মহাপ্রলয় বা ধ্বংস
জগতে যা কিছু হচ্ছে সবই আল্লাহ তায়ালার পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর অধীন। সৃষ্টিজগতের ধ্বংস, নতুন জগত সৃষ্টি ও মানুষের পুনর্জীবন লাভ সবই তাঁর মহান পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর অধীন।

মহাপ্রলয় শুরু করার জন্যে ফেরেশতা হযরত ইসরাফিল (আ) খোদার আদেশের প্রতীক্ষায় আছেন। আদেশ মাত্রই তিনি তাঁর সিংগায় ফুঁক দেবেন। এভাবে চিন্তা করা যেতে পারে যে, তিনি এক মহাশক্তিশালী সাইরেন বাজাবেন।

মহাপ্রলয় শুরু হওয়ার পূর্বে হযরত ইসরাফিল (আ) সিংগায় ফুঁক দেবেন। অর্থাৎ এক প্রকার বংশীধ্বনি করবেন। এ বংশীকে কুরআনে ( আরবী ****) সুর নামে অভিহিত করা হয়েছে। ইংরেজীতে যেমন-BUGLE বলা হয়। সে বংশীধ্বনি ও তাণ্ডবলীলার পূর্বাভাস। সে বংশী এবং তার ধ্বনি আমাদের কল্পনার অতীত এবং ভাষায় প্রকাশ করাও সম্ভব নয়। একটি উদাহরণসহ বুঝবার চেষ্টা করা যাক। বর্তমান কালে সাইরেন ধ্বনী যেমন একটা আশু বিপদ ও ধবংসের সংকেত দান করে, বিশেষ করে যুদ্ধকালীন সাইরেন-তেমনি ‘সুর’ বা সিংগা চরম ধ্বংসের পূর্ব মুহূর্তে এক আতংক ও বিভীষিকা সৃষ্টকারী ধ্বংস করতে থাকবে। সহজে বুঝাবার জন্যে এখানে সাইরেন দৃষ্টান্ত স্বরূপ ব্যবহার করা হয়েছে।

শিংগা থেকে প্রচণ্ড বেগে খটখটি শব্দ হবে তা তৎসহ একটানা ধ্বনিও হবে। সে শিংগা বা সাইরেন থেকে এমন বিকট, ভয়ংকর ও রোমাঞ্চকর ধ্বনি হতে থাকবে যে কর্ণকুহর বিদীর্ণ হবে। প্রত্যেকেই এ ধ্বনি তার নিকটস্থ স্থান থেকে সমভাবে শুনতে পাবে। প্রত্যেকের মনে হবে যেন তার পার্শ্ব থেকেই সে ধ্বনি উত্থিত হচ্ছে। এমনও হতে পারে যে, ফেরেশতা একই স্থান থেকে তাঁর শিংগা বা সাইরেন ধ্বনি করবেন। কিন্তু সমগ্র জগতব্যাপী মানুষের নিকটবর্তী স্থানে মাইক্রোফোনের হর্নের ন্যায় কোন অদৃশ্য যন্ত্র স্থাপন করা হবে।

হাদীসে এ (আরবী****) সূরকে (শিংগা) তিন প্রকার বলা হয়েছে। যথাঃ

১। (আরবী *****) (নাফখাতুল ফিযা) অর্থাৎ ভীত সন্তস্ত ও আতংকগ্রস্থ করার শিংগা ধ্বনি।

২। (আরবী******) ( নাফকাতুয সায়েক) অর্থাৎ পড়ে মরে যাওয়ার বা মরে পড়ে যাওয়ার শিংগা ধ্বনি।

৩। (আরবী******) (নাফখাতুল কিয়াম) অর্থাৎ কবর থেকে পুনর্জীবিত করে হাশরের ময়দানে সকলকে একত্র করার শিংগা ধ্বনি।

অর্থাৎ প্রথম শিংগা ধ্বনির পর এক ভয়ংকর প্রাকৃতিক বিশৃঙ্খলা বিপর্যয় সৃষ্টি হবে যে, মানুষ ও জীবজন্তূ ভীতসম্ভ্রস্ত হয়ে পাগলের মতো এদিক সেদিক ছুটোছুটি করবে।

দ্বিতীয়বার শিংগা ধ্বনির সাথে সাথেই যে যেখানেই থাকবে তৎক্ষণাৎ মরে ধরাশায়ী হবে। তারপর এক দীর্ঘ ব্যবধানে-তা সে কয়েক বছর এবং কয়েক যুগও হতে পারে অথবা অল্প সময়ও হতে পারে-তৃতীয় এবং শেষ পর্যায়ের মতো শিংগা ধ্বনি হবে। আর সংগে সংগেই তার মৃত্যুর স্থান অথবা কবর থেকে জীবিত হয়ে হাশরের ময়দানে জমায়েত হবে। আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী *********************************)

“(তাদের সেদিন ভয় দেখাও) যেদিন যমীন আসমানকে পরিবর্তন করে অন্যরূপ করে দেয়া হবে। তারপর সকলেই মহাপরাক্রাস্তশালী এক আল্লাহর সামনে হাতে পায়ে শিকল পরা এবং আরামহীন অবস্থায় হাজির হয়ে যাবে। সেদিন তোমরা পাপীদেরকে দেখবে আলকাতরার পোশাক পরিধান করে আছে। আর আগুনের লেলিহান শিখা তাদের মুখমণ্ডলের উপর ছড়িয়ে পড়তে থাকবে। এটা এজন্য হবে যে, আল্লাহ প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের বদলা দেবেন। আল্লাহর হিসাব নিতে বিলম্ব হয় না।”-(সূরা ইবরাহীমঃ ৪৮-৫১)

এ আয়াত থেকে এবং কুরআনের অন্যান্য ইশারা-ইংগিত থেকে জানা যায় যে, কিয়ামতের যমীন আসমানকে অস্তিত্বহীন করে দেয়া হবে না। বরঞ্চ বর্তমানের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার অবসান ঘটানো হবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিংগাধ্বনির মধ্যবর্তী কালের এক বিশেষ সময়ে (যা শুধু আল্লাহ তায়ালাই জানেন) যমীন আসমানের বর্তমান আকার আকৃতি পরিবর্তন করে অন্যরূপ ব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক আইন পদ্ধতিসহ তা নতুন করে তৈরী করা হবে। এটাই হবে আলমে আখেরাত বা পরকাল-পরজগত। তারপর শেষ শিংগাধ্বনির সাথে সাথে হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যতো মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে তারা সব নতুন করে জীবিত হবে এবং আল্লাহ তায়ালার সামনে হাজির হবে। কুরআনের পরিভাষায় একেই বলে হাশর। আর আভিধানিক অর্থ হলো চারদিক থেকে গুছিয়ে একস্থানে একত্র করা।–(তাফহীমুল কুরআন)

কুরআন পাকে ধ্বংসের যে ধারাবাহিক বিবরণ দেয়া হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত সার এই যে, সে সময়ে (প্রথম অবস্থায়) সূর্য আলোহীন হয়ে পড়বে। আকাশ বিদীর্ণ হবে। নক্ষত্ররাজি স্থলিত হয়ে নিম্নে পতিত হবে। সমস্ত জগতব্যাপী এক প্রলয়ংকর ভুমিকল্প হবে। পাহাড়-পর্বত চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ধূলিকণার ন্যায় উড়তে থাকবে। সমুদ্র উদ্বেলিত ও উচ্ছ্বসিত হয়ে স্থল্ভাগ প্লাবিত করে ফেলবে। মোটকথা সবকিছুই তসনস ও লণ্ডভণ্ড হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। জগত আকাশমণ্ডলী ও সৃষ্টি বলতে কিছুরই অস্তিত্ব থাকবে না। এমন কি কোন ফেরেশতারও অস্তিত্ব থাকবে না। একমাত্র আল্লাহ তায়ালার পবিত্র সত্তাই বিদ্যমান থাকবে।

(আরবী ***************************************)

“(সেদিন চীৎকার করে জিজ্ঞেস করা হবে) আজ বাদশাহী কার? (দুনিয়ার ক্ষমতাগর্বিত শাসকগন আজ কোথায়?) (এ ধ্বনি বা জবাবই উত্থিত হবে) আজ বাদশাহী কর্তৃত্ব প্রভুত্ব একমাত্র পরম পরাক্রান্তশালী আল্লাহর। (বলা হবে) আজ প্রত্যেক ব্যক্তিকে সে যা অর্জন করেছে-তার বদলা দেয়া হবে। আজ কারো প্রতি জুলুম করা হবে না। আর আল্লাহ হিসাব নেয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত ক্ষিপ্র।”-(সূরা মুমেনঃ ১৬-১৭)

এখন প্রশ্ন মানুষের পার্থিব জীবনের হিসাব-নিকাশ গ্রহণের। এতো অগনিত মানুষের জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ের হিসাব গ্রহণ কি সহজ কথা? কিন্তূ আল্লাহর নিকটে সবইতো অতি সহজ।

আল্লাহ বলেন যে, তিনি যখন মানুষের সৃষ্টি করেছেন, তখন সৃষ্টি করার পর তার কাজ শেষ হয়ে যায়নি। তিনি মানুষের গতিবিধি লক্ষ্য রাখেন। এমন কি তার অন্তরের গভীরতম প্রদেশে যে চিন্তাধারার উদয় হয়-তাও তাঁর জানা আছে।

আল্লাহ একথাও বলেন যে, তিনি মানুষের গলদেশের শিরা থেকেও নিকটে অবস্থান করেন। খোদার অসীম জ্ঞান পরিপূর্ণ পরিবেষ্টন করে আছে। তার প্রতিটি গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য আল্লাহকে কোথাও গমন করার প্রয়োজন হয় না। মানুষের প্রতি মুহূর্তের প্রতিটি গোপন ও প্রকাশ্য ক্রিয়াকর্ম তাঁর নিখুঁতভাবেই জানা থাকে। এ সম্পর্কে তার সরাসরি জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তিনি সৃষ্টিজগতের শাহানশাহ হিসেবে তাঁর অসংখ্য অফিসার নিযুক্ত করে রেখেছেন, মানুষের প্রতিটি কাজ লিপিবদ্ধ করার জন্যে। প্রত্যেক মানব সন্তানের জন্যে দু’জন করে ফেরেশতা নিযুক্ত আছেন। একজন ডান দিকে, অপরজন বাম দিকে। তার মুখ থেকে কোন কথা উচ্চারিত হবার সংগেই তার লিপিবদ্ধ করার জন্যে তাঁরা সদা সচেতন থাকেন। এমনিভাবে ফেরেশতাদ্বয় মানুষের প্রতিটি কাজের সঠিক ও পুংখ্যানুপুংখ রেকর্ড তৈরী করে যাচ্ছেন। এ রেকর্ড অথবা দলিল দস্তাবিজ প্রমাণ স্বরূপ পেশ করা হবে বিচার দিনে যা অস্বীকার করার কোনই উপায় থাকবে না।

মানুষের প্রতিদিনের কাজের এই যে, নিখুঁত রেকর্ড এর সঠিক ধারণা করা বড়ই কঠিন। কিন্তূ আজ পর্যন্ত যেসব তথ্য আমাদের কাছে উদ্ঘাটিত হয়েছে, তা থেকে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, মানুষ যে পরিবেশ থেকে তার দৈনন্দিন কাজকর্ম করে যাচ্ছে সেই পরিবেশের আনাচে-কানাচে রন্ধে রন্ধে তার কাজকর্ম কথা-বার্তা, হাসি-কান্না, চলা-ফেরা, ভাব-ভংগী, কণ্ঠস্বর প্রভৃতির অবিকল চিত্র অংকিত হয়ে যাচ্ছে। এসব কিছুতেই পুনর্বার এমনভাবে দৃশ্যমান করে তোলা যায় যে, প্রথম ও দ্বিতীয় চিত্রের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। মানুষ তার সীমিত জ্ঞান ও সীমিত শক্তি বিশিষ্ট যন্ত্র দ্বারা এর কিছুটা আয়ত্ত করতে পেরেছে। কিন্তূ আল্লাহর নিয়োজিত অফিসারবৃন্দের (ফেরেশতা) এসব যন্ত্রেরও কোন প্রয়োজন নেই এবং তাদের কাজের কোন বাধা-বন্ধনও নেই। মানুষের শরীর এবং তার চতুষ্পার্শস্থ প্রতিটি বস্তূই তাঁদের টেপ (Tape) এবং ফিল্ম (Film) যার উপর তাঁরা প্রতিটি শব্দ ও প্রতিটি চিত্র অবিকল অংকিত করতে পারেন। অতপর তাঁরা বিচার দিবসে মানুষেকে তার আপন কানে সেসব কিছুই শুনাতে পারেন, যা তারা নিজেরা বলেছে, এবং সেসব কিছুই তাদেরকে আপন চোখে দেখাতে পারেন যা তারা প্রকাশ্যে অথবা গোপনে করেছে। এরপর এ অস্বীকার করা তার পক্ষে আর কিছুতেই সম্ভব হবে না।

দুনিয়ার জীবনে হঠাৎ এক সময় মৃত্যু এসে উপস্থিত হয় মানুষের দুয়ারে। আত্না দেহচ্যুত করে মৃত্যু সংঘটিত করার জন্যে নির্দিষ্ট ফেরেশতা আছেন। তাঁর নাম হযরত আজরাইল (আ)। তাঁকে ‘মালেকুল মওত’ও বলে (মৃত্যুর রাজা বা যমরাজ) মৃত্যুর সময় অসহ্য যন্ত্রণাও হয়। আল্লাহ বলেন যে মৃত্যুকে মানুষ সবসময় এড়িয়ে চলতে চায় সে যখন অনিবার্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি নিয়ে উপস্থিত হয়, তখন সে ব্যক্তির কাছে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ে। এতদিন এ দুনিয়া এবং পরকালের মাঝে এক দুর্ভেদ্য যবনিকা বিরাজ করতো।

মৃত্যুর সময় সে যবনিকা উত্তোলন করা হবে। তখন সে সুস্পষ্টরূপে পরকাল দেখতে পাবে যার সম্বন্ধে আল্লাহর নবীগণ সর্বদা সতর্কবাণী ঘোষণা করেছেন। পরকালের সত্যতাই শুধু তার কাছে প্রতিভাত হবে নে, বরঞ্চ সে এটাও জানতে পারবে সে ভাগ্যবান হিসেবে পরকালের যাত্রা শুরু করছে, না ভাগ্যহীন হিসেবে।

পরকালে অবিশ্বাসী ব্যক্তি এসব কিছুই তার দুনিয়ার জীবনে অসত্য এং কাল্পনিক বলে বিদ্রুপ করে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তূ এখন তার সেই তথাকথিত কাল্পনিক পরকাল তার চোখের সামনে সুস্পষ্ট।

এমনি করেই প্রতিটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। অতপর যখন মহাপ্রলয়ের পর সাইরেন ধ্বনি হবে পুনরুত্থানের জন্যে, তখন প্রতিটি মানুষ বিচারের ময়দানে হাজির হবে। তার সংগে থাকবেন দু’জন ফেরেশতা। একজনের কাজ হবে পুনরুত্থানের স্থান থেকে খোদার দরবার পর্যন্ত তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া এবং অপরজন হবেন তার রেকর্ডবহনকারী ও সাক্ষ্যদাতা। সম্ভবত এ ফেরেশতাদ্বয়ই দুনিয়ার জীবনে মানুষের কৃতকর্ম রেকর্ড করার কাজে নিয়োজিত। সাইরেন ধ্বনির সংগে মানুষ যখন তার কবর অথবা মৃত্যুর স্থান থেকে জীবিত হয়ে উঠবে তখন এই ফেরেশতাদ্বয় তাকে তাদের হেফাজতে (Custody) নিয়ে খোদার সমীপে হাজির করেন, যেমন আসামীকে পুলিশ কোর্টে হাজির করে।

(আরবী ***********************************)

“সেদিন খোদা প্রত্যেক অবিশ্বাসীকে বলবেন, “এদিনের প্রতি অবিশ্বাস করে তুমি অবহেলায় জীবন কাটিয়েছ। আজ তোমার চোখের আবরণ আমি অপসারিত করে দিয়েছি। যা তুমি বিশ্বাস করতে চাওনি, অন্তরের চক্ষু দিয়ে তুমি দেখতে চাওনি, তা আজ প্রত্যক্ষ কর। এ সত্য দেখার জন্যে আজ তোমার দৃষ্টিশক্তি প্রখর করে দিয়েছি।”-(সূরা ক্বাফঃ ২২)

ফেরেশতাদ্বয় তাঁদের যিম্মায় গৃহীত ব্যক্তিকে খোদার দরবারে হজির করবেন, হাজির করার দায়িত্ব যার উপরে তিনি বল্বেনঃ

(আরবী **************************************)

“হে খোদা আমার দায়িত্বে যাকে দেয়া হয়েছিল, এই যে তাকে হাজির করেছি। (বিচারের পর হুকুম হবে) সত্যের প্রতি বিদ্বেষপোষণকারী প্রত্যেক কট্টর কাফেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর।”-(সূরা কাফঃ ২৩-২৪)

জাহান্নামবাসীর প্রধান প্রধান অপরাধ
(আরবী ***********************************)

“প্রত্যেক কাফেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর যে সত্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী, মংগল বা সৎপথের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী, সীমালংঘনকারী এবং দ্বীনের প্রতি সন্দেহপোষণকারী।”-(সূরা কাফঃ ২৪-২৬)

উপরোক্ত আয়াত দু’টি বিশ্লেষণ করলে জাহান্নামবাসীর যে প্রধান অপরাধগুলো ছিল তা নিম্নরুপঃ

নবীগণ কর্তৃক প্রচারিত সত্যকে অস্বীকার।
সত্য ও সত্যের দিকে আহ্বানকারীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ।
জীবনের প্রতি মুহূর্তে খোদার অনুগ্রহ ও ডান লাভ করে তাঁর অকৃতজ্ঞ হওয়া।
সৎপথের প্রতিবন্ধকতা করা ও সৎপথ থেকে নিজেকে দূরে রাখা এবং অপরকে পথভ্রষ্ট করা।
আপন ধন-সম্পদ থেকে খোদা ও মানুষের হক আদায় না করা।
জীবনে খোদা কর্তৃক নির্ধারিত সীমালংঘন করা।
অন্যের প্রতি অন্যায় অবিচার ও অত্যাচার করা।
নবী কর্তৃক প্রচারিত দ্বীনের প্রতি সন্দেহ পোষণ করা।
অপরের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করা।
খোদার সংগে অন্যকে অংশীদার করা।
__________________________

শয়তান ও মানুষের মধ্যে কলহ
প্রকাশ থাকে যে, দুনিয়াতে শয়তান মানুষকে পথভ্রষ্ট করার কাজে হর-হামেশায় লিপ্ত আছে। পরকালে জাহান্নামের শাস্তি প্রদত্ত ব্যক্তির সাথে তাকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করার আদেশ হবে। সে সময়ে সে ব্যক্তি এবং শয়তান উভয়ে একে অপরের প্রতি দোষারূপ করতে থাকবে। হতভাগ্য লোকটি শয়তানের প্রতি এই বলে দোষারূপ করবে যে, একমাত্র তারই প্ররোচনায় সে পথভ্রষ্ট হয়েছে। অতএব এ শাস্তি একমাত্র তারই প্রাপ্য।

অপর দিকে শয়তান তার নিজের ত্রুতি স্বীকার না করে লোকটিকেই দোষী বলবে। সে খোদার দরবারে তার সাফাই পেশ করে বলবেঃ

(আরবী ***********************)

“হে প্রভু পরোয়ারদেগার। আমি তাকে পথভ্রষ্ট করতে মোটেই চেষ্টা করিনি। বরঞ্চ সে নিজেই ছিল পথভ্রষ্ট।”

আল্লাহ উভয়কে সম্ভোধন করে বলবেন-“আমার সামনে তোমরা এভাবে কলহ করো না। এতে কোন লাভ নেই। কারন তোমাদের উভয়কেই আমি পূর্বোহ্নেই সতর্ক করে বলেছিলাম যে, যে ব্যক্তি নিজে পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যকেও করবে, তাদের উভয়কেই তার পরিণাম ভোগ করতে হবে। এখন উভয়েই এ অনিবার্য শাস্তি ভোগ কর। আমার সিদ্ধান্ত অটল ও অপরিবর্তনীয় হয়ে থাকে। তোমাদের প্রতি যে আদেশ দেয়া হয়েছে তা পরিবর্তন করা হবে না। পথভ্রষ্ট ও পথভ্রষ্টকারী উভয়কেই কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে বলে দুনিয়াতে আমার যে অটল আইন ঘোষণা করা হয়েছিল, তার কোন পরিবর্তন করা হবে না। এতদসত্বেও আমি কিন্তূ আমার বান্দাহর উপরে কণামাত্র অবিচার করি না। আজ তোমাদের প্রতি যে শাস্তি ঘোষণা করা হয়েছে, তোমরা তার প্রকৃতই উপযুক্ত। আমার বিচার ব্যবস্থা সত্য ও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। কাউকে এমন কোন শাস্তি দেয়া হয় না যার জন্যে সে সত্যিকারভাবে দায়ী নয়। অথবা যার অপরাধ অকাট্য সাক্ষ্য প্রমনাদির দ্বারা প্রমাণিত হয়নি।”-(সূরা কাফঃ ২৭-২৯ দ্রষ্টব্য)

জান্নাতবাসীর সাফল্যের কারণ
অপর দিকে যাঁরা খোদাভিরু, যাঁরা নবীদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন, নবীদের কথার উপর দ্বিধাহীনচিত্তে পরিপূর্ণ ঈমান এনেছেন, তাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন যে, বেহেশত তাঁদের অতি নিকটবর্তী করে দেয়া হবে। যেহেতু এ বেহেশতই হবে তাঁদের চিরন্তন বাসস্থান, সে জন্যে তাঁদের সপক্ষে রায় ঘোষণার সংগে সংগেই বেহেশত তাঁদের অতি সন্নিকটে করে দেয়া হবে। কষ্ট করে পায়ে হেটে অথবা কোন যানবাহনের মাধ্যমে বেহেশতে পৌছাব প্রয়োজন হবে না। রায় ঘোষিত হবার পর মুহূর্তেই তাঁরা অনায়াসে বেহেশতে প্রবেশ করবে। মোটামুটি কোন গুণাবলীর জন্যে তাঁরা বেহেশত লাভ করবে, তার উল্লেখও আল্লাহ করেছেন।

(আরবী **********************************************)

“এবং জান্নাত মুক্তাকীদের নিকটে আনা হবে, তা একটুও দূরে হবে না, বলা হবে-এটা ঐ জিনিস যার ওয়াদা তোমাদের কাছে করা হয়েছিল-প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির জন্যে যে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে এবং রক্ষণাবেক্ষণকারী।”-(সূরা কাফঃ ৩১-৩২)

(আরবী *************************************************)

“যে না দেখেই রহমানকে ভয় করে। যে একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট থাকে।”-(সূরা কাফঃ ৩৩)

o তাঁদের প্রথম গুন হবে খোদাভীতি (তাকওয়া)। দুনিয়ার জীবনে খোদার অসন্তুষ্টির ভয়ে তাঁরা থাকবেন সদাভীত সন্ত্রস্ত। এ খোদাভীতিই তাদেরকে প্রতি মুহূর্তে অবিচলিত রাখবে সৎপথে।

o তাঁদেরকে কুরআনের ভাষায় ‘আওয়াব’ বলে তাঁদের দ্বিতীয় গুনের কথা বলা হয়েছে। ‘আওয়াব’ (আরবী ***) শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। ‘আওয়াব’ বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায়, যিনি আল্লাহর নাফরমানী এবং প্রবৃত্তির দাসত্ব পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর সন্তোষ লাভের পথ অবলম্বন করেছেন। তিনি এমন সবকিছুই পরিত্যাগ করেছেন, যা আল্লাহ অপছন্দ করেন এবং এমন সবকিছু অবলম্বন করেছেন যা আল্লাহ পাক পছন্দ করেন। যে ব্যক্তি খোদার পথ থেকে হঠাৎ বিচ্যুত হয়ে পড়লে অতিমাত্রায় বিচলিত হয়ে পড়েন এবং সংগে সংগেই তওবা করে খোদার পথে ফিরে আসেন। যিনি সর্বদা আল্লাহকে ইয়াদ করেন এবং আল্লাহর নীতি অনুযায়ী সবকিছুর সিদ্ধান্ত করেন।

o তৃতীয় গুনের কথা বলতে গিয়ে তাঁদেরকে বলা হয়েছে ‘হাফিয’ (আরবী****) যার সাধারণ অর্থ রক্ষণাবেক্ষণকারী। এমন রক্ষণাবেক্ষণকারী যিনি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা, আল্লাহর ফরয ও হারামসমুহ এবং অর্পিত অন্যান্য আমানত ও দায়িত্বের পুরাপুরি রক্ষণাবেক্ষণ করেন। তিনি ঐসব হকের রক্ষণাবেক্ষণ করেন যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর উপর চাপানো হয়েছে। তিনি ঐসব শপথ ও প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে চলেন, যা তিনি ঈমান আনার সাথে সাথে আল্লার সংগে করেছেন। যিনি আপন সময় শক্তি, শ্রম ও চেষ্টা চরিত্রের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন যাতে করে তা কোন কুকর্ম ও কুপথে ব্যয়িত না হয়। তিনি তওবা করে তা রক্ষণাবেক্ষণ করেন যেন তা নষ্ট হয়ে না যায়। তিনি প্রতি মুহূর্তে নিজকে যাঁচাই (মুহাসাবায়ে নফস) করে দেখেন যে তিনি তাঁর কথা ও কাজের দ্বারা আল্লাহর কোন নাফরমানী করেননি। এমন ব্যক্তিকেই বলা হয়েছে ‘হাফিয’ এবং এসব গুনসম্পন্ন ব্যক্তিই হবে জান্নাতের অধিবাসী।

o যিনি আল্লাহকে কোনদিন দেখেননি, অথচ তাঁর সীমাহীন দয়ার প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় রেখে তাঁকে সর্বদা ভয় করে চলেন। অনস্ক দয়া ও করুণা অনুকম্পার সাগর আল্লাহকে কখনো দেখা যায় না এবং ইন্দ্রিয় শক্তির দ্বারা তাঁকে কোনরূপ অনুভবও করা যায় না। এতদসত্বেও তাঁর ভয়ে ভীত হয়ে যিনি তাঁর নাফরমানী থেকে সদা বিরত থাকেন। অন্যান্য অনুভূতি শক্তি ও প্রকাশ্যে দৃশ্যমান শক্তিশালী সত্তার চেয়ে অদেখা আল্লাহর ভয় যাঁর অন্তরে অত্যধিক। যিনি আল্লাহকে রহমানুর রহীম বলে বিশ্বাস করলেও তাঁর রহমত ও মাগফেরাতের আশায় পাপে লিপ্ত হন না। বরঞ্চ প্রতিমুহূর্তে যিনি আল্লাহর ভয়ে ভীত সংকিত থাকেন।

আলোচ্য আয়াতের (আরবী *********) অংশে মুমেনের দু’টি গুনের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। প্রথমত এমন আল্লাহকে ভয় করে চলা যাঁকে কোনদিন দেখা যায় না। দ্বিতীয়ত ‘রহমানুর রহীম’ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ভয়ে পাপ পথে পদক্ষেপ না করা।

o যিনি একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর প্রতি সর্বদা আকৃষ্ট থাকেন, আল্লাহ এমন ব্যক্তির মনকে ‘কলবে মুনীব’ (আরবী **********) বলে ব্যক্ত করেছেন।

“মুনিব” শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। কম্পাসের কাঁটা যেমন সকল অবস্থাতেই উত্তরমুখি হয়ে থাকে, শত চেষ্টা করেও যেমন তাঁকে অন্যদিকে ফিরানো যায় না, ঠিক তেমনি কোন মুমেনের মনকে ‘ফলবে মুনীব’ তখনই বলা হয় যখন তা সর্বাস্থায়, সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে শয়নে-স্বপনে, জাগরণে একমাত্র আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট হয়ে আল্লাহমুখী হয়ে থাকে।

আল্লাহর বেহেশতে প্রবেশাধিকার শুধুমাত্র সেসব ভাগ্যবানই লাভ করবেন, যাঁরা উপরে বর্ণিত পাঁচ প্রকারের গুনাবলী দ্বারা ভূষিত হবেন।

অতপর মহান আল্লাহ তাঁদেরকে সম্বোধন করে বলবেন, তোমরা বেহেশতে প্রবেশ কর, যেখানে না আছে দুঃখ-কষ্ট, আর না আছে কোন কিছুর চিন্তা-ভাবনা। এ এক অনাবিল অফুরন্ত সুখের স্থান। সেখানে আমার ফেরেশতাগনের পক্ষ থেকে তোমাদেরকে জানানো হবে খোশ আমদেদ।

এ বেহেশত এমন এক স্থান, যেখানে মানুষ তার প্রতিটি বাঞ্চিত বস্তূ লাভ করবে। উপরন্তূ আল্লাহ তার জন্যে এমন আরো অমুল্য সম্পদ রেখেছেন যার কল্পনাও সে করতে পারে না।–(সূরা আল ক্বাফঃ ৩১-৩৫)

পরকালে বিচার দিবসে মানবজাতিকে তাদের পাপ-পুণ্যের দিক দিয়ে তিন দলে বিভক্ত করা হবে। অগ্রবর্তী দল, দক্ষিন পার্শ্বে অবস্থিত দল এবং বাম পার্শ্বে অবস্থিত দল।

বিচার দিনে আল্লাহর মহিমান্বিত দরবারের চিত্র সম্ভবত এমন হবে যে, তাঁর সম্মুখে থাকবে অগ্রবর্তী দল। দক্ষিন পার্শ্বে একদল এবং বামপার্শ্বে আর একদল। শেষোক্ত দলটি বড়ই হতভাগ্য দল।

সুরায়ে ওয়াকেয়ায় এসবের বর্ণনা নিম্নরূপ দেয়া হয়েছেঃ

(আরবী ****************************************)

“সেদিন তোমরা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হবে। দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থিত একটি দল। এ দলটির কথা কি বলব? বামপার্শ্বে অবস্থিত আর একদল। এ দলটির (দুর্ভাগ্যের কথা) কথা কি বলা যায়? আর একটি দল হলো অগ্রবর্তী দল। এটি হলো আল্লাহর নিয়ামত পূর্ণ বেহেশত। এ দলে থাকবে প্রাথমিক যুগের অনেক আর পরবর্তী যুগের অল্প সংখ্যক। তাঁরা বালিশে ঠেস দিয়ে পরস্পর মুখোমুখী বসবে কিংখাপথচিত সিংহাসনে। তাদের আশে পাশে চিরকিশোরের দল ঘুরে ফিরে আনন্দ পরিবেশন করবে। তাদের হাতে থাকবে পানির সোরাহী, পানপাত্র ও ঝর্ণা থেকে আনা পরিশুদ্ধ সূরাভরা পেয়ালা। এ সূরা পান করে না মস্তক ঘূর্ণন শুরু হবে, আর না জ্ঞান লোপ পাবে। এবং চিরকিশোরেরা তাদের সামনে পরিবেশন করবে বিভিন্ন উপাদেয় ফলমূল, যেন তাঁর মধ্যে যা খুশী তা তাঁরা গ্রহণ করতে পারে। উপরন্তূ তাদের কাছে পরিবেশন করা হবে বিভিন্ন পাখীর সুস্বাদু গোশত। খুশী মতো তারা তা খাবে। তাদের জন্যে নির্ধারিত থাকবে সুলোচনা অপরূপ অপসরী! তাদের সৌন্দর্য হবে সযত্নে রক্ষিত মনিমুক্তার ন্যায়। পুণ্যফল হিসেবে এসব কিছু তারা লাভ করবে সে সব সৎকাজের বিনিময়ে যা তাঁরা দুনিয়ায় করেছে। সেখানে তারা শুনতে পাবে না কোন বেহুদা বাজে গালগল্প। অথবা কোন পাপচর্চা অসদালাপ। তাদের কথাবার্তা আলাপ-আলোচনা হবে শালীনতাপূর্ণ। থাকবে না তাঁর মধ্যে কোন প্রগলভতা (Insane talks)। তাদেরকে শুধু এই বলে সম্বোধন করা হবে। “ আপনাদের প্রতি সালাম সালাম।”-(সূরা ওয়াকেয়াঃ ৭-২৬)

অগ্রবর্তী দল
উপরে যে অগ্রবর্তী দলের কথা বলা হলো, সে দলের মধ্যে থাকবেন তাঁরা যারা সততায়, পুন্যার্জনের এবং সৎপথে চলার ব্যাপারে রয়েছে সকলের পুরোভাগে। খোদা ও রসূলের (স) আহ্বানে যারা সাড়া দিয়েছে সকলের আগে। জিহাদের হোক, অথবা আল্লাহর পথে অকাতরে অর্থদানের ব্যাপারে হোক, মানবতার সেবায় হোক অথবা দাওয়াত ও তবলিগের কাজে হোক-মোটকথা দুনিয়াতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের উৎখাতের জন্যে শ্রম ও ত্যাগ স্বীকারের যে কোন সুযোগই আসুক, এ কাজে যাঁরা থাকেন সামনের কাতারে, তাঁরাই অগ্রবর্তীদলের শামিল। এ জন্যে পরকালে শেষ বিচারের দিনে এ দলতিকে রাখা হবে সকলের সামনে। অন্যান্য ধর্মভীরু ও নেক লোকদের স্থান হবে ডানপার্শ্বে। আর হতভাগ্য পাপাত্নাগণ থাকবে বামপার্শ্বে।

হযরত আয়েশা (রা) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে যে, একবার নবী করিম (সা) লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি জান কারা কিয়ামতের মাঠে সর্বপ্রথম আল্লাহর (কুদরতের) ছায়ায় স্থান গ্রহণ করবে?”

লোকেরা বললেন, “একথা আল্লাহ ও তাঁর রসূলই ভালো জানেন।”

নবী বললেন, “তাঁরা ঐসব লোক যাদের অবস্থা এই যে, তাদের কাছে সত্যের দাবী করলে তারা তা গ্রহণ করে। তারা অন্যের বেলায় সেরূপ সিদ্ধান্তই করে যা তারা নিজেদের বেলায় করে থাকে।”

উপরে চির কিশোরদের কথা বলা হয়েছে। তারা অনন্তকাল পর্যন্ত এমনি কিশোরই থাকবে। তারা কখনো যৌবনলাভ করবে না অথবা বৃদ্ধ হবে না।

হযরত আলী (রা) এবং হযরত হাসান বসরী (রা) বলেছেন যে, এরা সে সব বালক যারা সাবালক হবার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছে। এদের কোনই পাপপুণ্য ছিল না যার জন্যে তাদের কোন শাস্তি অথবা পুরস্কার হতে পারে।

প্রকাশ থাকে যে, উপরোক্ত কিশোরেরা এমন সব লোকের সন্তান হবে যাদের ভাগ্যে বেহেশত হয়নি। বেহেশতবাসীদের সন্তানদের সম্পর্কে আল্লাহর ঘোষণা রয়েছে যে, তাদের সন্তানদেরকে তাদের সংগে বেহেশতে মিলিত করে দেয়া হবে। শুধু তাদের নিষ্পাপ শিশু সন্তানকেই নয়, বরঞ্চ বয়স্কদের মধ্যে যারা তাদের নেক আমলের দ্বারা বেহেশত লাভ করবে, তাদেরকেও পিতা-মাতার সংগে একত্রে বসবাসের সুযোগ দেয়া হবে।–(সূরা তূরঃ ২১ দ্রষ্টব্য)

দক্ষিণ পার্শস্থ দল
তারপর দ্বিতীয় শ্রেনীর ভাগ্যবান বেহেশতবাসীদের প্রসংগে আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী **************************************************************)

“এরা লাভ করবে দূর-দুরান্তে বিস্তৃত ছায়াযুক্ত কণ্টকহীন কুল ও ফলবাগান আর সদা প্রবাহিত পানির ঝর্ণা ও অফুরন্ত ফলমূল। এসব ফলমূল সকল মৌসুমেই পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাবে এবং তা লাভ করতে ও তার স্বাদ গ্রহণ করতে থাকবে না কোন বাধা বিপত্তি। তারা হবে উচ্চ আসনে সমাসীন। তাদের স্ত্রীদেরকে আমরা নতুন করে পয়দা করব। তাদেরকে কুমারী বানিয়ে দেব। স্বামীর প্রতি অভিশয় প্রেমানুরাগিনী এবং বয়সে সমান। এসব কিছু দক্ষিণ পার্শ্বস্থ লোকদের জন্যে।”-(সূরা ওয়াকে’আঃ ২৮-৩৮)

বর্ণিত কুমারীগন ঐসব নারীই হবেন যাঁরা তাদের ঈমানদারী ও সৎজীবন যাপনের ফলে বেহেশত লাভ করবেন। আর সেখানে তাঁরা লাভ করবেন নবযৌবন দুনিয়ায় বৃদ্ধা হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও। দুনিয়ায় তাঁরা সুন্দরী থাকুন, আর নাই থাকুন, বেহেশতে তাঁদেরকে বানিয়ে দেয়া হবে অপরূপ সুন্দরী। তাঁরা একাধিক সন্তানের মা হয়ে মরলেও বেহেশতে তাঁরা হবেন চির কুমারী। স্বামী সহবাসের পরও তাঁদের কুমারীত্ব ঘুচবে না কখনো।

এসব ভাগ্যবতী রমনীদের স্বামীগনও যদি বেহেশতবাসী হন, তাহলে তো কথাই নেই। এরা হবেন তাঁদেরই চিরসংগীনী। অন্যথায় তাঁদের নতুনভাবে বিয়ে হবে অন্য বেহেশতবাসীর সংগে।

শামায়েলে তিরমিযিতে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। একদা এক বৃদ্ধা নবী মুস্তফা (সা) কাছে আরজ করলো, হে আল্লাহর রসূল। আপনি দোয়া করুন যেন আমি বেহেশতে যেতে পারি।

নবী একটু রসিকতা করে বললেন, “কোন বৃদ্ধা বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।”

একথা শুনে বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে চলে গেল।

নবী লোকদেরকে বললেন, “তোমরা তাকে বলে দাও যে, বৃদ্ধাবস্থায় সে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। আল্লাহ বলেছেন তিনি প্রত্যেক বেহেশতবাসীনীকে কুমারী করে পয়দা করবেন।”

তাবারানীতে হযরত উম্মে সালমার (রা) এক দীর্ঘ বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে। কুরআনে বর্ণিত উপরোক্ত নারীদের সম্পর্কে নবীকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা করে বলেন যে, এরা সে সব নারী যারা দুনিয়াতে মৃত্যুবরণ করেছিল। আর তাঁরা ছিল বৃদ্ধা। তাঁদের চক্ষুদ্বয় ছিল কোঠরাগত। কেশরাজি ছিল পক্ক ও শ্বেত বর্ণের। তাদের এহেন বার্ধক্যের পর আল্লাহ তাদেরকে কুমারী করে পয়দা করবেন।

হযরত উম্মে সালমা (রা) জিজ্ঞেস করেন “পৃথিবীতে কোন নারীর যদি একাধিক স্বামী থাকে, তাহলে বেহেশতে সে কোন স্বামীর সংগ লাভ করবে?”

নবী বলেন, “তাকে পূর্ব স্বামীদের মধ্যে একজনকে নির্বাচন করার অধিকার দেয়া হবে। সে ঐ স্বামীকেই নির্বাচন করবে, যার স্বভাব-চরিত্র ও আচরণ ছিল সর্বাপেক্ষা উত্তম। সে আল্লাহর কাছে এভাবে আরজ করবে, হে আল্লাহ, যেহেতু অমুকের ব্যবহার ও আচার-আচরণ আমার প্রতি অন্যান্যদের চেয়ে অনেক ভাল ছিল, তাই আমাকে তারই সংগিনী হবার অধিকার দাও।”

অতপর নবী (সা) বললেন, “উম্মে সালমা, উত্তম চরিত্র ও আচার ব্যবহার এবাবে লুটে নেবে দুনিয়া ও আখেরাতের মংগল।”

বলা বাহুল্য বেহেশতবাসী পুরুষগনও নব যৌবন লাভ করবেন।

তাদের সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত আছে যে, তাঁদের বয়স হবে তিরিশের কাছাকাছি। দাড়ি ওঠেনি এমন বয়সের একেবারে নব্য যুবকের মতো। গৌরবর্ণের সুন্দর সুঠাম চেহারা হবে তাদের।

বাম পার্শ্বস্থিত দল
তারপর হতভাগ্য বাম পার্শ্বস্থিত দল জাহান্নামবাসীদের বিষয়ে বলা হয়েছেঃ

(আরবী *****************************************************)

“এরা অবস্থান করবে উত্তপ্ত বায়ু ও ফুটন্ত পানির মধ্যে। তাদেরকে আচ্ছাদিত করে রাখবে উত্তপ্ত কৃষ্ণবর্ণ ধুম্ররাশি-যা কখনো শীতল ও আরামদায়ক হবে না। এরা ঐসব লোক যারা দুনিয়ার জীবনে ছিল সুখী ও সচ্ছল। তাদের সুখী ও সচ্ছল জীবন তাদেরকে লিপ্ত করেছিল পাপ কাজে। সেসব পাপ কাজ তারা করতো জিদ হঠকারিতা করে। তারা বলতো, “মৃত্যুর পর তো আমরা কংকালে” পরিনত হবো। মিশে যাবো মাটির সাথে। তারপর আবার কি করে আমরা জীবিত হবো? আমাদের বাপ দাদাকেও কি এভাবে জীবিত করা হবে? আল্লাহ বলেন, “হে নবী! তাদেরকে বলে দাও, পরবর্তী এবং পূর্ববর্তী সকলকেই একদিন উপস্থিত করা হবে। তার জন্যে সময় কালও নির্ধারিত আছে। অতপর আল্লাহ বলেন, হে পথভ্রষ্ট মিথ্যাবাদীর দল, তাম্রা জাহান্নামে ‘যকুম’ বৃক্ষ খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করবে। তার দ্বারাই তোমরা উদর পূর্ণ করবে। তারপর তৃষ্ণার্ত উটের মতো তারা পেট ভরে পান করবে উত্তপ্ত ফুটন্ত পানি।”-(সূরা ওয়াকেয়াঃ ৪২-৫৫)

‘যকুম’ হলো এক প্রকার অতীব কণ্টকযুক্ত বিস্বাদ ফল বিশেষ।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি