[সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রঃ) ১৯৬৬ সালের ১৭ই ডিসেম্বর পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত এক সেমিনারে ইসলামের অর্থ ব্যবস্থার উপর এক সারগর্ভ ভাষণ প্রদান করেন। এই পুস্তকাটি তারই হুবহু বাংলা অনুবাদ।]

আমাকে কয়েকটি প্রশ্নের উপর আলোকপাত করার জন্য আহবান জানানো হয়েছে। আলোচনার পূর্বাহ্নেই আমি প্রশ্ন ক’টি আপনাদের পড়ে শুনিয়ে দিচ্ছি। তাতে আমার আলোচনার পরিসর সম্পর্কে আপনারা কিছুটা ধারণা লাভ করতে পারবেন।

প্রশ্নগুলো হচ্ছে
একঃ ইসলাম কি কোন অর্থনৈতিক বিধান রচনা করেছে? করে থাকলে তার খসড়া পেশ করুন। উপরন্ত ভূমি, শ্রম, পুঁজি ও সংগঠন ঐ খসড়ায় কোন ধরনের মর্যাদা লাভ করেছে?

দুইঃ যাকাত ও সাদকার অর্থ অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে ব্যায় করা যেতে পারে কি?

তিনঃ আমরা কি সুদবিহীন অর্থব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারি?

চারঃ ইসলামের দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থাগুলির মধ্যে কোন্ ধরনের পারস্পারিক সম্পর্ক বিদ্যমান?

প্রথম প্রশ্নের জবাব
এ প্রশ্নগুলোর প্রত্যেকটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার জন্য বিরাট গ্রন্হের প্রয়োজন। কিন্তু সময় সংক্ষেপ হেতু এবং বিশেষ করে আজকের আলোচনা সভায় উচ্চশিক্ষিত সমাজের নিকট আমার বক্তব্য উপস্থাপনের কারণে এ প্রশ্নগুলো সম্পর্কে সংক্ষপ্ত আলোচনাই আমি যথেষ্ট মনে করছি।

প্রথম প্রশ্নের দুটি অংশ। একঃ ইসলাম কি কোন অর্থনৈতিক বিধান রচনা করেছে? করে থাকলে তার খসড়া পেশ করুন। দুইঃ ঐ খসড়ায় ভূমি, শ্রম, পুজিঁ ও সংগঠন কোন ধরনের মর্যাদা লাভ করেছে? প্রশ্নের প্রথম অংশের জবাবে বলা যায়, ইসলাম অবশ্যই একটি অর্থনৈতিক বিধান রচনা করেছে। তবে ইসলাম প্রতি যুগের উপযোগী এমন একটি বিস্তারিত অর্থনৈতিক বিধান রচনা করেছে যেখানে অর্থনৈতিক বিধানের যাবতীয় খুটিনাটি বিষয়ের বিস্তারিত সমাধান দেয়া হয়েছে- এ অর্থে তা একটি অর্থনৈতিক বিধান নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে, ইসলাম আমাদের এমন কতগুলি মূলনীতি দিয়েছে যার ভিত্তিতে আমরা নিজেরাই প্রতি যুগের উপযোগী একটি অর্থনৈতিক বিধান রচনা করতে পারি। কুরআন হাদীস গভীরভাবে অধ্যায়ন করলে ইসলামের একটি রীতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হচ্ছে এই যে, ইসলাম জীবনের প্রতিটি বিভাগের একটি চৌহদ্দী নির্ধারণ করে দেয় এবং আমাদেরকে জানিয়ে দেয় যে, এই চতুর্সীমার মধ্যে থেকে তোমরা নিজেদের অবস্থা, প্রয়োজন ও অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে বিস্তারিত বিধান রচনা করতে পারো। ইসলাম এভাবেই ব্যক্তিগত জীবনক্ষেত্র থেকে শুরু করে সভ্যতা-সংস্কৃতির সকল বিভাগে মানুষকে পথনির্দেশ দিয়েছে। পথনির্দেশের এই একই পদ্ধতি আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও অবলম্বিত হয়েছে। এখানেও ইসলাম আমাদেরকে কতিপয় মূলনীতি ও চতৃর্সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এরি মধ্যে অবস্থান করে আমাদের নিজেদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কাঠামো গঠনে অগ্রসর হতে হবে এবং প্রত্যেক যুগ-সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে এ সম্পর্কিত যাবতীয় বিস্তারিত খুটিঁনাটি বিধান রচনার কাজ চালাতে হবে। অতীতে এভাবেই একাজ সম্পাদিত হয়ে এসেছে।

ইসলামী ফিকাহ গ্রন্হগুলি আলোচনা করলে দেখা যাবে, আমাদের ফকীহ্গণ এই চতুর্সীমার মধ্যে অবস্থান করেই স্ব স্ব যুগের বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি অর্থনৈতিক বিধান রচনা করেছিলেন। ফকীহ্গণ যে অর্থনৈতিক বিধান রচনা করেন তা ইসলামের মূলনীতি থেকেই গৃহীত এবং ইসলাম নির্ধারিত চতুর্সীমার মধ্যেই তার অবস্থান। ঐ খুটিঁনাটি বিধানগুলির যে অংশ আমাদের বর্তমান প্রয়োজন পূর্ণ করে তা আমরা হুবহু গ্রহণ করে নিব, আর এছাড়া আমাদের এখন যে সব নতুন প্রয়োজন ও সমস্যা দেখা দিয়েছে সেগুলির জন্য আমরা নতুন বিধান রচনা করতে পারি। তবে সেসব বিধান অবশ্যি ইসলাম প্রদত্ত মূলনীতি থেকে গৃহিত হতে হবে এবং ইসলাম নির্ধারিত চতুর্সীমার (Four Corners) মধ্যেই সেগুলিকে অবস্থান করতে হবে।

ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার মৌল উদ্দেশ্য
ইসলামের একটা অর্থনৈতিক বিধান রয়েছে- এ কথার অর্থ এখন সহজে অনুধাবন করা সম্ভব হবে। এ ব্যাপারে ইসলাম আমাদেরকে যে মূলনীতি দিয়েছে তা বর্ণনা করার পূর্বে আমি ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার উদ্দেশ্যাবলী [Objective] আলোচনা করতে চাই। এই উদ্দেশ্যাবলী সম্পর্কে সঠিক ধারনা না থাকলে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার মূলনীতি অনুধাবন করা এবং ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার যথার্থ প্রাণসত্তা অনুযায়ী বিস্তারিত ও খুটিঁনাটি বিধান রচনা সম্ভবপর নয়।

ব্যক্তি স্বাধীনতা সংরক্ষণ
অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইসলাম মানুষের স্বাধীনতা সংরক্ষণের উপর প্রাথমিক গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং মানব জাতির কল্যাণার্থে তার উপর যতটুকু বিধি-নিষেধ আরোপ করা অপরিহার্য কেবলমাত্র ততটুকু বিধি-নিষেধই তার উপর আরোপ করেছে। ইসলাম মানুষের স্বাধীনতাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দান করেছে। এর কারণ হচ্ছে, ইসলামের বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে। এখানে সমষ্টিগত জবাবদিহির কোন ধারণাই নেই। বরং প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের কাজের জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে দায়ী এবং ব্যক্তিগতভাবেই তার নিজের কাজের জবাব দিতে হবে। এ জবাবদিহির জন্য মানুষের নিজস্ব ঝোঁক প্রবণতা, যোগ্যতা ও নিজের ব্যক্তিগত নির্বাচন অনুযায়ী তার ব্যক্তিসত্তার উন্নয়নের সর্বাধিক সুযোগ থাকবে। এ জন্য ইসলাম ব্যক্তির নৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সাথে সাথে তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রতিও গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। যেখানে মুক্ত মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অপহৃত হয় সেখানে তার নৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতারও বিলোপ সাধন হয়।একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, যে ব্যক্তি নিজের অর্থনৈতিক ব্যাপারে অন্য কোন ব্যক্তির, প্রতিষ্ঠানের বা সরকারের মুখাপেক্ষী সে নিজস্ব কোন স্বাধীন চিন্তা পোষণ করলেও তাকে কার্যকরী করার স্বাধীনতা তার থাকে না। এ কারণে ইসলাম অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমাদেরকে যে নীতি দান করে তার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে সর্বাধিক স্বাধীনতা দান করা হয় এবং কেবলমাত্র মানবিক কল্যাণের স্বার্থে যে পরিমান বিধি নিষেধ অপরিহার্য সে পরিমানই তার উপর আরোপ করে। এজন্য ইসলাম রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গন মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতে সরকার প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী, জনগন নিজেদের ইচ্ছা মত সরকার পরিবর্তন করতে পারবে। জনগনের বা তাদের আস্থাভাজন প্রতিনিধিদের পরামর্শ অনুযায়ী সরকারের ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হবে। এ ব্যবস্থার সমালোচনা বা এ সম্পর্কে মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা জনগনের থাকবে। সরকার কোন ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী হবেনা বরং কোরআন সুন্নাহর উচ্চতর আইন ও বিধান তার জন্য ক্ষমতার যে সীমা নির্দেশ করেছে তার মধ্যে থেকেই সে কাজ করে যাবে। উপরন্তু ইসলামে আল্লাহর পক্ষ থেকে জনগনকে স্থায়ীভাবে মৌলক মানবাধিকার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এগুলি অপহরণ করার অধিকার কারোর নেই। ব্যক্তি-স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও ব্যক্তি-সত্তার উন্নয়ন রোধকারী কোন প্রকার নির্যাতন ও একনায়কত্বমূলক ব্যবস্থা যাতে করে তার উপর চেপে বসতে না পারে সে উদ্দেশ্যেই এসব ব্যবস্থাপনা গৃহিত হয়েছে।

নৈতিক সংশোধন- বল প্রয়োগ নয়
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ইসলাম মানুষের নৈতিক বিকাশ ও অগ্রগতিকে মৌলিক গুরুত্ব দান করে। এ উদ্দেশ্যে সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তি যাতে করে স্বাধীনভাবে সৎকর্ম করার সর্বাধিক সুযোগ লাভ করে তার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। এভাবে মানুষের জীবনে দয়া, প্রেম, বদান্যতা, সহানুভূতি, পরোপকার ও অন্যান্য নৈতিক গুনাবলী বিশেষভাবে স্থান লাভ করে। তাই অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম শুধুমাত্র আইন ও সংবিধানের উপর নির্ভর করেনা। বরং এ ব্যপারে ঈমান, ইবাদত, শিক্ষা ও নৈতিক অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষের অভ্যান্তরীণ ও মানসিক সংস্কার সাধন, তার রুচি ও চিন্তা পদ্ধতির পরিবর্তন এবং তার মধ্যে এমন একটি শক্তিশালী নৈতিক অনুভূতি সৃষ্টি করার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে, যার সাহায্যে সে নিজে ইনসাফ ও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে সক্ষম হয়। এসমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করার পরও কার্যসিদ্ধ না হলে মুসলমানদের সমাজে অবশ্যি এতটুকু প্রাণশক্তি থাকতে হবে যার ফলে সামাজিক চাপের মুখে মানুষকে ইসলামী বিধি বিধানের অনুগত রাখা সম্ভব হয়। এ ব্যবস্থা যথেষ্ট প্রমাণিত না হলে ইসলাম আইনের শক্তি ব্যবহার করে। এভাবে অবশেষে শক্তির সাহায্যে ইনসাফ ও ন্যায়ের প্রতিষ্টা সম্ভব হয়। যে সমাজ ব্যবস্থা ইনসাফ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য একমাত্র আইনের শক্তির উপর নির্ভরশীল হয় এবং মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে রেখে তাকে স্বেচ্ছায় ন্যায়ের পথে চলার শক্তি তিরহিত করে, ইসলাম তাকে ভ্রান্ত ও ত্রুটিপূর্ণ মনে করে।

তৃতীয় কথা হচ্ছে, ইসলাম মানবিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের ধারক এবং নৈরাজ্য, দলাদলি ও সংঘর্ষের বিরোধী। তাই ইসলাম মানব সমাজকে শ্রেণীতে বিভক্ত করে না এবং প্রকৃতিগতভাবে মানব সমাজে বিরাজিত শ্রেণীগুলিকে শ্রেণী সংগ্রামের পরিবর্তে সহানুভূতি ও সহযোগিতার পথ দেখায়। মানব সমাজ বিশ্লেষণ করলে এখানে দু’ধরনের শ্রেণী দেখা যাবে। কৃত্রিমভাবে একটি নির্যাতনমূলক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অবৈধ ও অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে এক ধরনের শ্রেণীর জন্ম দেয়, অতপর বলপূর্বক তাকে প্রতিষ্ঠীত রাখে। যেমন- ব্রাহ্মণ্যবাদ, জমিদারি ব্যবস্থা বা পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যেসব কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক শ্রেণীর জন্ম দিয়েছে। ইসলাম নিজে এই ধরনের ব্যবস্থার জন্ম দেয়না এবং এগুলি টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতীও নয়। বরং সমাজ সংস্কার ও আইনগত পদ্ধতি অবলম্বন করে এগুলির বিলোপ সাধন করে। প্রকৃতিগতভাবে মানবিক যোগ্যতা ও অবস্থার পার্থক্যের ভিত্তিতে দ্বিতীয় এক ধরনের শ্রেণীর উদ্ভব হয় এবং স্বাভাবিক পদ্ধতিতে তা পরিবর্তিত হতে থাকে। ইসলাম বলপূর্বক এই ধরনের শ্রেণীগুলির বিলোপ সাধন করেনা এবং এগুলিকে স্থায়ী শ্রেণী রূপদানও করেনা বা এদের পরস্পরকে শ্রেণী সংগ্রামেও লিপ্ত করেনা। বরং ইসলামের নৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের মধ্যে ইনসাফপূর্ণ ও ন্যায়ানুগ সহযোগীতা সৃষ্টি করে, তাদেরকে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল, পরস্পরকে সাহায্যকারী ও সহযোগী বানায় এবং শ্রেণী নির্বিশেষে সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যার ফলে শ্রেণীগুলি স্বাভাবিকভাবেই একাত্ন ও পরিবর্তিত হতে থাকে।

ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি
এ তিনটি বিষয় দৃষ্টি সমক্ষে রাখার পরই এই অর্থব্যবস্থার মূলনীতির যথার্থ উপলব্ধি সম্ভবপর হবে। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার মৌল উদ্দেশ্যাবলী বর্ণনার পর এবার আমি এর মূলনীতিগুলি বর্ণনায় প্রবৃত্ত হব।

ইসলাম কতিপয় বিশেষ সীমারেখার মধ্যে ব্যক্তিমালিকানার স্বীকৃতি দেয়। ব্যক্তিমালিকানার ব্যাপারে উৎপাদন ও উপকরণসমূহ এবং নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির মধ্যে কোন প্রকার পার্থক্য করেনা। ইসলাম মানুষকে সাধারণ অধিকার দান করে, তবে তাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। ইসলামে এমন কোন ধারনা নেই যার ভিত্তিতে উৎপাদন ও উপকরণসমূহ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে উৎপাদন ও উপকরণসমূহ ব্যক্তিমালিকানার আওতা বহির্ভূত এবং নিছক নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিকে এর আওতাভুক্ত করা যেতে পারে। ইসলামের দৃষ্টিতে এক ব্যক্তি যেমন বস্ত্র, পাত্র ও গৃহের আসবাবপত্রের অধিকারী হতে পারে অনুরূপভাবে সে জমি, মেশিন ও কারখানারও অধিকার লাভ করতে পারে। এভাবে যেমন এক ব্যক্তি নিজের প্রত্যক্ষ শ্রমার্জিত অর্থ-সম্পদের বৈধ অধিকারী হয়, তেমনি সে নিজের পিতা, মাতা, স্ত্রী বা স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পত্তিরও মালিক হতে পারে এবং ব্যবসায়ে অংশীদারীত্বের নীতির ভিত্তিতে সে এমন একটি উপার্জনেরও অংশীদার হতে পারে যা তার লগ্নীকৃত মূলধনকে ব্যবসায়ে খাটিয়ে অন্য ব্যক্তির পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জন করেছে। ইসলাম উৎপাদন-উপকরণসমূহকে মালিকানা বা নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির মালিকানা, এ দু-প্রকার মালিকানার মধ্যে পার্থক্য করেনা। বরং ইসালামে পার্থক্যের ভিত্তি হচ্ছে অর্থোপার্জনের উপায়সমূহের [Means] বৈধতা বা অবৈধতা অথবা অর্থ ব্যবহারে হারাম হালাল পদ্ধতি। ইসলাম সমগ্র অর্থনৈতিক জীবনের নীলনকশা এমনভাবে তৈরী করেছে যাতে মানুষ কতিপয় সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করে স্বাধীনভাবে অর্থোপার্জন করতে পারে। ইতিপূর্বেই আমি বলেছি, ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের স্বাধীনতার গুরুত্ব অপরিসীম এবং এ স্বাধীনতার ভিত্তিতেই সে মানবতার বিকাশ ও উন্নতির সমগ্র প্রসাদ নির্মাণ করে। মানুষের ব্যক্তিমালিকানা অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার পর অর্থনীতির সমগ্র উপায়-উপকরণের উপর সমিষ্টির মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করলে অনিবার্যভাবেই তার ব্যক্তিমালিকানা বিলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ এ অবস্থা সৃষ্টি হবার পর যে প্রতিষ্ঠানটি সমগ্র রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণসমূহের নিয়ন্ত্রণ করে সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি তার কর্মচারীতে পরিণত হয়।

সমবন্টন নয়-ইনসাফপূর্ণ বন্টন
সম্পদের সমবন্টনের [Equal distribution] পরিবর্তে ইনসাফপূর্ণ বন্টন [Equitable distribution] ইসলামী অর্থব্যবস্থার আরেকটি মূলনীতি। অর্থোপার্জনের উপায়-উপকরণসমূহ সমস্ত মানুষের মধ্যে সমানভাবে বন্টন করে দেয়া ইসলামের লক্ষ্য নয়। কোরআন মজীদ অধ্যায়ন করলে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হবে যে, আল্লাহর এ বিশ্বজাহানে কোথাও সমবন্টন নীতি কার্যকর নেই। সমবন্টন মূলত, অপ্রাকৃতিক ও অস্বাভাবিক। সমস্ত মানুষের স্মৃতি শক্তি কি সমান? সমস্ত মানুষ কি সমান সৌন্দর্য, শক্তি ও যোগ্যতা সম্পন্ন? একই ধরনের পরিবেশ ও অবস্থায় কি সমস্ত মানুষের জন্ম? দুনিয়ায় কাজ করার জন্য সবাই কি একই ধরনের অবস্থার সম্মূখীন হয়? এসব ব্যপারে এক্ষেত্রে সাম্য না থাকলে নিছক উৎপাদন উপকরণনমূহ ও অর্থ বন্টনের ক্ষেত্রে সাম্যের অর্থ কি? কার্যত এটা সম্ভব নয় এবং সেখানে কৃত্রিমভাবে এর প্রচেষ্টা চললে অনিবার্যভাবে তা ব্যর্থ হবে। উপরন্তু পরিণামেও দেখা দেবে মারত্নক ভুল। এজন্যেই ইসলাম অর্থনৈতিক উপায় উপকরণাদি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সুফলসমূহ সমবন্টনের কথা বলেনা। বরং ইসলাম ইনসাফপূর্ণ বন্টনের দাবীদার। এ ইনসাফের জন্য সে কতিপয় নীতি নির্ধারণ করেছে।

উপার্জন উপকরণাদিতে হালাল হারামের পার্থক্য
এ প্রসঙ্গে প্রথম নীতি হচ্ছে, সম্পদ আহরণের উপকরণাদির মধ্যে ইসলাম হালাল ও হারামের পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। এক দিকে সে ব্যক্তিকে স্বাধীন ও অবাধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে অর্থোপার্জনের অধিকার দান করে এবং অর্থোপার্জনের পদ্ধতিসমূহে হালাল হারামের সীমা নির্ধারণ করে। ইসলামী বিধান অনুযায়ী যেকোন ব্যক্তি হালাল পদ্ধতিতে অর্থ উপার্জনের পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে। এজন্য সে নিজের ইচ্ছামত অর্থোপার্জনের যেকোন উপায় অবলম্বন করতে পারে এবং যেকোন পরিমাণ অর্থ উপার্জনও করতে পারে। সে তার এই উপার্জিত অর্থের বৈধ মালিক বলে স্বীকৃত হবে। তার এই বৈধ মালিকানা সীমিত করার বা তার থেকে এর অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার ক্ষমতা কারো নেই। তবে হারাম পদ্ধতিতে একটি পয়সা উপার্জনের অধিকার তার নেই। হারাম পদ্ধতি অবলম্বন করা থেকে তাকে জোর পূর্বক বিরত রাখা হবে। এ পদ্ধতিতে উপার্জিত অর্থের সে বৈধ মালিক বলে স্বীকৃত হবেনা। তার অপরাধের পর্যায়ানুসারে তাকে করাদন্ড, অর্থদন্ড বা তার ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত করার শাস্তি দেয়া যেতে পারে এবং অপরাধমূলক কাজ থেকে তাকে বিরত রাখার জন্যে বিভিন্ন ব্যবস্থাও অবলম্বিত হবে।

ইসলামে যে সমস্ত পদ্ধতি ও উপায়-উপকরণকে হারাম গণ্য করেছে, সেগুলি হচ্ছে- আত্নসাৎ, ঘুষ, পরদ্রব্য গ্রাস, সরকারী থেকে আত্নসাৎ, চুরি, পরিমানে কম করা, চারিত্রিক নৌরাজ্য সৃষ্টিকারী ব্যবসায়, বেশ্যাবৃত্তি, মদ ও অন্যান্য মাদক দ্রব্যের শিল্প ও ব্যবসায়, সুদ, জুয়া, ধাপ্পাবাজি এবং ব্যবসায়ের এমন সব পদ্ধতি যেখানে প্রতারণা, চাপ প্রয়োগের ভিত্তিতে ব্যবসায় পরিচালিত হয় অথবা যেগুলির মাধ্যমে কলহ, বিশৃংখলা এবং বিভেদ সৃষ্টির পথ প্রশস্ত হয় এবং যেগুলি ইনসাফ, ন্যায়সীতি ও গণস্বার্থ বিরোধী। ইসলাম আইন প্রয়োগ করে এসব পদ্ধতি ও উপায় উপকরণের ব্যবহার করার পথ রোধ করে। এছাড়া ইসলাম মজুদদারী [Hoarding] নিষিদ্ধ গণ্য করে এবং যে ইজারাদারি কোন রকম ন্যায়সংগত কারণ ছাড়াই অর্থ ও উৎপাদনের উপকরণসমূহ থেকে সাধারণ লোকদের উপকৃত হবার সুযোগ ছিনিয়ে নেয় তার পথ রুদ্ধ করে।

এ পদ্ধতি ও উপায় উপকরণগুলি বাদ দিয়ে বৈধ উপায়ে মানুষ যে সম্পদ অর্জন করে, তা হালাল উপার্জনের অন্তর্ভূক্ত। এ হালাল সম্পদ সে নিজে ভোগ করতে পারে। উপহার, দান বা অন্য কোন পদ্ধতিতে অন্যের নিকট হস্তান্তর করতে পারে। এমনকি অধিক সম্পদ আহরণের জন্যও ব্যবহার করতে পারে এবং নিজের উত্তরাধকিারীদের জন্য মীরাস হিসেবেও রেখে যেতে পারে। এই বৈধ উপার্জনের উপর এমন কোন বিধি-নিষেধ আরোপিত নেই যার সাহায্যে কোন এক পর্যায়ে যেয়ে তাকে আরও উপার্জন থেকে বিরত রাখা যেতে পারে। কোন ব্যক্তি হালাল উপার্জনের মাধ্যমে কোটিপতি হয়ে গেলে ইসলাম তার পথে প্রতিবন্ধক হবেনা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সে ইচ্ছামত উন্নতি লাভ করতে পারে, তবে এ উন্নতি তাকে বৈধ পথে লাভ করতে হবে। অবশ্যি বৈধ উপায়ে কোটিপতি হওয়া সহজসাধ্য নয়, এটা বিরল ঘটনা। কোন অসাধারণ ব্যক্তি আল্লাহর এ অনুগ্রহ লাভ করতে পারে। নচেৎ বৈধ উপায় অবলম্বন করে কোটিপতি হবার অবকাশ খুব কমই থাকে। কিন্তু ইসলাম কাউকে বেধে রাখেনা। হালাল উপায়ে সে যত অধিক সম্পদ চায় আহরণ করতে পারে। তার পথে কোন বাঁধা নেই। কারণ অনর্থক বাঁধা-নিষেধ ও প্রতিবন্ধকতার কারণে মানুষের কর্মপ্রেরণা [Incentive] খতম হয়ে যায়।

সম্পদ ব্যবহারে হালাল হারামের পার্থক্য
এভাবে বৈধ ও হালাল উপায়ে যে সম্পদ অর্জিত হয় তা ব্যবহারের উপরও বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

প্রথমতঃ এসম্পদ মানুষ নিজের উপর ব্যয় করতে পারে। এ ব্যয়াকে ইসলাম এমনভাবে সংযত করে, যার ফলে তা মানুষের নিজের চরিত্র ও সমাজের জন্য কোনক্রমেই ক্ষতিকর হতে পারেনা। সে মদ্যপান করতে পারবেনা। ব্যভিচার করতে পারবেনা। জুয়াবাজিতে নিজের সম্পদ উড়িয়ে দিতে পারবেনা। নৈতিকতা বিরোধী পন্থায় বিলাসব্যসনে ব্যয় করতে পারবেনা। এমনকি বসবাসের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জাকজমকের আশ্রয় নিলে তার উপর অবশ্যি বিধি নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়তঃ এসম্পদের কম বেশি কোন অংশ মানুষ সংরক্ষিত রাখতে পারে। ইসলাম এ প্রবনতা পছন্দ করেনা। ইসলাম মানুষের অতিরিক্ত সম্পদ সংরক্ষিত রাখার পরিবর্তে বৈধ পদ্ধতিতে তাকে আবর্তিত করতে চায়। একটি বিশেষ আইন অনুযায়ী ইসলাম এ সরক্ষিত সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করে। ফলে এর একটি অংশ বঞ্চিত শ্রেণীর স্বার্থে ও সামষ্টিক কল্যাণে ব্যবহৃত হতে পারে। কোরআন মজীদে যে সব কাজের সব চাইতে কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে, মানুষের সম্পদ সংরক্ষণ প্রচেষ্টা তন্মধ্যে অন্যতম। কোরআন বলেঃ ‘যারা সোনা ও রুপা সরক্ষণ করে তাদের সংরক্ষিত সোনা ও রুপা জাহান্নামে তাদের দাগ দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হবে’। এর কারণ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা মানুষের উপকারের জন্য অর্থ সম্পদ সৃষ্টি করেছেন। কাজেই একে আটকে রেখে মানুষের উপকারের পথ রুদ্ধ করার অধিকার কারোর নেই। বৈধ ও হালাল উপায়ে অর্থ সম্পদ উপার্জন করুন। অতপর অবশিষ্ট যা থাকে বৈধ পদ্ধতিতে আবর্তন করাতে থাকুন।

এজন্য ইসলাম মজুদদারীর উপর নিষেধাজ্ঞা করেছে। মজুদদারীর অর্থ হচ্ছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি বাজারে না ছেড়ে গুদামে সংরক্ষণ করা। ফলে বাজারে তার সরবরাহ কম হলে দাম বেড়ে যাবে। ইসলামী আইন এ ধরণের কাজকে হারাম গণ্য করে। কোন ঘোরপ্যাঁচে না যেয়ে সোজাসুজি ব্যবসা চালাতে হবে।ব্যবসায়ীর নিকট বিক্রয়যোগ্য পণ্য থাকলে এবং বাজারে তার চাহিদা থাকলে তা বিক্রয় করতে অস্বীকার করার কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই। জেনে বুঝে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির অভাব সৃষ্ট করার জন্য তার বিক্রয়ে অসম্মতি জ্ঞাপন করা মানুষকে ব্যবসায়ীর পরিবর্তে ডাকাতে পরিণত করে।

এ কারণে ইসলাম অস্বাভাবিক ধরনের ইজারাদারীর বিরোধী। করাণ এ ধরনের ইজারাদারী সাধারণ মানুষকে অর্থোপার্জনের কিছু কিছু সুযোগ-সুবিধা ও উপায়-উপকরণ কতিপয় বিশেষ ব্যক্তি, বংশ বা শ্রেণীর জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়ে এক্ষেত্রে অন্যদের অগ্রসর হবার পথ রোধ করাকে কোনক্রমেই বৈধ গণ্য করেনা। সমষ্টিগত স্বার্থে যে ইজারাদারী একান্ত অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র এই ধরণের ইজারাদারীর বৈধতা ইসলামে স্বীকৃত। অন্যথায় নীতিগতভাবে ইসলাম অবাধ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সবার জন্য উন্মুক্ত রাখার এবং সবাইকে নিজের যোগ্যতা ও সামর্থ অনুযায়ী প্রচেষ্টা চালাবার সমান সুযোগ দেয়ার পক্ষপাতী।

অতিরিক্ত অর্থ সম্পদ ব্যবহার করে যদি কোন ব্যক্তি আরও অর্থ উপার্জন করতে চায় তাহলে তাকে একমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য ইসলাম নির্ধারিত হালাল পদ্ধতিতে তা করতে হবে। আমি ইতিপূর্বে অর্থোপার্জনের যেসব হারাম পদ্ধতির বর্ণনা দিয়েছি এ উদ্দেশ্যে সেগুলি ব্যবহার করা যাবেনা।

ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার
অতপর ইসলাম ব্যক্তির সম্পদের উপর সমষ্টির অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে এবং এজন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে। কোরআন মজীদে নিকট আত্নীয়দের অধিকার বর্ণনা করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, কোন ব্যক্তি উপার্জিত অর্থের উপর তার নিজের ছাড়াও তার আত্নীয়-স্বজনদেরও অধিকার রয়েছে। সমাজের কোন ব্যক্তির যদি প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী হয় এবং তার আত্নীয়দের কেউ প্রয়োজনের তুলনায় কম সম্পদের উপার্জন করে তাহলে নিজের সামর্থ অনুযায়ী এ আত্নীয়কে সাহায্য করা তার সামজিক দায়িত্ব। সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির উপর এই দায়িত্ব বর্তায়। কোন জাতির অন্তর্গত এক একটি পরিবার যদি নিজেদের এ দায়িত্ব অনুভব করে এবং সমাগ্রিকভাবে জাতির অধিকাংশ পরিবারকে সহায়তা দানের ব্যবস্থা করে তাহলে বাইরের সাহায্যের মুখাপেক্ষী পরিবারের সংখ্যা হয়তো অতি অল্পই থেকে যাবে। এজন্যই কুরআন মজীদে বান্দার হকের মধ্যে সর্বপ্রথম মা, বাপ ও আত্নীয় স্বজনের হকের উল্লেখ করা হয়েছে।

অনুরূপভাবে কুরআন মানুষের সম্পদের উপর তার প্রতিবেশীদের উপরও অধিকার আদায় করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, প্রত্যেক পড়ায় মহল্লায়, অলিতে গলিতে যাদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছল তাদের অবশ্যি সংশ্লিষ্ট পাড়া, মহল্লা ও গলির তুলনামূলকভাবে অস্বচ্ছল লোকদের সহায়তা করতে হবে।

এই দ্বিবিধ দায়িত্বের পর কুরআন মজীদে প্রত্যেক সাহায্যের মুখাপেক্ষী বা সাহায্য প্রার্থীকে নিজের সামর্থানুযায়ী সাহায্য করার জন্য প্রত্যেক স্বচ্ছল ব্যক্তির উপর দায়িত্ব অর্পণ করে।

(মানুষের ধণসম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।) যে ব্যক্তি আপনার নিকট সাহায্য-সহায়তা প্রার্থনা করে সে হচ্ছে প্রার্থী। যে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা মেগে বেড়ায় এবং ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে তাকে প্রার্থী বলা যায় না। বরং যথার্থ প্রার্থী এমন এক ব্যক্তিকে বলা যেতে পারে, যে সত্যিকার অভাবী এবং যথার্থ অভাবী কিনা এ ব্যাপারে নিজের সকল প্রকার সন্দেহ নিরসনের জন্য তার অবস্থা জানার অধিকার আপনার রয়েছে। কিন্তু সে যথার্থ অভাবী একথা আপনি জানতে পারেন এবং তাকে সাহায্য দেয়ার মত প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থও যদি আপনার নিকট থাকে তাহলে জেনে রাখুন আপনার ধন সম্পদে তার অধিকার রয়ে গেছে। আর বঞ্চিত বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায়, যে আপনার নিকট সাহায্য চাইতে আসেনা কিন্তু সে নিজের আহার্য সংস্থান করতে বা পুরোপুরি সংস্থান করতে পারেনা। যদি একথা আপনি জানেন তবে আপনার অর্থ সম্পদে এহেন ব্যক্তির অধিকার রয়েছে।

এ অধিকারগুলো ছাড়াও ইসলাম মুসলমানদেরকে আল্লাহর পথে দান করার সাধারণ নির্দেশ দান করে তাদের অর্থ সম্পদে সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রেরও অধিকার কায়েম করেছে। এর অর্থ হচ্ছে মুসলমানকে দানশীল, উদার হৃদয়, অনুভুতিশীল ও মানব দরদী হতে হবে। স্বার্থসিদ্ধির প্রবণতার পরিবর্তে নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তাকে প্রত্যেকটি সৎকাজের এবং ইসলাম ও সমাজের বিভিন্ন প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য অর্থ ব্যয় করতে হবে। এটি একটি প্রচন্ড শক্তিশালী নৈতিক ক্ষমতা । ইসলাম নিজের শিক্ষা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে এবং ইসলামী সমাজের সামষ্টিক পরিবেশের সাহায্যে প্রতিটি মুসলমানের মধ্যে এই নৈতিক ক্ষমতা সৃষ্টি করতে চায়। এভাবে কোন প্রকার বল প্রয়োগ ছাড়াই হৃদয়ের ঐকান্তিক ইচ্ছায় সে সমাজ কল্যাণে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি