পরিপূর্ণ সত্তা
আল্লাহর কুদরত (শক্তি)
এই বিশ্ব, এর গতি এবং স্থিতি সবই আল্লাহ তাআলার অসীম কুদরত ও শক্তিমত্তারই বহিঃপ্রকাশ। প্রতিটি জিনিসের মধ্যে যে উদ্যম ও শক্তি নিহিত রয়েছে তার উৎস সে নিজে নয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি মাটি ভেদ করে চারাগাছ বের হয়ে আসে এবং ধীরে ধীরে তা বড় হতে থাকে। এমনকি শেষ পর্যন্ত এই চারাগাছটি শক্তিশালী মেরুদণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষশ হয়। ঝড়-ঝাপটা সহজে তাকে কাবু করতে পারে না। এটা মূলত আল্লাহর অসীম কুদরতের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ প্রবল বেগে ধাবিত হয়ে তীরভাগে প্রচণ্ড আঘাত আনে। এই আক্রমণ সকাল-সন্ধ্যায়, অবিরত চলতে থাকে। তার কোন বিশ্রাম বা ক্লান্তি নেই। এ সবই আল্লাহর অসীম কুদরতের খেলা।

উড়োজাহাজ বা রেলগাড়ির ইঞ্জিন শূন্য ভেদ করে দ্রুতগতিতে বিরাট বিরাট দূরত্ব অতিক্রম করে, ভারী বোঝা বহন করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করে। এটাও দয়াময় রহমানুর রহীমের অসীম কুদরতেরই চমৎকারিত্ব।

এই জনসমুদ্র মানব বসতির দিকে তাকালে দেখা যায় –তাদের মধ্যে যেমন রয়েছে ভালবাসা, সম্প্রীতি, তেমনি রয়েছে শত্রুতা ও ঘৃণার অস্তিত্ব। তাদের মধ্যে আছে আনন্দ-বিষাদ, হাসি-কান্না, কর্ম-কোলাহল এবং নীরব নিস্তব্ধতা। এটাও মহান স্রষ্টার অসীম কুদরতের প্রদর্শনী।

তোমার অনুভূতি থাক বা না থাক –তোমার দেহের মধ্যে যে অন্তর রয়েছে এবং হৃদয়ের মধ্যে যে স্পন্দন রয়েছে অথবা শিরায়-উপশিরায় যে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে অথবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যে অনুভূতি বিরাজ করছে, অথবা দেহের কোষগুলোর (cells) মধ্যে জীভনের যে স্পন্দন রয়েছে অথবা ফোঁড়া বা বসন্তের গুঁটি থেকৈ যে রস নির্গত হয় এ সবই আল্লাহর কুদরতের লীলাখেলা।

এই মহাবিশ্বের কোন জিনিস সম্পর্কে এরূপ ধারণা করা উচিত নয় যে, তার মধ্যে নিজস্বভাবেই শক্তি (energy) বিরাজ করছে। মহান আল্লাহর অসীম কুদরত এগুলোকে নাস্তি থেকে অস্তিত্বে নিয়ে এসেছে এবং এর মধ্যে নিজের রহস্য লুকিয়ে রেখেছে, নিজের অসংখ্য নিদর্শন এই সৃষ্টির মধ্যে ছড়িয়ে রেখেছে যা তাঁর দিকেই পথ দেখায়।

কতিপয় প্রকৃতিবাদী নাস্তিক এসব নিদর্শন নিজেদের চর্ম-চোখে এবং জ্ঞান-চোখে অবলোকন করছে, কিন্তু তারা এগুলোকে কেবল প্রকৃতির খেলা অথবা বিভিন্ন উপাদান ও পদার্থের মধ্যে লুকায়িত শক্তির প্রদর্শনী মাত্র মনে করছে। এটা তাদের প্রকাশ্য প্রতারণা, বুদ্ধি-বিবেকের চরম অবমাননা এবং বাস্তব ঘটনার ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।

বৈদ্যুতিক তারের মধ্য দয়ে বিজলী প্রবাহিত হয়ে যে আলোর সৃষ্টি হয়, উড়োজাহাজের ইঞ্চিনের বিশেষ বিশেষ অংশে গ্যাস ভর্তি হয়ে যে গতির সৃষ্টি হয়, অনন্তর পাখার ঘূর্ণনে বাতাসের চাপের মধ্যে যে ভারসাম্য সৃষ্টি হয় এবং এভাবে তার মধ্যে উড়ে যাওয়ার যে ক্ষমতা সৃষ্টি হয় –এগুলোকে কেবল উপাদান ও পদার্থের বৈশিষ্ট্য বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না।

আমাদের কাছে এরূপ দাবি কেন করা হয়, আমরা যমীনের উপাদান সম্পর্কে এই ধারণা পোষণ করব যে, তা নিজস্ব শক্তিবলে গাছপালা তরুলতার উৎপাদন ও প্রতিপালন করে যাচ্ছে? যদি এ দাবি যথার্থ হয়ে থাকে তাহলে মাটিকে খোদা বনে যাওয়ার পথে কে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে? তাছাড়া যেসব জীবন্ত ও নির্জীব পদার্থ রয়েছে –তার সবগুলো সম্পর্কে একই রূপ ধারণা করে নিলে আমরা জটিলতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হব।

বাস্তব সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য এটা কি সবচেয়ে সহজ ও সংক্ষিপ্ত পথ নয় যে, আমরা যমীন থেকে শুরু করে আসমান পর্যন্ত গোটা বিশ্বকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখব যে, এসবই এক উচ্চতম শক্তি সৃষ্টি করেছেন এবং এ বিশ্বে যা কিছুই সংঘটিত হচ্ছে বা সবই এই মহাশক্তির তত্ত্বাবধানে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হচ্ছে।

পরিতাপের বিষয়, আজকের প্রকৃতি বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কেবল বাহ্যিক পদার্থ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বিভিন্ন উপাদান ও পদার্থের মধ্যে প্রাপ্ত সম্পর্ক এবং এর মধ্যে সর্বধা যে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে –তার রহস্য খুঁজে বের করা পর্যন্তই প্রকৃতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্র সীমিত। প্রকৃতি বিজ্ঞানের যত শাখা-প্রশাখা রয়েছে তার সবগুলোর কর্মক্ষেত্র এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। প্রকৃতি-বিজ্ঞানীরা যদি কখনো তাদের অনুসন্ধানের বিষয়বস্তুর মধ্যে কিছুটা সুনির্দিষ্ট ফলাফল লাভে সক্ষম হন তাহলে খুব কমই অন্য জিনিসের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন।

যদিও বিজ্ঞানের এসব শাখা-প্রশাখা এই বিশ্ব ও সৃষ্টিকূল সম্পর্কে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সহজলভ্য করে দেয় কিন্তু তা স্রষ্টা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের অন্ধকারে নিক্ষেপ করে। কেননা অনুসন্ধানের ব্যাপক ক্ষেত্রে যতটুকু ইঙ্গিত পাওয়া যায় শিক্ষার্থীরা তাঁর আলোক থেকে বঞ্চিতই থেকে যায়। এটা হচ্ছে একটা বিরাট বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতারণা। জ্ঞানের ডানা যদি স্বাধীনভাবে মুক্তবিশ্বে বিচরণ করতে পারত এবং দৃষ্টিশক্তি যদি নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ করত তাহলে মানুষের অভ্যন্তরভাগ ঈমান ও হিদায়াতের নূরে আলোকিত হয়ে যেত। মানুষের অন্তর আশা-নিরাশা এবং শান্তি ও শংকার অনুভূতিতে পরিপূর্ণ হয়ে মহান সৃষ্টির সামনে ঝুঁকে পড়ত।

এই একদেশদর্শী অনুসন্ধান প্রকৃতির যে দিকটির প্রতিই মনোনিবেশ করে কুদরতের আকর্ষণীয় নিদর্শনসমূহ তার সামনে এসে যায়। কিন্তু সেগুলোকে সে অস্পষ্ট ও অজ্ঞাত নামের মোড়কে বন্দী করে দেয় এবং শিক্ষার্থীদের অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষনের মধ্যে ব্যস্ত রাখে। এই প্রকৃতির মাঝে আল্লাহর যে গৌরব মহিমা ছড়িয়ে আছে –বিশ্ববিজ্ঞান, প্রকৃতি বিজ্ঞান এবং জীববিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞদের সেদিকে নজর দেওয়ার সময় কই? অথবা এ দিকে তাদের কোন আগ্রহ নেই। এজন্য তাদের সমস্ত অনুসন্ধানই অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায়। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝের বন্ধন ছিন্ন থাকার কারণে পূর্ণতায় তা পৌঁছতে পারে না।

এসব কথা থেকে জানা যায়, আল্লাহ তাআলা যাবতীয় জিনিসের ওপর শক্তিমান। তিনি সুদৃঢ় ও শক্তির আধার। সৃষ্টিকার্য এবং তাঁর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা তাঁর জন্য কঠিন কিছু নয়। কুরআন মজীদের ঘোষণাঃ

(আরবী*************************************************************************************)

আসমান ও যমীনের কোন জিনিসই আল্লাহকে দুর্বল করতে পারে না। তিনি মহাজ্ঞানী ও মহাশক্তির অধিকারী।–সূরা ফাতিরঃ ৪৪

আল্লাহর সৃষ্ট এই বিশাল প্রকৃতি যাবতীয় দোষত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এর গোটা অবয়বে কোন কলংক নেই। প্রকৃতির যে নিদর্শনই আমরা পর্যবেক্ষণ করি তা এমন মহাশক্তির সন্ধান দেয় যিনি সীমাহীন ও অতুলনীয়।

ইচ্ছা ও সংকল্প
আল্লাহ তাআলাই এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন এবং এখানে তাঁর ব্যবস্থাপনাই কার্যকর আছে। তিনি নিজের ইচ্ছায়ই তা করেছেন। তিনি যেভাবে চেয়েছেন এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। তিনি যেসব জিনিস যে যে মুহুর্তে অস্তিত্ববান করতে চেয়েছেন, তাই করেছেন। এর সাথে যে বৈশিষ্ট্য সংযুক্ত করতে চেয়েছেন তা যুক্ত করেছেন। তিনি কোন দিক থেকেই কারো চাপের মুখে নন। আসমান ও যমীনে যে নানা রকম জিনিস, নানা রং, নানা দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় তা সবই আল্লাহর ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ।

আল্লাহ তাআলা আজ যে জিনিস সৃষ্টি করেছেন, ইচ্ছা করলে শত শত বছর আগেও তা সৃষ্টি করতে পারতেন। এই যে তারকারাজি, চন্দ্র-সূর্য আলো বিকিরণ করে যাচ্ছে –তিনি ইচ্ছা করলে এগুলোকে কংকরময় প্রান্তরে পরিণত করে দিতে পারতেন। এই বিশ্বজগতে যত রকমের সৃষ্টি রয়েছে –এর গতি-প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, অবস্থা সব কিছুই আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ।

আমরা যে প্রথিবীর বাসিন্দা তিনি ইচ্ছা করলে তা ভিন্ন আকারে গড়তে পারতেন। এ সময় তার ভিন্নতর নকশা ও ভিন্নরূপ ব্যবস্থাপনা হত।

যাবতীয় সৃষ্টির ভিন্নরূপ অবস্থা হত। আর ইচ্ছায় একই মূল জিনিস থেকে ভিন্ন স্বাদের দুটি জিনিস জন্ম নেয়। একই স্থানে পরস্পর মিলিত দুটি শস্যক্ষেত কিন্তু তার উৎপাদন পরস্পর থেকে ভিন্ন। উৎপাদিত ফসলের বৈশিষ্ট্য ও পণ্যগুলোর মধ্যেও যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান।

উদ্ভিদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় –একই বীজ থেকে তা উৎপন্ন হয়েছে, কিন্তু এর ফল ও ফুলের রং, রস, স্বাদ-গন্ধ সম্পূর্ণ পৃথক। মানুষ ও জীবজন্তুর এই একই অবস্থা। দেখতে একই ধরনের বীজ। কিন্তু তা থেকে জন্ম নেওয়া মানুষ এবং পশুর মধ্যে কত পার্থক্য; একন অভিজাত, অপরটি নীচ, একজন বুদ্ধির সম্রাট, অন্যটি বুদ্ধিহীন পুতুল। মহান আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী***************************************************************************************)

এবং পৃথিবীতে ভূখণ্ডগুলো পাশাপাশি সম্মিলিত রয়েছে। আঙ্গুরের বাগান, কৃষিক্ষেত, খেজুর বাগান –সংযুক্ত শিকড় বিশিষ্ট এবং অসংযুক্ত শিকড় বিশিষ্ট, এরা একই পানিতে সিক্ত হয়। কিন্তু স্বাদে আমরা কোনটাকে উত্তম এবং কোনটাকে সাধারণ বানিয়ে দেই। এর মধ্যে জ্ঞানবান সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।–সূরা রা’দঃ ৪

আমাদের পূর্বকালের আলেমগণ মহান আল্লাহর ইচ্ছার সপক্ষে প্রমাণ পেশ করে বলেছেন, মৌমাছি গাছের পাতা খেলে তা মধুতে পরিণত হয়ে যায়। আর গুটিপোকা গাছের পাতা খেলে তা রেশমে পরিণত হয়ে যায়। অন্যান্য পশু বা পাখি তা খেলে বিষ্ঠায় পরিণত হয়ে যায়। আল্লাহর ইচ্ছা যখন কোন কাজ সংঘটিত করতে চায় অথবা কোন কিছুকে অস্তিত্ব দান করতে চায় তখন তা না হয়ে কোন উপায় নেই।

(আরবী**********************************************************************************)

নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা তাই করার ক্ষমতা রাখেন।–সূরা হুদঃ ১০৭

(আরবী********************************************************************************)

তাঁর কাজ এই যে, তিনি যখন কোন কিছুর ইচ্ছা পোষন করেন তখন শুধু বলেন, “হয়ে যা” আর অমনিই তা হযে যায়।–সূরা ইয়াসীনঃ ৮২

তাঁর ইচ্ছাই আসমানী জগতেও কার্যকর রয়েছে এবং পার্থিব জগতেও কার্যকর রয়েছে। কেউ তা প্রত্যাখ্যান করতেও পারে না আর কেউ তার সমালোচনা করারও দুঃসাহস করে না।

(আরবী********************************************************************************)

তোমার রব যা ইচ্ছা করেন তাই সৃষ্টি করেন এবং (যাকে ইচ্ছা নিজের কাজের জন্য) বাছাই করে নেন। এই বাছাই করার কাজ তাদের নয়।–সূরা কাসাসঃ ৬৮

আবার কখনো নেতিবাচকভাবে কোন কিছু করার সংকল্পকেও ‘ইচ্ছা’ বলা যায়। যেমন তুমি যখন কোন ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছ তখন বাড়ির মালিক ইচ্ছা করলে তোমাকের বের হতে বাধা দিতে পারে। কিন্তু সে তা করল না। তার এই নীরবতা প্রমাণ করে যে, তোমার বাইরে চলে যাওয়াটাই তার ইচ্ছা ছিল।

মুতানব্বীও তার এক কবিতায় এই দিকে ইঙ্গিত করছেন। তার সম্পর্কে কথিত আছে, একবার তিনি রাগান্বিত হয়ে সাইফুদ্দৌলার দরবার থেকে উঠে চলে যান। পরে তিনি নিম্নোক্ত কবিতার মাধ্যমে নিজের এই দুঃসাহসের ব্যাখ্যা দেন। তিনি সমস্ত দায়দায়িত্ব সাইফুদ্দৌলার মাথায় চাপিয়ে দেন।

“যখন চলে যাও তুমি

একদল লোকের মজলিস থেকে অথচ চাইলে তোমাকে রুখতে পারতো তারা

তখন তারাই যেন চলে গেলো”।

অতএব যে ব্যক্তি গোমরাহীর পথ অবলম্বন করে তার অবস্থাটাও সম্পূণ এ ধরনের। অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে সে এদিক সেদিক হাবুডুবু খেতে থাকবে এবং তাঁকে এ অবস্থায়ই পরিত্যাগ করা হবে। কেননা সে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অন্যথায় আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে তাকে নিজের রহমতের দ্বারা ধন্য করতে পারতেন। কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতগুলো খুব সম্ভব সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেঃ

(আরবী*********************************************************************************)

যেসব লোক কুফরীর পথে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, তাদের কর্মতৎপরতা তোমাকে যেন চিন্তান্বিত না করে। তারা আল্লাহর বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহর ইচ্ছা এই যে, আখিরাতে তিনি তাদের কোন অংশই দেবেন না। তাদের জন্য কঠিন শাস্তি নির্দিষ্ট রয়েছে।–সূরা আলে ইমরানঃ ১৭৬

কাফিরদের আমরা যে অবকাশ দিচ্ছি –এটাকে তারা যেন নিজেদের জন্য কল্যাণকর মনে না করে। আমরা তাদের এজন্যই অবকাশ দিচ্ছি যে, তারা যেন পাপের সঞ্চয় বৃদ্ধি করে নেয়। তাদের জন্য খুবই অপমানকর শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে।–সূরা আলে ইমরানঃ ১৭৮

প্রজ্ঞা
আল্লাহ তাআলা পূর্ণ শক্তি ও ইচ্ছার মালিক। তাঁর ইচ্ছা কোন কিছুর অধীন নয়। তিনি যা চান, যখন চান, যেভাবে চান করতে পারেন। তিনি যাকে যেভাবে চান, সৃষ্টি করেন। যে পরিমাণ চান রিযিক দান করেন। কাউকে কম দেন, আবার কাউকে বেশি দেন। কাউকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে উন্নত করেণ। কাউকে নিম্নস্তরে নামিয়ে দেন। কাউকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেন। আবার কারো চেহারা কুৎসিৎ করেন। কাউকে উন্নত মমশির বানান, কারো মাথা নত করে দেন। আল্লাহ তাআলার কি কোন পরিকল্পনা বা স্কীম নেই? এটা কি এরূপ যে, কোন খেয়াল মনে এসে গেল আর তা আল্লাহর সিদ্ধান্তে পরিণত হয়ে গেল। কখনো তা নয়।

এই গোটা বিশ্ব একটা অতি সূক্ষ্ম ও মজবুত ব্যবস্থাপনার অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। এমন কতগুলো স্থায়ী ও অপরিবর্তনশীল বিধান রয়েছে যা পরস্পরের সাথে সঙ্গতিশীল এবং যে কোন দিক থেকে পূর্ণাঙ্গ। গোটা বিশ্বের মানুষ যদি এই বিধান ভঙ্গ করতে বা উৎখান করতে একতাবদ্ধ হয় তবুও তারা এর মধ্যে কোন রদবদল সাধন করতে সক্ষম হবে না। এই ব্যবস্থাপনায় কোনরূপ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে না।

ফসল পেকে তা ঘরে তোলার উপযোগী হয়। তাও মূলত আল্লাহর কুদরত ও তাঁর ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ। এই কুদরত ও ইচ্ছার ধারাবাহিক বহিঃপ্রকাশ আমার সামনেই ঘটছে। তার রূপ এই যে, প্রথমে একটি জীব বপন করা হয়, পানি সিঞ্চন করা হয়, বিভিন্ন রকম পরিচর্যা করা হয়, মৌসুম ও স্থানকেও বিবেচনায় রাখতে হয়। মায়ের জরায়ুতে গোশতের একটি টুকরো বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে একটি পূর্ণাঙ্গ মানব শিশু হয়ে জন্ম নেয়। এসব কিছুই আল্লাহর কুদরত এবং তাঁর ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করার পরই তা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। মাতৃগর্ভের একটি শিশুকে এই পর্যায়গুলো অতিক্রম করতে হয়। অন্যথায় তা পূর্ণাঙ্গ শিশু হিসেবে ভূমিষ্ঠ হতেই পারে না।

মহান আল্লাহ বলেছেন, তিনিই কাউকে কর্তৃত্ব দান করেন আবার কারো কাছ থেকে তা ছিনিয়ে নেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তিনি সকালে বা সন্ধ্যায় একটি রাজত্ব কায়েম করে দেন, আবার কোন রাজপ্রাসাদকে ধূলিসাৎ করে দেন।

পরিপূর্ণ সত্তা
কোন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েম হওয়া বা তার পতন ঘটার পূর্বে যুগের পর যুগ ধরে বিভিন্ন কারণ ও ঘটনা পর্যায়ক্রমে প্রকাশ পেতে থাকে। এতে শত বছরও লেগে যেতে পারে। এরপর একটি পর্যায়ে পৌঁছে এর ফলাফল বাস্তবে প্রকাশ পায়। একদল নির্বোধ লোক মনে করে যে, আল্লাহ তাআলা নিজের যে গুণ বর্ণনা করেছেন যে, “তিনি যা চান তাই করেন” এর অর্থ হচ্ছে বান্দাদের মধ্যে তাঁর যে নির্দেশ জারি ও কার্যকর হচ্ছে তার ধরাবাধা কোন ব্যবস্থা নেই বা এর পরস্পরের মধ্যে কোন সংযোগ নেই।

খুব সম্ভব তারা দুনিয়ার রাজা-বাদশাদের কার্যকলাপের ওপর আল্লাহ তাআলার কর্তৃত্বকে অনুমান করছে। তাদের অবস্থা এই যে, তারা অনধ উটের মত পথ হারিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই মুর্খরা যা বুঝেছে আল্লাহর সত্তা ও তাঁর গুণাবলী এর অনেক ঊর্ধ্বে। এই জগত হচ্ছে কার্যকারণের জগত। এই কারণগুরো হচ্ছে চাবি যা মানুষকে দান করা হয়েছে। এগুলোর ব্যবহার করে তারা কল্যাণের দিকেও অগ্রসর হতে পারে অথবা ভুল পথে পরিচালিত হয়ে মন্দ পরিণতির সম্মুখীনও হতে পারে।

আল্লাহ তাআলা এই বিশ্বজাহানের জন্য যে প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং তাঁর বান্দাদের জন্য যে শরীআতী নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছেন –আল্লাহর তাআলার কুদরত ও ইচ্ছা এর অনুকূলেই আবর্তন করে। অনুরূপভাবে “আল্লাহর যা ইচ্ছা তাই করতে পারে” এর অর্থ এই নয় যে, তিনি পাপীদের পুরস্কৃত করতে পারেন এবং অনুগতদের শাস্তিও দিতে পারেন। অন্য কথায় এর অর্থ দাঁড়ায়, তিনি জুলুমও করতে পারেন, অধিকার খর্বও করতে পারেন এবং খেয়ানতও করতে পারেন (নাউযুবিল্লাহ)।

এটা কতদূর মারাত্মক ভ্রান্তি। এ ধরনের কথা বলার অর্থ যেন আল্লাহ তাআলা কুরআনে যা বলেছেন তা মিথ্যা মনে করা। আদল ও ন্যায়নিষ্ঠা তাঁর পরিপূর্ণ গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত। এর অর্থ এই নয় যে, তিনি যদি জুলুম করেন তাহলে কেউ তাঁকে শাস্তির সম্মুখীন করতে পারে অথবা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। এটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। কেমনেইবা তা হতে পারে? বিশ্ব চরাচরের অধিপতি তো তিনিই, অবশিষ্ট সব কিছুই তাঁর বান্দা ও হুকুমের অধীন। তার ঘাড় তাঁর সামনে নত হয়ে আছে।

একদল মুসলমান ‘আল্লাহর ইচ্ছার’ অর্থ এই মনে করেছে যে, বিশ্বজাহানের এই প্রাকৃতিক বিধানের কোন গুরুত্ব নেই। সর্বোচ্চ আদালত স্বতন্ত্র কোন জিনিস নয়। এর ফল এই দাঁড়িয়েছে যে, দীনের ফরয ও ওয়াজিব কর্তব্যগুলোর ক্ষেত্রে অনুভূতির এমন শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে যে, বিবেক-বুদ্ধি মতদ্বৈততায় পড়ে গেছে। ‘তাকদীর’ অধ্যায়ে আমরা এ সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করব।

জীবন
উচ্চ, নীচ, সম্মান ও পদমর্যাদার দিক থেকে অস্তিত্ববান জিনিসের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। জড় পদার্থের মর্যাদা উদ্ভিদের তুলনায় কম, জীবজন্তুর মর্যাদা উদ্ভিদের তুলনায় অধিক। মানব সত্তা সমস্ত সৃষ্টির তুলনায় অধিক মর্যাদাবান ও উন্নত।

আল্লাহ তাআলাও একটি অস্তিত্ববান জীবন সত্তা। তাঁর জীবন্ত থাকার অর্থ হচ্ছে –তাঁর এখানে তাঁর সত্তা যাবতীয় মহত্ত্ব ও গৌরব বর্তমান রয়েছে –যার আগে কারো অস্তিত্বের মহত্ত্ব ও মর্যাদা কল্পনা করা যায় না। তাঁর নিদর্শনাবলী সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে, তিনি বর্তমান আছেন এবং তাঁর অস্তিত্ব সূর্যের চেয়ে অধিক প্রতিভাত হয়ে আছে। তিনিই সমগ্র সৃষ্টির উৎস, তিনি নিজের পছন্দ ও ইচ্ছা অনুযায়ী যাকে চান অস্তিত্ব দান করেন।

একদল দার্শনিক বলে, এই বিশ্ব অন্য কোন সত্তার কারণে অস্তিত্ব লাভ করেছে। স্রষ্টা হচ্ছে সব কারণের মূল কারণ অথবা অস্তিত্বের সূচনা বিন্দু। এভাবে তারা এই মহান সত্তার ধারণাকে চরমভাবে কুয়াশাচ্ছন্ন করে দেয়। এতে কোন ব্যক্তির মনে এমন ধারণা জন্ম নেয় যে, রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় যেরূপ হয়ে থাকে –বিশ্বস্রষ্টা থেকে সৃষ্টিকুলের অস্তিত্বও ঠিক সেভাবেই হয়ে থাকে। এর মধ্যে না কোন জীবন আছে, আর না কোন আত্মা। এটা হচ্ছে একটা ভ্রান্ত মতবাদ।

এই মহান সত্তার কাছ থেকে পূর্ণাঙ্গ জীবনের আলোকচ্ছটা এমনভাবে প্রতিভাত হচ্ছে যে, তাঁর সামনে সমস্ত জীবনগুলো মূল্যহীন মনে হয়।

একবার কল্পনার জগতে ডুব দিয়ে দেখ, জীবন্ত হাত যে অবদান রাখছে, জীবন্ত জ্ঞান যে চিন্তাধারা পেশ করছে, জীবন্ত হৃদয়ে যে আবেগ-অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে –এসব কিছু খেয়াল কর। কোন একটি স্থানের কথা নয়, দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত জীবনের যতগুলো নমুনা ও অবদান থাকতে পারে –এসব কিছুই খেয়াল করে দেখ। শুধু আজকের কথাই নয়, অতীত শতাব্দীগুলোতে এরূপ যতগুলো জিনিস সম্ভব হতে পারে, বর্তমান যুগে যতগুলো সম্ভব হতে পারে এবং ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত যতগুলো জীনের সম্ভাবনা রয়েছে তার সবগুলো একত্র কর।

আবিস্কার ও সৃষ্টিশক্তিতে ভরপুর জীবনের এই চমৎকারিত্ব –সীমাহীন প্রশস্ত খোদায়ী জিন্দেগীর সামনে কোন গুরুত্ব রাখে না। বরং এগুলো সেই চিরন্তন ও চিরঞ্জীব সত্তার কাজের কয়েকটি নমুনা এবং তাঁর কুদরতের সামান্য দ্যুতিমাত্র। তিনি তাঁর রূহ থেকে প্রাণহীন বস্তুর মধ্যে ফুঁকে দেন এবং তার মধ্যে জীবনের স্পন্দন সৃষ্টি হয়ে যায়। জড় পদার্থের মধ্যে নিজের রূহ থেকে ফুঁকে দেন এবং তার মধ্যে গতি সৃষ্টি হয়ে যায়। মহান আল্লাহর বাণীঃ

(আরবী*******************************************************************)

দানা ও বীজকে দীর্ণকারী হচ্ছেন আল্লাহ। তিনিই জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন এবং মৃতকে বের করে জীবতি থেকে। এসব কাজের আসল কর্তা হচ্ছেন আল্লাহ। অতএব তোমরা উতভ্রান্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছ? –সূরা আনআমঃ ৯৫

(আরবী***********************************************************************)

আল্লাহ সেই চিরঞ্জীব শাশ্বত সত্তা, যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই।–সূরা বাকারাঃ ২৫৫

ইলম (জ্ঞান)
আল্লাহ তাআলা সব জিনিসেরই জ্ঞান রাখেন। তাঁর সামনে দিয়ে এমন কোন যুগ অতিক্রম করেনি যখন তিনি অজ্ঞতার অন্ধকারে ছিলেন, আর না তিনি ভুলের মধ্যে ছিলেন, অতীতেও এরূপ ঘটেনি এবং ভবিষ্যতেও এরূপ ঘটবে না। তাঁর জ্ঞানের মধ্যে ভুলের কোন অবকাশ নেই, এর সম্ভাবনাও নেই। প্রকাশ্য অথবা গোপন, অতীত অথবা ভবিষ্যত, দুনিয়া অথবা আখেরাত সব কিছুই তার কাছে সমান। প্রতিটি জিনিস তার সামনে পরিস্কার। কোন জিসি তাঁর জ্ঞানের অগোচরে নেই।

মানুষ বর্তমান যুগ সম্পর্কে কিছুটা খবর রাখে, অতীত কাল সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা রাখে। এছাড়া যা কিছু আছে সে ম্পর্কে সে অন্ধকারে নিমজ্জিত। মানুষ অতীতের দীর্ঘ ইতিহাসের কতটুকুইবা জানে? সে যে জগতে বাস করছে তার অধিকাংশ জিনিস সম্পর্কেও সে অনবহিত। কিন্তু আল্লাহ তাআলার দরবারে আমাদের জীবনের খুঁটিনাটি সব কিছুই লিপিবদ্ধ রয়েছে। অতীত ইতিহাসের প্রতিটি পাতা সেখানে সংরক্ষিত আছে। প্রতিটি রাজ্যের উত্থান-পতনের পুরা রেকর্ড সেখানে প্রস্তুত রয়েছে। মহান আল্লাহর বাণীঃ

(আরবী********************************************************************************)

ফিরাউন বলল, তাহলে পূর্বে যেসব লোক অতীত হয়ে গেছে তাদের অবস্থা কি ছিল? মূসা বলল, এ সম্পর্কিত জ্ঞান আমার প্রভুর কাছে একটি গ্রন্থে সুরক্ষিত আছে। আমার রব না পথহারা হন, না ভুলে যান। -সূরা ত্বাহাঃ ৫১-৫২

মহান আল্লাহর জ্ঞান এমন একটি সূর্য যার আলোকরশ্মি সমগ্র গুপ্ত স্থানকেও আলোকিত করে রেখেছে। যেখানেই এই আলোকরশ্মি পতিত হয় তার ভেতর ও বাহির সব উজ্জ্বল করে দেয়। সমস্ত গুণবৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হয়ে উঠে এবং প্রতিটি জিনিসের রহস্য ও তাৎপর্য আয়নার মত সামনে এসে যায়। কোন জিনিস প্রকাশ্য হোক অথবা গুপ্ত, সামনে হোক অথবা পর্দার আড়ালে, দূরে হোক অথবা কাছে –তাঁর জ্ঞানের সামনে সবই সমান।

(আরবী****************************************************************************)

কিয়ামত সম্পর্কিত জ্ঞান আল্লাহর দিকে বর্তায়। মুকূল থেকে যেসব ফর বের হয় সে সম্পর্কেও তিনি জানেন। কোন স্ত্রীলোক গর্ভবতী হল এবং কে সন্তান প্রসব করল তাও তাঁর জ্ঞানে রয়েছে।–সূরা হামীম সাজদাঃ ৪৭

আল্লাহর জ্ঞঅন প্রতিটি জিনিসের পরিপূর্ণ তত্ত্বাবধান করে যাচ্ছে। তিনি তাঁর গোটা সৃষ্টির ওপর নযর রাখেন। যমীনের বুকে বিশাল মরুভূমিতে যত বালুকণা রয়েছে, সাগর-মহাসাগরে পানির যত ফোটা রয়েছে, বাগান এবং বন-জঙ্গলের গাছপালায় যত পাতা রয়েছে, প্রতিটি শাখায় যত ফল এবং প্রতিটি ছড়ায় যত শস্যদানা রয়েছে, মানুষের মাথায় এবং পশুর চামড়ায় যত লোম রয়েছে –আল্লাহর জ্ঞানের এক ক্ষুদ্রতম অংশ এর হিসাব রাখার জন্য যথেষ্ট। অনন্তর এসব জিনিসের যে অবস্থান্তর হয়ে থাকে, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এদের যে সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে এবং এগুলোর সাথে যে গুণবৈশিষ্ট্য যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে –তা সবই আল্লাহর জ্ঞানে রয়েছে। অথচ এতসব কিছুর খোঁজ রাখা আমাদের জ্ঞানের পক্ষে সম্ভব নয়। মহান আল্লাহর বাণীঃ

(আরবী***********************************************************************************)

তোমরা একান্তে কথা বল কিংবা উচ্চস্বরে –তিনি তো মনের গহীনের অবস্থা পর্যন্ত জানেন। তিনি কি জানবেন না যিনি সৃষ্টি করেছেন? অথব তিনি অতীব সূক্ষ্মদর্শী ও সুবিজ্ঞ।–সূরা মূলকঃ ১৩-১৪

এই সুপ্রশস্ত জ্ঞান এবং পূর্ণ অবহিতি সেই মহান সত্তার বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত। কখনো কখনো আল্লাহ তাআলা কারো কারো জ্ঞানের সামনে তার ধারণক্ষমতা অনুযায়ী বিশ্বজগতের কিছু রহস্য উদ্ভাসিত করেন অথবা কোন অদৃশ্য বিষয় প্রকাশ করে দেন। কিন্তু তাও একটা নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন ও কল্যাণকারিতার অধীনেই হয়ে থাকে। এই সুযোগ মানুষ যতদূর পৌঁছতে পারে তাও সুনির্দিষ্ট এবং সীমাবদ্ধ। তাদেরকে খুব কমই দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলা যে গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তা পরিস্কার ভাষায় তিনি নিজ কিতাবে তুলে ধরেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************************************)

সমস্ত গায়েবের (অদৃশ্য জগৎ) চাবিকাঠি তাঁরই হাতে। তিনি ছাড়া আর কেউ তা জানে না। স্থল ও জলভাগে যা কিছু আছে তার সব কিছুই তিনি জানেন। গাছ থেকে পতিত এমন একটি পাতাও নেই যা তিনি জানেন না। জমির অন্ধকারাচ্ছন্ন পর্দার অন্তরালে একটি শস্যদানাও এমন নেই যে সম্পর্কে তিনি অবহিত নন। ভিজা এবং শুকনা জিনিসও তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়। এ সব কিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।–সূরা আনআমঃ ৫৯

শ্রবণ ও দর্শন
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, যাবতীয় প্রশংসা মহান সত্তার জন্য যাঁর কান সমস্ত আওয়াজ শুনে থাকে। ঝগড়াকারিণী ‘খাওলা’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের কাছে এলেন। তিনি ঘরের এক কোণে বসে তাঁর সাথে কথা বলছিলেন। আমি তার কথা শুনে পাইনি। আল্লাহ তাআলা সাত আসমানের উপর থেকে কথা শুনলেন এবং এই আয়াত নাযিল করলেনঃ

(আরবী******************************************************************************)

আল্লাহ সেই মহিলাটির-[মহিলাটির নাম খাওলা বিনতে সা’লাবা (রাঃ)। তিনি খাজরাজ গোত্রের কন্যা ছিলেন। তাঁর স্বামীর নাম আওস ইবনে সামিত আনসারী (রাঃ)। তিনি আওস গোত্রের সরদার উবাদা (রাঃ)-র ভাই ছিলেন। বিস্তারিত জানার জন্য তাফহীমুল কুরআনে অত্র সূরার থেকে ১১ নং টীকা পর্যন্ত দ্রষ্টব্য।-অনুবাদক] কথা শুননে পেয়েছেন, যে তার স্বামীর ব্যাপার নিয়ে তোমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে এবং আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতে থাকছে। আল্লাহ তোমাদের উভয়ের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছেন। তিনি সর্বশ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা।–সূরা মুজাদালাঃ ১

নিশ্চিতই মানুষের মধ্যে যে কথোপকথন হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে যে আলোচনা ও পরামর্শ হয়ে থাকে –দয়াময় আল্লাহর কান সবকিছুর আগেই তা শুনে নেয়। তবে কখনো এরূপ ধারণা করো না যে, আল্লাহ তাআলা যখন একদল লোকের কথাবার্তা শুনেন তখন অন্যদের কথা থেকে বেখবর হয়ে যান। তা কখনো নয়! কোন কথা শুনতে গিয়ে তিনি অন্য কোন কতা থেকে অমনোযোগী হয়ে যান না। গণ্ডগোল ও হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যেও যদি কোন গোপন পরামর্শ হয়ে থাকে –তা থেকেও তিনি অনবহিত নন। যে ভাষায়ই কথা বলা হোক না কেন –প্রতিটি ভাষাই শুনেন ও বুঝেন।

মানুষ কত উপায়-উপকরণ আবিস্কার করতে পেরেছে। তা নিয়ে তোমরা প্রাচ্যে বসে থাক এবং পাশ্চাত্য থেকে খবরাখবর আলোচনা, বক্তৃতা, গান, নাটক ইত্যাদি প্রচারিত হয়। এতটা দূরত্ব অতিক্রম করে তা তোমাদের কাছে পৌঁছে যায়। তোমরা ঘরে বসেই এসব শুনতে পাও এই মহাবিশ্বে যে কত রহস্য লুকিয়ে রয়েছে তার কতটুকুইবা আমরা জানি? বিবেকবুদ্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে একটা মোটেই কঠিন কিছু নয় যে, এই বিশ্বজাহানের রব এই বিশ্বে সংঘটিত প্রতিটি স্পন্দন, প্রতিটি নড়াচড়া এবং প্রতিটি আওয়াজ একই সময় শুনে থাকেন। চাই তা যত দূরে অথবা কাছেই সংঘটিত হোক না কেন –আল্লাহর কাছে দূরত্ব ও কাছে উভয়ই সমান অতএব তিনি প্রতিটি গতি ও স্তিতি লক্ষ্য করেন, যাবতীয় শব্দ শুনতে পান এবং প্রতিটি রহস্য সম্পর্কে অবহিত। নিঃসন্দেহে কোন একটি শব্দও তোমার প্রতিপালকের সামনে গোপন নয়। এমন কিছু আওয়াজ আছে যা তিনি শুনেন এবং পছন্দ করেন। হাদীসে এসেছেঃ

(আরবী*************************************************************************************)

আল্লাহ তাআলা কোন নবীর সুললিত কণ্ঠের আওয়াজ যেভাবে মোনেন অন্য কোন আওয়াজ সেভাবে শোনেনন না। তা হচ্ছে কোন ব্যক্তি সুমধুর কণ্ঠে কুরআন পাঠ করে থাকে।

কুরআন পাঠ শুনে তিনি যেভাবে খুশি হন, খারাপ কথা শুনে তিনি তদ্রুপ অসন্তুষ্ট হন। কুরআনের বাণীঃ

(আরবী**********************************************************************************)

মানুষ খারাপ কথা বলুক –তা আল্লাহ পছন্দ করেন না। তবে কারো ওপর জুলুম করা হয়ে থাকলে (সে যদি খারাপ কথা বলে ফেলে) অন্য কথা। আল্লাহ সব কিছুই শুনেন এবং সব কিছুই জানেন।–সূরা নিসাঃ ১৪৮

তোমাকে যদি বলা হয়, আল্লাহ তাআলা প্রতিটি দেহের প্রতিটি হৃদকম্পনও শুনে থাকেন, তাহলে এটা অত্যুক্তি হবে না। হৃদয় তো তাঁর কুদরতেরই একটি নিদর্শন। তিনি এর মধ্যে রূহ ফুঁকে দেন আর তা একটি নির্দিষ্ট সময় স্পন্দিত হতে থাকে। অতএব যে জিনিস তাঁরই সৃষ্ট, এর কম্পন শুনা তাঁর জন্য কি কোন কষ্টকর বিষয়?

তিনি প্রতিটি আওয়াজ যেভাবে শুনতে পান, অনুরূপভাবে তিনি প্রতিটি জিনিস দেখতে পান। যত গভীর অন্ধকারই হোক না কেন সেখানেও তাঁর দৃষ্টি পৌঁছে যায়। কোন জিনিস যেখানেই লুকিয়ে থাক না কেন, তাও আল্লাহর দৃষ্টির বাইরে নয়। যত সূক্ষ্ম কথাই হোক অথবা গহীন অন্ধকারে আচ্ছন্ন জিনিসই হোক –তিনি কোন জিনিস দেখার জন্য আলোর মুখাপেক্ষী নন এবং কোন সূক্ষ্ম কথা শুনার জন্য তাঁর কোন শ্রবণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। যখন তুমি দুইজন লোকের সাথে কথা বল তখন মনে রেখ চতুর্থ এক সত্তা তোমাদের সব কিছুই দেখছেন এবং শুনছেন। পবিত্র কুরআনের বাণীঃ

(আরবী***********************************************************************************)

আসমান ও যমীনের সব গোপন অবস্থা তাঁরই জানা আছে। তিনি কত সুন্দরভাবে দেখেন এবং কত সুন্দরভাবে শুনেন। যমীন ও আসমানের সব সৃষ্টির তত্ত্বাবধায়ক তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি তাঁর রাজ্য শাসনে কাউকেও অংশীদার করেন না।–সূরা কাহফঃ ২৮

আল্লাহ তাআলা যখন মূসা ও হারুণ আলাইহিমাস সালামকে ফিরাউনের কাছে পাঠান তখন তার অবাধ্যতা ও ঔদ্ধত্যে তাঁরা শংকিত হয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেনঃ

(আরবী*********************************************************************************)

হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের আশংকা হচ্ছে যে, সে আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করবে কিংবা সীমালংঘনমূলক আচরণ করবে।–সূরা ত্বাহাঃ ৪৫

তখন আল্লাহ তাআলা বললেনঃ

(আরবী*********************************************************************************)

তিনি বলেন, তোমরা ভয় পেও না। আমি তোমাদের সাথেই আছি, সবকিছুই শুনছি ও দেখছি।–সূরা ত্বাহাঃ ৪৬

আল্লাহ তাঁদের উভয়ের সাথে ছিলেন এবং সৃষ্টির সূচনা থেকে কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি মাখলুকের সাথেই আছেন এবং পরবর্তীকালেও থাকবেন। তিনি সবকিছুই শুনেন ও দেখেন। এই মহান সত্তা আমাদের দেহে চক্ষু সংযোজন করেছেন এবং এর সাহায্যে আমরা বই পড়ি, লেখি এবং যেভাবে ইচ্ছা দেখতে পারি। কিন্তু আল্লাহ তাআলার প্রশস্ত ও সর্বব্যাপক দৃষ্টির সাথে কি এর কোন তুলনা চলে? যদি দুনিয়ার সব চোখ একত্র হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে থাকা জিনিসগুলো দেখার চেষ্টা করে তাহলেও আল্লাহর দৃষ্টির তুলনায় এদের দৃষ্টিশক্তির কোন তাৎপর্য নেই। আল্লাহর দর্শন ক্ষমতার আমরা কি জানি? তিনি একই সময় সমগ্র সৃষ্টি জগতকে দেখতে পান। কিছুই তাঁর দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে না। রাতের গভীর অন্ধকারে কোন জিনিস লুকিয়ে থাক, অথবা দিনের উজ্জ্বল আলোয় চলাফেরা করুক, মানুষের দৃষ্টির সামনে হোক অথবা জনবসতি থেকে অনেক দূরে থাক সবই তাঁর জন্য সমান। মহান আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী********************************************************************************)

হে নবী! তুমি যে অবস্থায়ই থাক না কেন এবং কুরআন থেকে যা কিছু শুনাও; আর হে লোকেরা, তোমরাও যা কিছু কর সব অবস্থায়ই আমরা তোমাদের দেখি এবং লক্ষ্য করি। আসমান ও যমীনে এক বিন্দু পরিমাণ জিনিস এমন নেই –না ছোট, না বড় –যা তোমার প্রতিপালকের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে থাকতে পারে, এ সবই এক পরিচ্ছন্ন দফতরে লিপিবদ্ধ আছে।–সূরা ইউনুসঃ ৬১

এই বাস্ত সত্য উপলব্ধি করা দীনের অংশবিশেষ, বরং সত্য কথা এই যে, এটা দীনের সুউচ্চ গম্বুজ। নবী করীম (সঃ) বলেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

ইহসান এই যে, তুমি এমনবাবে আল্লাহর ইবাদত কর যেন তুমি তাঁকে দেখছ। তুমি যদি তাকে না দেখতে পাও তাহলে (এই অনুভূতি জাগ্রত কর যে) তিনি তোমায় দেখছেন।–বুখারী, মুসলিম

‘বান্দা আল্লাহকে দেখছে’ –এই অবস্থা তখনই সৃষ্টি হতে পারে যখন বান্দার মন-মগজে এই অনুভূতি ক্রিয়াশীল হয় যে, আল্লাহ তাআলা প্রতিটি বান্দার প্রতিটি কার্যকলাপ পর্যবেক্ষ করছেন, তিনি প্রতিটি গতি ও স্থিতি লক্ষ্য করছেন এবং গোপন-প্রকাশ্য সব কিছুরই জ্ঞান রাখেন; তাঁর সামনে প্রতিটি মানুষকে জবাবদিহি করতে হবে। এটাই হচ্ছে তাকওয়ার মজ্জা এবং ইখলাস ও নিষ্ঠার প্রাণশক্তি।

কালাম বা কথা
মনের ভাব, অনুভূতি ও জ্ঞান তথ্য প্রকাশ করার নাম হচ্ছে কথা বা ভাষা। কোন কিছু বলা, অন্যকে কিছু বুঝানো, উপদেশ দেওয়া এবং কোন ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করার মাধ্যম হচ্ছে এই কালাম বা ভাষা। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলার মাঝেও এই বৈশিষ্ট্য পূর্ণরূপে বিদ্যমান রয়েছে। তিনি গোটা সৃষ্টি জগতে জীবন-মৃত্যুর ধারবাহিকতা চালু রেখেছেন। অসংখ্য ফেরেশতা এ কাজে নিয়োজিত রেখেছেন। লক্ষ কোটি ফেরেশতাকে তিনি বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত রেখেছেন যার কোন খবরই আমরা রাখি না।

এই স্থায়ী বিশ্বব্যবস্থায় নিয়ত রুযী বণ্টিত হচ্ছে। কেউ সম্মানিত হচ্ছে, কারো সম্মান ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে, কেউ উন্নতির পথে এগিয়ে চলছে, কেউ পতনের দিকে ছুটে যাচ্ছে, কোন নিদর্শন বিলুপ্ত হচ্ছে, কোনটির ভিত্তি স্থাপিত হচ্ছে, বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গৃহীত হচ্ছে, বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা চালু হচ্ছে। এসব কিছুই আল্লাহ তাআলার স্থায়ী ব্যবস্থাপনার অধীনে ঘটছে।

আল্লাহ তাআলার জ্ঞানভাণ্ডারে যা আছে তার কোন সীমা-সংখ্যা নেই। যেসব বাক্যে তাঁর জ্ঞানের প্রকাশ ঘটছে তারও কোন শেষ নেই। আমাদের অবস্থা এই যে, ছোটখাটো কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য আমাদের বিরাট শব্দকোষের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অতএব রাব্বুল আলামীন সম্পর্কে তোমাদের কি ধারণা যিনি এই সৃষ্টিজগৎ পরিচালনা করছেন এবং এই বিরাট রাজ্যর ওপর শাসনক্ষমতা চালাচ্ছেন? তোমাদের জ্ঞান কি এই সাক্ষ্যও দেয় না যে, বাস্তবিকই তাঁর কথা, তাঁর বাক্য এবং তাঁর জ্ঞানভাণ্ডার এত ব্যাপক ও বিস্তারিত যা তিনি তাঁর কালামে পাকে উল্লেখ করেছেনঃ

(আরবী************************************************************************************)

যমীনের বুকেযত গাছ আছে সবই যদি কলম হয়ে যেত, সমুদ্র যদি কালি হয়ে যেত এবং একে আরো সাতটি সমুদ্র কালি সরবরাহ করত তবুও আল্লাহর কথাগুলো লেখা শেষ হত না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা প্রবল পরাক্রমশালী ও সুবিজ্ঞানী।–সূরা লুকমানঃ ২৭

(আরবী*****************************************************************************************)

হে মুহাম্মদ! বল, সাগর-মহাসাগরগুলো যদি আমার প্রভুর কথাসমূহ লেখার জন্য কালি হয়ে যায় তাহলে তা ফুরিয়ে যাবে কিন্তু আমার প্রতিপারকের কথা লেখা শেষ হবে না। বরং আমরা যদি আরো এত পরিমাণ কালি এনে নেই তবে তাও যথেষ্ট হবে না।–সূরা কাহফঃ ১০৯

যেসব মহান ঐশী গ্রন্থ আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীদের উপর নাযিল করেছেন তা তাঁর কথার উজ্জ্বল নিদর্শন বহন করে। আল্লাহ তাআলা মূসা আলাইহিস সালামের সাথে কথা বলেছেন। কিয়ামতের দিন তিনি তাঁর অনেক বান্দাকে এই সম্মান দান করবেন। তিনি হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে র্সশেষ ওহী নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের কাছে পাঠিয়েছেন। অনুরূপভাবে কুরআন শরীফ আল্লাহ তাআলার কথার সমষ্টি এবং মানব জাতির জন্য সর্বশেষ নির্দেশিকা। এর পর ঐশী কিতাব নাযিল হওয়ার ধারা বন্ধ হয়ে গেছে এবং তা কিয়ামত পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। মহান আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী**********************************************************************************)

তোমার রবের কথা সত্যতা ইনসাফের দিক দিয়ে পূর্ণ পরিণত। তাঁর কথার পরিবর্তনকারী কেউ নেই। তিনি সবকিছু শুনেন এবং সবকিছু জানেন।–সূরা আনআমঃ ১১৫

তবে আল্লাহ তাআলার কথা বলার ধরন সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। এটা এমন একটি বিষয় যা আমাদের জ্ঞানসীমার বাইরে এবং অনেক ঊর্ধ্বে। সে পর্যন্ত পৌঁছা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অবশ্য আমরা এতটুকু বলতে পারি যে, মুখ ও ঠোঁটের সাহায্যে সৃষ্ট কথার নাম আল্লাহর কথা নয়, এটা মানুষের কথা।

তুমিই আল্লাহ তুমিই মওলা
কল্পনার পাখা যখন আকাশ পানে ছুটে চলে-যেখানে রাতের বেলা তারকারাজির সমাবেশ ঘটে, দৃষ্টি যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন ও সীমাহীন বিশ্ব পরিভ্রমণ করতে গিয়ে থমকে যায়, যখন নীরবতার আতংক ছেয়ে যায় এবং অন্তর যখন বিনয় ও নম্রতায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় –তখন তোমর নূরালোকি চেহারা দিকচক্রবালে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে, তোমার মধুর আওয়াজ কানের পর্দায় বেজে উঠে এবং তোমার মহত্ব ও গৌরব বিনম্র ও প্রশান্ত আত্মাগুলোকে নিজের বক্ষে টেনে নেয়। এ সময় এই অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশ্বপ্রকৃতিকে উজ্জ্বল ও আনন্দমুখরিত মনে হয়, নীরবতা-নিস্তব্ধতা প্রশংসা গীতির সুর-মুর্ছনায় পরিণত হয়। এই গানের সুর-মুর্ছনা সর্বদিকে গুঞ্জরিত হতে থাকে। আর এই সময় বিনম্র ও প্রশান্ত আত্মাগুলোও গেয়ে উঠেঃ “তুমিই আল্লাহ তুমিই মাওলা”।

যখন কোন চিন্তাশীল ব্যক্তি অথৈ সমুদ্রের তীরে গিয়ে দাঁড়িয়ে দূরে বহু দূর পর্যন্ত নিরে দৃষ্টি প্রসারিত করে দেয়, যেখানে নীল আকাশ সমুদ্রের নীর পানির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে, যেখানে বিকেলের সূর্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে চাচ্ছে, যখন অন্তগামী সূর্যের লাল আভা দিক-চক্রবালে পাল তোলা নৌকার মত ভেসে বেড়াতে থাকে –যেন একটি পাখি অফুরন্ত নিয়ামতের মধ্যে সাঁতার কাটছে –তখন তার মনে এমন এক মহান সত্তার কথা ভেসে উঠে, যাঁর সামনে এই অতৈ সমুদ্র মূল্যহীন এবং খুবই নগণ্য মনে হতে থাকে।

এই দৃশ্য অবলোকন করে তার চোখ ঠাণ্ডা হয়ে আসে। সে চিন্তা করতে থাকে পানির সমতল বুক চিরে নৌযানগুলো স্বয়ং সম্পূর্ণ আল্লাহ তাআলার অসীম রহমতে এবং তাঁর তত্ত্বাবধানেই নিরাপদে অগ্রসর হচ্ছে। এ যেন এক মহান সত্তার মহানত্বের প্রদর্শনী। এ এমন এক চিত্তাকর্ষন দৃশ্য যা রূহ ও আত্মাকে শান্ত-শীতল করে দেয়। এ সময় মনের মণিকোঠায় খটখট শব্দ হয় এবং আত্মা সশব্দে চিৎকার করে উঠেঃ “তুমি আল্লাহ তুমিই প্রভু!”

সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজ যখন তীর থেকে অনেক দূরে গহীন সমুদ্রের মাঝে চলে যায়, হঠাৎ ভয়ংকর তুফান উত্থিত হয়, তীব্র বেগে বাতাস বইতে থাকে, সমুগ্রের উপরিভাগ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যায়, আসমান অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায়, বিজলীর চমকে চোখ দৃষ্টিহীন হয়ে যায়, মেঘের গর্ঝনে মন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যায়, অন্ধকারের মধ্যে বৃষ্টির বেগ আরো তীব্র হতে থাকে, উত্তাল তরঙ্গের আঘাতে জাহাজ ওলট-পালট খেয়ে নাচতে থাকে, নাস্তিকও থমকে গিয়ে আল্লাহ আল্লাত ডাক শুরু করে দেয়, জাহাজের কাপ্তান নিরাশায় উদভ্রান্ত হয়ে পড়ে, জাহাজ প্রায় ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়, চতুর্দিক থেকে কেবল মৃত্যুঘণ্টা বাজতে থাকে –এই মহাবিপদের মধ্যে হঠাৎ আশার আলো দেখা দেয়, অন্ধকার ঘনঘটার মধ্যে তোমার নূর জ্বলে উঠে, বিপদের মেঘ কেটে যেতে থাকে এবং তোমার দয়া ও অনুগ্রহ এই নিরাশ্রয় ও বিপদগ্রস্ত মানুষগুলোকে নিজের কোলে টেনে নেয়। এ সময় অন্তর ও মুখ নিজের অগোচরে সমস্বরে চিৎকার করে উঠেঃ “তুমি আল্লাহ, তুমিই মাওলা”।

ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে, সহানুভূতিশীলদের দোয়া ও বন্ধু-বান্ধবের সেবা-যত্নের মধ্যে অবস্থানকারী রোগীর অবস্থা যখন নাজুক হয়ে যায় তখন সে কল্যাণ কামনাকারীদের দোয়া এবং বন্ধুদের আশার মাঝে নিথর হয়ে পড়ে থাকে। ডাক্তার সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়েও নিরাশ হয়ে যায়, বন্ধুদের সহানুভূতি নিস্ফল প্রমাণিত হয়, বাঁচার যে ক্ষীণ আশা ছিল তাও নিরাশায় পরিণত হয়ে যায়, রোগীর উপর সবার মাথা ঝুঁকে পড়ে, হাত-পা ও অন্তর কাঁপতে থাকে, কলিজা মুখে এসে যায় –এই কঠিন মুহুর্তে তুমি আত্মপ্রকাশ কর এবং কানে বেজে উঠে, “আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করে ফেলেছি”। এ সময় ডাক্তার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, হিতাকাঙ্ক্ষী সবার মুখে একই কথা ফুটে উঠে, “নিঃসন্দেহে তুমিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মালিক, তুমিই আল্লাহ, তুমিই প্রভু”।

যখন কোন ব্যক্তি দুনিয়া থেকে বিদায় হতে যাচ্ছে এবং দুনিয়াও তাকে বিদায় দিতে যাচ্ছে, ধনসম্পদ তার হাত থেকে খসে যাচ্ছে, মান-সম্মান ও পদমর্যাদা খতম হয়ে যাচ্ছে, আশা-আকাঙ্ক্ষার সমস্ত ফুল ঝরে পড়ছে, চাওয়া-পাওয়ার দীপশিক্ষা নিভে যাচ্ছে, স্বাদ-গন্ধ রুচিহীন হয়ে যাচ্ছে, হাসি-খুশি, আনন্দ বিষাদে পরিণত হচ্ছে, এ সম্পদ ও পদমর্যাদার প্রতি তার মন বিতৃষ্ণ হয়ে পড়ে, আশা-আকাঙ্ক্ষার আগুনে নিভে ঠাণ্ডা হয়ে যায়, তখন তোমার স্মরণই প্রশান্তির বাহন হয়ে দাঁড়ায়ঃ “তুমিই আল্লাহ, তুমি মাওলা”।

বাগানে যখন কোন সুন্দর ফুল দেখা যায়, যখন চোখ এমন কোন চোখের সাথে মিলিত হয়, যার মধ্যে সৌন্দর্য রয়েছে, যখন ভোরের আভা অন্তরকে মোহাচ্ছ্নন করে ফেরে এবং পাখির কলগুঞ্জন কানের মধ্যে মধু ঢেলে দেয়, যখন বুক আনন্দে ভরে যায়, যখন অন্তর খুশিতে গদগদ করে, এ সময় আমাদের অন্তরে তোমার হৃদয়গ্রাহী চমক খেলে যায়। আমরা অনুভব করতে থাকিঃ “তুমিই আল্লাহ, তুমিই মাওলা”।

লোকেরা যখন শ্রেষ্ঠত্বের দ্যুতি, কুদরতের খেলা, দয়া ও অনুগ্রহের নিদর্শন, সৌন্দর্য ও গৌরবের আলোকচ্ছটা এবং স্থায়িত্বের প্রদর্শনী দেখতে পায় তখন বলে, তুমি মহান, তুমি দয়ালু, তুমি সৌন্দর্যের প্রতীক, তুমি সর্বশক্তিমান, তুমি স্বাধীন, চিরস্থায়ী, চিরঞ্জীব। অন্তরের তারে একটি গানই বেজে উঠেঃ

(আরবী************************************************************************)

তুমিই আল্লাহ তুমিই আল্লাহ

তুমিই মাওলান তুমিই মাওলা।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি