ইসলামী জাতীয়তার তাৎপর্য
বর্তমান যুগে গোটা মুসলিম সমাজের জন্য ‘কওম’ বা জাতি শব্দটি খুব বেশী ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের সামগ্রিক রূপকে বুঝাবার জন্য সাধারণত এ পরিভাষাটিই ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার এই যে, কুরআন হাদীসে ‘কওম’ (জাতি বা Nation অর্থে অন্য কোনো) শব্দকে পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু বর্তমানে কোনো কোনো মহল এ ভ্রান্ত মতের সুযোগে যথেষ্ট সুবিধা লাভ করছে। ইসলাম ‘কওম’ বা জাতি শব্দটি মুসলমানদেরকে বুঝাবার জন্য কেন ব্যবহার করেনি এবং তার পরিবর্তে কুরআন হাদীসে কোন্ শব্দ অধিকতার ব্যবহার করা হয়েছে, এখানে আমি সংক্ষেপে তাই আলোচনা করতে চাই। বস্তুত এটা নিছক কোনো বৈজ্ঞানিক আলোচনা মাত্র নয়, যেসব ধারণা-বিশ্বাস ও মতবাদের দৌলতে জীবনের বিভিন্ন ব্যাপারে আমাদের আচরণ ও কর্মনীতি সম্পূর্ণ ভুলে পরিণত হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই এ ‘কওম’ বা ‘জাতি’ শব্দটির ভুল প্রয়োগের দরুন হয়েছে।

‘কওম’-জাতি এবং ইংরেজী ভাষায় ‘নেশন’ (nation) প্রভৃতি শব্দগুলো প্রকৃতপক্ষে জাহেলী যুগের পরিভাষা। জাহেলী যুগের মানুষ নিছক সাংস্কৃতিক ভিত্তিতে (Caltural Basis) কখনোই জাতীয়তা (Nationality) স্থাপন করেনি-না প্রাচীন বর্বর যুগে, আর না অতি আধুনিক জাহেলী যুগে বংশীয় ও ঐতিহাসিক সম্পর্কের প্রেম তাদের মন-মস্তিষ্কের মধ্যে এমন গভীরভাবে বদ্ধমূল করে দেয়া হয়েছে যে, জাতীয়তা সম্পকীয় ধারণাকে তারা কখনোই মুক্ত করতে সমর্থ হয়নি। প্রাচীন আরবে ‘কওম’ (قوم) শব্দটি যেমন সাধারণভাবে একটি বংশ কিংবা একটি গোত্র সমদ্ভূত লোকদের সম্পর্কেই ব্যবহৃত হতো, বর্তমান যুগে ‘নেশন’ শব্দেও অনুরূপভাবে ‘মিলিত বংশ’ (Common Descent)-এর ধারণা অনিবার্যরূপে বর্তমান রয়েছে। আর এরূপ ধারণা ইসলামী সমাজ দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত বলে কুরআর মজীদে ‘কওম’ এবং অনুরূপ অর্থবোধক আরবী শব্দ-যথা شـــــعب ইত্যাদি। মুসলমানদের জামায়াত বুঝাবার জন্য পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। কারণ, যে জামায়তের সমাজ দর্শনের ভিত্তিমূলে রক্ত, মাটি, মাংসা ও বর্ণগোত্র এবং ঐ ধরণের অন্যান্য কোনো বস্তুরই বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই, সেই জামায়াতের জন্য এ ধরণের পরিভাষা কি করে ব্যবহৃত হতে পারে! এটা সর্বজনবিদিত যে, ইসলামী সমাজ নিছক নীতি, আদর্শ, মতবাদ ও আকীদ-বিশ্বাসের উপরই স্থাপিত হয়েছে এবং হিজরাত-দেশত্যাগ, বংশীয় সম্পর্ক ও জড় সম্বন্ধ কর্তনের মধ্য দিয়েই এ জামায়াতের সূচনা হয়েছে।

কুরআন মজীদে মুসলমানদের সম্পর্কে ‘হিয্ব’ (حــزب) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, এর অর্থ হচ্ছে পার্টি বা দল। জাতি সৃষ্টি হয় বংশ ও গোত্রের ভিত্তিতে আর দল গঠিত হয় আদর্শ, মতবাদ ও নীতির উপর ভিত্তি করে। এজন্য ‘মুসলমান’ মূলত একটি জাতি নয়-একটি দলমাত্র। মুসলমানগণ একটি বিশেষ নীতি ও আদর্শের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী এবং তার অনুসারী বলেই তারা দুনিয়ার অন্যান্য সকল লোক থেকে সম্পূর্ণ স্বত্রন্ত্র এবং এরা ঠিক ঐজন্যই পরস্পর পরস্পরের সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। আর যাদের সাথে এ নীতি আদর্শ মতবাদের দিক দিয়ে তারা যতোই নিকটবর্তী হোক না কেন-তাদের সাথে এদের কোনোই সম্পর্ক হতে পারে না। কুরআন মজীদ ভূ-পৃষ্ঠের এ বিপুল জনতার মধ্যে কেবল দুটি পার্টিরই অস্তিত্ব স্বীকার করেছে : একটি হচ্ছে আল্লাহর দল (حـــزب الله) আর অপরটি হচ্ছে শয়তানের দল (حـــزب الشيطان) শয়তানের দলের পরস্পরের মধ্যে নীতি ও আদর্শের দিক দিয়ে যতোই পার্থক্য ও বিরোধ হোক না কেন, কুরআনের দৃষ্টিতে তা সবই এক। কারণ, তাদের চিন্তা, পদ্ধতি ও কর্মনীতি কোনো দিক দিয়েই ইসলামী নয়। আর খুঁটিনাটি ও ক্ষুদ্র ব্যাপারে মতবিরোধ সত্ত্বেও তারা সকলেই এক শয়তানের পদাংক অনুসরণ করতে সম্পূর্ণরূপে একমত। কুরআন বলছে : اِسْتَحَوَذ عَلَيْهِم الشَّيطَانُ فَاَنْسَاهُمْ ذِكْرَ الله ط اُوْلَــــئِكَ حـــزب الشيطان ط الا اِنَّ حـــزب الشيطانِ هُمُ الخسِرُوْنَ – (المجادلة : ১৯) “শয়তান তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে আছে, ভাষা ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের দিক দিয়ে পরস্পরে যতোই বিভিন্ন হোক না কেন-তাদের পূর্বপুরুষদের পরস্পরের মধ্যে রক্তের শত্রুতা হয়ে থাকলেও-আল্লাহ প্রদত্ত চিন্তা-পদ্ধতি ও জীবন ব্যবস্থায় যখন তারা মিলিত হয়েছে, তখন আল্লাহর কর্তৃত্ব সম্পর্কে তাদেরকে নিবিড়ভাবে পরস্পর সংযুক্ত ও গ্রথিত করে দিয়েছে। এ নতুন দলে দাখিল হওয়ার সাথে সাথেই শয়তানের দলের লোকদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে।

দলের এ পার্থক্য (অনেক সময়) পিতা-পুত্রের সম্পর্কও ছিন্ন করে দেয়। এমনকি, পুত্র পিতার উত্তরাধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়! হাদীসে বলা হয়েছে : لا يتَوَارثُ اهل ملتين – “দুটি পরস্পর বিরোধী ‘মিল্লাতের’ লোক পরস্পরের উত্তরাধিকার লাভ করতে পারে না।”

দলের এ পার্থক্য স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে। এমনকি, এ ‘দলগত বিরোধ’ দেখা দেয়ার সাথে সাথেই পরস্পরের মিলন হারাম হয়ে যায়। এর একমাত্র কারণ এই যে, উভয়ের জীবনের পথ পরস্পরের বিরোধী দিকে চলে গেছে।

কুরআন মজীদে বলা হয়েছে : لأهُنَّ حِلٌّ لَّهُم وَلاَهُم يَهِلُّوْنَ لَهُنَّ ط – (الممتحنة : ১০) “এরা (স্ত্রীগণ) তাদের (পুরুষদের) জন্য হালাল নয়, আর তারা (পুরুষদের)-ও এদের (স্ত্রীদের) জন্য হালাল নয়।”

এ দলীয় পার্থক্য একটি বংশ-একটি গোত্রের মানুষদের মধ্যে পরিপূর্ণ সামাজিক ‘বয়কট’ ও সম্পর্কচ্ছেদের সৃষ্টি করে। এমনকি, নিজ বংশ ও গোত্রের যেসব লোক ‘শয়তানের দলের’ অন্তভূক্ত, আল্লাহর দলের লোকদের পে তাদের সাথে বিবাহ-শাদী করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কুরআন বলেছে : “মুশরিক স্ত্রীলোকদের বিয়ে করো না-যতোক্ষণ না তারা ইসলাম গ্রহণ করে। ঈমানদার ক্রীতদাসী মুশরিক পুরুষদের কাছেও তোমাদের মেয়েদের বিয়ে দিও না।-যতোক্ষণ না তারা ইসলাম কবুল করে। ঈমানদার ক্রীতদাস হলেও মুশরিক স্বাধীন লোক অপেক্ষা অনেক ভাল-যদিও তাদেরকে তোমরা অধিক পছন্দ করো।”

দলের এ পার্থক্য বংশীয় ও আঞ্চলিক ভিত্তিতে গঠিত জাতীয়তার সম্পর্ক কেবল ছিন্নই করে না, উভয়ের মধ্যে এক বিরাট ও স্থায়ী দ্বন্দ্বও সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় পক্ষ যতোক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহর দলের নীতি গ্রহণ করবে, ততোক্ষণ এ দ্বন্দ্ব ও পার্থক্যের আকাশ ছোঁয়া প্রাচীর দাঁড়িয়ে থাকবে।

কুরআনে বলা হয়েছে : قَد كَانَتْ لَكُم اُسوَةٌ حَسَنَةٌ فِى ابراهِيْمَ وَالَّذِيْنَ مَعَه ج اِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ اِنَّا بُرَاءَؤُا مِنْكُم وَمِمِّا تَعبدونَ من دون اللهِ ز كفرنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ العَدَاوَةَ وَالبَغَضَاءُ اَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللهِ وَحْدَهُ اِلاَّ قَوْلَ اِبْرِاهِيْمَ لِاَبِيْهِ لاَ تَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ – (الممتحنة : ৪) “ইবরাহীম এবং তাঁর সাথীদের জীবনে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে। তারা তাদের (বংশীয় সম্পর্কীয়) জাতিকে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছিল যে, তোমাদের তোমাদের উপাস্য ঐসব মাবুদদের (দেবদেবী) সাথে আমাদের কোনোই সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের থেকে সম্পূর্ণ নিঃসম্পর্ক ও বিচ্ছিন্ন। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে এক চিরন্তন শত্রুতার সৃষ্টি হয়েছে-যতোদিন না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। অবশ্য ইবরাহীম যে তাঁর কাফের পিতার মার জন্য দোয়া করবেন বলে ওয়াদা করেছিলেন-তাঁর এ কথায় তোমাদের জন্য কোনো আদর্শ নেই।” -সূরা মুমতাহিনা ঃ ৪ وَمَا كَانَ اِسْتَغفَارُ اِبْرِاهِيْمَ لِاَبِيْهِ اِلاَّ عَنْ مَّوْعِدَّةٍ وَّعَدَهََا اِيِّاهُ ج فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ اَنَّهُ عَدُوٌّلِّلهِ تَبَرَّامِنْهُ – (التوبة : ১১৪) একটি পরিবারের লোকদের এবং নিকটাত্মীয়দের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্ক্র এ দলের পার্থক্য হওয়ার কারণে ছিন্ন হয়ে যায়। এমনকি পিতা, ভাই ও পুত্র যদি শয়তানের দলের অন্তর্ভূক্ত হয়ে থাকে, এবং এটা সত্ত্বেও আল্লাহর দলের লোক যদি তাদের প্রতি ভালবাসা পোষণ করে, তবে তাঁর নিজ দলের সাধে তার গাদ্দারী করা হবে, সন্দেহ নেই। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদ সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছে : لا تجد قومًا يُّؤمنونَ بِاللهِ واليومِ الاخِرِ يُوَادُّونَ من حَادَّ اللهَ وَرَسُلَهُ وَلو كَانوا اباءَ هًُمْ اَوْ اَبنَاءَهُمْ اَوْ اِخْوَانَهُمْ اَوْ عشيرتَهُمْ ط …….. اُولـــئِكَ حزبَ اللهِ ط الا اِنَّ حزبَ اللهِ هُمُ المفلحونَ – (المجادلة : ২২) “কোনো একটߠদল আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়েও আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব করে-এমন (অবস্থা) কখনো (দেখতে) পাবে না। সেই সব লোক তাদের পিতা, পুত্র, ভাই কিংবা কোনো নিকটাত্মীয়ই হোক না কেন। …… বস্তুত উক্ত দলই প্রকৃত সাফল্য লাভ করবে।” -সূরা আল মুজাদালা : ২২

পার্টি বা ‘দল’ অর্থে কুরআন মজীদে অন্য যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তা হচ্ছে উম্মাত। হাদীসেও এ শব্দটির বহুল ব্যবহার হয়েছে। বিশেষ কোনো সংগঠক জিনিস, যা লোকদের একত্রিত করে-যে লোকদের মধ্যে কোনো সর্বসম্মত ঐক্যসূত্র রয়েছে, তাদেরকে সেই সূত্র মূলের দৃষ্টিতেই ‘এক উম্মাত’ বলা হবে। এজন্য বিশেষ কোনো যুগ ও কালের লোকদেরও ‘উম্মাত’ বলা হয়। এক বংশ কিংবা এক দেশের অধিবাসীদের ‘উম্মাত’ নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু যে সর্বসম্মত ঐক্যমূল মুসলমানদেরকে এক উম্মাতে পরিণত করেছে, তা বংশ-গোত্র, জন্মভূমি কিংবা অর্থনৈতিক স্বার্থের ঐক্য নয়, বরং তা হচ্ছে তাদের জীবনের প্রকৃত ‘মিশন’ এবং তাদের দলের আদর্শ ও নীতি। কুরআন মজীদে তাই বলা হয়েছে : كُنتم خَيرَ اُمَّةٍ اُخرِجَت للنَّاس تاْمُرُونَ بالمَعرُوف وَتنهونَ عَنِ المنكرِ وَنؤمنون باللهِ – (১১০) “তোমরা সর্বোত্তম জাতি, মানব জাতির (কল্যাণের) জন্যই তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সত্য ও সৎকাজের নির্দেশ দাও, অন্যায় পাপ থেকে লোকদের বিরত রাখ এবং আল্লাহর প্রতি তোমাদের অচল-অটল বিশ্বাস রয়েছে।”-সূরা আলে ইমরানঃ ১১০

وكذالك جعلناكم اُمَّةً وَّسَطَا لِّتكونوا شهــداءَ على النَّاسِ وَيَكونَ الرَّسُولُ عليكم شَهِيْدًَا ط-(البقرة : ১৪৩) “এরূপেই আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী উম্মাত সৃষ্টি করেছি। উদ্দেশ্য এই যে, তোমরা বিশ্ব-মানবের ‘পথ-প্রদর্শক’ হবে এবং তোমাদের পথ-প্রদর্শক হবেন স্বয়ং রাসূল।” -সূরা বাক্বারা : ১৪৩

এ আয়াতসমূহ সম্পর্কে চিন্তাকরলে সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যায় যে, এখানে ‘উম্মাত’ অর্থ মুসলমান একটি আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন দল (International Party)। একটি বিশেষ নীতি ও আদর্শে বিশ্ববাসী এবং একটি বিশেষ কার্যসূচী অনুযায়ী কাজ করতে ও একটি বিশেষ ‘মিশন’ সম্পন্ন করতে প্রস্তুত লোকদেরকে দুনিয়ার সকল দিক থেকে এনে এ দলে সংঘবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। এরা যেহেতু সকল জাতির মধ্য থেকেই নির্গত হয়ে এসেছে, এ একটি দলের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার কারণে কোনো বিশেষ জাতির সাথে তাদের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক রইলো না-এজন্যই এরা ‘মধ্যবর্তী’ দল নামে অভিহিত হতে পারে। সকল জাতির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর তাদের সাথে এদের এক নতুনতর সম্পর্ক স্থাপিত হবে। তা এই যে, এ মধ্যবর্তী দল দুনিয়ায় আলাহর ফৌজের দায়িত্ব পালন করবে। “তোমরা মানবজাতির উপর পর্যবেক-পথপ্রদর্শক” কথাটি প্রমাণ করে যে, মুসলমানদেরকে দুনিয়ায় আল্লাহর তরফ থেকে সৈনিকের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এবং “মানবজাতির জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে” বাক্যাংশ থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, মুসলমান একটি আন্তর্জাতিক ‘মিশন’ নিয়ে এসেছে। তা এই যে, আলাহ তায়ালার দলের একচ্ছত্র নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে আলাহ তা’য়ালা চিন্তা ও কর্মের যে পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা দিয়েছেন, তাকে সমগ্র মানসিক, নৈতিক ও বৈষয়িক জড়-শক্তির সাহায্যে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং অপর সকল মত ও পথকে পরাজিত করতে হবে। এ দায়িত্ব সমগ্র মুসলমানের উপর অর্পণ করা হয়েছে বলেই তাদের সকলেই একটি উম্মাতে পরিণত হয়েছে।

মুসলমানদের সমষ্টিগত রূপ বুঝাবার জন্য নবী করীম (সা.) তৃতীয় যে পরিভাষাটি ব্যবহার করেছেন, তা হচ্ছে ‘জামায়াত’। এ শব্দটিও ‘হিযব’ (حزب)-এর ন্যায় ‘দল’ অর্থবোধক। عليكم بالجماعة-“দলবদ্ধ হয়ে থাকা তোমাদের কর্তব্য” এবংيَدُ اللهِ على الجماعة “জামায়াতের উপরই হয় আল্লাহর রহমতের হাত” প্রভৃতি হাদীস সম্পর্কে চিন্তা করলে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, নবী করীম (সা.) ইচ্ছা করেই কওম (قوم) বা ‘শোয়েব’ (شعـــب) কিংবা সমার্থবোধক শব্দসমূহ ব্যবহার করেননি এবং তদস্থলে ‘জামায়াত’ পরিভাষাটি ব্যবহার করেছেন। তিনি একথা বলেননি যে, “সবসময় তোমার জাতির সমর্থন করবে” বা “জাতির উপরই আল্লাহর হাত রয়েছে।” সকল অবস্থায়ই তিনি কেবল ‘জামায়াত’ শব্দটিই ব্যবহার করেছেন। এর একমাত্র কারণ এই-এরাই হতে পারে যে, মুসলমানদের সামাজিক রূপ ও বৈশিষ্ট্যের স্বরূপ বুঝাবার জন্য ‘কওম’-এর পরিবের্ত জামায়াত, হিযব ও দল প্রভৃতি শব্দই বিশেষ উপযোগী ও সঠিক ভাব প্রকাশক। জাতি বা ‘কওম’ শব্দটি সাধারণত যে অর্থে ব্যবহৃত হয়, তার দৃষ্টিতে এক ব্যক্তি যে কোনো নীতি ও আদর্শে বিশ্বাসী ও অনুসারী হয়েও জাতির অন্তর্ভূক্ত থাকতে পারে। কারণ সে উক্ত জাতির মধ্যেই জন্মগ্রহণ করেছে। তার নাম, জীবন যাপনের ধরন এবং সামাজিক সম্পর্ক-সম্বন্ধের দিক দিয়ে উক্ত জাতির সাথে সম্বন্ধযুক্ত। কিন্তু পার্টি-দল বা জামায়াত এবং ‘হিযব’ শব্দের অর্থের দিক দিয়ে নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করা না করাই হয় পার্টি বা দলের মধ্যে থাকা বা না থাকার একমাত্র ভিত্তি। ফলে এক ব্যক্তি কোনো দলের নীতি ও আদর্শ ত্যাগ করে কখনই তার মধ্যে গণ্য হতে পারে না-তার নাম পর্যন্ত নিজের সাথে মিলিয়ে ব্যবহার করতে পারে না। এমনকি, দলের অন্যান্য লোকদের সাথেও তার কোনোরূপ সহযোগিতা থাকতে পারে না। যদি কেউ বলে : আমি নিজেও যদি এ দলের নীতি ও আদর্শের সমর্থক নই; কিন্তু আমার পিতামাতা যেহেতু এ দলেরই সদস্য ছিলেন এবং আমার নাম এ দলের লোকদের নামের মতোই; এজন্য দলের সকল লোকদের ন্যায় আমারও অধিকার রয়েছে এবং তা আমার লাভ হওয়া আবশ্যক-তবে একথাটি এতোই হাস্যকর বিবেচিত হবে যে, এটা শুনলে ঐ ব্যক্তির মাথা খারাপ হয়েছে বলে ধারণা হওয়া নিশ্চিত। কিন্তু পার্টির অন্তর্নিহিত এ ধারণা পরিত্যাগ করে করে ‘জাতির’ ধারণা মেনে নিলে এ ধরণের হাস্যোদ্দীপক কার্যকলাপ করার বিরাট অবকাশ থেকে যায়।

ইসলাম তার আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন পার্টির সদস্যদের মধ্যে ঐক্যভাবে এবং সামাজিক সামঞ্জস্য ও অবৈষম্য সৃষ্টির জন্য তাদেরকে একটি সাংগঠনিক সমাজে রূপায়িত করার জন্য-নিজেদের মধ্যেই বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে। সেই সাথে তাদের সন্তান-সন্ততির জন্য এমন দীক্ষার ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দিয়েছে, যার ফলে তারা গোড়া থেকেই দলের আদর্শ ও নীতির অনুসারী হয়ে উঠতে পারবে এবং প্রচারের সাথে সাথে বংশ বৃদ্ধির সাহায্যে দলের শক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। বস্তুত এখান থেকেই এ দল একটি জাতিতে পরিণত হতে শুরু করে। উত্তরকালে সংযুক্ত সামাজিকতা, বংশীয় সম্পর্ক-সম্বন্ধ এবং। ঐতিহাসিক ঐতিহ্য তার জাতীয়তাকে দৃঢ় করে।

এখন পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে-ঠিকই হয়েছে। কিন্তু মুসলমান যে একটি পার্টি এবং পার্টি হওয়ারই উপরই তাদের জাতীয়তার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে-ধীরে ধীরে তারা একথা ভুলে যেতে লাগলো। এ ভ্রান্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে এতোদূর অধোগতি ঘটেছে যে, পার্টি সম্পর্কীয় ধারণার স্থানে জাতি সম্পর্কীয় ধারণা এসে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। অতপর মুসলমান একটি জাতি মাত্র হয়ে রইল-যেমন জার্মান, জাপান একটি জাতি কিংবা ইংরেজ একটি জাতি। ইসলাম যেসব নীতি ও আদর্শের উপর তাদেরকে এক ‘উম্মাত’ রূপে গড়ে তুলেছিল, তাই যে একমাত্র মুল্যমান ও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ জিনিস-বর্তমানে মুসলমান একথা একেবারেই ভুলে বসেছে। যে বিরাট ‘মিশন’কে সুসম্পন্ন করার জন্য ইসলামের অনুসারীদেরকে একটি দলে সংগঠিত করে দেয়া হয়েছিল, তা তারা সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছে। তাদের নিজস্ব সকল মৌলিক তত্ত্ব ভুলে গিয়ে অমুসলিমদের কাছ থেকে জাতীয়তার জাহেলী ধারণা গ্রহণ করেছে। এটা এতোদূর মারাত্মক ও মূলগত ভুল এবং এর দুষ্ট প্রভাব এতো সুদূরপ্রসারী যে, এটা দূর না করে ইসলামকে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোনো প্রচেষ্টাই শুরু করা সম্ভব নয়।

একটি পার্টির সদস্যদের পরস্পরের মধ্যে যে ভালবাসা, সহানুভূতি, ভ্রাতৃভাব ও সহযোগিতার ভাবধারার সৃষ্টি হয়, তা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্পর্কের কারণে নয়, বরং তারা সকলেই এক নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী ও অনুসারী বলেই এটা অনিবার্যরূপে হয়ে থাকে। দলের একজন সদস্য দলের নীতি ও আদর্শ পরিত্যাগ করে কোনো কাজ করলে দলের অন্যান্য লোকদের পক্ষে তারা সাহায্য করা কর্তব্য নয়। শুধু তাই নয়, উপরন্তু তাকে এ বিদ্রোহমূলক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার জন্য চেষ্টা করাই সকলের কর্তব্য হয়। তা সত্ত্বেও যদি সে তা থেকে বিরত না থাকে, তবে দলীয় নিয়ম-শৃংখলা অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হয়। আর তাও ফলপ্রসু না হলে তাকে দল থেকে বহিষ্কৃত করতে হয়। দলীয় আদর্শের প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণ করলে তাকে যে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়-তার উদাহরণও কিছুমাত্র বিরল নয়।

কিন্তু বর্তমান দুনিয়ার মুসলমানদের অবস্থাটা একবার ভেবে দেখুন! তারা নিজেদেরকে ‘পার্টি’ মনে না করে জাতি বলে বুঝছে; এর দরুন তারা কঠিন ভ্রান্তিবোধে নিমজ্জিত হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ নিজের স্বার্থের জন্য ইসলামের বিপরীত নীতি অনুসারে কাজ করলে অন্যান্য মুসলমান তার সাহায্য করবে বলেই সে আশা করতে থাকে। আর তারা সাহায্য না করলে “মুসলমান মুসলমানের কাজে সাহায্য করে না” বলে অভিযোগ করতে শুরু করে। কেউ কারো জন্য সুপারিশ করলে বলে’ একজন মুসলমানের সাহায্য করা দরকার। সাহায্যকারীও একে একটি ইসলামী সহানুভূতি বলে অভিহিত করে। এ সমগ্র ব্যাপারেই শুনতে পাওয়া যায়; প্রত্যেকেরই মুখে ইসলামের কথা-ইসলামী সাহায্য, ইসলামী ভ্রাতৃত্ব এবং ইসলামী সম্পর্ক, কিন্তু কেউই একথা এক নিমিষের তরেও চিন্তা করে না যে, ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে ইসলামের দোহাই দেয়া-ইসলামের নামে সাহায্য প্রার্থনা করা এবং সাহায্য করা-একেবারেই অর্থহীন। বস্তুত যে ইসলামের তারা নাম করে, তা যদি বাস্তবিকই তাদের মধ্যে বর্তমান থেকে তবে তারা ইসলামী জামায়াতের কোনো লোক ইসলামের বিপরীত কাজ করছে শুনতে পেলেই তার বিরোধীতা করতে শুরু করতো এবং তাকে তা থেকে তাওবা করিয়ে ছাড়তো। সাহায্য করা তো দূরের কথা-কোনো জীবনী শক্তি সম্পন্ন ও সচেতন ইসলামী নিয়ম-নীতির বিপরীত কাজ করার সাহসই কারো হতে পারে না। কিন্তু বর্তমানকালের মুসলিম সমাজে দিন-রাত এটাই হচ্ছে। এর একমাত্র কারণ এটাই-এবং এটা ছাড়া আর কিছূই নয় যে, মুসলমানদের মধ্যে জাহেলী জাতীয়তা জেগে উঠেছে। কাজেই আজ যাকে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব বলে অভিহিত করা হয়, মূলত এটা অমুসলিমদের কাছ থেকে ধার করা জাহেলী জাতীয়তার সম্পর্ক ভিন্ন আর কিছুই নয়।

এ জাহেলী ধারণার প্রভাবেই মুসলমানদের মধ্যে ‘জাতীয় স্বার্থ’ সম্পর্কে একটি আশ্চর্য ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। আর মুসলমানগণ তাকেই ইসলামী স্বার্থ নামে অভিহিত করছে। মুসলমান নামে পরিচিত লোকদের উপকার হবে তাদের ধন-সম্পদ লাভ হবে, সম্মান-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাবে, শক্তি ও সামর্থ তারা লাভ করতে পারবে, আর কোনো না কোনো রূপে এ দুনিয়া তাদের জন্য সুকের দুনিয়ায় পরিণত হবে-এটাই হচ্ছে তথাকথিত ইসলামী স্বার্থ। কিন্তু এ স্বার্থ ও উপকারিতা ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী ও আদর্শ অনুসারে অর্জিত হচ্ছে কিংবা তার বিরোধীতা করেই তা লাভ হচ্ছে, সেদিকে মাত্রই লক্ষ্য করা হয় না। সাধারণত জন্মগতভাবে ও মুসলমান পরিবারে প্রসূত লোকদেরকেই ‘মুসলমান’ নামে অভিহিত করা হয়। তার ব্যতিক্রম হয় না বলেই মনে করা হয়। এর অর্থ এই যে, বাহ্যিক দেহকেই ‘মুসলমান’ মনে করা হয়-তার অভ্যন্তরীণ ভাবধারাকে মুসলমান মনে করা হয় না। ফলে ইসলামী বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী ছাড়াও এক ব্যক্তি মুসলমান হতে পারে। এ ভুল ধারণার ফলেই যেসব বাহ্যিক মুসলমানকে মুসলমান বলা হচ্ছে, তাদের হুকুমাতকেও ‘ইসলামী হুকুমাত’ বলেই অভিহিত করা হয়। তাদের উন্নতিকে ইসলামী উন্নতি তাদের স্বার্থকে ইসলামী স্বার্থ বলে ঘোষণা করা হয়। এ হুকুমাত এবং এ স্বার্থ প্রকাশ্যভাবে ইসলামের নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত ধারায় চললেও তাদের কোনো ক্ষতি নেই। জার্মানী হওয়া যেমন কোনো নীতি বা আদর্শ নয়, বরং এটা একটি জাতীয়তার মানমাত্র; এবং একজন জার্মান জাতীয়তাবাদী যেমন কেবল জার্মানের লোকদের উন্নতির জন্যই চেষ্টা করে-তা যে পন্থায়ই হোক না কেন। মুসলমানিত্বকেও অনুরূপ ভাবে একটি জাতীয়তা বলে মনে করা হয়েছে এবং মুসলমান জাতীয়তাবাদী লোকেরা কেবল নিজ জাতিরই প্রতিপত্তি ও উৎকর্ষ লাভের জন্য চেষ্টা করে। এ উন্নতি ও প্রতিপত্তি নীতিগতভাবে এবং কার্যত ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত নীতির অনুসরণের ফলেই লাভ হলেও এদের কাছে আপত্তির কোনো কারণ হয় না-এটা কি জাহেলী ধারণা নয়? মুসলমান যে একটি আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন দল, বিশ্বমানবতার কল্যাণ সাধনের জন্য একটি বিশেষ মতাদর্শ ও বাস্তব কর্মসূচী সহকারেই গণ্য করা হয়েছে-একথা কি আজ প্রকৃতপক্ষে ভুলে যাওয়া হয়নি? উক্ত মতাদর্শ ও কার্যসূচীকে বাদ দিয়ে কোনো মুসলমান ব্যক্তিগত কিংবা সমষ্টিগতভাবে অন্য কোনো মতাদর্শ অনুযায়ী কোনো কাজ করলে তাকে ইসলামী কাজ কিরূপে বলা যেতে পারে? পুঁজিবাদী নিয়মের অনুসারীকে কি কোথাও ‘কমিউনিস্ট’ বলে অভিহিত করা যায়! পুঁজিবাদী সরকারকে কি কখনো কমিউনিস্ট সরকার বলা যায়! ফ্যাসীবাদী প্রতিষ্ঠানকে কখনো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বলা হয়!-পরিভাষাসমূহ এরূপে কেউ ব্যবহার করলে সকলেই তাকে মূর্খ ও অজ্ঞ বলে বিদ্রুপ করবে। অথচ বর্তমান সময় ‘ইসলাম’ ও ‘মুসলমান’ এ পরিভাষা দুটির বিশেষ অপব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু তাকে কেউ ইসলামের বিপরীত বলে ধারণা করে না।

‘মুসলিম’ শব্দটিই প্রমাণ করে যে, এটা কোনো জাতিবাচক শব্দ নয়-বরং এটা গুণবাচক নাম এবং মুসলমানের একমাত্র অর্থ-ইসলামের অনুসারী। এটা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো অর্থ হতে পারে না। এটা মানুষের মধ্যে ইসলামের বিশেষ মানসিক, নৈতিক ও কর্মগত গুণকেই প্রকাশ করে। কাজেই এ শব্দটি মুসলিম, ব্যক্তির জন্য সেভাবে ব্যবহার করা যায় না, যেমন ব্যক্তি-হিন্দু ও ব্যক্তি-জাপানী কিংবা ব্যক্তি-চীনার জন্য হিন্দু, জাপানী অথবা চীনা প্রভৃতি শব্দসমূহ ব্যবহার করা হয়। মুসলমান নামধারী ব্যক্তি যখনি ইসলামের নীতি থেকে বিচ্যুত হয় মুসলমান হওয়ার মর্যাদা তার কাছ থেকে তখনি এবং নিজে নিজেই ছিন্ন হয়ে যায়। অতপর যে যা কিছু করে, ব্যক্তিগত হিসেবেই করে। তখন ইসলামের নাম ব্যবহার করার তার কোনোই অধিকার থাকে না। অনুরূপভাবে ‘মুসলমানের স্বার্থ’ মুসলমানদের উন্নতি রাষ্ট্র ও মন্ত্রিত্ব মুসলমানদের সংগঠন -প্রভৃতি শব্দ ও পরিভাষাসমূহ ঠিক তখনি ব্যবহার করা যেতে পারে, যখন এটা সবই ইসলামের নীতি ও আদর্শ অনুসারে হবে, ইসলামের আসল ‘মিশন’ পূর্ণ করারর দৃষ্টিতে সম্পন্ন হবে। অন্যথায় উল্লিখিত কোনো জিনিসের সাথেই মুসলমান শব্দটি ব্যবহৃত হতে পারে না। কারণ ইসলামের গুণকে বাদ দিয়ে মুসলমান বলতে কোনো জিনিসেরই অস্তিত্ব দুনিয়াতে নেই। কমিউনিজমকে বাদ দিয়ে কোনো ব্যক্তি বা জাতিকেই কমিউনিস্ট বলে অভিহিত করার ধারণাও করা যায় না। এবং এভাবে কোনো স্বার্থকেই কমিউনিস্ট স্বার্থ, কোনো রাষ্ট্রকে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র এবং কোনো সংগঠনকে কমিউনিস্ট সংগঠন বলা যায় না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও মুসলমানদের সম্পর্কে এরূপ ধারণা মানব মনে কেন বদ্ধমুল হয়েছে? ইসলামকে বাদ দিয়েও কোনো ব্যক্তি বা জাতিকে ‘মুসলমান’ বলে কিরূপে অভিহিত করা যায়?

এ ভ্রান্তিবোধই মূলগতভাবে মুসলমানদের তাহযীব, তামাদ্দুন এবং ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভুল আচরণ করা হচ্ছে। ইসলামের বিপরীত নীতি ও আদর্শে প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্র-সরকারসমূহকে ‘ইসলামী হুকুমাত’ বলে অভিহিত করা হয়। শুধু এ জন্যই যে, তার সিংহাসনের উপর মুসলমান নামধারী এক ব্যক্তি আসীন হয়েছে। বাগদাদ, কর্ডোভা, দিলী ও কায়রোর বিলাসী দরবারে যে তাহযীব ও তামাদ্দুন প্রতিপালিত হয়েছিল, আজ তাকেই ইসলামী তাহযীব ও তামাদ্দুন বলে গৌরব করা হয়। অথচ প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলামী তাহযীব সম্পর্কে একজন মুসলমানের কাছে প্রশ্ন করা হলেই অমনি আগ্রার তাজমহল দেখিয়ে দেয়। মনে হয় তাই যেন তার দৃষ্টিতে ইসলামী তাহযীবের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল নিদর্শন। অথচ একটি শবদেহ দাফন করার জন্য অসংখ্য একর জমি স্থায়ীভাবে ঘেরাও করে তার উপর লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতঃ প্রাসাদ তৈরি করা কোনোক্রমেই ইসলামী তাহযীব হতে পারে না।

এরূপে ইসলামী ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের আলোচনা শুরু হলেই আব্বাসীয়, সেলজুকীয় এবং মোগলীয় সম্রাটদের কীর্তি-কাহিনী পেশ করা হয়। অথচ প্রকৃত ইসলামী ইতিহাস-দর্শনের দৃষ্টিতে ঐসব কীর্তি কাহিনীর বেশীর ভাগই গৌরবের বস্তু না হয়ে অপরাধের তালিকায় লিখিত হওয়ার যোগ্য বলে নিরূপিত হবে। মুসলমান রাজা-বাদশাহদের ইতিহাসকে ‘ইসলামী ইতিহাস’ নামে অভিহিত করা হয়। অন্য কথায় রাজা-বাদশাহদের নাম হয়েছে ইসলামের ‘মিশন’ এবং তার মতবাদ ও নিয়ম-নীতির দৃষ্টিতে অতীত ইতিহাসের যাচাই করা এবং সুবিচারের শাণিত মানদণ্ডে ইসলামী কীর্তি ও ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করার পরিবর্তে মুসলমান নামধারী শাসকদের সমর্থন ও প্রতিরোধ করাকেই ইসলামী ইতিহাসের খেদমত মনে করা হয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গী, দৃষ্টিকোণ এবং বিচার পদ্ধতির এ মৌলিক পার্থক্যের একমাত্র কারণ এই যে, মুসলমানদের প্রত্যেকটি জিনিসকেই ‘ইসলামী’ মনে করার একটি স্থায়ী ভ্রান্তিবোধ সকলের মনে বদ্ধমূল হয়ে গেছে। এবং মুসলমান নামে পরিচিত ব্যক্তি ইসলাম বিরোধী নীতি-পদ্ধতিতে কাজ করলেও তার কাজকে মুসলমানের কাজ-তথা ইসলামী কাজ বলে মনে করা হয়।

মুসলমানগণ তাদের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও এ ভুল দৃষ্টিভঙ্গীই গ্রহণ করেছে। ইসলামের নীতি আদর্শ ও মতবাদ এবং তার মিশনকে উপেক্ষা করে-তা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে-একটি জাতিকে মুসলিম জাতি নামে অভিহিত করা হচ্ছে। এ জাতির পক্ষ থেকে কিংবা তার নামে অথবা তার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তি ও প্রত্যেকটি দলই চরম স্বেচ্ছাচারিতা প্রদর্শন করেছে। তাদের মতে মুসলিম জাতির সাথে সম্পর্ক যুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তিই মুসলমানদের প্রতিনিধি-শুধু তাই নয় তাদের নেতাও হতে পারে, ইসলাম সম্পর্কে বেচারা যদি একেবারে অজ্ঞ মূর্খ হয়, তবু কোনো ক্ষতি নেই। কোনো প্রকার উপকারিতা বা স্বার্থ লাভের সম্ভাবনা দেখলেই মুসলমান সকল ব্যক্তি ও দলের পশ্চাতে চলতে প্রস্তুত হয়ে পড়ে-এর মিশন ইসলামের মিশনের সম্পূর্ণ বিপরীত হলেও তারা কোনো দোষের মনে করে না। মুসলমানের জন্য অন্ন সংস্থান হচ্ছে দেখলেই তারা খুশিতে আত্মহারা হয়-ইসলামের দৃষ্টিতে তা হারামের অন্ন হলেও কুন্ঠাবোধ করে না। কোথাও একজন মুসলমানকে ক্ষমতার আসনে আসীন দেখতে পেলেই খুশিতে বুক স্ফীত হয়। সে একজন অমুসলমানের ন্যায় ইসলামের বিপরীত উদ্দেশ্যে সেই ক্ষমতা ব্যবহার করলেও কোনো আপত্তি হয় না। অসংখ্য গায়র-ইসলামী জিনিসকে এখানে ইসলামী ধরে নেয়া হয়েছে। ইসলামের আদর্শ ও সংগঠন নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত নিয়ম-নীতি অনুসারে যেসব দল গঠিত হয়েছে, মুসলমান সেই দলের সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য কোমর বেঁধে দাঁড়ায় এবং এসব উদ্দেশ্য লাভের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে। …..মুসলমানকে নিছক একটি জাতি মনে করা এবং তাদেরকে একটি আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন দল মনে করার কথা ভুলে যাওয়ার দরুনই মুসলমান সম্পর্কীয় মত ও তৎসংক্রান্ত কাজেকর্মে এ অবাঞ্ছিত ভুল দেখা গেছে। মুসলমানদের সম্পর্কে এ ভুল ধারণা দূর করে তাদেরকে একটি আদর্শবাদী দল যতোদিন না মনে করা হবে ততোদিন পর্যন্ত মুসলমানদের জীবনের কোনো কাজেই সঠিক আচরণ হতে পারে না। -তরজামানুল কুরআন, এপ্রিল, ১৯৩৯ ইং


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি