হাদীসের অপরিহার্যতা
হাদীস কুরআন মজীদের ব্যাখ্যাদাতা ও বিশ্লেষণকারী। হাদীসের সাহায্য গ্রহণ ব্যতীত কুরআন মজীদের যথাযথ ব্যাখ্যা ও অর্থ করা, উহার সঠিক উদ্দেশ্য ও ভাবধারা নিরূপণ করা সুকঠিন। নবী করীম (স) এই জন্যই নিজ ইচ্চামত কুরআন ব্যাখ্যা সস্পর্কে কঠোর সাবধান বাণী উচ্চারণ করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

যে ব্যক্তি নিজ ইচ্ছামত কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা করে সে যেন জাহান্নামে নিজের আসন তালাশ করিয়া লয়।[তিরমিযী, আরওয়াবুত্তাফাসীর, ইবনে আক্কাস বর্ণিত।]

হাদীসে বর্ণিত আছেঃ

******************************************************

যে লোক নিজের ইচ্ছামত কুরআন মজীদের অর্থ করে, তাহার ব্যাখ্যা নির্ভূল হইলেও সে ভূল করে।[তিরমিযী, আবওয়াবুত্তাফাসীর, জুনদুব হইতে বর্ণিত।]

বস্তুত মানুষের বুদ্ধি যতই প্রখর, তীক্ষ্ণ ও সুদূরপ্রসারী হউক না কেন, তাহা অবশ্যই সীমাবদ্ধ। একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত পৌছিঁয়া উহা ব্যর্থ হইতে ও স্বীয় অক্ষমতা প্রকাল এবং প্রমাণ করিতে বাধ্য কিন্তু বুদ্ধবাদ বা বুদ্ধির পূজা কোন সীমা মানিয়ালইতে প্রস্তুত নয়। বুদ্ধি ও বিবেক-শক্তি যদি রাসূলের সুন্নাত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়, তাবে তাহা বুদ্ধিবাদ ও বিবেক-পূজার নামান্তর। এই বুদ্ধিবাদ ও বিবেক-পূজা মানুষকে আল্লাহর আনগত্যের সীমা লংঘন করিতে বাধ্য করে। উপরন্তু তাহাতে একদিকে যেমন কুরআনের অপব্যাখ্যা, ভূল ও বিপরীত ব্যাখ্যা হয় বলিয়া উহার উপর জুলুম করা হয় এবং মানুষ এই কারণেই কুরআন মানিয়া চলার সৌভাগ্য হইতে বঞ্চিত হইয়া যায়; অপরদিকে তেমনি কুরআন বিশ্বাসীদের মধ্যে কঠিন মতবৈষম্য সৃষ্টি ও বিভিন্ সাংঘর্ষিক মতাদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব হওয়ার ফলে মুসলিম সমাজ বহুধা বিভক্ত হইয়া পড়ে। অনেক লোক আবার এই সুযোগে কুরআন লইয়া স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করে, কুরআনের ছত্রে ছত্রে নিজেদের মনগড়া ব া পরকীয় চিন্তার পাঠ গ্রহণ করিতে শুরু করে। রাসূলের হাদীস এই পথে প্রবল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। ইহাই মানুষের সম্মুখে কুরআনী হিদায়াতের প্রশস্ত পথ উপস্থাপিত করে; গোমরাহী বিভ্রান্তি হইতে মানুষকে রক্ষা করে ও সঠিক সরল ঋজুপথে পরিচালিত করে।

নবী করীম (স) কুরআনের বাহক, কুরআন তাঁহারই উপর অবতীর্ণ হইয়াছে; কিন্তু তিনি কেবল কুরআনই মানুষের সম্মুখে পেশ করেন নাই, কুরআনকে ভিত্তি ও কেন্দ্র করিয়া তিনি ইসলামের এক পূর্ণাঙ্গ বিধান উপস্থাপিত করিয়াছেন। এই কারণে তিনি নিজে কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে সুন্নাত ও হাদীসের গুরুত্বের কথা নানাভাবে ঘোষণা করিয়াছেন। এখানে আমরা এই প্রৃসংগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস উল্লেখ করা জরুরূ মনে করিতেছি।

হযরত মিকদাম ইবনে মা’দি কারাব (রা) বলিয়াছেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

সাবধান, আমাকে কুরআন দেওয়া হইয়াছে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে উহারই মত আর একটি জিনিস। সাবধান, সম্ভবত কোন সুখী ব্যক্তি তাহার বড় মানুষির আসনে উপবিষ্ট হইয়া বলিতে শুরু করিবে যে, তোমরা কেবল এই কুরআনকেই গ্রহণ কর, ইহাতে যাহা হালাল দেখিবে তাহাকেই হালাল এবং যাহাকে হারাম দেখিবে তাহাকেই হারাম মনে করিবে। অথচ প্রকৃত ব্যাপার এই যে, রাসূল যাহা হারাম করিয়াছেন, তাহা আল্লাহর ঘোষিত হারামের মতই মাননীয়।[ইবনে মাজা, পৃষ্ঠা ৩, আবূ দাউদ, কিতাবুস সুন্নাহঃ *********************]

এই হাদীসটিই ‘সুনানে দারেমী’ গ্রন্হ নিম্নলিখিত ভাষায় উল্লেখ করা হইয়াছেঃ

******************************************************

সম্ভবত এক ব্যক্তি তাহার আসনে হেলান দিয়া বসিয়া আমার বলা কথার উল্লেখ করিবে এবং বলিবেঃ তোমাদের ও আমাদের মাঝে একমাত্র আল্লাহর কিতাব রহিয়াছে। উহাতে যাহাই হালাল পাইব, তাহাকেই হালাল মনে করিব, আর যাহা হারাম পাইব, তাহাকেই হারামরূপে গ্রহণ করিব। (অতঃপর রাসূল বলেন) সাবধান, আল্লাহর রাসূল যাহা হারাম করিয়াছেন, তাহা আল্লাহর নির্দিষ্ট করা হারামের মতই।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭০।]

রাসূলের এই কথাটি অধিক সুস্পষ্ট হইয়া ফুটিঁয়া উঠিয়াছে নিম্নোক্ত হাদীসে। হযরত ইবরাজ ইবনে সারীয়া বলেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমাদের একজন তাহার আসনে বসিয়া কি এই ধারণ করে যে, কুরআনে যাহার উল্লেখ আছে তাহা ব্যতীত আল্লাহ তা’আলা আর কিছুই হারাম করেন নাই? সাবধান, আল্লাহর কসম, আমিও কিন্তু অনেক আদেশ করিয়াছে, উপদেশ দিয়াছি এবং অনেক বিষয়ে নিষেধ করিয়াছি; আর তাহাও কুরআনের মতই মাননীয় কিংবা তাহারও অধিক কিছু।[আবূ দাউদ কিতাবুসসুন্নাহ ইহার সনদে আশয়াস ইবনে শু’বা একজন বর্ণনাকারী; কিন্তু তাঁহার বর্ণিত হাদীস গ্রহণ সম্পর্কে আপত্তি করা হইয়াছে।]

কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসও গ্রহণ করিতে হইবে এবং কোন বিশুদ্ধ হাদীসই যে কুরআনের খেলাফ হইতে পারে না, তাহা নিম্নোক্ত হাদীস হইতে প্রমাণিত হয়। হযরত সায়ীদ ইবনে যুবায়র (রা) একদা নবী করীম (স)- এর একটি হাদীস বর্ণনা করিলেন। উপস্থিত এক ব্যক্তি বলিলঃ

******************************************************

এই সম্পর্কে কুরআনে এমন কথা আছে যাহা এই হাদীসের বিপরীত।

তখন হযরর সায়ীদ বলিলেনঃ

******************************************************

আমি তোমার নিকট রাসূলের হাদীস বর্ণনা করিতেছি, আর তুমি আল্লাহর কিতাবের সহিত উহার বিরোধিতার কথা বল। অথচ রাসূলে করীম আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে তোমার অপেক্ষা অধিক ওয়াকিফহাল ছিলেন।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭৭।]

হিদায়াতের পথে চলা ও গোমরাহী হইতে বাঁচিয়া থাকা কুরআন ও হাদীস উভয়ই মানিয়া ও পালন করিয়া চলার উপর নির্ভর করে। এই প্রসঙ্গে এখানে রাসূলে করীম (স) হইতে বর্ণিত দইটি হাদীসের উল্লেখ করা যাইতেছে। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন।

******************************************************

আমি তোমাদের মাঝে দুইটি জিনিস রাখিয়া যাইতেছে। এই দুইটি অনুসরণ করিতে থাকিলে অতঃপর তোমরা কখনও পথভ্রষ্ট হইবে না। তাহা হইতেছে আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাত (হাদীস) এবং কিয়ামতের দিন ‘হাওযে কাওসার’- এ উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত এই দুইটি জিনিস কখনই পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন হইবে না।[মুস্তাদরাক হাকেম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩।]

বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

দুইটি জিনিস, যাহা আমি তোমাদের মাঝে রাখিয়া যাইতেছি, তোমরা যতক্ষণ এই দুইটি জিনিস দৃঢ়ভাবে ধারণ করিয়া থাকিবে তোমরা কখনো গোমরাহ হইবে না। তাহা হইল, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত।[ঐ, মালেক ইবনে আনাস বর্ণিত।]

ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় এই ভাষণের ভাষা এইরূপঃ

******************************************************

আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রাখিয়া গেলাম যাহা তোমরা শক্তভাবে ধারণ করিয়া থাকিলে কস্মিনকালেও পথভ্রষ্ট হইবে না। তাহা হইল আল্লাহর কিতাব এবং তাঁহার নবী (স) –এর সুন্নাত।[তাফসীরে রুহুল মায়ানী, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৮।]

সীরাতে ইবনে হিশাম-এ বিদায় হজ্জের ভাষণের এই অংশ নিম্নোক্তরূপ ভাষায় বর্ণিত হইয়াছেঃ

******************************************************

হে মানব সমাজ, আমি তোমাদের নিকট এমন এক সম্পদ রাখিয়া গেলাম, তোমরা যদি তাহা খুব দৃঢ়তা সহকারে ধারণ কর, তবে কখনই গোমরাহ হইবে না। তাহা হইল, আল্লাহর কিতাব এবং তাঁহার নবীর সুন্নাত।

হযরত ইমরান ইবনে হুসায়ন (রা)-এর মজলিসে একজন লোক বলিলঃ

******************************************************

আপনি আমাদের নিকট কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু বর্ণনা করিবেন না।

তখন হযরত ইমরান সে ব্যক্তিকে ডাকিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

তুমি কি চিন্তা করিয়াদেখিয়াছ, তোমাকে ও তোমার সঙ্গী-সাথীদেরকে যদি কেবলমাত্র কুরআনের উপরই নির্ভরশীল করিয়াদেওয়া হয়, তাহা হইলে কি তুমি কুরআনে যেহরের চার রাকআত, আছরের চার রাকআত ও মাগরিবের তিন রাকআত নামাযের উল্লেখ পাইবে?

হজ্জের প্রসঙ্গ তুলিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

কেবল কুরআন মজীদেই কি তুমি সাতবার বায়তুল্লাহার তওয়াফ, সাফা-মারওয়ার তওয়াফ, আরাফার ময়দানে অবস্থান করা এবং পাথর টুকরা নিক্ষেপ করার বিধান দেখিতে পাও?

তিনি আরো বলিলেনঃ কুরআনে চোরের হাত কাটার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু-

******************************************************

চোরের হাত কোন স্থান হইতে কাটিতে হইবে?…………… এইখান হইতে না এইখান হইতে, তাহা কি কুরআনে লেখা আছে?[****************]

সুন্নাত ও হাদীসের গুরুত্ব এবং অপরিহার্যতা এইসব যুক্তি হইতে স্পষ্টভাবে ফুটিয়া উঠে। প্রাথমিক যুগের মনীষিগণ ইহার গুরুত্ব পূর্ণ মাত্রায় স্বীকার করিতেন। সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীন সকলেই কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসকেও অবশ্য পালনীয় বিষয় হিসাবে গ্রহণ করিতেন। এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা যথাস্থানে পেশ করা হইবে। এখানে প্রসংগত আমরা পূর্ববর্তী মনীষীদের এমন কিছু উক্তির উল্লেখ করিব, যাহা হইতে হাদীস ও সুন্নাত মানিয়া লওয়ার গুরুত্ব সুস্পষ্ট হইয়া উঠিবে।

এই পর্যায়ে প্রথমত সাহাবী যুগের একটি ঘটনা উল্লেখ করা আবশ্যক। এক ব্যক্তি হযরত ইমরান ইবনে হুসায়ন (রা) কে বলিলেনঃ

******************************************************

আপনারা আমাদের নিকট এমন সব হাদীস বর্ণনা করেন, যাহার কোন মূল ভিত্তি আমরা কুরআনে খুজিঁয়া পাই না।

ইহাতে হযরত ইমরান অত্যন্ত রাগান্বিত হন এবং প্রশ্নকারী ব্যক্তিকে সম্বোধন করিয়াবলিলেনঃ

******************************************************

প্রত্যেক চল্লিশ দিরহামে এক দিরহাম যাকাত দিতে হইবে, এত এত (প্রত্যেক চল্লিশটি) বকরীতে একটি বকরী দিতে হইবে ও এত এত (প্রত্যেক পচিঁশটি) উষ্ট্রে একটি উষ্ট্র দিতে হইবে- যাকাতের নিসাব কি তোমরা কুরআন মজীদে দেখিতে পাও?

অর্থাৎ যাকাত দানের স্পষ্ট আদেশ তো কুরআন মজীদে স্পষ্ট ভাষায় উদ্ধৃত হইয়াছে; কিন্তু উহার বিস্তারিত বিধান ও ব্যবস্থা কি কুরআনে উল্লিখিত হইয়াছে?

সেই ব্যক্তি বলিলেনঃ ‘না, তাহা কুরআনে পাওয়া যায় না’। তখন হযরত ইমরান বলিলেনঃ

******************************************************

তাহা হইলে যাকাতের এই বিস্তারিত বিধি-বিধান তোমরা কাহার নিকট হইতে জানিতে পারিলে? ইহা সবই তোমরা আমাদের (সাহাবীদের) নিকট হইতে পা্ইয়াছ, আর আমরা ইহা আল্লাহর নবীর নিকট হইতে (হাদীসের মাধ্যমে) লাভ করিয়াছি।[***************]

এই হাদীসের ভিত্তিতে মুহাদ্দিসগণ একবাক্যে যে মূলনীতি ও ফর্মূলা প্রমাণ করিয়াছেন, তাহা এইঃ

******************************************************

সমগ্র বিষয়েরই মূল বিধান কুরআনে উল্লিখিত; কিন্তু উহাদের শাখা-প্রশাখা খুটিঁনাটি (ও ব্যবহারিক নিয়মনীতি) সবই রাসূলের বর্ণনা হইতে জানা গিয়াছে।[******************]

মকহুল দেমাশকী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

কুরআন হাদীস বা সুন্নাতের প্রতি অধিকতর মুখাপেক্ষী, সুন্নাত কুরআনের প্রতি ততটা নয়।[**********************]

ইমাম আওযায়ীও এই কথা বলিয়াছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ

******************************************************

আল্লাহর কিতাব ব্যাখ্যার জন্য সুন্নাত অধিক দরকারী কিন্তু সুন্নাত ব্যাখ্যার জন্য কুরআনের প্রয়োজন ততটা নয়।[***********]

ইয়াহইয়া ইবনে আবী কাসীর বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুন্নাত বা হাদীস কুরআনের তুলনায় অধিক ফয়সালাকারী, কুরআন সুন্নাতের বিপরীত ফয়সালা দিতে পারে না।[**************]

ইমাম আহমদ ইবনে হা’ল এই দুইটি কথার ব্যাখ্যাদান করিতে গিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুন্নাত বা হাদীস কুরআনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকারী এবং সুন্নাত উহার অর্থ প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করে।[********]

শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী হাদীসের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা নিম্নোক্ত ভাষায় ঘোষণা করিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

ইলমে হাদীস সকল প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের তুলনায় অধিক উন্নত, উত্তম এবং দ্বীন-ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের ভিত্তি। হাদীসের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং তাহার সাহাবীদের হইতে নিঃসৃত কথা, কাজ ও সমর্থন বর্ণিত হইয়াছে। বস্তুত ইহা অন্ধকারের মধ্যে আলোকস্তম্ভ, ইহা যেন এক সর্বদিক উজ্জ্বলকারী পূর্ণ চন্দ্র। যে ইহার অনুসারী হইবে ও ইহকে আয়ত্ত করিয়া লইবে, সে সৎপথ প্রাপ্ত হইবে। সে লাভ করিবে বিপুল কল্যাণ। আর যে উহাকে অগ্রাহ্য করিবে, উহা হইতে বিমুখ হইবে সে পথভ্রষ্ট হইবে, লালসার অনুসারী হইবে, পরিণামে সে অধিক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। কেননা নবী করীম (স) অনেক কাজ করিতে নিষেধ করিয়াছেন, অনেক কাজের আদেশ করিয়াছেন। পাপের পরিণাম সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করিয়াছেন, নেক কাজের সুফল পাওয়ার সুসংবাদ দিয়াছেন। তিনি অনেক দৃষ্টান্ত দিয়া লোকদের নসীহত দান করিয়াছেন। অতএব তাহা নিশ্চয়ই কুরআনের মত কিংবা ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ।[হুজ্জতুল্লাহিল বালিগা, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১।]

শাহ দেহলভী আরো বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুন্নাত বা হাদীস কুরআনেরই ব্যাখ্যাদাতা এবং তাহা উহার কিছুমাত্র বিরোধিতা করে না।[***********************]

ইমাম আবূ হানীফার নিম্নোক্ত বাক্যটিও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়ঃ

******************************************************

সুন্নাত বা হাদীসের অস্তিত্ব না হইলে আমাদের মধ্যে কেহই কুরআন বুঝিতে পারিত না।[**************]

এই প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত কথাটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ

******************************************************

রাবিয়া (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা (হে নবী) তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করিয়াছেন অতিশয় বিস্তারিতভাবে; কিন্তু উহাতে হাদীস ও সুন্নাতের জন্য একটি অবকাশ রাখিয়া দিয়াছেন। নবী করীম (স) সেই সুন্নাত ও হাদীস স্থাপন করিয়াছেন, যদিও তাহাতে ইজতিহাদ করা বা নিজের মত প্রয়োগের সুযোগও রাখিয়া দেওয়া হইয়াছে।[তাফসীরে দুররে মনসুর, তারিখুত্তাফসীর, পৃষ্ঠা ৪।]

ইমাম উবায়াদ লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহ ও রাসূলের হালাল-হারাম সম্পর্কিত হুকুমের মধ্যে পার্থক্য নাই। রাসূল এমন কোন হুকুম দিতেন না, যাহার বিপরীত কথা কুরআন হইতে প্রমাণিত হইত। বরং সুন্নাত (হাদীস) হইতেছে আল্লাহর নাযিল করা কিতাবের ব্যাখ্যাদাতা এবং কুরআনের আইন-বিধান ও শরীয়াতের বিশ্লেষণকারী।[কিতাবুল আমওয়াল-আবূ উবায়দ, পৃষ্ঠা ৫৪৪।]

হাদীস অমান্যকারী কাফির

ইসলামী ফিকাহর ইমামগণ সম্পূর্ণ একমত হইয়া ঘোষণা করিয়াছেন যে, হাদীস অমান্যকারী গুমরাহ, ইসলাম হইতে বাহির হইয়া যাওয়া লোক। ইসহাক ইবনে রাহওয়াই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

যে লোকের নিকট রাসূল করীম (স) হইতে কোন হাদীস পৌছিঁল, সে উহার সত্যতা যথার্ততা স্বীকার করে তাহা সত্ত্বেও সে যদি কোনরূপ কারণ ব্যতীত উহা প্রত্যাখান করে। তাহা হইলে তাহাকে কাফির মনে করিতে হইবে।

ইমাম ইবনে হাজম তাঁহার ‘আল-আহাকাম’ গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

কোন ব্যক্তি যদি বলে যে, আমরা শুধু তাহাই গ্রহণ করিব যাহা কুরআনে পাওয়া যায়-উহা ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করিব না, তাহা হইলে সে গোটা মুসলিম উম্মতের ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাফির।

হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

খুব শীঘ্র এমন সব লোক আসিবে যাহারা কুরআনের প্রতি সন্দেহ লইয়া তোমাদের সহিত বিবাদ করিবে, তোমরা তাহাদিগকে সুন্নাত বা হাদীসের সাহায্যে পাকড়াও কর। কেননা সুন্নাতের ধারক বা হাদীস বিশারদ মহান আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে অধিক জ্ঞানের অধিকারী।*********************************


হাদীস ও রাসূলের ইজতিহাদ
নবী করীম (স) হইতে বিশ্বমানব দুইটি জিনিস লাভ করিয়াছে। একটি হইতেছে কুরআন মজীদ আর দ্বিতীয়টি সুন্নাত। কুরআন সরাসরি আল্লাহর কালাম, আল্লাহর নিকট হইতেই ওহীর মারফতে নাযিল হইয়াছে। আর সুন্নাতেরও মূল উৎস হইতেছে ওহী। রাসূলে করীম (স) অনেক ক্ষেত্রে নিজেই ইজতিহাদ করিয়াছেন একথা সত্য; কিন্তু তাহাও ওহীবিহীন নহে। হয় উহার সহিত ওহীর সরাসরি সম্পর্ক রহিয়াছে, নয় উহা ওহী কর্তৃক সমর্থিত এবং অনুমতিপ্রাপ্ত। কাজেই রাসূলের ইজতিহাদকেও ইসলামের উৎস হিসাবে স্বীকার করিতে হইবে।

এই পর্যায়ে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর আলোচনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি এই বিষয়টির প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দান প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

হাদীসের কিতাবসমূহে রাসূল (স) হইতে যেসব হাদীস বর্ণিত ও উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহা দুই প্রকারের। প্রথম প্রকারের হাদীস হইতেছে তাহা. যাহা রিসালাতের দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে বলা হইয়াছে। কুরআনের আয়াতঃ

******************************************************

‘রাসূল তোমাদিগকে যাহা কিছু দিয়াছেন তাহা গ্রহণ কর, আর যাহা হইতে নিষেধ করিয়াছেন তাহা হইতে বিরত থাক’- এই বিশাল পর্যায়ে এই ধরনের হাদীস গণ্য। এই ধরনের হাদীসের এক ভাগ তাহা, যাহাতে পরকালের অবস্থা ও মালাকুতী জগতের বিস্ময়কর বিষয় সম্পর্কে বলা হইয়াছে। এইসব বিষয়ের ভিত্তি হইতেছে ওহী। হাদীসসমূহে যে ভাবে শরীয়াতের হুকুম-আহকাম বর্ণিত হইয়াছে, ইবাদাতের আরকান ও নিয়মাবলীর বিশ্লেষণ রহিয়াছে, জীবন প্রণালীর বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা সম্পর্কিত ব্যাখ্যা ও উপদেশ রহিয়াছে, তাহা এই প্রথম পর্যায়ের প্রথম ভাগের হাদীস। প্রথম পর্যায়ের এই হাদীসসমূহের এব দ্বিতীয় ভাগের কিছু হাদীস ওহীবদ্ধ; আর কিছু রাসূলে করীমের নিজের ইজতিহাদ-ভিত্তিক। কিন্তু স্মরণ রাখিতে হইবে যে, রাসূলে করীমের ইজতিহাদও ওহীর সমপর্যায়ভুক্ত। কেননা আল্লাহ তা’আলা তাঁহাকে ভূল ইজতিহাদ করিতে দেন নাই। তাঁহার ইজতিহাদ কখনো ভূল হইয়া গেলে সেই ভূলের উপর তাঁহাকে কায়েম থাকিতে দেন নাই। কোন প্রকার ভূল হইলে অনতিবিলম্বে আল্লাহর তরফ হইতে উহার সংশোধন ও বিশুদ্ধ হইয়া যাওয়া অপরিহার্য।[****************]

শাহ ওয়ালীউল্লাহ এই শেষ কথা কয়টি এই ভাষায় লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

এই প্রকারের হাদীসের কিছু অংশ ওহীমূলক, আর কিছু ইজতিহাদমূলক। তবে রাসূলে করীম (স)-এর ইজতিহাদও ওহীরই সমতুল্য। কেননা রাসূলের রায়কে ভূলের উপর স্থায়ী হইয়া থাকা হইতে আল্লাত তা’আল্অ তাঁহাকে রক্ষা করিয়াছেন।


হাদীসের উৎপত্তি
পূর্বোক্ত বিস্তারিত আলোচনা হইতে ইসলামী জীবনে হাদীসের স্থান এবং হাদীসের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। বর্তমান পর্যায়ে আলোচনা করিব কিভাবে হাদীস লাভ করিলেন, তাহাই হইবে এখনকার মূল আলোচ্য বিষয়।

নবী করীম (স) এর নিকট হইতে হাদীসের সর্বপ্রথম শ্রোতা হইতেছেন সাহাবায়ে কিরাম। দ্বীন-ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তারিত জ্ঞান লাভের জন্য তাঁহারা রাসূলেল দরবারে উদগ্রীব হইয়া বসিয়া থাকিতেন। তাঁহারা নবী করীম (স) কে চব্বিশ ঘন্টা পরিবেষ্টিত করিয়া রাখিতেন। তিনি কোথায়ও চলিয়া গেলে তাঁহারা ছায়ার মত তাঁহার অনুসরণ করিতেন।

রাসূলে করীম (স) জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ছিলেন ইসলামী বিধানের ব্যাখ্যাদাতা। কেবল মুখের কথায়ই নয়, নিজের কাজকর্ম ও সাহাবাদের কথা ও কাজের সমর্থন দিয়াও তিনি উহার বাস্তব ব্যাখ্যা দান করিতেন। সাহাবাগণ ইহার মাধ্যমেই হাদীসের মাহন সম্পদ সংগ্রহ এবং সঞ্চয় করিতেন। দ্বীন-ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে যখনই কোন জটিলতা কিংবা অজ্ঞতা দেখা দিত। কোন প্রশ্নের উদ্রেক হইত, তখনই রাসূলের নিকট সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিয়াজওয়াব হাসিল করিতেন এবং সাহাবায়ে কিরাম (রা) একটি অমূল্য সম্পদ হিসাবে ইহার সংরক্ষণ করিতেন।

এতদ্ব্যতীত হাদীস উৎপত্তির আরো উপায় ইলমে হাদীসের ইতিহাসে সুস্পষ্টরূপে পরিলক্ষিত হয়। হযরত জিবরাঈল (আ) কখনো কখনো ছদ্মবেশে রাসূলের দরবারে উপস্থিত হইতেন এবং রাসূলের নিকট নানা বিষয়ে প্রশ্ন করিয়া ও উহার জওয়াব হাসিল করিয়া উপস্থিত সাহাবাদিগকে পরোক্ষভাবে শিক্ষাদান করিতেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত ‘হাদীসে জিবরাঈল’ নামের প্রখ্যাত হাদীসটি ইহার অকাট্য প্রমাণ। ইহাতে বলা হইয়াছে যে, একজন অপরিচিত ও সুবেশী লোক রাসূলের দরবারে উপস্থিত হইয়া ইসলাম, ঈমান, ইহসান ও কিয়ামাত প্রভৃতি বুনিয়াদী বিষয়ে প্রশ্ন করেন। রাসূলে করীম (স) প্রত্যেকটি প্রশ্নের যথাযথ জওয়াব দান করেন। অতঃপর তিনি দরবার হইতে চলিয়া যান। রাসূলে করীম (স) উপস্থিত সাহাবাদের মধ্যে হযরত উমর ফারূক (রা) কে জিজ্ঞাসা করেনঃ

******************************************************

হে উমর, তুমি জান, এই প্রশ্নকারী লোকটি কে?

হযরত উমর (রা) স্বীয় অজ্ঞতা প্রকাশ করিলে রাসূলে করীম (স) নিজেই বলিলেনঃ

******************************************************

এই প্রশ্নকারী ছিলেন জিবরাঈল, তিনি তোমাদের নিকট তোমাদিগকে দ্বীন শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে আসিয়াছিলেন।[*******************]

অতঃপর আমরা প্রামাণ্য গ্রন্হাবলী হইতে এমন কিছু ঘটনার উল্লেখ করিব, যাহা হইতে রাসূলের নিকট সাহাবাদের নানা বিষয়ে প্রশ্ন করা ও উহার জওয়াব হাসিল করার কথা প্রমাণিত হয়।

বস্তুত নবী করীম (স) এর নিকট সাহাবীদের সওয়াল করা অস্বাভাবিক ব্যাপর ছিল না। তিনি নিজেই তাহাদিগকে সওয়াল করিতেন, তাঁহার নিকট জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়া লইতে ও তদনুযায়ী কাজ করিতে বলিয়াছিলেন এবং এইজন্য সময় সময় তাকীদও করিতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেনঃ নবী করীম (স)-এর যামানায় এক ব্যক্তি আহত হইলে তাহাকে গোসল করিতে বলা হইল। পরে সে মারা যায়। এই ঘটনার কথা নবী করীম (স) শুনিতে পাইয়া ক্রুদ্ধস্বরে বলিলেনঃ

******************************************************

আল্লাহ‍‍! ঐ লোকগুলিকে খতম করুন। আমার নিকট জিজ্ঞাসা করিলে না কেন? জিজ্ঞাসা করাই কি সব অজ্ঞতার প্রতিবিধান নয়?[********************]

হযরত নাওয়াস ইবনে সালমান (রা) বলেনঃ আমি রাসূলের নিকট একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার জন্য দীর্ঘ একটি বৎসর পর্যন্ত মদীনায় অবস্থান করিয়াছি।

******************************************************

শেষ পর্যন্ত আমি তাঁহার নিকট ‘বিরর’ ও ‘ইসম’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলোম। তিনি জওয়াবে বলিলেনঃ ‘বিরর’ হইতেছে নেক চরিত্র আর ‘ইসম’ তাহাই যাহা তোমার খটকা জাগায়-সংকোচের সৃষ্টি করে এবং তাহা লোকেরা জানুক ইহা তুমি পছন্দ কর না।[*****************]

কেবল মদীনায় উপস্থিত লোকেরাই যে রাসূলের নিকট প্রশ্ন করিতেন তাহা নহে; সুদূরবর্তী শহর ও পল্লী অঞ্চল হইতেও নও-মুসলিম লোকেরা দরবারে উপস্থিত হইয়া প্রশ্ন করিতেন। একদিন নবী করীম (স) সাহাবাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া মসজিদে নববীতে বসিয়াছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি উটের উপর সওয়ার হইয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। রাসূলের নিকট প্রশ্ন করার অনুমতি চাহিয়া বলিলঃ

******************************************************

আমি আপনার নিকট প্রশ্ন করিব; প্রশ্ন করার ব্যাপারে আমি অত্যন্ত কঠোরতাও প্রদর্শন করিব, আপনি কিন্তু আমার সম্পর্কে মনে কোন কষ্ট নিতে পারিবেন না।

অতঃপর নবী করীম (স) তাহাকে প্রশ্ন করার অনুমতি দান করিলে সে আল্লাহ সম্পর্কে, সমগ্র মানুষের প্রতি রাসূলের রাসূল হিসাবে প্রেরিত হওয়া সম্পর্কে, পাঁচ ওয়াকত নামায, একমাসের রোযা এবং ধনীদের নিকট হইতে যাকাত আদায় করিয়া গরীবদের মধ্যে বন্টন করা ফরয হওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিল। রাসূলে করীম (স) উত্তরে বলিলেনঃ

******************************************************

হ্যাঁ, আল্লাহ তা’আলা এই সবই ফরয করিয়া দিয়াছেন।

শেষ কালে সেই লোকটি রাসূলের জওয়াবে উদ্ধুদ্ধ হইয়া বলিলঃ

******************************************************

আপনি যে দ্বীন লইয়া আসিয়াছেন, তাহার প্রতি আমি ঈমান আনিলাম। আমার নাম যিমাম ইবনে সা’লাবা; আমি আমার জাতির লোকদের প্রতিনিধি হইয়াই আপনার নিকট আসিয়াছি।

হযরত আনাম বলেনঃ গ্রামদেশীয় এক ব্যক্তি আসিয়া রাসূলে করীম (স) কে জিজ্ঞাসা করিলঃ

******************************************************

আপনার প্রেরিত ব্যক্তি আমাদের নিকট গিয়া এই সংবাদ দিয়া আসিয়াছে যে, আপনাকে আল্লাহ তা’আলা রাসূল বানাইয়া পাঠাইয়াছেন বলিয়া আপনি মনে করেন, ইহা কি সত্য?

নবী করীম (স) উত্তরে ইহার সত্যতা স্বীকার করিয়া লন। অতঃপর সেই ব্যক্তি দ্বীন-ইসলামের কতগুলি মৌলিক বিষয়ে পূর্বে যাহা কিছু শুনিতে পাইয়াছিল তাহার সত্যতা সম্পর্কে রাসূলকে প্রশ্ন করে। রাসূল (স) তাহার সত্যতা বুঝাইয়া দিলে পর সে উদাত্ত কন্ঠে বলিয়া উঠেঃ

******************************************************

আপনাকে সত্য বিধানসহ যে আল্লাহ পাঠাইয়াছেন তাহার নাম শপথ করিয়া বলিতেছিঃ আপনার বিবৃত বিষয়সমূহে আমি কিছুই বেশি-কম করিব না।[****************]

আবদুল কায়স গোত্রের প্রতিনিধিদল নবী করীম (স)-এর খেদমতে উপস্থিত হইয়া নিজেদের অসুবিধা সম্পর্কে বিবরণ দিতে গিয়া বলিলঃ ‘হে রাসূল, আমাদের ও আপনার মাঝে মুশরিক গোত্রের অবস্থিতি রহিয়াছে, এই কারণে যে চার মাস যুদ্ধ করা হারাম তাহা ব্যতীত অপর সময়ে আমরা আপনার নিকট উপস্থিত হইতে পারি না’। অতএবঃ

******************************************************

দ্বীন-ইসলামে মূল বিষয় সম্পর্কে আমাদিগকে এমন কিছু বলিয়া দিন, যাহা অনুসরণ ও সে অনুযায়ী আমল করিলে আমরা বেহেশতে দাখিল হইতে পারিব এবং আমাদের পিছনে অবস্থিত লোকদিগকে তদনুযায়ী আমল করার জন্য আমরা দাওয়াত জানাইব।[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, ৬২৭ পৃষ্ঠা-************]

বনূ তামীম গোত্র ও ইয়েমেনবাসীদের পক্ষ হইতে একদল লোক রাসূলের দরবারে উপস্থিত হইয়া আরয করিলেনঃ

******************************************************

আমরা আপনার নিকট দ্বীন-ইসলাম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে আগমন করিয়াছি। এই সৃষ্টির মূলে ও প্রথম পর্যায়ে কি ছিল, সে সম্পর্কেও আমরা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, ১৫ পৃষ্ঠা।]

বসরার বনূ-লাইস ইবনে বকর ইবনে আবদ মানাফ ইবনে কিনানা হইতে কিছু সংখ্যক যুবক ও সমবয়সী লোক মদীনায় রাসূলের দরবারে আসিয়া প্রায় বিশ দিন পর্যন্ত অবস্থান করেন। তাঁহারা যখন নিজেদের দেশে প্রত্যাবর্তন করিবার জন্য উদ্বগ্ন হইয়া পড়িলেন, তখন নবী করীম (স) তাঁহাদিগকে বলিলেনঃ

******************************************************

তোমরা ফিরিয়া যাও, তোমাদের পরিবার-পরিজনদের সহিত জীবন যাপন কর। তাহাদিগকে দ্বীন-ইসলামের শিক্ষা দান কর। তোমরা নামায পড়।(বুখারী)

মুসলিমের অপর বর্ণনায় ইহার পর রহিয়াছেঃ

******************************************************

(যেমন ভাবে তোমরা আমাকে নামায পড়িতে দেখ) আর যখন নামায উপস্থিত হইবে, তখন তোমাদের একজন সকলের জন্য আযান দিবে এবং তোমাদের অধিক বয়স্ক ব্যক্তি ইমামতি করিবে।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, *****************]

নবী করীম (স) এই যুবক দলকে বিশ দিন পর্যন্ত দ্বীন-ইসলামের অনেক কথাই হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়াছিলেন। শরীয়াতের হুকুম আহকাম ও ইবাদতের যাবতীয় নিয়ম-নীতিও শিক্ষা দিয়াছিলেন। ফলে একদিকে যেমন বহু হাদীসের উৎপত্তি হইয়াছে, অপরদিকে ঠিক তেমনি রাসূলের এই হাদীসসমূহ মদীনা হইতে সুদূর বসরা পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য সাহাবীদের মারফতে পৌছিঁতে ও প্রচারিত হইতে পারিয়াছে।

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেনঃ হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেনঃ আমরা রাসূলের দরবারে বসিয়াছিলাম। তিনি লোকদের সাথে কথা বলিতে ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় জনৈক আরব বেদুঈন আসিয়ারাসূলের নিকট জিজ্ঞাসা করিলঃ *************** ‘কিয়ামত কবে হইবে’? নবী করীম (স) তাঁহার কথা শেষ করিয়া বেদুঈনকে ডাকিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

আমানত যখন বিনষ্ট করা শুরু হইবে তখন কিয়ামরে অপেক্ষা করিবে।

লোকটি জিজ্ঞাসা করিলঃ *************** আমানত কিভাবে নষ্ট করা হইবে?

নবী করীম (স) বলিলেনঃ

******************************************************

দায়িত্বপূর্ণ কাজ যখন অনুপযুক্ত ব্যক্তির উপর ন্যস্ত করা হইবে, তখন কিয়ামতের প্রতীক্ষার সময় উপস্থিত মনে করিবে।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, ১৪ পৃঃ।]

এইসব ঘটনা হইতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কুরআনের বাহক হযরত মুহাম্মদ (স)- এর নিকট হইতে ইসলামের বিভিন্ন মৌলিক ও খুটিঁনাটি বিষয়ে জানিয়া লওয়ার তীব্র আকাঙ্খা এবং সেই জন্য চেষ্টা ও কষ্ট স্বীকার করিবার প্রবণতা সকল সহাবীর মধ্যেই বর্তমান ছিল। আর রাসূলে করীম (স) এইসব জিজ্ঞাসার জওয়াবে যত কথাই বলিয়াছেন, যত কজই করিয়াছেন এবং যত কথা ও কাজের সমর্থন করিয়াছেন, তাহার বিবরণ ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার বিস্তৃত ব্যাখ্যার পর্যায়ভুক্ত এবং তাহাই হাদীস। এই সম্পর্কে আল্লাম বদরুদ্দীন আয়নী যাহা লিখিয়াছেন, তাহা এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

******************************************************

সাহাবায়ে কিরাম রাসূলের নিকট অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য জিজ্ঞাসা করিতেন। নবী করীম (স) তাহাদিগকে একত্র করিতেন, তাহাদিগকে দ্বীনের শিক্ষাদান করিতেন। সাহাবাদের কিছু লোক রাসূলের নিকট প্রশ্ন করিয়াজওয়াব লাভ করিতেন, অপর কিছু লোক উহা স্মরণ করিয়া রাখিতেন, কিছু লোক তাহা অপরের নিকট পৌছাইয়া দিতেন, অপরকে জানাইতেন, এইভাবে আল্লাহ তা’আলা তাঁহার দ্বীনকে পূর্ণতারয় পরিণত করিয়া লন।[***********]

হাদীস শাস্ত্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ইহা এক প্রামাণ্য ভাষণ, সন্দেহ নাই। এই প্রসঙ্গে ইমাম এবনে কাইয়্যেমের একটি উদ্ধৃতিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বনুল মুনফাতিক নামক এক কবীলার আগমন সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে তাহাদের এক প্রশ্নের উল্লেখ করিয়াছেন এবং তাহার পর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

ইহা হইতে প্রমাণ পাওয়া গেল যে, সাহাবাগণ রাসূলের সম্মুখে তাঁহাদের নানাবিধ প্রশ্ন ও শোবাহ-সন্দেহ পেশ করিতেন এবং তিনি তাঁহাদিগকে উহার জওয়াব দিতেন। ফলে তাহাদের মন সান্ত্বনা লাভ করিত। তাঁহার নিকট শক্ররাও প্রশ্ন করিত, যেমন করিত তাঁহার সাহাবিগণ। পার্থক্য এই যে, শক্ররা প্রশ্ন করিত ঝগড়া করা ও নিজেদের বাহদুরী প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে, আর সাহাবিগণ প্রশ্ন করিতেন দ্বীনের তত্ত্ব বুঝিবার জন্য, উহার প্রকালের জন্য এবং বেশী বেশী ঈমান লাভের উদ্দেশ্যে। আর রাসূল (স) তাহাদের সকলেরই জওয়াব দান করিতন। অবশ্য যেসব বিষয়ের কোন জওয়াব তাঁহার জানা ছিল না- যেমন কিয়ামত হওয়ার সময়- কেবল সে- সব বিষয়েরই তিনি জওয়ার দিতেন না।[****************]

নবী করীম (স) কেবল যে লোকদের সওয়ালেরই জওয়াব দিতেন এবং তাহাতেই হাদীসের উৎপত্তি হইত, তাহাই নয়। তিনি নিজে প্রয়োজন অনুসারে সাহাবিগণকে দ্বীন সম্পর্কে বিস্তারিত শিক্ষা দান করিতেন। হাদীসে এই পর্যায়ে বহু গটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। আমরা এখানে এই পর্যায়ের দুই একটি বিবরণের উল্লেখ করিতেছি।

১. হযরত আবূ যায়দ আনসারী (রা) বলেনঃ “একদিন নবী করীম (স) আমাদের লইয়া ফজরের নামায পড়িলেন। পরে তিনি মিম্বরে উঠিয়া দাঁড়াইলেন ও আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দান করিলেন। জোহরের নামাযের সময় পর্যন্ত এই ভাষণ চলিল। তখন তিনি নামিয়া জোহরের নামায পড়িলেন। নাময পড়া হইয়া গেলে তিনি আবা মিম্বরে উঠিয়া দাঁড়াইলেন ও ভাষণ দিতে থাকিলেন। আসরেরর নামায পর্যন্ত তাহা চলিল। আসরের নামাযের সময় উপস্থিত হইলে তিনি নামিয়া আসরের নামায পর্যন্ত তাহা পড়িলেন। নামায পড়া হইয়া গেলে তিনি আবার মিম্বরে দাঁড়াইয়া ভাষণ দিতে লাগিলেন। এই ভাষণ সূর্যাস্তকাল পর্যন্ত চলিল। এই একদিন ব্যাপী দীর্ঘ ভাষণে তিনি আমাদের নিকট অতীত ও ভবিষ্যতের অনেক কথাই বলিলেন। শুধু বলিলেনই না, আমাদিগকে জানাইয়াদিলেন ও মুখস্থ করাইয়া দিলেন।[মুসনাদে আহমদ ইবন হা’ল, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৩।]

২. হযরত হানযালা (রা) বলেনঠঃ আমরা একদিন রাসূল (স)- এর সঙ্গে ছিলাম। এই সময় তিনি আমদিগকে জান্নাত ও জাহান্নামের কথা সবিস্তারে বলিলেন। উহার ফলে এই দুইটি জিনিস আমাদের সামনে উজ্জ্বল উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, যেন আমরা প্রত্যক্ষভাবে দেখিতে পাইতেছি……………….।[মুসনাদে আহমদ ইবন হা’ল, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৩।]

মাত্র দুইটি বর্ণনা এখানে উদ্ধৃত করা গেল, যদিও হাদীসের কিতাবে এই পর্যায়ের বহু কথারই উল্লেখ রহিয়াছে। এই দুইটি বিবরণ হইতেই এই কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইতেছে যে, নবী করীম (স) প্রয়োজনে বুঝিয়ানিজ হইতেই অনেক সময় দ্বীন সম্পর্কে অনেক কথাই বলিতেন এবং সব কথাই সাহাবিগণ স্মরণ রাখিতেন ও অন্যান্য লোকদের নিকট এই হাদীস- কথাসমূহ তাঁহারা বর্ণনা করিতেন।

হাদীসের উৎপত্তি পর্যায়ে এই কথাও উল্লেখ্য।


হাদীস সংরক্ষণ
ইসলাম বিশ্বমানবের জন্য এক চিরন্তন জীবন- ব্যবস্থা। এইজন্য উহার প্রধান ও প্রাথমিক বুনিয়াদ কুরআন মজীদের হিফাযতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি ঘোষণা করিয়াছেনঃ

******************************************************

নিশ্চয়ই আমিই কুরআন নাযিল করিয়াছি এবং আমিই উহার সংরক্ষণকারী।[সূরা আল-হিজর, আয়াত- ৯।]

বস্তুত আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদ নাযিল করার সঙ্গে সঙ্গে উহার পূর্ণ সংরক্ষণের সার্বিক ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা করিয়াছেন। জিবরাঈলের মারফতে রাসূলে করীমের নিকট কুরআন নাযিল হইয়াছে, তিনি সঙ্গে সঙ্গেই তাহা লোকদিগকে পাঠ করিয়া শোনাইয়াছেন। অতঃপর ইহাকে চিরতরে সংরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে দুইটি উপায় অবলম্বিত হইয়াছে। একদিকে সাহাবায়ে কিরাম কুরআন শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে তাহা মুখস্থ করিয়া লইয়াছেন। স্মরণ শক্তির মণিকোঠায় ইহার প্রতিটি শব্দ ও অক্ষর চিরদিনের তরে সুরক্ষিত করিয়া লইয়াছেন। [সূরা আল-আনকাবূত, ৪৯ আয়াতের ব্যাখ্যায় শাহ আবদুল কাদির লিখিত আলোচনা, **************** পৃষ্ঠা ১২৪।]

ফলে উহার একটি বিন্দুও বিলুপ্ত বা বিকৃত হইতে পারে নাই। এই উপায়ে সংরক্ষণে লাভের দিক দিয়াও কুরআন মজীদ আসামানী গ্রন্হাবলীর ইতিহাসে অতুলনীয় জিনিস, দুনিয়ার অপর কোন গ্রন্হই মুখস্থ করিয়া রাখাকে এক বিরাট সওয়াবের কাজ বলিয়া বিশ্বাস করেন। এই কারণে কুরআন মজীদ মুখস্থ করার রীতি আবহমানকাল হইতে চলিয়া আসিয়াছে। এমন কি, গ্রন্হাকারে লিপিবদ্ধ কুরআন যদি আজ বিলুপ্তও হইয়া যায়, তবুও হাফেজদের স্মৃতিপটে রক্ষিত কুরআন মজীদ তাহার স্থান দখল করিতে পারিবে। পুনরায় কুরআনকে লিখিতরূপ দান করা কিছুমাত্র অসুবিধার ব্যাপার হইবে না। ইহা যে কুরআন মজীদের এক মু’জিযা তাহাতে সন্দেহ নাই।

অপরদিকে কুরআন নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নবী করীম (স) সর্বক্ষণ নিযুক্ত ওহী-লেখকদের দ্বারা তাহা লিখাইয়া লইয়াছেন। হযরত বরা ইবনে আজিব (রা) বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসটি ইহার জ্বলন্ত প্রমাণঃ

******************************************************

নিষ্ক্রিয় মু’মিন লোক ও আল্লাহর পথে জিহাদকারী লোক কখনো সমান হইতে পার না- এই আয়াত যখন নাযিল হইল, তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ যায়দকে ডাকিয়া দাও এবং তাহাকে দোয়াত, তখতি ইত্যাদি লইয়া আসিতে বলিও। তিনি (যায়দ) যখন আসিলেন, তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ এই আয়াতটি লিখ……………।[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৪৬।]

এইভাবে সমস্ত কুরআন মজীদ নবী করীম (স) এর জীবদ্দশায়ই নির্দিষ্ট লেখকের দ্বারা লিখিত হয়। প্রায় চল্লিশ জন সাহাবী কুরআন মজীদ লিখিবার জন্য নিযুক্ত ছিলেন। [***********] প্রায় ছাব্বিশ জন সাহাবী ছিলেন তাঁহাদের মধ্যে প্রখ্যাত। হযরত আবূ বকর, হযরত উমর, হযরত উসমান, হযরত আলী, হযরত যায়দ ইবনে সাবিত, হযরত আবদুল্লাহ ইবন সায়াদ, হযরত জুবাইর ইবনুল আওয়াম, হযরত খালিদ ইবন সায়ীদ, হযরত আমর ইবনুল আ’স, হযরত মুয়াবিয়া ইবন আবূ সুফিয়ান, হযরত উবাই ইবন কায়াব (রা) প্রমুখ তাহাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। [তাবাকাতে ইবন সায়াদ, তারীখ-ই তাবারী, ***************************************]

এই উভয়বিধ উপায় অবলম্বিত হওয়ার ফলে কুরআন মজীদ সর্বপ্রকার বিকৃতিও বিলুপ্তির হাত হইতে চিরকালের তরে রক্ষা পাইয়াছে।

কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে কেবল কুরআন মজীদকে রক্ষা করাই দ্বীন ইসলাম রক্ষা ও স্থায়িত্বের জন্য যথেষ্ট ছিল না। এই কারণে আমরা দেখিতেছি, কুরআন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তা’আলা হাদীস সংরক্ষণেরও যথাযথ ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন। হাদীস সংরক্ষণের ইতিহাসে আমাদের সামনে স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, কুরআন সংরক্ষণের জন্য প্রধানত দুইটি বাহ্যিক উপায় অবলম্বিত হইয়াছে, রাসূলের সুন্নাত তথা হাদীসও প্রধানত ঠিক সেই দুইটি উপায়ের সাহায্যেই সুরক্ষিত হইয়াছে। আর তাহা হইতেছে আল্লাহ তা’আলার কায়েম করা স্বাভাবিক ব্যবস্থা এবং মানুষের মানবিক প্রচেষ্টা ও ব্যবস্থাপনা। এই পর্যায়ে বিস্তারিত ও ঐতিহাসিক তথ্য ও তত্ত্বভিত্তিক আলোচনা পেশ করার জন্য আমরা এখানে চেষ্টা করিব।

স্বাভাবিক ব্যবস্থা

হাদীস সংরক্ষণের স্বাভাবিক ব্যবস্থা যাচাই ও পরীক্ষা করিয়া দেখিলে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই ব্যবস্থাকে কার্যকর করিয়াছে বলিয়া মনে হয়। প্রথম, তদানিীন্তন আরবদের স্বাভাবিক স্মরণশক্তির তীক্ষ্ণতা ও প্রাখর্য। দ্বিতীয়, সাহাবায়ে কিরামের জ্ঞান-পিপাসা, জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানানুশীলনের অপূর্ব তিতিক্ষা এবং তৃতীয়, ইসলামী আদর্শ ও জ্ঞান বিস্তারের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দায়িত্ববোধ। এই তিনটি বিষয়েরই বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা যাইতেছে।

আরব জাতির স্মরণশক্তি

তদানীন্তন আরব জাতির স্মরণশক্তি বস্তুতই এক ঐতিহাসিক বিস্ময়। কুরআন এবং হাদীসের সংরক্ষণে ইহার যথেষ্ট অবদান রহিয়াছে। কুরআন মজীদ ইহাকে একটি স্বাভাবিক ব্যবস্থা হিসাবে গণ্য করিয়াছে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

বরং এই কুরআন সুস্পষ্ট আয়াত সমষ্টি, ইহা জ্ঞানপ্রাপ্ত লোকদের মানসপটে সুরক্ষিত।[সূরা আল-আনকাবুত, ৪৯ আয়াত।]

এই আয়াতে সেকালের মুসলিম জ্ঞানী লোকদের স্মরণশক্তির দিকে সুস্পষ্ট ইংগিত রহিয়াছে এবং কুরআন মজিদ যে তাহাদের মানসপটে স্মৃতিশক্তির মাধ্যমে সুরক্ষিত ছিল, তাহাও ব্যক্ত করা হইয়াছে। আল্লামা বায়াযাবী এই আয়াতের তাফসীরে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

অর্থাৎ তাঁহারা কুরআনক এমনভাবে হিফয করিয়া রাখিতেন ও উহার সংরক্ষণ করিতেন যে, কেহই উহাকে বিকৃত বা রদবদল করিতে পারিত না।[তাফসীরে বায়যাবী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৯।]

ইতিহাস প্রমাণ করিয়াছে যে, তদানীন্তন আরব সমাজের লোকদের স্মরণশক্তি অসাধারণরূপে প্রখর ছিল, কোন কিছু স্মরণ করিয়া রাখার জন্য একবার শ্রবণই তাহাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। এই সম্পর্কে ইবন আবদুল বির লিখিত এই ঐতিহাসিক তথ্য উল্লেখযোগ্যঃ

******************************************************

আরব জাতি স্বভাবতই স্মরণশক্তিসম্পন্ন ছিল এবং উহা ছিল তাহাদের বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য।

******************************************************

তাহারা স্বাভাবিকভাবেই স্মরণশক্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করিত।[****************]

******************************************************

এই কথা প্রসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত যে, আরব জাতি মুখস্থ করার ব্যাপারে বিশেষ শক্তি ও প্রতিভার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ছিল। তাহাদের এক একজন লোক যে কাহারো দীর্ঘ কবিতা একবার শুনিয়াই মুখস্থ করিয়া ফেলিতে ও স্মরণ রাখিতে সক্ষম হইত।[***************]

হযরত ইবন আব্বাস (রা) উমর ইবন আবূ রাবিয়ানামক প্রসিদ্ধ আরব কবির এক দীর্ঘ কবিতা একবার মাত্র শ্রসণ করিয়া সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লইয়াছিলেন। [***************] রাসূলের সাহাবিগণও খালেস আরব জাতির লোক ছিলেন। তাঁহারা প্রথমে না কিছু লিখিতে পারিতেন, না পারিতেন কোন লিখিত জিনিস পাছ করিতে। ফলে তাঁহাদের সকলকেই কেবল স্মরণশক্তির উপর নির্ভরশীল হইয়া থাকিতে হইত। জাহিলিয়াতের যুগে তাঁহারা তাঁহাদের দীর্ঘ বংশতালিকা, পূর্বপুরুষদের অপূর্ব প্রশংসা ও গুণ-গরিমার কথা সবিস্তারে মুখস্থ করিয়া রাখিতেন। তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে যখন বংশ-গৌরবের প্রতিযোগিতা হইত, তখন তাঁহারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অতীত বংশ গৌরব ও স্তুতি গাঁথা একটানা মুখস্থ বলিয়া যাইতেন। তাঁহাদের প্রায় প্রত্যেকেই স্মরণশক্তির তীক্ষ্ণতার কারণে নিজ নিজ বংশের ভাষ্যকার বা মুখপাত্র ছিলেন।

আল্লাহ তা’আলা স্বাভাবিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন এই আরব জাতিকেই হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুয়্যাত ও প্রচরিত বাণীর সংরক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। প্রখর স্মরণশক্তিসম্পন্ন এইসব হৃদয়কে কুরআনের আয়াত ও রাসূলের হাদীস মুখস্থ রাখার জন্য পূর্ণ মাত্রায় প্রস্তুত করিয়াছিলেন। [***************************]

ঠিক এই কারণেই আমরা দেখিতে পাই যে, কুরআন মজীদ নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহাবিগণ নবী করীম (স)- এর মুখে তাহা শুনিয়াই মুখস্থ করিয়া লইতে পারিতেন। এইভাবে পূর্ণ কুরআন মজীদ মুখস্থ করিয়ালওয়া এবং রাখা তাহাদের পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন ব্যাপার ছিল না।

প্রসিদ্ধ তাবেয়ী কাতাদাহ ইবন দায়ামহ দাবি করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহ এই জাতিকে স্মরণশক্তির এমন প্রতভা দান করিয়াছেন, যাহা কোন জাতিকেই দান করা হয় নাই। ইহা এক বিশেষত্ব, যাহা কেবল তাহাদিগকেই দেওয়া হইয়াছে এবং ইহা এমন এক সম্মান ও মর্যাদা যাহা দ্বারা শুধু তাহাদিগকেই সম্মানিত করিয়াছেন।[যুরকানী, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯৫।]ৱ

হযরত আবু হুরায়রা (রা)-এর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তিনি বিপুল সংখ্যাক হাদীসের হাফেজ ছিলেন। কিন্তু উমাইয়া বংশের শাসক খলীফা মারওয়ান ইবন হিকামের মনে এই সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক হয়। তিনি হযরত আবূ হুরায়রার পরীক্ষা লওয়ার জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করেন। একদিন হযরত আবূ হুরায়রাকে কিছু সংখ্যক হাদীস শোনাইবার জন্য অনুরোধ করিলেন। আবূ হুরায়রা (রা) তখন কিছু সংখ্যক হাদীস শোনাইয়া দেন। মারওয়ানের নির্দেশ মুতাবিক পর্দার অন্তরালে বসিয়া হাদীসসমূহ লিখিয়া লওয়া হয়। বৎসরাধিক কাল পরে একদিন ঠিক এই হাদীসসমূহই শোনাইবার জন্য হযরত আবূ হুরায়রাকে অনুরোধ করা হইলে তিনি সেই হাদীসসূহই এমনভাবে মুখস্থ শোনাইয়াদেন যে, পূর্বের শোনানো হাদীসের সহিত ইহার কোনই পার্থক্য হয় না। ইহা হইতে হযরত আবূ হুরায়রার স্মরণশক্তির প্রখরতা অনস্বীকার্যভাবে প্রমাণিত হয়।[কিতাবুল কুনী, ইমাম বুখারীকৃত, পৃষ্ঠা ৩৩।]

প্রসিদ্ধ হাদীস-সংকলক ইমাম ইবন শিহাব জুহরীও ছিলেন অসাধারণ স্মরণশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনিও একবার এক পরীক্ষার সম্মখীন হইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। তদানীন্তন বাদশাহ হিশাম তাঁহার পুত্রকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য কিছু সংখ্যক হাদীস লিখিয়া দিতে তাঁহাকে অনুরোধ করেন। জুহরী তখনি চারশত হাদীস লিখাইয়া দেন। দীর্ঘদিন পর সেই হাদীসসমূহ পুনরায় লিখাইয়া দেওয়ার জন্য অনুরুদ্ধ হইয়া তিনি আবার তাহা লিখিইয়া দেন। বাদশাহ এই উভয়বারে লিখিত হাদীসসমূহের তুলনামূলক পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পান যেঃ

******************************************************

এই দ্বিতীয়বারে সেই হাদীসসমূহের একটি অক্ষরও বাদ পড়িয়া যায় নাই।[তাযকিরাতুল হুফফাজ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০১।]

ইহা যেম ইমাম জুহরীর অপরিসীম স্মৃতিশক্তির বাস্তব প্রমাণ, তাহাতে সন্দেহ নাই।

ইবনে শিহাব জুহরী বলিতেনঃ

******************************************************

আমি যখনি ‘বকী’ বাজারের নিকট যাতায়াত করিতাম, তখন আমার কর্ণদ্বয় এই ভয়ে বন্ধ করিয়া লইতাম যে, উহাতে কোন প্রকার অশ্লীল কথা যেন প্রবেশ করিতে না পারে। কেননা, আল্লাহর শপথ, আমার কর্ণে কোন কথা প্রবেশ করিলে আমি তাহা কখনো ভুলিয়া যাই না।[******************]

তিনি আরো বলেনঃ

******************************************************

আমি আমার খাতা বইতে হাদীস বা অন্য যাহা কিছু লিখিয়াছি, তাহই মুখস্থ করিয়াছি।[**************]

প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ও বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী ইমাম শা’বী স্বীয় স্মরণশক্তি প্রখরতার পরিচয় ও বিবরণ দান প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি কখনো কোন খাতা হইতে কোন হাদীস লিখি নাই এবং কখনো কাহারো নিকট হইতে কোন হাদীস একাধিকবার শ্রবণ করার প্রয়োজন বোধ করি নাই।[***************]

ইমাম অকী’ও অনুরূপ একজন আসামন্য স্মরণশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল তাঁহার সম্পর্কে বলেনঃ

******************************************************

তাঁহার মত হাদীস হিফযকারী লোক আমি আর দেখি নাই।[তারীখে খতবী, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৭৪।]

অপর এক মুহাদ্দিস তাঁহার সম্পর্কে বলেনঃ

******************************************************

‘অকী’র স্মরণশক্তি ছিল প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য।[তারীখে খতবী, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৭৪।]

প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুহাদ্দিস কাতাদাহর স্মরণশক্তিও ছিল অতুলনীয়। তাঁহার এই ঐতিহাসিক স্মরণ শক্তির প্রমাণ পাওয়া যায় ইতিহাসকার হাফিজ যাহবীর নিম্নোক্ত বর্ণনা হইতে। তিনি বলেনঃ

******************************************************

কাতাদাহ ছিলেন বসরাবাসীদের মধ্যে সর্বাধিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি যে কথাই শুনিতেন, তাহাই স্রমণ করিয়ালইতেন। হযরত জাবিরের সংকলিত হাদীস গ্রন্হ তাঁহার সম্মুখে একবার পাঠ করা হইলে তিনি তাহা মুখস্থ করিয়া ফেলেন।[তাযকিরাতুল হুফফাজ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬।]

ইয়াহইয়া ইবনে কাতান বলেনঃ আমি সুফিয়ান সওরী অপেক্ষা অধিক স্মরণশক্তিসন্পন্ন লোক দেখি নাই। তাঁহার ত্রিশ হাজার হাদীস মুখস্থ ছিল। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

‘আমি যাহা কিছু একবার মুখস্থ করিয়াছে তাহা কখনই ভুলিয়া যাই নাই’।[তাযকিয়াতুল হুফফাজ, ১ম খণ্ড, ২৬ পৃষ্ঠা।]

সুফিয়ান ইবন উয়াইনার সাত সহস্র হাদীস কন্ঠস্থ ছিল এবং এজন্য তিনি কোন কিতাব রাখিতেন না।

ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল বলেনঃ রাজধানী বাগদাদে মুহাদ্দিস আবূ জুরয়া অপেক্ষা অধিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন লোক দেখা যায় নাই। কেবলমাত্র কুরআন সম্পর্কেই দশ হাজার হাদীস তাঁহার মুখস্থ ছিল। বস্তুত স্মরণশক্তির দিক দিয়া তিনি ছিলেন অতুলনীয়।

কাযী আবূ বকর ইসফাহানী মাত্র পাঁচ বৎসর বয়সেই সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করেন।

ইমাম বুখারীর উস্তাদ মুহাদ্দিস ইসহাক ইবন রাহওয়া-এর স্মরণশক্তি অতিশয় তীক্ষ্ণ ছিল। অসংখ্য হাদীস তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল। তাঁহার শিক্ষার্থীদিগকে তিনি মুখস্থ কয়েক সহস্র হাদীস লিখিয়াই দিয়াছিলেন, ইহাতে তিনি একবারও কিতাব দেখার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। তিনি নিজেই বলিতেনঃ ‘সত্তর সহস্র হাদীস আমার চোখের সম্মুখে সব সময় ভাসমান থাকে’।

মুহাদ্দিস আবু জুরয়া তাঁহার সম্পকের্ক বলিতেনঃ

তাঁহার (ইবন রাহওয়ার) মত স্মরণশক্তিসম্পন্ন লোক একজন দেখি নাই।[****************]

তদানীন্তন শাসনকর্তা আমীর আবদুল্লাহ তাঁহার স্মরণশক্তির বিস্ময়কর পরিচয় পাইয়া বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

আপনি অনেক বিষয় মুখস্থ করিয়া রাখিতে পারেন তাহা জানি, কিন্তু আপনার এই স্মরণশক্তির পরিচয় পাইয়া আমি আশ্চর্যান্বিত হইতেছি।[কিতাবুল-কুনী, ইমাম বুখারী কৃত, পৃষ্ঠা ৩৩]

পরবর্তী যুগের হাদীসবিদ ইমাম বুখারীর স্মরণশক্তিও কোন অংশে কম উল্লেখযোগ্য নয়। নওয়াব সিদ্দীক হাসান আবূ বকর ইবন আবূ ইতাব হইতে উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম বুখারী বাল্যাবস্থায়ই সত্তর হাজার হাদীস সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লইয়াছিলেন।[************]

তাঁহার সম্পর্কে আরো উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

বর্ণিত আছে, তিনি একবার মাত্র কিতাব দেখিয়া তাহা সবই মুখস্থ করিয়া লইতেন।[*************]

মুহাম্মদ ইবন আবূ হাতেম বলিয়াছেনঃ দুইজন লোক আমার নিকট বলিয়াছেন যে, আমরা একত্রে হাদীস শ্রবণ করিতাম, ইমাম বুখারী তখন আমাদের মধ্যে বালক বয়সের ছিলেন। আমরা যাহা শুনিতাম তাহা সঙ্গে সঙ্গে লিখিয়া লইতাম; কিন্তু ইমাম বুখারী কিছুই লিখিতেন না। একদিন তাঁহাকে এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিলেনঃ তোমরা আমার প্রতি বড় অবিচার করিলে। আচ্ছা, তোমরা কি লিখিয়াছ তাহাই আমাকে শোনাও। অতঃপর আমাদের লিখিত পনেরো হাজারেরও অধিক হাদীস তাঁহাকে দেখাইলাম।

******************************************************

অতপর তিনি তাঁহার স্মরণশক্তিতে রক্ষিত এই সব হাদীসই মুখস্থ পড়িয়া শোনাইলেন। এমনকি তাঁহার মুখস্থ পাঠ শুনিয়া আমাদের লিখিত কিতাবগুলিকে সংশোধন করিয়া লইলাম।[*****************]

ইমাম বুখারী সম্পর্কে আর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখযোগ্য। তিনি বাগদাদ আগমন করিলে মুহাদ্দিসগণ তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলেন ও আলাদা আলাদাভাবে মোট একশতটি হাদীস তাঁহার সম্মুখে এমনভাবে পেশ করিলেন যে, উহার প্রত্যেকটির সনদ উল্টাপাল্টা করিয়া দেওয়া হইয়াছে, একটির সনদ অপরটির সহিত জুড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। এইসব হাদীস সম্পর্কে ইমাম বুখারীর মতামত জানিতে চাহিলে তিনি এই হাদীসসমূহ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা প্রকাশ করিলেন। অতঃপর প্রত্যেকটি হাদীসকে সঠিকভাবে উল্লেখ করিয়া দেখাইয়াছেন যে, তাঁহারা উহাকে যেভাবে উল্লেখ করিয়াছিলেন, তাহাতে এই ভূল ছিল এবং কোন হাদীসের সনদ কোনটি-কোনটি নয়, তাহাও তিনি অকাট্যভাবে প্রকাশ করিয়া দিলেন। তাঁহার এই অপরিসীম স্মরণশক্তি দর্শনে সকলেই গভীর বিস্ময় প্রকাশ করেন।

******************************************************

তাঁহার এই অপরিসীম স্মরণশক্তির কথা তাঁহারা স্বীকার করিলেন এবং এই ব্যাপারে তাঁহার বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব সকলেই বিশ্বাস করিলেন।[*************]

এই সব ঘটনা হইতে এই কথা প্রমাণিত হয় যে, এই যুগের মুসলিম মনীষীদের স্মরণশক্তি স্বাভাবত অত্যন্ত তীক্ষ্ন ও প্রখর ছিল। সাহাবাদের যুগ হইতে তাবে-তাবেয়ীন ও মুহাদ্দিসীনের যুগ পর্যন্ত ইহার কোন ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় না। সেকালের আরবদের মধ্যেও যেমন এই বিস্ময়কর স্মরণশক্তি বর্তমান ছিল, অনারব মুসলিমদের মধ্যেও তাহার প্রকাশ দেখা গিয়াছে। বস্তুত মুসলিম উম্মতের প্রতি ইহা ছিল আল্লাত তা’আলার এক অপরিসীম ও মহামূল্য অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহ ছিল বলিয়াই কুরআন এবং হাদীস ইসলামের এই ভিত্তিদ্বয় যথাযথভাবে সংরক্ষিত হইতে ও সুরক্ষিত থাকিতে পারিয়াছে।

এই যুগের এই বৈশিষ্ট্যের একটি জীবতাত্ত্বিক তাৎপর্যও রহিয়াছে। আল্লাহ তা’আলা মানবদেহে যতগুলি শক্তি ও সামর্থ্য দান করিয়াছেন, তন্মধ্যে কোন একটির ব্যবহার না হইলে কিংবা কোন একটি অঙ্গ অকেজো হইয়া পড়িলে অপরচির শক্তি বৃদ্ধি পায়। যাহার একটিমাত্র হাত, তাহার সে হাতে দুই হাতের শক্তি সঞ্চিত হয়। অন্ধ ও দৃষ্টিহীন ব্যক্তির আন্দাজ অনুমান ও অনুভূতির শক্তি অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। ইসলামের প্রথম যুগের মুসলামানদের ব্যাপারে ইহার সত্যতা অস্বীকার করা যায় না। একালে সাধারণভাবে লেখাপড়ার বেশী প্রচলন ছিল না। মানুষ লেখনীশক্তির প্রয়োগ অপেক্ষা স্মরণশক্তির ব্যবহার বেশী করিত। ফলে এ্ই যুগে স্মরণশক্তির প্রয়োগ অপেক্ষা স্মরণশক্তির ব্যবহার বেশি করিত। ফলে এই যুগে স্মরণশক্তির বিস্ময়কর বিকাল পরিলক্ষিত হয়।কুরআন ও হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রাথমিক উপায় হিসাবে ইহা খুবই গুরত্বপূর্ণ স্থান দখল করিয়াছে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি