ভূমিকা
আমি এই পুস্তকে নবী-রসূলদের তাবলীদের পন্থা বিস্তারিতভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছি। বর্তমান কালে লোকদের মনে দ্বীন সম্পর্কে যেমন অসম্পূর।ণ ও অপূর্ণাঙ্গ জ্ঞান রয়েছে, তেমনিভাবে দ্বীনের প্রচারের ব্যাপারেও তাদে মধ্যে অত্যন্ত সীমিত এবং ত্রুটিপুর্ণ ধারণো রয়েছে। এই পুস্তকে আমি দ্বীন ইসলামকে একটি জীবন ব্যবস্থা (বাস্তবেও তাই) হিসাবে উপস্থাপন করেছি। তদনুযায়ী এই জীবন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় এবং চেষ্টা-সাধনার যেসব দাবী পূরণ করতে হয়, তাও বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছি। আমি এই পুস্তকের প্রতিটি অধ্যায়ের ভিত্তি কুরআন মজীদের শক্তিশালী দলীল প্রমাণের ওপর স্থাপন করেছি। অতপর যেখানে প্রয়োজন মনে করেছি, সহীহ হাদীস সমূহের সাহায্যে এর ব্যাখ্যাও করে দিয়েছি। আমি আশা করি, যিনি গভীর মনোযোগ সহকারে এই পুস্তক পাঠ করবেন, তিনি কুরআন বুঝবার ক্ষেত্রেও এ থেকেও সাহায্য পাবেন।
আমার বিরুদ্ধে কোন কোন বন্ধুর অভিযোগ রয়েছে যে, আমি খুব সংক্ষেপে বিষয়বস্তু উপস্থাপন করে থাকি। প্রতিটি পাঠক ভালভাবে বক্তব্য বুঝতে পারবে কিনা, সে দিকে আমি লক্ষ্য রাখিনা। েএই পুস্তকের মাধ্যমে আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ দূর করার চেষ্টা করেছ। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আমাকে সফলতা দান করুন এবং লোকেরা যেন এ থেকে অধিকতর ফায়দা অর্জন করতে পারে।
বিনীত
আমীন আহসান

তাবলীদের প্রচলিত পন্থায় ত্রুটি
একটা উল্লেখযোগ্য সময় ধরে ইসলারেম প্রচর ও প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব উপায় ও পন্থা মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত ও গৃহীত হয়ে আসছে, তাবলীগ (প্রচার) শব্দটি শুনা মাত্র লোকদের মন-মগজ ও চিন্তা-চেতনা ভাবেই সেদিকে ছুটে যায়। একটা দীর্ঘ সময়ের অনুশীলন যখন কোন কাজের জন্য কোন কর্মপন্থাকে সুপরিচিত করে দেয়, তখন হৃদয়ের ওপর এর ছাপ এমন ভাবে বসে যায় যে, লোকেরা তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু চিন্তা করতে পারে না। এই কাজ অঞ্জাম দেয়ার জন্য ঐ কর্মপন্থাকেই সম্পূর্ণ রূপে প্রকৃতিগত পন্থা বলে ধরে নেয়া হয়। যে ব্যক্তিই এই কাজ করতে অগ্রসহ হন তিনিও এই পন্থাই অবলম্বন করেন। এমনকি কখনো কখনো কোন ব্যক্তি তা থেকে বেঁচে থাকার সংকল্প নিয়ে ঘর থেকে বের হয়, কিন্তু পথ চলতে চলতে পাও আবার সেদিকেই ফরসকে যায় যা থেকে বাঁচার জন্য সে সংকল্প নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিল। এ জন্য সর্বপ্রথম তাবলীগের বর্তমা পন্থার ভ্রান্তি সমূহ সংক্ষেপে বর্ণনা করা প্রয়োজন।
আমাদের মতে তাবলীগের প্রচলিত পন্থায় জ্ঞানগত এবং কার্যগত উভবিধ ভ্রান্তি রয়েছে। অন্য কথায় বুঝানো যেতে পারে যে, তাবলীগের এই পন্থা দার্শনিক দিক থেকেও ভ্রান্ত। অতএব এই কারণে ইসলামের তাবলীগের নামে এ পর্যন্ত যত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যের দিক থেকে কেবল নিষ্ফলই প্রমানিত হয়নি, বরং এর দ্বারা ইসলারেম দাওয়াতের যথেষট ক্ষতিও হয়েছে। আমা প্রথমে এই পন্থার তত্ত্বগত ত্রুটি সমূহের দিকে ইংগিত করব।
তাবলীগের প্রচলিত পন্থায় বুদ্ধিবৃত্তিহক ত্রুটি
প্রথমত ত্রুটিঃ ইসলামকে পেশ করতে গিয়ে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ভুল যা করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, দাওয়াত পেশকারীগণ নিজেদের এবং ইসলামের সঠিক ভুমিকা অনুধাবন করতে পারেননি। এ কারণে তারা ইসলামকে ঠিক সেভাবে তুলে ধরতে পারেনি যেভাবে কুরআন তা মানব জাতির সামনে তুলে ধরেছিল। কুরআন মজীদ ইসলামকে এভাবে উপস্থাপন করেছে যে, সৃষ্টির সূচনা থেকে ইসলামই হচ্ছে আল্লাহর মনোনীত দীন। যখনই এবং যে জাতির কাছে আল্লাহ তায়ালা কোন নবী পাঠিয়েছেন, এই দীন সহকারেই পাঠিয়েছেন। বিভিন্ন জাতি আল্লাহর মনোনীত এই দীনের মধ্যে অনবরত দোষত্রুটির অনুপ্রবেশ ঘটাতে থাকে । এবং আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীদের মাধ্যমে এসব দোষত্রুটির সংশোধন করতে থাকেন। এমনকি তিনি তার সর্বশেষ রসূলকে পাঠিয়ে তাঁর সব নবী-রসূলদের দীনকে সম্পূর্ণ সঠিক এবং পুর্ণাংগ অবস্থায় নাযিল করে তাকে চিরকালের জন্য কোনরূপ মিশ্রণ, পরিবর্তন এবং বিকৃতিরর আশংকা থেকে সংরক্ষিত সরে দিয়েছেন। এই দীন কুরআন মজীদের আকারে সংরক্ষিত রয়েছে। এটা কোন বিশেষ জাতির ধর্ম নয়, বরং গোটা মানব ধর্ম এবং আল্লাহর সব নবীদের আনিত দীন। যে ব্যক্তি তা মেনে নেবে সে মুসলমান নামে পরিচিত হবে। আর যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করবেনা সে অমুসলিম গণ্য হবে। এই দীন আল্লাহর নবীদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্যও করেনা, তাঁর প্রেরিত কোন কিতাবকেও প্রত্যাখ্যান করেনা এবং কারো ওপর নিজের একচ্ছত্র মর্যাদাও দাবী করেনা। এর দাবী শুধু এতটুকু যে, এটা সমস্ত নবীদের শিক্ষার নির্ভরযোগ্য সারসংক্ষেপ এবং তাদের শিক্ষার পূর্ণতা বিধানকারী।
কিন্তু আমাদের প্রচারক এবং লেখকগণ এর সম্পূর্ণ উল্টা এই দীনকে মুসলিম জাতির দীন এবং দুনিয়ার সমস্ত ধর্মের শত্রু হিসাবে পেশ করেছেন। এর সত্যতা প্রমাণ করার জন্য অন্যান্য আসমানী কিতা সমূহের শিক্ষাকে উপহাস করেছেন। তারা কখনো কখনো আবেগ ও উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে এতটা বাড়াবাড়ি করেছেন যে, মুসলমান হিসাবে এবং সমস্ত নবীদের প্রতি ঈমান আনার দাবীদার হিসাবে এই সব কিতাবের যেসব শিক্ষার প্রতি তাদের ঈমান আনার সর্বাধিক দায়িত্ব ছিল তারা এর প্রতিও ঠাট্টা বিদ্রুপ করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং অপরাপর নবীদের মধ্যে তুলনা করে তাঁদেরকে নীচ প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়ছে। অথচ কুরআন মজীদে এ ধরণের বিশেষ অগ্রাধিকা দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রত্যেক নবীকে কোন কোন দিক থেকে মর্যাদা দান করেছেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে দৃষ্টি কোন থেকে মর্যাদা দেয়া হয়েছে তা সুনির্দিষ্ট ভাবে বলে দেয়া হয়েছৈ। স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য নবীদের তুলনায় তাঁ বিশেষ মর্যাদা দাবী করতে কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন। কিন্তু মুসলমানরা ইসলাম এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ধর্মীয় অন্ধ গোড়ামীর আবেগে তাড়িত হয়ে পেশ করেছেন। কেবল সাধারণ পেশাদার বক্তা এবং প্রচারকগণই এই ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়নি, বরং আমাদে বিশিষ্ট লেখক, গ্রন্থকার এবং সংকলকগণও এই ভ্রান্তিতে লিপ্ত হয়েছেন, যাদের রচিত বই-পুস্তক মুসলমান অমুসলমান উভয়ের জন্য ইসলামকে বুঝবার একক মাধ্যম ছিল। আপনি বিশিষ্ট গ্রন্থকারদের বই পুস্তক খুলে দেখুন যা ইসলামের ওপর লেখা হয়েছে। এ সব কিতাবে অন্যান্র নবীদে এবং তাদের শিক্ষা সম্পর্কে এমন বিষাক্ত কথাবার্তা পাবেন যা পাঠ করে পরিস্কার মনে হবে- ইহুদ-খ্রীষ্টানরা আল্লাহ এবং তাঁ রসূলদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার যে রোগে আক্রান্ত হয়েছিল- মুসলমানরাও একই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু মুসলমানরা এ ধরণের বই পুস্তক সম্মান ও মর্যাদার সাথে হাতে তুলে নিয়েছে এবং এ ধরণের ওয়াজ ও বক্তৃতা উৎসাহ সহকারে শুনে থাকে। কেননা এর দ্বারা তাদের অহংকার ও গৌরবের চাকচিক্য ফুটে উঠে।
পক্ষান্তরে যেসব লোকের রচনাবলী ও বক্তৃতার এই টক-মিষ্টির সংমিশ্রণ ছিলনা- তারা সর্বসাধারণের মধ্যেও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি এবং বিশেষ মহলেও কোন গুরুত্ব পায়নি। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, এই বিষাক্ত তাবলিগী সাহিত্য সৃষ্টিতে ইসলামের সমালোচনাকারীদেরও অনেকটা দখল রয়েছে। কিন্তু আমাদের মতে মুসলিম সাহিত্যিকরাই ভুল করেছেন। এই ভ্রান্ত জবাব পন্থা অবম্বনের পরিণতিতে অমুসলিমদের মনে পংকলিতা সৃষ্টি হয়ে গেছে এবং তারা ইসলামের ওপর এই দৃষ্টিকোন থেকে চিন্তা করেনি যে আসলাম তাদেরকে তাদের ভুলে যাওয়া সত্যকে স্মরণ করিয়ে দিতে এবং তাদের নবী-রসূলদের উত্তরাধিকারীদেরকে তাঁদের দিকে প্রত্যাবর্তন করানোজন জন্য এসেছে। বরং এটাকে দুশমন এবং ডাকারেত মত ঘৃনা চোখে দেখেছে যা তাদের কাছ থেকে তাদের দীনধর্মকে ছিনিয়ে নিয়ে তাদের ওপর নিজেই বিজয়ী হতে চায়।
দ্বিতীয় ত্রুটিঃ ইসলামকে উপস্থাপন ক্ষেত্রে দ্বিতীয় যে বুদ্ধিবৃত্তিক ভুল করা হয়েছে, তা হচ্ছে – ইসলামকে ইকটি জীবন-বিধান হিসাবে পেশ করা হয়নি, বা মানব জীবনের ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত, কর্মগত এবং আকীদাগত সমস্যাবলীকে একটি ‘এককে’ কেন্দ্রীভূত করে এবং বুধ্ধি ও স্বভাব সুলভ পন্থায় তার সমাধান করে। বরং আমাদের মুবাল্লিগ এবং তার্কিকগণ তাদের সমস্ত শক্তি এমন কতগুলো বিষয়ের ওপর ব্যয় করেছেন যা খ্রীষ্টান এবং হিন্দুদের সাথে ধর্মীয় সংঘাতের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। যেমন আত্মা এবং জড় পদার্থের চিরন্তনতা ও অভিনবত্ব প্রসংগ, পুনর্জন্মবাদ, মসীহ্ আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রভুত্ব এবং ত্রিত্ববাদের ঝগড়া ইত্যাদি। প্রত্যেক ধর্মের একদল পেশাদার তার্কিক এ ধরণের বিষয়ে খুবই আকর্ষণ বোধ করে। তাদের আসল সাফল্য এই সমস্যাগুলো সমাধান নয়, বরং এগুলোকে আরো বেশী সংবেদনশীল করে তোলাই তাদের লক্ষ্য। এ ধরণের লোকদের লা-জওয়াব করার চেষ্টা করার অর্থ হচ্ছে নিজের শক্তি ও যোগ্যতাকে ক্ষয় করা এবং নিজের সময়কে বরবাদ করা।
কিন্তু আমাদে মুবাল্লিগগণ এ ধরণের দ্বন্দ্বক্ষেত্রে নিজেদের জীবনটা শেষ করে দিয়েছেন। তারা এ কথা চিন্তা করার প্রয়োজনও অনুভব করেননি যে, এগুলো কেবল তর্কপ্রিয় লোকদের আকর্ষণীয় বিষয়- যারা এগুলোর সমাধান চায়না বরং একে আরো জটিল করে তোলাই তাদের উদ্দেশ্য। বাকি দুনিয়া আজ ভিন্নরূপ সমস্যার সম্মুখীন্ এগুলোর সমাধান করার জন্য দুনিয়অ আজ অস্থির হয়ে পড়েছে এবং এগুলোর সমাধান হওয়ার ওপরই দুনিয়ার মুক্তি নির্ভর করছে। যে ধর্মই সামনে অগ্রসহর হয়ে এসব সমস্যার গ্রহণ যোগ্য সমাধান পেশ করতে পারেবে তাই হবে সারা দুনিয়ার আগামী দিনের ধর্ম। এমন একটি জগত যা নিজের উদ্ভাবিত পন্থায় পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালিয়ে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে এবং জীবনের সংস্কৃতিক এবং সামগ্রিক সমস্যার কোন সমাধারন খুজে পাচ্ছেনা সেখানে ইসলামকে যদি কয়েকটি আকীদা-বিশ্বস ও রীতিনীতির আকারে পেশ না করে বরং একটি পূর্ণাংগ জীবন-বিধান হিসাবে পেশ করা হত তাহলে আজ দুনিয়ার চিত্র ভিন্নরূপ হত।
কিন্তু আমাদের মধ্য যেসব ব্যক্তি ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে সক্রিয় হয়েছেন, অথবা যারা ইসলামের ওপর বই-পুস্তক রচনা করেছেন সম্ভবত ধর্মের খ্রীষ্টবাদী দর্শনই তাদের সামনে ছিল, যা কয়েকটি দাবীর সমষ্টি- জীবনের বাস্তব সমস্যার সাথে এর কোন ইতিবাচক সম্পর্ক নেই। ফল হচ্ছে এই যে, খ্রীষ্টবাদের অনর্থক বাচালতরা প্রতি দুনিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক সম্প্রদায় যেভাবে কোন আকর্ণণ অনুভব করেনি, অনুরূপভাবে ইসলামের এই সমস্যাবলীর ইসলামী সমাধানের দিকও শিক্ষিত সমাজ কোন মনোযোগ দেয়ীন। ফলে ইসলারেম প্রচারকার্যের এই গোটা তৎপরতা অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্মের নগণ্য সংখ্যক অনুসারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। ফলে সময় এবং সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কোন বিশেষ ফল পাওয়া যায়নি।
তৃতীয় ত্রুটিঃ এ ব্যাপারে আরেকটি বুদ্ধিবৃত্তিক ভ্রান্তি হচেছ এই যে, আমাদের এখানে আজ পর্যন্ত ইসলারে ওপর যেসব কিতাব পত্র লেখা হয়েছে তা হয় তাত্ত্বিক ধরণের অথবা বিতর্কমূলক অথবা নতিস্বীকার মূলক অথবা কালাম শাস্ত্রের ঢংএ পেশ করা হয়েছে। এর প্রত্যেকটি সম্পর্কে নির্দ্বিধায় বলা যায়, দীনের দাওয়াতের ক্ষেত্রে এর কোনটিই উপকারে আসেনি। তাত্বিক আলোচনা কেবল এমন লোকদের উপকারেই আসতে পারে যাআ ইসলামের কোন বিশেষ দিকে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করতে চায়। কিন্তু দাওয়াত ও তাবলীগের উদ্দেশ্য নিয়ে তা লেখাও হয়না এবং এই উদ্দেশ্য সাধনের যোগ্যতাও তাদের মধ্যে পাওয়া যায়না। বিতর্কমূলক আলোচনা প্রথমত বিশেষ ধরণের কয়েকটি বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত। এর সাতে ইসলামের দৃষ্টিভংগীর কোন সম্পর্ক থাকে না। দ্বিতীয়ত, যেসব জিনিস হৃদয়-মনকে ইসলামেতর নিকটবর্তী করা পরিবর্তে বরং আরো দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় সেসব দোষ এর মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় বর্তমান রয়েছে। নতিস্বীকার মূলক প্রকাশভংগীতে লেখা জিনিস বলতে আমরা পাশ্চাত্য প্রভাবিত লোকদের ধর্মীয় বিষয়ের ওপর রচিত বইপুস্তকের দিকে ইশারা করেছি, ইউরোপবাসীদের কাছে যা প্রশংসিত হয়েছে। তারা পাশ্চাত্য প্রভাবিত চিন্তা ধারাকে ইসলামের মধ্যেও প্রবেশ করানো চেষ্টা করে। যদিও এর সাথে ইসলামের দুরতম সম্পর্কও নেই। অনুরূপভাবে ইসলামের যেসব জিনিস পাশ্চাত্যের কাছে নিন্দনীয় হয়েছে তাকে ইসলাম বহির্ভূত প্রমান করার দলীলও তারা একত্র করেছে- তা ইসলামের রুকন বা মূল নীতির অন্তর্ভুক্তই হোকনা কেন। এই ধরণের দুর্বলচেতা এবং পরাজিত মানসিকতা সম্পন্ন লোকেরা যা কিছু লিখেছে- তা না ইসলামের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করছে, আর না তার মধ্যে এমন বলিষ্ঠ আস্থা রয়েছে যা মনকে ইসলামের দিকে টেনে আনতে পারে এবং বিবেকের কাছে বলিষ্ঠ আবেদন রাখতে পারে।
দার্শনিক দৃষ্টিকোন থেকে যা কিছু লেখা হয়েছে তা আরো অধিক হতাশাজনক। কালাম শাস্ত্রবিদদের যুক্তির পদ্ধতি বুদ্ধি বিবেক এবং স্বভার প্রকৃতির পরিপন্থী। এর দ্বারা কোন সমস্যার গিট বৃদ্ধি করা যেতে পারে, কিন্তু কোন গিঠ খোলা সম্ভব নয়। যুক্তির এই ধরণ বক্র বিতর্কের জন্যই উপযুক্ত হতে পারে। এর মধ্যে না আছে কোন আকর্ষণ, না আছে সৌন্দর্য। সুস্থ বিবেক ও মানব প্রকৃতির সাতে এর কোন সামঞ্জস্য নেই। একে ইসলামকে উপস্থাপন করার মাধ্যম বানানোর অর্থ হচ্ছে লোকদেরকে ইসলাম থেকে পলায়নমুখী করা এবং তাদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে খারাপ ধারণর সৃষ্টি করা ।
ইসলামকে দুনিয়ার সামনে পেশ করার একক পন্থা ছিল তাই- যা আল্লাহর কিতাব এবং রসূল (সা) অবলম্বন করেছেন। কিন্তু আমাদের কালাম শাস্ত্রবিদগণ গ্রীক দর্শনের দ্বারা এতটা প্রবাবিত হয়ে পড়েন যে, তারা কুরআনের যুক্তি পদ্ধতিকে শুধু উপেক্ষাই করেনি বরং আরো একধাপ অগ্রসর হয়ে তার সমালোচনা করেছে এবং তাকে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। আমাদের প্রাচীন পন্থী কালামশাস্ত্রবিদগণও এই ভুল করেছেন এবং আমদের আধুনিক কালামশাস্ত্রবিদরাও তার শিকার হয়েছেন। এরফল হয়েছে এই যে, অমুসলিমদের সামনে পূর্ণাংগ ও যেসব শিক্ষিত মুসলমান নিজেদের মুসলমান হিসেবে টিকিয়ে রাখতে অথবা অন্ততপক্ষে মুসলমানদের মধ্যে পরিগণিত হতে চেয়েছিল তারা বলতে শুরু করল যে, ইসলাম অন্তরে মেনে নেয়ার জিনিস মাত্র। বুদ্ধি-বিবেক খাটিয়ে বুঝবার মত জিনিস তা নয়। যারা নির্ভিক এবং বগ্রাহীন- তারা প্রকাশ্যেই ইসলামের ঠাট্টাবিদ্রুপ শুরু করে দিল। এবং শুধু নাম ছাড়া আর সব ব্যাপারেই তারা ইসলামের বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ আযাদ হয়ে গেল।


তাবলীগের প্রচলিত পন্থায় বাস্তব কর্মগত ত্রুটি
তাবলীগের প্রচলিত পন্থায় কর্মগত দিক থেকেও ভ্রান্তি কম নয়। এর কতিপয় ভ্রান্তির দিকে আমরা ইংগিত করব।
প্রথমত ত্রুটিঃ প্রথম বাস্তব কর্মগত ভ্রান্তি হচ্ছে মুসলমানদের দ্বিমুখী নীতি। অর্থাৎ একদিকে তারা একটি মৌলিক জামাআত হওয়ার দাবী করছে- যা ইসলাম ঈমানের মূলনীতির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। কিন্তু অপরদিকে তারা নিজেদের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট জমা করেছে যেগুলো বংশ- গোত্র, আঞ্চলিকতা ও ভাষার ভিত্তিতে গড়ে উঠা কোন জাতির মধ্যে পাওয়া যায়। একদিকে তারা বলছে, মুসলমান সেই ব্যক্তি যে আল্লাহ, তাঁর রসূল, তাঁর কিতা এবং আখেরাতের ওপর ঈমান এনেছে এবং যাবতীয় কাজকর্ম, সামজিকতা ইত্যাদি সার্বিক ক্ষেত্রে আল্লাহ এবং তাঁর রসূলদের বাতানো পন্থায় অনুসরণ করে। অপরদিকে তাদের মধ্যে এমন অসংখ্য লোক রয়েছে, যাদের শুধু মুসলমান নামটাই অবশিষ্ট আছে এবং তারা মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে। এছাড়া কোন দিক থেকেই ইসলামের সাতে তাদের কোন সামঞ্জস্য নেই।
একদিকে তাদে দাবী হচ্ছে- জীবনের প্রতিটি দিকে ও বিভাগে তাদের পথপ্রদর্শক হচ্ছেন মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ (সা)। অপর দিকে তারা নিজেদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বাগডোর এমন লোকদের হাতে তুলে দিয়েছে- যারা জ্ঞান ও কর্ম উভয় দিক থেকে আল্লাহ রসূলে হেদায়াত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। একদিকে তারা নৈতিকতা ও কর্মের একটি পূর্ণাং বিধান পেশ করে এবং দাবী করে যে, এ থেকে বিচ্যুত হয়ে কেউ মুসলমান থাকতে পারেনা। অপর দিকে দুশ্চরিত্র ও দুষ্কর্মের যত রকম ও প্রকার অন্য জাতির মধ্যে পাওয়া যায়, তার সবগুলোর নমুনা তারা নিজেরাই পেশ করছে। এবং এতে তাদের মুসলমানিত্বের কোনরূপ ক্ষতি হয়ন। এ দিকে তারা একটি সত্য দীনের সাথে নিজেদের যাবতীয় সম্পর্ প্রমাণ করছে এবং দাবী করছে যে, এ থেকে মুখ ফিরিয়ে পলায়ন করা জায়েয নয়। কিন্তু অপর দিকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মুস্তফা কালাম (তুরস্ক) পর্যন্ত গোটা ইতহাসকে ইসলামের ইতিহাস বলে চালিয়ে দিচ্ছে। অথচ এই ইতিহাসের একটা বিরাট অংশের সাথে ইসলামের সত্য জীবন বিধানে সামন্যতম সামঞ্জস্যও নেই।
একদিকে তারা দাবী করছে, ইসলাম একটি স্বয়ং সম্পীর্ণ জীবন-বিধান এবং আজ যদি কোন বিধানে দুনিয়ার মুক্তি থেকে থাকে তাহলে তা এই বিধান গ্রহণ করার মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু অপর দিকে তার ইউরোপ আমেরিকা সফর করে দেখতে চেষ্টা করছে যে, ইংরেজদের ব্যবস্থা অধিক ইসলামী না আমেরিকান ব্যবস্থা?
মুসলমানরা তাদের এই দ্বিমুখী নীতি উপলব্ধি করতে পারুক বা না পারুক, কিন্তু অন্য জাতির লোকদের তা অনুধাবন করতে কষ্ট হওয়ার কোন কারণ নেই। তারা মুসলমানদের কথা ও কাজের মধ্যেকার বৈপরিত্য দেখে হতবুদ্ধি হয়ে যায়। এরপর যদি তাদের মধ্যেকার কোন ব্যক্তির ইসলামের প্রতি আকর্ষণ থেকেও থাকে তাহলে এই বৈপরিত্য দেখে থেমে যায় এবং সে মনে করে মুসলমানরাও তাদের মতই একটি জাতি। অতএব এ ধরণের এক জাতিকে পরিত্যাগ করে আরেক জাতির অন্তর্বূক্ত হওয়ার কি অর্থ থাকতে পারে?
আমাদের এই দ্বিমুখীপনা সত্ত্বেও যদি কোন অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেও থাকে তাহলে বিশ্বাস করা উচিৎ যে, সে আমাদের দাওয়াত পেয়ে ইসলাম গ্রহণ করেনি। বরং আল্লাহ তায়ালা তার সামনে তার ধর্মের ভ্রান্তি তুলে ধরার সাথে সাথে মুসলমানদের ভ্রান্তিও তার সামনে পরিস্কার করে তুলে ধরেছেন। সে ইসলাকে মুসলমানদের থেকে স্বতন্ত্র করে দেখে থাকে।
দ্বিতীয় ত্রুটিঃ দ্বিতীয় বাস্তব কর্মগত ভ্রান্তি হচ্ছে এই যে, মুসলমানরাও খৃষ্টান মিশনারীদের দেখাদেখি তাবলীগের জন্য সব সময় সমাজের নিম্ন শ্রেণীর লোকদের ওপরই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। অথচ এই পন্থা সম্পূণ্য ভ্রান্ত। দীনের দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথমত সেই শ্রেণীর লোকদের সম্বোধন করা উচিত যাদের চিন্তা ও দর্শনের নেতৃত্বে সমাজের ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হচ্ছে। এই শ্রেণীর লোকেরাই মূলত কোন জাতিকে গড়ে তুলে বা তার পতন ঘটায়। যদি তাদেরকে সৎপথে নিয়ে আসা যায় তাহলে গোটা ব্যবস্থাপনা আপনা আপনি সৎপথে চলে আসবে। যদি তারা ভ্রান্ত পথে থেকে যায় তাহলে প্রথমত নিম্ন শ্রেণীর লোকদের মধ্যে এমন কোন যোগ্যতা বর্তমান নেই যা তাদের সংশোধন করতে পারে। যদিওবা এ ধরনেরে যোগ্যতা তাদের মাঝে থেকে থাকে তাহলে সেটা একটা ব্যতিক্রম মাত্র। বরং তাদের পরাজিত মনোবৃত্তি খুব দ্রুত বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর ভ্রান্তিকে গ্রহণ করে নেয়। এর দৃষ্টান্ত অনেকটা হৃদয় এবং অংগ-প্রত্যংগের মত। যদি অন্তরের সংশোধন হয়ে যায় তাহলে গোটা দেহ আপনা-আপনি সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু যদি অন্তরে রোগ বর্তমান থাকে তাহলে অংগ-প্রত্যংগে তৈল মালিশ করে কোন ফায়দা নেই।
খৃষ্টান মিশনারীদের সামনে শুধু নিজেদের সংখ্যাবৃদ্ধির প্রশ্নই ‍ছিল। অতিএব তাদের জন্য এই পন্থা ফলপ্রসু হতে পারে। কিন্তু মুসলমানদের জন্য শুধু সংখ্যা বৃদ্দির উদ্দেশ্য নিয়ে তাবলীগ করা জায়েয হতে পারেনা। তাদের কাজ হচ্ছে পথহারা লোকগুলোকে সঠিক পথে নিয়ে এসে আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্ক জুড়ে দেয়া, সঠিক দিক থেকে তাদের জীবনকে পুনর্গঠিত করা। গোটা সমাজকে পুর্গঠিত করতে পারলেই ব্যক্তির পুনর্গঠন সম্ভব। সমাজের নেতৃস্থানীয় লোকেরা যখন সংশোধন কার্যক্রমকে গ্রহণ করবে তখনই সমাজের পুনর্গঠন আশা করা যেতে পারে। যারা সমাজ ও সংগঠনের কমবেশী ‍দৃষ্টি রাখে তার এই সত্যকে অস্বীকার করতে পারেনা যে, গণবিপ্লব ও বৈপ্লবিক আন্দোলন নীচ থেকে শুরু হয়ে উর্ধতন ব্যবস্থাপনাকে বিশৃংখল করে দিতে পারে। কিন্তু সংশোধন মূলক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দায়াত কেবল তখনই শিখড় মজবুত করতে পারে যখন তা উপর থেকে নীচের স্তরের দিকে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
মুসলমানদের মধ্যে যারাই দাওয়াতের কাজ করেছে- তা মুসলমানদের মধ্যেই হোক অথবা তাদের বাইরে- তারা সাধারণতভাবে যে ভুল করেছে তা হচ্ছে- তাদের দৃষ্টি সব সময় নিম্ন শ্রেণীর লোকদের ওপরই পতিত হয়েছে। তারা তাদেরকে শুধু কালেমা পড়িয়ে অথবা নামায শিখিয়ে মনে করে বসেছে যে, এখন তাদের সংশোধন হয়ে গেছে। নিসন্দেহে এভাবে কিছুটা আংশিক সংশোধন হতে পারে। কিন্তু সামগ্রিক জীবনে এভাবে কোন পরিবর্তন আসতে পারেনা। সামগ্রিক পরিবেশ যখন খারাপ থাকে তখন রোগের চিকিৎসার পরিবর্তে বরং রোগরে কারণ সমূহের মূলোৎপাটন করার চেষ্টা করা উচিৎ। যেসব আবর্জনাপূর্ণ নালা জীবনু ছড়ায় এবং বাতাসকে দুষিত করে সেগুলো মাটি দিয়ে ভরে ফেলার চেষ্টা করা উচিৎ। এছাড়া যে সংশোধন প্রক্রিয়া চালানো হবে তা কোন ব্যক্তিকে মহামারী-পূর্ণ এলাকায় আটকে রেখে টিকা-ইনজেকশন দেয়ার মতই হবে। এতে সাময়িক ভাবে মহামারীর আক্রমণ প্রতিহত করা যেতে পারে হয়ত, কিন্তু স্থায়ী ফল লাভ করা সম্ভব নয়।
এ কারণেই নবী-রসূলগণ প্রথমে সাধারণ লোকদের সম্বোদন করার পরিবর্তে সমাজের নেতৃস্থানীয় লোকদের মন-মানসিকতায় পরির্তন আনয়নের চেষ্টা করেছেন এবং তাদের সংশোধনকে জনসাধারণের সংশোধনের মাধ্যম বানিয়েছেন।
তৃতীয় ত্রুটিঃ বাস্তব কর্মগত তৃতীয় ভ্রান্তি হচ্ছে এই যে, মুসলমানরা কেবল মৌখিক উপদেশকেই তাবলীগের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছে। প্রকৃত ইসলামী জিন্দেগীর বাস্তব নমুনা পেশ করার চেষ্টা করেনি। অথচ একক ভাবে ইসলামের মূলনীতি সমূহের সৌন্দর্য অবলোকন করে খুব কম সংখ্যক বুদ্ধিমান এবং অসাধারণ নৈতিক যোগ্যতা সম্পন্ন লোকই ইসলাম গ্রহণ করতে পারে। দুনিয়ার বিরাট সংখ্যক লোক কেবল তখনই এসব মূলনীতির সত্যতা স্বীকার করবে যখন তারা বাস্বত জীবনে তার কার্যকরিতা এবং উত্তম ফল সৃষ্টি করতে দেখতে পাবে। কিন্তু আমাদের এখানে ইসলামের তাবলীগের নামে যে চেষ্টা সাধণা চালানো হচ্ছে তার রহস্য কেবল এতটুকু যে- বক্তাগণ সুললিত কণ্ঠে, প্রচারকগণ আবেগ-উত্তেজনা সহকারে এবং লেখকগণ দুনিয়ার মানুষকে ইসলামী জীবন-পদ্ধতির কাল্পনিক বেহেশতে পরিভ্রমন করাচ্ছেন। আরো মজার কথা হচ্ছে এই যে, একদিকে তারা ইসলামের সামাজিক- সাংস্কৃতিক কল্যাণের প্রশংসায় আসমান ও জবীনের মধ্যবর্তী স্থানকে মুখরিত করছে, অপর দিকে গোটা মুসলম সমাজ নিজেদের জাহেলিয়াতের যাবতীয় নোংরামী পুঞ্জিভুত করে তাদের দাবীকে মিথ্যা প্রমাণ করছে। কর্মের নিরব ভাষা দাবীর সকল ভাষার তুলনায় অধিক প্রভাবশালীর। এ কারণে এইসব ওয়াজ-নসীহত শূন্যে বিলীন হয়ে গেছে এবং দুনিয়ার বুকে এর কোন স্থায়ী প্রভাব অবশিষ্ট থাকেনি।
অতএব, শুধু মৌখিক বক্তব্যের পরিবর্তে যদি কিছু সংখ্যক আল্লাহর বান্দা যেসব মূলনীতির ওপর ঈমান এনেছে তার ভিত্তিতে একটি সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার চেষ্টা করত এবং এই প্রচেষ্টায় তারা যদি সফলকাম নাও হত-তবু তারা অধিক কর্যকর খেধমত আঞ্জাম দিতে পারত- বক্তাগণ নিজেদের ওয়াজ-নসীহতে সফল হয়েও যে খদমত আঞ্জাম দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ইসলামকে সারা দুনিয়ার মানুরে জন্য কল্যাণকর প্রমাণ করার জন্য শুধু অথীতের কিছু বিষ্ময়কর ইতিহাস বর্ণনা করাই যথেষ্ট হতে পারেনা। ইসলাম বর্তমানও মানব জাতির জন্য অতীতের সেই কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসতে পারে- একথার সমর্থনে শুধু প্রবন্ধ রচনা করা ও বক্তৃতা বিবৃতি দেয়ায়ও কোন ফায়দা নেই। এর একমাত্র পন্থা হচ্ছে এই যে, ইসলামের মৌলনীতির ওপর ঈমান আনয়নকারী জামায়াত একতাবদ্ধ হয়ে এসব মূলনীতির বাস্তব উদাহরণ পেশ করবে। দুঃখের বিষয় সবকিছুই হয়েছে কিন্তু শুধু এটাই হয়নি।
চতুর্থ ত্রুটিঃ চতুর্থ ভ্রান্তি হচ্ছে এই যে, মুসলমনরাও ইসলামের প্রচারের ক্ষেত্রে খ্রীষ্টান মিশনারীদের মত কতিপয় খোলঅ পন্থা অবলম্বন করেছে। খ্রীষ্টানরা দুনিয়ার পতিত শ্রেণীকে যেসব লোভ-লালসা ও স্বার্থের টো দেখিয়ে খ্রীষ্টান বানিয়েছে, মুসলমানরাও সে সব পন্থা অবলম্বন করতে চাচ্ছে। ব্রাহ্মণ সমাজ নিজেদের স্বার্থে যেসব টোপ ব্যবহার করছে, মুসলমানরাও তাই ব্যবহার করতে চাচ্ছে। বিতর্কের ক্ষেত্রে অন্যরা যে বাড়াবাড়ি, যে বক্র পন্থা এবং যে উদ্যত মুষ্ঠি ব্যবহার করছে, মুসলমানরাও তাতে মোটেই পিছিয়ে নেই। মুসলমানদের মধ্যে কোন ব্যক্তি লালসার শিকার হয়ে অথবা কোন ভ্রান্তির শিকার হয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিজেদের বিজয়ঢংকা বাজাতে থাকে। অনুরূপ ভাবে কোন হিন্দু ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করি দিলেই মুসলমানরা তাকে আসমানে তোলার চেষ্টা করে।
নির্বোধ কিশোরদের ফুসলিযে বিপথগামী করা অন্যদের কাছে যেমন ধর্ম প্রচারের কর্মসূচীর একটি গুরুত্ব পূর্ণ অংশ ছিল, অনুরূপ ভাবে মুসলমানদের মধ্যেও এরূপ পন্থাকে বৈধ মনে করা হল। মানসিক উত্তেজনার বশতবর্তী হয়ে যদি কোন হিন্দু নারী কোন বল্গাহীন মুসলমানের হাত ধরে পলায়ন করে তাহলে এটাকে ইসলারেম প্রচার কার্যেরে এক বিরাট বিজয় মনে করা হত। এ ধরনের নির্লজ্জতা ও লামপট্য ধ্মকে সহায়তা করা উপাদানে পরিণত হল। এর ফলে অসংখ্য ভ্রষ্টা নারী এবং লম্পট পুরুষ ধর্মান্তরকে একটা পেশায় পরিণত করে নিয়েছে। সকাল বেলা নিজেকে মুসলমান বলে জাহির কর মুসলমানদের কাঁধে সওয়ার হত এবং বিকেল বেলা নিজেকে হিন্দু অথবা খ্রীষ্টান বলে ঘোষণা করে তাদের কাছ থেকে টাকা পয়সা লাভ করত।
যে যুগে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় শুদ্ধি সংগঠনের খুব প্রভাব ছিল, এক মুসলমান বুযর্গ দিল্লীর মুসলমান পতীতাদের কাছে আবেদন করল- তার যেন তাদের অমুসলিম খদ্দেরদের কাছে ইসলামের তাবলীগ করে। এর ফলে অমুসলিমদের দৃষ্টিতে ইসলাম একটি মূল্যহীন বস্তুতে পরিণত হল। তারা মনে করে বসল, ইসলাম হচ্ছে একটা ব্যবস্থা, যা নিজ জাতির সংখ্যা বৃদ্ধির একটি উপায় মাত্র। সাধারণ লোকদের ধোকা দেয়ার জন্য মুসলমানরা এটাকে আল্লাহর দীন বলে তাদের সামনে পেশ করে থাকে। এরূপ ধারণা করাটা তাদের জন্য সম্পূর্ণ সংগত ছিল। কেননা যে উদ্দেশ্যে এবং ডেয পন্থায় অমুসলিমরা নিজেদের ধর্মকে ব্যবহার করছিল, ঠিক সেই উদ্দেশ্যে এবং সেই একই পন্থায় যখন তারা মুসলমানদেরও তাদের ধর্মকে ব্যবহার করতে দেখল তখন তাদের অন্তরে ইসলামের শ্রেষ্টত্বের ছার কি করে পড়তে পারে?
পঞ্চম ত্রুটিঃ পঞ্চম বাস্তব কর্মগত ভ্রান্তি হচ্ছে এই যে, মুসলমানরা দুনিয়ার যে কোন কাজের জন্য কোন না কোন যোগ্যতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। কিন্তু দুটি কাজের জন্য কোন যোগ্যতার প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে করেনা। মসজিদের ইমামতী ও দীনের তাবলীগ। এমন এক যুগ ছিল যখন নামাযের ইমামতী করত ইসলামী রাষ্ট্রের আমীর অথবা তার প্রতিনিধি। আর আজকে দিনে যে ব্যক্তি দুনিয়ার কোন কাজ আঞ্জাম দেয়ার যোগ্যতহা রাখেনা মুসলমানরা নিজেদের মসজিদের ইমাম নিযুক্ত করার জন্য তাকে খুজে বেড়ায়। এক কল্যাণময় যুগের মুসলমানরা মনে করত আল্লাহর রসুল যে দায়িত্বানুভুতি, কর্মতৎপরতা ও মনোনিবেশ সহকারে এই দীনকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন ঠিক সেই দায়িত্বানূভূতি, কর্মতৎপরতা ও মনোনেবেশ সহকার এই দীনকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যই আল্লাহ তায়ালা এই উম্মাতকে মনোনীত করেছেন। আর ইসলামী খিলাফত তার সর্বিক বিভাগ ও কর্মচারীদের নিয়ে রিসালাতের এই দায়িত্বই পালন করার একটি মাধ্যম ছিল। এদায়িত্ব আল্লাহর রসূলে পক্ষ থেকে এই উম্মাতের ওপর অর্পিত হয়েছিল। আর আজকের অবস্থা হচ্ছে এই যে, গোটা মুসলিম সমাজ তার সমস্ত বুদ্ধিমান ও কর্মতৎপর সদস্যদের নিয়ে একটি জাহেলী ব্যবস্থার খেদমতে নিয়েচিত রয়েছে।
প্রচলিত তাবলীগের পন্থার মধ্যে যেসব মোটা মোটা বুদ্ধিবৃত্তিক এবং কর্মগত ভ্রান্তি রয়েছে আমরা সেদিকে ইংগিত করলাম। এগুলোর সার্বিক মূল্যায়ন রলে আরো অনেক ভ্রান্তি পরিলক্ষিত হবে। কিন্তু আমরা আলোচনাকে আর দীর্ঘায়িত করতে চাইনা। এই ভ্রান্তিগুলোর উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, নবী-রসূলগণ যে পন্থায় দীনের প্রচারকার্য চালিয়েছেন তার সাথে বর্তমানে প্রচলিত পন্থায় কোন দুরতম সম্পর্কও নেই। নবীদের সামনে যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল, এদের সামনে সে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুপস্থি। তাঁদের যে কর্মপন্থা ছিল তার সাথে এদের কর্মপন্থায় কোন যোগসূত্র নেই। এদের উদ্দেশ্য-লক্ষ এবং কর্মপন্থায় অমুসলিম সংগঠন সমুহের অনুকরণ বিস্তার লাভ করেছে। এজন্য আমরা বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করতে চাই যে, নবী-রসূলগণ কি উদ্দেশ্যে তাবলীগ করেছেন এবং কিভাবে তাবলীগ করেছেন। এজন্য তাঁরা কি কি উপায় উপকরণ এবং কি পন্থা অবলম্বন করেছেন তাও আমরা উল্লেখ করব। প্রচারকার্যে তাঁদের কোন কোন স্তর অতিক্রম করতে হয়েছে। প্রতিটি স্তরের দাবী এবং যিম্মাদারী তারা কিভাবে পূরণ করেছেন এবং তাঁদের এই সংগ্রামের ফলে দুনিয়া কি কি কল্যাণ লাভ করেছে- আমরা তাও আলোচনা করব।


তাবলীগ কেন?
নবীরসূলের প্রয়োজনীয়তা
আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রকৃতির মধ্যে ভাল এবং মন্দকে চেনার যোগ্যতা এবং ভালকে গ্রহন করার ও মন্দ থেকে বেঁচে থাকার আকাংখা পদার্পন করেছে। সে নিজের অনুধাবন ক্ষমতার মাধ্যমে ভালকে গ্রহণ এবং মন্দকে পরিহার করে আল্লাহ তায়ালার কাছে ‍পুরুষ্কার পাবার যোগ্য হতে পারে। অপর দিকে নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে কল্যাণের পরিবর্তে খারাপ পথ অবলম্বন করে স্রষ্টা পক্ষ থেকে শাস্তির যোগৎ্য হয়ে যেতে পারে। কিন্তু একদিকে যেমন তার স্বভাবে সৌন্দর্য ও পূর্ণতার দিক রয়েছে, অপর পক্ষে তার মধ্যে ত্রুটি ও অপূর্ণতাও রয়েছে। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতেও তার হেদায়াত ও গোমরাহীর ব্যাপারটি এককভাবে তার স্বভাব প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দেননি এবং আখেরাতেও তাকে শাস্তি অথবা পুরস্কার দেয়ার ব্যাপারে কেবল স্বভাবগত পথনির্দেশকে যথেষ্ট মনে করেননি। বরং ফিতরাতের দাবী সমূহ এবং তার লুকায়িত যোগ্যতাকে উদ্ভাসিত করার জন্য এবং সৃষ্টির সামনে নিজের চুড়ান্ত প্রমাণ পেশ করার জন্য তিনি নবী রসূলদের পাঠিয়েছেন। যাতে লোকেরা কিয়ামতের দিন এই অভিযোগ উত্থাপন করতে না পারে যে, ভাল মন্দের রাস্তা তাদের জানা ছিলনা। এজন্য তারা গোমরাহীর পংকে নিমজ্জিত হয়েছে। এই সত্যকে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে।
رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمً
“আমরা রসূলদের পাঠিয়েছি সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী হিসেবে। যেন রসূলদের আসার পর লোকদের জন্য আল্লাহর কাছে ওজর পেশ করার আর কোন সুযোগ না থাকে। আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং সর্বজয়ী।”
(সূরা নিসাঃ ১৬৫)
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ عَلَى فَتْرَةٍ مِنَ الرُّسُلِ أَنْ تَقُولُوا مَا جَاءَنَا مِنْ بَشِيرٍ وَلَا نَذِيرٍ فَقَدْ جَاءَكُمْ بَشِيرٌ وَنَذِيرٌ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
“হে কিতাবধারীগণ! আমাদের এই রসূল এমন এক সময় তোমাদের কাছে এসেছে ও দীনের সুস্পষ্ট শিক্ষা তোমারেদ সামনে পেশ করছে- যখন রসূল আগমনের ক্রমিক ধারা দীর্ঘ দিনের জন্য বন্ধ ছিল। যেন তোমরা বলতে না পার যে, আমাদের কাছে কোন সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী আসেনি। অতএব, এই সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী এসেছে। আর আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের ওপরেই শক্তিশালী।”- (সূরা মায়েদাঃ ১৯)
নবীদের ব্যাপারে আল্লাহর বিধান
এ উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতির মধ্যে নবী-রসূল পাঠিয়েছেন যেন লোকদের সামনে সত্য পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে এবং বক্রতা ও গোমরাহির পথে অবিচল থাকার মত কোন ওজর তাদের কাছে অবশিষট না থাকে।নবীদের ব্যাপারে আল্লাহর বিধান এই ছিল যে, কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই তারা সবাই মানব-জাতির মধ্য থেকে এসেছেন, ফেরেশতা অথবা জিনদের মধ্য থেকে আসেননি। মানুষের কাছে যাতে মানব-স্বভাবের দাবীসমূহ মানুষের মাধ্যমেই পরিষ্কার করে তুলে ধরা যায়- সেজন্যই তাদের মধ্য থেকে নবী-রসূল পাঠানো হয়েছে। মানুষ যেন একথা বলার সুযোগ না পায় যে, মানুষের জন্য অ-মানবের (অন্য সৃষ্টিজীবের) জ্ঞান ও কর্ম ‍কি করে আদর্শ হতে পারে? এজন্য আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের মধ্য থেকে নবী-রসূল পাঠিয়েছেন, যাতে জাতিগত অপরিচিত লোকদের জন্য সত্যকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। আল্লাহর নবীগণ নিজ নিজ জাতির কাছে তাদের ভাষায়ই আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন, যাতে তাদের সামনে পরিষ্কার ভাব সত্য উপস্থাপিত হতে পারে। তাঁদের ভাষাও ছিল অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন, বোধগম্য এবং চিত্তাকর্ষক। তাছাড়া রসূলগণ কেবল একবার তাদেরকে সত্যের দিকে আহ্বান করে থেমে যাননি, বরং গোটা জীবনটাই এই উদ্দেশ্যে ব্যয় করেছেন। তাঁরা যে কাজ করার জন্য লোকদের আহ্বান জানিয়েছেন, নিজেরাও তা করে দেখিয়েছেন এবং তাঁদের সাথীরাও নিজেদের কর্মময় জীবচনে তার অনুশীলন করেছেন। এই ব্যবস্থা কেবল এজন্য করা হয়েছে যে, স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন এবং ‍দুনিয়াতে জীবন যাপনের জন্য সৃষ্টির যা কিছু জানা দরকার, তা বলে দেয়ার ক্ষেত্রে যেন কোনরূপ ত্রুটি ও অপূর্ণতা না থাকতে পারে এবং কিয়ামতের দিন লোকেরা নিজেদের দুষ্কর্মের অপবাদ আল্লাহর ওপর চাপাতে না পারে।
সর্বশেষ নবীর আগমন
দুনিয়া যতক্ষণ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের এমন সব উপায় উপকরণ সৃষ্টি করতে পারেনি- যা গোটা দুনিয়াকে একজন মাত্র আহ্বানকারীর আহ্বানে সাড়া দেয়ার জন্য একত্র করতে পারে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি জাতির জাছে স্বতন্ত্রভাবে নবী-রসূল পাঠানো অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু যখন নবীদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জাতি সমূহের নৈতিক এবং সামাজিক চেতনা ও অনুভূতি এতটা সজাগ হয়ে গেল যে, তারা এখন একটি বিশ্বব্যাপক জীবন-ব্যবস্থার অধীন জীবন যাপন করতে পারবে এবং সাথে সাথে সমাজ-সাংস্কৃতির বস্তুগত উপায়-উপকরণেরও এতটা উন্নতি হল যে, একজন মাত্র পথপ্রদর্শকের আহ্বান অতি সহজেই গোটা দুনিয়ায় পৌঁছে যেতে পারে- তখন আল্লাহ তায়ালা নিজ অনুগ্রহে সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়ায় পাঠালেন। তাঁর মাধ্যমে তিনি দুনিয়ার মানুষকে একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান দান করলেন। এই জীবন বিধান গোত্র বর্ণ নির্বিশেষে গোটা মানব জাতির মেজাজ প্রকৃতি এবং তাদের অবস্থা, পরিবেশ ও প্রয়োজনের সাথে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ। এটাই হল খোদায়ী জীবন-বিধান, যাকে আমরা “ইসলাম” নামে জানতে পেরেছি।
ইসলাম তার প্রাণসত্তার দিক থেকে সেই দ্বীন যা নিয়ে সমস্ত নবীদের আগমন ঘটেছে। শুধু কিছু কিছু ব্যাপারে সামান্য পার্থক্য ছিল। প্রথম দিককার নবীগণ নিজ নিজ জাতির ধারণ-ক্ষমতা অনুযায়ী আকীদা বিশ্বাসের তালীম দিয়েছেন। খাতামুল আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানব জাতির অনুধাবন ক্ষতা-যা আল্লাহ তাদের দান করেছেন তদনুযায়ী তাদের আকীদা বিশ্বাসের শিক্ষা দিয়েছেন। অপরাপর নবীগণ আইন কানুন শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে নিজ নিজ জাতির বিশেষ মেজাজ এবং বিশেষ বিশেষ রোগের দিকে লক্ষ্য রেখেছেন। কিন্তু ইসলারেম আইন বিধান কোন বিশেষ জাতিগত বা সামাজিক মেজাজ ও ঝোঁক প্রবণতাকে বিবেচনা করার পরিবর্তে শুধু মানব জাতির মেজাজকে বিবেচনা করা হয়েছে। অন্য নবীদের যে জীবন ব্যবস্থা আল্লাহর পক্ষ থেকে দান করা হয়েছিল তা কেবল নিজ নিজ জাতির প্রয়োজন অনুপাত ছিল। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে দুনিয়ার মানুষ যে জীবন ব্যবস্থা লাভ করেছে, তা কেবল কোন বিশেষ জাতির প্রয়োজনই পূর্ণ করেনা, বরং গোটা মানব জাতির সমস্ত ব্যক্তিগত এবং সামগ্রিক প্রয়োজন সমূহও পূরণকরে।
রসূলুল্লাহর আগমনের দুটি দিক
নবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর গোটা বিশ্বের হেদায়াত ও পথ প্রদর্শন এবং গোটা সৃষ্টির সামনে চুড়ান্ত প্রমাণ পেশ করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। তাঁর পরে আর কোন নবী আসার প্রয়োজন নেই। এজন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁকে দুটি নবুওয়াতের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। একটি বিশেষ ভাবে প্রেরণ, অপরটি সাধারণভাবে প্রেরণ। তাঁকে বিশেষভাবে আরববাসীদের মধ্যে পাঠানো হয়েছে। আরবদের সাথে এই বিশেষ সম্পর্কের কারণে তাঁকে উম্মী নবী অথবা রসূলে আরাবী বলা হয় এবং তাঁর ওপর যে অহী নাযিল হয় তার ভাষাও আরবী। এই দৃষ্টিকোন থেকে তাঁর যে দায়িত্ব (তাবলীগ ও হুজ্জাত পূর্ণ করণ) ছিল তা তিনি সরাসরি পালন করছেন।
তাঁকে সাধারণভাবে গোটা দুনিয়ার মানুষের কাছে পাঠানো হয়েছ। এই প্রেরণের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁকে একটি উম্মাত দান করেছেন এবং উম্মাতকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, রসূল তোমাদের কাছে যে দীনে হকের প্রচার করছেন- তোমরা সেই দীনের প্রচার অন্যদের কাছে করতে থাকবো। মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا
“আর এভাবেই আমরা তোমাদের এক মধ্যপন্থী উম্মাত বানিয়েছি যাতে তোমরা দুনিয়ার লোকদের জন্য সাক্ষী হতে পার, আর রসূল সাক্ষ্য হবে তোমাদের ওপর।” –(সূরা বাকারা ১৪৩)
وَأُوحِيَ إِلَيَّ هَذَا الْقُرْآنُ لِأُنْذِرَكُمْ بِهِ
“আর এই কুরআন অহীর মাধ্যমে আমার কাছে পাঠানো হয়েছে; যেন আমি তোমাদেরকে এবং আর যাদের কাছে তা পেীঁছুবে-তাদের সবাইকে সতর্ক করে দিতে পারি। -(সূরা আনআমঃ১৯)
দ্বীনের হেফাজতের জন্য ‍দু্টি বিশেষ ব্যবস্থা
রসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাধারণ প্র্রেরণের উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য আল্লাহ তায়ালা একটি পূর্ণাংগ উম্মাতের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে, প্রতিটি দেশ, প্রতিটি জাতি এবং দুনিয়া যাতে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় নাযিল হওয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকে চিরকালের জন্য মুখাপেক্ষীহীন হয়ে যায়। যেহেতু তাঁর পরে আর কোন নবীর আগমন ঘটবেনা। তাই সৃষ্টি কুলের পথপ্রদর্শন এবং দ্বীনে হকের প্রমান চুড়ান্ত করার দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে এবং চিরকালের জন্য তাঁর ‍উম্মাতের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। এজন্য আল্লাহ তায়ালা দীনের হেফাজতের জন্য দুটি বিশেষ ব্যবস্থাকরেছেন।
একঃ কুরআন মজীদকে তিনি যে কোন ধরণের পরিবর্তন পরিবর্ধন, তাহরীফ এবং সংশোধন ও সংকোচন থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত রেখেছেন, যাতে আল্লাহর বিধান জানার জন্য দুনিয়ার মানুষ কোন নতুন নবীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করে।
দুইঃ তিনি এই উম্মাতের একটি দলকে সব সময়ের জন্য হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছেন। একথা সহীহ হাদীস থেকেও প্রমাণিত। ফলে যেসব লোক সত্যের সন্ধানী হবে তাদের জন্য এদের জ্ঞান ও কর্ম আলোক-বর্তীকার কাজ দিতে থাকবে।
এ ধরণের একাটি জামাআত (তাদের সংখ্যা যত নগন্যই হোক না কেন) এই উম্মাতের মধ্যে অবশিষ্ট থাকবে। যত বিপর্যয়ই আসুক না কেন, এই পূন্যবান জামাআত’ রসূলুল্লাহ (সা) এবং তাঁর সাহাবীদের জ্ঞান ও কর্মকে জীবন্ত রাখবে। গোমরাহীর প্রভাব যখন এই উম্মাতের শিরাউপশিরায় এমন ভাবে প্রবাহিত হবে যেভাবে পাগলা কুকুরের বিষ আহত ব্যক্তির দেহে ছড়িয়ে পড়ে সে সময়ও আল্লাহ তায়ালা এই উম্মাতের একটি অংশকে গোমরাহী থেকে নিরাপদ রাখবেন। যখন দুনিয়ার মানুষের স্বভাব এতটা বিকৃত হয়ে যাবে যে, ন্যায় নিষ্ঠা অন্যায় হিসেবে গণ্য হবে এবং অন্যায়-অশ্লীলতা ন্যায় নিষ্ঠা ও ভদ্রতা হিসাবে পরিগণিত হবে; বিদআত পন্থীদের শক্তি এতটা বৃদ্ধি পাবে যে, ন্যায়ের দিকে আহ্বানকারীগণের অবস্থা দুনিয়াতে অপরিচিতজনের মত হয়ে যাবে- সে সময়ও এই লোকেরা সৃষ্টিকুলকে সত্য দীনের দিকে আহ্বান জানাতে থাকবে এবং প্রতি পদে পদে বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েও মানুষের সৃষ্ট বিকৃতির সংশোধন করার চেষ্টা করতে থাকবে।
প্রতিটি যুগে এ ধরণের একটি আমাআতকে সক্রিয় রাখার পেছনে আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, তিনি অহীর জ্ঞানকে যেভাবে কুরআনের আকারে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য সুরক্ষিত করে দিয়েছেন, অনুরূপভাবে আল্লাহর রসূল এবং রসূলের সাহাবীদের জ্ঞান ও কর্ম এই জামাআতের মাধ্যমে যেন চিরকালের জন্য সংরক্ষিত থাকতে পারে এবং সৃষ্টির পথ প্রদর্শন ও রসূলের প্রমাণ (হুজ্জাত) চূড়ান্ত করার জন্য যে আলোর প্রয়োজন তা যেন কখনো নির্বাপিত হয়ে না যেতে পারে। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ভাষায়-এই লোকেরা হবে পাহাড়ের প্রদীপ। এর সাহায্যে পথহারা ব্যক্তি পথ খুজে পাবে। এরা হবে জমীনের লবন যার সাহায্যে কোন জিনিস লবণাক্তকরা যেতে পারে।
রিসালাতের দায়িত্ব হিসেবে তাবলীগ
ওপরের আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার ভবে জানা গেল যে, লোকদের ওপর সাক্ষী হওয়া বা দীনের প্রচারকার্য চালানো শুধু একটি নেকীর কাজই নয় বা কেবল মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধিই উদ্দেশ্য নয়; বরং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাধারণ ভাবে পাঠানোর যে উদ্দেশ্য এই উম্মাতের হাতে পূর্ণ হবার রয়েছে- তাবলীগের দাবীই হচ্ছে তাই। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি ব্যক্তির তাবলীগের দায়িত্ব পালন করা একান্ত আপরিহার্য কর্তব্য। দ্বীনের প্রচারকার্য তাঁর উম্মাতের ওপর অর্পণ করেছেন। মুসলমানরা যদি এ দায়িত্ব পালনে কোনরূপ ত্রুটি করে, তাহলে তারা প্রকারান্তরে রিসালাতের দায়িত্ব পালনেই ত্রুটি করল। এ দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালাই তাদের ওপর অর্পন করেছিলেন। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে যে দায়িত্ব পালনের জন্য “খাইরা উম্মাত” বা সর্বশ্রেষ্ট জাতির মর্যাতায় আসীন করেছিলেন, সেই মর্যাদা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করে দেবেন এবং দুনিয়াবাসীর পথ ভ্রষ্টতার সমস্ত দায়দায়িত্ব তাদের মাথায় চাপবে। কেননা তারাই এখন খোদার সৃষ্টির সামনে দীনকে চুড়ান্তভাবে পেশ করার মাধ্যম। যদি তারা এ দায়িত্ব পালন না করে তাহলে দুনিয়ার মানুষ কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে এই ওজরে পেশ করার সুযোগ পেয়ে যাবে যে, তুমি যাদেরকে ‘শুহাদা আলান-নাস’ বানিয়েছিলে এবং তাদের ওপর আমাদের পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলে তারা আমাদের কাছে তোমার দীনের দাওয়াত পেশ করেনি। অন্যথায় আমরা গোমরাহীর শিকার হতামনা। মুসলমানরা তখন এই অভিযোগের কোন জবাব দিতে পারবেনা।
তাবলীগের শর্তাবলী
লোকদের ওপর সাক্ষী হওয়া বা সাধারণভাবে তাবলীগ ও প্রচার কার্যের এই দায়িত্ব দুনিয়াতে কেবল মুসলমান নামে একটি জাতির অস্তিত্ব বর্তমান থাকলেই আদায় হতে পারেন্-চাই তারা মানুষের ওপর সাক্ষী হওয়ার দায়িত্ব পালন করুক বা না করুক। এটা রিসালাতের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা তাবলীগের জন্য যেসব শর্ত আরোপ করেছেন এবং নবী-রসূলগণ যেসব শর্তের প্রতি খেয়াল রেখে তাবলীগের কাজ করেছেন- সেসব শর্ত পূরা করেই আল্লাহর দীনের প্রচারকার্য আঞ্জাম দিতে হবে। এখানে আমরা এ ধরনের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ শর্তের উল্লেখ করব যেগুলোকে এই দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হবে।
প্রথম শর্তঃ প্রচার কার্যের প্রথম শর্ত এই যে, আমরা যে দীনে হকের সাক্ষী, পথম আমাদেরকেই সেই দীনের ওপর বিশ্বস্তমন নিয়ে ঈমান আনতে হবে। নবী-রসূলগণ যে দীনের দাওয়াত দিতেন প্রথমে তাঁরা নিজেরা সেই দীনের ওপর ঈমান আনতেন। তাঁরা নিজেদেরকে এই দীনে হকের উর্ধে মনে করতেননা। “আমানার রসূলু বিমা উনযিলা ইলাইহি ওয়অল মুমিনূন”- (রসূলের ওপর যা কিছু নাযিল করা হযেছে- তিনি নিজে এবং মুমিনগণ তার ওপর ঈমান এনেছে)।
এই সত্য দীনের ওপর ঈমান আনার পর যেসব জিনিস তার পরিপন্থী মনে হল তা পরিহার করার জন্য তাঁরাই সর্বপ্রথম এগিয়ে আসলেন। চাই তা বাপ-দাদার ধর্মই হোক, অথবা গোত্র ও সাম্প্রায়িক বন্ধনই হোক, অথবা নিজের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত স্বার্থই হোক। এটা করতে গিয়ে তাদের সামনে যি বিপদই এসেছে, তাঁরা বলেছেন, “আমিই প্রথম মুমিন, আমিই প্রথম মুসলমান।” এমনটি কখনো হয়নি যে, তাঁরা নিজেদেরকে বিপদ থেকে নিরাপদ দুরত্বে রেখে অন্যদেরকে উত্তেজিত করেছেন- যদি তোমরা নাজাত পেতে চাও তাহলে এই বিপদের মধ্যে লাফিয়ে পড়।
দ্বিতীয় শর্তঃ দীনে হকের প্রচার কাজের দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে এই যে, মানুষ যে সত্যের ওপর ঈমান এনেছে তারা মৌখিকভাবে তার সাক্ষ্য দেবে। যে ব্যক্তি কোন সত্যেল ওপর ঈমান আনার পর তা প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখা সত্যেও যদি তা প্রকাশ না করে তাহলে সে একটি বোবা শয়তান। কিয়ামতের দিন সে সত্য গোপন করার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবে- যেভাবে ইহুদীরা এই অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছে। কুরআনের বাণীঃ
وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلَا تَكْتُمُونَهُ فَنَبَذُوهُ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ وَاشْتَرَوْا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا فَبِئْسَ مَا يَشْتَرُونَ “ আল্লাহ তায়ালা যখন কিতাবদের কাছ থেকে ওয়াদা গ্রহণ করেছিলেনঃ তোমরা এই কিতাবের শিক্ষা লোকদের মধ্যে প্রচার করতে থাকবে এবং তা গোপন করে রাখতে পারবেনা। কিন্তু তারা এই কিতাবকে পেছনের দিকে নিক্ষেপ করেছে এবং সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে তা বিক্রি করেছে।”
-(সূরা আলে ইমরানঃ১৮৭)
এ ব্যাপারে যে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত তা মূলত দীনে হকের স্বার্থেই করা উচিত। আর তা হচ্ছে এই দীনকে সঠিক পন্থায় সঠিক স্থানে এবং উপযুক্ত ব্যক্তির সামনে প্রচার করতে হবে। এতে সত্য দীনের দাওয়াত ব্যক্তির অন্তরে স্থান করে নিতে পরবে। যদি কোন ব্যক্তি সত্যকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কেবল নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে দীনে হকের প্রচার থেকে বিরত তাঁকে অথবা এ ব্যাপারে অনীহা প্রদর্শন করে তাহলে সে হয় মোনাফিক, অথবা ব্যক্তিত্বহীন এক কাপুরুষ। কেবল বিশেষ পরিস্থিতিতে সত্যকে প্রকাশ করা থেকে সাময়িকভাবে বিরত থাকার অনুমতি আছে। যেমন, তা করতে গেলে বাস্তবিক জীবন নাশের আশংকা রয়েছে এবং প্রচারকও মনে করে যে, এসময় দীনে হকের খেদমতের দৃষ্টিকোন থেকে নিজের জীবন রক্ষা করাটাই অধিক শ্রেয়।
তৃতীয় শর্তঃ তৃতীয় হচ্ছে এই যে, এই সাক্ষ্য কেবল মৌখিক ভাবে দিলেই চলবেনা, বরং বাস্তব কর্মের মাধ্যমেই এই সাক্ষ্য দিতে হবে। যে সাক্ষ্যের পেছনে বাস্তব কর্মের উপস্থিতি নেই- ইসলামে এ ধরনের সাক্ষ্য নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হয়না। কোন কোন ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসত এবং তাঁর সামনে শপথ করে বলত আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রসূল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদের এ সাক্ষ্য গহণ করেননি। তিনি বলেছেন, এরা মোনাফিক এবং মিথ্যাবাদী। এর সমর্থনে তিনি তাদের সামনে তাদের কার্যকলাপ ও বক্তব্যকে তুলে ধরেছেন। এর মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে তাদের বিরূপধারণা ও হকের বিরুদ্ধে তাদের শত্রুতা প্রকাশ পেয়েছে।
যে ব্যক্তি একটি সত্যকে মেনে নিয়েছে এবং লোকদেরও সেদিকে আহ্বান জানাচ্ছে, তার অপরিহার্য কর্তব্য হচ্ছে তার কাজকর্মও এই সত্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। অন্যথায় সে সেই ইহুদী আলেমদেরই পদাংক অনুসারী বিবেচিত হবে- কুরআন মজীদ যাদের কঠোর সমালোচনা করেছে। তারা অন্যদেরকে আল্লাহর বিশ্বাসভাজন হওয়ার জন্য আহ্বান করত, কিন্তু নিজেদের প্রসংগটি ভুলে যেত। যে ব্যক্তি বা দলের কার্যকলাপ তাদের দাওয়াতের পরিপন্থি, তারা মূলত নিজেদের দাওয়াদ প্রত্যাখ্যান করার প্রমাণ নিজেরাই পেশ করছে। বাস্তব কর্মের মাধ্যমে যে প্রমাণ পেশ করা হয় তা মৌখিক প্রমাণের চেয়ে অধিক শক্তিশালী। তাদের নিজেদের কার্যকলাপ তাদের দাবীর বিরুদ্ধে এতটা শক্তিশালী প্রমাণ বহন করে যে, এরপর তাদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার জন্য অন্য কোন প্রমানের প্রয়োহনীয়তা অবশিষ্ট থাকেনা।
মুসলমানরা যদি আল্লাহর দীনের সাক্ষী হয়ে থাকে, তাহলে তার অত্যাবশ্যকীয় দাবী হচ্ছে এই যে, তার এই দীনের ওপর ঈমান আনবে অন্যদের কাছে এর দাওয়াত পৌঁছাবে এবং নিজেদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে এই দীন অনুযায়ী আমল করবে। এছাড়া এই সাক্ষ্যের হক আদায় হতে পারেনা, যেজন্য আল্লাহ তায়ালা তাদের মনোনিত করেছেন। জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে এই দীনের সাথে সম্পর্ক না থাকা এবং মৌখিক ভাবে এটা সত্য দীন হওয়ার সাক্ষ্য দেয়া-সৃষ্টির সামনে হুজ্জাত (প্রমাণ) পূর্ণ করার দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণতই একটি হাস্যম্পদ ব্যাপার। এ ধরণের কর্মবিমুখ বক্তাদের ওয়াজের ভিত্তিতে আল্লাহ তায়ালা যদি তাঁর সৃষ্টিকে অপরাধী সাব্যস্ত করেন তাহলে এটা তাঁর ইনসাফের পরিপন্থী হবে। এর অত্যাবশ্যকীয় পরিণতি হবে এই যে, মুসলমানদের ওপর এই দীনের হুজ্জাত চূড়ান্তভাবে পূর্ণ হয়ে যাবে এবং কিয়ামতের দিন তারা নিজেদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই গ্রেপ্তার হবে।
বাস্তব কর্মক্ষেত্রে দীন থেকে পদাস্খলনে যেসব দিক ক্ষমার যোগৎ্য তা কুরআন নিজেই বর্ণনা করেছে এবং সাথে সাথে এর চিকিৎসার পদ্ধতিও বলে দিয়েছে। ক্ষমার যোগ্য পদাস্খলনের একটি দিক হচ্ছে এই যে, আবেগ-উত্তেজনা অথবা প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ যদি হকের পরিপন্থী কোন কাজ করে বসে। এর চিকিৎসা হচ্ছে সাথে সাথে তওবা করা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমার প্রার্থনা করা। অপর একটি দিক হচ্ছে, যদি কোন ব্যক্তিকে হকের পরিপন্থী কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এর চিকিৎসা হচ্ছে এই যে, মানুষ এই অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করবে। তওবা ও সংশোধনের চেষ্টা করার পরিবর্তে মানুষ যদি নিজের ভ্রান্তিকে চাদর করবে। তওবা ও সংশোধনের চেষ্টা করার পরিবর্তে মানুষ যদি নিজের ভ্রান্তিকে চাদর করবে। তওবা ও সংশোধনের চেষ্টা করার পরিবর্তে মানুষ যদি নিজের ভ্রান্তিকে চাদর এবং বিছানা বানিয়ে নেয় এবং সংকটাপন্ন অবস্থার মধ্যে সে পতিত হয়েছে তাকে যদি নিজের ধর্মে পরিণত করে নেয়, তাহলে এই অপরাধ ক্ষমার যোগ্য নয়। তাকে জনগণের ওপর সাক্ষী হওয়ার যে পদমর্যাদায় আসীন করা হয়েছিল, বাতিলের ওপর সন্তুষ্ট থাকার কারণে তাকে সেই মর্যাদাপূর্ণ পদ থেকে হটিয়ে দেয়া হবে।
চতুর্থ শর্তঃ তাবলীগের চতুর্থ শর্ত হচ্ছে এই যে, সাক্ষ্যকে যে কোন প্রকারের জাতিগত ও গোত্রগত গোড়ামী থেকে মুক্ত রাখতে হবে। যে দীনে হকের দাওয়াত আমরা পেশ করছি তার পথ থেকে কোন জাতির শত্রুতা অথবা মিত্রতা আমাদেরকে যেন বিচ্যুত করতে না পারে। আমাদের বিরোধীদের মোকাবিলায় আমাদেরকে যেভাবে নিরপেক্ষ থাকতে হবে, তার শিক্ষা কুরআন মজীদ নিম্নোক্ত বাক্যে দিয়েছেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর জন্য সত্যনীতির ওপর স্থায়ীভাবে দন্ডয়মান থাক এবং ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হও। কোন বিশেষ দলের শত্রুতা তোমাদেরকে যেন এতটা উত্তেজিত করে না দেয় যে, তোমরা ইনসাফ ত্যাগ করে ফেলবে। ন্যায় বিচার কর। এটা তাকওয়ার সাথে গভীর সামঞ্জস্যপূর্ণ।” (সূরা মায়েদাঃ৮)
নিজেদের বন্ধু ও আপনজনদের বেলায় যেভাবে নিরপেক্ষ থাকতে হবে তার শিক্ষাও কুরআন মজীদ নিম্নোক্ত আয়াতে তুলে ধরেছেঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ إِنْ يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا وَإِنْ تَلْوُوا أَوْ تُعْرِضُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا
“হে ঈমানাদারগণ! তোমরা ইনসাফের ধারক হও এবং আল্লাহর জন্য সাক্ষী হও। তোমাদের এই সুবিচার ও সাক্ষ্যের আঘাত তোমাদের নিজেদের ওপর অথবা তোমাদের পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের ওপরই পড়ুক না কেন, আর পক্ষদ্বয় গরীব অথবা ধনীই হোকনা কেন- তাদের সকলের অপেক্ষা আল্লাহর এই অধিকার অনেক বেশী যে, তোমরা তাঁর দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখবে। অতএব নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে গিয়ে সুবিচার থেকে বিরত থেকনা।” –(সূরা নিসাঃ ১৩৫)
পঞ্চম শর্তঃ দীন প্রচারের পঞ্চম শর্ত হচ্ছে এই যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে পূর্ণাংগ ও পরিপূর্ণ দীন আমাদের কাছে এসেছে সেই গোটা দীনের সার্বিক সাক্ষ্য দান করতে হবে। কোনরূপ তিরষ্কার অথবা বিরোধিতার ভয়ে এর মধ্য থেকে কোন কিছু বাদ দেয়া যাবেনা। যেসব বিষয়ের সাক্ষ্য ব্যক্তিগত জীবনের কর্তব্যের সাথে সংশ্লিষ্ট, ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত জীবনে সেগুলো সাক্ষ্য বহন করতে থাকবে। প্রতিটি ব্যক্তিকে নামায পড়তে হবে, রোযা রাখতে হবে, প্রতিটি ধনবান ব্যক্তিকে যাকাত দিতে হবে এবং প্রতিটি সামর্থবান ব্যক্তিকে হজ্জ করতে হবে। সৎকাজ, বিশ্বস্ততা, পবিত্র জীবন প্রত্যেক মুসলমানই অবলম্বন করবে।
কিন্তু যেসব জিনিসের সাক্ষ্য দেয়ার জন্য সমষ্টিগত জীবন শর্ত, সেখানে ব্যক্তির কর্তব্য হচ্ছে, সমষ্টিগত জীবন গঠন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। যখন তা অস্তিত্বে এসে যাবে তখন ঐসব বিষয়ের সাক্ষ্য দেবে। যেমন, সামাজিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং দেশের রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলা একক ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। এগুলোকে ইসলামী ছাঁচে ঢেলে সাজানোর জন্য একটি সাংগঠনিক শক্তির প্রয়োজন। এজন্য সর্বাগ্রে একটি সালেহ জামাআত গঠণ করা একান্ত প্রয়োজন। এই সংগঠন কায়েম করার পর সমষ্টিগত জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে দীনে হকের সাক্ষ্য দেয়া অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়বে। নিম্নে আমরা কয়েকটি আয়াত উধৃত করছি। তা থেকে জানা যাবে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোনরূপ হ্রাস-বৃদ্ধি ছাড়াই গোটা দীনের সাক্ষ্য বহন করার জন্য কতটা তাকিদ করা হয়েছে।
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ “হে রসূল! তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমার ওপর যা কিছু নাযিল করা হয়েছে, তা লোকদের কাছে পৌঁছে দাও। তুমি যদি তা না কর, তাহলে তুমি তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব পালন করলেন। লোকদের অনিষ্ট থেকেই আল্লাহ তোমাকের রক্ষা করবেন।” –(সূরা মায়েদাঃ৬৭)
الَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَالَاتِ اللَّهِ وَيَخْشَوْنَهُ وَلَا يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلَّا اللَّهَ وَكَفَى بِاللَّهِ حَسِيبًا
“যারা আল্লাহর পয়গাম সমূহ পৌঁছায়, তাঁকেই ভয় করে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করেনা।” (সূলা আহযাবঃ৩৯)
(আরবী****)
“কাফের এবং মোনাফিকদের কথায় মোটেই কর্ণপাত করোনা। তাদের নিপীড়নকে মোটেই পরোয়া করোনা। আল্লাহর ওপর ভরসা করো” (সূরা আহযাবঃ৮৮)
فَلِذَلِكَ فَادْعُ وَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَقُلْ آمَنْتُ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنْ كِتَابٍ
“অতএব তুমি সেই দীনের দিকে দাওয়াত দাও এবং তোমাকে যেমন হুকুম করা হয়েছে- সেই দীনের ওপর অবিচল থাক। কিন্তু এই লোকদের কামনা বাসনার অনুসরণ করোনা। তুমি বল, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন, আমি তার ওপর ঈমান এনেছি।” (সূরা শূরাঃ১৫)
ষষ্ঠ শর্তঃ দীন প্রচারের ষষ্ঠ শর্ত হচ্ছে এই যে, আল্লাহর দীনের দিকে আহ্বানকারীগণ প্রয়োজনবোধে জীবন দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে, জীবন দিয়ে দেবে। এটা সাক্ষ্যদানের সর্বোচ্চ স্তর। এ কারণেই যেসব লোক আল্লাহর দীনের জন্য জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং যে সত্যের ওপর ঈমান এনেছেন, তা সত্য হওয়ার সাক্ষ্য তরবারীর ছায়াতলেও দিয়েছেন, তখন তাদেরকে শীহদ করা হয়েছে। এ ধরণের প্রাণ উৎর্গকারী ব্যক্তিদের ছাড়া আর কে শহীদের এই মহান খেতাব লাভ করতে পারে। আর কার জন্য তা উপযুক্ত হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা এই উম্মতের ওপর লোকদের জন্য সাক্ষী হওয়ার যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, তা পূর্ণ করার জন্য হাজারো লাখো মানুষ দাঁড়িয়ে যেতে পারে এবং তাদের প্রত্যেকেই আল্লাহর কাছে নিজ নিজ শ্রমের প্রতিদান লাভ করবে। কিন্তু যারা এ পথে নিজেদের গোটা জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছে এবং নিজেদের জীবনের বিনিময়ে সত্যের সাক্ষ্য দিয়ে গেছে মূলত সেই ব্যক্তিই ‘শহীদ’ উপাধি লাভ করার যোগ্য। কেননা কোন একটি জিনিসের সত্য হওয়ার পক্ষে এর চেয়ে আর বড় সাক্ষ্য কি হতে পারে যে, কোন ব্যক্তি সত্য দীনের সাহায্যের জন্য নিজের অমূল্য জীবনকেও বিলিয়ে দিল। যে ব্যক্তি নিজের জীবনকে বাজি রেখে সত্যের সাক্ষ্য দান করল, যার পরে সত্যের সাক্ষ্যের আর কোন পর্যায় অবশিষ্ট থাকেনা। সেই হল প্রকৃত শহীদ।
মুসলমানদের দায়িত্ব
রিসালাদের এই দায়িত্বের কারণেই মুসলিম উম্মাতকে “সর্বোত্তম জাতি” বলা হয়েছে। মুসলমানরা যদি এই দায়িত্ব বিস্মৃত হয়ে যায় তাহলে তারা দুনিয়ার অন্যান্য জাতির মত একটি জাতি মাত্র। তাদের মধ্যে না আছে কোন বিশেষ সৌন্দর্য, আর না আছে বিশেষ মর্যাদা লাভের কোন কারণ। আল্লাহ তায়ালারও দেখার প্রয়োজন নেই যে, তারা দুনিয়াতে সসম্মানে বসবাস করছে,না অপমানিত অবস্থায় জীবন যাপন করছে। বরং এই দায়িত্ব ভুলে যাবার পর তারাও আল্লাহর অভিশাপে পতিত জাতিতে পরিনত হবে। যেমন, তাদের পূর্বে অন্য জাতিকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অর্পিত দায়িত্ব পালন না করার পরিণতিতে তারা অভিশপ্ত হয়েছে। অতএব যে আয়াতে মুসলমানদের সর্বোত্তম জাতি বলে ঘোষণা করা হয়েছে তাতে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যও পরিষ্কার ভাবে বলে দেয়া হয়েছে।
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَوْ آمَنَ أَهْلُ الْكِتَابِ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ مِنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ وَأَكْثَرُهُمُ الْفَاسِقُونَ
“তোমরা সর্বোত্তম জাতি, যাদেরকে মানুষের হেদায়াতে জন্য কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দাও, অন্যায় কাজ থেকে লোকদের বিরত রাখ এবং আল্লাহর ওপর ঈমান আন।” (সূরা আলে ইমরানঃ১১০)
এই সমষ্টিগত দায়িত্ব পালন করার পন্থাও আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলে দিয়েছেনঃ (আরবী*****************)
“তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক থাকতে হবে, যারা কল্যাণেল দিকে ডাকবে, ন্যায়ানুগ কাজের নির্দেশ দেবে এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ কাজ করবে তারাই সফলকাম হবে।” (সূরা আলে ইমরানঃ১০৪)
এই নির্দেশ পালন করার ক্ষেত্রে মুসলমানরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর সর্ব প্রথম যে কাজ করেছে, তা হচ্ছে এই যে, তারা অবিকল নবুওয়াতের পন্থায় খেলাফরেত ভিত্তি স্থাপন করে। এই সংস্থা কল্যাণকর কাজের দাওয়াত, ন্যায় কাজের নির্দশ এবং অন্যায় কাজ থেকে প্রতিরোধ করার জন্য একটি সাংগঠনিক সংস্থা হিসাবে কাজ করে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর মুসলমানদের ওপর দীনে হকের যে সমষ্টিক দায়িত্ব অর্পিত হয়, তা আঞ্জাম দেয়ার জন্যই তারা এই সংস্থা কায়েম করে। এই সংস্থা মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসাবে তাদেরকে সত্যের ওিপর কায়েম রাখার এবং দুনিয়ার মানুষকে হকের দিকে আহ্বান করার দায়িত্ব পালন করে। খেলাফত নামক এই সংস্থা যতদিন সঠিক ভাবে কায়েম ছিল, মুসলমান-অমুসলমান সবাই নিজের দায়িত্ব পালনে সক্রিয় ছিল। এসময় পর্যন্ত তাবলীগের দায়িত্ব পালন ফরজে কিফায়ার পর্যায়ভুক্ত ছিল। খেলাফত ব্যবস্থা তা আঞ্জাম দিয়ে জামাআতের প্রতিটি সদস্যকে আল্লাহর কাছে এই ফরজের যিম্মাদারী থেকে মুক্ত করতে থাকে। কিন্তু এই ব্যাবস্থা যখন এলোমেলো হয়ে গেল, তখন সত্যের সাক্ষ্যের এই দায়িত্ব পুনরায় সমাজের প্রতিটি সদস্যের উপর এসে পড়েছে। যেমন কোন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ভেংগে পড়ার পর তার বাসিন্দাদের জানমালের হেফাজদের দায়িত্ব রাষ্ট্রের পরিবর্তে তাদের নিজেদের ওপর এসে পড়ে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তারা পুনরায় নিজেদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারে, ততক্ষন এ দায়িত্ব তাদের ওপরই ন্যস্ত থাকে। অনুরূপ ভাবে খেলাফত ব্যবস্থ ভেংগে পড়ার পার লোকদের ওপর সাক্ষ্য হওয়ার দায়িত্ব উম্মাতের প্রতিটি সদস্যের ওপর এসে পড়েছে। এই দায়িত্ব পালনের জন্য তারা যতক্ষণ ইসলামের সঠিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলেতে না পারবে, ততক্ষণ এ দায়িত্ব পালন না হওয়ার গুনাহ প্রতিটি মুসলমানদের ওপর বর্তাবে। কিয়ামতের দিন প্রতিটি ব্যক্তিকে এজন্য জবাবদিহি করতে হবে।
সারসংক্ষেপঃ
এই গোটা আলোচনার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে এই যে,
(কা) কিয়ামত পর্যন্ত গোটা বিশ্বে আল্লাহর দীন প্রচারের যে দায়িত্ব রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অর্পন করা হয়েছিল, তা পূর্ণতায় পৌঁছানোর জন্য তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মাতের ওপর এ দায়িত্ব ন্যস্ত করে গেছেন। এখন এই উম্মাত কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি দেশ, জাতি এবং ভাষাভাষীর কাছে আল্লাহর দীনের প্রচারকার্য চালাতে থাকবে।
(খ) প্রচার কার্যের জন্য আল্লাহ তায়ালা এই শর্ত নির্ধারণ করেছেন যে, তা মৌখিক ভাবে, আন্তরিকভাবে এবং বাস্তব কর্মের মাধ্যমে করতে হবে। কোনরূপ পার্থক্য ও শ্রেণী বিভাগ না করে গোটা দীনের তাবলীগ করতে হব। নিন্দুকের নিন্দাকে উপেক্ষা করে পক্ষপাতহীন ভাবে তা করতে হবে। প্রয়োজন বোধে প্রচারক তার জীবনকে কোরবানী করে এ দায়িত্ব পালন করবে।
(গ) এই সামগ্রিক দায়িত্ব পালন করার জন্য যথারীতি খেলাফত নামক সংস্থা বর্তমান ছিল। এই সংস্থা কায়েম ছিল প্রতিটি মুসলমান এই দায়িত্ব থেকে মুক্ত ছিল।
(ঘ) এই সংস্থা অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর ইসলামের প্রচার কার্যের দায়িত্ব উম্মাতের প্রতিটি সদস্যের ওপর এসে পড়েছে। যোগ্যতা ও মর্যাদার তারতম্য অনুযায়ী এ দায়িত্ব তাদের মধ্যে বন্টিত হবে।
(ঙ) এখন এই ফরজের জবাবদিহি এবং দায়িত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দুটি পথ মুসলমানদের জন্য খোলা আছে। তারা হয় খেলাফত নামক এই সংস্থা পুনরায় কায়েম করবে অথবা অন্তত পক্ষে তা কায়েম করার জন্য জীবনকে বাজি রাখবে।
(চ) মুসলমনরা যদি এর কোনটিই না করে, তাহলে তাদের ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে রিসালাতের যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল- তা পালন না করার অপরাধে তারা অপরাধী সাব্যস্ত হবে। তাদেরকে কেবল নিজেদের অপরাধের বোঝাই বহন করতে হবেনা, বরং গোটা সৃষ্টির পথভ্রষ্টতার শাস্তিরও তাদের ভোগ করতে হবে।
এ আলোচনা থেকে জানা গেল যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলমনদের ওপর দীন প্রচারের যে মহান দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে- তা আঞ্জাম দেয়ার মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে তাদের চেতনা ও অনুভূতি। কল্যাণের দিকে আবহ্বানের এই খেলাফনত ব্যবস্থা যাতে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সে দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে আল্লাহর বান্দাদের সহজেই আল্লাহর দীনের দিকে পথ দেখানো যেতে পারে এবং দুনিয়ার সামনে চূড়ান্ত প্রমান পেশ করা যেতে পারে। দুনিয়াতে এই ব্যবস্থা যতদিন কায়েম না হবে, ততদিন মুসলমানের সবচেয়ে অগ্রগণ্য, সবচেয়ে বড় এবং সর্বশেষ্ট উদ্দেশ্য হবে এই ব্যবস্থা পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য কিছু না কিছু করা। শয়নে-জাগরনে প্রতিটি মুসলমানের এটাই হবে একমাত্র চিন্তা। এজন্যই তাদের পানাহার, এজন্যই তাদের জীবন-মরণ। এছাড়া মুসলমানদের জীবন যদি হয় আল্লাহর ইচ্ছায় সম্পূর্ণ পরিপন্থী, আল্লাহর কাছে তারা নিজেদের এই ত্রুটির কোন গ্রহনযোগ্য ওজর পেশ করতে সক্ষম হবে না। আল্লাহর জমীনে আল্লাহর খেলাফত প্রতিষ্ঠাই তাদের জীবনের উদ্দেশ্য। যদি তারা এ উদ্দেশ্য বিস্মৃত হয়ে যায়, তাহলে তারা পৃথিবীর বুকে কীট-পতঙ্গ ও খড়কুটার চেয়ে অধিক গুরুত্ব পাবার দাবী করতে পারেনা। এবং তারা কখনো মধ্যপন্থী উম্মাত অথবা সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাত হওয়ার মর্যাদাও পেতে পারেনা বা আল্লাহর তরফ থেকে কোনরূপ সাহায্য সহযোগিতা লাভের আশাও করতে পারে না।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি