মুখ্য বিষয়সমূহ
লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
বিংশ শতাব্দীতে এ উপমহাদেশে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (র) (২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ - ২২ সেপ্টেম্বের ১৯৭৯ ছিলেন একাধারে প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনি, মুসলিম গবেষক , রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক এবং সমাজ সংস্কারক । তিনি মাওলানা মওদুদী, আবার আরব বিশ্বে শাইখ সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী নামেও পরিচিত। তিনি উপমহাদেশের প্রাচীনতম জনপ্রিয় দল জামায়াতে ইসলামী নামক একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলেরও প্রতিষ্ঠাতা।তিনি ছিলেন ২০ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিম স্কলারদের মধ্যে একজন।তিনি ইতিহাসের দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ ব্যক্তি যাহার গায়েবানা জানাজার নামাজ পবিত্র কাবাতে পড়া হয়।
মাওলানা মওদুদীর প্রভাব ছিল ব্যাপক। ইতিহাসবেত্তা ফিলিপ জেনকিন্সের মতে, মিসরের হাসান আল বান্না এবং সাইয়েদ কুতুব তার বই পড়ে অনুপ্রাণিত হন। সাইয়িদ কুতব তার কাছ থেকে আদর্শ গ্রহণ করেন এবং এটি আরো সম্প্রসারিত করেন। তিনি একটি অগ্রগামী ইসলামী বিপ্লবী দল গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। ফিলিস্তিনি ইসলামপন্থী জুরিস্ট আবদুল্লাহ আযযামও তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। দক্ষিণ-এশীয় জনগন (বিরাট সংখ্যক ব্রিটেন প্রবাসী সহ) মাওলানা মওদুদীর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। এমনকি শিয়া অধ্যুষিত ইরানেও মওদুদীর বড় ধরণের প্রভাব আছে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ্ খোমেনী ১৯৬৩ সালে মাওলানা মওদুদীর সাথে সাক্ষাত করেন, পরবর্তীতে ইমাম খোমেনী মওদুদীর বইগুলো ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেন। এখনো পর্যন্ত প্রায়শঃই ইরানের ইসলামী সরকার মাওলানা মওদুদীর কর্মপন্থা অনুসরন করে থাকে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়ার পর তিনি (মওদুদী) দ্বিতীয় চিন্তাবিদ যিনি আধুনিক বিশ্বে ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তাধারা-কে প্রভাবিত করেছেন।
কাতারের প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার বিশ্ব ওলামা পরিষদের প্রধান আল্লামা ইউসুফ আল কারাদাবী লিখেছেন-
১৩৯৯ হিজরীর যিলকদ মাসের শুরুতে ২৩ শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৯ ইং বিশ্ব একজন অসাধারণ ইসলামিক চিন্তাবিদকে হারাল। যার মত লোক মুসলিম জাতির ইতিহাসে খুব কমই আসে। তিনি হচ্ছেন ভারত উপমহাদেশের জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা , পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের জন্য আলোকবর্তিকা, লক্ষ্য লক্ষ্য মুসলিম যুবক ও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা যার লেখনী থেকে উপকৃত হয়েছে বহু ভাষায় অনুদিত হওয়া প্রচুর গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচয়িতা- উসতাজ আবুল আ'লা মওদুদী।
ওমর তিলমেসানী, মাওলানা মওদুদী ও হাসানুল বান্নার মাঝে তুলনা করতে গিয়ে বলেছেন: তারা উভয়েই ছিলেন এ প্রজন্মের অনন্য ইমাম তথা নেতা বা পথপ্রদর্শক। আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের পদ্ধতি ও সিস্টেম ছিল এমন যে, তারা সর্বদা কুরআন ও হাদীস থেকেই মেটেরিয়াল গ্রহণ করতেন। কোন ফিলোসোফারের কাছ থেকে তা গ্রহণ করতেন না।
যারা হাসানুল বান্নার উপর আসা নির্যাতন দেখেছেন ঠিক তেমনি মাওলানা মওদুদীর উপরও একই ধরণের অত্যাচার নির্যাতন এসেছে।
আমি মাওলানা মওদুদীর মত এমন কোন ব্যক্তিকে জানিনা নতুন একটা মুসলিম প্রজন্মের উপর যার রয়েছে চিন্তা ও কর্মের দিক থেকে অত্যন্ত প্রভাব। তার দাওয়াতি কাজের ভিত্তি ছিল ইলমের উপর এবং তা ছিল রাজনৈতিক আহ্বানের চেয়েও অত্যন্ত গভীর ও শক্তিশালী। তার লেখা যুবকদের আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারে অত্যন্ত কার্যকর ভুমিকা রেখেছে। তারা (যুবকেরা) বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, ইসলাম সমস্ত যুগের সাথেই তাল মিলিয়ে চলতে পারে।
একনজরে মাওলানারা সংক্ষিপ্ত জীবনকালঃ
জন্মস্থানঃ আওরঙ্গাবাদ (বর্তমানে মহারাষ্ট্রের মধ্যে), হায়দারাবাদ, ভারত
১৯০৩- জন্ম গ্রহণ করেন। জন্মস্থানঃ আওরঙ্গাবাদ (বর্তমানে মহারাষ্ট্রের মধ্যে), হায়দারাবাদ, ভারত।
১৯১৮- সাংবাদিক হিসেবে 'বিজনোর' (Bijnore) পত্রিকায় কাজ শুরু করেন।
১৯২০- জবলপুরে 'তাজ' পত্রিকার এডিটর হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন।
১৯২১- দিল্লিতে মাওলানা আব্দুস সালাম নিয়াজির কাছে আরবি শিক্ষা গ্রহণ করেন।
১৯২১- দৈনিক 'মুসলিম' পত্রিকার এডিটর হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন।
১৯২৫- নয়া দিল্লির 'আল জামিয়াহ' পত্রিকার এডিটর হিসেবে নিয়োগ লাভ।
১৯২৬- দিল্লির 'দারুল উলুম ফতেহপুরি' থেকে 'উলুম-এ-আকালিয়া ওয়া নাকালিয়া' সনদ লাভ করেন।
১৯২৭- 'আল জিহাদ ফিল ইসলাম' নামে জিহাদ বিষয়ক একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা শুরু করেন।
১৯২৮- উক্ত প্রতিষ্ঠান (দারুল উলুম ফতেহপুরি) থেকে 'জামে তিরমিযি' এবং 'মুয়াত্তা ইমাম মালিক' সনদ লাভ করেন।
১৯৩০- 'আল জিহাদ ফিল ইসলাম' নামের বিখ্যাত বইটি প্রকাশিত হয়। তখন তার বয়স ২৭ বছর।
১৯৩৩- ভারতের হায়দারাবাদ থেকে 'তরজুমানুল কুরআন' নামক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন।
১৯৩৭- তার ৩৪ বছর বয়সে, লাহোরে, দক্ষিণ এশিয়ার কিংবদন্তিতুল্য মুসলিম কবি ও দার্শনিক আল্লামা মুহাম্মাদ ইকবালের সাথে পরিচয় হয়। পরিচয় করিয়ে দেন চৌধুরী নিয়াজ আলী খান।
১৯৩৮- তার ৩৫ বছর বয়সে, হায়দারাবাদ থেকে পাঠানকোটে গমন করেন। সেখানে তিনি দারুল ইসলাম ট্রাস্ট ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন, যেটি ১৯৩৬ সালে আল্লামা ইকবালের পরামর্শে চৌধুরী নিয়াজ আলী খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পাঠানকোটের ৫ কিমি পশ্চিমে, জামালপুরে, চৌধুরী নিয়াজ আলী খানের ১০০০ একর এস্টেট ছিল। চৌধুরী নিয়াজ আলী খান সেখান থেকে ৬৬ একর জমি দান করেন।
১৯৪১- লাহোরে 'জামায়াতে ইসলামী হিন্দ' নামে একটি ইসলামী রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর আমির হন।
১৯৪২ - জামায়াতে ইসলামীর প্রধান কার্যালয় পাঠানকোটে স্থানান্তর করেন।
১৯৪২ - তাফহীমুল কুরআন নামক তাফসির গ্রন্থ প্রনয়ন শুরু করেন।
১৯৪৭ - জামায়াতে ইসলামীর প্রধান কার্যালয় লাহোরের ইছরায় স্থানান্তর করেন।
সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদীর বাড়ির প্রবেশ পথ, ইছরা, লাহোর
১৯৪৮ - 'ইসলামী সংবিধান' ও 'ইসলামী সরকার' প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচারণা শুরু করেন।
১৯৪৮ - পাকিস্তান সরকার তাকে কারাগারে বন্দী করে।
১৯৪৯ - পাকিস্তান সরকার জামায়াতের 'ইসলামী সংবিধানের রূপরেখা' গ্রহণ করে।
১৯৫০ - কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।
১৯৫৩- 'কাদিয়ানী সমস্যা' নামে একটি বই লিখে কাদিয়ানী বা আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম প্রমাণ করেন। এ সময় অনেকগুলো সংগঠন একযোগে কাদিয়ানীদেরকে সরকারিভাবে অমুসলিম ঘোষনার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তারা সর্বদলীয় কনভেনশনে ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে 'ডাইরেক্ট একশন কমিটি' গঠন করে।জামায়াত ইসলামী এই কমিটির বিরোধিতা করে অহিংস আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়। কিন্তু তথাপি মার্চ মাসের শুরুতে আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে এবং পুলিশের গুলিতে কিছু লোক নিহত হয়।পরে একটি সামরিক আদালত আবুল আ'লাকে এই গোলযোগের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়, (যদিও কাদিয়ানী সমস্যা নামক বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়নি)। অবশ্য সেই মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়নি।
১৯৫৩- মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর চাপ এবং দেশী বিদেশী মুসলিম নেতৃবৃন্দের অনুরোধে মৃত্যুদন্ডাদেশ পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড করা হয়, কিন্তু পরে তা-ও প্রত্যাহার করা হয়।
১৯৫৮- সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান 'জামায়াতে ইসলামী'কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
১৯৬৪- আবারো তাকে কারাবন্দী করা হয়।
১৯৬৪- কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৭১- পাকিস্তান থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হবে কিনা এ প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের উপর ন্যাস্ত করেন
১৯৭২- তাফহীমুল কুরআন নামক জগৎবিখ্যাত তাফসির গ্রন্থটির রচনা সম্পন্ন করেন।
১৯৭২- জামায়াতে ইসলামীর আমির পদ থেকে ইস্তফা দেন।
১৯৭৮- তার রচিত শেষ বই 'সিরাতে সারওয়ারে আলম' প্রকাশিত হয়। এটি নবী মুহাম্মাদ-এর জীবনী গ্রন্থ।
১৯৭৯- চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন।
১৯৭৯- যুক্তরাষ্ট্রে তার মৃত্যু হয়।
১৯৭৯- লাহোরের ইছরায় সমাধিস্থ করা হয়।
গ্রন্থাবলীঃ
সারা বিশ্বে সাড়া জাগানো বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “ তাফহিমুল কুরআন” সহ প্রায় শতাধিক গ্রন্থের প্রণেতা ছিলেন সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মুদুদী রহঃ
মাওলানার কিছু ঐতিহাসিক উক্তিঃ
ঊনিশ শ’ তিপ্পান্ন সালের ৮ই মে পাকিস্তানের সামরিক আদালত মাওলানা মওদূদীকে মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রদান করে। এ আদেশ শ্রবণের পর নির্ভীক প্রশান্ত মর্দে মুজাহিদ এ ঐতিহাসিক উক্তি করেন:
“আপনারা মনে রাখবেন যে, আমি কোন অপরাধ করিনি। আমি তাদের কাছে কিছুতেই প্রাভভিক্ষা চাইব না। এমনকি আমার পক্ষ থেকে অন্য কেউ যেন প্রাণ ভিক্ষা না চায়- না আমার মা, না আমার ভাই, না আমার স্ত্রী-পুত্র-পরিজন। জামায়াতের লোকদের কাছেও আমার এই অনুরোধ। কারণ জীবন ও মরণের সিদ্ধান্ত হয় আসমানে- যমীনে নয়।”
ফাঁসীর মঞ্চে আরোহন যাঁর সুনিশ্চিত সেই বিপ্লবী যাত্রীর কাছে তাঁর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীগণ আবেদন জানালেন- “প্রাণ ভিক্ষা না চাওয়ার সিদ্ধান্ত তো আপনার নিজস্ব। এ সিদ্ধান্ত যে জামায়াতকে মেনে নিতে হবে তার কোন মানে নেই। জামায়াত বাইরের পরিস্থিতির আলোকে বৃহত্তর স্বার্থে যা সিদ্ধান্ত করবে তা আপনাকে মানতেই হবে।”
“আমি জামায়াতের দৃষ্টিতেও আমার সিদ্ধান্ত সঠিক মনে করি। আমার এ সুস্পষ্ট ও সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত জামায়াত নেতৃবৃন্দকেও আপনাদের জানিয়ে দেয়া কর্তব্য।”
“আমি যদি বসে পড়ি,
তাহারে দাঁড়িয়ে থাকবে কে?”
১৯৬৩ সালের অক্টোবর মাসে নিখিল পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর একটি সম্মেলন লাহোরে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন যাতে না হতে পারে সেজন্য সরকার অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। পরে সারা পাকিস্তানে মাইক ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এরপরও বিনা মাইকে দশ বারো হাজার লোকের সম্মেলন শুরু হয়। পনেরো বিশ হাত পরপর একটি টেবিলে দাড়িয়ে মঞ্চ থেকে বক্তৃতার সাথে সাথে একই সময়ে ছাপানো বক্তৃতা উচ্চস্বরে পড়ে শোনানো হয়।
সভার কাজ শুরু হওয়ার মিনিট দশ পর সভার প্যান্ডেলে হঠাৎ কিছু গুন্ডার অনুপ্রবেশ দেখা গেল। মদের নেশায় তারা ছিল উন্মত্ত প্রায়। তারা সভার শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা শুরু করল। হঠাৎ শামিয়ানায় আগুন জ্বলে উঠলো, শামিয়ানার বাইরে হৈ হল্লা ও পিস্তলের গুলির শব্দ শুনা গেল। মাওলানাকে লক্ষ্য করেও কয়েকবার গুলি বর্ষিত হল। কিন্তু প্রত্যেকটি গুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এসময়ে চারিদিক থেকে একথা বলতে শুনা যায়- “মাওলানা বসে পড়ুন, মাওলানা বসে পড়ুন।” বক্তৃতারত মাওলানা দাঁড়িয়ে থেকেই শান্ত কণ্ঠে বল্লেন, “আমি যদি বসে পড়ি, তাহলে দাঁড়িয়ে থাকবে কে?”…….. এভাবে তিনি তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতা শেষ করলেন।
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি
সংশ্লিষ্ট বই
লন্ডনের ভাষণ [মাওলানা মওদূদী]
লেখকঃ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী
প্রকাশনীঃ জুলকারনাইন পাবলিকেশন্স
ইসলাম কি চায় ?
এক।।
শুরুতেই এ কথা স্পষ্ট করে দেয়া প্রয়ােজন যে, আমাদের বিশ্বাস মতে দ্বীন ইসলাম মুহাম্মদ (সঃ) পয়লা নিয়ে আসেন নি। তাই তিনি এর প্রবর্তকও নন। কোরআন এ কথা সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, মানব জাতির জন্য খাদ্য সর্বদা এই দ্বীন পাঠিয়েছেন। আর তা হচ্ছে ইসলাম অর্থাৎ খােদার আনুগত্য মেনে নেয়া। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন জাতির কাছে খােদা যে সব নবী পঠিয়েছেন, তাদের কেউই পৃথক কোন ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন না। তাদের নিয়ে আসা কোন দ্বীনকে নুহের মতবাদ, ইবরাহীমের মতবাদ, মুসার মতবাদ কিংবা ঈসায়ী মতবাদ বলা চলে না। বরং প্রত্যেক নবীই পূর্ব নবীদের প্রচারিত একক দ্বীনের প্রচার করে গেছেন। .
দুই:
মূলত নবীদের ভেতর মুহাম্মদের (সঃ) বৈশিষ্ট্য ছিল এই-(১) তিনি খােদার শেষ নবী ছিলেন। (২) তার মারফত খােদা অন্যান্য নবীদের কাছে পাঠানো দ্বীনের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছেন। (৩) মূল দ্বীনের সাথে যুগে যুগে যে সব ভ্রান্তি জড়িয়ে এক দ্বীনকে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ধীনে রূপ দিয়েছে, খােদ। মুহাম্মদের (সঃ) মাধ্যমে তা নির্ভেজাল করে মানব জাতিকে দিলেন। (৪) তারপরে যেহেতু খােদার আর কোন নবী পাঠাবার ছিল না, তাই তাকে প্রদত্ত গ্রন্থটি খােদা যথাযথ ভাষায় অক্ষরে অক্ষরে সুরক্ষিত করলেন। ফলে সর্বকালের মানুষ তা থেকে সঠিক শিক্ষা নিতে পারবে। (৫) এমন কি তার জীবনী ও রীতি-নীতি সাহাবা ও হাদীসবেত্তাগণ অতুলনীয় ভাবে সুরক্ষিত রেখেছেন। অন্য কোন নবী যা ঐতিহাসিক ব্যক্তির জীবন, কথা ও কাজ এরূপে রক্ষা করা হয় নি। কোরআন এবং তার বাহকের জীবনী ও রীতিনীতি এরূপ সুরক্ষিত থাকায় উভয়ের সহায়তায় সর্বদা খােদার ধীনের আসল রূপ জানা যাচ্ছে। বুঝা যাচ্ছে তা আমাদের কোন পথ দেখায়, কি দেয় আমাদের আর কি চায় আমাদের কাছে।
তিন:
যদিও আমরা মুহাম্মদের (সঃ) আগেকার সব নবীর ওপর ঈমান রাখি, কোরআনে যাদের নাম পেয়েছি ও পাই নি, তাদের সবার ওপর ঈমান রাখি এবং এ বিশ্বাস আমাদের আকীদার অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিধায় আমরা তা ছাড়া মুসলমান হতে পারি না, তথাপি পথের দিশা লাভের ব্যাপারে শুধু মুহাম্মদকেই (সঃ) আমরা মানি। এটা কোন পক্ষপাতিত্ব নয়। মূলত তার পয়ল। কারণ, তিনি শেষ নবী বিধায় তার নিয়ে আসা বিধান আধুনিকতম পথ নির্দেশনা। দ্বিতীয়ত, তার মাধ্যমে খােদার যে বাণী আমাদের কাছে পৌচেছে, সেটাই নির্ভেজাল খােদার কালাম। তার সাথে মানুষের কথার মিশ্রন ঘটে নি। সে বাণী যথাযথ ভাষায় সংরক্ষিত রয়েছে। তার ভাষা আজও জীবন্ত ভাষা। কোটি কোটি মানুষ সে ভাষায় কথা বলে, লিখে ও বুঝে। কোরআন অবতরনের কালে সে ভাষার ব্যাকরণ, ধ্বনিতত্ব, বানান পদ্ধতি যা ছিল আজও তাই আছে। আমি কিছু আগে বলে এসেছি যে, তার জীবনী, চরিত্র, কথা ও কাজ, সব কিছুই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে, আর তা সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও বিস্তারিতভাবে রয়েছে। এটা যেহেতু অন্যান্য নবীদের ক্ষেত্রে পাই নি, তাই তঁাদের ওপর ঈমান আনতে পারছি, তঁাদের অনুসরণ করতে পারছি না।
চার:
আমাদের আকীদা (ধর্মবিশ্বাস) মতে মুহাম্মদ (সঃ) গােটা পৃথিবীর জন্য সর্ব যুগের নবী। তা এ কারণে (১) কুরআন তা সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে। (২) এটা তঁার শেষ নবী হবার স্বাভাবিক চাহিদা। শেষ নবী হবার অপরিহার্য শর্ত হল তিনি সকল মানুষের এবং তঁার পরবর্তী সকল যুগের নবী হবেন। (৩) তঁার মাধ্যমে মানুষের প্রায়জনীয় পথ নির্দেশনার কাজটি পরিপূর্ণ করে দেয়া হবে, এবং সেটাও তঁার শেষ নবী হবার স্বাভাবিক দাবী। কারন, পূর্ণাংগ পথ নির্দেশনা ছাড়া শেষ নবীর দায়িত্ব পূর্ণ হতে পারে না। অপর্ণতা আরও নবীর দাবীদার হয়। (৪) এটা আজ বাস্তব সত্য যে, তার অন্তধনের পরবর্তী চৌদ্দশ বছরেও দনিয়ায়, নবী দাবী করার মত এমন কোন ব্যক্তি জন্ম নেয় নি যার চরিত্র ও কার্যধারা কোন নবীর সাথে সামান্যতম সামঞ্জস্য রাখে। কোন গ্রন্থও কেউ পেশ করে নি যা কোন ঐশীগ্রন্থের সাথে পূর্ণতম সাযুজ্য রাখে। এমন কেউ দেখা দেয় নি যাকে শরিয়ত প্রবর্তক নষী বলা যেতে পারে।
পাঁচ:
আলােচনার এ স্তরে জেনে নেয়া দরকার যে, খােদার তরফ থেকে মানুষের কোন বিশেষ বিদ্যাটির প্রয়ােজন যা নবীর মাধ্যমে পাঠানাে হল ?
পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু রয়েছে যা আমরা পঞ্চেীয়ের সাহায্যে জানতে পাই কিংবা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সাহায্যেও জেনে নিই। তারপর এ সব উপায়-উপকরণ থেকে যা কিছু জানলাম সেগুলােকে বাস্তব উদাহরণ, অভিজ্ঞতা, চিন্তা-ভাবনা ও দলীল প্রমাণ দিয়ে সাজিয়ে নতুন নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি। এ ধরনের বস্তুগত জ্ঞান খোদার তরফ থেকে আসার প্রয়ােজন নেই। এ সব আমাদের অনুসন্ধিৎসা-অনুসন্ধান, চিন্তা-ভাবনা এবং বিশ্লেষণ-উদ্ভাবনের আওতায় রয়েছে। অবশ্য এ সব ব্যাপারেও সৃষ্টিকর্তা আমাদের অসহায় ভাবে ছেড়ে দেন নি। ইতিহাসের গতিধারায় তিনি অজ্ঞাতভাবে তার ক্রমবিকাশমান পৃথিবীর সাথে আমাদের ক্রমাগত পরিচয়ের ব্যবস্থা রেখে দিয়েছেন। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দুয়ার আমাদের সামনে মুক্ত করে চলেছেন। এক এক সময়ে তিনি দিব্য জ্ঞানের মাধ্যমে এক এক জনকে কোন না কেন নতুন আবিষ্কার কিংবা প্রকৃতির কোন নতুন রীতির ওপর সাফল্য দান করেন। মোট কথা, এ সবই মানবীয় জ্ঞানের আওতার ব্যাপার। এ সবের জন্য খােদার পক্ষ থেকে কোন নবী আসার দরকার হয় না। বরং এর জন্য যা কিছু জ্ঞান দরকার তা মানুষকে দেয়া হয়েছে। | আরেক ধরনের ব্যাপার রয়েছে যা আমাদের অনুভুতি ও যন্ত্রপাতির নাগালের বাইরে অবস্থিত। সেগুলো আমরা না জরীপ করতে পারি, না ওজন করতে পারি, না কোন যন্ত্রপাতি প্রয়ােগ করে সেগুলো সম্পর্কে এতটুকু জানতে পারি যাকে অন্তত বিদ্যা বলা যায়। দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা সে সব সম্পর্কে নিছক অনুমান ভিত্তিক সিন্ধান্ত নিতে পারেন। তাই তাকে ইলম বা জ্ঞানের মর্যাদা দেয়া যায় না। এ চরম সত্য সম্পর্কে যারা যুক্তি প্রমান পেশ করেন, তারাও নিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে পারেন না। যদি তারা তাদের জ্ঞানের পরিধি জানতে পান তা হলে না তারা নিজেরা সে সবকে নিশ্চিত বলে বিশ্বাস করেন, না অন্য কাউকে তা বিশ্বাস করার জন্য বলতে পারেন।
এ সীমা রেখায় এসেই মানুষ যথার্থ সত্যকে জানার জন্য নিখিল সৃষ্টির
মহান স্রষ্টার অবতীর্ণ সত্যের মুখাপেক্ষী হয়। সেই সত্য মহান স্রষ্টা কোন বই আকারে লিখে যে কারো কাছে দেন তা নয়। এও নয় যে, সেই বই কাউকে দিয়ে বলেন, এ বই পড়ে তােমার ও অন্য সব সৃষ্টির রহস্য জেনে নাও আর বুঝে নাও, এ সত্যের আলােকে তােমার পার্থিব জীবন পদ্ধতি কি হবে। বরং সেই জ্ঞানকে মানুষের দুয়ারে পেঁৗছাবার জন্য আল্লাহ তালা সর্বদা পয়গম্বরকে মাধ্যম করেছেন। ওহীর মাধ্যমে তাদের সব কিছু অবহিত করেছেন। তারপর মানুষের কাছে সেই সত্য তুলে ধরার জন্য তাদের নিযুক্ত করেছেন। | ছয়। মানুষের কাছে সত্যকে শুধু পেঁৗছে দেয়াই নবীর কাজ নয়। বরং সেই সত্যের আলােকে খােদার সাথে মানুষের ও মানুষের সাথে মানুষের মূল সম্পর্ক কি এবং কার্যত কি সম্পর্ক হওয়া উচিত, তাও বলে দেয়া। এ জ্ঞান কিরূপ চাল চলন ও চরিত্র এবং কিরূপ কৃষ্টি ও সভ্যতা দাবী করে তাও, তিনি বলে দেবেন। সেই ইলমের আলােকে ব্যক্তি ও সমাজ জীবন, অর্থনীতি, রাজনীতি, বিচার বিভাগ, যুদ্ধ ও শান্তি, আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি, এক কথায় জীবনেয় প্রতিটি ক্ষেত্র কিভাবে পরিচালিত হওয়া চাই, তাও নির্দেশ করা। নবী শুধু কিছু সামাজিক রীতি-নীতি ও ইবাদত-উপাসনা পদ্ধতি নিয়ে আসেন না। বরং তিনি পূর্ণাংগ এক জীবন পদ্ধতি নিয়ে আসেন। ইসলামের পরিভাষায় তারই নাম দ্বীন (জীবন পদ্ধতি)।
সাত:
দ্বীনের জ্ঞান পোঁছানােই শুধু নবীর মিশন নয়। নবীর মিশন যারা দ্বীনের ডাকে সাড়া দিয়ে মুসলিম হল, তাদের দ্বীনের তাৎপর্য হৃদয়ংগম করানো, তাদের চিন্তা, চরিত্র, উপাসনা, আইন-কানুন ও সামগ্রিক জীবন বিধান সম্পর্কে সচেতন করা, তাদের সামনে নিজকে পূর্ণাংগ মুসলমানের এক নমুনা হিসেবে পেশ করা যেন তাকে তারা অনুসরন করতে পারে, তাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রশিক্ষন দিয়ে সঠিক ইসলামী সংস্কৃতি ও সভ্যতার জন্য গড়ে তােলা এবং তাদের সংঘবদ্ধ এক জাতিতে পরিণত করে দুনিয়ার বুকে খােদার দ্বীন বাস্তবায়নের এরূপ সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া যেন অন্যান্য মতাদর্শ তলিয়ে গিয়ে খােদায়ী মতাদর্শ মাথা তুলে পঁাড়ায়।
সব নষীই যে তার এ মিশনের শেষ স্তর পর্ষন্ত উতরে যাবেন তা অপরিহার্য নয়। অনেক নবীই নিজ দুর্বলতার জন্য নয়, বরং মানুষের সংকীর্ণ দৃষ্টি ও প্রতিকূল মানসিকতার দুর্বলতার কারণে মিশনের চরম লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন। তথাপি সব নবীর মিশন একই ছিল। অবশ্য ইতিহাসের দৃষ্টিতে মুহাম্মাদুর রসুলুল্লার বৈশিষ্ট্য হল এই, তিনি ঠিক ঊধ লােকের মতই দুনিয়ার বুকে খােদার বাদশাহী কায়েম করে দেখালেন।
আট:
কুরআন মজীদ ও মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ শুরু থেকেই হয় গােটা মানব জাতিকে উদ্দেশ করে, নয় তো মানব মণ্ডলী থেকে যারা ঈমান এনেছে তাদের লক্ষ্য করে বক্তব্য রেখেছেন। কোরআন পাকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য করুন। তারপর মুহাম্মাদুর রসূলুল্লার বক্ততা ও কথা-বার্তার পূর্ণ রেকর্ড পর্যালােচনা করুন। দেখবেন, তাতে কোন ভাষা-ভাষী, বর্ণ কিংবা গােত্র বিশেষ অথবা বিশেষ শ্রেণীর লােককে সম্বােধন করা হয় নি। সর্বত্র হয় ‘ইয়া বনি আদম’ নয় তত ‘ইয়া আইউহান্নাসো বলে গােটা মানব জাতিকে ইসলাম গ্রহনের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। অথবা যারা ইসলাম গ্রহন করেছে তাদের পথ নির্দেশনা ও জীবন বিধান দিতে গিয়ে ‘ইয়া আইউহাল্লাজীনা আমানু’ বলা হয়েছে। এ থেকে আপনা আপনি এটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, যে, ইসলামের আহ্বান বিশ্বজনীন। যে ব্যক্তিই এ ডাকে সাড়া দেয়, সে সব ব্যাপারে অধিকার নিয়ে মুমিন হয়ে যায়। কুরআন বলে, ঈমানদাররা একে অপরের ভাই। রসূল (সঃ) বলেন, যে ব্যক্তি ইসলামের ধ্যান-ধারনার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করল এবং মুসলমানের রীতি-নীতি অনুসরন করল, তার অধিকার আর আমাদের অধিকার এক এবং আমাদের দায়িত্ব সমান। এ থেকেও সুস্পষ্ট করে রসুল (সঃ) অন্যত্র বলেন, শােন, তােমাদের খােদা এক এবং তােমাদের বাপও এক (আদম)। তাই কোন আরষের অনারবের ওপরে মর্যাদা নেই। তেমনি নেই কোন অনারবের কোন আরবের ওপরে। মর্যাদার ভিত্তি হল খোদাভীরুতা।
নয়:
ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের ভেতর সর্বাগ্নে স্থান হল খােদার একত্বে বিশ্বাস। শুধু এ বিশ্বাস নয় যে খােদা আছেন, শুধু এ নয় যে তিনি এক, বরং একমাত্র তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা, প্রভু, শাসক ও পরিচালক।
তিনি বহাল রেখেছেন বলে সৃষ্টি জগত বহাল রয়েছে। তিনি তা চালান বলেই চলছে। সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুর অবস্থিতি ও স্থায়িত্বের জন্য যে রুজী ও শক্তির প্রয়োজন তা তিনিই জুগিয়ে থাকেন। সার্বভৌমত্বের যত গুণ ত। শুধু তারই ভেতর পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র অংশীদারও কেউ নেই। খােদায়ী ও প্রভুত্বের সর্ববিধ গুণের অধিকারী কেবল তিনিই। তিনি ভিন্ন কেউ সে সব গুণের কোনটরই অধিকারী নয়। গােটা সৃষ্টি ও তার প্রতিটি অংশ তিনি একই নজরে দেখতে পান। সৃষ্টির সব কিছুই তিনি সরাসরি ভাবে জানেন। তার বর্তমানই শুধু নয়, অতীত এবং ভবিষ্যৎও তিনি জানেন। এ সাবিক দৃষ্টি ও অদৃশ্য জ্ঞান তিনি ছাড়া আর কারও নেই। তিনি চিরস্থায়ী ও চিরঞ্জীব, অন্য সব কিছুই নশ্বর। নিজ থেকেই তিনি জীবিত আছেন ও থাকবেন। তিনি কারো সন্তান নন এবং তারও কোন সন্তান নেই। তিনি ভিন্ন সবই তঁার সৃষ্টি। দুনিয়ার বুকে কারাে এমন মর্যাদা নেই যাকে তার সমকক্ষ কিংবা সন্তান বলা যায়। তিনিই মানুষের সত্যিকার উপস্থ। তঁার উপাসনার সাথে অন্য কাউকে শরীক করা সব চাইতে বড় পাপ ও বিরাট অকৃতজ্ঞতা। মানুষের প্রার্থন। কেবল তিনি শুনে থাকেন এবং তা মঞ্জুর করা বা না করা একমাত্র তারই ইচ্ছাধীন রয়েছে। তার কাছে কোন কিছু প্রার্থনা না করা অন্যায় দাম্ভিকতা। তিনি ছাড়া কারাে কাছে কোন কিছু প্রার্থনা করা মূখ তা বৈ নয়। তার সাথে সাথে অন্য কারাে কাছে কিছু প্রার্থনা করা খােদা নয় এমন এক সত্ত্বাকে খােদার সাথে অংশীদার করার শামিল।
দশ:
ইসলামের দৃষ্টিতে খােদার প্রভুত্ব শুধু অপ্রাকৃত জগতেই সীমিত নয়। বরং পার্থিব রাজনৈতিক ও শাসন তান্ত্রিক ব্যাপারেও প্রসারিত। তার এ পার্থিব প্রভুত্বের বেলায়ও কেউ তার সমকক্ষতা রাখে না। তঁার পৃথিবীতে তারই বান্দাদের ওপর তিনি ছাড়া কারো প্রভুত্ব চালাবার অধিকার নেই। হোক তা শাহী এক নায়কত্বের শাহানশাহ কিংবা রাজতন্ত্রের প্রতিভু অথবা জন গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী। তার অধীনতা থেকে যে স্বাধীনতা ঘােষণা করে, সে বিদ্রোহী। তেমনি তার আনুগত্য ছেড়ে যে অন্যের অনুগত হয়, সেও বিদ্রোহী। তেমনি যে ব্যক্তি বা সংগঠন রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক
প্রভুত্বকে নিজেদের মুঠোয় নিয়ে খােদার অধিকারের সীমাকে ব্যক্তির নৈতিক বা ধর্মীয় বিধি-বিধানে সীমিত করে দেয়, তারাও বিদ্রোহী। মূলত নিজ পৃথিবীতে নিজের সৃষ্ট মানুষের জন্য আইন দাতা তিনি ছাড়া আর কেউ নয়, হতেও পারে না। তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার অধিকার কারাে নেই।
এগার:
ইসলামের খােদা সম্পর্কিত এ ধারনার প্রেক্ষিতে কয়েকটি সিদ্ধান্তে পৌছা যায়।
(১) একমাত্র খােদাই মানুষের সত্যিকারের উপাস্য, অন্য কথায় উপাসনা লাভের যােগ্য এবং তিনি ছাড়া আর কারো এরূপ যােগ্যতা নেই যে মানুষ তার বন্দেগী ও বন্দনা করবে।
(২) একমাত্র তিনিই নিখিল সৃষ্টির সকল শক্তির শাসন কর্তা। মানুষের আশা-আকাংখা পূর্ণ করা বা না করা তাঁরই ইচ্ছাধীন। তাই যা কিছু চাওয়ার তঁারই কাছে মানুষকে চাইতে হবে। অন্য কারাে কাছে কিছু চাওয়া বা পাওয়ার আছে বলে ধারনাও করতে নেই। | (৩) একমাত্র তিনি মানুষের ভাগ্য বিধাতা। মানুষের ভাগ্য গড়। যা ভাংগার অন্য কোন শক্তি নেই। তাই মানুষের আশা ও নিরাশা দুটোরই উৎস তিনি। তিনি ছাড়া না কারাে কাছে কিছু পাবার অেেছ, না কাউকে ভয় করার কিছু আছে।
(৪) একমাত্র তিনিই মানুষ ও তার পারিপার্শিক জগতের স্রষ্টা ও স্বত্বাধিকারী। তাই মানুষ ও গােটা দুনিয়ার সব কিছুর রহস্য একমাত্র তিনিই জানেন এবং শুধু তার পক্ষেই জানা সম্ভব। তাই শুধু তিনিই জীবনের জটিল আবর্তের মাঝে সঠিক পথ বাতলাতে পারেন। তিনিই সঠিক জীবন পদ্ধতি দিতে পারেন। ২ (৫) যেহেতু মানুষের স্রষ্টা ও প্রভু তিনি এবং এ পৃথিবীর মালিকও তিনি, তাই মানুষের ওপর অন্য কারাে কিংবা মানুষের নিজের প্রভুত্ব কায়েম করা সরাসরি কুফরী। তেমনি মানুষের নিজের আইনদাতা হওয়া কিংবা অন্য কোন ব্যক্তি বা সংগঠনকে আইনদাতা বলে স্বীকার করাও কুফরী। গােটা পৃথিবী ও অন্যান্য সৃষ্টির আইনদাতা প্রভু কেবল তিনিই হতে পারেন।
সর্বোচ্চ ক্ষমতার মালিক হিসাবে তার আইন স্বভাবতই সর্বোপরি আইন (Supreme law) হবে এবং মানুষের আইন রচনার (Legislation) সীমা উক্ত আইনের আওতার ভেতরে থাকবে। মানবীয় আইনের উৎস হযে খােদায়ী আইন এবং খােদায়ী আইনের অনুমােদন সাপেক্ষে তার বাস্তবায়ন চলবে।
যার। আলােচনার এ অধ্যায়ে আমাদের সামনে ইসলামের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম বিশ্বাসটি আসে। তা হচ্ছে রিসালাতের প্রত্যয় বা রসূল বিশ্বাস। খােদ। যার মাধ্যমে তার আইন মানুষের কাছে পৌঁছান তিনিই রসূল। রসুল থেকে এ আইন আমরা দু’ভাবে পাই। এক, কালাম পাক—যা শব্দে শব্দে রসুলের ওপর নাযিল করা হয়েছে। মানে, কুরআন মজীদ। দুই, খােদার পথ নির্দেশনার প্রেক্ষিতে রসূল যা বলেছেন, করেছেন এবং তার অনুগামীদের করতে বা বলতে আদেশ দিয়াছেন বা নিষেধ করেছেন, সেগুলো। মানে, সুন্নতে রসূল। এ ধর্ম বিশ্বাসটির গুরুত্ব এই যে, এটি ছাড়। শুধু খােদা বিশ্বাস নিছক থিওরী বা কল্পনা মাত্র হয়ে দাঁড়ায়। খােদা অর্চনাকে যে বস্তু একটি সংস্কৃতি, একটি সভ্যতা ও একটি জীবন ব্যবস্থায় রূপ দেয়, তা হচ্ছে রসূলের আদর্শিক ও বাস্তব পথ নির্দেশনা। তঁারই মাধ্যমে আমরা আইন পেয়ে থাকি। তিনিই সেই আইনের চাহিদা অনুসাবে জীবন বিধান প্রবর্তন করেন। এ কারণেই তাওহীদের পরে রিসালাতের ওপর ঈমান না এনে কেউ কার্যত মুসলমান হতে পারে না।
তের:
ইসলাম রসূলের স্থান এরূপ পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে যে, আমর। তঁার যথাযথ পরিচয় জানতে পাই। জানতে পাই তিনি কি এবং তিনি কি নন।
রসূল আসেন মানুষকে খােদার বান্দা বানাতে, নিজের বান্দা নয়। নিজেও তিনি নিজেকে খােদার বান্দা বলে ঘােষণা করেন। মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ মুসলমানের দৈনিক নামাযের ভেতর সতেরবার যে কলেমায়ে শাহাদত পড়ার সবক দিয়েছেন, তাতে এ অংশটি অবশ্যই পড়তে হয়—আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দহ ওয়া রাসুলুহু।
-আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ আল্লার বান্দা ও রসুল। কুরআন পাকে রসূলের মানুষ হওয়া ও খােদায়িত্বে তঁার বিন্দুমাত্র অংশ না থাকার ব্যাপারটি এরূপ স্পষ্ট করা হয়েছে যাতে সংশয়ের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। রসূল না অতি মানব, না মানবীয় দূর্বলতা থেকে মুক্ত। তিনি যেমন খােদার ধনভাণ্ডারের মালিক নন, তেমনি খােদার অদৃশ্য জ্ঞানেরও অধিকারী নন বলে সর্বজ্ঞও নন। তিনি অপরের কল্যাণ বা অকল্যাণ সাধন তো দুরে, নিজেরও কোন কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে অক্ষম। তার কাজ খোদার পয়গাম বান্দার কাছে পৌঁছে দেয়া, কাউকে পথে আনা নয়। অস্বীকার করলে তার কৈফিয়ত তলব কিংবা তার ওপর গজব নাযিল তার কাজ নয়। যদি তিনিও (মা’আজাল্লাহ) খােদার নাফরমানী করেন কিংবা নিজের মনগড়া কিছু খােদার নামে চালান অথবা খােদার ওহীতে সামান্যতম রদবদলের দুঃসাহস দেখান, তাহলে তিনিও খােদার আজাব থেকে বাঁচতে পারেন না। | মুহাম্মদ (সঃ) রসূলেরই একজন। তিনিও রিসালতের সীমার বাইরে কোন কিছুর অধিকারী নন। তিনি কোনকিছু হালাল বা হারাম করতে পারেন
। অন্য কথায় খােদার অনুমোদন ছাড়া কোন আইন দেবার ক্ষমতা তার নেই। তাঁর কাজই হল খােদার অবতীর্ণ বিধানের অনুসরণ। | এ ভাবে ইসলাম তার অনুসারীদের সেইসব বাড়াবাড়ি থেকে বাঁচিয়েছে যা তার পূর্ববর্তীরা তাদের পথ প্রদর্শকদের বেলায় করেছিল। এমন কি তারা পথ প্রদর্শককে খােদা অথবা খােদার গােত্র কিংবা তঁার সন্তান বা অবতার (incarnation) বানিয়ে ছেড়েছিল। এ ধরনের সর্বাবধ বাড়াবাড়ি নিষিদ্ধ করে ইসলাম রসূলের আসল যে অবস্থাটি তুলে ধরেছে তা এই রসূলের ওপর ঈমান না এনে কেউ মুমিন হতে পারে না। যে ব্যক্তি রসূলের অনুগত হয়, সে মূলত আল্লার অনুগত হয়। কারণ, যে কোন রসূলকেই খােদা তার আনুগত্য প্রতিষ্ঠার জন্য পাঠিয়েছেন। রসূলের অনুগত ব্যক্তিই পথ পায়। রসূলের আদেশ ও নিষেধ পুরােপুরি অনুসরণ করা চাই।
(স্বয়ং রসুল (সঃ) ব্যাপারটি এ ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, আমি একজন মানুষ মাত্র।" দ্বীনের ব্যাপারে আমি, তােমাদের যা বলি তা মেনে চল। আর
নিজের খেয়াল মতে যা বলি তা একজন মানুষ হিসেবেই বলি। পার্থিব ব্যাপারে তােমরা বেশী জান।)
রসুলের সুন্নাহ মূলত কোরআনের ব্যাখ্যা। এ ব্যাখ্যা স্বয়ং কোরআন প্রণেতা তঁাকে শিখিয়েছেন। তাই তঁার প্রদত্ত ব্যাখ্যা পরবর্তীদের জন্য খােদায়ী সনদের ( Authority) মর্যাদা পেয়েছে। তাই তা থেকে সরে গিয়ে কারাে কোরআন ব্যাখ্যার কোন অবকাশ নেই। আল্লাহ পাক রসুলের জীবনকে প্রতীক জীবন রূপে নির্দিষ্ট করেছেন। রসূলের সিদ্ধান্ত বা মিমাংসা অগ্রাহ্য করে কেউ মুমিন হতে পারে না। খােদা ও রসূলের দেয়া সিদ্ধান্তের পর নিজের কোন সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার মুসলমানের নেই। যে কোন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে খােদা ও রসূলের সিদ্ধান্ত সামনে না নিয়ে মুসলমান অগ্রসর হতে পারে না।
উপরোক্ত আলােচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আল্লাহ পাক রসূলের মাধ্যমে শুধু সর্বোচ্চ বিধি-বিধানই (Supreme Law) দেন নি, বরং স্থায়ী মূল্যবােধও দিয়েছেন। কোরআন-সুন্নায় যেগুলােকে খায়ের বা কল্যাণ বলা হয়েছে তা সব সময়েই কল্যাণ। তেমনি যেগুলােকে শর বা অকল্যাণ বলা হয়েছে তাও সর্বকালের অকল্যাণ। যা কিছু ফরজ করা হয়েছে স্থায়ী ভাবেই তা ফরজ বা অপরিহার্য। এ ভাবে হালাল-হারামও স্থায়ী মর্যাদা নিয়ে এসেছে। এ বিধানে কোনরূপ সংশােধন, বিয়ােজন, সংযােজন ও বর্জনের অধিকার কাউকে দেয়া হয় নি। হুঁ। যদি কোন ব্যক্তি, দল, গােত্র বা জাতি ইসলামই বর্জনের ইচ্ছা করে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু, মুসলমান থেকে এটা সম্ভব নয় যে, কালকের কল্যাণ আজ তার কাছে অকল্যাণ ও আগামী দিন আবার কল্যাণ হয়ে ধরা দেবে। কোন কিয়াস, ইজমা বা ইজতেহাদেরই এ ধরনের পরিবর্তন সাধনের অনুমতি নেই।
চৌদ্দ:
ইসলামের তৃতীয় মৌলিক বিশ্বাস হল পরকাল। পরকাল বিশ্বাসের গুরুত্ব এত বেশী যে, পরকাল অবিশ্বাসী কাফের হয়ে যায়। পরকাল বাদ দিয়ে খোদা, রসূল, কোরআন সবকিছু মেনে নিলেও কাফের হওয়া থেকে নিস্তার নেই। এ বিশ্বাসের বিশ্লেষণ থেকে ছয়টি অপরিহার্য ধ্যানধারণা জন্ম নেয়।
ইসলাম কি চায় ? হবার উপলব্ধি নিয়ে যথাযথভাবে খােদার বন্দেগী করেছে কিনা? যদি করে থাকে তাে জান্নাত পাবে। অন্যথায় জাহান্নামে ঠাই হবে।
পনের:
এ বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা তিন ধরনের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন তিন রূপ জীবনধারা সৃষ্টি করে। এক ধরনের মানুষ পরকাল বিশ্বাস করে না এবং এ পৃথিবীর জীবনকেই সব কিছু ভেবে থাকে। সুতরাং তার ভাল-মন্দের মানদণ্ডও পার্থিব লাভালাভের ভিত্তিতে নির্ণীত হয়। দুনিয়ার স্বার্থে যে কাজটি উপকারী, সেটাই তার কাছে ভাল বলে বিবেচিত এবং তার বিপরীত যা কিছু সেটা মন্দ বলে বিবেচিত হয়। এমন কি পার্থির স্বার্থের মানদণ্ডে একই কাজ এক সময়ে তার জন্য ভাল ও অন্য সময় মন্দ হয়ে দেখা দেয়।
দ্বিতীয় ধরনের মানুষ পরকাল তো বিশ্বাস করে। কিন্তু তার ধারণা যে, কারো সুপারিশে সে পরকালের বিপদ উতরে যাবে। কিংবা তার পাপের কাফফারা আগেই কেউ আদায় করে রেখেছেন। অথবা সে আল্লার খাস পেয়ারের বান্দা। তাই যত বড় পাপই সে ঝরুক, নামমাত্র কিছু শাস্তি দেয়া হবে। এ সব ভ্রান্ত ধারণা পরকাল বিশ্বাসের যতসব নৈতিক কল্যাণময়তা ধ্বংস করে দেয়। ফলে এ দলও পয়লা দলের অস্তভুক্ত হয়ে যায়। | তৃতীয় ধরনের মানুষ পরকাল বিশ্বাসকে ইসলাম যেভাবে তুলে ধরেছে তা যথাযথ ভাবে গ্রহণ করে। তারা কোন কাফফারা, অন্যায় সুপারিশ কিংবা আল্লার সাথে বিশেষ সম্পর্কের ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে না। তাদের জন্য। পরকাল বিশ্বাস বিরাট নৈতিক শক্তি হয়ে দেখা দেয়। যার অন্তরে পরকালের যথাযথ বিশ্বাস ঠাই পেয়েছে, তার অবস্থা দাঁড়াবে এই যে, তার সাথে সর্বদা একজন পাহারাদার লেগে রয়েছে। সে তার প্রতিটি অন্যায় কাজে বাধা দেয়, সমালােচনা করে এবং তিরস্কার করে চলে। বাহ্যত তাকে পাকড়াও করার কোন পুলিশ, সাক্ষী, আদালত, নিন্দাকারী সমাজে থাক বা না থাকে, তার ভেতরে সর্বদা এক কড়া হিসাব-নিকাশ নেবার শক্তি বসে রয়েছে। তার পাকড়াওর ভয়ে নিঃসংগতায় কি জংগলে কিংবা গভীর আঁধারে অথবা জনমানবহীন স্থানেও খােদার নির্ধারিত ফরজ থেকে বিচ্যুত হয়ে হারাম কার্য অনুসরণের সাহস করতে পারবে না। যদি কিছু করেও প্রথম-পৃথিবীতে মানুষকে দায়িত্বহীন করে সৃষ্টি করা হয় নি। বরং সে তার সৃষ্টি কর্তার কাছে জবাবদেহী হবে। দুনিয়ার বর্তমান জীবন মূলত মানুষের দায়িত্বের পরীক্ষার জন্য। জীবন শেষে তাকে খােদার কাছে নিজ কার্যাবলীর হিসাব দিতে হবে।
দ্বিতীয়—হিসাব-নিকাশের জন্য আল্লাহ একটি সময় নির্ধারিত করেছেন। মানব জাতির জন্য আল্লাহ যতটুকু সময় দেবার সিদ্ধান্ত করেছেন তা শেষ হলেই কেয়ামত ঘটবে। তাতে পৃথিবীর বর্তমান আকৃতি-প্রকৃতি চুর্ণ বিচুর্ণ হয়ে যাবে। তারপর এক নতুন জগত নতুন রীতি নিয়ে সৃষ্টি হবে। সেই নতুন পৃথিবীতে সব মানুষকে আবার জীবিত করা হবে। পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যত মানুষ জন্ম নেবে সযই সেখানে পুনরুপিত হবে। | তৃতীয়-তখন তাদের সবাইকে একই সময়ে খােদাতালার সামনে হাজির, করা হবে। প্রত্যেককে ব্যক্তিগত ভাবে নিজ নিজ কাজের হিসাব দিতে হবে। নিজ দায়িত্বে দুনিয়ায় যা কিছু করে গেছে তার সব কিছুরই কৈফিয়ত দিতে হবে।
চতুর্থ—সেখানে আল্লাহ তা'ল। নিজের ব্যক্তিগত জানা ব্যাপার হিসাবে রায় দিবেন না। বরং ন্যায় বিচারের সকল শর্তই সেখানে পূর্ণ করা হবে। প্রত্যেক ব্যক্তির গােটা জীবনের কার্যকলাপের পূর্ণ রেকর্ড হুবহু তার সামনে তুলে ধরা হবে। তারপর সে গােপনে ও প্রকাশ্যে যা কিছু করেছে তার দলীল স্বরূপ অসংখ্য সাক্ষী-প্রমাণ হাজির করা হবে। এমন কি কোন উদ্দেশ্যে কি কাজ করেছে তাও সেখানে প্রমাণিত হবে।
পঞ্চম-আল্লার আদালতে ঘুষ, অন্যায় সুপারিশ, মিথ্যা ওকালতি কিংবা উদোর পিণ্ডি বুধাের ঘাড়ে চাপানাে চলবে না। নিকটাত্মীয়, বন্ধু, নেতা, পীর, কিংবা স্বঘোষিত .কোন উপাস্য সাহায্য করতে এগােবে না। মানুষ নিতান্ত নিঃসংগ ও অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে নিজ হিসাব দিবে এবং রায় দানের অধিকার তখন শুধু আল্লারই থাকবে।
ষষ্ঠরায় দানের একমাত্র ভিত্তি হবে এই, মানুষ পৃথিবীতে নবীদের নির্দেশিত মত ও পথ অনুসরণ করে পরকালে খােদার কাছে জবাবদেহী
ফেলে তাে পরোক্ষণেই অনুতপ্ত হয়ে সে তওবা করবে। এর থেকে বড় কোন নৈতিক সংস্কারের এবং মানুষের ভেতর সুদৃঢ় এক কর্মশক্তি সৃষ্টির হাতিয়ার, নেই। খােদার সর্বোন্নত বিধান মানুষকে যে স্বতন্ত্র মূল্যবােধ দান করে, তার ওপর সুদৃঢ় থেকে কাজ করার এবং কোনক্রমে তা থেকে বিচ্যুত না হবার ভিত্তিই হল পরকালের যথাযথ বিশ্বাস। এ কারণেই ইসলাম। পরকালের সঠিক বিশ্বাস ছাড়া খােদা ও রসুল বিশ্বাসকে অর্থহীন বলেছে।
দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে বলে এসেছি, ইসলাম একটি পূর্ণাংগ সংস্কৃতি, পরিপূর্ণ : সভ্যতা, সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থা ও মানব জীবনের সব ক্ষেত্রের নৈতিক পথ প্রদর্শক। এ কারণেই তার নৈতিকতা পাদরী, সন্যাসী, যােগী ও দরবেশের জন্য নয়। বরং যার। মানব জীবনের বিভিন্ন শাখায় কাজ করছে কিংবা তা চালাচ্ছে, ইসলামের নৈতিক নির্দেশনা তাদেরই জন্য। মানুষ যেখানে গীর্জা, প্যাগােডা, মন্দির ও খানকায় উন্নত নৈতিকতার সন্ধান চালাত, ইসলাম সেটাকে সর্ব সাধারন মানুষের সকল স্তরে পৌঁছে দিতে চাইল। ইসলাম চায়, রাষ্ট্র নায়ক, গভনর, জজ, সেনানায়ক, পলিশ, অফিসার, পালামেন্ট সদস্য, অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের কর্মকর্তারা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ছেলে-মেয়েদের অভিভাবক ও অভিভাবকদের ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীদের স্বামীরা ও স্বামীদের স্ত্রীরা, পাড়াপড়শীর পরস্পর প্রতিবেশীরা, এক কথায় সকল স্তরের মানুষ নৈতিকতার মানদণ্ডে মহিয়ান হােক। সে চায় সব ঘরেই নৈতিক উন্নতির জয়-জয়কার হােক। প্রতিটি মহল্লা ও বাজারে সচ্চরিত্রতার রাজত্ব চলুক। সে চায় কাজ কারবারের সকল দপ্তরে ও শাসনযন্ত্রের সব বিভাগে সচ্চরিত্রতার আনুগত্য 'চলুক। রাজনীতি সত্য ও সততা ভিত্তিক হোক। জাতি সত্যপ্রিয় ও দায়িত্বশীল রূপে পারস্পরিক লেন-দেন চালাক। যুদ্ধ হলেও তা মানবতা ও ন্যায়ানুগতার পথে হােক। নেকড়ের মত তা যেমন খুশী পাশবিকতার প্রকাশ না হোক।
মানুষ যখন খােদাকে ভয় করে চলে, খােদার আইনকে সর্বোচ্চ মনে করে, খােদার কাছে জবাবদেহী হতে হবে ভেবে স্বতন্ত্র চিন্তা ও কাজ অনুসরণ করে চলে, তখন তার এ কার্যধারা শুধু উপাসনালয়ে সীমিত
থাকে না। বরং যে নামেই যেখানে সে কাজ করুক, খােদার সাচ্চা ফরমাবরদার বান্দা হিসেবে কাজ করে থাকে।
ইসলাম যা চায় তা সংক্ষেপে এই। এটা কোন দার্শনিকের কল্পনার স্বর্গ (utopia) নয়। বরং মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ বাস্তবে তা দেখিয়ে গেছেন। আজ চৌদ্দশ বছর পরেও মুসলমান সমাজে তার কিছু না কিছু নমুনা দেখতে পাওয়া যায়।
[ উনিশ শ ছিয়াত্তরের এপ্রিলে লণ্ডনে ইউরোপীয় ইসলামী পরিষদের উদ্যোগে আয়ােজিত তিনমাস ব্যাপী ইসলামী সম্মেলনে প্রেরিত মাওলানার এ লিখিত ভাষণটি পাঠ করে শুনান অধ্যাপক গােলাম আযম। আমরা ভাষণটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করলাম। ]
- প্রিয়তে যোগ করতে লগিন করুন
- লাইব্রারীতে যোগ করতে লগিন করুন
পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।
দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি