ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার

মৌলিক অধিকার বলতে কি বুঝায়?
মৌলিক অধিকার বলতে বুঝায় এমন সব অধিকার, যা সমাজের লোক হিসাবে জীবন যাপনের জন্যে একজন মানুষের পক্ষে একান্তই অপরিহার্য। যা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকা কিছুতেই সম্ভবপর নয়, উচিত নয়। এ অধিকারগুলো নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে, ব্যক্তির নিজের প্রাণ সংরক্ষণ, তার আযাদী এবং তার ব্যক্তিগত সম্পদ-সম্পত্তির নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে। এ অধিকারগুলো যথাযথরূপে সংরক্ষিত না হলে মানুষের মানবিক মর্যাদা অরক্ষিত ও বিপন্ন হতে বাধ্য।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এ অধিকারগুলোকে দুটো বড় বড় ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম-সাম্য ও সমতা, দ্বিতীয়-আযাদী বা স্বাধীনতা। সমতা বা সাম্য কয়েক ভাগে বিভক্ত। তাহলোঃ আইনের দৃষ্টিতে সাম্য, বিচারের ক্ষেত্রে সাম্য ও সমতা। আযাদীও এমনিভাবে কয়েক ভাগে বিভক্ত। তাহলোঃ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, মালিকানা অর্জন ও রক্ষণের স্বাধীনতা, বাসস্থান অর্জনের ও গ্রহণের স্বাধীনতা, আকীদা-বিশ্বাস ও ইবাদাত-উপাসনার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের ও শিক্ষার স্বাধীনতা।- আদ দিমোক্রতিয়াতুল ইসলামিয়া লিদ দাক্তু উসমান খলীল, ২৩ পৃষ্ঠা।

আলোচনার পদ্ধতি
ইসলামী শরীয়ত প্রদত্ত জনগণের সাধারণ অধিকারসমূহ সম্পর্কে আমরা এখানে আলোচনা করতে প্রবৃত্ত হবো। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এ অধিকারগুলোকে যেভাবে বিভক্ত করা হয়েছে, আমরা বিষয়টিকে ঠিক সেভাবে ভাগ করেই আলোচনা করতে চাই। ইসলামের ছত্র ছায়ায় এ অধিকারগুলো সাধারণ মানুষ কিভাবে এবং কতখানি উপভোগ করতে পারে, তা বিশ্লেষণ করাই হলো আমাদের এ আলোচনা লক্ষ্য। এজন্যে আমরা বিষয়টিকে মৌলিকভাবে দুপর্যায়ে ভাগ করবো। প্রথমে আমরা সাম্য ও সমতা সম্পর্কে সম্পর্কে আলোচনা করবো এবং পরে আযাদী বা স্বাধীনতা সম্পর্কে।

সাম্য ও সমতা
ইসলামী শরীয়তে সাম্যের গুরুত্বঃ ইসলামী শরীয়তে সাম্য ও সমতার গুরুত্ব বিরাট। সব মানুষ মৌলিকভাবেই সমান বলে ইসলাম ঘোষণা করেছে। ইসলাম মূলের দিক দিয়েই সব মানুষের মাঝেও অভিন্ন সাম্য কায়েম করতে বদ্ধপরিকর। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের মাঝে পার্থক্য হতে পারে কেবল নেক আমল ও কল্যাণকর কার্যক্রমের ভিত্তিতে। আল্লাহ তায়ালা একথাই ঘোষণা করেছেন কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াতেঃ

*****আরবী******

হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি পুরুষ ও স্ত্রী থেকে। আর তোমাদের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও গোত্রে বিভক্ত করেছি তোমাদের পারস্পরিক পরিচিতি লাভের জন্যে। তবে আসল কথা হলো, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশী সম্মানার্হ, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহভীরু।- সুরা হুজরাতঃ ১৩

এ আয়াত স্পষ্ট বলছে, মানুষ মৌলিকভাবেই এক, অভিন্ন ও সর্বতোভাবে সমান। মানুষ হিসাবে তাদের মাঝে কোনোই পার্থক্য নেই। আর মানুষকে যে বিভিন্ন গোত্র, গোষ্ঠী ও বংশ সম্ভূত করে সৃষ্টি করা হয়েছে, এর উদ্দেশ্য মানুষকে নানাভাবে বিভক্ত এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও নিঃসম্পর্ক করে দেয়া নয়, বরং তার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো মানুষের পারস্পরিক পরিচিতি লাভ ও পারস্পরিক গৌরব-অহংকার করা এবং নানাভাবে পার্থক্য ও ভেদাভেদের পাহাড় খাড়া করা কখনো এর উদ্দেশ্য নয়, তা করা জায়েযও নয় কারোর জন্যে। এর ভিত্তিতে কেউ কারোর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব, প্রাধান্য ও বৈশিষ্ট্যের দাবী করতে পারে না। বস্তুত ইসলামের এ মহান আদর্শ মানব সমাজ থেকে হিংসা, বিদ্বেষ ও ভেদাভেদের মূলকেই উৎপাটিত করে দিয়েছে, শেষ করে দিয়েছে সব বংশীয় ও বর্ণীয় গৌরব অহংকার। অতঃপর প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি মানুষের মাঝে পার্থক্য ও তারতম্য করার কোনো ভিত্তি নেই? পার্থক্য করার বস্তুনির্ভর কোনো ভিত্তি যে নেই তা চূড়ান্ত। ইসলাম এ পার্থক্যের একটি ভিত্তিই শুধু উপস্থাপিত করেছে এবং তা এমন, যা মানুষের নিজস্ব গুণ ও ইচ্ছা প্রণোদিত হয়ে অর্জন করতে পারে, যে কোনো মানুষ তা লাভ করতে পারে। তার পথে কোনো বংশগত বা অর্থগত-সম্পদগত মর্যাদা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

বস্তুত ইসলামী শরীয়তে সাম্য ও সমতার শিকড় অতি গভীরে নিবদ্ধ। শরীয়তে যাবতীয় বিধি-বিধান ও আইন-কানুনেই এ সাম্য পূর্ণ মাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা এখানে এ পর্যায়ের কয়েকটি দিকের উল্লেখ করছি। এর মধ্যে আইনের দৃষ্টিতে সাম্য ও বিচার-ব্যবস্থার সাম্যের দিকটি সবচেয়ে বেশী উল্লেখ্য।

 

আইনের দৃষ্টিতে মানুষের সাম্যঃ আইনের দৃষ্টিতে মানুষের সাম্য, সাম্যের এক পরম প্রকাশ। ইসলাম যে সুবিচার নীতি উপস্থাপিত করেছে এ তারই চুড়ান্ত রূপ। ইসলামে আইন সকল মানুষের প্রতিই সমানভাবে প্রযোজ্য। আইন প্রয়োগে মানুষের মানুষে মানুষে কোনোরূপ ভেদাভেদ করার নীতি ইসলামে আদৌ সমর্থিত নয়, না বংশের দিক দিয়ে না বর্ণ, ভাষা ও সম্পদ পরিমাণের ভিত্তিতে। এমনকি আকীদা, বিশ্বাস, আত্মীয়তা, নৈকট্য, বন্ধুত্ব ইত্যাদির কারণেও আইন প্রয়োগে মানুষের মাঝে কোনোরূপ পার্থক্য করা চলবে না। হাদীসে নবী করীম স.-এর এ ঘোষণাটি এক বিপ্লবী ঘোষণা হিসাবেই উদ্ধৃত হয়েছেঃ

******আরবী*******

তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো ধ্বংস হয়েছে কেবল এ বিভেদ নীতির ফলে যে, তাদের সমাজের ভদ্রলোকেরা যখন চুরি করতো, তখন তাদের কোনো শাস্তি দেয়া হতো না। পক্ষান্তরে তাদের মাঝে দুর্বল লোকেরা যখন চুরি করতো, তখন তারা তাদের ওপর কঠোর অনুশাসনই চাপিয়ে দিতো। আল্লাহর শপথ, মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করে, তাহলে তার হাতও কেটে দেয়া হবে।- তাফসীরুল উসূল, ২য় খণ্ড, ১৪ পৃষ্ঠা।

আইনের দৃষ্টিতে সাম্যের গুরুত্বঃ বস্তুত জনসম্পদে এরূপ নির্বিশেষে সমতা বিধানের ফলেই রাষ্ট্রের জনগণ সন্তোষ এবং নিশ্চিন্ততা লাভ করতে পারে। তারা কার্যত দেখতে পায় যে, এখানে কারোর প্রতিই কোনোরূপ অবিচার বা যুলুম করা হয় না, করা হয় না কারোর প্রতি এক বিন্দু পক্ষপাতিত্ব, এখানে নির্বিশেষে সকলেরই অধিকার পূর্ণ মাত্রায় সংরক্ষিত হয়। তখন তারা রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য পোষণ করে। এ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্যে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করতে কুণ্ঠিত হয় না।

কিন্তু এ সাম্য যদি কখনোও লঙ্ঘিত হয় আর আইন যদি কেবল দুর্বলদের ওপরই কার্যকর হতে থাকে, তখন জনগণ এ রাষ্ট্র সম্পর্কে চরম নৈরাশ্য পোষণ করতে শুরু করে। রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি তাদের মনে থাকে না কোনোরূপ আন্তরিকতা। তখন তারা এর স্থিতি ও প্রতিরক্ষার জন্যে কোনোরূপ ত্যাগ

স্বীকার করতে ও প্রস্তুত হয়না। আর এর ফলেই জনগণের উপর যুলুম হতে শুরু হয়। এখানে কেবল শক্তিশালীদেরই কর্তৃত্ব চলে। শক্তিই হয় চুড়ান্ত ফয়সালাকারী, আইন নয়। জোর যার মুল্লুক তার এ-ই হয় এখানকার অবস্থা সম্পর্ক সঠিক কথা। আর কোন রাষ্ট্র যখন এ অবস্থায় পৌঁছে যায়, তখন স্থায়িত্ব অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এজন্য আরবী ভাষায় এ কথাটি প্রচলিত হয়েছে:

*****আরবী******

সুবিচারকারী রাষ্ট্র কাফের হলেও টিকে থাকে আর যালেম রাষ্ট্র মুসলিম হলেও টিকে থাকেনা।

একটি দৃষ্টান্তঃ খলীফায়ে রাশেদ হযরত উমর ফারুক রা: এর খেলাফতের আমলে মিসরের শাসনকর্তা হযরত আমর এবনুল আছ রা: একজন কিবতী নাগরিককে অকারনে চপেটাঘাত করেছিলেন। কিবতি হযরত উমর রা: এর কাছে অভিযোগ করলো। পরে ইবনে আমর যখন খলীফার দরবারে হাযির হলেন, তখন তিনি কিবতিকে হাযির করে জিজ্ঞেস করলেন: তোমাকে এই লোক মেরে ছিলো? কিবতি বললো হ্যাঁ, এ লোকই আমাকে অকারনে চপেটাঘাত করেছিলো। খলীফা বললেন: তাহলে তুমিও ওকে মারো। এ আদেশ পেয়ে ইবনে আমরকে মারতে শুরু করলো। পরে খলীফা ওমর রা: আমর ইবনুল আসকে লক্ষ্য করে বলেন:

*****আরবী******

হে আমর! কবে থেকে তুমি লোকদের গোলাম বানাতে শুরু করলে। অথচ তাদের মায়েরাতো তাদের স্বাধীন রূপেই প্রসব করেছিল?

বিচারের ক্ষেত্রে সাম্য: ইসলামী রাষ্ট্রে দেশের সকল নাগরিকই বিচারের ক্ষেত্রে সমান ব্যবহার পাওয়ার অধিকারী। সে খানে যে কোন লোকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা যায় এবং আদালত যেকোন লোককে বিচারের সম্মুখীন হতে বাধ্য করতে পারে। বিচারালয়ে কোন রূপ বাদী বিবাদীর মাঝে কোনরূপ পার্থক্য করা চলেনা। এমনকি কোন শত্রু ও যদি আদালতের সামনে ফরিয়াদি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সে ঠিক তেমনি আচরণই পাবে যেমন আচরণ পাবে একজন মিত্র বা স্বদেশের নাগরিক। একথাই আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন কুরআন মাজীদের নিম্নক্ত আয়াতে: হে, ঈমানদারগণ! আল্লাহর ওয়াস্তে সত্য নীতির উপর স্থায়ীভাবে দণ্ডায়মান ও ইনসাফের সাক্ষ্য দাতা হও। কোন বিশেষ দলের শত্রুতা তোমাদেরকে যেন এতদূর উত্তেজিত করে না দেয় যে, (তার ফলে) ইনসাফ ত্যাগ করে ফেলবে। ন্যায় বিচার করো। বস্তুত আল্লাহর পরস্তির সাথে এর গভীর সামঞ্জস্য রয়েছে। আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাক। সুরা আল মায়েদা: ৮

তিনি আরো স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন এ ভাষায়:

*****আরবী******

তোমরা যখন লোকদের মাঝে বিচার কার্য করবে, তখন অবশ্যই সুবিচার করবে। সুরা আন নিসা: ৫৮

বস্তুত আইনের দৃষ্টিতে সাম্য ও বিচারের ক্ষেত্রে সাম্য—এ দুটোই ইসলামী শাসন ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। খলীফা হযরত উমর রা: গভর্নর হযরত আবু মুসা আশয়ারীকে লিখেছেন:

*****আরবী******

তোমরা বৈঠকে, চেহারা ও বিচারে পূর্ণ সাম্য রক্ষা করবে লোকদের মাঝে, যেন কেউ তোমার দোষ ধরতে না পারে এবং দুর্বল লোকেরা যেন তোমার সুবিচার থেকে নিরাশ হয়ে না যায়। এনামুল মুয়াওবেকিন, ১ম খন্ড, ৭২ পৃষ্ঠা।

বস্তুত ইসলামের এ সাম্যনীতি এতই উন্নত যে, আধুনিক কালে কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থাও এর সমান হওয়া দাবি করতে পারেনা।

ব্যক্তি স্বাধীনতা
ব্যক্তি স্বাধীনতার সংজ্ঞা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে বুঝায়, রাষ্ট্রর নাগরিকদের স্বাধীন, অবাধ চলাফেরা ও যাতায়াতের অধিকার, শত্রুতা শত্রুতা থেকে আত্মরক্ষা করার অধিকার; এ অধিকার যে তার মালিকানাধীন সম্পদ ও সম্পত্তি অকারনে কেউ হরণ করে নেবে না কেউ তার উপর অকারণে অত্যাচার যুলুম করবে না। কেউ তাকে বিনা অপরাধে আটক করবে না দেশের বৈধ আইন মোতাবেকই সে জীবন যাপন করতে পারবে এবং তার সাথে আইন –সম্মত ভাবেই আচরণ করা হবে সে নিজের ইচ্ছায় দেশের বাইরে ও যেতে পারবে, আবার সময় মতো নিজের ঘরে ও আসতে পারবে।

শরীয়তে ব্যক্তি স্বাধীনতা: বস্তুত ইসলামী শরীয়তে এ অর্থে ব্যক্তিগত অধিকার পুরোমাত্রায় স্বীকৃত। বরং ইসলামী রাষ্ট্রে কার্যত ব্যক্তিদেরকে এর চেয়ে ও প্রশস্ততর অধিকার দেয়া হয়েছে। জনগণের উপর কোনোরূপ বাড়াবাড়ি করা যুলুম। আর যুলুম ইসলামে চিরদিনের তরে হারাম। এখানে রাষ্ট্র ব্যক্তির যাবতীয় অধিকার রক্ষার জন্য দায়িত্বশীল। ব্যক্তি জীবন, দেহ ইজ্জত আব্রু ও সম্পদ –সম্পত্তি সংরক্ষিত রাখার জন্যে রাষ্ট্র সতত তৎপর হয়ে থাকবে। ইসলামী শরীয়ত একথাই ঘোষণা করছে স্পষ্ট ভাষায়। এ জন্য যুলুমকারীকে শাস্তি ও দন্ড দিতে রাষ্ট্র একান্ত ভাবে বাধ্য। শরীয়তে এ শাস্তির ব্যবস্থা ও রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যক্তিকে কোনোরূপ শাস্তি ভোগের সম্মুখীন হতে হয় তখন যখন শরীয়তের আইনের প্রকাশ্য বিচারে তার অপরাধ সপ্রমানিত হবে এবং শাস্তি ঠিক ততটুকু দেয়া হবে যতটুকু শাস্তি তার অপরাধের জন্য শরীয়তে বিধিবদ্ধ রয়েছে। এখানে একজনের অপরাধের জন্য অন্য জনকে শাস্তি ভোগ করত হয় না। যার অপরাধ তাকেই শাস্তি ভোগ করতে হবে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে:

*****আরবী******

একজনের বোঝা অপরজন কখনো বহন করবেনা। সুরা বনী ইসরাইল: ১৫

নিজের ঘরের বাইরে, নিজ দেশের যেখানে সেখানে এবং দেশের বাইরে ভিন্ন দেশে যাতায়াত করার অধিকার ও প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত। শুধু তাই নয়, শরীয়তে এজন্য রীতিমত উৎসাহ প্রধান করা হয়েছে। কুরআন মজীদে প্রশ্ন তোলা হয়েছেঃ

*****আরবী******

লোকেরা কি যমীনের যত্রতত্র ঘুরে বেড়াবে না এবং তাদের পূর্ববর্তী লোকদের কি পরিণতি হয়েছে তা স্বচক্ষে দেখবে না?—সুরা ইউসূফঃ১০৯

ব্যবসায়ের জন্য বিদেশে ভ্রমণ করার ও নির্দেশ রয়েছে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ

*****আরবী******

তোমরা যমীনের পরতে পরতে চলাফেরা কর এবং তার ফলে উপার্জিত রিযিক আহার করো। শেষ পর্যন্ত তারই কাছে ফিরে যেতে হবে তোমাদের সকলকে। সূরা আল মূলকঃ১৫

অবশ্য কোন কারণে কো ব্যক্তিকে যদি বাইরে যেতে না দেয়াই আইনসম্মত বিবেচিত হয়, তাহলে সে লোকের যাতায়াতের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার অধিকার রাষ্ট্রর রয়েছে। হযরত উমর ফারুক রা: তার খেলাফত আমলে বড় বড় সাহাবীদের মদীনার বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলেন, যেন রাষ্ট্রীয় জটিল ব্যাপারে সময় মতো তাদের সাথে পরামর্শ করা যায়। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের কারণে যখন এ নিয়ন্ত্রণ আরোপ সংগত, তখন জাতীয় কল্যাণের দৃষ্টিতে ও তা অবশ্যই সংগত হবে।

ব্যক্তির ইজ্জত-আব্রু রক্ষা করা সরকারি দায়িত্ব
ব্যক্তি জীবন, দেহ ও সম্পত্তি রক্ষা করাই রাষ্ট্রর একমাত্র দায়িত্ব নয়। সেই সাথে ইজ্জত আব্রু রক্ষা করা এবং তা কারোর দ্বারা ক্ষুণ্ণ হলে তার প্রতি বিধান করা ও সরকারের দায়িত্ব। রাষ্ট্র সরকার নিজে কাউকে অকারনে অপমান করবেনা। কেননা মুসলিম মাত্রই সম্মানিত, তার সম্মান চির সংরক্ষিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ ইজ্জত সম্মান সবই আল্লাহ, রাসূল এবং সকল মু’মিনদের জন্য’ অতএব কেউ লজ্জিত বা অপমানিত হোক তা ইসলামী রাষ্ট্র কিছুতেই বরদাশত করতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ ইসলামের রিসালাত উত্তরকালীন দায়িত্ব পালন করতে পারে কেবল মাত্র স্বাধীন সম্মানিত ও মর্যাদাবান মুসলমান। এজন্যে ইসলামী রাষ্ট্র জনগনকে ইজ্জত সম্মান ও মর্যাদার তাৎপর্য শিক্ষা দিতে চেষ্টা করবে এবং এ যে সব কাজে তা ব্যবহৃত ও ক্ষুণ্ণ হয় তার প্রতিরোধ করতে সর্ব শক্তি নিয়োগ করবে। হযরত ওমর ফারুক রা: তার শাসন কর্তাদের বলেছিলেনঃ

*****আরবী******

তোমরা মুসলিম জনগণকে অন্যায় ভাবে প্রহার করবে না, কেননা তাহলে তোমরা তাদেরকে অপমান করলে। ”

এ জন্য তিনি হজ্জের সময় সমবেত জনতার সামনে তাদের হাজির করতেন এবং লোকদের সামনে ভাষণ দিয়ে ঘোষণা করতেনঃ

*****আরবী******

“ হে জনতা আমি আমার শাসকবর্গকে তোমাদের উপর নিয়োগ করেছি এ জন্যে যে, তারা তোমাদের জানমাল ও ইজ্জতের উপর হস্তক্ষেপ করবে। বরং তাদের নিয়োগ করেছি এ উদ্দেশ্য যে, তারা তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ইনসাফ কায়েম করবে, সরকারি ভাণ্ডার থেকে জাতীয় প্রয়োজনমত তোমাদের মাঝে বণ্টন করবে। এদের কেউ যদি এর বিপরীত কিছু করে থাকে তাহলে এ জনসমাবেশে তার বিরুদ্ধে আমার সামনে দাঁড়িয়ে ফরিয়াদ করো। তাবকাতে ইবনে সায়াদ, ৩য় খন্ড ২৯৩ পৃষ্ঠা।

অমুসলিম ব্যক্তিস্বাধীনতা
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলমান নাগরিকদের জন্যেও র্পূণমাত্রায় ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষিত থাকে। এ পর্যায় ইসলামী আইনবিদরা যে ফরমুলা ঠিক করেছেন তাহলোঃ

*****আরবী******

আমাদের জন্যে যেসব অধিকার ও সুযোগ সুবিধা তাদের জন্যে ও তাই এবং আমাদের উপর যেসব দায়িত্ব তাদের উপর ও তাই।

হযরত আলী রা: বলেন

*****আরবী******

অমুসলমান নাগরিকরা জিযিয়া কর আদায় করে এ উদ্দেশ্য যে তাদের ধন সম্পদ জান প্রাণ, মুসলিম নাগরিকদের মতই সংরক্ষিত হবে। আল মগনী ৮ম খন্ড ৪৪৫ পৃষ্ঠা.

বস্তুত ইসলামী শরীয়াত ভিত্তিক রাষ্ট্র অমুসলিমরা যে বিরাট অধিকারও সর্ববিদ যে সুযোগ সুবিধা লাভ করেছে, দুনিয়ার অপর কোনো আদর্শিক রাষ্ট্রও তার কোন তুলনা নাই। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্র বিরোধী মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় কি?সে খানে সুযোগ সুবিধা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা তো দুরের কথা, সমাজতন্ত্র বিরোধী কোনো আদর্শে বিশ্বাসী মানুষের বেঁচে থাকার ও কোনো অধিকার নেই। অথচ ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিক শুধু বেঁচেই থাকেনা, বেঁছে থাকে সবর্বিধ অধিকার ও লাভ করে। অমুসলিম নাগরিকদের জন্যে স্বয়ং আল্লাহ এবং তার রাসূলই নিরাপত্তার জিম্মাদার।

নবী করিম সঃ ঘোষণা করেছেনঃ

*****আরবী******

যে লোক ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিককে কোনোরূপ কষ্ট দেবে, আমি নিজেই তার বিপক্ষে দাঁড়াবো এবং আমি যার বিরুদ্ধে দাঁড়াবো কিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে আমি মামলা দায়ের করবো।

আল জামেউল সাগীর লিস সুয়ুতী, ২য় খন্ড ৪৭৩ পৃষ্ঠা

অমুসলিম নাগরিকদের সম্পর্কে নবী করিম স: যেসব অসিয়ত করেছেন তার ভিত্তিতে ইসলামী আইন পারদর্শীগণ স্পষ্ট করে বলেছেন যে, অমুসলিম নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান ওয়াজিব এবং এদের কোনরূপ কষ্ট দেয়া সম্পূর্ণ হারাম। ফকীহ কারাফী বলেছেনঃ অমুসলিম নাগরিককে যদি কেউ কষ্ট দেয়, একটি খারাপ কথাও বলে, তাদের অসাক্ষাতে তাদের ইজ্জতের উপর এক বিন্দু আক্রমণ ও কেউ করে কিংবা তাদের সাথে শত্রুতার ইন্ধন যোগায় তাহলে সে আল্লাহ এবং তার রাসুলের এবং দীন ইসলামের দায়িত্বকে লঙ্ঘন করলো।

আল্লামা ইবনে হাজার বলেছেনঃ এ ব্যাপারে ইসলামী আইনবিদদের ইজমা হয়ে গেছে যে, ইসলামী রাষ্ট্রের নিয়মিত অমুসলিম নাগরিকদেরকে হত্যা করার জন্যে যদি কোন বৈদেশিক শত্রু এগিয়ে আসে, তাহলে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো তার বিরুদ্ধে লড়াই করে তাকে হত্যা করা। আল ফারুক লিকিরাকি, ৩য় খন্ড, ১৪ পৃষ্ঠা।

আকীদা ও ইবাদতের স্বাধীনতা
ইসলাম কোনো লোককে ইসলামী আকীদা গ্রহনের জন্যে বলপূর্বক বাধ্য করে না। ইসলাম ধর্মমত গ্রহনে এবং পূজা উপাসনা ও আরাধনা করার ব্যাপারে কোনো জোর জবরদস্তি নেই। একথা কুরআন মজীদে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে। এভাবেঃ লা ইকারা ফিদ্ দীন—দীন গ্রহন করানোর ব্যাপারে কোনো জোর জবরদস্তি করা চলবে না অন্য কথায় ইসলাম নিজে এ ব্যাপারে কোনোরূপ বল প্রয়োগ করতে প্রস্তুত নয়, বলপ্রয়োগ করাকে সমর্থন ও করে না ইসলাম ধর্ম প্রচারে বল প্রয়োগ নয়, শান্তি ও শৃঙ্খলা সহকারে প্রচারের মাধ্যমে মানুষের মন ও চিন্তার পরিবর্তন সাধনে বিশ্বাসী। এজন্যে ইসলাম দাওয়াতি কাজের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। কুরআন মজীদে এরশাদ করা হয়েছেঃ

*****আরবী******

তোমরা তোমাদের আল্লাহর দিকে লোকদের দাওয়াত দাও। যুক্তিপূর্ণ কথাবার্তা ও উত্তম ওয়াজ নছিহতের মাধ্যমে এবং বিরোধীদের সাথে উত্তম পন্থায় মুকাবিলা করো। সূরা আন নাহলঃ১২৫

ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর ধর্মের ব্যাপারে জোর-জবরদস্তি করা সম্পর্কে কুরআন মাজীদে বলা হয়েছেঃ

*****আরবী******

দীন বা ধর্মের ব্যাপারে কোনোরূপ জোর-জবরদস্তি করা যেতে পারে না।কেননা প্রকৃত হেদায়াতের পথ ও আদর্শ কোন্‌টি এবং কোন্‌টি পথভ্রষ্টতা তা স্পষ্ট হয়ে গেছে।–সূরা আল বাকারাঃ ২৫৬

এ পর্যায়ে শরীয়তের নির্দিষ্ট ফর্মূলা হলোঃ

*****আরবী******

তাদের এবং তারা যা কিছু পালন করে তা ছেড়ে দিলাম।

অতএব অমুসলিমদের ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস ও ইবাদাত-উপাসনার ব্যাপারে ইসলামী রাষ্ট্রের কিছুই করনীয় নেই।নবী করীম স. নাজরানবাসীদের সাথে সন্ধিচুক্তি করেছিলেন, তাতে লিখেছিলেনঃ

*****আরবী******

নাজরানবাসীরা এবং তাদের সঙ্গী-সাথীরা আল্লাহ ও তাঁর রসূল মুহাম্মদ স. এর নিরাপত্তা লাভ করবে, তাদের ধন-সম্পদে তাদের গীর্জা ও উপাসনাগারে এবং আর যা কিছু তাদের রয়েছে সে ব্যাপারে।– কিতাবুল খারাজ, আবু ইউসুফ, ৯১ পৃষ্ঠা।

এরপর ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন হওয়া সত্ত্বেও খৃষ্টান ও অন্যান্য বিধর্মীরা তাদের ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেছে।তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বা মুসলিম জনগণের পক্ষ থেকে কোনোরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।কোনো অপকারিতাই তাদের স্পর্শ করেনি এবং তারা পূর্ণ স্বাধীনতা সহকারে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করতে পেরেছে।

বস্তুত ব্যক্তির আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ইসলামী আইনে যতখানি আযাদী ভোগ করার সুযোগ রয়েছে, তত সুযোগ দুনিয়ার অন্য কোনো আইনে স্বীকৃত হয়নি।ইমাম শাফেয়ী র. বলেছেন, স্বামী-স্ত্রী একজন যদি মুসলিম এবং অপরজন খৃষ্টান হয়, তাহলে ইসলামী শরীয়ত তাতে কোনো বাদ সাধবে না।কেননা তা যদি করা হয়, তাহলে ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়।অথচ কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা হলো, অমুসলিমের ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় ব্যাপারে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ বা জোর-জবরদস্তি করা হবে না। -শারহুল কানজ, ২য় খণ্ড, ১৭৪ পৃষ্ঠা।

তবে এ পর্যায়ে মুরতাদকে শাস্তিদানের ইসলামী ব্যবস্থা নিয়ে কোনোরূপ ভুল ধারণার সৃস্টি হওয়া উচিত নয়।কেনা, সেটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যাপার।একজন মুসলিম নাগরিক যদি মুসলিম থাকার পর ইসলামী রাষ্ট্রে ইসলাম ত্যাগ করে ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করে তাহলে তাকে মুরতাদ বলা হয়।ইসলামী রাষ্ট্রে তাকে কঠোর শাস্তি দেবে।কেনান, সে যখন নিজেকে একবার মুসলিম বলে ঘোষণা দিয়েছে, তখন তাকে মুসলিম হয়েই ইসলামী রাষ্ট্রে বাস করতে হবে।যদি সে তা না করে তাহলে সে ইসলামী রাষ্ট্রেরই ক্ষতি সাধন করে।আর দুনিয়ার কোনো রাষ্ট্রেই কোনো নাগরিকের রাষ্ট্রের এরূফ ক্ষতি বরদাশত করতে প্রস্তুত হতে পারে না বরং এটা অতীব যু্ক্তিসংগত কথা।

বাসস্থানের স্বাধীনতা
ইসলামী রাষ্ট্রে প্রত্যেকটি নাগরিকই তার বাসস্থানের স্থান গ্রহনের ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে। তার অনুমতি ও সন্তোষ ছাড়া কেউই তার ঘরে প্রবেশ করার অধিকার পেতে পারে না। কেন না বসবাসের স্থান হলো ব্যক্তির নিজস্ব গোপন এলাকা। এখানে তার সাথে স্ত্রী ও পরিবারবর্গ বাস করে। কাজেই এখানে যদি কেউ অপরের কারো ঘরে ও বসবাসের স্থানে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে, তাহলে তা হবে তার অনধিকার চর্চা। আর ইসলামী রাষ্ট্রে কাউকে কারোর উপর অনধিকার চর্চার অধিকার দেওয়া যেতে পারে না। কুরআন মজীদে এজন্যে স্পষ্ট নিষেধ বাণী উচ্চারিত হয়েছে ওজস্বিনী ভাষায়ঃ

*****আরবী******

“ হে ঈমানদার লোকেরা ! তোমরা অপর লোকদের ঘরে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না সে ঘরের লোকদের কাছ থেকে অনুমতি পাবে ও তাদের প্রতি সালাম করবে। তোমরা যদি বুঝতে পারো তবে এ নীতিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তোমরা সে ঘরে যদি কাউকে বর্তমান না পাও, তাহলে সে খানে তোমরা প্রবেশ করবে না। যতক্ষণ না অনুমতি দেয়া না হবে। আর যদি তোমাদের পিরে যেতে বলে তাহলে তোমরা ফিরেই যাবে। এ ফিরে যাওয়াই তোমাদের জন্যে পবিত্রতার নীতি। জেনে রাখবে তোমরা যা কিছু করো, সে বিষয়ে আল্লাহ খুব ভালোভাবেই অবহিত রয়েছেন। সূরা আন নুরঃ ২৭-২৮

কর্মের স্বাধীনতা
“শরীয়ত সম্মত যে কোনো কাজই ইসলামে সম্মানার্হ। অতএব ব্যক্তিকে শরীয়ত সম্মত যে কোন কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে ইসলামে। হাদীসে স্পষ্ট করে বলা হয়েছেঃ

*****আরবী******

“ব্যক্তি তার নিজের শ্রমে উপার্জিত যে খাদ্য খায়, তার চেয়ে উত্তম খাওয়া আর কিছু হতে পারে না। আল্লাহর নবী হযরত দাউদ আঃ নিজের শ্রমে অর্জিত খাদ্য খেতেন। ”

অতএব ইসলামী রাষ্ট্রে প্রত্যেক ব্যক্তিকে ব্যবসায়, শিল্পে ও কৃষি প্রভৃতি বিভিন্ন উপার্জন কাজে শুধু স্বাধীনতাই দেয়া হয় না, সে জন্যে রীতিমতো উৎসাহিতও করা হয়। তবে শরীয়ত বিরোধী কোন কাজের সুযোগ দেয়া হয় না ইসলামী রাষ্ট্রে। কেননা সেরূপ কাজ করা হলে হয় তাতে অপরের প্রতি যুলুম করা হবে, না হয় তা নৈতিকতা বিরোধী কাজ হবে। আর এ ধরনের কাজে যে সমাজের সাধারণ মানুষেরই ক্ষতি সাধিত হয়, তবে কোন সন্দেহ নেই। এভাবে ব্যক্তি যদি শরীয়ত সম্মত কোনো কাজে ব্যতীত হয় তাহলে ইসলামী রাষ্ট্র তার সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করবে এবং সে কাজের ফলাফল সে-ই ভোগ করবে। কেননা প্রত্যেকেরই নিজের শ্রমের ফল ভোগ করার অধিকার রয়েছে। আল্লাহ কোন আমলকারীর আমলের ফল নষ্ট করেন না-সে আমল বৈষয়িক উপার্জন সংক্রান্ত হোক কি পরকালীন, তা কুরআনেরই ঘোষণা:

তবে তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে, ইসলামে প্রত্যেক ব্যক্তিকে এমন নিরঙ্কুশ স্বাধীনতাই দেয়া হয়েছে যে, কাউকে কোন কাজের জন্যে কৈফিয়ত ও জিজ্ঞেস করা হবে না। যেমন সরকারী কর্মচারীরা যদি সরকারি দায়িত্বে নিযুক্ত থাকা অবস্থায় উপার্জন সংক্রান্ত অন্য কোন কাজ করে তবে সে অধিকার কাউকে দেয়া যেতে পাওে না। এ কারনেই হযরত উমর ফারুক রা: তাঁর নিয়োগকৃত সরকারী কর্মচারীদেরও ধন-সম্পদেও হিসাব নেয়ার ব্যবস্থা করে ছিলেন। এদের একজন যখন বললো:

*****আরবী******

“আমি ব্যবসা করেছি এবং তাতে মুনাফা হয়েছে, এতে কার কি বলার থাকতে পারে?”

জবাবে হযরত ওমর বলেছিলেনঃ

*****আরবী******

“আমিতো তোমাকে ব্যবসায়ের জন্যে নিযুক্ত করিনি” মাআরেমুশ শারহিল ইসলামী, অহমদ যারকা।

ব্যক্তি যে কাজ যতক্ষণ করতে চাইবে সে ততক্ষণই করবে এবং যখন সে কাজ ত্যাগ করার ইচ্ছা করবে, তখনই সে তা ত্যাগ করতে ও পারবে। কিন্তু এ অধিকার এ শর্তের অধীনে যে, তাঁর এ কাজ ত্যাগ করায় অপর কারোরই যেন এক বিন্দু ক্ষতি সাধিত না হয়। এজন্যে ইসলামী আইনবিদরা বলেছেনঃ

*****আরবী******

“সর্বসাধারণের জন্যে জরুরী ও অপরিহার্য শিল্প ও ব্যবসায়ের কাজে তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদেরও বাধ্য করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে রাষ্ট্র সরকারের এবং সে জন্যে তাদের ন্যায্য মজুরী দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আত তুরুকুল হুকমীয়াতু ইবনে কায়েম।

এ কারণে এসব ক্ষেত্রে কর্মচারীদেরও সাধারণ ধর্মঘট করার কোন অধিকারই ইসলামী রাষ্ট্রের দেয়া যেতে পাওে না। কেননা, তার ফলে সাধারণ জন মানুষের জীবন কঠিন বিপর্যয় নেমে আশার আশংকা রয়েছে। তবে তারা কাজ উপযোগী ন্যায্য মজুরীর দাবী জানাতে পাওে ও সে জন্যে নিয়মতান্ত্রিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আর রাষ্ট্র তাদেও কাজ অনুপাতে ন্যায্য মজুরী নির্দিষ্ট করে দিতে বাধ্য। কেননা সর্ব পর্যায়ে ইনসাফ কায়েম করাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আর শ্রমিকদের জন্যে ন্যায্য মজুরীর ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় ইনসাফেরই অন্তর্ভুক্ত কাজ এরূপ মজুরী দিতে মালিক পক্ষ যদি অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে রাষ্ট্র তাতে হস্তক্ষেপ করবে এবং মজুরী দানের ক্ষেত্রে পূর্ণ ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত করবে। তাহলে এর ফলে না শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না মালিক পক্ষ। বরং এর ফলে সামাজিক সাম্য ও শান্তি স্থাপিত হবে।

ব্যক্তিগত মালিকানা রাখার অধিকার
ইসলামী শরীয়ত ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত মালিকানা রাখার অধিকার দিছে। অতএব ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত মালিকানার ওপর অন্যায় ভাবে হস্তক্ষেপ করা চলবে না। বরং তা রক্ষা করার দায়িত্বই পালন করতে হবে রাষ্ট্রকে। যদি কেউ তার ওপর হস্তক্ষেপ করে তবে তার প্রতিরোধেও জন্যে সরকারকে অবিলম্বে এগিয়ে আসতে হবে। অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

ইসলামে ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত এবং মালিক তার মালিকানা ভোগ ব্যবহার করার অবাধ অধিকারই লাভ করে থাকে। তবে তা শর্তহীন ও নিরঙ্কুশ নয়। সে জন্যে কতগুলো জরুরী ও অপরিহার্য শর্ত পালন করতে হবে। এ শর্ত গুলো মালিকানা লাভ, বৃদ্ধিসাধন ও তাঁর ব্যয় ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরোপিত এবং যেসব দিক দিয়ে তা অন্য মানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট সে সব দিক দিয়ে তা অবশ্যই লক্ষণীয়।

সাধারণ প্রচলিত কাজ ও শ্রমের পরিণামে অর্জিত সম্পদ, মীরাস সূত্রে প্রাপ্ত ও পারস্পরিক লেনদেন ও চুক্তি ব্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জিত ধন ঐশ্বর্যে ব্যক্তিগত মালিকানা ইসলামী শরীয়তে বৈধ মালিকানা রূপে স্বীকৃত। কিন্তু তাতে যদি চুরি, লুটতরাজ, জুয়া মাত্রাতিরিক্ত মূল্য গ্রহন, ঘুস ও সুদ ইত্যাদি ধরনের কোন আয় জড়িত হয়, তবে তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অতএব শরীয়তের দৃষ্টিতে কারোর মালিকানা বৈধ প্রমাণিত হলে তার ব্যয় ও ব্যবহারের অধিকার ও নিঃসন্দেহে স্বীকৃত হবে এবং তা সে শরীয়ত সম্মত পথে নিয়োগ করে তার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারবে। ধোঁকা-প্রতারণা, সুদী কারবার, মওজুদ করণ ও অতিরিক্ত মূল্য গ্রহনের মাধ্যমে সম্পদ ও সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করার অধিকার কারোর নেই। তা কেউ করলে সরকারে বাজেয়াপ্ত হবে।

শরীয়তের ব্যক্তি মালিকানা স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় প্রয়োজনে শরীয়তের কল্যাণ দৃষ্টিতে ন্যায্য মূল্যের বিনিময়ে ব্যক্তি মালিকানা হরণ ও করা যেতে পারে।

ব্যক্তি মালিকানার উপর ইসলামী শরীয়ত অনেকগুলো শর্ত ও অধিকার ধার্য করেছে। যে লোকই ব্যক্তি মালিকানার অধিকারী তাকে এসব শর্ত পূরণ এবং অধিকার আদায় করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। এ শর্ত গুলোর মধ্যে মোটামুটি উল্লেখযোগ্য হলো (১) নিকটাত্মীয়ের অধিকার আদায়, (২) যাকাত দান ও (৩) অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করা। অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্রজনের সাহায্য দান করার কাজটি অপরিহার্য হবে তখন, যদি যাকাত ফান্ড ও সরকারী ব্যবস্থাপনা তাদের অভাব মেটাতে ও প্রয়োজন পূরণ যথেষ্ট না হয় এবং রাষ্ট্রের বায়তুলমাল এ কাজে সম্পূর্ণ অক্ষম হয়ে পড়ে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা
ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যক্তির মত পোষণ ও প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ অধিকার হরণ করার এবং এ থেকে জনগনকে বঞ্চিত করার অধিকার কারো নেই। বস্তুত ব্যক্তির চিন্তা ও মানসিক প্রতিভার স্ফুরণের জন্যে ব্যক্তির মতের স্বাধীনতা থাকা একান্তই অপরিহার্য। এ না থাকলে মুসলমানরা তাদের দ্বীনি দায়িত্ব কর্তব্য ও পালন করতে পারে না। ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধ তো মুসলিম মাত্ররই কর্তব্য। আর চিন্তা ও মতের স্বাধীনতা থাকলেই এ কাজ বাস্তবায়িত হতে পারে। কুরআন মাজীদে এ জিনিষের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এবং এ কাজকে মানুষের ঈমানের সাথে সংশ্লিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছেঃ

*****আরবী******

“ কালের শপথ মানুষ মাত্রই ধ্বংসের মুখে উপস্থিত। তবে যারা ঈমান এনেছে, নেক আমল করেছে এবং সত্য ও ধৈর্যাবলম্বনের জন্যে উপদেশ দেবে-তারা এ থেকে বাচতে পারবে। ” সূরা আল আসরঃ১-৩

বলা হয়েছেঃ

*****আরবী******

“ মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন স্ত্রী পরস্পর বন্ধু। তারা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ ব্রতে ব্রতী হয়ে থাকে। ”-সুরা আত তওবাঃ৭১

আর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছেঃ

*****আরবী******

“ তোমাদের মধ্যে থেকে একটি সুসংহত বাহিনী এমন বের করতে হবে, যারা কল্যাণের দিকে আহবান জানাবে, ন্যায়ের আদেশ করবে ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করবে। ” সূরা আল ইমরাণঃ১৪

হাদিসে রাসূলে করীম স: এর স্পষ্ট ঘোষণা ও উদ্বৃত্ত হয়েছে এ পর্যায়েঃ

*****আরবী******

“ তোমাদের মাঝে যে লোক কোন অন্যায় দেখতে পাবে সে যেন তা তার শক্তি দিয়ে প্রতিহত করে, শক্তি না থাকলে মুখে যেন তার বিরুদ্ধে কথা বলে। আর মুখে বলার মতো অবস্থা না হলে অনন্ত মনে মনেও যেন তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে। যদি ও এ অত্যন্ত দুর্বল ঈমানের পরিচয়।

শাসন কর্তৃপক্ষের ওপর তীব্র-তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং তাদের কোনো ত্রুটি গোচরীভূত হলে তার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করা প্রত্যেকটি নাগরিকেরই কর্তব্য। আর এসব কাজ সম্ভব হতে পারে ঠিক তখন যদি ব্যক্তির মত পোষণ ও প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকৃত থাকে।

পারস্পরিক পরামর্শ বিধান এ কাজে যে মতবিরোধ হয় এবং শেষ পর্যন্ত একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তাতে ও চিন্তা ও মতের স্বাধীনতা অপরিহার্য, বরং তা না থাকলে পারস্পরিক পরামর্শের ইসলামী বিধান কার্যকরই হতে পারে না।

“এ সব কারণে ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যক্তিদের নিজস্ব চিন্তা ও মতের স্বাধীনতাকে পূর্ণ গুরুত্ব সহকারে রক্ষা করা হয়। ব্যক্তির অনুরূপ পরিবেশ দিয়ে লালন ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এবং শাসন কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে জনগনকে সব সময়ই উৎসাহ দান করে থাকে। কেউ যদি এ অধিকার ভোগ না করে তাহলে বরং তাদের কড়া শাসন করা হয়। এ পর্যায়ে ঐতিহাসিক ঘটনার কোন শেষ নেই। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা: কে লক্ষ্য করে একব্যক্তি বললো ‘ হে ওমর তুমি আল্লাহকে ভয় কর। তখন ওমর রা: বললেন, হ্যাঁ, আমাকে তাই বলবে। না বললে বরং তোমরা কোনো কল্যাণ লাভ করতে পারবেনা। আর আমরাও কোনো কল্যাণ লাভ করতে পারবো না, যদি তা না শুনি।”

তবে ব্যক্তি স্বাধীন মত পোষণ ও প্রকাশের শুধু সুযোগ থাকাই যথেষ্ট নয় বরং এ জন্যে তাদের মাঝে প্রবল মনোবল, সৎ সাহস, ও বীরত্ব বর্তমান থাকা আবশ্যক। শাসকদের ব্যাপারে তাদের সম্পূর্ণ নির্ভীক হতে হবে, তবেই তারা এ সুযোগের পুরোমাত্রায় সদ্ব্যবহার করতে পারবে। কেননা ভয়, ত্রাস ও শঙ্কা মানুষকে তার স্বাধীন মত প্রকাশ থেকে বিরত রাখে, সুযোগ হলেও কোনো কথাই বলতে দেয়া হয় না। আর কোনো জাতি যদি এমনি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে তা হলে সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। সে জাতি আল্লাহর রহমত থেকেও বঞ্চিত হয়। এ জন্য নবী করিম সা: ইরশাদ করেছেনঃ

*****আরবী******

“ তুমি যখন আমার উম্মতকে দেখবে যে, সে যালেমকে যালেম বলতে ভয় পায়, তখন তুমি তার কাছ থেকে বিদায় নিবে। ”

আর মুসলমানদের মনোবল, সাহস, হিম্মত ও বীরত্বের মূল উৎস হচ্ছে তাদের তাওহীদি আকিদা। এ আকিদা যদি তাদের মনে বদ্ধমূল হয় এবং তারা গভীর ভাবে এর তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে, তাহলে তাদের মনে জাগবে সাহস ও বীরত্ব। মুসলমানদের এ কথাই বুঝতে হবে যে, ক্ষতি এবং উপকার সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে নিবন্ধ, অন্য সবই আল্লাহর দাসানুদাস মাত্র, রাষ্ট্রপ্রধান ও অন্যান্য সরকারী কর্মচারী সকলে আল্লাহরই সৃষ্ট, আল্লাহর কাছে তাদের ও হিসাব দিতে হবে। তাহলেই তারা স্পষ্ট ভাষায় নিজেদের মত প্রকাশ করার সাহস পাবে এবং এ ব্যাপারে তরা কাউকে ভয় পাবে না।

ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমা
অবশ্য একথা মনে রাখতে হবে যে, ব্যক্তির মত পোষণও প্রকাশের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ ও উৎশৃঙ্খল হতে পারে না। বরং সে জন্যে কিছু শর্ত কিছু কিছু নিয়ম-নীতি অবশ্যই রয়েছে। তার আসল শর্ত হলো তার মূলে সদিচ্ছা নিহিত থাকতে হবে। কল্যাণের উদ্দেশ্যই এ অধিকার প্রয়োগ করতে হবে। আর আল্লাহকে সন্তুষ্ট করাই হতে হবে তার চরম লক্ষ্য। মত প্রকাশের এ স্বাধীনতা থেকে সামগ্রিক কল্যাণ লাভ করাই উদ্দেশ্য হতে হবে। আর এ শর্ত ইসলাম প্রদত্ত অপরাপর অধিকার ভোগের মতোই অত্যন্ত যুক্তিসংগত। দ্বিতীয় শর্ত এইযে, ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করে নিজের বীরত্ব ও বাহাদুরি জাহির করা চলবে না। চলবে না তা করে অন্যকে হীন প্রমাণ করার চেষ্টা করা। কিংবা অপর কোনো বৈষয়িক স্বার্থ লাভ করার চেষ্টা করা।

তৃতীয় শর্ত এইযে, এ অধিকার ভোগ করার সময় ইসলামের মৌলিক আকীদা ও ইসলামের সামাজিক প্রয়োজনীয়তা বৈধতার বিরোধীতা করা চলবে না। ইসলামী আকীদা –বিশ্বাস ও জীবনাদর্শের সমালোচনা করা চলবে না এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে ইসলামী আদর্শের কোনো দোষ প্রচার করার অধিকার কাউকে দেয়া যেতে পারে না। কেন না এ কাজ মুসলমানকে মুরতাদ বানিয়ে দেয়, সে জন্যে তার শাস্তি হওয়াই বিধেয়। আর চতুর্থ শর্ত এই যে ইসলামের নৈতিক নিয়ম-নীতিকে পূর্ণ মাত্রায় বহাল রাখতে হবে তাকে লঙ্ঘন করা চলবে না। কেউ কাউ গালাগাল করতে পারবে না, মিথ্যা দোষারোপ করতে পারবে না কেউ কারো ওপর। কেননা, সেরূপ করার স্বাধীনতা দেয়ার মানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নয়। এ পর্যায়ে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্র, সরকার ও সরকারী দায়িত্বশীল কর্মচারীদের কাজকর্ম ও চরিত্রে কোনোরূপ অন্যায় দেখতে পেলে তার বিরুদ্ধে কথা বলার ও পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে প্রত্যেকটি নাগরিকের। কিন্তু তাই বলে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রহাত্মাক কথা বলার অধিকার কাউকে দেয়া যেতে পারে না। বিপরীত মতাদর্শের সাথে মতবিরোধ করার অধিকার রয়েছে তার সমালোচনা ও দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা ও যেতে পারে। কিন্তু কারোর সভা-সম্মেলনে গোলযোগ করার অধিকার কারোর থাকতে পারে না। আর যতক্ষণ কেউ বিপরীত মতপোষন করা সত্ত্বে ও কোনোরূপ অশান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি না করবে। ততক্ষণ সরকার ও তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করবে না। ব্যক্তিগত মত পোষণ ও প্রকাশের এই হলো সীমা নির্দেশ। এ সীমা রক্ষা করাই সকল শ্রেণীর নাগরিকদের কর্তব্য। এ পর্যায়ে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হলো, হযরত আলী রা: এর খেলাফত আমলে বিরোধী মতাবলম্বী খাওয়ারিজদের প্রতি তাঁর গৃহীত নীতি। তাদের লক্ষ করে খলীফা বলেছিলেনঃ

*****আরবী******

“ তোমরা যতক্ষণ পর্যন্ত কোনোরূপ অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি না করবে ততক্ষণ তোমাদের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই শুরু করবো না। ” নাইলুল আওতার, ৭ম খন্ড ১৫৭ পৃষ্ঠা

বস্তুত বিরোধী মতাবলম্বীরা যতক্ষণ জনগনকে তাদের মত গ্রহনে বলপূর্বক বাদ্য করেত না চাইবে, ততক্ষণ ইসলামী রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর দমন নীতি গ্রহন করবে না ততক্ষণ পর্যন্ত সরকারের কর্তব্য হলো তাদের বুঝানো, ভালো শিক্ষাদানে উপদেশ –নসিহতের মাধ্যমে তাদের মনের পরিবর্তন করতে চেষ্টা করা। খাওয়ারিজদের সম্পর্কে এ নীতিই গৃহীত হয়েছিল। বলা হয়েছে, তারা ইনসাফ পূর্ণ সমাজে বসবাস করা সত্বেও যদি তাদের মতাদর্শ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে, তাহলে রাষ্ট্রর কর্তব্য হলো তাদের মতাদর্শের দোষ-ত্রুটি ও মারাত্মকতা লোকদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা। তাহলে তারা সে ভুল মত ত্যাগ করে সত্য ও নির্ভুল মতাদর্শ গ্রহন করে সমাজের সাথে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। ইমতাউল আসমা, ১১০ পৃষ্ঠা

শিক্ষাখাতের অধিকার
ইসলামে জ্ঞান ও শিক্ষার এবং জ্ঞানী ও শিক্ষিত লোকদের মর্যাদা সর্বোচ্চ। ইসলাম মানুষকে জ্ঞান লাভের জন্যে তৎপর হতে, জ্ঞান বৃদ্ধির জন্যে চেষ্টা করতে ও সে জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে নির্দেশ দিয়েছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ করা হয়েছেঃ

*****আরবী******

“ তুমি বলো হে, আল্লাহ আমার জ্ঞান ও বিদ্যা বাড়িয়ে দাও। ”

আর আমল কবুল হওয়ার জন্যে ইলম তো একান্তেই জরুরী। কেননা সে কেবল আল্লাহর কাছে কবুল হতে পারে, যা হবে খালেস ভাবে কেবল মাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্য, যা হবে শরীয়তের বিধান মোতাবেক নির্ভুল ও সঠিক। আর ইলম জ্ঞান ও বিদ্যা ছাড়া এরূপ হওয়া সম্ভব নয়।

ইলম ও কয়েক প্রকারের রয়েছে। কিছু ইলম তো অর্জন করাতো ‘ফরজে আইন’। যেমন আকীদা ও ইবাদত সংক্রান্ত ইলম। আর কতক রয়েছে ‘ফরযে কেফায়া’। এ জ্ঞান সাধারণ ভাবে সমাজ ও জাতির লোকদের কারো মধ্যে থাকলেই হলো। মানুষের দ্বীনের বিস্তারিত রূপ, শিল্প ব্যবসায়-বাণিজ্যে, রাষ্ট্র শাসন বিধি, আইন কানুন ইত্যাদি সংক্রান্ত জ্ঞান এ পর্যায়ে গণ্য। এসব বিষয়ে জ্ঞান অর্জনও জরুরী বটে, এবং রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে জনগণের মধ্যে এ সব জ্ঞান বিস্তারের জন্যে সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহন করা। নবী করিম স: এর কর্ম পদ্ধতি থেকে এ পর্যায়ে সরকারী দায়িত্বের কথা স্পষ্ট হয়ে উঠে। বদর যুদ্ধে যেসব কুরাইশ বন্দী হয়েছিল তাদের মুক্তিপণ হিসাবে ঠিক করে দেয়া হয়েছিল, প্রত্যেক লেখাপড়া যানা বন্ধী অন্তত দশজন মুসলমানকে লেখাপড়া শেখাবে কেন না তখন মুসলমানদের মধ্যে লেখাপড়া জানা লোকদের সংখ্যা অত্যন্ত কম ছিল। রাসূলে করীম সা: রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে লোকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্য এরূপ ব্যবস্থা গ্রহন করার প্রয়োজনবোধ করেছিলেন।

ভরণ-পোষণের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা লাভের অধিকার
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকই খাদ্য পানিয় বস্ত্র-বাসস্থানের নিরাপত্তা লাভের অধিকারী। কোনো নাগরিকই এসব মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে বঞ্চিত থাকতে পারে না। যে লোক নিজের সামর্থ্যে স্বীয় প্রয়োজন পূরণে সামর্থ্য হবে নামাজ ও রাষ্ট্র তার সে প্রয়োজন পূরণের জন্যে দায়ী। এসব মৌলিক প্রয়োজন থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকতে কেউ বাধ্য হয় না ইসলামী রাষ্ট্রে।

ইসলামী রাষ্ট্রের এরূপ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো এই য, ইসলামী সমাজই হলো পারস্পরিক সাহায্য ভিত্তিক সমাজ। সমাজের প্রত্যেকেই প্রত্যকের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে প্রস্তুত। কেননা মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হলোঃ

*****আরবী******

“ তোমরা সবাই পরস্পরের সাহায্যে কাজে এগিয়ে নেক কাজ ও তাকওয়া সংক্রান্ত বিষয়াদিতে এবং গুনাহের কাজ ও আল্লাহদ্রোহিতায় কোনোরূপ সাহায্য করোনা কারোর। ”

আর অভাব গ্রস্ত ব্যক্তির অভাব মোচনের চেয়ে বড় নেক কাজ কি হতে পারে!পারস্পরিক সাহায্য সংক্রান্ত কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সচ্ছল অবস্থার লোকেরা অভাবগ্রস্ত ও গরীব লোকদের সাহায্য করবে। তাতে তাঁর মৌলিক প্রয়োজন পূরণ হবে নবী করীম স: ইরশাদ করেছেন:

*****আরবী******

“ যার খাবার বেশি আছে সে তাকে তা দেবে, যার খাবার নেই। আর যার পাথেয় বেশি আছে সে তা সেই পথিকে দিবে যার পথের সম্বল নেই। ” আনমাহাল, ইবনে হময ৬ষ্ছ খন্ড ১৫৬ পৃষ্ঠা।

অপর এক হাদিসে বলা হয়েছে:

*****আরবী******

“ যার কাছে দু’জনার খাবার আছে, সে যেন তিন জনকে খাওয়ায়। আর যার কাছে চার জনের খওয়ার আছে, সে যেন পাঁচ জন কিংবা ছয়জনকে খাওয়ায়। ” অনমহাল ২য় খন্ড ৫৭ পৃষ্ঠা।

বস্তুত রাষ্ট্র হলো সমাজ সমষ্ট্রির প্রতিভূ, সমাজের লোকদের প্রতিনিধি। কাজেই এই হাদিসের মূল প্রতিপাদ্য অনুযায়ী আমল করা সমাজ- সমষ্ট্রির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র- সরকারেরই দায়িত্ব। অতএব একথা প্রমাণিত যে ইসলামী রাষ্ট্র দেশের সমস্ত অভাব গ্রস্ত ও দরিদ্র জনগণের অভাব মেটানোর জন্যে দায়িত্বশীল। এ পর্যায়ে আরো একটি হাদিস উল্লেখ্য। তাতে সরকারের এ দায়িত্ব কথাই প্রমাণিত হয়। বলা হয়েছে:

*****আরবী******

“ যে মু’মিন মরে যাবে ও ধন সম্পদ রেখে যাবে, তার নিকটাত্মীয়রাই তার ওয়ারিশ হবে। আর যে মু’মিন ণ রেখে বা অক্ষম সন্তান রেখে যাবে, তাদের দায়িত্ব আমার উপর বর্তাবে, আমিই তাদের অভিভাবক হবো। ” নবী কারীম সা: এ দায়িত্ব পালন করতেন ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে, রাষ্ট্রীয় বায়তুলমাল থেকে, নিজের সম্পত্তি থেকে নয়। কাজেই এ দায়িত্ব সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হলো।

সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:

*****আরবী******

“ তোমরা প্রত্যেকেই অপরের জন্যে দায়ী এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। অতএব জনগণের রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের জন্যে দায়ী, তাকে জনগণের জন্যে জবাবদিহি করতে হবে। ”

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী লিখেছেন: “ এ হাদিসে দায়িত্বশীল বলে এ কথা বুজানো হয়েছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তিকেই তাঁর অধীন যাবতীয় বিষয়ে দেখাশুনা করা, তাদের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করা এবং দীন ও দুনিয়ার দিক দিয়ে তাদের পক্ষে কল্যাণ কর যাবতীয় বিষয়ে ইনসাফ করার দায়িত্ব পালন করতে হবে। ” আর জনগণের বৈষয়িক কল্যাণ হচ্ছে তাদের যাবতীয় বৈষয়িক প্রয়োজন পূরণ করে দেয়া, যদি তারা নিজেরা তা পূরণ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। এ প্রয়োজন পূরণ হলেই মুমিনদের আল্লাহর বন্দেগী সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনও সহজ হতে পারে। কেননা, একথা সর্বজনবিদিত যে, যারা তাদের বৈষয়িক প্রয়োজন পূরণে অক্ষম, তারা সে চিন্তায় এমন কাতর হয়ে পড়ে যে, তারা আল্লাহর বন্দেগীর কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয় না।

ব্যক্তির অধিকার আদায়ে শরীয়তের বিধান
ব্যক্তি অধিকার আদায় করার জন্যে ইসলামী শরীয়তে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। এ ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ইসলামী রাষ্ট্র এ ব্যাপারে জনগণকে সাধারণ নিরাপত্তার কথা ঘোষণা করে। এ জন্যে যে ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে তা কয়েক পর্যায়ে বিভক্ত:

প্রথম: ব্যক্তির শ্রম ও কাজ। এ পর্যায়ে মৌলিক কথা হলো, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি নাগরিকই নিজের প্রয়োজন নিজে পূরণ করবে। সে, কাজ করবে, উপার্জন করবে। সে জন্যে অপর কোন মানুষের সামনেই ভিক্ষার হাত দরাজ করবে না। কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে “ওপরের হাত নিছের হাতের তুলনায় অনেক উত্তম” অতএব গ্রহনের চেয়ে দান ভালো। আর দান সম্ভব হয় যদি ধন থাকে এবং ধন শ্রম ও উপার্জন ব্যতিরেকে হস্তগত হওয়া সম্ভবপর নয়। হাদিস শরীফে উদ্বৃত্ত হয়েছে:

*****আরবী******

“ যার হাতে আমার প্রাণ নিবদ্ধ তার নামে কসম করে বলছি, তোমাদের কেউ যদি রশি দিয়ে পাহাড়ে চলে যায় এবং কাষ্ঠ আহর‌ণ করে পিঠের ওপর রেখে বহন করে নিয়ে আসে, তা বিক্রি করে অর্থ রোজগার করে এবং তা দিয়ে নিজের ভরণ-পোষণ চালায়, তবে তা লোকের কাছে ভিক্ষা করার চেয়ে অনেক ভালো ‘

সরকার প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা
দ্বিতীয়ঃ বস্তুত মানুষ নিজে যদি কাজ করতে ও তার মাধ্যমে স্বীয় মৌলিক প্রয়োজন পূরণ পরিমাণ উপার্জন করতে সক্ষম হয়, তাহলে সে যেমন ভিক্ষা করবে না তেমনি কোনরূপ সরকারী সাহায্যের ও মুখাপেক্ষী হবে না। আর কাজ করাই যখন শরীয়তের দৃষ্টিতে বাঞ্ছনীয় এবং ভিক্ষা করা যখন ঘৃণ্য, পরিত্যাজ্য; আর ইসলামী রাষ্ট্রর যখন দায়িত্বই হলো যা শরীয়তের দৃষ্টিতে ভালো তাকে বাস্তবায়িত করা এবং যা শরীয়তের দৃষ্টিতে মন্দ তাকে নির্মূল করা তখন ইসলামী রাষ্ট্রর এ দায়িত্ব সু স্পষ্ট যে যখন ঘৃণ্য পরিত্যাজ্য আর ইসলামী রাষ্ট্রের যখন দায়িত্বই হলো যা শরীয়তের দৃষ্টিতে ভালো তাকে বাস্তবায়িত করা এবং যা শরীয়তের দৃষ্টিতে মন্দ তাকে নির্মূল করা তখন ইসলামী রাষ্ট্রর এ দায়িত্ব সুস্পষ্ট যে, নাগরিদের জন্যে কাজ করে উপার্জন করার পথ সুগম ও সহজ করে দেবে। অতএব নানা কাজের উদ্ভাবন করে বেকার লোকদের জন্যে কাজের ব্যবস্থা করা সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। সেই সাথে বায়তুলমালের ধন সম্পদ বিলাসিতায় বা বিনা প্রয়োজনে ব্যয় করা কিংবা অকল্যাণ কর কাজে অর্থ বিনিয়োগ করা বন্দ করতে হবে। নাগরিকদের কোনো না কোনো রোজগার বিনিয়োগের জন্যে বায়তুলমাল থেকে ব্যক্তিগত – দানের প্রয়োজন হলে তাও দিতে হবে। কেননা ভিক্ষা দানের অপেক্ষা দান খুবই শ্রেয়। ইমাম আবু ইউসুফ রা: বলেছেনঃ

*****আরবী******

খারাজি জমির মালিক যদি দরিদ্রতা বশত জমি চাষ করতে অক্ষম হয় তাহলে তাকে বায়তুলমাল থেকে ‍ঋণ দিতে হবে, যেন সে শ্রম করে জমিতে ফসল ফলাতে পারে”। ইবনে আবেদীন ৩য় খন্ড, ৩৬৪ পৃ.

সাহায্য লাভের অধিকার
ব্যক্তি যদি কোন কাজ না পায় রুজি রোজগারের নিজস্ব কোনো উপায় না থাকে, তাহলে তার নিকটবর্তী ধনী সচ্ছল আত্মীয় তাকে সাহায্য করবে। তা করা তার উপর ওয়াজিব। দরিদ্র ব্যক্তি এভাবে নিজের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে পারে। এও এক সামাজিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং যে ব্যবস্থার মধ্যে পরিবারস্থ ও নিকটাত্মীয় লোকেরা শামিল রয়েছে এরূপ ব্যবস্থা কার্যকর করা ধনী ও সচ্ছল ব্যক্তির কেবল অনুগ্রহের ওপরই নির্ভরশীল নয়। বরং ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে এরূপ তার একান্তই কর্তব্য।

যাকাত
সমাজে যে ব্যক্তির অবস্থা এরূপ হবে যে, তার নিজের কোনো কামাই রোজগারের ব্যবস্থা নেই এবং তার নিকট আত্মীয়দের মধ্যে ও এমন কেউ নেই, যে তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করতে পারে। তার যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে যাকাত ফান্ড থেকে। কেননা, ধনীদের কাছ থেকে যে যাকাত আদায় হওয়া ইসলামী শরীয়তের মৌলিক ব্যবস্থা তা, এ শ্রেণীর গরীব রোকদেরই প্রাপ্য। আসলে শরীয়তের বিধান হলো, রাষ্ট্র সরকার, এ যাকাত আদায় করবে এবং তা পাওয়ার লোকদের মধ্যে সরকারী ভাবেই বণ্টন করবে। যাকাতের টাকা এ শ্রেণীর গরীবদের ছাড়া অন্যখাতে ব্যয় করা জায়েজ নয়। এ জন্যে আদায় ও বণ্টনের কার্যকর ব্যবস্থা ও বিভাগ কায়েম করা ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য।

বস্তুত যাকাত হচ্ছে গরীব লোকদের অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণের জন্যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভিত্তি। যাকাত আদায় করার জন্যে সরকারী ক্ষমতা প্রয়োগ করার প্রয়োজন দেখা দিলে তা করতেও কুণ্ঠিত হওয়া চলবে না যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা: সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে ছিলেন। বস্তুত যাকাত আদায় এবং বিলি বণ্টনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা হলে সমাজের কোনো গরীবই তার মৌলিক প্রয়োজন পূরণ থেকে বঞ্চিত থাকতে পারেনা, কেননা যাকাত গ্রহন করা হয় মূলধন, তারা মুনাফা, পণ্য দ্রব্য জমির ফসল (ওশর), ব্যবসায়ের পশু ও খনিজ দ্রব্য থেকে। বাংলাদেশ যদি রীতিমত হিসাব করে যাকাত আদায় করা হয় তাহলে তার পরিমাণ বছরে প্রায় একশ’ কোটিতে এসে দাঁড়াবে।

বায়তুলমাল থেকে সাহায্য দান
পূর্বোক্ত ব্যবস্থাসমূহে ও যদি জনগণের অভাব মেটানোর জন্যে যথেষ্ট না হয়, তাহলে রাষ্ট্র সরাসরি তার দায়িত্ব গ্রহন করবে এবং সব অভাবগ্রস্থ ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব পালন করবে। ব্যক্তির প্রতি সমাজ সমষ্টির যে দায়িত্ব, তা এভাবেই পালিত হতে পারে। অতএব বায়তুলমাল থেকে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই গুরুত্ব আরোপ করা হবে। ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেনঃ

*****আরবী******

“ যাকাত দ্বারা যদি অভাব গ্রস্তদের অভাব মোচন সম্ভব না হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় কোষ থেকে তাদের জন্যে অন্যান্য কাজ বাদ দিয়েও অর্থ ব্যয় করতে হবে। ” আস সিয়াসাতুশ শারইয়া, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ৫৩ পৃ.

এমনকি রাষ্ট্র সরকার যদি এ দায়িত্ব পালন করতে প্রস্তুত না হয় তাহলে অভাবগ্রস্তরা সরকারের বিরুদ্ধে সর্ব সর্বোচ্চ আদালতে এজন্যে মামলাও দায়ের করতে পারে। তখন বিচারপতি সরকারকে এ কাজ করতে বাধ্য করবে। ইসলামী আইন বিশারদ ইবনে আবেদিন একথা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ

*****আরবী******

“ বিচারপতি যেমন অক্ষম –দরিদ্র ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণের জন্যে তার ধনী অভিভাবক বা নিকট আত্মীয়কে বাধ্য করবে। তেমনি রাষ্ট্রপ্রধানকেও বিচারের মাধ্যমে এজন্যে বাধ্য করবে। ” আত্ তাশরীউল ইসলামী, শায়ক মুহাম্মদ, অবু যোহরা। দরিদ্র জনগণের অভাব মেটানোর ব্যাপারে সরকারের দায়িত্বের কথা ইসলামের ইতিহাস থেকে ও প্রমাণিত হয়। হযরত ওমর রা: এ দায়িত্বে স্বীকৃতি দিয়েছেন। দূর্ভিক্ষকালে তিনি অভাব গ্রস্তদের জন্যে সরকারী পর্যায়ে খাবার তৈরি করিয়ে ঘোষণা করিয়ে দিয়েছিলেন এ বলে: “যার ইচ্ছা এ খাবার খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে পারে, আর যার ইচ্ছা বায়তুলমাল থেকে তার ও তার পরিবারবর্গের প্রয়োজন পরিমাণ সামান সামগ্রী গ্রহন করতে পারে। ”

রাষ্ট্র এ সাহায্যদানে অক্ষম হলে
অভাবগ্রস্ত লোকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানে রাষ্ট্র যদি কখনো অক্ষম হয়ে পড়ে, রাষ্ট্রীয় কোষ যদি শূন্য হয়ে যায়, কিংবা বায়তুলমালে এমন পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকে, যা সমস্ত অভাবগ্রস্ত লোকের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে যথেষ্ট নয়, তাহলে তাদেও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব সমাজের ধনশালী ব্যক্তিদের ওপর অর্পিত হবে এবং ‘ফরযে কেফায়া’ হিসাবে তা সমগ্র জাতির পক্ষ থেকেই তাদেও পালন করতে হবে। ইসলামী ফিকাহবিদগণ এ বিষয়ে স্পষ্ট করে বলেছেনঃ

*****আরবী******

“ যাকাত ও বায়তুলমালের সাধারণ অর্থ-সম্পদ যদি অসমর্থ হয়, তাহলে বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান ও অভুক্তকে অন্নদান প্রভৃতি জরুরী কাজে আনজাম দেয়ার দায়িত্ব পড়বে। তাদেও মধ্যে সচ্ছল ও সমর্থ লোকের ওপর। এ দায়িত্ব আদের জন্যে ফরযে কেফায়া হিসাবে অতিরিক্ত হিসাবে চাপবে” আলমিনহাজ, ইমাম নববী এবং তার শরাহঃ৭ম খন্ড, ১৯৪ পৃ.

একথার অর্থ নিশ্চয়ই এই যে, শীতল ও গ্রীষ্মেও উপযোগী বস্ত্র দিতে হবে, চিকিৎসার প্রয়োজন পূরণ ও এরই অন্তর্ভুক্ত বলে চিকিৎসকের মজুরী ও ঔষধের মূল্য দেয়ার ব্যবস্থা ও করতে হবে। অর অক্ষম ও পঙ্গু লোকদের খাদেম নিয়োগও এ পর্যায়েরই একটি কাজ। অতএব বায়তুলমাল যতক্ষণ অক্ষম থাকবে সমাজের ধনী লোকেরাই অভাবগ্রস্তদের প্রয়োজন পূরণে বাধ্য থাকবে। আর ধনী লোকেরা তা করতে যদি অস্বীকার করে, তাহলে সরকার তা করার জন্যে তাদেরকে আইনত বাধ্য করবে। ইমাম ইবনে হাযম এ পর্যায়ে লিখেছেনঃ

*****আরবী******

“ যাকাত ফান্ড রাষ্ট্রীয় কোষাগার দরিদ্র জনগণের প্রয়োজন পূরণে অক্ষম হলে তখন তাদেও পেট ভরা খাবার ও শীতল গ্রীষ্মেও উপযোগী পোশাক এবং বর্ষা, শীতের রৌদ্রতাপ ও পথচারীদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

”—“ধাল মুহাল্লা ইবনে হাযম, ৬ষ্ঠ খন্ড ২৫৬ পৃ.

অমুসলিম নাগরিকের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা

ইসলামী রাষ্ট্রে নাগরিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার যে মহান দায়িত্ব গ্রহন করে, তা কেবল মুসলিম নাগরিকদের জন্যেই নির্দিষ্ট নয়। অমুসলিম নাগরিকদের জন্যে এ ব্যবস্থা গ্রহন করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বস্তুত এ ব্যাপারে মুসলিম অমুসলিম কোন পার্থক্য করা হয় না। এ ব্যাপারে প্রমাণ হিসাবে সেনাপতি হযরত খালেদ ইবনে অলীদ রা: এর স্বাক্ষরিত এক চুক্তি নামার একটা অংশ এখানে উল্লেখযোগ্য। তাতে তিনি বলেছিলেনঃ

*****আরবী******

“ অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে যে লোক বার্ধক্য, পঙ্গুত্ব বা বিপদের কারণে অথবা স্বচ্ছতা থাকার পর দরিদ্র হয়ে পড়ার কারণে যদি এমন অবস্থায় পড়ে যায় যে, তার স্বধর্মীরা তাকে ভিক্ষা দিতে শুরু করেছে, তাহলে তার পক্ষ থেকে যিযিয়া নেয়া বন্ধ করা হবে এবং যতদিন ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাস করবে ততদিন পর্যন্ত তার পরিবারবর্গকে বায়তুলমাল থেকে ভরণ-পোষণ করা হবে। ”–কিতাবুণ খারাজ, আবু ইউসূফ, ১৪৪ পৃ.

হযরত খালেদ রা: সেনাপতি হিসাবে এ চুক্তি স্বাক্ষর করে ছিলেন বং তখনকার খলীফা হযরত আবুবকর রা: এ চুক্তি মেনে নিয়েছিলেন। অতএব এ নীতি সম্পর্কে সকল সাহাবির ইজমা সম্পাদিত হয়েছে বলা চলে।

হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ রা: তার বসরার শাসন কর্তা অদি ইবনে আরতাদকে লিখে পাঠিয়েছিলেনঃ

*****আরবী******

“ তুমি নিজে লক্ষ্য করে দেখ, অমুসলিম নাগরিকদের মধ্য থেকে যে সব লোক বয়োবৃদ্ধ ও কর্মক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছে এবং যার উপার্জন –উপায় কিছুই নেই, তুমি তাদের প্রয়োজন মত অর্থ রাষ্ট্রীয় বাইতুলমাল থেকে তাদের দাও। ” কিতাবুল আমওয়াল, আবু উবাইদ, ৪৫-৫৬ পৃ.

নাগরিকদের ওপর রাষ্ট্রের অধিকার
রাষ্ট্রের ওপর নাগরিকদের অধিকার সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে বিস্তারিত অলোচনা করেছি। কিন্তু রাষ্ট্র নাগরিকদের এসব অধিকার যথাযথরূপে আদায় করতে পারে না, যদি নাগরিকগণ এ কাজে রাষ্ট্রের পূর্ণ সহযোগিতা না করে। আসলে রাষ্ট্র বাইরে থেকে আসা কোন জিনিস নয়, জনগণ গঠিত সংস্থারই অপর নাম রাষ্ট্র ও সরকার। এজন্যে জন-প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের জন্যে যে সংস্থা গঠন করা হয়, সার্বিক ও নির্বিশেষ ভাবে সকলকেই বাস্তব সহযোগিতা করাতে হবে। জনগণের শক্তিই রাষ্ট্রের শক্তি। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব জনগণের বাস্তব সহযোগিতার ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। অতএব বলতে হবে, রাষ্ট্রের ও অনেক অধিকার রয়েছে জনগণের ওপর এবং সে অধিকার সমূহ জনগণকে অবশ্যই আদায় করতে হবে।

রাষ্ট্র হলো জনগণের ঘর, জনগণ এ ঘরেই বসবাস করে, জীবন যাপন করে। জনগণ রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় নিশ্চিন্তে দিন যাপন করে। জনগণের খেদমত-জনকল্যাণে আত্মনিয়োগ করাই রাষ্ট্রের কাজ। এক কথায় রাষ্ট্র জনগণের খাদেম। রাষ্ট্র যেন বংশের পিতা-পৈত্রিক স্নেহ মমতা নিয়েই জনগণের খেদমত করতে হবে। যেমন পিতা স্নেহ মমতাভাজন হয়ে থাকে ছেলে সন্তান ও পারবারবর্গের প্রতি। তাই জনগণের কল্যাণ হলো জনগণের ওপর রাষ্ট্রের অধিকার অধিকার আদায়ে রাষ্ট্রের পূর্ণ সহযোগিতা করাই জনগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য। দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে বাস্তব সহযোগিতা নিয়েই এগিয়ে আসতে হবে দেশের জনগণকে। জনগণ যদি রাষ্ট্রের এ অধিকার পূর্ণ মাত্রায় ও যথাযথভাবে আদায় না করে তা হলে তার পরিণাম এই হবে যে, রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ থেকে যাবে এবং তার সমূহ ক্ষতি জনগণকেই ভোগ করতে হবে। তার পরিণতিতে জন-জীবনে নেমে আসবে কঠিন বিপর্যয়ের ঢল। এ কারণে জনগণের ওপর রাষ্ট্রের প্রধানতম অধিকার হলো, জনগন রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার করবে, রাষ্ট্রের আদেশ ও নিষেধ মেনে চলবে। রাষ্ট্রের মর্যাদা ও অস্তিত্ব রক্ষার্থে যে কোনো কাজের জন্যে সতত প্রস্তুত থাকতে হবে। জনগণের ওপর রাষ্ট্রের এ অধিকার দু’টি সম্পর্কেই আমরা সর্ব প্রথমে আলোচনা করবো।

প্রথমতঃ আনুগত্য পাওয়ার অধিকার
এ পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন:

*****আরবী******

“ হে ঈমানদার লোকেরা !তোমরা আনুগত্য স্বীকার করো আল্লাহর অনুগত হয়ে চলো রাসুলের এবং তোমাদের মাঝে দায়িত্বশীলদের ও”সূরা নিসা: ৫৯ আয়াতে উল্লেখিত ‘উলুল আমর’অর্থ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বসম্পন্ন ব্যক্তিরা। অথবা ইসলামী আইন বিধানে পারদর্শী ব্যক্তিরা ”আহকামুল কুরআন লিল তাফসীরে কুরতুবী, ৫ম খন্ড, ২৫৯ পৃ.হাদিসে উদ্বৃত্ত হয়েছে, নবী করিম সা: ইরশাদ করেছেন

*****আরবী******

“মুসলিম নাগরিককে রাষ্ট্রের আনুগত্য অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, তার আদেশ-নিষেধ অবশ্যই মেনে চলতে হবে সব ব্যাপারেই, তাই তারা পসন্দ করুক আর নাই করুক-যতক্ষণ না তাদের কোনো গুনাহ ও নাফরমানীর আদেশ করা হয়। শরহে সহীহ বোখারী, আল অসকালানী, ৩য় খন্ড ১০০ পৃ.

অতএব জনগণের রাষ্ট্রানুগত্য প্রতিফলিত হবে প্রশাসকদের যাবতীয় আদেশ নিষেধ পালনের মাধ্যমে। জনগণের ওপর রাষ্ট্রের এ অধিকার শরীয়ত সম্মত এবং রাষ্ট্রের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ জনকল্যাণ বিধানে কায়েম করা সংগঠনও প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়মশৃংখলা রক্ষা করা জনগণের কর্তব্য জনগণের রাষ্ট্রানুগত্য স্বেচ্ছামুলুক হওয়া বাঞ্ছনীয় এ জিনিষ জনগণের অন্তর থেকে ফুটে ওঠা উচিত। এজন্যে যেন রাষ্ট্রকে জোর –জবরদস্তি বা শক্তি প্রয়োগ করতে না হয় ত-ই শরীয়তের কাম্য। রাষ্ট্রীয় অনানুগত্যের ফলে রাষ্ট্রীয় জীবনে মহা অশান্তি-দুঃখ নেমে আসে। আনুগত্যহীন এ লোকদেরকে দমন ও বশ করার জন্যে রাষ্ট্রকে অকারণে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়;বিদ্রোহীদের মূলোৎপাটনে রাষ্ট্রকে শক্তি ব্যয় করতে হয়। আর এ কাজে যে শক্তি ক্ষয় হয়, তা জনগণের কোন ইতিবাচক কল্যাণ সাধন করতে পারে না। এ ছাড়া ও অনানুগত্য ও বিদ্রোহের ভাবধারা জনগণের একাংশে দেখা দিলে তা গোটা জনসমাজে বিষ বাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সমাজে দেখা দেয় উচ্ছৃঙ্খলতা, অশান্তি ও বিপর্যয়। রাষ্ট্রের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হয়। রাষ্ট্র যদি জনগণের ওপর এ জন্যে বলপ্রয়োগ করে তাহলে জনগণের মনে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমুলক ভাবধারা জেগে ওঠে। আর রাষ্ট্রও প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্য পূর্ণ শক্তিতে জেনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে যে রাষ্ট্র জনকল্যাণে নিযুক্ত থাকার উদ্দেশ্য গঠিত তা-ই গনবিরোধী ও দুর্ধর্ষ অত্যাচারী রাষ্ট্রর রূপ পরিগ্রহ করে বসে। এর ফলে রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যই সম্পূর্ণ ব্যাহত হয়, নিষ্ফল, অর্থহীন হয়ে যায় যাবতীয় শক্তিও ক্ষমতা। আর শেষ পর্যন্ত তা ধ্বংস হতে ও বাধ্য হয়।

উপরোক্ত হাদিস থেকে একথাও প্রমাণিত হয় যে, জনগণকে সব ব্যাপারেই রাষ্ট্রের আনুগত্য করতে হবে—জনগণ পসন্দ করুক আর না-ই করুক। এ পর্যায়ে আর ও একটি হাদিস উল্লেখ্য। রাসূল সা: ইরশাদ করেছেনঃ “মুসলিম নাগরিকদের কর্তব্য হলো রাষ্ট্রের আনুগত্য করা –শুনা ও মেনে চলা। সব ব্যাপারে –তা তাদের পসন্দ হোক আর না-ই হোক”

রাষ্ট্র দেশের সব মানুষকে একই সময় খুশী করতে পারবেনা। সকলের মত সমর্থন নিয়ে কাজ করার ও রাষ্ট্রের সব সময় সম্ভবপর হয় না। আইন ও শাসনকার্য সকল ব্যক্তির মর্জীর উপর নির্ভরশীল হলে কোনো রাষ্ট্র কাজ করতে পারে না। রাষ্ট্রের সব কাজে প্রত্যেকটি ব্যক্তি সন্তুষ্ট হবে এমন কথা বলা যায় না। বরং দেখা যায়, একটি কাজে কিছু লোক সন্তুষ্ট হলে ও অপর কিছু লোক তাতে নিশ্চয়ই অসন্তুষ্ট হয়েছে। তাই সবাইকে খুশি ও রাজী করা রাষ্ট্রের কাজ নয়। সঠিকভাবে সমস্ত মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যই রাষ্ট্রকে কাজ করতে হবে। আইন ও শাসন চালাতে হবে। অতএব রাষ্ট্রীয় কাজ কর্মকে খামখেয়ালীর মানদণ্ডে বিচার করা উচিত হবে না কখনো। আর মনমতো কাজ করাও রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের পূর্ব শর্ত হওয়া উচিত হতে পারে না?জনগণ ইচ্ছা হলে রাষ্ট্রের আনুগত্য করবে, না হলে করবে না এরূপ মনোভাব কোনো রাষ্ট্রই চলতে পারে না। জনগণের ইচ্ছামূলক আনুগত্য রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনের অনুকূলে নয়, বরং তা তার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বস্তুত রাষ্ট্রের অধীন সব মানুষকেই আনুগত্য স্বীকার করতে হবে। অনুগত হয়ে থাকতে হবে। এ ব্যাপারে কাউকে কোনো বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেয়া যেতে পারে না।

অতএব রাষ্ট্রের আনুগত্য আন্তরিকতা ও ঔকান্তিক নিষ্ঠা সহকারই হতে হবে। তাকে মনে করতে হবে যে, রাষ্ট্রর আনুগত্য করে সে আল্লাহ এবং তার রাসূল সা: এরই আনুগত্য করেছে। কেননা আল্লাই নাগরিকদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। অবশ্য তা আল্লাহ ও রাসূল স: এর আনুগত্যের ওপর ভিত্তিশীল, রাষ্ট্রকে এজন্যে আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী কাজ করতে হবে। তাহলে জনগণ যেমন নামাজে ইমামের আনুগত্য করে থাকে, রাষ্ট্রীয় ব্যাপারেও তেমনি তারা মেনে চলবে রাষ্ট্র পরিচালক তথা প্রশাসন কর্তৃপক্ষকে।

মনে রাখতে হবে, ইসলামে এ রাষ্ট্রানুগত্য শর্তহীন নয়। হাদিসে সে জন্যে একটি মাত্র শর্তেরই উল্লেখ করা হয়েছে। সে শর্ত হলো, রাষ্ট্র এমন কাজ করার আদেশ দিতে পারবে না যা পালন করলে আল্লাহ ও তার রাসূল স: এর নাফরমানী করা হয়। এরূপ কোন কাজের নির্দেশ দিলে জনগণ তা করতে বাধ্য হবে না। কেননা, হারাম কাজে রাষ্ট্রের আনুগত্য কারাও হারাম। হাদিসে এ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

*****আরবী******

কোনো নাফরমানীমূলক কাজের আদেশ করা হলে জনগণ তা ও শুনবে না, পালন করবে না।

প্রথমোক্ত আয়াতে তাফসীরে মুফাসসিরগণ একথাই বলেছেন স্পষ্ট ভাষায়। আল্লামা ইবনে কাসীর বলেছেনঃ

*****আরবী******

“ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বসম্পন্ন লোকদের আনুগত্য করতে হবে সে সব কাজে যা করলে আল্লাহর আনুগত্য হবে। আল্লাহর নাফরমানীর কাজে কোনা আনুগত্য করা চলে না। কেননা আল্লাহর নাফরমাণীমুলক কাজে সৃষ্টির আনুগত্য করা যেতে পারে না। ” মু’মিন মহিলাদের ‘বায়আত’গ্রহনের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা রাসূলে করীম স: কে সম্বোধন করে এরশাদ করেছেনঃ

*****আরবী******

হে নবী তোমার কাছে মুমিন মহিলারা যখন বায়আত গ্রহণের জন্যে আসবে তখন তুমি বায়আত গ্রহন করবে একথার ওপর যে তারা শরীক করবে না কোন কিছুকে আল্লাহর সাথে তারা চুরি করবে না তারা ব্যভিচার করবে না তারা তাদের সন্তানদের হত্যা করবে না তার মিথ্যা-মিথ্যে ও প্রকাশ্যে নির্লজ্জভাবে কারোর ওপর অকারণে দোষারোপ করবে না। এবং তারা ন্যায়সঙ্গত কাজে –হে নবী ! তোমরা নাফরমানী করবে না। এসব শর্তে ‍তুমি তাদের কাছ থেকে বায়আত গ্রহন করলে তাদের জন্যে অআল্লাহর কাছে মাগফিরাত চাইবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান। সুরা আলমুমতাহিনাঃ ১২

রাসূলে করীম স: নিশ্চয়ই কখনো খারাপ কাজের নির্দেশ দিতেন না আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজ করতে বলতেন না। একথা সুস্পষ্ট কিন্তু তা সত্বেও কুরআনের পূর্বোদ্ধৃত মারূফ বা ন্যায়সঙ্গত কাজের শর্তের কথা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে এক সাথে দুটি কথা প্রমাণিত হয়ঃ আনুগত্য শর্তহীন হতে পারে না এবং আল্লাহ ও রাসূল স: এর নাফরমানীর আনুগত্য করা যেতে পারে না।

আল্লাহর নাফরমানীর আদেশ পালন করা যেতে পারে না তা করা হলে শরীয়তের সীমালঙ্ঘন করা হবে। সে জন্যে আদেশদাতা ও আদেশ পালন কারী উভয়কেই কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। নবী করীম স: জনৈক আনছারীর নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। লোকদেরকে সে আনসারীর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিদেশে থাকাকালে সেনাধ্যক্ষ সাথের লোকদের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে তাদের কাষ্ঠ সংগ্রহ করার নির্দেশ দেয়। তা দিয়ে অগ্নিকুন্ড জ্বালানো হলে সবাইকে তাতে ঝাঁপ দেয়ার নির্দেশ দেয়। পরে এ ঘটনা রাসূল স: এর কাছে উল্লেখ করা হলে তিনি বলেনঃ

*****আরবী******

লোকেরা যদি সে অগ্নিকান্ডে ঝাঁপিয়ে পড়তো তাহলে তারা চিরদিন জাহান্নামী হতো। আসলে ন্যায় সংগত কাজেই নেতার আদেশের আনুগত্য করতে হবে নাফরমানী ও অন্যায় কাজে নয়। সহীহ বোখারী ১ম খন্ড ১১৩-১১৪ পৃ.

অন্যায়কারী অনাচারী ও অত্যাচারী রাষ্ট্র শাসকদের আনুগত্য স্বীকার করা এবং তাদের শরীয়ত বিরোধী কাজকর্মে মেনে নেয়া ও সমর্থন করার পরিণাম। অত্যন্ত মারাত্মক। দুনিয়া ও যেমন সে জন্যে দুঃখ ও লাঞ্ছনার সম্মুখীন হতে হয় তেমনি পরকালেও নিমজ্জিত হতে হবে কঠিন আযাবে। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদে কিয়ামতের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে।

*****আরবী******

লোকরা বলবে হে আমাদের রব আমরা দুনিয়া তোমাদের নেতৃবৃন্দের ও বড়দের আনুগত্য করেছি। ফলে তারা আমাদের গোমরাহ করেছে। অতএব হে রব তুমি আজ আমাদের দ্বিগুণ আযাব দাও এবং তোমর রহমত থেকে তাদের বহুদূর সরিয়ে দাও। সুরা আল আহযাবঃ৬৭-৬৮

অপর আয়াতে বলা হয়েছে

*****আরবী******

আল্লাহ যখন শাস্তি দিবেন তখন এরূপ অবস্থা দেখা দিবে যে দুনিয়াতে যে সব নেতা ও প্রধান ব্যক্তির অনুসরণ করা হতো তারা নিজ নিজ অনুসারীদের সাথে সকল সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা ঘোষণা করবে। কিন্তু তা সত্বেও তারা অবশ্যই শাস্তি পাবে এবং তাদের সকল উপায়-উপাদানের সম্পর্ক ও কার্যকারণ ধারা ছিন্ন হয়ে যাবে। আর দুনিয়ায় যারা তাদের অনুসরণ করতো তারা বলবে হায় আমাদের যদি আবার সুযোগ দেয়া হতো তাহলে আজ এরা যেমন আমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেদের দায়িত্বহীন থাকার কথা প্রকাশ করেছে আমরা ও তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেখিয়ে দিতাম। আল্লাহ অবশ্যই তাদের সকল কাজ-যাকিছু তারা দুনিয়াতে করেছে—তাদের সামনে এমনভাবে উপস্থিত করবেন যে তারা শুধু লজ্জিত হবে ও দুঃখ করবে। কিন্তু জাহান্নামের গর্ত থেকে বের হবার কোন পথই তারা খুঁজে পাবে না। সুরা আল বাকারাঃ১৬৬-১৬৭

অর্থাৎ শরীয়তে আনুগত্যের সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। মুসলিম উম্মত সে অনুগত্যের সীমাকে কখনোই এবং কিছুতেই লঙ্ঘন করতে পারে না করলে সে জন্যে আল্লাহর কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে।

দ্বিতীয়ঃ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া
রাষ্ট্রর প্রতিরক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া জনগণের দ্বিতীয় কর্তব্য জনগণের উপর রাষ্ট্রের দ্বিতীয় অধিকার। রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্যে যে কোনো কাজ করাকে ইসলাম জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ বলা হয়েছে, কুরআন ও হাদিসে এ বিষয়ে প্রদত্ত উৎসাহ বাণীতে ভরপুর হয়ে রয়েছে। ইসলামে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার কাজে পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করা জনগণের দীনী ফরয। এ কাজের বিরাট সওয়াবের কথা ঘোষিত হয়েছে কুরআন ও হাদিসে। আর যে লোক এ কাজে কুণ্ঠিত হবে, ইচ্ছা করে গাফলতি দেখাবে তার কঠিন আযাব হওয়ার কথাও বলা হয়েছে। কুরআনের নির্দেশ হলোঃ

*****আরবী******

বের হয়ে পড়ো একাকী বা দলবদ্ধভাবে—হালকাভাবে কিংবা ভারি-ভাবে এবং তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদ ও জান প্রাণ দিয়ে জিহাদ করো আল্লাহর পথে। সুরা আত তাওবাঃ ৪১

হাদিসে হযরত আবু যার রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আমি বললাম

*****আরবী******

ইয়া রাসূল আল্লাহ কোন কাজ সর্বোত্তম? – তিনি বললেনঃ

*****আরবী******

আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং তার পথে জিহাদ করা। রিয়াদুস সালেহীন। পৃষ্ঠা ৪৬৯

দেশ রক্ষার জন্যে জিহাদের ব্যবস্থাপনা করা এবং প্রয়োজন মতো জনগণ এ কাজে যাতে করে যোগ দিতে পারে তার পথ উন্মুক্ত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। এ ব্যবস্থাপনা নিশ্চয়ই প্রয়োজন মতো এবং যুগোপযোগী হতে হবে। যুগোপযোগী শক্তি সামর্থ্য ও অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহ করাতো রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব। আর জিহাদের এ ফরজ কেবলমাত্র মুসলিম নাগরিকদের উপর, অমুসলিমদের উপর তা ফরয নয়। কিন্তু অনুগত অমুসলিম নাগরিকও এতে মুসলমানদের সাথে শরীক হতে পারে। প্রতি রক্ষার এ দায়িত্ব পালনের জন্যেই ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকদের ওপর জিযিয়া কর ধার্য হয়ে থাকে। কিন্তু তারা যদি প্রত্যক্ষভাবে প্রতিরক্ষা কাজে অংশ গ্রহন করে, তা হলে এ জিযিয়া কর রহিত করা ইসলামী রাষ্ট্রের জন্যে সম্পূর্ণ জায়েয।

— সমাপ্ত—


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি