মৃত ব্যক্তি দুনিয়ার কোন কিছু শুনতে পায় কিনা
মৃত্যুর পর একটি মানুষ আলমে বরযখ নামে এক অদৃশ্য জগতে অবস্থান করে। এখন প্রশ্ন এই যে, তারা দুনিয়ার মানুষের কোন কথা-বার্তা, কোন স্তবস্তুতি, কোন প্রশংসাবাদ, কোন দোয়া ও কাকুতি-মিনতি শুনতে পায় কিনা।

এর জবাব কুরআন পাকে দেখতে পাওয়া যায়। আল্লাহ্‌ বলেনঃ (আরবী************)

“সে ব্যক্তির চেয়ে অধিক বিভ্রান্ত আর কে হতে পারে – যে আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমনসব সত্তাকে ডাকে যারা কিয়ামত পর্যন্তও তার জবাব দিতে পারে না। তারা বরঞ্চ এসব লোকের ডাকাডাকির কোন খবরই রাখে না।” -(সূরা আল আহকাফঃ ৫)

দুনিয়ার যেসব লোক তাদেরকে ডাকে, সে ডাক তাদের কাছে মোটেই পৌঁছে না। না তারা স্বয়ং সে সব ডাক তাদের নিজ কানে শুনে আর না কোন কিছুর মাধ্যমে তাদের কাছে এ খবর পৌঁছে যে, কেউ তাদেরকে ডাকছে।

আল্লাহ্‌ তায়ালার এ এরশাদ বিশদভাবে বুঝতে হলে এভাবে বুঝতে হবে যে, দুনিয়ার যাবতীয় মুশরিক আল্লাহ্‌ ছাড়া যেসব সত্তাকে ডেকে আসছে তারা তিন প্রকারের। এক হচ্ছে, কিছু প্রাণহীন জড় পদার্থ যাদের স্বয়ং মানুষ নিজ হাতে তৈরী করে তাদেরকে উপাস্য বানিয়েছে।

দ্বিতীয়ত কতিপয় নেক ও বুযর্গ লোক যারা অতীত হয়েছেন।

তৃতীয়ত ঐসব বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট মানুষ যারা অপরকেও বিভ্রান্ত ও বিকৃত করে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেছে।

প্রথম ধরণের উপাস্য সম্পর্কে একথাতো সুস্পষ্ট যে, প্রাণহীন জড় পদার্থ হওয়ার কারণে না তারা কিছু শুনতে ও দেখতে পায়, আর না তাদের কোন কিছু করার কোন শক্তি আছে।

দ্বিতীয় ধরণের উপাস্যগণও অর্থাৎ মৃত্যুবরণকারী নেক ও বুযর্গগণও দু’ কারণে দুনিয়ার মানুষের ফরিয়াদ ও দোয়া প্রার্থনা থেকে বেখবর থাকবেন। এক এই যে, তাঁরা আল্লাহর নিকটে এমন এক অবস্থায় রয়েছেন যেখানে দুনিয়ার মানুষের আওয়াজ সরাসরি পৌঁছে না, দুই- আল্লাহ্‌ ও তাঁর ফেরেশতাগণও তাঁদের কাছে দুনিয়ার কোন খবর পৌঁছিয়ে দেন না। তার কারণ এই যে, যারা জীবনভর মানুষকে একমাত্র আল্লাহর দরবারে দোয়া করা শিক্ষা দিয়ে এলেন, তাদেরকেই এখন মানুষ ডাকছে- এর চেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় তাঁদের কাছে আর কিছু হবে না। আল্লাহ্‌ তাঁর নেক বান্দাহদের রূহে কোন প্রকার কষ্ট দেয়া কিছুতেই পছন্দ করেন না।

তৃতীয় প্রকার উপাস্যদেরও বেখবর থাকার দু’টি কারণ আছে। এক এই যে, তাঁরা আসামী হিসাবে আল্লাহর হাজতে রয়েছে যেখানে দুনিয়ার কোন আওয়াজই পৌঁছে না। তাদের মিশন দুনিয়াতে খুব সাফল্য লাভ করেছে এবং মানুষ তাদেরকে উপাস্য বানিয়ে রেখেছে- আল্লাহ্‌ ও তাঁর ফেরেশতাগণ একথা তাদেরকে পৌঁছিয়ে দেন না।

এমন খবর তাদেরকে জানিয়ে দিলে-তা তাদের জন্যে খুবই আনন্দের কারণ হবে। আর আল্লাহ্‌ এসব যালেমদেরকে কখনো সন্তুষ্ট করতে চান না।

এ প্রসঙ্গে একথা বুঝে নেয়া উচিত যে, দুনিয়াবাসীর সালাম এবং দোয়া তাঁর নেক বান্দাহদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। কারণ এটা তাদের জন্যে আনন্দের বিষয় হবে।

ঠিক তেমনি পাপাচারী-অপরাধীদেরকে আল্লাহ্‌ দুনিয়াবাসীর অভিশাপ, লাঞ্ছনা, ভৎর্সনা, গালি প্রভৃতি শুনিয়ে দেন। এতে তাদের মনকষ্ট আরও বাড়ে।

হাদীসে আছে বদরের যুদ্ধের পর যুদ্ধে নিহত কাফেরদেরকে নবী করিমের ভৎর্সনা শুনিয়ে দেয়া হয়, কারণ এ তাদের মনঃকষ্টের কারণ হয়। কিন্তু নেক বান্দাহদের মনঃকষ্টের কারণ হয় এমন কিছু তাদের কাছে পৌঁছানো হয় না।

মৃত ব্যক্তি দুনিয়ার কোন কিছু জানতে ও শুনতে পারে কিনা এ সম্পর্কে উপরের আলোচনায় এ সম্পর্কে ধারণা সুস্পষ্ট হবে বলে মনে করি।

বেশ কিছু কাল আগে আজমীরে খাজা সাহেবের মাজার জিয়ারতের পর আমার জনৈক গায়ক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমরা যেমন আল্লাহ্‌ তায়ালার দরবারে বহু কিছু চাই, কাকুতি-মিনতি করি, কান্নাকাটি করি, তেমনি কিছু লোককে দেখলাম মরহুম খাজা সাহেবের কাছে কাকুতি-মিনুতি করে বহু কিছু চাইছে। কেউ তাঁর মাজারে কাওয়ালী জ্ঞান করছে। ইসলামে এসব কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, আপনি কি মনে করেন?

তিনি বললেন, আর যাই হোক, তাঁর মাজারে গান গাওয়া নিষিদ্ধ হলে তিনি তো নিষেধ করে দিতেন, অথবা তাঁর বদদোয়া লাগতো, তাতো কারো হয়নি, তাছাড়া তিনি কাওয়ালী গান ভালোবাসতেন।

বন্ধুটি প্রথম কথাগুলোর জবাব এড়িয়ে গেলেন, তবে তাঁর মাজারে কাওয়ালী গান গাইলে তিনি তা শুনেন এবং খুশী হন- এমন ধারণা বিশ্বাস বন্ধুটির ছিল। উপরের আলোচনায় বন্ধুটির এবং অনেকের এ ধরণের ধারণা বিশ্বাসের খণ্ডন হবে বলে মনে করি। আল্লাহ্‌র অনেক অলী দরবেশকে অসীম ক্ষমতার মালিক মনে করে তাঁদের কাছে বহু কিছু চাওয়া হয়। অথচ আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কেউ, কোন শক্তি বা সত্তা, মানুষের কোন ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না। একথা কুরআন পাকের বহু স্থানে বলা হয়েছে।

মজার ব্যাপার এই যে, এবং শয়তানের বিরাট কৃতিত্ব এই যে, যারা সাআরা জীবন তৌহীদের শিক্ষা দিয়ে গেলেন, মৃত্যুর পর তাঁদেরকে মানুষ খোদা বানিয়ে দিয়েছে।

হযরত আবদুল কাদের জিলানী (র) এ শিক্ষা দিয়েছেন যে, (হে আবদুল কাদের! আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু দাও) তার মৃত্যুর পর তাঁকে সম্বোধন করে এ কথা বলাও শির্ক হবে, কিন্তু কাদেরীয়া তরীকার প্রসিদ্ধ খানকার বাইরের দেয়ালের গায়ে উপরের কথাগুলো বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা থাকতে দেখেছি। তাঁর নামেও বহু শির্ক প্রচলিত আছে। কিন্তু তিনি এবং তাঁর মতো অনেকেই মোটে জানতেই পারেন না যে, অজ্ঞ মানুষ তাঁদেরকে খোদা বানিয়ে রেখেছে।

কারো কারো এমন ধারণা বিশ্বাসও রয়েছে যে, মৃত ব্যক্তির আত্মা দুনিয়ায় যাতায়াত করে, এ ধারণা সত্য হলে উপরের কথাগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হয়। খাজা আজমীরি এবং হযরত আবদুল কাদের জিলানী (র) তাহলে স্বয়ং দেখতে পেতেন যে মানুষ তাঁদেরকে খোদা বানিয়ে রেখেছে এবং এটা তাঁদের জন্যে ভয়ানক মনঃকষ্টের কারণ হতো। আর আল্লাহ্‌ তা কখনো পছন্দ করেন না। অতএব আলমে বরযখ থেকে দুনিয়ায় ফিরে আসার কোনই উপায় নেই।

একটা ভ্রান্ত ধারণা
পরকালে সৎ ও পুণ্যবান লোকই যে জয়জুক্ত হবে তা অনস্বীকার্য। অমুসলমানদের মধ্যে অনেকেই বহু প্রকারের সৎকাজ করে থাকেন। সত্য কথা বলা, বিপন্নের সাহায্য করা, অন্নের মঙ্গল সাধনের জন্যে অর্থ ব্যয় ও ত্যাগ স্বীকার করা, বহু জনহিতকর কাজ করা প্রভৃতি কাজগুলো অন্য ধর্মের লোকদের মধ্যেও দেখা যায়। তারা আল্লাহর তাওহীদ ও দ্বীনে হকে বিশ্বাসী না হলেও তাঁদের মধ্যে উপরোক্ত গুণাবলী পাওয়া যায়। বর্ণিত কাজগুলো যে পুণ্য তাতেও কোন সন্দেহ নেই। অতএব পরকালে বিচারে তাঁদের কি হবে?

অনেকের বিশ্বাস তাদের সৎকাজের পুরষ্কার স্বরূপ তারাও স্বর্গ বা বেহেশত লাভ করবেন। এ বিশ্বাস বা ধারণা কতখানি সত্য তা একবার যাচাই পর্যালোচনা করে দেখা যাক।

(আরবী****************)

“এবং যে নেক কাজ করবে, সে পুরুষ হোক অথবা নারী, তবে যদি সে মুমেন হয়, তাহলে এসব লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের উপর কণামাত্র জুলুম করা হবে না (অর্থাৎ তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হবে না)।”–(সূরা আন নিসাঃ ১২৪)

(আরবী*******)

“যে ব্যক্তিই নেক কাজ করবে- সে পুরুষ হোক বা নারী হোক- তবে শর্ত এই যে, সে মুমেন হবে- তাহলে দুনিয়াতে তাকে পূত-পবিত্র জীবনযাপন করার এবং (আখেরাতে) এমন লোকদের আমল অনুযায়ী উৎকৃষ্ট প্রতিদান দেব।”–(সূরা আন নাহলঃ ৯৭)

(আরবী**********)

“এবং যে নেক আমল করবে- পুরুষ হোক বা নারী হোক যদি মুমেন হয়, তাহলে এমন লোক সকলেই জান্নাতে প্রবেশ করবে যেখানে তাদেরকে অগণিত জীবিকা সম্ভার দান করা হবে।”–(সূরা আল মুমেনঃ ৪০)

উপরোক্ত আয়াতগুলো নেক কাজের জন্যে পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক বারেই এ শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, নেক আমলকারীকে অবশ্যই মুমেন হতে হবে। ইসলামী বুনিয়াদী আকীদাগুলোর প্রতি ঈমান আনার পরই নেক কাজের পুরষ্কার পাওয়া যাবে।

কুরআন পাকের বহুস্থানে এভাবে কথা বলা হয়েছেঃ

(আরবী**************)

যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে- অর্থাৎ ঈমান নেক আমলের পূর্ব শর্ত। আল্লাহ্‌, তাঁর কিতাব, রসূল এবং আখেরাতের প্রভৃতির উপর প্রথমে ঈমান আনতে হবে। অতপর সৎকাজ কি কি তাও বলে দেয়া হয়েছে। এ সৎকাজগুলো নবী-রসূলগণ বাস্তব জীবনে স্বয়ং দেখিয়েছেন। তাদের বলে দেয়া পন্থা পদ্ধতি অনুযায়ী সে কাজগুলো করতে হবে। এ কাজের লক্ষ্য হবে, যাকে স্রষ্টা, রিযিকদাতা, মালিক, প্রভু, বাদশাহ ওঁ শাসক হিসেবে মেনে নেয়া হলো (যার অর্থ ঈমান আনা), তাঁর সন্তুষ্টিলাভের জন্যেই সেসব নেক কাজ করা হবে। পুরষ্কার দেয়ার একমাত্র অধিকার যার তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও তাঁর সন্তুষ্টিলাভের ইচ্ছা যদি না থাকে তাহলে পুরষ্কার আসবে কোথা থেকে? সে জন্যে পরকালীন মুক্তি ও পুরষ্কার নির্ভর করছে নেক আমলের উপর এবং নেক আমল ফলদায়ক হবে ঈমানের সাথে।

একথা কে অস্বীকার করতে পারে যে, বিশ্বজগত ও তার প্রতিটি সৃষ্টি কণার স্রষ্টা ও মালিক প্রভু একমাত্র আল্লাহ্‌ তায়ালা? মানুষকে তার জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় সবকিছুই দিয়েছেন সেই আল্লাহ্‌। জীবনে উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্যে সুখ স্বাচ্ছন্দের ও নব নব উদ্ভাবনী কাজের সকল সামগ্রী ও উপাদান তিনি তৈরী করেছেন। জ্ঞান, বুদ্ধি-বিবেক, কর্মশক্তি, প্রখর উদ্ভাবনী শক্তি দিয়েছেন তিনি। তিনিই মানুষের জন্যে পাঠিয়েছেন দ্বীনে হক বা সত্য সুন্দর ও মঙ্গলকর জীবন বিধান। মানুষকে সদা সৎপথে পরিচালিত করার জন্যে এবং তাদের নৈতিক শিক্ষার জন্যে পাঠিয়েছেন যুগে যুগে নবী ও রসূলগণকে। তিনিই ইহজগতের এবং পরজগতের স্রষ্টা ও মালিক প্রভু। বিচার দিনের একচ্ছত্র মালিক এবং বিচারকও তিনি। এমন যে আল্লাহ্‌, তাঁর প্রভুত্ব কর্তৃত্ব ও আনুগত্য অস্বীকার করা হলো। অস্বীকার করা হলো তাঁর নবী-রসূল ও আখেরাতের বিচার দিবসকে। স্রষ্টা প্রভু ও প্রতিপালক আলাহর স্তবস্তুতি, আনুগত্য দাসত্ব করার পরিবর্তে করা হলো তাঁরই কোন সৃষ্টির অথবা কোন কল্পিত বস্তুর। উপরে অমুসলিম সৎ ব্যক্তির গুণের মধ্যে একটা বলা হয়েছে সত্যবাদিতা। কিন্তু সত্য দ্বীনকে অস্বীকার করার পর এবং দয়ালু স্রষ্টা প্রভু ও প্রতিপালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা অস্বীকার করার পর সত্যবাদিতার কানাকড়ি মূল্য রইল কি?

দ্বিতীয়ত তাদের বদান্যতা, জনহিতকর কাজ এবং দান খয়রাতের মতো গুনাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু চিন্তা করুন, অর্থ-সম্পদ, জনহিতকর কাজের যাবতীয় সামগ্রী, জ্ঞান-বুদ্ধি ও কর্মশক্তি সবই আল্লাহর দান। একদিকে দানের বস্তু দিয়ে অপরের সাহায্য করা হলো এবং প্রকৃত দাতার আনুগত্য, দাসত্ব ও কৃতজ্ঞতা অস্বীকার করা হলো। এ যেন পরের গরু পীরকে দান। এ দানের কি মূল্য হতে পারে?

স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহর আনুগত্যে মস্তক অবনত করা এবং তাঁরই স্তবস্তুতি ও এবাদত-বন্দেগী অস্বীকার করা কি গর্ব-অহংকার এবং কৃতঘ্নতার পরিচায়ক নয়? এটাকি চরম ধৃষ্টতা, নিমকহারামকারী ও বিশ্বাসঘাতকতা নয়? উপরন্তু এবাদত-বন্দেগী, দাসত্ব-আনুগত্য করা হলো আল্লাহরই অন্যান্য সৃষ্টির। সৃষ্টিকে করা হলো স্রষ্টার মহিমায় মহিমান্বিত। এর চেয়ে বড় ধৃষ্টতা এর চেয়ে বড় অন্যায় ও যুলুম আর হতে পারে কি? তাই আল্লাহ্‌ বলেনঃ

(আরবী**********)

“যারা খোদার দ্বীন গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে তাদের দৃষ্টান্ত এরূপ যে, তাদের সৎকাজগুলো হবে ভস্মস্তূপের ন্যায়। ঝড়-ঝঞ্চার দিনে প্রচণ্ড বায়ু বেগে সে ভস্মস্তূপ যেমন শূন্যে উড়ে যাবে, ঠিক সে সৎকাজগুলোর কোন অংশেরই তাড়া লাভ করবে না। কারণ খোদার দ্বীনের প্রতি অবিশ্বাস তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে বহু দূরে নিয়ে গিয়েছিল।”–(সূরা ইবরাহীমঃ ১৮)

অর্থাৎ যারা আপন প্রভু আল্লাহর সাথে নিমকহারামী, বিশ্বাসঘাতকতা, স্বেচ্ছাচারিতা অবাধ্যতা ও পাপাচারের আচরণ করেছে এবং দাসত্ব-আনুগত্য ও এবাদত বন্দেগীর সেসব পন্থা অবলম্বন করতে অস্বীকার করেছে- যার দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম, তাদের জীবনের পরিপূর্ণ কার্যকলাপ এবং সারা জীবনের আমল-আখলাকের মূলধন অবশেষে এমন ব্যর্থ ও অর্থহীন হয়ে পড়বে, যেন একটা বিরাট ভস্মস্তূপ ধীরে ধীরে জমে উঠে পাহাড় পর্বতের আকার ধারন করেছে। কিন্তু একটি দিনের প্রচণ্ড বায়ুতে তার প্রতিটি ভস্মকণা শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে। তাদের প্রতারণামূলক সুন্দর সভ্যতা ও কৃষ্টি-কালচার তাদের বিস্ময়কর শিল্পকলা ও স্থাপত্য শিল্প, বিরাট বিরাট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ললিতকলা, প্রভৃতি অনন্ত সম্ভার এমন কি তাদের উপাসনা-আরাধনা, প্রকাশ্য সৎকাজগুলো, দান খয়ারত ও জনহিতকর কার্যাবলী একটা বিরাট ভস্মস্তূপ বলেই প্রমাণিত হবে। তাদের এসব গর্ব অহংকারের ক্রিয়াকলাপ আখেরাতের বিচার দিনে বিচারের দাঁড়িপাল্লায় কোনই ওজন বা গুরুত্বের অধিকারী হবে না।

আল্লাহ্‌ আরও বলেনঃ

(আরবী*************)

“তোমাদের মধ্যে যারা দ্বীন ইসলাম থেকে ফিরে যাবে এবং কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের সকল সৎকাজগুলো বিনষ্ট হয়ে যাবে। তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী এবং তারা থাকবে চিরকাল।”–(সূরা আল বাকারাঃ ২১৭)

দ্বীনে ইসলামে যারা অবিশ্বাসী তাদেরই সৎকাজগুলো বিনষ্ট হবে না, বরঞ্চ দ্বীন ইসলামে বিশ্বাসস্থাপন করার পর যারা তা পরিত্যাগ করবে, তাদের, তাদের পরিণামও অবিশ্বাসী কাফেরদের মতো হবে।

মোটকথা কুরআন হাকীমের প্রায় পাতায় পাতায় একথা দ্ব্যথহীনভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, যারাই আল্লাহর প্রেরিত দ্বীনে হক গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে, তারা এ দুনিয়ায় কোন ভালো কাজ করুক বা না করুক, তাদের স্থান হবে জাহান্নামে।

আল্লাহ্‌ ও রসূলকে যারা অস্বীকার করে, পরকালে পুরষ্কার লাভ যদি তাদের একান্ত কাম্য হয়, তবে তা দাবী করা উচিত তাদের কাছে যাদের পূজা ও স্তবস্তুতি তারা করেছে, যাদের হুকুম শাসনের অধীনে তারা জীবন যাপন করেছে, যাদের প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব তারা মেনে নিয়েছে। কিন্তু আল্লাহ্‌ ব্যতীত সেদিন কোন শক্তিমান সত্তা থাকবে কি যে কাউকে কোন পুরষ্কার অথবা শাস্তি দিতে পারে? বেহেশতের দাবী দাওয়া নিয়ে কোন শ্লোগান, কোন বিক্ষোভ মিছিল করার ক্ষমতা, সাহস ও স্পর্ধা হবে কি? তাছাড়া পুনর্জীবন, পরকাল, হিসাব-নিকাশ, দোযখ-বেহেশত যারা অবিশ্বাস করলো, সেখানে কিছু পাবার বা তার জন্যে তাদের বলারই বা কি আছে?

অতএব খোদাদ্রোহী ও খোদাবিমুখ অবিশ্বাসীদের সৎকাজের কোনই মূল্য যদি পরকালে দেয়া না হয়, তাহলে তা হবে পরিপূর্ণ ন্যায় বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত।

তবে হাঁ, তারা দুনিয়ার বুকে কোন ভালো কাজ করে থাকলে তার প্রতিদান এ দুনিয়াতেই তারা পাবে। মৃত্যুর পর তাদের কিছুই পাওনা থাকবে না।

আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের পার্থিব সুফল
প্রতিটি মানুষ, যে কোন দেশের যে কোন জাতির হোক না কেন, শান্তির জন্যে লালায়িত। এ শান্তি স্ত্রী পুত্র পরিজন নিয়ে নিশ্চিন্তে নিরাপদে বসবাস করার, নিশ্চয়তার মধ্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার, মৌলিক অধিকার ভোগ করার আপন অধিকারের উপরে অপরের হস্তক্ষেপ থেকে নিরাপদ থাকার মধ্যে নিহিত। আর এ শান্তি নিহিত নিজস্ব আদর্শ ও মূল্যবোধের উপর জীবন গড়ে তোলার স্বাধীনতা ও সুযোগ সুবিধার মধ্যে। এর কোন একটা বাধাগ্রস্থ হলে অথবা কোন একটির নিশ্চয়তার অভাব ঘটলেই শান্তি বিঘ্নিত হয়।

কিন্তু এ শান্তি মানব সমাজে কোথাও আছে কি? কোথাও তা মোটেই নেই এবং কোথাও থাকলে কিঞ্চিত পরিমাণে। আপনার পরিবারের মধ্যে যদি আদর্শের লড়াই না হয় অথবা চরম মতানৈক্যের ঝড় না বয়, আপনার আবাস গৃহের সীমানার মধ্যে যদি কখনো চোর বদমায়েশের আনাগোনা না হয়, আপনার মাঠের সবটুকু ফসল যদি নিরাপদে ঘরে তুলতে পারেন, আপনার চাকর-বাকর আপনার বাজার সওদা করতে গিয়ে যদি কানাকড়িও আত্মসাৎ না করে অথবা বাইরের ষড়যন্ত্রে আপনার জান-মালের উপর হাত না দেয়, তাহলে আলবৎ বলা যাবে যে, আপনি শান্তিতে বসবাস করছেন। কিন্তু আজকাল সর্বত্রই এর উল্টোটা দেখা যায় তাই শান্তি কোথাও নেই।

আমাদের সমাজটার কথাটাই ধরুন। চরম নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে সমাজের সর্বস্তরে চরম দুর্নীতির ব্যধি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। আপামর জনসাধারণের মধ্যে দুর্নীতি, শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে দুর্নীতি, সরবস্তরের দায়িত্বশীলদের মধ্যে দুর্নীতি। মসজিদে জুতা চুরি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি ব্যাপক হারে চলছে। দুর্নীতি দুষ্কৃতি দমনের জন্যে যেসব সংস্থা কার্যরত আছে তাদের মধ্যে দুর্নীতি। যে সর্ষে দিয়ে ভূত ছাড়াবেন সে সর্ষের মধ্যেই ভূত আত্মগোপন করে আছে। যার ফলে আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। তাই মজলুম ব্যক্তি কোন সুবিচার পায় না, ক্ষমতাসীন ধনবান ও সমাজ বিরোধীরা আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাদের কু-মতলব হাসিল করে।

তারপর দেখুন আজকাল দেশে দেশে চরম সন্ত্রাস দানা বেঁধে উঠেছে। খুন রাহাজানি ছিনতাই (বিমান ছিনতাইসহ) নির্মম হত্যাকাণ্ড, ডিনামাইট ও নানাবিধ বিস্ফোরক দ্রব্যাদির সাহায্যে দালান কোঠা ঘর উড়িয়ে দেয়া নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বাড়িতে, শিক্ষাঙ্গনে, রাস্তা-ঘাটে মেয়েদের ইজ্জত আবরু এমনকি জীবনটা পর্যন্ত আজকাল নিরাপদ নয়। একটি শক্তিশালী দেশ অন্য একটি দেশের উপর সশস্ত্র আগ্রাসন চালিয়ে তার উপর আধিপত্য বিস্তার করছে। লক্ষ্য লক্ষ্য নর-নারী নির্মমভাবে হত্যা করছে। একটির পর একটি গ্রাম ও শস্যক্ষেত জালিয়ে দিচ্ছে। মানুষের কংকাল থেকে শুধু উঠছে হাহাকার আর্তনাদ। এ জুলুম নিষ্পেষণের কোন প্রতিকার নেই। গোটা মানবতা আজ অসহায়।

এসবের প্রতিকার কারো কাছে আছে কি? এইতো সেদিন বৈরূতে আমেরিকার দূতাবাস ভবনটি সন্ত্রাসবাদীরা উড়িয়ে দিল। জান-মালের প্রচুর ক্ষতি হলো। দক্ষিন কোরিয়ার যাত্রীবাহী বিমান রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধ্বংস হলো। কয়েক শ’ নিরপরাধ আদম সন্তান প্রাণ হারালো। রাশিয়া গায়ের জোরে আফগানিস্তান দখল করে আফগানদের ভিটেমাটি উজাড় করে দিয়েছে, লক্ষ, লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, প্রাণের ভয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহ হারা হয়েছে। তাদের হাহাকার আর্তনাদ দুনিয়ার মানুষকে ব্যথিত করেছে। গোটা লেবাননকে ইসরাঈল কারবালায় পরিণত করেছে। কিন্তু কোন প্রতিকার হলো কি? এ ধরণের লোমহর্ষক ঘটনা তো নিত্য নতুন ঘটছেই সারা দুনিয়া জুড়ে। সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে ক্যাসপার ওয়াইনবার্গার কিছু বলতে পারেননি, বলবেন বা কি? আঘাতের প্রত্যুত্তরে যদি আঘাত দেয়া হয় তাহলে বৃহত্তর আঘাতের প্রতীক্ষা করতে হবে। অন্যায় আঘাতের মনোভাব দূর করা যায় কি করে? সমাজ বিরোধী, দুষ্কৃতিকারী, দস্যুতস্কর, লুটেরা, সন্ত্রাসবাদী প্রভৃতি মানব দুশমনদের চরিত্র সংশোধনের কোন ফলপ্রসূ পন্থা পদ্ধতি আধুনিক সভ্যতার সমাজ ও রাষ্ট্রপতিদের জানা আছে কি? নেই- মোটেই নেই। আঘাত হানার জন্যে এবং আঘাত থেকে আত্মরক্ষার জন্যে তারা শুধু অস্ত্র নির্মাণ প্রতিযোগিতাই করতে জানে। মানুষের চরিত্র সংশোধনের কোন অস্ত্রই তাদের কাছে নেই।

এ অস্ত্র শুধু ইসলামের কাছেই রয়েছে। এ অস্ত্র আল্লাহ্‌ পাঠিয়েছেন নবী-রসূলগণের মাধ্যমে মানবজাতির জন্যে। সে অস্ত্র হলো একটা বিশ্বাস। একটা দৃঢ় প্রত্যয় যার ভিত্তিতে মন মানসিকতা, চরিত্র, রুচি ও জীবনের মূল্যবোধ গড়ে তোলা হয়। যে বিশ্বাস একটা জীবন দর্শন পেশ করে, জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শিক্ষা দেয়, জীবনের কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ শিক্ষা দেয়, জীবনকে অর্থবহ করে এক অদৃশ্য শক্তির কাছে প্রতিটি কাজের জন্যে জবাবদিহির তীব্র অনুভূতি সৃষ্টি করে। যে বিশ্বাস এ শিক্ষা দেয় যে- সৃষ্টিজগত ও তার মধ্যেকার মানুষকে উদ্দেশহীনভাবে সৃষ্টি করা হয় নি। সৃষ্টি করার পর তাকে এখানে লাগামহীন ছেড়ে দেয়া হয় নি যে, সে এখানে যা খুশি তাই করবে, যে কোন ভালো কাজ করলে তার পুরষ্কার দেবারও কেউ নেই- এবং অসৎ কাজ করলে তার জন্যে কেউ শাস্তি দেবারও কেউ নেই। আসল কথা – যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন, মরণের পর তার কাছেই ফিরে যেতে হবে। তারপর তার দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি ভালোমন্দ কাজের হিসেব তাঁর কাছে দিতে হবে। দুনিয়ার জীবনে কারো অন্যায় করে থাকলে দুষ্কৃতিকারী বলে, সন্ত্রাসবাদী হয়ে মানুষের জীবন ও ধন-সম্পদ ধ্বংস করলে তার সমুচিত শাস্তি তাকে পেতেই হবে। শাস্তিদাতার শাস্তিকে ঠেকাবার কোন শক্তিই কারো হবে না সেদিন। তখনকার শাস্তি হবে চিরন্তন। কারণ তখনকার জীবনেরও কোন শেষ হবে না, মৃত্যু আর কোনদিন কাউকে স্পর্শ করবে না। এটাই হলো পরকালে বিশ্বাস। সেদিনের শাস্তি অথবা পুরষ্কারদাতা স্বয়ং আল্লাহ্‌ তায়ালা যিনি দুনিয়ারও স্রষ্টা, মানুষসহ সকল জীব ও বস্তুরও স্রষ্টা, পরকালেরও স্রষ্টা ও মালিক প্রভু।

একমাত্র এ বিশ্বাসই মানুষকে মানুষ বানাতে পারে, নির্দয় পাষণ্ডকে স্নেহময় ও দয়াশীল বানাতে পারে। চরিত্রহীনকে চরিত্রবান, দুষ্কৃতিকারী লুটেরাকে বানাতে পারে- মানুষের জীবন ও ধন-সম্পদের রক্ষক। সন্ত্রাসবাদীকে বানাতে পারে মানবদরদী ও মানবতার বন্ধু, দুর্নীতিবাজকে করতে পারে দুর্নীতি নির্মূলকারী। সৃষ্টির সপ্তম শতাব্দীতে এ ধরণের অলৌকিক ঘটনাই ঘটেছিল আরবের নবী মুহাম্মদ মুস্তফার (সা) নেতৃত্বে। নবী (সা) আল্লাহর প্রতি তাঁর যাবতীয় গুণাবলীসহ বিশ্বাস সৃষ্টি করেন পাপাচারী মানুষের মধ্যে, আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস ও জবাবদিহিতার অনুভূতিও সৃষ্টি করেন। এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাদের চরিত্র সংশোধন করেন। দুর্ধর্ষ রক্তপিপাসু একটা জাতিকে মানবতার কল্যাণকামী জাতিতে পরিণত করেন। তাদেরকে দিয়ে এক সত্যিকার কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। ভ্রাতৃত্ব, স্নেহ-ভালোবাসা, পর দুঃখ-কাতরতা ও পারস্পারিক সাহায্য সহযোগিতার সুদৃঢ় বন্ধনে সকলকে আবদ্ধ করেন। সমাজ থেকে সকল অনাচার দূর হয়ে যায়। এমন এক সুখি ও সুন্দর সমাজ গড়ে ওঠে যা ইতিপূর্বে দুনিয়া কোনদিন দেখতে পায়নি। তেমন সমাজব্যবস্থা আজও দুনিয়ার কোথাও নেই।

আজ যদি পরাশক্তিগুলো ও তাদের আশীর্বাদপুষ্ট রাষ্ট্রগুলো খোদা ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস পোষণ করতো এবং অস্ত্র নির্মাণ প্রতিযোগিতায় যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে তা যদি মানবতার সেবায় লাগাতো তাহলে এক নতুন দুনিয়ার সৃষ্টি হতো। খোদা ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বনবী মুহাম্মদ মুস্তফার (সা) আদর্শিক নেতৃত্বের অধীন যদি সর্বত্র পথহারা মানুষ তাদের চরিত্র গড়ে তোলে, তাহলে সর্বত্র মানুষের রক্তে হোলিখেলা বন্ধ হয়ে যাবে। প্রত্যেকে তার জান-মাল নিরাপদ মনে করবে, দুর্নীতির মানসিকতা দূর হয়ে যাবে। প্রশাসন ব্যবস্থা আইন-শৃঙ্খলা, ব্যবসা-বানিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা, বিচার-আচার সবকিছুই চলতে থাকবে সঠিকভাবে এবং মানুষের কল্যাণের জন্যে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিজেই আইন ভংগ করবে না। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করবে না। রাষ্ট্রীয় সম্পদ কেউ আত্মসাৎ করবে না, কেউ কাউকে প্রতারণা করবে না। অস্ত্রের সাহায্যে কেউ জাতির ঘাড়ে ডিক্টেটর হয়ে বসবে না। মজলুমের কণ্ঠ কখনো স্তব্ধ হয়ে যাবে না, কাউকে গোলামির শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে হবে না, অন্ন-বস্ত্রের অভাবে কোথাও হাহাকার শুনা যাবে না, চিকিৎসার অভাবে কাউকে রোগ যন্ত্রণায় কাতরাতে হবে না। আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের এসবই হলো পার্থিব মঙ্গল ও সুফল। ক্ষমতা গর্বিত লোকেরা স্বৈরাচারী শাসকরা, খোদা ও আখেরাতে অবিশ্বাসী জড়বাদী পাশ্চাত্য সভ্যতার ধারক-বাহক ও মানসিক গোলামরা যদি এ সত্য উপলব্ধি করতে পারে, তাহলে গোটা মানবতারই মঙ্গল হতে পারে।

সন্তানের প্রতি পিতামাতার এবং পিতামাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব
পিতার ঔরসে ও মাতার গর্ভে যে সন্তানের জন্ম হয়, তাকে পিতা ও মাতা সবচেয়ে ভালোবাসে। সন্তানের কোন প্রকার দুঃখ-কষ্ট মা-বাপের সহ্য হয় না। সন্তান কখনো অসুস্থ হয়ে পড়লে মা-বাপ অত্যন্ত অধীর হয়ে পড়ে। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, সাধারণত পিতার চেয়ে মায়ের কাছে সন্তান অধিকতর ভালোবাসার বস্তু। চরম ও পরম স্নেহ আদরের এ প্রিয়তম আকাংখিত বস্তু লাভ করার জন্যে মা তাকে গর্ভ ধারণ করার কষ্ট ও প্রসবকালীন চরম যন্ত্রণা সেচ্ছায় ও হাসিমুখে বরণ করে। এ যন্ত্রণা মৃত্যু যন্ত্রণার মতোই। এ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনেকেই মৃত্যু বরণও করে। তথাপি পর পর গর্ভ ধারন করতে কেউ অস্বীকৃতি জানায় না। অতীব জ্বালা যন্ত্রণার পর সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার দিকে তাকাতেই মায়ের সকল দুঃখ-কষ্ট ও জ্বালা-যন্ত্রণা দূর হয়ে যায় এবং তার স্বর্গীয় আনন্দের হাসি ফুটে উঠে। এ সন্তান তার সবচেয়ে ভালোবাসার বস্তু হওয়ারই কথা।

সন্তানের সাথে পিতার রক্ত মিশে আছে বলে সেও পিতার সবচেয়ে ভালোবাসার পাত্র। তাই স্বভাবতই মা এবং বাপ তাদের সন্তানদের সুখী ও সুন্দর জীবনযাপনই দেখতে চায়। সন্তানকে সুখী করার জন্যে চেষ্টা-চরিত্রের কোনরূপ ত্রুটি পিতা-মাতা করে না। উপার্জনশীল পিতা তাদের জন্যে জমি জেরাত করে দালান কোঠা করে ব্যাংক বেলান্স রেখে যায় যাতে করে তারা পরম সুখে জীবনযাপন করতে পারে।

কাজ যদি তাদের এতটুকুই হয় তাহলে বুঝতে হবে জীবন সম্পর্কে তাদের ধারণা ভ্রান্ত অথবা অপূর্ণ। দুনিয়ার জীবনটাই একমাত্র জীবন নয়, বরঞ্চ গোটা জীবনের একটা অংশ। দুনিয়ার পরেও যে জীবন আছে এবং সেটাই যে আসল জীবন তারই পূর্ণাংগ আলোচনাই তো এ গ্রন্থে করা হয়েছে।

তাহলে একথা মানতে হবে যে, সন্তানের জীবনকে যারা সুখী ও দুঃখ-কষ্টের ঊর্ধ্বে দেখতে চায় তাদেরকে দুনিয়ার জীবনের পরের জীবনটা সম্পর্কেও অবশ্যই চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। কিন্তু যারা পরকাল আছে বলে স্বীকার করেন, তাদের মধ্যে শতকরা কতজন সন্তানের পরকালীন চিরন্তন জীবন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেন? সন্তানের ভালো চাকুরী, গাড়ি, বাড়ি, দু’ হাতে অঢেল কামাই, নাম-ধাম ইত্যাদি হলেই তো পিতা-মাতা খুশীতে বাগ বাগ হয়ে যায়। তারা ভেবে দেখে না ছেলেরা কামাই রোজগার কিভাবে করছে। জীবন কন পথে পরিচালিত করছে। একজন সত্যিকার মুসলমানের জীবন যাপন করছে, না এক আদর্শহীন লাগামহীন ও জড়বাদী জীবনের ভোগবিলাসে ডুবে আছে- তার খোঁজ-খবর রাখার কোন প্রয়োজন তারা মনে করে না। মেয়েকে যদি কোন ধনীর দুলালের সাথে বিয়ে দেয়া যায়, অথবা জামাই যদি হয় বড়ো চাকুরে অথবা ব্যবসায়ী, তাহলে এদিক দিয়ে জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে বলে মনে করা হয়। মেয়ে যদি নর্তকী গায়িকা হয়, কোন চিত্র তারকা হয়ে অসংখ্য ভোগবিলাসী মানুষের চিত্তবিনোদনের কারণ হয়, তাহলে অনেক বাপ-মায়ের বুক খুশীতে ফুলে উঠে। অবশ্যি যাদের পরকালের প্রতি বিশ্বাস নেই, তাদের এরূপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আল্লাহ্‌ তায়ালাও বলেছেনঃ

(আরবী*************************)

“খাও দাও মজা উড়াও কিছু দিনের জন্যে। কারণ তোমরা তো অপরাধী” –(সূরা মুরসালাতঃ ৪৬)

তারা পরকালের জীবনকে তো অস্বীকার করেছে। তারা মনে করে জীবন বলতে তো এ দুনিয়ার জীবনটাই। কিন্তু তারা মনে করলেও তো আর প্রকৃত সত্য মিথ্যা হয়ে যায় না? পরকাল তো অবশ্যই হবে এবং সে জীবনে তাদের পাওনা তো আর কিছুই থাকবে না। পরকালের জীবনকে যারা মিথ্যা মনে করেছিল, তাদের সেদিন ধ্বংসই হবে।

এত গেল পরকাল যারা বিশ্বাস করে না তাদের ব্যাপার। কিন্তু যারা নিজেদেরকে মুসলমান বলে, তাদের আচরন ঠিক ঐরূপই দেখা যায়। তাহলে কি চিন্তা করার বিষয় নয়?

অন্যদিকে পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা, তাদের অনুগত হওয়া, তাদের খেদমত করা তাদের জীবনে কোন দুঃখ-কষ্ট আসতে না দেয়া, সন্তানের কর্তব্য। অনেকে সে কর্তব্য পালন করে, আবার অনেকে করে না। যারা করে না তারা আলবৎ অকৃতজ্ঞ, অবাধ্য ও লাঞ্ছনার যোগ্য। কিন্তু যারা কৃতজ্ঞতা পালন করাকে তাদের দায়িত্ব কর্তব্য মনে করে, তাদের এটাও কর্তব্য যে, পিতামাতার পরকালীন জীবন যাতে সুখের, তার জন্যে চেষ্টা করা। তাছাড়া তাদের জীবদ্দশায় তাদের কোন তাদের কোন দুঃখ কষ্ট দেখলে আদর্শ সন্তানও দুঃখে অধীর হয়ে পড়ে এবং পিতামাতার দুঃখ-কষ্ট দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তেমনি তাদের মৃত্যুর পর আদর্শ সন্তান এটাও করে যে, তার মা অথবা বাবা হয়তো কোন কষ্টে রয়েছে। বাস্তবে তখন আর কিছু করার না থাকলেও তাদের জন্যে সন্তান প্রাণ ভরে আল্লাহর তায়ালার কাছে দোয়া করে। “হে পরোয়ারদেগার! তুমি তাদের উপর রহম কর যেমন তারা আমাকে ছোট বেলায় বড় স্নেহভরে লালন-পালন করেছেন।”এই দোয়াটাও আল্লাহ্‌ তায়ালাই শিখিয়ে দিয়েছেন। অতএব তাঁর শিখানো দোয়া আন্তরিকতার সাথে সন্তান বাপ-মায়ের জন্যে করলে অবশ্যই তা কবুল হওয়ার আশা করা যায়। এভাবেই সন্তান তার পিতা-মাতার হক সঠিকভাবে আদায় করতে পারে- তাদের জীবদ্দশাতেও এবং মৃত্যুর পরেও।

কিন্তু আমরা কি দেখি? প্রায় এমন দেখা যায়, পিতা তার একাধিক স্ত্রী ও সন্তানকে সমান চোখে দেখতে পারে না। সম্পদ বণ্টনে কম বেশি করে কাউকে তার ন্যায্য দাবী থেকে বেশী দেয়, কাউকে কম দেয়, কাউকে একেবারে বঞ্চিত করে। আবার কোন কোন সন্তান জড়বাদী জীবনদর্শন দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে পিতাকে অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করে এবং ভাই-বোনকে বঞ্চিত করে, পিতার কাছ থেকে সিংহভাগ লেখাপড়া করে আদায় করে নেয়। পিতা কোন স্ত্রীর নামে অথবা কোন সন্তানের নামে বেনামী সম্পত্তি করে রাখে। উভয় পক্ষেরই এ বড় অন্যায় ও অসাধু আচরণ। এর জন্যে আখেরাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন আযাবের সম্মুখীন হতে হবে।

অতএব পিতামাতা যদি তাদের সন্তানের পরকালীন সুখময় জীবন কামনা করে এবং সন্তান যদি মা-বাপের আখেরাতের জীবনকে সুখী ও সুন্দর দেখতে চায়- তাহলে দুনিয়ার বুকে তাদের উভয়ের আচরণ হতে হবে এমন যা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রসূল শিখিয়ে দিয়েছেন।

পিতামাতার কর্তব্য হচ্ছে শিশুকাল থেকেই সন্তানের চরিত্র ইসলামের ছাঁচে গড়ে তোলা যাতে করে তারা পরিপূর্ণ মুসলমানী জীবন যাপন করে। পক্ষান্তরে কোন নেক সন্তান যদি পিতামাতাকে পথভ্রষ্ট দেখে তাহলে তাদেরকে সৎ পথে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করবে।

উভয়ে উভয়ের দায়িত্ব যদি পালন করে তাহলে উভয়ের পরকালীন জীবন হবে অফুরন্ত সুখের। আল্লাহ্‌ তায়ালার অনুগ্রহে তাহলে একত্রে একই স্থানে অনন্ত সুখের জীবন কাটাতে সক্ষম হবে।

আল্লাহ্‌ বলেনঃ

(আরবী*****************)

“এমন জান্নাত যা হবে তাদের চিরন্তন বাস্থান। তারা (ঈমানদার) স্বয়ং তাতে প্রবেশ করবে এবং মা-বাপ, বিবি ও সন্তানগণের মধ্যে যারা নেক তাদের সাথে সেখানে যাবে। চারদিক থেকে ফেরেশতাগণ আসবে খোশ আমদেদ জানাতে এবং তাদেরকে বলবে, তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তোমরা দুনিয়াতে যেভাবে ধৈর্যের সাথে সবকিছু মুকাবেলা করেছো, তার জন্যে আজ তোমরা এ সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছ। আখেরাতের এ আবাসস্থল কতোই না ভালো?”–(সূরা আর রাদঃ ২৩-২৪)

আরও বলা হয়েছেঃ

(আরবী************)

“আরশে এলাহীর ধারক ফেরেশতাগণ এবং যারা তার চারপাশে অবস্থান করেন- সকলেই তাদের প্রভুর প্রশংসাসহ তসবীহ পাঠ করেন। তাঁরা তাঁর উপর ঈমান রাখেন এবং ঈমান আনয়নকারীদের সপক্ষে মাগফেরাতের দোয়া করেন। তাঁরা বলেন, হে আমাদের রব! তুমি তোমার রহমত ও এলম সহ সবকিছুর উপর ছেয়ে আছ। অতএব মাফ করে দাও এবং দোযখের আজাব থেকে বাঁচাও তাদেরকে যারা তওবা করেছে এবং তোমার পথ অবলম্বন করেছে। হে আমাদের রব! প্রবেশ করাও তাদেরকে সেই চিরন্তন জান্নাতের মধ্যে যার ওয়াদা তুমি তাদের কাছে করেছিলে। এবং তাদের মা-বাপ, বিবি ও সন্তান-সন্ততির মধ্যে যারা সালেহ (নেক) তাদেরকেও তাদের সাথে সেখানে পৌঁছিয়ে দাও। তুমি নিঃসন্দেহে মহাপরাক্রমশালী ও মহাবিজ্ঞ।”–(সূরা মুমেনঃ ৭-৮)

আল্লাহ্‌ তায়ালার উপরোক্ত এরশাদের অর্থ অত্যন্ত পরিষ্কার এবং এর ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। সূরা তুরে আরও পরিষ্কার করে বলা হয়েছেঃ

(আরবী***************)

“যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের সন্তান-সন্ততি ঈমানেরও কোন না কোন স্তরে তাদের পদাংক অনুসরণ করে চলেছে, তাদের সেসব সন্তানদেরকেও আমি তাদের সাথে মিলিত করে দেব। এতে করে তাদের আমলে কোন ঘাটতি আমি হতে দেব না।”–(সূরা আত তুরঃ ২১)

সূরা মুমেনে বলা হয়েছে যে, ঈমানদার ও নেক লোক জান্নাতের সৌভাগ্য লাভ করবে। তখন তাদের চক্ষু শীতল করার জন্যে তাদের মা-বাপ, স্ত্রী ও সন্তানদেরকে তাদের সাথে একত্রে থাকার সুযোগ দেয়া হবে যদি তাঁরা ঈমান আনার পর নেক আমল করে থাকে। অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনের মতো আখেরাতের জীবনেও তারা বেহেশতের মধ্যে স্ত্রী পুত্র পরিজনসহ একত্রে বসবাস করতে পারবে। সূরা তুরে অতিরিক্ত যে কথাটি বলা হয়েছে তা এই যে, যদি সন্তানগণ ঈমানের কোন না কোন স্তরে তাদের বাপ-দাদার পদাংক অনুসরণ করতে থাকে, তবে বাপ-দাদা যেমন তাদের উৎকৃষ্টতর ঈমান ও আমলের জন্যে যে উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছে, তা তারা না করলেও তাদেরকে বাপ-দাদার সাথে একত্রে মিলিত করে দেয়া হবে। আর মিলিত করাটা এমন হবে না যেমন মাঝে মধ্যে কেউ কারো সাথে গিয়ে সাক্ষাত করে। বরঞ্চ তারা জান্নাতে তাদের সাথেই বসবাস করতে থাকবে। তারপর অতিরিক্ত এ আশ্বাস দেয়া হয়েছে যে, সন্তানের সাথে মিলিত হওয়ার জন্যে বাপ-দাদার মর্যাদা খাটো করে নীচে নামিয়ে দেয়া হবে না বরং সন্তানের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়ে পিতার সাথে মিলিত করে দেয়া হবে।

যেমন ধরুন, পিতা-পুত্র উভয়ে ঈমান ও আমলের বদৌলতে জান্নাত লাভ করেছে। কিন্তু পিতা প্রথম শ্রেণীভুক্ত এবং পুত্র তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত হয়েছে। এখন উভয়কে মিলিত করার জন্যে পিতাকে তৃতীয় শ্রেণীতে আনা হবে না, বরঞ্চ পুত্রকেই প্রমোশন বা পদোন্নতি দান করে প্রথম শ্রেণীভুক্ত করা হবে এবং পিতার সাথে একত্রে বসবাসের সুযোগ দেয়া হবে। নেক বান্দাহদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার এ এক অসীম অনুগ্রহ ও উদারতার নিদর্শন তাতে কোন সন্দেহ নেই।

বিষয়টি সকল মাতাপিতা ও সন্তানদের গভীরভাবে চিন্তা করার বিষয়। উভয়ে উভয়ের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে শুধু তাদের পরকালীন জীবনই সুখী ও সুন্দর হবে না, বরঞ্চ এ দুনিয়ার বুকেও এক সুন্দর পুত-পবিত্র সমাজ ও পরিবেশ গড়ে উঠবে। দুষ্কৃতি, অনাচার অশ্লীলতার অস্তিত্ব থাকবে না এবং জান-মালের নিরাপত্তাসহ একটা ইনসাফ ভিত্তিক মানব সমাজ জন্ম লাভ করবে।

শেষ কথা
এখন শেষ কথা এই যে, মৃত্যুর পর মানুষ যে নতুন জীবন লাভ করে এক নতুন জীবনে পদার্পণ করবে তা এক অনিবার্য ও অনস্বীকার্য সত্য। এ শেষ জীবনকে সুখী ও আনন্দমুখর করার জন্যেই তো এ জগত। ইহজগত পরজগতেরই কর্মক্ষেত্র।

(আরবী*****************)

পৌষে নতুন ধানের সোনালী শীষে গোলা পরিপূর্ণ করার জন্যেই তো বর্ষার আগমন হয় আষাঢ় শ্রাবণে। যে বুদ্ধিমান কৃষক বর্ষার পানিতে আর সূর্যের রৌদ্র তাপে ভিজে-পুড়ে ক্ষেত-খামারে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সে-ই তাঁর শ্রাবণের সোনালী ফসল লাভ করে হেমন্তের শেষে। এ দুনিয়াটাও তেমনি পরকালে ফসল লাভের জন্যে একটা কৃষিক্ষেত্র। যেমন কর্ম এখানে হবে, তার ঠিক তেমনি ফল হবে পরকালে।

পরম দয়ালু আল্লাহ্‌ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সর্বত্র মানুষকে বার বার তার ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছেন। তিনি তাঁর তৈরি মানুষকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। সে জন্যে তিনি চান মানুষ তার পরকালের অনন্ত জীবনকে ও সুন্দর করে তুলুক। আল্লাহর প্রতিটি সতর্কবাণীর মধ্যে ফুটে উঠেছে তাঁর একান্ত দরদ ও স্নেহমমতা।

“এ বিচার দিবস একেবারে অতি নিশ্চিত এক মহাসত্য। অতএব যার ইচ্ছা সে তার প্রভুর কাছে শেষ আশ্রয়স্থল বেছে নিক। একটা ভয়ংকর শাস্তির দিন যে তোমাদের সন্নিকট, সে সম্পর্কে আমরা তোমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছি এবং দিচ্ছি। প্রতিটি মানুষ সেদিন তার স্বীয় কর্মফল দেখতে পাবে। এ দিনের অবিশ্বাসী যারা তারা সেদিন অনুতাপ করে বলবে, হায়রে! আমরা মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ না করে যদি মাটি হতাম।”–(সূরা আন নাবাঃ ৩৯-৪০)

এটাও উল্লেখ্য যে, খোদাদ্রোহী ও খোদা বিমুখ লোকদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কোন বিদ্বেষ নেই, থাকতেও পারে না। তাঁর অনুগ্রহ কণার উপর নির্ভরশীল তাঁর সৃষ্টির উপর তাঁর কি বিদ্বেষ হতে পারে? বরঞ্চ তাঁর অনন্ত দয়া ও অনুকম্পার পরিচয় পাওয়া যায়, যখন তিনি চরম খোদাদ্রোহী ও পাপাচারীকে তাঁর দিকে ফিরে আসার জন্যে উদাত্ত আহ্বান জানান।

একথাও মনে রাখা দরকার যে, এ উদাত্ত আহ্বানে তাঁর নিজের কোন স্বার্থ নেই।

(আরবী**************)

“আমি তাদের (মানব ও জ্বীন জাতির) কাছে কোন জীবিকার প্রত্যাশা করি না। আমি এটাও চাই না যে, তারা আমার পানাহারের ব্যবস্থা করুক। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ জীবিকাদাতা ও অসীম শক্তিশালী।”–(সূরা আয যারিয়াহঃ ৫৭-৫৮)

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্‌ দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন যে, জ্বীন এবং মানুষের সাথে তাঁর স্বার্থের কোন বালাই নেই। মানুষ খোদার দাসত্ব আনুগত্য করুক বা না করুক, তাঁর খোদায়ী এক চির শাশ্বত বস্তু। খোদা কারো দাসত্ব আনুগত্যের মোটেই মুখাপেক্ষী নন। খোদার দাসত্ব করা বরঞ্চ মানুষের জন্মগত ও প্রাকৃতিক দায়িত্ব। এর জন্যেই তাদেরকে পয়দা করা হয়েছে। খোদার দাসত্ব আনুগত্য থেকে বিমুখ হলে তাদের প্রকৃতিরই বিরোধিতা করা হবে এবং ডেকে আনা হবে নিজেদেরই সর্বনাশ।

দুনিয়ার সর্বত্রই বাতিল খোদারা কিন্তু তাদের অধীনদের আনুগত্যের উপর নির্ভরশীল। তাদের আনুগত্যের উপরেই এ বাতিল খোদাদের খোদায়ীর ঠাঠ, ধন-দৌলতের প্রাচুর্য ও বিলাসবহুল জীবন নির্ভরশীল। তারা তাদের অনুগতদের জীবিকাদাতা নয়, বরঞ্চ অধীন এবং অনুগতরাই তাদের জীবিকা ও সুখ-সাচ্ছন্দের কারণ। অনুগত অধীন দেশবাসী বিদ্রোহী হলে তাদের খোদায়ীর প্রাসাদ চুর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু সর্বশক্তিমান ও মহান আল্লাহ্‌ সকল জীবের জীবিকাদাতা ও পালনকর্তা।

তাহলে তাঁর দিকে ফিরে আসার বার বার উদাত্ত আহ্বান কেন? তার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিতে চান যদি তারা ফিরে আসে তাঁর দিকে।

তিনি চান তাঁদেরকে তাঁর অনুগ্রহ কণা বিতরণ করতে।

(আরবী**********)

“এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন খোদাকে অংশীদার বানায় না, মানুষ হত্যা করে না, অবশ্য ন্যায়সঙ্গত কারণে করলে সে অন্য কথা এবং যারা ব্যাভিচার করে না, (তারাই আল্লাহর প্রকৃত প্রিয় বান্দাহ) এবং যারা তা করে, তারা এর পরিণাম ভোগ করবে। কিয়ামতের দিনে তাদের শাস্তি দিগুন হবে। এবং এ শাস্তির স্থান জাহান্নামে তারা বসবাস করবে চিরকাল ও লাঞ্ছিত অবস্থায়। কিন্তু যারা অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে যায়, ঈমান আনে এবং সৎকাজ করতে থাকে, আল্লাহ্‌ তাদের পাপের স্থলে পুণ্য লিপিবদ্ধ করেন। এবং আল্লাহ্‌ অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ও দয়ালু।”–(সূরা আল ফুরকানঃ ৬৮-৭০)

আলোচ্য আয়াতগুলোতে আল্লাহ্‌ ক্ষমা ঘোষণার পূর্বে তিনটি অতি বড় বড় পাপের কথা উল্লেখ করেছেনঃ

একঃ আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করা। আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে বিপদে-আপদে সাহায্যের জন্যে, মনোবাঞ্ছনা পূরণের জন্যে ডাকা- যাকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয়েছে শির্ক।

দুইঃ তারপর হলো অন্যায়ভাবে হত্যা করা। এটাও এতবড় পাপ যে, এর জন্যে কাফের মুশরেকদের মতো চিরকাল জাহান্নামের অধিবাসী হতে হবে।

(আরবী**************)

“এবং যে ব্যক্তি মোমেনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে তার পরিণাম হলো জাহান্নাম, যেখানে তাকে থাকতে হবে চিরকাল। এবং আল্লাহ্‌ তার উপর ক্রোধান্বিত এবং তাকে অভিসম্পাৎ করবেন এবং তার জন্যে নির্ধারিত কঠোর শাস্তি।”–(সূরা আন নিসাঃ ৯৩)

আল্লাহ্‌ মানব সমাজে পূর্ণ শান্তি-শৃঙ্খলা দেখতে চান এবং দেখতে চান প্রতিটি মানুষের জান-মাল ইজ্জত আবরুর পূর্ণ নিরাপত্তা। এর ব্যতিক্রম তাঁর অভিপ্রেত কিছুতেই নয়। তাই তিনি বলেনঃ

(আরবী***********)

“যে ব্যক্তি দুনিয়ায় কোন মানুষকে হত্যার অপরাধ ব্যতীত অথবা দুনিয়ার ফাসাদ সৃষ্টি করার অপরাধ ব্যতীত হত্যা করলো সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করলো এবং যে ব্যক্তি একটি মানুষের জীবন রক্ষা করলো সে যেন সমগ্র মানবজাতির জীবন রক্ষা করলো।”–(সূরা আল মায়েদাহঃ ৩২)

আল্লাহ্‌ মানুষের রক্ত একে অপরের জন্যে হারাম করে দিয়েছেন। তার জন্যে উপরের ঘোষণা ও কঠোর শাস্তির সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।

তিনঃ বড় বড় পাপের মধ্যে আর একটি পাপের কথা উপরে ঘোষণা করেছেন। তাহলো ব্যভিচার।

কিন্তু মহান ও দয়ালু আল্লাহ্‌ এসব পাপ করার পরও পাপীদেরকে আশার বাণী শুনিয়েছেন। অনুতপ্ত ও প্রত্যাবর্তনকারী (তওবাকারী) পাপীর পাপের স্থলে পুণ্যের প্রতিশ্রুতি দান করেছেন! অর্থাৎ পাপ করার পরও যদি কোন ব্যক্তি অনুতপ্ত হয়ে খোদার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হয়, পাপকাজ পরিত্যাগ করে, পরিপূর্ণ ঈমান আনে এবং নেক কাজ করা শুরু করে, তাহলে নামায়ে আমলে লিখিত পূর্বের পাপরাশি মিটিয়ে দিয়ে তথায় সৎকাজ লিখিত হয়। তার মনের আবিলতা ও কলুষ কালিমা দূর হয়ে যায় এবং হয় সুন্দর, স্বচ্ছ ও পবিত্র। পরিবর্তিত হয় তার ধ্যান-ধারণা, মননশীলতা ও রুচি। সে হয় আল্লাহর অসীম অনুগ্রহ ও করুণার অধিকারী। পাপীদের জন্যে এর চেয়ে সুবর্ণ সুযোগ আর কি হতে পারে?

তবে একটি বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। বলা হয়েছে পাপ করার পর যদি তওবা করে এবং ঈমান আনে। ঈমান আনা কথাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই ঈমান আনার অর্থ শুধু আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্বের উপর ঈমান নয়। বরঞ্চ কেতাবের উপরও আল্লাহর কেতাবে হারাম ও হালাল, পাপ ও পুণ্য, সত্য ও মিথ্যা, সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তার বর্ণিত হারামকে হারাম, হালালকে হালাল, পাপকে পাপ, পুণ্যকে পুণ্য বলে বিশ্বাস করতে হবে। পাপকে পাপ মনে করলেই তার জন্যে অনুতাপ অনুশোচনা হওয়া স্বাভাবিক। পাপ করার পরও অনেকে তাকে পাপ করে না। নরহত্যা ও ব্যভিচার করার পর তার জন্যে অনুতাপ করার পরিবর্তে তা নিয়ে গর্ব করে এবং অপরের কাছে প্রকাশ করে আনন্দ পায়। আল্লাহর কেতাবে বর্ণিত প্রতিটি বিধি-বিধান মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে তার কাছে মাথানত করতে হবে। কুরআনকে গোটা জীবনের জীবন বিধান হিসেবে মেনে নিতে হবে। তারপরই তওবা এবং সৎকাজ আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে। যাহোক পাপীদের জন্যে আল্লাহর দিকে ফিরে যাবার পথ সকল সময়েই উন্মুক্ত রয়েছে। এ আল্লাহর অসীম দয়া ও অনুকম্পারই নিদর্শন সন্দেহ নেই।

আল্লাহ্‌ তওবাকারী বান্দাহর প্রতি কি পরিমান আনন্দিত হন তা বুঝবার জন্যে নিম্নের হাদীসটি প্রণিধানযোগ্য।

হাদীস বর্ণনাকারী হযরত আনাস (রা) বলেছেন যে, আল্লহর নবী বলেন, ‘যখন কোন বান্দাহ আল্লাহর কাছে খাঁটি দেলে তওবা করা, তখন তিনি অধিকতর আনন্দিত হন সে ব্যক্তি থেকে যে একটি জনহীন প্রস্তরময় প্রান্তর অতিক্রম করা কালে তার বাহনের পশুটি হঠাৎ হারিয়ে ফেলে। বাহনটির পিঠে তার খাদ্য, পানীয় ও অন্যান্য দ্রব্যসম্ভার ছিল। বহু সন্ধানের পর সে হতাশ হয়ে একটি বৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় নেয়। নৈরাশ্য ও দুঃখে সে ভেঙে পড়ে। কিছুক্ষন পর সে হঠাৎ দেখতে পায় তার হারিয়ে যাওয়া পশুটি সমুদয় দ্রব্য সম্ভারসহ তার সামনে দণ্ডায়মান। সে তার লাগাম ধরে ফেলে এবং আনন্দের আতিশয্যে তার মুখ দিয়ে এ ভুল কথাটি বেরিয়ে পড়ে “হে আল্লাহ্‌, তুমি আমার বান্দাহ এবং আমি তোমার রব।”–(মুসলিম)

এ ব্যাপারে আর একটি হাদীস এখানে উল্লেখ্য। হযরত ওমর ফারুক (রা) বলেছেনঃ

একবার কিছু লোক যুদ্ধবন্ধী হয়ে নবীর (সা) দরবারে এলো। তাদের মধ্যে ছিল একটি স্ত্রীলোক যার দুগ্ধ পোষ্য সন্তান ছাড়া পড়েছিল। স্ত্রীলোকটি কোন শিশু সন্তানকে সামনে দেখতে পেলেই তাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে স্তন্যদান করতো। নবী (সা) তার করুণ অবস্থা দেখে আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি কখনো ভাবতে পারো যে, এ স্ত্রীলোকটি তার আপন শিশুকে স্বহস্তে আগুনে নিক্ষেপ করবে?”

আমরা বললাম কখনোই না। স্বহস্তে আগুনে নিক্ষেপ করাতো দূরের কথা কেউ নিজে নিজে পড়তে গেলেও সে তাকে বাঁচাবার জন্যে চেষ্টার কোন ত্রুটিই করবে না।

নবী বল্লেনঃ

(আরবী**********)

“এ স্ত্রীলোকটি তার সন্তানের প্রতি যতটা দয়ালু, তার চেয়ে অনেক বেশী দয়ালু আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাহদের প্রতি।”–(তাফহীমুল কুরআন, সূরা হুদের তফসীর দ্রঃ)

দেখুন, আল্লাহ্‌ তায়ালা কত বড় দয়ালু এবং মানুষ কত বড় নাফরমান অকৃতজ্ঞ।

অতএব কেউ প্রবৃত্তির তাড়নায় অতিমাত্রায় পাপ করে থাকলেও তাঁর নৈরাশ্যর কোন কারণ নেই। তাঁর উচিত কাল বিলম্ব না করে অনুতপ্ত হৃদয়ে খোদার দিকে ফিরে যাওয়া এবং পাপ পথ পরিত্যাগ করে তাঁরই দাসত্ব আনুগত্যে নিজেকে সঁপে দেয়া। খোদার দেয়া জীবন বিধানকে ত্যাগ করে মানব রচিত জীবন বিধানে যারা বিশ্বাসী এবং বিশ্বনবী মুহাম্মদের (সা) নেতৃত্ব ত্যাগ করে খোদাহীন নেতৃত্বের মোহে যারা ছুটে চলেছে তাদের উচিত সময় থাকতে আল্লাহর রসূলের দিকে ফিরে আসা।

নবী বলেছেন, তাড়াহুড়ো শয়তানের কাজ। শুধু পাঁচটি ব্যাপারে তা ভালো। (১) মেয়ে সাবালিকা হলে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া। (২) ঋণ পরিশোধ করার সুযোগ আসামাত্র তা পরিশোধ করা। (৩) মৃত্যুর পর অবিলম্বে মুর্দাকে দাফন করা। (৪) মেহমান আসা মাত্র তার মেহমানদারী করা। (৫) পাপ করার পরক্ষনেই তওবা করা।

এখনই তওবা করে কি হবে? আর কিছুদিন যাক। বয়সটা একটু পাকাপোক্ত হোক। এখন তওবা করে তা ঠিক রাখা যাবে না ইত্যাদি- এসব কিছুই শয়তানের বিরাট ধোঁকা।

জীবনের কোন একটি মুহূর্তেরও ভরসা নেই। কথিত আছে হযরত ঈসা (আ) বলেছেন, “দুনিয়া শুধু তিন দিনের। গতকাল তো চলেই গেছে তার কিছুই তোমার হাতে নেই। আগামী কাল তুমি থাকবে কিনা, তা তোমার জানা নেই। শুধু আজকের দিনটিই তোমার সম্বল। অতএব আজকের দিনটিকেই তুমি সম্বল মনে করে কাজে লাগাও।”

কতবড় মূল্যবান কথা। কিন্তু শয়তানের ধোঁকার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে অনেকের জীবনাবসান হয়ে যায়। সে আর তওবা করার সুযোগই পায় না। তার ফলে পাপের মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে তার মৃত্যু হয়।

আর একটি কথা। যারা মনে করে যে ভবিষ্যতে কোন এক সময়ে তওবা করে ধর্ম কর্মে মন দিলেই চলবে। এত সকাল সকাল ধার্মিক সেজে কাজ নেই।

তারা কতখানি আত্মপ্রবঞ্চিত তা তারা বুঝতে পারে না। কারণ পাপ করতে করতে তাদের মন এমন কঠিন হয় যে, তওবা করার মনোভাব আর কোন দিন ফিরে আসে না। আর পাপ করা অবস্থাতেই হঠাৎ মৃত্যু এসে গেলেই বা তারা তাকে ঠেকাবে কি করে?

অতএব ওসব চিন্তা যে শয়তানের ধোঁকা প্রবঞ্চনা তাতে সন্দেহ নেই। এর থেকে আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখুন, আমীন।

তওবা করার পর আল্লাহর নির্দেশিত ভালো কাজগুলো কি কি তা জানার জন্যে কুরআন হাদীসের জ্ঞান অর্জন করার বিশেষ প্রয়োজন। আল্লাহর উপর ঈমান আনার পর তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে সর্বপ্রথম যে কাজটি করতে হয় তা হচ্ছে নামায কায়েম করা। আল্লাহ্‌ মানুষকে যত কাজের আদেশ করেছেন তার সর্বপ্রথমটি হচ্ছে নামায। খোদার প্রতি ঈমানের ঘোষণা ও আনুগত্যের স্বীকৃতির প্রথম নিদর্শনই নাময। খোদার এ ফরয কাজ নামাযকে যারা লংঘন করলো, তারা আনুগত্য অস্বীকার করলো বুঝতে হবে এবং তারপর খোদার অন্যান্য ফরয আদায় তাদের দ্বারা সম্ভব হয় না। আখেরাতের সর্বপ্রথম যে বিষয়টির হিসাব নেয়া হবে তাহলো নামায। পরীক্ষার এ প্রথম ঘাঁটি উত্তীর্ণ হলে অন্যান্য ঘাটিগুলো অধিকতর সহজ হবে। আর প্রথম ঘাঁটিতেই অকৃতকার্য হলে অপরাপর ঘাঁটিগুলো অধিকতর কঠিন হবে।

নামাযের হাকিকত বা মর্মকথা ভালো করে জেনে নিতে হবে। তার সংগে যাকাত, রোযা, হজ্জ মোটকথা আল্লাহর প্রতিটি হুকুম নির্দেশ ভালো করে জেনে নিয়ে পালন করে চলার অভ্যাস সৃষ্টি করতে হবে।

সর্বদা একটা কথা মনে রাখতে হবে। তা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তায়ালার কতকগুলো নির্দেশ ব্যক্তিগত জীবনে অবশ্য পালনীয়। যথা নামায কায়েম করা, রমযানের রোযা রাখা, যাকাত দেয়া, হজ্জ করা ও অতিরিক্তভাবে দান খয়রাত করা; ইসলামের পথে অর্থ ব্যয় করা, বৈধ উপায়ে উপার্জন ও ব্যয় করা, হিংসা বিদ্বেষ অহংকার পরনিন্দা না করা ইত্যাদি।

আর কতকগুলো নির্দেশ এমন আছে যা পরিবার, আত্মীয়-স্বজন সমাজ ও গোটা মানবজাতির সাথে সম্পর্ক রাখে। সকলের সাথে সদ্ব্যব্যবহার করা ও তাদের হক আদায় করা, কারো প্রতি অন্যায় অবিচার না করা, অপরের হক নষ্ট না করা ইত্যাদি। এগুলো পালন না করে উপায় নেই। মানুষের কোন কিছুই ব্যক্তি স্বার্থ কেন্দ্রিক হওয়া কিছুতেই চলবে না। তাই পিতার কর্তব্য তার অধীন সন্তানদেরকে আল্লাহর পথে চলার জন্যে তৈরী করা। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্যও তাই। মানুষ তার আপন স্ত্রী ও সন্তানদেরকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে। তাদের সামান্য অসুখ-বিসুখ বা দুঃখ-কষ্ট তার সহ্য হয় না। অতএব তাদের মৃত্যুর পরের অনন্ত জীবন সুখী ও সুন্দর হওয়া কি তার বাঞ্ছনীয় নয়? কিন্তু অধিকাংশই এ সম্পর্কে উদাসীন।

অতপর আপন পরিবারের গণ্ডি অতিক্রম করে বাইরের সমাজে ইসলামের দাওয়াত ও তবলিগের কাজ করতে হবে। ঠিক তেমনি একটি মুসলিম রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের ভেতরে ও বাইরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইসলামের দাওয়াত পেশ করবে। এটা তার পালনীয় কর্তব্য।

অন্যায় অবিচার, অনাচার পাপাচার সকল প্রকার সম্ভাব্য উপায়ে বন্ধ করার চেষ্টা না করলে পার্থিব জীবনেও খোদার তরফ থেকে যেসব বিপদ মুসিবত আসে শুধু যালেমদের উপরই পতিত হয় না, বরঞ্চ ঐসব সৎ ব্যক্তির উপরেও যারা তা বন্ধ করার চেষ্টা করেনি।

আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী***********)

“সে সব মুসিবতে তোমরা অবশ্যই ভয় করবে যাতে কেবল মাত্র তারাই নিমজ্জিত হবে না যারা তোমাদের মধ্যে যুলুম করেছে।”–(সূরা আনফালঃ ২৫)

আবার কুরআন পাক আলোচনা করলে এটাও জানা যায় যে, যারা সর্বদা খোদার পথে চলেছে, ইসলাম প্রচারের কাজ করেছে, করেছে ‘আমর বিল মা’রুফ (ভালো কাজের আদেশ)’ও ‘নাহি আনিল মুনকারের’(মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখা) কাজ, তারপর খোদা এক শ্রেণীর লোকের পাপের জন্যে আযাব নাযিল করলেও যারা উপরোক্ত সৎকাজ করেছে, তাদেরকে তিনি বিচিত্র উপায়ে রক্ষা করেছেন। অতএব দুনিয়া ও আখেরাতের বিপদ থেকে বাঁচতে হলে সে পথ অবলম্বন করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

অতপর মৃত্যু যবনিকার ওপারে বা আখেরাতের আলোচনা সম্বলিত গ্রন্থখানি শেষ করার আগে আর একটা কথা বলে রাখি।

ঈমান হচ্ছে বীজ স্বরূপ এবং আমল তার বৃক্ষ ও ফল। আখেরাতের বিশ্বাস যতো বেশী দৃঢ় হবে, আমলের বৃক্ষও ততবেশী সুদৃঢ় এবং শাখা প্রশাখা ও ফুলে ফলে সুশোভিত হবে।

আর একদিক দিয়ে দেখতে গেলে ঈমান হচ্ছে আল্লাহর সাথে বান্দাহর একটা চুক্তি। সে চুক্তির সারমর্ম এই যে, যেহেতু আল্লাহ মানুষের স্রষ্টা এবং বাদশাহ এবং মানুষ তার জন্মগত গোলাম ও প্রজা, অতএব গোলাম ও প্রজা তার জীবনের সব ক্ষেত্রে একমাত্র তার প্রভু ও বাদশাহর আদেশ নিষেধ ও আইন-কানুন মেনে চলবে। স্রষ্টা, প্রভু ও বাদশাহর আদেশ নিষেধ ও আইন-কানুন মেনে চলবে। স্রষ্টা, প্রভু ও বাদশাহর আইন মানার পরিবর্তে অন্য কারো আইন মেনে চলা- যে তার স্রষ্টাও নয় প্রভু এবং বাদশাহও নয়- হবে বিশ্বাসঘাতকতা করা, নিমকহারামি এবং চরম নির্বুদ্ধিতা এবং তা হবে চুক্তি লংঘনের কাজ।

আবার খোদার আইন পালনে অথবা জীবনের সব ক্ষেত্রে তাঁর দাসত্ব আনুগত্য পালনে যে শক্তি বাধাদান করে তাহলো তাগুতি শক্তি এবং কৃত্রিম খোদায়ীর দাবীদার শক্তি। খোদার সাথে বান্দাহর সম্পাদিত চুক্তি কার্যকর করতে হলে এ তাগুতি শক্তিকে উৎখাত করাও অনিবার্য দাবী। তাই জীবনের সকল ক্ষেত্রে অর্থাৎ যেসব ক্ষেত্রে ও বিষয়ের সাথে মানুষের জীবন-জীবিকা সুখ-দুঃখ জান-মাল ও ইজ্জত আবরুর প্রশ্ন ওতপ্রোত জড়িত এক কথায় ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন, শিক্ষা ও সংস্কৃতির অংগন, যুদ্ধ, সন্ধি, শত্রুতা, বন্ধুত্ব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্বন্ধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে আল্লাহর আইন শাসন ও প্রভুত্ব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই ঈমানের দাবী। এ দাবী আদায়ের সংগ্রামকে বলা হয়েছে “আল জিহাদু ফী সাবিলিল্লাহ”– আল্লাহর পথে জিহাদ। আর এর সফল পরিণতিই হলো ‘একামতে দ্বীন’– দ্বীন ইসলামের প্রতিষ্ঠা, যার জন্যে হয়েছিল সকল নবীর আগমন। আখেরাতের সাফল্যের জন্যে এ কাজ অপরিহার্য। শেষ নবীর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এ কাজের জন্যেই ব্যয়িত হয়েছে এবং তাঁর এ কাজের পূর্ণ অনুসরণই প্রকৃত মুমেনের একমাত্র কাজ।এরই আলোকে একজন মুমেনের সারা জীবনের কর্মসূচী নির্ধারিত হওয়া অপরিহার্য কর্তব্য।

সর্বশেষে রাহমানির রাহীম আল্লাহ তায়ালার দরবারে আমাদের কাতর প্রার্থনা। তিনি যেন আমাদেরকে উপরোক্ত দায়িত্ব পালনের পূর্ণ তওফিক দান করেন। সকল প্রকার গুনাহ থেকে পাক-পবিত্র রেখে তাঁর সেরাতুল মুস্তাকীমে চলার শক্তি দান করেন। অবশেষে তাঁর প্রিয় বান্দাহ হিসেবে তাঁর সাথে মিলিত হতে পারি। আমীন।

(আরবী***********************)

— সমাপ্ত —


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি