ছয়: বিশ্বলোক ও উর্দ্ধজগত সম্পর্কে নির্ভুল তথ্যের বর্ণনা দান
পবিত্র কোরআনে বহু জায়গায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে আল্লাহর অসীম কুদরতের বর্ণনা দান করতে গিয়ে উর্দ্বলোক, ভুমণ্ডল এবং এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যে সব তথ্যে অবতারণা করা হয়েছে, বিজ্ঞানের উন্নতি বিভিন্ন পর্যায় তার বাস্তবতা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিম্নে তার কয়েকটি নমুনা পেশ করা হচ্ছে,

(ক) মহাশুন্যে বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহ যে একটি অপরটিকে আকর্ষণ করে এবং এরই ফলে যে এরা শূণ্যে ভেসে রয়েছে, ১৯৯৫ খৃষ্টাব্দে নিউটনের মধ্যাকর্ষণী থিওরী আবিষ্কারের পূর্বে জগদ্বাসী এর বিশেষ কোন খবর রাখত না। কিন্তু নিউটনের জন্মের প্রায় হাজার বছর আগে এ তথ্য আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে তাঁর নবীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। নিম্নে এ সম্পর্কীয় আয়াত উদ্ধৃত করা হচ্ছে,

(***************)

“এবং আল্লাহ তায়ালার মহা নিদর্শনাবলীর মধ্যে এটাও একটি যে উর্দ্ধলোক ও ভূমন্ডল তারই আমর দ্বারা মহাশূণ্যে প্রতিষ্ঠিত।” (সুরা রুম, আয়াত-২৫)

যে মহাশক্তি বলে উর্দ্ধলোকের যাবতীয় বস্তু এবং ভূ মন্ডল শূণ্যে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, তাকে আয়াতে “আমরুল্লাহ” বল হয়েছে। আর সেটাই হচ্ছে ‍ নিউটনের আবিস্কৃত মধ্যাকর্ষণ শক্তি।

(**************)

“আর সমস্ত নক্ষত্ররাজি তারই আমর দ্বারা বাঁধা (নিয়ন্ত্রিত)। নিশ্চয়ই এর ভিতরে বিজ্ঞ লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” (সুরা নাহল, আয়াত-১২)

উপরোক্ত আয়াতে আমর দ্বারা সেই মহা আকর্ষণ শক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যার আকর্ষণ শক্তি বলে মহাশূণ্য নক্ষত্ররাজি বিক্ষিপ্ত হয়ে ছুটেছেন।

(*************)

নিশ্চয় আল্লাহ নভোমণ্ডল ও ভূ মণ্ডলকে এমনভাবে ধারণ করে রেখেছেন যার ফলে উহা বিচ্ছিন্ন হয়ে পতিত হয় না।” (সুরা ফাতের, আয়াত-৪১)

বর্ণিত আয়াতে আল্লাহ তায়ালার ধারণ শক্তি হল নিউটনের আবিষ্কৃত মধ্যাকর্ষণ শক্তি।

যদিও খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে গ্রীক বিজ্ঞানী টলেমী পৃথিবীর গোলাকৃতি এবং মহাশূন্যে সেটা ঝুলে থাকার তথ্য আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু কোন শক্তি বলে তা ঝুলে রয়েছে, তার যেমন তিনি সন্ধান দিতে পারেননি, তেমনি তিনি পৃথিবীর গতি সম্পর্কেও কোন খবর দিতে পারেননি।

(খ) সৃষ্টির ব্যাপারে বিশ্বের সর্বত্রই যে আল্লাহ তায়ালা দ্বৈত ও জোড়া পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, ফরাসী পদার্থ বিজ্ঞানী দ্য-ব্রগলী ১৯১৫ সনে এই আশ্চ* দৈতরূপের প্রতি ইঙ্গিত করেন। তার মতে প্রকৃতির সর্বত্র যে দ্বৈতভাব বিরাজ করছে, আলোর দ্বৈতধর্ম তারই একটি দিক মাত্র। অথচ দ্য-ব্রগলীর প্রায় তের শত বছর পূর্বে এই দ্বৈত ভাবের কথা কোরআনের মাধ্যমে মানুষকে জানানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,

(*************)

“ বড়ই মহিমান্বিত সেই সত্ত্বা যিনি দ্বৈতরূপে সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন। যা কিছু ভূমি হতে ও তাদের (মানুষের) ভিতর হতে জন্মে এবং এমন বস্তু হতে জন্মে যার খবর তারা রাখেনা।” (সুরা ইয়াসিন, আয়াত-৩৬)

(***************)

“এবং আমি তোমাদেরকে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছি।” (সুরা নাবা, আয়াত-৮)

(গ) চন্দ্র সূ*সহ বিশ্বের সবকিছুই যে অবিরতভাবে গতিশীল, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন ও আইনিস্টাইন প্রভৃতি বিজ্ঞানীদের জন্মের বহু পূর্বে কোরআন এ কথা ঘোষণা করেছে,

(**************)

“সূ* তার গন্তব্যস্থলের দিকে চলছে। আর এ হল তাঁরই ব্যবস্থাপনা যিনি মহা-পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী। আর চন্দ্রের জন্যও আমি তার মনজিল ঠিক করে দিয়েছি, এমনকি এক সময় উহা পুরান খেজুর শাখের রূপ ধারণ করে। সূ*র যেমন শক্তি নেই চন্দ্রকে ধরে ফেলার, রাতেরও তেমনি ক্ষমতা নেই দিনকে অতিক্রম করার। আর প্রত্যেকেই মহাশূন্যে সাঁতার কাটছে।” (সুরা ইয়াসীন, আয়াত-৩৮-৪০)

(************)

“তিনিই সৃষ্টি করেছেন দিন ও রাতকে, সূ* ও চন্দ্র তাঁরই সৃষ্টি। আর সকলেই মহাশূন্যে সাঁতার কাটছে।” (সুরা আম্বিয়া, আয়াত-৩৩)

এবার এ সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কথা শুনুন,

“বিশ্বে গতিহীন স্থির কোন কাঠামো নেই। বিশ্ব গতিশীল, নক্ষত্র, নীহারীকা-জগত এবং বহির্বিশ্বের বিরাট মধ্যাকর্ষণীয় জগত সমস্তই অবিরামভাবে গতিশীল।”

এ সম্পর্কে স্যার আইজাক নিউটনের মত হলো নিম্নরূপ:

“পৌরনীতি প্রবর্তনের সময় সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি বস্তুকে তার অক্ষের উপর প্রদক্ষিণ করার ব্যবস্থা করেন।”

(ঘ) সৃষ্টির প্রথমাবস্থায় নক্ষত্র, নীহারিকা ও সৌরজগত যে পরস্পর সংযু্ক্ত ও অবিচ্ছিন্ন ছিল বিজ্ঞানীদের বহু পূর্বে কোরআন আমাদেরকে তার সন্ধান দিয়েছে,

(***************)

“যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে, তারা কি ইহা অবলোকন করে না যে, আদিতে আকাশ মণ্ডলী ও ভূ-মণ্ডল পরস্পর সংযুক্ত ছিল। অতঃপর আমি উহাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি।” (সুরা আম্বিয়া, আয়াত-৩০)

বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে বেলজিয়াম বিশ্বতত্ত্ববিদ আথেল্য মেতরের কথা হল এই যে,“একটি বিরাটাকায় আদিম অণূ হতেই বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে। অণুটি কালক্রমে বিদীর্ণ হয়ে যায় এবং তার নানা অংশ নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে।”

(*********)

সম্প্রতি জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জর্জ গ্যামো বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্ক নিম্ন লিখিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন,

“আদিতে বিশ্বের কেন্দ্র সমজাতীয় আদিম বাষ্পের একটা জ্বলন্ত নরককুন্ড ছিল- ক্রমে ক্রমে এই মহাজাগতিক ভর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে এবং বিভিন্ন অংশের তাপমাত্রা ক্রমেই কমতে থাকে।”

উপরোক্ত দু জন খ্যাতনাম বিজ্ঞানীদের মতের সাথে উপরে বর্ণিত ঘোষনাটির আশ্চর্য সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

(ঙ) মহাবিশ্বের সৌরজগৎসহ বিভিন্ন জগতের সময়কাল ও দিবা-রাত্রি পরিমাণ যে এক নয়, বর্তমান বিজ্ঞানের অনেক আগে কোরআন এর ইঙ্গিত দিয়েছে,

(*************)

“সে মহান সত্ত্বাই আকাশ হতে ভূমণ্ডল পর্যন্ত যাবতীয় বিষয়গুলোর তদারক করেন। অতঃপর এমন একদিনে সবকিছুই তার নিকট ফিরে আসবে, যে দিনটির সময়কাল হবে তোমাদের গণনা মোতাবেক হাজার বছর।” (সুরা সাজদা, আয়াত-৫)

কোরআন অবতীর্ণ হবার সময় কালের এ ব্যবধানটি বোধগম্য না হলেও বর্তমান বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার তা মানুষের কাছে সহজ ও বোধগম্য করে দিয়েছে।

এ সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের উক্তি হল নিম্নরূপ,

“প্রত্যেক জগতের একটি নিজস্বকাল আছে। জগতের উল্লেখ না করে কোন ঘটনার কালের উল্লেখের কোন অর্থই হয় না। প্রত্যেক জগতের গতিবেগ অনুসারে স্থান ও কালের পরিবর্তন ঘটে।”

বিশ্ব রহস্য ও ড. আইনস্টাইন,লিংকন বেমিট।

সুতরাং আল্লাহ যদি কিয়ামতের দিন আমাদের হিসাব-নিকাশের ব্যবস্থা এমন একটি জগতে করেন, যে জগতকে আলোকিত করবে এমন একটি গ্রহ যে গ্রহকে কেন্দ্র করে উক্ত জগতটি তার অক্ষের উপরে আমাদের পৃথিবীর হাজার বছরে একবার মাত্র ঘুরে আসবে; আর এরই ফলে সেখানকার একদিনের পরিমাণ হবে আমাদের পৃথিবীর হাজার বছরের সমান, তাহলে তাতে আশ্চ* হওয়ার কি আছে?

(চ) পবিত্র কোরআনের অন্য এক স্থানে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নৈপুণ্যের বর্ণনা দান প্রসঙ্গে বলেন,

(*************)

“সেই মহান সত্ত্বাই সাত আসমানকে স্তরে স্তরে তৈরী করেছেন। তুমি সে করুণাময়ের সৃষ্টিতে কোথাও কোন ত্রুটি দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টি ফিরাও কোন ত্রুটি দেখতে পাচ্ছ কি? অতঃপর তুমি পুনঃ পুনঃ দৃষ্টি নিক্ষেপ কর। তোমার দৃষ্টিশক্তি অবনমিত হয়ে ফিরে আসবে।” (অথচ তুমি কোথাও কোন ত্রুটি দেখতে পাবে না।) (সুরা মূলক, আয়াত ৩-৪)

এই বৈশিষ্ট্যময় বিশ্ব যে আল্লাহ অহেতুক খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করেননি, সে সম্পর্কে কোরআন বলে,

(*************)

“আমি আকাশ ও ভূমণ্ডল এবং তন্মধ্যস্থ যাবতীয় বস্তু খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। নিশ্চয় আমি উভয়কে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তৈরী করেছি! কিন্তু অধিকাংশই লোকই তা অনুধাবন করে না।” (সুরা দোখান, আয়াত ৩৮-৩৯)

এবার এই নৈপূন্যময় বিশ্ব সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মত শুনুন,

আমি একটি সুসামঞ্জস্য ও সুশৃঙ্খল বিশ্বে বিশ্বাসী। অনুসন্ধানী মানুষ একদিন বাস্তব সত্যের সন্ধান পাবে বিশ্বাস আমি পোষণ করি। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনা যে, জগত নিয়ে সৃষ্টিকর্তা পাশা খেলছেন।” (বিশ্ব রহস্য ও ড. আইনস্টাইন)।

(ছ) পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, সে ভয়াবহ দিনে সূ* ও চন্দ্রে কোন আলো থাকবে না এবং নক্ষত্রগুলিও তাদের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবে। আর আল্লাহ এক অভিনব নূর (আলো) দ্বারা সমগ্র হাশর ময়দানটি আলোকিত করে ফেলবেন। যেমন সুরায়ে কিয়ামায় উল্লেখ আছে,

(*************)

“এরা (রসূলেন কাছে) জিজ্ঞেস করছে যে, কিয়ামত কবে হবে? যেদিন দৃষ্টি শক্তি ঝলসে যাবে এবং চন্দ্রে কোন আলা থাকবে না। আর চন্দ্র, সূর্য একই অবস্থা প্রাপ্ত হবে।” (সুরা কিয়ামাহ, আয়াত ৬-৯)

কিয়ামতের বর্ণনা দান প্রসঙ্গে আল্লাহ পবিত্র কোরআনের অন্য এক স্থানে বলেছেন,

(**************)

“যেদিন সূর্য কোন আলো থাকবে না, নক্ষত্রগুলো স্থানচ্যুত হবে, আর পাহাড়-পর্বতগুলিও সরে যাবে।” (সুরা তাকবীর, আয়াত ১-৩)

কোরআন নাযিলের সময় যদিও উক্ত কথাগুলি কারো কারো কাছে অসম্ভব বলে মনে হত, কিন্তু বর্তমান বিশ্বের প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরা চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজির উপরোক্ত অবস্থা প্রাপ্তির কথাকে আর আদৌ অসম্ভব মনে করেন না। বরং তাদের মতামত তাকে সমর্থন করার পক্ষে। যেমন তারা বলেছেন,

“সূ* ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে নিভে যাচ্ছে। তারকাদের অনেকেই এখন পোড়া কয়লা মাত্র। বিশ্বের সর্বত্রই তাপের মাত্রা কমে আসছে। পদার্থ বিকীর্ণ হয়ে ধ্বংস প্রাপ্ত হচ্ছে এবং কর্মশক্তি মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ক্রমে ক্রমে বিশ্ব এভাবে তাপ-মৃত্যুর (***) দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অনেক কোটি বছর পরে বিশ্ব যখন এরূপ অবস্থায় পৌঁছবে, তখন প্রকৃতির সমস্ত প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে।”

(বিশ্ব রহস্য ও ড. আইনস্টাইন, পৃঃ নং ১২৩-১২৪)

“প্রকৃতির সমস্ত দৃশ্য এবং তথ্যাদি দ্বারা এই একমাত্র সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, অনমনীয় ও অপরিবর্তনীয়ভাবে বিশ্ব এক অন্ধকার ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলছে।” (বিশ্ব রহস্য ও ড. আইনস্টাইন পৃঃ নং ১২৭)

বিজ্ঞানীদের মতে প্রকৃতির সমস্ত প্রক্রিয়া যেদিন স্তব্ধ হয়ে যাবে সেদিন বিশ্ব ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।

(*************)

“বিশ্বে যা কিছু আছে সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর তোমরা একমাত্র প্রতিপালকই অবশিষ্ট থাকবেন, যিনি মহীয়ান ও গরীয়ান।”

(সুরা আর-রহমান, আয়াত ২৬-২৭)

(জ) পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন উদ্ভিদ, তরুলতা ও গাছ-গাছড়া ইত্যাদিকে মানব ও জন্তু-জানোয়াররের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

(*************)

“অতঃপর তিনি জমিনকে বিস্তার করে দিয়েছেন। আর তা হতে পানি ও তরুলতাদি নির্গত করেছেন এবং পাহাড়কে তিনিই সু-প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর তা (গাছ-গাছড়া) হল তোমাদের এবং তোমাদের জন্তু-জানোয়ারদের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ।” (সুরা আন নাজিয়াত, আয়াত নং ৩০-৩৩)

অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

(*****************)

মানুষের উচিৎ তার খাদ্য বস্তুর দিকে লক্ষ্য করা। এক অত্যাশ্চ* পদ্ধতিতে আমি পানি বর্ষণ করেছি। অতঃপর অভিনব পদ্ধতিতে আমি জমিনকে বিদীর্ণ করে তা হতে নানা ধরনের শস্য, আঙ্গুর, শাক-সব্জি, জাইতুন, খেজুর, ঘন বৃক্ষরাজি পরিপূর্ণ বাগ-বাগিচা ফল-মূল, তৃণ-রাজি উৎপাদন করেছি। আর এসব হল তোমাদের ও তোমাদের গৃহপালিত পশুগুলির জন্য বিশেষ উপকারী।” (সূরা আবাসা, আয়াত ২৪-৩২)

বর্তমান বিজ্ঞানীদের উদ্ভিদ সম্পর্কে নানারূপ গবেষণা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, প্রকৃতির মধ্যে মানুষের এবং জন্তু-জানোয়ারদের জন্য উদ্ভিদের চেয়ে পরম বন্ধু আর কিছুই নেই। কেননা উদ্ভিদ শুধু আমাদের খাদ্য জোগায় না, বরং বায়ু হতে বিষাক্ত গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন তৈরী করে দেয়।

উদ্ভিদ শিকড়ের সাহা* মাটি হতে পানি শুষে পাতায় নিয়ে আসে এবং পাতা বায়ু হতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস শুষে নেয়। গাছের পাতায় রক্ষিত ক্লোরোফিল (যার কারণে পাতা সবুজ দেখায়) ও সূর্য কিরণের দ্বারা পাতার ভিতরেই এক ধরণের রান্নার কাজ চলে। ফলে তৈরী হয় শর্করা যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। আর বের হয়ে আসে অক্সিজেন যা না হলে আমরা সামান্য সময়ও বাঁচতে পারি না।

কাজেই উদ্ভিদ আমাদের জন্য মামুলী সম্পদ নয় বরং মহামূল্যবান সম্পদ। কোরআনে অসংখ্য বার আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর উদ্ভিদরূপ নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছেন।

(ঝ) উদ্ভিদ ও যাবতীয় ধাতব পদার্থের যে জীবনী শক্তি আছে, প্রখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুই নাকি তা সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন। অথচ বসু মহাশয়ের উক্ত আবিষ্কারের প্রায় তেরশত বছর পূর্ব পবিত্র কোরআন আমাদেরকে উদ্ভিদ, পাথর যাবতীয় ধাতব পদার্থ ইত্যাদির জীবনী শক্তি ও অনুভূতি শক্তির সন্ধান দিয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে কোরআন হতে কয়েকটি উদ্ধৃতি দেয়া হচ্ছে,

(***************)

“সপ্ত আকাশ, ভূমণ্ডল ও তন্মধ্যস্থ সকল বস্তুই আল্লাহর গুণগান করে। আর এমন কোন বস্তু নেই যা তার গুণকীর্তন করে না, কিন্তু তোমরা তাদের এ গুণকীর্তন (তাসবীহ পাঠ) উপলব্ধি করতে পারো না। আর তিনি হলেন ধৈর্যশীল ও ক্ষমাকারী।” (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত-৪৪)

(**************)

“আকাশ ও ভূমণ্ডলস্থ সকলেই আল্লাহর গুণগানে মশগুল। আর তিনি হলেন মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী।” (সুরা ছফ, আয়াত-১)

নিম্নের আয়াতটি বিশেষভাবে পাথরের জীবনী শক্তির ইঙ্গিত বহন করে,

(**************)

“আর কোন কোন পাথর এমনও হয়ে থাকে যা হতে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়। কোন কোনটি ফেটে গিয়ে তা থেকে পানি নির্গত হয়। আবার কোন কোনটি আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হয়ে ভূতলে পতিত হয়। আর আল্লাহ তোমাদের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে মোটেই অনবহিত নহেন।”

(সুরা বাকারা, আয়াত-৭৪)

একদা এক অভিযানকালে হযরত মুহাম্মদ (স) যখন সৈন্যদেরকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন যে, কোন কোন সাহাবী হাতের অস্ত্রের আঘাতে পথিপাশর্স্থ গাছের ডাল-পালা কাটছেন। হুজুর (স) তাদেরকে নিষেধ করলেন, আর বললেন, “ খবরদার অযথা তোমরা গাছ-পালার উপরে আঘাত করবে না। কেননা তাদের প্রাণ আছে তোমাদের আঘাতে তারা কষ্ট পায় ও কাঁদে।”

অতিসম্প্রতি রুশ বিজ্ঞানী মানুষের সুখে ও দুঃখে নিকটবর্তী ফুলও যে প্রভাবান্বিত হয়, অর্থাৎ মানুষের সুখে ও আনন্দে নিকটবর্তী ফুলও আনন্দিত হয় এবং মানুষের দুঃখে বেদনা বোধ করে, এ তথ্যটি আবিষ্কার করেছেন।

মাত্র কিছুদিন পূর্বে আমেরিকার দুজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী পিটার টস্পকীন এবং ক্রিস্টোফার-বার্ত্ত কর্তৃক লিখিত (***********) নামক পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তারা প্রমাণ করেছেন যে, সক রকমের গাছ-গাছড়া এমনকি মূলা, গাজর, পিঁয়াজ ইত্যাদির শুধু অনুভূতি শক্তিই নেই বুদ্ধি এবং ইচ্ছা শক্তিও আছে।

এমনকি অন্য উদ্ভিদের সাথে যোগাযোগ করার ভাষাও আছে। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীদ্বয় তাদের পুস্তকে খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ক্লেপব্যকস্টার, মর্সেল ভোগেল, কেন হার্মিমোট ও ভারতীয় বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু প্রভৃতি বিজ্ঞানীদের মতামতও প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেন।

শস্যের চারা কিভাবে সঙ্গীতে সাড়া দেয়, বীজ ও কুঁড়ি কিভাবে বৈদ্যুতিক আঘাতে জেগে ওঠে, এ সম্পর্কে কাজাকিস্তানের রুশ বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানের ফলাফলও উক্ত পুস্তকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।


সাত: কোরআনের অভিনব হেফাযত ব্যবস্থা
স্মরণাতীত কাল হতে পয়গাম্বরদের উপরে যে সব কিতাব নাযিল হয়েছে তার অধিকাংশই এখন দুষ্প্রা্য। যে অল্প কয়েকখানা পাওয়া যায় তাও তার মূল ভাষায় নয়। আর মূল ভাষা হতে যখন কোন গ্রন্থকে অনুবাদ করা হয়, তখন তা অনুবাদ গ্রন্থ, আসল গ্রন্থ নয়। বিশেষ করে মহান আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের অনুবাদ। আর অনুবাদ গ্রন্থের ভাষা গ্রন্থের অনুবাদকের, আল্লাহর নয়।

তাছাড়া ঐ সমস্ত গ্রন্থ যে পরিবর্তন মুক্ত নয় তা তাদের বিজ্ঞ অনুসারীদের অনেকেই মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করেছেন। কেননা সে যুগে না ছিল কাগজ, আর না ছিল আজকের মত ছাপাখানা। ফলে বৃক্ষপত্র, কাষ্ঠফলক, সমৃণ পাথর-প্লেট অথবা পাতলা চামড়ায় উহা লিখে রাখা হত এবং উহার অতিরিক্ত কপি করা অসম্ভব বিধায় পাদরী পুরোহিতদের কাছে উহার এক আধ কপি তাদের কেন্দ্রীয় উপাসনালয়ে রক্ষিত হত। আর যখনই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কোন জাতি তাদের রাজধানী কিংবা নগর আক্রমণ করত, তখন তাদের ধর্মগ্রন্থ ও উপাসনালয়ই হত বিজয়ী জাতির আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যস্থল। ইসলামের অভ্যুত্থানের পূর্বে এভাবে বহুবার প্রতিদ্বন্দ্বি শক্তি কর্তৃক ইহুদী ও খৃস্টানদের ধর্মগ্রন্থ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। অধুনা একখানা পূর্ণাঙ্গ তাওরাত কিংবা ইঞ্জিল তার মূল ভাষায় পাওয়া সাধারণভাবে অসম্ভব।

পবিত্র তাওরাত গ্রন্থ যা হযরত মূসার (আ) উপরে অবতীর্ণ হয়েছিল, সেটা কয়েকবারেই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে খৃঃ পূঃ ৫৮৬ সনে ব্যাবিলনের অত্যাচারী শাসক বখতে নাছার (নবুকারদোযাহ) জেরুজালেম আক্রমণ করে শহরটিকে ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় এবং ইসরাইলী আলেম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে বন্দী করে ব্যাবিলনে নিয়ে যায়। বখতে নাছার হযরত সুলায়মানের (আ) তৈরী পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ এবং সেখানে রক্ষিত তাওরাত গ্রন্থও ধ্বংস করে দেয়।

অতঃপর প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে খৃ: পৃ: ৫৩৮ সনে পারস্য সম্রাট মহামতি সাইরাছ ব্যাবিলনের বাদশাহকে পরাজিত করে ইহুদীদের মুক্ত করে দেন এবং ফিলিস্তিনে তাদের পূনর্বাসন, নতুন করে জেরুজালেম নগরী ও বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ পুনঃনির্মাণে সহায়তা করেন। তৎপর ইহুদী আলেমগণ তাওরাতের বিক্ষিপ্ত অংশ যা তাদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল এবং যা তাদের মুখস্ত ছিল তা হতে তাওরাত নতুন করে লিপিবদ্ধ করেন। এ সম্পর্কে (***********) নামক গ্রন্থের প্রসিদ্ধ ইউরোপীয়ান লেখকের মত হল নিম্নরূপ:

(**************)

“প্রকৃত ব্যাপর ছিল এই যে, তাওরাতের মূল লিপি, হযরত সুলায়মানের পবিত্র মসজিদের সাথেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর ইজরা বা হযরত ওজায়ের (আ) যা কিছু সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন তা দ্বারা নতুন একটি কপি তৈরী করলেন।”

রোমান ঐতিহাসিক প্রিণীর মতে জেরোস্তারের উপরে নাযিলকৃত কিতাব জিন্দাবেস্ত মোট বার হাজার গরুর চামড়ায় সোনালী কালিতে লিপিবদ্ধ করে পারসিয়ানদের তদানন্তীন রাজধানী পার্সেপলিসের বিখ্যাত লাইব্রেরীতে রাখা হয়েছিল। অতঃপর গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার যখন উক্ত রাজধানী দখল করে পুড়িয়ে দেয়, তখন লাইব্রেরীটি এবং তাতে রক্ষিত জিন্দাবেস্তা কিতাবখানিও পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়।

বাইবেল নিউটেস্টামেন্ট (ইঞ্জিল) সম্পর্কে লেখক তার অনুসন্ধানের ফল ব্যক্ত করে বলেন,

(*****************)

“সমস্ত নিউটেস্টামেন্টই (ইঞ্জিল) অন্যান্য ডকুমেন্টসহ যে মূল লিপিতে লেনিনগ্রাডে রক্ষিত আছে সেটাকে ‘ছায়ানাইটিক লিপি’ বলা হয়। এটা যথাসম্ভব খৃস্টীয় শতাব্দীদে মিসরে লিখিত হয়।”

সুতরাং হযরত ঈসার (আ) মৃত্যুর চারশত বছর পর যদি তাঁর উপর নাযিলকৃত কিতাব লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে তাতে কতখানি মৌলিকত্ব আছে তা ভাববার বিষয় বটে?

আবার কোন কোন ঐশীবাণী (ওয়াহী) পুরুষাক্রুমে ধর্মযাজকগণ তাদের শিষ্যদের তালিম দিতেন। অতঃপর সেটা যখন কালের গর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিত, কিংবা ব্যাপকভাবে তাতে বাইরের আখ্যান ইত্যাদি যুক্ত হত, তখনই তাদের কোন জ্ঞানী ব্যক্তি সেটাকে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করে নিতেন। ফলে উহা হতে যেমন কোন অংশ বাদ পড়ত, তেমনি অনেক বাইরের কথাও তাতে শামিল হয়ে যেত।

হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ বেদ বৈদিক যুগের অনেক পরে মহাভারতীয় যুগে (কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়) বেদব্যাস মুনি কর্তৃক সঙ্কলিত হয়। পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মতে বেদ যীশু খৃস্টের জন্মের মাত্র সাত কি আটশত বছর পূর্বের রচনা। অনুরূপভাবে বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটককে তৃতীয় পিটকখানা বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় দুই শত বছর পর মহামতি অশোকের নেতৃত্বে লিপিবদ্ধ করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় পিটকদ্বয়ও বুদ্ধের মৃত্যুর পরে সংকলিত। উপরন্তু কোরআন পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থগুলো যে সব ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছিল, দুনিয়ার কোথাও আর সে সব ভাষার প্রচলন নেই। জগতের অধিকাংশ পয়গম্বরই ছিলেন বনি ইসরাইল কওমভুক্ত, আর তাদের ভাষা ছিল ইবরানি বা হিব্রু। এ সকল ইবরানী পয়গম্বরদের উপরে নাযিলকৃত সমস্ত কিতাবের ভাষাই ছিল ইবরানি বা হিব্রু। এ সকল ইবরানী পয়গম্বরদের উপরে নাযিলকৃত সমস্ত কিতাবের ভাষাই ছিল হিব্রু। কিন্তু ‍দুনিয়ার কোথাও আজ আর হিব্রু ভাষার তেমন প্রচলন নেই।

অনুরূপভাবে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদ ও গীতার ভাষা সংস্কৃতেরও যেমন কোন সন্ধান পাওয়া যায় না, তেমনি বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ পিটকের ভাষা পালিতেও এখন আর কেউ কথা বলে না। এসব এখন মৃত ভাষার শামিল।

কিন্তু একমাত্র কোরআনের ব্যাপারই এসব থেকে স্বতন্ত্র। যে মূল ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, সেই মূল ভাষায়ই তার কোটি কোটি কপি দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন লোকের কাছে মওজুদ আছে। কোরআন যে শুধু গ্রন্থাবস্থাই রক্ষিত আছে তাই নয়, বরং কোরআন নাযিলের পর থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে অগণিত লোক তা পুরাপুরি মুখস্থ করে রেখেছেন।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোরআন অল্প অল্প করে তেইশ বছর ধরে অবতীর্ণ হয়েছে। যখনই কোরআনের কোন অংশ হুজুর (স) এর উপরে অবতীর্ণ হত, হুজুর (স) সাথে সাথেই যেমন সেটা কাতিব (ওয়াহী লিপিবদ্ধকারী) দ্বারা লিপিবদ্ধ করিয়ে নিতেন, তেমনি বহু মুসলমান সঙ্গে সঙ্গেই ঐ অংশটুকু মুখস্থ করে ফেলতেন। তেইশ বছর পর যখন কোরআন নাযিল হওয়া সমাপ্ত হলো, তখন একদিকে যেমন কোরআন পুরাপুরি লিপিবদ্ধ হয়ে রক্ষিত হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে তেমনি অসংখ্য মুসলমান সেটাকে পূর্ণরূপে মুখস্থ করে তার হেফাযতের চমৎকার ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। অতঃপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উক্ত হেফাযত ব্যবস্থা যথা নিয়মেই চলে এসছে।

কেউ যদি উহা পরীক্ষা করে দেখতে চায়, তাহলে তিনি যেন পূর্ব এশিয়ার কোন এক দেশ হতে একখানা কোরআন সংগ্রহ করেন। অতঃপর উত্তর আফ্রিকার কোন একজন হাফেযের মুখে তা পাঠ করিয়ে শুনে নেন। শব্দ ও অক্ষর তো দূরের কথা একটা জের যবরেরও কোন অমিল পাবে না।

তাছাড়াও যে মূল আরবী ভাষায় কোরআন মহানবীর প্রতি নাযিল হয়েছে, আজ চৌদ্দশত বছরের ব্যবধানেও কোরআনের সে ভাষা না পুরান হয়েছে, না পরিত্যক্ত।

[আরবী ভাষার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের প্রশংসা করতে গিয়ে প্রখ্যাত আমেরিকান পণ্ডিত জর্জ সার্টন বলেন,

“মুসলিম তামুদ্দুন ছিল বিচিত্র প্রকৃতির। মুসলমানেরা ধর্ম ও ভাষারূপ দুটি শক্তিশালী বন্ধন দ্বারা নিজেদেরকে ঐক্যসূত্রে গেথে নিয়েছিল। মুসলমানদের প্রধান কর্তব্যগুলোর ভিতরে একটি হল মূল আরবী ভাষার কোরআন পাঠ করা। এ চমৎকার ধর্মীয় বিধানকে ধন্যবাদ…..। আজকেও যেসব ভাষা পৃথিবীর সর্বত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে, আরবী তাদের অন্যতম। (*************) লেখক তাঁর পুস্তকের অন্য এক জায়গায় বলেছেন’ “অষ্টম শতকের মধ্য ভাগ হতে একাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত আরবী ভাষা-ভাষীরা এগিয়ে চলছিল মানব জাতির পুরো ভাগে। তাদেরকে ধন্যবাদ, আরবী ভাষা শুধু কোরআনের পবিত্র ভাষা বা আল্লাহর বাণীর বহনরূপেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং তা বিশ্বের সামনে নিজেকে তুলে ধরেছে আন্তর্জাতিক ভাষারূপে।” মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে আরবী রচনাবলী অসীম গুরুত্বের কথা স্বীকার করে লেখক গ্রন্থের অন্য এক জায়গায় লিখেছেন,

“ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্যে যারা অগ্রগামী ছিলেন তারা বুঝতে পারলেন যে, আরবী রচনাবলী শুধু যে গুরুত্বপূর্ণ তাই নয়, সেগুলো অপরিহার্যও বটে। কারণ তারই মধ্যে সঞ্চিত ছিল জ্ঞানের প্রচুর সম্পদ। এ কথা বললে মোটেই অতিরিক্ত হবে না, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত খৃস্টান পণ্ডিতদের প্রধান কাজ ছিল আরবী গ্রন্থের ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ।”(***************) ]

বরং দুনিয়ার বেশ কয়েক কোটি লোকই উক্ত ভাষায় কথাবার্তা বলে। কোরআনের পাঠক মাত্রই তার এ অভিনব হেফাযত ব্যবস্থায় মুগ্ধ না হয়ে পারবে না।

আল্লাহ তায়ালার সর্বশেষ পয়গম্বরের প্রতি নাযিলকৃত তাঁর এ সর্বশেষ কিতাবখানার এ অভিনব হেফাযত ব্যবস্থা যে আল্লাহর নিজেরই পরিকল্পিত সে কথা আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন। এ ঘোষণাটি একবার আমরা দেখতে পাই ‘সুরা কিয়ামাহ’ নামক প্রাথমিক স্তরের একটি মক্কী সুরাতে। আর একবার আমরা দেখতে পাই ‘সুরায়ে হিজর’ নামক অপর একটি মক্কী সুরাতে।

মক্কা শরীফের প্রথম যখন জিরারাইল (আ) হুজুরের (স) কাছে উপস্থিত হয়ে ওয়াহী পাঠ করে শুনাতেন, তখন হুজুর (স) জিবরাইলের (আ) সাথে ব্যস্ততার সাথে তা পাঠ করতে থাকতেন, যাতে ওয়াহীর কোন একটা অংশও বাদ না পড়ে। ফলে মহান আল্লাহ নিম্নলিখিত মর্মে হুজুরকে আশ্বস্ত করলেন,

(*************)

“হে রাসূল, দ্রুত কোরআন আয়ত্ব করার জন্যে আপনি আপনার জিহ্বা সঞ্চালন করবেন না। কোরআন পূর্নাঙ্গ করা এবং তা পাঠ করিয়ে দেয়া আমার দায়িত্ব। সুতরাং আমি যখন (জিবরাইলের জবানে) সেটা পাঠ করি, তখন আপনি তা অনুসরণ করুন। অতঃপর তার ব্যাখ্যা দানও আমার জিম্মাদারী।” (সুরা কিয়ামাহ, আয়াত ১৬-১৯)

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

(*********)

“নিশ্চয় কোরআন আমিই নাযিল করেছি। আর অবশ্যই তার হেফাযতের দায়িত্ব আমারই।” (সুরা হিজর, আয়াত-৯)

সুরা তায়াহায়ও অনুরূপ ধরনের একটি উক্তি দেখা যায়।

“কোরআন যখন নাযিল হয়, তখন তা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কোরআনের (হেফাযতের) জন্য আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না। আর আপনি বলুন, হে আল্লাহ! তুমি আমার ইলম বাড়িয়ে দাও”। (সুরা তায়াহা, আয়াত-১১৪ )

কোরআনের এই অত্যাশ্চর্য হেফাযতের ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে মন আপন হতে সাক্ষ্য দিবে যে, এ হেফাযত ব্যবস্থার মূলে তাঁর হাতই ক্রিয়াশীল, ‍যিনি উহা নাযিল করেছেন।

আট: কোরআনের ভাষা ও ভাবে আশ্চর্য সাঞ্জস্য
দীর্ঘ তেইশ বছর কালব্যাপী অল্প অল্প নাযিল হওয়ার পরেও কোরআনের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত ভাষা, সাহিত্যিক মান, অর্থ ও ভাবে যে আশ্চর্য ধরনের সামঞ্জস্য উহাও প্রমাণ করে যে, কোরআন মানব রচিত কোন গ্রন্হ নয়। কেননা কোন মানুষের পক্ষে উক্ত বিষয়সমূহের ভিতরে এরূপ ধারাবাহিকতা ও সামঞ্জস্য রক্ষা করা দীর্ঘকালব্যাপী সম্ভব ছিল না।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি