আখেরাতের চিন্তার লালন
আপনারা হয়তো জিজ্ঞেস করবেন যে, আমরা সেই জন্য কিরূপ চেষ্টা করতে পারি? এবং এ জন্য আমরা কোন কোন জিনিসের সাহায্য গ্রহণ করবো? এর জবাবে আমি বলতে চাই যে, এরও দুটি উপায় রয়েছে : একটি চিন্তাও আদর্শমূলক। অপরটি হলো বাস্তব কর্মপন্থা।

চিন্তা ও আদর্শিক অনুশীলনের পন্থা এই যে, আপনি শুধু আমি আখেরাতের প্রতি ঈমান আনলাম। একথাটির মুখে উচ্চারণ করেই ক্ষান্ত হবেন না। বরং অর্থ বুঝে কালামে পাক অধ্যয়নের অভ্যাস করবেন। এর ফলে আপনার বিশ্বাসের চোখে ক্রমাগত পার্থিব দুনিয়ার এ আবরণের অন্তরালে অবস্থিত আখেরাত অত্যন্ত স্পষ্টরূপে ধরা দেবে। কারণ কালামে পাকে সম্ভবত এমন একটি পৃষ্ঠাও নেই যেখানে কোনো না কোনোরূপে আখেরাতের উল্লখ পাওয়া যায় না। বিভিন্ন স্থানে আখেরাতের এমন বিস্তারিত নকশা দেখতে পাবেন যে, আপনার মনে হবে, যেন কেউ চাক্ষুসভাবে দেখার পরেই এটা বর্ণনা করেছে। এমনকি অনেক স্থানে এ চিত্র এমন সুন্দরভাবে ফুটে উছেছে বলে অনুভব করতে থাকে তখন মনে হয় যেন, এজড় জগতের হাল্কা পর্দাখানা একটু একটু সরে গেলেই বর্ণিত ঘটনবলী প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হতো। সুতরাং নিয়মিত কুরআন শরীফ বুঝে তেলাওয়াত করতে থাকলে মানুষের মনে ক্রমশ সর্বদা স্মরণ রাখতে পারবে যে, তার স্থায়ী হতে পারবে। তখন সে কথাটি সর্বদা স্মরণ রাখতে পারবে যে, তার স্থায়ী বাসভূমির সন্ধান লাভ মৃত্যুর পরই সম্ভব এবং দুনিয়ার এ অস্থায়ী জীবনেই এর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

হাদীস অধ্যয়ন করলে এ মনোভাব আরও বলবত ও মযবুত হয়। কারণ হাদীস শরীফে পরলোক সম্পর্কে প্রায় চাক্ষুস অভিজ্ঞতার মতোই বিবরণ সন্নিবিষ্ট রয়েছে। এছাড়া হযরত নবী করীম (স) স্বয়ং এবং তাঁর সাহাবায়ে কিরাম সর্বদা আখেরাত সম্পর্কে কতখানি সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন তা থেকে তা জানা যায়। কবর যিয়ারত করলে এ বিষয়ে আরো সাহায্য লাভ করা যায়। নবী করীম (স) কবর যিয়ারত উদ্দেশ্যে সম্পর্কে বলেছেন যে, মানুষ এর সাহায্য নিজের মৃত্যুর স্মরণ করতে সক্ষম হয় এবং লোভ-লালসায় পরিপূর্ণ এ দুনিয়ার বুকে অবস্থান করেও একথা তার মনে জাগরুক রাখতে পারে যে, সকল মানুষ যেখানে গিয়েছে এবং প্রত্যহ অসংখ্য লোক যেখানে পৌঁছাছে তাকেও একদিন সেখানে এবং প্রত্যহ অসংখ্য লোক যেখানে পৌঁছেছে তাকেও একদিন সেখানে যেতে হবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, বর্তমানে গুমরাহ লোকেরা যে সমস্ত মাযারকে মকছুদ হাসিল কিংবা মুশকিল আসানের কেন্দ্র হিসেবে খাড়া করেছে,তার পরিবর্তে সাধারণ গরীব লোকদের কবরস্থান এদিক দিয়ে অনেক বেশী উপকারী। অথবা এ উদ্দেশ্যে প্রাচীন রাজা-বাদশাহদের শূন্য ও পাহারাদার বিবর্জিত বিরাটকার কবরগুলো পরিদর্শন করা চলে।

অতএব বাস্তব কর্মপন্থার কথায় আসুন। এ পার্থিব জীবনে আপনাকে ঘর-সংসার, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, নিজের শহর ও দেশের ব্যবস্থাপনা, আদান-প্রদান এবং অর্থনৈতিক কাজ-কারবার এক কথায় জীবনের প্রতি পদেই আপনাকে উভয় সংকটের সম্মুখীন হতে হয় এবং একদিকে আখেরাত বিশ্বাস আর অপরদিকে দুনিয়াদারী আপনাকে হাতছানি দেয়। এমতাবস্থায় আপনাকে প্রথমোক্ত পথেই অগ্রসর হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হবে। যদি নফসের দুর্বলতা কিংবা আলস্যবশত আপনি কখনো ভিন্ন পথেই অগ্রসর হন, তবে সেই কথা স্মরণ হওয়ার সাথে সাথেই আপনি পথ পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন, ভুল পথে আপনি অনেক দূল অগ্রসর হলেও কোনো কথা নেই। তাছাড়া আপনি মাঝে মাঝে নিজের হিসেব-নিকেশ করে দেখবেন, কোন কোন ক্ষেত্রে দুনিয়া আপনাকে নিজের দিকে টানতে সমর্থ হয়েছে আর আপনিইবা কতবার আখেরাতের দিকে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়েছেন। এ পর্যালোচনার দ্বারাই আপনি কতখানি মযবুত হয়েছে আর কতখানি আপনাকে অভাব পূরণ করতে হবে। যতখানি অভাব দেখেবেন তা নিজেই পূরণের চেষ্টা করবেন। এ ব্যাপারে বাহির থেকে কোনো প্রকার সাহায্য লাভ করতে হলে আপনাকে সর্বপ্রথম দুনিয়াদার লোকদের সংশ্রব পরিত্যাগ করতে হবে এবং আপনার জানা মতে যাঁরা দুনিয়ার তুলনায় আখারতেরই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, এধরনের নেক লোকদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। কিন্তু একটি কথা আপনাকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, আপনার নিজের চেষ্টা ছাড়া কোনো গুণের হ্রাস-বৃদ্ধি করার বাস্তব কোনো পন্থা এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। কিংবা নিজের মধ্যে মূল উপাদান পর্যন্ত বর্তমান নেই, এমন গুণ সৃষ্টিও করাও সম্ভব নয়।

অযথা অহমিকা বর্জন
তৃতীয় যে বিষয়ে আমি আপনাদেরকে উপদেশ দিতে চাই তা এই যে, গত কয়েক বছর যাবৎ ক্রমাগত চেষ্টার ফলে আপনাদের ব্যক্তিগত কিংবা সাংগঠনিকভাবে কখনো দেখা না দেয়। আপনারা যেন ব্যক্তিগত কিংবা সাংগঠনিকভাবে কখনো এরূপ ভুল ধারণা পোষণ না করেন যে, আমরা এখন পূর্ণত্ব লাভ করেছি, যা কিছু যোগ্যতা অর্জন করা দরকার ছিলো, তার সবই আমরা হাসিল করে ফেলেছি। সুতরাং এখন আর আমাদের কাম্য এমন কোনো বস্তু নেই, যেজন্য আমাদেরকে আরো চেষ্টা-যত্ন করতে হবে। আমাকে এবং জামায়াতের অন্যান্য দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণকে অনেক সময়ই একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বেশ কিছুদিন যাবত কিছু সংখ্যক লোক জামায়াতে ইসলামীর-প্রকৃতপক্ষে জামায়াত পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের মূল্য হ্রাস করার মতলবে প্রচার করে বেড়াচ্ছে যে, এ জামায়াত নিছক একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার আত্মশুদ্ধি বা আধ্যাত্মিকতার কোনো নাম-নিশানা নেই। এর কর্মীদের মধ্যে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক এবং আখেরাত চিন্তার অভাব রয়েছে। এদলের পরিচালক নিজে যেমন কোনো পীরের মুরীদ নয়, তেমনি তিনি কোনো খানকা হতেও তাকওয়া পহহেযগারী বা ইহসান-কামালিয়াতের ট্রেনিং-এর সুযোগ পাবেন, তারও কোনো সম্ভবনা নেই। এধরনের প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর কর্মী এবং আন্দোলনের প্রতি আগ্রহশীল লোকদের মনে জামায়াতের প্রতি বীতশ্রদ্ধার সৃষ্টি করা এবং তাদেরকে পুনরায় এমন আস্তনায় ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করা, যেখানে কুফরীর আশ্রয়ে থেকে ইসলামের আংশিক খেদমত করাকেই আজ পর্যন্ত এক বিরাট কীর্তীরূপে গণ্য করা হচ্ছে, যেখানে দীন ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও বিজয়ী করার কোনো কল্পনারই অস্তিত্ব নেই। বরং যেখানে এ ধরনের কোনো পরিকল্পনার কথা উত্থাপন করার পার নানাভাবে এটাকে এক অধর্মীয় প্রস্তাব বলে প্রমাণ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে এবং এরূপ প্রস্তাবকে এমনভাবে বিকৃত করা হয়েছে যে, কুফর ও ফাসেকীর পরিবর্তে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পুন: প্রতিষ্ঠা ও প্রাধান্য বিস্তারের কল্পনাকে একটি নিতান্ত বৈষায়িক চিন্তা বলে অভিহিত করা হয়েছে। একারণেই আমাদরকে বাধ্য হয়ে খানকার আত্মশুদ্ধি ও ইসলামী আত্মশুদ্ধির মধ্যকার পার্থক্য উদঘাটন করতে হয় এবং প্রকৃত তাকওয়া পরহেযগারী ও ইহসানের সঠিক পরিচয় যা ইসলামের কাম্য-পরিষ্কার করে বর্ণনা করতে হয় এবং ধর্ম শিল্পে লোকগণ যে সনাতন ও কামালিয়াতের শিক্ষা বা ট্রেনিং দিচ্ছেন, তার সাথে ইসলামের পার্থক্য কতটুকু তা বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সেই সাথে জামায়াতে ইসলামী কর্তক অনুসৃত সংশোধন ও ট্রেনিং পদ্ধতি এবং এর ফলাফলও আমাদেরকে প্রকাশ করতে হয়, যেন ইসলাম সম্পর্কে সঠিক চেতনা সম্পন্ন যে কোনো লোক একথা বুঝতে পারেন যে, জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ও কর্মনীতির প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পর প্রাথমিক ভাবধারা সৃষ্টি হতে শুরু করে, তা জীবন ব্যাপী আত্মশুদ্ধির ট্রেনিং লাভের পরও এমনকি ট্রেনিংদাতাদের মধ্যেও দেখা যায় না।

এ সকল কথা আমরা আমাদের সমালোচকদের বে-ইসাফীর কারণেই বলতে বাধ্য হচ্ছি। নিছক আত্মরক্ষার জন্য নয়, বরং ইসলামী আন্দোলনের নিরাপত্তার জন্য এটা আমাদের বলতে হয়, কিন্তু এ সমস্ত কথার ফলে আমাদের সহকর্মীদের মনে যেন কোনো প্রকার গর্ব-অহংকার কিংবা নিজেদের কামালিয়াত সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা না জন্মে, সে জন্য আমরা আল্লাহর নিকট পানাহ চাচ্ছি। আল্লাহ না করুন, আমাদের মধ্যে যদি কোনো প্রকার মিথ্যা অহমিকা দেখা দেয়, তবে এ পর্যন্ত আমরা যতটুকু লাভ করেছি তাও হয়তো হারিয়ে বসবো।

এ বিপদ হতে আত্মরক্ষার জন্যই আমি আপনাদেরকে তিনটি নিগুঢ় সত্য ভালো করে বুঝে নিতে এবং তা কখনো বিস্মৃত না হতে অনুরোধ করি।

কামালিয়াত (পূর্ণত্ব) একটি সীমাহীন ব্যাপার, এর শেষ সীমা আমাদের দৃষ্টির অগোচরে অবস্থিত। মানুষের কর্তব্য হচ্ছে, এর শীর্ষদেশে আরোহণ করার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করা এবং কথাও পৌঁছেয়ে একথা ব্যক্ত না করে যে, সে কামেল হয়ে গিয়েছে। কোনো ব্যক্তি যে মুহূর্তে এ ধারণায় পতিত হবে সাথে সাথেই তার উন্নতি থেমে যাবে। শুধু যে থেমে যাবে তা-ই নয়, বরং সেই সাথে তার অবনতির সূত্রপাত হবে। একথা স্মরণ রাখা দরকার যে, কেবল উচ্চস্থানে উন্নীত হওয়ার জন্যই নয় বরং সেই সাথে তার অবনতির সূত্রপাত হবে। একথা স্মরণ রাখা দরকার যে, কেবল উচ্চস্থানে উন্নীত হওয়ার জন্যই নয় বরং সেখানে টিকে থাকতে হলেও অবিশ্রান্ত চেষ্টা-তৎপরতা আবশ্যক। কারণ এ চেষ্টার ধারা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে নিম্নভূমির আকর্ষণ মানুষকে নীচের দিকে টানতে আরম্ভ করে। কোনো বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে কেবলমাত্র নীচের দিকে তাকিয়ে সে কতখানি উপরে উঠেছে, তা দেখা উচত নয়। বরং তার আর কতখানি উপরে উঠেছে, তা দেখা উচিত নয়। বরং তার আর কতখানি উপরে উঠতে হবে এবং এখনো সে কতখানি দূরে রয়েছে এটাই তার দেখা কর্তব্য।

দ্বিতীয়ত, ইসলাম আমাদের সামনে মানুষত্বের যে উচ্চতম আদর্শ উপস্থাপিত করেছে, এর প্রাথমিক স্তরসমূহ ও অন্যান্য অনৈসলামিক ধর্ম ও মতবাদগুলোর উচ্চতম আদর্শের তুলনায় অনেক ঊর্ধে অবস্থিত। এটা আদৌ কোনো কল্পনাপ্রসূত মান নয় বরং এ পার্থিব জীবনেই আম্বিয়ায়ে কিরাম, মহানুভব সাহাবাগণ এবং জাতির আদর্শ পুরুষগণ পবিত্র জীবনধারা আমাদের সামনে ইসলামের মহান আদর্শ সম্পর্কে পথনির্দে করেছে। এ আদর্শ আমন সর্বদা আপনার সামনে রাখবেন। এভাবে আপনার তথাকথিত কামালিয়াতের বিভ্রান্তির কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে পারবেন এবং নিজেদের পশ্চাৎপদতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভে সক্ষম হবেন। পরন্তু উন্নতি লাভের চেষ্টা-তৎপরতার জন্য এটা এমনভাবে অনুপ্রেরণা যোগাতে থাকবে, যার ফলে আপনি আজীবন সংগ্রাম-সাধনার পরও মনে করবেন যে, এখনো উন্নতির অনেক স্তর বাকী রয়েছে। আপনার আশেপাশে মূমূর্ষ রোগীদের দেখে নিজেদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতা সম্পর্কে একটুও গর্ববোধ করবেন না। আপনারা নৈতিক ও আধ্যাত্মিকতার সেই বীর পাহলোয়ানদের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন যাদের স্থলাভিষিক্ত হিসেবেই আপনারা শয়াতানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ময়দানে অবতীর্ণ হচ্ছেন। দীন-সম্পদের ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত উন্নত ও অগ্রসর লোকদের দিকে লক্ষ্য রাখা এবং বৈষায়িক ধন-সম্পদের কর্তব্য, যেন তার ভিতর থেকে দীন-সম্পদের ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত দুর্বল লোকদেরকে সামনে রাখাই ঈমানদার লোকদের কর্তব্য, যেন তার ভিতর থেকে দীন-সম্পদ লাভের তৃষ্ণা বিদূরিত না হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাকে যতটুকু বিষয়-সম্পত্তি দান করেছেন তাতেই সে আল্লাহর শোকর করতে পারে এবং অল্পতেই যেন তার ধন-সম্পদের পিপাসা নিবৃত হয়।

তৃতীয়ত, আমাদের জামায়াত এ পর্যন্ত যতটুকু গুণ-বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে, প্রকৃতপক্ষে শুধু তা বর্তমান বিকৃত পরিবেশের কারণেই সম্ভব হয়েছে। কেননা এ ঘনঘোর অন্ধকার মধ্যে আমরা যে ক্ষীণ শিখার একটি প্রদীপ জ্বলাবার সৌভাগ্য লাভ করেছি, তাই এখন উজ্জ্বল প্রকটিত হয়ে দেখা দিয়েছে। নতুবা প্রকৃত সত্য কথা এই যে, ইসলামের নিন্মতম আদর্শের সাথে আমাদের চেষ্টা-তৎপরতার তুলনা করলেও প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে-ব্যক্তিগত জীবন ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে-কেবলমাত্র ত্রুটি-বিচ্যুতি স্বীকার কির তবে তা যেন শুধু বিনয় প্রকাশের জন্যই না হয়, বরং তা যেন আন্তরিক স্বীকৃত হয়। এর ফলে আমাদের প্রত্যেকটি দুর্বলতা যেন সুস্পষ্টরূপে ধরা পড়ে এবং তা দূর করার জন্য আগ্রহ ও চেষ্টা যেন তীব্রতর হয়।

ট্রেনিং কেন্দ্রসমূহের উপকারিতা
এ কাজে আপনাদের সাহায্যের জন্যই জামায়াতের পক্ষ থেকে ট্রেনিং-এর নতুব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ কার্যসূচী অনুসারে যে সমস্ত ট্রেনিং কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে তাতে জামায়াতের রুকন বা মুত্তাফিক সকলেই শরীক হতে পারেন। ট্রেনিং-এর মেয়াদ ইচ্ছা করেই সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে, যেন ব্যবসায়ী, কর্মচারী, কৃষিজীবী সকল শ্রেণীর লোকই এটা হতে সহজে ফায়াদা হাসিল করতে পারেন। ট্রেনিং কোর্সের দুটি ভাগ রয়েছেঃ একটি শিক্ষা মূলক, অপরটি অনুশীলনমূলক। প্রথম অংশে আমাদের লক্ষ্য হলো-শিক্ষার্থীগণ অল্প সময়ের সধ্যেই যেন পবিত্র কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা, ফিকাহ শাস্ত্রের হুকুম ও আহকাম এবং জামায়াতের পুস্তকাদির একটি প্রয়োজনীয় অংশ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভে সক্ষম হয়। এর ফলে ট্রেনিং গ্রহণকারী কর্মী যেন সহজেই দীনি

যে ব্যক্তি নিজের দীনের ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত উন্নত লোকের প্রতি দৃষ্টি রেখে তার অনুসরণ করবে এবং পার্থিব বিষয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যক্তিকে দেখে আল্লাহ তাআলার দান সামগ্রীর শুকরিয়া প্রকাশ করবে, সে আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞ ও ধৈর্যশীলরূপে পরিগণিত হবে। আর যে ব্যক্তি দীনের ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত দুর্বল লোকের প্রতি লক্ষ্য করবে এবং পার্থিব ব্যাপারে অধিক ধনশীলতার প্রতি লক্ষ্য করবে, কোনো বিষয়ের অভাব থাকলে সেই জন্য সে আফসোস করবে, আল্লাহর দরবারে সেই ব্যক্তি কৃতজ্ঞ এবং ধৈর্যলীরূপে পরিগণিত হতে পারবে না।

ব্যবস্থা, তার দাবী, তদনুযায়ী জীবনযাপনের পন্থা এবং এর প্রতিষ্ঠার জন্য গৃহীত কর্মসূচী স্পষ্ট বুঝতে পারে। সেই সাথে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বাস্তব রূপায়ণের জন্য কোন ধরনের ব্যক্তিগত ও সামাজিক চরিত্রের আবশ্যক, তাও যেন সে উপলব্ধি করতে পারে। কর্মসূচীর অনুশীলনমূলক অংশের উদ্দেশ্য এই যে, এর মাধ্যমে আমাদের কর্মগণ অনন্ত কিছুদিন এ স্থানে সমবেতভাবে স্বচ্ছ ও নির্মল ইসলামী পরিবেশে বসবসের সুযোগ স্থানে সমবেতভাবে স্বচ্ছ ও নির্মল ইসলামী পরিবেশে বসবাসের সুযোগ লাভ করতে পারবে। এর ফলে তাদের মধ্যে নিয়মানুবর্তীতা, শৃঙ্খলা রক্ষা, সৌভ্রাতৃত্ব এবং প্রীতি সৌহার্দের অভ্যাস জন্মাবে, এছাড়া একে অপরের গুণাবলী আহরণ করতে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে নিজেদের দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতসমূহ দূর করার সুযোগ লাভ করবে। সর্বোপরি তারা কয়েক দিনের জনব্য হলেও নিরবচ্ছিন্ন সাংসারিক কাজ-কর্ম হতে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে একান্তভাবে আল্লাহ তাআলার জন্যই নিজেদের সমস্ত চিন্তা,লক্ষ্য এবং কর্মতৎপরতা কেন্দ্রিভূত করতে সক্ষম হবে।

এজন্য অন্ততপক্ষে প্রত্যেক জেলায় এক একটি করে ট্রেনিং কেন্দ্র স্থায়ীভাবে স্থাপন করার জন্য আমরা আন্তরিক আগ্রহ পোষণ করি। কিন্তু এ ধরনের ট্রেনিং কেন্দ্র পরিচালনার জ্য আমাদের কাছে যোগ্যতাসম্পন্ন লোক এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপায়-উপাদানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ কারণেই আপাতত লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি, মূলতান ও করাচীতে সাময়িকভাবে ট্রেনিং কেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এতদসত্ত্বেও এ সামান্য ব্যবস্থা দ্বারাই আপনাদের যথেষ্ট উপকার হবে বলে আমি আশা করি। ইনশাআল্লাহ ট্রেনিং কেন্দ্রের কর্মসূচী অনুশীলনের পর নিজেরাই এর বিরাট উপাকারিতা অনুভব করতে পারবেন। তখন আপনারা বুঝতে পারবেন যে, জামায়াত যথার্থই একটি প্রয়োজনীয় কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।

আমি এ কর্মসূচীর মাধ্যমে যতবেশী সম্ভব ফায়দা হাসিল করার জন্য সমস্ত কর্মীকে অনুরোধ করছি।

নিজেদের ঘর সামলান
অতপর আমি আপনাদের সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের লোকজন সংশোধন সম্পর্কে বলতে চাই। আল্লাহ বলেছেনঃ

যে সন্তান-সন্ততি ও স্ত্রী-পরিজনের অন্ন-বস্ত্রের জন্য আপনারা চিন্তা করেন, তারাও যাতে দোযখের ইন্ধনে পরিণত না হয়, সেদিকেও আপনাদের বিশেষ লক্ষ্য রাখা কর্তব্য। তাদের পরিণাম যাতে শুভ হয় এবং জান্নাতের পথেই তারা অগ্রসর হয়, সেই জন্য অপরকে সাধ্যানুসারে চেষ্টা করতে হবে। এর পরও যদি কেউ স্বেচ্ছায় ভুল পথেই অগ্রসর হয় তবে সে জন্য আপনার কোনো দায়িত্ব থাকবে না। মোটকথা, তাদের অশুভু পরিণতির ব্যাপারে আপনার যেন কোনো সহযোগিতা না থাকে সে দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।

আমার কাছে অনেক সময় অভিযোগ করা হয় যে, জামায়াতের কর্মীগণ সাধারণ মানুষের সংশোধন ও কল্যাণের জন্য যতটা চেষ্টা করেন নিজেদের পরিবার-পরিজন এবং সন্তান-সন্ততির সংশোধনের জন্য কতটা চেষ্টা করেন না। হয়তো কোনো কোনো লোকের বেলায় এ অভিযোগ সত্য হতে পারে, আবার কারোও বেলায় হয়তো বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের অবস্থা পর্যালোচনা করা আমার পক্ষে মুশকিল। এজন্যই আমি এ সম্পর্কে কয়েকটি সাধারণ নীতি বর্ণনা করতে চাই।

আমাদের একান্ত প্রিয়জনকে শান্তি ও কল্যাণের পথে অগ্রসর হতে দেখে আমাদের চক্ষু যাতে জুড়ায় এবং প্রাণ-মন শীতল হয় সেজন্য আমাদের সকলেরই ঐকান্তিক বাসনা থাকা উচিত এবং সে জন্য আমাদের চেষ্টা ও যত্ন থাকা আবশ্যক। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেনঃ

হে আমাদের রব! আমাদের স্ত্রী ও স্তানদের এমন গুণ বিশিষ্ট করে তোল যে, যাদের দেখে যেন আমাদের চক্ষু জুড়ায় এবং আমাদেরকে পরহেযগার লোকদের অনুগামী করে দাও। সূরা ফুরকান : ৭৪

এ ব্যাপারে জামায়াতের কর্মীদের পরষ্পরের জীবন ধারার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া আবশ্যক। তাদের কেবল আপডন-সন্তান-সন্ততিই নয় বরং কর্মীদের সন্তান-সন্ততির সংশোধনের দিকেও খেয়অল রাখা উচিত। কেননা অনেক সময় শিশুকে পিতার তুলনায় পিতার বন্ধুদের প্রভাব সহজেই গ্রহণ করতে দেখা যায়।

পারষ্পরিক সংশোধন ও এর পন্থা
নিজেদের ও পরিবারস্থধ লোকজনের সংশোধন প্রচেষ্টার সাথে সাথে আপনারা সহকর্মীদের সংশোধনের দিকেও খেয়াল রাখনবেন। যারা আল্লাহর উদ্দেশ্য সত্যের কালেমাকে বুলন্দ করার জন্য একটি জামায়াতে পরিণত হয়েছে, তাদের পরষ্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সাহায্যকারী হওয়া একান্ত আবশ্যক। তাদের বুঝা দরকার যে, তাদের সংগঠন যদি নৈতিকতা ও নিয়ম-শৃংখলার দিক দিয়ে সামগ্রিকভাবে মযবুত না হয়, তবে তাদের মহান উদ্দেশ্য কিছুতেই সফল হতে পারে না। সুতরাং তাদের এ অনুভূতির ফল স্বারূপ পারষ্পরিকব দোষ-ত্রুটি সংশৌধনের কাজে সহযোগিতা করা এবং সম্মিলিতভঅবে আল্লাহ তাআলার পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য একে অপরকে সাহায্য করা কর্তব্য। এটা হচ্ছে ইসলামের সামগ্রিক সংশোধন প্রচেষ্টার উপায়। আপনি যদি আমাকে আছাড় খেতে দেখেন তা ত্বরিদ্বেগে এসে আমাকে সাহায্য করবেন। আর আমি যদি আপনাকে ভুল করতে দেখি তা কখনই আমি অগ্রসর হয়ে আপনার হাত ধরবো। আমার পরিচ্ছেদে কোনো কালিমা দেখলে আপনারা তা পরিষ্কার করবেন। আমার পরিচ্ছেদ কোনো কালিমা দেখলে আপনারা তা পরিষ্কার করবেন। আর আপনাদরপোষাকে কোনো ময়লা দেখলে আপনারা তা পরিষ্কার করবেন। আর আপনাদের পোশাকে কোনো ময়লা দেখলে আমিও তা পরিষ্কার করবো। আবার যে কাজে আমার মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলে আপনারা মঙ্গল হবে বলে আমি মনে করবো আপনাদেরকে তা জানাব। বস্তুত বৈষায়িক ব্যাপারে পারষ্পরিক আদান-প্রদানের ফলে যেমন সামগ্রিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়, তেমনি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাপারেও পারষ্পরিক সহযোগিতা ও আদান-প্রদানের রীতি চালু হলে গোটা জামায়াতের নৈতিক সম্পদ বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

পারষ্পরিক দোষ-ত্রুটি সংশোধনের সঠিক পন্থা এই যে, কারো কোনো কাজে আপনার আপত্তি থাকলে কিংবা কারো বিরুদ্ধে আপনার কোনো অভিযোগ থাকলে, সে বিষয়ে তাড়াহুড়ো না করে প্রথমে বিষয়টি সুষ্ঠরূপে বুঝতে চেষ্টা করবেন। পরে আপনি প্রথম অবকাশেই তার সাথে সাক্ষাত করে সেই সম্পর্কে নির্জনে আলাপ করবেন। এতেও যদি তার সংশোধন না হয় এবং বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়, তবে সংশিষ্ট এলাকার আমীরকে এটা জানাবেন। প্রথমে তিনি নিজেই তার সংশোধনের জন্য চেষ্টা করবেন। পরে আবশ্যক হলে জামায়াতের বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করবেন। এ সময়ে মধ্যে উক্ত বিষয়ে কখনো সংশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অবর্তমানে আলোচনা করা স্পষ্ট গীবত বা পরিচর্চায় পরিণত হবে। সুতরাং এটা সর্বোতভাবে পরিত্যাগ করতে হবে।

পারষ্পরিক সমালোচনার সঠিক পন্থা
নিজেদের মধ্যকার দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতা দূর করার আর একটি উত্তম ব্যবস্থা হচ্ছে সমালোচনা। কিন্তু সমালোচনার সঠিক সীমা ও পদ্ধতি সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন না করলে এতে ভয়ানক ক্ষতির আশাংকা রয়েছে। এজন্যই আমি বিস্তারিতভাবে এর সীমা ও পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই।

একঃ সকল স্থানে ও সকল সময়ে আলোচনা করা চলবে না বরং বিশেষ বৈঠক আমীরে জামায়াতের প্রস্তাব কিংবা অনুমতিক্রমেই তা করা যেতে পারে।

দুইঃ সমালোচনাকারী সর্বপ্রথম। আল্লাহতাআলাকে হাযির-নযির জেনে নিজের মনের অবস্থা সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা করে দেখবেন যে, তিনি সততা ও শুভাকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়েই সমালোচনা করেছেন, না কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ এর মূলে সক্রিয় রয়েছে। প্রথমোক্ত অবস্থায় নিসন্দেহে সমালোচনা করা যেতে পারে, অন্যথায় কোনো প্রকার উচ্চবাক্য না করে নিজের অন্তর হতে এ কালিমা দূর করার জন্য তার সচেষ্ট হওয়া উচিত।

তিনঃ সমালোচনার ভঙ্গী ও ভাষা এমন হওয়া উচিত, যা শুনে প্রত্যেকেই বুঝতে পারবে যে, আপনি সত্যই সংশোধনের বাসনা পোষণ করেছেন।

চারঃ সমালোচনা উদ্দেশ্য কথা বলার পূর্বে আপনার অভিযোগের সমর্থনে কোনো বাস্তব প্রমাণ আছে কিনা, তা অবশ্যই ভেবে দেখবেন। অহেতুক কারো বিরুদ্ধে কথা বলা অত্যন্ত কঠিন গুনাহ,এর ফলে সামাজিক জীবনে বিশৃংখলা দেখা দেয়।

পাঁচঃ যে ব্যক্তির সমালোচনা করা হবে, তার অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে সমালোচকের বক্তব্য শ্রবণ করা এবং সততার সাথে তা ভেবে দেখা কর্তব্য। অভিযোগের যে অংশ সত্য, তা অকপটে স্বীকার করা এবং যে অংশ সত্য নয় তা যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা খন্ডন করা উচিত। সমালোচনা শুনে রাগান্বিত হওয়া অহংকার ও আত্মরিকতার লক্ষণ।

ছয়ঃ সমালোচনা এবং এর জবাবের ধারা সীমাহীনভাবে চলা উচিত নয়, কেননা এতে একটি স্থায়ী বিরোধ ও কথা কাটাকাটির সূত্রপাত হতে পারে। আলোচনা শুধু উভয় পক্ষের বক্তব্য সুস্পষ্ট না হওয়া পর্যন্তই চলতে পারে। এরপরও যদি বিষয়টির মীমাংসা না হয়, তবে আলোচনা সেখানেই স্থগিত রাখুন, যেন উভয় পক্ষ ধীরস্থীরভাবে এবং শান্ত মনে নিজেদের বক্তব্য সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।

অতপর সে বিষয়ে যদি একান্তেই কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়, তবে পরবর্তী বৈঠকে পুনারায় তা উত্থাপন করা যেতে পারে, কিন্তু এতদসত্ত্বেও আপনাদের জামায়াতে বিরোধী বিষয় সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ব্যবস্থা থাকা এবং উক্ত সিদ্ধান্তের ফলে বিরোধের সমাপ্তি ঘটা আবশ্যক।

উল্লেখিত সীমার প্রতি লক্ষ্য রেখে যে সমালোচনা করা হবে তা শুধু কল্যাণকরই নয় জামায়াতের নিয়ম-শৃংখলা বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বটে। এ ধরনের ব্যবস্থা ছাড়া কোনো সংগঠই সঠিকভাবে বেশী দূর অগ্রসর হতে পারে না। সুতরাং কাউকেও এ সমালোচনার উদ্র্ধে নয়। আমি এটাকে জামায়াতের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য একান্ত অপরিহার্য মনে করি।আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, যে দিন আমাদের জামায়াতে এ সমালোচনার দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে, ঠিক সেদিন হতেই আমাদের অধপতন শুরু হবে। এজন্যই আমি প্রথম হতেই প্রত্যকটি সাধারণ সম্মেলনের পরে জামায়াতের কার্যাবলী ও ব্যবস্থাপনার সমালোচনা-পর্যালোচনার জন্য রুকনদের একটি বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠান করে আসছি। এধরনের বৈঠকে সর্বপ্রথমে আমি নিজেকে সমালোচনার জন্য পেশ করি, যেন আমার বিরুদ্ধে কিংবা আমার কোনো কাজে কারো আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে তারা সকলের সামনে বিনা দ্বিধায় প্রকাশ করতে পারে। এটা হলে হয় আমার ভুল-ত্রুটির সংশোধন হবে নতুবা আমার জবাব শুনে অভিযোগকারী এবং তার ন্যায় অন্যান্য লোকেদেরও ভুল ধারনা দূর হবে। গত রাতে ঠিক এ ধরনেরই একটি বৈঠকে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে প্রকাশ্য ও অবাধ সমালোচনার দৃশ্য আপনারা সকলেই প্রত্যক্ষ্য করেছেন। আমি জেনে বিস্মিত হলাম যে, জামায়াতের যেসব কর্মী এই প্রথমবার এ ধরনের দৃশ্য দেখার সুযোগ পেয়েছেন, তারা নাকি খুবই মর্মাহত হয়েছেন। তারা কিরূপ দৃষ্টিভঙ্গিতে এর বিচার বিশ্লেষণ করলে তাদের নিকট জামায়াতের গুরুত্ব পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পেত। এ ভূখন্ডে জামায়াতে ইসলামী ছাড়া এমন কোন সংগঠন রয়েছে, যেখানে তিন-চার শত প্রতিনিধি একত্রে একস্থানে বসে কয়েক ঘন্টা যাবত এরূপ অবাধ ও প্রকাশ্য সমালোচনা করার পরও একখানা চেয়ারও ভাঙ্গে না, একটি মাথাও ফাটে না বরং বৈঠক সমাপ্ত কালে কারও মনে কতটুকু কালিমা রেখা পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে না।

আনুগত্য ও নিয়ম-শৃঙ্খলা সংরক্ষণ
আর একটি বিষয়ে আমি আপনাদের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট করার প্রয়োজন অনুভব করছি। তা এই যে, এখনও আমাদের মধ্যে আনুগত্য ও নিয়ম-শৃঙ্খলার যথেষ্ট অভাব দেখা যাচ্ছে। একথা যদিও সত্য যে, আমাদের বর্তমান সামাজিক পরিবেশের প্রতি লক্ষ্য করলে নিজেদেরকে অনেক সুসংবদ্ধ বলে মনে হয়। কিন্তু ইসলামের সুমহান আদর্শ ও আমাদের কঠিন দায়িত্বও কর্তব্যের প্রতি লক্ষ্য করলে আমাদের বর্তমান শৃঙ্খলা ও সংগঠনকে নিতান্তই নগণ্য বলে মনে হবে।

আপনারা মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক যৎ সামান্য উপায়-উপাদান নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন। অথচ ফাসেকী ও জাহেলিয়াতের কয়েক হাজার গুন অধিক শক্তি এবং কয়েক লক্ষ গুণ বেশী উপায়-উপাদানের মুকাবিলায় শুধু বাহ্যিক জীবন ব্যবস্থারই নয়, বরং এর অন্তর্নিহিত ভাবধারও আমূল পরিবর্তন সাধন করাই হচ্ছে আপনাদের লক্ষ্য। কিন্তু আপনারাই হিসেব করে দেখতে পারেন, সংখ্যা-শক্তি কিংবা উপায়-উপাদানের দিক দিয়ে প্রতিপক্ষের সাথে আপনাদের কোনো তুলনাই হয় না। এমতাবস্থায় আপনাদের কাছে নৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তি ছাড়া আর কোন জিনিসটি আছে যার সাহায্যে প্রতিযোগিতায় সাফল্য লাভের আশা পোষণ করতে পারেন? আপনাদের সততা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে সমাজ মনে যদি আস্থা জন্মে এবং আপনাদের সংগঠন যদি এতখানি শক্তিশালী হয় যে, জামায়াতের দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ আবশ্যক বোধে একটি মাত্র ইশরায়ই প্রয়োজনীয় শক্তি সমাবেশ করতে সক্ষম হবেন ; কেবল তখনই আপনাদের মহান উদ্দেশ্য সফল হতে পারে।

ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীতে দীন ইসলাম বাস্তব রূপায়ণের উদ্দেশ্য গঠিত কোনো জামায়াত তার নির্বাচিত আমীরের নেক কাজে আনুগত্য করা মূলত আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (স) এরই আনুগত্যের শামিল। যে বেক্তি আল্লাহ তাআলার কাজ মনে করে এ আন্দোলনে শরীক হয়েছে এবং আল্লাহ তাআলার রেযামন্দির উদ্দেশ্যেই নিজেদের মধ্য থেকে কাউকে আমীর নির্বাচিত করেছে, সে উক্ত আমীরের জায়েয ও সংগত আদেশ-নিষেধ পালন করে মূলত তার নয় বরং আল্লাহ এবং রাসূলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে। মোটকথা আল্লাহ এবং তাঁর মনোনীত দীনের (জীবন ব্যবস্থার) সাথে তার যত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকবে, সে ততবেশী আনুগত্য পরায়ণ বলে প্রমাণিত হবে। পক্ষান্তরে এই সম্পর্কে যে ব্যক্তি যতখানি পশ্চাদপদ ও দুর্বল থাকবে, আনুগত্য ও নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে সে ততখানি দুর্বল সাব্যস্ত হবে। আপনার উপর যার যতটুকু প্রভুত্ব নেই, আপনি যাকে শুধু আল্লাহ তাআলার কাজের জন্যই আমীর হিসেবে বরণ করেছেন, একজন লোকের ন্যায় নিজের অভীরুচী, পছন্দ এবং স্বার্থের বিরুদ্ধে তার নির্দেশ আপনি একান্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করে চলবেন এতদপেক্ষা বড় কুরবানী আর কি হতে পারে? যেহেতু এ কুরবানী মূলত আল্লাহ তাআলার জন্যই করা হচ্ছে, সে জন্য আল্লাহ তাআলার নিকট হতেও এর বিনিময় বিরাট পুরষ্কার পাওয়া যাবে। পক্ষান্তরে কোনো ব্যক্তি যদি এ আন্দোলনের শরীক হওয়ার পরও কোনো অবস্থাতেই ছোট কাজে রাযী না হয়, আনুগত্য করাটাকে মর্যাদাহীনকর মনে করে অথবা কোনো নির্দেশের ফলে মনে মনে ক্ষুন্ন হয় এবং এতে বিরক্তি ও অস্বস্তিরোধ করে কিংবা নিজের ইচ্ছা ও স্বার্থের খেলাপ কোনো আদেশ পালনে ইতস্তত করে তবে বুঝতে হবে, সে এখনো তার ইচ্ছা-প্রবৃত্তিকে আল্লাহ তাআলার সামনে সম্পূর্ণরূপে নত করেনি এবং এখনো তার আমিত্ববোধ নিজের দাবী-দাওয়া পরিত্যাগ করেনি।

জামায়াতের নেতৃবৃন্দের প্রতি উপদেশ
জামায়াতের সদস্যগণকে আনুগত্যের অনুরোধ জানাবার সাথে সাথে জামায়াতের নেতৃবৃন্দকে আমি হুকুম চালাবার সঠিক পন্থা শিক্ষা করার উপদেশ দিচ্ছি। যিনি জামায়াতের কোনো দায়িত্বপূর্ণ পদে অভিষিক্ত হবেন, যার অধীনে কিছু সংখ্যক লোক থাকবে, তার পক্ষে নিজেকে বড় কিছু একটা মনে করে অধস্তন সমকর্মীদের উপর অহেতুক কর্তাগিরী ফলানো কোনো মতেই সংগত নয়। তার পক্ষে কখনো প্রভুত্বের স্বাদ গ্রহণ করা উচিত নয়, বরং সহকর্মীদের সাথে নম্র ও মধুর ব্যবহার করাই তার কর্তব্য। কোনো কর্মীর মনে বিদ্রোহের ভাব ও কর্মপন্থার উপর অর্পিত না হয়, সে জন্য সর্বদা তার বিশেষভাবে সতর্ক থাকা দরকার। যুবক-বৃদ্ধ, দুর্বল-সবল, ধনী-গরীব ইতাদির ব্যাচ বিচার না করে সকলের জন্য একটা ধারা অবলম্বন করা তার পক্ষে ব্যক্তিগত অবস্থার প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা উচিত এবং যে এতটুকু সুযোগ-সুবিধা লাভের যোগ্য তাকে ততটুকু সুযোগ-সুবিধা দেয়া উচিত। জামায়াতকে তার এমনভাবে গড়ে তোলা উচিত, যেন আমীর কোন বিষয়ে উপদেশ দিলেন কিংবা আবেদন করলেন, কর্মীগণ যেন তা নির্দেশ হিসেবেই গ্রহণ করে তদানুযায়ী কাজ সম্পন্ন করে। কোনো বিষয়ে যদি আমীরের আবেদন কার্যকরী না হয় এবং বাধ্য হয়ে তিনি হুকুম দেয়ার প্রয়োজনবোধ করেন তবে তা দ্বারা সাংগঠনিক চেতনারই অভা¬¬ব প্রমাণিত হয়। প্রকৃতপক্ষে বেতন ভুক্ত সিপাহীদেরকেই হুকুম দিতে হয়। কিন্তু যে স্বেচ্ছা-সৈনিকরা আপন প্রভুর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই সমবেত হয়েছে, আল্লাহর কাছে নিজেকে নির্বাচিত আমীরের আনুগত্যের বেলায় তাদের নির্দেশের কোনো প্রয়োজন হয় না। তাদের জন্য শুধু এটুকু ইশারাই যথেষ্ট যে, অমুক জায়গায়, অমুক কাজ সম্পাদন করে আপন প্রভুর খেদমত আনজাম দেয়ার সুযোগ তোমার উপস্থিত হয়েছে। যেদিন আপনারা দেখতে পাবেন যে, নিজেদের মধ্যে মাঝে মাঝে যেসব তিক্ততার সৃষ্টি হয়, তার প্রায় সবগুলোই স্বাভাবিকভাবে দূরীভূত হয়েছে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি