আর-রুবায়্যি‘উ বিন্‌ত মু‘আওবিয (রা)
মদীনার ‘আদী ইবন আন-নাজ্জার খান্দানের মেয়ে আর-নুবায়্যি‘উ। যে সকল আনসার পরিবার ইসলামরে সেবায় মহান ভূমিকা পালন করেছে তাঁর পরিবারটি এর অন্তর্গত। প্রথম পর্বে আল্লাহর রাসূল (সা), ইসলঅম ও মক্কা থেকে আগত মুসলমানদের সেবায় এই পরিবারটির রয়েছে গৌরবময় অবদান। তাঁর মহান পিতা মৃ‘আওবিয, ইয়াস, ‘আকিল, খালিদ, ও আমির। তাঁদের মা ‘আফরা’ বিন্‌ত ‘উবাইদ আল-আনসারিয়্যা আন-নাজ্জারিয়্যা (রা)। তাঁর প্রথম তিন সন্তানের পিতা আল-হারিছ ইবন রিফ‘আ আন-নাজ্জারী। কিন্তু তাঁরা তাঁদের পিতার নামের চেয়ে মা ‘আফরার (রা) নামের সাথে অধিক পরিচিত। ইতিহাসে তাঁরা (আরবী***********)(‘আফরার ছেলেরা) নামে প্রসিদ্ধ। বাকী চারজনের পিতা আল-বুকাইর ইবন ‘আবদি ইয়ালীল আল-লায়ছী। ‘আফরার (রা) এই সাত ছেলের সকলে ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরে রাসূলে কারীমের (সা) সাথে অংশগ্রহণ করেন। মদীনার যে ছয় ব্যক্তি মক্কায় গিয়ে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহর (সা) সংগে গোপনে দেখা করে ইসলাম গ্রহণ করেন রুবায়্যি‘উ-এর চাচা ‘আওফ তাঁদের একজন। তিনি একজন ‘আকাবীও অর্থাৎ ‘আকাবার দুইটি বাই‘আতের অংশীদার। তাঁর পিতা মু‘আওবিয ও অপর চাচা মু‘আয (রা) ‘আকাবার প্রথম বাই‘আতে অংশগ্রহণ করেন।

তাঁর দাদী ‘আফরাৎ’ বিন্‌ত ‘উবাইদ মদীনায় ইসলামের বাণী পৌঁছার সূচনাপর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় আগমনের পর অন্য আনসারী মহিলাদের সাথে তিনিও বাই‘আত করেন। বদর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর (সা) পতাকাতলে শামিল হয়ে তাঁর সাতটি ছেলে অংশগ্রহণ করেন এবং দু‘চন শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর মত সৌভাগ্যের অধিকারী মুসলিম নারী জাতির মধ্যে দ্বিতীয় আর কেউ আছেন কি? আর-রুবায়্যি‘উ-এর মা উম্মু হয়াযীদ বিন্‌ত কায়সও মদীনার ‘আদী ইবন আন-নাজ্জআ গোত্রের মেয়ে।

আবূ জাহল যে কিনা এই উম্মএতর ফির‘আউন অভিধায় ভূষিত, বদরে তাকে ‘আফরা’র দুই ছেলে হত্যা করেন এবং রাসূলুল্লঅহর (সা) নেক দু‘আর অধিকারী হন। তিনি দু‘আ করেন :[ আনসাব আল-আশরাফ-১/২৯৯; আহমাদ যীনী দাহলান, আস-সীরাহ্ আন-নাবাবিয়্যা-১/৩৮৯] (আরবী******)

‘আল্লাহ ‘আফরা’র দুই ছেলের প্রতি দয়া ও করুণা বর্ষণ করুন যারা এই উম্মাতের ফির‘আউন আবূ জাহলকে হত্যায় অংশগ্রহণ করেছে।’

আর-রুবায়্যিউ-এর মা উম্মু ইয়াযীদ বিন্‌ত কায়স মদীনার আন-নাজ্জার গোত্রের মেয়ে। তাঁর বোন ফুরাই‘আ বিন্‌ত মু‘আওবিয। তিনিও একজন উঁচু স্তরের সাহাবিয়া ছিলেন। আল্লাহর দরবারে তাঁর দু‘আ অতিমাত্রায় কবুল হওয়ার কারণে (আরবী******) (মুজাবাতুদ দুা‘ওয়াহ্‌) বলা হতো।[আল-ইসতী‘আব-৪/৩৭৫]

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, আর-রুবায়্যি‘উ- এর বাবা-চাচারা বদর যুদ্ধের বীর যোদ্ধা ছিলেন। সে দিন তাঁরা জীবন দিয়ে পরবর্তীকালের ইসলামের বিজয়ধারার সূচনা করেন। এদিন কুরায়শ পক্ষের বীর সৈনিক আবুল ওয়ালীদ-‘উতবা ইবন রাবী‘আ, তার ভাই শায়বা ও ছেলে আল-ওয়ালীদ ইবন ‘উতবাকে সংগে নিয়ে পৌত্তলিক বাহিনী থেকে বেরিয়েং মুসলিম বাহিনীর দিকে এগিয়ে এসে তাদেরকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহবান জানায়। সাথে সাথে ‘আফরার তিন ছেলে মু‘আওবিয, মু‘আয ও ‘আওফ অস্ত্রসজ্জিত অবস্থায় তাদের দিকে এগিয়ে যয়। তারা প্রশ্ন করে : তোমরা কারা? তাঁরা বলেন : আমরা আনসারদের দলভুক্ত। তারা বললো : তোমাদের সাথে আমরা লড়তে চাই না। রাসূল (সা) তাদের ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন এবং তাদেরই স্বগোত্রীয় হামযা, ‘আলী ও ‘উবাইদাকে (রা) সামনে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ করলেন। তাঁরা এগিয়ে গেলেন এবং একযোগে আক্রমণ করে এই শয়তানের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।

আর-রুবায়্যি‘উর-এর পরিবারের লোকেরা জানতো এই উম্মাতের ফির‘আউন আবূ জাহল ইসলামের প্রচার-প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রতিবন্ধক। সে এমন ইতর প্রকৃতির যে আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়, তাঁকে গালি দেয়। দুর্বল মুসলামানদের উপর নির্যাতন চালায় এবং তাদেরকে হত্যঅ করে। তাই আর-রুবায়্যি‘উ এর বাবা মু‘উওবিয ও চাচা মু‘আয (রা) বাগে পেলে এ্‌ নরাধমকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা অঙ্গীকার করেন হয় তাকে হত্যা করবেন, নয়তো নিজেরা শহীদ হবেন। তাঁদের আরাধ্য সুযোগটি এসে গেল। তাঁরা সাত ভাই বদর যুদ্ধে গেলেন। এর পরের ঘটনা বিখ্যাত মুহাজির সাহাবী হযরত ‘আবদুর রহমান ইকন ‘উওফ (রা) চমৎকার ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন :৩[সাহীহ আল-বুখারী : ফী ফারদিল খুমুস (৩১৪১), ফী আল-মাগাযী (৩৯৬৪ম ৩৯৮৮) : মুসলিম : ফী আল-জিহাদ (১৭৫২); সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-১/২৫০; বানাত আস-সাহাবা-৬৬] (আরবী*******)

‘বদরের দিন আমি সারিতে দাঁড়িয়ে ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখি আমার দুই পাশে অল্প বয়সী দুই তরুণ। তাদের অবস্থানকে আমার নিজের জন্য যেন নিরাপদ মনে করালাম না। এমন সময় তাদের একজন অন্য সঙ্গী যেন শুনতে না পায় এমসভা ফিস ফিস করে আমাকে বললো : চাচা! আমাকে একটু আবূ জাহলকে দেখিয়ে দিন। বললাম : ভাতিজা! তাকে দিয়ে তুমি কি করবে? বললো : আমি আল্লাহর সংগে অঙ্গীকার করেছি, যদি আমি তাকে দেখি, হয় তাকে হত্যা করবো, নয়তো নিজে নিহত হবো। অন্যজনও একইভাবে একই কথা আমাকে বললো।

‘আবদুর রহমান ইবন ‘আওফ বলেন : তখন তাদের দুইজনের মাঝখানে আমি অবস্থান করতে পেরে কী যে খুশী অনুভব করতে লাগলাম! আমি হাত দিয়ে ইশারা করে তাদের আবূ জাহলকে দেখিয়ে দিলাম। সাথে সাথে দু্ইটি বাজ পাখীর মত তারা আবূ জাহলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করলো। তারা ছিল ‘আফরার দুই ছেলে।’

আবূ জাহলকে হত্যার পর তাঁরা বীর বিক্রমে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েরন। এই বদরেই আর-রুবায়্যি‘উ –এর মহান পিতা মু‘আওবিয (রা) শাহাদাত বরণ করেন।[আল-ইসতিবসার-৬৬, ] আবূ জাহলকে হত্যার ব্যাপারে রাসূলকে (সা) প্রশ্ন করা হয়েছিল : তাকে হত্যার ক্ষে্রে তাদের দুইজনের সংগে আর কে ছিল? বললেন : ফেরেশতাগণ এবং ‘আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ শেষ আঘাত হানে। আবূ জাহলের হত্যার পর রাসূল (সা) বললেন : আবূ জাহলের অবস্থা কি তা কেউ দেখে আসতে পারবে কি? ইবন মাস‘উদ (রা) বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যাচ্ছি। তিনি গিয়ে দেখেন ‘আফরার দুই ছেলে তাকে এমন আঘাত হেনেছে যে সে একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।[‘উয়ূন আল-আছার-১/৩১৫; আস-সীরাহ্‌ আল-হালরিয়্যা-২/৪৩৩]

হযরত রাসূলে কারীমের (সা) মদীনায় হিজরাতের পূর্বে আর-রুবায়্যি‘উ (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন তিনি একজন কিশোরী। রাসূল (সা) মক্কা থেকে কুবায় এসে উঠলেন। সেখানে তিন দিন অবস্থানের পর মদীনার কেন্দ্রস্থরের দিকে যাত্রা করেন এবং মসজিদে নববীর পাশে হযরত আবূ আইউ আল-আনসারীর (রা) গৃহে ওঠেন। তাঁর এই শুভাগমনে গোটা মদীনা আনন্দে দাঁড়িয়ে নেচে-গেয়ে তাঁকে স্বাগতম জানায়। তাদের স্বাগত সঙ্গীতের একটি চরণ ছিল এরকম :

(আরবী*****)

‘আমরা বানূ নান-নাজ্জারের কিশোর-কিশোরী। কি মজা! মুহাম্মাদ আমাদের প্রতিবেশী।’

রাসূল (সা) তাদের লক্ষ্য করে বললেন : তোমরা কি আমাকে ভালোবাস? তারা বললো : হাঁর । তিনি বললেন : আল্লাহ জানেন, আমার অন্তর তেকামাদের ভালোবাসেন। অনেকে বলেছেন, এই কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আর-রুবায়্যি‘উও ছিলেন।[নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ-১৫০,১৫১] বয়স বাড়ার সাথে রাসূলে কারীম (সা) ও ইসলামের প্রচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি নানাভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। বিভিন্ন দৃশ্যপটে তাঁকে উপস্থিত দেখা যায়। ইসলামের সেবায় অতুলনীয় ত্যাগের জন্য রাসূল (সা) এই পরিবারের সদস্যদের বিশেষ মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতেন। সব সময় হযরত রাসূলে কারীমের (সা) ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও সুখ-সুবিধার খোঁজ-খবর রাখতেন। রাসূল (সা) তাজা খেজুরের সাথে কচি শশা খেতে পছন্দ করতেন। আর-রুআয়্যি‘উ বলেন : আমার পিতা মু‘আাওবিয ইবন ‘আফরা (রা) একটি পাত্রে এক সা‘ তাজা খেজুর ও তার উপর কিছু কচি শশা দিয়ে আমাকে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট পাঠান। তিনি শশা পছন্ত করতেন। সেই সময় বাহরাইন থেকে রাসূলেল (সা) নিকট কিছু গহনা এসেছিল। তিনি তার থেকে এক মুট গহনা নিয়ে আমাকে দেন। অপর একটি বর্ণনায় স্বর্ণের কথা এসেছে। তারপর বলেন : এ দিয়ে সাজবে। অথবা বলেন : এ দিয়ে গহনা বানিয়ে পরবে।[বুখারী, ফী আল-আত‘ইমা-৯/৪৯৫; মুসলিম ফী আল-আশরিয়া (২০৪৩); তিরমিযী (১৮৪৫) ও ইবন মাজাহ (৩৩২৫)ফী আল-আত‘ইমা; মাজমা‘উ যাওয়ায়িদ লিল হায়ছামী-৯/১৩]

বিয়ের বয়স হলে বিখ্যাত মুহাজির সাহাবী ইবন আল-বুকাইরন আল-লায়ছীর সাথে বিয়ে হয় এবং তাঁর ঔরসে জন্মগ্রহণ করে ছেলে মুহাম্মাদ ইবন ইয়অস। তাঁর এই বিয়ের বিশেষ মহত্ব ও মর্যাদা এই যে, বিয়ের দিন সকালে রাসূল (সা) তাঁদের বাড়ৎীতে যান এবং তাঁর বিছানায় বসেন। পরবর্তী জীবনে আর-রুবায়্যি‘উ (রা) অত্যন্ত গর্বের সাথে সেকথা বলেছেন এভাবে : [বুখারী ফী আন-নিকাহ (৫১৪৭); ফী আল-মাগাযী (৪০০১); তিরমিযী-১০৯০; তাবাকাত-৮/৩২৮; তাহযীব আল-আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৬০৯] (আরবী******)

‘আমার বিয়ের দিন সকালে রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের বাড়ীতে এসে আমার ঘরে প্রবেশ করেন এবং বিছানায় বসেন। আমাদের ছোট ছোট মেয়েরা দফ বাজিয়ে বদর যুদ্ধে নিহত আমার বাপ-চাচাদের প্রশংসামূলক গীত সুর করে গাচ্ছিল। এর মধ্যে একজন গাইলো : আমাদের নবী আছেন যিনি ভবিষ্যতের কথা জানেন। তখন রাসূল (সা) তাকে বললেন : এটা বাদ দাও। আগে তোমরা যা বলছিলে তাই বল। অপর একটি বর্ণনায় এসেছে :

একথা বলো না। বরং আগে যা বলছিলে তাই বল। মূলতঃ তার প্রতি যে ভবিষ্যতের জ্ঞান আরোপ করা হয়েছে, তা থেকে বিরত রাখার জন্য একথা বলেন।

ইমাম আয-যহাবী এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :[ সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’ -৩/১৯৮] (আরবী*******)

‘নবী (সা) তাঁর বিয়ের দিন সকালে তার সাথে আত্মীয়তার সূত্রে তাঁকে দেখতে যান।’

আর-রুবায়্যি‘উ-এর বিয়ের দিন রাসূলুল্লাহর (সা) উপস্থিতি সম্ভবতঃ তাঁর প্রতি তথা তাঁর পরিবারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য ছিল। কারণ, ইসলামের জন্য এ পরিবারটির যে ত্যাগ ও কুরবানী ছিল তা রাসূল (সা) উপেক্ষা করতে পারেননি। ইসলামের জন্য এ পরিবার তাদের অর্থ-সম্পদ ব্যয় করেছে, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং জীবনও দিয়েছে। সুতরাং পিতৃহারা এই মেয়েটি যার পিতা আবূ জাহলেল ঘাতক এবয় যিনি বদরে শাহাদাত বরণ করেছেন, তার আনন্দের দিনে রাসূল (সা) কিভাবে দূরে থাকতে পারেন?

যুদ্ধের ময়দানে আর-রুবায়্যি‘উ-এর পিতা বদর যুদ্ধেঘ অংশগ্রহণের মাধ্যমে জিহাদের সূচনা করেন, তাঁর মেয়ে হিসেবে তিনি সে ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। পিতার রক্ত তাঁর ধমনীতে প্রবাহিত ছিল। তাই তাঁর মধ্যে ছিল জিহাদে গমনের অদম্য স্পৃহা। জিহাদের সীমাহীন গুরুত্ব তিনি পূর্ণরূপে অনুধাবন করেন। তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য রাসূলুল্লাগর (সা) সংগে বেশ কিছু জিহাদে যোগ দেন। ইবন কাছীর (রহ) বলেন : তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সংগে জিহাদে যেতেন। আহতদের ঔষুধ সেবন এবং ক্ষত-বিক্ষতদের পানি পান করাতেন। তিনি নিজেই বলেছেন :[সিফাতুস সাফওয়া-২/৭১; আত-তাজ আল-জামি’ লিল উসূল-৪/৩৪৪](আরবী******)

‘আমরা রাসূলুল্লাহর (সা) সংগে জিহাদে যেতাম। মুজাহিদদের পানি পান করাতাম, তাদের সেবা করতাম এবং আহত-নিহতদের মদীনায় পাঠাতাম।’

৬ষ্ঠ হিজরীর যুলকা‘দা মাসে হুদায়বিয়াতে মক্কার পৌত্তলিকদের সংগে রাসূলুল্লাহর (সা) যে সন্ধি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, সেই চৌদ্দ শো মুাজাহিদের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। সেখানে রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জীবন বাজি রাখার যে বাই‘আত অনুষ্ঠিত হয়, তিনিও সে বাই‘আত করেন। এ বাই‘আতকে বাই‘আতে রিদওয়ান ও বাই‘আতে শাজারা বলা হয়। ইসলামের ইতিহাসে এ বাই‘আতের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন ও তাঁর রাসূল (সা) যে এ বাই‘আতকে খুবই পছন্দ করেছেন তা কুরআন ও হাদীছের বাণীতে স্পষ্ট জানা যায়। যেমন : আল্লাহ বলেন:[ সূরা আল-ফাতহ-১০] (আরবী*******)

‘যারা তোমার হাতে বাই‘আত করে তারা তো আল্লাহরই হাতে বাই‘আত করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর। অতঃপর যে তা ভঙ্গ করে, তা ভঙ্গ করার পরিণাম তারই এবং যে আল্লাহর ষাথে অঙ্গীকার পূর্ণ করে তিনি অবশ্যই তাকে মহাপুরস্কার দেন।’

এ আয়াতে রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে হাত রেখে বাই‘আত করাকে আল্লাহর হাতে হাত রেখে বাই‘আত করা বলা হয়েছে। এতে এ বাই‘আতের বিরাট গুরুত্ব প্রমাণিত হয়।

হযরত রাসূলে কারীম (সা) এ বাই‘আতের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন :[ মুসলিম (২৪৯৬); তাবাকাত-২/১০০, ১০১] (আরবী******)

‘বৃক্ষের নীচে বাই‘আতকারীদের কেউই জাহান্নামে প্রবেশ করবে না।’

সেদিন বাই‘আতকারীদেরে উদ্দেশ্যে রাসূল (সা) বলেন :[ বুখারী : বাবু গাযওয়াতিল ফাতহ] (আরবী*****)

‘আজ তোমরা প্রথিবীর অধিবাসীদের মধ্যে সর্বোত্তম মানুষ।’

স্পষ্টভাষিণী

আবূ জাহলের ঘাত তাঁর মহান পিতাকে নিয়ে আর-রুবায়্যি‘উর (রা) গর্বের অন্ত ছিল না। আবূ জাহলের মা আসমা‘ বিন্‌ত মাখরামার সাথে তাঁর একটি ঘটনা দ্বারা একথা প্রমাণিত হয়। আর-রুবায়্যি‘উ বলেন :

আমি ‘উমার ইবন আল-খাত্তাবের (রা) খিলাফতকালে একদিন কয়েকজন আনসারী মহিলার সাথে আবূ জাহলের মা আসমা‘ বিন্‌ত মাখরামামর নিকট গেলাম। আবদুল্লাহ ইবন আবী রাবী‘আ (আবূ জাহলের বৈপিত্রেয় ভাই) ছিল তাঁর আরেক ছেলে। তিনি ইয়ামন থেকে মদীনায় তাঁর মা আসমার নিকট আতর পাঠাতেন, আর তিনি তা বিক্রি করতেন। আমরাও তাঁর নিকট থেকে আতর কিনতাম। সেদিন আমার শিশিতে আতর ভরে ওযন দিলেন, যেমন আমার সাথীদের আতর ওযন দিয়েছিলেন। তারপর বললেন : আপনাদের কার নিকট কত পাওনা। থাকলো তা লিখিয়ে দিন। আমি বললাম : আর-রুবায়্যি‘উ বিন্‌ত মু‘আওবিযের পাওনা লিখুন।

আসমা‘ আমার নাম শুনেই বলে উঠলেন : (আরবী***) –হালকা। শব্দটি অভিশাপমূলক। অর্থাৎ গলায় যন্ত্রণা হয়ে তোমার মরণ হোক। তারপর বললেন : তুমি কি কুরায়শ নেতার হত্যাকারীর মেয়ে?

বললাম : নেতার নয়, তাদে দাসের হত্যাকারীর মেয়ে।

বললেন : আল্লাহর কসম! তোমার নিকট আমি কিছুই বেচবো না।

আমিও বললাম : আল্লাহর কসম! আমিও আপনার নিকট থেকে আর কখনো কিচু কিনবো না। তোমার এ আতরে কোন সুগন্ধি নেই।। মতান্তরে একথাও বলেন যে, আপনার আতর চাড়া আর কারো আতরে আমি পঁচা গন্ধ পাইন। একথাগুলো বলে আমি উঠে আসি। আসলে উত্তেজনাবশতঃ আমি একথা বলি। মূলতঃ তাঁর আতরের চেয়ে সুগন্ধ আতর আমি কখনো শুকিনি।[আল-মাগাযী লিল ওয়াকিদী-১/৮৯; তাবাকাত-৮/৩০০.৩০১; আনসাব আল-আশরাফ-১/২৯৮; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-৩/১৯৯]

হাদীছ বর্ণনা

কেবল জিহাদে গমনের ক্ষেত্রেই তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল তা নয়, শরী‘আতের বিভিন্ন বিষয় জানা এবং রাসূলুল্লাহর (সা) বাণী শোনা ও আচরণ পর্যবেক্ষণেও তাঁর ছিল সমান আগ্রহ। আর এ উদ্দেশ্যে তিনি প্রায়ই উম্মুল মু‘মিনীন হযরত ‘আয়িশার (রা) নিকট যেতেন। তাই তাঁর থেকে রাসূলুল্লাহর (সা) বেশ কিছু গুণ-বৈশিষ্ট্য। ইমাম আয-যাবাহী বলেছেন : তিনি রাসুলুল্লাহর (সা) সাহচর্য যেমন পেয়েছেন তেমনি তাঁর হাদীছও বর্ণনা করেছেন। তাঁর থেকে রাসূলুল্লাহর (সা) ২১ (একুশ) টি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। সাহীহ ও সুনানের গ্রন্থাবলীতে এ হাদীছগুলো সংকলিত হয়েছে। তার মধ্যে একটি হাদীছ মুত্তাফাক ‘আলাইহি।[জাওয়ামি‘উ আস-সীরাহ্‌ আন-নাবাবিয়্যা-২৮২; বানাত আস-সাহাবা-১৬৭, ১৬৮]

উঁচু স্তরের অনেক ‘আলিম তাবি‘ঈ তাঁর নিকট হাদীছ শুনেছেন এবং তাঁর সূত্রে বর্ণনাও করেছেন। সেই সকল বিখ্যাত তাবি‘ঈদের কয়েকজন হলেন :

সুলায়মান ইবন ইয়াসার ও আবূ সালামা ইবন ‘আবদির রহমান। এ দুইজন হলেন সাতজন প্রথম সরির আলিম তাবি‘ঈর অন্তর্গত। তাছাড়া আবূ ‘উবায়দা মুহাম্মাদ ইবন ‘আম্মার ইবন ইয়াসির, ইবন ‘উমারের (রা) আযাদকৃত দাস নাফি’, ‘উবাদা ইবন আল-ওয়ালীদ ইবন ‘উবাদা ইবন আস-সামিত (রা) খালিদ ইবন যাকওয়ান ‘আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ ইবন ‘আকীল, আয়িশা বিন্‌ত আনাস ইবন মালিক প্রমুখ।[আল-ইসতী‘আব -৪/৩০২; তাহযীব আত-তাহযীব-১২/৪১৮; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’-৩/১৯৮]

সাহাবায়ে কিরাম (রা) হযরত রাসূলে কারীমের (সা) চেহারার দীপ্তি ও সৌন্দর্যের চমৎকার সব বর্ণনা দিয়েছন। তার মধ্যে কারো কারো বর্ণনার কিছু বাক্যের অনুপম শিল্পরূপ পাঠক ও শ্রোতাতে দারুণ মুগ্ধ করে। যেমন হযরত আবূ হুরায়রার (রা) একটি বাক্য :[ মুসনাদে আহমাদ-২/৩৫০, ৩৮০; বানত আস-সাহাবা-১৬৬;](আরবী*****)

‘আমি রাসূলুল্লাহর (সা) চেয়ে অধিকতর সুন্দর কোন কিছু কখনো দেখিনি। যেন সূর্য ছুটছে।’ রাসূলুল্লাহর (সা) মুখমণ্ডলের সৌন্দর্যের একটি বর্ণনা দিতে। তিনি বললেন :[ দালায়িল আন-নুবুওয়া্‌ লিল বায়হাকী-১/২০০; উসুদুল গাবা-৫/৪৫৫;] (আরবী****)

‘বেটা, তুমি যদি তাঁকে দেখতে তাহলে বলতে, সূর্যের উদয় হচ্ছে।’ সত্যি এ এক অপূর্ব বর্ণনা।

একবার রাসূলুল্লাহ (সা) রুবায়্যি‘উ-এর বাড়ীতে ওযু করেন। কিভাবে তিনি ওযু করেছিলেন, রুবায়্যি‘উ (রা) তা প্রত্যক্ষ করেন। পরবর্তীতে তিনি তা বরাণনা করতেন। সে বর্ণনা শোনার জন্য বহু মানুষ তাঁর নিকট আসতেন। একবার আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস (রা) আসেন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) ওযুর অবস্থা বর্ণনা করার অনুরোধ জানান।[তাফসীর আল-কুরতুবী-৬/৮৯] তাঁর সেই বর্ণনাটি হাদীছের বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।[আবূ দাঊদ : ফী আত-তাহারা-বাবু সিফাতি ওয়াদুয়িন নাবীয়ি্য (সা); আত-তিরমিযী: আত-তাহারা। (৩৩); ইবন মাজাহ (৪১৮)]

এ পৃথিবীতে এক জোড়া নর-নারীর দাম্পত্য জীবন যাপন যেমন স্বাভাবিক তেমনি সে জীবনে মনোমালিন্য, কলহ এবং বিচ্ছেদও স্বাভাবিক। আর-রুবায়্যি‘উ (রা)-এর জীবনেও এমনটি ঘটেছিল। দীর্ঘদিন স্বামী ইয়াস ইবন আল-বুকাইরের সাথে থাকার পর পরস্পরের মধ্যে এমন বিরোধ সৃষ্টি হয় যে কোনভাবেই এক সাথে থাকা সম্ভব হলো না। বিষয়টির বর্ণনা তিনি এভাবে দিয়েছেন : ‘আমার ও আমার চাচাতো ভাই অর্থাৎ স্বামীর মধ্যে একদিন ঝগড়া হলো। আমি তাকে বললাম : আমার যা কিছু আছে সব নিয়ে তুমি আমাকে প্রথক করে দাও। সে বললো : ঠিক আছে, আমি তাই করলাম। রুবায়্যি‘উ (রা) বলেন : আল্লাহর কসম! সে আমার সবকিছু নিয়ে নিল, এমনকি বিছানাটিও। আমি ‘উছমানের (রা) নিকট গিয়ে সব কথা তাঁকে খুলে বললাম। তিনি তখন অবরুদ্ধ অবস্থায়। বললেন : শর্ত পূর্ণ করাই উচিত। ইয়াসকে লক্ষ্য করে বললেন: তুমি ইচ্ছা করতে তার যা কিছু আছে সব নিতে পার, এমনকি চুলের ফিতাটি পর্যন্ত। [আল-ইসাবা-৪/২৯৪; ‍সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-৩/৩০০] তাঁদের এই বিচ্ছেদের ঘটনাটি ঘটে হিজরী ৩৫ সনে।

হযরত রুবায়্যি‘উ (রা) দীর্য় জীবন পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। তবে সু্নির্দিষ্টভাবে ওয়াতের সনটি জানা যায় না। ইমাম আ-যাহবিী (রহ) বলেছেন, তিনি হিজরী ৭০ (সত্তর) সনের পরে ‘আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানের খিলাফতকালে ইনতিকাল করেন।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’-৩/৩০০] অবশ্য কোন সূত্র হিজরী ৪৫ (পঁতাল্লিশ) সনে তাঁর মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছে। ‘আল্লামা আযযিরিক্‌লী বলেছেন, তিনি হযরত মু‘আবিয়ার (রা) খিলাফতকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।[আল-আ‘লাম-৩/৩৯]
হিন্দ বিন্‌ত ‘উতবা
‘উতবা ইবন রাবী‘আ ইবন ‘আবদু মান্নাফ ইবন ‘আবদু শামস-এর কন্যা হিন্দ। তাঁর মা সাফিয়্যা বিন্‌ত উমাইয়্যা ইবন হারিছা আস-সুলামিয়্যা। মক্কার অভিজাত ‍কুরাইশ খান্দানের সন্তান।[তাবাকাত-৮/২৩৫; তাযহীব আল-আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৩৫; আল-ইাবা ফী তাময়ীয আস-সাহাবা-৪/৪০৯] ইসলাম-পূর্ব ও ইসলাম-পরবর্তী আরবে যে সকল মহিলা খ্যাতির অধিকারিণী তিনি তাঁদের একজন। তাঁর বড় পরিচয় তিনি উমাইয়্যা খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মু‘আবিয়া ইবন আবী সুফইয়ানের (রা) গৌরবান্বিত মা।

কুরাইশ বংশের যুবক আল-ফাকিহ্‌ ইবন আল-মুগীরা আল-মাখযূমীর সাথে হিন্দ –এর প্রথম বিয়ে হয়, কিন্তু সে বিয়ে টেকেনি। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এই ছাড়াছাড়ি হওয়ার পশ্চতে একাট চমকপ্রদ কাহিনী আছে, আরবী সাহিত্যের প্রাচীন সূত্রসমীহে যা বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাকি এই রকম :

মক্কার কুরাইশ গোত্রের আল-মাখযূমী শাখার যুবক আল-ফাকিহ্‌ ইবন আল-মুগীরার সাথে হিন্দ-এর বিয়ে হয়। সে ছিল অতিথিপরায়ন। অতিথিদের থাকার জন্য তার ছিল একটি অতিথিখারা। বাইরের লোক বিনা অনুমতিতে সব সময় সেখানে আসা-যাওয়া করতো। একদিন আল-ফাকিহ্‌ স্ত্রী হিন্দকে নিয়ে সেই ঘর দুপুরে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। এক সময় হিন্দকে নিদ্রাবস্থায় রেখে সে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।এ সময় একজন আগন্তুক আসে এবং একজন মহিলাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে দরজা থেকেই ফিরে যায়। ফেরার পথে লোকটি আল-ফাকিহ্‌‘এর সামনে পড়ে এবং তার সন্দেহ হয়। সে ঘরে ঢুকে হিন্দকে জিজ্ঞেস করে : এইমাত্র যে লোকটি তোমার নিকট থেকে বেরিয়ে গেল সে কে? হিন্দ বললেন : আমি কিছুই জানি না। কাউকে আমি দেখেনি। আল-ফাকিহ্‌ তার কথা বিশ্বাস করলো না। সে হিন্দকে তার পিতৃগৃহে চলে যাওয়ার জন্য বললো। ব্যাপারটি মানুষের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেল। হিন্দ-এর পিতা ‘উতবা মেয়েকে বললো : তোমার ব্যাপারটি আমাকে খুলে বল। যদি আল-ফাকিহ্‌‘র কথা সত্য হয় হাতলে কোন গুপ্ত ঘাতক দিয়ে আমি তাকে হত্যা করে ফেলবো। তাতে চিরদিনের জন্য তোমার দুর্নাম দূর হয়ে যাবে। আর সে মিথ্যাবাদী হলে আমি ইয়ামনের একজন বিখ্যাত কাহিন (ভবিষ্যদ্বক্তা)-এর নিকট বিচার দিব। হিন্দ বললেন : আব্বা, সে মিথ্যাবাদী।

‘উতবা আল-ফাকিহ্‌র নিকট গেল এবং তাকে বললো : তুমি আমার মেয়ের প্রতি একটি বড় ধরনের অপবাদ দিয়েছো। হয় তুমি আসল সত্য প্রকাশ করবে, আর না হয় ইয়ামনের কাহিনের নিজক বিচারের জন্য তোমাকে যেতে হবে। সে বললো : ঠিক আছে, তাই হোক। আল-ফাকিহ্‌ বাণূ মাখযূমের নারী-পুরুষের একটি দল নিয়ে যেমন মক্কা থেকে ইয়ামনের দিকে বের হলো তেমনি ‘ইতবাও বের হলো বানূ আবদি মান্নাফেল নারী-পুরুষের একটি দল নিয়ে।

যখন তারা কাহিনের বাড়ীর কাছাকাছি পৌঁছলো তখন হিন্দ-এর চেহারা বিরূপ হয়ে গেল। তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়লেন।এ অবস্থা দেখে তার পিতা তাকে বললো : মক্কা থেকে বের হওয়ার সময় তোমার চেহারা তো এমন ছিল না? তিনি বললেন : আব্বা! আমি কোন খারাপ কাজ করেছি, এজন্য আমার চেহারার এ অবস্থা হয়নি, বরং আমি চিন্তা করছি, তোমরা যার নিকট যাচ্ছো সে তো একজন মানুষ। সে ভুল ও শুদ্ধ দুটোই করতে পারে। হতে পারে আমার প্রতি দোষারোপ করে বসলো, আর তা চিরকাল আরবের মানুষের মুখে মুখে প্রচার হতে থাকলো। পিতা বললো: তুমি ঠিকই বলেছো।

এক সময় তারা কাহিনের নিকট পৌঁছলো। মেয়েরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো। কাহিন একেকজনের নিকট গিয়ে তার মাথায় হাত রেখে বলছিল: যাও! তুমি তোমার কাজ কর। এক সময় সে হিন্দ-এর নিকট গেল এবং তার মাথায় হাত রেখে বললো : (আরবী****)

‘যাও, তুমি কোন অশ্লীল কাজ করোনি এবং তুমি ব্যভিচারিণীও নও। ভবিষ্যতে তুমি এক বাদশার জন্ম দেবে যার নাম হবে মু‘আবিয়া।’

হিন্দ কাহিনের নিকট বাইরে বেরিয়ে এলে আল-ফাকিহ্‌ তার হাত ধরে; কিন্তু হিন্দ সজোরে হাতটি ছাড়য়ে নেন এবং আল-ফাকিহ্‌কে লক্ষ্য করে বলেন : আল্লাহর কসম! আমি চাই অন্য কারো ঔরসে আমার গর্ভে সেই সন্তানের জন্ম হোক। অতঃপর আবূ সুফইয়ান তাঁকে বিয়ে করেন এবং মু‘আবিয়ার পিতা হন।

বর্ণিত হয়েছে, আল-ফাকিহ্‌ থেকে পৃথক হওয়ার পর হিন্দ পিতাকে বললেন : আব্বা! আমার কোন মতামত ছাড়াই এই লোকটির সাথে তুমি আমার বিয়ে দিয়েছিলে। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। এবার কোন ব্যক্তির স্বভাব বৈশিষ্ট্য আমার নিকট বিস্তারিতভাবে বর্ণনা না করে কারো সাথে আমার বিয়ে দেবে না। অতঃপর সাহাইল ইবন ‘আমর ও আবূ সুফইয়ান ইবন হরব বিয়ের পয়গাম এভাবে উপস্থাপন করলো : (আরবী*****)

‘ওহে নারী জাতির হিন্দ! সুহাইল ও হারবের পুত্র আবূ সুফইয়ান তোমার নিকট এসেছে। তোমার প্রতি তাদের আগ্রহ ও সন্তুষ্টি আছে।

তাদের অনুগ্রহ ও কল্যাণে জীবন যাপন করা যায়। তারা ক্ষতি ও উপকার দুটোই করতে পারে।

তারা দু‘জন মহানুভব ও দানশীল। তারা দু‘জন উজ্জ্বলমুখমণ্ডল বিশিষ্ট সাহসী বীর।

তোমার নিকট উপস্থাপন করলাম। তুমিই নির্বাচন কর, কারণ তুমি দূরদৃষ্টিসম্পন্না বুদ্ধিমতী মহিলা। ধোঁকা ও প্রতারণার আশ্রয় নিও না। কারণ যে প্রতারণা করে সে প্রতারিত হয়।’

হিন্দ বললেন : আব্বা! আমি এসব কিছুই শুনতে চাই না। আপনি তাদের দু‘জনের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য আমার কাছে একটু ব্যাখ্যা করুন। তাহলে আমার জন্য অধিকত উপযোগী কে তা আমি নির্ধারণ করতে পারবো। ‘উতবা এবার সুহাইলের বর্ণনা দিতে গিয়ে বললো : একজন তো গোত্রের উঁচু স্থানীয় ও বিত্তবান। তুমি তাঁর আনুগত্য করলে সে তোমার অনুগত থাকবে। তুমি তার প্রতি বিরূপ হলে সে তোমার কাছে নত হবে। তারপর পরিবার ও সম্পদের ব্যাপরে তুমি তার উপর কর্তৃত্ব করবে। আর অন্যজন উঁচু বংশ ও সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য সকলের নিকট পরিচিত। সে তার গোত্রের সম্মান ও মর্যাদা। প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন, অত্যন্ত সতর্ক, সম্পদের পাহারায় উদাসীন হয়ে ঘুমায় না এবং তার পরিবারের উপর থেকে তার লাঠি কখনো নামায় না। হিন্দ বললেন : আব্বা! প্রথম ব্যক্তি হবে একজন স্বাধীন নারীকে বিনষ্টকারী। সেই নারী বিদ্রোহী হলে আর আত্মসমর্পণ করবে না। স্বামীর ছায়াতলে মূলত সেই সবকিছু করবে। স্বামী তার আনুগত্য করলে স্ত্রীল ইশারা-ইঙ্গিতে চলবে। পরিবারের লোকেরা তাকে ভয় করে চলবে। তখন তাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় সে যদি কোন সন্তানের জন্ম দেয়, সে সন্তান হবে নির্বোধ। এই লোকটির আলোচনা আমার নিকট করবেন না। তার নামও আমর আমর নিকট উচ্চারণ করবেন না। আর অন্যজন পূতঃপবিত্র স্বাধীন ও কুমারী নারীল স্বামী হওয়ার যোগ্য। এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ যে, তার গোত্র তার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে পারবে না এবং কোন ভয়-ভীতি তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে সক্ষম হবে না। এমন স্বভাব-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিই আমার স্বামী হওয়ার যোগ্য। তার সাথেই আমাকে বিয়ে দিন। ‘উতবা আবূ সুফইয়ানের সাথে হিন্দ-এর বিয়ে দেয়। তার ঔরসে হিন্দ মু‘আবিয়অ নামের পুত্রের জন্ম দেয়। সুহাইল ইবন ‘আমর হিন্দকে না পেয়ে দারুণ আহত হয় এবং তার মনোবেদনা একটি কবিতায় প্রকাশ করে। আবূ সুফইয়ানকে একটু হেয় করারও চেষ্টা করে। আবূ সুফইয়ান একটি কবিতায় তার জবাব দেন।

এর পরের ঘটনা। সুহাইল অন্য মহিলাকে বিয়ে করে এবং তার গর্ভে সুহাইলের এক ছেলের জন্ম হয়। ছেলেটি বড় হলে একদিন সুহাইল তাকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছে। পথে সে দেখতে পায় এক ব্যক্তি একটি মাদী উটের উপর সওয়া হয়ে ছাগল চরাচ্ছে। ছেলেটি পিতাকে বলে : আব্বা! এই ছোটগুলো কি বড়টির বাচ্চা? তার প্রশ্ন শুনে পিতা সুহাইলের মুখ থেকে স্বগতোক্তির মত বের হয় : ‘আল্লাহ হিন্দ-এর প্রতি দয়া ও করুণা করুন। এ মন্তব্য দ্বারা সে হিন্দ-এর দূরদৃষ্টির কথা স্মরণ করে।[তারীখু দিমাশ্‌ক-তারাজিম আন-নিসা’-৪৪০-৪৪১; আল-‘ইকদ আল-ফারীদ-৬/৮৯; আস-সাবীহ আল-হালাবিয়্যা-৬/৮৬-৭৮; মাজমা‘ আয-যাওয়অহিদ-৯/২৬৭-২৬৮;]

ইবন সা‘দ অবশ্য বলেছেন, হিন্দ-এর প্রথম স্বামী হাফ্স ইবন আল-মুগীরা ইবন ‘আবদুল্লাহ ইবং তার ঔরসে হিন্দ-এর পুত্র আবান-এর জন্ম হয়।[তাবাকাত-৮/২৩৫]

হিন্দ ভালোবাসতেন মুসাফির ইবন আবী ‘আমরকে। মুসাফিরও তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসতো। এই মুসাফির ছিল রূপ-সৌন্দর্যে, কাব্য প্রতিভা ও দানশীলতায় কুরাইশ যুবকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। একদিন হিন্দ তাকে বললেন : যেহেতু তুমি দরিদ্র, তাই আমার পরিবার তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে রাজি হবে না। তুমি পার্শ্ববর্তী কোন রাজান নিকট যাও এবং সেখন থেকে কিছু সম্পদের মালিক হয়ে ফিরে এসে আমাকে বিয়ে করবে। মুসাফির হিন্দ-এর মাহরের অর্থ লাভের আশায় হীরার রাজা আন-নু‘সান ইবন আল-মুনযিরের নিকট গেল। কিছুদিন পর আবূ সুফইয়ান ইবন হরব, মতান্তরে জনৈক ব্যক্তি মক্কা থেকে হীরায় গেল। মুসাফির তার নিকট মক্কার হল-হাকীকত জিজ্ঞেস করলো এবং জানতে চাইলো সেখানকার নতুন কোন খবর আছে কিনা। আবূ সুফইয়ান বললো : নতুন তেমন কোন খবর নেই। তবে আমি হিন্দ বিন্‌ত ‘উতবাকে বিয়ে করেছি। মুসাফির নিম্নের চরণ দু‘টি আবৃত্তি বরতে শুরু করলো :[ আ’লাম আন-নিসা’ -৫/২৪২] (আরবী****)

‘ওহে, হিন্দ তোমার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেছে এবং নিকৃষ্টতম নিষিদ্ধ বস্তুতে পরিণত হয়েছে। সে এমন খারাপ মানুষের মত হয়ে গেছে যে তার অস্ত্র কোষমুক্ত করে, তীর-ধনুক দু‘হাত দিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখে।’

এক সময় মক্কায় ইসলামের অভ্যুদয় হলেঅ।

পরবর্তী বিশ বছর পর্যন্ত হিন্দ ইসলামের আহবানের প্রতি কর্ণপাত করেননি। বরং তার এ দীর্ঘ সময় আল্লাহর রাসূল, ইসলাম ও মুসলমানদের মাত্রাছাড়া বিরুদ্ধচরণ ও শত্রুতায় অতিবাহিত হয়েছে। এ সময় শত্রুতা প্রকাশের কোন সুযোগই তিনি হাতছাড়া করেননি। স্বর্ণ ও অলঙ্কারের প্রতি মহিলাদের আবেগ স্বভাবগত। কোন অবস্থাতেই তার এ দু‘টো জিনিস হাতছাড়া করতে চায় না। কিন্তু হিন্দ দুটোর বিনিময়েও ইসলামের প্রচার-প্রসার ঠেকাতে মোটেই কার্পণ্য করেননি। মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল (সা) আবূ সুফইয়ানের গৃহকে নিরাপদ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আবূ সুফইয়ানের ঘর আশ্রয় নিবে সে নিরাপদ থাকবে। এ ঘোষণার পর আবূ সুফইয়ান ঘরে প্রবেশ করতে চাইলে হিন্দ তাকে তিরস্কার করে বলেন : আল্লাহ তোমার অনিষ্ট করুন। ‍তুমি একজন নিকৃষ্ট প্রবেশকারী।[আয-যাহাবী, তারখী আল-ইসলাম ওয়া তাবাকাত আল-মাশাহীর ওয়া আল-আ‘লাম-৩/২৯৮] তার এমন মাত্রাছাড়া শত্রুতার কারণে রাসূল (সা) তাকে হত্যার ঘোষণা দেন। ইসরামের এহেন শত্রু মক্কা বিজয়েল সময় ইসলামের ঘোষণা দেন।

হিন্দ ছিলেন কুরাইশদের অন্যতাম সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী মহিলা।[প্রাগুক্ত] চমৎকার কাব্য প্রতিভাও ছিল তাঁর। বদরে নিহতদের স্মরণে, বিশেষত তাঁর পিতা ‘উতবা, ভাই আল-ওয়ালীদ ইবন ‘উতবা এবং চাচা শায়বা ইবন রাবী‘আ ও অন্যদের স্মরণে তিনি অনেক মরসিয়া রচনা করেছেন।

‘উমার রিদা কাহ্‌হালা হিন্দ-এর পরিচয় দিয়েছেন এভাবে :[ আ‘লাম আন-নিসা’-৫/২৪২] (আরবী*******)

রূপ. সৌন্দর্য, মতামত, সিদ্ধান্তক, বুদ্ধি-প্রজ্ঞা, ভাষার শুদ্ধতা ও অলঙ্কার, সাহিত্য, কবিতা, বীরত্ব-সাহসিকতা ও আত্মসম্মানবোধের অধিকারিণী ছিলেন হিন্দগ বিন্‌ত ‘উতবা।’

বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা) ইসলাম প্রচারে আদিষ্ট হয়ে যখন কুরাইশ গোত্রের লোকদের সমবেত করে তাদের সামনে ইলামের দা‘ওয়াত উপস্থাপন করেন তখন আবূ লাহাব তার প্রতিবাদ করে এবং তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর সে হিন্দ বিন্‌ত ‘উতবার নিকট এসে বলে : ‘উতবা মেয়ে! আমি মুহাম্মাদের থেকে পৃথক হয়ে এসেছি এবং সে যা কিছু নিয়ে এসেছে বলে দাবী করছে তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছি। আমি লাত ও ‘উয্‌যাকে সাহায্য করেছি এবং তাদের দু‘জনকে প্রত্যাখ্যান করায় আমি মুহাম্মাদের প্রতি ক্ষব্ধ হয়েছি। হিন্দ মন্তব্য করলেন : ‘উতবার বাবা! আল্লাহ আপনাকে ভালো প্রতিদান দিন।[সীরাতু ইবন হিশাম-১/৬৫৪]

ইসলামের প্রতি হিন্দ-এর প্রচণ্ড বিদ্বেষ ও শত্রুতা ছিল। তা সত্ত্বেও তাঁর মধ্যে অনেক গুণ বিদ্যমান ছিল। ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যাতে তাঁর প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ এবং নারী জাতির প্রতি তীব্র সহানুভূতি ও সহমর্মিতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাসূলুল্লাহর (সা) কন্যা হযরত যায়নাবের (রা) স্বামী আবুল ‘আস ইবন রাবী’ (রা) কুরায়শ বাহিনীর সঙ্গে বদরে যান মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। দুর্ভাগ্য তাঁর, মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হলেন। মক্কায় অবস্থানরাত স্ত্রী যায়নাবের (রা) চেষ্টায় এবং মুসলমানদের উদারতায় মুক্তি লাভ করে মক্কায় ফিরে যান। তবে মদীনা থেকে আসার সময় রাসূলুল্লাহকে (সা) কথা দিয়ে আসেন যে, মক্কায় পৌঁছে যায়নাবকে সসম্মানে মদীনায় পৌঁছে দেবেন। মক্কায় ফিরে তিনি স্ত্রী যায়নাবকে (রা) সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বললেন। যায়নাব চুপে চুপে প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। এ খবর হিন্দ-এর কানে গেল। তিনি গোপনে রাতের অন্ধকারে যায়নাবের নিকট গেলেন এবং বললেন : ‘ওহে মুহাম্মাদের মেয়ে! শুনতে পেলাম তুমি নাকি তোমার পিতার নিকট চলে যাচ্ছ? যায়নাব (রা) বলেন : এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি। হিন্দ মনে করলেন, হয়তো যায়নাব তাঁর কাছে বিষয়টি গোপন করছে, তাই তিনি বললেন : আমার চাচাতো বোন! গোপন করো না। ভ্রমণ পথে তোমার কাজে লাগে এমন জিনিসের প্রয়োজন থাকলে, অথবা অর্থের সংকট থাকলে আমাকে বল, আমি তোমাকে সাহয্য করবো। আমার কাছে লজ্জা করো না। পুরুষদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব-ফাসাদ তা নারীদের সম্পর্কে কোন রকম প্রভাব ফেলে না। পরবর্তীকালে যায়নাব (রা) বলেছেন, আমার বিশ্বাস ছিল তিনি যা বলছেন তা করবেন। তা সত্ত্বেও আমি তাঁকে ভয় করেছিলাম। তাই আমি আমার উদ্দেশ্যের কথা অস্বীকার করেছিলাম।[প্রাগুক্ত]

একদিন যায়নাব (রা) মক্কা থেকে মদীনার দিকে বের হলেন। কুরাইশরা তাঁকে বাধা দিয়ে আবার মক্কায় ফিরিয়ে দিল। একথা হিন্দ জানতে পেরে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে ঘর থেকে বের হলেন এবং সেই সব দুরাচারীদের সামনে গিয়ে তাদের এহেন দুষ্কর্মের জন্য কঠোর সমালোচনা করলেন। তাদের উদ্দেশ্যে নিম্নের চরণটিও আওড়ালেন :[ প্রাগুক্ত-১/৬৫৬; নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়অহ্‌-৪৭২] (আরবী*****)

‘সন্ধি ও শান্তির সময় কঠিন ও কঠোর গাধার মত আচরণ করতে পার, আর রণক্ষেত্রে ঋতুবতী নারীর রূপ ধারণ কর।’

কুরাইশ পাষণ্ডরা যায়নাবকে (রা) মক্কায় আবূ সুফইয়ানের নিকট নিয়ে আসে। উল্লেখ্য যে, যায়নাব (রা) সন্তানসম্ভবা ছিলেন। পাষণ্ডরা উটের পিঠ থেকে ফেলে দেওয়ায় তিনি বেশ আঘাতও পেয়েছেলেন। তাঁর সেবা ও আদর-আপ্যায়ন করার জন্য তাঁকে নিয়ে বানূ হাশিম ও বানূ উমাইয়্যার মেয়েরা বিবাদ শুরু করে দেয়। অবশেষে হিন্দ তাঁকে নিজের কাছে রেখে দেন এবং সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলেন। এ সময় হিন্দ প্রায়ই তাঁকে বলতেন, তোমার এ বিপদ তোমার বাবার জন্যই।

হিজরী ২য় সনে সিরিয়া থেকে মক্কা অভিমুখী আবূ সফইয়অনের একটি বাণিজ্য কাফেলা নির্বিঘ্নে পার করা এবং মুসলমানদেরকে চিরতরে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে মক্কার পৌত্তলিকদের বিশাল একটি বাহিণী বের হয়। এই বাহিনীর পুরোভাগে ছিল কুরাইশদের বাছা বাছা মানুষ ও নেতৃবৃন্দ। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, বদরে পৌঁছে উট জবাই করে ভুরিভোজ এবং মদ পান করে আনন্দ ফূর্তি করবে। তারপর মুসলমানদের শিকড়সহ উৎখাত করবে। যাতে আরবের আর কেউ কোন দিন তাদের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দুঃসাহস না করে।

মক্কার এই পৌত্তলিক বাহিনীতে ছিল হিন্দ-এর পিতা, ভাই, চাচা ও তাঁর স্বামী। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ইবন ‘উতবা (রা) ও তাঁর আযাদকৃত দাস সালিম (রা) । বদর যুদ্ধে এই আবূ হুযাইফা ইবন ‘উতবা (রা) ও তাঁর আযাদকৃত দাস সালিম (রা)। বদর যুদ্ধে এই আবূ হুযাইফার (রা) ছিল এক গৌরবজনক ভূমিকা।

এ যুদ্ধে তিনি পিতা ‘উতবাকে তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান জানান। হিন্দ তাঁর ভাইয়ের এহেন আচরণের নিন্দায় নিম্নের চরণ দু‘টি বলেন : [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’ -১/১৬৬; নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবাওয়াহ্‌-৪৭২] (আরবী******)

‘ত্যাড়া চোখ, বাঁকা দাঁত ও নিন্দিত ভাগ্যের অধিকারী আবূ হুযাইফা দীনের ব্যাপারে নিকৃষ্ট মানুষ।

তোমার পিতা যিনি তোমাকে ছোটবেলা থেকে প্রতিপালন করেছেন এবং কোন রকম বক্রতা ছাড়াই তুমি পূর্ণ যুবক হয়েছো, তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না।?’

যুদ্ধের সূচনা হিন্দা‘র পিতা, ভাই ও চাচা নিহত হয়। শুধু তাই নয়, পৌত্তলিক বাহিনীর সত্তরজন বাছা বাছা সৈনিকও নিহত হয়। তাদের মৃত দেহ বদরে ফেলে রেখে অন্যরা মক্কার পথ ধরে পালিয়ে যায়। এই পলায়নকারীদের পুরোভাগে ছিল হিন্দ-এর স্বামী আবূ সুফইয়ান। এ বিজয়ে মুসলমানরা যেমন দারুণ উৎফুল্ল হন তেমনি কুরাইশ বাহিনীর খবর মক্কায় পৌঁঝলে সেখানের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে হতবাক হয়ে যায়। প্রথমে অনেকে সে খবর বিশ্বাস করতে পারেনি। পরাজিতরা যখন মক্কায় ফিরতে লাগলো তখন খবরের যথার্থতা সম্পর্কে আর কোন সন্দেহ থাকলো না। ঘটনার ভয়াবহতায় মক্কাবাসীদের মথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আবূ লাহাব তো শোকে দুঃখে শয্যা নিল এবং সে অবস্থায় সাতদিন পরে জাহান্নামের পথে যাত্রা করে। তার জীবনের অবসান হয়। কুরাশি নারীরা তাদের নিহতদের স্মরণে এক মাস ব্যাপী শোক পালন করে। বুক চাপড়িয়ে, মাথায় চুল ছিঁড়ে তারা মাতম করতে থাকে। নিহত কোন সৈনিকের বাহন অথবা ঘোড়ার পাশে সমবেত হয়ে তারা রোনাজারি করতে থাকে। একমাত্র হিন্দ ছাড়া এই শোক প্রকাশ ও মাতম করা থেকে মক্কার কোন নারী বাদ যায়নি। হাঁ, হিন্দ কোন রকম শোক প্রকাশ করেননি। একদিন কিছু কুরাইশ মহিলা হিন্দ-এর নিকট গিয়ে প্রশ্ন করে : তুমি তোমার পিতা, ভাই, চাচা ও পরিবারের সদস্যদের জন্য একটু কাঁদলে না? বললেন : আমি যদি তাদের জন্য কাঁদি তাহলে সে কথা মুহাম্মাদের নিকট পৌঁছে যাবে।

তারা এবং খাযরাজ গোত্রের নারীরা উৎফুল্ল হবে। আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ ও তাঁর সহচরদের নিকট থেকে প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত তেল-সুগন্ধি আমার জন্য হারাম। আমি যদি জানতাম কান্নাকাটি ও মাতম আমার দুঃখ-বেদনা দূর করে দেবে তাহলে আমি কাঁদতাম। কিন্ত আমি জানি আমার প্রিয়জনদের বদলা না নেওয়া পর্যন্ত আমার অন্তরের ব্যথা দূর হবে না।

হিন্দ তেল-সুগন্ধির ধারে কাছেও গেলেন না এবং আবূ সুফইয়ানের শয্যা থেকেও দূরে থাকলেন। পরবর্তী উহুদ যুদ্ধ পর্যন্ত মক্কাবাসীদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলেন। আর বদরে নিহতদের স্মরণে প্রচুর মরসিয়া রচনা করলেন। সেই সকল মরসিয়ার কয়েকটি চরণ নিম্নরূপ :[ শা‘ইরাত আল-‘আরাব-৪৬৮; আ’লাম আন-নিসা’-৫/২৪৩] (আরবী*******)

‘আমি আল আবতাহ উপত্যকাদ্বয়ের নেতা এবং প্রতিটি বিদ্রোহীর অসৎ উদ্দেশ্য থেকে তাকে রক্ষাকারীর মৃত্যুতে কাঁদছি।

তোমার ধ্বংস হোক! জেনে রাখ, আমি কাঁদছি সৎকর্মশীল উতবা, শায়বা এবং গোত্রের নিরাপত্তা বিধানকারী তার সন্তানের জন্য। তারা সবাই গালিবের বংশধরের মধ্যে উঁচু মর্যাদার অধিকারী। তাদের সম্মান ও মর্যাদা অনেক।’

বদর যুদ্ধে হিন্দ-এর পিতা ‘উতবা, চাচা শায়বা এবং ভাই নিহত হলো। হিন্দ তাদের স্মরণে মরসিয়া গাইতে থাকেন। তৎকালীন ‘আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি আল-খানসা’। জাহিলী আমলের কোন এক যুদ্ধে তাঁর দু‘ভাই সাখর ও মু‘আবিয়া নিহত হয়। আল-খানসা’ সারা জীবন তাদের জন্য কেঁদেছেন, মাতম করেছেন এবং বহু মর্মস্পর্শী মরসিয়া রচনা করে সমগ্র আরববাসীকে তাঁর নিজের শোকের অংশীদার করে তুলেছেন। এ কারণে ‘উকাজ মেলায় আল-খানসা‘র হাওদা ও তাঁবুর সামনে পতাকা উড়িয়ে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হতো। তিনি বলতেন : আমি আরবের সবচেয়ে বড় মুসীবতগ্রস্ত মানুষ। হিন্দ এসব কথা অবগত হয়ে বলতেন : আমি আল-খানসা’র চেয়েও বড় মুসীবতগ্রস্ত। তারপর তিনিও আল-খানসা’র মত হাওদা বিশেষভাবে চিহ্নিত করার নির্দেশ দেন এবং উকাজে উপস্থিত হন। তিনি বলেন : আমার উট আল-খানসা’র উটের কাছাকাছি নাও। তাই করা হলো। আল-খানসা’র কাছাকাছি গেলে তিনি বললেন : বোন! আপনার পরিচয় কি? বললেন : আমি হিন্দ বিন্‌ত ‘উতবা-আরবের সবচেয়ে বড় মুসীবতগ্রস্ত মানুষ। আমি জানতে পেরেছি, আরববাসীর নিকট নিজেকে আপনি সবচেয়ে বড় বিপদগ্রস্ত মানুষ হিসেবে তুলি ধরেছেন। আপনার সেই বিপদটি কি? বললেন : আমার পিতা ‘আমর, ভাই সাখর ও মু‘আবিয়ার মৃত্যু।

তিনি পাল্টা হিন্দকে প্রশ্ন করলেন : তা আপনার বিপদটা কি? বললেন : আমার পিতা ‘উতবা ও ভাই আল-ওয়ালীদের মৃত্যু। আল-খানসা’ বললেন : এছাড়া আর কেউ আছে? তারপর তিনি আবূ ‘আমর, মু‘আবিয়া ও সাখরের স্মরণে একটি মরসিয়া কবিতা আবৃত্তি করেন।[আ‘লাম আন-নিসা’ -৫/২৩৪]

উহুদের প্রস্তুতি

বদরের পর থেকে কুরাইশদের অন্তরে শান্তি নেই। তাদের নারীরা নিহত পুত্র, পিতা, স্বামী অথবা প্রিয়জনদের স্মরণে শোক প্রকাশ করে চলেছে। তাদের অন্তরে বড় ব্যথা। অতঃপর মক্কার পৌত্তলিকরা বদরের উপযুক্ত বদলা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। মহিলারাও এবার জিদ ধরলো পুরুষদের সঙ্গে যুদ্ধে যাবার। তবে সাফওয়ান ইবন উমাইয়্যা এবং আরো কিছু অশ্বারোহী ও পদাতিক যোদ্ধা মহিলাদের সঙ্গে নিতে রাজি হচ্ছিল না। হিন্দ ঘর থেকে বেরিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ালেন এবং সাফওয়ান ইবন উমাইয়্যাকে লক্ষ্য করে বললেণ : তুমি তো বদলে প্রাণে বেঁচে গিয়ে নিরাপদে স্ত্রীর নিকট ফিরে এসেছিলে। হাঁ, এবার আমরা যাব এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবো। বদরে যাত্রাকালে আল-জুহফা থেকে তোমরা মহিলাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে, এবার কেউ আর তাদেরকে ফেরাতে পারবে না। সেবার তারা তাদের প্রিয়জনদের হারিয়েছে।

কুরাইশ বাহিনী মক্কা থেকে বের হয়ে মদীনার দিকে চললো। হিন্দ- এর নেতৃত্বে পনেরো জন মহিলাও তাদের সহযাত্রী হলো।[আনসাবুল আশরাফ-১/৩১২-৩১৩; মক্কা থেকে আর যে সকল নারী উহুদে গিয়েছিল তাদের অন্যতম হলো : সাফওয়ান ইবন উমাইয়্যার স্ত্রী বরযায্‌ বিন্‌ত উমউদ আছ-ছাকাফী, তালহা ইবন আবী তালাহার স্ত্রী সালামা বিন্ত সা‘দ. আল-হারিছ ইবন হিশামের স্ত্রী ফাতিমা বিন্‌ত আল-ওয়ালীদ ইবন আল-মুগীরা ও আমর ইবন আল-আরেস স্ত্রী হিন্দ বিন্‌ত মুনাব্‌বিহ। (আল-ওয়াকিদী, আল-মাগাযী-১/২০২-২০৩] তাদের অন্তরে প্রতিশোধেল আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। বদরে মাহাম্মাদের (সা) চাচা হামযা ইবন আবদিল মুত্তালিব হিন্দ- এর প্রিয়তম ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। তাই হিন্দ হাবশী ক্রীতদাস ওয়াহশীকে নানা রকম অঙ্গীকার করে উত্তেজিত ও উৎসাহিত করেছেন। সে যদি হামযাকে হত্যা করতে পারে তাহলে তিনি তাকে প্রচুর স্বার্ণ, অলঙ্কার ও অর্থ দিবেন। উল্লেখ্য যে, এই ওয়াহশী ছিলেন জুবায়র ইবন মুতইমের ক্রীতাদাস।

উহুদের ময়দানে উভয় বাহিনী পরস্পর মুখোমুখি হলো। উভয় পক্ষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে। কুরাশিরা বদর ও সেখানে নিহতদের স্মৃতিচারণ করছে। হিন্দ- এর নেতৃত্বে কুরাইশ নারীরা দফ তবলা বাজিয়ে নিম্নের এ গানটি গাইতে গাইতে তাদের সারিবদ্ধ সৈনিকদের সামনে দিয়ে চক্কর দিতে লাগলো।[আ‘লাম আন-নিসা’- ৫/২৪৪; বিভিন্ন বর্ণনায় গানটির কিছু পার্থক্য দেখা যায়। ](আরবী***********)

‘তারকার কন্য মোরা, নিপুপ চলার ভঙ্গি। সামনে যদি এগিয়ে যাও জড়িয়ে নেবো বুকে। আর যদি হটে যাও পিছে, পৃথক হয়ে যাব চিরদিনের তরে।’ অপরদিকে মুসলমানরা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও তাঁর সাহায্যকে স্মরণ করছে। হযরত রাসূলে কারীম (সা) কিছু দক্ষ তীরন্দাযকে পাহাড়ের উপর একটি নির্দিষ্ট স্থানে নিয়োগ করলেন এবং গোটা বাহিনীকে এমনভাবে সাজালেন যে, কেউ ভুল না করলে আল্লাহর ইচ্ছায় বিজয় অবধারিত।

যুদ্ধ শুরু হলো। প্রথম দিকে পৌত্তলিক বাহিনীর পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো। মুসলিম বাহিনী বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেল। কুরাইশ বাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লো। কুরাইশ রমণীরা হেয়, লাঞ্ছিত অবস্থায় যুদ্ধবন্দিনী হতে চলছিল। যুদ্ধেল এমন এক পর্যায়ে কিছু মুসলিম সৈনিক শত্রুপক্ষের পরিত্যক্ত জিনিসপত্র সংগ্রহে মনোযোগী হয়ে পড়লো, আর পাহাড়ের উপর নিয়োগকৃত তীরন্দায বাহিনীল কিছু সদস্য রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশের কথা ভুলে গিয়ে স্থান ত্যাগ করলো। মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধের রূপ পাল্টে গেল। পলায়নপর পৌত্তলিক বাহিনী মুসলমানদের এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করলো। তারা ফিরে দাঁড়িয়ে পাল্টা আক্রমণ করে বসলো। মুসলিম বাহিনী হতচকিত হয়ে পড়লো। আবার যুদ্ধ শুরু হলো। বহু হতাহতকসহ সত্তর (৭০) জন মুসলিম সৈনিক শাহাদাত বরণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলো। ওয়াহশীর হাতে হযরত হামযা (রা) শহীদ হলেন।

কুরাইশরা আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়লো। বদরের কঠিন বদলা নিতে পেরেছে মনে করে আত্মতৃপ্তি অনুভব করলো। সবচেয়ে বেশী খুশী হলেন হিন্দ। হামযার (রা) হত্যায় তিনি তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি কুরাইশ নারীদের সঙ্গে নিয়ে নিহত মুসলিম সৈনিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং তাঁদের এবং তাঁদের নাক, কান, হাত, পা ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে চরমভাবে বিকৃতি সাধন করলেন।

আল-বালাযুরী হিন্দ- এর নৃশংসতার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন : ‘ওয়াহশী হযরত হামযাকে হতৎ্যা করে তাঁর বুক চিরে কলিজা বের করে এনে হিন্দ এর হাতে দেয়। হিন্দ সেই কলিজা দাঁত দিয়ে চিবিয়ে থুথু করে ফেলে দেন। তারপর নিজে গিয়ে কেটে-কুটে হামযার (রা) দেহ বিকৃত করে ফেলেন। হিন্দ তাঁর দেহ থেকে দু‘হাতের কব্জী, পাকস্থলী ও দু‘ পা কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। তরপর ফিরে এসে নিজের অঙ্গ থেকে মূল্যবান রত্নখচিত স্বর্ণের অলঙ্কার, যথা পায়ের খাড়ু, গলার হার ও কানের ‍দুল খুলে ওয়াহশীর হাতে তুলে দেন। পায়ের আঙ্গুলে পরিহিত স্বর্ণের আংটিগুলিও খুলে তাকে দিয়ে দেন। কারণ, এই হামযা বদর যুদ্ধে তার বাবা ‘উতবাকে হত্যা করেছিলেন। [আনসাব আল-আশরাফ-১/৩২২]

হযরত হামযার (রা) কলিজা চিবানোর কথা শুনে হযরত রাসূলে কারীম (সা) বলেন : যদি হিন্দ হামজার কলিজা চিবিয়ে গিলে ফেলতো তাহলে জাহান্নারেম আগুন তাকে স্পর্শ করতো না। আল্লঅহ রাব্বুল ‘আলামীন জাহান্নামের আগুনের জন্য হামযার গোশ্‌ত স্পর্শ করা নিষিদ্ধ করেছেন।[আ‘লাসি আন-নিসা’-৫/২৪৫]

সে এমনই এক নিষ্ঠুর ও অমানবিক কাজ ছিল যার দায়ভার কুরাইশ দলপতি আবূ সফইয়ানও নিতে অস্বীকার করেন। তিনি একজন মুসলমানকে লক্ষ্য করে বলেন, আল্লাহর কসম! তোমাদের যে বিকৃত সাধন করা হয়েছে তাতে যেমন আমি খুশী নই, তেমনি অখুশীও নই। আমি কাউকে বারণও করিনি, আবার করতেও বলিনি। সবকিছু শেষ করে হিন্দ একটি উঁচু পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে নিম্নের চরণগুলি উচ্চারণ করেন :[ আয-যাহাবী, তারীখ-২/২০৫] (আরবী**********)

‘আমরা তোমাদেরকে বদরের বদলা দিয়েছি। একটি যুদ্ধের পর আরেকটি যুদ্ধ হয় আগুনওয়ালা। আমার পিতা ‘ইতবা, ভাই, চাচা ও দলের জন্য আমি ধৈর্যহারা হয়ে পড়েছিলাম। আমি আমার অন্তরকে সুস্থ করেছি, অঙ্গীকার পূর্ণ করেছি। হে ওয়াহশী! তুমি আমার অন্তরকে রোগমুক্ত করেছো।’

বদরের ক্ষতি, অপমান ও লজ্জা অনেকটা পুষিয়ে নিয়ে অন্তরভরা আনন্দ-খুশী সহকারে কুরাইশরা ফিরে চললো। হিন্দ তখন গাইতে লাগলেন : [সীরাতু ইবন হিশাম-২/১৬৮] (আরব**********)

‘আমি ফিরে চলেছি, অথচ আমার অন্তরে রয়েঠে বহু পুঞ্জিভীত ব্যথা। আমার উদ্দেশ্য যা ছিল তার কিছু অর্জনে ব্যর্থ হয়েছি। তবে আমি কিছু অর্জন করেছি। আমার উদ্দেশ্য এবং আমার চলার পথে যেমনটি আমি আশা করেছিলাম তেমনটি হয়নি।’

মদীনাবাসীদের সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষের মধ্য কুরাইশদের বেশ কয়েকটি বছর কেটে গেল।

খন্দকের যুদ্ধ, হুদাইবয়অর সন্ধি এবং সবশেষে মক্কা বিজয়। কোন উপায় না দেখে রাসূলুল্লাহর (সা) মক্কায় প্রবেশের আগের দিন কুরাইশ নেতা হিন্দ-এর স্বামী আবূ সুফইয়ান গেলেন রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট মক্কাবাসীদের নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনার জন্য। সেখানেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করে মক্কায় ফিরে এসে ঘোষণা দেন : ওহে কুরাইশ সম্প্রদায়! তোমরা শুনে রাখ, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। তোমরাও ইসলাম গ্রহণ কর। কারণ, মুহাম্মাদ তোমাদের নিকট এসে গেছেন এমন শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে যার ধারণাও তোমাদের নেই। সঙ্গে সঙ্গে হিন্দ তার মাথাটি সজোরে চেপে ধরে বলেন : তুমি সম্প্রদায়ের একজন নিকৃষ্ট নেতা। তারপর হিন্দ মক্কাবাসীরেদ প্রতি শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এবং মাহাম্মাদকে (সা) হত্যা করতে আহ্বান জানান।[আ‘লাম আন-নিসা’ -৫/২৪৫]

ইসলাম গ্রহণ ও বায়‘আত

এ ব্যাপারে সকল বর্ণনা একমত যে, মক্কা বিজয়ের দিন হিন্দ-এর স্বামী আবূ সুফইয়ানের ইসলাম গ্রহণের পর হিন্দ ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি খুব ভালো মুসলমান হয়েছিলেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্রে যে সকল তথ্য বর্ণিত হয়েছে তা একত্রিত করলে নিম্নের রূপ ধারণ করে :

হিন্দ আবূ সুফইয়ানকে বললেন ; আমি ইচ্ছা করেছি, মুহাম্মাদের অনুসারী হবো।

আবূ সুফইয়ান : গতকালও তো দেখলাম তুমি এ কাজকে ভীষণ অপছন্দ করছো।

হিন্দ : আল্লাহর কসম! আমার মনে হয়েছে, গত রারে পূর্বে এই মসজিদে আর কোন দিন আল্লাহর সত্যিকার ইবাদাত হয়নি। তারা কিয়াম, রুকূ‘ ও সিজদার মাধ্যমে নামায আদায়েল উদ্দেশ্যেই সেখানে এসেছে ।

আবূ সুফইয়ান : ‍তুমি যা করার তাতো করেছো। তুমি তাঁর নিকট যাওয়ার সময় তোমার গোত্রের কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।[মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল (সা) ছয়জন পুরুষ ও চরজন মহিলাকে ক্ষমার আওতার বাইরে রাখেন এবং তাদেরকে নাগালের মধ্যে পাওয়া মাত্র হত্যার নির্দেশ দেন। পুরুষরা হলো :‘ইকরামা ইবন আবী জাহ্‌ল, হাব্বাব ইবন আল-আসওয়অদ, ‘আবদুল্লাহ ইবন সা‘দ ইবন আবী সারাহ, ‍মুকায়্যিস ইবন সুবাবা, আল-হুয়ায়রিছ ইবন নুকায়য। মহিলারা হলো : হিন্দ বিন্‌ত ‘উতবা, আমর ইবন হাশিম ইবন ‘আবদুল মুত্তালিবের দাসী সাবা,ম হিলাল ইবন ‘আবদিল্লাহর দু‘জন গায়িকা- ফারতানা ও আরনা। এ দু‘ গায়িকা রাসূলুল্লাহর (সা) নিন্দামূলক গান গেয়ে বেড়াতো। (আনসাব আল-আশরাফ-১/২৫৭; নিসাৎ মিন ‘আসর আন-নুবাওয়াহ্‌-৪৮৬) ইবন হাজার এর বাইরে আরো কিছু নারী-পুরষের নাম উল্লেখ করেছেন। (ফাতহুল বারী-৮/১১-১২)]

এ কথার পর হিন্দ ‘উছমান, মতান্তরে ‘উমারের (রা) নিকট যান। তখন হিন্দ-এর সঙ্গে ইতিপূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছেন এমন কিছু মহিলাও ছিলেন। ‘উছমান (রা) গিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) সঙ্গে সাক্ষাতে অনুমতি নিয়ে এলেন। হিন্দ-এর ভয় ছিল, হামযার (রা) সাথে তাঁর আচরণের জন্য রাসূল (সা) তাঁকে পাকড়াও করতে পারেন, তাই মাথা-মুখ ঢেকে অপরিচিতের বেশে রাসূলের (সা) নিকট প্রবেশ করেন।

তাঁর সঙ্গে গেলেন আরো অনেক মহিলা। উদ্দেশ্য তাঁদের, রাসূলুল্লঅহর (সা) হাতেক বাই‘য়াত হওয়া। তঁরা যখন রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে পৌঁছলেন তখন তাঁর নিকট বসা তাঁর দুই বেগম, কন্যা ফাতিমা ও বানূ ‘আবদিল মুত্তালিবের আরো অনেক মহিলা। মাথা ও মুখ ঢাকা অবস্থায় হিন্দ কথা বললেণ : রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে। উহুদের যুদ্ধে হযরত হামযার (রা) কলিজা চিবিয়েছিলেন তাই আজ বড় লজ্জা ও অনুশোচনা। মাথা ও মুখ ঢাকা অবস্থায় বললেন :

‘ইয়অ রাসূলাল্লাহ! সেই আল্লাহর প্রশংসা, যিনি তাঁর মনোনীত দীনকে বিজয়ী করেছেন। আপনার ও আমার মাঝে যে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে সে সূত্রে আমি আপনার নিকট ভালো ব্যবহার আশা করি। এখন আমি একজন ঈমানদার ও বিশ্বাসী নারী- একথা বলেই তিনি তাঁর অবগুণ্ঠন খুলে পরিচয় দেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি হিন্দ বিন্‌ত ‘উতবা। রাসূল (সা) বললেন : খোশ আমদেদ। হিন্দ বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম! হেয় ও অপমান করার জন্য আপনার বাড়ীর চেয়ে আমার নিকট অধিক প্রিয় বাড়ী ধরাপৃষ্ঠে এর আগে আর ছিল না। আর এখন আপনার বাড়ীর চেয়ে অধিক সম্মানিত বাড়ী আমার নিকট দ্বিতীয়টি নেই।[আসহাবে রাসূলের জীবনকথা-১/২০৫]

রাসূল (সা) বললেন : আরো অনেক বেশী। তারপর তিনি তাদেরকে কুরআন পাঠ করে শোনান এবং বাই‘আত গ্রহণ করেন। রাসূল (সা) বললেন : তোমরা একথার উপর অঙ্গীকার কর যে, আল্লাহর সাথে আর কোন কিছুকে শরীক করবে না।

হিন্দ বললেন : আপনি আমাদের থেকে এমন অঙ্গীকার নিচ্ছেন যা পুরুষদের থেকে নেন না। তা সত্ত্বেও আমরা আপনাকে এ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।

রাসূল (সা) : তোমরা চুরি করবে না।

হিন্দ : আল্লাহর কসম! আমি আবূ সুফইয়ানের অর্থ-সম্পদ থেকে মাঝে মাঝে কিছু নিয়ে থাকি। আমি জানিনে, তাকি আমার জন্য হালাল হবেচ, নাকি হারাম হবে।

পাশে বসা আবূ সুফইয়ান বলে উঠলেন : অতীতে তুমি যা কিছু নিয়েছো তাতে তুমি হলালের মধ্যে আছ। রাসূল (সা) বললেন : তুমি তো হিন্দ বিন্‌ত ‘উতবা।

হিন্দ : হাঁ, আমি হিন্দ বিন্‌ত ‘উতবা। আপনি আমার অতীতের আচরণকে ক্ষমা করে দিন। আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন।

রাসূল (সা) বললেন : তোমরা ব্যভিচার করবে না।

হিন্দ : ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন মুক্ত-স্বাধীন নারী কি ব্যভিচার করে?

রাসূল (সা) : তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না।

হিন্দ বললেন : আমরা তো তাদেরকে শিশুকালে লালন-পালন করেছি। আপনি তাদের বড়দেরকে বদরে হত্যা করেছেন। সুতরাং আপনি এবং তারা এ বিষয়টি ভালো জানেন।

তাঁর এবখা শুনে ‘উমার (রা) হেসে দেন।

রাসূল (সা) : কারো প্রতি বানোয়অট দোষারোপ করবে না।

হিন্দ : কারে প্রতি দোষারোপ কর দারুণ খারাপ কাজ।

রাসূল (সা): কোন ভালো কাজে আমার অবাধ্য হবে না।

হিন্দ : আমরা এই মজলিসে বসার পরও কোন ভালো কাজে আপনার অবাধ্য হবো?

রাসূল (সা) ‘উমারক বললেন : তুমি এই মহলাদের বাই‘আত গ্রহণ কর এবং তাদের মাগফিরাত কামনা করে আল্লাহর নিকট দু‘আ কর।

‘উমার (রা) তাঁদের বাই‘আত গ্রহণ করলেন। রাসূল (সা) মহিলাদের সাথে করমর্দন করতেন ন। তিনি তাঁর জন্য বৈধ অথবা মাহরিম নারী ছাড়া অন্য কোন নারীকে স্পর্শ করতেন না। তেমনি তাদেরকে স্পর্শ করার সুযোগও দিতেন ন। তাই হিন্দ যখন বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনাকে স্পর্শ করতে চাই। বললেন : আমি মহিলাদের সঙ্গে করমর্দন করি না। একজন নারীর জন্য আমার যে বক্তব্য, এক শো’ নারীর জন্য আমার বক্তব্য একই।

অতঃপর রাসূল (সা) আবূ সুফইয়ান ও হিন্দ-এর পূর্বের বিয়েকে বহাল রাখেন।[তাবাকাত-৮/২৩৬, ২৩৭; আত-তাবারী, তারীখ-২/১৬১, ১৬২; আল-ইসতীআব-৪/৪১১; উসুদুল গাবা-৪/৪/৪০৯; আস-সীরাহ্‌ আল-হালবিয়্যাহ্‌-৩/৪৬, ৪৭; এছাড়া বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈসহ বিভিন্ন গ্রন্থে ঘটনাটি কমবেশী বর্ণিত হয়েছে।]

নারী জাতির মধ্যে হিন্দ-এর ব্যক্তিত্বে ছিল এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ছাপ। তাঁর মধ্যে ইসলাম প্রবেশ করার পর তাঁর অন্তরের সকল পঙ্কিলতা দূর করে দেয়, সাহাবিয়া সমাজে তিনি এক অনন্য মহিলা রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মূর্খতার আবরণ এবং বিবেক ও চেতনাকে আচ্ছাদনকারী সকল অসত্য ও অসারতাকে দূর করে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করে দেন। ইসলাম গ্রহণের পর আর কখনো কোন ভ্রান্ত বিশ্বাসের কাছে নত হননি। ইসলামী বিশ্বাসকে তিনি বাস্তবে রূপদান কনে। ইসলাম পূর্ববর্তী জীবনে তাঁর গৃহে একটি মূল্যবান বিগ্রহ ছিল। ইসলাম গ্রহণ করে ফিরে গিয়ে- তোমার ব্যাপারে আমরা একটা ধোঁকার মধ্যে ছিলাম- একথা বলতে বলতে কুড়াল দিয়ে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলেন।[তাহযীব আল-আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৩৫৭; তাবাকাত-৮/২৩৭; আনসাবুল আশরাফ-১/৩৬০]

একথা প্রতীয়মান হয় যে, হিন্দ ভদ্রতা ও শিষ্টচারিতার গুণে গুণান্বিত ছিলেন। ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর (সা) রিসালাতহকে সত্য বলে মেনে নেওয়ার পর রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট উপহার পাঠান। রাসূল (সা) তাঁর দু‘আ করেন। এ প্রসঙ্গে ইবন আসাকির বলেন : ইসলাম গ্রহণের পর হিন্দ দু‘টি ভূনা বকরীর বাচ্চা এবং মশক পানি তাঁর দাসীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট পাঠান। রাসূল (সা) তখন আল-আবতাহ উপত্যকায় অবস্থান করছিলেন। রাসূলের (সা) সঙ্গে তখন উম্মু সালাম, মায়নূনাসহ বানূ ‘আবদিল মুত্তালিবের আরো কিছু মাহিলা ছিলেন। খাবারগুলি রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে উপস্থাপন করে দাসীটি বললো : এই উপহারটুকু আমার মনিবা পাঠিয়েছন এবং বিনয়ের সাথে এ অক্ষমতার কথাও বলেছেন : বর্তমান সময়ে আমাদের ছাগীগুলি কমই মা হচ্ছে। রাসূল (সা) বললেন : আল্লাহ তোমাদের ছাগলে বরকত দিন এবং মায়ের সংখ্যা বাড়িয়ে দিন।

দাসী ফিরে গিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) দু‘আর কথা হিন্দকে অবহিত করলে তিনি ভীষণ খুশী হন। পরবর্তীকালে দাসীটি বলতেন, আমরা আমাদে ছাগল ও তার মায়ের সংখ্যা এত বেশী হতে দেখেছি যা পূর্বে আর কখনো হয়নি। হিন্দ বলতেন : এটা রাসূলুল্লা্হর (সা) দু‘আ ও তাঁর বরকতে হয়েছে। সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদেরকে ইসলামের হিদায়াত দান করেছেন। তারপর তিনি এই স্বপ্নের কথা বলতেন : আমি স্বপ্নের মধ্যে দেখেছিলাম, অনন্তকাল ধরে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। ছায়া আমার নিকটেই, কিন্তু সেখানে যেতে সক্ষম হচ্ছি না। যখন রাসূল (সা) আমাদের কাছে আসলেন, দেখলাম, আমি যেন ছায়ায় প্রবেশ করলাম।[তারীখু দিমাশ্‌ক, তারাজিম আন-নিসা’-৪৫৬, ৪৫৭]

হিন্দ-এর জ্ঞানগর্ভ বাণী

হিন্দএর মুখ-নিঃসৃত অনেক জ্ঞানগর্ভ বাণী আছে যা প্রায় প্রবাদ-প্রবচনে পরিণত হয়েছে। শব্দ এত যাদুকারী ও ভাব এত উন্নতমানের যে, তা দ্বারা তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা ও চমৎকার চিন্তা ও অনুধ্যান ক্ষমতা প্রমাণিত হয়। এই জীবনের রঙ্গমঞ্চ সম্পর্কে তাঁর ব্যাপক অভিজ্ঞতা, সিদ্ধান্তে দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা, সত্যকে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি গুণের কথাও তা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ কারণে ইবনুল আছীর তাঁর পরিচয় দিয়েছেন এভাবে : [উসুদুল গাবা-৫/৫৬৩] (আরবী********)

‘তিনি ছিলেন একজন প্রাণসত্তার অধিকারিণী, আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্না, স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা সম্পন্না এবং বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার অধিকারিণী মহিলা।’

যেমন তিনি বলেছেন : ‘নারী হলো বেড়ি। তার জন্য অবশ্যই একটি কণ্ঠের প্রয়োজন। তোমার কণ্ঠে ধারণ করার পূর্বে ভালো করে দেখে নাও, কাকে ধারণ করছো।’ তিনি আরো বলেছেন : ‘নারীরা হলো বেড়ি। প্রত্যেক পুরুষ অবশ্যেই তার হাতের জন্য একটি বেড়ি ধারণ করবে।’[আল-বায়ান ওয়াত তাবয়ীন-৩/২৬৭; আল-আ‘লাম-৮/৯৮]

পরবর্তীকালের ঘটনা। খলীফা ‘উমারের খিলাফতকাল, মক্কায় আবূ সুফইয়ানের (রা) বাড়ীর দরজহার সামনে দিয়ে পানি গড়িয়ে যেত। হাজীদের চলাচলের সময় তাদের পা পিছলে যেত। ‘উমার (রা) তাঁকে এভাবে পানি গড়ানো বন্ধ করতে বলেন। আবূ সুফইয়ান (রা) ‘উমারের (রা) কথার গুরুত্ব দিলেন না। এরপর ‘উমার (রা) একদিন সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই দরজার ভিজে স্থনটিতে তাঁর পা পিছলে গেল। তিনি হাতের চাবুকটি আবূ সুফইয়ানের (রা) মাথার উপর উঁচু করে ধরে বলেন : আমি কি আপনাকে এই পানি গড়ানো বন্ধ করতে বলিনি? আবূ সুফইয়ান সঙ্গে সঙ্গে নিজের শাহাদাত আঙ্গুলি দ্বারা নিজের মুখ চেপে ধরেন। তখন ‘উমার (রা) বলেন : ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাকে এমনও দেখালেন যে, আমি মক্কার বাতহা’ উপত্যকায় আবূ সুফইয়ানকে পিটাচ্ছি, অথচ তাঁর সাহায্যকারী নেই, আমি তাঁকে আদেশ করছি, আর তিনি তা পালন করছেন।’ উমারের এ মন্তব্য শুনে হিন্দ বলে ওঠেন : ওহে ‘উমার! তাঁর প্রশংসা কর। তুমি তাঁর প্রশংসা করলে তোমাকে অনেক বড় কিছু দেওয়া হবে।

হযরত ‘উমার ইবন আল-খাত্তাব (রা) যখন ইয়াযীদ ইবন আবী সুফইয়ানকে (রা) শামের ওয়ালী নিয়োগ করেন তখন মু‘আবিয়া (রা) ইয়াযীদের সংগে শামে যান। এ সময় আসূ সুফইয়ান (রা) একদিন হিন্দকে (রা) বলেন : এখন যে তোমার ছেলে মু‘আবিয়া আমার ছেলে ইয়াযীদের অধীন থাকবে- এটা তোমার কেমন লাগবে? হিন্দ বললেন : যদি আরব ঐক্যে অস্থিরতা দেখা দেয় তখন দেখেবে আমার ছেলে এবং তোমার ছেলের অবস্থান কি হয়। উল্লেখ্য যে, ইয়াযীদ (রা) ছিলেরন আবূ সুফইয়ানের (রা) অন্য স্ত্রীর সন্তান। এর অল্পকাল পরে ইয়াযীদ (রা) শামে মারা যান। ‘উমার (রা) তাঁর স্থলে মু‘আবিয়াকে (রা) নিয়োগ করেন। এ নিয়োগ লাভের পর হিন্দ মু‘আমিয়াকে (রা) বলেন : আমার ছেলে! আল্লাহর কসম! আরবের স্বাধীন নারীরা তোমার মত সন্তান খুব কম জন্ম দিয়েছে। এ ব্যক্তি তোমাকে টেনে তুলেছে। সুতরাং তোমার পছন্দ হোক বা অপছন্দ হোক তুমি তাঁর মর্জি মত কাজ করবে। হযরত হিন্দ- বিভিন্ন সময়ের এ জাতীয় মন্তব্য ও আচরণ দ্বারা বুঝা যায় হযরত ‘উমারের (রা) প্রতি ছিল তাঁর দারুণ শ্রদ্ধাবোধ। সব সময় তাঁকে সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতেন।

হিন্দ একবার খলীফা ‘উমারের (রা) নিকট গিয়ে বাইতুল মাল থেকে চার হাজার দিরহাম ঋণের আবেদন জানিয়ে বললেন, এদিয়ে আমি ব্যবসা করবো এবং ধীরে ধীরে পরিশোধ করবো। খলীফা তাঁকে ঋণ দিলেন। তিনি সেই অর্থ নিয়ে কালবে গোত্রের এলাকায় চলে যান এবং সেখানে কেনাবেচা করতে থাকেন। এর মধ্যে তিনি খবর পেলেন আবূ সুফইয়ান ও তাঁর ছেলে ‘আমর ইবন আবী সুফইয়ান এসেছেন মু‘আবিয়ার (রা) নিকট। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মু‘আবিয়ার (রা) নিকট চলে যান।

উল্লেখ্য যে, আগেই আবূ সুফইয়ানের (রা) সাথে তাঁর দূরত্বের সৃষ্টি হয়।

মু‘আবিয়া (রা) মায়েল এভাবে আসার কারণ জানতে চান। হিন্দ বলেন : আমি তোমাকে নজরে রাখার জন্য এসেছি। ‘উমার তো কেবল আল্লাহর জন্য কাজ করেন। এদিকে তোমার বাবা এসেছেন তোমার নিকট। আমার ভয় হলো তমি সবকিছু তাঁর হাতে উঠিয়ে না দাও। মানুষ জানত পারবে না তুমি এসব জিনিস কোথা থেকে তাঁকে দিচ্ছো। পরে ‘উমার তোমাকে পাকড়াও করবেন। মু‘আবিয়া (রা) বাবা ও ভাইকে একশো দীনারসহ কাপড়-চোপড় ও বাহন দিলেন। ভাই আমর এ দানকে যথেষ্ট বলে মনে করলেন।

আবূ সুফইয়ান বললেন : একে বড় দান মনে করো না। হিন্দ-এর অগোচরে এ দান দেওয়া হয়নি। আর এই যে, সুন্দর পোশাক, এগুলো হিন্দ এনেছে। এরপর তাঁরা সবাই মদীনায় ফিরে আসেন। এক সময় আবূ সুফইয়ান হিন্দকে জিজ্ঞেস করেন : ব্যবসায়ে কি লাভ হয়েছে? হিন্দ বলেন : আল্লাহই ভালো জানের। মদীনায় আমার কিছু ব্যবসা আছে। মদীনায় এসে হিন্দ তাঁর পণ্য কিক্রি করলেন এবং ‘উমারের (রা) নিকট গিয়ে ব্যবসায়ে তাঁর লোকসানের কথা জানালেন। ‘উমার বললেন : তোমাকে দেওয়া অর্থ যদি আমার হতো আমি ছেড়ে দিতাম। কিন্তু এ অর্থ তো মুসলমানদের। আর এই যে, সুন্দর পোশাক তুমি আবূ সুফইয়ানকে দিয়েছিলে তাতে এখনো তার নিকট আছে। তারপর ‘উমার (রা) লোক পাঠিয়ে আবূ সুফইয়ানকে গ্রেফিতার করেন। হিন্দ-এর নিকট থেকে পাওনা উসূল করে তাঁকে ছেড়ে দেন। ‘উমার (রা) আবূ সুফইয়ানকে (রা) জিজ্ঞেস করেন : মু‘আবিয়া আপনাকে নগদ কত দিয়েছে? আবূ সুফইয়ান বলেন : এক শো দীনার।[আ‘লাম আন-নিসা‘-৫/২৪৯]

“আল-‘ইকদ আল-ফারীদ” গ্রন্থে এসেছে। আবূ সুফইয়ান মু‘আবিয়ার নিকট থেকে মদীনায় এসে ‘উমারের (রা) নিকট গিয়ে বলেন : আমাকে কিছু দান করুন। ‘উমার (রা) বললেন : আপনাকে দেওয়ার মত আমার নিকট তেমন কিছু নেই। ‘উমার (রা) সীল মোহর একজনের হাতে দিয়ে হিন্দ-এর নিকট পাঠালেন। তাঁকে বলে দিলেন : ‍তুমি তাকে বলবে, যে দু‘টি পাত্র তুমি নিয়ে এসেছো, তা আবূ সুফইয়ান পাঠিয়ে দিতে বলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে পাত্র দু‘টি উমারের (রা) নিকট নিয়ে আসা হলো। তার মধ্যে দশ হাজার দিরহাম ছিল। ‘উমার (রা) পাত্রসহ দিরহামগুলো বাইতুল মালে পাঠিয়ে দিলেন। ‘উমারের (রা) পর ‘উছমান (রা) খলীফা হলেন। তিনি সেই অর্থ আবূ সুফইয়ানকে (রা) ফেরত দিতে চাইলেন। কিন্তু আবূ সুফইয়ান তা নিতে অস্বীকৃতি জানান এই বলে : যে, অর্থের জন্য ‘উমার আমাকে তিরস্কার করেছেন তা আমি অবশ্যই নেব না।[প্রাগুক্ত; আল-‘ইকদ আল-ফারীদ-১/৪৯]

হিন্দগ ও মু‘আবিয়া

হিন্দ-এর ছেলে মু‘আবিয়অ (রা) দুধ পান করানো অবস্থায়ই তিনি ছেলেকে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন, উদার, ভদ্র তথা বিভিন্ন গুণে গুণনান্বিত করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তিনি ছেলেকে শিশুকারে কোলে করে নাচাতে নাচাতে নিম্নের চরণগুলি সুর করে আবৃত্তি করতেন। [নিসা‘ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্‌-৪৮০]

(আরবী***********)

‘আমার ছেলে সম্ভ্রান্ত মূল বা খান্দানের। তার পরিবারের মধ্যে অতি প্রিয় ও বিচক্ষণ। সে অশ্লীল কর্ম সম্পাদনকারী নয় এবং নীচ প্রকৃতিরও নয়। ভীরু ও তাপুরুশ নয় একং অশুভ ও অকল্যাণের প্রতীকও নয়। বানূ ফিহরের শীলা, তাদের নেতা। মানুষের ধারণা ও অনমানকে সে মিথ্যা হতে দেয় না এবং ভীত হয়ে পালিয়েও যায় না।’

মু‘আবিয়া (রা) যখন ছোট্ট শিশুটি তখন একদিন একটি লোক তাঁকে দেখে মন্তব্য করে : আমার বিশ্বাস এই ছেলেটি তার জাতির নেতৃত্ব দিবেই।[আল-‘ইকদ আল-ফারীদ-২/২৮৭; ‘উয়ূন আল-আখবার-১/২২৪]

ইয়াযীদ ইবন আবী সুফইয়ানের মৃত্যুর পর অনেকে বলাবলি করতে লাগলো, আমরা আশা করি মু‘আবিয়া হবে ইয়াযীদের যোগ্য উত্তরসূরী। একথা শুনে হিন্দ মন্তব্য করেন : মু‘আবিয়ার মত মানুষ কারো উত্তরসূরী হয় না। আল্লাহর কসম! গোটা আরব ভূমিকে যদি এক সঙ্গে মিলিত করা হয় এবং তার মাঝখানে তাকে ছুড়ে ফেলা হয় তাহলে যেদিক দিয়ে ইচ্ছো সে বেরিয়ে আসতে পারবে।[আল-‘ইকদ আল-ফারীদ -৩/১৪] একবার তাঁকে বলা হলো : মু‘আবিয়া যদি বেঁচে থাকে তাহলে তার জাতিকে শাসন করবে। হিন্দ বললেন : তার সর্বনাশ হোক! যদি সে তার জাতিকে ছাড়া অন্যদের শাসন না করে। একবার তিনি শিশু মু‘আবিয়াকে নিয়ে তায়িফ যাচ্ছেন। উটের পিঠে হাওদার সামনের দিকে মু‘আবিয় বসা। এক আরব বেদুঈন তাকে দেখে হিন্দকে বলে : আপনি শিশুটিকে দু‘হাত দিয়ে ভালো করে ধরে রাখুন এবং তাকে যত্নের সাথে প্রতিপালন করুন। কারণ ভবিষ্যতে এ শিশু একজন বড় নেতা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী ব্যক্তি হবে। হিন্দ তার কথার প্রতিবাদ করে বলেন : না, বরং সে একজন উঁচু মর্যাদাসম্পন্ন বাদশাহ এবং দানশীল ব্যক্তি হবে।[আ‘লাম আল-নিসা’-৫/২৫০]

হযরত মু‘আবিয়অ (রা) তাঁর ময়ের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন : হিন্দ ছিলেন জাহিলী যুগে কুরাইশদের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং ইসলামী যুগে একজন সম্মানিত অভিজ্ঞ মহিলা। হযরত মু‘আবিয়অ (রা) ছিলেন আরবের অন্যতাম শ্যেষ্ঠ বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান, মেধাবী ও দক্ষ মানুষ। তিনি তাঁর যাবতীয় গুণ পিতার চেয়ে মায়েল নিকট থেকেই বেশী অর্জন করেন। হযরত মু‘আবিয় (রা) পরবর্তী জীবনে কোথাও নিজের গুণ বৈশিষ্ট্যের প্রসঙ্গ অকপটে মায়েল প্রতিই আরোপ করতেন। প্রতিপক্ষের সমালোচনার জবাবে তিনি গর্বের সাথে প্রায়ই বলতেন : আমি হিন্দ-এর ছেলে।[আল-বায়ান ওয়াত তাবয়ীন-২/৯২

হযরত হিন্দ (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) অঙ্গীকারের উপর আমরণ অটল ছিলেন। অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করেন। ইয়ারমুক যদ্ধে যোগদান করেন এবং যুদ্ধের ময়দানে সৈনিকদের রোমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলেন। ‘উমারের (রা) খিলাফতকালে তিনি ছেলে মু‘আবিয়ার (রা) নিকট যান।[তারীখু দিমাশ্‌ক, তারাজিম আন-নিসা’ -৪৩৭; আল-আ‘লাম-৮/৯৮]

হযরত হিন্দ (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) কয়েকটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তাঁর সূত্রে মু‘আবিয়া ও উম্মুল মু‘মিনীন ‘আয়িশা (রা) বর্ণনা করেছেন। তাঁর থেকে বর্ণিত হাদীছের একটি এই :[ একমাত্র তিরমিযী ছাড়া সিহাহ সিত্তার অন্য পাঁচটি গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। মুসনাদে আহমাদ-৬/৩৯; তাবাকাত-৮/২৩৭;] (আরবী********)

‘আমি নবীকে (রা) বললাম : আবূ সুফইয়ান একজন কৃপণ ব্যক্তি। তাঁর সম্পদ থেকে তাঁর অগোচরে আমি যা কিছু নিই তাছাড়া তিনি আমার তিনি আমার ছেলে ও আমাকে কিছুই দেন না। এতে কি আমার কোন অপরাধ হবে? তিনি বললেন : তোমার ছেলে ও তোমার প্রয়োজন পূরণ হয় ততটুকু যুক্তিসম্মত ভাবে গ্রহণ কর।’

তবে ইবনুল জাওযী ‘আল-মুজতানা’ গ্রন্থে বলেছেন, হিন্দ রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে সরাসরি কিছু বর্ণনা করেছেন বলে আমাদের জানা নেই।[আ‘লাম আন-নিসা-৫/২৫০]

বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায় হিন্দ (রা) খলীফা হযরত ‘উমারের (রা) খিলাফতকালে হিজরী ১৪, খ্রীঃ ৬৩৫ সনে ইনতিকাল করেন। তিনি যে দিন ইনতিকাল করেন সে দিনই হযরত আবূ বকর সিদ্দীকের (রা) পিতা হযরত আবূ কুহাফা (রা) ইনতিকাল করেন।[উসুদুল গাবা-৫৬৩; তাহযীব আল-আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৩৫৭] তবে একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, আবূ সুফইয়ান (রা) হযরত ‘উছমানের (রা) খিলাফতকালে ইনতিকাল করলে জনৈক ব্যক্তি হযরত মু‘আবিয়অর (রা) নিকট হিন্দকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে তিনি ভদ্রভাবে একথা বলে প্রথ্যাখ্যান করেন যে, তিনি এখন বন্ধ্যা হয়ে গেছেন, তাঁর বিয়েল আর প্রয়োজন নেই।[আস-ইসাবা-৪/৪২৬; সাহাবিয়াত -২৭১]
দুররা (রা) বিবিন্‌ত আবী লাহাব
হযরত রাসূলে কারীম (সা) নবুওয়াত লাভের পর তিন বছর যাবত মক্কায় গোপনে ইসলামের বাণী প্রচার করতে থাকেন। অনেকে তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনেন। অনেকের ঈমান আনার কথা প্রকাশ পেলেও অধিকাংশের কথা কুরাশদের নির্যাতনের ভয়ে গোপন থাকে। প্রথম দিকে কুরাইশরা রাসূলের (সা) প্রচারকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। তিন বছর পর হযরত জিবরীল (আ) এসে রাসূলকে (সা) প্রকাশ্যে ইসলামের আহ্বান জানাতে বলেন এবং তাঁকে একথাও জানিয়ে দেন যে, তিনি হলেন একজন প্রকাশ্য সতর্ককারী। ইবন আব্বাস (রা) বলেন : যখন এ আয়াত- (আরবী*********)

‘আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন’[সূরা আশ-শু‘আরা-২১৪ ]- নাযিল হলো, রাসূল (সা) সাফা পাহাড়ের চূড়ায় উঠলেন এবং উচ্চকণ্ঠে আহ্বান জানাতে লাগলেন : ওহে ফিহ্‌র গোত্রের লোকেরা, ওহে ‘আদী গোত্রের লোকেরা!

এই আওয়াজ শুনে কুরাইশদের নেতৃস্থানীয় সকল লোক একত্রিত হলো। যিনি যেতে পারলেন না তিনি একজন প্রতিতিনধি পাঠালেন কি ব্যাপার তা জানার জন্য। কুরাইশরা হাজির হলো, আবূ লাহাবও তাদের সঙ্গে ছিল। এরপর তিনি বললেন : তোমরা বলো, যদি আমি বলি যে, পাহাড়ের ওদিকের প্রান্তরে একদল ঘোড়সওয়ার আত্মগোপন করে আছে, তারা তোমাদের উপর হামলা করতে চায়, তোমরা কি সে কথা বিশ্বাস করবে? সবাই বললো, হাঁ বিশ্বাস করবো। কারণ আপনাকে আমরা কখনো মিথ্যা বলতে শুনিনি। নবী (সা) বললেন তবে শোন, আমি তোমাদেরকে এক ভয়াবহ আযাবের ব্যাপারে সাবধান করতে প্রেরিত হয়েছ্ আবূ লাহাব বললো, তুমি ধ্বংস হও। আমাদেরকে কি একথা বলার জন্য এখানে ডেকেছো/

আবূ লাহাব একথা বচলার পর আল্লাহ তা‘আলা সূরা লাহাব নাযিল করেন। তাতে বলা হয় (আরবী*******)

‘আবূ লাহবের দু‘টি হাত ধ্বংস হোক এবং সে নিজেও ধ্বংস হোক।’[সহীহ মুসলিম-১/১১৪; সহীহ বুখারী-২/৭০৬; তাফসীর আল-খাযিন-৭/৩১১; তাফসীর ইবন কাছীর : সূরা আল-মাসাদ]

দুর্‌রা (রা) ছিলেন এই আবূ লাহাবের কন্যা এবং ‘আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন তাঁর দাদা। তিনি মক্কার কুরাইশ খান্দানের হাশিমী শাখার সন্তান এবং হযরত রাসূলে কারীমের (সা) চাচাতো বোন।[উসুদুল গাবা-৫/৪৪৯; আল-ইসতী‘আব-৪/২৯০; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৭৫] দুর্‌রার (রা) জীবন আলোচনার পূর্বেচ তাঁর পিতা-মাতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

আবূ লাহাব রাসূলুল্লাহর (সা) এক চাচা। তার আসল নাম ‘আবদুল ‘উয্‌যা ইবন ‘আবদুল মুত্তালিম ইবন হাশি। ভাতিজা মুহাম্মাদের (সা) প্রতি তার ছিল দারুণ ঘৃণা ও বিদ্বেষ। তাঁকে কষ্ট দিতে, তাঁর ধর্ম ও সত্তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তার চিন্তা ও চেষ্টার অন্ত ছিল না। দৈহিক সৌন্দর্য ও মুখমণ্ডলের দীপ্তির জন্য তাকে “আবূ লাহাব” (অগ্নিশিখা) বলে ডাকা হতো। অথচ দীপ্তিমান মুখমণ্ডলের অধিকারীর জন্য (আবুন নুর) (আরবী****) অথবা (আরবী****) (আবুদ দিয়া)হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু ভবিষ্যতে তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম তাই আল্লাহ প্রথম থেকেই মানুষের দ্বারা তার নাম রেখে দেন আবূ লাহাব।[তাফসীর ইবন কাছীরন; সূরা লাহাব]

আবূ লাহাব হযরত রাসূলে কারীমের (সা) চাচা হওয়া সত্ত্বেও ভাতিজার প্রতি তার বিন্দুমাত্র দয়া-মমতা ছিল না। ভাতিজা নবুওয়অত লাভের দাবী ও প্রকাশ্যে ইসলামের দা‘ওয়অতী কার্যক্রম শুরু করার সাথে সাথে তাদের সম্পর্কে দারুণ অবনতি ঘটে। বাতিজাকে হেয় ও লাঞ্ছিত করার জন্য সে তার পিছে লেগে যায়। তাঁকে কষ্ট দেওয়ার কোন সুযোগ সে হাতছাড়া করতো না। মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করতে বাজার এবং বিভিন্ন জনসমাবেশে তাঁর পিছনে লেগে থাকতো। ইমাম আহমাদ (রা) আবুয যানাদের সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আবুয যানাদ বলেছেন, আমাকে রাবী‘আ ইবন ‘আব্বাদ নামের এক ব্যক্তি, যিনি পর্বর্তীতে ইসলমান গ্রহণ করেন, বলেছেন : আমি একবার যাল-মাজাযের বাজারে নবীকে (সা) দেখলাম, জনতাকে সম্বোধন করে বলেছেন : (আরবী******)

‘ওহে জনমণ্ডলী! তোমরা বল, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তোমরা সফলকাম হবে।’ তাঁর চারপাশে জনতার সমাবেশ ছিল। আর তাঁকে অনুসরণ করতো দীপ্তিমান চেহারার এক ব্যক্তি। সে মানুষকে বলতো ‘এ ধর্মত্যাগী মিথ্যাবাদী’। আমি লোকদের নিকট এই লোকটির পরিচয় জানতে চাইলে বললো : সে তাঁর চাচা আবূ লাহব।[প্রাগুক্ত; নিসা মিন ‘আসার আন-নুবাওয়াহ্‌-১৯১]

তারিক ইবন ‘আবদিল্লাহ আল-মুহারিবীর বর্ণনা থেকে জানা যায়, আবূ লাহাব নবীর (সা) কথা মিথ্যা প্রমাণ করতেই শুধু ব্যস্ত থাকতো না বরং তাঁকে পাথরও নিক্ষেপ করতো। এতে নবীর (সা) পায়ের গোড়ালি রক্তাক্ত হয়ে যেত।[তাফহীমুল কুরআন-৬/৫২২; ফী জিলাল আল-কুরআন-৩/২৮২]

শুধু কি তাই? সে মনে করতো তহার অর্থ-সম্পদ তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল অপমান, লাঞ্ছনা ও শাস্তি থেকে রক্ষা করবে। বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা) যখন তাঁর সম্প্রদায়কে আল্লহর প্রতি ঈমানের দিকে আহ্বান জানালেন তখন আবূ লাহাব বললো : আমার ভাতিজা যা বলছে তা যদি সত্য হয় তাহলে আমি কিয়ামতের দিন আমার অর্থ-বিত্ত ও সন্তন-সন্ততিদের বিনিময়ে নিজেকে মুক্ত করতে পারবো। সে উপেক্ষা করে আল্লাহ তা‘আলার এ ঘোষণা :[ সূরা আশ-শুআরা-৮৮-৮৯] (আরবী*******)

‘যেদনি ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না। সেদিন উপকৃত হবে কেবল সে, যে আল্লাহর নিকট আসবে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে।

রাসূলুল্লাহ (সা) নবুওয়াত প্রাপ্তির আগে আবূ লাহাব তুর দুই পুত্র ‘উতবা এবং ‘উতাইবাকে রাসূলেল (সা) দুই কন্য রুকায়্যাকে এবং উম্মু কুলসুমের সাথে বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু রাসূলের (সা) নবুওয়অত পাওয়ার পর এবং দ্বীনের দাওয়াত প্রচারে শুরুতে আবূ লাহাব নবীর দুই কন্যাকে তালাক দিতে তার দুই পুত্রকে বাধ্য করেছিল।[তাফহীমুল কুরআন-৬/৫২২; ফী জিলাল আল-কুরআন-৩/২৮২]

হযরত রাসূলে কারীমের (সা) দ্বিতীয় পুত্র ‘আবদুল্লাহর ইনতিকালের পর আবূ লাহাব এতো খুশী হয়েছিল যে, তার বন্ধুদের কাছে দৌড়ে গিয়ে গদগদ কণ্ঠে বলেছিল, মুহাম্মাদ অপুত্রক হয়ে গেছে।[তাফহীমুল কুরআন-৬/৪৯০]

আবূ লাহবের স্ত্রী তথা দুর্‌রার (রা) মা উম্মু জামীলের প্রকৃত নাম আরওয়। সে ছিল হারব ইবন উমাই্য়্যার কন্যা এবং আবূ সুফইয়ানের (রা) বোন। হযরত রাসূলে কারীমের (সা) প্রতি শত্রুতার ক্ষেত্রে সে স্বামীল চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। রাসূল (সা) যে পথে চলাফেরা করতেন সেই পথে এবং তাঁর দরজায় কাঁটা বিছিয়েু রাখতো। সে অত্যন্ত অশ্লীল ভাষী এবং প্রচণ্ড ঝেগড়াটে ছিল। নবীকে (সা) গালাগাল দেওয়া এবং কুটনামি, নানা ছুতোয় ঝগড়া, ফেতনা-ফাসাদ এবং সংঘাতময় পরিস্থির সৃষ্টি করা ছিল তার কাজ। এক কথায় সে ছিল নোংরা স্বভাবের এব মহিলা। এ কারণে আল-কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা তার নিন্দায় বলেছেন,

(আরবী*******) –এবং তার স্ত্রীও সে ইন্ধন বহন করে।[সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩৫৫]

এই উম্মু জামীল যখন জানতে পালো যে, তাঁর নিজের এবং স্বামীর নিন্দায় আয়াত নাযিল হয়েছে তখন সে রাসূলুল্লাহকে (সা) খুঁজে খুঁজে কা‘বার কাছে এলো, রাসূল (সা) তখন সেখানে ছিলেন। সংগে হযরত আবূ বকর সিদ্দীকও ছিলেন। আবূ লাহাবের স্ত্রীর হাতে ছিল এক মুঠ পাথর। রাসূলের (সা) কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলে আল্লাহ তার দৃষ্টি কেড়ে নেন। ফলে সে রাসূলকে (সা) দেখতে পায়নি, আবূ বকরকে (রা) দেখছিল। সে আবূ বকরের (রা) সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমার সাথী কোথায়? আমি শুনেছি তিনি আমার নিন্দা করেছেন। আল্লাহর কসম! যদি তাঁকে পেয়ে যাই তবে তাঁর মুখে এ পাথর ছুড়ে মারবো। দেখ, আল্লাহর কসম! আমিও একজন কবি। এরপর সে নিম্নের দু‘টি আবৃত্তি করে (আরবী****)

‘মুযাম্মামের অবাধ্যতা করেছি, তাঁর কাজকে অস্বীকার করেছি এবং তাঁর দীনকে ঘৃণা ও অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি।’

উল্লেখ্য যে, তৎকালীন মক্কার পৌত্তলিকরা নবী কারীমকে (সা) মুহাম্মাদ না বলে ‘মুযাম্মাম’ বলতো। মুহাম্মাদ অর্থ প্রশংসিত। আম ‘মুযাযাম্মম’ অর্থ নিন্দিত। এরপর উম্মু জামীল চলে গেল। আবূ বকর সিদ্দিীক (রা) নবী (সা) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! সে কি আপনাকে দেখতে পায়নি? বললেন : না, দেখতে পায়নি। আল্লাহ তা‘আলা আমার ব্যাপারে তার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিলেন।[প্রাগুক্ত-১/৩৫৬]

ইবন ইসহাক বলেন, যেসব লোক রাসূলকে (সা) ঘরের মধ্যে কষ্ট দিত তাদের নাম হলো আবূ লাহাব, হাকাম ইবন আবুল ‘আস ইবন উমাইয়্যা, ‘উকবা ইবন আবী মু‘ঈত, ‘আদী ইবন হামরা, ছাকাফী ইবনুল আসদা‘ প্রমুখ। তারা সবাই ছিল রাসূলের (সা) প্রতিবেশী।[আর রাহীক আল-মাখতূ,-১০৩]

হযরত রাসূলে কারীমের (সা) এহেন চরম চরম দুশমনের পরিণতি কি হয়েছিল তা একটু জানার বিষয়। বদর যুদ্ধের সময় সে মক্কায় ছিল। যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের খবর শোনার পর প্লেগ জাতীয় (আরবী***) (আল-আদাসা) নামক একপ্রকার মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তিন দিন পর্যন্ত মৃতদেহ ঘরে পড়ে থাকে। সংক্রমণের ভয়ে কেউ ধারে-কাছে যায়নি। যখন পচন ধরে গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকে তখন তার এক ছেলে দূর থেকে পানি চুড়ে মেরে মৃতদেহকে গোসল দেয়। কুরাইশ গোত্রের কেউ লাশের কাছে যায়নি। তারপর কাপড়ে জড়িয়ে উঠিায়ে মক্কার উঁটু ভূমিতে নিয়ে যায় এবং একটি প্রাচীরের সাথে ঠেস দিয়ে রেখে পাথর চাপা দেয়। এই ছিল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলৈর (সা) চরম দুশমনের পার্থিব নিকৃষ্ট পরিণতি।[নিসা মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্‌-১৯২]

এমন একটি নোংরা ও ভয়াবহ পরিবারে দুর্‌রা বিন্‌ত আবী লাহাব জন্মগ্রহণ করেন এবং বেড়ে ওঠেন। তিনি সেই শিশুকাল থেকেই পিতা-মাতার এহেন নোংরা ও কুরুচিপূর্ণ কাজ দেখতেন, কিন্তু তাদের এসব কাজ ও আচরণ মেনে নিতে পারতেন না। মনে মনে পিতা-মাতার এসম ঘৃণ্য কাজকে প্রত্যাখ্যান করতেন।

ধীর ধীরে ইসলামের বাণী তিনি হৃদয়ঙ্গম করেন। ইসলাম তাঁর অন্তরে আসন করে নেয়। একদিন তিনি পৌত্তলিকতার অন্ধকার ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন। (আরবী****) (তিনি জীবিতেকে বের করেন মৃত থেকে।) আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেমন মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন দুর্‌রা (রা) ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে বলা চলে।

হযরত দুর্‌রা (রা) মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করেন।[আয-যিরিকলী : আল-আ‘লাম-২/৩৩৮] তবে কখন তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তিন মদীনায় হিরাত করেন।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৭৫] তাঁর প্রথম স্বামী আল-হারিছ ইবন নাওফাল ইবন আল-হারিছ ইবন আবদুল মুত্তালিব। কুরইশ পক্ষে বদর যুদ্ধে যেয়ে সে পৌত্তলিক অবস্থায় নিহত হয়। তার ঔরসে দুররা (রা) ‘উকবা, আল-ওয়ালীদ ও আবূ মুসলিম- এ তিন ছেলে জন্ম দেন। মদীনায় আসার পর প্রখ্যাত সাহাবী হযরত দিহইয়া আল-কালবীর (রা) সাথে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয়।[তাবাকাত ইবন সা‘দ-৮/৫০; নিসা মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্‌-১৯৩] এই দিহইয়া আল-কালবী (রা) ছিলেন প্রথমপর্বে ইসলাম গ্রহণকারী একজন মহান সাহাবী। বদরের পরে সকল যুদ্ধে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে অংশগ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহর (সা) পত্র নিয়ে রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের দরবারে যান। অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন। জিবরীল (আ) তাঁর আকৃতি ধারণ করে মাঝে মাঝে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট আসতেন। হযরত মু‘আবিয়ার (রা) খিলাফতকাল পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন।[তাহ্‌যীবুল আসমা’ ওয়াল লুগাত-১/১৮৫]

হযরত দুররা (রা) হিজরাত করে মদীনায় আসার পর যথেষ্ট সমাদর, সম্মান ও মর্যাদা লাভ করলেও কোন কোন মুসলিম মহিলা তাঁকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। রাসূলুল্লাহর (সা) প্রতি তাঁর পিতা-মাতার আচরণের কথা মনে করে তাঁরা তাঁকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। দুররা (রা) বড় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। এ অবস্থা থেকে রাসুল (সা) তাঁকে উদ্ধার করেন। এ সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্রে যা বর্ণিত হয়েছে তা একত্র করলে নিম্নরূপ দাঁড়ায়। “দুররা বিন্‌ত আবী লাহাব হিজরাত করে মদীনায় আসলেন এবং রাফি’ ইবন আল-মু‘আল্লা আয-যুরকীর (রা) গৃহে অবতরণ করেন। বানূ যুরাইক গোত্রে মহিলারা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে এসে বললো, আপনি তো সেই আবূ লাহাবের কন্যা যার সম্পর্কে নাযিল হয়েছে : (আরবী*********)

তাহলে তোমার এ হিজরাতে ফায়দা কোথায়?

অত্যন্ত ব্যথিত চিত্তে দুররা (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে ‍যুরাইক গোত্রের নারীদের মন্তব্যের কথা জানালেন। রাসূল (সা) তাঁকে শান্ত করে বললেন : বস। তারপর জুহরের নামায আদায় করে মিম্বরের উপর বসে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন। তাপর বললেন : (আরবী*******)

‘ওহে জনমণ্ডলী! আমার পরিবারের ব্যাপারে আমকে কষ্ট দেওয়া হয় কেন? আল্লাহর কসম! আমার নিকটাত্মীয়রা কিয়অমতের দিন আমার সুপারিশ লাভ করবে। এমন কি (ইয়ামানের) সুদা, হাকাম ও সাহ্‌লাব গোত্রসমূহও তা অবশ্য লাভ করবে।[আ‘লাম আন-নিসা-১/৪০৯; উসুদুল গাবা-৫/৪৫০; আল-ইসাবা-৪/৪৯০; হায়াতুস সাহাবা-১/৩৭২]

অপর একটি বর্ণনায় এসেছে; রাসূল (রা) দুররার (রা) মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন : (আরবী********)

‘যে তোমাকে রাগান্বিত করবে সে আল্লাহকে রাগান্বিত করবে।’[আশ-শাওকানী, দুররুস সাহাবা-৫৪২;]

নবী পরিবারের সাথে হযরত দুররার (রা) সম্পর্ক দূরের ছিল না। এ কারণে প্রায়ই উম্মুল মু‘মিনীন ‘আয়িশার (রা) নিকট যেতেন এবং তাঁর থেকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করতেন। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহর (সা) সেবার ক্ষেত্রে দুইজন পাল্লা দিচ্ছেন। যেমন একদিনের ঘটনা তিনি বর্ণনা করেছেন এভাবে: আমি ‘আয়িশার (রা) নিকট বসে আছি এমন সময় রাসূল (সা) ঘরে ঢুকে বলেন, আমাকে ওজুর পানি দাও। আমি ও ‘আয়িশা দু‘জনই পানির পাত্রের দিকে দৌড় দিলাম। ‘আয়িশার আগেই আমি সেটা ধরে ফেললাম, রাসূলুল্লাহ (সা) সেই পানি দিয়ে ওজু করার পর আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন এবং বললেন :

(আরবী*****) তুমি আমার (পরিবারের একজন এবং আমিও তোমার (পরিবারের) একজন।[ইমাম আশ-শাওকানী বলেছেন, ইমাম আহমাদ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। দুররা থেকে এর বর্ণনাকারীদের সূত্রের সকলে ‘ছিকা’ বা বিশ্বস্ত। (দুরুসুস সাহাবা-৫৪৩)]

হযরত দুররা (রা) ছিলেন অন্যতম কুরাইশ মহিলা কবি। তিনি হাদীছও বর্ণনা করেছেন। নবী (রা) থেকে সরাসরি ও ‘আয়িশার (রা) সূত্রে মোট তিনটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণিত একটি হাদীছ নিম্নে উদ্ধৃত হলো : (আরবী******)

‘দুররা (রা) বলেন : রাসূল (সা) মিম্বরের উপর আছেন, তখন এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে : ইয়া রাসূলুল্লাহ! কোন ব্যক্তি সবচেয়ে ভালো? রাসূল (সা) বললেন : যে বেশী কুরআন পাঠ করে, বেশী তাকওয়া-পরহেগারী অবলম্বন করে, বেশী বেশী ভালো কাজের আদেশ দেয়, বেশী বেশী খারাপ কাজ করতে বারণ করে এবং বেশী বেশী আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখে, সেই ব্যক্তি সবচেয়ে ভালো।’

তাঁর থেকে বর্ণিত দ্বিতীয় হাদীছটি হলো : (আরবী********)

‘কোন মৃত ব্যক্তির করণে কোন জীবিত ব্যক্তিকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।’[আল-ইসতী‘আব-৪/২৯১; আল-ইসাবা-৪/২৯১; আল-আ‘লাম -২/৩৩৮]

তাঁর মধ্যে এক শক্তিশালী কাব্য প্রতিভা ছিল। কাব্যচর্চা করেছেন। চমৎকার ভাবসমৃদ্ধ কিছু কবিতা তাঁর নামে বিভিন্ন গ্রন্থে দেখা যায়। ফিজার যুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর একটি কবিতার কিছু অংশ নিম্নরূপ : [আ‘লাম আন-নিসা-১/৪০৯; শা‘য়িরাত আল-আরাব-১২০; নিসা মিন ‘আসর আন-নুবুয়াহ্‌-১৯৬] (আরবী*********)

‘ভীতি ও আতঙ্কের দিন প্রত্যুষে তারা পাহাড়ের মত অটল বাহিনীর সাক্ষাৎ লাভ করে যার মধ্যে বনী ফিহ্‌রের যুদ্ধের পোশাক পরিহিত নেতৃবৃন্দও আছে।

পাগলের মত উত্তেজিত ও বোবা বিশাল বাহিনী যখন দৃশ্যমান হয় তখন তোমার মনে হবে তা যেন সমুদ্রের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ।

অশ্বারোহী বাহিনী শিকারী বাজপাখীর মত উন্মুক্ত তরবারি হাতে ছোঁ মেরে ধূসর বর্ণের বাহিনীর সামনে নেমে আসে।

সেই তরবারির মরণরূপী মারাত্মক বিষ তাদের শীতলতম ব্যক্তিকেও উত্তেজিত করে এবং উষ্ণতমকে প্রবাহিত করে দেয়।

তারা এমন সম্প্রদায় যদি পাথর সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, তারাও শক্ত হয়ে যায় এবং কঠিন পাথরকেও নরম করে ফেলে।’

হযরত দুররা (রা) রাসূলে কারীমের (সা) নিকট থেকে যে সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেন তা আজীবন বজায় রাখেন। রাসূল (রা) তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকা অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। আর দুররা (রা) খলীফা হযরত ‘উমারের (রা) খিলাফতকালে হিজরী ২০ (বিশ) সনে ইনতিকাল করেন।[নিসা মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্‌-১৯৬]

উল্লেখ্য যে, ইতিহাসে দুররা নামের তিনজন মহিলা সাহাবীর পরিচয় পাওয়া যায়। তারা হলেন : দুররা বিন্‌ত আবী সুফইয়ান, দুররা বিন্‌ত আবী সালামা ও দুর্‌রা বিন্‌ত আবী লাহাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুন্ন।
উম্মু কুলছূম (রা) বিন্‌ত ‘উকবা
মক্কার কুরায়শ খান্দানের কন্যা উম্মু কুলছূম। এটা তাঁর ডাকনাম। আসল নাম জানা যায় না। পিতা ‘উকবা ইবন আবী মু‘আইত আল-উমাবী, মাতা আরওয়অ বিন্‌ত কুরাইয।[উসুদুল গাবা-৫/৬১৪; তাহযীবুল আল-আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৩৬৫; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’-২/২৭৬] উল্লেখ্য যে, এই উম্মু কুলছূম নামে মোট সাতজন মহিলা সাহাবীর সন্ধান পাওয়া যায়।[দ্র. উসুদুল গাবা-৫/৬১২-৬১৫] তিনি আশারা মুবাশ্‌শারার অন্যতম সদস্য ইসলামরে তৃতীয় খলীফা হযরত ‘উছমান ইবন ‘আফফানের (রা) বৈপিত্রেয় বোন। কারণ, আরওয়া বিন্‌ত কুরাইয হযরত ‘উছমানেরও (রা) মাতা। উম্মু কুলছূমের (রা) আপন দুই ভাই আল-ওয়ালীদ ও ‘উমারা মক্কা বিজয়ের সমগয় ইসলাম গ্রহণ করেন।[নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবাওয়াহ্ -৩৮৩]

হযরত উম্মু কুলছূমের (রা) পিতা ছিল মহানবীর (সা) মাক্কী জীবনের একজন জানি দুশমন। মক্কায় নবী (সা) ও দুর্বল মুসলমানদের উপর বাড়াবাড়ি রকমের নির্যাদনের জন্য ইতিহাসে সে খ্যাত হয়ে আছে। বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হয় এবং রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়। উম্মু কুলছূম (রা) তখন মক্কায়। পাষণ্ড পিতার হত্যার খবর শোনার পর তাঁর চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও পড়েনি বলে ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন।

উম্মু কুলছূম (রা) মক্কায় অল্প বয়সে পিতৃগৃহে থাকা অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সেখানেই রাসূলুল্লাহর (সা) হিজরাতের পূর্বে তাঁর নিকট বাই‘আত করেন। তিনি ছিলেন দুই কিচলার দিকে নামায আদায়কারীদের অন্যতম।[প্রাগুক্ত]

তিনি প্রথম মুহাজির মহিলা যিনি পালিয়ে একাকী মদীনার পথে বের হন।

তাঁর জন্ম হয়েছিল মক্কার এক চরম ইসলামবিদ্বেষী পরিবারে। ইসলাম গ্রহণের কথা জানাজানি হয়ে গেলে মারাত্মক প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখী হন। তাঁর উপর যুলুম-নির্যাতন নেমে আসে। ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হয়, যাতে তিনি মদীনাগামী মুহাজিরদের সাথে হিজরাত করতে না পারেন। এ অবস্থায় তাঁকে একটা দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করতে হয়।

ইবন ‘আবদিল বার (মৃ. ৪৬৩ হি.) হিজরী সপ্তম সন পর্যন্ত উম্মু কুলছূম (রা) হিজরাত করতে পারেননি। হুদায়বিয়ার সন্ধির অব্যবহিত পরে তাঁর জীবনে মদীনায় হিজরাতের সুযোগ আসে এবং মক্কা থেকে পালিয়ে মদীনায় উপস্থিত হন। হুদায়বিয়ার সন্ধির একটি শর্ত ছিল, মক্কার কেউ ইসরাম গ্রহণ করে মদীনায় গেলে তাকে ফেরত পাঠাতে হবে। উম্মু কুলছূম (রা) মদীনায় পৌঁছার দুই দিন পর তাঁর দুই সহোদর আল-ওয়ালীদ ও ‘উমারা ইবন ‘আকবা তাঁকে ফেরত দানের দাবী নিয়ে মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট পৌঁছে। তখন সূরা আল-মুমতাহিনার ১০ম আয়াতটি নাযিল হয় এবং তাতে মক্কা থেকে আসা মহিলা মুহাজিরদেরকে ফেরত দিতে বারণ করা হয়। এ আয়াত নাযিলের পর রাসূল (সা) উম্মু কুলছূমকে (রা) তাঁর ভাইয়ের হাতে অর্পণ করতে অস্বীকার করেন।[আল-বায়হাকী, দালাযিল আন-নুবাওয়াহ্‌-৪/১৭১; আল-ইসতী‘আব-৪/৪৬৫; নাসাবু কুরায়শ-১৪৫] তিনি তাদেরকে বলেন : (আরবি*******)

‘শর্ত ছিল পুরুষদের সম্পর্কে, স্ত্রীলোকদের সম্পর্কে নয়।’[তাফহীমুল কুরআন-খণ্ড-১৭, পৃ. ৭২; ইমাম রাযীর তাফসীরে কাবীর ও ইবনুল আরাবীর আহকামুল কুরআনের সূত্রে তাফহীমুল কুরআনের হাদীছটি উল্লেখ করা হয়েছে।]

হযরত উম্মু কুলছূমের (রা) মদীনায় হিজরাতের ঘটনাটি বেশ চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, তিনি একাকী মক্কা থেকে বের হন এবং পথে খুযা‘আ গোত্রে এক ব্যক্তিকে সঙ্গী হিসেবে প্রহণ করেন। পায়ে হেঁটে, মতান্তরে উটের পিঠে চড়ে মদীনায় পৌঁছেন। ইবন সা‘দ (মৃ. ২৩০ হি.) বলেন : একমাত্র উম্মু কুলছূম (রা) ছাড়া অন্য কোন কুরায়শ মহিলার ইসলাম সহকারে একাকী আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হিকরাত করার কথা আমাদের জানা নেই।[তাবাকাত-৮/২৩০]

হযরত উম্মু কুলছূমের (রা) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের কাহিনী ও কৌশলের কথা তাঁর মুখেই শুনা যাক:

আমার পরিবারের একাংশ গ্রামে (মরুদ্যানে) থাকতো। আমি সেখানে একাকী যেতাম এবং তিন চারদিন সেখানে অবস্থান করে আবার মক্কায় ফির আসতাম। আমার এমন যাওয়া কেউ বারণ করতো না। এক পর্যায়ে আমি মদীনায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। একদিন গ্রামের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে বের হলাম। আমাকে যারা এগিয়ে দিতে এসেছিল তারা কিচুদূর এগিয়ে দিয়ে ফিরে গেল। আমি একাকী চলছি, এমন সময় খুযা‘আ গোত্রের এক ব্যক্তির সাথে দেখা হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : তুমি কোথায় যাবে?

আমি চানতে চাইলাম : আপনি এ প্রশ্ন করছেন কেন এবং আপনি কে?

বললেন : আমি খুযা‘আ গোত্রের লোক।

তিনি খুযা‘আ গোত্রের লোক বলাতে আমি নিশ্চিন্ত হলাম। কারণ, এ গোত্র রাসূলুল্লাহর (সা) সঙ্গে সন্ধি ও শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছিল। আমি আমার পরিচয় দিয়ে বললাম :

আমি কুরায়শ গোত্রের একজন নারী, রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যেতে চাই, কিন্তু আমার পথ জানা নেই।

বললেন : আমি তোমাকে মদীনায় পৌঁছে দিচ্ছি।

তারপর তিনি একটি উট আমার কাছে নিয়ে আসলেন। আমি তার পিঠে চড়ে বসলাম।

এক সময় আমরা মদীনা পৌঁছলাম। তিনি ছিলেন একজন উত্তম সঙ্গী। আল্লাহ তাঁকে ভালো প্রতিদান দিন। আমি উম্মুল মু‘মিনীন উম্মু সালামার (রা) নিকট গিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন : মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও তাঁর রাসূলের (স) দিকে হিজরাত করেছো?

বললাম : হাঁ। তবে আমার ভয় হচ্ছে, আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় কিনা।

একটু পরে রাসূল (সা) উম্মু সালামার (রা) নিকট আসলেন। উম্মু সালামা (রা) তাঁকে আমার বিষয়টি জানালে তিনি আমাকে ‘মারহাবান ওয়া ‘আহলান’ বলে স্বাগত জানালেন।

বললাম : আমি আমার দীনের জন্য আপনার নিকট পালিয়ে এসেছি। আমাকে আশ্রয় দিন। ফেরত পাঠাবেন না। ফেরত পাঠালে আমাকে এমন শাস্তি দিবে যা আমি সহ্য করতে পারবো না।

রাসূল (সা) বললেন : মহান আল্লাহ মহিলাদের ব্যাপারে সন্ধিচুক্তি অকার্যকর ঘোষণা করেছেন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তির যে ধারাতে মক্কাবসীদেরকে ফেরত দানের কথা ছিল, তাতে কেবল পুরুষদের কথা উল্লেখ ছিল, মহিলাদে সম্পর্কে কোন কথা ছিল না। এরপর রাসূল (সা) নিম্নের এ আয়াত দুইটি পাঠ করেন :[ সূরা আল-মুমতাহিনা-১০-১১] (আরবী**********)

‘হে মু‘মিনগণ! তোমাদের নিকট মু‘মিন নারীরা হিজরাত করে এলে তাদের পরীক্ষা করবে; আল্লাহ তাদের ঈমান সম্যক অবগত আছেন। যদি তোমরা জানতে পার যে, তারা মু‘মিন তবে তাদেরকে কাফিরদের নিকট ফেরত পাঠাবে না। মু‘মিন নারীগণ কাফিরদের জন্য বৈধ নয় এবং কাফিরগণ মু‘মিন নারীদের জন্য বৈধ নয়। কাফিররা যা ব্যয় করেছে তা তাদেরকে ফিরিয়ে দাও। অতঃপর তোমরা তাদেরকে বিয়ে করলে তোমাদের কোন অপরাধ হবে না যদি তোমরা তাদেরকে মাহর দাও। তোমরা কাফির নারীদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখ না। তোমরা যা ব্য করেছো তা ফেরত চাইবে এবং কাফিররা ফেরত চাইবে যা তারা ব্যয় করেছে। এটাই আল্লাহর বিধান; তিনি তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করে থাকেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যদি কেউ হাতছাড়া হয়ে কাফিরদের মধ্যে থেকে যায় এবং তোমাদের যদি সুযোগ আসে তখন যাদের স্ত্রীগণ হাতছাড়া হয়ে গেছে তাদেরকে, তারা যা ব্যয় করেছে তার সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করবে। ভয় কর আল্লাহকে, যার প্রতি তোমরা ঈমান এনেছো।’

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) উম্মু কুলছূম (রা) এবং তাঁর পরে যে সকল নারী মদীনায় এসেছেন তাঁদের সকলকে এ আয়তের আলোকে পরীক্ষা করেছেন। হযরত ইবন ‘আব্বাসকে প্রশ্ন করা হলো : নারীদেরকে পরীক্ষা করার রাসূলুল্লাহর (সা) পদ্ধতি কি ছিল? বললেন : তিনি মদীনায় আগত মহিলাদের এভাবে শপথ করাতেন : আল্লাহর কসম! স্বামীর প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষবশত আমি ঘর থেকে বের হইনি। আল্লাহর কসম! এক যমীন থেকে অন্য এক যমীনের প্রতি আকর্ষণবশত বের হইনি। আল্লাহর কসম! পার্থিব কোন লোভ-লালসাবসত ঘর ত্যাগ করিনি। আল্লাহর কসম! কেবল আল্লাহ তাঁর রাসূলের (সা) মুহাব্বতে ঘর ত্যাগ করেছি।[মুখতাসার তাফসীর ইবন কাছীর-৩/৪৮৫; তাফসীরুল খাযিন মা‘আ হামিশ আল-বাগাবী-৭/৭৮; সীরাতু ইবন হিশাম-২/৩২৫; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’ -২/২৭৬; আয-যাহাবী : তারীখ-২/৪০০; যাদুল মা‘আদ-৩/৩০০]

উপরোক্ত ঘটনার মাধ্যমে উম্মু কুলছূমের (রা) তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা ও দৃঢ় ঈমানের পরিচয় পাওয়া যায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে কেন্দ্র করে ইসলামী শরী‘আতের অনেকগুলো বিশেষ বিধান জারী করেন। এ তাঁর জন্য এক বিশেষ মর্যাদার বিষয়।

মাদানী জীবনে হযরত উম্মু কুলছূম (রা) মাহিলা সাহাবীদের মধ্যে এক বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্টিত হন। হযরত রাসূলে কারীম (সা) তাঁকে সম্মানের দৃষ্টিতে এবং তাঁর ঈমানী সততাকে খুব বড় করে দেখতেন। কোন কোন জিহাদে তাঁকে সংগে নিয়ে গেছেন এবং আহতদের সেবায় নিয়োগ করেছেন। যুদ্ধলব্ধ গনীমতেও তাঁকে অংশ দিয়েছেন।[নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্‌-৩৮৬]

বিয়ে

হিজরাতের আগ পর্যন্ত উম্মু কুলছূম (রা) বিয়ে করেননি। মদীনায় আসার পর প্রখ্যাত চারজন সাহাবী তাঁকে বিয়ের পয়গাম পাঠান। তাঁরা হলেন : যুবায়র ইবন আল-‘আওয়াম, যায়দ ইবন হারিছা, ‘আবদুল রহমান ইবন ‘আউফ ও ‘আমর ইবন আল-‘আস (রা)। তিনি বৈপিত্রেয় ভাই ‘উছমান ইবন ‘আফ্‌ফানের (রা) সাথে পরামর্শ করেন। ‘উছমান (রা) তাঁকে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে পরামর্শ করতে বলেন। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তঁর পরামর্শ চান। রাসূল (সা) তাঁকে বলেন : তুমি যায়দ ইবন হারিছাকে বিয়ে কর। তোমার জন্য ভালো হবে। তিনি যয়দকে বিয়ে করেন।

হযরত যায়দ (রা) মূতার যুদ্ধে শহীদ হলেন। অতঃপর হযরত যুবায়র ইবন আল-আওয়াম (রা) তাঁকে বিয়ে করেন। হযরত যুবায়রের (রা) স্বভাবে একটু রূঢ়তা ছিল। বেগমদের প্রতি বেশ কঠোর আচরণ করতেন।

এ কারণে হযরত ‍উম্মু কুলকছূম (রা) তালাকের আবেদন করেন এবং তিনি তালাক দেন। এভাবে তাঁদের ছাড়াছড়ি হয়ে যাওয়ার পর হযরত ‘আবদুর রহমান ইবন ‘আওফ (রা) তাঁকে বিয়ে করেন। ‘আবদুর রহমান রোগাক্রান্ত হয়ে ইনতিকাল করেন। তখন ‘আমর তাঁকে বিয়ে করেন। ‘আবদুর রহমান রোগাক্রান্ত হয়ে ইনতিকাল করেন। তখন ‘আমর ইবন আল-‘আস (রা) মিসরের গভর্নর। তিনি উম্মু কুলছূমকে (রা) বিয়ে করেন এবং তাঁর ঘরেই তিনি ইনতিকাল করেন।[তাহযীব আল-আসমা’ ওয়াল লুগাত-২/৩৬৫; তাহযীব আত-তাহযীব-১২/৪৭৭; আনসাব আল-আশরাফ-১/৪৭১; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’ -২/২৭৭] তখন চতুর্থ খলীফা হযরত ‘আলীর (রা) খিলাফাতকাল।

সন্তান

হযরত যুবায়র ইবন আল-‘আওয়ামের (রা) ঘরে যায়নাব এবং ‘আবদুর রহমান ইবন ‘আওফের (রা) ঘরে ইবরাহীম, মুহাম্মাদ ও ইসমা‘ঈলের জন্ম হয়। হযরত যায়দ ও ‘আমর ইবন আল-‘আসের (রা) ঘরে কোন সন্তানের জন্ম হয়। হযরত যায়দ ও ‘আমর ইবন আল-‘আসের (রা) ঘরে কোন সন্তানের জন্ম হয়নি। তাঁর সন্তনদের মধ্যে হুমায়দ একজন তাবি‘ঈ এবং বড় মাপের ফকীহ ‘আলিম হন। তিনি বহু হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তিনি তাঁর মামা হযরত ‘উছমানের (রা) নিকট থেকে ছোট বেলায় হাদীছ শুনেছেন। ইবনুল ‘ইমাদ আল-হাম্বলী বলেছেন : তিনি একজন খ্যাতিমান মর্যাদাসম্পন্ন ‘আলিম ছিলেন। হিজরী ৯৫ সনে মৃত্যুবরণ করেন।[শাযারাত আয-যাহাব-১/৩৮৬-৩৮৭]

সেকালে যখন লেখা-পড়ার মোটেই প্রচলন ছিল না তখন যে কয়েকজন কুরায়শ মহিলা কিছু লিখতে পড়তে জানতেন। উম্মু কুলছূম (রা) তাঁদের একজন। তিনি লিখতে ও পড়তে জানতেন। রাসূলুল্লাহর (সা) দশটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তাঁর থেকে যাঁরা হাদীছ বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে তাঁর দুই পুত্র হুমায়দ ইবন নাফি’ ও তাঁর সূত্রে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। [আল-ইসতী‘আব-২/৭৯৪] সাহীহাইনে (বুখরী ও মুসলিম) তাঁর হাদীছ সংকলিত হয়েছে। একটি হাদীছ মুত্তাফাক ‘আলাইহি। ইবন মাজাহ্‌ ছাড়া সিহাহ সিত্তার অন্যান্য গ্রন্থেও হাদীছগুলো সংকলিত হয়েছে।[সাহাবিয়্যাত-২৪৩; নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্‌-৩৮৮]
আসমা’ বিন্‌ত ‘উমাইস (রা)
আরবের খাস‘আম গোত্রের কন্যা আসমা’ । পিতা ‘উমাইস ইবন মা‘আদ এবং মাতা কাওলা বিন্‌ত ‘আওফ। মা খাওলা, যিনি হিন্দা নামেও পরিচিত, কিন্না গোত্রের মেয়ে। আসমার ডাক নাম উম্মু ‘আবদিল্লাহ।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৮২] উম্মুল মু‘মিনীন হযরত মায়মুনার (রা) সৎ বোন ছিলেন।[সীরাতু ইবন হিশাম-১/২৫৭; টীকা-৭; সিয়ারু সাহাবিয়অত-১৪১] হযরতহ ‘আলী ইবন আবী তালিবের বড় ভাই জা‘ফর ইবন আবী তালিবের (রা) সাথে বিয়ে হয়।[তাবাকাতে ইবন সা‘দ-৮/২৮০;ইবন কুতায়বা; আল-মা‘-আরিফ-১৭১, ১৭৩] তিনি ছিলেন একদল বিখ্যাত মহিলা সাহাবীর সহোদরা অথবা সৎ বোন। তাদের সংখ্যা নয় অথবা দশজন।[আল-ইসাবা-৪/২৩১]

রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কায় দারুল আরকামে অবস্থান গ্রহণের পূর্বে তিনি মুসলমান হন।[তাবাকাত-৮/২৮০]

এরই কাছাকাছি সময়ে তাঁর স্বামী হযরত জা‘ফরও (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন।[সীরাতু ইবন হিশাম-১/১৩৬] ইসলাম গ্রহণের পর তিনি স্বামীর সাথে হাবশায় হিজরাত করেন। সেখানে তাঁদের তিন ছেলে- ‘আবদুল্লাহ, মুহাম্মাদ ও ‘আওনের জন্ম হয়।[প্রাগুক্ত-১/৩২৩, ২/৩৫৯; আনসাবুল আশরাফ-১/১৯৮; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৮৩; জামহারাত আনসার আল-‘আরাব-৩৯০]

কয়েক বছর হাবশায় অবস্থানের পর হিজরী সপ্তম সনে খাইবার বিজয়ের সময় হাবশা থেকে সরাসরি মদীনায় পৌঁছেন।[আনসাবুল আশরাফ-১/১৯৮; সীরাতু ইবন হিশাম-২/৩৫৯, ২৬৯] মদীনায় পৌঁছে তিনি উম্মুল মু‘মিনীন হযরত হাফসার (রা) ঘরে যান। তখন সেখানে হযরত ‘উমার (রা) উপস্থিত হন। তিনি প্রশ্ন করেন মহিলাটি কে? বলা হলো : আসমা বিন্‌ত উমাইস। ‘উমার (রা) বললেন : হ্যাঁ, সেই হাবশী মহিলা, সেই সাগরের মহিলা! আসমা বললেন : হ্যাঁ সেই। ‘উমার (রা) বললেন : হিজরাতের দ্বারা আমরা মর্যাদার দিক দিয়ে তোমাদেরকে অতিক্রম করে গিয়েছি। আসমা’ বললেন : হ্যাঁ, তা আপনি ঠিক বলেছেন। আপনারা রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে ছিলেন। তিনি আপনাদের ক্ষুধার্তদের আহার করাতেন এবং মূর্খদের শিক্ষা দিতেন। আর আমরা দেশ থেকে বহু দূরে অসহায় অবস্থায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলেল সন্তুষ্টির জন্য পড়ে ছিলাম। ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে কঠিন থেকে কঠিনতর বিপদ-মুসিীবতের মুকাবিলা করছিলাম। দেখি রাসূল (সা) ফিরে আসুন, বিষয়টি তাঁকে অবহিত করবো। অনেকটা ক্ষোভের সাথে আসমা‘ এ কথাগুলো বলেন। এরই মধ্যে রাসূল (সা) এসে উপস্থিত হন। আসমা‘ (রা) তাঁকে সবকথা খুলে বলেন। রাসূল (সা) বলেন : তারা তো এক হিজরাত করেছে, আর তোমরা করেছো দুই হিজরাত। এদিক দিয়ে তোমাদের মর্যাদা বেশি।[ফাতহুল বারী-৭/৩১৭; আল-মাগাযী-বাবু গাযওয়াতি খায়বার; মুসলিম, হাদীছ নং-২৫০৩; ফী ফাদায়িলি আস-সাহাবা; কানযুল ‘উম্মাল-৮/৩৩৩]

‘আমির থেকে বর্ণিত হয়েছে। আসমা’ অভিযোগ করেন এ ভাষায় : ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই লোকেরা মনে করে যে, আমরা মুহাজির নই। জবাবে রাসূল (সা) বলেন : যারা এমন কথা বলে তারা অসত্য বলে। তোমাদের হিজরাত দুইবার হয়েছে। একবার তোমরা নাজ্জাশীর নিকট হিজরাত করেছো। আরেকবার আমার নিকট।[তাবাকাত-৮/২৮১; আল-ইসাবা-৪/২৩১]

রাসূলুল্লাহর (সা) এ মুখ নিঃসৃত সুসংবাদ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়লে হাবশায় হিজরাতকারী ব্যক্তিরা দারুণ উৎফুল্ল হন। তাঁরা আসমার নিকট এসে এ সুসংবাদের সত্যতা যাচাই করে যেতেন।[‍বুখারী -২/৬০৭-৬০৮; তাবাকাত-৮/২৮১]

ঐতিহাসিক মূতার যুদ্ধ হয় হিজরী অষ্টম সনে। হযরত আসমা’র (রা) স্বামী জা‘ফার (রা) ছিলেণ এ ‍যুদ্ধের একজন সেনা অধিনায়ক। যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। খবরটি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট পৌঁছর পর তিনি আসমার (রা) বাড়ীতে ছুটে যান এবং বলেন, জা‘ফারের ছেলেদেরকে আমার সামনে নিয়ে এসো। আসমা’ ছেলেদেরকে গোসল করিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে হাজির করেন। রাসূলুল্লাহর (সা) চোখ ‍দুইটি পানিতে ভিজে গেল। তিনি ছেলেদের জাড়িয়ে চুমু দেন। আসমা‘ জিজ্ঞেস করলেন, জা‘ফারের কি কোন খবর পেয়েছেন? রাসূল (সা) জবাজ দিলেন, “হ্যাঁ, সে শহীদ হয়েছে।” এতটুকু শুনতেই আসমা’ চিৎকার দিয়ে ওঠেন এবং বাড়ীতে একটা মাতমের রূপ ধারণ করে। প্রতিবেশী মহিলারা তাঁর পাশে সমবেত হয় এবং তাঁকে বলে, রাসূল (সা) বুকে হাত মারতে নিষেধ করছেন। সেখান থেকে উঠে রাসূল (সা) নিজের ঘর ফিরে এলেন এবং বললেন : তোমরা জা‘ফরের ছেলেদের জন্য খাবার তৈরি কর। কারণ তাদের মা আসমা’ শোক ও দুঃখ্যে কাতর হয়ে পড়েছে।[মুসনাদ-৬/৩৭০; আনসাবুল আশরাফ-১/৩৮০]

অতঃপর রাসূল (সা) ব্যথিত চিত্তে বিমর্ষ মুখে মসজিদে গিয়ে বসেন এবং হযরত জা‘ফারের (রা) শাহাদাতের খবর ঘোষণা করেন। ঠিক এ সময় এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে বলে, জা‘ফারের স্ত্রী মাতম শুরু করেছেন এবং কান্নাকাটি করছেন। তিনি লোকটিকে বলেন, তুমি যাও এবং তাদেরকে এমন করতে বারণ কর। কিচুক্ষণ পর লোকটি আবার ফিরে এসে বলে, ইয়া রাসূলাল্লাহ, তারা তো বিরত হচ্ছে না। তিনি লোকটিকে আবার একই কথা বলে পাঠালেন। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হলো না। তখন রাসূল (সা) বললেন, তার মুখে মাটি ভরে দাও। সহীহ বুখারীতে একথাও এসেছে যে, হযরত ‘আয়িশা (রা) ঐ লোকটিকে বলেন, আল্লাহর কসম! তোমরা যদি এ কাজ (মুখে মাটি ভরা) না কর তাহলে রাসূল (সা) কষ্ট থেকে মুক্তি পাবেন না। তৃতীয় দিন রাসূল (সা) আসমার বাড়ী যান এবং তাঁকে শোক পালন করতে বারণ করেন।[মুসনাদ-৬/৩৬৯]

দ্বিতীয় বিয়ে

স্বামী হযরত জা‘ফারের (রা) শাহাদাতের ছয় মাস পরে অষ্টম পরে অষ্টম হিজরীর শাওয়অল মাসে হুনাইন যুদ্ধের সময়কালে হযরত আবু বাকরের সাথে আসমার দ্বিতীয় বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) স্বয়ং বিয়েটি পড়ান।[আল-ইসাবা-৪/২৩১] এই বিয়ের দুই বছর পর দশম হিজরীর জুলকা‘দা মাসে আবূ বাকরের (রা) ঔরসে ছেলে মুহাম্মাদ ইবন আবী বাকরের জন্ম হয়। আসমাৎ তখন রাসূলুল্লাহর (সা) বিদায় হজ্জের কাফেলার সাথে শরীক হয়ে মক্কার পথে ছিলেন। জুল হুলায়ফা পৌঁছার পর মুহাম্মাদ ভূমিষ্ঠ হয়। এখন তিনি হজ্জ আদায়ের ব্যাপারে সংশয়িত হয়ে পড়েন। স্বামী আবু বাকরও (রা) তাঁকে মদীনায় ফেরত পাঠাতে চাইলেন। অবশেষে রাসূলুল্লাহর (সা) মতামত জানতে চাওয়া হলো। রাসূল (সা) বললেন, তাকে বলো সে যেন গোসল করে হজ্জের ইহরাম বেঁধে নেয়।[তাবাকাত-৮/২৮২; মুসনাদ-৬/৩৬৯; মুসলিম-৩/১৮৫-১৮৬]

হিজরী অষ্টম সনে প্রথম স্বামী জা‘ফারের ইনতিকালে হযরত আসমা‘ (রা) ভীষণ ব্যথা পান। কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি লাভের আশায় এই শোক ও দুঃখকে তিনি সবর ও শোকরে রূপান্তরিত করেন। কিন্তু হিজরী ১৩ সনে দ্বিতীয় স্বামী হযরত আবু বাকরের (রা) মৃত্যুতে তিনি আবার শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে তিনি এ শোকও কাটিয়ে ওঠেন। মৃত্যুকালে আবু বাকর (রা) ওসীয়ত করে যান, স্ত্রী আসমা’ তাঁকে অন্তিম গোসল দিবেন। আসমা’ তাঁকে গোসল দেন।[মুওয়াত্তা-১/ ২২৩; তাবাকাত-৮/২৮৩] গোসল দেয়া শেষ হলে তিনি উপস্থিত মুহাজিরদের লক্ষ্য করে বলেন : আমি রোযা আছি। আর দিনটিও ভীষণ ঠাণ্ডার। আমাকেও গোসল করতে হবে? লোকেরা বললো : না।[মুওয়াত্তা-১/২২২-২২৩; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৮৬]

হযরত আবু বাকরের (রা) ইনতিকালের সময় তাঁর ঔরসে আসমার গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তান মুহাম্মাদের বয়স প্রায় তিন বছর ছিল।[তাবাকাত-৮/২৮৪] পরবর্তীকালে এই মুহাম্মাদ তৃতীয় খলীফা হযরত উছমানের (রা) হত্যার মত মারাত্মক ট্রাজেডীর এক অন্যতম সাক্ষী অথবা নায়কে পরিণত হন।

দ্বিতীয় স্বামী আবু বাকরের (রা) মৃত্যুর পর হযরত আসমা’ হযরত আলীকে (রা) তৃতীয় স্বামী হিসেবে গ্রহণ কনে। শিমু মুহাম্মাদ ইবন আবী বাকর মায়ের সাথে সৎ পিতা ‘আলীর (রা) সংসারে চলে আসেন এবং তাঁর স্নেহচায়ায় ও তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন। উল্লেখ্য যে, পরবর্তীকালে হযরত উছমান (রা) হত্যার দায়-দায়িত্ব যে অনেকে হযরত ‘আলীর (রা) উপর চাপাতে চেয়েছিলেন, তার মূল কারণ এই সৎ পুত্র মুহাম্মাদের আচরণ।

পাঠকবর্গ লক্ষ্য করে থাকবেন, হযরত আসমার দুই ছেলের নাম মুহাম্মাদ- মুহাম্মাদ ইবন জা‘ফার ও মুহাম্মাদ ইবন আবী বাকর। একদিন এই দুই ছেলে একজন আরেকজনের উপর কৌলিন্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে বলতে থাকে, আমি তোমার চেয়ে বেশী মর্যাদাবান। আমার পিতা তোমার পিতার চেয়ে বেশী সম্মানীয়। অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাদের এ বিতর্ক চলতে থাকে। হযরত আলী (রা) তাদের মা আসমাকে বললেন, তুমিই তাদের এ বিাবদের ফয়সালা করে দাও। আসমা’ বললেন, আমি আরব যাবকদের মধ্যে জা‘ফারের চেয়ে ভালো কাউকে পাইনি, আর বৃদ্ধদের মধ্যে আবু বাকরের চেয়ে বেশী ভালো কাউকে দেখিনি। ‘আলী (রা) বললেন, তুমি তো আমার বলার কিছু রাখলে না। তুমি যা বলেছো, তাছাড়া অন্য কিছু বললে আমি বেজার হতাম। আসমা’ তখন বলেন, আর ভালো মানুষ হিসেবে আপনি তিনজনের মধ্যে তৃতীয়।[প্রাগুক্ত-৮/২৮৫; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৮৭]

হযরত আলীর (রা) ঔরসে হযরত আসমা’ ছেলে ইয়াহইয়াকে জন্মদান করেন। তবে ইবন সা‘দ তাঁর তাবাকাতে মুহাম্মাদ ইবন ‘উমারের সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, ‘আলীর (রা) ঔরসে আসমা গর্ভে দুই ছেলে- ইয়াহইয়অ ও ‘আওনের জন্ম হয়। প্রথমোক্ত বর্ণনাটি সঠিক বলে মনে হয়। কারণ, বেশীল ভাগ সীরাত বিশেষজ্ঞ উক্ত মতটিই গ্রহণ করেছেন। শেষোক্ত মতটিকে ‘আল্লামা ইবনুল আছীর ভুল বলেছেন। তিনি লিখেছেন, এটা ইবনুল কালবীল একটা কল্পনা। আর তিনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ মিথ্যাবাদী।[উসুদুল গাবা-৫/৩৯৫; সিয়ারুস সাহাবিয়াত-১৪৪; আল-ইসতী‘আব-২/৭৪৫] তাহলে হযরত আসমার (রা) তিন স্বামীর ঘরে মোট সন্তান সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচজন। হযরত জা‘ফারের ঘরে মাহাম্মাদ, ‘আবদুল্লাহ, ‘আওন, আবু বাকরের (রা) ঘরে মুহাম্মাদ এবং ‘আলীর (রা) ঘর ইয়াহইয়অ।[আনসাবুল আশরাফ-১/৪৪৭] পাঁচজনই পুত্র সন্তান।

পূর্বেই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, মুহাম্মাদ ইবন আবী বাকর খলীফা ‘উছমানের খিলাফতকালের বিদ্রোহ বিশৃখলায় জড়িয়ে পড়েন। আর এরই প্রেক্ষিতে হিজরী ৩৮ সনে তিনি মিসরে নিহত হন। গাধার চামড়ার মধ্যে ভরে তাঁর মৃতদেহ জ্বালিয়ে ফেলে অতি নিষ্ঠুরভাবে প্রশোধ নেওয়া হয়। ছেলের এমন মর্মান্তিক পরিণতিতে স্বভাবতঃই মা আসমা’ ভীষণ দুঃখ পান। কিন্তু ভেঙ্গে না পড়ে ধৈর্য ধারণ করেন। এই মর্মন্তুদ খবর শোনার পর জায়নামায বিছিয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে যান।[আল-ইসাবা-৪/২৩১; সাহাবিয়াত-১৭৩]

হযরত আসমা’ (রা) হাবশা অবস্থানকালে সেখানকার সাদামাটা ধরনের টোটকা চিকিৎসার জ্ঞান অর্জন করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) যখন অন্তিম রোগশয্যায় এবং পার্থিব জীবনের প্রান্ত সীমায় তখন উম্মু সালামা ও আসমা’ (রা) মিলিতভাবে রাসূলুল্লাহর (সা) রোগ ‘জাতিুল জান্‌ব’ বলে নির্ণয় করেন এবং তাঁকে ঔষধ পান করাতে উদ্যোগী হন। রাসূল (সা) কোন প্রকার ঔষধ পান করতে অস্বীকৃতি জানান। ঠিক সে সময় তিনি একটু অচেতন হয়ে পড়েন। এটাকে তাঁর দুইজন একটি সুযোগ বলে মনে করেন। তাঁরা রাসূলুল্লাহর (সা) মুখ একটু ফাঁক করে ঔষধ ঢেলে দেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁর অচেতন অবস্থা দূর হয়ে গেলে তিনি কিছুটা স্বস্তি অনুভব করেন এবং বলেন : এ ব্যবস্থাপত্র সম্ভবতঃ আসমা’ দিয়ে থাকবে।[বুখারী-২/৮৫১; আনসাবুল আশরাফ-১/৫৪৫]

হযরত আসমা’ (রা) থেকে ষাটটি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। তাঁর নিকট যাঁরা হাদীছ শুনেছেন ও বর্ণনা করেছেন তাঁদে মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলেন- ‘আবদুল্লাহ ইবন জা‘ফার, ইবন ‘আব্বাস, কাসিম ইবন মুহাম্মাদ, ‘আবদুল্লাহ ইবন শাদ্দাদ ইবন আল-হাদ, ‘উরওয়অ, সা‘ঈদ ইবন মুসায়্যিব, উম্মু ‘আওন বিন্‌ত মুহাম্মাদ ইবন জা‘ফার, ফাতিমা বিনত ‘আলী, আবূ ইয়াযীদ আল মাদানী।[আদ-দুররুল মানছুর -৩৫; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৭৮] তিনি সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতেন। রাসূল (সা) বিপদ-আপদের সময় পড়ার জন্য তাঁকে একটি দু‘আ শিখিয়ে দেন। আসমা’ সেটি পাঠ করতেন।[মুসনাদ-৬/৩৬৯; কান্‌য আল-‘উম্মাল-১/২৯৯]

তিনি স্বপ্নের তা‘বীর ভালো জানতেন। এ কারণে উমার (রা) সচরাচর তাঁর কাছ থেকেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিতেন।[কান্‌য আল-উম্মাল-৩/১৫৩; আল-ইসাবা-৪/২৩১; হায়াতুস সাহাবা-৩/৪৫০]

হযরত আসমার (রা) তৃতীয় স্বামী ‘আলী (রা) হিজরী ৪০ সনে শাহাদাত বরণ করেন। হযরত আসমাও এর কিছু দিন পরে ইনতিকাল করেন।[তাহজীবুত তাহজীব-১২/৩৯৯; শাজারাতুজ জাহাজ-১/১৫, ৪৮]

একদিন রাসূল (সা) আসমার প্রথম স্বামী জা‘ফারের তিন ছেলেকে খুবই ক্ষীণ ও দুর্বল দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেন, এদের এমন অবস্থা কেন? আসমা’ বলেন, তাদের অতিমাত্রায় নজর লাগে। রাসূল (সা) তা তুমি ঝাড়-ফুঁক কর না কেন। হযরত আসমার একটি মন্ত্র জানা ছিল। তিনি সেটি রাসূলকে (সা) শোনান। রাসূল (সা) শুনে বলেন, হ্যাঁ এটি ঠিক আছে।[মুসলিম-২/২২৩]

হযরত আসমা’ (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) জীবদ্দশায় তাঁর পরিবারের সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। কোন কোন বর্ণনায় দেখা যায়, হযরত ফাতিমার (রা) বিয়ের সময় তিনি বেশ কর্মতৎপরতা দেখান।পাত্রী পক্ষ থেকে তিনি জামাই ‘আলীল (রা) বাড়ীতে যান।[হায়াতুস সাহাবা-২/৬৬৭-৬৬৮]

গ্রন্থপঞ্জি
১. আল-ইমাম আয-যাহাবী:

(ক) সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা, (বৈরূত : আল-মাওয়াস্‌সাতুর রিসালা, সংস্করণ-৭, ১৯৯০)

(খ) তাযকিরাতুল হুফ্‌ফাজ, (বৈরূত : দুরু ইহইয়অ আত-তুরাছ আল-ইসলামী)

(গ) তারীখ আল-ইসলাম ওয়া তাবাকাত আল-মাশাহীর ওয়াল আ‘লাম, (কায়রো : মাকতাবা আল-কুদসী, ১৩৬৭ হি.)

২. ইবন হাজার :

(ক) তাহযীব আত-তাহযীব, (হায়দ্রাবাদ : দায়িরাতুল মা‘আরিফ, ১৩২৫ হি.; বৈরূত : দুরুল মা‘রিফা)

(খ) তাকরীব আত-তাহযীব (লাখনৌ)

(গ) আল-ইসাবা ফী তাময়ীয আস-সাহাবা,(বৈরূত : দুর আল-ফিকর, ১৯৭৮)

(ঘ) লিসান আল-মীযান, (হায়দ্রাবাদ, ১৩৩১ হি.)

(ঙ) ফাতহুল বারী, (মিসর, ১৩১৯ হি.)

৩. জামাল উদ্দীন ইউসুফ আল-মিয্‌যী: তাহযীব আল-কামাল ফী আসমা’ আর-রিজাল, (বৈরূত : মুওয়অস্‌সাসাতুর রিসালা, সংস্করণ-১/১৯৮৮)

৫. আবূ ইউসুফ : কিতাব আল-খারাজ,(বৈরূত : আল-মাকতাব আত-তিজরী)

৬. ইবন কাছীর :

(ক) তাফসীর আল-কুরআন আল-‘আজীম, (মিসম : দারু ইহইয়া আল-কুতুব আল-‘আরাবিয়্যা)

(খ) মুখতাসার তাফসীর ইবন কাছীর, (বৈরূত : দার-আলকুরআন আল-কারীম, ১৯৮১)

(গ) আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ্‌, (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-‘আলমিয়্যা )

(ঘ) আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, (বৈরূত : মাকতাবাহ্‌ আল-মা‘আরিফ; বৈরূত : দুরুল কুতুব আল-ইলমিয়্যা, ১৯৮৩)

৭. ইবনুল জাওযী : সিফাতুস সাফওয়া, (হায়দ্রাবাদ : দায়িরাতুল মা‘আরিফ, ১৩৫৭ হি.)

৮. ইবন সা‘দ : আত-তাবাকাত আল-কুবরা, (বৈরূত : দারু সাদির)

৯. ইবন ‘আসাকির : আত-তারীখ আল-কারীর, (শাম : মাহবা‘আতু আশ-শাম, ১৩২৯ হি.)

১০. ইয়অকূত আল-হামাবী : মু‘জাম আল-বুলদান, বৈরূত : দারু ইহইয়া আত-তুরাছ আল-‘আরাবী)

১১. আবুল ফারাজ আল-ইসফাহানী : কিতাব আল-আগানী, (মিসর : ১৯২৯)

১২. ইবন হাযাম : জামহারাতু আনসাব আল-‘আরাব, (মক্কা : দার আল-মা‘আরিফ, ১৯৬২)

১৩. ইবন খাল্লিকান : ওফাতুল আ‘য়ান, (মিসর : মাকতাবা আন-নাহ্দা আল-মিসরিয়্যা, ১৯৪৮)

১৪. মুহাম্মাদ আল-আলূসী : বুলূগ আ।– আরিব ফী মা‘রিফাতি আহওয়ালিল ‘আরাব, (১৩১৪ হি.)

১৫. ইবনুল আছীর :

(ক) উসুদুল গাবা ফী মা‘রিফাতিস সাহাবা, (বৈরূত : দারু ইহইয়অ আত-তুরাছ আল-‘আরাবী)

(খ) তাজরীদু আসমা’ আস-সাহাবা, (হয়দ্রাবাদ : দায়িরাতুল মা‘আরিফ, সংস্করণ- ১,১৩১৫ হি.)১৬. আল-বালাযরী:

(ক) আনসাব আল-আশরাফ, (মিসর : দার আল-মা‘আরিফ)

(খ) আয-যিরিক্‌লী : আল-আ‘লাম, (বৈরূত : দারুল ‘ইলম লিল মালাঈন, সংস্করণ-৪, ১৯৭৮)

১৮. ইবন হিশাম : আল-সীরাহ্‌ আন-নাবাবিয়্যা, (বৈরূত:)

১৯. ইউসুফ আল-কান্‌ধালূবী : হায়াত আস-সাহাবা, (দিমাশ্‌ক : দারুল কালাম, সংস্করণ-২, ১৯৮৩)

২০. সা‘ঈদ আল-আনসারী, মাওলানা : সিয়ারে আনসাব, (ভারত :১৯৪৮)

২১. নিয়ায ফতেহপূরী : সাহাবয়িাত, (করাচী : নাফীস একাডেমী)

২২. ইবন ‘আবদিল বার : আল-ইসতী‘আব (আল-ইসাবার পার্শ্বটীকা)

২৩. আহমাদ খলীল জুম‘আ : নিসা’ আহলিল বায়ত, (দিমাশ্‌ক : দারুল য়ামাম, সংস্করণ-৩ ১৯৯৮)

২৪. ইবন সাল্লাম আল-জামহী : তাবাকাত আশ শু‘আরা’ , (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-‘ইলমিয়্যা, সংস্করণ-১ ১৯৮১)

২৬. ড. আবদুল রহমা আল-বাশা : ‍সুওয়ারুন মিন হায়াত আস-সাহাবা, (সৌদি আরব, সংস্করণ-১)

২৭. ড. শাওকী দায়ফ : তারীখ আল-আদাব আল-আরাবী, (কায়রো : দার আল-মা‘আরিফ, সংস্করণ-৭)

২৮. ড. ‘উমার ফাররূখ : তারীখ আল-আদাব আল-আরাবী, (বৈরূত : দারুল ‘ইলম লিল মালায়ীন, ১৯৮৫)

২৯. জুরযী যায়দান : তারীখ আল-আদাব আল-লুগাহ্‌ আল-‘আরাবিয়্যা, (বৈরূত : দারুল মাকাতাবা আল-হায়াত, সংস্করণ৩/১৯৭৮)

৩০. ‘আলাউদ্দীন ‘আলী আল-মুত্তাকী : কান্‌য আল-‘উম্মাল, (বৈরূত : মুওয়াস্‌সাসাতুর রিসালা, সংস্করণ-৫, ২৯৮৫)

৩১. আহমাদ ‘আবদুর রহমান আল-বান্না : বুলুগ আল-আমানী মিন আসরার আল-ফাতহির রাব্বানী (শারহুল মুসনাদ), (কায়রো : দার-আশ-শিহাব)

৩২. ড. মুসতাফা আস-সিবা‘ঈ : আস-সুন্নাহ ওয়া মাকানাতুহা ফী আত-তাশরী’ আল-ইসলামী, (বৈরূত : আল-মাকতাব আল-ইসলামী, সংস্করণ-২, ১৯৭৬)

৩৩. হাজী খালীফা : কাশ্‌ফ আজ-জুনীন ‘আন আসামী আল-কুতাব ওয়াল ফুনূন, (বৈরূত : দার আল-ফিক্‌র, ১৯৯০)

৩৪. মুহাম্মাদ আল-খাদারী বেক : তারীখ আল-উমাম আল-ইসলামিয়্যা, (মিসর : আল-মাকতাবা আত-তিজারিয়্যা আল-কুরবা, ১৯৬৯)

৩৫. মুহিউদ্দীন ইবন শারফ আন-নাওবী : তাহযীব আল-আসমা’ ওয়াল লুগাত, (মিসর : আত-তিবা’আ আল-মুগীরিয়্যা)

৩৬. দায়িরা-ই-মা‘আরিফ-ই-ইসলামিয়া (লাহোর)

৩৭. ইবন ‘আবদি রাব্বিহি : আল-‘ইকদ আল-ফারীদ, (কায়রো : লুজনাতুত তা‘লীফ ওয়াত তারজামা, সংস্করণ-৩/১৯৬৯)

৩৮. ইবন মানজূর : লিসান আল-‘আরাব, (কায়রো : দারু মা‘আরিফ)

৩৯. ‘উমার রিদা কাহহালা : আ‘লাম আন-নিসা’ , (বরূত : মাআস্‌সাসাতুর রিসালা, সংস্করণ-৫, ১৯৮৪)

৪০. মাহমূদ মাহদী আল-ইসতানবূলী ও মাসতাফা আশ-শিলবী : নিসা’ হাওলার রাসূল (সা), (জিদ্দা : মাকতাবা আস-সাওয়াদী, সংস্করণ-৯,২০০১)

৪১. আহমাদ খলীল জুম‘আ : নিসা’ মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ্‌, (মক্কা : দারু তায়্যিবা আল-খাদরা, সংস্করণ-২, ২০০০)

৪২. সা‘ঈদ আনসারী : সিয়ারুল সাহাবিয়াত, (আজগড়, ১৩৪১)

৪৩. সায়্যিদ সুলায়মান নাদবী : সীরাতে ‘আয়িশা (রা), (করাচী : উরদূ একাডেমী সিন্‌ধ )

৪৪. ড. আবদুর কারীম যায়দান : আল-মুফাস্‌সাল ফী আহকাম আল-মারআতি ওয়াল বায়ত ফী আশ-শারী‘আ আল-ইসলামিয়্যা, (বৈরূত : মাআসাসাতুর রিসালা, সংস্করণ-৩, ১৯৯৭)

৪৫. আল-বাকিল্লানী : ই‘জাজ আল-কুরআন, (বৈরূত : মুআস্‌সাসাতুল কুতুব আছ-ছাকফিয়্যা, সংস্করণ-১, ১৯৯১)

৪৬. আস-সুয়ূতী : আদ-দুররুল মানছূর, (বৈরূত : দারুল মা‘রিফা)

৪৭. ‘আবদুল কাদির আল-বাগদাদী : খাযানাতুল আদাব, (বৈরূত : দারু সাদির)

৪৮. মুহাম্মাদ ‘আলী আশ-শাওকানী : দাররুস সাহাবী ফী মানাকিব আল-কারাবা ওয়অস সাহাবা, (দিমাশ্‌ক : দারুল ফিক্‌র, সংস্করণ-১, ১৯৮৪)

৪৯. আলী ইবন বুরহানউদ্দীন আল-হালাবী : আস-সীরাহ্‌ আল-হালাবিয়্যা, (মিসর :সংস্করণ-১, ১৯৬৪)

৫০. আল-বায়হাকী : দালায়িল আন-নুবুওয়াহ্‌, (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-‘ইলমিয়্যা, সংস্করণ-১, ১৯৮৫)

৫১. আহমাদ খলীল জুম‘আ : নিসা’ মাবাশ্‌শারাত বিল জান্নাহ্‌, (বৈরূত : দারু ইবন কাছীর, সংস্করণ-৪. ২০০১)

৫২. মুহিব্বুদ্দীন আত-তারাবী : আর-রিয়াদ আন-নাদিরা ফী মানাকিব আল-‘আশারা, (বৈরূত : দুরুল কুতুব আল-‘ইলমিয়্যা, সংস্করণ-১, ১৯৮৪)

৫৩. আহমাদ যীনী দাহলান : আস-সীরাহ্‌ আন-নাবাবিয়্যা, (বৈরূত : আহলিয়া লিন নাশ্‌র ওয়াত তাওযী’, ১৯৮৩)

৫৪. আবূ নু‘আইম আল-ইসফাহানী : হিলয়াতুল আওলিয়া, (বৈরূত : দার আল-কিতাব আল-আরাবী, সংস্করণ-২, ১৯৬৭)

৫৫. খলীল জুম‘আ : বানাত আস-সাহাব, (বৈরূত : আল-যামামা, সংস্করণ-১, ১৯৯৯)

৫৬. আস-সামহীদী : ওফা’ আল-ওফা’ , (বৈরূত : দারু ইহইয়অ আত-তুরাছ আল-‘আরাবী, সংস্করণ-৪, ১৯৮৪)

৫৭. ইবন ‘আসাকির : তারীখু দিমাশ্‌ক, (দিমাশ্‌ক : দারু ফিক্‌র)

৫৮. আল-হায়ছামী : মাজমা’ আয-যাওয়অয়িদ ওয়া মানবা’উল ফাওয়ায়িদ, (বৈরূত : মাআস্‌সাসা আল-মা‘আরিফ, ১৯৮৫৬)

৫৯. মুস‘আব আয-যুবায়রী : নাসাবু কুরায়শ, (মিসর : দার আল-মা‘আরিফ, সংস্করণ-৩)

৬০. ইবন কায়্যিম : যাদ আল-মা‘আদ, (বৈরূত : মুআস্‌সাসাতুর রিসালা, সংস্করণ-২, ১৯৮২)

৬১. ইবন কায়্যিম : যাদ আল-মা‘আদ, (বৈরূত : মুআস্‌সাসাতুর রিসালা, সংস্করণ-২, ১৯৮২)

৬১. আল-ওয়াকিদী : আল-মাগাযী, (বৈরূত : ‘আলম আল-কুতুব)

৬২. ইবন সায়্যিদ আন-নাস : ‘উয়ূন আল-আছার ফী ফুনূন আল-মাগাযী ওয়াস সিয়অর, (মুআস্‌সাতু ‘ইয্‌যিদ্দীন)

৬৩. ইবন কুতায়বা ‘উয়ূন আল-আখবার, (দারুল কুতুব, ১৯৬৩)

৬৪. ইবন কুতায়বা : আল-মা‘আরিফ, (মিসর : দারুল মা‘আরিফ, সংস্করণ-৪, ১৯৭৭)

৬৫. মানসূর ‘আলী নাসিফ : আত-আল-জামি’ লিল উসূল, (মিসর : মাতবা‘আতু আল-বাবী আল-হালাবী, সংস্করণ-৪)

৬৬. আত-তাবারী : তারীখ আল-উমাম ওয়াল মুলূক, (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-‘ইলমিয়্যা সংস্করণ-২, ১৯৮৮)

৬৭. ‘আবদুল বাদী’ সাকার : শা‘ইরাত আল-আরাব, (আল-মাকতাব আল-ইসলামী, সংস্করণ-১, ১৯৬৭)

৬৮. আহমাদ খলীল জুম‘আ : নিসা’ মিনাত তারীখ, (দিমাশ্‌ক : দারুল য়ামামা, সংস্করণ-১, ১৯৯৭)

৭০. ড. আয়িশা আবদুর রহমান : তারাজিমু সায়্যিদাত বায়ত আন-নুবুওয়াহ্‌, (কায়রো : দার আদ-দায়ান লিত-তুরাছ, সংস্করণ ১, ১৯৮৮)

৭১. ইবন দুরইদ : আল-ইশতিকাক, (কায়রো, ১৯৫৮)

৭২. ইবন কুদামা আল-মাকদাসী : আল-ইসতিবসার ফী নাসাবিস সাহাবা মিনাল আনসার, (বৈরূত : দারুল ফিক্‌ক)

৭৩. ইমাম আল-বুখারী : আল-আদাব আল-মুফরাদ, (ঢাকা : আহসান পাবলিকেশন, ২০০১)

৭৪. ‘আবদুর রউফ দানাপুরী : আসাহ আস-সীরাহ্‌, (করাচী)

৭৫. ড. আবদুল মা‘বুদ : আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, খণ্ড-১-৫, (ঢাকা : বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার)

৭৬. ড. মুহাম্মদ আবদুল মা‘বুদ : আসহাবে রাসূলের কাব্য প্রতিভা, (ঢাকা : আহসান পাবলিকেশন, সংস্করণ-১. ২০০৩)

৭৭. হাদীছের বিভিন্ন গ্রন্থ


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি