জাতীয়তার মৌলিক উপাদান

উল্লিখিত দিকগুলো বাদ দিয়ে জাতীয়তার আধুনিক ভিত্তিসমূহকে তাদের নিজেস্ব দিক থেকে পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। উপরোল্লেখিত ভিত্তিসমূহ মূলত ও প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানসম্মত, না মরীচিকার ন্যায় একেবারে অন্তসারশূন্য-এখানে আমরা তাই দেখতে প্রয়াস পাব।

গোত্রবাদ
গোত্রবাদ বা বংশবাদ আধুনিক কালের জাতীয়তার একটি প্রধান ভিত্তি। কিন্তু এ গোত্রবাদের অর্থ কি? নিছক রক্তের সম্পর্ক ও একত্বেরই নাম হচ্ছে গোত্রবাদ। একই পিতা ও মাতার ঔরসজাত হওয়ার দিক দিয়ে কিছু সংখ্যক লোকের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক স্থাপিত হয়; এটাই হচ্ছে বংশবাদের প্রথম ভিত্তি। এটাই সম্প্রসারিত হয়ে একটি পরিবাররূপে আত্মপ্রকাশ করে, এটা হতেই হয় গোত্র এবং বংশ। এ শেষ সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে মানুষ তার বংশের আদি পিতা থেকে এতদূরে গিয়ে উপনীত হয় যে, তখন তার উত্তরাধিকারত্ব নিছক কাল্পনিক বস্তুতে পরিণত হয়। তথাকথিত এ বংশের সমুদ্রে বহিরাগত রক্তের অসংখ্য নদীনালার সংগম হয়। কাজেই উক্ত সমুদ্রের ‘পানি’ যে সম্পূর্ণ খাঁটি ও অবিমিশ্রিত-তার আসল উৎস থেকে উৎসারিত হয়ে পানি ছাড়া তাতে অন্য কোনো পানির ধারা মিশ্রিত হয়নি, জ্ঞান-বুদ্ধি সমন্বিত কোনো ব্যক্তিই এরূপ দাবী করতে পারে না। এরূপ সংমিশ্রণের পরও একই রক্তের সামঞ্জস্য মানুষ একটি বংশকে নিজেদের মিলন কেন্দ্ররূপে গ্রহণ করতে পারে। তাহলে আদি পিতা ও আদি মাতার রক্তের যে একত্ব দুনিয়ার সমগ্র মানুষকে পরস্পর মিলিত করে, তাকে ঐক্যের ভিত্তিস্বরূপ কেন গ্রহণ করা যেতে পারে না? আর দুনিয়ার আর দুনিয়র নিখিল মানুষকে একই বংশোদ্ভূত ও একই গোত্র বলে কেন মনে করা যাবে না? আজ যেসব লোককে বিভিন্ন বংশ বা গোত্রের প্রতিষ্ঠাতা বা ‘প্রথম পুরুষ’ বলে মনে করা হয়, তাদের সকলেরই পূর্ব পুরুষ উর্দ্ধদিকে কোথাও না কোথাও এক ছিল এবং শেষ পর্যন্ত এ সকলকেই একই মূল সূত্র থেকে উদ্ভূত বলে স্বীকার করতে হবে। তাহলে ‘আর্য’ ও ‘অনার্য’ নামে মানুষের মধ্যে এ বিভেদ কিরূপে স্বীকার করা যেতে পারে?

স্বদেশিকতা
স্বদেশিকতার ঐক্য গোত্রবাদ অপেক্ষাও অস্পষ্ট ও অমূলক। যে স্থানে মানুষের জন্ম হয়, তার পরিধি এক বর্গ গজের অধিক নিশ্চয় হয় না। এতোটুকু স্থানকে যদি সে নিজের স্বদেশ বলে মনে করে, তাহলে বোধ হয় সে কোনো দেশকেই নিজের স্বদেশ বলতে পারে না। কিন্তু সে এ ক্ষুদ্রতম স্থানের চর্তুদিকে শত-সহস্র মাইল ব্যাপী সীমা নির্ধারণ করে ও এ সীমান্তবর্তী স্থানকে সে ‘স্বদেশ’ বলে অভিহিত করে এবং উক্ত সীমারেখা বর্হিভূত এলাকার সাথে তার কোনোই সম্পর্ক নেই বলে অকুন্ঠিতভাবে প্রকাশ করে। মূলত এটা তার একমাত্র দৃষ্টিসংকীর্ণতা ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যকথায় গোটা পৃথিবীকে তারা নিজের বলে অভিহিত করতে কোনোই বাঁধা ছিলো না। এক ‘বর্গগজ’ পরিমিত স্থানের ‘স্বদেশ’ যে যুক্তির বলে সম্প্রসারিত হয়ে শত-সহস্র বর্গমাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে, ঠিক সেই যুক্তিতেই তা আরো অধিকতর বিস্তার লাভ করে নিখিল বিশ্ব তার স্বদেশে পরিণত হতে পারে। নিজের দৃষ্টিকোণ সংকীর্ণ না করলে মানুষ স্পষ্টভাবে দেখতে পারে যে, নদী-সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি যা কিছুকেই কাল্পনিকভাবে সীমারেখা হিসাবে ধরে নিয়ে একটি এলাকাকে অপর একটি এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখে, প্রকৃতপক্ষে তা একই বিশাল পৃথিবীর অংশবিশেষ; কাজেই এ পাহাড়-পর্বত ও নদী-সমুদ্র তাকে সীমাবদ্ধ একটি এলাকায় কিরূপে বন্দী করে দিতে পারে? সে নিজেকে সমগ্র পৃথিবীর অধিবাসী বলে মনে করে না? সারা দুনিয়াকে সে তার ‘স্বদেশ’ বা জন্মভূমি বলে মনে করলে সে নিজেকে গোটা ভূপৃষ্ঠের অধিবাসী বলে কেন মনে করে না? সারা দুনিয়াকে সে তার স্বদেশ বা জন্মভূমি বলে মনে করলে আর ভূ-পৃষ্ঠের অধিবাসী সমগ্র মনুষ্যজাতিকে ‘স্বদেশবাসী’ বলে অভিহিত করলে এবং ভূমিষ্ঠ হওয়ার নির্দিষ্ট স্থানটুকুতে তার যে অধিকার আছে, সমগ্র বিশ্বজগতের উপরও সেই অধিকার দাবী করলে তা ভুল হবে কেন?

ভাষাগত বৈষম্য
ভাষার ঐক্য ও সামঞ্জস্যে একই ভাষাভাষী লোকেরা পারস্পারিক আলাপ-আলোচনা ও চিন্তার আদান-প্রদান করার বিপুল সুযোগ লাভ করতে পারে, তা অনস্বীকার্য। এর দরুন জনগণের পরস্পরের মধ্যে অপরিচিতির যবনিকা উত্তোলিত হয় এবং তারা পরস্পর পরস্পরকে ‘আপন’ ও ‘নিকটবর্তী’ বলে অনুভব করতে পারে। কিন্তু চিন্তা ও মতের বাহন এক হলেই চিন্তা ও মত যে অভিন্ন এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে-এমন কোনো কথাই নেই। একই মতবাদ দশটি বিভিন্ন ভাষার প্রচারিত হতে পারে এবং এসব বিভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে চিন্তা ও মতের পরম ঐক্য স্থাপিত হওয়া শুধু সম্ভবই নয়- অতি স্বাভাবিকও বটে। পাক্ষান্তরে দশটি বিভিন্ন মত একই ভাষায় ব্যক্ত হতে পারে। কিন্তু একই ভাষায় ব্যক্ত সেই বিভিন্ন মতবাদের লোকেরা পরস্পর বিভিন্ন ও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নও হতে পারে। অতএব চিন্তা ও মতের ঐক্য-যা প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তার প্রাণবস্তু –ভাষার ঐক্যের মুখাপেক্ষী নয়। উপরন্তু ভাষার ঐক্য ও সামঞ্জস্য হলেই যে, চিন্তা ও মতবাদের ঐক্য হবে, তা কেউই বলতে পারে না। এরপর একটি গুরুতর প্রশ্ন জেগে উঠেঃ মানুষের মনুষ্যত্ব এবং তার বক্তিগত ভালমন্দ গুণের ব্যাপারে ভাষার কি প্রভাব রয়েছে? একজন জার্মান ভাষাভাষীকে-সে জার্মান। ভাষায় কথা বলে বলেই কি একজন ফরাসী ভাষাভাষীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করা যেতে পারে? বস্তুত ব্যক্তির আভ্যন্তরীণ গুণ বৈশিষ্ট্য মূলত দেখার বস্তু, ভাষা ইত্যাদি নয়। তবে নির্দিষ্ট একটি দেশের শাসন-শৃংখলা ও যাবতীয় কাজকর্মের ব্যবস্থাপনা এবং সাধারণ কাজকর্মে সেই দেশের ভাষাভাষী ব্যক্তিই অধিকতর সুফলদায়ক হতে পারে, তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু মানবতাকে বিভক্ত করা ও জাতীয় বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের ব্যাপারে ভাষা বিরোধ কোনো নির্ভুল ভিত্তি কোনোক্রমেই হতে পারে না।

বর্ণবৈষম্য
মানব সমাজে বর্ণবৈষম্য সর্বাপেক্ষা অধিক কদর্য ও অর্থহীন ব্যাপার। বর্ণ কেবল দেহের একটি বাহ্যিক গুণমাত্র; কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, মানুষ মনুষত্বের মর্যাদা তার দেহের জন্য লাভ করেনি, তার আত্মা ও মানবিকতাই হচ্ছে এ মর্যাদা লাভের একমাত্র কারণ। অথচ এর রঙ বা বর্ণ বলতে কিছু নেই। এমতাবস্থায় মানুষের মধ্যে লাল, হলুদ, কৃষ্ণ ও শ্বেত প্রভৃতি বর্ণের দিক দিয়ে পার্থক্য করার কি যুক্তি থাকতে পারে? কৃষ্ণ বর্ণের গাভী ও শ্বেত বর্ণের গাভীর দুধের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যায় না। কারণ দুধই সেখানে মুখ্য, সেখানে রক্ত বা বর্ণের কোনোই গুরুত্ব নেই। কিন্তু মানুষের দেউলিয়া বুদ্ধি আজ মানুষের আভ্যন্তরীণ গুণ-গরিমা থেকে তার দেহাবরণের বর্ণের দিকে আমাদেরকে আকৃষ্ট করেছে। এটা অপেক্ষা মর্মান্তিক দুরবস্থা আর কি হতে পারে?

অর্থনৈতিক জাতীয়তা
অর্থনৈতিক স্বার্থসাম্য মানুষের স্বার্থপরতার এক অবৈধ সন্তান; এটা কখনোই প্রকৃতির সৃষ্টি নয়। মানব শিশু মাতৃগর্ভ থেকেই কর্মশক্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। চেষ্টা ও সাধনার জন্যে এক বিশাল ক্ষেত্র তার সামনে উন্মুক্ত হয়। জীবন যাত্রার অপর্যাপ্ত উপায়-উপকরণ তাকে সাদর অ্যভ্যর্থনা জ্ঞাপন করে। কিন্তু তার জৈবিক প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার ব্যাপারে শুধু রিযে‌‌কে‌র দ্বার উন্মুক্ত হওয়াকেই সে অপরিহার্য যথেষ্ট মনে করে না, সেই সাথে অন্যের জন্যে সেই দুয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়াকেও সে অপরিহার্য বলে মনে করে। এরূপ স্বার্থপরতার ব্যাপার কোনো বিরাট মানবগোষ্ঠী সমানভাবে অংশীদার হলে যে ঐক্যের সৃষ্টি হয়, উত্তরকালে তা-ই একটি জাতি হিসাবে তাদেরকে সংঘবদ্ধ করতে বিশেষ সাহায্য করে। স্থূল দৃষ্টিতে তারা মনে করেঃ অর্থনৈতিক স্বার্থসাম্যের ভিত্তিতে সংগঠিত হয়ে তারা নিজেদের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষীত করে নিয়েছে; কিন্তু বহু সংখ্যক দল ও জাতি যখন নিজেদের চারপাশে এরূপ স্বার্থপরতার দুর্লংঘ প্রাচীর দাঁড় করে নেয়, তখন মানুষের জীবন তাদের নিজেদের কৃতকর্মের দরুন অত্যন্ত দুঃসহ হয়ে পড়ে। তাদের নিজের স্বার্থপরতাই তাদের পায়ের বেড়ী এবং হাতের হাতকড়া হয়ে বসে-অন্যের রিয্কের দরজা বন্ধ করার প্রচেষ্টায় সে নিজেরই জীবিকা ভাণ্ডারের চাবিকাঠি হারিয়ে ফেলে। আজ আমাদেরই চোখের সামনে এ দৃশ্য স্পষ্টরূপে ভাসমান রয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের রাষ্ট্রসমূহ এরই কুফল ভোগ করছে। সংরক্ষণের নিখুঁত উপায় মনে করে তারা নিজেরাই যেসব অর্থনৈতিক দূর্গ প্রতিষ্ঠিত করেছিল, সেগুলোকে কিভাবে যে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিবে, তাই আজ তাদের বোধগম্য হচ্ছে না। এরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে এখনো কি আমরা জীবিকা উপার্জনের জন্যে গোষ্ঠী বিভাগ এবং সেই সবের ভিত্তিতে জাতীয় বৈশিষ্ট্যের প্রতিষ্ঠাকে সম্পূর্ণরূপে অবৈজ্ঞানিক ও নির্বৃদ্ধিতাব্যঞ্জক বলে মনে করবো না? বস্তুত আল্লাহর বিশাল দুনিয়ায় আল্লাহর প্রদত্ত রিয্কের অনুসন্ধান ও উপার্জনের ব্যাপারে মানুষকে স্বাধীনতা দান করা, কি অমঙ্গলের অবকাশ থাকতে পারে, তা বুঝতে পারা যায় না।

রাজনৈতিক জাতীয়তা
শাসনতান্ত্রিক ঐক্য একই সরকারের অধীন হওয়া মূলত এক অস্থায়ী, ক্ষণভঙ্গুর ও ভিত্তিহীন বস্তু। এর ভিত্তিতে কখনোই সুদৃঢ়, স্থায়ী ও মযবুত জাতীয়তা স্থাপিত হতে পারে না। একই রাষ্ট্রের অধীন প্রজাসাধারণকে তার আনুগত্য করার সূত্রে গ্রথিত করে এক জাতিরূপে গঠন করার কল্পনা কখনোই সাফল্যমণ্ডিত হয়নি। রাষ্ট্র যতোক্ষণ পর্যন্ত বিজয়ী, আধিপত্যশীল ও দুর্জয় শক্তি সম্পন্ন হয়ে থাকে, ততোদিন পর্যন্ত প্রজাসাধারণ সুসংবদ্ধ হয়ে তার আইনের বন্ধনে বিজড়িত হয়ে থাকে একথা ঠিক; কিন্তু এ আইনের বাঁধন যখনই একটু শিথিল হয়ে পড়ে, বিভিন্ন ভাবধারার জনগণ নিমেষে ইতস্তত বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য। মোগল সাম্রাজ্যে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রশক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়ার পর ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় স্বতন্ত্র রাজনীতি ভিত্তিক জাতীয়তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবার পথে বিন্দুমাত্র প্রতিবন্ধকতা ছিল না। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অবস্থাও অনুরুপ ছিল। শেষকালে তুরষ্কের যুবকগণ ওসমানী জাতীয়তার প্রাসাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল বটে; কিন্তু সামান্য আঘাতেই তাসের ঘরের ন্যায় তা চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অষ্ট্রিয় হাংগেরীর উদাহরণ ইহা অপেক্ষা অধিকতর আধুনিক। ইতিহাসের পৃষ্টায় এ ধরণের ঘটনার অভাব নেই। কিন্তু এসব ঐতিহাসিক নজির প্রত্যক্ষ করার পরও যারা রাজনৈতিক জাতীয়তা স্থাপন করা সম্ভব বলে মনে করে, তাদের এ রঙিন স্বপ্ন ও উগ্র কল্পনা-বিলাসের জন্যে তারা নিশ্চয়ই ধন্যবাদার্হ।

বিশ্বমানবিকতা
উপরের বিশ্লেষণ থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, মানব জাতিকে যতো ভাগেই বিভক্ত করা হয়েছে, তার একটি বিভাগেরও মূলে কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই। এগুলো নিছক বৈষয়িক ও স্থুল বিভাগ ছাড়া আর কিছুই নয়। ফলে দৃষ্টির সামান্য বিশলতাই তার প্রত্যেকটির সীমা চূর্ণ করে দেয়। উক্ত বিভাগগুলোর স্থিতি ও স্থায়ীত্ব মূর্খতার অন্ধকার, দৃষ্টির সসীমতা এবং মনের সংকীর্ণতার উপরই নির্ভরশীল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিদ্যুৎচ্ছটা যতোই স্ফূর্ত ও বিকশিত হয়, অর্ন্তদৃষ্টি যতোই তীক্ষ্ম ও সুদূর প্রসারী হয়, অন্তরের বিশালতা যতোই বৃদ্ধি পায়, এ বস্তুভিত্তিক ও স্থূল পার্থক্য যবণিকা ততোই উত্তোলিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত বংশবাদ মানবতার জন্যে এবং আঞ্চলিকতাবাদ বিশ্বনিখিলতার জন্যে নিজ নিজ স্থল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। বর্ণ ও ভাষার পার্থক্যের মধ্যেও মানবতার মূল প্রাণবস্তুর ঐক্য উদ্ভাসিত হয়ে থাকে। আল্লাহর পৃথিবীতে আল্লাহর সকল বান্দাহর মিলিত অর্থনৈতিক স্বার্থ বিদ্যমান। রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিসীমায় কয়েকটি ছায়ামাত্র পরিদৃষ্টি হয়, সৌভাগ্য সূর্যের আবর্তনে তা ভূ-পৃষ্ঠে গতিশীল, হ্রাস-বৃদ্ধিশীল।

ইসলামের উদার মতাদর্শ
ঠিক একথাই ঘোষণা করেছে ইসলাম। মানুষ ও মানুষের মধ্যে ইসলাম কোনো বৈষয়িক, বস্তুভিত্তিক কিংবা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পার্থক্য সমর্থন করেনি। ইসলামের দৃষ্টিতে সকল মানুষ একই মূল থেকে উদ্ভূতঃ

خلقكم من نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ وَّ خَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ منهُما رِجَلاً كَثِيرًا وَّنِساءً – (النساء: ১)

‘আল্লাহ তোমাদেরকে একই ব্যক্তি সত্তা থেকে সৃষ্টি করেছেন। অতপর তা থেকে তার জুড়ি সৃষ্টি করেছেন। এবং উভয়ের মিলনে অসংখ্য পুরুষ ও স্ত্রীলোককে দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন।” -সূরা আন নিসাঃ১

মানুষের জন্মস্থান কিংবা সমাধিস্থানের পার্থক্য কোনো মৌলিক পার্থক্য নয়, মূলত সমস্ত মানুষ সম্পূর্ণরূপে একঃ

وهُو الَّذى انْشاْكم من نَّفسٍ وَّاحِدَةٍ فَمُستَقَرَّ وَّمُستَوْدَعٌ ط – (الانعام : ৯৮) “তিনি তোমাদেরকে একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেকেরই জন্য থাকার স্থান এবং সমাধি নির্দিষ্ট হয়ে আছে।” -সূরা আল আনআমঃ ৯৮ অতপর বংশ ও পারিবারিক বৈষম্যের নিগূঢ় তত্ত্ব উদঘাটন করা হয়েছেঃ

يَاَيُّها النَّاسُ اِنَّا خلقناكم من ذكَرٍ وَّ اُنْثى و جعلناكم شعوبا وَّقبائلَ لِتِعارَفوا ط اِنَّ اكرمكم عند الله اتقاكم ط – (الحجرات : ১৩)

“হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে দল ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে (তোমাদের মধ্যে) সর্বাপেক্ষা ধার্মিক ও আল্লাহভীরু ব্যক্তিই তোমাদের মধ্যে অধিকতর সম্মানিত।” -সূরা হুজুরাতঃ ১৩

অর্থাৎ দল-গোত্রের পার্থক্য কেবলমাত্র পারস্পারিক পরিচয় লাভের জন্যেই করা হয়েছে; পরস্পরের হিংসা-দ্বেষ, গৌরব-অহংকার বা ঝগড়া বিবাদ করার উদ্দেশ্য নয়। এ বাহ্যিক পার্থক্য ও বিরোধের কারণে মানবতার মৌলিক ঐক্য ভুলে যাওয়া সংগত হবে না। তোমাদের পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য করার একমাত্র মাপকাঠি হচ্ছে নৈতিক চরিত্র, বাস্তব কার্যকলাপ এবং সততা ও পাপপ্রবণতা।

অতঃপর আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন যে. মানব সমাজে দলাদলি এবং বিভিন্ন দলের পারস্পারিক বিরোধ আল্লাহ তা’য়ালার একটা আযাব বিশেষ। এটা তোমাদের পারস্পারিক শত্রু“তার বিষেই তোমাদেরকে জর্জরিত করে তোলে।

اَوْ يلبسكم شِيِعًا وَّيُذيْقَ بعضَكم بَاْسَ بَعضٍ ط – (الانعام : ৬৫)

“কিংবা তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দিবে এবং তোমাদেরকে পরস্পরের শক্তি আস্বাদন করবে।” – সূরা আল আনআমঃ ৬৫

ফিরাউন যেসব অপরাধের দরুন আল্লাহর নিকট অভিশপ্ত ও দণ্ডিত হয়েছিল, দলাদলি করাকেও কুরআর মজীদে অনুরূপ অপরাধের মধ্যে গণ্য করা হয়েছেঃ

اِنَّ فِرْعَونَ علاَ فى الارْضِِ وَجَعَلَ اهلها شِيَعًا – (القصص : ৪)

“ফিরাউন পৃথিবীতে অহংকার ও গৌরব করেছে এবং তার অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দিয়েছে।” -সূরা আল কাসাসঃ ৪

তারপর বলেছেন যে, পৃথিবীর মালিক আল্লাহ, তিনি মানব জাতিকে এ পৃথিবীতে খিলাফতের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। পৃথিবীর সমগ্র বস্তুকেই মানুষের অধীন করে দিয়েছেন। কাজেই বিশেষ কোনো অঞ্চলের দাস হয়ে থাকা মানুষের জন্য জরূরী নয়। বিশাল পৃথিবী তার সামনে পড়ে আছে। একস্থান তার জন্যে দুর্গম বা বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেলে অন্যত্র চলে যাওয়া তার পক্ষে খুবই সহজ। সে যেখানেই যাবে আল্লাহর অসীম ও অফুরন্ত নিয়ামত বর্তমান পাবে।

মানব সৃষ্টির সময় আল্লাহ বলেছিলেনঃ

اِنِّى جَاعلٌ فِى الارضِ خَليفةٌ ط – (البقرة : ৩০)

“আমি পৃথিবীতে একজন খলীফা প্রেরণ করতে চাই।” -সূরা আল বাক্বারাঃ ৩০

ألم تَرَ اَنَّ الله سخَّرلكم مَّا فِى الارضِ – (الحج : ৬৫)

“দুনিয়ার যাবতীয় জিনিস আল্লাহ তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন তা কি দেখতে পাও না?”-সূরা আল হাজ্জঃ ৬৫

أَلم تكن ارضُ الله وَاسعَةً فَتُهَاجِرُوا فِيْهَا ط – (النَّساء : ৯৭)

“আল্লাহর পৃথিবী কি বিশাল ছিলো না? -একস্থান থেকে অন্যত্র কি তোমরা হিজরত করে যেতে পারতে না?” -সূরা আন নিসাঃ ৯৭

وَمن يُّهَاجر فِى سبيل الله يَجِد فِى الارض مُرَغَمًا كَثِيْرًا وَّسَعَةً – (النِّساء : ১০০)

“আল্লাহর পথে যে হিজরত করবে, পৃথিবীতে সে বিশাল স্থান ও বিপুল স্বাচ্ছন্দ লাভ করবে।” -সূরা আন নিসাঃ ১০০

সমগ্র কুরআন পাঠ করুন, বংশবাদ-গোত্রবাদ কিংবা আঞ্চলিকতাবাদের সমর্থনে একটি শব্দও কোথাও পাওয়া যাবে না; কুরআন গোটা মানব জাতিকেই সম্বোধন করে ইসলামী দাওয়াত পেশ করেছে। ভূপৃষ্ঠের গোটা মানুষ জাতিকে কল্যাণ ও মঙ্গলের দিকে আমন্ত্রন জানাচ্ছে। এ ব্যাপারে কোনো জাতি কিংবা কোনো অঞ্চলের প্রতি বিন্দুমাত্র বিশেষত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়নি; দুনিয়ার মধ্যে কেবল মক্কার সাথেই তার বিশেষ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু সেই মক্কা সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

سَوَاءَنِ العَاكِفُ فِيْهِ وِالبَادِ ط – (الحج : ২৫)

“মক্কার আসল অধিবাসী ও বাইরের মুসলমান-মক্কাতে সকলেই সম্পূর্ণরূপে সমান। -সূরা হাজ্জঃ ২৫

মক্কার প্রাচীন অধিবাসী মুশরিকদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

اِنَّمِا المُشْرِكون نَجَسٌ فَلاَ يَقربوا المَسْجد الحرَام بَعدَ عَامِهِم هَذَا ج- ( التَّوب : ২৮)

“মুশরিকরা অপবিত্র, তারা যেন এ বছরের পর আর মসজিদে হারাম-কা’বার কাছেও না আসে।” -সূরা আত তাওবাঃ ২৮

উপরোক্ত স্পষ্ট বিশ্লেষণ থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, ইসলামের স্বদেশিকতা ও আঞ্চলিকতার পূর্ণ মূলোৎপাটন করা হয়েছে। এখন প্রত্যেকটি মুসলমানই বলতে পারেঃ “প্রত্যেকটি দেশই আমার দেশ, কেননা তা আমার আল্লাহর দেশ।”

গোত্রবাদ ও ইসলামের দ্বন্দ্ব
ইসলামের অভ্যুদয়ের প্রথম অধ্যায়েই বংশ, গোত্র এবং স্বাদেশিকতা ভিত্তিক বিদ্বেষ ও বৈষম্যই তার পথের প্রধান অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছিল।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিজ জাতিই ছিল এ ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা অগ্রসর। বংশ গৌরব এবং গোত্রীয় ও ব্যক্তিগত আভিজাত্যবোধ তাদের ও ইসলামের মধ্যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা বলতোঃ

لَوْ لاَ نُزِّلَ هذا القران على رَجُلٍ من القَرْيَتَيْنِ عَظِيْم – (زخرف : ৩১) “কুরআন যদি বাস্তবিকই আল্লাহর প্রদত্ত কিতাবই হয়ে থাকে, তবে এটা মক্কা বা তায়েফের কোনো প্রধান ব্যক্তির প্রতিই নাযিল হতো।”-সূরা যুখরুফঃ ৩১

আবু জাহেল মনে করতো যে, মুহাম্মদ (সা.) নবী হওয়ার দাবী করে নিজেদের বংশীয় গৌরবের মাত্রা বৃদ্ধি করছে মাত্র। সে বলেছেঃ

“আমাদের ও আবদে মানাফ গোষ্ঠীর মধ্যে প্রাক্তন প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছিলো। অশ্বারোহনের ব্যাপারে আমরা তাদের প্রতিদ্বন্দী ছিলাম। খাওয়া-দাওয়া, অতিথেয়তা ও দান-খয়রাতের ব্যাপারেও আমরা তাদের সমকক্ষ ছিলাম, এখন সে বলতে শুরু করেছে যে, আমার নিকট ওহী নাযিল হয়। খোদার শপথ, আমরা মুহাম্মদকে কখনোই সত্য বলে মানবো না।”

এটা কেবল আবু জাহেলের চিন্তাধারাই নয়; সমগ্র মুশরিক আরবের এটাই ছিল মস্তবড় ত্রু“টি। এজন্য কুরাইশের অন্যান্য সমগ্র গোষ্ঠীই বনী হাশেমের শত্রু“তা করতে শুরু করে। ওদিকে বনী হাশেমের লোকেরাও এ জাতিগত বিদ্বেষের বশবর্তী হয়েই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সমর্থন ও সাহায্য করতে থাকে। অথচ তাদের মধ্যে অনেক লোকই তখন পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেনি। ‘আবু তালিব গুহায়’ বনী হাশেমকে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল এবং সমগ্র কুরাইশ গোত্র এ কারণেই তাদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। যেসব মুসলিম পরিবার অপোক্ষাকৃত দুর্বল ছিল, কুরাইশদের কঠোর নিষ্পেষণ ও নির্মম উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে তারা আবিসিনিয়ার দিকে হিজরত করতে বাধ্য হয় এবং যাদের বংশ অধিকতর শক্তিশালী ছিলো তারা নিজেদের বংশীয় শক্তির দৌলতে জুলুম-নিষ্পেষণ থেকে কোনো প্রকারে আত্মরক্ষা করে বেঁচে ছিলো।

আরবের ইহুদীগণ বনী ইসরাঈল বংশের নবীদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে একজন নবীর আবির্ভাবের জন্য প্রতীক্ষা করছিলো। তাদের প্রচারিত সংবাদের দরুন নবী করিম (সা.)-এর ইসলাম প্রচারের সূচনাতেই মদীনার অসংখ্য বাসিন্দা ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু স্বয়ং ইহুদীগণ কেবল বংশীয় আভিজাত্যবোধের দরুনই শেষ নবীর প্রতি ঈমান আনতে পারেনি। নবাগত নবী ইসরাঈল বংশে জন্মগ্রহণ করার পরিবর্তে ইসমাঈল বংশে জন্মগ্রহণ করলেন, এটাই ছিল তাদের আপত্তি। তাদের এ আভিজাত্যবোধ তাদেরকে এতোদূর বিভ্রান্ত ও বিকারগ্রস্থ করে দিয়েছিল যে, তারা তাওহীদবাদীদের পরিবর্তে মুশরিকদের সাথে সঙ্গ স্থাপন করেছিল।

সেখানকার খৃস্টানদের অবস্থাও ছিল এরূপ। তারাও অনাগত নবীর প্রতীক্ষায় ছিল। কিন্তু তাদের ধারণা ছিলঃ এ নবী সিরিয়ায় জন্মগ্রহণ করবেন। আরবের কোনো নবীকে স্বীকার করতে আদৌ প্রস্তুত ছিল না। হিরাকিয়াসের নিকট নবী করীম (সা.)-এর ফরমান পৌঁছলে, সে কুরাইশ ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য করে বলেছিলঃ “আরো একজন নবী আসবেন তা আমি জানতাম; কিন্তু তিনি যে তোমাদের বংশে আসবেন সে ধারণা আমার ছিল না।”

মিশরের মুকাওকাসের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছলে সেও বলেছিলঃ “আরো একজন নবীর আগমন হবে তা আমার জানা ছিল, কিন্তু তিনি সিরিয়ায় জন্মগ্রহণ করবেন বলে আমার ধারণা ছিল।”

তদানীন্তন অনারব লোকদের মধ্যেও এ আভিজাত্যবোধ অত্যন্ত তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছিল। খসরু পারভেজের নিকট যখন হযরত (সা.)-এর চিঠি পৌঁছলো, তখন তাকে কোন্ জিনিস ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল? সে বলেছিলঃ গোলাম জাতির একটি লোক অনারবজগতের বাদশাহকে সম্বোধন করে কথা বলার দুঃসাহস করে!” আরব জাতিকে সে নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত মনে করতো। এহেন জাতির মধ্যে সত্যের দিকে ডাকবার মত লোকের জন্ম হতে পারে, সে কথা স্বীকার করতে তারা মোটেই প্রস্তুত ছিল না।

ইসলামের দুশমন ইহুদীদের দৃষ্টিতে জনগণের মধ্যে সমগোত্রীয় বিদ্বেষ ও বংশীয় আভিজাত্যবোধ জাগ্রত করাই ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার মতো অতিশয় ধারালো হাতিয়ার। মদীনার মুনাফিকদের সাথে যোগ সাধন ছিল এরই জন্য। একবার তারা বুয়াস যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আনসার বংশের আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ ও আভিজাত্যের এমন আগুন প্রজ্জ্বলিত করেছিল যে, উভয় দলের শাণিত কৃপাণ কোষমুক্ত হওয়ার ও প্রত্যক্ষ্য সংগ্রামের মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। এ সম্পর্কেই নিন্মলিখিত আয়াতটি নাযিল হয়েছিলঃ

يّايُّهَا الَّذينَ امَنُوا اِنْ تُطِعُوا فَرِيْقًا مِّنَ الَّذِيْنَ اُوْتُوا الكتَابَ يَرُدَّوكُم بَعْدَ اِيْمَانِكم كَافِرُوْنَ – (ال عمران : ১০০)

“মুসলমানগন! আহলে কিতাবের একদলের যদি তোমরা অনুস্মরণ কর তবে,তারা তোমাদেরকে ঈমানের দিক থেকে কুফরের দিকে ফিরিয়ে দিবে।”-সূরা আলে ইমরানঃ ১০০

বংশ ও স্বদেশের এ আভিজাত্যবোধের কারণেই মদীনায় কুরাইশ বংশের নবীকে শাসক হিসেবে এবং মুহাজিরদেরকে আনসারদের খেজুর বাগানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দেখে মদীনার মুনাফিকগণ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল। মুনাফিকদের নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই বলে বেড়াতো যে, “কুরাইশ বংশের এ সর্বহারা ব্যক্তিরা আমাদের দেশে এসে গর্বে স্ফীত হয়েছে। এরা আদরে লালিত কুকুরের ন্যায়, এখন এরা প্রতিপালককেই কামড়াতে শুরু করেছে।” আনসারদেরকে লক্ষ্য করে সে বললো যে, “তোমরাই এদেরকে মাথায় তুলে নিয়েছ, তোমরাই তাদেরকে নিজেদের দেশে স্থান দিয়েছো। তোমাদের ধন-সম্পত্তি থেকে তাদেরকে অংশ দিয়েছ। খোদার কসম, যদি আজ তোমরা এদের সমর্থন ও সহযোগিতা পারত্যাগ করো, তাহলেই এরা একেবারে অসহায় হয়ে পড়বে।” তাদের এসব কথাবার্তার জবাব কুরআন মজীদে এরূপ দেয়া হয়েছেঃ

هُمُ الَّذِيْنَ يَقُلُونَ لاَ تُنْفِقُونَ على مِنْ عِنْدِ رَسُولِ الله حَتَّى يَنْفَضُّوا ط وَ لِلّه خَزَئِنُ السَّموات وَالارضِ وَلكنَّ المُنَافِقِيْنَ لاَ يَفْقَهُونَ – يَقُوْلُوْنَ لَئِنْ رَّجَعْنَا إلىَ المَدِيْنَةِ لَيُخْرِجَنَّ الاغَزُّ مِنْهَا الاَذَلَّ ط وَلِلَّهِ العِزِّةُ وَلِرَسُوْلِهِ وَلِلْمُةْمِنِيْنَ وَلَكِنَّ المُنافِقِيْنَ لاَ يَعلمون – (৮-৭)

“এরাই বলে বেড়ায় যে, রসূলুল্লাহর সঙ্গী-সাথীদের জন্যে কিছুই খরচ করো না, তাহলেই এরা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু আকাশ ও পৃথিবীর ধন-সম্পদের মালিক যে আল্লাহ তা’য়ালা, একথা এসব মুনাফিকরা বুঝতে পারছে না। তারা বলে যে, আমরা (যুদ্ধের ময়দান থেকে) যদি মদীনার দিকে প্রত্যাবর্তন করি, তাহলে সম্মানিত ব্যক্তি লাঞ্ছিত ব্যক্তিকে সেখান থেকে বহিষ্কার করে দিবে। অথচ প্রকৃতপক্ষে সকল প্রকার সম্মান আল্লাহ, রাসূল এবং সমগ্র মুসলমানদের জন্যে সংরক্ষিত। কিন্তু মুনাফিকগণ একথা মাত্রই জানে না।”-সূরা মুনাফিকুনঃ ৭-৮

এরূপ আভিজাত্যবোধের তীব্রতাই আব্দুল্লাহ বিন উবাইকে হযরত আয়েশার উপর দোষারোপ ও কুৎসা রটনার কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এবং খাযরাজ সমর্থনের দরুনই আল্লাহ ও রসূলের এ দুশমন নিজেদের কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ থেকে রক্ষা পেয়েছিল।

আভিজাত্য ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে ইসলামের জিহাদ
উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, কুফর ও শিরকের পর বংশীয় ও স্বাদেশিকতা ভিত্তিক আভিজাত্য ও হিংসা-বিদ্বেষই হচ্ছে ইসলামের মহান দাওয়াত ও আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ শত্রু“। এ কারণেই শেষ নবী তাঁর ২৩ বছরের নবুওয়াতের জীবনে কুফরের পর সর্বাপেক্ষা বেশী জিহাদ করেছেন আভিজাত্য ও হিংসা-বিদ্বেষের এ জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে -এটাকে চিরতরে নির্মূল করার উদ্দেশ্য। হাদীস ও জীবনোতিহাসের যাবতীয় গ্রন্থাবলী খুলে দেখলেই উক্ত কথার সত্যতা সন্দেহাতীত রূপে প্রমাণিত হয়। নবী করীম (সা.) মানুষের রক্ত, মাটি, বর্ণ, ভাষা এবং উচ্চ নীচের পার্থক্যকে যেভাবে নির্মূল করেছেন, মানুষের পারস্পারিক বিরোধ বৈষম্যের অস্বাভাবিক ও দূর্ভেদ্য প্রাচীর চূর্ণ করেছেন এবং মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতিকে সমান ও একীভূত করেছেন, তা চিন্তা করলে সত্যিই বিস্ময়ের সীমা থাকে না।

হযরত (সা.) উদাত্ত কন্ঠে বলেছেনঃ

ليسَ مِنَّا مَنْ مَّاتَ على العَصَبِيَّةِ لَيْسَ مِنَّا الى دعى الى العَصَبِيَّةِ لَيْسَ مِنَّا قَاتَلَ على العَصَبِيَّةِ -

“আভিজাত্যবোধ ও হিংসা-দ্বেষের জন্য যে লোক মৃতু্মুখে পতিত হয়, যে লোক সেদিকে অন্যদের আহ্বান জানায় এবং সে জন্য যে যুদ্ধ সংগ্রাম করে, সে আমার উম্মাতের মধ্যে গণ্য হতে পারে না।”

তিনি বলেছেনঃ

لَيْسَ لاَحَدٍ فَضْلٌ على اَحَدٍ اِلاَّ بِدِيْنٍ وَتَفْوًى – النَّاسُ كُلُّهمْ بَنُوادَمَ وَاَدَمُ مِنْ تُرابٍ -

“পরহেযগারী, ধর্মপালন ও ধার্মিকতা ছাড়া অন্য কোনো ভিত্তিতে এক ব্যক্তিকে অন্য ব্যক্তির উপর কিছুমাত্র শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া যেতে পারে না। সকল মানুষই আদমের সন্তান আর আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।”

বংশ, স্বদেশ, ভাষা ও বর্ণভিত্তিক পার্থক্যকে তিনি এ বলে চূর্ণ করেছেনঃ

لأ فَضْلَ لِعَرَبىٍّ عَلى عَجْمِىْ وَلاَ لِعَجَمِىْ عَلى عَرَبِىٍُّ كُلُّكُمْ اَبْنَاءُ اَدَمَ – (البخارى)

“আরবের উপর কোনো অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, অনারবের উপর আরবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তোমরা সকলেই আদমের সন্তান।”

لأ فَضْلَ لِعَرَبىٍّ عَلى عَجْمِىْ وَلاَ لِعَجَمِىْ عَلى عَرَبِىٍُّ وَلاَ لِاَبْيَضَ على اَسْوَدَ وَلأ لِاَسْوَدَ على ابيَضَ الاَّ بالتَّقوى – (زَادِ المَعَاد)

“অনারবের উপর আরবের, আরবের উপর অনারবের এবং শ্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের ও কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের কোনোই বিশেষত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কেবল আল্লাহভীতি ও ধর্মপালনের দিক দিয়েই এ বিশেষত্ব হতে পারে।”

اِسْمَعُوْا وَاَطِعُوا وَلَوْ اُسْتُعْمِلَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ حَبشىٌّ كَانَ رَأسُهُ زَبِيْةٌ – (البخارى)

“কিশমিশ আকারের মস্তিষ্ক বিশিষ্ট কোনো হাবশী গোলামকেও যদি তোমাদের রাষ্ট্রনেতা নিযুক্ত করা হয়, তবুও তোমরা তার কথা শোন এবং মান-তার পূর্ণ আনুগত্য করো।”

মক্কা বিজয়ের পরে মুসলমানদের অস্ত্রশক্তি যখন কুরাইশদের গর্বোন্নত ও দুর্বিনীত মস্তকে অবনমিত করেছিলে, তখন হযরত রাসূলে করীম (সা.) বক্তৃতা করার জন্য দণ্ডায়মান হলেন এবং তিনি বজ্র গম্ভীর কন্ঠে ঘোষণা করলেনঃ

اَلأَ كُلُّ مَا ثَرَةٍ اَوْ مَالٍ اَوْ يُدْعى فهوَ تَحتَ قَدَمِىِْ هَاتَيْنِ -

“জেনে রাখ, গর্ব, অহংকার, গৌরব ও আভিজাত্যবোধ-প্রভৃতির সকল সম্পদ এবং রক্ত ও সম্পত্তি সম্পর্কীয় যাবতীয় অভিযোগ আজ আমার এ দু’পদতলে নিষ্পেষিত।”

يَا مِعْشَرِ قَرَيْشٍ اِنَّ اللهَ اَذهَبَ عَنْكم نُخْوَةَ الجَاهِلِيَّةِ وَتَعَظُّمَهَا الاَبَا -

“হে কুরাইশগণ! আল্লাহ তোমাদের জাহেলী যুগের সকল হিংসা-বিদ্বেষ ও গর্ব-অহংকার এবং পৈত্রিক গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্ববোধ নির্মূল করেছেন।” اَيُّهَا النَّاسُ كُلُّكم من ادمَ وَادمُ من ترابٍ – لاَفَخْرَ للاَنْسَابِ لاَ فَخْرَ للعربىِّ على العجمىِّ ولاَ للعجمىِّ على العرَبِىِّ اِنَّ اكرمكم عِنْدَ اَللهِ اَتْقَأكُمْ -

“হে মানুষ! তোমরা সকলেই আদম সন্তান; আর আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। বংশ গৌরবের কোনোই অবকাশ নেই। অনারবের উপর আরবের, আরবের উপর অনারবের কোনোই শ্রেষ্ঠত্ব গৌরব নেই। তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ধার্মিক ও আল্লাহভীরু ব্যক্তিই তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশী সম্মানিত।”

আল্লাহর ইবাদত সম্পন্ন করার পর নবী (সা.) আল্লাহর সামনে তিনটি কথার সাক্ষ্য এবং আন্তরিক স্বীকৃতি পেশ করতেন। প্রথমত, আল্লাহর কেউ শরীক নেই। দ্বিতীয়ত, হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বান্দাহ ও রসূল। এবং তৃতীয়ত, আল্লাহর বান্দাহগণ সকলেই সমানভাবে ভাই ভাই।

ইসলামী জাতীয়তার ভিত্তি
এভাবে যেসব গণ্ডীবদ্ধ, জড় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, বৈষয়িক ও কুসংস্কারপূর্ণ ভিত্তির উপর দুনিয়ার বিভিন্ন জাতীয়তার প্রাসাদ স্থাপিত হয়েছে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল এগুলোকে চূড়ান্তভাবে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছেন। বর্ণ, গোত্র, জন্মভূমি, ভাষা, অর্থনীতি ও রাজনীতির উপরোল্লেখিত অবৈজ্ঞানিক বিরোধ ও বৈষম্যের ভিত্তিতে মানুষ নিজেদের মূর্খতা ও চরম অজ্ঞতার দরুন মানবতাকে বিভিন্ন ওক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত করেছিল, ইসলাম তার সব গুলোকেই চরম আঘাতে চূর্ণ করে দিয়েছে এবং মানবতার দৃষ্টিতে সমস্ত মানুষকে সমশ্রেণীর সমমর্যাদাসম্পন্ন ও সমানাধিকারী করেছে।

জাহেলী যুগের এ বর্বরতাকে নির্মূল করার পর ইসলাম বিজ্ঞানের ভিত্তিতে জাতীয়তার এক নতুন ধারণা উপস্থাপিত করেছে। ইসলামী জাতীয়তার মানুষে মানুষে পার্থক্য করা হয় বটে; কিন্তু তা জড়, বৈষয়িক ও বাহ্যিক কোনো কারণে নয়; তা করা হয় আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানবিকতার দিক দিয়ে। মানুষের সামনে এক স্বাভাবিক সত্যবিধান পেশ করা হয়েছে-তার নাম হচ্ছে ইসলাম। আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য, হৃদয় মনের পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা, কর্মের অনাবিলতা-সততা ও ধর্মানুসরণের দিকে গোটা মানবজাতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে যে, যারা এ আমন্ত্রণ কবুল করবে তারা একজাতি হিসাবে গণ্য হবে। আর যারা তা অগ্রাহ্য করবে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতির অন্তর্ভূক্ত হবে। অর্থাৎ মানুষের একটি হচ্ছে ঈমান ও ইসলামের জাতি এবং তার সমগ্র ব্যক্তি সমষ্টি মিলে একটি উম্মাত وَكَذَالِكَ جَعَلناكم اُمَّةً وَّسَطًا অন্যটি হচ্ছে কুফর ও ভ্রষ্টতার জাতি। তার অনুসারীরা নিজেদের পারস্পারিক মতদ্বৈততা ও বৈষম্য সত্ত্বেও একই দল একই জাতির মধ্যে গণ্য। وَاللهُ لاَ يَهْدىِ القَومَ الكافِرِيْنَ

এ দুটি জাতির মধ্যে বংশ ও গোত্রের দিক দিয়ে কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য হচ্ছে বিশ্বাস ও কর্মের। কাজেই একই পিতার দুটি সন্তানও ইসলাম ও কুফরের উল্লিখিত ব্যবধানের দরুন স্বতন্ত্র ও দুজাতির মধ্যে গণ্য হতে পারে এবং দুই নিঃসম্পর্ক ও অপরিচিত ব্যক্তি একই ইসলামে দীতি হওয়ার কারণে এক জাতির অন্তর্ভূক্ত হতে পারে।

জন্মভূমির পার্থক্যও এ উভয় জাতির মধ্যে ব্যবধানের কারণ হতে পারে না। এখানে পার্থক্য করা হয় হক ও বাতিলের ভিত্তিতে। আর হক ও বাতিলের ‘স্বদেশ’ বলতে কিছু নেই। একই শহর, একই মহল্লা ও একই ঘরের দুই ব্যক্তির জাতীয়তা ইসলাম ও কুফরের পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন হতে পারে। এবং একজন নিগ্রো ইসলামের সূত্রে একজন মরক্কোবাসীর ভাই হতে পারে।

বর্ণের পার্থক্যও এখানে জাতীয় পার্থক্যের কারণ নয়। বাহ্যিক চেহারার রঙ ইসলামে নগণ্য, এখানে একমাত্র আল্লাহর রঙেরই গুরুত্ব রয়েছে, আর তাই হচ্ছে সর্বাপেক্ষা উত্তম-সবচেয়ে উৎকৃষ্ট রঙ।

صِبْغَةَ اللهُ ط وَمَنْ اَحسَنُ مِنَ اللهِ صِبْغَةً ইসলামের দৃষ্টিতে একজন শ্বেতাঙ্গ ও একজন কৃষ্ণাঙ্গ একই জাতির মানুষ বলে গণ্য হতে পারে এবং কুফরের কারণে দুজন শ্বেতাঙ্গের দুই জাতিভূক্ত হওয়াও সম্পূর্ণরূপে সম্ভব।

ভাষার বৈষম্যও ইসলাম ও কুফরের পার্থক্যের কারণ নয়। ইসলামে মুখের ভাষার কোনোই মূল্য নেই, মূল্য হচ্ছে মনের-হৃদয়ের ভাষাহীন কথার। কারণ সমগ্র দুনিয়াতে এটাই কথিত হয়, এটাই সকলে বুঝতে পারে। এর দৃষ্টিতে আরব ও আফ্রিকাবাসীর একই ভাষা হতে পারে। এবং দুজন ‘আরবের’ ভাষাও বিভিন্ন হতে পারে।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পার্থক্যও ইসলাম ও কুফরের বৈষম্যের ব্যাপারে একেবারেই অমূলক। অর্থ-সম্পদ নিয়ে এখানে কোনোই বিতর্ক নেই, ঈমানের দৌলত সম্পর্ক হচ্ছে এখানকার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মানুষের প্রভূত্ব নয়, আল্লাহর আনুগত্যই এখানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের একমাত্র ভিত্তি। যারা হুকুমাতে ইলাহীয়ার পক্ষ্যপাতি-অনুগত এবং যারা নিজেদেরকে নিজেদের ধন-প্রাণকে এরই জন্যে কুরবান করেছে, তারা সকলেই এক জাতি, তারা পাকিস্থানের বাসিন্দা হোক কিংবা তুর্কিস্থানের। আর যারা আল্লাহর হুকুমাতের দুশমন, শয়তানের হাতে যারা নিজেদের জান-মাল বিক্রয় করেছে, তারা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক জাতির অন্তর্ভূক্ত। তারা কোন্ রাজ্যের অধিবাসী বা প্রজা, আর কোন্ প্রকার অর্থব্যবস্থার অধীনে বসবাস করছে, তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির কোনোই অবকাশ নেই।

এভাবে ইসলাম জাতীয়তার যে সীমা নির্দেশ বা গণ্ডী নির্ধারণ করেছে, তা কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, জড় ও বৈষয়িক বস্তু নয়; তা সম্পূর্ণরূপে এক বিজ্ঞানসম্মত গণ্ডী। এক ঘরের দুজন লোক এ গণ্ডীর কারণে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হতে পারে। পক্ষান্তরে দূরপ্রাচ্য ও দূরপাশ্চাত্যে অবস্থিত দুজন মানুষ উক্ত গণ্ডীর অন্তর্ভূক্ত হতে পারে।

এখানে কিছু উর্দূ লেখা আছে।

ইসলামী জাতীয়তার এ বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে কালেমা-“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।” বন্ধুতা আর শত্রু“তা সবকিছুই এ কালেমার ভিত্তিতেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। এর স্বীকৃতি মানুষকে একীভূত করে এবং এর অস্বীকৃতি মানুষের মধ্যে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটায়। এ কালেমা যাকে বিচ্ছিন্ন করে, তাকে রক্ত, মাটি, ভাষা, বর্ণ, অন্ন, শাসনব্যবস্থা প্রভৃতি কোনো সূত্র এবং কোনো আত্মীয়তাই যুক্ত করতে পারে না। অনুরূপভাবে এ কালেমা যাদেরকে যুক্ত করে, তাদেরকে কোনো জিনিসই বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। কোনো ভাষা, গোত্র-বর্ণ, কোনো ধন-সম্পত্তি বা জমির বিরোধ ইসলামের পরিসীমার মধ্যে মুসলমানদের পরস্পরে কোনো বৈষম্যমূলক সীমা নির্ধারণ করতে পারে না, সে অধিকার কারো নেই। মুসলিম ব্যক্তি চীনা বাসিন্দা হোক, কি মরক্কোর, কৃষ্ণাঙ্গ, আর কি শ্বেতাঙ্গ, হিন্দী ভাষাভাষী হোক, কি আরবী; সিমেটিক হোক, কি আর্য; একই রাষ্ট্রের নাগরিক হোক, কি বিভিন্ন রাষ্ট্রের অধিবাসী, তারা সকলেই মুসলিম জাতির অন্তর্ভূক্ত। তারা ইসলামী সমাজের সদস্য,ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক, ইসলামী সৈন্যবাহিনীর তার সৈনিক, ইসলামী আইন ও বিধানের সংরক্ষক। ইসলামী শরীয়াতের একটি ধারা ইবাদত, পারস্পারিক লেনদেন, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাজনীতি-জীবনের কোনো একটি ব্যাপারেও লিঙ্গ, ভাষা বা জন্মভূমির দিক দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিন্দুমাত্র পার্থক্য করে না-কাউকেও অন্য কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব বা হীন বলে অভিহিত করে না।

 

সংগঠন ও বিপেনের ইসলামী নীতি
কিন্তু, ইসলাম সমগ্র মানবিক ও বাস্তব সম্পর্ককে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছে-এরূপ সন্দেহ করলে তা মারাত্মক ভুল হবে। ইসলাম মুসলমানদেরকে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে চলার নির্দেশ দিয়েছে, সম্পর্ক ছিন্ন করতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছে। পিতামাতার আনুগত্য ও নির্দেশ পালনের জন্যে জোর তাগিদ করেছে। রক্তের সর্ম্পক সম্পন্ন লোকদের মধ্যে মীরাসী আইন অনুসারে উত্তরাধিকার জারী করেছে, দান-খয়রাতের ব্যাপারে নিকটাত্মীয়দের প্রথম অধিকার স্বীকার করেছে। নিজেদের পরিবার-পরিজন, ঘর-বাড়ী এবং ধন-সম্পত্তিকে শত্রু“র আক্রমণ থেকে রক্ষা করার নির্দেম দিয়েছে। অত্যাচারীর মুকাবিলায় যুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছে এবং এ ধরণের যুদ্ধ-বিগ্রহে নিহত ব্যক্তিদেরকে ‘শহীদ’ আখ্যা দেয়া হয়েছে। জীবনের সমগ্র ব্যাপারে, ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষের প্রতি সহানুভূতি, সদাচার, প্রেম ও ভালবাসার ব্যবহার করার শিক্ষা দিয়েছে। দেশ ও জাতির সেবা সংরক্ষণের জন্য চেষ্টা করতে কিংবা অমুসলিম প্রতিবেশীর সাথে সন্ধি ও সৌজন্যের ব্যবহার করতে ইসলাম নিষেধ করেছে, একথা ইসলামের কোনো একটি নির্দেশ থেকেও বুঝা যায় না-তা বুঝানোও যেতে পারে না।

মানুষের পরস্পরের সাথে সম্পর্ক রাখার যে নির্দেশ ইসলাম দিয়েছে, তা ঐসব বাস্তব সম্পর্ক সম্বন্ধের সংগত ও স্বাভাবিক অভিব্যক্তি মাত্র। কিন্তু অবশ্য জাতীয়তার ব্যাপারে ইসলাম ও অ-ইসলাম মধ্যে নীতিগত পার্থক্য বর্তমান রয়েছে। সে পার্থক্য এদিক দিয়েও সুপ্রকট হয়ে উঠেছে যে, দুনিয়ার অন্যান্য মানুষ ঐসব জড় বিষয়ের উপর জাতীয়তার ভিত্তিস্থাপন করেছে, কিন্তু ইসলাম তার কোনো একটির উপরও জাতীয়তার ভিত্তি স্থাপিত করেনি। ইসলামের দৃষ্টিতে উল্লিখিত বৈষয়িক সম্পর্ক সম্বন্ধ অপেক্ষা ঈমানের সম্পর্কই অগ্রগণ্য ও গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি প্রয়োজন হলে একমাত্র এ একটি দিকের সম্পর্ক রক্ষার জন্য অন্যান্য সকল প্রকার সম্পর্ককে কুরবান করতেও প্রস্তুত হতে হবে। ইসলামের ঘোষণা এইঃ

قَد كَانت لكم اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فىْ اِبْرَاهِيْمَ وَالَّذِيْنَ مَعَهُ ج اِذ قَالوُا لِقَوْمِهِم اِنَّا بُرِءَؤُا منكم وَ مِمَّا تعبدون من دُوْنِ اللهِ ز كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَاْ بَيْنَنَا وَبَيْنَكم العَدَاوَةَ وَألبَغَضَاءُ اَبَدًا حَتَّى تَؤْمِنُوْا بِاللهِ وَحدَهُ – (الممتحنة : ৪)

“ইবরাহীম এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের কাজকর্মে তোমাদের জন্য অনুসরণযোগ্য আদর্শ রয়েছে। তারা স্বদেশী ও বংশভিত্তিক জাতিকে স্পষ্টভাষায় বলে দিয়েছেন যে, তোমাদের এবং আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তোমরা উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছ তাদের সাথে আমাদের কোনোই সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করলাম। তোমাদের সাথে আমাদের চিরকালীন শত্রু“তার সূত্রপাত হলো-যতোক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।” -সূরা মুমতাহিনাঃ ৪

ইসলাম বলেছেঃ

لاَ تَتَّخذوا ابَاءَكم وَاِخوانكم اَوْ لياءَ اِنِ اِسْتَحَبُّوا الكُفرَ على الايْمَان ط وَمن يَتَوَلَّهم منكم فَاُلَــــئِك هُمُ الطَّلِمُوْنَ – (التَّوبة : ২৩)

“তোমাদের পিতামাতা এবং ভাইও যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার পরিবর্তে কুফরকে পছন্দ করে ও ভালবাসে, তবে তোমরা তাদেরকেও নিজেদের ‘আপন লোক’ বলে মনে করবে না। তোমাদের কোনো লোক যদি তাদেরকে বন্ধু বলে মনে করে, তবে সে নিশ্চয়ই জালেমদের মধ্যে গণ্য হবে।”-সূরা আত্ তাওবাঃ ২৩

আরো- اِنَّ مِنْ اَزواجكم وِاَوْلاَدكم عَدُوًّا لَّكم فاحذَرُوْهُمْ ج – (التَّغَابُنْ : ১৪)

“তোমাদের স্ত্রী এবং সন্তানদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যারা (তোমাদের মুসলমান হওয়ার দিক দিয়ে) তোমাদের দুশমন, তাদের সম্পর্কে সাবধান হও।” -সূরা আত তাগাবুনঃ ১৪

ইসলামের নির্দেশ এই যে, তোমাদের দ্বীন ইসলাম এবং তোমাদের মার্তৃভূমির মধ্যে যদিও বিরোধ ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তাহলে দ্বীন ইসলামের জন্যে মার্তৃভূমি পরিত্যাগ করে চলে যাও। যে ব্যক্তি দ্বীনের ভালবাসার জন্যে স্বদেশ-প্রেম ভুলে হিজরত করতে পারে না সে মুনাফিক, তার সাথে তোমাদের কোনোই সম্পর্ক থাকতে পারে না।

فَلاَ تَتَّخِذُوْا منهم اَوْلــياءَ حَتَّى يُهَاجِرُوا فى سَبِيْل اللهِ ط – (النســـاء : ৮৯)

“যতোক্ষণ পর্যন্ত তারা আল্লাহর পথে হিজরত না করবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত তাদের মধ্যে থেকে কাউকে তোমরা বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না।” -সূরা আন নিসাঃ ৮৯

ইসলাম ও কুফরে পার্থক্যের জন্য রক্তের নিকটতম সম্পর্ক বন্ধনও ছিন্ন হয়ে যায়। পিতামাতা, ভাই, পুত্র কেবল ইসলামের বিরোধী হওয়ার কারণেই সম্পর্কহীন হয়। আল্লাহর সাথে শত্রু“তা করার কারণে একই বংশের লোকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়। কুফর ও ইসলামের মধ্যে চরম শত্রু“তা শুরু হওয়ার ফলে জন্মভূমিকেই পরিত্যাগ করতে হয় অকুন্ঠচিত্তে। এর পরিষ্কার অর্থ এই যে, দুনিয়ার সমগ্র বস্তু এবং সম্পর্কের উপরেই হচ্ছে ইসলামের স্থান। ইসলামের উদ্দেশ্য অতি অনায়াসেই দুনিয়ার সর্বস্ব কুরবান করা যায়; কিন্তু কোনো জিনিসের জন্যই ইসলামকে ত্যাগ করা যেতে পারে না। অন্য দিকেও অনুরূপ দৃশ্য-অনুরূপ ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়। যেসব লোকেরা পরস্পরের মধ্যে রক্ত, স্বদেশ, ভাষা, বর্ণ প্রভৃতি কোনো জড় বস্তুরই সম্পর্ক বা সামঞ্জস্য নেই, সেসব লোককে ইসলাম নিবিড় ভ্রাতৃবন্ধনে আবদ্ধ করে-তারা পরস্পর ‘ভাই’ হয়ে যায়। কুরআন মজীদে সমগ্র মুসলমানকে সম্বোধন করে বলা হয়েছেঃ

وَاعتَصِمُوا بحبل اللهِ جَمِيْعَا وَّلاَ تَفَرَّقُوا ص وَاذكُرُوا نِعمِةَ اللهِ عليكم اِذ كنتم اعداءً فَالَّفَ بَيْنَ قُلُبِكم فَاصْبحتُم بِنِِعمته اِخْوَانَا ج وَكنتم على شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَانْقَذَكم مِنْهَا ط – (ال عِمران : ১০৩)

“তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জু ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যেওনা। তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো, এক সময় তোমরা পরস্পরের প্রকাশ্য দুশমন ছিলে, কিন্তু আল্লাহ তোমাদের মনে পারস্পারিক ভালবাসা জাগিয়ে দিয়েছেন। এবং তোমরা তাঁর নিয়ামত-ইসলামের দৌলতে পরস্পর ভ্রাতৃবন্ধনে আবদ্ধ হলে। তোমরা নিজেদের (আভিজাত্যবোধ ও হিংসা-দ্বেষের কারণে) এক গভীর প্রজ্জ্বলিত অগ্নি গহ্বরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলে, আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছিলেন।” -সূরা আলে ইমরানঃ ১০৩

সকল প্রকার অমুসলিমদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

فَاِنْ تَابُوا وَاَقَامُوا الصَّلوة وَاَتُوا الزَّكوة فَاِخْوَانكم فى الدِّيْنِ ط – (التَّوبة : ১১)

“তারা যদি কুফর ত্যাগ করে তাওবা করে, এবং সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাইরূপে গণ্য হবে।” -সূরা আত তাওবাঃ ১১

পান্তরে মুসলমানদের পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছেঃ

مُحَمَّدُ الرَّسُولُ اللهِ ط وَالَّذِيْن َمَعَهُ اَشِدَّءُ على الكُفَّارِ رُحُمَاءُ بَيْنَهُم – (الفتح : ২৯)

“মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীগণ কাফেরদের সমীপে দুর্বিনীত, ইস্পাত-কঠিন অনমনীয় ও দৃঢ়, কিন্তু নিজেদের পরস্পরের মধ্যে অতুলনীয় স্নেহ-ভালবাসার নিবিড় সম্পর্কে জড়িত।” -সূরা আল ফাতহঃ ২৯

হযরত নবী করিম (সা.) বলেনঃ

“আমাকে লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যতোণ না তারা স্যা দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই, (হযরত) মুহাম্মদ (সা.) তাঁর নবী। এবং আমাদের কেবলার দিকে মুখ করবে, আমাদের যবেহকৃত জন্তু আহার করতে প্রস্তুত হবে এবং আমাদের অনুরূপ সালাত আদায় করবে। তারা যখনই এরূপ করবে তখনই তাদের জানমাল আমাদের উপর ‘হারাম’। অবশ্য তারপরও হক ও ইনসাফের খাতিরে তাদের উপর হস্তপে করার পথ উন্মুক্ত থাকবে। তাদের অধিকার অন্যান্য মুসলমানদের অধিকারের সমান হবে এবং তাদের কর্তব্যও অন্যান্য মুসলমানদের কর্তব্যের অনুরূপ।” – আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ।

তারা কেবল যে অধিকার ও কর্তব্যেই সমান হবে, তা নয়। প্রকৃতপক্ষে কোনো দিকে দিয়েই তাদের মধ্যে পার্থক্য ও বৈষম্য সৃষ্টির অবকাশ নেই। উপরোক্ত হাদীসের সাথে একথাও উল্লিখিত হয়েছেঃ

المسلم للمسلمِ كالبنيانِ يَشُدُّ بَعضَهُ بَعْضًا -

“মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে একটি প্রাচীরের ন্যায় মযবুত সম্পর্ক বর্তমান। তার প্রত্যেকটি অংশ অপর অংশকে দৃঢ় করে দেয়।”

مَثَلُ المُؤمِنِيْنَ فِىْ تَوَادِّهِمْ وَتَرَحُمِهم وَتَعَاطُفِهِمْ كَمَثَلِ الجَسَدِ الوَاحِدِ اِذَا اشْتَكَ منه عُضْوٌ تداعى له سائِرُ الجَسَد بالسَّهْرِ وَالحُمَّى -

“পারস্পারিক প্রেম-ভালবাসা ও স্নেহ-বৎসল্যের দিক দিয়ে মুসলিম জাতি একটি পুর্ণাঙ্গ দেহের সমতুল্য। তার একটি অংগে কোনো ব্যাথা অনুভূত হলে গোটা দেহই সেজন্য নিদ্রহীন ও বিশ্রামহীন হয়ে পড়ে।”

মিল্লাতে ইসলামীয়ার এ ‘দেহ’কে নবী করীম (সা.) ‘জামায়াত’ নামে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ

يَدُ اللهِ على الجماعة وَمنْ شَذَ شُذَ فِىْ النَّارِ-

“জামায়াতের উপর আল্লাহর হাত রয়েছে। যে জামায়াতের বর্হিভূত হবে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।”

مَنْ فَارَقَ الجمعة شِبرًا خلع رِقْبَةً الاِسْلامِ من عُنُقِهِ -

“যে ব্যক্তি অংগুলি পরিমাণ স্থানও জামায়াত হতে বিচ্ছিন্ন ও দূরবর্তী হবে, সে যেন তার নিজ গলদেশ থেকে ইসলামের রজ্জু ছিন্ন করে দিল।”

এখানেই শেষ নয়, এতোদূর পর্যন্ত বলা হয়েছেঃ

مَنْ اَرَدَ اَنْ يُفَرِّقُ جَمَاعتَكم فَاقْتُلُوهُ -

“যে ব্যক্তি তোমাদের জামায়াতে ভাঙ্গন সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করবে, তাকে তোমরা ‘কতল’ কর।” এবং مَنْ اَرَدَ اَنْ يُفَرِّقُ اَمرالاُمَّةِ وَهِىَ جَمِيعُ فَاضْرِبُهُ بالسُّيُفِ كَائنا من كان – (مسلم, كتاب الامارة) “এ (ইসলামী) জাতির সুদৃঢ় সূত্রকে যে ব্যক্তি ছিন্ন করতে চাইবে তাকে তরবারী দ্বারা শায়েস্তা কর-সে যেই হোক না কেন।”

ইসলামী জাতীয়তা কিভাবে গঠিত হলো?
ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে রক্ত, মাটি, বর্ণ ও ভাষার মধ্যে কোনোই বৈষম্য ছিল না। ইরানের সালমান ছিলেন এ জাতির একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি। তাঁর বংশ পরিচয় জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতেন, “সালমান বিন ইসলাম”-ইসলামের পুত্র ইসলাম। হযরত আলী (রা.) তাঁর সম্পর্কে বলেতেন, -“সালমান আমাদেরই ঘরের লোক।” বাযান বিন্ সাসান এবং তাঁর ছেলে শাহার বিন্ বাযানও সেই সমাজে বাস করতেন। এরা ছিলেন বাহরামগোর-এর বংশধর। হযরত নবী করীম (সা.) বাযানকে ইয়ামানের এবং তাঁর পুত্রকে ছানয়া’র শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। আবিসিনিয়ার নিগ্রো বিলালও ছিলেন এ জামায়াতেরই একজন। হযরত উমর ফারুক (রা.) তাঁর সম্পর্কে বলতেন-ইনি ‘নেতা’র দাস এবং আমাদেরও নেতা।” রোমের ছোহাইব-ও এ জাতিরই একজন ছিলেন। হযরত উমর (রা.) তাঁকে নিজের স্থানে সালাতের ইমামতি করার জন্যে নিযুক্ত করতেন। হযরত আবু হোযাইফার ক্রীতদাস সালিম সম্পর্কে হযরত উমর জীবনের শেষ মুহূর্তে বলেছেন-“আজও সালিম যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে আমার পরবর্তী খলিফার জন্যে আমি তাঁর নাম প্রস্তাব করতাম। যায়েদ বিন হারেসা ছিলেন একজন ক্রীতদাস, (কিন্তু তিনিও ইসলামী জাতির অন্তর্ভূক্ত ছিলেন বলে) হযরত নবী করীম (সা.) তাঁর ফুফাতো ভগ্নি উম্মুল মু’মিনীন হযরত যয়নবকে তাঁর কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন। যায়েদের পুত্র উসামাও এ জামায়াতের একজন ‘সদস্য’ ছিলেন-হযরত নবী করীম (সা.) তাঁকে সৈন্যবাহিনীর ‘নেতা’ নিযুক্ত করেছিলেন এবং তাতে হযরত আবু বকর, উমর ফারুক, আবু উবায়দা বিন র্জারাহ্ প্রমুখ শ্রেষ্ঠ সাহাবায়ে কিরাম সাধারণ সৈনিক হিসাবে শরীক ছিলেন। এ উসামা সম্পর্কেই হযরত উমর (রা.) তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহর নিকট বলেছিলেন-“উসামার পিতা তোমার পিতা অপেক্ষা উত্তম ছিলেন এবং উসামা তোমার অপেক্ষা উত্তম।”

মুহাজিরদের আদর্শ
ইসলামী আদর্শে গঠিত জাতি বা (জামায়াত) ইসলামের শাণিত তরবারির আঘাতে বংশ, স্বদেশ, বর্ণ ও ভাষা প্রভৃতি নামে অভিহিত সকল দেবতা এবং আবহমানকাল থেকে চলে আসা হিংসা-বিদ্বেষের ভিত্তিসমূহ চূর্ণ করেছে। রাসূলে করীম (সা.) নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করলেন এবং সংগী-সাথীদের নিয়ে মদীনায় হিজরত করলেন। এর অর্থ এই নয় যে, হযরত (সা.) এবং তাঁর সংগী-সাথীদের মনে জন্মভূমির প্রতি কোনো টান-স্বাভাবিক দরদও ছিল না। মক্কা ত্যাগ করার সময় তিনি বলেছিলেনঃ “হে মক্কা, তুমি আমার কাছে দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রিয়। কিন্তু কি করবো, তোমার অধিবাসীগণ এদেশে আমাকে থাকতে দিলে না।” হযরত বিলাল (রা.) মদীনায় গিয়ে যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তখন তিনি মক্কার এক ব্যক্তি একটি জিনিস স্মরণ করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ সকল মহান ব্যক্তি একমাত্র ইসলামের জন্যেই হিজরত করেছিলেন এবং সে জন্যে তাঁরে মনে কখনো কোন ক্ষোভ জাগ্রত হয়নি।

الاليت شعرى هل ابيتن ليلة * بفتح وحولى اذخرو جليل وهل اردن يوما مياه مجنة * وهل تبدو الى شامة وطفيل

আনসারদের কর্মর্নীতি
অন্যদিকে মদীনাবাসীগণ রাসূলে করীম (সা.) এবং অন্যান্য মুহাজিরীনকে বিপুল সংবর্ধনা জানিয়েছিলেন। তাদের জন্যে নিজেদের জান ও মাল পর্যন্ত অকাতরে উৎসর্গ করেছিলেন। হযরত আয়েশা (রা.) এ কারণেই বলেছিলেনঃ “মদীনা কুরআনের দ্বারা জয় করা হয়েছে।” হযরত নবী করীম (সা.) আনসার ও মুহাজিরীনকে পরস্পর ভ্রাতৃবন্ধনে বেঁধে দিয়েছিলেন। আর তাঁরাও এমন গভীর ভ্রাতৃবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন যে, দীর্ঘকাল যাবত একে অপরের উত্তরাধিকার (মীরাস) পেয়ে আসছিলেন। অতপর, আল্লাহকে এ আয়াত নাযিল করেই এ কাজ বন্ধ করেছিলেনঃ وَاُولُو الارحام بَعضَهُم اَولى بِبَعضٍ মীরাসের ব্যাপারে রক্ত সম্পর্কই বেশী হকদার। আনসারগণ নিজেদের জমি-তে আধাআধি ভাগ করে মুহাজির ভাইদের মধ্যে বন্টন করেছিলেন। পরে বনী নযীরের ভূমিসহ যখন অধিকার করা হয়, তখন এ জমিগুলোকেও মুহাজির ভাইদের দান করার জন্য আনসারগণ নবী করীম (সা.) এর নিকট দাবী জানিয়েছিলেন। এ আত্মদানের প্রশংসা করে আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেনঃ وَيُؤثرونَ على اَنْفُسِهِم وَلو كان بِهِم خِصَاصةٌ -

“তারা নিজেদের অভাব ও কষ্ট থাকা সত্ত্বেও নিজেদের উপর মুহাজিরদেরকে অধিক প্রাধান্য দিচ্ছে।”

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আওফ ও হযরত সা’দ বিন রবী আনসারী পরস্পর ভ্রাতৃবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। অতপর হযরত সা’দ তাঁর এ দ্বীনি ভাইকে অর্ধেক সম্পত্তি দিলেন এবং তাঁর একাধিক স্ত্রীদের মধ্যে থেকে একজনকে তালাক দিয়ে তাঁর নিকট বিবাহ দিতে প্রস্তুত হলেন। নবী করীম (সা.)-এর যুগের মুহাজিরগণই যখন ক্রমাগত খলীফা নিযুক্ত হতে লাগলেন, তখন মদীনার কোনো এক ব্যক্তিও তাদেরকে একথা বলেননি যে, তোমরা বিদেশী লোক, আমাদের দেশে কর্তৃত্ব করার তোমাদের কি অধিকার আছে। রাসূলে করীম (সা.) এবং হযরত উমর ফারুক (রা.) মদীনার অদূরে মুহাজিরদেরকে ভূমি দান করেছিলেন; কিন্তু কোনো আনসার সে সম্পর্কে ‘টু’ শব্দ পর্যন্ত করেননি।

ইসলামী সম্পর্ক রক্ষার জন্য পার্থিব সম্পর্কচ্ছেদ
অতঃপর বদর ও ওহুদ যুদ্ধে মক্কার মুহাজিরগণ দ্বীন ইসলামের জন্য নিজেদেরই আত্মীয় বান্ধবদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করেছেন। হযরত আবু বকর (রা.) স্বয়ং তাঁর পুত্র আব্দুর রহমানের উপর তরবারির আঘাত হেনেছিলেন, হযরত হুযায়ফা নিজের পিতা আবু হুযায়ফার উপর আক্রমণ করেছিলেন, হযরত উমর (রা.) তাঁর মামাকে হত্যা করেছিলেন,স্বয়ং নবী করীম (সা.)-এর পিতৃব্য আব্বাস চাচাতো ভাই আকীল, জামাতা আবুল আছ বদর যুদ্ধে বন্দী হয়ে আসে এবং তাদেরকেও সাধারণ কয়েদীদের ন্যায় রাখা হয়। হযরত উমর (রা.) প্রস্তাব করেছিলেন যে, সমগ্র যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করা হোক এবং প্রত্যেকেই নিজের নিকটাত্মীয় বন্দীকে হত্যা করুক।

মক্কা বিজয়কালে রাসূলে করীম (সা.) অনাত্মীয় বৈদেশিক লোকদের সহযোগিতায় নিজ গোত্র এবং আপন জন্মভূমি আক্রমণ করেছিলেন। অপরের দ্বারা আপন লোকদের গর্দান কেটেছিলেন। আরবের কোনো ব্যক্তির পক্ষে তার গোত্র বর্হিভূত লোকদের নিয়ে নিজ গোত্র-গোষ্ঠীর উপর আক্রমণ করা-তাও আবার কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ কিংবা সম্পদ বা সম্পত্তি দখল করার জন্যে নয়, কেবলমাত্র একটি কালেমাকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে আরবের ইতিহাসে বাস্তবিকই অপূর্ব, অচীন্ত্যপূর্ব ঘটনা। কুরাইশ বংশের বদমাশ যুবক দল যখন নিহত হচ্ছিল, তখন আবু সুফিয়ান এসে বলেছিলঃ “হে রাসূলুল্লাহ! কুরাইশ বংশের কচি সন্তান সব নিহত হচ্ছে, ফলে কুরাইশ বংশের নাম-নিশানা পর্যন্ত মুছে যাবে।” রাহমাতুল্লিল আলামীন (সা.) মক্কাবাসীদের নিরাপত্তা দান করলেন। এতে আনসারগণ মনে করলেন যে, হযরত (সা.) এর মনে হয়তো তাঁর জাতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। তাঁরা বললেনঃ “হযরত (সা.) মানুষ বৈ আর কিছুতো নন, শেষ পর্যন্ত নিজ বংশের আভিজাত্য সুরতি না করে পারলেন না।” নবী করীম (সা.) একথার সংবাদ পেয়ে আনসারদের সমবেত করলেন এবং বললেনঃ “বংশ বা স্বগোত্রের প্রেম আমাকে কিছুমাত্র আকৃষ্ট বা বিচলিত করতে পারেনি; আমি আল্লাহর বান্দাহ এবং তাঁর রাসূল। আল্লাহর জন্যেই হিজরত করে তোমাদের নিকট গিয়েছি। এখন আমার জীবন ও মৃত্যু তোমাদের সাথে জড়িত।” এখানে নবী করীম (সা.) যা কিছু বলেছিলেন জীবনের প্রতিটি কাজ দ্বারা তার সত্যতা প্রমাণ করেছিলেন। যে কারণে মক্কা থেকে তিনি হিজরত করেছিলেন, মক্কা বিজয়ের পর তার কোনো একটি কারণও অবশিষ্ট ছিল না; কিন্তু তবুও তিনি মক্কায় বসবাস করেননি। এটা থǠƕে প্রমাণিত হচ্ছে যে, রাসূলে কারীম (সা.) কোনো স্বাদেশিক কিংবা প্রতিশোধমূলক ভাবধারার বশবর্তী হয়ে মক্কা আক্রমণ করেননি; করেছিলেন কেবলমাত্র সত্যের মহান বাণীর প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্যে।

পরবর্তীকালে যখন হাওয়াযিন ও সাক্বীফ গোত্রের ধন-সম্পদ ঞস্তগত হয়েছিল, তখনও অনুরূপ ভুল ধারণার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল। নবী করীম (সা.) গণীমাতের মাল থেকে কুরাইশ বংশের নওমুসলিমদেরকে বেশী অংশ দান করেছিলেন। কোনো কোনো যুবক আনসার এটাকে জাতীয় পপাতিত্ব বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। তারা একটু ক্রুদ্ধ এবং উত্তেজিত হয়ে বলেছিল যে, আল্লাহ রাসূলে করীম (সা.)-কে মাফ করুন, তিনি কুরাইশদের দিয়েছেন আর আমাদেরকে বঞ্চিত করেছেন। যদিও এখন পর্যন্ত আমাদের তরবারী থেকে তাদের রক্ত টপ টপ করে ঝরছে। এটা শুনে নবী করীম (সা.) আবার তাদেরকে সমবেত করে বললেনঃ এরা নতুন নতুন ইসলাম গ্রহণ করেছে বলেই এদেরকে বেশী দান করেছি। তাদের মন রক্ষা করাই একমাত্র উদ্দেশ্য। এরা পার্থিব সম্পদ নিবে, আর তোমরা আল্লাহর রাসূলকে পাবে। এ ‘বন্টন’ কি তোমরা পছন্দ করো না?

বনী মুস্তালিক যুদ্ধে একজন গিফার বংশের ও একজন আওফ বংশের লোকদের মধ্যে বিতর্ক হয়েছিল। গিফার বংশের লোকটি আওফ বংশের লোকটিকে চপেটাঘাত করে। আওফ বংশ আনসারদেরকে গিফারীদের বিরুদ্ধে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানাল। অপরদিকে গিফার বংশ মুহাজিরদের নিকট মুকাবিলার জন্য সাহায্য দাবী করেন। উভয় পরে শাণিত তরবারী কোষমুক্ত হবার উপক্রম হয়। নবী করীম (সা.) এ সংবাদ পেয়ে উভয় পক্ষকে ডেকে পাঠান এবং বলেনঃ “তোমাদের মুখে আজ এ কি জাহেলিয়াতের শব্দ ধ্বণিত হলো?” তারা বললোঃ “একজন মুহাজির একজন আনসার ব্যক্তিকে মেরেছে?” নবী করীম (সা.) বললেনঃ “তোমরা এ অন্ধকার বর্বর যুগের কথাবার্তা পরিত্যাগ করো, এটা বড়ই ঘৃণিত ব্যাপার।”

এ যুদ্ধে মদীনার প্রসিদ্ধ জাতীয়তাবাদী নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাইও যোগ দিয়েছিল। সে এ ঘটনা শুনতে পেয়ে বললোঃ “এরা আমাদের দেশে এসেই ‘ফুলে ফলে বিকশিত’ হয়েছে, আর এখন আমাদেরই মাথায় চড়ছে। একটি কুকুরকে পুষ্টিকর খাদ্য খাইয়ে পরিপুষ্ট ও শক্তিশালী করার পর সে যদি প্রতিপালককেই দংশন করে, তবে সেই অবস্থাকে আমাদের বর্তমান অবস্থার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। আল্লাহর শপথ! মদীনার প্রত্যাবর্তন করার পর আমাদের মধ্যে সম্মানিত ও শক্তিশালী দল দুর্বল ও লাঞ্চিত দলকে শহর থেকে বহিষ্কার করে দিবে।”

অতঃপর আনসারদের লক্ষ্য করে সে বললোঃ “তোমাদেরই বা কি হলো? তোমরাই ঐ লোকদেরকে নিজেদের দেশে স্থান দিয়েছ, ধন-সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছ। আল্লাহর শপথ! তোমরাই যদি এদের পরিত্যাগ কর, তবে এরা বায়ু সেবন করেই জীবন ধারণ করতে বাধ্য হবে।” নবী করীম (সা.) যখন এসব কথা শুনতে পেলেন, তখন তিনি আব্দুল্লাহ বিন উবাইর ছেলে হযরত আব্দুল্লাহকে ডেকে বলেন যে, “তোমার পিতা একথা বলছে।” হযরত আব্দুল্লাহ পিতাকে অত্যন্ত বেশী ভালবাসতেন এবং খাজরায বংশের কোন পুত্রই পিতাকে এতোখানি ভালবাসে না বলে তিনি গৌরববোধ করতেন। কিন্তু একথা শুনে তিনি বললেনঃ “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি আদেশ করলে এখনি তার মস্তক কেটে আনবো।” কিন্তু নবী করীম (সা.) নেতিবাচক উত্তর দিলেন। যুদ্ধ থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করার পর হযরত আব্দুল্লাহ পিতার পিতার উপর তরবারী উত্তোলন করে বললেনঃ “হযরতের অনুমতি না হলে তুমি মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না। তুমি নাকি বলেছ যে, আমাদের মধ্যে সম্মানিত দল লাঞ্ছিত লোকদের মদীনা থেকে বহিষ্কার করে দিবে? তবে তুমি জেনে রাখ, যাবতীয় সম্মান কেবল আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের জন্যেই সংরক্ষিত।” ইবনে উবাই একথা শুনে চিৎকার করে উঠলো এবং বললো, “খাজরাযগণ শোন, আমার পুত্রই এখন আমাকে ঘরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।” লোকজন এসে হযরত আব্দুল্লাহকে অনেক বুঝালেন। কিন্তু তিনি বললেনঃ “হযরতের অনুমতি না হওয়া পর্যন্ত আমি তাকে কিছুতেই মদীনায় প্রবেশ করতে দিব না।” শেষ পর্যন্ত হযরতের নিকট থেকে যখন অনুমতি আসলো, তখন তা শুনে হযরত আব্দুল্লাহ তরবারী কোষবদ্ধ করলেন এবং বললেনঃ “নবী করীম (সা.)-এর যখন অনুমতি হয়েছে, তখন আমার কোনো আপত্তি নেই।”

বনু কায়নুকা উপর যখন আক্রমণ করা হয়, তখন হযরত উবাদা বিন সামেতকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মীমাংসা করার জন্যে ‘শালিস’ নিযুক্ত করা হলো। তিনি গোটা গোত্রকে মদীনা থেকে নির্বাসিত করার ফয়সালা করলেন। এরা হযরত উবাদার গোত্র খাজরাযের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিল। তথাপি তিনি এর বিন্দুমাত্র পরোয়া করলেন না। বনু কুরাইযার ব্যাপারেও অনুরূপভাবে আওস নেতা হযরত সা’দ বিন মায়াজকে ‘বিচারক’ মনোনীত করা হয়েছিল। তিনি ফয়সালা করলেন যে, বনু কুরাইযার সকল পুরুষকে হত্যা করা হবে, নারী ও শিশুদের বন্দী করে রাখতে হবে এবং তাদের ধন-সম্পত্তি ‘গণীমত’ হিসাবে গণ্য হবে। এ ব্যাপারে তিনি আওস ও বনু কুরাইযার মধ্যে যুগান্তকালের সন্ধি-চুক্তির প্রতি বিন্দুমাত্র খেয়াল করলেন না। অথচ এটা সর্বজনবিদিত যে, আরব দেশে পারস্পারিক চুক্তির অত্যন্ত গুরুত্ব ছিল। উপরন্তু শত শত বছর ধরে এরা আনসারদের সাথে একত্রে ও একই দেশে বসবাস করছিল। কিন্তু তা সবই ব্যর্থ হলো।

ইসলামী জাতি গঠনের মৌলিক প্রাণসত্ত্বা
এসব ঐতিহাসিক প্রমাণ ও তথ্য থেকে এ সত্যই পরিস্ফুট হচ্ছে যে, ইসলামী জাতীয়তার ভিত্তি স্থাপনের ব্যাপারে বংশ, গোত্র, ভাষা ও বর্ণের কিছুমাত্র গুরুত্ব নেই। যে নির্মাতা এ ‘প্রাসাদ’ নির্মান করেছেন, তাঁর পরিকল্পনা সম্পূর্ণ অভিনব-অতুলনীয়। তিনি সমগ্র মনুষ্য জগতের ‘কাঁচামাল’ সূক্ষ্মভাবে যাচাই করে দেখেছেন। বেছে বছে উত্তম ও উৎকৃষ্ট মাল-মসলা যা পাওয়া গেছে, তা সংগ্রহ করেছেন। ঈমান ও সৎকাজ পোখ্ত ও নিখুঁত ছিল বলে এসব বিভিন্ন উপাদানকে একত্রে সমন্বিত করেছেন এবং এক বিশ্বব্যাপক ও নিখিল সৃষ্টিলোকব্যাপী এ জাতীয়তার প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন। এ বিরাট ও মহান প্রাসাদের স্থিতি ও স্থায়িত্ব শুধু একটি কাজের উপর একান্তভাবে নির্ভর করে। তা এই যে, তার মূল আকৃতি ও স্থানের দিক দিয়ে বিভিন্ন ‘অংশ’ নিজেদের স্বতন্ত্র মৌলিকতার কথা ভুলে একটি মাত্র বর্ণে ‘মূলকেই’ গ্রহণ করবে ও স্মরণে রাখবে; নিজেদের বিভিন্ন বর্ণ ভুলে একটি মাত্র বর্ণে ভূষিত হবে। স্থান ও ভূমি নির্বিশেষে সকলে একই ‘মুক্তিকেন্দ্র’ থেকে নির্গত হবে এবং একই ‘সত্য মঞ্জিলে’ উপস্থিত হবে। সীসা ঢেলে তৈরি করা এ প্রাচীরই জাতীয় ঐক্যের মূলকথা। এ ঐক্য যদি চূর্ণ হয়, জাতির মৌলিক উপকরণসমূহে যদি নিজেদের মূল বংশের আলাদা আলাদা হওয়ার, নিজেদের জন্মভূমি ও বাসস্থানের বিভিন্ন হওয়ার এবং নিজেদের পার্থিব স্বার্থের পরস্পর বিরোধী হওয়ার অনুভূতি তীব্রভাবে জেগে উঠে, তাহলে এ ইমারতের প্রাচীরে ফাটল ধরে তার বুনিয়াদ চূর্ণ হওয়া এবং তার সমগ্র মৌলিক উপকরণ ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত হওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। একই রাষ্ট্রের মধ্যে যেমন বহু রাষ্ট্র গড়া যায় না, ঠিক তেমনি একই জাতীয়তার মধ্যে একাধিক জাতীয়তা স্থান পেতে পারে না। ইসলামী জাতীয়তার মধ্যে বংশীয়, গোত্রীয়, স্বাদেশিক, ভাষা এবং বর্ণ ভিত্তিক জাতীয়তার সমাবেশ হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। এ উভয় জাতীয়তার মধ্যে একটি মাত্র জাতীয়তাই টিকতে পারে-বেশী নয়।

অতএব যে ব্যক্তি প্রকৃত মুসলমান, মুসলমান হয়ে থাকা ও বাস করাই যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, তাকে দুনিয়ার অন্যান্য সকল প্রকার জাতীয়তার অনুভূতিকে বাতিল মনে করতে হবে, মাটি এবং রক্তের সকল প্রকার সম্পর্ক-সম্বন্ধকে ছিন্ন ও অস্বীকার করতে হবে। কিন্তু তবুও যদি কেউ ঐসব সম্পর্ক অবিকৃত ও পূর্বের ন্যায় স্থায়ী করে রাখতে চায়, তবে তার হৃদয়, মন ও মস্তিষ্কে ইসলাম যে, প্রবেশ লাভ করেনি; তাতে কোনোই সন্দেহ থাকতে পারে না। বস্তুত এমন ব্যক্তির মন ও মগজের উপর চরম জাহেলিয়াত আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কাজেই আজ না হলেও কাল সে অবশ্যই ইসলাম ত্যাগ করবে এবং ইসলামও তাকে ত্যাগ করবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।

শেষ নবীর উপদেশ
মুসলমানদের মধ্যে এ প্রাচীন জাহেলী হিংসা-দ্বেষ ও আভিজাত্যবোধ যাতে পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে না উঠে এবং তার কারণে ইসলামের জাতীয় প্রাসাদের ভিত্তি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে না যায়, এটাই ছিল নবী করীম (সা.)-এর শেষ কালের সর্বাপেক্ষা বড় আশংকা। এজন্যই তিনি বারবার বলতেনঃ

لاَ تُرجِعُوا بَعدى كُفَّارًا يَضْرِبُ بعضكم رشقاب بعضٍ – (بخارى؛ كتاب الفتن)

“আমার পরে তোমরা যেন পুনরায় কুফুরীতে লিপ্ত না হও এবং তার পরিণামে তোমরা যেন পরস্পরকে হত্যা করতে উদ্যত না হও।”

নবী করীম (সা.) জীবনের শেষ হজ্জ্বে-বিদায় হজ্জ্ব উপলক্ষ্যে আরাফাতের ময়দানে বিরাট মুসলিম জনসম্মেলনে বক্তৃতা করে বলেনঃ

“জেনে রাখ! জাহেলী যুগের সমস্ত বস্তুই আমার এ দু’পায়ের নীচে। আরবকে অনারবের উপর এবং অনারবকে আরবের উপর কোনোই শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়নি। তোমরা সকলেই আদমের সন্তান এবং আদম মাটি থেকে সৃষ্টি। মুসলমান মুসলমানের ভাই-মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। জাহেলী যুগের সকল প্রকার মতবাদ বাতিল করে দেয়া হয়েছে। এখন তোমাদের রক্ত, তোমাদের উজ্জত এবং তোমাদের ধন-সম্পদ পরস্পরের পক্ষে ঠিক তদ্রুপ হারাম, যেমন আজিকার এ হজ্জ্বের দিন তোমাদের এ মাস ও এ শহরে হারাম-সম্মানিত।”

অতপর ‘মিনা’ নামক স্থানে উপস্থিত হয়ে এটা অপেক্ষাও অত্যন্ত জোরালো ভাষায় পুনরায় এ বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন। তখন তিনি এটাও বলেছেনঃ

“শোন! আমার পরে তোমরা পুণরায় পথভ্রষ্ঠ হয়ে পরস্পরে হত্যা কাজে লিপ্ত হবে না। অতি শীঘ্রই তোমরা তোমাদের রবের সাথে মিলিত হবে। তখন তোমাদের নিকট থেকে তোমাদের যাবতীয় কাজ কর্মের হিসাব নেয়া হবে।”

“শুনে রাখ! কোনো নাকবোঁচা নিগ্রোকেও যদি তোমাদের ‘রাষ্ট্রকর্তা’ নিযুক্ত করা হয় এবং সে যদি তোমাদেরকে আল্লাহর বিধান অনুসারে পরিচালিত করে, তবে তোমরা অবশ্যই তার কথা শুনবে এবং মেনে চলবে।”

একথা বলে তিনি সমবেত জনসমুদ্রকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “আমি কি তোমাদের নিকট এ বাণী পৌছতে দিয়েছি? জনসমুদ্র বলে উঠলো, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল।” তখন নবী করীম (সা.) বললেনঃ “হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষি থেকো।” সমবেত লোকদেরও তিনি বলেলেনঃ উপস্থিত লোকেরা আমার এ বাণী যেন অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌছে দেয়।”

হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তন করে ওহুদ যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাদের স্থানে উপস্থিত হলেন এবং বললেনঃ “আমার পরে তোমরা শিরকে লিপ্ত হবে, সে আশংকা আমার নেই। কিন্তু তোমরা দুনিয়ার লালসায় লিপ্ত হও নাকি, তাই ভাবনার বিষয়। পরস্পর লড়াই করতে শুরু করো না। তা করলে, তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে, যেমন প্রাচীন জাতিসমূহ ধ্বংস হয়ে গেছে।”

ইসলামের জন্যে সবচেয়ে বড় বিপদ
বিশ্বশ্রেষ্ঠ মহামানব যে বিপদের আশংকা প্রকাশ করেছিলেন, বস্তুতই তা অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং মারাত্মক প্রমাণিত হয়েছে। ইসলামের সোনালী যুগ থেকে আজ পর্যন্ত ইসলাম এবং মুসলমানদের উপর যেসব সর্বগ্রাসী বিপদ আবর্তিত হয়েছে, তা সবই এর কারণে সম্ভব হয়েছে। নবী করীম (সা.)-এর ইন্তেকালের কয়েক বছর পরই হাশেমী বংশের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে উমাইয়া গোত্রের হিংসা ও আভিজাত্যবোধের উন্মাত্তনা ফেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো এবং তারা ইসলামের প্রকৃত রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চিরতরে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল। অতপর তাই আবার আরবী, আযমী ও তুর্কী জাতি-বিদ্বেষ রূপে আত্মপ্রকাশ করলো এবং ইসলামের রাষ্ট্রীয় ঐক্যকে ধ্বংস করলো। এরপর বিভিন্ন দেশে যেসব ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ স্থাপিত হয়েছিল, সে সবের ধ্বংসপ্রাপ্তির মূলেও এ ফেতনার তীব্র প্রভাব বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু এ ফেতনা সে দুটিকেও ধ্বংস করেছে। ভারতবর্ষে মোগল ও ভারতীয়দের মধ্যে বিরোধ ও বৈষম্য, মোগল রাষ্ট্রের বুনিয়াদ চূর্ণ করেছে এবং তুর্কী রাষ্ট্র তুর্ক, আরব ও কুর্দিদের পারস্পারিক পার্থক্য ও বিরোধের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।

ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস পড়ে দেখুন, যেখানেই কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্র পরিলক্ষিত হবে, তারই বুনিয়াদে জাতি-বর্ণ-দেশ নির্বিশেষে অসংখ্য বংশের বিভিন্ন বংশের এবং বিভিন্ন জাতির রক্ত ধারায় ত্রিবেনী সংগম ঘটেছে-দেখতে পাবেন, তারা রাষ্ট্রনেতা, সেনাধ্ক্ষ্য, লেখক-চিন্তাবিদ এবং যোদ্ধা সকলেই বিভিন্ন জাতি সমুদ্ভুত হবে। ইরাকবাসীকে আফ্রিকায়, সিরিয়ানকে ইরানে, আফগানকে ভারতে (ভারতীয়কে পাকিস্থানে) অত্যন্ত সাহসিকতা, বিশ্বস্থতা, সততা ও নির্ভীকতা সহকারে মুসলিম রাষ্ট্রের কল্যাণকর কাজে নিযুক্ত দেখতে পাবেন। আর তাদের এ খেদমত বৈদেশিক বা পররাষ্ট্রের খেদমত নয়, একান্তভাবে নিজের দেশ হিসাবেই তাঁরা এটা করছেন। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের বীর কর্মধ্ক্ষ্য সংগ্রহ করার ব্যাপারে বিশেষ কোনো দেশ, বিশেষ কোনো গোত্র কিংবা জাতির উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করেনি। যেখানেই প্রতিভাসম্পন্ন মস্তিষ্ক এবং বলিষ্ঠ, দক্ষ্য ও নিপুণ হস্ত হয়ে গেছে, সেখান থেকেই তাদেরকে একত্র করা হয়েছে। তাঁরা প্রত্যেক দারুল ইসলামকেই নিজের দেশ এবং আপন ঘর মনে করেছেন। কিন্তু অহমিকা, স্বার্থপরতা ও জাতি-বিদ্বেষের সর্বগ্রাসী ফেতনা যখন উঠলো, তখন তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে হিংসা ও বিদ্বেষের বহ্নি প্রজ্জ্বলিত করতে শুরু করলো। দলাদলি, আত্মকলহ এবং কুটিল ষড়যন্ত্রের সয়লাব বইতে লাগলো। যে শক্তি একদা দুশমনদের বিরুদ্ধে নিয়োজিত ছিল, তাই এখন পরস্পরের বিরুদ্ধে শাণিত হাতিয়ার হয়ে দেখা দিলো। মুসলমানদের মধ্যে সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল এবং বড় বড় মুসলিম শক্তিসমূহ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ
বর্তমান পাশ্চাত্য জাতিসমূহের নিকট শিক্ষাগ্রহণ করে, তাদের অন্ধ অনুকরণ করে দুনিয়ার সকল দেশের মুসলমান বংশ বা গোত্রবাদ এবং স্বাদেশিকতার মহিমা গাইতে শুরু করেছে। আরব দেশ আজ আরব জাতীয়তার জন্য গৌরব করেছে, মিশরবাসী আজ বহু প্রাচীনকালের স্বৈরাচারী ফিরাউনকে জাতীয় নায়ক হিসাবে স্মরণ করছে। তুরস্কবাসী তুর্কীবাদের উত্তেজনায় ইতিহাস প্রসিদ্ধ চেংগিজ ও হালাকু খানের সাথে নিজেদের নিকটতম গভীর আত্মীয়তা অনুভব করছে। ইরানবাসীগণ আজ ইরানী আভিজাত্যবোধের তীব্রতায় দিশেহারা। তদের মতে আরব সাম্রাজ্যবাদের দৌলতেই হুসাইন ও আলী (রা.)-এর মতো লোক জাতীয় হিরো হতে পেরেছেন, অন্যথায় রুস্তম ও এসফানদিয়ারই প্রকৃতপক্ষে তাদের জাতীয় স্মরণীয় বক্তি। বিভাগপূর্ব ভারতেও বহু মুসলমান নিজেদেরকে ভারতীয় জাতীয়তার অন্তর্ভূক্ত বলে মনে করেছে, অনেক লোক আরবে যমযমের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে ‘গংলার জলের’ সাথে নিজেদের জাতীয় সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ভীম এবং অর্জনুকে জাতীয় ‘হিরো’ মনে করেছে। কিন্তু এর কারণ কি? এ মারাত্মক অবস্থার একমাত্র কারণ হচ্ছে এসব অজ্ঞ-মূর্খগণ যেমন নিজেদের তাহযীব-তামাদ্দুনকে মোটেই অনুধাবন করতে পারেনি, ঠিক তেমনি পাশ্চাত্য তাহযীবকেও নয়। মূলনীতি এবং নিগূঢ় সত্য তাদের গোচরীভূত হয়নি। তারা অত্যন্ত স্থুলদর্শী বলে বাহ্যিক চাকচিক্যময় ও চিত্তহারী চিত্র দেখে মুগ্ধ হয়- তার জন্যে পাগল হয়ে উঠে। তারা মাত্রই বুজতে পারে না যে, পাশ্চাত্য জাতীয়তার জন্য যা সঞ্জীবনী সূধা, ইসলামী জাতীয়তার জন্য তাই মারাত্মক হলাহল। পাশ্চাত্য জাতীয়তার ভিত্তি বংশ, দেশ, ভাষা ও বর্ণের ঐক্যের উপর স্থাপিত। এ জন্য যে ব্যক্তি তার স্বজাতীভূক্ত ও একই বংশোদ্ভূত এবং একই ভাষাভাষী নয়-সে যদি তার সীমান্তের এক মাইল দূরেও অবস্থিত হয়, তবুও তার সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করতে এবং কোনো প্রকার সম্পর্ক না রাখতে বাধ্য হয়। সে দেশে এক জাতির লোক অন্য জাতির প্রকৃত ও একনিষ্ঠ বন্ধু হতে পারে না, এক দেশের অধিবাসী অন্য দেশের প্রকৃত খাদেম হতে পারে না। এক জাতি অন্য জাতির কোনো ব্যক্তির প্রতি এতোটুকু আস্থা রাখতে পারে না যে, সে তার নিজ জাতির স্বার্থকে বাদ দিয়ে তার স্বার্থকে বড় করে দেখতে পারবে। কিন্তু ইসলামী জাতীয়তার ব্যাপারটি এটা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ইসলামী জাতীয়তার ভিত্তি বংশ-গোত্র এবং স্বদেশের পরিবর্তে মতবাদ-বিশ্বাস ও কর্মাদেশের উপর স্থাপিত। দুনিয়ার সমগ্র মুসলমান সর্বপ্রকার জাতিগত বৈষম্যের উর্দ্ধে থেকে পরস্পর সুখ-দুঃখের অংশীদার এবং সহযোগী ও সহকর্মী হতে পারে। একজন ভারতীয় (বা বাংলাদেশী) মুসলমান মিশরের ততোখানি বন্ধু হতে পারে-অনুগত হতে পারে, যতোখানি পারে সিরিয়া রক্ষার ব্যাপারে। এজন্যই বলছিলাম যে, এক দেশের মুসলমান অন্য দেশের মুসলমানদের মধ্যে ভৌগলিক বা বংশীয়-গোত্রীয় কোনো পার্থক্য নেই। এ ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি এবং পাশ্চাত্য দেশের নিয়ম-নীতি পরস্পর বিরোধী। সে দেশের জন্যে যা শক্তির কারণ, ইসলামের পক্ষে তাতে ভাঙন ও বিপর্যয় ঘটে। পাক্ষান্তরে ইসলামের জন্য যা সঞ্জীবক, পাশ্চাত্য জাতীয়তার জন্য তাই হত্যাকারী বিষ। কবি ইকবাল এ তত্ত্বটি কি চমতকার ভাবে ব্যক্ত করেছেনঃ (এখানে কয়েকটি উর্দু লাইন আছে)।

কোনো কোনো লোক এটাই ধারণা করে যে, স্বাদেশিক কিংবা বংশীয় গোত্রীয় জাতীয়তার অনুভূতি জাগ্রত হওয়ার পরও ইসলামী জাতীয়তার সূত্র মুসলমানদেরকে গভীর ভাবে বাঁধতে পারে। এজন্য তারা নিজেদেরকে এ বলে ধোঁকা দেয় যে, এ উভয় ধরণের জাতীয়তা একই সাথে চলতে পারে না। একের দ্বারা অপরের বিন্দুমাত্রও ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই। বরং আমরা উভয় প্রকার জাতীয়তা থেকেই অফুরন্ত সুফল লাভ করতে পারি। কিন্তু এটা যে একেবারেই চরম মূর্খতা এবং বুদ্ধিহীনতারই অনিবার্য ফল, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। একটি দেহে যেমন দুটি মন স্থান লাভ করতে পারে না, তেমনি একটি মনে দুটি জাতীয়তার পরস্পর বিরোধী ও সাংঘর্ষিক ভাবধারার সমন্বয় করাও কিছুতেই সম্ভব নয়। জাতীয়তার অনুভূতি ‘আপন’ ও ‘পরের’ মধ্যে অনিবার্যরূপে পার্থক্যের সীমারেখা অংকিত করে। ইসলামী জাতীয়তার অনিবার্য ও দুর্নিবার প্রভাবে একজন মুসলিম বাধ্য হয়েই মুসলমানকে আপন এবং অমুসলিমকে ‘পর’ বলে মনে করবে। অপরদিকে স্বাদেশিক বা বংশীয় জাতীয়তার অনুভূতির স্বাভাবিক পরিণতিতে আপনার দেশে, নিজের বাংশ বা গোত্রের প্রত্যেকটি মানুষকে আপন এবং অন্য দেশের বা অন্য বংশের লোককে পর বলে মনে করবেই। এ উভয় ভাবধারা-উভয় প্রকার অনুভূতিই একই স্থানে সমন্বিত হতে পারে বলে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তিই কি প্রমাণ করতে পারে? আপনার দেশের অমুসলিমকে আপনও মনে করবেন-‘পর’ও মনে করবেন, বিদেশী মুসলমানকে দূরবর্তীও মনে করবেন, আবার নিকটবর্তীও-এটা কেমন করে সম্ভব হতে পারে?

هَل يَجتَمِعًا مَعًا ؟ ألَيْسَ مِنْكُم رَجُلٌ رَشِيْدٌ ؟

অতএব একথা পরিষ্কাররূপে বুঝে নিতে হবে যে, মুসলমানদের মধ্যে ভারতীয়, তুর্কী, আফগানী, আরবী, ইরানী, পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী প্রভৃতি হওয়ার অনুভূতি জাগ্রত হওয়া ইসলামী জাতীয়তার চেতনা এবং ইসলামী ঐক্যবোধের পক্ষে অত্যন্ত মারাত্মক এবং ক্ষতিকারক। এটা কেবল বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার ফলই নয়, বাস্তব ক্ষেত্রেও এটা বরাবর অনুষ্ঠিত হতে দেখা গেছে। মুসলমানদের মধ্যে যখন আঞ্চলিক বা বংশীয় জাতীয়তার হিংসা-বিদ্বেষ জাগ্রত হয়েছে, তখনি মুসলমান মুসলমানদের গলায় ছুরি চালিয়েছে, এবং لاَ تَرجعوا بعدى كَفَّارًا يَضْرِبُ بعضكم رِقاَبَ بَعْضٍ “আমার পরে তোমরা কাফেল হয়ে গিয়ে পরস্পরের গলা কাটতে শুরু করো না।”-নবী করীম (সা.)-এ আশংকাকে বাস্তব করেই ছেড়েছে! কাজেই ইসলামী জাতীয়তাকে বাদ দিয়ে অন্য কোনোরূপ জাতীয়তা-ভৌগলিক, গোত্রীয় বা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার প্রচার যদি করতেই হয়, তা ভাল করেই জেনে শুনেই করা আবশ্যক-জেনে নেয়া আবশ্যক যে, এ ধরণের জাতীয়তার মতবাদ শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক প্রচারিত জাতীয়তার সম্পূর্ণ বিপরীত।

এ ব্যাপারে নিজেকে প্রবঞ্চিত করে বা অন্য লোকদের প্রতারণা ও গোলক ধাঁধায় দিক ভ্রান্ত করে কোনোই লাভ নেই।(রচনাকাল -তরজামানুল কুরআনঃ নভেম্বর-ডিসেম্বর, ১৯৩৩ ইং)।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি