নির্ভেজাল তৌহিদ
আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়
এই গোটা বিশ্বের ইলাহ মাত্র একজন। সমগ্র সৃষ্টিজগত তাঁর অসীম ক্ষমতা, গৌরব ও মহত্বের সামনে নতশিরে দণ্ডায়মান। মহান আল্লাহর বাণীঃ

(আরবী****************************************************************************************)

আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে তা সবই দয়াময় রহমানের কাছে বান্দা হিসেবে উপস্থিত হবে। তিনি তাদের ভাল করেই জানেন এবং তিনি তাসের সঠিকভাবে গণনা করে রেখেছেন। কিয়ামতের দিন সকলেই তাঁর সামনে এককভাবে হাযির হবে। -সূরা মরিয়মঃ ৯৩:৯৫

একদল লোক যেসব জিনিসকে আল্লাহর সাথে শরীক বলে ধারণা করে নিয়েছে, আমরা সেগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, এগুলোর অবস্থা এমন যে, বিশ্বজগতে অথবা এর ব্যবস্থাপনায় এগুলোর কোন স্থঅন নেই। প্রাচীনকালে লোকেরা পাথরের পূজা করত। সুস্থ বুদ্ধির অধিকারী কোন ব্যক্তি কি এ কথা সমর্থন করতে পারে যে, মাটির কোন পাথর, এমনকি গোটা পৃথিবী ইলাহ (উপাস্য) হওয়ার যোগ্যতা রাখে? তারা কোন পশুর পূজা শুরু করে দিল এবং এর গোটা প্রজাতিকেই পবিত্র মনে করে নিল। হিন্দুদের মধ্যে আজ পর্যন্তও এই মহামারী দেখা যাচ্ছে। কোন পশুর বাচ্চা –তা যতই মোটাতাজা ও হৃষ্টপুষ্ট হোক না কেন –উপাস্য হওয়ার মর্যাদার আসীন হতে পারে কি?

নিঃসন্দেহে মূর্তিপূজা করা নিজেদের মর্যাদা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এজন্যই তারা এত নি নেমে গেছে। কোন কোন ব্যক্তি নিজেই ইলাহ হওয়ার দাবি করেছিল। যেমন মিসরের রাজা ফিরাউন এবং সেই নমরূদ, যে ইবরাহীম (আঃ)-এর সাথে তাঁর রব সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল। যেমন পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছেঃ

(আরবী*****************************************************************************)

তুমি কি সেই ব্যক্তি দেখেছ, যে ইবরাহীমের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল এই কথা নিয়ে যে, রব কে? সে এই দুঃসাহস এজন্য করতে পেরেছিল যে, আল্লাহ তাকে রাজত্ব দান করেছিলেন। ইবরাহীম যখন বলল, আমার রব তিনি –যাঁর এখতিয়ারে রয়েছে জীবন ও মৃত্যু। তখন সে বলল, জীবন ও মৃত্যু তো আমারই এখতিয়ারে। -সূরা বাকারাঃ ২৫৮

এই নির্বোধ মনে করে বসল, যে রাজত্বের সে একচ্ছত্র মালিক হয়ে বসেছে এবং যার ভিত্তিতে সে প্রজাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তাকে হত্যা করেছে এবং যাকে ইচ্ছা জীবিত রাখছে –তা তাকে উপাস্য হওয়ার পদমর্যাদায়ও অভিষিক্ত করতে পারে। একদল লোকের মগজে আজো এ ধরনের ধারণা বিদ্যমান। কিন্তু জনগণ প্রতিটি যুগেই এদের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে আসছে।

ইহুদী-খৃষ্টানরাও তাদের নবী-রাসূলদের মর্যাদা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাঁরা তাদেরকে ইলাহ হওয়ার পদমর্যাদায় উন্নীত করে পথভ্রষ্ট হয়েছে। অথচ তাঁরা আল্লাহর বান্দা ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। নবুয়াতের পদমর্যাদা তাঁদের দান করা হয়েছিল মাত্র। এ ব্যাপারে তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে নিজেরাই প্রতারিত হয়েছে। কোন মানুষ –সে যত শক্তিশালীই হোক না কেন –আমরা যদি তার সম্পর্কে ধারণা করি যে, সে কোন একটি তারকা সৃষ্টি করেছে –তবে এটা কত বড় নির্বুদ্ধিতা।

আমরা দূরে কেন যাচ্ছি? এদের কেউই তো একটি মাছি, এমনকি এর চেয়েও ক্ষুদ্র কোন জীব সৃষ্টি করতে কখনো সক্ষম হয়নি। অতএব যারা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর একটি প্রাণী সৃষ্টি করতেও সক্ষম নয়, তারা আবার উপাস্য হয় কেমন করে? সৃষ্টি করা তো দূরের কথা, একটি মাত্র মৌমাছির পেটে যে হাজার হাজার জীবাণু (Germs) রয়েছে তার একটি জীবাণু যদি এদের কারো স্বাস্থ্যের উপর আক্রমণ করে বসে, তাহলে সে তার প্রতিরোধ করতেও সক্ষম নয়। এরপর আর কিসের বিত্তিতে তাদের কাউকে উপাস্যের আসন বসানো যেতে পারে?

ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ)
ঈসা ইবন মরিয়ম (আ)-কে এই জগতের প্রভু অথবা এক্ষেত্রে তাঁকে আল্লাহর অংশীদার বানিয়ে যে নিকৃষ্ট মানসিকতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে দুনিয়াতে আর কোন নিকৃষ্ট কাজ এতটা প্রচার পায়নি। চিন্তা ও কুপ্রবৃত্তির অনুপাত অনুযায়ী এই মূর্খতার ক্ষেত্র প্রশস্তও হতে থাকে এবং সংকীর্ণও হতে থাকে। কখনো বলা হয়, আল্লাহ ঈসা, তাঁর মা ও পবিত্র আত্মা মিলে গঠিত হয়েছে একটি যৌথ মালিকানা। এই বিশ্বজগৎ উল্লেখিত কোম্পানীর তত্ত্বাবধানেই বিভিন্ন অংশ অথবা বিভিন্ন রূপ –যা অনুধাবন করা মানুষের বুদ্ধি-বিবেকের পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়।

এই সবই হচ্ছে মহাসত্য থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং চরম ভ্রান্তি। মহান আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী*********************************************************************)

যারা বলেছে, মসীহ ইবন মরিয়মই হচ্ছে খোদা, তারা নিশ্চয়ই কুফরী করেছে। -সূরা মাইদাঃ ৭২

(আরবী************************************************************************************)

যারা একথা বলেছে যে, আল্লাহ তিনজনের মধ্যে একজন –তারা নিশ্চয়ই কুফরী করেছে। অথচ আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। -সূরা মাইদাঃ ৭৩

ঈসা (আঃ) ছিলেন একজন মানুষ। তিনি পানাহার করতেন এবং দেহ থেকে উচ্ছিষ্ট ও মলমূত্র নির্গত করতেন। অতএব তাঁর মানব বৈশিষ্ট্য কি করে অস্বীকার করা যেতে পারে? অথবা কি করে তাঁর জন্য অতিমানবীয় মর্যাদা দাবি করা যেতে পারে? মহান আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী**********************************************************************************)

মরিয়মের পুত্র মসীহ একজন রসূল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তার পূর্বে আরো অনেক রসূল অতীত হয়েছে। তার মা ছিল এক পবিত্রতম ও সত্যপন্থী মহিলা। তারা উভয়েই খাদ্যগ্রহণ করত। -সূরা মাইদাঃ ৭৫

তিনি ছিলেন একজন বান্দা মাত্র। মহান রাব্বুল আলামীনের সামনে তাঁর মাথা অবনত হয়ে যেত। তিনি পূর্ণ নীরবতা সহকারে, নিজেকে ধন্য মনে করে এং স্বীকৃতিসুলভ ভঙ্গীতে এই ঘোষণা শুনছেনঃ

(আরবী**********************************************************************************)

হে মুহাম্মদ! তাদের বল, আল্লাহ যদি মরিয়মের পুত্র মসীহকে এবং তার মা ও সমস্ত পৃথিবীবাসীকে ধ্বংস করে দিতে চান, তাহলে তাঁর ইচ্ছা থেকে তাঁকে বিরত রাখার মত শক্তি কার আছে? সূরা মাইদাঃ ১৭

ঈসা (আ) ও তাঁর মা আল্লাহ তাআলার মুখাপেক্ষী দুইজন বান্দাহ। তাঁরা নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে ভালভাবেই অবহিত ছিলেন। হাশরের দিন তাঁরা অকপটে তা স্বীকার করবেন এবং তাঁদেরকে কেন্দ্র করে যারা বাড়াবাড়ির পথ অবলম্বন করেছে –তাঁরা উভয়ে তাদের সাথে নিজেদের সম্পর্কহীনতার কথা ঘোষণা করবেন। কুরআন মজীদের ভাষায়ঃ

(আরবী*********************************************************************************)

আল্লাহ যখন বলবেন, হে ঈসা ইবনে মরিয়ম! তুমি কি লোকদের বলেছিলে –তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার মাকে খোদা বানিয়ে নাও? তখন সে উত্তরে বলবে, মহান পবিত্র তোমার সত্তা, এমন কথা বলা আমার কাজ নয়, যা বলার কোনই অধিকার আমার ছিল না। যদি আমি এরূপ কোন কথা বলেই থাকতাম তাহলে আপনি তা অবশ্যই জানতেন। আমার মনের সবকিছুই আপনি জানেন, কিন্তু আপনার মনের কিছুই আমি জানি না। আপনি তো সকল গোপন তত্ত্বকথাই জানেন। আপনি আমাকে যা বলার নির্দেশ দিয়েছিলেন, আমি কেবল তাই তাদের কাছে বলছি। আর তা হচ্ছে –তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর –যিনি আমারও রব, তোমাদেরও রব। -সূরা মাইদাঃ ১১৬-১৭

বাস্তবতার নিরিখেও ঈসা (আঃ)-কে খোদা হিসেবে মেনে নেওয়াটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। তাঁর সম্পর্কে এরূপ ধারণা করাও সম্পূর্ণ অসঙ্গত যে, তিনি সৃষ্টি করেন, রিযিকের ব্যবস্থা করেন, মৃত্যু দেন, জীবন দেন, বিশ্ববাসীর প্রয়োজন পূরণ করেন, এই বিশ্বব্যবস্থা পরিচালনা করেন ইত্যাদি। কেননা জীবনে তিনি একজন দুর্বল বান্দা হিসেবেই ছিলেন। যেসব লোক ঈসাকে প্রভু বল দাবি করে, তারাও এসব কিছু ভালভাবেই জানে এবং বুঝে, তাই তারা তাঁর মধ্যে খোদায়িত্ব প্রমাণ করার জন্য আল্লাহর সাথে তাঁর সম্পর্ক জুড়ে দেয়। তারা বলে, ঈসা আল্লাহর পুত্র। এভাবে যেন তিনি তাঁর উত্তরসুরী হলেন। তাদের এই বাজে কথার ভিত্তি এই যে, ঈসা (আঃ) (বিনা বাপে) মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।

সত্য কথা এই যে, একজন আবিস্কর্তা ও তার আবিস্কার অথবা স্রষ্টা ও তার সৃষ্টির মধ্যে যেরূপ সম্পর্ক বিদ্যমান, আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টিকুলের মধ্যেও অনুরূপ সম্পর্ক বিদ্যমান। এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব সৃষ্টিই সমান। আল্লাহ তায়ালা এই বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা, তিনিই একে অস্তিত্ব দান করেছেন এবং এর পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করেছেন। এ বিশ্বের কোন সৃষ্টিই নিজের উপকার বা অপকার করার শক্তি রাখে না, সে নিজের জীবন-মৃত্যুরও মালিক নয়। জীবিত ও নির্জীব সমস্ত সৃষ্টিই আল্লাহর সামনে অবনত হয়ে পড়ে আছে, তাঁর প্রশংসা ও গুণগানে লিপ্ত আছে এবং তাঁর প্রভুত্বের সামনে সিজদারত আছে।

আল্লাহ তাআলাই নিজের সৃষ্টির কোনটিকে যমীন, কোনটিকে আসমান, কোনটিকে মাটি, কোনটিকে সোনা, কোনটিকে গাছ, কোনটিকে পশু, কোনটিকে জিন ও কোনটিকে মানুষ বানিয়েছেন। এখন যদি তিনি তাঁর কোন সৃষ্ট জীবকে উচ্চ মর্যাদা দিয়ে থাকেন তাহলে এটা তাঁর অনুগ্রহই বলতে হবে। তিনি যদি কোন মাখলুককে কম মর্যাদাসম্পন্ন করে থাকেন তাহলে এটাকে তার দূরদর্শিতা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বলতে হবে।

কিছু সংখ্যক ফেরেশতা এবং কিছু সংখ্যক মানুষকে আল্লাহ তাআলা বিশেষ যোগ্যতা দান করেছেন, অন্যদের তুলনায় তিনি তাঁদের বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। তিনি নিজের রিসালাত ও দৌত্যকার্যের জন্য তাদের মনোনীত করেছেন। মহান প্রতিপালক প্রভু তাঁর সৃষ্টির সাথে যে কর্মপন্থাই অবলম্বন করুন তাতে বিশ্বজগৎ ও তার ধারকের মধ্যকার সম্পর্কের উর কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। যদি কোন প্রকৌশলী কিছু পাথর ভিত হড়ার জন্য মাটির নিচে স্থাপন করেন এবং কিছু পাথর দিয়ে সুউচ্চ মিনার তৈরি করেন, তাহলে উপরের এই পাথরগুলো কি দাবি করতে পারে যে, তারা স্বয়ং প্রকৌশলী হয়ে গেছে অথবা তার সমান মর্যাদার অধিকারী হয়েছে?

এটা কত বড় নির্বুদ্ধিতাপ্রসূত উক্তি যে, কতিপয় সৃষ্টি আল্লহার সার্বভৌম ক্ষমতায় শরীক আছে। এই ধারণা কেমন করে সৃষ্টি হল? শুধু এ কারণে যে, আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করেছিলেন আর তারা এই সুযোগে বিদ্রোহে লিপ্ত হয়েছে। আসমান ও যমীদের স্রষ্টা সম্পর্কে কেমন করে এরূপ ধারণা করা যেতে পারে যে, যেসব কাঠামো তিনিই সৃষ্টি করেছেন –এখণ তিনি তার পিতা হয়ে যাবেন? অধিকন্তু এই বিশাল বিশ্বজগৎ এবং এই বিশাল সাম্রাজ্যের সাথে ঈসা আলাইহিস সালামের কি তুলনা হতে পারে? মহান আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী**************************************************************************************)

এরা বলে রহমানের সন্তান আছে। একথা থেকে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র। তারা তো বান্দা মাত্র, তাদের সম্মানিত করা হয়েছে। তারা তাঁর সামনে অগ্রসর হয়ে কথা বলে না, কেবল তাঁর নির্দেশমত করে যায়।

-সূরা আম্বিয়াঃ ২৬-২৭

এই নাদান-মূর্খরা জন্ম ও বংশধারা, নবুয়ত, রিসালাত ইত্যাদি সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করে তা খোদায়িত্বের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। খোদায়িত্বের মর্যাদা এর অনেক ঊর্ধ্বে। মহান আল্লাহর বাণীঃ

(আরবী**************************************************************************************)

আল্লাহ যদি কাউকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করতে চাইতেন, তাহলে নিজের সৃষ্টির মধ্যে যাকে ইচ্ছা বাছাই করে নিতে পারতেন। তিনি এ থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। তিনি তো আল্লাহ, এক অদ্বিতীয়। তিনি সকলের উপর বিজয়ী। -সূরা যুমারঃ ৪

(পিতার ঔরস ছাড়া) কেবল মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করাটাই যদি খোদার বেটা হওয়ার ক্ষেত্রে ঈসার জন্য যথেষ্ট হত এবং এভাবে তিনি উপাস্য হওয়ার অধিকারী হয়ে যেতেন, তাহলে আদম (আঃ) তো তাঁর চেয়েও অধিক হকদার। কেননা তাঁর তো বাপও ছিল না এবং মাও ছিল না। বরং আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতারা তো আরো একধাপ অগ্রসর হয়ে ঐ মর্যাদার অধিকারী হত। কেননা অতি ঊর্ধ্ব জগতেই তাদের অবস্থান, এই মাটির জগতে নয়।

একটি ভ্রান্তি
ডঃ শিবল শ্যামুয়েলের ডায়রীতে এক স্বদেশী খৃষ্টানের কিছু বক্তব্য পাঠ করার সুযোগ আমার হয়েছে। তিনি একটি মুসলিম নাম নিজের ছদ্মনাম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ) সম্পর্কে মুসলমান ও খৃষ্টানদের দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে সমন্বয় সাধণ করার চেষ্টা করেছেন। এই লেখকের মৌলিক বিষয় হচ্ছে এই যে, ইসলাম ও খৃষ্টান উভয় ধর্মের মধ্যে কতিপয় গূঢ় রহস্য রয়েছে।

একদিকে খৃষ্ট ধর্মে ঈসা (আঃ)-এর বৈশিষ্ট্য এবং রাব্বুল আলামীনের সাথে তাঁর সম্পর্কের ধরনের মধ্যে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে, অপরদিকে ইসলামেও এমন কতগুলো বিষয় রয়েছে যার মধ্যে অস্পষ্টতা বিদ্যমান। সুতরাং এক্ষেত্রে দু’টি ধর্মের অবস্থাই এক। অতএব ত্রিত্ববাদকে এমন কোন গ্রন্থি মনে করার কোন কারণ নেই, যা আল্লাহর একত্বের পরিপন্থী হতে পারে।

এই লেখক আরো বলেন, এক আল্লাহ যিনি কোন জড়-বস্তু নন –তাঁর সম্পর্কে খৃষ্টানদের যে আকীদা-বিশ্বাস রয়েছে, সে সম্পর্কে অধিকাংশ মুসলিম পণ্ডিতই অবহিত নন –যেভাবে অধিকাংশ খৃষ্টান পণ্ডিত মুসলমানদের আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে অবহিত নন। খৃষ্টানদের আকীদাগত দর্শনে কিছুটা কাঠিন্য অনুভূতি হওয়ার ভিত্তিতে খৃষ্টানরা বলে যে, ধর্মের মধ্যে এমন কতগুলো বিষয় রয়েছে বা জ্ঞানবুদ্ধির সীমার ঊর্ধ্বে। তারা এগুলোকে নিজেদের ধর্মের গৌরবের বিষয় মনে করে। মুসলমানরা মনে করে ‘জ্ঞান-বুদ্ধির সীমা-বহির্ভূত’ অর্থ ‘জ্ঞানবুদ্ধির পরিপন্থী’। মূলত তা নয়, এর অর্থ হচ্ছে জ্ঞান তার পরিচয় লাভ করতে বা তা অনুধাবন করতে সক্ষম নয়। এ ধরনের কথা মুসলমানেরদ মধ্যেও প্রসিদ্ধ।

কিন্তু বর্তমান যুগে তাদেরই একদল লেখক ঘোষণা করছেন যে, একমাত্র ইসলামই বুদ্ধিবৃত্তিক ধর্ম। তারা একথা ব্যাখ্যায় বলেন, ইসলামের প্রতিটি বিষয়ই মানুষের জ্ঞান অনুধাবন করতে সক্ষম।

কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না যে, মানুষের জ্ঞান কি করে অদৃশ্য জগতের বিষয়সমূহ অনুধাবন করতে সক্ষশ হতে পারে? যেমন বেহেশতের মধ্যকার দুধ ও মধুর প্রস্রবণ, আত্মার জগৎ, ফেরেশতাদের জগৎ ইত্যাদিকে মানুষের জ্ঞান কিভাবে অনুধাবন করতে পারে? তাছাড়া মূসা (আঃ) যে আগুন দেখেছিলেন –তারা এরইবা কি ব্যাখ্যা করবেন?

(আরবী*********************************************************************************)

সেখানে পৌঁছলে ডাক দিয়ে বলা হল, হে মূসা! আমিই তোমার রব। তোমার জুতা খুলে ফেল। তুমি তো তুয়া নামক পবিত্র প্রান্তরে উপস্থিত হয়েছ। -সূরা ত্বাহাঃ ১১,১২

আছে কি এমন কোন জ্ঞান এই ডাকের তাৎপর্য অনুধাবন করতে সক্ষম –যা মূসা (আ) শুনেছিলেন এবং বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন? আল্লাহ তাআলা কিভাবে মরিয়মের লজ্জাস্থানে ফুঁ দিয়েছিলেন –তা হৃদয়ঙ্গম করার জ্ঞানবুদ্ধি বর্তমান আছে কি? যেমন কুরআন মজীদে এসেছেঃ

(আরবী*************************************************************************************)

আর ইমরান কন্যা মরিয়ম –যে নিজের লজ্জাস্থানের হেফাজত করেছিল, আমরা তার ভেতরে নিজের পক্ষ থেকে রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম।–সূরা তাহরীমঃ ১২

খৃষ্টানরা বলে, আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয় –যেমন মুসলমারা বলে থাকে। তারা আরো বলে, ঈসা (আ) আল্লাহর কলেমা এবং তাঁর রূহ। মুসলমানরাও একথা বলে। খৃষ্টানরা আরো বলে, ঈসা (আ) যে আল্লাহর রূহ এবং তার কলেমা এবং কুমারী মরিয়মের পেটে তা অন্তঃসত্তা হিসেবে স্থান পেয়েছিল, কোন মানুষ তাঁর সতীত্বে হাত লাগাতে পারেনি –মুসলমানরাও এই একই কথা বলে থাকে।

আমি আমার মুসলমান ভাইদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, তাঁরা যেন সর্বপ্রথম এ সব ব্যাখ্যার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা নির্ণয় করেন। তাঁরা এ কথাগুলো ভালভাবে বুঝে নেবেন, অতঃপর পিতা-পুত্র, পবিত্র আত্মার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে খৃষ্টানদের ত্রুটি নির্দেশ করবেন অথবা যে দর্শনের ভিত্তিতে এই তিনটি শব্দ একই তত্ত্ব নির্দেশ করে অথবা একই তত্ত্বের তিনটি রূপ হিসেবে গণ্য করা হয় –সেই দর্শন সম্পর্কে প্রশ্ন তুলবেন। মুসার আগুনের দৃষ্টান্ত পাঠকদের সামনেই রয়েছে।

এই কথার মধ্যে সুস্পষ্ট ভ্রান্তি রয়েছে। আমরা পূর্বেকার অনুচ্ছেদে আলোচনা করে এসেছি যে, (১) জ্ঞান কোন জিনিসের অস্তিত্বই অস্বীকার করে এবং (২) কোন জিনিসের হৃদয়ঙ্গম করা জ্ঞানের পক্ষে কষ্টকর –এ দুটি কথার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে।

এই পৃথিবী এবং এর বাইরের অদৃশ্য জগতে এমন অনেক রহস্য লুক্কায়িত আছে, যার অস্তিত্ব আমরা স্বীকার করি, কিন্তু এই তাৎপর্য সম্পর্কে আমরা অবহিত নই। আমরা যদি এর তাৎপর্য অনুধাবনে অক্ষমও হই তাতে এগুলোর অস্তিত্বের ওপর কোন আঘাত আসতে পারে না। অনন্তর এই দৃশ্যমান জগত এবং অদৃশ্যমান জগত –উভয়ের মধ্যে এমন অনেক কিছু আছে –যে সম্পর্কে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, এর কোন অস্তিত্ব নেই। এটা গ্রহণযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গী নয়। যা সম্ভব কিন্তু কঠিন, আর যা মূলতই অসম্ভব এবং অস্তিত্বহীন –এ দু’টো ব্যাপার কখনো এক হতে পারে না।

তিনকে এক (১) বলা দুই বিপরীত জিনিসের সমন্বয় হওয়ার মতই ব্যাপার। অর্থাৎ এমন দুই বিপরীত জিনিসের একাকার হয়ে যাওয়ার মত, যা কখনো সম্ভব নয়। এটা কোন কঠিন কথা নয়, বরং এমন একটি দাবি যার কোন ভিত্তিই নেই।

বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি এবং বাস্তব দৃষ্টান্ত
ইতিহাস পাঠে আমরা দেখতে পাই, যে ব্যক্তিই খোদায়ী দাবি করেছে তার সমর্থনে কোন দলিল নেই। যাদের সাথে খোদায়ীর দাবি সংযুক্ত করা হয় তারা নিজেরা হয় এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, কিন্তু তাদের ওপর জোরপূর্বক এটা চাপানো হয়েছে, যেমন নবী-রাসূল, ফেরেশতা ইত্যাদি; অথবা তারা এমন মাখলুকাত, যার কোন অনুভূতি শক্তি নেই, কোন জ্ঞানবুদ্ধিও নেই; যেমন –পাথর, গরু ইত্যাদি; অথবা নিকৃষ্ট চরিত্রের শাসক –যেমন মিসরের ফিরাউন বা এ ধরনের মাতাল যারা সরাসরি খোদায়ী দাবি করেছে।

বিশেষজ্ঞ আলেমগণ ব্যাপক বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। বাস্তব অবস্থাও তাই। যদি থাকত তাহলে সে আমাদের সামনে তার দাবি পেশ করত। আমাদের এই বস্তুজগতে দ্বিতীয় কোন খোদার অস্তিত্ব থাকত তাহলে সে আমাদের সামনে তাঁর পরিচয় তুলে ধরত। যত নবী-রাসূলের আগমন ঘটেছে তাঁর সবাই জোর দিয়ে বলেছেন যে, তাঁরা এক লা শারীক আল্লাহর তরফ থেকে এসেছেন, যিনি সারা জাহানের রব, প্রতিপালক, পরিচালক। তাঁদের কেউই এমন কথা বলেননি যে, তিনি অন্য কারো কাছ থেকে এসেছেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী****************************************************************************************)

আমরা তোমর পূর্বে যে রাসূলই পাঠিয়েছি তাকে এই ওহীই দিয়েছি যে, আমি ছাড়া কোন খোদা নেই, অতএব তোমরা আমারই দাসত্ব কর। -সূরা আম্বিয়াঃ ২৫

যদি দ্বিতীয় কোন ইলাহ থাকত তাহলে কে তাঁর বাকশক্তি ছিনিয়ে নিয়েছে যে, সে প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ শুনতে পাচ্ছে অথচ নিজের অধিকারহারা হয়ে যাওয়ার অভিযোগটুকুও উত্থাপন করছে না? সত্য কথা এই যে, গোটা বিশ্বের রাজাধিরাজ একমাত্র আল্লাহ। অন্য যত কল্পিত খোদা রয়েছে সেগুলো রুগ্ন চিন্তার অস্তির কল্পনা মাত্র এগুলো এমন কতগুলো নাম যা অলীক কল্পনার আবিস্কার মাত্র। মহান আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী*****************************************************************************************)

জেনে রাখ! আসমানের অধিবাসী হোক কি যমীনের সকলেই এবং সবকিছুই আল্লাহর মালিকানাভুক্ত। যারা আল্লাহকে ছাড়া নিজেদের মনগড়া শরীকদের ডাকে তারা নিছক ধারণা ও অনুমানের অনুসারী, তারা শুধু কল্পনাই করে। -সূরা ইউনুসঃ ৬৬

শিরক এবং একাধিক খোদার অস্তিত্ব প্রত্যাখ্যান করে বিশেষজ্ঞ আলেমগণ যেসব বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন তা এমন সব তাত্ত্বিক বিষয় যে সম্পর্কে আলোচনা করার কোন অবকাশ নেই। যাকে খোদা বলে মেনে নেওয়া হবে তার মধ্যে এসব গুণ বিদ্যমান থাকা অত্যাবশ্যক। যদি এই বিশ্ব চরাচরে আরো কোন উপাস্য থেকে থাকে তাহলে আল্লাহর তুলনায় তার মর্যাদা কি? যদি তার মর্যাদা আল্লাহর চেয়ে কম হয়ে থাকে তাহলে সে খোদা হতে পারে না। আর যদি তাঁর মর্যদা আল্লাহর চেয়ে অধিক হয়ে থাকে তাহলে সে-ই খোদা হওয়ার যোগ্য। কিন্তু মর্যাদা যদি সমান সমান হয় তাহলে তাদের দুজনের রাজত্বের সীমা কতদূর? প্রত্যেকের র্কক্ষেত্র কতদূর বিস্তৃত? জীবন ও মৃত্যু, ধ্বংস ও কল্যাণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে তাদের উভয়ের নির্দেশ একই সময় কিভাবে কার্যকর হয়? এ সম্পর্কে কুরআন মজীদের ঘোষণাঃ

(আরবী************************************************************************************)

আল্লাহ কাউকেও নিজের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেননি। আর দ্বিতীয় কোন খোদাও তাঁর সাথে শরীক নেই। যদি তাই হত তাহলে প্রত্যেক খোদা নিজ নিজ সৃষ্টি নিয়ে আলাদা হয়ে যেত। অতঃপর একজন অপরজনের ওপর চড়াও হয়ে বসত। লোকেরা যা মনগড়াভাবে বলে মহান আল্লাহ তা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। -সূরা মুমিনুনঃ ৯১

(আরবী***********************************************************************************)

যদি আসমান ও যমীনে এক আল্লাহ ছাড়া আরো বহু খোদা থাকত তাহলে (আসমান-যমীন) উভয়টির শৃংখল ব্যবস্থা বিনষ্ট হয়ে যেত। অতএব আরশের মালিক আল্লাহ তায়ালা পাক ও পবিত্র সেসব কথা থেকে, যা এই লোকেরা বলে বেড়ায়। -সূরা আম্বিয়াঃ ২২

কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি আসমান ও যমীনের ব্যবস্থাপনায় কোন বিশৃংখলা সৃষ্টি হচ্ছে না, কোন রকম ত্রুটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এই মহাবিশ্বের ব্যবস্থাপনা এবং প্রাকৃতিক বিধান ঘোষণা করছে যে, তারা একজন স্রষ্টারই সৃষ্টি –যার কোন অংশীদার নেই, যিনি সব কিছুরই মালিক এবং স্বয়ং সম্পূর্ণ।

পবিত্র কুরআনের বাণীঃ

(আরবী************************************************************************************)

তোমাদের খোদা এক ও অদ্বিতীয়। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তিনি মেহেরবান এবং দয়ালু। -সূরা বাকারাঃ ১৫৩

খালেস তৌহীদ
জোরপূর্বক যাদেরকে খোদার আসনে নিয়ে বসানো হয়েছে ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থায় সেগুলোর মূল্যায়ন করার পর আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। আমরা আত্মবিশ্বাস সহকারে বলতে পারি যে, এ বিশ্বে এমন কোন জিনিস নেই যা মহান ও পরাক্রমশালী এক আল্লাহর সামনে একটি নগণ্য বান্দা ছাড়া আর কিছু হতে পারে।

কিন্তু মানুষ এক অদ্ভুদ জীব। সে মনের গভীরে এটা অনুভব করে, সে প্রকৃতির ডাক শুনতে পায়, তার স্বভাব-প্রকৃতি তাকে বারবার ডেকে সেই এক ও অদ্বিতীয় মহান সত্তার তৌহীদের ঘোষণা দিচ্ছে, কিন্তু তবুও সে হকের সাথে বাতিলের সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছে। সে এই তৌহীদের মধ্যে এমন ভেজাল আমনাদি করছে যার ফলে তার স্বচ্ছ দৃষ্টিশক্তি অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে, তার ভিত্তিমূল ফাঁপা হয়ে পড়ছে।

ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সব মানুষই একথা স্বীকার করে যে, আল্লাহ তাআলাই হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতা। যেসব খৃষ্টান ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর সাথে শরীক বানিয়ে নিয়েছে তারা দাবি করছে না যে, ঈসা (আ) আসমানের কোন অংশ নির্মাণ করেছেন, অথবা যমীনের বুকে কোন পাহাড় দাঁড় করে দিয়েছেন, অথবা একদল মানুষের রিযিকের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, অথবা কোন ক্ষেতের শস্যবীজের অংকুরোদগম করে দিয়েছেন অথবা কোন ফলের বাগান সৃষ্টি করেছেন। কখনো নয়, কখনো নয়, একমাত্র আল্লাহই এসব কিছুর স্রষ্টা মালিক ও মনিব।

এই স্বীকৃতির পরও তারা একনিষ্ঠভাবে এক আল্লাহর ইবাদত করছে না, একাগ্র মনে তাঁর আনুগত্য করছে না। তারা নিজেদের ফিতরাতের এই সাক্ষ্য শুনছে, কিন্তু সেদিকে অগ্রসর হয়ে তাঁর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য কোন চিন্তা-ভাবনা করছে না। তারা নিজেদের মানত ও আনুগত্য গায়রুল্লাহর খিদমতে পেশ করছে। এই গায়রুল্লাহ কে? এসব লোকের চেহারা তার দিকে ঝুঁকে কেন মুশরিকরা এর ব্যাখ্যায় বলে যে, তারা খোদা থেকে দূরে সরে যায়নি, বরং তারা যাদের দিকে নিজেদের মুখমণ্ডল ঘুরিয়ে দিয়েছেন তারা মূলত সেই মহান উপাস্যের মহিমামণ্ডিত প্রাসাদেরই চাবি। তারা এদের কাছে শুধু এই উদ্দেশ্যেই গিয়েছে যে এরা তাদেরকেই সেই মহান প্রভুর কাছে পৌঁছে দেবে।

তারা বলে, কোন পাথর অথবা মানুষকে সৃষ্টিকর্তা এবং রিযিকদাতা হিসেবে মেনে নেব এবং আল্লহার সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতা হওয়ার ব্যাপরটিকে অস্বীকার করব –এতটা দুঃসাহস আমাদের নেই। আমরা তাঁর পুত্র-কন্যাদের তাঁর রহমত ও অনুগ্রহ উসিলা বানিয়েছি মাত্র। কুরআনের ভাষায়ঃ

(আরবী**************************************************************************************)

আর যারা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যদের পৃষ্ঠপোষক বানিয়ে নিয়েছে (এবং নিজেদের এ কাজের ব্যাখ্যা দেয় এই বলে যে,) আমরা তো এদের ইবাদত করি কেবল এইজন্য যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। -সূরা যুমারঃ ৩

তাদের এই ভূমিকা কত অবাঞ্ছিত এবং লজ্জাকর। আল্লাহর পুত্র-কন্যা বলতে কিছুই নেই। আল্লাহ ও তাঁর বান্দাদের মধ্যে কোন মাধ্যম, কোন সুপারিশকারী বা কোন মধ্যস্বত্বভোগী নেই। প্রতিটি মানুষেরই সরাসরি আল্লাহর কাছে নিজের আবেদ পেশ করার অধিকার রয়েছে। সে কোন অপরাধ করে বসলে সরাসরি নিজের রবের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে নিজের দুর্বলতা স্বীকার করে তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়ার অধিকার তার রয়েছে। কিন্তু অপর কোন ব্যক্তির এরূপ শক্তি নেই যে, সে অন্যের গুনাহের বোঝা নিজের ঘাড়ে তুলে নেবে অথচা ক্ষমা করানোর দায়িত্ব গ্রহণ করবে। সৃষ্টির সূচনা থেকে আল্লাহ তাঁর নবী-রাসূলের মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের কাছে তাঁর মনোনীত দীন পৌঁছিয়েছেন এবং তাঁর ও বান্দাদের মধ্যকার সরাসরি সম্পর্কের কথাও বলে দিয়েছেন। সত্যিই যদি আল্লাহর পুত্র-কন্যা থাকত –যদিও তিনি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র –তাহলে এদের উপাসনা করতে আমাদের কি ক্ষতি ছিল? কুরআনের বাণীঃ

(আরবী**********************************************************************)

বল (হে মুহাম্মদ)! দয়াময রহমানের যদি কোন পুত্র-সন্তান থাকত তাহলে আমিই সর্বাগ্রে তার ইবাদত করতাম। -সূরা যুখরুফঃ ৮১

স্রষ্টাকে কেন্দ্র কের মুশরিকদের আকীদা-বিশ্বাস একটা ভ্রান্তি, প্রতারণা এবং তাঁর প্রতি অপবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই আবর্ঝনার মধ্যে আমরা নিজেদের কি করে নিক্ষেপ করতে পারি? দুঃখের বিষয়, মানুষ যখন আল্লাহ তাআলার ওপর এই অপবাদ চাপাল এবং তাঁর অংশীদার ও তাঁর দরবারে সুপারিশকারী নির্দিষ্ট করে নির তখন এই ভ্রান্তির পরিণতিতে তারা অনবরত অন্ধকার ও অধঃপতনের অতল গহবরে তলিয়ে গেল। এমনকি শেষ পর্যন্ত তারা আল্লাহকেই ভুলে গেল এবং তাঁকে বাদ দিয়ে যেসব নবী, ওলী-দরবেশ অথবা মূর্তিকে উসিলা বানিয়ে নিয়েছিল তাদের স্মরণেই তারা এখন আনন্দ পেতে লাগল। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************************************************)

যখন একাকী আল্লাহর কথা বলা হয়, তখন আখেরাতের প্রতি বেঈমান লোকদের দিল ছটফট করতে থাকে। আর যখন তাঁকে ছাড়া অন্যদের উল্লেখ করা হয় তখন সহসা তারা আনন্দে হেসে উঠে। -সূরা যুমারঃ ৪৫

এভাবে তাদের মনগড়া মূর্তি ও দালানগুলো সিংহের মত তাদের ইবাদত, ন্যায়নিষ্ঠা, নযর-নিয়াজ, প্রার্থনা, ভালবাসা, বন্ধুত্ব সবকিছুতেই ভাগ বসাল এবং আল্লাহর জন্য এর কিছুই অবশিষ্ট থাকল না। মহান আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী************************************************************************************)

এই লোকেরা আল্লাহর জন্য তাঁর নিজেরই সৃষ্টি করা ক্ষেত-খামারের ফসল এবং গৃহপালিত পশু থেকে একটা অংশ নির্দিষ্ট করেছে। অতএব তারা বলে, এটা আল্লাহর জন্য, -এটা তাদের নিজস্ব ধারণা অনুমান মাত্র –্র এটা আমাদের বানানো শরীকদের জন্য। কিন্তু যে অংশ তাদের বানানো শরীকদের জন্য তা আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না। অথচ যা আল্লাহর জন্য তা তাদের বানানো শরীকদের পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কতইনা খারাপ এই লোকদের ফয়সালা। -সূরা আনআমঃ ১৩৬

হাদীসে কুদসীতে এসেছে, মহান আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী***************************************************************************)

আমার এবং মানুষ ও জিনের ব্যাপারটি কি কম আশ্চর্যজনক! সৃষ্টি করছি আমি আর ইবাদত করা হচ্ছে অন্যের। রিযিক দিচ্ছি আমি আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হচ্ছে অন্যের কাছে।

আকীদা-বিশ্বাসের মধ্যে এই আবর্জনা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, তা মানুষের জীবনযাত্রা ও যাবতীয় কার্যকলাপকে পুতিগন্ধময় করে দিয়েছে। এই বিশ্ব চরাচরে তৌহীদের আলোকপ্রভা দৃষ্টিগোচর হবে না –এর চেয়ে বড় অন্ধত্ব আর কি হতে পারে! আমরা যখন দেখি দুনিয়ার বুকে কত শত জাতি এই শক্তি-সামর্থ্যহীন মূর্তিগুলোর পূজায় ফেঁসে গেছে তখন আমাদের খুবই দুঃখ হয়। অনুরূপভাবে এমন অনেক দেশ রয়েছে যেখানে এই অংশীবাদী খৃষ্টবাদ মজবুতভাবে নিজের শিকড় গেড়ে আছে এবং মানুষ অত্যন্ত নিকৃষ্ট পন্থায় অলীক ধারণা অনুমান ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত হয়ে আছে। মহান আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী*********************************************************)

তাদের অধিকাংশ লোকই আল্লাহর ওপর ঈমান রাখে না, বরং তারা শিরকে লিপ্ত হয়ে আছে। -সূরা ইউসুফঃ ১০৬

একথা দৃঢ়ভাবে বলা যায় যে, এই শিরকের রাজত্বই অথবা এর প্রাধান্যই দুনিয়ার বুকে নাস্তিক্যবাদের জন্ম দিয়েছে। এরই কারণে আল্লাহকে অস্বীকার করার এবং ঈমানের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার দরজা খুলে গেছে।

মূর্তি ও মূর্তিপূজক
মহামহিম আল্লাহ নাদান মুশরিকদের সামনে পরিস্কারভাবে তুলে ধরার ইচ্ছা করলেন যে, তারা যেগুলোর উপাসনা করে তার মর্যাদা কি? অতএব এই কল্পিত মূর্তি বা উপাস্যগুলোকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছেঃ

এক. পাথরের মূর্তি। এ ক্ষেত্রে উপসনাকারীরাই তাদের কল্পিত উপাস্যদরে তুলনায় অধিক শক্তিশালী। কেননা তাদের হাত-পা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবকিছুই আছে। এর সাহায্যে তারা যেকোন কাজ করতে পারে। কিন্তু এই পূজ্য দেবতা? এর কাছে কি আছে?

(আরবী************************************************************************************)

এদের কি পা আছে, যাতে ভর করে এরা চলতে পারে? এদের কি হাত আছে, যার সাহায্যে এরা ধরতে পারে? অথবা এদের কি চোখ আছে, যার সাহায্যে এরা দেখতে পারে? অথবা এদের কি কান আছে, যার সাহায্যে এরা শুনতে পারে? –এদের কাছে এগুলোর কিছুই নেই। -সূরা আরাফঃ ১৯৫

দুই. অথবা মনে করা যাক এই মনগড়া দেবতাগুলোর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অনুভূতিশক্তি আছে। এক্ষেত্রে উপাসনাকারী ও উপাস্য উভয়ই সমান শক্তিশালী। তাহলে এই দেব-দেবীর প্রাধান্য কোথায়? পূজারী ও পূজ্য দেবতা শক্তি-সামর্থ্য ও মর্যাদার দিক থেকে যদি সমকক্ষ হয়ে যায় তাহলে এই খোদায়ীর অবস্থাটা কি হতে পারে?

(আরবী************************************************************************************)

আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদের ডাক তারা তোমাদের মতই বান্দামাত্র। তাদের সম্পর্কে তোমাদের ধারণা যদি সত্যই হয় তাহলে তাদের ডেকে দেখ না তারা তোমাদের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে প্রমাণ করুক। -সূরা আরাফঃ ১৯৪

এটা মানব স্বভাবের সম্পূর্ণ পরিপন্থী যে, সে এমন খেঅদার সামনে মাথা নত করবে –যে তাঁর তুলনায় কম অথবা সমান যোগ্যতাসম্পন্ন। যদি এগুলোকে ডাকা হয় তাহলে শুনবার শক্তি রাখে না, যদি শুনেও থাকে তাহলে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে না।

(আরবী*****************************************************************************************)

যদি তোমরা এদের ডাক তাহলে এরা তোমাদের দোয়া শুনতে পায় না, শুনলেও তোমাদেরকে এরা কোন জবাব দিতে পারে না। কিয়ামতের দিন এরা তোমাদের শিরকী কাজকে প্রত্যাখ্যান করবে। প্রকৃত ব্যাপার সম্পর্কে এমন নির্ভুল খবর একজন ওয়াকিফহাল সত্তা ছাড়া আর কেউই তোমাদের দিতে পারে না। -সূরা ফাতিরঃ ১৪

এজন্য মানব-স্বভাব এ ধরনের ভ্রান্তি এবং অলীক কল্পনা ও কুসংস্কারের মাঝে ঘুরপাক খেতে পারে না। এটা অত্যন্ত নিকৃষ্ট ব্যাপার। কুরআন মজীদে এ সম্পর্কে অসংখ্য দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তি-প্রমাণ পেশ করা হয়েছে, বিবেক-বুদ্ধিকে জাগ্রত করা হয়েছে, মানুষের অনুভূতিকে খোঁচা দিয়ে সজাগ করা হয়েছে –যেন সে শিরকের অন্ধকার কূপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। শিরকের পরিণতি সম্পর্কে কুরআন মজীদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। মানুষ যদি তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে তাঁর স্বভাব-প্রকৃতি শিরকের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়বে। কুরআন অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও তার আবেগ-অনুভূতিকে সম্বোধন করেছেঃ

(আরবী**********************************************************************************)

একাধিক প্রভু উত্তম অথবা একমাত্র পরাক্রমশালী আল্লাহ? –সূরা ইউসুফঃ ৩৯

(আরবী********************************************************************************)

আল্লাহ একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। এক ব্যক্তি তো সেই (গোলাম) যার মালিকানায় বহু সংখ্যক বাঁকা স্বভাবের মনিব শরীক আছে। এরা তাকে স্ব স্ব দিকে টানছে। আর অপর ব্যক্তি পুরোপুরিভাবে একই মনিবের গোলাম। এই দুজনের অবস্থা কি কখনো এক রকম হতে পারে? যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য। কিন্তু অধিকাংশ লোকই অজ্ঞতার মধ্যে পড়ে আছে। -সূরা যুমারঃ ২৯

সত্যকথা এই যে, তৌহীদই হচ্ছে ইসলামের প্রাণ, এর আকীদা-বিশ্বাসের অলংকার এবং এর ইবাদতের মেরুদণ্ড। এই তৌহিদী প্রাণ ইসলামের গোটা শিক্ষার মধ্যে এমনভাবে বিস্তৃত হয়ে আছে যেমন গাছপালা ও লতা-পাতার মধ্যে পানি প্রবহমান রয়েছে এবং দেহের মধ্যে শিরা-উপশিরা ছড়িয়ে আছে।

কুরআন মজীদ তৌহীদের ওপর ব্যাপক আলোচনা করেছে, এর প্রতিটি দিক পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছে এবং যেসব জিনিস তৌহীদের জন্য ক্ষতিকর অথবা তৌহীদের পরিপন্থী, তাও চিহ্নিত করে দিয়েছে। বলতে গেলে ইসলামের শিক্ষায় তৌহীদকে যেভাবে পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে এবং এর পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে –দুনিয়ার আর কোন ধর্মেই তা দেখা যায় না। ইসলাম গোটা বিশ্বের মানুষকে আল্লাহর একনিষ্ঠ ইবাদতে মগ্ন করার চেষ্টা করেছে এবং এমন সব দৃষ্টিভঙ্গী ও ঝোঁক প্রবণতার মূলোচ্ছেদ করেছে যা মানুষকে অন্য জিনিসের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের দিকে আকৃষ্ট করতে পারে। এটা ইসলামের মৌলিক ও প্রধান শিক্ষা। মহান আল্‌লাহ বলেনঃ

(আরবী*************************************************************************************)

বস্তুত যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করেছে, আল্লাহ তার জন্য বেহেশত হারাম করে দিয়েছেন। তার পরিণতি হবে জাহান্নাম। কেউই এসব জালিমের সাহায্যকারী হবে না। -সূরা মাইদাঃ ৭২

একমাত্র আল্লাহই ক্ষতি বা উপকার করার মালিক। অপমানিত বা মর্যাদাবান করার মালিকও তিনি। তিনি যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন এবং যাকে ইচ্ছা বঞ্চিত করেন। তাঁর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কারো আপত্তি করার অধিকার নেই। আসমানের ফেরেশতাই হোক অথবা কোন নবী –তাঁর সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়। আল্লাহর ওলীই হোক অথবা তাঁর দুশমন –কারো ইচ্ছা-বাসনাই আল্লাহর ইচ্ছাকেই পরাভূত করতে পারে না। এজন্য আমাদের সামর্থ্যের বাইরের ব্যাপারসমূহেও কেবল আল্লাহর ওপর ভরসা রাখাও নির্ভেজাল তৌহীদের অন্তর্ভুক্ত। তাঁকেই ভয় করতে হবে, তাঁর কাছেই কোন কিছু পাওয়ার আশা রাখতে হবে।

(আরবী**********************************************************************************)

আল্লাহ কি তাঁর বান্দাদের জন্য যথেষ্ট নন? –সূরা যুমারঃ ৩৬

(আরবী**********************************************************************************)

তাদের বল! তোমরা কি মনে কর, আল্লাহ যদি আমার কোন ক্ষতি করতে চান, তাহলে তোমাদের এই দেবীরা –যাদের তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে ডাকছ –আমাকে তাঁর ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারবে? অথবা আল্লাহ যদি আমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চান, তাহলে এরা কি তাঁর রহমতকে প্রতিরোধ করে রাখতে পারবে। বল, আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট। ভরসাকারী লোকেরা তার ওপরই ভরসা করে। -সূরা যুমারঃ ৩৮

মুমিন ব্যক্তির একটি মাত্র কিবলা, সেদিকেই সে নিজের চেহারা ফিরিয়ে রাখে। এটাই তার আকীদা-বিশ্বাস ও ভালবাসার কেন্দ্রবিন্দু। সেদিকে ফিরেই সে মুনাজাত করে, জীবনের অন্ধকারে এখান থেকেই আলো গ্রহণ করে।

মুমিনের আসল সম্পর্ক হচ্ছে আল্লাহর সাথে। এর ভিত্তিতেই সে লোকদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। যে কোন মুমিনের মধ্যে আশা-নিরাশা, আনন্দ-বেদনা, ভালবাসা-ঘৃণা এবং পশুত্ব ও মনুষ্যত্বের আবেগ জাগ্রত হয়। এই আবেদ তার মনে যতই উত্তেজনা সৃষ্টি করুক –সে সর্বদা আত্মবিশ্বাসের ভিত্তির ওপর মজবুতভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এবং মারিফাতে ইলাহীর আলোকে এই আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে অথবা শক্তিশালী করে। ইমামুল আম্বিয়া মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম তাঁর তাহাজ্জুদের নামাযে নিম্নের দোয়া পাঠ করতেন এবং মুমিনদের মনে এর ভাব-গম্ভীরতা প্রবিষ্ট করাতেনঃ

(আরবী**********************************************************************************)

হে আল্লাহ! আমি নিজেকে তোমার কাছে সমর্পণ করলাম, তোমারই ওপর ঈমান আনলাম, তোমার ওপরই আমার ভরসা, তুমিই আমার প্রত্যাবর্তন স্থল। তোমার জন্যই ঝগড়ায় লিপ্ত হই, তোমারই হাতে আমার ফয়সালা। আমি আগে ও পরে এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে যে অপরাধ করে ফেলেছি তুমি তা মাফ করে দাও। এ সম্পর্কে তুমি আমার চেয়ে অধিক অবগত। সম্মান ও অপমান এবং উন্নতি ও অবনতি তোমারই হাতে। তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই।

এই অনুনয়-বিনয়, আনন্দ ও ভালবাসার এই অস্থিরতা পরিপূর্ণ তৌহীদের নিদর্শন। দেহের শিরা-উপশিরায় যখন তা প্রবাহিত হয় তখন কলব ও আত্মার জগতে জীবনের বসন্ত এসে যায়। মন যদি আবেগশূন্য হয়ে যায়, তাহলে আত্মার অপমৃত্যু ঘটে এবং তা এমনবাবে অন্ধকার আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে, এরপর আর অধিক অন্ধকারের ধারণাই করা যায় না।

আমরা এ জগতে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই। এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাদের মূল্য ও আমাদের বিশেষত্ব পরিস্কারভাবে ফুটে উঠে। যেমন পরীক্ষাগারে রাসায়নিক পরীক্ষার মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য ও তরল পদার্থের বৈশিষ্ট্যসমূহ আমাদের সামনে ভেসে উঠে। এ বিশ্বের অলৌকিক নিদর্শনগুলো সদাসর্বদা আমাদের যেসব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করছে তার মাধ্যমে আমরা ঈমান ও কুফর, নিষ্ঠা ও নিফাক (কপটতা) এবং খাঁটি ও ভেজালের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারি। পবিত্র কুরআনের বাণীঃ

(আরবী*************************************************************************************)

আর আমরা ভাল ও মন্দ অবস্থায় নিক্ষেপ করে তোমাদের সকলের পরীক্ষা করছি। অবশেষে তোমাদের সবাইকে আমাদের কাছেই ফিরে আসতে হবে। -সূরা আম্বিয়াঃ ৩৫

যখন তুমি দেখতে পাও, কোন ব্যক্তি আল্লাহর চেয়ে গায়রুল্লাহকেই অধিক ভালবাসে, তার মধ্যে আল্লাহর ভয়ের তুলনায় মানুষের ভয়ই অধিক প্রবল, তার অন্তর মানুষের প্রতিপালকের তুলনায় মানুষের প্রতিই অধিক আকর্ষণ বোধ করে, তার কার্যকলাপের লক্ষ্য থাকে মানুষকে সন্তুষ্ট করা, আখেরাতের সওয়াব অর্জন করা নয়, তার ওপর কোন বিপদ এসে পড়লে আল্লাহর পরিবর্তে বিশেষ বিশেষ লোককে স্মরণ করে, সে যদি কোন ব্যাপারে সফলকাম হতে পারে তাহলে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরিবর্তে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় –তখন বুঝে নেবে যে, এই ব্যক্তি প্রকাশ্য শিরকে লিপ্ত রয়েছে।

যদিও একদল আলেমের বক্তব্য হচ্ছে, আকীধাগত শিরকের মত কর্মগত শিরক এতটা মারাত্মক হয় –আকীদাগত শিরক যতটা মারাত্মক, কার্যকলাপের মধ্যে সংঘটিত শিরক তার চেয়ে অনেক হালকা প্রকৃতির। কিন্তু ব্যাপারটা তারা যত সহজ মনে করেছেন আসলে তা এত সহজ নয়।

মূলত শিরক হচ্ছে আবর্জনায় পরিপূর্ণ চরম দুর্গন্ধময় একটি কূপ বিশেষ। যখন তা মানুষের অন্তরে প্রবেশ করার সুযোগ পায় তখন তা প্লাবনের চেয়েও দ্রুতগতিতে প্রবাহিত হয় এবং ঈমানের যাবতীয় সৌন্দর্যকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অতঃপর ঈমানের নামগন্ধও অবশিষ্ট থাকে না। তাঁরা যেটাকে হালকা শিরক বলে ব্যাখ্যা করেন তা মারাত্মক শিরকের রূপ ধারণ করে নেয়। ইসলাম এই শিরককে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ সাব্যস্ত করেছে। কবি বলেনঃ

ছোট ছো বিষয়গুলো

জন্ম দেয় বড় বড় বিষয়ের………।

ইসলাম এক যুগে লাত, মানাত ও উযযা নামক দেব-দেবীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। এই যুদ্ধের সম্পর্ক এগুলোর দৈহিক সত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না। এর সাথে ইসলামের কোন ব্যক্তিগত দুশমনী ছিল না। এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার একমাত্র কারণ এই ছিল যে, এই মূর্তিগুলো নিজেদের অনুসারীদের মনে যে মর্যাদার আসন গেড়ে নিয়েছিল তা কেবল অধীনস্থ গোলামরাই তাদের মনিবের জন্য কল্পনা করতে পারে।

অতএব এমন প্রতিটি জিনিস যা মানুষকে খোদার স্মরণ থেকে বিমুখ করে দেয় তা এক একটি প্রতিমা হিসেবে গণ্য হতে পারে। মুশরিকদের অন্তরে প্রাচীন কালের এই মূর্তিগুলোর যে মর্যাদার আসন প্রতিষ্ঠিত ছিল বর্তমানেও কোন জিনিস যদি কোন ব্যক্তির অন্তরে অনুরূপ মর্যাদার আসন পায় তাহলে সেও উল্লিখিত হুকুমের আওতায় পড়বে। এসব লোক তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং তাদেরই সাথে এদের হাশর হবে। এটা কোন আশ্চর্যের কথা নয় যে, কেবল শরাবই হারাম করা হয়নি, বরং নেশা উদ্রেককারী যেকোন ধরনের পানীয়ই হারাম করা হয়েছে। ঈমানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কোন পরিবর্তন হয় না, যদিও যুগে যুগে ঈমান বিধ্বংসী ফিতনার রূপ পরিবর্তন হয়েছে।

তৌহীদের ত্রুটিপূর্ণ আকীদা
আত্মসমর্পণ, ইখলাস, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও আদর্শের দিক থেকে মুসলিম উম্মাহর একটি দৃষ্টান্তমূলক জাতি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমরা অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে লক্ষ্য করছি যে, মুসলমানদের সর্বাধিক সংখ্যক লোক এমন কাজে লিপ্ত রয়েছে যার ফলে চিন্তার জগতে তাদের বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হয়েছে, ধর্মীয় অধঃপতন ঘটেছে, আকীদা-বিশ্বাস বিকৃত হয়ে গেছে এবং কর্মক্ষেত্রে সীরাতে মুস্তাকিম থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে।

এসব কারণ নির্ণয় করতে আমরা কখনো গোপনীয়তার আশ্রয় নিতে চাই না। কেননা তৌহীদের ভিত্তিমূলের কোথাও ফাটল সৃষ্টি হওয়ার অর্থ হচ্ছে, এই সত্যনিষ্ঠ দীনের মধ্যে চিন্তাগত নেতৃত্বের যে মূল কেন্দ্র রয়েছে তা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে থেকে যাওয়া। নিঃসন্দেহে তৌহীদই হচ্ছে ইসলামের রূহ ও প্রাণসত্তা, এর আঙ্গিনা ও স্তম্ভ, এর পথপ্রদর্শক ও গন্তব্যস্থল এবং এর শুরু ও শেষ।

মানুষকে অপবাদ দেওয়ার আমাদের কোন আগ্রহ নেই অথবা কুফরী ফতোয়া দেওয়াও আমাদের অভ্যাস নয়। অবৈধ পন্থায় অপরের অধিকার খর্ব করা আমাদের নীতি নয়। কিন্তু আমাদের সামনে এমন কতগুলো জিনিস রয়েছে যার দাবি এই যে, আমরা একটু থেকে যেন এর মূল্যায়ন করি। এ ব্যাপারে সদুপদেশ দেওয়ার হকটুকু যেন আদায় করি এবং কিতাব ও সুন্নাহর পথ থেকে বিচ্যুতি দেখতে পেলে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষন করি।

মিসরের দিকে যখন সমাজতন্ত্রের সয়লাব আসতে শুরু করল, তখন বৃটিশ সরকারের দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল এবং সে এদেশের ধর্মীয় অবস্থা যাচাই করতে চাইল। সে যখন দেখল, এ বছর তিরিশ লাখ লোক আহমদা বাদাবীর কবর যিয়ারত করতে তানতা গেছে। তখন সে আশ্বস্ত হল। যেসব লোক তাঁর কবর যিয়ারত করতে গেছে, আমি (লেখক) তাদের সম্পর্কে অনবহিত নই। কয়েকবার আমি তাদের সেখানে ওয়াজ-নসিহত করেছি। এ সময় আমি সেখানে এমন সব জঘন্য কাজ হতে দেখেছি যার প্রতিরোধের জন্য কোন হুমকি, তিরস্কার ও মৌখিক সতর্কীকরণই যথেষ্ট ছিল না, বরং বেত্রাঘাতের প্রয়োজনও অনুভূত হয়। এদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ইসলামের মর্যাদা, ধর্মীয় শিষ্টাচার ও শরীআতের আইন-কানুন সম্পর্কে অজ্ঞ।

এদের বাস্তব অবস্থা এই যে, তাদেরকে যদি সঠিক দায়িত্ব পালনের জন্য আহবান করা হয়, তাহলে তারা দ্রুত পলায়ন করবে। কিন্তু তাদেরকে যদি বিদআতের দিকে আহবান করা হয়, তাহলে এরা পঙ্গপালের চেয়েও দ্রুতগতিতে সেদিকে ছুটে আসবে। তাদের অবস্থা এই যে, তারা নিজেদের মানত পুরা করার জন্য এবং নিজেদের আবেদন-নিবেদন পেশ করার জন্য এই কবরের কাছে সমবেত হয়। এই মানত ও আরাধনা কার উদ্দেশ্যে ছিল? প্রথম নম্বরেই সায়্যিদ বাদারীর জন্য ছিল। তাদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হলে তারা বলে, সায়্যিদ বাদাবীর মাধ্যমে তারা এই নযর-নিয়ায মূলত আল্লাহর কাছেই পেশ করছে। এই বিভ্রান্তের মধ্যে যারা অধিক মাত্রায় পথভ্রষ্ট তারা বলে, আমরা আল্লাহকে ভাল করেই চিনি এবং আমরা এও জানি যে, আওলিয়াগণ হচ্ছেন আল্লাহর বান্দা। তাঁরা আমাদের তুলনায় অধিক পাক-পবিত্র ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। তাই আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য তাদেরকে উসিলা হিসেবে গ্রহণ করি মাত্র।

ইসলাদের দৃষ্টিতে এটা ভ্রান্ত কথা তাতে সন্দেহ নেই। আল্লাহ তাআলা আমাদের কাছে কখনো এরূপ দাবি করেননি যে, তোমাদের সাথে আরো কিছু লোক নিয়ে আমার কাছে আস। তারা আমদের কাছে তোমাদের সৎ কাজগুলো জমা দেবে এবং পাপ কাজগুলো মাফ করিয়ে নেবে। মহান আল্লাহর বাণীঃ

(আরবী**************************************************************************)

এরা কি খোদার এমন কিছু শরীক বানিয়ে নিয়েছে, যারা এদের জন্য দীনের মধ্যে কোন আইন-বিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছে –আল্লাহ যার কোন অনুমতি দেননি? –সূরা শূরাঃ ২১

বরং এটা তো ইসলামের একেবারে প্রাথমিক এবং বুনিয়াদী কথার অন্তর্ভুক্ত যে, চাওয়া-পাওয়ার জন্য, নৈকট্য লাভের জন্য সরাসরি আল্লাহর কাছে আবেদন করতে হবে, মধ্যস্থতার কোন প্রয়োজন নেই।

(আরবী****************************************************************)

আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং কেবল তোমার কাছেই সাহায্য চাই। -সূরা ফাতিহা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ

(আরবী**********************************************************************************)

যখন কিছু চাও –সরাসরি আল্লাহর কাছে চাও, আর যখন সাহায্যের প্রয়োজন তখন সরাসরি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও।

এটা কি হাস্যকর কথা নয় যে, আমরা এমন লোকদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করব যারা নিজেরাই সাহায্যের মুখাপেক্ষী এবং এমন লোকদের উসিলা হিসেবে গ্রহণ করব যারা নিজেদের অপরাধ ক্ষমা করানোর জন্য এবং কল্যাণ লাভের আশায় স্বয়ং উসিলা করে বেড়ায়? মহান আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী********************************************************************************)

এরা যাদের ডাকে তারা নিজেরাই তাদের খোদার কাছে পৌঁছবার উসিলা তালাশ করছে যে, কে তাঁর অধিক নিকটবর্তী হয়ে যাবে এবং তারা তাঁর রহমতের প্রত্যাশী ও তাঁর শাস্তিকে ভয়কারী। -সূরা ইসরাঃ ৫৭

মুসলমানের ওপর দিয়ে এমন একটি কাল অতীত হয়েছে যে, তারা মহাসত্যকে ভুলে গেছে। কোন ব্যক্তি যদি কোন সামান্য জিনিস সম্পর্কে অনবহিত থাকে বা কোন মামুলী জিনিসের অনুসরণ করতে সক্ষম না হয়, তাহলে তার ওজন গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কিন্তু সে যদি তার অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলে এবং ঈমানের মহামূল্য সম্পদ সম্পর্কেই বেখবর থাকে, তাহলে এটাই তো কিয়ামত। কুরআনে হাকীমের নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ তৌহীদের সম্পর্কিত এই ভ্রান্তির প্রতিবাদ করেছেঃ

(আরবী*******************************************************************************)

সেদিন (তোমাদের প্রতিপালক) তাদেরকে এবং তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের উপাসনা করেছে –তাদেরকে একত্র করবেন। অতঃপর তিনি জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা কি আমার এই বান্দাদের গোমরাহ করেছ না এরা নিজেরাই পথভ্রষ্ট হয়েছে? তারা বলবে, পবিত্র মহান আপনার সত্তা! আমরা আপনাকে ছাড়া অপর কাউকে আমাদের অভিভাবক প্রভু, বানানো –সেই সাধ্য আমাদের ছিল না। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আপনি এদেরকে এবং এদের পূর্ব-পুরুষদেরকে সম্পর্দের প্রাচুর্য দান করেছিলেন। ফলে তারা আসল শিক্ষা ভুলে গেছে এবং ভাগ্যাহত হয়ে পড়েছে। -সূরা ফুরকানঃ ১৭, ১৮

হ্যাঁ, আসলেই তারা যিকির ভুলে গেছে এবং এদের তারা যিকিরের ভিত্তি তৌহীদকেও ভুলে গেছে। মনে রাখতে হবে এখন প্রতিরোধের জন্য কেবল এতটুকুই যথেষ্ট নয় যে, তারা আল্লাহকে জানে। তারা আরো জানে যে, কেবল আল্লাহ তাআলাই দোয়া কবুল করার ক্ষমতা রাখেন, তিনিই নিয়ামত দানকারী এবং তিনি ছাড়া অন্য যারা রয়েছে তাদের এ ধরনের কোন ক্ষমতা বা এখতিয়ার নেই। তাদের এই জানাটা মোটেই বিবেচনাযোগ্য হবে না যতক্ষণ তারা আল্লাহকে নিজেদের অভিনিবেশের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে না নেবে, একনিষ্ঠভাবে তাঁর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ না করবে এবং দোয়া ও মুনাজাত তাঁরই কাছে না করবে। কেননা প্রাচীনকালের মুশরিকরাও আল্লাহ তাআলাকে এ পরিচয়ে জানত। যেমন কুরআনের বাণীঃ

(আরবী*******************************************************************************)

তাদের কাছে জিজ্ঞেস কর, আসমান ও যমীন থেকে তোমাদের কি রিযিক দান করে? এই শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি কার মালিকানাধীন? নির্জীব নিষ্প্রাণ থেকে কে জীবন্তকে বের করে এবং সজীব থেকে কে নির্জীবকে বের করে? এই বিশ্বের ব্যবস্থাপনা কে পরিচালনা করছে? জবাবে তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। -সূরা ইউনুসঃ ৩১

লক্ষ্য করার বিষয়, তারা পরিস্কার ভাষায় আল্লাহর নাম নিচ্ছে, কিন্তু এই মৌখিক বক্তব্যের ভিত্তিতে তাদেরকে মুমিনদের মধ্যে গণ্য করা হচ্ছে না।

এজন্য যে, তারা যদি বাস্তবিকই আল্লাহকে জানত তাহলে যেসব বৈশিষ্ট্য আল্লাহ তাআলার জন্য নির্দিষ্ট-সে ব্যাপারে তাদের মনে অন্যের ধারণা কেন আসবে? এতটুকু বলেই কুরআন ক্ষান্ত হয়নি, বরং আরো প্রশ্ন রাখছেঃ

(আরবী************************************************************************************)

বল, তাহলে তোমরা (এই মহাসত্যের বিপরীত আচরণ থেকে) কেন বিরত থাক না? এই আল্লাহই তোমাদের প্রকৃত খোদা। তাহলে মহান সত্যের পর সুস্পষ্ট ভ্রান্তি ছাড়া আর কি-ই বা অবশিষ্ট থাকে? তোমাদেরকে কোথায় এবং কোন দিকে ঘোরাফেরা করতে বাধ্য করা হচ্ছে? এরূপ নাফরমানীর নীতি অবলম্বনকারীদের সম্পর্কে তোমার প্রতিপালকের কথা সত্য প্রমাণিত হল যে, তারা মোটেই ঈমান আনবে না। -সূরা ইউনুসঃ ৩১-৩৩

আমাদের জনসাধারণ রীতিবত সফর করে এমন সব কবরের দিকে ছুটে যায়, যার মধ্যে বিগলিত হাড় ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তারা এসব কবরের বাসিন্দাদের আল্লাহর রাজপ্রাসাদের দরজা মনে করে এবং নিজেদের নযর-নিয়ায, আবেদন-নিবেদন নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। নিঃসন্দেহে তারা ইসলামের নামে এসব কাজ করে চরম অপরাধ করে যাচ্ছে। আমরা যে দৃষ্টিকোণ থেকেই তাদের এসব কাণ্ড-কারখানা দেখি না কেন, তার মধ্যে এমন কোন দিক নেই যার ওপর কোন মুমিন ব্যক্তির অন্তর সান্ত্বনা লাভ করতে পারে।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, নেক কাজের প্রতি আকর্ষন এবং পাপ কাজের প্রতি ঘৃণাবোধ ইসলামের নির্দশনের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আকর্ষণ ও ঘৃণার ধরনটা কিরূপ হয়ে থাকে তা কারো গোপন নয়। নেক কাজের প্রতি আকর্ষণের অর্থ হচ্ছে যদি এসব বুযুর্গ লোক জীবিত থেকে থাকেন তাহলে তাদের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা রাখতে হবে, আর যদি মরে গিয়ে থাকেন তাহলে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। খারাপ কাজের প্রতি ঘৃণার অর্থ হচ্ছে –নিকৃষ্ট প্রকৃতির লোকেরা যদি জীবিত থেকে থাকে তাহলে এদেরকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখতে হবে এবং যদি এরা মরে যায় তাহলে এদের প্রতি অভিসম্পাত করতে হবে। আজকাল মুসলমানরা যা করছে –আকর্ষণ ও ঘৃণার অনুভূতির সাথে এর কি কোন সম্পর্ক আছে?

তাদের কারো কারো অবস্থা এই যে, তারা দুষ্কর্মের মধ্যে ডুবে আছে, পিতামাতার জীবিত থাকা অবস্থায়ই তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করছে এবং নিকৃষ্ট লোকেরাই এদের বন্ধু। কিন্তু এরাই যখন নেককার লোকদের কবরের কাছে যায়, তখন এদেরকে খুবই সক্রিয় দেখা যায়। তারা কবরবাসীদের দোয়া করার উদ্দেশ্যে সেখানে যায় না, বরং তাদের কাছে এমন সব পার্থিব সুযোগ-সুবিধ লাভ করার জন্যে প্রার্থনা করতে যায় যে, তারা নিজেরাই যার মুখাপেক্ষী। এটা হচ্ছে সুস্পষ্ট গোমরাহী।

নেককার লোকদের কবরের ওপর ইবাদতখাতা নির্মাণের এই প্রথা প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। কুরআন মজীদ থেকে জানা যায়, পূর্বেকার জাতিসমূহের মধ্যে এই মারাত্মক ব্যাধি সাধারণভাবেই প্রচলিত ছিল। গুহাবাসীগের ঘটনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

(আরবী*************************************************************************************)

তারা বলল, এদের ওপর একটি প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দাও। এদের প্রতিপালকই এদের ব্যাপারটি ভাল জানেন। কিন্তু যেসব লোক কর্তৃত্বের অধিকারী ছিল তারা বলল, আমরা এদের ওপর একটি ইবাদতখানা নির্বাণ করব। -সূরা কাহফঃ ২১

সে যুগে সম্ভবত প্রতিকৃতি নির্মাণের মতই কবরের ওপর ইবাদতখানা নির্মাণ করাও জায়েয ছিল। কেননা তার সাথে তখনো শেরেকী আবেগ সংযুক্ত হয়নি। পরবর্তীকালের লোকেরা গোমরাহীর পথ অনুসরণ করল। যেসব পাথর তারা নিজেদের বুযুর্গ লোকদের নামে খোদাই করেছিল, পরবর্তীকালে সেগুলোই তাদের খোদা হয়ে বসল এবং রীতিমত এগুলোর পূজা উপাসনা হতে লাগল অথবা তাদের ভাষায় এরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হয়ে গেল।

নেককার লোকদের কবরের ওপর তারা যেসব ইবাদতখানা নির্মাণ করেছিল, এর সাথে সম্মান ও পবিত্রতার এমন সব রীতিনীতি সংযুক্ত হল যে, এগুলোও শেষ পর্যন্ত মূর্তির মর্যাদায় উন্নীত হল।

এজন্যই ইসলামের আবির্ভাবের সাথে সাথে সে মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং শিরকের যাবতীয় নিদর্শন চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেওয়ার জন্য জোর তৎপরতা চালায়। কে না জানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে উচ্চ কবর সমতল করে দেওয়ার জন্য এবং মূর্তি ভেঙ্গে চুরমার করে দেওয়ার জন্য এক অভিযানে পাঠিয়েছিলেন। তিনি উচ্চ কবরগুলো এবং বেদীতে স্থাপিত মূর্তিগুলোকে গোমরাহীর দৃষ্টিতে সমান বিবেচনা করেছেন। তিনি পূর্ববর্তী জাতিসমূহের এসব আহাম্মকী কাজের উল্লেখপূর্বক নিজের উম্মাতকে তাদের রাস্তা অবলম্বন করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************************************************)

ইয়াহুদী-খৃষ্টানদের ওপর আল্লার অভিসম্পাত। তারা নিজেদের নবীদের কবরসমূহ সিজদার স্থানে পরিণত করেছে। সাবধান! তোমরা কবরকে মসজিদে পরিণত কর না। আমি তোমাদের তা করতে নিষেধ করছি। -মুসলিম

মৃত্যুপীড়ায় আক্রান্ত অবস্থায় তিনি নিজের মুখমণ্ডল থেকে চাদর সরাতেন আর বারবার এ সম্পর্কে সতর্ক করতেন। পরবর্তীকালে যেসব বিপর্যয় ও বিশৃংখলা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, সে সম্পর্কে খুব সম্ভব তিনি অনুমান করছিলেন। সুতরাং মৃত্যুসয্যায় সেই মুমূর্ষ অবস্থায় তিনি এ দোয়াও করলেনঃ

(আরবী***********************************************************************************)

হে আল্লাহ! আমার মৃত্যুর পরে আমার কবরকে মূর্তিতে পরিণত করো না যে, তার পূজা হবে।

এই পাপ কাজের বিরুদ্ধে ইসলামের এত অধিক সাক্ষ্য-প্রমাণ বর্তমান রয়েছে যে, আমাদের সতর্ক করার জন্য তা যথেষ্ট। তা সত্ত্বেও মুসলমানরা বুযুর্গ লোকদের কবরের ওপর মসজিদ ও মাযার নির্মাণ করতে লাগল। মাযার নির্মাণে তারা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হল। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, এখন কাল্পনিক মাযার নির্মিত হতে লাগল। এমন কত মাযার রয়েছে যা গাছ-পাথর ও জীব-জন্তুর লাশের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে। এখন সেগুলোর এতটা প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যে, মানুষ বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য, রোগমুক্তির জন্য, মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার জন্য এসব কল্পিত মাযারের ওপর মানত ও নযর-নিয়ায চড়াচ্ছে। আমি এসব মাযার ধ্বংসের অভিযান চালিয়ে বিশৃঙ্খলার জন্ম দিতে চাই না।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের ইচ্ছা ছিল কাবা ঘর ভেঙ্গে দিয়ে তা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্থাপত্য রীতি অনুযায়ী পুননির্মাণ করাবেন। কিন্তু আরবের লোকেরা এইমাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছে, এজন্য শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থে নিজের পরিকল্পনা স্থগিত রাখেন। মুসলিম জনগণকে সর্বপ্রথম একান্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা আবশ্যক। ক্রমান্বয়ে তাদেরকে এমনভাবে ইসলামের বিষয়বস্তুর কাছাকাছি নিয়ে আসতে হবে, যাতে তারা নিজেরাই এইসব কবরের কাছে যাওয়া বা এ উদ্দেশ্যে সফর করা পরিত্যাগ করে।

শিক্ষকদের নিষ্ঠা এবং প্রচারকদের বুদ্ধিমত্তা আকীদা-বিশ্বাসের সংশোধন ও চিন্তার পরিশুদ্ধি আনয়নের ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক ভূমিকা রাখতে পারে এবং রেখে আসছেও। কোন কোন লোকের তাওয়াসসূলের (উসিলা) তাৎপর্য অনুধাবনে কিছুটা পেরেশানী আসতে পারে। আমরা তাদের বোঝাতে চেষ্টা করব, আল্লাহর দীনে পূর্ণাঙ্গ ঈমানের সাহায্যে তাওয়াসসূল লাভ করা যেতে পারে, অথবা নেক কাজের মাধ্যমে। হাদীসে এসেছেঃ

(আরবী***********************************************************************************)

হে আল্লাহ! তোমার কাছেই প্রার্থনা করছি। কেননা তুমিই একমাত্র ইলাহ, যিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই; যিনি এক এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ।

তিনি কারো পুত্র নন এবং তাঁরও কেউ পুত্র নয়, তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।

এটা হল ঈমানের মাধ্যমে উসিলা। নেক কাজের মাধ্যমে উসিলা অন্বেষণের দৃষ্টান্ত হচ্ছে সেই হাদীস যাতে তিন ব্যক্তির ঘটনা উল্লেখ আছে। হাদীসটির মর্মার্থ নিম্নরূপঃ

“হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ একদা তিন ব্যক্তি একত্রে কোথাও যাচ্ছিল। হঠাৎ তাদেরকে বৃষ্টিতে পেয়ে বসল। অবশেষে তারা পাহাড়ের একটি গুহায় আশ্রয় নিল। হঠাৎ একটি পাথর গুহার মুখে পতিত হল। ফলে তারা গুহার অভ্যন্তরে আটকে গেল। তারা পরস্পর বলতে লাগল, আমরা নিজেদের জীবনের কৃতকর্মের হিসাব নেই এবং আমাদের প্রত্যেকে যে ভাল কাজ করেছে তার উল্লেখপূর্বক আল্লাহর কাছে দোয়া করি। আশা করা যায় আল্লাহ তাআলা এর উসিলায় আমাদের মুক্তির ব্যবস্থা করবেন।

অতএব তাদের একজন বলল, হে আল্লাহ! আমার পিতামাতা জীবিত ছিলেন এবং তাঁরা ছিলেন খুবই বৃদ্ধ। আমার কয়েকটি ছোট ছোট সন্তানও ছিল। আমি কয়েকটি পশুরও মালিক ছিলাম। দিনের বেলা এগুলো মাঠে চরাতাম, এবং সন্ধাবেলা ফিরিয়ে নিয়ে এসে দুধ দোহন করতাম। আমি প্রথমে পিতামাতাকে দুধ পান করাতাম, অতঃপর নিজের সন্তানদের পান করাতাম। একদিন ঘাসের সন্ধানে পশুগুলো নিয়ে অনেক দূরে চলে গেলাম এবং বাড়ি পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। তখন পিতামাতা ঘুমিয়ে গেছেন। আমি দুধ দোহন করে তাদের শিয়রে নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তাদের ঘুম থেকে তুলে দুধ পান করানোটা ভাল মনে করলাম না এবং আমার সন্তানদের তাদের আগে দুধ পান করানোটাও পছন্দ করলাম না। আমার সন্তানেরা ক্ষুধার জ্বালায় আমার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খেতে থাকে। আমি দুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম এবং এ অবস্থায় ভোর হয়ে গেল। হে আল্লাহ! এটা যদি আমি তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি তাহলে গুহার মুখ থেকে পাথরটি সরিয়ে দাও, যাতে আসমান দেখা যায়। অতএব আল্লাহ তাআলা পাথরটি এতখানি সরিয়ে দিলেন যে, আসমান দেখা গেল।

দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমার এক চাচাতো বোন ছিল। আমি তার প্রেম পিপাসু ছিলাম। আমি তাঁর সাথে মিলিত হওয়ার প্রস্তাব দিলাম। সে একশ স্বর্ণমুদ্রা দাবি করল। আমি অনেক চেষ্টা করে তা সংগ্রহ করে তার কাছে গেলাম। আমি যখন তার দুই উরুর মাঝখানে অবস্থান নিলাম তখন সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় কর। আমার সতীত্ব নষ্ট কর না। আমি তৎক্ষণাৎ তার কাছ থেকে সরে দাঁড়ালাম। হে আল্লাহ! যদি আমি তোমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য এই পাপ কাজ থেকে বিরত হয়ে থাকি তাহলে আমাদের জন্য গুহার মুখ খুলে দাও। অতএব গুহার মুখ কিছুটা খুলে গেল।

তৃতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ, আমি নির্দিষ্ট মজুরীর বিনিময়ে একজন শ্রমিক নিয়োগ করি। সে কাজ শেষ করে মজুরী চাইল। আমি তা হাযির করি। কিন্তু সে তা নিল না। আমি এই মজুরী বিনিয়োগ করে তা বাড়াতে থাকি। তা বৃদ্ধি পেতে পেতে অনেক গরু জমা হল। পরে সে আমার কাছে আবার ফিরে আসে এবং তার পাওনা দাবি করে। আমি তাকে গরুর পাল দিয়ে দিলাম। হে আল্লাহ! আমি যদি তোমার সন্তোষ লাভের আশায় এটা করে থাকি তাহলে আমাদের জন্য গুহার মুখ খুলে দাও। অতএব আল্লাহ তাআলা পাথর সরিয়ে দিলেন এবং তাদরে জন্য গুহার মুখ খুলে গেল।–বুখারী ও মুসলিম থেকে সংক্ষেপিত

কোন ব্যক্তি তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দোয়া করার অর্থেও ‘তাওয়াসসূল’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এক মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের দোয়া সব সময়ই কাম্য। ব্যক্তি বিশেষকে উসিলা বানানোর কোন সুযোগ কুরআনেও নেই এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সুন্নাতেও নেই। সে ব্যক্তি যত মহৎ, যত বড় মর্যাদাসম্পন্ন্‌ হোক না কেন, চাই সে জীবিত হোক অথবা মৃত, কোন অবস্থায়ই থাকে উসিলা বানানো যেতে পারে না।

কিন্তু ব্যক্তি বিশেষকে উসিলা বানানোর প্রথা সাধারণবাবে মুসলমানদের মধ্যে চালু আছে। তারা এটাকে দীনের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত করে নিয়েছে এবং মনে করা হচ্ছে যদি কেউ তা অস্বীকার করে অথবা এ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে তাহলে তাকে সহ্য করা যেতে পারে না।

সর্বসাধারনের মধ্যে তৌহীদের অবস্থা
আমার কছে জনৈক ছাত্র একটি চিঠি পাঠিয়েছে। এর ভাষা ও বিষয়বস্তু উচ্চমানের। যেসব লোক উসিলার প্রবক্তা এই পত্রে তাদের যুক্তি-প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে। তা নিম্নরূপঃ

এক. জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ গুনাহগার। আর আল্লাহ তাআলা মুত্তাকী লোকদের দোয়াই কবুল করে থাকেন। লোকেরা যদি তাদের প্রতিপালকের কাছে যায় এবং তাদের মাথার উপর গুনাহের বোঝা থাকে তাহলে তিনি তাদের প্রার্থনা কবুল করবেন না এবং তাদের প্রতি কোন অনুগ্রহও করবেন না। অতএব লোকদের উচিত তারা যেন গ্রহণযোগ্য কোন উসীলা তালাশ করে। অন্য কথায় তারা যেন কোন ওলী বা বুযুর্গ ব্যক্তিকে উসিলা হিসেবে গ্রহণ করে।

দুই. একথা বলা ঠিক নয় যে, ‘উসিলা’ শিরকের অন্তর্ভুক্ত। কেননা কৃতকর্মের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তকারী জিনিস হচ্ছে নিয়াত। উসিলা গ্রহণকারীদের নিয়াতে কখনো শিরক স্থান পেতে পারে না। তারা তা পছন্দও করে না।

তিন. রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবাগণ, ফিকাহবিদগণ এবং অপরাপর ইমামগণ সবাই নবী-রাসূল ও বুযুর্গ লোকদের উসিরা বানাতেন। হযরত উমার (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের চাচা হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে উসিলা বানিয়েছেন।

চার. দুই ইয়াতীম বালকের ঘরের দেওয়ালের উল্লেখপুর্বক আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে বলেনঃ

(আরবী************************************************************)

তাদের পিতা ছিল নেককার।–সূরা কাহফঃ ৮৩

পত্র লেখকের জিজ্ঞাসা এই যে, এ আয়াত থেকে কি প্রমাণিত হয় না যে, জীবিত ব্যক্তিরা মৃত ব্যক্তিদের ফায়েয লাভ করে থাকে?

অনুরূপভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

(আরবী**************************************************************************************)

তারা যখন নিজেদের ওপর জুলুম করল তখন যদি তারা তোমার কাছে আসত এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমার দোয়া করত। -সূরা নিসাঃ ৬৪

এ আয়াত থেকে কি উসিলা গ্রহণ করা জায়েয প্রমাণিত হয় না?

আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের চিঠিও আমার কাছে এসেছে। এর বিষয়ব্সতু নিম্নরূপঃ

“একজন বিশেষজ্ঞ আলেম বলেছেন, কবরবাসীদের উসিলা বানানো একান্ত অপরিহার্য। কেননা আল্লাহর দরবারে একজন মৃত মানুষের যে প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে, কোন জীবিত মানুষের তা নেই। উসিলা গ্রহণকারী যদি এই আকীদা রাখে যে, আল্লাহ তাআলাই হচ্ছেন সর্বশক্তিমান, তাঁর ইচ্ছায়ই সবকিছু হয়ে থাকে তাহলে এতে দোষের কিছু নেই।

আলেম সাহেব আরো বলেন, যেসব আয়াতের ভিত্তিতে আমরা উসিলার ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করি সেগুলো বিশেষভাবে কাফির-মুশরিকদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (স) এক অন্ধ ব্যক্তিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সে যেন তাঁকে উসীলা বানিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করে। অতএব আল্লাহ তাআলা তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন।

এ হচ্ছে সেই সব যুক্তি একদল লোক যার আশ্রয় নিয়েছে। একে ভিত্তিকে রে তারা এমন সব মতবাদ গড়ে নিয়েছে বা নির্ভেজাল তৌহীদের আলোকে প্রভাবে স্নান করে দিয়েছে। তারা অসংখ্য মুসলমানকে এই ধ্বংসকর জাহিলিয়াতের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আমরা যখনই এই বিষয়বস্তুর ওপর আলোচনা করতে অথবা কিছু লিখতে যাই তখনই আমাদের মধ্যে অবসন্নতা ও নিরুৎসাহ এসে যায়। কেননা হক সম্পূর্ণ উদ্ভাসিত এবং রাস্তা সম্পূর্ণ আলোকিত। তা সত্ত্বেও দীর্ঘকাল ধরে এ নিয়ে নিষ্ফল বিতর্ক চলে আসছে। এখন শুধু এর ধ্বংসাবশেষ বাকি আছে। অতএব লোকদেরকে এই মহাসত্য মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে। সে যাই হোক, এই অবসন্নতা ও নিরুৎসাহ সত্ত্বেও আমরা উল্লেখিত সংশয়ের জবাব দেবঃ

“গুণাহগার ব্যক্তির সরাসরি আল্লাহর দরবারে হাযির হওয়ার অধিকার নেই, এজন্য আল্লাহর দরবারে হাত তোলার পূর্বে কোন বুযুর্গ ব্যক্তিকে সাথে নিতে হবে। এটা এমন একটা কথা –ইসলামে যার কোন ভিত্তি নেই। ইবলীসও সরাসরি আল্লাহরদ দরবারে মুনাজাত করেছিল এবং তার দোয়াও কবুল হয়েছিল। পবিত্র কুরআনের বাণীঃ

(আরবী*******************************************************************************)

শয়তান বলল, হে প্রভু! পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দিন। প্রভু বললেন, ঠিক আছে তোমাকে নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত অবকাশ দেওয়া হল।–সূরা হিজরঃ ৩৬-৩৮

মুশরিকরাও সরাসরি আল্লাহ তাআলার দরবারে দোয়া করেছিল এবং তা কবুল হয়েছিল। কুরআনের বাণীঃ

(আরবী*********************************************************************************)

তারা সকলেই নিজেদের দীনকে আল্লাহর জন্য খালেস করে দিয়ে তাঁর কাছে দোয়া করে –তুমি যদি এই বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা কর তাহলে আমরা কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে থাকব। কিন্তু যখন তিনি তাদের উদ্ধার করেন, তখন তারাই অন্যায়ভাবে যমীনের বুকে বিদ্রোহ করতে শুরু করে। -সূরা ইউনুসঃ ২২-২৩

ইবলীস ও তার সৈন্যরা যে অধিকার লাভ করেছে সেই অধিকারটুকুও কি গুনাহগার মুসলমানরা পেতে পারে না? তারা কি শয়তানের চেয়েও বড় অপরাধী হয়ে গেল? কোন মুসলমানের দ্বারা গুনাহর কাজ সংঘটিত হয়ে গেলে তার কর্তব্য হচ্ছে অনতিবিলিম্বে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। কোন নবী, ওলী, বুযুর্গ ব্যক্তি বা শয়তানের উসিলা দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। মহান আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী**********************************************************************)

আর যাদের অবস্থা এমন যে, তাদের দ্বারা যদি কোন অশ্লীল কাজ সংঘটিত হয় অথবা নিজেদের আত্মার ওপর জুলুম করে বসে –তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া গুনাহ মাফ করতে পারে এমন আর কে আছে? –সূরা আল ইমরানঃ ১৩৫

কোন ব্যক্তির অবস্থা যদি এই হয় যে, তার কোন দোয়াই কবুল হতে পারে না –তাহলে তার জন্য অপর কারো দোয়া কবুল না হওয়াই উচিত।

দোয়াকারী চাই ওলীকুল শিরোমণি, সাইয়েদুল আম্বিয়াই হোন না কেন। দেখছেন না, মুনাফিকের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর জন্য রাসূলুল্লাহ (সঃ) মাগফিরাতের জন্য দোআ করেছিলেন কিন্তু তা কবুল নয়নি।

সাধারণ মুসলমানদের সম্পর্কে বলতে হয়, আল্লাহকে সরাসরি ডাকার অধিকার তাদের রয়েছে, বরং তাঁকে সরাসরি ডাকা তাদের ওপর ফরয। এজন্য অপর কোন সৃষ্টির দিকে ভ্রূক্ষেপও করবে না। তবে একথা সত্য যে, দোয়া কবুল হওয়ার জন্য ইখলাস, আন্তরিক নিষ্ঠা এবং তাকওয়া বর্তমান থাকা শর্ত। কিন্তু এই বিষয়ের সাথে আমাদের কি সম্পর্ক আছে?

তুমি কি মনে কর যদি কোন ব্যক্তির মধ্য থেকে সত্যনিষ্ঠা, আল্লাহ ভীরুতা এবং ঈমানের জোশ নির্বাপিত হয়ে যায় তাহলে কোন জীবিত অথবা মৃত ব্যক্তির কাছে গেলেই কি এর প্রতিকার হয়ে যাবে? এটা হচ্ছে একটা ভ্রান্ত চিন্তাধারা। আল্লাহর দীনের মধ্যে এর কোন সমর্থন নেই। আল্লাহর দীন বরং এর চরম বিরোধী।

দ্বিতীয়ত, কাজের কোন বিবেচনা করা হবে না, বরং এই কাজের পেছনে যে উদ্দেশ্য, যে নিয়াত ক্রিয়াশীল তাই বিবেচনা করা হবে। একথা ঠিক নয়। কেননা দীনের দৃষ্টিতে কোন কাজ গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য তার মধ্যে দুটি বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক। -(১) সৎ উদ্দেশ্য এবং (২) শরীআন অনুমোদিত পন্থায় কাজটির বাস্তব প্রকাশ। -যেকোন কাজের জন্য এ দুটি জিনিস হচ্ছে স্তম্ভ। এ দুটির যেকোন একটির অনুপস্থিতিতে কাজটি বাতিল গণ্য হবে।

কোন কাজের বাহ্যিক দিকটি যদি শরীআতের সাথে সামঞ্স্যপূর্ণ হয়, কিন্তু এর কর্তা যদি প্রদর্শনেচ্ছা বা কপটতার শিকার হয় তাহলে তার সমস্ত পুণ্য নষ্ট হয়ে যাবে। উদ্দেশ্য যদি সৎ হয় কিন্তু কাজের শরীআত অনুমোদিত পন্থা অনুসৃত না হয়, তাহলে এ ধরনের সৎ উদ্দেশ্যের কোন মূল্য নেই এবং এ কাজও গ্রহণযোগ্য নয়।

মানব রচিত আইনের আওতায়ও যদি কোন ব্যক্তি নিষিদ্ধ অথবা আইনের পরিপন্থী কোন কাজ করে বসে, তাহলে তার সৎ উদ্দেশ্যের কোন মূল্যই দেওয়া হয় না। আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা আইন কার্যকর করার পথে বাধার সৃষ্টি করতে পারে না। যদি তাই হত তাহলে নিত্য নতুন কূটকৌশল আইনের মর্যাদা ও উপযোগিতা ধুলিসাৎ করে দিত। তাহলে মানব রচিত আইন যতটুকু মর্যাদার অধিকারী –খোদায়ী আইন কি ততটুকু মর্যাদাও পেতে পারে না? অতএব আমরা কবর পূজারীদের শিরকে লিপ্ত বলে ঘোষণা করতে এতটা সংকোচ বোধ করব কেন? অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বাহ্যাড়ম্বরকেও শিরক বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেনঃ “আল-রিয়া শিরকুন”। কপটতা, প্রদর্শনেচ্ছা ও বাহ্যাড়ম্বর হচ্ছে শিরক।

যেকোন মুসলিম বিশেষজ্ঞ আলিমের কর্তব্য হচ্ছে –তাওয়াসসূল বা উসিলার এই ভ্রান্ত পন্থার প্রতি নিজের ঘৃণা প্রকাশ করা এবং যেসব লোক এই ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে তাদেরকে মহাসত্যের কাছে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। নিজের জ্ঞানবুদ্ধি ও শক্তি-সামর্থ্য এই ভ্রান্তির সমর্থনে তার ব্যয় করা উচিত নয়।

যেসব লোক সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে কুফরীর ফতোয়া ছড়াতে আনন্দ পায় তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু এটা তো জায়েজ হতে পারে না যে, জাহিলিয়াত নির্ভেজাল আকীদা-বিশ্বাসের পোষ্ট মর্টেম করবে আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখব যদি কোন ডাক্তার যক্ষার রোগীর চিকিৎসা করার পরিবর্তে তাকে কেবল সান্ত্বনা দিতে থাকে এবং বলতে থাকে যে, তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছ তাহলে এটা কত বড় অন্যায়। এই পন্থা কখনো অনুমোদনযোগ্য হতে পারে না।

তৃতীয়ত, সাহাবায়ে কিরাম জীবিত এবং মৃত ব্যক্তিদের উসিলা হিসেবে গ্রহণ করতেন। এই বক্তব্য সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, ভিত্তিহীন এবং প্রত্যাখ্যাত। ইমাম শাফিঈ (রঃ)-এর সাথে যে কবিতা সংযুক্ত করা হয়েছে তাও মনগড়া এবং এরও কোন ভিত্তি নেই। আমরা একথা পূর্বে বলে এসেছি যে, যেকোন ব্যক্তি তার নিজের জন্যও দোয়া করবে এবং অপরের জন্যও কল্যাণ কামনা করবে। এটা খুবই পছন্দনীয় কাজ। অতএব কুরআন মজীদের ভাষায় নবী-রাসূল ও নেককার লোকদের মুখ দিয়ে এ ধরনের দোয়াই বের হয়েছে। হযরত ইবরাহীম আলাইহিসসালামের দোয়াঃ

(আরবী******************************************************************)

হে আমার প্রতিপালক হিসাব-নিকাশ নেওয়ার দিন আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং সমস্ত মুমিন লোকদের ক্ষমা করে দিন। -সূরা ইবরাহীমঃ ৪২

হযরত নূহ আলাইহিস সালামের দোয়াঃ

(আরবী*******************************************************************************)

হে আমার প্রতিপালক! আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, আমার পরিবারের মুমিন লোকদের এবং অন্য সব মুমিন পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের ক্ষমা করে দাও। -সূরা নূহঃ ২৮

(আরবী***********************************************************************************)

যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে, হে আমাদের রব। আমাদের ও আমাদেরই সেই ভাইদের ক্ষমা করে দাও যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে।–সূরা হাশরঃ ১০

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামও আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন আমরা যেন একে অপরের জন্য তার অনুপস্থিতিতে দোয়া করি। অতএব এটা অত্যন্ত পছন্দনীয় কাজ যে, আমরা নিজেদের জন্যও আল্লাহর রহমত তালাশ করব এবং এ কাজে পরস্পরকে উৎসাহিত করব। হযরত উমর (রাঃ) হযরত আব্বাস (রাঃ)-এর কাছে মুসলমানদের জন্য দোয়া করার যে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন তার ধরণও ছিল এইরূপ। আব্বাস (রাঃ) দোয়া করছিলেন আর মুসলমানরা তার দোয়ার সাথে সাথে আমীন বলছিল।

যুবাইর ইবনে বাক্কার ‘আল-আনসাব’ নামক গ্রন্থে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর দোয়ার ধরণ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, উমার (রা) আব্বাস (রা) কে বৃষ্টি প্রার্থনা করে দোয়া করতে বলেন। তিনি বললেনঃ

(আরবী****************************************************************************)

হে আল্লাহ! যে গযবই নাযিল হয় তা গুনাহের কারণেই নাযিল হয় এবং তা কেবল তওবা করার মাধ্যমেই দূরীভূত হয়। তোমার নবীর সাথে আমার যে সম্পর্ক বিদ্যমান তার কারণেই এই লোকেরা তোমার দরবারে আমাকে নিয়ে এসেছে। আমরা তোমার দরবারে আমাদের অপরাধী হাত তুললাম এবং তওবার মস্তক অবনত করে দিলাম। অতএব তুমি আমাদের বৃষ্টির মাধ্যমে সিক্ত কর।

এটা কোন জরুরী বিষয় নয় যে, নেককার লোকের সব সময় অপরাধীদের জন্য দোয়া করবে। এটা একটা ভুল ধারণা। বরং বিষয়টি আরো প্রশস্ত। যেমন নবী সাল্লাল্লহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম উমার (রাঃ)-কে তাঁর জন্য দোয়া করতে অনুরোধ করেন। উপরন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) গোটা উম্মাতকে তাঁর জন্য দোয়া করার নিদের্শ দেন। আমরা কি আল্লাহ তাআলার নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর রাসূলের ওপর দরূদ ও সালাম পেশ করি না? অতএব বর্তমানে প্রচলিত উসিলার সাথে যার মধ্যে সাধারণ মুসলমানরা ডুবে রয়েছে –উল্লিখিত উসিলার কোন সম্পর্ক নেই।

চতুর্থত, উসিলার সাথে নিম্নোক্ত আয়াতের কি সম্পর্ক আছে তা আমি বুঝতে অক্ষম।

(আরবী**************************************************************************************)

আর দেওয়ালটির ব্যাপার এই যে, দুইটি ইয়াতীম ছেলে এর মালিক। তারা এই শহরেই বাস করে। এই দেওয়ালের নিচে ছেলে দুটির জন্য একটি সম্পদ গচ্ছিত আছে। এদের পিতা ছিল নেককার লোক। এই কারণে তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলেন, ছেলে দুটি বড় হয়ে তাদের এই গচ্ছিত সম্পদ তুলে নিক। -সূরা কাহফঃ ৮২

(আরবী********************************************************************)

লোকদের ভয় করা উচিত যে, তারা যদি অসহায় সন্তান রেখে দুনিয়া থেকে চলে যায়, তাহলে মৃত্যুর সময় তাদের সন্তানদের সম্পর্কে কত আশংকা তাদের কাতর করে। অতএব তাদের খোদাকে ভয় করা উচিত। -সূরা নিসাঃ ৯

এ আয়াত থেকে জানা যায়, পিতার নেক কাজের প্রভাব সন্তানের ওপরও পতিত হয়, যেমনিভাবে তার অসৎ কাজের ফল তাদেরও ভোগ করতে হয়।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, নেককার লোকদের মৃত্যুর পর তাদের সন্তান ও পরিবার-পরিজন তাদের নেক কাজের কল্যাণ ও বরকত লাভ করে থাকে। আমরা বলি, ‘কখনো’ –কেননা উত্তরাধিকারেরও কতগুলো নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন রয়েছে। এই মহাবিশ্বের প্রতিপালক তা নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু কে যে কার উত্তরাধিকারী হবে তা আমরা কখনো সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারি না। কি আশ্চর্য! এক কট্টর কাফিরের ঔরসে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মত একন মহান নবীর জন্ম হয়। অপরদিকে হযরত নূহের মত একজন মহান নবীর ঔরসে কাফির সন্তান জন্ম নেয়। মহান আল্লাহ নূহ এবং ইবরাহীমের সন্তানদের সম্পর্কে বলেনঃ

(আরবী**********************************************************************)

এই দুই জনের সন্তানদের মধ্যে কেউ তো নেককার আর কেউ নিজের ওপর সুস্পষ্ট জুলুমকারী।–সূরা সাফফাতঃ ১১৩

স্বয়ং এই যুগে কি এমন লোকের অভাব আছে, যারা নবী করীম (স)-এর সাথে নিজেদের বংশসূত্র যোগ করে অথচ তারাই আবার ইসলামের মূলোৎপাটনে সক্রিয়?

অতএব প্রার্থনাকারীর উদ্দেশ্য যদি এই হয় যে, তারা যাদেরকে উসিলা বানিয়েছে সেগুলো বর্তমান যুগের মূর্তি, তাহলে আমরা তাদের বিরোধিতা করছি এবং এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনছি। হযরত হুসায়ন রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন জীবিত ছিলেন তখন নিজের ওপর আপতিত বিপদ দূর করতে সক্ষম হননি। তখন তিনি মৃত্যুর পর কেমন করে অন্যের বিপদ দূর করতে পারেন?

এখন থাকল আল্লাহ তাআলার বাণী “ওয়ালাও আন্নাহুম ইযযালামূ আনফুসাহুম জাউকা”। এ আয়াত থেকে উসিলা ধরা জায়েয প্রমাণিত হয় কিভাবে? উসিলা ধরা জায়েয প্রমাণিত হওয়া তো দূরের কথা, এ প্রতি সামান্য ইঙ্গিতও এ আয়াতে পাওয়া যায় না। আয়াত পরিস্কার বক্তব্য রেখেছে। এখানে ক্ষমার জন্য প্রার্থনা করানোর উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে আসার কথা বলা হয়েছে। আর এটা সুস্পষ্ট যে, তাঁর জীবদ্দশার সাথেই এর সম্পর্ক ছিল, তাঁর মৃত্যুর পরে এ ধরনের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।

এখানে সূফী-দরবেশদের কিছু রহস্যজনক কথাবার্তা প্রসঙ্গক্রমে এসে যায়। যদি তা সত্য হয়ে থাকে তাহলে সেটা তাদের নিজস্ব গণ্ডি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। আল্লাহর দ্বীনে এর কোন গুরুত্ব নেই। ইলসামী শরীআতের উৎস-পরচিতও প্রসিদ্ধ। অমুক সূফী বা দরবেশ এই এই স্বপ্ন দেখেছে; অথবা অমুক মাজযুব (ধ্যানমগ্ন ব্যক্তি) নবী করীম (সঃ)-এর রওযা মুবারক যিয়ারত করার সময় এই এই জিনিস অনুভব করেছে –ইসলামী শরীআতে এর কোনই গুরুত্ব নেই।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমার নিজস্ব কিছু ব্যতিক্রমী অবস্থা ছিল। এটা তাঁর গভীর রাসূল-প্রীতির ফল। যেমন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) সফরের সময় যেখানে যেখানে থেমেছেন আবদুল্লাহ বিন উমর (রাঃ)-ও সেখানে থামতেন এবং কিছু সময় অবস্থান করতেন। তিনি যেকানে যেকানে প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের জন্য বসেছেন আবদুল্লাহ (রাঃ) ও সেখানে গিয়ে বসতেন –তখন যদিও তাঁর প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের দাবী অনুভূত হত না। বিশেষজ্ঞ আলেমগণ এসব কিছুকে ইবন উমর (রাঃ)-এর নিজস্ব অভিরুচি অথবা তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। অন্য কোন ব্যক্তি তা অনুসরণ করতে বাধ্য নয় এবং তা শরীআত হিসেবে বিধিবদ্ধ হওয়ার মর্যাদাও পায়নি।

অতএব কোন ব্যক্তি যদি এ ধরনের কোন ঘটনা বর্ণনা করে যে, সে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-রে রওযা মুবারকে গিয়েছে, সেখানে গিয়ে সালাম করেছে এবং সালামের জবাব শুনতে পেয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাত মুবারকও চুম্বন করেছে –এসব কারামত সে লাভ করেছে; তবে এর দুটি অবস্থা হতে পারে। হয় সে মিথ্যাবাদী যার কথার কোন মূল্য নেই; অথবা সে মাযযুব (অর্ধপাগল), যে তেলেসমাতি রচনা করেছে এবং কল্পনার জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ ধরনের লোকের কথারও কোন গুরুত্ব নেই। এই প্রকারের কিসসা-কাহিনীর ভিত্তিতে আমরা আমাদের মহান প্রতিপালকের কিতাব এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাত পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত নই।

এখন যে ব্যক্তি উসিলা গ্রহণ করা ফরয বলে সাব্যস্ত করে এবং মনে করে যে, জীবিত ব্যক্তির তুলনায় আল্লাহর দরবারে মৃত ব্যক্তিদের অধিক প্রভাব রয়েছে, তার জ্ঞানে দৈন্যতা ও বিশৃংখলা আছে। সে যদি ধারণা করে যে, সমস্ত কাজের কাযী একমাত্র আল্লাহ তাআলা, অতএব শিরকের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। বাস্তবতার সাথে এই ধারণার কোন সম্পর্ক নেই। আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করে এসেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগের মুশরিকরাও এ ধরনের বিশ্বাস রাখত। তাদেরও আকীদা ছিল –সমস্ত কাজের কাযী একমাত্র আল্লাহ। তারা বিভিন্ন দেবদেবীর কাছে যে উদ্দেশ্যে যেত এবং এদেরকে উসিলা বানাত তার কারণটা নিম্নরূপঃ

(আরবী******************************************************************************)

আমরা এজন্যই তাদের পূজা করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর অতি কাছে পৌঁছে দেবে।–সূরা যুমারঃ ৩

কিয়ামতের দিন তারা এ কারণেই অনুতপ্ত হবে যে, তারা সৃষ্টিকে স্রষ্টার জন্য নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের মধ্যে অনুপ্রবেশ করিয়েছে।

(আরবী***********************************************************************************)

আল্লাহর শপথ আমরা সুস্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত ছিলাম যে, আমরা তোমাদেরকে মহাবিশ্বের প্রতিপালকের আসনে সমাসীন করেছিলাম।–সূরা শূআরাঃ ৯৭-৯৮

এ ধরনের অর্থজ্ঞাপক আরো বিশটি আয়াত রয়েছে। এ স্থানে একদল লোক অবশ্যই বলবে, এসব শরীকরা তো এদের পূজা উপাসনা করত। আর আজকের মুসলমানরা তো কেবল দোয়া করে এবং মনোবাসনা পূরণের জন্য প্রার্থনা করে। মুশরিকদের পূজা-উপাসনা এবং মুসলমানদের অলী-দরবেশের উসিলা বানানোর মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।

জবাবে আমরা বলব, এটা একটা ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু নয়। কুরআন ও হাদীস থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, দোয়া এবং ফরিয়াদেও ইবাদতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

(আরবী**************************************************************)

তোমাদের রব বলেন, আমার কাছে দোয়া কর, আমি তোমাদের দোয়া কবুল করব। যেসব লোক গর্ব ও অহংকারে নিমজ্জিত হয়ে আমার ইমবাদত করা থেকে বিমুখ থাকে –তারা অবশ্যই লাঞ্ছিত ও অপমানিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।–[দোয়াই মূল ইবাদত-ইবাদতের প্রাণ হচ্ছে দোয়া –এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য তাফহীমুল কুরআনে সূরা মুমিনের ৮৪ নম্বর টীকা দ্রষ্টব্য।-অনুবাদক] অনন্তর হাদীসে এসেছেঃ

(আরবী********************************************************************************)

দোয়াই ইবাদতের সার।–তিরমিযী

অতএব যেটা উপাস্যের বিশেষত্ব তা নিয়ে আমরা মানুসের কাছে যাব কেন? মুর্খ লোকেরা বোকামী করে এই অনিষ্টের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে থাকলে আমরা দ্রুত তাদেরকে অনিষ্ট থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করব না কেন? আমরা কেবল বসে বসে তাদের বিরুদ্ধে কোন মুখরোচর ফতোয়া প্রণয়ন করব? এ স্থানে অন্ধ ব্যক্তির ঘটনারও বরাত দেওয়া যেতে পারে। সে নবী আলাইহিস সালামকে উসিলা বানিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিল –যেন আল্লাহ তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন।

এই ঘটনাকে সহীহ বলে স্বীকার করে নিলেও এর ওপর উসিলার ব্যাপারটি কিয়াস করা ঠিক হবে না। কেননা এখানে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্নতর। এই অন্ধ ব্যক্তি সরাসরি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিল। আর এই নাদান লোকেরা অন্যের কাছে প্রার্থনার হাত প্রসারিত করে। অনন্তর-উল্লেখিত ঘটনা সম্বলিত হাদীস সহীহ নয়; আর আকীদা-বিশ্বাস এবং হুকুম-আহকাম প্রমাণ করার ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের হাদীস কেবল ওয়ায-নসিহতে এবং কোন কাজের ফযীলত বর্ণনা করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।

কুরআনের আয়াতের ক্ষেত্রে শব্দের সাধারণ প্রয়োগের দিকে লক্ষ্য করতে হবে, বিশেষ কারণ বা উপলক্ষ বিবেচ্য নয়। আল্লাহ তাআলা আরববাসীদের জন্য শিরক হারাম ঘোষণা করেছেন, তা অন্যদের জন্যও হারাম হয়ে গেছে। এ আয়াতগুলো জাহিলী যুগের মুশরিকদের লক্ষ্য করে নাযিল হয়েছে –এরূপ কথা বলা অজ্ঞতা ও মুর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। জ্ঞানবুদ্ধির দৃষ্টিতে এর কোন মূল্য নেই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সত্যিকার তৌহীদের স্বাদ আস্বাদন করান। আমরা যদি বেঁচে থাকি তাহলে এই তৌহীদ নিয়েই যেন বেঁচে থাকতে পারি এবং মরে গেলেও যেন এই তৌহীদ নিয়েই মরতে পারি।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ

(আরবী*******************************************************************************)

কাঁকরময় ভূমির উপর দিয়ে অন্ধকার রাতে পিঁপড়া যেমন সন্তর্পনে অগ্রসর হয় –শিরকও তেমনি নীরবে অনুপ্রবেশ করে। বরং শিরক এর চেয়েও সন্তর্পণে আগমন করে। জুলুমের প্রতি তোমার কিছুটা আকর্ষণ এবং ইনসাফের প্রতি কিছুটা ঘৃণাও সাধারণ পর্যায়ের শিরক। আর আকর্ষণ ও ভালবাসা এবং ঘৃণা ও অসন্তোষই তো হচ্ছে দীন। অতঃপর নবী (সঃ) নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করলেনঃ

(আরবী****************************************************************************************)

হে নবী! লোকদের বল, তোমরা যদি প্রকৃতই আল্লাহকে ভালবেসে থাক তাহলে আমার অনুসরণ কর। আল্লাহও তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়াময়। -সূরা আলে ইমরানঃ ৩১

এ থেকে জানা গেল, ইনসাফের প্রতি আকর্ষণ এবং জুলুমের প্রতি বিকর্ষণও ঈমান ও ইখলাসের দাবির অন্তর্ভুক্ত। এখন যদি কোন ব্যক্তি জালিমের সাথে মহব্বত রাখে এবং ইনসাফের অনুসারী ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তির প্রতি ঘৃণা পোষন করে তাহলে সে শিরকের সীমানার মধ্যে পা রাখল।

অন্তরের পবিত্রতা এবং ভ্রান্ত ঝোঁক প্রবণতার পরিশুদ্ধির ক্ষেত্রে ইসলামের অনুভূতি যদি এতটা তীক্ষ্ণ হয়ে থাকে –তাহলে এটা কেমন করে জায়েয হতে পারে যে, কোন ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া ভিন্ন কোন শক্তির সামনে আহাজারী করছে, তার কাছে প্রার্থনা করছে, তাকে ভয় করছে, তার মাধ্যমেই কিছু পাওয়ার আশা করছে –আর আমরা তার এসব কার্যকলাপ স্বচক্ষে দেখার পরও তাকে বলছি –ঠিক আছে, এতে কোন দোষ নেই?

এক্ষেত্রে একজন আলেমের ভূমিকা এমন হওয়া উচিত নয়, যেমন একজন উকিলের ভূমিকা হয়ে থাকে। তার কাজই হচ্ছে অপরাধীর সাহায্য করা এবং তার পক্ষ সমর্থন করা। সে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে আইনের বিভিন্নরূপ ব্যাখ্যা দিতে থাকে এবং অপরাধীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ খণ্ডন করতে চেষ্টা করতে থাকে।

পক্ষান্তরে একজন মুসলিম আলেমের ভূমিকা এই হওয়া উচিত যে, সে ইষলামের রীতিনীতির সাহায্য ও সমর্থন করবে। যদি তার বক্তব্য অনুযায়ী অপরাধীর শাস্তি হওয়া উচিত নয় –কেননা সে অপরাধ সম্পর্কে অবহিত ছিল না –তাহলে তাকে আল্লাহর দীন শেখাতে হবে। শয়তানের আক্রমণের মুখে তাকে ছেড়ে দেয়া উচিত হবে না।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি