার অঙ্গনে গমন করলেন। সেখানে জুহাইর সমবেত জনতাকে সম্বোধনপূর্বক জিজ্ঞাসা করলেন,
“হে মক্কাবাসী! এটা কেমন কথা যে, আমরা সুখে শান্তিতে দিন যাপন করব, আর বনু হাশিমদের ভাগ্যে সামান্য খাবারও জুটবে না? খোদার কসম! এই অন্যায় চুক্তিপত্র ছিঁড়ে না ফেলা পর্যন্ত আমি শান্ত হব না।” এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আবু জাহল দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলো, “সাবধান, এই চুক্তিপত্রের বিরুদ্ধে কাকেও কিছু করতে দেয়া হবে না।” যুম’আ দাঁড়িয়ে পড়লেন, “তুমি মিথ্যাবাদী। এই চুক্তিপত্র সম্পাদনের সময় আমরা রাজি ছিলাম না।”
যুম’আর কথা শেষ হতেই আবুল বুখতারি দাঁড়িয়ে বলল, “কি ছাইভস্ম লেখা হয়েছে এতে, আমরা মোটেই খুশি নই, ওসব লেখাটেখা আমরা মানিও না।” বুখতারি থামতেই মুতইম উঠে বলল, “তোমরা দুজন ঠিকই বলেছ। ভিন্ন কথা যে বলবে সে –ই হবে মিথ্যাবাদী।” হিশাম তাকে সমর্থন করল।
আবু জাহল বলল, মনে হয়, তোমরা আগে-ভাগে জোট বেঁধে এসেছ।
এসব বাক-বিতণ্ডার মধ্যে মুতইম লাফ দিয়ে উঠে কাবার দেওয়াল থেকে বয়কটের দলিল নামিয়ে আনল ছিঁড়ে ফেলার জন্যে।
কিন্তু ছিঁড়ে ফেলতে হলো না। আল্লাহর পোকা-সৈনিকরা অনেক আগেই ধ্বংস করেছিল অন্যায় দলিলটিকে। দেখা গেল দলিলের সব শব্দ, সব কথা পোকায় খেয়ে ফেলেছে, অক্ষত রয়েছে একমাত্র ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ শব্দ।

মজলুম চাইলেন জালিমরা বেঁচে থাকুক
মহানবী ধর্ম প্রচারের জন্য তায়েফ গমন স্থির করলেন। মহানবী ভেবেছিলেন, সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা তায়েফের মানুষের মন হয়তো আরও নরম পাওয়া যাবে।
মহানবী তায়েফ চললেন। তায়েফের প্রধান গোত্র ছিল বনু সাকিফ। আবদ ইয়ালিল, মাসউদ ও হাবিব নামে তিন ভাই ছিল সে গোত্রের প্রধান। মহানবী প্রথমে তাদের কাছে গেলেন, আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিলেন তাদেরকে। তারা দাওয়াত তো গ্রহণ করলই না বরং তাকে নানা রকমের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে জর্জরিত করলো।
তারা যখন দাওয়াত কবুল করলনা, তখন মহানবী তাদেরকে নিরপেক্ষ থাকতে অনুরোধ করলেন যাতে করে তাদের মত দ্বারা সাধারণ মানুষ প্রভাবিত হতে না পারে।
কিন্তু উল্টোই করলো তারা। লেলিয়ে দিল ছেলে-ছোকরা ও দাসদের। মহানবী রাস্তায় বের হলেন তারা তাঁর পেছনে ছুটত, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতো, পাথর ছুরতো।
এর মধ্যেই মহানবী সত্যের আহবান তায়েফের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে লাগলেন। পথের দুধার থেকে তাঁর পা লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করা হতে লাগলো। রক্ত রঞ্জিত হয়ে গেল তাঁর পা। চলতে না পেরে মাঝে মাঝে তিনি বসে পরতেন। লোকরা তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আবার সেই আগের মতই পাথর নিক্ষেপ করতো। এভাবে ক্রমে তাঁর জীবন সংশয় দেখা দিল।
অবশেষে মহানবী মক্কায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সময় অত্যাচার ভীষণ আকার ধারণ করলো। একদিন তারা পাথরের আঘাতে আঘাতে তাঁর দেহ জর্জরিত করে তুললো। সর্বাঙ্গ থেকে রক্তের ধারা গড়িয়ে পরতে লাগলো। এক সময় অবসন্ন হয়ে পড়ে গেলেন মহানবী। ক্লান্ত অবসন্ন দেহটা নিয়ে মহানবী ঢুকে পড়লেন একটি আঙ্গুর বাগানে।
দেহের প্রবাহিত রক্ত জুতায় প্রবেশ করে পায়ের সাথে জমাট বেঁধে গিয়েছিল। জুতা খুলতে খুবই কষ্ট হলো তাঁর। ওযু করে মহানবী বিশ্ব জগতের মালিক প্রভুর উদ্দেশ্যে নামাযে তন্ময় হয়ে গেলেন। নামায শেষে প্রভুর উদ্দেশ্যে দুটি প্রার্থনার হাত উত্তোলন করলেন। কি প্রার্থনা করলেন তিনি? তিনি কি নিজের কষ্ট লাঘবের জন্য দোয়া করলেন? নাকি তিনি তায়েফবাসীর জন্য বদদোয়া করলেন? না তিনি এ সবের কিছুই করেন নি। তিনি প্রভুর সমীপে দুটি হাত তুলে বললেন, “হে আমার আল্লাহ, তোমাকে ডাকছি। নিজের এই দুর্বলতা, নিরুপায় অবস্থা সম্বন্ধে তোমার কাছেই অভিযোগ পেশ করছি। হে পরম দয়াময়, তুমিই যে দুর্বলের বল। প্রভুহে, তোমার সন্তোষই আমার একমাত্র কাম্য। তোমার সন্তোষ পেলে এসকল বিপদ-আপদের কোন পরওয়াই করি না।”
মহানবী মক্কায় ফিরে চলেন।যখন তিনি তায়েফ ছাড়ছিলেন, তখন আল্লাহর নির্দেশে পাহাড়ের ফিরিশতা এসে তায়েফবাসীদেরকে পাহাড় চাপা দিয়ে মেরে ফেলার অনুমতি চাইলেন। মহানবী(সা) বললেন, আমি চাই তারা বেঁচে থাকুক। তাদের বংশধরগণ তো ইসলাম গ্রহণ করতে পারে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি