অনুবাদকের কথা
সাহাবায়ে কিরামের(রাঃ) যুগ থেকেই ইসলামে ইজতিহাদী বিষয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়ে আসছে। ইজতিহাদী মতপার্থক্য কখনো মুজতাহিদগণের খামখেয়ালির কারণে সৃষ্টি হয়নি। বরঞ্চ ইজতিহাদ এবং মতপার্থক্যের মূল ভিত্তি ছিলো সুন্নাতে রাসুল(সঃ) এবং সাহাবায়ে কিরামের আছার। সাহাবায়ে কিরাম(রাঃ), তাবেয়ী এবং ইমাম মুজতাহিদগণের কালে মতপার্থক্য ইসলামের জন্য ক্ষতিকর কিছু ছিলোনা। বরঞ্চ তখন তা ছিলো রহমত ও কল্যাণময়। কিন্তু পরবর্তীতে কিছু লোক মতপার্থক্যকে বড় করে দেখতে থাকে। এটাকে বিদ্বেষ, গোঁড়ামী ও বিবাদ বিসম্বাদের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত করে। ফলে মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন দল উপদলের। অজ্ঞতাবশত এদের এক দল নিজেদের মতকেই সঠিক আর ভিন্ন মতকে বেঠিক বলে আখ্যায়িত করতে শুরু করে। ফলে সত্য সন্ধানী লোকেরা পড়েন বিপাকে। সাধারণ মানুষ হয় বিভ্রান্ত।

এ ধরণের মতপার্থক্য ও মতবিরোধপুর্ণ বিষয়ে কোন্‌ মত গ্রহনীয় আর কোন্‌ মত বর্জনীয়, একজন সত্যসন্ধানী কিভাবে উবয় মতের মধ্যে সমতা বিধান এবং তা অবলম্বনের জন্যে সঠিক পন্থাটাই বা কি সে সম্পর্কে মশহুও মুজতাহিদ ও মুজাদ্দিদ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহ্লাবী তার ‘আল ইনসাফ ফী বায়ানী আসবাবিল ইখতিলাফ’ গ্রন্থে অত্যন্ত সুন্দরভাবে যুক্তিসিধ পর্যালোচনা ও সমাধান পেশ করেছেন।

গ্রন্থটি মুসলমানদের বিভিন্ন মসলকের মধ্যকার বিদ্বেষ, গোঁড়ামী, মতবিরোধ, বিবাদ বসম্বাদ ও রেষারেষী দূর করে তাদেরকে সীসাঢালা প্রাচীরের মধ্যে গ্রথিত ইটসমূহের ন্যায় মজবুতভাবে ঐক্যবদ্ধ উম্মাতে পরিণত করতে দারূণভাবে সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি। সেই মহান উদ্দ্যেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে অনেকদিন থেকেই গ্রন্থখানা অনুবাদ করার আশা পোষণ করে আসছিলাম। এ কাজের গুরুত্বের কথা আরো অনেকেই চিন্তা করেছেন, বলেছেন। অবশেষে করুণাময় আল্লাহ ত’আলার উপর ভরসা করে এ গুরুত্বপুর্ণ কাজে হাত দিই। ‘মতবিরোধপুর্ণ বিষয়ে সঠিকপন্থা অবলম্বনের উপায়’ শিরোনামে সেই মুল্যবান গ্রন্থটিরই বঙ্গানুবাদ পাঠকগণের হাতে তুলে দিতে পেরে আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করছি।

গ্রন্থটি আরবী ভাষায় লিখিত। খ্যাতনামা আরব আলিম আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ সম্পাদিত এবং বৈরুতের ‘দারুন নাফায়েস’ কর্তৃক প্রকাশিত ১৯৮৪ ঈসায়ীতে মুদ্রিত গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করন আমার হস্তগত হয়। অপরদিকে ভারতে গ্রন্থটির উর্দূ অনুবাদ করেছেন খ্যাতনামা আলিম মাওলানা সদরুদ্দীন ইসলাহী। তিনি গ্রন্থটিকে ‘ইখতিলাফে মাসায়েল মে ই’তেদাল কী রাহ’ নাম দিয়েছেন এবং সুসম্পাদিত করেছেন। বিভিন্ন অধ্যায় এবং অনুচ্ছেদে বিভক্ত ক্রেছেন। সেগুলোতে চমৎকারভাবে শিরোনাম ও উপশিরোনাম বসিয়ে সহজবোধ্য করেছেন।

অনুবাদকালে আমি দ’টি গ্রন্থকেই সামনে রেখেছি। টিকা টিপ্পনীর ক্ষেত্রে সহযোগীতা গ্রহণ করেছি। বিশেষ করে মাওলানা ইসলাহী প্রদত্ব শিরোনাম ও উপশিরোনামসমূহ হূবহূ গ্রহন করেছি।

অনুবাদ চলাকালে গ্রন্থটি মাসিক পৃথিবীতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এ সহযোগিতার জন্য আমি বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টারের পরিচালক পত্রিকাটির নির্বাহি সম্পাদক অধ্যাপক এ,কে,এম নাজির আহমদ এর নিকট আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।

আল্লাহ তা’আলা এ গ্রন্থটির মাধ্যমে বাংলা ভাষাভাষী উলামায়ে কিরাম ও অন্যান্য শিক্ষিত সমাজকে ইজতিহাদী ও মাযহাবী মতপার্থক্যের ক্ষেতে সঠিক মতামত ও দৃষ্টিভংগি প্রতিষ্ঠার তৌফিক দিন এবং গ্রন্থকার ও অনুবাদককে আদালতে আখিরাতে জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমীন।

আবদুস শহীদ নাসিম

সেপ্টেম্বর, ১৯৯১

গ্রন্থকারের ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। সালাত পেশ করছি রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর প্রতি। এক সময় আল্লাহতায়ালা আমার অন্তরে সত্য ও ন্যায়ের জ্ঞান প্রতিভাত করে দেন। ফলে উম্মাতের মুহহামদীয়ার মধ্যে বিরাজিত মতপার্থক্য ও মতবিরোধসমূহের কারণ এবং আল্লাহ ও রাসূলের নিকট কোনটি সত্য-সঠিক তা আমি উপলব্ধি করতে পারি। এসব বিষয়ের এমন সহজ সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং সমাধান পেশ করার যোগ্যতা ও আল্লাহতায়ালা আমাকে দান করেচন, যে ব্যাখ্যা ও সমাধান পেশ করার পর আর কোন সংশয় ও জটিলতা বাকি থাকবে না।

অতপর লোকেরা আমাকে জিজ্ঞেস করে, সাহাবায়ে কিরাম (রা) এবং ইসলামী মিল্লাতের পরবর্তী মনীষীগনের মধ্যে মতপার্থক্যের, বিশেষ করে ফিকহী বিধি বিধানের ক্ষেত্রে মতপার্থক্যের কারণ কি ছিলো? আমি পরিবেশ ও প্রশ্নকর্তার জ্ঞানবুদ্দি এবং ধারণ ক্ষমতার আলোকে সেইসব সত্যের একাংশ তাদের নিকট বর্ণনা করি, যা আল্লাহতায়ালা আমার অন্তরে প্রতিভাত করে দিয়েছিলেন। এসব বিবরণ একটি পুস্তিকার রূপ লাভ করে। আমি পুস্তিকাটির নাম রাখলামঃ ‘আল ইনসাফ ফী বয়ানি আসবাবিল ইখতিলাফ’।

১. মতবিরোধমুক্ত সোনালী যুগঃ রাসুলুল্লাহর (সা) যুগ
আমাদের একালের মতো নবী করীমের (সা) যুগে ফিকহী মাসআলা মাসায়েল নিয়ে গবেষণা করা হতোনা। তার সময় ‘ফিকাহ’ নামে আলাদা কোনো বিষয়েরও অস্তিত্ব ছিলনা। জ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে পৃথক একটি বিভাগ হিসেবে ‘ফিকাহ’ নামে কোনো বিষয়ের সংকলন সম্পাদনাও হয়নি। বর্তমানে আমাদের আমাদের ফকীহরা (ইসলামী আইন বিশারদরা) যেভাবে দলিল-আদিল্লা ও যুক্তিপ্রমাণসহ পৃথক পৃথকভাবে প্রতিটি বিষয়ের গুরুত্ব, মর্যাদা, বিধি-বিধান, শর্ত-শারায়েত ও প্রয়োগরীতি বর্ণনা করেন, সে সময় বিধি বিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো পদ্ধতি চালু ছিল না। এখন যেমন কোনো একটি সমস্যা (মাসআলা) কল্পনা করে নিয়ে তার উপর গবেষণা চালানো হয়; যেসব জিনিসের সংজ্ঞা প্রদান করা যেতে পারে, সেগুলোর যুক্তি ভিত্তিক সংজ্ঞা প্রদান করা হয়; যেসব জিনিসের সীমা ও পরিধি নির্ণয় করা যেতে পারে সেগুলোর সীমা-পরিধি স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়—এরূপ কোনো পদ্ধতি তখন ছিলনা।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরীকা ছিলো এর চাইতে ভিন্নতর। তার তরীকা এরূপ, যেমন তিনি অযু করতেন। সাহাবায়ে কিরাম প্রত্যক্ষ করতেন, তিনি কি নিয়মে অযু করছেন। তার অযু দেখে দেখে তার তরিকায় অযু করতেন। এটি অযুর রুকন, এই অংশ অযুর নফল কিংবা এটা অযুর আদব—এভাবে বিশ্লেষণ করে করে তিনি বলতেন না। একইভাবে তিনি নামায পড়তেন। সাহাবায়ে কিরাম তার নামায পড়া দেখতেন। তার নামায পড়া দেখে দেখে তার তরীকা অনুযায়ী নামায আদায় করতেন। তিনি হজ্জ পালন করেন। লোকেরা তার হজ্জের পদ্ধতি অবলোকন করে এবং সেই অনুযায়ী নিজেরা হজ্জ পালন শুরু করে। সাধারণত এটাই ছিলো নবী করীম (সা) এর শিক্ষাদান পদ্ধতি। তিনি কখনও ব্যাখ্যা করে বলেননি যে অযুত চার ফরয, কিংবা ছয় ফরয। অযু করার সময় কখনও কোনো ব্যাক্তি যদি অযুর অংগ সমূহ পরপর ধৌত না করে তবে তার অযু হবে কি হবেনা—এমন কোনো ঘটনা আগে থেকে ধরে নিয়ে সে বিষয়ে আগাম কোনো বিধান জারি করা উচিৎ বলে তিনি কখনও মনে করতেন না। এরূপ ধরে নেয়া এবং অসংগঠিত অবস্থার বিধাবনের ক্ষেত্রে তিনি কদাচিতই কিছু বলেছেন।

অপরদিকে সাহাবায়ে কিরামের (রা) অবস্থাও এই ছিলো, এই ধরনের ব্যাপারে তারা নবী করীমকে (সা) খুব কমই প্রশ্ন করতেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথীগণের চাইতে উত্তম কোনো মানব দল কখনও দেখিনি। রাসুলে খোদার গোটা জিন্দেগীতে তারা তাকে মাত্র তেরটি প্রশ্ন করেছেন। এর সবগুলোই কুরআনে উল্ল্যেখ হয়েছে।

যেমনঃ ‘(আরবীيسئلونك عن الشهر الحرام قتال فيه :)

(ইয়াসআলুনাকা আনিশ শাহরিল হারামি কিতালুন ফীহি)’—‘হে নবী এরা তোমাকে হারাম মাসগুলোতে যুদ্ধ সংক্রান্ত বিধান জিজ্ঞেস করছে’। অথবা

‘(আরবী: يسئلونك عن المحيض)

(ইয়াসালুনাকা আনিল মাহীদ)’—হে নবী তারা তোমার নিকট হায়েয সংক্রান্ত বিষয় জানতে চাচ্ছে’—প্রভৃতি।”

অতপর হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেনঃ “সাহাবীগণ কেবল সেইসব প্রশ্নই করতেন, যা ছিলো তাদের জন্য উপকারী।”

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) বলেনঃ “তোমরা এমন কোন বিষয়ে প্রশ্ন করোনা, যা বাস্তবে সংঘটিত হয় নি। কারণ, আমি উমর ইবনুল খাত্তাবকে (রা) এ ধরনের প্রশ্নকর্তাদের অভিসম্পাত করতে দেখেছি।”

কাসেম (রা) লোকদের সম্বোধন করে বলেনঃ “তোমরা এমনসব বিষয়ে প্রশ্ন করছো, যেসব বিষয়ে প্রশ্ন করার জন্যে আমরা কখনো মুখ খুলিনি। তাছাড়া তোমরা এমনসব বিষয়েও খুটে খুটে প্রশ্ন করছো যা আমার জানা নেই। সেগুলো যদি আমার জানা থাকতো, তবে তা নবী করীমের (সা) ফরমান অনুযায়ী বলে দিতাম।”১

[১. নবী করীম (সা) বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন ঐ আলিমের মুখে আগুনের লাগাম পরানো হবে, যে কোন জ্ঞান রাখ সত্বেও প্রশ্নকর্তাকে তা বলেনি। -অনুবাদক]

উমার ইবনে ইসহাক (রহ) বলেছেনঃ “রাসূলে খোদার (সা) অর্ধেকের বেশী সাহাবীর (রা) সংগে সাক্ষাতের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমি তাদের চাইতে অধিক জটিলতামুক্ত এবং কঠোরতা বর্জনকারী মানব সাক্ষাত পাইনি।”

উবাদা ইবনে বসরকান্দী (রা) থেকে এই ফতোয়া চাওয়া হয়েছিলোঃ “কোনো নারী যদি এমন কোনো স্থানে মৃত্যুবরণ করে, যেখানে তার কোনো ওলী পাওয়া যাবেনা, সে অবস্থায় তাকে গোসল দেয়ানো হবে কিভাবে?” জবাবে তিনি বলেছিলেনঃ “আমি এমন লোকদের সাক্ষাত লাভ করেছি,২

[২. অর্থাৎ সাহাবায়ে কিরাম (রা)–অনুবাদক]

যারা তোমাদের মতো কঠোরতা এবং জটিলতা অবলম্বন করতেন না। তারা তোমাদের মতো (ধরে নেয়া বিষয়ে) প্রশ্ন করতেন না।”৩

[৩. এই বাণী (আছার) গুলো সবই ইমাম দারমীর গ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। –গ্রন্থকার ]

২. মতবিরোধের ইতিহাসের সূচনাযুগঃ
সাহাবায়ে কিরামের (রা) যুগঃ

শায়খাইনদের কর্মনীতিঃ

রাসূলুল্লাহ (সা) সাধারণত সাহাবীগণের সাধারণ সভাতেই দ্বীনি কথাবার্তা বলতেন এবং শিক্ষা প্রদান করতেন। সে কারণেই দেখা যায়, শায়খাইন [হযরত আবু বকর (রা) ও হযরত উমার (রা)] তাদের খিলাফতামলে কোন বিষয়ের শরয়ী বিধান জানা না থাকলে তা অন্যান্য সাহাবীদের নিকট থেকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতেন। তারা জিজ্ঞেস করতেন, তোমরা এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) কোনো বক্তব্য শুনেছ?

আবু বকরের সম্মুখের যখন দাদীর ওয়ারিশী পাওনা সংক্রান্ত মাসয়ালা উপস্থাপিত হলো, তখন তিনি বললেন, “দাদীর অংশ পাওয়া সম্পর্কে আমি রাসূলুল্লাহর (সা) কোনো বাণী শুনিনি। তাই এ বিষয়ে আমি অন্যদের কাছে জিজ্ঞেস করে নেবো।” অতঃপর যোহরের নামাযের পর তিনি সমবেত লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কেউ দাদীর ওয়ারিশী পাওয়া সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সা) থেকে কোনো বক্তব্য শুনেছ কি?”

মুগীর ইবনে শু’বা (রা) বললেনঃ ‘হ্যাঁ, আমি শুনেছি।’ তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘কি শুনেছ’ মুগীরা (রা) বললেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সা) দাদীকে মাইয়্যেতের রেখে যাওয়া সম্পদের এক ষষ্ঠাংশ প্রদান করেছেন।” তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “বিষয়টি তুমি ব্যাতিত আর কারো জানা আছে কি?” মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম (রা) বললেনঃ “মুগীরা যথার্থ বলেছেন।”

তাদের বক্তব্য শুনার পর আবু বকর (রা) আবেদনকারী মহিলাকে তার মৃত নাতির রেখে যাওয়া সম্পদের এক ষষ্ঠাংশ দিয়ে দেন। এরূপ দুয়েকটি নয়, অসংখ্য ঘটনা হাদীসের গ্রন্থাবলীতে উল্ল্যেখ আছে। যেমনঃ হযরত উমারের নিকট গর্ভস্থ সন্তানের দিয়্যতের (রক্তমূল্য) বিষয়টি উত্থাপিত হলে এ বিষয়ে তার কোনো বিধান জানা না থাকায় তিনি এ প্রসংগে সাহাবায়ে কিরামের নিকট প্রশ্ন করেন। জবাবে মুগীরা ইবনে শু’বা (রা) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) এর রক্তমূল্য নির্ধারণ করেছেন ‘গুররাহ’।৪

[৪. ‘গুররা’ একজন দাস মুক্ত করা কিগবা মৃতের ওলীকে পঞ্চাশ দিনার বা পাঁচশ দিরহাম প্রদাব করা।–অনুবাদক]

তার নিকট এ বিষয়ে নবী করীমের (সা) হাদীস শুনার পর হযরত উমার (রা) সে মুতাবিক ফায়সালা প্রদান করেন। মহামারী আক্রান্ত অঞ্চলের উপর দিয়ে সফর করা যাবে কিনা এ বিষয়ে হযরত উমার (রা) আবদুর রহমান আউফের (রা) বর্ণিত হাদীসের উপর আমল করেন।৫

[৫. ঘটনাটি হলোঃ সিরিয়া অভিযানের সময় হযরত উমার (রা) মুসলিম বাহিনী নিয়ে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে কোনো এক স্থানে গিয়ে জানতে পারেন সম্মুখের অঞ্চলগুলো ব্যাপক মহামারীতে (প্লেগ) আক্রান্ত। যাত্রা অব্যাহত রাখা না রাখার ব্যাপারে তিনি উপস্থিত লোকদের পরামর্শ চাইলেন। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ এসে বললেন, নবী করিম (সা) মহামারী আক্রান্ত অঞ্চলে যেতে নিষেধ করেছেন। এ হাদীস শুনে তিনি বাহিনীকে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন। –অনুবাদক]

মাজুসীদের (যরোষ্ট্রীয় ধর্মাবলম্বী) ব্যাপারেও তিনি হযরত আবদুর রাহমান ইবনে আউফ (রা) এর বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী ফায়সালা করেন।৬

[৬. হযরত উমার (রা) তার খিলাফত আমলে মাজুসীদের থেকে জিযিয়া আদায় করছিলেন না। অতপর আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা) বললেনঃ নবী করীম (স) হিজরের মাজুসীদের নিকট থেকে জিযিয়া আদায় করতেন। এ হাদীস শুনার পর তিনি তাদের উপর জিযিয়া ধার্য করে দিলেন।–অনুবাদক]

আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা) মা’কাল ইবনে ইয়াসার (রা) বর্ণিত হাদীস স্বীয় রায়ের সম্পুর্ণ সমার্থক পেয়ে সীমাহীন খুশী হন।৭

[৭. এ রায় ছিলো এমন একজনের ব্যাপারে যার স্বামী এমন অবস্থায় মারা গিয়েছেন যে, এখনো তিনি স্ত্রী্র সান্নিধ্যে আসেননি এবং তার মোহরও ধার্য করেননি।–অনুবাদক]

হযরত আবু মুসা আশয়ারী কোনো প্রয়োজনে উমার ফারুকের কাছে আসেন।দরজায় তিনবার আওয়াজ দেবার পরও কোনো জবাব না পেয়ে তিনি প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। অতঃপর উমার (রা) দরজা খুলে দূর থেকে তাকে ডেকে আনেন এবং ফিরে যাবার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। তিনি বললেন, নবী করীম (সা) বলেছেনঃ “তিনবার আওয়াজ দেওয়ার পরও অনুমতি পাওয়া না গেলে দরজা থেকে ফিরে যাবে।” উমার (রা) বললেনঃ তোমার বর্ণনার সপক্ষে আরেকজন সাক্ষী লাগবে। অতঃপর আবু সায়ীদ খুদরী (রা) আবু মুসার (রা) বর্ণিত হাদীসের সত্যতা স্বীকার করলে হযরত উমার (রা) তা গ্রহণ করেন।

 

মতপার্থক্যের ভিত্তি, সূচনা ও কারণ

মোটকথা, নবী করীম (সা) সাধারণত মাসায়েল এবং আহকামে শরীয়াহ সাহবায়ে কিরামের আ’ম ইজতেমায় ইরশাদ করতেন। একেকজন সাহাবী নবী করীম (সা) কে যে তরীকায় ইবাদাত করতে দেখেছেন এবং তার থেকে যেভাবে ফতোয়া ও ফায়সালা শুনেছেন, তিনি তা আয়ত্ত করে নেন এবং সেভাবে আমল করতে থাকেন। অতঃপর তিনি নবী করীম (সা) এর এসব বক্তব্য ও আমলকে অবলম্বন করে পরিবেশ পরিস্থিতি ও অবস্থার বিচারে সেগুলোর উদ্দ্যেশ্য ও গুরুত্ব নির্ণয় করতেন। এ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই কাজ করত ঐকান্তিক নিষ্ঠা। এভাবে তারা কোনো হুকুমকে নির্ণয় করেন ‘মুবাহ’। কোনটিকে ‘মুস্তাহাব’ ও কোনটিকে ‘মানসূখ’। এ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে দার্শনিক দলিল প্রমাণ নয়, বরঞ্চ তাদের মনের প্রশান্তি ও প্রসন্নতাই ভূমিকা পালন করে। যেমন, তোমরা সরল সোজা গ্রাম্য লোকদের অবস্থা দেখতে পাচ্ছ। তারা অতি সহজেই পরস্পরের কথা বুঝে ফেলে। তারা একজন অপরজনের কথার মধ্যকার ইশারা-ইংগিত, উপমা উদাহরণ এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দ্বারা তার বক্তব্য বিষয়কে নির্দ্বিধায় বুঝে নিতে পারে।

রাসূলে খোদার (সা) যুগ পর্যন্ত এভাবেই লোকেরা আমল করতো। অতঃপর সাহাবায়ে কিরামের (রা) বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। তারা যে যেখানে গেছেন, তিনিই সেখানকার জনগণের নেতৃত্ব লাভ করেন। এ সময় জীবনের বিভিন্ন বিভাগে নতুন নতুন ঘটনা তাদের সামনে আসতে থাকে। এসব বিষয়ে লোকেরা তাদের কাছে ফতোয়া ও ফায়সালা চান। প্রত্যেক সাহাবী তার নিকট রক্ষিত প্রমাণিত জ্ঞান (কুরআন-সুন্নাহ) দ্বারা কিংবা প্রমাণিত জ্ঞানের আলোকে জবাবা প্রদান করতেন। কোনো বিষয়ে যদি এভাবে সমাধান পাওয়া না যেতো তবে তারা সে বিষয়ে ইজতেহাদ করতেন এবং যে কারণ ও উদ্দেশ্যের ভিত্তির উপর রাসূলে খোদা (সা) শরয়ী বিধান প্রদান করেছেন, তা জানার চেষ্টা করতেন। অতঃপর যে কারণ উদ্দেশ্যের সাথে মাসয়ালার সাথে সামঞ্জস্য দেখতে পেতেন, সেখানে তারা অনুরূপ বিধান প্রয়োগ করতেন। এই প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা রাসূলে খোদার বিধান প্রয়োগ নীতি ও উদ্দেশ্যের পূর্ণ অনুবর্তন করতেন।

এ ব্যাপারে তারা পূর্ণ তাকওয়া ও ঈমানদারীর সাথে নিজেদের যোগ্যতাকে কাজে লাগাতেন। এখান থেকেই শুরু হয় তাদের মধ্যে মতপার্থক্যের। আর এর কারণ প্রতিষ্ঠিত ছিলো কয়েকটি মৌলিক ভিত্তির উপরঃ

প্রথম পার্থক্যঃ রাসূলের হাদীস জানা না থাকার পার্থক্য

যেসব কারণের উপর ভিত্তি করে সাহাবায়ে কিরামের মতামতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছিলো, তার পয়লাটি হচ্ছে এই যে, কোনো একটি প্রশ্ন বা সমস্যার সমাধান সম্পর্কে একজনের হয়তো রাসূলুল্লাহর বক্তব্য জানা ছিলো, পক্ষান্তরে অন্য এক সাহাবীর হয়তো সে বিষয়ে নবী করীম (স) এর বক্তব্য জানা ছিলো না যার ফলে সে বিষয়ে তিনি বাধ্য হয়ে ইজতিহাদ করেন। এরূপ ইজতিহাদের কয়েকটি অবস্থা হতো। যেমনঃ

এক. কখনো এরূপ ইজতিহাদ রাসূল (সা) এর অনুরুপ হয়ে যেতো। ইমাম নাসায়ী (রা) প্রমুখ থেকে বর্ণিত একটি হাদীস হচ্ছে এর উদাহরণ। উক্ত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা) নিকট এমন একজন মহিলার প্রসংগে জিজ্ঞাসা করা হয়, যার স্বামী তার মহরানা নির্ধারণ এবং সান্নিধ্য গমনের পূর্বেই মৃত্যু বরণ করেছে? তিনি জবাব দিলেন, এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) কোনো ফায়সালা আমার জানা নেই। কিন্তু এ বিষয়ে যে কোনো একটি ফায়াসালা দেওয়ার জন্য লোকেরা তাকে পীড়াপীড়ি করতে থাকে। তখন তিনি বিষয়টির উপর ইজতিহাদ করে এই ফায়সালা প্রদান করেনঃ মহিলাটিকে এমন পরিমাণ মোহরানা দিতে হবে, যা তার সমমর্যাদার মহিলারা পেয়ে থাকে। এর চাইতে কম ও না এর চাইতে বেশী ও না। তাছাড়া মহিলাটিকে ইদ্দত পূর্ণ করতে হবে এবং সে তার স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে উত্তরাধিকার লাভ করবে। এ ফায়সালা শুনার সাথে সাথে হযরত মা’কাল ইবনে ইয়াসার (রা) দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের কাবিলার জৈনক মহিলার ব্যাপারে ঠিক অনুরূপ ফায়সালা করেছিলেন।” তার সাক্ষ্য শুনে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ এতো খুশি হন, যতটা ইসলাম কবুল করার পর থেকে ঐ সময় পর্যন্ত আর হননি।

দুই. কখনো এমন হতো যে, কোনো একটি মাসয়ালা সম্পর্কে দু’জন সাহাবী পরস্পর আলোচনা করতেন। এ আলোচনার মাধ্যমে রাসূলের (সা) কোনো হাদীস তাদের সামনে এসে যেতো এবং হাদীসটির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে তাদের মধ্যে প্রবল আস্থা জন্ম নিতো। এমতাবস্থায় মুজতাহিদ তার ইজতিহাদ পরিত্যাগ করে হাদীসটি গ্রহণ করতেন। উদাহরণস্বরূপ সেই হাদীসটির কথা উল্লেখ করা যাক, যেটি হাদীসের ইমামগণ হযরত আবু হুরাইরা (রা) সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। তা হলো এই যে, হযরত আবু হুরাইরা (রা) এর ধারণা ছিলোঃ “যার উপর গোসল ফরয হলো (জুনুবী), সে যদি সূর্যোদয়ের পূর্বে গোসল না করে, তাহলে তার রোযা হবে না।” কিন্তু নবী করীমের (সা) পবিত্র স্ত্রীগণের কেউ কেউ যখন নবী করীম (সা) এর এই ধারণার বিপরীত ছিলো বলে বর্ণনা করলেন, তিখিন হযরত আবু জুরাইরা তার ধারণা থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন।

তিন. আবার কখনো এমন হতো যে, ইজতিহাদকারী সাহাবীর নিকট রাসূলুল্লাহর (সা) এর হাদীসটি পৌছেছে বটে, কিন্তু তা বিশ্বাসযোগ্য পন্থায় পৌছায়নি। এমতাবস্থায় মুহতাহিদ বর্ণনাটি পরিত্যাগ করতেন এবং নিজের ইজতেহাদের উপর আমল করতেন। এ উদাহরণ পাওয়া যায় ফাতেমা বিনতে কায়েস (রা) এর একটি হাদীস থেকে যা ছয়টি সহীহ গ্রন্থেই (সিহাহ সিত্তাহ) বর্ণিত হয়েছে। হাদীসটি হলোঃ “ফাতেমা বিনতে কায়েস (রা) হযরত ইমারের (রা) সম্মুখে বললেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) জীবিত থাকতে আমাকে তিন তালাক দেয়া হয়েছিলো কিন্তু তিনি আমাকে ইদ্দতকালীন খোরপোষ দেয়ার নির্দেশ দেননি এবং তালাক দেয়া স্বামীর বাড়িতেও থাকতে দেননি।” হযরত উমার (রা) ফাতিমা (রা) এর এ বক্তব্য গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেনঃ “আমরা একজন নারীর কথায় আল্লাহর কিতাব পরিত্যাগ করতে পারি না।৮

[৮. এখানে কুরআনের কয়েকটি আয়াতাংশকে ইংগিত করা হয়েছে। সূরা তালাকে বলা হয়েছেঃ “আরবীঃولا تخرجهن من بيوتهن (ওয়ালা তুখরিজুহুন্না মিন বুয়ুতিহিন্না) “অর্থাৎ, ইদ্দতকালে তোমরা তাদের বাসগৃহ থেকে বের করে দিও না।” এবং “اسكنهن من حيث سكنتم من وجدكم” (আসকিনহুন্না মিন হাইছু সাকানতুম মিন উজদিকুম) “তাদের ইদ্দতকালে তাদের সেই বাসগৃহে থাকতে দাও তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তোমরা নিজেরা যে বাসগৃহে থাকো।” এ আয়াতগুলো থেকে জানা গেলো যে, ইদ্দতকালে নারীদেরকে ঘর থেকে বের করে দেয়া যাবে না। বরঞ্চ তালাকপ্রাপ্তাকে এ সময়ের জন্যে নিজের ঘরে থাকতে দেয়া স্বামীর দায়ীত্ব। তাছাড়া কুরআনে আরো বলা হয়েছেঃ “انفقوا عليهن” (আনফিকু আলাইহিন্না) “তাদের ব্যায়ভার বহন করো।” এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইদ্দতকালে তালাকপ্রাপ্তার ব্যায়ভার ও বহন করতে হবে। আয়াতাংশগুলো অর্থ প্রকাশের দিক থেকে পরিস্কার, দ্ব্যর্থহীন, ও সাধারণ অর্থবোধক। এখানে নির্দিষ্ট করে কেবল ‘তালাকে রিজয়ী’ (ফেরতযোগ্য তালাক) দেয়া নারীর কথা বলা হয়নি। তাই এ আয়াতগুলোর হুকুম সব ধরনের তালাক দেয়া নারির উপরই প্রযোজ্য হবে। এই সাধারণ হুকুমটির প্রেক্ষিতেই হযরত উমার (রা) ফাতিমা বিনতে কায়েসের (রা) বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তার বর্ণনাটি কুরআনের আয়াতের স্পষ্ট বিরোধী।

হযরত উমার (রা) এর এই কর্মপন্থা থেকে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি লাভ করি। ফাতিমা (রা) ছিলেন একজন সাহাবী। উদুকে হাদীস অনুযায়ী ‘আসসাহবাতু কুল্লুহুম উদূল’ আর ফাতিমা ও সাহাবীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। কিন্তু তা সত্বেও তার বর্ণনা কুরআনের স্পষ্ট অর্থের সাথে সাংঘর্ষিক হউয়ায় তিনি তা গ্রহন করেননি। এতে বুঝা গেলো, হাদীস বিচারে কেবল সনদই বিবেচ্য নয়, বরঞ্চ বক্তব্য বিষয়ও (মতন) খতিয়ে দেখতে হবে। সোনালী সূত্রের মধ্যেও ভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকতে পারে। সুত্রের (সনদ) বিশুদ্ধতা সর্বাবস্থায় হাদীসের বিশুদ্ধতার জন্যে যথেষ্ট নয়। কারণ ফাতিমা বিনতে কায়েসের (রা) বর্ণনার মধ্যে তো সুত্রগত দুর্ববলতার কোনো অবকাশ ছিল না। (সঃ ইসলহী)]

তাছাড়া তার বক্তব্য সঠিক কি ভুল তাও নিশ্চিত বলা যায় না। তিন তালাকপ্রাপ্তা মহিলাকে অবশ্যি খোরপোষ এবং বাসস্থান দিতে হবে।” তাছাড়া “আমাকে রাসূল (সা) খোরপোষ এবং বাসস্থানের ব্যাবস্থা করে দেননি” ফাতিমা বিনতে কায়েসের (রা) একথাশুনতে পেয়ে হযরত আয়িশা (রা) বলে উঠলেনঃ “ফাতিমার কি হলো? সেকি আল্লাহকে ভয় করে না?”

দ্বিতীয় আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি। আ উদাহনরণটি বর্ণনা বুখারী এবং মুসলিমে উল্লেখিত হয়েছেঃ “হযরত উমার (রা) মনে করতেন, জুনুবী (যার উপর গোসল ফরয হয়েছে) যদি গোসলের পানি না-ও পায়, তবু তায়াম্মুম দ্বারা সে পবিত্রতা অর্জন করতে না। ”

অতঃপর হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসার (রা) তাকে নিজের ঘটনা শুনালেন। তিনি বলেন, “একবার রাসূলুল্লাহ (সা) এর সফরসংগী ছিলাম। আমার গোসলের জরুরত হলো। কিন্তু পানি পাওয়া গেল না। তার তায়াম্মুমের উদ্দেশ্যে ধুলায় গড়াগড়ি করে নিলাম। পরে ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সা) কে জানালাম। তিনি বললেন, তোমার এতটুকুই করা যথেষ্ট ছিলো, (একথা বলতে বলতে) তিনি নিজের দু’হাত যমীনের মারলেন এবং সেখান থেকে উঠিয়ে স্বীয় মুখমন্ডল ও হস্তদ্বয় মাসেহ করে দেখালেন।” হযরত উমারের (রা) দৃষ্টিতে আম্মারের এ বর্ণনায় কোনো দুর্বলতা ছিলো। ফলে তিনি তার এই বক্তব্য গ্রহণ করলেন না। তার দৃষ্টিতে বর্ণনাটি প্রামাণ্য দলিল ছিলো না। অবশ্য পরবর্তীতে হাদীসটি মশহুর হয়ে যায় এবং দুর্বল হবার ধারণা চাপা পড়ে যায়। ফলে লোকেরা তার উপর আমল করতে থাকে।

চার. কখনো এমন হতো যে, মুজতাহিদ সাহাবীর নিকট সংশ্লিষ্ট বিষয়ের হাদীসই পৌছেনি। যেমন সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছেঃ আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) মহিলাদেরকে গোসলের সময় মাথার চুল খুলে নিতে হুকুম করতেন। হযরত আয়িশা (রা) ব্যাপারটি হানতে পেরে বিস্মিত হয়ে বললেন, “ইবনে উমারের কি হলো, কেনো তিনি মহিলাদেরকে চুল খোলার নির্দেশ দেন? এমন হলে তো তাদেরকে মাথার চুল কামিয়ে ফেলতে বললেই হয়। অথচ আমি এবং রাসূলুল্লাহ (সা) এক পাত্রে গোসল করতাম। আমি কহুলতাম না শুধুমাত্র মাথায় তিনবার পানি ঢালতাম।”

এ ব্যাপারে দ্বিতীয় উদাহরণটি পাওয়া যায় ইমাম যুহুরী বর্ণিত একটি ঘটনায়। তাহলোঃ “হিন্দ রাদিয়াল্লাহু আনহার একথা জানা ছিলো না যে, কোও নারীর যদি দশদিনের বেশী ঋতুস্রাব হতে থাকে, তাহলে তাকে দশম দিনের পর থেকে নামাজ পড়তে হবে। এ কারণে তিনি সেসময় নামায পড়তেন না। আর নামাজ পড়তে না পারার কারণে তিনি শুধু কান্নাকাটি করতেন।”

দ্বিতীয় কারণঃ রাসূলের কজের ধরণ নির্ণয়ের পার্থক্য

সাহাবায়ে কিরামের (রা) মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হবার দ্বিতীয় কারণটি ছিলো এই যে, তারা নবী করীম (সা) একটি কাজ করতে দেখেছে। (কিন্তু মানবিক চিন্তার প্রকৃতিগত তারতম্যের কারণে কাজটির ধরন ও গুরুত্ব অনুধাবনের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়।)। ফলে কেউ রাসূলের (সা) উক্ত কাজটিকে মনে করেছেন ইবাদাত আর কেউ মনে করেছেন মুবাহ। এ ব্যাপারে দু’টি উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে। প্রথম উদাহরণটি হচ্ছে ‘তাসবীহের’। মানে হজ্ব সফরের উদ্দেশ্যে রাসূল (সা) এর আবতাহ উপত্যকায় অবতরণের ঘটনা। আসহাবে উসূল ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। আবু হুরায়রা (রা) এবং আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) এর দ্ররুষ্টিতে এই অবতরণের কাজটি ইবাদতের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। তারা এটাকে হজ্জের সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত মনে করত। কিন্তু হযরত আয়িশা (রা) এবং আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) এর মতে, তিনি সেখানে ঘটনাক্রমে অবতরন করেছিলেন। সুতরাং সেটা হজ্জের সুন্নাতের অন্তর্ভূক্ত নয়।

এ ব্যাপারে দ্বিতীয় উদাহরনটি হচ্ছে এই যে, “সাধারণ মুসলমানদের মতে, খানায়ে কা’বার তাওয়াফের সময় ‘রমল’ করা সুন্নাত। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) এর মতে রাসূলুল্লাহ (সা) যে রমিল করেছিলেন, তা ছিলো একটি আকস্মিক ঘটনা। তিনি তা করেছিলেন মক্কার মুশরিকদের একটি র্ভৎসনার জবাবে তিনি সাময়িকভাবে এ কাজটি করেছিলেন। তারা বলতঃ ‘মদীনার সুতাররা মুসলমানদেরকে বিচূর্ণ ও ক্লান্ত করে রেখেছে।’ এ র্ভৎসনার জবাব তিনি মুসলমানদের নিতান্তই সাময়িকভাবে “রমল” করার হুকুম দিয়েছেন। এটি হজ্জের স্থায়ী কোনো সুন্নাত নয়।”

তৃতীয় কারণঃ ধারণাগত বিশ্লেষণের পার্থক্য

সাহাবায়ে কিরামের (রা) মধ্যে মতপার্থক্যের সৃষ্টি হবার তৃতীয় কারণটি হলো, রাসুলুল্লাহর (সা) কাজস্মূহের কথা বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁদের ধারণাগত বিশ্লেষণ। যেমন, রাসূলুল্লাহ (সা) হজ্জ সম্পাদন করেছেন আর সাহাবায়ে কিরাম (রা) তা প্রত্যক্ষ করেছেন। পরে তারা লোকদের কাছে রাসূলুল্লাহর (সা) সেই হজ্জের ধরণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, তিনি ‘হজ্জে তামাত্তু’ করেছেন। কেউ বলেছেন, তিনি ‘হজ্জে কিরান’ করেছেন। আবার কারো কারো মতে সেটা ছিলো ‘হজ্জে ইফরাদ’।৯

[৯. ‘তামাত্তু’ সে ধরণের হজ্জকে বলা হয়ম যাতে হজ্জের মাসগুলোতে মক্কা গিয়ে উমরা আদায় রবং মাথা মুনফ করে ইহরাম খুলে ফেলা হয়। অতঃপর জিলহজ মাসের আট তারিখে আবার নতুন করে ইহরাম বেঁধে হজ্জ আদায় করা হয়। ‘কেরান’ সেই হজ্জকে বলা হয়, যাতে উমরা এবং হজ্জ উভয়টার জন্যে একত্রে ইহরাম বাঁধা হয় এবং উভয়টা সমাপ্ত করার পর ইহরাম খোলা হয়। আর উমরা বিহীন হজ্জকে ইফরাদ বলা হয়।–অনুবাদক]

এর দ্বিতীয় উদাহরণটি হচ্ছে আবু দাউদে সংকলিত হযরত সায়ীদ ইবনে যুবায়ের (রা) বর্ণিত একটি হাদীস। তিনি বলেনঃ “আমি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে বললাম, হে আব্বাস! হজ্জের ইহরাম বাঁধার পর রাসূলুল্লাহ (সা) যে তালবিয়া১০

[১০. হজ্জের তালবিয়া হচ্ছে, (لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لاَ شَرِيْكَ لَكَ) “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকালা-শারিকালাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক লা-শারিকালা।”]

পাঠ করেছিলেন, সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবীগণের মধ্যে মতপার্থক্য দেখে আমার কাছে বিস্ময় লাগছে।” আমার বক্তব্য শুনে ইবনে আব্বাস বললেনঃ

“এ বিষয়ে প্রকৃত ঘটনা আমার সবার চাইতে বেশী জানা আছে, আসলে রাসুলুল্লাহ (সা) একটিই মাত্র হজ্জ করেছিলেন, আর এই জন্যেই সে হজ্জের বিস্তারিত বিবরণের ব্যাপারে লোকদের মধ্যে মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনা হছে এই যে, রাসূলুল্লাহ (সা) হজ্জের উদ্দেশুএ মদীনা ত্যাগ করেন। অতঃপর তিনি মসজিদে যুলহুলাইফাইয় দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন। তারপর সেখানেই হজ্জের তালবিয়া পাঠ করেন। সেখানে তার আশে পাশে যারা ছিলেন, তারা তার এই তালবিয়া পাঠ শুনেন এবং মনে রাখেন। অতঃপর তিনি উটে আরোহণ করেন, ইট তাকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলে তিনি পুনরায় তালবিয়া পাঠ করেন। এ সময় আবার অপর কিছু লোক তা শুনতে পায়, ব্যাপার হলো সফর ব্যপদেশে সাহাবীগণের পৃথক পৃথক দল একের পর এক রাসূলুল্লাহর (সা) এর খিদমতে আত্মনিয়োগ করে তার পাশে থাকতেন। সে কারণে উট তাকে নিয়ে যাত্রা শুরু করার সময় তার পাশে যারা ছিলেন, তারা তখনকার তালবিয়া শুনতে পান এবং তারা মনে করে বসেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) কেবল তখনই তালবিয়া পাঠ করেছেন যখন যুলহুলাইফার মসজিদ থেকে উটে করে যাত্রা শুরু করেন। অতঃপর তিনি সম্মুখে অগ্রসর হয়ে বায়দাউপত্যকা অতিক্রমকালে এর উপরে উঠলে পুনরায় তালবিয়া পাঠ করেন। এ সময় আরেকদল লোজ তার তালবিয়া শুনতে পায়। এরা মনে কর বসে রাসূলুল্লাহ (সা) শুধু বায়দা উপত্যকা অতিক্রমকালে তালবিয়া পাঠ করেছেন অথচ, খোদার কসম, জায়নামাজে বসে ও তিনি হজ্জের নিয়ত করেছিলেন। অতঃপর উট তাকে বিয়ে যাত্রা শুরু করার পর ও তালবিয়া পাঠ করেছেন এবং বায়দা অতিক্রমকালেও তালবিয়া পাঠ করেছেন।”

চতুর্থ কারণঃ ভুলে যাবার কারণে মতপার্থক্য

সাহাবায়ে কিরামের (রা) এর মধ্যে মতপার্থক্যের কারন হচ্ছে ভুলচুক (যা মানুষের জন্যে অস্বাভাবিক কিছু নয়।)

এর উদাহরণ হচ্ছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) সম্পর্কিত একটি বর্ণনা। তিনি (ইবনে উমার) বলতেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সা) একটি উমরা করেছেন রজব মাসে।” তার এ বক্তব্য অবগত হলে আয়িশা বললেনঃ “ইবনে উমার ব্যাপারটা ভূলে গেছেন।১১”

[১১. জামউল ফাউয়ায়িদ ১ম খন্ড পৃঃ ৩৪৫-৩৪৬; বর্ণনাঃ উমার রবং ইবনে উমার (রা) –অনুবাদক]

পঞ্চম কারণঃ রাসূলুল্লাহ্র (সা) বক্তব্যের সঠিক উদ্দেশ্য আয়ত্ত করা না করার পার্থক্য

সাহাবায়ে কিরামের (রা) মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হওয়ায় পঞ্চম কারণ হচ্ছে এই যে, কখনো কখনো রাসূলুল্লাহর (সা) বক্তব্যের যথার্থ ও পূর্ণ উদ্দেশ্যে সকলে সমানভাবে আয়ত্ত করে রাখতেন না। এর উদাহরণ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহর (সা) সুত্রে হযরত ইবনে উমার (রা) বর্ণিত একটি হাদীস। তিনি বলেনঃ

“রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ মৃত ব্যাক্তির পরিবার পরিজন কান্নাকাটি করলে মৃত ব্যাক্তিটিকে আযাব দেয়া হয়।” এ বক্তব্য শুনে হযরত আয়িশা (রা) বললেনঃ এটা ইবনে উমারের ধারণা প্রসূত কথা। রাসূলুল্লাহর বক্তব্যের উদ্দেশ্যে এবং স্থানকাল পাত্র তিই আয়ত্ত রাখেননি। প্রকৃত ঘটনা হছে এই যে, রাসূলুল্লাহ (সা) এক ইয়াহুদী মহিলার কবরের পাশ দিয়ে যাবার কালে দেখলেন, তার আপনজনেরা তার জন্য মাতম করছে। তিনি বললেনঃ “এরা এখানে তার জন্যে কান্নাকাটি করছে অথচ তার কবরের আযাব হচ্ছে।”১২

[১২. এ ঘটনা মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে। –অনুবাদক]

এখানে হযরত উমার (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) বক্তব্যের যথার্থ উদ্দেশ্য আয়ত্ত করতে পারেননি। তিনি মনে করেছেন, কান্নাকাটির কারণে মাইয়্যেতের আযাব হয়েছে এবং ব্যাপারটা সাধারণভাবে সকল মাইয়্যেতের জন্যই প্রযোজ্য। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা) বক্তব্য ছিলো কেবল উক্ত মাইয়্যেতের জন্যে নির্দিষ্ট (খাস) এবং বক্তব্যে তিনি কান্নাকাটিকে আযাবের কারোন হিসেবে উল্লেখ করেননি।

৬ষ্ট কারণঃ বিধানের কারণ নির্ণয়গত কারণ

সাহাবায়ে কিরামের (রা) মধ্যে যেসব কারণে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েক্সহে তন্মধ্যে আরেকটি হচ্ছে এই যে, কোনো বিধান স্থির করার পিছনে কি কারন ছিলো তা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তাঁদের মতামত এর ভিন্নতা। যেমন, কফিন অতিক্রমকালে দাঁড়ানো। এ ব্যাপারে কোনো কোনো সাহাবী বলেছেনঃ ফেরেশতাদের সম্মানার্থে দাঁড়ানো হয়, কেননা প্রত্যেক কফিনের সাথেই ফেরেশতারা শামিল হয়। এ মতানুযায়ী মৃতব্যাক্তি মুমিন হোক কিংবা কাফির সর্বাবস্থায় ই দাড়াতে হবে। আবার কেউ কেউ বলেছেনঃ মৃত্যু ভীতির কারণে দাঁড়ানো হয়। এ মতানুযায়ীও যে কোনো ধরণের লোকের কফিনের জন্য দাড়াতে হবে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, একবার রাসূল (সা) এর নিকট দিয়ে এক ইয়াহুদীর কফিন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তার মাথা উপর দিয়ে ইয়াহুদীর লাশ অতিক্রম করা তিনি পছন্দ করলেন না। তার তিনি দাড়ালেন। এটা যদি সঠিক কারণ হয়ে থাকে, হবে দাড়ানোটা শুধু কাফিরের কফিনের জন্যে নির্দিষ্ট।

৭ম কারণঃ সামঞ্জস্যবিধানগত পার্থক্য

কোনো বিধানের বৈপরিত্য নিরসনকল্পে সামনহস্য বিধান করতে গিয়ে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, রাসূলুল্লাহ (সা) খাইবার যুদ্ধের সময় ‘মুতআ’ বিয়ের অনুমতি দিয়েছিলেন। যদ্ধের পর আবার তা নিষেধ করে দেন। অতঃপর ‘আওতাস’ যুদ্ধের সময় পুনরায় মুতআর অনুমতু প্রদান করেন। এবারও যুদ্ধের পর অনুমতি প্রত্যাহার করে নেন।

এখন এ বিষয়ে হযরত আব্বাসের (রা) মত হলো, প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে ‘মুতআর’ অনুমতি দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন শেষ হবার সাথে সাথে অনুমতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। সুতরাং অনুমতি প্রয়োজনের সাথে সম্পর্কিত। এ জন্যে এ অনুমতি স্থায়ী। (অর্থাৎ প্রয়োজন দেখা দিলে মুতআ বিয়ে করা যাবে। আর প্রয়োজন দূরীভুত হলে তা নিষিদ্ধ।) কিতু সাধারণ সাহাবীগণের মত এর বিপরীত। তাদের মত হলো, মুতআ বিয়ের ইনুমিতিটা ছিলো মুবাহ পর্যায়ের। নিষেধাজ্ঞা সে অনুমতিকে স্থায়ীভাবে রদ (মানসুখ) করে দিয়েছে।

এ ব্যাপারে দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে এই যে, রাসূলুল্লাহ (সা) কিবলামুখী হয়ে ইস্তেঞ্জা করতে নিষেধ করেছেন। এ ব্যাপারে কিছু সাহাবীদের মত হলো, এ নিষেধাজ্ঞা সাধারণ এবং রদযোগ্য নয়। কিন্তু ওফাতের এক বছর হযরত জাবির (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) কে কিবলামুখী হয়ে পেশাব করতে দেখেছেন। তাই তার ধারণা জন্মেছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা) এর এই কাজ সংক্রান্ত তাঁর পূর্ববর্তী নিষেধাজ্ঞাকে রদ করে দিয়েছে। এমিনিভাবে হযরত ইবনে উমার (রা) রাসূলুল্লাহকে (সা) কিবলার দিকে পিছু দিয়ে এবং সিরিয়ার দিকে মুখ করে ইস্তেঞ্জা করতে দেখেছেন। এর ভিত্তিতে তিনি তাদের মতকে রদ করে দিয়েছেন যারা বলেন, কিবলার দিকে পিছু দিয়ে ইস্তেঞ্জা করে নিষেধ। অতঃপর কিছু লোক এই উভয় মতের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেছেন। ইমাম শা’বী (রা) প্রমুখ মত দিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিষেদাজ্ঞা ছিলো খোলা উন্মুক্ত জায়গার বেলায়। কেউ যদি পায়খানা বা টয়লেটে বসে ইস্তেঞ্জা করে, তখন কিবলার দিকে মুখ কিরে বা পিছু দিয়ে বসলে কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু কেউ কেউ আবার ভিন্ন মত ব্যাক্ত করেছেন। তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) নিষেধাজ্ঞা স্থায়ী এবং সাধারণ। তবে হযরত জাবির (রা) এবং ইবনে উমার (রা) যা দেখেছেন, সেটা করা নবী হিসেবে বিশেষভাবে কেবলমাত্র তার জন্য বৈধ ছিলো। সুতরাং তার সে কাজ এ সংক্রান্ত তার নিষেধাজ্ঞাকে রদ করে না। তাক্সহাড়া কোনো বিশেষ স্থানে কিবলামুখী বা কিবলাকে পিছু দিয়ে ইস্তেঞ্জা করাও বৈধ বলে প্রমাণ করেনা।

 

৩. মতবিরোধের ইতিহাসের দ্বিতীয় যুগঃ তাবেয়ীগণের যুগ
তাবেয়ীগণের মতপার্থক্য

এভাবেই সাহাবায়ে কিরামের মাঝে মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। উত্তরাধিকার সুত্রে এ মতপার্থক্য তাবেয়ীদের নিকত পৌছে। প্রত্যেক তাবেয়ীর নিকট যা কিছু পৌছে তিনি সেটাকে আয়ত্ত করে নেন। রাসূলুল্লাহ (সা) এর যে যে হাদীস এবং যে যে সাহাবীগণের যে যে মতামত শুনেছেন, তা তাঁরা তাঁদের স্মৃতিতে অংকিত করে নেন। সাহাবীগণের বক্তব্যে যেসব ইখতিলাফ লক্ষ্য করেছেন, নিজ নিজ জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী তাঁরা সেগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেছেন। কখনো একটি বক্তব্যকে আরেকটি বক্তব্যের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এ ব্যাপারে কোনো কোনো বক্তব্য তাদের সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য হয়েছে। এমনকি তা যদি প্রথম শেণীর কোনো সাহাবীর বক্তব্যও হয়ে থাকে। যেমন, ‘তায়াম্মুম দ্বারা ফরয গোসলের কার্য সমাধান হয় না’- হযরত উমার (রা) এবং ইবনে মাসউদের (রা) এ মতকে তারা গ্রহন করেননি। পক্ষান্তরে এ প্রসংগে তাঁরা হযরত আম্মার (রা) এবং ইমরান ইবনে হুসাইন প্রমুখের মশহুর রেওয়ায়াত গ্রহণ করেছেন। এ পর্যায়ে এসে তাবেয়ীগণের মধ্যে ও স্বাভাবিক মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়ে যায়। দেখা দেয় ভিন্ন ভিন্ন মত। আর বিভিন শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় ভিন্ন ভিন্ন মতের আলিমদের নেতৃত্ব। যেমনঃ

ক) মদীনায় সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেব (রহ) এবং সালিম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমারের (রহ) মতামত গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। তাঁরা মদীনার জনগণের ইমামের মর্যাদা লাভ করেন। এ দু’জনের পর মদীনায় যুহুরী, কাযী ইয়াহিয়া ইবনে সায়ীদ এবং রাবীয়া ইবনে আবদুর রহমান অনুরুপ মর্যাদা লাভ করেন।

খ) মক্কায় আতা ইবনে আবি রিবাহ গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে তাদের ইমামের মর্যাদা লাভ করেন।

গ) কুফায় ইব্রাহীম নখয়ী এবং শা’বী এ মর্যাদা লাভ করেন।

ঘ) বসরায় এ মর্যাদা লাভ করেন হাসান বসরী।

ঙ) ইয়েমেনে লাভ করেন তাউস ইবনে কাইসান আর

চ) সিরিয়ায় মাকহুল।

অতঃপর আল্লাহ তা’আলা কিছু লোকের অন্তরে এঁদের থেকে ইলম হাসিল করার আকাঙ্কখা জাগ্রত করে দেন। এভাবে তারা এঁদের নিকট থেকে রাসূলুল্লাহ (সা) এর হাদীস, সাহাবায়ে কিরামের (রা) বক্তব্য ও ফতোয়া ও এই লোকদের মতামত ও বিশ্লেষণ সংগ্রহ করেন। অতঃপর তাঁদের কাছে ফতোয়া চাইতে আসে অসংখ্য লোক। তাদের সম্মুখে আসে হাজারো মাসায়েল। উত্থাপিত হয় শত শত মামলা মুকাদ্দামা। (এ সকল বিষয়ে তাদেরকে ফতোয়া দিতে হয় এবং ব্যাক্ত করতে হয় নিজেদের মতামত।)

ফিকাহ সংকলনের সূচনাঃ

উপোরক্ত ব্যাক্তিদের মধ্যে সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেব এবং ইব্রাহীম নখয়ী প্রমুখ যথানিয়মে বিভিন্ন অধ্যায় ভিত্তিক ফিকাহ সংকলন করেন। প্রত্যেক অধ্যায়ে তাঁরা কিছু মূলনীতির অনুসরন করেন। যা তাঁরা তাঁদের পুর্ববর্তীদের থেকে লাভ করেছেন।

সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেব এবং তার ছাত্ররা এ মত পোষণ করতেন যে, হারামাইনের বাসিন্দারা ফিকাহর ব্যাপারে সর্বাধিক যোগ্যতার অধিকারি। তাঁদের মতামতের (মাযহাবের) ভিত্তি ছিলো হযরত উমার (রা) ও হযরত উসমানের (রা) ফতোয়া ফায়সালা সমূহ, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা), আয়িশা (রা), ও ইবনে আব্বাসের (রা) ফতোয়াসমূহ এবিং মদীনার কাযীগণের ফায়সালা ও রায়সমূহ। আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত তাওফীক অনুযায়ী তাঁরা এসকল বিধান ও ফতোয়া সংগ্রহ করেন এবং গবেষণা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেগুলো পর্যালোচনা করেন। অতঃপর (ক) যে বিষয়ে মদিনার আলিওগণের ঐক্যমত পোষণ করেছেন, সেটা দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করেছেন। (খ) যে বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিলো সে বিষয়ে ঐ মতকে গ্রহণ করেন, যা কোনো না কোনো কারণে মজবুত এবং অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। এসব কারণ আবার বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকতে পারে। যেমন, আধিকাংশ আলেম কর্তৃক সে মতটি গ্রহণ করা কিংবা কিয়াসের ভিত্তি মজবুত হওয়া, বা সরাসরি কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিতে গবেষণা করে নির্ণয় করা কোনো ফায়সালার সাথে সামঞ্জস্যশীল হওয়া অথবা অন্য কোনো কারণে। (গ) আর যে বিষয়ে তাদের কোনো ফতোয়া এরা লাভ করেননি, সে বিষয়ে তাঁদের অনুরূপ অন্যান্য বক্তব্য ও ফতোয়াসমূহের উপর গবেষণা করতেন, সেগুলোর উদ্দেশ্য, ও ইংগিত ও দাবী খুঁজে বের করতেন এবং সে অনুযায়ী কোনো সিদ্ধান্তে পৌছুতেন। এভাবে প্রতিটি অধ্যায়ে তারা অসংখ্য মাসায়েল ও বিধান রচনা করেন। ইব্রাহীম নখয়ী এবং তার ছাত্রের ধারণা ছিলো, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং তার শিষ্যগণই ফিকাহশাস্ত্রে সর্বাধিক দক্ষ। যেমন, আলকামা মাসকুককে বলেছিলেঃ “সাহাবীদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের চাইতে বড় কোনো ফকীহ ছিলেন কি?” একইভাবে ইমাম আবু হানীফা (রহ) ইমাম আওযায়ীকে বলেছেনঃ “ইব্রাহীম নখয়ী সালিম ইবনে আবদুল্লাহর চাইতে বড় ফকীহ। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ তো আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ই। তাঁর সাথে আর কার তুলনা হয়?” মূলতঃ ইব্রাহীম নখয়ী ও তার ছাত্রদের ফিকহী মসলকের ভিত্তিই ছিলো আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের মতামত ও ফতোয়া, হযরত আলী (রা) এর ফতোয়া ও ফায়সালাসমূহ, কাযী শূরাইহর ফায়সালাসমূহ এবং কুফার অন্যান্য কাযীর ফায়সালাসমূহের উপর। ইব্রাহীম নখয়ী তাঁর সাধ্যানুযায়ী এইসব ফতোয়া, ফায়সালা ও বিধান সংগ্রহ করেন এবং এগুলো ঠিক সেইভাবে কাজে লাগান, যেভাবে মদীনায় সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেব প্রমুখ সেখানকার সাহাবী ও পরবর্তী আলিমদের বক্তব্য (আছার) ও ফতোয়াসমূহ কাজে লাগান। এগুলোর ভিত্তিতে অনুসন্ধান ও গবেষণা ভালিয়ে অসংখ্য মাসায়েল উদ্ঘাটন করেন। ফলশ্রুতিতে এখানেও ফিকাহর প্রতিটি অধ্যায়ে মাসায়েলের স্তুপ জমা হয়ে যায়।

সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেব ছিলেন মদীনার ফকীহদের মুখপাত্র। মদীনার ফকীহদের মধ্যে হযরত উমারের (রা) ফায়সালাসমূহ এবং আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসসমুহ তাঁর চাইতে অধিক কারো মুখস্ত ছিলো না। আর ইব্রাহীম নখয়ী ছিলেন কুফার ফকীহদের মুখপাত্র। এঁরা দু’জন কারো সুত্র উল্লেখ না করে যখন কোনো মাসয়ালা বর্ণনা করতেন, তখন তার অর্থ এই হতো না যে, কারো সুত্র ছাড়াই স্বীয় ইজতিহাদের ভিত্তিতে মাসয়ালাটি প্রদান করেছেন। বরঞ্চ সাধারণত এসব মাসায়েক তাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অতীতের কোনো ফকীহর সুত্রেই বর্ণনা করতেন। শেষ পর্যন্ত এ দুজনকে ঘিরে উভয় শহরে গড়ে উঠে বিরাট ফকীহ গোষ্ঠী। তাঁরা দুজন দুই স্থানে এই শাস্ত্রের কেন্দ্রীয় ব্যাক্তিত্বে পরিণত হন। অসংখ্য লোক তাদের কাছ থেকে লাভ করেন ফিকাহর ইলম। তাঁদের এসব ছাত্ররা ও আবার গবেষণা বিশ্লেষণের মাধ্যমে মাসয়ালা বের করেন। বের করেন মাসয়ালার শাখা প্রশাখা এবং খুঁটিনাটি অনেক বিষয়।

৪. মতবিরোধের ইতিহাসের তৃতীয় যুগঃ তা’বে তাবেয়ীনদের যুগ
উলামায়ে তাবে’তাবেয়ীন

তাবেয়ীগের যুগ শেষ হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা ইলমে দ্বীনের আরেক দল বাহক সৃষ্টি করেন। এতে করে ইলমে দ্বীন সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সা) নিম্নোক্ত প্রতিশুতি পূর্ণ হলঃ (আরবীঃ يحمل هذا العلم من كل خلاف عدله) “ইয়াহমিলু হা-যাল ইলম মিন কুল্লি খালাফিন উদুলহু—প্রত্যেকটি ভবিষ্যত বংশধরের ন্যায়পরায়ণ লোকেরা এই ইলমের আমানত বহন করবে।”

ইলমে দ্বীনের এই বাহক দল সেই দায়িত্ব পালন করছেন। এঁরা ছিলেন তাবেয়ীনদের ছাত্র। তারা তাবেয়ীগণের নিকট থেকে তাঁদের সংগৃহীত অযু, গোসল, সালাত, হজ্জ, বিয়ে-শাদী, লেনদেন ব্যাবসা বাণিজ্য প্রভৃতি সাধারণভাবে দৈনন্দিন জীবনে ঘটমান যাবতীয় বিষয়ের শরয়ী পন্থাসমূহ সংগ্রহ করেন; রাসূলুল্লাহ (সা) এর হাদীস সংগ্রহ এবং বর্ণনা করেন; বিভিন্ন শহরের কাযীদের ফায়সালা এবং মুফতীদের ফতোয়া সংগ্রহ করেন। এছাড়াও তাঁরা তাঁদের থেকে মাসায়েল জিজ্ঞাসা করেন এবং সকল বষয়ে নিজেরাও ইজতহাদ করেন। এভাবে তাঁরা জাতিএ শ্রেষ্ট আলিমের মর্যাদা লাভ করেন। জনগণ তাঁদেরকে ইমাম হিসেবে গ্রহণ করেন। এবং শরয়ী ব্যাপারে তাঁদের বক্তব্য শুদ্ধ বলে মেনে নেন। এঁরাও আবার নিজ নিজ শিক্ষকের পন্থা অবলম্বন করেন। অতীত আলেমগণ এর বক্তব্য ও ফতোয়ার উদ্দেশ্য ও দাবী অনুধাবনের ক্ষেত্রে তারা নিষ্ঠার সাথে নিজেদের পূর্ণ প্রতভাকে কাজে লাগান। নিজেদের অগাধ প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে তাঁরাও মানুষকে ফতোয়া দান করেন। বিভিন্ন বিষয়ের ফায়সালা প্রদান করেন। হাদীস বর্ণনা করেন এবং জ্ঞান শিক্ষা দেন।

তাবে’তাবেয়ী আলিমগণের চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি

এ স্তরের আলিমগণের চিন্তাপদ্ধতি ও কর্মপদ্ধতি ছিলো খুনই সামঞ্জস্যপুর্ণ। তাঁদের চিন্তা ও কর্মের এই সামঞ্জস্যের সারসংক্ষেপ হলোঃ

১. তাঁদের দৃষ্টিতে ‘মুসনাদ হাদীস’ যেমন গ্রহণযোগ্য ছিলো, অনুরূপভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলো ‘হাদীসে মুরসাল’।১৩

[১৩. যে হাদীসের সাথে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনাকারীর নাম উল্লেখ করা হয়, সেটা হলো ‘হাদীসে মুসনাদ (সনদযুক্ত)’ আর সনদ উল্লেখ করা ছাড়াই কোনো তাবেয়ী বা তাবেতাবেয়ী সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে যা হাদীস বর্ণনা করেন, তাকে ‘হাদীসে মুরসাল’ বলে।]

২. তাঁরা সাহাবী এবং তাবেয়ীগণের বক্তব্যকে শরয়ী দলীল হিসেবে গ্রহণ করতেন। এ প্রসংগে তাঁদের দৃষ্টিভংগী এই ছিলো যেঃ

(ক) শরয়ী বিষয়ে সাহাবী এবং তাবেয়ীগণ যেসব বক্তব্য দিয়েছেন সেগুলো হয়তো রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীস হিসেবেই তাঁরা উল্লেখ করেছেন, তবে সংক্ষিপ্ত করে ‘মওকূফ’১৪ করেছেন।

[১৪. ‘মওকূফ’ হচ্ছে সেই হাদীস যার সুত্র (সনদ) সাহাবী পর্যন্ত পৌছেছে। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহর (সা) সুত্র উল্লেখ ছাড়াই সাহাবী যে বক্তব্য প্রদান করেছেন, সেটাই মওকূফ।]

যেমন, ইব্রাহীম নখয়ী সরাসরি এভাবে হাদীস বর্ণনা করেছেনঃ “রাসূলূল্লাহ (সা) মুহাকালা১৫ এবং মুযাবান১৬ করতে নিষেধ করেছেন।” তাঁর মুখ থেকে এ হাদীসটি শুনার পর তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, “এটি ছাড়া রাসূলুল্লাহর (সা) অন্য কোনো হাদীস কি আপনার মুখস্থ নেই?”

[১৫. খোশা ছাড়ানো গমের স্থলে খোশাযুক্ত গম বিক্রি কে ‘মুহাকালা’ বলে।–অনুবাদক]

[১৬. মুযাবানা হলো নিজ ক্ষেতের ফসল আনুমানিক পরিমাণ ধরে একথা বলে বিক্রি করা যে, বেশী হলে ফেরত নেব না আর কম হলে আমি গচ্চা দিব।–অনুবাদক]

তিনি বললেন, “অবশ্যই আছে। তবে, আবদুল্লাহ (ইবনে মাসউদ) বলেছেন, “আলাকামা বলেছেন” এভাবে বলতেই আমি বেশী ভালবাসি।”

একই ভাবে ইমাম শা’বির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁকে একটি হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় এবং বলা হয়, হাদীসটির সনদ কি রাসূলুল্লাহ (সা) পর্যন্ত যায় না? তিনি বললেনঃ আমার দৃষ্টিতে সুত্র রাসূলুল্লাহ (সা) পর্যন্ত পৌছানো ঠিক না। কারণ বক্তব্যের মধ্যে যদি কিছু কম বেশী থাকে, এভাবে তা রাসূলুল্লাহর প্রতি আরোপিত হবে না। বরঞ্চ যে সাহাবীর নিকট আমি শুনেছি তাঁর প্রতি ই আরোপিত হবে।

(খ) কিংবা তাঁদের বক্তব্যগুলো হলো সেইসব শরয়ী বিধান, যা তাঁরা কুরআন সুনাহ থেকে অনুসন্ধান করে বের করা। বা নিজেরা ইজতেহাদ করে বের করেছেন। এই মনীষীদের গবেষণা ও ইজতিহাদ সম্পর্কে একথা মনে রাখা দরকার যে, তাঁরা তাঁদের পরবর্তী লোকদের তুলনায় অনেক উন্নত কর্মপন্থা এবং বিশুদ্ধতম চিন্তা ও মতামতের অধিকারী ছিলেন। তাছাড়া, পরবর্তী লোজদের তুলনায় তাঁরা রাসূলুল্লাহর (সা) অধিকতর কাছাকাছি সময়ের এবং অধিক ইলমের অধিকারী ছিলেন। সুতরাং তাঁদের বক্তব্য অনুসরনীয় এবং অনুবর্তনীয়। তবে, সে অবস্থাতে তাঁদের বক্তব্য এর উপর আমল করার ক্ষেত্রে জটিলতা ও বাধা রয়েছে, যখন কোনো বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য রাসূলুল্লাহর হাদীসে সাথে সাংঘর্ষিক বলে প্রমাণিত হয়েছে।

(৩) তাবে’তাবেয়ী ইমামগণের কর্মনীতিতে তৃতীয় যে সামঞ্জস্যটি পাওয়া যায়, তাহলো এই যে, কোনো বিষয় যদি তাঁরা পরস্পরবিরোধী হাদীসে সন্ধান পেতেন, তবে সে বিষয়ে শরয়ী বিধান অবগত হবার জন্যে সাহাবায়ে কিরামের (রা) বক্তব্যের প্রতি প্রত্যাবর্তন করতেন, সাহাবীগণ যদি পরস্পরবিরোধী হাদীসগুলোর কোনটি মানসূখ বা তা’বীলযোগ্য বলে উল্লেখ করে থাকেন কিংবা বিলুপ্তি বা তাব্দীলের কোনো ব্যাখ্যাদান ছাড়াই তা পরিত্যাগ করার ব্যাপারে একমত হয়ে থাকেন, যার অর্থ মূলত হাদীসটিকে জয়ীফ, মানসূখ কিংবা তাবীলযোগ্য বলে ঘোষণা করা —এই সকল অবস্থাতেই তাঁরা সাহাবীগণের অনুসরণ করতেন। অর্থাৎ ঐ হাদীসটিকে তাঁরা ততটুকুও মর্যাদা ও গুরুত্ব দান করতেন। যতটুকু মর্যাদা দান করেছেন স্বয়ং সাহাবা কিরামগণ। এর উদাহরণ হচ্ছে কুকুরের ঝুটা বরতনের বিধান প্রসংগের হাদীস১৭ সম্পর্কে ইমাম মালিক (রহ) এর বক্তব্য। হাদীসটি সম্পর্কে তিনি বলেন, “এটিতো হাদীস হিসেবে বর্ণিত আছে। তবে এর হাকীকত বা তাৎপর্য আমি বুঝতে অক্ষম।”১৮

[১৭. হাদীসটি হলোঃ কোনো পাত্রে কুকুর মুখ ঢুকালে তা সাতবার ধুইয়ে নাও অতঃপর একবার মাটি দিয়ে ঘষে মেজে পরিস্কার করে নাও।–অনুবাদক]

[১৮. ইবনে হাজিব এ ঘটনা তাঁর ‘মুখতাসারুল উসূল’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।–অনুবাদক]

অর্থাৎ অতীত ফকীহগণকে (সাহাবীগণকে) আমি এর উপর আমল করতে দেখিনি।

(৪) তাঁরা যখন কোনো বিষয়ে সাহাবী এবং তাবেয়ীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে বলে দেখতে পেতেন, তখন তাঁদের প্রত্যেক আলিমই নিজ নিজ শহরের সাহাবী ও তাবেয়ী এবং নিজ নিজ উস্তাদের মত অনুসরন করতেন। কেননা তিনি তাঁদের বক্তব্যের মজবুতি ও দুর্বলতা সম্পর্কে অধিকতর ওয়াকিফহাল ছিলেন এবং তাঁদের বক্তব্য অ রায় যেসব মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো, সেগুলোর তাৎপর্য সম্পর্কেও তিনি অধিক জ্ঞাত ছিলেন। তাছাড়া তাঁদের মর্যাদা, কামালিয়াত ও সমুদ্রসম জ্ঞানের প্রতিও ছিলেন তিনি আকৃষ্ট।(সুতরাং এমনটি করা তাঁদের প্রত্যেকের জন্যেই ছিলো এক স্বাভাবিক ব্যাপার।) এর ফলে মদীনাবাসীদের নিকট উমার, উসমান, ইবনে উমার, আয়িশা, ইবনে আব্বাস, যায়িদ ইবনে সাবিত (রা) প্রমুখ শ্রেষ্ট সাহাবী এবং তাঁদের সেরা ছাত্র সায়ীদ (রহ) ইবনে মুসাইয়্যেব (রহ) (যিনি হযরত উমারের (রা) ফায়সালা এবং আবু হুরাইরা (রা) বর্ণিত হাদীস সমূহের সর্বাধিক হাফিয ছিলেন), উরওয়া, সালিম, আতা, কাসিম, ইকরামা১৯

[১৯. ইকরামার নাম এখানে উল্লেখ হলে ও তাঁকে এই উদাহরণের অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। কারণ তিনি ছিলেন মক্কার অধীবাসী।–অনুবাদক]

উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ যুহরী, ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ, যায়িদ ইবনে আসলাম, ও রবীয়া (রহ) প্রমুখের মতামত ও চিন্তাধারা অন্য সকলের তুলনায় অধিকতর গ্রহণযোগ্য ছিলো। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনার বিরাট মর্যাদা ও গুরুত্বের কথা বলে গেছেন২০ এবং মদীনা সবসময়ই ফকীহ ও আলিমদের কেন্দ্র ছিলো বলেও তারা এমনটি করে থাকতে পারেন। এ কারণেই দেখা গেছে, ইমাম মালিজ (রহ) মদিনার আলিমগণের মতামতকে আবশ্যিকভাবে গ্রহণ করতেন। ইমাম বুখারীও তাঁর গ্রন্থে একটি অধ্যায় এর নাম দিয়েছেন “মক্কা ও মদীনাবাসীদের সর্বসম্মত বিষয়কে গ্রহণ করা”।

[২০. হাদীসটি হলোঃ বিদ্বান্বেষণের জন্য লোকেরা অচিরেই মদীনার দিকে যান বাহন দৌড়াবে। আর মদীনার আলমরা হবে শ্রেষ্ঠ আলিম। —অনুবাদক]

পক্ষান্তরে কুফাবাসীদের নিকট আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) এবং তাঁর শাগরেদদের বক্তব্য হযরত আলীর (রা) রায় ও ফায়সালা, কাযী শুরাইহ ও শা’বীর ফায়সালা এবং ইব্রাহীম নখয়ীর ফতোয়াসমূহ অন্যদের তুলনায় অগ্রাধিকারযোগ্য ও অধিকতর অনুসরনযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। এ কারণেই তাশরীক২১ প্রসংগে আলকামা মাসরুককে যায়িদ ইবনে সাবিতের (রা) বক্তব্যের প্রতি ঝুকতে দেখে বলেছিলেন “কোনো সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা) চাইতেও অধিকতর শরীয়াহ সংক্রান্ত বুঝ-সমঝ রাখতেন কি?”

[২১. ‘তাশরীক’ মানে বর্গা চাষ বা জমির মালিক কর্তৃক ফসল ভাগাভাগি ভিত্তিতে নিজের জমি অপরকে চাষ করতে দেয়া। –অনুবাদক]

জবাবে মাসরুক বলেছিলেন, ‘রাখতেন না বটে, তবে আমি যায়িদ ইবনে সাবিতের (রা) এবং অপরাপর মদীনাবাসীকে তাশরীক করতে দেখেছি।”

মোটকথা, এভাবে এ যুগের প্রত্যেক আলিমের নিকট তাঁর উস্তাদ এবং নিজ শহরের শাসক, কাযী ও আলিমগণের ফায়সালা ও মতামত অগ্রাধিকারযোগ্য এবং অধিকতর অনুসরনযোগ্য ছিলো। নিজ শহরের ওলানাকে কোনো বিষয়ে একমত দেখতে পেলে সে বিষয়টিকে তো তাঁরা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরতেন। এ ধরণের বিষয়গুলো সম্পর্কেই ইমাম মালিক বলেন, “যেসব সুন্নাতের বিষয়ে (আহলে মদীনার) কোনো মতপার্থক্য নেই, সেগুলো তো আমাদের নিকট এরূপ এরূপ।” (অর্থাৎ অবশ্য করনীয়)। কোনো বিষয়ে নিজ শহরের ফকীহগণের মধ্যে মতপার্থক্য দেখতে পেলে সে অবস্থায় তাঁরা ঐ মতটিকে গ্রহণ করতেন। আর ‘মজবুত ও অগ্রাধিকারযোগ্য’ মনে করতেন। আর ‘মজবুত ও অগ্রাধিকারযোগ্যে’ নির্ণয়ে ক্ষেত্রে তাঁরা ‘অধিকাংশের মত’ কিংবা ‘মজবুত কিয়াসের’ উপর প্রতিষ্ঠিত অথবা ‘কিতাব ও সুন্নাহর নীতিমালার সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যশীল’ প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। এ প্রসংগে ইমাম মালিকের একটি কথা উল্লেখযোগ্য। তিনি মদীনার আলিমগণের সম্পর্কে বলতেন, “তাঁদের থেকে আমি যা শুনতে পেয়েছি তা কতোইনা উত্তম।”

নিজ শহরের সাহাবী, তাবেয়ী এবং আলিমগণের বক্তব্য ও মতামত থেকে সরাসরি যদি টাঁরা কোনো মাসআলার জবাব না পেতেন, তখন তাঁরা তাঁদের বক্তব্য ও মতামতের আলোকে গবেষনা করে তাঁদের বক্তব্য ও মতামতের উদ্দেশ্য অনুশন্ধান করে সিদ্ধান্তে পৌছুতেন।

এই যুগের আলিমগণের অন্তরে ফিকাহর গ্রন্থাবলী সংকলনের অনুভূতি ইলহাম করে দেয়া হয়েছিলো। তাইতো দেখা যায়, মদীনায় ইমাম মালিক এবং মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আবিযিব মক্কায় ইবনে জুরাইজ এবং ইবনে উয়াইনা, কুফায় সওরী এবং বসরায় রুবাই ইবনে সুবাইহ পৃথক পৃথকভাবে ফিকাহ গ্রন্থ সংকলন করেন। সংকলনকালে এরা সকলেই সেই নীতি পদ্ধতি অনুসরন করেন যার প্রতি আমি এতক্ষণ আলোকপাত করলাম।

 

৫. প্রসিদ্ধ ফিকহী মাযহাবসমূহ
(১) ইমাম মালিক ও মালিকী মাযহাব

খলীফা মনসুর হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় এলে ইমাম মালিককে বললেন, “আমি আপনার গ্রন্থের কপি করিয়ে সেগুলো মুসলমানদের সকল শহরে পাঠিয়ে দিয়ে তাদেরকে এ নির্দেশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, এখন থেকে এ কিতাবগুলোরই অনুসরন করতে হবে এবং এগুলো ত্যাগ করে অন্য কোনো মতের অনুসরণ করা যাবে না।” জবাবে ইমাম মালিক বললেন, “আমীরুল মুমিনীন, এমনটি করবে না। কারণ, বিভিন্ন লোকের নিকট বিভিন্ন মত পৌছেছে, বিভিন্ন ধরনের হাদয়স তারা শুনেছে এবং বিভিন্ন রকম বর্ণনা তাদের নিকট বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং যে লোকেরা যে ধরণের হাদীস ও মতামত শুনেছে, তারা সবাই তারই উপর আমল করে আসছে। এভাবে লোকদের মধ্যে ভিন্ন মতের অনুসারী রয়েছে লোক রয়েছে। তাই লোকদের তাদের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিন। যে শহরের লোকেরা যে মত (মসলক)-এর অনুসরণ করেছে, তাদেরই তাই অনুসরণ করতে দিন।”

কেউ কেউ এ ঘটনাটি খলিফা হারুনুর রশীদের সাথে সম্পৃক্ত বলে উল্লেখ করেছেন এবং এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, হারূনুর রশিদ ইমাম মালিকের নিকট পরামর্শ চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা মুয়াত্তা খানায়ে কা’বায় উৎকীর্ণ করে দিয়ে লোকদের সকল মতপার্থক্য ত্যাগ করে এর অনুসরন করতে বাধ্য করলে কেমন হয়?” জবাবে ইমাম মালিক বললেন, “এমনটি করবেন না। রাসূলুল্লাহর (সা) এর সাহাবীদের মধ্যেই বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য ছিলো। অতপর তারা বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ার ফলে বিভিন্ন মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং বর্তমানে লোকদের মধ্যে যে মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে, তা সাহাবায়ে কিরামের (রা) থেকেই চলে আসছে।” তার বক্তব্য শুনে হারুনুর রশীদ বললেন, “আবু আবদুল্লাহ! আল্লাহতায়ালা আপনাকে দ্বীন সম্পর্কে আরো অধিকতর বিজ্ঞতা দান করুক।” এ ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন ইমাম সুয়ুতী।

মদীনাবাসীরা রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে যেসব হাদীস বর্ণনা করেছেন, ইমাম মালিক ছিলেন সেসব হাদীসের শ্রেষ্ঠতম আলিম। তাঁর বর্ণিত হাদিসমূহ সনদ্গত দিক থেকে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য। তাছারা হযরত উমারের (রা) ফায়সালাসমূহ এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার, আয়িশা সিদ্দিকা (রা) ও তাদের ছাত্র সপ্ত ফকীহর২২ বক্তব্য ও মতামত সম্পর্কে তাঁর চাইতে বড় আলিম আর কেউ ছিলো না।

[২২. এই সাতজন ফকীহ হলেনঃ (১) সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেব (২) উরোয়া ইবনে যুবায়ের (৩) কাসিম ইবনে মিহাম্মদ ইবনে আবু বকর (৪)আবু বকর ইবনে আবদুর রাহমান মাখযুমী (৫) খারিজা ইবনে যায়িদ ইবনে সাবিত (৬) উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ মাসউদী (৭) সুলাইমান ইবনে ইয়াসার হিলালী।–অনুবাদক]

এই মহান আলিম এবং তাঁর মতো অন্যান্য শ্রেষ্ঠ আলিমদের হাতেই ইলমে রাওয়ায়াত ও ইলমে ইফতা’র ভিত্তি স্থাপিত হয়। ইলম ও ইরশাদের সনদরূপে প্রতিষ্ঠিত হবার পর হাদিস বর্ণনা, ফতোয়া দান, ইজতিহাদ, ও জ্ঞান বিতরণের ক্ষেত্রে ইমাম মালিক যে বিরাট অবদান রেখেছে তা দ্বারা নবী করীমের (সা) সেই ভবিষ্যতবাণিই সত্যে পরিণত হয়েছে, যাতে তিনি বলেছিলেন, “অচিরেই লোকেরা উটে আরোহণ করে ইলম হাসিলের জন্য ছুটোছুটি করবে। কিন্তু মদীনার আলিমদের চাইতে বড় কোনো আলিম তারা পাবেনা।” ইবনে ইয়াইনা ও আবদুর রাজ্জাকের মতো সেরা চিন্তা বিদের মতে রাসূলুল্লাহ (সা) এর এই ভবিষ্যতবাণী ইমাম মালিকের মাধ্যমে সত্যে পরীণত হয়েছে, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছাত্ররা তাঁর বর্ণিত সকল হাদীস ও মতামত সংগ্রহ করেন। তাঁরা এগুলোর সম্পাদনা করেন এবং ব্যাখ্যা প্রদান করেন। এগুলোর মূলনীতি ও দলিল-আদিল্লা নিয়ে গবেষনা করেন এবং এর ই ভিত্তিতে তাঁরা আরো অধিক মাসালা-মাসায়েল উদ্ভাবন করেন। এসব পাথেয় সাথে নিয়ে তাঁরা মরক্কো ও পৃথিবীর অন্যান্য দিকে ছড়িয়ে পড়েন। এদের মাধ্যমে আল্লাহ তা’ইয়ালা উপকৃত করেন তাঁর অসংখ্য সৃষ্টিকে। ইমাম মালিকের মাযহাবের এই হচ্ছে মূলকথা। তুমি যদি আমার বক্তব্যের সত্যতা জানতে চাও, তবে মুআত্তায়ে মালিক পড়ে দেখো। এখানে আমরা যা কিছু বলেছি গ্রন্থটিতে তার সত্যতা খুঁজে পাবে।

(২) ইমাম আবু হানীফা ও হানাফী মাযহাব

ইমাম আবু হানীফা কঠোরভাবে ইব্রাহীম নখয়ী ও ইব্রাহীম নখয়ীর স্বখেয়ালের উলামায়ে তাবেয়ীনের মসলক অনুসরণ করেন। কদাচিতই তিঁনি তাঁদের অনুসরণ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। এই মসলকের ভিত্তিতে পূর্ণ দক্ষতার সাথে মাসায়েল বের করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বিরাট মর্যাদার অধিকারী। মাসায়েল তাখ্রীজের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বাস্তবধর্মী ও যুক্তিবাদী। তাঁর পুরো দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো ক্ষুদ্র ও খুঁটিনাটি বিষয়গুলোর প্রতি, তুমি যদি তাঁর সম্পর্কে আমার মন্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে চাও তবে ইমাম মুহাম্মদের ‘কিতাবুল আছার’ আবদুর রাজ্জাকের ‘জামে’ এবং আবু বকর ইবনে শাইবার ‘মুসান্নেফ’ গ্রন্থ থেকে ইব্রাহীম নখয়ীর বক্তব্যগুলো বেছে বেছে বের করে নাও। অতঃপর আবু হানীফার মাযহাবের সাথে সেগুলো মিলিয়ে দেখো। তুমি দেখতে পাবে, দুয়েকটি জায়গায় ছাড়া লোথাও তাঁর কদম ইব্রাহীম নখয়ীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেশণ ও মসলক থেকে বিচ্যুত হয়নি। আর সেই ব্যাতিক্রম দুয়েকটি জায়গায়ও আবু হানীফা নিজের পক্ষ থেকে অভিনব কোনো পন্থা অবলম্বন করেননি। বরঞ্চ কুফারই অন্য কোন না কোনো ফকীহর অনুসরণ করেছেন।

আবু হানীফার ছাত্রদের মধ্যে সর্বাধিক মশহুর ছিকেন আবু ইউসুফ, হারুনুর রশীদের শাসনকালে ইনি প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। তাঁর এই পদে নিয়োগ লাভের ফলে হানাফী মাযহাব রাষ্ট্রীয় ভাবে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইরাক, খোরাসান এবং তুরান সর্বত্রই এ মাযহাব রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর হয়।

তাঁর অপর ছাত্র মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান গ্রন্থ রচনা, সম্পাদনা ও সংকলনের দিক থেকে অন্য সকলের তুলনায় অগ্রগণ্য ছিলেন। দারস ও তাদরীসের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অনন্য। প্রথমত তিনি আবু হানীফা এবং আবু ইউসুফের নিকট থেকে ‘মুআত্তা’ শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর নিহেই চিন্তা গবেষণার কাজ শুরু করেন। স্বীয় উস্তাদ আবু হানীফা ও আবু ইউসুফের প্রত্যেকটি মাসআলা মুআত্তার আলোকে পর্যালোচনা করেন। আর যেগুলোতে উভয়ের মিল খুঁজে পেয়েছেন, সেগুলো তো আনন্দচিত্তেই গ্রহন করেছেন। আর যেগুলোর ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে মতপার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন, সেগুলোর ব্যাপারে পুনরায় পর্যালোচনা করেছেন। তন্মধ্যে যেটিকে কোনো সাহাবী বা তাবেয়ীর মতের অনুরূপ পেয়েছেন, সেটির ব্যাপারে ও হানাফী মাযহাব কেই গ্রহন করেছেন। আর যেটিকে দুর্বল কিয়াস ও দুর্বল ইস্তেম্বাতের উপরে প্রতিষ্ঠিত পেয়েছেন এবং ফকীহদের অনুসৃত শীহ হাদীস ও অধিকাংশ আলেমের মতের বিপরীত পেয়েছেন সেটির ব্যাপারে নিজের মাযহাব ত্যাগ করে অর্থাৎ আবু হানীফার ও আবু ইউসুফের সাথে একমত না হয়ে সাহাবী কিংবা তাবেয়ীদের মধ্যে থেকে এম;ন কারো মত গ্রহন করেছেন, যার মতটি তার কাছে সর্বাধিক যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে।

আবু হানীফার এ দু’জন ছাত্র তাঁরই মতো যথাসম্ভব ইব্রাহীম নখয়ীর মাযহাবের অনুসরণ করেছেন। তবে দু’টি অবস্থায় কখনো কখনো উস্তাদের (আবু হানীফা) সাথে তাদের মতপার্থক্য হয়েছেঃ

১. কখনো এমন হতো যে, আবু হানীফা ইব্রাহীম নখয়ীর মাযহাবের ভিত্তিতে কোনো মাসয়ালা বের করেছেন, কিন্তু আবু ইউসুফ এবং মুহাম্মাদ এই তাখরীজকে গ্রহণ করেননি।

২. কখনো এমন হতো যে, কোনো একটি মাসয়ালার ব্যাপারে ইব্রাহীম নখয়ীসহ কুফার অন্যান্য ফকীহদের মধ্যে মতপার্থক্য পাওয়া যেতো। যেখানে কোনো একটি মতকে অগ্রাধিকার দেবার প্রশ্ন দেখা দিতো। এমতাবস্থায় অনেক সময় তাঁদের মত আবু হানীফার মতের অনুরূপ হতো না।

আগেই বলেছি ইমাম মুহাম্মাদ গ্রন্থ রচনা ও সংকলনের প্রতি দৃষ্টিবান ছিলেন। তিনি এই তিন জনের২৩

[২৩. অর্থাৎ ইব্রাহীম নখয়ী, আবু হানীফা ও আবু ইউসুফ (রাহিমাহুমুল্লাহ)]

রায়সমূহ সংকলন করে ফেলেন, যার ফলে উপকৃত হতে থাকে অসংখ্য মানুষ। পরবর্তী সময়ে হানাফী আলিমগণ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তাঁর গ্রন্থাবলীর প্রতি দৃষ্টি প্রদান করে থাকেন। তাঁরা এগুলোর সার নির্যাস বের করেন, সম্পাদিত করেন, তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন এবং সহজে বুঝাবার উপযোগী করে তুলেন। সেগুলোর ভিত্তিতে আরো অনেক মাসায়েল ইস্তেম্বাত করেন এবং দলিল-আদিল্লা যুক্ত করে সেগুলোকে মজবুত করেন। অতঃপর তারা এসব গ্রন্থাবলী সাথে নিয়ে সমুদ্র পেরিয়ে প্রাচ্যের দিকে ছড়িয়ে পড়েন আর সেসব গ্রন্থের সকল মাসায়েল আবু হানীফার মাযহাব বলে গণ্য হতে থাকে।

এভাবে আবু ইউসুফ এবং মুহাম্মাদের মাযহাবও আবু হানিফার (রহ) মাযহাব বলেই গণ্য হতে থাকে। তিনজনকে একই মাযহাবের সাথে একাকার করে ফেলা হয়। অথচ এঁরা দুইজনে ছিলেন স্বাধীন মুজতাহিদ। আবু হানীফার সাথে মূলনীতি ও খুঁটিনাটি বিষয় তাদের মতপার্থক্য মোটেও কম ছিলো না। তাদেরকে একই মাযহাবের বলে গণ্য করার কারণ এই ছিলো যে,

১. একটি ব্যাপারে তাদের তিনজনের মাধ্যেই মিল অর্থাৎ তারা তিজনই একজনের (ইব্রাহীম নখয়ী) মাযহাবের অনুসারী।

২. দ্বিতীয়ত ‘মাসবুত’ এবং ‘জামেউল কবীর’ গ্রন্থে তাঁদের তিনজনের মাযহাবই একত্রে সংকলিত হয়েছে।

(৩) ইমাম শাফেয়ী এবং শাফেয়ী মাযহাব

উপরোক্ত দু’টি মাযহাবের (মালিকী ও হানাফী) প্রসিধি এবং মূলনীট ও খুঁটিনাটি বিষয়সমূহ সংকলনের সূচনাকালেই শাফেয়ীর আবির্ভাব ঘটে। তিনি গভীরভাবে পূর্ববর্তীদের চিন্তা ও গবেষণা সমূহ পর্যালোচনা করতেন। তাঁদের ইস্তেম্বাত ও ইস্তেখরাজের পদ্ধতি তিনি বিশ্লেষণ করেন। এতে কিছু বিষয়ে তাঁর মনে খটকার সৃষ্টি হয়। তাঁর রচিত আমর গ্রন্থ ‘কিতাবুল উম্মে’র প্রথমদিকের এ বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন। এখানে সংক্ষেপে সেগুলো উল্লেখ করছিঃ

ক. তিনি দেখলেন, তাঁরা (মদীনা ও কুফার ফকীহগণ অর্থাৎ মালিকী ও হানাফীহণ) ‘মুরসাল ও মুনকাতি’ হাদীসও গ্রহণ করেছেন।২৪

[২৪. মুরসাল হচ্ছে ঐ হাদিস যা কোনো তাবেয়ী মধ্যবর্তী বর্ণনাকারী সাহাবীর নাম উল্লেখ করা ছাড়াই সরাসরি রাসুলুল্লাহর সুত্রে বর্ণনা করেছেন। আর মুনকাতি হলো সে হাদীস, যার বর্ণনাকারী দের (সনদের) ধারাবাহিকতা ভিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।–অনুবাদক] এর ফলে তাদের মধ্যে ক্রুটি প্রবেশ করেছে। হাদীস বত্তণনার সবগুলো পন্থা কমা করলে দেখা যায় বহু মুরসাল হাদীসে কোনোভিত্তি এই। বহু মুরসাল হাদীস মুসনাদ হাদীসে সাথে সাংঘর্ষিক। এ কারণে ইমাম শাফেয়ী কতগুলো শর্ত পূর্ণ হবার পূর্ব পর্যন্ত মুরসাল হাদীস গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেন। শর্তগুলো উসূলের গ্রন্থাবলীতে উল্লেখ রয়েছে।

খ. তিনি দেখলেন, তাঁরা ইখতিলাফপূর্ণ প্রমাণসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে কোনো নির্দিষ্ট বিধি অনুসরণ করেননি। যা অনুসরণ করলে তাঁদের ইজতিহাদসমূহ ভ্রান্তি থেকে সুরক্ষিত (মাহফুয) হতো। সুতরাং শাফেয়ী এ বিষয়ে মূলনীতি ও বিধি বির্ধারণ করে গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর এ গ্রন্থই উসূলে ফিকাহর পয়লা গ্রন্থ।

পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে তাঁর এই দ্বিতীয় উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনা উল্লেখ করে গেলোঃ একদিন ইমাম শাফেয়ী ইমাম মুহাম্মাদের কাছে এলেন। দেখলেন, তিনি বক্তব্য রাখছেন এবং বক্তব্যে এই বলে মদীনার ফকীহদের অভিযুক্ত করছেন “তারা মকদ্দমার ফায়সালার জন্যে দু’জন সাক্ষীর সাক্ষ্য জরুরী মনে করেনা, বরঞ্চ একজনের সাক্ষ্য এবং সেইসাথে বাদীর শপথের ভিত্তিতে ফায়সালা (রায়) দিয়ে দেয়। অথচ এটা আল্লাহর কিতাবের সাথে মানুষের মতের সংযোজন।” তাঁর বক্তব্য শুনে শাফেয়ী বললেন, “খবরে ওয়াহিদ২৫ দ্বারা কিতাবুল্লাহর উপর কিছু সংযোজন করা বৈধ নয়, এটা কি আপনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত?” তিনি বললেনঃ “হ্যাঁ।”

[২৫. খবরে ওয়াহিদ হলো সে হাদীস যার বর্ণনাকারীর সংখ্যা সকল যুগেই তিনজন, দুইজন কিংবা একজন ছিলো। —অনুবাদক]

এবার শাফেয়ী বললেন, “তবে আলা লা অসীয়্যাতা লোয়ারিছিন”—সাবধান, ওয়ারিশের জন্যে অসীয়াত করা যাবে না২৬

[২৬. বুখারী, নাসায়ী, মুসনাদে আহমদ প্রভৃতি গ্রন্থে হাদীসটি উল্লেখ হয়েছে। ইমাম শাফেয়ীর বক্তব্য হলো হাদীসটি খবরে ওয়াহিদ শ্রেণীভূক্ত।—অনুবাদক]

—হাদীসটির ভিত্তিতে ওয়ারিশের জন্যে অসীয়ত করা যাবে না বলে আপনি কমন করে মত দিয়েছেন? অথচ আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ (

كُتِبَ عَلَيْكُمْ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ إِن تَرَكَ خَيْرًا الْوَصِيَّةُ لِلْوَالِدَيْنِ وَالأقْرَبِينَ بِالْمَعْرُوفِ حَقًّا عَلَى الْمُتَّقِينَ

কুতিবা আলাইকুম ইযা হাদারা আহাদাকুমুল মাউতু ইন তারাকা খাইরানিল অসিয়্যাতু লিল ওয়ালিদাইনি ওয়াল আকরাবীনা বিল মা’রুফ )—তোমাদের কারো মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে সে যদি ধন-সম্পদ রেখে যেতে থাকে তাহলে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তার পিতামাতা এবং নিকটাত্নীয়দের জন্যে অসীয়াত করাকে তোমাদের উপর ফরয করে দেয়া হলো।২৭

[২৭. দেখুন, সূরা আল বাকারা-১৮০। –অনুবাদক]

এটা কি খবরে ওয়াহিদ দ্বারা কুরআনের উপর সংযোজন নয়? এভাবে শাফেয়ী মুহাম্মাদের আরো কয়েকটি অভিযোগ উত্থাপন করলেন। এর ফলে মুহাম্মাদ চুপ হয়ে যান।

গ. তিনি দেখলেন, উলামায়ে তাবেয়ীন, যাদের উপর ফতোয়া দানের দায়িত্ব ছিলো-কোনো কোনো সহীহ হাদীস তাদের নিকট পৌছেইনি। তাই, হাদীসে রাসূলে স্পষ্ট বিধান রয়েছে, এরূপ মাসায়েলও কখনো কখনো তাদের কাছে এলে হাদীস জানা না থাকার ফলে তারা সে বিষয়ে ইজতিহাদ করেছেন, কিংবা সাধারণ ধারণামতে ফতোয়া দিয়েছেন অথবা কোনো সাহাবীর কর্মনীতিকে অবলম্বন করে সে অনুযায়ী ফতীয়া প্রদান করেছেন। অতঃপর কখনো এমন হয়েছে যে, পরবর্তীতে তৃতীয় স্তরে এসে সে সংক্রান্ত হাদীস নজরে এলো। কিন্তু তারপরও ফকীহগণ তা গ্রহণ করেননি এবং সে অনুযায়ী আমল করেননি। তাদের ধারণা ছিলোঃ এ হাদীস তো আমাদের শহরের পুর্ববর্তী আলিমগণের আমল এবং মাযহাবের বিপরীত। সুতরাং এতে কোনো না কোনো দুর্বলতা বা ক্রুটি রয়েছে, যার ফলে তা তাঁদের নিকট তা গ্রহণযোগ্য হয়নি।

আবার কখনো এমন হয়েছে যে, সে হাদীসগুলো তৃতীয় স্তরে এসে ও সকলের নজরে আসেনি। এসেছে আরো পরে যখন মুহাদ্দিসগণ পৃথিবীর দিক দিগন্তে হাদীস সংগ্রহের জন্যে ছড়িয়ে পড়েন এবং হাদীসে বিভিন্ন তরীকা ও সনদ সংগ্রহের কাজে পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেছেন। ফলে বহু হাদীসের অবস্থা এমন হয়েছে, যেগুলোর বর্ণনাকারী সাহাবীর সংখ্যা এক বা দুইয়ের অধিক ছিলো না। তাঁদের থেকে শুনে পরবর্তীদের যারা শুনিয়েছেন তাদের সংখ্যাও এক বা দুইয়ের অধিক ছিলো না। তাঁদের থেকে শুনে পরবর্তীদের যারা শুনিয়েছেন তাদের সনহখ্যা ও এক বা দুইয়ের অধিক ছিলো না। এমনি করে পরবর্তীতেও বর্ণনাকারীদের সংখ্যা কমই থেকে যায়, এর ফলে এই দীর্ঘ সমকাল হাদীসগুলো সাধারণ ফকীহদের দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যায়। অতঃপর হাদীসে সেইসব মহান হাফিযদের যুগে এসে সেগুলো সকলের নজরে আসে, যারা বিভিন্ন তরীকায় বিভিন্ন সূত্র ও উৎস থেকে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন করেন।

এই বাস্তব বিষয়গুলোর প্রেক্ষিতে ইমাম শাফেয়ীর বক্তব্য হলো, আমাদেরকে সাহাবী এবং তাবেয়ী আলিমগণের নীতি অনুসরণ করা উচিত। তাঁদের সামনে যখন কোনো মাসয়ালা আসতো, তখন প্রথমেই তাঁরা সে বিষয়র রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীস অনুসন্ধান করতেন। সে সংক্রান্ত কোনো হাদীস পাওয়া না গেলে কেবল তখনই তা অন্য প্রকার দলিল ও যুক্তি গ্রহণ করেতেন। কিন্তু তারপরও তাঁরা নিজেরদের জন্যে হাদীস গ্রহণের দরজা নন্ধ করে দিতেন না। বরঞ্চ যখনই সেই সংক্রান্ত কোনো হাদীস তাঁদের অবগতিতে আসতো সাথে সাথে নিজেদের ইজতিহাদ পরিত্যাগ করে সেই হাদীসকে গ্রহণ করতেন। বাস্তব ঘটনাই যখন এই, তখন তাঁরা কোনো হাদীসকে গ্রহণ করেননি বলেই তা দুর্বল বা ক্রুটিপূর্ণ হবার কথা স্পষ্টভাবে বলে গিয়ে থাকলে তা আলাদা কথা। এর উদাহরন হচ্ছে হাদীসে কিল্লাতাইন।২৮

[২৮. কিল্লাতাইন ‘কিল্লাতুন’ এর দ্বিবচনঃ কিল্লাতুন মানে বড় মটকা যাতে পাঁচশ রতল পানি ধরে। হাদীসটি হলোঃ “ইযা কানা বালাগাল মাউ কিল্লাতাইন লাম ইয়াহমিলিল হুবূস—দুই কিল্লা পরিমাণ পানিতে নাজাসাত পড়লে তা নাপাক হয় না।“ (মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ, দারেমী)–অনুবাদক]

বিভিন্ন সুত্রে বর্ণিত এই হাদীসটি একটি সহীহ হাদীস। অধিকাংশ সুত্রে প্রথিম দিকের রাবীগণ হলেন। “হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ওলীদ ইবনে কাসীর, তাঁর কাছে বর্ণনা করেছেন মুহাম্মাদ ইবনে জাফর ইবনে যুবায়ের কিংবা মুহাম্মাদ ইবনে ইবাদ ইবনে জাফর, তাঁর কাছে বর্ণনা করেছেন উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ এবং তার কাছে বর্ণনা করেছেন আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা)।” পরবর্তীকালে সনদটির বিভিন্ন শাখা প্রশাখা সৃষ্টি হয়। এই দুইজন রাবীই (মুহাম্মাদ ইবনে জাফর এবং মুহাম্মাদ ইবনে ইবাদ) যদিও পুর্ণ বিশ্বস্ত কিন্তু যেহেতু তাঁরা ঐসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না যারা ফতোয়া দানের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। সে কারণে হাদীসটি সায়িদ অবনে মুসাইয়্যেব এবং যুহুরীর যামানায় খ্যাতি লাভ করেনি আর তা মালিকী এবং হানাফিদের দৃষ্টিতেও আসেনি। ফলে তাঁরা এর ভিত্তিতে আমল করেননি। কিন্তু শাফেয়ীর যামানায় হাদীসটি খ্যাতি লাভ করে এবং তিনি তার ভিত্তিতে আমল করেন।

এর দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে, খিয়ারে মজলিসের হাদীস।২৯

[২৯. হাদীসটি হলোঃ “ক্রয়-বিক্রয়ের অনুষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পূর্ব পর্যন্ত ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই ক্রয় বা বিক্রয় বাতিল করবার ইখতিয়ার থাকে।“ ইমাম মালিক মুআত্তায় হাদীসটি বর্ণনা করেছেন বটে, কিন্তু এর ভিত্তিতে আমল করেননি।—অনুবাদক]

ঘ. শাফেয়ীর যামানায় সাহাবায়ে কিরামের (রা) কওল সর্বাধিক সংগ্রথিত হয়। এসব বক্তব্য ছিলো ব্যাপক বিস্তৃত ও ইখতিলাফ পূর্ণ। তিনি এসব কওলের পর্যালোচনা বিশ্লেষণ করতেন। ফলে এর একটা বিরাট অংশ তিনি সহীহ হাদীসের বিপরীতে দেখতে পান। কারণ এ হাদীসগুলো সকল সাহাবীর নিকট পৌছেনি। তিনি আরো দেখলেন, এরূপ অবস্থা সৃষ্টি হলে অতীতের আলিমগণ সাহাবীদের কওল ত্যাগ করে হাদীসে রুজু করতেন। সুতরাং এরূপ অবস্থায় তিনিও সাহাবীদের কওল অনুসরণ করেননি। তিনি বলতেন, সাহাবীগণও মানুষ আমরাও মানুষ।৩০

[৩০. অর্থাৎ আমাদেরই মতো তারাও বুঝের ও চিন্তার ক্ষেত্রে ক্রুটি-বিচ্যুতির উর্ধে ছিলেন না। সুতরাং নবীর বক্তব্যের মতো তাঁদের বক্তব্যও চোখ বন্ধ করে গ্রহণ করা যায় না। কুরআন সুনাহ থেকে মাসায়েল ইস্তেম্বাত করা তাঁদের জন্যে যেমন বৈধ ছিলো, আমাদের জন্যেও তেমনি বৈধ। সর্বাবস্থায় তাঁদের ইস্তেম্বাতের অনুসরণ করতে আমরা বাধ্য নই।—অনুবাদক]

ঙ. তিনি আরো দেখলেন, একদল ফকীহ ‘রায়’ এবং ‘কিয়াস’কে একাকার করে ফেলেছে। উভয়টির মধ্যে কোনো পার্থক্যই বাকী রাখছে না। অথচ শ্রীয়ত ‘রায়’কে নাজায়েজ এনং ‘কিয়াস’কে জায়েজ ও মুস্তাহসান বলে আখ্যায়িত করে। এই লোকগুলো কখনো কখনো ‘রায়কে’ ইস্তেহসান বলে থাকে। তিনি বলেন, আমি ‘রায়’ বলতে কোনো ক্রুটি কিংবা যুক্তির ধারণা বা সম্ভাবনাকে কোনো বিধানের ভিত্তি বা কারণ ধরে নেয়াকে বুঝাচ্ছি আর ‘কিয়াস’ বলতে বুঝাচ্ছি, কোনো মানসূস বিধানের কারণ খুঁজে বের করা এবং সেই কারণের ভিত্তিতে অনুরূপ অন্যান্য বিষয়েও একই বিধান স্থির করা।

শাফেয়ী ফকীহদের এই কর্মপন্থাকে সম্পূর্ণ বাতিল ঘোষণা করেন, তিনি বলেন, “যে ব্যাক্তি ইস্তেহসান বা রায়ের ভিত্তিতে কাজ করে, সে মূলত নিজেই শরীয়ত প্রণেতা হতে চায়।” তাঁর এ বক্তব্যটি ইবনে হাজিব ‘মুখতাসারুল উসূল’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

এর উদাহরণ হচ্ছে ইয়াতীমের বুঝ-জ্ঞান হবার মাসয়ালা। আসলে ইয়াতীমদের বুঝ-জ্ঞান হওয়াটা এমন একটা গোপন বিষয় যার সময়-রেখা সকলের জন্যে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু কোনো কোনো ফকীহ ভাবলেন, মানুষের তো পঁচিশ বছরের মধ্যে অবশ্যি বুঝ-জ্ঞান হয়ে যায়। সুতরাং তাঁরা পঁচিশ বছরের এ ধারণা বা সম্ভাবনাকে “বুঝ-জ্ঞান’ হওয়ার বিকল্প হিসেবে ধরে নেন। এই ধারনা তাদের কাছে বিধানে পরিণত হয়েচ যায় যে, ইয়াতীমের বয়স পঁচিশ হলে তার মাল অবশ্যি তার কাছে ফেরত দিতে হবে। তাদের মতে এটা হচ্ছে ‘ইস্তেহসান’। অথচ এ মাসয়ালায় কিয়াস হচ্ছে ইয়াতীমের মাল অতোক্ষণ পর্যন্ত তার হাতে ফেরত দেয়া যাবে না যতোক্ষণ না সে পুরোপুরি বুঝ-জ্ঞান প্রাপ্ত হয়।

মোট কথা, সাফেয়ী তাঁর পুর্ববর্তীদের মদ্যে যখন এই বিষয় গুলো দেখতে পেলেন, তখন তিনি ইলমে ফিকাহর প্রতি সম্পূর্ণ নতুনভাবে দৃষ্টি আরোপ করলেন। এবং উসূলে ফিকাহর ভিত্তি স্থাপন করেন। অতঃপর সেই উসূলের ভিত্তিতে ফিকাহর বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় ইস্তেম্বাত করেন, গ্রন্থাবলী রচনা করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে উপকৃত করেন। সমকালীন ফকীহরা তার চারপাশে একত্রিত হয়ে যান। তাঁরা তাঁর চিন্তাধারা ও গ্রন্থাবলী অধ্যায়নে মনোনিবেশ করেন, সেগুলোর সার নির্যাস বের করেন, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন, সেগুলো থেকে দলিল আদিল্লা গ্রহণ করেন এবং সেগুলোকে সামনে রেখে নতুন নতুন মাসায়েল ইস্তেম্বাত করেন। অতঃপর এসব জিনিস সাথে নিয়ে তাঁরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েন। এভাবেই ফিকাহর আরেকটি স্কুল আরেকটি মাযহাব প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি লাভ করে, যা শাফেয়ীর মাযহাব নামে পরিচিত।৩১

[৩১. গ্রন্থকার এখানে হাম্বলী মাযহাবকে পৃথক মাযহাব হিসেবে উল্লেখ করেননি। সম্মুখে একস্থানে তিনি এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। —অনুবাদক]


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি