বাংলা একাডেমী বিজ্ঞান বিশ্বকোষ (৩য় খণ্ড)
লেখকঃ অজয় রায়
প্রকাশনীঃ বাংলা একাডেমী
বহুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “দেশের বিষয়ে আমাদের যাহা কিছু শিক্ষণীয় বিদেশীর হাত দিয়া প্রস্তুত হইয়া বিদেশীর মুখ দিয়া। উচ্চারিত হইলে তবেই আমরা কণ্ঠস্থ করিব। দেশের জ্ঞানপদার্থে আমাদের স্বায়ত্ব ও অধিকার থাকিবে না...এ দৈন্য আমরা আর কতদিন স্বীকার করিব ! ... দেশের কোনাে পদার্থকেই তুচ্ছ না করিবার এবং দেশী সমস্ত জিনিসই নিজে দেখিবার শুনিবার ও বুঝিবার চেষ্টা আমাদের যথার্থ স্বদেশপ্রীতির দিকে অগ্রসর এবং স্বদেশসেবার জন্য প্রস্তুত করিবে। ...জগতে যে জাতি দেশকে ভালােবাসে সে অনুরাগের সহিত স্বদেশের সমস্ত সন্ধান নিজে রাখে, পরের পুঁথির প্রত্যাশায় তাকাইয়া থাকে না। স্বদেশের সেবা যথাসাধ্য নিজে করে, কেবল পরের কর্তব্য বােধকে জাগ্রত করিবার উপায় সন্ধান করে না; এবং দেশের সম্পদকে নিজের সম্পূর্ণ ব্যবহারে আনিতে চেষ্টা করে। বিদেশী ব্যবসায়ীর অশুভাগমনের প্রতীক্ষায় নিজকে পথের কাঙাল করিয়া রাখে না।"
“অনুরাগের সহিত স্বদেশের সমস্ত সন্ধান নিজে” করার প্রেরণা থেকে বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ যে “বাংলা একাডেমী বিজ্ঞান বিশ্বকোষ রচনার কাজ হাতে নিয়েছে তার তৃতীয় খণ্ড আজ প্রকাশ করতে পেরে আমরা সত্যিই আনন্দিত। “দেশী সমস্ত জিনিসই নিজে দেখিবার শুনিবার ও বুঝিবার চেষ্টা করা থেকেই এই খণ্ডে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশে দেশী মােরা-মুরগি ছাড়াও উন্নত জাতের মুরগি পালনের প্রবণতা বেড়েছে।...বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কোয়েল পালন এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এদেশের আবহাওয়াও কোয়েল পালনের বেশ উপযােগী। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের পশ্চাৎপদতা সর্বজনবিদিত—বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এখনই পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি ২০২০ সালের মধ্যে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। তাই এই খণ্ডে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমানে (অক্টোবর ২০০০) স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩৭৩৫ মেগাওয়াট। ... বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলাে অধিকাংশই খুব পুরাতন বিধায় তাদের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। ... বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে ৩ » ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বার্জ মাউন্টেড প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ... এতােসব আয়ােজন সত্ত্বেও বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকটের নিরসন হয়নি।” এই হতাশাজনক পরিস্থিতির পাশাপাশি প্রযুক্তি অপপ্রয়ােগের ব্যাপারেও এই খণ্ডে সাবধানবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। “প্লাস্টিক দ্রব্য পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হতে পারে। অধিকাংশ প্লাস্টিক দ্রব্যই সহজে ক্ষয় হয় না। কিছু প্লাস্টিক রিসাইকল করা গেলেও অধিকাংশ বর্জ্য অব্যহৃত থাকে। ... তা চাষযােগ্য জমির মাটির সাধারণ গুণ নষ্ট করতে পারে। তারপর জনস্বাস্থ্য সম্বন্ধে বলা হয়েছে, “স্বাধীনতার পর পরই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ সময় প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তােলার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়।"
| আমাদের দেশের সমাজ পরিবর্তনের একমাত্র হাতিয়ার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একথা অনেকেই বলেন কিন্তু কতজন তা বিশ্বাস করেন তা বলা মুস্কিল। কিন্তু বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধে আগ্রহ এবং উৎসাহ অতুলনীয় বলেই আমাদের মনে হয়েছে। বিশ্বকোষের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে কম্পিউটারের বিভিন্ন দিক নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলােচনা করা হয়েছে, এই খণ্ডেও কিছু আলােচনা যথাস্থানে করা হয়েছে। বিশ্বকোষের সুনির্দিষ্ট ফর্মাটে এর বেশি করা সম্ভব হয়নি। একইভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের নানা সাম্প্রতিকতম আবিষ্কার, যেমন চৌম্বক তার বা ম্যাগনেটার, উল্লেখ করা হয়েছে। হাল ধ্রুবকের সাম্প্রতিকতম মান দ্বিতীয় খণ্ডে দেয়া হয়েছে। এই খণ্ডেও জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে কিছু আলােচনা করা হয়েছে সংক্ষিপ্ত ফর্মাটে।
কোনাে কোনাে বিষয় সম্বন্ধে বিস্তৃততর আলােচনা করলে যথার্থ হতাে এ সম্বন্ধে সম্পাদকমণ্ডলীও সচেতন। এ কারণেই বিশ্বকোষের একটি পঞ্চম খণ্ড প্রকাশ করে যেসব বিষয় প্রথম চারটি খণ্ডে দেয়া যায়নি বা যাদের সম্বন্ধে আরাে আলােচনা করা উচিত ছিল তা অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তাভাবনা আমাদের আছে। বিশেষ করে বিগত শতাব্দীর নানা কালজয়ী আবিষ্কার এবং আবিষ্কারকের জীবনী নিয়ে একটি খণ্ড প্রকাশ করা যায় কিনা সে সম্বন্ধেও আমরা চিন্তাভাবনা করেছি। এই প্রস্তাবিত পঞ্চম খণ্ডে বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে বিষয়ভিত্তিক আলােচনা করা হলে দেশের বিজ্ঞান ইতিহাসের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র হয়তাে তুলে ধরা যাবে।
তৃতীয় খণ্ডে M থেকে Q পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথ যত্নের সঙ্গে অতিক্রম করা হয়েছে বলেই আমরা বিশ্বাস করি এবং প্রায় দুহাজারের মতাে ভুক্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যার ফলে পৃষ্ঠার সংখ্যা দাড়িয়েছে এক হাজারের বেশি এবং ছবির সংখ্যাও পূর্বের তুলনায় শতকরা পঞ্চাশভাগ বেশি। এই খণ্ড রচনাকালেই আমাদের প্রিয় সহকমী ড. মােহাম্মদ শহীদুল্লাহ মৃধা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। সম্পাদকমণ্ডলী এবং সংকলকদের সম্মিলিত অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এই খণ্ডটি দ্বিতীয় খণ্ডের মতাে এক বছরের মধ্যে প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। এজন্যে বিশেষভাবে আমরা কৃতজ্ঞ সেলিনা হােসেন, সুব্রত বড়ুয়া, ড. স্বরােচিষ সরকার এবং মতিউর রহমানের কাছে। এছাড়াও আমাদের কম্পিউটারের আবু মােঃ ইমদাদুল হক অক্ষরবিন্যাস ও অলঙ্করণের পাশাপাশি প্রচুর জটিল চিত্র অঙ্কন করেছেন। মােঃ সােলায়মান ও শুভ্রা বড়ুয়াদের কাছেও আমরা বিশেষভাবে ঋণী। বাংলা একাডেমীর এই নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের আমরা জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।