কোরআনের ঐশী গ্রন্থ হওয়ার কয়েকটি অকাট্য প্রমাণ
পবিত্র কোরআন যে আল্লাহ তায়ালারই বাণী এবয় এই ধরনের কিতাব যে মানুষের পক্ষে তৈরী করা আদৌ সম্ভব নয় এর অসংখ্য প্রমাণ স্বয়ং কোরআনেই বর্তমান। নিম্নে তা হতে কয়েকটি উদ্ধৃত হচ্ছে:

এক: কোরআনের ভাষাগত ও সাহিত্যিক মান
কোরআনের ভাষাগত ও সাহিত্যিক মান অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের। এর ভাষা যেমন- স্বচ্ছ, তেমনি এর বাক্য বিন্যাসও অত্যন্ত নিখুঁত ও অভিনব। নবী করীম (সঃ) যখন কোরআন তেলাওয়াত করতেন, তখন এর ঝংকার ও সুরমাধুরী তাঁর সমভাষীদের মন মগজকে মোহিত করে তুলত। তারা বাস্তবভাবে উপলব্ধি করত যে, এ কালাম কিছুতেই মানুষের পক্ষে রচনা করা সম্ভন নয় তা সে আরবী সাহিত্যের যত বড় পন্ডিতই হোক না কেন। যদিও পূর্ব পুরুষের অন্ধ অনুকরণ, গোত্রীয় অহমিকা ও সংকীর্ণ স্বার্থবোধ কোরআনকে হোক বলে গ্রহণ করার পথে তাদের জন্য প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে রেখেছিল, কিন্তু তারা এ কথা ভালোভাবে উপলব্ধি করত যে, একজন উম্মী লোকের পক্ষে, যে কোনদিন পাঠশালার বারান্দাও মাড়ায়নি এ ধরনের উচ্চমানের কালাম রচনা করে পেশ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। স্বয়ং কোরআনই একাধিকবার আরবদেরকে খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ করেছে যে, “ তোমরা যতি একে নবীর (সঃ) রচিত বাণী বলে মনে কর, তাহলে তোমরা এ ধরনের বাণী তৈরী করে দেখাও।”

মুশরেকদের প্রাণান্তর বিরোধিতার মুখে মক্কা শরীফে বিভিন্ন সময় উক্ত চ্যালেঞ্জ তিনবার প্রদান করা হয়্। রসূলের মাদানী জিন্দেগীর প্রথম দিকে আর একবার এ চ্যালেঞ্জ পুনরোক্তি করা হয়। মক্কায় একবার সুরা ইউনুসের ভিতরে, একবার সুরা হুদের ভিতরে আর একবার সুরা বনি ইসরাইলের ভিতরে নিম্নরূ চ্যালেঞ্জ দান করা হয়:

(*****************)

”এরা কি দাবী করে যে, কোরআন (আপনার) বানানো। আপনি বলুন, তোমরা যদি তোমাদের দাবীতে সত্যবাদী হও, তাহলে একটি সুরা অন্তত তৈরী করে নিয়ে এসো। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত যাদের সাহায্য প্রয়োজনবোধ করা। সাধ্যমত তাদেরকেও ডেকে নাও”

(সুরা ইউনুস, আয়াত-৩৮)

(*********************)

”উহারা নাকি বলে যে, কোরআন রসূলের (সঃ) তৈরী করা, আপনি বলুন, তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তাহলে এ ধরনের রচিত দশটি সুরা নিয়ে এসো। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত যাদের সাহায্য প্রয়োজন বোধ কর সাধ্যমত তাদেরকেও ডেকে নাও।”

(সুরা হুদ, আয়াত-১৩)

(********************)

আপনি ঘোষণা করে দিন, জগতের সমগ্র মানব ও জ্বীন জাতি মিলেও যদি এ ধরনে একখানা কোরআন তৈরী করার চেষ্টা করে, তাহলেও তারা তা পারবে না, যদিও তারা এ ব্যাপারে পরস্পরকে সাহায্য করে।”

(সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত-৮৮)

নবী করীম (স:) মদীনায় হিজরত করার পরপরই আর একবার সুরায়ে বাকারার ভিতরে উক্ত চ্যালেঞ্জের পুনরাবৃ্ত্তি নিম্নরূপে করা হয়,

(*********************)

আর যে কিতাব আমি আমার বান্দার (মুহাম্মদের) উপর নাযিল করেছি, তা আমার পক্ষ হতে কিনা? এ ব্যাপারে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে. তাহলে অনুরূপ একটি সুরা তৈরী করে নিয়ে এসো। আর এ কাজে আল্লাহ ছাড়া তোমাদের অন্যান্য সাহয্যকারীদেরকে ডেকে নাও যদি তোমরা সত্যবাদী হও।” (সুরা বাকারা, আয়াত-২৩)

আরবদের কঠিন বিরোধিতার মুখে যখন বার বার এ চ্যালেঞ্জ প্রদান করা হয়েছিল, তখন নিশ্চয়ই তারা চুপ করে বসে ছিল না। তাদের ভিতরে বেশ কিছু বড় বড় কবি এবং উচ্চমানের সাহিত্যিক বর্তমান ছিল। এহেন প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জের জওয়াব দানের জন্য ইসলাম বিরোধীরা এদের সকলের দ্বারেই ধর্ণা দিয়েছিল। কিন্তু তারা সকলেই তাদেরকে হতাশ করেছিল। তাদের কোন কবি কিংবা কোন সাহিত্যিক প্রতিভার পক্ষেই কোরআনের ছোট্ট একটি সূরার অনুরুপও কোন সূরা তৈরী করে দেয়া সম্ভব হয়েছিল না।

আল্লাহ তায়ালা ঘোষিত উক্ত চ্যালেঞ্জ শুধু ঐ সময়ের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। বরং কোরআন অবতীর্ণের সময় হতে আরম্ভ করে কিয়ামত পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালব্যাপী কোরআন বিরোধীদের জন্য এটা একটি খোলা চ্যালেঞ্জ। আজও মিসর, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন প্রভৃতি দেশে আরবী বংশজাত বহু খৃস্টান ও ইহুদী পরিবার বর্তমান, যাদের মধ্যে আরবী ভাষার বড় বড় পন্ডিতও আছে। ইচ্ছা করলে তারাও এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখতে পারে। হয়তো তারা তা করে দেখেছেও। কিন্তু পূর্ববর্তীদের ন্যায় তাদের ভাগ্যেও হতাশা ছাড়া আর কিছুই জুটবেনা।

যারা আরবী ভাষার পন্ডিত এবং যাদের মাতৃভাষা আরবী তারা এটা ভালভাবেই অনুধাবন করতে পারে যে, কোরআনের ভাষার সাথে মানব রচিত কোন আরবী পুস্তকের ভাষার তুলনাই হয় না। বরং নবী করীমের (স:) ভাষাও কোরআনের ভাষার ন্যায় উচ্চমানের ছিল না। নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি যে সব কথাবার্তা বলেছেন, এমনকি নবুয়ত প্রাপ্তি পরও সাধারণভাবে নবী (স:) (ওয়াহী ব্যতীত) যেসব কথা বলতেন তাও ছিল কোরআনের ভাষা হতে নিম্নমানের। ওয়াহীর ভাষার সাথে তার কোন তুলনাই হতো না।

সুতরাং কোরআন যে আল্লাহর কিতাব, তার উচ্চাঙ্গের সাহিত্যিক মান, সুনিপুন শব্দ গঠন প্রণালী, অভিনব বাক্যবিন্যাস আর মর্মস্পর্শী সুরঝঙ্কার প্রভৃতিই তার অকাট্য প্রমাণ।

দুইঃ কোরআনের আলোচ্য বিষয়সমূহ
কোরআনে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের আলোচনা করা হয়েছে এবং যেসব দুরূহ সমস্যার সমাধান দেওয়া হয়েছে। সেটাও কোরআনের ঐশী গ্রন্থ হওয়ার একটি উজ্জ্বল প্রমাণ। কেননা নবী করীম (স:) যে এলাকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে এলাকা ছিল তখনকার সভ্য জগতের বাইরে। কোন সুসংগঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাও যেমন সেখানে ছিল না, তেমনি কোন মার্জিত সভ্যতাও সেখানে গড়ে উঠেনি। দু একটি ছোটখাট শহর ব্যতীত আর সব এলাকার অধিবাসীরাই যাযাবর জীবন যাপন করতো। প্রতিটি গোত্রই আলাদা আলাদা গোত্রীয় শাসন অর্থাৎ গোত্র সর্দারের অনুশাসন মেনে চলত। কদাচিত এক-আধজন লোক সামান্য লেখাপড়া জানলেও কোথাও কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না।

এমন এক পরিবেশে জন্ম নিয়ে মুহাম্মদ (স:) শৈশবেই পিতৃ-মাতৃহীন এতিমে পরিণত হন। ফলে তাঁর ভাগ্যে কোনরূপ লেখাপড়াই জোটেনি। যৌবনে সিরিয়ার দিকে দুটি সংক্ষিপ্ত বাণিজ্যিক সফর ব্যতীত কোন শিক্ষামূলক সফরও তিনি করেননি। কোন শিক্ষিত জ্ঞানী ব্যক্তির সাহচর্যও তিনি আদৌ পাননি।

এমতাবস্থায় এমন একজন উম্মি লোকেরে পক্ষে বহু বিচিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্বলিত কোরআনের মত একখানা গ্রন্থ রচনা করে পেশ করা যে আদৌ সম্ভব নয়, তা যে কোন সাধারণ জ্ঞানের লোকও অনুধাবন করতে পারে। সুতরাং কোরআনের আলোচ্য বিষয়সমূহই বলে দেয় যে, কোরআন আল্লাহর কিতাব।

তিন: প্রাগৈতিহাসিক ঘটনাবলীর যথাযথ বর্ণনা
পবিত্র কোরআনে এমন ঘটনাসমূহের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা ঘটেছিল ইতিহাস সৃ্ষ্টির বহু পূর্বে এবং যার সম্পর্কে ষষ্ঠ শতাব্দীর দুনিয়া বিশেষ কোন খোঁজ-খবর রাখত না। প্রাগৈতিহাসিক যুগের কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ ইহুদীদের ধর্ম গ্রন্থে ছিল বটে, তবে তার অধিকাংশই ছিল অতিরঞ্জিত ও বিকৃত। আবার কিছু কিছু ঘটনার চর্চা যদিও আরব এবং পাশ্ববর্তী এলাকার লোকদের ভিতরে ছিল কিন্তু তা ছিল একেবারেই অস্পষ্ট ও সন্দেহপূর্ণ। আবার এমন বহু ঘটনার বর্ণনা কোরআনে দেখা যায়, যার উল্লেখ না ছিল ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থে আর না ছিল তার চর্চা আরবদের ভিতরে।

পবিত্র কোরআন প্রাগৈতিহাসিক যুগের বিভিন্ন ঘটনা বিভিন্ন প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত অথচ এমন নিখুঁতাভাবে বর্ণনা করেছে যার সত্যতাকে আপ পর্যন্ত কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। বরং অধুনা প্রত্নতত্ত্ববিদের ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহের নব নব আবিষ্কার এর সত্যতাকে আরও সন্দেহাতীত করে তুলেছে।

হযরত আদম-হাওয়া (আ) বৃত্তান্ত, হযরত নূহের ঘটনা, হযরত ইবরাহীম, হযরত ইসমাইল ও হযরত ইয়াকুবের (আ) কাহিনী, নমরুদ-ফেরাউনের প্রসঙ্গ, হযরত ইউসুফ ও হযরত ইয়াকুবের (আ) কাহিনী, আদ, সামুদ, তুব্বা ও সাবা ইত্যাদি জাতিসমূহের বৃত্তান্ত, জালুত ও হযরত দাউদের প্রসঙ্গ, জুকারনাইন, আছহাবে কাহাফ ও হযরত লোকমানের ঘটনা, হযরত সুলায়মান, হযরত জাকারিয়া, হযরত ইয়াহীয়া ও হযরত ঈসার (আ) বর্ণনাবলী ইত্যাদি এমন একজন উম্মি লোকের পক্ষে যিনি কোনদিন ইতিহাস-পুস্তকের একটি লাইনও পড়েননি, অথবা বিভিন্ন দেশে পর্যটক হিসেবে আদৌ সফর করেননি, নিখুঁতভাবে বর্ণনা করা যে সম্ভব নয় তা যে কোন লোকই বুঝতে পারে। ইহার প্রমাণ স্বরূপ পবিত্র কোরআন হতে নিম্নে কয়েকটি ঘটনার উদ্ধৃতি দেয়া হচ্ছে,

(ক) মহানবীর আবির্ভাবের হাজার হাজার বছর আগে এবং মানব সৃষ্টির কেবল অল্পকাল পরেই ছাহেবে শরীয়ত পয়গম্বর হযরত নূহের (আ) আগমন ঘটেছিল। পবিত্র কোরআনে সুরায়ে হুদে আল্লাহ রাব্বুল আলামী হযরত নূহের নবুয়ত প্রাপ্তি, কওমের নিকটে তাঁর দাওয়াত পেশ, কওম কর্তৃক উহা প্রত্যাখ্যান এবং নূহকে (আ) নানারূপ তকলীফ দান, দীর্ঘ চেষ্টা যত্নের পরে নিরাশ হয়ে কওমের ধ্বংসের জন্য আল্লাহর দরবারে মোনাজাত, অবশেষে প্রলয়ঙ্করী প্লাবনে হযরত নূহ (আ) এবং তাঁর কতিপয় ঈমানদার সঙ্গী ব্যতীত বাকী সমগ্র মানব গোষ্ঠীর ধ্বংস সাধনের ঘটনাবলী বর্ণনা করার পরে আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদকে (স) লক্ষ্য করে বলেন,

(********************)

এ হলো অজ্ঞাত অজানা ঘটনাবলী, যা আমি তোমাকে ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত করাচ্ছি। অথচ এসব ঘটনা ইতিপূর্বে না তোমার জন্য ছিল, না তোমার জাতির। সুতরাং অপেক্ষা করতে থাক অবশ্যই শেষ ফল পরহিজগারদের ভাগ্যে।” (সুরা হুদ, আয়াত-৪৯)

(খ) রাসূলের জন্মের প্রায় দু হাজার বছর আগে হযরত ইউসুফের (আ) জীবনে যে বিচিত্র ঘটনা ঘটেছিল, দার বর্ণনা দান প্রসঙ্গে রসূলের উপরে কোরআনের সুরায়ে ইউসুফ নামীয় দীর্ঘ সুরাটি অবতীর্ণ হয়। উক্ত ভাষ্যটিতে আল্লাহ তাঁর নবীকে হযরত ইউসুফের পূর্ণ জীবনের বিচিত্র কাহিনীগুলিকে সংক্ষেপে অতি চমৎকার ও নিখুঁরূপে ওয়াহীর মারফতে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

কেমন করে হযরত ইউসুফের ভাইয়েরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাকে কূপে নিক্ষেপ করেছিল, কিভাবে তাঁকে বণিক কাফেলার লোকেরা তুলে নিয়ে মিশরের প্রধানমন্ত্রীর কাছে গোলাম হিসেবে বিক্রি করেছিল, তারপর মন্ত্রীর ভা*র ষড়যন্ত্রে কিভাবে তিনি কারাগারে আবদ্ধ হয়েছিলেন, পরে মিশর রাজের স্বপ্নের ব্যাখ্যা দান করে কিরূপে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সেক্রেটারী ও প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োজিত হয়েছিলেন, অবশেষে পিতা-মাতা ও ভাই-ভগ্নিসহ তাঁর সমগ্র পরিবার কেমন করে কেনান হতে মিশরে এসেছিলেন, এর পূর্ণ বিবরণ সুরায়ে ইউসুফের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। আর ওয়াহী ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে এমন নিখুঁতভাবে জানানো যে সম্ভব হত না তার কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন,

(***************)

”আর এসব কথা হল অজানা ও অজ্ঞাত ঘটনাবলী যা ( হে নবী) তোমাকে আমি ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত করাচ্ছি। অথচ ইউসুফের (আ) ভাইয়েরা যখন ষড়যন্ত্র করেছিল এবং তাদের পরিকল্পনা ঠিক করে নিয়েছিল, তখন তুমি সেখানে উপস্থিত ছিলে না।” (সুরা ইউসুফ, আয়াত-১০২)

(গ) হযরত ঈসার (আ) জননী হযরত মরিয়মের মাতা হান্নাহ কর্তৃক গর্বস্থ সন্তানকে আল্লাহর রাহে বায়তুল মোকাদ্দাসের খেদমত ও দ্বীনের কাজের জন্য উৎসর্গকরণ, অতঃপর তাঁর নামকরণ ও তাঁকে বায়তুল মুকাদ্দাসের যাজকদের হাতে অর্পণ, কে তাঁর লালন-পালন করবে তা ঠিক করার উদ্দেশ্য কোরআন কলম নিক্ষেপ, আশ্চর্য ও অলৌকিক উপায়ে উক্ত কন্যার খাদ্য প্রাপ্তি, তারপর কন্যা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে হযরত জিরাঈলের (আ) তাঁকে সাক্ষাৎ দান ও সুসংবাদ প্রদান ইত্যাদি সম্পর্কীয় অজ্ঞাত কাহিনী বর্ণনা করার আল্লাহ তাঁর নবীকে লক্ষ্য করে বলেন,

(**************)

”এ হল অজ্ঞাত ঘটনাবলী, যা আমি (হে মুহাম্মদ) তোমাকে ওয়াহীর মাধ্যমে অবগত করাচ্ছি। অথচ তারা যখন (মরিয়মের লালন-পালনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য) ভাগ্য নির্ণয়ে কাঠি নিক্ষেপ করেছিল এবং পরস্পর তর্কে লিপ্ত ছিল, তখন তুমি সেখোনে উপস্থিত ছিলে না।” (সুরা আল-ইমরান, আয়াত-৪৪)

(ঘ) রসূলের (স) জন্মের প্রায় এক হাজার আটশত বছর আগে ফেরাউনের স্ত্রী কর্তৃক তাকে উত্তোলন ও রাজ পরিবারে ব্যবস্থাপনায় তার লালন পালন, যৌবনে পদার্পণের পর একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর ফাঁসির সিদ্ধান্ত, ভীত সন্ত্রস্ত মূসার (আ) দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মাদায়েনে পলায়ন, সেখানে হযরত সোয়াইবের কন্যান পানি গ্রহণ এবং দশ বছরকাল অবস্থান। অতঃপর পরিবার-পরিজনসহ মিশরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা, পথিমধ্যে সিনাই পর্বতের পবিত্র উপত্যকায় নবূয়ত ও ওয়াহী প্রাপ্তি, অবশেষে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে ফেরাউনের দরবারে উপস্থিত ও দাওয়াত পেশ, ফেরাউন ও তার জাতির সাথে দীর্ঘ দ্বন্ধ ও বিভিন্ন মোযেযা প্রদর্শন, অকৃতকার্য হয়ে কয়েক লক্ষ্য ইসরাইলীদের নিয়ে আল্লাহর আদেশে মিশর ত্যাগ ও ফিলিস্তিনের দিকে রওয়ানা, ফেরাউন ও তার ফওযের পশ্চাদনুসরণ, অতঃপর আল্লাহর অনুগ্রহ হযরত মূসা ও বনি ইসরাইলদের লোহিত সাগর অতিক্রম। ফেরাউনের ও তার লোক-লস্করের সলিল সমাধি, অতঃপর বিস্তীর্ণ সিনাই প্রান্তরে ইসরাইলদের দীর্ঘ চল্লিশ বছর যাযাবর জীবন যাপন এবং সেখানকার বহু বিচিত্র ঘটনাবলীর একটি সংক্ষিপ্ত অথচ অত্যন্ত চমৎকার বর্ণনা দান করার পরে আল্লাহ তার নবীকে লক্ষ্য করে বলেন,

(*************)

”সিনাই (তুর) পর্বতের পশ্চিম প্রান্তে মুসাকে (আ) যখন আমি আমার নির্দেশনাবলী দিয়েছিলাম, তখন তুমি সেখানে উপস্থিত ছিলে না। আর প্রকৃত ব্যাপার হল এই যে, জগতে আমি বহু জাতি সৃষ্টি করেছিলাম, যাদের সৃষ্টির পরে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। আর তুমি (হে মুহাম্মদ (স) তৎকালে মাদায়েন নগরের অধিবাসীদের সাথেও বসবাস করতেন না যে, আমার (সেই সময় সংঘটিত) নিদর্শনাবলীর কথা তাদেরকে বলবে। বরং আমি রসূল প্রেরণ করে থাকি (যাদের কাছে অতীত ঘটনা ওয়াহীর মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়)। আর যখন আমি মুসাকে তুর পাহাড়ের পাদদেশে আহবান করেছিলাম, তখন তুমি সেখানে উপস্থিত ছিলে না। বরং ইহা হল তোমার প্রভুর পক্ষ হতে রহমত (ওয়াহী) যাতে করে তুমি এমন একটি জাতিকে ভীতি প্রদর্শন করতে পার যাদের কাছে ইতিপূর্বে কোন ভীতি প্রদর্শনকারী (পয়গম্বর) আসেনি। আর এইভাবেই হয়ত তারা উপদেশ গ্রহণ করবে।” (সুরা কাসাস, আয়াত-৪৪-৪৬)

(ঞ) অনুরূপভাবে পবিত্র কোরআনের সুরা ত্বহায় মহাজ্ঞানী আল্লাহ হযরত মুসার (আ) জন্ম ও লালন-পালন থেকে আরম্ভ করে তার যৌবন প্রাপ্তি, মাদায়েনে পলায়ন, নবুয়ত প্রাপ্তি, হারুন (আ) সহ মিশর রাজ ফেরাউনের কাছে দাওয়াতত পেশ, বিভিন্ন মোজেজা প্রদর্শন ও ফেরাউনের সাথে দীর্ঘ দ্বন্ধ। অতঃপর ফিলিস্তিনের দিকে হিজরত। আল্লাহ তায়ালার অলৌকিক মহিমায় কয়েক লক্ষ লোকসহ লোহিত সাগর অতিক্রম। অতঃপর মুসার তুর পাহাড়ে গমন এবং খোনে শরীয়িত প্রাপ্তি ইত্যাতি ঘটনা বর্ণনা করার পরে আল্লাহ তাঁ প্রিয় নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

(*************)

”এভাবেই আমি আপনার কাছে অতীত ঘটনাবলী বর্ণনা করছি। আর অবশ্যই আমি আপনাকে নিজের নিকট হতে একটি উপদেশনামা দিয়েছি।” (সুরা তাহা আয়াত-৯৯)

সুতরাং একথা একন জোর করে বলা জলে যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের এসব ঘটনাবলী সেই মহান সত্তাই বর্ণা করেছেন, যিনি ইতিহাস সৃষ্টি পূর্ওে ছিলেন, এখনও আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। কারণ কোরআন তাঁরই শ্বাশতবাণী আর তিনিই উক্ত ঘটনাবলী নবীর কাছে ওয়াহী মারফত বর্ণনা করেছেন।


চার: ভবিষ্যত ঘটনাবলী সম্পর্কে সংবাদ দান
কোরআন শরীফে এমন বহু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা সংঘটিত হওয়ার বহু পূর্বেই আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে রসূলকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। নিম্নে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হচ্ছে,

(ক) ভবিষ্যদ্বানী সম্পর্কীয় ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বর্ণনা আমরা দেখতে পাই পবিত্র কোরআনের সুরায়ে রোমের প্রথমে। রসুলেন হিজরতের প্রায় সাত বছর আগে মক্কা শরীফে এ সুরাটি অবতীর্ণ হয়। সুরার প্রথমে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে, তা হল রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস কর্তৃক পারস্য সম্রাট খসরুকে পরাজিত করার ভবিষ্যদ্বানী। ঘটনাটি ঘটার প্রায় নয় বছর পূর্বে আল্লাহর রবী ওয়াহীর মাধ্যমে এ খবর শুনিয়ে দিয়েছিলেন। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:

ইসলামের অভ্যত্থানের সামান্য আগে সারা পৃথিবীতে দুটি রাষ্ট্রই ছিল বৃহৎ ও শক্তিশালী। আর এদের সীমানওি ছিল পরস্পর সন্নিহিত। এর একটি হল পারস্য সাম্রাজ্য এবং অপরটি হল রোম সাম্রাজ্য। দুনিয়ার অপরাপর ছোট-খাট রাষ্ট্র ছিল এদের প্রভাবাধীন। এ দুটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের ভিতরে প্রায়ই যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে থাকতো। ৬১৫ খৃষ্টাব্দে রসূলের (স) হিজরতের সাত বছর পূর্বে পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় খসরুর সেনাবাহিনীর হাতে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বাহিনী ভীষণভাবে পরাজিত হয়। পারসিয়ানরা জেরুজালেমস্থ রোমদের পবিত্র স্থানগুলো ধ্বংস করে দিয়ে খৃস্টানদের পবিত্র ক্রুশ নিয়ে যায়। এ যুদ্ধে সম্রাট তার গোটা এশিয়ান এলাকাই হারিয়ে কনস্ট্যান্টিনোপলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আর এ সংঘর্ষে রোমক শক্তি এমনভাবে পর‌্যুদস্ত হয়েছিল যে, দুর ভবিষ্যতেও তার পুনরুত্থানের কোন সম্ভাবনাই পরিলক্ষিত হচ্ছিল না।

পারস্য সম্রাটের এ বিজয়ের খবর যখন মক্কায় পৌঁছে তখন ছিল নবুয়তের পঞ্চম বর্ষ। পারসিয়ানরা পৌত্তলিক হওয়ার কারণে এ বিজয়ের সংবাদে মক্কার পৌত্তলিকেরাও বিশেষভাবে উৎফুল্ল হয়েছিল এবং মুসলমানদের এ বরে তারা বিদ্রুপ করছিল যে, যেভাবে আহলে কিতাব খৃস্টানরাজ রোম সম্রাট পৌত্তলিক পারসিয়ান সম্রাটের হাতে পর্যুদস্ত ও পরাভূত হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতে কিতাবধারী মুহম্মদ (স) এবং তাঁর অনুসারীরাও পৌত্তলিক কোরায়েশদের হাতে পর্যুদস্তু হবে। মোট কথা উক্ত ঘটনাকে মুশরিকগণ মুসলামানদের বিরুদ্ধে তাদের বিজয়ের একটি শুভ ইঙ্গিত বলে দাবী করছিল।

আর প্রকৃত ব্যাপার ছিল এই যে, এই যুদ্ধের সূচনা হতেই পৌত্তলিক কোরায়েশদের মানসিক সমর্থন ছিল পারসিয়ানদের পক্ষে। আর রোমকরা আহলে কিতাব হওয়ার কারণে মুসলমানদের সমর্থন ছিল রোমকেদের পক্ষে। অতঃপর পারসিয়ানদের বিজয় সংবাদে মক্কার পৌত্তলিকরা যখন বিজয়োৎসব করছিল, তখন রোমকদের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করে আল্লাহ তার নবীর উপরে নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন,

(**************)

”রোমানরা আরবদের নিকটবর্তী ভূ-খন্ডে পরাজয়বরণ করেছে। অতঃপর তারা দশ বছরেরও কম সময়ের ভিতরে বিজয় লাভ করবে। প্রকৃতপক্ষে প্রথমাবস্থায়ও (পরাজয়কালে) যেমন চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী তিনিই। আর সেদিন (রোমকদের বিজয়কালে) মুসলমানেরা আল্লাহ তায়ালার সাহয্যপ্রাপ্ত হয়ে আনন্দোৎসব করবে।” (সুরা রুম আয়াত ১-৫)

আল্লাহ তায়ালাম উপরোক্ত ভবিষ্যদ্বানী রসূল (স) যখন পাঠ করে শুনালেন, তখন মক্কার মুশরিকেরা এ নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ শুরু করে দিল। কেননা রোমান শক্তি পারসিয়ানদের হাতে এমনভাবে পর্যুদস্ত হয়েছিল যে, তাদের পক্ষে পুনরায় একটি বৃহত্তর শক্তি হিসেবে দাঁড়াবার কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছিল না।

এমনাবস্থায় এ ধরনের একটি পর্যুস্ত শক্তি মাত্র দশ বছরেরও কম সময়ের ভিতরে একটি বৃহত্তর শক্তিকে পুনর্গঠিত হয়ে বিজয়ী পারসিয়ানদেরকে পরাভূত করবে, এটাকে কল্পনা বিলাসীর কল্পনা বলেই মনে হত।

তাছাড়াও উপরোক্ত আয়াতগুলোর ভিতরে আল্লাহ ক্ষুদ্র এবং দুর্বল মুসলিম জামাতকেও অনুরূপ সময়কালেন চিতরে তাদের শক্তিশলিী দুশমনদের উপরে বিজয় লাখের সংবাদ দিয়েছিলেন আর এটা ছিল বাহ্যিক দৃষ্টিতে একেবারেই অসম্ভব।

কিন্তু সমগ্র বিশ্বকে আশ্চর্য করে পরাজয়ের মাত্র নয় বছর পর ৬২৪ খৃষ্টাব্ধে পুনর্গঠিত রোমান শক্তি পারসিয়ানদের কাছ থেকে শুধু তাদের এশিয়ার হারানো এলাকাই উদ্ধার করল না বরং মূল পারস্য ভূ খন্ডে পারস্য বাহিনীকে চরম পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করল। আর ওই সময়ই বদরের ময়দানে ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী কর্তৃক কোরায়েশদের বিরাট সম্পূর্ন পর্যুদস্ত হল। ফলে কোরআনের ভবিষ্যদ্বানী অক্ষরে অক্ষরে ফলতে দেখে যেমন মুসলমানরা আনন্দিত হয়েছিল, তেমনি মুশরিকরাও ক্ষোভে ও দুঃখে যথেষ্ট মর্মাহত হয়েছিল, তেমনি মুশরিকরাও ক্ষোভে ও দুঃখে যথেষ্ট মর্মাহত হয়েছিল।

কোরআন মহান আল্লাহর কালাম বলেই তার পক্ষেই এই ধরনের নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব ছিল। কেননা আল্লাহর কাছে অতীত ও ভবিষ্যৎ বর্তমানের ন্যায়।

(খ) অনুরূপ ভবিষ্যৎবাণী সম্পর্কীয় আর একটি ঘটনা আমরা দেখতে পাই সুরায়ে হাশরে। হিজরী পঞ্চম বচরে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মুশরিকদের সম্মিলিত বিরাহ বাহিনী মদীনায় চড়াও হয়ে চতুর্দিক হতে মদীনাকে অবরোধ করে ফেলল। মদীনার ইহুদীদের সাথে মুসলমানদের এই মর্মে চুক্তি ছিল যে, কোন বিদেশী শক্তি ‍যদি মদীনা আক্রমণ করে, তাহলে তারাও মুসলমানদের সাথে মিলে উক্ত শক্তির বিরুদ্ধে লড়বে। কিন্তু খন্দক যুদ্ধে যখন মুশরিকরা এসে মদীনা আক্রমণ করল, তখন ইহুদীরা উক্ত চুক্তির কোর পরওয়া না করে মুশরিকদের পক্ষই অবলম্বন করল। অতঃপর যুদ্ধে যখন সুবিধা না করতে পেরে মুশরিকরা অবরোধ উঠিয়ে চলে গেল, তখন ইহুদীরা তাদের এ কৃতকর্মের জন্য প্রমোদ গুনলো। আর মুসলমানরা যে এরপর ঘরের শত্রুকে বরদাস্ত করবে না, তা তারা উপলব্ধি করে যথেষ্ট ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। ঠিক এই সময়ে মদীনার মুনাফেকরা ইহুদীদেরকে এই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল যে, মুসলমানেরা তাদেরকে যদি আক্রমন করে, তাহলে তারা তাদেরকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে, এমনকি যদি মুসলমানেরা ইহুদীদের মদীনা হতে বের করেও দেয়, তাহলে তারাও তাদের সাথে মদীনা ত্যাগ করে চলে যাবে।

মুনাফেকরা যে তাদের এ ওয়াদা পালন করবে না পূর্বাহ্নেই আল্লাহ নিম্নের আয়াত দ্বারা নবীকে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন,

(**************)

”হে রাসূল (স) আপনি কি মুনাফেকদের সম্পর্কে অবগত আছেন, যারা তাদের আহলে কিতাব কাফের ভাইদেরকে বলছে- “আল্লাহর শপথ! যতি তোমাদেরকে (মদীনা হতে) বের করে দেয়া হয়, তাহলে আমরাও তোমাদের সাথে বের হয়ে যাব এবং তোমাদের ব্যাপারে আমরা আদৌ কারও কথা শুনব না। আর যদি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করা হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা তোমাদের সাহায্য করব।” আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফেকরা (তাদের দাবীতে) একেবারেই মিথ্যাবাদী। যদি ইহুদীদের বের করে দেয়া হয়, তাহলে এরা তাদের সাথে বের হয়ে যাবে না। আর যদি তাদের সাথে যুদ্ধ হয়, তাহলে মুনাফেকরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না।” (সুরা হাশর আয়াত-১১-১২)

ইতিহাস সাক্ষী পরবর্তী পর্যায়ে যখন ইহুদীদের বিশ্বাসঘাতকতা ও চুক্তি ভঙ্গের কারণে তাদেরকে অবরোধ করা হল, তখন মুনাফেক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সঙ্গী তাদের সাহায্যের জন্য আদৌ এগিয়ে আসেনি। অতঃপর যখন মদীনার নিরাপত্তার খাতিরে ইহুদীদেরকে মদীনা হতে বের করে দেয়া হল, তখনও মুনাফেকরা তাদের সাথে বের হয়ে যায়নি। আর এভাবেই কোরআনের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছিল।

(গ) এই ধরনের আর একটি ঘটনার উল্লেখ আছে সুরা বাকারায়। নবী করিম (সাঃ) মদীনায় হিযরত করার পরে প্রায় বছরকাল বায়তুল মোকাদ্দেসকে কেবলা করে নামায আদায় করেন। অতঃপর হিজরী ‍দ্বিতীয় বর্ষে কাবা শরীফকে কেবলা করে আয়াত অবতীর্ণ হয়। কেবলা পরিবর্তনের পরে মুনাফেক, ইহুদী তথা ইসলামী বিরোধীদের ভিতরে তার কি প্রতিক্রিয়া হবে এবং তারা কি বলে প্রপাগান্ডা করবে, আল্লাহ আগে-ভাগেই তা ওয়াহীর মাধ্যমে রসূলকে জানিয়ে দিয়েছেলেন,

(*************)

“শীঘ্রই নির্বোধ লোকেরা বলবে,” যে কেবলার দিকে মুখ করে তাঁরা এতদিন নামায পড়েছে, কি কারণে তাঁরা সেটা হতে ফেরত গেল।” হে নবী, আপনি বলে দিন, পূর্ব-পশ্চিম সব দিকই আল্লাহর। তিনি যাকে ইচ্ছা সৎপথ প্রদর্শন করেন।” (সুরা বাকারা আয়াত-১৪২)

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা মুনাফেক ও ইহুদীরা কেবলা পরিবর্তনের পরে কি ধরনের প্রপাগান্ডা করবে তা পূর্বাহ্নেই নবীকে (স) জানিয়ে দেয়া হয়েছিল।

(ঘ) ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কীয় আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আমরা সুরায়ে তওবার একাদশ রুকুতে দেখতে পাই। নবম হিজরীতে নবী করীম (স) খবর পেলেন যে, রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মদীনা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং এই উদ্দেশ্যে সিরিয়া ও হেজাজ সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করছে। হুজুর (স) এ সংবাদ পাওয়া মাত্রই গোটা মুসলিম বাহিনী নিয়ে হেজাজ সীমান্তেই তাদেরকে বাধা দেয়ার জন্য রওয়ানা হলেন। আর যুদ্ধক্ষম প্রতিটি মুসলিমকেই হুকুম দিলেন যে, সকলকেই এ যুদ্ধে শরীক হতে হবে। কেউ বাড়ী থাকতে পারবে না।

মদীনায় কিছু সংখ্যক মুনাফেক ছিল, তারা যে যুদ্ধে মুসলমানদের নিশ্চিত বিজয়ের সম্ভাবনা থাকত কেবলে সেগুলিতেই শরীক হত। আর যে যুদ্ধে সম্ভাবনা থাকত না টালবাহানা করে সেগুলো হতে বিরত থাকত।

তাবুক অভিযান ছিল এমন একটি শক্তির বিরুদ্ধে যে শক্তিটি তখনকার দুণিয়ায় এক নম্বর শক্তি হিসেবে বিবেচিত হত। তাই মুনাফেকদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয় অনিবার্য। এছাড়াও তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। মরুভূমিতে প্রচন্ড বেগে লু-হাওয়া বইতেছিল। এমতাবস্থায় মদীনা হতে তাবুক পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশত মাইল পথ অতিক্রম করে এক শক্তিশালী সেরাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া তাদের কাছে ছিল সাক্ষাৎ মৃত্যুর সামিল। সুতরাং তারা নানারূপ টালবাহানা করে মদীনায়ই থেকে গেল।

অতঃপর অভিযান শেষে নবী করীম (স) যখন মদীনার দিকে রওয়ানা হলেন, তখন পথিমধ্যেই আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে একদিকে যেমন মুনাফেকদের গোপন দুরভিসন্ধির কথা হুজুরকে জানিয়ে দিলেন, অন্যদিকে তেমনি হুজুরের মদীনা প্রত্যাবর্তনের পরে তারা শাস্তির হতে বাঁচার জন্য যে, সব মিথ্যা ওজর পেশ করবে তারও আগাম সংবাদ নবীকে দিয়ে দিলেন,

(*************)

“হে রসূল, আপনারা যখন মদীনায় মুনাফেকদের কাছে ফিরে যাবেন, তখন তারা ওজর পেশ করবে। আপনি বলুন, তোমাদের ওজর পেশ করার কোন প্রয়োজন নাই। আমরা আর তোমাদের কথা বিশ্বাস করছি না। আল্লাহ (পূর্বাহ্নেই) তোমাদের বিষয় আমাদেরকে অবগত করিয়ে দিয়েছেন।” (সুরা তওবা আয়াত-৯৪)

অতঃপর আল্লাহ নবীকে আরও জানিয়ে দিচ্ছেন,

(*************)

“আপনারা যখন (মদীনায়) এদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবেন, তখন এই মুনাফেকরা আপনাদের কাছে এসে আল্লাহর নামে শপথ করবে। যেন আপনারা তাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন। আচ্ছা, আপনারা এদেরকে ছেড়ে ‍দিন, এরা এদের কৃতকর্মের ফল স্বরূপ জাহান্নাম ভোগ করবে।” (সুরা তওবা আয়াত-৯৫)

(**************)

এরা আপনাদের কাছে এ জন্যই শপথ করবে, যেন আপনারা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান। মনে রাখবেন, আপনারা এদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেও আল্লাহ এসব পাপীদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না।” (সুরা তওবা, আয়াত-৯৬)

উপরোক্ত আলোচনায় মাত্র কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করা হল, যার প্রতিটিই হুবহু সত্যে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়াও বহু ভবিষ্যদ্বাণী পবিত্র কোরআনে দেখা যায়, যা ইতিপূর্বেই বাস্তবায়িত হয়েছে।

এতদ্ব্যতীত হাশর-নাশর, পরকাল-পুনরুত্থান হিসাব-নিকাশ, বেহেশত-দোযখ ইত্যাদি সম্পর্কীয় অসংখ্য ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে যা প্রতিফলিত হওয়ার সময় এখনও আসেনি। এসব নিখুঁত ভবিষ্যদ্বানী নিশ্চয়ই এ কথা প্রমাণ করে যে, কোরআন আল্লাহর কিতাব, কেননা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ভবিষ্যতের জ্ঞান রাখে না।


পাঁচ: মানব জীবনের জন্য সূদুর প্রসারী ও মৌলিক ব্যবস্থা দান
কোরআন মানব জীবনের বিভিন্ন ‍দিক সম্পর্কে যে সমস্ত সুসামঞ্জস্য, সুপরিকল্পিতও সূদুরপ্রসারী ব্যবস্থা দান করেছে, তাও কোরআনের ঐশীগ্রন্থ হওয়ার একটি জাজ্জল্যমান প্রমাণ।

কোরআনের এসব চমৎকার বিধানবলীর প্রশংসা করতে গিয়ে প্রসিদ্ধ পাশ্চাত্য পন্ডিত স্যার ডায়মন্ডবার্স লিখেছেন,

“কোরআনের বিধানবলী শাহানশাহ থেকে আরম্ভ করে পর্ণকুটীরের অধিবাসী পর্যন্ত সকলের জন্যই সমান উপযোগী ও কল্যাণকর। দুনিয়ার জন্য কোন ব্যবস্থায় এর বিকল্প খুঁজে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব।”

ডক্টর অসওয়েল জনসন বলেন,

“কোরআনের প্রজ্ঞাপূর্ণ বিধানবলী এতই কার্যকরী এবং সর্বকালেন উপযোগী যে, সর্বযুগের দাবীই উহা পূরণ করতে সক্ষম। কর্ম-কোলাহলপূর্ণ নগরী, মুখর জনপদ, শুণ্য মরুভূমি এবং দেশ হতে দেশান্তর পর্যন্ত সব জায়গায় এ বাণী সমভাবে ধ্বনিত হতে দেখা যায়।”

গীবন বলেন,

“জীবনের প্রতিটি শাখার কার্যকরী বিধান কোরআন মওজুদ রয়েছে”

বিবাহ-তালাক সম্পর্কীয় যাবতীয় বিধান, উত্তরাধিকার সম্পর্কীয় ব্যবস্থাবলী, রাষ্ট্রীয় ও আর্থিক মূলনীতিসমূহ, যুদ্ধ-সন্ধি সম্পর্কীয় নিয়ম কানুন ইত্যাদি নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, কোরআন আল্লাহর কিতাব। কেননা যে নবীর মুখ থেকে আমরা এ কিতাব পেয়েছি তিনি ছিলেন উম্মি। সুতরাং তিনি কোন আইনের কিতাবও অধ্যয়ন করেননি, কিংবা কোন আইনজ্ঞের কাছে কোন পাঠও গ্রহণ করেননি। কাজেই নবী না হলে তাঁর পক্ষে এ ধরনের চমৎকার বিধানবলী পেশ করা সম্ভব ছিল না।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি