৬. আহলে হাদীস
হাদীসে অনুসৃতি

জেনে রাখো, সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেব, ইব্রাহীম নখয়ী এবং যুহরীর যামানায়, এরপর মালিক ও সুফিয়ান সওরীর যামানায়, এমনকি তাঁদের পরেও একদল আলিম সবসময় এমন ছিলেন, যাঁরা শরয়ী বিষয়ে চিন্তা গবেষণা করার ক্ষেত্রে ব্যাক্তিগত রায় প্রয়োগ করাকে কঠোরভাবে অপছন্দ করতেন। তাঁরা সাধারণত ফতোয়া প্রদান করতে এবং মাসয়ালা ইস্তিম্বাত করতে ভয় পেতেন। যেক্ষেত্রে ফতোয়া দান বা ইস্তেম্বাত ছাড়া বিকল্প ছিলো না কেবলমাত্র সেক্ষেত্রেই তারা ফতোয়া দিতেন এবং ইস্তিম্বাত করতেন। রাসূলুল্লাহর (রা) হাদীসের প্রতিই তাঁদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো। কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হলে সে সংক্রান্ত হাদীস বর্ণনা করে দেয়াকেই তাঁরা শ্রেষ্ঠ পন্থা মনে করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে কোনো মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলতেন, ‘আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক হারামকৃত কোনো জিনিসকে তোমার জন্যে হালাল করাকে এবং আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক হালালকৃত কোনো জিনিসকে তোমার জন্যে হারাম করাকে আমি সাংঘাতিক অপছন্দ করি।‘৩২

[৩২. মানে কোনো জিনিস বৈধ কি অবৈধ কুরআন-হাদীসী মাধমে তা যতোক্ষণ না জানা যাবে, ততোক্ষণ কেবল নিজ রায়ের ভিত্তিতে সেটাকে বৈধ বা অবৈধ বলা যেতে পারেনা। কারণ এতে করে হারাককে হালাল এবং হালালকে হারাম বলে ফেলার আশংকা থেকে যায়। —অনুবাদক]

মুওয়াজ ইবনে জাবাল বলেছেন, “বিপদ আসার আগে বিপদের জন্যে ব্যাস্ত হয়ে পড়ো না।৩৩ কারণ প্রত্যেক যুগেই এমন মুসলিম মওজুদ থাকবে, যারা সমকালীন মাসায়েলের সঠিক জবাব দিতে সক্ষম হবে।”

[৩৩. অর্থাৎ সমস্যা সৃষ্টি হবার আগের সে সম্পর্কে মাসয়ালা জিজ্ঞেস করোনা। —অনুবাদক]

হযরত উমার (রা), হযরত আলী (রা), ইবনে আব্বাস (রা), এবং ইবনে মাসউদ ও একইভাবে সমস্যা সৃষ্টি হবার পূর্বেই সে সম্পর্কে ফতোয়া চাওয়াকে মাকরুহ মনে করতেন।

ইবুনে উমার (রা) জাবির ইবনে ইয়াযিদকে বলেছিলেন, “তুমি বসরার ফকীহদের অন্যতম। সাবধান, যখনই কোনো ফতোয়া দেবে, তা দেবে স্পষ্টভাষী কুরআন কিংবা প্রতিষ্ঠিত সুন্নাত দ্বারা। এর খেলাফ করলে তুমি নিজেও ধ্বংস হবে, অন্যদেরকেও ধ্বংস করবে।”

আবু নদর বলেছেনঃ হযরত আবু সালামা যখন বসরায় তাশরীফ এনেছিলেন, তখন আমি এবং হাসান বসরী তাঁর সম্মুখে হাজির হই। তিনি হাসান বসরীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আপনিই কি হাসান বসরী? বসরায় আপনার সাক্ষাত পাবার জন্যে আমি সবচাইতে উদগ্রীব ছিলাম। এর কারণ হলো, আমি শুনতে পেয়েছি, আপনি নাকি স্বীয় ‘রায়’ দ্বারা ফতোয়া দিয়ে থাকেন। এমনটি করবেন না। ফতোয়া কেবল রাসূলুল্লাহর (সা) সুন্নাহ কিংবা আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব দ্বারা দেবেন।”

ইবনুল মুনকাদির বলেছেন, “আলিম ব্যাক্তি আল্লাহ এবং তাঁর বান্দাদের মাঝখানে অবস্থান করে। সুতরাং এ নাজুক অবস্থা থকে নিরাপদে বেরুবার পথ অন্বেষণ করা তার উচিত।”

শা’বীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “আপনাদের কাছে লোকেরা ফতোয়া চাইলে আপনারা কি করতেন?” জবাবে তিনি বলেন, “খুবই বিজ্ঞতাপূর্ণ প্রশ্ন! আমাদের কারো নিকট ফতোয়া চাওয়া হলে সাথীদের কাউকে বলতামঃ ফতোয়াটা দিয়ে দিন। তিনি আবার দায়িত্বটা অপর কারো কাছে হস্তান্তর করতেন। এভাবে দায়িত্ব পরিবর্তন হতে হতে পুনরায় সেই প্রথম ব্যাক্তির ঘাড়েই এসে দায়িত্ব চাপতো।” ইমাম শা’বীর আরেকটি কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিই বলেছেন, “ফতোয়াদানকারী রাসূলুল্লাহর (সা) পক্ষ থেকে তোমাকে যা কিছু শুনাবে তা-ই গ্রহণ করবে কিন্তু স্বীয় রায় দ্বারা যদি কিছু বলে, তবে তা শুনবে না পায়খানায় নিক্ষেপ করবে।”৩৪

[৩৪. এইসব ঘটনা দারেমীর সুত্রে উদ্ধৃত হলো। —অনুবাদক]

হাদীস সংকলনের যুগ

এইসব কারণ ও অবস্থার প্রেক্ষিতে ইসলামী সাম্রাজ্যে রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীস এবং সাহাবায়ে কিরামের (রা) আছার সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ ব্যাপকতা লাভ করে। এমনকি হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে সম্ভবত এমন লোক খুব কমই ছিলেন, যার নিকট কমপক্ষে হাদীসের একটি সংকলন, পুস্তিকা কিংবা গ্রন্থ ছিলনা। এ যুগের সেরা মুহাদ্দীসগণ হিজাজ, সিরিয়া, মিসর, ইয়েমেন, খোরাসান প্রভৃতি দেশ সগর করেন। তাঁরা তৎকালীন গোটা মুসলিম বিস্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে লোকদের কাছ থেকে তাদের সংগৃহীত হাদীসের কিতাব, সংকলন ও পুস্তিকাসমূহ সংগ্রহ করেন। তাঁরা এর কষ্ট সাধ্য কাজ এতোটা নিখুঁতভাবে করেছেন যে গরীব হাদীস৩৫ এবং দুর্বল আছারসমূহ পর্যন্ত খুঁজে বের করেছেন।

[৩৫. গরীব হাদীস হচ্ছে সেইসব হাদীস, যা কেবল মাত্র একজন মাত্র রাবী বর্ণনা করেছেন। —অনুবাদক]

এমনি করে এই লোকদের প্রচেষ্ঠায় হাদীস ও আছারের এতোটা বিরাট ভান্ডার সংগৃহীত হয়ে যায়, যতোটা ইতিপূর্বের সকল যুগ মিলিয়েও সম্ভব হয়নি। এভাবে একত্রে সকল বিষয়ের হাদীস ও আছার জানা এই সময়ের লোকদের জন্যে যতোটা সহজ হয়ে যায়, তা তাদের পূর্বেকার লোকদের জন্যে ততোটা সহজ ছিলনা। এদের কাছে এককটি হাদীস বিভিন্ন সুত্রে (সনদ) এসে পৌছেছে। এমনকি কোনো কোনো হাদীসের সনদ সংখ্যা একশতের বেশী, এমন হাদীসও পাওয়া গেছে। একেকটি হাদীস বহু সনদের মাধ্যেমে পাওয়া যাবার ফলে অনেক উপকার হয়েছে।

যেমনঃ

১. কোনো সনদে একটি হাদীসে কিছু অংশ ছার পড়ে গিয়ে থাকলে অন্য সনদে তা বর্ণিত হয়ে প্রকাশ হয়েছে।

২. গরীব ও মশহুর৩৬ হাদীস চিহ্নিত করা সহজ হয়েছে।

[৩৬. মশহুর হাদীস সেই সকল হাদীসকে বলা হয়, যে হাদীস সাহাবী এবং তাবেয়ীদের যুগে খুব বেশী প্রচার লাভ না করলেও পরবর্তীকালে কোনো বিশেষ কারণে প্রসিদ্ধি লাভ করে। —অনুবাদক]

৩. এর ফলে এ সময়কার আলিমদের জন্যে হাদীসে ‘শাহিদ’ এবং ‘মুতাবি’৩৭ সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা করা সম্ভব হয়েছে।

[৩৭. ‘শাহিদ’ মানে সাক্ষী বা সমর্থক। ঐ হাদীসগুলো একটি আরেকটির শাহিদ যেগুলোর বিষয়বস্তু একতিই কিন্তু বিভিন্ন রাবী বিভিন্ন সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন।

‘মুতাবি’ মানে অধীন বা অনুসারী। ঐ হাদীসগুলো একটি আরেকটির ‘মুতাবি’ যেগুলোর বিষয়বস্তু এক এবং একজন মাত্র সাহাবী থেকে বিভিন্ন রাবী সুত্র এ বর্ণিত হয়ে এসেছে। —অনুবাদক]

৪. এর ফলে এ সময়কার আলিমদের নিকট এমনসব সহীহ হাদীস প্রকাশিত হয়ে পড়ে, যেগুলো তাঁদের পূর্বেকার ফতোয়া দানকারীদের জানাই ছিলো না। ইমাম শাফেয়ী ইমাম আহমদকে বলেছিলেনঃ আপনারা সহীহ হাদীস সম্পর্কে আমাদের অধিকতর জ্ঞান রাখেন। আপনার জানা যে কোনো সহীহ হাদীস সম্পর্কে আমাকে অবগত করবেন, চাই সে হাদীস কুফার লোকদের বর্ণিত হোক কিংবা বসরার লোকদের বর্ণিত হোক কিংবা হোক সিরিয়ার লোকদের বর্ণিত।৩৮

[৩৮. ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন ইবনুল হুমাম। —অনুবাদক]

অনেকগুলো হাদীস যে কিছুলোক জানতেন আবার কিছুলোক জানতেন না, তার কয়েকটি কারন ছিলো। সেগুলো হলোঃ

১. অনেক হাদীস এমন ছিলো, যেগুলোর বর্ণনাকারীরা কেবল কোনো একটি বিশেষ স্থানের অধিবাসী ছিলেন। যেমন, সেসব হাদীস যেগুলো শুধু সিরিয়া কিংবা ইরাকের লোকেরা বর্ণনা করেছে।

২. অনেকগুলো হাদীস এমন ছিলো যেগুলো কোনো বিশেষ খানদানের লোকদের হাতে আবদ্ধ ছিলো। যেমন, ‘নুসাখায়ে বুরাইদা’ নামক হাদীস সমষ্টি। আ হাদীসগুলো বরীদ আবু বারদা থেকে এবং আবু বারদা আবু মুসা আশয়ারী (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। এর দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে ‘নুসখায়ে আমর ইবনে শুয়াইব’। এ নুসখার হাদীসগুলোর বর্ণনাকারী শুধুমাত্র আমর ইবনে শুয়াইব। তিনি তার পিতা থেকে এবং তাঁর পিতা তাঁর দাদার কাছ থেকে শুনে হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন।

৩. এমন কিছু হাদীস ছিলো, যেগুলোর বর্ণনাকারী সাহাবী ছিলেন অখ্যাত অপরিচিত। এরূপ লোকদের হাদীস ও কম জানা ছিলো এবং বর্ণনাও করেছেন কম। তাই স্বাভাবিকভাবে তাঁদের থেকে খুব কম লোকই হাদীস বর্ণনা করেছেন।

এই ধরণের হাদীসগুলো সাধারণ ফতোয়া দানকারী লোকদের নিকট ছিলো অজ্ঞাত। পক্ষন্তরে এ যুগের আলিমদের নিকত গোটা হাদীসে ভান্ডার তো পৌছেছেই, সেই সাথে প্রতিটি জনপদের বসবাসকারী সাহাবী এবং তাবেয়ী ফকীহদের আছার পর্যন্ত তাদের নিকট পৌছে যায়। অথচ এ যুগের পূর্বেকার যেকোনো ব্যাক্তি কেবলমাত্র সেইসব হাদীসই সংগ্রহ করতে সক্ষম ছিলো, যেগুলো শুধুমাত্র তার শহরের লোকদের এবং তাঁর উস্তাদদের মাধ্যমে তাঁর নিকট পৌছেছে। এর পূর্বে রাবীদের নাম এবং তাঁদের আদালতগত৩৯ মর্যাদা নির্ণয় রাবীর অবস্থা ও পরিবেশের ভিত্তিতে সাধারন মানবিক দৃষ্টিতে।

[৩৯. ‘আদালত’ হাদীসের একট পরিভাষা। এর অর্থ জলো হাদীস বর্ণনাকারীর সুস্থ বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন বালিগ মুসলমান হওয়া, ফিসক ও লজ্জাহীনতার ক্রুটি থেকে মুক্ত হওয়া এবং বিশ্বস্ততার ব্যাপারে কোনো প্রকার সনশয় সৃষ্ট হতে পারে এরূপ কার্যকলাপ থেকে মুক্ত থাকা। —অনুবাদক]

কিন্তু এ যুগে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও গবেষণা পর্যালোচনার মাধ্যমে এটাকে একটা পৃথক ‘বিষয়’ হিসেবে প্রতিষ্টিত করা হয়েছে। পুংখানুপুংখ যাচাই বাছাইর মাধ্যমে প্রত্যেক রাবীর ভাল মন্দ সকল দিক নির্ণয় করা হয়েছে। এবং এ বিষয়ে বলিষ্ঠ গ্রন্থাবলী রচনা করা হয়েছে। এই বিচার বিশ্লেষন ও গ্রন্থরচনার ফলে হাদীসসমূহের মুত্তাসিল এবং মুনকাতি হবার বিষয় পরিস্কার হয়ে যায়। এখন তাদের কাছে এটা সুস্পষ্ট যে, কোনটা হাদীসে মুত্তাসিল আর কোনটা হাদীসে মুনকাতি।৪০

[৪০. যে হাদীসের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিকতা সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ন রয়েছে এবং যে কোনো পর্যায়ে কোনো বর্ণনাকারী উহ্য থাকেনি, এরূপ হাদিসকে মুত্তাসিল হাদীস বলে। আর যে হাদীসে বর্ণনাকারীদের নামের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকেনি, এবং মাঝখান থেকে কোনো রাবী উহ্য থেকে গেছে বা বাদ পড়ে গেছে, তাকে মুনকাতি হাদীস বলে। —অনুবাদক]

সুফিয়ান সওরী, ওকী এবং তাদের সমপর্যায়ের লোকেরা তো চূড়ান্ত পর্যায়ের ইজতিহাদ করেছিলেন, কিন্তু তারপরও এক হাজার মুত্তাসিল মারফু হাদীস সংগ্রহ করতে সক্ষম হননি। মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্যে আবু দাউদ সিজিস্তানীর লেখা চিঠি থেকে এ তথ্য জানা যায়। অথচ এই স্তরের লোকদের বর্ণিত হাদীসসংখ্যা চল্লিশ হাজার বা তার কাছাকাছি। (অবশ্য এই সংখ্যা এর চাইতেও অনেক গুণ বেশী। কিন্তু বাকীগুলো তাঁরা হাদীস যাচাইয়ের কষ্টি পাথরে নিরীক্ষণ করে পরিত্যাজ্য ও অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করেন।) ইমাম বুখারী থেকে তো একথা বিশুদ্ধভাবেই বর্ণিত হয়েছে যে, ছয় লাখ হাদীস পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই বাছাই করে তিনি ‘সহীহ বুখারী’ সংকলন করেছেন। আবু দাউদ-সিজিস্তানী থেকে বর্ণিত হয়েছে, পাচঁ লক্ষ হাদীস যাচাউ বাছাই করে তিনি ‘সুনানে আবু দাউদ’ সংকলন করেছেন। আহমদ এবনে হাম্বল তো তাঁর ‘মুসনাদ’ কে এমন এক মান্দন্ড হিসেবে সংকলন করেছেন, যার ভিত্তিতে হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাই করা যেতে পারে। যদিও তাঁর সংকলিত হাদীসগুলো একটি সুত্রে বর্ণিত হয়েছে, তবু তাঁর গ্রন্থে বর্তমান থাকে, তবে বলা যায়, হাদীসটির ভিত্তি রয়েছে আর যদি তাঁর গ্রন্থে হাদীসটি নাথাকে তবে বলা যেতে পারে হাদীসটির কোনো ভিত্তি নেই।

হাদীস বিশারদগণের ফিকাহর প্রতি মনোযোগ

এ সময় আরো যারা হাদীস শাস্ত্রে যারা অবদান রাখেন, তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পর্যায়ের ছিলেনঃ আবদুর রাহমান ইবনে মাহদী, ইয়াহিয়া ইবনে সায়ীদ কাতান, ইয়াযীদ ইবনে হারূন, আবদুর রাযযাক, আবু বকর ইবনে আবী শাইবা, মুসাদ্দাদ, হান্নাদ, আহমদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ইবনে রাহুইয়া, ফদল ইবনে দুকাইন, আলী ইবনে আলমাদানী এবং তাঁদের সমপর্যায়ের আরো কতিপয় মুহাদ্দিস। এটা হাদীস বিশারদহণের সেই তবকা যা ছিলো সকল তবকার চাইতে সেরা। গবেষণ পর্যালোচনা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে হাদীসশাস্ত্রকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর এ শাস্ত্রে মুহাক্কিকগণ কিকাহর প্রতি মনোনিবেশ করেন। তাঁদের পূর্বেকার ফিকাহর ইমামদের কোনো একজনের তাকলীদ করার ব্যাপারে একমত হওয়া তাদের জন্যে সম্ভব হয়নি। কারণ, তাঁরা দেখলেন, প্রত্যেকটি মাযহাবের এমন অনেক মতামত রয়েছে যা বহুসংখ্যক হাদীস এবং আছারের৪১ সাথে সাংঘর্ষিক।

[৪১. সাহাবায়ে কিরামের কথা, কাজ, সমর্থন ও মতামতকে ‘আছার’ বলা হয়। –অনুবাদক]

তাই তারা কিছু মূলনীতি প্রণয়ন করেন এবং তার ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীস এবং সাহাবী, তাবেয়ী ও মুজতাহিদ্গণের আছার পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক বিধান অবগত হয়ে তার উপর আমল করেন। তাঁদের প্রণীত মূলনীতিগুলো সংক্ষেপে আমি তোমার সম্মুখে পেশ করছি।

 

নতুন উসূলে ফিকাহ

তাদের মূলনীতি ছিলো এই যেঃ

১. কোনো বিষয়ে কুরআনে স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া গেলে, সে বিষয়ে অন্য কিছুর প্রতি প্রত্যাবর্তন করা বৈধ নয়।

২. কোনো বিষয়ে যদি কুরআনের বক্তব্যের একাধিক অর্থ গ্রহণের অবকাশ থাকে, তবে সুপ্রতিষ্ঠিত সুন্নাতে রাসূল দ্বারা সে বিষয়ের ফায়সালা গ্রহণ করতে হবে।

৩. যে মাসয়ালায় কুরআন থেকে কোনো ফায়সালা পাওয়া যায় না, সেক্ষেত্রে তাঁরা হাদীসে রাসূলকে আঁকড়ে ধরেছেন। সে হাদীস সকল ফকীহর নিকট গ্রহণযোগ্য ছিলো কি ছিলনা সেদিকে তাঁরা নজর দেননি। কিংবা হাদীসটি কোনো বিশেষ শহর বা খান্দানের সুত্রেই বর্ণিত হয়ে আসুকনা কেন, তাতেও তাঁরা কোনো প্রকার দোষ মনে করেননি, তাও তাঁরা দেখেননি। মোটকথা কোনো হাদীস পাওয়া গেলে তার সম্মুখে তারা কোনো ইজতিহাদকে গুরুত্ব দিতেন না।

৪. কোনো মাসয়ালা সম্পর্কে চূড়ান্ত পর্যায়ের অন্বেষণের পরও যদি কোনো হাদীস না পেতেন, তবে সেক্ষেত্রে তাঁরা বিরাট সংখ্যক সাহাবী ও তাবেয়ীর মতামতের অনুসরণ করতেন। তবে এ ক্ষেত্রে তাঁরা পূর্ববর্তী ফকীহদের নীতি অনুসরণ করতেন না। এরূপ অবস্থায় ফকীহগণের অনুসৃত নীতি ছিলো এই যে, তাঁরা সকল সাহাবী ও তাবেয়ীর মতামতের প্রতি লক্ষ্য না করে শুধুমাত্র বিশেষ সংখ্যক বা বিশেষ শহরের আলিমগণের মতামত অনুসরণ করতেন। এঁরা নিজেদেরকে অনুরূপ কোনো বনফহনে আবদ্ধ করেননি। বরঞ্চ এঁদের নিয়ম এই ছিলো যে, কোনো মাসয়ালার ক্ষেত্রে খুলাফায়ে রাশেদীন এবং মশহুর ফকীহগণকে একমত দেখতে পেলে তাঁরা নির্দ্বিধায় তা অনুসরণীয় মনে করতেন। কিন্তু যদি তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য পেতেন, সেক্ষেত্রে তাঁরা ঐ ব্যাক্তির রায়কে অগ্রাধিকার দিতেন যিনি তাঁদের মধ্যে ইলম, খোদাভীতি ও স্মরণশক্তির দিক থেকে অগ্রগণ্য ছিলেন। অথবা ঐ মতটি গ্রহণ করতেন যেটি সাধারন ভাবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিল। তাছাড়া কোনো মাসয়ালার ক্ষেত্রে যদি সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ দুটি মত পেতেন, তবে সেটিকে তাঁরা “দুই মতওয়ালা মাসয়ালা” বলতেন।৪২

[৪২. এক্ষেত্রে দুটি মতই তাদের কাছে সমানভাবে অনুসরণযোগ্য ছিলো। —অনুবাদক]

৫. চতুর্থ পন্থায়ও যদি কোনো মাসয়ালার সমাধান পেতে ব্যার্থ হতেন, তখন তাঁরা আয়াতে কুরআন ও সহীহ হাদীসে সাধারণ অর্থ, ভাভত ইংগিত ও উপযোগিতার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেন। এবং এ সংক্রান্ত পূর্ব দৃষ্টান্ত অন্বেষণ করতেন আর দৃষ্টান্তকে অবশ্যি মাসয়ালাটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হতো। এভাবেই উপনীত হতেম তাঁরা কোনো একটি সমাধানে। এক্ষেত্রে ও তাঁরা কোনো একটি ধরাবাধা নিয়মের ইধীন ছিলেন না। বরঞ্চ সেই সমাধানটিই তাঁরা গ্রহণ করতেন, যেটির প্রতি তাদের জ্ঞানবুদ্ধি আস্থাশীল হতো এবং মনে হতো আশ্বস্ত। ব্যাপারটি ঠিক তেমন, যেমন কোনো হাদীসকে ‘মুতাওয়াতির’ বলে নির্ণয় করাটা হাদীসটির রাবি সংখ্যাটা এবং রাবীদের আদালতের ধরনের উপর নির্ভর করতোনা। বরঞ্চ লোকদের মনের নিষ্ঠগত ইয়াকীন সেদিকে সায় দিতো তার ভিত্তিতে হাদীসটির বিশুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা নির্ণয় করা হতো। সাহাবীদের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে আমরা বিষয়টি উল্লেখ করে এসেছি।

উসুলগুলোর উৎস

হাদীস বিশারদ্গণের এই উসূলগুলোর উৎস ছিলো তাঁদের পূর্ববর্তীগণের কার্যক্রম ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। এ সম্পর্কে মাইমুন ইবনে মিহরান বলেনঃ

“আবু বকরের (রা) সামনে কোনো বিবাদের মীমাংসার জন্যে মুকদ্দমা পেশ করা হতে তিনি আল্লাহর কিতাবের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেন। তাতে যদি বিষয়টি সংক্রান্ত বিধান পেয়ে যেতেন, তাই দিয়েই ফায়সালা করতেন। কিতাবুল্লায় সে সংক্রান্ত কোনো বিধান না পাওয়া গেলে সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সা) সুন্নাত বা হাদীস নিজের জানা না থাকলে বেরিয়ে পড়তেন। এবং মুসলমানদের মধ্যে কারো জানা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করতেন। বলতেনঃ আমার কাছে এরূপ এরূপ একটি মুকদ্দমা দায়ের করা হয়েছে, অনুরূপ বিষয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) কোনো ফায়সালা তোমাদের জানা আছে? এমতাবস্থায় সাধারণত তাঁর সামনে একদল লোক জমা হয়ে যেতো। তাঁদের প্রত্যেকেই অনুরূপ বিষয়ে রাসূলুল্লাহর ফায়সালার ঘটনা তাঁকে শুনাতেন। তখন আবু বকর বলতেনঃ ‘শোকর সেই আল্লাহর, যিনি আমাদের মধ্যে এমনসব লোক সৃষ্টি করেছেন, যাঁরা আমাদের জন্যে আমাদের নবীর বানী সংরক্ষণ করে রেখেছেন।’ সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টার পরও সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহর কোনো সুন্নাত৪৩ উদ্ধার করতে না পারলে সাহাবীদের মধ্যকার সর্বোত্তম ও শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী লোকদের ইজতেমা করতেন এবং সে বিষয়ে তাঁদের কাছে পরামর্শ চাইতেন। অতঃপর কোনো একটি রায়ের উপর তাঁদের মতৈক্য হলে তিনি সেই অনুযায়ী ফায়সালা করে দিতেন।”

[৪৩. এ গ্রন্থে ‘সুন্নাত’ শব্দটি ‘হাদীসে রাসূল’ ও সুন্নাতে রাসূল’ উভয় অর্থে ব্যাবহৃত হয়েছে। অনুবাদক]

একইভাবে হযরত উমার (রা) সম্পর্কে শুরাইহ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি শুরাইহকে ফরমান পাঠিয়েছিলেনঃ “আপনার কাছে যদি এমন কোনো বিষয় উপস্থাপিত হয় যার বিধান আল্লাহর কিতাবে মুজুদ রয়েছে তবে সে অনুযায়ী ফায়সালা করবেন। মানুষের মতামত যেনো আপনাকে আল্লাহর কিতাব থেকে অনুদিকে ফেরাতে না পারে। এমন কোনো মুকদ্দমা যদি আপনার সামনে পেশ করা হয়, যার কোনো বিধান আল্লাহর কিতাবে নেই তবে সে বিষয়ে সুন্নাতে রাসূল এর প্রতি দৃষ্টি আরোপ করুন এবং সে অনুযায়ী ফায়সালা করুন। এমন কোনো বিষয় যদি আপনার সামনে উপস্থাপিত হয়ে যার কোনো বিধান কিতাবুল্লাহতেও নেই এবং রাসূলুল্লাহর সুন্নাহ ও নিরব, তবে সে বিষয়ে লোকদের সাধারণ ও সর্বসম্মত মত কি তা দেখুন এবং সে অনুযায়ী ফায়সালা করুন। আর আপনার নিকট যদি এমন কোনো মুকদ্দমা থাকে যে সম্পর্কে কিতাবুল্লাহ এবং সুন্নাতে রাসূলে তো কোনো বিধান নেই-ই এমনকি আপনার পূর্ববর্তীদের ও কেউই সে সম্পর্কে কোনো মতামত দিয়ে যাননি, তবে সে সম্পর্কে আপনি দুটি পন্থার যে কোনোটি অবলম্বন করতে পারেন। (এক) নিজের রায় দ্বারা ইজতিহাদ করে সাথে সাথে কোনো ফায়সালা প্রদান করতে পারেন। কিংবা (দুই) ইজতিহাদী রায় কর্যকর করার বিষয়টি বিলম্ব করতে পারেন এবং বিষয়টি নিয়ে আরো অধিকতর চিন্তা ভাবনা করতে পারেন। আর শেষোক্ত জিনিসটি (বিলম্ব) করা আমি আপনার জন্য উত্তম মনে করি।”

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেনঃ

“আমাদের জীবনে এমন একটি সময়৪৪ অতিবাহিত হয়েছে, যখন আমরা কোনো ফায়সালা প্রদান করতাম না এবং তার উপযুক্ত ও আমরা ছিলাম না। কিন্তু আল্লাহ তায়্যালার ইচ্ছা অনুযায়ী সেই স্থানে উপনীত হয়েছি। যা তোমরা দেখতে পাচ্ছ।

[৪৪. অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সা) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের যামানা। —অনুবাদক]

শোনো আজকের পর যার সামনেই কোনো মুকদ্দমা উপস্থিত হয় সে যেনো অবশ্যি আল্লাহর কিতাবের ভিত্তিতে ফায়সালা করে। এমন কোনো বিষয় যদি তার সামনে পেশ হয় যে সম্পর্কে আল্লাহর কিতাবে কোনো বিধান নেই, তপবে সে যেনো রাসূলুল্লাহর সুন্নাহর প্রতি দৃষ্টি দেয়। এবং সে যেনো সে অনুযায়ী ফায়সালা প্রদান করে। কিন্তু যখন এমন কোনো বিষয় তার সামনে উপস্থিত হবে যে সম্পর্কে কোনো বিধান কুরআন এবং হাদীসে উভয়টি থেকেই পাওয়া না যাবে তখন যেনো সে উক্ত বিষয় এ সালিহ লোকদের ফায়সালার ভিত্তিতে ফায়সালা করে। এক্ষেত্রে সে যেনো এমনটি না বলে যে, আমি ভয় পাচ্ছি কিংবা আমার মত এটা। কেননা হারাম সুস্পষ্ট এবং হালালও সুস্পষ্ট। আর এ দুটির মাঝখানে এমন কিছু জিনিস আছে, যেগুলোর হারাম হওয়াটা স্পষ্ট নয় এবং এবং হালাল হওয়াটাও স্পষ্ট নয়। সুতরাং অষ্পষ্ট জিনিসগুলোর ব্যাপারে এই নীতি অবলম্বন করো যে, তোমার মনে যে জিনিস সম্পর্কে খটকা লাগে তা ত্যাগ করো আর যে সম্পর্কে মন নিশ্চিন্ত হয়, তা গ্রহণ করো।”

ইবনে আব্বাস (রা) থেকে যখন কোনো মাসয়ালা জিজ্ঞেস করা হতো, তিনি কুরআনের বিধান মুতাবিক তার জবাব দিতেন। জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের জবাবা আল্লাহর কিতাবে পাওয়া না গেলে রাসূলুল্লাহর (সা) সুন্নাহ মুতাবিক তার জবাব দিতেন। কিতাবুল্লাহ এবং সুন্নাতে রাসূল কোনোটিতেই পাওয়া না গেলে । তবে আবুবকর এবং উমারের (রা) এর ফায়সালার ভিত্তিতে জবাব দিতেন। কিন্তু যখন তাঁদের থেকেও অনুরূপ কোনো ফায়সালার দৃষ্টান্ত পাওয়া না যেতো, তখন ইজতিহাদ করে নিজ রায়ের ভিত্তিতে ফায়সালা দিতেন।

এই ইবনে আব্বাসই (রা) এক ভাষণে লোকদের সতর্ক করতে গিয়ে বলেছিলেনঃ “তোমরা যে বলো, ‘রাসূলুল্লাহ একথা বলেছেন আর অমুক একথা বলেছেন’ —এ ব্যাপারে তোমাদের কি এই ভয় নেই যে, তোমাদেরকে কঠিন আযাব গ্রাস করবে কিংবা জনীন তলিয়ে নিবে!”

কাতাদাহ (রা) থেকে বর্ণিত আছেঃ ইবনে সীরীন কোনো এক ব্যাক্তিকে রাসূলুল্লাহর (সা) একটি হাদিস শুনালে সে বললোঃ “এই মাসয়ালাটি সম্পর্কে অমুক ব্যাক্তি এরূপ বলেছে।” ইবনে সীরীন জবাব দিলেন “আমি তোমাকে রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীস শুনালাম, আর তুমি বলছো, অমুক ব্যাক্তি এরূপ বলেছে?”

আওযায়ী থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ উমার ইবনে আবদুল আযীয লিখিত ফরমার জারি করেন যে, “কিতাবুল্লাহর হুকুমের সামনে কোনো ব্যাক্তির রায়ের বিন্দুমাত্র মূল্য নেই। আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীনের রায় কেবলমাত্র ঐসব ক্ষেত্রেই বিবেচ্য হবে, যেসব ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব এবং সুন্নাতে রাসূলের বিধান অনুপস্থিত। যেক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) কোনো সুন্নাহ রয়ে গেছে, সেক্ষেত্রে কোনো রায় প্রদানের অধিকার কারো নেই।”

আ’মাশ বলেনঃ ইব্রাহীম নখয়ী একিক মুক্তাদীকে ইমামের বাম পাশে দাঁড়াতে বলতেন। আমি তাঁকে সামী যাইয়াতের সুত্রে ইবনে আব্বাস বর্ণিত এই হাদীসটি শুনালাম, “ রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে (ইবনে আব্বাসকে) ডান পাশে দাঁড় করিয়েছিলেন।৪৫ হাদীসটি শুনার সাথে সাথে ইব্রাহীম নখয়ী তা গ্রহণ করেন এবং নিজের ধারণা পরিবর্তন করেন।

[৪৫. একবার তাহাজ্জুদ নামাযে ইবনে আব্বাস (রা) রাসূলুল্লাহর বাম পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর পিছে অকতিদা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে ধরে এনে ডান পাশে দাঁড় করিয়ে দেন। —অনুবাদক]

শা’বী থেকে জনৈক ব্যাক্তি তাঁর কাছে কোনো একটি বিষয়ে জানতে আসে, তিনি বলে দিলেন, এ ব্যাপারে ইবনে মাসউদ এরূপ বলেছেন। লোকটি বললো “বিষয়টি সম্পর্কে আপনার রায় কি?” তিনি বলেনঃ “হে লোকেরা, এই লোকটির কথা তোমাদের বিস্মিত করছেনা! আমি তাকে ইবনে মাসউদের সুত্রে জবাব দিয়ে দিয়েছি, অথচ সে আমার নিজের রায় জানতে চাচ্ছে! আমি তাকে যে জবাব দিয়েছি, জবাব দেবার রি তরীকারি মামার কাছে সর্বোত্তম। আল্লাহর কসম, তোমাকে আমি যার সুত্রে জবাব দিয়েছি, তার পরিবর্তে আমার নিজের রায়া প্রদানকরার চাইতে কোনো গাণ গাওয়াকে৪৬ আমি অধিক পছন্দ করি।”৪৭

[৪৬. ‘গাণ গাওয়া বলতে, মুখ থেকে কোনো গুণাহর উপযুক্ত কথা বেরিয়ে পড়া। —অনুবাদক]

[৪৭. উপরোল্লেখিত সবগুলা ঘটনা ও বক্তব্য দারেমীর সুত্রে উদ্ধৃত হলো। —গ্রন্থকার]

তিরমিযী আবু সায়িবের সুত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ আমরা ওকীর নিকট বসা ছিলাম। রায় দ্বারাকার্য সম্পাদনের পক্ষপাতী এক ব্যাক্তিকে তিনি বলচিলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সা) কুরবানীর উটের কূঁজে আঘাত করে রক্ত প্রবাহিত করে দিয়েছিলেন। অথচ আবু হানীফা এটাকে বলেছেন, নাক কান কর্তিত করা!” লোকটি বললঃ “এর কারণ ইব্রাহীম নখয়ী এটাকে নাক কান কর্তিত করা বলেছেন।” তার এ বক্তব্য শুনে অকী ভীষণভাবে রাগান্বিত হন এবং বলেনঃ “আমি তোমাকে রাসূলুল্লাহ (সা) এরূপ বলেছেন! অথচ তুমি বলছো ইব্রাহীম ঐরূপ বলেছে! তোমাকে কয়েদখানায় আবদ্ধ করা উচিত এবং ততোক্ষণ পর্যন্থ সেখান থেকে মুক্ত করা উচিত নয় যতোক্ষণ না তুমি তোমার এরূপ চিন্তা ও বক্তব্য থেকে প্রত্যাবর্তন করো।”

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আতা, মুজাহিদ এবং মালিক ইবনে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুম বলতেন, “রাসূলুল্লাহ (সা) ব্যাতীত এমন কোনো মানুষ নেই যার কথার কিছু অংশ গ্রহণযোগ্য এবং কিছু অংশ বর্জনযোগ্য হয় না।”

ফিকাহর এই পদ্ধতির সাফল্য

মোটকথা হাদীসে আলিমগণ মাসয়ালা ইস্তিম্বাত করার জন্যে যখন উসূলে ফিকাহকে এই নতুন বুনিয়াদের ভিত্তিতে সাজালেন, তখন আর তাঁদের পূর্ববর্তীদের আলোচিত কিংবা তাদের নিজেদের সময়ে সংঘটিত এমন কোন মাসয়ালা অবশিষ্ট থাকলো না যেটি সম্পর্কে কোনো না কোনো মারফু মুত্তাসুল বা মুরসাল কিংবা মুকূফ অথচ সহীহ, হাসান এবং নির্ভরযোগ্য হাদীস পাওয়া যায়নি। কদাচিৎ কোনো ক্ষেত্রে অনুরূপ কোনো হাদীস পাওয়া না গেলেও অন্তত শায়খাইন৪৮ ও অন্যান্য খলীফার আছার, বিভিন্ন শহরে কাযীদের রায় অথবা ফকীহগণের কোনো ফতোয়া অবশ্যি পেয়েছেন কিংবা নসসে সরীহর উমুম, ইংগিত ও উপযোগিতার ভিত্তিতে সরাসরি ইস্তিম্বাত করে নিয়েছেন। এভাবেই সত্যিকার সুন্নাতে রাসূলের রাজপথ অনুসরণের কাজ আল্লাহতায়ালা তাঁদের জন্যে সহজ করে দেন। এই আলিমগণের মধ্যে পূর্ণত্বের দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্ব হাদীসের জ্ঞানের শীর্ষে অবস্থান করছিলেন আহমদ ইবনে হাম্বল এবং ইসহাক ইবনে রাহুইয়া।

[৪৮. অর্থাৎ আবু বকর ও উমর রাদিয়াল্লাহূ আনহুমা। —অনুবাদক]

ফিকাহর এই তরীকা অনুশীলনের জন্যে প্রয়োজন বিরাট জ্ঞান ভান্ডারের। এ পন্থায় শরয়ী বিধান সম্পর্কে রায় কায়েম করার জন্যে ব্যাক্তির ভান্ডারে হাদীস ও আছারের বিরাট সঞ্চয় বর্তমান থাকা আবশ্যক। আহমদ ইবনে হাম্বলকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল “এক লাখ হাদীস জানা থাকা মুফতী হবার জন্যে যথেষ্ট নয় কি?” তিনি বলেন ‘নয়’। অতঃপর প্রশ্নকর্তা হাদীসের সংলহ্যা বাড়াতে থাকে আর তিনি ‘নয়’ বলতে থাকেন। অবশেষে প্রশ্নকর্তা বললেন “পাঁচ লাখ হাদীস জানা থাকলে?” এবার তিনি বললেন “হ্যাঁ, আশা করা যেতে পারে।”৪৯ এখানে ইমাম আহমদ উপরোল্লেখিত মুলনীতির ভিত্তিতে ফতোয়া দান বুঝিয়েছেন।

[৪৯. ঘটনাটি ‘গায়াতুল মুনতাহা’ গ্রন্থ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। —গ্রন্থকার]

অতঃপর আল্লাহ তায়ালা আরেকদল লোক সৃষ্টি করলেন। এরা দেখলেন, তাঁদের পূর্ববর্তী মনীষীগণ হাদীস সংগ্রহ, সংকলন ও (উপরোল্লেখিত মূলনীতির ভিত্তিতে) উসুলে ফিকাহর বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করে তাঁদেরকে সৌভাগ্যের অধিকারী করে গেছেন। সুতরাং এরা হাদীস শাস্তের অন্যান্য দিকের প্রতি মনোনিবেশ করেন। যেমন, তাঁরা সেসব সহীহ হাদীসকে পৃথক করেন, যেগুলো সহীহ হবার ব্যাপারে ইয়াযীদ ইবনে হারূন, ইয়াহিয়া ইবনে সায়ীদুল কাতান, আহমদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ইবনে রাহুইয়া এবং তাঁদের সমপর্যায়ের সেরা হাদীস বিশারদ্গণ একমত পোষণ করেছেন। তাঁরা ঐসব ফিকহী হাদীসকে বেছে বেছে প্ররতজক করেন, যেগুলোর ভিত্তিতে বিভিন্ন শহরের ফকীহ ও আলিমগণ নিজ নিজ মাযহাব প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরা ঐসব শায৫০ ও গরীব হাদীসের উপর অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে সেগুলোর মর্যাদা ও হুকুম বর্ণনা করেন, অতীতের আলিমগণ যেগুলো উপেক্ষা করে এসেছেন।

[৫০. ‘শায’ হচ্ছে ঐসব হাদীস যার বর্ণনাকারী বিশ্বস্ত বটে, কিন্তু হাদীসটি তার চাইতে অধিকতর বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীর হাদীসের বিপরীত। —অনুবাদক]

এর প্রত্যেকটি হাদীসের সনদ্গত ও বিধানগত মর্যাদা বর্ণনা করেন। তাঁরা সেইসব সনদও অনুসন্ধান করে বের করেন, তাঁদের পূর্বের হাদীস সংগ্রহকারীগণ যেসব সনদের মাধ্যমে হাদীস সংগ্রহ করতে পারেননি অথচ সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন সনদ্গুলো উদ্ধার করার ফলে দেখা গেলো, কোনোটি মুত্তাসিল, কোনোটি উঁচুস্তরের রাবী কর্তৃক বর্ণিত, কোনোটি ফকীহ থেকে গকীহ কর্তৃক বর্ণিত এবং কোনোটি হাফিযে হাদীস রাবী থেকে হাফীযে হাদীস রাবী কর্তৃক বর্ণিত। এভাবে সেগুলো থেকে অনেক তত্ব ও তথ্য উদঘটিত হয়।

হাদীসের এই মহান খাদিমদের শীর্ষস্থানীয় ছিলেন বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, আবদ ইবনে হুমাইদ, দারেমী, ইবনু মাজাহ, আবু ইয়ালী, তিরমিযী, নাসায়ী, দারুজুতনী, হাকিম, বায়হাকী, খতীব, দায়লামী, ইবমে আবদুল বার এবং এঁদের সমপর্যায়ের অন্যান্য মুহাদ্দীসগণ।

এই মনীষীগণের মধ্যে আবার আমার মতে জ্ঞান, গ্রন্থরচনা এবং খ্যাতির দিক থেকে শীর্ষচূড়ায় অবস্থানকারী ছিলেন চারজন। চারজনই প্রায় সম-সাময়ীক কালের লোক ছিলেন। তাঁরা হলেনঃ

একঃ আবু আবদুল্লাহ আর বুখারীঃ এ চারজনের প্রথম ব্যাক্তি হলেন আবু আবদুল্লাহ আল বুখারী। তাঁর দৃষ্টি ভংগি ছিলো এই যে, মুত্তাসিল, মশহুর ও সহীহ হাদীসসমূহকে অন্য ধরনের হাদীসসমূহ থেকে ছেঁটে বেছে পৃথক করতে হবে এবং এগুলোরই উপর ফিকাহ, সীরাত, এবং তাফসীরের ভিত্তি স্থাপন করে মাসায়েল ইস্তিম্বার করতে হবে। এই দৃষ্টিভংগিতেই তিনি সংকলন করেন তাঁর চির অম্লান গ্রন্থ ‘জামিউস সহীহ’ (আল বুখারী)। এ গ্রন্থে তাঁর পূর্ব নির্ধারিত শর্ত সমূহ তিনি পুরোপুরি রক্ষা করেন।

শুনেছি জনৈক বুযুর্গ স্বপ্নে দেখেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে বলছেন, “তোমার কি হলো যে, তুমি আমার কিতাব পরিত্যাগ করে মুহাম্মাদ ইবনে ইদরীসের৫১ ফিকাহর প্রতি মনোনিবেশ করেছো?” বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার কিতাব কোনটি?” রাসুলুল্লাহ জবাব দিলেন, “সহীহ আল বুখারী।”

[৫১. অর্থাৎ ইমাম শাফেয়ী (র)। –অনুবাদক]

আল্লাহর কসম, এই গ্রন্থ খ্যাতি এবং গ্রহণযোগ্যতার এমন শীর্ষ চূড়ায় পৌছেছে যার চাইতে অধিক আশা করা যায় না।

দুই. মুসলিম নিশাপুরীঃ এঁদের মধ্যে দ্বিতীয় ব্যাক্তি হলেন, মুসলিম নিশাপুরী। তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিলো এই যে, যেসব মুত্তাসিল মারফু হাদীসে বিশুদ্ধতা সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের ঐক্যমত রয়েছে এবং যেগুলো দ্বারা সুন্নাতে রাসূলকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সহজ হবে সেই সব হাদীসকে নির্বাচিত করে আলাদা করতে হবে। এই হাদীসগুলোকে তিনি এমন এক পদ্ধতিতে সংকলন করার সিদ্ধান্ত নেন। যার ফলে সেগুলো মস্তিষ্কে ধারণের উপযোগী হবে এবং সেগুলো থেকে মাসায়েল ইস্তিম্বাত সহজ হবে।

অতঃপর তিনি তার এই আকাঙ্ক্ষা ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে অতি উত্তম তারতীবের সাথে একটি গ্রন্থ সংকলন করেন। অর্থাৎ প্রত্যেকটি হাদীসের সবগুলো সনদ এক স্থানে একত্র করেন, যাতে করে একই হাদীসে মতনের৫২ বিভিন্নতা পরিস্কার হয়ে যায় এবং একই মুলসূত্র থেক সনদের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা কিভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তাও জানা যায়।

[৫২. প্রত্যেক হাদীসে দুইটি অংশ থাকে। একটি হলো বর্ণনাকারীদের নামের ধারানাহিক তালিকা অপরটি হলো মূল বক্তব্য বা হাদীস অংশ। হাদীসে পরিভাষায় প্রথম অংশকে ‘সনদ’ এবং শেষাংশকে ‘মতন’ বলে।]

বাহ্যিকভাবে যেসব হাদীসের মধ্যে পারস্পরিক বৈপরিত্য ছিলো, তিনি সেগুলোর মধ্যেও সামঞ্জস্য বিধান করেন। এভাবে তিনি তাঁর এই মহান প্রচেষ্টার মাধ্যমে (অর্থাৎ সহীহ মুসলিম সংকলনের মাধ্যমে) একজন আরবী জানা ব্যাক্তির জন্যে সুন্নাতে রাসূলের রাজপথ ত্যাগ করে অন্য কোনো দিকে ধাবিত হবার পক্ষে কোনো ওজর বাকী রাখেননি।

তিন. আবু দাউদ সিজিস্তানীঃ এই চার মনীষীর তৃতীয় ব্যাক্তি হলেন, আবু দাউদ সিজিস্তানী। তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো সেই হাদীসগুলোকে বাছাই করে পৃথক করা, যেগুলোকে ফকীহগণ দলিল হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তাঁদের মধ্যেই অধিক খ্যাতি লাভ করেছে আর সেসব হাদীস, বিভিন্ন শহরের আলিমগণ যেগুলোর উপর আহকামের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি সংকলন করেন তাঁর অমর গ্রন্থ ‘সুনানে আবু দাউদ’। এ গ্রন্থে সহীহ এবং হাসান হাদীসের সাথে এমনসব দুর্বল হাদীসও তিনি সংকলন করে নেন, যেগুলো দুর্বল হওয়া সত্বেও আমলের উপযোগী। আবু দাউদ নিজেই বলেছেন, “আমার গ্রন্থে আমি এমন কোনো হাদীস সংকলন করিনি, যেটি সকল মুহাদ্দিসের দৃষ্টিতে পরিত্যাজ্য। “আমার গ্রন্থে সংকলিত জয়ীফ হাদীসে জয়ীফ হবার ব্যাখ্যাও প্রদান করেছি। কোনো হাদীসে কোনো সূক্ষ্ম ক্রুটি থেকে থাকলে তাও এমনভাবে বয়ান করে দিয়েছি যে কোনো হাদীস বিশারদের পক্ষে তা বুঝতে কিছুমাত্র কষ্টও হবে না।” তার গ্রন্থের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, প্রত্যেকটি হাদীস বর্ণনার পূর্বে এমন একটি ফিকহী বিধানকে সেটির শিরোনাম ধার্য করেছেন, যা অনশ্যি কোনো ফকীহ ইস্তিম্বাত করেছেন কিংবা কারো না কারো মাযহাবে পরিণত হয়েছে। এ কারণে আল গাযালী প্রমুখের মতে, ‘মুজতাহিদের জন্যে সুনানে আবু দাউদ যথেষ্ট।‘

চার. আবু ঈসা তিরমিযীঃ এ মনীষীদের চতুর্থ ব্যাক্তি হলেন আবু ঈসা তিরমিযী। বুঝা যাচ্ছে তিনি একদিকে রেওয়ায়াতের পদ্ধতিগত দিক থেকে শায়খাইনকে৫৩ অনুসরণ করেছেন।

[৫৩. হাদীস শাস্ত্রে ‘শায়খাইন’ বলতে ইমাম বুখারী আর ইমাম মুসলিমকে বুঝায়। –অনুবাদক]

অপরদিকে, ফকীহ ও আলিমদের মত ও মাযহাব বর্ণনার ক্ষেত্রে আবু দাউদের পন্থা অনুসরণ করেছেন। তাই তাঁর গ্রন্থে সাহাবী, তাবেয়ী এবং ফকীহদের মাযহাবও বর্ণনা করে দিয়েছেন। এভাবে তিনি এমন এক মৌলিক ও পূর্ণাংগ গ্রন্থ রচনা করেন, যাতেঃ

ক. সংক্ষিপ্ত আকারে অতিশয় বিজ্ঞতার সাথে একেকটি হাদীসর সবগুলো সনদ উল্লেখ করা হয়েছে তবে একটির পূর্ণ বিবরন দেয়া হয়েছে আর বাকীগুলোর প্রতি ইংগিত করা হয়েছে।

খ. প্রত্যেকটি হাদীসের অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে। সেটা কি সহীহ, হাসান, জয়ীফ আকি মুনকার তা বয়লে দেয়া হয়েছে। জয়ীফ রেওয়ায়েতসমূহের জয়ীফ হবার কারণ স্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে, যাতে করে এ বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু ব্যাক্তিরা অন্তরদৃষ্টি লাভ করতে পারেন এবং নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য হাদীসের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম হন।

গ. প্রতিটি হাদীস সম্পর্কে বলে দেয়া হয়েছে, সেটি ‘মশহুর’ নাকি ‘গরীব’।

ঘ. সাহাবী এবং ফকীহগণের মাযহাব উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসংগে প্রয়োজনানুসারে কারো নাম আবার কারো কুনিয়াহ উল্লেখ করা হয়েছে।

মোটকথা, জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্যে এ গ্রন্থে আর কোনো পর্দা রেখে দেয়া হয়নি এ কারণেই বলা হয় “গ্রন্থটি মুজতাহিদের জন্যে যথেষ্ট আর মুকাল্লিদের জন্যে পর্যাপ্ত।”

৭. আহলূর রায়
ইজতিহাদী রায়ের প্রবণতা

এতোক্ষণ যে মনীষীদের কথা আলোচনা করলাম (এবং যাদেরকে মুলত আহলুল হাদীস বলা হয়), তাদের দৃষ্টিভংগির প্রতিকূল দৃষ্টিভংগির অধিকারী আরেক দল লোক ছিলেন, যারা মাসয়ালা কল্পনা করে তার জবাব নির্ণয় করার কাজকে খারাপ মনে করতেন না এবং ফতোয়া দিতেও ইতস্তত বোধ করতেন না। ইমাম মালিক ও সুফিয়ান সওরীর যুগ থেকে আরম্ভ করে পরবর্তী কিছুকাল পর্যন্ত এদের সময়কাল পরিব্যাপ্ত। এদের বক্তব্য হলোঃ ফিকাহর উপরই দ্বীনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। তাই এর প্রসার ও পরিব্যাপ্তি আবশ্যক। অপরদিকে এরা রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীস বর্ণনা করতে এবং হাদীসকে রাসূলুল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করতে ভয় পেতেন। যেমন শা’বী বলেছেনঃ

“কোনো হাদীসকে স্বয়ং রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে সম্পৃক্ত না করে সাহাবীদের সুত্রে বর্ণনা করাই আমার নিকট অধিক প্রিয় (আর মূলত সাহাবীদের সুত্রেই তো হাদীস আমাদের নিকট পৌছেছে), কেননা তাতে কোনো প্রকার কম-বেশী হয়ে থাকলে সে কম বেশীকে নবীর সাথে সম্পৃক্ত করার গুনাহ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।”

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ যখন রাসূলুল্লাহর (সা) কোনো হাদীস বর্ণনা করতেন, তখন (হাদীস বত্তণনার বিরাট দায়িত্বানুভূতির ফলে) তাঁর মুখমফলে অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হতো। তিনি বলতেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সা) এরূপ কিংবা এরি কাছাকাছি বলেছেন।”

আনসারদের দ্বারা গঠিত একটি প্রতিনিধি দলকে কুফা পাঠানোর সময় উমার (রা) তাঁদের বলেছিলেনঃ

“তোমরা কুফায় যাচ্ছো! শোনো সেখানে তোমরা এমনসব লোকদের সাক্ষাত পাবে, যারা কুরআন পড়ার সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তোমাদের দেখে তার বলবেঃ ‘মুহামাদ (সা) এর সাথীরা এসেছেন, মুহাম্মাদ (সা) এর সাথীরা আগমন করেছেন।‘ তাঁরা তোমাদের নিকট হাদীস শুনতে চাইবে, তোমরা কিন্তু রাসূলুল্লাহর (সা) পক্ষ হতে যথাসম্বব কম হাদীস বর্ণনা করবে।”

ইবনে আউন বলেছেনঃ “শা’বীর নিকট কোনো মাসয়ালা এলে তিনি (ভয়ে) তার জবাব দেয়া থেকে বিরত থাকতে চাইতেন। পক্ষান্তরে ইব্রাহীম নখয়ীর নিকট কোনো মাসয়ালা এলে তিনি তার জবাব দিতে ইতস্তত করতেন না।”৫৪

[৫৪. এ আছার গুলো দারেমীর সুত্র হতে বর্ণিত। –গ্রন্থকার]

তাখরীজের কারণ

(আহলূল হাদীস এবং আহলূর রায়ের এই দৃষ্টিভংগিগত পার্থক্যের কারণের পূর্ববর্তী লোকারা) হাদীস, ফিকাহ এবং মাসায়েলের যেসব সংকলন তৈরী হরেছিলেন, সেহুলো যেভাবে তাদের কাজে লেগেছিল এবং প্রয়োজন পূরণ করেছিল, তার কারণ ছিলো ভিন্ন। (আর এ লোকেরা তাথেকে সেই ফায়দা লাভ করতে পারেননি, যা পেরেছিলেন সেসব লোকেরা অর্থাৎ হাদীসের আলিমগণ)। এর কারণগুলো এখন আমি বিশ্লেষণ করছি।

ক. এঁদের কাছে হাদীস এবং আছারের সেই বিরাট ভান্ডার ছিলো অনুপুস্থিত, যার ভিত্তিতে তাঁরা হাদীসের আলিমহণের অনুসৃত মূলনীতির ভিত্তিতে ফিকহী মাসায়েল ইস্তিম্বাত করতে পারতেন।

খ. পূর্বতন (সকল) আলিমগণের মতামত (ও মতপার্থক্য) সমূহ গভীরভাবে চিন্তা করে দেখা এবং সেগুলো একত্র করে গবেষণা ও ব্যাখ্যা বিস্লেষণ করে সঠিক মত নির্বাচন করার ব্যাপারে তাদের বক্ষ প্রশস্ততা লাভ করেনি। পক্ষান্তরে তাঁরা এ ব্যাপারে এমন পন্থা অবলম্বন করেন, যার ফলে অপবাদ ও দুর্নামের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। তাঁরা (অন্যদের ত্যাগ করে) কেবল নিজেদের উস্তাদ ও ইমামদেরি অনুসরণ করেন এবং ইসলামের ব্যাখ্যা বিস্লেষণের ব্যাপারে এঁদের মর্যাদাগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা নিজেদের অন্তরে বদ্ধমূল করে নেন। মোটকথা, নিজেদের উস্তাদ ও অগ্রবর্তীদের প্রতি তাদের অন্তর চরমভাবে ঝুকে পড়েছিল। যেমন, আল্কামা স্পষ্টভাবে বলেছেন, “আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের চাইতে অধিকতর মজবুত রায়ের অধিকারী কোনো সাহাবী ছিলেন কি?” আর আবু হানীফা (রাহ) বলেছেনঃ “ইব্রাহীম নখয়ী সালিম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমারের চাইতে বড় ফকীহ ছিলেন।”

গ. আল্লহতায়ালার পক্ষ থেকে এই লোকেরা এমন মন-মস্তিষ্ক ও বুঝ-জ্ঞান লাভ করেছিলেন এবং একটি জিনিস থেকে আরেকটি জিনিসের প্রতি মনকে এতো দ্রুত ধাবিত করার সামর্থ্য লাভ করেছিলেন যে, স্বীয় উস্তাদ ও অগ্রবর্তীদের বক্তব্য থেকে অতি সহজে তাঁরা মাসয়লা তাখরীজ করতে পারতেন। আসল কথা হলো, যাকে যে কাজের জন্যে সৃষ্টি করা হয়, তার জন্য সেকাজ সহজও করে দেয়া হয়। ওয়া কুল্লু হিযবিন বিমা লাদাইহি ফারেহুন—আর প্রতিটি দল তাদের নিকট যা কিছু আছে তাতেই মগ্ন।

মোটকথা, এসব কারণের প্রেক্ষিতে তার ‘তাখরীজ’কে কিজেদের ফিকাহর ভিত্তি হিসেভে গ্রহণ করেন।

তাখরীজ কি?

এখন প্রশ হলো তাখরীজ কি? তাদের অনুসৃত তাখরীজ ছিলো এই যে, তাদের প্রত্যেকেই এমন একটি কিতাব মুখস্থ ও আত্মস্থ করে নিতেন, যাতে তার উস্তাদ ও অগ্রবর্তীদের বক্তব্যকে পুরোপুরি সমর্থন করে হয়েছে, তাদের বক্তব্যকে সর্বোত্তমভাবে জানার ব্যাবস্থা করা হয়েছে এবং তাদের মতপার্থক্যের একটিকে আরেকটির উপর সঠিকভাবে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এরপর তারা প্রত্যেকটি মাসয়ালার বিধান কোন কারণের প্রেক্ষিতে নির্ণয় করা হয়েছে সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতেন। অতঃপর যখনই তাদের নিকট কোনো মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করা হতো, কিংবা নিজেদেরই শয়ীয়তের কোনো বিধান জানার প্রয়োজন হতো, তখন স্বীয় উস্তাদ ও অগ্রবর্তীদের যেসব বক্তব্য তাঁরা আত্মস্থ করেছিলেন, সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন। সেখানে যদি জবাব পেয়ে যেতেন, সানন্দ চিত্তে তা গ্রহন করতেন, কিন্তু সেখানে যদি সরাসরি জবাব না পেতেন, তবে তাঁদের রায় ও বক্তব্য সমূহ যেসব বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হতো সেগুলোর সাথে নিজের বিষয়টি মিলিয়ে দেখতেন এবং কোথাও না কোথাও তা খাপ খেয়ে যেত। কিন্তু এভাবেও যদি কোনো বিধান নির্ণয় করতে না পারতেন, তবে তাঁদের রায় ও বক্তব্যসমূহের আনুষংগিক ইংগিতের প্রতি লক্ষ্য করতেন এবং তার ভিত্তিতে মাসয়ালা ইস্তিম্বাত করতেন।

প্রকৃতপক্ষে অনেক বক্তব্যের মধ্যি এমন ইংগিত ও উপকরণ থাকে, যা থেকে কোনো মাসয়ালা বা সমস্যার স্পষ্ট সমাধান বুঝা যায়। কখনো এমন হতো যে, নিজের সম্মুখে উপস্থিত মাসয়ালাটির কোনো নজীর পূর্ববর্তীদের বক্তব্যের মধ্যে পেয়ে যেতেন, আর সে নজীরের উপর এ মাসয়ালাটির ভিত্তি স্থাপন করতেন। কখনো আবার এমন হতো যে তাঁরা পূর্ববর্তীদের নির্ণীত এমনসব বিধানের ‘ইল্লত’ তথে কারণ বা উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেন, যেসব বিধান সরাসরি প্রকাশ হয়নি, বরঞ্চ প্রকাশ হয়েছে তাখরীজ, সিবর৫৫ কিংবা প্রত্যাখ্যানের (হযফ) মাধ্যমে।

[৫৫. ‘সিবর’ তাখরীজের মতই একটি প্রচলিত শব্দ। এর অর্থ হলো, মূল জিনিসের স;মস্ত বৈশিষ্ট্য তার এমন একটি অঙ্গ বা শাখার মধ্যে যাচাই করে দেখা যার ভিত্তিতে মূল জিনিস সম্পর্কে ধারণা লাভের চেষ্টা করা হচ্ছে। অতঃপর মূল এবং শাখার মধ্যে যে বৈশিষ্ট্য যৌথভাবে বর্তমান পাওয়া যায়, তাকে গ্রহণ করে বাকীগুলোর উপর শুধু নযর আওড়িয়ে যাওয়া যাতে করে বিধানের কারণ বা উদ্দেশ্য নির্ণীত হতে পারে। —অনুবাদক]

অতঃপর সেই ইল্লতকে নিজের মাসয়ালাটির সাথে সামঞ্জস্যশীল দেখতে পেলে সেটির বিধানই এটির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতেন। (এ ধরনের বিধান নির্ণয়কে তাখরীজের তাখরীজ বলা যেতে পারে)। আবার কখনো পূর্ববর্তী মুজতাহিদের দুটি মত তাদের সামনে আসতো। এ ক্ষেত্রে কোন মতটি নিজ মাসয়ালার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করবেন, তা তাদের ফায়সালা করতে হতো। এমতানস্থায় ‘কিয়াসে ইকতিরানী’৫৬ এবং ‘কিয়াসে শর্তীর’৫৭ ভিত্ততে উভয় মতকে একত্র করলে যে রেজাল্ট বের হতো, সেটাকেই স্বীয় মাসয়ালাটির জবাব বলে ধরে নিতেন।

[৫৬. কিয়াসে ইকতিরানী মুলত যুক্তিশাস্ত্রীয় পরিভাষা। ফিকাহ শাস্ত্রেও এর প্রয়োগ হয়ে থাকে। এটা হচ্ছে সেই কিয়াস যা দুটি ঘটনার বিবরণের সমন্বয়ে গঠিত হয়, যার একটি ছোট আরেকটি বড় এবং উভয়টি থেকে একই রেজাল্ট প্রকাশিত হয়। যেমনঃ “প্রতিটি দেহই সৃষ্ট আর প্রতিটি সৃষ্টিই ধ্বংসশীল। সুতরাং প্রতিটি দেহই ধ্বংসশীল।” ফিকাহ শাস্ত্রে এরূপ উদাহরণ হচ্ছেঃ “সকল মাদকতাই মদ্য আর সকল প্রকার মদ্যই হারাম। সুতরাং সকল প্রকার মাদকতাই হারাম। —অনুবাদক]

[৫৭. কিয়াসে শর্তী কিয়াসে ইকতিরানীরই শ্রেণীভুক্ত। তবে, ইকতিরানী থেকে এর পার্থক্য এই যে, এর দুটি অংশই শর্তযুক্ত। যেমনঃ জ্ঞানী ব্যাক্তি যদি ধ্বংসশীল হন, তবে তার সৃষ্টি ও আছে। কিন্তু তিনি অবশ্যি ধ্বংসশীল। সুতরাং তার সৃষ্টিও আছে।

ফিকাহ শাস্ত্রে এর উদাহরণ হলোঃ বিয়েটি যদি বিশুদ্ধ হয়, তবে তা অটুট বন্ধন হবে। কিন্তু বিয়েটি অবশ্যি বিশুদ্ধ। সুতরাং তার বন্ধন অটুট। —অনুবাদক]

অবস্থা এমন হতো যে, উস্তাদ ও অগ্রবর্তীদের বক্তব্যের মধ্যে এমন ফরমান থাকতো যা উপমা উদাহরণ এবং শ্রেনীবিন্যাস হিসেবে স্পষ্ট ছিলো। কিন্তু সেটার সঠিক ও যথার্থ সংজ্ঞা ছিলো অস্পষ্ট। এমতাবস্থায় সেটার সংজ্ঞা জানার জন্যে তাঁরা ভাষাতত্ববিদদের প্রতি প্রত্যাবর্তন করতেন এবং সেটার সঠিক তত্ব ও তাৎপর্য অবগত হতেন। সঠিক ও যথার্থ সংজ্ঞা জেনে নিতেন। অস্পষ্ট ও কঠিন অংশগুলো স্পষ্ট করে নিতেন। কখনো উস্তাদ এবং অগ্রবর্তীদের বক্তব্য দ্ব্যার্থবোধক হতো। এমতাবস্থায় এঁরা চিন্তা গবেষণা করে একটি অর্থকে অগ্রাধিকার প্রদান করতেন। কখনো অগ্রজদের মাসায়েল এবং মাসায়েলের দলিল প্রমাণের মাঝে অন্তরাল সৃষ্টি হয়ে থাকতো। এমতাবস্থায় এঁরা চিন্তা গবেষণা করে সেই অন্তরাল দূরীভুত করে দিতেন। আবার কখনো এই তাখরীজকর্তারা তাদের অগ্রজদের কোনো কাজ বা নীরবতাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করতেন। তাখরীজের এ রকম আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে।

মোটকথা, মাসায়েল ইস্তিম্বাতের এই তরীকাকেই ‘তাখরীজ’ বলে।

 

মাযহাবী মুজতাহিদ

উপরোক্ত তরীকায় যে মাসয়ালা ইস্তিম্বাত করা হয়, তার উল্লেখ এভাবে করা হয়ে থাকেঃ “এটি অমুকের তাখরীজ করা মাসয়ালা।” কিংবা বলা হয়ঃ “অমুক ইমামের মাযহাব অনুযায়ী বা অমুকের প্রতিষ্ঠিত মূলনীতি অনুযায়ী কিংবা অমুকের বক্তব্য অনুযায়ী মাসয়ালাটির জবাব এইরূপ।” আর এই তাখরীজকর্তাদের ‘মাযহাবী মুজতাহিদ’ বলা হয়ে থাকে। যারা বলেঃ “যে ব্যাক্তি মাবসুত৫৮ আয়ত্ত করলো, সে মুজতাহিদ।”

[৫৮. ‘মাসবুত’ হলো হানাফী মাযহাবের ইমাম সারাখাসী লিখিত বিরাট ফিকাহ গ্রন্থ। —অনুবাদক]

তাদের এই কথার অর্থ দাঁড়ায়, সে যদি হাদীস সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই না রাখে এবং একটি হাদীসও না জানে, তনু সে মুজতাহিদ। মূলত তাঁরা এই ইজতিহাদ দ্বারা সেই ইজতিহাদকেই বুঝিয়ে থাকেন, যা উপরোল্লেখিত তাখরীজের পন্থায় করা হয়েছে।

কিছু মাযহাব প্রসারিত আর কিছু মাযহাব সংকুচিত হবার কারণ

প্রতিটি মাযহাবে এ ধরণের তাখরীজ হয়েছে এবং জোরেশোরে হয়েছে। কিন্তু যেসব মাযহাবের ইমামরা ছিলেন মশহুর, স্বাভাবিকভাবেই রায় এবং ফতোয়ার পদমর্যাদায় তাদেরকেই অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের গ্রন্থাবলী সমাদৃত হয়ে পড়ে। চতুর্দিকে লোকেরা সেগুলোই পঠনপাঠনে লেগে পড়ে। এভাবেই সেসব মাযহাব সারা বিশ্ব ছড়িয়ে পড়ে। এবং পড়তে থাকে। পক্ষান্তরে যেসব মাযহাব এর ইমামদের নাম ততোটা খ্যাতি লাভ করেই, যারা বিচার ফায়সালা এবং ফতোয়া দানের পদ লাভ করেননি এবং সাধারন মানুষেরও তাদের প্রতি আকৃষ্ট গবের সুযোগ ঘটেনি, সেই মাযহাবগুলোই দিন দিন নির্জীব ও বিলীন হবার দিকে এগিয়ে গেছে।

৮. সঠিক পন্থা ও সুষম নীতি
সঠিক পন্থা হলো মধ্যমপন্থা

উপরে যে দুটি পন্থার কথা আলোচনা করে এলাম, অর্থাৎ (১) হাদীসের শব্দের হুবহু অনুসরণ এবং (২) ফকীহদের বক্তব্য থেকে মাসয়ালা তাখরীজ করা –এই উভয় পন্থারই দ্বীনি ভিত্তি রয়েছে। সকল যুগের মহাক্কি আলিমগন দু’টি পন্থাই অনুসরন করে আসছেন। তবে (পার্থক্য ছিলো কেবল উভয় পন্থার মধ্যে সাওঞ্জস্য বিধানের)। অর্থাৎ তাদের কেউ তাখরীজের তরীকার প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়েন আবার কেউ অধিক ঝুঁকে পড়েন হাদীসের শব্দ অনুসরণ নীতির প্রতি। (উভয় নীতির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রতি তাঁরা কেউই মনোযোগ দেননি।) আসলে, এই দুটি পন্থার কোনো একটিকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করা যেতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত উভয় পন্থার (অর্থাৎ আহলে হাদীস ও আহলে ফিকাহর) লোকেরাই এই কাজটী করেছেন। তাঁরা একটিকে পরিত্যা করে অপরটির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। কিন্তু সঠিক পন্থা ছিলো এর চাইতে ভিন্নতর। উচিত ছিলো, উভয় তরীকাকে একত্র করে একটিকে আরেকটির সাথে তুলনা করে দেখা এবং একটিতে কোন ভুল ক্রুটি থাকলে অপরটির দ্বারা তা নিরসন করা। এ কথাটিই বলেছেন হাসান বসরী তার নিম্নোক্ত বক্তব্যেঃ

“কসম সেই আল্লাহর, যিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, তোমাদের পথ হচ্ছে গালী (সীমালংঘনকারী) এবং জাফী (অপরিহার্য সীমার নিচে অবস্থানকারী) এর মাঝখান দিয়ে।”

অতএব আহলে হাদীসের উচিত, তাদের অনুসৃত ও অবলম্বিত যাবতীয় মাসয়ালা এবং মাযহাবকে তাবেয়ী এবং পরবররীকালের মুজতাহিদ ইমামগণের রায়ের সাথে তুলনা করে দেখা এবং তাদের ইজতিহাদ থেকে ফায়দা হাসিল করা। আর আহলে ফিকাহর লোকদেরও উচিত সাধ্যানুযায়ী হাদীসের ভান্ডারে চিন্তা ও গবেষণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করা, যাতে করে সরীহ ও সহীহ হাদীসের বিপরীত মত প্রদান থেকে বাঁচতে পারেন এবং যেসব বিষয়ে হাদীস কিংবা আছার বর্তমার রয়েছে, সেসব বিষয়ে মত প্রদান থেকে মুক্ত থাকতে পারেন।

আহলে হাদীসের বাড়াবাড়ি

হাদীসের ইমমগণ পূর্ণ ইতমীনানের সাথে যেসব বিধিমালা প্রণয়ন করেছেন, অথচ সর্বাবস্থায় সেগুলোর অকাট্যতার পক্ষে সরয়্যত প্রণেতার কোনো সুষ্পষ্ট দলিল নেই, সেগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো মুহাদ্দিসের এতোটা বাড়াবাড়ি করা উচিত নয় যে, কোনো হাদীস (যা এসব বিধিমালার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়নি) কিংবা সহীহ কিয়াসের সাথে সাংজ্ঞহর্ষিক হলেও সেসব বিধিমালার উপর অটল থাকবেন। যেমনঃ

(ক) কোনো হাদীস মুরসাল কিংবা মুনকাতি হবার ব্যাপারে মামুলী কোনো সন্দেহ থাকলেও সেটিকে অস্বীকার করা, যেমনটি করেছেন ইবনে হাযম। তিনি বুখারীর বর্ণিত ‘তাহরীমে মায়ারিফ’ (গানবাদ্য হারাম হওয়া) সংক্রান্ত হাদীসটি কেবল সনদে ইনকিতা থাকার সন্দেহে অগ্রাহ্য ও অস্বীকার করেছিলেন। অথচ প্রকৃতপক্ষে, হাদীসটি মুত্তাসিল এবং সহীহ। তাই ভিত্তিহীন সন্দেহকে কিছুতেই এতোটা গুরুত্ব দেয়া উচিত নয় যে, তার ভিত্তিতে কোনো হাদীসকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করা যাবে। এ ধরণের সন্দেহ কেবল তখনই মনোযোগ লাভের যোগ্য হয়, যখন সন্দেহ আরোপিত হদীসটির সাথে সাংঘর্ষিক কোনো সহীহ হাদীস বর্তমান পাওয়া যাবে।

(খ) অথবা এমনটি বলা যে, “অমুক ব্যাক্তি অমুকের বর্ণিত হাদীসের সবচাইতে বড় হাফিয।” এই মানসিকতার ভিত্তিতে তার বর্ণিত হাদীসকে অন্যদের বর্ণিত হাদীসের উপর অগ্রাধহিকার দান করা, যদিও অগ্রাধিকার লাভের পক্ষে অন্যদের মধ্যে হাজারো কারণ বর্তমান থাকে। আর একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, রাবীগণ ‘অর্থভিত্তিক বর্ণনার’ (রেওয়ায়াত বিল মা’না) সময় সাধারণত হাদীসের অর্থ ও মূল বক্তব্যের প্রতিই লক্ষ্য রাখেন, ভাষাতত্ববিদদের মতো ভাষা ও সাহিত্যের অনুকরণের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেন না। এমতাবস্থায় কোনো বিশেষ ব্যাক্তির বর্ণনার প্রতিটি বর্ণকে অনুকরণ করার কি গুরুত্ব হতে পারে? মজার ব্যাপার হলো যে, তোমরা দেখবে একই হাদীস অপর কোনো বিশ্বস্ত রাবী সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের শব্দ প্রয়োগ করে বর্ণনা করেছেন। বক্তব্যের মধ্যে আগপাছ করেছেন।

সুতরাং, প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক রাবী বাহ্যত যা বর্ণনা করেন তা নবীর (সা) বাণি বা ইরশাদ। তবে কোনো বর্ণনার বিপরীত কোনো হাদীস বা দলিল যদি সকলের নিকট গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে তবে এই বর্ণনাকে পরিত্যাগ করে সেটাকে গ্রহণ করতে হবে।

আহলূর রায়ের বাড়াবাড়ি

একইভাবে তাখরীজকারীদেরও এমন কোনো কথা তাখরীজ করা উচিত নয়, যা তাদের পূর্ববর্তী ইমামদের বক্তব্য ও বক্তব্যের ভাব্ধারার অউসারী নয়, যেটাকে জ্ঞানী লোকেরা এবং ভাষাবিদরা পূর্ববর্তীদের বক্তব্যের অনুসারী এবং অনুকূল মনে করেন না এবং পূর্ববর্তীদের যে নজীর বা দৃষ্টান্তকে ভিত্তি করে তাখরীজ করা হয়েছে, বিশেষজ্ঞ এবং ভাষাবিদগণে তাখরীজটিকে সেই দৃষ্টান্তের সাথে সামঞ্জস্যশীল হবার ব্যাপারে একমত নন, এমনকি পূর্ববর্তীরা যদি বেঁচে থাকতেন এবং তাঁদের জিজ্ঞেস করা হতো যে, আপনাদের যে মাসয়ালাটিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করে এই তাখরীজটি করা হয়েছে, তা কি সেটার সাথে সামঞ্জস্যশীল? তখন, হয়তো তাঁরা বলতেন যে, এক্ষেত্রে আমাদের যে উদ্দেশ্য ও কার্যকারণ ছিল তার সাথে এটা সামঞ্জস্যশীল নয়। (সুতরাং এই পন্থায় তাখরীজ করা বা রায় প্রদান করা সঠিক নয়, বরং বাড়াবাড়ি)। প্রকৃতপক্ষে তাখরীজ তো অবশ্যি মুজতাহিদের অনুকরণের ভিত্তিতে হতে হবে। মুজতাহিদের অনুকরন বা তাকলীদের ভিত্তিতে যে তাখরীজ হবে, সেটাই বৈধ তাখরীজ। মুজতাহিদের বক্তব্যকে সঠিকভাবে অনুধাবন করে তার যথার্থ অনুকরণ করতে পারলেই তাখরীজ ক্রুটিমুক্ত হতে পারে।

একই ভাবে ইজেদের কিংবা নিজেদের উস্তাদদের নির্ধারিত উসূলের অনুসরণ করতে গিয়ে (যে উসূল অকাট্য হবার কোনো প্রমাণ নেই) এমন কোনো হাদীস বা আছারকে বর্জন করা তাদের উচিত নয়, যা সকল হাদীস বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে বিশুদ্ধ। (নিজেদের কিয়াস এবং উসূল অনুসরণ করতে গিয়ে) এ ধরণের কাজ করেছেন তাঁরা ‘হাদীসে মুসাররা’৫৯ এবং গনীমতের মালে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকটাত্মীয়দের৬০ অংশ রদ করে দিয়ে।

[৫৯. মুসাররা সেই দুধদানকারী পশুকে বলা হয়, যাকে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে গেরস্থ করেক বেলা দুধ দুহন করেনি, যাতে করে ক্রেতা তার উলান বড় দেখে প্রতারিত হয়। ‘হাদীসে মুসাররা’ বলতে সেই হাদীসকে বুঝায়, যাতে নবী করীম (সা) বলেছেনঃ “যে ব্যাক্তি মুসাররা পশু ক্রয় করলো এবং তা দুহন করার পর তার প্রকৃত অবস্থা অবগত হলো, তার জন্যে পশুটি রাখার বা ফেরত দেবার ইখতিয়ার রয়েছে। সে যদি পশুটি ফেরত দেবার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে দুহনকৃত দুধের বিনিওয়ে মালিককে এক সা’ পরিমাণ খুরমা প্রদান করতে হবে।”

হানাফী ফকীহরা এই কারণের হাদীসটি গ্রহন করতে অস্বীকার করেছেন যেঃ হাদীসটির বক্তব্য কিয়াসের বিপরীত। তাই এটি সাধারণ বিধান হতে পারে না। কিয়াস বলে দুধের বিনিময় সমপরিমাণ হওয়া উচিত। অথচ হাদীসটিতে বলা হয়েছে, দুধের পরিমাণ এক সের কিংবা দশ সের যাই হোক না কেন, তার বিনিময়ে এক সা’ খুরমা প্রদান করতে হবে। —অনুবাদক]

[৬০. রাসূলুল্লাহর (সা) নিকতাত্মীয় মানে বনী হাশেম এবং বনী মুত্তালিব। খাইবার বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহর (সা) তাদেরকে গনীমতের মাল প্রদান করেছিলেন। খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে এর উপর আমল না হওয়ায় কিছু কিছু ফকীহ তাদের অংশ অস্বীকার করেন। —অনুবাদক]

মনে রাখা দরকার, নিজেদের তৈরী তাখরীজের উসূলের তুলনায় রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীসকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মনে করা উচিত। এ সত্যটির প্রতি ইংগিত করেছেন শাফেয়ী (রহ)। তিনি বলেছেনঃ

“যে রায়ই আমি দিয়েছি, কিংবা নির্ধারণ করেছি কোন উসূল, (হাদীসে রাসূলের (সা) মুকাবিলায় তার কোনো গুরুত্ব নেই।) আমার রায় কিংবা উসূলের বিপরীত যদি রাসূলুল্লাহর (সা) পক্ষ হতে কোনো বাণী পাওয়া যায়, তবে তার বাণীকেই গ্রহণ করতে হবে।”

(আহলে হাদীস এবং আহলে রায়ের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে) এ যাবত আমরা যা কিছু বললাম, প্রায় অনুরূপ কথাই বলেছেন আবুল সুলাইমান খাত্তাবী তাঁর ‘মুয়ালিমুস সুনান’ গ্রন্থের শুরুর দিকে। তিনি বলেছেনঃ

“আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের যুগের আলিমরা দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। একটি দল হলো হাদীস ও আছারের অনুসারী আর অপর দলটি হলো ফিকাহ ও রায়পন্থী। তাঁদের বাস্তব অবস্থা হচ্ছে এই যে, (দু’টি বিপরীত ক্যাম্পে অবস্থান করা সত্বেও) তাঁরা নিঃসন্দেহে পরস্পরের নিকট সমভাবে মুখাপেক্ষী। নিজ নিজ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যেতাদের একদলের পক্ষে আরেক দলকে বাদ দিয়ে চলা সম্ভব নয়। হাদীস এবং ফিকাহ একটি আরেকটির সাথে এমন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, যেমন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত একটি অট্টালিকা এবং তার ভিত। এ ক্ষেত্রে হাদীস হচ্ছে ‘ভিত’ আর ফিকাহ হচ্ছে তার উপর নির্মিত ‘অট্টালিকা’। আর একথা তো সকলেরই জানা যে, কোনো অট্টালিকাকে যদি ভিত ছাড়াই নির্মাণ করা হয়, তবে তার পক্ষে যেমন প্রতিষ্ঠিত থাকা সম্ভব নয়, তেমনি যে ভিতের উপর কোনো ইমারত নির্মাণ করা হয়না তাও মানুষের কোনো কল্যাণে আসে না। উভয় দলের প্রত্যেকেই যদিও মর্যাদার দিক থেকে একে অপরের অপরিহার্য সাথী ও পরিপূরক, পরস্পরের মুখাপেক্ষী এবং কারো পক্কে কাউকেও বাদ দিয়ে চলা সম্ভব নয়, কিন্তু তা সত্বও আমি তাদের দেখতে পাচ্ছি পরস্পরের প্রতি বিমুখ। অথচ হকের পথে পরস্পরকে ছাড়িয়ে যাবার পরিবর্তে পরস্পরের সাহায্য-সহযোগিতা করাই ছিলো তাদের অপরিহার্য কর্তব্য। এদের মধ্যে যে দলটির নাম ‘আহলে হাদীস’ তাদের অধিকাংশই রেওয়ায়াত বর্ণনা করা, সনদ সংগ্রহ করা এবং আমনসব গরীব ও শায হাদীস অন্বেষণ করার কাজে তৎপর, যেগুলোর অধিকাংশই হয় মওদ’ না হয় মাকলুব৬১।

[৬১. ‘মাকলুব’ হচ্ছে সেই হাদীস যা রাবীর ভ্রান্তির কারণে যার শব্দ বা বাক্য আগপাছ হয়ে গেছে। —অনুবাদক]

তাঁরা হাদীসের মতনের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে না, অর্থ ও তাৎপর্য বুঝার চেষ্টা করে না, বক্তব্যের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে যত্নবান হয়না এবং বক্তব্যের গভীরে দৃষ্টিদান করে অন্তর্নিহিত ভাব বের করার চেষ্টা করে না। তারা প্রতিনিয়ত ফকীহদের ক্রুটি খুঁজে বেড়ায়, তাদের দুর্নাম রটায় এবং তাঁদের বিরুদ্ধে সুন্নাতে রাসূলের বিরোধিতার অভিযোগ উত্থাপিত করতে থাকে। অথচ তারা এ জিনিসটা বুঝে না যে, ফকীহদেরকে শরীয়তের যে বুঝ ও জ্ঞান দান করা হয়েছে, তারা সে পর্যায়ে পৌছুতে অক্ষম। তারা একথাও বুঝতে পারছে না যে, খামোখা তাদের বিরুদ্ধে মন্দবাক্য উচ্চারণ করে তাঁরা গুনাহগার হচ্ছে। বাকী থাকলো দ্বিতীয় দলটির কথা, যারা ফিকাহ ও রায়পন্থী। তাদের মদ্ধ্যে খুব কম লোকই হাদীসের সাথে ব্যাপক ও গভীর সম্পর্ক রাখে, সহীহ-জয়ীফ হাদীসের তারতম্য করতে পারে এবং কৃত্রিম হাদীস থেকে খাঁটি হাদীস পৃথক করার যোগ্যতা রাখে। হাদীসের ব্যাপারে তার এতই বেপরোয়া যে, তাদের অবলম্বিত মাযহাব এবং পছন্দনীয় রায়ের অনুকূলে কোনো হাদীস পাওয়া গেলে, সেটাকে ও তাঁরা তাদের বিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রমাণ স্বরূপ পেশ করতে কোনো প্রকার পরোয়া করেনা। তাদের ইমাম ও উস্তাদদের নিকট কোনো ‘খবরে জয়ীফ’ এবং ‘হাদীসে মুনকাতি’ ও যদি মশহুর এবং গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে থাকে, তবে, তার ভিত্তি যতোই টোটকা এবং বিশুদ্ধতা যতোই সন্দেহযুক্ত হোকনা কেন, সেটাকে গ্রহণ করার ব্যাপ্রে তাঁরা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে নিয়েছে, সুতরাং এটা রায়ের এক বিরাট ভ্রান্তি ও সন্দিগ্ধতা। এই লোকদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, (আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এবং বিশেষভাবে তাদেরকে তোয়ফিক দান করুন), তাদের নিকট যদি তাদের মাযহাবের প্রথম সারির কোনো ব্যাক্তি কিংবা তাদের স্কুলের কোনো দায়িত্বশীল চিন্তাবিদের ইজতিহাদকৃত কোনো কথা বর্ণনা করা হয়, তবে সেটা গ্রহণ করার জন্যে কথাটি কার বা কাদের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে, প্রথমে তাঁরা সেটা দেখে নেয় এবং কেবল সেকাহ ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর মাধ্যমে প্রাপ্ত কথাটাই গ্রহণ করে। এই অনুযায়ী আমরা মালেকীদের দেখতে পাই, তারা তাদের মাযহাবের ইমাম ও দায়িত্বশীলদের বক্তব্য গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ইবনে কাসেম, আশহুব এবং এদের সমপর্যায়ের লোকদের বর্ণনা উপরই নির্ভর করে। কিন্তু এদের তুলনায় কিছুটা কম মর্যাদার আলেমদের মাধ্যমে যদি মাযহাবের ইমাম ও দায়িত্বশীলদের এমন কোনো বক্তব্য শুনতে পায় যা এদের বর্ণনার বিপরীত, তবে তাঁরা তা গ্রহণ করে না। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল হাকাম এবং তার সমপর্যায়ের লোকদের বর্ণনা। তুমি হানাফীদের দেখতে পাবে, তাঁরা আবু ইউসূফ, মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান এবং আবু হানীফার ছাত্রদের মধ্যে এদের সমপর্যায়ের শ্রেষ্ঠ ছাত্রদের মাধ্যম ছাড়া অন্যদের মাধ্যমে তাঁরা আবু হানীফার বক্তব্য গ্রহণ করে না। তারা হাসান ইবনে যিয়াদ লুলুবী এবং তার সমপর্যায়ের বা তার চাইতে নিচের দরজার এলেমদের মাধ্যমে উপরোক্তদের বর্ণিত বক্তব্যের বিপরীত আবু হানীফার কোনো কোনো বক্তব্য পেলে সেটাকে বিন্দু মাত্র গুরুত্ব দেয়না। সেটাকে নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য মনে করে না। একইভাবে তুমি শাফেয়ীর মুকাল্লেদদের দেখতে পাবে, তাঁরা শাফেয়ীর বক্তব্য গ্রহণের ক্ষেত্রে কেবল মুযান্নী এবং রবী ইবনে সুলাইমান মুরাদীর বর্ণনাকেই গুরুত্ব দেয়। কিন্তু হারমালা, জীযী ও এদের সমপর্যায়ের লোকদের মাধ্যমে যদি উপরোক্তদের বর্ণনা বিপরীত শাফেয়ীর কোনো বর্ণনা তাঁরা শুওতে পায়, সেটাকে তাঁরা গ্রহণযোগ্যই মনে করেনা। মোটকথা, প্রত্যেক ফেরকার আলেমরাই তাদের ইমাম ও উস্তাদদের থেকে তাদের মাযহাবের আহকাম গ্রহণের ক্ষেত্রে এই নিয়ম অবলম্বন করে আসছে। খুঁটিনাটি বিষয়ে (ফরূয়াত) এই হচ্ছে তাদের সতর্কতার দৃষ্টান্ত। যেখানে নিজেদের ইমাম ও অগ্রবর্তীদের থেকে এসব খুঁটিনাটি বষয় গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁরা এতোটা সেকাহ, বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য মাধ্যম বা সুত্র অন্বেষণ করে, সেক্ষেত্রে কি করে তাদের পক্ষে সুত্রের বাছবিচার ছাড়াই অনায়াসে যেকোনো ব্যাক্তির থেকেই সেই মহান ইমামেরবাণী গ্রহণ করা বৈধ হতে পারে, যিনি সকল ইমামের ইমাম, রাব্বুল ইযযতের রাসূল, যাঁর ফরমান সর্বাবস্থায় আমাদের জন্যে ফরয, যাঁর আনুগত্য অপরিহার্য, যাঁর হুকুমের সম্মুখে মাথানত করে দেয়া মাদের জন্যে অবশ্যকর্তব্য, যাঁর ফায়সালা রহণ করার ক্ষেত্রে আমাদের অন্তরে বিন্দুমাত্র অনীহা, সংকীর্ণতা ও হঠকারিতার উদ্রেক হওয়া আমাদের জন্যে বয়ে আনবে চরম ধ্বংসাত্মক পরিণতি?… আসলে কিছু লোক সূক্ষাতিসুক্ষভাবে যাচাই বাচাই করে খাঁটি ও প্রকৃত জ্ঞান হাসিল করাকে সুষ্কর মনে করে নিয়েছে। তাঁরা মনে করছে, এ পন্থায় জ্ঞান্রাজ্যে অগ্রসর হওয়া এক সুদীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। অথচ তাঁরা অতি সহজে ও অল্প সময়ের মধ্যেই মনযিলে মাকসাদে পৌছে যেতে চায়। এজন্যে তাঁরা জ্ঞান লাভের পথিকে সংক্ষিপ্ত করে নিয়েছে। সীমিত কিছু কথা এবং উসূলে ফিকাহর বিধিবদ্ধ নিয়ম থেকে মুক্ত হয়ে বিশেষ বিশেষ কিছু জিনিসকেই তাঁরা নিজেদের জন্যে যথেষ্ঠ মনে করে নিয়েছে। আর তাঁরা এটার নাম রেখেছে ‘ইলাল’ যাতে করে তাদেরকেও জ্ঞানের পঞ্চয়ারোহীদের মধ্যে গণ্য করা হয়। এসব তত্বকে তাঁরা তাদের মর্যাদাগত শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীকরূপে গ্রহণ করেছে। আর এসব তত্বকে তাঁরা বিরীধী পক্ষের সাথে বিতর্কযুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করে। এরি অন্তরালে তাঁরা চুলচেরা খুঁজে খুঁজে বের করে জগড়া ও বিতর্কের উপকরণ সংগ্রহ করে এবং তাই দিয়ে বিপক্ষের সাথে বাহাছ ও মুনাযেরায় লিপ্ত হয়ে তুফান সৃষ্টি করে। অতঃপর মুনাযেরার ময়দান থেকে ফিরে এসে বাকযুদ্ধে বিজয়ী ব্যাক্তির মাথায় তাঁরা শেষ্ঠ বুদ্ধিমানের শিরোপা পরিয়ে দেয়। আর তাকেই তারা যুগের সেরা ফকীহ এবং সর্বশেরেষ্ঠ ইমামের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে নেয়। এতো গেলো তাদের অবস্থার একদিক। কিন্তু এর চাইতেও লজ্জাকর দিক হলো, শয়তান অতি সংগোপনে একটি সুক্ষ কৌশল তাদের অন্তরে অদ্রেক করে দিয়েছে এবং তাদেরকে এক সুগভীর ফাঁদে ফেঁসে দিয়েছে। এর্থ সে তাদেরকে এই পাঠদান করেছে, তোমাদের কাছে জ্ঞানের যে পুঁজি আছে তা খুবই নগণ্য। তা দিয়ে তোমাদের প্রয়োজন পূরণ হতে পারেনা এবং তা তোমাদের জন্যে যথেষ্টও হতে পারেনা। সুতরাং ‘ইলমে কালাম’ শিখে সেটাকে মজবুত করে নাও। ইলমে কালামের কিছু কিছু বিতর্ক পদ্ধতি শিখে নিয়ে তাতে পট্টি লাগাও। এইসাথে মুতাকাল্লিমদের (দার্হনিক বা দর্শনবেত্তাদের) কিছু নীতিমালা শিখে নাও, এতে তোমাদের চুলচেরা বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা বাড়বে এবং দৃষ্টি প্রশস্ত হবে। এভাবে ইবলিস তাদের উপর তার চিন্তাকে সত্যে পরীণত হতে দেখলো। তাদের বিরাট সনহখ্যক লোক শয়তানের আনুগ্রত্য ও অনুবর্তনের পথ ধরলো। কেবল অল্পসংখ্যক লোকই এ থেকে আত্মরক্ষা করতে পেরেছে। আফসোস, এই লোকদের বিদ্যাবুদ্ধির প্রতি! তারা কোথায় ছুটে চলেছে? শয়তান তাদেরকে তাদের লক্ষ্যপথ ও হিদায়াত থেকে কোনদিকে হটিয়ে নিয়ে যাচ্ছ? কেবল মহান আল্লাহই সেই সত্তা, যার কাছে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে।”৬২

[৬২. ইমাম আবু সুলাইমা খাত্তাবীঃ মুয়ালিমস সুনান]

 

৯. তাকলীদ
তাকলীদবিহীন যুগ

জেনে রাখো, পহেলা এবং দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীতে কোনো নির্দিষ্ট ফিকহী মাযহাবের তাকলীদ করবার প্রচলন ছিলনা। এ প্রসংগে আবু তালিব মাক্কী তাঁর ‘কুওয়্যাতুল কুলূব’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ “এইসব (ফিকাহর) গ্রনন্থাবলী তো পরবর্তীকালে রচিত ও সংকলিত হয়েছে। প্রথম এবং দ্বিতীয় হিজরী শতকে লোকদের কথাকে (শরীয়তের বিধানরূপে) পেশ করা হতো না। কোনো এক ব্যাক্তির মাযহাবের ভিত্তিতে ফতোয়া দেয়া হতো না। সকল (মাসয়ালার) ক্ষেত্রে এক ব্যাক্তির মতই উল্লেখ করা হতো না এবং কেবল এক ব্যাক্তির মাযহাবকেই বুঝার চেষ্টা করা হতো না।

আমি বলবো, তখন লোকদের অবস্থা ছিলো এর চাইতেও সম্পুর্ণ পৃথক ধরণের। তখন মুসলমানদের মধ্যে দুই শ্রেণীর লোক ছিলো। এক শ্রেণীর লোকেরা ছিলেন সাধারণ মুসলমান। সাধারণ মুসলমানরা সর্বসম্মত বা মতবিরোধহীন মাসয়ালাসমূহের ক্ষেত্রে মুজতাহিদগণের তাকলীদ করতেন না, বরঞ্চ সরাসরি শরীয়ত প্রণেতা আলাইহিস সালামের অনুসরণ অনুকরণ করতেন। তারা অযু গোসল প্রভৃতির নিয়ম পদ্ধতি এবং নামায যাকাত প্রভৃতির বিধান তাদের মুরুব্বীদের নিকট থেকে অথবা নিজেদের এলাকার আলিমদের থেকে শিখতেন এবং সেই অনুযায়ী আমল করতেন। আর যখন কোনো বিরল ঘটনা ঘটতো তখন মত ও মাযহাব নির্বিশেষে যে কোনো মুফতী তারা পেতেন তার নিকটই সে বিষয় এ ফতোয়া চাইতেন। ইবনে হুমাম তাঁর ‘আত তাহরীর’ গ্রন্থের শেষ দিকে লিখেছেনঃ

“সেকালে লোকেরা কখনো একজন আলিমের নিকট ফতোয়া চাইতেন আবার কখনো আরেকজন আলিমের নিজট। কেবল একজন মুফতীর নিকটই ফতোয়া চাওয়ার নিয়ম ছিল না।”

আলিম শ্রেণীর লোকেরা আবার দুই ধরনের ছিলেন।

(১) এক ধরণের আলিম ছিলেন তাঁরা, যাঁরা কিতাব, সুন্নাহ এবং আছারে সাহাবার উপর গবেষণা ও অনুসন্ধান কাজে নিজেদের জ্ঞান ও বুদ্ধি বিবেককে পূর্ণশক্তিতে প্রয়োগ করেন এবং এতোটা উচ্চতর যোগ্যতা অর্জন করেন যে, জনগণ ফতোয়ার ব্যাপারে তাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। আর তাঁরা ফতোয়া দানের ব্যাপারে এতোটা ব্যুতপত্তি লাভ করেন যে, সাধারণত সকল মাসায়েলের জবাব দানের যোগ্যতা অর্জন করেন। কোনো মাসাআলার জবাবা দানের ক্ষেত্রে এমন ব্যুতপত্তির অধিকারী আলীমদেরই বলা হয় ‘মুজতাহিদ’।

এরূপ (ইজতিহাদী) যোগ্যতা দুভাবে অর্জিত হয়। কখনো সম্ভাব্য সকল প্রক্রিয়ায় প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে রেওয়ায়েত সংগ্রহ করার মাধ্যমে এ যোগ্যতা অর্জন করা হয়। কারণ, আহকামের একটা বিরাট অংশ রয়েছে হাদীসের মধ্যে। আরেকটা বিরাট অংশ রয়েছে সাহাবায়ে কিরা, তাবেয়ী এবং তাবে’তাবেয়ীগণের আছারের মধ্যে। (তাই একজন মুজতাহিদ আত্যন্ত সাফল্যের সাথে এই রেওয়ায়েতের ভান্ডার থেকে মাসায়েল অবগত হতে পারেন)। আর এ কথাতো পরিস্কার যে, একজন চোখ-কান খোলা বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন আলিম ভাষা এবং বাক্য প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে অনবহিত থাকেন না। তাছাড়া এমন ব্যাক্তিকে বিরোধপূর্ণ রেওয়ায়েতের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের নিয়ম পদ্ধতি এবং দালায়েলের তারতীব নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয়েও ব্যুৎপত্তির অধিকারী হতে হয়। এরূপ যোগ্যতার বাস্তব উদাহরণ হলেন দুই মহান ইমাম, আহমদ ইবনে হাম্বল এবং ইসহাক ইবনে রাহুইয়া (রাহিমাহুমুল্লাহ)।

আবার কখনো তাখরীজের তরীকাসমূহকে পূর্ণভাবে আত্মস্থ করা এবং প্রত্যেকটি বিষয়ে ফিকাহর ইমামগণ বর্ণিত উসূলী নিয়ম কানুন আয়ত্ত করার মাধ্যমে এ যোগ্যতা অর্জিত হয়। তবে সেইসাথে হাদীস এবং আছারের একতা যুক্তিসংগত পুঁজি আয়ত্ত থাকা শর্ত। এরূপ ইজতিহাদী যোগ্যতার পূর্ণাংগ উদাহরণ হলেন দুই মহান ইমাম, আবু ইউসুফ এবং মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (রাহিমাহুমুল্লাহ)।

(২) আরেকধরণের আলিম ছিলেন তাঁরা, যাঁরা কুরআন ও সুন্নাহর উপর এতোটা ব্যুৎপত্তি রাখতেন যে, ফিকাহর মূলনীতি এবং মৌলিক মাসয়ালাসমূহ বিস্তারিত দলিল প্রমাণের সাথে অবগত হবার যোগ্যতা রাখতেন। অবশ্য এরূপ কিছু কিছু মাসয়ালার ক্ষেত্রে আবার নিরবতা অমলম্বন করতেও বাধ্য হতেন এবং এসব ক্ষেত্রে অন্যান্য বিশেষজ্ঞ আলিমগণের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। কেননা, স্বাধীন মুজতাহদের মতো তাঁরা ইজতিহাদের পরিপূর্ণ যোগ্যতা রাখতেন না। অতএব এসব আলিম কিছু কিছু মাসায়েলের ক্ষেত্রে ছিলেন গায়রে মুজতাহিদ। সাহাবী এবং তাবেয়ীগণের ব্যাপারে তো মুতাওয়াতির বর্ণনার মাধ্যমে একথা প্রমাণিত যে, যখনই তাঁদের নিকট কোনো হাদীস পৌছুতো, তখন তাঁরা কোনো প্রকার বিধি নিয়মের তোয়াক্কা না করেই তার উপর আমল করতেন।

ব্যাক্তিকেন্দ্রিক তাকলীদের সূচনা

তৃতীয় হিজরী শতাব্দী ব্যাক্তিগত পর্যায়ে মুজতাহিদদের তাকলীদের বার্তা নিয়ে আসে। লোকেরা একজন নির্দিষ্ট মুজতাহিদের মাযহাব অউসরণের বন্ধনে নিজেদের বন্দী করে নেয়। এক ব্যাক্তির তাকলীদ করার বন্ধন থেকে খুব নগণ্য সংখ্যক লোকই মুক্ত থাকে। এরূপ তাকলীদ করাকে লোকেরা তখন অপরিহার্য বানিয়ে নিয়েচ্ছিল। এর একটা বিশেষ কারণও ছিলো। তা হলো, কোনো ফিকাহ চর্চাকারী কোনো অবস্থাতেই দুটি অবস্থা থেকে মুক্ত ছিল না।

১. একটি হলো এই যেঃ হয়তো তাঁর যাবতীয় প্রচেষ্টা নিবদ্ধ হয় ইতিপূর্বে মুজতাহিদগণ যেসব মাসায়েলের জবাব দিয়ে গিয়েছিলেন, সেগুলো অবগত হওয়া, সেগুলোর দলিল প্রমাণ আয়ত্ত করা, সেগুলোর প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা এবং কোনটির উপর কোনটি অগ্রাধিকারযোগ্য তা নির্ণয় করার কাজে। এটা ছিলো একটা বড় কঠিন কাজ। এমন একজন মুজতাহিদ ইমামের অনুসরণ ছাড়া এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না, যিনি ফিকাহর প্রতিটি অধ্যায়ে মাসয়ালাকে বিভক্ত করে বর্ণনা করেছেন এবং দলিল প্রমাণযুক্ত করে মাসয়ালাসমূহকে শক্তি ও সমৃদ্ধি দান করেছেন। এরূপ ইমামের অনুসরণ এজন্যে প্রয়োজন ছিলো, যাতে তাঁর দলিল প্রমাণ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সাহায্যে যাবতীয় মাসায়েল খতিয়ে দেখা যায় এবং একটিকে আরেকটির উপর অগ্রাধিকার দেয়া যায়। এরূপ কোনো মুজতাহিদ ইমাম এর ইকতিদা করার সু্যোগ না পেলে তার জন্যে একজন সফল ফকীহ হবার পথ জটিল হয়ে পড়তো। আর এ কথাতো অনস্বীকার্য যে, কোনো কাজের সহজ পথ খোলা থাকতে জটিল পথে অগ্রসর হবার কোনো অর্থ হয় না।

ফিকাহর এই গবেষক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে একটি কথা খুবই বাস্তব যে, তিনি তার ইমাম মুজতাহিদের (যার অনুসরণ তিনি করেছেন) কোনো বক্তব্যকে উত্তম মনে করে তার সাথে একমত হবেন। আবার কোনো কোনো বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ ও করবেন। এক্ষেত্রে সামগ্রিক পর্যালোচনাইয় যদি তার ঐকমত্য অধিক হয় আর মতপার্থক্য হয় কম, তবে এই গবেষক ফকীহকে সেই ইমাম মুজতাহিদের মাযহাবের ‘আসহাবুল উজুহ’র৬৩ অন্তর্ভূক্ত গণ্য করা হয়।

[৬৩. ‘আসহাবুল উজুহর’ সেই সব আলিমদের বলা হয়, যারা কোনো ইমাম মুজতাহিদের মুকাল্লিদ এবং তাঁর মূলনীতি ও বক্তব্যকে ভিত্তি করেই মাসায়েল ইস্তেম্বাত করেন বটে, কিন্তু প্রাসংগিক মাসায়েলের ক্ষেত্রে নিজস্ব বিশেষ বিশেষ দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে ইমাম মুজতাহিদের সাথে আবার মতপার্থক্য ও করেন। এ ধরণের ইখতিলাফী মতামতও সেই ইমাম মুজতাহিদের মাযহাবের অংশ বলে গণ্য করা হয়। —অনুবাদক]

পক্ষান্তরে, মতপার্থক্য যদি অধিক হয়, তবে তাকে উক্ত মাযহাবের ‘আসহাবুল উজুহ’র অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হয় না। কিন্তু তা সত্বেও তাকে ঐ ইমামাএর মাযহাবের ফকীহ বলেই গণ্য করা হয়। তবে ইনি ঐ সমস্ত লোকদের থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যারা অপর কোনো ইমামের এবং তাঁর মাযহাবের অধিকাংশ মূলনীতি ও প্রসংগিক বিষয়ের ইকতিদা করেন।

তাছাড়া, এই আলিমের ইজতিহাদের মধ্যে এমনসব মাসয়ালার জবাবও পাওয়া যায়, যেসব বিষয়ে তাঁর পূর্বেকার ফকীহদের ইজতিহাদে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এমনটিতো হবেই। কারন, মানুষ নিত্য নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয় আর ইজতিহাদের দরজাও রয়েছে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। এমতাবস্থায় ইজতিহাদ করাতো তাঁর জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তাই এ ধরণের (নতুন) ঘটনায় তিন স্বীয় ইমামের চিন্তা বাদ দিয়ে সরাসরি কুরআন, সুন্নাহ এবং আছার অনুসন্ধান করেন এবং মাসয়ালা ইস্তেম্বাত করেন। তবে এরূপ নতুন মাসায়েল নিঃসন্দেহে ঐসব মাসায়েলের তুলনায় অনেক কম, যেগুলোর জবাব পূর্ববর্তী ইমামা ও আলিমগণ প্রদান করেছেন। এরূপ মুজতাহিদকে সম্পর্ক রক্ষাকারী স্বাধীন মুজতাহিদ (মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব) বলা হয়।

২. দ্বিতীয় অবস্থা এই হতে পারে যে, তিনি ঐ সমস্ত মাসায়েল অবগত হবার জন্যে সর্বাধিক মনোনিবেশ করবেন, যেগুলো ফতোয়া জিজ্ঞাসাকারীরা জিজ্ঞাসা করে, অথচ পূর্ববর্তী ইমাম ও আলিমগণ সেগুলোর জবাব দিয়ে যাননি। এই ফকীহ এমন একজন ইমাম মুজতাহিদের ইকতিদা করার ক্ষেত্রে পূর্বোক্ত ফকীহর চাইতেও অধিক মুখাপেক্ষী, যার সংকলিত ফিকহী মূলনীতি থেকে প্রতিটি অধায়ে তাঁর জন্যে ফায়দা হাসিল করা সম্ভব। কেননা, ফিকহী মাসায়েলসমূহ তো পুঁতির মালার মতো একটার সাথে আরেকটা গ্রথিত এবং সকল প্রাসংগিক বিষয় মূল বিষয়ের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। এমতাবস্থায় তিনি যদি সকল মাযহাবের ফিকাহর যাচাই বাছাই এবং সকল মুজতাহিদের চূলচেড়া বিশ্লেষণ শুরু করেন, তবে তিনি নিজেকে এমন এক অথৈ সমুদ্রে নিক্ষেপ করবেন, জীবনভর চেষ্টা করেও যা অতিক্রম করা সমচব হবে না এবং সম্ভবতঃ জীবনেও কুলকিনারায় পৌছুতে পারবেন না। সুতরাং তাঁর জন্যে পথ একটাই খোলা থাকে। তা হলো, অতীতে যেসব মাসায়েলের জবাব দেয়া হয়েছে, সেগুলোর ভিত্তিতে চিন্তা গবেষণা করে করে প্রাসংগিক মাসায়েলসমূহের জবাব দেবেন। তবে ইমাম মুজতাহিদের সাথে তাঁর কোথাও মতপার্থক্য হবে না যে তা নয়। কখনো কখনো কুরআন, সুন্নাহ, আছার ও স্থায়ী কিয়াসের ভিত্তিতে ইমামের সাথে তাঁর মতপার্থক্য হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তা হবে মতৈক্যের তুলনায় নেহাত কম। এরূপ মুজতাহিদকে মুজতাহিদ ফিল মাযহাব (মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত মুজতাহিদ) বলা হয়।

তৃতীয় আরেকটি অবস্থা হতে পারে এই যে, প্রথমতঃ তিনি ঐ সমস্ত মাসায়েল জানার জন্যে তাঁর পুরো প্রচেষ্টা নিয়োজিত করবেন, ইতিপূর্বে মুজতাহিদ ও আলিমগণ সেগুলোর জবাব প্রদান করেছেন। অতঃপর কোনো এক পর্যায়ে গিয়ে নিজের মনোনিত ও পছন্দনীয় মাসায়েল্গুলোর ভিত্তিতে আরো অধিক প্রাসংগিক মাসায়েল বের করার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। কিন্তু এরূপ করতে পারাটা একেবারে অসম্ভব ও অবাস্তব। কেননা, ওহী অবতীর্ণের বরকতময় যুগ এই লোকদের অনেক আগেই অতিক্রম হয়ে গেছে। সে কারণে এ সময়কার প্রত্যেক আলিম অসংখ্য জরুরী ইলমী বিষয়ে অতীত আলিমগণের মুখাপেক্ষী। তাঁকে অতীত আলিমগণের সুত্রেই জানতে হবে হাদীসসমূহের মতন ও সনদ্গত পার্থক্য, রাবীগণের মর্যাদাগত পার্থক্য, হাদীসের বিশুদ্ধতা ও দুর্বলতাগত তারতম্য এবং মতবিরোধপূর্ণ হাদীস ও আছারসমূহের মধ্যে সমতা বিধানের পন্থা। তাঁদের সুত্রেই তাঁকে জানতে হবে কোনসব হাদীস ফিকাহর উৎস? জটিল ও অপ্রচলিত শব্দাবলীর বিশ্লেষণ কিভাবে করতে হয়? উসূলে ফিকাহর জ্ঞান লাভ করার পন্থা কি? এবং ঐ সব মাসায়েল পূর্ণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং পারস্পরিক বিরোধের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে বর্ণনা করার পন্থা কি, যেগুলো অতীত মুজতাহিদ ও আলিমগণের থেকে বর্ণিত হয়েছে? তাছাড়া ঐসকল বিরোধপূর্ণ রেওয়ায়াতে ও মাসায়েল সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা করার পর সেগুলোর ফায়সালা করা এবং সেগুলোকে দলিল প্রমাণের কষ্টিপাথরে যাচাই করার পন্থাও তাঁকে তাঁদের সুত্রে গ্রহণ করতে হবে। এই অসংখ্য জিনিসের জ্ঞান লাভ করতে করতে যখন তিনি জীবন সায়াহ্নে এসে পৌছুবেন, তখন আরো জরুরী ও প্রাসংগিক মাসায়েল উদ্ভাবন করার কাজে আত্মনিয়োগ করা তাঁর পক্ষে কেমন করে সম্ভব হতে পারে? আর মানুষ যতো মেধাবী ই হোক না কেন, তার একটা সীমা আছে। এ সীমার বাইরে কিছু করতে সে অক্ষম।

অবশ্য চিন্তা গবেষণা ও দৃষ্টিভংগির এই পূর্ণতা ঐসব আলিমরা অবশ্যি লাভ করেছিলেন, যাঁরা ওহী বন্ধ হবার কাছাকাছি যুগে ইজতিহাদের শিরচূড়ায় আরোহণ করেছেলেন। কারণ, তাঁদের ইজতিহাদের যুগ এবং অহী বন্ধ হবার সময়ের মধ্যে খুব বেশী ফারাক ছিল না। তখন জ্ঞান বিজ্ঞান এ সময়কার মতো বেশুমার শাখা প্রশাখায় সম্প্রসারিত হয়নি। এবং ইজতিহাদকৃত মাসায়েলের বিরাট সম্ভার সমুপস্থিত ছিলো না। কিন্তু তা সত্বেও মাত্র গুটিকয়েক লোকের পক্ষেই এই পূর্ণতা লাভ করা সম্ভব হয়েছিলো। আর এ গুটিকয়েক লোকের অবস্থাও এরূপ ছিলো যে, তাদের পূর্ণতার সমস্ত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকা সত্বেও তাঁরা স্বীয় উস্তাদগণের অনুসরণের বন্ধন থেকে মুক্ত ছিলেন না। উস্তাদগণের ইলমী পথ-নির্দেশনার সাহায্যেই তাঁরা ইজতিহাদের পথে পা বাড়ান। কিন্তু, যেহেতু তাঁরা এই শাত্রে যথেষ্ট পরিশ্রম করে গেছেন এবং চিন্তা গবেষণার বিরাট ভান্ডার সৃষ্টি করে গেছেন, সেহেতু তাঁরা স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ইমাম ও মুজতাহিদের মর্যাদা লাভ করেছিলেন।

তাকলীদের অপরিহার্যতা এবং এই সঠিক অর্থ

মোটকথা, মুজতাহিদ ইমামগণের মাযহাব অনুসরণ করাটা এমন একটি কুদরতী রহস্য যা আল্লাহ (হিকমত ও কল্যাণের খাতিরে) আলিমদের অন্তরে ইলহাম করে দিয়েছেন আর এ ব্যাপারে সচেতনভাবে হোক কিংবা অচেতনভাবে তাঁরা একমত হয়েছেন।৬৪

[৬৪. এটি গ্রন্থকারের ব্যাক্তিগত মতামত। এ বিষয়ে আলিমগণের মধ্যে ভিন্ন দৃষ্টিভংগি রয়েছে। —অনুবাদক]

শাফেয়ী ফকীহ ইবনে যিয়াদ ইয়েমেনীর বক্তব্যে আমাদের উপরোক্ত মতের প্রতি সমর্থন রয়েছে। দুটি প্রস্নের জবাবে ইমাম বুলকীনী ইমাম শাফেয়ীর মতের বিপক্ষে ফতোয়া দিয়েছিলেন, তার জবাবে ইবনে যিয়াদ ইয়েমেনী বলেনঃ

“তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত বুল্কীনীর বক্তব্যের মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে না যতোক্ষণ না তাঁর ইলমী মর্যাদা অবগত হবে। তিনি ছিলেন মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব, গায়রে মুস্তাকিল এবং আতলিত তাখরীজ ও তারজীহ। “মুজতাহদ মতলক মুনতাসিব’ বলে আমি বুঝাচ্ছি, তিনি এমন ব্যাক্তি যিনি ঐ ইমামের মাযহাবে অগ্রগণ্যতার অধিকার রাখেন, যে ইমামের মাযহাবের সাথে তিনি সম্পর্কিত। এমনকি মাযহাবের ভিতরে প্রাধান্য পাওয়া কোনো মতেরও তিনি বিরোধিতা করার যোগ্যতা রাখেন। শাফেয়ীর মাযহাবের প্রাচীন ও পরবর্তী অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ আলিমের অবস্থাই অনুরূপ। সম্মুখে তাদের বৃত্তান্ত ও মর্যাদাগত ক্রমিক পর্যালোচনা উল্লেখ করা হবে। বুলকীনীকে যারা মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব বলে গণ্য করেন তাদের মধ্য অন্যতম হলেন তাঁর ছাত্র আবু যুরআ। তিনি বলেন, “একবার আমি আমার উস্তাদ ইমাম বুলকীনীকে জিজ্ঞেস করলামঃ শাইখ তকীউদ্দিন সবকী ইজতিহাদের রাজপথে চলেন না কেন, তাঁর মধ্যে তো ইজতিহাদের সমুদয় শর্তাবলী বর্তমান? তিনি কী কারণে তাকলীদ করেন? আবু যুরয়া বলেন, আমি লজ্জায় তাঁর (বুলকীনীর) নাম আর উল্লেখ করলাম না। অথচ তাঁর সম্পর্কেও আমার একই প্রশ্ন! আমার প্রশ্ন শুনে তিনি চুপ থাকেন। অতঃপর আমি নিজেই জবাব দিতে লাগলামঃ আমার মতে সেই সরকারী চাকুরী চলে যাবার ভয়ে তিনি এমনিটি করেছেন, যা চার মাযহাব থেকে খারিজ হয়ে স্বাধীনভাবে ইজতিহাদ করবেন, তার সরকারী চাকরী হবে না। বিচারপতির পদ তার জন্যে হারাম হয়ে যাবে। লোকেরা তার কাছে ফতোয়া চাইতে আসবে না। এবং তাকে বিদয়াতী বলে আখ্যায়িত করবে। আমার বক্তব্য শুনে তিনি মুচকি হাসলেন এবং এর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলেন।” কিন্তু আবু যুরআর বক্তব্যের প্রতি আমার মন সায় দেয় না। এই নিকৃষ্ট স্বার্থ তাদেরকে কী করে ইজতিহাদ থেকে বিরত রাখতে পারত তা আমার বুঝে আসে না। ইজতিহাদের সমুদয় শর্তাবলী তাদের মধ্যে বর্তমান থাকা সত্বেও বিচারপতির পদ এবং উপার্জনের উপায় উপকরণ তাদেরকে ইজতিহাদ থেক বিরত রাখবে, এমন অবস্থা থেকে তাঁদের মর্যাদা তো অনেক উর্ধ্বে ছিলো। এই মনীষীদের সম্পর্কে এরূপ খারাপ ধারণা করা কিছুতেই বৈধ হতে পারেনা। কেননা ইজতিহাদের পূর্ণ যোগ্যতা যাদের রয়েছে, তাঁদের জন্যে ইজতিহাদ করা যে ওয়াজিব এ ব্যাপারে আলিমগণ সর্বসম্মত, একথা আগেই আলোচিত হয়েছে। সুতরাং চাকুরী বাকুরী বা পার্থিব সুযোগ সুবিধার জন্য তারা একটি ওয়াজিব বিষয়কে সারা জীবন পরিত্যাগ করেছেন, এমন কথা কি বিশ্বাস করা যেতে পারে? এমন ধরণের মন্তব্য করা আবু যুরয়ার পক্ষে কী করে উচিত হতে পারে? তিনি কেমন করে বূলকীনীর ব্যাপারেও এ মন্তব্য প্রযোজ্য মনে করে? অথচ জালালুদ্দীন সুয়ূতী তাঁর ‘শরহুত তানবীহ’র তালাক অধ্যায়ে লিখেছেনঃ

“ইমামগণের মতামতের মধ্যে যে পার্থক্য পরিলক্ষত হয় (অর্থাৎ একই বিষয়ে একজন ইমাম যে একাধিক মত দিয়েছেন),তার কারণ হলো তাদের ইজতিহাদের পরিবর্তন হওয়া। যখন তারা যে জিনিসকে সঠিক কবললেন, তাদের ইজতিহাদের দৃষ্টিতে সে সময়ের জন্য সেটাই সঠিক। আর সে কিতাবের গ্রন্তকার হলেন এমন এক ব্যাক্তি যার ইজতিহাদের মর্যাদাকে অস্বীকার করা যেতে পারে না। একথা অনেক আলিমই স্পষ্টভাষায় বলেছেন যে, উল্লেখিত গ্রন্থকার, ইবনে সব্বাগ, ইমামুল হারামাইন এবং গাযালী ‘মুজতাহিদ মতলকের’ মর্যাদায় উপনীত হয়েছেন। ফতোয়ায়ে ইবনুস সিলাহে যে বলা হয়েছে ‘এরা ইজতিহাদে মতলক নয় বরঞ্চ ইজতিহাদ ফীল মাযহাবের মর্যাদায় উপনীত হয়েছিলেন’, তার অর্থ হলো, তাঁরা ‘মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব’ (সম্পর্কযুক্ত স্বাধীন মুজতাহিদ)। ‘ইজতিহাদে মতলক মুসতাকিল’ এবং (দুই) ‘ইজতিহাদে মতলক মুনতাসিব’। স্বয়ং ইবনে সিলাহ তাঁর ‘কিতাবুল ফাতায়া’ এবং নববী তাঁর ‘শরহে মুহাযযাব’ গ্রন্থে ‘ইজতহাদে মতলক’কে দুই প্রকার বলেছেন। প্রথমটি হলো ‘মুসতাকিল’ আর দ্বিতীয়টি হলো ‘মুনতাসিব’। চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রথমোক্ত ধরনের ইজতিহাদের দরজা চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে গেছে, যা এখন আর খোলার কোনো সম্ভাবনা নেই। শেষোক্ত ধরণের ইজতিহাদের দরজা খোলা রয়েছে। কিয়ামতের শর্তাবলী প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত খোলা থাকবে। কোনো যুগেই তা থেমে যাওয়া বৈধ নয়। কারণ, তা ফরযে কিফায়া। কোনো যুগের লোকের যদি এই ইজতিহাদ করার ক্ষেত্রে কসুর করে, এমনকি তা ত্যাগ করে বসে, তবে তারা সকলেই গুনাহগার হবে। একথা আমাদের আলিমগণ স্পষ্টভাবেই বলেছেন। মাউরিদী তাঁর গ্রন্থ ‘আল হাদীতে’ রূইয়ানী তাঁ ‘আল বাহারে’ এবং বগবী তাঁর ‘আত তাহযীব’ গ্রন্থে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলছেন। এ ছাড়াও আরো অনেক আলিম তাঁদের গ্রন্থাবলীতে কথাটি পরিষ্কার করে লিখেছেন। প্রকাশ থাকে যে, ইজতিহাদ ফীল মাযহাব দ্বারা এ ফরযে কিফায়া আদায় হতে পারেনা। ইবনে সিলাহ একথা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলেছেন এবং নববীও ‘শরহে মুহাযযাব’ এ তা পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন। আমিও আমার “আর রদ্দু আ’লা মান আখলাদা ইলাল আরদি ওয়া জাহালা আন্নাল ইজতিহাদা ফী কুল্লি আসরিন ফারদুন” গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেছি। এই আলিমগণ (যাদের কথা উপরে উল্লেখ করেছি) কেবল শাফেয়ী হবার কারণে ‘মুজতাহিদ মতলক মুনতাসিব’ হওয়া থেকে হতে পারেননি। নববী এবং ইবনে সিলাহ তাঁর ‘তবকাতে’ স্পষ্টভাষায় এ সত্যটি প্রকাশ করেছেন। ইবনে সাবকীও একই কথা বলেছেন। এ কারণেই তোমরা দেখতে পাচ্ছো এই মনীষীরা শাফেয়ী মাযহাবের গ্রন্থাবলী রচনা করেছেন এবং তাঁদের ফিকহী গ্রন্থাবলীকে শাফেয়ী মাযহাবের ফিকাহর কিতাব বলা হয়। শাফেয়ী হিসেবে তাঁরা ফতোয়া দিয়েছেন এবং তাঁদের ফতোয়াসমূহকেও শাফেয়ী মাযহাবের ফতোয়া বলা হয়। যেমন এই গ্রন্থকার এবং ইবনে সিবাহকে বাগদাদের নিযামিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষতার দায়িত্ব অর্পন করা হয়, ইমামুল হারামাইন এবং গাযালীকে নিশাপুরের নিযামিয়া মাদ্রাসায় এবং ইবনে আবদুস সালামকে কায়রোর মাদরাসায়ে জাবীয়া এবং যাহিরিয়ার ইনচার্জ নিয়োগ করা হয়। আর ইবনে দাকীকুল ঈদকে মাদরাসায়ে সিলাহিয়ার দায়িত্ব অর্পন করা হয়, যা নাকি আমাদের ইমাম শাফেয়ী রাদিয়াল্লাহু আনহুর কবরের পাশেই অবস্থিত ছিলো। তাছাড়া মাদরাসায়ে ফাজিলিয়া এবং কামিলিয়ার দায়িত্ব ও অর্পন করা হয়। অবশ্য যিনি এর চাইতে উর্ধ্বে উঠে ‘ইজতিহাদ মতলক মুসতাকিল’ এর মর্যাদায় উপনীত হন তিনি শাফেয়ী হওয়া থেকে মুক্ত হরে পারেন। তাঁর মতামতকেও শাফেয়ী ফিকাহর অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হয় না। কিন্তু আমি যতোটা জানি একমাত্র আবু জাফর ইবনে জারীর তাবারী ছাড়া আর কেউ এ মর্যাদায় উপনীত হতে পারেননি। তিনি প্রথমত শাফেয়ীই ছিলেন। পরে একটি স্বাধীন ফিকহী মুজতাহিদ ইমামের মর্যাদা লাভ করেন। এ কারণের রাফেয়ী প্রমুখ বলেছেনঃ তাঁর (তাবারীর) মতামত (শাফেয়ীর) মাযহাবের মধ্যে গণ্য নয়।”

সুয়ূতীর ভাষ্যে ইবনে সাবকীর যে মর্যাদা পরিষ্কার হলো, আমার মতে তা আবু যুরয়ার মতের চাইতে উত্তম। আর আমার মতে এটাই প্রকৃত ঘটনা। কিন্তু তিনি যে বললেন, ইবনে জরীরকে শাফেয়ী মাযহাবের অন্তর্ভূক্ত গণ্য করা যাবেনা, একথা আমি সমর্থন করি না। কেননা আল্লামা রাফেয়ীই (সুয়ূতী যার কথা উল্লেখ করেছেন) তাঁর কিতাবুয যাকাতের শুরুতে লিখেছেনঃ “ইবনে জারীর তাবারীর মতামত আমাদের মাযহাবের মতামত বলে গণ্য নয়। অবশ্য তিনি নিজে আমাদের মাযহাবের লোক।” নববী তার ‘আত তাহযীব’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ আবু আসিম ইবাদী ইবনে জরীরকে শাগেয়ী ফকীহদের অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, তিনি আমাদের প্রথম সারির আলিমদের অন্তর্ভুক্ত। তিবি রবী মুরাদী এবং হাসান জা’ফরানী থেকে শাফেয়ী ফিকাহর জ্ঞান লাভ করেন।” তাকে শাফেয়ীর সাথে সম্পৃক্ত করার অর্থ হলো, তাঁর ইজতিহাদ ও দলিল গ্রহণ পদ্ধতি এবং সেগুলোর বিন্যাস শাফেয়ীর ইজতিহাদের আস্থে সামঞ্জস্যশীল। কোথাও যদি সামঞ্জস্যশীল না-ও হয়, তাতে তার বিশেষ গুরুত্ব লাভ হয় না। আর এতে করে (শাফেয়ীর) মাযহাব থেকে মুক্তও হয়ে যান না। মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল আল বুখারীও এই পর্যায়েরই একজন। তাঁকেও শাফেয়ী ফকীহদের মধ্যে গণ্য করা হয়। তাঁকে যারা শাফেয়ী ফকীহদের মধ্যে গণ্য করেছেন, তাঁদের অন্যতম হলেন শাইখ তাজুদ্দীন সবকী। তাঁর মতেঃ “ইমাম বুখারী হুমাইদী থেকে এবং হুমাইদী শাফেয়ী থেকে ফিকাহ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।” আমাদের আল্লামা শাইখও বুখারীকে শাফেয়ী বলে গণ্য করতেন। তাঁর দলিল হলো সবকীর বক্তব্য। আমরা উপরে নববীর যে বক্তব্য উল্লেখ করেছি, তাও এ বক্তব্যের সমর্থক। শাইখ তাজুদ্দীন সবকী তাঁর তবকাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেনঃ

“কোনো তাখরীজকারী যদি এমন কোনো তাখরীজ করেন যা সম্পুর্ণ বিরল ও অসাধারণ, তবে এই তাখরীজকারীর জীবনে যদি মাযহাব এবং তাকলীদ প্রভাবশীল হয় তবে তাকে (শাফেয়ী) মাযহাবের লোক বলে গণ্য করা হবে। যেমনঃ শাইখ আবু হামিদ গাযালী এবং কিফাল। পক্ষান্তরে তাঁর জীবনে যদি ইমাম শাফেয়ীর মাযহাব ও তাকলীদ প্রভাবশীল না হয়ে থাকে, তবে তাকে শাফেয়ী বলে গণ্য করা হবে না। যেমনঃ মুহাম্মাদ ইবনে জরীর মুহাম্মাদ ইবনে খুযাইমা, মুহাম্মাদ ইবনে নসর আল মরূযী এবং মুহাম্মাদ ইবনুল মুনযির। এখন প্রশ্ন থেকে যায় মুযনী এবং ইবনে শুরাইহ কোন পর্যায়ের লোক? গবেষণা থেকে বুঝা যায়, তাঁদের অবস্থান মাঝামাঝি পর্যায়ে। উপরোক্ত চার মুহাম্মাদের মতো তাঁরা শাফেয়ী থেকে খারিজও নন, আবার ইরাকী এবং খোরাসানীদের মতো শাফেয়ী মাযহাবের শিকলেও আবদ্ধ নন।”

তাছাড়া, সবকী তার ‘তবকাতে’ আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ইমাম আবিল হাসান আশ’আরী সম্পর্কেও লিখেছেনঃ “তিনি ও শাফেয়ী ফকীহদের অন্তর্ভুক্ত। শাইখ আবু ইসহাক মরূযী থেকে তিনি ফিকাহ শিখেছেন।”৬৫

[৬৫. ইবনে যিয়াদ ইয়েমেনীর বক্তব্যের উদ্ধৃতি এখানে শেষ হলো। –গ্রন্থকার]

‘কিতাবুল আনওয়ারে’ ও তাকলীদ সম্পর্কে আমাদের মতের সমর্থন রয়েছে। এর গ্রন্থকার লিখেছেনঃ

“যেসব লোক নিজেদেরকে শাফেয়ী, আবু হানীফা, মালিক এবঙ্গাহমদ ইবনে হাম্বলের মাযহাবের সাথে সম্পৃক্ত করেন, তারা কয়েক শ্রেণীরঃ প্রথমত, সাধারণ মানুষ। এরা সরাসরি নয়, বরঞ্চ ঐসব আলিম ও ফকীহদের মাধ্যমে ইমামের তাখলীদ করেন, যারা ইজেদেরকে ইমামের মাযহাবের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। যেমন শাফেয়ী মাযহাবের সাধারণ মানুষ সেই মাযহাবের ফকীহ ও আলিমগনের মাধ্যমেই ইমাম শাগেয়ীর মাযহাবের তাকলীদ করেন। দ্বিতীয়ত, ঐ সব লোক যারা ইজতিহাদের মর্যাদায় পৌছেছেন। যদিও একজন মুজতাহিদ আরেকজন মুজতাহিদের তাকলীদ করেন না, কিন্তু তা সত্বেও এদেরকে ইমাম মুজতাহিদের প্রতি সম্পৃক্ত করা হয়। কারণ, তাঁরা ইজতিহাদের পদ্ধতি, দলিল্ল ও যুক্তি গ্রহণের ধরন ও বিন্যাস্রীতি ইমাম মুজতাহিদ মতলক থেকেই গ্রহণ করেছেন। তৃতীয়ত, উপরোক্ত দুই শ্রেণীর মধ্যবর্তী শ্রেণী। এরা যদিও ইজতিহাদের দরজা লাভ করেননি, কিন্তু ইমাম কর্তৃক গৃহীত ইজতিহাদের নীতিমালা এদের নিকট সুস্পষ্ট ছিল। এরা এ ব্যাপারে যোগ্য ছিলেন যে, ইমামের যেসব মতামত ও মাসয়ালায় যুক্তি প্রমাণ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছিল না, তাঁরা ইমামের অপর যুক্তি প্রমাণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সম্বলিত মাসয়ালার ভিত্তিতে সেগুলোর জবাব দিতে পারতেন। এরা মূলতঃ ইমামের মুকাল্লিদই ছিলেন, যেমন প্রথমোক্ত শ্রেণীর লোকেরা এঁদের ইস্তিম্বাত করা বক্তব্য মতামত অনুসরণ করেও ইমামেরই মুকাল্লিদ।”


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি