জাতীয়তাবাদ কি কখনো মুক্তি বিধান করতে পারে
মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী দীর্ঘদিন নির্বাসিত জীবন যাপনের পর যখন ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন ‘বঙ্গীয় জমিয়াতে উলাম’র পক্ষ থেকে তার কলিকাতা অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার জন্য তাঁকে আমন্ত্রন জানানো হয়। এ অধিবেশনে তিনি যে ভাষণ দান করেন, তা পাঠ করে ভারতবাসীগণ সর্বপ্রথম তাঁর বিশেষ মতবাদ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হবার সুযোগ পায়। তাঁর ভাষণের যেসব অংশ বিশেষভাবে মুসলমানদেরকে বিক্ষুব্ধ করে দিয়েছে, তা এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছে : এক : “যে বিপ্লব এখন সমগ্র বিশ্বকে গ্রাস করেছে ও প্রত্যেক দিন গ্রাস পেতে চলেছে, তার অপকারিতা ও ক্ষতি থেকে আমার দেশ যদি রক্ষা পেতে চায় তবে তাকে ইউরোপীয় আদর্শের জাতীয়তাবাদকে উন্নতি ও বিকাশ দান করতে হবে। বিগত যুগে আমাদের দেশ যতোখানি সুখ্যাত ছিল, বিশ্ববাসী সে সম্পর্কে তা সুবিদিত রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে জাতিসমূহের মধ্যে নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে পূর্বখ্যাতি থেকে আমরা কিছুমাত্র উপকৃত হতে পারবো না।”

দুই : “আমি সুপারিশ করছি, আমাদের ধর্মীয় ও জাতীয় নের্তৃবৃন্দ বৃটিশ সরকারের দুশত বছর কালীন শাসন আমলের যতোদূর সম্ভব উপকারীতা লাভ করতে চেষ্টা করুন। ইউরোপের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে আমাদের উন্নতিকে যেভাবে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি, এখন আমাদেরকে তা ত্যাগ করতে হবে। এ ব্যাপারে আমি সুলতান মাহমুদ থেকে মোস্তফা কামালের প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র পর্যন্ত তুর্কী জাতির বিপ্লবকে পূর্ণরূপে অধ্যয়ন ও পর্যবেণ করেছি। ইউরোপের আন্তর্জাতিক সম্মেলনসমূহে আমাদের দেশ সম্মানিত সদস্য হিসেবে গণ্য হোক, এটাই আমি কামনা করি। কিন্তু সেজন্য অবশ্য আমাদের সমাজ ক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা বোধ হতে হবে।”

এই সমাজ বিপ্লবের ব্যাখ্যা করে মাওলানা সিন্ধী সিন্ধু প্রদেশের জন্য একটি বিপ্লবাত্মক কার্যসূচী উপস্থাপিত করেন। তিনি বলেন : “সিন্ধুবাসী নিজেদের দেশে উৎপন্ন কাপড় পরিধান করবে; কিন্তু তা কোট ও প্যান্টের আকারে হবে কিংবা কলারধারী শার্ট ও ‘হাফপ্যান্ট’ রূপে। মুসলমানগণ হাটুর নীচ পর্যন্ত দীর্ঘ হাফপ্যান্ট পরিধান করতে পারে। এ উভয় অবস্থায়ই হ্যাট্ ব্যবহার করা হবে। মসজিদে মুসলমানগণ হ্যাট খুলে রেখে নগ্ন মাথায় সালাত আদায় করবে।”

মাওলানা সিন্ধী একজন অভিজ্ঞ ও বিশ্বদর্শী ব্যক্তি। তিনি নিজের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের জন্য কয়েক বছর পর্যন্ত যে বিরাট ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তা থেকে তাঁর ঐকান্তিক আদর্শ-নিষ্ঠারই প্রমাণ পাওয়া যায়। এমতাবস্থায় তিনি যদি আমাদের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার কোনো সমাধান পেশ করেন, তা বাহ্যদৃষ্টিতে যতোই অভিজ্ঞতা ও চিন্তা-গবেষণার ফল হোক না কেন, নিজেদের মনকে সকল প্রকার সন্দেহ-সংশয় থেকে মুক্ত করে তাঁর মতবাদগুলোর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে যাচাই করে দেখাই আমাদের কর্তব্য।

একজন পারদর্শী ও বৃদ্ধিমান ব্যক্তি সদুদ্দেশ্যে যা কিছু বলেন, তার অন্তর্নিহিত ভুলভ্রান্তি তাঁর সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠলে তিনি তা ত্যাগ করতে কুন্ঠিত হবেন না, এটাই আমাদের বিশ্বাস। আর যদি তিনি তা পরিত্যাগ করতে একান্তই প্রস্তুত না হন, তবে বৈজ্ঞানিক সমালোচনার তীব্র আঘাতে এ ভুল মতবাদের মূলোৎপাটন একান্ত অবশ্যক।

সুবিধাবাদের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ
ইউরোপীয় নীতির ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদকে উৎকর্ষ দানের জন্যে ভাষণদাতা যেসব কারণ ও যুক্তি-পরামর্শ দিয়েছেন, তা নিম্নররূপ : এক : গোটা পৃথিবীকে যে বিপ্লবী ভাবধারা আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং আরো গ্রাস করে চলেছে, তা থেকে আমাদের দেশ রা পেতে চাইলে …..” ঐরূপ করতে হবে।

দুই : “আমাদের অতীত কীর্তি ও যশঃগাথা দুনিয়াবাসী জানে বটে; কিন্তু তা থেকে আমরা কিছুমাত্র উপকৃত হতে পারবো না, যদি না বর্তমান জাতিসমূহের মধ্যে আমরা যথাযথ স্থান ও মর্যাদা দখল করে নিতে পারি।”

আর এ স্থান ও মর্যাদা একমাত্র পাশ্চাত্য জাতিসমূহের অনুকরণ করলেই লাভ করা যায়-এটা সুস্পষ্ট কথা। তিন : আমাদের ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীন অধ্যায়-যা হিন্দু-সভ্যতা নামে পরিচিত এবং আধুনিক যুগ-যা ইসলামী সভ্যতা নামে খ্যাত-উভয়েই ধর্মীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে স্থাপিত। কিন্তু আধুনিক ইউরোপীয় মতবাদ ধর্মীয় ভাবধারা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তা কেবল বিজ্ঞান ও দর্শনের ভিত্তিতেই স্থাপিত। কাজেই আমাদের দেশে যদি এ বিপ্লব অনুধাবন করার যোগ্যতা সৃষ্টি না হয়, তাহলে আমাদের ক্ষতিগ্রস্থই হতে হবে।”

এখানে ‘অনুধাবন করার যোগ্যতা’ বলতে খুব সম্ভব গ্রহণ করার কথাই বুঝাতে চেয়েছেন। কেননা বক্তার পূর্বোক্ত সূত্রগুলো তাই প্রমাণ করে।

এ তিনটি কথাই যাচাই ও বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। প্রথমত: একটি জিনিস সত্য কিংবা নীতিগতভাবে গ্রহণযোগ্য বলে তা গ্রহণ করার আহ্বান দেয়া হয়নি, দেয়া হয়েছে অবস্থার গতিতে ও সুবিধাবাদী নীতিতে (Expediency) দরকার বলে। এমতাবস্থায় একজন মুসলমান আদর্শবাদী ব্যক্তির দৃষ্টিতে এ উপমহাদেশের কি মূল্য হতে পারে। অমুক কি ক্ষতি থেকে বাঁচতে হলে এ কাজ করা দরকার, এটা করলে এ স্বার্থ লাভ হবে; কিংবা অমুক জিনিস এখন দুনিয়ায় চলতে পারে না, তার পরিবর্তে ‘এটা’ চালাতে হবে-এরূপ দৃষ্টিভংগী কোনো আদর্শবাদী, নৈতিক ও মতাদর্শশীল কোনো ব্যক্তি গ্রহণ করতে পারে না। এটা নিতান্ত সুবিধাবাদী দৃষ্টিভংগী (Opportunism) ছাড়া আর কিছুই নেই। জ্ঞান-বুদ্ধি ও নীতি-দর্শনের সাথে এর কোনোই সম্পর্ক থাকতে পারে না। একজন নীতিবাদী ও আদর্শানুসারী মানুষ চিন্তা-গবেষণা ও যাচাই-বিশ্লেষণের পর যে মত ও আদর্শ সত্য মনে করে গ্রহণ করবে, সে দৃঢ়তার সাথেই সেই অনুযায়ী কাজ করবে, এটাই একমাত্র সঠিক কর্মনীতি। দুনিয়ার অন্যান্য দেশে কোনো ভ্রান্তনীতি অনুসারে কাজ হতে থাকলে তার পশ্চাদনুগামী না হয়ে নিজ আদর্শের দিকেই গোটা মানব সমাজকে টেনে আনার জন্য চেষ্টা করাই তার কর্তব্য। দুনিয়ার অনুগমন না করলে যদি আমাদের কোনো দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়, তবে তা বিশেষ ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার সাথে বরদাশত করাই বাঞ্ছণীয়। দুনিয়ার পশ্চাতে না চলার কারণেই যদি তার নিকট আমাদের কোনো মর্যাদা স্বীকৃত না হয় তবে এমন দুনিয়ার উপর আমাদের পদাঘাত করাই উচিত। পার্থিব মান ও মর্যাদা আমাদের মাবুদ নয়-প্রভু নয়, তার মনস্তুষ্টির জন্য আমরা যত্র-তত্র ধাবিত হতে পারি না। আমরা যাকে সত্য মনে করি, তার ‘যুগ’ যদি অতীত হয়েও থাকে তবুও আমাদের মধ্যে যুগের ‘কান’ ধরে সত্যের দিকে ফিরিয়ে আনার মতো ব্যক্তিত্ব ও আত্মজ্ঞান বর্তমান থাকা বাঞ্ছণীয়। কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেকে পরিবর্তিত করা কাপুরুষের নীতি হতে পারে, কোনো আদর্শবাদী মানুষের নয়।

এ ব্যাপারে মুসলমানদের অন্ততঃ এতোখানি দৃঢ়তা ও আদর্শবাদীতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা উচিত, যতোখানি কার্লমার্কসের পদাংক অনুসারীরা প্রথম মহাযুদ্ধের সময় দেখিয়েছিল। ১৯১৪ সালে যখন বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ছিল, তখন ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক’ মেম্বরদের মধ্যে এ জাতীয়তাবাদ নিয়ে ভায়ানক মতভেদের সৃষ্টি হয়েছিল। সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক ফ্রন্টে যেসব সোশ্যালিষ্ট কাজ করতো তারা নিজ নিজ জাতিকে যুদ্ধের অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে অন্ধ জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয় এবং তারা সাম্প্রতিক যুদ্ধে নিজ নিজ জাতির পক্ষ সমর্থন করতে ইচ্ছুক হয়। কিন্তু মার্কবাদীরা ঘোষণা করলো যে, আমরা যে আদর্শ (?) নিয়ে লড়াই শুরু করেছি, তার দৃষ্টিতে দুনিয়ার সকল জাতির পুঁজিবাদীরাই আমাদের শত্রু এবং সকল মজুর-শ্রমিকগণ আমাদের বন্ধু, এমতাবস্থায় আমরা জাতীয়তাবাদকে কি করে সমর্থন করতে পারি! কারণ এটা মজুরদেরকে পরস্পর বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন করে পুঁজিবাদীদের সাথে মিলে পরস্পর বিরুদ্ধে লড়াই করতে উব্ধুদ্ধ করে ও এ নীতির ভিত্তিতেই মার্কসবাদীগণ নিজেদের বহু প্রাচীন কমরেডদের সম্পর্ক ত্যাগ করে। অধিকন্তু পাক্কা কমিউনিষ্টগণ নিজ নিজ হাতে এ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের দেবমূর্তিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছিল। জার্মানের কমিউনিস্টগণ নিজেদের আদর্শের জন্য জার্মানীর বিরুদ্ধে, রুশীয় কমিউনিস্টগণ নিজেদের আদর্শের জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে এবং এভাবে প্রত্যেক দেশের কমিউনিস্টগণ নিজেদের আদর্শের জন্য নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কমিউনিস্টদের যেমন একটি মত ও আদর্শ রয়েছে, একজন মুসলমানেরও অনুরূপভাবে একটি মত ও আদর্শ রয়েছে। এমতাবস্থায় ক্ষয়-ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্যে কিংবা কারো নিকট থেকে সামান্য মর্যাদা লাভ করার জন্য সে একজন মুসলমান তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে কেন? ….. সে যদি একান্তই বিচ্যুত হয়-তবে সে কি ত্যাগ করে কি গ্রহণ করতে যাচ্ছে, তা সর্বপ্রথম ভাল করে বুঝে নেয়া তার কর্তব্য। কেননা একটি নীতি পরিত্যাগ করা নিছক দুর্বলতা ছাড়া আর কিছুই নয়; কিন্তু নীতি বিচ্যুত হওয়ার পরও নিজেকে নীতির অনুসারী মনে করা যেমন দুর্বলতা তেমনি অচৈতন্যের লক্ষণও বটে। আমি যতোক্ষণ পর্যন্ত জীবনের প্রত্যেক ব্যাপারে ইসলামী মত ও বিধান অনুসারে কাজ করবো, ঠিক ততোক্ষনই আমি ‘মুসলিম’ থাকতে পারবো। আমি যদি এ মত কখনো পরিত্যাগ করে অন্যকোন মতবাদ গ্রহণ করি, তবে তখনো আমার নিজেকে ‘মুসলমান’ মনে করা মারত্মক অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই নয়। মুসলমান হয়েও অনৈসলামিক মতবাদ গ্রহণ করা সুস্পষ্টভাবে অর্থহীন। ‘জাতীয়তাবাদী মুসলমান ’, ‘কমিউনিস্ট মুসলমান’ প্রভৃতি পরস্পর বিরোধী পরিভাষা-এটা ঠিক ততোখানি ভুল যতোখানি ভুল ‘ফ্যাসিস্ট কামিউনিস্ট’, ‘যৈন-কশাই’ ‘কমিউনিস্ট জমিদার’ ‘তাওহীদবাদী মুশরিক’ ইত্যাদি বলা।

জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম
জাতীয়তাবাদের অর্থ ও তার নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে যারা চিন্তা করবে তারা নিঃসন্দেহে স্বীকার করবে যে, অন্তর্নিহিত ভাবধারা, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যের দৃষ্টিতে ইসলাম এবং জাতীয়তাবাদ পরস্পর বিরোধী দুটি আদর্শ। ইসলাম নির্বিশেষে সমগ্র মানুষকে আহ্বান জানায় মানুষ হিসেবে। সমগ্র মানুষের সামনে ইসলাম একটি আদর্শগত ও বিশ্বাসমূলক নৈতিক বিধান পেশ করে-একটি সুবিচার ও আলাহভীরুমূলক সমাজ ব্যবস্থা উপস্থিত করে এবং নির্বিশেষে সকল মানুষকেই তা গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানায়। অতপর যারাই তা গ্রহণ করে, সমান অধিকার ও মর্যাদা সহকারে তাদের সকলকেই তার গণ্ডীর মধ্যে গ্রহণ করে নেয়। ইসলামের ইবাদত, অর্থনীতি, সমাজ, আইনগত অধিকার ও কর্তব্য ইত্যাদি কোনো কাজেই ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে জাতিগত, বংশগত, ভৌগলিক কিংবা শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টি করে না। ইসলামের চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন একটি বিশ্বরাষ্ট্র (World state) গঠন করা, যাতে মানুষের মধ্যে বংশগত ও জাতিগত হিংসা-বিদ্বেষের সমস্ত শৃংখলা ছিন্ন করে সমগ্র মানুষকে সমান অধিকার লাভের জন্য সমান সুবিধা দিয়ে একটি তামাদ্দুনিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করা হবে। সমাজের লোকদের মধ্যে শত্রুতামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবর্তে পারস্পারিক বন্ধুত্বমূলক সহযোগিতা সৃষ্টি করা হবে। ফলে সকল মানুষ পরস্পরের জন্য বৈষয়িক উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধি লাভ এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে সাহায্যকারী হবে। মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য ইসলাম যে নীতি ও জীবন ব্যবস্থা পেশ করে, সাধারণ মানুষ তা ঠিক তখন গ্রহণ করতে পারে, যখন তার মধ্যে কোনোরূপ জাহেলী ভাবধারা ও হিংসা-বিদ্বেষ বর্তমান থাকবে না। জাতীয় ঐতিহ্যের মায়া, বংশীয় আভিজাত্য ও গৌরবের নেশা, রক্ত এবং মাটির সম্পর্কের অন্ধ মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত করে কেবল মানুষ হিসেবেই তাকে সত্য, সুবিচার, ন্যায় ও সততা যাচাই করতে হবে-একটি শ্রেণী, জাতি বা দেশ হিসেবে নয়, সামগ্রিকভাবে গোটা মানবতার কল্যাণের পথ তাকে সন্ধান করতে হবে।

পক্ষান্তরে জাতীয়তাবাদ মানুষের মধ্যে জাতীয়তার দৃষ্টিতে পার্থক্য সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদের ফলে অনিবার্য রূপে প্রত্যেক জাতির জাতীয়তাবাদী ব্যক্তি নিজ জাতিকে অন্যান্য সমগ্র জাতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর মনে করবে। সে যদি অত্যন্ত হিংসুক জাতীয়তাবাদী (Aggressive Nationalist) না-ও হয়, তবুও নিছক জাতীয়তাবাদী হওয়ার কারণে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইন-কানুনের দিক দিয়ে সে নিজ জাতি ও অপর জাতির মধ্যে পার্থক্য করতে বাধ্য হবে। নিজ জাতির জন্যে যতোদূর সম্ভব অধিক স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধা সংরক্ষণের চেষ্টা করবে। জাতীয় স্বার্থের জন্য অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রাচীর দাঁড় করাতে বাধ্য হবে। উপরন্তু যেসব ঐতিহ্য ও প্রাচীন বিদ্বেষভাবের উপর তার জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত, তার সংরক্ষণের জন্যে এবং নিজের মধ্যে জাতীয় আভিজাত্যবোধ জাগ্রত রাখার জন্য তাকে চেষ্টানুবর্তী হতে হবে। অন্য জাতির লোককে সাম্যনীতির ভিত্তিতে জীবনের কোনো বিভাগেই সে নিজের সাথে শরীক করতে প্রস্তুত হতে পারবে না। তার জাতি যেখানেই অন্যান্য জাতি অপেক্ষা অধিকতর বেশী স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে থাকবে বা লাভ করতে পারবে, সেখানে তার মন ও মস্তিষ্ক থেকে সুবিচারের একটি কথাও ব্যক্ত হবে না। বিশ্বরাষ্ট্রের (World State) পরিবর্তে জাতীয় রাষ্ট্র (National state) প্রতিষ্ঠা করাই হবে তার চরম লক্ষ্য। সে যদি কোনো বিশ্বজনীন মতাদর্শ গ্রহণ করে, তবুও তা নিশ্চিতরূপে সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হবে। কারণ তার রাষ্ট্রে অন্যান্য জাতীয় লোকদেরকে সমান অংশীদার হিসেবে কখনো স্থান দেয়া যেতে পারে না। অবশ্য গোলাম ও দাসানুদাস হিসেবেই তাকে গ্রহণ করা যেতে পারে।

এখানে এ দ্বিবিধ মতবাদের নীতি, উদ্দেশ্য ও অন্তর্নিহিত ভাবধারার সাধারণ আলোচনাই করা হলো। এতোটুকু আলোচনা থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, এ দুটি সম্পূর্ণরূপে পরস্পর বিরোধী। যেখানে জাতীয়তাবাদ হবে, সেখানে ইসলাম কখনোই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। অনুরূপভাবে যেখানে ইসলাম কায়েম হবে, তথায় এ জাতীয়তাবাদ এক মূহুর্তও টিকতে পারে না। জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও উৎকর্ষ হলে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার পথ সেখানে অবরুদ্ধ হবে। আর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে জাতীয়তাবাদের মূল উৎপাটিত হবেই। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তির পক্ষেএকই সময় এ উভয় সময় কেবলমাত্র একটি মতকে গ্রহণ করতে পারে। একজন লোক একই সময় কেবলমাত্র একটি মতকে গ্রহণ করতে পারে। একই সময় এ দুই বিপরীতমুখী নৌকায় আরোহণ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। একটি অনুসরণ করে চলার দাবী করার সাথে সাথেই তার ঠিক বিপরীত আদর্শের সমর্থন, সাহায্য ও পক্ষপাতিত্ব করা মানসিক বিকৃতির পরিচায়ক। যারা এরূপ করছে তাদের সম্পর্কে আমাদেরকে বাধ্য হয়েই বলতে হবে যে, হয় তারা ইসলামকে বুঝতে পারেনি, নয় জাতীয়তাবাদকে, কিংবা এ দুটির মধ্যে কোনোটিকেই তারা সঠিকরূপে অনুধাবন করতে সমর্থ হয়নি।

ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের প্রকৃত অবস্থা
জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক সূত্র সম্পর্কে চিন্তা করলেই যা বুঝতে পারা যায়, উপরে শুধু তারই উল্লেক করা হয়েছে। কিন্তু আমাদেরকে আরো অগ্রসর হয়ে ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদকেও যাচাই করতে হবে।

প্রাচীন জাহেলী যুগে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে লোকদের ধারণা খুব পরিপক্কতা লাভ করতে পারেনি। মানুষ তখনো জাতীয়তাবাদ সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে পারেনি বলে বংশীয় বা গোত্রীয় ভাবধারায়ই অধিকতর নিমজ্জিত ছিল। ফলে সে যুগে জাতীয়তাবাদের নেশায় বড় বড় দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক পর্যন্ত অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরিস্টোটল-এর ন্যায় একজন উচ্চ শ্রেণীর চিন্তাশীল তাঁর Politics গ্রন্থে এ মত প্রকাশ করেছেন যে, অসভ্য ও বর্বর জাতিগুলো গোলামী করার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর মতে এসব মানুষকে গোলাম বানাবার জন্য যুদ্ধ করা অর্থোৎপাদনের অন্যতম উপায়। কিন্তু আমরা যখন দেখি গ্রীকরা সকল অ-গ্রীক লোকদেরকেই ‘বর্বর’ বলে মনে করতো, তখনি এরিস্টোটলের উলিখিত মতের মারাত্মকতা অনুভব করা যায়। কারণ তারা নিশ্চিতরূপে মনে করতো যে, গ্রীসের লোকদের নৈতিক চরিত্র ও মানবিক অধিকার দুনিয়ার অন্যান্য মানুষ অপো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

জাতীয়তাবাদের এ প্রাথমিক বীজই উত্তরকালে ইউরোপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অবশ্য খৃস্টীয় মতবাদ এর অগ্রগতি দীর্ঘকাল পর্যন্ত প্রতিরোধ করে রেখেছিল। একজন নবীর শিক্ষা-তা যতোই বিকৃত হোক না কেন-স্বাভাবিকভাবে গোত্রবাদ ও জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ দৃষ্টির পরিবর্তে বিশাল মানবিক দৃষ্টিভংগীই গ্রহণ করতে পারে। উপরন্তু রোমান সাম্রাজ্যবাদের সর্বাত্মক রাষ্ট্রনীতি বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিকে একটি মিলিত কেন্দ্রিয় শক্তির অধীন ও অনুসারী করে দিয়েছিল বলে জাতীয় ও গোত্রীয় হিংসা-বিদ্বেষের তীব্রতা অনেকখানি হ্রাস করে দিয়েছিল। এভাবে কয়েক শতাব্দীকাল পর্যন্ত পোপের আধ্যাত্মিক এবং সম্রাটের রাজনৈতিক প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব পরস্পর মিলে খৃস্টান জগতকে নিবিড়ভাবে যুক্ত রেখেছিল। কিন্তু এ উভয় শক্তিই অত্যাচার-নিষ্পেষণ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরোধীতায় পরস্পরের সাহায্য করতো। পার্থিব মতা-ইখতিয়ার ও বৈষয়িক স্বার্থ বন্টনের ব্যাপারে এরা পরস্পরের শত্রুতায় লিপ্ত ছিল। একদিকে তাদের পারস্পারিক দ্বন্দ্ব সংগ্রাম, অন্যদিকে তাদের অসৎ কার্যকলাপ ও জুলুম নিষ্পেষণ এবং তৃতীয় দিকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক নবজাগরণ ষষ্ঠ শতাব্দীতে একটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম দেয়। এ আন্দোলনকে ‘সংশোধনের আন্দোলন’ নামে অভিহিত করা হয়।

এ আন্দোলনের ফলে পোপ ও সম্রাটের প্রগতি ও সংশোধন বিরোধী শক্তির সমাপ্তি ঘটেছিল। কিন্তু অন্যদিকে এ ক্ষতিও হলো যে, এর দরুন একই সূত্রে গ্রথিত বিভিন্ন জাতি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো। সংশোধনী (Reformation) আন্দোলন বিভিন্ন খৃস্টান জাতির এ আধ্যাত্মিক সম্পর্কের মধ্যস্থিত কোনো বিকল্প পেশ করতে পারলো না। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ঐক্য এবং সংহতি চূর্ণ হওয়ার পর জাতিগুলো যখন পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো, তখন তারা বিক্ষিপ্তভাবেই নিজেদের স্বতন্ত্র জাতীয় রাষ্ট্র গঠন করতে লাগলো। প্রত্যেক জাতির ভাষা ও সাহিত্য স্বতন্ত্রভাবে উৎকর্ষ লাভ করতে লাগলো। প্রত্যেক জাতির অর্থনৈতিক স্বার্থ অন্যান্য প্রতিবেশী জাতি থেকে বিভিন্ন হয়ে দেখতে লাগলো। এভাবে বংশীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও তামাদ্দুনিক ভিত্তিতে নতুন জাতীয়তা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে শুরু করলো। এটা বংশীয় আভিজাত্যবোধ ও হিংসা-বিদ্বেষর স্থান অধিকার করতে লাগলো। অতঃপর বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পারিক দ্বন্দ্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা (Competition) মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো। যুদ্ধ ও সংগ্রাম বাধতে শুরু করলো। একজাতি অন্য জাতির স্বার্থে দ্বিধাহীনচিত্তে আঘাত হানতে শুরু করলো। অত্যাচার-নিষ্পেষণের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে থাকলো। এর ফলে জাতীয়তা সম্পর্কীয় ভাবধারার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে থাকলো। এর ফলে জাতীয়তা সম্পর্কীয় ভাবধারার মধ্যে তিক্ততা তীব্রতর হতে লাগলো। এভাবে জাতীয়তাবোধ (sence of Nationality) ‘জাতীয়তাবাদে’ (Nationlism) পরিণত হলো।

ইউরোপে এই যে, জাতীয়তাবাদের ও উৎকর্ষ ও বিকাশ ঘটলো, প্রতিবেশী জাতিগুলোর সাথে প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষ সৃষ্টির পরই তা হয়েছিল বলে তাতে অবশ্যম্ভবীরূপে নিম্মলিখিত চারটি ভাবধারা শামিল হয়েছে : এক : জাতীয় আভিজাত্য গৌরব। এর দরুন একজন লোক নিজের জাতীয় ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যের অন্ধ পূজারী হয়ে পড়ে। অন্যান্য জাতি অপেক্ষা নিজ জাতিকে সর্বতোভাবে উচ্চ, উন্নত ও শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতে শুরু করে। দুই : জাতীয় অহমিকা। এর দরুন মানুষকে ন্যায়-অন্যায়ের উর্ধে উঠে সকল অবস্থায় নিজ জাতিকেই সমর্থন করে যেতে হয়। তিন : জাতীয় সংরক্ষণের ভাবধারা। এটা জাতির প্রকৃত ও কাল্পনিক স্বার্থ সংরণের জন্য জাতিকে দেশরা থেকে শুরু করে পররাজ্য আক্রমণ করা পর্যন্ত অনেক কাজ করতে বাধ্য করে। অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আমদানী রফতানী শুল্ক হ্রাস-বৃদ্ধি করা, অপর জাতির লোকদের অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা, নিজ দেশের চতুঃসীমার মধ্যে অন্য জাতির লোকদের জন্য রুজী-রোজগার ও নাগরিক অধিকার লাভ করার পথ বন্ধ করা, দেশ রার জন্য অত্যাধিক পরিমাণ সামরিক শক্তি অর্জন করতে চেষ্টা করা এবং নিজ দেশ ও জাতির সংরণের জন্য অপর রাজ্যে গমন করা একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়ে। চার : জাতীয় অহংকার ও শ্রেষ্ঠত্ববোধ (National Aggrandisment) এটা প্রত্যেক উন্নতিশীল ও শক্তিসম্পন্ন জাতির মধ্যে দুনিয়ার অন্যান্য জাতির উপর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য লাভের ভাবধারা জাগ্রত করে। অন্য জাতির অর্থ ব্যয় করে নিজের সমৃদ্ধি বিধানে সচেষ্ট করে। অনুন্নত জাতি-গুলোর মধ্যে সভ্যতা-সংস্কৃতি বিস্তারের কাজে নিজেকে দায়ী বলে মনে করে এবং অন্যান্য দেশের প্রাকৃতিক সম্পদরাজি ভোগ করার তার জন্মগত অধিকার রয়েছে মনে করে শক্তিশালী জাতি দুর্বল জাতিদের শোষণ করে।

ইউরোপের এ জাতীয়তাবাদের নেশায় মত্ত হয়েই কেউ ঘোষণা করে “জার্মানী সকলের উপর” কেউ দাবী করে “আমেরিকা খোদার নিজের দেশ।” কেউ বলে “ইটালীবাসী হওয়াই ধর্মের মূলকথা।” কারো মুখে এ ঘোষণা শ্রুত হয় যে, “শাসন করার জন্মগত অধিকার একমাত্র বৃটিশের।” এভাবে প্রত্যেক জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিই একটি ধর্মমতের ন্যায় এ মত পোষণ করে- “আমার দেশ-ন্যায় করুক, কি অন্যায়” (My country Wrong or right)। বস্তুত জাতীয়তাবাদের এ উন্মাদনা বর্তমান দুনিয়ার মানবতাকে নির্মমভাবে অভিশপ্ত করেছে। এটা মানব সভ্যতার পক্ষে সর্বাপেক্ষা অধিক মারাত্মক। এটা মানুষকে নিজ জাতি ছাড়া অন্যান্য লোকদের পক্ষে হিংস্র পশুতে পরিণত করছে।

শুধু নিজ জাতির প্রতি ভালবাসা পোষণ করা এবং তাকে স্বাধীন, সমৃদ্ধ এবং উন্নতমীল দেখার প্রত্যাশী হওয়াকেই জাতীয়তাবাদ বলা হয় না। কেননা মূলত এটা এক পবিত্র ভাবধারা সন্দেহ নেই। প্রকৃতপক্ষে নিজ জাতিকে ভালবাসা নয়-বিজাতির প্রতি শত্রুতা, ঘৃণা, হিংসা-দ্বেষ ও প্রতিশোধ নেয়ার আক্রোশই এ জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করে এবং এটাই তা লালন-পালন করে। জাতীয়তাবাদের আক্রমণে আহত মনোভাব ও নিষ্পেষিত জাতীয় উন্মাদনা মানুষের মনে এক প্রকার আগুন জ্বালিয়ে দেয়, আর প্রকৃতপক্ষে এটাই হয় জাতীয়তাবাদের জীবন উৎস। এ আগুন এ বর্বর যুগের অহমবোধ জাতি প্রেমের মহান পবিত্র ভাবধারাকেও সীমাতিক্রান্ত করে এক অপবিত্র জিনিসে পর্যবসিত করে। এক একটি জাতির মধ্যে এ ভাবধারা বিজাতির প্রকৃত কিংবা কাল্পনিক কোনো অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যই প্রথমে জাগ্রত হয়। কিন্তু কোনো নৈতিক বিধি-নির্দেশ আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং আল্লাহর শরীয়াত যেহেতু তার পথনির্দেশ করে না, এজন্য এটা সীমা অতিক্রম করে সাম্রাজ্যবাদ (Imperialism), অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ (Economic Nationalism), বংশীয় বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং আন্তর্জাতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। আধুনিক যুগের একজন নামকরা Francis W-Cocker লেখক লিখেছেন :

“কোনো কোনো জাতীয়তাবাদী লেখক দাবী করেন যে, স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করার অধিকার কেবল উন্নতশীল জাতিগুলোরই রয়েছে …… যাদের উন্নততর সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য বিদ্যমান। তাঁর যুক্তি এই যে, একটি উচ্চ শ্রেণীর সভ্যজাতির অধিকার ও কর্তব্য কেবল নিজ স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং নিজেদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারসমূহ অন্যের হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্পন্ন করাই নয়, বরং অপেক্ষাকৃত অনুন্নত জাতিগুলোর উপর নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করাও তাদের অধিকারভূক্ত এবং কর্তব্য- সে জন্য শক্তি প্রয়োগ করতে হলেও বাধা নেই। তাঁরা বলেন, প্রত্যেক উন্নত জাতিরই একটা বিশ্ব ব্যাপক মর্যাদা থাকে, তার অভ্যন্তরীণ যোগ্যতা প্রতিভাকে কেবলমাত্র নিজেদের দেশের মাটির মধ্যে প্রেথিত করার কিংবা স্বার্থপরতার বশীভূত হয়ে কেবল নিজের উন্নতি সাধনের জন্যই তার প্রয়োগ করার কোনোই অধিকার নেই। …..বস্তুত এরূপ মত ও যুক্তি ধারাই ঊনবিংশ শতকের শেষ অধ্যায়ে সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনে ইউরোপ এবং আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী নীতির অধীন করা হয়েছিল ঠিক এরূপ যুক্তি প্রদর্শন করে।”

তিনি আরো লিখেছেন- “এখনও বলা হয় যে, একটি বড় জাতির উপর যখন আক্রমণ হয়, তখন শুধু প্রতিরোধ করার অধিকারই তার হয় না, বরং তার স্বাধীন জীবনধারা ও সমৃদ্ধির পক্ষে ক্ষতিকর যে কোনো কাজের প্রতিরোধ করার অধিকারও তার থাকে। নিজেদের সীমান্তের সংরক্ষণ, নিজস্ব উপায়-উপাদানকে নিজেদেরই কর্তৃত্বাধীনকরণ এবং নিজেদের সম্মানের নিরাপত্তা বিধানই একটি জাতির জীবনের জন্য যথেষ্ট নয়। বেঁচে থাকতে হলে তাকে আরো অনেক কিছুই করতে হবে। তাকে সামনে অগ্রসর হতে হবে, ছড়িয়ে পড়দে হবে, নিজস্ব সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে, নিজ জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও চাকচিক্য বজায় রাখতে হবে। অন্যথায় সে জাতি ধীরে ধীরে অধঃপতনের দিকে নেমে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তার অস্তিত্ব নিঃশেষ হয়ে যাবে। নিজ স্বার্থ সংরক্ষণ এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির পরিধি বিস্তার করতে যে জাতি যতবেশী সাফল্য লাভ করবে, সে জাতির বেঁচে থাকার অধিকার ততই বেশী হবে। যুদ্ধে জয়ী হওয়াই জাতির যোগ্যতম (Fittest) হওয়ার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ডাঃ বীজহাট-এর কথায় “যুদ্ধ জাতি গঠন করে।”

তিনি অতঃপর লিখেছেন- “ডারউনের ক্রমবিকাশ মতাদর্শকেও এসব মতবাদের সমর্থনে সম্পূর্ণ ভুলের সাথে ব্যবহার করা হয়েছে। আর্নেস্ট হেকল (Ernist Haekel) জার্মানে ডারউনবাদের সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিপত্তিশালী ‘বাণী বাহক’ ছিলেন! তিনি তাঁর জীব বিজ্ঞান (Biological) সংক্রান্ত মতবাদ খুবই সতর্কতার সাথে দর্শন ও সমাজ বিজ্ঞানে (Sociology) ব্যবহার করেছেন। তিনি স্বার্থপরতা ও আত্মপূজাকে এক সার্বিক জীব বিধান মনে করেন এবং বলেন, এ আইন মানব সমাজে এক প্রকার বংশীয় মানব ধ্বংসের ব্যবস্থা হিসেবে জারী হয়ে থাকে। তাঁর মতে পৃথিবীর বুকে যতো প্রাণীই জন্মগ্রহণ করে, তাদের সকলের জন্য উপজীব্য এখানে বর্তমান নেই। ফলে দুর্বল প্রাণীর বংশ শেষ হয়ে যায়। কেবল এজন্য নয় যে, পৃথিবীর সীমাবদ্ধ উপজীব্য আহরণ করার জন্য যে প্রবল দ্বন্দ্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে, তাতে এরা অন্যান্যদের সাথে সাফল্যজনক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সমর্থ হয় না, বরং এজন্যও যে, শক্তিশালী প্রাণীসমূহের বিজয়ী পদক্ষেপের প্রতিরোধ করার কোনো মতাও তাদের মধ্যে হয় না। এভাবে কার্ল পিয়ার্সন (Karl Pearson) আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব-সংগ্রামকে ‘মানবজাতির স্বাভাবিক ইতিহাসের এক অধ্যায়’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর দাবী এই যে, বৈজ্ঞানিক ধারণার (Scientific View of Life) দিক দিয়ে মানব সভ্যতা ও তামাদ্দুনের ক্রমবিকাশ মূলত সেই দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের কারণে ঘটে থাকে, যা শুধু ব্যক্তিদের মধ্যেই নয়-জাতিসমূহের মধ্যেও চিরন্তনভাবে বর্তমান থাকে। একটি উচ্চ শ্রেণীর জাতি যখন দুর্বল বংশধরদের ধ্বংস করার এবং কেবল শক্তিশালী বংশ সৃষ্টি করে নিজের অভ্যন্তরীণ যোগ্যতা বৃদ্ধি করে নেয়, তখন সে অন্যান্য জাতিসমূহের সাথে মুকাবেলা করে নিজের বাহ্যিক যোগ্যতাকে (Fitness) বিকশিত করতে শুরু করে। এ দ্বন্দ্বে দুর্বল (অযোগ্য) জাতিসমূহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। শক্তিশালী জাতিসমূহই অবশিষ্ট থাকে। এরূপে সামগ্রিকভাবে গোটা মানবজাতিই উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়। এ জাতি অন্যান্য উন্নততর জাতির সমতুল্য হওয়ার প্রমাণ ঠিক তখনি দিতে পারে, যখন তা ব্যবসায়-বাণিজ্যে, কাঁচামাল ও খাদ্য সংগ্রহের জন্য তাদের সাথে নিরন্তর সাধনা-প্রতিযোগিতা করতে থাকে। যদি নিম্মস্তরের জাতিগুলোর সাথে মিলেমিশে থাকতে শুরু করে, তবে মনে করতে হবে যে, সে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের দাবী প্রত্যাহার করেছে। আর সেইসব জাতিকে নির্বাসিত করে নিজেই যদি সেই দেশ অধিকার করে কিংবা তাদেরকে বসবাস করার অধিকার দান করে তাকে স্বার্থের অনুকূলে ব্যবহার করে, তবে তাতেই একটা জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। -Recent political Thought, New York, 1934, p.443-48.

জোসেফ লিটেন (Joseph Lighten) নামক অন্য একজন গ্রন্থকার লিখেছেন : “পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে দুনিয়ার ইতিহাস অপেক্ষাকৃতভাবে জাতীয় রাষ্ট্রসমূহের পারস্পারিক অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের ইতিহাস। অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ ক্রমাগতভাবে জাতসমূহের পারস্পারিক সংঘর্ষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমে ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিবন্ধকতার সূচনা হয়। তারপরই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আমেরিকা, আফ্রিকা, সাত সমুদ্রের দ্বীপসমূহ এবং এশিয়ার বড় বড় অংশের উপর আধিপত্য বিস্তার, উপনিবেশ স্থাপন এবং এসব দেশের অর্থনৈতিক উপায়-উপাদন শোষণ (Exploitation) করা-প্রভৃতি এ লুট-তরাজ ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় মাত্র। যদিও এসব কিছুই রোমকদের পতনের পর লুট-তরাজ করতে করতে বর্বর জাতিদের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ার সময়ও খুব ক্ষুদ্র আকারে সংঘটিত হয়েছিল। তবে পার্থক্য এই যে, রোমক সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ থেকে ধর্মীয়, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিতে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কিন্তু নতুন পৃথিবীতে তা সম্ভব হয়নি।” – Social Philosophies in Conflict, New York 1937, p.439

এ গ্রন্থকার অন্যত্র লিখেছেন : “সাংস্কৃতিক ঐক্য সম্পন্ন একটি জাতি যখন রাজনীতির দিক দিয়ে স্বাধীন এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমস্বার্থ বিশিষ্ট হয় এবং এরূপ সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জাতীয়তায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ববোধ জাগ্রত হয়, তখন অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ অনিবার্যরূপে তীব্র হয়ে দেখা দেয়। কারণ দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পারিক যে দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের প্রচলন রয়েছে, তার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে এ জাতীয়তাবাদ। আর এ জাতীয়তাবাদই অনতিবিলম্বে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয়। ব্যবসায়-বাণিজ্য সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা করার জন্য জাতিসমূহ পরস্পরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এবং বৈদেশিক বাজার এবং পশ্চাদবর্তী দেশের অর্থ-সম্পদ করায়ত্ত করার জন্য তাদের পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়।”

“রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের সমস্যা-যার সমাধানের কোনো উপায়ই পাওয়া যায়নি-এই যে, একদিকে একটি জাতির কল্যাণ ও মঙ্গল বিধানের জন্যে একটি জাতীয় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অপরিহার্য এবং তার কেবল অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যই নয়-তার সাংস্কৃতিক উন্নতি, তার শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প-তার প্রত্যেকটি বিষয়ের উৎকর্ষ লাভ জাতীয় রাষ্ট্রের উন্নতি ও শক্তি লাভের উপর একান্তভাবে নির্ভর করে। কিন্তু অপরদিকে বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ আপনা আপনিই সৃষ্টি হয়ে পড়ে। প্রত্যেক জাতির ক্ষতি করে নিজের উন্নতি সাধনের জন্য চেষ্টা করে। এর ফলে জাতিসমূহের পরস্পরের মধ্যে প্রতিহিৎসা, সন্দেহ, ভয় ও ঘৃণার ভাবধারা প্রতিপালিত হতে থাকে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে প্রকাশ্য ময়দানে সামরিক সংঘর্ষ পর্যন্ত অবাধগতি এবং এটা অত্যন্ত নিকটবর্তী পথ।” -প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪-৫.

পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী আদর্শের পার্থক্য
পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদ, তার চিন্তা-পদ্ধতি ও কর্মনীতি আমার নিজের কথায় প্রকাশ করার পরিবর্তে পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের ভাষায়ই এখানে পেশ করা আমি অত্যাধিক ভাল মনে করেছি। এর ফলে স্বয়ং পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের লেখনীর সাহায্যেই পাঠকদের সামনে ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের প্রকৃত চিত্র সঠিকরূপে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইউরোপে যেসব ধারণা-কল্পনা এবং যেসব নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ স্থাপিত ও বিকশিত হয়ে হয়েছে, উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহ থেকে একথা অনস্বীকার্যরূপে প্রমাণিত হয়েছে যে, তা সবই মানবতার পক্ষে নিঃসন্দেহে মারাত্মক। এসব নীতি ও ধারণা মানুষকে পাশবিকতা-চরম হিংস্রতার পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। যা আল্লাহর পৃথিবীকে জুলুম-পীড়ন ও রক্তপাতে জর্জরিত করে দেয় এবং মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ প্রতিরোধ করে। আদিকাল থেকে আল্লাহর প্রেরিত নবীগণ দুনিয়াতে যে মহান উদ্দেশ্যে চেষ্টা-সাধনা করেছেন, পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদের এ নীতি তা সব ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। আলাহর শরীয়াত যে উদ্দেশ্যে দুনিয়ায় এসেছে, যেসব নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও আদর্শ নিয়ে আসমানী কিতাব নাযিল হয়েছে, উপরোক্ত শয়তানী নীতি তার প্রতিরোধকারী। এটা মানুষকে সংকীর্ণমনা, সংকীর্ণ দৃষ্টি ও হিংসুক করে দেয়। এটা জাতি ও বংশসমূহকে পরস্পরের প্রাণের দুশমন বানিয়ে সত্য, ইনসাফ ও মনুষ্যত্বের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ অন্ধ করে দেয়। বৈষয়িক শক্তি ও পাশবিক বলকে এটা নৈতিক সত্যের স্থলাভিষিক্ত করে ইলাহী শরীয়তের মর্মমূলে কঠিন আঘাত হানে।

মানুষের পরস্পরের মধ্যে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করে বিশাল ও ব্যাপক কর্মক্ষেত্রে পরস্পরের সাহায্যকারী ও সহানুভূতিশীল বানিয়ে দেয়া ইলাহী শরীয়তের চিরন্তন উদ্দেশ্য। কিন্তু জাতীয়তাবাদ বংশীয়-গোত্রীয় ও ভৌগলিক বৈষম্যের ক্ষুরধার তরবারী দ্বারা এসব সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয় এবং জাতীয় হিংসা-দ্বেষ সৃষ্টি করে মানুষকে পরস্পরের শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত করে।

মানুষের পরস্পরের মধ্যে যথাসম্ভব স্বাধীন সম্পর্ক ও সম্বন্ধ স্থাপনের উদার অবকাশ সৃষ্টি করাই ইলাহী শরীয়তের লক্ষ্য। কারণ মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা এরই উপর নির্ভর করে। ফলে এক জাতীয়তাবাদ এ সম্পর্ক-সম্বন্ধ স্থাপনে প্রবল বাঁধার সৃষ্টি করে। ফলে এক জাতির প্রভাবান্বিত এলাকার অপর জাতির পক্ষে জীবন ধারণ করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে।

খোদায়ী শরীয়তের লক্ষ্যবস্তু হলো প্রতিটি ব্যক্তি; প্রতিটি জাতি এবং প্রতিটি প্রজন্ম তার স্̠ƾভাবিক বৈশিষ্ট্য এবং জন্মগত যোগ্যতা লালন করার পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা লাভ করুক, যাতে সামগ্রিকভাবে মানবতার উন্নতি বিধানে নিজের ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ প্রতিটি জাতি আর প্রতিটি প্রজন্মের মধ্যে এমন প্রেরণা সৃষ্টি করে, যাতে সে শক্তি অর্জন করে অন্য জাতি আর প্রজন্মকে তুচ্ছ, মূল্যহীন এবং হেয় সাব্যস্ত করতঃ তাদেরকে দাসে পরিণত করে তাদের জন্মগত যোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়ে কাজ করার সুযোগই না দেয়; বরং তাদের বেঁচে থাকার অধিকারই হরণ করে ছেড়ে দেয়।

খোদায়ী শরীয়তের শীর্ষ মূলনীতি এই যে, শক্তির পরিবর্তে নৈতিকতার উপর মানবাধিকারের ভিত্তি স্থাপিত হোক; এমন কি একজন শক্তিধর ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দুর্বল ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অধিকার আদায় করবে যখন নৈতিক বিধান তাতে সমর্থন জ্ঞাপন করে। পক্ষান্তরে এর বিপরীতে জাতীয়তাবাদ এ নীতি প্রতিষ্ঠা করে যে, শক্তিই হলো সত্য, (Might is right) এবং দুর্বলের কোনো অধিকার নেই। কারণ অধিকার আদায় করার ক্ষমতা তার নেই।

খোদায়ী শরীয়ত যেমনি নৈতিকতার সীমারেখার মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিকাশের বিরোধী নয়, তেমনিভাবে তা জাতি সত্তার লালনেরও বিরোধী নয়। মূলতঃ ইলাহী শরীয়ত এজন্য সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। কারণ এক একটি জাতির স্ব স্ব স্থানে উন্নতি-অগ্রগতি সাধনের উপরই এমনভাবে জাতিকে লালন করতে চায়; যা বৃহত্তর মানবতার (Humanity at Large) প্রতি সহানুভূতি, সহায়তা এবং কল্যাণকামিতা নিয়ে অগ্রসর হয় এবং এমন ভূমিকা পালন করে, সমুদ্রের জন্য নদী যে ভুমিকা পালন করে। পক্ষান্তরে জাতীয়তাবাদ মানুষের মধ্যে এমন মানসিকতা সৃষ্টি করে, যার ফলে সে তার যাবতীয় শক্তি-সামর্থ সকল যোগ্যতা-প্রতিভা কেবল স্বজাতির শ্রেষ্ঠত্বের জন্য নির্ধারণ করে নেয় এবং বৃহত্তর মানবতার সহায়ক হবে না কেবল তা-ই নয়ম বরং স্বজাতির স্বার্থের বেদীতে বৃহত্তর মানবতার স্বার্থ বিসর্জন দিতেও কুন্ঠাবোধ করবে না। ব্যক্তিগত জীবনে ‘আত্মস্বার্থে’র সে স্থান, সামাজিক জীবনে সে স্থান ‘জাতিপূজার’। একজন জাতীয়তাবাদী স্বভাবতই সংকীর্ণমনা হয়ে থাকে। সে বিশ্বের তাবৎ রূপ-সৌন্দর্য আর গুণ-বৈশিষ্ট্য কেবল স্বজাতির আর স্ব-গোত্রের মধ্যে দেখতে পায়, অন্যান্য জাতি আর বংশ গোত্রের মধ্যে সে এমন কোনো মূল্যবান বস্তু দেখতে পায় না, যার টিকে থাকার অধিকার রয়েছে। এহেন মানসিকতার চূড়ান্ত প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই জার্মানীর জাতীয় সমাজতন্ত্রে। হিটলারের ভাষায় জাতীয় সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা হলো : “যে কোনো ব্যক্তি যে জাতীয় লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে এতোটা উর্দ্ধে তুলে ধরার জন্য প্রস্তুত, যার ফলে তার কাছে স্বজাতির মঙ্গল ও কল্যাণের উর্ধে আর কোনো কিছুই থাকতে পারে না। এবং যে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত Germany above all-জার্মানী সকলের ঊর্ধে-একথার তাৎপর্য ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করে নিতে সক্ষম হয়েছে অর্থাৎ এ বিশাল বিস্তীর্ণ বিশ্বে জার্মান দেশ ও জাতির চেয়ে উন্নত কোনো বস্তু তার দৃষ্টিতে প্রিয় ও সম্মানযোগ্য থাকতে পারে না। এমন ব্যক্তিই হবে ন্যাশনাল সোশ্যালিষ্ট।”

আত্মচরিত ‘আমার সংগ্রাম’ -এ হিটলার লিখেন : “মহাবিশ্বে মূল্যবান যা কিছু আছে-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং আবিষ্কার-উদ্ভাবন-এসব কিছুই গুটিকতেক জাতির সৃজনশীল প্রতিভার ফলশ্রুতি। আর এসব জাতি মূলত একই বংশধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা যদি মানব জাতিকে তিনভাগে ভাগ করি-যারা ষংস্কৃতি গড়ে তোলে, যারা সংস্কৃতি সংরক্ষণ করে এবং যারা সংস্কৃতি ধ্বংস করে – তাহলে কেবল আর্য বংশই প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত হবে।”

এ বংশ গৌরবের ভিত্তিতেই জার্মানীতে অনার্যদের জীবন ধারণ সংকীর্ণ করে তোলা হয়। আর এর উপর জার্মানীর বিশ্বজয় দর্শনের ভিত্তি স্থাপিত। একজন জার্মান সোশ্যালিষ্টের মতে বিশ্বে জার্মান জাতির মিশন এই যে, সে নিম্নশ্রেণীর জাতিকে ধ্বংসে পরিণত করতঃ সভ্যতা বিস্তারে ক্রীড়নক হিসাবে ব্যবহার করবে। আর এটা কেবল জার্মানীরই বৈশিষ্ট্য নয়, গণতন্ত্রপ্রেমী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এরই ভিত্তিতে বর্ণ বৈষম্য করা হয়। শ্বেতাঙ্গ মার্কিনীরা কৃষ্ণাঙ্গ নিগ্রোদেরকে মানুষ বলে গণ্য করতে প্রস্তুত নয়। ইউরোপের প্রতিটি জাতির দৃষ্টিভঙ্গীও এটিই। সে দেশ বৃটেন, ফ্রান্স, ইটালী, হল্যাণ্ড যে কোনোটি হোক না কেন।

অতপর এ জাতি পূজাঁর এক অনিবার্য বৈশিষ্ট্য এই দাঁড়ায় যে, এহেন জাতিপূজা মানুষকে স্বার্থপূজারীতে পরিণত করে। পৃথিবীতে শরীয়তী বিধানের অগমন ঘটেছে মানুষকে নীতিবাদীতে পরিণত করার জন্য। ইলাহী শরীয়ত মানুষের কর্মধারাকে এমন স্বতন্ত্র নীতির অনুসারী বানাতে চায়, স্বার্থ আর মনস্কামনার সঙ্গে সঙ্গে যেসব নীতির পরিবর্তন ঘটবে না, পক্ষান্তরে এর ঠিক বিপরীতে জাতিপূজা মানুষকে নীতিহীন করে তোলে। জাতিপূজারীর জন্য স্বজাতির কল্যাণ কামনা ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো নীতি নেই। নীতি বিজ্ঞান, ধর্মের বিধান এবং সভ্যতা দর্শন যদি এ উদ্দেশ্যে তার সহায়ক হয় তাহলে সে সানন্দে সেসব নীতির প্রতি ঈমান আনা তথা বিশ্বাস স্থাপন করার দাবী করবে। আর তা এ পথে প্রতিবন্ধক হলে সেসব বিসর্জন দিয়ে অন্য নীতি-দর্শন গ্রহণ করবে।

মুসোলিনীর জীবন চরিতে আমরা একজন জাতীয়তাবদীর চরিত্রের পূর্ণ নমুনা দেখতে পাই। বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে সে ছিল একজন সোশ্যালিষ্ট। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সে কেবল এজন্য সোশ্যালিষ্টদের থেকে পৃথক হয়ে যায় যে, ইটালীর যুদ্ধে যোগদানের মধ্যেই সে জাতীয় স্বার্থ নিহিত রয়েছে দেখতে পায়। কিন্তু যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মধ্যে ইটালী তার কাংখিত কল্যাণ লাভ না করতে পেরে সে নয় ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের পতাকা উড্ডীন করে। এই নতুন আন্দোলনেও সে বারবার নীতির পরিবর্তন ঘটাতে থাকে। ১৯১৯ সালে সে ছিল একজন লিবারেল সোশ্যালিষ্ট, ১৯২০ সালে হয় এনাকিষ্ট তথা স্বৈরশাসক। ১৯২১ সালে কয়েক মাস পর্যন্ত সে ছিল সোশ্যালিষ্ট এবং গণতান্ত্রিক শ্রেণীগুলোর বিরোধী; কয়েক মাস তাদের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়। অবশেষে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা নতুন নীতি গড়ে তোলে, বারবার এহেন রংবদল করা, এ নীতিহীনতা এবং এহেন স্বার্থান্বেষীতা কেবল মুসোলিনীরই একক বৈশিষ্ট্য নয়। বরং এটাই হলো জাতীয়তাবাদী প্রকৃতির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তিগত জীবনে একজন স্বার্থপর ব্যক্তি যা কিছু করতে পারে, একজন জাতীয়তাবাদী জাতীয় জীবনে ঠিক তা-ই করতে পারে। কোনো নীতি দর্শনে স্বতন্ত্রভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা তার পক্ষে অসম্ভব।

কিন্তু ন্যাশনালিজম এবং ইলাহী শরীয়তের মধ্যে সংঘাত সবচেয়ে খোলাখোলীভাবে আরো এক দিক থেকেও হয়। একথা তো স্পষ্ট যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে নবীই আগমন করবেন, কোনো এক জনপদেই তাঁর জন্ম হবে। তেমনিভাবে সে নবীকে যে কিতাব দেয়া হবে, তা অনিবার্যভাবেই সেই জনপদের ভাষায়ই হবে, যে জনপদে তিনি প্রেরিত হয়েছেন। অতপর সে নবুওয়াতের মিশনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনকারী সেসব স্থান সম্মান ও মর্যাদার আসন লাভ করবে, সেসব স্থানও বেশির ভাগ সেই জনপদেই থাকবে।

কিন্তু এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একজন নবী আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সত্যবাণী এবং হিদায়াতের শিক্ষা নিয়ে আগমন করেন তা কোনো দেশ জাতির জন্য সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং তা সকল মানুষের জন্য থাকে সর্বাব্যাপী গোটা মানবজাতিকে নির্দেশ দেয়া হয় সে নবী এবং উপস্থাপিত কিতাবের প্রতি ঈমান আনার জন্য। চাই কোনো নবীর মিশন সীমাবদ্ধ হোক, যেমন হযরত হূদ এবং হযরত সালেহ আলাইহিস সালামসহ আরো অনেক, অথবা তাঁর মিশন ব্যাপক হয়, যেমন হযরত ইব্রাহীম এবং হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সর্বাবস্থায় সকল নবীর প্রতি ঈমান আনতে এবং তাঁকে সম্মান করতে সমস্ত মানুষ আদিষ্ট ছিল। যখন কোনো নবীর মিশন বিশ্বজনীন হয় তখন তো এটা স্বাভাবিক যে, তাঁর উপস্থাপিত কিতাব আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করবে, সে কিতাবের সাংস্কৃতিক প্রভাবও হবে আন্তর্জাতিক, তার পবিত্র স্থানসমূহ কোনো এক দেশে হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করবে। কেবল সে নবীই নয়, বরং তাঁর সঙ্গী-সাথী এবং তাঁর মিশনের প্রচার-প্রসারে শীর্ষ অংশগ্রহণকারী প্রাথমিক লোকগুলো একটা জাতির সঙ্গে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সমস্ত জাতির মধ্যে হিরো বলে অভিহিত হবে। এসব কিছুই একজন জাতীয়তাবাদী স্বভাব-রুচি তার আবেগ-অনুভূতি এবং তার দর্শন আর দৃষ্টিভঙ্গীর বিপরীত। একজন ন্যাশনালিষ্টের জাতীয়তাবোধ কিছুতেই এটা গ্রহণ করতে পারে না যে, এমন ব্যক্তিদেরকে সে হিরো হিসাবে স্বীকার করে নেবে, যে তার স্বজাতির লোক নয়, এমন স্থানকে পবিত্র বলে কেন্দ্র হিসাবে গ্রহণ করবে, যে স্থান তার স্বদেশ ভূমির অন্তর্ভূক্ত নয়। এমন ভাষার সাংস্কৃতিক প্রভাব স্বীকার করে নেবে, যা তার আপন ভাষা নয়। সে সমস্ত ঐতিহ্য দ্বারা আত্মিক প্রেরণা লাভ করবে যা বহির্দেশ থেকে আগত। এসব বিষয়কে সে কেবল বিদেশী বলে অভিহিত করবে না, বরং সে এমন ঘৃণা আর অসহ্যের দৃষ্টিতে দেখবে, যে দৃষ্টিতে দেখা হয় বৈদেশিক হামলাকারীদের সবকিছুই। স্বজাতির জীবন থেকে বাইরের সমস্ত প্রভাব দূর করার জন্য সে চেষ্টা চালাবে। তার জাতীয়তাবোধের প্রেরণার স্বাভাবিক দাবীই এই যে, সম্মান আর মর্যাদার সমস্ত আবেগ আর অনুভূতিকে সে কেবল স্বদেশ ভূমির মাটির সঙ্গেই সম্পৃক্ত করবে, স্বদেশের নদী-নালা আর পর্বতমালার প্রশংসার গান গাইবে। স্বজাতির প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যকে জীবন্ত করবে (বহিরাগত ধর্ম যেসব ঐতিহ্যকে জাহিলী যুগ বলে অভিহিত করে থাকে) আর এ জন্য সে গর্ববোধ করবে। অতীতের সঙ্গে নিজের বর্তমানের সম্পর্ক স্থাপন করবে এবং নিজের পূর্বসূরীদের সংস্কৃতির সঙ্গে নিজের সংস্কৃতির সম্পর্ক স্থাপন করবে, স্বজাতির ঐতিহাসিক বা কাল্পনিক বুযুর্গদেরকে হিরো হিসাবে গ্রহণ করবে এবং তাদের বাস্তবিক বা কাল্পনিক কীর্তি থেকে নিজের আত্মিক প্রেরণা লাভ করবে।

মোটকথা হলো এটা ন্যাশনালিজমের অবিকল স্বভাব প্রকৃতির অন্তভূক্ত যে, বহিরাগত যে কোনো বস্তু থেকে বিমুখ হয়ে সে এমন বস্তুর দিকে মুখ করবে, যা তার নিজের ঘরের। এ রাস্তা যে চূড়ান্ত মনযিলে পৌঁছে তা এই যে, বহিরাগত ধর্মকেও চূড়ান্তভাবে বর্জন করা হবে এবং সেসব ধর্মীয় ঐতিহ্যকে জীবন্ত করে তোলা হবে, যা স্বজাতির জাহিলী যুগ থেকে কোনো জাতীয়তাবাদী লাভ করেছে। হতে পারে অনেক জাতীয়তাবাদী শেষ মনযিল পর্যন্ত পৌঁছতেই পারবে না, মধ্যস্থলে কোনো মনযিলে থাকবে; কিন্তু যে পথে চলছে সে পথ সেদিকেই যায়।

অধুনা জার্মানীতে যা কিছু ঘটছে, তা জাতীয়তাবাদের এই স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যেরই পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশেষণ। নাৎসীদের একটা দল তো প্রকাশ্যেই হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করছে; কারণ তিনি ইহুদী বংশোদ্ভূত ছিলেন। আর কোনো ব্যক্তি ইহুদী হওয়া এজন্য যথেষ্ট যে, আর্য বংশের একজন পূজারী তাঁর সাংস্কৃতিক, নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক যাবতীয় মূল্য ও গুরুত্ব অস্বীকার করবে। তাইতো এ দলের লোকেরা নির্দ্বিধায় বলে : “মাসীহ ছিলেন একজন প্রোলেটারী ইহুদী। তিনি ছিলেন মাক্সের পূর্বসূরী। এজন্যইতো তিনি বলেছিলেন যারা নিঃস্ব সর্বহারা, তারাই পৃথিবীর ওয়ারিশ হবে।” পান্তরে যেসব নাৎসীদের অন্তরে এখনো মাসীহের জন্য স্থান রয়েছে তারা তাঁকে নরডিক বংশোদ্ভূত বলে প্রমাণ করছে। যেন একজন জার্মান জাতীয়তাবাদী হয় মাসীহকে মানবেই না, কারণ তিনি ইহুদী ছিলেন; অথবা তাকে স্বীকার করলেও ইসরাঈলী মাসীহকে স্বীকার করবে না, বরং স্বীকার করবে নরডিক বংশোদ্ভূত মাসীহকে। সর্ববস্থায় তার ধর্ম বংশপূজার অধীন। কোনো অনার্যকে আত্মিক এবং নৈতিক সভ্যতার নেতা বলে স্বীকার করে নিতে কোনো জাতিপূজার জার্মান প্রস্তুত নয়। চরম সত্য কথা এই যে, জার্মান জাতীয়তাবাদীর জন্য সে খোদাও গ্রহণযোগ্য নয়, যার ধারণা আমদানী করা হয়েছে বহির্দেশ থেকে। পূরাকালে টিউটন গোত্র যেসব দেবতার পূজা করতো, কোনো নাৎসী মহল সেসবকে জীবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাইতো প্রাচীন ইতিহাস তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান করতঃ দেব দেবীর পূর্ণ কাহিনী প্রস্তুত করা হয়েছে। এবং ওটন (Wotan) নামক দেবতা, প্রাচীন জাহেলী যুগে টিউটন গোত্রের লোকেরা যাকে প্লাবণের খোদা বলে স্বীকার করতো তাকেই তারা মহাদেবতা বলে স্বীকার করছে। এই ধর্মীয় আন্দোলন তো সবে মাত্র নতুন শুরু হয়েছে। কিন্তু সরকারীভাবে অধুনা নাৎসী যুবকদেরকে যে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তাতেও খোদাকে রাব্বুল আলামীন হিসেবে নয়, বরং কেবল রাব্বুল আলমানিয়্যীন তথা জার্মানীদের খোদা হিসাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এ ধর্ম বিশ্বাসের শব্দমালা এই : “আমরা খোদার প্রতি এ হিসাবে বিশ্বাস করি যে, যিনি শক্তি ও প্রাণের আদি উৎস, পৃথিবীতে এবং সৃষ্টিলোকে ……. জার্মান মানুষের জন্য খোদার ধারণা স্বভাবজাত। খোদা আর চিরন্তনতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা অন্য কোনো ধর্মবিশ্বাসের ধারণার সাথে কোনোভাবেই মিলবে না। জার্মান জাতি এবং জার্মানী অনাদি বলে আমরা বিশ্বাস করি। কারণ, শক্তি ও জীবন অনাদি বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা জীবনের ন্যাশনাল সোশ্যালিষ্ট ধারণায় বিশ্বাসী। আমাদের জাতীয় লক্ষ্য সত্য বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা আমাদের নেতা এডলফে বিশ্বাস করি।”

অর্থাৎ খোদা এমন এক শক্তি ও জীবনের নাম যা জার্মান জাতিতে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে আর জার্মান জাতি হচ্ছে পৃথিবীতে সে খোদার প্রকাশ। আর হিটলার হচ্ছে সে খোদার রাসূল। আর জাতীয় লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো সে রাসূলের উপস্থাপিত ধর্ম। একজন জাতীয়তাবাদীর মানসিকতার সঙ্গে ধর্মীয় ধারণার যদি কোনো মিল থেকে থাকে তবে তা কেবল এটাই।

পশ্চিমা ন্যাশনালিজমের পরিণতি
ইউরোপীয় নীতিতে যদি ন্যাশনালিজমের উন্নতি সাধন করা হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত তা এ স্থানে এসেই দম নেবে। সেসব লোক এখনো মধ্যস্থলের মনযিলে আছে সীমা পর্যন্ত এখনো পৌঁছতে সক্ষম হয়নি, তাদের না পৌঁছতে পারার কারণ কেবল এটাই যে, এখনো তাদের জাতীয়তাবাদের উদ্দীপনায় তেমন আঘাত লাগেনি, যে আঘাত বিশ্বযুদ্ধের ফলে জার্মানীকে হানা দিয়েছিল। কিন্তু আপনি নিশ্চিত থাকুন যে, তারা যখন ন্যাশনালিজমের রাস্তায় নেমেছে তখন অবশ্যই তাদের শেষ মনযিল মকসুদ হবে চরম পর্যায়ের জাহিলিয়াত, যা খোদা এবং ধর্মকে পর্যন্ত জাতীয় না বানিয়ে শান্ত হবে না। ন্যাশনালিজমের স্বভাব-প্রকৃতির দাবী এটাই। ন্যাশনালিজম অবলম্বন করে তার স্বাভাবিক দাবী থেকে কে রক্ষা পেতে পারে? ভেবে দেখুন, জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা অবলম্বন করা মাত্রই কোন্ বস্তুটা একজন মিশরী জাতীয়তাবাদীর গতি আপনাআপনিই মিশরের ফেরাউনদের দিকে আবর্তিত করে দেয়? যা ইরানীকে শাহনামার গল্পের নায়কদের প্রতি উৎসাহী করে তোলে? যা একজন হিন্দুস্থানীকে ‘প্রাচীন সময়’-এর দিকে টেনে নিয়ে যায় এবং গঙ্গা-যমুনার পবিত্রতার গান তার মুখে উচ্চারণ করায়। যা একজন তুর্কীকে তার ভাষা, সাহিত্য এবং তমদ্দুনিক জীবনের এক একটি বিভাগ থেকে আরবীয় প্রভাব দূর করতে বাধ্য করে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে জাহিলী যুগের তুর্কী ঐতিহ্যের প্রত্যাবর্তন করতে উদ্বুদ্ধ-অনুপ্রানিত করে। যে মন-মানসে ন্যাশনালিজমের বীজ উপ্ত হয় তার সমস্ত আগ্রহ জাতীয়তার গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যায় এবং গণ্ডীর বাইরের সমস্ত কিছু থেকে সে মুখ ফিরায়ে নেয়-এ ছাড়া তার আর কি মনস্তাত্বিক বিশেষণ আপনি করতে পারেন?

এ নিবন্ধটি রচনাকালে আংকারার ডাইরেক্টর জেনারেল অফ প্রেস-এর লেখা একটি নিবন্ধ আমার সম্মুখে রয়েছে যার শিরোনাম ‘ইতিহাসে তুর্কী নারী।’ নিবন্ধটির প্রাথমিক বাক্যগুলো এ রকম : “আমাদের নব উদ্ভূত গণতন্ত্র তুর্কী নারীদেরকে যে উন্নত এবং সম্মানজনক স্থান দান করতে আগ্রহী, সে সম্পর্কে আলোচনা করার আগে এক নজরে আমাদের দেখা উচিত যে, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন যুগে তুর্কী নারীদের জীবন কেমন ছিল। এ সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা দ্বারা একথা স্পষ্ট হয়ে থাকে যে, অধুনা তুর্কী-পুরুষের মধ্যে যে সাক্ষ্য পরিলক্ষিত হয়, তা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। এ থেকে একথাও জানা যাবে যে, তুর্কী পরিবার আর তুর্কী তমাদ্দুনিক ব্যবস্থা যখন বাইরের প্রভাব মুক্ত ছিল তখন তুর্কী নারীরা যেকোনো তমাদ্দুনিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতো। আমাদের খ্যাতনামা সমাজ তাত্ত্বিক জিয়া লোক অল্প বিয়ষটা নিয়ে বেশ গবেষণা করেছেন। তার গবেষণা দ্বারা এমন অনেক অধিকার সম্পর্কে জানা যায় তুর্কী নারীরা প্রাচীন সভ্যতার (তুরষ্কের জাহেলী যুগ) অর্জন করেছিল। এসব সাক্ষ্য দ্বারা একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সেকালের তুর্কী নারী আর একালের তুর্কী নারীর তমদ্দুনিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির দিক থেকে গভীর সাদৃশ্য পাওয়া যায়।”

উপরোক্ত বাক্যাবলীর প্রতি লক্ষ্য করুন। একজন জাতীয়তাবাদী তুর্কী কিভাবে তার ইতিহাসের সে অধ্যায় থেকে মুখ ফিরায়ে নেয়, যে অধ্যায় তার জাতি বৈদেশিক প্রভাভাধীন হয়ে পড়ে এবং কিভাবে সে নিজের বর্তমানের জন্য অতীতকে ‘উত্তম আদর্শ’ হিসাবে গ্রহণ করে, যখন তার জাতি সে বৈদেশিক প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল। এভাবে এ জাতীয়তাবাদ মানুষের মনকে ইসলাম থেকে জাহিলিয়াতের দিকে নিয়ে যায়। গোক অল্প জিয়া মূলত যিনি সভ্যতা-সংস্কৃতির দিক থেকে আধুনিক তুরস্কের জন্মদাতা, যার প্রদর্শিত পথেই অধুনা তুর্কী জাতি ধাবিত হচ্ছে। খালিদা আদীব খানমের ভাষায় তিনি হলেন : “তিনি এমন এক তুরস্ক গড়ে তুলতে চান, যা ওসমানী তুর্কী এবং তাদের তুরানী পূর্বসূরীদের মধ্যকার শূন্যতা পূরণ করতে পারে। ………ইসলাম পূর্ব যুগে তুরস্কের রাজনৈতিক এবং তমদ্দুনিক সংগঠন সম্পর্কে তিনি যেসব তথ্য সরবরাহ করেছেন তারই ভিত্তিতে তিনি তমদ্দুনিক সংস্কার সাধন করতে চান। তিনি নিশ্চিত বিশ্বাস করতেন যে, আরবরা যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করছে তা আমাদের অবস্থার সাথে খাপ খেতে পারে না। আমরা জাহিলী যুগের দিকে ফিরে যেতে না চাইলে আমাদেরকে এমন এক ধর্মীয় সংস্কার করতে হবে যা আমাদের স্বভাব-প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জ্যস্যশীল।”

তুর্র্কীদের বদনাম রটাতে চায়, একথাগুলো এমন কোনো পশ্চিমা প্রোপাগাণ্ডাকারীর নয় বরং এগুলো একজন জাতীয়তাবাদী তুর্কী রমণীর কথা। একথাগুলোতে আপনি স্পষ্টভাবে এ দৃশ্য দেখতে পারেন যে, মুসলমানদের মন-মানসে যখন এক দিক থেকে জাতিপূজা প্রবেশ করা শুরু করে তখন কিভাবে অন্য দিক থেকে ইসলাম বের হতে শুরু করে। ব্যাপারটা কেবল তুর্কীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, যেকোনো মুসলমান জাতীয়তাবাদের শয়তানের সাথে আপোষ করবে, ইসলামের ফেরেশতার সঙ্গে তাকে বিদায় করমর্দন করতেই হবে। সাম্প্রতিককালে হিন্দুস্থানের জনৈক ‘মুসলমান’ কবি একট স্বদেশ বদ্ধনামূলক সঙ্গীত রচনা করেছেন। এতে তিনি ভারত মাতাকে সম্বোধন করে বলেন : বিঃ দ্রঃ এখানে কয়েকটি উর্দু লাইন আছে।

ভাবার্থ : যার পানি অমৃত, তার ভাণ্ডারতো তুমি,

যার দানা বিদ্যুৎ, তার ভাণ্ডার তো তুমি,

যার কংকর হীরা, সে খনি তো তুমি,

যার কারণে দুনিয়া স্বর্গ, সে বাগানতো তুমি,

দেব-দেবীর বাসস্থানতো তুমি,

আমরা সাজদা দ্বারা কা’বা বানাবো তোমায়।

ইসলাম এবং জাতীয়তাবাদ যে সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী দুটি বস্তু শেষ শোকটি পাঠ করে কি সে ব্যাপারে কোনো সংশয় থাকতে পারে? বিপরীত মানসিকতার এ দুটি বস্তু এক স্থানে মিলিত হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। মূলত ন্যাশনালিজম নিজেই একটা মাযহাব যা খোদায়ী শরীয়তের বিরোধী। বরং কার্যত জাতীয়তাবাদ মানব জীবনের সেসব দিকের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করার দাবী করে, খোদায়ী শরীয়ত সেসব দিক ও বিভাগকে নিজ আয়ত্বাধীন করতে চায়। একজন বুদ্ধিমান লোকের জন্য কেবল একটা উপায়ই অবশিষ্ট্য থাকে যে, মন-মানস আর দেহ-প্রাণের দাবীদার এ দুয়ের কোনো একটাকে গ্রহণ করতঃ নিজেকে তার হাতে সঁপে দেবে এবং যখন একটার কোলে আশ্রয় নেবে তখন অন্যটার নামও মুখে উচ্চারণ করবে না।


পৃথিবী কোন্ জাতীয়তাবাদের অভিশাপে নিপতিত?
সন্দেহ নেই যে, বর্তমান যুগে স্বাধীনতা উন্নতি-অগ্রগতি এবং মান-মর্যাদা লাভের একটা পরীক্ষিত উপায়ই বিশ্ববাসীর জানা আছে। আর তা হলো এই জাতীয়তাবাদের ব্যবস্থাপত্র। এরই ফলে উন্নতি-অগ্রগতি প্রত্যাশী জাতিমাত্রই এদিকেই ছুটে যায়। অন্যদেরকে যে দিকে ছুটে যেতে দেখে আমরাও সেদিকে ছুটে যাওয়ার আগে আমাদেরকে ভেবে দেখা উচিত যে, আজ দুনিয়ার এ অবস্থা কেন হয়েছে। আজ বিশ্ব এ অবস্থায় নিপতিত কেবল এজন্য যে, ব্যক্তি এবং ব্যষ্টির আশা-আকাঙ্খাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনো শক্তি, আশা-আকাঙ্খা আর উৎসাহ-উদ্দীপনাকে বৈধ সীমার মধ্যে রাখার কোনো মতা, চেষ্টা-সাধনার শক্তিকে সরল পথ প্রদর্শন করার মতো কোনো শক্তি, স্বাধীনতা, উন্নতি-অগ্রগতি এবং সম্মান ও মর্যাদা অর্জন করার মতো কোনো সঠিক ও নির্ভুল পথ ও পন্থা নির্দেশ করার মতো যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শিক্ষা এবং কোনো নৈতিক জ্ঞান আজ বিশ্বের নিকট নেই। এ শক্তি আর নীতিমালার অভাবেই আজ বিশ্বের নানা জাতি বিপথগামী হয়ে পড়েছে। এ নীতি-নৈতিকতার অভাবেই আজ নানা জাতিকে অজ্ঞতা-কূপমণ্ডুকতা এবং জুলুম-অবিচারের দিকে ঠেলে দিয়েছে। স্বয়ং আমাদের দেশের হিন্দু, সিক, পারসিক, ইত্যাদি জাতি আজ যে কারণে পাশ্চাত্যের জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা গ্রহণ করছে তা এই যে, তারাও এ ব্যাপারে সঠিক পথ নির্দেশ থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এ বিপদের চিকিৎসা আর এ বিভ্রান্তির সংস্কার যদি কোথাও থাকতে পারে তা কেবল আল্লাহর বিধান। আর বিশ্বে কেবল মুসলমানরা-ই সেই দল, যারা আল্লাহর শরীয়তের প্রতিনিধিত্ব করে। সুতরাং সম্মুখে অগ্রসর হয়ে সেই অজ্ঞতাপ্রসূত ধ্যাণ-ধারণার শিকড় কর্তন করা যা দাবানলের মতো গোটা বিশ্বকে গ্রাস করার জন্য এগিয়ে আসছে। তাদের কর্তব্য হচ্ছে বিশ্বের প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠীকে উদ্ধাত্ত কন্ঠে একথা জানিয়ে দেয়া যে, তোমাদের জন্য কেবল স্বাধীনতা উন্নতি-অগ্রগতি এবং মান-মার্যাদারই নয়, বরং তার সঙ্গে সঙ্গে শান্তি-নিরাপত্তার এবং সত্যিকার সমৃদ্ধি ও আগ্রগতির পথ কেবল তা-ই যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর রাসূল নিয়ে এসেছেন। শয়তানের পক্ষ থেকে ধ্বংস ও বিপর্যয়ের ইমাম তোমাদেরকে যে পথ দেখাচ্ছে, তা সত্যিকার মুক্তি ও সমৃদ্ধির পথ নয়।

কিন্তু বর্তমান যুগের সবচেয়ে বড় ট্রাডেজি তথা বিয়োগান্ত ঘটনা এই যে, বিশ্বকে ধ্বংস ও বিভ্রান্তি-বিপথগামিতা থেকে রা করতে পারে যে মুসলিম দলটি, বিশ্বের বুকে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের মিশন প্রতিষ্ঠা আর প্রসারের দায়িত্ব দিয়ে আলাহ যাদেরকে প্রেরণ করেছেন তারা আজ নিজেদের সে দায়িত্বের কথা বিস্মৃত হয়ে বসে আছে। হিদায়াতের মশাল নিয়ে অন্ধকারে হাবুডুবু বিশ্বকে আলোকিত করার পরিবর্তে আজ তারা নিজেরাই বিভ্রান্ত জনগোষ্ঠীর পিছু পিছু ছুটার জন্য উদ্যত হয়েছে। দুঃখের বিষয় এই যে, এ হাসপাতালে একজন মাত্র চিকিৎসক ছিলেন, এখন সে চিকিৎসকও রোগাক্রান্তদের অন্তর্ভূক্ত হতে চলেছেন!

কবি কি চমৎকার কথা বলেছেন : “মৃত্যুর জন্য সুসংবাদ, ঈসাতো নিজেই পীড়িত।”

জাতীয়তাবাদ ও ভারতবর্ষ
পূর্ববর্তী নীতিগত আলোচনা দ্বারা আমরা প্রমাণ করেছি যে, সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আঞ্চলিক জাতীয়তা ইসলামী আদর্শবাদের সাথে সাংঘর্ষিক এবং সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অতএব মুসলিম বলতে যদি এমন ব্যক্তিকে বুঝায় যার জীবনের সকল ব্যাপারে ইসলামী দৃষ্টিকোণ রয়েছে, মুসলিম বলতে এটা ছাড়া যদি অন্য কিছু না-ই বুঝায়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় যে, যেখানে যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, সে আঞ্চলিক জাতীয়তার বিরোধীতা করবেই-বিরোধীতা করাই তার একান্ত কর্তব্য্য। তাহলে কোনো বিশেষ দেশ বা অঞ্চলে দেশভিত্তিক বা আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদীর ব্যাপারে মুসলমানের ভূমিকা কি হবে-কি হতে পারে-তা নিয়ে বিশেষ কোনো বিতর্কের সৃষ্টি হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু এটা সত্ত্বেও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ (কিংবা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ) সমর্থন করার জন্য যখন আমাদের নিকট বারবার দাবী উত্থাপন হচ্ছে, তখন এ (অবিভক্ত) ভারতের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এখানে জাতীয়তাবাদের পরিণাম কি হতে পারে এবং তা দ্বারা ভারতের-তথা ভারতীয় মুসলমানদের মুক্তিলাভের কোনো সম্ভাবনা আছে কি-না, তা বিচার-বিশেষণ করে দেখা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।

জাতীয়তাবাদের মৌল উপাদান
কোনো দেশে এক জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠার জন্য সেখানে পূর্ব থেকেই এক জাতীয়তা বর্তমান থাকা-আর তা না হলে তার অস্তিত্ব লাভের সম্ভাবনা বর্তমান থাকা-একান্তই আবশ্যক। কেননা যেখানে মূলতই জাতীয়তা বর্তমান নেই, সেখানে জনগণের মধ্যে জাতি পূজার ভাবধারা সৃষ্টি হওয়া সম্ভবপর নয়। জাতীয়তাবাদের অপর নাম-ই হচ্ছে জাতিপূজার ভাবধারা। মূল স্ফুলিঙ্গই যখন নেই, তখন তা থেকে আগুন জ্বলে উঠা কিরূপে সম্ভবপর হবে? কিন্তু জাতীয়তাবাদী ভাবধারার আগুন জ্বলে উঠার জন্য কি ধরণের জাতীয়তা বর্তমান থাকা আবশ্যক ?

এক প্রকারের জাতীয়তা হয় রাজনীতির দৃষ্টিতে, তাহলো রাজনৈতিক জাতীয়তা (Political Nationalism)। অর্থাত যারা একটিমাত্র রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীন বসবাস করে তাদেরকে শুধু রাজনৈতিক ঐক্যের দিক দিয়ে ‘একজাতি’ মনে করা যেতে পারে। এ ধরণের জাতীয়তার জন্য তাকে শরীক সব মানুষের ভাবাবেগ, অনুভূতি, চিন্তা-বিশ্বাস, মতাদর্শ, তাদের নৈতিক মূল্যমান ও দৃষ্টিকোণ, তাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস, তাদের ভাষা, সাহিত্য ও জীবন যাপন পদ্ধতি এবং ধারার এক অভিন্ন হওয়া কিছুমাত্র জরূরী নয়। এসব দিক দিয়ে সেই লোকদের বিভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে এক রাজনৈতিক জাতীয়তা বর্তমান রয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। আর তারা যতোদিন রাজনৈতিক ও শাসনের দিক দিয়ে এক থাকবে এ জাতীয়তার আয়ুও ঠিক ততোদিন-ই টিকে থাকবে। কিন্তু তাদের বিভিন্ন সমাজ যদি বিভিন্ন ও পরস্পর বিরোধীও হয়ে যায়-এমনকি তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও জাতীয় প্রেরণাও যদি পরস্পর সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে এবং সেই কারণে পরস্পরের বিরুদ্ধে বাস্তব চেষ্টা চালানো হয়, তাহলেও তাদের রাজনৈতিক জাতীয়তা এক-ই থাকবে। এধরণের জাতীয়তাকে যদিও একটা জাতীয়তা নামে অভিহিত করা যায়; কিন্তু ঠিক একজাতীয়তা সৃষ্টির জন্য যে ভাবধারা ও বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক তা এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত-ই মনে করতে হবে।

জাতীয়তার অপর একটি রকম হলো সাংস্কৃতিক জাতীয়তা (Cultural Nationalism) এ জাতীয়তা কেবলমাত্র সেই লোকদের মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে, যাদের ধর্ম এক, চিন্তা ও মতাদর্শ, আবেগ-অনুভূতি, মূল্যবোধ এক, যাদের মধ্যে একই ধরণের নৈতিক গুণাবলী পাওয়া যাবে, যারা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারসমূহে একই ধরণের দরদ ও দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করে এবং তার প্রভাবে জীবনের সাংস্কৃতিক ও সামষ্টিক ক্ষেত্রে একই ভাবধারা প্রকাশিত হবে। ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, হারাম-হালাল ও পবিত্র-অপবিত্র প্রভৃতি নির্ধারণের মানদণ্ড একই রকম। এরা পরস্পরের অনুভূতি গভীরভাবে অনুধাবন করে, পরস্পরের স্বভাব-অভ্যাস, চরিত্র ও আগ্রহ-ঔৎসুক্যের সাথে সুপরিচিত। একজনের আনন্দে অন্যেরা আনন্দ এবং একজনের দুঃখ ও বিপদে অন্যেরা সমান দুঃখ ও বিপদ মনে করে। তাদের সমাজে রক্ত ও মনের সম্পর্ক ব্যাপক ও গভীরভাবে গড়ে উঠে। তারা একই প্রকারের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়। মোটকথা, মানসিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক ও সামষ্টিক দিক দিয়ে তারা একদল, একসমাজ এবং এক ও অবিভাজ্য সমাজে পরিণত হয়। লোকদের মধ্যে কেবলমাত্র এরূপ ভাবধারার দিক দিয়েই জাতীয় প্রেরণা ও উদ্বোধণ সৃষ্টি হতে পারে এবং এটাই হতে পারে জাতীয়তার ভিত্তি। কেবলমাত্র এ সমাজে একটা জাতীয় রূপ, ধরণ ও এক অভিন্ন জাতীয় আদর্শবাদ লালিত-পালিত ও ক্রমবিকশিত হতে পারে। এটাই উত্তরকালে একজাতীয়তা সৃষ্টি করে ও জাতীয়তার সমচেতনা (National self) জাগিয়ে তোলে। আঞ্চলিক বা দেশ-ভিত্তিক একজাতীয়তা এহেন ভাবধারার জন্য মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আসে।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদে কিভাবে মুক্তি আসতে পারে ?
উল্লেখিত বিশ্লেষণ সামনে রেখে ভারতবর্ষের পরিস্থিতি যাচাই করলেই জাতীয়তাবাদের উল্লেখিত ভিত্তি এখানে বর্তমান আছে কি-না, তা নিশ্চিতরূপে বুঝতে পারা যাবে। ভারতবর্ষে রাজনৈতিক জাতীয়তা নিশ্চয়ই বর্তমান রয়েছে, কারণ এ দেশের অধিবাসীগণ একই শাসনব্যবস্থার অধীন জীবন যাপন করছে। তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের উপর একই প্রকার আইন চালু রয়েছে এবং তাদের সকলকেই একটি মাত্র লৌহশক্তি কঠিন বাঁধনে বন্দী করে রেখেছে। কিন্তু পূর্বেই বলেছি, নিছক রাজনৈতিক জাতীয়তা, জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট নয়। এরূপ জাতীয়তা অস্ট্রেলিয়া, হাঙ্গেরী, বৃটেন, আয়ারল্যাণ্ড এবং আরো অনেক সাম্রাজ্যেও বর্তমান ছিল। এখনো অনেক দেশে তা বর্তমান রয়েছে। কিন্তু তা কোনো দেশে ‘জাতীয়তাবাদের’ সৃষ্টি করেনি। স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে মিলিত হওয়া কিংবা দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মুসীবতে সমভাগী হওয়ার কারণেও জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করতে পারে। আর প্রত্যেক চাক্ষুষ্মান ব্যক্তিই এক দৃষ্টিতে বুঝতে পারে যে, ভারতবর্ষের অধিবাসীদের মধ্যে কোনো প্রকার সাংস্কৃতিক জাতীয়তার অস্তিত্ব আদৌ বর্তমান নেই।

প্রকৃত ব্যাপার যখন এটাই, তখন জাতীয়তাবাদের উল্লেখ করে লাভ কি ? যেখানে মা’র কোনো অস্তিত্ব নেই, সেখানে সন্তানের উল্লেখ নিবৃর্দ্ধিতা ভিন্ন আর কি হতে পারে! আর এতদসত্ত্বেও যারা এ দেশে জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখছে, তাদের একথা ভাল করেই জেনে নেয়া আবশ্যক যে, সাংস্কৃতিক জাতীয়তার গর্ভেই এ ‘সন্তানে’র জন্ম হতে পারে। এবং তার জন্মের পূর্বে তার মায়ের জন্ম হওয়া একান্ত আবশ্যক। এ তত্ত্ব জেনে নেয়ার পর তাদের দাবী পরিবর্তন করা অবশ্যাম্ভাবী হয়ে পড়ে এবং ভারতবর্ষে এ জাতীয়তার নাম নেয়ার পূর্বেই তাদেরকে সাংস্কৃতিক জাতীয়তা সৃষ্টির জন্য আত্মনিয়োগ করতে হবে। অন্যথায় ভারতীয় জাতীয়তার জন্ম কিছুতেই সম্ভব নয়।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদ কিরূপে সৃষ্টি হতে পারে ?
অতপর ভারতবর্ষে এক সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি এবং তার সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করা অত্যন্ত জরূরী।

বস্তুত যে দেশে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক জাতীয়তা রয়েছে, তথায় এক জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির মাত্র দুটি উপায়ই হতে পারে : এক : একজাতির সভ্যতা-সংস্কৃতি অন্যান্য সকল জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতিকে গ্রাস করবে। অথবা দুই : সকলের পারস্পারিক নিবিড় মিলন ও সংমিশ্রণের সাহায্যে এক সর্বজাতীয় ও সম্মিলিত সভ্যতার সৃষ্টি করা হবে।

প্রথম উপায়টি সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা অনাবশ্যক। কারণ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নেতৃবৃন্দ সেরূপ করাকে নিজেদের লক্ষ্যরূপে গ্রহণ করেননি। তবে যারা ‘হিন্দু জাতীয়তা’ কিংবা ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’১ সৃষ্টি করতে চান, তারা এ উপায় অবলম্বন করতে পারেন। সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদীগণ কেবলমাত্র দ্বিতীয় উপায়ই অবলম্বন করতে পারেন। এজন্য এ দেশের বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে এক নবতর জাতীয়তা সৃষ্টির জন্য তারা প্রায়ই আলোচনা করে থাকেন। কিন্তু তাদের বালকোচিত কথাবার্তা শুনে মনে হয়, তারা সাংস্কৃতিক জাতীয়তার প্রকৃত অর্থ মাত্রই বুঝতে পারেননি। এই প্রকার জাতীয়তাসমূহের সংমিশ্রণ কোন্ নিয়মনীতি অনুসারে হতে পারে, সেই সম্পর্কেও তারা মাত্রই অবহিত নন। আর এরূপ সংমিশ্রণ সাধনের ফলে কোন ধরণের জাতীয়তা রূপ লাভ করতে পারে, সে বিষয়েও তাদের ধারণা নেই। এ কাজকে তারা ‘ছেলে খেলা’ মনে করেন, আর নিতান্ত ছেলেদের মতোই এ ক্রীড়া তারা খেলতে চান।

বস্তুত একটি জাতির বুদ্ধি, প্রকৃতি ও নৈতিক ব্যবস্থারই নাম হচ্ছে সাংস্কৃতিক জাতীয়তা। আর এরূপ জাতীয়তা এক-দুদিনে কখনই রূপ লাভ করতে পারে না। কয়েক শতাব্দীকাল ধরে ক্রমাগতভাবে তার বিকাশ ঘটে থাকে। কয়েক শতাব্দীকাল পর্যন্ত কিছুসংখ্যক লোক যখন বংশানুক্রমিকভাবে একই প্রকার ধারণা, বিশ্বাস, প্রথা ও রীতিনীতির অধীন জীবনযাপন করে, তখনি তাদের মধ্যে এক মিলিত ও সর্বসম্মত ভাবধারার সৃষ্টি হয়, সম্মিলিত নৈতিক গুণাগুণ সুদৃঢ় হয়, এক বিশিষ্ট বৃদ্ধি-প্রকৃতি গড়ে উঠে। যেসব ঐতিহ্যের সাথে তাদের মনের আবেগ-উচ্ছাস (sentiments) সংযোজিত থাকে, তাই অত্যন্ত গভীর হয়ে বসে। তাদের মন ও মস্তিষ্কের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবধারা ফুটে ওঠে তাদের সাহিত্যে। তাদের মধ্যে আধ্যাত্মিক ও মানসিক ঐক্যরূপে গড়ে উঠে। ফলে তাদের মধ্যে পারস্পারিক বন্ধুতা ও সমঝোতার (Mutual Intelligibility) সৃষ্টি হয়। এসব গভীর ও সুদৃঢ় প্রভাবের দরুন যখন কোনো দলে স্বতন্ত্র জাতীয়তা গড়ে ওঠে- অন্যথায় তার নৈতিক ও বুদ্ধিগত প্রকৃতি যখন সুদৃঢ় হয়, তখন অন্য কোনো দলের সাথে সংমিশ্রিত হয়ে অন্য কোনো জাতীয়তায় রূপান্তরিত হওয়া তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় এ দল শত শত বছর কাল পর্যন্ত একই আবহাওয়ায়, পরিবেশে ও একই ভূ-খণ্ডে পাশাপাশি বসবাস করে; কিন্তু তবুও এদের কোনোরূপ সংমিশ্রণের সৃষ্টি হয় না। ইউরোপে জার্মান, মগিয়ার, পোল, চেক, ইহুদী, সালাফী এবং এ প্রকারের অন্যান্য অনেক জাতি দীর্ঘকাল ধরে একই স্থানে জীবন যাপন করছে; কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের মধ্যে কোনো প্রকার মিলন সৃষ্টি হয়নি। ইংরেজ ও আইরিশ যুগ-যুগান্তকাল একই সাথে বসবাস করছে; কিন্তু মধ্যে তাদের কোনো প্রকার মিলন সৃষ্টি হয়নি। কোনো কোনো দেশে এ প্রকার জাতিসমূহের ভাষা এক হলেও তাদের মন ও হৃদয়ে কোনো দিক দিয়েই সাদৃশ্যের সৃষ্টি হয়নি। শব্দ এক হতে পারে, কিন্তু তা প্রত্যেক জাতির হৃদয়-মনে স্বতন্ত্র ভাবধারা ও মতবাদের প্রবাহ জাগায় যা সম্পূর্ণরূপে পরস্পর বিরোধী।

বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দলের নৈতিক বিধান ও বুদ্ধি-প্রকৃতির মধ্যে যদি বিরাট কোনো পার্থক্য না থাকে, বরং তা যদি পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ চরিত্র বিশিষ্ট্য হয়, তবে তখনই একত্রে বসবাস ও দীর্ঘকাল পর্যন্ত পারস্পারিক সংমিশ্রণের ফলে এ ধরণের দলগুলোর পরস্পর মিলিত একটি খাঁটি, পরিপূর্ণ ও যুক্ত জাতীয়তার সৃষ্টি করা সম্ভব। এ অবস্থায় তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং স্বতন্ত্র জাতীয় সত্তা নিঃশেষে মিলে যায়। তখন এক সর্বদলীয় নৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। কিন্তু এ কাজ নিমেষ মাত্র সময়ের মধ্যে হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। দীর্ঘকাল ধরে বহু ভাঙা-গড়া ও ঘাত-প্রতিঘাতের পরই বিভিন্ন অংশের পরস্পর মিলিত হওয়ার ফলে এক স্বতন্ত্র প্রকৃতি জেগে ওঠে। ইংল্যাণ্ডে ব্রাইটন, হেকসন ও নারীমণ্ডী জাতিসমূহের এক জাতিতে পরিণত হতে শত শত বছর অতিবাহিত হয়েছে। ফ্রান্সে দশ শতাব্দী থেকে এ কাজ চলছে। কিন্তু এখনও জাতীয়তার উৎসমূলের সন্ধান পাওয়া যায়নি। যেসব বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে ইটালীয় জাতীয়তার রূপায়ন হয়েছে, নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে তারা পরস্পর বিরোধী না হওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত তথায় জাতীয় ভাবধারার সৃষ্টি হতে পারেনি। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে কেবল তাদের নিয়েই ‘একজাতি’ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে, যারা প্রায় সকল দিক দিয়েই সামঞ্জস্যপূর্ণ চরিত্র সম্পন্ন এবং যারা স্বার্থের সামান্য দ্বন্দ্ব পরিহার করে অনতিবিলম্বে ‘একজাতি’ হতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এ কাজ সম্পন্ন হতে দু-তিন শতাব্দীকাল অতীত হয়েছে।

একই প্রকার চরিত্র সমন্বিত জাতিসমূহের সংমিশ্রণে একটি বিশিষ্ট ও উৎকৃষ্ট জাতীয়তার সৃষ্টি কেবল এজন্যই সম্ভব হয়ে থাকে যে, এ সংমিশ্রণ কার্য সম্পন্ন করার সময় তাদেরকে নিজেদের মতবাদ, বিশ্বাস ও নৈতিক মানদণ্ড পরিহার করা এবং নিজেদের উচ্চ ও উন্নত নৈতিক গুণাবলীর মূলোৎপাটন করার কোনোই আবশ্যক হয় না। বরং এসব জিনিসই তাদের মধ্যে বহু পূর্ব থেকেই বর্তমান থাকে। কেবল ঐতিহ্য-ইতিহাসের রদ-বদল এবং আবেগ, উচ্ছাস, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পুনঃ প্রতিষ্ঠা (Readjustment) দ্বারাই তাদের এ নবতম জাতীয়তা স্থাপিত হতে পারে। পক্ষান্তরে, যেখানে বিভিন্ন প্রকার নৈতিক চরিত্র বিশিষ্ট জাতিসমূহের মধ্যে কোনো প্রকার কৃত্রিম চাপ, কোনো প্রকার অস্বাভাবিক প্রচেষ্টা এবং কোনো সাধারণ কারণে এ সংমিশ্রণ সাধিত হয়, সেখানে সর্বাপেক্ষা হীন ও নিকৃষ্ট জাতীয়তাই গড়ে ওঠে। কারণ, এমতাবস্থায় তাদের মতবাদের ভিত্তিমূল শিথিল হয়ে যায়। তাদের উন্নত নৈতিক চরিত্র-যার স্বাতন্ত্রমূলক বৈশিষ্ট্যের দরুন আজ পর্যন্ত সংমিশ্রণ হয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না, নিঃশেষে বিলীন হয়ে যায়। তাদের জাতীয় সত্তার অনুভূতি-যার ভিত্তিতে তার জাতীয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল-খতম হয়ে যায়। তাদের প্রত্যেক জাতিই নিজ নিজ শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশিষ্টতার মানদণ্ড পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের নতুন জাতীয়তা তাদের প্রত্যেকেরই নৈতিক পংকিলতার একটি সমষ্টিতে পরিণত হয়। এ ধরণের সংমিশ্রণে সংশ্লিষ্ট জাতিসমূহের নৈতিক চরিত্রের মেরুদণ্ড চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। অতপর নবতর নৈতিক চরিত্র গড়ে উঠতে দীর্ঘ সময়ের আবশ্যক হয়। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব প্রাচীন ঐতিহ্যের সাথে তাদের সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়, নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি হওয়ার জন্য দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়। নিজ নিজ জাতীয় ধরণকে তারা নিজেরাই চুরমার করে-কিন্তু নতুন জাতীয় ধরণ তৈরি করতে বহুকাল অবকাশের আবশ্যক হয়।

যারা এরূপ মারাত্মক পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত হবে, তাদের প্রকৃতি কখনই মযবুত হতে পারে না, তারা হবে হীন চরিত্র, সংকীর্ণমনা, উদ্দীপনাহীন ও নীতিহীন। যে পবিত্র বৃন্তচ্যুত হয়ে মাটিতে ঝরে পড়েছে, তার যেমন কোনোরূপ স্থিতি নেই-বায়ুর প্রত্যেকটি প্রবাহে তা একস্থান থেকে অন্য স্থানে গড়াতে থাকে, ঐসব জাতির প্রকৃত অবস্থা সেরূপই হয়ে থাকে। দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে বিভিন্ন চরিত্র বৈশিষ্ট্য জাতিসমূহের পারস্পারিক সংমিশ্রণের পরিণতি যারা দেখেছে, তারা প্রত্যেকেই একবাক্যে সাক্ষ্য দেয় যে, এর ফলে সংশ্লিষ্ট জাতিসমূহের নৈতিক সৌন্দর্য একেবারেই খতম হয়ে গেছে এবং এর দরুন সেই দেশের অধঃস্তন পুরুষ জ্ঞান-বুদ্ধি, নৈতিক চরিত্র ও দেহ-সংস্থার দিক দিয়ে একেবারে নিকৃষ্ট হয়ে জন্মগ্রহণ করছে।

সমাজ বিজ্ঞান সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক স্বার্থপরতার উর্ধ্বে থেকে প্রকৃত ব্যাপার সম্পর্কে স্বাধীন মত প্রকাশে সমক্ষ কোনো ব্যক্তিই পাক-ভারতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক জাতিসমূহকে সামঞ্জস্যপূর্ণ চরিত্র বিশিষ্ট বলে মনে করতে পারে না। কারণ, ইউরোপের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক জাতীয়তার মধ্যে যতোখানি বৈষম্য রয়েছে, পাক-ভারতের বর্তমান জাতিসমূহের মধ্যে বিশ্বাসের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে উদয়-তোরণ ও অস্ত-গগনের দূরত্ব রয়েছে। এদেশের সভ্যতা-সংস্কৃতির মূলনীতিসমূহ পরস্পর বিরোধী, ঐতিহ্যসমূহের উৎসমূল সম্পূর্ণরূপে বিভিন্ন। অভ্যন্তরীণ হৃদয়াবেগ ও ভাবধারা পরস্পর বিরোধী। একটি জাতির জাতীয় ধরণের সাথে অন্য জাতির জাতীয় ধরণের বিন্দুমাত্র সামঞ্জস্য নেই। নিছক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য এ বিভিন্ন জাতীয়তাকে নির্মূল করে একটি যুক্ত জাতীয়তা সৃষ্টি করার পরিণাম পূর্ব বর্ণিত কারণে মারাত্মক হবে। দুর্ভাগ্যবশত দেড় শতাব্দী কালের বৃটিশ প্রভুত্ব ভারতের জাতিসমূহকে পূর্ব থেকেই নৈতিক চরিত্রহীনতার গভীরতর পংকে নিমজ্জিত করে দিয়েছে। দাসত্বের খুন তাদের মনুষ্যত্ববোধকে অন্তঃসারশূন্য করে দিয়েছে। তাদের নৈতিক চরিত্রের ভয়ানক পতন ঘটেছে। অধঃস্তন পুরুষের মধ্যে এ মারাত্মক পতন সর্বগ্রাসী কুফল এনে দিয়েছে। এ সংকট মুহূর্তে নতুন জাতিগঠনের কাজ শুরু করার জন্য তাদের ধ্বংসাবশিষ্ট সংস্কৃতির ভিত্তিতে আঘাত হানলে সমগ্র দেশের নৈতিক-বাঁধন আকস্মিকভাবে ছিন্নভিন্ন হবে এবং তার পরিণাম খুবই ভয়াবহ!

পাক-ভারতের কোনো কল্যাণকামীই কি একজাতীয়তা সমর্থন করতে পারে ?
এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মনে করেন যে, বৈদেশিক শক্তির গোলামীর নাগপাশ থেকে মুক্তিলাভ করার জন্য এ দেশে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করা অপরিহার্য। আর জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির প্রয়োজন একজাতীয়তা। কাজেই বর্তমানের সকল জাতীয়তাকে নির্মূল করে এক সর্বদলীয় জাতীয়তা গঠন করা আবশ্যক। অথচ প্রকৃতপক্ষে তাদের এ চিন্তা একেবারেই অমূলক। তাদের মধ্যে যদি নির্ভূল অর্ন্তদৃষ্টি বর্তমান থাকতো এবং পাশ্চাত্যেও মানসিক গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে যদি তারা চিন্তা করতে চেষ্টা করতেন, তবে তারা নিঃসন্দেহে বুঝতে পারতেন যে, একজাতীয়তার পথে পাক-ভারতের বিন্দুমাত্র মুক্তি নেই-আছে মারাত্মক ধ্বংস ও বিলুপ্তি।

প্রথমত, এ পথে জাতীয়তা লাভ করতে দীর্ঘকাল সময় লাগবে। শত-সহস্র বছরের ঐতিহ্যের ভিত্তিতে যে সাংস্কৃতিক জাতীয়তা গড়ে উঠেছে, তা নির্মূল করে তদস্থলে এক নবতর জাতীয়তা গড়ে তোলা এবং এ নতুন জাতীয়তা মযবুত ও সক্রিয় হয়ে এক জাতীয়তা পর্যন্ত উপনীত হওয়া মাত্রই সহজসাধ্য নয়। সে জন্য দীর্ঘকালের দরকার হবে। দ্বিতীয়ত এ পথে জাতীয়তা লাভ হলেও শেষ পর্যন্ত সমগ্র দেশের চরম নৈতিক চরিত্রহীনতা নিম্নতম পংকে নিমজ্জিত হওয়ার নিশ্চিত আশংকা রয়েছে। তৃতীয়ত যেসব জাতি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য এবং স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখার পক্ষপাতী, তারা এ ধরণের একজাতীয়তা সৃষ্টির বিরুদ্ধে প্রাণপন চেষ্টা করবে এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলে আযাদী যুদ্ধের জন্য কোনো যুক্ত প্রচেষ্টা গড়ে ওঠা সম্ভব হবে না। ফলে বৈদেশিক শাসন-নিগড় থেকে মুক্তিলাভও সুদূরপরাহত হবে। এমনকি, এ পথে চেষ্টা করলে রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্বপ্ন চিরতরে ম্লান হয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।

কাজেই পাশ্চাত্য জাতিদের অনুকরণে যারা জাতীয়তাবাদকেই স্বাধীনতা লাভের একমাত্র অস্ত্র বলে মনে করে, আমার মতে-তারা নির্বোধ ও অজ্ঞ। আমি পূর্বেও বলেছি, এখনো বলছি : ভারতের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি লাভের জন্য বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে ঐক্য ও জাতীয়তাবাদের মূলত-ই কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। যে দেশে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক জাতীয়তা বর্তমান রয়েছে, সেখানে একজাতীয়তার জন্য চেষ্টা করা কেবল বাহুল্য মাত্রই নয়, নীতি হিসাবে তা মারাত্মক ভুলও বটে। উপরন্তু পরিণামের দিক দিয়ে তা কিছুমাত্র কল্যাণকর না হয়ে বিরাট অকল্যাণেরই সৃষ্টি করবে, সন্দেহ নেই।

ফিরিংগী পোশাক
মাওলানা সিন্ধী ভাষণের শেষাংষে মুসলমানদেরকে হাফপ্যান্ট, কোট-পাতলুন ও হ্যাট ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। এ আলোচনার শেষভাগে আমি এ সম্পর্কেও আলোচনা করতে চাই।

প্রাচ্যের এ জাতীয়তাবাদীরা এক আশ্চর্য ধরণের জীব। একদিকে তারা জাতীয়তাবাদের প্রবল প্রচার চালাচ্ছে, অন্যদিকে ভিন্ন জাতি ও ভিন্ন দেশের পোশাক ও তামাদ্দুনিক রীতিনীতি গ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করছে না। শুধু তাই নয়, ভিন্ন জাতির পোশাক ও তামাদ্দুনিক রীতিনীতিকে নিজেদের জাতির মধ্যে প্রচলিত করার উদ্দেশ্যে তাকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক অনিবার্য কার্যসূচী হিসেবেই গ্রহণ করার জন্যও তারা চেষ্টা করছে। এমনকি, যেখানে শক্তি প্রয়োগ করা সম্ভব, সেখানে বলপূর্বক এটা দেশবাসীর মাথার ওপর চাপাতে চেষ্টা করছে। ভারতবর্ষ, ইরান, মিশর, তুরস্ক-সর্বত্রই জাতীয়তাবাদীদের এ একই অবস্থা। অথচ জাতীয়তাবাদ-এ শব্দে জাতীয় সম্মানবোধের ভাব কিছুমাত্রও যতি বর্তমান থেকে থাকে, তবে প্রত্যেক জাতিরই নিজ জাতীয় পোশাক-পরিচ্ছদ এবং সভ্যতা তামাদ্দুনের ওপর সুদৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ও তাতেই আত্মমর্যাদা অনুভব করা এবং তা নিয়ে গৌরব করাই কর্তব্য। আর যেখানে জাতীয় সত্তার বিন্দুমাত্র অনুভূতি বর্তমান নেই সেখানে জাতীয়তাবাদ সুস্পষ্টরূপে পরস্পর বিরোধী। কিন্তু আমাদের প্রাচ্য দেশীয় জাতীয়তা-বাদীগণ এ পরস্পর বিরোধী ভাবধারার সংমিশ্রণ সাধনে সিদ্ধহস্ত। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, চিন্তা ও কাজের বৈষম্য ও বিরোধ থেকে বাঁচার জন্য অনাবিল সুস্থ মানসিকতা এবং সংস্কারমুক্ত উদার উচ্চ দৃষ্টি আবশ্যক। আর এটাই যদি কেউ লাভ করতে পারে, তবে প্রকৃতির সহজ-সরল পথ পরিত্যাগ করে তথাকথিত জাতীয়তাবাদের আশ্রয় নেয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তাই তার হবে না।

সর্বপরি তাদের এ নীতির প্রতি ইসলামের বিন্দুমাত্র সমর্থন নেই। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সহজ-সরল, ঋজু, আড়ম্বরহীন অকৃত্রিম পন্থারই নাম হচ্ছে ইসলাম। জাতীয়তার সীমালংঘনকারী বাড়াবাড়ি যেমন ইসলামের মনঃপূত নয়, তেমনি জাতীয়তার সংগত ও স্বাভাবিক সীমাভংগকারী, জাতিসমূহের স্বাতন্ত্র (Individuality) ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ নিশ্চিহ্নকারী এবং তাদের মধ্যে পংকিল কলুষ চরিত্র সৃষ্টিকারী কোনো জিনিসকেও ইসলাম মাত্রই বরদাশত করতে পারে না।

কুরআন শরীফ ঘোষণা করেছে : মানুষ যদিও একই মূল থেকে উদ্ভুত, কিন্তু তবুও আল্লাহ তা’য়ালা তাদের মধ্যে মাত্র দু’প্রকারের পার্থক্য সৃষ্টি করার অবকাশ রেখেছেন। প্রথম স্ত্রী ও পুরুষের পার্থক্য এবং দ্বিতীয় বংশ, গোত্র ও জাতীয়তার পার্থক্য। يَايُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقنَاكُمْ من ذَكَرٍ وَّاُنْثَى وَجَعَلناكُم شُعُوْبًا وَّقَابَائــــلَ لِتَعَارِفُوا ط – (الحجرات : ১৩) “হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে একই স্ত্রী-পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করে দিয়েছি-শুধু এজন্য যে, যেন তোমরা পরস্পর পরস্পরকে চিনতে পারো।” -সূরা আল হুজুরাত : ১৩ وَاِنَّهً خَلَقَ الزَّوْجَيْنِ الذَّكَرَ وَالاُنْثَى – (النجم : ৪৫) “এবং আল্লাহ তা’য়ালা পুরুষ ও স্ত্রী এ দুটি লিঙ্গ বিশিষ্ট্য মানুষ সৃষ্টি করেছেন।” -সূরা আন নাজম : ৪৫

বস্তুত এ উভয় প্রকার পার্থক্য সৃষ্টিই মানব সভ্যতা ও সামাজিক জীবন ধারার মূলভিত্তি। অতএব একে যথযথভাবে বজায় রাখায় হলো আল্লাহর সৃষ্ট বিশ্বপ্রকৃতির স্বাভাবিক দাবী। স্ত্রী ও পুরুষের পারস্পারিক মনের টান ও আকর্ষণ-শক্তি জাগ্রত করার জন্যই এদের মধ্যে লিঙ্গগত পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে। কাজেই সমাজ ও বিশাল তামাদ্দুনের ক্ষেত্রে উভয়েরই স্বাভাবিক গুণ-বৈশিষ্ট্যসমূহ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংরক্ষিত হওয়া একান্তই অপরিহার্য। অপরদিকে মানুষের পরস্পরের মধ্যে তামাদ্দুনিক সম্প্রীতি ও সহযোগিতা সৃষ্টির জন্য তাদের এক একটি সামাজিক পরিবেষ্টনী ও ক্ষেত্র তৈরি অত্যন্ত আবশ্যকীয় বিধায় জাতিসমূহের পারস্পারিক পার্থক্য রা করা দরকার। এজন্যই প্রত্যেক মানব দল বা সমাজ ও তামাদ্দুনিক পরিবেষ্টনীর কিছু না কিছু পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ হওয়া অপরিহার্য। এর ফলে একই ভালবাসার সৃষ্টি হতে পারবে, পরস্পরকে অনুধাবন করতে পারবে। আর অন্যান্য পরিবেষ্টনীর মানুষ থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রা করতে পারেব। অতএব এতে আর কোনোই সন্দেহ থাকতে পারে না যে, ভাষা, পোশাক, জীবন যাত্রার ধারা ও তামাদ্দুনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ পার্থক্য দরকারী উপাদান। এদের যথাযথ সংরক্ষণ প্রকৃত স্বভাব-নীতিরই দাবী।

ঠিক এ কারণেই ইসলামে ‘তাশাব্বুহ’ (تَشَبُّه অর্থাৎ পরের সাথে নিজেকে পুরোপুরি মিলিয়ে দেয়া বা নিজেকে অপরের বাহ্যিক বেশে সজ্জিত করা)-কে নিষেধ করা হয়েছে। হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে : পুরুষের পোশাক পরিধানকারিণী স্ত্রীলোক এবং স্ত্রীলোকের পোশাক পরিধানকারী পুরুষের ওপর নবী করীম (সা.) অভিসম্পাত করেছেন। অপর একটি হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে : স্ত্রীলোকের বেশ ধারণকারী পুরুষদেরকে এবং পুরুষদের বেশ ধারণকারিণী স্ত্রীলোকদেরেক নবী করীম (সা.) অভিশপ্ত বলে ঘোষণা করেছেন। এর একমাত্র কারণ এই যে, স্ত্রী ও পুরুষের পরস্পরের মধ্যে আল্লাহ তা’য়ালা মনের যে টান ও আকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন, পরস্পরের বেশ পরিবর্তনের ফলে অনিবার্যরূপে তা নিভে যায়। আর ইসলাম তা স্বয়ং মানবতার সংরক্ষণের জন্য বাঁচিয়ে রাখতে চায়। অনুরূপভাবে জাতিসমূহের পারস্পারিক পোশাক, তামাদ্দুন ও প্রধান লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্যসমূহ নিশ্চিহ্ন করা বা পরস্পর অদল-বদল করে কোনো মিশ্র সংস্কৃতি সৃষ্টি করা সামাজিক শান্তি, স্থৈর্য, স্বার্থ ও কল্যাণের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এজন্যই ইসলামও তার বিরোধীতা করে। জাতীয় স্বকীয়তাকে তার স্বাভাবিক সীমালংঘন করে জাতীয়তাবাদ বা জাতি পূজায় পরিণত করলেই ইসলাম তার বিরুদ্ধে জিহাদ করবে। কারণ, তার ফলেই জাহেলী অহমিকা, অত্যাচারমূলক হিংসা-দ্বেষ ও সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি হয়ে থাকে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ইসলামের শত্রুতা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ (Nationalism) বা জাতিপূজার বিরুদ্ধে-জাতীয়তার (Nationality) বিরুদ্ধে নয়। ইসলাম জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে জাতীয়তাকে রক্ষা করতে চায় এবং তাকে ধ্বংস করার ততোদূরই বিরোধীতা করে, যতোদূর বিরোধীতা করে তার স্বাভাবিক সীমালংঘন করে যাওয়া। এজন্য ইসলাম যে মধ্যম ও ভারসাম্যমূলক পন্থা গ্রহণ করেছে, তা অনুধাবন করার জন্য নিম্মলিখিত নির্দেশসমূহ লক্ষণীয়:

এক : একজন সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, স্বজাতি পূজা বা জাতি-বিদ্বেষ কাকে বলে? নিজ জাতিকে ভালবাসাও কি জাতি বিদ্বেষ? উত্তরে নবী করীম (সা.) বললেন-‘না, জুলুমের কাজেও নিজ জাতির সহযোগিতা করার নামই হচ্ছে স্বজাতি পূজা। -ইবনে মাজাহ্

দুই : রাসূলে করীম (সা.) বলেছেন : যে ব্যক্তি যে জাতির বেশ ধারণ করবে, সে তাদেরই মধ্যে গণ্য হবে। -আবু দাউদ।

তিন : হযরত ওমর ফারুক (রা.) আজারবাইজানের গভর্ণর উতবা বিন ফরকদকে লিখেছিলেন : “সাধারণ মুশরিক (অর্থাত আজারবাইজানের অধিবাসীদের) পোশাক পরিধান করবে না। -কিতাবুল লিবাস ওয়ায যীনাহ

চার : হযরত ওমর (রা.) রাজ্যের সমস্ত অমুসলিম অধিবাসীকে আরবদের পোশাক-পরিচ্ছদ ও বেশ-ভূষা গ্রহণ থেকে বিরত রাখার জন্য তার সকল গভর্ণরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি, কোনো কোনো এলাকার বাসিন্দাদের সাথে সন্ধি করার সময় “তোমরা আমাদের পোশাক পরিধান করবে না” বলে একটি স্বতন্ত্র শর্তই যথারীতি চুক্তিপত্রে লিখিত হতো। -কিতাবুল খারাজ : ইমাম আবু ইফসুফ।

পাঁচ : যেসব আরববাসী সামরিক কি রাষ্ট্রীয় কার্যোপলক্ষে ইরাক ইরান প্রভৃতি দেশে মোতায়েন ছিলেন, হযরত ওমর (রা.) ও হযরত আলী (রা.) তাদেরকে নিজেদের ভাষা ও কথা বলার ভাব-ভঙ্গী সংরক্ষণ করতে এবং অনারবের ভাষা ও ভঙ্গী গ্রহণ না করতে বারবার নির্দেশ পাঠাতেন। -বায়হাকী

এ নির্দেশ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম যে ধরণের আন্তর্জাতিক ধারক, তা জাতিসমূহের স্বকীয় পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্যসমূহ নিশ্চিহ্ন করে একটি জগাখিচুড়ী সৃষ্টির পক্ষপাতি নয়। বরং তা জাতিসমূহকে তাদের জাতীয়তা ও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সহকারে স্থায়ী রেখে তাদের মধ্যে সভ্যতা, কৃষ্টি, সৌজন্য, নৈতিক-চরিত্র ও মতবাদ-চিন্তাধারার এমন একটি সুদৃঢ় বন্ধনের সৃষ্টি করতে চায়, যার দরুন আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম, টানাহেচড়া, স্নায়ুযুদ্ধ, প্রতিবন্ধকতা, অত্যাচার ও হিংসা-দ্বেষ দূর হয়ে যাবে এবং তাদের মধ্যে পরস্পর সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্বের নির্মল ভাবধারা পরিস্ফুটিত হবে। ‘তাশাব্বুহ’ বা পরানুকরণের আরো একটি দিক রয়েছে, যে জন্য ইসলাম তার প্রচণ্ড বিরোধী। একটি জাতি নিজ জাতীয় বৈশিষ্ট্য কেবল তখতি ত্যাগ করতে পারে, যখন তাদের মধ্যে কোনো মানসিক দুর্বলতা ও নৈতিক শিথিলতা দেখা দেয়। পরের প্রভাবে যে ব্যক্তি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য পরিত্যাগ করে এবং পরের রঙে নিজেকে রঞ্জিত করে, তার মধ্যে নীচতা-হীনতা, বহুরূপী ভাব, খুব শীঘ্র প্রভাবিত হওয়ার দুর্বলতা ও দায়িত্বহীন কার্যকলাপের মারাত্মক রোগ অনিবার্যরূপে বর্তমান থাকবেই; আর সাথে সাথেই এ রোগের চিকিৎসা করা না হলেই তা বৃদ্ধি পাবে ও সংক্রমিত হবে। আর বহু সংখ্যক লোকের মধ্যে এ রোগ সংক্রমিত হলে গোটা জাতিই মানসিক দুর্বলতায় নিমজ্জিত হবে। তার নৈতিক চরিত্রে দৃঢ়তা ও বীর্যবত্তা বলতে কিছুই থাকবে না। তার মনের ওপর নৈতিক চরিত্রের কোনো সুদৃঢ় ভিত্তিই স্থাপিত হতে পারবে না। কাজেই ইসলাম কোনো জাতিকেই নিজের মধ্যে এরূপ মানসিক দুর্বলতা সৃষ্টি করার অনুমতি দেয়নি। কেবল মুসলমানদেরই নয়, তার ক্ষমতায় হলে অমুসলমানদেরও এ মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে। কারণ ইসলাম কোনো মানুষের মধ্যেই নৈতিক দুর্বলতা দেখতে মাত্রই প্রস্তুত নয়।

বিশেষ করে বিজিত ও অধিকৃত লোকদের মধ্যে এ রোগ খুব তীব্র হয়ে দেখা দিয়ে থাকে। কেবল নৈতিক দুর্বলতাই নয়, তাদের মধ্যে এমন মারত্মক মনোভাবও দেখা দেয়, যার ফলে তারা নিজেদেরকেই লাঞ্ছিত ও অপমানিত বলে মনে করতে থাকে, সকল দিক দিয়েই নিজেদেরকে হীন ধারণা করতে থাকে, সকল দিক দিয়েই নিজেদেরকে হীন ধারণা করতে শুরু করে এবং শাসকগোষ্ঠীর অন্ধ অনুকরণ করেই সম্মান ও মান-মর্যাদা লাভ করতে চায়। কারণ, ইয্যত,মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, শরাফত, সভ্যতা-সংস্কৃতি-প্রত্যেকটিরই আদর্শ নমুনা তারা তাদের শাসকদের মধ্যেই দেখতে পায়। দাসত্ব তাদের মনুষ্যত্বকেই ধ্বংস করে, অতপর অপমান, লাঞ্ছনা, হীনতা ও নীচতার শরীরি বিজ্ঞাপন থেকেও তাদের বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ হয় না; বরং তাতে লজ্জার পরিবর্তে গৌরবই বোধ করে। ইসলাম মানুষকে সকল প্রকার নীচতা-হীনতার গভীর পংক থেকে উদ্ধার করে মনুষত্বের উচ্চতম শিখরে নিয়ে যেতে চায়; কাজেই কোনো মানবগোষ্ঠীকেই তা অধঃপতনের দিকে ধাবিত হতে দেখতে মাত্রই প্রস্তুত নয়। হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর খেলাফতকালে বহু অনারব জাতি যখন ইসলামী হুকুমাতের অধীন হতে লাগলো, তখন তিনি তাদেরকে আরবদের অনুকরণ করতে তীব্রভাবে নিষেধ করে দিলেন। এ জাতিগুলোর মধ্যে দাসত্বসূলভ মনোবৃত্তি জাগ্রত হলে ইসলামী জিহাদের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যেতো। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) জাতিসমূহের মনিব-প্রভূ সাজার জন্য আরবদের হাতে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেননি।

এসব কারণেই একটি জাতির অন্য জাতির হুবহু নকল করে চলার এবং তার পোশাক-পরিচ্ছদ ও জীবনযাপন পদ্ধতি অনুকরণ করার প্রচেষ্টাকে ইসলাম মাত্রই সমর্থন করেনি। তবে তাহযীব-তামাদ্দুনের পারস্পারিক লেনদেনের-পারস্পারিক সম্পর্ক-সংশ্রব রাখার দরুন বিভিন্ন জাতির মধ্যে যা হওয়া অনিবার্য-ইসলাম মাত্রই তার বিরোধী নয়-বরং এর উৎকর্ষ সাধনই তার লক্ষ্য। নিজেদের তামাদ্দুনের মধ্যে অন্য জাতির কিছুই গ্রহণ করবো না-এরূপ হিংসা-বিদ্বেষভাব সৃষ্টি করে জাতিসমূহের পরস্পরের মধ্যে বিরাট প্রাচীর খাড়া করা ইসলামের অভিপ্রেত নয়। নবী করীম (সা.) সিরিয়া দেশের ‘জুব্বা’ (Overcoat) পরিধান করেছেন-অথচ তা ইহুদীদের পোশাকের একটি অংশ। হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে : فَتَوَضَّأَ وَعَلَيْهِ جُبُّةٌ شِامِيَةٌ “নবী করীম (সা.) অযু করলেন এবং তাঁর গায়ে সিরিয়া দেশের একটি জুব্বা ছিল।” তিনি সংকীর্ণ হাতাওয়ালা রোম দেশীয় জুব্বাও ব্যবহার করেছেন। অথচ এটা রোমান ক্যাথলিক খৃস্টানরাই পরতো। নওশেরাওয়ানী ‘ক্বাবাও’ তিনি ব্যবহার করেছেন। হাদীসে তা جُبُّةٌ طَيَا لَسَةٍ كِسْرَوانِيَةٌ নামে উল্লেখ হয়েছে। হযরত ওমর (রা.) ‘ব্রবুরনুস’ নামী এক প্রকার উচু টুপী পরিধান করেছেন-এটা খৃস্টান দরবেশের পোশাকেরই একটি অংশ ছিল। এ থেকে অকাট্যরূপে প্রমাণিত হয় যে, এ ধরণের বিভিন্ন বংশগত পোশাক ব্যবহার করলে তাতে ‘তাশাব্বুহ’ হয় না। মূলত ব্যক্তির সমগ্র বেশভূষা ভিন্ন জাতির অনুরূপ হলেই এবং তাকে দেখে তার জাতীয়তা সম্পর্কে নির্দিষ্ট ধারণা করা কঠিন হলেই তখন ‘তাশাব্বুহ’ হয় এবং তা-ই ইসলামে নিষিদ্ধ। পক্ষান্তরে পারস্পারিক লেনদেন সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। একটি জাতি অন্য জাতির কোনো ভাল কিংবা অবস্থানুকূল ‘জিনিস’ নিয়ে নিজের বেশভূষার মধ্যে গণ্য করলে তাতে কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। কারণ তাতে তার জাতীয় বেশভূষা সমষ্টিগতভাবেই বর্তমান থাকে। -তরজামানুল কুরআন : ১৯৩৯ ইং


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি