রাষ্ট্র সংস্থা ও সংগঠন
ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যক্তির মর্যাদা এবং অধিকার অতীব স্পষ্ট এবং প্রকট। ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যকে সেখানে কখনোই অস্বীকার করা হয় না বরং ব্যক্তি সেখানে ব্যক্তিগত পর্যায়ের যাবতীয় অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, প্রত্যেক ব্যক্তি অবাধে কাজ করতে পারে সেখানে স্বীয় যোগ্যতা ও প্রতিভার স্ফুরণ ও বিকাশদানের জন্যে, নিজস্ব রুচি ও ঝোঁক প্রবণতা চরিতার্থতার জন্যে। ব্যক্তির অধিকার ইসলামী রাষ্ট্রে এক স্বাভাবিক অধিকাররূপেই স্বীকৃতি পায় এবং তার ওপর কোনোরূপ হস্তক্ষেপ বা তাকে ক্ষুণ্ণ ও ব্যাহত করার অধিকার দেয়া যেতে পারে না কাউকেই। ইসলামী রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে ব্যক্তির অধিকার রাষ্ট্রের কল্যাণ ও স্থিতি, উন্নতি লাভ ও শক্তিশালী হয়ে ওঠার জন্যেই অপরিহার্য। সেখানে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মাঝে কোনো বিরোধ নেই, হবে না কোনো সংঘর্ষ। পরস্পরের বিরোধ সৃষ্টিতে কোনো কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলে মনে হয় না। স্বাভাবিক ও সাধারণ অবস্থায়ই ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যক্তির মর্যাদা এমনি-ই হয়ে থাকে।

তবে ইসলামী রাষ্ট্রে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয় শুধু তখন, যখন এ দুয়ের কোনো একটি ইসলামী আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়, ইসলামী আদর্শের বিরুদ্ধতা করতে উদ্যত হয়। কেননা, এ দুয়ের মাঝে যে মিল, মৈত্রীর সম্পর্ক, তা শুধু এ ইসলামের কারণেই এবং ইসলামের ভিত্তিতেই। এ ভিত্তিকে কেউ অস্বীকার বা উপেক্ষা করলে অপর পক্ষ সক্রিয়ভাবে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, তাতে কোনোই সন্দেহ থাকতে পারে না। এজন্যে ইসলাম ব্যক্তিকে যা কিছু অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে তা সে সেখানে পুরোপুরিই লাভ করতে পারে। কেননা, ইসলাম ব্যক্তিকে যা কিছু দিয়েছে, ইসলামী রাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই তা দেবে, দেবে নিজের আভ্যন্তরীণ তাগীদেরই। বিশেষত এজন্যে যে, ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তির যাবতীয় অধিকার লাভে ধন্য হওয়া-ই হলো ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ সুদৃঢ় হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ। অধিকার দিলেই অধিকার হরণ করে যে রাষ্ট্র, তার মত দুর্বল ক্ষণভঙ্গুর রাষ্ট্র আর একটিও হতে পারে না। এজন্যে ব্যক্তিদের অধিকারের ওপর অকারণ হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে কি না, সেদিকে তীব্র-তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টি রাখা ইসলামী রাষ্ট্রের এক স্থায়ী স্বভাব।

বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় আরো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। সে আলোচনার জন্যে ব্যক্তির অধিকারসমূহকে আমরা আরো দুভাগে ভাগ করে নেবোঃ রাজনৈতিক অধিকার ও সাধারণ অধিকার। এ দুয়ের প্রত্যেকটি সম্পর্কেই আমরা বিস্তারিত আলোচনা করছি।

রাজনৈতিক অধিকার
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকারের সংজ্ঞা হলোঃ

*************আরবী**************

একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার কারণে, অর্থনৈতিক লালন-পালন ও রাষ্ট্রের সাধারণ সুযোগ-সুবিধে প্রভৃতির ক্ষেত্রে এক একজন নাগরিক যা কিছু লাভ করে, তা-ই তার রাজনৈতিক অধিকার রূপে গণ্য।

-উসুলুল কানুন লিদদাকতুর সিনহুরা, ২৬৮ পৃ.।

অথবা তারা সংজ্ঞা হবেঃ

***********আরবী************

রাষ্ট্রের আওতায় রা তার বিধান অনুযায়ী ব্যক্তি যা কিছু লাভ করে তা-ই তার রাজনৈতিক অধিকার।- আল কানুনুদ্দুয়ালীলখাস লিদদাকতুর জাবের জাদ, ১ম খণ্ড, ২৭২ পৃ.।

এ দৃষ্টিতে ইসলামী শরীয়ত ব্যক্তিকে কি সব অধিকার দিয়েছে, অতঃপর আমরা তার উল্লেখ করবো। তাতে করে শরীয়তের দেয়া অধিকার ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের বিবৃত অধিকারে যে কোনো বিরোধ বা পার্থক্য নেই, তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

নির্বাচনের অধিকার
রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনঃ দেশে রাষ্ট্রপ্রধান কে হবে, সে ব্যাপারে মত জানানোর অধিকার রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের। ফলে নাগরিকগণ যে ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপ্রধান পদের জন্য নির্বাচিত করবে সে-ই হবে রাষ্ট্রপ্রধান। ইসলামী রাষ্ট্র বিজ্ঞানীগণ এ পর্যায়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাদের একটি স্পষ্ট উক্তি হলোঃ

************আরবী*************

যে ব্যক্তিত্বের নেতৃত্ব সম্পর্কে মুসলিম নাগরিকগণের মতৈক্য হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে যার হাতে বাইয়াত হবে তারাই ইমামত (রাষ্ট্রপ্রধান) হওয়া স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তারই সাহায্য-সহযোগিতা করা সকলের প্রতিই অবশ্য কর্তব্য।

-আলমুগান্নী লে-ইবনে কুদামা হাম্বলী, ৮ম খণ্ড, ১০৬ পৃ.।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেনঃ

*********আরবী**************

রাষ্ট্রের নেতৃত্ব জনগণের বাইয়াতের ভিত্তিতে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ জনগণ যখন কারোর হাতে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব অর্পণ করে, তখনি সে রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারে, পূর্ববর্তী কোনো পদাধিকার বলে নয়।-মিনহাজুস সুন্নাত, ১ম খণ্ড, ১৪২ পৃ.।

এসব সংজ্ঞা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, রাষ্ট্রপ্রধান হবে সে, যাকে সমাজের জনগণ রাষ্ট্রপ্রধানরূপে বাছাই ও নির্বাচিত করবে এবং তার প্রতি এ জন্যে সন্তুষ্ট থাকবে। জনগণের এ অসন্তোষ ও নির্বাচনের ফলেই এক ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব লাভ করতে পারে। এছাড়া অন্য কোনো উপায়ে নয়।

কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের ব্যাপারে জনগণের এই যে অধিকার তার ভিত্তি কি?…..কি কারণে জনগণের এ অধিকার স্বীকৃত হচ্ছে?

এ অধিকারের ভিত্তি সংস্থাপিত হয়েছে পরামর্শ নীতির ওপর। ইসলামী শরীয়ত এ পরামর্শ নীতির ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। সমাজ যেহেতু শরীয়তের বিধান কার্যকরী করার জন্যে দায়ী এবং সে দায়িত্ব এই পারস্পরিক পরামর্শ নীতির ভিত্তিতেই প্রতিপালিত হতে পারে। আর সে কারণেই রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগের ব্যাপারে ব্যক্তির পরামর্শ দানের অধিকার অনস্বীকার্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আর এ পরামর্শ নীতির মূল উৎস হচ্ছে কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াত। ইরশাদ হয়েছেঃ

**********আরবী*************

মুসলমানদের যাবতীয় ব্যাপারে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করতে হবে।-সূরা আশ শুরাঃ ৩৮

এ আয়াতাংশ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছে যে, মুসলমানদের সকল ব্যাপার বিশেষভাবে যাবতীয় গুরুতর সামাজিক ও জাতীয় ব্যাপার পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সুসম্পন্ন করতে হবে। আর রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগের ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল জাতীয় ও সামাজিক ব্যাপার। কেননা, রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে পূর্ণ আত্মবিশ্বাস সহকারে কাজ করার জন্যে প্রয়োজন তার পিছনে সক্রিয় জনসমর্থন বর্তমান থাকা। এ সমর্থন আচে কি নেই, কত সংখ্যক লোকের রয়েছে, কত সংখ্যকের নেই, বেশীরভাগ লোকের এ সমর্থন বা আস্থা রয়েছে কার ওপর, তা নিঃসন্দেহে জানার একটি মাত্র উপায়-ই হতে পারে। সে উপায় হলো জনগণের রায় জানার জন্যে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন। অতএব রাষ্ট্রের প্রত্যেক ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপ্রধানরূপে সে কাকে পেতে চায়-কার ওপার আস্থা আছে, তা জানার অধিক-সুযোগ দিতে হবে।

দ্বিতীয়, শরীয়ত কার্যকর করণ জাতীয় দায়িত্ব। শরীয়তের আইন-বিধান কার্যকর ও জারী করার দায়িত্ব সমজের, জাতির, জনগণের। সে জন্যে বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণ করা সমাজ ও জাতির-ই কর্তব্য। কুরআন থেকে এ বিধান অকাট্যভাবেই প্রমাণিত। আর তার সমর্থনে ইতিহাস অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রকট। কুরআন মুসলিম সমাজ ও জাতিকে সম্বোধন করে নির্দেশ দিয়েছে এই বলেঃ

**********আরবী***********

হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী হয়ে উঠো আল্লাহর জন্যে সাক্ষদাতারূপে তা যদি তোমাদের নিজেদের, তোমাদের পিতা-মাতা, ও আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধেও যায়, তবুও।

বলা হয়েছেঃ

****************আরবী*********************

ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার মেয়েলোক পরস্পরের পৃষ্ঠপোষক। তারা সবাই ভালো কাজের আদেশ করে ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।

*****************আরবী****************

তোমাদের রবের কাছ থেকে যা-ই নাযিল হয়েছে তা-ই তুমি পালন করে চলো।-সূরা আল আরাফঃ ৩

*******************আরবী*****************

ব্যভিচারী নারী ও পুরুষ প্রত্যেককেই একশটি কোড়া মারো।-সূরা আন নূরঃ ২

*******************আরবী*****************

পুরুষ চোর ও মেয়ে চোর-প্রত্যেকেরই হাত কেটে দাও।

কুরআন মজীদের এ আয়াতসমূহে এবং এমনিতর আরো বহু সংখ্যক আয়াত স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, শরীয়তের আইন বিধান কার্যকর করা এবং এ কার্যকারিতার জন্যে বাস্তব ও সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব মুসলিম সমাজের।

এ সামাজিক ও জাতীয় দায়িত্ব পালনের জন্যেই সমাজের পক্ষ থেকে এক ব্যক্তির প্রত্যক্ষভাবে দায়িত্বশীল হওয়া একান্তই অপরিহার্য। সেই দায়িত্বশীল ব্যক্তি সমাজ ও জাতীয় দায়িত্বশীল প্রতিনিধি হিসাবে এসব কর্তব্যসমূহ যথাযথ মর্যাদা সহকারে পালন করবে।

কেননা, শরীয়তের তরফ থেকে গোটা সমাজ ও জাতির ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, সমাজ ও জাতি হিসাবে তাতো পালন করতে পারে না। সমাজের সকলে মিলে এক সাথে এ কাজ করা অসম্ভব। এ কারণেই প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আদিম কাল থেকে সভ্য সমাজের শৃঙ্খলা বিধানের জন্যে। তাই সমাজ ও জাতি-ই তাদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি নির্বাচন করবে, যেন সমাজের ওপর আরোপিত দায়িত্ব সমাজের পক্ষ থেকে সে পালন করতে পারে। অতএব এ প্রতিনিধি নির্বাচন করার ব্যাপারে প্রত্যেক ব্যক্তির অধিকার অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত ও স্বাভাবিক। এ অধিকার সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন-কোনো আপত্তিই তোলা যেতে পারে না। কেননা, যে লোক যে জিনিসের মালিক সে জিনিসের ব্যাপারে প্রতিনিধি বা উকিল নিয়োগ করার অধিকার তারই থাকতে পারে, অন্য কারোর নয়। আর রাজনীতির দৃষ্টিতে জাতি-মুসলিম সমাজই-রাষ্ট্রের মালিক। সে মালিকানায় শরীক প্রত্যেকটি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে এবং সমষ্টিগতভাবেও। অতএব সে রাষ্ট্রের ব্যাপারে প্রতিনিধি নিয়োগের অধিকার প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগতভাবেও এবং সমষ্টিগতভাবেও। তাই রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগে প্রত্যেক ব্যক্তির ভোট দেয়ার অধিকার-প্রত্যক্ষভাবে, পরোক্ষ নয়-প্রত্যেকটি নাগরিকের। এ অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করার অধিকার কারোরই থাকতে পারে না।

জাতিই সার্বভৌমত্বের উৎস
রাষ্ট্রপ্রধান যখন জাতির প্রতিনিধি, তখন একথা স্পষ্ট যে, তাকে প্রতিনিধি নিয়োগকারী জাতিই হবে সার্বভৌমত্বের উৎস। এজন্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়ঃ রাষ্ট্রপ্রধান জাতির নামে ও জাতির প্রতিনিধি হিসাবেই সার্বভৌমত্বের প্রয়োগ করে।

সেই সাথে একথাও মনে রাখতে হবে যে, জাতি যদিও এ সার্বভৌমত্বের উৎস কিন্তু তার সার্বভৌমত্ব কোনো অসীম ক্ষমতার অধিকারী নয়, নয় নিরঙ্কুশ। বরং তা আল্লাহর অসীম-অশেষ-সর্বাত্মক সার্বভৌমত্বের অধীন, তারই দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বাস্তবায়িত হয়েছে তারই ব্যক্তি ও সমষ্টির জন্য দেয়া শরীয়তের বিধানের মাধ্যমে। এ থেকেই বুঝা যায় যে, জাতির সার্বভৌমত্ব হচ্ছে প্রশাসন সংক্রান্ত, কার্যকর করার সার্বভৌমত্ব-এর সার্বভৌমত্ব। তা অসীমও নয়, জন্মগতও নয়, নয় নিজস্ব অর্জিত কিছু। কাজেই সে সার্বভৌমত্ব আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে না, আল্লাহর বিধানের বিপরীত পন্থায় ও কাজে তা প্রয়োগও করতে পারে না। আল্লাহর বিধানকে তা পরিবর্তনও করতে পারে না। আর জাতিই যখন আল্লাহর শরীয়ত বদলাতে পারে না, তার বিরুদ্ধতা করতে পারে না, তাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে না, তখন রাষ্ট্রপ্রধান-যে হলো জাতির প্রতিনিধি, নির্বাচিত-ভারপ্রাপ্ত, সেও এরূপ কাজ করার অধিকারী নয়। কেননা, রাষ্ট্রপ্রধানের নিয়োগকারী জাতি যে কাজ করার অধিকার দেয়নি, সে কাজ করার কোনো অধিকার তার কেমন করে থাকতে পারে।

এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, জাতি যদি আল্লাহর শরীয়তের বিপরীত কোনো আইন প্রণয়ন করে বা তার বিপরীত কোনো ফরমাশ বা অর্ডিনেন্স জারী করে অথবা জাতির প্রতিনিধি রাষ্ট্রপ্রধান তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে এ উভয় অবস্থায়ই এ কাজটি শরীয়তের সনদবিহীন বলে গণ্য হবে এবং সার্বভৌমত্বের নির্দিষ্ট সীমালঙ্ঘন করার কারণে তা বাতিল হয়ে যাবে। কেননা জাতির সার্বভৌমত্ব হলো বাস্তবায়নের সার্বভৌমত্ব। তার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হচ্ছে আল্লাহর শরীয়তকে কার্যকর করার মধ্যে, কোনো নতুন শরীয়ত বা শরীয়ত বিরোধী আইন রচনা করে তা জারি করার মূলগতভাবেই তার কোনো অধিকার নেই।

প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও পরোক্ষ নির্বাচন
রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করা জাতির এক সাধারণ ও মৌলিক অধিকার। কিন্তু এ অধিকার তারা কিভাবে প্রয়োগ করবে? জাতির ব্যক্তিগণ প্রত্যক্ষ ও সরাসরিভাবে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করবে, না পরোক্ষভাবে? সত্যি কথা হচ্ছে এই যে, শরীয়তে এ ব্যাপারে স্পষ্ট ও অকাট্যভাবে কোনো পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। বরং তা জাতির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে, তারা দেশ-স্থান-কাল খেদে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যে কোনো একটা পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে। এ উভয় ধরনের নির্বাচনের-ই অবকাশ ইসলামী শরীয়তে স্বীকৃত। তবে কুরআনের আয়াতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের সনদই অনেকটা স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়।

কুরআনের আয়াত

*******************আরবী*****************

তাদের যাবতীয় ব্যাপারে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতেই মীমাংসিত হয়।-সূরা আশ শুরাঃ ৩৮

বাহ্যত ও স্পষ্টত প্রত্যক্ষ নির্বাচনকেই সমর্থন করে। আর রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন যেহেতু গোটা জাতির একটা সাধারণ অধিকার ও দায়িত্বের ব্যাপার, কাজেই এ কাজের জন্যে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যেন শরীয়ত অনুযায়ী ভোটের অধিকারী প্রত্যেকটি মানুষই ভোটদান করতে পারে। এ ছোট আয়াতের ভিত্তিতে আমরা এইমাত্র যা কিছু বললাম তার স্পষ্ট সমর্থন পাওয়া যায়, এ আয়াতের বিভিন্ন তাফসীরে। ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী লিখেছেনঃ

*******************আরবী*****************

যখন কোনো ঘটনা সংঘটিত হতো তখন তারা সকলে একত্রিত হতেন এবং পরস্পর পরামর্শ করতেন। এজন্যে আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে তাদের প্রশংসা করেছেন। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, তাঁরা কেউ নিজের ব্যক্তিগত মতে ভিত্তিতে কাজ করতেন না। বরং সবাই একত্রিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা কোনো সিদ্ধান্তই গ্রহণ করতেন না।

-তাফসীরুর রাজী, ৩৭খণ্ড, ১৭৭পৃ.।

অবশ্য পরোক্ষ নির্বাচনের সমর্থন পাওয়া যায় ইসলামের স্বর্ণযুগের ইতিহাসে খিলাফতে রাশেদার নির্বাচনের। এ ছিলো ইসলামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠার যুগ। খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রত্যেকের নির্বাচনে প্রথমে অংশগ্রহণ করে মুসলিম জাতির অল্পসংখ্যক লোক। ইসলামী রাষ্ট্র বিজ্ঞানের পরিভাষায় তাদের বলা হয় আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ-দায়িত্ব সম্পন্ন সমঝদার লোক। পরে মদীনায় অবস্থিত অপরাপর লোকেরা তাদের অনুসরণ করেছে, তারাও তাকেই খলীফারূপে মেনে নিয়েছে যাকে ইতিপূর্বেই সমাজের দায়িত্বশীল লোকেরা খলীফা পদে বরণ করে নিয়েছে। সমস্ত মুসলমান একত্রে একমত হয়ে কোনো খলীফাকেই নির্বাচিত করেনি। এ বিষয়ে যেমন খলিফাগণ নিজেরা কোনো আপত্তিও তোলেননি, তেমনি জনগণের মধ্য থেকেও এ সম্পর্কে কোনো আপত্তি উত্থাপিত হয়নি। ফলে রাষ্ট্রপ্রধানের এ পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতির যুক্তিযুক্ততার ওপর তাদের ইজমা হয়েছে বলা চলে। পরোক্ষ নির্বাচনের স্বপক্ষে এটি এটি দলীল বটে। অতএব রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উভয়ের যে কোনো একটি পদ্ধতি গ্রহণ করার অধিকার জাতির রয়েছে বলা চলে। কেননা কোনো অধিকার সম্পন্ন ব্যক্তি নিজেই তার অধিকারের কাজটি সম্পন্ন করবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। বরং সে ইচ্ছে করলে এ কাজের জন্যে স্বেচ্ছায় অপর একজনকে দায়িত্বশীলও বানাতে পারে। ইসলামের ফকীহগণও এ পরোক্ষ নির্বাচনের স্বপক্ষেই মত জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেনঃ রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করা আহলুল হল্লে ওয়াল আকদেরই দায়িত্ব। অতএব এ কাজে সমগ্র জাতিকে যোগদান করানো কোনোই প্রয়োজন নেই। আল্লামা ইবনে খালদুন তার ইতিহাসের ভূমিকায় লিখেছেনঃ

*************আরবী*****************

একথা যখন স্থির হলো যে, খিলাফতের পদ কায়েম করা সর্বসম্মতভাবে ওয়াজিব তখন তা ফরযে কেফায়া পর্যায়ের কাজ এবং তা সম্পাদনের ভার আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ-এর ওপর বর্তাবে। এ কাজ সম্পাদন করা তাদেরই দায়িত্ব এবং জনগণের উচিত তাঁদের নির্বাচনকে মেনে নেয়া।-মুকাদ্দমা ইবনে খালদুল, ১৯৩ পৃ.।

ইমাম মারওয়ারদী এ সম্পর্কে লিখেছেনঃ

***************আরবী****************

ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন দুভাবে হতে পারেঃ হয় তা আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ-এর ভোটে ও নির্বাচনে অনুষ্ঠিত হবে, না হয় পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপ্রধানের মনোনয়নে।-আল মাওয়ারদী, ৪র্থ পৃষ্ঠা।

কিন্তু ইসলামী ইতিহাসের এই ব্যাখ্যা-ই চূড়ান্ত, এর অন্য কোনো রূপ ব্যাখ্যা চলে না-এমন কথা বলা যায় না। আমরাও এর একটা ব্যাখ্যা পেশ করতে পারি এবং তা এভাবে যে, খোলাফায়ে রাশেদীনের সব কয়জনেরই নির্বাচন সাধারণ ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন তখনকার সময়ে ও তদানীন্তন ভৌগলিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক দিয়ে সম্ভবপর ছিলো। প্রত্যেক খলীফার নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে এ ব্যাখ্যা কিছুমাত্র ভিত্তিহীন বিবেচিত হবে না। বিশেষত কুরআন মজীদ থেকে যখন প্রত্যক্ষ নির্বাচনেরই সমর্থন পাওয়া যায়, তখন তার বিপরীত ব্যাখ্যা দেয়ার কোনো প্রয়োজন থাকতে পারে না।

আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ
রাষ্ট্র প্রধানের নির্বাচন যদি পরোক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়-যেমন ইসলামী শরীয়ত তাকে সমর্থন করেছে, তখন যারা তাকে প্রথম নির্বাচিত করে ফিকাহবিদগণ তাদের নাম দিয়েছেন আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ। কিন্তু এ আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ কারা? জাতির সাথে তাদের সম্পর্ক কি? আর তারা এ মর্যাদা পায়-ই কি করে?

পয়লা সওয়ালের জবাব হলো, ফিকাহবিদগণ কতগুলো গুণের উল্লেখ করেছেন, এ গুণ যাদের রয়েছে তারাই আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ। আল্লামা মাওয়ারদী এ পর্যায়ের তিনটি গুনের কথা উল্লেখ করেছেনঃ এক, পূর্নাঙ্গ আদালত-সুবিচার-ন্যায়বাদী-বিশ্বস্ত হওয়া। দুই, শরীয়তের নির্দিষ্ট শর্তের ভিত্তিতে জাতির মাঝে কোন লোকটি রাষ্ট্রপ্রধান বা সমাজ-ইমাম হওয়ার যোগ্য অধিকারী তা জানার ও বুঝার মতো জ্ঞান ও ইলম। তিন, জনগণের সার্বিক কল্যাণের দিক দিয়ে ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার অধিক যোগ্য ব্যক্তি চিনার ও বাছাই করার মতো বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা। এ তিনটি গুণ সমাজের যেসব লোকের বেশী আছে, তারাই আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ হওয়ার যোগ্য। কোনো কোনো মুহাদ্দিস-ফকীহ এ পর্যায়ের গুণাবলীর আরো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। আল্লামা রশীদ রেজা মিছরী তাঁর তাফসীরে লিখেছেনঃ

***********আরবী*****************

উলুল আমর হচ্ছে মুসলমান সমাজের সবকিছু ভাঙ্গা-গড়ার জন্যে দায়িত্বশীল। আর তারা হচ্ছে উচ্চ পর্যায়ের রাজন্যবর্গ, সর্বোচ্চ শাসক, আলেম-শিক্ষিত, সেনাবাহিনীর প্রধান প্রধান ব্যক্তিরা, আর জনগণ নিজেদের প্রয়োজনে ও সার্বিক কল্যাণের ব্যাপারে যেসব চিন্তাশীল-বুদ্ধিমান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির প্রতি রুজু করে-আস্থা রাখে-তারা।

-তাফসীরুল মানার, ৫ম খণ্ড, ১৮১ পৃ.।

একথা থেকে বুঝা গেল যে, আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ বলতে বুঝায় সমাজের এমন সব লোককে যারা জনগণের অনুসরণীয়, আস্থাভাজন যাদের মতামত জনগণ মেনে নেয়, তার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেয়।-এজন্যে যে, তাদের ভিতর নিঃস্বার্থতা, দৃঢ়তা, আল্লাহভীতি, সুবিচার ও ন্যায়-নিষ্ঠা, নির্ভুল রায় দান, সব ব্যাপারে গভীর তাৎপর্য অনুধাবন এবং সর্বোপরি জনকল্যাণের উদ্যম-আগ্রহ বিদ্যমান।

দ্বিতীয় সওয়াল-জাতির সাথে আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ-এর সম্পর্ক সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, এরা হবে জাতির প্রতিনিধি, উকিল-তাদের পক্ষ থেকে তাদের জন্য কর্মসম্পাদনের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। তারা জনগণের পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করবে। অন্য কথায় নির্বাচনের অধিকার প্রয়োগের জন্য তারা হবে তাদের মনোনীত প্রতিনিধি। আর এজন্যে তাদের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন হবে কার্যত জাতির রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের সমপর্যায়ভুক্ত।

তৃতীয় সওয়াল- জাতীয় ব্যাপারে তারা আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ পর্যায়ভুক্ত হবে কেমন করে। এর জবাব এই যে, একথা তো স্পষ্ট যে, জাতিই তাদের এ মর্যাদায় অভিষিক্ত করবে তাদের নিজস্ব বাছাই নির্বাচনের মাধ্যমে। আর অতীত ইতিহাস আমাদের বলে দেয়, জাতির লোকেরা একত্রিত হয়ে প্রথমে নিজেদের ইচ্ছায় স্বাধীনভাবে তাদের নির্বাচন করে নেবে। এ নির্বাচন আনুষ্ঠানিকভাবেও হতে পারে, আবার তাদের স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠিত মর্যাদার ভিত্তিতেও হতে পারে।

খিলাফতে রাশেদার যামানায় যেসব লোক এ মর্যাদায় অভিষিক্ত ছিলেন তারা নিজেদের স্বাভাবিক নীতি-নিষ্ঠা, ইসলাম পালনে অগ্রগণ্যতা ও জনকল্যাণকামী হওয়ার দিক দিয়ে স্বতঃই এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেখানে এজন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন দেখা দেয়নি। কেউ তাদের এ মর্যাদাকে চ্যালেঞ্জ করেনি কখনো। এমনকি বলা যেতে পারে যে, তখন যদি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন করানো হতো, তাহলে এরাই এ পদমর্যাদায় নির্বাচিত হতেন। কাজেই তারা যখন প্রয়োজন মত রাষ্ট্রপ্রধান খলীফা নির্বাচন করেছে তখন জাতির প্রতিনিধি হিসাবেই তা করেছে। জনগণ তাদের নির্বাচনের বিরুদ্ধে কখনো গররাজি হয়নি, দ্বিমত প্রকাশ করেনি। বরং তাঁকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করে নির্বাচিত খলীফার হাতে বাইয়াত করেছে অকুণ্ঠ আগ্রহ ও ভক্তি সহকারে।

 

বর্তমান সময়ে আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ নির্বাচনের উপায়
বর্তমান সময়ে পরোক্ষ নির্বাচন-নীতিতে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন পদ্ধতি গ্রহণ করা হলে প্রথমে এক সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ নির্বাচিত করা যেতে পারে। তারা জাতির ভোট ও আস্থা পেয়ে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের জন্যে জাতির পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল হবে। এ উদ্দেশে জনগণ যাদেরকে নির্বাচিত করবে তারা নির্বাচনী কলেজের সদস্য হতে পারে। অথবা প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্যও হতে পারে। নির্বাচনী কলেজ হলে তাদের একমাত্র কাজ হবে নির্বাচনকালে ভোটদান করা এবং ভোট দানের কাজ সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের সদস্য পদ বাতিল হয়ে যেতে ও এ কলেজ ভেঙ্গে যেতে হবে। তাদের দ্বারা অপর কোনো কাজই নেয়া যেতে পারে না।

অলী আহাদ নিয়োগ
ফিকাহবিদগণ বলেছেনঃ রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের কাজ সম্পন্ন হতে হবে পূর্ববর্তী খলীফার মনোনয়নে পরবর্তী খলীফা নিয়োগ নীতির ভিত্তিতে। মাওয়ারদী বলেছেনঃ রাষ্ট্রপ্রধান দুভাবে নির্বাচিত হতে পারেঃ এক, আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ-এর নির্বাচনের মাধ্যমে। দুই, পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপ্রধানের মনোনয়নের ভিত্তিতে। আল মাওয়ারদী, ৪ পৃষ্ঠা।

এভাবে অলী আহাদ নিয়োগের রীতি কেমন করে গণতণ্ত্রসম্মত বা গণনির্বাচনের পর্যায়ে গণ্য হতে পারে?-এ একটা প্রশ্ন। এর জবাব এই যে, অলী আহাদ নিয়োগের অধিকারটি মূলত নামের প্রস্তাবনা পর্যায়ের মাত্র। খলীফা নিজের হিসাবে তিনি কাকে পসন্দ করবেন তার নাম প্রস্তাব করবেন মাত্র। কিন্তু তার এ প্রস্তাবই চূড়ান্ত নিয়োগ নয়। খলীফা মৃত্যুর পূর্বে কারোর নাম বলে গেলেই জনগণ তার পরে তাকেই খলীফা মেনে নিতে বাধ্য নয়। এ কারণেই যেখানে যেখানে এরূপ অলী আহাদ নিয়োগ হয়েছে, সেখানেই পরবর্তী সময়ে আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ -এর লোকদের বাইয়াত করতে হয়নি। যদি প্রস্তাবনা-ই খলীফা নিয়োগের জন্যে যথেষ্ট হতো, তাহলে এ বাইয়াতের কোনো প্রয়োজন হতো না। এমনকি এরূপ নাম প্রস্তাবনার পরেও জনগণ তাকে খলীফারূপে মেনে নিতে অস্বীকার করারও অধিকার রাখে।

নবী করীম স.-এর মৃত্যু শয্যায় শায়িত থাকাকালীন একটি কথা থেকেও একথাই অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। তিনি তাঁর পরবর্তী ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান কে হবেন, সে চিন্তায় অস্থির পয়ে পড়েছিলেন। তখন হযরত আয়েশা রা.-কে ডেকে একদিন বললেনঃ

************আরবী**************

আমি আবু বকর ও তাঁর পুত্রকে ডাকবো ও তাঁর পক্ষে পরবর্তী খলীফা হওয়ার ওয়াদা গ্রহণ করবো। যেন পরে আপত্তিকারীরা আপত্তি না করে কিংবা আশা পোষণকারীরা আশা পোষণ না করে। পরে আমি চিন্তা করলাম যে, আল্লাহ এসব রুখবেন এবং মুসলমানরা তার প্রতিরোধ করবে অথবা অন্য কথায় আল্লাহ প্রতিরোধ করবেন ও মুসলমানরা রুখে দাঁড়াবেন।-বুখারী

এ হাদীসের শব্দ ***আরবী*** আল-মুমিনুন অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, খলীফা নির্বাচনের কাজ মুমিন-মুসলমানের স্বাধীন ইচ্ছা ও মতের ভিত্তিতে সম্পন্ন হতে হবে এবং ইসলামে খলীফা নির্বাচনের উত্তম ও উন্নত আদর্শ হচ্ছে এ নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক পদ্ধতি।

হযরত আলী রা. -কে যখন লোকেরা খিলাফতের বাইয়াত গ্রহণ করতে বললেন, তখন তিনি বললেনঃ

***আরবী***

আমার বাইয়াত গোপনে অনুষ্ঠিত হবেনা এবং তা মুসলিম জনগণের স্বাধীন ইচ্ছা ও মর্জি ছাড়া কিছুতেই হতে পারে না।

এ কারণে কোনো কোনো ফিকাহবিদ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ

***আরবী***

রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন সম্পূর্ণ হয় জনগণের বাইয়াতের ভিত্তিতে। জন-সমর্থনের মাধ্যমে। পূর্ববর্তী খলীফার মনোনয়নের ভিত্তিতে নয়।

-মিনহাজুস সুন্নাহঃ ইবনে তাইমিয়া, ১ম খণ্ড, ১৪২ পৃ.।

এ হলো জনগণের অধিকারের ব্যাপার। জনগণের আর একটি অধিকার হলো পরামর্শে শরীক হওয়ার। আসলে এ হলো জনগণের খলীফা নির্বাচনের পরবর্তী দায়িত্বের কাজ। জনগণ রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করবে, রাষ্ট্রপ্রধান হবে জনগণের যাবতীয় জাতীয় ও সামগ্রিক দায়িত্বসম্পন্ন কাজের ভারপ্রাপ্ত। সেই সাথে তার ওপর জাতির অধিকার হলো এই যে, সেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে জাতির পরামর্শ গ্রহণ করবে-পরামর্শ চাইবে এবং জাতি যে পরামর্শ দিবে সে তদনুযায়ী কাজ করবে।

যদি প্রশ্ন করা যায় যে, রাষ্ট্রপ্রধান তো স্বতঃ-ই জনগণের আস্থাভাজন ব্যক্তি। তাহলে আবার জনগণের পরামর্শ গ্রহণে তাকে বাধ্য করার অর্থ কি? তাহলে এর দুভাবে জবাব দেয়া যেতে পারেঃ

একঃ রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের আস্থাভাজন ব্যক্তি এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে, জনগণের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে। তাই সব গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ব্যাপারে তাদের কাছে পরামর্শ চাওয়া ও তদনুযায়ী কাজ করা কর্তব্য। তাহলে এ পর্যায়ের অনেক ভুল ও মারাত্মক পদক্ষেপের হাত থেকে জাতি রক্ষা পেতে পারে।

দুইঃ জাতি রাষ্ট্রপ্রধানকে জাতীয় কাজের জন্য দায়িত্বসম্পন্ন বানায় বটে, কিন্তু তা শর্তহীন নয়। তার মধ্যে একটি জরুরী শর্ত হলো এই যে, সে জাতির কাছে পরামর্শ চাইবে। কেননা, পরামর্শ চাওয়ার নির্দেশ শরীয়তে স্পষ্ট ভাষায় দেয়া হয়েছে। এ অধিকার জনগণের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। তাদের সে অধিকার হতে কিছুতেই বঞ্চিত করা যেতে পারে না। কেননা রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতা তা শরীয়তের বিধানের শর্তে সীমাবদ্ধ। সে শর্ত পূরণ না হলে রাষ্ট্রপ্রধান তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। নির্বাচনের সময় একথা স্পষ্ট ভাষায় বলা হোক আর না-ই হোক একথা একান্তই অনিবার্য। আর জাতির পরামর্শ পাওয়ারও অধিকার রয়েছে রাষ্ট্রপ্রধানের। এ অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত হতে দেয়া যেতে পারে না।

রাষ্ট্রপ্রধানকে যে জাতির কাছে পরামর্শ চাইতে হবে এ বিষয়ে কুরআনের নির্দেশ স্পষ্ট ও অকাট্য। রসূলে করীম স.-কে রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবেই এ নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এবং সে হিসাবে সব ইসলামিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের জন্যেই এ নির্দেশ অবশ্য পালনীয়। সে নির্দেশ হলোঃ

***আরবী***

তুমি তাদের ক্ষমা করো, তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে মাগফেরাত চাও। আর জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারসমূহে তাদের সাথে পরামর্শ করো। অনন্তর তুমি যখন কোনো সংকল্প-সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তখন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করো।-সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৯

এ আয়াতটি রাষ্ট্রপ্রধানকে পরামর্শ চাওয়া ও গ্রহণ করার জন্যে স্পষ্ট নির্দেশ দিচ্ছে এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে তা ওয়াজিব। এজন্যে ইমাম ইবনে তাইমিয়া লিখেছেনঃ

***আরবী***

কোনো রাষ্ট্রপ্রধান-ই পরামর্শ চাওয়া ও গ্রহণ করার দায়িত্ব থেকে মুক্ত নয়। কেননা এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে এজন্যে নির্দেশ দিয়েছেন। -আসসিয়াসাতুশ শারইয়্যা, ১৬৯ পৃষ্ঠা।

আর আল্লামা তাবারী এ আয়াতের তাফসীরে লিখেছেনঃ

***আরবী***

আল্লাহ তাঁর নবীকে আসহাবগণের সাথে পরামর্শ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশ সেই পরামর্শ গ্রহণের জন্যে, যে বিষয়ে আল্লাহ তাঁদের প্রশংসা করেছেন যেন তাঁর উম্মতেরা তাদের ওপর অনুরূপ অবস্থা দেখা দিলে তারা তাদের অনুসরণ করে ও পারস্পরিক পরামর্শ করে। -তাফসীরে তাবারী, ৪র্থ খণ্ড, ৯৪ পৃষ্ঠা ও তাফসীরে কুরতুবী, ৪র্থ খণ্ড, ২৫ পৃষ্ঠা।

আর ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী লিখেছেনঃ

***আরবী***

হাসান বছরী ও সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ বলেছেনঃ আল্লাহ নবী করীম স.-কে পরামর্শ গ্রহণের জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তারা পরামর্শ গ্রহণের ব্যাপারে তাঁর অনুসরণ করে। আর এ নীতি তাঁর উম্মতের মধ্যে সুন্নাহরূপে অনুসৃত হয়। – তাফসীরুল কবীর, ৯ম খণ্ড, ৬৬ পৃষ্ঠা।

পরামর্শ গ্রহণের রসূল স.-এর সুন্নাত
পরামর্শ গ্রহণ করা শাসকদের উপর জনগণের একটা অধিকার। নবী করীম স. এতো বড় সম্মান-মর্যাদা ও আসমানী ওহী পাওয়ার সুযোগ সত্ত্বেও তাঁর আসহাবদের সাথে খুব বেশী পরামর্শ করতেন। উহুদ যুদ্ধে মদীনার বাইরে গিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করা হবে, না শহরে বসেই প্রতিরোধ করা হবে, এ নিয়ে সাহাবাগণের সাথে পরামর্শ করতেন। বদর যুদ্ধেও তা-ই করেছেন। এ যুদ্ধে হুবার ইবনে মুনযিল পানির স্থানে অবতরণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। রসূলে করীম স. সে পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন। খন্দকের যুদ্ধে মদীনার কিছু ফসলের বিনিময়ে শত্রুদের সাথে সন্ধি না করার-যেন তারা ফিরে যায়-দুজন সাহাবী পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ পরামর্শও গৃহীত হয়েছিলো।-তাফসীরে ইমাম রাজী, ৯ম খণ্ড, ৬৭ পৃষ্ঠা। এমনিভাবে নবী করীম স. যে সাহাবাদের সাথে খুব বেশী পরামর্শ করতেন তার ভুরি ভুরি নযীর উল্লেখ করা যায়।

পরামর্শ গ্রহণ না করা অপরাধ
পরামর্শ দেয়া জনগণের অধিকার। রাষ্ট্রপ্রধানের তাই চাওয়া কর্তব্য। ফিকাহবিদগণ স্পষ্ট করে লিখেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান যদি এ কর্তব্য পালন না করে এবং জনগণকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখে তবে এজন্যে তাকে পদচ্যুত করতে হবে। ইমাম কুরতুবী লিখেছেনঃ ইবনে আতীয়া বলেছেনঃ পরামর্শ গ্রহণ রীতি ইসলামী শরীয়তের মৌল ব্যাপার। এজন্যে শরীয়তের সুস্পষ্ট নির্দেশ এসেছে। যে রাষ্ট্রপ্রধান দীন ও শরীয়তের বিজ্ঞ-বিশেষজ্ঞদের কাছে পরামর্শ চাইবে না, তাকে বরখাস্ত করা ওয়াজিব। অন্য কথায় ইসলামী আদর্শে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো স্বৈরাচারী শাসকের স্থান নেই।

কোন কোন বিষয়ে পরামর্শ
জাতির জনগণের সাথে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। আর যেসব বিষয়ে ইসলামের অকাট্য ঘোষণা বা নির্দেশ নেই সেসব ইজতেহাদী বিষয়েও পরামর্শ অনুষ্ঠিত হতে হবে। এক কথায় রাষ্ট্রপ্রধান দীন ও দুনিয়ার নানা বিষয়ে জাতির সাথে পরামর্শ করবে-পরামর্শ চাইবে ও গ্রহণ করবে। আল্লামা জাসসাস তাই লিখেছেনঃ

***আরবী***

দুনিয়ার বৈষয়িক যাবতীয় বিষয়ে এবং দীনের যেসব বিষয়ে কোনো ওহী নাযিল হয়নি সে সম্পর্কে পরামর্শ চাইতে হবে।-আহকামুল কুরআন, ২য় খণ্ড, ৪০ পৃ.।

আর দুনিয়ার বা বৈষয়িক যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে, যুদ্ধ প্রস্তুতি ও যুদ্ধ ঘোষণা, বৈদেশিক নীতি, চুক্তি-সন্ধি, রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতি ইত্যাদি সব-ই এ পর্যায়ে গণ্য। অবশ্য নিত্য-নৈমিত্তিক ছোট ছোট ব্যাপারে জনগণের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণের কোনো প্রয়োজন নেই। তা সম্ভবও নয়। তা করে রাষ্ট্র চালানো যায় না। তা যুক্তিসঙ্গত নয়, তাতে ফায়দাও কিছু নেই।

পরামর্শ গ্রহণ পদ্ধতি
কিন্তু প্রশ্ন হলো, পরামর্শ গ্রহণের কাজ কিভাবে সম্পন্ন হবে?… আর জাতির সব লোকের সাথেই পরামর্শ করা কি রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব, না তাদের মাঝ থেকে বিশেষ এক শ্রেণীর সাথে পরামর্শ করা হবে কিংবা কতিপয় ব্যক্তির সাথে। এসব প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, নবী করীম স. সমগ্র জনগণের সাথে পরামর্শ করতেন এমন সব ব্যাপারে যা সরাসরিভাবে সমগ্র জনতার সাথে সংশ্লিষ্ট, যা সকলের সামগ্রিক ব্যাপার। যেমন উহুদ যুদ্ধে মুশরিকদের সাথে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে মদীনা থেকে বাইরে যাওয়ার ব্যাপার নিয়ে তিনি মদীনায় অবস্থিত সমস্ত মুসলিম জনগণের সাথে পরামর্শ করেছেন। তিনি সকলকে লক্ষ করে বললেনঃ তোমরা সবাই আমাকে পরামর্শ দাও।

হাওয়াজিনের যুদ্ধে লব্ধ গণিমতের মাল কি করা হবে, তা নিয়েও তিনি মুসলমানদের সাথে পরামর্শ করেছেন। এ যুদ্ধে যত লোক শরীক হয়েছিলো, গনিমতের ব্যাপারে তাদের সকলেরই মত তিনি জানতে চেয়েছিলেন। এ বিষয়ে ইতিহাসে বলা হয়েছে, গনিমতের মালের ব্যাপারে নবী করীম স. যা কিছু করণীয় করেছিলেন, তা সবারই সামনে পেশ করেছিলেন। তখন উপস্থিত সবাই এক বাক্যে বলে উঠেছিলঃ হে রসূল স.! আপনি যা ফায়সালা করেছেন তাতেই আমরা রাজি আছি এবং তা-ই মেনে নিলাম।

তখন নবী করীম স. নেতৃস্থানীয় সাহাবাদের পাঠালেন অনুপস্থিত অন্যান্য মুসলমানদের মত জানার জন্যে। হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত আনসারদের কাছে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তারাও সবাই মেনে নিলো। একজন লোকও তাতে কোনো দ্বিমত প্রকাশ করলো না এবং এসব কথা নবী করীম স.-কে জানিয়ে দেয়া হলো। এভাবে পরামর্শ গ্রহণের এ বিরাট ব্যাপারটি সম্পন্ন হলো। (জনগণ নির্বাচিত কিংবা জনগণের আস্থাভাজন নেতৃবৃন্দের সাথে জাতীয় জটিল বিষয়াদির পরামর্শ গ্রহণের নীতিও রসূলে করীম স. কর্তৃক অনুসৃত হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে তার অসংখ্য দৃষ্টান্ত চির সমুজ্জ্বল। এ পর্যায়ে একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাচ্ছে।

জটিল জাতীয় ব্যাপারসমুহে সমস্ত মুসলমানই ছিলো পরামর্শদাতা। সমস্ত মুসলিম জনগণের কাছেই তিনি পরামর্শ চেয়েছেন। কেননা এ ব্যাপারগুলোই ছিলো সমস্ত জনগণের সাথে সম্পর্কিত।) (ঐ ২৯ পৃ.)।

এসব ঘটনা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, নবী করীম স.-এর সময়ে যুদ্ধ ও গনিমতের মাল বণ্টন ইত্যাদি হাওয়াজিন গোত্রের কাছ থেকে পাওয়া ধন-সম্পদ ও যুদ্ধ বন্দীদের ব্যাপারে কি নীতি অবলম্বিত হবে, নবী করীম স. সে বিষয়টি সম্পর্কে স্বীয় প্রস্তাব এক বিরাট জনসমাবেশে জনতার সামনে পেশ করলেন এবং তাদের মতামত জানতে চাইলেন। জবাবে জনতা সোচ্চার হয়ে উঠলো কিন্তু অসংখ্য লোকের একটি সমাবেশে প্রত্যেকটি মাগরিবের মত সুস্পষ্টরূপে শুনতে পাওয়া ও অধিক সংখ্যক লোক কি মত পোষণ করে তা হিসাব ও যাচাই করা এবং তদ্দৃষ্টে কোনো চূড়ান্ত ফায়সালা গ্রহণ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার ছিলো। তাই নবী করীম স. সমবেত জনমণ্ডলীকে সম্বোধন করে বললেনঃ

***আরবী***

তোমাদের কে স্বপক্ষে মত দিয়েছে, আর কে বিপক্ষে তা আমি জানতে পারলাম না। কাজেই তোমরা সবাই ফিরে যাও। পরে তোমাদের নির্বাচিত বা মনোনীত ব্যক্তিরা এসে যেন তোমাদের মত আমাকে জানিয়ে দেয়। এর পর লোকেরা ফিরে গেল এবং তাদের নেতৃস্থানীয় লোকেরা তাদের মতামত জেনে নিলো। তারা এসে রসূলে করীম স.-কে জানিয়ে গেল যে, লোকেরা আপনার প্রস্তাবকে ভালো মনে করেছে ও সমর্থন করেছে।

রসূল স.-এর জীবনের এমন অনেক ঘটনারও উল্লেখ পাওয়া যায়, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, তিনি সবারই সাথে নয় বিশেষ সাহাবীর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করেছেন। বদর যুদ্ধে যেসব কাফের বন্দী হয়েছিল তাদের সম্পর্কে কি নীতি গ্রহণ করা হবে সে বিষয়ে সব সাহাবীদের সাথে পরামর্শ না করে তিনি বিশেষ ও বিশিষ্ট সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেছেন। মদীনার এক-তৃতীয়াংশ ফসলের ভিত্তিতে গাতফান গোত্রের সাথে সন্ধি করার ব্যাপারে নবী করীম স. কেবলমাত্র গোত্র-সরদার হযরত সায়াদ ইবনে মুয়ায ও সায়াদ ইবনে ওবাদার সাথেই পরামর্শ করেছিলেন। তখন তাঁরা দুজন বলেছিলেনঃ

এ ব্যাপারটি সম্পর্কে আপনি যদি আসমান থেকে নির্দেশ পেয়ে থাকেন তাহলে আপনি তাই করুন। এ বিষয়ে যদি কোনো নির্দেশ আপনাকে না দেয়া হয়ে থাকে, আর এতে আপনি স্বাধীন হয়ে থাকেন, তাহলেও তা শিরোধার্য। কিন্তু এ যদি শুধু আমাদের মতের ব্যাপার হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের কাছে তাদের জন্যে তরবারি ছাড়া আর কিছু নেই। তখন নবী করীম স. তাঁদের দেয়া পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং গাতফান কবীলার সাথে সন্ধি করার ইচ্ছা ত্যাগ করেন।-আমতাউল আসমা, ২৬৩ পৃ.।

বস্তুত এসব ঘটনা থেকেই রসূলে করীম স. -এর সুন্নত-আদর্শ কর্মনীতি জানা যায়। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, রসূলে করীম স.-এর পরামর্শদাতা কখনো হতো সর্বসাধারণ মুসলমান, কখনো ঘটনাস্থলে উপস্থিত মুসলমানরা, কখনো বিশিষ্ট মুসলমানরা মাত্র। এসবের ভিত্তিতে আমরা অনায়াসে বলতে পারি যে, রাষ্ট্রপ্রধান বিভিন্ন বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট, বিভিন্ন মানুষের সাথে পরামর্শ করবে। যদি বিষয়টি হয় সর্বসাধারণ মানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট, তাহলে সে বিষয়ে সেই সর্বসাধারণ মানুষের সাথেই পরামর্শ করতে হবে। আধুনিক পরিভাষায় তাকে আমরা বলি গণভোট বা (Referendum)। আর তা যদি সম্ভবপর না-ই হয় তাহলে তাদের আস্থাভাজন আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ -এর সাথে পরামর্শ করতে হবে। আর বিষয়টি যদি এমন হয় যা ভালো ও মন্দ দিক-ই শুধু জানতে হবে, তাহলে সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করতে হবে। ইমাম কুরতুবী এ দিকে ইংগিত করেই বলেছেনঃ

রাষ্ট্রকর্তারা যেসব বিষয়ে জানে না, সেসব বিষয়ে-ই তাদের পরামর্শ করতে হবে। দীন সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ করতে হবে দীনের আলেমদের সাথে, যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ করতে হবে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথে। জনকল্যাণ বিষয়ে পরামর্শ করতে হবে সাধারণ মানুষের সাথে। আর শহর-নগর নির্মাণ ও উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ করতে হবে মন্ত্রী, সেক্রেটারী ও অন্যান্য কর্মচারীদের সাথে। -তাফসীরে কুরতুবী, ৪র্থ খণ্ড, ২৪৯-২৫০ পৃষ্ঠা।

আল্লামা কুরতুবী আরো লিখেছেন, শরীয়তী হুকুম-আহকামের ব্যাপারে যাদের সাথে পরামর্শ করতে হবে তাদের হতে হবে আলেম ও দীনদার। তার বৈষয়িক ব্যাপারসূহে যাদের পরামর্শ চাওয়া যেতে পারে তাদের হতে হবে বুদ্ধিমান ও বহুদর্শী দীর্ঘকালীন বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোক।

-তাফসীরে কুরতুবী, ৪র্থ খণ্ড, ২৪৯-২৫০ পৃষ্ঠা।

আধুনিক সময়ে পরামর্শ গ্রহণ পদ্ধতি
আমরা পূর্বেই একথা স্পষ্টভাবে বলেছি, শুরু বা পরামর্শ গ্রহণ পদ্ধতির বিষয়ে রসূলে করীম স.-এর সুন্নাত প্রমাণ করে যে, ইসলামী শরীয়তে শুরার কোনো বিশেষ ও নির্দিষ্ট ধরনের ব্যবস্থা বা কাঠামো পেশ করা হয়নি। এটাই হলো ইসলামী শরীয়তের সৌন্দর্য, বৈশিষ্ট্য এবং ভবিষ্যতের জন্যে সতর্কতার নীতি। কেননা, শুরা বা পরামর্শ গ্রহণের কাজটি নানাভাবে সম্পন্ন হতে পারে এবং বিভিন্ন সময়ে তার রূপ বদলে যেতে পারে। বিভিন্ন ভৌগলিক অবস্থার কারণে বিভিন্ন ধরনের কাঠামোও গড়ে তোলা যেতে পারে। এমনকি, দেশ ভেদে তার বাস্তব কাঠামোর তারতম্যও হতে পারে। অতএব পরামর্শ গ্রহণ পদ্ধতি দেশের অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে নির্দিষ্ট করা জাতির দায়িত্ব। এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, আমাদের এ কালের উপযোগী পন্থা এটাই হতে পারে যে, জাতির জনগণ মজলিসে শুরার বা পার্লামেন্টের সদস্যদের নির্বাচিত করবে এবং তারা নির্বাচিত করবে রাষ্ট্রপ্রধানকে। আর সদস্যরাই রাষ্ট্রশাসনের ব্যাপারে রাষ্ট্রপ্রধানকে পরামর্শ দেবে এবং রাষ্ট্রপ্রধানও এদের মত নিয়ে কাজ করতে বাধ্য থাকবে। অবশ্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারসূহে সাধারণ গণভোট গ্রহণ করারও পূর্ণ অধিকার থাকবে রাষ্ট্রপ্রধানের। মজলিসে শুরার (পার্লামেন্টের) সদস্যদের নির্বাচন করার পন্থা, পদ্ধতি ও নীতি এরাই নির্ধারিত করবে।

পার্লামেন্ট বা আইন-পরিষদ সদস্যদের নির্বাচনের ব্যাপারটি সুষ্ঠু ও নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করার এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বাছাই করার জন্যে কেবল একটা নির্বাচন পদ্ধতি ঠিক করাই যথেষ্ট নয়। বরং সে জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার আবশ্যকতা রয়েছে। আর এ পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে ইসলামী আদর্শ ও মৌলনীতির শিক্ষার ব্যাপক প্রচার জাতীয় নৈতিকতার মান উন্নতকরণ এবং আল্লাহর ভয় ও পরকাল বিশ্বাসের প্রেরণায় ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধ করা একান্তই জরুরী। তাহলেই আশা করা যেতে পারে যে, তারা যোগ্যতম ব্যক্তিদেরই নির্বাচিত করবে, এমন ব্যক্তিদের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেবে যারা ইসলামী আদর্শকে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করবে।

পরামর্শ পরিষদ ও রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে বিরোধ ও মতবৈষম্য হলে
পরামর্শ পরিষদ বা পার্লামেন্ট এবং রাষ্ট্রপ্রধানের মাঝে মতবৈষম্য সৃষ্টি হতে এবং তদ্দরুন বিরোধ দেখা দিতে পারে। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাহলে এরূপ অবস্থায় তার মীমাংসার উপার ও পন্থা কি হতে পারে?..এর মীমাংসার পথ ও পন্থা কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতে ঘোষিত হয়েছেঃ

**********আরবী**********

হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করো, অনুসরণ করে চলো রসূলের এবং তোমাদের মাঝে যারা দায়িত্বশীল কর্মকর্তা তাদেরও। অনন্তর তোমরা যদি কোনো বিষয়ে মতবিরোধে নিমজ্জিত হও, তাহলে সে বিষয়টিকে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার হয়ে থাকো। বস্তুত এ নীতিই অতীব কল্যাণময় এবং পরিণামের দিক দিয়েও তা অতীব উত্তম।

এ আয়াত অনুযায়ী যাবতীয় বিরোধীয় বিষয়কে আল্লাহর কিতাব ও রসূল স.-এর সুন্নাতের দৃষ্টিতে পুনর্বিবেচনাক্রমে চূড়ান্ত ফায়সালা করতে হবে। সব তাফসীরকারই একথা বলেছেন। অতএব কুরআন কিংবা হাদীসে কোনো বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ বা ঘোষণা পাওয়া গেলে, তা মেনে নেয়া ও তদনুযায়ী কাজ করা ওয়াজিব। এর বিপরীত কারোর কথা মানা যেতে পারে না। আর যদি কোনো সুস্পষ্ট হুকুম না-ই পাওয়া যায়, তাহলে যে মত কুরআন ও সুন্নাতের অধিক নিকটবর্তী, তা-ই গ্রহণ ও তদনুযায়ী আমল করতে হবে।-তাফসীরে তাবারী, ৫ম খণ্ড, ৮৭ পৃষ্ঠা, তাফসীরে কুরতুবী, ৫ম খণ্ড, ২৬১ পৃষ্ঠা ও আহকামুল কুরআন লিল জাসসাস, ২য় খণ্ড, ২১২ পৃষ্ঠা।

কিন্তু কোন মতটি কুরআন ও সুন্নাতের নিকটবর্তী, তাও যদি জানা না যায় বা তাও যদি নির্ধারণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে তখন কি করা যাবে? এ পর্যায়ে তিনটি পন্থার যে কোনো একটা গ্রহণ করা যেতে পারেঃ

প্রথম পন্থাঃ শালিস নিয়োগ
এ পর্যায়ের প্রথম পন্থা হলো, ফিকাহবিদ, উত্তম সুস্থজ্ঞান ও বিবেকসম্পন্ন এবং রাষ্ট্র বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের একটা বিশেষ সংস্থা উদ্ভাবন করতে হবে। তাদের স্বতন্ত্র মান-মর্যাদা ও স্বাধীনতার ব্যাপারে পূর্ণ নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা দিতে হবে এবং তাদের ওপর কোনোরূপ প্রভাব বিস্তার করা চলবে না। বস্তুত পরামর্শ পরিষদ ও রাষ্ট্রপ্রধানের মাঝে মতবিরোধ দেখা দিলে তার চূড়ান্ত মীমাংসার এ-ই হতে পারে এক সুস্পষ্ট কর্মনীতি। অবশ্য এরূপ শালিস নিয়োগ করা হলে তাদের রায় মেনে নেয়া উভয় পক্ষের বাধ্যতামূলক হবে। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত একটি ঘটনা এ পন্থার সুষ্ঠুতা নির্দেশ করে। একবার তিনি সিরিয়া রওয়ানা হয়েছিলেন। পথিমধ্যে তিনি জানতে পারলেন যে, সেখানে মহামারী দেখা দিয়েছে। তখন সেখানে যাওয়া উচিত হবে কিনা এ বিষয়ে তাঁরা একমত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারলেন না। অতঃপর তিনি তাঁর সঙ্গী আনসার মুসলমানদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। কিন্তু তাঁদের মাঝেও মতবিরোধ দেখা দিল। তখন তিনি প্রাথমিক পর্যায়ে মুহাজির কুরাইশদের যেসব বৃদ্ধ ও অধিক বয়স্ক লোক ছিলেন, তাঁদের ডেকে পরামর্শ চাইলেন। তাঁরা সবাই বললেন, ফিরে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। তখন তাঁদের এ মত অনুযায়ী-ই আমল করা হলো। -তাফসীর আল মানার, ৫ম খণ্ড, ১৯৪-১৯৭ পৃষ্ঠা।

দ্বিতীয় পন্থাঃ সংখ্যাগুরুর মত মেনে নেয়া
এ পন্থার দৃষ্টিতে পরামর্শ পরিষদের অধিকাংশ যে মত পোষণ করে, সেই বতকেই মেনে নেয়া যেতে পারে, যদি তা স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধানের মতের বিপরীতও হয়। এ মতের সমর্থনে বলা যায়, নবী করীম স. উহুদ যুদ্ধে মুশরিকদের মুকাবিলা করার জন্যে মদীনার বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ নিয়েছিলেন এবং তখন তিনি অধিকাংশ লোকের মতই গ্রহণ করেছিলেন, যদিও মদীনার বাইরে গিয়ে প্রতিরোধ করার প্রতি তাঁর নিজের তেমন কোনো ঝোঁক ছিলো না। আর বস্তুতই এটা দোষের কিছু নয়। কেননা, সমাজের অধিকাংশ লোকই তাদের সামগ্রিক ব্যাপারে যা চিন্তা করে তা নির্ভুল হবে বলেই ধারণা করা যায়, যদিও নিশ্চয়তা কিছু নেই। কেননা, অনেক এ-ও দেখা যায় যে, বেশীর ভাগ লোক যা বলেছে, তা ভুল। আর নির্ভুল সত্য হলো তা, যা অল্পসংখ্যক লোকেরা প্রকাশ করে।

তৃতীয় পন্থাঃ রাষ্ট্রপ্রধানের নিজের মত গ্রহণ
তৃতীয় পন্থা এ হতে পারে যে, রাষ্ট্রপ্রধান সংশ্লিষ্ট লোকদের সাথে পরামর্শ করবে, বেশীর ভাগ লোক কি বলছে তাও তার সামনে উদঘাটিত হবে এবং কম লোকের মতও জানা যাবে। অতঃপর সে এ পরিপ্রেক্ষিতে নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এবং তা-ই মেনে নেয়া হবে। সংখ্যাগুরুর ও সংখ্যালঘুর কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। এ পন্থার কিছুটা ইংগিত পাওয়া যায় নিম্নোক্ত আয়াতে। আল্লাহ তায়ালা নবী করীম স.-কে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেছেনঃ

*********আরবী*************

তুমি লোকদের সাথে পরামর্শ করো। অতঃপর তুমি যখন সিদ্ধান্তে পৌঁছবে, তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করে কাজ করে দেবে।

-সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৯

কাতাদাহ তাবেয়ী বলেছেনঃ

**********আরবী************

আল্লাহ তাঁর নবীকে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত করে তা করে যেতে এবং এ ব্যাপারে লোকদের পরামর্শের ওপর নয়- মহান আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করার নির্দেশ দিয়েছেন।-তাফসীরে কুরতুবী

এ পর্যায়ে একথাও মনে রাখতে হবে যে, মূলত রাষ্ট্রপ্রধানই জনগণের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল এবং তার কাজের জন্য জবাবদিহি তাঁকেই করতে হবে। কাজেই ইজতিহাদী ব্যাপারে তাঁকে কর্মের স্বাধীনতা দিতে হবে, অবশ্য যদি তা শরীয়তের অকাট্য নীতি ও আইনের বিপরীত কিছু না হয়। আর মানুষের জবাবদিহি করতে বাধ্য হওয়ার অর্থই হলো তাকে কর্মের স্বাধীনতা দেয়া, যেন সে নিজের মত ও রায় অনুযায়ী কাজ করতে পারে। কিন্তু তাকে যদি অপরের মতেই কাজ করতে হয়, তাহলে তার জবাবদিহির কথা-ই অর্থহীন হয়ে যায়। কাজ হবে অপরের মতের ভিত্তিতে, আর জবাবদিহি করতে হবে রাষ্ট্রপ্রধানকে একথাটিও অযৌক্তিক।

আমরা কোন পন্থা গ্রহণ করতে পারি
যদিও বাহ্যত এ শেষোক্ত পন্থাটি অধিক কার্যকর, সহজসাধ্য এবং নির্ভুল মনে হয়, কিন্তু তবু নান কারণে এ মতটি গ্রহণ করা সমীচীন হতে পারে না। কেননা রাষ্ট্রপ্রধানকে এভাবে কাজ করার সুযোগ দিলে সে চরম স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে? আর একবার যদি কোনো রাষ্ট্রনায়ক স্বেচ্ছাচারিতা করার সুযোগ পায়, তাহলে জনমতের ভিত্তিতে কোনো কাজ সম্পন্ন হবে কোনো দিন তার আশা করা যায় না। তাই দ্বিতীয় পন্থা গ্রহণ করা-ই অধিকতর কল্যাণকর। অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধান পরামর্শ পরিষদের অধিক সংখ্যক সদস্যদের মত অনুসারে কাজ করবে। অবশ্য এজন্যে কয়েকটি শর্ত অপরিহার্যঃ (১) রাষ্ট্রপ্রধান যদি অধিকাংশ লোকদের মতকে যথেষ্ট মনে না করেন তাহলে তাকে কোনো তৃতীয় পক্ষ বিচারকের-নিরপেক্ষ শালিসের কাছে বিরোধীয় বিষয়টি সম্পর্কে মীমাংসার জন্যে পেষ করবে। (২) এরূপ কোনো নিরপেক্ষ সংস্থার মীমাংসাকেও যদি যথেষ্ট মনে করা না হয়, তাহলে এ বিরোধীয় বিষয়টিকে নিয়ে গণভোট গ্রহণ করা যেতে পারে। জাতির জনগণ যদি রাষ্ট্রপ্রধানের মতের প্রতি সমর্থন জানায় তাহলে তার মতকেই গ্রহণ করা হবে। আর যদি তার বিপরীত হয়, যদি রাষ্ট্রপ্রধানের মতকে জাতির জনগণ প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান হয় জনগণের মতকে মেনে নিবে, কিংবা পদত্যাগ করবে। (৩) রাষ্ট্রপ্রধানকে বিশেষ বিশেষ অবস্থায়, যেমন যুদ্ধ কিংবা কঠিন কোনো জাতীয় সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে কারো মত মানতে বাধ্য না করে তা নিজের মতেই কাজ করার স্বাধীনতা তাকে দেয়া হবে।

রাষ্ট্রপ্রধানের সমালোচনার অধিকার ও দায়িত্ব
রাষ্ট্রপ্রধানের কাজকর্মের প্রতি তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা এবং সেই সাথে রাষ্ট্রের বড় বড় দায়িত্বপূর্ণ পদাধিকারী ব্যক্তিদের কার্যকলাপের প্রতি লক্ষ্য রাখা সামগ্রিকভাবে গোটা জাতির এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকটি নাগরিকের একান্ত কর্তব্য, এটা একটা বড় দায়িত্বও বটে। কেননা রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে তাদের যে সম্পর্ক, তাকে এরূপ দৃষ্টি ও লক্ষ্য রাখাই হলো তার স্বাভাবিক দাবী। আর সে সম্পর্ক হচ্ছে উকিল হওয়ার সম্পর্ক। জাতি সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্রপ্রধানকে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কার্যসম্পাদনের জন্যে উকিল নিয়োগ করে। জাতি এবং জাতির ব্যক্তিগণ হয় তা মুয়াক্কিল। আর প্রত্যেক মুয়াক্কিলেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো তার উকিলের কার্যকলাপের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা। অন্যথায় উকিল যেমন সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, তেমনি সে মুয়াক্কিলের মর্জির বিপরীত কাজও করে বসতে পারে।

বিশেষত রাষ্ট্রপ্রধান যদি ইসলামী আদর্শের বিপরীত কোনো কাজ করে তখন তার প্রতি এরূপ দৃষ্টি রাখা সর্বাধিক কর্তব্য হয়ে পড়ে। এরূপ অবস্থায় রাষ্ট্রপ্রধানকে সঠিক পরামর্শ দান, সদুপদেশ দান, তার ভুল-ভ্রান্তি তার সামনে স্পষ্টভাবে বলে দিয়ে তাকে সংশোধন করা এবং তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করা জাতির ও জাতির ব্যক্তিদের অবশ্য কর্তব্য। বস্তুত এ কাজ যদি সঠিকরূপে পালন করা না হয় তাহলে রাষ্ট্রপ্রধানের মারাত্মক ভুল করে বসার আশংকা রয়েছে। সে এতোখানি বিগড়ে যেতে পারে যে, শেষ পর্যন্ত সে গোটা জাতি ও রাষ্ট্রকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। এজন্যে হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, নবী করীম স. ইরশাদ করেছেনঃ

**********আরবী*********

দীন হলো নসীহত। আমরা বললামঃ কার জন্যে? তিনি বললেনঃ আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্যে, তাঁর রসূলের জন্যে, মুসলিম (রাষ্ট্রীয়) নেতাদের জন্যে এবং মুসলিম জনগণের জন্যে। -মুসলিম শরীফ

এভাবে নসিহতের পরও যদি কোনো শুভ ফলোদয় না হয়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধানকে ঠিক পথে পরিচালিত করার জন্যে শক্তি প্রয়োগ করা আবশ্যক। জোর করে তাকে যুলুমের পথ থেকে, অন্যায় পথ থেকে এবং সর্বপ্রকারের বিপদ থেকে বিরত রাখা জাতির কর্তব্য। এ পর্যায়ে নবী করীম স. -এর নির্দেশ হলো।

**********আরবী*********

আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, তোমরা অবশ্যই ন্যায়ের আদেশ করবে। অন্যায়ের প্রতিরোধ করবে। যালেমের হাত শক্ত করে ধরে রাখবে, সত্য নীতির ওপর স্থির করে রাখবে এবং তাকে সত্য কাজ করতেই বাধ্য করবে। অন্যথায় মনে রাখবে, আল্লাহ তোমাদের মনকে পরস্পরের প্রতি খারাপ করে দেবেন। আর শেষ পর্যন্ত তোমাদেরকে পূর্ববর্তীদের মতো অভিশপ্ত করবেন।-আবু দাউদ

অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ

**********আরবী*********

লোকেরা যখন যালেমকে যুলুম করতে দেখবে, তখন যদি তারা তার দুহাত শক্ত করে না ধরে রাখে তাহলে আল্লাহর আযাব সাধারণভাবে সবাইকে গ্রাস করতে পারে। -রিয়াদুস সালেহীন

রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রের অপরাপর দায়িত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের প্রতি এরূপ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখার অধিকার একটা জাতীয় অধিকার। ইসলামী রাষ্ট্রে এ অধিকার পুরোপুরি রক্ষিত হয়েছে। বরং ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলরা এ অধিকারের পূর্ণ প্রয়োগের জন্যে জনগণকে আহবান জানাতো। ইতিহাস এ পর্যায়ের অনেক ঘটনাকেই তার পৃষ্ঠায় স্থান দিয়েছে। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. খলীফা নির্বাচিত হয়ে সর্বপ্রথম যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেনঃ

**********আরবী*********

আমি ভালো করলে তোমরা সবাই আমার সহযোগিতা করবে। আর আমি যদি বাঁকা পথে চলতে শুরু করি, তাহলে তোমরা আমাকে সঠিক পথে চলতে বাধ্য করবে। -তাবকাতে কুবরা, ইবনে সায়াদ, ৩য় খণ্ড, ১৮৩ পৃষ্ঠা।

দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারুক রা.-এর এক ভাষণে উদ্ধৃত হয়েছেঃ

**********আরবী*********

তোমাদের মধ্য থেকে কেউ আমার মধ্যে কোনোরূপ বক্রতা লক্ষ্য করলে তা দূর করে দেয়া তার কর্তব্য।

তখন উপস্থিত লোকদের একজন বলে উঠলোঃ

**********আরবী*********

আল্লাহর কসম, তোমার মধ্যে কোনোরূপ বক্রতা দেখতে পেলে আমরা তোমাকে আমাদের তরবরীর সাহায্যেই ঠিক করে রাখবো।

একথা শুনে দ্বিতীয় খলীফা উচ্চস্বরে বলে উঠলেনঃ

**********আরবী*********

আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ স. -এর উম্মতের মধ্যে এমন লোক সৃষ্টি করেছেন, যারা তাদের তরবারির দ্বারা ওমরকে ঠিক পথে চালাতে পারে, এজন্যে আল্লাহর লাখো শোকর।

রাষ্ট্রপ্রধানের পদচ্যুতি
আমরা ইতিপূর্বে বলেছি, ইসলামী রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধানের আইনগত মর্যাদা হলো, সে হচ্ছে জাতির উকিল-জাতির সামগ্রিক কার্যাবলী সম্পন্ন করার জন্যে দায়িত্বশীল। এই যখন প্রকৃত অবস্থা তখন রাষ্ট্রপ্রধান তার দায়িত্ব বিরোধী কোনো কাজ করলে অথবা অক্ষমতা বা উপেক্ষার দরুন তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে তাকে পদচ্যুত করার অধিকার জাতিকে অবশ্যই দিতে হবে। যে নিয়োগ করতে পারে সে বহিষ্কৃতও করতে পারে এটাই তো স্বাভাবিক! আর জাতির জনগণই রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ করে, কাজেই তাকে পদচ্যুত করার অধিকারও জাতিরই থাকতে হবে। ইসলামী শরীয়তেও জনগণের এ অধিকার স্বীকৃত। আর ফিকাহর কিতাবে এ অধিকারের কথা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষিত। এ অধিকারের ভিত্তি হলোঃ দায়িত্বের সীমালঙ্ঘন এবং দায়িত্ব পালনের অক্ষমতা। ফিকাহবিদগণ তাই লিখেনঃ

**********আরবী*********

উপযুক্ত কারণে রাষ্ট্রপ্রধানকে পদচ্যুত করার অধিকার জাতির রয়েছে। সে কারণের মধ্যে মুসলমানদের অবস্থা বিপর্যস্ত হওয়া এবং দীনের ব্যাপারটি লঙ্ঘিত বা উপেক্ষিত হওয়া বিশেষভাবে উল্লেখ্য। মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ও তার উন্নয়নের জন্যে রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়োগ করাও যেমন তাদেরই অধিকার ছিলো, এও তেমনি।

-আল মাওয়াকিফ, আন্ নযরীয়াতুস সিয়াসাতুল ইসলামীয়া।

আর প্রখ্যাত ফিকাহ ও রাজনীতিবিদ ইমাম ইবনে হাজার আন্দালুসী রাষ্ট্রপ্রধান প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ

**********আরবী*********

রাষ্ট্রপ্রধানকে মেনে চলা ওয়াজিব ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ সে জনগণকে আল্লাহর কিতাব ও রসূল স.-এর সুন্নাত অনুযায়ী পরিচালিত করবে। সে যদি তা থেকে এক বিন্দু ভিন্ন পথে ধাবিত হয়, তাহলে তাকে সে পথ থেকে বিরত রাখা হবে এবং তার ওপর শরীয়তের অনুশাসন কার্যকর করা হবে। আর তাকে পদচ্যুত না করা হলে তার দুষ্কৃতি থেকে নিরাপদ থাকা যাবে না মনে করা হলে তাকে পদচ্যুত করা হবে এবং তার স্থানে অপর একজনকে নিয়োগ করা হবে।

পদচ্যুত করার নিয়ম
রাষ্ট্রপ্রধানকে পদচ্যুত করার যখন জাতির অধিকার রয়েছে, তখন এ কাজ তার সমকক্ষ লোকদের দ্বারা সম্পন্ন করানোই যুক্তিযুক্ত, তার সমকক্ষ হচ্ছে, আহলুল হল্লে ওয়াল আকদ। তারা শক্তভাবে ব্যাপারটিকে ধারণ করবে এবং এ পদচ্যুতির কাজটিকে বাস্তবায়িত করবে। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান যদি তাদের কথা মেনে নিতে রাজী না হয়, তাহলে এরূপ অবস্থায় তাকে পদচ্যুত করার জন্যে শক্তি প্রয়োগ করা অবশ্যই বৈধ হবে। অবশ্য এ শক্তি প্রয়োগের জন্যে শরীয়তের মজবুত ভিত্তি থাকতে হবে। যেমন ইসলামের মৌল আদর্শ ও আইন-কানুন লঙ্ঘন করলে ইসলামের দৃষ্টিতে এ হবে সুস্পষ্ট কুফরী। আর হাদীসে এ পর্যায়েই ইরশাদ করা হয়েছে, হযরত উবাইদা ইবনে সামেত রা. বলেনঃ

***********আরবী************

নবী করীম স. আমাদের ডাকলেন, আমরা তাঁর হাতে বাইয়াত করলাম। আনন্দ ও দুঃখ, শান্তি ও কষ্ট এবং বিপদ-আপদ সর্বাবস্থায় আমরা তাঁকে মেনে চলবো। আর রাষ্ট্র-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধতা করবো না। তবে যদি তাদের দ্বারা সুস্পষ্ট কুফরী অনুষ্ঠিত হতে দেখো, তাহলে তার সম্পর্কে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্যে তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে অকাট্য দলীল বর্তমান রয়েছে।-বুখারী, ৯ম খণ্ড, ৮৫ পৃষ্ঠা।

কিন্তু মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রপ্রধানকে শক্তি প্রয়োগে পদচ্যুত করার পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অপরিহার্য শর্ত হলোঃ শক্তি যথেষ্ট পরিমাণে থাকা দরকার আর সাফল্য ও বিজয়ের খুব বেশী সম্ভাবনা থাকতে হবে। অন্যথায় কোনোরূপ নিষ্ফল দুর্ঘটনা ঘটানো কিছুতেই জায়েয হতে পারে না। কেননা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ-কাজের জন্যে জরুরী শর্ত হলো এই যে, একটি অন্যায়কে খতম করতে গিয়ে যেন তার চেয়েও বড় অন্যায় সৃষ্টির কারণ ঘটানো হয়। এজন্যে যে, তাতে করে অনাহুতভাবে শুধু রক্তপাতই করা হবে, দেশ ও জনগণের জীবনে তা কোনো কল্যাণই সৃষ্টি করতে পারবে না। আর ইসলামের দৃষ্টিতে অকারণ রক্তপাত ও জনজীবন বিপর্যস্ত করা সবচেয়ে বড় অন্যায় ও অপরাধ।

পঞ্চমঃ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অধিকার
ব্যক্তির পদপ্রার্থী হওয়ার অধিকারঃ রাষ্ট্রের কোনো পদ বা সর্বসাধারণের কাজের বা কোনো বৃত্তির জন্যে প্রার্থী হওয়া-নিজেকে প্রার্থীরূপে দাঁড় করানোর অধিকার ব্যক্তির আছে কি?…থাকা উচিত কি? একথা নিঃসন্দেহ যে, এরূপ করার অধিকার ইসলামী রাষ্ট্রে নেই-থাকা উচিতও নয়। ইসলামী শরীয়তে এ একটা সাধারণ নিয়ম। সহীহ হাদীসে আবদুর রহমান ইবনে সামুরাহ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম স. তাঁকে সম্বোধন করে ইরশাদ করেছেনঃ

********আরবী********

হে আবদুর রহমান ইবনে সামুরাহ! তুমি কোনো দায়িত্বপূর্ণ পদের জন্য প্রার্থী হবে না। প্রার্থী হওয়ার দরুন যদি তোমাকে কোনো পদে নিযুক্ত করা হয়, তাহলে তোমাকে তাতেই সোপর্দ করা দেয়া হবে। আর যদি প্রার্থী না হয়েও তমি তেমন কোনো পদে নিযুক্ত হও, তাহলে সে দায়িত্ব পালনে তোমাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য করা হবে।-বুখারী, ৯ম জিলদ, ১১৪ পৃষ্ঠা।

কোনো প্রার্থী হওয়ার মানে তুমি পদ চাও, পদাধিকারী হওয়ার জন্যে তোমার মনে খাহেশ জেগেছে। কর্তৃত্বের জন্যে লোভ জেগেছে, আর ইসলামী শরীয়তে তা জায়েজ নয়।

কিন্তু কোনো পদের জন্যে অন্য ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করা শরীয়তে সম্পূর্ণ জায়েয। কেননা, তাতে নিজের কোনো খাহেশ বা লোভের প্রশ্রয় থাকে না। এতে বরং জাতির দৃষ্টি কোনো যোগ্য ব্যক্তির প্রতি আকর্ষণ করা হয়। আর তা শুধু জায়েযই নয়, কর্তব্যও।

বর্তমানকালে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপার
ব্যক্তির নিজের প্রার্থী হওয়া শরীয়তে অবৈধ একথা যেমন ঠিক, একটি সাধারণ নিয়ম হিসাবেই তা অনুসরণীয়, ঠিক তেমনি যদি প্রয়োজন তীব্র হয়ে দেখা দেয়, শরীয়তের দৃষ্টিতে তা করা কল্যাণকর মনে হয়, তাহলে তখন তা আর নাজায়েয হতে পারে না। আর বর্তমানকালে অনেক সময় জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারগুলো এমন জটিল হয়ে দেখা দিয়ে থাকে যে, অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থী হয়ে না দাঁড়ালেও আবার চলে না। জনসাধারণকে ভালোভাবে জানতে হবে যে, সমাজের মধ্যে কোন লোকেরা সত্যিই নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য। তা না জানতে পারলে জনসাধারণ নিজেদের থেকে যোগ্যতম লোকদের নির্বাচিত করতে সক্ষম হবে না। অথচ যাবতীয় রাষ্ট্রীয় পদে সমাজের সর্বোত্তম ও অধিক যোগ্য লোকদের নির্বাচিত করা একান্তই অপরিহার্য। অন্যথায় রাষ্ট্রীয় কঠিন ও জটিল ব্যাপারগুলো যথাযথভাবে আনজাম পেতে পারবে না। এরূপ অবস্থায় এক ব্যক্তির নিজেকে কোনো পদে নির্বাচিত হওয়ার জন্যে জনগণের সামনে পেশ করার অর্থ হবে জনগণকে জানিয়ে দেয়া ও কি ধরনের লোককে নির্বাচিত করতে হবে তা বুঝিয়ে দেয়া এবং সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার সুযোগ করে দেয়া। অবস্থা যদি সত্যিই এরূপ হয়, তাহলে এভাবে ব্যক্তির প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারটি অবৈধ বলে কিছুতেই উড়িয়ে দেয়া যেতে পারে না। এরূপ জাতীয় সংকটের অবস্থায় যোগ্য ব্যক্তিকে যে, জনগণের সামনে নিজেকে প্রার্থী রূপে উপস্থাপিত করার প্রয়োজন রয়েছে, তা হযরত ইউসুফ আ.-এর নিম্নোক্ত উক্তি থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। তিনি মিসর দেশের এমনি এক সংকটকালে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেনঃ

*******আরবী**********

আমাকে দেশের যাবতীয় ধন-সম্পদের ওপর দায়িত্বশীল বানিয়ে দাও, আমি অধিক সংরক্ষণকারী ও বিষয়টি সম্পর্কে অধিক অবহিত।- সূরা ইউসুফঃ ৫৫

হযরত ইউসুফ আ.-এর মনে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লোভ ছিলো, এমন কথা কিছুতেই ধারণা করা যায় না। নিশ্চয়ই অবস্থার জটিলতা নিরসনের উদ্দেশেই এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো যেমন রাষ্ট্রীয় সংকট দূর করে সুষ্ঠু পন্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যবস্থা করা, তেমনি রাষ্ট্রশক্তিকে আল্লাহর মর্জী মতো পরিচালিত করা। আর এ এমন একটা ব্যাপার, যা বর্তমানের যে কোনো রাষ্ট্র ব্যক্তিগত প্রার্থী হওয়াকে বৈধ করে দেয়।

কিন্তু ব্যক্তিগত প্রার্থী হওয়া অবস্থার জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে বৈধ হলেও কোনো প্রার্থীর পক্ষেই কেবল নিজের প্রচার ও প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি জায়েয হতে পারে না। প্রার্থীর জন্যে বৈধ শুধু এতোটুকু যে, সে নিজের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও আদর্শকে প্রচার করবে। সে রাষ্ট্রীয় পদে নির্বাচিত হলে রাষ্ট্র ও জনগণের জন্যে শরীয়তের ভিত্তিতে কি কি কল্যাণ সাধন করবে, তা-ই শুধু এতোটুকু যে, তা-ই শুধু সে প্রচার করবে, এর বেশী কিছু নয়।

বর্তমান সময়ে যেমন প্রার্থী হওয়ার প্রয়োজন তীব্র হয়ে দেখা দিতে পারে, তেমনি নিছক ব্যক্তিগত প্রার্থী হওয়ার পথ থেকে দূরে থাকাও সম্ভব হতে পারে। আর তার উপায় হলো দলীয় ভিত্তিতে প্রার্থী দাঁড় করানো নীতি অনুসরণ। এতে করে যেমন ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থী হওয়া সম্পর্কে রসূলে করীম স.-এর নিষেধকে মান্য করা যায়, তেমনি হযরত ইউসুফ আ.-এর আদর্শও অনুসৃত হতে পারে।

সরকারী চাকরীতে ব্যক্তিগত প্রার্থী হওয়ার রীতি
সরকারী চাকরীতে নিয়োগের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তিরই নিজস্বভাবে প্রার্থী হওয়ার রীতি ইসলামী শরীয়তের সমর্থিত নয়। এরূপ করার কোনো অধিকার ব্যক্তিকে দেয়া হয়নি। আসলে এ কাজটি সম্পন্ন হওয়া উচিত সরকারের নিজস্ব উদ্যোগক্রমেই। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবু মূসা আশয়ারী রা. বলেনঃ

আমি রসূলে করীম স.-এর খেদমতে হাজির হলাম। আমার সাথে আমার দুজন চাচাতো ভাইও সেখানে উপস্থিত হলো। তাদের একজন বললো, ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনার ক্ষমতাধীন কোনো রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপূর্ণ কাজে আমাকে নিযুক্ত করুন। অপরজনও এরূপ কথা বললো। তখন নবী করীম স. ইরশাদ করলেনঃ আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, এ রাষ্ট্রীয় কাজে আমি এমন কোনো লোককে নিয়োগ করবো না, যে তা পেতে চাইবে কিংবা সে জন্যে লোভ করবে।- তাইসীরুল উসুল, ১ম খণ্ড, ১৮ পৃষ্ঠা।

এ হাদীস থেকে স্পষ্ট জানা গেল, সরকারী দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ লাভের কোনো অধিকার জনগণের নেই। কেননা যদি এ অধিকার থাকতোই, তাহলে তা পেতে চাওয়া থেকে বিরত রাখার কোনো কারণ থাকতে পারে না। বস্তুত এটা ব্যক্তির অধিকার নয় সরকারের ওপর, বরং সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য ব্যক্তির প্রতি।

তাহলে সরকার জনগণকে এ পদে কি করে নিয়োজিত করবে? এখানেই সরকারের দায়িত্বের প্রশ্ন। সরকার প্রত্যেকটি কাজের জন্যে যোগ্যতম ব্যক্তিকে যাচাই-বাছাই করার একটা পন্থা উদ্ভাবন করতে পারে। এজন্যে যারা অধিক যোগ্য প্রমাণিত হবে, কোনোরূপ প্রার্থী হওয়ার রীতি অনুসরণ ছাড়াই সেই যোগ্য লোকদের নিয়োগ করা যেতে পারে। তবে এ পর্যায়ে হাদীসে যোগ্যতার সনদ ছাড়া অন্য কোনো কারণে আত্মীয়তা, স্বজনপ্রীতি, বন্ধুত্বতা, খাতির বা ঘুষ ইত্যাদি কোনো কিছুর দরুন কাউকে কোনো পদে নিয়োগ করা কিছুতেই উচিত নয়। নবী করীম স. ঘোষণা করেছেনঃ

**********আরবী***********

যে লোক মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল হবে, সে যদি কোনো অধিক যোগ্য মুসলমানদের পরিবর্তে অপর কোনো ব্যক্তিকে সরকারী কোনো চাকরীতে নিয়োগ করে, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।- আস-সিয়াসাতুশ শারয়ীয়া, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ৪ পৃষ্ঠা।

এভাবে প্রত্যেকটি দায়িত্বপূর্ণ কাজে যোগ্যতম ব্যক্তিকে নিয়োগ করাই যখন সরকারী কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব, তখন যোগ্যতার মাপকাঠিকে সামনে তুলে ধরা একান্ত জরুরী। কিন্তু শরীয়তের দৃষ্টিতে সরকারী কর্মচারীদের যোগ্যতার মান কি?- বলা যায়, তাহলো শক্তি, কর্মক্ষমতা ও কার্য সম্পাদনে যোগ্যতা এবং বিশ্বস্ততা, আন্তরিকতা ও ঐকান্তিকতা। কুরআন মজীদের একটি আয়াত থেকে এ মানদণ্ডের কথাই জানতে পারা যায়। ইরশাদ হয়েছেঃ

*******আরবী******

তোমার পক্ষে উত্তম শ্রমিক হতে পারে সে-ই, যে লোক শক্তি সম্পন্ন ও বিশ্বস্ত। – সূরা আল কাসাসঃ ২৬

এখানে শক্তি অর্থ নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের যোগ্যতা, ক্ষমতা এবং তা কাজের বিভিন্নতার কারণে বিভিন্ন হতে পারে। অর্থাৎ যেমন কাজ ঠিক তেমন-সেই কাজ সুষ্ঠুরূপে আনজাম দেয়ার যোগ্য হতে হবে।

আর আমানত শব্দটি বুঝায়, কাজ ও দায়িত্বটির প্রতি ঠিক যেরূপ ব্যবহার হওয়া উচিত, যতখানি গুরুত্ব পাওয়া বাঞ্ছনীয় শরীয়তের দৃষ্টিতে, তার সাথে ঠিক সেরূপ আচরণ করা এবং তাকে ঠিক সেরূপই গুরুত্ব আরোপ করা। আর আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ভয় মনে স্থান দিয়ে সে কাজকে অনুরূপভাবে আনজাম দেয়া। কাজ সম্পন্ন করার ব্যাপারে লোকভয় বা কোনোরূপ ব্যক্তিগত লোভ ও স্বার্থপরতাকে একবিন্দু প্রশ্রয় না দেয়া।

আধুনিক যুগে যোগ্য লোক নিয়োগের উপায়
একদিকে শরীয়তে পদপ্রার্থী হওয়া অবাঞ্ছনীয়, অপরদিকে প্রত্যেকটি কাজের জন্যে যোগ্য লোক সন্ধান করা সরকারী দায়িত্ব। বর্তমান যুগে এ দুয়ের মাঝে সামঞ্জস্য স্থাপনের পন্থা কি হতে পারে?

জবাবে বলা যায়, কাজের গুরুত্বের দৃষ্টিতে তাকে দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে। সরকারের কতকগুলো কাজ থাকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ পর্যায়ের, যাতে ব্যক্তির ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকে, থাকে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা লাভের অবকাশ। যেমন মন্ত্রীগণ, সেনাধ্যক্ষ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব। এসব কাজের জন্যে রাষ্ট্রপ্রধানকে নিজ থেকেই উপরোক্ত গুণদ্বয়ের দৃষ্টিতে যোগ্য লোক সন্ধান করতে হবে। এছাড়া অন্যান্য হাজার হাজার সরকারী পদের জন্যে লোক নিয়োগের কাজ সম্পাদনের জন্যে লোকদের কাছে থেকে দরখাস্ত আহবান করা ছাড়া কোনো উপার দেখা যায় না। এজন্যে একটি বিশেষ বিভাগ খোলা যেতে পারে এবং বিভিন্ন কাজের জন্যে লোক সন্ধান করার দায়িত্ব এ বিভাগের ওপর অর্পণ করা যেতে পারে। কিন্তু এ বিভাগ থেকে বাছাই করা যোগ্য লোক নিয়োগের জন্যে রসূলে করীম স.-এর এ হাদীস অনুযায়ী নির্দেশ দিতে হবেঃ

*********আরবী********

দায়িত্বপূর্ণ বিষয়াদি যখন বিনষ্ট হতে থাকে, তখন তোমরা কিয়ামতের অপেক্ষা করো। জিজ্ঞেস করা হলো, কেমন করে তা বিনষ্ট হতে পারে? রসূলে করীম স. বললেন, দায়িত্বপূর্ণ কাজ যখন কোনো অযোগ্য লোকের উপর ন্যস্ত করা হয়, তখন তা বিনষ্ট হওয়ার অবস্থা দেখা দেয়।-তাইসীরুল উছুল, ১ম খণ্ড, ৩২ পৃষ্ঠা।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি