উম্মু সুলাইম বিন্‌ত মিলহান (রা)
ডাকন নাম উম্মু সুলাইম। আসল নামের ব্যাপারে বিস্তর মতভেদ দেখা যায়। যথা: সাহলা, রুমাইলা, মুলাইকা, আল-গুমাইসা’ ও আর-রুমাইসা’। বানু নাজ্জারের প্রখ্যাত মহিলা আনসারী সাহাবী। প্রখ্যাত সাহাবী ও রাসূলুল্লাহর (রা) অতি স্নেহের খাদেম হযরত আনাসের গর্বিত মা। পিতার নাম মিলহান ইবন খালিদ এবং মাতার নাম মুলাইকা বিন্‌তে মালিক এবন ‘আদী ইবন যায়দ ইবন মানাত। অন্য একটি বর্ণনায় ‘উনাইকা’ বলা হয়েছে।[আল-ইসামা-৪/৪৬১, ৪৬২, তাবাকাত-৩/৫০৪] ঐতিহাসিক বীরে মা‘উনার ঘটনায় শাহাদগাত প্রাপ্ত অন্যতম সাহাবী হযরত হারাম ইবন মিলহান তাঁর ভাই।[হায়াতুস সাহাবা (আরবী)-১/৫২৮] ইতিহাসে তি উম্মু সুলাইম নামে প্রস্ধি।

জাহিলী যুগে প্রথম জীবনে তিনি মালিক ইবন নাদারকে বিয়ে করেন। রাসূলুল্লহর (সা) মদীনায় হিজরাতের দশ বছর পূর্বেই তারই ঔরসে পুত্র আনাসের জন্ম হয়। আনসারদের মধ্যে যাঁরা প্রথম ভাগে ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি তাঁদে অন্যতম। তাঁর ইসলাম গ্রহণ করার কারণে সম্পর্ক ছিন্ন করে তাঁর স্বামী মালিক তাঁকে ও তাঁর সন্তানকে ফেলে দেশান্তরী হয়।[আল-ইসাবা-৪/৪৬১]এ সম্পর্কে আনাস থেকে বর্ণিত হয়েছে। উম্মু সুলাইম একদিন স্বামী মালিকের নিকট এসে বললেন : আজ আমি এমন একটি খবর নিয়ে এসেছি যা তোমার পছন্দ নয়। মালিক বললেন : তুমি তো সব সময় এই বেদুঈনের কাছ থেকে আমার অপছন্দনীয় বার্তাই এনে থাক। স্বামীর কথার প্রতিবাদ করে তিনি বললেন : হাঁ, তিনি বেদুঈন, তবে আল্লহা তাঁকে ননোনীত করে নবী বানিয়েছেন। মালিক জানতে চাইলো : তা আজ কী খবর আন লে, শুনি। বললেন : মদ হারাম ঘোষিত হয়েছে। মালিক বললো : তোমার ও আমার সম্পর্ক এখানেই শেষ হলো। তারপর সে ঘর-সংসার ও স্ত্রী পুত্র সবকিছু ছেড়ে শামে চলে যায় এবং সেখানেই পৌত্তলিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।[হায়াতুস সাহাবা-২/৫৯০; আল-ইসাবা-৪/৪৬১; তারীখে আবন ‘আসাকির-৬/৫]

উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় মালিকের সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয় রাসূলুল্লাহর (রা) মদীনায় আসার অনেক পরে যখন মদ হারাম হয় পক্ষান্তরে হযরত আবু তালহার (রা) সাথে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে সম্পর্কে যত বর্ণনা এসেছে, সেগুলি দ্বারা বুঝা যায় রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় আসার আগেই তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কোন কোন বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় আসার আগেই তিনি আবু তালহাকে দ্বিতীয় স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেন। আবার এমন বর্ণনাও দেখা যায় যে, মদীনায় খোদ রাসূলুল্লাহর (সা) হাতেই আবু তালহা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তারপরই উম্মু সুলাইম তাঁকে বিয়ে করেন। এমনি ধরনের নানাবিধ রর্ণনা দেখা যায়। তবে একথা স্বীকৃত যে রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় আসার আগেই উম্মু সুলাইম ইসলাম গ্রহণ করেন। নিম্নে আবু তালহার সাথে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে সম্পর্কিতহ দুই একটি বর্ণনা তুলে ধরছি। আনাস থেকে বর্ণেত। আবু তালহা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে উম্মু সুলাইমকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। জবাবে উম্মু সুলাইম বলেন : আবু তালহা, আপনি কি জানেন না, যে ইলাহ্‌র ইবাদাত আপনি করেন তা মাটি দ্বারা তৈরী? তিনি বললেন : তা ঠিক। উম্মু সুলাইম আবার বললেন : একটি গাছের পূজা করতে আপনার লজ্জা হয় না? আপনি ইসলাম গ্রহণ করলে আপনার সাথে বিয়েতে আমার আপত্তি থাকবে না। আর সে ক্ষেত্রে আপনার ইসলাম ছাড়া অন্য কোন মোহরের দাবীও থাকবে না। ‘বিষয়টি আমি ভেবে দেখবো’- একথা বলে আবু তালহা চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এসে পাঠ করলেন : ‘আশহাদু আল-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান রাসূলুল্লাহ’।

অতঃপর উম্মু সুলাইম ছেলে আনসকে ডেকে বললেন : আনাস! আবু তালহার বিয়ের ব্যবস্থা কর। আনাস তাঁর মাকে আবু তালহার সাথে বিয়ে দিলেন। ঘটনাটি বিভিন্ন সনদে বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।[হায়াতুস সাহাবা-১/১৯৬; আল-ইসাবা-৪/৪৬১; তাবাকাত-৩/৫০৪;তারীখে ইবন ‘আসাকির-৬/৫]

অন্য একটি বর্ণনা এসেছে, আনাস বললেন : আবু তালহা বিয়ের প্রস্তাব দিলে উম্মু সুলাইম তাঁকে বললেন : আমি এ ব্যক্তির ওপর ঈমান এনেছি এবং ঘোষণা দিয়েছি যে, তিনি আল্লাহর রাসূল। আপনি আমার অনুসারী হলে আপনাকে বিয়ে করতে পারি। আবু তালহা বললেন : বেশ তো, তোমার ধর্ম আমিও গ্রহণ করলাম। এরপর উম্মু সুলাইম তাঁকে বিয়ে করেন। আবু তালহার ইসলামই ছিল এ বিয়ের মোহর। এ সনদে একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, আবু তালহা প্রস্তাব দিলে উম্মু সুলাইম বললেন : আনাস বালেগ হয়ে বিভিন্ন মজলিসে বসার উপযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমি দ্বিতীয় বিয়ে করবো না। আনাস বলেন, আল্লাহ আমার পক্ষ থেকে মাকে প্রতিদান দিন। তি আমাকে উত্তমরূপে প্রতিপালন করেছেন। উম্মু সুলাইমের কথা শুনে আবু তালহা বললেন : আনাস তো মজলিসে বসেছে এবং কথাও বলেছে। অতঃপর আনাস তাঁর মাকে বিয়ে দেন।

অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, উম্মু সুলাইম বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে আবু তালহা তাঁকে বললেন : আল্লাহর কসম, এ হয় হয়তো তোমার মনের কথা নয়। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন : তোমার ইচ্ছা, সোনা-রূপা পাওয়অ? উম্মু সুলাইম তখন বললেন : আমি আপনাকে ও আল্লাহর নবীবে সাক্ষী রেখে ঘোষণা করছি, যদি আপনি ইসলাম গ্রহণ করেন তাহলে আপনার ইসলামের বিনিময়েই আমি বিয়েতে রাজী আছি। একথা শুনে আবু তালহা বললেন : এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারে কে? উম্মু সুলাইম ছেলে আনাসকে বললেন : আনাস, তুমি তোমার চাচার সাথে যাও। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আনাস বলেন : আবু তালহা আমার কাঁধে হাত রাখলেন এবং এ অবস্থায় আমরা চললাম। যখন আমরা রাসূলুল্লাহর (সা) নিকটবর্তী হলাম, তিনি আমাদের কথা শুতে পেয়ে বলে ওঠেন : এই যে আবু তালহা, তার দু‘চোখের মাঝখানে তো ইসলামের সম্মান ও গৌরব দীপ্তিহমান। আবু তালহা নবীকে (সা) সালাম দিয়ে বললেন : আশহাদু আন লাইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ও রাসূলুহু। অতঃপর ইসলামের বিনিময়ে রাসূল (সা) তাঁকে উম্মু সুলাইমের সাথে বিয়ে দেন।

উম্মু সুলাইমের প্রথম স্বামীর পক্ষে আনাস এবং দ্বিতীয় স্বামী হযরত আবু তালহার পক্ষে দু‘ছেলে (১) আবু ‘উমাইর ও (২) ‘আবদুল্লাহর জন্ম হয়। আবু ‘উমাইর শৈশবে মারা যায়। অপর দু‘জনের মাধ্যমে বংশ বিস্তার হয়।

আবু ‘উমাইরের মৃত্যুতে উম্মু সুলাইম যে ধৈর্য অবলম্বন করেন তা মানব জাতির জন্য শিক্ষণীয়। আবূ ‘উমাইর যখন মারা যায় তখন সে কেবল হাঁটতে শিখেছে। ছোট ছোট পা ফেলে যখন সে হাঁটে বাবা-মা অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকেন। এমন সময় আল্লাহ পাক তাকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেন। ছেলেটি আবু তালহা খুব আদরের ছিল।

অসুস্থ ছেলেকে ঘরে রেখে আবু তালহা কোন কাজে বাইরে গেছেন। এর মধ্যে ছেলের মৃত্যু হয়েছে। মা উম্মু সুলাইম বাড়ীর অন্য লোকদের বলে রাখলেন, আবু তালহা ফিরে এসে অসুস্থ ছেলের অবস্থা জানতে চাইলেন। উম্মু সুলাইম বললেন : যে অবস্থায় ছিল, তার চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে। স্ত্রীর কথায় আবু তালহা মনে করলেন, ছেলে ভালো আছে। তিনি যথারীতি পানাহার সেরে বিছানায় গেলেন। উম্মু সুলাইমও কাজ সেরে সেজে-গুজে সুগন্ধি লাগিয়ে বিছানায় গেলেন। স্বামী-স্ত্রী গভীর সান্নিধ্যে আসলেন। এর পর উম্মু সুলাইম স্বামীকে ছেলের মৃত্যুর খবর এভাবে দেন : আবু তালহা, যদি কেউ আপনার নিকট কোন জিনিস গচ্ছিত রাখে এবং পরে তা ফেরত নিতে আসে তখন কি তা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানাবেন? আবু তালহা বললেন : ‘কক্ষণো না’। উম্মু সুলাইম বললেন : তাহলে বলছি, ছেলের ব্যাপারে আপনাকে ধৈর্যশীল হতে হবে। সে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। আবু তালহা জানতে চাইলেন : সে এখন কোথায়? বললেন : এই যে গোপন কুঠরীতে। আবু তালহা সেখানে ঢুকে মুখের কাপড় উঠিয়ে ইন্না লিল্লাহ পাঠ করেন। অন্য একটি বর্ণনা মতে, আবু তালহা ফিরে আসার আগেই উম্মু সুলাইম মৃত ছেলেকে দাফন করে দেন।

এরপর আবু তালহা রাসূলুল্লাহর (সা) দরবারে উপস্থিত হয়ে ছেলের মৃত্যু এবং উম্মু সুলাইমের আচরণের কথা তাঁকে বলেন। রাসূল (সা) সবকিছু শুনে মন্তব্য করেন : আল্লাহ তায়ালা আজকের রাতটি তোমাদের জন্য বরকতময় করেছেন। যিনি আমাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন সেই সত্তার শপথ! আল্লাহ তার রিহমে (গর্ভে) একটি ‘জিকর’ নিক্ষেপ করেছেন। এ কারণে সে তার ছেলেন মৃত্যুতে এত কঠিন ধৈর্য ধারণ করতে পেরেছে।[হায়াতুস সাহাবা-২/৫৯০; মুসলিম-২/৩৪২; আল-ইসাবা-৪/৪৬১] এ রাতে তাঁদের মিলনে এক পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে। তিনিই আবদুল্লাহ ইবন তালহা। আল্লাহ তাঁকে অনেক সন্তান-সন্ততি দান করেন।[আল-ইসাবা-৪/৪৬১; দ্রঃ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা (৩য় খণ্ড) -১১৫] অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা) সেদিন এই দম্পতির জন্য এই বলে দু‘আ করেছিলেন : ‘হে আল্লাহ, এ দু‘জনের এ রাতটির মধ্যে বরকত ও কল্যাণ দিন।’

অকঃপর উম্মু সুলাইম সন্তান প্রসব করলেন। রাসূল (সা) এ খবর পেয়ে আনাসকে বলেন : তোমার মায়ের কাছে যেয়ে বল, সন্তানের নাড়ি কাটার পর আমার কাছে না পাঠিয়ে তার মুখে যেন কিছুই না দেয়। আনাস বলেন : আমার মা ছেলেকে আমার হতে তুলে দেন এবং আমি রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে এনে রাখি। তারপর রাসূল (সা) আনাসকে তিনটি ‘আজওয়া খেজুর আনতে বলেন। আনাস তা নিয়ে এলে তিনি সেগুলির আঁটি ফেলে দিয়ে নিজের মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে ভালো করে চিবান। পরে শিশুটির মুখ ফাঁক করে কিছু তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। শিশুটি মুখ নেড়ে চুষতে থাকে। তা দেখে রাসূল (সা) মন্তব্য করেন : ‘আমার আনসাররা খেজুর পছন্দ করে’। তারপর শিশুটিকে আনাসের হাতে দিয়ে বলেন : তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাও। রাসূল (সা) শিশুটির নাম রাখেন ‘আবদুল্লাহ। তিনি এই বলে শিশুটির জন্য দু‘আও করেন যে, আল্লাহ তাকে নেককার মুত্তাকী করুন। আনসারদের এক ব্যক্তি বলেন : আমি এ ‘আবদুল্লাহর নয় সন্তানকে দেখেছি, তারা সবাই কুরআনের একজন বড় কারী। হায়াতুস সাহাবা-২.৫৯০-৫৯১;ড় তারীখে ইবন ‘আসাকির-৬/৬]

রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় আসার পরপরই উম্মু সুলাইম ছোট্ট ছেলে আনাসের হাত ধরে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট নিয়ে যেয়ে বলেন :‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই থাকলো আনাস। সে আপনার খিদমত করবে।’ আনাস তখন দশ বছরের বালক মাত্র। তখন থেকে রাসূলুল্লাহর (সা) ওফাত পর্যন্ত আনাস তাঁর খিদমত করেন। এ কারণে তিনি ‘খাদেমুন নাবী(সা)’ খ্যাতি অর্জন করেন।[আল-ইসাবা-৪/৪৬২] অপর একটি বর্ণনায় এসছে, তিনি আরও ‘আরজ করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি তার জন্য একটু দু‘আ করনি। রাসূল (সা) তার জন্য দু‘আও করেন।[মুসলিম-২/৯৪৪; বুখারী-২/৩০২] হযরত রাসূলে কারীম (সা) মদীনায় মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে ভ্রাতৃ-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন, একটি বর্ণনা মতে সে বৈঠকটি হয়েছিল উম্মু সুলাইমের বাড়ীতে। হযরত উম্মু সুলাইম অত্যন্ত আগ্রহের সাথে বড় বড় যুদ্ধে উম্মু সুলাইম ও অন্য কতিপয় আনসারী মহিলাকে সাথে নিয়ে যেতেন। তাঁরা সৈনিকদের পানি পান করাতেন এবং আহতদের সেবা করতেন।[মুসলিম-২/১০৩; হায়াতুস সাহাবা-১/৫৯২-৫৯৩] তিরমিযীও হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। উহুদ যুদ্ধে যখন মুসলিম বাহিনীর বিপর্যয় হয় তখনও তিনি অতি সাহসিকতার সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করেন। আনাস (রা) বলেন : আমি ‘আয়িশা ও উম্মু সুলাইমকে মশক ভরে পানি এনে আহতদের পান করাতে দেখেছি। মশক খালি হয়ে গেলে তারা আবার ভরে এনে পান করিয়েছেন।[বুখারী-কিতাবুল মাগাযী-২/৫৮১;]

হিজরী ৭ম সনে খাইবার যুদ্ধেও তিনি যান। খাইবারে অথবা খাইবার থেকে ফেরার পথে হযরত রাসূলে কারীমের (সা) হযরত সাফিয়্যার (রা) শাদী মুবারক ও বাসর অনুষ্ঠিত হয়। তিনিই হযরত সাফিয়্যাকে চুল বেঁধে সাজ-গোজ করিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট উপস্থাপন করেন।[সহীহ মুসলিম-১/৫৪৬; সীরাতু ইবন হিশাম-২/৩৪০; আল-ইসাবা-৪/৪৬২]

হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন আবী বকর (রা) থেকে বর্ণিত। হুনাইন যুদ্ধে উম্মু সুলাইম খঞ্জর হাতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। এক সময় যুদ্ধের মধ্যে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) নজরে পড়লেন। তিনি তখন কোমরে চাদর পেঁচিয়ে স্বামী আবু তালহার পাশে দাঁড়িয়ে। ‘আবদুল্লাহ ইবন আবী তালহা তখন তাঁর পেটে। তাঁর সাথে আবু তালহার উট। উটটি বশে আনার জন্য তারা মাথার কেশ ও লাগামের মধ্যে হাত দিয়ে রেখেছেন। রাসূল (সা) ডাকলেন : উম্মু সুলাইম? তিনি সাড়া দিলেন : হাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার মা-বাবা আপনার প্রতি কুরবান হোক! আপনার বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করছে, আপনি যেভাবে তাদের হত্যা করছেন, আমিও ঠিক সেভাবে যারা আপনাকে ছেড়ে রণক্ষেত্র থেকে পালাবে তাদের হত্যা করবো। কারণ, তারা হত্যারই উপযুক্ত। তাঁর কথা শুনে রাসূল (সা) বললেন : উম্মু সুলাইম! আল্লাহ কি এ ব্যাপারে যথেষ্ট নন? উম্মু সুলাইমের হাতে তখন একটি খঞ্জর। সেদিকে ইঙ্গিত করে আবু তালহা বললেন : উম্মু সুলাইম তোমার হাতে এ খঞ্জর কেন? বললেন : কোন মুশরি (পৌত্তলিক) আমার নাগালের মধ্যে এলে এ খঞ্জর দিয়ে আমি তার পেট ফেঁড়ে ফেলবো। এ কথা শুনে আবু তালহা বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! উম্মু সুলাইম আর-রুমাইসাৎ যা বলছে তাকি শুনেছেন! এতে রাসূল (সা) মৃদু হেসে দেন।[মুসলিম-২/]

হিজরী ৫ম সনে রাসূলুল্লহর (সা) সাথে উম্মুল মু‘মিনীন হযরত যয়নাবের (রা) বিয়ে হয়। এ উপলক্ষে উম্মু সুলাইম নিজ হাতে অতি সুন্দর কারুকাজ করা পশমী পোশাক তৈরী করে ছেলে আনাসের হাতে পাঠিয়ে দেন। রাসূল (সা) যেন তার এ ছোট্ট উপহার গ্রহণ করেন- এ কথাটির বলার জন্যও তিনি আনাসকে তাকীদ দেন।

হযরত উম্মু সুলাইম মাঝে মাঝে রাসূলুল্লাহর (সা) জন্য খাদ্য তৈরী করে পাঠাতেন। নিজের বাড়ীতে ভালো কিছু তৈরী হলে তার কিছু রাসূলুল্লাহর (সা) জন্যও পাঠাতেন। আবু হাতেম থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহর (সা) কোন এক স্ত্রীর সাথে প্রথম মিলন উপলক্ষে উম্মু সুলাইম ‘হাইস’ (খেজুর, আকিত ও চর্বি দ্বারা তৈরী নামক এক প্রকার খাবার তৈরী করে পিতল বা কাঠের পাত্রে ঢালেন। তারপর ছেলে আনাসকে ডেকে বলেন : এটা রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট নিয়ে যেয়ে বলবে, আমাদের পক্ষ থেকে সামান্য হাদিয়া। আনাস বলেন : মানুষ সে সময় দারুণ অন্ন কষ্টে ছিল। আমি পাত্রটি নিয়ে যেয়ে বললাম ইয়া রাসূলুল্লাহ! এটা উম্মু সুলাইম আপনাকে পাঠিয়েছেন। তিনি আপনাকে সালামও পেশ করেছেন এবং বলেছেন, এ হচ্ছে আমাদের পক্ষ থেকে সামান্য হাদিয়া। রাসূল (সা) পাত্রটির দিকে তাকিয়ে বললেন : ওটা ঘরের এক কোণে রাখ এবং অমুক অমুককে ডেকে আন। তিনি অনেক লোকের নাম বললেন। তাছাড়া আরও বললেন : পথে যে মুসলমানের সাথে দেখা হবে, সাথে নিয়ে আসবে। আনাস বলেন : যাদের নাম তিনি বললেন তাদেরকে তো দাওয়াত দিলাম। আর পথে আমার সাথে যে মুসলমানের দেখা হলো তাদের সকলকেও দাওয়াত দিলাম। আমি ফিরে এসে দেখি রাসূলুল্লাহর (সা) গোটা বাড়ী সুফফা ও হুজিরা- সবই লোকে লোকারণ্য।

বর্ণনাকারী আনাসকে জিজ্ঞেস করলেন : তা কত লোক হবে বললেন : প্রায় তিন শো। আনাস বলেন : রাসূল (সা) আমাকে খাবার পাত্রটি আনতে বললেন। আমি কাছে নিয়ে এলাম। তিনি তার ওপর হাত রেখে দু‘আ করলেন। তারপর বললেন : তোমরা দশজন দশজন করে বসবে, বিসমিল্লাহ বলবে এবং প্রত্যেকে নিজের পাশ থেকে খাবে। রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশ মত সবাই পেট ভরে খেলো। তারপর তিনি আমাকে বললেন : পাত্রটি উঠাও। আনাস বলেন : আমি এগিয়ে এসে পাত্রটি উঠালাম। তার মধ্যে তাকিয়ে দেখলাম। কিন্তু আমি বলতে পারবো না, যখন রেখেছিলাম তখন বেশী ছিল না যখন উঠালাম।[হায়াতুস সাহাবা-২/৬৬০-৬৬১]

অন্য একটি ঘটনা আনাস তাঁর মা থেকে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মার একটি ছাগী ছিল। তার দুধ থেকে ঘি তৈরী করে একটি চামড়ার পাত্রে ভরেন। একদিন পাত্রটি রাবীবার হাতে দিয়ে বলেন, এটা রাসূলাল্লাহকে (সা) দিয়ে এসো, তিনি তরকারি হিসেবে খাবেন। রাবীবা সেটি হাতে নিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যেয়ে বললেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! এক উক্‌কা বা পাত্র ঘি উম্মু সুলাইম পাঠিয়েছেন। রাসূল (সা) লোকদের বললেন, তোমরা ঘি ঢেলে রেখে পাত্রটি তাঁকে ফেরত দাও। খালি পাত্রটি তাঁকে ফেরত দেওয়া হলো। তিনি পাত্রটি একটি খুঁটির সাথে ঝুলিয়ে রাখলেন। উম্মু সুলাইম বাড়ী এসে দেখেন পাত্রটি হতে ঘি উপচে পড়ছে। তিনি বললেন : আমি তো আপনার কথা পালন করেছি। যদি বিশ্বাস না হয় আমার সাথে চলুন, রাসূলুল্লাহকে (সা) জিজ্ঞেস করুন। উম্মু সুলাইম রাবীবাকে সাথে করে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যেয়ে বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি এর মাধ্যমে এক পাত্র ঘি পাঠিয়েছিলাম। রাসূল (সা) বললেন : হাঁ, সে তা দিয়েছে। উম্মু সুলাইম তখন বললেন : যিনি আপনাকে সত্য এবং সত্য দীন সহকারে পাঠিয়েছেন, সে সত্তার শপথ। পাত্রটি তো এখনও ঘি-ভরা এবং তা উপচে পড়ছে। একথা শুনে রাসূল (সা) বললেন : উম্মু সুলাইম!

আল্লাহ তোমাকে খাওয়ান যেভাবে তুমি তাঁর নবীকে খাইয়েছো, এত কি তুমি বিস্মিত হচ্ছো? নিজে খাও এবং অপরকে খাওয়াও। উম্মু সুলাইম বলেন : আমি বাড়ী ফিরে এসে তা কয়েকটি গ্লাসে ভাগ করে রাখলাম এবং এক অথবা দু‘মাস যাবত আমরা তা খেয়েছি।[আল-বিদায়া-৬/১০২; হায়াতুস সাহাবা-২/৬৩৫]

ইমাম মুসলিম আর একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। আনাস বলেন : একদিন আবু তালহা আমার মা উম্মু সুলাইমকে বললেন, আজ আমি যেন রাসূলুল্লাহর (সা) কণ্ঠস্বর একটু দুর্বল শুনতে পেলাম। মনে হলো তিনি ক্ষুধার্ত। তোমার কাছে কোন খাবার আছে কি? মা বললেন : আছে। তিনি কয়েক টুকরো রুটি আমার কাপড়ে জড়িয়ে দিয়ে আমাকে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট পাঠালেন। আমাকে দেখেই রাসূল (সা) জিজেজ্ঞস করলেন : আবু তলিহা পাঠিয়েছে? বললাম : হাঁ। বললেন : খাবার? বললাম : হাঁ। রাসূল (সা) সাথের লোকদের বললেন : তোমরা ওঠো। তাঁরা উঠলেন এবং আমি তাদের আগে আগে চললাম। আবু তালহা সকলকে দেখে স্ত্রীকে ডেকে বললেন : উম্মু সুলাইম, দেখ, রাসূল (সা) লোকজন সংগে করে চলে এসেছেন। সবাইকে খেতে দেওয়ার মত খাবার তো নেই। উম্মু সুলাইম বললেন : আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) সে কথা ভালোই জানেন। আবু তালহা অতিথিদের নিয়ে বসালেন। রাসূল (সা) ঘরে ঢুকে বললেন : যা আছে নিয়ে এসো। সামান্য খাবার ছিল তাই হাজির করা হলো। তিনি বললেন : প্রথমে দশজনকে আসতে বল। দশজন ঢুকে পেট ভরে খেয়ে বের হয়ে গেল। তারপর আর দশজন। এভাবে মোট সত্তর অথবা আশিজন পেট ভরে সেই খাবার খেয়েছিল।[বুখারী-২/৩৪২; মুসলিম-২/১৭৮; আল-বিদায়া-৯/১০৫ ;হায়াতুস সাহাবা-২/১৯৩-১৯৪]

তিনি নবী কারীমকে (সা) সীমাহীন ভালোবাসতেন। নবী কারীমও (সা) প্রায়ই উম্মু সুলাইমের গৃহে যেতেন এবংদুপুরে সেখানে বিশ্রাম নিতেন। এ সুযোগে উম্মু সুলাইম রাসূলুল্লাহর (সা) ঘাম ও ঝরে পড়া লোম সংগ্রহ করতেন।[বুখারী-২/৯২৯]

আনাস (রা) বলেন : একদিন দুপুরে রাসূল (সা) আমাদের বাড়ীতে এসে বিশ্রাম নিলেন এবং ঘেমে গেলেন। আমার মা একটি বোতল এনে সেই ঘাম ভরতে লাগলেন। রাসূল (সা) জেগে উঠে বললেন : উম্মু সুলাইম, একি করছো? মা বললেন : আপনার এ ঘাম আমাদের জন্য সুগিন্ধি। আনাস বলতেন : রাসূলুল্লাহর (সা) ঘামের সুগন্ধি থেকে অধিকতর সুগন্ধিযুক্ত মিশ্‌ক অথবা আম্বর আমার জীবনে আর শুকিনি।[তারীখে ইবন ‘আসাকির-৩/১৪৪, ১৪৫] আনাস আরও বলেন : আমার মা উম্মু সুলাইমের আবু তালহার পক্ষের আবু ‘উমাইর নাকে একটি ছোট্ট ছেলে ছিল। রাসূল (সা) আমাদের বাড়ীতে এলে তার সাথে একটু রসিকতা করতেন। একদিন দেখলেন আবু ‘উমাইর মুখ ভার করে বসে আছে। রাসূল (সা) বললেন : আবু ‘উমাইর, এমন মুখ গোমড়া করে বসে আছ কেন? মা বললেন : তার খেলার সাথী ‘নুগাই‘টি মারা গেছে। তখন থেকে রাসূল (সা) তাঁকে দেখলে কাব্যি করে বলতেন :

‘ইয়া আবা ‘উমাইর, মা ফা‘য়ালান নুগাইর’- ওহে আবু ‘উমাইর, তোমার নুগাইরটি কি করলো? উল্লেখ্য যে, ‘নুগাইরৎ লাল ঠোঁট বিশিষ্ট চড়ুই-এর মাত এক প্রকার ছোট্ট পাখী।[প্রাগুক্ত ৩/১৩৯; হায়াতুস সাহাবা-২/৫৭০, ৫৭১; তাবাকাত-৩/৫০৬]

আনাস (রা) বলেন : রাসূল (সা) তাঁর সহধর্মিনীদের ঘর ছাড়া একমাত্র উম্মু সুলাইমের ঘরে যেভাবে গেছেন সেভাবে আর কোথাও যাননি। একবার রাসূলকেজ (সা) এর কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তার প্রতি আমার দয়া হয়। তার বাবা ও ভাই আমার সাথে থেকে শহীদ হয়েছে।[মুসলিম -২/৩৪১; আল-ইসাবা-৪/৪৬১] ইবন হাজার বলেন : উম্মু হারাম ও তাঁর বোন উম্মু সুলাইমের গৃহে রাসূলুল্লাহর (সা) প্রবেশের উত্তর হলো, তারা দু‘জন একই বাড়ীতে থাকতেন এবং উম্মু সুলাইম রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে জিহাদে যেতেন।[আল-ইসাবা-৪/৪৬১]

উম্মু সুলাইম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সা) খালা হতেন। রাসূলুল্লাহর (সা) দাদা আবদুল মুত্তালিবের মা সালমা বিনতু ‘আমর-এর নসব ‘আমির ইবন গানাম- এ গিয়ে আনাসের মার বংশের সাথে মিলিত হয়েছে।[উসুদুল গাবা-১/১২৭; আসাহহুস সীয়অর-৬০৬] তিনি অন্তর দিয়ে রাসূলকে (সা) ভালোবাসতেন, ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। আর রাসূলও (সা) তাঁর কথা কখনও বিস্মৃত হননি। এই সম্মানিত মহিলাকে রাসূল (সা) জান্নাতের সুসংবাদও দান করেছেন।[দায়িরা-ই-মা‘য়ারিফ-ই-ইসরলামিয়্যা (উর্দু)-৩/৪০২]

হযরত উম্মু সুলাইমের সম্মান ও মর্যাদা অনেক। রাসূল (সা) বলেছেন : আমি জান্নাতে যেয়ে এক মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। জানতে চাই এ মহিলা কে? আমাকে জানানো হয়, আনাসের মা গুমাইসা বিন্‌তু মিলহান।[মুসলিম-২/৩৪২]

হযরত উম্মু সুলাইম রাসূলুল্লাহর (সা) অনেক হাদীছ বর্ণনা করেছেন। আনাস ইবন মালিক, ইবন ‘আব্বাস, যায়দ ইবন ছাবিত, আবু সালামা ইবন ‘আবদির রহমান ও আরও অনেক সাহাবী তাঁর থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। জনসাধারণ তাঁর কাছে জরুরী দীনী মাসায়িল জিজ্ঞেস করতো। একবার হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস এবং হযরত যায়দ ইবন ছাবিতের মধ্যে একটি বিবাদ দেখা দিলে তাঁরা উভয়ে তাঁকেই বিচারক মানেন।[মুসনাদ-৬/৪৩১; আল-ইসাবা-৪/৩৬২]

তিনি কোন দীনী বিষয়ে জানার জন্য রাসূলুল্লাহকে (সা) প্রশ্ন করতে লজ্জা পেতেন না। হযরত ‘আয়িশা (রা) বলেন : আনসারদের মেয়েরা কত ভালো। দীনী বিষয়ে প্রশ্ন করতে এবং দীনকে জানার ব্যাপারে লজ্জা তাদেরকে বিরত রাখতে পারেনা। ইমাম আহমাদ উম্মু সুলাইম থেকে বর্ণা করেছেন। তিনি বলেছেন : আমি রাসূলুল্লাহর (সা) স্ত্রী উম্মু সালঅমার পাশাপাশি ছিলাম। আমি প্রশ্ন করলাম : ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন মহিলা যদি ঘুমের মধ্যে দেখে যে তার স্বামীর সাথে সহবাস করছে, তাহলে তাকে কি গোসল করতে হবে? প্রশ্ন শুনে উম্মু সালামা বলে উঠলেন : উম্মু সুলাইম, তোমার দু‘হাত ধুলিমলিন হোক! রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে গোটা নারীকূলকে তুমি লজ্জা দিল। উত্তরে সুলাইম বললেণ : সত্য প্রকাশে আল্লাহ লজ্জা পাননা। কোন সমস্যার ব্যাপারে অন্ধকারে থাকার চেয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট জিজ্ঞেস করাই উত্তম। উত্তরে রাসূল (সা) বললেন : উম্মু ‍সুলাইম! তোমার দু‘হাত ধুলিমলিন হোক। তার ওপর গোসল ফরজ হবে, যদি সে ঘুম থেকে জেগে পানি দেখতে পায়। উম্মু সুলাইম আবার প্রশ্ন করেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! মেয়েদেরও কি পানি আছে? নবী (সা) বললেন : ‍যদি পানিই না থাকবে তাহলে সন্তান তার মত হয় কি করেন? তারা তো পুরুষেরই মত।[হায়াতুস সাহাবা-৩/২২১, ২২২]

আনাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছ। তিনি বলেন : একবার আমার মা আমাকে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট নিয়ে যেয়ে বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার এই ছোট্ট খাদিমটার জন্য একটু দু‘আ করুন। রাসূল (সা) দু‘আ করলেন ‘হে আল্লাহ! ‍তুমি তার অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে সমৃদ্ধি দান কর। তাকে দীর্ঘজীবী কর এবং তার গুনাহ মাফ করে দাও’। শেষ জীবনে আনাস বলতেন, আমি আমার সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে থেকে ৯৮ মতান্তরে ১০২ জনকে শুধু কবরই দিয়েছি। আমার বাগিচায় বছরে দু‘বার করে ফুল আস। এত দীর্ঘ জীবন পেয়েছি যে, জীবনের প্রতি আমি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছি। আর চতুর্থটির অর্থাৎ গুনাহ্‌ মাফের আশায় আছি।[প্রাগুক্ত-৩/৩৪৭, ৬৩৩]

হযরত আনাস প্রতিদিন রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমাত করে দুপুরে বাড়ী ফিরতেন। একদিন দুপুরে বাড়ীর দিকে চলেছেন। পথে দেখলেন তাঁরই সমবয়সী ছেলেরা খেলছে। তাঁর কাছে খেলাটি ভালো লাগলো। তিনি দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর দেখলেন, রাসূল (সা) তাদের দিকে আসছেন। তিনি এসে আনাসের হাতটি ধরে কোন কাজে পাঠালেন। আনাস ফিরে এলে রাসূল (সা) বাড়ীর দিকে চললেন। আনাসে বাড়ী ফিরতে দেরী হওয়ায় তাঁর মা উম্মু সুলাইম জিজ্ঞেস করলেন, এত দেরী হলো কেন? তিনি বললেন : রাসূলুল্লঅহর (সা) একটি গোপন কাজে গিয়েছিলাম। এজন্য ফিরতে দেরী হয়েছে। মা মনে করলেন, ছেলে হয়তো সত্য গোপন করছে। এজন্য জানতে চাইলেন : কী কাজ? আনাস জবাব দিলেন : একটি গোপন কথা, কাউকে বলা যাবে না। মা বললেন : তাহলে গোপনই রাখ কারও কাছে প্রকাশ করোনা। [আল-ফাতহুর রাব্বানী-২২/২০৪; হায়াতুস সাহাবা-১/৩৪৩; ২/৫০৩] হযরত আনাস আজীবন এ সত্য গোপন রেখেছেন।

এভাবে উম্মু সুলাইমের জীবনের অনেক কথা বিভিন্ন গ্রন্থে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যা খুবই শিক্ষাপ্রদ। তাঁর মৃত্যুসন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
উম্মু হারাম বিনত মিলহান (রা)
হযরত উম্মু হারাম (রা) এর আসল নাম জানা যায় না। এ তাঁর ডাকনাম এবং এ নামেই তিনি ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। তিনি মদীনার বিখ্যাত খাযরাজ গাত্রের নাজ্জার শাখার কন্যা। পিতা মিলহান ইবন খালিদ। মাতার দিক দিয়ে তিনি হযরত উম্মু সুলাইমের (রা) বোন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) খাদিম প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আনাস ইবন মালিকের খালা। আর দুধপানের দিক দিয়ে ছিলেন হযরত রাসূলে কারীমের (সা) খালা। [আস-সীরাহ্ আল-হালাবিয়্যা-৩/৭৩]

মদীনার নাজ্জার খান্দানের মিলহানের পরিবারটি ছিল একটি অতি সৌভাগ্যবান পরিবার। মদীনায় ইসলামী দা‘ওয়াতের সূচনালগ্নে এ পরিবারের সদস্যগণ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন। আল্লাহ ও রাসূলের (সা) গভীর প্রেম ও ভালোবাসা এ পরিবারের সদস্যবর্গের অন্তরের অন্তমূলে গেঁড়ে বসে। তাদের নারী-পুরুষ সকলে জিহাদ, জ্ঞানচর্চা, ইসলামের সেবায় জীবন দান, বদান্যতা প্রভৃতি কল্যাণমূলক কাজে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। মিলহানের দুই ছেলে হারাম ও সুলাইম (রা) বদর ও উহুদ যোদ্ধা ছিলেন। উভয়ে বি‘রে মা‘উনার অন্যতম সদস্য ছিলেন এবং সেখানে শাহাদাত বরণ করেন। হারাম ইবন মিলহানের (রা) জীবনের বড় কৃতিত্ব এই যে, তিনি তার ঘাতক জব্বার ইবন সুলামীকে মুসলমান বানিয়ে যেতে সক্ষম হন। ঘটনাটি সংক্ষেপে এই রকম: জব্বার ইবন সুলামী হারাম কে লক্ষ করে তীর নিক্ষেপ করলে তার বক্ষ ভেদ করে যায় এবং তিনি জোরে (আরবী**************)

উচ্চারণ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। বাক্যটির অর্থৎ “কা‘বার প্রভুর শপথ, আমি কামিয়াব হয়েছি। অর্থা শাহাদাত লাভে কামিয়াব হয়েছি। ঘাতক জব্বার যখন (আরবী *****) শব্দের অর্থ জানলো তখন তার মধ্যে ভাবান্তর হলো। সে তওবা করে ইসলামে দাখিল হয়ে গেল। হযরত হারাম ইবন মিলহানের (রা) জীবনের সর্বশেষ উচ্চারিত বাক্যটি হযরত জাব্বার ইবন সুলামীর (রা) ইসলাম গ্রহণের কারণ হয়ে যায়। [বুখারী: বাবুর রাজী; নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-৪২]

মদীনার যে সকল মহিয়সী নারী হযরত রাসূলে কারীমের (সা) সহচর্যে নিজেদের চারিত্রিক শোভা আরো উ**কর্ষমণ্ডিত করে তোলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মিলহানের দুই কন্যা উম্মু সুলাইম ও উম্মু হারাম। কেবল ‘আত-তাহযীব‘ গ্রন্হকার উল্লেখ করেছেন যে, উম্মু হারামের (রা) প্রথম স্বামী আমর ইবন কায়স আল-আনসারী। [আত-তাহযীব-১২/৪৬]। তবে অধিকাংশ গ্রন্হে তার স্বামীর নাম প্রখ্যাত সাহাবী হযরত উবাদা ইবন আস-সামিত উল্লেখ করা হয়েছে। ইবন সা‘দের ধারণা, ‘উবাদা ইবন আস-সামিত তার প্রথম স্বামী এবং তার ‍দ্বিতীয় স্বামী আমর ইবন কায়স। [তাবাকাত-৮/২৬৮]। তবে নির্ভরযোগ্য সীরাতের গ্রন্হাবলীর মাধ্যমে জানা যায় যে, উবাদা ইবন আর-সামিত (রা) তার সর্বশেষ স্বামী। [সাহাবিয়াত-২১০]। এই উবাদা (রা) একজন প্রথমপর্বের মহান আনসারী সাহাবী, আকাবার সদস্য, নাকীব, বদর-উহুদ-খন্দকের সাহসী মুজাহিদ এবং বাই‘আতু রিদওয়ানসহ উল্লেখযোগ্য সকল ঘটনার অংশীদার। হিজরী ৩৪ সনে ফিলিস্তীনের রামলায় ইন্তিকাল করেন। [তাহযীবুল আসমা‘ ওয়াল লুগাত-১/২৫৬, ২৫৭; আল-আ‘লাম-৩/২৫৮।]

হযরত রাসূলে কারীম (সা) মদীনার কেন্দ্রস্থল থেকে দুই মাইল (মু‘জামুল বুলদান-৪/৩০২) দূরে তাকওয়া ও খোদাভীত্তির উপর ভিত্তি করে যে মসজিদটি নির্মাণ করেন সেটি হলো- মাসজিদুল কুবা। এ মসজিদ সম্পর্কে নাযিল হয়েছে এ আয়াত:[সূরা আত-তওবা-১০৮; আস-সীরাত আল-হালাবিয়্যাহ্ -৩/৭৩] (আরবী***********) ‘যে মসজিদের ভিত্তি প্রথম দিন হতেই স্থাপিত হয়েছে তাকওয়ার উপর, তাই তোমার সালাতের জন্য অধিক যোগ্য‘

ইসলামের ইতিহাসে এ মসজিদের গুরুত্ব অপরিসীম। হযরত ইবন উমার (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা) বাহনে চড়ে অথবা পায়ে হেঁটে এ মসজিদে আসতেন এবং এখানে দুই রাকা‘য়াত নামায আদায় করতেন। [সহীহ মুসলিম-৪/১২৭] কুবার এই পবিত্র মসজিদের পাশে ছিল উম্মু হারামের পরিবারের বসবাস। রাসূল (সা) হযরত হারামকে (রা) যথেষ্ট মর্যাদা ও গুরুত্ব দিতেন। মাঝে মাঝে তার গৃহে যেতেন এবং দুপুরে বিশ্রামও নিতেন। [উসুদুল গাবা-৫/৫৭৪; আল-ইসতী‘আব-৪/৪২৪; আয-যাহাবী: তারীখ-৩/৩১৭; আল-ইসাবা-৪/৪৪১]। মাঝে মাঝে নামাযও আদায় করতেন। হযরত আনাস (রা) বলেন: একদিন নবী (সা) আমাদের নিকট আসলেন। তখন বাড়ীতে কেবল আমি, আমার মা (উম্মু সুলাইম) ও আমার খালা উম্মু হারাম ছিলেন। তিনি আমাদের লক্ষ করে বললেন: তোমরা এসো, আমি তোমাদের নিয়ে নামায আদায় করি। তখন কোন নামাযের ওয়াক্ত ছিল না। তিনি আমাদের নিয়ে নামায আদায় করলেন এবং আমাদের পরিবারের সকলের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কল্যান কমনা করে দু‘আ করলেন। (সহীহ মুসলিম-২/১২৮)। একবার রাসূল (সা) উম্মু হারামের (রা) গৃহে এলে তিনি খাবার তৈরী করে তাকে খাওয়ান। আহার শেষে একটু বিশ্রাম নিতে থাকেন, আর উম্মু হারাম (রা) রাসূলের (সা) মাথার চুল বিলি দিয়ে উকুন দেখতে শুরু করেন। এমতাবস্থায় রাসূলের (সা) একটু হালকা ঘুমের ভাব এসে যায়। একটু পরে জেগে উঠে মৃদু হেসে উম্মু হারামকে (রা) শাহাদাতের সুসংবাদ দান করেন। আর সেদিন থেকেই তাকে “আল-শাহীদা“ (মহিলা শহীদ) বলা হতে থাকে। রাসূল (সা) শাহাদাতের সুসংবাদ অপর যে মহিলাকে দান করেন তিনি হলেন উম্মু ওয়ারাকা আল-আনসারিয়্যা (রা)। উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহর (সা) দাদা আব্দুল মুত্তালিবের মা ছিলেন বানূ নাজ্জারের কন্যা। তাই উম্মু হারাম (রা) রাসুলুল্লাহর (সা) খালা সম্পর্কীয়া হওয়ার করাণে মাহরামা ছিলেন। আর তাই তিনি রাসূলের (সা) মাথা স্পর্শ করে উকুন খুঁটতে পেরেছেন। [নিসা‘মিন ‘আসর আন-নুবুওয়াহ-৪৪]

ইমাম আত-তিরমিযী হযরত আনাস ইবন মালেকের বর্ণনা সংকলন করেছেন। তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা) উম্মু হারামের গৃহে আসতেন এবং তিনি রাসূলকে (সা) আহার করাতেন। উম্মু হারাম ছিলেন ‘উবাদা ইবন আস-সামিতের স্ত্রী। একদিন রাসূল (সা) আসলেন। তাকে আহার করালেন। তারপর রাসূলের (সা) মাথার চুল বিলি দিয়ে উকুন দেখতে শুরু করলেন। রাসূল (সা) ঘুমিয়ে গেলেন। একটু পরে জাগলেন এবং মৃদু হাসলেন। উম্মু হারাম জিজ্ঞেস করলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! হাসলেন কেন? বললেন: ঘুমের মধ্যে আমাকে দেখানো হলো, আমার উম্মতের কিছু লোক জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর উদ্দেশ্যে সাগর পাড়ি দেওয়ার জন্য জলযানে আরোহী হয়েছে। উম্মু হারাম আরজ করলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহ যেন আমাকেও তাদের অন্তর্ভূক্ত করেন সে জন্য আল্লাহর নিকট দু‘য়া করুন।

এরপর রাসূল (সা) মাথা রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর মৃদু হাসতে হাসতে জেগে উঠলেন। উম্মু হারাম আবার প্রশ্ন করলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! হাসছেন কেন? জবাবে রাসূল (সা) পূর্বের কথাটি বললেন। উম্মু হারামও আগের মত আরজ করলেন। এবার রাসূল (সা) বললেন: (আরবী**********) তুমি প্রথম দলের অন্তর্ভূক্ত।

সময় গড়িয়ে চললো। রাসূলুল্লাহ (সা) ইনতেকাল করলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় খলীফা আবূ বকর ও উমার (রা) একে একে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। ইসলামী খিলাফতের সীমা সরহদের দারুণ বিস্তার ঘটলো। তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রা) খিলাফতের মসনদে আসীন। সিরিয়ার আমীর হযরত মু‘আবিয়া ইবন আবী সুফইয়ান (রা) খলীফার নিকট সাগর দ্বীপ কুবরুস (সাইপ্রাস) অভিযানের অনুমতি চাইলেন। উল্লেখ্য যে, এ সময় কুবরুস ছিল বাইজান্টাইন রোমান শাসিত একটি দ্বীপ। ইতিপূর্বে মুসলমানদের যেমন কোন নৌ-বাহিনী ছিল না তেমনি ছিল না জলপথে অভিযানের কোন অভিজ্ঞতা। তাই আমীর মু‘আবিয়ার (রা) আবেদনের প্রেক্ষিতে হযরত উসমান (রা) মজলিসে শূরার বৈঠক আহ্বান করলেন। দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনার পর নৌ-বাহিনী গঠন ও জলপথে কুবরুস অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়। এটাই ছিল মুসলমানদের নৌপথে প্রথম অভিযান। তাই দারুণ কতর্কতা অবলম্বন করা হয়।

মজলিসে শূরার সিদ্ধান্ত মুতাবিক হযরত উসমান (রা) হিজরী ২৭ সনে সাগর পাড়ি দিয়ে কুবরুস অভিযানের নির্দেশ দেন। হযরত ম‘আবিয়া (রা) একটি নৌ-বাহিনী গঠন করেন। এই নৌবাহিনীতে হযরত আবূ যার আল-গিফারী (রা), আবুদ দারদা (রা), উবাদা ইবন আস-সামিত (রা) প্রমুখের মত বহু উচু স্তরের সাহাবীকে অন্তর্ভূক্ত করেন।

যেদিন রাসূল (সা) উম্মু হারামকে নৌ-যুদ্ধে অংশ গ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণী করেন এবং যেদিন তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) মুখে একথা শোনেন: (আরবি***********) “আমার উম্মতের প্রথম একটি বাহিনী সাগর পথে যদ্ধ করবে, তারা নিজেদের জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে নিবে। উম্মু হারাম, তুমিও তাদের মধ্যে থাকবে। [বুখারী : আল জিহাদ; হিলয়াতুল আওলিয়া ওয়া তাবাকাত আল-মাশাহীর ওয়াল আল-আ‘লাম-২/৬১; তারিখু ‍দিমাশক- ৪৮৬ [তারাজিম আন-নিসা]

সেদিন থেকে হযরত উম্মু হারাম (রা) এমন একটি নৌ-অভিযানের প্রতিক্ষায় ছিলেন। দীর্ঘদিন সে সুযোগ এসে গেল। তিনি স্বামী উবাদা ইবন আস-সামিতের (রা) সংগে জিহাদে বেরিয়ে পড়লেন। তরঙ্গ-বিক্ষুদ্ধ সাগর পাড়ি দিয়ে মুসলিম বাহিনী কুবরুস অবতরণ করে এবং রোমান বাহিনী কে তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে ইসলামী পতাকা উড্ডিন করেন। মূলত যুদ্ধ ছাড়াই কেবল সন্ধির মা্ধ্যমে কুবরুস বিজিত হয়।

কুবরুস বিজয় শেষে বাহিনী যখন মূল ভূমিতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন একদিন উম্মু হারাম (রা) একটি বাহন পশুর পিঠে চড়তে গিয়ে পড়ে যান। ভীষণ আঘাত পান এবং সেই আঘাতে সেখানে ইন্তেকাল করেন। সাগর দ্বীপ কুবরুসের মাটিতেই তাকে দাফন করা হয়। [ সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং- ১৬৪৫; দালায়িল আন-নুবুওয়াহ-২/৭১২; নাসাবু কুরায়শ-১২৪-১২৫]

হিশাম ইবন আল-গায বলেন: উম্মু হারাম বিনতে মিলহানের কবর কুবরুসে। স্থানীয় জনসাধারণ বলে থাকে : এ হচ্ছে একজন স**কর্মশীল মহিলার কবর। [তারিখু দিমাশক-৪৯৬ (তারাজিম আন-নিসা)] তিনি আরো বলেছেন : আমি হিজরী ৯১ সনে বাকাকীস সাগর উপকূলে তার কবর দেখেছি এবং তার পাশে দাড়িঁয়েছি। আজো সেখানে বিভিন্ন মহাদেশের অসংখ্য মানুষের ভীড় জমে। [নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-৪৭]

হযরত উম্মু হারাম (রা) ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মহিলা নৌ-যোদ্ধা। তিনি প্রথম মহিলা সাহাবী নৌ-সেনা যিনি যুদ্ধের উদ্দেশ্যে শ্বেতসাগর পাড়ি দিয়েছেন।

হাদীস বর্ণনা

হযরত উম্মু হারাম (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীস বর্ণনা করেছেন। তার থেকে মোট পাঁচটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সে সব হাদীস উচু স্তরের অনেক সাহাবী ও তাবি‘ঈ বর্ণনা করেছেন। যেমন : আনাস ইবন মালিক (রা), আমর ইবন আসওয়াদ (রা), উবাদা ইবন আস-সামিত (রা), আতা ইবন ইয়াসার, ইয়ালা ইবন শাদ্দাদ ইবন আওস (রা) প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।

তিনি তিন ছেলে- কায়েস, আব্দল্লাহ ও মুহাম্মদকে রেখে যান। প্রথম দুইজন প্রথম স্বামীর এবং শেষের জন উবাদা ইবন আস-সামিতের (রা)। [তাবাকাত-৮/৩১৮; আল-ইসাবা-৪/৪৪২]
ফাতিমা বিনত কায়স আল-ফিহরিয়্যা (রা)
হযরত ফাতিমার (রা) পিতা কায়স ইবন খালিদ এবং মাতা উমাইমা বিনত রাবী‘আ। ভাই দাহহক ইবন কায়স। ফাতিমা দাহহাকের দশ বছরের বড় ছিলেন। ফাতিমার মা উমাইমা ছিলেন বানূ কিনানার মেয়ে। আবু আমর হাফস-ইবন মুগীরার সাথে তার প্রথম বিয়ে হয়। [আল-ইসতীয়াব-৪/৩৮৩ (আল-ইসাবার পার্শ্বটিকা) : তাবাকাত-৮/২৭৩] মক্কায় ইসলামী দা‘ওয়াতের প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহন করেন এবং মহিলারা যখন মক্কা থেকে হিজরাত করতে শুরু করে, তিনিও হিজরত করেন। [উসুদুল গাবা-৫/৫২৬]

হিজরী ১০ সনে হযরত আলীর (রা) নেতৃত্বে একটি বাহিনী ইয়ামনের দিকে পাঠানো হয়। ফাতিমার স্বামী আবু আমরও এ বাহিনীর একজন সদস্য ছিলেন। পূর্বেই আমর ফাতিমাকে দুই তালাক দান করেছিলেন এখন মদীনা থেকে যাত্রাকালে তাদের বিয়ের উকিল আয়্যাশ ইবন রাবী‘আর (রা) মাধ্যমে তৃতীয় তালাকের খবরটি তাকে পৌছে দেন। আর সেই সাথে পাঁচ সা‘ যব ও পাঁচ সা‘ খুরমাও তার খোরাকি হিসেবে পাঠান। ফাতিমা যখন ‘আয়্যাশের নিকট তার খোরপোষ ও থাকার জন্য ঘরের দাবী জানালেন তখন তিনি বললেন : তোমার স্বামী শুধু এই খুরমাগুলি ও যবটুকু পাঠিয়েছেন। এছাড়া আমাদের কাছে আর কিছু নেই। আর এই যতটুকু দেওয়া হলো তাও শুধু অনুগ্রহ ও সহমর্মিতা স্বরূপ। অন্যথায় আমাদের কাছে তোমার আর কোন কিছুর অধিকার নেই।

আয়্যাশের এমন কথা ফাতিমা মেনে নিতে পারলেন না। তিনি নিজের কাপড়-চোপড় বেঁধে সোজা রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমতে হাজির হলেন। খালিদ ইবন ওয়ালিদসহ আরো কিছু লোক সেখানে উপস্থিত হলেন। ফাতিমা তার সব ঘটনা বর্ণনা করলেন। রাসূল (সা) জানতে চাইলেন : আবু আমর তোমাকে কতবার তালাক দিয়েছে? বললেন : তিনবার। রাসূল (সা) বললেন- তাহলে এখন তোমার খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আবু আমরের নেই। এখন তুমি শুরাইকের নিকট অবস্থান করে তোমার ইদ্দত পূর্ণ কর। কিন্তু উম্মু শুরাইকের বাড়ীতে তার আত্মীয়-পরিজন ছিল, তাই তিনি আবার বললেন : ইবন মাকতুম একজন অন্ধ মানুষ। আর সে তোমার চাচাতো ভাই। তাই তার ওখানে থেকে তোমার ইদ্দত পূর্ণ করাই ভাল।

হযরত ফাতিমা রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশ মুতাবিক ইবন মাকতুমের বাড়িতে থাকতে লাগলেন। ইদ্দত পালন শেষে হওয়ার পর চারদিক থেকে বিয়ের পয়গাম আসতে লাগলো। তার মধ্যে মু‘আবিয়া ইবন আবী সুফইয়ান, আবু জাহম ও উসামা ইবন যায়েদের পয়গামও ছিল। ফাতিমা (রা) এসব পয়গামের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে পরামর্শ করলেন। রাসূল (সা) বললেন : মু‘আবিয়া একজন বিত্তহীন মানষ, তার তেমন কিছু নেই, আর আবু হাজম একজন ঝগড়াটে ও রুক্ষ্ম মেজাজের লোক। উসামা ইবন যায়েদ এ দুজনের চেয়ে ভালো। তুমি তাকে বিয়ে কর। ফাতিমার ধারণা ছিল স্বয়ং রাসূল (সা) তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দান করবেন। এ কারণে তিনি উসামা কে বিয়ে করার ব্যাপারে ইতস্তত করতে থাকেন। তার এ অবস্থা দেথে রাসূল (সা) তাকে বললেন তাকে বিয়ে করতে আপত্তি কিসে? আল্লাহ ও তার রাসূলের (সা) আনুগত্য কর। তাতে তোমার জন্য কল্যান আছে। রাসূলুল্লাহর (সা) এমন কথায় ফাতিমা (রা) উসামা ইবন যায়েদকে বিয়ে করেন। ফাতিমা (রা) পরবর্তীকালে বলতেন, আমার এ বিয়ের পর আমি মানুষের ঈর্ষার পাত্রীতে পরিণত হই। [সহীহ মুসলিম-১/৪৮৩; মুসনাদ-৬/৪১১-৪১৪; তাবাকাত-৮/২৭৪-২৭৫]

হিজরী ২৩ সনে খলীফা হযরত উমারের (রা) ওফাতের পর মজলিশে শূরার অধিবেশন ফাতিমার (রা) বাড়িতে বসতো। [আল-ইসতিআব-৪/৩৮৩; উসুদুল গাবা-৫/৫২৭] হিজরী ৫৪ সনে স্বামী উসামার (রা) ইন্তেকাল হয়। স্বামী বিচ্ছেদ বেদনায় তিনি বেশ কাতর হয়ে পড়েন। বিধবা হিসেবে বাকি জীবন ভাই দাহহাকের সংসারে কাটিয়ে দেন। পরবর্তীকালে ইয়াযীদ ইবন মু‘আবিয়া (রা) তার খিলাফতকালে দাহহাক ইবন কায়েসকে ইরাকের গভর্নর নিয়োগ করলে ফাতিমা তার কুফায় চলে যান এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। [উসুদুল গাবা-৫/৫২৬] মৃত্যু সন সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়েরর (রা) খিলাফতকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। [সহীহ মুসলিম১/৪৮৫]

তিনি ছিলেন একজন রূপবতী মহিলা। [আল-ইসাবা-৪/৩৮৪] সেই সাথে তিনি ছিলেন একজন তীক্ষ্ণ মেধা, বুদ্ধিমত্তা, উন্নত সাংস্কৃতিক রুচি, সঠিক মতামত ও চিন্তা-চেতনার অধিকারিণী পূর্ণ মানের নারী। [উসুদুল গাবা-৫/৫২৬]

হযরত সা‘ঈদ ইবন যায়দের মেয়ে ছিলেন ‘আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন উছমানের স্ত্রী। ফাতিমা (রা) ছিলেন মেয়েটির খালা। আবদুল্লাহ তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিলেন। ফাতিমা মেয়েটিকে তার কাছে চলে আসতে বললেন। মারওয়ান এ কথা জানতে পেরে কুবায়সাকে তার নিকট পাঠালেন। কুবায়সা ফাতিমার নিকট এসে বললেন, আপনি একজন মহিলাকে তার ইদ্দত কাল পূর্ণ হওয়ার আগে কিভাবে ঘর থেকে বের করছেন? জবাবে তিনি বললেন, এটা এজন্য যে, রাসূল (সা) আমাকে এমন আদেশই করেছিলেন। তারপর তিনি নিজের জীবনের ঘটনাটি বর্ণনা করেন এবং তার সমর্থনে কুরআনের নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেন। (আরবী**********) [সূরা আত-তালাক, আয়াত-১-২] এতটুকু পাঠ করার পর বলেন, এ পর্যন্ত হলো তালাকে রিজ‘ঈ বা ফিরিয়ে নেয়ার তালাকের অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত। তার পরেই এসেছে : (আরবী*********) “তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে চাও তখন তাদেরকে তালাক দিয়ো ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং ইদ্দত গননা কর। তোমরা তোমাদের পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করো। তাদেরকে তাদের ঘর থেকে বের করে ‍দিও না। ‍যদি না তারা সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কাজে লিপ্ত হয়। অতপর তারা যখন তাদের ইদ্দতকালে পৌছে, তখন তাদেরকে যথোপযুক্ত পন্থায় রেখে দেবে অথবা যথোপযুক্ত পন্থায় ছেড়ে দিবে।“

এই শেষোক্ত আয়াতের ভিত্তিতে তিন তালাকের পরে কোন অবস্থায় সম্ভাবনা অবশিষ্ট নেই। তারপর তিনি বলেন, যেহেতু আমাদের নিকট এ অবস্থায় স্ত্রী সন্তান সম্ভাবা না হলে কোন খোরপোষ না দেওয়া উচিত, এ কারণে তাকে আর আটকে রাখার কোন অর্থ হয় না। [সহীহ বুখারী-৯/৪২১-৪২২; সহীহ মুসলিম, তালাক অধ্যায়, হাদীস নং-১৪৮০; আবু দাউদ, তালাক হাদীস নং-২২৮৪; তিরমিযী, নিকাহ, হাদীস নং-১১৩৫; মুওয়াত্তা ইমাম মালিক-১/৯৮; মুসনাদ-৬/৪১৫-৪১৬]

হযরত ফাতিমা বিনত কায়েস (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) কয়েকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তার থেকে যারা এ হাদীসগুলি শুনে বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ হলেন : কাসিম ইবন মুহাম্মদ, আবু বাকর ইবন আবু জাহম, আবু সালমা, সা‘ঈদ ইবন মুসায়্যিব, উরওয়া, আবদুল্লাহ ইবন আবদিল্লাহ, আসওয়াদ, সুলায়মান ইবন ইয়াসার, আবদুল্লাহ আল বাহী, মুহাম্মদ ইবন আবদির রহমান ইবন ছাওবান, শা‘বী, আবদুর রহমান ইবন আসিম ও তামীম। [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/৩১৯; আল-ইসতি‘আব-৪/৩৮৩; সাহাবিয়াত-১৮০]

হযরত ফাতিমা (রা) ছিলেন অতি মার্জিত, রুচিশীল ও ভদ্র স্বভাবের মহিলা। বিখ্যাত তাবি‘ঈ ইমাম শা‘বী ছিলেন তার শাগরিদ। একবার তিনি ফাতিমার সাথে দেখা করতে এরেন। ফাতিমা (রা) তাকে খুরমা খেতে দেন ও ছাতু গুলিয়ে পান করান। [সহীহ মুসলিম-১/৪৮৪]
ফাতিমা বিন্‌ত খাত্তাব (রা)
হযরত ফাতিমার (রা) পিতা আল-খাত্তাব ইবন নুফায়ল। মক্কার কুরাইশ গোত্রের আল-আদাবী শাখার সন্তান। মাতা হানতামা বিনত হাশিম ইবন আল-মুগীরা কুরাইশ গোত্রের আল-মাখযুমী শাখার কন্যা। [ইবন সা‘দ, তাবাকাত-৮/২৬৭; আল-ইসাবা-৪/৩৭০] ফাতিমার (রা) সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো, তিনি হযরত উমার ইবন আল-খাত্তাবের (রা) সহোদরা এবং হযরত সা‘ঈদ ইবন যায়েদের (রা) সহধর্মিনী। তার ডাক নাম উম্মু জামীল। [উসুদুর গাবা-৫/৫১৯; আল-ইসতী‘য়াব-৪/৩৭০] মক্কায় ইসলামের সেই সূচনা পর্বে রাসূলুল্লহর (সা) আল-আরকাম ইবন আবিল আরকামের (রা) গৃহে অবস্থান গ্রহণের পূর্বে হাতে গোনা যে কয়েকজন নর-নারী ইসলাম গ্রহন করেন এই ফাতিমা (রা) ও তার স্বামী তাদের অন্তর্ভূক্ত। [তাবাকাত-৮/২৬৭; নিসা‘মিন আসর আন-নুবুয়াহ-৪৬২]

ফাতিমা ছিলেন একজন প্রখর বুদ্ধিমতী, দূরদৃষ্টিসম্পন্না, স্বচ্ছ স্বভাব-প্রকৃতি ও পরিচ্ছন্ন অন্তকরণ বিশিষ্ট মহিলা। তার ইমান এত মজবুদ ছিল যে, সেখানে সন্দেহ-সংশয়ের লেশমাত্র স্থান লাভ করতে পারেনি। বর্ণিত হয়েছে, হযরত খাদীজার (রা) পরে মহিলাদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহন করেন যথাক্রমে আব্বাস ইবন আবদিল মত্তালিবের (রা) স্ত্রী উম্মুল ফাদল, হযরত আবু বকরের (রা) কন্যা আসমা (রা) ও খাত্তাবের কন্যা ফাতিমা (রা)। [আস-সীরাতুল হালাবিয়্যাহ-১/৪৪৫] ইবন হিশাম মক্কায় প্রথম পর্বে আটজন ইসলাম গ্রহনকারীর নাম উল্লেখ করার পর যে দশজন নারী-পুরুষের ইসলাম গ্রহণের বিষয় আলোচনা করেছেন তাদের মধ্যে সা‘ঈদ ইবন যায়দ ও তার স্ত্রী ফাতিমার (রা) নামও আছে। [সীরাত ইবন হিশাম-১/২৫২-২৫৪]

মক্কার কুরাইশ পৌত্তলিকরা মুসলমানদের উপর নানা ভাবে অত্যাচার চালাতো। উমার ইবন আল-খাত্তাব (রা) তার বোন ফাতিমা (রা) ইসলাম গ্রহণের কারণে তার উপরও অত্যাচার চালান। তিনি অন্য মুসলামনদের উপরও অত্যাচার চালাতেন। কিন্তু তার বোন ফাতিমা তার মধ্যে অনুশোচনার সৃষ্টি করেন এবং তাকে ইসলামের দিকে টেনে আনেন।

ইসলামের অভ্যুদয়ের আগেই মক্কার কুরাইশ গোত্রের সা‘ঈদ ইবন যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়লের সাথে ফাতিমার (রা) বিয়ে হয়। সা‘ঈদ মদীনায় হিজরত করেন এবং বদরসহ সকল অভিযানে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে অংশগ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) কর্তৃক জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সৌভাগ্যবান দশজনের অন্যতম। হিজরী ৫১ সনে তিনি মদীনায় ইন্তেকাল করেন। [আল-আ‘লাম-৩/১৪৬; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-১/১২৪] বর্ণেত হয়েছে যে, স্বামী-স্ত্রী দু‘জন একসাথে ইসলাম গ্রহন করেন। আবার এ কথাও বর্ণিত হেয়েছে যে, ফাতিমা তার স্বামীর আগেই মুসলমান হন। [আল-ইসতীয়াব, আল-ইসাবার পার্শ্বটীকা-৪/৩৮৩]

ফাতিমা ও উমারের (রা) ইসলাম গ্রহণ

নির্ভরযোগ্য প্রাচীন সূত্রসমূহে হযরত উমারের (রা) ইসলাম গ্রহণের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ বিভিন্ন বর্ণনার মাধ্যমে এসেছে। এখানে সে সব বর্ণনার সারকথা উপস্থাপন করা হলো।

রুক্ষ মেজাজ, কঠোর স্বভাব ও রাসূলুল্লাহর (সা) প্রতি চরম শত্রুতামূলক মনোভাবের জন্য উমার প্রসিদ্ধ ছিলেন। একদিন তিনি রাসূলুল্লাহকে (সা) হত্যার উদ্দেশ্যে তসবারী কঁধে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হলেন।

পথে নু‘আইন ইবন আবুদিল্লাহ আন-নাহহামের সাথে দেখা হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : উমার! কোন দিকে যাওয়া হচ্ছে? ‍উমার জবাব ‍দিলেন : মুহাম্মদকে হত্যা করতে যাচ্ছি। নু‘আইম : মুহাম্মদকে হত্যা করলে বানূ হাশিম ও বানূ যাহরা কি তোমাকে ছেড়ে দিবে? উমার : মনে হচ্ছে তুমিও তোমার পূর্বপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে বিধর্মী হয়ে গিয়েছো। নু‘আইম : উমার! আমি কি তোমাকে একটি অবাক হবার মতো কথা শোনাবো? তোমার বোন ও বোনের স্বামী দু‘জনই ইসলাম গ্রহন করে তুমি যে ধর্মে আছো তা ত্যাগ করেছে। উমার (রা) একথা শুনে রাগে ক্ষেভে উত্তেজিত অবস্থায় বোন-ভগ্নিপতির বাড়ীর পথ ধরেন। তাদের ওখানে তখন হযরত খাব্বাব ইবন আল-আরাত (রা) ছিলেন। তার সংগে ছিল “সূরা তাহা“ লিখিত একটি পুস্তিকা। তিনি তাদের দু‘জনকে এই সূরাটি শেখাচ্ছিলেন। তারা যখন উমারের (রা) উপস্থিতি টের পেলেন তখন খাব্বাব (রা) বাড়ীর এক কোণে আত্মগোপন করলেন। ফাতিমা পুস্তিকাটি লুকিয়ে ফেললেন। খাব্বাব যে তাদেরকে কুরআন শিখাচ্ছিলেন, উমার (রা) তা বাড়ীর কাছাকাছি এসে শুনতে পেয়েছিলেন। তাই তিনি ঘরে ঢুকেই প্রশ্ন করেন : তোমাদের এখানে যে গুনগুন আওয়াজ শুনতে পেলাম তা কিসের? তারা বললেন : আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলাম। উমার বললেন : সম্ভবত তোমরা ধর্মত্যাগী হয়েছো। আমি জেনেছি তোমরা মুহাম্মদের ধর্মের অনুসারী হয়ে গিয়েছো। ভগ্নিপতি সা‘ঈদ (রা) বললেন : উমার! সত্য যদি তোমার নিজের ধর্মের বাইরে অন্য কোথাও থাকে তাহলে তুমি কি করবে? এবার উমার (রা) নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারলেন না। সা‘ঈদের (রা) উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তাকে কিল-ঘুষি মারতে মারতে মাটিতে ফেলে দিয়ে দুপায়ে দলতে লাগলেন। ফাতিমা তার স্বামীর উপর চড়ে বসা উমার কে সরিয়ে দিলেন। কিন্তু উমার (রা) ফাতিমার (রা) মুখমণ্ডলে এমন এক ঘুষি মারেন যে, তার মুখটি রক্তে ভিজে যায়। এ অবস্থায় ফাতিমা বলেন : উমার! সত্য তোমার ধর্মের বাইরে অন্যত্র রয়েছে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। আরো দিচ্ছি মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রাসূল। আমি তো ইসলাম গ্রহন করেই ফেলেছি। এখন তোমার ভয়ে এর থেকে বেরিয়ে আসার কোন সুযোগ নেই।

বোনের রক্তভেজা মুখ দেখে উমার (রা) আতকে উঠলেন। লজ্জিত ও অনুতপ্ত হলেন। বললেন : ঠিক আছে, তোমরা যে পুস্তকটি পড়ছিলে সেটা আমাকে একটু দও, আমি পড়ে দেখি। উমার লিখতে পড়তে জানতেন। বোন তার ভাই উমারের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে দারুণ আগ্রহী ছিলেন। তুমি তো একজন অপবিত্র মানুষ। আর এটা পবিত্র ব্যক্তিরা ছাড়া স্পর্শ করতে পারেনা। ওঠো গোসল করে এসো। সুবোখ বালকটির মত উমার উঠে গেলেন এবং গোসল করে ফিরে এসে পুস্তিকাটি হাতে নিয়ে পাঠ করলেন : (আরবী*********) -পরম করুণাময় দয়াময় আল্লাহর নামে- এতটুকু পড়ে তিনি মন্তব্য করলেন : অতি সুন্দর পবিত্র নাম সমূহ। তারপর পাঠ করলেন : (আরবী *********) থেকে এ আয়াত পর্যন্ত : [সূরা ত্বাহা-১৪] (আরবী******) “আমিই আল্লাহ, আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। অতএব আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে নামায কয়েম কর।“

এরপর তিনি উত্ফুল্ল চিত্তে বলে উঠলেন : এ তো অতি চমত্কার মহিমান্বিত কথা! মুহাম্মদ কোথায়, আমাকে তার কাছে নিয়ে চলো।

উমারের (রা) এ আহ্বান শুনে খাব্বাব ইবন আল-আরাত (রা) কাছে ছুটে আসেন। উমারকে লক্ষ করে বলেন : উমার! তোমার জন্য সুসংবাদ! আমি আশা করি রাসূলুল্লাহ (সা) গত বৃহস্পতিবারে যে দুয়াটি করেছিলেন তা তোমার ক্ষেত্রে কবুল হয়েছে। সেই দু‘আটি ছিল এই- (আরবী**************) “হে আল্লাহ! উমার ইবন খাত্তাব অথবা আবূ জাহল ইবন হিশামের দ্বারা আপনি ইসলামকে শক্তিশালী করুন।“ খাব্বাব (রা) আরো অবহিত করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) এখন সাফা পাহাড়ের পাদদেশে আল-আরকামের গৃহে আছেন।

অতপর উমার (রা) সাফা পাহাড়ের সন্নিকটে আরকামের (রা) গৃহে পৌছলেন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে ইসলাম গ্রহণের ঘোষাণা দিলেন। [ঘটনাটি বস্তারিত জানার জন্য দ্র: সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩৪৩-৩৪৫; তাবাকাত-৩/২৬৭-২৬৮; উসুদুল গাবা-৪/৫২-৫৩; সিফাতুস সাফওয়া-১/২৬৯-২৭১; আ‘লাম আন-নিসা-৪/৫০; আয-যাহাবী, তারীখ-১/১৭৪-১৭৫]

ফাতিমা (রা) আপন ভাইয়ের হাতে মার খেয়েও ভাইকে ইসলামের মধ্যে নিয়ে আসতে পারায় দারুণ খুশী হলেন। মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের আদেশ হলে ফাতিমা ও তার স্বামী সা‘ঈদ ইবন যায়দ (রা) প্রথম পর্বে হিজরতকারীদের সাথে মদীনায় চলে যান। [আল-ইসতীয়াব-২/৫৫৩] সেখানে তিনি অন্যান্য মুসলিম নারীদের সাথে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে সাধ্যমত অংশগ্রহণ করেন।

ইবনুল জাওযী (রহ) বলেছেন, ফাতিমা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তবে কতগুলো তা নির্ধারণ করা যায় না। হাদীসের সহীহ গ্রন্থসমূহে তার বর্ণিত কোন হাদীস দেখা যায় না। [নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-৪৬৮] ইবন হাজার (রহ) তার এই হাদীসটি বর্ণনা করেছন। (আরবী****************)[আল ইসাবা-৪/৩৮১]

“আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) একথা বলতে শুনেছি যে, যতদিন পর্যন্ত ফাসিক আলিম, জাহিলকারী ও স্বৈরাচারী শাসকদের মাধ্যমে আমার উম্মতের মধ্যে দুনিয়া-প্রীতির প্রকাশ না ঘটবে ততদিন তারা শুভ ও কল্যাণের মধ্যে থাকবে। আর যখন তাদের মধ্যে দুনিয়া-প্রীতির প্রকাশ ঘটবে, আমার আশঙ্কা হয় আল্লাহ তখন তাদের উপর শাস্তি ব্যাপক করে ‍দিবেন।“

“আদ-দুররুল মানছুর“ গ্রন্থে তার মহত্ব ও মর্যাদার কথা বলা হয়েছে এভাবে : (আরবী*******) [আদ-দুররুল মানছুর-৩৬৪]

“তিনি ছিলেন একজন সুসাহিত্যিক, বিদূষী, বুদ্ধিমতী মহিলা। মৃত্যুকালে চার ছেলে রেখে যান। শুভ ও কল্যাণকে ভালোবাসতেন, অশুভ ও অকল্যাণকে ঘৃণা করতেন, সত্কাজের আদেশ করতেন, অসৎ কাজ করতে নিষেধ করতেন।“

হযরত উমারের (রা) খিলাফতকালে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে চার ছেলে রেখে যান। তারা হলেন : আবদুল্লাহ, আবদুর রহমান, আযইয়াদ ও আসওয়াদ। [প্রাগুক্ত]
ফাতিমা বিন্‌ত আল-আসাদ (রা)
তিনি ছিলেন একজন মহিয়সী সাহাবীয়া যিনি রাসূলুল্লাহকে (সা) এমনভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করেন যেমন একজন মানুষের বুক তার অন্তরকে এবং চোখের পাঁপড়ি চোখ দুটিকে রক্ষা করে। তিনি রাসূলুল্লাহকে (সা) এমন ভালোবাসতেন যেমন ভালোবাসে একজন মমতাময়ী মা তার একমাত্র সন্তানকে। ইসলামের প্রথম পর্বের ইতিহাসের যে সকল মহিয়সী মহিলার অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়েছে তাদের মধ্যে এই মহিলার নামটিও বিদ্যমান। তিনি অনেক মহত্ব ও মর্যাদার অধিকারিণী। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা) এর দাদা আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যুর তিনি তার লালন-পালনের সুযোগ লাভে ধন্য হন। তিনি ছিলেন ইসলামের চতুর্থ খলীফা ও রাসূলুল্লাহর (সা) একজন অন্যতম শ্রেষ্ট অশ্বারোহী বীর সৈনিক সাহাবী আলী ইবন আবী তালিবের (রা) গর্বিত মা। তিনি ছিলেন জান্নাতের অধিকারী যুবকদের দু‘নেতা হযরত হাসান ও হুসায়নর (রা) দাদী। মহান ম‘তার যুদ্ধের শহীদত্রয়ীর অন্যতম জ‘ফার আত-তায়্যারের (রা) মা। সর্বোপরি তিনি ছিলেন রাসূলুল্লহর (সা) প্রিয়তমা কন্যা, হাসান-হুসায়নের (রা) জননী হযরত ফাতিমা আয-যাহরার (রা) শ্বাশুড়ী। ইমাম শমসুদ্দিন আয-যাহবী (রহ) তার পরিচয় দিয়েছেন এভাবে : (আরবী*************) [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/১১৮]

ফাতিমার পিতার নাম আসাদ। পিতামহ হাশিম, প্রপিতামহ আবদি মান্নাফ ইবন কুসায়। তিনি কুরায়শ গোত্রের হাশিমী শাখার কন্যা এবং আলী ইবন আবী তালিবের মা। পিতামহ হাশিমে গিয়ে তার বংশধারা রাসূলুল্লাহর (সা) বংশধারার সাথে মিলিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহর (সা) দাদা আবদুল মুত্তালিব ছিলেন একদিকে তার শ্বশুর এবং অন্য দিকে চাচা। প্রথম পর্বে মক্কা থেকে যে সকল মহিলা মদীনায় হিজরাত করেন তিনি তাদের একজন।

রাসূলুল্লাহর (সা) দাদা আবদুল মুত্তালিব যখন বুঝতে পারলেন যে, তার জীবন সন্ধা ঘনিয়ে এসেছে তখন তিনি ছেলে আবূ তালিবকে ডেকে তার ইয়াতিম ভাতিজা মুহাম্মদ ইবন আবদিল্লাহর লালন-পালানের ভার তার উপর অর্পণ করেন। তিনি চান যেন তার ইয়াতিম পৌত্রটি আবূ তালিব ও তার স্ত্রী ফাতিমা বিনত আসাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠে। তিনি তাদেরকে মুহাম্মদের প্রতি বিশেষ যত্নবান হতে তাগিদ দেন। আর সেই থেকে বালক মুহাম্মদ তার চাচা-চাচী আবূ তালিব ও ফাতিমার (রা) সংসারের সাথে যুক্ত হন। ফাতিমা তার স্বামীর সাথে একযোগে মুহাম্মদের তত্ত্বাবধান ও প্রতিপালনে মনোযোগী হন। বালক তার মুহাম্মদ তার পরিবারে যুক্ত হওয়ার পর তিনি দেখতে পান, তার ছেলে-মেয়েরা যখন মুহাম্মদের সাথে আহার করে তখন তাদের খাবারে দারুণ বরকত হয়। আবূ তালিবের ছিলো অনেক গুলো ছেলে-মেয়ে। নিতান্ত অভাবী মানুষ। প্রতিবেলা তার পরিবারের জন্য যে খাদ্য-খাবারের ব্যবস্থা করা হতো তা সবাই এক সাথে অথবা পৃথকভাবে খেলে সবার পেট ভরতো না। কিন্তু যখন তাদের সাথে মুহাম্মদ খেতেন তখন সবারই পেট ভরে যেত। এ কারণে ছেলে-মেয়েরা যখন খেতে বসতো তখন আবূ তালিব বলতেন : “তোমরা একটু অপেক্ষা করো, আমার ছেলে মুহাম্মদ আসুক।“ তিনি আসতেন, এক সাথে খেতেন এবং তাদের খাবার বেঁচে যেত। এক পেয়েলা দুধ থেকে তিনি প্রথমে পান করলে তারা সবাই তৃপ্ত হয়ে যেত- যদিও তাদের একজনই সেই পূর্ণ পেয়ালাটি শেষ করে ফেলতে পারতো। তাই আবূ তালিব তাকে বলতেন : তুমি বড় বরকতময় ছেলে।

সাধারণত শিশু-কিশোররা উসকো-খুশকো ও ধুলি-মলিন থকে, কিন্তু মুহাম্মদ (সা) সবসময় তেল-সুরমা লাগিয়ে পরিপাটি অবস্থায় থাকতেন। [সীরাতু ইবন হিশাম-১/১২০] ফাতিমা বিনত আসাদ এ সবকিছু ‍দেখতেন। আর এতে মুহাম্মদের (সা) প্রতি স্নেহ-মমতা আরো বেড়ে যেত। তার প্রতি আরো যত্নবান হতেন। এভাবে তাকে শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত, তথা হযরত খাদীজার (রা) সাথে বিয়ের আগ পর্যন্ত নিজের সন্তানের থেকেও অধিক স্নেহ-মমতা দিয়ে লালন-পালন করেন। সব রকমের অশুভ ও অকল্যাণ থেকে আঁচলে লুকিয়ে রাখার মত তাকে আগলে রাখেন। এ কারণে নবী (সা) সারা জীবন চাচী ফাতিমা বিনত আসাদের মধ্যে নিজের মা আমিনা বিনত ওহাবের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতেন। তাকে গর্ভধারিণী মায়ের পরে দ্বিতীয় মা বলে মনে করতেন।

হযরত ফাতিমা বিনত আসাদ (রা) মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে লোকেরা যা কিছু বলাবলি করতো, বিশেষত স্বামী আবূ তালিব যে প্রায়ই বলতেন- [আস-সীরাতুল হালাবিয়্যাহ্-১/১৮৯; নিসাউন মুবাশশারাত বিল-জন্নাহ্-৪১] আমার এ ভাতিজা একজন বড় সম্মানের অধিকারী ব্যক্তি হবে- কান লাগিয়ে শুনতেন। তিনি স্বামীর মুখে আরো শোনেন সিরিয়া সফরের সময় কিশোর মুহাম্মদকে (সা) কেন্দ্র করে যেসব অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল তার বর্ণনা। তাছাড়া তিনি আরো শোনেন হযরত খাদীজার দাস মায়সাবার বর্ণনা যা তিনি যুবক মুহাম্মদের (সা) সাথে সিরিয়া ভ্রমণের সময় প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি নিজে মুহাম্মদের (সা) মধ্যে যা কিছু দেখেছিলেন এবং অন্যদের মুখে তার সম্পর্কে যেসব কথা শুনেছিলেন তাতে এত প্রভাবিত ও মুগ্ধ হন যে, কলিজার টুকরো আলীকে তার তত্ত্বাবধানে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা-সংকোচ করেননি।

তিনি অতি নিকট থেকে মুহাম্মদের (সা) মধ্যে স্নেহময় পিতার রূপ দেখেছিলেন। তিনি লক্ষ করেছিলেন আলীর জন্মের পর থেকে তার প্রতি মুহাম্মদের (সা) অত্যাধিক আগ্রহ ও উত্সাহকে। বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলতেন : আলীর জন্মের পর মুহাম্মাদ তার নিজের মুখ থেকে একটু থুথু নিয়ে তার মুখে দেয়। তারপর সে জিহ্বা চাটতে চাটতে ঘুমিয়ে যায়। পরদিন সকালে আমরা আলীর জন্য ধাত্রী ডেকে পাঠালাম। কিন্তু কারো স্তনই গ্রহন করলো না। আমি মুহাম্মাদ কে ডাকলাম। সে তার জিহ্বায় একটু দুধ ‍দিল। আর আলী তা চাটতে চাটতে ঘুমিয়ে গেল। আল্লাহ যতদিন ইচ্ছা করলেন এভাবে চলতে লাগলো। [আস-সীরাতুল হালাবিয়্যা-১/৪৩২; প্রাগুক্ত] এ সবকিছু দেখে-শুনে মুহম্মাদের প্রতি ফাতিমা বিনত আসাদের স্নেহ-মমতা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা দিন দিন বেড়ে যেতে থাকে। তিনি ছেলে আলীকে মুহাম্মাদের (সা) সার্বাক্ষণিক সহচর হওয়ার তাকিদ দেন।

রাসূল (সা) প্রথম দিকে যখন কা‘বার চত্বরে নামায আদায় করতেন তখন কুরায়শরা তেমন গুরুত্ব ‍দিত না। পরে যখন নিয়মিত পড়তে লাগলেন, তখন আলী ও যায়দ তাকে পাহারা দিতেন। পরে এমন হলো যে, তারা দু‘জন রাসূল (সা) ঘর থেকে বের হলে সর্বক্ষণ তার সংগে থাকতেন। একদিন আলী (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন, তখন আবূ তালিব তাকে ডেকে পেলেন না। আলীর মা ফাতিমা বললেন : আমি তাকে মুহাম্মাদের সাথে যেতে দেখলাম। আবূ তালিব তাদেরকে তালাশ করতে করতে শি‘আবে আবী দাব-এ গিয়ে পেলেন। মুহাম্মাদ (সা) নামাযে দাঁড়িয়ে, আর আলী (রা) তাকে পাহারা ‍দিচ্ছেন। [আনসাবুল আশরাফ-১/১১১]

মুহাম্মাদ (সা) নবুওয়াত লাভ করলেন। নিজ গোত্র ও আত্মিয়-বন্ধুদেরকে ইসলামের দিকে আহবান জানানোর নির্দেশ লাভ করলেন। আল্লাহ নাযিল করলেন : (আরবি *******)[সূরা আশ-শু‘আরা-২১৪] “তুমি তোমার নিকট-আত্মিয়দের সতর্ক কর।

নবী (সা) তার প্রভুর নির্দেশ পালন করলেন। নিকট-আত্মিয়দের দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের দিকে আহবান জানালেন। তাদেরকে আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনার তাগিদ ‍দিলেন। ইসলামের সেই একেবারে সূচনা পর্বে যে ক‘জন মুষ্টিমেয় মহিলা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনে মুসলমান হন তাদের মধ্যে ফাতিমা বিনত আসাদ অন্যতম। সেদিন তার স্বামী আবূ তালিব ভাতিজা মুহাম্মাদের (সা) আবেদনে সারা দিতে অপারগ হলেও তাদের কিশোর ছেলে আলী (রা) আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনেন।

এখান থেকেই এই মহিয়সী সাহাবীয়া ফাতিমা বিনত আসাদের (রা) জীবনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো। কুরায়শরা মুহাম্মাদ ও তার দীন ইসলামের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে লেগে গেল। তারা বানূ হাশিমের সাথে বিবাদে লিপ্ত হলো। যখন তারা দেখলো আবূ তালিব ও তার স্ত্রী মুহাম্মাদের (সা) সমর্থন ও আশ্রয় দিচ্ছেন তখন তারা মুহাম্মাদকে (সা) তাদের হাতে সমর্পণের দাবী জানালো। কিন্তু চাচা-চাচী ভাতিজা মুহাম্মাদের (সা) পক্ষে অটল থাকলেন। কোন চাপের কাছেই নত হলেন না। মুহাম্মাদকে (সা) তাদের হতে অর্পণের আবদার শক্তভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন। ফলে যারা ঈমান এনে মুহাম্মাদের (সা) অনুসারী হয়েছিল তাদের প্রতি তারা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠলো।

নবী (সা) যখন দেখলেন কুরায়শরা তার অনুসারীদের উপর অত্যাচার-উত্পীড়নের ক্ষেত্রে মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে তখন তিনি তাদেরকে আবিসিনিয়ায় হিজরাতের অনুমতি দান করেন। কুরায়শদের অত্যাচার থেকে বাচার জন্য মুসলামনদের যে দলটি প্রথম আবিসিনিয়া হিজরাত করেন তার মধ্যে ফাতিমা বিনত আসাদের কলিজার টুকরা জা‘ফার ইবন আবী তালিব (রা) ও তার স্ত্রী আসমা বিনত উমাইসও (রা) ছিলেন। যাত্রাকালে মা ফাতিমার (রা) এই ছেলেটি ছিল চেহারা-সুরতে ও আদবে-আখলাকে নবী করীমের (সা) অনুরূপ। কুরায়শদের যে পাঁচ ব্যক্তিকে লোকেরা রাসূলুল্লাহর (সা) অনুরূপ বলে মনে করতো তারা হলেন : জা‘ফার ইবন আবী তালিব, কুছাম ইবন আল-আব্বাস, আস-সায়িব ইবন উবায়দ ইবন আবদি ইয়াযীদ ইবন হাশিম ইবন আবদুল মুত্তালিব, আবূ সুফিয়ান ইবন আল-হারিছ ইবন আবদিল মুত্তালিব ও আল-হাসান ইবন আলী ইবন আবী তালিব (রা)। [নিসাউন মুবাশশারাত বিল জান্নাহ-৪২]

কুরায়শরা যখন দেখলো বিষয়টি আস্তে আস্তে তাদের ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে, তারা বানূ হাশিম ও বানূ আবদিল মুত্তালিবের নারী-পুরুষ ও শিশু-যুবক-বৃদ্ধ সকলকে “শি‘আবে আবী তালিব“ উপত্যকায় অবরুদ্ধ অবস্থায় রাখার সিদ্ধান্ত নিল। ফাতিমা বিনত আসাদ (রা) আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অন্য নারীদের সাথে এ অবরোধ মেনে নেন। অন্যদের সাথে তিনিও এ অবরুদ্ধ জীবনের তিনটি বছর সীমাহীন ক্ষুধা ও অনাহারের মুখোমুখি হন এবং গাছের পাতা খেয়ে কোন রকম জীবন রক্ষা করেন। অবশেষে তিন বছর পর নবুওয়াতের দশম বছরে তারা অবরোধ তুলে নেয়। অন্য মুসলমানদের সাথে ফাতিমাও (রা) মুক্ত জীবনে ফিরে আসেন। এ তিনটি বছর মহিলারা চরম ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দান করেন।

“শি‘আবে আবী তালব“ থেকে মুক্ত হওয়ার পর নবুওয়াতের দশম বছরে রাসূলুল্লাহর (সা) অতি আপন দু‘ব্যক্তি মাত্র অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে ইনতিকাল করেন। প্রথমে তার প্রিয়তমা স্ত্রী উম্মুল মু‘মিনীন হযরত খাদীজা বিনত খুওয়ায়লিদ (রা) ও পরে চাচা আবূ তালিব এ দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। এতদিন এ দু‘জনই ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) জীবনে ঢালস্বরূপ। এখন এ দু‘জনের অবর্তমানে অত্যাচারী কুরায়শরা আরো জোরে-শোরে নবী (সা) ও তার অনুসারীদের উপর জুলুম-নির্যাতন করতে শুরু করে। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা নবী করীম (সা) ও মুসলমানদেরকে মদীনায় হিজরাতের অনুমতি দান করেন।

রাসূল (সা) ও তার সঙ্গী-সাথীরা মদীনায় হিজরাত করলেন। ফাতিমা বিনত আসাদও (রা) অন্যদের সাথে মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় চলে গেলেন। যুবায়র ইবন বাক্কর তার ইসলাম ও হিজরাত সম্পর্কে বলেন : (আরবী*****************) [আল-ইসতিয়াব-৪/৩৭০] “তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের দিকে হিজরাত করেন।“

তার স্থান ও মর্যাদা

অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাবি‘ঈ ইমাম আশ-শা‘বী (রহ) তার ইসলাম ও হিজরাত সম্পর্কে বলেন : (আরবী*****************) [উসুদুল গাবা-(৭১৬৮); আল-ইসাবা-৪/৩৮০] “আলী ইবন আবী তালিবের (রা) মা ফাতিমা বিনত আসাদ ইবন হাশিম ইসলাম গ্রহন করেন এবং মদীনায় হিজরাত করেন।“

রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট ফাতিমা বিনত আসাদের (রা) মর্যাদা ও গুরুত্ব সম্পর্কে ইবন সা‘দ বলেন : (আরবী***********) [তাবাকাত-৮/২২২; সিফাতুল সাফওয়া-২/৫৪; আল-ইসাবা-৪/৩৮০] “ফাতিমা বিনত আসাদ ইসলাম গ্রহন করেন। তিনি একজন সত্কর্মশীল মহিলা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে দেখতে যেতেন এবং তার গৃহে দুপুরে বিশ্রাম নিতেন।“

তার সত্যনিষ্ঠা ও ধর্মপরায়ণতার কারণে রাসূল (সা) তাকে অতিমাত্রায় ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। তাকে লালন-পালন, আদব-আখলাক শিক্ষাদান ও তার সাথে সুন্দর ব্যবহারের প্রতিদানে রাসূলও (সা) তার সাথে সবসময় সদ্ব্যবহার করতেন। তার ছেলে আলীর (রা) সাথে রাসূলুল্লাহর কন্যা ফাতিমার (রা) বিয়ে হলো। তখন তিনি একজন মমতাময়ী মা ও একজন আদর্শ শ্বাশুড়ী হসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাদের জীবন তো আর এমন বিত্ত-বৈভবের জীবন ছিলনা। সব কাজ নিজেদেরই করতে হতো। নবী দহিতা ফাতিমাকে (রা) ঘরে আনার পর আলী (রা) মাকে বললেন : আমি পানি আনা, প্রয়োজনে এদিক-ওদিক যাওয়ার ব্যাপারে ফাতিমা বিনত রাসূলুল্লাহকে সাহায্য করবো, আর আপনি তাকে ঘরের কাজে, গম পেষা ও আটা চটকানোর কাজে সাহায্য করবেন। [সিফাতস সাফওয়া-২/৫৪; আয-যাহাবী, আরীখুল ইসলাম-৩/৬২১; উসুদুল গাবা-৫/৫১৭]

ফাতিমা বিনত আসাদের প্রতি রাসূলুল্লাহর (সা) অতিরিক্ত ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকার কারণে তিনি মাঝে মাঝে তাকে বিভিন্ন জিনিস উপহার-উপঢৌকন পাঠাতেন। জা‘দা ইবন হুবায়রা আলী থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন : একবার রাসূল (সা) আমাদের নিকট এক জোড়া অতি উন্নতমানের নতুন কাপড় পাঠালেন। সাথে সাথে এ কথাও বলে পাঠালেন যে, “এ দু‘টোকে নিকাবের কাপড় বানিয়ে ফাতিমাদের মধ্যে ভাগ করে দাও।“ আমি চার টুকরো করলাম। এক টুকরো ‍দিলাম ফাতিমা বিনত রাসূলুল্লাহকে, এক টুকরো ফাতিমা বিনত আসাদকে এবং আর এক টুকরো ফাতিমা বিনত হামযাকে (রা)। তবে তিনি চতুর্থ টুকরোটি যে কাকে দেন তা বলেননি। ইবন হাজার (রহ) বলেছেন, সম্ভবত চতুর্থটি দেন আকীল ইবন আবী তালিবের স্ত্রী ফাতিমা বিনত শায়বাকে। [উসুদুল গাবা-৫/৫১৭; আল-ইসাবা-৪/৩৮০] উল্লেখ্য যে, ফাতিমা নামে চব্বিশজন মহিলা সাহাবী ছিলেন। [নিসাউন মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-২২; নিসাউন মুবাশশারাত বিল জান্নাহ-৪৪]

ইবনুল আছীর বলেছেন, ফাতিমা বিনত আসাদ প্রথম হাশিমী মহিলা যিনি একজন হাশিমী বংশের সন্তান জন্মদান করেন। [আল-ইসতীয়াব-২/৭৭৪; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/১১৮] তিনি প্রথম হাশিমী যার গর্বে একজন খলীফার জন্ম হয়। তারপর ফাতিমা বিনত রাসূলিল্লাহর (সা) গর্ভে জন্ম হয় আল-হাসান ইবন আলীর (রা)। তারপর খলীফা হারূনুর রশীদের স্ত্রী যুবাইদার গর্ভে জন্মগ্রহন করেন খলীফা আল-আমিন। [নিসাউন মুবাশশারাত বিল-জান্নাহ-৪৫]

সাহাবায়ে কেরামের অন্তরেও ফাতিমা বিনত আসাদের (রা) একটা মর্যাদাপূর্ণ আসন ছিল। বিশেষ করে সাহাবী কবিদের নিকট। জা‘ফার ইবন আবী তালিব (রা) মু‘তায় শহীদ হওয়ার পর কবি আহসান ইবন ছাবিত (রা) তার স্বরণে যে কবিতাটি রচনা করেন তাতে তার মা ফাতিমারও ভূয়সী প্রশংসা করেন। [সীরাতু ইবন হিশাম-২/১৫১]

তেমনিভাবে কবি আল-হাজ্জাজ ইবন আলাত আস-সুলামীও উহুদ যুদ্ধে হযরত আলীর (রা) বীরত্ব ও সাহসিকতার প্রশংসা করতে গিয়ে তার মায়েরও প্রশংসা করেন। [আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৭/৩৩৬; নিসাউন মুবাশশারাত বিল-জান্নাহ-৪৫]

অনেকের ধারণা যে, তিনি হিজরাতের পূর্বে ইন্তেকাল করেন। তবে তা সঠিক নয়। ইমাম আস-সামহূদী (রহ) তার “আল-ওয়াফা বি আখবারি দারিল মুস্তাফা“ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি মদীনায় মারা যান এবং তাকে “আর-রাওহা“ গোরস্তানে দাফন করা হয়। [আল-ইসাবা-৪/৩৮০]

নবী করীমের (সা) অন্তরে হযরত ফাতিমা বিনত আসাদের (রা) ছিল বিশেষ মর্যাদার স্থান। তাই তার মৃত্যুর পরেও রাসূল (সা) তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কথা ভোলেননি। তিনি নিজের জামা দিয়ে ফাতিমাকে কাফন দিয়েছেন। তার কবরে নেমে তার পাশে শুয়েছেন এবং তার ভালো কাজের কথা উল্লেখ করে প্রশংসা করেছেন। [ উসুদুল গাবা-৫/৫১৭ ] আস-সামহুদী উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) মাত্র পাঁচটি কবর ছড়া আর কোন কবরে নামেননি। সেই পাঁচটির মধ্যে তিনটি নারীর এবং দুটি পুরুষের। তার মধ্যে আবার একটি মক্কায় এবং চারটি মদীনায়। মদীনার গুলো হলো : ১. খাদীজার (রা) ছেলের কবর। ছেলেটি রাসূলুল্লাহর (সা) গৃহে ও তত্ত্বাবধানে ছিল। ২. “যূ আল-বিজাদাইন“ (দুই চাদরের অধিকারী) বলে খ্যাত আবদুল্লাহ আল-মুযানীর (রা) কবর। ৩. উম্মুল ম‘মিনীন আয়িশার (রা) মা উম্মু রূমানের (রা) কবর। ৪. ফাতিমা বিনত আসাদের (রা) কবর। [ওয়াফা আল-ওয়াফা৩/৮৯৭; নিসাউন মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-২৩]

হযরত ফাতিমা বিনত আসাদের মৃত্যু রাসূল (সা) এবং সাহাবীদের মনে দারুণ বেদনার ছাপ ফেলে। রাসূল (সা) তার জন্য দুয়া করেন, তার প্রশংসা করেন এবং নিজের জামা দিয়ে তার কাফন দেন। হযরত জাবির ইবন আবদিল্লাহ (রা) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে বসে ছিলাম। এমন একজন এসে বললো : ইয়া রাসূলুল্লাহ! আলী, জা‘ফার ও আকীলের মা মারা গেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : তোমরা সবাই আমার মার কাছে চলো। আমরা উঠলাম এবং এমন নিশব্দে পথ চললাম যেন আমাদের প্রত্যেকের মাথার উপর পাখী বসে আছে। বাড়ির দরজায় পৌছার পর রাসূল (সা) গায়ের জামাটি খুলে পরিবারেরে লোকদের হাতে দিয়ে বলেন : তার গোসল দেওয়া শেষ হলে এটি তার কাফনের নীচে দিয়ে দেবে।

যখন লোকেরা দাফনের জন্য লাশ নিয়ে বের হলো তখন রাসূল (সা) একবার খাটিয়ায় কাঁধ দেন, একবার খাটিয়ার সামনে যান, আরেকবার পিছনে আসেন। এভাবে তিনি কবর পর্যন্ত পৌছেন। তারপর কবরে নেমে গড়াগড়ি ‍দিয়ে আবার উপরে উঠে আসেন। তারপর বলেন : আল্লাহর নামের সাথে এবং আল্লাহর নামের উপরে তোমরা তাকে কবরে নামও। দাফন কাজ শেষ হওয়ার পর তিনি সোজা হয়ে দাড়িয়ে বলেন : আমার মা ও প্রতিপালনকারিণী! আল্লাহ আপনাকে ভালো প্রতিদান দিন। আপনি ছিলেন আমার একজন চমত্কার মা ও চমত্কার প্রতিপালনকারিণী। জাবির বলেন : আমরা বললাম : ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি এখানে এমন দুটি কাজ করেছেন, আমরা কখনো আপনাকে এ ধরণের কাজ করতে দেখিনা। বললেন : সে দুটি কাজ কি? বললাম : আপনার জামা খুলে দেওয়া এবং কবরে গড়াগড়ি দেওয়া। বললেন : জামাটির ব্যাপার হলো, আমি চেয়েছি তাকে যেন কখনো জাহান্নামের আগুন স্পর্শ না করে। যদি আল্লাহ চান। আর কবরে আমার গড়াগড়ি দেওয়া – আমি চেয়েছি আল্লাহ যেন তার কবরটি প্রশস্ত করে দেন। [ কানয আল-উম্মাল-১৩/৬৩৬; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/১১৮]

অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে নবী (সা) ফাতিমা বিনত আসাদের কবরে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েন। তারপর এই দু‘আটি পাঠ করেন : (আরবী****************) “ আল্লাহ যিনি জীবন ও মৃত্যু দান করেন। তিনি চিরঞ্জীব যার মৃত্যু নেই। আমার মা ফাতিমা বিনত আসাদকে আপনি ক্ষমা করুন এবং তাকে তার যুক্তি-প্রমাণকে শিখিয়ে দিন। আপনার নবী এবং আমার পূর্ববর্তী নবীদের দাবির ভিত্তিতে আপনি তার কবরকে প্রশস্ত করে দিন। আপনি হলেন সকল দয়ালুদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দয়ালু।“

তারপর তিনি চারবার তাকবীর উচ্চারণ করেন। লাশ কবরে নামান রাসূল (সা), আব্বাস ও আবূ বকর সিদ্দিক (রা)। [নিসাউন মবাশশারাত বিল-জান্নাহ-৪৭]

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) বলেন, যখন আলীর (রা) মা ফাতিমা (রা) গেলেন তখন নবী (সা) নিজের একটি জামা তাকে পরান এবং তার সাথে শুয়ে পড়েন। লোকেরা বললো : ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা)! আমরা তো আপনাকে আর কখনো এমনটি করতে দেখিনি। বললেন : আবূ তালিবের পরে তার চেয়ে বেশী সদাচরণ আর কেউ আমার সাথে করেনি। আমি আমার জামা তার গয়ে এ জন্য পরিয়েছি যেন তাকে জান্নাতের পোশাক পড়ানো হয়, আর তার সাথে এজন্য শুয়েছি যেন তার সাথে সহজ আচরণ করা হয়। [ আ‘লাম আন-নিসা-৪/৩৩; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/১১৮]

এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় ফাতিমা বিনত আসাদ (রা) অবশ্যই জান্নাতে যাবেন। ইমাম আল-কুরতুবী বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা তার নবী মুহাম্মাদের (সা) এ বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যে, কবরে তার উপর দলন-পেষণ চালানো হবে না। যেহেতু তিনি ফাতিমা বিনত আসাদের কবরে শুয়েছেন, এজন্য তার বরকতে ফাতিমা (রা) কবরের পেষণ থেকে মুক্তি পেয়ে গিছেন। [ আস-সীরাতুল আলাবিয়্যা-২/৬৭৩]

হযরত আনাস ইবন মালিক (রা) বলেছেন, যখন আলীর (রা) মা ফাতিমা বিনত আসাদ (রা) মারা গেলেন তখন রাসূল (সা) তার বাড়ীতে গেলেন এবং তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন : হে আমার মা, আল্লাহ আপনার প্রতি দয়া করুন। আমার মার পরে, আপনি অভুক্ত থেকে আমার পেট ভরাতেন, আপনি না পরে আমাকে পরাতেন এবং ভালো কিছু নিজে না খেয়ে আমাকে খাওয়াতেন। এর দ্বারা আপনি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকাল লাভের আশা করতেন। [ মাজমা আয-যাওযায়িদ-৯/২৫৬; নিসাউন মবাশশারাত বিল-জান্নাহ-৪৮]

হযরত রাসূলে কারীম (সা) এত বড় মহানুভব ব্যক্তি ছিলেন যে, কেউ তার প্রতি সামান্য দয়া ও অনুগ্রহ দেখালে তা কোনদিন ভোলেননি। কথায় ও কর্মের দ্বারা সবসময় তার প্রতি কৃতিজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তাহলে ফাতিমা বিনত আসাদ (রা), যিনি নবীর (সা) জীবনে মায়ের ভূমিকা পালন করেছেন, আল্লাহ ও তার রাসূলের জন্য হিজরাত করেছেন এবং সারাটি জীবন রাসূলেস কল্যাণ চিন্তা করেছেন, তাকে তিনি ভুলবেন কেমন করে? তার সাথে যেমন আচরণ করা দরকার তা তিনি করেছেন।

হযরত ফাতিমা বিনত আসাদ (রা) থেকে রাসূলুল্লাহর (সা) ছেচল্লিশটি (৪৬) হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে একটি মুত্তাফাক আলাইহি (বুখারী ও মুসলিমে একই সনদে বর্ণিত হয়েছে)। [ আ‘লাম আন-নিসা-৪/৩৩]

তার ছেলেরা হলেন : তালিব, আকীল, জা‘ফার ও আলী (রা) এবং মেয়েরা হলেন : হাম্মাদ ও রীতা। [তাবাকাত-৮/১৬১]
সুমায়্যা বিনত খুববাত (রা)
ইসালামের প্রথম শহীদ হযরত সুমায়্যা (রা) একজন মহিলা সাহাবী। তার বংশ পরিচয় তেমন একটা পাওয়া যায় না। ইবন সা‘দ তার পিতার নাম “খুববাত“ বলেছেন, [তাবাকাত-৮/২৬৭] কিন্তু বালাজুরী বলেছেন ‘খায়্যাত‘। [আনসাবুল আশরাফ-১/১৫৭] প্রখ্যাত শহীদ সাহাবী ‘আম্মার ইবন ইয়াসিরের (রা) মা এবং মক্কার আবু হুজাইফা ইবন আল-মগীরা আল-মাখযুমীর দাসী। [তাবাকাত-৮/২৬৮]

আল-ওয়াকিদীসহ একদল বংশবিদ্যা বিশারদ বলেছেন, হযরত ‘আম্মারের (রা) পিতা ইয়াসির ইয়ামনের মাজহাজ গোত্রের ‘আনসী শাখার সন্তান। তবে তার ছেলে ‘আম্মার মক্কার বানূ মাখযুমের আযাদকৃত দাস। ইয়াসির তার দু‘ভাই- আল হারিছ ও মালিককে সংগে নিয়ে তাদের নিখোঁজ চতুর্থ ভাইয়ের সন্ধানে মক্কায় আসেন। আল-হারিছ ও মালিক স্বদেশ ইয়ামনে ফিরে গেলেন, কিন্তু ইয়াসির মক্কায় থেকে যান। মক্কার রীতি অনুযায়ী তিনি আবূ হুযায়ফা ইবন আল-মুগীরা আল-মাখযুমীর সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে থাকেন। আবূ হুজাইফা তার দাসী সুমায়্যাকে ইয়াসিরের সাথে বিয়ে দেন এবং তাদের ছেলে ‘আম্মারের জন্ম হয়। আবূ হুজাইফা ‘আম্মারকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে নিজের সাথে রেখে দেন। যতদিন আবূ হুজাইফা জীবিত ছিলেন ‘আম্মার তার সাথেই ছিলেন। [সীরাত ইবন হিশাম-১/২৬১; টিকা-৪; আনসাবুল আশরাফ-১/১৫৭] উল্লেখ্য যে, এই আবূ হুজাইফা ছেলেন নরাধম আবূ জাহলের চাচা। [ আল-আ‘লাম-৩/১৪০] হযরত সুমায়্যা (রা) যখন বার্ধক্যে দুর্বল হয়ে পড়েছেন তখন মক্কায় ইসলামী দা‘ওয়াতের সূচনা হয়। তিনি প্রথম ভাগেই স্বামী ইয়াসির ও ছেলে আম্মার সহ গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেন। কিছুদিন পর প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন। মক্কায় তাদের এমন কোন আত্মিয়-বন্ধু ছিল না যারা তাদেরকে কুরাইশদের নিষ্ঠুরতার হাত থেকে বাঁচাতে পারতো। আর তাই তারা তাদের উপর মাত্রা ছাড়া নির্যাতন চালাতে কোন রকম ত্রুটি করেনি।

ইমাম আহমাদ ও ইবন মাজাহ বর্ণনা করেছেন, আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ (রা) বলেন : সর্ব প্রথম যারা ইসলামের ঘোষণা দান করেন, তারা হলেন সাত জন। রাসূলুল্লাহ (সা), আবু বকর, আম্মার, আম্মারের মা সুমায়্যা, সুহাইব, বিলাল ও আল-মিকদাদ (রা)। আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহকে (সা) তার চাচার দ্বারা এবং আবু বকরকে তার গোত্রের দ্বারা নিরাপত্তা বিধান করেন। আর অন্যদেরকে পৌত্তলিকরা লোহার বর্ম পরিয়ে প্রচন্ড রোদে দাড় করিয়ে রাখতো। [ আল-বিদায়া-৩/২৮; কানয আল ‘উম্মাল-৭/১৪; আল-ইসাবা-৪/৩৩৫; হায়াতুস সাহাবা-১/২৮৮]

হযরত জাবির (রা) বলেন, একদিন মুশরিকরা যখন ‘আম্মার ও তার পরিবারবর্গকে শাস্তি দিচ্ছিল তখন সেই পথ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) কোথাও যাচ্ছিলেন। তিনি তাদের অবস্থা দেখে বলেন : “হে ইয়াসিরের পরিবার-পরিজন! তোমাদের জন্য সুসংবাদ। তোমাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি।“ [ হায়াতস সাহাবা-১/২৯১]

আবদুল্লাহ ইবন জা‘ফার (রা) বলেন, রাসূল (সা) তাদের সেই অসহায় অবস্থায় দেখে বলেন : “হে ইয়াসিরের পরিবারবর্গ ধৈর্য ধর। তোমাদের জন্য জান্নাত নির্ধারিত রয়েছে। [সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩২০; আনসাবুল আশরাফ-১/১৬০, হায়াতস সাহাবা-১/২৯১] ইবন আব্বাসের (রা) বর্ণনায় একথাও এসেছে যে, সুমায়্যাকে (রা) আবু জাহল বল্লম মেরে হত্যা করে। ‍অত্যাচার, উত্পীড়নে ইয়াসিরের মৃত্যু হয় এবং আবদুল্লাহ ইবন ইয়াসিরকে তীরবিদ্ধ করা হয়, তাতেই তিনি মারা যান।

উসমান (রা) বলেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে ‘আল-বাতহা‘ উপত্যকায় হাটছিলাম। তখন দেখতে পেলাম, আম্মারের পিতা রাসূলকে (সা) দেখে বরে ওঠেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! কালচক্র এ রকম? রাসূল (সা) বললেন : হে ইয়াসিরের পরিবার-পরিজন! ধৈর্য ধর। হে আল্লাহ! ইয়াসিরের পরিবারবর্গকে ক্ষমা করুন। [ তাবাকাত-৩/১৭৭; কানয আল-উম্মাল-৭/৭২]

সারাদিন এভাবে শাস্তি ভোগ করার পর সন্ধ্যায় তারা মুক্তি পেতেন। শাস্তি ভোগ করে হযরত সুমায়্যা প্রতিদিনের মত একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন। পাষণ্ড আবু জাহল তাকে অশালীন ভাষায় গালি দিতে থাকে। এক পর্যায়ে তার পশুত্বের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যায়। সে সুমায়্যার দিকে বর্শা ছুড়ে মারে এবং সেটি তার যৌনাঙ্গে গিয়ে বিদ্ধ হয় এবং তাতেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। [ তাবাকাত-৮/২৬৫; আল-বিদায়া-৩/৫৯; সিফাতুস সাফওয়া-২/৩২] ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি‘উন।

মায়ের এমন অসহায় মৃত্যুবরণে ছেলে আম্মারের দুখের অন্ত ছিলনা। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে বললেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! এখন তো জুলুম-অত্যাচার মাত্রা ছাড়া রূপ নিয়েছে। রাসূল (সা) তাকে ধৈর্য ধরার উপদেশ দিলেন। তারপর বললেন : “হে আল্লাহ, তুমি ইয়াসিরের পরিবারের কাউকে জাহান্নামের আগুনের শাস্তি দিওনা।“[সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩১৯; টিকা-৫]

হযরত সুমায়্যার (রা) শাহাদাতের ঘটনাটি হিজরতের পূর্বের। এ কারণে তিনিই হলেন ইসলামের প্রথম শহীদ। হযরত মুজাহিদ (রহ) বলেন : ইসলামের প্রথম শহীদ হলেন আম্মারের মা সুমায়্যা। [তাবাকাত-৮/২৬৫; আল-বিদায়া-৩/৫৯; সিফাতুস সাফওয়া-২/৩২]

বদর যুদ্ধে নরাধম আবু জাহল নিহত হলে রাসূল (সা) আম্মারকে বলেন : “আল্লাহ তোমার মায়ের ঘাতককে হত্যা করেছেন। [আল-আসাবা-৪/৩৩৫] হযরত সুমায়্যা (রা) শাহাদাতের ঘটনাটি ঘটে ৬১৫ খ্রীস্টাব্দে। [আল-আ‘লাম-৩/১৪০]
উম্মু উমার (রা)
মদীনার একজন আনসারী মহিলা। ‍উম্মু উমার উপনামে তিনি ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। ভালো নাম নুসাইবা। পিতার নাম কা‘আব ইবন আমর। মদীনার বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের নাজ্জার শাখার কন্যা। [ সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৭৮] রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় হিজরতের প্রায় চল্লিশ বছর পূর্বে মদীনায় জন্ম গ্রহণ করেন। [সাহাবিয়াত-২০৪] বিখ্যাত বদরী সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবন কা‘ব আল মাযিনীর বোন। [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৭৮]

উম্মু উমারার প্রথম বিয়ে হয় যায়দ ইবন আসিম ইবন আমরের সাথে। এই যায়দ ছিলেন তার চাচাতো ভাই। তার মৃত্যুর পর গাযিয়্যা ইবন আমরের সাথে ‍দ্বিতীয় বিয়ে হয়। প্রথম পক্ষে আবদুল্লাহ ও হাবীব এবং দ্বিতীয় পক্ষে তামীম ও খাওলা নামক মোট চার সন্তানের মা হন। [তাবাকাত-৮/৪১২; আল-ইসাবা-৪/৪৭৯]

ইসলামের একেবারে সূচনাপর্বে হযরত রাসূলে করীম (সা) মক্কায় ও তার আশে-পাশের জনপদে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চলেছেন এবং দিন দিন কঠোর থেকে কঠোরতর প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছেন। মাঝে মাঝে অন্তর মাঝে নৈরাশ্য ও হাতশা বোধ জন্ম নিলেও আল্লাহর রহমত এবং সাহায্য-সহায়তার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে তাবলীগী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। রাসূলুল্লাহর (সা) মক্কী জীবনের এমন এক প্রক্ষাপটে ইয়াছরিবের ছয় ব্যক্তি মক্কায় আসেন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে সাক্ষাৎ করেন, কথা শোনেন এবং ইসলাম গ্রহণ করে ইয়াছরিবে ফিরে যান। পরের বছর হজ্জ মওসুমে তারা আরো ছয় জনকে সংগে করে মক্কায় যান এবং গোপনে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে সাক্ষাৎ করে বাই‘আত করেন। যাকে আকাবার প্রথম বাই‘আত বলা হয়। ইয়াছরিব তথা মদীনায় ইসলাম প্রচার ও প্রসারের লক্ষে এবং তাদের অনুরোধে রাসূল (সা) দা‘ঈ হিসেবে মুস‘আব ইবন উমাইরকে (রা) তাদের সাথে মদীনায় পাঠান। এই ছোট্ট দলটি পরবর্তী একবছর মদীনায় ব্যাপকভাবে ইসলামের প্রচারের কাজ নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখেন। তারা এত আন্তরিকভাবে কাজ করেন যে, মাত্র এক বছরের মধ্যে মদীনার প্রতিটি ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌছে যায়। এ সময়ের মধ্যে মদীনার অনেক বড় বড় নেতা ও অভিজাত ঘরের নারী-পুরুষ ইসলামের দা‘ওয়াত কবুল করেন। যার ফল এই দাঁড়ায় যে, পরবর্তী হজ্জ মওসুমে তিয়াত্তর মাতন্তরে পঁচাত্তর জনের বিশাল একটি দল নিয়ে মুস‘আব মক্কায় যান এবং আকাবায় রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে গোপনে সাক্ষাৎ করেন। আর সেখানে অনুষ্ঠিত হয় আকাবার দ্বিতীয় বাই‘আত। রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় হিজরাতের পূর্বে হযরত মুস‘আবের তাবলীগে মদীনার যে সকল নারী-পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করেন উম্মু উমারা (রা) তাদের একজন। কেবল তিনি নন, এ সময়কালে তার গোটা খানদান মুসলমা হন। এভাবে তিনি হলেন প্রথম পর্বের একজন মুসলমান আনসারী মহিলা। [সাহাবিয়াত-২০৪]

হযরত উম্মু উমারার জীবনের বড় ঘটনা আকাবার বাই‘আতে অংশগ্রহণ। আকাবার দ্বিতীয় বাই‘আতে পঁচাত্তর জন মুসলমান অংশগ্রহণ করেন। তার মধ্যে দুই জন মহিলা ছিলেন। উম্মু উমারা (রা) তার একজন। দ্বিতীয় মহিলা ছিলেন উম্মু মানী (রা)। [সীরাত ইবন হিশাম-১/৪৪১] পুরুষদের বাই‘আতের শেষে উম্মু উমারার স্বামী হযরত গাযিয়্যা ইবন আমর মহিলা দইজনকে ডেকে রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে হাজির করে আরজ করেন : ইয়া রাসূলুল্লহ! এই দুই মহিলাও বাই‘আতের উদ্দেশ্যে আমাদের সাথে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি বললেন : যে অঙ্গীকারের উপর তোমাদের বাই‘আত গ্রহণ করেছি ঐ একই অঙ্গীকারের উপর তাদেরও বাই‘আত গ্রহণ করছি। হাত মিলনোর প্রয়োজন নেই। আমি মহিলাদের সাথে হাত মিলাইনা। [আনসাব আল-আশরাফ-১/২৫০; আল-ইসাবা-৪/৪৭৯; সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৬৬]

হিজরী দ্বিতীয় সনে উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে উম্মু উমারা (রা) যোগ দেন। এ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর (সা) মুহতারাম চাচা হযরত হামযা (রা) সহ বহু মুসলমান শহীদ হন। আল-ওয়াকিদী বলেন : [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৭৮] উম্মু উমারা তার স্বামী গাযিয়্যা ইবন আমর ও প্রথম পক্ষের দুই ছেলে আবদুল্লাহ ও হাবীবের [কোন কোন বর্ণনায় হাবীব-এর স্থলে ‘খুবায়ব‘ এসেছে] সাথে উহুদে যোগদান করেন। মূলত তিনি গিয়েছিলেন একটি পুরানো মশক সংগে নিয়ে যোদ্ধাদের পানি পান করানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু এক পর্যায়ে সরাসরি সংঘর্ষে জরিয়ে পড়েন। চমত্কার রণকৌশলের পরিচয় দেন। শত্রুর বারোটি মতান্তরে তেরোটি আঘাতে তার দেহ জর্জরিত হয়। [তাবাকাত-৮/৪১২; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৭৯] কোন কোন বর্ণনায় এসেছে এ যোদ্ধে তিনি তীর-বর্শা দ্বারা বারোজন পৌত্তলিক সৈন্যকে আহত করেন। [আনসাব আল-আশরাফ-১/৩২৫]

উহুদ যোদ্ধের এক পর্যায়ে শত্রু বাহিনীর পাল্টা আক্রমনে মুসলিম বাহিনীর বনোবল ভেঙ্গে যায়। মুষ্টিমেয় কয়েকজন জানবাজ মুজাহিদ ছাড়া আর সকলে রাসূলুল্লাহকে (সা) ছেড়ে ময়দান থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। যে কয়েকজন মুজাহিদ নিজেদের জীবন বাজি রেখে রাসূলুল্লাহর (সা) নিরাপত্তা বিধান করেন তাদের মধ্যে উম্মু উমারা, আর স্বামী গাযিয়্যা ও ‍দুই ছেলে আবদুল্লাহ ও হাবীবও ছিলেন।

রণক্ষেত্রের এই নাজুক অবস্থার আগে যখন মুসলিম বাহিনী খুব শক্তভাবে শত্রুবাহিনীর মুকাবিলা করছিল এবং বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌছে গিয়েছিল তখনো উম্মু উমারা (রা) হাত পা গুটিয়ে বসে ছিলেন না। মশকে পানি ভরে নিয়ে মুজাহিদদের পান করাচ্ছিলেন। এমন সময় দেখলেন যে সবাই ময়দান ছেড়ে পালাচ্ছে। রাসূলুল্লাহর (সা) পাশে মাত্র গুটিকয়েকজন মুজাহিদ। তিনিও এগিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) পাশে জীবন বাজি রেখে অটল হয়ে দাঁড়ালেন। আর তার পাশে এসে অবস্থান নিলেন স্বামী ও দুই ছেলে। তিনি একদিকে রাসূলুল্লাহর (সা) উপর কাফিরদের আক্রমণ প্রতিহত করছিলেন, অপর দিকে তাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমন চালিয়ে অনেককে ধরাশায়ী করে ফেরেছিলেন।

উহুদ যুদ্ধের সেই মারাত্মক পর্যায়ের বর্ণনা উম্মু উমারা দিয়েছেন এভাবে : “আমি দেখলাম, লোকেরা রাসূলুল্লাহকে (সা) ছেড়ে পালাচ্ছে। মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন যাদের সংখ্যা দশও হবেনা, রাসূলুল্লাহর (সা) পাশে আছি। আমি, আমার দুই ছেলে ও স্বামী রাসূলুল্লাহর (সা) পাশে দাঁড়িয়ে তাকে রক্ষা করেছি। তখন অন্য মুজাহিদরা পরাজিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহর (সা) পাশ ‍দিয়ে চলে যাচ্ছিল। রাসূল (সা) দেখলেন আমার হাতে কোন ঢাল নেই। তিনি এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সে পালাচ্ছে এবং তার হতে একটি ঢাল। তিনি তাকে বললেন, ওহে, তুমি তোমার ঢালটি যে লড়ছে এমন কারো দিকে ছুড়ে মার। সে ঢালটি ছুড়ে মারে এবং আমি তা হতে তুলে নেই। সেই ঢাল দিয়েই আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) আড়াল করতে থাকি। সেদিন অশ্বারোহী যোদ্ধারা আমাদের সাথে খুব বাজে কাজ করেছিল। যদি তারা আমাদের মত পদাতিক হতো তাহলে আমরা শত্রুদের ক্ষতি করতে সক্ষম হতাম।“

তিনি আরো বলেছেন : কোন অশ্বারোহী আমাদের দিকে এগিয়ে এসে আমাকে তরবারির আঘাত করছিল, আর আমি সে আঘাত ঢাল দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। আমার কিছুই করতে সক্ষম হয়নি। তারপর যেই না সে পিছন ফিরে যেতে উদ্যত হিচ্ছল অমনি আমি তার ঘোড়ার পিছন পায়ে তরবারির কোপ বসিয়ে দিচ্ছিলাম। ঘোড়াটি আরোহীসহ মাটিতে পরে যাচ্ছিল। তখনই রাসূল (সা) আমার ছেলেকে ডেকে বলছিলেন : ওহে উম্মু উমারার ছেলে! তোমার মাকে সাহায্য কর।‘ সে ছুটে এসে আমাকে সাহায্য করছিল। এভাবে আমি তাকে মৃত্যুর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিচ্ছিলাম। [তাবাকাত-৮/৪১৩; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৭৯]

উম্মু উমারার ছেলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। যখন মুসলিম মুজাহিদরা রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তখন আমি ও আমার মা তার নিকট গিয়ে কাফিরদের আক্রমন থেকে রক্ষা করতে শুরু করলাম। এসময় রাসূল (সা) আমাকে বললেন, তুমি উম্মু উমারার ছেলে? বললাম হ্যাঁ। তিনি বললেন, শত্রুদের দিকে কিছু ছুড়ে মার। আমি আমার সামনের একটি লোকের দিকে একটি পাথর ছুড়ে মারলাম। লোকটি ছিলো ঘোড়ার পিঠে। নিক্ষিপ্ত পাথরটি গিয়ে লাগলো ঘোড়ার একটি চোখে। ঘোড়াটি ছটফট করতে করতে তার আরোহীসহ মাটিতে পড়ে গেল। আর আমি লোকটির উপর পাথর ছুড়ে মারতে লাগলাম। আমার একাজ দেখে রাসূল (সা) মৃদ্যু হাসতে থাকেন। [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৮০]

উহুদের দিন উম্মু উমারা (রা) ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিলেন। দামরা ইবন সা‘ঈদের দাদা উহুদের একজন যোদ্ধা, তিনি বলেছেন উম্মু উমারা সেদিন কোমরে কাপড় পেঁচিয়ে শত্রুদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। এ যুদ্ধে তার দেহের তেরোটি স্থান মারাত্মকভাবে আহত হয়। [ তাবাকাত-৮/৪১৩]

এ সময় এক কাফিরের নিক্ষিপ্ত একটি আঘাতে হযরত রাসূলে পাকের একটি দাঁত ভেঙ্গে যায়। পাষণ্ড ইবন কামিআ রাসূলুল্লাহকে (সা) তাক করে তরবারির একটি কোপ মারে, কিন্তু তা ফসকে যায়। মুহূর্তে উমারা (রা) ফিরে দাঁড়ান। তিনি নরপশু ইবন কামিআর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু তার সারা দেহ বর্ম আচ্ছাদিত থাকায় বিশেষ কার্যকর হলোনা। তবে সে উম্মু উমারাকে তাক করে এবার একটি কোপ মারে এবং তা উম্মু উমারার কাধে লাগে। এতে তিনি মারত্মক আহত হন। [প্রাগুক্ত-৮,৪২৪; ইবন হিশাম-২/৮১-৮২]

ইবন কামিআ তো ভেগে প্রাণ বাঁচালো। কিন্তু উম্মু উমারার আঘাতটি ছিল অতি মারাত্মক। তার সারা দেহ রক্তে ভিজে গেল। তার ছেলে আবদুল্লাহ বর্ণনা করেছেন : আমার মা সেদিন মারাত্মক ভাবে আহত হন। রক্ত বন্ধই হচ্ছিল না। রাসূল (সা) তাকে বলেন : তোমার ক্ষত স্থানে ব্যান্ডেজ কর। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা) তাকে আহত হতে দেখে তার ছেলে আবদুল্লাহকে ডেকে বলেন : তোমার মাকে দেখ, তোমার মাকে দেখ। তার ক্ষত স্থানে ব্যান্ডেজ কর। হে আল্লাহ! তাদের সবাইকে জান্নাতে আমার বন্ধু করে দাও। [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৮১] উম্মু উমারা বলেন ‘দুনিয়ায় আমার যে কষ্ট ও বিপদ আপদ এসেছে, তাতে আমার কোন পরোয়া নাই। [তাবাকাত-৮/৪১৪-৪১৫] সেদিন রাসূল (সা) নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার ক্ষত স্থানে ব্যান্ডেজ বাঁধান। এ সময় রাসূল (সা) কয়েকজন সাহসী সাহাবীদের নাম উচ্চারণ করে বলেন : উম্মু উমারার আজকের কর্মকাণ্ড তাদের কর্মকাণ্ড থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। এরপর প্রায় একবছর যাবত তার ক্ষত স্থানের চিকিত্সা করা হয়। [প্রাগুক্ত-৮/৪১২; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৭৯]

উহুদের এই মারাত্মক আক্রমণে উম্মু উমারার ছেলে আবদুল্লাহও মারাত্মকভাবে আহত হলোভ আবদুল্লাহ বর্ণনা করেছেন : সেদিন আমি মারাত্মক ভাবে আহত হলাম। রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছিল না। তা দেখে রাসূল (সা) বলেন : তোমার আহত স্থানে ব্যান্ডেজ বাঁধ। কিছুক্ষণ পর আমার মা অনেকগুলো ব্যান্ডেজ হাতে নিয়ে আমার দিকে ছুটে আসেন এবং আমার আহত স্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন। রাসূল (সা) তখন পাশেই দাঁড়িয়ে। ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ করে মা আমাকে বলেন : বেটা ওঠো। শত্রু সৈন্যদের গর্দান মার। রাসূল (সা) তখন বলেন : ওহে উম্মু উমারা, তমি যতখানি শক্তি ও সামর্থ্য রাখ, অন্যের মধ্যে তা কোথায়?

আবদুল্লাহ আরো বর্ণনা করেন, এ সময় যে শত্রু সৈন্যটি আমাকে আহত করেছিল, অদূরে তাকে দেখা গেল। রাসূল (সা) আমার মাকে বললেন : এ সেই ব্যক্তি যে তোমার ছেলেকে যখম করেছে। আমার মা বললেন : আমি তার মুখোমুখি হবো এবং তার ঠ্যাংয়ের নলা ভেঙ্গে দিবো। একথা বলে তিনি তকে আঘাত করে ফেলে দেন। তা দেখে রাসূল (সা) হেসে দেন এবং আমি তার সামনের দাঁত দেখতে পাই। তার পর তিনি বলেন : উম্মু উমারা তুমি বদলা নিয়েছো। তার পর আমরা দুজনে মিলে আঘাতের পর আঘাত করে তাকে জাহান্নামের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিই। তখর রাসূল (সা) বলেন, উম্মু উমারা, সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি তোমাকে সফরকাম করেছেন। [প্রাগুক্ত]

উহুদ যুদ্ধ শেষ হলো। মুজাহিদরা ঘরে ফিরতে লাগলেন। রাসূল (সা) আবদুল্লাহ ইবন কা‘ব মাযিনীকে পাঠিয়ে উম্মু উমারার অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল না হয়ে ঘরে ফিরলেন না।

উহুদ যুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহর (সা) ঘোষণা ‍মদীনার মুজাহিদদেরকে ‘হামরা আল আসাদ‘ [মদীনা থেকে জুল হুলাইফার দিকে যেতে রাস্তার বাম দিকে আট মাইলের মাথায় একটি স্থান] এর দিকে বেরিয়ে পড়ার ঘোষণা দেন। উম্মু উমারা সেখানে যাওয়ার জন্য মাজার কাপড় পেঁচিয়ে প্রস্তুত হয়ে যান। কিন্তু ক্ষত থেকে রক্ত ক্ষরণের কারণে সক্ষম হনন। [ তাবাকাত-৮/৪১৩]

উহুদ যুদ্ধ ছাড়াও তিনি আরো অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ইবন সা‘দের বর্ণনা মতে, তিনি উহুদ, হুদাইবিয়া, খায়বার, কাজা ‘উমরা আদায়, হুনাইন ও ইয়ামামার যুদ্ধ ও অভিযানে যোগ দেন। হাকেম ও ইবন মুন্দার মতে, তিনি বদরেও যোগ ‍দিয়েছিলন। তবে ইমাম জাহাবী বলেন, তার বদরে অংশগ্রহণ কথাটি সঠিক নয়। [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা২/২৭৮.২৮২] তবে একমাত্র ইয়ামামার যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোন যুদ্ধে ও অভিযানে তার অংশগ্রহণের কোন বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। উম্মু উমারার বোনও তার সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। [ইবন হিশাম-১/৪৬৬]

রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতেকালের পর ইয়ামামার অধিবাসী এবং তথাকার নেতা মুসায়লামা আল-কাজ্জাব মুরতাদ হয়ে যায়। সে ছিল একজন নিষ্ঠুর প্রকৃতির অত্যাচারী মানুষ। তার গোত্রে প্রায় চল্লিশ হাজার যুদ্ধ করার মত লোক ছিল। তারা সবাই তাকে সমর্থন করে। নিজের শক্তির অহমিকায় সে নিজেকে একজন নবী বলে দাবী করে এবং তার সমর্থকদের সবার নিকট থেকে জোর-জবরদস্তীভাবে স্বীকৃতি আদায় করতে থাকে। আর যারা তার নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীকে মানতে অস্বীকৃতি জানায় তাদের উপর নানাভাবে নির্যাতন চালাতো। হযরত উম্মু উমারার (রা) ছেলে হযরত হাবীব ইবন যায়দ উমান থেকে মদীনায় আসার পথে মুসায়লামার হতে বন্দী হন। মুসায়লামা তাকে বলেন, তুমি তো সাক্ষ্য দিয়ে থাক যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। হাবীব বলেন, হ্যাঁ, আমি তাই সাক্ষ্য দিয়ে থাকি। মুসায়লামা তখন বলে : না, তোমাকে এ কথা বলতে হবে যে, মুসায়লামা আল্লাহর রাসূল।‘ হযরত হাবীব অত্যন্ত শক্তভাবে তার দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার মুসায়লামা হযরত হাবীবের একটি হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তারপর সে হাবীবের নিকট একই স্বীকৃতি দাবী করে। তিনি পূর্বের মতই অস্বীকৃতি জানান। পাষাণ মুসায়লামা তার দ্বিতীয় হাতটি কেটে দেয়। মোটকথা, নরাধম মুসায়লামা তার দবীর উপর অটল থাকে, আর হযরত হাবীবও অটল থাকেন নিজের শক্ত বিশ্বাসের উপর। পাষণ্ড মুসায়লামা একটি একটি করে হযরত হাবীবের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আল্লাহর এই বান্দা জীবন দেওয়া সহজ মনে করেছেন, কিন্তু বিশ্বাস থেকে চুল পরিমাণ বিচ্যুত হওয়া সমীচীন মনে করেননি। এ ঘটনার কথা উম্মু উমারার (রা) কানে পৌছলে তিনি মনকে শক্ত করেন এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন যদি কখনো মুসলিম বাহিনী এই ভণ্ড নবীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে তখন তিনিও অংশগ্রহণ করবেন এবং আল্লাহ চাইলে নিজের হাতে এই জালিমকে জাহান্নামের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিবেন। [প্রাগুক্ত; সাহাবিয়াত-২০৭; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৮১]

মুসায়লামার এহেন ঔদ্ধ্যত ও বাড়াবাড়ির কথা খলীফা হযরত আবু বকরের (রা) কানে এলো। তিনি এই ধর্মদ্রোহিতার মূল উপরে ফেলার লক্ষে চারহাজার সৈন্যসহ হযরত খালিদ ইবন ওয়ালীদকে (রা) পাঠান। উম্মু উমারা (রা) তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য এটাকে সুবর্ণ সুযোগ হসেবে গ্রহণ করলেন। তিনি খলীফার নিকট এই অভিযানে অংশগ্রহণের অনুমতি চাইলেন। খলীফা অনুমতি দিলেন। উম্মু উমারা (রা) খালিদ ইবন ওয়ালিদরে (রা) বাহিনীর সাথে ইয়ামামায় গেলেন। প্রচণ্ড যুদ্ধ হলো। বারো শো মুজাহিদ শহিদ হলেন। অন্যদিকে ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মতে, মুসায়লামার আট/নয় হাজার সৈন্য মারা যায়। অবশেষে মুসায়রামার হত্যার মাধ্য দিয়ে মুসলিম বহিনীর বিজয় হয়।

প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। উম্মু উমারা (রা) সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। তার একমাত্র লক্ষ্য তার ছেলের ঘাতক পাষণ্ড মুসায়লামা আল-কাজ্জাব। এক সময় তিনি এক হাতে বর্শা ও অন্য হতে তারবারি চালাতে চালাতে শত্রু বাহিনীর ব্যূহ ভেদ করে মুসায়লামার কছে পৌছে যান। এ পর্যন্ত পৌছতে তার দেহের এগারটি স্থান নিযা ও তরবারির আঘাতে আহত হয়। শুধু তাই নয়, একটি হাত বাহু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতেও তার সিদ্ধান্ত টলেনি। মোটেও ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেনি। তিনি আরো একটি এগিয়ে গেলেন। মুসায়লামাকে তাক করে তরবারির কোপ মারবেন, ঠিক এমন সময় হঠাৎ এক সাথে দুইখানি তরবারির কোপ মুসায়লামার উপর এসে পড়ে। আর সে কেটে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটেকে পড়ে। তিনি বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন, ছেলে আবদুল্লাহ পাশে দড়িয়ে। জিজ্ঞেস করলেন, তুমিই কি তাকে হত্যা করেছো? আবদুল্লাহ জবাব দিলেন, একটি কোপ আমার অন্যটি ওয়াহশীর। আমি বোঝতে পারছিনে কার কোপে সে নিহত হয়েছে। উম্মু উমারা (রা) দারুণ উত্ফুল্ল হলেন এবং তখনই সিজদায়ে শুকর আদায় করলেন। [ইবন হিশাম-১/৪৬৬; সাহাবিয়াত-২০৮]

উম্মু উমারার (রা) যখম ছিল খুবই মারাত্মক। একটি হাতও কাটা গিয়েছিল।এ কারণে খুবই দুর্বল হয়ে পরেছেলেন। বাহিনী প্রধান হযরত খালিদ ইবন ওয়ালীদ ছিলেন তার বীরত্ব ও সাহসিকতার একজন গুণমুগ্ধ ব্যক্তি। তিনি তাকে খুব তা‘জীমও করতেন। তিনি আপন তত্ত্বাবধানে তার সেবা ও চিকিত্সার ব্যবস্থা করেন। তার চিকিত্সায় যাতে কোন ত্রুটি না হয় সে ব্যাপারে সর্বক্ষণ সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। তাই তিনি সুস্থ হয়ে সারাজীবন খালিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। তার প্রশংসায় তিনি বলতেন, তিনি একজন সহমর্মী, উচুমনা ও বিনয়ী নেতা। তিনি খুব আন্তরিকতার সাথে আমার সেবা ও চিকিত্সা করেন। মদীনায় ফেরার পর খলীফা আবু বকর (রা) তাকে প্রায়ই দেখতে যেতেন। [তাবাকাত-৮/৪১৬]

হযরত উম্মু উমারা (রা) ছিলেন একজন মহিলা বীর যোদ্ধা। তার বীরত্ব ও সাহসিকতার বিস্ময়কর বাস্তবতা আমরা বিভিন্ন রণাঙ্গনে প্রত্যক্ষ করেছি। তার যে রণমূর্তি আমরা উহুদ ও ইয়ামামার যুদ্ধে দেখি, তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায়। হযরত রাসূলে করীম (সা) ছিলেন তার সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি। তার ভালবাসার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন উহুদের ময়দানে। রাসূল (সা) তার বাড়ীতে মাঝে মাঝে যেতেন। একদিন রাসূল (সা) আসলেন। তিনি তাকে খাবার দিলেন। রাসূল (সা) তাকেও তার সাথে খেতে বললেন। উম্মু উমারা বললেন, আমি রোযা আছি। রাসূল (সা) বললেন, যখন রোযাদারের নিকট কিছু খাওয়া হয় তখন ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করে। [প্রাগুক্ত; মুসনাদে আহমাদ-৬/৪৩৯; তিরমিজী-৭৮৫; ইবন মাজাহ-১৭৪৮]

খলীফা হযরত উমারও (রা) উম্মু উমারার (রা) সম্মান ও মর্যাদার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। তার খেলাফত কালে একবার গনীমতের মালের মধ্যে কিছু চাদর আসে। তার মধ্যে একটি চাদর ছিল খুবই সুন্দর ও দামী। অনেকে বললেন, এটি খলীফা তনয় আবদুল্লাহর (রা) স্ত্রীকে দেওয়া হোক। অনেকে খলীফার স্ত্রী কুলছুম বিনত আলীকে (রা) দেওয়ার কথা বললেন। খলীফা কারো কথায় কান দিলেন না। তিনি বললেন, আমি এ চাদরের সবচেয়ে বেশী হকদার উম্মু উমারাকে মনে করি। এটি তাকেই দেব। কারণ, আমি উহুদের দিন তার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সা) বলতে শুনেছি : “আমি যে দিকেই দৃষ্টিপাত করছিলাম, শুধু উম্মু উমারাকেই লড়তে দেখছিলাম।“ অতপর তিনি চাদরটি তার কাছে পাঠিয়ে দেন। [তাবাকাত-৮/৪১৫; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৮১; আনসাব আল-আশরাফ-১/৩২৬]

রাসূলুল্লাহর (সা) বেশ কিছু হাদীস তার সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তার থেকে এ হাদীসগুলি উব্বাদ ইবন তামীম ইবন যায়দ, হারিছ ইবন আবদিল্লাহ ইবন কা‘ব আকরামা ও লায়লা বর্ণনা করেছেন। [আল-ইসাবা-৪/৪৮০]

হযরত উম্মু উমারার (রা) মৃত্যসন সঠিকভাবে জানা যায় না। মুসায়লামার সাথে যুদ্ধ পর্যন্ত যে জীবিত ছিলেন সেটা নিশ্চিত। তবে তার পরে কতদিন জীবিত ছিলেন তা নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারেননি।

হযরত উম্মু উমারা (রা) সব সময় রাসূলের (সা) মজলিসে উপস্থিত থাকতেন এবং মনোযোগ সহকারে তার কথা শুনতেন। এভাবে তার বিশ্বাস প্রতিদিনই দৃঢ় হতো এবং জ্ঞান ‍বৃদ্ধি পেত। একদিন তিনি রাসূলুল্লাহকে বলেন : আমি দেখতে পাচ্ছি সব জিনিসই পুরুষদের জন্য, মহিলাদের জন্য কোন কিছুর উল্লেখ করা হয় না। অর্থাৎ তার দাবী ছিল কুরআনে পুরুষদের কথা যেমন এসেছে নারীদের কথাও তেমন আসুক। তার এমন দাবীর প্রেক্ষাপটে নাযিল হলো সূরা আল-আহযাবের ৩৫ তম আয়াতটি। [তিরমিজী-৪/১১৬; প্রাগুক্ত-৪/৪৭৯]
উম্মু ওয়ারাক ইবন নাওফাল (রা)
এ পৃথিবীতে এমন অনেক মহিলা আছেন কালচক্র যাদেরকে লুকিয়ে রেখেছে এবং ইতিহাসও তাদের ব্যাপারে নীরবতা পালন করেছে। তা সত্বেও আল্লাহ তায়ালা তাদের জীবন এমন কোন ঘটনার সৃষ্টি করেছেন যাতে তাদের জীবনী প্রকাশ হয়ে পড়েছে। আর যখন তাদের স্মরণ ও স্মৃতির উপর থেকে পুঞ্জিভূত ধুলি ও আবর্জনা পরিষ্কার হয়ে গেছে তখন তাদের ছবিগুলো উজ্জ্বল ও দীপ্তিমান হয়ে উঠেছে। তাদের একজন হলেন উম্মু ওয়ারাকা আল-আনসারিয়্যা (রা)। উম্মু ওয়ারাকা এই উপনামেই তিনি ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। সাহাবীদের চরিত অভিধানের একটিতেও তার আসল নামটি উল্লেখ করা হয়নি। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে “আশ-শাহীদা“ (মহিলা শহীদ) উপাদি দান করেন। [আল-ইসাবা-৪/৪৮১] তার বংশ পরিচয় এ রকম : উম্মু ওয়ারাকা বিনত আবুদিল্লাহ ইবন আল-হারিছ ইবন উওয়াইমির ইবন নাওফাল। তবে ‘উসুদুল গাবা‘ গ্রন্থে ‘উওয়াইমির‘ এর স্থলে উমাইর এসেছে। তিনি তার বংশের এক উর্দ্ধতন পুরুষ “নাওফাল“ এস প্রতি আরোপিত হয়ে উম্মু ওয়ারাকা বিনত নাওফাল বলে পরিচিত লাভ করেছেন। [উসুদুল গাবা-৫/৬২৬; তাহযীবুত তাহযীব-১২/৪৮২] তার জন্ম ও মৃত্যুর সন সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। তবে এ কথা মোটামুটি সর্বজন স্বীকৃত যে, খলীফা উমার ইবন খাত্তাবের (রা) খিলাফতকালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, তিনি যেমন রাসূলুল্লাহর (সা) জীবনকাল পেয়েছেন, তেমনি ভাবে পেয়েছেন খলীফা আবূ বকরের (রা) খিলাফতকালের পুরোটা এবং উমারের (রা) খিলাফতকালের কিছুটা। তিনি সম্ভবত হিজরী বাইশ সনে শাহাদাত বরণ করেন। [তাবাকাত-৯/১৬৫; নিসা রায়িদাত, পৃ.-১০৮]

উম্মু ওয়ারাকা ছিলেন একজন আনসারী মহিলা। রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় হিজরাতের অব্যবহিতপরে যে সকল মহিলা তাঁর রিসালাতে বিশ্বাস করে তাঁর নিকট বাই‘আত করেন তিনি তাঁদের একজন।[আ‘লা আন-নিসা‘-৫/২৮৪; তাবাকাত-৮/৪৫৭] তিনি ইসলামকে অতি চমত্কার রূপে ধারণ করেন এবং আল্লাহর দীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। আল-কুরআন অধ্যয়ন করেন এবং তার বেশীর ভাগ মুখস্ত করে ফেলেন। একটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি সমগ্র কুরআন সংগ্রহ করেন।[আল-ইসাবা-৪/৫০৫] একথা বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আবু বকর (রা) যখন কুরআন সংগ্রহ ও সংকলন করেন, তখন এই উম্মু ওয়ারাকার সংগ্রহেরও সাহায্য নেন। তিনি কুরআনের কিছু কিছু সূরা লেখা ছিল এমন কিছু সহীফা (পুস্তিকা) সংরক্ষণ করতেন।[নিসা‘ রায়িদাত-১০৮] তাঁর কাছে সমগ্র কুরআন না হলেও অধিকাংশ লিখিত আকারে সংরক্ষিত ছিল। তিনি ছিলেন একজন তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ঈমানদার মহিলা। দীনের বিধি-বিধান সম্পর্কে দক্ষ। রাসূল (সা) মাঝে মাঝে তাঁর গৃহে যেতেন। তিনি ছিলেন সেই সব মুষ্টিমেয় মহিলার একজন যাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করতে রাসূল (সা) তাঁদের বাড়ীতে যেতেন। রাসূল (সা) তাঁর অর্থ-সম্পদ ও সমাজে উঁচু স্থানের জন্য তাঁকে এভাবে মূল্যায়ন করতেন না, বরং তাঁর আল্লাহর উপর ঈমান, দৃঢ় আকীদা-বিশ্বাস এবং দীনের বিধি-বিধানের দক্ষতা ও ‘ইবাদাত-বন্দেগীর কারণে তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য যেতেন। হিজরী ২য় সনে রাসূল (সা) বদরে মক্কার পৌত্তলিকদের সাথে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন। এ খবর উম্মু ওয়ারাকার নিকট পৌঁছলো। তিনি যুদ্ধে যোগদানের জন্য জিদ ধরে বসলেন। ঘর-গৃহস্থলীর নানা রকম দায়িত্ব, সন্তান প্রতিপালনের কর্তব্যসমূহ তাঁকে “জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ“ (আল্লাহর পথে জিহাদ)-এর কর্তব্য থেকে বিরত রাখতে পারলো না। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট ছুটে গেলেন এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অনুমতি চাইলেন। তিনি তাঁর উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বললেন, যুদ্ধে আহতদের ব্যাণ্ডেজ বাঁধবেন, রোগীদের সেবা করবেন, তাঁদের পানাহারের নিশ্চয়তা বিধান করবেন এবং যুদ্ধ চলাকালে যোদ্ধাদের প্রয়োজনে সাড়া দিবেন। তিনি সেখানে এমন সব ভূমিকা পালন করবেন যার গুরুত্ব যোদ্ধাদের ভূমিকার চেয়ে কোন অংশ কম নয়। হতে পারে আল্লাহ তায়ালা তদের সাথে এই বের হাওয়াতে শাহাদাতও দান করতে পারেন। আল-ইসাবার বর্ণনায় তার বক্তব্য এভাবে এসেছে : [আল-ইসাবা-৪/৫০৫]

ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে অনুমতি দিলে আমি আপনাদের সাথে ‍যুদ্ধে যেতাম। আপনাদের অসুস্থদের সেবা করতাম, আহতদের ঔষধ পান করাতাম। এতে আল্লাহ তা‘য়ালা আমাকে শাহাদাতও দান করতে পারেন। জবাবে রাসূল (সা) বলেন : ওহে উম্মু ওয়ারাকা! তুমি ঘরেই অবস্থান কর। নিশ্চয় আল্লাহ ঘরেই তোমার শাহাদাতের ব্যবস্থা করবেন।‘ অন্য একটি বর্ণনায় “আল্লাহ তোমাকে শাহাদাত দান করবেন“ কথাটি এসেছে।[তাবাকাত-৮/৪৫৭; আল-ইসতী‘আব-৪/৪৮১; সুনানু আবী দাউদ-১/৯৭; আস-সীরাহ আল-হালাবিয়্যাহ-২/৩৫৭] মূলত এ দিন থেকেই রাসূল (সা) তাঁকে শহীদ হিসাবে আখ্যায়িত করেন। তিনি মাঝে মাঝে তাঁকে দেখার জন্য তাঁর বাড়ীতে সাহাবীদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। বলতেন : (আরবী**********) [আবূ-নু‘আয়ম, হিলয়িতুল আওলিয়া-২/৬৩; উসুদুল গাবা-৫/৬২৬ (৭৭১৮)]

“তোমরা আমার সাথে চলো, আমরা এই মহিলা শহীদকে একটু দেখে আসি।“ রাসূলের (সা) এ জাতীয় কথা দ্বারা এই মহিলা যে শহীদ হবেন সেদিকেই ইঙ্গিত করতেন।

ইসলামের ইতিহাসে অনেকগুলো বিষয় উম্মু ওয়ারাকার অগ্রগামিতার কথা জানা যায়। যেমন :

১. তিনি প্রথম মহিলা যাঁর গৃহে আযান দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

২. মদীনায় সর্বপ্রথম তিনি মহিলাদের নামাযের জামা‘আত প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেই জামা‘আতের ইমামতি করেন।

৩. তিনি ইসলামের প্রথম মহিলা রাসূল (সা) যাঁকে “শাহীদা“ উপাধি দান করেন।

৪. ইসলামের ইতিহাসে তিনি প্রথম মহিলা যাঁকে হত্যার অভিযোগে একজন দাস ও একজন দাসীকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয়।[নিসা‘রাদিয়াত-১১০]

উম্মু ওয়ারাকা তাঁর নিজ বাড়ীতে একটি নামায-ঘর প্রতিষ্ঠা এবং প্রত্যেক নামাযের ওয়াকতে আযান দেওয়ার জন্য একজন মুআযযিন নিয়োগের জন্য রাসূলুল্লাহর (সা) অনুমতি চাইলেন। রাসূল (সা) তাঁর বাড়ীতে আযান দেওয়ার জন্য একজন মুআযযিন ঠিক করে দেন। তিনি প্রত্যেক নামাযের সময় আযান দিতেন। উম্মু ওয়ারাকার মৃত্যু পর্যন্ত এ ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকে।[আবূ দাঊদ-১/৯৭; নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-২৯৭] তিনি প্রথম মহিলা যিনি এ সৌভাগ্য ও গৌরবের অধিকারী হন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা করেছেন, আমি উম্মু ওয়ারাকার মু‘আযযিনকে দেখেছি। তিনি ছিলেন একজন অতি বৃদ্ধ ব্যক্তি। সেই ব্যক্তির নাম আবদুর রহমান।[নিসা‘ মুবাশশারাত বিল জিন্নাহ-২৯৩]

রাসূল (সা) তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা, প্রখর স্মৃতিশক্তি ও দীনের বিধি-বিধান সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের কথা জানতেন। তাই তিনি মআযযিনের আযান দেওয়ার পর উম্মু ওয়ারাকাকে তাঁর নিজের বাড়ীতে ও প্রতিবেশী মেয়েদের নিয়ে তাঁর বাড়ীতে জামা‘আত কায়েম করার ও তাতে ইমামতি করার অনুমতি দান করেন। এ ব্যবস্থা উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) খিলাফতকালে অর্থাৎ উম্মু ওয়ারাকার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। ইসলামের ইতিহাসে তিনি প্রথম মহিলা যাঁর বাড়ীতে মেয়েদের জন্য মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। [প্রাগুক্ত; সাহাবিয়াত-২১৬]

উম্মু ওয়ারাকার (রা) বয়স বেড়ে গেল। ছেলে-মেয়েরা বড় হলো। মেয়েদের বিয়ে হলো এবং এক এক করে তারা স্বামীর ঘরে চলে গেল। ছেলেরাও নিজ নিজ দায়িত্বের খাতিরে মায়ের নিকট থেকে দূরে যেতে বাধ্য হলো। ‍উম্মু ওয়ারাকর বাড়ীটি এখন একেবারে শূন্য প্রায়।

তিনি নিজের সেবা ও বাড়ী-ঘর দেখাশুনা করার জন্য একজন দাস ও একজন দাসী রাখলেন। তিনি তাদের সাথে অতি ভালো ব্যবহার করতেন। তিনি তাঁদেরকে কথা দেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর তারা স্বাভাবিক ভাবে আযাদ হয়ে যাবে। অর্থাৎ দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। এই দাস-দাসী খুব শীঘ্র উম্মু ওয়ারাকার মৃত্যুর কোন লক্ষণ দেখতে পেল না। তাদের আর তর সইলো না। তারা তাঁর পরিবারের লোকদের অনুপস্থিতিতে খালি বাড়ীতে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করলো। সুযোগ মতো এক রাতে তারা একটি কাপড় পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে তাঁকে হত্যা করলো এবং নিজেদেরকে দাসত্ব থেকে মুক্ত মনে করে পালিয়ে গেল।

উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) উম্মু ওয়ারাকার (রা) বাড়ীর আযান ও মেয়েদের জামা‘আতের তোড়জোড়ের সাড়া-শব্দ প্রতিদিন শুনতে পেতেন। একদিন তিনি বললেন, আচ্ছা গতকাল থেকে তো উম্মু ওয়ারাকা খালার কুরআন পাঠের শব্দ শুনতে পাচ্ছিনে। তাঁর কি হলো? তাঁর খবর জানার জন্য তিনি লোক পাঠালেন। লোকটি ফিরে এসে বললো বাড়ীটি বাইরে থেকে তালা মারা এবং দরজায় টোকা দিয়ে ভিতর থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। উমারের (রা) সন্দেহ হলো। এবার তিনি নিজে গেলেন। বাড়ীতে কাওকে না দেখে ভিতরে ঢুকলেন। ঢুকেই দেখলেন, একটি চাদরে জড়ানো অবস্থায় তাঁর লাশ মেঝেতে পড়ে আছে। তিনি জোরে “আল্লহু আকবার“ বলে উঠলেন। তারপর মন্তব্য করেন : রাসূল (সা) যখন তাঁকে “শাহীদা“ উপাধি দেন তখন সত্যই বলেছিলেন।[আল-ইসাবা-৪/৫০৫]

তারপর উমার (রা) মসজিদের মিম্বরে উঠে ঘোষণা দেন যে, উম্মু ওয়ারাকা শহীদ হয়েছেন। তাঁর দুই দাস-দাসী তাঁকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে পালিয়েছে। তিনি তাদেরকে খুঁজে বের করে ধরে নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দেন। মুহূর্তে জনতা তাদের খোঁজে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তারা পালিয়ে যাওয়া অবস্থায় ধরা পড়ে এবং তাদেরকে মদীনায় খলীফা উমারের (রা) সামনে হাজির করা হয়। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রথমে তারা হত্যার সাথে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করতে চাইলেও পরে স্বীকার করে যে, দু‘জনে একজোগে তাঁকে হত্যা করেছে। তখন উমার (রা) তাঁর আগের কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন : আল্লাহর রাসূল (সা) সত্য বলেছেন যখন তিনি বলতেন : (আরবি*****************) “তোমরা আমার সাথে চলো, এই শহীদকে দেখে আসি।“ এভাবে উম্মু ওয়ারাকা (রা) হন ইসলামের প্রথম মহিলা যাঁকে “আশ-শাহীদা“ অভিধায় ভূষিত করা হয়।

দাস-দাসীর দু‘জনের শাস্তি ছিল অবধারিত। উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) তাদেরকে শূলীতে চড়িয়ে হত্যার নির্দেশ দেন। তাদেরকে শূলীতে চড়িয়ে হত্যা করা হয়। এ দু‘জন দাস-দাসী ছিল মদীনার প্রথম শূলীতে চড়ানো দু‘ব্যক্তি, আর উম্মু ওয়ারাকা হলেন ইসলামের প্রথম মহিলা যাঁকে হত্যার কারণে একজন দাস একজন দাসী কে শূলীতে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।[আবূ-দাঊদ-১/৯৭; তাবাকাত-৮/৪৫৭; আল-ইসতী‘আব-৪/৪৮২]

দীনের তাত্পর্য গভীরভাবে হ্রদয়ঙ্গম করা, পাড়া-প্রতিবেশী ও তাঁর নিকট আগত মহিলাদের শিক্ষা দানের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার কারণে উম্মু ওয়ারাকা (রা) মুসলিম নারীদের একজন নেত্রীতে পরিণত হন। শাহাদাত লাভের বাসনায় জিহাদে যোগদানের যে ইচ্ছার কথা রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট প্রকাশ করেন তাতে তাঁর মহত্ব ও মর্যাদা শতগুণ বেড়ে যায়।

উম্মু ওয়ারাকার (রা) নিহত হওয়ার মধ্যে এমন প্রত্যেক মানুষের জন্য শিক্ষা রয়েছে, যারা দাস-দাসী ও চাকর-চাকরানীর উপর সম্পুর্ণ নির্ভর করে, বিশেষত সেই দাস-দাসী ও চাকর-চাকরানী যদি হয় অমুসলিম। জগতে এমন বহু দাস-দাসী ও চাকর-চাকরানীর কথা জানা যায় যারা তাদের মনিবদের জীবনে বহু অকল্যাণ বয়ে নিয়ে এসেছে। পৃথিবীর প্রায় সকল জাতি-গোষ্ঠির লোকদের মধ্যে একথাটি শোনা যায় যে, তুমি যার উপকার করেছো তার অনিষ্ট থেকে সতর্ক থাক। উম্মু ওয়ারাকা তারঁ দাস-দাসীর প্রতি সুন্দর আচরণ করেছিলেন, তাদেরকে মুক্তির অঙ্গীকার করেছিলেন, আর তারই পরিণতিতে তাদেরই হাতে তাঁকে প্রাণ দিতে হয়। আধুনিক যুগের মুসলিম মহিলাদের জন্য এই ঘটনার মধ্যে বিরাট শিক্ষা ও উপদেশ করেছে।

উম্মু ওয়ারাকা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর তাঁরা থেকে পৌত্ররা বর্ণনা করেছেন।[নিসা‘রায়িদাত-১১৩]
উম্মু হাকীম বিনত আল-হারিছ (রা)
হযরত রাসূলে কারীম (সা) নবুওয়াত লাভের পর মক্কা এবং পরে মদীনায় বিশ বছরের অধিক সময় আরবের লোকদেরকে, বিশেষকরে মক্কাবাসীদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে গেছেন। তাদেরকে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের দিকে আহবান জানিয়েছেন, কিন্তু মক্কাবাসীরা অন্ধ ও বধিরের তম আচরণ করেছে। তাদের সে আচরণ ছিল এমন : (আরবী***********) [সূরা হা-মীম আস-সাজদাহ-৫]

“তারা বলে, তুমি যার প্রতি আমাদেরকে আহবান করছো সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আবরণ আচ্ছাদিত, আমাদের কানে আছে বধিরতা এবং তোমার ও আমাদের মধ্যে আছে অন্তরাল। সুতরাং তুমি তোমার কাজ কর এবং আমরা আমাদের কাজ করি।“

তারা প্রেম প্রীতির বদলা দিল শত্রুতা দ্বারা এবং কল্যাণ ও ‍উপকারের বদলা দিল অকল্যাণ ও ক্ষতির দ্বারা, তাদের সে আচরণ ছিল এমন : (আরবী ***************) [সূরা আল-কামার-৩]

“তারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে, আর প্রত্যেক ব্যাপারই লক্ষ্যে পৌছবে।“

তারা হযরত রাসূলে করীমের (সা) সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে মক্কা থেকে তাড়িয়ে দেয়। তাতেও তারা তুষ্ট হতে পারেনি। বার বার যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ইসলামের আলোকে নিভিয়ে দিতে সব রকমের সুযোগকে কাজে লাগায়।

অতপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের উপর বিজয় দান করলেন। মক্কা বিজয় হলো। অতবড় বিশ্ব যখন তাদের নিকট সংকীর্ণ হয়ে পড়লো, তারা যখন চতুর্দিকে কেবল অন্ধকার দেখতে লাগলো তখন আল্লাহর রাসূল (সা) তাদের প্রতি মহানুভবতার পরিচয় দিলেন। তাদের বিগত দিনের সকল আচরণ ক্ষমা করে দিলেন। মক্কাবাসীরা স্বেচ্ছায় দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করলো। উম্মু হাকিম, তাঁর পিতা, মাতা ও স্বামী সকলে মক্কা বিজয়ের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, এ চার জনই ছিলেন ইসলাম ও রাসূলুল্লাহর (সা) চরম দুশমন। ইসলামের সূচনা থেকে ঈমান আনার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত বিশ বছর তাঁদের শত্রুতা ছিল মাত্রা ছাড়া।

উম্মু হাকীম মক্কার কুরাইশ গোত্রের আল-মাখযূমী শাখার সন্তান। উম্মু হাকীম ডাক নাম। এর অন্তরালে তাঁর আসল নামটি হারিয়ে গেছে। তা আর জানা যায় না। ‍উম্মু হাকীমের পরিবারটি ছিল কুরাইশ বংশের মধ্যে সম্মান, মর্যাদা ও নেতৃত্বের অন্যতম কেন্দ্র। পিতা আল-হারিছ ইবন হিশাম ইবন আল-মগীরা আল-মাখযূমী, নরাধম আবূ-জাহলের ভাই। মক্কা বিজয়ের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন। একজন ভদ্র ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। ইসলামের উপর অটল রাখার উদ্দেশ্যে রাসূল (সা) হুনাইন যুদ্ধের গণীমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) থেকে একশো (১০০) উট তাঁকে দান করেন। তিনি একজন ভালো মুসলমান হন। পরবর্তীকালে একজন মুজাহিদ হিসেবে শামে যান এবং সেখানে ‘আঊন‘ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।[আয-যাহবী, তারীখ আল-ইসলাম-২/১৮৩-১৮৪]

মা ফাতেমা বিনত আল-ওয়ালীদ ইবন আল-মুগীরা আল-মাখযূমিয়্যা প্রখ্যাত সেনানায়ক খালিদ ইবন আল-ওয়ালীদের (রা) বোন। মক্কা বিজয়ের ‍দিন ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লহর (সা) একটি হাদীস তিনি বর্ণনা করেছেন। স্বামী আল-হারিছের শাম অভিযানে তিনিও সফর সঙ্গী হন। আল-হারিছের ঔরসে তিনি ছেলে আবদুর রহমান ও মেয়ে উম্মু হাকীমের জন্ম দেন।[তারীখু ‍দিমাশক-তারাজিম আন-নিসা-৩০৫-৩০৭]

উম্মু হাকীমের স্বামী ইকরিমা ইবন আবী জাহল আল-মাখযূমী জাহিলী মক্কার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা। মক্কা বিজয়ের পরে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে ইসলামের ঘোষণা দেন এবং পরবর্তীতে একজন অতি ভালো মুসলমান হন। শাম অভিযানে বের হন এবং হিজরী ১৩ সনে আজনাদাইন, মতান্তরে ইয়ারমুক যুদ্ধে শহীদ হন। উম্মু হাকীমের মামা সাইফুল্লাহ খালিদ ইবন আল-ওয়ালীদ (রা)।

এমনই এক পরিবার ও পরিবেশে উম্মু হাকীম বেড়ে উঠেন। চাচাতো ভাই ইকরিমাকে বিয়ে করেন। মহানবী (সা) মক্কায় রাসূল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। যে দিন তিনি ইসলামের দিকে মক্কাবাসীদেরকে আহবান জানালেন সেই দিন থেকে এই পরিবারটি মহানবী (সা) ও ইসলামের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত ইসলামকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য যত রকম ষড়যন্ত্র করা হয়েছ, ইসলামকে সমূলে উত্খাত করার জন্য যত যুদ্ধ হয়েছে, তার সবকিছুতে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। উহুদ যুদ্ধে আল-হারিছ, তাঁর স্ত্রী ফাতিমা, ইকরিমা, তাঁর স্ত্রী উম্মু হাকীম ও খালিদ ইবন আল-ওয়ালীদ- কুরাইশ বাহিনীর সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন।

ইসলামের বিরোধিতা ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে কোন সুযোগকে তাঁরা হাতছাড়া করেননি। এমনকি হযরত রাসূলে কারীম (সা) যাদেরকে মহা অপরাধী বলে ঘোষণা দেন এবং কা‘বার গিলাফের নীচে পাওয়া গেলেও হত্যার নির্দশ দেন, উম্মু হাকীমের স্বামী ইকরিমা তাদের অন্যতম।

হযরত রাসূলে কারীম (সা) মক্কা বিজয়ের পর যে অবস্থান গ্রহণ করেন মানব জাতির ইতিহাসে তা এক অনন্য আদর্শ হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে আছে। সে দিন তাঁর দয়া ও করুণা শত্রু-মিত্র, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সকলকে বেষ্টন করে। দীর্ঘদিন যাবত যারা তার প্রতি অন্ধ বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করেছে, সেদিন তাঁর এই ব্যাপক ক্ষমা ও দয়া তাদের পাষাণ হ্রদয় পরম প্রশান্তি বয়ে আনে। মুহুর্তে তাদের অন্তর জেগে ওঠে এবং ভ্রান্তির বেড়াজাল ছিন্ন করে পতঙ্গের ন্যায় আলোর নিকট নিজেদেরকে সমর্পন করে। উম্মু হাকীম নিজে তাঁর স্বামীর জন্য এই ক্ষমার সুযোগ গ্রহণ করেন। তিনি কুরাইশ গোত্রের অন্যসব মহিলা, যেমন : ফাতিমা বিনত আল-ওয়ালীদ, হিন্দ বিনত উতবা, ফাখতা বিনত আল-ওয়ালীদ প্রমুখের সাথে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যান এবং ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে বাই‘আত করেন। ইসলাম গ্রহণের পর থেকে রাসূল (সা) তাঁকে যথেষ্ট সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। এ কারণে মহিলা সমাজে তিনি এক বিশেষ মর্যাদার আসন লাভ করেন।

উম্মু হাকীমের স্বামী ইকরিমা ছিলেন ইসলামের চরম দুশমন। মহানবীর দৃষ্টিতে মহা অপরাধী। তাই রাসূল (সা) তার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন। মক্কা বিজয়ের পর প্রাণভয়ে তিনি ইয়ামনে পালিয়ে যান। স্ত্রী উম্মু হাকীমের চেষ্টায় তিনি মক্কায় ফিরে আসেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর উম্মু হাকীম (রা) উঠে দাঁড়িয়ে বললেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি ইকরিমাকে হত্যা করতে পারেন, এ ভয়ে সে ইয়ামনের দিকে পালিয়ে গেছে। আপনি তাঁকে নিরাপত্তা দিন, আল্লাহ আপনাকে নিরাপত্তা ‍দিবেন। রাসূল (সা) বললেন : সে নিরাপদ।

সেই মুহুর্তে উম্মু হাকীম স্বামী ইকরিমার সন্ধানে বের হলেন। সংগে নিলেন তাঁর এক রোমান ক্রীতদাসকে। তাঁরা দু‘জন চলছেন। পথিমধ্যে দাসের মনে তার মনিবের প্রতি অসৎ কামনা দেখা দিল। সে চাইলো তাঁকে ভোগ করতে, আর তিনি নানা রকম টালবাহানা করে সময় কাটাতে লাগলেন। এভাবে তাঁরা একটি আরব গোত্রে পৌছলেন। উম্মু হাকীম তাদের সাহায্য কামনা করলেন। তারা সাহায্যের আশ্বাস দিল। তিনি দাসটিকে তাদের জিম্মায় রেখে একাকী পথে বের হলেন। অবশেষে তিহামা অঞ্চলে সাগর তীরে ইকরিমার দেখা পেলেন। সেখানে তিনি এক মাঝির সাথে কথা বলছেন তাকে পার করে দেওয়ার জন্য, আর মাঝি তাকে বলছেন :

-সত্যবাদী হও।

ইকরিমা বললেন : কিভাবে আমি সত্যবাদী হবো?

মাঝি বললেন : তুমি বলো, (আরবি ************)

“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি এক আল্লাহ ছড়া আর কোন ইলাহ আ মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।“

ইকরিমা বললেন : আমি তো শুধু এ কারণে পালিয়েছি।

তাদের দু‘জনের এ কথোপকথনের মাঝখানেই উম্মু হাকীম উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁর স্বামী কে লক্ষ্য করে বললেন : হে আমার চাচাতো ভাই! আমি সর্বোত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম ব্যক্তির নিকট থেকে আসছি। আমি তাঁর কাছ থেকে আমান (নিরাপত্তা) চেয়েছি। তিনি আপনার আমান মঞ্জুর করেছেন। সুতরাং এরপরও আপনি নিজেকে ধ্বংস করবেন না।

ইকরিমা জানতে চাইলেন : তুমি নিজেই তাঁর সাথে কথা বলেছো? বললেন : হাঁ, আমিই তাঁর সাথে কথা বলেছি এবং তিনি আপনাকে আমান দিয়েছেন। বার বার তিনি তাঁকে আমানের কথা শোনাতে লাগলেন। অবশেষে আশ্বস্ত হয়ে স্ত্রীর সাথে ফিরে চললেন।[আ‘লাম আন-নিসা-১/২৮১]

পথে চলতে চলতে উম্মু হাকীম তাঁর দাসটির অসৎ অভিপ্রায়ের কথা স্বামীকে বললেন। ফেরার পথে ইসলাম গ্রহণের পূর্বেই ইকরিমা দাসটিকে হত্যা হরেন। পথিমধ্যে তাঁরা এক বাড়ীতে রাত্রি যাপন করেন। ইকরিমা চাইলেন স্ত্রীর সাথে একান্তে মিলিত হতে। স্ত্রী কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে বলেন : আমি একজন মুসলিম নারী এবং আপনি এখনো একজন মুশরিক। স্ত্রীর কথা শুনে ইকরিমা অবাক হয়ে গেলেন। বললেন : তোমার ও আমার মিলনের মাঝখানে যে ব্যাপারটি অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাতো খুব বিরাট ব্যাপার।

এভাবে ইকরিমা যখন মক্কার নিকটবর্তী হলেন, তখন রাসূল (সা) তাঁর সাহাবীদের বললেন : খুব শিগগির ইকরিমা কুফর ত্যাগ করে মু‘মিন হিসেবে তোমাদের কাছে আসছে। তোমরা তার পিতাকে গালি দেবেনা। মৃত ব্যক্তিকে গালি দিলে তা জীবিতদের মনে কষ্টের কারণ হয় এবং তা মৃতের কাছেও পৌছে না।

কিছুক্ষণের মধ্যে ইকরিমা তাঁর স্ত্রী উম্মু হাকীমসহ রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট উপস্থিত হলেন। রাসূল (সা) তাঁকে দেখেই আনন্দে উঠে দাঁড়ালেন এবং চাদর গায়ে না জড়িয়েই তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর রাসূল (সা) বসলেন। ইকরিমা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বলেন :

ইয়া মুহাম্মাদ! উম্মু হাকীম আমাকে বলেছে আপনি আমাকে আমান দিয়েছেন। নবী বললেন : সে ঠিক বলেছে। তুমি নিরাপদ। ইকরিমা বললেন : মুহাম্মাদ আপনি কিসের দা‘ওয়াত দিয়ে থাকেন?

রাসূল (সা) বললেন : আমি তোমাকে দা‘ওয়াত দিচ্ছি তুমি সাক্ষ্য দেবে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি (মুহাম্মাদ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। তারপর তুমি নামায কায়েমকরবে, যাকাত আদায় করবে। এভাবে তিনি ইসলামের সবগুলি আরকান বর্ণনা করলেন।

ইকরিমা বললেন : আল্লাহর কসম! আপনি কেবল সত্যের দিকেই দা‘ওয়াত ‍দিচ্ছেন এবং কল্যাণের কথা বলছেন। তারপর তিনি বলতে লাগলেন :

এ দা‘ওয়াতের পূ্র্বেই আপনি ছিলেন আমাদের মধ্যে সর্বাধিক সত্যবাদী ও সত্কর্মশীল। তারপর “আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লহু ওয়া আশহাদু আন্নাকা আবদুহু ওরাসূলুহু“- বলতে বলতে রাসূলুল্লহর (সা) ‍দিকে হাত বাড়িয়ে দেন।

রাসূল (সা) বললেন : তুমি বলো, “উশহিদুল্লাহ ওয়া উশহিদু মান হাদারা আন্নি মুসলিমুন মুজাহিদুন মুহাজিরুন“-আল্লাহ ও উপস্থিত সকলকে সাক্ষি রেখে বলছি আমি একজন মুসলিম, মুজাহিদ ও মুহাজির।

ইকরিমা তাই উচ্চারণ করলেন। তারপর রাসূল (সা) তাঁকে বললেন : অন্য কাউকে আমি দিচ্ছি, এমন কিছু আজ যদি আমার কাছে চাও, আমি তোমাকে দেব।

ইকরিমা বললেন : আমি চাচ্ছি যত শত্রুতা আমি আপনার সাথে করেছি, যত যুদ্ধে আমি আপনার মুখোমুখি হয়েছি এবং আপনার সামনে অথবা পিছনে যত কথাই আমি আপনার বিরুদ্ধে কলেছি- সবকিছুর জন্য আপনি আল্লাহর কাছে আমার মাগফিরাত কামনা কিরুন।

রাসূল (সা) তাঁর জন্য দু‘আ করলেন : হে আল্লাহ! যত শত্রুতা সে আমার সাথে করেছে, তোমার নূরকে বিভিয়ে দেওয়ার দেওয়ার উদ্দেশ্যে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হতে যত পথই সে ভ্রমণ করেছে- সবকিছুই তাকে ক্ষমা করে দাও। আমার সামনে বা অগোচরে আমার মানহানিকর যত কথাই সে বলেছে, তা-ও তুমি ক্ষমা করে দাও।

আনন্দে ইকরিমার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, তিনি বললেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর কসম! আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যতকিছু আমি ব্যয় করেছি তার ‍দ্বিগুণ আল্লাহর পথে ব্যয় করবো এবং আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যুদ্ধ আমি করেছি, তার ‍দ্বিগুণ যুদ্ধ আমি আল্লাহর পথে করবো।[ আত-তাবারী, তারীখ-২/১৬০; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৪/২৯৭; আল-আ‘লাম-২/২৬৯; উসুদুল গাবা-৫/৫৭৭; আসহাবে রাসূলের জীবন কথা-১/২০৫-২০৮]

এদিন থেকেই তিনি আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী কাফেলায় শরীক হলেন এবং ইয়ারমূক যুদ্ধে শাহাদাত বরণের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে কৃত অঙ্গীকার অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণ করেন।

উম্মু হাকীম (রা) স্বামী ইকরিমার (রা) সাথে রোমানদের সাথে যু্দ্ধের জন্য শামে যান। ইয়ারমূক রাণাঙ্গনে রোমান ও মুসলিম বাহিনী মুখোমুখি হয় এবং প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে কুরাইশ রমণীরা অসি চালনায় পুরুষ যোদ্ধাদেরকেও হার মানায়। এই রমণীদের মধ্যে উম্মু হাকীমও একজন। এই ইয়ারমূক যুদ্ধে উম্মু হাকীম (রা) স্বামীকে হারান। ইকরিমা (রা) এ যুদ্ধে শহীদ হন।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-১/৩২৪; আল-ইসাবা-৪/৪২৬] চার মাস দশ ‍দিন ইদ্দত পালনের পর বহু লোক তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। ইয়াযীদ ইবন আবী সুফইয়ানও (রা) তাঁদের একজন। তিনি সকলকে হতাশ করে খালিদ ইবন সা‘ঈদ ইবন আল-আসের (রা) প্রস্তাবে সাড়া দেন। চার শো দীনার মাহরের বিনিময়ে তাঁর সাথে বিয়ে সম্পন্ন হয়। আকদ সম্পন্ন হলেও বাসর শয্যার পূর্বেই ‍দিমাশকের দক্ষিণে সংঘটিত “মারজ আস-সাফার“ যুদ্ধের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। মুসলিম সৈনিকরা সেখানে চলে যায়। হযরত খালিদ (রা) যুদ্ধে যাওয়ার আগেই স্ত্রীর সাথে বাসর সম্পন্ন করতে চাইলেন। স্ত্রী উম্মু হাকীম বললেন : শত্রু বাহিনীর এই সমাবেশ পর্যুদস্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত।

খালিদ (রা) বললেন : আমার অন্তর বলছে এই যুদ্ধে আমি শাহাদাত বরণ করবো। উম্মু হাকীম (রা) আর আপত্তি করলেন না। মারজ আস-সাফারে একটি পুলের ধারে একটি তাঁবুর মধ্যে তাঁদের বাসর শয্যা রচিত হয় এবং সেখানে তাঁরা রাত্রি যাপন করেন।

পরবর্তীকালে এ পুলটির নাম হয় “কানতারাতু উম্মি হাকীম“-উম্মু হাকীমের পুল। সকালে ওলীমা ভোজও হয়। ভোজ শেষ হতে না হতেই রোমানদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। খালিদ (রা) শত্রু বাহিনীর উপর ঝাঁপিয় পড়েন এবং বীরের মত যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। উম্মু হাকীম (রা) তখনো নববধূর সাজে। হাতে মেহেদীর রং, দেহে সুগন্ধি। যে তাঁবুতে রাত বাসর করেছেন, তার একটি খুঁটি তুলে হাতে নিলেন। সেই তাঁবুর পাশেই তিনি রোমান সৈনিকদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন এবং সেই খুঁটি দিয়ে পিটিয়ে সেদিন তিনি সাতজন রোমান সৈন্যকে হত্যা করেন।[আল-ইসতী‘আব-৪/৪২৫; তারীখু দিমাশক-৫০৬; উসুদুল গাবা-৫/৫৭৭; আ‘লাম আন-নিসা-১/২৮১; আল-ইসাবা-৪/৪২৬]

উম্মু হাকীম (রা) আবার বিধবা হয়ে মদীনায় ফিরে আসেন। খলীফা হযরত উমারের (রা) তাঁকে বিয় করেন এবং এখানে তাঁর গর্ভে কন্যা ফাতিমা বিনত উমারের জন্ম হয়। ফাতিমার চাচা যায়দ ইবন আল-খাত্তাবের ছেলের সাথে এই ফাতিমার বিয়ে হয়।[আত-তাবারী, তারীখ-২/৫৬৪; আয-যাহাবী, তারীখ-৩/২৭৪; নাসাবু ‍তুরায়শা-৩০৩]

বিভিন্ন ঘটনার আলোকে ‍বুঝা যায় উম্মু হাকীম (রা) স্বামী হযরত উমারের (রা) জীবদ্দশায় তাঁরই খিলাফতকালে ইনতিকাল করেন। আল্লামা যিরিকলী সুনির্দিষ্টভাবে হিজরী ১৪ সনের কথা বলেছেন।[নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-৪৮৯]
উমামা বিনত আবিল আস (রা)
হযরত উমামার বড় পরিচয় তিনি হযরত রাসূলে কারীমের (সা) দৌহিত্রী। তাঁর পিতা আবুল আস (রা) ইবন বারী এবং মাতা যায়নাব (রা) বিনত রাসূলিল্লাহ (সা)। উমামা তাঁর নানার জীবদ্দশায় মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের অনেক আগেই নানী উম্মুল মু‘মিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা) ইনতিকাল করেন। উমামার দাদী ছিলেন হযরত খাদীজার ছোট বোন হালা বিনত খুওয়ায়লিদ। হিজরী ৮ম সনে উমামার মা এবং দ্বাদশ সনে পিতা ইনতিকাল করেন।[তারাজিমু সায়্যিদাত বায়াতিন নুবুওয়াহ-৫৩৬-৫৩৭]

নানা হযরত রাসূলে কারীম (সা) শিশু উমামাকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। সব সময় তাকে সংগে সংগে রাখতেন। এমনকি নামাযর সময়ও কাছে রাখতেন। মাঝে মাঝে এমনও হতো যে, রাসূল (সা) তাকে কাঁধের উপর বসিয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। রুকূ‘তে যাওয়ার সময় কাঁধ থেকে নামিয়ে দিতেন। তারপর সিজদায় গিয়ে তাকে মাথার উপর বসাতেন এবং সিজদা থেকে উঠার সময় কাঁধের উপর নিয়ে আসতেন। এভাবে তিনি নামায শেষ করতেন। এ আচরণ দ্বারা উমামার প্রতি তাঁর স্নেহের আধিক্য কিছুটা অনুমান করা যায়।

রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবী হযরত আবূ কাতাদা (রা) বলেন, একদিন বেলাল আযান দেওয়ার পর আমরা জুহর, মতান্তরে আসরের নামাযের জন্য অপেক্ষায় আছি, এমন সময় রাসূল (সা) উমামা বিনত আবিল আসকে কাঁধে বসিয়ে আমাদের মাঝে উপস্থিত হলেন। রাসূল (সা) নামাযে দাঁড়ালেন এবং আমরাও তাঁর পিছনে নামাযে দাঁড়িয়ে গেলাম। উমামা তখনও তার নানার কাঁধে একইভাবে বসা।

রাসূল (সা) রুকূতে যাবার সময় তাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে মাটিতে রাখেন। রুকূ-সিজদা শেষ করে যখন উঠে দাঁড়ালেন তখন আবার তাঁকে ধরে কাঁধের উপর উঠিয়ে নেন। প্রত্যেক রাক‘আতে এমনটি করে তিনি নামায শেষ করেন।[সুনানু নাসাঈ-২/৪৫,৩/১০; তাবাকাত-৮/২৩২; আল ইসাবা-৪/২৩৬; হায়াতুস সাহাবা-২/৪৮২]

উম্মুল মু‘মিনীন হযরত আইশা (রা) বর্ণনা করেছেন। হাবশার সম্রাট নাজ্জাশী রাসূলুল্লাহকে (সা) কিছু স্বর্ণের অলঙ্কার উপহার হিসেবে পাঠান, যার মধ্যে একটি স্বর্ণের আংটিও ছিলো। রাসূল (সা) সেটি উমামাকে দেন।[নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-২৮৯]

উমামার প্রতি রাসূলুল্লাহর (সা) স্নেহের প্রবলতা আরেকটি ঘটনার দ্বারাও অনুমান করা যায়। একবার রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট মুক্তা বসানো স্বর্ণের একটি হার আসে। হারটি হাতে করে ঘরে এসে বেগমদের দেখিয়ে বলেন : দেখ তো, এটি কেমন? তাঁরা সবাই বলেন : অতি চমত্কার! এর চেয়ে সুন্দর হার আমরা এর আগে আর দেখিনি। রাসূল (সা) বললেন : এটি আমি আমার পরিবারের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশী প্রিয় তার গলায় পরিয়ে দেব। আইশা (রা) মনে মনে ভাবলেন, না জানি তিনি এটা আমাকে না দিয়ে অন্য কোন বেগমের গলায় পরিয়ে দেন কিনা। অন্য বেগমগণও ধারণা করলেন, এটা হয়তো আইশা (রা) ভাগ্যেই জুটবে। এদিকে বালিকা উমামা তাঁর নানা ও নানীদের অদূরেই মাটিতে খেলছিল। রাসূল (সা) এগিয়ে গিয়ে তার গলায় হারটি পরিয়ে দেন।[আল-ইসতী‘আব-৪/২৩৮; উসুদুল গাবা-৫/৪০০; আস-সীরাহ আল-হালাবিয়্যাহ-২/৪৫২; দুররুস সাহাবা ফী মানাকিব আল-কারাবাহ ওয়াস সাহাবা-৫৩৫; আ‘লাম আন-নিসা-১/৭৭]

হযরত উমামার (রা) পিতা আবুল আস ইবন রাবী (রা) হিজরী ১২ সনে ইনতিকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর মামাতো ভাই যুবাইর ইবন আল-আওয়ামের সাথে উমামার বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছার কথা বলে যান। এদিকে উমামার খালা হযরত ফাতিমাও (রা) ইনতিকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি স্বামী আলীকে বলে যান, তাঁর পরে তিনি যেন উমামাকে বিয়ে করেন। অতপর উমামার বিয়ের বয়স হলো। যুবাইর ইবন আল-আওয়াম (রা) হযরত ফাতিমার (রা) অন্তিম ইচ্ছা পূরণের জন্য উদ্যেমী হলেন। তাঁরই মধ্যস্থতায় আলীর (রা) সাথে উমামার (রা) বিয়ে সম্পন্ন হলো। তখন আমীরুল মু‘মিনীন উমারের (রা) খিলাফতকাল।

হিজরী ৪০ সন পর্যন্ত তিনি আলীর (রা) সাথে বৈবাহিক জীবন যাপন করেন। এর মধ্যে আলীর (রা) জীবনের উপর দিয়ে নানা রকম ঝড়-জঞ্ঝা বয়ে যায়। অবশেষে হিজরী ৪০ সনে তিনি আততায়ীর হাতে মারত্মক ভাবে আহত হন। এই আঘাতে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি স্ত্রী উমামাকে বলেন, আমার পরে যদি তুমি কোন পুরুষের প্রয়োজন বোধ কর, তাহলে আল-মুগীরা ইবন নাওফালকে বিয়ে করতে পার। তিনি আল-মুগীরাকেও বলে যান, তাঁর মৃত্যুর পর তিনি যেন উমামাকে বিয়ে করেন। তিনি আশংকা করেন, তাঁর মৃত্যুর পরে মু‘আবিয়া (রা) উমামাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন। তাঁর এ আশংকা সত্যে পরিণত হয়। তিনি ইনতিকাল করেন। উমামা উদ্দত তথা অপেক্ষার নির্ধারিত সময়সীমা অতিবাহিত করলেন। হযরত মু‘আবিয়া (রা) মোটেই দেরী করলেন না। তিনি মারওয়ানকে লিখলেন, তুমি আমার পক্ষ থেকে উমামার নিকট বিয়ের পয়গাম পাঠাও এবং এ উপলক্ষে এক হাজার দীনার ব্যয় কর। এ খবর উমামার (রা) কানে গেল। তিনি সাথে সাথে আল-মুগীরাকে লোক মারফত বললেন, যদি আপনি আমাকে পেতে চান, দ্রুত চলে আসুন। তিনি উপস্থিত হলেন এবং হযরত হাসান ইবন আলীর (রা) মধ্যস্থতায় বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়।[আল-ইসাবা-৪/২৩৭] এই আল-মুগীরার স্ত্রী থাকা অবস্থায় মু‘আবিয়ার (রা) খিলাফতকালে তিনি ইনতিকাল করেন। আলীর (রা) ঘরে উমামার (রা) কোন সন্তান হয়নি। তবে আল-মুগীরার ঘরে তিনি এক ছেলের মা হন এবং তার নাম রাখেন ইয়াহইয়া। এ জন্য আল-মুগীরার ডাকনাম হয় আবূ ইয়াহইয়া।[প্রাগুক্ত; উসুদুল গাবা-৫/৪০০; আ‘লাম আন-নিসা-১/৭৭] তবে অনেকে বলেছেন, আল-মুগীরার ঘরেও তিনি কোন সন্তানের মা হননি। তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহর (সা) কন্যাদের মধ্যে একমাত্র ফাতিমা (রা) ছাড়া আর কারো বংশধারা অব্যাহত নেই। হতে পারে আল-মুগীরার ঔরসে ইয়াহইয়া নামের এক সন্তানের জন্ম দেন, কিন্তু শিশু কালেই তার মৃত্যু হয়। উমামার মৃত্যুর মাধ্যমে নবী দুহিতা যায়নাবের (রা) বংশধারার সমাপ্তি ঘটে। কারণ তাঁর পূর্বেই যয়নাবের পুত্রসন্তান আলীর মৃত্যু হয়।[তারাজিমু সায়্যিদাতি বাতিন নুবুওয়াহ-৫৩৮; নিসা মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-২৮০]
খাওলা বিনত হাকীম (রা)
হযরত খাওলা (রা) মক্কার বানূ সুলাইম গোত্রের হাকীম ইবন উমাইয়্যার কন্যা। ডাকনাম উম্মু সুরাইক।[তাবাকাত-৮/১৫৮; আল-ইসতী‘আব-৪/২৮১; উসুদুল গাবা-৫/৪৪৪; তাহযীব আত-তাহযীব-১২/৪১৫] তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি প্রখ্যাত সাহাবী হযরত উছমান ইবন মাজ‘ঊনের (রা) সহধর্মিনী। এই উছমান (রা) মদীনায় হিজরাতকারী মুহাজিরদের অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। বদর যুদ্ধের পর মদীনায় ইনতিকাল করেন। রাসূল (সা) তাঁর জানাযার নামায পড়ান এবং মদীনার আল-বাকী গোরস্তানে দাফন করেন। আল-বাকী গোরস্তানে দাফন কৃত তিনি প্রথম সাহাবী। খাওলা (রা) হযরত রাসূলে কারীমের (সা) খালা সম্পর্কীয় ছিলেন।[মুসনাদে আহমাদ-৬/৪০৯]

মক্কায় ইসলামী দা‘ওয়াতের সূচনাপর্বে মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন নারী-পুরুষ আগে-ভাগে ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি তাঁদের একজন। ইসলাম গ্রহণের আগেই উছমান ইবন মাজ‘ঊনের (রা) সাথে তাঁর বিয়ে হয়। সম্ভবত স্বামী-স্ত্রী একই সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি ঈমানের মজাদার স্বাদ পূর্ণরূপে পেয়ে যান এবং সত্যের আলো তাঁর চোখের সকল পর্দা ছিন্নভিন্ন করে দেয়। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সাহচর্য ও সান্নিধ্যে চলে যান। তাঁর সেবায় নিজেকে উত্সর্গ করেন। রাসূলুল্লাহর (সা) আত্মিয়া হওয়ার কারণে এ কাজ আরো সহজ হয়ে যায়। মক্কায় প্রতিদিন রাসূলুল্লাহর (সা) ঘর-গৃহস্থলীসহ সকল সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ-খবর নিতেন। মদীনায় গিয়েও আমরণ এ কাজ অব্যাহত রাখেন। রাসূলুল্লাহর (সা) জীবনের কয়েকটি বড় ঘটনার সাথে তাঁর সংশ্লিষ্টতা তাঁকে বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। ইবন আবদিল বার (রহ) তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন : (আরবী*****************) “তিনি ছিলেন সত্কর্মশীলা ও গুণসম্পন্না মহিলা­।“ হযরত উমার ইবন আবদিল আযীয (রহ) ও তাঁকে সত্কর্মশীলা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি একটি প্রসঙ্গে বর্ণনা করতে গিয়ে এভাবে উল্লেখ করেছেন : (আরবী**************) [আল-ইসাবা-৪/২৯৩]

“সত্কর্মশীলা মহিলা উছমান ইবন মাজ‘ঊনের স্ত্রী খাওলা বিনত হাকীম ধারণা করেছেন।“

এভাবে অনেক সীরাত বিশেষজ্ঞই তাঁকে সত্কর্মশীলা মহিলা বলে উল্লেখ করেছেন।

হযরত খাদীজা (রা) ছিলেন হযরত রাসূলে কারীমের (সা) প্রথমা ও প্রিয়তমা স্ত্রী। রাসূলুল্লাহর (সা) মক্কী জীবনের সকল সংকটে তিনি ছিলেন একান্ত সংগিনী। প্রতিটি সংকটময় মুহুর্তে তিনি স্বামীকে সন্ত্বনা দিতেন, সমবেদনা প্রকাশ এবং পাশে থেকে সকল বাধা অতিক্রমে সাহায্য করতেন। এমন একজন অন্তরঙ্গ স্ত্রী ও বান্ধবীর তিরোধানে রাসূল (সা) দারুণ বিমর্ষ ও বেদানাহত হয়ে পড়েন। তাছাড়া খাদীজা ছিলেন রাসূলুল্লাহর সন্তানদের জননী ও গৃহকর্মী। তাঁর অবর্তমানে মাতৃহারা সন্তানদের লালন-পালন ও ঘর সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। উপরন্তু পৌত্তলিকদের জ্বালাতন ও উত্পাতের মাত্রাও বেড়ে যায়। রাসূলুল্লাহর (সা) এমন অবস্থা তাঁর সাহাবীদেরকে দারুণ ভাবে ভাবিয়ে তোলে।

হযরত রাসূলে কারীমের (সা) জীবনের এমনই এক ‍দুসময়ে খাওলা একদিন গেলেন রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এবং তাঁকে বিমর্ষ দেখে বলে ফেললেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার মনে হচ্ছে, খাদীজার তিরোধানে আপনি বেদনাকাতর হয়ে পড়েছেন এবং তাঁর অভাব বোধ করছেন। রাসূল (সা) বললেন : হাঁ, তা ঠিক। সে ছিল আমার সন্তানদের মা এবং ঘরের কর্ত্রী। নানা কথার ফাঁকে এক সময় খাওলা অত্যন্ত সশ্রদ্ধাভাবে বলে ফেললেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি আবার বিয়ে করুন। রাসূল (সা) জানতে চাইলেন : পাত্রীটি কে? খাওলা বললেন : বিধবা ও কুমারী- দুই রকম পাত্রীই আছে। আপনি যাকে পছন্দ করেন তার ব্যাপারে কথা বলা যেতে পারে। তিনি আবার জানতে চাইলেন : পাত্রী কে? খাওলা বললেন : বিধবা পাত্রী সাওদা বিনত যাম‘আ, আর কুমারী পাত্রী আবূ বকরের মেয়ে আয়িশা। রাসূল (সা) বললেন : হাঁ, এ ব্যাপারে ভূমিকা পালনের জন্য মহিলারা যোগ্যতর।[তাবাকাত-৮/৫৭; সীরাতে আয়িশা (রা)-২৪] যাও, তুমি তাদের দু‘জনের নিকট আমার প্রস্তাব দাও।

রাসূলুল্লহর (সা) সম্মতি পেয়ে খাওলা সর্বপ্রথম আয়িশা না সাওদার বাড়ীতে গিয়েছিলেন সে সম্পর্কে একটু মতপার্থক্য আছে। যাই হোক, তিনি গেলেন সাওদার গৃহে এবং সাওদাকে দেখেই বলে উঠলেন : আল্লাহ তোমার মধ্যে কী এমন কল্যাণ ও সমৃদ্ধি দান করেছেন? সাওদা বললেন : একথা কেন? বললেন : রাসূলুল্লাহ (সা) তোমার বিয়ের পয়গাম দিয়ে আমাকে পাঠিয়েছেন। সাওদা বললেন : আমি চাই, তুমি আমার পিতার সাথে কথা বলো।

সাওদার (রা) পিতা তখন জীবনের প্রান্তসীমায় । পার্থিব সকল কর্মতত্পরতা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়েছেন। খাওলা তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে ‘আন‘ইম সাবাহান‘ (সুপ্রভাত) বলে জাহিলী রীতিতে সম্ভাষণ জানান।

বৃদ্ধ প্রশ্ন করেন : কে তুমি? খাওলা উত্তর দেন : আমি খাওলা বিনত হাকীম। বৃদ্ধ তাঁকে স্বাগতম জানিয়ে কাছে বসান। খাওলা বিয়ের প্রস্তান পেশ করেন এভাবে : মুহাম্মাদ ইবন আবদিল্লাহ ইবন আবদুল মুত্তালিব সাওদাকে বিয়ের প্রস্তান করেছেন। বৃদ্ধ বলেন : এতো অভিজাত কুফু। তোমার বান্ধবী সাওদা কি বলে? খাওলা বলেন : তার মত আছে। বৃদ্ধ সাওদাকে ডাকতে বলেন। সাওদা উপস্থিত হলে বলেন : আমার মেয়ে! এই মেয়েটি (খাওলা) বলছে, মুহাম্মাদ ইবন আবদিল্লাহ তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে তাকে পাঠিয়েছেন। অভিজাত পাত্র। আমি তাঁর সাথে তোমার বিয়ে দিতে চাই, তুমি কি রাজি? সাওদা বলেন : হাঁ, রাজি। তখন বৃদ্ধ খাওলাকে বলেন : তুমি যাও, মুহাম্মাদকে ডেকে আন। রাসূল (সা) বরবেশে উপস্থিত হন এবং সাওদার পিতা সাওদাকে তাঁর হাতে তুলে দেন।[তাবারী : তারীখ-২/২১১; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-২/১৩০; আয-যাহাবী : তারীখ-১/১৬৬; আনসাব আল-আশরাফ-১/৪০৮; মুসনাদে আহমাদ-৬/২১০; তাবাকাত-৮/৫৩]

খাওলা (রা) হযরত রাসূলে কারীমের (সা) সম্মতি পেয়ে আবূ বকরের বাড়িতে গিয়ে আয়িশার (রা) মা উম্মু রূমানের (রা) সাথে দেখা করলেন এবং বললেন : উম্মু রূমান! আল্লাহ আপনাদের বাড়িতে কী এমন কল্যাণ ও সমৃদ্ধি দান করেছেন? তিনি বললেন : এমন কথা কেন? খাওলা বললেন : রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে আয়িশার বিয়ের পয়গাম দিয়ে পাঠিয়েছেন। উম্মু রূমান বললেন : একটু অপেক্ষা কর, আবূ বকর এখনই এসে পড়বেন। আবূ বকর ঘরে ফিরলেন এবং খাওলা তাঁর নিকট প্রস্তাবটি পাড়লেন। উল্লেখ্য যে, জাহিলী আরবের রীতি ছিল, তারা আপন ভাইয়ের সন্তানদের যেমন বিয়ে করা বৈধ মনে করতো না, তেমনিভাবে সৎ ভাই, জ্ঞাতি ভাই বা পাতনো ভাইয়ের সন্তানদেরকেও বিয়ে করা সঙ্গত ভাবতো না। এ কারণে প্রস্তাবটি শুনে আবূ বকর বললেন : খাওলা! আয়িশা তো রাসূলুল্লাহর (সা) ভাতিজী। সুতরাং এ বিয়ে হয় কেমন করে? খাওলা ফিরে এলেন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন : রাসূল (সা) বললেন : আবূ বকর আমার দীনী ভাই। আর এ ধরণের ভাইদের সন্তানদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক করা যায়। আবূ বকর (রা) প্রস্তাব মেনে নেন এবং খাওলাকে বলেন রাসূলুল্লাহকে (সা) নিয়ে আসতে। তারপর খাওলা রাসূলুল্লাহকে (সা) নিয়ে গেলেন এবং বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো।[সাহীহ বুখারী, বাবু তাযবীয আস-সিগার মিনাল কিবার; ইবন কাছীর, আস-সীরাহ আন-নাবাবীয়্যাহ-১/৩১৬; আসহাবে রাসূলের জীবন কথা-৫/৫৬]

হযরত খাওলার (রা) স্বামী হযরত উছমান ইবন মাজ‘ঊন (রা) মক্কায় প্রথম পর্বের একজন মুসলমান। পৌত্তলিকদের হতে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হন। তিনি হাবশায়ও হিজরাত করেন এবং কিছুকাল পরে আবার মক্কায় ফিরে আসেন। হযরত খাওলার হাবশায় হিজরাতের কোন কথা পাওয়া যায় না। উছমান ইবন আজ‘ঊনের (রা) সঙ্গে খাওলার বিয়ে যদি ইসলামের প্রথম পর্বেই হয়ে থাকে তাহলে তিনিও উছমানের পরিবারের সদস্য হিসেবে কুরাইশদের যুলুম-নির্যাতনের যাতায় পিষ্ট হয়ে থাকবেন। সেসব তথ্য পাওয়া যায় না। তবে তিনি স্বামীর সাথে মদীনায় হিজরাত করেন- এ কথা জানা যায়।

হযরত উছমান ইবন মাজ‘ঊনের (রা) স্বভাবে রুহবানিয়্যাত বা বৈরাগ্যের প্রতি গভীর ঝোঁক ছিল। ইবাদাত ও শবগোজারী ছিল তাঁর প্রিয়তম কাজ। সারা রাত নামায আদয় করতেন। বছরের অধিকাংশ দিন রোযাও রাখতেন। বাড়ীতে একটা ঘর ইবাদাতের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন। রাত দিন সেখানে ই‘তিকাফ করতেন। এক পর্যায়ে তিনি স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি একেবারেই উদাসীন হয়ে পরেন। হযরত খাওলার (রা) অভ্যাস ছিল নবীগৃহে আসার এবং রাসূলুল্লাহর বেগমদের খোঁজ খবর নেওয়ার। একদিন তিনি নবীগৃহে আসেন। নবীর (সা) বেগমগণ তাঁর মলিন বেশ-ভূষা দেখে জিজ্ঞেস করেন : তোমার এ অবস্থা কেন? তোমার স্বামী তো কুরাইশদের মধ্যে একজন বিত্তবান ব্যক্তি। তিনি বললেন : তাঁর সাথে আমার কী সম্পর্ক! তিনি দিনে রোযা রাখেন, রাতে নামায পড়েন। বেগমগণ বিষয়টি রাসূলুল্লাহর (সা) গোচরে আনেন। তিনি সাথে সাথে উছমান ইবন মাজ‘ঊনের বাড়ীতে ছুটে যান এবং তাঁকে ডেকে বলেন : উছমান! আমার জীবন কি তোমার জন্য আদর্শ নয়? উছমান বললেন : আমার মা-বাবা আপনার প্রতি কুরবান হোক! আপনি এমন কথা বলছেন কেন? রাসূল (সা) বললেন : তুমি দিনে রোযা রাখ এবং সারা রাত নামাযে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দাও। বললেন : হাঁ, এমনই করে থাকি। ইরশাদ হলো! এমন আর করবেনা। তোমার উপর তোমার চোখের, তোমার দেহের এবং তোমার পরিবার-পরিজনের হক বা অধিকার আছে। নামায পড়, আরাম কর, রোযাও রাখ এবং ইফতার কর। এই হিদায়াতের পর তাঁর স্ত্রী খাওলা আবার একদিন নবীগৃহে আসলেন। সেদিন নববধূর সাজে সজ্জিত ছিলেন। দেহ থেকে সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ছিল।[সিয়ারু আ,লাম আন-নুবালা-১/১৫৭,১৫৮; নিসা মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-১৬]

হযরত খাওলা (রা) একজন সুভাষিণী মহিলা ছিলেন। বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলতেন। কোমল আবেগ-অনুভূতির অধিকারিণী ছিলেন। কাব্যচর্চাও করতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। স্বামী উছমানের (রা) ইনতিকালের পর তিনি একটি মরসিয়া রচনা করেন, তার কয়েকটি চরণ নিম্নরূপ :(আরবী *****************) [নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-১৬৯; হায়াতুস সাহাবা-২/৬১১]

“হে আমার চক্ষু! অবিরত অশ্রু বর্ষণ কর

উছমান ইবন মাজ‘ঊনের বড় বিপদে।

এমন ব্যক্তির জন্য যে তার স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য রাত্রি অতিবাহিত করেছে,

দাফনকৃত সেই মৃত ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ।

তার জন্য বাকী‘ আবাসস্থল বানিয়েছে, বৃক্ষ ছায়া দান করেছে,

তার ভূমি আলোকিত হয়েছে প্রস্তরময় ভূমি হিসেবে পড়ে থাকার পর,

অন্তরকে ব্যথা ভারাক্রান্ত করেছে-মৃত্যু পর্যন্ত যার শেষ নেই।

আমার অশ্রু প্রবাহের শিরাগুলো তার জন্য অশ্রু প্রবাহে অক্ষম হয়ে পড়বে।“

হিজরী ২য় সনে খাওলা (রা) বিধবা হওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। সবসময় বিমর্ষ থাকতেন। হাদীসে ও সীরাতের গ্রন্থসমূহের বর্ণনায় জানা যায়, বেশ কিছু নারী স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে নিজেদেরকে নবীর (সা) নিকট বিয়ের জন্য নিবেদন করেছিলেন। হযরত আয়িশা (রা) বলেন, খাওলা তাঁদের একজন। ‍উরওয়া ইবন আয-যুবাইর (রা) বলেন : আমরা বলাবলি করতাম যে, খাওলা নিজেই রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট নিজেকে নিবেদন করেছেন। তিনি ছিলেন একজন সত্কর্মশীলা মহিলা। ইবন আব্বাস (রা) বলেন, যে সকল নারী নিজেদেরকে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট অর্পণ করেছিলেন, এমন কাউকে তিনি গ্রহণ করেননি। যদিও আল্লাহ তায়ারা নবীকে (সা) এমন নারীকে গ্রহণ করার ইখতিয়ার দিয়েছেলেন। এ ইখতিয়ার কেবল তাঁকেই দার করা হয়েছিল। আল্লাহ বলেন :(আরবী *****************)[সূরা আল-আহযাব-৫০]

“কোন মু‘মীন নারী নবীর নিকট নিজেকে নিবেদন করলে এবং নবী তাকে বিয়ে করতে চাইলে সেও বৈধ।“[তাফসীর আল-কুরুতুবী ও তাফসীর ইবন কাছীর-সূরা আল-আহযাব, আয়াত-৫০-৫১; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৫/২৫৯; তাবাকাত-৮/১৫৮; আল-বায়হাকী, দালায়িল আন-নুবুওয়াহ-৭/২৮৭]

উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ ধরণের নারীকে মু‘মীন নারী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এটা তাঁদের জন্য বিরাট গর্ব, গৌরব ও সফলতা। হযরত খাওলাও এ গর্ব ও গৌরবের অধিকারিণী।

তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে জিহাদে অংশগ্রহণের গৌরবও অর্জন করেন। তায়িফ অভিযানে তিনি শরীক ছিলেন। এ সময় তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট আবেদন জানান : ইয়া রাসূলুল্লাহ! যদি তায়িফ বিজয় হয় তাহলে আমাকে বাদিয়া বিনত গায়লান অথবা ফারি‘আ বিনত আকীলের অলঙ্কার দান করবেন। উল্লেখ্য যে, এ দু‘জনের অরঙ্কার ছিল ছাকীফ গোত্রের মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও মূল্যবান। রাসূল (সা) তাঁকে বলেন : তাদের ব্যাপারে এখনো আমাকে অনুমতি দেওয়া হয়নি এবং আমি ধারণা করি না যে, এখনই আমরা তাদেরকে জয় করবো। খাওলা (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট থেকে বেরিয়ে এসে একথা উমার ইবন আল-খাত্তাবকে (রা) বললেন। উমার (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট গিয়ে বললেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! খাওলা যে একটি কথা বলেছে এবং সে ধারণা করছে যে আপনি তা বলেছেন – এটা কী? রাসূল (সা) বললেন : আমি তা বলেছি। উমার (রা) বললেন : আমি কি প্রস্থানের ঘোষণা দেব? রাসূল (সা) বললেন : হাঁ, দাও। উমার (রা) প্রস্থানের ঘোষণা দেন।[ইবন হিশাম, আস-সীরাহ-২/৪৮৪; উসুদুল গাবা-৫/৪৪৪; আল-ইসাবা-৪/২৯১; আস-সীরাহ আল হালাবিয়্যাহ-৩/৮১-৮২]

হযরত খাওলা (রা) হযরত রাসূলে কারীমের (সা) কিছু হাদীসও সংরক্ষণ করেছিলেন। তাঁর সূত্রে মোট পনেরোটি (১৫) হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবন মাজাহ তাঁদের সংকলনে সেগুলো বর্ণনা করেছেন। হযরত সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা) ও সা‘ঈদ ইবন আল-মুসায়্যিব, বিশর ইবন সা‘ঈদ, উরওয়া (রহ) ও আরো অনেকে তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।[নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-১৭০; সাহাবিয়্যাহ-২৫১]
খাওলা বিনত ছা‘লাবা (রা)
হযরত খাওলার (রা) পিতার নাম ছা‘লাবা ইবন আসরাম। ইবন হাজার তাঁর পিতার নাম মালিক ও দাদার নাম ছা‘লাবা বলেছেন।[আল-ইসাবা-৪/২৮৯] মদীনার খাযরাজ গোত্রের বানূ আওফের সন্তান। কেউ কেউ তাঁর নাম খাওলার পরিবর্তে ‘খুওয়ায়লা‘ বলেছেন।[তাবাকাত-৮/৩৮৭; তাহযীবুত তাহযীব-১২/৪১৪; উসুদুল গাবা-৫/৪৪২] মদীনায় ইসলাম প্রচারের প্রথম ভাগে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় আসার পর তাঁর নিকট বাই‘আত (আনুগত্যের অঙ্গীকার) করেন। তাঁর পরিবারটি ছিল একটি ইসলামী পরিবার। তিন ভাই বাহহাছ, আবদুল্লাহ ও ইয়াযীদ (রা)- সবাই ছিলেন বিখ্যাত আনসারী সাহাবা। মদীনায় ইসলাম প্রচারের প্রথমপর্বে তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর স্বামী মদীনার খাযরাজ গোত্রের নেতা উবাদা ইবন আস-সামিতের (রা) ভাই আওস ইবন আস-সামিত (রা)। এই আওস (রা) বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে অংশগ্রহণ করেন। তিনি একজন কবি ছিলেন। ফিলিস্তীনের রামাল্লায় হিজরী ৩২ সনে ৭২ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন।[তাবাকাত-৩/৫৪৭; তাহযীবুল আসমা‘ ওয়াল লুগাত-১/১২৯]

আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) বলেন, ইসলামী যুগে ‘জিহার‘ সংক্রান্ত ব্যাপার সর্বপ্রথম আওস ইবন আস-সামিত দ্বারা সংঘটিত হয়েছে।[ইবন কুতায়বা- আল-মা‘আরিফ-২৫৫] আর তাঁর স্ত্রী ছিলেন খাওলা বিনত ছা‘লাবা (রা)।

জাহিলী আরব প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটতো যে, স্বামী-স্ত্রীতে একটু মনোমালিন্য ও ঝগড়া-বিবাদ হলে স্বামী ক্রুদ্ধ হয়ে বলতো : (আরবী **********)- এই বাক্যের শাব্দিক অর্থ হলো : “তুমি আমার জন্য এমন, যেমন আমার মায়ের পৃষ্ঠদেশ।“ এরূপ কথার স্পষ্ট অর্থ এই দাঁড়ায় যে, সে নিজের স্ত্রী কে এখন আর স্ত্রী মনে করে না, বরং তাকে সেই নারীদের মধ্যে গণ্য করে যারা তার জন্য মুহাররাম। এ ধরণের কথা বলাকেই ফিকাহর পরিভাষায় ‘যিহার‘ আরবী******) বলে। আরবী ভাষায় আরবী****) শব্দটি (আরবী******) হতে নির্গত। এর প্রচলিত অর্থ সওয়ারী, যার উপর সওয়ার হওয়া যায়। জন্তুযানকে আরবীতে ‘যাহর‘ বলা হয়। কেননা তার পিঠের উপর আরোহণ করা হয়। জাহিলী যুগের আরবের লোকেরা নিজের স্ত্রীকে নিজের জন্য হারাম করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে বলতো : “তোমারকে যাহর‘- সওয়ারী বানানো আমার জন্যে নিজের মাকে সওয়ারী বানানোর মতই হারাম। এ কারণে এ ধরণের বাক্য বা উক্তি মুখে উচ্চারণ করাকে তাদের পরিভাষায় ‘যিহার‘ বলা হতো। জাহিলিয়াতের যুগে আরবে এ ধরণের বাক্য তালাক- বরং তার চেয়েও বেশী শক্তভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করার সমতুল্য মনে করা হতো। কেননা, তাদের নিকট এর অর্থ ছিল স্বামী নিজের স্ত্রীর সাথে শুধু বিয়ের সম্পর্কই ছিন্ন করছে না, তাকে মায়ের মতই নিজের জন্যে হারামও বানিয়ে নিচ্ছে। তাই আরব সমাজে তালাক দানের পরও স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করার একটা উপায় থাকতো, কিন্তু ‘যিহার‘ করার পর আর কোন পথই খোলা থাকতো না।[তাফহীমুল কুরআন, তাফসীর, সুরা-আল-মুজাদালা-১৬/১৮৩]

মুহাদ্দিছগণ হযরত আওসের জিহারের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ বিভিন্ন বর্ণনাকারীর সূত্রে দান করেছেন। সেইসব বর্ণনার সার ও মূলকথা হলো যে, আওস (রা) বার্ধক্যে পৌছে কিছুটা খিট-খিটে প্রকৃতির হয়ে গিয়েছিলেন। কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে, তাঁর মধ্যে পাগলামীর অবস্থা দেখা দিয়েছিল। হাদীসের বর্ণনাকারীগণ একথা বুঝাবার জন্যে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তাহলো : (আরবী************)। আরবী ভাষায় এই (আরবী******) শব্দের অর্থ পুরোপুরি পাগলামী নয়, তবে এ এমন এক অবস্থা বোঝায়, যা ‘অমুক লোকটি রাগে পাগল হয়ে গেছে‘ বলে আমরা বুঝাতে চাই। মেযাজ-প্রকৃতির এরূপ অবস্থা হওয়ার কারণে এর পূর্বেও কয়েকবার তাঁর স্ত্রীর প্রতি ‘যিহার‘ করেছিলেন। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর স্ত্রীর সাথে ঝগড়া হবার কারণে এরূপ ব্যাপার আবার তাঁর দ্বারা সংঘটিত হয়।

এরপর তাঁর স্ত্রী খাওলা (রা) রাসূলে কারীমের (সা) নিকট উপস্থিত হলেন এবং সমস্ত ব্যাপার খুলে বলার পর আরজ করলেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! এমতবস্থায় আমার ও আমার সন্তানাদির জীবন কঠিন বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার কোন উপায় কি হতে পারে?

জবাবে নবী কারীম (সা) যা কিছু বলেছিলেন তা বিভিন্ন বর্ণনাকারী বিভিন্ন ভাষায় বর্ণনা করেছেন। কোন কোন বর্ণনায় তাঁর জবাব ছিল : “এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমাকে কোন হুকুম দেওয়া হয়নি।“ কোন বর্ণনার ভাষা হল : “আমার মনে হয় তুমি তোমার স্বামীর জন্যে হারাম হয়ে গিয়েছো।“ আর কোন বর্ণনায় তিনি বলেন : “তুমি তার জন্যে হারাম হয়ে গিয়েছো।“ এরূপ জবাব শুনে হযরত খাওলা খুবই কান্নাকাটি, আর্তনাদ ও ফরিয়াদ করতে লাগলেন।

বারবার নবীকে (সা) বলতে লাগলেন : “তিনি ‘তালাক‘ শব্দ তো বলেননি। আপনি এমন কোন পন্থা আমাকে বলুন, যাতে আমার সন্তানাদি ও আমার বৃদ্ধি স্বামীর জীবন কঠিন বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারে।“ কিন্তু প্রত্যেকবারই নবী কারীম (সা) তাঁকে উক্তরূপ ও একই ধরণের জবাব দিতে থাকলেন। অবশেষে খাওলা (রা) হাত উঠিয়ে দু‘আ করতে লাগলেন : হে আল্লাহ! আমি তোমাকে আমার বড় কষ্ট এবং আমার স্বামী থেকে বিচ্ছেদের তীব্র জ্বালার কথা জানাচ্ছি। হে আল্লাহ! আমাদের জন্য কল্যাণকর হয় এমন কোন কথা আপনার নবীর (সা) মুখ দিয়ে প্রকাশ করে দিন। আয়িশা (রা) বলেন, তখন এমন একটি দৃশ্যের সৃষ্টি হয় যে, আমি এবং সেখানে উপস্থিত সকলে খাওলার করুণ আকুতি ও আর্তনাদে কেঁদে ফেলি।

এ সময় রাসূলে কারীমের (সা) উপর ওহী নাযিলের অবস্থা প্রকাশ পেল। আয়িশা (রা) আনন্দের সাথে খাওলাকে (রা) বললেন : “খাওলা, খুব শিগগীরই আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার বিষয়টির ফায়সালা হয়ে যাবে।“ এ সময়টি ছিল তাঁর জন্যে খুবই কঠিন সময়। আশা-নিরাশার দোলাচালে তিনি বড় অস্থির হয়ে পড়েন। এমন আশংকার সৃষ্টি হয় যে, বিচ্ছেদের নির্দেশ আসে, আর তিনি সেই দুখে প্রাণ হরান। কিন্তু রাসূলুল্লাহর (সা) দিকে তাকিয়ে তাঁর হাসিমুখ দেখে আশান্বিত হলেন। খুশীর চোটে দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন রাসূল (সা) বললেন : খুওয়ায়লা! আল্লাহ তোমার ও তোমার সংগীর ব্যাপারে ওহী নাযিল করেছেন। তারপর তিনি পাঠ করেন : (আরবী ********************)[সূরা আল-মুজাদালা-১-৪]

“যে নারী তার স্বামীর বিষয়ে আপনার সাথে বাদানুবাদ করছে এবং অভিযোগ পেশ করছে আল্লাহর দরবারে, আল্লাহ তার কথা শুনেছেন। আল্লাহ আপনাদের উভয়ের কথাবার্তা শুনেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শুনেন, সবকিছু দেখেন। তোমাদের মধ্যে যারা তাদের স্ত্রীগণকে মাতা বলে ফেলে, তাদের স্ত্রীগণ তাদের মাতা নয়। তাদের মাতা কেবল তারাই, যারা তাদেরকে জন্ম দান করেন। তারা তো অসমীচীন ও ভিত্তিহীন কথাই বলে। নিশ্চয় আল্লহ মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল। যারা তাদের স্ত্রীগণকে মাতা বলে ফেলে, অতপর নিজেদের উক্তি প্রত্যাহার করে, তাদের কাফফারা এই : অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে একটি দাসকে মুক্তি দিবে। এটা তোমাদের জন্যে উপদেশ হবে। আল্লাহ খবর রাখেন তোমরা যা কর। যার এ সামর্থ্য নেই, সে একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে একাধারে দু‘মাস রোযা রাখবে। যে এতেও অক্ষম, সে ষাটজন মিসকীনকে আহার করাবে। এটা এ জন্যে, যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। এগুলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক আযাব।“

উপরিউক্ত আয়াতগুলো নাযিলের পর রাসূল (সা) খাওলাকে বললেন : তোমার স্বামীকে একটি দাস মুক্ত করে দিতে বলবে। খাওলা বললেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! দাস মুক্তি করার মত সমর্থ্য তার নেই। নবী (সা) বললেন : একাধারে দু‘মাস সাওম পালন করতে হবে। খাওলা বললেন : সে যে বৃদ্ধ, সাওম পালন করার সামর্থ্য তার কোথায়? দিনে ‍দু‘তিনবার পানাহার না করলে তার দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেতে শুরু করে। নবী (সা) বললেন : তাহলে ষাটজন মিসকীনকে খাওয়াতে হবে।

খাওলা বললেন : এর জন্যে প্রয়োজনীয় আর্থিক সামর্থ্য তার নেই। তবে আপনি সাহায্য করলে তা করা যেতে পারে। তখন নবী কারীম (সা) ষাটজন মিসকীনকে দু‘বেলা খাওয়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণের খাদ্যদ্রব্য দান করলেন। কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে নবী কারীম (সা) যত পরিমাণ দ্রব্য দিয়েছিলেন, খাওলা (রা) ঠিক সেই পরিমাণ নিজের নিকট থেকে স্বামীকে দেন তার কাফফারা আদায় করার জন্য।[আল-ইসাবা-৪/২৯০]

স্ত্রী খাওলা তো গেছেন রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যিহারের ফায়সালা জানার জন্য। আর এদিকে স্বামী আওস (রা) অস্থিরভাবে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর ফেরার প্রতীক্ষায় । দ্বিধা-দ্বন্দ্বে বুক তাঁর দুরু-দুরু কাঁপছে, না জানি কি ফায়সালা নিয়ে আসে। এক সময় দূরে খাওলাকে দেখে তিনি অস্থিরভাবে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেন : খাওলা কি হয়েছে?

খাওলা বললেন : ভালো। তুসৌভাগ্যবান। তারপর তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সিদ্ধান্তের কথা জানান ও সেই কাফফারা আদায় করেন।[তাবাকাত-৮/৩৭৯-৩৮০; সাজারাত আয-যাহাব-১/১৩৮-১৩৯; আনসাব আল-আশরাফ-১/২৫১; তাফহীম আল-কুরআন-১৬/১৮৫-১৮৬]

আল্লাহ তায়ালা হযরত খাওলাকে (রা) সম্মান দার করে তাঁর ফরিয়াদের জবাবে সূরা আল-মুজাদালার উপরিউক্ত আয়াতগুলো নাযিল করেন। তাতে তিনি কেবল যিহারের বিধান বর্ণনা এবং তাঁর কষ্ট ও যন্ত্রনা দূর করার ব্যবস্থাই করেননি, বরং তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য শুরুতেই বলে দেন : যে নারী তার স্বামীর ব্যাপারে আপনার সাথে বাদানুবাদ করছিল, আমি তার কথা শুনেছি। আয়িশা সিদ্দিকা (রা) বলেন : সেই সত্তা পবিত্র, যিনি সব আওয়াজ ও প্রত্যেকের ফরিয়াদ শুনেন। খাওলা বিনত ছা‘লাবা যখন রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে তার স্বামীর ব্যাপারে অভিযোগ করছিল তখন আমি সেখানে ছিলাম। কিন্তু এত নিকটে থাকা সত্ত্বেও আমি তার কোন কোন কথা শুনতে পারিনি। অথচ আল্লাহ তা‘আলা সব শুনেছেন।[তাফসীরুল কুরতুবী ও তাফসীরু ইবন কাছীর, সূরা আল-মুজাদিলার তাফসীর, আয়াত ১-৪] আয়াতগুলো নাযিলের পর খাওলার (রা) নাম “আল-মুজাদিলা“ (বাদানুবাদকারিণী) হয়ে যায়।

খাওলা ছিলেন আনসারদের মধ্যে অন্যতম বিশুদ্ধভাষিণী মহিলা। অলঙ্কার মণ্ডিত ভাষায় চমত্কার ভঙ্গিতে সিদ্ধান্তমূলক কথা বলায় তিনি ছিলেন পারাঙ্গম। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে অভিযোগ উত্থাপন করেন, এখানে তার কিছু দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। তিনি বলেন : (আরবী*************************) [নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-৪০৫; হায়াতুস সাহাবা-৩/৩১]

“হে আল্লাহর রাসূল! সে আমার অর্থ-সম্পদ ভোগ করেছে ও আমার যৌবনকে উপভোগ করে নিশেষ করে ফেলেছে। আমি আমার উদরকে তার জন্য বিছিয়ে দিয়েছি। আর এখন যখন আমার বয়স হয়েছে এবং আমার সন্তানাদি হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে তখন সে আমার সাথে ‘যিহার‘ করেছে।“

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, তবে তাতে একটি শিল্পরূপ আছে। মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষমতা আছে। তাঁর ফরিয়াদ আল্লাহর নিকট শ্রুত ও গৃহীত হওয়া এবং অনতিবিলম্বে আল্লাহর নিকট থেকে অনুকূল ফরমান জারী হওয়া এমন একটা ব্যাপার যার দরুন সাহাবীদের সমাজে তাঁর এক বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা স্বীকৃত হয়েছিল। ইবন আবী হাতিম ও বাইহাকী বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, হযরত উমার (রা) একবার কয়েকজন সঙ্গী সাথীসহ কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে এক মহিলা তাঁর পথ রোধ করে দাঁড়ালো। উমার (রা) দাঁড়িয়ে থাকলেন এবং মাথা নত করে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাঁর বক্তব্য শুনলেন। তাঁর কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি দাঁড়িয়েই থাকলেন। সঙ্গীদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলেন : আপনি এই বৃদ্ধার কারণে কুরাইশ বংশের নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে এখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। উমার (রা) বললেন : তোমরা কি জানো, কে এই মাহিলা? ইনি খাওলা বিনত ছা‘লাবা। ইনি এমন এক মহিলা যার অভিযোগ সপ্তম আসমানের উপর শ্রুত হয়েছে। আল্লাহর শপদ! ইনি যদি আমাকে রাত পর্যন্তও দাঁড় করিয়ে রাখতেন, আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম। কেবল সালাতের সময়ই তাঁর নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে নিতাম।[তাফহীমুল কুরআন-১৬/১৮২]

ইবন আবদিল বার তাঁর “আল-ইসতী‘আব“ গ্রন্থে কাতাদা (রহ) থেকে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। এই মহিলা (খাওলা) পথিমধ্যে উমারের (রা) সম্মুখীন হলে তিনি তাঁকে সালাম করলেন। মহিলা সালামের জবাব দেয়ার পর বলতে লাগলেন : ওহো, হে উমার এমন একটা সময় ছিল যখন আমি তোমাকে উকাজের বাজারে দেখতে পেয়েছিলাম। তখন তোমাকে সকলে উমাইর বলতো। হাতে লাঠি নিয়ে ছাগল চরাতে। তারপর কিছুদিন যেতে না যেতেই লোকেরা তোমাকে উমার বলতে শুরু করলো। আরো কিছুদিন পর তোমাকে ‘আমীরুল মু‘মিনীন‘ বলা হতে লাগলো। আমি বলি কি, প্রজা সাধারণের ব্যাপারে আল্লাহকে একটু ভয় করে চলবে। স্মরণ রাখবে, যে লোক আল্লাহর অভিশাপকে ভয় করে, তার জন্য দূরের লোকও নিকট আত্মিয়ের মত হয়ে যায়। আর যে মৃত্যুকে ভয় করে, তার সম্পর্কে আশংকা, সে যে জিনিসকে রক্ষা করতে চায়, তাই হয়তো সে হারিয়ে ফেলবে।

একথা শুনে উমারের (রা) সঙ্গী জারূদ আল-আবদী বললেন : ওহে মহিলা! তুমি আমীরুল মু‘মিনীনের সাথে খুব বেয়াদবীর কথাবার্তা বলছো।

উমার (রা) বললেন : তাঁকে বলতে দাও। তুমি কি জানো তিনি কে? তাঁর কথা তো সপ্তম আসমানের উপরও শুনা গিয়েছে, উমারকে (রা) তো অবশ্যই শুনতে হবে।[ইযালাতুল খাফা-১/৫১; আল-ইসতী‘আব-৪/২৮৩; আল-ইসাবা-৪/২৮৩; কানয আল-উম্মাল-১/৩৮৫; হায়াতুস সাহাবা-২/৪৩৬]

এই হলেন খাওলা বিনত ছা‘লাবা (রা), একজন ঈমানদার আনসারী মহিলা- যাঁর সম্পর্কে কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে। যার ওসীলায় ইসলামী শরী‘আতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান প্রবর্তিত এবং মুসলিম নারীদের সম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত হয়েছে।

তাঁর মৃত্যুর সঠিক সন-তারিখ জান যায় না। তবে বিভিন্ন ঘটনা দ্বারা জানা যায়, তিনি খিলাফতে রাশিদার বেশীরভাগ সময় জীবিত ছিলেন এবং এ সময়কালেই ইনতিকাল করেছেন।
হাওয়া বিনত ইয়াযীদ (রা)
হাওয়ার পিতার নাম ইয়াযীদ ইবন সিনান। মদীনার আবদুল আশহাল গোত্রের মেয়ে। তিনি মদীনার কায়স ইবন খুতায়মের স্ত্রী ছিলেন। মদীনার মহান আনসারী সাহাবী সা‘দ ইবন মু‘আয (রা) ছিলেন হাওয়ার মা আকরাব বিনত মু‘আযের আপন ভাই। সুতরাং বিখ্যাত সাহাবী সা‘দ ছিলেন হাওয়ার মামা। মহান বদরী সাহাবী রাফি‘ ইবন ইয়াযীদ (রা) হাওয়ার সহোদর। রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনার হিজরাতের পূর্বে, মদীনায় ইসলাম প্রচারের সূচনা পর্বে হাওয়া ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল (সা) যে সকল মহিলাকে সম্মান ও সম্ভমের দৃষ্টিতে দেখতেন তিনি তাঁদের একজন। হাওয়া আকাবার প্রথম ও দ্বিতীয় বাই‘আতের মধ্যবর্তী সময়ে ইসলাম গ্রহণ করে থাকবেন। [আল-ইসাবা-৪/২৭৭; নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-৯১]

মদীনার যে ক‘জন মহিলা সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁর নিকট বাই‘আত করেন, এই হাওয়া তাঁদের অন্যতম। আবদুল আশহাল গোত্রের এক মহিলা উম্মু আমির বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি, লাইলা বিনত আল-হুতায়ম ও হাওয়া বিনত ইয়াযীদ- এই তিনজন একদিন মাগরিব ও ঈশার মাঝমাঝি সময়ে আমাদের চাদর ‍দিয়ে সারা দেহ ঢেকে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট উপস্থিত হলাম। আমরা সালাম দিলাম। তিনি আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। আমরা পরিচয় দিলাম। তিনি আমাদেরকে স্বাগত জানিয়ে জানতে চাইলেন : তোমরা কি জন্য এসেছো?

আমরা বললাম : ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা আপনার নিকট ইসলামের বাই‘আত (আনুগত্যের অঙ্গীকার) করতে এসেছি। আমরা আপনার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং আপনি যা নিয়ে এসেছেন তা সত্য বলে সাক্ষ্য দিয়েছি।

রাসূল (সা) বললেন : সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি তোমাদের ইসলামের প্রতি হিদায়াত দান করেছেন। আমি তোমাদের বাই‘আত গ্রহণ করলাম। উম্মু আমির (রা) বলেন : অতপর আমি একটু রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে এগিয়ে গেলাম। তখন তিনি বললেন : আমি মহিলাদের সাথে করর্মদন কারি না। হাজার মহিলার উদ্দেশ্যে আমার যে কথা, একজন মহিলার জন্যও আমার সেই এক কথা।

উম্মু আমির বলেন : রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট আমরা প্রথম বাই‘আত গ্রহণকারী।[তাবাকাত-৮/১২; আল-ইসাবা-৪/২৭৬]

ইসলামের কারণে যাঁরা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, হাওয়া তাঁদের অন্যতম। তাঁর স্বামী কায়স ইবন খুতায়ম ছিলেন মদীনার আওস গোত্রের খ্যাতনামা কবি। তিনি পৌত্তলিকতার উপর অটল থাকলেও তাঁর অজ্ঞাতে স্ত্রী হওয়া ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি তা জানতে পেরে তাঁকে ইসলাম থেকে বিরত রাখার জন্য তাঁর উপর নির্যাতন আরম্ভ করেন। তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতেন, নামাযরত অবস্থায় সিজদায় গেলে মাটিতে ফেলে দিতেন।[আল-ইসাবা-৪/২৭৬] হাওয়া নীরবে সকল অত্যাচার সহ্য করে যেতেন। রাসূল (সা) তখন মক্কায়। মদীন থেকে যে সকল মুসলমান মক্কায় যেতেন তাঁদের মুখে তিনি মদীনার হাল-হাকীকত অবগত হতেন। তাঁদের কাছেই তিনি হাওয়ার উপর নির্যাতনের কথা অবগত হন। মৃত্যুর পূর্বে একবার কায়াস মক্কার “যুল মাজায“-এর মেলায় যান। রাসূল (সা) খবর পেয়ে তাঁর অবস্থানস্থলে গিয়ে হাজির হন। রাসূলকে (সা) দেখে কায়স সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং খুবই সম্মান ও সমাদর করেন। রাসূল (সা) তাঁকে ইসলাম গহণের আহ্বান জানান। তিনি এই বলে সময় নেন যে, মদীনায় ফিরে গিয়ে আরো একটু চিন্তা করে দেখবেন। রাসূল (সা) তাতে রাজি হন। তারপর তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বলেন, তোমার স্ত্রী হাওয়া বিনত ইয়াযীদ তো ইসলাম গ্রহণ করেছে। তুমি তাকে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে থাক। আমি চাই তুমি আর তাকে কোনভাবে কষ্ট দিবে না। আল্লাহকে ভয় কর। তার ব্যাপারে আমার কথা মনে রেখ।[তাবাকাত-৩/৩২৪;৮/২৩; আ‘লাম আন-নিসা-১/৩০৪]

কায়স বললেন : আবুল কাসিম! আপনার সম্মানে আমি তাকে আর কোন কষ্ট দিবো না। রাসূলকে (সা) কথা দিয়ে মদীনায় ফিরে এলেন। স্ত্রীকে বললেন : তোমার সেই বন্ধু আমার সাথে দেখা করেছেন এবং তোমাকে কোন রকম কষ্ট না দেওয়ার জন্য আমাকে অনুরোধ করেছেন। সুতরাং এখন থেকে আমি আর তোমাকে কিছু বলবো না। তুমি স্বাধীনভাবে তোমার দীন চর্চা করতে পার।[ইবন সাল্লাম, তাবাকাত আশ-শু‘আরা-১৯২,১৯৩]

অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি স্ত্রীকে বলেন : তুমি তোমার দীন যেভাবে ইচ্ছা পালান করতে পর। আমি আর কোন রকম বাধা দিব না। আল্লাহর কসম! আমি তাঁর চেয়ে সুন্দর চেহেরা ও সুন্দর আকৃতির কোন মানুষ আর দেখিনি। [আল-বায়হাকী, দালায়িল আন-নুবুওয়াহ-২/৪৫৬; আ‘লাম আন-নিসা-১/৩০৪]

এরপর হাওয়া (রা) স্বামীর নিকট ইসলামের যা কিছু গোপন রেখেছিলেন সবই প্রকাশ করে দেন। প্রকাশ্যেই ইসলাম চর্চা করতে থাকেন। কায়স আর মোটেও বাধা দেননি। প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবরা যখন তাঁকে বলতো, তুমিতো পৌত্তলিক ধর্মের উপর অটল আছ, কিন্তু তোমার স্ত্রী তো মুহাম্মাদের (সা) অনুসারী হয়ে গেছেন। তিনি বলতেন : আমি মুহাম্মাদকে কথা দিয়েছি যে, আমি আর তাকে কোন কষ্ট দেব না এবং তাকে দেওয়া কথা আমি রক্ষা করবো। কায়সের এ অঙ্গীকার পালন এবং স্ত্রীকে নির্যাতন না করার কথা রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে পৌছলে তিনি মন্তব্য করেন : (আরবী*********) অর্থাৎ কাঁচা-পাকা জোড়া ভ্রূ বিশিষ্ঠ লোকটি কথা রেখেছে। [উসুদুল গাবা-৫/৪৩১; নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-৯৪]

এভাবে নির্বিঘ্নে হাওয়া ইসলামী জীবন যাপন করতে লাগলেন। এর মধ্যে রাসূল (সা) হিজরাত করে মদীনায় চলে আসলেন। হাওয়া আরো কিছু আনসারী মহিলাদের সাথে প্রথম পর্বেই রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট উপস্থিত হয়ে বাই‘আত সম্পন্ন করেন।

কায়স ইসলাম গ্রহণ করেননি। তবে হাওয়ার (রা) গর্ভে জন্ম নেওয়া তাঁর দুই ছেলে ইয়াযীদ ও ছাবিত- উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। উহুদ যুদ্ধে ইয়াযীদ রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে অংশগ্রহণ করেন এবং দেহের বারোটি স্থানে আঘাত পান। এদিন তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে তরবারি হাতে নিয়ে প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হন। তখন রাসূল (সা) তাঁকে ‘জাসির‘ নামে সম্বোধন করে নির্দেশ দিচ্ছিলেন এভাবে : (আরবী ************)- হে জাসির! সামনে এগিয়ে যাও। জাসির! পিছনে সরে এসো।

আবূ উবায়দার (রা) নেতৃত্বে পরিচালিত “জাসর“-এর যুদ্ধে এই ইয়াযীদ শাহাদাত বরণ করেন। [প্রাগুক্ত] আর ছাবিত, ইবন আবদিল বার “আল ইসতী‘আব“ গ্রন্থে বলেছেন, তাকে সাহাবীদের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি মু‘আবিয়ার (রা) খিলাফাতকালে ইনতিকাল করেন।[নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-৯২]

উল্লেখ্য যে, কায়স ইবন খুতাইমের দুই বোন- লাইলা ও লুবনা ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট বাই‘আত করেন। হযরত হাওয়ার শেষ জীবন সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তিনি কখন, কোথায় এবং কিভাবে মারা গেছেন সে সম্পর্কে ইতিহাস নীরব। তাবে তিনি যে একজন ভালো মুসলমান হতে পেরেছিলেন, ইতিহাসের সকল সূত্র সে কথা বলেছে।[আল-ইসাবা-৪২৭৬]
শিফা বিনত আবদিল্লাহ (রা)
হযরত শিফা (রা) মক্কার কুরায়শ খান্দানের আদী শাখার কন্যা। ডাকনাম উম্মু সুলায়মান। পিতা আবদুল্লাহ ইবন আবদি শামস‘, মাতা একই খান্দানের আমর ইবন মাখযূম শাখার সন্তান ফাতিমা বিনত আবী ওয়াহাব। [উসুদুল গাবা-৫/৪৮৬; আল-ইসাবা ফী তাময়ীয আস-সাহাবা-৪/৩৩৩] আবূ হুছমা ইবন হুযায়ফা আল-আদাবীর সঙ্গে শিফার বিয়ে হয়।[তাবাকাত-৮/২৬৮; আল-ইসতী‘আব-৪/৩৩২] অনেকে বলেছেন, তাঁর আসল নাম লায়লা এবং পরবর্তীতে তাঁর প্রতি আরোপিত উপাধি আশ-শিফা নামে পরিচিতি লাভ করেন।[নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ, টীকা নং-১, পৃ. ১৫৯]

হিজরাতের পূর্বে মক্কাতেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং প্রথম পর্বে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতকারী মহিলাদের মধ্যে তিনিও একজন।[আল-ইসাবা-৪/৩৩৩] যে সকল মহিলা সাহাবী রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট বাই‘আত করেন তিনি তাঁদের অন্যতম। [নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ, পৃ.১৫৯] হযরত রাসূলে কারীমের (সা) প্রতি ছির তাঁর গভীর ভক্তি ও ভালোবাসা। রাসূল (সা) ও তাঁর এ ভক্তি-ভালোবাসাকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিতেন। তিনি মাঝে মাঝে শিফার গৃহে যেতেন এবং বিশ্রাম নিতেন। হযরত শিফা (রা) তাঁর গৃহে রাসূলের (সা) জন্য একটি বিছানা এবং এক প্রস্থ পরিধেয় বস্ত্র বিশেষভাবে রেখে দেন। রাসূল (সা) তা ব্যবহার করতেন। হযরত শিফার ইনতিকালের পর তাঁর সন্তানরা এসব জিনিস অতি যত্নের সাথে সংরক্ষণ করতে থাকেন। কিন্তু উমাইয় খলীফা মারওয়ান ইবন হাকাম (মৃ.৬৫হি.) তাদের নিকট থেকে সেগুলো ছিনিয়ে নেন। ফলে তা শিফার পরিবারের বেহাত হয়ে যায়। [তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত-২/৮৭; আল-ইসতি‘আব-৪/৩৫৮]

হযরত উমার (রা) শিফাকে বিশেষ মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতেন। তাঁর মতামতের অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন এবং তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার ভাব পোষণ করতেন। তিনি শিফার বাজার পর্যবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার কিছু দায়িত্ব প্রদান করেন। [জামহারাতুল আনসাব আল-আরাব-১/১৫০; আল-ইসাবা-৪/৩৩৩]

হযরত রাসূলে কারীম (সা) তাঁকে একটি বাড়ী দান করেন। সেই বাড়ীতে তিনি ছেলে সুলায়মানকে নিয়ে বাস করতেন। [নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ-পৃ.১৬১]

একবার খলীফা হযরত উমার (রা) তাঁকে ডেকে এনে একটি চাদর দান করেন। ঠিক সে সময় উপস্থিত আতিকা বিনত উসাইদকেও অপেক্ষাকৃত একটি ভালো চাদর দান করেন। অভিযোগের সুরে শিফা খলীফাকে বলেন : আপনার হাত ধুলিমলিন হোক! আপনি তাকে আমার চাদরের চেয়ে ভালো চাদর দান করেছেন। অথচ আমি তার আগে মুসলমান হয়েছি এবং আমি আপনার চাচাতো বোন। তাছড়া আমি এসছি, আপনি ডেকে পাঠিয়েছেন, তাই। আর সে নিজেই চলে এসেছে। জবাবে উমার (রা) বললেন : আমি তোমাকে ভালো চাদরটি দিতাম; কিন্তু সে এসে পড়ায় তাঁকে প্রাধান্য দিতে হয়েছে। কারণ বংশগত দিক থেকে সে রাসূলুল্লাহর (সা) অধিকতর নিকটবর্তী। [আল-ইসতী‘আব-৪/৩৫৮; উসুদুল গাবা-৫/৪৯৭; সাহাবিয়াত, পৃ.২৪০]

হযরত শিফাও ছিলেন হযরত উমারের (রা) গুণমুগ্ধা। সময় ও সুযোগ পেলেই উমারের (রা) আদর্শ মানুষের সামনে তুলে ধরতেন। যেমন, একদিন তিনি কয়েকজন যুবককে তাঁর সামনে দিয়ে অত্যন্ত ধীরগতিতে চাপাস্বরে কথা বলতে বলতে যেতে দেখে প্রশ্ন করলেন এদের অবস্থা এমন হয়েছে কেন? লোকেরা বললো : এরা আবিদ- আল্লাহর ইবাদতে মশগুল ব্যক্তিবর্গ। হযরত শিফা (রা) একটু রাগত স্বরে বললেন : (আরবী***********) [তারীখ আত-তাবায়ী-২/৫৭১; তাবাকাত-৩/২৯০]

“আল্লাহর কসম! উমার যখন কথা বলতেন, উচ্চস্বরে বলতেন, যখন হাঁটতেন, দ্রুতগতিতে হাঁটতেন, যখন কাউকে মারতেন, অত্যন্ত ব্যথা দিতেন। আল্লাহর কসম! তিনিই সত্যিকারের আবিদ।“

হযরত উমার (রা) হযরত শিফার (রা) সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য মাঝে মাঝে তাঁর বাড়ীতে যেতেন, তাঁর খোঁজ-খবর নিতেন। স্বামী-সন্তানদের কুশল জিজ্ঞাসা করতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদেরকে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিতেন। শিফা (রা) বলেন : একদিন উমার (রা) আমার গৃহে এসে দু‘জন পুরুষ লোককে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেন। উল্লেখ্য যে, লোক দু‘জন হলেন তাঁর স্বামী ও ছেলে সুলায়মান। উমার প্রশ্ন করলেন : এদের ব্যাপারটি কি? এরা কি সকালে আমাদের সাথে জামা‘আতে নামায পড়েনি? বললাম : হে আমীরুল মু‘মিনীন! তারা জামা‘আতে নামায পড়েছে। সারা রাত নামায পড়ে সকালে ফজরের নামায জামা‘আতে আদায় করে ঘুমিয়েছে। উল্লেখ্য যে, তখন ছিল রমাদান মাস। উমার বললেন : সারা রাত নামায পড়ে ফজরের জামা‘আত ত্যাগ করার চেয়ে ফজরের নামায জামা‘আত আদায় করা আমার অধিক প্রিয়। [কানয আল-উম্মাল-৪/২৪৩; হায়াতুস সাহাবা-৩/১২৩]

তিনি কিছু ঝাড়ফুঁক ও লিখতে জানতেন। জাহিলী যুগে এ দুটি বিষয় অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হতো। একবার তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট আসেন এবং বিনয়ের সাথে বলেন, জাহিলী জীবন আমি কিছু ঝাড়ফুঁক জানতাম। আপনি অনুমতি দিলে শোনাতে পারি। রাসূল (সা) অনুমতি দেন এবং তিনি সেই মন্ত্র শোনেন। রাসূল (সা) বলেন, তুমি এই মন্ত্র দিয়ে ঝাড়ফুঁক চালিয়ে যেতে পার। হাফসাকেও (উম্মুল মু‘মিনীন) শিখিয়ে দাও।

অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা) তাঁকে বলেন : (আরবী**************)

“তুমি নামলার মন্ত্র হাফসাকে শিখিয়ে দাও, যেমন তাকে লেখা শিখিয়েছো।“ এ বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, তিনি হযরত হাফসাকে (রা) লেখা শিখিয়েছিলেন।[আল-ইসাবা-৪/৩৩৩] উল্লেখ্য যে, আধুনিককালের চিকিত্সাবিদদের মতে “নামলা“ একজিমা ধরণের এক প্রকার চর্মরোগ।[আ‘লাম আন-নিসা -২/২০১] রাসূলুল্লাহর (সা) অনুমতি পেয়ে তিনি সেই মন্তর মহিলাদেরকে শেখাতেন।[নিসা‘মিন আসর আন-নুবুওয়াহ, পৃ.১৬০]

হযরত শিফা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে সরাসরি এবং উমার (রা) থেকে কয়েকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর থেকে যাঁরা বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে তাঁর পুত্র সুলায়মান, পৌত্র আবূ সালামা আবূ বকর ও উছমান এবং আবূ ইসহাক ও উম্মুল মু‘মিনীন হযরত হাফসা (রা) বিশেষ উল্লেখযোগ্য।[তাহযীবুত তাহযীব-১২/৪২৮; আল-ইসতী‘আব-৪/৩৩৩] তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা-১২ (বারো)।[আল-ইসাবা-৪/৩৩৩]

তাঁর দুই সন্তানের কথা জানা যায়- পুত্র সুলায়মান এবং এক কন্যা-যিনি শুরাহবীল ইবন হাসানার (রা) স্ত্রী ছিলেন। সুলায়মান ছিলেন একজন জ্ঞানী ধর্মপরায়ণ সজ্জন ব্যক্তি। মুসলিম মনীষীদের মধ্যে তিনি এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।[তাবাকাত-৮/২৬৮]

হযরত শিফার (রা) মৃত্যসন জানা যায় না। তবে অনেকে হযরত উমারের (রা) খলাফতেকালে হিজরী ২০ সনের কাছাকাছি কোন এক সময়ের কথা বলেছেন। [আ‘লাম আন-নিসা-২/১৬৩]

হযরত শিফার বর্ণিত একটি অন্যতম হাদীস হলো : (আরবী************) [উসুদুল গাবা-৫/৪৮৭; আল-ইসাবা-৪/৩৩৩]

“রাসূলুল্লাহকে (সা) সর্বোত্তম আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাস করা হলো। তিনি বললেন : আল্লাহর উপর ঈমান, আল্লাহর হথে জিহাদ এবং হজ্জে মাবরূর বা আল্লাহর নিকট গৃহীত হজ্জ।“

তাবারানী ও বায়হাকী হযরত শিফার (রা) একটি চমকপ্রদ হাদীস বর্ণনা করেছেন। শিফা (রা) বলেন : আমি একদিন রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট গেলাম এবং কিছু সাদাকার আবেদন জানালাম। তিনি অক্ষমতা প্রকাশ করে চললেন, আর আমিও চাপাচাপি করতে লাগলাম। এর মধ্যে নামাযের সময় হয়ে গেল। আমি বেরিয়ে আমার মেয়ের ঘরে গেলাম। মেয়ের স্বামী ছিল শুরাহবীল ইবন হাসানা। আমি এ সময় শুরাহবীলকে ঘরে দেখে বললাম : নাময শুরু হতে চলেছে, আর তুমি এখন ঘরে? আমি তাকে তিরস্কার করতে লাগলাম। সে বললো : খালা! আমাকে তিরস্কার করবেন না। আমার একখানা মাত্র কাপড়, তাও রাসূল (সা) ধার নিয়েছেন। আমি বললাম : আমি যাকে তিরস্কার করছি তার এই অবস্থা, অথচ আমি তার কিছুই জানিনা। শুরাহবীল বললো : আমার একখানা মাত্র তালি দেয়া কাপড় আছে।[কানয আল-উম্মাল-৪/৪১; হায়াতুস সাহাবা-১/৩২৬]


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি