যায়নাব বিনত রাসূলিল্লাহ (সা)
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেয়ে সায়্যিদা যায়নাব (রা)- যিনি আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাত বরণ করেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত ‘আয়িশা (রা্) তাঁর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সা) এ বাণী বর্ণনা করেছেন : [হায়াতুস সাহাবা-১/৩৭২] (আরবী*******)

‘সে ছিল আমার সবচেয়ে ভালো মেয়ে। আমাকে ভালোবাসার কারণেই তাকে কষ্ট পেতে হয়েছে।’

হযরত যায়নাবের (রা) সম্মানিতা জননী উম্মুল মু‘মিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা)। যিনি মুহাম্মাদ (সা) এর রিসালাতের প্রতি সর্বপ্রথম ঈমান আনার অনন্য গৌরবের অধিকারিণী। তাঁর মহত্ব ও মর‌্যাদা এক বিশাল যে বিগত উম্মাত সমূহের মধ্যে কেবল মারইয়ামের (আ)-এর রিসালাতের প্রতি সর্বপ্রথম ঈমান আনার অনন্য গৌরবের অধিকারিণী। তাঁর মহত্ত্ব ও মর্যাদা এত বিশাল যে বিগত উম্মাত সমীহের মধ্যে কেবল হযরত মারইয়ামের (আ) সাথে যা তুলনীয়।

ইমাম আজ-জাহাবী বলেন :[ সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৪৬](আরবী*******)

‘যায়নাব হলেন রাসূলুল্লাহর (সা) মেয়ে এবং তাঁর হিযরাতকারিণী সায়্যিদাত বোনদের মধ্যে সবার বড়।’

আবু ‘আমর বলেন, যায়নাব (রা) তাঁর পিতার মেয়েদের মধ্যে সবার বড়্ এ ব্যাপারে কোন মতপার্থক্য নেই। আর যাঁরা ভিন্নমত পোষণ করেন তাঁরা ভুলের মধ্যে আছেন। তাদের দাবীর প্রতি গুরুত্ব প্রদানের কোন হেতু নেই। তবে মতপার্থক্য যে বিষয়ে আছে তা হলো, রাসূলুল্লাহর (সা) ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যায়নাব প্রথমন সন্তান, না কাসিম? বংশবিদ্যা বিশারদদের একটি দলের মতে আল-কাসিম প্রথম ও যায়নাব দ্বিতীয় সন্তান। ইবনুল কালবী যায়নাবকে (রা) প্রথম সন্তান বলেছেন। ইবনে সা‘দের মতে, যায়নাব (রা) মেয়েদের মধ্যে সবার বড়।[তাবাকাত-৮/৩০] ইবন হিশাম রাসূলুল্লাহর (সা) সন্তনদের ক্রমধারা এভাবে সাজিয়েছেন :[ আস্-সীরাতুন নাবাবিয়্যা-১/১৯০] (আরবী*********)

রাসূলুল্লাহর (সা) বড় ছেলে আল কাসিম, তারপর যথাক্রমে আত-তায়্যিব ও আত-তাহির। আর বড় মেয়ে রুকাইয়্যা, তারপর যথাক্রমে যায়নাব, উম্মু কুলছূম ও ফাতিমা।’

পিতা মুহাম্মাদ (সা)-এর নুবুওয়াত প্র্রাপ্তির দশ বছর পূর্বে হযরত যায়নাবের (রা) জন্ম হয়। তখন হযরত রাসূলে কারীমের (সা) বয়স তিরিশ এবং মাতা হযরত খাদীজার (রা) পঁয়তাল্লিশ বছর্ হযরত যায়নাবের (রা) শৈশব জীবনের তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তাঁর এ জীবনটি সম্পূর্ণ অন্ধকারেই রয়ে গেছে। তাঁর জীবন সম্পর্কে যতটুকু যা জানা যায় তা তাঁর বিয়ের সময় থেকে।

রাসূলুল্লাহর (সা) মেয়েদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত যায়নাবের (রা) বিয়ে অল্প বয়সে অনুষ্ঠিত হয়। তখনও পিতা মুহাম্মাদ (সা) নবী হননি।৫ ইমা, আজ- জাহাবীড এ মত গ্রহণ করতে পানেনি। তিনি বলেন: [তাবাকাত-৮/৩০-৩১] (আরবী======)

‘ইবন সা‘দ উল্লেখ করেছেন যে, আবুল আ‘স যায়নাবকে বিয়ে করেন নবুওয়াতের পূর্বে। এ এক অবাস্তব কথা।’

যাই হোক স্বামী আবুল ‘আস ইবন আর রাবী’ ইবন আবদুল ‘উয্যা ছিলেন যায়নাবের খালাতো ভাই। মা হযরত খাদীজার (রা) আপন ছোট বোন হালা বিনত খুওয়াইলিদের ছেলে। [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৪৬]

বিয়ের সময় বাবা-মা মেয়েকে যে সকর উপহার সামগ্রী দিয়েছিলেন তার মধ্যে িইয়ামনী আকীকের একটি হারও ছিল। হারটি দিয়েছিলেন মা খাদীজা (রা)।[তাবাকাত-৮/৩১]

পিতা মুহাম্মাদ (সা) ওহী লাভ করে নবী হলেন। মেয়ে যায়নাব (রা) তাঁর মার সাঞেথ মুসলমান হলেন। স্বামী আবুল ‘আস তখন ইসলাম গ্রহণ করেননি। রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় হিজরাত করলেন। পরে হযরত যায়নাব (রা) স্বামীকে মুশরিক অবস্থায় মক্কায় রেখে মদীনায় হিজরাত করেন।[প্রাগুক্ত-৮/৩২]

রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত যায়নাব (রা) ও আবুল ‘আসের মধ্যের গভীর সম্পর্ক এবং ভদ্রোচিত কর্মপদ্ধতির প্রায়ই প্রশংসা করতেন।[সুনানু আবী দাউদ-১/২২২]

আবুল ‘আস যেহেতু শিরকের উপর অটল ছিলেন, এ করণে ইসলামের হুকুম অনুযায়ী উচিত ছিল, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেওয়া। কিন্তু রাসূল (সা) মক্কায় সে সময় শক্তিহীন ছিলেন। ইসলামী শক্তি তেমন মজবুত ছিল না। তাছাড়া কাফিরদের জুলুম-অত্যাচারের প্লাবন সবেগে প্রবাহমান ছিল। এদিকে ইসলামের প্রচার প্রসারের গতি ছিল মন্থর ও প্রাথমিক প্রর্যায়ের। এসকল কারণে তাঁদের স্বামিী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ না ঘটানোই রাসূল (সা) সমীচীন মনে করেন।

আবুল ‘আস স্ত্রী যায়নাবকে (রা) অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং সম্মানও করতেন। কিন্তু তিনি পূর্বপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে প্রিয়তমা স্ত্রীর নতুন দ্বীন কবুল করতে কোনভাবেই রাজী হলেন না। এ অবস্থা চলতে লাগলো। এদিকে রাসূলুল্লাহ (সা) ও কুরাইশদের মধ্যে মারাত্মক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত শুরু হয়ে গেল। কুরাইশরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলো :

‘তোমাদের সর্বনাশ হোক! তোমরা মুহাম্মাদের মেয়েদের বিয়ে করে তার দুশ্চিন্তা নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিয়েছো। তোমরা যদি এ সকল মেয়েকে তার কাছে ফেরত পাঠাতে তাহলে সে তোমাদের ছেড়ে তাদেরকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়তো।’ তাদের মধ্যে অনেকে এ কথা সমর্থন করে বললো- ‘এ তো অতি চমৎকার যুক্তি।’ তারা দল বেধে আবুল ‘আসের কাছে যেয়ে বললো, ‘আবুল ‘আস, তুমি তোমার স্ত্রীকে তারাক দিয়ে তার পিতার কাছে পাঠিয়ে দাও। তার পরিবর্তে তুমি যে কুরাইশ সুন্দরীকে চাও, আমরা তাকে তোমার সাথে বিয়ে দেব।’ আবুল ‘আস বললেন, ‘আল্লাহর কসম! না তা হয়না। আমার স্ত্রীকে আমি ত্যাগ করতে পারিনে। তার পরিবর্তে সকল নারী আমাকে দিলেও আমার তা পসন্দ নয়।’ একারণে রাসূল (সা) তাঁর আত্মীয়তাকে খুব ভালো মনে করতেন। এবং প্রশংসা করতেন। [তাবারী-৩/১৩৬; ইবন হিশাম, আস্-সীরাহ-১/৬৫২]

হযরত যায়নাব (রা) স্বামী আবুল ‘আসকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। স্বামীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও ত্যাগের অবস্থা নিম্নের ঘটনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে:

নবুওয়াতের ১৩তম বছরে রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করেন। হযরত যায়নাব (রা) স্বামীর সাথে মক্কায় থেকে যান।[আনসাবুল আশরাফ-১/২৬৯] কুরাইশদের সাথে মদীনার মুসলমানদের সামরিক সংঘাত শুরু হলো। কুরাইশরা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বদরে সমবেত হলো। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবুল ‘আস কুরাইশদের সাথে বদলে গেলেন। কারণ, কুরাইশদের মধ্যে তাঁর যে স্থান তাতে না যেয়ে উপায় ছিলনা। বদরে কুরাইশরা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। তাদের বেশ কিছু নেতা নিহত হয় এবং বহু সংখ্যক যোদ্ধা বন্দী হয়। আর অবশিষ্টরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! এই বন্দীদের মধ্যে রাসূলুল্লাহর (সা) জামাই হযরত যায়নাবের (রা) স্বামী আবুল ‘আসও ছিলেন। ইবন ইসহাক বলেন, হযর ত ‘আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর এবন নু‘মান (রা) তাঁকে বন্দী করেন। তবে আল-ওয়াকিদীর মতে হযরত খিরাশ িইবন আস-সাম্মাহর (রা) হতে তিনি বন্দী হন।[আল-ইসাবা ফী তাময়ীযিস সাহাবা-৪/১২২]

বন্দীদের সামাজিক মর্যাদা এবং ধনী-দরিদ্র প্রভেদ অনুযায়ী একহাজার থেকে চার হাজার দিরহাম মুক্তিপণ নির্ধারিত হলো। বন্দীদের প্রতিনিধিরা ধার্যকৃত মুক্তিপণ নিয়ে মক্কা-মদীনা ছুটাছুটি শুরু করে দিল। নবী দুহিতা হযরত যায়নাব (রা) স্বামী আবুল ‘আসের মুক্তিপণসহ মদীনায় লোক পাঠালেন। আল-ওয়াকিদীর মতে আবুল ‘আসের মুক্তিপণ নিয়ে মদীনায় এসেছিল তাঁর ভাই ‘আমর ইবন রাবী’। হযরত যায়নাব মুক্তিপণ দিরহামের পরিবর্তে একটি হার পাঠিয়েছিলেন। এই হারটি তাঁর জননী হযরত খাদীজা (রা) বিয়ের সময় তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন্ হযরত রাসূলে কারীম (সা) হারটি দেখেই বিমর্ষ হয়ে পড়লেন এবং নিজের বিষণ্ণ মুখটি একখানি পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেললেন। জানানাতবাসিনী প্রিয়তমা স্ত্রী ও অতি আদরের মেয়ের স্মৃতি তাঁর মানসপটে ভেসে উঠেছিল।

কিছুক্ষণ পর হযরত রাসূলে কারীম (সা) সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেন : ‘যায়নাব তার স্বামীর মুক্তিপণ হিসেবে এই হারটি পাঠিয়েছে। তোমরা ইচ্ছে করলে তার বন্দীকে ছেড়ে দিতে পার এবং হারটিও তাকে ফেরত দিতে পার।’ সাহাবীরা রাজী হয়ে গেলেন। তাঁরা আবুল ‘আসকে মুক্তি দিলেন, আর সেই সাথে ফেরত দিলেন তাঁর মুক্তিপণের হারটি। তবে রাসূলুল্লাহ (সা) আবুল ‘আসের নিকট থেকে এ অঙ্গিকার নিলেন যে মক্কায় ফিরে অনতিবিলম্বে সে যায়নাবকে মদীনায় পাঠিয়ে দেকে।

রাসূলুল্লাহ (সা) যায়নাবকে (রা) নেওয়ার জন্য আবুল ‘আসের সংগে হযরত যায়দ ইবন হারেছাকে (রা) পাঠন। তাঁকে ‘বাতান’ অথব ‘জাজৎ নামক স্থানে অপেক্ষা করতে বলেন! যায়নাব (রা) মক্কা থেকে সেকানে পৌছলে তাঁকে নিয়ে মদীনায় চলে আসতে বলেন। আবুল ‘আস মক্কায় পৌছে যায়নাবকে (রা) সফরের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত আছেন, এমন সময় হিন্দ বিনত ‘উতবা এসে হাজির হলো। প্রস্তুতি দেখে বললো : মুহাম্মাদের মেয়ে, তুমি কি তোমার বাপের কাছে যাচ্ছো? যায়নাব (রা) বললেন, এই মুহূর্তে তো তেমন উদ্দেশ্য নেই, তবে ভবিষ্যতে আল্লাহর যা ইচ্ছ হয়। হিন্দ ব্যাপারটি বুঝতে পেরে বললো : বোন, এটা গোপন করার কি আছে। সত্যিই যদি তুমি যাও তাহলে পথে দরকার পড়ে এমন কোন কিছু প্রয়োজন হলে রাখঢাক না করে বলে ফেলতে পার, আমি তোমার খিদমতের জন্য প্রস্তুত আছি।

মহিলাদের মধ্যে শত্রুতার সেই বিষাক্ত প্রভাব তখনও বিস্তার লাভ করেনি যা পুরুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কারণে হযরত যায়নাব (রা) বলেন : হিন্দ যা বলেছিল, অন্তরের কথাই বলেছিল। অর্থাৎ আমার যদি কোন জিনিসের প্রয়োজন হতো, তাহলে অবশ্যই সে তা পূরণ করতো। কিন্তু সে সময়ের অবস্থা চিন্তা করে আমি অস্বীকার করি।[তাবারী-১/১২৪৭; ইবন হিশাম-১/৬৫৩-৫৪]

হযরত যায়নাব (রা) কিভাবে মক্কা থেকে মদীনায় পৌছেন সে সম্পর্কে সীরাতের গ্রন্থসমীহে নানা রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো:

ইবন ইসহাক বলেন, সফরের প্রস্তুতি শেষ হলে যায়নাবের (রা) দেবর কিনানা ইবন রাবী‘ একটি উট এনে দাঁড় করালো। যায়নাব উটের ফিঠের হাওদায় উঠে বসলেন। আর কিনানা স্বীয় ধনুকটি কাঁধে ঝুলিয়ে তীরের বাণ্ডিলটি হাতে নিয়ে দিনে দুপুরে উট হাঁকিয়ে মক্কা থেকে বের হলো। কুরাইশদের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে গেল। তারা ধাওয়া করে মক্কার অদূরে ‘জী-তুওয়া’ উপত্যকায় তাঁদের দুই জনকে ধরে ফেললো। কিনানা কুরাইশদের আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে কাঁধের ধনুকটি হাতে নিয়ে তীরের বাণ্ডিলটি সামনে ছড়িয়ে দিয়ে বললো : তোমাদের কেউ যায়নাবের নিকটে যাওয়ার চেষ্টা করলে তার সিনা হবে আমার তীরের লক্ষ্যস্থল। কিনানা ছিল একজন দক্ষ তীরন্দাজ। তার নিক্ষিপ্ত কোন তীর সচরাচর লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো না। তার এ হুমকী শুনে আবু সুফইয়ান ইবন হারব তার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বললো :

‘ভাতিজা, তুমি যে তীরটি আমাদের দিকে তাক করে রেখেছো তা একটি ফিরাও। আমরা তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই।’ কিনানা তীরটি নামিয়ে নিয়ে বললো, কি বলতে চান, বলে ফেলুন। আবু সুফইয়ান বললো :

‘তোমার কাজটি ঠিক হয়নি। তুমি প্রকাশ্যে দিনে দুপুরে মানুষের সামনে দিয়ে যায়নাবকে নিয়ে বের হয়েছো, আর আমরা বসে বসে তা দেখছ্ িগোটা আরববাসী জানে বদরে আমাদের কী দুর্দশা ঘটেছে এবং যায়নাবের বাপ আমাদের কী সর্বনাশটাই না করেছে। তুমি যদি এভাবে প্রকাশ্যে তার মেয়েকে আমাদের নাকের উপর দিয়ে নিয়ে যাও তাহলে সবাই আমাদের কাপুরাষ ভাববে এবং এ কজটি আমাদের জন্য অপমান বলে বিবেচনা করবে। তুমি আজ যায়নাবকে বাড়ী ফিরিয়ে নিয়ে যাও। কিছুদিন সে স্বামীর ঘরে থাকুক। এদিকে লোকেরা যখন বলতে মুরু করবে যে, আমরা যায়নাবকে মক্কা থেকে যেতে বাধা দিয়েছি, তখন একদিন গোপনে তাঁকে তার বাপের কাছে পৌছে দিও।’ [আল-বিদায়-৩/৩৩০; ইবন হিশাম-১/৬৫৪-৫৫]

কিনানা আবু সুফইয়ানের কথা মেনে নিযে যায়নাবসহ মক্কায় ফিরে এল। যখন ঘটনাটি মানুষের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেল, তখন একদিট রাতের অন্ধকারে সে আবার যায়নাবকে নিয়ে মক্কা থেকে বের হলো এবং ভাইয়ের নির্দেশ মত নির্দিষ্ট স্থানে তাঁকে তাঁর পিতার প্রতিনিধির হাতে তুলে দিল। যায়নাব (রা) হযরত যায়দ ইবন হারিছার (রা) সাথে মদীনায় পৌছলেন। [তাবারী-১/১২৪৯; যুরকানী : শারহুল মাওয়াহিব-৩/২২৩’]

তাবারানী ‘উরওয় ইবন যুবাইর হতে বর্ণনা করেছেন। এক ব্যক্তি যায়নাব বিনত রাসূলুল্লাহকে (সা) সাথে নিয়ে মক্কা থেকে বের হলে কুরায়শদের দুই ব্যক্তি [সেই দুই ব্যক্তির একজন হাব্বার ইবন আল-আসওয়াদ। সে ছিল হযরত খাদীজার (রা) চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। তাই সম্পর্কে সে যায়নাবের মামাতো ভাই। আর দ্বিতীয়জন ছিল নাফে’ ইবন ‘আবদি কায়স অথবা খালিদ ইবন ‘আবদি কায়স্ তাদের এমন অহেতুক বাড়াবাড়িমূলক আচরণের জন্য রাসূল (সা) ভীষণ বিরক্ত হন। তাই তিনি নির্দেশ দেন : (আরবী========)

‘যদি তোমরা হাব্বার ইবন আল-আসওয়াদ ও সেই ব্যক্তিটি যে তার সাথে যায়নাবের দিকে এগিযে যায়, হাতের মুঠোয় পাও, তাহলে আগুনে পুড়িয়ে মারব্ ’ কিন্তু পরদিন তিনি আবার বলেন : (আরবী=========)

‘আমি তোমাদেরকে বলেছিলাম, যদি তোমরা এ দুই ব্যক্তিকে ধরতে পার, আগুনে পুড়িয়ে মারবে। কিন্তু পরে আমি ভেবে দেখলাম এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য কাউকে আগুন দিয়ে শাস্তি দেওয়া উচিত নয়্ তাই তোমরা যদি তাদেরকে ধরতে পার, হত্যা করবে।’ কিন্তু পরে তারা মুসলমান হয় এবং রাসূল (সা) তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। (বুখারী, কিতাবুল জিহাদ : বাবু লা ইউ‘য়াজ্জাবুয বিআজাবিল্লাহ; আল-ইসাবা : হাব্বার ইবন আল-আসওয়াদ, ৩য় খণ্ড; আনসাবুল আশরাফ-১/৩৫৭, ৩৯৮, সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৪৭; ইবন হিশাম-১/৬৫৭)] পিছু ধাওয়া করে তাদের ধরে ফেলে। তারা যায়নাবের (রা) সংগী রোকটিকে কাবু করে যায়নাবকে (রা) উটের পিঠ থেকে ফেলে দেয়। তিনি একটি পাথরের উপর ছিটকে পড়লে শরীর

ফেটে রক্ত বের হয়ে যায়্ এ অবস্থা তারা যায়নাবকে(রা) মক্কায় আবু সুফইয়ানের নিকট নিয়ে যায়। আবু সুফইয়ান তাঁকে বনী হাশিমের মেয়েদের কাছে সোপর্দ করে। পরে তিনি মদীনায় হিজরাত করেন। উঠের পিঠ থেকে ফেলে দেওয়ায় তিনি যে আঘাত পান, আমরণ সেখানে ব্যথা অনুভব করতেন এবং সেই ব্যথায় শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেন। এজন্য তাঁকে শহীদ মনে করা হতো।[হায়াতু সাহাবা-১/৩৭১]

হযরত ‘আয়িমা (রা) বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহর (সা) মেয়ে যায়নাব কিনানার সাথে মক্কা থেকে মদীনার উদ্দেশ্যে বের হলো। মক্কাবাসীরা তাদের পিছু ধাওয়া করলো। হাব্বার ইবনুল আসওয়াদ সর্বপ্রথম যায়নাবকে ধরে ফেললো। সে যায়নাবের উটটি তীরবিদ্ধ করলে সে পড়ে গিয়ে আঘাত পেল। সে সন্তান সম্ভাবা ছিল। এই আঘাতে তার গর্ভের কসন্তানটি নষ্ট হয়ে যায়। অতঃপর বানু হাশিম ও বানু উমাইয়্যা তাঁকে নিয়ে বিবাদ শুরু করে দিল। অবশেষে সে হিন্দ বিনত ‘উতবার নিকট থাকতে লাগলো। হিন্দ প্রায়ই তাকে বলতো, তোমার এ বিপদ তোমার বাবার জন্যেই হয়েছে। [ইবন হিশাম ১/৬৫৪]

একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) যায়দ ইবন হারিছাকে বললেন, তুমি কি যায়নাবকে আনতে পারবে? যায়দ রাজি হলো। হযরত রাসূলে কারীম (সা) যায়দকে একটি আংটি দিয়ে বললেন, ‘এটা নিয়ে যাও, যায়নাবের কাছে পৌছাবে।’ আংটি নিয়ে যায়দ মক্কার দিকে চললো। মক্কার উপকণ্ঠে সে এক রাকালকে ছাগল চরাতে দেখলো। সে তাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কার রাখাল? বললো, ‘আবুল ‘আসের’। আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘ছাগলগুলি কার?’ বললো, ‘যায়নাব বিনত মুহাম্মাদের।’ যায়দ কিছুদূর রাখালের সাথে চললো। তারপর তাকে বললো, ‘আমি যদি একটি জিনিস তোমাকে দিই, তুমি কি তা যায়নাবের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে?’ রাখাল রাজি হলো। যায়দ তাকে আংটিটি দিল, আর রাখাল সেটি যায়নাবের হাতে পৌঁছে দি।।

যায়নাব রাখালকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটি তোমাকে কে দিয়েছে?‘ বললো, ‘একটি লোক’। আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘তাকে কোথায় ছেড়ে এসেছো?’ বললো, অমুক স্থানে।/ যায়নাব চুপ থাকলো। রাতের আঁধারে যায়নাব চুপে চুপে সেখানে গেল। যায়দ তাকে বললো, ‘তুমি আমার উটের পিছে উঠে আমার সামনে বস।’ যায়নাব বললো, ‘না, আপনিই আমার সামনে বসুন।’ এভাবে যায়নাব যায়দের (রা) পিছনে বসে মদীনায় পৌঁছলেন। হযরত রাসূলে কারীম (সা) প্রায়ই বলতেন, ‘আমার সবচেয়ে ভালো মেয়েটি আমার জন্য কষ্ট ভোগ করেছে।’[হায়াতু সাহাবা -১/৩৭১-৭২] সীরাতের গ্রন্থসমীহে হযরত যায়নাবের (রা) মক্কা থেকে মদীনা পৌঁছার ঘটনাটি একাধিক সূত্রে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বর্ণিত হতে দেখা যায়।

যেজেকু তাঁদের দুইজনের মধ্যের সম্পর্ক অতি চমৎকার ছিল, এ কারণে হযরত যায়নাবের (রা) মদীনায় চলে যাওয়ার পর আবুল ‘আস বেশীর বাগ সময় খবই বিমর্ষ থাকতেন। একবার তিনি যখন সিরিয়া সফরে ছিলেন তখন যায়নাবের (রা) কথা স্মরণ করে নিম্নের পংক্তি দুইটি আওড়াতে থাকেন :[ তাবাকাত-৮/৩২; আনসাবুল আশরাফ-১/৩৯৮] (আরবী==========)

“যখন আমি ‘আরিম’ নামক স্থানটি অতিক্রম করলাম তখন যায়নাবের কথা মনে হলো। বললাম, আল্লাহ ত‘আলা ঐ ব্যক্তিকে সজীব রাখুন যে হারামে বসবাস করছেন। আমী মুহাম্মাদের (সা) মেয়েকে আল্লাহ তা‘আলা ভালো প্রতিদান দিন। আর প্রত্যেক স্বামী সেই কথার প্রশংসা করে যা তার ভালো জানা আছে।”

মক্কার কুরায়দের যে বিশেষ গুণের কথা কুরআনে ঘোষিত হয়েছে—‘রিজলাকাষ ষিকায়ি ওয়াস সাঈফ’ – শীতকালে ইয়ামনের দিকে এবং গ্রষ্মকালে শামের দিকে তাদের বাণিজ্য কাফিলা চলাচল করে—আবুল ‘আসের মধ্যেও এ গুণটির পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল। মক্কা ও শামের মধ্যে সবসময় তাঁর বাণিজ্য কাফিলা যাতায়াত করতো । তাতে কমপক্ষে একশো উটসহ দুইশো লোক থাকতো্ তাঁর ব্যবসায়িক বুদ্ধি, সততা ও আমানতদারীর জন্য মানুষ তাঁর কাছে নিজেদের পণ্যসম্ভার নিশ্চিন্কে সমর্পণ করতো। ইবন ইসহাক বলেন, ‘অর্থ-বিত্ত, আমানতদারী ও ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি মক্কার গণমান্য মুষ্টিমেয় লোকদের অন্যতম ছিলেন।’[আল-ইসাবা-৪/১২২]

স্ত্রী যায়নাব (রা) থেকে বিচ্ছেদের পর আবুল ‘আস মক্কায় কাটাতে লাগলেন। হিজরী ৬ষ্ঠ

সনের জামাদি-উল-আওয়াল মাসে তিনি কুরাইশদের ১৭০ উটের একটি বাণিজ্য কাফিলা নিয়ে সিরিয়া যান। বাণিজ্য শেষে মক্কায় ফেরার পথে কাফিলাটি যখন মদীনার কাছাকাছি স্থানে তখন রাসূলুল্লাহ (সা)খবর পেলেন। তিনি এক শো সত্তর সদস্যের একটি বাহিনীসহ যায়দ ইবন হারিছাকে (রা) পাঠালেন কাফিলাটিকে ধরার জন্য। ‘ঈস নামক স্থানে দুইটি দল মুলোমুখি হয়। মুসলিম বাহিনী কুরায়শ কাফিলাটিকে বাণিজ্য সম্ভারসহ সকল লোককে বন্দী করে মদীনায় নিয়ে যায়। তবে আবুল ‘আসকে ধরার জন্য তারা তেমন চেষ্টা চালালো না। তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। [আনসাবুল আশরাফ-১/৩৭৭, ৩৯৯-৪০০; তাবাকাত-৮/৩৩; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা—২/২৫৯]

অবশ্য মূসা ইবন ‘উকবার মতে, আবু বাসীর ও তাঁর বাহিনী আবুল ‘আসের কাফিলার উপর আক্রমণ চালায়। উল্লেখ্য যে, এই আবু বাসীর ও আরও কিছু লোক হুদায়বিয়ার সন্ধির পর ইসলাম গ্রহণ করেন। তবে সন্ধির শর্তানুযায়ী মদীনাবাসীরা তাঁদের আশ্রয় দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করে। ফলে মক্কা থেকে পালিয়ে তাঁরা লোহিত সাগরের তীরবর্তী এলাকায় বসবাস করতে থাকেন। তাঁরা সংঘবদ্ধভাবে মক্কার বাণিজ্য কাফিলার উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে লুটপাট করতে থাকেন। তাঁরা কুরায়শদের জন্র কাল হয়ে দাঁড়ান্ তাঁদের ভয়ে কুরায়শদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। অবশেষে মক্কার কুরায়শরা বাধ্য হয়ে তাদের মদীনায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহকে (সা) অনুরোধ করে।[আল-ইসাবা-৪/১২২]

যাই হোক, আবুল ‘আস তাঁর কাফিলার এ পরিণতি দেখে মক্কায় না গিয়ে ভীত সন্ত্রস্তভাবে রাতের অন্ধকারে চুপে চুপে মদীনায় প্রবেশ করলেন এবং সোজা যায়নাবের (রা) কাছে পৌঁছে আশ্রয় চাইলেন। যায়নাব তাঁকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিলেন। কেউ কিছুই জানলো না।[আনসাবুল আশরাফ-১/৩৭৭, ৩৯৯]

রাত কেটে গেল। হযরত রাসূলে কারীম (সা) নামাযের জন্য মসজিদে গেলেন। তিনি মিহরাবে দাঁড়িয়ে ‘আল্লাহ আকবার’ বলে তাকবীর তাহরীমা বেঁধেছেন। পিছনের মুকতাদীরাও তাকবীর তাহমীমা শেষ করেছে। এমন সময় পিছনে মেয়েদের কাতার থেকে যায়নাবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো- ‘ওহে জনমণ্ডলী, আমি মুহাম্মাদের (সা) কন্যা যায়নাব। আমি আবুল ‘আসকে নিরাপত্তা দিয়েছি, আপনারাও তাঁকে নিরাপত্তা দিন।’

রাসূলুল্লাহ (সা) নামাজ শেষ করে লোকদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি যা শুনেছি তোমরাও কি তা শুনেছো?”

লোকেরা জবাব দিল, ‘হাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ!’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘যার হতে আমার জীবন, সেই সত্তার শপথ, আমি এ ঘটনার কিছুই জানিনা। কী অবাক কাণ্ড! মুসলমানদের একজন দুর্বল সদস্যাও শত্রুকে নিরাপত্তা দেয়। সে সকল মুসলমানের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা দিয়েছে।’[প্রাগুক্ত-১/৩৯৯-৪০০; তাবাকাত-৮/৩৩]

অতঃপর রাসূল (সা) ঘরে গিয়ে মেয়েকে বললেন, ‘আবুল আসের তাকার সম্মানজনক ব্যবস্থা করবে। তবে জেনে রেখ তুমি আর তার জন্য হালাল নও। যতক্ষণ সে মুশরিক থাকবে। হযরত যায়নাব (রা) পিতার কাছে আবেদন জানালেন আবুল ‘আসের কাফিলার লোকদের অর্থসম্পদসহ মুক্তিদানের জন্য।

রাসূলুল্লাহ (সা) সেই বাহিনীর লোকদের ডাকলেন যারা আবুল ‘আসের কাফিলার উট ও লোকদের ধরে নিয়ে এসেছিল। তিনি তাদের বললেন, ‘আমার ও আবুল ‘আসের মধ্যে যে সম্পর্ক তা তোমরা জান। তোমরা তার বাণিজ্য সম্ভার আটক করেছো। তার প্রতি সদয় হয়ে তার মালামাল ফেরত দিলে আমি খুশী হবো। আর তোমরা রাজী না হলে আমার কোন আপত্তি নেই। আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে তোমরা তা ভোগ করতে পার। তোমরাই সেই মালের বেশী হকদার।’ তারা বললো, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা তার সবকিছু ফেরত দিচ্ছি।’[ইবন হিশাম – ১/৬৫৮; তাবাকাত- ৮/৩৩]

আবুল ‘আস চললেন তাদের সাথে মালামাল বুঝে নিতে। পথে তারা আবুল ‘আসকে বললো, শোন আবুল ‘আস, কুরায়শদের মধ্যে তুমি একজন মর্যাদাবান ব্যক্তি। তাছাড়া তুমি রাসূলুল্লাহর (সা) চাচাতো ভাই এবংতাঁর মেয়ের স্বামী। তুমি এক কাজ কর। ইসলাম গ্রহণ করে মক্কাবাসীদের এ মালামালসহ মদীনায় থেকে যাও। বেশ আরামে থাকবে। আমি আমার নতুন দ্বীনের জীবন শুরু করবো শঠতার মাধ্যমে?[ প্রাগুক্ত]

আবুল ‘আস তাঁর কাফিলা ছাড়িয়ে নিয়ে মক্কায় পৌছালেন। মক্কায় প্রত্যেকের মাল বুঝে দিয়ে বললেন, ‘হে কুরায়শ গোত্রের লোকেরা! আমার কাছে তোমাদের আর কোন কিছু পাওনা আছে কি?’ তারা বললো না। আল্লাহ তোমাকে উত্তম পুরস্কার দান করুন আমরা তোমাকে একজন চমৎকার প্রতিশ্রুতি পালনকারী রূপে পেয়েছি।

আবুল ‘আস বললেন, ‘আমি তোমাদের হক পূর্ণরূপে আদায় করেছি। এখন আমি ঘোষনা করছি- আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ও রাসূলুহু- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা) তাঁর একজন বান্দা ও রাসূল। মদীনায় অবস্থানকালে আমি ঘোষণা দিতে পারতাম। কিন্তু তা দিইনি এ জন্যে যে, তোমরা ধারণা করতে আমি তোমাদের মাল আত্মসাৎ করা উদ্দেশ্যেই এমন করেছি। আল্লাহ যখন তোমাদের যার যার মাল ফেরত দানের তাওফীক আমাকে দিয়েছেন এবং আমি আমার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছি, তখনই আমি ইসলামের ঘোষণা দিচ্ছি।’

ই হিজরী সপ্তম সনের মুহাররম মাসের ঘটনা। এরপর আবুল ‘আস (রা) জন্মভূমি মক্কা থেকে হিজরাত করে মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমতে হাজির হন।[প্রাগুক্ত]

হযরত রাসূলে কারীম (সা) সম্মানের সাথে আবুল ‘আসকে (রা) গ্রহণ করেন এবং তাঁদের বিয়ের প্রথম ‘আকদের ভিত্তিতে স্ত্রী যায়নাবকেও (রা) তাঁর হাতে সোপর্দ করেন। [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৪৯; আল ইসাবা-৪/৩১২,]

হযরত যায়নাব (রা) স্বামী আবুল ‘আসকে তাঁর পৌত্তলিক অবস্থায মক্কায় ছেড়ে এসেছিলেন। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটেছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। পরে আবুল ‘আস যখন ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় আসলেন তখন রাসূল (সা) যায়নাবকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে দিলেন। এখন প্রশ্ন হলো, প্রথম ‘আকদের ভিত্তিতে যায়নাবকে প্রত্যর্পণ করেছিলেন, না আবার নতুন ‘আকদ হয়েছিল? এ ব্যাপারে দুই রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। হযরত ইব ‘আব্বাস (রা) বলেন : [ইবন হিশাম-১/৬৫৮-৫৯; রিমিজী (১১৪৩); ইবন মাজাহ (২০০৯); সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৪৯] (আরবী====)

‘রাসুলুল্লাহ (সা) তাঁর মেয়েকে অনেক বছর পর প্রথম বিয়ের ভিত্তিতে আবুল ‘আসের নিকট ফিরিয়ে দেন এবং কোন রকম নতুন মাহর ধার্য করেননি।’

ইমাম শা‘বী বলেন :[ তাবাকাত-৮/৩২] (আরবী============)

‘যায়নাব ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হিজরাতও করেন। তারপর আবুল ‘আস ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল (সা) তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটাননি।’

এর কারণ হিসেবে বলাহয়েছে যে, তখনও পর্যন্ত সূরা আল-মুমতাহিনার নিম্নের আয়াতটি নাযিল হয়নি : [সূরা আল-মুমতাহিনা-১০] (আরবী======)

একই ধরনের কথা হযরত কাতাদও বলেছেন। তিনি বলেন : (আরবী========)

‘এ ঘটনার পরে নাযিল হয় সূরা ‘আল-বারায়াতৎ। অতঃপর কোন স্ত্রী তার স্বমীর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করলে নতুন করে ‘আকদ ছাড়া স্ত্রীর উপর স্বামীর কোন প্রকার অধিকার থাকতো না।’

কিন্তু তার পূর্বে মুসলিম নারবীরা স্বামীর ইসলাম গ্রহণের পর নতুন ‘আকদ ছাড়াই স্বামীর কাছে ফিরে যেতেন।

তবে অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে : (আরবী=====)

‘নবী (সা) নতুন বিয়ে ও নতুন মাহরের ভিত্তিতে যয়নাবকে আবুযল ‘আসের নিকট প্রত্যর্পণ করেন।’ ইমাম আহমাদ বলেন : এটি একটিচ দুর্বল হাদীছ।

সনদের দিক দিয়ে ইবন ‘আব্বাসের (রা) বর্ণনাটি যদিও অপর বর্ণানটির উর প্রাধান্যযোগ্য, তবুও ফকীহরা দ্বিতীয়বার ‘আকদের বর্ণনাটির উপর আমল করেছেন। তাঁরা ইবন ‘আব্বাসের (রা) বর্ণনাটি যদিও অপর বর্ণনাটির উপর প্রাধান্যযোগ্য, তবুও ফকীহরা দ্বিতীয়বার ‘আকদের বর্ণাটির উপর আমল করেছেন। তাঁরা ইবন ‘আব্বাসের (রা) বর্ণনাটির এরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, যেহেতু দ্বিতীয় ‘আকদের সময় মাহর ও অন্যান্য বিষয় অপরিবর্তিত ছিল, তাই তিনি প্রথম ‘আকদ বলে বর্ণনা করেছেন। অন্যথায় এ ধরনের বিচ্ছেদে দ্বিতীয়বার ‘আকদ অপরিহার্য। ইমাম সুহায়লীও এরূপ কথা বলেছেন।

হযরত যায়নাব (রা) পিতা রাসূলুল্লাহ (সা) ও স্বামী আবুল ‘আস (রা)- উভয়কে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। ভালো দামী কাপড় পড়তে আগ্রহী ছিলেন। হযরত আনাস (রা) একবার তাঁকে একটি রেশমী চাদর গায়ে দেওয়া অবস্থায় দেখতে পান। চাদরটির পাড় ছিল হলুদ বর্ণের।

হযরত আবুল ‘আসের (রা) ঔরসে হযরত যায়নাবের (রা) দুইটি সন্তান জন্মলাভ করে। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। ছেলে ‘আলী হিজরতের পূর্বে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে নিজের দায়িত্বে নিয়ে প্রতিপালন করতে থাকেন। মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মক্কায় প্রবেশ করেন তখন ‘আলী নানার উটের টিছে সওয়ার ছিলেন। বালেগ হওয়ার পূর্বে পিতা আবুল ‘আসের (রা) জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন। [আল-আ‘লাম-৩/৩৬]

কিন্তু ইবন ‘আসাকিরের একটি বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, ‘আলী ইয়ারমূক যুদ্ধ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন এবং এই যু্দ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। [আল-ইসাবা-৪/৩১২] মেয়ে উমামা (রা) দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন।

হযরত যায়নাব (রা) স্বামী আবুল ‘আসের (রা) সাথে পুনর্মিলনের পর বেশীদিন বাঁচেননি। এক বছর বা তার চেয়ে কিছু বেশীদিন মদীনায় স্বামীর সাথে কাটানোর পর হিজরী অষ্টম সনের প্রথম দিকে মদীনায় ইনতিকাল করেন।[তাবাকাত-৮/৩৪; আল-আ‘লাম-৩/৬৭] তাঁর মৃত্যুর কারণ ও অবস্থা সম্পর্কে ইবন ‘আবদিল বার লিখেছেন :[ আল ইসতী ‘আব (আল-ইসাবার পার্শ্বটীকা) ৪/৩১২]

‘হযরত যায়নাবের (রা) মৃত্যুর কারণ হলো, যখন তিনি তাঁর পিতা রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে যাওয়ার জন্য মক্কা থেকে বের হন তখন হাব্বার ইবন আল-আসওয়াদ ও অন্য এক ব্যক্তি তাঁর উপর আক্রমণ করে। তাদের কেউ একজন তাঁকে পাথরের উপর ফেলে দেয়। এতে তাঁর গর্ভপাত ঘটে রক্ত ঝরে এবং তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত রোগে ভুগতে থাকেন। অবশেষে হিজরী অষ্টম সনে ইনতিকাল করেন।

হযরত উম্মু আয়মান (রা), হযরত সাওদা (রা), উযরত উম্মু সালামা (রা) ও হযরত উম্মু ‘আতিয়্যা (রা), হযরত যায়নাবকে (রা) গোসল দেন।[আনসাবুল আশরাফ-১/৪০০ ] রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর জানাযার নামায পড়ান এবং নিজে কবরে নেমে নিজ হাতে অতি আদরের মেয়েটিকে কবরের মধ্যে রেখে দেন। তখন রাসূলুল্লাহর (সা) চেহারা মুবারক খুবই বিমর্ষ ও মলিন দেখাচ্ছিল। তিনি তাঁর জন্য দু‘আ করেন এই বলে: হে আল্লাহ! যায়নাবের (রা) সমস্যাসমূহের সমাধান করে দিনেএবং তার কবরের সংকীর্ণতাকে প্রশস্ততায় পরিবর্তন করে দিন।[উসুদুল গাবা-৫/৪৬৮; তাবাকাত-৮/৩৪]

হযরত উম্মু ‘আতিয়া (রা) বলেন, আমি যায়নাব বিনত রাসূলিল্লাহর (সা) গোসলে শরীক ছিলাম। গোসলের নিয়ম-পদ্ধতি রাসূলুল্লাহ (সা) নিজেই বলে দিচ্ছিলেন। তিনি বললেন, প্রথমে প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তিন অথবা পাঁচবার গোসল দিবে। তারপর কর্পূর লাগাবে।[তাবাকাত-৮/৩৪; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৫০ ] একটি বর্ণনায় সাতবার গোসল দেওয়ার কথাও এসেছে। মূলত উদ্দেশ্য ছিল তাহারাত বা পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা যদি তিন বারে অর্জিত হয়ে যায় তাহলে বেশী ধোয়ার প্রয়োজন নেই। তা না হলে পাঁচ/সাত বারও ধুতে হবে। উম্মু ‘আতিয়্যা আরও বলেন:[ প্রাগুক্ত]

আমরা যখন যায়নাবকে গোসল দিচ্ছিলাম তখন রাসূল (সা) আমাদেরকে বললেন : ‘তোমরা তার ডান দিক ও ওজুর স্থানগুলি হতে গোসল আরম্ভ করবে।’

হযরত রাসূলে কারীম (সা) উম্মু ‘আতিয়্যাকে (রা) একথাও বলেন যে, গোসল শেষ হলে তোমরা আমাকে জানাবে। সুতরাং গোসল শেষ হলে তাঁকে জানানো হয়। তিনি নিজের একখানি তবন (লুঙ্গি) দিয়ে বলেন, এটি কাফনের কাপড়ের মধ্যে প্রতীক হিসেবে দিয়ে দাও।[বুখারী: বাবু গুসলিল মায়্যিত; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৫২] রাসূল (সা) তাঁর পূর্বে মৃত্যুবরণকারী ‘উছমান ইবন মাজ‘উনের (রা) পাশে দাফন করার নির্দেশ দেন।[আনসাবুল আশরাফ-১/২১২]

হযরত যায়নাবের (রা) ইনতিকালের অল্প কিচুদিন পর তাঁর স্বামী আবুল ‘আসও (রা) ইনতিকাল করেন।[উসুদুল গাবা-৫/৪৬৮] বালাজুরী বলেন, ইসলাম গ্রহণের পর তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি এবং হিজরী ১২ সনে ইনতিকাল করেন। হযরত যুবায়র ইবনুল ‘আওয়াম (রা) ছিলেন তাঁর মামাতো ভাই। মৃত্যুর পূর্বে তাঁকেই অসী বানিয়ে যান। [আনসাবুল আশরাফ-১/৪০০]

রুকায়্যা বিনত রাসীলিল্লাহ (সা)
রাসূলুল্লাহ (সা) ও হযরত খাদীজার (রা) মেঝো মেয়ে হযরত রুকায়্যা (রা)। পিতা মুহাম্মাদের (সা) নবুওয়াত লাভের সাত বঝর পূর্বে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। যুবাইর ও তাঁর চাচা মুসআব যিনি একজন কুষ্টিবিদ্যা বিশারদ, ধারণা করেছেন, রুক্য়্যা (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) ছোট মেয়ে। জুরজানী এ মত সমর্থন করেছেন। তবে অধিকাংশের মতে যায়নাব (রা) হলেন বড়, আর রুকায়্যা মেঝো। ইবন হিশামের মতে, রুকায়্যা মেয়েদের মধ্যে বড়।[সীরাত ইবন হিশাম-১/১৯০]

মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক সংকলিত একটি বর্ণনামতে, রাসূলুল্লাহর (সা) বয়স যখন তিরিশ তখন হযরত যায়নাবের (রা) জন্ম হয় এবং তেত্রিশ বছর বয়সে জন্ম হয় হযরত রুক্য়্যার (রা)।[আল ইসতী‘আব (আল-ইসাবার পার্শ্ব টীকা)-৪/২৯৯] যাই হোক, সীরাত বিষেজ্ঞরা হযরত রুকায়্যাকে রাসূলুল্লাহর (সা) মেঝো মেয়ে বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

রাসূলুল্লাহর (সা) নবুওয়াত লাভের পূর্বে মক্কার আবু লাহাবের পুত্র ‘উতবার সাথে হযরত রুকায়্যার (রা) প্রথম বিয়ে হয়। [তাবাকাতে ইবন সা‘দ-৮/৩৬] রাসূলুল্লাহ (সা) বনুওয়াত লাভ করলেন। কুরায়শদের সাথে তাঁর বিরোধ যখন চরম আকার ধারণ করে তখন তারাপ আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেওয়ার সকল পথ ও পন্থা বেছে নেয়। তারা সকল নীতি-নৈতিকতার মাথা খেয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে মুহাম্মাদের বিবাহিত মেয়েদের স্বামীর উপর চাপ প্রয়োগ অথবা প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেকের স্ত্রীকে তালাক দেওয়াবে এবং পরে তাদের পিত্রগৃহে পাঠিয়ে দেবে। তাতে অন্তত মুহাম্মাদের মনোকষ্ট ও দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পাবে এবং নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।

যেমন চিন্তা তেমন কাজ। তারা প্রথমে গেল রাসূলুল্লাহর (সা) বড় মেয়ের স্বামী আবুল ‘আম ইকন রাবী‘র নিকট। আবদার জানালো তাঁর স্ত্রী যায়নাব বিনত মুহাম্মাদকে তালাক দিয়ে পিতৃগৃহে পাঠিয়ে দেওয়ার। কিন্তু তিনি তাদের মুখের উপর সাফ ‘না’ বলে দিলেন। নির্লজ্জ কুরায়শ নেতৃবৃন্দ এমন জবাব মুনেও থামলো না। তারা গেল রুকায়্যার (রা) স্বামী ‘উতবা ইবন আবী লাহাবের নিকট এবং তার স্ত্রীকে তালাক দানের জন্যে চাপ প্রয়োগ করলো। সাথে সাথে এ প্রলোভনও দিল যে, সে কুরায়শ গোত্রের যে সুন্দরীকেই চাইবে তাকে তার বউ বানিয়ে দেওয়া হবে। বিবেকহীন ‘উতবা তাদের প্রস্তাব মেনে নিল। সে রুকায়্যার বিনিময়ে স‘ঈদ ইবনুল ‘আস, [আনসাবুল আশরাফ-১/৪০১] মতান্তরে আবান ইব স‘ঈদ ইবনুল ‘আসের একটি মেয়েকে পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। কুরায়শ নেতারা সানন্দে তার এ দাবী মেনে নিল। তাদের না মানার কোন কারণ ছিল না। তাদের তো প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যে কোনভাবে এবং যতটুকু পরিমণেই হোক মুহাম্মাদকে (সা) দৈহিক ও মনসিকভাবে নির্যাতন করা। মুহাম্মাদের (সা) একটু কষ্টতেই তাদের মানসিক প্রশান্তি। নরাধম ‘উতবা তার স্ত্রী সয়্যিদা রুকায়্যাকে (রা) তালাক দিল।[সীরাতু ইবন হিশাম-১/৬৫২]

তবে এ ব্যাপারে আরেকটি বর্ণনা এই যে, যখন ‘উতবার পিতা-মাতার নিন্দায় সূরা ‘লাহাম’- (আরবী====) নাযিল হয় তখন আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মু জামীল-হাম্মালাতাল হাতাব- ক্ষুব্ধ হয়ে ছেলে ‘উতবাকে বললো, তুমি যদি মুহাম্মাদের মেয়ে রুকায়্যাকে তালাক দিয়ে বিদায় না কর তাহলে তোমার সাথে আমাদের আর কোন সম্পর্ক নেই। মাতা-পিতার অনুগত সন্তান মা-বাবাকে ‍খুশী করার জন্যে স্ত্রী রুকায়্যাকে তালাক দেয়।[আল-ফাতহুর রাব্বানী মা‘আ বুলগিল আমানী-২২/৯৯ (হাদীস নং ৮৯৩)] উল্লেখ্য যে, ‘উতবার সাথে রুকায়্যার কেবল আক্দ হয়েছিল। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাসের পূর্বেই তালাকের এ ঘটনা ঘটে।[তাবাকাত -/৩৬]

হযরত রুকায়্যার (রা) দ্বিতীয় বিয়ে

হযরত ‘উছমান (রা) তাঁর ইসলাম গ্রহণ ও বিয়ের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, আমি পবিত্র কা‘বার আঙ্গিনায় কয়েকজন বন্ধুর সাথে বসে ছিলাম। এমন সময় কোন এক ব্যক্তি এসে আমাকে জানালো যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর মেয়ে রুকয়্যাকে ‘উতবা ইবন আবী লাহাবের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। যেহেতু হযরত রুকাইয়্রা রূপ-লাবণ্য এবং ঈর্ষণীয় গুণ-বৈশিষ্ট্যের জন্যে স্বাতন্ত্রের অধিকারিণী ছিলেন, এ কারণে তাঁর প্রতি আমার খানিকটা মানসিক দুর্বলতা ছিল। আমি তাঁর বিয়ের সংবাদ শুনে কিছুটা অস্থির হয়ে পড়লাম। তাই উঠে সোজা বাড়ী চলে গেলাম। তখন আমাদের বাড়ীতে থাকতেন আমার খালা সা‘দা। তিনি ছিলেন আবার একজন ‘কাহিনা’ (ভাবিষ্যদ্বক্তা)।[ইসলামপূর্ব আরবের ইতিহাসে বহু কাহিন ও কাহিনার নাম পাওয়া ‍যায়। তারা সাধারণত হেঁয়ালিপূর্ণ ও ধাঁধামূলক কথায় সত্য ও অর্ধসত্য ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করতো।] আমাকে দেখেই তিনি অকস্মাৎ নিম্নের কথাগুলো বলতে আরম্ভ করলেন : (আরবী========)

‘(হে উছমান) তোমার জন্য সুসংবাদ। তোমার প্রতি তিনবার সালাম। আবার তিনবার। তারপর আবার তিন বার। শেষে একবার সালাম। তাহলে মোট দশটি সালাম পূর্ণ হয়ে যায়। আল্লাহর ইচ্ছায় তুমি মুভ ও কল্যাণের সাথে মিলিত হবে এবং অমঙ্গল থেকে দূরে থাকব। আল্লাহর কসম, তুমি একজন ফুলের কুঁড়ির মত সতী-সাধ্বী সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করেছো। তুমি একজন কুমার, এক কুমারী পাত্রীই লাভ করেছো।’

তাঁর এমন কথাতে আমি ভীষণ তাজ্জব বনে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, খালা! আপনি এসব কী বলছেন তিনি বললেন : (আরবী=====)

‘উছমান, উছমান, হে ‘উছমান! তুমি সুন্দরের অধিকারী, তোমার জন্যে আছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইনি নবী, তাঁর সাথে আছে দলিল-প্রমাণ। তিনি সত্য-সঠিক রাসূল। তাঁর উপর কুরআন নাযিল হয়েছে। তাঁকে অনুসরণ কর, মূর্তির ধোঁকায় পড়ো না।’

আমি এবারও কিছু বুললাম না। আমি তাকে একটু ব্যাখ্যা করে বলার জন্যে অনুরোধ করলাম। এবার তিনি বললেন : (আরবী======)

‘মুহাম্মাদ ইবন ‘আবদিল্লাহ যিনি আল্লাহর রাসূল, কুরআন নিয়ে এসেছেন। আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাচ্ছেন। তাঁর প্রদীপই প্রকৃত প্রদীপ, তাঁর দীনই সফলতার মাধ্যম। যখন মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়ে যাবে এবং অসি উন্মুক্ত হবে এবং বর্শা নিক্ষেপ করা হবে তখন শোরগোল হৈচৈ কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না।’

তাঁর একথা আমাকে দারুণভাবে প্রবাবিত করলো। আমি ভবিষ্যতের করণীয় বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলাম। আমি প্রায়ই আবু বকরের কাছে গিয়ে বসতাম। দুইদিন পর আমি যখন তাঁর কাছে গেলাম তখন সেখানে কেউ ছিলনা। আমাকে চিন্তিত অবস্থায় বসে থাকতে দেখে তিনি প্রশ্ন করলেন, আজ তোমাকে এত চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন? তিনি আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন, তাই আমি আমার খালার বক্তব্যের সারকথা তাঁকে বললাম। আমার কথা শুনে তিনি বললেন : ‘উছমান, তুমি একজন বুদ্ধিমান মানুষ। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য যদি তুমি বরতে না পার তাহলে সেটা হবে একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। তোমার স্বজাতির লোকেরা যে মূর্তিগুলির উপাসনা করে, সেগুলি কি পাথরের তৈরী নয়- যারা কোন কিছু শুনতে পায় না, দেখতে পারে না এবং কোন উপকার ও অপকারও করার ক্ষমতা তারা রাখেনা? উছমান বললেন, আপিনি যা বলেছেন, তা সবটুকু সত্য।

আবু বকর বললেন, তোমার খালা যে কথা বলেছেন তা সত্য। মুহাম্মাদ ইবন ‘আবদিল্লাহ আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ তাঁর বাণী মানুষের পৌঁছানোর কন্যে তাঁকে পাঠিয়েছেন। যদি তুমি তাঁর কাছে যাও এবং মনোযোগ সহকারে তাঁর কথা শোন, তাতে ক্ষতির কী আছে? তাঁর একথার পর আমি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট গেলাম। আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, তাদের এ আলোচনার কথা শুনে রাসূল (সা) নিজেই ‘উছমানের (রা) নিকট যান। রাসূল (সা) বলেন, শোন উছমান, আল্লাহ তোমাকে জান্নাতের দিকে ডাকছেন, তুমি সে ডাকে সাড়া দাও। আমি আল্লাহর রাসূল- তোমাদের তথা সমগ্র সৃষ্টি জগতের প্রতি আমাকে পাঠানো হয়েছে।

আল্লাহই জানেন তাঁর এ বাক্যটির মধ্যে কী এমন শক্তি ছিল! আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। অবলীলাক্রমে আমার মুখ থেকে উচ্চারিত হলো কালেমায়ে শাহাদাত- আশহাদু আন লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ।[আল ইসাবা-৪/৩২৭-২৮]

এ ঘটনার পর মক্কাতেই হযরত উছমানের (রা) সাথে হযরত রুকায়্যার (রা) বিয়ের ‘আকদ সম্পন্ন হয়।

হযরত রুকায়্যা (রা) তাঁর মা উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজা (রা) ও বড় বোন হযরত যায়নাবের সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’ -২/২৫১] অন্য মহিলারা যখন রাসূলুল্লাহর (সা) বাই‘আত করেন তখন তিনিও বাই‘আত করেন।[তাবাকাত-৮/৩৬]

নবুওয়াতের পঞ্চম বছরে তিনি স্বামী হযরত ‘উছমানের (রা) সাথে হাবশায় হিজরাত করেন। হযরত আসমা বিনত আবী বকর (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সা) ও আবু বকর হিরাগুহায় অবস্থান করতেন আর আমি তাঁদের দুইজনের খাবার নিয়ে যেতাম। একদিন হযরত ‘উছমান (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট হিজরাতের অনুমতি চাইলে তাঁকে হাবশায় যাওয়ার অনুমতি দান করেন। অতঃপর তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মক্কা ছেড়ে হাবশার দিকে চলে যান। তারপর আমি আবার যখন তাঁদের খাবার নিয়ে গেলাম তখন রাসূল (সা) জানতে চান : উছমান ও রুক্য়্যা কি চলে গেছে? বললাম : জী হাঁ, তাঁরা চলে গেছেন। তখন আমার পিতা আবু বকরকে (রা) শুনিয়ে বললেন : (আরবী=======)

‘নিশ্চয় তারা দুইজন ইবরাহীম ও লূত-এর পর প্রতম হিজরাতকারী।’[আনসাবুল ‘আশরাফ০১/১৯৯। হযরত কাতাদা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা) বলেন : ‘উছমান ইবন ‘আফফান সপরিবারে মহান আল্লাহর দিকে প্রথম হিজরাতকারী।’ (হায়াতুস সাহাবা-১/৩৪৬)।]

কিছুকাল হাবশায় অবস্থানের পরতাঁরা আবার মক্কায় ফিরে আসেন। মক্কার কাফিরদের অপতৎপরতার মাত্রা তখন আরো বেড়ে গিয়ে বসবানের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। তাই সেখানে অবস্থান করা সমীচীন মনে করলেন না। আবার হাবশায় ফিরে গেলেন।

হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। ‘উছমান িইব ‘আফ্ফান (রা) তাঁর স্ত্রী রুকায়্যাকে (রা) নিয়ে হাবশার দিকে বেরিয়ে গেলেন। তাঁদের খবর রাসূলুল্লাহর নিকট আসতে দেরী হলো। এরমধ্যে এক কুরায়শ মহিলা হাবশা থেকে মক্কায় এলো। সে বললো : মুহাম্মাদ, আমি আপনার জামাইকে তার স্ত্রসহ যেতে দেখেছি। রাসূল (সা) জানতে চাইলেন : তুমি তাদের কি অবস্থায় দেখেছো? সে বললো : দেখলাম সে তার স্ত্রীকে একটি দুর্বল গাধার উপর বসিয়ে হাঁকয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাসূল (সা) তখন মন্তব্য করলেন : (আরবী==========)

‘আল্লাহ তাদের সাথী হোন। লুত আলাইহিস সালামের পরে উছমান প্রথম ব্যক্তি যে সস্ত্রীক হিজরাত করেছে। [আল-বিদায়া-৩/৬৬; সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা-২/২৫১]

তাঁরা দ্বিতীয়বার বেশ কিছুদিন হাবশায় অবস্থান করার পর মক্কায় ফিরে আসেন এবং কিছুদিন মক্কায় থেকে পরিবার-পরিজনসহ আবার চিরদিনের জন্য মদীনায় হিজরাত করেন।[তাবাকাত-৮/৩৬]

দ্বিতীয়বার হাবশায় অবস্থানকালে হযরত রুকায়্যার (রা) পুত্র ‘আবদুল্লাহর জন্ম হয়। এ ‘আবদুল্লাহর নামেই হযরত ‘উছমানের উপনাম হয় আবু ‘আবদিল্লাহ। এর পূর্বে হাবশায় প্রথম হিজরাতের সময় তার গর্ভের একটি সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। [প্রাগুক্ ‘ উসুদুল গাবা-৫/৩৫৬] কাতাদা বলেন, ‘উছমানের (রা) ঔরসে রুকায়্যার (রা) কোন সন্তান হয়নি। ইবন হাজার বলেন এটা কাতাদার একটি ধারণা মাত্র। এমন কতা তিনি ছাড়া আর কেউ বলেননি।[আলইসতী‘আব-৪/৩০০] তবে ‘আব্দুল্লাহর পরে হযরত রুকায়্যার (রা) আর কোন সন্তান হয়নি।[তাবাকাত – ৮/৩৬]

‘আবদুল্লাহর বয়স যখন মাত্র ছয় বছর তখন হঠাৎ একদিন একটি মোরগ তার একটি চোখে ঠোকর দেয় এবং তাতে তার মুখমণ্ডল ফুলে গোটা শরীরে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এই দুর্ঘটনায হিজরী চতুর্থ সনের জামাদিউল আওয়াল মাসে সে মারা যায়।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৫১] রাসূল (সা) তাঁর জানাযার নামাজ পড়ান এবং হযরত ‘উছমান (রা) কবরে নেমে তার দাফন কাজ সম্পন্ন করেন।

মদীনা পৌঁছার পর হযরত রুকায়্যা (রা) হিজরী দ্বিতীয় সনে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হন। তখন ছিল বদর যু্দ্ধের সময়কাল। হযরত রাসূলে কারীম (সা) যু্দ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি ‘উছমানকে (রা) তাঁর রুগ্ন স্ত্রীর সেবা-শুশ্রুষার জন্য মদীনায় রেখে নিজে বদরে চলে যান। হিজরাতের এক বছর সাত মাস পরে পবিত্র রমজান মাসে হযরত রুকায়্যা ইনতিকাল করেন। উসামা ইবন যায়দ (রা) বলেন, আমরা যখন রাসূলুল্লাহর (সা) মেয়ে রুকায়্যাকে কবর দিয়ে মাটি সমান করছিলাম ঠিক তখন আমার পিতা যায়দ ইবন হারিছা বদরের বিজয়ের সুসংবাদ নিয়ে উপস্থিত হন। রাসূল (সা) আমাকে ‘উছমানের সাথে মদীনায় রেখে গিয়েছিলেন।[সীরাতু ইবন হিশান-১/৬৪২-৪৩; আনসাবুল আশরাফ-১/২৯৪, ৪৭৫]

অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, তারা যখন রুকায়্যার (রা) দাফন কাজে ব্যস্ত ঠিক সে সময় ‘উছমান (রা) দূর থেকে আসা একটি তাকবীর ধ্বনী শুনতে পেয়ে উসামার (রা) নিকট জানতে চান এটা কী্য তাঁরা তাকিয়ে দেখতে পেলেন যায়দ ইবন হারিছা (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) উটনীর উপর সওয়অর হয়ে আছেন এবং বদরে মক্কার কুরায়শ নেতাদের হত্যার খবব ঘোষণা করছেন। [আল-ইসাবা-৪/৩০৫]

অসুস্থ স্ত্রীর পাশে তাকার জন্য হযরত ‘উছমান (রা) বদরের মত এত গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তবে রাসূল (সা) তাঁকে বদরের অংশীদার গণ্য করে গণীমতের অংশ দান করেন। ‘উছমান (রা) জানতে চান, জিহাদের সাওয়াবের কি হবে রাসূল (সা) বলেন : তুমি সাওয়াবও লাভ করবে।[আনসাবুল আশরাফ-১/২৮৯; সীরাতু ইবন হিশাম-১/৬৭৮]

ইবন ‘আব্বাস বলেন, রুকায়্যার (রা) মৃত্যুর পর রাসূল (সা) বলেন :[ আল ইসাবা-৪/৩০৪] (আরবী=======)

‘তুমি আমাদের পূর্বসূরী ‘উছমান ইবন মাজ‘উনের সাথে মিলিত হও।’ [‘উছমান ইবন মাজ‘উন (রা) উম্মুল মু‘মিনীন হযরত হাফসার (রা) মামা। তিনি দুইবার হাবশায় হিজরাত করেন। সর্বশেষ মদীনায় হিজরাত করেন। এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, তিনি হযরত রুকায়্যার (রা) পূর্বে মারা যান। বালাজুরীর বর্ণনা মতে, তিনি হিজরী ২য় সনের জিলহাজ্জ মাসে মদীনায় ফিরে এসে হিজরাতের তিমিশ মাস পরে মারা যান। (আসহাবে রাসূলোর জীবন কথা-২/২৭) আর হযরত রুকায়্যার (রা) বদর যুদ্ধের সময় মারা যান, এ ব্যাপারে সকলে একমত। সুতরাং বিষয়টি বোধগম্য নয়।] মহিলারা কাঁদতে থাকে। এসময় ‘উমার (রা) এসে তাঁর হাতের চাবুক উঁচিয়ে পেটাতে উদ্যত হন। রাসূল (সা) হাত দিয়ে তাঁর চাবুকটি ধরে বলেন, ছেড়ে দাও। তারা তো কাঁদছে। অন্তর ও চোখ থেকে যা বের হয়, তা হয় আল্লাহ ও তাঁর অনুগ্রহ থেকে। আর হাত ও মুখ থেকে যে ক্রিয়া প্রকাশ পায় তা হয় শয়তান থেকে। ফাতিমা (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) পাশে কবরের ধারে বসেছিলেন। রাসূল (সা) নিজের কাপরের কোনা দিয়ে তাঁর চোখের পানি মুছে দিচ্ছিলেন। [সিয়ারু আ‘লাম-নুবালা-২/২৬২; তাবাকাত-৮/৩৭।] ইবন সা‘দ উপরোক্ত বর্ণনা সম্পর্কে বলেন, সকল বর্ণনাকারীর নিকট এটাই সর্বাধিক সঠিক বলে বিবেটিত যে, রুকায়্যার (রা) মৃত্যু ও দাফনের সময় রাসূল (সা) বদরে ছিলেন। সম্ভবত এটা রাসূলুল্লাহর (সা) অন্য মেয়ের মৃত্যুর সময়ের ঘটনা। আর যদি রুকায়্যার মৃত্যু সময়ের হয় তাহলে সম্ভবত রাসূল (সা) বদর খেকে ফিরে আসার পরে কবরের পাশে গিয়েছিলেন, আর মহিলারাও তখন ভীড় করেছিলেন। [মুসনাদে ইমাম আহমাদের একটি বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূলের (সা) বদর থেকে ফিরে আসার পরে কবরের পাশে গিয়েছিলেন, আর মহিলারাও তখন ভীড় করেছিলেন।[তাবাকাত-৮/৩৭] মুসনাদে ইমাম আহমাদের একটি বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূলের (সা) অনিচ্ছার কারণে উছমানের (রা) পরিবর্তে আবু তালহা (রা) কবরে নেমে রুকায়্যাকে শায়িত করেন। এ ক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন উছেছে যে, তা কেমন করে সম্ভপ? রাসূল (সা) তো তখন বদরে। তাই মুহাদ্দিছগণ বলেছেন, এটা উম্মু কুলছূমের (রা) দাফনের সময়ের ঘটনা। তাছাড়া অপর একটি বর্ণনায় উম্মু কুলছূমের (রা) নাম এসেছে।[আল-ফাতহুর রাব্বানী মা‘আ বুলুগিল আমানী-২২/১৯৯]

উল্লেখ্য যে, উম্মু কুলছূম (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) তৃতীয় মেয়ে- রুকায়্যার (রা) মৃত্যুর পর ‘উছমান (রা) তাঁকে বিয়ে করেন। কিছুদিন পর তিনি মারা যান।

যযরত রুকায়্যা (রা) খুবই রূপ-লাবণ্যের অধিকারিণী ছিলেন। ‘দুররুল মানছূর’ গ্রন্থে এসেছে : ‘তিনি ছিলেন দারণ রূপবতী। হাবশায় অবস্থানকালে সেখানকার একদল বখাটে লোক তাঁর রূপ-লাবণ্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। এই দলটি তাঁকে ভীষণ বিরক্ত করে। তিনি তাদের জন্য বদ-দু‘আ করেন এবং তারা ধ্বংস হয়ে যায়। [দুররুল মানছুর-২০৭; সাহাবিয়াত-১২৮]

প্রিয়তমা স্ত্রী ও সুখ-দুঃখের সাথীর অকাল মৃত্যূতে হযরত ‘উছমান (রা) দারুণ কষ্ট পান। তাঁদের দুইজনের মধ্যে দারুণ মিল-মুহাব্বত ছিল। লোকেরা বলাবলি করতো এবং কথাটি যেন উপমায় পরিণত হয়েছিল যে, (আরবী======)

‘মানুষের দেখা দম্পতিদের মধ্যে ও তাঁর স্বামী ‘উছমান হলো সর্বোত্তম। [আল-ইসাবা-৪/৩০৫] বিভিন্ন বর্ণনায় জানা যায়, রুকায়্যা ছিলেন একজন স্বামী-সোহাগিনী এবং পতি-পরায়ণা স্ত্রী। তাঁদের স্বল্পকালের দাম্পত্য জীবনে তাঁরা কখনো বিচ্ছিন্ন হননি। সকল বিপদ-আপদ ও প্রতিকূল অবস্থা তাঁরা একসাথে মুকাবিলা করেছেন। তিনি নিজে যেমন স্বামীর সেবা করে সকল যন্ত্রণা লাঘব করার চেষ্টা করতেন, তেমনি স্বামী ‘উছমানও স্ত্রীর জীবনকে সহজ করার চেষ্টা সব সময় করতেন। একদিন রাসূল (সা) ‘উছমানের (রা) ঘরে গিয়ে দেখেন রুকায়্যা স্বামীর মাথা ধুইয়ে দিচ্ছেন। তিনি বলেন : [প্রাগুক্ত](আরবী=========)

‘আমার মেয়ে! তুমি আবু ‘আবদিল্লাহর (‘উছমান) সাথে ভালো আচরণ করবে। কারণ আমার সাহাবীদের মধ্যে স্বভা-চরিত্রে আমার সাথে তাঁর বেশী মিল’

আবু হুরাইরা (রা) বলেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহর (সা) মেয়ে ও ‘উছমানের স্ত্রী রুকায়্যার ঘরে গিয়েঢ দেখি তাঁর হাতে চিরুনী। তিনি বললেন : রাসূলূল্লাহ (সা) এই মাত্র আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিনি দেখে গেলেন আমি ‘উছমানের মাথায় চিরুনী করছি। [হায়াতুস সাহাবা-২/৫৪২]

উম্মু কুলছূম বিনত রাসূলিল্লাহ (সা)
হযরত উম্মু কুলছূম (রা) হযরত রাসূলে কারীমের (সা) তৃতীয় মেয়ে। তবে এ ব্যাপারে সীরাত বিশেষজ্ঞদের কিছুটা মতপার্থক্য আছে। ইমাম আয-যাহাবী তাঁকে রাসূলুল্লাহর (সা) সন্তানদের মধ্যে চতুর্থ বলেছেন।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা, ২/২৫২] যুবাইর ইবন বাককার বলেছেন, উম্ম কুলছূম ছিলেন রুকাইয়্যা ও ফাতিমা (রা) থেকে বড়। কিন্তু অধিকাংশ সীরাত লেখক এ মতের বিরোধিতা করেছেন। সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য মত এটাই যে, হযরত উম্মু কুলছূম (রা) ছিলেন হযরত রুকায়্যার (রা) ছোট।[সীরাতু ইবন হিশাম, ১/১৯০] তাবারী রাসূলুল্লাহর (সা) মেয়েদের জন্মের ক্রমধারা উল্লেখ করেছেন এভাবে।[তারীখ আত-তাবাবী (লেইডেন) ৩/১১২৮] (আরবী=======)

‘যায়নাব, রুকায়্যা, উম্মু কুলছূম ও ফাতিমা জন্মগ্রহণ করেন।’

হযরত রুকায়্যা (রা) ছিলেন হযরত ‘উছমানের (রা) স্ত্রী। হিজরী ২য় সনে তাঁর ইনতিকাল হলে রাসূল (সা) উম্মু কুলছূমকে (রা) ‘উছমানের (রা) সাথে বিয়ে দেন।[তাবাকাত, ৮/৩৫] যদি উম্মু কুলছূম বয়সে রুকায়্যার বড় হতেন তাহলে ‘উছমানের (রা) সাথে তাঁরই বিয়ে হতো আগে, রুকায়্যা নয়। কারণ, সকল সমাজ ও সভ্যতায় বড় মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থাটা আগেই করা হয়। আর এটাই বুদ্ধি ও প্রকৃতির দাবী।

সীরাত ও ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে হযরত উম্মু কুলছূমের (রা) জন্ম সনের কোন উল্লেখ দেখা যায় না। তবে রাসূলুল্লাহর (সা) নবুওয়াত লাভের ছয় বছর পূর্বে তাঁর জন্ম হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। কারণ, একথা প্রায় সর্বজন স্বীকৃত যে, নবুওয়াতের সাত বঝর পূর্বে রুকায়্যার এবং পাঁচ বছর পূর্বে হযরত ফাতিমার (রা) জন্ম হয়। আর একতাও মেনে নেয়া হয়েছে যে, উম্মু কুলছূম (রা) ছিলেন রুকায়্যার ছোট এবং ফাতিমার বঙ। তাহলে তাঁদের দুইজনের মধ্যবর্তী সময় তাঁর জন্মসন বলে মেনে নিতেই হবে। আর এই হিসেবেই তিনি নবুওয়াতের ছয় বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন।[সাহাবিয়াত-১২৯]

অনেকের মত হযরত উম্মু কুলছূমেরও (রা) শৈশবকাল অজ্ঞতার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেছে। আরবের সেই সময়কালটা এমন ছিল যে, কোন ব্যক্তিরই জীবনকথা পূর্ণভাবে পাওয়া যায় না। এ কারণে তাঁর বিয়ের সময থেকেই তাঁর জীবন ইতিহাস লেখা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (সা) নবুওয়াত লাভের পূর্বে আবু লাহাবের পুত্র ‘উতবার সাথে রুকায়্যার এবং তার দ্বিতীয় পুত্র ‘উতাইবার সাথে উম্মু কুলছূমের বিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ (সা) নবুওয়াত লাভের পর যখন আবু লাহাব ও তার স্ত্রীর নিন্দায় সূরা লাহাব নাযিল হয় তখন আবু লাহাব, মতান্তরে আবু লাহাবের স্ত্রী দুই ছেলেকে লক্ষ্য করে বলে, ‘তোমরা যদি তাঁর [মুহাম্মাদ (সা)] মেয়েকে তালাক দিয়ে বিদায় না কর তাহলে তোমাদের সাখে আমার বসবাস ও উঠাবসা হারাম।’[তাবাকাত-৮/৩৭] হযরত রুকায়্যার (রা) জীবনীতে আমরা উল্লেখ করেছি যে, পিতা-মাতার এরূপ কথায় এবং সামাজিক চাপে ‘উতবা তার স্ত্রী রুকায়্যাকে তালাক দেয়। তেমনিভাবে ‘উতাইবাও মা-বাবার হুকুম তামিল করতে গিয়ে স্ত্রী উম্মু কুলছূমকে তালাক দেয়। এ হিসেবে উভয়ের তালাকের সময়কাল ও কারণ একই।[উসুদুল গাবা-৫/১২] উভয় বোনের বিয়ে হয়েছিল ঠিকই কিন্তু স্বামীর ঘরে যাবার পূর্বেই এ ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।

হিজরী দ্বিতীয় সনে রুকায়্যা (রা) মৃত্যুবরণ করলে হযরত ‘উছমান (রা) স্ত্রী শোকে বেশ বিষন্ন ও বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তছার এ অবস্থা দেখে রাসূল (সা) একদিন তাঁকে বললেন, ‘উছমান, তোমাকে এমন বিমর্ষ দেখছি, কারণ কি? ‘উছমান (রা) বললেন, আমি এমন বিমর্ষ না হয়ে কেমন করে পারি? আমার উপর এমন মুসীবত এসেছে যা সম্ভবত : কখনো কারো উপর আসেনি। রাসূলুল্লাহর (সা) কন্যার ইনতিকাল হয়েছে। এতে আমার মাজা ভেঙ্গে গেছে। রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল তা ছিন্ন হয়ে গেছে। এখন আমার উপায় কি? তাঁর কথা শেষ না হতেই রাসূল (সা) বলে উছলেন, জিবরীল (আ) আল্লাহর দরবার থেকে আমাকে হুকুম পৌঁছে দিয়েছেন, আমি যেন রুকায়্যার সমপরিমাণ মাহরের ভিত্তিতে উম্মু কুলছূমকেও তোমার সাথে বিয়ে দিই। প্রাগুক্ত-৫/৬১৩ [] অতঃপর রাসূল (সা) হিজরী ৩য় হিজরী সনের রবী‘উল আউয়াল মাসে হযরত ‘উছমান (রা) সাথে উম্মু কুলছূমের ‘আকদ সম্পন্ন করেন।[তাবাকাত-৮/৩৭] ‘আকদের দুই মাস পরে জামাদিউস ছানী মাসে তিনি স্বামী গৃহে গমন করেন। হযরত উম্মু কুলছূম কোন সন্তানের মা হননি।[প্রাগুক্ত]

একটি বর্ণনায় এসছে, রুকায়্যার (রা) ইনতিকালের পর ‘উমার ইবন আল খাত্তাব (রা) তাঁর মেয়ে হাফসাকে (রা) উছমানের (রা) সাথে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থাকেন। একথা রাসূল (সা) জানতে পেরে ‘উমারকে বলেন, আমি হাফসার জন্যে ‘উছমানের চেয়ে ভাল স্বামী এবং এবং ‘উছমানের জন্যে হাফসার চেয়ে ভালো স্ত্রী তালাশ করবো। তারপর তিনি হাফসাকে বিয়ে করেন এবং উম্মু কুলছূমকে ‘উছমানের সাথে বিয়ে দেন।[প্রাগুক্ত-৮/৩৮]

হযরত উম্মু কুলছূম (রা) তাঁর মা উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজার (রা) সাথেই ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে অন্য বোনদের সাথে রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে বাই’আত করেন।[প্রাগুক্ত-৮/৩৭] রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় হিজরাতের পর তিনি পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে মদীনায় হিজরাত করেন। [সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা-২/২৫২, হায়াতুস সাহাবা-১/৩৬৯]

হযরত উম্মু কুলছূমের (সা) ইনতিকালের পর রাসূল (সা) বলেন, আমার যদি দশটি মেয়ে থাকতো তাহলে একের পর এক তাদের সকলকে ‘উছমানের (রা) সাথে বিয়ে দিতাম।[আল-ইসতী’আব-৭৯৩] একটি বর্ণনায় দশটি মেয়ের স্থলে একশোটি মেয়ে এসেছে। স্বামী ‘উছমানের (রা) সাথে ছয় বছর কাটানোর পর হিজরী ৯ম সনের শা’বান মাসে হযরত উম্মু কুলছূম (রা) ইনতিকাল করেন।[সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা-২/২৫৩] আনসারী মহিলারা তাঁকে গোসল দেন। তাঁদের মধ্যে উম্মু ‘আতিয়্যাও ছিলেন। রাসূল (সা) জানাযার নামায পড়ান। হযরত আবু তালহা, ‘আলী ইবন আবী তালিব, ফাদল ইবন ‘আব্বাস ও উসামা ইবন যায়দ (রা) লাশ কবরে নামান।[তাবাকাত-৮/৩৮-৩৯]

একটি বর্ণনায় এসেছে, আনাস (রা) উম্মু কুলছূমকে (রা) রেখা অঙ্কিত রেশমের কাজ করা একটি চাদর গায়ে দেওয়া অবস্থায় দেখেছেন।[বুখারী : বাবুল হারীর লিন-নিসা; আবু দাউদ (২০৫৮); নাসাঈ-৮/১৯৭; ইবন মাজাহ্-(৩৫৯৮); তাবাকাত-৮/৩৮]

নরাধম ‘উতায়বা তার জাহান্নামের অগ্নিশিখা পিতা আবু লাহাব এবং কাঠকুড়ানি মা উম্মু জামীল হাম্মালাতাল হাতাব- এর চাপে স্ত্রী উম্মু কুলছূমকে তালাক দানের পর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এসে চরম অমার্জিত আচরণ করে। সে রাসূলকে (সা) লক্ষ্য করে বলে : ‘আমি আপনার দীনকে অস্বীকার করি, মতান্তরে আপনার মেয়েকে তালাক দিয়েছি। আপনি আর আমার কাছে যাবেন না, আমিও আর আপনার কাছে আসবো না।’ একথা বলে সে গোঁয়ারের মত রাসূলুল্লাহর (সা) উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাতে রাসূলুল্লাহর (সা) জামা ছিঁড়ে যায়। এরপর সে শামের দিকে সফরে বেরিয়ে যায়। তার এমন পশুসুলভ আচরণে রাসূল (সা) ক্ষুব্ধ হয়ে বদ-দু’আ করেন এই বলে : আমি আল্লাহর কাছে কামনা করি, তিনি যেন তাঁর কোন কুকুরকে তার উপর বিজয়ী দেন।’

‘উতাইবা কুরাইশদের একটি বাণিজ্য কাফেলার সাথে শামের দিকে বেরিয়ে পড়লো। যখন তারা ‘আয-যারকা’ নামক স্থানে রাত্রি যাপন করছিল, তখন একটি কেড়ে তাদের অবস্থান স্থলের পাশে ঘুর ‍ঘুর করতে থাকে। তা দেখে ‘উতাইবার মনে পড়ে রাসূলুল্লাহর (সা) বদ-দু‘আর কথা। সে তার জীবন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে বলতে থাকে, ‘আমার মা নিপাত যাক, মুহাম্মাদের কথা মত এ নেকড়ে তো আমাকে খেয়ে ফেলবে।’ যাহোক, কাফেলার লোকেরা তাকে সকলের মাঝখানে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে ঘুমিয়ে পড়ে। নেকড়ে সকলকে ডিঙ্গিয়ে মাঝখান থেকে ‘উতাইবাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং কামড়ে, খামছে রক্তাক্ত করে হত্যা করে।

ফাতিমা বিনত রাসূলিল্লাহ (সা)
জন্ম ও পিতৃ-মাতৃ পরিচয়

হযরত রাসূলে কারীমের (সা) নবুওয়াত লাভের পাঁচ বছর পূর্বে উম্মুল কুরা তথা মক্কা নগরীতে হযরত ফাতিমা (রা) জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সায়্যিদুল কাওনায়ন রাসূলু রাব্বিল ‘আলামীন আবুল কাসিম মুহাম্মাদ ইবন ‘আবদিল্লাহ ইবন ‘আব্দুল মাত্তালিব এবং মাতা সারা বিশ্বের নারী জাতির নেত্রী, প্রথম মুসলমান উম্মুল ম‘মিনীন খাদীজা বিনত খুয়ায়লিদ (রা)। ফাতিমার যখন জন্ম হয় তখন মক্কার কুরায়শরা পবিত্র কা‘বা ঘরের সংস্কার কাজ চালচ্ছে সেটা ছিল রাসূলুল্লাহর (সা) নবুওয়াত লাভের পাঁচ বছর পূর্বের ঘটনা। ফাতিমার জন্মগহণে তার মহান পিতা-মাতা দারুণ খুশী হন।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/১১৯] ফাতিমা ছিলেন কনিষ্ঠা মেয়ে। মা খাদীজা (রা) তাঁর অন্য সন্তানদের জন্য ধাত্রী রাখলেও ফাতিমাকে ধাত্রীর হাতে ছেড়ে দেননি। তিনি তার অতি আদরের ছোট মেয়েকে নিজে দুধ পান করান। এভাবে হযরত ফাতিমা (রা) একটি পূতঃপবিত্র গৃহে তাঁর মহান পিতা-মাতার তত্ত্বাধানে লালিত-পালিত হয়ে বেড়ে ওঠেন এবং নবুওয়াতের স্বচ্ছ ঝর্ণাধারায় স্নাত হন।

শ্রেষ্ঠত্বের কারণ

হযরত ফাতিমার (রা) মহত্ব, মর্যাদা, আভিজাত্য ও শ্রেষ্ঠত্বের যেসব কতা বলা হয় তার কারণ সংক্ষেপে নিম্নরূপ :

১. তাঁর পিতা মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ)-এর শ্রেষ্ঠ সন্তান রাহমাতুল্লিল ‘আলামীন আমাদের মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম।

২. তছার মা বিশ্বের নারী জাতির নেত্রী, সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী উম্মুল মু’মিনীন খাদীজা বিনত খুওয়ায়লিদ (রা)।

৩. স্বামী দুনিয়া ও আখিরাতের নেতা আমীরুল মু’মিনীন হযরত ‘আলী (রা)।

৪. তাঁর দুই পুত্র-আল-হাসান ও আল-হুসায়ন (রা) জান্নাতের যুবকদের দুই মহান নেতা এবং রাসূলুল্লাহর (রা) সুগন্ধি (আরবী====)।

৫. তাঁর এক দাদা শহীদদের মহান নেতা হযরত হামযা (রা)।

৬. অন্য এক দাদা প্রতিবেশীর মান-মর্যাদার রক্ষক, বিপদ-আপদে মানুষের জন্য নিজের অর্থ-সম্পদ খরচকারী, উলঙ্গ ব্যক্তিকে বস্ত্র দানকারী, অভুক্ত ও অনাহার-ক্লিষ্টকে খাদ্য দানকারী হযরত আল-‘আব্বাস ইবন আবদিল মুত্তালিব (রা)

৭. তাঁর এক চাচা মহান শহীদ নেতা ও সেনানায়ক হযরত জা‘ফার ইবন আবী তালিব (রা)।

উল্লেখিত গৌরবের অধিকারী বিশ্বের নারী জাতির মধ্যে আর কেউ কি আছে?

ইসলাম গ্রহণ

হযরত রাসূলেকারীমের (রা) উপর ওহী নাযিল হবার পর উম্মুল মু‘মিনীন হযরত খাদীজা (রা) সর্বপ্রথম তাঁর প্রতি ঈমান আনেন এবং তাঁর রিসালাতকে সত্য বলে গ্রহণ করেন। আর রাসূলুল্লাহর (সা) প্রতি প্রথম পর্বে যেসব মহিলা ঈমান আনেন তাঁদের পুরো ভাগে ছিলেন তাঁর পূতঃপবিত্র কন্যাগণ। তাঁরা হলেন : যায়নাব, রুকাইয়্যা, উম্মু কুলছূম ও ফাতিমা (রা)। তাঁরা তাঁদের পিতার নবুওয়াত ও রিসালাতের প্রতি ঈমান আনেন তাঁদের মহিয়ষী মা খাদীজার (রা) সাথে।

ইবন ইসহাক হযরত ‘আয়িশার (রা)সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন : আল্লাহ যখন তাঁর নবীকে নবুওয়াতে ভূষিত করলেন তখন খাদীজা ও তাঁর কন্যারা ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে রাসূলুল্লাহর (সা) কন্যারা তাঁদের মায়ের সাথে প্রথম ভাগেই ইসলামের আঙ্গিনায় প্রবেশ করেন এবং তাঁদের পিতার রিসালাতে বিশ্বাস স্থাপন করেন। নবুওয়াত লাভের পূর্বেই তাঁরা উন্নত মানের নৈতিক গুণাবলীতে বিভূষিত হন। ইসলামের পরে তা আরো সুশোভিত ও সুষমামণ্ডিত হয়ে ওঠে।

ইমাম আয-যুরকানী ‘শারহুল মাওয়াহিবৎ গ্রন্থে ফাতিমা ও তাঁর বোনদের প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণের কথা বলেছেন এভাবে : ‘তাঁর মেয়েদের কথা উল্লেখের প্রয়োজন নেই। কারণ, নবুওয়াতের পূর্বেই তাঁদের পিতার জীবন ও আচার-আচরণ দৃঢ়ভাবে অনুসরণ ও শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।’ অন্য এক স্থানে আয্-‘যুরকানী নবী-দুহিতাদের ইসলাম গ্রহণের অগ্রগামিতা সম্পর্কে বলেছেন এভাবে : মোটকথা, আগেভাগে তাঁদের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে কোন প্রমাণের প্রয়োজন নেই। সর্বাধিক সত্য, সর্বাধিক অভিজাত পিতৃত্ব এবং সবচেয়ে ভালো ও সর্বাধিক স্নেহময়ী মাতৃত্বের ক্রোড়ে বেড়ে ওঠার কারণে তাঁরা লাভ করেছিলেন তাঁদের পিতার সর্বোত্তম আখলাক তথা নৈতিকতা এব তাঁদের মার থেকে পেয়েছিলেন এমন বুদ্ধিমত্তা যার কোন তুলনা চলেনা পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালে কোন নারীর সাথে। সুতরাং নবী পরিবারের তথা তাঁর স্ত্রী-কন্যাদের ইসলাম ছিল স্বচ্ছ-স্বভাবগত ইসলাম। ঈমান ও নবুওয়াত দ্বারা যার পুষ্টি সাধিত হয়। মহত্ব, মর্যাদা ও উন্নত নৈতিকতার উপর যাঁরা বেড়ে ওঠেন।[তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৫৯২]

শৈশব-কৈশোরে পিতার সহযোগিতা

হযরত রাসীলে কারীমের (সা) উপর ওহী নাযিল হলো। তিনি আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের নির্দেশমত মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানাতে লাগলেন এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করলেন। আর এজন্য তিনি যত দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ, অত্যাচার নির্যাতন, অস্বীকৃতি, মিথ্যা দোষারোপ ও বাড়াবাড়ির মুখোমুখী হলেন, সবকিছুই তিনি উপেক্ষা করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে কুরায়শরা রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে চরম বাড়াবাড়ি ও শত্রুতা করতে লাগলো। তারা তাঁকে ঠাট্টাবিদ্রূপ করতে লাগলো, তাঁর প্রতি মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলতে আরম্ভ করলো। হযরত ফাতিমা (রা) তখন জীবনের শৈশব অবস্থা অতিক্রম করছেন। পিতা যে তাঁর জীবনের একটা কঠিন সময় অতিবাহিত করছেন, মেয়ে ফাতিমা এত অল্পবয়সেও তা বুঝতে পারতেন। অনেক সময় তিনি পিতার সাথে ধারে-কাছে এদিক ওদিক যেতেন। একবার দুরাচারী ‘উকবা ইবন আবী মু‘ঈতকে তাঁর পিতার সাথে এমন একটি নিকৃষ্ট আচরণ করতে দেখেন যা তিনি আজীবন ভুলতে পানেন্ িএই ‘উকবা ছিল মক্কার কুরায়শ বংশের প্রতি আরোপিত। আসলে তার জন্মের কোন ঠিক-ঠিকানা ছিল না। একজন নিকৃষ্ট ধরনের পাপাচারী ও দুর্বৃত্ত হিসেবে সে বেড়ে ওঠে। তার জন্মের এই কালিমা ঢাকার জন্য সে সব সময় আগ বাড়িয়ে নানা রকম দুষ্কর্ম করে কুরায়শ নেতৃবৃন্দের প্রীতিভাজন হওয়ার চেষ্টা করতো।

একবার ‘উকবা মক্কার পাপাচারী পৌত্তলিক কুরায়শদের একটি বৈঠকে বসা ছিল। কয়েকজন কুরায়শ নেতা বললো : এই যে মাহাম্মাদ সিজদায় আছেন। এখানে উপস্থিতদের মধ্যে এমন কে আছে, যে উটের এই পচাগলা নাড়ী-ভুঁড়ি উঠিয়ে নিয়ে তাঁর পিঠে লেলে আসতে পারে? নরাধম ‘উকবা অতি উৎসাহ ভরে এই অপকর্মটি করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে বললো : আমি যাচ্ছি। তারপর সে দ্রুত পচা নাড়ী-ভুঁড়ির দিকে চলে গেল এবং সেগুলো উঠিয়ে সিজদারত মুহাম্মাদ (সা)-এর পিঠের উপর ফেলে দিল। দূর থেকে কুরায়শ নেতারা এ দৃশ্য দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হযরত রাসূলে কারীম (সা) সিজদা থেকে উঠলেন না। সাথে সাথে এ খবর বাড়ীতে হযরত ফাতিমার (রা) কানে গেল। তিনি ছুটে এলেন, অত্যন্ত দরদের সাথে নিজ হাতে পিতার পিঠ থেকে ময়লা সরিয়ে ফেলেন এবং পানি এনে পিতার দেহে লাগা ময়লা পরিষ্কার করেন। তারপর সেই পাপাচারী দলটির দিকে এগিয়ে গিয়ে তাদেরকে অনেক কটু কথা শুনিয়ে দেন।[আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৩/৪৪; হায়াত আস-সাহাবা-১/২৭১]

রাসূল (সা) নামাজ শেষ করে দু‘হাত উঠিয়ে দু’আ করলেন : (আরবী=======)

‘জে আল্লাজ! তুমি শায়বা ইবন রাবী’আকে পাকড়াও কর, হে আল্লাহ! তুমি আবূ জাহ্ল ইবন হিশামকে ধর. হে আল্লাহ! ‘উকবা ইবন আবী মু’ঈতকে সামাল দাও, হে আল্লাহ উমাইয়্যা ইবন খালাফের খবর নাও।’

রাসূলুল্লাহকে (সা) হাত উঠিতে এভাবে দু‘আ করতে দেখে পাষণ্ডদের হাসি থেমে যায়। তারা ভীত-শঙ্কিত হয়ে পড়ে। আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীর দু‘আ কবুল করেন। উল্লেখিত চার দুর্বৃত্তের সবাই বদরে নিহত হয়।[আল-বায়হাকী, দালায়িল আন-নুবুওয়াহ্-২/২৭৮, ২৮০; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৩/৪৪] উল্লেখ্য যে, ‘উকবা বদরে মুসলমানদের হতে বন্দী হয়। রাসূল (সা) তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। তখন সে বলে : মুহাম্মাদ! আমার ছোট্ট মেয়েগুলোর জন্য কেক থাকবে? বললেন : জাহান্নাম। তারপর সে বলে, আমি কুরায়শ হওয়া সত্ত্বেও আমাকে তুমি হত্যা করবে? বললেন : হাঁ। তারপর তিনি সাহাবীরেদ দিকে ফিরে বলেন : তোমরা কি জান এই লোকটি আমার সাথে কিরূপ আচরণ করেছিল? একদিন আমি মাকামে ইবরাহীমের পিছনে সিজদারত ছিলাম। এমন ময় সে এসে আমার ঘাড়ের উপর পা উঠিয়ে এত জোরে চাপ দেয় যে, আমার চোখ দু’টি বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। আরেকবার আমি সিজদায় আছি। এমন সময় সে কোথা থেকে ছাগলের বর্জ্য এনে আমার মাথায় ঢেলে দেয়। ফাতিমা দৌড়ে এসে তা সরিয়ে আমার মাথা ‍ধইয়ে দেয়। মুসলমানদের হাতে এ পাপিষ্ঠ ‘উকবার জীবনের সমাপ্তি ঘটে। [আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৩/৪৪; হায়াত আস-সাহাবা-১/২৭১; নিসা’ মুবাশশারাত বিল জান্নাহ্-২০৬]

সেই কিশোর বয়সে ফাতিমা পিতার হাত ধরে একদিন গেছেন কা‘বার আঙ্গিনায়। তিনি দেখলেন, পিতা যেই না হাজারে আসওয়াদের কাছাকাছি গেছেন অমনি একদল পৌত্তলিক একযোগে তাঁকে ঘিরে ধরে বলতে লাগলো : আপনি কি সেই ব্যক্তি নন যিনি এমন এমন কথা বলে থাকেন? তারপর তারা একটা একটা করে গুনে বলতে থাকে : আমাদের বাপ-দাদাদের গালি দেন, উপাস্যদের দোষের কথা বলেন, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ লোকদেরকে নির্বোধ ও বোকা মনে করেন।

তিনি বলেন : হাঁ, আমিই সেই ব্যক্তি।

এর পরের ঘটনা দেখে বালিকা ফাতিমার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তিনি ভয়ে অসাড় হয়ে পড়েন। দেখেন, তাদের একজন তাঁর পিতার গায়ের চাদরটি তাঁর গলায় পেঁচিয়ে জোরে টানতে শুরু করেছে। আর আবূ বকর (রা) তাদের সামনে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত উত্তেজিত কণ্ঠে বলছেন : তোমরা একটি লোককে মুধু এ জন্য হত্যা করবে যে, তিনি বলেন : আল্লাহ আমার রব, প্রতিপালক?

লোকগুলো আগুন ঝরা দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালো। তাঁর দাড়ি ধরে চানলো, তারপর মাথা ফাটিয়ে রক্ত ঝরিয়ে ছাড়লো।[ ইবন হিশাম, আল-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ্-১/৩১০]

এভাবে আবূ বকর (রা) সেদিন নিজের জীবন বিপন্ন করে পাষণ্ডদের হাত থেকে মুহাম্মাদকে (সা) ছাড়ালেন। ছাড়া পেয়ে তিনিবাড়ীর পথ ধরলেন। মেয়ে ফাতিমা পিতার পিছনে পিছনে চললেন। পথে স্বাধীন ও দাস যাদের সাথে দেখা হলো প্রত্যেতেই নানা রকম অশালীন মন্তব্য ছুড়ে মেরে ভীষণ কষ্ট দিল। রাসূল (সা) সোজা বাড়ীতে গেলেন এবং মারাত্মক রকমের বিধ্বস্ত অবস্থায় বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। বালিকা ফাতিমার চোখের সামনে এ ঘটনা ঘটলো।[তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ্-৫৯২]

ফাতিমা শি‘বু আবী তালিবে

কুরায়শরা রাসূলুল্লাহর (সা) উপর নির্যাতন চালানোর নতুন পথ বেছে নিল। এবার তাদের নির্যাতনের হাত বানূ হাশিম ও বানূ ‘আবদিল মুত্তালিবের প্রতিও সম্প্রসারিত হলো। মক্কার মুশরিকরা তাদেরকে বয়কট করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিল। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের কাছে নত না হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে কেনাবেচা, কথা বলা ও উঠাবসা বন্ধ। একমাত্র আবূ রাহাব ছাড়া বানূ হাশিন ও বানূ ‘আবদিল মুত্তালিব মক্কার উপকণ্ঠে “শি‘বু আবী তালিব” –এ আশ্রয় নেয়। তাদেরকে সেখানে অবরোধ করে রাখা হয়। অবরুদ্ধ জীবন এক সময ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। “শি’বু” –এর বাইরে থেকেও সে সময় ক্ষুধা-কাতর নারী ও শিশুদের আহাজারি ও কান্নার রোল শোনা যেত। এই অবরুদ্ধদের মধ্যে ফাতিমাও (রা) ছিলেন। এই অবরোধ তার স্বাস্থ্যের উপর দারুন প্রভাব ফেলে। এখানে নাহারে থেকে যে অপুষ্টির শিকার হন তা আমরণ বহন করে চলেন। এই অবরোধ প্রায় তিন বছর চলে।[নিসা‘ মুবাশশারাত বিল জান্নাহ্-২০৬]

অবরুদ্ধ জীবনের দুঃখ-বেদনা ভুলতে তিনি আরেকটি বড় রকম দুঃখের মুখোমুখী হন। স্নেহময়ী মা হযরত খাদীজা (রা), যিনি তাঁদের সবাইকে আগলে রেখেছিলেন, যিনি অতি নীরবে পুণ্যময় নবীগৃহের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে চলছিলেন, ইনতিকাল করেন। তিনি আল্লাহর রাসূলের (সা) যাবতীয় দায়িত্ব যেন কন্যা ফাতিমার উপর অর্পণ করে যান। তিনি অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয় ও দৃঢ়তার সাথে পিতার পাশে এসে দাঁড়ান। পিতার আদর ও স্নেহ বেশী মাত্রায় পেতে থাকেন। মদীনায় হিজরাতের আগ পর্যন্ত মক্কায় পিতার দা‘ওয়াতী কার্যক্রমের সহযোগী হিসেবে অবদান রাখতে থাকেন। আর এ কারণেই তাঁর ডাকনাম হয়ে যায়- “উম্মু আবীহা” (তাঁর পিতাম মা)।[প্রাগুক্ত-২০৭; উসুদুল গাবা-৫/২৫০; আল-ইসাবা-৪/৪৫০]

হিজরাত ও ফাতিমা

যে রাতে রাসূল (সা) মদীনায় হিজরাত করলেন সে রাতে ‘আলী (রা) যে দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করেন, ফাতিমা (রা) অতি নিকট থেকে তা প্রত্যক্ষ করেন। ‘আলী (রা) নিজের জীবন বাজি রেখে কুরায়শ পাষণ্ডদের ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে রাসূলের (সা) বিঝানায় শুয়ে থাকেন। সেই ভয়াবহ রাতে ফাতিমাও বাড়ীতে ছিলেন। অত্যন্ত নির্ভীকভাবে কুরায়শদের সব চাপ প্রত্যাখ্যান করেন। তারপর ‘আলী (রা) তিন দিন মক্কায় থেকে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট গচ্ছিত অর্থ-সম্পদ মালিকদের নিকট প্রত্যার্পণ করে মদীনায় পাড়ি জমান।

ফাতিমা ও তাঁর বোন উম্মু কুলছূম মক্কায় থাকলেন। রাসূল (সা) মদীনায় একটু স্থির হওয়ার পর পরিবারের লোকদের নেয়ার জন্য একজন সাহাবীকে পাঠালেন। আর সেটা ছিল নবুওয়াতের ১৩তম বছরের ঘটনা। ফাতিমা (রা) তখন অষ্টাদশী মদীনায় পৌছে তিনি দেখেন সেখানে মুহাজিররা শান্তি ও নিরাপত্তা খুঁজে পেয়েছেন। বিদেশ-বিভুঁইয়ের একাকীত্বের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক করে দিয়েছেন। তিনি নিজে ‘আলীকে (রা) দ্বীনি ভাই হিসেবে গ্রহণ করেছেন।[ইবন হিশান-২/১৫০; আল-ইসতী‘আব-৩/১৯৮]

বিয়ে

হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের পরে ‘আলীর (রা) সাথে ফাতিমার (রা) বিয়ে হয়। বিয়ের সঠিক সন তারিখ ও বিয়ের সময় ফাতিমা ও আলীর (রা) বয়স নিয়ে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কিঞ্চিৎ মতপার্থক্য দেখা যায়। একটি মত এরকম আছে যে, উহুদ যুদ্ধের পর বিয়ে হয়। একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সা) হযরত ‘আয়িশাকে (রা) য়রে উঠিয়ে নেয়ার চার মাস পরে ‘আলী-ফাতিমার বিয়ে হয় এবং বিয়ের নয় মাস পরে তাঁদের বাসর হয়। বিয়ের সময় ফাতিমার (রা) বয়স পনেরো বছর সাড়ে পাঁচ মাস এবং আলীর (রা) বয়স একুশ বছর পাঁচ মাস।[আ‘লাম আন-নিসা’ -৪/১০৯] ইবন ‘আবদিল বার তাঁর “আল-ইসতী‘আব” গ্রন্থে এবং ইবন সা‘দ তাঁর “তাবাকাত” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ‘আলী (রা) ফাতিমাকে (রা) বিয়ে করেন রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় আসার পাঁচ মাস পরে রজব মাসে এবং বদর যুদ্ধ থেকে ফেরার পর তাঁদের বাসর হয়। ফাতিমার বয়স তখন আঠারো বছর। তাবারীর তারীখে বলা হয়েছে, হিজরী দ্বিতীয় সনে হিজরাতের বাইশ মাসের মাথায় জিলহাজ্জ মাসে ‘আলী-ফাতিমার (রা) বাসর হয়। বিয়ের সময় ‘আলী (রা) ফাতিমার চেয়ে চার বছরের বড় ছিলেন।[প্রাগুক্ত; তাবাকাত-৮/১১; নিসা’ মাবাশশারাত বিল জান্নাহ্-২০৮]

আবূবকর (রা) ও ‘উমারের (রা) মত উঁচু মর্যাদার অধিকারী সাহাবীগণও ফাতিমাকে (রা) স্ত্রী হিসেবে পেতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁরা রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট প্রস্তাবও দেন। কিন্তু তিনি অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। হাকিমের মুসতাদরিক ও নাসঈর সুনানে এসেছে যে, আবূ বকর ও উমার (রা) উফয়ে ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। রাসূল (সা) তাঁদেরকে বলেন : সে এখনো ছোট। একটি বর্ণনায় এসেছে, আবূ বকর প্রস্তাব দিলেন। রাসূল (সা) বললেন : আবূ বকর! তাঁর ব্যাপারে আল্লাহর সিদ্ধান্তের অপেক্ষা কর। আবূ বকর (রা) একথা ‘উমারকে (রা) বললেন, ‘উমার (রা) বললেন : তিনি তো আপনার প্রস্তাব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারপর আবূ বকর ‘উমারকে (রা) বললেন : এবার আপনি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিন। ‘উমার (রা) প্রস্তাব দিলেন। রাসূল (সা) আবূ বকরকে যে কথা বলে ফিরিয়ে দেন, ‘উমারকেও ঠিক একই কথা বলেন। ‘উমার (রা) আবূ বকরকে সে কথা বললে তিনি মন্তব্য করেন : ‘উমার, তিনি আপনার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারপর ‘উমার (রা) ‘আলীকে (রা) বলেন, আপনিই ফাতিমার উপযুক্ত পাত্র। ‘আলী (রা) বলেন, আমার সম্পদের মধ্যে এই একটি বর্ম ছাড়া তো আর কিছুই নেই। আলী-ফাতিমার বিয়েটি কিভাবে হয়েছিল সে সম্পর্কে বেশ কয়েকটি বর্ণনা দেখা যায়। সেগুলো প্রায় কাছাকাছি। এখানে কয়েকটি তুলে ধরা হলো।

তাবাকাতে ইবন সা‘দ ও উসুদুর গাবা‘র গ্রন্থের একটি বর্ণনা মতে ‘আলী (রা) ‘উমারের কথামত রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট বিয়ের যান এবং ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। রাসূল (সা) সাথে সাথে নিজ উদ্যোগে আলীর (রা) সাথে ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। রাসূল (সা) সাথে সাথে নিজ উদ্যোগে আলীর (রা) সাথে ফাতিমাকে বিয়ে দেন। এ খবর ফাতিমার কানে পৌঁছলে তিনি কাঁদতে শুরু করেন। অতঃপর রাসূল (সা) ফাতিমার কাছে যান এবং তাঁকে লক্ষ্য করে বলেন : ফাতিমা! আমি তোমাকে সবচেয়ে বড় জ্ঞানী, সবচেয়ে বেশী বিচক্ষণ এবং প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তির সাথে বিয়ে দিয়েছি। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, আলী (রা) প্রস্তাব দানের পর রাসূল (সা) বলেন : ফাতিমা!‘আলী তোমাকে স্মরণ করে। ফাতিমা কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থাকেন। অতঃপর রাসূল (সা) বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেন।

অন্য একটি বর্ণনা এ রকম : মদীনার আনসারদের কিছু লোক আলীকে বলেন : আপনার জন্য তো ফাতিমা আছে। একথার পর ‘আলী রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যান। রাসূল (সা) বলেন : আবূ তালিবের ছেলের কি প্রয়োজন? আলী ফাতিমার প্রসঙ্গে কথা বলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন : মারহাবান ওয়া আহলান। (পরিবারে সুস্বাগতম)। এর বেশী আর কিছু বললেন না। ‘আলী রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট থেকে উঠে অপেক্ষামান আনসারদের সেই দলটির কাছে গেলেন। তারা জিজ্ঞেস করলো : পিছনের খবর কি? ‘আলী বললেন : আমি জানিনে। তিনি আমাকে “মারহাবান ওয়া আহলান” ছাড়া আর কিছুই বলেননি। তাঁরা বললেন : রাসূলুল্লাহর (সা) পক্ষ থেকে আপনাকে এতটুকু বলাই কি যথেষ্ট নয়? তিনি আপনাকে পরিবারের সদস্য বলে স্বাগতম জানিয়েছেন। ফাতিমার সাথে কিভাবে বিয়ে হয়েছিল সে সম্পর্কে আলীর (রা) বর্ণনা এ রকম : রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট ফাতিমার বিয়ের পয়গাম এলো। তখন আমার এক দাসী আমাকে বললেন : আপনি কি একথা জানেন যে, রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট ফাতিমার বিয়ের পয়গাম এসেছে?

বললাম : না।

সে বললো : হাঁ, পয়গাম এসেছে। আপনি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট কেন যাচ্ছেন না? আপনি গেলে রাসূলুল্লাহ (সা) ফাতিমাকে আপনার সাথেই বিয়ে দিবেন।

বললাম : বিয়ে করার মত আমার কিছু আছে কি?

সে বললো : যদি আপনি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যান তাহলে তিনি অবশ্যই আপনার সাথে তাঁর বিয়ে দিবেন।

‘আলী (রা) বলেন : আল্লাহর কসম! সে আমাকে এভাবে আশা-ভরসা দিতে থাকে। অবশেষে আমি একদিন রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট গেলাম। তাঁর সামনে বসার পর আমি যেন বোবা হয়ে গেলাম। তাঁর মহত্ত্ব ও তাঁর মধ্যে বিরাজমান গাম্ভীর্য ও ভীতির ভাবের কারণে আমি কোন কথাই বলতে পারলাম না। এক সময় তিনিই আমাকে প্রশ্ন করলেন : কি জন্য এসেছো? কোন প্রয়োজন আছে কি? আলী (রা) বলেন : আমি চুপ করে থাকলাম। রাসূল (সা) বললেন : নিশ্চয় ফাতিমাকে বিয়ে প্রস্তাব দিতে এসেছো?

আমি বললাম : হাঁ। তিনি বললেন : তোমার কাছে এমন কিছু আছে কি যা দ্বারা তুমি তাকে হালাল করবে? বললাম : আল্লাহর কসম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! নেই। তিনি বললেন : যে বর্মটি আমি তোমাকে দিয়েছিলাম সেটা কি করেছো?

বললাম : সেটা আমার কাছে আছে। ‘আলীর জীবন যে সত্তার হাতে তার কসম, সেটা তো একটি “হুতামী” বর্ম। তার দাম চার দিরহামও হবে না।

রাসূল (সা) বললেন : আমি তারই বিনিময়ে ফাতিমাকে তোমার সাথে বিয়ে দিলাম। সেটা তার কাছে পাঠিয়ে দাও এবং তা দ্বারাই তাকে হালাল করে নাও।

‘আলী (রা) বলেন : এই ছিল ফাতিমা বিনত রাসূল্লিাহর (সা) মাহর।[দালায়িল আন-নুবুওয়াহ্-৩/১৬০; উসুদুল গাবা-৫/২৫০; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৩/৩৪৬; তাবাকাত-৮/১২]

‘আলী (রা) কুব দ্রুত বাড়ী গিয়ে বর্মটি নিয়ে আসেন। কনেকে সাজগোজের জিনিসপত্র কেনার জন্য রাসূল (সা) সেটি বিক্রি করতে বলেন।[সহীহ আল-বুখারী, কিতাব আল-বুয়ূ’; সুনানে নাসাঈ, কিতাব আন-নিকাহ; মুসনাদে আহমাদ-১/৯৩, ১০৪, ১০৮] বর্মটি ‘উছমান ইবন ‘আফফান (রা) চার ‘শো সত্তর (৪৭০) দিরহামে কেনেন। এই অর্থ রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে দেয়া হয়। তিনি তা বিলালের (রা) হাতে কিছু আতর-সুগন্ধি কিনতে বলেন, আর বাকী যা থাকে উম্মু সালামার (রা) হাতে দিতে বলেন। যাতে তিনি তা দিয়ে কনের সাজগোজের জিনিস কিনতে পারেন।

সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে রাসূল (সা) সাহাবীদের ডেকে পাঠান। তাঁরা উপস্থিত হলে তিনি ঘোষণা দেন যে, তিনি তাঁর মেয়ে ফাতিমাকে চার ‘শো মিছকাল রূপোর বিনিমযে ‘আলীর (রা) সাথে বিযে দিয়েছেন। তারপর আরবের প্রথা অনুযায়ী কনের পক্ষ থেকে রাসূল (সা) ও বর ‘আলী (রা) নিজে সংক্ষিপ্ত খুতবা দান করেন। তারপর উপস্থিত অতিথি সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে খোরমা ভর্তি একটা পাত্র উপস্থাপন করা হয়।[তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ্-৬০৭]

ফাতিমা ও ‘আলীর (রা) বিয়েতে প্রদত্ত রাসূলুল্লাহর (সা) খুতবা :[ জামহারাতু খতাব আল-‘আরাব-৩/৩৪৪] (আরবী==========)

‘সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি তাঁর দান ও অনুগ্রগের কারণে প্রশংসিত, শক্তি ও ক্ষমতার জোরে উপাস্য, শাস্তির কারণে ভীতিপ্রদ এবং তাঁর কাছে যা কিছু আছে তার জন্য প্রত্যাশিত। আসমান ও যমীনে তিনি স্বীয় হুকুম বাস্তবায়নকারী। তিনি তাঁর শক্তি ও ক্ষমতা দ্বারা এই সৃষ্টিজগত সৃষ্টি করেছেন, তারপর বিধি নিষেধ দ্বারা তাদেরকে পার্থক্য করেছেন, দীনের দ্বারা তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন এবং তাঁর নবী মুহাম্মাদ (সা)-এর দ্বারা তাদেরকে সম্মানিত করেছেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বিবাহ ব্যবস্থাকে পরবর্তী বংশ রক্ষার উপায় এবং একটি অবশ্যকরণীয় কাজ করে দিয়েছেন। এর দ্বারা রক্ত সম্পর্ককে একটির সাথে আরেকটি সংযুক্ত করে দিয়েছেন। এ ব্যবস্থা সৃষ্টি জগতের জন্র অবধারিত করেছেন।

যাঁর নাম অতি বরকতময় এবং যাঁর স্মরণ সুমহান, তিনি বলেছেন : “তিনিই পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন মানুষকে, অতঃপর তাকে রক্তগত বংশ ও বৈবাহিক সম্পর্কশীল করেছেন। তোমার রব সবকিছু করতে সক্ষম।” সুতরাং আল্লাহর নির্দেশ চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ধাবিত হয়। প্রত্যেকটি চুড়ান্ত পরিণতির একটি নির্ধারিত সময় আছে। আর প্রত্যেকটি নির্ধারিত সময়ের একটি শেষ আছে। ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা বিলীন করেন এবং বহাল রাখেন। আর মূল গ্রন্থ তাঁর কাছেই রয়েছে।’

অতঃপর, আমার রব আমাকে আদেশ করেছেন, আমি যেন, ‘আলীর সাথে ফাতিমার বিয়ে দিই। আর আমি তাঁকে চার শো ‘মিছকাল’ রূপোর বিনিময়ে তার সাথে বিয়ে দিয়েছি- যদি এতে আলী রাজী থাকে।’

রাসূলুল্লাহর (সা) কুতবার পর তৎকালীন আরবের প্রথা-অনুযায়ী বর ‘আলী (রা) ছোট্ট একটি খুতবা দেন। প্রথমে আল্লাহর হামদ ও ছানা এবং রাসূলের প্রতি দরূদ ও সালাম পেশ করেন। তারপর বলেন :[প্রাগুক্ত-৩/৩৪৫] (আরবী============)

‘আমাদের এই সমাবেশ, আল্লাহ যা নির্ধারণ করেছেন এবং তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। আর বিয়ে হলো আল্লাহ যার আদেশ করেছেন এবং যে ব্যাপারে অনুমতি দান করেছেন। এই যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তাঁর কন্যা ফাতিমার সাথে চার শো আশি দিরহাম মাহরের বিনিময়ে বিয়ে দিয়েছেন। আমি তাতে রাজি হয়েছি। অতএব আপনারা তাঁকে জিজ্ঞেস করুন্ সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।’

এভাবে অতি সাধারণ ও সাদাসিধে ভাবে ‘আলীর সাথে নবী দুহিতা ফাতিমাতুয যাহরার শাদী মুবারক সম্পন্ন হয়। অন্য কথায় ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাসের সবচেয়ে মহান গৌরবময় বৈবাহিক সম্পর্কটি স্থাপিত হয়।

সংসার জীবন

মদীনায় আসার পর রজব মাসে এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। আর হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের পর আলী (রা) তাঁর স্ত্রীকে উঠিয়ে নেয়ার জন্য একটি ঘর ভাড়া করতে সক্ষম হন। সে ঘরে বিত্ত-বৈভবের কোন স্পর্শ ছিল না। সে ঘর ছিল অতি সাধারণ মানের। সেখানে কোন মূল্যবান আসবাব পত্র, খাট-পালঙ্ক, জাজিম, গতি কোন কিছুই ছিল না। ‘আলীর ছিল কেবল একটি ভেড়ার চামড়া, সেটি বিছিয়ে তিনি রাতে ঘুমাতেন এবং দিনে সেটি মশকের কাজে ব্যবহার হতো। কোন চাকর-বাকর ছিল না।[আ‘লাম আন-নিসা’ -৪/১০৯; তাবাকাত-৮/১৩; সাহাবিয়াত-১৪৮] আসমা‘ বিনত ‘উমাইস (রা) যিনি ‘আলী-ফাকিসার (রা) বিয়ে ও তাঁদের বাসর ঘরের সাজ-সজ্জা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, বলেছেন, খেজুর গাছের ছাল ভর্তি বালিশ-বিছানা ছাড়া তাদের আর কিছু ছিল না। আর বলা হয়ে থাকে ‘আলীর (রা) ওলীমার চেয়ে ভালো কোন ওলীমা সে সময় আর হয়নি। সেই ওলীমা কেমন হতে পারে তা অনুমান করা যায় এই বর্ণনা দ্বারা : ‘আলী (রা) তাঁর একটি বর্ম এক ইহুদীর নিকট বন্ধক রেখে কিছু যব আনেন।’[তাবাকাত-৮/২৩] তাঁদের বাসর রাতের খাবার কেমন ছিল তা এ বর্ণনা দ্বারাপ অনুমান করতে মোটেই কষ্ট হয় না।

তবে বানূ ‘আবদিল মুত্তালিব এই বিয়ে উপলক্ষে জাঁকজমকপূর্ণ এমন একটা ভোজ অনুষ্ঠান করেছিল যে, তেমন অনুষ্ঠান নাকি এর আগে তারা আর করেনি। সাহীহাইন ও আল-ইসাবার বর্ণনা মতে তাহলো, হামযা (রা) যিনি মুহাম্মাদ (সা) ও ‘আলী উভয়ের চাচা, দুটো বুড়ো উট যবেহ করে আত্মীয়-কুটুম্বদের খাইয়েছিলেন।[তারাজিমু বায়ত আন-নুবুওয়াহ্-৬০৭]

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে আগত আত্মীয়-মেহমানগণ নব দম্পতির শুভ ও কল্যাণ কামনা করে একে একে বিদায় নিল। রাসূল (সা) উম্মু সালামাকে (রা) ডাকলেন েএবং তাঁকে কনের সাথে ‘আলীর বাড়ীতে যাওয়ার জন্য বললেন। তাঁদেরকে একথাও বলে দিলেন, তাঁরা যেন সেখানে তাঁর (রাসূল সা.) যাওয়ার অপেক্ষা করেন।

বিলাল (রা) ‘ঈশার নামাযের আযান দিলেন। রাসূল (সা) মসজিদে জামা‘আতের ইমাম হয়ে নামায আদায় করলেন। তারপর ‘আলীর (রা) বাড়ী গেলেন। একটু পানি আনতে বললেন। পানি আনা হলে কুরআনের কিছু আয়াত তিলাওয়াত করে তাতে ফুঁক দিলেন। সেই পানির কিচু বর-কনেকে পান করাতে বললেন। অবশিষ্ট পানি দিয়ে রাসূল (সা) নীচে ধরে রাখা একটি পাত্রের মধ্যে ওযূ করলেন। সেই পানি তাঁদের দু‘জনের মাথায় ছিটিয়ে দিলেন। তারপর এই দু‘আ করতে করতে যাওয়ার জন্য উঠলেন :[ আ‘লাম আন-নিসা’-৪/১০৯] (আরবী========)

‘হে আল্লাহ! ‍তুমি তাদের দু‘জনের মধ্যে বরকত দান কর। হে আল্লাহ! তুমি তাদের দু‘জনকে কল্যাণ দান কর। হে আল্লাহ! তাদের বংশধারায় সমৃদ্ধি দান কর।’

অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, যাবার সময় তিনি মেয়েকে লক্ষ্য করে বলেন : ফাতিমা! আমার পরিবারের সবচেয়ে ভালো সদস্যের সাথে তোমার বিয়ে দেয়ার ব্যাপারে কোন ত্রুটি করিনি।[তাবাকাত-৮/১৫, ২৮]

ফাতিমা চোখের পানি সম্বরণ করতে পারেননি। পিতা কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর পরিবেশকে হালকা করার জন্য অত্যন্ত আবেগের সাথে মেয়েকে বলেন : আমি তোমাকে সবচেয়ে শক্ত ঈমানের অধিকারী, সবচেয়ে বড় জ্ঞানী, সবচেয়ে ভালো নৈতিকতা ও উন্নত মন-মানসের অধিকারী ব্যক্তির নিকট গচ্ছিত রেখে যাচ্ছি।[তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ্-৬০৮]

দারিদ্রের কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখী

পিতৃগৃহ থেকে ফাতিমা যে স্বামী গৃহে যান সেখানে কোন প্রাচুর্য ছিল না। বরং সেখানে যা ছিল তাকে দারিদ্রের কঠোর বাস্তবতাই বলা সঙ্গত। সে ক্ষেত্রে তাঁর অন্য বোনদের স্বামীদের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলক অনেক বালো ছিল। যায়নাবের বিয়ে হয় আবুল ‘আসের (রা) সাথে। তিনি মক্কার বড় ধনী ব্যক্তি ‘আবদুল ‘উযযা ইবন ‘আবদিল মুত্তালিবের দুই ছেলের সাথে। ইসলামের কারণে তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর একের পর একজন করে তাঁদের দু‘জনেরই বিয়ে হয় ‘উছমান ইবন ‘আফফানের (রা) সাথে। আর ‘উছমান (রা) ছিলেন একজন বিত্তবান ব্যক্তি। তাঁদের তুলনায় ‘আলী (রা) ছিলেন একজন নিতান্ত দরিদ্র মানুষ। তাঁর নিজের অর্জিত সম্পদ বলে যেমন কিছু ছিল না, তেমনি উত্তরাধিকার সূত্রেও কিছু পাননি। তাঁর পিতা মক্কার সবচেয়ে সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন। তবে তেমন অর্থ-বিত্তের মালিক ছিলেন না। আর সন্তান ছিল অনেক। তাই বোঝা লাঘবের জন্য মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁর চাচা ‘আব্বাস তাঁর দুই ছেলের লালন-পালনের ভার গ্রহণ করেন। এভাবে ‘আলী (রা) যুক্ত হন মুহাম্মাদের (সা) পরিবারের সাথে।

এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, ‘আলীর (রা) মত মক্কার সম্ভ্রান্ত বংশীয় বুদ্ধিমান যুবক এত সীমাহীন দারিদ্রের মধ্যে থাকলেন কেন? এর উত্তর ‘আলীর (রা) জীবনের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। মাহাম্মাদ (সা) রাসূল হলেন। কিশোরদের মধ্যে ‘আলী (রা) সর্বপ্রথম তাঁর প্রতি ঈমান আনলেন। ইবন ইসহাকের বর্ণনা অনুযায়ী তখন তাঁর বয়স দশ বছর।[প্রাগুক্ত-৬১২] আর তখন থেকে তিনি নবী মুহাম্মাদের (সা) জীবনের সাথে জড়িঃেয় পড়েন। নবী (সা) যত কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছেন, ‘আলীর (রা) জীবন যেভাবে শুরু হয় তাতে এ পেশার মাধে জড়ানোর সুযোগ ছিল কোথায়? মক্কার কুরাইশদের সাথে ঠেলঅ-ধাক্কা করতেই তো কেটে যায় অনেকগুলো বছর। মদীনায় গেলেন একেবারে খালি হাতে। সেকানে নতুন জায়গায় নতুনভাবে দা‘ওয়াতী কাজে জড়িয়ে পড়লেন। এর মধ্যে বদর যুদ্ধ এসে গেল। তিনি যুদ্ধে গেলেন। যুদ্ধের পর গনীমতের অংশ হিসেবে রাসূল (সা) তাকে একটি বর্ম দিলেন। এই প্রথম তিনি একটি সম্পদের মালিক হলেন।

‘আলী (রা) যে একজন নিতান্ত দরিদ্র মানুষ ছিলেন তা ফাতিমার জানা ছিল। তাই, বালাযুরীর বর্ণনা যদি সত্য হয়- রাসূল (সা) ফাতেমাকে যখন ‘আলীর প্রস্তাবের কতা বলেন তখন ফাতিমা ‘আলীর দারিদ্রের কথা উল্লেখ করেন। তার জবাবে রাসূল (সা) বলেন :

সে দুনিয়াতে একজন নেতা এবং আখিরাতেও সে সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিদের একজন হবে। সাহাবীদের মধ্যে তার জ্ঞান বেশী। সে একজন বিচক্ষণও। তাছাড়া সবার আগে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে।’[প্রাগুক্ত; হায়াত আস-সাহাবা-৩/২৫৬]

এই বর্ণনাটি সত্য হতেও পারে। কারণ, বিয়ে-শাদীর এ রকম পর্যায়ে অভাব-দারিদ্র বিবেচনায় আসা বিচিত্র কিছু নয়।

ফাতিমা (রা) আঠারো বছরে স্বামী গৃহে যান। সেখানে যে বিত্ত-বৈভবের কিচু মাত্র হ্নি ছিল না, সে কথা সব ঐতিহাসিকেই বলেছেন। সেই ঘরে গিয়ে পেলেন খেজুর গাছের ছাল ভর্তি চামড়ার বালিশ, বিছানা, এক জোড়া যাতা, দু‘টো মশক, দু‘টো পানির ঘড় আর আতর-সুগন্ধি। স্বামী দারিদ্রের কারণে ঘর-গৃহস্থালীর কাজ-কর্মে তাঁকে সহায়তা করার জন্য অথবা অপেক্ষাকৃত কঠিন কাজগুলো করার জন্য্ কোন চাকর-চাকরানী দিতে পারেননি। ফাতিমা (রা) একাই সব ধরনের কাজ সম্পাদন করতেন। যাতা ঘুরাতে ঘুরাতে তাঁর হাতে কড়া পড়ে যায়, মশক ভর্তি পানি টানতে টানতে বুবে দাগ হয়ে যায় এবং ঘর-বাড়ী ঝাড়ু দিতে দিতে পরিহিত কাপড়-চোপড় ময়লা হয়ে যেত।[তাবাকাত-৮/১৫৯; আল-ইসাবা-৪/৪৫০]তাঁর এভাবে বাজ করা ‘আলী (রা) মেনে নিতে পারতেন না। কিন্তু তাঁর করারও কিছু ছিল না। যকটুবু পারতেন নিজে তাঁর কাজে সাহায্য করতেন। তিনি সব সময় ফাতিমার স্বাস্খ্যের ব্যাপারে সতর্ক থাকতেন। কারণ, মক্কী জীবনে নানারূপ প্রতিকূল অবস্থায় তিনি যে অপুষ্টির শিকার হন তাতে বেশ ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে পড়েন। ঘরে-বাইর এভাবে দু‘জনে কাজ করতে করতে তাঁরা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েন্ একদিন ‘আলী (রা) তাঁর মা ফাতিমা বিনত আসাদ ইবনে হাশিনকে বলেন : তুমি পানি আনা ও বাইরের অন্যান্য কাজে রাসূলুল্লাহর (সা) মেয়েকে সাহায্য কর, আর ফাতিম তোমাকে বাড়ীতে গম পেষা ও রুটি বানাতে সাহায্য করবে। এ সময় ফাতিমার পিতা রাসূলুল্লাহ (সা) প্রচুর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ও যুদ্ধবন্দীসহ বিজয়ীর বেশে একটি যুদ্ধ থেকে মদীনায় ফিরলেন। ‘আলী (রা) একদিন বললেন : ফাতিমা! তোমার এমন কষ্ট দেখে আমার বড় দুঃখ হয়। আল্লাহ তা‘লা বেশ কিচু যুদ্ধ বন্দী দিয়েছেন। তুমি যদি তোমার পিতার কাছে গিয়ে তোমার সেবার জন্য যুদ্ধবন্দী একটি দাসের জন্য আবেদন জানাতে! ফাতিমা ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় হাতের যাতা পাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে বলেন : আমি যাব ইনশা আল্লাহ। তারপর বাড়ীর আঙ্গিনায় একটু বিশ্রাম নিয়ে চাদর দিয়ে গা-মাথা ঢেকে ধীর পায়ে পিতৃগৃহের দিকে গেলেন। পিতা তাঁকে দেখে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলেন : মেয়ে! কেন এসেছো? ফাতিমা বললেন : আপনাকে সালাম করতে এসেছি। তিনি লজ্জায় পিতাকে মনের কথাটি বলতে পারলেন না। বাড়ঢ ফিরে এলেন এবং স্বামীকে সে কথা বললেন। ‘আলী (রা) এবার ফাতিমাকে সংগে করে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট গেলেন। ফাতিমা পিতার সামনে লজ্জায় মুখ নীচু করে নিজের প্রয়োজনের কথাটি এবার বলে ফেলেন। পিতা তাঁকে বলেন : আল্লাহর কসম! তোমাদেরকে আমি একটি দাসও দিব না। আহ্লুস সুফফার লোকেরা না খেয়ে নিদারুণ কষ্টে আছে। তাদের জন্য আমি কিছুই করতে পারছিনে। এগুলো বিক্রি করে সেই অর্থ আমি তাদের জন্য খরচ করবো।

একথা শোনার পর তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দু‘জন পিতাকে ধন্যবাদ দিয়ে ঘরে ফিরে আসেন। তাঁদেরকে এভাবে খালি হাতে ফেরত দিয়ে স্নেহশীল পিতা যে পরম শান্তিতে থাকতে পেরেছিলেন তা কিন্তু নয়। সারাটি দিন কর্মক্লান্ত আদরের মেয়েটির চেহারা তাঁর মনের মধ্যে ভাসতে থাকে।

সন্ধা হলো। ঠাণ্ডাও ছিল প্রচণ্ড। ‘আলী-ফাতিমা শক্ত বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু এত ঠাণ্ডায কি ঘুম আসে? এমন সময় দরজায় করাঘাতের শব্দ। দরজা খুলতেই তাঁরা দেখতে পান পিতা মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা) দাঁড়িয়ে। তিনি দেখতে পান, এই প্রবল শীতে মেয়ে-জামাই যে কম্বলটি গায়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্ট করছে তা এত ছোট যে দু‘জন কোন রকম গুটিশুঁটি মেরে থাকা যায়। মাথার দিকে টানলে পায়ের দিকে বেরিয়ে যায়। আবার পায়র দিকে সরিয়ে দিলে মাথার দিক আলগা হয়ে যায়। তাঁরা এই মহান অতিথিকে স্বগতম জানানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি তাঁদেরকে ব্যস্ত না হয়ে যে অবস্থায় আছে সেবাবে থাকতে বলেন। তিনি তাঁদের অবস্থা হৃদয় দিয়ে গভীরভাবে উলব্ধি করেন, তারপর কোমল সুরে বলেন: তোমরা আমার কাছে যা চেয়েছিলে তার চেয়ে ভালো কিছু কি আমি তোমাদেরকে বলে দিব?

তাঁর দু‘জনই এক সাথে বলে উঠলেন : বলুন, ইয়া রাসূলাল্লাহ!

তিনি বললেন : জিবরীল আমাকে এই কথাগুলো শিখিয়েছেন : প্রত্যেক নামাজের পরে তোমরা দু‘জন দশবার সুবহানাল্লাহ, দশবার আলহামদুলিল্লাহ ও দশবার আল্লাহু আকবর পাঠ করবে। আর রাতে যখন বিঝানায় ঘুমোতে যা তখন সুবহানাল্লাহ তেত্রিশবার, আলহামদুলিল্লাহ তেত্রিশবার, আল্লাহু আকবার চৌত্রিশবার পাঠ করবে। একথা বলে তিনি মেয়ে-জামাইকে রেখে দ্রুত চলে যান।[হাদীছটি সাহীহ বুখারী ও সাহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া তাবাকাত-৮/২৫; আ‘লাম আন-নিসা’-৪/১১১-দ্র.।]

এ ঘটনার শত বর্ষের এক তৃতীয়াংশ সময় পরেও ইমাম ‘আলীকে (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) শিখানো এই কথাগুলো আলোচনা করতে শোনা গেছে। তিনি বলতেন : রাসূলুল্লাহ (সা) শিখানো এই কথাগুলো আলোচনা করতে শোনা গেছে। তিনি বলতেন : রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে এই কথাগুলো শিকানোর পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি একদিনও তা বাদ দিইনি। একবার একজন ইরাকী প্রশ্ন করেন : সিফফীন যুদ্ধের সেই ঘোরতর রাতেও না? তিনি খুব জোর দিয়ে বলেন : সিফফীনের সেই রাতেও না।[সাহীহ মুসলিম; আদ-দু‘আ, খণ্ড-৪, হাদীছ নং-২০৯১; তাবাকাত-৮/১৯]

এ প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। আলী (রা) একবার দারুণ অভাব অনটনে পড়লেন। একদিন স্ত্রী ফাতিমাকে (রা) বললেন, যদি তুমি নবী (সা)-এর নিকট গিয়ে কিছু চেয়ে আনতে তাহলে ভালো হতো। ফাতিমা (রা) গেলেন। তখন নবীর (সা) নিকট উম্মু আয়মন (রা) বসা ছিলেন। ফাতিমা দরজায় টোকা দিলেন। নবী (সা) উম্মু আয়মনকে বললেন : নিশ্চয় এটা ফাতিমার হাতের টোকা। এমন সময় সে আমাদের নিকট এসেছে যখন সে সাধারণতঃ আসতে অভ্যস্ত নয়। ফাতিমা (রা) ঘরে ঢুকে বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই ফেরেশতাদের খাদ্য হলো তাসবী-তাহলীল ও তাহমীদ। কিন্তু আমাদের খাবার কি? বললেন : সেই সত্তার শপথ যিনি আমাকে সত্যসহকারে পাঠিয়েছেন, মুহাম্মাদের পরিবারের রান্না ঘরে তিরিশ দনি যাবত আগুন জ্বলে না। আমার নিকট কিছু ছাগল এসেছে, তুমি চাইলে পাঁচটি ছাগল তোমাকে দিতে পারি। আর তুমি যদি চাও এর পরিবর্তে আমি তোমাকে পাঁচটি কথা শিখিয়ে দিতে পারি যা জিবরীল আমাকে শিখিয়েছেন।

ফাতিমা (রা) বললেন : আপনি বরং আমাকে সেই পাঁচটি কথা শিখিয়ে দিন যা জিবরীল আপনাকে শিখিয়েছেন। নবী (সা) বললেন, বল (আরবী========)

এই পাঁচটি কথা শিখে ফাতিমা (রা) ফিরে গেলেন ‘আলীর (রা) নিকট। ফাতিমাকে দেখে ‘আলী (রা) পশ্ন করলেন : খবর কি? ফাতিমা বললেন : আমি দুনিয়া পাওয়ার জন্র প্রত্যাশা নিয়ে তোমর নিকট থেকে গিয়েছিলাম, কিন্তু ফিরে এসেছি আখিরাত নিয়ে। ‘আলী (রা) বললেন : আজকের দিনটি তোমার জীবনের সর্বোত্তম দিন।[কানয আল-‘উম্মাল-১/৩০২; হায়াত আস-সাহাবা-১/৪৩]

ছোটখাট দাম্পত্য কলহ

সেই কৈশোরে একটু বুদ্ধি-জ্ঞান হওয়ার পর থেকে হযরত ফাতিমা যে অবস্থায যৌবনের এ পর্যন্ত পৌঁছেছেন তাতে আনন্দ-ফুর্তি যে কি জিনিস তাতো তিনি জানে না। পিতা তাঁর কাছ থেকে নিকটে বা দূরে যেখানেই তাতে আনন্দ-ফুর্তি যে কি জিনিস তাতো তিনি জানেন না। পিতা তাঁর কাছ থেকে নিকটে বা দূরে যেকানেই থাকেন না কেন সবসময় তাঁর জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কোন অন্ত থাকেনা। তিনি যখন যুদ্ধে যান তখন তা আরো শত গুণ বেড়ে যায়। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই পিতাকে আগলে রাখতে রাখতে তাঁর নিজের মধ্যেও একটা সংগ্রামী চেতনা গড়ে উঠেছে। তােই সুযোগ পেলে তিনি যুদ্ধের ময়দানে ছুটে যান। উহুদ যুদ্ধে তাই তাঁকে আহত যোদ্ধাদেরকে পট্টি বাঁধতে, তাদের ক্ষতে ঔষুধ লাগরতে এবং মৃত্যুপথযাত্রী শহীদদেরকে পানি পান করাতে দেখা যায়। যখন ঘরে থাকতেন তখন চাইতেন স্বামীর সোহাগভরা কোমল আচরণ। কিন্তু আলীর (রা) জীবনের যে ইতিহাস তাতে তাঁর মধ্যে এই কোমলতার সুযোগ কোথায়? তাঁর জীবনের গোটাটাই তো হলো কঠোর সঙগ্রাম, তাই তাঁর মধ্যে কিচুটা রূঢ়তা থাকা বিচিত্র নয়। ফলে তাঁদের সম্পর্ক মাঝে মধ্যে উত্তপ্ত হয়ে উঠতো। পিতার কানেও সে কথা পৌঁছে যেত। তিনি ছুটে যেতেন এবং ধৈর্যের সাথে দু‘জনের মধ্যে আপোষ রফা করে দিতেন।

বর্ণিত হয়েছে যে, একদিন রাসূলকে (সা) সন্ধার সময় একটু ব্যস্ততার সাথে মেয়ের বাড়ীর দিকে যেতে দেখা গেল, চোখে-মুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ভাব। কিছুক্ষণ পর যখন সেখান থেকে বের হলেন তখন তাঁকে বেশ উৎফুল্ল দেখা গেল। সাহাবায়ে কিরাম বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাকে এক অবস্থায় ঢুকতে দেখলাম, আর এখন বের হচ্ছেন হাসি-খুশী অবস্থায়!

তিনি জবাব দিলেন : আমার সবচেয়ে বেশী প্রিয় দু‘জনের মধ্যে আপোষ-মীমাংসা করে দিলাম তাতে আমি খুশী হবো না।[তাবাকাত-৮/৪৯৯; আল-ইসাবা-৪/৩৬৮; আ‘লাম আন-নিসা’-৪/১১]

আরেকবার ফাতিমা (রা) ‘আলীর (রা) রূঢ়তায় কষ্ট পান। তিনি বলেন : আমি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট নালিশ জানাবো- একথা বলে ঘর থেকে বের হন। ‘আলীও (রা) তাঁর পিছে চলেন। ফাতিমা তাঁর স্বামীর প্রতি যে কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন তা পিতাকে বলেন, মহান পিতা বেশ নরমভাবে বুঝিয়ে তাঁকে খুশী করেন। ‘আলী (রা) স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ী ফেরার পথে বলেন : আল্লাহর কসম! তুমি অখুশী হও এমন কিছুই আমি আর কখনো করবো না।[তাবাকাত-৮/২৬; আল-ইসাবা-৪/৩৬৮]

ফাতিমার বর্তমানে আলীর (রা) দ্বিতীয় বিয়ের ইচ্ছা

ফাতিমা (রা) না চাইলেও এমন কিচু ঘটনা ঘটতো যা তাঁকে ভীষণ বিচলিত করে তুলতো। তাঁর স্বামী আরেকটি বিয়ে করে ঘরে সতীন এনে উঠাবে ফাতিমা তা মোটেই মেনে নিতে পারেন না। ‘আলী (রা) আরেকটি বিয়ের ইচ্ছা করলেন। তিনি সহজভাবে হিসাব কষলেন, শরী‘আতের বিধান মতে আরেকটি বিয়ে করা তো বৈধ। অন্য মুসলিম মহিলাদের ক্ষেত্রে যেমন এক সাথে চারজনকে রাখা বৈধ তেমনিভাবে নবীর (সা) মেয়ের সাথেও অন্য আরেকজন স্ত্রীকে ঘরে আনাতে কোন দোষ নেই। তিনি ধারণা করলেন, এতে ফাতিমা তাঁর প্রতি তেমন ক্ষ্যাপবেন না। কারণ, তাঁর পিতৃগৃহেই তো এর নজীর আছে। ‘আয়িশা, হাফসা ও উম্মু সালামা (রা) তো এক সাথেই আছেন। তাছাড়া একবার বানূ মাখযূমের এক মহিলা চুরি করলে তার শাস্তি মওকুফের জন্য মহিলার আত্মীয়রা উসামা ইবন যায়িদের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট আবেদন করে। তখন রাসূল (সা) বলেছিলেন : তুমি আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি রহিত করার জন্য সুপারিশ করছো? তারপর তিনি উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন। তাতে বলেন : তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়েছে এই জন্য যে, তাদের কোন সম্মানীয় ব্যক্তি চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর দুর্বল কেউ চুরি করলে তার উপডর “হদ” বা নির্ধারিত মাস্তি প্রয়োগ করতো। আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরি করে আমি তার হাত কেটে দেব।[সাহীহ আল-বুখারী : আল-আম্বিয়া; মুলিম : আল-হুদূদ; তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৬১৮]এ বক্তব্যের দ্বারা ‘আলী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ফাতিমাও তো অন্য দশজন মুসলিম মেয়ের মত।

এমন একটি সরল হিসেবে ‘আলী ৯রা) আরেকটি বিয়ের চিন্তা করেছিলেন, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া যে এত মারাত্মক হবে ‘আলীর (রা) কল্পনায়ও তা আসেনি। ‘আমর ইবন হিশাম ইবন আল-মুগীরা আল-মাখযুমীর মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন, একথা প্রকাশ করতেই ফাতিমা ক্ষোভে-উত্তেজনায় ফেটে পড়লেন। রাসূলও (সা) রাগান্বিত হলেন। ‘আমর ইবন হিশাম তথা আবূ জাহলের মেয়ের সাথে ‘আলীর বিয়ের প্রস্তাবের কথা ফাতিমার কানে যেতেই তিনি পিতার কাছে ছুটে যেয়ে অনুযোগের সুরে বলেন : আপনার সম্প্রদায়ের লোকেরা ধারণা করে, আপনার মেয়ের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলেও আপনি রাগ করেন না। এই ‘আলী তো এখনেআবূ জাহলের মেয়েকে বিয়ে করছে।[নিস’ মুবাশশারাত বিল জান্নাহ্-২১৫]

আসলে কথাটি মুনে রাসূল (সা) দারুণ ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু বিষয়টি ছিল বেশ জটিল। কারণ, এখানে ‘আলীর (রা) অধিকারের প্রশ্নও জড়িত ছিল। ফাতিমাকে রেখেও ‘আলী আরো একাধিক বিয়ে করতে পারেন। সে অধিকার আল্লাহ তাঁকে দিয়েছেন। এ অধিকারে রাসূল (সা) কিভাবে বাধা দিবেন? অন্যদিকে কলিজার টুকরো মেয়েকে সতীনের ঘর করতে হবে এটাও বড় দুঃখের ব্যাপার। তাই এখানে সমস্যাটির আরেকটি দিক আছে। তা হলো আলীর প্রস্তাবিত কনে আবূ জাহ্ল ‘আমর ইবন হিশামের মেয়ে। ‘আলীর গৃহে তাঁর স্ত্রী হিসেবে আল্লাহর রাসূলের মেয়ে এবং আল্লাহর দুশনের মেয়ে এক সাথে অবস্থান করতে পারে?

এই সেই আবূ জাহল, ইসলামের প্রতি যার নিকৃষ্ট শত্রুতা এবং নবী (সা) ও মুসলমানদের উপর নির্দয় যুলুম-নির্যাতনের কথা নবী (সা) ও মুসলমানদের স্মৃতি থেকে এখনো মুছে যায়নি। আল্লাহর এই দুশমন একদিন কুরাইশদেরকে বলেছিল : “ওহে কুরাইশ গোত্রের লোকেরা! তোমরা এই মুহাম্মাদকে আমাদের উপাস্যদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করে বেড়াতে, আমাদের পূর্বপুরুষকে গালিগালাজ করতে এবং আমাদের বুদ্ধিমান লোকদেরকে বোকা ও নির্বোধ বলে বেড়াতে দেখছো তা থেকে সে বিরত হবে না। আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আগামীকাল আমি বহন করতে সক্ষম এমন একটি বড় পাথর নিয়ে বসে থাকবো। যখনই সে সিজদায় যাবে অমনি সেই পাথরটি দিয়ে আমি তার মাথাটি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলবো। তখন তোমরা আমাকে বানূ আবদি মান্নাফের হাতে সোপর্দ অথবা তাদের হাত থেকে রক্ষা, যা খুশী তাই করবে।”[ ইবন হিশাম, আস-সীরাহ্-১/৩১৯; তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ্-৬১৯]

সে কুরাইশদের সমাবেশে নবী মুহাম্মাদকে (সা) বিদ্রূপ করে বলে বেড়াতো : ‘ওহে কুরাইশ গোত্রের লোকেরা! মুহাম্মাদ মনে করে দোযখে আল্লাহর যে সৈনিকরা তোমাদেরকে শাস্তি দিবে এবং বন্দী করে রাখবে তাদের সংখ্যা মাত্র উনিশজন। তোমরা তো তাদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশী। তোমাদের প্রতি এক শো’ জনে কি তাদের একজনকে রুখে দিতে পারবে না?’ তখন নাযিল হয় কুরআনের এ আয়াত : (আরবী=========)

‘আমি ফেরেশতাগণকে করেছি জাহান্নামের প্রহরী; কাফিরদের পরীক্ষাস্বরূপিই আমি তাদের এই সংখ্যা উল্লেখ করেছি।[ইবন হিশাম, আস-সীরাহ্-১/৩৩৩, ৩৩৫]

এই সেই আবূ জাহ্ল যে আখনাস ইবন মুরায়ককে যখন সে তার কাছে তার শোনা কুরআন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল, বলেছিল : তুমি কী শুনেছো? আমরা ও বানূ ‘আবদি মান্নাফ মর্যাদা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করলাম। তারা মানুষকে আহার করালো, আমরাও করালাম। তারা মানুষের দায়িত্ব ক৭াধে নিল আমরাও নিলাম। তারা মানুষকে দগান করলো; আমরাও করলাম। এভাবে আমরা যখন বাজির দুই ঘোড়ার মত সমান সমান হয়ে গেলাম তখন তারা বললো : আমাদের মধ্যে নবী আছে, আকাশ থেকে তাঁর কাছে ওহী আসে। এখন এ নবী আমরা কিভাবে পাব? আল্লাহর কসম! আমি কক্ষনো তার প্রতি ঈমানও আনবো না, তাকে বিশ্বাসও করবো না।[তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৬২০]

এ সেই আবূ জাহ্ল যে কোন মর্যাদাবান ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে শুনতে পেলে তাকে ভয়-ভীতি দেখাতো, হেয় ও অপমান করতো। বলতো : ‘তুমি তোমার পিতাকে যে তোমার চেয়ে ভালো ছিল,ত্যাগ করেছো? তোমার বুদ্ধিমত্তাকে আমরা নির্বুদ্ধিতা বলে প্রচার করবো, তোমার মতামত ও সিদ্ধান্তকে আমরা ভুল-ভ্রান্তিতে পূর্ণ বলে প্রতিষ্ঠা করবো এবং তোমার মান-মর্যাদা ধুঅেয় মিশিয়ে দিব।’

আর যদি কোন ব্যবসায়ী ইসলাম গ্রহণ করতো, তাকে বলতো : ‘আল্লাহর কসম! আমরা তোমার ব্যবসা লাটে উঠাবো, তোমার অর্থ-সম্পদের বারোটিা বাজিয়ে ছাড়বো।’ আর ইসলাম গ্রহণকারী দুর্বল হলে দৈহিক শাস্তি দিয়ে তাকে ইসলাম ত্যাগের জন্য চাপ দিত।

এ সেই আবূ জাহ্ল যে মক্কার শি‘আবে আবী তালিবের অবরোধকালে হাকীম ইবন হিযাম ইবন খুওয়াইলিদকে তাঁর ফুফু খাদীজর (রা) জন্য সামান্য কিচু খাবার নিয়ে যেতে বাধা দিয়েছিল। এই অভিশপ্ত ব্যক্তি তাঁর পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে বলেছিল : ‘তুমি বানূ হাশিমের জন্য খাদ্য নিয়ে যাচ্ছো? আল্লাহর কসম! এ খাবার নিয়ে তুমি যেতে পারবে না। মক্কায় চলো, তোমাকে আমি অপমান করবো। সে পথ ছাড়তে অস্বীকার করলো। সেদিন দু‘জনের মধ্যে বেশ মারপিট হয়। এরই প্রেক্ষিতে নাযিল হয় :[ সূরা আদ-দুখান-৪৩-৪৬; ইবন হিশাম, আস-সীরাহ্-২/২২, ১২৬, ১৩২] (আরবী=====)

‘নিশ্চয় যাক্কুম বৃক্ষ পাপীর খাদ্য। গলিত তামার মত তাদের পেটে ফুটতে থাকবে। ফুটন্ত পানির মত।’

এই আবূ জাহ্ল মক্কায় আগত নাজরানের একটি খ্রীস্টান প্রতিনিধি দলের মুখোমুখী হয়। তারা এসেছিল মক্কায় মুহাম্মাদের (সা) নুবুওয়াত লাভের খবর পেয়ে তাঁর সম্পর্কে আরো তথ্য লাভের উদ্দেশ্যে। তারা রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে সাক্ষাতের পর তাঁর কথা শুনে ঈমান আনে। তারা রাসূলুল্লাহর (সা) মজলিস থেকে বেরিয়ে আসার পরই আবূ জাহ্ল তাদের সামনে এসে দাঁড়াঃয় এবং তাদেরকে লক্ষ্য করে বলে :

‘আল্লাহ তোমাদের কাফেলাটিকে ব্যর্থ করুন। পিছনে ছেড়ে আসা তোমাদের স্বধর্মাবলম্বীরা তোমাদেরকে পাঠিয়েছে এই লোকটি সম্পর্কে তথ্য নিয়ে যাবার জন্য। তার কাছে তোমরা একটু স্থির হয়ে বসতে না বসতেই তোমাদের ধর্ম ত্যাগ করে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে বসলে? তোমাদের চেয়ে বেশী নির্বোধ কোন কাফেলার কথা আমার জানা নেই।’ [ইবন হিশাম, প্রাগুক্ত]

এই আবূ জা্হল রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় হিজরাতের অব্যবহিত পূর্বে কুরাইশদেরকে বলেছিল, কুরাইশ গোত্রের প্রতিটি শাখা থেকে একজন করে সাহসী ও চালাক-চতুর যুবক নির্বচন করে তার হতে একটি করে তীক্ষ্ণ তরবারি তুলে দেবে। তারপর একযোগে মুহাম্মাদের উপর হামলা চালিয়ে এক ব্যক্তির মতহ এক কোপে তাকে হত্যা করবে। তাতে তার রক্তের দায়-দায়িত্ব কুরাইশ গোত্রের সকল শাখার উপর সমানভাবে বর্তাবে।[তাবাকাত-২/১৫,১৭]

রাতে রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় হিজরাত করলেন। পরের দিন সকালে কুরাইশরা তাঁর খোঁজে বেরিয়ে পড়লো। তাদের মধ্যে আবূ জাহ্লও ছিল। তারা আবূ বকরের (রা) বাড়ীর দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁকডাক দিতে আরম্ভ করলো- আবূ বকরের (রা) মেয়ে আসমা’ (রা) বেরিয়ে এলেন। তারা প্রশ্ন করলো : তোমার আব্বা কোথায়? তিনি বললেন : আল্লাহর কসম! আমার আব্বা কোথায় তা আমার জানা নেই। তখন যাবতীয় অশ্লীল ও দুষ্কর্মের তোহা আবূ জাহ্ল তার হাতটি উঠিয়ে সজোরে আসমা’র গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। আসমা’র কানের দুলটি ছিটকে পড়ে।

বদরে যখন দু‘পক্ষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার তোড়-জোড় করছে তখন কুরাইশ বাহিনী একজন লোককে পাঠালো শত্রু বাহিনীর সংখ্যা ও শক্তি সম্পর্কে তথ্য নিয়ে আসার জন্য। সে ফিরে এসে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দিল। হাকীম ইবন হিযাম ইবন খুওয়াইলিদ গেলেন ‘উতবা ইবন রাবী‘আর নিকট এবং তাকে লোক-লস্করসহ ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানালেন। ‘উতবা নিমরাজি ভাব প্রকাশ করে সে হাকীমকে আবূ জাহলের নিকাট পাঠালো। কিন্তু আবূ জাহ্ল যুদ্ধ ছাড়া হাকীমের কথা কানেই কুললো না।

এ সেই আবূ জাহ্ল, বদরের দিন রাসূল (সা) যে সাতজন কট্টর কাফিরের প্রতি বদ-দু‘আ করেন, সে তাদের অন্যতম। এ যুদ্ধে সে অভিশপ্ত কাফির হিসেবে নিহতহ হয়। তার মাথাটি কেটে রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে আনা হলে তিনি আল্লাহর প্রশংসা করেন।[প্রাগুক্ত; তারাজিমু সায়্যিদিতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৬১২] রাসূল (সা) আবূ জাহলেন উটটি নিজের কাছে রেখে দেন। এর চার বছর পর ‘উমরার উদ্দেশ্যে যখন মক্কার দিকে যাত্র করেন তখন উটটি কুরবানীর পশু হিসেবে সংগে নিয়ে চলেন। পথে হুদায়বিয়াতে কুরাইশদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সেখানেই উটটি কুরবানী করেন।[তাবাকাত-২/৬৯]

ইসলামের এহেন দুশমন ব্যক্তির মেয়ে কি রাসূলুল্লাহর (সা) মেয়ে ফাতিমার (রা) সতীন হতে পারে? তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) প্রত্যাখ্যান করেন। রাসূল (সা) রাগান্বিত অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদের দিকে যান এবং সোজা মিম্বরে গিয়ে ওঠেন। তারপর উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্য নিম্নের ভাষণটি দেন :

‘বানী হিশাম ইবন আল-মুগীরা ‘আলীর সাথে তাদের মেয়ে বিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আমর অনুমতি চায়। আমি তাদেরকে সে অনুমতি দিব না। আমি তাদেরকে সে অনুমতি দিব না। আমি তাদেরকে সে অনুমতি দিব না। তবে ‘আলী ইচ্ছা করলে আমার মেয়েকে তালাক দিয়ে তাদের মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। কারণ, আমার মেয়ে আমার দেহেরি একটি অংশের মত। তাকে যা কিছু অস্থির করে তা আমাকেও অস্থির করে, আর যা তাকে কষ্ট দেয় তা আমাকেও কষ্ট দেয়। আমি তার দীনের ব্যাপারে সঙ্কটে পড়ার ভয় করছি।

তার পর তিনি তাঁর জামাই আবুল ‘আসের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। তার সাথে বৈবাহিক আত্মীয়তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন :

‘সে আমাকে কথা দিয়েছে এবং সে কথা সত্য প্রমাণিত করেছে। সে আমার সাথে অঙ্গীকার করেছে এবং তা পূরণ করেছে। আমি হালালকে হারাম করতে পারবো না। তেমনিভাবে হারামকেও হালাল করতে পারবো না। তবে আল্লাহর রাসূলের মেয়ে ও আল্লাহর দুশমনের মেয়ের কখনো সহ অবস্থান হতে পারে না।’[হাদীছটি সাহীহ আল-বুখারী, আল-মুসলিম, সুনানে আবী দাউদ, সুনানে ইবন মাজাহ, সুনানে তিরমিযী ও সুনানে আহমাদ(৬/৩২৬, ৩২৮) সহ হাদীছের প্রায় সকল গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।]

‘আলী (রা) মসজিদে ছিলেন। চুপচাপ বসে শ্বশুরের বক্তব্য শুনলেন। তারপর মসজিদ থেকে বের হয়ে ধীর পায়ে বাড়ীর পথ ধরলেন। এক সময় বাড়ীতে পৌঁছলেন, সেখানে দুঃখ ও বেদনায় ভারাক্রান্ত ফাতিমা বসা আছেন। ‘আলী (রা) আস্তে আস্তে তাঁর পাশে গিয়ে বসলেন। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। কি বলবেন তা যেন স্থির করতে পারছেন না। যখন দেখলেন ফাতিমা কাঁদছেন, তখন ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে আস্তে করে বলেন :

‘ফাতিমা! ‘তোমার অধিকারের ব্যাপারে আমার ভুল হয়েছে। তোমার মত ব্যক্তিরা ক্ষমা করতে পারে।’ অনেক্ষণ কেটে গেল ফাতিমা কোন জবাব দিলেন না। তারপর এক সময় বললেন : ‘আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন।’ এবার ‘আলী (রা) একটু সহজ হলেন। তারপর মসজিদের সব ঘটনা তাঁকে বর্ণনা করেন। তাঁকে একথাও বলেন যে, রাসূল (সা) বলেনছেন, আল্লাহর রাসূলের মেয়ে ও আল্লাহর দুশমনের মেয়ের সহঅবস্থান কক্ষনো সম্ভব নয়। ফাতিমার দু‘চোখ পানিতে ভরে গেল। তারপর তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। [তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুযওয়াহ-৬২৪]

দ্বিতীয় বিয়ের অভিপ্রায়ের এ ঘটনাটি ঘটেছিল কখন

এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, তা হলো- ‘আলী (রা) কখন এই দ্বিতীয় বিয়ের ইচ্ছা করেছিলেন? ইতিহাস ও সীরাতের গ্রন্থাবলীতে রাসূলুল্লাহর (সা) উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণটি বর্ণিত হলেও কেউ তার সময়কাল সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করেননি। অথচ এটা নবীর (সা) জীবন ও তাঁর পরিবারের জন্য ছিল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাই কোন কোন বিশেষজ্ঞ বিভিন্নভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, এটা ছিল ‘আলী-ফাতিমার (রা) বিবাহিত জীবনের প্রথম দিকের ঘটনা। আর সুনির্দিষ্টভাবে তা হয়তো হবে হিজরী দ্বিতীয় সন, তৃতীয় সনে তাঁদের প্রথম সন্তান হাসান হওয়ার পূর্বে। অবশ্য এটা সম্পূর্ণ অনুমান ভিত্তিক মতামত; এর সপক্ষে কোন বর্ণনামূলক দলিল-প্রমাণ নেই।[প্রাগুক্ত]

হাসান-হুসায়নের জন্ম

‘আলী-ফাতিমার (রা) জীবনে মেঘ ভর করেছিল তা কেটে গেল, জীবনের এক কঠিন পরীক্ষায় তারা উৎরে গেলেন। অভাব ও টানাটানির সংসারটি আবার প্রেম-প্রীতি ও সহমর্মিতায় ভরে গেল। এরই মধ্যে হিজরী তৃতীয় সনে তাঁদের প্রথম সন্তান হাসানের জন্ম হঅো। ফাতিমার পিতা নবীকে (সা) এ সুসংবাদ দেয়া হলো। তিনি দ্রুত ছুটে গেলেন এবং আদরের মেয়ে ফাতিমার সদ্যপ্রসূত সন্তানকে দু‘হাতে তুলে তার কানে আযান দেন এবং গভীরভা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। গোটা মদীনা যেনো আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠে। রাসূল (সা) দৌহিত্র হাসানের মাথা মুড়িয়ে তার চুলের সমপরিমাণ ওজনের রূপা গরীব-মিসকীনদের মধ্যে দান করে দেন। শিমু হাসানের বয়স এক বঝরের কিছু বেশী হতে না হতেই চতুর্থ হিজরীর শা‘বান মাসে ফাতিমা (রা) আরেকটি সন্তন উপহার দেন। আর এই শিশু হলেন হুসায়।[সাহীহ আল-বুখারী, কিতাবুল মানাকিব; মুলিম-আল-ফাদায়িল]

আবূ জাহলের সেই কন্যার নাম নিয়ে মতপার্থক্য আছে। সর্বাধিক প্রস্ধি মতে “জুওয়ায়বিয়া”। তাছাড়া আল-‘আওরা’, আল-হানকা’, জাহদাম ও জামীলাও বলা হয়েছে। ইসলাম গ্রহণ করে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট বায়‘আত হন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) কিছু হাদীছও স্মৃতিতে সংরক্ষণ করেন।[আ‘লাম-আন-নিসা’ -৪/১১২; টীকা নং-১]

‘আলী (রা) তাঁর পয়গাম প্রত্যাহার করে নেন এবং আবূ জাহলের কন্যাকে ‘উত্তাব ইবন উসায়দ বিয়ে করেন।

এ ঘটনার পর হযরত ফাতিমা (রা) জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ‘আলীর (রা) একক স্ত্রী হিসেবে অতিবাহিত করেন। ফাতিমার (রা) মৃত্যূর আগ পর্যন্ত তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেননি। ফাতিমা হাসান, হুসাইন, উম্মু কুলছূম ও যায়নাক- এ চার সন্তানের মা হন। তিনি শিশু হাসানকে দু‘হাতের উপর রেখে দোলাতে দোলাতে নিম্নের চরণটি আবৃত্তি করতেন :[ প্রাগুক্ত-৪/১১৩] (আরবী=======)

‘আমার সন্তান নবীর মত দেখতে, ‘আলীর মত নয়।’

হাসান-হুসায়নের প্রতি রাসূলুল্লাহর (সা) স্নেহ-আদর

হযরত রাসূলে কারীমের (সা) অতি আদরের এ দুই দৌহিত্র যেমন তাঁর অন্তরে প্রশান্তি বয়ে আনে তেমনি তাঁদের মা আয-যাহরার দু‘ কোল ভরে দেয়। হযরত খাদীজার (রা) ওফাতের পর রাসূল (সা) বেশ কয়েকজন নারীকে বেগমের মর্যাদা দান করেন, কিন্তু তাঁদের কেউই তাঁকে সন্তান উপহার দিতে পারেননি। পুত্র সন্তানের যে অভাববোধ তাঁর মধ্যে ছিল তা এই দুই দৌহিত্রকে পেয়ে দূর হয়ে যায়। এ পৃথিবীতে তাঁদের মাধ্যমে নিজের বংশধারা বিদ্যমান থাকার সম্ভাবনায় নিশ্চিত হন। এ কারণে তাঁর পিতৃস্নেহও তাঁদের ‍উপর গিয়ে পড়ে। আর তাই এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, তিনি তাঁদের দু’জনকে নিজের ছেলে হিসেবে অভিহিত করেছেন। আনাস ইবন মালিক থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা) ফাতিমাকে (রা) বলতেন, আমার ছেলে দুটোকে ডাক। তাঁরা নিকটে এলে তিনি তাঁদের দেহের গন্ধ শুঁকতেন এবং জড়িয়ে ধরতেন।[তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৬২৬] হযরত উসামা ইবন যায়দ (রা) বলেছেন, আমি, আমি একদিন কোন একটি প্রয়োজনে রাসূলুল্লাহর (সা) ঘরের দরজায় টোকা দিলাম। তিনি গায়ের চাদরে কিছু জড়িয়ে বেরিয়ে এলেন। আমি বুঝতে পারলাম না চাদরে জড়ানো কি জিনিস। আমার কাজ শেষ হলে প্রশ্ন করলাম : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি চাদরে ঢেকে রেখেছেন কি জিনিস?

তিনি চাদরটি সরালে দেখলাম, হাসান ও হুসায়ন। তারপর তিনি বললেন : এরা দু‘জন হলো আমার ছেলে এবং আমার মেয়ে। হে আল্লাহ! আমি এদের দু‘জনকে ভালবাসি, আপনিও তাদেরকে ভালোবাসুন। আর তাদেরকে যারা ভালোবাসে তাদেরকেও ভালোবাসুন।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’-৩/২৫১]

আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন ফাতিমা আয-যাহরা’র প্রতি বড় দয়া অনুগ্রহ করেছেন। তিনি তাঁর মাধ্যমে প্রিয় নবী মুস্তাফা (সা) বংশধারা সংরক্ষণ করেছেন। তেমনিভাবে ‘আলীর (রা) ঔরসে সর্বশেষ নবীর বংশধারা দান করে আল্লাহ তাঁকেও এক চিরকালীন সসম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। রক্ত সম্পর্কের দিক দিয়ে ‘আলী (রা) রাসূলুল্লাগর (সা) নিকটতম জামাই। তাঁর দেহে পরিচ্ছন্ন হাশেমী রক্ত বহমান ছিল। রাসূল (সা) ও ‘আলীর (রা) নসব ‘আবদুল মুত্তালিবে গিয়ে মিলিত হয়েছে। উভয়ে ছিলেন তাঁর পৌত্র। ‘আলীর (রা) পরবর্তীতে মুহাম্মাদ (সা) সেই পিতৃতুল্য চাচার ছেলে ‘আলীকে পিতৃস্নেহে পালন করে নিজের কলিজার টুকরা কন্যাকে তাঁর নিকট সোপর্দ কনে। সুতরাং রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট ‘আলীর (রা) স্থান ও মর্যাদা ছিল অত্যুচ্চে। ‘আলী (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে : একদিন আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) প্রশ্ন করলাম : আমি ও ফাতিমা- এ দু‘জনের কে আপনার বেশী প্রিয়? বললেন : ফাতিমা তোমর চেয়ে আমার বেশী প্রিয়। আর তুমি আমার নিকট তার চেয়ে বেশী সম্মানের পাত্র।

এ জবাবের মধ্যে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট ফাতিমা ও ‘আলীর (রা) স্থান ও মর্যাদা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ কারণে শত ব্যস্ততার মাঝে সুযোগ পেলেই তিনি ছুটে যেতেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় এই দম্পতির গৃহে এবং অতি আদরের দৌহিত্রদ্বয়কে কোলে তুলে নিয়ে স্নেহের পরশ বুলাতেন। একদিন তাঁদের গৃহে যেয়ে দেখেন, ‘আলী-ফাতিমা ঘুমিয়ে আছেন আর শিশু হাসান খাবারের জন্য কান্না জুড়ে দিয়েছে। তিনি তাঁদের দু‘জনের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে চাইলেন না। হাসানকে উঠিয়ে নিয়ে বাড়ীর আঙ্গিনায় বাধা একটি ছাগীর কাছে চলে যান এবং নিজ হতে ছাগীর দুধ দুইয়ে হাসানকে পান করিয়ে তাকে শান্ত করেন।

আর একদিনের ঘটনা। রাসূল (সা) ফাতিমা- ‘আলীর (রা) বাড়ীর পাশ দিয়ে ব্যস্ততার সাথে কোথাও যাচ্ছেন। এমন সময় হুসায়নের কান্নার আওয়াজ তাঁর কানে গেল। তিনি বাড়ীতে ঢুকে মেয়েকে তিরস্কারের সুরে বললেন : তুমি কি জন না, তার কান্না আমাকে কষ্ট দেয়?[ তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৬২৭]

কন্য যায়নাব ও উম্মু কুলছূমের জন্ম

এরপর এ দম্পতির সন্তান সংখ্যা বাড়তে থাকে। হিজরী ৫ম সনে ফাতিমর (রা) প্রথম কন্যার মা হন। নানা রাসূল (সা) তার নাম রাখেন “যায়নাব”। উল্লেখ্য যে, ফাতিমার এক সহোদরার নাম ছিল “যায়নাব”, মদীনায় হিজরাতের পর ইনতিকাল করেন। সেই যয়নাবের স্মৃতি তাঁর পিতা ও বোনের হৃদয়ে বিদ্যমান ছিল। সেই খালার নামে ফাতিমার এই কন্যার নাম রাখা হয়। এর দু‘বছর পর ফাতিমা (রা) দ্বিতীয় কন্যার মা হন। তারও নাম রাখেন রাসূল (সা) নিজের আরেক মৃত কন্যা উম্মু কুলছূমের নামে। এভাবে হযরত ফাতিমা (রা) তাঁর কন্যার মাধ্যমে নিজের মৃত দু‘বোনের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখেন। ফাতিমার (রা) এ চার সন্তানকে জীবিত রেখেই রাসূল (সা) আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের সান্নিধ্যে চলে যান।

ফাতিমার (রা) সব সন্তানই ছিল হযরত রাসূলে কারীমের (সা) কলিজার টুকরা্ বিশেষতঃ হাসান ও হুসায়নের মধ্যে তিনি যেন নিজের পরলোকগত পুত্র সন্তানদেরকে খুঁজে পান। তাই তাদের প্রতি ছিল বিশেষ মুহাব্বাত। একদিন তিনি তাদের একজনকে কাঁধে করে মদীনার বাজারে ঘরছেন। নামাযের সময় হলে তিনি মসজিদে ঢুকলেন এবং তাকে খুব আদরের সাথে এক পাশে বসিয়ে ইমাম হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলেন। কিন্তু এত দীর্ঘ সময় সিজদায় কাটালেন যে পিছনের মুক্তাদিরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। নামায শেষে কেউ একজন জিজ্ঞেস কসলো : ইয় রাসূলাল্লাহ! আপনি এত লম্বা সিজদা করেছেন যে, আমরা ধারণা করেছিলাম কিছু একটা ঘটেছে অথবা ওহী নাযিল হয়েছে। জবাবে তিনি বললেন : না, তেমন কিছু ঘটেনি। আসল ঘটনা হলো, আমার ছেলে আমার পিঠে চড়ে বসেছিল। আমি চেয়েছি তার ইচ্ছা পূর্ণ হোক। তাই তাড়াতাড়ি করিনি।[]

একদিন রাসূল্লাহ (সা) মিম্বরের উপর বসে ভাষণ দিচ্ছেন। এমন সময় দেখলেন হাসান হুসায়ন দুই ভাই লাল জামা পরে উঠা-পড়া অবস্থায় হেঁটে আসছে। তিনি ভাষণ বন্ধ করে মিম্বর থেকে নেমে গিয়ে তাদের দু‘জনকে উঠিয়ে সামনে এনে বসান। তারপর তিনি উপস্থিত জনমণ্ডলীকে লক্ষ্য করে বলেন : আল্লাহ সত্যই বলেছেন :[ সূরা আত-তাগাবুন-১৫] (আরবী=========)

‘তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পরীক্ষা বিশেষ।’

আমি দেখলাম, এই শিশু হাঁটছে আর পড়ছে। দৃশ্য দেখে সহ্য করতে না পেরে কথা বন্ধ করে তাদেরকে উঠিয়ে এনেছি।

আরেকদিন তো দেখা গেল, শিশু হুসায়নের দু‘কাঁধের উপর রাসূলের (সা) হাত। আর তার দ‘পা রাসূলের দু’পায়ের উপর। তিনি তাকে শক্ত করে ধরেবলছেন, উপরে বেযে ওঠো। হুসায়ন উপরের দিকে উঠতে উঠতে এক সময় নানার বুকে পা রাখলো। এবার তিনি হসায়নকে বললেন : মুখ খোল। সে হা করলো। তিনি তার মুখে চুমু দিলে বললেন : হে আল্লাহ! আমি তাকে ভালোবাসি এবং সেও আমাকে ভালবাসে। তাকে যারা ভালোবাসে আপনি তাদের ভালোবাসুন।[মুসলিম, আল-ফাদায়িল]

একদিন রাসূল (সা) কয়েকজন সাহাবীকে সংগে করে কোথাও দা‘ওয়াত খেতে যাচ্ছেন। পথে হুসায়নকে তার সমবয়সী শিশুদের সাথে খেলতে দেখলেন। রাসূল (সা) দু’হাত বাড়িয়ে তাকে ধরার জন্য এগিয়ে গেলেন। সে নানার হাতে ধরা না দেওয়ার জন্য একবার এদিক, একবার ওদিক পালাতে থাকে। রাসূল (সা) হাসতে হাসতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। এক সময় তাকে ধরে নিজের একটি হাতের উপর বসান এবং অন্য হাতটি তার চিবুকের নীচে রেখে তাকে চুমু দেন। তারপর বলেন : হুসায়ন আমার অংশ এবং আমি হুসায়নের অংশ।[তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৬৩০]

ফাতিমার বাড়ীর দরজায় আবূ সুফইয়ান

সময় গড়িয়ে চললো। ইসলামের আলোতে গোটা আরবের অন্ধকার বিদূরিত হতে চললো। এক সময় রাসূল (সা) মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। মদীনায় ব্যাপক সাড়া পড়ে দেল। নারী-পুরুষ সবাই এ অভিযানে অংশ নিবে। মক্কায় এ খবর সময় মত পৌঁছে গেল। পৌঁত্তলিক কুরায়শদের হৃদকম্পন শুরু হলো। তারা ভাবলো এবার আর রক্ষা নেই। অনেক কিছু চিন্তা-ভাবনার পর তারা মদীনাবাসীদেরকে তাদের সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রাখার জন্য আবূ সুফইয়ান ইবন হারবকে মদীনায় পাঠালো। কারণ, ইতোমধ্যে তাঁর কন্যা উম্মু হাবীবা রামলা (রা) ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং রাসূল (সা) তাঁকে বেগমের মর্যাদা দান করেছেন। সুতরাং তাঁকে দিয়েই এ কাজ সম্ভব হবে।

আলী ও ফাতিমা এ অভিাযানে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। যাত্রার পূর্বে একদিন রাতে তাঁরা সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। নানা স্মৃতি তাঁদের মানসপটে ভেসে উঠছে। মাঝে মাঝে তাঁরা স্মৃতিচরণও করছেন। আট বছর পূর্বে যে মক্কা তাঁরা পিছনে ফেলে চলে এসেছিলেন তা কি তেমনই আছে? তাঁদের স্মৃতিতে তখন ভেসে উঠছে মা খাদীজা (রা), পিতা আবূ তালিবের ছবি। এমনই এক ভাব-বিহ্বল অবস্থার মধ্যে যখন তাঁরা তখন অকস্মাৎ দরজায় টোকা পড়লো। এত রাতের আগুন্তুক কে তা দেখার জন্য ‘আলী (রা্য) দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। ফাতিমাও সে দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দরজা খুলতেই তাঁরা দেখতে পেলেন আবূ সুফইয়ান ইবন হারব দাঁড়িয়ে। এই সেই আবূ সুফইয়ান, যিনি মক্কার পৌত্তলিক বাহিনীর পতাকাবাহী এবং উহুদের শহীদ হযরত হামযার (রা) বুক ফেঁড়ে কলিজা বের করে চিবিয়েছিল যে হিন্দ, তার স্বামী।

আবূ সুফইয়ান বলতে লাগলেন, কিভাবে মদীনায় এসেছেন এবং কেন এসেছেন, সে কথা। বললেন : মক্কাবাসীরা মুহাম্মাদের (সা) আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য, তাঁর সাথে একটা আপোষরফা করার উদ্দেশে তাঁকে পাঠিয়েছে। তিনি নিজের পরিচয় গোপন করে মদীনায় ঢুকে পড়েছেন এবং সরাসরি নিজের কন্যা উম্মুল মু‘মিনীন উম্মু হাবীবা রামলার (রা) ঘরে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানে রাসূলুল্লাহর (সা) বিছানায় বসার জন্য উদ্যত হতেই নিজ কন্যার নিকট বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। কারণ, তিনি একজন অংশীবাদী, অপবিত্র। আল্লাহর রাসূলের (সা) পবিত্র বিছানায় বসার যোগ্যতা তাঁর নেই। কন্যা বিছানাটি গুটিয়ে নেন। মনে কথা বলেন, কিন্তু তাঁর নিকট থেকে কোন জবাব পাননি। আবূ বকরের (রা) নিকট থেকেও একই আচরণ লাভ করেন। তারপর যান ‘উমারের (রা) নিকট। তিনি তাঁর বক্তব্য শুনে বলেন : ইম যাব তোমার জন্য শুপারিশ করতে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট? আল্লাহর কসম! বূমিতে উদ্গত সামান্য উদ্ভিদ ছাড়া আর কিছুই যদি না পাই, তা দিয়েই তোমাদের সাথে লড়বো।[ইবন হিশা, আস-সীরাহ-৪/৩৮]

এ পর্যন্ত বলার পর আবূ সুফইয়ান একটু চুপ থাকলেন, তারপর একটা ঢোক গিলে ‘আলীকে (রা) লক্ষ্য করে বললেন : ওহে ‘আলী! তুমি আমার সম্প্রদায়ের প্রতি সবচেয়ে বেশী সদয়। আমি একটা প্রয়োজনে তোমার কাছে এসেছ। অন্যদের নিকট থেকে যেমন হতাশ হয়ে ফিরেছি, তোমার নিকট থেকে সেভাবে ফিরতে চাইনে। তুমি আমার জন্য একটু রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট সুপারিশ কর।

‘আলী (রা) বললেন : আবূ সুফইয়ান! তোমার অনিষ্ট হোক। আল্লাহর কসম! রাসূল (সা) একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। সে ব্যাপারে আমরা কোন কথা বলতে পারি না।

এবার আবূ ‍সুফইয়ান পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ফাতিমার দিকে তাকালেন এবং পাশের বিছানায় সদ্য ঘুম থেকে জাগা ও মায়ের দিকে এগিয়ে আসা হাসানের দিকে ইঙ্গিত করে ফাতিমাকে বললেন : ওহে ‍মুহাম্মাদের মেয়ে! তুমি কি তোমার এ ছেলেকে বলবে, সে যেন মানুষের মাঝে দাঁড়িযে তার গোত্রের লোকদের নিরাপত্তার ঘোষণা দিক এবং চিরকালের জন্য সমগ্র আরবের নেতা হয়ে থাক?

ফাতিমা জবাব দিলেন : আমার এই টুকু ছেলের মানুষের মাঝে দাঁড়িযে কাউকে নিরাপত্তা দানের ঘোষণা দেওয়ার বয়স হয়নি আর রাসূলুল্লাহকে (সা) ডিঙ্গিয়ে কেউ কাউকে নিরাপত্তা দিতে পারে না।

হাতশ অবস্থায় আবূ সুফইয়ান যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। দরজা পর্যন্ত গিযে একটু থামলেন। তারপর অত্যন্ত নরম সুরে বললেন : আবুল হাসান (‘আলী)! মনে হচ্ছে বিষয়টি আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে গেছে। তুমি আমাকে একটু পরামর্শ দাও।

‘আলী (রা) বললেন : আপনার কাজে আসবে এমন পরামর্শ আমার জানা নেই। তবে আপনি হলেন কিনানা (কুরায়শ গোত্রের একটি শাখা) গোত্রে নেতা। আপনি নিজেই জনমণ্ডলীর মাঝে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তার আবেদন করুন। তারপর নিজের জন্মভূমিতে ফিরে যান।

আবূ সুফইয়ান বললেন : এটা কি আমার কোন কাজে আসবে? ‘আলী (রা) কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন : আল্লাহর কসম! আমি তা মনে করি না। কিন্তু আমি তো আপনার জন্য এছাড়া আর কোন পথ দেখছিনে।

আবূ সুফইয়ান ‘আলীর (রা) পরামর্শ মত কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে গেলেন। আর এ দম্পতি ঘরের দরজা বন্ধ করে দিযে মহান আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের অসীম ক্ষমতার কথা ভাবতে লাগলেন। তাঁরা ভাবতে লাগলেন উম্মুল কুরা মক্কা, কা‘বা, কুরয়শদের বাড়ীঘর ইত্যাদির কথা।[তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৬৩৩]

মক্কা বিজয় অভিযানে ফাতিমা (রা)

দশ হাজার মুলমান সঙ্গীসহ রাসূল (রা) মদীনা থেকে মক্কার দিকে যাত্রা করলেন। আট বছর পূর্বে কেবল আবূ বকর সিদ্দীককে (রা) সঙ্গে নিয়ে রাতের অন্ধকারে মক্কা থেকে হিজরাত করে মদীনায় চলে আসেন। নবী পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে ফাতিমাও এই মহা বিজয় ও গৌরবজনক প্রত্যাবর্তন প্রত্যক্ষ করার জন্য এই কাফেলায় শরীক হলেন। আট বছর পূর্বে তিনি একদিন বড় বোন উম্মু কুলছূমের সাথে মক্কা ছেড়ে মদীনায় চলে এসেছিলেন। তাঁর অন্য দুই বোন রুকাইয়্যা ও যয়নাবও হিজরাত করেছিলেন। কিন্তু আজ এই বিজয়ী কাফেলায় তাঁরা নেই। তাঁরা মদীনার মাটিতে চিরদিনের জন্য শুয়ে আছেন। আর কোনদিন মক্কায় ফিরবেন না। অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ফাতিমা কাফেলার সাথে চলছেন। এক সময় কাফেলা “মাররুজ জাহরান” এসে পৌঁছলো এবং শিবির স্থাপন করলো। দিন শেষ হতেই রারে প্রথম বাগে মক্কার পৌত্তলিক বাহিনীর নেতা আবূ ‍সুফইয়ান ইবন হারব এসে উপস্থিত হলেন। মক্কাবাসীদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহর (সা) সিদ্ধান্ত জানার জন্য সারা রাত তিনি তাঁর দরজায় অপেক্ষা করলেন। ভোর হতেই তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। তারপর সেখান থেকে বের হয়ে সোজা মক্কার পথ ধরেন। মক্কায পৌঁছে একটা উঁচু টিলার উপর দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা দেন : ‘ওহে কুরায়শ বংশের লোকেরা! মুহাম্মাদ এমন এক বিশাল বাহিনী নিয়ে আসছেন যার সাথে তোমরা কখনো পরিচিত নও। যে ব্যক্তি আবু সুফইয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ, যে নিজ গৃহে দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে সে নিরাপদ, আর যে মসজিদে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ।’

ঘোষণা মুনে মক্কার অধিবাসীরা নিজ নিজ গৃহে এবং মসজিদুল হারামে ঢুকে পড়লো। রাসূল (সা) ‘যী তুওয়া’ –তে বাহনের পিঠে অবস্থান করে সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন বাগে বিভক্ত করে প্রত্যেক ভাগের একজন নেতা ও পতাকাবাহী হন সা‘দ ইবন ‘উবাদা আল-নানসারী (রা)। তিনি আবার ‘আলীকে (রা) বলেন : ‘পতাকাটি খায়বারে, বানী কুরায়জার যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর (সা) এবং উহুদ যুদ্ধে মুহাজিরদের পতাকাবাহী ছিলেন।[তাবাকাত -/২৭, ৭৭]

মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল (সা) ‘আযাখির’ –এর পথে মক্কায় প্রবেশ করে মক্কার উঁচু ভূমিতে অবতরণ করেন। উম্মুল মু‘মিনীন হযরত খাদীজার (রা) কবরের অনতিদূরে তাঁর জন্য তাঁবু স্থাপন করা হয়। সঙ্গে কন্যা ফাতিমা আয-যাহরাও ছিলেন। মক্কা থেকে যেদিন ফাতিমা (রা) মদীনায় যাচ্ছিলেন সেদিন আল-হুওয়ায়রিছ ইবন মুনকিয তাঁকে তাঁর বাহনের পিঠ থেকে ফেলে দিয়ে জীবন বিপন্ন করে ফেলেছিল। সেই স্মৃতি তাঁর দীর্ঘদিন পর জন্মভূমিতে ফিরে আসার আনন্দকে ম্লান করে দিচ্ছিল। রাসূলও (সা) সে কথা ভোলেননি। তিনি বাহিনীকে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে একজন পরিচালক নির্ধারণ করে বলেন, এরা যদি কা‘বার গিলাফের নীচেও আশ্রয নেয় তাহলেও তাদের হত্যা করবে। তাদের মধ্যে আল-‘জুয়ায়রিছ ইবন মুনকিযও ছিল। তাকে হত্যার দায়িত্ব অর্পিত হয় হযরত ফাতিমার (রা) স্বামী ‘আলীর (রা) উপর।[তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৬৩৫]

রাসূলুল্লাহর (সা) চাচাতো বোন উম্মু হানী বিনত আবী তালিব, মক্কার হুবায়রা ইবন আবী ওয়াহাবের স্ত্রী্ তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কার উঁচু ভূমিতে অবতরণ করার পর বানূ মাখযূনের দুই ব্যক্তি আল-হারিছ ইবন হিশাম ও যুহায়র ইবন আবী উমাইয়্যা ইবন আল-মুগীরা পালিয়ে আমার গৃহে আশ্রয় নেয়। আমার ভাই ‘আলী ইবন আবী তালিব (রা) আমার সাথে দেখা করতে এসে তাদেরকে দেখে ভীষণ ক্ষেপে যান। আল্লাহর নামে কসম করে তিনি বলেন : আমি অবশ্যই তাদেরকে হত্যা করবো। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট ছুটে গেলাম। সেখানে পৌঁছে দেখি, তিনি একটি বড় পাত্রে পানি নিয়ে গোসর করছেন এবং ফাতিমা তাঁকে কাপড় দিয়ে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছেন। রাসূল (সা) গোসল সেরে আট রাক‘আত চাশতের নামায আদায় করলেন, তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন : উম্মু হানী, কি জন্য এসেছো? আমি তাঁকে আমার বাড়ীর ঘটনাটি বললাম। তিনি বললেন : তুমি যাদের আশ্রয় দিয়েছো আমিও তাদের আশ্রয় দিলাম। যাদের তুমি নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছো আমিও তাদের আশ্রয় দিলাম। যাদের তুমি নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছো আমিও তাদের নিরাপত্তা দান করলাম। ‘আলী তাদের হত্যা করবে না।[প্রাগুক্ত; সাহীহ মুসলিম : সালাতুল মুসাফিরীন]

মক্কায় হযরত ফাতিমার (রা) প্রথম রাতটি কেমন কেটেছিল সে কতাও জানা যায়। তিনি বেশ আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। প্রিয়তমা মায়ের কথা, দুই সহোদরা যায়নাব ও রুকাইয়্যার স্মৃতি তাঁর মানসপটে ভেসে উঠছিল। মক্কার অধিবাসীরা তাঁর পিতার সঙ্গে যে নির্মম আচরণ করেছিল সে কথা, মক্কায় নিজের শৈশব-কৈশোরের নানা কথা তাঁর স্মৃতিতে ভেসে উঠছিল। সারা রাত তিন দু‘চোখের পাতা এক করতে পারেননি। প্রভাতে মসজিদুল হারাম থেকে বিলালের কণ্ঠে ফজরের আযান ধ্বনিত হলো। ‘আলী (রা) শয্যা ছেড়ে নামাযে যাবার প্রস্তুতির মধ্যে একবার প্রশ্ন করলেন : হাসানের মা, তুমি কি ঘুমাওনি? তিনি একটা গভীর আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠে জবাব দিলেন : আমি সম্পূর্ণ সজাগ থেকে বিজয়ীবেশে এ প্রত্যাবর্তনকে উপভোগ করতে চাই। গুমিয়ে পড়লে গোটা ব্যাপারটিই না জানি স্বপ্ন বলে ভ্রম হয়।

এরপর তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে যান। নামায শেষে একটু ঘুমিয়ে নেন। ঘুম থেকে উঠে সেই বাড়ীটিতে যাওয়ার ইচ্ছা করেন যেখান তাঁর জন্ম হয়েছিল। যে বাড়ীটি ছিল তাঁর নিজের ও স্বামী ‘আলীর শৈশব-কৈশোরের চারণভূমি। কিন্তু সেই বাড়ীটি তাঁদের হিজরাতের পর ‘আকীল ইবন আবী তালিবের অধিকারে চলে যায়। মক্কা বিজয়ের সময়কালে একদিন উসামা ইবন যায়িদ (রা) রাসূলকে (সা) জিজ্ঞেস করেন : মক্কায় আপনারা কোন বাড়ীতে উঠবেন? জবাবে তিনি বলেন : ‘আকীল কি আমাদের জন্য কোন আবাসস্থল বা ঘর অবশিষ্ট রেখেছে?

এই সফরে তাঁর দু‘মাসের বেশী মক্কায় অবস্থান করা হয়নি। অষ্টম হিজরীর রামাদান মাসে মক্কায আসেন এবং একই বছর যুল কা‘দা মাসের শেষ দিকে ‘উমরা আদায়ের পর পিতার সাথে মদীনায় ফিরে যান। এ সময়ে তিনি জান্নাতবাসিনী মা খাদীজার (রা) কবরও যিয়ারাত করেন।

হিজরী নবম সনে রাসূলুল্লাহর (সা) তৃতীয় কন্য, হযরত ‘উছমানের (রা) স্ত্রী উম্মু কুলছূম (রা) ইনতিকাল করেন। দশম হিজরীতে রাসূলুল্লাহর (সা) স্ত্রী মারিয়া আল-কিবতিয়্যার গর্ভজাত সন্তান হযরত ইবরাহীমও ইহলোক ত্যাগ করেন। এখন রাসূলুল্লাহর (সা) সন্তানদের মধ্যে একমাত্র ফাতিমা আয-যাহরা ছাড়া আর কেউ জীবিত থকলেন না।

পিতা অন্তিম রোগশয্যায়

এর পরে এলো সেই মহা মুসীবতের সময়টি। হিজরী ১১ সনের সফর মাসে ফাতিমার (রা) মহান পিতা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। নবী পরিবারের এবং অন্য মুসলমানরা ধারণা করলেন যে, এ হয়তো সামান্য অসুস্থতা, কুব শীঘ্রই সেরে উঠবেন। কেউ ধারণা করলেন না যে এ তাঁর অন্তিম রোগ। পিতা মেয়েকে ডেকে পাঠালেন। সঙ্গে সঙ্গে পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর গৃহের দিকে বেরিয়ে পড়লেন। রাসূলের (সা) শয্যাপাশে তখন হযরত ‘আয়িশা (রা) সহ অন্য বেগমগণ বসা। এ সময় ধীর স্থির ও গম্ভীরবাবে কন্যা ফাতিমাকে এগিয়ে আসতে দেখে পিতা তাঁকে স্বাগতম্ জানালেন এবাবে-

(আরবী====) আমার মেয়ে! স্বাগতম্ তারপর তাঁকে চুমু দিয়ে ডা পাশে বসান এবং কানে কানে বলেন, তাঁর মরণ সময় ঘনিযে এসেছে। ফাতিমা কেঁদে ফেলেন। তাঁর সেই কান্না থেমে যায় যখন পিতা তাঁর কানে কানে আবার বলেন : [তাবাকাত-৮/১৬‘ বুখারী : বাবু ‘আলামাত আন-নুবুওয়াহ; মুসলিম : ফাদায়িল আস-সাহাবা; কানয আল-‘উম্মাল-১৩/৬৭৫] (আরবী======)

‘আমার পরিবারবর্গের মধ্যে তুমি সর্বপ্রথম আমার সাথে মিলিত হবে। ফাতিমা! তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, ঈমানদার মহিলাদের নেত্রী হও?’ অথবা রাসূল (সা) একথা বলেন, ‘তুমি এই উম্মাতের মহিলাদের নেত্রী হও তাতে কি সন্তুষ্ট নও?’

এ কথা শোনার সংগে সংগে ফাতিমার মুখমণ্ডলে আনন্দের আভা ফুটে উঠলো। তিনি কান্না থামিয়ে হেসে দিলেন। তাঁর এমন আচরণ দেখে পাশেই বসা হযরত ‘আয়িশা (রা) বিস্মিত হলেন। তিনি মন্তব্য করেন । (আরবী=======)

‘দুঃখের অধিক নিকটবর্তী আনন্দের এমন দৃশ্য আজকের মত আর কখনো দেখিনি।’

পরে তিনি ফাতিমাকে এক সুযোগে জিজ্ঞেস করেন : তোমার পিতা কানে কানে তোমাকে কি বলেছেন? জবাবে তিনি বললেন : আমি রাসূলুল্লাহর (সা) গোপন কথা প্রকাশ করতে পারিনে।[তাবাকাত-৮/১৬]

পিতার রোগের এ অবস্থা দেখে ফাতিমা (রা) সেদিন নিজের বাড়ী ফিরে গেলেন্ এদিকে রাসূল (সা) এ রোগের মধ্যেও নিয়ম অনুযায়ী পালাক্রমে উম্মাহাতুল মু‘মিনীন (বেগম)দের ঘরে অবস্থান করতে লাগলেন। যেদিন তিনি উম্মুল মু‘মিনীন মায়মূনা বিনত আল-হারিছ আল-হিলালিয়্যার (রা) ঘরে সেদিন তাঁর রোগের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। তিনি অন্য বেগমদের ডেকে পাঠান। তাঁরা উপস্থিত হলে তিনি এ অসুস্থ অবস্থায় হযরত ‘আয়িশার (রা) গৃহে অবস্থানের অনুমতি চান এবং তাঁদের অনুমতি লাভ করেন।

নবী কন্যা ফাতিমা (রা) সব সময়,এমনটি রাত জেগে অসুস্থ পিতার সেবা-শুশ্রূষা করতে থাকেন। ধৈয্যের সাথে সেবার পাশাপাশি অত্যন্ত বিনয় ও বিনম্রভাবে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের দরবারে পিতার সুস্থতার জন্র দু‘আ করতে থাকেন। এত কিছুর পরেও যখন উত্তরোত্তর রোগের প্রকোপ বেড়ে যেতে লাগলো এবং কষ্টের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়ে চললো, ফাতিমা (রা) তখন হাতে পানি নিয়ে অত্যন্ত দরদের সাথে পিতার মাথায় দিতে থাকেন। পিতার এ কষ্ট দেখে কান্নায় কণ্ঠরোধ হওয়ার উপক্রম হয়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে অনুচ্চ স্বরে উচ্চারণ করেন : আব্বা! আপনার কষ্ট তো আমি সহ্য করতে পারছিনে। পিতা তাঁর দিকে স্নেহমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে অত্যন্ত দরদের সাথে উত্তর দেন কক: আজকের দিনের পর তোমার আব্বার আর কোন কষ্ট নেই।[বুখারী : বাবু মারদিহি ওয়া ওফাতিহি (সা) : ফাতহুল বারী-৮/১০৫; মুসনাদে আহমাদ-৩/১৪১; তাবাকাত-২/২]

কন্যাকে দুঃখের সাগরে বাসিযে পিতা মহাপ্রভুর সান্নিধ্যে যাত্রা করলেন। আজ ফাতিমা (রা) সত্যিকারভাবে পিতৃ-মাতৃহারা এক দুঃখী এতীমে পরিণত হলেন। এ দুঃখ-বেদনায় সান্ত্বনা লাভের কোন পথই তাঁর সামনে ছিল না।

পিতাকে হারিয়ে ফাতিমা (রা) দানুণভাবে শোকাতুর হয়ে পড়লেন। এ অবস্থায় দু‘দিনের মধ্যেই সাকীফা বানূ সা‘ইদা চত্বরে খলীফা হিসেবে হযরত আবূ বকরের (রা) হাতে বায়‘আত সম্পন্ন হয়্ ফাতিমা (রা) তাঁর বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থাকে একটু সামলে নিয়ে ধীর পদক্ষেপে পিতার কবরের নিকট যান এবং কবর থেকে এক মুঠ মাটি উঠিয়ে নিয়ে অশ্রু বিগলিত দু‘চোখের উপর বুলিয়ে দেন। তারপর তার ঘ্রাণ নিতে নিতে নিম্নের চারণ দু‘টি আওড়াতে থাকেন।[সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা’ -২/১৩৪; আ‘লাম আন-নিসা’-৪/১১৪] (আরবী======)

‘যে ব্যক্তি আহমাদের কবরের মাটির ঘ্রাণ নেয় সারা জীবন সে যেন আর কোন সুগন্ধির ঘ্রাণ না নেয়। আমার উপর যে সকল বিপদ আপতিত হয়েছে যদি তা হতো দিনের উপর তাহলে তা রাতে পরিণত হতো।’

হযরত সাহাবায়ে কিরাম (রা) হযরত রাসূলে কারীমের (সা) দাফন-কাফন শেষ করে হযরত ফাতিমার (রা) নিকট আসেন তাকে সান্ত্বনা দানের জন্য। তিনি হযরত আনাসকে (রা) জিজ্ঞেস করে বসেন : আপনারা কি রাসূলুল্লাহকে (সা) মাটিতে ঢেকে দিতে আপনাদের অন্তর সায় দিল কেমন করে? তারপর তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) স্মরণে নিম্নের চরণগুলো আবৃত্তি করেন : [উসুদুল গাবা-৫/৫৩২; আ‘লাম আন-নিসা’ -৪/১১৩](আরবী=====)

আকাশের দিগন্ত ধুলিমলিন হয়ে গেছে, মধ্যাহ্ন-সূর্য ঢাকা পড়ে গেছে এবং যুগ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে।

নবীর (সা) পরে ভূমি কেবল বিষণ্ণ হয়নি, বরং দুঃখের তীব্রতায় বিদীর্ণ হয়েছে।

তার জন্য কাঁদছে পূর্ব-পশ্চিম, মাতম করছে সমগ্র মুদার ও ইয়ামান গোত্র।

তাঁর জন্য কাঁদছে বড় বড় পাহাড়-পর্বত ও বিশালকায় অট্টালিকাসমূহ্

হে খাতামুন নাবিয়্যীন, আল্লাহর জ্যোতি আপনার প্রতি বর্ষিত হোক্ আল-কুর‘আনের নাযিলকারী আপনার প্রতি করুণা বর্ষণ করুন।’

অনেকে উপরোক্ত চরণগুলো হযরত ফাতিমার (রা), আর পূর্বোক্ত চরণগুলো ‘আলীর রচিত বলে উল্লেখ করেছেন।[সাহাবিয়াত-১৫০]

হযরত ফাতিম (রা) পিতার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এ চরণ দুটিও আবৃত্তি করেন :[ আ‘লাম আন-নিসা’ -৪/১১৪] (আরবী======)

‘ভূমি ও উট হারানোর মত আমরা হারিয়েছি আপনাকেেআপনার অদৃশ্য হওয়ার পর ওহী ও কিতাব

আমাদের থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছ্

হায়! আনার পূর্বে যদি আমাদের মৃত্যু হতো! আপনার মৃত্যু সংবাদ শুনতাতে হতো না এবং মাটির ঢিবিও আপনার মাঝে অন্তরায় হতো না। বিয়ের পরেও হযরত ফাতিমা (রা) পিতার সংসারের সকল বিষয়ের খোঁজ-খবর রাখতেন। অনেক সময় তাঁর সৎ মা‘দের ছোটখাট রাগ-বিরাগ ও মান-অভিমানের ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করতেন। যেমন হযরত রাসূলে কারী (সা) উম্মুল মু‘মিনীন ‘আয়িশাকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। একথা গোটা সাহাবী সমাজের জানা ছিল। এ কারণে রাসূল (সা) যেদিন ‘আয়িশার (রা) ঘরে কাটাতেন সেদিন তারা বেশী বেশী হাদিয়া-তোহফা পাঠাতেন। এতে অন্য বেগমগণ ক্ষুব্ধ হতেন । তাঁরা চাইতেন রাসূল (সা) যেন লোকদের নির্দেশ দেন, তিনি যেদিন যেখানে থাকেন লোকেরা যেন সেখানেই যা কিছু পাঠাবার পাঠায়। কিন্তু সে কথা রাসূলকে (সা) বলার হিম্মত কারো হতো না। এই জন্য তাঁরা সবাই মিলে তাঁদের মনের কথা রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাসূলে কারীমের (সা) কলিজার টুকরা ফাতিমাকে (রা) বেছে নেন। রাসূল (সা) ফাতিমার (রা) বক্তব্য শুনে বললেন, ‘মা, আমি যা চাই, তুমি কি তা চাও না?’ ফাতিমা (রা) পিতার ইচ্ছ বুঝতে পারলেন এবং ফিরে এলেন। তাঁর সৎ মায়েরা আবার তাঁকে পাঠাতে চাইলেন : কিন্তু তিনি রাজি হলেন না।[বুখারী : ফাদায়িলু ‘আয়িশা (রা) ; মুসলিম : ফাদায়িলুস সাহাবা (২৪৪১); আসহাবে রাসূলের জীবনকথা-৫/৭৩]

জিহাদের ময়দানে

জিহাদের ময়দানে হযরত ফাতিমার (রা) রয়েছে এক উজ্জ্বল ভূমিকা। উহুদ যু্দ্ধে হযরত রাসূলে কারীম (সা) দেহে ও মুখে আঘাত পেয়ে আহত হলেন। পবিত্র দেহ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কোন কিছুতে যখন রক্ত বন্ধ করা যাচ্ছিল না তখন ফাতিমা (রা) খেজুরের চাটাই আগুনে পুড়িয়ে তার ছাই ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেন।[আনসাব আল-আশরাফ-১/৩২৪] এ প্রসঙ্গে ইমার আল-বায়হাকী বলেন : মুহাজির ও আনসার নারীগণ উহুদের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলেন। তাঁরা তাঁদের পিঠে করে পানি ও খাদ্য বহন করে নিয়ে গেলেন। তাঁদের সঙ্গে ফাতিমা বিনত রাসূলুল্লাহ (সা)ও বের হন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে তিনি যখন পিতাকে রক্তরঞ্জিত অবস্থায় দেখলেন, তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন্ তাঁর মুখমণ্ডল থেকে রক্ত মুছতে লাগলেন। আর রাসূলুল্লহর (সা) মুখ থেকে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল; [আল-বায়হাকী : দালায়িল আন-নুবুওয়াহ-৩/২৮৩] (আরবী========)

‘আল্লাহর শক্ত ক্রোধ পতিত হয়েছে সেই জাতির উপর যারা আল্লাহর রাসূলের (সা) মুখমণ্ডলকে রক্তরঞ্জিত করেছে।’

উহুদে হযরত ফাতিমার (রা) ভূমিকার বর্ণনা দিতে গিয়ে মহান সাহাবী সাহল ইবন সা‘দ বলেছেন : রাসূল (সা) আহত হলেন, সামনের দাঁর ভেঙ্গে গেল, মাথায় তরবারি ভাঙ্গা হলো, ফাতিমা বিনত রাসূলুল্লাহ (সা) রক্ত ধুতে লাগলেন, আর ‘আলী (রা) ঢালে করে পানি ঢালতে লাগলেন। ফাতিমা (রা) যখন দেখলেন, যতই পানি ঢালা হচ্ছে ততই রক্ত বেশী বের হচ্ছে তখন তিনি একটি চাটাই উঠিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করলেন- এবং সেই ক্ষতস্থানে লাগালেন। আর তখন রক্তপড়া বন্ধ হয়। [আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৪/৩৯; তাবাকাত-২/৪৮; বুখারী : আল-মাগাযী; মুসলিম : আল-হুদূদ ওয়াস সিয়ার]

উহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর (সা) চাচা ও ফাতিমার (রা) দাদা হযরত হামযা (রা) শহীদ হন। তিনিই হযরত ফাতিমার (রা) বিয়ের সময় ওলীমা অনুষ্ঠান করে মানুষকে আহার করান। ফাতিমা (রা) তাঁর প্রতি দারুণ মুগ্ধ ছিলেন। তিনি আজীবন হযরত হামযার (রা) কবর যিয়ারত করতেন এবং তাঁর জন্য কেঁদে কেঁদে আল্লাহর দরবারে দু‘আ করতেন।[আল-বায়হাকী : দালায়িল আল-নুবুওয়াহ; আল-ওয়াকিদী : আল-মাগাযী-২/৩১৩]

অন্যান্য যুদ্ধেও হযরত ফাতিমার (রা) যোগদানের কথা জানা যয়। যেমন খন্দক ও খায়বার অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। এই খায়বার বিজয়ের পর তথাকার উৎপাদিত গম থেকে তাঁর জন্য রাসূল (সা) ৮৫ ওয়াসক নির্ধারণ করে দেন। মক্কা বিজয়েও তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সফরসঙ্গী হন। মূতা অভিযানে রাসূল (সা) তিন সেনাপতি-যায়দ ইবন আল-হারিছা, জা‘ফর ইবন আবী তালিব ও ‘আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাকে (রা) পাঠান। একের পর এক তাঁরা তিনজনই শহীদ হলেন। এ খবর মদীনায় পৌঁছলে ফাতিমা (রা) তাঁর প্রিয় চাচা জা‘ফরের (রা) শোকে ‘ওয়া আম্মাহ্’ বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা) সেখানে উপস্থিত হন এবং মন্তব্য করেন ‘যে কাঁদতে চায় তার জা‘ফরের মত মানুষের জন্য কাঁদা উচিত।’ [নিসা‘ মুবাশশারাত বিল জান্নাহ-২১৪]

হযরত ফাতিমার (রা) মর্যাদা

তাঁর মহত্ব, মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য অনেক। নবী পরিবারের মধ্যে আরো মর্যাদাবান ব্যক্তি আছেন। কিন্তু তাঁদের মাঝে হযরত ফাতিমার (রা) অবস্থান এক বিষেশ মর্যাদাপূর্ণ আনে। সূরা আল-আহযাবের আয়াতে তাতহীর (পবিত্রকরণের আয়াত) এর নুযূল হযরত ফাতিমার (রা) বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করেন। [সূরা আল-আহযাব-৩৩] (আরবী=========)

‘হে নবী-পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণবূপে পবিত্র করতে।’

উম্মুল ম‘মিনীন হযরত ‘আয়িশা (রা) বলেন : [মুখতাসার তাফসীর ইবন কাছীর -৩/৯৪] (আরবী========)

‘আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) দেখলাম, তিনি আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসায়নকে (রা) ডাকলেন এবং তাদের মাথার উপর একখানা কাপড় ফেলে দিলেন। তারপর বললেন : হে আল্লাহ! এরা আমার পরিবারের সদস্য। তাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করে দিন এবং তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করুন!’

হযরত আনাস ইবন মালিক (রা) বলেন, রাসূল (সা) এ আয়াত নাযিলের পর ছয়মাস পর্যন্ত ফজরের নামাযে যাওয়ার সময় ফাতিমার (রা) ঘরের দরজা অতিক্রম করাকালে বলতেন : আরবী===================

‘আস্-সালাত, ওহে নবী-পরিবার! আস-সালাত।’

তারপর তিনি পাঠ করতেন :[ উসুদুল গাবা, জীবনী ন!-৭১৭৫; আদ-দুররুল মানছূর -৬/৬০৫; নিসা‘ মুবাশশারাত বিল জান্নাহ্-২১৯] আরবী=============

ইমাম আহমাদ (রা) হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। নবী (সা) ‘আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসায়নের (রা) দিকে তাকালেন, তারপর বললেন :[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’ -২/১২৩] আরবী================

‘তোমাদের সঙ্গে যে যুদ্ধ করে আমি তাদের জন্র যুদ্ধ, তোমরদের সাষে যে শান্তি ও সন্ধি স্থাপন কর আমি তাদের জন্য শান্তি।’

এই নবী পরিবার সম্পর্কে হযরত রাসূলে কারীমের (সা) অন্য একটি বাণীতে এসেছে : [প্রাগুক্ত ](আরবী**********)

‘যে কেউ ‘আহলি বায়ত’ বা নবী-পরিবারের সাথে দুশমনি করবে আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।’

হিজরী ৯ম সনে নাজরানের একটি খ্রীষ্টান প্রতিনিধি দল হযরত রাসূলে কারীমের (সা) নিকট আসে এবং হযরত ‘ঈসার (আ) ব্যাপারে তারা অহেতুক বিতর্কে লিপ্ত হয়। তখন নাযিল হয় আয়াকে ‘মাবাহালা’। মাবাহালার অর্থ হলো, যদি সত্য ও মিথ্যার ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয় এবং যুক্তিতর্কে মীমাংসা না হয়, তাহলে তারা সকলে মিলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, যে পক্ষ এ ব্যাপারে মিথ্যাবাদী, সে যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এভাবে প্রার্থনা করাকে ‘মুবাহালা’ বলা হয়। এই মুবাহালা বিতর্ককারীরা একত্রিত হয়ে করতে পারে এবং গুরু ত্ব বাড়ানোর জন্য পরিবার-পরিজনকেও একত্রিত করতে পারে। মাহাবালার আয়াতটি হলো :[ সূরা আলে ইমরান-৬১](আরবি*********)

‘তোমার নিকট জ্ঞান আসার পর যে কেউ এ বিষয়ে তোমার সাথে তর্ক করে তাকে বল এসো, আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রগণকে, তোমাদের পুত্রগণকে, আমাদের নারীগণকে, তেহামাদের নারীগণকে, আমাদের নিজদিগকে ও তোমাদের নিজদিগকে, অতঃপ আমরা বিনীত আবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের উপর দেই আল্লাহর লা‘নত।’

এ আয়াত নাযিলের পর হযরত রাসূলে কারীম (সা) প্রতিনিধি দলকে মুহাবালার আহ্বান জানান এবং নিজেও ফাতিমা, আলী, হসান ও হুসায়নকে (রা) সঙ্গে নিয়ে মুবাহালার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসেন এবং বলেন : (আরবী********) ‘হে আল্লাহ! এই আমার পরিবার-পরিজন। আপনি তাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করে তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করুন।’ এ কথাগুলো তিনবার বলার পর উচ্চারণ করেন :[ সহীহ মুসরিম : ফাদায়িল আস-সাহাবা; মুনসাদ-৪/১০৭; মুখতাসার তাফসীর ইবন কাছীর- ১/২৮৭-২৮৯] (আরবী***********)

‘হে আল্লাহ আপনি আপনার দয়া ও অনুগ্রহ মুহাম্মাদের পরিবার-পরিজনকে দান করুন যেমন আপনি করেছেন ইবরাহীমের পরিবার-পরিজনকে। নিশ্চয় আপনি প্রশংসিত ও সম্মানিত।’

হযরত রাসূলে কারীম (সা) একদিন ফাতিমাকে (রা) বলেন :[ তাহযীব আত-তাহযীব -১২/৪৪২; আল-ইসাবা-৪/৩৬৬] (আরবী********)

‘আল্লাহ তা‘আলা তোমার খুশীতে খুশী হন এবং তোমার অসন্তুষ্টিতে অসন্তুষ্ট হন।’

রাসূল (সা) যখন কোন যুদ্ধ বা সফর থেকে ফিরতেন তখন প্রথমে মসজিদে যেয়ে দুই রাক‘আত নামায আদায় করতেন। তারপর ফাতিমার ঘরে গিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাত করে বেগমদের নিকট যেতেন।[উসুদুল গাবা-৫/৫৩৫]

একবার হযরত ফাতিমা (রা) অসুস্থ হলে রাসূল (রা) দেখতে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন : মেয়ে! কেমন আছ?

ফাতিমা বললেন : মেয়ে! তুমি বিশ্বের সকল নারীর নেত্রী হও এতে কি সন্তুষ্ট নও?

ফাতিমা বললেন : আব্বা! তাহলে মারয়াম বিনত ইমরানের অবস্থান কোথায়?

জবাবে রাসূল (সা) বললেন : তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের নারীদের নেত্রী, আর তুমি হবে তোমার সময়ের নারীদের নেত্রী।

আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতের একজন নেতার সাথে বিয়ে দিয়েছি

হযরত রাসূলে কারীম (সা) তাঁকে –(আরবী*********)

‘জান্নাতের অধিবাসী নারীদের নেত্রী হলেন ক্রমানুসারে মারয়ম, ফাতিমা বিনত মুহাম্মাদ (সা), খাদীজা ও পির‘আওনের স্ত্রী আসিয়া।’

একবার রাসূল (সা) মাটতে চারটি রেখা টানলেন, তারপর বললেন, তোমরা কি জান এটা কি? সবাই বললো : আল্লাহর ও তাঁ রাসূলই (সা) ভালো জানেন। তিনি বললেন : ফাতিমা কিন্ত মুহাম্মাদ, খাদীজা বিনত খুওয়ইদিলদ, মারয়াম বিনত ‘ইমরান ও আসিয়া বিনত মুযাহিম (ফির‘আওনের স্ত্রী)। জান্নাতের নারীদের উপর তাদের রয়েছে এক বিশেষ মর্যাদা।

হযরত ফাতিমা (রা) ব্যক্তিত্বের প্রতি যে এক বিশেষ বৈশিষ্ট আরোপ করা হয়েছে তা রাসূলের (সা) এই হাদীছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে :[ তিরমিযী; আল-মানকিব] (আরবী********)

‘প্রথিবীর নারীদের মধ্যে তোমার অনুসরণের জন্য মারয়াম, খাদীজা, ফাতিমা ও ফির‘আওনের স্ত্রী আসিয়া যথেষ্ট।’

হযরত রাসূলে কারীমের (সা) সবটেয়ে বেশী স্নেহের ও প্রিয় পাত্রী ফিলেন ফাতিমা (রা)। একবার রাসূলকে (সা) জিজ্ঞেস করা হলো : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার সবচেয়ে বেশী প্রিয় মানুষটি কে? বললেন : ফাতিমা। ইমাম আয-যাহাবী বলেন : (আরবী*****)

‘নারীদের মধ্যে রাসূলুল্লাহর (সা) সবচেয়ে বেশী প্রিয় ছিলেন ফাতিমা (রা) এবং পুরুষদের মধ্যে আলী (রা)।’

একবার হযরত আলী (রা) রাসূলকে (সা) জিজ্ঞেস করলেন : ফাতিমা ও আমি এ দুইজনের মধ্যে কে আপনার সবচেয়ে বেশী প্রিয়। বললেন : তোমারর চেয়ে ফাতিমা আমার বেশী প্রিয়।[নিসা‘ মুবাশশারাত বিল জান্নাহ্-২১৬]

আল্লাহর প্রিয় পাত্রী

হযরত ফাতিমা যে, আল্লাহরও প্রিয় পাত্রী ছিলেন কোন কোন অলৌকিক ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে একবার সামান্য খাদ্যে আল্লাহ যে বরকত ও সমৃদ্ধি দান করেছিলেন তা উল্লেখ করা যায়। বিভিন্ন সূত্রে ঘটনাটি যেভাবে বর্ণিদ হয়েছে তার সারকথা হলো, একদিন তাঁর এক প্রতিবেশিনী তাঁকে দুইটি রুটি ও এক খণ্ড গোশত উপহার হিসেবে পাঠালো। তিনি সেগুলো একটি থালায় ঢেকে ঢেকে দিলেন। তারপর সাসূলকে (সা) ডেকে আনার জন্য ছেলেকে পাঠালেন। রাসূল(সা) আসলেন এবং ফাতিমা (রা) তাঁর সামনে থালাটি উপস্থাপন করলেন। এরপরের ঘটনা ফাতিমা (রা) বর্ণনা করেছেন এভাবে :

আমি থালাটির ঢাকনা খুলে দেখি সেটি রুটি ও গোশতে পরিপূর্ণ। আমি দেখে তো বিস্ময়ে হতবাক! বুঝলাম, এ বরকত আল্লাহর পক্ষ থেকে। আমি । আল্লাহর প্রশংসা করলাম এবং তাঁর নবীর উপর দরূদ পাঠ করলাম। তারপর খাদ্য ভর্তি থালাটি রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে উপস্থাপন করলাম। তিনি সেটি দেখে আল্লাহর প্রশংসা করে প্রশ্ন করলেন : মেয়ে! এ খাবার কোথা থেকে এসেছে?

বললাম : আব্বা : আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করেন।

রাসূল (সা) বললেন : আমার প্রিয় মেয়ে! সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি তোমাকে বনী ইসরাঈলের নারীদের নেত্রীল মত করেছেন। আল্লাহ যখন তাঁকে কোন খাদ্য দান করতেন এবং সে সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হতো, তখন তিনি বলতেন : এ আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। নিশ্চয় আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করেন।

সেই খাবার নবী করীম (সা), ‘আলী, ফাতিমা, হাসান, হুসায়ন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) সকল বেগম খান। তাঁরা সবাই পেট ভরে খান। তারপরও থালার খাবার একই রকম থেকে যায়। ফাতিমা সেই খাবার প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। আল্লাহ সেই খাবারে প্রচুর বরকত ও কল্যাণ দান করেন। [আল-বিদায়অ ওয়ান নিহায়া-৬/১১১; হায়াত আস-সাহাবা-৩/৬২৮; তাফসীর ইবন কাছীর -৩/৩৬০]

নবী কারীম (সা) একবার দু‘আ করেন, আল্লাহ যেন ফাতিমাকে ক্ষুধার্ত না রাখেন। ফাতিমা বলেন, তারপর থেকে আমি আর কখনো ক্ষধার্ত হইনি। ঘটনাটি এরকম :

একদিন রাসূল (সা) ফাতিমার (রা) ঘরে গেলেন। তখন তিনি যাতায় গম পিষছিলেন। গায়ে ছিল উটের পশমে তৈরী কাপড়। মেয়ের এ অবস্থা দেখে পিতা কেঁদে দেন এবং বলেন :‘ফাতিমা! আখিরাতের সুখ-সম্ভোগের জন্য দুনিয়ার এ তিক্ততা গিলে ফেল।’

ফাতিমা উঠে পিতার সামনে এসে দাঁড়ালেন। পিতা কন্যার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, প্রচন্ড ক্ষুধায় তার মুখমণ্ডল রক্তশূন্য হয়ে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গেছে। তিনি বললেন : ফাতিমা! কাছে এসো। ফাতিমা পিতার সামনে এসে দাঁড়ালেন। পিতা একটি হাত মেয়ের কাঁধে রেখে এই দু‘আ উচ্চারণ করেন : [আ‘লাম আন-নিসা’- ৪/১২৫] (আরবী*********)

‘ক্ষুধার্তকে আহার দানকারী ও সংকীর্ণতাকে দূরীভূতকারী হে আল্লাহ! তুমি ফাতিমা বিনত মুহাম্মাদের সংকীর্ণতাকে দূর করে দাও।’

কথাবার্তা, চালচলন, উঠাবসা প্রতিটি ক্ষেত্রে ফাতিমা (রা) ছিলেন হযরত রাসূলে কারীমের (সা) প্রতিচ্ছবি। হযরত আয়িশা (রা) বলেন : (আরবী*********)

‘ফাতিমা (রা) হাঁটতেন। তাঁর হাঁটা রাসূলুল্লাহর (সা) হাঁটা থেকে একটুও এদিক ওদিক হতো না।’[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’-২/১৩০] সততা ও সত্যবাদিতায় তাঁর কোন জুড়ি ছিল না। ‘আয়িশা (রা) বলতেন : [প্রাগুক্ত-১৩১] (আরবী********)

‘আমি ফাতিমার (রা) চেয়ে বেশী সত্যভাষী আর কাউকে দেখিনি। তবে যাঁর কন্য (নবী সা.) তাঁর কথা অবশ্য স্বতন্ত্র।’

‘আয়িশা (রা) আলো বলেন :[ আবূ দাঊদ : বাবু মা জায়াফিল কিয়াম (৫২১৭) ; তিরমিযী : মানাকিবু ফাতিমা (৩৮৭১)] (আরবী**********)

‘আসি কথাবার্তা ও আলোচনায় রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে ফাতিমার (রা) চেয়ে বেশী মিল আছে এমন কাউকেজ দেখিন্ ফাতিমা (রা) যখন রাসূলেন (সা) নিকট আসতেন, তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে কাছে টেনে চুমু দিতেন, স্বাগত জানাতেন। ফাতিমাও পিতার সাথে একই রকম কারতেন।’ রাসূল (সা) যে পরিমাণ ফাতিমাকে (রা) ভালোবিাসতেন, সেই পরিমাণ অন্য কোন সন্তানকে ভালোবাসতেন না।

তিনি বলেছেন (আরবী*********)

‘ফাতিমা আমার দেহের একটি অংশ। কেউ তাকে অসন্তুষ্ট করলে আমাকে অসন্তুষ্ট করবে।’

ইমাম আস-সুহাইলী এই হাদীছের ভিত্তিতে বলেছেন, কেউ ফাতিমাকে (রা) গালিগালাজ করলে কাফির হয়ে যাবে। তিনি তাঁর অসন্তুষ্টি ও রাসূলুল্লাহর (সা) অসন্তুষ্টি এক করে দেখেছেন্। আর কেউ রাসূলকে (সা) ক্রোধা্ন্বিত করলে কাফির হয়ে যাবে।[আ‘লাম আন-নিসা’ -৪/১২৫, টীকা-২]

ইবনুল জাওযী বলেছেন, রাসূলুল্লাহর (সা) অন্য সকল কন্যাকে ফাতিমা (রা) এবং অন্য সকল বেগমকে ‘আয়িশা (রা) সম্মান ও মর্যাদায় অতিক্রম করে গেছেন।[প্রাগুক্ত-৪/১২৬]

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (সা) বলেছেন : একজন ফেরেশতাকে আল্লাহ আমার সাক্ষাতের অনুমতি দেন। তিনি আমাকে এ সুসংবাদ দেন যে, ফাতিমা হবে আমার উম্মাতের সকল নারীর নেত্রী এবং হাসান হুসায়ন হবে জান্নাতের অধিবাসীদের নেতা।[প্রাগুক্ত-৪/১২৭] এক প্রসঙ্গে তিনি ‘আলীকে (রা) বলেন : ফাতিমা আমার দেহের একটি অংশ। সুতরাং তার অসন্তুষ্টি হয় এমন কিছু করবে না।’

পিতার প্রতি ফাতিমার (রা) ভালোবাসা

হযরত রাসূলে কারীম (সা) যেমন কন্য ফাতিমাকে (রা) গভীরভাবে ভালোবাসতেন তেমনি ফাতিমাও পিতাকে প্রবলভাবে ভালোবাসতেন। পিতা কোন সফর থেকে যখন ফিরতেন তখন সর্বপ্রথম মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করতেন। তারপর কন্যা ফাতিমার ঘরে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে নিজের ঘরে যেতেন। এটা তাঁর নিয়ম ছিল। একবার রাসূল (সা) এক সফর থেকে ফিরে ফাতিমার ঘরে যান। ফাতিমা (রা) পিতাকে জড়িয়ে ধরে চোখে-মুখে চুমু দেন। তারপর পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করেন। রাসূল (সা) বলেন : কাঁদছো কেন? ফাতিমা (রা) বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার চেহারা বির্ণ হয়ে গেছে এবং আপনার পরিধেয় বস্ত্রও ময়লা, নোংরা হয়েছে। এ দেখেই আমার কান্না পাচ্ছে। রাসূল (সা) বললেন : ফাতিমা, কেদঁ না। আল্লাহ তোমার পিতাকে একটি বিষয়ের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। ধরাপৃষ্ঠের শহর ও গ্রামের প্রতিটি ঘরে তিনি তা পৌঁছে দেবেন। সম্মানের সঙ্গে হোক বা অপমানের সঙ্গে।[কানয আল-‘উম্মাল-১/৭৭; হায়াত আস-সাহাবা-১/৬৫]

রাসূলুল্লাহর (সা) তিরস্কার ও সতর্ককরণ

হযরত রাসূলে কারীমের (সা) এত প্রিয়পাত্রী হওয়া সত্ত্বেও দুনিয়ার সুখ-ঐশ্বয্যের প্রতি সামান্য আগ্রহ দেখলেও রাসূল (সা) তাঁকে তিরস্কার করতে কুণ্ঠিত হতেন না। রাসূল (সা) পার্থিব ঠাঁটবাট ও চাকচিক্য অপসন্দ করতেন। তিনি নিজে যা পসন্দ করতেন না তা অন্য কারো জন্য পসন্দ করতে পারেন না। একবা স্বামী ‘আলী (রা) একটি সোনার হার ফাতিমাকে (রা) উপহার দেন। তিনি হারটি গলায় পরে আছেন। এমন সময় রাসূলুল্লঅহ (সা) আসেন এবং হারটি তাঁর দৃষ্টিতে পড়ে। তিনি বলেন, ফাতিমা! তুমি কি চাও যে, লোকেরা বলুক রাসূলুল্লাহর (সা) কন্যা আগুনের হর গলায় পরে আছে? ফাতিমা পিতার অসন্তুষ্টি বুঝতে পেরে হারটি বিক্রী করে দেন এবং সেই অর্থ দিয়ে একটি দাস ক্রয় করে মুক্ত করে দেন। একথা রাসূল (সা) জানার পর বলেন: [আত-তারগীব ওয়াত তারহীব-১/৫৫৭; মুসনাদ-৫/২৭৮, ২৭৯; নিসা‘ হাওলাদার রাসূল-১৪৯] (আরবী*******)

‘সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি ফাতিমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচিয়েছেন।’

আরেকটি ঘটনা। রাসূল (সা) কোন এক যুদ্ধ থেকে ফিরলেন। অভ্যাস অনুযায়ী তিনি ফাতিমার (রা) গৃহে যাবেন। ফাতিমা (রা) পিতাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ঘরের দরজায় পর্দা ঝুলালেন, দুই ছেলে হাসান ও হুসায়নের (রা) হাতে একটি করে রূপোর চুড়ি পরালেন। ভাবলেন, এতে তাঁদের নানা রাসূল (সা) খুশী হবেন। কিন্তু ফল উল্টো হলো। রাসূল (সা) ঘরে না ঢুকে ফিরে গেলেন। বুদ্ধিমতি কন্যা ফাতিমা (রা) বুঝে গেলেন, পিতা কেন ঘরে না ঢুকে ফিরে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পর্দা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলেন এবং দুই ছেলের হাত থেকে চুড়ি খুলে ফেলেন। তাঁরা কাঁদতে কাঁদতে তাঁদের নানার নিকট চলে যায়। তখন হযরত রাসূলে কারীমের (সা) মুখ থেকে উচ্চারিত হয়, এরা আমার পরিবারের সদস্য। আমি চাইনা পার্থিব সাজ-শোভায় তারা শোভিত হোক।[সাহাবিয়াত-১৪৭]

একবার রাসূল (সা) ফাতিমা, ‘আলী, হাসান ও হুসায়নকে (রা) বললেন : যাদের সঙ্গে তোমাদের যুদ্ধ, তাদের সাথে আমারও যুদ্ধ, যাদের সঙ্গে তোমাদের শান্তি ও সন্ধি তাদের সঙ্গে আমারও শান্তি ও সন্ধি। অর্থাৎ যাদের প্রতি তোমরা অখশী তাদের প্রতি আমিও অখুশী, আর যাদের প্রতি খুশী, তাদের প্রতি আমিও খুশী।

রাসূল (সা) অতি আদরের কন্যা ফাতিমাকে (রা) সব সময় স্পষ্ট করে বলে দিতেন যে, নবীর (সা) কন্যা হওয়অর কারণে পরকালে মুক্তি পাওয়অ যাবে না। সেখানে মুক্তির একমাত্র উপায় হবে আমল, তাকওয়া ও খাওফে খোদা্ একবার তিনি ভাষণে বলেন :[ বুখারী-৬/১৬ (তাফসীর সূরা আশ শু‘আরা); নিসা’ হাওলার রাসূল-১৪৯] (আরবী********)

‘হে কুরায়শ গোত্রের লোকেরা! তোমরা তোমাদের নিজ নিজ সত্তাকে ক্রয় করে নাও। আল্লাহর নিকট আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারবো না।… হে ফাতিমা বিনত মুহাম্মাদ! তুমি আমার সম্পদ থেকে যা ইচ্ছা আমার নিকট চেয়ে নাও। তবে আল্লাহর নিকট তোমার জন্য কিছুই করতে পারবো না।’

তিনি একথাও বলেন : (আরবী**********)

‘হে ফাতিমা বিনত মুহাম্মাদ, তুমি নিজকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। আমি আল্লাহর দরবারে তোমার উপকার ও অপকার কিছুই করতে সক্ষম হবো না।’

এক মাখযূমী নারী’ চুরি করলে তার গোত্রের লোকেরা রাসূলের (সা) প্রীতিভাজন উসামা ইবন যায়দের (রা) মাধ্যমে সুপারিশ করে শাস্তি মওকুফের চেষ্টা করে। তখন রাসূল (সা) বলেন :[বুখারী : আল-হুদূদ; মুসলিম : বাবু কিত‘উস সারিক (১৬৮৮)] (আরবী**********)

‘আল্লাহর কসম! ফাতিমা বিনত মুহাম্মাদও যদি চুরি করে তাহলে আমি তার হাত কেটে দেব।

পিতার উত্তরাধিকার দাবী

হযরত রাসূলে কারীম (সা) িইনতিকাল করলেন। তাঁর উত্তরাধিকারের প্রশ্ন দেখা দিল। ফাতিমা (রা) সোজা খলীফা আবূ বকরের (রা) নিকট গেলেন এবং তাঁর পিতার উত্তরাধিকার বণ্টনের আবেদন জানালেন। আবূ বকর (রা) তাঁকে রাসূলুল্লাহর (সা) এ হাদীছটি শোনান : (আরবী*********)

‘আমরা যা কিছু ছেড়ে যাই সবই সাদাকা হয়। তার কোন উত্তরাধিকার হয় না।’ তারপর তিনি বলেন, এরপর আমি তা কিভাবে বণ্টন করতে পারি? এ জবাবে হযরত ফাতিমা (রা) একটু রুষ্ট হলেন।[মুসলিম : ফিল জিহাদ ওয়াস সায়ব (১৭৫৯); বুখারী : ৬/১৩৯, ১৪১; ৭/২৫৯ ফিল মাগাযী : বাব : হাদীছু বানী আন-নদীর; তাবাকাত-৮/১৮; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/১২০] ফাতিমা (রা) ঘরে ফিরে এসে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এ রকমও বর্ণিত হয়েছে যে, আবূ বকরের (রা) এ কজবাবে হযরত ফাতিমা (রা) দুঃখ পান এবং আবূ বকরের (রা) প্রতি এত নারাজ হন যে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর সাথে কোন কথা বলেননি। কিন্তু ইমাম আশ-শা‘বীর (রহ) একটি বর্ণনায় জানা যায়, ফাতিমা (রা) যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন আবূ বকর (রা) তাঁর গৃহে যান এবং সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করেন। ‘আলী (রা) ফাতিমার (রা) নিকট গিয়ে বলেন, আবূ বকর (রা) তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছেন। ফাতিমা (রা) ‘আলীকে (রা) প্রশ্ন করলেন : আমি তাঁকে সাক্ষাতের অনুমতি দিই তাতে কি তোমার সম্মতি আছে? ‘আলী (রা) বললেন : হাঁ। ফাতিমা (রা) অনুমতি দিলেন। আবূ বকর (রা) ঘরে ঢুকে কুশল বিনিময়ের পর বললেন : আল্লাহর কসম! আমি আমার অর্থ-বিত্ত, পরিবার-পরিজন, গোত্র সবকিছু পরিত্যাগ করতে পারি আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল (সা) এবং আপনারা আহলি বায়ত তথা নবী পরিবারের সদস্যদের সন্তুষ্টির বিনিময়ে। আবূ বকরের (রা) এমন কথায় হযরত ফাতিমার (রা) মনের সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। তিনি খুশী হয়ে যান।[তাবাকাত-৮/২৭]ইমাম আয-যাহাবী (রা) এ তথ্য উল্লেখ করার পর মন্তব্য করেছেন, স্বামীর গৃহে অন্য পুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে স্বামীর অনুমতি নিতে হয়- এ সন্নাত সম্পর্কে হযরত ফাতিমা (রা) অবহিত ছিলেন। এ ঘটনা দ্বারা সেকথা জানা যায়। [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’ -২/১২১] এখানে উল্লেখিত এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় হযরত ফাতিমার (রা) অন্তরে পূর্বে কিছু অসন্তুষ্টি থাকলেও পরে তা দূর হয়ে যায়। তাছাড়া একটি বর্ণনায় একথাও জানা যায় যে, ফাতিমা (রা) মৃত্যুর পূর্বে আবূ বকরের (রা) স্ত্রীকে অসীয়াত করে যান, মৃত্যুর পরে তিনি যেন তাঁকে গোসল দেন।[নিসা‘ মুবাশশারাত বিল কজান্নাহ-২২৪; টীকা নং-১]

মৃত্যু

হযরত ফাতিমার (রা) অপর তিন বোন যেমন তাঁদের যৌবনে ইনতিকাল করেন তেমনি তিনিও হযরত রাসূলে কারীমের (সা) ওফাতের আট মাস, মতান্তরে সত্তুর দিন পর ইহলোক ত্যাগ করেন। অনেকে রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতিকালের দুই অথবা চার মাস অথবা আট মাস পরে তাঁর ইনতিকালেন কথাও বলেছেন। তবে এটাই সঠিক যে, হযরত রাসীলে কারীমের (সা) ই্নতিকাল করেন। রাসূলুল্লাহর (সা) ভবিষ্যদ্বাণী- ‘আমার পরিবারের মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম আমার সঙ্গে মিলিত হবে‘- সত্যে পরিণত হয়। রাসূলুল্লাহর (সা) নবুওয়াত লাভের পাঁচ বছর পূর্বে যদি হযরত ফাতিমার (রা) জন্ম ধরা হয় তাহলে মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ২৯ বছর হয়। আর কেউ বলেছেন যে, নবুওয়াত লাভের এক বছর পর ফাতিমার (রা) জন্ম হয়, এই হিসাবে তাঁর বয়স ২৯ বছর হবে না। যেহেতু অধিকাংশ সীরাত বিশেষজ্ঞ মনে করেন, মৃত্যুকালে ফাতিমার (রা) বয়স হয়েছিল ২৯ বছর, তাই তাঁর জন্মও হবে নবুওয়াতের পাঁচ বছর পূর্বে।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা‘ -২/১২৭]

আল-ওয়াকিদী বলেছেন, হিজরী ১১ সনের ৩ রমাদান ফাতিমার (রা) ইনতিকাল হয়। হযরত ‘আব্বাস (রা) জানাযার নামায জড়ান। হযরত ‘আলী, ফাদল ও ‘আব্বাস (রা) কবরে নেমে দাফন কাজ সম্পন্ন করেন। তাঁর অসীয়াত মত রাতের বেলা তাঁর দাফন করা হয়। একতাও বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আলী, মতান্তরে আবূ বকর (রা) জানাযার নামায পড়ান। স্বামী ‘আলী (রা) ও আসমা বিনত ‘উমাইস (রা) তাঁকে গোসল দেন।[আল-ইসতী‘আব- ৪/৩৬৭, ৩৬৮; আনসাব আল-আশরাফ-১/৪০২, ৪০৫]

হযরত ফাতিমার (রা) অন্তিম রোগ সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। মারাত্মক কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে কিচুকাল শয্যাশায়ী ছিলেন, এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। উম্মু সালমা (রা) বলেন, ফাতিমার (রা) ওফাতের সময় ‘আলী (রা) পাশে ছিলেন না। তিনি আমাকে ডেকে পাঠান এবং বলেন, আমার গোসলের জন্য পানির ব্যবস্থা করুন। নতুন পরিচ্ছন্ন কাপড় বের করুন, পরবো। আমি পানির ব্যবস্থা করে নতুন কাপড় বের করে দিলাম। তিনি উত্তমরূপে গোসল করে নতুন কাপড় পরেন। তারাপর বলেন আমার বিছানা করে দিন বিশ্রাম করবো। আমি বিছানা করে দিলাম। তিনি কিবলামুখী হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তারপর আমাকে বলেন, আমার বিদায়ের সময় অতি নিকটে। আমি গোসল করেছি। দ্বিতীয়বার গোসল দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমার পরিধেয় বস্ত্রও খোলার প্রয়োজন নেই। এরপর তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

‘আলী (রা) ঘরে আসার পর আমি তাঁকে এসব ঘটনা বললাম। তিনি ফাতিমার (রা) সেই গোসলকেই যথেষ্ট মনে করলেন এবং সেই অবস্থায় দাফন করেন।[দ আ‘লাম আন-নিসা’ -৪/১৩১] এ রকম বর্ণনা উম্মু রাফি’ থেকেও পাওয়া যায়। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, ‘আলী (রা), মতান্তরে আবূ বকরের (রা) তাঁকে গোসল দেন।[তাবাকাত-৮/১৭, ‘৮; সিয়ারু আ‘লামত আন-নুবালা’ -২/১২৯]

জানাযায় কুব কম মানুষ অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। তার কারণ, রতে তাঁর ইনতিকাল হয় এবং হযরত ‘আলী (রা) ফাতিমার অসীয়াত অনুযায়ী রাতেই তাঁকে দাফন করেন। তাবাকাতের বিভিন্ন স্থানে এ রকম বর্ণনা এসেছে। ‘আয়িশা (রা) বলেন, নবীর (সা) পরে ফাতিমার (রা) ছয় মাস জীবিত ছিলেন এবং রাতের বেলা তাঁকে দাফন করা হয়। [সিয়ারু আ‘লামত আন-নুবালা’ -২/১২৯]

লজ্জা-শরম ছিল হযরত ফাতিমার (রা) স্বভাবের অন্যতম বৈশিস্ট্য। মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে তিনি আসমা‘ বিনত ‘উমাইসকে (রা) বলেন, মেয়েদের লাশ উন্মুক্ত অবস্থায় যে, গোরস্থানে নিয়ে যাওয়অ হয় এ আমার পসন্দ নয়। এতে বেপর্দা হয়। নারী-পুরূষের লাশের ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য করা হয় না। পুরুষরা যে মেয়েদের লাশ খোলা অবস্থায় বহন করেন, এ তাদের একটা কমন্দ কাজ। আসমা‘ বিনত ‘উমাইস (রা) বললেন, আল্লাহর রাসূলের কন্যা! আমি হাবশায় একটি ভালো পদ্ধতি দেখেছি। আপনি অনুমতি দিলে দেখাতে পারি। একথা বলে তিনি খেজুরের কিছু ডাল আনলেন এবং তার উপর একটি কাপড় টানিয়ে পর্দার মত করলেন। এ পদ্ধতি হযরত ফাতিমার (রা) বেশ পসন্দ হলো এবং তিনি বেশ উৎফুল্ল হলেন।

হযরত ফাতিমার (রা) লাশ পর্দার মধ্য দিয়ে কবর পর্যন্ত নেওয়া হয়। ইসলামে সর্বপ্রতম এভাবে তাঁর লাশটিই নেওয়া হয়। তাঁর পরে উম্মুল মু‘মিনীন হযরত যয়নাব বিনত জাহাশের লাশটিও এভাবে কবর পর্যন্ত বহন করা হয।

হযরত ‘আলী (রা) স্ত্রী ফাতিমার (রা) দাফন-কাফনের কাজ সম্পন্ন করে যখন ঘরে ফিরলেন তখন তাঁকে বেশ বিষণ্ণ ও বেদনাকাতর দেখাচ্ছিল। শোকাতুর অবস্থায় বার বার নীচের চরণগুলো আওড়াচ্ছিলেন :[আ‘লাম আন-নিসা’-৪/১৩১] (আরবী*****)

‘আমি দেখতে পাচ্ছি আমার মধ্যে দুনিয়ার রোগ-ব্যাধি প্রচুর পরিমাণে বাসা বেঁধেছে। আর একজন দুনিয়াবাসী মৃত্যু পর্যন্ত রোগগ্রস্তই থাকে।

ভালোবাসার লোকদের প্রতিটি মিলনের পরে বিচ্ছেদ আছে। বিচ্ছেদ ছাড়া মিলনের সময়টুকু তা অতি সামান্যই।

আহমাদের (সা) পরে ফাতিমার (রা) বিচ্ছেদ একথাই প্রমাণ করে যে, কোন বন্ধই চিরকাল থাকে না।’

হযরত ‘আলী (রা) প্রতিদিন ফাতিমার (রা) কবরে যেতেন, স্মৃতিচারণ করে কাঁদতেন এবং নিম্নের এ চরণ দু‘টি আবৃত্তি করতেন : (আরবী*********)

‘আমার একি দশা হয়েছে যে, আমি কবরের উপর সালাম করার জন্য আসি; কিন্তু প্রিয়ার কবর আমর প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না।

হে কবর! তোমার কী হয়েছে যে, তোমার আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দাও না?

তুমি কি তোমার প্রিয়জনের ভালোবাসায় বিরক্ত হয়ে উঠেছো?

দাফনের স্থান

আল-ওয়াকিদী বলেন, আমি আবদুর রহমান ইবন আবিল মাওলাকে বললাম, বেশীর ভাগ মানুষ বলে থাকে হযরত ফাতিমার (রা) কবর বাকী‘ গোরস্তানে। আপনি কী মনে করেন? তিনি জবাব দিলেন : বাকী‘তে তাঁকে দাফন করা হয়নি। তাঁকে ‘আকীলের বাড়ীর এক কোনে দাফন করা হয়েছে। তাঁর কবর ও রাস্তার মধ্যে ব্যবধান ছিল প্রায় সাত হাত।[সাহাবিয়াত-১৫৩]

হাদীছ বর্ণনা

হযরত ফাতিমা (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) আঠারোটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে একটি হাদীছ মুত্তাফাক ‘আলাইহি অর্থাৎ হযরত ‘আয়িশার (রা) সনদে বুখারী ও মুসলিম সংকলন করেছেন। ইমাম আবূ দুউদ, ইবন মাজাহ ও তিরমিযী তাঁদের নিজ নিজ সংকলনে ফাতিমা (রা) বর্ণিত হাদীছ সংকলন করেছেন। আর ফাতিমা (রা) থেকে যাঁরা হাদীছ বর্ণা করেছেন তারা হলেন : তাঁর কলিজার টুকরা দুই ছেলে- হাসান, হুসায়ন, স্বামী‘আলী ইবন আবী তালিব, উম্মুল মু‘মিনীন ‘আয়িশা, সালমা উম্মু রাফি’, আনাস ইবন মালিক, উম্মু সালামা, ফাতিমা বিনত আল-হুযসায়ন (রা) ও আরো অনেকে। ইবনুল জাওযী বলেন, একমাত্র ফাতিমা (রা) ছাড়া রাসূলুল্লাহর (রা) অন্য কোন মেয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) কোন হাদীছ বর্ণনা করেছেন বলে আমরা জানি না।[সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/১১৯; আ‘লাম আন-নিসা’ -১২৮, টীকা নং-১]


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি