প্রাথমিক কথা
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে আদর্শ দুনিয়ার মানুষের সামনে উপস্থাপিত করেছেন, এক কথায় তা-ই সুন্নাত এবং তার বিপরীত যা কিছু তা বিদয়াত এর পর্যায়ে গণ্য। নবী করীম (সাঃ) ‍এর তেইশ বছরের অবিশ্রান্ত সাধনা ও সংগ্রামের মাধ্যমে যে সমাজ গড়ে তুলেছিলেন, তাকে তিনি মুক্ত করেছিলেন সকলপ্রকার বিদয়াত ও জাহিলিয়াতের অক্টোপাশ থেকে এবং প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সুন্নাতের আলোকোদ্ভাসিত মহান আদর্শের উপর। বিশ্ব মানবতার পক্ষে এ ছিল মহা সৌভাগ্যের ব্যাপার।

উত্তরকালে নানা কারণে মুসলিম সমাজ সুন্নাতের আদর্শ হতে বিচ্যূত হয়ে পড়ে, তাদের আকীদা ও আমলে প্রবেশ করে অসংখ্য বিদয়াত। এমন দিনও দেখা যায়, যখন মুসলমানরা সুন্নাত ও বিদয়াতের সংমিশ্রণে এক জগাখিচুড়ী বিধানকেই ইসলামী আদর্শ বলে মনে করতে ও অনুসরণ করতে শুরু করে। ফলে তাদের জীবনে আসে সার্বিক ভাঙন ও বিপর্যয়। বর্তমান সময় সে বিপর্যস্ত পরিবেশ ও পরিস্থিতিই গ্রাস করেছে সমগ্র বিশ্বমুসলিমকে।

কিন্তু এ অবস্থা বাঞ্চনীয় নয় মুসলমানদের জন্য। কারো পক্ষেই কাম্য হতে পারেনা এ আদর্শের বিচ্যূতি। এজন্য আজ নতুন করে লোকদের সামনে ইসলামী আদর্শবাদের ব্যাপক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ অপরিহার্য্য, যেন মুসলমানদের মনে চেতনা জেগে উঠে, উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে তাদের অবস্থার পরিবর্তনের পুনর্জাগরণের এবং নতুন করে আদর্শবাদী হয়ে উঠার এক উদগ্র বাসনা। এ পর্যায়ে আমার ক্ষুদ্র লেখনী-শক্তি যতোটুকু কাজ করেছে, তার মধ্যে বর্তমান গ্রন্থ একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সুন্নাত ও বিদয়াতের মৌলিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এবং আকীদা বিশ্বাসে, জীবনে ও সমাজে কোথায় কোথায় সুন্নাত থেকে বিচ্যূতি আর বিদয়াতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে তা স্পষ্ট করে তুলে ধরাই আমার এ গ্রন্থ রচনার মূলে একমাত্র উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্য কতখানি সফল হয়েছে কিংবা আদৌ তা সাফল্যের দাবি করতে পারি কিনা পাঠকবর্গ-ই তা বিবেচনা করবেন। আমার বক্তব্য শুধু এতটুকু যে, যা কিছু লিখেছি গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করে বুঝে শুনে লিখেছি, সঠিক কথা সুস্পষ্টভাবে পেশ করার জন্যই লিখেছি, লিখেছি কুরআন-হাদীস, ফিকাহ ও সর্বজনমান্য মনীষীদের মতামতের ভিত্তিতে। এ বইয়ে আলোচিত মতামতের জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি-ই দায়ী এবং যদি কাউকে দায়ী করতে হয় সেজন্য কেবল আমাকেই দায়ী করা যেতে পারে, অন্য কাউকে নয়। এ আলোচনায় আমি কোন ভুল করে থাকলে, কারো দোহাই দিয়ে নয়, কুরআন-হাদীসের ভিত্তিতেই আমার ভুল ধরিয়ে দেয়া যেতে পারে। এ ধরণের যে কোনো ভুলের সংশোধন করে নিতে আমি সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত।

এতদসত্ত্বেও আমার এ প্রচেষ্টা যদি আদর্শকে সমুজ্জল করে তোলবার এবং বিদয়াতের অন্ধকার বিদূরণে সামান্য কাজও করতে সক্ষম হয় তাহলে আমার শ্রম সার্থক মনে করবো এবং তাকে পরকালে আল্লাহর নিকট মুক্তিলাভের অসীলারূপে মনে করে তাঁর শোকরিয়া আদায় করবো।

মুহাম্মাদ আবদুর রহীম

 

দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা
আমার লিখিত ‘সুন্নাত ও বিদয়াত’ গ্রন্থখানি ১৯৬৭ সনের সেপ্টেম্বর মাসে সর্ব প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। অতঃপর অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর সমস্ত কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। গ্রন্থখানি যে বিদগ্ধ সমাজের নিকট সমাদৃত হয়েছে এবং চিন্তার জগতে তা যে বিশেষ আলোড়নের সৃষ্টি করেছে, তা তখনই স্পষ্ট বুঝতে পারা গিয়েছিল। বস্তুত আমাদের সমাজে যুগ যুগ ধরে সিঞ্চিত ও পুঞ্জীভূত বিদয়াতের উপর এ গ্রন্থখানি এক প্রচন্ড আঘাত হেনেছিল এবং বিদয়াতের পূজীরী ও বিদয়াত আশ্রিত গোষ্ঠী এ আঘাতে হতচকিত ও ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়েছিল। চারদিকে ‘গেল গেল’ রব ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল। চলমান বিদয়াতের এটা ছিল আমার একটা চ্যালেঞ্জ।স্বভাবতই আমি আশা করেছিলাম, বিদয়াত পন্থীদের পক্ষ হতে এর প্রতিবাদ হয়তো আসবে।

কিন্তু কার্যত দেখা গেল, এ গ্রন্থের অকাট্য শাণিত ও অমোঘ আঘাতের জবাবে বিদয়াত পন্থীদের নিকট বলার মতো কোন কথা নেই। যদিও তারা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করতে ত্রুটি করেনি। অতঃপর সংশ্লিষ্ট মহলসমূহ নীরবতা অবলম্বন ছাড়া আর কোন পথ খুঁজে পায়নি। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছি এ দেখে যে, আমি পর্বত সমান বিদয়াতের বিরুদ্ধে যে কথা বলেছি, কোন অকাট্য দলীল দ্বারা তা রদ করার সাধ্য কোন মহলেরই নেই। আমি মহান আল্লাহর শোকর আদায় করছি এ জন্য যে, এ কালের পুঞ্জীভূত বিদয়াতের বিরুদ্ধে হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর সুন্নাত আদায় করা এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও মুজাদ্দিদে আলফেসানী (র)-র আদর্শ অনুসরণের কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভবপর হয়েছে তা যত সামান্য ও যত ক্ষুদ্রই হোকনা কেন।

এই প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমি পীর-মুরীদী ব্যবস্থাকে ‘সুন্নাত’ বিরোধী ও বিদয়াত প্রমাণ করেছি, কিন্তু এদেশে আলিম ও পীরসাহেবান আবহমানকাল ধরে ইসলামের যে বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন, এ দেশে এখনো যে দ্বীন ইসলামের নাম নিশানা রয়েছে তার পেছনে তাঁদের যে অপরিসীম অবদান রয়েছে, আমি তা অবশ্যই স্বীকার করেছি।

বিগত প্রায় দশটি বছর যাবত গ্রন্থটি পূর্ণমুদ্রণ সম্ভবপর হয়নি কোনো দুঃসাহসী প্রকাশক পাওয়া যায়নি বলে। বর্তমানে জনাব মোঃ আতাউর রহমান কর্তৃক তা নতুনভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এতে অনেক কয়টি নতুন বিষয় সংযোজিত হয়েছে এবং প্রথম সংস্করণের অনেক কথা অধিকতর বলিষ্ঠ ও যুক্তিসহ পুনর্লিখিত হয়েছে। তত্ত্ব ও তথ্যের তুলনায় পূর্বের তুলনায় যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছে এ সংস্করণটি।

তাই সহজেই আশা করতে পারি, প্রথম সংস্করণের তুলনায় এই সংস্করণ বিদগ্ধ পাঠক সমাজের নিকট অনেক বেশি সমাদৃত হবে। নতুন করে গ্রন্থখানি পাঠক সমাজের নিকট উপস্থাপিত করতে পারলাম দেখে মহান আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি।

মুহাম্মদ আবদুর রহীম

 

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

‘সুন্নাত’ ও ‘বিদয়াত’ দুটোই আরবী শব্দ। তা সত্ত্বেও মুসলিম সমাজে এ দুটো শব্দ ব্যাপকভাবে পরিচিত এবং ইসলামের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এ শব্দ দুটো বহুল ব্যবহৃত। কিন্তু যতদূর বোঝা যাচ্ছে, এ দুটো পরিভাষার সঠিক তাৎপর্য অনেকেই অনুধাবন করতে সক্ষম নয়। অথচ ইসলামী সংস্কৃতির যতোগুলো মৌলিক পরিভাষা রয়েছে, যে-সব পরিভাষার উপর ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার সম্যক অনুধাবন নির্ভরশীল, এ দুটো শব্দ তার মধ্যেই গণ্য। অতএব এ দুটো শব্দের সঠিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ এবং এ দুটোর দৃষ্টিতে বর্তমান বিশ্ব-মুসলিম এর আকীদা, আমল ও আখলাক যাচাই ও পরখ করা একান্তই জরুরী, যদিও বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষ।

এ বিষয় আলোচনার প্রয়োজনীয়তা আরো অধিক তীব্র হয়ে দেখা দেয়, যখন আমরা দেখতে পাই যে, বর্তমান মুসলিম সমাজে কার্যত সুন্নাত ও বিদয়াতের মাঝে কোন পার্থক্য করা হয়না। শুধু তাই নয়, বহু রকমের সুন্নাত সমর্থিত ও সুন্নাতের দৃষ্টিতে অপরিহার্য-অবশ্য করণীয় কাজ আজ্ও মুসলিম সমাজেই সাধারণভাবে পরিত্যক্ত হয়ে রয়েছে এবং বহু প্রকারের বিদয়াত সুন্নাতের মতই গুরু্ত্ব লাভ করে শক্তভাবে শিকড় গেড়ে এবং শাখা প্রশাখায়, পত্র ও ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে বসে আছে। এখন অবস্থা এই যে, বর্তমান মুসলিম সমাজের চেহারা দেখে, তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক সামগ্রিক কার্যক্রম দেখে এবং জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের বাস্তব ভূমিকা লক্ষ্য করে বুঝবার কোন উপায় নেই যে, কোনটি সুন্নাত আর কোনটি বিদয়াত।আজকের মুসলিম জীবনে সুন্নাতের দিকপ্লাবী নির্মল আলোকচ্ছটা ম্লান হয়ে এসেছে এবং তদস্থলে বিদয়াতের কালো আঁধার সর্বত্র ছেয়ে আছে, গ্রাস করে ফেলেছে সমগ্র মুসলিম জীবনকে। বিদয়াতের এ রাহুগ্রাস হতে মুক্তি পাওয়া না পর্যন্ত সুন্নাতের স্বচ্ছ আলোকধারায় মুসলিম জীবনকে উদ্ভাসিত করে তোলা কিছুতেই সম্ভবপর হবেনা, হতে পারেনা। ঠিক এ উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে-ই আমরা এ আলোচনায় প্রবৃত হয়েছি।

সুন্নাত ও বিদয়াতের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য
প্রথমে আমরা মৌলিকভাবে এ শব্দ দুটোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করতে চাই, বুঝতে চাই ইসলামী পরিভাষা হিসেবে ‘সুন্নাত’ বলতে কি বুঝায় এবং আহলে সুন্নাতই বা কারা? এবং বিদয়াত কি এবং সে বিদয়াত কতো দিক দিয়ে সচেতন বা অবচেতনভাবে মুসলিম সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে।

‘সুন্নাত’ শব্দের ব্যাখ্যা
‘সুন্নাত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘পথ’।

কুরআন মজীদে এ ‘সুন্নাত’ শব্দটি বহু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে।

একটি আয়াত হলোঃ

سُنَّةَ اللَّهِ الَّتِي قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلُ ۖ وَلَن تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلًا [٤٨:٢٣]

আল্লাহর সুন্নাত, যা পূর্ব থেকেই কার্যকর হয়ে রয়েছে। আর আল্লাহর এ সুন্নাতে কোনরূপ পরিবর্তন দেখবেনা কখনো।(আল ফাতহঃ48)

অপর আয়াতে বলা হয়েছেঃ فَلَن تَجِدَ لِسُنَّتِ اللَّهِ تَبْدِيلًا ۖ وَلَن تَجِدَ لِسُنَّتِ اللَّهِ تَحْوِيلًا

-তুমি আল্লাহর সুন্নাতে কোনরূপ পরিবর্তন হতে- কোনো প্রকারের ব্যতিক্রম হতে দেখবেনা।(আল ফাতীরঃ42)

সূরা বনি ইসরাঈলেও ‘সুন্নাত’ শব্দটি একই আয়াতে দুবার ব্যবহৃত হয়েছে।

আয়াতটি- سُنَّةَ مَن قَدْ أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِن رُّسُلِنَا ۖ وَلَا تَجِدُ لِسُنَّتِنَا تَحْوِيلًا [١٧:٧٧]

-তোমার পূর্বে যেসব রাসূল পাঠিয়েছি এ হচ্ছে তাদের ব্যাপারে সুন্নাত এবং তুমি আল্লাহর সুন্নাতে কোনোরূপ পরিবর্তন পাবেনা।

এসব আয়াতে ব্যবহৃত ‘সুন্নাত’ শব্দের শাব্দিক ও আভিধানিক অর্থ পথ, পন্থা ও পদ্ধতি। কিন্তু ‘সুন্নাতুল্লাহ’-আল্লাহর সুন্নাতের মানে কি?

ইমাম রাগেব ইসফাহানী লিখেছেনঃ আল্লাহ তা’আলার সুন্নাত বলা হয় তাঁর কর্মকুশলতার বাস্তব পন্থাকে, তাঁর আনুগত্য করার নিয়ম ও পদ্ধতিকে।

এভাবে দেখা যায় যে, ‘সুন্নাত’ শব্দটি একটি মৌলিক বিষয় সম্পর্কিত এবং তা যেমন আল্লাহর ব্যাপারে প্রয়োগ করা হয়েছে, তেমনি করা হয়েছে নবী ও রাসূলদের ক্ষেত্রেও। সাধারণ মানুষের বাস্তব অবস্থান বুঝবার জন্যেও এ শব্দের ব্যবহার দেখা যায় কুরআন মজীদে।

এ হলো ‘সুন্নাত’ শব্দটির শাব্দিক ব্যবহার ও আভিধানিক অর্থ। আমরা এখানে ‘সুন্নাত’ শব্দটির যে বিশ্লেষণ শুরু করেছি, তা এ দৃষ্টিতেই। আমাদের সামনে রয়েছে ‍এর মূল ও নির্গলিত অর্থ ।

ইমাম রাগেবের ভাষায়ঃ নবীর সুন্নাত হচ্ছে সে নিয়ম, পন্থা ও পদ্ধতি, যা তিনি বাস্তব কাজে ও কর্মে অনুসরণ করে চলতেন।

আর আল্লামা মুহাম্মাদ বশীর সাহসোয়ানীর ভাষায় ‘সুন্নাত’ হলোঃ সেই বিশেষ পথ, পন্থা ও পদ্ধতি যা নবী করীম (সাঃ) এর সময় থেকেই দ্বীন ইসলামের ব্যাপারে কোনো কাজ করার বা না করার দিক দিয়ে বাস্তবভাবে অনুসরণ করা হয়-যার উপর দিয়ে চলাচল করা হয়। ‘কিতাবুল মকসূদ’ এর ‘কিতাবুল কাজী’ অধ্যায়ে ‘সুন্নাত’ শব্দের ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবেঃ ‘সুন্নাত’ দ্বীন ইসলামের এমন এক অনুসৃত কর্মপদ্ধতি, যার অনুসরণ সকল অবস্থায়ই ওয়াজিব বা কর্তব্য।

আল্লামা আবদুল আযীয আল হানাফী লিখেছেনঃ ‘সুন্নাত’ শব্দ বোঝায় রাসূল(সাঃ) এর কথা ও কাজ। আর তা রাসূলে করীম(সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের বাস্তব কর্মনীতি বুঝবার জন্যও ব্যবহৃত হয়।

আল্লামা সফীউদ্দীন আল-হাম্বলী লিখেছেনঃ কুরআন ছাড়া রাসূলের যে কথা, যে কাজ বা অনুমোদন বর্ণনার সূত্রে পাওয়া যায় তা-ই সুন্নাত।

মনে রাখতে হবে, এখানে সুন্নাতের সে অর্থ আলোচ্য নয়, যা হাদীস বিজ্ঞানীরা পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছেন; সে অর্থও নয় যা ফিকহ শাস্ত্রে গ্রহণ করা হয়েছে। হাদীস বিজ্ঞানীদের পরিভাষায় ‘সুন্নাত’ হচ্ছে রাসূলে করীম(সাঃ) এর মুখের কথা, কাজ ও সমর্থন অনুমোদনের বর্ণনা- যাকে প্রচলিত কথায় বলা হয় ‘হাদীস’। আর ফিকাহশাস্ত্রে ‘সুন্নাত’ বলা হয় এমন কাজকে, যা ফরজ ও ওয়াজিব নয় বটে; কিন্তু নবী করীম(সাঃ) তা প্রায়ই করেছেন। এ গ্রন্থে এ দুটো সুন্নাতের কোনটি-ই আলোচ্য নয়। এখানে আলোচ্য হচ্ছে ‘সুন্নাত’ তার মূলগত অর্থের দিক দিয়ে যা মৌলিক আদর্শ রীতি-নীতি, পথ, পন্থা ও পদ্ধতি বোঝায়। বস্তুত এ হিসেবে ‘সুন্নাত’ হলো সেই মূল আদর্শ, যা আল্লাহ তা’আলা বিশ্ব মানবের জন্য নাজিল করেছেন, যা রাসূলে করীম(সাঃ) নিজে তাঁর বাস্তব জীবনে দ্বীনি দায়িত্ব পালনের বিশাল ক্ষেত্রে অনুসরণ করেছেন; অনুসরণ করার জন্য পেশ করেছেন দুনিয়ার মানুষের সামনে। মূল ইসলামেরই বিকল্প শব্দ হচ্ছে ‘সুন্নাত’ যা আমরা এখানে আলোচনা করেছি। কেননা নবী করীম(সাঃ) যা বাস্তবভাবে অনুসরণ করেছেন, তার উৎস হচ্ছে ওহী- যা আল্লাহর নিকট হতে তিনি লাভ করেছেন। এ ‘ওহী’ দু’ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে আল্লাহর জানিয়ে দেয়া বিধান ও নির্দেশ। রাসূলে করীম (স) এর বাস্তব কর্মজীবন এ দুটোরই সমন্বয়, যেখানে এসবকিছুরই প্রতিফলন ঘটেছে পরিপূর্ণভাবে। রাসূলের বাস্তব জীবন বিশ্লেষণ করলে এ সব কটিরই প্রকটভাবে সন্ধান লাভ করা যাবে। আর তাই হচ্ছে ‘সুন্নাত’, তাই হচ্ছে পরিপূর্ণ দ্বীন ইসলাম। কুরআন মজীদে রাসূলের এ বাস্তব জীবনের সত্যিকার রূপ সুস্পষ্ট করে তুলবার জন্যেই তাঁর জবানীতে বলা হয়েছেঃ আমি কোন আদর্শই অনুসরণ করিনা; করি শুধু তাই যা আমার নিকট ওহীর সূত্রে নাযিল হয়।

ওহীর সূত্রে নাযিল হওয়া আদর্শই রাসূল করীম(স) বাস্তব কাজে ও কর্মে অনুসরণ করেছেন, তা-ই হচ্ছে আমাদের আলোচ্য ‘সুন্নাত’। এই সুন্নাতেরই অপর নাম ইসলাম।

কুরআন মজীদে এ সুন্নাতকেই ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। রাসূলের জবানীতে কুরআন মজীদে ঘোষণা করা হয়েছেঃ

নিশ্চয়ই এ হচ্চে আমার সঠিক সরল দৃঢ় পথ। অতএব তোমরা এ পথই অনসরণ করে চলবে, এ ছাড়া অন্যান্য পথের অনুসরণ তোমরা করবেনা। তা করলে তা তোমাদের এ পথ হতে বিচ্ছিন্ন করে দূরে নিয়ে যাবে। আল্লাহ তোমাদের এরূপ-ই নির্দেশ দিয়েছেন যেন তোমরা ভয় করে চলো।

এ আয়াতে ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ বলতে সে জিনিসকেই বুঝানো হয়েছে, যা বোঝায় ‘সুন্নাত’ শব্দ হতে। ইমাম শাতেবী ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ এর পরিচয় সম্পর্কে লিখেছেনঃ ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ হচে্ছ আল্লাহর সেই পথ, যা অনুসরণের জন্য তিনি দাওয়াত দিয়েছেন। আর তা-ই সুন্নাত; আর অন্যান্য পথ বলতে বোঝানো হয়েছে বিরোধ ও বিভেদপন্থীদের পথ, যা মানুষকে ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ হতে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। আর তারাই হচ্ছে বিদয়াতপন্থী লোক। আরও মনে রাখতে হবে, সুন্নাত হচ্ছে তা-ই , যা বিদয়াতের বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত হয়। কেননা এ সুন্নাতের বিপরীতই হচ্ছে বিদয়াত।

‘বিদয়াত’ শব্দের ব্যাখ্যা
ইমাম রাগেব ‘বিদয়াত’ শব্দের অর্থ লিখেছেনঃ

কোনরূপ পূর্ব নমুনা না দেখে এবং অন্য কোন কিছুর অনুকরণ অনুসরণ না করেই কোনো কাজ নতুনভাবে সৃষ্টি করা।

আর দ্বীনের ক্ষেত্রে যে বিদয়াত তার সংজ্ঞা হিসেবে লিখেছেনঃ আরবী(*********)

দ্বীনের ক্ষেত্রে বিদয়াত হচ্ছে এমন কোনো কথা উপস্থাপন করা, যার প্রতি বিশ্বাসী ও যার অনুসারী লোক কোন শরীয়ত প্রবর্তক বা প্রচারকের আদর্শে আদর্শবান নয়, শরীয়তের মৌলনীতি ও সুষ্ঠু পরিচ্ছন্ন আদর্শের সাথেও যার কোন মিল নেই।

অর্থাৎ শরীয়ত প্রবর্তক যে কথা বলেননি সে কথা বলা এবং তিনি যা করেননি এমন কাজকে আদর্শরূপে গ্রহণ করা তা-ই হচ্ছে বিদয়াত।

ইমাম নবয়ী বিদয়াত শব্দের অর্থ লিখেছেনঃ আরবী(*********)

-এমন সব কাজ করা বিদয়াত, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই।

আর আল্লামা মুল্লা-আলী আল কারী লিখেছেনঃ আরবী(*********)

-রাসূলের যুগে ছিলনা এমন নীতি ও পথকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে প্রবর্তন করা।

ইমাম শাতেবী লিখেছেনঃ আরবী(*********)

-আরবী ভাষায় বলা হয় অমুক লোক বিদয়াত করেছেন। আর এর মানে বোঝা হয়ঃ অমুক লোক নতুন পন্থার উদ্ভাবন করেছে, যা ইতিপূর্বে কারো দ্বারাই অনুসৃত হয়নি।

তিনি আরো লিখেছেনঃ আরবী(*********)

-বিদয়াত তখনই বলা হবে যখন বিদয়াতী কোনো কাজকে শরীয়ত মোতাবিক কাজ বলে মনে করবে অথচ তা মূলত শরীয়ত মোতাবিক নয়। এছাড়া আর অন্য কোনো অর্থ নেই।

তার মানে, শরীয়ত মোতাবিক নয়- এমন কাজকে শরীয়ত মোতাবিক বলে আকীদা হিসেবে বিশ্বাস করে নেয়াই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে বিদয়াত। অন্যত্র লিখেছেনঃ আরবী(*********)

-এজন্যই এমন কাজকেও ‘বিদয়াত’ নাম দেয়া হয়েছে, যে কাজের সমর্থনে শরীয়তের কোনো দলীল নেই।

মোটকথা দাঁড়াল এই যে, বিদয়াত বলা হয় দ্বীন-ইসলামের এমন কর্মনীতি বা কর্মপন্থা চালু করাকে, যা শরীয়তের বিপরীত এবং যা করে আল্লাহর বন্দেগীর ব্যাপারে আতিশয্য ও বাড়াবাড়ি করাই হয় লক্ষ্য।

আবার প্রকৃত বিদয়াত ও আপেক্ষিক বিদয়াত এর পার্থক্য প্রদর্শন প্রসঙ্গে ইমাম শাতেবী লিখেছেনঃ আরবী(*********)

-প্রকৃত ও সত্যিকারের বিদয়াত তাই, যার স্বপক্ষে ও সমর্থনে শরীয়তের কোনো দলীলই নেই। না আল্লাহর কিতাব, না রাসূলের হাদীস, না ইজমার কোনো দলীল, না এমন কোনো দলীল পেশ করা যায় যা বিজ্ঞজনের নিকট গ্রহণযোগ্য। না মোটামোটিভাবে, না বিস্তারিত ও খুঁটিনাটিভাবে। এজন্য এর নাম দেয়া হয়েছে বিদয়াত। কেননা তা মনগড়া, স্ব-কল্পিত, শরীয়তে যার কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই।

প্রখ্যাত হাদীসবিদ ইমাম খা্ত্তাবী বিদয়াতের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবেঃআরবী(*********)

-যে মত বা নীতি দ্বীনের মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, নয় কোনো দৃষ্টান্ত কিংবা কিয়াস সমর্থিত- এমন যা নবোদ্ভাবিত করা হবে, তাই বিদয়াত। কিন্তু যা দ্বীনের মূলনীতি মোতাবিক, তারই ভিত্তিতে গঠিত, তা বিদয়াতও নয়, গোমরাহীও নয়।

হাফেজ ইবনে রজবও এ কথাই লিখেছেনঃ আরবী(*********)

‘বিদয়াত’ বলতে বোঝায় তা, যা নবোদ্ভাবিত, বোঝার মতো কোনো দলীল বা প্রমাণ শরীয়তে যার নেই।

 

কুরআন ও হাদীসে ‘বিদয়াত’ শব্দের উল্লেখ
কুরআন মজীদে ‘বিদয়াত’ শব্দটি তিনটি ক্ষেত্রে তিনভাবে উল্লেখিত হয়েছে।

একঃ আল্লাহ সম্পর্কে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে দুটি আয়াতে। একটি আয়াতঃ

بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ وَإِذَا قَضَىٰ أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُن فَيَكُونُ [٢:١١٧]

- আসমান জমিনের সম্পূর্ণ নবোদ্ভাবনকারী, নতুন সৃষ্টিকারী। তিনি যখন কোনো কাজের ফায়সালা করেন, তখন তাকে শুধু বলেনঃ হও। অমনি তা হয়ে যায়।(আল বাকারাহঃ117)

অপর আয়াতটি

بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ أَنَّىٰ يَكُونُ لَهُ وَلَدٌ وَلَمْ تَكُن لَّهُ صَاحِبَةٌ ۖ وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ ۖ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ [٦:١٠١

- তিনি তো আসমান জমিনের নব ‍সৃষ্টিকারী। তাঁর সন্তান হবে কোথ্থেকে, কেমন করে হবে তাঁর স্ত্রী? তিনি-ই তো সব জিনিস সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি সর্ব বিষয়েই অবহিত।(আল আনআমঃ101)

এ দুটো আয়াতেই আল্লাহ তা’আলাকে ‘আসমান জমিনের বদীউন’- ‘পূর্ব দৃষ্টান্ত, পূর্ব উপাদান ও পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই সৃষ্টিকার’ বলা হয়েছে।

দ্বিতীয়, রাসূলে করীম(স) এর জবানীতে তাঁর নিজের সম্পর্কে বলা একটি আয়াতে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এভাবেঃ

قُلْ مَا كُنتُ بِدْعًا مِّنَ الرُّسُلِ وَمَا أَدْرِي مَا يُفْعَلُ بِي وَلَا بِكُمْ ۖ

-বলো হে নবী! আমি কোনো অভিনব প্রেৃরিত ও নতুন কথার প্রচারক রাসূল হয়ে আসিনি। আমি নিজেই জানিনে আমার সাথে কিরূপ ব্যবহার করা হবে, তোমাদের সাথে কি করা হবে, তাও আমার অজ্ঞাত। (আল আহকাফঃ9)

আর তৃতীয়, এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে বনী ইসরাঈলের এক অংশের লোকদের বিশেষ ধরণের আমলের কথা বলতে গিয়ে।

আয়াতটি এইঃ وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ

-এবং অত্যধিক ভয়ের কারণে গৃহীত কৃচ্ছসাধনা ও বৈরাগ্যনীতি তারা নিজেরাই রচনা করে নিয়েছে। আমরা তাদের উপর এই নীতি লিখে ফরজ করে দিইনি। বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি সন্ধানকেই তাদের জন্য লিপিবদ্ধ করে দিয়েছিলাম।(আল হাদীদঃ 27)

এখানে ‘রাহবানিয়াত’ কে বিদয়াত বলা হয়েছে, যা আল্লাহ তা’আলা ব্যবস্থা করে দেননি, লোকেরা নিজেদের তরফ থেকে রচনা করে নিয়েছে। এখানে যে ‘বিদয়াত’ এর কথা বলা হয়েছে, সুন্নাত এর বিপরীত শব্দ হিসেবে, এ গ্রন্থে তা-ই আমাদের আলোচ্য বিষয়। এ আয়াত হতে যে কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠে তা হলোঃ আল্লাহ বান্দাদের জন্য যে বিধি ও বিধান দেননি-বান্দারা নিজেদের ইচ্চেমতো যা রচনা করে নিয়েছে, তা-ই ‘বিদয়াত’। পক্ষান্তরে আল্লাহ যা কিছু লিখে দিয়েছেন, বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন, যা করতে আদেশ করেছেন, তা করা ‘বিদয়াত’ নয়। এখান হতেই ‘বিদয়াত’ সংক্রান্ত মূল সংজ্ঞা ও ভাবধারার স্পষ্ট আভাস পাওয়া গেল।

সূরা ‘আল কাহাফ’ এর এক আয়াতে ‘বিদয়াত’ শব্দের এই অর্থের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষায়।

আয়াতটি এইঃ قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُم بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا [١٨:١٠٣]

الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا [١٨:١٠٤]

-বলো হে নবী! আমলের দিক দিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের কথা কি তোমাদের বলবো? তারা হচ্চে এমন লোক যাদের যাবতীয় চেষ্টা সাধনাই দুনিয়ার জীবনে বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। আর তারাই মনে মনে ধারণা করে যে তারা খুবই ভালো কাজ করেছে। (আল কাহাফঃ102-103)।

অর্থাৎ যাবতীয় কাজ কর্ম ভুলের ভিত্তিতে সম্পাদিত হওয়া সত্ত্বেও যারা নিজেদের কাজকে খুবই ভালো, খুবই ন্যায়সঙ্গত, খুবই সওয়াবের কাজ বলে মনে করে, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত লোক। বিদয়াতপন্থীরাও ঠিক এমনি। তারা যেসব কাজ করে, আসলে তা আল্লাহর দেয়া নীতির ভিত্তিতে নয়। তা সত্ত্বেও এই হচ্ছে বিদয়াতের সঠিক পরিচয়। সূরা আল-কাহাফের উপরোক্ত আয়াতের তাফসীরে আল্লামা ইবনে কাসীর লিখেছেনঃ এ আয়াত সাধারণভাবে এমন সব লোকের বেলায়ই প্রযোজ্য , যারা আল্লাহর ইবাদত করে আল্লাহর পছন্দনীয় পন্থার বিপরীত পন্থা ও পদ্ধতিতে। তারা যদিও মনে করছে যে, তারা ঠিক কাজই করেছে এবং আশা করছে যে, তাদের আমল আল্লাহর নিকট স্বীকৃত ও গৃহীত হবে। অথচ প্রকৃতপক্ষে তারা ভুল নীতির অনুসারী এবং এ পর্যায়ে তাদের আমল আল্লাহর নিকট প্রত্যাখ্যাত।

অর্থাৎ ইবাদত-বন্দেগীর কাজ-যা করলে সওয়াব হবে এবং যা না করলে গুনাহ হবে বলে মনে করা হবে-এমন সব কাজই হতে হবে আল্লাহর সন্তোষমূলক পন্থা ও পদ্ধতিতে। এই হচ্ছে সুন্নাত। আর তার বিপরীত রীতি ও নিয়মে হলে তা হবে সুস্পষ্ট বিদয়াত। কেননা তা সুন্নাত বিরোধী। ইমাম কুরতবী তাই বিদয়াত বলেছেন এমন সব জিনিসকে যাঃ যা আল্লাহর কিতাব বা রাসূলের সুন্নাত অথবা সাহাবাদের আমলের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও তার অনুরূপ নয়।

এ সম্পর্কে অধিক সুস্পষ্ট কথা বিবৃত হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতটিতেঃ আয়াতটি এইঃ

وَمَن يُشَاقِقِ

الرَّسُولَ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ ۖ وَسَاءَتْ مَصِيرًا [٤:١١٥

-যে ব্যক্তি সঠিক হেদায়াতের পথ স্পষ্ট উজ্জ্বল হয়ে উঠার পরও রাসূলে করীমের বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং মুমিন সমাজের সুন্নতী আদর্শকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো পথ ও আদর্শের অনুসরণ করবে, আমরা তাদের সে পথেই চলতে দিবো। আর কিয়ামতের দিন তাদের পৌছে দিবো জাহান্নামে। বস্তুত জাহান্নাম অত্যন্ত খারাপ জায়গা। (আন নিসাঃ115)

এ আয়াতটি সুন্নাতের কুরআনী দলীল সমূহের অন্যতম। যে হেদায়াতের সুস্পষ্ট প্রতিভাত হয়ে উঠার কথা এখানে বলা হয়েছে মূলত তা-ই ‘সুন্নাত’। এ সুন্নাতই হেদায়াতের একমাত্র রাজপথ। কেননা আল্লাহর কালাম ও আল্লাহর অস্পষ্ট ওহী (ওহীয়ে খফী) অনুযায়ীই তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে সুন্নাতের এ আদর্শকেই তিনি উদ্ভাসিত করে তুলেছিলেন। রাসূলের তৈরি সমাজের মুমিনগণ এই পথ অনুসরণ করেই চলতেন। এখন যদি কউ রাসূলের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে, রাসূলের আদর্শ অনুসরণ করে চলতে প্রস্তুত না হয়, আর এ জন্যে মুমিন সমাজের অনুসৃত আদর্শকে বাদ দিয়ে অপর কোনো আদর্শকে অনুসরণ করে চলে, তবে তার পরিণাম জাহান্নাম ছাড়া আর কিছু নয়। অতএব রাসূলের ‘সুন্নাত’কে অনুসরণ করে চলাই কল্যাণ ও মুক্তিলাভের একমাত্র উপায়।

হাদীসে নবী করীমের ভাষায় ‘সুন্নাত’ কেই বলা হয়েছে ‘আল-আমর’। হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হয়েছে, নবী-করীম (স) ঘোষণা করেছেনঃ

আরবী(*********)

যে লোক আমার এই জিনিসে এমন কোনো জিনিস নতুন শামিল বা উদ্ভাবন করবে, যা মূলত এই জিনিসের অন্তর্ভূক্ত নয়, তা-ই প্রত্যাহৃত হবে।

এই হাদীসে ‘আমর’(অমর) বলে বুঝিয়েছেন মূল দ্বীন ইসলামকে, যা নবী করীম (স) দুনিয়ায় উপস্থাপিত করেছেন। কেননাঃ এই দ্বীন-ইসলামই তাঁর কর্মনীতি এবং তাঁর মান-মর্যাদা ও অবস্থার সাথে পূর্ণ সম্পৃক্ত।

আল্লামা কাজী ইয়াজ এ হাদীসের অর্থ বলেছেন এ ভাষায়ঃ

যে লোক ইসলামে এমন কোনো মত বা রায় প্রবেশ করাবে-ইসলামী বলে চালিয়ে দেবে, যার অনুকুলে কুরআন ও হাদীসে কোনো স্পষ্ট প্রকাশ্য বা প্রচ্ছন্ন কিংবা প্রকাশযোগ্য কোনো সনদ বর্তমান নেই, তাই প্রত্যাহারযোগ্য। আর এ জিনিসেরই অপর নাম ‘ বিদয়াত’। উপরোক্ত হাদীসে রাসূলে করীম (স) ‘আমার এই ব্যাপারে’ বলে ইসলামকেই বুঝিয়েছেন। এতে প্রমাণিত হলো যে, রাসূলের দৃষ্টিতে এ দ্বীন এক পরিপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ ও পূর্ণ পরিমত দ্বীন এবং তা সর্বজন পরিচিত, ব্যাপক প্রচারিত ও অনুভবযোগ্য মাত্রায় সর্বদিকে প্রকাশিত। এ দ্বীন বা দ্বীনের কোনো মৌলিক খুঁটিনাটি দিকও কোনো দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তির নিকট অজ্ঞাত, অপরিচিত বা লুকায়িত নেই। এখন কেউ যদি এতে দ্বীন বহির্ভূত কোনো বিষয় বৃদ্ধি করতে চায়, কোনো অ-দ্বীনি ব্যাপার বা কাজকে ‘দ্বীনি’ বলে চালিয়ে দিতে চায়, তাহলে সেতো গোটা দ্বীনকেই বিনষ্ট করে দিবে। কেননা সে তো মূল দ্বীনকেই আদৌ চিনতে বা বুঝতে পারেনি। এ জন্য বিদয়াতের পরিচয় দান করতে গিয়ে আল্লামা কান্দেলভী লিখেছেনঃ বিদয়াত বলতে বোঝায় এমন জিনিস, যা দ্বীনের ক্ষেত্রে অভিনব, শরীয়তে যার কোনো ভিত্তি নেই, মৌলিক সমর্থন নেই। শরীয়তের পরিভাষায় তারই নাম হচ্ছে বিদয়াত।

‘বিদয়াত’ এর এ সংজ্ঞা হতে স্পষ্ট জানা গেল যে, ব্যবহারিক জীবনের কাজে কর্মে ও বৈষয়িক জীবন যাপনের নিত্য নতুন উপায় উদ্ভাবন এবং নবাবিষ্কৃত যন্ত্রপাতি নির্মাণের সঙ্গে শরীয়তী বিদয়াতের কোনো সম্পর্ক নেই। কেননা তার কোনোটিই ইবাদত হিসেবে ও আল্লাহর কাছে সওয়াব পাওয়ার আশায় করা হয়না। অবশ্য এ পর্যায়েও শর্ত এই যে, তার কোনোটিই শরীয়তের মূল আদর্শের বিপরীত হতে পারবেনা। অনুরূপভাবে যেসব ইবাদত নবী করীম(স) কিংবা সাহাবায়ে কিরাম(রা) হতে কথার কিংবা কাজের বিবরণ এর মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে ও ইশারা ইঙ্গিতে প্রমাণিত, তাও বিদয়াত নয়। এই সঙ্গে এ কথাও জানা গেল যে, নবী করীম(স) এর জমানায় যে কাজ করার প্রয়োজন হয়নি; কিন্তু পরবর্তীকালে কোনো দ্বীনি কাজের জন্য দ্বীনি লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যেই তা করার প্রয়োজন দেখা দিবে, তা করাও বিদয়াত পর্যায়ে গণ্য হতে পারেনা। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, প্রচলিত নিয়মে মাদ্রাসা শিক্ষা ও প্রচারমূলক সংস্থা ও দ্বীনি প্রচার বিভাগ কায়েম করা, কুরআন হাদীস বুঝাবার জন্যে আরবী ব্যাকরণ রচনা বা ইসলাম বিরোধীদের জবাব দেবার জন্য যুক্তিবিজ্ঞান ও দর্শন রচনা, জিহাদের জন্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, যন্ত্রপাতি ও আধুনিক যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষাদান, দ্রুতগামী ও সুবিধাজনক যানবাহন ব্যবহার এসব জিনিস এক হিসেবে ইবাদতও বটে যদিও এগুলো রাসূলে করীম(স) এবং সাহাবায়ে কিরামের যুগে বর্তমান রূপে প্রচলিত হয়নি। তা সত্ত্বেও এগুলোকে বিদয়াত বলা যাবেনা। কেননা এসবের এভাবে ব্যবস্থা করার কোনো প্রয়োজন সেকালে দেখা দেয়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে এর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে বলেই তা করা হয়েছে এবং তা দ্বীনের জন্যই জরুরী। আর সত্য কথা এই যে, এসবই সেকালে ছিল সেকালের উপযোগী ও প্রয়োজনীয় রূপে ও ধরনে। তাই আজ এর কোনোটিই ‘বিদয়াত’ নয়।

এসব সম্পর্কে এ কথাও বলা চলে যে, এগুলো মূলত কোনো ইবাদত নয়। এগুলো করলে সওয়াব হয়, সে নিয়তেও তা কউ করেনা। এগুলো হলো ইবাদতের উপায়, মাধ্যম বা ইবাদতের পূর্বশর্ত। তার মানে এগুলো এমন নয়, যাকে বলা যায় ‘দ্বীনের মধ্যে নতুন জিনিসের উদ্ভাবন।’ এবং এগুলো হচ্ছে –‘দ্বীনি পালন ও কার্যকরকরণের উদ্দেশ্যে নবোদ্ভাবিত জিনিস।’ আল কুরআন ও হাদীসের নিষিদ্ধ হলো দ্বীনের ভিতর দ্বীনরূপে নতুন জিনিস উদ্ভাবন করা। দ্বীনের বাস্তবায়নের জন্য নতুন জিনিস উদ্ভাবনতো নিষিদ্ধ নয় আদৌ। কাজেই এ জিনিসকে না বিদয়াত বলা যাবে, না তা অবশ্যই অপরিহার্য বলে বিবেচিত হবে।

কুরআনের আয়াত- আরবী(*********)

-যারা নিজেদের দ্বীনের মূলকে নানাভাগে ভাগ করে নানা দিকে যাওয়ার পথ বের করেছে এবং নানা দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, তাদের সাথে আপনার-হে নবী –কোনোই সম্পর্ক নেই।

এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা খাজেন লিখেছেন, হযরত আবু হুরায়রার বর্ণনা অনুযায়ী এখানে বলা হয়েছে, এ উম্মতে মুসলিমার গোমরাহ লোকদের কথা। আর অপর এক হাদীস অনুযায়ী নবী করীম(স) বলেছেন, এ আয়াতে মুসলিম উম্মতের বিদয়াতপন্থী, সংশয়বাদী ও পথভ্রষ্ট লোকদের কথাই বলা হয়েছে।

এ আলোচনার ফলে প্রমাণিত হয় যে, নবী করীম(স) যে দ্বীন আল্লাহর নিকট হতে লাভ করেছেন, যা তিনি নিজে বাস্তব জীবনে অনুসরণ করে চলেছেন এবং যা তিনি জনগণের সামনে উপস্থাপিত করেছেন ও অনুসরণ করে চলতে বলেছেন, এক কথায় একটি পরিভাষা হিসেবে তা-ই হচ্ছে সুন্নাত। আর তার বিপরীত যা কিছু-আকীদা, বিশ্বাস, আমল ও চরিত্র তা যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক তা-ই হলো ‘বিদয়াত’। এ দৃষ্টিতে ‘সুন্নাত’ ও ‘বিদয়াত’ দুটি পরস্পর বিপরীত, পরস্পর বিরোধী মতাদর্শ, সম্পূর্ণ বিপরীতমূখী চিন্তা-বিশ্বাস, জীবনধারা ও জীবন ব্যবস্থা। এ দুটো সরলরেখার মতো পরস্পর বিপরীতদিকে ধাবিত। যা সুন্নাত তা বিদয়াত নয়; যা বিদয়াত তা সুন্নাত নয়। অনুরূপভাবে সুন্নাত কখনো বিদয়াত হতে পারেনা এবং বিদয়াত কোনোরূপেই এবং কারো কথাতেই সুন্নাতরূপে গৃহীত হতে পারেনা।

 

কুরআনে সুন্নাতের প্রমাণ
কুরআন মজীদে রাসূলে করীম(স) সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছেঃ

يَأْمُرُهُم بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنكَرِ

-তিনি ‘মারুফ’ কাজের আদেশ করেন এবং ‘মুনকার’ কাজের নিষেধ করেন।

(আল আরাফঃ157)

এই ‘মারুফ’ ও ‘মুনকার’ বলতে কি বোঝায়, সে বিষয়ে তাফসীরকারকগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এক ব্যাখ্যা অনুযায়ী ‘মারুফ’ বলতে ‘সুন্নাত’ ও ‘মুনকার’ বলতে ‘বিদয়াত’কে বোঝানো হয়েছে। আল্লামা হাদ্দাদী তাঁর তাফসীরে লিখেছেনঃ ‘মারুফ’ হচ্ছে ‘সুন্নাত’ আর ‘মুনকার’ হচ্ছে ‘বিদয়াত’।

হাদীসের সুন্নাতের প্রমাণ
হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন(রা) বলেন, কুরআন নাযীল হলো এবং রাসূল(স) সুন্নাত প্রতিষ্ঠিত করলেন। অতঃপর বললেন, তোমরা আমার অনুসরণ করো। আল্লাহর কসম, যদি তা না করো, তবে তোমরা গোমরাহ হয়ে যাবে।

অর্থাৎ কুরআন অনুযায়ী জীবন যাপনের যে নিয়ম, পথ ও আদর্শ তা-ই সুন্নাত। রাসূলে করীম(স) এই সুন্নাতকেই উপস্থাপিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং তা-ই অনুসরণ করে চলার নির্দেশ দিয়েছেন সব মানুষকে। আর শেষ ভাগে বলেছেন, এ সুন্নাতের অনুসরণ করা না হলে স্পষ্ট ভ্রষ্টতা ও গোমরাহী ছাড়া আর কিছুই থাকেনা। বস্তুত এ ভ্রষ্টতাই হচ্ছে বিদয়াত-যা সুন্নাতের বিপরীত।

হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ(রা) বলেনঃ আমরা একদা রাসূলে করীম(স) এর নিকট বসা ছিলাম। তিনি তাঁর সামনে একটি রেখা আঁকলেন এবং বললেনঃ এই হচ্ছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর পথ। অতঃপর তার ডান দিকে ও বাম দিকে দুটো রেখা আঁকলেন এবং বললেন এ হচ্ছে শয়তানের পথ। তারপর তিনি মাঝখানে রেখার উপর হাত রাখলেন এবং কুরআনের এ আয়াতটি পড়লেনঃ(যার মানে হলো)“এই হচ্ছে আমার পথ সুদৃঢ়, সোজা ও সরল, অতএব তোমরা তা-ই অনুসরণ করে চল। আর এছাড়া যত অন্যান্য যত পথ-রেখা দেখতে পাচ্ছ, এর কোনোটাই অনুসরণ করোনা। অন্যথায় তোমরা আল্লাহর পথ হতে দূরে সরে যাবে, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। আল্লাহ তোমাদের এরই নির্দেশ দিয়েছেন, সম্ভবত তোমরা আল্লাহকে ভয় করে এই নির্দেশ অবশ্যই পালন করবে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা) হতেও এই হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। তবে উভয়ের ভাষায় কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। (দারেমী, মুসনাদে আহমদ)

হযরত ইবরাজ ইবনে সারিয়াতা বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসে রাসূলে করীম(স) বলেছেনঃ তোমাদের অবশ্যই অনুসরণ করে চলতে হবে আমার সুন্নাত এবং হেদায়াতপ্রাপ্ত সত্যপন্থী খলীফাদের সুন্নাত। তোমরা তা শক্ত করে ধরবে, দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে ধরে স্থির হয়ে থাকবে(যেন কোন অবস্থায়ই তা হাতছাড়া হয়ে না যায়, তোমরা তা হতে বিচ্যূত ও বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়)।

[ব্যাখ্যাঃ উপরোক্ত হাদীসে নবী করীম(স) নিজের সুন্নাতের সঙ্গে সঙ্গে খুলাফায়ে রাশেদীন এর সুন্নাতকেও অনুসরণ করার তাগিদ দিয়েছেন। কেননা তারা পুরোপুরিভাবেই রাসূলের সুন্নাতকে অনুসরণ করেছেন, সে অনুযায়ীই তাঁরা কাজ করেছেন এবং কোনো ক্ষেত্রেই রাসূলের সুন্নাতের বিপরীত কোনো কাজ তাঁরা করেননি। তা হলে সে সুন্নাতকে ‘খুলাফায়ে রাশেদূন এর সুন্নাত’ বলা হলো কেন? বলা হয়েছে এজন্য যে, তাঁরা রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ীই আমল করেছেন, তাঁরা রাসূলের কথা ও কাজ থেকে তা-ই বুঝতে পেরেছেন এবং তা-ই তাঁরা গ্রহণ করেছেন। তাঁরা প্রত্যেকটি ব্যাপারে রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ী আমল করার জন্য অতিশয় উদগ্রীব থাকতেন এবং তাঁর বিরুদ্ধতা হতে তাঁরা সবাই দূরে থাকতেন। কেবল বড় বড় ব্যাপারেই নয়, ছোট ছোট ব্যাপারেও তাঁরা তাই করতেন। কুরআন ও রাসূলের সুন্নাত থেকে কোনো বিষয়ে কোনো দলীল পেলে তাঁরা তা-ই আঁকড়ে ধরেছেন, কিছুতেই তা ত্যাগ করতেননা। অবশ্য যে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো নির্দেশ পেতেননা, সেক্ষেত্রে তাঁরা গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা, পর্যালোচনা ও পারস্পরিক পরামর্শ করে একটা মত ঠিক করতেন এবং তদনুযায়ী আমল করতেন। এখানে প্রশ্ন হতে পারে, খোলাফায়ে রাশেদূন যদি নিজেদের মতো কাজই করে থাকেন তাহলে ‘খুলাফায়ে রাশেদূন এর সুন্নাত’ বলার কি তাৎপর্য থাকতে পারে। এর জবাব হলো এই যে, এমন অনেক লোকই ছিল যারা রাসূলের সময় ছিলনা, খলীফাদের সময় ছিল কিংবা এ উভয় কালেই জীবিত ছিল; কিন্তু উত্তরকালে অনেক নতুন অবস্থার উদ্ভব হওয়ার কারণে খুলাফায়ে রাশেদূনকে এ ব্যাপারে একটা নীতি নির্ধারণ করতে হয়েছে। তা দেখে এ পর্যায়ে লোকদের মনে নানা সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে। সে কারণে এ কথাটি বলে রাসূলে করীম(স) এ সন্দেহ দূর করার ব্যবস্থা করে দিলেন। বলে দিলেন, তাঁরা যে কাজ করবে তাতে আমারই সুন্নাত অনুসৃত হয়েছে বলে তোমরাও তা মেনে নেবে।]

সুন্নাতকে শক্ত করে ধারণ করার এবং অচল অটলভাবে তার অনুসরণ করার এবং তাগিদ অত্যন্ত তীব্র ও মজবুত। কেননা এ সুন্নাত হচ্ছে নবী করীম(স) এর বাস্তব কর্মনীতি। তার অনুসরণই হলো কার্যত ইসলাম পালন আর তা ত্যাগ করা হলে সুস্পষ্ট গোমরাহী ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা। বলা হয়েছেঃ মূল সত্য বাদ দিলে গোমরাহী ছাড়া আর কি-ই বা অবশিষ্ট থাকে?

এজন্য রাসূলে করীম(স) এর ঘোষণাটি অত্যন্ত তাৎপয্যপূর্ণ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা) বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসের শেষ বাক্যটি হলোঃ তোমরা যদি তোমাদের নবীর সুন্নাত পরিত্যাগ করো, তাহলে তোমরা নিঃসন্দেহে গোমরা হয়ে যাবে। তিনি অপর এক হাদীসে বলেছেনঃ যে লোক আমার সুন্নাত থেকে বিমুখ হয়ে যাবে-তা অনুসরণ করে চলবেনা, সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়, নয় সে আমার পথের পথিক।

এক ব্যক্তি বসানো অবস্থায় উট জবাই করতে শুরু করেছিল। তখন আবদুল্লাই ইবনে উমর(রা) তাকে বলেনঃ উটটিকে বেঁধে দাঁড় করাও, তারপর নহর করো- এ-ই হচ্ছে হযরত আবুল কাসেম মুহাম্মদ(স) এর সুন্নাত।

মুসলিম সমাজে শরীয়ত মুতাবিক যে কর্মনীতি চালু রয়েছে, হাদীসে তাকেও সুন্নাত বলে অভিহিত করা হয়েছে। রাসূলে করীম(স) ইরশাদ করেছেনঃ যে লোক ঈদুল আযহার নামাজ পড়ে জন্তু জবাই করলো, সে তার কুরবানী পূর্ণ করে দিলো এবং মুসলমানদের রীতিনীতি ঠিক রাখল। ‘রাসূলের সুন্নাত’ মানে রাসূলের আদর্শ, রাসূলের কর্ম-বিধান। আর তা অনুসরণ না করার মানে হলো তার বিপরীত কর্মাদর্শ মেনে চলা। তাহলে যে লোক রাসূলে করীম(স) এর বিপরীত কর্মাদর্শ পালন ও অনুসরণ করে চলবে, সে কিছুতেই ইসলাম পালনকারী হতে পারেনা, হতে পারেনা সে মুসলিম। বস্তুত এ হাদীস হতে আরো বলিষ্ঠভাবে প্রমাণিত হলো যে, এ ‘সুন্নাত’ ফিকাহশাস্ত্রের পারিভাষিক নয়, নয় হাদীস শাস্ত্রবিদদের পারিভাষিক সুন্নাত। এসব হাদীসে ‘সুন্নাত’ বলে বোঝানো হয়েছে রাসূলে করীমের উপস্থাপিত ও বাস্তবে অনুসৃত জীবনাদর্শ। আর এ সুন্নাতই আমাদের আলোচ্য।

 

বিদয়াতের তাৎপর্য্
এই সুন্নাতের বিপরীত যা তা-ই হচ্ছে বিদয়াত। বিদয়াত কাকে বলে? সাইয়েদ জামালউদ্দীন আল কাসেমী লিখেছেনঃ বিদয়াত বলতে বোঝায় দ্বীন পূর্ণ পরিণত হওয়ার পর দ্বীনের মধ্যে কোনো নতুন জিনিসের উদ্ভব হওয়া। আর তা হচ্ছে এমন সব জিনিস যার অস্তিত্ব নবী করীম(স) এর যুগে বাস্তব কাজ, কথা বা সমর্থন অনুমোদনের আকারেও বর্তমান ছিলনা এবং শরীয়তের নিয়ম বিধানের দৃষ্টিতেও যে বিষয়ে কোনো অনুমতি পাওয়া যায়না। আর অস্বীকৃতিও পাওয়া যায়না।

এ সংজ্ঞার দৃষ্টিতে যার অস্তিত্ব সাহাবায়ে কিরামের যুগের কথা, কাজ বা অনুমতি পর্য়ায়ে কোনো ইজমা হওয়ারও সন্ধান পাওয়া যায়না, তাও বিদয়াত।

কেননা দ্বীনে কোনো নতুন জিনিস উদ্ভব করার অধিকারই কারো থাকতে পারেনা। বস্তুত দ্বীন পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর তাতে কোনো জিনিসের বৃদ্ধি করা বা কোনো নতুন জিনিসকে দ্বীন মনে করে তদনুযায়ী আমল করা-আমল করলে সওয়াব হবে বলে মনে করা এবং আমল না করলে আল্লাহর আজাব হবে বলে ভয় করাই হচ্ছে বিদয়াতের মূল কথা। যে বিষয়েই এরূপ অবস্থা হবে, তা-ই হচ্ছে বিদয়াত। কেননা, এরূপ করা হলে স্পষ্ট মনে হয় যে, তা পূর্ণ নয়, অপূর্ণ এবং তাতে অনেক কিছুরই অভাব ও অপূর্ণতা রয়েছে। আর এই ভাবধারাটা কুরআনের নিম্নোক্ত ঘোষণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

কুরআন মজীদে দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেনঃ

আরবী(*********)

আজকের দিনে তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ পরিণত করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমাদের নিয়ামতকে সম্যকভাবে সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম-মনোনীত করলাম।

এ আয়াত থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ। এতে নেই কোনো অসম্পূর্ণতা, কোনো কিছুর অভাব। অতএব তা মানুষের জন্য চিরকালের যাবতীয় দ্বীনি প্রয়োজন পূরণে পূর্ণমাত্রায় সক্ষম এবং এ দ্বীনে বিশ্বাসী ও এর অনুসরণকারীদের কোন প্রয়োজন হবেনা এ দ্বীন ছাড়া অন্য কোনো দিকে তাকাবার, বাইরের কোনো কিছু এতে শামিল করার এবং এর ভিতর থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করার। কেননা এতে যেমন মানুষের সব মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, তেমনি নেই এতে কোনো বাজে-অপ্রয়োজনীয় বা বাহুল্য জিনিস। অতএব না তাতে কোনো জিনিস বৃদ্ধি করা যেতে পারে, না পারা যায় তা থেকে কোনো কিছু বাদ দিতে। এ দুটোই দ্বীনের পরিপূর্ণতার বিপরীত এবং আল্লাহর উপরোক্ত ঘোষণার স্পষ্ট বিরোধী। ইসলামী ইবাদতের ক্ষেত্রে সওয়াবের কাজ বলে এমন সব অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করা, যা নবী করীম(স) ও সাহাবায়ে কিরামের জামানায় চালু হয়নি এবং তা দেখতে যতই চাকচিক্যময় হোকনা কেন তা স্পষ্টত বিদয়াত তা দ্বীন-ইসলামের পরিপূর্ণতার-কুরআনী ঘোষণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মনোপুত ছিলনা, পছন্দসই ছিলনা বলেই তা সেকালে চালু করা হয়নি। এ কারণেই ইমাম মালিক বলেছিলেনঃ সেকালে যে কাজ দ্বীনী কাজ বলে ঘোষিত ও নির্দিষ্ট হয়নি, আজও তাকে দ্বীনী কাজ বলে মনে করা যেতে পারেনা।

দ্বীনের ক্ষেত্রে বিদয়াতের প্রচলনে মূল দ্বীনেরই বিকৃত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কারণ নিহিত রয়েছে। ইবাদতের কাজ কর্মে যদি আজ মনগড়া নিয়ম, শর্ত ও অনুষ্ঠানাদিকে বরদাশত করে নেয়া হয়, তাহলে তাতে নতুন নতুন জিনিস এত বেশি শামিল হয়ে যাবে যে, পরে কোনটি আসল এবং নবী করীম(স) প্রবর্তিত আর কোনটি নকল-পরবর্তীকালের লোকদের শামিল করা জিনিস, তা নির্দিষ্ট করাই সম্ভব হবেনা। অতীতকালের নবীর উম্মতদের দ্বারা নবীর উপস্থাপিত দ্বীন বিকৃত ও বিলীন হয়ে যাওয়ারও একমাত্র কারণও এই। তারা নবীর প্রবর্তিত ইবাদতে মনগড়া নতুন জিনিস শামিল করে নিয়েছিল। কিছুকাল পরে আসল দ্বীন কি, তা বুঝবার আর কোনো উপায়ই রইলোনা।

দ্বীনতো আল্লাহর দেয়া আর রাসূলের উপস্থাপিত জিনিস। তাতে যখন কেউ নতুন কিছু শামিল করে, তখন তার অর্থ এই হয় যে, আল্লাহ বা রাসূলে করীম(স) যেন বুঝতেই পারছিলেননা দ্বীন কিরূপ হওয়া উচিত আর এরা এখন বুঝতে পারছে (নাউজুবিল্লাহ)। তাই নিজেদের বুঝমত সব নতুন জিনিস এতে শামিল করে এর ত্রুটি দূর করতে চাইছে এবং অসম্পূর্ণতাকে সম্পূর্ণ করে তুলছে। আর এর ভেতর থেকে কিছু বাদ সাদ দিয়ে একে যুগোপযোগী করে তুলতে চাইছে। এরূপ কিছু করার অধিকার তাকে কে দিলো? আল্লাহ দিয়েছেন? তাঁর রাসূল দিয়েছেন? না কেউ দেয়নি, নিজ ইচ্ছেমতো ই সে তা করছে। ঠিক এ দিকে লক্ষ্য রেখেই হযরত হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা) বলেছেনঃ যে ইবাদাত সাহাবায়ে কিরাম করেননি, সে ইবাদাত তোমরা করোনা। (তাকে ইবাদত বলে মনে করোনা, তাতে সওয়াব হয় বলেও বিশ্বাস করোনা।) কেননা অতীতের লোকেরা পিছনের লোকদের জন্য কিছু বাকী রেখে যাননি যা লোকদের পূরণ করতে হবে। অতএব হে মুসলিম সমাজ, তোমরা আল্লাহর ভয় করো এবং পূর্ববর্তী লোকদের রীতিনীতি গ্রহণ ও অনুসরণ করে চলো।

এমতাবস্থায় ও দ্বীনের মাঝে কিছু বৃদ্ধি করা বা তা থেকে কিছু কমানোর অর্থ শরীয়তের বিধানের অনধিকার চর্চা, অবৈধ হস্তক্ষেপ এবং আল্লাহর ঘোষণার বিরুদ্ধতা আর তাঁর অপমান। এরূপ অনধিকার চর্চা করার ধৃষ্টতা ক্ষমার অযোগ্য।

‘বিদয়াত’ করে এবং তা বরদাশত করে তারা, যারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করতে পারেনি, যারা নিজেদের অনুগত বানাতে পারেনি রাসূলের। বস্তুত বিদয়াতের উৎস হচ্ছে নফসের খাহেশ, স্বেচ্ছাচারিতা, লালসা ও অবাধ্যতা। যারা আল্লাহর ফয়সালা ও রাসূলের পথ প্রদর্শনকে নফশের খাহেশ পূরণের পথে বাধাস্বরূপ মনে করে, তারাই দ্বীনের ভিতর নিজেদের ইচ্ছেমতো হ্রাস-বৃদ্ধি করে। এই হ্রাস-বৃদ্ধির পর যা হয় তাকেই দ্বীনের মর্যাদা দিয়ে বসে। আর যেহেতু এ কাজকেও দ্বীনী কাজই মনে করা হয়, সেজন্য এ কাজের ভুল ও মারাত্মকতা তাদের চোখে ধরা পড়েনা। এ কারণেই বিদয়াতীরা কখনো বিদয়াত হতে তাওবা করার সুযোগ পায়না। এ বিদয়াত এমনই এক মারাত্মক জিনিস, যা শরীয়তের ফরজ ওয়াজিবকে পর্যন্ত বিকৃত করে দেয়। শরীয়তের ফরয ওয়াজিবের প্রতি অন্তরে থাকেনা কোনো মান্যতা গণ্যতার ভাবধারা। শরীয়তের সীমালঙ্ঘন করার অভ্যাস হতে হতে লোকদের স্বাভাবিক প্রকৃতিই বিগড়ে যায় আর মন মগজ এতই বাঁকা হয়ে যায় যে, অতঃপর শরীয়তের সমস্ত সীমা-সরহদ চূর্ণ করে ফেলতেও কোনো দ্বিধা-কোনো কুন্ঠা জাগেনা তাঁদের মনে। শরীয়ত বিরোধী কাজগুলোকে তখন মনে হতে থাকে খুবই উত্তম।

প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে, দ্বীন ইসলামের পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ বিধান হওয়ার সঠিক তাৎপর্য্য কি? বস্তুত নবী করীম(স)দ্বীন সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়কে বিস্তারিতভাবে পৌছে দিয়েছেন। আর দুনিয়া সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে দিয়েছেন মোটামুটি বিধান ও ব্যবস্থা। দিয়েছেন কতগুলো মূলনীতি।

বাস্তব ব্যবস্থাপনা দিক দিয়ে ইসলামের শূরা ব্যবস্থা মুসলমানদের রাষ্ট্র নেতাকে শরীয়তের সীমার মধ্যে আনুগত্য দেয়া এবং তারা ইজতিহাদ করে যেসব হুকুম আহকাম বের করবে তা মানা, সহজতা বিধান, কষ্ট বিদূরণ ও প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা। এগুলো এমন যে, কালের পরিবর্তিত যে কোনো স্তরে এর নিয়ম বিধান সম্পূর্ণ নতুনভাবে মানুষের জীবন ও সমাজ গড়তে পারে। এ পর্যায়ে কয়েকটি হাদীসের ভাষা এখানে উল্লেখযোগ্য। একটি হচ্ছে ইবরাজ ইবনে সারিয়ারা বর্ণিত হাদীসঃ আরবী(********)

-রাসূলে করীম(স) একদা আমাদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজ করলেন, উপদেশ দিলেন। তার প্রতিক্রিয়া ও প্রভাবে উপস্থিত মানুষের চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল। লোকদের দিল নরম হয়ে গেল, কেঁপে উঠল। আমরা বললামঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনিতো বিদায় গ্রহণকারীর মতো ওয়াজ করলেন। তাহলে আমাদের প্রতি আপনি কি নির্দেশ দিচ্ছেন? রাসূল(স) বললেনঃ তোমাদেরতো আমি এমন এক আলোকোজ্জ্বল আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত রেখে যাচ্ছি যার দৃষ্টিতে রাতও দিনের মতোই উদ্ভাসিত। আমার চলে যাওয়ার পর যে-ই এর বিরুদ্ধতা করবে সে-ই ধ্বংস হবে।

এ হাদীসে আলোকোজ্জ্বল আদর্শ বলতে রাসূলের কর্মময় বাস্তব জীবনের আদর্শ, দৃষ্টান্ত ও নির্দেশসমূহকে বোঝানো হয়েছে। আর বস্তুতই তা এমন উজ্জ্বল প্রকট জিনিস যে, তার দৃষ্টিতে মানব জীবনের ঘোরতর সমস্যা সংকুল অন্ধকারেও দিনের আলোকের মতোই পথের দিশা লাভ করা যেতে পারে। অন্ধকার কোথাও এসে পথ রোধ করে দাঁড়াতে পারেনা, জীবনকে অচল ও সমস্যা ভারাক্রান্ত করে তুলতে পারেনা। কেননা নবী করীম(স) বিশ্ব মানবতাকে এমনই এক আলোকোজ্জ্বল পথের দিশা দিয়ে যাবার জন্যই এসেছিলেন দুনিয়ায়। আর তিনি তাঁর এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন পূর্ণ মাত্রায়। তাতে থেকে যায়নি কোনোরূপ অসম্পূর্ণতার কালো ছায়া। ইমাম মালিকের এই কথাটিও এ প্রেক্ষিতে পঠিতব্যঃ

যে লোক ইসলামে কোনো বিদয়াত উদ্ভাবন করবে এবং তাকে ভালো ও উত্তম মনে করবে, সে যেন ধারণা করে নিয়েছে যে, নবী(স) রিসালাত ও নবুয়্যতের দায়িত্ব পালন করেননি, খেয়ানত করেছেন। কেননা তিনি যদি তা করেই থাকেন, তাহলে ইসলাম ও সুন্নাত ছাড়া আর তো কোনো কিছুর প্রয়োজন করেনা। সব ভালোই তো তাতে রয়েছে।

ইবরাহীম নখয়ী(রহ)বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা তোমাদের এমন কোনো কল্যানই দেননি যা সাহাবায়ে কিরামের নিকট গোপন বা অজ্ঞাত থেকে গেছে। অথচ সাহাবারা তাঁর রাসূলেরই সঙ্গি-সাথী ছিলেন এবং তার মাখলুকাতের মধ্যে সর্বোত্তম লোক ছিলেন।”

ইবরাহীম নখয়ী(রহ)-এর এ কথার তাৎপর্য্ এই যে, দ্বীনের ব্যাপারে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। সত্যিকারভাবে যে দ্বীন রাসূলের নিকট হতে পাওয়া গেছে, ঠিক তা-ই পালন করে চলা উচিত সকল মুসলমানের। না তাতে কিছু কম করা উচিত, না তাতে কিছু বেশি করা সঙ্গত হতে পারে।

কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে এই কথাই বলা হয়েলে আহলী কিতাবকে লক্ষ্য করেঃ

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ وَلَا تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلَّا الْحَقَّ ۚ

-হে আহলী কিতাব! তোমরা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করোনা। আর আল্লাহ সম্পর্কে প্রকৃত হক ছাড়া কোনো কথা বলোনা।

এই ‘আহলী কিতাব’ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا [٥٧:٢٧]

-এবং বৈরাগ্যবাদ তারা নিজেরা রচনা করে নিয়েছে, আমরা তাদের জন্য এ নীতি লিখে দিইনি। আমরা তো তাদের জন্য লিখে দিয়েছিলাম আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্য চেষ্টা করাকে কিন্তু তারা এ নিষেধের মর্যাদা পূর্ণ মাত্রায় রক্ষা করেনি।(সূরা হাদীদঃ 27)।

এ আয়াতদ্বয়ের দৃষ্টিতে দ্বীনকে যথাযথভাবে গ্রহণ করাই মুমিনের কর্তব্য। তাতে নিজ থেকে কিছু বাড়িয়ে দেয়া বা কিছু বাদ সাদ দিয়ে কমানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ কাজ। এমনকি আল্লাহর দ্বীনে যেসব জিনিস বা যে কাজের যতটুকু গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সে জিনিস ও কাজকে ঠিক ততটুকু গুরুত্ব না দেয়া, কম গুরুত্বকে বেশি গুরুত্ব দেয়া আর বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে কম গুরুত্ব দেয়া এ সবই নিতান্ত বাড়াবাড়ি। এমন কোনো জিনিসকে দ্বীনের জিনিস বলে চালিয়ে দেয়া, যা আদৌ দ্বীনের জিনিস নয়-সুস্পষ্টভাবে দুষণীয় কাজ, অপরাধজনক কাজ।

অতএব, কেউ যদি এমন কাজ করে শরীয়তের বা শরীয়তসম্মত কাজ মনে করে, যা আদপেই শরীয়তের কাজ নয়, সে তো দ্বীনের ভিতরে নতুন জিনিসের আমদানী করলো এবং এটাই হচ্ছে বিদয়াত। সে নিজের মুখে সম্পূর্ণ না-হকভাবে আল্লাহ সম্পর্কে কথা বলছে। আল্লাহ যা বলেননি তাকেই আল্লাহর নামে চালিয়ে দিচ্ছে।

হযরত আনাস ইবনে মালিক(র) এর নিকট এক লোক জিজ্ঞেস করলোঃ

আমি ইহরাম বাঁধব কোন জায়গা থেকে? তিনি বললেনঃ যেখান হতে নবী করীম(স) বেঁধেছেন সেখান হতেই বাঁধবে। লোকটি বললো “ আমি যদি সে জায়গার এ দিকে বসে ইহরাম বাঁধি তা হলে কি দোষ হবে? হযরত আনাস (রা) বললেনঃ না তা করবেনা। আমি ভয় করছি তুমি ফিতনায় নিমজ্জিত হয়ে যেতে পার। সেলোক বললোঃ ভালো কাজে কিছুটা বাড়াবাড়ি করাটাও কি ফিতনা হয়ে যাবে?”

তখন আনাস (রা) এ আয়াতটি পাঠ করলেনঃ

فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَن تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ[ ٢٤:٦]

-যারা রাসূলের আদেশ ও নিয়ম-বিধানের বিরোধিতা করে, তাদের ভয় করা উচিত। ফিতনা তাদেরকে গ্রাস করতে পারে কিংবা পৌছাতে পারে কোনো প্রাণান্তকর আযাব।

বললেনঃ“তুমি এমন একটা কাজকে ‘নেক কাজ’ বলে মনে করছো যাকে রাসূলে করীম(স) নেক কাজ বলে নির্দিষ্ট করে দেননি,-এর চেয়ে বড় ফিতনা আর কি হতে পারে?

এ কথোপকথোন থেকে বিদয়াত হতে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেল এবং জানা গেল যে ‘নেক কাজ’, ‘সওয়াবের কাজ’ মনে করেও এমন কোনো অতিরিক্ত কাজ করা যেতে পারেনা, যে কাজের কোনো বিধান মূল শরীয়তে নেই।

বিদয়াত কিভাবে চালু হয়?
‘বিদয়াত’ উদ্ভূত ও চালু হওয়ার মূলে চারটি কার্য্কারণ লক্ষ্য করা যায়। একটি হলো এই যে, বিদয়াতী- নিজের থেকে তা উদ্ভাবন করে সমাজে চালু করে দেয়। পরে তা সাধারণভাবে সমাজে প্রচলিত হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় হলো, কোনো আলিম ব্যক্তি হয়তো শরীয়তের বিরোধী একটা কাজ করেছেন, করেছেন তা শরীয়তের বিরোধী জানা সত্ত্বেও; তা দেখে জাহিল লোকেরা মনে করতে শুরু করে যে, এ কাজ শরীয়তসম্মত না হয়ে যায়না। এভাবে এক ব্যক্তির কারণে গোটা সমাজেই বিদয়াতের প্রচলণ হয়ে পড়ে। তৃতীয় এই যে, জাহিল লোকেরা শরীয়তবিরোধী কোনো কাজ করতে শুরু করে। তখন সমাজের আলিমগণ সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব থাকেন, তার প্রতিবাদও করেননা, সে কাজ করতে নিষেধও করেননা-বলেন না যে, এ কাজ শরীয়ত বিরোধী, তোমরা এ কাজ কিছুতেই করতে পারবেনা। এরূপ অবস্থায় আলিমদের দায়িত্ব, সুযোগ ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিদয়াত বা শরীয়ত বিরোধী কাজের প্রতিবাদ বা বিরুদ্বাচরণ না করার ফলে সাধারণ লোকদের মনে ধারণা জন্মে যে, এ কাজ নিশ্চয়ই নাজায়েজ হবেনা, বিদয়াত হবেনা। হলে কি আর আলিম সাহেবরা এর প্রতিবাদ করতেননা। অথবা অমুক সভায় এ কাজটি হয়েছে, এ কথাটি বলা হয়েছে, সেখানে অমুক অমুক বড় আলিম উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা যখন এর প্রতিবাদ করেননি, তখন বুঝতেই হবে যে, এ কাজ বা কথা শরীয়তসম্মত হবেই, না হলে তো তাঁরা প্রতিবাদ করতেনই। এভাবে সমাজে সম্পূর্ণ বিদয়াত বা নাজায়িজ কাজ ‘শরীয়তসম্মত’ কাজরূপে পরিচিত ও প্রচলিত হয়ে পড়ে। আর চতূর্থ এই যে, কোনো কাজ হয়তো মূলতই ভালো, শরীয়তসম্মত কিংবা সুন্নাত অনুরূপ। কিন্তু বহুকাল পর্যেন্ত তা সমাজের লোকদের সামনে বলা হয়নি, প্রচার করা হয়নি। তখন সে সম্পর্কে সাধারণের ধারণা হয় যে, এ কাজ নিশ্চয়ই ভালো নয়, ভালো হলে কি আলিম সাহেবরা এতদিন তা বলতেননা! এভাবে একটি শরীয়তসম্মত কাজকে শেষ পর্যন্ত শরীয়তবিরোধী কাজ বলে লোকেরা মনে করতে থাকে আর এ-ও একটি বড় বিদয়াত।

বিদয়াত প্রচলিত হওয়ার আর একটি মনস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে। আর তা হলো এই যে, মানুষ স্বভাবতই চিরন্তন শান্তি ও সুখ- বেহেশত লাভ করার আকাঙ্খী। আর এ কারণে সে বেশি বেশি নেক কাজ করতে চেষ্টিত হয়ে থাকে। দ্বীনের হুকুম আহকাম যথাযথভাবে পালন করা কঠিন বোধ হলেও সহজসাধ্য সওয়াবের কাজ করার জন্য লালায়িত হয় খুব বেশি। আর তখনি সে শয়তানের ষড়যন্ত্রে পড়ে যায়। এই লোভ ও শয়তানী ষড়যন্ত্রের কারণে সে খুব তাড়াহুড়ো করে কতক সহজ সওয়াবের কাজ করার সিদ্ধান্ত করে ফেলে। নিজ থেকেই মনে করে নেয় যে, এগুলো খুব নেক কাজ, সওয়াবের কাজ। তা করলে এত বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে যে, বেহেশতের চিরস্থায়ী শান্তি সুখ লাভ করা কিছুমাত্র কঠিন হবেনা। কিন্তু এ সময়ে যে কাজগুলোকে সওয়াবের কাজ বলে মনে করে নেয়া হয়, সেগুলো শরীয়তের ভিত্তিতে কিংবা বাস্তবিকই সওয়াবের কাজ কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবার জন্য ইসলামী যোগ্যতাও যেমন থাকেনা, তেমনি সে দিকে বিশেষ উৎসাহও দেখানো হয়না। কেননা তাতে করে চিরন্তন সুখ লাভের সুখ স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। আর তাতেই তাদের ভয়।

প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে যে, একটি দ্বীনি সমাজে দ্বীনের নামে বিদয়াত চালু হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয় এবং তা মানব ইতিহাসে অভিনব কিছু নয়। দ্বীন যখন প্রথম প্রচারিত হয়, তখন তার ভিত্তি রচিত হয় ইলমের উপর। উত্তরকালে সেই ইলম যখন সমাজের অধিকাংশ বা প্রভাবশালী লোকেরা হারিয়ে ফেলে, তখন দ্বীনের প্রতি জনমনে যে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ থাকে, তার মাধ্যম দ্বীনের নামে অদ্বীন ও বেদ্বীন ঢুকে পড়ে। মানুষ অবলীলাক্রমে সে কাজগুলো দ্বীনি মনে করেই করতে থাকে। ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, আরবরা ইবরাহীম-ইসমাঈল(আ) এর বংশধর ছিল। তাদের মধ্যে তওহীদ বিশ্বাস ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছিল। পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত তথায় তওহীদী দ্বীন প্রবল হয়েছিল কিন্তু তার পরে সুদীর্ঘকাল অতিবাহিত হওয়ার কারণে তাদের আকীদা ও আমালে ‘হক’ এর সাথে ‘বাতিল’ সংমিশ্রিত হয়ে পড়ে। ভালো কাজ হিসেবে একসময় মূর্তিপূজা, পাথর-পাহাড় পূজাও ব্যাপকভাবে চালু হয়ে পড়ে। রাসূলে করীম(স) এর আগমনকালে তাদের দ্বীনি ও নৈতিক অবস্থা চরমভাবে অধঃপতিত হয়েছিল।

আকায়েদ ও ফিকাহর দৃষ্টিতে বিদয়াত
আকায়েদ ও ফিকাহর কিতাবাদিতেও `বিদয়াত’ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। কেননা বিদয়াত ইসলামে এক বড় গর্হিত কাজ এবং সর্বপর্যায়ে তা বর্জন করে চলাই মুমিনের কর্তব্য। সাধারণভাবে মুসলমানদের এ মহা অন্যায় থেকে বাঁচবার জন্যেই এসব কিতাবে বিদয়াত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আমরা এখানে কয়েকটি কিতাবের ভাষ্য উল্লেখ করছি।

‘কাশফ বজদূভী’ কিতাবে বলা হয়েছেঃ “বিদয়াত হচ্চে দ্বীন এ নতুন উদ্ভাবিত জিনিস, যা সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়ীন আমলে আসেন”।

‘শরহে মাক্কাসিদ’ গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ ঘৃণিত বিদয়াত বলতে বোঝায় এমন জিনিস, যা দ্বীনের মধ্যে নতুন উদ্ভাবন করা হয়েছে, অথচ তা সাহাবায়ে ও তাবেয়ীন এর জমানায় ছিলনা। আর না শরীয়তের কোন দলীলই তার সমর্থনে রয়েছে।

আল্লামা শিহাবউদ্দীন আফেন্দী লিখিত ‘মাজালিসুল আবরার’ গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ জেনে রেখো, বিদয়াত শব্দের দুটো অর্থ। একটি আভিধানিক আর তা হচ্ছে, যে কোনো নতুন জিনিস, তা ইবাদতের জিনিস হোক, কি অভ্যাসগত কোনো ব্যাপার। দ্বিতীয় হচ্ছে শরীয়তী পারিভাষিক অর্থ। এ দৃষ্টিতে বিদয়াত হচ্ছে সাহাবাদের পরে দ্বীন ইসলামের কোনো জিনিস বাড়িয়ে দেয়া কিংবা হ্রাস করা যে সম্পর্কে নবী করীম(স)এর তরফ থেকে কথা কিংবা কাজের দিক দিয়ে স্পষ্ট কিংবা অস্পষ্ট কোনো অনুমতিই পাওয়া যায়না।

বিদয়াত সম্পর্কে হাদীসের ভাষ্য
একটি দীর্ঘ হাদীসের শেষাংশে ‘সুন্নাত’ পালনের তাগিদ করার পর বিদয়াত সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে রাসূলে করীম(স) ইরশাদ করেছেনঃ

আরবী(********)

তোমরা নিজেদের দ্বীনে নিত্য নব-উদ্ভূত বিষয়াদি থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। কেননা দ্বীনে প্রত্যেক নব উদ্ভাবিত জিনিসই বিদয়াত এবং সব বিদয়াতই চরম গোমরাহীর মূল। (আহমাদ)

এ হাদীসের শব্দ ‘মুহদাসাতুল উমুর’ এর ব্যাখ্যায় আল্লামা আহমাদুল বান্না লিখেছেনঃ মুহদাসাতুল উমুর বোঝায় এমন জিনিস ও বিষয়াদি যা কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা-কোনো দিক দিয়েই শরীয়তের বিধিবদ্ধ নয়। আর এ-ই হচ্ছে বিদয়াত।

হযরত আয়েশা(রা) বর্ণিত পূর্বোক্ত হাদীসটি মুসলিম শরীফ গ্রন্থে উদ্বৃত হয়েছে এ ভাষায়ঃ যে লোক এমন আমল করলো, যার অনুকূল ও সমর্থনে আমার ‍উপস্থাপিত শরীয়ত নয়(অর্থাৎ যা শরীয়ত মোতাবিক নয়)সে আমল অবশ্য প্রত্যাহারযোগ্য।

ইমাম শাতেবী এ হাদীসটি সম্পর্কে বলেছেনঃ বিশেষজ্ঞদের মতে এ হাদীসটি ইসলামের এক-তৃতীয়াংশ মর্যাদার অধিকারী। কেননা এ হাদীসে নবী করীম(স) এর উপস্থাপিত বিধানের বিরোধিতার সব কয়টি দিকই একত্রিতভাবে উদ্ধৃত হয়েছে, আর এর মোকাবিলায় সমায় হয়ে দাঁড়ায় সে জিনিস, যা বিদয়াত বা নাফরমানীর বিষয়।

হযরত উমর ফারুক ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেছেনঃ তোমরা. হে মুসলিম জনতা! অনেক কিছুই নতুন উদ্ভাবন করবে। আর তোমাদের জন্যও উদ্ভাবন করা হবে দ্বীন ইসলামের অনেক নতুন জিনিস। জেনে রাখো, সব নব উদ্ভাবিত জিনিসই সুস্পষ্ট গোমরাহী। আর সব গোমরাহীরই চূড়ান্ত পরিণতি জাহান্নাম।

নবী করীম(স) ইরশাদ করেছেনঃ

আরবী(*******)

-তোমরা শুধু রাসূলের দেয়া আদর্শকে অনুসরণ করে চলো এবং কোনোক্রমেই বিদয়াত করোনা।

এক ভাষণে তিনি বলেছিলেনঃ

আরবী(******)

-জেনে রাখো, সর্বোত্তম বাণী হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। আর সর্বোত্তম কর্মবিধান হচ্ছে মুহাম্মদ(স) এর উপস্থাপিত জীবন-পন্থা। পক্ষান্তরে নিকৃষ্টতম জিনিস হচ্ছে নবোদ্ভাবিত মতাদর্শ আর প্রত্যেক নবোদ্ভাবিত মতাদর্শ-ই সুস্পষ্ট গোমরাহী।

এ হাদীসের ‘মুহদাসাত’ শব্দের ব্যাখ্যায় আল্লামা মোল্লা আল কারী লিখেছেনঃ ‘মুহদাসাত’ বলতে বোঝায় সে সব বিদয়াত যা আকীদা, কথাবার্তা এবং আমলের ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবিত হয়।

ইমাম মালিক(র) বলেছেনঃ রাসূলে করীম(স) এবং তারপরে মুসলমানদের দায়িত্বসম্পন্ন ব্যক্তিগণ সুন্নাতকে নির্ধারণ করে গেছেন। এখন তাকে আঁকড়ে ধরে এবং অনুসরণ করে চললেই আল্লাহরই কিতাবের সত্যতা বিধান করা হবে, আল্লাহর আনুগত্য করে চলার দায়িত্ব পূর্ণতাপ্রাপ্ত হবে। এ সুন্নাতই হলো আল্লাহর দ্বীনের স্বপক্ষে এক অতি বড় শক্তি বিশেষ। এ সুন্নাতকে পরিবর্তন করে বা বদলে দিয়ে তার স্থানে অন্য কিছু চালু করারা অধিকার কারোই নেই এবং তার বিপরীত কোনো জিনিসের প্রতি দৃষ্টি দেয়াও যেতে পারেনা। বরং যে লোক এ সুন্নাত অনুযায়ী আমল করবে সেই হবে হেদায়াতপ্রাপ্ত। যে এর সাহায্যে শক্তি অর্জন করতে চাইবে সেই হবে সাহায্যপ্রাপ্ত, কিন্তু যে লোক এর বিরুদ্ধতা করবে, সে মুসলমানদের অনুসৃত আদর্শকেই হারিয়ে ফেলবে। এসব লোক নিজেরা যেদিকে ফিরবে আল্লাহও তাদের সে দিকেই ফিরিয়ে দিবেন। আর তাদের জাহান্নামে পৌছে দিবেন। কিন্তু জাহান্নাম বড়ই নিকৃষ্ট জায়গা।

নবী করীম(স) এর অনুসৃত কর্মনীতিই সুন্নাত। তাও সুন্নাত, যা তাঁর পরবর্তীকালের ইসলামী সমাজের পরিচালকগণ খুলাফায়ে রাশেদীন প্রবর্তন করেছেন। তাঁরা তো তাই প্রবর্তন করেছেন, যা রাসূলে করীম(স)করতে বলেছেন-পথ দেখিয়েছেন। রাসূলের দেখানো আদর্শের তাঁরা বিরোধিতা করেননি, তাঁরা কোনো নতুন জিনিসের উদ্ভাবনও করেননি দ্বীন ইসলামে। এরাই হচ্ছেন খোলাফায়ে রাশেদীন।

এ পর্যায়ে ইমাম শাতেবী লিখেছেনঃ রাসূলে করীম(স) এর পরে মুসলিম সমাজের দায়িত্বশীল লোকেরা(খুলাফায়ে রাশেদীন) যে সুন্নাত-বাস্তব কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছেন, তা-ও অবশ্যই অনুসরণীয় সুন্নাতরূপে গ্রহণীয়। তা কোনো বিদয়াত হতে পারেনা, নেই তাতে তাতে কোনো বিদয়াত, যদিও কুরআন ও হাদীস হতে তা স্পষ্টভাবে জানা যায়না। কেননা নবী করীম(স) বিশেষভাবে এ সুন্নাতেরও উল্লেখ করেছেন।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা) কুরআন ও সুন্নাতের যথার্থ দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। খোদ নবী করীম(স-ই ও তার সাক্ষ্য দিয়েছেন।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা) বিশ্বাস করতেন যে, শিরক তাওহীদের পরিপন্থী(Negation)আর বিদয়াত সুন্নাতের বিপরীত। শিরক লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু- কালেমার এই প্রথম অংশের অস্বীকৃতি। আর বিদয়াত হচ্ছে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ কালেমার এই শেষাংশের বিপরীত আর অন্তর থেকে তার অস্বীকৃতি। মুজাদ্দেদী আলফেসানী(রহ)এই তত্ত্বের খুবই সুন্দর করে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর কথা হলো শিরক ও বিদয়াত সুন্নাতের নির্মূলকারী। এ কারণে উভয়েরই পরিণতি জাহান্নামের আগুন ছাড়া আর কিছু হতে পারেনা।

এ কথা মুজাদ্দিদ সাহেব নিজ থেকে বলেননি। মুসনাদে আহমাদ এ গজীব ইবনুল হারিস শিমালির বর্ণনায় উদ্বৃত হয়েছেঃ জনগণ যে বিদয়াতের উদ্ভাবন করে, তারই মতো একটা সুন্নাত সেখান হতে বিলুপ্ত হয়ে যায়। অতএব বিদয়াত উদ্ভাবন না করে সুন্নাত আঁকড়ে ধরাই উত্তম।

মুসনাদে দারেমী হাদীস গ্রন্থে হযরত হিসনের উক্তি উদ্বৃত হয়েছেঃ

জনগণ তাদের দ্বীনের মধ্যে যে বিদয়াতই চালু করে আল্লাহ তা’আলা তাদের নিকট হতে অনুরূপ একটি সুন্নাত তুলে নিয়ে যান। পরে কিয়ামত পর্যন্ত তা আর ফিরিয়ে আনেননা।

যে কাজটি সম্পর্কে আমাদের মনে ধারণা জন্মিবে যে, তা করলে আল্লাহ তা’আলা খুশি হবেন, আল্লাহ কিংবা রাসূলের নিকট প্রিয় বান্দা বলে গণ্য হবো অথবা আমাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়ে যাবে কিংবা এই কাজটির দ্বারা আমাদের সন্তান সন্তনির রিজিকের পরিমাণ অতিপ্রাকিৃতিক উপায়ে বৃদ্ধি পেয়ে যাবে অথবা তাতে বরকত হবে বা সে কাজের বরকতে আমাদের বিপদ-আপদ অতিপ্রাকৃতিকভাবে দূর হয়ে যাবে। এই ধরণের সব কথাই ‘দ্বীনি’ বলে পরিচিত; কিন্তু এর সমর্থনে যদি শরীয়তের প্রমাণ না থাকে বা বড় বড় সাহাবীগণ নিজেদের জীবদ্দশায় তা না করে থাকেন, তাহলে তা বিদয়াত হবে। অনুরূপভাবে কোনো জায়েজ কাজ যদি শরীয়তের দিক হতে একাধিক পন্থায় পালন করার অনুমতি থাকে; কিন্তু তন্মধ্যে একটিমাত্র পন্থাকে সে জন্যে আমরা যদি সুনির্দিষ্ট করে নিই এবং বিশ্বাস করি যে, কেবল সেই পন্থায়ই তা করলে সওয়াব হবে, তাহলে তা-ও বিদয়াত হবে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি