Ethics: নীতিশাস্ত্র
নীতিশাস্ত্র দর্শনের একটি শাখার নাম। মানুষের ব্যবহারগত সম্পর্কের তাৎপর্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে নীতিশাস্ত্র বিকাশ লাভ করেছে।
নীতিশাস্ত্রের দুটি দিক প্রধান। একটি হচ্ছে নীতির তত্ত্বের দিক। অর্থাৎ ভালোমন্দ কাকে বলে; মানুষের কর্মের পেছনে একটা চালক শক্তি আছে, এ কথার তাৎপর্য কি ইত্যাদি প্রশ্নের তত্ত্বগত এবং ঐতিহাসিক আলোচনা হচ্ছে নীতি-তত্ত্বের বিষয়। নীতিশাস্ত্রের অপর দিক হচ্ছে তত্ত্বের প্রয়োগগত দিক। মানুষের কোনো ব্যবহার সৎ বা ভালো এবং কোনো ব্যবহার মন্দ; মানুষের সঙ্গে মানুষের কি সম্পর্ক থাকা সঙ্গত; ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে কোনো নীতির বন্ধন কাম্য এবং কোনো আদর্শ অনুসরণ সঙ্গত –এ সসমস্ত বিষয়ের আলোচনা ব্যবহারিক নীতিশাস্ত্রের প্রয়োগের শাখায় অধিক পরিমাণে করা হয়।
ন্যায়-অন্যায়, সঙ্গত-অসঙ্গত, উচিত-অনুচিতের বোধ মানুষের জীবনে গোড়া থেকেই বিদ্যমান। মানুষ যখন গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বাস করতে শুরু হলে গোষ্ঠী সে ধরনের কাজকে অসঙ্গত বলেছে। আবার গোষ্ঠীর কোনো অনুশাসন ব্যক্তির নিরানন্দ ব্যক্তির নিরানন্দ, দুঃখ কিংবা লাঞ্ছনার কারণ হলে সে অনুশাসনকে ব্যক্তি অনুচিত মনে করেছে। আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সাম্যমূলক সমাজে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নানা নীতি ও অনুশাসনে পারস্পরিকভাবে আবদ্ধ থাকলেও তখন নীতিশাস্ত্রের উদ্ভব হয় নি। নীতিশাস্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে সভ্যতার বিকাশে এবং সর্বপ্রথম দাস-প্রভুতে বিভক্ত এবং রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামোতে সংগঠিত সমাজে। এই সময় থেকে নীতিশাস্ত্র কেবল ব্যক্তির মনোভাব নয়। নীতিশাস্ত্র রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে পরিগণিত হতে থাকে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে ক্রমান্বয়ে সমাজ ও ব্যক্তির মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিরোধাত্মক সম্পর্কের তীব্রতা প্রশমিত করার জন্য তথা প্রভু শ্রেণীর সমাজ-ব্যবস্থা ও স্বার্থ রক্ষার দিক থেকে সমাজে ব্যক্তির আচরণের নীতিগত আলোচনা ও নীতি-নির্ধারক অনুশাসনের প্রণয়ন শুরু হয়। এইধারায় ক্রমান্বয়ে ব্যক্তির কর্মের পেছনে অতিমানবিক রহস্যময় এই আদর্শের আকর্ষণ সৃষ্টি করার চেষ্টা হতে থাকে। তত্ত্বগতভাবে কেউ বলতে থাকেন, এক অজ্ঞেয় অলভ্য চরম মহৎকে সামনে রেখেই মানুষ জীবন যাপন করবে। তার দৈনন্দিন সুখ-দুঃখভোগ ন্যায় বা অন্যায় আচরণ সব কিছুরই পরিমাপক হবে সেই পরম মহৎ-এর নৈকট্যলাভের প্রায়াস। আবার কেউ ব্যক্তিক এবং দৈহিক সুখরাভ বা উপভোগকে সমস্ত কর্মের মূল লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেন।
প্রাচীন ভারতের চার্বাকপন্থীগণ, চীনের কনফুসিয়াস, ইয়াংচু, লাওজে, গ্রিসের ডিমোক্রিটাস, এপিক্যুরাস, এ্যারিস্টটল প্রমুখ জ্ঞানী ও দার্শনিকগণ মানুষের জীবন নীতিগত দিকের বিশেষ আলোচনা করেছেন।
ইউরোপে পুঁজিবাদী সমাজ যখন প্রতিষ্ঠিত হলো তখন একদিকে বিস্ময়কর আবিস্কারসমূহ, শিল্পের প্রতিষ্ঠা, বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের দাসের মতো যূথবদ্ধভাবে উৎপাদন, অপরদকে নগণ্য সংখ্যক ধনপতির সমস্ত সম্পদের ভোগ –ইত্যাকার অবস্থা মিল যে অভূতপূর্ব জটল পরিস্থতির সৃষ্ট হয়, তাতে ব্যক্তি ও সমাজর জীবনে ন্যায়, সঙ্গত-অসঙ্গত, শান্তি-অশান্তির প্রশ্নও নানারূপে মাথা তুলতে শুরু করে। এই পর্যায় থেকে নীতি-শাস্ত্রের আলোচনায় বস্তুবাদী এবং ভাববাদী বৈশিষ্ট্য অধিকতর পরস্পর-বিরোধী রূপ গ্রহণ করে। ভাববাদী নীতিশাস্ত্রের চরম প্রকাশ দেখা যায় ইমানুয়েল কাণ্টের রচনায়। তিনি মানুষের নীতির ক্ষেত্রে কতকগুলি ‘ক্যাটেগরিকাল ইম্পারেটিভ’ বা ‘শর্তহীন বিধান’ প্রবর্তনের চেষ্টা করেন। তাঁর মতে এই বিধানগুলি মানুষ মেনে চললে সমাজে যে অন্যায়, বিরোধ ও সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে তা বিদূরিত হবে। তাঁর নীতি-বিধানের অন্যতম বিধান বাস্তব সমাজের পরিস্তিতির সঙ্গে সম্পর্কশূন্য এবং বাস্তব সমাজের বিশ্লেষণ এখানে অনুপস্থিত। ইংল্যাণ্ডের জেরমী বেনতাম (১৭৪৮-১৮৩২) এবং জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-১৮৭৩) নীতির ক্ষেত্রে ‘হিতবাদ বা উপযোগবাদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা বলে পরিচিত। তাঁরা বৃহত্তম সংখ্যক মানুষের সুখ লাভকে ব্যক্তি ও সমাজের কাম্য আদর্শ বলে ঘোষণা করেন। বৃহত্তম সংখ্যক মানুসের সুখ লাভকে ব্যক্তি ও সমাজের কাম্য আদর্শ বলে ঘোষণা করেন। বৃহত্তম মানুষের উপর অনুষ্ঠিত অসঙ্গত আচরণ থেকে তাঁদের এ নীতি উদ্ভুত হলেও তাঁদের এ ঘোষণারও তেমন কোনো ব্যবহারিক তাৎপর্য ছিল না। তাঁদের মত যত বিমূর্ত মহৎ আদর্শের কথাই নীতির ক্ষেত্রে কেউ প্রচার করুক না কেন, তার বাস্তব তাৎপর্য সেই সময়ের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কাঠামো দ্বারা নির্দিষ্ট হয়। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে সে বাস করে। কিন্তু সেই সমাজ ইতিহাসে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে অগ্রসর হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত সমাজের শাসক শ্রেণীর ব্যবস্থাদি রক্ষণের জন্যই সেই সমাজের বিশষ নীতিশাস্ত্র রচিত হয়। সমাজবদ্ধ মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের জন্য জীবন ধারণের ও বিকাশের সঙ্গত অবস্থা সৃষ্টিকে মানুষের কাম্য নৈতিক আদর্শ বলে মনে করে।

Euclid: ইউক্লিড (৩৩০-২৭৫ খ্রি. পূ.)
প্রাচীনকালের গ্রিক অঙ্কশাস্ত্রবিদ, জ্যামিতিক। জন্ম আলেকজান্দ্রিয়ায়। জীবন-বৃত্তান্ত তেমন জানা যায় না। কিন্তু আধুনিককাল পর্যন্ত তাঁর জ্যামিতিক তত্ত্বসমূহ শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের মূল পাঠ্য হিসাবে চলে এসেছে। কেবলমাত্র সাম্প্রতিককালে তাঁর তত্ত্বসমূহের পরিবর্তে নতুন তত্ত্ব প্রচারিত হচ্ছে। ইউক্লিডের জ্যামিতিক তত্ত্ব অবরোহী বা ডিডাকটিভ অনুমানের প্রধান ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। ইউক্লিড তাঁর ‘ডাটা’ বা ‘ডিডোমেনা’ গ্রন্থে ৯৫টি থিওরেম পেশ করেছেন। এসব থিওরেমের প্রতিপাদ্য হচ্ছে এই তত্ত্ব যে, কতগুলি স্বতঃসিদ্ধ স্বীকার করলে তার ভিত্তিতে একাধিক সিদ্ধান্তকে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারি। বিজ্ঞানের ইতিহাসে আলেকজান্দ্রিয় যুগটি অঙ্কমাস্ত্রের বিকাশে বিশেষ অবদান রেখেছে বলে মনে করা হয়। আলেকজান্দ্রিয়ার একাডেমীর অন্যতম অঙ্কবিদ ছিলেন ইউক্লিড। ইউক্লিডের ‘এলিমেন্টস অব জিওমেট্রি’ সম্পর্কে এরূপ বলা হয় যে, তাঁর এই গ্রন্থ আধুনিককাল পর্যন্ত যে-বিপুল সংখ্যায় পঠিত হয়েছে সে সংখ্যা কেবল খ্রিষ্টানধর্মের ‘বাইবেল’ পাঠের সংখ্যার সঙ্গেই তুলনীয়।

Eratosthens: এরাটোসথেনিস (২৭৬-১৯৪ খ্রি. পূ.)
আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত গ্রন্থাগারিক এবং ব্যাকরণবিদ। প্রাচীনকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্বান বলেও পরিচিত। কেবল যে গ্রন্থাগারিক এবং ব্যাকরণবিদ তাই নয়। ভূগোলবিজ্ঞানেও তাঁর অবদান স্বীকৃত। তিনি সেকালে পৃথিবী গ্রহকে পরিমাপেরও একটি সূত্র আবিস্কার করেন।

Eudemonism: সুখবাদ, হিতবাদ
নীতিশাস্ত্রের একটি মতকে সুখবাদ বা হিতবাদ বলা হয়। প্রাচীন গ্রিসের ডিমোক্রিটাস, এপিক্যুরাস, সক্রেটিস এবং এ্যারিস্টটলের রচনায় এবং ভারতের চার্বাকপন্থীদের আলোচনায় এই নীতির ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এ তত্ত্বের মূল বক্তব্য হচ্ছে যে, মানুষের কর্মের নিয়ামক হচ্ছে সুখ। সুখ ব্যক্তিক কিংবা সামাজিক হতে পারে। ইতিহাসের আধুনিক যুগে ইউরোপে ফরাসি দেশের হেলভেটিয়াস, ডিডেরট এবং ইংল্যাণ্ডের বেনথাম ও জন স্টুয়ার্ট মিলকে এই তত্ত্বের ব্যাখ্যাতা হিসাবে দেখা যায়। প্রাচীন কিংবা আধুনিক সুখবাদের একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, এ তত্ত্বের প্রবর্তকগণ কোনো অতিজাগতিক নীতি বা আদর্শকে মানুষের কর্মের নির্ধারক বলেন নি। স্বর্গলোকে নয়, এই পৃথিবীতে মানুষ কীভাবে সুখময় জীবন যাপন করতে পারে সে কথা এঁরা আলোচনা করেছেন। এ দিক থেকে সুখবাদ বস্তুবাদী তত্ত্ব। কিন্তু বাস্তব সামাজিক-আর্থিক অবস্থা নিরপেক্ষভাবে সুখকে কাম্য বললেই ব্যক্তি বা সমাজ জীবনে সুখ প্রতিষ্ঠিত হয় না। মহৎ সুখকে আদর্শ বলে যদি ব্যক্তি কল্পনা করে, তা হলেও সুখ তার লাভ না হতে পারে। সুখের প্রতিষ্ঠা সম্ভব সামাজিক অসঙ্গতি দূরীকরণের মাধ্যমে। কাজেই মহৎ সুখ কি এবং কি করে তা লাভ করা যায়, তার আলোচনা কোনো বিশেষ যুগের সমাজ ব্যবস্থার আলোচনা এবং তার অসঙ্গতি দূরীকরণের উপায় নির্দেশ ব্যতীত অবাস্তব এবং অসার্থত হতে বাধ্য। এ কারণে এপিক্যুরাস, সক্রেটিস কিংবা আধুনিক হিতবাদীদের নীতি-তত্ত্বের কোনো বাস্তব ব্যবহারিক তাৎপর্য দেখা যায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ তত্ত্ব নির্বিচার দৈহিক সুখলাভের বিকারে পর্যবসিত হয়েছে। সামাজিক সমস্যার বিশ্লেষণ ও তা নিরসনের উপায়ের ইঙ্গিত না থাকাতে প্রতিপক্ষীয়গণ এপিক্যুরাসের মতকে যদৃচ্ছা সুখ ভোগ এবং চার্বাকবাদীদের মতকে ‘ঋণং কৃত্য ঘৃতং পিবেৎ’-এর তত্ত্ব বলে প্রচার করতে সক্ষম হয়েছে।

Evolution and Revolution: বিবর্তন এবং বিপ্লব
বিবর্তন ও বিপ্লব বিকাশের অবিচ্ছেদ্য দুটি দিক। বিবর্তন বলতে কোনো অস্তিত্ব বা বিষয়ের মধ্যে পরিবর্তনের ধারাবাহিক এবং পরিমাণগত বৃদ্ধিকে বুঝায়। বিপ্লব বলতে বিকাশের কোনো পর্যায়ে অস্তিত্বের মধ্যে দ্রুত এবং আকস্মিক পরিবর্তন বুঝায়।
বিবর্তন ও বিপ্লবের মধ্যকার সম্পর্ক যে অবিচ্ছেদ্য, এটি আধুনিক বিজ্ঞানের এবং সমাজবিজ্ঞান, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তত্ত্ব। পূর্বে মানুষ বিবর্তন ও বিপ্লবকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন এবং বিরোধাত্মক ব্যাপার বলে মনে করত। পূর্বে এরূপ ধারণা ছিল যে, বিবর্তন ঘটতে থাকবে; অর্থাৎ পরিবর্তনের কেবল পরিমাণগত বৃদ্ধি হতে থাকবে, অস্তিত্বে নতুন কোনো গুণের উদ্ভব হবে না। এ ধারনার অস্তিত্বের বিকাশে বিবর্তন একমাত্র প্রক্রিয়া। এ ধারণায় বিপ্লব কেবল জবরদস্তির নামান্তর। অস্তিত্বের বহির্ভূত কোনো শক্তি হিসাবে বাইরে থেকে অস্তিত্বকে পরিবর্তিত করতে চায়। আধুনিক বিজ্ঞান অস্তিত্বের বিকাশের ধারণাকে সুস্পষ্ট করে দিয়েছে। পানি যখন উত্তপ্ত হতে থাকে, তখন পানির মদ্যে বিন্দু বিন্দু পরিমান পরিবর্তন সংঘটিত হতে থাকে। কিন্তু পরিবর্তনের এই বৃদ্ধি অনির্দিষ্ট কালের জন্য কেবল পরিমাণেই সীমাবদ্ধ থেকে পানিকে পানি হিসাবে বজায় রেখে এগোয় না। পরিবর্তনের পরিমাণগত বৃদ্ধির একটা চরম বিন্দুতে পানির পুরাতন অস্তিত্বের আমূল রূপান্তর সংঘটিত হয়। পানি বাষ্পে পরিণত হয়। পানি থেকেই বাষ্প; কিন্তু পানি এবং বাষ্পকে আমরা দৃশ্যত এক অস্তিত্ব মনে করি না। এখানে পানির বিকাশে বিবর্তনের একটা স্তরে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, এ কথা বলা যায়। প্রাকৃতিক জগতে এরূপ দৃষ্টান্তের অভাব নেই।
সামাজিক জীবনে বিবর্তন ও বিপ্লব প্রশ্নের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ ঘটেছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এবং মার্কসবাদের হাতে। মার্কসবাদের প্রবক্তাগণ প্রাকৃতিক জগতের অস্তিত্বে সক্রিয় পরিবর্তনের নিয়মকে সমাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে বলেন যে, সমাজ-দেহেও পরিবর্তনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে পেয়ে একটি চরম পর্যায়ে বিপ্লব সংগঠিত হয়। বিপ্লব কোনো অস্বাভাবিক কিংবা অস্তিত্বের বহির্ভূত ব্যাপার নয়। বস্তুগত কিংবা সামাজিক সমস্ত অস্তিত্বই সতত গতিশীল। অস্তিত্ব মাত্রের গতি সৃষ্টি হয় তার আভ্যন্তরিক বিরোধের ভিত্তিতে। অস্তিত্বের অন্তর্গত দ্বন্দ্বমান শক্তির বিরোধ বিভিন্ন কারণে বৃদ্ধি পেতে পেতে একটা বিস্ফোরণের মূহুর্তে উপস্থিত হয়। এক বিস্ফোরণই বিপ্লব। বিপ্লবের ফলে অস্তিত্বের এমন সব চরিত্র সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে চরিত্রগুলি বিপ্লবের পূর্বে অস্তিত্বের মধ্যে সুপ্ত কিংবা স্বল্প প্রকাশিত ছিল; কিন্ত এরূপ প্রবল এবং প্রধান হয়ে কার্যকর হয় নি।
বিবর্তন শব্দের একটা সাধারণ ব্যবহার আছে। সমাজের বিবর্তন, বিশ্ব জগতের বিবর্তন। এরূফ ব্যবহারে কোনো ক্ষেত্রে বিবর্তন ও বিপ্লবসহ পরিবর্তনের সমগ্র বিষয়টিকেই বুঝান হয়।
বিপ্লব শব্দের অনেক বিকৃত এবং সংকীর্ণ ব্যবহারও দেখা যায়। বিপ্লবের মৌলিক অর্থ অস্তিত্বে অদৃষ্টপূর্ব নতুন চরিত্রের উদ্ভব। কিন্তু অনেক সময়ে কোনো রাষ্ট্রকাঠামোতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জবরদস্তি ক্ষমতা দখলকেও বিপ্লব বলে অভিহিত করা হয়। পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে শাসনযন্ত্রের অধিকারীর ক্ষেত্রে অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় কিছু সংখ্যক ব্যক্তির রদ-বদল সংঘটিত হয়েছিল। এই ঘটনায় পাকিস্তানের সামাজিক চরিত্রে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে নি। কিন্তু শাসকগণ একে বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করেছিল। জবরদস্তি এবং রক্তপাত মাত্রকেই বিপ্লব বলা যায় না। বাস্তব সমাজের মধ্যে মৌলিকভাবে নতুন চরিত্রের উদ্ভব বিপ্লবকে সূচিত করে।

Existence: অস্তিত্ব
সাধারণ ‘অস্তিত্ব’ দ্বারা স্থায়ী, অস্থায়ী, স্থির এবং অস্থির সমস্ত সৃষ্টিকেই বুঝায়। তা হলেও অনেকে আবার অস্তিত্বকে সার-অস্তিত্ব এবং অসার-অস্তিত্ব বলে বিভক্ত করেন। যাঁরা এরূপ করেন, তাঁরা মনে করেন যে, সাধারণভাবে দৃষ্ট এবং জ্ঞাত অস্তিত্বের গভীরে এক মূল অস্তিত্ব বিরাজমান। দৃশ্য বা দৃষ্ট অস্তিত্ব সদা পরিবর্তনমান। কিন্তু মূল অস্তিত্বির কোনো পরিবর্তন নেই। এঁদের মতে মূল অস্তিত্ব বা সার-অস্তিত্বকে মানুষ জানতে পারে না। এরূপ চিন্তা ভাববাদী চিন্তা। অস্তিত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ অর্থে সার এবং অসারের পার্থক্য চিন্তা করা চলে। তুলনামূলকভাবে যা গভীরে, দৃষ্টির আড়ালে এবং অপর অস্তিত্বের ধারক হিসাবে কাজ করে, তাকে সার-অস্তিত্ব এবং যে অস্তিত্ব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, সদা পরিবর্তনশীল, অস্থির এবং আকস্মিক, তাকে অসার-অস্তিত্ব বলা চলে। কিন্তু সার এবং অসার মিলেই সমগ্র অস্তিত্ব। অসারের সঙ্গে সম্পর্কশূন্য গতিহীন এবং অপরিবর্তনীয় কোনো সার-অস্তিত্বের কল্পনা করা চলে না। অস্তিত্বমাত্রই গতিময় এবং পরিবর্তনশীল্
অস্তিত্বের আর একটি বিশেষ অর্থ পাওয়া যায় অস্তিত্ববাদী দর্শনে। এ দর্শনের মূল হচ্ছে ‘অস্তিত্ব’। আর এ অস্তিত্ব বলতে বুঝাবে মানুষ বা ব্যক্তির অলব্ধ সুপ্ত সম্ভাবনা। ব্যক্তিকে ঘিরে আছে যে পরিবেশ বা বাস্তব জীবন, সে অস্তিত্ব হচ্ছে অনিত্য অস্তিত্ব। কিন্তু নিত্য-অস্তিত্ব হচ্ছে ব্যক্তির সুপ্ত সম্ভাবনা। এ অস্তিত্বের মূলে আছে কোনো এক রহস্যময় বিধাতা বা শক্তি। প্রতিনিয়ত যে-ব্যক্তিরূপে আমরা জীবন যাপন করি, সে ব্যক্তি বাস্তব পরিবেশ দ্বার নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি। এ অসার। এখানে তার নিজের শক্তির কোনো প্রকাশ নেই। কিন্তু কোনো সংকটকালে পরিবেশকে উপেক্ষা কিংবা অতিক্রম করে যে অস্তিত্ব আকস্মিকভাবে প্রকাশিত হয়, ব্যক্তির সেই অস্তিত্বই সার বা মূল অস্তিত্ব। ব্যক্তির এ অস্তিত্ব বুদ্ধি ও জ্ঞানের বাইরে কোনো সংকটমুহুর্তে মানুষ এর আলোকে আকস্মিকভাবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

Existentialism: অস্তিত্ববাদ
অস্তিত্ববাদ আধুনিক দর্শনের একটি চিন্তাধারা। প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর যুগে জার্মানি এবং ফরাসি দেশে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের বিপর্যস্ত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই চিন্তার উদ্ভব এবং বিস্তার দেখা যায়।
অস্তিত্ববাদী দর্শনের মূল প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ এবং বিশেষ করে ব্যক্তির অস্তিত্ব। কিন্তু এই প্রশ্নের আলোচনাকারীদের মধ্যে মতামতেরও পার্থক্য আছে।
ইউরোপ এবং আমেরিকার কয়েকজন খ্যাতনামা লেখকের সৃজনশীল গল্প, উপন্যাস, কবিতায় অস্তিত্ববাদী মতের প্রকাশ ঘটেছে। এঁদের রচনায় প্রচার এবং পরিচয়ের মাধ্যমে অস্তিত্ববাদী দর্শন আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও কিছুটা প্রসার লাভ করেছে; এই সমস্ত লেখকের মধ্যে কার্ল জাসপার্স (১৮৮৩-১৯৬৯), মার্টিন হাইডেগার (১৮৮৯-১০৭৬), আলবেয়ার ক্যামু (১৯১৩-১৯৬২), জাঁ পল সার্ত্রে (১৯০৫-১৯৮০), ফ্রাঞ্জ কাফকা (১৮৮৩-১৯২৪) বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন।
অস্তিত্ববাদী চিন্তাধারাকে বুঝার জন্য উনিশ শতকের ইউরোপে উদ্ভুত ‘জীবনের দর্শণ’ নামক তত্ত্বটির পরিচয় থাকা আবশ্যক। বস্তুত ‘জীবনের দর্শন’ই অস্তিত্ববাদের উৎস এবং পটভূমি। উনিশ শতকে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়, বিশেষ করে জীববিদ্যায় এবং মনোবিজ্ঞানে যে বিস্ময়কর আবিস্কারসমূহ সংঘটিত হয়, তাতে জীবন ও জগতের এতকদিনকার সহজ এবং যান্ত্রিক ব্যাখ্যা অকেজো হয়ে দাঁড়ায়। জীবন ও জগৎ বস্তু বটে কিন্তু সে বস্তু সহজ নয়, সে বস্তু জটিল। তার যান্ত্রিক ব্যাখ্যা মানুষের মনের বহু প্রশ্নের জবাব দানেই অক্ষম। এতনিদকার ভাববাদী কিংবা অষ্টাদশ শতকের যান্ত্রিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যার বিফলতার প্রতিক্রিয়ায় একদল চিন্তাবিদের কাছে জীবন এক অজ্ঞেয় রহস্যের আধার বলে প্রতীয়মান হতে থাকে। জীবন হচ্ছে এক অসীম শক্তির উৎস; এ না বস্তু; না চেতনা। এর গতি আছে, এর প্রকাশ আছে। কিন্তু সে গতি বা প্রকাশ আমাদের বুদ্ধির আয়ত্তযোগ্য নয়। একে মানুষ কেবল তার সহজাত সজ্ঞা, ইনট্যুইশন বা সম্মোহিত অনুভূতির মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে পারে। আর যেহেতু সজ্ঞা বা সম্মোহিত অবস্থা নিছক ব্যক্তিগত ব্যাপার তাই জীবনের উপলব্ধি ব্যক্তিগত ছাড়া সমষ্টিগত জ্ঞানের ব্যাপার হতে পারে না। জীবনের কোনো বিজ্ঞান তৈরি করা সম্ভব নয়, জীবন কেবল অনুভূতি বা উপলব্ধির বিষয়। জীবনের এরূপ ব্যাখ্যই শপেনহার (১৭৭৮-১৮৬০) এবং হেনরী বার্গসঁ (১৮৫৯-১৯৪১) প্রমুখ দার্শনিকের তত্ত্বে দেখা যায়। ডেনমার্কের আত্মবিমোহিত বুদ্ধিজীবী সোরেন কিয়ের্কেগার্ড (১৮১৩-১৮৫৫)-এর রচনায়ও এই ‘জীবনদর্শনের’ সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কিয়ের্কেগার্ডকে অস্তিত্ববাদের সাক্ষাৎ পূর্বসূরি বলে মনে করা হয়। কিয়ের্কেগার্ড দর্শনের ক্ষেত্রে চরম ভাববাদ কিংবা ধর্মের ক্ষেত্রে খ্রিষ্টীয় যাজকদের ব্যাখ্যা কোনোটাকেই স্বীকার করতে পারেন নি। নিজের জীবনে কিয়ের্কেগার্ড ছিলেন অস্বাভাবিকরূপে আত্মকেন্দ্রিক ও ব্যক্তিবাদী। এই জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর চিন্তা ও রচনায়। তাঁর মতে এই জগতে ব্যক্তির অস্তিত্বই হচ্ছে কেন্দ্র-কথা। ব্যক্তি তার সংকটরূপে প্রতিভাসিত। সর্বক্ষণ সে সংকটের মুখোমুখি। হয় তাকে এ পথ গ্রহণ করতে হয়, নয় ওপথ; হয় তাকে এটা করতে হবে, নয় ওটা। সংকটের মোকাবেলাতেই ব্যক্তি তার অস্তিত্বের পরিচয় দিতে পারে এবং তাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। কিয়ের্কেগার্ডের মতে সামগ্রিকভাবে দেখলে মানুষের জীবনের দুটি সংকট প্রধান। হয় সে পরিবেশকে গ্রহণ করে নিজের অস্তিত্বকে লুপ্ত করে দেবে জীবনের ভোগে-দুর্ভোগে, আনন্দ-কষ্টে নিমজ্জিত হবে; নয়তো সে পরিবেশকে উপেক্ষা করে বিধাতার কিট আত্মসমর্পণ করে সেই উপেক্ষার শক্তিতে আর আত্মসমর্পণের স্বাধীনতায় নিজের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করবে। কিয়ের্কেগার্ড তাঁর একখানি গ্রন্থের নামকরণই করেছিরেন ‘হয়/নয়’ রূপে।
অস্তিত্ববাদের মতে দর্শনের করণীয় হচ্ছে বিষয় এবং বিষয়ীকে অবিভাজ্য এবং সামগ্রিক সত্তা হিসাবে ব্যাখ্যা করা। বিষয় এবং বিষয়ী, জ্ঞান এবং জ্ঞাতার অবিচ্ছেদ্য সত্তাই হচ্ছে অস্তিত্ব। এ অস্তিত্বকে ব্যক্তি উপলব্ধি করতে পারে অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্বের সংকট সীমায় দাঁড়িয়ে। মৃত্যু, যন্ত্রণা, পাপবোধ, অসন্তোষের মধ্যেই ব্যক্তি সেই সংকট সীমায় উপনীত হতে পারে। বুদ্ধি বা যুক্তির মাধ্যমে এ অস্তিত্বকে জানা সম্ভব নয়।
অস্তিত্ববাদের প্রাথমিক প্রবক্তা কিয়ের্কেগার্ডের সিদ্ধান্তে ধর্মীয় ভাব সুস্পষ্ট। কিন্তু অস্তত্ববাদীগণ সাধারণত নাস্তিক বলে মনে করা হয়। এঁদের ভাবধারার মধ্যে নিটশের দর্শনের প্রভাব দেখা যায়। নিটশে ‘ঈশ্বর’কে মৃত বলে ঘোষণা করেছিলেন। সার্ত্রের বক্তব্য হচ্ছে ঈশ্বরকে অস্বীকার করেই ব্যক্তিকে বাঁচতে হবে। আর ঈশ্বরই হচ্ছে ব্যক্তি জীবনে সমস্ব বন্ধনের মূল। সেই ঈশ্বরই যখন অস্বীকৃত, ব্যক্তি তখন অবাধ-স্বাধীন। তার নিজের কাছে ছাড়া অপর কারুর কাছে তার কোনো জবাবদিহি করার নেই। অপর কারুর কাছে দায়িত্ব বা কর্তব্যে সে দায়ী নয়। সবার বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ। সব কিছুকে, সব আইন-কানুন, ভালো-মন্দ, নিয়ম-নীতি, প্রেম-ভালবাসা, স্নেহ-মমতা, দান-গ্রহণ সব কিছুকে অস্বীকার করার চেষ্টায় এবং সে চেষ্টার সফলতার মধ্যে ব্যক্তির অস্তিত্ব নিহিত। সেই চেষ্টতেই ব্যক্তির অস্তিত্বের উপলব্ধি। জগৎ আর ব্যক্তি পরস্পর-বিরুদ্ধ শক্তি। এ জগতে ব্যক্তি বহিরাগত। অস্তিত্ববাদী সাহিত্যিকদের মধ্যে সমধিক পরিচিত আলবেয়ার ক্যামু তাঁর এক উপন্যাসের নাম দিয়েছিলেন ‘বহিরাগত’ বা ‘আউটসাইডার’। তাঁর অপর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘প্লেগ’ উপন্যাসেও পরিবেশের সমস্ত ঘটনা, দুর্ঘটনা, ভয়, আতঙ্ক, মৃত্যু, প্রেমিকার আহবান সব কিছুর প্রতি অত্যদ্ভুত এক নির্লিপ্ততা সহকারে দৈনন্দিন দায়িত্ব পালনের আকর্ষণীয় চিত্র নায়কের চরিত্রে অঙ্কিত হতে দেখা যায়। আলবেয়ার ক্যামুর আর একখানি উপন্যাস ‘মিথ অব সিসিপাস’-এর প্রতিপাদ্য ছিল: আত্মহত্যার যদি কোনো যুক্তি না থাকে, বেঁচে থাকারও কোনো যুক্তি নেই। অতএব যুক্তিগতভাবে ব্যক্তি যখন আত্মহত্যা করতে পারে না কিংবা বাঁচতেও পারে না, তখন ‘কেবল বাঁচার জন্য বাঁচা’ ব্যতীত ব্যক্তির জন্য আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
আধুনিক পৃথিবীর প্রতিষ্ঠিত সমাজ-ব্যবস্থা, পুঁজিবাদের চরম উন্নতি ঘটে ঊনবিংশ শতকে। তার বিকাশের সমস্ত গোড়া থেকেই শুরু হয় তার তীব্র ক্ষয়ের যুগ। এখন সেখানে সম্ভাবনা কেবলমাত্র ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সংঘর্ষ নয়, কেবলমাত্র শ্রেণীর হাতে শ্রেণীর শোষণ নয়। এখন মানুষের জীবনের প্রতি মুহুর্তের আশঙ্কা জাতিতে জাতিতে বৈরীর, ধ্বংসযজ্ঞের, মিথ্যার বেসাতির এবং যে মানুষ এই আশ্চর্য মানব সভ্যতা সৃষ্টি করেছে সেই মানুষের হাতে তার নিশ্চিহ্ন বিলোপের সম্ভাবনা এক অযৌক্তিক অসঙ্গত এবং ভীতিজনক অবস্থা। এরই প্রকাশ হিসাবে প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। মানুষের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, ন্যায়-নীতি, শৃঙ্খলা ভেঙে গেছে। এই বিপর্যস্ত অবস্থায় যে-বুদ্ধিজীবী মানুষের জন্য মুক্তির এবং অগ্রসরের আর কোনো পথ আবিস্কার করতে অক্ষম তার পক্ষে নৈরাজ্যিক মনোভাব নিয়ে চরম বিপর্যয়ে চিন্তাবিদ মাত্রই অস্তিত্ববাদী হয় নি। পৃথিবীর মানুষ প্রতিষ্ঠিত সমাজ-ব্যবস্থার বিপর্যয়কে মানুষের জন্য চরম বলে স্বীকার করে নি; সংঘবদ্ধ চেষ্টায় সে এমন এক নতুন সঙ্গত সমাজ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে যেখানে ব্যক্তি, সমষ্টির মধ্যেই নিজের অস্তিত্বের সার্থকতা উপলব্ধি করতে পারবে। সে হিসাবে অস্তিত্ববাদ সাধারণ চিন্তার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। অস্তিত্ববাদ এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর বিপর্যস্ত মনের প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে চরম আত্মরতিমূলক প্রতিক্রিয়া।

F
Fa Chila: ফাচিয়া
প্রাচীন চীনের একটি অগ্রসরকামী চিন্তাধারা। এই ধারার প্রধান প্রবক্তা হিসাবে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় এবং দ্বিতীয় শতাব্দীতে আমরা শাঙচুন এবং হানফিজু নামক দুজন দার্শনিকের সাক্ষাৎ পাই।
আলোচ্য সময়ে চীনের সমাজ-দেহ একটা পরিবর্তনের প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছিল। মানুষের অর্থনীতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সহজতর বিনিময় পদ্ধতির উদ্ভবে সমাজে নতুনতর শক্তির সৃষ্টি হচ্ছিল। এর ফলে এতদিনকার অনড় সীমাবদ্ধ মাতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠী-সমাজ বিচলিত হয়ে উঠল। তার স্থানে ব্যাপকতর এলকাভিত্তিক নতুন অভিজাততন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রয়াস পেতে লাগল। ফাচিয়া সীমাবদ্ধ গোষ্ঠী-সমাজের বিরুদ্ধে সংগ্রামী নতুনতর অভিজাত তন্ত্রেরই আদর্শগত হাতিয়ার। ফাচিয়া মতের অনুসারীগণ গোষ্ঠীতান্ত্রিক বিভাগের স্থানে ঐক্যবদ্ধ চীন গঠনের এবং সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের পক্ষপাতী ছিল। হানফিজু ছিলেন এই নতুন বিকাশের দার্শনিক। তিনি বলতেন, বস্তুজগতের নিয়ামত হচ্ছে ‘তাও’ বা প্রাকৃতিক বিধান। কোনো অতিপ্রাকৃতিক বিধাতা নয়। তেমনি সমাজের নিয়ামত হিসাবেও থাকবে সামাজিক বিধান বা ‘ফা’। সামাজিক বিধান দ্বারাই মানুষ সংগ্রাম করবে রক্ষণশীল শক্তির বিরুদ্ধে। হানফিজু এবং ফাচিয়ার অন্যান্য অনুসারীরা ধর্মান্ধতা, রহস্যবাদ এবং কুসংস্কারের বিরোধী ছিলেন।

Fabian Society, Fabianism: ফ্যাবিয়ান সমিতি, ফ্যাবিয়ানবাদ
প্রাচীন রোমের বিখ্যাত সমরবিদ ফ্যাবিয়াস-এর নামের ভিত্তিতে ঊনবিংশ শতকের ইংল্যাণ্ডের একদল গণতান্ত্রিক সমাজবাদী চিন্তাবিদের প্রতিষ্ঠিত সমিতি ‘ফেবিয়ান সোসাইটি’ নামে পরিচিত। রোমের সমরবিদ ফ্যাবিয়াসের নাম গ্রহণ করার কারণ এই সমরবিদ সেকালে (খ্রি. পূ. ৩২২-২৯৫) কারথেজের সঙ্গে রোমের যুদ্ধে যে কৌশল গ্রহন করেছিলেন সে কৌশলের বৈশিষ্ট্য ছিল ‘বিলম্বিতকরণ’। ল্যাটিন শব্দ ‘কাংটেটর’-এর অর্থ হলো বিলম্বকারী। ফ্যাবিয়াসকে তাই ‘কাংটেটর’ বলা হতো। ফ্যাবিয়াস কার্থেজের প্রখ্যাত সমরবিদ হানিবলের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ পরিহার করে যুদ্ধ প্রলম্বিত করে পরিশেষে হানিবলকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। আধুনিককালে, ঊনবিংশ শতকে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন যখন বিস্তার লাভ করতে থাকে তখন ইংল্যাণ্ডের গণতন্ত্রবাদী বেশ কিছু সমাজবাদী পুঁজিবাদের সঙ্গে সরাসরি মারাত্মক সংঘর্ষ বা বিপ্লবকে পরিহার করে ক্রমান্বয়ে প্রচারের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তত্ত্বকে গ্রহণ করেন। তাঁদের তত্ত্বের সারমর্মকে প্রকাশের জন্য ‘ফ্যাবিয়াস’ নামের ভিত্তিতে তাঁদের সমিতিকে ফ্যাবিয়ান সমিতি বলে অভিহিত করেন। এই সমিতির সূচনাকলের সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ, সিডনী ওয়েব, সিডনী অলিভার এবং গ্রাহাম ওয়ালাস। ১৮৮৯ সনে ‘ফ্যাবিয়ান নিবন্ধাবলী’ বা ‘ফ্যাবিয়ান এসেজ’ নামক গ্রস্থ প্রকাশের মাধ্যমে এই সমিতির প্রতিষ্ঠা ঘটে। এই সমিতির উদ্যোগে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বের কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে এই কমিটি থেকে ইংল্যাণ্ডের লেবার পার্টির উদ্ভব ঘটে। প্রায় ১৯১৪ সন পর্যন্ত ফ্যাবিয়ান সমিতির কার্যক্রমে জোর ছিল। এই সময়ে সমিতির সদস্যসংখ্যা ১৫০০০ এবং স্থানীয়ভাবে প্রায় ১০০০টি সমিতিকে পৌঁছেছিল। ১৯২০ ও ত্রিশের দশকে সমিতির কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। ১৯৩৯ সনের দিকে এ্যাটলী, জি.ডি.এইচ. কোল প্রমুখ রাজনীতিক নেতা এবং লেখকের উদ্যোগে সমিতিটিকে পুনর্গঠিত হতে দেখা যায়। এর পরেও সমিতিটির কার্যক্রমের, বিশেষ করে এদের ‘ক্রমান্বয়বাদী’ সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রকাশ নানা সম্মেলন আহবান, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, গবেষণা ও প্রকাশনার মাধ্যমে ঘটতে দেখা যায়। ইংল্যাণ্ডের লেবার পার্টিকে ফ্যাবিয়ান সোসাইটির প্রধান ফলশ্রুতি এবং উত্তরাধিকারী বলে বিবেচনা করা চলে। বিভিন্ন সময়ে পার্লামেন্টে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে প্রায় ১৩০ জন সদস্য ফ্যাবিয়ান সমিতিভুক্ত ছিলেন। এঁদের মধ্যে হ্যারলড উইলসনের নাম উল্লেখযোগ্য। (দ্র. Socialism, ফ্যাবিয়ান সমাজতন্ত্র)।

Fall of Bastil: বাস্তিলের পতন
ফ্রান্সের বিপ্লব-এর সময়ে ১৪ জুলাই, ১৭৮৯ সালে বিদ্রোহী জনতা বাস্তিল দুর্গ অধিকার করল। পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু তাঁর স্নেহাস্পদ কন্যা ইন্দিরা প্রিয়দর্শীনিকে পত্রাকারে লিখেছেন, “বাস্তিলের পতন ইতিহাসের একটি স্মরণীয় ঘটনা। সারাদেশ ব্যাপী বাস্তিলের পতন ছিল মহাবিদ্রোহের সংকেত। এর অর্থ দাঁড়াল, ফ্রান্সে প্রাচীন রীতি সামন্তপ্রথা রাজার একাধিপত্য এবং সম্প্রদায় বিশেষের বিশেষ অধিকারের পরিসমাপ্তি। ১৪ই জুলাই ক্রুব্ধ জনতার কাছে বাস্তিল দুর্গের পতন হল”।

Family: পরিবার
বিবাহ-বন্ধনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, ভাই-বোন ইত্যাদি সামাজিক সম্পর্কের উৎস হচ্ছে পরিবার। পরিবার হচ্ছে মানুষের একটি ঐতিহাসিক সামাজিক সংস্থা এর বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট হয় মানুষের জৈবিক প্রয়োজন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং তার নৈতিক ও মানসিক ধ্যান-ধারণা দ্বারা।
মানুষের সামাজিক সংস্থাসমূহের মধ্যে প্রাচীনতম হলেও মানুষের জীবনের আদিতে পরিবারের অস্তিত্ব ছিল না। মানুষের জীবনের বিকাশের একটি বিশেষ পর্যায়ে পরিবারের উদ্ভব ঘটে। মানুষের প্রয়োজনবোধ থেকেই যে-কোন সামাজিক সংস্থার সৃষ্টি। মানুষের যৌন সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতেই পরিবারের সৃষ্টি। আদিতে নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক ও সামাজিক কোনো বিধি-নিষেধের অস্তিত্ব ছিল না। এই বিধি-নিষেধের প্রথম উদ্ভব ঘটে গোত্রতান্ত্রিক সমাজে। মানুষ এতদিতে যাযাবর শিকারী জীবনের জন্য যৌন সম্পর্ক ছাড়া জীবিকার উপায় এবং সম্পত্তির উপর অধিকারের ধারাবাহিকতার প্রয়োজনও মানুষ অনুভব করতে শুরু করেছে। এই প্রয়োজন সাধনের জন্যই প্রথম পরিবারের উদ্ভব ঘটে। বর্তমানে পরিবারের উদ্ভব ঘটে মাতৃতান্ত্রিক রূপে। সন্তানের জনক সমাজে তখন তত সুনির্দিষ্ট ছিল না। কিন্তু সন্তানের জননী সুনির্দিষ্ট। জননীর মাধ্যমেই তাই বংশের ধারাবাহিকতা চিহ্নিত করা সহজ ছিল। আর্থিক বিকাশেও তখন পর্যন্ত নারী-পুরুষের কাজের বিভাগ তত প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায় নি। কালক্রমে নারী-পুরুষে কাজের বিভাগ এবং সম্পত্তির ভোগ সীমাবদ্ধ করার প্রয়োজনে নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্কের অধিকতর নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়। এই পরিক্রমায় পিতৃতান্ত্রিক পরিবার সৃষ্টি হয়। এ বিকাশ পৃথিবীর সর্বত্র এই সময়ে ঘটে নি। আজো মানব সমাজের কোনো কোনো অংশে মাতৃতান্ত্রিক সমাজের পরিচয় পাওয়া যায়। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের বৈশিষ্ট্যও যুগ এবং সমাজ-নিরপেক্ষ নয়। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের পরিবারের আভ্যন্তরিক বৈশিষ্ট্য পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের তুলনায় পুঁজিতান্ত্রিক সমাজেও পরিবারের মূল বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট হয় ব্যক্তিগত সম্পত্তির স্বার্থ দ্বারা।
নারী-পুরুষের সম্পর্কের নিয়ামকও ব্যক্তিগত সম্পত্তি। কিন্তু মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্পত্তির ভোগ ও রক্ষাই যে একমাত্র নিয়ামক হবে –এমন কোনো চরম কথা নেই। জীবন ধারনের উপায় যখন ব্যক্তি এবং পরিবারের জন্য কোনো সমস্যামূলক প্রশ্ন থাকবে না, তখন পরিবারের বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে নতুনতর রূপান্তর সংঘটিত হবে। সংকীর্ণ আর্থিক স্বার্থকে অতিক্রম করে নতুনতর মানবিকতা বোধ তখন পরিবারের আভ্যন্তরিক সম্পর্কের মূল নিয়ন্তা হয়ে দাঁড়াবে। নারী ও পুরুষ তখন সমান সুযোগ ও অধিকার-ভোগী মানুষে পরিণত হবে। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ পরিবারের এইরূপ রূপান্তরকে স্বাভাবিক বলে গণ্য করে এবং এই আদর্শ অর্জনকে সামাজিক বিপ্লবের অন্যতম লকষ্য বলে ঘোষণা করে।

Fascism: ফ্যাসিবাদ
পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া মহাজনী মূলধনের চরম জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল ও সন্ত্রাসমূলক প্রকাশ হচ্ছে ফ্যাসিবাদ। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ইতালিতে এবং ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানিতে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। ফ্যাসিবাদ চরম জাতীয়তাবাদ, অযৌক্তিক ধর্ম ও বর্ণবিদ্বেষ এবং উদ্দেশ্য সাধনে চরম বর্বরতার আদর্শ প্রচার করে। ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদের চরম সংকটের পরিচয়বাহক। সাম্রাজ্যবাদী যুগ হচ্ছে পুঁজিবাদের চরম যুগ। জাতীয় ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের বিকাশ যখন নিঃশেষিত, তখন পুঁজিবাদ নিজের শোষণমূলক ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র গ্রহণ করে। সাম্রাজ্যবাদী যুগেরও পরিণামে পুঁজিবাদ সামাজিক সংকটের ফলে বিপ্লব এবং নিজের উচ্ছেদ অত্যাসন্ন দেখে জাতীয় ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের সকল ব্যবস্থা পরিত্যাগ করে স্বৈরতন্ত্রের রূপ গ্রহণ করে। সমাজতন্ত্রই পুঁজিবাদের মূল প্রতিশক্তি। এ জ্ঞান থেকে শ্রমিক শ্রেণীকে ফ্যাসিবাদ তার আক্রমণের মূল লক্ষ্য বলে নির্দিষ্ট করে। শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী আদর্শ ও সংগঠনকে ব্যর্থ করার জন্য একদিকে তার উপর সে চরম অত্যাচারের নীতি যেমন গ্রহণ করে, তেমনি তার মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য ‘জাতির ঊর্ধ্বে কিছু নেই’, ‘আমার জাতি সবার সেবা’, ‘জাতীয় সমাজন্ত্র’ ইত্যাদি ভাবধারা প্রচারের সর্বপ্রকার মাধ্যম গ্রহণ করে। ফ্যাসিবাদের আক্রমণ জাতীয় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না।বর্বরতা, অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও অন্ধ জাতীয়তাবাদ দ্বারা সঙ্কটের সমাধান করতে না পেরে ফ্যাসিবাদ অপর জাতি ও দেশকে আক্রমণ করতে শুরু করে। দেশের মানুষের দৃষ্টিতে আভ্যন্তরিক সংকট থেকে এভাবে বাইরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ফ্যাসিবাদী ইতালি এবং জাপান দখলের বেপরোয়া জঙ্গী নীতি থেকেই শুরু হয়। পরবর্তীকালে ফ্যাসিবাদী ইতালি ও জাপান জার্মানির সঙ্গে মিলিত হয়ে বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদী অক্ষ তৈরি করে। বিশ্ব্যাপী অভূতপূর্ব ক্ষয়-ক্ষতি ও জীবন বিনাশের পরে ফ্যাসিবাদী শক্তি পরাভূত হয়। ফ্যাসিবাদী আদর্শের স্থায়ী উচ্ছেদ সমগ্র পৃথিবীতে সামাজিক বিপ্লব ব্যতীত সম্ভব নয়। বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশ সংকট থেকে পরিত্রাণের শেষ উপায় হিসাবে এখনো ফ্যাসিবাদী চরিত্র গ্রহণ করার চেষ্টা করছে।

Fatalism: অদৃষ্টবাদ
মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা-নিরপেক্ষভাবেই তার জীবনের ঘটনাপ্রবাহ সংঘটিত হয়, এরূপ বিশ্বাসকে অদৃষ্টবাদ বলে। প্রাচীন গ্রিকদের মধ্যে এই ধারণা এরূপ ব্যাপক ছিল যে, কেবল মানুষ নয়, অলিম্পিয়া পাহাড়ের অধিবাসী দেবতাগণও স্বাধীন হয়। তাদের জীবনও ঊর্ধ্বতর অপর কোনো শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে অদৃষ্টবাদে বিশ্বাস একটি সাধারণ এবং প্রায় সর্বজনীন বিশ্বাস। দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রে না হলেও সাধারণ মানুষ মনে করে মানুষের জন্ম, মৃত্যু, যুদ্ধ, ঝড়, ঝঞ্ঝা, দুর্যোগ, সামাজিক বিপ্লবের ন্যায় বিরাট ঘটনাসমূহ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা তার কার্যকলাপের উপর নির্ভর করে না। বিশ্ববিধাতার ইচ্ছানুযায়ী এরূপ ঘটনা সংঘটিত হয়। অদৃষ্টবাদের বিশ্বাদ একেবারে নেতিবাচকও হতে পরে। এমন ক্ষেত্রে মানুষ মনে করে যে, বিশ্বের ঘটনা প্রবাহরে মধ্যে মানুষ একেবারে অসহায়। আবার এ বিশ্বাস যুক্তিগত হতে পারে। যুক্তিগত বিশ্বাসে মানুষ এরূপ যুক্তি দেবার চেষ্টা করে যে, স্রষ্টার দ্বারা যখন সৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টার হাতে বিশ্বের সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হওয়াই স্বাভাবিক। যুক্তিগত অদৃষ্টবাদ কোনো কোনো ব্যাখ্যায় ‘নির্ধারিত ভবিষ্যৎ’-এর তত্ত্বরূপে প্রকাশিত হয়েছে। আবার কেউ একে ‘ইচ্ছাবাদ’ বলেও অভিহিত করেছেন। ‘ইচ্ছাবাদের’ দাবি হলো যে, বিশ্বের মূল হচ্ছে ইচ্ছা। ইচ্ছার কারণেই বিশ্বের সৃষ্টি। বিশ্বের ঘটনা-প্রবাহ কোনো প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, এক অলৌকিক ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত। মানুষের ইচ্ছা পরিবেশের উপর নির্ভরশীল নয়। মানুষের ইচ্ছারও মূল হচ্ছে সেই অতিপ্রাকৃতিক আদি ইচ্ছা। এখানে অবশ্য আদি ইচ্ছা বলতে প্রকারান্তরে বিধাতাকেই বুঝান হয়। ইতিহাসে অদৃষ্টবাদ সব সময়েই জ্ঞান এবং সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা গ্রহণ করেছে। একদিকে অদৃষ্টবাদ মানুষকে ঘটনা-প্রবাহের নিষ্ক্রিয় দাসে যেমন পরিণত করতে পারে, তেমনি অদৃষ্টবাদের মাধ্যমে ধর্মীয় গোঁড়ামী এবং অন্ধ জাতীয়তা ও ফ্যাসিবাদ সমাজকে গ্রাস করতে পারে। ভাগ্য আমাদের বিশ্ব-শাসনের জন্য নির্বাচিত করেছে, আমরা নির্বাচিত জাতি –এ বিশ্বাসেই ফ্যাসিবাদের জন্ম।

Federalism: যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা
‘ফেডারেশন’ থেকে ‘ফেডারেলিজম’। একটি রাষ্ট্রের মধ্যে ভাষা, জাতি বা অঞ্চলগত বৈচিত্র্যকে সমন্বিত করে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করা হয় তাকে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অভিহিত করা হয়। এর বিপরীতে ইউনিটারী বা এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা বলে কথাটি প্রচলিত। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাধারণ বৈশিষ্ট্য এরূপ যে, রাষ্ট্রের অন্তর্গত প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যগুলির কিছুটা স্বকীয় সংগঠন ও ক্ষমতার বিধান থাকে। অঙ্গরাজ্যগুলির কি ক্ষমতা এবং সংগঠন থাকবে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তা সমগ্র রাষ্ট্রের মূল সংবিধানে লিপিবদ্ধ রাখা হয়। এরূপ সংবিধানে অনেক সময়ে কেন্দ্রীয়ক্ষমতা, অঙ্গরাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং যৌথ তথা অঙ্গরাজ্য এবং কেন্দ্রের যুক্তক্ষমতা বলে ক্ষমতার তিনটি তালিকারও উল্লেখ থাকে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কোথাও কোথাও যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং অঙ্গরাষ্ট্রীয় নাগরিকতারও বিধান থাকে। সাধারণত সমগ্র দেশের রক্ষাব্যবস্থা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার বা কেন্দ্রের হাতে ন্যস্ত থাকে। অঙ্গরাষ্ট্রীয় ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারসমূহের ক্ষমতা প্রয়োগে বিরোধ দেখা দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্ট তার নিষ্পত্তি করে। এবং তার রায়কে সকলের জন্য মান্য বলে বিবেচনা করা হয়। মূল সংবিধানের ব্যাখ্যার দায়িত্বও সুপ্রিম কোর্ট পালন করে। যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এরূপ একটি শর্ত সংবিধানে রাখা হয় যে অঙ্গরাষ্ট্রের জন্য নির্দিষ্ট বিধি অনুযায়ী তাদের সম্মতি ব্যতিরেকে সংবিধানের সংশোধন করা হবে না।
আধুনিক কালে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রথম উদ্ভব দেখা যায় আমেরিকাতে। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধকালে উত্তর আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশ এক সম্মেলনে মিলিত হয়ে আপন স্বকীয়তা বা অধিকার বজায় রেখে এক ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা’ বা ‘আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র’ নামে তারা স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে আবার দাস সমস্যার মীমাংসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অঙ্গরাষ্ট্র, বিশেষ করে দাসদের মুক্তির সমর্থক উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে দাসব্যবস্থা বজায় রাখার সমর্থক দক্ষিণ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলির আপসহীন মতবিরোধের ফলে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে সশস্ত্র গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়। (দ্র. আমেরিকার গৃহযুদ্ধ)।
সমস্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা অভিন্ন নয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা। সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার একটি প্রধান সাংবিধানিক বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, সেখানে অঙ্গরাষ্ট্রগুলির বিচ্ছিন্ন হওয়ার এবং বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষা করার সাংবিধানিক অধিকারের স্বীকৃতি ছিল। বাস্তবে অবশ্য সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অঙ্গরাষ্ট্র এই অধিকারকে ব্যবহার করে নি। তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের দাবির ভিত্তিতে জাতিসংঘে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত রিপাবলিক ইউক্রেন এবং বাইলোরুশিয়ার প্রতিনিধিত্বকে স্বীকার করা হয়। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের চরিত্রে অঙ্গরাজ্যের অধিকারের চাইতে কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকারের বৈশিষ্ট্যই প্রবল। অবশ্য রাষ্ট্র বিজ্ঞানের গবেষকদের মতে রাষ্ট্রনির্বিশেষে বর্তমান যুগে প্রত্যেকটি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। (নব্বই এর দশকে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের ভেঙে যাওয়ার ঘটনা স্মরণযোগ্য)।

Fetishism: বস্তুরতি
প্রাকৃতিক কোনো বস্তুর পূজা বা আরাধনাকে বস্তুরতি বলা হয়। বস্তুরতি আদিম সমাজের ধর্মের অঙ্গীভূত ছিল। প্রাকৃতিক জগতের বিভিন্ন বস্তুর রহস্য মানুষের তখনো অজানা ছিল। পাহাড়, পর্বত, ঝড়ঝঞ্ঝা, মেঘ, বিদ্যুৎ যাবতীয় শক্তিশালী বস্তুরই কৃপার পাত্র ছিল মানুষ। ফলে আরাধনা ও পূজা দ্বারা এই সমস্ত প্রাকৃতিক শক্তিকে সন্তুষ্ট করে প্রাকৃতিক বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব বলে মানুষ মনে করত। বস্তুরতি থেকে গোত্র প্রতীকবাদের উদ্ভব ঘটে। প্রাচীনকালে গোত্র দেবতা হিসাবে প্রাকৃতিক কোনো বিশেষ বস্তু বা বস্তুকে এক একটি গোত্র বিশেষভাবে মান্য করত। তার পূজা করত। এবং সেই বস্তু বা জন্তুর প্রতীক বহন করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করত। এই বস্তুরতির রেশ আধুনিক কালেও যে সমস্ত ধর্মে মূর্তিপূজা, ক্রশ ধারণ, পাথর চুম্বন প্রভৃতি প্রচলিত আছে তার মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। ‘বস্তুরতি’ শব্দ আজকাল কিছুটা ব্যাপকতর অর্থেও ব্যবহৃত হয়। কোনো কিছুর উপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করাকে বস্তুরতি বলা হয়। এই অর্থে আধুনিক অর্থনীতিতে ‘পণ্যপূজা’ বা ‘পণ্যরতি’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

Feudalism: সামন্তবাদ
মানুষের সামাজিক আর্থিক বিকাশের একটি পর্যায়। মানুষের সামাজিক বিকাশ তার জীবিকার উপায় এবং উৎপাদন সম্পর্কে বিকাশের ভিত্তিতে প্রধানত নির্দিষ্ট হয়। জমির কর্ষণ থেকে জীবন ধারনের প্রধান উপায় শস্য লাভের কৌশল মানুষের আয়ত্তে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন দাস সমাজের ভাঙনের মধ্য দিয়ে নতুন সামন্ত সমাজের উদ্ভব হয়। সামন্ত সমাজের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি জমি। জমির মালিকানার ভিত্তিতে জমির প্রভু বা সামন্ত সমানের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি জমি। জমির মালিকানার ভিত্তিতে জমির প্রভু বা সামন্ত-প্রভু সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই প্রাচীন দাস সমাজের পরে সামন্ত সমাজের বিকাশ ঘটেছে। উৎপাদনের উপায়ের নতুনতর বিকাশে সামন্ত সমাজের স্থা আধুনিক কালে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পুঁজিবাদের পরবর্তী ঐতিহাসিক পর্যায় সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রও পৃথিবীর একাধিক দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সমাজের বিকাশ ও রূপান্তর যান্ত্রিক নয়। সমাজতন্ত্রের যুগেও অনেক দেশে সামন্ততন্ত্রের রেশ দেখতে পাওয়া যায়। ইউরোপে ফরাসি বিপ্লব অর্থাৎ ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত সামন্ততন্ত্রের স্থায়িত্বের কাল ধরা হয়। সামন্ততন্ত্রে জমির সাক্ষাৎ উৎপাদনকারী কৃষকের নিকট থেকে নানাপ্রকার কর আদায় করত। এই করের পরিমাণ অনেক সময় তার উৎপাদিত সমস্ত সম্পদকে গ্রাস করত। এমনকি, উৎপাদনের পরিমাণ নির্বিশেষে তার উপর খাজনা ধার্য হতো। ফলে অনেক স্থানে কৃষক দৈহিক যাতায়াতের স্বাধীনতা হারিয়ে ভূমির সীমানায় বন্দি ভূমিদাসে পরিণত হতো। সামন্ত সমাজের শাসক ও শোষখ শ্রেণী রাজা, সামন্ত-প্রভু, জমিদার এবং ধর্মযাজকদের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। কিন্তু সমাজ বিরোধ-শূন্য ছিল না। শাসক শ্রেণীসমূহ অর্থাৎ রাজা, সামন্ত-প্রভু ও ধর্মযাজক এদের মধ্যে যেমনি নিরন্তর ক্ষমতার অন্তর্বিরোধ চলত, তেমনি সমগ্র শাসক শোষকদের বিরুদ্ধে শোষিত কৃষক সমাজের বিদ্রোহের প্রয়াস সামন্ত সমাজের ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।

Feuerbach, Ludwig: লুডউইগ ফয়েরবাক (১৮০৪-৭২ খ্রি.)
জার্মানির বস্তুবাদী দার্শনিক। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু তাঁর বস্তুবাদী চিন্তাধারার জন্য ১৮৩০ সালে ফয়েরবাককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হয়। হেগেলের ভাববাদের সমালোচনা এবং ধর্মের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার জন্য ফয়েরবাক এঙ্গেলস, মার্কস এবং সমসাময়িক অন্যান্য বস্তুবাদী চিন্তাবিদদের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেন। ফয়েরবাকের চিন্তাদারা এবং রচনাসমূহের বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশের বিশ্লেষণ করে ভাববাদের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক প্রমাণ করেন। হেগেলের দ্বান্দ্বিকতার মূল চরিত্র যে ভাববাদ তাও ফয়েরবাক বিশ্লেষণ করে দেখান। জ্ঞানতত্ত্বে তিনি অজ্ঞেয়বাদের বিরোধিতা করেন। জ্ঞানের উৎস হচ্ছে অভিজ্ঞতা এবং ইন্দ্রিয়ানুভূতি। কিন্তু অভিজ্ঞতা ও ইন্দ্রিয়ানুভূতির উপর গুরুত্ব আরোপ করতে যেয়ে তিনি জ্ঞানের ক্ষেত্রে মনের ভূমিকা অস্বীকার করেন নি। মানুষের জ্ঞান ও চেতনা কেবল ব্যক্তিক নয়। ফয়েরবাক মনে করতেন জ্ঞান এবং জ্ঞাতা, বিষয় ও বিষয়ীর পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতেই জ্ঞানের উদ্ভব। কাজেই জ্ঞান হচ্ছে সামাজিক প্রক্রিয়া। কিন্তু মার্কস এবং এঙ্গেলস-এর মতে ফয়েরবাক উনিশ শতকের বস্তুবাদীদের পথিকৃৎ হলেও তাঁর চিন্তাধারার সীমাবদ্ধতা ছিল। ইতিহাস ও সমাজের মধ্যে তিনি যেমন ধর্মের উৎপত্তি নির্দেশ করে সমাজবিজ্ঞানীদের ভূমিকা পালন করেছেন, তেমনি আবার ধর্মকে মানুষের অচেতন আত্মচেতনার প্রকাশ বা নিজের চরিত্রের বাস্তব রূপায়ন বলে তিনি ধর্মের ভাববাদী ব্যাখ্যার রহস্যে নিজেকে আবদ্ধ রেখেছেন। মানুষের নীতিরোধকেও তাই তিনি বাস্তব পরিবেশ ও সমাজনির্দিষ্ট বিষয়ের চেয়ে মানুষের চিরন্তন সুখান্বেষী স্বভাবের পক্রাশ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ফয়েরবাক নিঃসন্দেহে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের সাক্ষাৎ পূর্বগামীদের অন্যতম ছিলেন।

Fichte: ফিকটে (১৭৬২-১৮১৪ খ্রি.)
জার্মান ভাববাদী দর্শনে কাণ্টের পরেই ফিক্টের স্থান। জার্মান ভাববাদী দর্শনে কাণ্টের পরেই ফিক্টের স্থান। দরিদ্র ঘরের সন্তান ফিক্টে কিশোর বয়স থেকেই অসাধারণ বুদ্ধির পরিচয় দেন। তাঁর জীবনে প্রথম খ্যাতি আসে আকস্মিকভাবে। ১৭৯০ সালে কাণ্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তিনি বেনামীতে কাণ্টীয় দর্শনের ব্যাখ্যামূলক একটি প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলে বুদ্ধিজীবী মহল একে কাণ্টের নিজের রচনা বলে মনে করেন। কিন্তু কাণ্ট বললেন, এ লেখা তাঁর নয়। প্রবন্ধের লেখকের নাম প্রকাশিত হলে লেখক ফিক্টে জার্মানির সাহিত্যিক ও দার্শনিক মহলে প্রখ্যাত হয়ে পড়েন। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়। ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারা, বিশেষ করে বুদ্ধির মুক্তির জোয়ার ফিক্টেকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। মানুষের চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা জন্মগত। এই অভিমত প্রচার করে ফিক্টে দুখানি পুস্তিকা লেখেন। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর বয়স যখন মাত্র ৩১ বৎসর, তখন ফিক্টে জেনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিবাগের অধ্যক্ষ নিয়োজিত হন। কিন্তু ছাত্র এবং তরুণদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা এবং ধর্মের নীতিগত ব্যাখ্যার কারণে ফিক্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হয়ে দর্শন বিভাগ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কাণ্টের পরবর্তীকালে ফিক্টের দর্শনের গভীরতাই উনিশ শতকের গোড়ায় ইউরোপে জার্মানীকে দর্শনের বিশিষ্ট কেন্দ্রে পরিণত করে। ফিক্টে ভাববাদী হলেও তিনি কাণ্টের দর্শনের অন্তর্নিহিত অসামঞ্জস্যের সমালোচনা করেন। কাণ্ট তাঁর দর্শনকে বুদ্ধি, বিচার এবং নীতি এই তিন ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। ফিক্টে সমালোচনা করে বলেন, কাণ্টের বিভাগগুলি পরস্পর বিচ্ছিন্ন। ফিক্টের মতে দর্শনের এরূপ বিভাগ অসঙ্গত। দর্শন হচ্ছে অবিভাজ্য এক সত্তা। মানুষের বুদ্ধি, বিচার এবং নীতি সবই সেই অবিভাজ্য সত্তারই প্রকাশ। কাণ্টের সত্তার সত্তা বা ‘থিং ইন ইটসেলফ’-এর তত্ত্বকে তিনি অস্বীকার করেন। মানুষের জীবনের নিয়ামত অবাস্তব চিন্তা নয়, বাস্তব কর্মই মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। মানুষের বাস্তব কর্ম নির্দিষ্ট হবে মানুসের নীতিবোধ দ্বারা। জ্ঞানের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ভিত্তিতেই মানুষ বাস্তব জীবন যাপন করবে। সত্তার প্রকাশ এবং অপ্রকাশ এ দুই-এর মধ্যে কোনো বিরোধ থাকতে পারে না। আসলে এরূপ দ্বৈত অস্তিত্বের কোনো সত্তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। ফিক্টের ভাববাদকে আত্ম-ভাববাদ বলা চলে। চরম আত্মাই সব সৃষ্টির মূল। চেতনার চরম নৈতিক উপলব্ধি হচ্ছে চরম আত্মা। ব্যক্তিক আত্মা চরম আত্মার অনুকূল। ফিক্টের নীতি-দর্শনের একটি মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ব্যক্তির স্বাধীনতার সমস্যা। ফিক্টে মনে করতেন, ব্যক্তি স্বাধীন বলতে এ কথা বুঝায় না যে ব্যক্তি আদৌ কোনো বিধানের অনিবার্যতার উপলব্ধিতেই ব্যক্তির স্বাধীনতা নিহিত। ইতিহাসের কোনো বিশেষ যুগে ব্যক্তির স্বাধীনতা ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে যুগের বাস্তব অবস্থার উপর। ফিক্টের মধ্যে জার্মান ধনতন্ত্রবাদের বিকাশের বৈপরীত্যগুলির প্রকাশ দেখা যায়। বুদ্ধির মুক্তি এবং বাস্তব জীবনের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে তিনি অগ্রসর চিন্তাবিদ। কিন্তু বিশ্বজগতের ব্যাখ্যায় তিনি ভাববাদের সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ।

Fideism: বিশ্বাসবাদ
যুক্তি নয়, বিশ্বাস দ্বারাই মানুষ চরম সত্যকে লাভ করতে পারে, এই মতকে বিশ্বাসবাদ বলা হয়। শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়, দর্শনের ক্ষেত্রেও বিশ্বাসবাদের প্রকাশ দেখা যায়। বিশেষ করে ভাববাদী দর্শনের মৌলিক কোনো প্রশ্নের সমাধানে পরিণামে বিশ্বাসের আশ্রয় গ্রহণ একটি সাধারণ সত্য। ধর্মীয় বিশ্বাসেরও কিছু রকম-ভেদ দেখা যায়। এর একটি প্রকাশকে চরম বিশ্বাস বলা যায়। চরম বিশ্বাস যুক্তিবিরোধী। চরম বিশ্বাস বিজ্ঞানের সার্থকতা অস্বীকার করে। এজন্য চরম বিশ্বাসবাদ যুক্তিবিরোধী। অস্তিত্ববাদী দর্শনের বিশ্বাসবাদী কিয়ের্কেগার্ড এবং অন্যান্য দার্শনিক অ-যুক্তি বা যুক্তির ঊর্ধ্বে কোনো মাধ্যমকে চরম জ্ঞানের উপায় বলে মনে করেন। এঁদের একটি কথা আছে ‘যা অবিশ্বাস্য তাকেই আমি বিশ্বাস করি’। এর অর্থ, বিশ্বাস্য হচ্ছে সাধারণ। অবিশ্বাস্য হচ্ছে অসাধারণ। আর অসাধারণের মধ্যেই সত্য, সাধারণের মধ্যে নয়। কিন্তু সেন্ট অগাস্টিনের ন্যায় ধর্মীয় দার্শনিকগণ যুক্তির তাৎপর্য পুরাপুরি অস্বীকার করেন না। এ জন্য তাঁদের মতকে নরমপন্থী বিশ্বাসবাদ বলা হয়। সেণ্ট অগাস্টিন বলতেন, বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে আমরা সত্যের অনুসন্ধান শুরু করি। কিন্তু অনুসন্ধানের শেষে দেখতে পাই যে, কেবল যক্তিতে চরম সত্য লাভ সম্ভব নয়। বিশ্বাসেই চরম সত্য লাভ করা যায়। দর্শনের বিশ্বাসবাদ সাক্ষাৎভাবে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত না হতে পারে।
অজ্ঞেয়বাদী হিউম বলতেন মানুষ বস্তু, কার্যকারণ, স্থানকাল কোনো কিছুর অস্তিত্বই জানতে পারে না। মানুষ কেবল বিশ্বাস করে যে, এসব সত্যের অস্তিত্ব আছে। জর্জ সান্তায়ানা মনে করতেন যে, মানুষের অস্তিত্বের মূল বিশ্বাস তা না যুক্তিগত, না ধর্মীয়। কতকগুলি মৌলিক জান্তব বিশ্বাস বা ধারণার উপর মানুষ জীবনযাপন করে।
বার্ট্রাণ্ড রাসেল মনে করতেন যে, বিশ্বাসই পুরোপুরি করা মানুষের অসাধ্য। বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণাগুলি ভিত্তিও বিশ্বাস, যুক্তিগত প্রমাণ নয়। দ্বন্দ্বমূলক বা বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ বিশ্বাসকে অস্বীকার করে না সত্য। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে বিশ্বাস হচ্ছে জ্ঞানের সদা বিকাশমান প্রক্রিয়ার একটি প্রয়োজনীয় শর্ত। কিন্তু তাই বলে যুক্তি এবং বাস্তব অনুসন্ধানের বাইরে জ্ঞান লাভের বিশ্বাসরূপ কোনো অনন্যনির্ভর মাধ্যম থাককে পারে না। অভিজ্ঞতা-ঊর্ধ্ব বিশ্বাস আকর, জ্ঞানলাভের কোনো মাধ্যম নয়।

Filmer, Robert: রবার্ট ফিলমার (১৫৮৯-১৬৫৩ খ্রি.)
সপ্তদশ শতকের ইংল্যাণ্ডের একজন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। রবার্ট ফিলমার অবশ্য অধিক খ্যাতিলাভ করেন তাঁর মৃত্যুর পর। ১৬৪৯-এর গৃহযুদ্ধে পার্লামেন্ট-পক্ষের বিজয় এবং রাজার বিচার ও রাচার শিরচ্ছেদ ঘটলেও ক্রমওয়েলের পার্লামেন্টীয় শাসনের পরে ইংল্যাণ্ডে পুনরায় রাজতন্ত্রের প্রবর্তন ঘটে। সেই সময়কার ইংল্যাণ্ডে রাজা বনাম পার্লামেন্টের বিতর্কের সঙ্গে ধর্মের ক্ষেত্রে ক্যাথলিক বনাব প্রটেস্ট্যান্টবাদও একটি বড় রকমের আলোড়নকারী বিতর্ক ছিল। ইংল্যাণ্ডের কোনো রাজা প্রটেস্ট্যান্টবাদও একটি বড় রকমের আলোড়নকারী বিতর্ক ছিল। ইংল্যাণ্ডের কোনো রাজা ক্যাথলিকবাদী হতে পারবে না –নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা একটি সামাজিক ধর্মীয় বিধান বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু দ্বীতিয় র্চাসের আসন্ন মৃত্যুর কালে সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে এই বিতর্ক পুনরায় জাগরিত হয়। তা ছাড়া গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত পার্লামেণ্টের ক্ষমতাকে ‘অস্বীকার করে ইংল্যাণ্ডের রাজা যখন নিজস্ব ক্ষমতা ব্যবহার করার প্রবণতা দেখাতে পুনরায় শুরু করে তখন সে সার্বভৌম: রাজা, না পার্লামেণ্ট তথা জনসাধারণের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান, এই প্রশ্ন রাজনৈতিক বিতর্কে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। এ সময়ে আবার একপক্ষ রাজতন্ত্র তথা রাজার সার্বভৌমত্বের উপর যুক্তি প্রদর্শন করতে থাকে। অপর পক্ষ জনসাধারনের সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব উপস্থিত করে। রবার্ট ফিলমামেরর খ্যাতি তখন এই কারণে ঘটে যে তিনি তাঁর জীবিতকালে ‘প্যাটরিয়ারকা’ বা ‘ন্যাচারাল পাওয়ার অব কিংস’ –অর্থাৎ রাজার ক্ষমতার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে যে পুস্তক রজার পক্ষীয়গণ তাঁর মৃত্যুর ত্রিশ বৎসর পরে ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশ করে। এই গ্রন্থে ফিলমার একদিকে যেমন ধর্মীয় যুক্তিতে আদমকে ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রথম রাজা এবং আদমের পুত্র হিসাবে পার্থিব রাজাকে ঈশ্বরসৃষ্ট রাজারই উত্তরাধিকরকারীরূপে সার্বভৌম বলে মত প্রকাশ করেন, তেমনি জনসাধারনের সার্বভৌমত্বকে যাঁরা প্রকৃতির বিদান এবং সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে সমর্থন করে, তাঁদের যুক্তিকে বেশ জোরের সঙ্গে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছিলেন। ফিলমানের মতে ‘জনসাধারণ’ কথাটাই বাস্তবতাহীন। জনসাধারনের কোনোকালে চুক্তি করে সম্মতি জানিয়ে রাষ্ট্র এবং রাজা তৈরি করেছিল –এটা না ঐতিহাসিক, না যুক্তিভিত্তিক। জনসাধারণ আসলে ‘মুণ্ডবিহীন এবং সংখ্যা ব্যততি’ আর কিছু নয়। তাঁর কথায় ‘হেডলেস মালটিচুড’। জন লক তাঁর ঐতিহাসিক ‘টু প্রিটিজেস অব সিভিল গভর্নমেন্ট’ –নামক গ্রন্থে রবার্ট ফিলমারের যুক্তিকে খণ্ডন করেন। রাজনৈতিক এ সকল বিতর্কের একটি বাস্তব সমাধান ঘটে ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যাণ্ডের পার্লমেন্ট কর্তৃক রাজার শাসনের শর্তাবলী নির্ধারণপূর্বক পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব ঘোষণার মাধ্যমে।

Form and Content: আকার ও বস্তু; আধেয় ও আধার
কোনো বস্তু বা অস্তিত্বের সামগ্রিক চরিত্র উপলব্ধির সূত্র। আধেয় বলতে কোনো অস্তিত্বের অন্তর্গত বস্তুপুঞ্জকে বুঝায়। আধার বলতে আধেয়র অন্তর্গত বস্তুপুঞ্জের পারস্পরিক সম্পর্কের সামগ্রিক রূপকে বুঝায়। একটি টেবিলের বস্তুর বা আধেয় বলতে টেবিলটা যা দিয়ে তৈরি আমরা তাকে বুঝি। টেবিলের আধার বা আকার বলতে বস্তুর সাংগঠনিক রূপ বুঝি। আকার ও বস্তুর পারস্পরিক সম্পর্ক একটি দার্শনিক প্রশ্ন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে আকার ও বস্তুর পারস্পরিক সম্পর্ক হচ্ছে দ্বন্দ্বমূলক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক। এই দর্শন অনুযায়ী আকার ও বস্তুর মধ্যকার দ্বন্দ্বের মূল হচ্ছে অস্তিত্বের বিকাশে আকার ও বস্তুর ভূমিকার পার্থক্য। বস্তুই হচ্ছে বিকাশের মূল। আকার হচ্ছে বস্তুর অস্তিত্বের সাংগঠনিক রূপ। ভাববাদী দর্শনে আকারকে বস্তুনিরপেক্ষ শক্তি বলে মনে করা হয়। প্লেটো, কাণ্ট প্রমুখ বিশিষ্ট ভাববাদী দার্শনিকের মতে বস্তু হচ্ছে আকারের প্রকাশ। বস্তুর পরিবর্তন বা বিকাশও তাই আকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই দর্শনে আকরই মূল, বস্তু নয়। চরম আকার অদৃশ্য এবং অজ্ঞেয়। কিন্তু দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ মনে করে যে, বস্তুর নিজস্ব গতি আছে। আকার বস্তুর বিকাশে প্রায় ক্ষেত্রে সহায়ক না হয়ে প্রতিবন্ধক শক্তি হিসাবে কাজ করে। বস্তুর আভ্যন্তরিক পরিবর্তনের ফলেই তার আকারের পরিবর্তন ঘটে। সমাজের বিকাশের ক্ষেত্রে বস্তু ও আকারের এই বিরোধাত্মক সম্পর্কের উত্তম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। সমাজের মানুষ, হাতিয়ার, যন্ত্রপাতি, সম্পদ হচ্ছে সমাজের বস্তু। সমাজের আকার হচ্ছে উৎপাদনের উপায়ের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে প্রতিষ্ঠিত সম্পর্ক। সমাজের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সামাজিক বস্তুর পরিবর্তনে আকার এক সময়ে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। আবার বস্তু পরিবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আকারে পরিবর্তন ঘটে না। পুরাতন আকারের রেশ কিছুকাল চলতে থাকে। কিন্তু পুরাতন আকার স্থায়ীভাবে টিকে থাকতে পারে না। বস্তুর পরিবর্তনের আকারও পরিশেষে পরিবর্তিত হয়ে যায়।

Fourier: ফোরিয়ার (১৭৭২-১৮৩৭ খ্রি.)
ফ্রাঙ্কো-ম্যারি-চার্লস ফোরয়ান ছিলেন বিখ্যাত ফরাসি কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদী। ফোরিয়ার একটি অর্থবান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং পিতার মৃত্যুর পরে নিজে যথেষ্ট অর্থের মালিকও হ। কিন্তু পরিবর্তীকালে রাজনৈতিক গণ্ডগোলে তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি বিনষ্ট হয়। ফোরিয়ার প্রথমে সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেন। পরে তিনি একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী হিসাবে নিযুক্ত হয়ে নিজের জীবিকানির্বাহ করেন। সমাজ সম্পর্কে তাঁর প্রথম বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ ১৮০৮ সনে প্রকাশিত হয়। একদিকে ফরাসি বিপ্লবের সাম্যমৈত্রীয় আদর্শ, অপর দিকে ধনতন্ত্রের বাস্তব জীবনে শোষক শোষিতের ব্যবধা ফোরিয়ারকে সমাজের এই বৈপরিত্যের বিশ্লেষণে উদ্ধুদ্ধ করে। ফোরিয়ার অত্যন্ত প্রাহ্জলভাবে সমাজের এক শ্রেণীর সম্পদ এবং অপর শ্রেণীর দারিদ্র্যের চিত্র অঙ্কন করেন। এই অসঙ্গতি তাঁকে সমাজতান্ত্রিক চিন্তার পথে নিয়ে যায়। এই বৈষম্যের কারণ কি? মানুষ কি স্বভাবগতভাবে কেউ শোষক এবং কেউ শোষিত হবে? এ প্রশ্নের জবাবে ফোরিয়ার ফরাসি বস্তুবাদীদের দর্শনকে সমর্থন করে বলেন যে, মানুষ স্বভাবগতভাবে শোষবক বা শোষিত নয়। মানুষের কোনো প্রবৃত্তিই তার মনজাত নয় –তা তার সমাজ বা পরিবেশজাত। যে চরিত্র অধিকাংশ মানুষের জন্য অমঙ্গলকর তা দূরীকরণের উপায় হচ্ছে বাস্তব পরিবেশকে পরিবর্তন করা। সুখ কিংবা স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করার ইচ্ছা মানুষমাত্রেরই স্বাভাবিক। প্রয়োজন হচ্ছে এমন এক সমাজ সৃষ্টির যে সমাজে প্রত্যেক মানুষের স্বাভাবিক ইচ্ছা চরিতার্থ হতে পারবে। ফোরিয়ারের মতে এ সমাজ সৃষ্টিতে বিপ্লব বা জবরদস্তির কোনো প্রয়োজন নেই। এজন্য আবশ্যক মানুষের বৃহৎ সমাজকে স্বল্পসংখ্যক (চারশত পরিবারের) উৎপাদনশীল কতকগুলি ফ্যালাঞ্জ বা বাহিনীতে বিভক্ত করা। ফোরিয়ারের মতে এরূপ স্বল্পায়তন একই ভবিষ্যৎ সমাজের মূল কোষ হিসাবে কাজ করবে। ফ্যালাঞ্জ-এর সদস্যরা গৃহের ন্যায় স্বাধীনভাবে পরিশ্রম করবে। পরিশ্রমের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা থাকবে না এবং শ্রমের বিভাগও এই ফ্যালাঞ্জ সমাজে এরূপ হবে না যে, একজন উৎপাদক উৎপাদিত দ্রব্যের মাত্র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের সঙ্গে জড়িত থাকবে। আধুনিক শিল্পোৎপাদনের এই চরম শ্রমবিভাগ শ্রমকে অর্থহীন একঘেঁয়েমিপূর্ণ যাতনাকর দৈহিক শ্রমে পর্যবসিত করেছে। পরিকল্পিত সমাজে একজন শ্রমিক শুধু এক রকম নয়, সব রকম উৎপাদনের সঙ্গেই জড়িত থাকবে। ফ্যালাঞ্জ-এর সদস্যদের দৈনন্দিন শ্রম এরূপভাবে সংগঠিত হবে যাতে একজন শ্রমিক একটা নির্দিষ্ট সময় (দেড় ঘণ্টা থেকে দুঘণ্টা) একটা নির্দিষ্ট কাজে নিযুক্ত থাকার পরে ভিন্নতর কাজে নিযুক্ত হবে। এভাবে সংকীর্ণ পেশাদারী চরিত্র কারুর মধ্যে জন্মলাভ করতে পারবে না। সবাই উৎপাদনের সামগ্রিকরূপের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে। এভাবে ফ্যালাঞ্জ-এর উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ফ্যালাঞ্জ-এর সম্পদে প্রাচুর্য আসবে। উৎপাদিত সম্পদ ফ্যালাঞ্জ-এর সদস্যদের মধ্যে তাদের নিজ নিজ দক্ষতা এবং শ্রমের ভিত্তিতে বণ্টিত হবে। ফোরিয়ার শহর এবং গ্রাম এবং দৈহিক শ্রম এবং মানসিক শ্রমের মধ্যকার পুঁজিবাদী সমাজের বিরোধ দূর করার প্রয়োজনের উপরও জোর দিয়েছিলেন। ফোরিয়ারের এসব মানবতাবাদী কল্পনার মহত্ত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ পরিবর্তনে শ্রমিক শ্রেণী যে অগ্রসর ভূমিকা পালন করবে –এ সত্যকে তিনি উপলব্ধি করতে পারেন নি। অন্যান্য কল্পনাবাদী সমাজতান্ত্রিকের মত ফোরিয়ারও পুঁজিবাদীদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ প্রচারের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করতেন।

Freedom and Necessity: স্বাধীনতা ও অনিবার্যতা, নিয়মাধীনতা
মানুষের ক্রিয়াকর্ম এবং সমাজ ও প্রকৃতির বিধানের মধ্যকার সম্পর্কের সমস্যাসূচক দার্শনিক ধারণা। মানুষ তার কর্মের ক্ষেত্রে কি স্বাধীন, না প্রকৃতি ও সমাজের বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? মানুষ স্বাধীন না নিয়মের দাস? স্বাধীনতার অর্থ কি? নিয়ম-নিরপেক্ষ কোনো স্বাধীনতার অস্তিত্ব কি সম্ভব? এই প্রশ্নগুলি দর্শনে বিশেষ আলোচিত প্রশ্ন। ভাববাদী দর্শনে স্বাধীনতা ও নিয়মাধীনতা বা অনিবার্যতাকে পরস্পর-বিরোধী ধারণা বলে মনে করা হয়। এই দর্শনের মতে স্বাধীণতা হচ্ছে আত্মা বা ইচ্ছার স্বাধীনতা। এ স্বাধীণতার সঙ্গে আত্মার বহির্গত কোনো অবস্থা বা বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। মানুষের আত্মা বা ইচ্ছা হচ্ছে চরম আত্মা বা চরম ইচ্ছার প্রকাশ। চরম আত্মা চরমভাবে স্বাধীন। ব্যক্তির মধ্যেতার প্রকাশও পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। কারণ মানুষের ইচ্ছা যদি পরিবেশের অধীন হয়, তা হলে মানুষের উপর কোনো কাজের নৈতিক দায়িত্ব আরোপ করা চলে না। মানুষ ইচ্ছার ক্ষেত্রে স্বাধীন বলেই তার কাজের নীতিগত বিচার সম্ভব। কাজেই মানুষের স্বাধীনতার কোনো নিয়ন্ত্রণ হতে পারে না। এই নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতার একেবারে বিপরীত প্রান্তের মত হচ্ছে যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণবাদ। যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণবাদের মতে, মানুষের স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকতে পারে না। মানষ হচ্ছে প্রাকৃতিক বিধানের দাস। তার প্রতিটি আচরণ ও তার কাজ অনিবার্যভাবে এই বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ দর্শনে তাই মানুষ প্রাকৃতিক বিধানের অসহায় ক্রীড়নক বৈ আর কিচু নয়। কিন্তু ভাববাদী স্বাধীনতা আর যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রনবাদ উভয়ই স্বাধীণতা ও নিয়মাধীনতা বা অনিবার্যতার অবৈজ্ঞানিক একতরফা ব্যাখ্যা। স্বাধীণতা ও নিয়মাধীনতা পরস্পর সম্পর্কিত সত্য। উভয়ের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক উপলব্ধির মধ্যেই এদের যথার্থ চরিত্র বোঝা সম্ভব। এই সম্পর্ক উপলব্ধির প্রথম প্রয়াস দেখা যায় স্পিনোজার দর্শনে। তিনি কোনো বিধান বা অবস্থার অপরিহার্যতার উপলব্ধিকে ব্যক্তির স্বাধীনতা বলে অভিহিত করেছেন। মানুষ মাধ্যাকর্ষণের অধীন। মানুষ এমন কোনো স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে না, যে স্বাধীনতায় সে মাধ্যাকর্ষণের অধীন তখনি মাত্র সে মাধ্যাকর্ষণের অধীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহারে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে, মাধ্যাকর্ষণকে অতিক্রম বা নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি সে অর্জন করতে পারে। কাজেই জ্ঞানের ক্ষেত্রে বাস্তব বিধানের অপরিহার্যতার কারণ সচেতনভাবে উপলব্ধির মধ্যেই মানুষের স্বাধীনত নিহিত। মানুষ প্রকৃতির পরিপূর্ণ দাস ছিল সেই আদিম যুগে, যখন সে প্রকৃতির রহস্য উদঘাটন করতে অক্ষম ছিল। তখন সে প্রকৃতির বিধানকে জানত না। আজ মানুষ ক্রমাধিক পরিমাণে প্রকৃতির প্রভু হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রকৃতির বিধানকে লঙ্ঘন করে নয়, প্রকৃতির বিধান সম্যকভাবে জ্ঞান হওয়ার মাধ্যমেই। বিধানহীন চরম স্বাধীনতা বলে মানুষের কিছু থাকতে পারে না। আবার বস্তুজগতের সে অসহায় ক্রীড়নকও নয়। মানুষ বস্তু, জগৎ ও সমাজের বিধান যত জ্ঞাত হতে পারে, বস্তু, জগৎ ও সমাজকে পরিবর্তন করার স্বাধীনতাও সে তত অর্জন করতে পারে।

French Revolution: ফরাসি বিপ্লব
Paris Commune: প্যারিসের কমিউন শ্রমিকদের বিপ্লবী ব্যবস্থা। কিন্তু শাসকশ্রেণীর আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়েছিল। ১৫ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত প্যারিস কম্যুনের অস্তিত্ব ছিল। তথাপি শ্রমিকদের বিপ্লবী ক্ষমতা দখল হিসাবে ‘প্যারিস কম্যুনকে’ মূল্যবান বলে গণ্য করা হয়।

Freud, Sigmund: সিগমাণ্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯ খ্রি.)
সিগমাণ্ড ফ্রয়েড মনোসমীক্ষণের প্রবক্তারূপে মনোবিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাত। অস্ট্রিয়ার মোরাভিয়াতে ফ্রয়েডের জন্ম। অধ্যয়নজীবনে আইন থেকে বিজ্ঞান এবং পরবর্তীকালে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে আত্মনিয়োগ করেন। ১৮৮৪ সনে ফ্রয়েড ভিয়েনার হাসপাতালে চিকিৎসক হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৮৮৫ সনে ফ্রয়েড ফরাসি স্নায়ুতন্ত্রবিদ চারকটের সংযোগে আসেন। চারকট মনে করতেন মৃগীরোগের মূলে মানসিক কারণ নিতিহ। চারকটের নিকট থেকে মনোসমীক্ষার আগ্রহ নিয়ে ফ্রয়েড ভিয়েনায় প্রত্যাবর্তন করেন। ১৮৯৩ সালে ফ্রয়েড ব্রুয়ারের সহযোগিতায় ‘স্টাডিয়েন উবার হিস্টোরি’ নামক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে তিনি এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, হিপনোসিস বা সংবেশনের মাধ্যমে রোগীর অচেতন মনের অবদমিত ভাবকে অর্গলমুক্ত করে মৃগীরোগীকে রোগমুক্ত করা সম্ভব। কিন্তু এমন চিকিৎসার ফল তেমন স্থায়ী হয় না দেখে ফ্রয়েড পরবর্তীকালে হিপনোসিস বা সংবেশন পদ্ধতি পরিত্যাগ করেন। এর পরে তিনি এককভাবে তাঁর মনোসমীক্ষণের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তাঁর স্বপ্নের তত্ত্বও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ফ্রয়েপ মনে করতেন স্বপ্নের মধ্যে অচেতন জগতে অবদমিত বাসনা আত্মপ্রকাশ করে। কাজেই স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে মানসিক রোগের কারণ নির্ণয় করা সম্ভব। মনোবিজ্ঞানে ফ্রয়েডের প্রধান অবদান হচ্ছে তাঁর ‘আনকনসাস’ বা অচেতন মনের ব্যাখ্যা (দ্র. Unconscious অচেতন)। ফ্রয়েডের অচেতনকে ‘ইড’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ‘ইড’ হচ্ছে ব্যক্তির রোগ নিরপেক্ষভাবে হতে পারে এই তত্ত্বই যে ফ্রয়েড প্রবর্তন করেন, তাই নয়। তিনি আরো বলেন, সকল মানসিক রোগের মূলে আছে যৌনকামনা বা প্রবৃত্তির অবদমন। যৌনাবেগ হচ্ছে মানুষের জীবনের মূল আবেগ। কিন্তু সমাজের এই আবেগের স্বতঃস্ফুর্ত পূরণ সম্ভব নয়। বিভিন্নভাবে যৌন আবেগ ও ইচছাকে অবদমিত করা হয়। এই অবদমিত ইচ্ছা নিয়ে মনের বৃহত্তর এবং অচেতন ভাগের সংগঠন। অবদমিত ইচ্ছার আত্মপ্রকাশ এবং আত্মতৃপ্তি লাভের চেষ্টা এবং সচেতন মন বিবেক বা সেন্সরের প্রহরা ও প্রতিরোধ চেষ্টায় ব্যক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের উদ্ভব ঘটে। দ্বন্দ্বের তীব্রতায় ব্যক্তির মানসিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে মানসিক রোগের সৃষ্টি করে। ফ্রয়েড ১৮৮৯ সালে ঘোষণা করেন, যৌনানুভূতি কেবল যে মৌলিক অনুভূতি তাই নয়। সাধারণভা মনে করা হয় যে, যৌনানুভূতি কেবল যে মৌলিক অনুভূতি তাই নয়। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, যৌনানুভূতি বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে ব্যক্তির মধ্যে জন্ম লাভ করে এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু ফ্রয়েড বলেন, বয়ঃপ্রাপ্তিতে নয়, ব্যক্তির জন্ম থেকেই যৌনানুভূতির জন্ম। ফ্রয়েডের তত্ত্বের অভিনবত্ব সমকালীন চিন্তার ক্ষেত্রে আলোড়ন এবং প্রতিবাদের সৃষ্টি করে। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, ফ্রয়েডের পূর্বে মনের এরূপ গভীর বিশ্লেষণ আর কেউ করেন নি। তাছাড়া যৌনানুভূতি যে ব্যক্তি চরিত্রের একটি শক্তিশালী নিয়ামক তা আজ সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। কিন্তু ফ্রয়েড তাঁর এই তত্ত্বে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে যৌন অনুভূতিকে সব বিকারের একমাত্র কারণ বলে নির্দিষ্ট করার যে প্রবণতা দেখিয়েছেন তাকে গ্রাহ্য বলে অনেকে মনে করেন না। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ফ্রয়েড তাঁর তত্ত্বের অভিনবত্বে কিছুটা বিমোহিত হয়ে কল্পনাবাদীতে পরিণত হয়েছেন। মানসিক রোগের কারণকে তিনি ব্যক্তির দেহ এবং সামাজিক পরিবেশ বিচ্ছিন্নভাবে নির্দিষ্ট করার প্রয়াস পেয়েছেন। ফলে মানসিক রোগ নিরাময়ের সমাজ বিচ্ছিন্ন যে পদ্ধতির তিনি আবিস্কার করেছেন তা দ্বন্দ্ব সংঘাতময় সমাজে অসহায় ব্যক্তির মানসিক বিকারের নিরসনে খুব কার্যকর কোনো ভূমিকা পালনে সক্ষম হয় নি।
১৯০৩ সালে তিনি ভিয়েতনাতে ‘মনোসমীক্ষণবিদ চক্র’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৬ সালের মধ্যে বিভিন্ন দেশে এই সংগঠনের শাখা প্রসার লাভ করে। তাঁর উদ্যোগে ১৯০৮ সালে সুইজারল্যাণ্ডের সালজবার্গে বিকৃতি নিবারণের উদ্দেশ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক মনোসমীক্ষণ সমিতি অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৬ সালে ফ্রয়েডের আত্মজীবনীমূলক রচনা প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮ সালে ফ্যাসিস্ট হিটলারের বাহিনী ভিয়েনা দখল করার পরে নিরাপত্তার জন্য লণ্ডনে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং ১৯৩৯ সনে লণ্ডনেই মারা যান।

Futurism: ভবিষ্যবাদ
১৯০৯-১১ সালে ইতালির কবি মারিনেতী (১৮৭৬-১৯৪৪) শিল্প এবং সাহিত্যে ‘যন্ত্রই সব’ এরূপ একটি নতুন ধারা প্রবর্তনের চেষ্টা করেন। মারিনেতী তাঁর ‘মেফেস্টি দাল ফিউচারিজমো’ নামক গ্রন্থে ঘোষণা করেন: ‘যন্ত্রই আমাদের অরাধ্য। যন্ত্রকে আমরা শীর্ষে স্থাপন করব। আমরা যন্ত্রের গুণ কীর্তন করব’। শিল্পবোধে নতুনত্ব আমদানি করে মারিনেতী বলেনঃ একটা বিদ্যুৎগতি মোটর গাড়ি একটি তথাকথিত সুন্দর ভাস্কর মূর্তির চেয়ে আমাদের নিকট অনেক বেশী সুন্দর। ১৯১১ সালে মারিনেতী ইতালির পাঁচজন তরুণ শিল্পীর একটি চিত্রপ্রদর্শনী সংগঠিত করেন। এই শিল্পীগণ তাঁদের ঘোষণাপত্রে নিজেদের বিপ্লবী ঘোষণা করে বলেন যে, প্রতিষ্ঠিত শিল্পবোধের তাঁরা বিরোধী। ‘আমরা গতির শিল্পী। গতিকে আমরা মূর্ত করে তলব। চিত্রকলা আর ইন্দ্রিয়ানুভূতি আচ্ছেদ্য। একটি খণ্ডকে অঙ্কন করা যথেষ্ট নয়। যেটা আবশ্যক সে হচ্ছে সেই বস্তুর মধ্যে যে গতি আছে তাকে অঙ্কন করা’। কবি মারিনেতীর এ ধারাটি খুব দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। কিন্তু স্বল্পকাল স্থায়ী এই ধারাটির মধ্যে অতীতের বিরুদ্ধে একটা প্রতিক্রিয়ার এবং আধুনিক যন্ত্র-সভ্যতার যন্ত্রশক্তির অনিবার্য প্রভাবের সচেতন স্বীকৃতির একটা প্রয়াস দেখা যায়। ভবিষ্যবাদের আর একটি দিক আছে। যন্ত্রকে একমাত্র আরাধ্য করার মধ্যে এই যন্ত্রের সত্যকার স্রষ্টা যে শ্রমজীবী মানুষ তার গুরুত্বের যেমন স্বীকৃতি নেই, তেমনি এই শ্রমজীবী মানুষের যে দুর্দশা যন্ত্র দ্বরাই অনড় করে রাখার সুকৌশল চেষ্টা চরছে তার উপলব্ধির সাক্ষাৎও ভবিষ্যবাদের প্রবক্তাদের চিন্তায় পাওয়া যায় না। বস্তুত ভবিষ্যবাদ প্রকারান্তরে পুঁজিবাদের সৃষ্টি যান্ত্রিক শক্তিবাদের পরিপোষক।

G
Galaxy: ছায়াপথ
সূর্যসহ জ্যোতির্মণ্ডলের দশ হাজার কোটি তারকার সমবায়ে গঠিত জগৎকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ ছায়াপথ বলে অভিহিত করেন। ছায়াপত হচ্ছে তারকারাজি ও নীহারিকার পারস্পরিক আকর্ষণের ভিত্তিতে গঠিত ঘুর্ণ্যমান এক জটিল মণ্ডল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটা ছায়াপথের পরিধি আলোক বৎসরের হিসাবে পরিমাপ করেন। সেকেণ্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল গতিসম্পন্ন আলো এক বৎসরে যতটা পথ অতিক্রম করতে পারে, তাকে আলোক বৎসর বলা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ মনে করে যে, একটা ছায়াপথের পরিধি এমনি একশ হাজার বা একলক্ষ আলোক বৎসরের পরিমাণ। জ্যোতির্মণ্ডলে ছায়াপথ কেবল একটি নয়। কয়েক শ কোটি থেকে কয়েক লক্ষ কোটি তারকার সমন্বয়ে গঠিত একাধিক ছায়াপথ নিয়ে তৈরি হয় অধিছায়াপত। জ্যোতির্বিজ্ঞান মানুষের দৃষ্টিতে সীমাহীন দিহন্তে প্রসারিত করে দিয়েছে। মহাবিশ্বের বিপুলতার কিছুটা ধারণা মানুষ ছায়াপথের বিবরণ থেকে করতে পারে।

Galen: গ্যালেন (১৩০-২০১ খ্রি.)
চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক হিপোক্রাটিসের পরেই চিকিৎসাবিদ গ্যালেনের স্থান। প্রাচীন এশিয় মাইনরের পারগামসে গ্যালেনের জন্ম। পারগামস, কোরিনথ এবং আলেকজান্দ্রিয়াতে চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়নের পরে গ্যালেন রোম গমন করে এবং পরবর্তীকালে রোমের সম্রাট মারকাস অরেলিয়াস-এর চিকিৎসাবিদ হিসাবে নিযুক্ত হন। হিপোক্রিটাস ব্যতীত চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে অপর কেউ গ্যালেনের মতো সুদীর্ঘকালব্যাপী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন নি। ষোড়শ শতকের ভেসালিয়াসের পূর্বে গ্যালেনের ন্যায় শারীরবিদ বা এ্যানটমিস্ট যেমন অপর কেউ ছিলেন না, তেমনি সপ্তদশ শতকের হারভের পূর্ব পর্যন্ত এমন দক্ষ ফিজিওলজিস্ট বা দেহতত্ত্ববিদও ছিলেন না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর তাঁর রচনার সংখ্যা গবেষকদের মতে ছিল ১৩০ এবং দর্শন, আইন এবং ব্যাকরণের উপর তাঁর সংখ্যা ছিল ১২৫।

Galileo: গেলিলিও (১৫৬৪-১৬৪২ খ্রি.)
গেলিলী গেলিলিও ছিলেন ইতালির পদার্থবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী। এ্যারিস্টটলের অনড় অভিমত এবং মধ্যযুগের বন্ধ্যা বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গেলিলিও ছিলেন বিদ্রোহী পথপ্রদর্শক। তিনি বৈজ্ঞানি বিশ্বদৃষ্টির প্রবক্তা এবং আপেক্ষিকতা ও ‘ল অব ইনারসিয়া’ বা বস্তুর জড্যতার বিধানের আবিস্কারক। গেলিলিওর গবেষণা কপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিকতার তত্ত্বকে সুপ্রমাণিত করে বিশ্ব সম্পর্কে ধর্মীয় বিশ্বাসের মূলে আঘাত করে। এই আঘাতে যাজক সম্প্রদায় সন্ত্রস্ত হয়ে ইনকুইজিশন বা ধর্মীয় বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে ঘোষণা করে যে, কপারনিকাসের তত্ত্ব সঠিক বলে কোনো অভিমত প্রকাশ করতে পারবে না। তেমন অভিমত কেউ প্রকাশ করলে তাকে জীবন্দ দগ্ধ করা হবে। এর ফলে গেলিলিও দীর্ঘকাল নীরব থাকতে বাধ্য হন। গেলিলিওর বিশ্বদৃষ্টি ছিল সুস্পষ্টরূপে প্রগতিশীল। তিনি মনে করতেন, বিশ্ব হচ্ছে অসীম এবং বস্তু হচ্ছে শাশ্বত। বিশ্ব প্রকৃতিকে জানার একমাত্র উপায় হচ্ছে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা।

Ghose, Aurobindo: অরবিন্দ ঘোষ (১৮৭২-১৯৫০ খ্রি.)
বিশিষ্ট বাঙালি চিন্তাবিদ, এককালের রাজনৈতিক নেতা এবং শেষ বয়সে যোগী শিক্ষাজীবনের পর অরবিন্দ স্বদেশের মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯০৮ সালে তিনি বৈপ্লবিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার এবং বে-আইনিভাবে বোমা তৈরির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। অরবিন্দ এবং অন্যান্য গোপন বিপ্লবীর বিরুদ্ধে, ‘আলীপুর বোমার মামলা’ বলে বিখ্যাত মামলা দায়ের করা হয়। বোমার মামলা থেকে মুক্ত হয়ে অরবিন্দ রাজনীতি পরিত্যাগ করে ধর্ম-সাধনায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত দার্শনিক ধারণা প্রচারের জন্য অরবিন্দ দক্ষিণ ভারতরে পণ্ডিচেরিতে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। অরবিন্দ বেদান্ত দর্শনের নতুন ব্যাখ্যাদানের চেষ্টা করেন। তাঁর ব্যাখ্যাকে সমন্বিত বেদান্ত দর্শন বলা হয়। তাঁর এই ব্যাখ্যার প্রাচীন ভারতের বেদান্ত দর্শন এবং ইউরোপীয় আধুনিক দর্শন, বিশেষ করে হেগেল, ব্রাডলে, আলেকজাণ্ডার প্রমুখ ভাববাদী দার্শনিকদের ভাবসমূহের মিশ্রণ দেখা যায়। অরবিন্দ মানুষের ইতিহাসকে চেতনার স্তর-ক্রমিক বিকাশ বলে বর্ণনা করতে চেয়েছেন। তাঁর মতে অর্ধ-চেতন, এবং অতি-চেতন মানুষের চেতনা এইরূপ বিভিন্ন পর্যায়ের মাধ্যমে বিকাশ লাভ করেছে। সামাজিক বিকাশে পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র কোনোটাকে শ্রেয় মনে করতে না পেরে অরবিন্দ বিকাশের এক তৃতীয় পথের কল্পনা করেন। অরবিন্দের দর্শন প্রধানত ভাববাদী।

Gandhism: গান্ধীবাদ
অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রখ্যাত রানীতিক মোহন দাস করমচান্দ গান্ধীর (১৮৬৯০১৯৪৮ খ্রি.) সামাজিক, রাষ্ট্রীয় অভিমত গান্ধীবাদ বলে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। গান্ধীবাদ রাজনীতি ও সমাজনীতির সাথে ধর্মের সংমিশ্রণে গঠিত। গান্ধীবাদ বলতে অহিংসাবদও বুজায়। কারণ গান্ধী অহিংসাকে কোনো লক্ষ্য সাধনের কেবল উপায় নয়, অহিংসাকেই চরম লক্ষ্য বলে মনে করতেন। তাঁর মতে অহিংসা ও নৈতিক শক্তি হচ্ছে সকল পরিবর্তনের মূল উপায়। অহিংসা নিছক একটা কর্মকৌশল নয়। অহিংসা মানবজীবন ও সমাজের মূল ভিত্তি। গান্ধীর অহিংসাবাদের সঙ্গে কাউন্ট লিও টলস্টয়ের নৈরাষ্ট্রবাদী মতের মিল ছিল। বস্তুত গান্ধীর সমাজদর্শনে টলস্টয়ের সমাজদর্শনের সুস্পষ্ট প্রবাবের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ‘হরিজন’ পত্রিকা এবং আপন স্মৃতিকথা ও তাঁর অপরাপর গ্রন্থে গান্ধীবাদের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। গান্ধী তাঁর অহিংসাবাদ বা প্রতিপক্ষের সঙ্গে অহিংস অসযোগিতার নীতি দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর অহিংসাবাদ বা প্রতিপক্ষের সঙ্গে অহিংস অসহযোগিতার নীতি দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর রাজনীতিক জীবনের শুরুতে প্রয়োগ করেন। পরবর্তীকালে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতালাভের উপায় হিসাবে ভারবতবর্ষে এই পদ্ধতি প্রয়োগের নীতি গ্রহণ করেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীবাদের প্রয়োগ অবিমিশ্র এবং সর্বদা সার্থক না হলেও তাঁর ব্যক্তিত্ব, সারল্য এবং অনমনীয়তা ভারত ভূখণ্ডের জনসাধারণের, বিশেষ করে বৃহত্তর হিন্দুসমাজের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা জাগাতে এবং ভারতের স্বাধীনতার দাবিকে ইংরেজ শাসকদের কাছে অপ্রতিরোধ্য করে তুলতে বিপুলভাবে সাহায্য করে। গান্ধীবাদ একান্তই ব্যক্তিবাদী ধর্মাশ্রয়ী বুর্জোয়া কল্পনাবিলাসী দর্শন। সমাজের বৈষম্যের জন্য দুৎখবোধ করলেও গান্ধীবাস সেই বৈষম্যের মূল কারণ বিশ্লেষিত হয় নি। ফলে অহিংসার মাধ্যমে সব বৈষম্য দূরীকরণের প্রচেষ্টা বাস্তবে স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। গান্ধীর মৃত্যুর (১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারী তিনি গোঁড়া হিন্দু বিনায়ক গডসের গুলিতে নিহত হন) সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর ভারতীয় সমাজ জীবন হতে হ্রাস পেতে থাকে। গান্ধীবাদের কোনো শক্তিশালী উত্তরাধিকার ভারতীয় সমাজে দৃষ্ট হয় না।

General Will: সাধারণ ইচ্ছা
রুশোর রাষ্ট্র-তত্ত্বমূলক বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সোস্যাল কণ্ট্রাক্ট’ বা ‘সমাজ চুক্তি’ কিংবা ‘সামাজিক চুক্তি’র একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ হচ্ছে ‘জেনারেল উইল’ বা ‘সাধারণ ইচ্ছা’। এই পদের মাধ্যমে রুশো একদিকে যেমন অষ্টাদশ শতকে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ব্যক্তির স্বাধীনতার লড়াইতে ব্যক্তির সার্বভৌমত্বের উপর জোর প্রদান করেছেন, অপরদিকে তেমনি তিনি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কোনো বিশেষ ব্যক্তির ইচ্ছা বা স্বাধীনতা যে মূল নয়, মূল যে মানুষের যৌথ স্বেচ্ছায় সৃষ্ট সমাজসত্তা, তাকেও যুক্তিগতভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এই ক্ষেত্রে রুশো ব্যক্তি ইচ্ছাকে দুইভাবে বিভক্ত করেছেন। ব্যক্তির সার্বভৌম ইচ্ছার ভিত্তিতে সৃষ্ট যৌথ সত্তা হচ্ছে রাষ্ট্র বা সমাজ। এই সমাজ একটি ক্রিয়াশীল অস্তিত্ব। এ অস্তিত্বেরও ইচ্ছারূপ শক্তি আছে। এবং এই ইচ্ছা’র উৎস হচ্ছে ব্যক্তির সমাজ বা রাষ্ট্র তৈরি করার ক্ষেত্রে পরস্পরের সঙ্গে ঐকমত্য। রাষ্ট্র বা সমাজ হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের ইচ্ছা। এবং এই ইচ্ছাই হচ্ছে ব্যক্তির ইচ্ছার সাধারণ রূপ। সাধারণ বা জেনারেল এই অর্থে যে এ ক্ষেত্রে সকল ব্যক্তির ইচ্ছাই এক। সকলের ইচ্ছা অভিন্ন। সকলে মিলে যৌথ জীবন যাপনের ইচ্ছা। এবং সমাজ জীবনে এই অভিন্ন ইচ্ছাই হচ্ছে সার্বভৌম। ‘ব্যক্তির ইচ্ছার ভিত্তিতে সমাজ বা রাষ্ট্রের ইচ্ছা’ এই তত্ত্বের কারণেই রুশোকে ‘জনগণের সার্বভৌমত্বের’ প্রবক্তা বলা হয়। কিন্তু ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে, প্রতিমুহুর্তে কার্যে যে ইচ্ছার প্রকাশ ঘটে সে হচ্ছে ব্যক্তির বিশেষ বা ‘পারটিকুলার’ ইচ্ছা। অনেক সময়ে ব্যক্তির এই বিশেষ ইচ্ছার সঙ্গে তার সাধারণ ইচ্ছার বিরোধ ঘটে। ব্যক্তি যখন সচেতন বা অচেতনভাবে যৌথের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত হয় তখনি ব্যক্তির ইচ্ছার এই বিরোধের দিকটি প্রকাশিত হয়। রুশো তাঁর ‘সোস্যাল কন্ট্রাক্ট’ গ্রন্থে এই তত্ত্বকে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। সে আলোচনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসঙ্গতির প্রকাশ ঘটেছে। তথাপি ‘সাধারণ ইচ্ছার’ তত্ত্ব যে রুশোর রাষ্ট্রদর্শনের কেন্দ্রবিন্দু এবং রাষ্ট্রদর্শনে এটি যে অনন্য অবদান, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। (দ্র. Rousseau: রুশো; Social Contract: সামাজিক চুক্তি)।

Gibbon: গিবন
Gibbon Edward (1737-94) বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক। ১৭৬৪ খৃষ্টাব্দে রোম ভ্রমনকালে গিবন প্রাচীন রোমসাম্রাজ্যের এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার পরিকল্পনা করেন। তাঁর রচিত রোমের এই ইতিহাসই ইংরেজি সাহিত্যের অতুলনীয় এক রোম সাম্রাজ্যের পরিচিতি লাভ করে। তিনি তাঁর এই গ্রন্থের নাম রাখেন রোমসাম্রাজ্যের ক্ষয় এবং পতনের ইতিহাস (১৭৭৬-৮৮) ছয় খণ্ডে বিভক্ত এই ইতিহাস গ্রন্থে গিবন প্রাচীনকাল হতে আধুনিক কাল পর্যন্ত ধারা বিবরণী তৈরি করেন। এই বিবরণে খৃষ্টান ধর্মের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার, টিউটনদের উদ্ভব, ইসলাম ধর্মের সঙ্গে খৃষ্টান ধর্মের যুদ্ধ (ক্রুসেড) ইত্যাকার সব কিছুর বিবরণ গিবন অন্তর্ভুক্ত করেন।

Good and Evil: ভালো এবং মন্দ
মানুষের সামাজিক আচরণের লক্ষ্য এবং লক্ষ্য সাধনের উপায়ের মূল্যায়নসূচক নীতিবাদ সূত্র। একটা বিশেষ সমাজে যে আচরণকে বাঞ্ছিত ও অনুকরণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয় তাকে ভালো এবং যা অবাঞ্ছিত ও পরিত্যজ্য তাকে মন্দ বলে চিহ্নিত এবং অভিহিত করা হয়। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় –এই নীতিবাদী সূত্রকাল ও সমাজ নিরপেক্ষ সূত্র নয়। আদি গোত্রতান্ত্রিক সমাজে এবং প্রথম উদ্ভব। ব্যক্তির সমন্বয়ে গোত্র কিংবা সমাজ- কিন্তু গোত্র সমাজভুক্ত ব্যক্তি যদি নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী আচরণ করতে থাকে তা হলে আর গোত্র বা সমাজ সংবদ্ধ থাকতে পারে না। তখন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির আচরণের বিরোধ ও সংঘর্ষে সমাজ ভেঙে যায়। কিন্তু সমাজ বাদে ব্যক্তির জীবন ধারণ সম্ভব নয়। মানুষের এই মৌলিক অভিজ্ঞতা থেকেই ব্যক্তির আচরণের সামাজিক মূল্যায়ন এবং সমাজের সংগঠন ও শৃঙ্খলার সহায়ক আচরণ বাঞ্ছিত ও কাম্য বা ভারো এবং সমাজের অহিতকর আচরণ মন্দ বলে অভিহিত হতে শুরু করে। সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশে ক্রমান্বয়ে যখন রাষ্ট্রীয় সংগঠন উদ্ভুত হয় তখন ‘ভালো’, ‘মন্দ’, ‘ন্যায়’, ‘অন্যায়’ প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় বিধান হিসাবে করণীয়, অকরণীয়, শাস্তিযোগ্য, পুরস্কারযোগ্যরূপে লিপিবদ্ধ হতে থাকে। এই পর্যায় থেকে সামাজিক ভালো-মন্দ বোধগুলি শ্রেণী চরিত্রও লাভ করতে শুরু করে। সমাজের ভালো-মন্দ এখন থেকৈ শাসক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার জন্য আইন বিধিবদ্ধ হতে থাকে। ভালো মন্দের দার্শনিক আলোচনায় দুটি প্রধান ধারা লক্ষনীয়। এর একটি হচ্ছে ভাববাদী ধারা। ইমানুয়েল কাণ্টের রচনায় এর প্রকৃষ্ট প্রকাশ দেখা যায়। এই মত অনুযায়ী ভালো-মন্দ সমাজ ও কাল-নিরপেক্ষ এক অলৌকিক আদর্শ দ্বারা নির্দিষ্ট হয়। মানুষের মধ্যে ভালোত্বর যে বোধ আছে এটা তার সহজাত ধারণা। তার এ ধারণা হচ্ছে চরম অলৌকিক ভালোর প্রকাশ। মানুষের এই ভালোত্ববোধের জন্ম কোনো বাস্তব অবস্থার উপর নির্ভর করে না। বস্তুবাদী ধারণা এর বিপরীত। বস্তুবাদ, বিশেষত দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে ভালোমন্দ বোধ মানুষের জীবন যাপনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনবোধ থেকেই সৃষ্ট হয়েছে। যে আচরণ জীবনের সহায়ক তাই ভালো। যা জীবনের জন্য ক্ষতিকর তাই মন্দ। এই ভালো-মন্দর ধারণা যুগ এবং অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। সুতরাং চরম ভালো বলে কোনো অলৌকিক আদর্শ নেই। এই দুই ধারার মধ্যে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দার্শনিক ভালো-মন্দর বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন।। প্রাচীন গ্রিসের এরিসটিপাস এবং এপিক্যুরাস বলতেন, যে আচরণ মানুষের জন্য সুখ আনয়ন করে সেই আচরণ বা বস্তু ভালো এবং যা মানুষের দুঃখের কারণ তা মন্দ। এজন্য তাঁদের নীতিবাদকে সুখবাদ বলে অভিহিত করা হয়।

Generalisation: সামান্যীকরণ, সাধারণীকরণ
বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অন্বেষার প্রয়োজনীয় স্তরসমূহের মধ্যে সাধারণীকরণ অন্যতম। জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়াটি সংক্ষেপে এভাবে বিবৃত করা যায়: কোনো প্রশ্নের মীমাংসার জন্য আমরা প্রথমে প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত বিশেষ বিশেষ ঘটনা বা বস্তুকে পর্যবেক্ষণ করি; এটি প্রথম স্তর। দ্বিতীয় স্তরে পর্যবেক্ষিত বস্তু বা ঘটনাকে তুলনা ও বিশ্লেষণ করে পর্যবেক্ষিত বস্তু বা ঘটনা এবং অনুরূপ বস্তু বা ঘটনার উপর প্রয়োগযোগ্য একটি ব্যাখ্যা বা সমাধান তৈরি করি। এই স্তরটি সাধারণীকরণের স্তর। সাধারণীকরণ দ্বারা বা সাধারণ ধারণাটি বাস্তবে প্রয়োগ করে আমাদের অনুমিত সিদ্ধান্তের সঠিকতা কিংবা বেঠিকতাকে আমরা যাচাই করি। বাস্তব অভিজ্ঞতা গৃহীত সাধারণ সিদ্ধান্তটি সঠিক প্রমাণ করলে সাধারণ সিদ্ধান্তটি একটি নিয়ম বা বিধানের মর্যাদা লাভ করে। দৃষ্টান্ত হিসাবে ম্যালেরিয়া জ্বরের কারনের অনুসন্ধানের উল্লেখ করা যায়। ম্যালেরিয়া জ্বরের কারণ জানার জন্য প্রথম স্তরে এই জ্বরে আক্রান্ত একাধিক রোগীকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। পর্যবেক্ষণের পরে রোগীদের মধ্যকার সাধারণ বা সর্বদা উপস্থিত অবিচ্ছেদ্য বিষয় বা উপাদান (এনোফেলিস মশার কামড়) বিশ্লেষণের মারফত নির্দিষ্ট করে এই জ্বরের কারণ সর্বদাই যে এনোফেলিস মশার কামড়, সেরূপ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তী স্তরে সিদ্ধান্তটিকে বাস্তবে আরো প্রয়োগ ও পরীক্ষার মাধ্যমে তার নিসংশয়তা স্থির করা হয়। জ্ঞানের বিকাশে সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা মানুষের একটি উন্নততর স্তরকে চিহ্নিত করে। মানুষ আদিতেই বস্তুপুঞ্জ পর্যবেক্ষণ করে তাকে তুলনা ও বিশ্লেষণ করে সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে নি। তার জন্য তার মনন ক্ষমতার অধিকতর বিকাশের অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সাধারণ ধারণায় আমরা যেমন বস্তুর সারকে জানার চেষ্টা করি, তেমনি আবার বিশেষ বস্তুর যে বৈচিত্র্য, সাধারণ সিদ্ধান্তে তার অনুপস্থিতি ঘটে। আমরা একত্রে সন্নিবেশিত বৃক্ষরাজিকে পর্যবেক্ষণ করে তাকে সামগ্রিকভাবে বন বলে আখ্যায়িত করি। বৃক্ষরাজির সম্মেলনে বন তৈরি হয়; সে ‘বনে’র একটি সাধারণ রূপ আছে –বিশেষ বিশেষ বৃক্ষের বৈচিত্র্য তাতে নেই।

Genetic Method: জনিতপদ্ধতি
কোনো বস্তু বা বিষয়ের উদ্ভব এবং বিকাশের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত গবেষণার পদ্ধতিকে জনিত বা জনিতপদ্ধতি বলা হয়। একে ঐতিহাসিক পদ্ধতিও বলা চলে। সপ্তদশ শতকে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিকাশের তত্ত্ব যখন প্রাধান্য পেতে শুরু করে, তখন থেকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে জনিতপদ্ধতির ব্যবহার ও প্রয়োগ শুরু হয়। এর পূর্বে দর্শন বিজ্ঞান সর্বক্ষেত্রে বিশ্লেষক পদ্ধতিরই প্রাধান্য ছিল। বিশ্লেষক পদ্ধতিতে কোনো সমস্যা সমাধানে বস্তু বা বিষয়ের চরিত্র বিশ্লেষণের উপর জোর দেওয়া হয়। কোনো সমস্যার চরিত্র যে তার উদ্ভব এবং বিকাশ দ্বারা নির্দিষ্ট, এই সত্যের স্বীকৃতি বিশ্লেষক পদ্ধতিতে পাওয়া যায় না। ফলে, বিশ্লেষক পদ্ধতির বিষয় জ্ঞান ও কালনিরপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্লেষক পদ্ধতিরই তাই সিদ্ধান্ত অনেক সময়ে কাল্পনিক, অবাস্তব এবং জ্ঞানের বিকাশের প্রতিকূল। দর্শনে প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত বিশ্লেষক পদ্ধতিই ছিল প্র্রধান পদ্ধতি। কিন্তু জ্ঞানের প্রসার এবং জনিতপদ্ধতির কার্যকারিতার অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় দর্শনও জনিতপদ্ধতি গ্রহণ করতে শুরু করে। বস্তুত দর্শন ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রের আজ জনিতপদ্ধতি জ্ঞানের বিকাশে অন্যতম সহায়ক পদ্ধতি বলে বিবেচিত। জনিতপদ্ধতি কোনো সমস্যার বিচারে তার উদ্ভবকালের অবস্থা, তার পরবর্তী বিকাশের পর্যায়সমূহ এবং এই বিকাশের অন্তর্নিহিত ধারা নির্ধারণ করার চেষ্টা করে। জনিতপদ্ধতির মৌলিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে এই যে, সমস্যা, বস্তু বা বিষয়মাত্রেরই উদ্ভব এবং বিকাশ আছে। তার আভ্যন্তরিক বিধান ও চরিত্র কেবলমাত্র বিবেচ্য সমস্যাকে স্থান ও কালের সঙ্গে সংযুক্ত করেই নির্ধারণ করা সম্ভব। জনিতপদ্ধতির যেমন কার্যকারিতা আছে তেমনি তার কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। জনিতপদ্ধতি বলতে যদি কেবল বিকাশের বিবরণ বুঝায়, তা হলে সে পদ্ধতি বিবরণকে অতিক্রম করে কোনো বস্তু বা বিষয়ের ভবিষ্যৎ বিকাশ সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত দানে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং বিকাশের বিবরণেই তা পর্যবসিত হয়ে পড়ে। সে জন্য প্রয়োজন বিকাশকে বিশ্লেষণ করা। এ কারণে কার্যকর জনিতপদ্ধতি বলতে এমন পদ্ধতি বুঝায়, যে পদ্ধতি সমস্যার উদ্ভব এবং বিকাশের বিবরণেই তা পর্যবসিত হয়ে পড়ে। সে জন্য প্রয়োজন বিকাশকে বিশ্লেষণ করা। এ কারণে কার্যকর জনিতপদ্ধতি বলতে এমন পদ্ধতি বুঝায়, যে পদ্ধতি সমস্যার উদ্ভব এবং বিকাশকে যেমন বিবেচনা করবে, তেমনি বিশ্লেষণের সাহায্যে এই বিকাশের ধারা উদঘাটিত করে একটি সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।

Getty Burg Address: গেটিস বার্গ-ভাষণ (১৮৬১-১৮৬৫)
আমেরিকার দক্ষিণ অঞ্চলীয় এবং উত্তর অঞ্চলীয় ব্রিটিশ কলোনিসমূহের মধ্যে দাসপ্রথার পক্ষ ও বিপক্ষ হিসাবে বিভক্ত অঙ্গরাষ্ট্রগুলি পাঁচ বছরব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধকে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ বলা হয়।
উত্তর অঞ্চলের জয়লাভের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধ শেষে মৃত সৈনিকদের সম্মানে গেটিস বার্গে যে শোক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় তাতে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন যে শোকভাষণ দেন সে ভাষণ কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের জন্য ঐতিহাসিক ভাষণ তথা গেটিসবার্গ ভাষণ নামে অভিহিত হয়ে আসছে।
আব্রাহাম লিংকনের ভাষনটি যেমন ছিল ইতিহাসের ক্ষুদ্রতম ভাষণসমূহের অন্যতম একটি ক্ষুদ্র ভাষণ, তেমনি বক্তব্যের তাৎপর্যেও ভাষণটি ছিল যথার্থই একটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ। একজন ঐতিহাসিকের বর্ণনায় সমাবেশ যখন অধীর আগ্রহের সঙ্গে লিংকনের ভাষণের জন্য অপেক্ষা করছিল, তখনি তারা দেখল আব্রাহাম লিংকনের ভাষণ শেষ হয়ে গেছে।
মাত্র উনিশটি বাক্যে প্রদত্ত ভাষণটির শেষ কয়েকটি বাক্য ছিল এরূপঃ “…that from these honoured dead we take increased devotion to that cause for which they gave the last full measure of devotion; that we here highly resolve that these dead shall not have died in vain; that this nation, under God, shall have a new birth of freedom; and that government of the people, by the people, for the people, shall not parish from the earth.
গৃহযুদ্ধের অবসানের পরবর্তীতে ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল তারিখে গুপ্তগাতকের গুলিতে আব্রাহাম লিংকন নিহত হন। তখন লিংকনের বয়স ছিল মাত্র ৬৫ বৎসর। (দ্রষ্টব্য: আমেরিকার গৃহযুদ্ধ।)

Godwin, Willam: উইলিয়াম গডউইন (১৭৫৬-১৮৩৬ খ্রি.)
ইংল্যাণ্ডের একজন রাজনৈতিক চিন্তাবিদ এবং ঔপন্যাসিক। কবি শেলী তাঁর জামাতা ছিলেন। গডউইনের খ্যাতি এ কারণে যে, তিনি জীবনের প্রথম দিকে একজন ধর্মযাজক থাকলেও ফরাসি দার্শনিকদের রচনাপাঠে প্রভাবিত হয়ে তিনি ক্রমান্বয়ে ধর্ম সম্পর্কে সমালোচনাবাদী হয়ে ওঠেন এবং গ্রন্থরচনায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর গ্রন্থসমূহের মধ্যে ‘রাজনৈতিক ন্যায়ের বিষয়ে’ বা ‘কনসারনিং পলিটিক্যাল জাসটিস’ তাঁর শ্রেণীগত চিন্তাবিদদের চিন্তার ব্যতিক্রমী চিন্তা হিসাবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। এই গ্রন্থের অভিমতসমূহ ফরাসি বিপ্লবের প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ পায়। ইংল্যাণ্ডের প্রগতিবাদী চিন্তারও তিনি সমর্থক হয়ে ওঠেন। রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে তাঁর চিন্তায় ক্রমান্বয়ে কল্পনাবাদী সমাজতন্ত্রীয় এবং নৈরাষ্ট্রবাদী ভাব প্রকাশ পেতে থাকে। তিনি বলেন রাষ্ট্রে মানুষ বাস করে বটে, কিন্তু রাষ্ট্র মানুষের শেষ লক্ষ্য নয়। রাষ্ট্র হচ্ছে জবরদস্তির প্রতীক। মানুষের লক্ষ্য নয়। রাষ্ট্র হচ্ছে জবরদস্তির প্রতীক। মানুষের লক্ষ্য হবে রাষ্ট্রকে অতিক্রম করে সামাজিক জীবনযাপন করা। জোর বা জবরদস্তির মৌল বিরোধিতা করেন। মানুষ প্রকৃতির বিধানে সমান। এবং সে কারণে মানুষে মানুষে সম্পদে অসাম্য থাকা অসঙ্গত। মানুষের সমাজে বিদ্যমান অসঙ্গতির মূলে হচ্ছে অজ্ঞতা। অশিক্ষা দূর হলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যকার অসাম্য, অবাঞ্ছিত আইন-কানুন, সরকারের শক্তিপ্রয়োগ প্রভৃতির বিলোপ ঘটবে। গডউইনের এরূপ চিন্তায় প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এবং পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের কল্পনাবাদী টমাস মুরের চিন্তার মিশ্রণ দেখা যায়। যুক্তিবাদী হিসাবে ধর্ম সম্পর্কে তাঁর সমালোচনা ক্রমান্বয়ে তীব্র হয়ে ওঠে। ধর্ম মানুষকে পরলোকবাদী হিসাবে ধর্ম সম্পর্কে তাঁর সমালোচনা ক্রমান্বয়ে তীব্র হয়ে ওঠে। ধর্ম মানুষকে পরলোকবাদী করে তার জাগতিক শক্তি ও সম্ভাবনাকে বিভ্রান্ত এবং বিনষ্ট করে। খ্রিষ্টধর্মকেও তিনি এই কারণে ক্ষতিকর বলে সমালোচনা করেন। নিজের বৈবাহিক জীবন থাকলেও বৈবাহিক রীতির প্রয়োজনকে তিনি অস্বীকার করেন। তাঁর এসব চিন্তার মধ্যে ইংল্যাণ্ডের অভিজাত সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তার প্রতিবাদী অভিমত প্রকাশিত হয়। এ কারণে তাঁর সমকালীন স্বীকৃতি এবং জনপ্রিয়তা ইংল্যাণ্ডের চাইতে ফ্রান্সে অধিক ঘটে। ফ্রান্সের সেণ্ট সাইমন এবং প্রুধো তাঁর চিন্তাধারার সমর্থক হন।

Great Leap Forward (1958): আধুনিক চীনের শিল্পায়নে দ্রুত উন্নয়নের চেষ্টা
উৎপাদনের পরিমাণে বিরাট পরিমাণ ধার্য করা এবং কৃষি ও শিল্প উভয়ক্ষেত্রে একই সাথে তা পূর্ণ করার চেষ্টা ঘোষণা করা হয়। কৃষিতে কম্যুন ব্যাপক সংখ্যায় সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উচ্চমান অর্জন করতে না পারায় পরিকল্পনা বিফল হয়। জাতীয় নেতা মাওসেতুঙের উপর এই বিফলতার দায়িত্ব ন্যস্ত হয় এবং মাওসেতুঙ দ্রুত উন্নয়নের এই পরিকল্পনায় ব্যর্থ হওয়ার সমালোচনার পাত্র হতে শুরু করেন।

Great Wall of China: চীনের প্রাচীর
উত্তর চীনে আত্মরক্ষামূলক এক বিরাট ঐতিহাসিক দেয়াল। দৈর্ঘে ছিল ৪২০০ মাইল। এই দেয়াল তৈরি করা শুরু হয় মিং রাজবংশের শাসনকালে ১৩৬৮ খৃষ্টাব্দে এবং সমাপ্ত হয় ১৫৪৪ খৃষ্টাব্দে। আত্মরক্ষামূলক হলেও চীনের এই বিরাট দীর্ঘ দেয়ালের উপর দিয়ে মানুষও চলাচল করতে পারত। অদ্যাবধি চীনের এই দেয়াল চীন ভ্রমণকারীদের একটি অন্যতম দ্রষ্টব্যের বিষয় হিসাবে বিরাজ করছে।

Green, T.H.: টি.এইচ.গ্রীন (১৮৩৬-১৮৮২ খ্রি.)
ঊনবিংশ শতকের ইংল্যাণ্ডের একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ এবং দার্শনিক ছিলেন টমাস হিল গ্রীন। টমাস হিল গ্রীন এবং তাঁর সমকালের এবং এই চিন্তার অধিকারী দার্শনিক ব্রাডলে এবং বোসাঙ্কোয়েটকে সাধারণত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নব ভাববাদী বলে আখ্যায়িত করা হয়। গ্রীনের রচনাবলীর মধ্যে নীতিশাস্ত্রের উপর ‘প্রলেগোমেনা টু এথিক্স’ এবং রাজনীতির উপর ‘প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল অবলিগেশন’ বিশেষভাবে পরিচিত। ফরাসি বিপ্লবোত্তর কালে ধনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে যেসব আর্থিক ও রাষ্ট্রিক সমস্যার উদ্ভব হয় গ্রীন এবং তাঁর সঙ্গীরা তাকে তাঁদের নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার চেষ্টা করেন। এই বিচারের বৈশিষ্ট্য এই যে, এঁরা এ্যারিস্টটল এবং প্লেটোর মতো, রাষ্ট্রকে যেমন একটি নৈতিক সংস্থা বলে বিবেচনা করেন, তেমনি রাষ্ট্র বনাম ব্যক্তিরূপে গোড়ার দিকে যেখানে ব্যক্তির নিরঙ্কুশ সার্বভৌমিকতা এবং ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্রের কোনোরূপ হস্তক্ষেপ না করার উপর জোর ছিল, সেখানে ঊনবিংশ শতকের অবস্থাতে এই তাত্ত্বিকেরা রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি যে একটি যৌথ সংস্থা, তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এঁদের মতে ব্যক্তি বাদে যেমন রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্র বাদেও তেমনি ব্যক্তি নয়।
উভয়ই নৈতিক সত্তা। এবং নৈতিক সত্তার আসল বিচার সে কি করে, তার চাইতে কি তার করা উচিত তথা তার লক্ষ্য দ্বারা নির্ধারিত হয়। ব্যক্তির লক্ষ্য নৈতিক প্রাণী হিসাবে অধিকতর উত্তম প্রাণী হিসাবে বিকাশ লাভ করা। এ বিকাশ ব্যক্তি এককভাবে সাধন করতে পারে না। নৈতিকতার বোধটিই হচ্ছে একটি সামাজিক বোধ। সমাজ-শূন্য কোনো ব্যক্তি কাল্পনিক ব্যক্তি, বাস্তব অস্তিত্ব নয়। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কে গঠিত যে রাষ্ট্র, সে রাষ্ট্রও উন্নতি, ব্যক্তির উন্নতি বাদে সাধিত হতে পারে না, যেমন, ব্যক্তির উন্নতি রাষ্ট্রের উন্নতি বাদে সাধিত হতে পারে না। তাই রাষ্ট্রের উন্নতির মাধ্যমে ব্যক্তির উন্নতি অর্জন করা। এই অবস্থাটিকে প্রকাশ করে গ্রীন বলেছেন, রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তির সম্মতি বা ‘উইল’, শক্তি তথা ফোর্স নয়। রাষ্ট্রের লক্ষ্য হবে ব্যক্তির জীবনে এমন বাস্তব অবস্থা তৈরি করা যে বাস্তব অবস্থায় ব্যক্তি নৈতিক প্রাণী হিসাবে যা তার করা উচিত সে তাই করতে পারে। এই প্রসঙ্গে গ্রীন ‘পজিটিভ’ এবং ‘নেগেটিভ’ ফ্রিডম –তথা বাস্তব স্বাধীনতা এবং অবাস্তব স্বাধীনতার ধারণাটি তৈরি করেন। তিনি বিদ্যমান ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করে দেখান যে অন্নহীন ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে কোনো নৈতিক বা স্বাধীন ব্যক্তি বলা যায় না। ক্ষুধার্ত ব্যক্তি অপরের খাদ্য দ্রব্য ‘চুরি’ করলে তাকে অপরাধী বলে বিচার করা চলে না। কারণ, বুভুক্ষু ব্যক্তির যেখানে চুরি করে খাদ্য সংগ্রহ করা ব্যতীত উপায় নেই, সেখানে তার এমন বাধ্যতামূলক কার্যকে স্বাধীন ইচ্ছানুযায়ী কৃত কার্য বলা চলে না। আসলে আধুনিক ধনবাদী সমাজের তথাকথিত স্বাধীনতা হচ্ছে প্রধাতন এরূপ অসহায় ব্যক্তির জন্য অবাস্তব বা নেগেটিভ স্বাধীনতা। এরূপ অসহায় ব্যক্তি প্রাচীনকারের শেকলে আবদ্ধ থাকত, বর্তমানে সমাজের এমন দাসরা ক্ষুধার শিকলে আবদ্ধ। এরা পুরো নাগরিক বা ‘সিটিজেন’ নয় এদেরকে বলা উচিত “ডেনিজেন” বা অ-নাগরিক।ধনতান্ত্রিক সমাজের অসঙ্গতির এরূপ তাত্ত্বিক জোরালো সমালোচনার মধ্যে ঊনিশ শতকে ক্রমবর্ধমানরূপে প্রচারিত সমাজতান্ত্রিক ভাবের প্রকাশ পাওয়া যায়। গ্রীনের মতে, এ কারণে, রাষ্ট্রকে নিষ্ক্রিয় থাকলে চলবে না। কোনো ব্যক্তি যেন তার অবাধ প্রতিযোগিতার অধিকার ব্যবহার করে ব্যক্তিগত সম্পত্তির একচেটিয়া মালিকানার মাধ্যমে সামাজিক সম্পদের অপব্যবহার দ্বারা অসংখ্য ব্যক্তিকে মানবেতর প্রাণীতে পর্যবসিত করতে না পারে, রাষ্ট্রকে তা দেখতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। এরূপ বিচারে গ্রীন সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন হলেও তিনি পুরোপুরি সমাজতান্ত্রিক ছিলেন না। তিনি একদিকে যেমন ব্যক্তিবাদী তথা ব্যক্তির উন্নতিকে রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য বলেছেন, অপরদিকে তেমনি ব্যক্তিগত সম্পত্তির সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন, তার পুরো বিলোপের সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বকে সমর্থন করেন নি। এ কারণে তাঁর এবং তাঁর সঙ্গী চিন্তাবিদদের চিন্তাকে ‘ব্যক্তিবাদ তথা উদারনীতিবাদের ভাববাদী সংশোধন’ বা ‘আইডিয়ালিস্ট রিভিশন অব লিবারেলিজম’ বলে অভিহিত করা হয়।

H
Haridas Bhattacharyya: হরিদাস ভট্টাচার্য (১৮৯০-১৯৫৫ খ্রি.)
অবিভক্ত ভারতের একজন প্রখ্যাত দার্শনিক, অধ্যাপক ও বাগ্মী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরবর্তীকালে ১৯২১ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তার গোড়াতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জীর সঙ্গে আলাপক্রমে সংগৃহীত বিশিষ্ট অধ্যাপকদের একজন ছিলেন তরুণ অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগকে সংগঠিত করার দায়িত্ব নিয়ে তিনি ‘রিডার’ হিসাবে ১৯২১ সনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং ১৯৪৫ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় গমন করেন। হরিদাস ভট্টাচার্য বিশেষ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অধ্যাপক ছিলেন। বাংলা এবং ইংরেজী উভয় ভাষায় দক্ষ এবং ওজম্বিনী রীতিকে বক্তৃতাদানের তিনি ক্ষমতা রাখতেন। নিজে পরিবারবগভাবে নদীয়ার গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ছিলেন। প্রথিতযশা দার্শনিক হলেও নিজের পৈতৃক ধর্মের সকল আচার-অনুষ্ঠান নিষ্ঠার সঙ্গে বিম্বাস ও পালন করতেন। কিন্তু সংকীর্ণমনা ছিলেন না। ভারতের বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হুমায়ুন কবির তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং পরবর্তীতে খ্যাতিমান বহু প্রখ্যাত দার্শনিক এবং সাহিত্যিক তাঁর সাক্ষাৎ ছাত্র ছিলেন। ধর্মের ক্ষেত্রে তাঁর উদার দার্শনিক মনোভাবের পরিচয় বহন করে তাঁর বিশিষ্ট গবেষণা গ্রন্থ ‘ফাউণ্ডেশনস অব লিভিং ফেইথস’ বা ‘প্রচলিত ধর্মসমূহের ভিত্তি’। এই গ্রন্থের মধ্যে ইসলাম ধর্মের দর্শন এবং তার অন্তর্গত সমস্যাসমূহ সম্পর্কেও তাঁর গভীর জ্ঞানের প্রকাশ ঘটেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনের প্রথম দিকে অধ্যাপনাকালে হরিদাস ভট্টাচার্য প্রখ্যাত ভারতীয় দার্শনিক আচার্য ব্রজেন্দ্র নাথ শীলের প্রশংসাধন্য একজন তরুণ সহকর্মী ছিলেন।

Hervey William: উইলিয়াম হারভে (১৫৭৮-১৬৫৭ খ্রি.)
ইংল্যাণ্ডের উইলিয়াম হারভে একজন চিকিৎসাবিদ। উইলিয়াম হারভে দেহের রক্তসঞ্চালন সত্যের আবিস্কারক। শিক্ষাজীবনে তিনি নিজ দেশের ক্যাণ্টারবেরি এবং ক্যাম্ব্রিজে শিক্ষালাভের পর ফ্রান্স এবং জার্মানি পরিভ্রমণ করে তৎকালে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ইতালির পদুয়াতে গমন করে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান তাঁকে অধ্যাপনা এবং চিকিৎসকের পদে নিযুক্ত করে এবং বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত করে। ১৬১৬ সনে হারভে তাঁর একটি নিবন্ধে তাঁর ‘রক্ত সঞ্চালন’ তত্ত্ব প্রকাশ করেন। চিকিৎসা শাস্ত্রের অগ্রগতিতে হারভের ‘রক্ত সঞ্চালন’ তত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি তাঁর তত্ত্বে দেখান যে রক্ত প্রথমে ডানদিকের অরিকলে বা অলিন্দে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে ডান ভেনট্রিকলে বা নিলয়ে অন্তর্গত হয়। এই রক্ত তখন পালমুনারী বা ফুসফুসের শিরার মাধ্যমে ফুসফুসে সঞ্চালিত হয় এবং সেখান থেকে ভেনট্রিকলে প্রবেশ করে। এর পরে রক্ত দেহের বিভিন্ন অংশে শিরা উপশিরার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই রক্ত পুনরায় আরটারি বা ধমীর মাধ্যমে এবং শিরার দ্বারা ফুসফুসে প্রেরিত হয়ে একটা পুরো বৃত্তত তৈরি করে। এ বিবরণ আমাদের নিকট জটিল বলে বোধ হলেও এই তত্ত্ব আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় সূত্র হিসাবে ভূমিকা পালন করে উইলিয়াম হারভেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর করে রেখেছে।

Hedonism: সুখবাদ
সুখবাদ হচ্ছে নীতিবাদের একটি তত্ত্ব। মানুষের জীবনে চরম কামনা কি এবং মানুষের সামাজিক আচরণের মূল প্রেরণা কি, এই মৌলিক প্রশ্নের জবাব মানুষ বিভিন্নভাবে দেবার চেষ্টা করেছে। সুখবাদ এই সমস্ত জবাবের মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। এটি একটি প্রাচীন তত্ত্ব। গ্রিসের দার্শনিক এপিক্যুরাসের রচনায় এই তত্ত্বের একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আধুনিক ইউরোপের মিল, বেন্থাম প্রমুখ দার্শনিকের উপযোগবাদ বা হিতবাদ নামক নীতিতত্ত্বের উৎস হিসাবে এপিক্যুরাসের অভিমতকে উল্লেখ করা হয়।
প্রেরণা বাদে মানুষ কোনো কাজই সম্পাদন করতে পারে না। সুখবাদের প্রতিপাদ্য হলো, আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে মানুষের সকল কাজের অন্তর্নিহিত প্রেরণা। কিন্তু সুখ বলতে কি বুঝবে, এ নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। কেউ বলেছেন, সুখ হচ্ছে দৈহিক সুখ। আবার কেউ বলেছেন, দেহের সুখই একমাত্র সুখ নয়। ন্যায় ও ধর্মের কারণে দৈহিক সুখের বিসর্জনও মানুষের জন্য সুখকর এবং কাম্য হতে পারে। ব্যাখ্যার এই পার্থক্যের ভিত্তিতে সুখবাদকে মনস্তাত্ত্বিক এবং নীতিগত সুখভাদ এই দুটি উবিভাগে বিভক্ত করা হয়। মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদের মতে, মানসিক সুখ হচ্ছে সকল কাজের মূল। মানুষ যখন কোনো বিশেষ সুখকে বিসর্জন দেয় তখনও সে অপর কোনো সুখলাভের কথা মানসিকভাবে কল্পনা করে। নীতিবাদী সুখবাদের মতে সুখের কামনা মানুষের কেবল ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়। সুখের কামনা মানুষের একটি দায়িত্ব বা কর্তব্য। কেননা সুখলাভের কামনা ব্যতীত মানুষের জীবন আদৌ ক্রিয়াশীল হতে পারে না। সুখের ক্ষেত্রে আর একটি প্রশ্ন হচ্ছে: সুখ কি ব্যক্তিগত হবে, না সমষ্টিগত হবে। এ প্রশ্নে ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত সুখবাদ বলে দুটি উপধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত সুখবাদের ব্যক্তির কাছে নিজের সুখ হচ্ছে চরম কথা ও একমাত্র কাম্য। সমষ্টির সুখ যদি ব্যক্তির সুখের পরিপোষক হয় তবেই ব্যক্তি সমষ্টির সুখেরও কামনা করতে পারে। ব্যক্তির সুখের পরিপন্থী হলে নয়। অনেকে এপিক্যুরাস এবং এরিসটিপাসকে ব্যক্তিগত সুখবাদের প্রবক্তা মনে করেন। কিন্তু সুখের ব্যাখ্যায় এপিক্যুরাস এবং এরিসটিপাসের মধ্যেও পার্থক্য আছে। এরিসটিপাস যেখানে মুহুর্তের সুখকেই প্রধান মনে করেছেন, এটিক্যুরাস সেখানে মুহুর্তের বাইরে ব্যক্তির সামগ্রিক জীবনের সুখকে ব্যক্তির লক্ষ্য বলে নির্দেশ করেছেন। মিল ও বেন্থামের উপযোগবাদ সমষ্টিগত সুখবাদের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। উপযোগবাদ বা হিতবাদের একটি বহুল উল্লিখিত বাক্য হচ্ছে: ‘বৃহত্তম সংখ্যার বৃহত্তম পরিমাণ সুখ হবে মানুষমাত্রের লক্ষ্য’। মিল অবশ্য বৃহত্তম পরিমাণ সুখ বলতে কেবল সুখের পরিমাণই বুঝাতে চান নি। তিনি সুখের ক্ষেত্রে পরিমাণ ও গুণের প্রশ্নটি বিবেচনা করেছেন এবং গুণগতভাবে যে সুখ কাম্য তাকে পরিমাণ নির্বিশেষে কাম্য বলে মনে করতেন।

Hegel: হেগেল (১৭৭০-১৮৩১ খ্রি.)
জর্জ উইলহেলম ফ্রেডারিক হেগেলের মধ্যে জার্মান ভাববাদী দর্শনের চরম প্রকাশ ঘটে। ভাবের বাস্তব তত্ত্বের জন্য অনেকে তাঁর দর্শনকে ‘বাস্তব ভাববাদ’ বলেও আখ্যায়িত করেন। হেগেল কাণ্টের দর্শনের সমালোচনার ভিত্তিতে নিজের দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। এতে কাণ্টের নিকট হেগেলের ঋণ প্রমাণিত হয়। কাণ্টের অভিমতের উল্লেখ ব্যতীত হেগেলের চিন্তার বিকাশ বুঝা সম্ভব নয়। নিম্নোক্ত তিনটি ক্ষেত্রে কাণ্ট ও হেগেলের দর্শনের পারস্পরিক পার্থক্য নির্দিষ্ট করা যায়: (১) কাণ্ট তাঁর দর্শন দ্বারা এই কথা প্রকাশ করার চেষ্টা করেন যে, মানুষের কাছে দৃশ্য বা জ্ঞেয়জগৎ মানুষের বুদ্ধিকে অতিক্রম করে যেতে পারে না। বুদ্ধির সূত্র হচ্ছে মানুসের কাছে জ্ঞানের একমাত্র সূত্র। বুদ্ধির মাধ্যমে জগৎ মানুষের কাছে যেভাবে উপস্থিত হয় মানুষ জগৎকে সেইভাবে উপলব্ধি করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই জ্ঞেয় বা দৃশ্য জগৎই একমাত্র জগৎ নয়। বুদ্ধির অগম্য এবং মানুষের অজ্ঞেয় আর একটা জগৎ আছে –যাকে বলা যায় আসল জগৎ বা সত্তার সত্তা। হেগেল কাণ্টের বুদ্ধির সূত্র স্বীকার করে বলেন: বুদ্ধি দ্বারাই আমরা জগৎ বা সত্যকে জানি। বস্তুত বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাই মানুষের জ্ঞানের একমাত্র মাধ্যম। বুদ্ধি অগম্য এবং মানুসের অজ্ঞেয় আসল জগৎ বলে কিছু আছে এরূপ কতা মানুষ বলতে পারে না। মানুষ জ্ঞেয় জগৎই একমাত্র জগৎ। (২) কাণ্ট বুদ্ধিকে বোধ এবং প্রজ্ঞা বলে দুভাগে ভাগ করে বোধকে আংশিক অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যাতা এবং প্রজ্ঞাকে চরম সত্য উপলব্ধির মাধ্যম হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। হেগেল বলেন, বুদ্ধির মধ্যে ক্ষমতার তারতম্য করা গেলেও সমগ্র, বুদ্ধিদত্ত যে সত্য তার মধ্যে কোনো বিভাগ করা চলে না। সত্যের কোনো ভাগ নেই: সত্য সমগ্র, সমগ্রই সত্য। (৩) কাণ্ট মানুষের জ্ঞানের সীমা জ্ঞেয় বা দৃশ্যজগতে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। হেগেল বলেন, আমাদের জ্ঞানের জগৎকে আমরা দৃশ্য জগৎ বা মায়া বলি কারণ আমরা এই জগতের প্রকাশের সামগ্রিকতকে উপলব্ধি করতে পারি নে। দৃশ্য জগতের প্রকাশের কারণ যখন আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হই, তখন আর দৃশ্য জগৎ আংশিক বা মায়া বলে বোধ হয় না। তখন আমরা বুঝতে পারি, এটাই একমাত্র জগৎ। (৪) নীতির ক্ষেত্রে কাণ্ট এমন এক মহৎ বা আদর্শের কল্পনা করেছেন যে আদর্শ কখনো বাস্তবায়িত হতে না পারলেও মানুষ তাকে একমাত্র বাস্তব বলে ভাবতে বাধ্য। হেগেল বলেন, আমর আদর্শের বিকাশের পর্যায়গুলি বুঝতে সক্ষম বলেই কোনো আদর্শ আমাদের কাছে অন্যায় ও অবাস্তব বলে বোধ হয়। আদর্শের বিকাশের পর্যায়কে সম্যকভাবে উপলব্ধি করলে বাস্তব-অবাস্তবের বিরোধ দেখা দিতে পারে না। (৫) কাণ্ট জ্ঞানের সূত্রকে বিকাশের সম্ভাবনাহীন অনড় স্থির সূত্র বলে মনে করেছেন। কাণ্টের কাছে জ্ঞান-সূত্রের উৎস মানুষের কাছে অজ্ঞেয়। অজ্ঞাত কোনো শক্তি মানুসের জন্য অপরিহার্য এই জ্ঞানসূত্রগুলি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। হেগেল মনে করেন, জ্ঞানের সূত্রগুলি অপরিহার্য বটে। কিন্তু এগুলি বিকাশের সম্ভাবনাহীন, অনড় বা এর উৎস অজ্ঞেয় নয়। হেগেলের মতে দর্শনের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে জ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করি সেগুলি আমরা কেনইবা ব্যবহার করি এবং সূত্রগুলি কীভাবে মানুষের জীবনে বিকশিত হয়েছে।
কাণ্টের সঙ্গে নিজের দর্শনের এই পার্থক্য ব্যাখ্যা করে হেগেল ভাবের বিকাশের দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্ব তৈরি করেন। দ্বন্দ্বই হচ্ছে ভাব বা অস্তিত্বের বিকাশের মূল কারণ। অস্তিত্বের মধ্যে নিরন্তর ‘হাঁ’ এবং ‘না’-এর দ্বন্দ্ব চলছে। বিকাশের এই তত্ত্বের ব্যাখ্যায় হেগেল ‘পরিমাণ থেকে গুণের’ তত্ত্বও উপস্থিত করেন। অস্তিত্বের মধ্যে পরিবর্তন পরিমাণগতভাবে বৃদ্ধি পেতে পেতে বিশেষ পর্যায় নূতন গুণের উদ্ভব ঘটায়।
সমাজের ইতিহাস ও বিজ্ঞানের বিকাশকে অগ্রসর সচেতন চিন্তার দ্বারা উপলব্ধি করে হেগেল এই তত্ত্ব তৈরি করেন। কিন্তু হেগেল কাণ্টের সমালোচনা করলেও তিনি ভাববাদকে অতিক্রম করতে পারেন নি। জগৎ বা সত্যের ক্ষেত্রে জ্ঞেয় এবং অজ্ঞেয়-র দ্বৈত রূপ হেগেল অস্বীকার করলেও হেগেলের নিকটও মূল হচ্ছে ভাব; বস্তু নয়। যা কিছু জ্ঞেয় বা দৃশ্য সর্বই হচ্ছে ভাবের প্রকাশ ও বিকাশ। এ ছাড়া ভাবের চরম বিকাশ জার্মান রাষ্ট্রযন্ত্রে ঘটেছে বলে হেগেলের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের আদর্শগত হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হতে পেরেছে। বস্তুত হেগেল-দর্শন থেকে উত্তরকালে দুটি পরস্পর-বিরোধী ধারার বিকাশ ঘটেছে: এর একটি হচ্ছে মার্কসবাদ বা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ; অপরটি হচ্ছে নবভাববাদ ও স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক মতবাদ।

Heidegger: হাইডেগার (১৮৮৯-১৯৭৬ খ্রি.)
হাইডেগার জার্মান অস্তিত্ববাদী দার্শনিক ফ্যাসিবাদের পোষকতা করে ১৯৩৩ সালে ফ্রাইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর নিযুক্ত হন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের পরে উক্ত পদ থেকে তাঁকে অপসারিত করা হয়। অস্তিত্ববাদী চিন্তাধারয় হাইডেগার কিয়ের্কেগার্ডের অনুসারী। তবে কিয়ের্কেগার্ডের অনুসারী। তবে কিয়ের্কেগার্ড যেখানে অন্ধবিশ্বাসের হাতে আত্মসমর্পণকে ব্যক্তির জন্য একমাত্র গ্রহণীয় পথ বলে চিহ্নিত করেছেন, সেখানে হাইডেগার নাস্তিকতার মনোভাব পোষণ করেন। হাইডেগারের দর্শনের মূল হচ্ছে মুহুর্তবাদ-এর তত্ত্ব। উদ্বেগ, আশঙ্কা, ভীতি এগুলি হচ্ছে মানুষের অস্তিত্বের সহজাত স্মারক। এগুলির মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় মানুষের নিজস্ব অস্তিত্ব। নিজের অস্তিত্ব উপলব্ধির জন্য মানুষের প্রয়োজন হচ্ছে বাস্তব জগতের সমস্ত লক্ষ্য ও আদর্শের চিন্তা পরিত্যাগ করে জীবনের ভঙ্গুরতা, মৃত্যু, অনিত্যতা –এই মূল সত্যের মুখোমুখি হওয়া। জাগতিক দায়-দায়িত্ব, কামনা, স্বপ্ন অস্তিত্বের এই মৌলিক সত্য উপলব্ধি ব্যাহত করে। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েই মাত্র মানুষ নিজের অস্তিত্বের মুহুর্তকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারে। বিজ্হানের বিরোধিতা এবং জীবন সম্পর্কে গভীর হতাশা হচ্ছে হাইডেগারের অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য।

Heliocentricism and Geocentricism: সূর্যকেন্দ্রিকতা ও ভূকেন্দ্রিকতা
পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যকার সম্পর্ক এব মহাবিশ্ব সম্পর্কে দুটি পরস্পরবিরোধী বৈজ্ঞানিক অভিমত। সূর্যকেন্দ্রিকতাই হচ্ছে বর্তমানে গৃহীত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী অন্যান্য গ্রহের ন্যায় পৃথিবী নিজ কক্ষে ঘুর্ণ্যমান অবস্থায় সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। সূর্যকেন্দ্রিকতার তত্ত্ব কেবল আধুনিককালে প্রমাণিত ও সত্য বলে গৃহীত হলেও প্রাচীনকালেও বিভিন্ন দার্শনিকের মধ্যে এই তত্ত্বের অনুসরণ দেখা যায়। বিশেষ করে ৩১০-২৩০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টার্কাস এবং তাঁর পরবর্তী নিকোলাস স্পষ্টরূপেই মনে করতেন যে, পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। কিন্তু প্লেটো, এ্যারিস্টটল ভূকেন্দ্রিকতার তত্ত্বের পরিপোষক ছিলেন। প্লেটো এবং এ্যারিস্টটল এবং পরবর্তীকালের টলেমীর ব্যাখ্যার সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসযুক্ত হয়ে ভূকেন্দ্রিকতার তত্ত্বকে বহুকাল যাবৎ অপতিদ্বন্দ্বী করে রেখেছিল। আধুনিককালে এর উপর প্রথম আঘাত হানেন কপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩ খ্রি.)। কপারনিকাস আঙ্কিকভাবে সূর্যকেন্দ্রিকতার তত্ত্ব প্রমাণিত করেন। পরবর্তীকালে গেলিলিও, কেপলার ও নিউটন এই তত্ত্বকে বৈজ্ঞানিকভাবে অধিকতর শক্তিশালী করেন। সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব অনুযায়ী সূর্য বিশ্বের একমাত্র কেন্দ্র নয়; সূর্য কেবলমাত্র সৌরমণ্ডলের কেন্দ্র; মহাবিশ্বব্যাপী এরূপ আরো সূর্য আছে এবং তাদের কেন্দ্র করে অগণিত মণ্ডলেরও অস্তিত্ব রয়েছে।

Heracledes: হেরাক্লিডাস (৪০০ খ্রি পূ.)
হেরাক্লিডস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের একজন দার্শনিক। প্লেটোর একাডেমীর সদস্য এবং তাঁর শিষ্য হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। কিন্তু দার্শনিক মতামতের ক্ষেত্রে হেরাক্লিডসের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল। পদার্থবিদ্যা, সঙ্গীত, ব্যাকরণ, ছন্দ এবং ইতিহাস প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর রচনার নমুনা গবেষকগণ আবিস্কার করেন। বিশ্বজগতের মূল গঠনের প্রশ্নে তিনি ছিলেন অণুবাদী। তাঁর মতে, ‘নাউস’ বা এক বিশ্বপ্রজ্ঞা জগতের মূল অণুগুলিকে সৃষ্টি করেছে। জ্যোতির্মণ্ডলের ব্যাখ্যায় হেরাক্লিডাস-এর মধ্যে সূর্যকেন্দ্রিকতার আভাস পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে সূর্যকেন্দ্রিকতার তত্ত্ব সুস্পষ্টভাবে এরিস্টার্কাস পোষণ করতেন। কিন্তু তার প্রাথমিক আভাস হেরাক্লিডাস-এর রচনাতেও দেখা যায়। হেরাক্লিডস মনে করতেন পৃথিবী নয়, সূর্য হচ্ছে বিশ্বের কেন্দ্র। হেরাক্লিডস অবশ্য সূর্যের আবর্তন অনুমান করতে পারেন নি। তিনি মনে করতেন সূর্য স্থির এবং পৃথিবী তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে।

Heraclitus: হেরাক্লিটাস (৫৩৫-৪৭৫ খ্রি. পূ.)
প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন হেরাক্লিটাস। বিরামহীন পরিবর্তনের ব্যাখ্যাতা হিসাবে তাঁর বিশেষ পরিচয়। এক নদীতে কেউ দুবার অবগাহন করতে পারে না, এ উক্তি বিখ্যাত হেরাক্লিটাসের বলেই পরিচিত। হেরাক্লিটাস মনে করতেন, বিশ্বের মূল বস্তু হচ্ছে আগুন। আগুন প্রবাহ ও পরিবর্তনের উত্তম দৃষ্টান্ত। সমগ্র বিশ্ব এবং তার অভ্যন্তরের বিশেষ বিশেষ বস্তু, কিংবা আত্মা সবকিছুর উৎপত্তি ঘটেছে আগুন থেকে। বিশ্বের সৃষ্টি অলৌকিক কোনো দেবতা দ্বারা ঘটে নি। আগুনের আকারে বিশ্ব বা বস্তু সব সময়েই ছিল এবং সব সময়েই থাকবে। এই অস্তিত্বের মূলে আছে বিশ্বের নিজস্ব ‘লগোস’ বা বিধান। হেরাক্লিটাস বিশ্বের প্রবাহকে মনে করতেন চক্রবৎ। এক চক্র বা এক কাল সমাপ্ত হলে বিশ্বের বস্তুপুঞ্জ আগুনে রূপান্তরিত হয়ে আর এক পরিক্রমা শুরু করে। নিয়ত পরিবর্তমান বস্তুপুঞ্জ নিজ নিজ অস্তিত্ব থেকে তার বিপরীতে পরিবর্তিত হতে থাকে। গরম ঠাণ্ডায় এবং ঠাণ্ডা গরমে রূপান্তরিত হয়। বস্তুর বিপরীতে পরিবর্তনের মূলে রয়েছে সংঘর্ষ। বিপরীতের সংঘর্ষেই বস্তুর পরিবর্তন ও প্রবাহ। এই নিয়ত পরিবর্তন ও প্রবাহের ফলে জগতের কোনো কিছুই অপর কিচু থেকে বিযুক্ত নয়। সব কিছুর সঙ্গে সব কিছু যুক্ত। কাজেই সব কিছুই আপেক্ষিক। জ্ঞানের প্রশ্নেও হেরাক্লিটাস ছিলেন বস্তুবাদী। তাঁর মতে ইন্দ্রিয় হচ্ছে জ্ঞানের মূল। ইন্দ্রিয়ানুভূতি এবং যুক্তি বা বুদ্ধি দ্বারা মানুষ সব রহস্যকেই ভেদ করতে পারে। মানুষের কাছে অজ্ঞেয় অলৌকিক কোনো জগৎ নেই। ‘প্রকৃতি’ সম্পর্কে হেরাক্লিটাসের বিখ্যাত রচনাংশ থেকে গবেষকগণ তাঁর দর্শন উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর সমসাময়িক প্রায় সব দার্শনিকের চিন্তাধারার বিরোধী ছিল হেরাক্লিটাসের চিন্তাধারা।

Heredity: বংশগতি, বংশানুক্রমিতা
জন্ম থেকে সন্তানে জীবনের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিকতাকে বংশগতি বলা হয়। জীববিদ্যায় বংশগতির মাধ্যমের প্রশ্ন একটি বিতর্কিত এবং বিশেষ আলোচিত প্রশ্ন। বিপরীত যৌনের সম্মেলনে জীবের উৎপাদন। কিন্তু জনকের গুণ সন্তানে কীভাবে প্রভাহিত হয় তার ধারণা পূর্বে স্পষ্ট ছিল না। কোষময় জীবের সৃষ্টি ধারায় পুরুষ ও নারীর ভূমিকার বৈশিষ্ট্য নির্ধারনের চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে সাধারণভাবে এই বলা যায় যে, বংশক্রম বা বংশগতির মূল হচ্ছে জীবের সঙ্গে পরিবেশের সম্পকর্ এবং উভয়ের পারস্পরিক প্রভাব। যে-কোনো শ্রেণীর জীবের জন্য তার পরিবেশই প্রধান। পরিবেশ অনুযায়ী নিজেকে পরিবর্তিত করে কিংবা নিজের প্রয়োজনে পরিবেশকে পরিবর্তিত করে জীবমাত্র জীবন ধারণ করার প্রয়াস পায়। এই প্রক্রিয়ায় জীবের যে চরিত্র, বৈশিষ্ট্য বা দেহগত কাঠামো বাঁচার অনুকূল বলে প্রমাণিত হয় সেই চরিত্র বা কাঠামো স্বভাবগত নির্বাচনের মাধ্যমে জীব নিজের অস্তিত্বের ধারাবাহিক অংশ হিসাবে তৈরি করে নেয় এবং যে চরিত্র বা কাঠামো বাঁচার প্রতিকূল হয় তা বর্জিত হয়ে অস্তিত্ব থেকে ক্রমান্বয়ে বিচ্ছিন্ন এবং বিলুপ্ত হয়ে যায়। জীবের বিবর্তনের মূল কারণ হচ্ছে এই পরিবর্তন এবং স্বভাবগত নির্বাচনের জৈবিক ক্ষমতা।

Hieroglyphs, Theory of: প্রতীকবাদ
জ্ঞানের প্রশ্নে একটি বিশেষ তত্ত্ব। ইন্দ্রিয়ের অনুভূতির মাধ্যমে আমরা বস্তু জগতের প্রতিচ্ছবি লাভ করি। এই প্রতিচ্ছবি মিলিয়ে মন বস্ত জগতের জ্ঞান তৈরি করে। এটি হচ্ছে জ্ঞানের সাধারণ গৃহীত তত্ত্ব। কিন্তু প্রতীকবাদ জ্ঞানের এই তত্ত্বকে স্বীকার করে না। প্রতীকবাদের মতে ইন্দ্রিয়ানুভূতি আমাদের মনে বস্তুর হুবহু প্রতিচ্ছবি তৈরি করে না, সে মনের মধ্যে কতকগুলি প্রতীক বা সঙ্কেতের সৃষ্টি করে। এই প্রতীক বা সঙ্কেতগুলির সঙ্গে বস্তুর চরিত্রের কোনো সাদৃশ্য নেই। বিশ শতকের গোড়ার দিকে রুশ দার্শনিক প্লেখানভ জ্ঞানের প্রশ্নে ‘প্রতীক’ শব্দের ব্যবহার করেন। প্রতীকবাদ জ্ঞানের প্রশ্নে অজ্ঞেয়বাদে পর্যবসিত হতে পারে। কারণ, ইন্দ্রিয়ানুভূতি যদি বস্তুর চরিত্রকে মনের মধ্যে প্রতিফলিত না করে কেবল কতকগুলি বৈশিষ্ট্যহীন প্রতীক মাত্র সৃষ্টি করে তা হলে বস্তুর চরিত্র জানা মনের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মনের কাছে বস্তু অজ্ঞেয় থেকে যায়। দ্বন্দ্বমূলক বা বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ প্রতীকবাদকে সঠিক মনে করে না। ইন্দ্রিয়ানুভূতি মনে বস্তুজগতের হুবহু প্রতিচ্ছবি তৈরি না করলেও ইন্দ্রিয় হচ্ছে বস্তুজগৎ ও মনের মধ্যকার সাক্ষাৎ যোগসূত্র। ইন্দ্রিয়দত্ত অনুভূতিগুলি হচ্ছে মনের নিকট বস্তুজগতের জ্ঞান তৈরির স্থূল কাঁচামাল বিশেষ। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বস্তুজগতের সঙ্গে মনের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে মনের বিশ্লেষণ, সংশ্লেসণ, অনুমান ইত্যাকার বিভিন্ন ক্ষমতা বিকাশ লাভ করেছে। মন ইন্দ্রিয়ের দেওয়া অনুভূতির পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ প্রভৃতি মারফত বস্তুজগতের ধারণা তৈরি করে। এ ধারণা বা জ্ঞান কোনো সময়ে চরম এবং অপরিবর্তনীয় নয়। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মন ও বস্তুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যেমন নিরন্তর চলছে তেমনি বস্তুজগৎ সম্পর্কে মনের জ্ঞানও বিকশিত হচ্ছে।

Hinduism: হিন্দু ধর্ম
ভারতবর্ষের প্রাচীন ধর্ম। বর্তমানকালেও পৃথিবীর প্রচলিত ধর্মসমূহের অন্যতম ধর্ম হচ্ছে হিন্দু ধর্ম। ‘হিন্দুদের ধর্ম’ হিসাবেও শব্দটির ব্যবহার করা হতো। এবং এদিক থেকে ‘ইণ্ডাস’ অঞ্চলের অধিবাসীদের ধর্মকে হিন্দু ধর্ম বলা হতো। এ থেকে বুঝতে পারা যায় হিন্দু ধর্ম দ্বারা কোনো সীমাবদ্ধ সুনির্দিষ্ট একক বিশ্বাসের বদলে প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন অহ্চলের এবং যুগের অধিবাসীদের নানা প্রকার বিশ্বাস, আচার, আচরণ ও চিন্তাকে সামগ্রিকভাবে বুঝানো হতো। প্রাচীনকালে এই সমস্ত বিশ্বাস ও দর্শন আর্যদের ভারত আগমনের পূর্বেও ভারতে এক বিকশিত সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল। অনুমান করা হয় খ্রি. পূ. ১৮০০-১৫০০ শতকের সময়কালে ভারতের বাইরে থেকে আগত আর্যদের সঙ্গে আদি ভারতবাসী তথা অনার্যদের দীর্ঘকালব্যাপী সংঘর্ষ এবং সমন্বয় প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়। কালক্রমে আদি ভারতবাসীদের দেবদেবী বিশ্বাসও আর্যদের দেবদেবী ও বিশ্বাসের অঙ্গীভূত হয়ে এক বিস্তারিত এবং মিশ্র এক ধর্ম ব্যবস্থা বিকশিত হয়। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর এই তিন শক্তি হচ্ছে হিন্দু ধর্মের মূল অলৌকিক শক্তি। ভারতীয় দর্শন এবং ভারতীয় ধর্ম, দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করা কষ্টকর। কর্মের ভিত্তিতে বারংবার পুনর্জন্ম এবং এই দারার ক্রমান্বয়ে কর্মের বন্ধন থেকে আত্মার মুক্তি, হিন্দু ধর্মের অন্যতম দার্শনিক বিশ্বাস। হিন্দু ধর্মের সমাজব্যবস্থায় একটি বৈশিষ্ট্য ছিল চার বর্ণাশ্রমব্যবস্থা: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র। আদিতে জীবিকার বিভাগ হিসাবে এই ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়ে থাকলেও পরবর্তীতে এই ব্যবস্থা জন্মগত এবং অপরিবর্তনীয় হয়ে দাঁড়ায় এবং একটির চেয়ে অপরটি উত্তম কিংবা অধম বলে বিবেচিত হয়। এই বর্ণাশ্রমে সবচেয়ে নিম্নে অবস্থিত শূদ্র এবং হরিজন। তারা উচ্চতর, বিশেষ করে উচ্চমত শ্রেণী ব্রাহ্মনের কাছে অস্পৃশ্য বলে গণ্য হতো। সামাজিক ক্ষেত্রে বর্ণাশ্যমের এই ভেদ ভারতবর্ষে আজও বিলুপ্ত হয় নি। এই ভেদাভেদের মূল ভিত্তি যে উচ্চতর অর্থনৈতিক শ্রেণীর সঙ্গে নিম্নতর বিত্তহীন মানুষের স্বার্থ এবং অধিকারের বৈষম্য এবং সংঘর্ষ, তা আধুনিককালে বুঝতে অসুবিধা হয় না। মহাত্মা গান্ধী সামাজিক বিপ্লবের পরিবর্তে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে প্রেম ও দয়ার কথা প্রচার করে এই বর্ণভেদের বৈষম্যকে দূর করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তাঁর সে ব্যক্তিভিত্তিক মহৎ চেষ্টা তেমন সফল হতে পারে নি।

Hippocratis: হিপোক্রাটিস (৪৬০-৩৭৫ খ্রি. পূ.)
প্রাচীন গ্রিসের চিকিৎসাবিদ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক বলে তিনি পরিচিত। সততার সঙ্গে মানুষের সেবাই হবে একজন চিকিৎসকদের নীতি বা ধর্ম –এই মর্মে চিকিৎসকের শপথ নেওয়ার যে কথা তিনি বলেচিলেন তা আজো ‘হিপোক্রাটিসের শপথ’ বলে সম্মানিত। তাঁর জীবনকালে তিনি গ্রিসের বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তাঁর চিকিৎসার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল মানুষকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা। পর্যবেক্ষণ হচ্ছে বিজ্ঞানের প্রথম শর্ত। সেকালেও রোগের ক্ষেত্রে শল্য চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচারের তিনি একজন প্রবক্তা ছিলেন। মানুষের রোগের মূলে রয়েছে দেহের রক্তের সংশ্লেষণ ব্যত্যয়ের উদ্ভব এরূফ অভিমত পোষণ করে দেহের জলীয় পদার্থকে তিনি বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেন। ধীর, স্থির চরিত্রের অধিকারী হিপোক্রাটিসের মন তাঁর রোগীদের জন্য যেমন সহানুভূতিতে পূর্ণ ছিল, তেমনি তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান দ্বারা তাঁর সহকর্মী ও উত্তরাধিকারী চিকৎসক-সমাজও যেন লাভবান হতে পারে, তেমন একটি দার্শনিক এবং সহৃদয় বোধ দ্বারা হিপোক্রাটিস উদ্ধুদ্ধ ছিলেন। বিজ্ঞানের সেই সূচনাকালে যেখানে কল্পনা এবং দর্শনেরই ছিল প্রাধান্য সেখানে হিপোক্রাটিস সেই পথিকৃৎদের অন্যতম যাঁরা যুক্তিকে বাস্তব পর্যবেক্ষণে প্রয়োগ করে প্রমাণযোগ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বস্তুত হিপোক্রাটিসের অনুসৃত পদ্ধতিই আরোহী বিজ্ঞান তথা ‘ইনডাকটিভ সায়েন্স’-এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ কারণে হিপোক্রাটিস এবং তাঁর অনুসারীদের রচনাসমূহের তাৎপর্য কেবল চিকিৎসাশাস্ত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সেকালে হঠাৎ মূর্ছা যাওয়া এবং অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যাধিকে ভৌতিক বা অলৌকিক বলে সাধারণ মানুষ ধারণা করত। রোগের কার্যকারণবোধ স্বীকৃত ছিল না। কিন্তু এই কালেই হিপোক্রাটিসের একজন অনুসারী মূর্ছা যাওয়ার ঘটনাকে কার্যকারণের ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন। এ প্রসঙ্গে খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৪০০ বৎসর পূর্বে হিপোক্রাটিসের রচিত ‘অলৌকিক রোগ’ বা ‘সেকরেড ডিজিজ’ নামক রচনায় তার নিম্নোক্ত উক্তিটি বিশেষ তাৎপর্যময় উক্তি বলে বোধ হয়।
“যেসব রোগকে অলৌকিক বলে অভিহিত করা হয় তারাও কারণবিহীন নয়। অন্য রোগের মতো এ সকলেও উৎস হচ্ছে দেহের মধ্যে শৈত্য, তাপ, বায়ু এবং এরূপ নিত্য-অস্থির উপাদানসমূহের প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণ। সব ঘটনারই পূর্ব ঘটনা থাকে। যে তার অন্বেষণ করে সে অবশ্যই তার সাক্ষাৎ লাভে সক্ষম হয়”। (দ্র A Short History of Scientific Ideas to 1900 by Charles Singer. Oxford University Press 1959.)।

Hippocratic Oath: হিপোক্রাটিসের শপথ
চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক, খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের চিকিৎসাবিদ হিপোক্রাটিস অসুস্থ মানুষের সেবায় নিঃস্বার্থ এবং সততার সঙ্গে চিকিৎসকমাত্রের করণীয় হিসাবে যে শপথনামা তৈরি করেছিলেন তা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে পৃথিবীব্যাপী হিপোক্রাটিসের শপথ বা ‘হিপোক্রাটিক ওথ’ নামে পরিচিত। হিপোক্রাটিসের শপথের মর্মকথা ছিল এরূপ: “যে গুরু আমাদের শিক্ষাদান করেছেন মহৎ এই শাস্ত্র, তিনি আমার পিতার মতো: আমার জীবন তাঁর জীবনেরই অঙ্গস্বরূপ আমার যা কিছু সুখ, তাকে আমি ভোগ করব আমার সেই পিতার সঙ্গে মিলিতভাবে। তাঁর সন্তানতরা আমরা নিজের সহোদর সম। আমার কর্তব্য আমার এ সহোদরদের শিক্ষাদান করা আমার গুরুর প্রদত্ত এই শাস্ত্র-কৌশলকে। এই শাস্ত্রকে আয়ত্ত করার অদিকার কেবল তাদেরই যারা এই শাস্ত্রের নীতিকে মান্য করার প্রতিশ্রুতিতে স্বইচ্ছাতে আবদ্ধ। আমার জ্ঞান, ক্ষমতা এবং বিবেচনাবোধ দ্বারা আমি আমার রোগীদের তেমন নিরাময়পত্রই প্রদান করব, যা তাদের মঙ্গল সাধন করবে, উপশমে সাহায্য করবে এবং ক্ষতির কোনো কারণ হবে না। কোনো মারাত্মক ঔষধ যা আমার রোগীর মৃত্যু ঘটাতে পারে, আমি তেমন কোনো ঔষধের ব্যবস্থা আমার রোগীকে প্রদান করব না কিংবা মাতার গর্ভজাত ভ্রুণকে বিনষ্টকারী কোনো উপায়েরও আমি উৎস হবো না। আমার জীবনের এবং এই শাস্ত্রের পবিত্রতা রক্ষা করা হবে আমার পালনীয় ব্রত। আমার রোগীর দেহে বিষাক্ত পদার্থের বিমোক্ষণে শল্য ক্রিয়ার প্রয়োজন হলে তা সম্পন্ন করার দায়িত্ব কেবল এমন ক্রিয়ার বিশেষজ্ঞেরই: অবিশেষজ্ঞের নয়। আমার রোগীর গৃহে প্রবেশ ঘটবে তার উপশম এবং মঙ্গলের জন্য: স্ত্রী কিংবা পুরুষ, দাস কিংবা অ-দাস কারুর প্রতি কোনো মোহাকর্ষণ আমার জন্য অপবিত্র। আমার চিকিৎসাকর্মকালে আমার রোগীর যা কিছু তথ্য আমার জ্ঞানের মধ্যে আসুক না কেন তাকে গোপন রাখা এবং প্রকাশ না করা হবে আমার শাস্ত্রীয় কর্তব্য। আমার এই আনুগত্যই হবে আমার জীবনের সকল সুখ ও সম্মানের একমাত্র ভিত্তি। এবং এর কোনো ব্যত্যয় নিয়ে আসবে আমার জীবনে এর বিপরীত তথা অভিশাপ এই হোক আমার জীবনের প্রত্যয় এবং প্রত্যাশা”।

History, Economic Interpretation of: ইতিসাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা
ইতিহাসের মার্কসবাদী ব্যাখ্যাকে অনেক সময়ে ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা বলে অভিহিত করা হয়। বস্তুত মার্কসবাদের মূল সূত্র তিনটি বলে পরিচিত ১. বস্তুবাদ তথা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ ২. ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বা ইতিহাসের ব্যাখ্যায় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়োগ ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ; ৩. সমাজের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ। মার্কস মানুষকেই ইতিহাসের নির্মাতা বলেছেন। তাঁর মতে মানুষই ইতহাস তৈরি করে। কিন্তু যে-কোন ব্যক্তি-মানুষের ইচ্ছামাফিক নয়। মানুষ ইতিহাসের বিধানকে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দ্বারা দ্বান্দ্বিকভাবে জ্ঞাত হওয়ার মাধ্যমে ইতিহাস নির্মাতার ভূমিকা পালণন। এর অর্থ, ব্যক্তি-নিরপেক্ষভাবে ইতিহাসের বিকাশের বিধান আছে। এই প্রসঙ্গে মার্কস বলেছিলেন, এ যাবৎকালের দর্শনের ইতিহাসের বিকাশের বিধান আছে। এই প্রসঙ্গে মার্কস বলেছিলেন, এ যাবৎকালের দর্শনের ইতিহাসে দেখা যায়, দার্শনিকগণ নানাভাবে জীবন ও সমাজকে ব্যাখ্যা করেছেন। যেন মানুষের ব্যাখ্যা করার অধিকতর কোনো ভূমিকা নেই। ‘আসলে প্রয়োজন এখন কেবল ব্যাখ্যার নয়, প্রয়োজন মাজকে পরিবর্তনের’। এমন কথা দ্বারা মার্কস ইতিহাসের বিকাশে ইতিহাসের বিধানের জ্ঞানে সমৃদ্ধ মানুষের সক্রিয় ভূমিকার উপর জোর প্রদান করতে চেয়েছেন। মার্কসীয় সূত্রের সহজ ব্যাখ্যা এই যে, ১. বস্তু হচ্ছে মূল সত্তা; ২. বস্তুবাম্রই দ্বন্দ্বমূলক গতিসম্পন্ন; ৩. মানুষও বস্তুর দ্বন্দ্বমান বিকাশের প্রকাশ এবং মানুষের সামাজিক জীবনের ইতিহাসও হচ্ছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের দৃষ্টান্তস্বরূপ; ৪. মানুষের সমাজ-জীবনের মূল হচ্ছে মানুসের জীবন নির্বাহের জন্য কর্মকাণ্ড ততা তার অর্থনৈতিক কার্যাবলী। অর্থনৈতিক কার্যাবলীর প্রধান হচ্ছে জীবিকা সংগ্রসের হাতিয়ার বা উপায় এবং এই হাতিয়ার বা উপায়সমূহের ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে সম্পর্ক। এর একটিকে উৎপাদনের শক্তি এবং অপরটিকে উৎপাদনের সম্পর্ক বলে অভিহিত করা চলে। উৎপাদনের উপায় বা শক্তি এবং উৎপাদনের সম্পর্ক অপরিবর্তিত থাকে না। তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বমূলক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় তার পরিবর্তিত হয় এবং আদিমকাল থেকে পরবর্তিত হয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে ঊনবিংশ শতকের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উপনীত হয়েছেঠ। এই পরিবর্তন প্রবহমান। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্তার পর থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের পরে, সমাজ উৎপাদনের উপায়ের মালিক এবং অ-মালিক, এরূপ আর্থিক শ্রেণীতে বিভক্ত হয়েছে। পুনরায় অর্থনৈতিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে যৌথ মালিকানা তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সমাজ অর্থনৈতিকভাবে পরস্পর-বিরোধী দ্বন্দ্বমান শ্রেণীবিভক্ত সমাজ এবং এই সমাজের ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। মানব সমাজের ইতিহাসের এরূপ ব্যাখ্যা ইতিহাসের ব্যাখ্যা হিসাবে পরিচিত। (দ্র. Dialecal Materialism: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ)।

Historicism: ঐতিহাসিকতাবাদ
ইতিহাসের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো বস্তু বা বিষয়ের উদ্ভব এবং বিকাশের অনুধাবন। ঐতিহাসিকতাবাদ বৈজ্ঞানিক গবেষণার একটি মৌলিক পদ্ধতি। জগৎ ও সমাজের প্রশ্নে আধুনিক বিজ্ঞানের বিকাশের পূর্ব পর্যন্ত প্রচলিত পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য ছিল দার্শনিক কল্পনা ও বিশ্লেষণ। এ পদ্ধতিতে সমস্যামাত্রকে নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন মনে করা হতো। ফলে, বাস্তব অবস্থা, অতীত ঘটনা ইত্যাদি নিরপেক্ষভাবে দার্শনিকগণ যে-কোন সমস্যার রহস্যোদঘাটন এবং সমাধান সম্ভব বলে মনে করতেন। অনেকে ইতিহাসকে মনে করতেন একটা চক্রের আবর্তন। এরূপ আবর্তনে সমাজে এবং জগতে নতুনের কোনো বিকাশ সম্ভব বলে মনে করা হয় না। চক্রের আবর্তনে একই ঘটনা, সমস্যা বা বিষয় বারবার আবির্ভূত হয়। ইতিহাস ও জগতের এই দার্শনিক ব্যাখ্যা প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত সমাজ ও বিজ্ঞানের সর্বক্ষেত্রে জ্ঞানের বিকাশকে আড়ষ্ট করে রেখেছিল। ঐতিহাসিকতাবাদ দার্শনিক সেই ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করে সমাজ ও ইতিহাসের সর্বত্র আপেক্ষিকতার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কোনো বস্তু বা ঘটনাই কালনিরপেক্ষ নয়। তার বর্তমান চরিত্র নিদিষ্ট হচ্ছে তার অতীত উদ্ভব এবং বিকাশ দ্বারা। তার ভবিষ্যৎও নির্দিষ্ট হবে সেই বিকাশের প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত বর্তমান দ্বারা। সমাজের কোনো অবস্থারই হুবহু পুনরাবর্তন সম্ভব নয়। ইতিহাসকে সদা নতুন দিগন্তে অগ্রসরমান রথ বলে মনে করা চলে, তাকে শুধু চক্র বলে মনে করা চলে না। অতীতই ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করে; কোনো অতীত ভবিষ্যৎ ফিরে আসতে পারে না। জীবনের জন্ম ও বিকাশকে চার্লস ডারউইন ঐতিহাসিকতার তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করে জীববিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের বিকাশকে অবারিত করে দিয়েছেন। ঐতিহাসিকতাবাদের তত্ত্ব প্রয়োগ করে মার্কসবাদ মানুসের সামাজকি জীবনের বিকাশের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তৈরি করেছে।

Hitler Adolf: এ্যাডলফ হিটলার
হিটলারের (১৮৮৯-1945) পার্টির নাম ছিল ফ্যাসিস্ট পার্টি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে হিটলারের বিরোধী সমাজতান্ত্রিক পার্টি ছিল জার্মানীর কমিউনিস্ট পার্টি। জার্মান রাইখকে বলা হত পার্লামেন্ট। হিটলারের পার্টি রাইখে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে দায়ী করে কমিউনিস্টদের ব্যাপকভাবে গ্রেপ্তার করতে থাকে। দ্বিতীয় যুদ্ধের সময়ে হিটলারের আসল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েট ইউনিয়নকে ধ্বংস করা। এই উদ্দেশ্যে ইউরোপের অন্যান্য দেশ আক্রমণ করার পরে ১৯৪১ সালে সোভিয়েট ইউনিয়নকে সর্বগ্রাসীভাবে আক্রমণ করে। সোভয়েট ইউনিয়নের নেতা স্ট্যালিনের নেতৃত্বে আমরণ প্রতিরোধ করতে থাকে। হিটলারের বাহিনী মস্কো ঘেরাও করে ফেললেও মস্কো দখল করতে ব্যর্থ হয়। সোভিয়েট সৈন্য পাল্টা আক্রমণ করে ফ্যাসিস্ট বাহিনী পরাজিত করে বার্লিন পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে মিত্রপক্ষের রুজভেল্ট এবং ইংল্যাণ্ডের নেতা উইনস্টোন চার্চিলের মিলিত সভায় হিটলারের বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। সংক্ষেপে এটাই হচ্ছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কাহিনী।

Hobbes, Thomas: টমাস হবস (১৫৮৮-১৬৭৯ খ্রি.)
টমাস হবস ছিলেন সপ্তদশ শতকের ইংল্যাণ্ডের বস্তুবাদী দার্শনিক। ইংল্যাণ্ডে এই সময়ে ধনতান্ত্রিক সমাজ-বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে। ধানতান্ত্রিক বিপ্লবের এই পরিবেশ টমাস হবসকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। হবসকে যান্ত্রিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যাতা বলা হয়। তাঁর মতে সমগ্র জগৎ হচ্ছে বস্তুর সমষ্টি। মানুষও বস্তুমাত্র। জগৎ ও সমাজ, সর্বক্ষেত্রে একটি মাত্র মৌলিক বিধান কার্যরত রয়েছে। সে বিধান হচ্ছে বস্তুর যান্ত্রিক গতি। মানুষ কিংবা অপরাপর জন্তু বস্তুর জটিল গ্রন্থনে সৃষ্ট যন্ত্রবিশেষ। কোনো যন্ত্র যেমন বাইরে থেকে দেওয়া শক্তির জোরে চলতে থাকে, মানুষ এবং জন্তুরও বাইরের শক্তি দ্বারা চালিত হচ্ছে। কাজে কাজেই মানুষ বা অপর প্রাণীর মধ্যে দেহের অতিরিক্ত অস্তিত্বসম্পন্ন আত্মা বলে কিছু নেই। বিধাতাকে আত্মার স্রষ্টা বলা হয়; কিন্তু বিধাতা মনুষের কল্পনার সৃষ্টি বৈ কোনো অস্তিত্ব নয়। বস্তু থেকে বস্তুর পার্থক্য কেবল সংখ্যা বা পরিমাণগত। হবস বিধাতাকে কাল্পনিক বলে বস্তুবাদের পরিপোষক হয়েছেন, কিন্তু বস্তুর গতি বস্তুর বাইরে থেকে আসে মনে করে বস্তুকে আর এক কাল্পনিক শক্তির উপর নির্ভরশীল করেছেন। বস্তু যে আপন শক্তিতেই গতিসম্পন্ন, এ ধারণাকে অস্বীকার করেন। ইন্দ্রিয়ের অনুভূতির ভিত্তিতেই মানুষের জ্ঞান তৈরি হয়, অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে বা সহজাত কোনো ভাবের মাধ্যমে নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় শাসনের প্রশ্নে হবস রাজার ঐশ্বরিক অধিকারের তত্ত্বকে নাকচ কর সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব সমর্থন করেন। তাঁর মতে মানুষের সম্মিলিত চুক্তির ভিত্তিতে সমাজ তৈরি হয়েছে এবং রাজাও চুক্তির ভিত্তিতে রাজ্য শাসন করেন। রাজার হাতে চুক্তির ভিত্তিতে অধিকার সমর্পণ করার পরে নাগরিকের রাজাকে অমান্য করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। একচ্ছত্র রাজতন্ত্র ইচ্ছামতো প্রতিষ্ঠিত হয় না, সমাজ দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং জনসাধারনের জন্য একমাত্র রাজতন্ত্রই সর্বোত্তম শাসন-ব্যবস্থা। কারণ, সমাজের ব্যক্তিমাত্রই স্বভাবগতভাবে স্বার্থপর এবং অপরের অধিকারের প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন। এর ফলে শক্তিশালী শাসক ব্যতীত সমাজে অরাজকতা বিরাজ করারই আশঙ্কা। শাসকের শক্তি সীমাবদ্ধ হলে শাসক সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ব্যর্থ হবে। মূলত একচ্ছত্র শাসন সমর্থন করলেও হবস মনে করতেন, ব্যক্তি তার জীবন রক্ষার প্রয়োজনে বিদ্রোহের অধিকারী। হবসের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় তত্ত্বের বিস্তারিত প্রকাশ ঘটেছে ‘লেভিয়াথান’ নামক তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ।

Holbach: হলবাক (১৭২৩-১৭৮৯ খ্রি.)
ফরাসি বিপ্লব-পূর্বকালের বস্তুবাদী দার্শনিক। ফরাসি বিশ্বকোষকারকদের নাম জ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাত। হলবাককে এই বিশ্বকোষকারকদের কেন্দ্রীয় শক্তি বলে মনে করা হতো। তাঁর ‘লা সিস্তেম দা লা ন্যাচার’ নামক গ্রন্থ প্যারিস পার্লামেণ্টের আদেশে ১৮৭০ সালে ভস্মীভূত করা হয়। হলবাকের মতামত ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। ধর্ম এবং ভাববাদী দর্শনের তিনি ছিলেন বিরোধী। তাঁর মতে ধর্মের উৎপত্তি অধিকাংশ মানুষের অজ্ঞতা, ভয় এবং কিছু সংখ্যক সচেতন লোকের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে প্রতারণামূলক অভিসন্ধির মধ্যে নিহিত। হলবাক ধর্মযাজক বার্কলে ব্যাখ্যাত ভাববাদের তীব্র সমালোচনা করে ভাববাদকে মানুসের সাধারণ বুদ্ধির বিরোধী এক অবাস্তব তত্ত্ব বলে অভিহিত করেন। বস্তুর বাইরে কোনো অস্তিত্ব নেই; বস্তু আমাদের ইন্দ্রিয়কে আঘাত করে আমাদের মধ্যে অনুভূতির সৃষ্টি করে। বস্তুর মৌল পদার্থ হচ্ছে অবিভাজ্য অণু। হলবাকের মতে বস্তুর গতি আছে কিন্তু সে গতি যান্ত্রিক। মানুষ প্রকৃতির অংশ এবং প্রাকৃতিক বিধানে সে আবদ্ধ। মানুষ প্রাকৃতিক বিধানের অধীন –এ তত্ত্বের যেরূপ ব্যাখ্যা হলবাক করেন তাতে মনে হয় যেন মানুষ অসহায়ভাবে নিয়ন্ত্রণবাদের দাস।
Hsun Tzu : সুনজু(২৪৯-২৩৮ খৃ.পূ)
প্রাচীন চীনের একজন বস্তুবাদী দার্শনিক ছিলেন সুনজু। তাঁর সময়কার প্রচলিত চিন্তাধারার তিনি ছিলেন বিরোধী। সমগ্র বিশ্বকে বস্তু হিসেবে ব্যাখ্যা করার তিনি চেষ্টা করেন। বিশ্বের কোনো স্রষ্টা আছে-এ কথা তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি প্রকৃতির ক্ষেত্রে দুটি শক্তি অস্তি (ইয়াং) এবং নাস্তি( ইন) এর তত্ত্ব তৈরি করেন। বিশ্বের সব কিছুই নিয়ত অস্তি এবং মাস্তির পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভূত ও পরিবর্তিত হয়ে চলছে। তাঁর মতে জ্ঞানের শুরু ইন্দ্রিয়ের অনুভূতিতে। কিন্তু শুধু অনুভূতি জ্ঞান নয়। মানুষের বুদ্ধি ইন্দ্রিয়লব্ধ অনুভূতির ভিত্তিতে প্রকৃতির জ্ঞান তৈরি করে। শিক্ষা হচ্ছে মানুষের মুক্তির একমাত্র উপায়। মানুষের মধ্যে যার যা কিছু মহৎ তা শিক্ষার দ্বারাই সৃষ্টি হয়। চীনের দর্শনের পরবর্তী বিকাশ সুনজুর চিন্তাধারা দ্বারা বিরাটভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
Hume, David: ডেভিড হিউম(১৭১১-১৭৬৬ খৃ.)
ইংরেজী ভাববাদী দার্শনিক ডেভিড হিউম মনোবিজ্ঞানী এবং ঐতিহাসিক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। জ্ঞানের সমস্যার যে ব্যাখ্যা হিউম উপস্থাপিত করেন তা পরবর্তীতে ভাববাদী দর্শনকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেন। ‘জ্ঞানের মূল হচ্ছে ভাব’- এ তত্ত্ব দুটি ধারার সৃষ্টি করে। জন লক বলেছেন, ভাবের মূল হচ্ছে অভিজ্ঞতা। বার্কলে বলেছেন, ভাবের মূল হচ্ছে মন। ভাব মনকে অতিক্রম করে বস্তু বা অভিজ্ঞতায় আদৌ পৌছতে পারে না। এ তর্কে হিউম যোগদান করে বললেন, এই বিরোধিতায় জ্ঞানের মূল সমস্যার কোনোরূপ মীমাংসা আদৌ সম্ভব নয়।
‘বস্তু আছে কি নেই’ এরূপ প্রশ্নের সমাধান ভাবের তত্ত্ব দ্বারা কোনোরূপে সম্ভব নয়। হিউমের মতে আসলে মানুষ বস্তুর জ্ঞান আদৌ লাভ করতে পারে না। তার অর্থ এই নয় যে, বস্তু নেই-একথা মানুষ জানতে পেরেছে। বস্তু আছে বা নেই জ্ঞান দ্বারা মানুষ এর কোনো উত্তরই দিতে পারে না। বস্তুর সঠিক জ্ঞান বলতেও কিছু নেই। সঠিকজ্ঞান কেবলমাত্র অঙ্কশাস্ত্রেই সম্ভব। কারণ, অঙ্কের কারবার বস্তু নিয়ে নয়, সংখ্যা নিয়ে, সূত্র নিয়ে। সংখ্যা বা সূত্র কোনো বস্তু নয়। জ্ঞানের মূল কাজ বস্তুর অস্তিত্ব নির্ণয় করা নয়। জ্ঞানের কাজ হচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনের সহায়ক মাধ্যম হওয়া। ভাবের প্রবাহ বা ধারা নিয়ে আমাদের সাধারণ জ্ঞান তৈরি হয়। কিন্তু ভাবের মূল কি, তা মানুষের অজ্ঞেয়। বস্তু আছে কি নেই-দুটোই আমাদের অবিশ্বাসের ব্যাপার, প্রমাণের বিষয় নয়। আমরা বিশ্বাস করি, ঘটনার মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধ আছে। কোনো ঘটনাকে কোনো ঘটনার কারণ কিংবা ফল হিসেবে আমরা চিহ্নিত করি। কিন্তু ঘটনার মধ্যে কারণ কিংবা ফল আছে বলে প্রমাণ করা চলে না। মানুষের মধ্যে যে সময় বোধ আছে, তা থেকে মানুষ ঘটনাসমূহকে কালের বুকে পূর্বাপর হিসেবে কল্পনা করতে পারে; কিন্তু তার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে বার করে তার ভিত্তিতে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী সে করতে পারে না। মানুষ অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কেবল আশা করতে পারে যে, অতীতে যা ঘটেছে ভবিষ্যতেও তা ঘটবে। কিন্তু অনিবার্য পুনরাবৃত্তির নিয়ম সে আবিষ্কার করতে পারে না। হিউম অবশ্য মানুষের ভাবের রাজ্যকে অরাজক বলতে চান নি। মানুষ অভিজ্ঞতার মধ্যে অনেক ভাবকে শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে সংঘটিত হতে দেখে। কিন্তু কার্যকারণের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশ্বাস এক কথা, আর তার অস্তিত্ব প্রমাণ আর এক কথা। মোট কথা, জ্ঞানের সমস্যার বিশ্লেষণে হিউম দেখাতে চেয়েছেন যে, মানুষের পক্ষে জ্ঞান অর্থাৎ বস্তুর লাভ সম্ভব নয়। এই জন্য হিউমকে অজ্ঞেয়বাদী বলে অভিহিত করা হয়।
Hunger-strike: অনশন
অনশন শব্দটির অর্থ হচ্ছে কোনো খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ না করা। উপবাসে থাকা। বিভিন্ন ধর্মে কোনো কোনো উপলক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য উপবাস করার নিয়ম দেখা যায়। এরূপ অনশন দ্বারা মানুষ মনের শান্তি লাভ করতে চায় এবং ধর্মের অনুশাসন লাভ করে। কিন্তু আধুনিককালে অনশন একটি রাজনৈতিক অর্থ বহন করে। বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে অনশনকে সংগ্রামের একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। ভারত উপমহাদেশ যখন ইংরেজ শক্তির শাসনে ছিল তখন ইংরেজ সরকার বিভিন্ন সময় স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে এবং কারাগারে বন্দীদের উপর নানারূপ নির্যাতন করার নীতি অনুসরণ করেছে। কারাগারে আবদ্ধ এরূপ বন্দী নিতান্তই অসহায়। বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে তার দৈহিক সংগ্রাম করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু এমন অবস্থাতেও যে বন্দী তার বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের উপায় বের করতে পারে, তার দৃষ্টান্ত ভারতের কারাগারে আবদ্ধ স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মীগণ বহুবার স্থাপন করেছেন। তাঁরা কারাগারে নিজেদের জন্য রাজনৈতিক ও মানবিক মর্যাদা আদায়ের জন্য এবং সরকার কিংবা কারাগার কর্তৃপক্ষের অন্যায় আদেশ ও আচরণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক উপায় হিসেবে খাদ্যগ্রহণ করার অস্বীকার করার নীতি গ্রহণ করেন। ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘদিন যাবত অনশন বা এরূপে স্বেচ্ছায় খাদ্য গ্রহণ না করে বন্দিশালায় বহু বন্দি মৃত্যুও বরণ করেছেন। তাঁদের সেই মৃত্যু দেশের ব্যাপকতর জনসাধারণের মাঝে আবেগের সঞ্চার করেছে এবং দেশের মানুষকে স্বাধীনতা আন্দোলনে অধিকতর উদ্বুদ্ধ করেছে। এভাবে কারাগারের মধ্যে আবদ্ধ থেকেও নিজেদের জীবনদান করে রাজবন্দিরা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে অগ্রসর করে দিয়েছেন। এরূপ ঘটনা ও জীবন দানের কাহিনীর মধ্যে লাহোর দূর্গে বন্দী বাংলার বিপ্লবী নেতা যতীন দাসের ১৯২৯ সনে ৬৩ দিনের অনশন এবং এই অনশনে তাঁর মৃত্যু একটি স্মরণীয় ঘটনা। কারাগারে অনশনে যতীন দাসের মৃত্যু ঐ সময়ে সমগ্র ভারতবর্ষকে আন্দোলিত করে তুলেছিল। কবি রবীন্দ্রনাথ যতীন দাসের মৃত্যুতে ক্ষোভ প্রকাশ করে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করেছিলেন এবং জনসাধারণের প্রতিবাদসভায় যোগদান করেছিলেন। আন্দামান দ্বীপে কারারুদ্ধ রাজনৈতিক বন্দিরাও একাধিকবার সে যুগে অনশন ধর্মঘট করেছিলেন এবং তাতে জানা-অজানা বহু বন্দি মৃত্যুবরণ করেন। পাকিস্তান শাসনামলেও বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে শত শত রাজবন্দি আমরণ অনশন ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে ১৯৪৯-১৯৫০ সনে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অবলম্বিত ৫৮ দিনের অনশন ধর্মঘট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই অনশনে কুষ্টিয়ার শ্রমিক নেতা শিবেন রায় নিহত হন। কারাগারের বাইরেও রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা অনশন করার দৃষ্টান্ত আছে। এরূপ অনশনের দৃষ্টান্ত প্রথম স্থাপন করেন ভারতের অহিংস আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী। তিনি অনেকবার ঘোষণা করে অনশন করেছেন। কেবল ইংরেজ শক্তির কোনো নীতি বা নির্যাতনের বিরুদ্ধে নয়। নিজের ‘আত্মাকে শুদ্ধ’ করার উদ্দেশ্যে বা দেশবাসীর কোনো অবাঞ্চিত আচরণের প্রতিবাদেও অনির্দিষ্টকালের বা আমরণ অনশনের ঘোষণা দ্বারা তিনি অনশন করেছেন। বাংলাদেশের জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও গান্ধীজির অনুসরণে বিভিন্ন সময়ে অনশন করেছেন।
ভারতের বাইরে, ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে উত্তর আয়ারল্যান্ডের রাজবন্দিদের অনশন সাম্প্রতিককালে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছে। ১৯৮২ সনে এরূপ অনশনে একাধিক রাজবন্দি মৃত্যুবরণ করেছেন।
Hypothesis: প্রকল্প, আন্দাজ
কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সমাধানের মধ্যে কোনো একটিকে নির্বাচন করে প্রমাণ ও পরীক্ষার দিকে অগ্রসর হওয়ার পদ্ধতিকে প্রকল্প বা আন্দাজের ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়া বলে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রকল্প একটি প্রয়োজনীয় স্তর। মঙ্গল গ্রহে জীবন আছে কিনা এ প্রশ্নের একাধিক উত্তর সম্ভব। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ ও তথ্যের ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্ট জবাব বাছাই করে এক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিককে অগ্রসর হতে হয়। একটি প্রকল্প সাধারণত সরাসরিভাবে প্রমাণিত বা অপ্রমাণিত হয় না। প্রকল্প প্রমাণের পদ্ধতিটি এইরূপ যদি গৃহীত আন্দাজ বা প্রকল্পটি সঠিক হয় তা হলে বাস্তব ক্ষেত্রে একটি বিশেষ পরিফল দৃষ্ট বা সংঘটিত হবে। অনুমিত পরিফল বাস্তবে সংঘটিত হয়েছে। সুতরাং গৃহীত প্রকল্পটি সত্য বলে প্রমাণিত হলো। একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রধান স্তরগুলিকে নিম্নোক্তভাবে নির্দিষ্ট করা যায়। কোনো সমস্যার বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রথমে পর্যবেক্ষণ দিয়ে শুরু হয়। এ-টি প্রথম স্তর। পর্যবেক্ষণে সংগৃহীত তথ্যাদির বিশ্লেষণে যদি একাধিক সমাধানের সম্ভাবনা দেখা যায়, তবে একটি সমাধান বাছাই করা হয়। এটি গবেষণার দ্বিতীয় বা প্রকল্পের স্তর। একাধিক সম্ভাব্য সমাধানের মধ্যে একটি সমাধানের নির্বাচনের প্রধান শর্ত হচ্ছে নির্বাচিত প্রকল্পটিকে সর্বোত্তম বিবেচনা করতে হবে। প্রচলিত বৈজ্ঞানিক বিধানসমূহের বিরোধী কোনো প্রকল্পকে গ্রহণ করা যাবে না। প্রকল্পটি প্রমাণযোগ্য হতে হবে। নির্বাচিত প্রকল্পের ভিত্তিতে গবেষণার প্রমাণ ও প্রয়োগ অর্থাৎ তৃতীয় স্তর শুরু হয়। প্রমাণ ও প্রয়োগে নির্বাচিত প্রকল্পটি সঠিক দেখা গেলে প্রকল্পটি প্রকল্প বা আন্দাজ হিসেবে না থেকে সঠিক সমাধান বলে বিবেচিত হয়। অপরদিকে প্রমাণ ও প্রয়োগে নির্বাচিত প্রকল্প নাকচ হলে গবেষণাকে নতুন আর একটি প্রকল্প গ্রহণ করে প্রয়োগ ও প্রমাণের অধ্যায় পুণরায় শুরু করতে হয়। নির্বাচিত প্রকল্পকে কার্য প্রকল্প বলেও অভিহিত করা হয়।
Ibn Khaledun : ইবনে খালেদুন (১৩৩২-১৪০৬ খ্রি.)
আরব সভ্যতার ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসের দার্শনিক হিসাবে ইবনে খালদুন এর নাম সুবিখ্যাত। উত্তর আফ্রিকার তিউনিসে তাঁর জন্ম। তাঁর শিক্ষাগত ও রাজনৈতিক জীবনের বিচিত্র কর্মকান্ডের কেন্দ্র প্রধানত উত্তর আফ্রিকা। মাত্র বিশ বছর বয়সে দেশের সুলতানের অধীনে গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি নিযুক্ত হন। তারপর কখনো সুলতানের কর্মসচিব, কখনো সুলতানের কাজি, কখনো রাষ্ট্রদূত হিসেবে বিচিত্র দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। তাঁর জীবনে উত্থান পতন কম ছিল না। সুলতানের বিরাগভাজন হওয়াতে দুবার তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। মঙ্গোল বাদশাহ তৈমুর লঙ এর দিগ্বিজয়ের অভিযানে সিরিয়া আক্রান্ত হলে মিসরের সুলতানের সঙ্গে যে যুদ্ধ ঘটে তাতে তৈমুর লঙ এর বাহিনীর হাতে ইবনে খালদুন বন্দী হন। তাঁকে তৈমুর লঙ এর দরবারে হাজির করা হয়। তৈমুর লঙ তাঁর পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে মুক্তি দিয়ে মিসরে প্রেরণ করেন। ইবনু খালদুন কায়রোর আল আজহার মসজিদের শিক্ষাকেন্দ্রের অধ্যাপকও নিযুক্ত হয়েছিলেন। কায়রোতেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।
আত্মজীবনী ব্যতীত ইবনু খালদুন এর প্রধান এবং সুবিপুল ইতিহাস সম্পর্কিত গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘কিতাব উল ইবার ওয়া দেওয়ান উল মুরতাদা ওয়া আল খবর ফি আয়াম উল আরব ওয়া আল আজম ওয়া আল বারবার’। এই গ্রন্থে ইতিহাসের বিবরণগত অংশে লেখক প্রথমে আরব এবং তার প্রতিবেশী জাতিসমূহের ইতিহাস এবং তারপরে বারবার ও উত্তর আফ্রিকার জাতিসমূহের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু এই বিবরণের পূর্বে তিনি ইতিহাস পাঠের তত্ত্বগত যে ভূমিকা বা ‘মুকাদ্দিমা’ রচনা করেন তা ইতিহাস তত্ত্বে এক আশ্চর্য অমর অবদান বলে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। মুকাদ্দিমার মধ্যে ইবনু খালদুন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বন্ধনের মূল কি এবং কোনো স্থান বা রাষ্ট্রের অধিবাসীর চরিত্র তাদের চারিপাশের জলবায়ু ও জীবিকার্জনের উপায় দ্বারা কিভাবে প্রভাবিত ও গঠিত হয় এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় বিধি বিধানে কিভাবে পরিবর্তন সংঘটিত হয় তার মৌলিক ও বিশ্লেষণমূলক আলোচনা পেশ করেন। সমাজ ও ইতিহাসের ক্ষেত্রে এরূপ বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আলোচনা জ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম। এ কারণে ইবনু খালদুন সমাজতত্ত্ব ও ইতিহাসের দর্শনের অবিসংবাদী জনক বলে স্বীকৃতি লাভ করেন। ইবনু খালদুনের বিবরণ আরব দেশসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ইতিহাসকে বিজ্ঞান হিসাবে তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন। আধুনিক পাশ্চাত্য জগতের অন্যতম ইতিহাসকার আর্নল্ট টয়েনবি তাঁর সুবিখ্যাত ‘স্টাডি অব হিস্টরি’ গ্রন্থে ইবনু খালদুনের মূল্যায়ণ করে বলেছেন, ‘খালদুনের ইতিহাসের দর্শন জ্ঞানের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত অনতিক্রান্ত সৃষ্টির মর্যাদায় মহিমান্বিত। জর্জ সারটন তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘ইনট্রোডাকশন টু দ্য হিস্টরি অব সায়েন্স’ গ্রন্থে এরূপ উল্লেখ করেছেন যে, কেবলমাত্র মধ্যযুগেরই নয়, প্রাচীন ঐতিহাসিকগণের পর ম্যাকিয়াভেলি পর্যন্ত ইতিহাসের তত্ত্ব ও মানুষের অভিজ্ঞতার দর্শনের ক্ষেত্রে ইবনে খালদুনের সমকক্ষ অপর কেউ জন্মগ্রহণ করেন নি।
ইউরোপীয় ইতিহাসের মধ্যযুগের এক পর্বে আরবী ভাষার রচনাবলী ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত হওয়ার মরসুম শুরু হয়েছিল। এই সময়ে অনুবাদের মাধ্যমে ইউরোপ আরবী সভ্যতার মহৎ সৃষ্টি এবং প্রাচীন গ্রিসের দর্শনের পরিচয় লাভ করে। ইবনে খালদুনের জন্ম অনুবাদের এই মরসুমের পরে ঘটায় ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ইবনু খালদুনের আরবি রচনাবলি ও তাঁর উৎকর্ষ ইউরোপে ছিল অপরিচিত। ১৮৬২-৬৮ সালের দিকে ফরাসি দেশে ফরাসি ভাষায় সর্বপ্রথম তাঁর ঐতিহাসিক গ্রন্থের অনুবাদ হয়। ইংরেজি অনুবাদ ঘটে মাত্র অতি সাম্প্রতিককালে ১৯৫৮ সালে।

Ibn Rushd : ইবনে রুশদ (১১৬২-১১৯৮ খ্রি.)
আরব সভ্যতার বিখ্যাত দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক। ইউরোপে তিনি ‘আভারস’ নামে পরিচিত। জন্ম মুসলিম সাম্রাজ্যভুক্ত স্পেনের কর্ডোভা শহরে। আইন, ধর্মতত্ত্ব, অংকশাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং দর্শন অর্থাৎ জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তাঁর অগাধ প্রগাঢ় পান্ডিত্য ছিল।
ইবনে রুশদনের দার্শনিক চিন্তার বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি ইসলামের ধর্মীয়বোধের বিরোধিতা না করেও গ্রিসের দার্শনিক এরিস্টটলের দর্শনের বস্তুবাদী দিক বিকশিত করার চেষ্টা করেন। তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বস্তু এবং গতির কোনো স্রষ্টা নেই। আত্মার অমরতা ও পরকালকে ইবনে রুশদ অস্বীকার করেন। আল-গাজ্জালীর ধর্মীয় রহস্যবাদকে ইবনে রুশদ তীব্রভাবে সমালোচনা করেন। প্রাচীণ গ্রীক দর্শনের সঙ্গে ইউরোপের সাক্ষাৎ পরিচয়ের অন্যতম মাধ্যম ছিলেন ইবনে রুশদ। এরিস্টটলের দর্শনের যে ব্যাখ্যা তিনি রচনা করেন তার মাধ্যমে ইউরোপের জ্ঞানজগৎ গ্রিক দর্শনের পরিচয় লাভ করে। ইবনে ‍রুশদের দর্শন এবং তার অনুসারীগণ মুসলিম ও খ্রিষ্টীয় ধর্মের গোঁড়াপন্থীগণের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। তাঁর কোনো কোনো গ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলা হয়, তাদের এই বিরোধিতা ইবনে রুশদের দর্শনের শক্তি এবং প্রভাবের পরিচায়ক। কেবলমাত্র মুসলিম সাম্রাজ্য নয়, ত্রয়োদশ শতকের ফরাসি চিন্তাধারার উপরও ইবনে রুশদের অগ্রসর চিন্তাধারার প্রভাব পরিদৃষ্ট হয়। ইতালিতে চতুর্দশ হতে ষোড়শ শতক পর্যন্ত ইবনে রুশদের চিন্তাধারার সাক্ষাত পাওয়া যায়। ইবনে রুশদের দর্শনের প্রধান অভিমত হচ্ছে বিশ্ব চিরস্থায়ী এবং আত্মাও দেহের ন্যায় মরণশীল। ধর্মের সঙ্গে বিরোধ এড়াবার জন্য ইবনে রুশদ দ্বৈত সত্ত্বার তত্ত্ব রচনা করেন। তিনি বলতেন, সত্য দুই প্রকারঃ দর্শন ও বিজ্ঞানের সত্য এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের সত্য। দর্শন ও বিজ্ঞানের সত্য যেমন ধর্মীয় বিশ্বাসের কাছে গ্রাহ্য নয়, তেমনি জগৎ সম্পর্কে ধর্মের ব্যাখ্যা ও বিজ্ঞান ও দর্শনের কাছে গ্রহণীয় হতে পারে না। মধ্যযুগে বিজ্ঞান যখন গোঁড়ামির শিকল ভেঙ্গে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে তখন ইবনে রুশদের দার্শনিক রচনা্র মধ্যে এরিস্টটলের দর্শনবিষয়ক তার তিন খন্ডের বক্তব্য সমধিক পরিচিত। এছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর তিনি সাত খন্ডে ‘কিতাব উল কুললিয়াত’ নামে যে বিশ্বকোষ রচনা করেন তাও জ্ঞানের ইতহিাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এই বিশ্বকোষে ইবনে রুশদ শরীরাংশ, দেহতত্ত্ব, রোগতত্ত্ব, সাধারণ চিকিৎসা, খাদ্য ও ঔষধপথ্য ব্যবস্থা এবং আরোগ্য বিজ্ঞানের সুবিস্তারিত বিবরণ পেশ করেন।
Ibn-Sina : ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রি.)
মধ্য এশিয়ার বুখারার আবু আলী ইবনে সিনা ইউরোপে দার্শনিক আভিসেনা নামে পরিচিত; দার্শনিক, চিকিৎসাবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী এবং কবি ইবনে সিনার জীবন ছিল বিপুল জ্ঞানরাশিতে সমৃদ্ধ ও ঘটনায় বিচিত্র। অতি অল্প বয়সে তাঁর বুদ্ধির আশ্চর্য দীপ্তি প্রকাশ পায়। দশ বছর বয়সে তিনি হাফেজে কোরআন এবং ষোল বৎসরে চিকিৎসার একটি নতুন পদ্ধতির আবিষ্কারক হিসেবে সকলের বিস্ময় দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সতেরো বছর বয়সে বুখারার আমীর তাঁকে দরবারের চিকিৎসক নিযুক্ত করেন। কিন্তু এই আমীরের পতনের পর ইবনে সিনার জীবনেও অনিশ্চয়তা নেমে আসে। এরপর থেকে দেশে-বিদেশে ঘুরে ঘুরে তাঁকে জীবন কাটাতে হয়। এক সময় ইবনে সিনা কারাগারেও নিক্ষিপ্ত হন। কারাগার হতে পলায়ন করে তিনি ইস্পাহান যান।
আরব সভ্যতায় প্রাচীন গ্রীসের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনকে সংযোজিত করে আরব সভ্যতার মাধ্যমে ইউরোপে সেই অমর জ্ঞান সম্ভারকে পৌছে দেয়ার ক্ষেত্রে ইবনে সিনার অবদান অতুলনীয়। ইবনে সিনা ইউক্লিডের জ্যামিতিকে আরবী ভাষায় প্রথম অনুবাদ করেন এবং এরিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা ও পদার্থবিদ্যার নতুনতর বিকাশ সাধন করেন। ইবনে সিনার দর্শনে ভাববাদী ও বস্তুবাদী উভয় ধারারই আমরা পরিচয় পাই। ইবনে সিনা গতি, শূণ্যতা, তাপ, আলো, স্থানিক আকর্ষণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে গবেষণা করেন। সে যুগে প্রচলিত আল-কেমি বা কিমিয়া বিদ্যার ধাতু রূপান্তরবাদকে তিনি অস্বীকার করেন।
ইবনে সিনার অবদানের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর রচিত তাঁর বিশ্বকোষ ‘কানুন’। চিকিৎসার তত্ত্ব, অমিশ্র বা সহজতর ঔষধাদি, রোগের সাধারণ প্রকার, রোগের নিরাময় ব্যবস্থা এবং মিশ্র ঔষধ প্রভৃতি বিষয়ের উপর পাঁচ খন্ডে রচিত সুবিপুল ‘কানুন’ এ ইবনে সিনা চিকিৎসা বিজ্ঞানের সমস্ত তথ্য ও তত্ত্ব এরূপভাবে পেশ করেন যে, তাঁর এই গ্রন্থ চিকিৎসা বিজ্ঞানের গুরু বলে পরিচিত গ্যালেনের গ্রন্থসমূহকে অতিক্রম করে যায় এবং পাঁচ শতাধিক বছর ধরে চিকিৎসা-বিজ্ঞানে অপ্রতিদ্বন্ধী জ্ঞানগ্রন্থ বলে প্রতিষ্ঠিত থাকে। মূলত চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইবনে সিনার কানুন এরূপ অভ্রান্ত বলে গৃহীত হতে থাকে যে, এর বাইরে অপর কোনো তত্ত্ব বা তথ্য থাকতে পারে বলে মানুষ বিশ্বাস করতে চাইত না। এর ফলে পরবর্তীকালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অধিকতর বিকাশের ক্ষেত্রে ইবনে সিনার ‘কানুন’ প্রতিবন্ধকতার দুর্গ হয়ে দাঁড়ায়।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি