একটি অভিযোগ এবং তার জবাব

প্রশ্ন করা যেতে পারে,

“শরীয়ত যখন একটিই, তখন সে শরীয়তে একটি জিনিস এক সময় ওয়াজিব না থাকা আর অপর সময় ওয়াজিব হয়ে যাওয়াটা কেমন ব্যাপারঃ একই শরীয়াতে তো এমনটি হতে পারে না। সুতরাং ‘প্রথমত মুজতাহিদ মুসতাকিল-এর ইকতিদা ওয়াজিব ছিল না, পরে তা ওয়াজিব হয়ে যায়।’ এটা পরস্পরবিরোধী কথা নয় কি?” এর জবাবে আমি বলবোঃ প্রকৃতপক্ষে ওয়াজিব তো হচ্ছে, উম্মতের মধ্যে এমনসব লোক বর্তমান থাকা, যারা প্রাসংগিক বিধানসমূহকে মজবুত দলিল প্রমাণের দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত করার যোগ্যতা রাখেন। সমস্ত হকপন্থী এই ওয়াজিবের ব্যাপারে সর্বসম্মত। একইভাবে এ বিষয়টিও সর্বসম্মত যে, যে জিনিস কোনো ওয়াজিব বিধান লাভ করার মাধ্যম, স্বয়ং সে জিনিসটিও ওয়াজিব। আর কোনো ওয়াজিব বিষয় লাভ করার যদি একাধিক মাধ্যম বা পন্থা থাকে, তবে সেগুলোর কোনো একটি গ্রহণ করা ওয়াজিব। কিন্তু কোনো ওয়াজিব বিষয় লাভ করার উপায় বা পন্থা যদি একটিই বর্তমান থাকে, তবে সেটিই ওয়াজিব। যেমন, ক্ষুধায় এক ব্যাক্তির জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। আর ক্ষুধা নিবারণের জন্য কয়েকটি পন্থা বা উপায় তার কাছে রয়েছে। সে ইচ্ছা করলে খাবার কিনে খেতে পারে, বাগান থেকে ফল পেড়ে খেতে পারে অথবা খাওয়ার উপযুক্ত প্রাণী শিকার করে খেতে পারে। এখন এ ব্যাক্তির জন্যে তিনটি উপায়ের ‘যে কোনো একটি’ অবলম্বন করা ওয়াজিব, নির্দিষ্ট একটি নয়। কিন্তু সে যদি এমন কোনো স্থানে থাকে, যেখানে কোনো ফল এবং শিকার পাবার সুযোগ নেই, তবে সেক্ষেত্রে পয়সাদিয়ে খাবারক্রয় করেই ক্ষুধা নিবারণ করা তার জন্যে ওয়াজিব। (আলোচ্য মাসয়ালাটি এ দৃষ্টান্তের সাথে তুলনীয়)। এই মূল ওয়াজিব হাসিল করার জন্যেও অতীত আলিমগণের নিকট কয়েকটা পন্থা ছিলো। সুতরাং কয়েকটা পথের মধ্যে যে কোনো একটিকে অবলম্বন করাই ছিলো তাদের জন্যে ওয়াজিব, নির্দিষ্ট একটিকে অবলম্বন করে নয়। অতঃপর তাঁরা যখন একটি পথ৬৬ অবলম্বন করলেন, তখন সেই একটি ছাড়া বাকী সব পথ বন্ধ হয়ে যায়।

[৬৬. অর্থাৎ তাকলীদের পথ। এখানে সেই প্রশস্ত অর্থে তাকলীদের কথা বুঝানো হয়েছে, যার স্বরূপ একটু আগেই আলোচিত হয়েছে। –অনুবাদক]

এমতাবস্থায় সকলের জন্যে এই একটি পথের অনুসরণই ওয়াজিব হয়ে পড়ে। উলামায়ে সলফ হাদীস লিখতেন না। কিন্তু আধুকিনকালে কি দেখছো? এখন হাদীস লেখা ওয়াজিব হয়ে পড়েছে। কারণ, মৌখিকভাবে হাদীস বর্ণনার ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং গ্রন্থাবলীর মাধ্যম ছাড়া এখন আর হাদীস জানার কোনো উপায় নেই।

(আরবী ভাষার) ব্যাকরণ ও ভাষাতত্বের ব্যাপারেও একই কথা। উলামায়ে সলফ এগুলির প্রতি কিছুমাত্র মনোযোগ আরোপ করেতেন না। সুতরাং তাঁরা এ বিষয়ে শিক্ষালাভের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। অথচ আমাদের যুগের আলিমদের জন্যে আরবী ভাষাতত্ব ও ব্যাকরণ শেখা ওয়াজিব হয়ে পড়েছে। কারণ ইসলামের প্রাথমিক যুগের আরবী থেকে বর্তমান সময়টা ব্যাবধান বিরাট। এরকম আরো অনেক উদাহরণই পেশ করা যেতে পারে।

কখন নির্দিষ্ট ইমামের তাকলীদ করা ওয়াজিব

একজন ইমামের তাকলীদ করার বিষয়টি ও এই মূলনীতির আলোকেই কিয়াস করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট ইমামের তাকলীদ করাটা কখনো ওয়াজিব থাকে। আবার কখনো ওয়াজিব থাকে না। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবেঃ ভারতবর্ষ কিংবা ইউরোপ বা আমেরিকায় যদি কোনো জাহিল মুসলমান বর্তমান থাকে আর সেখানে মালেকী, শাফেয়ী এবং হাম্বলী মাযহাবে কোনো আলিম বা গ্রন্থ না থাকে, তবে এ ব্যাক্তির জন্যে আবু হানীফার মাযহাবের তাকলীদ করা ওয়াজীব এবং এ মাযহাবের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া বৈধ নয়। কারণ, এমতাবস্থায় সে এই মাযহাবের বন্ধন থেকে বেরিয়ে পড়লে, ইসলামের বন্ধন থেকেই মুক্ত হয়ে পড়বে। পক্ষান্তরে কোনো ব্যাক্তি যদি মক্কা বা মদীনায় অবস্থানকারী হয়, তবে তার জন্যে নির্দিষ্ট এক ইমামের তাকলীদ করা ওয়াজিব নয়। কেননা সেখানে সকল মাযহাব সম্পর্কে অবগত হওয়া তার পক্ষে খুবই সহজ।

 

১০. ইজতিহাদ
ইজতিহাদে মতলক

(এবার ইজতিহাদ প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাক। ইজতিহাদ মূলত দুই প্রকার। একঃ ইজতিহাদে মতলক দুইঃ ইজতিহাদে মুকাইয়্যাদ।) মুজতাহিদ মতলক হচ্ছে তিনি, যিনি পাঁচ প্রকার জ্ঞানে দক্ষতা রাখেন। ইমাম নববী তাঁর ‘আল মিনহাজ’ গ্রন্থে এর বিবরণ লপবদ্ধ করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ

“কাযী হবার শর্তাবলী হলোঃ ব্যাক্তিকে মুসলিম হতে হবে। বালেগ ও বিবেকসম্পন্ন হতে হবে। স্বাধীন হতে হবে। পুরুষ হতে হবে। ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং বাকশক্তি সম্পন্ন হতে হবে। আর মুজ্জতাহিদ ঐ ব্যাক্তিই হতে পারেনঃ

১. যিনি কিতাব ও সুয়াহর বিধান সংক্রান্ত অংশগুলোর উপর গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী। তাছাড়া ঐসব বিধানের খাস, আম, মুজমাল, মুবাইয়্যান, নাসিখ ও মানসূখ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন।

২. যিনি বর্ণনা গত দিক থেকে হাদীসসমূহের মুতাওয়াতির, খবরে ওয়াহিদ, মুত্তাসিল ও মুরসাল হবার অবস্থা এবং শক্তিশালী ও দুর্বল রাবী সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন।

৩. যিনি ভাষাতত্ব ও ব্যাকরণ উভয় দিক থেকেই আরবী ভাষায় পান্ডিত্য রাখেন।

৪. যিনি সাহাবী ও তাবেয়ী আলিমগণের ব্যাপারে এ খবর রাখেন যে, তাঁরা কোন কোন মাসয়ালার ক্ষেত্রে একমত পোষণ করতেন আর কোন কোন মাসয়ালার ক্ষেত্রে তাঁদের মতপার্থক্য ছিলো।

৫. যিনি কিয়াসের তাৎপর্য ও তার সকল প্রকারভেদ সম্পর্কে সম্যক অবগত।”

মুজতাহিদ মতলকের প্রকারভেদ

ইজতিহাদে মতলক সম্পর্কে জানার পর যে জিনিসটি জানা দরকার তা হলো, ‘মুজতাহিদ মতলক’ দু’রকম হয়ে থাকেন। এক, ‘মুজতাহিদ মতলক মুসতাকিল।’ দুই ‘মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব’।

মুজতাহিদ মতলক মুসতাকিল এবং তার বৈশিষ্ট্য

এমন এক ইসলামী বিশেষজ্ঞকে ‘মুজতাহিদ মতলক মুসতাকিল’ (স্বাধীন স্বয়ংসম্পুর্ণ মুজতাহিদ) বলা হয়, যাঁর মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান এবং সেগুলো এতোটা বিশেষভাবে বিদ্যমান যে, সেগুলো তাঁকে অন্য সকল ইজতিহাদের অধিকারী লোকদের থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করে। যেমন, তোমরা শাফেয়ীকে দেখতে পাচ্ছো, যাঁর মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। সেই বৈশিষ্ট্য তিনটি হলোঃ

এক. তিনি নিজেই ফিকহী মাসায়েল ইস্তিম্বাত করার উসূল ও নিয়মকানূন নির্ধারণ করবেন।৬৭ যেমন

[৬৭. অর্থাৎ উসূলে ফিকাহ প্রণয়ন করবেন। –অনুবাদক]

শাফেয়ী ‘আল উম্ম’ গ্রন্থের প্রথম দিকে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে আলোচিত হয়েছে। সেখানে তিনি তাঁর পূর্ববর্তী আলিম ও মুজতাহিদ্গণের ইজতিহাদের পদ্ধতি আলোচনা করে তাঁদের কিছু কিছু উসূলের সমালোচনা ও বিরোধিতা করেছেন। ইমাম শাফেয়ীর সেই বক্তব্যটির মধ্যেও আমার এ কথার সমর্থন রয়েছে, যে বক্তব্যটি আমার উস্তাদ শাইখ আবু তাহের মুহাম্মাদ ইবনে ইব্রাহীম মাদানী তাঁর নিম্নোক্ত মাক্কী শাইখগণের সুত্রে আমার নিকট বর্ণনা করেছেন। সুত্রটি হলোঃ শাইখ হাসান ইবনে আলো আজমী>শাইখ আহমদ নখলী> শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আ’লা বাহেলী>ইব্রাহীম ইবনে ইব্রাহীম লাক্কানী>আবদুর রউফ তাবলাবী জালাল>আবু ফদল সুয়ুতী>আবিল ফদল মারজানী>আবুল ফরজ গযযী>ইউনুস ইবনে ইব্রাহীম দবূসী>আবুল হাসান ইবনুল বকর>ফদল ইবনে সাহল ইসফ্রাইনী>হাফিযুল হুজ্জাত আবু বকর আহমাদ ইবনে আল খতীব>আবু নুয়ীম আল হাফিয আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে জা’ফর ইবনে হাব্বান>আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব আবু হাতিম অর্থাৎ রাযী ইউনুস ইবনে আবুল আ”লা মুহাম্মাদ ইবনে ইদরীস শাফেয়ী। তিনি (শাফেয়ী) বলেনঃ

“মূল (উৎস) হচ্ছে, কুরআন ও সুন্নাহ। কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহ যদি সরাসরিভাবে কোনো মাসয়ালা পাওয়া না যায়, তবে সেগুলোর ভিত্তিতে কিয়াস করতে হবে। কোনো হাদীসের সনদ যদি রাসূলুল্লাহ (স) পর্যন্ত পৌছে এবং তা যদি বিশুদ্ধ হয়, তবে সেটাই ‘সুন্নাহ’। খবরে মুফরাদের চাইতে ইজমা অধিকতর শক্তিশালী। হাদীসে বাহ্যিক অর্থই গ্রহ করা উচিত। কোনো হাদীস যদি একাধিক অর্থবহ হয়, সেক্ষেত্রে ঐ অর্থই গ্রহণ করা উচিত, যা হাদীসটির বাহ্যিক দিকের নিকটতর। যদি একই বিষয়ে (মতবিরোধপূর্ণ) কয়েকটি হাদীস পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ঐ হাদীসটিকেই বিশুদ্ধ মনে করতে হবে, যেটির সনদ বিশুদ্ধতম। মুনকাতি হাদীসের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেব বর্ণিত (মুনকাতি) হাদীসগুলো অবশ্যি গুরুত্বপূর্ণ। শরীয়তের কোনো মূলভিত্তিকে অপর মূলভিত্তির উপর কিয়াস করা যাবে না। এটা ‘কেন হলো’ ‘কেমন করে হলো’ –শরীয়তের কোনো মূলভিত্তির ব্যাপারে এ ধরনের কোনো কথা বলা যাবে না। তবে প্রাসংগিক (ফরুয়াত) বিধানের ক্ষেত্রে এ ধরনের কথা বলা যাবে। আর কিয়াসের প্রয়োজন তো প্রাসংগিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।

সুতরাং কোনো মূলভিত্তির নিরিখে কোনো প্রাসংগিক বিষয়ের কিয়াস যদি সঠিক হয়, তবে সে প্রাসংগিক বিধান সহীহ এবং হুজ্জাত হিসেবে স্বীকৃত হবে।”

দুইঃ তিনি সাধ্যানুযায়ী ‘হাদীস’ এবং ‘আছারের’ একটা বড় ভান্ডার সংগ্রহ করবেন। এগুলোর ভেতর থেকে যেসব বিধান পাওয়া যেতে পারে, সেগুলো জেনে নেবেন। এগুলোর মধ্যে কোন হাদীসগুলো ফিকাহর উৎস। সেগুলো পরিস্কারভাবে চিহ্নিত করবেন। ইখতিলাফপূর্ণ হাদীসগুলোর মধ্যে সমতা বিধান করবেন। এবং দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে একটিকে আরেকটির উপর অগ্রাধিকার প্রদান করবেন। কোনো হাদীস যদি একাধিক অর্থবহ হয় সেটির একটি অর্থ নির্ণয় করবেন। (এগুলো বিরাট যোগ্যতার ব্যাপার) এমনকি আমার মতে এই বৈশিষ্ট্যটি ইমাম শাফেয়ীর দুই তৃতীয়াংশ ইলমের সমতুল্য। তবে আল্লাহই অধিক জানেন।

তিন. তিনি তাঁর ইজতিহাদী যোগ্যতা দ্বারা তাঁর সামনে আসা সমস্ত মাসয়ালার জবাব দিতে সক্ষম হবেন, যেগুলোর জবাব তাঁর পূর্বে কেউই দিয়ে যাননি।

মোটকথা, মুজতাহিদ মতলক মুসতাকিল তিনিই হতে পারেন, যিনি এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে এতোটা দখতা, পারদর্শিতা ও স্বতন্ত্রের অধিকারী যে, এ ময়দানে তিনি অন্যদের ছাড়িয়ে অনেক দূরত্বে এগিয়ে গেছেন।

উপরোক্ত তিনটি বৈশিষ্ট্য ছাড়াও চতুর্থ একটি বিষয় আছে, তা হলো, উর্ধ্বজগত থেকে তার পক্ষে সাধারণের নিকট গ্রহনযোগ্যতা নাজিল হতে হবে আর তা হবে রভাবে যে, মুফাসসিরীন, মুহাদ্দিসীন, উসূল বিশেষজ্ঞগণ এবং ফিকাহ গ্রন্থাবলীর হাফিযগণ দলে দলে তাঁর ইলমের প্রতি আকৃষ্ট ও প্রভাবিত হয়ে পড়বে। আর এই সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পরবর্তীতে যুগের পর যুগ চলে থাকবে। এমনকি মানুষের অন্থরের গহীনে এই গ্রহণযোগ্যতা শিকড় গেড়ে নিবে।৬৮

[৬৮. এই চতুর্থ বিষয়টি একজন মুজতাহিদ মতলক মসতাকিলের জন্যে প্রয়োজন বটে, কিন্তু শর্ত নয়। প্রথম তিনটি এ যোগ্যতার অপরিহার্য শর্ত। এ জন্যেই গ্রন্থকার চতুর্থটিকে পয়লা তিনটি থেকে পৃথক করে আলোচনা করেছেন। –অনুবাদক]

মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব

‘মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব’ (স্বাধীন সম্পর্কযুক্ত মুজতাহিদ) বলা হয় তাকে যিনি উপরোক্ত তিনটি শর্তের মধ্যে প্রথমটির ক্ষেত্রে উপরোল্লেখিত ধরনের কোনো মুজতাহিদকে অনুসরন করেন। কিন্তু দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তিনি নিজেই। এ দুটির ক্ষেত্রে ইমামের তাকলীদের পরিবর্তে নিজেই তাঁর মতো স্বতন্ত্র অবদান রাখেন।

মুজতাহিদ ফিল মাযহাব

মুজতাহিদ ফীল মাযহাব বা মাযহাবী মুজতাহিদ হলেন তিনি, যিনি উল্লিখিত তিনটি শর্তের দুইটির ক্ষেত্রে ইমাম মুজতাহিদকে তাকলীদ করেন। তবে তৃতীয়টির ক্ষেত্রে কিছুটা স্বতন্ত্র অবদান রাখেন। অর্থাৎ ইমাম মুজতাহিদের পন্থা অনুসরণ করে মাসয়ালা ইস্তিম্বাত করেন। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছিঃ

এখন আমাদের যুগে যারা চিকিৎসকের কাজ করেন, তারা হয় প্রাচীন ইউনানী চিকিৎসকদের প্রদর্শিত পন্থানুযায়ী চিকিৎসা করেন, না হয় প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসকদের অনুসরণে চিকিৎসাকার্য পরচালনা করেন। এক্ষেত্রে এই প্রাচীন ইউনানী (গ্রীক) বা প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসকগণ (যাদের প্রদর্শিত পন্থায় বর্তমান কালের চিকিৎসকগণ চিকিৎসাকার্য পরিচালনা করেন) মুজতাহিদ মতলক মুসতাকিলের মতো মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।

এখন আমাদের কালের এই চিকিৎসকদের দুইটি অবস্থা হতে পারে। একটা অবস্থা এই হতে পারে যে, তারা ঔষধের বিশেষত্ব, গুণপ্রকৃতি এবং রোগের উৎস ও শ্রেণী বিভাগ সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। এ প্রসংগে প্রাচীন চিকিৎসকগণ যে পথ ও পদ্ধতি প্রদর্শন করে গেছেন, তা অনুসরণ করে তারা এই শাস্ত্রবিদ্যায় স্বয়ংসম্পূর্ণ ও প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অধিকারী হয়েছেন। প্রাচীন চিকিৎসকদের মতো নিজেরাও এতোই বুৎপত্তি অর্জন করেছেন যে, তারা তাদের অনুসরণ ছাড়াই রোগের এমনসব প্রকৃতি বৈশিষ্ট্য, কারণ ও শেণীবিন্যাস নির্ণয় করেন যা প্রাচীন চিকিৎসকেরা আলোচনাই করে যাননি। তাছাড়া এ পর্যায়ে প্রাচীনদের অনুসরণ ছাড়াই তারা রোগের প্রকৃতি অনুযায়ী ঔষধ তৈরী ও চিকিৎসার ফর্মূলা স্থির করতে সক্ষম। এ ক্ষেত্রে তারা প্রাচীন চিকিৎসকদের সাথে মতপার্থক্য করেন। তাদের ফর্মূলাকে ভুল প্রমাণ করে নিজেরা নতুন ফর্মূলাও প্রদান করেন। এ মতপার্থক্য সীমিত পরিসরে ও হতে পারে আবার ব্যাপক পরিসরেও হতে পারে, এইরূপ চিকিৎসকদের মর্যাদা হলো মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিবের মতো।

আমাদের কালের এই চিকিৎসকদের আরেকটি অবস্থা এই হতে পারে যে, তারা চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে প্রাচীন চিকিৎসকদের মতামত ও ফর্মূলা মেনে চলে। তবে তাদের আসল দক্ষতা হলো, তারা প্রাচীন চিকিৎসকদের ফর্মূলা অনুযায়ী ঔষধ প্রস্তুত করেন। এইরূপ চিকিৎসকদের মর্যাদা হলো মুজতাহিদ ফীল মাযহাব বা মাযহাবী মুজতাহিদের মতো।

আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমাদের যুগে যারা কবিয়ালী করে, তারা কবিতার মাত্রা, ছন্দ, আনুপ্রাস ও স্টাইলের ক্ষেত্রে হয় প্রাচীন আরব কবিদের অনুসরণ করে, না হয় প্রাচীন অনারব কবিদের। এক্ষেত্রে এই প্রাচীন আরব বা অনারব কবিদের মর্যাদা হলো, মুজতাহিদ মতলক মুসতাকিল এর মতো।

এখন আমাদের যুগের এই কবিদের দুইটি অবস্থা হতে পারে। এদের মধ্যে যারা কবিতার মাত্রা, ছন্দ, অনুপ্রাস, এবং স্টাইলের ক্ষেত্রে তারা এমন এমন অভিনব নিয়ম-পন্থা তৈরী করে নেয়, যা অতীতের কেউ চিন্তা ও করে নাই। যেমন দুই দুই বা চার চার পংক্তির কবিতা, কিংবা অন্তমিল বা বে-মিল পংক্তির কবিতা। এরূপ কবিদের মর্যাদা হলো, মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিবের মতো। পক্ষান্তরে এদের মধ্যে যেসব কবি কেবল ঐ প্রাচীন কবিদের রীতিনীতিকেই অনুসরণ করে, তাদের মর্যাদা হলো মুজতাহিদ ফীল মাযহাবের মতো। ইলমে তাফসীর, ইলমে তাসাউফ এবং অন্যান্য শাস্ত্রের ক্ষেত্রেও একই ধরনের উদাহরণ প্রযোজ্য।

প্রাচীনরা উসূলে ফিকাহ সংকলন করেননি কেনো?

এ পর্যায়ে তোমরা যদি আমাকে প্রশ্ন করো, প্রাথমিক যুগের আলিমগণ উসূলে ফিকাহ সংকলন করে যাননি কেন? এমনকি তারাতো এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাতও করে যাননি। অতঃপর ইমাম শাফেয়ীর প্রকাশ ঘটল। তিনি উসূলে ফিকাহ প্রণয়ন ও সংকলন করে যান যা পরম কল্যাণকর প্রমাণিত হয়। এখন প্রশ্ন হলো তার পূর্বেকার মুজতাহিদ্গণ কেনো এ বিষয়ে হাত দেননি?

এর জবাবে আমি বলবো, প্রাচীন আলিমগণের প্রত্যেকের কাছে কেবল নিজ নিজ শহরের লোকদের বর্ণিত হাদীস এবং আছারই বর্তমান ছিলো। সকল শহরের সম্মিলিত বর্ণনাসমূহ কোনো একজনের নিকট সঞ্চিত ছিল না। এ কারণে কোনো বড় ধরনের মতপার্থক্যের সম্মুখীন তাদের হতে হয়নি। নিজ শহরের বর্ণনাসমূহের মধ্যে যদি কখনো কোনো মতবিরোধপূর্ণ বর্ণনা পাওয়া যেতো, সেক্ষেত্রে তারা নিজ নিজ বিচক্ষণতা ও অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা তার মধ্যে সমতা বিধান করতেন। অতঃপর শাফেয়ীর যুগ আসে। এসময় পর্যন্ত সকল শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাদীস ও আছারসমূহ এবং বিভিন্ন শহরের ফকীহদের রায়ের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এর মধ্যে বহু মতপার্থক্য ছিলো জটিল ধরনের। প্রত্যেক শহরের লোকেরা নিজ নিজ শাইখদের বর্ণিত হাদীস, আছার ও রায়কেই সঠিক মনে করেছিল। ফলে ইখতিলাফ আরো জটিলতর ও ব্যাপকতর হয়ে পড়ছিল। ইখতিলাফের ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। লোকেরা এসব ইখতিলাফের ঘূর্ণিপাকে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এর থেকে বেরুবার কোনো পথ পাচ্ছিলনা। অতঃপর তাদের প্রতি আল্লাহর সাহায্য এলো। শাফেয়ীর অন্তরে এমন কিছু উসূল ও নিয়ম বিধান ইলহাম করে দেয়া হয়, যেগুলোর সাহায্যে তিনি বিরোধপূর্ণ হাদীসসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করেন। ফলে পরবর্তী লোকদের এ পথে চলার পথ প্রশস্ত ও সুগম হয়ে যায়।

চার মাযহাবের ইজতিহাদের ইতিহাস

১. তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর পর আবু হানীফার মাযহাবে ‘মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব’ আবির্ভাব হবার ধারাবাহিকতা শেষ হয়ে যায় কারণ, হানাফী আলিমরা আগে পরে সবসময়ই হাদীসশাস্ত্রের সাথে খুব কমই সম্পর্ক রাখতেন ও রাখছেন। আর হাদীসশাস্ত্রে অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী হওয়া ছাড়া একজন আলিম কোনো অবস্থাতেই ‘মুজতাহিদ মতলক মনতাসিব’ হতে পারে না। তবে তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর পর এ মাযহাবে ‘মাযহাবী মুজতাহিদ’ (মুজতাহিদ ফীল মাযহাব) এর আবির্ভাব ঘটে। আর যিনি মুজতাহিদ হবার নুন্যতম শর্ত ‘মাবসূত’ গ্রন্থটি মুখস্ত থাকতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন, তিনি মূলত মাযহাবী মুজতাহিদের কথাই বুঝাতে চেয়েছেন।

২. মালিকী মাযহাবেও মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব খুব কমই হয়েছেন। আর কেউ এ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে থাকলেও তাঁর ইজতিহাদী রায়সমূহকে মালিকী মাযহাবের মত বলে গণ্য করা হয় না। যেমন কাযী আবু বকর ইবনে আরবী এবং আল্লামা ইবনে আবদুল বার নামে খ্যাত আবু উমার।

৩. আহমাদ ইবনে হাম্বলের মাযহাব প্রথম দিকেও খুব একটা সম্প্রসারিত হয়েছি না, আর এখনো তা হয়নি। কিন্তু তা সত্বেও এই মাযহাবে ‘মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব’ পয়দা হতে থাকে। এর ধারাবিহিকতা নবম হিজরী তে এসে শেষ হয়। এর পরে এসে অধিকাংশ স্থানেই এ মাযহাবের কর্তৃত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে। তবে মিসর ও বাগদাদে এখনো এ মাযহাবের কিছু অনুসারী রয়েছে, যদিও তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য।

আসলে আহমাদ ইবনে হাম্বলের মাযহাব সেরকম ভাবেই শাফেয়ীর মাযহাবের সাথে সমন্বিত হয়ে আছে, যেমনটি সমন্বিত হয়ে আছে আবু ইউসুফ এবং মুহাম্মাদের মাযহাব আবু হানীফার মাযহাবের সাথে। তবে শেষোক্ত দু’জনের মাযহাবের মতো আহমাদের মাযহাব শাফেয়ীর মাযহাবের সাথে একত্রে সংকলিত হয়নি। একারণেই তোমরা দেখতে পাচ্ছ, দু’জনের মাযহাবকে এক মাযহাব গণ্য করা হয় না। অন্যথায় উভয় মাযহাবকে মনোযোগের সাথে অধ্যয়নকারীর পক্ষে দু’টিকে একটি মাযহাব হিসেবে (মানা) ও সংকলন করা মোটেও কঠিন নয়।

৪. বাকী থাকলো শাফেয়ীর মাযহাব। মূলত এ মাযহাবেই সর্বাধিক ‘মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব’ ও মুজতাহিদ ফীল মাযহাবের আবির্ভাব ঘটে। এখানেই সর্বাধিক আবির্ভাব ঘটে উসূল ও ইলমে কালাম বিশেষজ্ঞদের। কুরআনের মুফাসসির এবং হাদীসে ব্যাখ্যাদাতাদেরও আবির্ভাব ঘটে এখানে সর্বাধিক। এ মাযহাবের রেওয়ায়েত ও সনদসমূহও অন্যান্য মাযহাবের তুলনায় সর্বাধিক মজবুত। এর ইমামের মতামতসমূহ সর্বাধিক মজবুতভাবে সংরক্ষিত। ইমামের এবং আসহাবুল উজুহ’র বক্তব্য এখানে সুস্পষ্টভাবে পৃথক রাখা হয়েছে। বিভিন্ন মত ও বক্তব্যের একটিকে আরেকটির উপর অগ্রাধিকার দেয়ার ক্ষেত্রে সর্বাধিক মনযোগ দেয়া হয়েছে।

এই কথাগুলো সেইসব লোকদের অজানা নয়, যারা উপরোক্ত মাযহাবসমূহ সম্পর্লে বিশ্লেষণমূলক অধ্যয়ন করেছেন এবং একটা দীর্ঘসময় এর পিছে লেগে থেকেছেন।

শাফেয়ীর প্রথম দিককার ছাত্ররা সবাই মুজতাহিদ মতলক (মুনতাসিব) ছিলেন। তাদের মধ্যে এমন কেউই ছিলেন না, যিনি তাঁর (শাফেয়ীর) সকল ইজতিহাদের তাকলীদ করতেন। অতঃপর ইবনে সুরাইজের যামানা এলো। তিনি তাকলীদ ও তাখরীজের নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর তাঁর শিষ্যরা তাঁর দেখানো পথে চলতে থাকে। এ হিসেবেই তাঁকে সেই মুজতাহিদদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হয় , প্রতি শতাব্দীর মাথায় যাদের আগমনের সংবাদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।

যে ব্যাক্তি দীর্ঘ সময়কাল ধরে মাযহাবসমূহের বিশ্লেষণমূলক অধ্যায়ন করেছেন, তাঁর কাছে একথাও গোপন থাকতে পারে না যে, যেসব হাদীস ও আছারের উপর শাফেয়ীর মাযহাবের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত সেগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংকলিত ও সম্পাদিত। এ কথাগুলো সকল আহলে ইলমেরই জানা। এবং এগুলো থেকে তারা উপকৃত ও হয়েছেন। এটা এই মাযহাবের এমন একটা মর্যাদা, যা আর কোনো মাযহাবই লাভ করতে পারেনি। এই সংকলিত ও সম্পাদিত গ্রন্থাবলির মধ্যে যেগুলোর উপর শাফেয়ী মাযহাবের ভিত প্রতিষ্ঠিত, সেগুলোর একটি হলো মুআত্তা, যা নাকি শাফেয়ীর অনেক আগেই সংকলিত হয়েছে। শাফেয়ী এই গ্রন্থটিকে তার মাযহাবের ভিত হিসেবে গ্রহণ করেন। অন্যান্য গ্রন্থগুলো হচ্ছেঃ সহীহ আল বুখারী, সহীহ আল মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, দারেমী, মুসনাদে শাফেয়ী, সুনানে নাসায়ী, সুনানে দারু কুতনী, সুনানে বায়হাকী এবং বগবীর শরহুস সুন্নাহ।

অধিকাংশ ফিকহী ব্যাপারে ঐক্যমত থাকার কারণের যদিও বুখারীকে শাফেয়ীর প্রতি সমন্ধযুক্ত (মুনতাসিব) করা হয়, তবুও এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, অনেক বিষয়ে তিনি আবার শাফেয়ীর সাথে মতপার্থক্যও করেছেন, সেগুলো শাফেয়ী মাযহাবের বলে গণ্য হয় না।

আবু দাউদ এবং তিরমিযী তার দুজনই মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব। তবে তাদের ইনতেসাব আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং ইসহাক ইবনে রাহুইয়ার প্রতি। ইবনে মাজাহ এবং দারেমীর অবস্থাও তাদের অনুরূপ।

আর মুসলিম, মুসনাদে শাফেয়ীর সংকলক আব্বসুল আসাম এবং অন্য যাদের কথা উল্লেখ করেছি এরা সবাই এককভাবে শাফেয়ীর অনুসারী।

এ যাবত আমি যা কিছু আলোচনা করলাম, তার মর্ম যদি তুমি উপলব্ধি করে থাকো, তবে অবশ্য তোমার কাছে এ সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে যে, ঐ ব্যাক্তি নিঃসন্দেহে ইজতিহাদে মতলক থেক বঞ্চিত হবে, যে শাফেয়ীর মাযহাবের সাথে শত্রুতা পোষণ করবে। আর যে ব্যাক্তি শাফেয়ী এবং আসহাবে শাফেয়ীর ইলমী ফয়েজ থেকে বিমুখ তার কর্মকান্ড মূলত হাদীসের ইলম অস্বীকারেরই নামান্তর।


১১. চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর পর ফিকহী মতপার্থক্য
ফিতনার যুগ এলো

এ যাবত যাদের কথা আলোচনা করলাম, অরপর তাদের সময়কাল অতীতের কোলে পাড়ি জমায়। তাঁদের আবির্ভাব ঘটে মুসলমানদের নতুন প্রজন্মের। এই নতুন প্রজন্ম ডানে বামে যেতে থাকে। (তাদের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের বিপ্লব ঘটে। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে যেসব ধ্বংসাত্মক রোগ তাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে, সেগুলোর কয়েকটি নিম্নরূপঃ

১. ফিকহী বিবাদ

পহেলা বিপর্যয়টি ছিলো ফিকাহ শাস্ত্রে বিবাদ বিরোধকে কেন্দ্র করে। গাযালীর (রহ) কলামে এর বিস্তারিত রূপ অবলোকন করুনঃ

“খুলাফায়ে রাশেদীন আল-মাহদীয়ীন এর যুগ শেষ হবার পর খিলাফতের বাগডোর এমন সব লোকের হাতে এসে পড়ে, এ মহান দায়িত্ব পালনে যাদের না যোগ্যতা ছিলো আর না ফতোয়া ও আহকামে শরয়ীর ক্ষেত্রে ব্যুৎপত্তি ছিলো। তাই ফতোয়া দান, বিচার ফায়সালা প্রদান ও শরয়ী বিধান কার্যকর করার ক্ষেত্রে তারা ফকীহদের সাহায্য নিতে এবং সবসময় তাদেরকে সাথে রাখতে বাধ্য হয়। ‘আইরুল কুরূন’ এর যুগ যদিও শেষ হয়ে গেছে, তবুও তখন পৃথিবী এমনসব আলিম থেকে শুন্য ছিল না, যারা প্রাথমিক যুগের আলিমদের মতোই ছিলেন বলিষ্ঠচিত্ত ও প্রকৃত দ্বীনের বাহক। শাসকরা এঁদের কাছে টানতে চেষ্টা করে। কিন্তু তারা যতোই এঁদের কাছে টানতে চেষ্টা করতোক তাঁরা ততোই তাদের থেকে দূরে সরে যেতেন। আলিমদের এরূপ সম্মান ও মর্যাদা অবলোকন করে পদলোভী লোকেরা সরকারী পদ ও সম্মান লাভের উদ্দেশ্যে দ্বীনি ইলম হাসিল করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে শাসকরা আলিমদের খুঁজে বেড়ানোর পরিবর্তে আলিমরাই শাসকদের পিছে ঘুরতে থাকে। এতোদিন শাসকরা তাদের মুখাপেক্ষী থাকার কারণে তাঁরা ছিলেন মর্যাদাবান। আর এখন শাসকদের নিকট পদমর্যাদা চাইতে গিয়ে তারা লাভ করলেন সম্মানের পরিবর্তে লাঞ্ছনার আর অসম্মান। তবে দু’চারজনের কথা আলাদা। এদের আগেকার একদল লোক ইলমে কালাম (তর্কশাস্ত্র) এর উপর অনেক কিছু লিখে গেছে। তারা যুক্তি তর্কের ঝড় সৃষ্টি করে গেছে। অভিযোগ এবং জবাবের বাজার গরম করে রেখে গেছে। বাহাছ ও মুনাযরার পথ প্রশস্ত করে রেখে গেছে। ফলে আলোচ্য ফকীহরা এগুলোর জালে আবদ্দ হয়ে পড়ে এবং দীর্ঘদিন আবদ্ধ ছিলো। এ সময় এমন কিছু রাজা বাদশাহরও জন্ম হয়, যারা ফিকহী বাহাছ ও মুনাযিরার প্রতি চরমভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। অমুক মাসয়ালার ক্ষেত্রে হানাফী মাযহাব শ্রেষ্ঠ কিংবা অমুক মাসয়ালার ক্ষেতের শাফেয়ী মাযহাব সেরা প্রভৃতি তথ্যের জানার জন্যে তারা উৎফুল্ল উঠে। এর ফলশ্রুতিতে লোকেরা কালাম শাস্ত্র এবং অন্যান্য বিষয়ের ইলমী গবেষণা ত্যাগ করে আবু হানীফা ও শাফেয়ীর (রহ) মাযহাবের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ মাসয়ালাসমূহের প্রতি মনোনিবেশ করে। বিশেষভাবে এ দু’টি মাযহাবকে তর্ক-বাহাছের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হয়। এদিক থেকে তারা মালিক, সুফিয়ান এবং আহমদ ইবনে হাম্বল এর মাযহাবকে কিছুটা ছাড় দেয় (কারণ শাসকদের আকর্ষণ ছিলো বিশেষভাবে উক্ত দু’টি মযহাবের প্রতিই)।

তাদের ধারণা ছিলো, এভাবে তারা শরীয়তের সুক্ষাতিসুক্ষ রহস্যসমূহ উদঘাটলন করছে, প্রতিটি মাযহাবের ভাল-মন্দ দিকসমূহ নির্ণয় করছে এবং ফতোয়ার নীতিমালার পথ প্রশস্ত করছে। এ উদ্দেশ্যে তারা রচনা করে বহু গ্রন্থাবলী, উদ্ভাবন করে বহু বিষয়াদি, নিত্যনতুন আবিষ্কার করে বাহাছ ও বিবাদের অসংখ্য হাতিয়ার। বড়োই আফসোসের বিষয় তারা এইসব কার্যক্রম এখনী চালিয়ে যাচ্ছে। এসব তৎপরতা যে ভবিষ্যতে কী রূপ নেবে, তা আল্লহই ভাল জানেন।”

২. মুজতাহিদ ইমামদের মধ্যকার মতপার্থক্যের কারণ সম্পর্কে অজ্ঞতা

শুনো, আমি এদের অধিকাংশ কেই এ ধারণা পোষণ দেখেছি যে আবু হানিফা ও শাফেয়ীর মধ্যকার মতপার্থক্যের কারণ হলো সেসব উসূল, যেগুলো বয়দুবী প্রমুখের গ্রন্তে উল্লেখ হয়েছে। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হলো, সেসব উসূলের অধিকাংশই সম্মানিত ইমামদ্বয়ের মতামতের আলোকে পরবর্তীকালে নির্ণয় করা হয়েছে। যেমন, আমার মতে নিম্নোক্ত ফিকহী উসুলগুলো ইমামদের বক্তব্যের আলোকে পরবর্তী লোকেরা নির্ণয় করেছেঃ

১. ‘খাস’ এর বিধান সুস্পষ্ট। তার সাথে কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সংমিশ্রণ ঘটানো যাবে না।

২. কোনো বিধানের উপর পরিবর্ধন রহিত।

৩. ‘খাস’ এর মতো ‘আম’ ও অকাট্য দলিল।

৪. বর্ণনাকারীদের আধিক্য অগ্রধিকারের জন্য অনিবার্য নয়।

৫. ফকীহ নয় এমন রাবীর রেওয়ায়েত কিয়াসের বিপরীত হলে তা গ্রহণ করা আবশ্যকীয় নয়।

৬. ‘মাফহুম শর্ত’ এবং ‘মাফহুম ওয়াসফ’ এর কোন ব্যাখ্যা নেই।

এ ক’টি এবং এ রকম আরো অনেক ফিকহী উসূল হানাফী ইমামদের কর্তৃক নির্ধারিত নয়। বরঞ্চ তাদের ফতোয়ার আলোকে পরবর্তী লোকেরা এগুলো নির্ণয় করেছে। আবু হানীফা এবং তাঁর দুই সাথী (আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ) কর্তৃক এগুলি নির্ধারিত হয়েছে বলে কোনো প্রমাণিত রেওয়ায়েত নেই। এখন এসব রসূলের হিফাযত করতে গিয়ে এবং এগুলোর উপর আরোপিত অভিযোগ খন্ডন করতে গিয়ে লোকেরা যা করছে তা নিতান্তই অযৌক্তিক ও হাস্যকর।

কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করতে চাইঃ

১. এই পরবর্তী আলিমরা তো হানাফী ফিকাহর এইসব উসূল নির্ধারণ করলো যেঃ “খাস এর বিধান সুস্পষ্ট। তার সাথে কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সংমিশ্রণ ঘটানো যাবে না।” কিন্তু উসূলটি পূর্ববর্তী আলিমগণের দৃষ্টি ভংগির বিপরীত। ‘ওয়াসজুদু ওয়ারকাউ’ (রুকু কর, সিজদা করো) –কুরআনের এই আয়াত এবং “ততোক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যাক্তির নামায হয় না, যতোক্ষন না সে রুকু এবং সিজদায় পূর্ণভাবে নিজের পিঠকে স্থির করবে” –রাসূলুল্লাহ (সা) এর এই হাদীসের বিধানের ক্ষেত্রে পূর্বর্তীদের দৃষ্টিভংগি ছিলো তাদের দৃষ্টিভংগির বিপরীত। পূর্ববর্তীরা হাদীসটিকে আয়াতটির ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আর এরা উল্লিখিত উসূলের আলোকে হাদীসটিকে আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ না করে কেবল রুকু সিজদাকেই ফরয বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং রুকু সিজদায় গিয়ে পিঠ স্থির করাকে ফরয ধরেননি। পরবর্তীদের বক্তব্য হলো, তারা পূর্ববর্তীদের অনেক মাসায়েলের সাথেই তাদের এই উসূল সাংঘর্ষিকঃ

‘ওয়ামসাহু বিরুউসিকুম৬৯ (আর তোমাদের মাথাকে মসেহ করো)’ আয়াতে শুধুমাত্র মাথা মাসেহ করা হুকুম দেয়া হয়েছে (কোনো সীমা নির্ধারণ করা হয়নি)। কিন্তু পূর্ববর্তী আলিমগণ নবী করীমের (সা) কপাল মাসেহ করাকে আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং এর-চতুর্থাংশ মাথা মাসেহ করাকে ফরয বলে ফতোয়া দিয়েছেন।

[৬৯. সুরা মায়িদাঃ ৬]

এইভাবেঃ “ব্যভিচারী এবং ব্যভিচারিনী এদের প্রত্যেককে একশ’ কোড়া মারো”৭০ “চোর পুরুষ এবং চোর নারীর হাত কেটে দাও”৭১ এবং যতক্ষোণ না সে (নারী) অপর কোনো পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়”৭২ প্রভৃতি আয়াতে ‘খাস’ বিদ্যমান।

[৭০. সুরা আন নূনঃ ২]

[৭১. সূরা আল মায়িদাঃ ৩৮]

[৭২. সূরা আলা বাকারাঃ ২৩০]

কিন্তু পূর্ববর্তীগণ এসব ‘খাস’ এর বিধানের ক্ষেত্রে হাদীসকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ এ আয়াতগুলোর বিধান প্রসঙ্গে যেসব হাদীস এসেছে, তারা সেসব আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।৭৩

[৭৩. এসব আয়াতে “ব্যভিচারী ও ব্যভিচারীনী” “চোর পুরুষ এবং চোর নারী” “বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়” শব্দগুলো খাস। এখানে ব্যভিচারী, চুরি, এবং হিল্লা বিবাহের বিধান দেয়া হয়েছে। এটা বিবাহিত নাকি অবিবাহিত ব্যভিচারীর শাস্তি, সে কথা বলা হয়মি। কি পরিমাণ মাল চুরি করলে চোরের এ শাস্তি হবে তা বলা হয়নি। এবং বিবাহের পর স্বামীর সাথে যৌনসংগম করতে হবে, সেকথা এখানে বলা হয়নি। এই ব্যাখ্যাগুলো হাদীসে রয়েছে। –অনুবাদক]

অতঃপর এখন যখন এর ভিত্তিতে পরবর্তীদের বানানো ফিকহী উসূলের ব্যাপারে অভিযোগ উথাপিত হয়, তখন তারা এর জবাবে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলতে থাকে, যার বিস্তারিত বিবরণ তাদের রচিত গ্রন্থাবলীতে দেখা যেতে পারে।

২. নামাজের কিরআত সম্পর্কে কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, “যতোটা কুরআন সহজে পাঠ করতে পার, পড়ো।”৭৪

[৭৪. সূরা আল মুযযাম্মিলঃ ২]

কিন্ত্য হাদীসে বলা হয়েছেঃ “লা-সালাতা ইল্লা বিফাতিহাতিল কিতাব—সূরা ফাতিহা ছাড়া নামাজ নেই।”৭৫

[৭৫. জামে তিরমিযী]

“যতোটা সহজে পড়া যায়” কথাটি ‘খাস’, কিন্তু এই হাদীসটি তার ব্যাখ্যা। হাদীসটির দাবী অনুযায়ী প্রত্যেক রাকায়াতে ‘ফাতিহা’ পড়া ফরয।

একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ “নদী নালা ও খাল বিলের পানিতে (সেচের পাই ছাড়াই) যে ফসল জন্মে, তার যাকাত এক দশমাংশ।”৭৬

[৭৬. বুখারী ও মুসলিম]

অথচ অপর একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ “পাচ ওয়াসকের কম ফসলের যাকাত নেই।”৭৭

[৭৭. মুয়াত্তা-ই-ইমাম মালিক]

এখানেও তারা পরবর্তী হাদীসটিকে পূর্ববর্তী হাদীসটির ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করেননি। অথচ “ফাইন উহসিরতুম ফামাস্তাইসারা মিনাল হাদাইয়ে—কোথাউ যদি পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ো, তবে যে কুরবানীই সম্ভব তা খোদার উদ্দেশ্যে পেশ করো।”৭৮

[সুরা আল বাকারাঃ ১৯৬ আয়াত]

আয়াতটির ব্যাপারে যখন বলা হয় যে, পূর্বর্তী আলিমগণ ‘যে কুরবানীই সম্ভব’ কথাটিকে অকাট্য ধরে নেননি। (কেননা তাঁরা যদি এটাকে তাঁদের নিয়মের ছাঁচে ঢালতেন, তাহলে বলতেন, এর অর্থ ছোট বড় যে পশুই সম্ভব কুরবানী করো)। কিন্তু সেটা না বলে তাঁরা হাদীসের ভিত্তিতে এর ব্যাখ্যা করে বএছেন, এই কুরবানীর জন্যে ছাগলের চাইতে বড় কোনো পশু হতে হবে। তখন এই অভিযোগের ব্যাপারে তারা (পরবর্তীরা) যতসব অযৌক্তিক ও হাস্যকর জবাব দেন এবং এরূপ জবাবের উপর একগুঁয়েমী প্রদর্শন করেন।

৩. ‘মাফহু শর্ত এবং মাফহুম ওয়াসফের কোনো ব্যাখ্যা নেই’–এই উসূলটির ক্ষেত্রেও তারা একই কান্ড ঘটিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী এ উসূলটিও তাঁরা প্রাচীনদের অনুসৃত নীতী থেকেই গ্রহণ করেছেন। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, প্রাচীনরা এক্ষেত্রে ব্যাখ্যা করেছেন। যেমনঃ “আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যাক্তি বংশীয় মুসলমান মেয়েদের বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে না, সে যেনো মালিকানাভুক্ত মুমিন দাসীদের বিয়ে করে।”৭৯

[৭৯. সূরা আন নিসাঃ ২৫ আয়াত]

এ আয়াতে দাসী বিয়ে করার জন্যে ‘অসামর্থ্যের’ যে শর্তারোপ করা হয়েছে প্রাচীণ সে শর্ত উন্মুক্ত করে সামর্থবানদের জন্যেও দাসী বিয়ে করা বৈধ বলে ফতোয়া দিয়েছেন।

এভাবে পূর্ববর্তীদের আরো অনেক ফতোয়া উত্তরবর্তীদের এই উসূলের সাথে সাংঘর্ষিক প্রমাণিত হয়েছে।

তাছাড়া, তুমি দেখবে, এই পরবর্তী হানাফীদের তাখরীজসমূহের মধ্যে রয়েছে বহু স্ববিরোধিতা। আরো দেখবে এমন অনেক তাখরীজ, যেগুলোর একটিকে আরেকটি রহিত করে দেয়।

৩. ফিকহী মতামতের তাৎপর্য সম্পর্কে অজ্ঞতা

আমি দেখতে পেয়েছি, এদের (হানাফীদের) কিছু লোক মনে করে ফিকাহ ও ফতোয়ার গ্রন্থাবলীতে যতো টিকা টিপ্পনী ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রয়েছে সবই আবু হানীফা কিংবা সাহিবাইনের মতামত। মূল জিনিস আর তার তাখরীজের মধ্যে তারা কোনো পার্থক্য করে না। ‘কারখীর ফতোয়া অনুযায়ী বিষয়টি এরূপ’ এবং ‘তোহাবীর ফতোয়া অনুযায়ী এরূপ’—তারা যেনো এ ধরনের বাক্যগুলোকে অর্থহীন মনে করে। ‘আবু হানীফা এরূপ বলেছেন’ এবং ‘এটি আবু হানীফার মাযহাবের মত’ তাদের দৃষ্টি তে এ দু’টি কথার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

আমি আরো দেখেছি, কিছুলোক মনে করে, আবু হানীফার মাযহাব সারাখসী প্রণীত মাবসূত এবং হিদায়া ও তিবঈন প্রভৃতি গ্রন্থাবলীতে ছড়িয়ে থাকা বিবাদমূলক বাহাছসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত। অথচ তারা জানে না যে, তার্কিক বাহাছের ভিত্তির উপর তাঁর মাযহাব প্রতিষ্ঠিত নয়। তাদের মধ্যে এরূপ বাহাছের সূত্রপাত করে আসলে মুতাযিলারা। ফলে পরবর্তী লোকেরা ধারণা করে বসে, ফিকহী আলোচনার মধ্যে হয়তো এরূপ কথাবার্তার অবকাশ রয়েছে। তাছাড়া এর ফলে শিক্ষার্থীদের মনমস্তিষ্কেও তর্কবাহাছের তীক্ষ্মতা স্থান করে নিয়েছে।

লোকদের এসব ধারনা কল্পনা ও সন্দেহ সংশয়ের প্রতিবিধানকল্পে এখানে আমি দীর্ঘ আলোচনা করতে চাই না। কারণ, এ অধ্যায়ের সূচনাতে আমি যে ভূমিকা দিয়েছিলাম, এর অধিকাংশের নিরসনের জন্যে তাই যথেষ্ট।

৪. ‘রায়’ এবং ‘যাহেরীয়াতের’ তাৎপর্য সম্পর্কে অজ্ঞতা

কিছু লোককে আমি এ ধারণাও পোষণ করতে দেখেছি যে, “মাত্র দু’টি ফিকহী গ্রুপই বর্তমান আছে। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো গ্রুপ নেই। দু’টির একটি গ্রুপ হলো ‘আহলুর রায়’ আর অপরটি হলো ‘যাহেরিয়া’। আহলুর রায় হলো সে গ্রুপ যারা কিয়াস এবং ইস্তিম্বাত এর সাহায্যে কার্য সম্পাদন করে।” অথচ এ ধারণা একটা দারূণ অজ্ঞতা। ‘রায়’ মানে নিরেট বুঝ-বুদ্ধি (ফাহম ও আকল) ই নয়। কারণ কোনো আলিমই এ দুটি গুণবিহীন নন। এই ‘রায়’ সুন্নাতের রাসূলের সাথে সম্পর্কহীন ‘রায়’ নয়। কারণ, ইসলামের কোনো অনুসারীই সুন্নাতের সাথে সম্পর্খীন রায় গ্রহণ করতে পারেনা। ‘রায়’ এর অর্থ নিরেট কিয়াস এবং ইস্তিম্বাতের যোগ্যতাও নয়।

আসলে, ‘আহলূর রায়’ এর অর্থ এগুলো নয়। প্রকৃতপক্ষে ‘আহরুল রায়’ হলেন সেইসব লোক যাঁরা মুসলমানদের সর্বসম্মত কিংবা অধিকাংশ কর্তৃক গৃহীত মাসায়েলসমূহের প্রাসংগিক বিষয়াদি তাখরীজ করার প্রতি মনোনিবেশ করেছেন ইমাম মুজতাহিদদের নির্ণীত উসূলের ভিত্তিতে। তারা এ কাজ হদীস এবং আছারের ভিত্তিতে করেননি। বরং মুজতাহিদ ইমামদের নির্ণীত মাসায়েল সমূহের অজীর ও কার্যকারণকে সামনে রেখে করেছেন। পক্ষান্তরে ‘আহলুয যাহের’ বা ‘যাহেরিয়া’ হলেন তাঁরা, যারা কিয়াস বা সাহাবীগণের আছার এ দু’টির কোনোটিকেই অবলম্বন করেননি। যেমন, ইমাম দাউদ এবং ইবনে হাযম। এই উভয় গ্রুপের মাঝে রয়েছেন ‘মুহাক্কিকীন’ এবং ‘আহলুস সুন্নাহ’। যেমন, আহমদ এবং ইসহাক।

 

৫. অন্ধ অনুকরনের প্রাধান্য

আরেকটি প্রধান বিপর্যয় হলো, এ সময় লোকেরা চরমভাবে অন্ধ অনুকরণে (তাকলীদে) নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এতোটা নিশ্চিন্তে তারা এ পথে অগ্রসর হয় যে, তারা তাদের অস্থি-মজ্জায় মিশে যায়। এর পিছনে নিম্নোক্ত কারণগুলো কাজ করেছিলঃ

একটি কারণ ছিলো ফকীহদের মধ্যে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ। ফলে, একজন ফকীহ যখন কোথাও কোনো ফতোয়া দিলেন, সাথে সাথে আরেকজন ফকীহ তা খন্ডন করে, আরেকটি ফতোয়া দিয়ে বসেন। সে কারণে প্রত্যেকেই স্বীয় ফতোয়াকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে মুজতাহিদ ইমামদের (মতামতের) প্রতি প্রত্যাবর্তন করেন।

এ সময় শাসকদের যুলুমের কারণে মুসলমানগণ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না। ফলে, তাদের নিয়োগকৃত কাজীদের প্রতিও জনগণ আস্থাশীল ছিল না। তাই, তারা বাধ্য হয়েই নিজেদের ফতোয়া ফায়সালার পক্ষে ইমাম মুজতাহিদ্গণের মতামত দলিল হিসেবে পেশ করতো।

আরেকটি কারণ এই ছিলো যযে, এ সময় সমাজের নেতৃস্থানীয় লোকেরা দ্বীনি জ্ঞান লাভ থেকে ছিলেন অনেক দূরে। ফলে, লোকেরা ফতোয়া নেয়ার জন্যে এমনসব লোকদের দিকে প্রত্যাবর্তন করে যাদের না হাদীসের জ্ঞান ছিলো আর না তাখরীজ এবং ইস্তিম্বাতের যোগ্যতা ছিলো। পরবর্তীকালের আলিমদের মধ্যে এ অবস্থা তোমরা নিজেরাই দেখতে পাচ্ছো। ইমাম ইবনে হুমাম প্রমুখ এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করেছেন। এ সময় মুজতাহিদ নয় এমন লোকদেরও ফকীহ বলা হতে থাকে।৮০

[৮০. সে সময় মুজতাহিদ নয় এমনসব লোকদের ফকীহ বলার কারণে গ্রন্থকার আফসোস করেছেন। কিন্তু আমাদের কালে ফকীহ হবার জন্যে মুজতাহিদ হবার প্রয়োজন তো নেই ই, বরঞ্চ ইজতিহাদ করাকে নিষিদ্ধ মনে করা হয়। –অনুবাদক]

এ সময় মানুষের মধ্যে ফিকহী বিষয়াদি নিয়ে বিদ্বেষ এবং রেষারেষিও ছড়িয়ে পড়ে।

প্রকৃতপক্ষে ফকীহদের মধ্যে যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, তার অধিকাংশই মাযহাবীহবের মতামতের বিভিন্নতা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। যেমনঃ আইয়্যামে তাশরীকের তাকবীর, দুই ঈদের তাকবীর, মুহরেমের (ইহরামকারীর) বিয়ে, ইবনে আব্বাস এবং ইবনে মাসউদের তাশাহহুদ, নামাযে বিসমিল্লাহ এবং আমীন সশব্দে বা নিঃশব্দে বলা প্রভৃতি। তাঁদের মধ্যে এগুলোর সংখ্যা ও পদ্ধতি ইয়ে যে মতপার্থক্য ছিলো, তা ছিলো নেহাতই অগ্রাধিকারের ব্যাপার। তাঁরা একটি মতকে আরেকটি মতের চাইতে উত্তম মনে করতেন। এর চাইতে বেশী কিছু নয়।

৬. শাস্ত্রীয় গবেষণার অপ্রয়োজনীয় হিড়িক

এ সময় আরেকটি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। তা হলো, শরীয়তের আসল উৎসকে উপেক্ষা করে অধিকাংশ লোক বিভিন শাস্ত্রীয় গবেষণার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। ফলে কেউ কেউ আসমাউল রিজাল এবং জারাহ ও তা’দীলের ক্ষেত্রে গবেষণায় অবতীর্ণ হয়ে ধারণা করে বসে আমি এ বিষয়ের ভিত্তি মযবুত করছি। কেউ নিমজ্জিত হয় প্রাচীন ও সমকালীন ইতিহাস গবেষণায়। কেউ নিমজ্জিত হয় বিরল, গরীব এমনকি মওদু’ হাদীসসমূহের যাচাই বাছাইর কাজে।

কেউ কেউ তাঁর গবেষণার ঘোড়া দৌড়ান উসূলে ফিকাহর ক্ষেত্রে। স্বীয় অনুসারীদের জন্যে আবিষ্কার করেন বিবাদ করার নিয়ম কানুন। অতঃপর অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগের তুফান ছুটান। বীরদর্পে জবাব্দেন অন্যদের অভিযোগের। প্রতিটি জিনিসের সংজ্ঞা প্রদান করেন। মাসয়ালা এবং বাহাছকে শ্রেণী বিভক্ত করেন। এভাবে এসব বিষয়ে দীর্ঘ হ্রস্ব গ্রন্থাদি রচনা করে যান।

অনেকে আবার এমনসব ধরে নেয়া বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা গবেষণা চালান, যেগুলো ছিলো নিতান্তই অনর্থক এবং কোনো জ্ঞানবান ও বুদ্ধিমান ব্যাক্তি যেগুলোকে তাকিয়ে দেখারও যোগ্য মনে করে না। এসব মতবিরোধ ঝগড়া বিবাদ ও বাহুল্য গবেষণার ফিতনা ছিলো প্রায় সেই ফিতনার মতো, যারশিকার হয়েছিল মুসলমানরা তাদের প্রাথমিক যুগে। যখন রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হ্য আর প্রত্যেকেই নিজ নেতাকে ক্ষমতাসীন করা বা ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার কাজে আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছিল। এর ফলে তখন যেমন মুসলমানদের উপর যালিম অত্যাচারী একনায়ক শাসকরা সওয়ার হয়ে বসেছিল এবং ইসলামের ইতিহাসের সবচাইতে ন্যাক্কারজনক ঘটনাবলো সংঘটিত হয়েছিল, ঠিক তেমনি এই নব ফিতনাও মুসলিম সমাজে অজ্ঞতা, অন্ধতা, সন্দেয়-সংশয় ও ধারণা কল্পনার চরম ধ্বংসকারী ঝড় তুফান বইয়ে দেয়।

অতঃপর আসে এদের পরবর্তী জেনারেশন। এই জেনারেশন তাদের পূর্বসূরীদের অন্ধ অনুকরণ করে সম্মুখে ধাবিত হয়। ফলে, তারা সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যার্থ হয়। ঝগড়া বাহাছ এবং সঠিক ইস্তিম্বাতের মধ্যে পার্থক্য করার চেতনাই তারা লাভা করেনি। এখন সেই ব্যাক্তিই ফকীহ উপাধি পেতে থেকে যে বেশী বকবক করতে এবং মিথ্যা জটিলতা পাকাতে পারে, যে কোনো বিষয়ে নীরব থাকতে এবং সত্য মিথ্যা যাচাই করতে জানে না এবং ফকীহদের দুর্বল ও মযবুত বক্তব্যের পার্তক্য নির্ণয় করতে পারে না। একইভাবে এমনসব লোকদেরকে মুহাদ্দিস বলা হতে হাকে, যারা সঠিক ও ভ্রান্ত হাদীসের মধ্যে পার্থক্য করতে জানে না এবং সঠিক ও ভ্রান্ত হাদীসকে সমানভাবে চালিয়ে দেয়।

সকলেরই এরূপ অবস্থা ছিলো, সে কথা আমি বলি না। আল্লাহর একদল বান্দাহ সব সময়ি তাঁর সন্তুষ্টির পথে কাজ করেছেন, কোনো শত্রুতা তাদেরকে এপথ থেকে ফিরাতে পারেনি। পৃথিবীতে এরাই আল্লাহর হুজ্জত।

অতঃপর এদের পরে যে জেনারেশনের আগমন ঘটে, তারা এদের চাইতেও বড় ফিতনাবাজ প্রমাণিত হয়। তারা বিদ্বেষমূলক তাকলীদের দিক থেকেও ছিলো অগ্রগামী। তাদের অন্তরে না ছিলো জ্ঞানের আলো আর না ছিলো অন্তরদৃষ্টি। তারা দ্বীনি বিষয়ে চিন্তা গবেষণা করাকে ‘বিদআত’ বলে আখ্যায়িত করে সদর্পে ঘোষণা দিয়েছেঃ

“আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের এভাবেই চলতে দেখেছি আর আমরা তাদেরই পদাংক অনুসরন করতে থাকবো।”

এখন একমাত্র আল্লাহর কাছেই এ বিষয়ে অভিযোগ করা যায়! তাঁর কাছেই সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। তিনিই একমাত্র নির্ভরযোগ্য সত্ত্বা আর তাঁর উপরই ভরসা করা যেতে পারে।


১২. মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে সঠিকপন্থা অবলম্বনের উপায়
ইসলাম এসেছিল ঐক্যের পয়গাম নিয়ে। কিন্তু অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও গোঁড়ামীর কবলে পড়ে সে আজ মতবিরোধ ও ঝগড়া বিবাদের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। কতিপয় ক্ষুদ্র আনুষঙ্গিক মাযহাবী মাসালাকে কেন্দ্র করে ঝগড়া বিবাদের তুফান বইয়ে দেয়া হয়েছে। এসবের কারণ নিয়ে যখনই আমি গভীরভাবে চিন্তা করেছি, দেখতে পেয়েছি, প্রতিটি গ্রুপই সত্য ও ন্যায়ের কেন্দ্র থেকে কিছু না কিছু বিচ্যুত হয়েছে। গোঁড়ামী এবং বিদ্বেষ দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। প্রত্যেকেই সত্যের অনুসারী বলে দাবী করেছে। কিন্তু সত্যের একনিষ্ঠ রাজপথে চলার পরিবর্তে তারা আবেগতাড়িত হয়েছে। আমি পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহের জন্যে কৃতজ্ঞ, তিনি আমাকে সঠিক সুষম ন্যায়-পন্থা জানার মানদন্ড প্রদান করেছেন। তা দিয়ে আমি সত্য ও ভ্রান্তের মধ্যে পার্থক্য করতে পারছি। জানতে পারছি, সত্যের সরল সোজা রাজপথ কোনটি? আরো জানতে পারছি, লোকেরা এখন কোন ধরনের মতবিরোধসমূহের মধ্যে নিমজ্জিত? আর তাদের এস মতবিরোধ ও ঝগড়া বিবাদের ভিত্তি কি?

মুসলমানদের এই অবস্থা আমাকে দারুন পীড়া দেয়। তাই তাদের সমস্যার সঠিক ধরন তাদের সামনে তুলে ধরা দরকার। তাদের চিন্তা ও উপলব্ধির ভ্রান্তি সম্পর্কে তাদের সাবধান করা দরকার। তারা এই ভ্রান্ত পথে মুখে এবং কলিমের মাথায় যে বারাবাড়ি করছে, সে সম্পর্কে তাদের হুঁশিয়ার করা দরকার।

১. বিবাদের সবচাইতে বড় হাতিয়ারটি হলো তাকলীদ। চারজন ইমামের তাকলীদের ব্যাপারে প্রায় গোটা উম্মাত একমত। সেই প্রাচীন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত লোকেরা প্রায় সর্বসম্মতভাবে তাঁদের তাকলীদ করে আসছে। আর এতে যে বিরাট কল্যাণ নিহিত আছে, তাও সকলের চোখের সামনেই রয়েছে। বিশেষ করে কাল পরিক্রমায় লোকেরা যখন দ্বীনি বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা গবেষণা পরিত্যাগ করে বসেছে, নিজ মতের পিছে ছুটে বেড়াচ্ছে এবং নফসের ঘোড়ার পিছে দৌড়াচ্ছে।

তাকলীদ সম্পর্কে ইবনে হাযমের বক্তব্যঃ “কুরআন এবং প্রাচীন আলিমগণের সর্বসম্মত মতানুযায়ী তাকলীদ হারাম এবং মুজতাহিদ ইমামগণ স্বয়ং তাঁদের তাকলীফ করতে নিষেধ করে গেছেন” লোকদের দারুণ ভুল বুঝাবুঝিতে নিমজ্জিত করেছে। তারা মনে করে বসেছে, কথাটা বুঝি সর্বশ্রেণীর মানুষের জন্যেই প্রযোজ্য! কথাটি স্বয়ং সত্য কথা। তবে তা প্রযোজ্য হবে ক্ষেত্রবিশেষে। অর্থাৎ তাকলীদ নিষিদ্ধ তাদের জন্যে, যারা ইজতিহাদের যোগ্যতা রাখেন অন্তত একটি মাসয়ালার ক্ষেত্রে হলেও। তাদের জন্যেও তাকলীদ করা নিষেধ, যারা সুস্পষ্টভাবে জানেন যে, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) অমুক কাজের হুকুম দিয়েছেন, অমুক কাজ নিষেধ করেছেন এবং অমুক হুকুম রহিত।’ এ জ্ঞান তারা সরাসরি হাদীস অদ্যায় করে অর্জন করুক কিংবা অর্জন করুক দ্বীনের সেরা আলিমদের আমল দেখে, তাতে কিছু যায় আসে না। এ সত্যের প্রতিই ইংগিত করেছেন শাইখ ইযযুদ্দীন আবদুস সালাম। তিনি বলেছেনঃ

“ঐসব ফকীহদের অবস্থা দেখে আমি বিস্মিত হচ্ছি, যারা স্বীয় ইমামদের ইজতিহাদী ভ্রান্তি সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্বেও সেই ভ্রান্তিকে আঁকড়ে ধরে থাকে এবং তা ত্যাগ করে কিতাব, সুন্নাহ ও কিয়াসের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিশুদ্ধ মতকে গ্রহণ করে না। বরং এসব অজ্ঞ অন্ধরা তাদের অন্ধ তাকলীদের ভ্রান্ত জজবায় অনেক সময় বাস্তবে কুরআন সুন্নাহর বিরুদ্ধে চলে যায় এবং স্বীয় ইমামকে ক্রুটিহীন প্রমাণ করার জন্যে কুরআন সুন্নাহর এমন ভ্রান্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে যা কালামের তাহরীফ ছাড়া আর কিছু নয়।”

তিনি অন্যত্র লিখেছেনঃ

“প্রথম যুগের লোকেরা যে আলিমকেই সামনে পেতেন, তাঁর কাছেই ফতোয়া জেনে নিতেন। তিনি কোন খেয়াল ও মসলকের লোক, তা জানার চেষ্টা করতেন না। কিন্তু পরবর্তীকালে এ অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। চার মাযহাবের আবির্ভাব ঘটে। সেগুলোর অন্ধ অনুকরণকারীদের আগমন ঘটে। লোকেরা হিদায়াতের আসল উৎস থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবল ইমামদের বক্তব্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাদের কোনো বক্তব্য যতোই দুর্বল ও দলিলবিহীন হোক না কেন। ভাবটা যেন এমন যে, মুজতাহিদরা মুজতাহিদ নন বরং আল্লাহর রাসূল, মাসূম এবং তাদের কাছে ওহী নাযিল হয়! এটা সত্য ও হকের পথ নয়। বরঞ্চ নির্ঘাত অজ্ঞতা ও ভ্রান্তির পথ।”

এ প্রসঙ্গে ইমাম আবু শামাহ বলেনঃ

কেউ যদি ফিকাহর প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন, তিনি যেনো কোনো একটি মাযহাবেকে যথেষ্ট মনে না করেন। বরঞ্চ প্রত্যেক মুজতাহিদের মতামত যেনো মনোযোগ দিয়ে দেখেন। প্রত্যেকের মধ্যে ডুব দিয়ে সত্যের বাতি জ্বালিয়ে দেখা উচিত। অতঃপর যে মতটিকে কুরআন সুন্নাহর অধিকতর মনে কাছাকাছি মনে করবেন সেটাই যেনো গ্রহন করেন। প্রাচীন আলিমগণের জ্ঞান ভান্ডারের প্রয়োজনীয় অংশগুলোর প্রতি যদি তিনি নযর দেন, তবে ইনশাল্লাহ যাচাই বাছাইর এ শক্তি অর্জন করা তার জন্যে সহজ হয়ে যাবে এবং সহজেই শরীয়তের সত্যিকার রাজপথের সন্ধান পেয়ে যাবেন। এরূপ লোকদের কর্তব্য হলো গোষ্ঠীগত গোঁড়ামী থেকে নিজেদের মন মস্তিষ্ককে পবিত্র রাখা। বিবাদ বসম্বাদের ময়দানে একটি কদমও না ফেলা। কারণ সেখানে সময় নষ্ট করা এবং স্বভাব ও আচরণে বিকৃতি লাভ করা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। ইমাম শাফেয়ী তাঁর এবং অন্যদের তাকলীদ করতে লোকদের নিষধ করে গেছেন। একথা বলেছেন শাফেয়ীর ছাত্র আল মুযনী তাঁর গ্রন্থ মুখতাসার এর সূচনায়। ইবনে হাযমের মন্তব্য এমন সাধারণ ব্যাক্তির ব্যাপারেও প্রযোজ্য যে দ্বীনি ইলম সম্পর্কে পূর্ণাংগ না থাকার তাকলীদ করে বটে, কিন্তু কোনো একজন ফকীহর তাকলীদ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে করে যে, তিনি ভুল করে না, তিনি যা বলেন সবই সঠিক। তাছাড়া দলিল প্রমাণের দিক থেকে তাঁর মত যতোই ভুল এবং বিপরীত মত যতোই বিশুদ্ধ হোক না কেন, সর্বাবস্থায়ই সে তাঁর তাকলীদের উপর জমে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। মূলত এ নীতি সেই ইহুদীবাদেরই অনুরূপ যা তাওহীদী আদর্শকে শিরকে রূপান্তরিত করে দিয়েছিল। এ প্রসংগে একতি হাদীস উল্লেখযোগ্য। হাদীসটি মুসলিম শরীফে আদী ইবনে হাতিম থেকে বর্ণিত হয়েছে।

“রাসূলুল্লাহ (সা) ‘ইত্তাখাযু আহবারাহুম ওয়া রুহবানাহুম আরবাবাম মিন দুনিল্লাহ—তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের উলামা মাশায়েখদের রব বানিয়ে নিয়েছে।’৮১

[৮১. সূরা তাওবা আয়াতঃ ৩১]

আয়াত পড়ে বলেছেনঃ ইহুদীরা তাদের উলামা মাশায়েখদের ইবাদাত করতো না বটে, কিন্তু তারা যখন কোনো জিনিসকে বৈধ বলতো। তারা সেটাকেই (নির্বিচারে) বৈধ বলে গ্রহণ করতো আর তারা তাদের জন্যে যেটাকে নিষিদ্ধ করতো, সেটাকেই অবৈধ বলে মেনে নিতো।”

সুতরাং এই দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো একজন মাত্র ইমাম এর তাকলীদ করা যে, তিনি শরীয়তের নির্ভুল মুখপাত্র—তার পূজা করারই সমতুল্য।

ঐ ব্যাক্তির ব্যাপারেও ইবনে হাযমের ফতোয়া প্রযোজ্য যে মনে করে, কোনো হানাফীর জন্যে শাফেয়ী ফকীহর কাছে এবং কোনো শাফেয়ীর জন্যে হানাফী ফিকাহর নিকট ফতোয়া চাওয়া বৈধ নয়, কিংবা হানাফীর জন্যে শাফেয়ী ইমামের পিছে এবং শাফেয়ীর জন্যে হানাফী ইমামের পিছে (নামাযে) ইক্তেদা করা বৈধ নয়। এটা সাহাবী, তাবেয়ী ও উলামায়ে সলফের কর্মনীতির সুস্পষ্ট বিরোধিতা। এরূপ চিন্তা ও কর্ম কোনো অবস্থাতেই বৈধ হতে পারে না।

মূলত এই হল ইবনে হাযমের মন্তব্যের সঠিক তাৎপর্য। যেখানে অবস্থা এরূপ নয়, সেই ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্যও প্রযোজ্য নয়। যেমন, এক ব্যাক্তি কেবল রাসূলুল্লাহর (সা) বক্তব্যের ভিত্ততেই দ্বীনকে দ্বীন মনে করে, আল্লাহ ও রাসূল যা হালাল করেছেন, সেটাকেই হালাল মনে করে, আল্লাহ ও রাসূল যা হারাম করেছেন সেটাকেই অবৈধ মনে করে এবং কনো অবস্থাতেই কোনো মানুষের বক্তব্যকে বৈধ ও অবৈধতার মানদন্ড বানায় না।

কিন্তু এরূপ বিশুদ্ধ ঈমান আকীদার অধিকারী হওয়া সত্বেও যেহেতু সে কুরআন হাদীস সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেনা, বিরোধপূর্ণ হাদীসসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের যোগ্যতা রাখেনা এবং কুরআন হাদীসের ভিত্তিতে মাসায়েল ইস্তিম্বাতের যোগ্যতা রাখে না, সেহেতু সে যদি তার দৃষ্টিতে সুন্নাতের রাসূলের ভিত্তিতে ফতোয়াদেবার উপযুক্ত নির্ভরযোগ্য কোনো আলিমের ইক্তেদা-অনুসরণ করে এবং মনে এই চিন্তা রাখে যে, যখনই সে আলিমের কোনো ফতোয়া কুরআন সুন্নাহর প্রমাণিত দলিলের বিপরীত দেখতে পাবে, তখনই তা ত্যাগ করবে, কোনো প্রকার গোঁড়ামী করবে না, এরূপ ব্যাক্তির জন্যে তাকলীদকে কিছুতেই অবৈধ বলা যেতে পারে না। কারণ, রাসূলুল্লাহর সে যুগ থেক এ নিয়ে আজ পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে ফতোয়া চাওয়া এবং ফতোয়া দেয়ার এ নিয়মই অবিচ্ছিন্নভাবে চলে আসছে। সুতরাং এই নীতিতে আমল করার পর এক ব্যাক্তির কাছে সবসময় ফতোয়া কিংবা বিভিন্ন ফকীহর নিকট বিভিন্ন সময় ফতোয়া চাওয়া উভয়টাই বৈধ। এটা কেমন করে অবৈধ হতে পারে? কারণ আমি তো কোনো ফকীহর ব্যাপারে এরূপ ঈমান পোষণ করি না যে, তাঁর নিকট আল্লাহ তায়ালা ফিকাহ সংক্রান্ত ওহী নাযিল করেন, তাঁর ইতায়াত করা আমার জন্যে ফরয এবং তিনি নিষ্পাপ। আমি যখন কোনো ফকীহর ইক্তেদা করি, তখন তার সম্পর্কে এ ধারণা নিয়েই তাঁর ইক্তেদা করি যে, তিনি কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের একজন আলিম। সুতরাং তাঁর বক্তব্য কুরআন সুন্নাহ মুতানিকই হবে। হয় সরাসরি কুরআন হাদীস দিয়েই কথা বলবেন, কিংবা কুরাআন হাদীসের ভিত্তিতে ইস্তিম্বাত করে কথা বলবেন।……এরূপ না হতে তো কোনো মুমিনই কোনো মুজতাহিদের তাকলীদ করতো না। কোনো বিশুদ্ধ নির্ভরযোগ্য সুত্রে যদি আল্লাহর সেই মাসুম রাসূলের (সা) কোনো হাদীস আমার নিকট পৌছে, যাঁর আনুগত্য করা আমার জন্যে ফরয, সেই হাদীসটি যদি আমার ইমাম এর (বা মাযহাবের) মতের বিরোধী হয়, তখন যদি আমি হাদীসটিকে ত্যাগ করে ইমাম এর মতকে আঁকড়ে থাকার ব্যাপারে গোঁড়ামী প্রদর্শন করি, তাহলে আমার চেয়ে বড় যালিম আর কে হতে পারে? এক্ষেত্রে কিয়ামতের দিন রাব্বুল আলামীনের দরবারে আমি কি জবাব দেবো?

২. তাকলীদের পর মুসলমানদের মধ্যে সবচাইতে বড় সমস্যার কারণ হয়েছে কুরআন হাদীসের শাব্দিক অনুসরণ এবং ইস্তেখরাজ।

এখানে দু’টি নিয়ম রয়েছে। একটি হলো, হাদীসের শাব্দিক অনুসরণ। আর দ্বিতীয়টি হলো, মুজতাহিদ ইমামদের প্রণীত উসূলের ভিত্তিতে মাসায়েল ইস্তিম্বাত করা। শরয়ী দিক থেকে এই দু’টি নিয়মই সর্বস্বীকৃত। সকল যুগের বিজ্ঞ ফকীহগণ দু’টি বিষয়ের প্রতিই গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তবে কেউ একটির প্রতি অধিক মনোনিবেশ করেন, আবা কেউ অপরটির প্রতি বেশী যত্মবান হন। কিন্তু কোনো একটিকে সম্পুর্ণ পরিত্যাগ কেউ করেননি। সুতরাং হক পথের কোনো পথিকেরই কেবল একটি মাত্র পন্থার প্রতি সম্পূর্ণ ঝূঁকে পড়া উচিত নয়। অথচ দুঃখের বিষয়, বর্তমানকালে এই প্রবণতাই তাদের গোমরাহীর জন্যে দায়ী। এই দু’টি পন্থার একটিকে বাদ দিয়ে বাকো একটি দ্বারা হিদায়াএর রাজপথের সন্ধান পাওয়া খুবই দুষ্কর। সঠিক নীতি হচ্ছে, উবয় পন্থাকে প্ররথক করে না দিয়ে উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা। একটি দ্বারা আরেকটির কাঠামোকে আঘাত না করে একটির সাহায্যে আরেকটিকে ক্রুটিমুক্ত করা। কেবল এভাবেই অটল মজবুত ভিতের উপর দ্বীনী বিধানের এক দুর্ভেদ্য প্রাসাদ নির্মিত গতে পারে। এভাবেই তাতে কোনো ভ্রান্তির প্রবেশ পথ বন্ধ হতে পারে। এ নীতির প্রতিই আমাদেরকে অংগুলি নির্দেশ করে দেখিয়েছেন হাসান বসরীঃ

“আল্লাহর কসম, তোমাদের পথ হচ্ছ, সীমা থেকে দূরে অবস্থান এবং সীমাতিক্রম—এ দূটির মাঝখানে।”

৩. তৃতীয় যে জিনিসটি মুসলমানদের মধ্যে সুস্যা সৃষ্ট করেছে, তা হলো শরয়ী বিধান জানার জন্যে কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের অনুসরণ অনুকরণগত তারতম্য।

শরয়ী বিধান অবগত হবার জন্যে কুরআন ও হাদীসে যে অনুসরণ করা হয়, তার মধ্যে মাত্রাগত পার্থক্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম মর্যাদা হলো, কুরআন সুন্নাহর আলোকে শরয়ী বিধানসমূহ সমর্কে এতোটা বিজ্ঞতা অর্জন করা, যাতে করে প্রশ্নকর্তাদের প্রায় সমস্ত প্রশ্নের জবাব অতি সহজেই দেয়া যায় এবং মানব জীবনে সংঘটিত সজল ঘটনাবলীর শরয়ী সমাধান অবগত হবার জন্যে তার অনেক দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয়, অনেক নীরবতা অবলম্বন করতে হয়। এটা হচ্ছে ইজতিহাদের মর্যাদা। আর এর যোগ্যতা অর্জন করার কয়েকটি পন্থা রয়েছেঃ

ক. কখনো এ যোগ্যতা অর্জিত হয় হাদীসে ভান্ডার নিয়ে চিন্তা গবেষণা ও সংগ্রহ-সংকলনের কাজে আত্মনিয়োগ করা এবং শায ও গরীব হাদীসসমূহের নিরীক্ষণের মাধ্যমে। এ মত পোষণ করেন আহমদ ইবনে হাম্বল। কিন্তু এ কথা মনে করা ঠিক হবে না যে, কেবল চিন্তা গবেষণাও যাচাই বাছাইর কাজই এই বিজ্ঞতা অর্জন করার জন্যে যথেষ্ট। বরঞ্চ সেইসাথ এরুপব্যাক্তিকে ভাষাতত্ব ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও সুপন্ডিত্ হতে হবে। প্রাচীন আলিমগণ বিরোধপূর্ণ হাদীসের মধ্যে কিভাবে সমতা বিধান করেছেন এবং তাঁদের দলিল গ্রহণ পদ্ধতি কি ছিলো, সে সম্পর্কেও অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে।

খ. কখনো এ যোগ্যতা অর্জিত হয় তাখরীজের উসূলসমূহকে পুরোপুরি আয়ত্ত করার মাধ্যমে। কিন্ত্য এজন্যে কেবল ইমাম মুজতাহিদ প্রণীত উসূলের ভিত্তিতে মাসায়েল ইস্তিম্বাত করার পন্থা অবগত হওয়াই যথেষ্ট নয়। বরঞ্চ হাদীস এবং আছারের একটা বিরাট অংশ তাঁর আয়ত্তে থাকতে হবে। যাতে করে সর্বস্মমত কোনো মতের সাথে তাঁর ইস্তিম্বাত সাংঘর্ষিক হয় কিনা তা তিনি জানতে পারেন। এটাই হচ্ছে তাখরীজকারীদের পন্থা।

গ. দুই বলয়ে অবস্থিত উপরোক্ত দু’টি পন্থার মধ্যবর্তী ও সঠিক পন্থা হচ্ছে কুরআন সুন্নাহ সম্পর্কে এতোটা অবগত থাকা, যাতে করে ফিকাহর উসূল ও মৌলিক মাসায়েলসমূহ এবং সেগুলোর দলিল প্রমাণ সংক্রান্ত জ্ঞান অতি সহজের অর্জন করা যায়। তাছাড়া এরূপ ব্যাক্তিকে কিছু কিছু ইজতিহাদী মাসয়ালা, সেগুলোর দলিল-আদিল্লা ও একটিকে আরেকটির উপর অগ্রাধিকার দেয়ার ব্যাপারে পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। অন্যদের তাখরীজের ক্রুটি নির্দেশ এবং খাঁটি ও মেকীর মধ্যে পার্থক্য করার মতো যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে। তবে একজন মুজতাহিদ মতলককে যতোটা ব্যাপক ও সমুদ্রসম জ্ঞান, দূরদৃষ্টি ও অন্তরদৃষ্টির অধিকারী হতে হয়, তার মধ্যে সেসব শর্ত পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান না থাকলেও চলবে। এ পর্যায়ে পৌছার পর বিভিন্ন মাযহাবের ক্রুটিপূর্ণ মতসমূহের সমালোচনা করা তাঁর জন্যে বৈধ। তবে সমালোচনা করার পূর্বে তাঁকে অবশ্য সেগুলোর পক্ষে তাদের যেসব দলিল প্রমাণ আছে, সেগুলো অবহিত হতে হবে। এ পর্যায়ে পৌছে বিভিন্ন মাযহাবের মতামতের দলিল প্রমাণ পর্যালোভনার পর তিনি যদি এই মাযহাবের কিছু এবং ঐ মাযহাবের কিছু মত গ্রহণ করেন এবং তাঁর গবেষণায় ভুল প্রমাণিত হওয়ায় সব মাযহাবেরই কিছু মতের সমালোচনা করেন এবং বর্ণনা করেন, যদিও প্রাচীনরা তা গ্রহণ করেছেন, তবে এমনটি করাও তাঁর জন্যে বৈধ।

এ কারণের দেখা যায়, যেসব আলমরা নিজেদেরকে মুজতাহিদ মতলক বলে দাবী করতেন না, তাঁরা ফিকহী গ্রন্থাবলী রচনা করেছেন, মাসয়ালা সংকলন করেছেন, তাখরীজ করেছেন এবং পূর্ববর্তী আলিমগণের একটি মতকে আরেকটি মতের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছেন, কারণ ইজতিহাদ আর তাখরীজ তো মুলত একই জিনিসের দু’টি অন্ধ। আর উভয়টিরই উদ্দেশ্য কোনো বিষয়ে সত্যের কাছাকাছি পৌছা বা সত্যিকার ধারণা লাভ করা।

এবার ওইসব লোকদের কথায় আসা যাক, যারা মাসায়েল যাচাই বাছাই করার মতো দ্বীনি জ্ঞানের অধিকারী নয়। তাদের উচিত প্রচলিত যাবতীয় বিষয়ে নিজেদের পূর্বপুরষ ও স্থানীয় মুসলমানদের অনুসরণ করা, আর যখন কোনো নতুন বিষয় তাদের সামনে আসবে, সে বষয়ে নিষ্ঠাবান মুফতীগণের নিকট ফতোয়া চাওয়া আর মামলা মুকদ্দমার ক্ষেত্রে কাযীগণের ফায়সালা অনুসরণ করা। এটাই তাদের জন্যে সরল সঠিক ও উত্তম পন্থা।

প্রত্যেক মাযহাবের প্রাচীন ও আধুনিক মুহাক্কিক আলিমগণকে এইরূপ চিন্তা চেতনার অধিকারীই পেয়েছি। সকল মাযহাবের ইমামগণ তাঁদের সাথী ও ছাত্রদেরকে এই ধারণার অনুসরণেরই অসীয়ত করেছেন। ‘ইয়াকুত ও জাওয়াহেরে’ উল্লেখ আছে যে, আবু হানীফা (রহ) বলতেনঃ

আমার মতের পক্ষে গৃহীত দলিলসমূহ যার জানা নেই আমার মতানুযায়ী ফতোয়া দেয়া তার উচিত নয়। আবু হানীফা স্বয়ং কোনো ফতোয়া দেয়ার সময় বলতেনঃ “এটা নুমান বিন সাবিতের (অর্থাৎ আমার) মত। আমার নিজের বুঝ জ্ঞান আনুযায়ী আমি এটাকেই উত্তম মনে করি।”

ইমাম মালিক (রহ) বুতেঃ

“রাসূলুল্লাহ (সা) ছাড়া এমন কোনো মানুষ নেই, যার পুরো বক্তব্য গ্রহযোগ্য হতে পারে। তিনি ছাড়া আর সকলের বক্তব্যের কিছু অংশ গ্রহণযোগ্য এবং কিছু অংশ বর্জনীয়।”

হাকিম ও বায়হাকীতে বর্ণিত হয়েছে, শাফেয়ী ( রহ) বলতেনঃ

“কোনোঃ বিষয়ে সহীহ-বিশুদ্ধ হাদীস পাওয়া গেলে সে বিষ্যে সেটাই আমার মত।” অপর একটি বর্ণনায় রয়েছে, শাফেয়ী (রহ) বলেছেনঃ

“তোমরা যখন আমার কোনো মতকে হাদীসের সাথে বিরোধপূর্ণ দেখতে পাবে, তখন তোমরা হাদীসের ভিত্তিতে আমল করবে এবং আমার মতকে দেয়ালের ওপাশে নিক্ষেপ করবে।”

শাফেয়ী (রহ) একদিন ইমাম মুযনীকে লক্ষ্য করে বলেনঃ “হে আবু ইব্রাহীম! আমার প্রতিটি কথার অন্ধ অনুকরণ (তাকলীদ) করো না। বরঞ্চ সে বিষয়ে নিজেও চিন্তা গবেষণা করা উচিত। কারণ, এটা যা-তা ব্যাপার নয়, দ্বীনের ব্যাপার।”

তিন আরও বলতেনঃ

“রাসূলুল্লাহ (স) ছাড়া আর কারো কথার মধ্যে কোনো হুজ্জত নেই, তাদের সংখ্যা যদি বিরাটও হয়।”

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ) বলতেনঃ

“আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথার সাথে বিরোধপূর্ণ হলে কোনো ব্যাক্তির কথাই গ্রহণযোগ্য নয়।”

তিনি এক ব্যাক্তি কে বলেছিলেনঃ

“আমার তাকলীদ করো না। মালিক, আওযায়ী, ইব্রাহীম নখয়ী প্রভৃতি কারই তাকলীদ করো না। তারা যেমন কিতাব ও সুন্নাহ থেকে মাসয়ালা গ্রহণ করেছেন, তোমরাও অনুরূপভাবে কুরআন ও সুন্নাহ থেকেই মাসয়ালা গ্রহণ করো। সকল ইমামের মাযহাব ও মতামত সম্পর্কে অবগত হওয়া ছাড়া কারোই ফতোয়া দেয়া উচিত নয়। কারো নিকট যদি এমন কোনো মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করা হয়, যেটির বিষয়ে স্বীকৃত ইমামগণ একমত পোষণ করেছেন সেটির সেই সর্বসম্মত জবাবটি বলে দেয়াতে কোনো দোষ নেই। কারণ এরূপ ক্ষেত্রে সেটা তার নিজস্ব মতামত নয়, বরঞ্চ ইমামা মুজতাহিদ্গণের মতেরই ভাষ্য বলে গণ্য হবে। তার নিকট যদি কেউ কোনো মতবিরোধপূর্ণ মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করে, সেক্ষেত্রে এটা অমুকের মতে জায়েজ আর অমুকের মতে নাজায়েজ জবাব দেয়াতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু এরূপ ক্ষেত্রে এক পক্ষের মত বলে দেয়া উচিত নয়।”

আবু ইউসুফ ও যুফার (রহ) প্রমুখ বলেছেনঃ

“এমন কোনো ব্যাক্তির আমাদের মত অনুযায়ী ফতোয়া দেয়া উচিত নয়, যিনি আমাদের মতের ভিত্তি সম্পর্কে অবগত নন।”

ইমাম আবু ইউসুফকে বলা হয়ঃ ‘আবু হানীফার সাথে আপনার ব্যাপক মতপার্থক্য লক্ষ্য করছি।‘ তিনি তাকে জবাবে বলেনঃ “এর কারণ, আবু হানীফাকে যতোটা বুঝ জ্ঞান দেয়া হয়েছে, ততোটা আমাদেরকে দেয়া হয়নি। তিনি তাঁর বুঝ জ্ঞানের মাধ্যমে যা অনুধাবন করেছেন, তার সবটা বুঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাঁর যে বক্তব্য আমরা উপলদ্ধি করতে পারি না, তা দিয়ে ফতোয়া দেয়া আমাদের জন্যে বৈধ হতে পারে না।”

মুহাম্মদ ইবনুল হাসানকে জিজ্ঞসা করা হয়, কখন একজন লোক ফতোয়া দেয়ার বৈধতা অর্জন করে? জবাবে তিনি বলেনঃ “ইজতিহাদের যোগ্যতা অর্জন করলে।” জিজ্ঞাসা করা হয়ঃ ‘কিভাবে ইজতিহাদের যোগ্যতা অর্জন হয়?’ জবাব তিনি বলেনঃ “যখন কোনো ব্যাক্তি কিতাব ও সুন্নাহর ভিত্তিতে মাসায়েলের সকল দিকের উপর নজর দিতে পারেন এবং তার মতের বিরোধিতা করা হলে যুক্তিসঙ্গত জবাব দিতে পারেন, তখন তিনি ইজতিহাদের যোগ্যতা অর্জন করেন।”

কেউ কেউ বলেছেনঃ “ইজতিহাদের নুন্যতম শর্ত হলো ‘মাবসূত’ গ্রন্থ মুখস্থ থাকা” ইবনুস সিলাহ বলেছেনঃ “শাফেয়ী মাযহাবের কোনো ব্যাক্তির নজরে যদি এমন কোনো হাদীস পড়ে, যেটি শাফেয়ীর মতের সাথে সাংঘর্ষিক, এরূপ ক্ষেত্রে তিনি যদি ইজতিহাদের মতলকের অধিকারী হন কিংবা সেই বিষয় বা মাসয়ালাটি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হন, তবে বিষয়টি সম্পর্কে গবেষোণা করার পর হাদীসটি বিশুদ্ধ প্রমাণিত হলে, সেক্ষেত্রে হাদীসটির উপর আমল করা এবং তাকলীদ পরিহার করা তাঁর জন্যে জরুরী। আর তিনি যদি এরূপ যোগ্যতার অধিকারী না হন আর দেখেন যে, অপর কোনো ইমাম এর মত হাদীসটির অনুরূপ। সে ক্ষেত্রেও হাদীসটির উপরই আমল করা তাঁর জন্য জরুরী। কারণ, এতে করে তাঁর কোনো না কোনো ইমামের তাকলীদ করা হয়ে যাচ্ছে।”—ইমাম নববীও এ মতই পোষণ করেন।

৪. চতুর্থ সমস্যাটি সৃষ্টি হয়েছে ফকীহদের পারস্পরিক মতপার্থক্য কে কেন্দ্র করে। অথচ ফকীহদের মধ্যে তো মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেসব বিষয়ে, যেসব বিষয়ে স্বয়ং সাহাবায়ে কিরামের (রা) নিকট থেকেই পার্থক্যপূর্ণ মত (ইখতেলাফ) পাওয়া গেছে। যেমনঃ তাশরীক ও দুই ঈদের তাকবীর, মুহরেমের (যিনি ইহরাম বেধেছেন) বিয়ে, ইবনে আব্বাস ও ইবনে মাসউদের (রা) তাশাহুদ, বিসমিল্লাহ এবং আমীন সশব্দে কিংবা নিঃশব্দে পড়া প্রভৃতি বিষয়ে। এসব ক্ষেত্রে তাঁরা একটি মতকে আরেকটি মতের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছেন মাত্র।

অতীত আলিমগণের মতপার্থক্য মূল শরীয়তের ব্যাপারে ছিলোনা। মতপার্থক্য হয়েছে আনুসঙ্গিক বিষয়াদিতে। আর সেসব মতপর্থক্যও ছিলো নেহতই সাধারণ ধরণের। মতপার্থক্য ছিলো দু’টি বিষয়ের মধ্যে কোনটি উত্তম, তাই নিয়ে। কেউ মনে করেছেন এটি উত্তম, আবার কেউ মনে করেছেন ওটি উত্তম। যেমন, কারীগণের কিরআতের পার্থক্য। বিভিন্ন কারী বিভিন্ন দৃষ্টিভংগিতে তিলাওয়াত করেন। একই শব্দ বা আয়াত এর তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে তুমি তাদের মধ্যে বেশ পার্থক্য দেখতে পাবে। ফকীহদের মতপার্থক্যের ধরনও অনুরূপ। ফকীহগণ তাঁদের মতপার্থক্যের কারণ হিসেবে বলেছেন, এই মতও সাহাবীদের থেকে পাওয়া গেছে, ঐ মতও সাহাবীগণের (রা) নিকট থেকে পাওয়া। অর্থাৎ তাদের মধ্যেও পারস্পরিক মতপার্থক্য ছিলো এবং তা সত্বেও তাঁরা সকলেই হিদায়াতের উপর ছিলেন। এ কারণে হকপন্থী আলিমগণ ইজতিহাদী মাসায়েলের ক্ষেত্রে সকল মুজতাহিদের ফতোয়াকেই জায়েজ মনে করেন, সকল কাযীর ফায়সালাকেই স্বীকার করেন এবং অনেক সময় নিজ মাযহাবের বিপরীত মতের উপরও আমল করেন। এ কারণেই তুমি দেখতে পাচ্ছো, তারা মাসয়ালার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং ইখতেলাফী দিকসমূহ আলোচনার পর বলে দেন, ‘আমার মতে এটাই উত্তম’, ‘আমার মতে এটা গ্রহণ করা ভালো’। আবার কখনো বলেনঃ ‘আমি কেবল এতোটুকুই জানতে পেরেছি।‘ ‘আল মাসবূত’ আছারে মুহাম্মাদ এবং শাফেয়ীর বক্তব্যের মধ্যে এ কথাগুলোর সাক্ষ্য তুমি দেখতে পাবে।

অতঃপর শুভবুদ্ধির অধিকারী দ্বীনের সেই মহান খাদিমদের কাল অতিক্রান্ত হয়। তাদের পরে এমনসব লোকের আগমন ঘটে, যারা সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগির অধিকারী হবার কারণে হিংসা বিদ্বেষ ও বিবাদের ঝড় বইয়ে দেয়। মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়গুলোর কোনো একটিকে আঁকড়ে ধরে। এ মতের অধিকারীদের এক পক্ষ আর ঐমতের অধিকারীদের আরেক পক্ষ হিসেবেভাবএ থেকে। এভাবেই শুরু হয় ফিরকা-পুরস্তী। এতে করে মানুষের মধ্য থেকে বিলুপ্ত হয়ে পড়ে তাহকীক ও চিন্তা গবেষণার জজবা। তারা নিজ নিজ ইমামের মাযহাবকে আকড়ে ধরে অন্ধভাবে। আফসোস তাদের এই বস্থার জন্যে!

অথচ এইসব মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়ে সাহাবী, তাবেয়ী ও তাদের পরবর্তী মহান আলিমগণের অবস্থা দেখো! তাঁরা (নামাজে) কেউ বিসমিল্লাহ পড়তেন, আবার কেউ পড়তেন না। কেউ তা সশব্দে পড়তেন, আবার কেউ নিঃশব্দে পড়তেন। কেউ ফজরে দোয়ায়ে কুনুত পড়তেন, আবার কেউ তা পড়তেন না। কেউ নকসীর, বমি ও ক্ষৌরকার্য করার পর অযু করতেন, আবার কেউ করতেন না। কেউ কামনা সাথে স্বীয় লিংগ এবং স্ত্রীকে স্পর্শ করলে অযু করতেন, আবার কেউ করতেন না। কেউ রান্না করা খাদ্য খেলে অযু করতেন আবার কেউ করতেন না। তাদের কেউ উটের গোশত খেলে অযু করতেন আবার কেউ করতেন না।

এতদসত্বেও তাঁদের একজন অপরজনের পিছনে নামাজ পড়তেন। যেমন, আবু হানীফা ও তাঁর সাথীরা এবং শাফেয়ী প্রমুখ মদীনার ইমামদের পিছনে নামাজ পড়তেন। অথচ তাঁরা ছিলেন মালিকী অন্যান্য মতের লোক এবং তাঁরা সশব্দে কিংবা নিঃশব্দে বিসমিল্লাহও পড়তেন না। ইমাম আবু ইউসুফ হারুনুর রশীদের পিছে নামাজ পড়েছেন। অথচ হারুনুর রশীদ ক্ষৌরকার্য করার পর নতুন করে অযু করতেন না। কারণ ইমাম মালিক (রহ) ফতোয়া দিয়েছেন, ক্ষৌরকার্য করার পর অযু করার প্রয়োজন নেই। আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ) ক্ষৌরকার্য এবং নকসীর৮২ এর জন্যে অযু করার কথা বলেছেন।

[৮২. গরমের প্রকোপে নাক দিয়ে যে রক্ত বের হয়, তাকে নকসীর বলে। –অনুবাদক]

কিন্তু যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হলোঃ “যদি ইমামের শিরীর থেকে রক্ত বের হয় আর তিনি অযু না করেন, তিবে কি আপনি তার পিছে নামাজ পড়বেন?” জবাবে তিনি বললেনঃ ‘কেমন করে আমি মালিক ও সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেবের পিছে নামাজ না পড়ে থাকতে পারি?’৮৩

[৮৩. এ দু’জনের মতে এটা অযু ভঙ্গের কারণ নয়। –অনুবাদক]

বর্ণিত আছে, আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ উভয়েই ঈদে ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত আকবীরের অনুসরণ করতেন। হারুনুর রশীদের পছন্দের কারণে তাঁরা এটা করতেন। অথচ তাঁরা ইবনে মাসউদ বর্ণিত তাকবীরের অনুসারী।

একবার শাফেয়ী আবু হানীফার কবরের কাছাকাছি স্থানে ফজরের নামাজ আদায় করেন। এ সময় আবু হানীফার সম্মানার্থে তিনি ফজরের নামাজে দোয়ায়ে কুনুত পড়েননি। তিনি বলতেন, আমি অনেক সময় ইরাকবাসীদের (আবু হানীফার) মাযহাবের উপর আমল করি।

এ প্রসঙ্গে ইমাম মালিক (রহ) মানসুর এবং হারুনুর রশীদকে কি বলেছিলেন, এর আগে এ গ্রন্থে আমরা সে কথা উল্লেখ করেছি।

‘আল বাযাযিয়া’ গ্রন্থে ইমাম সানী অর্থাৎ আবু ইউসুফ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, একবার তিনি হাম্মাম থেকে গোসল করে এসে জুমার নামাজ পড়ান। নামাজ শেষে লোকেরা চলে যাবার পর তাঁকে জানানো হয়, তিনি যে কুয়োর পানি দিয়ে গোসল করেছিলেন, তাতে মরা ইঁদুর পাওয়া গেছে। খবরটি শুনে তিনি বললেনঃ “ঠিক আছে, এ বিষয়ীখন মাওরা মাদের মদীনার ভাইদের (মালিকী মাযহাবে) মতের অনুসরণ করলাম যে, দুই কুল্লা পরিমাণ পানি থাকলে তা অপবিত্র হয় না। কারণ, এ পরিমাণ পানির বিধান ‘অধিক পানির’ বিধানের মতো।”

ইমাম খানজাদীকে শাফেয়ী মাযহাবের এমন এক ব্যাক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, যে ব্যাক্তি এক বা দুই বছরের নামাজ ছেড়ে দিয়েছিল, অতঃপর আবু হানীফার মাযহাব গ্রহণ করে। এখন সে কোন মাযহাবের রীতিতে নামাজগুলো কাযা করবে? শাফেয়ী মাযহাবের রীতিতে নাকি হানাফী মাযহাবের রীতিতে? জবাবে ইমাম খানজাদী বলেনঃ “সে বৈধ মনে করে, এমন যে কোনো মাযহাবের রীতিতে পড়লেই নামাজ আদায় হয়ে যাবে।”

কোনো হানাফী মাযহাবের লোক যদি শপথ করে যে, ‘আমি যদি অমুক মহিলাকে বিয়ে করি, তবে তাকে তিনি তালাক দিলাম।’৮৪

[৮৪. উল্লেখ্য, হানাফী মাযহাব অনুযায়ী এভাবে শপথ করলে সেই মহিলাকে বিয়ে করার সাথে সাথে তার উপর তিন তালাক প্রযোজ্য হয়ে যাবে। –অনুবাদক]

অতঃপর কোনো শাফেয়ী আলিমের নিকট ফতোয়া চাইলে তিনি যদি বলেনঃ ‘তালাক হয়নি, তোমার শপথ বাতিল, সেটা ছিলো একটা বাহুল্য কথা।’ এমতাবস্থায় এ ব্যাপারে সে যদি শাফেয়ী মাযহাবের অনুসরণ করে, তবে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কারণ, এর পক্ষে বিরাট সংখ্যক সাহাবীর মত রয়েছে। এ কথাগুলো উল্লেখ হয়েছে ‘জামিউল ফাতাওয়া’ গ্রন্থে।

ইমাম মুহাম্মাদ (রহ) তাঁর ‘আমালী’ গ্রন্থে বলেছেনঃ “কোনো ফকীহ যদি তার স্ত্রীকে বলে, ‘তোমাকে তালাক দিয়ে দিলাম’ এবং তার মাযহাব অনুযায়ী সে যদি এটাকে তিন তালাক বা বায়েন তালাক মনে করে, কিন্তু সমকালীন কাযী যদি সেটাকে তালাকে রিজয়ী (ফেরতযোগ্য) বলে ফায়সালা দেয়, তবে তার স্ত্রীর সাথে ঘর করার অবকাশ তার রয়েছে।”

একইভাবে হালাল হারাম, লেনদেন ও পারস্পরিক সম্পর্কের সেইসব বিষয়ে, যেগুলোর ব্যাপারে ফকীহদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে, প্রত্যেক ফকীহর উচিত সেসব বিষয়ে ইসলামী আদালত তার মাযহাবের বিপরীত রায় দিলেও সে রায়ের উপর আমল করা এবং সেসব ক্ষেত্রে স্বীয় মাযহাবের উপর আমল না করা।

আলোচনাকে অন্যন্ত দীর্ঘায়িত করলাম। যেসব কারণে বিভিন্ন মাযহাব ও দল উপদলের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদ লেগে আছে, সেগুলোর কারণ উদ্ঘাটিত করা এবং সত্য ও সঠিক পথের দিশা দেয়াই এ দীর্ঘ আলোচনার উদ্দেশ্য। কেউ যদি বিদ্বেষী এবং অতি সংকীর্ণ ও অতি উদার মনোভাব থেকে মুক্ত হয়ে ন্যায় ও সত্যানুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে এ কথাগুলোর প্রতি দৃষ্ট দেয়, তবে সত্য ও সঠিক পথের অনুসরণের জন্যে এ কথাগুলোই তার জন্যে যথেষ্ট। আর প্রকৃত সত্য সম্পর্কে তো আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।

—-সমাপ্ত —-


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি