যায়িদ ইবন আরকাম (রা)
ভালো নাম যায়িদ। কুনিয়াত বা ডাক নামের ব্যাপারে দারুন মতভেদ আছে। যেমনঃ আবু উমার আবু আমের আবু সা’দ আবু উনাইস ইত্যাদি।১ পিতা আরকাম ইবন যায়িদ। মদীনার খায়রাজ গোত্রের বনু হারিস শাখার সন্তান। একজন আনসারী সাহাবী খুব অল্প বয়সে পিতৃহারা হন। হযরত আবদল্লাহ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনÍাওয়াহা (রা) ছিলেন একজন উচু মর্যাদার সাহাবী। সম্পর্কে তিনি যায়িদের চাচা। তিনি পিতৃহারা যায়িদকে তত্বাবাধানে নেন এংব লালন পালন করেন।২ আবদুল্লাহইবন রাওয়াহা (রা) আকাবরা বাইয়াতে (শপথ) শরীক ছিলেন। মূলতঃ তাঁরই প্রভাবে হযরত যায়িদ (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন।
হযরত যায়িদ উহুদ যুদ্ধে যেতে চায়েছিলেন। কিন্তু তখন তাঁর যুদ্ধে যাওয়ার বয়স না হওয়ায় হযরত হযরত রাসূলে কারীম (সা) তাঁকে বিরত রাখেন। সর্ব প্রথম খন্দক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। তবে একথাও বর্ণিত আছে যে, আল’মুরাইসী তাঁর জীবনের প্রথম সহীহ আল বুখারীতে এভবে তাঁর বর্ণনায় আছে রাসূল (সা) মোট ঊনিশটি যুদ্ধ করেছেন তারমধ্যে আমি সতেরটিতে (১৭) শরীক ছিলাম।৩
মূতার যুদ্ধে চাচা আবদুল্লাহ ইবর রাওয়াহার ছিলেন বড় মাপের কবি। তিনি পথে চলতে চলতে একটি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন যাতে তাঁর শাহাদাতের তীব্র আকাঙ্খা প্রকাশ পায়।যায়িদ কবিতাটি শুনে কাঁদতে শুরু করেন। ইবন রাওয়াহা ছড়ি ঝাঁকিয়া বলে ওঠেন, ওরে ছোটলোক আমরা শাহাদাতের ভাগ্য হলে তোর ক্ষতি কি?৪
খুলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যে হযরত আলীর (রা) সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। সিফফীন যুদ্ধে আলীর (রা) পক্ষে যোগদান করেন। তাঁকে আলীর ঘনিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য করা হয়।৫
হযরত যায়িদ (রা) শেষ জীবনে কূফার বনু কিন্দা মহল্লাহয় বাড়ী করে বসতি স্থাপন করেন। এ কূফা শহরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্য সন নিয়ে কিছু মতান্তর আছে। অনেকের মতে, আলÑমুখতার আসÑসাকাফীর বিদ্রোহের সময় হিজরী ৬৬ সনে মারা যান। তবে আলÑ হায়সামা ইবন আদী এবং আরো অনেকের মতে তাঁর মৃত্য সন হিজরী ৬৮ সন। অনেকে একথাও বলেছেন যে হযরত আল-হুসাইনের (রা) শাহাদাতের অল্প কিছু দিন পর তাঁর মৃত্যু হয়।৬
হযরত যায়িদ (রা) ছিলেন তাঁর সময়ের জ্ঞান, মর্যাদা ও সম্মানের একটি কেন্দ্রবিন্দু। জ্ঞানের সন্ধানে মানুষ দূরÑদুরান্ত থেকে তাঁর কাছে ছুটে আসতো। এক ব্যক্তিতো কিসতাস এর শেষ প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছিল তাঁর কাছে একটি মাসায়ালা জিজ্ঞেস করতে।৭ তিনি যেখানেই যেতেন হাদীসের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিরা তাঁর পাশে ভীড় জমাতো। একবার বসরা মতান্তরে মক্কায় গেলে হযরত আব্বাস (রা) বলেন, অমুক হাদীসটি যা আপনি বর্ণনা করে থাকেন, আবার আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।৮ একবার আতিয়্যা বললেন আপনি অমুক হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আমার আসার উদ্দেশ্য হলো, আপনার মুখ থেকেই হাদীসটি শোনা। তিনি হাদীসটি বর্ণনা করলে আতিয়্যা বললেন আপনি এ বাক্যটিও তো বলেছিলেনÑ আমি যেমন শুনেছি তেমনই তোমাকে বর্ণনা করবো।৯
হাদীস ছাড়াও যে সকল দু’আ তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) মুখ থেকে শুনে মুখস্ত করেছিলেন, মানুষকে শিখাতেন, তাই আমরা তোমাদে কে শিখাচ্ছি। তাঁর বর্ণিত বহু দু’আ হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থসমূহে সংকলিত হয়েছে।১০ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে হযরত যায়িদ (রা) দারুণ সতর্ক ছিলেন। আবদুর রহমান ইবন আবী লায়লা বলেন: আমরা তাঁর কাছে এসে আবেদন জানাতাম, আমাদের কাছে রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীস বর্ণনা করুন। বলতেনঃ আমি এখন বুড়ো হয়েছি এবং স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে। রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীস বর্ণনা করা বড় কঠিন কাজ।১১
একবার ইয়াযীদ ইবন হায়্যান, হুসাইন ইবন সাবরা ও আমর ইবন মুসলিম হাদীস শোনার জন্য তাঁর কাছে যান। প্রথমে তাঁর যায়িদের (রা) প্রশংসা করে বলেন, আল্লাহ আপনাকে বড় ফজীলাত দিয়েছেন। আপনি রাসূল্ল্লুাহর (সা) কামলিয়্যাত (পূর্ণতা) প্রত্যক্ষ করেছেন। হাদীস শুনেছেন,তাঁর সাথে যুদ্ধে গেছেন এবং তাঁর পিছনে নামায আদায় করেছেন। এর চেয়ে বড় মর্যাদার আর কিহতে পারে? আমাদেরকে রাসূলুল্লাহর (সা) কিছু হাদীস শোনান। জবাবে যায়িদ (রা) বললেনঃ ভতিজা আমি এখন বুড়ো হয়েছি, সেে সময়ও চলে গেছে। অনেক কথাই আজ স্মৃতি ও স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। হাদীসের একটি বড় ভান্ডার আজ ভুলে গেছি। এখন আমি যা কিছু বর্ণনা করি তাই শোন। যা নেই তার জন্য আমাকে কষ্ট দেওয়া তোমাদের উচিত হবে না।১২ এ কারণে হযরত যায়িদের (রা) বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মাত্র নব্বই (৯০) টি। তিনি হযরত রাসূলে করীম (সা) আলীর (রা) মুখ থেকে হাদীস শুনেছেন এবং তাই বর্ণনা করেছেন। আর তাঁর সুত্রে যে সকল সাহাবী ও তাবেঈ হাদীস বর্ণনা করেছেন, এখানে তাঁদের বিশিষ্ট নাম উল্লেখ করা হলো।:
আনাস ইবন মালিক, আবদুল্লাহ ইবনুল আব্বাস, আবততুফাইল, আবু উসমান আনÑনাহদী, আবুদুর রহমান ইবন আবী লায়লা, আবদে খায়র আলÑহামাদানী, তঊস, নাদার ইবন আনাস, আবু উমার শায়বানী, আবুল মিসহাল,আবদুর রহমান ইবন মাতয়িম, আবু ইসহাক আসÑসাবাঈ, মহাম্মাদ ইবন কা’ব আলÑকারাজী, আবু হামযা তালহা ইবন ইয়াযীদ, আবদুল্লাহ ইবন আলÑহারিস, আলÑবসর, কাসেম ইবন আওফ, আতিয়্যা আলÑআওফ, আবু মসলিম আল বাজালী প্রমুখ।১৩ হযরত যায়িদের (রা) মধ্যে ইসলামের রুহানী বা আধ্যাতিœক শিক্ষা মাত্রায় বিকতি হয়েছিল। তবে বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায় বনু মুসতালিক যুদ্ধের সময়ের একটি ঘটনায়। ঘটনাটি সংক্ষেপে এরুপঃ
বনু আলÑমুসালিক এর সংরক্ষিত জলাশয়ের নাম আলÑমুরাইসী। ইবন ইসহাকের মতে হিজরী ৬ এবং মূসা ইবন উকাবার মতে ৪ সনে এ জলাশয়ের পাশে রাসূলুল্লাহর (সা) নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীর এক যুদ্ধ হয়। যা ইতিহাসে আলÑমুরাইসী’র য্দ্ধু নামে খ্যাত। এ যুদ্ধে বনু মুসতালিফ শোচনিয়ভাবে পরাজিত হয়।১৪
রাসূল (সা) তাঁর বাহীনিসহ এ জলশায়ের পাশে শিবির স্থাপন করেছিলেন।সৈনিকরা এখান থেকেই পশুকে পানি পান করাতো। হযরত উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) ছিল জাহ্জাহ্ ইবন মসউদ নামে বনু গিফর গোত্রের এক মজুর। তিনি উমারের (রা) ঘোড়াটি চরাতেন। একদিন ঘোড়াটি পানি পান করতে গিয়ে খওফ ইবন খাযরাজের হালীখা বা বন্ধু সিনান ইবন ওয়াবার আলÑজুহানী আনসারদের সাহায্য চেয়ে চিৎকার জুড়ে দেন। জাহ্জাহ্ বসে থাকলেন না।তিনিও মুহাজিরদরে সাহায্য চেয়ে আওয়াজ দেন। মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সালুল এতে দারুন ক্ষুদ্র হয়। তখন তার নিকট তার গোত্রের একদল লোক উপস্থিত ছিল। তাদরে মধ্যে যায়িদ ইবন আরকামাও ছিলেন। তিনি এখন একজন তরুণ ব্যক্তি।
আবদুল্লাহ ইবন উবাই সুযোগ বুঝে তার গোত্রের লোকদের লক্ষ্য করে বললেনঃ মুসলিম মুহাজিররা আমাদের সাথে এমন আচারণ করলো? আমাদেরই ভূমিতে তারা আমাদেদেকে ঘৃনা করছে এবং আমদের চেয়ে সংখ্যায় বেড়ে গেছেভ মুহাজিরদের ব্যাপারটি যেন খাইয়ে মোটাতাজা করা সেই পালিত কুকুরের মত যে তার প্রভুকে খেয়ে ফেলে। আল্লাহর কসম মদীনায় ফিরতে পারলে আমরা তথাকার অভিজাতরা এই ইতরদেরকে বিতাড়িত করে ছাড়বে। মূলতঃ এটা তোমাদেরই কর্মফল। তোমাদের মাতৃভূমির দুয়ার তাদের জন্য খুলে দিয়েছো। তোমাদের যা আছে তা যদি তোমরা তাদেরকে ভাগ কর দিয়েছো। আল্লাহর কসম, তোমাদের মাতৃভুমি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবে। মুনাফিক ইবন উবা এভাবে তার গোত্রীয় লোকদের সুপ্ত অনুভুতিেিত আঘঅত করে মুহাজিরদের বিরুদ্ধে ক্ষেপেয়ি তুলতে চেষ্টার ক্রটি করলো না। যায়িদ ইবন আরকাম (রা) চুপ করে তার সব কথা শুনলেন। তাঁর ঈমানী চেতনা তাঁকে এ মুনাফিকের কথাগুলি চেপে রাখতে দিলোনা। যদিও ইবন উবাই ছিল তাঁর স্বগোত্রীয় লোক। হযরত রাসূলে কারীম (সা) যুদ্ধের ব্যস্ততা শেস করে একটু বিশ্রামে আছেন। উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) তখন তাঁর কাছে বসা। এ সময় যায়িদ (রা) উপস্থিত হলেন এবং সব কথা খুলে বললেন। উমার (রা) রাগে ফেটে পড়লেন এবং রাসূলকে (সা) পরামর্শ দিলেনঃ আপনি ইবন উবাইকে হত্যা করার জন্য আব্বাদ ইবন বিশরকে নির্দেশ দিন। রাসূল (সা) বললেনঃ উমার লোকে যখন বলাবলি করবে মুহাম্মাত তাঁর সঙ্গীদের হত্যা করেন। তখন কি হবে? না তা হয়না। তুমি বরং লোকদেরকে এখান থেকে চলার কথা জানিয়ে দাও। সাধারণত রসূল (সা) এমন সময় যাত্রা শুরু করতেন না ঘোষনা অনুযায়ী লোকদের যাত্রা শুরু করলো।
এ দিকে মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবন উবাই যখন জানালো যায়িাদ ইন আরকাম তার সব কথা রাসূলুলালাহর (সা) কানে পৌঁছে দিয়েছে তখন সে রাসূূলুল্লাহ (সা) কাছে ছুটে এসে হলফ করে বললোঃ যায়িদ যা বলেছে তার কিছুই আমি বলিনি। এমন কোন কথঅি আমি উচ্চারণল করিনি। েিস ছিল তার গোত্রেরে একজন অতি সম্মানিত ব্যক্তি। তাই যে সকল আনসার সাহাবী তখন উপস্থিত ছিলেন তাঁরা বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ সম্ভবত এ তরুণ ইন উবাইয়ের কথা বুঝতে ভুল করেছে এবং তার মূল বক্তব্য মনে রাখতে পারেনি। এভাবে তাঁরা আবদুল্লাহ ইবন উবাইয়ের কথ বিশ্বাস করে তার পক্ষে সাফাই গাইলেন। যায়িদ (রা) চাচা আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাও (রা) তাকে তিরস্কার করলেন।
ইবন ইসহাক বলেনঃ রাসূল (সা) আলÑমুরাইসী থেকে যাত্রা করলেন। উসাইদ ইবন হুদাইর এসে বললেনঃ তোমাদের সাথী যে কথা বলেছে তা কি তোমর কানে পৌঁছেনি? উবই। সে কি বলেছে? এ প্রশ্নের উত্তরে রাসূল (সা) যা শুনেছিলেন তাই তাঁকে বললেন। উসাইদ তখন বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহর কসম, আপনি তো সম্মানিত ও শক্তিশালী। এরপর তিনি আবদুলআহ ইবন উবারি প্রতি রকরুণা করার জন্য রাসূলকে (সা) আনুরোধ করেন।
এরপর রাসূল (সা) হিজাযের বাকায়া নামাক উঁচু ভূমিতে যাত্রা বিরতি করেন। আর সেখানেই সূরা আলÑমুনফিকুন নাযিল হয়। এতে আবদুল্লাহ ইবন উবাই ও তার মত আন্য মুনাফিকদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছিল। আর সেই সাথে ঘোষিত হয়েছে হযরত যায়িদের (রা) নিষ্ঠা ও সত্যবাদিতা। সূরাটি যেভাবে শুরু হয়েছে তা বুঝার জন্য এখানে প্রথম দুটি আয়াত অনুবাদ দেওয়া হলো:
‘মুনাফিকরা তোমার কাছে এসে বলেঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ জানেন যে তুমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল এংব আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। তারা তাদের শপথসমূ বে ঢালরুপে ব্যবহার করে। অতঃপর তারা আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে। তারা যা করছে তা খুবই মন্দ।” সূরা আলÑমুনাফিকুন নাযিল হওয়ার পর রাসূল (সা) হযরত যায়িদের (রা) কান ধরে বলেন, এ সইে ব্যক্তি যার কান আল্লাহর হক পূর্ণরুপে আদায় করেছে।
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, আল মুরইসী থেকে সফর শুরু করার র হযরত যায়িদ (রা) বারবার রাসূললুল্লাহর (সা) কাছে আসতেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এই মুনাফিক লোকটি আমাকে মিথ্যাবদী বলে গোটা সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে হেয় প্রতিপন্ন করেছে। অতএব আমার সত্যায়ন ও এই ব্যাক্তির মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন সম্পর্কে অবশ্যই কুরআন নাযিল হবে। হঠৎ যায়িদ ইবন আরকাম দেখলেন যে, রাসূলুল্লাহর (সা) মধ্যে ওহী নাযিলের সময়ের লক্ষণাদি ফুটে উঠেছে। তিনি আশবাদী হলেন যে, এখন এ সম্পকের্ কোন বোর ওজী রাযিল হবে। আবশেষে রাসূলুল্লাহ (সা) এই অবস্থা দূর হয়ে গেল। যায়িদ (রা) বলেনঃ আমার সাওয়ারী রাসূলুল্লাহ (সা) কাছ থেকে ঘোঁষে যাচ্ছিল। তিনি নিজের সাওয়ারীর ওপর থেকেই আমার কান ধরলেন এবং বললেন: হে বালক, আল্লাহ তোমার কথার সত্যায়ন করেছেন।
এ বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, সূরা মুনাফিকুন সফরের মধ্যেই নাযিল হয়েছে। কিন্তু ইমাম বাগাভীর (রহ) বর্ণনায় এসেছে রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মদীনায় পৌঁছে যান এবং যায়িদ ইবন আরকাম (রা) অপমানের ভয়ে ঘরে আতœগোপন করেন তখন এই সূরা নাযিল হয়।১৫
তিনি সুন্নতে নাবাবীর অনুসারণে বিন্দুমাত্র হরেফের করতেন না। জানাযার নামাযে তিনি চারতারবী বলতেন। একবার পাঁচ তাকবীর বললেন। এক ব্যক্তি হাত পেনে ধরে জিঞ্জাসা করলেন, বুল করেননি তো? বললেনঃএটাও রাসূলুল্লাহর (সা) সুন্নাত। আমি একেবারেই ছেড়ে দিই কিভাবে?১৬
তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (রা) অতি ঘনিষ্ট জন। ে কান এক সময় অস্স্থু হলে রাসূল (সা) তাকে দেখতে যেতেন।১৭ একবার তিনি চোখের রোগে আক্রান্ত হলেন। রাসূল (সা) দেখতে গেলেন। সেরে ওঠার পর রাসূল (সা) জিজ্ঞাসা করলেনঃ সবর করতাম এবং সাওয়াবের প্রত্যাশঅয় থাকতাম। রাসূল (সা) বললেনঃ এমন করল পাপমুক্ত অবস্থায় আল্লাহর সান্নিধ্যে যেতে।১৮ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা) তাঁকে বললেনঃ এ রোগে তোমার কোন ক্ষতি হবেনা। কিন্তু আমার মৃত্যুর পর যদি তুমি বেচে থাক এবং অন্ধ হযে যাও তাহলে কি করবে? তিনি জবাবে দিলেনঃ আমি তখন সবর করবো এবং সাওয়াবের প্রত্যাশায় থাকবো। রসূল (সা) বললেনঃ তাহলে তুমি বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে। রাসূললু­হর (সা) মৃত্যুর পর হযরত যায়িদ (রা) অন্ধ হয়ে যান।১৯
কারও সম্মান ও মর্যাদ ক্ষুন্ন হয় এমন আচারল ও মন্তব্য থেকে তিনি সব সময় বিরত থাকতেন। আর কারও মধ্যে এ ক্রটি দেখতে পেলে তার প্রতিবাদ করতেন। একবার হযরত আলী (রা) সম্পর্কে হযরত মুগীর ইবন শুবা (রা) একটি আশোভন উক্তি করেন। সাথে সাথে হযরত যায়িদ (রা) বলেনঃ রসূল (সা) মৃতদেরকে খারাপ বলতে নিষেধ করেছেন। আলী (রা) মারা গেছেন। এখন তাকে খারাপ বলছেন কেন?
মানুষের বিপদ মুসীবতে খোঁজ-খবর নেওয়া এবং সমবেদনা ও সহানুভূতি প্রকা করা ছিল তাঁর স্বভাব। হাররার ঘটনায় হযরত আনাসের এক চেলৈ এবং তার কিছু আতœীয় বন্ধু মারা যান। হযরত যায়িদ (রা) সববেদনাও সহমর্মিতা প্রকাশ করে আনাসের (রা) কাছে একটি চিঠি লেখেন। তাতে তিনি বলেনঃ আমি আপনাকে আল্লাহর সুসংবাদ শুনাচ্ছি। রাসূল (সা) বলেছেঃ হে আল্লাহ আনাসার তাদর সন্তান-সন্তুতি অধঃস্তন পুরুষ, তাদের নাতী-নাতনী এবং তাদের সকল ছেলে মেয়েদেরকে আপনি ক্ষমা করে দিন।২০
তিনি তাঁর সমকালীন ব্যক্তিদের যোগ্যতা ও গুণাবালীকে অত্যন্ত উদার চিত্তে স্বীকৃতি দিতেন। একারণে কেউ কোন বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেসা করতে এলে তাকে সেই বিষযে অভিঙ্গ ব্যক্তির কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিতেন। একবার আবুল মিনহাল আসলেন তাঁর কাছে ব্যায় সারফ সম্পর্কে জিঞ্জাসা করো। এ ব্যাপারে তিনি আমার চেয়ে ভলো এবড় বড় আলিমঃ আবুল মিনহাল বারা এর কাছে গেলেন। তিনি মাসায়ালার জবাব দিয়ে বললেনঃ আামি যা বলেছি এর সত্যতা যাচাই করে নিবে। যায়িদ ইবন আরকামের নিকট থেকে। তিনি আমার চেয়ে বেশি এবং ভালো জানেন।
আমীর- উমারদের সাথে তাঁর উঠা বসা ছিল। রাসূলুল্লাহর (সা) জীবনকালে ব্যবাসেয়র দ্বারা জীবিবা নির্বাহ করতেন।
হযরত যায়িদ ইবন আরাকাম ইসলামের বিভিন্ন মৌলিক বিশ্বাস এবং ইবাদাত সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থাবলীতে তা ছাড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যেমন তিনি বলেছেনঃ য়ে ব্যক্তি নিষ্টার সাথে লা ইলাহা ইল্লাহল্লাহ পাঠ করবে, সে জান্নাতে যাবে। জিঞ্জাসা করা হলোঃ নিষ্ঠার সাথে পাঠ করার অর্থ কি? বললেনঃ আল্লাহর নিষেধ থেকে বিরত থাকা।২১
একাবর কিছু লোক কুবার মসজিদে চাশতের নামায পড়ছিলো। ঐ পথে কোথাও যাচ্ছিলেন। লোকদের নামায পড়তে দেখে বললেন, সম্ববত তাদের জানা নেই যে এ নামাযের জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আছে।
তথ্যসূত্র:
যায়িদ ইবন সাবিত (রা)
রাসূলুল্লাহর (সা) অন্যতম শ্রেষ্ট সাহাবী হযরত যায়িদ (রা) এর বেশ কয়েকটি উপনাম বা ডাকনাম সীরাত গ্রন্থসূমহে পাওয়া যায়। যেমনঃ আবু সাঈদ, আবু খারিজা, আবু আবদির রহমান ও আবু সাবিত।১ মুসলিম উম্মাহ তাকে অনেকগুলি উপধিতে ভূষিত করেছে। যেমনঃ হাবরুল উম্মাহ, কাতিুবুল ওহী ইত্যাদি। মদীনার বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের নাজ্জার শাখার সন্তান। পিতা সাবিত ইবন দাহহাক এবং মাতা নাওয়ার বিনতু মালিক।২ নাওয়ার ছিলেন প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আনাস ইবন মালিকের (রা) খান্দনের মেয়ে।
রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় আসার পূর্বে মদীনার অধিবাসীদের পরস্পরের মধ্যে যে সব রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও সংঘর্ষ হয় তার মধ্যে বুয়াস যুদ্ধটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। এ যুদ্ধে যায়িদের পিতা সাবিত নিহত ন। এটা হিজরতের পাঁচ বছর পূর্বের ঘটনা। তখন যায়িদের বয়স মাত্র ছয় বছর। তিনি মায়ের তত্ত্বাধানে বড় হন। রসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় হিযরাতের সময় যায়িদ এগারো বছরের এক বালক মাত্র।৩
তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন মদীনায় ইসলামের ভিত্তি কুব একটা মজবুত হয়নি। মক্কা থেকে হযরত রাসূলে কারীম (সা) প্রেরিত সুবাল্লিগ হযরত মুসা’য়াব ইবন উমাইর (রা) যখন মাদীায় ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চলেছেন তখন কোন এক সময়ে আতি অল্প বয়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। বালেগ হওয়ার পূর্বে ঈমান আনা যাদি কোন গৌরবের বিষয় হয় তাহলে হযরত যায়িদ সেই গৌরবের বিষয় হয় তাহলে হযরত যায়িদ সেই গৌরবের অধিকারী। জীবনের সূচনা থেকেই এভাবে তিনি শিরকের পস্কিলতা থেকে মুক্তি থাকেন।
তিনি ইসলাম গ্রহন পর থেকেই কুরআন পড়তে শুরু করলেন। মানুষ ও তাকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো। তিনি ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী ও তীক্ষè ধীশক্তির অধিকারী।৪ রাসূলুল্লাহর (সা) রবার নিয়ে গেল এবং এই বলে পরিচয় করে দিল যে, ছেলেটি নাজ্জার গোত্রের। এরই মধ্যে সে সতেরটি সূরার পাঠ শেষ করেছে। রাসূল (সা) তাঁর মুখ থেকে কুরআন তিলওয়াত শুনে খুব খুশি হলেন।৫ যায়িদ বলেনঃ তখন আমার বয়স মাত্র এগারো বছর।৬ বদর যুদ্ধের সময় তিনি তের (১৩Ñ) বছরের এক বালক মাত্র। যুদ্ধে যাওয়ার বয়স তখনো হয়নি। তবুও আনসারও মুহাজিরগণ যখন বদরের দিকে যাত্রা করলেন তখন এ বালকও যুদ্ধে যাওয়ার সিন্ধান্ত নিলেন। তাঁরই মত ছোটদের একটি দলের সাথে রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। যুদ্ধের বয়স না হওয়ার কারনে রাসূল (সা) তাদেরকে সান্তনা দিয়ে ফিরিয়ে দেন।৭
হযরত যায়িদ সর্ব প্রথম কোন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন সে বিষয়ে সীরাত বিশেঙ্গদের মতভেদ আছে। আনেকের ধারণা তিনি উহুদে যোগদান করেন। এটাই তাঁর বয়স ষোল পূর্ণ হয়ে গেছে। আবার আনেকে বলেছেন, খন্দক তাঁর জীবনের প্রথম যুদ্ধ।৮ আল ওয়াকিদী বর্ণনা করেছেন, যায়িদ ইবন সাবিত বলেনঃ আমাকে বদর ও উহুদে অংশ গ্রহনের অনুমতি দেওয়া হয়নি। খন্দকে প্রথম অনুমতি পাই।৯ ইবন হিশামও বলেন, তাঁর বয়স কম হওয়ায় রাসূল (সা) অন্যদের সাথে তাঁকেও উহুদে ফিরিয়ে দেন।১০
হায়াতুস সাহাবা গ্রন্থে যায়িদ ইবন সাবিতের একটি বর্ণনা সংলিত হয়েছে। তাদ্বারা বুঝা যায়, তিনি উহুদে অংশ গ্রহন করেছিলেন। তিনি বলেনঃ উহুদের দিন যুদ্ধ শেষে রাসূল (সা) আমাকে সা’দ ইবনুর রাবীকে খুঁজতে পাঠালেন। যাবার সময় বলে দিলেনঃ যাদি তাঁকে পাও আমার সালাম জানাবে। আর তাকে বলবে রাসূলুল্লাহ (সা) জানতে চেয়েছেন, তুমি নিজেকে কেমন দেখতে পাচ্ছো?
যায়িদ বলেনঃ আমি শহীদদের মাঝে ঘুরে ঘুরে তাঁকে খুঁজতে লাগলাম। এক সময় পেয়ে গেলাম। তখন তাঁর অন্তিম মুহূর্ত। সারা দেহে তাঁর তীর, বর্শ ও তারবারির সত্তরটি আঘাত। বললামঃ সা’দ রাসূলুল্লাহ (সা) প্রতি সালাম এবং তোমার প্রতিও। তুমি বলবে, আমি জান্নাতের খোশবু লাভ করছি।১১
যাইহোক, খন্দক যুদ্ধে যে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন, এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। যায়িদ (রা) বলেনঃ রাসূল (সা) আমাকে খন্দকে আংশগ্রহণের অনুমতি দেন এবং এক খন্ড কুবতী (মিসরীয় সূক্ষè ও শুভ্র) বস্ত্র ও দান করেন।১২ খন্দক খনন ও মাটি বহনে অংশ নেন। এ অবস্থায় আম্মার একবার রাসূলুল্লাহর (সা) দৃষ্টিতে পড়লে তিনি মন্তব্য করেনঃ বেশ ভালো ছেলে তো।১৩ এই ঘটনাক্রমে একমসয় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এই অবস্থায় ইবন হাযাম একটু রসিকাত করে তাঁর কাঁধ থেকে অস্ত্র সরিয়ে নেন। যায়িদ টের পেলেন না। রাসূলুল্লাহ (সা) কাছেই ছিলেন। তিনিও একটু রস করে ডাক দিলেনঃ ইয়া আবা রুকাদ! ওহে নিদ্রাকাতর ব্যক্তি ওঠো। তারপর তিনি লোকদের এ ধরনের মশাকারা করতে নিষেধ দেন।১৪ এই খন্দক থেকে নিয়ে পরবর্তীকালের সকল যুদ্ধ ও অভিযানে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে অংশগ্রহণ করেন।১৫
তাবুক যুদ্ধের সময় হযরত যায়িদের (রা) গোত্র মালিক ইবন নাজ্জার ঝান্ডা প্রথম ছিল আম্মারা ইবন হাযামের হাতে। পরে রাসূল (সা) সেটি যায়িদের হাতে অর্পণ করেন। এতে আম্মার মানে করেন, হয়তো তাঁর কোন ক্রটি হয়েছে। তিনি প্রশ্ন করেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার কোন ক্রটি হয়েছে কি? তিনি জবাব দেনঃ না, তেমন কিছু নয়। আমি কুরআনের বিষয়টি প্রতি লক্ষ্য রেখে একাজ করেছি। যায়িদ তোমার চেয়ে বেশি কুরআন পড়েছি। কুরআনই অগ্রাধিকারযোগ্য।১৬
খলীফা হযরত আবু বকরের (রা) খিলাফাতকালে ভন্ড নবী মুসায়ালামা আল-কাজ্জাবের সাথে ইয়ামামার যুদ্ধ হয়। এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে যায়িদও (রা) অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর গায়ে একটি তীর লাগে। কিন্তু তিনি মারাতœক আঘাত থেকে বেঁচে যান।১৭ খলীফা উমারের (রা) আমালে খাইবার থেকে ইহুদীদের বিতাড়নের পর তথাকার ওয়াদি-উল-কুরা’ মুসলামানদের মধ্যে বন্টন করা হয়। যায়িদও (রা) একটি অংশ লাভ করেন।১৮
খলীফা উসমান (রা) যখন বিদ্রোহীদের দ্বারা গ্রহবন্দী তখন মদীনার বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি বিদ্রোহীদের সাথে লড়াবার জন্য খলীফার অনুমতি চান। এ সময় যায়িদ ইব্ন সাবিতও (রা) খলীফার সাথে দেখা করে বলেনঃ আনসাররা আপনার দরজায় হাজির আপনি চাইলে তারা আবারও আল্লাহর আনসার হিসাবে কাজ করতে প্রস্তুত। খলীফা বলেনঃ তোমারা যদি লড়াই করার ইচ্ছা করে থাক তাহলে তাতে আমার সম্মতি নাই।১৯
হযরত যায়িদ ইবন সাবিতের (রা) গোটা জীবন সৎকর্মের সমষ্টি। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) সেক্রেটারী। ওহী লিখতেন। রাসূলুল্লাহর (সা) চিঠি-পত্র লিখতেন এবং যে সব চিঠি-পত্র আসতো তা পাঠ করে শোনাতেন। পরবর্তীকালের খলীফা উমারেরও (রা) সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন।২০
পবিত্র কুরআন ইসলারে মূল ভিত্তি। এর সংগ্রহ ও সংকলন করার মহা গৌরবের অধিকারী হলেন কতিবুল ওহী যায়িদ ইবন সাবিত (রা)।২১ হযরত রাসূলে কারীমের (সা) জীবনকাল পর্যন্ত হাড়, চামড়া খেজুরের পাতা ও মুসামান হাফেজদের স্মৃতিতে কুরআন সংরক্ষিত ছিলো। বহু সাহাবী কুরআন মুখস্থ করেছিলেন। এ কল হাফেজদের মধ্যে যায়িদও একজন।
হযরত রাসূলের কারীমের (সা) ইনতিকালের পর আরব উপদ্বীপের একদল মানুষ মুরতাদ (ইসলাম ত্যাগ করা) হয়ে মুসায়লামা আলÑকাজ্জাবের দলে ভিড়ে যায়। সে ইয়ামামায়ে নিজেকে নবী বলে ঘোষনা করে। হযরত আবু বকর (রা) তার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষনা করেন। মুসয়ালামা ইয়ামামার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত হয়। তবে এ যুদ্ধে ৭০ জন হাফেজ কুরআন শাহাদাত বরণ করেন।
এ ঘটনার পর হযরত উমারের (রা) অন্তরে কুরআন সংগ্রহ করার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। তিনি খলীফা আবু বকরকে (রা) বলেন, এভাবে হাফেজদের শাহাদাতের ধারা অব্যাহত থাকলে কুরআনের বিরাট অংশ এক সময় হারিয়ে যাবার আশংকা আছে। সুতারং বিলম্ব না করে গোটা কুরআন এক স্থানে সংগ্রহ করার ব্যবস্থা নিন। খলীফা তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করেন। তিনি যায়িদ ইবন সাবিতকে ডেকে বলেন, তুমি একজন বুদ্ধিমান নওজোয়ান। তোমার প্রতি সবার আস্থা আছে। তুমি রাসূলুল্লাহর (সা) জীবদ্দশায় ওহী লিখেছিলে। সুতারা এ কাজটি সম্পাদন কর।২২
হযরত যায়িদ (রা) বলেনঃ আল্লাহর কসম! তাঁরা আমাকে কুরআন সংগ্রহ করার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা করার চেয়ে একটি পাহাড় সরানোর দায়িত্ব দিলে তা আমার কাছে অধিকতর সহজ হতো।২৩ তিনি খলীফাকে বললেনঃ তা ঠিক। তবে ভালো কাজে অসুবিধা কি? তারপরেও যায়িদ কাজটি করতে ইতস্তত করতে থাকেন। খলীফা বিভিন্নভাবে বুঝানোর পর তিনি রাজী হয়ে গেলেন।২৪
এ কাজে যায়িদকে সহোযোগিতার জন্য খলীফা আবু বকর (রা) আরও একদল সাহাবাকে দিলেন। দলটির সংখ্যা ৭৫ বলে বর্ণিত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে উবাই ইবন কা’ব ও সা’ ঈদ ইবনুল আসও (রা) ছিলেন। হযরত যায়িদ খেজুরের পাতা, পাতলা পাথর ও হাড়ের ওপর লেখা কুরআনের সকল অংশ সংগ্রহ করলেন। হাফেজদের পাঠের সাথে তা মিলিয়ে দেখলেন। তিনি নিজেও আল কুরআনের একজন হাফেজ ছিলেন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) জীবনকালে আল কুরআন সংগ্রহ করেছিলেন।২৫
আয়াতের সত্যতা এবং বিশুদ্ধাতা যাচাইয়ের জন্য ক্ষেত্র বিশেষে বিতর্ক ও ঝগড়ার পর্যায়ে চলে যেত। এক স্থানে পৌঁছে যায়িদ বললেন, এরপর আমি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট রজমের আয়াত থেকে শুনেছিলাম। হযরত উমার (রা) বললেনঃ কিন্তু রাসূল (সা) তা লেখার আনুতি দেননি।২৬ মোট কথা কঠোর পরিশ্রম করে হযরত যায়িদ (রা) এ গুরুত্বপূর্ন কাজ সমাপ্ত করেন।তাঁর দ্বারাই সম্পর্ণ আল কুরআন সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করা হয়।
একটি আয়াতের ব্যাপারে দ্বিতীয় কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রমানের নিয়ম ধরা হয়েছিল প্রতিটি আয়াতের ব্যাপারে কম পক্ষে দু’ ব্যক্তি সাক্ষ্য। আয়াতটি ছিল হযরত আবু খুযায়মার (রা) নিকট। ইনি সেই আবু খুযায়মা যাঁরা একার সক্ষ্যকে রাসূল (সা) দুজনের সাক্ষোর সমান বলে ঘোষনা দিয়েছিলেন। একারণে হযরত যায়িদ উক্ত আয়াতিটি ব্যাপারে দ্বিতীয় কোন সাক্ষ্যের প্রযোজন মনে করেননি। তাছাড়া আয়তটি তাঁর নিজের জানা ছিল।২৭ হযরত যায়িদ (রা) কর্তৃক সংগৃহীত ও লিখিত কুরআন মাজীদের এ কপিটি খলীফা হযরত আবু বকর (রা) নিজের হিফাজতে রাখেন। তাঁর ইনতিকালের পর দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমারের (রা) হাতে হয়ে তা তাঁর কণ্যা উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসার (রা) এর হাতে পৌঁছে এবং সেখানে সংরক্ষিত হয়।২৮
তৃতীয় খলীফা হযরত উসমানের (রা) খিলাফতকালে বিভিন্ন অঞ্চলে যখন আল কুরআনের পাঠে তারতম্য দেখা দেয় তখন হযরত হুজায়ফা ইবনুল ইয়মান (রা) খলীফাকে পরামর্শ দেন যে, ইহুদি ও নাসারাদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হওয়ার পূর্বেই আননি তা রোধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। খলীফাও এর গুরুত্ব ও প্রয়োজন অনুধাবন করেন। তিনি হযরত যায়িদের (রা) সংগৃহিত আল কুরআনের কপিটি হযরত হাফসার (রা)নিকট থেকে চেয়ে নেন। তারপর হযরত যায়িদ ইবন সাবিত, আবদুল্লাহ ইবনুয্য়ুবাইর, সা’ঈদ ইনুল আসও আবদুর রহমান ইবনুল হারেস ইবন হিশাম (রা) এ চারজন বিশিষ্ট সাহাবিকে তার থেকে কপি করার নির্দেশ দেন। তাঁর হযরত আবু বকর (রা) ঐ মূল কটি থেকে পাঁচ কপি নকল করে দেন। খলীফা উসমান (রা) এই কপিগুলো খিলাফতের পাঁচটি অঞ্চেলে পাঠিয়ে দেন এবং হযরত আবু বকর (রা) কর্তৃক প্রস্তুকৃত মূল কপটি যা মাহসাফে সিদ্দীকী নামে প্রসিদ্ধ -আবার হযরত হাফসার (রা) নিকট ফিরিয়ে দেন।২৯ নিরক্ষর নবী মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা) ওহী লেখার দায়িত্ব বিভিন্ন সাহাবীর ওপর অর্পণ করেছিলেন। এ সকল ভাগ্যবান সাহাবীর অন্যতম হলেন হযরত যায়িদ ইবন সাবিত (রা)।
হযরত যায়িদ কলম, কাগজ, দোয়াত, খেজুর পাতা, চাওড়া ও পাতলা হাড়, পাথর ইত্যাদি নিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) পাশে বসে যেতেন। যখন ওহী অবতীর্ণ হতো রাসূল (সা) বলে, যেতেন, আর তিনি লিখে চলতেন। লেখা সম্পর্কে বিশেষ কোন নির্দেশ থাকলে রাসূল (সা) তা বলে দিতেন, আর যায়িদ তদানুযায়ী কাজ করতেন।
ইমামা বুখারী (রহ) আল-বারা (রা) থেকে বর্ণনা করেছের। যখন সূরা আন-নিসার ৯৫ নং আয়াতটি-
(গৃহে উপবিষ্ট মুসলমান এবং ঐ মুসলমান য়ারা জান ও মাল দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে-সমান নয়।) নাযিজ হলো তখন রাসূল (সা) বললেনঃ কাঠ দোয়াত হাড়, নিয়ে যায়িদকে আমার কাছে আসতে বলো, যায়িদ এলে তিনি আয়াতটি লিখতে বললেন। রাসূলুল্লাহর (সা) পিছনে তখন অন্ধ সাহাবী আমার ইবন উম্মে মাকতুম বসা ছিলেন। তিনি বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ!আমার ব্যাপারে কি হুকুম? আমি তো একজন অন্ধ মানুষ। তখন যাদের কোন সঙ্গত ওযর নেই অংশটি নাযিল হয়। তখন রাসূল (সা) যায়িদকে আয়াতটি এভাবে সাজিয়ে বলেনঃ৩০ যায়িদ পরে অবতীর্ণ অংশটুকু হড়ের ফাটার মধ্যে লিখে নেন। কারন, যে হাড়টি মধ্যে পূর্বে আয়াতটি লেখা হয়েছিল তা ফাটা ছিল।৩১
রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতিকালের সাথে সাথে আনসাদের মধ্যে খিলাফতের বিষয়টি প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা সাকীফা বনী সায়িদায় সমবেত হন এবং তাদের নেতৃত্বের আসন অলস্কৃত করেন প্রখ্যাত আনসারী সাহাবী হযরত সাদ ইবন উবাদা (রা) তাঁরই মনোনীত ব্যক্তিরা সেখানে বক্তৃতা করছিলেন এবং আনসারদের একটি বড় দল ছিলেন তাঁর সমর্থক। এ মজলিসে যায়িদ ইবন সাবতও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু জনতার মতেন বিরুদ্ধে তখন কথা বলা সহজ ছিল না। এ জন্য তিনি চুপ করে বসে থাকতেন।
তারপর হযরত আবু বকর উমার ও আবু বকর উবাইদাহ (রা) সাকীফা বনী সায়িদাÑয় পৌঁছালেন এবং মুহাজিরদের পক্ষ থেকে উমার (রা) খিলাফাতের বিষয়টি আলোচনা শুরু করলেন। তখন সর্ব প্রথম যে আনসারী ব্যক্তি তাঁর বক্তব্য সমর্থন করেন তিনি যায়িদ ইবন সাবিত।
হযরত হুবাব ইবনুল মুনজির (রা) একজন আনসারী ও বদরী সাহাবী। তিনি যখন তাঁর বক্তৃতায় দুই আমীরের তত্ব পেশ করে মুহাজিরদের লক্ষ্য করে বললেনঃ আপনাদের মধ্য থেকে একজন এবং আমাদের মধ্যে থেকে একজন আমীর হবেন। এছাড়া আর কিছুতেই আপোষ হবেনা। তখন যায়িদ ইবন সাবিত উঠে দাঁড়ালেন এবং তাঁর বক্ত্যব্যের প্রতিবাদ করে এক নতুন তত্ব দিলেন। তিনি বলেনঃ রাসূল (সা) ছিলেন একজন মুহাজির। এখন ইমাও হবেন একজন মুহাজির। আর আমরা যেমন ছিলাম রাসূলের (সা) আনসার তেমনিভাবে এখন হবো ইমামের আনসার। একথা বলে তিনি আবু বকরের (রা) একটি হাত ধরে আনসারদের লক্ষ্য করে বলেনঃ এই তোমাদের বন্ধু তোমার হাতে বাইয়াত কর।৩২
হযরত যায়িদ (রা) এ বক্তব্য ছিল তারই গোত্রের লোকদের বিপক্ষে। তা সত্ত্বেও স্বীয় অনুভূতি প্রকাশ করতে কুন্ঠবোধ করেননি। তাঁর বক্তব্য শেষ হরে হযরত আবু বকর (রা) দাঁড়িয়ে যায তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে বরেন, আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দান দিন। যদি এর বিপরীত কিছু বলা হতো তাহলে আমার হয়তো মনতাম না।৩৩
হযরত রাসূলে করীম (সা) মদীনায় আসার পর পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ ও এলকার রাজা বাদশা, আমীর উমা, ও গোত্র প্রধানদের চিঠিপত্র বিভিন্ন সময় তাঁর নিকট আসতে থাকে। যার বেশীর ভাগই হতো সুরইয়সী ও ইবরানী হিব্র“ ভাষায়। মদীনায় তখন এ দুটি ভাষা জানতো শুধু ইহুদিরা। তাদের ছির আাবার ইসলামের সাথে চরম দুশমনী। এ কারণে উক্ত ভাষা দুটি আয়ত্ত করা ছিল মুসলমাদের একান্ত প্রয়োজন।
হযরত রাসূলে করীম (সা) এ প্রয়োজনে তীব্রভাবে অনুভব করলেন। তিনি হযরত যায়িদের (রা) মেধার পরিচয় পেয়ে তাঁকেই এ কাজের জন্য নির্বাচিত করলেন। এ প্রসঙ্গে হযরত যায়িদের (রা) একটি বর্ণনা উদ্ধৃত হলোঃ
রাসূল (সা) মদীনায় এলে আমাকে তাঁর সামনে হাজির করা হয়। তিনি আমাকে বললেনঃ যায়িদ আমার জন্য তুমি ইহুদিদের লেখা শিখ। আল্লাহর কসম! তারা আমার পক্ষ থেকেইবরানী ভাষায় যা কিছু লিখা থাকে তার ওপর আমার আস্থা হয় না। তাই আমি ইবরনী ভাষা শিখলাম। মাত্র আধা মাসের মধ্যে এতে দক্ষতা অর্জন করে ফেললাম। তারপর রাসূলুল্লাহর (সা) ইহুদীদেরকে কিছু লেখার দরকার হলে আমিই লিখতাম এবং রাসূলকে (সা) কিছু লিখলে আমিই তা পাঠ করে শুনাতাম।
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে। রাসূল (সা) আমাকে বললেনঃ যায়িদ তুমি কি সুরইয়ানী ভাষা ভালো জান? এ ভাষায় আমার কাছে টিঠি পত্র আসে। বললামঃ না। তিনি বললেনঃ তাহলে এ ভাষাটি লিখে ফেল। এরপর আমি মাত্র সতের দিনে ভাষাটি শিখে ফেললাম।৩৪
যায়িদের (রা) এই সীমাহীন মেধা ও জ্ঞানের কারণে হযরত রসূলে কারীম (সা) যাবতীয় লেখালেখির দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পণ করেন। মুহাম্মদ ইব উমার বলেনঃ যায়িদ আরবী ও ইবরানীÑদু ভাষাতেই লিখতেন।৩৫ বালাজুরী বলেনঃ সর্ব প্রথম রাসূলুল্লাহর (সা) সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন উবাই ইবন কা’ব আলÑআনসারী। উবাই এর অনুপস্থিতিতে যায়িদ এ দায়িত্ব পালন করের। তাঁরা ওহী ছাড়াও রাসূলুল্লাহর (সা) চিঠি পত্র ও লিখতেন।৩৬ রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতিকাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। হযরত আবু বকর (রা) ও উমারের (রা) খিলাফত কালেও এ দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। তাবে তখন কাজের চাপ অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় মুয়াইকিব আদÑদাওসীকে তাঁর সহকারী নিয়োগ করা হয়।৩৭
ইসলামী হুকুমাতের একটি অতি মর্যাদাপূর্ন দফতর হলো বিচার বা কাজা। প্রসিদ্ধ মতে এ দফতারটি সৃষ্টি হয় হযরত ফারুকে আজমের খিলাফতকালে। রাষূল (সা) ও আবু বকরের (রা) আমলে পৃথকভাবে এ দফতরটি ছিল না। খলীফা হযরত উমার (রা) এর সূচনা করেন এবং হযরত যায়িদ ইবন সাবিতকে (রা) মদীনায় কাজী নিয়োগ করেন। তাবাকাত ইবন সা’দ ও আথবারুল কুজাত গ্রন্থে এসেছেঃ উমার (রা) যায়িদকে কাজী নিয়োগ কেরন এবং তাঁর ভাতাও বির্ধারণ করেন।৩৮
তখনও বিচারকের জন্য পৃথক আদালত ভবন বাড়ি নির্মাণ হয়নি। হযরত যায়িদের (রা) বড়িই ছিল দারুল কাজা বা বিচারলয়। ঘরের মেঝেতে ফরাশ বিছানো থাকতো। তিনি তার ওপর মাঝখানে বসতেন। রাজধানী মদীনা ও তার আশে পামের যাবতীয় মামলা মোকদ্দামা হযরত যায়িদের (রা) এজলাসে উপস্থিত হতো। এমন কি তৎকালীন খলীফা খোদ উমারের (রা) বিরুদ্ধেও এখানে মামলা দায়ের হয়েছে এবং তার বিচারও চলেছে।
ইমাম শা’বী বর্ণনা করেছেন। একবার খলীফা হযরত উমার (রা) ও হযরত উবাই ইবর কাবের (রা) মধ্যে একটি বিবাদ দেখা দিল। হযরত যায়িদের (রা) এজলাশে মুকাদ্দামা পেশ হলে। বিবাদী হিসাবে খলীফা উমার (রা) আদালতে হাজির হরেন। আধুনিক যুগে যেমন আাদালতে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপ্রধানে বসার জন্য চেয়ার দানের নিয়ম হয়েছে, হযরত যায়িদ ও তমেনী খলীফাকে নিচের আসনের পাশে বসার স্তানে করে দেন। কিন্তু ইসলাম যে সাম্য ও মসাতার বিধান কায়েম করেছিল, সাহাবায়ে কিরাম (রা) তা অত্যন্ত কঠোরভাবে মেনে চলতেন। বিশেষত হযরত উমার(রা) তো এ ব্যাপারে ছিরেন আপোষহীন। তিনি বিচারক হযরত যায়িদের (রা) এ আচরণে ক্ষুদ্ধ হয়ে বলেন, এ হলো আপনার প্রথম অবিচার। আমাকে আমার প্রতিপক্ষের সাথে বসা উচিত। অতঃপর বাদী বিবাদী উভয়ে আদালতের সাম্েন এক সাথে বসেন।
মামলার শুনানী শুরু হলো। হযরত উবাই (রা) ছিলেন বাদী। তিনি ছিলেন একটি বিষয়ের দাবীদার; পক্ষান্তরে উমার (রা) চিলৈলন অস্বীকারী। ইসলামী বিচার বিধি অনুাযায়ি অস্বীকারকরীর ওপর বসম বাশপথ দেওয়া ওয়াজিব। কিন্তু হযরত যায়িদ (রা)খিলাফতের সম্মান ও মর্যাদার প্রতিলক্ষরেখে বাদীকে বলেন, যদিও নিয়ম নয় তবুও আমি বলছি আপনি আমীরুল মুমিনীনকে কসম দানের বিষয়টি মাফ করেদিন। একথা শুনে আমীরুল মুমিনীন ক্ষোভের সাথে বললেনঃ যায়িদ ন্যায় বিচারক হতে পারবেন, যতক্ষন না উমাও সাধারন একজন মুসলমান তাঁর নিকট সমান হয়।৩৯
তৎকালীন খিলাফতের বিভিন্ন স্থানে যদিও একাধিক স্থানীয় বাইতুল মাল ছিল, তবুও দারুল খিলাফা মদীনায় ছিল কেন্দ্রীয় বাইতুলমাল। হযরত যায়িদ (রা) ছিরেন এই কেন্দ্রীয় বাইতুলামলের দায়িত্বশীল। হিজরী ৩১ সনে খলীফা উসমান (রা) তাঁকে এ দায়িত্বে নিয়োগ কেরন। এই বাইতুলামলের কর্মচারীদের মধ্যে ওহাইব নামে যায়িদের (রা) একজন দাসও ছিলেন। তিনি চিরৈন খুবই বুদ্ধিমান। নানা কাজে যায়িদকে (রা) সাহায্য করতেন।
একদিন তিনি বাইতুল মালে কাজ করছেন। এমন সময় খলীফা উসমান (রা) সেখানে উপস্থিত হন। তিনি জিজ্ঞেসা করেনঃ এ কে? যায়েদ বলেনঃ আমার দাস। উসমান (রা) বলেনঃ আমাদের নিকট তার অধিকার আছে। কারণ সে মুসলমানদের সাহয্য করছে। মূলত তিনি বাইতুলমালের কাজের প্রতি ইঙ্গিত কারেন। তারপর তিনি দু হাজার দিরহাম তাঁর বেতন নির্ধারনের ইচ্ছা করেন। কিন্তু হযরত যায়িদ এক হাজার করার প্রস্তাব রাখেন। খলীফা তাতে রাজী হন। এভাবে তাঁর বেতন এক হাজার নির্ধারিত হয়।৪০ খলীফা হযরত আবু বকরের (রা) আমালে মুহাজির ও আনসারদের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বেয়ে গঠিত মজলিসে শূরার একজন সম্মনিত সদস্য ছিলেন যায়িদ (রা)। খলীফা উমার (রা) উক্ত শূলাকে একটি উপদেষ্ট কাউন্সিলের রুপ দান করেন। যায়িদ (রা) তারও সদস্য ছিলেন।
হযরত যায়িদেরও (রা) মধ্যে ইল্ম ও দ্বীনের পূর্র্ণতার সাথে প্রশাসনিক যোগ্যতাও ছিল। তাঁর ওপর খলীফা উমারের (রা) এতখানি আস্তা ছিল যে, যখনি তিনি মদীনার বাইরে সফরে যেতেন, তাঁকেই স্থালাভিষিক্ত করে যেতেন। খলীফা উসমানও (রা) একই পন্থা অনুসারণ করেন। ইবন উমারের থেকে নাফে বর্ণনা করেছেন। উমার (রা) যখন হজ্জে যেতেন, যায়িদকে স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন। উসমানও তাই করতেন।৪১
হযরত উমারের (রা) খিলাফতকালে মোট তিনবার খলীফার স্থলভিষিক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। হিজরী ১৬ ও ১৭ সনে দু’বার। বালাজুরী বলেনঃ হিজরী ২৩ সনে রাসূলুল্লাহর (সা) সহধমির্নীদের সাথে নিয়ে উমার হজ্জ করেন। তখনও যায়িদ ইবন সাবিতকে মদীনায় স্থলাভিষিক্ত করে যান।৪২ খলীফা উমার (রা) যখন শাম সফর করেন তখনও যায়িদকে (রা) দায়িত্ব দিয়ে যান। শামে পৌঁছে তিনি যায়িদের নিকট ওয পত্র লেখেন তাতে যায়িদরে সামটি খলীফার নিজের নামের আগেই উল্লেখ করেন। তিনি লেখেনঃ
-যায়িদ ইবন সাবিতের প্রতি উমার ইবনুল খাত্তাবের নিকট থেকে।৪৩
হযরত যায়িদ (র) অত্যন্ত সসতর্কতা ও যোগ্যতার সাথে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। হযরত উমার (রা) তাঁর দায়িত্ব পালনে খুশী হতেন এবং ফিরে এসে তাঁকে রাষ্টের পক্ষ থেকে কিছু না কিছু দান করতেন।
হাদীসে এসেছে, ঈমানের সত্তরটিও বেশী শাখা আছে। তার মধ্যে আমানদারী বা বিশ্বস্তাতা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এমন কি রাসূলে (সা) বলেছেনঃ যার আমানতদারী নেই তার ঈমানও নেই। হযরত যায়িদ (রা) মধ্যে এ আমানাদতদারীর পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল। তাই রাষ্ট্রের অর্থ বিষয়ক অনেক গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব বিভিন্ন সময় তাঁর ওপর অর্পিত হয়েছে।
হযরত রাসূলে করীমের (সা) সময়কালে যে গনীমাতের মাল আসতো তার বেশীর ভাগ তিনি নিজ হাতে বন্টন করতেন। এতে একাজটি গুরুত্ব কত খানি তা বুঝা যায়। হযরত উমারের (রা) খিলাফতকালে ইযারমুকের যুদ্ধটি অতি প্রসিদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ। এ যুদ্ধে প্রাপ্ত গনীামতের বিপুল পরিমান সম্পদ বন্টনের ভার খলঅফা অর্পন করেছিলেন যায়িদের ওপর। তাছাড়া খলীফা উমার (রা) যখন সাহাবাদের ভাতা নির্ধারণ করেন তখন আনাসাদের ভাতা বন্টনের দায়িত্ব তাঁকেই দেন। তিনি আয়ালী থেকে শুরু করেন। তারপর যাথাক্রমে আবদুল আশহাল, আউস, খাযরাজ প্রভৃতি গোত্রে বন্টন করে সব শেষে নিজের ভাতা গ্রহণ করেন।৪৪
হযরত যায়িদ (রা) ছিলেন খলীফার দরবারের অতি ঘনিষ্টজন। হযরত উমারের (রা) নিকটতম ব্যক্তিগেদর মধ্যে তাঁর স্থান ছিল শীর্ষে। খলীফা উসমানেরও (রা) তিনি বিশ্বাসভাজন ছিলেন। তাঁর খিলাফতের শেষ দিকে যখন চতুর্র্দিকে বিদ্রোহ ও অশান্তি ধূমায়িত হয়ে ওঠে তখনও যায়িদ (রা) ছিলেন খলীফার পক্ষে। সেই হাঙ্গামা ও বিশৃংখলার মধ্যে তিনি একদিন আনসারদের সম্বোধনরা করে বলেনঃ ওহে আনসার সম্প্রদায়! তোমারা আরো একবার আল্লাহর আনাসার হও। দুঃখের বিষয় হযরত যায়িদের(রা) মত ব্যক্তির সে দিন ইতিহার সেই চরম ট্রাজেডী রুখতে পারেননি।
এই ব্যর্থতার কারণও ছিল। কিছু সাহাবায়ে কিরাম (রা) কেন যে হযরত উসমানের (রা) প্রতি সেদিন ক্ষুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে হযরত আবু আইউব আল-আনসারীর (রা) মত বিশিষ্ট সাহাবীও ছিলেন। তিনি হযরত যায়িদের (রা) কথার প্রতিবাদ করে বললেনঃ উসমানের সাহায্যের জন্য তুমি মানুষকে এজন্য উৎসাহিত করছে যে, তিনি তোমাকে বহু দাস দিয়েছেন। হযরত আবু আইউব (রা) ছিলেন বিশাল মর্যদার অধিকারী একজন আনসারী সাহাবী। তাঁর সামনে হযরত যায়িদের (রা) চুপ করে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিলনা।
তাহজীবুল কামাল গ্রন্থাকার হযরত যায়িদের (রা) একাধিক স্ত্রী ও ঊনত্রিশজন ছেলে-মেয়ের নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে প্রখ্যাত শহীদ সাহাবী হযরত সা’দ ইবন রাবী’ আল-আনাসারীর কণ্যা একজন।৪৫
হযরত সা’দ ইবন রাবী ’ (রা) উহুদে শহাদাত বরণ করেন। দু’কন্যা ও স্ত্রী ও রেখে যান। স্ত্রী তখন গর্ভবর্তী। গর্ভের এই সন্তটিই উম্মু সা’দ বা উম্মুল আলা। ভালো নামস জামীলা। পরবর্তীকালে তিনিই যায়িদের (রা) সম্মানিত স্ত্রী। সা’দ (রা) যখন মারা যান তভন মীরামের আয়াতনাযিন হয়নি। এ কারণ জাহিলী প্রথা অনুযায়ী সাদের ভাই গোটা মীরাস আতœাসাৎ করে। তখনই রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট মীরাসের আয়াত নাযিল হয়। তিনি সাদের (রা) ভাইকে ডেকে ২/৩ অংশ দু’ কন্যা এবং ১/২ অংশ স্ত্রীকে দিয়ে বাকী অংশ গ্রহণের নির্দেশ দেন। তখনও গর্ভের সন্তানকে মীরাস দানের বিধান চালু হয়নি। পরবর্তীকালের খলীফা উমার (রা) গর্ভের সন্তানকে মীরস দানের বিধান চালু করলে হযরত যাযিদ স্ত্রীকে বললেনঃ তুমি যদি চাও তাহলে তোমার পিতার মীরাসের ব্যাপারে তোমার বোনদের সাথে কথা বলতে পার। কারণ, এখন আমীরুল মুমিনীন গর্ভের সন্তানদের মীরস ঘোষনা করেছেন। উম্মু সা’দ বললেনঃ না, আমি আমার বোনদের কাছে কিছুই চাইবো না।৪৬
হযরত যায়িদের (রা) সন্তানদের মধ্যে খারিজ ছিলেন সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। তিনি বিখ্যাত সাতজন ফক্হীর অন্যত এবং উম্মু সা’ দের গর্ভজাত সন্তান। তাঁর দ্বিতীয় সন্তান এবং একজন পৌত্রও নিজেদের যুগের বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁরা হাদীস শাস্ত্রের ইমাম হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর আযাদকৃত দাসের সংখ্যাও ছিল অনেক। তাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন সাবিত ইবন উবাইদ ও ওহাইব।
হযরত যায়িদের (রা) মৃত্যু সন সম্পর্কে প্রচুর মতভেদ আছে। ওয়াকিদীর মতে হিজরী ৪৫ সন। আলী-আল মদীনীর মতে হিঃ ৫১ আহমাদ ইবন হাম্বল ও আবু হাফ্স আলÑফাল্লাসের মতে হিঃ ৫১ এবং আলÑহায়সাম ইবন আদী ও অইয়াহইয়া ইবন মুঈেনের মতে হিঃ ৫৫ সনে তিনি মারা যান।৪৭ ইবন হাজার (রহ) বলেনঃ অধিকাংশের মতে হিজরী ৪৫ সনে তিনি মারা গেছেন।৪৮ মৃত্যাকলে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৪/৫৫ বছর। মারওয়ান ইবন হাকাম তখন মদীনার আমীর। তাঁর সাথে যায়িদের (র) অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। তিনিই জানাযান নামায পড়ান।৪৯ তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনে জনগন শোকভিত হয়ে পড়েন। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনে জনগন শোকাভূত হয়ে পড়েন। হযরত আবু হুরাইরা (রা) তাঁর মৃত্যুর দিন মন্তব্য করেনঃ আজ হাবরুল উম্মাহ’ উম্মাতের ধর্মীয় নেতা চলে গেলেন।৫০ সালেম ইব আবদুল্লাহ বলেনঃ যায়িদ ইবন সাবিত যে দিন মারা যান সেদিন আমারা আবদুল্লাহ ইবন উমারের (রা) সংগে ছিলাম। আমি বললামঃ আজ জনগণের শিক্ষক মারা গেলেন। ইবন উমার (রা) বললেনঃ আল্লাহ তাখে রহম করুন। উমারের (রা) খিলাফতকালে তিনি ছিলেন জনগণের শিক্ষক ও হাবর (ধর্মীয় নেতা)।৫১
প্রখ্যাত তাবেঈ ইবনুল মুসায়্যাব বলেনঃ আমি যায়িদ ইবন সাবিতের (রা) জানাযায় শরীক ছিলাম যখন তাঁকে কবরে নামানো হলো ইবন আব্বাস (রা) তোমারা যারা ইলম কিভাবে উঠে যায় তা জানতে চাও তারা জেনে নাও এভবে ইলম উঠে যায়। আজ বহু ইলম চলে গলে। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেনঃ আজ অনেক ইলম দাফন হয়ে গেল। হাত দিয়ে কবরের দিকে ইঙ্গিত করে বলেনঃ এভাবে ইলম চলে যায়। একজন মানুষ মারা যায় এবং সে জানতে তা যদি অন্যরা না জানে তাহলে সে তার জ্ঞান নিয়েই কবরে চলে যায়।৫২ কবি হাসনাস ইÍ সাবিত (রা) একটি শোকাগাঁধা রচনা করেন। তাঁর একটি পংক্তি নিম্নরুপঃ৫৩
-হাস্সান ও তার পুত্রের পর কবিতার ছন্দ কে আর রচনা করবে?
বিরাআত, ফারেয়েজ, বিচার ও ফাতাওয় শাস্ত্রে হযরত যায়িদ (রা) ছিলেন একজন বিশেষজ্ঞ। পবিত্র কুরআনের ভাষায় তিনি রাসখ ফিল ইলম (জ্ঞানে সুগভীর)। হযরত আবদ্ল্লুাহ ইবন আব্বাস (রা) যাকে সাহাবাদের মধ্যে ইলমের সাগর গণ্য করা হতো তিনিও যায়িদকে রাসেখ ফিল ইলম গন্য করতেন।৫৪ ইবনুল আসীরের মতে তিনি সাহাবা সমাজের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন।৫৫ হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদের (রা) অন্যতম শ্রেষ্ট ছাত্র মাসরুক ইবন আজাদা বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবাদের মধ্যে ইলম জ্ঞান পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেছি। তাঁদের সকালের জ্ঞানের সমাবেশ ঘটেছে উমার, আলী আবদুল্লাহ মুয়াজ আবুদ দারদা ও যায়িদ ইবন সাবিত এই ছয়জনের মধ্যে। তিনি আরো বলেনঃ আমি দীনায় গিয়ে রাসূলুল্লহার (সা) সাহাবীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, যায়িদ ইবন সাবিত আর রাসেখুনা ফিল ইলম এর অন্যতম ব্যক্তি।৫৬
ইসলাম যে সকল জ্ঞানÑবিজ্ঞানের ভিত্তিস্থাপন করেছে ইলমে কিরাআত তার মেধ্য বিশেষ উল্লেখ যোগ্য। এ শাস্ত্রে হযরত যায়িদের পন্ডিত্য সাহাবায়ে কিরম ও তাবেঈনের প্রতিটি ব্যক্তি স্বীকার করতেন।
ইমাম শী’বীর মত শেষ্ট বিদ্বান তাবেঈ বলেনঃ যায়িদ ইলমে ফারায়েজের মত ইলমে কুরআতে ও সকল সাহাবীর ওপর শ্রেষ্টত্ব অর্জন করেছিলেন।৫৭
পবিত্র কুরআনের সাথে হযরত যায়িদের (রা) যে গভীর সম্পর্ক ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর ইসলাম গ্রহণের সময়ের ঘটনা দ্বারা। মাত্র এগারো বছর বয়সে ১৭টি সূরা হিফজ করেন। অবশিষ্ট সূরা হিফজ করেন। জীবনে কুরআরন লেখালেখির মধ্যেই অতিবাহিত হয়। রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যখন যতটুকু ওহী নাযিল হতো তিনি জেনে লিখে নিতেন ও মুখস্থ করে ফেলতেন। এভাবে রাসূলুল্লাহর (সা) জীবদ্দশায় গোটা কুরআন তাঁর মুখস্থ হয়ে যায়।৫৮ কাতাদাহ্ বলেনঃ চারজন তাঁদের সবাই আনাসার উবাই ইবন কা’ব মুয়াজ ইবন জাবাল, যায়িদ ইবন সাবিত ও আবু যায়িদ।৫৯ এ কারণে খলীফা আবু বকর (রা) যখন কুরআন সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নেনতখন এ দাযিত্ব পালনের জন্য যায়িদকে নির্বাচিত করেন। আর খলীফা উসমান যখন কুরআনের কপি তৈরী করান তখনও এ কাজে যায়িদের (রা) সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য মনে করেন।
হযরত উবাই ইবন কা’ব (রা) ছিলেন কুরার বা কুরআন পঠকদের নেতা। হযরত উমার (র) যায়িদকে তাঁরও ওপর প্রাধান্য দিতেন। আবদুর রহমান আসসুলামী একবার খলীফা উসমানকে কুরআন পাঠ করে শুনাতে চাইলে তিনি বললেন তাহলে তো তুমি আমাকে মানুষের কাজ থেকে বিরত রাখবে। তুমি বরং যায়িদ ইবন সাবিতের কাছে যাও। এ কাজের জন্য তাঁর হাতে বেশী সময় আছে। তাঁকে শুনাও তাঁর ও আমার পাঠ একই। দু জনের পাঠে কোন ভিন্নতা নেই।৬০
হযরত যায়িদের কিরাআতের সিলসিলা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত চিল। সেহেতু তিনি কুরাইশদের মত পাঠ করতেন এ কারণে মানুষের ঝোঁক ছিল তাঁরই দিকে। হযরত উবাই ইবন কাবের জীবদ্দশায় যদিও তিনি এক্ষেত্রে সকলের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারেননি, তবে তাঁর মৃত্যুর পর গোটা মুসলিম বিশ্বের একক কেন্দ্রে পরিণত হন। বিভিন্ন অঞ্চলের মাসুষ মদীনায় তাঁর নিকট ছুটে আসতো।
গযরদ যায়িদ (রা) কুরআন মাজীদের যে কিরআত বা পাঠ প্রতিষ্টা করেন তা আজও বেঁচে আছে। ইবন আব্বাস, আবু আবদির রহমান, আসÑসুলামী, আবুল আলিয়া রাইয়্যাহী, আবু জাফর প্রমুখ ছিলেন কিরআত শাস্ত্রে তাঁর ছাত্র।৬১
পবিত্র কুরআনের পরেই মাহানবীর স্থান। তিনি অন্যদের মত বেশী হাদীস বর্ণনা করেননি। তবে তাঁর বৈশিষ্ট এই ছিল যে তিনি দিরায়াত বা যুক্তিকে কাজে লাগাতেন। হযরত রাফে ইবন খাদীজা (রা) বর্ণনা করলেন, রাসূল (সা) ভূমি ইজারা দিতে নিষেধ করেছেন। এ কথা যায়িদের (রা) কানে গেলে বললেনঃ আল্লাহ রাফেকে ক্ষা করুন! তাঁর এত বেশি হাদীস বর্ণনার রহস্য আমর জানা আছে। আসল ঘটনা হলো। দু ব্যক্তি ঝগড়া করছিল। রাসূল (সা) তা দেখে বলেন এই যে যদি অবস্থা হয় তাহলে ইজারার ভিত্তিতে ভূমি চাষ করা উচিত নয়। রাফে শুধু শেষের অংশটুকু শুনেছেন।৬২
হযরত আয়িশা (রা) যুবইরের (রা) সন্তনাদের নিকট বর্ণনা করেন, যে রাসূল (সা) আসরের পরে তাঁর ঘরে দু রাকাত নামায আদায় করেছিলেন। তাঁরা এ দু’ রাকায়াতকে সুন্নাত মনে করে আদায় করা শুরু করেন। এ কথা যায়িদ (রা) জানতে পেরে বললেনঃ আল্লাহ আয়িশাকে ক্ষমা করুন! হাদীসের জ্ঞান তাঁর চেয়ে আমরা বেশী আছে। আসরের পরে নামায আদায়ের কারণ হলো, দুপুরে কয়েকজন বেদুঈন রাসূলুল্লাহর (সা) সাথেঞ সাক্ষাৎ করতে আসে। তারা প্রশ্ন করছিল, আর রাসূল (সা) উত্তর দিচ্ছিলেন। এভাবে জুহরের নামাজের সময হলে তা আদায় করেন। ঘরে ফেরার পর স্মরণ হয় যে, জুহরের ফরজের পরের দু’রাকা’য়াত সুন্নাত আদায় করেননি।তখন সেখানেই দু’রাকা’ য়েত নামায আদায় করেন। আল্লাহ আয়িশাকে ক্ষমা করুন। তাঁর চেয়ে আমর বেশী জানা আছে যে, রাসূল (সা) আসরে পরে নামায পড়তে নিষেধ করেছেন।৬৩
কোন হাদীস সহীহ হলে এবং সে সম্পর্কে তাঁর নিকট কেউ জিজ্ঞেসা করলে তিনি সমর্থন জানাতেন। একবার হযরত আবু সা’ঈদ খুদরী (রা) স্বৈরাচারী উমাইয়্যা শাসক মারওয়ানের সামনে সাহাবীদের মর্যদাবিষয়ক একটি হাদীস বর্ণনা করেন। মারওয়ানত বললেনঃ আপনি অসত্য বলছেন। যায়িদ ইবন সাবিত ও রাফে ইবন খাদীজা (রা) মারওয়ানের পাশে মঞ্চে বসে ছিলেন। আবু সা’ঈদ মারওয়ানকে বললেন, আপনি তাঁদের কাছে জিজ্ঞেসা করতে পারেন। মারওয়ান তা না করে আবু সা’ঈদকে মারার জন্য ছুড়ি তুলে ধরেন। তখন এ দুই মাহান সাহাবী আবু সা’ঈদের কথা সত্য বরে সামর্থন করেন।৬৪
হযরত যায়িদের (রা) অধিকাংশ হাদীস সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে বর্ণিত। তাছাড়া আবু বকর উমার ও উসমান (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস বর্ণনা করেছেন।৬৫
হাদীস শাস্ত্রে তাঁর ছাত্রদের তালিকা অনেক দীঘ। তাঁর কাছে যাঁরা হাদীস শুনেছেরন এবং তাঁঁর সুত্রে বর্ণনা করেছেন, এমন কয়েকজন বিখ্যাত সাহাবী ও তাবেঈর নাম এখানে উল্লেখ করা হলো।৬৬
ইবন আব্বাস, ইবন উমার, আনাস ইবন মালিক, আবু হুরাইরা, আবু সা’ঈদ খুদরী, সাহ্ল ইবন হুনাইফ, সাহ্ল ইবন সা’দ, আবদুল্লাহ ইবন ইয়াযীদ আলÑখুতামী। এরা সকলে সাহাবী। সা’ঈদ ইবন মুসাইয়্যাব, কাসেম ইবন মুহাম্মদ, আবান ইবন উসমান, খারেজা ইবন যায়িদ (যায়িদের ছেলে এবং মীনার সপ্ত ফুকাহার এরকজন), সাহ্ল ইবন আবী হাসামা আবু আমার, মারওয়ান ইবন হাজম, ইবাইদ ইবন সাব্বাক, আতা ইবন ইয়াসার বুসর ইবন সা’ঈদ, হাজার আলÑমুদরী, তাউস, উরওয়া ইবন যুবাইর, সালমান ইবন যায়িদ, সাবিত ইবন উবাইদ, উম্মু সা’দ (যায়িদের স্ত্রী)। এছাড়া আরো আনেক। হযরত যায়িদের (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা তুলনামূলকভবে অনেক কম। মাত্র ৯২ (বিরানব্বই) টি। তারমধ্যে পাঁচটি মুত্তফাক আলাইহি হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বনের কারণে তাঁর হাদীসের সংখ্যা এত কম হয়েছে। অন্যথায় তাঁর অধিকাংশ সময় রাসূলুল্লাহর (সা) দরবারে থাকা পড়েছে, বহু হাদীস শোনা এবং বহু ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্যও হয়েছে। এত কম হাদীস বর্ণনার কারণ হলো, রাসূলুল্লাহর (সা) একটি সতর্কবাণী। আর সে বানীই তাঁর মত আরও অনেককে বেশী হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে সংযমী করে তুলেছে। মুহাম্মদ ইবন সা’দ তাঁর তাবাকাতে আনসারদের তৃতীয় তাবকায় তাঁকে উল্লেখ করেছেন। আল্লামা জাহাবী তাজকিরাতুর হাফ্ফজ গ্রন্থে প্রথম তাবারয় তাঁর আলোচনা এনেছেন।
ফিকাহ্ শাস্ত্রে হযরত যায়িদ (রা) দারুণ পারদর্শী ছিলেন। রাসূলুল্লাহর (সা) জীবদ্দশায় ইফতার আসনে অধিষ্টিত হন। সাহ্ল ইবন আবী খায়সামা বলেনঃ রাসূলুল্লাহর (সা) জীবদ্দশায় মুহাজীরদের তিন ব্যক্তি ও আনসারদের তিন ব্যক্তি ফাতওয়া দিতেন। আনসারদের সেই তিন জনের একজন হলেন যায়িদ ইবন সাবিত (রা)।৬৭ ইমাম শা’বী ও প্রখ্যাত তাবে’ঈ মাসরুক একই ধরনের কথা বর্ণনা করেছেন।৬৮ হযরত আবু বকর (রা) ও উমারের (রা) খিলাফতকালেও তিনি মদীনায় ইফতার মসনতেদ আসীন ছিলেন। শুধু তাই নয় হিজরী ৪৫ সন পর্যন্ত আমারণ এ পদে অধিষ্টিত থাকেন। ইবন সা’দ বর্ণণা করেছেন। খলীফা আবু বকর (রা) কোন জটিল সমস্যার সম্মুখীন হলে কতিপয় চিন্তাশীল ও ফিকাহবিদ আনাসার ও মুহজির সাহাবীর সাথে পরামর্শ করতেন। তাঁদের মধ্যে যায়িদ ইবন সাবিতও একজন। আর তাঁরই আবু বকর, উমার ও উসমানের (রা) যুদে ফাতওয়া দিতেন।৬৯
কাবীস ইবন জুওয়াইব বর্ণনা করেছেন যে উমার, উসমান,আলীর (রা) আমলে এমনকি হিজরী ৪০ সনে মু’য়াবিয়ার (রা) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর হিজরী ৪৫ সনে মৃত্যু পর্যন্ত যায়িদ (রা) মদীনার বিচার ও ফাতওয়া, কিরাআত ও ফারায়েজ শাস্ত্রের প্রধান ছিলেন।৭০ তাঁর যোগ্যতার পূর্ণ স্বীকৃতি খলীফা উমার (রা) দিয়েছেনভ তিনি যায়িদকে (রা) এত গুরুত্ব দিতেন যে তাঁকে মদীনার বাইরে কোথাও যাওয়ার অনুমতি দিতেন না। মদীনার বইরে বিভিন্ন স্থানে অতি গরুত্বপূর্ণ পদ শূণ্য হতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী সম্পদনের জন্য উপযুক্ত লোকের প্রয়োজন দেখা দিত, আর সেজন্য খলীফার নিকট বিভিন্ন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করা হতো। তিনি তাঁদের কাউকে মনোনীত করতেন। কিন্তু যায়িদের নামাটি প্রস্তাব করা হেলই তিনি বলতেন, যায়িদ আমার হিসাবের বাইরে নেই। কিন্তু আমি কি করবো? মদীনাবাসী তাঁর মুখাপেক্ষী বেশী। কারণ তাঁর কাছে যা পারে অন্যার কাছে তা তারা পারে না।৭১
হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার বলতেন, যায়িদ ছিলেন ফারুকী খিলাফতের একজন বড় আলীম। উমার (রা) সকল মানুষকে নানা দেশে ও শহরে ছড়িযে দিয়েছিলেন। ফাতওয়া ও সিন্ধন্ত দানের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। কিন্তু যায়িদ মদীনায় বসে বসে মদীনাবাসী এবং সেখানে আগত লোকদের নিকট ফাতওয়া দিতেন।৭২
সুলায়মান ইবন ইয়াসার বলেনঃ ফাতওয়া, ফারায়েজ ও কিরাআতে উমার ও উসমান (রা) যায়িদের (রা) ওপর কাউকে প্রাধান্য দিতেন না।৭৩ প্রখ্যাত তাবেঈ হযরত সা’ঈদ ইবন মুসায়্যাব একজন মস্তবড় মুজতাহিদ হওয়া সত্বেও ফাতওয়া বিচারে হযরত যায়িদের (রা) অনুসারী ছিলেন। তাঁর সামনে যখন কোন মাসয়ালা বা প্রশ্ন আসতো এবং মানুষ অন্যান্য সাহাবীর ইজতিহাদসমূহ বর্ণনা করতো তখন তিনি তাদেরকে প্রশ্ন করতেন, এ ব্যাপারে যায়িদ কি বলেছেন? বিচার ফায়সালায় যায়িদ ছিলেন সবচেয় বেশী জ্ঞানী। আর যে সকল বিষয়ে কোন হাদীস পাওয়া যায় না সে সম্পর্কে মাতাত দানের ব্যাপারে তিনি ছিলেন বেশী অন্তদৃষ্টির অধিকারী। তাঁর কোন কথা থাকলে তাই বল।৭৪
ইমাম মালিক (রহ) ছিলেন মদীনার ইমাম। আজও তিনি ফিকাহ ও হাদীস শাস্ত্রে অগাণিত মানুষের ইমাম। তিনি বলতেন, উমারে (রা) পরে যায়িদ ইবন সাবিত ছিলেন মদীনার ইমাম। ইমাম শাফেঈও (রহ) ফারায়েজ শাস্ত্রের সকল মাসয়ালা হযরত যায়িদের তাকলীদ করেছেন।৭৫
ফকীহ সাহাবীদের তিনিটি তাবকা বা স্তর ছিল। এর প্রথম তাবকায় ছিল হযরত যায়িদের (রা) স্থান। তিনি জীবনে বিপুল পমিাণ ফতওয়া দিয়েছেন। সবগুলি একত্রে সংগ্রহ করা হলে বিরট আকারে একটি বই হবে।৭৬
হযরত যায়িদের (রা) ফিকাহ্ তাঁর জীবনকালে জনগণের নিকট ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। হযরত সা’ঈদ ইবন মুসায়্যাব বলতেন, যায়িদ ইবন সাবিতের এমনস কোন কথা নেই যার ওপর মানুষ সর্বসম্মতভাবেব আমল করেনি। সাহাবাদের মধ্যে বহু ব্যক্তি এমন ছিলেন যাঁদের কথার ওপর কেউই আমল করেননি। কিন্তু হযরত যায়িদের (রা) ফাতওয়ার ওপর তাঁর জীবনকালেই পূর্ব Ñপশ্চিমে সকল মানুষ আমল করেছে।
মানুষের ধারণা ফিক্হা শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ও প্রসারের নিমিত্ত হচ্ছেন চারজন সাহবী ব্যক্তিত্ব। যায়িদ ইবন সাবিত, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ আবদুল্লাহ ইবন উমার ও আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা)। তাঁদের শিষ্য শ্গারিদদের মাধ্যমে গোটা মুসলিম জাহনে ইলমে দীনের ্রসার ঘওর। কিন্তু মদীনা ছিল ইসলামের উৎস ও নবীর (সা) আবাস স্থল। এ ঘটনা যায়িদ ও তাঁর ছাত্রদের বদৌলতে জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র পরিণত হয়।
ফকীহ সাহাবীদের দুটি মজলিস ছিল। একটির সভাপতি ছিলেন হযরত উমার (রা) আর অন্যটির হযরত আলী (রা)। হযরত যায়িদ (রা) ছিলেন উমারের (রা) মজলিসের সদস্য। এখানে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হতো এবং জটিল ও গুরুত্বপূর্ন মাসয়ালা সম্পর্কে সিন্ধান্ত গৃৃহীত হতো।
যে সকল বিষয় এখনো বাস্তবে ঘটেনি সে সম্পর্কে কোন প্রশ্নের জবাব তিনি দিতেন না খারেজা ইবন যায়িদ বর্ণনা করেন, কোন বিষয়ে প্রশ্ন করা হলেÑ এটা কি ঘটেছে, না ঘটেনি? এ রকম প্রশ্ন না কে র তিনি কোন মতামত দিতেন না। বিষয়টি যদি বাস্তবে না ঘটতো তাহলে সে সম্পর্কে কিছুই বলতেন না।আর ঘটলে বলতেন।৭৭
হযরত যায়িদ (রা) সাধারণতঃ সব সময়ে জ্ঞান বিতরণে নিয়োজিত থাকতেন। তা সত্বেও সর্ব সাধারণের সুবিধার্যে মসজিদে নববীতে একটি নিদিষ্ট সময়ে ফাতওয়া ও মাসায়ালার জবাব দিতে বসতেন।
হযরত যায়িদের (রা) মাসায়ালাসমূহ ফিকাহর সকলের অধ্যায়ে পরিব্যাপ্ত।তার বিস্তারিত আলোচনা সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়। এখানে সংক্ষেপে কয়েকটি মাসায়ালা তুলে ধরছি।
১. তিনি বলেছেন, ফরজ নামায ছাড়া অন্য নামায ঘর আদায় করা উত্তম।৭৮ তিনি বলেছেন, কাড়ীদে পরুশের সামায আদায় একটি নূর বা জ্যোতি বিশেষ। পুরুষ যখন ঘরে নামায়ে দাঁড়ায় তখন তার পাপসমূহ মাথার ওপর ঝুরন্ত অবস্থায় থাকে। একটি সিজদা দেওয়ার সাথে সাথে আল্লাহ তার পাপ মুছে দেন।৭৯
২. এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলো জুহর ও আসরে কি কিরআত আছে? বললেনঃ হ্যাঁ। রাসূল (সা) দীর্ঘ সময় ধরে এ দুটি নামায কিয়াম (দাড়িয়ে থাকা) করতেন এবং এ সমং তার ঠোঁট ও নাড়াচাড়া করতো।৮০ এর অর্থ এ নয় যে ইমামের পিছনে মুকতাদিরও কিরাআত করা উচিত। মূলতঃ প্রশ্নটি ছিল ইমাম সম্পর্কে, মুকতাদি সম্পর্কে নয়। প্রশ্নের উদ্দেশ্যে হলো জুহর ও আসর নামাযে কি কিছু পড়া হয়? যায়িদ ইবন সাবিত, আবু কাতাদাহ ও সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা) থেকে যে সব বর্ণনা এসেছে তার কোনটি দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে. সাহাবায়ে কিরাম (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) পিছনে কিরআত করেছেন।
৩. কোন ব্যক্তি যদি নিজের বাসগৃহে নজের জীবদ্দশা পর্যন্ত কাউকে থাকার জন্য দান করে তাহলে তার মৃত্যুর পর তার ছেলেরা তার ওয়ারিস হবে। হযরত যায়িদের বর্ণনায় এর বিবরণ এসেছে। তিনি বলেছেনঃ
৪. হযরত যায়িদের মতে, যতদিন পর্যন্ত বাগানে ফল ভালো মত না আসে অথবা গাছে খেচুর পরিপক্ক না হয় ততদিন তা আন্দাজে বেচাকেনা নাজায়েজ।৮১
ইসলাম পূর্ব আমলে মদীনায় গাছে ফল পরিপক্ক হওয়ার আগেই বিক্রির প্রথা ছিল। এরত যকন ক্রেতার লোকসান হতো তখন দু পক্ষের মধ্যে বিবাদ শুরু হতো। রাসূল (সা) মদীনায় এসে এর অবস্থা দেখে এ ধরনের কেনাবেচা করতে নিষেধ করেন।
ফিকাহর অন্য সকল অধ্যায়ের চেয়ে ফারায়েজ এর অধ্যায় ছিল হযরত যায়িদের বিশেষ পারদর্শিতা। রাসূলুল্লাহর (সা) একটি হাদীসে এসেছে:৮২ আমার উম্মতের সবচেয়ে বড় ফারায়েজ শাস্ত্রে ফরেজ বিশেষজ্ঞ যায়িধ ইবন সাবিত। রাসূলুল্লাহর (সা) এ নদ দ্বারা বুঝা যায় তিনি ফারায়েজ শাস্ত্রে কত গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। সাহাবায়ে কিরামও এ শাস্ত্রে তাঁর পন্ডিত্য স্বীকার করতেন। খলীফা উমার (রাা) তাঁর জাবীয়ার ঐতিহাসিক ভাষণে অগণিত শ্রোতার সামনে ঘোষণা করেনঃ ফারায়েজ স্মপর্কে কারো কিছু জিজ্ঞাসার থাকলে সে যেন যায়িদ ইবন সাবিতের নিকট যায়।৮৩ তাঁর সমকালীন লোকেরা বলতো,যায়িদ ফারায়েজ ও কুরআনে অন্যদের অতিক্রম করে গেছেন।৮৪
ফারায়েজ শাস্ত্রটি বেশ জটিল। কুরআনে এ মাস্ত্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ মাসায়ালা সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। তার বিস্তরিত ব্যাখ্যাÑ বিশ্লেষণ রাসূলুল্লাহর (সা) বানী, কর্ম এবং সাহাবায়ে কিরামের (সা) ফাতওয়া ও বিচার আচার থেকেই গ্রহণ করা হয়। কুরআনে মীরাস ওঅসীয়াত বিষয়ে যা কিছু এসেছে তা অতি চুম্বক কথায়। তাতে স্বমীÑস্ত্রী, পুত্রÑকন্যা, মাতা, পিতা, ভ্রাতাÑভগ্নি ইত্যাতি ধরনের ইত্তরাধিকারীদের নির্ধারিত অংশ ঘোষণা করে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি এ সীমা লংঘন করবে সে হবে মূলত নিজের ওপর অত্যাচারী।
হযরত রাসূলে কারীম (সা) বিচার ফায়সালার মধ্যোমে এই সংক্ষিপ্ত বিধানের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর ইনতিকালের পর যায়িদ (রা) এ শাস্ত্রের এত উন্নতি সাধন করেন যে, তাঁর পরেই এ বিষয়ে গ্রন্থ রচিত হয় এবং বিষয়টি একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্রে পরিণত হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমারের (সা) মত জ্ঞানী ও উঁচু মর্যাদার সাহাবীরাও যায়িদের (রা) এর নিকট ফারায়েজ সংক্রান্ত মাসায়ালর সমাধান জানতে চাইতেন।
ইয়ামামরা নিহত অধিবাসীদের ব্যাপার হযরত আবু বকর (রা) হযরত যায়িদের (রা) ফাতওয়া অনুযায়ী ফায়সারা করেন। অর্থ্যৎ যারা বেঁচে গিয়েছিল তাদেরই মৃতদের ওয়ারিস নির্ধারণ করেন। মৃতদেরকে পরস্পর ওয়ারিস নির্ধরাণ করেননি।৮৫
আমওয়াসের তা’উন মাহমারীতে যখন গোত্রের পর গোত্র মৃত্যু বরণ করে তখন উমার (রা) যায়িদের (রা) উল্লেখিত মতের ওপর ভিত্তিতে সমাধান দেন। এমন কি হযরত আবদুল্লাহ ইবনর আব্বাস (রা) যাঁকে উম্মাতের তত্ত্বজ্ঞনী ও জ্ঞানের সাগর বলা হয়, তিনিও যায়িদের (রা) সমাধানে নিশ্চিত হতেন।
একদিন তিনি ছাত্র আকরামকে একথা বরে পাঠালেন, তুমি যায়িদকে জিজ্ঞেসা করে এসো যে, এক ব্যক্তি স্ত্রী ও মাতা পিতা রেখে মারা গেছে, তার মীরাস কিভাবে বন্টিত হবে? যায়িদ বললেন, স্ত্রী অর্ধেক এবং বাকী অর্ধেকের একÑতৃতীয়াংশ মাতা এবং অবশিষ্ট যা থাকবে তা পাবে পিতা। ইবন আব্বাসের (রা) ধারনো ছিল ভিন্ন। তিনি মনে করতেনর মাতা পাবে একÑতৃতীয়াংশ। এজন্য আবার জানতে চাইলেন, এরকম বন্টন কি কি কুরআনে আছে, না এা আপনার নিজের মত? যায়িদ (রা) বললেন, এ আমার ইজতিহাদ। আমি মাতাকে পিতার ওপর প্রাধান্য দিতে পারিনে।৮৬
খিরাফতের প্রতন্ত অঞ্চল থেকে জনগণ লিখিত আকার ফাতওয়া চেয়ে চিঠি লিখতো। তিনিও লিখিত জবাব দিতেন। আমীর মু’য়াবিয় (রা) একবার চিঠি মারফত দাদার অংশ সস্পর্কে যায়িদের (র) ফাতওয়া জানতে চান। হযরত যায়িদ (রা) জবাবে যে লিখিত ফাতওয়াটি দান করেন তা কানযুল উম্মাল গ্রন্থে বর্ণিত হযেছে। তিনি সেই চিঠিতে খলীফা উমার (রা) ও উসমান যেখাবে দাদার অংশ বন্টন করেছিলেন তা উল্লেখ করেন।৮৭
হযরত যায়িদ (র) ফারয়েজের নানা ধারনের জিজ্ঞসা বা মাসয়ালর সমাধান খলীফা উমারের (রা) আমলেই বিন্যাস করেন।৮৮ তাঁর বোধা ও বুদ্ধিতে নতুন সম্যসার উদয় হতো আর তিনি তার সামাধান বের করতেন। পরবর্তীাকলে এ সব সমাধান এ শাস্ত্রের অবিচ্ছিন্ন অংশে পরিণত হয়।
হযরত যায়িদ (রা) দাদা মীরাসের ব্যাপারে যে সিদ্ধন্ত দান করেন সাহাবাদের মধ্যে অনেকেই তার বিরোধীতা ছিলেন। তবে জনতার সমর্থর তার পক্ষেই ছিল। ফারায়েজ শাস্ত্রে দাদার মীরাস একটি দারুণ মতবিরোধ পূূর্ণ মাসায়াল। এমন কি হযরত যায়িদ (রা) এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। ইমাম বুখারী আল Ñফারায়েজ অধ্যায়ে দাদার মীরাস শিােনামে একটি অনুচ্ছেদ এনেছেন। তাতে তিনি এ মতবিরোধের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি একাথাও বলেছেন এ বিষয়ে ইবন উমার আলী, ইবন মাসউদ, ও যায়িদের (রা) বিভিন্ন রকম কথা বর্ণিত হয়েছে।৮৯ তবে যে মতের ওপর হযরত যায়িদের (রা) শেষ জীবন পর্যন্ত অটল ছিলেন উামর ও উসমান (রা) সেটাই প্রয়োগযোগ্য মনে করেছেন।
ইসলামের ইতিহাসে হযরত উমার (রা) সর্বপ্রথম দাদার অংশ গ্রহণ করেন। তাঁর এক পৌত্র মারা গেলে তিনি নিজেকে তার যাবতীয় সম্পত্তির অধিকারী মনে করতে থাকেন। লোকেরা এর বিরোধীতা মত পোসন করতে থাকে। একদিন হযরত উমার যখন হযরত যায়িদের (রা) বাড়ীতে উপস্থিত হরেন তখন তিনি চিরুনী করছিলেন এবং দাসী তার চুল পরিপাটি করে দিচ্ছিলেন। হযরত যায়িদ (রা) খলীফাকে বললেন, কষ্ট করে আসার কি প্রয়োজন ছিল, ডেকে পাঠালেই তো পারতেন। খলীফা বললেন একটি মাসায়ালা সম্পর্কে পরামর্শ করতে এসেছি। যদি আপনার ওপর কোন রকম বাধ্যবাধকতা নেই। যায়িদ এ অবস্থায় মতামত দিতে অস্ককৃতি জানালেন। উমার ফিলে গেলেন। অন্য একদিন আবার গেলেন। যায়িদ বললেনম আমার সিন্ধান্ত আমি লিখিতভাবে জানাবো। অতঃপর তিনি শাজারার আকৃতিতে বিন্যাস করে অংশ বন্টন করেন। হযরত উমার (রা) জনগনের উদ্দেশ্যে ভাষণ দানকালে বলেন, যায়িদ ইবন সাবিত এটি লিখে আামার কাছে পাঠিয়েছেন। আমি তা চালু করছি।৯০
হযরত যায়িদের (রা) ইলমে ফারায়েজ গ্রন্ধাবন্ধ করেন এবং এর বিভিন্ন খুটিনাটি বিষয়ে গবেষনা করে নতুন নতুন মাসায়ালাও সৃষ্টি করেন। তবে এর মধ্যে তাঁর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উদ্ভবধন হলো মাসায়ালা অওলে। কিছু লোকে ধারণা আওলের উদ্ভাবক হলে হযরত আব্বাস (রা)। কিন্তু এ দারণা বর্ণনা ও যুক্তি উভয়ের পরিপন্থি।
প্রথমত: এ ধারণার পশ্চাতে তেমন কোন সনদ নেই। দ্বিতীয়ত: হযরত আব্বাসের (রা) ফারায়েজ শাস্ত্রে তেমন বুৎপত্তি ছিলনা। এ কারণে এ জাতীয় উদ্ভবনা তাঁর প্রতি আরোপ করা যুক্তির পরিপন্থি।
হযরত যায়িদ (রা) ফারায়েজ শাস্ত্রেও যতটুকু খিদমাত করেছেন তা উপরোক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে। হযরত রাসূলে কারীমের বানীÑ আমর উম্মাতের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফারায়েজ বিশেষজ্ঞ হচ্ছে যায়িদ’ Ñ অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছে। হযরত যায়িদের (রা) অসাধারণ বুদ্ধি তীক্ষè, মেধা ও অভিনব চিন্তাশক্তী দেখে সে যুগের উলামাÑমাশায়েখ দারুন বিস্মিত হয়েছেন। উলুমে শারা’য়িয়্যা ছাড়াও পার্থিব জ্ঞান বিজ্ঞানে তিনি যে কতখানি পারদর্শী ছিলেন সে সম্পর্কেও কিছু আলোকপাত করা প্রয়োজন। এখানে তার কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
যায়িদ (রা) রাসুলে কারীমের (সা) নির্দেশে মুতাবিক হিব্র“ ও সুরইয়ানী ভাষা শিখেছিলেন। তাঁর মেধা এত তীক্ষè ছিল যে মাত্র পনেরো দিনের চেষ্টায় এ ভাষা দুটিতে এতখানি দক্ষতা অর্জন করেন যে, আনায়াসে চিঠি লিখতে সক্ষম হন। পরে আরো চর্চার ফলে এতখানি উন্নতি হয় যে তাওরাত ও ইনজীলের ভাষাসমূহ একজন আলেমে পরিণত হন। মাসউদী লিখেছেন, তিনি ফার্সী, রোমান হাবশী ভাষাগুলোও জানতেন। এগুলি তিনি শিখেছিলেন মদীনায় যারা এ ভাষা জানতো তাদের নিকট থেকে।৯১
তৎকালীন আরবে হিসাব বা অংক শাস্ত্রের তেমন প্রচলন ছিলনা। এ কারণে ইসলামের প্রথম পর্বে খারাজের হিসাবপত্র অথবা রোমান অথবা ইরানীরা করতো। আরববাসী হাজারের ওপর গণান করতে জানতো না। আরবীতে হাজারেরও ওপর সংখ্যার জন্য কোন শব্দও ছিলনা। কিন্তু যায়িদের (রা) অংকে এতখানি পারদর্শিতা ছিল যে, ফারায়েজ শাস্ত্রেও অতি জটিল ও সূক্ষè মাসায়ালা সমূহ ও অংক দ্বারা সমাধান করতেন। তাছাড়া অর্থ সম্পর্দেও বন্টনও করতে পারতেন। হিজরী ৮ম সনে হুনাইনর যদ্ধ হয়। এতে প্রায় বারো হাজার মানুষ অংশ গ্রহণ করে। তাঁরই আদমশুমারী ও প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী রাসূলে (সা) মালে গানীমত বন্টন করেন। প্রথমে তিনি মানুষের সংখ্যা অবগত হন। তারপর মালে গানীমত উক্ত সংখ্যার ওপর বিছিয়ে দেন। এননিভাবে ইয়ারমুকের যুদ্ধেও মালে গনীমাত মদীনায় আসলে যায়িদই (রা) তা বন্টন করেন।৯২
ইসলামÑপূর্ব আরবে লেখার তেমন প্রচলন ছিলনা, সুপ্রাচীন কালের বর্ণনা সমূহ তারা স্মৃতিতে বংশপরম্পর ধরে রাখতো। যায়িদ (রা) লিখতে জানতেন এবং তার সমকালে তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত লেখক। বিভিন্ন ফরমান চুক্তিপত্র চিঠিপত্র লেখা ছাড়াও সুন্দও অস্কন ও জানতেন।
খলীফা উমারের (রা) সময়ে আরবের বিখ্যাত দুর্ভিক্ষ আম্মুর রামাদাহ দেখা দেয়। এ দুর্ভিক্ষ মুকাবিলার জন্য তিনি মিসরের গভর্ণর আমর ইবনুল আসাকে (রা) খাদ্যশস্য পাঠতে বলেন। আমার ইবনুল আস (রা) বিশটি জাহাজ বোঝাই করে খাদ্য শস্য রাজধানী মাদীনায় পাঠান। উমার (রা) অত্যন্ত বিচলিতভবে জাহাজের প্রতীক্ষায় থাকেন। যায়িদ সহ আরো কিছু সাহাবীকে সংগে নিয়ে তিনি মদীনার নিকটবর্ত জার নামক বন্দরে চলে যান। খাদ্যশস্য ভর্তি জাহাজ এলে সেখানে দুটি গুদাগম বানিয়ে তাতে সংরক্ষন করেন। তিনি যায়িদকে দুর্ভিক্ষ কবলিত মাসুষের একটি তালিকা ও তাদের প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দকৃত শস্যেও পরিমাণ লেখা তাকে এমন একটি ফর্দ তৈরী করতে নির্দেশ দেন। এ নির্দেশের ভিত্তিতে যায়িদ একটি রেজিস্টার তৈরী করেন, প্রত্যেককে একটি কাগজের চাকতি দেন যার নিচে উমারের (রা) সীলÑমোহর লাগানো ছিল। চাকতি তৈরী ও তাতে মহোর লাগানোর ঘটনা ইসলামে ছিল এটাই প্রথম। আর এর রুপকার ছিলেন যায়িদ।
ইসলামের আসল উদ্দেশ্য হলো মহত্তম চারিত্রের পূর্ণতা সাধন। তাঁর চরিত্রের যে সকল গুণÑবৈশিষ্ট উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তা হলো হুব্বে রাসূল, ইত্তেবায়ে রাসূল, আমর বিল মারুফ, শাসকদের প্রতি উপদেশ নসীহত ও মুসলি উম্মার কল্যাণ কামনা।
রাসূলের প্রতি প্রবল ভালবাসার কারণে অধিকাংশ সময় তাঁর দরবারে উপস্থিত থাকতেন। প্রত্যূষে ঘুম থেকে উঠে সোজা রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমতে হাজির হয়ে যেতেন। কোন কোন সময় এত সকালে যেতেন যে, রাসূলের (সা) সাতেই সেহরী খেতেন। রাসূল (সা) তাঁকে স্বীয় কক্ষে ডেকে নিতেন।৯৩
একদিন রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট গিয়ে দেখতে পান, তিনি খেজুর দিয়ে সেহরী খাচ্ছেন। তাঁকেও আহারে অংশ গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। যায়িদ বললেন, আমি রোযা রাখার ইরাদা করেছি। রাসূল (সা) বললেন আমরাও তো এটাই ইরাদা। সেদিন হযরত যায়িদ রাসূলের (সা) সঙ্গে সেহরী খান। কিছুক্ষন পর নামাযের ওয়াকত হলে তিনি রাসূলের (সা) সাথে মসজিদে যান এবং তাঁর সাথে নামায আদায় করেন।৯৪
যায়িদ (রা) অধিকাংশ সময় রাসূলুল্লাহর (সা) পাশে বসে যেতেন। রাসূল (সা) তাঁর সাথে এতখানি খোলামেলা ছিলেন যে কখনো কখনো নিজের হাঁটু যায়িদের রানের ওপর রেখে যেতেন। একদিন তো এ অবস্থায় ওহী নায়িল হয়। যায়িদ বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহর (সা) হাঁটু এ সময় এত ভারী মনী হচ্ছিল যে তার ভার সহ্য করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মনে হচ্ছিল যে আমার রান ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। কিন্তু বেয়াদবী হয় এ ভায়ে তিনি উহ শব্দটিও উচ্চারণ করেননি। চুপ করে বসে থাকতেন।৯৫
রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশ পালন বিন্দুমাত্র হেরফের বরদাশত করতেন না। একবার শামে গেলেন আমীর মুয়াবিয়ার (রা) নিকট। তাঁর কাছে একটি হাদীস বর্ণনা করলেন। মু’য়াবিয়ার (রা) এক ব্যক্তিকে হাদীসটি লিখে রাখার জন্য বললেন। যায়িদ (রা) বললেন, রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীস লিখতে নিষেধ করেছেন। এরপর তিনি তাঁর লিখিত অংশটুকু মুছে দেন।৯৬
আমীর উমারাদের সামনেও তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সুন্নাতের প্রচারের ব্যাপারে চুপ থাকতেন না। মারওয়ান ইবনুল তখন মদীনার গভর্ণর। তিনি মাগরিব নামাযে ছোট ছোট সুরা পড়তেন। যায়িদ বললেন, এমনটি করেন কেন? রামূল (সা) তো বড় বড় সূরাও পড়তেন।৯৭
সাহাবা ও তাবেঈনদের কেউ কখনো অজ্ঞতাবশত সুন্নাতের পনিপন্থী কোন কাজ করে বসলে যায়িদ তাঁকেও সতর্ক করে দিতেন। একবার গুরাইবীল ইবন সা’দ (রা) বাজারে একটি পাখি ধরেন। যায়িদ তো তা দেখে ফেলেন। তিনি তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে এক থাপ্পড় মারেন এবং পাখিটি ছিনিয়ে উড়িয়ে দেন। তারপর তাঁতে লক্ষ্য করে বলেন, ওরে নিজের শক্র, তোমার জানা নেই যে, রাসূল (সা) মদীনাকে হারাম ষোঘণা করেছেন!৯৮
একবার তিনি শুরাহবীলকে বাগানে জাল পাততে দেখে চেঁচিয়ে উঠালেনÑ এখানে শিকার করা নিষেদ্ধ।৯৯
শাম থেকে এক ব্যক্তি মদীনায় এলো যয়তুনের তেল বিক্রী করতে। আনেক ব্যবসায়ী কথাবার্তা বললো। আবদুল্লাহ ইবন উমার কথাবার্তা বলে তেল খরীদ করেন নিলেন। মাল সেখানে থাকতেই দ্বিতীয় ক্রেতা পাওয়া গেল। সে আবদুল্লাহ ইবন উমারকে বললেন, আমি আপনাকে এত লাভ দিচ্ছি। আমার কাছে বিক্রী করে দিন। ইবন উমার রাজী হয়ে গেরেন। তিনি কথা পাকাপাকি করার জন্য তার হাতের ওপর স্বীয় হাত রাখবেন, এমন সময় পিছন থেকে একজন তাঁর হাত টেনে ধরেন। তিনি তাকিয়ে দেখেন যায়িদ ইবন সাবিত। তিনি ইবন উমারকে বললেন, এখন বেচো না। প্রথমে মাল এখানে থেকে সরিয়ে নাও। কারণ রাসূল (সা) এমনভবে বেচাকেনা করতে নিষেধ করেছেন।১০০
একবার তিনি দুপুরের সময় মদীনার গভর্ণর মারওয়ানের বাড়ী থেকে বের হলেন। শিষ্য শাগারিদরা তা দেখে ফেলে। তারা মনে করলো, হয়তো বিশেষ কোন প্রয়োজনে গিয়েছিলেন। তারা এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেলো। যায়িদ বললেন, এ সময় তিনি কয়েকটি হাদীস জিজ্ঞেসা করেছিলেন। আমি তাঁকে বলেছি, তিনটি অভ্যাসের ব্যাপারে মুসলামনের অন্তর বিরুপ ভাব জন্মবে না। তাহলো আল্লাহর জন্য কাজ রার শাসকদের নসীহত করা জামায়াতের সাথে থাকা।১০১
উবাদা ইবন সামিত ছিলেন একজন উঁচু স্তরের সাহাবী। একবার তিনি বায়তুল মাকদাস গেলেন। সেখানে একজন থাবাতী ব্যক্তিকে তাঁর বহানটি একটু ধরতে বললেন। সে ধরতে অস্বীকৃতি জানালো। উবাদা তাকে খুব ধমকালেন এবং মারলেন। কথাটি খলীফা উমারের কানে গেল। তিনি উবাদাকে বললেন আপনি এ কেমন কাজ করলেন? উবাদা বললেন আমি তাঁকে ঘোড়াটি একটু ধরতে বলামা আর সে অস্বীকার করলো। উমার মেজাজটা একটু গরম। আমি তাকে মেরে বসলাম। উমার বললেন, আপনি বদলা বা কিসাসের জন্য প্রস্তুত হোন। সেখানে যায়িদ ইবন সাবিত উপস্থিত ছিলেন। তিনি এভাবে একজন সাহাবীর অপমান সহ্য করতে পারলেন না। উমারকে বললেন, আপনি একজন গোলামের বদলায় নিজের ভাইকে মারবেন? তাঁর একথার পর উমার কিসাকেস পরিবর্তে শুধু দিয়াত ধার্য করেন। উবাদাকে (রা) দিয়াত আদায় করতে হয়।১০২
এমনি আর একটি ঘটনা। উমার (রা) যখণ শামে ছিলেন তখন একদিন খবর পেলেন যে, একজন মুসলাম একজন জিম্মীকে হত্যা করেছে। উমার হত্যাকারী মুসলামকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। যায়িদ অতিকষ্টে খলীফাকে বুঝালেন এবং কিসাসের পরিবর্তে দিয়াতে রাজী করেন।১০৩
স্বভাগত ভাবেই তিনি চুপচাপ থাকতে ভালবাসতেন। খলীফাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজার রাখতেন। খলীফা উমারের অন্যতম সঙ্গী ও পারিষদ ছিলেন। খলীফা উসমানের (রা) সাথে তাঁর এত গভীর সম্পর্ক ছিল যে, লোকে তাঁকে উসমান (রা) তাঁকে খুবই ভালোবাসতেন। আলী মুয়াবিয়ার (রা) দ্বন্দ্বে আলীর (রা) পক্ষে কোন যুদ্ধে অংশ নেননি, তা সত্বেও তিনি আলীকে দারুণ ভালোবাসতেন এবং তাঁর মাহাতœ্য ও মর্যাদার প্রবক্তা ছিলেন। আমীর মুয়াবিয়ার (রা) সাথেও সুসম্পর্ক ছিল। শামে গেলে তাঁর গৃহেই উঠতেন।১০৪
মারওয়ান ছিলেন তাৎকালীন আরব বিশ্বের একজন অতি বিখ্যাত রাজনীতিবিদ। যায়িদের (রা) ছিল তাঁর সাথেন অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই তিনি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতেন না। একদিন যায়িদ ইবন সাবিতকে ডেকে রাজনীতি বিষয়ক কিছু প্রশ্ন করেন। যায়িদ জবাব দিচ্ছেন, এমন সময় তিনি বুঝতে পারলেন কিছু লোক পর্দার আড়াল থেকে তাঁর বক্তব্য লিখে নিচ্ছে। যায়িদ তক্ষুণি বলে উঠলেন, মাফ করবেন, এতক্ষণ আমি যা কিছু বলেছি তা সবই আমার ব্যক্তিগত মতামত।
হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) তাঁকে খুবই সম্মান করতেন। একদনি যায়িদ (রা) যখন ঘোড়ায় চড়তে যাবেন, ইবন আব্বাস তাঁর জিনিসটি ধরে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন। যায়িদ (রা) বললেনঃ আপনি হচ্ছেন রাসূলুল্লাহর (সা) চাচাতো ভাই। দয়া করে আপনি সরে যান। তিনি বললেনঃ আমাদের উলামা ও বড়দের সাথে এমন আচরণ করার জণ্য আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যায়িদ বললেনঃ আপনার হাতটি একটু বাড়িয়ে দিন। ইবন আব্বাস (রা) হাত বাড়িয়ে দিলে যায়িদ হাতে চুমু দিয়ে বললেনঃ আমাদেরকে ও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নবীর (সা) পরিবার পরিজনদের সাথে এমন আচারণ করতে করার জন্য।১০৫
মে মারওয়ান ইবনুল হাকাম, আবু সাঈদ আলÑখুদরী (রা) মতে একজন উচুঁ মর্যদা সাহাবীকে মারার জন্য ছড়ি উঠিয়েছিলেন, তিনিও যায়িদকে (রা) অতন্ত্য সম্মান করতেন। দরাবারে গেলে মারওয়ান তাঁকে আসানের পাশেই বসাতেন।যায়িদ (রা) অন্যান্য সাহাবী ও তাবেঈদেরকে মাঝে মধ্যে চিঠির মাধ্যমে উপদেশ দিতেন। প্রখ্রাত সাহবী উবাই ইবন কা’বকে (রা) তিনি এমনি একটি উপদেশমূলক চিঠি লিখেছিলেন। সীরাত ও হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থে তা বর্ণিত হয়েছে।১০৬
সত্য কতা বলতে কাকেও পরোয় করতেন না। তাবারানী বর্ণনা করেছেন। খলীফা উমার (রা) একদিন গোপনে খবর পেলেন আবু মিহ্জান আসÑসাকাফী নামক একব্যক্তি তার এক বন্ধুর সাথে ঘরের মধ্যে মদ পান করছে। তিনি তৎক্ষণাত রওয়না দিলেন এবং সোজা তার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। সেখানে আবু মিহ্জানকে বললেনঃ একাজটি আপনি ঠিক করেননি। কারণ আল্লাহ ক্ষাপনাকে গুপ্তচাগিরি করতে নিষেধ করেছেন। উমার (সা) সাতে সঙ্গীদের প্রতি লক্ষ্য করে বললেনঃ এ কি বলে? যায়িদ ইবন সাবিত ও আবদুর রহমান ইবন আলÑআরকান (রা)Ñ বললেনঃ আমীরুল মুমিনীন, সে ঠিক বলেছে। এ এক ধরনের গুপ্তচরবৃত্তি। উমার (রা) তাকে ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে আসেন।১০৭
যায়িদ (রা) পরিবার পরিজন ও আতœীয় স্বজনদের প্রতি খুবই সদয় ছিলেন। ঘুমানোর সময় দু’আ করতেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে পরিবার পরিজনের স্বাচ্ছন্দ ও প্রাচুর্য কামনা করি। আর কোন আতœীয়ের সাথে আতœীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করলে তার বদ দুআ থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করি। পরিবার পরিজনদের মধ্যে তিনি খুব রসিক হতেন যেসন মজলিসে হতেন অত্যন্ত গম্ভীর।১০৮
তাঁকে নিয়ে তাঁর নিজ গোত্রে খাযরজীদের গর্বের অন্ত ছিলনা। মদীনার চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই গোত্র আউস ও খাযরাজ। ইসলাম গ্রহণের পরেও তারা মাঝে মাঝে নানা বিষয় নিয়ে একে অপরের ওপর আভিজাত্য ও শ্রেষ্টত্ব দাবী করত। এমনিভাবে একাবর খাযাজীরা বললো, আমাদের মধ্যে এমন চার ব্যক্তি যাঁদের সমকক্ষ কেউ তোমাদের মধ্যে নেই। তাঁরা রাসূর্লুলাহর (সা) জীবদ্দশায় গোটা কুরআন সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁদের একজন যায়িদ ইবন সাবিত।১০৯
যায়িদের (রা) জীবন ও কর্ম ছোট কোন প্রবন্ধে তুলে ধরা সম্ভব নয়। হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থ সমূহে তাঁর সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
তথ্যসূত্র:

আমার ইবন আল-জামূহ (রা)
হযরত আমর ইবন আলÑ জাহামূহের (রা) পিতার নাম আলÑ জামাহূ ইবন যায়িদভ মদীনার বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের বনু সালামা শাকার সন্তান। একজন আনসারী সাহাবী।১ জন্ম সন ও প্রথম জীবন সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। ইবন ইসহাক তাঁর মাগাযীতে বলেনঃ তিনি বনু সালামা তথ্য গোটা আনাসার সম্প্রদায়ের একজন নেতা ও সম্মনিত ব্যক্তি ছিলেন।২ তাছাড়া জাহিলী আমলে তিনি তাদের ধর্মীয় নেতাও ছিলেন। তাদের মূর্তি উপাসনা কেন্দ্রের বা মুতাওয়াল্লীও ছিলেন।৩
তাঁর ঘরে কাঠের নির্মিত একটি বিগ্রহ ছিল তার নাম ছিল মানাত। বিগ্রহটিকে তিনি সীমাহীন তাজীম করতেন।৪ এর মধ্যে মক্কায় ইসলামের ধ্বনি উথিত হলো। কিছু লোক মদীনা থেকে মক্কায় আসলেন এবং আকাবার দ্বিতীয় শপথে অংশগ্রহণ করে আবার মদীনায় ফিরে গেলেন। এই দুই দলে আমারের ছেলে মুয়াজও ছিলেন।
মদীনায় ফিরে এসে তাঁরা খুব জোরেশোরে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন এবং অতি দ্রুত তথাকার অলি গলি তাকবীর ধ্বনিতে প্রতিধ্বনি হয়ে উঠলো। এরই মধ্যে বুন সালামার কিছু তরুণ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, যে কোনভাবে তাঁদের সম্মনিত নেতা আমরকে ইসলামের সুশীলত ছায়ায় আনতে হবে। তাঁর ছেলে মুয়াজ চেষ্টার কোন ক্রটি করলেন না। এক পর্যায়ে তাঁদের মথায় নতুন এক খেয়াল চাপলো।
তাঁর ছেলে মুয়াজ বন্ধু ইবন হায়াসাম মতান্তরে মুয়াজ ইবন জাবারল ও অন্যদের সংগে করে রাতে বাড়ীতে আসতেন এবং সকলের অগোচলে অতি সন্তর্পণে আমরের অতিপ্রিয় বিগ্রহটি তুলে নিয়ে দূরে কোন ময়লাÑআবর্জনার গর্তে ফেলে আসতে লাগলেন। সকালে আমার তাঁর প্রিয় বিগ্রটির এমন দারুন দশা দেখে দারুণ দুঃখ পেতেন। আবার সেটা কুড়িয়ে এনে ধুয়ে মুছে সুগন্ধি লাগিয়ে পূর্ব স্থানে রেখে দিতেন। এ প্রক্রিয়া কিছু দিন যাবত চলতে লাগলো। অবশেষে একদনি নিরুপায় হয়ে বিগ্রটির কাঁধে একখানি তরবারি ঝুলিয়ে বললেন, কারা তোমাদের সাথে এমন অশোভন আচরণ করছে আমার তা জানা নেই। যদি জানতে পররতাম, তাদের উচিত শিক্ষা দিতাম। এই থাকলো তরবারি তুমি কিছু করতে পারলে কর।
তরুণরা তখন আর একটি নতুন খেলা খেললেন। তাঁরা রাতরে অন্ধকারে বিগ্রহটি উঠিয়ে নিয়ে তরবারিটি সরিয়ে নিলেন এবং তার সাথে একটি মরা কুকুর বেঁধে ময়লার গর্তে ফেলে রাখলেন। সকালে আমার তাঁর উপাস্যের এমন অবমাননা দেখে ক্ষিপ্ত হওয়ার পরিবর্তে সঠিক পথের দিশা পেলেন। প্রৃত সথ্য তাঁর চোর ধরা পড়লো। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন। তাঁর তখনকার সেই অনুভুতিক তিনি একটি কবিতায ধরে রেখেছেন। একানে তার কয়েকটি পংক্তির অনুবাদ দেওয়া হল।
১. আল্লাহর নামের শপথ! যদি তুমি ইলাহ হতে তাহলে ময়লার গর্তে এভাবে কুকুর সাথে এক রশিতে বাঁধা থাকতে না।
২. সকল প্রশংসা মাহান আল্লাহর, যিনি দানশীল, সৃষ্টির রিযিকদাতা ও দ্বীনের বিধান দানকারী।
৩. তিনিই আমাকে বাঁচিয়েছেন করের অন্ধকারে বন্দী হওয়ার পূর্বে। অন্য একটি কবিতায় তিনি বেলনঃ
১. আমি পূতঃ পবিত্র আল্লাহর নিকট তাওবা করছি। আমি আল্লাহর আগুন থেকে ক্ষমা ভিক্ষা করছি।
২. প্রকাশ্য ও গোপনে আমি তাঁর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও প্রশংসা করছি।৫
ইবন ইসহাক ‘আমার ইবন আলÑজামূহের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে ভিন্ন একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। বনু সালামের তরুণদের সাথে আমরে স্ত্রীÑপুত্রও ইসরাম গ্রহণ করলেন। একদিন আমার স্ত্রীকে বললেন, এসব যুবক কি করে তার শেষ না দেখা পর্যন্ত তুমি তোমার পরিবারের কাউকে তাদের দলে ভিড়াতে দিওনা। স্ত্রী বললেনঃ আমি না হয় তা করলাম; কিন্তু আপনার ছেলে এই ব্যক্তি৬ সম্পর্কে কি সব কথাবার্তা বলে তাকি আপনি শোনেন? আমর বললেনঃ সম্ভবত সে ধর্মত্যাগী হয়েছে। স্ত্রী বললেনঃ না সে তার গোত্রীয় লোকদের সাথে ছিল। তাকে এখানো পাঠানো হয়েছে। আমর স্ত্রী জিজ্ঞসা করলেনঃ তুমি কি এই লোকটির কোন কথা শুনেছো? বললোঃ হ্যাঁ, শুনেছি। এরপর সূরা আলÑফাতিহার প্রথম থেকে পাঠ করে শোনালেন। আমর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন এভাবেঃ এতি মিষ্টিমধুর বাণী! তার সবই বাণীই কি এমন? স্ত্রী বললেনঃ হায়রে আমার কপাল! এর চেয়েও ভালো। আপনার গোত্রীয় লোকদের মত আপনিও কি বাইয়াত বা শপথ করতে চান? বললেনঃ না আমি তা করছি না। আমি একটু মানাত দেবীর সাথে পরামর্শ করতে চাই। দেখি সে কি বলে। আরবদের প্রথা ছিল তারা মানাতের কথা শুনতে চাইলে একজন বৃদ্ধা তার পিছনে দাড়িয়ে তার পক্ষে উত্তর দিত। আমর মানাতের কাছে আসলে বৃদ্ধাটি অদৃশ্য কত কথা বলে উড়াচ্ছে, আর তুমি নিরব শ্র্যেতা হয়ে দাড়িয়ে আছ। এ ব্যক্তি তোমার ইবাদত করতে নিষেধ করছে। তোমাকে পরিত্যাগ করতে বলছে। আমি তোমার পরামর্শ ব্যতীত তারহতে বাইয়াত করতে চাইনা। বল, আমি কি করতে পারি। তিনি দীর্ঘক্ষর্ণ পরামর্শ চাইলেনঃ কিন্তু মাানাত কোন সাড়া দিল না। তারপর তিনি ক্ষুদ্ধ হয়ে বললেনঃ সম্ভবত তুমি রাগ করেছো। ঠিক আছে এখন থেকে তোমার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে মানাতের মূতির্টি ভেঙ্গে গুঁড়ো করে ফেললেন।৭
হযরত আমরেরইসলাম গ্রহণের সময়কাল সম্পর্কে আরো কিছু অপ্রসিদ্ধ মতামত আছে। ইবনুল আসীর বলেন, একটি বর্ণনা মতে তিনি আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াত ও বদরের তাবাকাত বা স্তরে উল্লেখ করেননি।৮ কালবী বলেছেন তিনি আনাসারদের মধ্যে সর্বশেষ ইসলাম গ্রহণকারী।৯
রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় এসে আনাসার মুহাজিরদের মধ্যে যে দ্বীনী ভ্রাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্টা করে দেন, একটি বর্ণনা মতে তাতে উবাইদা ইবনুল হারেস ও আমরের মধ্যে এ সম্পর্ক প্রতিষ্টত হয়।১০
বদর যুদ্ধে হযরত আমরের (রা) যোগদানের ব্যাপারে মতভেদ আছে। তবে সঠিক মত এই যে তিনি বদরে যোগদান করেননি। কোন কারণে তিনি পায়ে আঘাত পান এবং খোঁড়া হয়ে যান। এ অবস্থায়ও তিনি যুদ্ধে যেতে চাইলেন ছেলেরা রাসূলুল্লাহ (সা) অনুমতি নিয়ে তাঁকে তাঁর সংকল্প থেকে বিরত রাখেন। তাঁরা বোঝান যে এ অবস্থায় তাঁর ওপর জিহাদ ফরজ নয়।
উহুদের রণÑদামামা বেজে উঠলো। আমর ছেলেদের ডেকে বললেন, তোমরা আমাকে বদরে যেতে দাওনি। এবার আমি তোমাদের কোন নিষেধ মানবো না। এ যুদ্ধে আমি যাবই। ইবন ইসহাক ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ আমর ইবন আলÑজামূহ ছিলেন মারাতœক ধরনের খোঁড়া। সিংহের মত তাঁর চার ছেলে ছিল। সকল কাজ ও ঘটনায় তাঁরা রাসূলুল্লাহর (সা) সংগে থাকতেন। উহুদের দিনে তাঁরা বললেনঃ আল্লাহ আপনাকে মাজুর (অক্ষম) করেছেন। আপনার যুদ্ধে যাওয়ার দরকার নেই। আমর (রা) খোঁড়তে খোঁড়াতে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে বললেনঃ আমার ছেলেরা আমাকে যুদ্ধে যেতে বারণ করছে। আল্লাহর কসম! এ খোঁড়া পা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমি জান্নাতে যেতে চাই। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ আল্লাহ তো আপনাকে মাজুর করেছেন। জিহাদ আপনার ওপর ফরজ নয়। একথার পরও আমরকে তাঁর সিদ্ধান্তে অটল দেখে রাসূলু (সা) তাঁর ছেলেদের বললেনঃ তোমার আর তাঁকে বাধা দিওনা। আল্লাহ পাক হয়তো তাঁকে শাহাদাত দান করবেন।১১
ইমাম সুহাইলী বলেনঃ অন্যরা আরো বলেছেন, আমার বাড়ী থেকে বের হওয়র সয়ম অন্তরে সবটুকু বিনীত ভাব ঢেলে দিয়ে দু’আ করেনঃ
ইলাহী! তুমি আর আমাকে মদীনায় ফিরিয়ে এনো না। আল্লাহ পাকের দরবারে তাঁর এ আকুল আবেদন কবুল হয় যায়। তিনি শহীদ হন।১২
উহুদ যুদ্ধ শুরু হলো। আমরও প্রাণপণ করে যুদ্ধে করছেন। প্রচন্ড যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলিম বাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লো। তখন তিনি ছেলে খাল্লাদকে সাথে নিয়ে পৌত্তলিক বাহিনীর ওপর প্রচন্ড আক্রমন চালালেন। দারুণ সাহসিকাতর সাথে যুদ্ধ করে পিতা ও পুত্র এক সাথে শাহাদাত বরণ করেন। হযরত আমরের (রা) তীব্র বাসনা ও রাসূলুল্লাহর (সা) ভবিষ্যদ্বানী সত্যে পরিণত হলো। তিনি খোঁড়াতে খোঁড়াতে জান্নাতে পৌছে গেলেন। এটা হিজরী ৩য়/ খ্রীঃ ৬২৫ সনের ঘটনা।১৩
যুদ্ধ ক্ষেত্রে হযরত আমরের (রা) প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে। রাসূল (সা) পাশ দিয়ে যাচ্ছেন। লাশটি দেখে চিনতে পেরে থমকে দাড়ালেন। বললেনঃ আল্লাহ তাঁর কোন কোন কসম পূরণ করেন। আমার তাদেরই একজন। আমি তাঁকে খুড়িয়ে খুঁড়িয়ে জান্নাতের হাঁটতে দেখতে পাচ্ছি। আমর ও খাল্লাদের (সা) ঘাতক আলÑআসওয়াদ ইবন জাউন।১৪
আমরের (রা) শাহাদাতের খবর তাঁর স্ত্রীর কাছে পৌঁছালে তিনি একটি উট নিয়ে আসেন স্বামী ও ভাই আবদুল্লাহ ইবন আমর (জাবির (রা) পিতা) এর লাশ দুটি উটের পিঠে উঠিয়ে বাড়ীতে নিয়ে যান। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত হয়, উহুদের রণÑক্ষেত্রেই সকল শহীদকে দাফন করা হবে। রাসূল (সা) আমরের স্ত্রীর নিকট থেকে লাশ দুটি ফিরিয়ে আনেন এবং উহুদের সকল শহীদের সাথে দাফন করেন।১৫ ইবন ইসহাক বনু সালমার কতিপয় সম্মানীয় বৃদ্ধ ব্যক্তির সূত্রে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) উহুদের শহীদদের দাফনের সময় বলেনঃ তোমরা আমর ইবন জামূহ ও আবদুল্লাহ ইবন হারামের দিকে একটু লক্ষ্য রেখো। দুনিয়াতে তারা একই সারিতে সারিবদ্ধ ছিল। তাদেরকে একই কবরে দাফন কর।১৬ তাদেরকে এক কবরে একই সাথে দাফন করা হয়।
তবে ইমাম সুহাইলী বর্ণনা করেন, যে আমরের ছেলেরা তাঁর লাশ মদীনায় আনার জণ্য একটি উটের ওপর উঠান। উট অবাধ্য হয়ে যায়। শত চেষ্টা করেও তাঁরা উটটি মদীনার দিকে আনতে পারলেন না। তখন তাদের স্মরণ হলো পিতার অন্তিম দু’ আটির কথা: প্রভু হে আমাকে, আর মদীনায় ফিরে এনো না। তারা আর অহেতুক চেষ্টা করলেন না। পিতাকে তাঁরা তাঁর নিহত হওয়ার স্থলেই দাফন করেন।১৭
ইমাম মালিক আলÑমুওয়াত্তা গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। উহুদে শাহাদাত প্রাপ্ত আমর ইবন জামূঞ ও আবদুল্লাহ ইবন আমরকে পানির নালার ধারে এক সাথে কবর দেওয়া হয়। বহু বছর পর স্রোতে কবরটি ভেঙ্গে যায় এবং লাশ দুটি সম্পর্ন অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে পড়ে। যেন তাঁরা গতকার মৃত্যুবরণ করেছেন। অন্যত্র কবর দেওয়ার জন্য লাশ দুটি তোলা হয়। আবদুল্লাহ ছিলেন আহত। তাঁর একটি হাত ক্ষত স্থানটির ওপর রাখা এভাবেই তাঁদেরকে আবার দাফন করা হয়। উহুদের যুদ্ধ ও এই ঘটনার মাঝখানে মসয়ের ব্যবধানি ছল প্রায় ৪৬ (ছিচল্লিশ) বছর।
জাবির বলেনঃ কবর থেকে তোলার পর আমি আমার পিতাকে দেখলাম তিনি যেন কবরে ঘুমিয়ে আছেন। দেহের কোন অংশ বিন্দুমাত্র বিকৃত হয়নি। তাঁকে প্রশ্ন করা হলো তাঁদের দাফনের আবস্থা কিরুপ দেখেছিলেন? বললেনঃ এক টুকরো কাপড় দিয়ে দেখলাম তিনি মুখসহ উপর দিক ঢাকা ছিল। আর পায়ের দিকে ছল হারমাল নামক এাক প্রকার ঘাস। এ দুটি বস্তুও অক্ষত ছিল।১৮
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, আমরের (রা) ছিল চার ছেলে। তাঁরা সকলে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে সকল যুদ্ধ ও ঘটনায় শরীক ছিলেন। সীরাত গ্রন্থে সমূহে দুইজনের নাম পাওয়া যায়। মুয়াজ ও খাল্লাদ। মুয়াজ (রা) পিতপার আগেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াত বা শপথে অংশ গ্রহণ করার গৌরব অর্জণ করেন। খাল্লাদ (রা) উহুদের অন্যতম শহীদ। এছাড়া আমরের (রা) আবু আয়মান নামক এক দাসও এ যুদ্ধে শহীদ হন।১৯ একজন মুসলামনের জন্য এর চেয়ে আর বড় গৌরব ও সম্মানের আর কি হতে পারে?
আমরের (রা) গর্বিত স্ত্রীর নাম ছিল হিন্দা বিনতু আমর। বানু সালামার এক নেতা, উহুদের শহীদ আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন হ ারামের বোন এবং প্রখ্যাত সাহাবী জাবির ইবন আবদিল্লাহর (রা) আপন ফুফু।
আমর (রা) ছিলেন দীর্ঘদেহী, উজ্জল গৌর বর্ণের। মাথার চুল ছিল কোঁকড়ানো। পা ছিল খোঁড়া।২০ অতিথি সেবা ও দানশীলতা হচ্ছে আরবদের প্রাচীন ঐতিহ্য। তাঁর দানমীলতার জন্য রাসূল করীম (সা) তাঁকে বনু সালামার নেতা ঘোষণা করেন। ঘটনাটি এই রকম। একবার বনু সালামার কিছু লোক রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট আসলো। তিনি জিজ্ঞেসা করলেনঃ তোমাদের নেতা কে? তারা বললোঃ জাদ্দা ইবন কায়স। সে একজন কৃপণ ব্যক্তি। তাদের কথা শুনে রাসূল বললেনঃ কৃপণতার চেয়ে নিকৃষ্ট রোগ আর নেই। তোমাদের নেতা বরং আমর ইবন আলÑজামূহ।২১ অবশ্য ইমাম যুহরীর একটি বর্ণনা বিশর ইবন আলÑবারার নামটি এসেছে।২২ এ ঘটনাকে আনসারদের একজন কবি কাব্যাকারে বর্ণনা করেছেন।২৩ তার কয়েকটি পংক্তির অনুবাদ নিম্নরুপঃ
১, রাসূল (সা) বললেনÑ আর তাঁর কথাইতো সত্য তোমাদের নেতা কে?
২, তারা বলরোঃ জাদ্দা ইবন কায়স যদিও সে আমাদের নেতৃত্ব দেয় সে একজন কৃপণ।
৩, সে এমন এক যুবক যে পৃথিবীবাসীর প্রতি কোন পদক্ষেপ নেয়না এব ংকারো প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ায় না।
৪, অতএব, তিনি আমর ইবন জামূহকে নেতা বানালেন তাঁর দানশীলাতর জন্য। দানশীলতার কারণে নেতৃত্ব দানের অধিকার আমরেরই।
৫, কোন সাহায্যেপ্রার্থী তাঁর কাছে এলে তিনি তাঁর সম্পদ তাকে দেন। আর বলেন, এগুলি লও এবং আগামীকাল আবার এসো।
রাসূল কারীমের প্রতি ছিল তার প্রচন্ড ভক্তি ও ভালোবাসা। রাসূল (সা) যখন কোন শাদী করতেন তিনি নিজ উদ্যেগে তার ওলীমা করতেন।২৪
তথ্যসূত্র:

‘আমর ইবন হায্ম (রা)
‘আমর (রা) এর ডাকনাম আবু আদ-দাহ্হাক। মতান্তরে আবু মুহাম্মদ। পিতা হায্ম ইবন যায়িদ মদীনার খায়ার গোত্রের বুন নাজ্জর শাখার ছেলে এবং মাতা বনু সায়িদা শাখার মেয়ে।১ হযরত আম্মার ইবন হায্ম (রা) যিনি আকাবার বাইয়াতে শরীক ছিলেন, আমার বৈমাত্রীয় ভাই।২
ইসলামের সূচনা পর্বে ও হিজরাতের সময় পর্যন্ত আমার চিলৈন প্রাপ্ত বয়স্ক। এ কারণে তিনি যে কখন ইসলাম গ্রহণ করেন তা সঠিকভবে নির্ণয় করা যায় না। সম্ভবতঃ নিজের পরিবারের লোকদের সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন।৩
যুদ্ধে যাওয়ার বয়স না হওয়ার কারণে বদর ও উহুদ যুদ্ধে যোগদান করতে পারননি। ইবন হিশাম বলেনঃ রাসূলে (সা) বয়স কম হওয়ায় উমামা ইবন যায়িদ আবদুল্লাহ ইবন উমার ইবন আল খাত্তাব ইবন সাবিত, আল বারা ইবন আমির, আমর ইবন হায্ম ও উসাইদ ইবন জুাহইরেকে উহুদ যুদ্ধে যোগদানের অনুমতি দেননি।তাঁরা যেতে চেয়েছিলেন; কিন্তু রাসূল (সা) তাঁদেরকে ফিরিয়ে দেন। খন্দক যুদ্ধের সময় যোগদানের অনুমতি দেন।৪ ইবন ইসহাক বলেনঃ আমর বলেনঃ পনেরো বছর বয়েসে খন্দক যুদ্ধে যোগদান করেন।৫ খন্দক পরবর্তী সকল যুদ্ধে তিনি অয়শ নেন।তাঁর জীবনের প্রথম যুদ্ধ খন্দক।৬
ইবন ইসহাক বলেনঃ রাসূল (সা) হিজরী দশ সনের রাবীউল আওয়াল অথবা জামাদিউল আওয়াল মাসে খালিদ ইবনুল ওয়ালিদকে নাজরানের বনু আল হারিস ইবন কা’ব এর নিকট পাঠান। যাওয়ার সময় তাঁকে নির্দেশ দেন, তাদের সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দেওয়ার আগে তিনবার তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেবে। তারা সে দাওয়াত গ্রহণ করলে তাদেরকে তুমি তো মেনে নেবে। প্রত্যাখ্যান করলে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। খালিদ সেখানে পৌঁছে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তারা গ্রহণ করে। খালিদের আপ্রাণ চেষ্টায় নাজরানের অধিবাসীরা ইসলাম কবুল করে। খালিদ সেকানে অবস্থান করে তাদেরকে ইসলামে বিভিন্ন বিষয়, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের (সা) সুন্নাত শিক্ষা দিতে থাকেন।
এক পর্যায়ে খালিদ (রা) নাজরানের সঠিক অবস্থা বর্ণনা করে রাসূলকে (সা) পত্র লেখেন। উত্তরে রাসূলও (সা) একটি পত্র খালিদকে (রা) পাঠন। তাতে তিনি বনু আলÑহারিসের একটি প্রতিনিধিদল সংগে করে মদীনায় আসার জন্য খালিদকে নির্দেশ দেন। খালিদ একটি প্রতিনিধি দল সাথে নিয়ে মদীনয় আসেন। প্রতিনিধিদলের সাথে রাসূলুল্লাহর (সা) বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। ইবন হিশাম বলেনঃ এ দলটি শাওয়াল মাসের শেষ অথবা জুল কা’দাহ মাসের প্রথম স্বদেশে ফিরে যায়। তাদের ফিরে যাওয়র পর রাসূল (সা) মাত্র চার মাস জীবিত ছিলেন। ইবন হিশাম আরো বলেন, প্রতিনিধিদলটি ফিরে যাওয়ার পর রাসূল (সা) তাদেরকে দ্বীনের প্রকৃত জ্ঞানদান ইসলামের মৌলিক বিষয় সমূহ ব্যাখ্যা, রাসূলুল্লাহর (সা) সুন্নাতের শিক্ষা দান এবং যাকাত ও সাদাকা আদায়ের জন্য আমর ইবন হায্মাকে পূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে তাদের কাছে পাঠান। যাত্রার পূর্বে তাঁর দায়িত্বের পরিধি এবং কর্ম পদ্ধতির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে রাসূর (সা) তাঁকে একখানি লিখিত অঙ্গীকার পত্র দান করেন।৭ এখানে পত্রটি ভাবর্থ দেওয়া হলোঃ
বিসমিল্লাহ রাহমনির রহীম। এ আল্লাহ ও রাসূলের ঘোষণা, হে ঈমানদার ব্যক্তিগণ তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর যখন তাকে ইয়ামেনে পাঠানো হচ্ছে। তিনি তাকে সকল ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করার নির্দেশ দিচ্ছেন। কারণ আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে নির্দেশ দিচ্ছেন, আল্লাহর নির্দেশ মতে সত্যসহকারে মানুষের অর্থ সম্পদ গ্রহণ করার।
তুমি মানুষের কল্যাণের সুসংবাদ দেবে এবং ভালো কাজের আদেশ করবে। কুরআনর শিক্ষা দেবে, তাদের সামনে কুরআনের গভীর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করবে এবং তাদেরকে খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করবে। কেউ পবিত্র অবস্থায় ছাড়া কুরআন স্পর্শ করতে পরবে না। মানুষের অধিকার ও দায়িত্ব কার্তব্য তাদেরকে অবহিত করবে। মুনষ হক বা সত্যের ওপর থাকলে তাদের প্রতি কমল হবে, তারা অত্যাচারি হলে কঠের হবে। করাণ আল্লাহ অত্যাচার অপসন্দ করেন এবং অত্যাচার করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেনঃ সাবধান! অত্যাচারীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ। মানুষকে জান্নাত ও জান্নাতের কাজসমূহের সুসংবাদ দেবে।তেমনিভাবে জাহান্নাম ও জাহান্নামের কাজগুলি সম্পর্কে সতর্ক করে দেবে।
মানুষের সাথে হদ্যতার সম্পর্কে গড়ে তুলবে। যতে তারা দ্বীন বুঝতে পারে। হজ্জ্বের নিদর্শনসমূহ, সুন্নাত ও ফরজসমূহ এবং সে সম্পর্কে আল্লাহ যা বর্নণা করেছেন তা তাদেরকে অবহিত করবে। হজ্জের আকবর সম্পর্কে জানাবে। হজ্জ দুই প্রকারঃ হজ্জে আকবর ও হজ্জে আসগর। উমার হচ্ছে হজ্জে আসগর। মানুষকে একখানা ছোট কাপড়ে নামায পড়তে নিষেধ করবে। দুই কাধের ওপর আর একখানি কাপড় পেচানো থাকরে একটি ছিদ্র দিয়ে মাথাটি আকাশের উচু হয়ে আছে। মাথার দিকে চুলের বেনী বাঁধতে নিষেধ করবে।
উত্তেজিত হয়ে গোত্রে ও সম্প্রদায়েকে জানাতে মানুষকে নিষেধ করবে। তাদের আহবান হবে কেবল আল্লাহর দিকে। কেউ আল্লাহর দিকে না ডেকে গোত্র ও সম্প্রদায়ের দিকে আহবা জানালো তরবারী দিয়ে মাথাটি কেটে ফেলবে। যাতে, তাদের আহবান হয় এক আল্লাহর দিকে। মানুষেকে পরিপূর্ণরুপে অজু করতে আদেশ করবে। আল্লাহ যেমন মুখমন্ডল, কনুই পর্যন্ত হাত, গিরা দুই পা ধুইতে এবং মাথা মাসেহ করতে বলেছেন, সেইভাবে। সঠিক সময়ে নাময আদায় করতে ও যথাযথভাবে রুকুÑ সিজদা করতে আদেশ করবে। সকালের নামায অন্ধাকরে জুহরের নামায সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে গেলে, আসরের নামায সূর্য পৃথিবীর দিকে পিছনে দিলে এবং মাগরিবের নামায রাতের আগমন ঘটলে আদায় করতে মানুষকে আদেশ করবে। মাগরিবের নামায আকাশে নক্ষত্র দেখা যায় এমন সময় পর্যনত দেরী করবে না। রাতের প্রথম ভাগে ঈশার নামায আদায় করতে বলবে। জুম’আর নামাযের আজান হলে সক কাজ বন্ধ করে জুম’আর নামাযে যেতে বলবে। যাওয়ার আগে গোসল করতে বলবে।
যে কোন ইয়াহুদী অথবা নাসারা নিষ্টাসহকারে মুসলাম এবং ইসলামের বিধিÑবিধান মেনে চলবে সে সত্যিকার মুমিন বলে বিবেচিত হবে। মুমিনদের সামান অধিকার যেমন সে ভোগ করবে, তেমনি সামান দায়িত্ব ও কর্তব্যও তার ওপর বর্তাবে। আর যে ইয়াহুদী ও নাসারা তার নিজ ধর্মে থেকে যাবে তাকে কোন রকম বাধা দেওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে নারীÑপরুস, স্বাধীন ও দাস নির্বিশেষে প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্কের ওপর পূর্ণ এক দীনার অথবা তাঁর রাসূলের। যে তা দিতে অস্বীকার করবে সে আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল ও মুমিন সকলের শত্র“। মুহাম্মাদের ওপর আল্লাহর করুণা বর্ষিত হোক। ওয়াস সালামু আলাইহি ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহু।
নাজরানের সরকার পরিচালনার পাশাপাশি ধর্মিয় ও অর্থনৈতিক দায়িত্ব ও তাঁর হাতে ন্যস্ত ছিল। তিনি শিক্ষাদান ও তাবলীগের দায়িত্বেও পালন করতেন। ইবনুল আসীর বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে নাজরানবাসীদেরকে ফিকাহ ও কুরআন শিক্ষা দান ও তাদের নিকট থেকে যাকাত ও সাদাকা আদায়ের দায়িত্ব প্রদান করেন।৮
ইবন হাজার বলেনঃ রাসূল (সা) আমরকে যখন নাজরানে পাঠান তখান তাঁর বয়স মাত্র সতেরো বছর। ইবন সা’দাও এ কথা বলেছেন।৯ কিন্তু তাঁদের এ কথা সঠিক নয় বলে মনে হয়। কারণ সীরাত ও ইতিহাসের সকল গ্রন্থে একাত বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি হিজরী দশ সনে নাজারানে যার।আর একথাও বর্ণিত হয়েছে যে খন্দক যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল পনেরো বছর। ইবন হাজর তাঁর তাহজীবুত তাহজীব’ (৮/৯) গ্রন্থেও বলেছেন তিনি পনেরো বছর বয়েসেই খন্দক যুদ্ধে যোগদান করেন। আর একথাও তো সত্য যে খন্দক যুদ্ধ হয় হিজরী পঞ্চম সনে। অতএব ডহজরী দশ সনে কোন অবস্থাতে তাঁর বয়স বিশ বছরের কম হতে পারে না।
হযরত ‘আমর (রা) মদীনা থেকে নাজরান যাওয়ার সময় স্ত্রীকেও সয়গে নিয়ে যান। স্ত্রীর নাম ছিল উমর্ ানাজরানর পৌছার পর সেই বছরই তাঁদের এক পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে।পিতা-মাতা সন্তানের নাম রাখেন মুহাম্মাদ এবং ডাক নাম আবু সুলায়মান। এ খবর মদীনায় রাসূলের (সা) নিকট পৌঁছালে তিনি সন্তানের নাম মুহাম্মাদ ও ডাকনাম আবু আবুদল মালিক রাখার জন্য লিখে পাঠান।১০ ইমাম আল হাযেমী এই মুহাম্মাদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেনঃ যাদেরকে ইয়ামেনের নাজরানের প্রতি সম্পৃক্ত করা হয়েছে, আবু আবুদল মালিক মুহাম্মাদ ইবন আমর ইবন হায্ম তাদের একজন। তাঁকে নাজরানী বলা হয়। কারণ তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) জীবনকালে হিজরী দশ সনে সেখানে জন্ম গ্রহণ করেন। মদীনায় আনসাররা আল-হাররা এর দিনে তাঁকেই ওয়ালী মানোনীত করেন এবং হিজরী ৬৩ সনে তিনি আল-হাররা এর ঘটনায় শাহাদাত বরণ করেন।১১
হযরত আমরের (রা) দুই স্ত্রী। প্রথমার নাম উমরা। তিনি আবদুল্লাহ ইবন আল-হারিস আল-গাসসানীর কন্যা। এই আবদুল্লাহ ছিলেন মীনায় বহিরাগত এবং মদীনায় সায়িদা গোত্রের হালীফ বা চুক্তিবদ্ধ।১২ দ্বিতীয়ার নাম সাওদা বিনতু হারিস।১৩ আমরের (রা) জীবনেরশেষ দিন পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।
আমরের (রা) সন—ানদের সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। তবে ছেলে মুহাম্মাদ, যিনি রাসূলুল্লাহর (সা) জীবদ্দশায় জন্ম গ্রহণ করেন, খ্যাতিমান হয়েছিলেন। তিনি উমার (রা) ও অন্যদের সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তাঁর পিতাকে দেওয়া রাসূলুল্লাহর (সা) চিঠিটি তিনি লোকদের দেখিয়ে বলতেন, এ হচ্ছে রাসূলুল্লাহর (সা) একটি চিঠি। তিনি আমর ইবন হায্মকে ইয়ামনে পাঠানোর সময় তাঁকে দিয়েছিলেন।১৪ প্রখ্যাত মুজতাহিদ ও ফকীহ কাজী আবু বকর ছিলেন এই মুহাম্মাদের পুত্র।১৫
গভীর জ্ঞান, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, তীক্ষè বিচার ক্ষমতা এবং শরীয়াতের বিধি বিধানে অপরিসীম দখল ছিল তাঁর। এর প্রমাণ পাওয়া যায় রাসূল (সা) কর্তৃক তাঁকে নাজরানের ওয়ালী নিয়োগের মাদ্যমে। মাত্র বিশ বছর বয়সে শাসন পরিচালনার মত গুরুদায়িত্ব পালন এবং কুরআন হাদীস শিক্ষাদান তাঁর আসাধারন যোগ্যতা ও প্রতিভার স্বক্ষর বহন করেন।
রাসূলুল্লাহর (সা) বেশ কিছু হাধীস তাঁর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। বিশেষত নাজরান যাওয়ার প্রক্কালে রাসূলে করীম (সা) যে লিখিত পুস্তিকাটি তাঁকে দান করেন তা আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবন হিব্বান, দ ারেমী প্রমুখ মাহাদ্দিসীন বর্ণনা করেছেন। তাঁর থেকে যাঁরা হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁদের কয়েক জনের নাম এখানে দেওয়া হলোঃ
স্ত্রী সাওদা, পৌত্র আবু বকর, পুত্র মুহাম্মাদ, নাদর ইবন আবদুল্লাহ সালামী এবং যিয়াদ ইবন সুয়াইম আল-হাদরামী।১৬
আমরের (রা) চরিত্রের উজ্জ্বল বৈশিষ্ট লো সততা ও সত্যবাদিতা। কারও রক্তচক্ষু কখনো তাঁকে সত বলা থেকে বিরত রাখতে পরেননি। প্রখ্যাত সাহাবী আম্মার ইবন ইয়াসির (রা) সম্পর্কে রাসূলে করীম (সা) ভবিষ্যৎদ্বাণী করেন যে, একটি বিদ্রোহী দল তাঁকে হত্য করবে। সিফফীনে যুদ্ধে আম্মার (রা) পক্ষে যুদ্ধ করা মুয়াবিয়ার (রা) বাহিনীর হাতে শহীদ হন। আম্মার (রা) আলীর (রা) পক্ষে যুদ্ধ কের মুয়াবিয়ার (রা) পৃষ্টপোষক আমর ইবনুল আসের (রা) নিকট এবং বলেনঃ আম্মার তো নিহত হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সা) বানী আছেঃ তাঁকে একটি বিদ্রোহী দল হত্যা করবে। এরপর তিনি যান মুয়াবিয়ার (রা) নিকট। বলেনঃ আম্মার তো নিহত হয়েছে। আমি রাসূলুল্লাহ (সা) বলতে শুনেছিঃ তাকে একটি বিদ্রোহী দল হত্যা করবে। মুয়াবিয়া (রা) বললেনঃ দুমি তোমার যুক্তিতে ভুল করছো। আমার কি তাকে হত্যা করছি? তাকে হত্যা করেছে আলী ও তার সংগীরা। তাঁরাই তাঁকে আমাদের বর্শা ও তরবারির সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি।১৭
মু’য়াবিয়া (রা) তখন খলীফা। একবার আমার (রা) গেলেন খলীফার দরবারে এবং তাঁর শাসনের প্রতি ইঈিত করে তাঁকে রাসূলুল্লাহর (সা) হাদীস শোনালেন।তিনি বললেনঃ আমি রাসূলুল্লাহর (সা) মুখে শুনেছি, কিয়ামতের দিন রাজাকে তার প্রজাদের সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।১৮
মুসনাদে আবু ইয়ালা গ্রন্থে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, মুয়াবিয়া (রা) যখন স্বীয় পুত্র ইয়াযিদের জন্য বাইয়াত শপথ গ্রহণ করেন তখন একবার তাঁর সাথে আমরের (রা) শক্ত বাকযুদ্ধ হয়।১৯
আমরের (রা) মৃত্যু সন নিয়ে মতবিরোধ আছে। হিজরী ৫১, ৫৩,ও ৫৪ সনে তাঁর মৃত্যুর কথা বর্ণিত হয়েছে। আবু নু’য়াইমা বলেন, আমর ইবন হাযম উমারের (রা) খিলাফতকালে মৃত্যু বরণ করেন। ইবরাহীম ইবন মুনজিরও তাঁর তাবাকাত গ্রন্থে একই কথা বলেছেন। তবে হিজরী পঞ্চাশ সনের পর মারা গেছেন বলে যে সকল মত বর্ণিত হয়েছে। ইবন হাজার তার কোন একটি সঠিক বলে মত প্রকাশ করেছেন। কারণ, মুয়াবিয়ার (রা) সাথে তাঁর যে ঝগড়া হয় তা বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে। সুতারং উমারের (রা) খিলাফতাকলে তাঁর মৃত্যুর প্রশ্নই উফে না। তিনি মদীনায় মারা যান।২০
‘আমর ইবন হায্ম বলেনঃ রাসূল (সা) একদিন আমাকে একটি কবরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলেনঃ নেমে এসো। কবরে শায়িত ব্যক্তিকে কষ্ট দিও না।২১
তথ্যসূত্র:

কা’ব ইবন মালিক (রা)
কা’ব (রা) ইতিহাসের সেই তিন ব্যক্তির একজন যাঁরা আলস্যবশতঃ তাবুক যুদ্ধে যোগদানত থেকে বিরত থাকেন এবং আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল (সা) ও মুমিনদের বিরাগভাজনে পরিণত হন। অতঃপর আল্লাহ পাক তাঁদের তাওবা কবুলের সুসংবাদ দিয়ে আয়াত নাযিল কারেন।১ হিজরতের ২৫ বছর পূর্বে ৫৯৮ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ইয়াসরিবে জন্ম গ্রহণ করেন।২ তাঁর আনেকগুলো কুনিয়াতবা ডাক নাম ইতিহাসে ও সীরাত গ্রন্থেসমূহে বূর্ণিত রয়েছে। যথাঃ আবু ‘আবদুল্লাহ, আবু আবদির রহমান, আবু মুহাম্মাদ ও আবু বাশীর।৩ ইবনে হাজারের একটি বর্ণনায় জানা যায়, জন্মের পর তাঁর পিতা মালিক ইবন আবী কাব আমর ছেলের ডাকনাম রাখেন আবু বাশীর। ইসলাম গ্রহনের পর রাসূলে কারীম (সা) রাখেন আবু আবদিল্লাহ। তিনি পিতা- মাতার একমাত্র সন্তান।৪ মাতার নাম লায়লা বিনতু যায়িদ। পিতামাতা উভয়ে মদীনার খায়রাজ গোত্রের বনু সালিমা শাখার সন্তান।৫ তিনি একজন আকাবী ও উহুদী সাহাবী। ইবন আবী হাতেম বলেনঃ তিনি ছিলেন আহলুস সুফ্ফাহরও আন্যতম সদস্য।৬ পচিঁশ বছর বয়সে গোত্রীয় লোকদের সাথে বাই’য়াতে আকাবায় শরীক হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন।৭
ইবনুল আসীর বলেনঃ প্রায় সকল সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতে, কাব আকাবার শেষ বাই’য়াতে শরীক ছিলেন।৮ উরওয়া সেই সত্তর জনের মধ্যে তাঁর নামটি উল্লেখ করেছেন যাঁরা আকাবায় অংশ গ্রহন করে ছিলেন।৯ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে কা’ব বলেছেনঃ আমি বাইয়াতে আকাবায় রাসূলুল্লাহর (সা) সংগে উপস্থিত ছিলাম। আমরা ইসলামের ওপর অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলাম। তবে অপর একটি বর্ণনায় এসেছে। তিনি বলেন, আমি লায়লাতুল আকাবায় বাইয়াত থেকে বঞ্চিত হই।১০
কা’ব ইবন মালিক যে আকাবার শেষ বাইয়াতে শরীক ছিলেন তা ইবন ইসহাকের বর্ণনায় স্পষ্টভাবে জানা যায়। এ বাইয়াতে বিস্তারিত বিবারণ কা’ব দিয়েছেন এবং বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে তা বর্ণিত হয়েছে। সীরাতু ইবন হিশামে কাবের জবানীতে তা হুবহু এসেছে সংক্ষেপে তার কিছু এখানে তুলে ধারা হলো।
ইবন ইসহাক কা’ব এর ছেলে আবদুল্লাহ ও মা’বাদ এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। কা’ব মদীনা থেকে স্বগোত্রীয় পৌত্তলিক হাজীদর একটি কাফেলার সাথে মাক্কার উদ্দেশ্যে বের হন। এ কাফেলার সাথে পূবেই ইসলামের গ্রহণকারী কিছু মুসলামনও ছিলেন। তারা দ্বীন ও বুঝেছিলেন এবং নামায পড়তেন। এ কাফেলার তাঁদের বয়োজ্যেষ্ট নেতা আলÑবারা ইবন মারুর ও ছিলেন। চলার পথে তিনি একদিন বললেনঃ আমি আর এই কা’বার দিকে পিঠ করে নামায পড়তে চাইনে। এখানে থেকে কা’বার মুখ করেই নামায পড়বো। কা’ব ও অন্যরা তাঁর একথায় আপত্তি জানিয়ে বললেন, আমাদের নবী (সা) তো শামের বায়তুল মাকাদাসের দিকে মুখ করে নামায আদায় করতে থাকেন। তাঁর বিরোধীতা হয় আমরা এমনভাবে নামায পড়তে চাইনা। এর পরও আল-বারা তাঁর মতে অটল থাকলেন।
পথে নামাযের সময় হলে আল-বারা কাবার দিকে, কা’বও অন্যরা শামের দিকে মুখ করে নামায আদায় করতে মক্কায় পৌঁছালেন। তাঁরা আল-বারা কে তাঁর এ কাজের জন্য তিরস্কার করেন। কিন্তু তাতে কোন কাজ হলোনা, তিনি স্বীয় মতে আনড় থাকলেন।
মক্কায় পৌঁছালে আল-বারা’কা’বার দিকে, কাব’ কে বললেনঃ তুমি আমাকে একটু রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট নিয়ে চলো। আসার পথে আমি যে কাজ করেছি সে ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেসা করতে চাই। তোমাদের বিরোধিতা করে আমার মনটা ভালো যাচ্ছে না। কা’বকে তাঁকে সংগে করে রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে চললেন। দুইজনের কেউই এর আগে রাসূলুল্লাহকে (সা) চিনত না এবং দেখেননি। পথে মাক্কার দুই ব্যক্তির সাথে তাঁদের দেখা হলো। তাঁরা রাসূলুল্লাহর (সা) অবস্থান সম্পর্কে জানাতে চাইলেন। তাঁরা বললোঃ আপনারা কি তাঁকে চেনেন? কা’ব ও আল-বারা জবাব দিলেনঃ না। তারা প্রশ্ন করলোঃ তাঁরা চাচা আব্বাসকে চেনেন? তাঁরা জবাব দিলোঃ হ্যাঁ, আব্বাস চিনি। ব্যবসা উপলক্ষে তিনি আমাদের ওখানে য়াতয়াত করন। তখন তারা বললোঃ আপনারা মাসজিদে ঢুকে দেখবেন আব্বাসের সাথে একটি লোক বসে আছেন। তিনি সেই ব্যক্তি।
কা’বও আল-বারা লোক দুইটির কথামত মসজিদে হারামে ঢুকে আব্বাসকে এবং তাঁর পাশে রাসূলুল্লাহর (সা) বসা দেখতে পেলেন। সালাম দিয়ে তাঁদের পাশে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (সা) আব্বাস কে বললেনঃ আবুল ফাদল! আপনি কি এ দুই ব্যক্তিকে চেনেন? আব্বাস বললেনঃ হাঁ ইনি আল-বারা ইবন মারুফ। তাঁর সম্প্রদায়ের নেতা। আর ইনি কা’ব ইবন মালিক। কা’ব বলেনঃ আল্লাহর কসম! আমি রাসূলুল্লাহর (সা) সেই প্রশ্নবোধক শব্দটি আজও ভুলিনি- কবি? অথ্যাৎ রাসূলু (সা) আব্বাসকে প্রশ্ন করেনঃ একি সেই কবি কা’ব ইবন মালিক? আব্বাস জবাব দেনঃ হ্যঁ, ইন সেই কবি কা’ব। এরপর কা’ব বর্ণনা করেছেন, কিভাবে কেমন করে রাসূলুল্লাহর (সা) সাক্ষাৎ হলো এবং কোন কথার ওপর তাঁরা তার বাইয়াত করলেন।১১ রাসূল (সা)যে বারোজন নাকীব মনোনিত করেন, কা’ব একটি কবিতায় তাঁদের পরিচয়ও ধরে রেখেছেন।ইবন হিশাম সে কবিতাটিও বর্ননা করেছেন।১২
রাসূলে করীম (সা) মদীনায় এসে আনসার ও মাহাজিরদের মধ্যে দ্বীনী মুওয়াখাত বা ভ্রাতৃ সম্পর্খে প্রতিষ্টা করেন। আশারা মুবাশ্শারার সদস্য তালহা ইবন উবাইদুল্লাহর (রা) সাথে কা’বের এ সম্পর্কে প্রতিষ্টা হয়। একথা ইবন ইসহাক বর্ণনা করেছেন।১৩ তবে উরওয়া থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে (সা) যুবাইর ও কাবের মধ্যে ভ্রাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্টা করে দেন।১৪ উহুদের দিন কা‘ব আহত হলে যুবাইর তাঁকে মুমূর্ষে অবস্থায় কাঁধে বহন করে নিয়ে আসেণ। সেদিন কা’ব মারা গেলে যুবাইর হতেন তাঁর উত্তরাধিকারী পরবর্তীকালে সূরা আল আনফারের ৭৫ নং আয়াত-‘বস্তুতঃ যারা উলুল আরহমা’ বা রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়, আল্লাহর বিধান মতে তাঁরা পরস্পর বেশী হকদার-নাযিল করে এ বিধান রহিত করা হয়।১৫
একমাত্র বদর ও তাবুক ছাড়া অন্য সকল যুদ্ধ ও অভিযানে তিনি রাসূল কারীমের (সা) সাথে অংশ গ্রহণ করেন। ইবনুল কালবীর মতে, তিনিবদর যোগদানকরেন।১৬ তবে অধিকাংশ সীরাত বিশেষজ্ঞের নিকট এ মতটি স্বীকৃত হয়নি। আসল ঘটনা হলো, যে তাড়াহুড়ো ও দ্রুততার সাথে বদর যুদ্ধের সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় তাতে অনেকের মত কা’বও অংশ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত থাকেন। এ কারণে রাসূল (সা) কাউকে কিছুই বলেননি।
কা’ব বলেন: তাবুক পর্যন্ত একমাত্র বদর ছাড়া সকল যুদ্ধের আমি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে অংশ গ্রহণ করেছি।ক্ষদরে যাঁরা যাননি, রাসূল (সা) তাঁদেরকে কোন প্রকার তিরস্কার করেননি। মূলতঃ রাসূল (সা) মদীনা থেকে বের হন আবু সুফইয়ানের বাণিজ্য কাফিলার উদ্দেশ্যে। আর এদিকে কুরাইশরা মক্কা থেকে বেরিয়ে পড়ে আবূ সুফইয়ানের মুখোমুখিী হয় কোন রকম পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই। কা’ব আরও বলেন, বদর রাসূলুল্লাহর (সা) জীভনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ বলে মানুষের নিটক বিবেচিত। তবে ‘লাইলাতুল ’আকাবা’-যখন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা) হাতে ইসলামের ওপর বাই’য়াত (অঙ্গীকার) করেছিলাম, তার পরিবর্তে বদর আমার নিকট মোটেই প্রাধান্যযোগ্য নয়। এরপর একমাত্র তাবুক ছাড়া আর কোন যুদ্ধ থেকে পিছনে থাকিনি।১৭
তবে কোন কোন বর্ণনায় দেখা যায় কা’ব বদরে অশং করেছেন। ইবন ইসহাক কা’বের নামটি বদরে অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় উল্লেখ করেছেন।১৮ তাছাড়া একটি বর্ণনায় এসেছে, কা’ব বলেছেন: আমিমুসলমানদের সাথে বদরে যাই। যুদ্ধ শেষে দেখলাম পৌত্তলিক যোদ্ধাদের বিকৃত লাশমুসলিম শহীদদের সাথে পড়ে আছে। আমি ক্ষণিক দাঁড়িয়ে থেকে চলে যাচ্ছি এমন সময় হঠাৎ দেখতে পেলাম একজন পৌত্তলিক অস্ত্র সজ্জিত হয়ে মুসলিম শহীদদের অতিক্রম করছে। একজন অস্ত্রসজ্জিত যোদ্ধাও যেন তার অপেক্ষা করছিল। আমি একটু এগিয়ে এ দুইজনের ভাগ্য দেখার জন্য তাদের পিছনে দাঁড়ারাম। পৌত্তলিকটি ছিল বিরাট বপুধারী। আমি তাকিয়ে থাকতেই মুসলিম নৈকিটি তার কাঁধে তরবারির এমন এক শক্ত কোপ বসিয়ে দেয় যে, তার নিতম্ব পর্যন্ত পৌঁছে তাকে দুইভাগ করে ফেলে। তারপর লোকটি মুকের বর্ম খুলে ফেলে বলেঃ কা’ব কেমন দেখলে? আমি আবূ দুজানা।১৯ তবে অধিকাংশ সীরাত বিশেষজ্ঞ তাঁর বদরে অনুপস্থিত থাকার বর্ণনাগুলি সঠিক বলে মনে করেছেন।
উহুদ যুদ্ধে কা’ব তাঁর দ্বীনী ভাই তালহার (রা) সাহসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এই যুদ্ধে তিনি পরেন রাসূলুল্লাহর (সা) বর্ম এবং রাসূলুল্লাহ (সা) পরেন তাঁর বর্ম। রাসূল (সা) নিজ হাতে তাঁকে বর্ম পরিয়ে দেন। এই উহুদে তাঁর দেহে মোট এগারো স্থানে যখম হয়।২০ তবে বহু মুহাদ্দিস তাঁর দেহে সতোরোটি আঘাতের কথা বর্ণনা করেছেন।২১
এ যুদ্ধের এক পর্যায়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, রাসূলে কারীম (সা) শাহাদাত বরণ করেছেন। এতে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে ্কটো দারুণ হৈ চৈ পড়ে যায়। এ অবস্থায় কা’বই সর্বপ্রথম রাসূলকে (সা) দেখতে পান এবং গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠেন-রাসূল (সা) এই যে, এখানে। তোমরা এদিকে এসো। কা’ব তখন উপত্যকার মধ্যস্থলে। রাসূল (সা) তখণ তাঁর হলুদ বর্ণের বর্ম দ্বারা তাঁকে ইঙ্গিত করে চুপ থাকতে বলেন।২২
উহুদের পরে যত যুদ্ধ হয়েছে তার প্রত্যেকটিতে কা’ব (রা) দারুণ উৎসাহ ও উদ্দীপনাসহকারে যোগদান করেছেন। তবে ্ভাবতে আবাক লাগে যে, নবীর (সা) জীবনে প্রথম যুদ্ধ বদরের মত শেষ যুদ্ধ তাবুকেও তিনি যোগদান করতে ব্যর্থ হন। তাবুক ছিল রাসূলুল্লাহর (সা) জীবনের সর্বশেষ যুদ্ধ অভিযান। নানা কারণে একে কষ্টের যুদ্ধও বলা হয়। রাসূলুল্লাহর (সা) রীতি ছিল, যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে স্পষ্টভাবে কিচু বলতেন না। কিনউত এবার রীতি বিরুদ্ধ কাজ করলেন। এবার তিনি ঘোষণা করে দিলেন। যাতে দীর্ঘ ও কষ্টকর সফরের জন্য মুসলমানরা যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারে। কা’ব এই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য দুইটি উট প্রস্তুত করেন। তাঁর নিজের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি পূর্বের কোন যুদ্ধেই এতখানি সচ্ছল ও সক্ষম ছিলেন না, যতখানি এবার ছিলেন।
এ যুদ্ধের প্রতি রাসূলুল্লাহর (সা) এতখানি গুরুত্বদান ও সতকর্তা অবলম্বনের কারণ এই ছিল যে, মূলতঃ সংঘর্ষটি ছিল তৎকালীন বিশ্বের সুপার পাওয়ার প্রবল পরাক্রমশালী রোমান বাহিনীর সাথে। সাজ-সরঞ্জাম, সংখ্যা, ঐক্য ও অটুট মনোবলের দিক দিয়ে তাদের বাহিনী ছিল বিশ্বের সেরা ও শক্তিশারী বাহিনী।
নবম হিজরীর রজব মাস মুরু হয়েছে। প্রচন্ড গরমের মওসুম। রাসূল (সা) তাবুক অভিযানের প্রস্তুতি নিলেন এবং সকলকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশও দিলেন।২৩ সংগত ও অসংগত নানা অজুহাতে মোট তিরাশিজন (৮৩) সক্ষম মসুলমান এ যুদ্ধে গমন থেকে বিরত থাকেন। তাদের কিচু ছিল মুনাফিক (কপট মুসলমান)। কারও বাগানের ফল পাকতে শুরু করেছিল, তা ছেড়ে যেতে তার ইচ্ছা হয়নি। কেউ ভয় পেয়েছিল প্রচন্ড গরম ও দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার। আবার কেউ ছির অতি দরিদ্র, যার কোন বাহন ছিল না।২৪
ইবন ইসহাক বলেন: যাঁরা সন্দেহ সংশয় বশতঃ নয়; বরংয় আলস্যবশতঃ যোগদানে ব্যর্থ হন তারা মোট চার জন। কা’ব ইবন মালিক, মুরারা ইবন রাবী, হিলাল ইবন উমাইয়্যা ও আবূ খায়সামা। তবে আবূ খায়সামা একেবারে শেষ মুহূর্তে তাবুকে পৌঁছেন ও রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে মিলিত হন।২৫কারও কারও মতে প্রচন্ড গরমের কারণে তাঁরা তাবুক গমনে বিরত থাকেন।২৬ রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর বাহিনী নিয়ে তাবুকের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। কা’ব (রা) প্রতিদিনই যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেন; কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। দ্বিধা-দ্বধ্বে তাঁর সময় বয়ে যায়। তিনি প্রতিদিনই মনে মনে বলেতেন আমি যেতে পারবো। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পাল্টে যেত। যাত্রার উদ্যোগ নিয়ে আবার থেমে যেতেন। এ অবস্থায় একদিন মদীনায় খবর এলা, রাসূল (সা) তাবুক পৌঁছে গেছেন।
মদীনা ও তার আশা-পাশের সকল সক্ষম ব্যক্তি রাসূলুলÍাহর (সা) সাথে তাবুক চলে যান। কা’ব (রা) যখন মদীনা শহরে বের হতেন তখন শুধু শিশু, বৃদ্ধ ও কিচু মুনাফিক ছাড়া আর কোন মানুষের দেখা পেতেন না। লজ্জা ও অনুশোচনায় জর্জরিত হতেন। সুস্থ, সবল ও সক্সম হওয়া সত্ত্বেও কেন পিছনে থেকে গেলেন, সারাক্ষণ এই অনুশোচনার অনলে দগ্ধিভূত হতেন।
রাসূলুল্লাহর (সা) সেনা বাহিনীর কোন দফতর ছিলনা। সুতরাং এত মানুষের মধ্যে কা’বারে মত একজন লোক এলো কি এলা না, তা তাঁর জানা াকার কা নয়। একমাত্র আল্লাহ পাকের ওহীই ছিল ত৭ার জানার মাধ্যম। তাবুক পৌঁছে একদিন তিনি কা’ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। কোন এক ব্যক্তি বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তার এত সময় কোথায় যে সে এখানে আসবে? মু’য়াজ ইবন জাবাল কাছেই ছিলেন। তিনি প্রতিবাদের সুরে বললেন, আমরা তো তাঁর মধ্যে খারাপ কোন কিছ ুদেখিনি। একথা শুনে রাসূল (সা) চুপ থাকলেন।
রোমানদের সাথে রাসূলুল্লাহর (সা) কোন মারাত্মক সংঘর্ষ হলো না। উত্তর আরবের অনেক গোত্র জিযিয়ার বিনিময়ে সন্ধি করলো। রাসূল (সা) মদীনায় ফিরে এলেন। রাসূলুল্লাহর (সা) ফিরে আসার খবর কা;ব পেলেন। তাঁর অন্তরে তখন নানা রকম চিন্তার ঢেউ খেলছে। রাসূলুল্লাহর (সা) অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচার উপায় কি, সে বিষয়ে পরামর্শ চাইলেন পরিবারের লোকদের কাছে। তখনও এমন চিন্তাও তাঁর মনে উদয় হলো যে, সত্য অসত্য মিলিয়ে কিছু কারণ রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে তুলে ধরবেন। কিন্তু পরক্ষণেই এ চিন্তা যেন কোথায় হাওয়া হয়ে যেত। এ করম দ্বিধা দ্বন্দ্বের এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, কপালে যা আছে তাই হোক, কোনরকম ছল-চাতুরীর আশ্রয় তিনি নেবেন না। যা সত্য তাই বলবেন।
এর মধ্যে দলে আশি জনের মত লোক রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট উপস্থিত হয়ে যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য আত্মাপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য রাখলো। রাসূল (সা) তাদের সকলের ওজর-আপত্তি গ্রহণযেগ্য মনে কররেন। সকলের অপরাধ ক্ষমার জন্য আল্লাহর দরবারে দু’আ করলেন এবং পুনরায় তাদের বাই’য়াত বা অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন।
কা’ব (রা) আসলেন রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট। তাঁকে দেখে রাসল (সা) মৃদু হেসে বললেন: এসো। কা’ব সামনে এসে বসার পর প্রশ্ন করলেনঃ যুদ্ধে যাওনি কেন? কা’ব বললেনঃ আপনার কাছে কী আর গোপন করবো? দুনিয়ার কোন রাজা-বাদশাহ হলে নানারকম কথার জাল তৈরী করে তাকে খুশী করতাম। সে শক্তি আমার আছে।অ আমি তো একজন বাগ্মী ও তর্কবাগিশ। আমি আপনার নিকট সত্য গোপন করবো না। এতে হতে পারে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন। কিন্তু মিথ্যা বললে এ মুহূর্তে আপনি খুশী হয়ে যাবেন। তবে আল্লাহ আপনাকে আমার ব্যাপারে নাখোশ করে দেবেন। আর তা আমার জন্য মোটেই সুখকর নয়। মূলতঃ আমার না যাওয়ার কোনকারণ ছিল না। আমি ছিলাম সুস্থ সবল এবং অর্থে-বিত্তেও যুদ্ধের সাজ-সরজ্ঞামে সমর্থ। তবুও আমার দুর্ভাগ্য যে, আমি যেমে পরিনি। তাঁর কথা মুনে শুনে রাসূল (সা) বললেনঃ সত্য বলেছো। তুমি এখন যাও। দেখা যাক আল্লাহ তোমার ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত দান করেন।
রাসূলুল্লাহর (সা) দরবার থেকে উঠে আসার পর বনু সালেমার কিছু লোক তাঁকে বললো, আপনি এর আগে আর কোন অপরাধ করেননি। এটাই আপনার প্রথমবারের মত একটি অপরাধ। অথচ এর জন্য ভালোমত কোন ওজর ও আপত্তি উপস্থাপন করতে পারলেন না। অন্যদের মত আপনিও কিচু ওজর পেশ করতেন, রাসূল (সা) আপনার গোনাহ মাফের জন্য দু’আ করতেন, আর আল্লাহ মাফ করে দিতেন। কিন্তু তা আপনি পারলেন না। তাদের কথা শুনে কা’বের ইচ্ছা হলো, রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট ফিরে গিয়ে পূর্বের বর্ণনা প্রত্যাহাপর করেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে তিনি প্রশ্ন করলেন: আমার মত আর কেউ কি আছে? তিনি জানতে পেলেন, আরও দুইজন আছেন। তাঁরা হলেন: মুরারা ইবন রাবী ও হিলাল ইবন উমাইয়্যা। তঁ*ারা দুইজনই অতি নেক্কার বান্দা ও বদরী সাহাবী। তাঁরেদ নাম শুনে তিনি কিছুটা আশ্বাস্ত হলেন এবং নতুন করে ওজর পেশ করার ইচ্ছা দম ন করলেন।
রাসূলে কারীম (সা) পূর্বে উল্লেখিত তিন ব্যক্তির সাথে কথা বলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। পঞ্চাশ দিন পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবত াকে। মানুষ তাঁদের প্রতি আড় চোখে তাকিয়ে দেখতো। কোন কা বলতো না। মুরারা ও হিলাল নিজেদেরকে আপন আপন গৃহে আবদ্ধ করে রাখেন। দিন রাত তাঁরা শুধু কাঁদতেন। কা’ব ছিলেন যুবক। ঘরে বসে থাকা কি তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল? পাঁচ ওয়াকত নামাযেই তিনি মসজিদে আসা যাওয়া করতেন, হাটে বাজারেও ঘোরাঘুরি করতেন। বিন্তু কোন মুসলমান ভুলেও তাঁর সাথে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন না।
কা’ব মসজিদে যেতেন এবং নামাযের পর রাসূলকে (সা) সালাম করতেন। রাসূল (সা) জায়নামাযে বসে থাকতেন। রাসূল (সা) সালামের জবাব দিচ্ছেন কিনা বা তাঁর ঠোঁট নড়ছে কিনা, কা’ব তা গভীরভাবে লক্ষ্য করতেন। তারপর আবার রাসূলুল্লাহর (সা) নিকটেই নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। চোখ আড় করে একটু একটু করে রাসূলুল্লাহর (সা) দিকে তাকাতেন এবং রাসূলও (সা) তাকে আড় চোখে দেখতেন। যখন কা’ব নামায শেষ করে রাসূলুল্লাহর (সা) দিকে ফিরতেন তখণ তিনি কা’বের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন।
কা’বের (রা) সাথে তাঁর পরিবারের সদস্যদের আচরণও ছিল অভিন্ন। আবূ কাতাদাহ (রা) ছিলেন কা’বের চাচাতো ভাই। একদিন কা’ব বাড়ীর প্রাচীরের ওপর উঠে তাঁকে সালাম করলেন; কিন্তু কাতাদাহ জবাব দিলেন না। কা’ব তিনবার কসম খেয়ে বললেন, তুমি তো জান আমি আল্লা ও তাঁর রাসূলকে কত ভালোবাসি। শেষবার কাতাদাহ্ শুদু মন্তব্য করলেনÑবিষয়টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন।
কাতাদাহর (রা) এমন জবাবে কা’ব (রা) দারুণ হত্যশ হলেন। আপন মনে বললেণ, এখন তো আমার ঈমানের ব্যাপারে সাক্ষী দেওয়ারও কেউ নেই। তাঁর চোখ থেকে অশ্র“ গড়িয়ে পড়লো। তিনি বাজারের দিকে বেরিয়ে গেলেন। এদিকে বাজারে তখণ শামের এক নাবাতী ব্যক্তি তাঁকে খুঁজছিলেন। কা’বকে দেখে লোকেরা ইঙ্গিত করে বললো, ঐ যে তিনি আসছেন। লোকটি কা’বের নামে লেখা গাসসানীয় রাজার একটি চিঠি নিয়ে এসেছিলো। তাঁর নিকট তেকে চিঠিটি নিয়ে কা’ব পড়লেন। তাঁতে লেখা ছিলÑ‘তোমার বন্ধু (রাসূল (সা) তোমরা প্রতি খুব অবিচার করেছেন। তুমি তো কোন সাধারণ ঘরের সন্তান নও। তুমি আমার কাছে চলে এসো। চিঠিটি পড়ে তিনি মন্তব্য করলেন, এটাও এক পরীক্ষা। চিঠিটি তিনি জ্বলন্ত চুলায় ফেলে দিলেন।
এভাবে চল্লিশ দিন কেটে গেল। চল্লিশ দিন পর রাসূলুল্লাহর (সা) পক্ষ থেকে এক ব্যক্তি তাঁর নিকট গিয়ে বললেন: রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশ হলো, তোমার স্ত্রী থেকে তুমি দূরে থাকবে। কা’ব জানতে চাইলেন, আমি কি তাঁকে তালাক দেব? তিনি বললেনঃ না। শুধু পৃথক থাকবে।
কা’ব (রা) বললেন, তুমি তোমার পিাত-মাতার কাছে চলে যাও। আমার ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত সেখানেই থাক। অন্য দুইজনথÑহিলাল ও মুরারাকেও (রা) একই নির্দেশ দেওয়া হয়। হিলাল ছিলেন বৃদ্ধ। তাঁর স্ত্রী রাসূলুল্লাহর (সা) দরবারে উপস্থিত হয়ে স্বামী সেবার বিশেষ অনুমতি নিয়ে আসেন। কা’বের পরিবারের লোকেরা তাঁর স্ত্রীকেও বললেন, তুমিও রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট যেয়ে স্বামী সেবার অনুমতি নিয়ে এসো। কিন্তু তিনি সম্মত হলেন না। বললেনঃ আমি যাব না। না জানি, রাসূলুল্লাহ (সা) কি বলবেন।
পঞ্চাশ দিনের মাথায় ফজরের নামায আদায় করে কা’ব (রা) ঘরের ছাদে বসে আছেন। ভাবছেন, এখন তো আমার জীবনটাই বোঝা হয়ে উঠেছে। আসমান-যমীন আমার জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেছে। এ ধরণের আকাশ-পাতাল চিন্তা করছেন, এমন সময় সালা’ পাহাড়ের শীর্ষদেশ থেকে কারও কষ্ঠস্বর ভেসে এলোঃ কা’ব শোন! তোমরার জন্য সুসংবাদ! তিনি বুঝলেন, তাঁর দু’আ ও তাওবা কাবুল হয়েছে। সাথে সাথে তিনি সিজদায় লুটিয়ে পড়ে আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আয়াদ করেন। নিজের ভূলের জন্য মাগফিরাত কামনা করেন। কিছুক্ষণ পর দুই ব্যক্তি যাদের একজন ছিল ঘোড় সাওয়ার, এসে তাঁকে সুসংবাদ দান করেন। কা’ব নিজের গায়ের কাগড় খুলে তাদেরকে দান করেন। অতিরিক্ত কাপড় ছিল না তাই সেই দান করা কাপড় আবার চেয়ে নিয়ে পরেন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট ছুটে যান।
ইতিমধ্যে খবরটি মদীনায় ছড়িয়ে পড়েছে। দলে দলে মানুষ তাঁর বাড়ীর দিকে আসতে শুরু করেছে। পথে যার সাথেই দেখা হচ্ছে, তাঁকে মুবারকবাদ দিচ্ছে। তিনি মসজিদে নবনীতে পৌঁছে রাসূলকে (সা) সাহাবীদের মাঝে বসা অবস্থায় পেলেন। মসজিদে ঢুকতেই তালহা (রা) দৌড়ে এসে হাত মেলালেন। তবে অন্যরা নিজ নিজ স্থানে বসে থাকলেন। কা’ব (রা) এগিয়ে গিয়ে রাসূলে কারীমকে (সা) সালাম করলেন। তাবারানী বর্ণনা করেছেন; তাওবা কবুল হওয়ার পর কা’ব রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে তাঁর দুইখানি পবিত্র হাত ধরে চুমু দিয়েছিলেন।২৭ তখন রাসূলে কারীমের চেহারা মুবািরক চাঁদের মত দীপ্তিমান দেখচ্ছিল। তিনি কা’বের (রা) উদ্দেশ্যে বললেনঃ তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছি। তোমার জন্মের পর থেকে আজকের দিনটির মত এত ভালো দিন তোমার জীবনে আর আসেনি।
আপনি কি আমাকে ক্ষমা করেছেন? রাসূল (সা) বললেন: আমি কেন, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করেছেন।’ এ কথা বলে তিনি তাদের সম্পর্কে সদ্য নাযিল হওয়া সূরা তাওবার ১১৭ নং আয়াতটি পাঠ করে শোনান। আল্লা দয়অশীল নবীর প্রতি, এবং মুহাজির ও আনসারদের প্রতি, যাঁরা কঠিন মুহূর্তে নবীর সঙ্গে চিল, যখন তাদের এক দলের অন্তর ফিরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। অতঃপর তিনি দয়াপরবশ হন তাদের প্রতি। নিঃসন্দেহে তিনি ত৭াদের প্রতি দয়অশীল ও করুণাময়।’ তিলাওয়াত শেষ হলে আনন্দের আতিশয্যে কা’ব বলে উঠলেন।, ‘আমি আমার সমন্ত ধন সম্পদ সাদাকা করে দিচ্ছি।’ রাসূল (সা) বললেনঃ সব নয়, কিছু দানকর। কা’ব তাঁর খাইবারের সম্পত্তি দান করেন। এরপর তিনি মন্তব্য করেনঃ আল্লাহ আমার সততার জন্যই মুক্তি দিয়েছেন। আমি অঙ্গীকার করছি, বাকী জীবনে আমি শুধু সত্যই বলবো।
সত্য বলার জন্য কা’ব ও তাঁর অপর দুই সঙ্গীকে যে চরম পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, ইসলামের ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত পাওয়া দুস্কার। এত বড় বিপদেও তাঁদের দৈর্য্যচ্যুতি ঘটেনি। পবিত্র কুরআনের এ আয়াতে তাঁদের সেই করুণ অবস্থা াতি চমঃকারভাবে চিত্রিত হয়েছেঃ
“এবং অপর তিনজনকে যাদেরকে পিছনে রাখা হয়েছিল, যখন পৃথিবী বিšতৃত হওয়ার সত্ত্বেও তাঁদের জন্য সস্কৃচিতহয়ে গেল এবং তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলো; আর তারা বুঝতে পারলো যে, আল্লাহ ব্যতিত আর কোন আশ্রয়স্থল নেইÑঅতঃপর তিনি সদয় হলেন তাদের প্রতি যাতে তারা ফিরে আসে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ দয়াময় করুণাশীল। হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।” (সূরা তাওবা ১১৮-১১৯)
এ আয়াতে যাদেরকে পিছনে রাখা হয়েছিল বলা হয়েছে। এর অর্থ যুদ্ধ থেকে পিছনে থেকে যাওয়া নয়। বরং এর অর্থ যাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল এবং রাসূলুল্লাহর (সা) আল্লাহর পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত আসার প্রতীক্ষার ছিলেন।
কা’ব বলেনঃ আমাদের তাওবাহ কবুল সম্পর্কিত আয়াত নাযিল হয় রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে। উম্মু সালামা তখন বললেনঃ হে আল্লাহ নবী! আমরা কি কা’বকে সুসংবাদটি জানিয়ে দেব? রাসূল (সা) বললেন: তাহলেতো মানুষের ঢল নামবে এবং তোমরা আর ঘুমাতে পারবে না।২৮
কা’বের (রা) মৃত্যু সন নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। ইবন হিববান বলেন, তিনি আলীর (রা) শাহাদারে সময়কালে মারা যান। ইবন আবী হাতেম বলেন, মু’য়াবিয়ার (রা) খিলাফতকালে তিনি অন্ধ হয়ে যান। ইমাম বুখারী ত৭ার মৃত্যু সম্পর্কে শুধু এতটুকু উল্লেখ করেছেন যে, তিনি উসমানের মৃত্যুতে শোকগাথা রচনা করেছেন এবং মু’য়াবিয়া ও আলীর (রা) দ্বন্দ্বে তাঁর ভূমিকার বিষয়ে আমরা কোন তথ্য পাইনি। ইমাম বাগাবী বলেন, আমি জেনেছি, তিনি মু‘য়াবিয়ার (রা) খিলাফত কালে শামে মারা যান। আবুল ফারাজ আল ইসপাহানী কিতাবুল আগামী গ্রন্থে একটি দুর্বল সনদে উল্লেখ করেছেন যে, হাসসান ইবন সাবিত কা’ব ইববন মালিক ও আন-নূ’য়ান ইবন বাশীর (লা) একবার আলীর (রা) কাছে যান এবং উসমানের (রা) সত্যার বিষয় নিয়ে তাঁর সাথে তর্কে লিপ্ত হন। তখন কা’ব (রা) উসমানের (রা) শানে তাঁর রচিত একটি শোকগাথা আবৃত্তি করে আলীকে শোনান। তারপর ত৭ারা সেখান থেকে উঠে সোজা মু’য়াবিয়ার কাছে চলে যান। মু’য়াবিয়া (রা) তাঁদেরকে উপযুক্ত মর্যাদা দান করেন।২৯
আল-হায়সাম ও আল-মাদায়িনীর মতে কা’ব হিজরী ৪০ সনে মারা যান। তবে তাঁর থেকে হিজরী ৫১ সনের কথাও বর্নিত হয়েছে। আল-ওয়াকিদী বর্ণনা করেছেন, হিজরী ৫০ সনে তাঁর মৃত্যুর কথা বর্ণিত আছে। তবে সর্বাধিক প্রসিদধ ও সঠিক মত এই যে, হিজরী ৫০ থেকে ৫৫ (৬৭০-৬৭৩ খ্রীঃ)-এর মধ্যে প্রায় ৭৭ বছর বয়সে তিনি মারা যান।৩০
সীরাত গ্রন্থসমূহে ত৭ার পাঁচ ছেলের নাম পাওয়া যায়। তারা হলেনঃ আবদুল্লাহ, উবায়দুল্লাহ, আবদুর রহমান. মা’বাদ ও মুহাম্মদ। শেষ জীবন কা’ব (রা) অন্ধ হয়ে যান।৩১ ছেলেরা তাঁকে হাত ধরে নিয়ে বেড়াপতেন।৩২ ইবন ইসহাক তাঁর ছেেেল আবদুর রহমানের সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন: শেষ জীবনে আমার পিতা অন্ধ হয়ে গেলে আমি তাঁকে নিয়ে বেড়াতাম। আমি যখন তাঁকে জুম’আর নামাযের জন্য নিয়ে বের হতাম তখন আজান শোনার সাথে সাথে তিনি আবু উমামা আস’য়াদ আবিন খুরারার জন্যে মাগফিরাত কামনা করে দু’আ করতেন। জুরআর আজান শুনলেই তাঁকে আমি সব সময় এ কাজটি করতে দেখতাম। বিষয়টি আমার কাছে রহস্যজনক মন হলো। আমি একদন জুম’আর দিনে ত৭াকে নিয়ে বের হয়েছিল, পথে আজানের ধ্বনি শোনার সাথে সাথে তিনি আবু উমামার জন্য দু’আর করতে শুরু করেন। আমি বললামঃ আব্বা, জুম’আর আজান শুললেই আপনি এভাবে আবু উমামার জন্য দু’আ করেন কেন? বললেনঃ বাবা, রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় আসার আগে সেই আমাদেরকে সমবেত করে সর্বপ্রথম জুরম’আর জামায়াত কায়েম করেন। সেটি অনুষ্ঠিত হতো হাররার বনু বায়দার হাযমুন নাবীত পাহাড়ের নাকী আলÑখাদিমাত’ নামক স্থানে। আমি প্রশ্ন করলাম: তখন আপনারা কতজন ছিলেন? বললেন: চল্লিশজন।৩৩
হাদীসের গ্রন্থসমূহে কা’বের বর্ণিত মোট আশিটি (৮০) হাদীস পাওয়া যায়।৩৪ তবে ইমাম জাহবী বলেন: ত৭ার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ত্রিশে পৌঁছবে। তারমধ্যে তিনটি মত্তাফাক আলাইহি। একটি বুখারী ও দুইি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন।৩৫ তিনি খোদ রাসূল (সা) ও উসাইদ ইবন হুদাইর (রা) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।৩৬
কা’ব (রা) থেকে যে সকল মনীষী হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কতিপয় ব্যক্তি হলেন: আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস, জাবির ইবন আবদল্লিাহ ও আবু ইমামা আল-বাহিলী। উল্লেখিত তিনজইন হলেন সাহাবী। আর তাবেঈদের মধ্যে ইমাম বাকের, ‘আমর ইবন হাকাম ইবন সাওবান, আলী ইবন আবী তালহা উমার ইবন কাসীর ইবন আফলাহ, উমার ইবন আল-হাকাম ইবন রাফে, কা’বের পাঁচ পুত্র ও পৌত্র আবদুর রহমান ইবন আবদিল্লাহ প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।৩৭
বালাজুরীর বর্ণনায় জানা যায়, রাসূল কারীম (সা) আসলাম, গিফারী ও জুহাইনা গোত্রের যাকাত-সাদাকা রহমান ইবন আবদিল্লাহ প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।৩৮
উসমানের (রা) শাহাদাতের দুঃখজনক ঘটনায় কা’ব (রা) একটি মারসিয়া (শোকগাথা) রচনা করেন এবং আলীকে (রা) আবৃত্তি করে শোনান। তার কয়েকটি পংক্তির অনুবাদ নিম্নরূপ:৩৯
১.উসমান তাঁর হাত দুটি গুটিয়ে নিলেন তারপর দ্বার রুদ্ধ করে দিলেন। তিনি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করলেন, আল্লাহ উদাসীন নন।
২.গৃহে যারা ছিল তাদের বললেন, তোমরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ো না। াযারা যুদ্ধ করেনি আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করুন।
৩.বন্ধুত্ব সৃষ্টির পর আল্লাহ কেমন করে তাঁদের অন্তরে শত্র“তা, হিংসা ও বিধ্বেষ ঢেলে দিলেন?
৪.আর কল্যাণ কিভাবে তাঁদের দিকে পশ্চাদ্দেশ ফিরিয়ে উট পাখীর মত দৌড় দিল? আলী (রা) কবিতাটি শোনার পর মন্তব্য করলেনঃ উসমান আত্মাত্যাগ করেছেন। আর এ ত্যাগ ছিল অতীব দুঃখজনক। আর তোমরা তখণ ভীত হয়ে পড়েছিলে। সে ভীতি ছির অতি নিকৃষ্ট ধরনের।
আলী ও মুয়াবিয়ার (রা) মধ্যে যেদ্বন্দ্ব-ষংঘাত ঘটেছির তাতে কা’ব (রা) কোন পক্ষে যোগ না দিয়ে উভয়ের থেকে দূরে থাকেন।
সততা ও সত্য বলা ছিল কা’বের (রা) চরিত্রের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্যকে যেভাবে তিনি ধারণ করেন সেভাবে অনেকেই ধারণ করতে পারেননি। দু’আ কবুল হওয়ার পর জীবনে কোন দিন বিন্দুমাত্র মিথ্যার আশ্রয় নেননি। তিনি নিজেই বলেছেনঃ আল্লাহর কসম! যে দিন আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) সেই খথাগুলি বলেছিলাম সেদিন থেকে আজকের দিনটি পর্যন্ত আর কোন প্রকার মিথ্যা বলিনি।৪০ তাবুক যুদ্ধের পূর্বের জীবনটি ছিল তাঁর অতি পরিচ্ছন্ন। এ কারণে তার জীবনে যখন তাবুকের বিপর্যয় নেমে এলো তখণ তাঁর নিজ গোত্র বনু সালেমা তাঁকে বলতে পেরেছিল আল্লাহর কসম! তোমাকে তো আমরা এর পূর্বে আর কোন অপরাধ করতে দেখিনি।৪১
কা’ব (রা) ছিলেন তাঁর সময়ের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তৎকালীন আরব কবিদের মধ্যে যাঁরা বেশী বেশী কবিতা রচনা করেছেন তিনি তাঁদেরই একজন। জাহিলী আমলেও কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সাহিত্য সমালোচকদের মতে, তাঁর কবিতা খুবই উন্নতমানের।৪২ মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা) পাশে যে তিনজন কবি কুরাইশ ও তাদের স্বগোত্রীয় কবিদের মুকাবিলায় দুর্ভেদ্য ব্যুহ রচনা করেন, কা’ব (রা) সেই ত্রয়ীর অন্যতম। তাঁরা ইসলামবিদ্বেষী কবিদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেন।৪৩ ইবন সীরীন বলেন: এ তিন কবি হলেন, হাসসান ইবন সাবিত, ‘আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ও কা’ব ইবন মালিক। তাঁরাই রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবীদের ম্েযধ শ্রেষ্ঠ কবি।৪৪
কা’ব ইসলাম গ্রহনের পর কুরাইশদের দেব-দেবীর সমালোচনা করে প্রচুর কবিতা রচনা করেছেন। তিনি একটি শ্লোকে বলেছেন:৪৫
আমরা আল-লাত, আল ‘উয্যা ও উদ্দাকে ভুলে যাব। তাদের গলার হার ও কানের দুল ছিনিয়ে নেব।’
রাসূলুল্লাহর (সা) দরবারের প্রধান তিন কবির কবিতার বিষয় ছিল ভিন্ন। কা’বের কবিতার মূল বিষয় ছিল যুদ্ধের ভয় দেখিয়ে কাফিরদের ান্তরে ভীতির সৃষিট করা এবং মুলসামানদের অন্তর থেকে ভীতি দূর করে তাদেরকে অটল ও দৃঢ় করা। ইবন সীরীন বলেনঃ৪৬ কা’ব তো কবিতায় যুদ্ধের কথা বলে কাফিরদের ভূয় দেখাতেন। বলতেন: আমরা এমন করেছি, এমন করছি বা করবো। হাসসান তাঁর কবিতায় কাফিরদের দোষ ক্রুটি এবং তাদের যুদধ বিগ্রহের কথা বর্ণনা করতেন। আর ইবন রাওয়াহী কুফরী এবং আল্লাহ ও রাসূলের অস্বীকৃতি ও অবাধ্যতার উল্লেখ করে তাদেরকে ধিক্কার ও নিন্দা জানাতেন।
কা’বের (রা) ছেলে আবদুর রহমান বলেণ, আমার পিতা একদিন বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ, কবিদের সম্পর্কে আল্লাহ তো যা নাযিল করার তা করেছেন। উত্তরে রাসূল (সা) বললেন: একজন প্রকৃত মুজাহিদ তার তরবারি ও জিহবা উভয়টি দিয়ে জিহাদ করে। আমার প্রাণযে সত্তার হাতে তার নামের শপথ! তোমরা তো শক্রুদের দিকে (জিহবা দিয়ে) তীরের ফলাই ছুড়ে মারছো।
ইবন ইসাহক বর্ণনা করেছেন। যখন সূরা আশ-শূ’য়ারার ২২৪ থেকে ২২৬ নং আয়াত- বিভ্রান্ত লোকেরাই কবিদের অনুসরণ করে। তুমি কি দেখনা যে, তারা প্রতি ময়দানেই কবি-হাসসান, আবদুল্লাহ ও কা’ব কাঁদতে কাঁদতে রাসূলুল্লাহর (সা) দরবারে উপস্থিত হলেন। তাঁরা বললেনঃ হে আল্লাহ নবী! আল্লাহ যখন এ আয়াত নাযিল করেছেন তখন তো অবশ্যই জেনেছেন, আমরা কবি। রাসূল (সা) তখন তাঁদেরকে আয়াতের ব্যতিক্রমী অংশ তবে তাদের কথা ভিন্ন যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং আল্লাহকে খুব স্বরণ করে এবং নিপীড়িত হওয়ার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে পাঠ করে শোনালেন। তারপর বললেন: এ হচ্ছো তোমরা।৪৮
কা’ব (রা) ইসলামের প্রতিপক্ষ কুরাইশদের নিন্দায় বহু শ্লোক রচনা করেছেন। আল্লাহ দরবারে অন্তরঃ তার একটি শ্লোক যে গৃহীত হয়েছে, সে কথা খোদ রাসূল (সা) বলেছেন। জাবির (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। একদিন রাসূল (সা) কা’বকে বললেনঃ তুমি যে শ্লোকটি বলেছো, তাতে তোমার রব তোমাকে ভোলেননি। কা’ব জানতে চাইলেনঃ কোন শ্লোকটি? রাসূল (সা) তখন আবু বকরকে বললেন: আপনি শ্লোকটি একটু আবৃত্তি করুন তো। আবু বকর তখন শ্লোকটি আবৃত্তি করে শোনান।৪৯ প্রাচীন আরবী সূত্রসমূহে শ্লোকটি সংকলিত হয়েছে।৫০ শ্লোকটির অনুবাদ এখানে ওদয়া হলোঃ ‘সাখীনা ধারণা করেছে, সে তার রবকে (প্রভু) পরাভূত করবে। সকল বিজয়ীদের ওপর বিজয়ী (আল্লাহ) অবম্যই জয়ী হবেন।’
এখানে ‘সাখীন’ অর্থ আটা ও ঘি অথবা আটা ও খোরমা দিয়ে তৈরি এক প্রকার খাবার। এটি ছিল কুরাইশদের খুবই প্রিয় খাদ্য। তারা খেতও খুব বেশী বেশী। এ কারণে কবি কুরাইশদেরকে ‘সাখীনা’ বলেছেন। এ দ্বারা মূলতঃ তাদেরকে হেয় ও অপমান করা হয়েছে।৫১
কা’ব (রা) কবিতা রচনা করে রাসূলকে (সা) শোনাতেন। মাঝে মাঝে রাসূল (সা) তাতে কিছু শব্দ রদ-বদল করে সংশোধন করে দিতেন। কা’ব তা সবিনয়ে গ্রহণ করে নিজেকে ধন্য মনে করতেন।৫২
সমকালীন আরব সমাজে কা’বের (রা) কবিতা এক অসাধারণ প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। রাসূলে কারীম (সা) হুনাইন যুদ্ধ শেষ করে যখন তায়েফের দিকে যাত্রা করেন প্রভাব ফেলে যে, তারা তা শুনেই ইসলাম গ্রহণ করে। শ্লোক দু’টির অর্থ নিম্নরূপ:
‘তহিামা ও খায়বার থেকে আমরা সকল প্রকার হিংসা-বিদ্ভেষ বিদূরিত করে তরবারি কোষে আবদ্ধ করে ফেলেছি।
এখন আবার আমরা তাকে যে কোন দু’টির মধ্যে একটি স্বাধীনতা দিচ্ছি। যদি তরবারি কথা বলতে পারতো তাহলে বলতো এবার দাউস অথবা সাকীফের পালা।’
ইবনে সীরীন বলেনঃ দাউস গোত্র যখন উক্ত পংক্তি দুটি শুনলো তখন তারা ভীত হয়ে পড়লো। তারা বললো, এখন মুসলমান হয়ে যাওয়াই উচিত। তা না হলে আমাদের দশাও হবে অন্যদের মত। এরপর তারা একযোগে ইসলাম গ্রহণ করে।৫৩
কা’ব (রা) ইসলাম গ্রহণের পর থেকে জীবনের শেস দিন পর্যন্ত স্বীয় কাব্য প্রতিভাকে ইসলাম ও মুসলমানদের সেবায় নিয়োগ করেন। প্রয়োজনের মুহূর্তে তিনি যেমন তরবারি হাতে তুলে নিয়েছেন তেমনিভাবে ভাষার যুদ্ধও চালিয়েছেন। তাঁর জীবনকালের ইসলামের ইতহিাসের সকল ঘটনা তিনি তাঁর কবিতায় ধরে রেখেছেন। বদর যুদ্ধের উবনুল হারেস মহীন হন। তাঁর স্বরণে রচনা করেন এক শোকগাথা।৫৪ উহুদ যুদ্ধ এবং সে যুদ্ধের শহীদের সম্পর্কে বহু কবিতা তিনি রচনা করেছেন। এ যুদ্ধের অন্যতম শহীদ রাসূলুল্লাহর (সা) চাচা সায়্যিদুশ শুহাদা হামযার (রা) স্মরণে তিনি অনেক কবিতা রচনা করেছেন। এ সময় মক্কার পৌত্তলিক কবিদের সাথে ত৭ার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। সীরাতে ইবন হিশামে তার একটি চিত্র পাওয়া যায়।৫৫
হামযার (রা) শানে রচিত একটি মরসিয়াতে তিনি হামযার বোন সাফিয়্যা বিনতু আবদিল মুত্তালিবকে লক্ষ্য করে বলছেন:৫৬
১.ওঠো সাফিয়্যা, ভেঙ্গে পড়োনা। হামযার স্মরণে বিলাপের জন্য নারীদের প্রতি আহবান জানাও।
২.মানুসের অন্তর কাঁপানো যে বিপদ আল্লাহর সিংহের ওপর আপতিত হয়েছে, সেজন্য দীর্ঘ ক্রন্দনে ক্লান্ত হয়ো না।
৩.তিনি ছিলেন পিতৃ-মাতৃহীনদের জন্য মর্যদার প্রতীক। অস্ত্রসজ্জিত অবস্থায় ছিলেন সিংহের মত।
৪.তাঁর সকল কর্ম দ্বারা তিনি শুধু আহমাদের সন্তুষ্টি এবং আরশ ও ইজ্জতের একচ্ছত্র মালিক আল্লাহর খুশীই কামনা করতেন।
বীরে মা’উনায় রাসূলুল্লাহর (সা) প্রতিনিধিদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে কবি কা’বের যবান সোচ্চার হয়ে ওঠে তিনি হত্যাকারীদের নিন্দায় অনেক কবিতা রচনা করেন।৫৭ মদীনার ইহুদী গোত্র বনু নাদীরের নির্বাসন ও ইহুদী নেতা কা’ব আশরাফের হত্যার চিত্র তাঁর একটি দীর্ঘ কবিতায় ধরা পড়েছে। এ ঘটনা লক্ষ্য করে প্রতিপক্ষ কবিদের নিন্দাবাদের জবাবও তিনি দিয়েছেন।৫৮
খন্দক যুদ্ধের চিত্রও তাঁর কবিতায় ধরা পড়েছে। প্রতিপক্ষের বাহিনী ও কবিদের নিন্দায় তিনি দীর্ঘ কবিতা রচনা করেছেন।৫৯ বনু লিহইয়ানের যুদ্ধও তাঁর কবিতায় ধরা পড়েছে।৬০ জ্বি-কারাদের ঘটনায়ও তাঁকে সোচ্চার দেখা যায়।৬১ খায়বার বিজয়ের চিত্রও তাঁর কবিতায় বিধৃত হয়েছে।৬২ মূতার যুদ্ধের শহীদরা তাঁর হৃদয়ে দারুণ ছাপ ফেলেছে। তাঁদের স্বরণে তিনি রচনা করেছেন আবেগ-ভরা এক কাসীদা।৬৩ এভাবে রাসূলুল্লাহর (সা) এ মহান কবির জিহ্বা ইসলামের প্রথম পর্বের সকল ঘটনা ও যুদ্ধে সোচ্চার থেকে আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিভাব যথাযথ ব্যবহার করে ইতিহাসে খ্যাত হয়ে আছেন। তাঁর কিছু কিছু পংক্তি আরবী ভাষা সাহিত্যে প্রবাবদ-প্রবচনে পরিণত হয়েছে। রাওহ ইবন যানবা বলেন, কা’বের নিজ গোত্রের এক ব্যক্তির প্রশংসায় রচিত তাঁর একটি শ্লোক আরবী কাব্য গজতে সর্বাধিক বীরত্বব্যঞ্জক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।৬৪
তথ্যসূত্র:
হাস্সান ইবন সাবিত (রা)
সীরাতের গ্রন্থসমূহ হাস্সানের (রা) অনেকগুলি ডাকনাম বা কুনিয়াত পাওয়া যায়। আবুল ওয়ালীদ, আবুল মাদরাব, আবুল হুসাম ও আবূ আবদির রহমান। তবে আবুল ওয়ারীদ সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।১ তাঁর লকব বা উপাধি ‘শায়িরু রাসূলিল্লাহ’ বা রাসূলুল্লাহর (সা) কবি। তাঁর পিতার নাম সাবিত ইবন আল-মুনজির এবং মাতার নাম আল-ফুরাই’য়া বিনতু খালিদা।২ ইবন সা‘দ আল-ওয়াকিদীর সূত্রে তাঁর মায়ের ানম আল-ফুরাইয়া বিনত হুরাইস বলে উল্লেখ করেছেন।৩ তাঁরা উভয়ে মদীনার বিখ্যাত নাযরাজ গোত্রের বনু নাজ্জার শাখার সন্তান। রাসূলুল্লাহর (সা) মাতুল গোত্র বনু নাজ্জারে সন্তান হওয়ার কারণে রাসূলে পাকের (সা) সাথে আত্মীয়তা ও রক্তের সম্পর্ক ছিল।৪ মা আল-ফুরাইয়া ইসলামের আবির্ভাব কাল পেয়েছিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবিয়্রাতের মর্যাদা লাভ করেছিলেন।৫ তিনি ছিলেন খাযরাজ গোত্রের বিখ্যাত নেতা সা‘দ ইবন উবাদার (রা) চাচাতো বোন।৬ হযরত হাসসান (রা) তাঁর কবিতার একটি চরণে মা আল-ফুরাইয়া’র নামটি ধরে রেখেছেন।৭ প্রখ্যাত সাহাবী শাদ্দাদ ইবন আউস (রা) হাস্সানের (রা) ভাতিজা।৮ হাস্সান (রা) একজন সাহাবী, রাসূলুল্লাহর (সা) দরবারী কবি, দুনিয়ার সকল ঈমানদার কবিদের ইমাম এবং তাঁর কাব্য প্রতিভা রুহুল কুদুস জিবরীল দ্বারা সমর্থিত।৯
ইবন সাল্লাম আল-জামহী বলেনঃ হাস্সানের পিতা সাবিত ইবন আল-মুনজির ছিলেন তাঁর সম্প্রদায়ের একজন নেতা ও সম্মানীয় ব্যক্তি। তাঁর দাদা আল-মুনজির প্রাক-ইসলামী আমলে ‘সুমাইয়া’ যুদ্ধের সময় মীদনার আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের বিচারক হয়ে তাদের মধ্যে ফায়সালা করেছিলেন। কবি হাস্সানের কবিতায় তার একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। একবার মুযানিয়্যা গ্রো কবির পিতাকে বন্দী করেছিল। কবির গোত্র তাঁকে ছাড়িয়ে আনার জন্য ফিদিয়ার প্রস্তাব দিলে তারা প্রত্যাখ্যান করে। দীর্ঘদিন বন্দী থাকার পর তাঁর পিতার প্রস্তাবেই বন্দী বিনিময়ের মাধ্যমে তিনি মুক্ত হন।১০ হাস্সানের দাদা আল-মুনজির ছিলেন খুবই উদার ও শান্তিপ্রিয় মানুষ।
হাস্সান হিজরাতের প্রায় ষাট বচর পূর্বে ৫৬৩ খ্রীষ্টাব্দে ইয়াসরিবে (মদীনা) জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে নির্মিত মসজিদে নব্বীর পশ্চিম প্রান্তে বাবে রহমতের বিপরীত দিকে অবস্থিত ‘ফারে’ কিল্লাটি ছির তাঁদের পৈত্রিক আবাসস্থল। হাস্সানের কবিতায় এর একটি বর্ণনা পাওয়া যায়।১১ কবি হিসেবে বেড়ে ওঠেন এবং কবিতাকে জীবকিার উৎস হিসেবে গ্রহণ করেন। প্রাচীন আরবের জিল্লাক ও হীরার রাজপ্রাসাদে যাতায়াত ছিল। তবে গাস্সানীয় সম্রাটদের প্রতি একটু বেশী দুর্বল ছিরেন। হাস্সানের সাথে ত৭াদের একটা গভীর হৃদ্যতার সম্পর্কে গড়ে ওঠে। তিনি তাঁদের প্রশংসায় বহু সুন্দর সুন্দর কবিতা রচনা করেছেন। তার কিছু অংশ সাহিত্য সমালোচকগণ হাস্সানের শ্রেষ্ঠ কবিতার মধ্যে গণ্য করেছেন।১২ সম্রাটগণও প্রতিদানে তাঁর প্রতি যথেষ্ট বদান্যতা প্রদর্শন করেছেন। তাঁদের এ সম্পর্ক ইসলামের পরেও বিদ্যমান ছিল।১৩
গাস্সানীয় সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট জাবালা ইবন আল-আয়হাম। তাঁর প্রশংসাংয় কবি হাস্সান অনেক কবিতা রচনা করেছেন। খলীফা উমারের (রা) খিলাফতকালে গোটা শামে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হলে এই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। পরাজয়ের পর জাবালা ইবন আল-আয়হাম ইসলাম গ্রহণ করে কিচুকাল হিজাযে বসবাস করেন। এ সময় একবার হজ্জ করতে যান। কা’বা তাওয়াফের সময় ঘটনাক্রমে ত৭ার কাপড়ের আঁচল এক আরব বেদুঈনকে একইভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার নির্দেশ দিরে। জাবালা আত্মাপক্ষ সমর্থন করে বলরেন: আমি একজন রাজা। একজন বেদুঈন কিভাবে আমাকে থাপ্পড় মাতে পারে? উমার (রা) বললেন: ইসলাম আপনাকে ও তাকে একই কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে। জাবালা বিষয়টি একটু ভেবে দেখার কথা বলে সময় চেয়ে নিলেন। এরপর রাতের আঁধারে রোমান সাম্রাজ্যে পালিয়ে যান। পরবর্তীকালে ইসলাম ত্যাগ করেন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।১৪
এই রোমান সাম্রাজ্যে অবস্থানকালে পরবর্তীকালে একবার মু’য়াবিয়া (রা) প্রেরিত এক দূতের সাথে জাবারার সেখানে সাক্ষাৎ হয়। জাবালা তাঁর নিকট হাস্সানের কুশল জিজ্ঞেস করেন। দূত বলেন: তিনি এখন বার্দ্ধক্যে জর্জরিত। অন্ধ হয়ে গেছেন। হাস্সানকে দেওয়ার জন্য জাবালা তাঁর হাতে এক হাজার দীনার দানকরেন। দূত মদীনায় ফিরে আসলেন এবং কবিকে মসজিদে নববীতে পেরেন। তিনি কবিকে বলরেন: আপনার বন্ধু জাবালা আপনাকে সালাম জানিয়েছেন। কবি বললেন: তহালে তুমি যা নিয়ে এসেছো তা দাও। দূত বরলেন: আবুল ওয়ালীদ, আমি কিচু নিয়ে এসেছি তা আপনি কি করে জানলেন? বললেন: তাঁর কাছ থেকে যখনই কোন চিঠি আসে, সাথে কিছুনা কিছু থাকেই।১৫
আল-আসমা’ঈ বণৃনা করেছেন। একবার এক গাস্সানীয় সম্রাট দূত মারফত কবি হাস্সানের নিকট পাঁচ শো দীনার ও কিচু কাগড় পাঠিয়েছিরেন। দূতকে বলে দিয়েছিলেন, তিনি যদি জীবিত না থাকেন তাহলে কাপড়গুলো কবরের ওপর বিছিয়ে দেবে এবং দীনারগুলি দ্বারা একটি উট খরীদ করে তার কবরে পাশে জবেহ করবে। দূত মদীনায় এসে কবির সাক্ষাৎ পেলেন এবং কথাগুলি বললেন। কবি বললেন: তুমি আমাকে মৃতই পেয়েছো।১৬
গাস্সানীয় রাজ দরবারের মত হীরার রাজ দরবারেও কবি হাস্সানের প্রঅভাব প্রতিপত্তি ছিল। জুরজী যায়দান বলেন: প্রাক-ইসলামী আমলে যে সকল খ্যাতিমান আরব কবির হীরার রাজ দরবারের আসা-যাওয়া ছিল এবং আপনা কাব্য-প্রতিভা বলে সেখানে মর্যাদার আসনটি লাভ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে হাস্সান অন্যতম।১৭
ইসলাম-পূর্বকারে কবি হাস্সান ইয়াসরিবের চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই গোত্র আউস ও খাযরাজের মধ্যে যে সকল যুদ্ধ হতো তাতে নিজ গোত্রের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করতেন। আর এখান থেকেই প্রতিপক্ষ আউস গোত্রের দুই শ্রেষ্ঠ কবি কায়স ইবন খুতাইম ও আবী কায়স ইবন আল-আসলাত-এর সাথে কাব্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।১৮
হাস্সানের চার পুরুষ অতি দীর্ঘ জীবন লাভ করেন। প্রত্যেকে একশো বিশ বছর করে বেঁচে ছিলেন। আরবের আর কোন খান্দানের পরপর চার পুরুষ এত দীর্ঘ জীবন লাভ করেনি হাস্সানের প্রপিতামহ হারাম, পিতামহ আল-মুনজির, পিতা সাবিত এবং তিনি নিজে-পেেত্যকে ১২০ বছর বেঁচে ছিলেন।১৯
হাস্সান যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাঁর জীবনে বার্দ্ধক্য এসে গেছে। মদীনায় ইসলাম প্রচারের সূচনা পর্বে তিনি মুসলমান হন। রাসূলুল্লাহর (সা) মদীনায় হিজরাতের সময় হাস্সানের বয়স হয়েছিল ষাট বছর।২০ ইবন ইসহাক হাস্সানের পৌত্র আবদুর রহমানের সূত্রে বর্ণনা করেছেন। হিজরাতের সময় তাঁর বয়স ষাট, এবং রাসূলুল্লাহর (সা) বয়স তিপ্পান্ন বছর ছিল। ইবন সা’দ আরো বর্ণনা করেছেন যে, তিনি ষাট বছর জাহিলিয়্যাতের এবং ষাট বছর ইসলামের জীবন লাভ করেন।২১
রাসূলুল্লাহর (সা) আবির্ভাব বিষয়ে ইবন ইসহাক হাস্সানের একটি বর্ণনা নকল করেছেন। হাস্সান বলেন: আমি তখন সাত/আট বছরের এক চালাক=-চতুর বালক। যা কিচু শুনতাম, বুঝতাম। একদিন এক ইহুদীকে ইয়াসরিবের একটি কল্লিার ওপর উঠে চিৎকার করে মানুষকে কাডতে শুনলাম। মানুষ জড় হলে সে বলতে লাগলো: আজ রাতে আহমাদের লক্ষত্র উদিত হয়েছে। আহমাদকে আজ নবী করে দুনিয়ায় পাঠানো হবে।২২
ইবনুল কালবী বলেন: হাস্সান ছিরেন একজন বাগ্মী ও বীর। কোন এক রোগে তাঁর মধ্যে ভীরুতা এসে যায়। এরপর থেকে তিনি আর যুদ্ধের দিকে তাকাতে পারতেন না এবং কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণও করেননি।২৩ তবে ইবন ‘আব্বাসের (রা) একটি বর্ণনায় জানা যায়, তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। আল্লামাহ ইবন হাজার ‘আসকালানী লিখেছেন: একবার ইবন আববাসকে বলা হলো হাস্সান-আল-লা’ঈন’ (অভিশপ্ত হাস্সান) এসেছে। তিনি বললেন: হাস্সান অভিশপ্ত নন। তিনি জীবন ও জিহবা দিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে জিহাদ করেছেন।২৪ আল্লামাহ্ জাহাবী বলেন, এ বণৃনা দ্বারা প্রমাণিত হয় তিনি জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন।২৫
হাস্সানের (রা) যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ সম্পর্কে যে সবকথা প্রচলিত আছে তা এই বর্ণনায় বিপরীত। খন্দক মতান্তরে উহুদ যুদ্ধের সময় রাসূল (সা) মুসলিম মহিলাদেরকে হাস্সানের ফারে দূর্গে নিরাপত্তার জন্য রেখে যান। তাদের সাথে হাস্সানও ছিলেন। এই মহিলাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহর (সা) ফুফু সাফিয়্যা বিনত ‘আবদিল মুত্তলিবও ছিলেন। একদিন এক উহুদীকে তিনি কিল্লার চতুর্দিকে গুর ঘুর করতে দেখলেন। তিনি প্রমাদ গুণলেন যদি সে মহিলাদের অবস্থান জেনে যায় তাহলে ভীষণ বিপদ আসতে পারে। কারণ রাসূল (সা) তাঁর বাহিনী নিয়ে তখন প্রত্যক্ষ জিহাদে লিপ্ত। তিনি হাস্সানকে বললেন, এই ইহুদীকে হত্যা কর। তা না হলে সে আমাদের অবস্থানের কথা ইহুদীদেরকে জানিয়ে দেবে। হাস্সান বললেন, আপনার জানা আছে আমার নিকট এর কোন প্রতিকার নেই। আমার মধ্যে যদি সেই সাহসই থাকতো তাহলে আমি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথেই থাকতাম। সাফিয়্যা তখন জিনেই তাঁবুর একটি খুঁটি হাতে নিয়ে ইহুদীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করেন। তারপর হাস্সানকে বলেন, যাও, এবার তার সঙ্গের জিনিসগুলি নিয়ে এসো। যেহেতু আমি নারী, আর সে পুরুষ, তাই একাজটি আমার দ্বারা হবে না। এ কাজটি তোমাকে করতে হবে। হাস্সান বললেন, ঐ জিনিসের প্রয়োজন নেই।২৬
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে। সাফিয়্যা লোকটিকে সহ্যার পর মাথাটি কেটে এসে হাস্সাকে বলেন, ধর, এটা দূর্গের নীচে ইহুদীদের মধ্যে ফেলে এসো। তিনি বললেন: এ আমার কাজ নয়। অতঃপর সাফিয়্যা নিজেই মাথাটি ইহুদীদের মধ্যে ছুড়ে মারেন। ভয়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।২৭
হাস্সান (রা) সশরীরে না হরেও জিহবা দিয়ে রাসূলে কারীমের সাথে জিহাদ করেছেন। বনু নাদীরের যুদ্ধে রাসূল (সা) যখন তাদেরকে অবরুদ্ধ করেন এবং তাদের গাছপালা জ্বালিয়ে দেন তখন তার সমর্থনে হাস্সান কবিতা রচনা করেন। বনু নদীর ও মক্কার কুরাইশদের মধ্রে দ্বিপাক্ষিক সাহায্য ও সহযোগিতা চুক্তি ছিল। তাই তিনি কবিতায় কুরাইশদের নিন্দা করে বলেন, মুসলমানরা বুন নাদীরের াবগ-বাগিচা জ্বালিয়ে ছিল, তোমরা তাদের কোন উপকারে আসনি। এ কবিতা মক্কায় পৌঁছালে কুরাইশ কবি আবু সুফইয়ান ইবনুল হারিস বলেন: আল্লাহ সর্বদা তোমাদের এমন কর্মশক্তি দান করুন, যাতে আশে-পাশের আগুনে খোদ মদীনা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আর আমরা দূরে বসে তামাশা দেখবো।২৮
হিজরী পঞ্চম সনে ‘আল-মুরাইসী’ যুদ্ধ থেকে মদীনায় ফেরার সময় একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। সুযোগ সন্ধ্যানী মুনাফিকরা তিলকে তাল করে ফেলে। তারা আয়িশার (রা) পূতঃপবিত্র চরিত্রের ওপর অপবাদ দেয়। মুনফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবন উবাই ছিল এ ব্যাপারে সকলের অগ্রগামী। কতিপয় প্রকৃত মুসলমানও তাদের এ ষড়যন্ত্রের ফাঁদে আটকে পড়েন। যেমন হাস্সান, মিসতাহ ইবন উসাসা, হামনা বিন্ত জাহাশ প্রমুখ। যখন আয়িশার (রা) পবিত্রতা ঘোষণা করে আল কুরআনের আয়াত নাযিল হয় তখন রাসূল (সা) অপবাদ দানকারীদের ওপর কুরআনের নির্ধারিত ‘হদ’ (শাস্তি) আশি দুররা জারি করেন। ইমাম যুহরী থেকে সাহীহাইনে একথা বর্ণিত হয়েছে।২৯ অবশ্য ানেকে ‘হদ’ জারি বিষযটি অস্বীকার করেছেন।৩০
অনেকে অবশ্য হাস্সানের জীবন, কর্মকাণ্ড এবং তাঁর কবিতা বিশ্লেষণ করে এ মত পোষণ করেছেন যে, কোনভাবেই তিনি ইফ্ক’ বা অপবাদের ঘটনায় জড়িত ছিলেন না। যেহেতু তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) পাশে দাঁড়িয়ে মক্কার পৌত্তলিক কুরাইশদের আভিজাত্যের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছিলেন এবং আরববাসীর নিকট তাদের হঠকারিতার স্বরূপ স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিরেন, একারণে পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণকারী কুরাইশরা নানাভাবে তাঁকে নাজেহাল করেছেন। তাঁরা মনে করেন, ইফ্ক’-এর ঘটনায় হাস্সানের নামটি জড়ানোর ব্যাপারে যারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন, তাদের পুরোধা সাফওয়ান ইবন মু’য়াত্তাল। হাস্সান আয়িশার (রা) শানে অনেক অনুপম কবিতা রচনা করেছেন। একটি চরণে তিনি ইফক’-এর ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ান্য একডিট চরণে যারা তাঁর নামটি জড়ানোর ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেছেন, সেই সব কুরাইশ মুহাজিরদের কঠোর সমালোচনা করেছেন।৩১
‘ইফ্ক’-এর ঘটনায় তাঁর জড়িয়ে পড়ার যত বর্ণনা পাওয়া যায়, সীরাত বিশেষজ্ঞরা সেগুলিকে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন। একারণে পরবর্তীকালে বহু সাহাবী ও তাবে’ঊ তাঁকে ভালো চোখে দেখেননি। অনেকে ত৭াকে নিন্দা-মন্দ করেছেন। তবে খোদ আয়িশা (রা) ও রাসূল (সা) ত৭াকে ক্ষমা করেছিলেন। একথা বহু বর্ণনায় জানা যায়। আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। হাস্সানকে মুমিনরাই ভালোবাসে এবং মুনফিকরাই ঘৃণা করে। তিনি আরো বলেছেন: হাস্সান হচ্ছে মুমিন ও মুনাফিকদের মধ্যে প্রতিবন্ধক।৩২ কেউ আয়িশার (রা) সামনে হাস্সানকে (রা) খারাপ কিছু বললে তিনি নিষেধ করতেন।
হাস্সান (রা) শেষ জীবনে অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর একবার আয়িশার (রা) গৃহে আসেন। তিনি যদি বিছিয়ে হাস্সানকে (রা) বসতে দেন। এমন সময় আয়িশার (রা) ভাই আবদুর রহমান (রা) উপস্থিত হন। তিনি বোনকে লক্ষ্য করে বলেনঃ আপনি তাঁকে পদির ওপর বিসয়েছেন? তিনি কি আপনার চরিত্র নিয়ে এসব কথা বলেননি? আয়িশা (রা) বললেনঃ তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) পক্ষ থেকে কাফিরদের জবাব দিতেন শক্রুদের জবাব দিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) অন্তরে শান্তি দিতেন। এখন তিনি ান্ধ হয়েছেন। আমি আশা করি, আল্লা আখিরাতে তাঁকে শাস্তি দেবেন না।৩৩
প্রখ্যাত তাবে’ঈ মাসরূক বলেন: একবার আমরা আয়িশার (রা) কাছে গিয়ে দেখলাম হাস্সান সেখানে বসে বসে আয়িশার (রা) প্রশংসায় রচিত কবিতা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছেন। তার মধ্যে এই পংক্তিটিও ছিল:
‘সাহ্সানুল রাযাবুন মা তুযান্ন বিরীবাতিন’-অর্থাৎ তিনি পূতঃপবিত্র, শক্ত আত্মাসম্মানবোধ সম্পন্ন ভদ্রমহিলা, তাঁর আচরণে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। পরনিন্দা থেকে মুক্ত অবস্থায় তাঁর দিনের সূচনা হয়।
পংক্তিটি শোনার পর আয়িশা (রা) মন্তব্য করলেন: কিন্তু আপনি তেমন নন।’ আশিয়াকে (রা) বললাম: আপনি তাকে এখানে আসার অনুমতি দেন কেন? আল্লরাহ তা’য়ালা তো ঘোষণা করেছেন, ইফ্ক-এ যে অগ্রহণী ভুমিকা রেখেছে, তার জন্য রয়েছে বিরাট শাস্তি। (সূরা: আন-নূর-১১) ‘আয়িশা (রা) বললেন: তিনি ান্ধ হয়ে গেছেন। তাঁর কাজের শাস্তি তো তিনি লাভ করেছেন। অন্ধত্বের চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে? তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) পক্ষ থেকে কুরাইশদের প্রতিরোধ করেছেন এবং তাদের কঠোর নিন্দা করেছেন।৩৪
‘উরওয়া বলেন: একবার আমি ফুরাই’য়ার ছেলে হাস্সানকে আয়িশার (রা) সামনে গালি দিই। আয়িশা (রা) বললেনঃ ভাতিজা, তুমি কি এমন কাজ থেকে বিরত হবে না? তাঁকে গ্যালি দিওনা। কারণ, তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) পক্ষ থেকে কুরাইশদের জবাব দিতেন।৩৫
একবার কতিপয় মহিলা আয়িশার (রা) উপসিথতিতে হাস্সানকে নিন্দমন্দ করে। আয়িশা (রা) তাদেরকে বললেন: তোমরা তাঁকে নিন্দামন্দ করোনা। আল্লাহ তা’য়ালা যে তাদেরকে কঠিন শাস্তি দানের অঙ্গিকার করেছেন, তিনি তা পেয়ে গেছেন। তিনি অন্ধ হয়ে গেছেন। আমি আশা করি তিনি কুরাইশ কবি আবু সুফইয়ান ইবনুল হারিসের কবিতার জবাবে রাসূলুল্লাহর (সা) প্রশংসায় যে কবিতা রচনা করেছেন তার বিনিময়ে আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করবেন। একথা বলে তিনি হাস্সানের হাজাওতা মুহাম্মাদান ফা আজাবতু আনহু’ কবিতাটির কয়েকটি লাইন পাঠ করেন।৩৬
উল্লেখখিত বর্ণনাসমূহ দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা) কবি হাস্সানকে ক্ষমা করেছিলেন। এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আয়িশার (রা) সাথে তাঁর সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।
রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতিকালের পর হাস্সান (রা) দীর্ঘদিন জীবিত ছিলেন। ত৭ার মৃত্যু সময় নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য আছে। আবন ইসহাকের মতে িিতনি হিজরী ৫৪ সনে মারা যান। আল হায়সাম ইবন আদী বলেন: হিজরী ৪০ সনে মারা যান। ইমাম জাহাবী বলেন: তিনি জাবালা ইবন আল-আয়হাম ও আমীর মু’য়াবিয়ার দরবারে গিয়েছেন। তাই কইবন সা’দ বলেছেন: মু’য়াবিয়ার খিলাফতকালে তাঁর মৃত্যু হয়। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে, তিনি হিজরী ৫৪/খ্রীঃ ৬৭৪ সনে ১২০ বছর বয়সে মারা যান।৩৭
আবু’ উবায়েদ আল-কাসেম ইবন সাল্লাম বলেন: হিজরী ৫৪ সনে হাকীম ইবন হিযাম’ আবু ইয়াযীদ হুয়াইতিব ইবন আবদিল উয্যা, সা’ঈদ ইবন ইয়ারবু আল মাখযুমী ও হাস্সান ইবন সাবিত আল-আনসারী মৃত্যুবরণ করেন। এঁদের প্রত্যেকে ১২০ বছর জীবন লাভ করেছিলেন।৩৮
হাস্সানের (রা) স্ত্রীর নাম ছিল সীরীন। তিনি একজন মিসরীয় কিবতী মহিলা। আল-বায়হাকী বর্ণনা করেছেন। রাসূলে কারীম (সা) সাহাবী হযরত হাতিব ইবন বালতা’য়াকে (রা) ইস্কান্দারিয়ার শাসক ‘মাকুকাস’-এর নিকট দূত হিসেবে পাঠান। মাকুকাস রাসূলুল্লাহর (সা) দূতকে যথেষ্ট সমাদর করেন। ফেরার সময় তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) জন্য কিছু উপহার পাঠান। এই উপহার সামগ্রীর মধ্যে তিনটি কিবতী দাসীও ছিল। রাসূলুল্লাহর (সা) ছেলে ইবরাহীমের মা মারিয়্যা আল কিবতিয়্যা (রা) এই দাসী ক্রয়ের একজন। অন্য দুইজন দাসীর মধ্যে রাসূল (সা) হাস্সান ইবন সাবিত ও মুহাম্মদ ইবন কায়স আল-আবদীকে একটি করে দান করেন। হাস্সানকে প্রদত্ত দাসীটি ছিলেন উম্মুল মুমিনীন মারিয়্যা আল-কিবতিয়্যার বোন। নাম ছিল সীরীন। তাঁরই গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন হাস্সানের (রা) ছেলে আবদুর রহমান। এই আবদুর রহমান এবং রাসূলুল্লাহর (সা) ছেলে ইবরাহীম ছিলেন পরস্পর খালাতো ভাই।৩৯
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ফারে’ পর্বতের দূর্গ ছিল হাস্সানের (রা) পৈতৃক বাসস্থান। আবু তালহা (রা) যখন বীরহা’ উদ্যান ত৭ার নিকট আত্মীয়দের মধ্যে সাদাকা হিসেবে বণ্টন করে দেন তখন সেখান থেকে একটি অংশ লাভ করেন। এরপর তিনি এখানে বাসস্থান নির্মাণ করেন। স্থানটি আল-বাকী’র নিকটবর্তী। পরে আমীর মু’য়াবিয়া (রা) তাঁর নিকট থেকে সিটি খরীদ করে সেখানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। যা পরে কাসরে বনী হুদায়লা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। কারো কারো ধারণা যে, রাসূল (সা) এ ভূমি তাঁকে দান করেন। কিন্তু তা সঠিক নয়। উপরে উল্লেখিত আমাদের বক্তব্য সাহীহ বুখারীর বর্ণনা দ্বারা সমর্থিত।
হাস্সানের (রা) মাথার সামনের দিকে এক গোছা লম্বা চুল ছিল। তিনি তা দুই চোখের মাঝখানে সব সময় ছেড়ে রাখতেন। ভীষণ বাক্পটু ছিলেন। এ কারণে বলা হতো, তিনি ত৭ার জিহবার আগা নাকের আগায় ছোঁয়াতে পারতেন। তিনি বলতেন, আরবের কোন মিষ্টভাষীই আমাকে তুষ্ট করতে পারে না। আমি যদি আমার জিহ্বার আগা কারো মাথার চুলের ওপর রাখি তাহলে সে মাথা ন্যাড়া হয়ে যাবে। আর যদি কোন পাথরের ওপর রাখি তাহলে তা বিদীর্ণ হয়ে যাবে।৪০
হাস্সান (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর তাঁর থেকে যাঁরা হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেষযোগ্য হলেনঃ আল-বারা’ ইবন আযিব, সা’ঈদ ইবন মুসাঢ্যিব, আবূ সালামা ইবন আবদির রহমান, উওওয়া ইবন খুরাইর আবুল সাহান মাওলা নবী নাওফাল, খারিজা ইবন যায়িদ ইবন সাবিত, ইয়াহইয়া ইবন আবদির রহমান ইবন হাতিব আয়িশা আবু হুরাইরা, সুলায়মান ইবন ইয়াসার আবদুর রহমান ইবন হাসসান প্রমুখ।৪১ ইবন সা’দ হাস্সানকে (রা) দ্বিতীয় তাবকায় (স্তর) উল্লেখ করেছেন।৪২
রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতিকালের পর প্রথম দুই খলীফা আবূ বকর ও উমারের (রা) খিলাফতকালে হাস্সানের (রা) কোন রাজনৈতিক তৎপরতা দেখা যায় না। উসমানের (রা) খিলাফতের সময় ত৭র মধ্যে রআবার আসাবিয়্যাতের (অন্ধ পক্ষপাতিত্ব) কিচু লক্ষণ দেখা যায়। তিনি খলীফা উসমানের (রা) পক্ষ নিয়ে বনু উমাইয়্যাকে আলীর (রা) বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেন। খলীফা উসমান (রা) বিদ্রোহীদের হাতে শাহাদাত বরণ করলে তিনি বনু হাশিম, বিশেষতঃ আলীকে (রা) ইঙ্গিত করে কিছু কবিতা রচনা করেছেন।৪৩
হাস্সানের (র) জীবনে কবিত্ব একটি স্বতন্ত্র শিরোনাম। কাব্য প্রতিভা সর্বকালে সকল জাতি-গোষ্ঠীর নিকট সমাদৃত। বিশেষ করে প্রাক-ইসলামী আরবে এ গুণটির আবার সবচেয়ে বেশী কদর ছিল। কবিতা চর্চা ছিল সেকালের আরববাসীর এক বিশেষ রুচি। তৎকালীন আরবে কিছু গোত্র ছিল কবির খনি বা উৎস খ্যাত। উদাহরণ স্বরূপ কায়স, রাবী’য়া, তামীম, মুদার, য়ামন প্রমুখ গোত্রের নাম করা যায়। এ সকল গোত্রে অসংখ্য আরবী কবির জন্ম হয়েছে। মদীনার আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় ছির শেষোক্ত য়ামন গোত্রের অন্তর্ভূক্ত। হাস্সানের (রা) পৈত্রিক বংশধারা উপরের দিকে এদের সাথে মিলিত হয়েছে।
উপরে উল্লেখিত গোত্রসমূহের মধ্যে আবার কিচু খান্দানে কবিত্ব বংশানুক্রমে চলে আসছিল। হাস্সানের (রা) খান্দানটি ছির তেমনই। উপরের দিকে তাঁর পিতামহ ও পিতা, নীচের দিকে তাঁর পুত্র আবদুর রহমান, পৌত্র সা’ঈদ ইবন আবদির রহমান এবং তিনি নিজে সকলেই ছিরেন ত৭াদের সমকালে একেকজন শ্রেষ্ঠ কবি।৪৪ হাস্সানের (রা) এক মেয়েও একজন বড় মাপের কবি ছিলেন। হাস্সান (রা) তাঁর বার্দ্ধক্যে এক রাতের কবিতা রচনা করতে বসেছেন। কয়েকটি শ্লোক রচনার পর আর ছন্দ মিলাতে পারছেন না। তাঁর অবস্থা বুঝতে পেরে মেয়ে বললেন: বাবা, মনে মনে হচ্ছে আপনি আর পাররছন না। বললেন: ঠিকই বলেছো। মেয়ে বললেন: আমি কি কিচু শ্লোক মিলিয়ে দেব? বললেন: পারবে? মেয়ে বললেন: হাঁ, তা পারবো। তখন বৃদ্ধ একটি শ্লোক বললেন, আর তার সাথে মিল রেখে একই ছন্দে মেয়েও একটি শ্লোক রচনা করলেন। তখন হাস্সান বললেন: তুমি যতদিনজীবিত আছ আমি আর একটি শ্লোক ও রচনা করবো না। মেয়ে বললেন: তা হয় না; বরং আমি আর আপনার জীবদ্দশায় কোন কবিতা রচনা করবো না।৪৫
প্রাক-ইসলামী ‘আমলের অগণিত আরব কবির অনেকে ছিলেন’ আসহাবে মুজাহ্হাবাত’ নামে খ্যাত। মুজাহ্হাবাত’ শব্দটি জাহাব’ থেকে নির্গত। ‘জাহাব’ অর্থ স্বর্ণ। যেহেুত এ সকল কবিদের কিছু অনুপম কবিতা স্বর্নের পানি দ্বারা লিখিত হয়েছিল, এজন্য সেই কবিতাগুলিকে ‘মুজাহ্হাবাত’ বলা হতো। আর ‘আসহাব’ শব্দটি ‘সাহেব’ শব্দের বহুবচন। যার অর্থ ‘অধিকারী, মালিক।’ সুতরাং’ আসহাবে মুজাহ্হাবাত’ অর্থ স্বর্ণ দ্বারা লিখিত কবিতা সমূহের অধিকারী বা রচয়িতাগণ। পরবর্তীকালে প্রত্যেক কবির সর্বোত্তম কবিতাটিকে মুজাহ্হাব’ বলা হতে াকে। হাস্সানের (রা) ‘মুজাহ্হাবার’ প্রম পংক্তি নিম্নরূপ:৪৬
আরবী হবে
(লা’আমরু আবীকাল খায়রু হাক্কান লিমা বিনা..............)
আরবী কবিদের চারটি তাবকা বা স্তর। ১. জাহিলী বা প্রাক-ইসলামী কালের কবি, ২.মুখাদরাম-যে সকল কবি জাহিলী ও ইসলামী উভয় কাল পেয়েছেন, ৩. ইসলামী-যারা ইসলামের অভ্যূদয়ের পর জন্মগ্রহণ করেন এবং কবি হয়েছেন, ৪. মুহদাস-আব্বাসী বা পরবর্তীকালের কবি। এ দিক দিয়ে হযরত হাস্সান দ্বিতীয় স্তরের কবি। তিনি জাহিলী ও ইসলাম-উভয়কালেই পেয়েছেন।৪৭
কাব্য প্রতিভায় হাস্সান (রা) ছিলেন জাহিলী আমলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। ইমাম আল-আসমা’ঈ বলেন: হাস্সানের জাহিলী আমলের কবিতা শ্রেষ্ঠ কবিতাসমূহের অন্তর্গত।৪৮
হাস্সানের (রা) কাব্য জীবনের দুইট অধ্যায়। একটি জাহিলী ও অন্যটি ইসলামী! যদিও দুইটি ভিন্নধর্মী অধ্যায়, তথাপি একটি অপরটি থেকে কোন অংশে কম নয়। জাহিলী জীবনে তিনি গাস্সান ও হীরার রাজন্যবর্গের স্তুতি ও প্রশংসাগীতি রচনার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। ইসলামী জীবনে তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন রাসূলুল্লাহর (সা) প্রশংসা, তাঁর পক্ষে প্রতিরোধ ও কুরাইশদের নিন্দার জন্য। তিনি সমকালীন শহরে কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি বলে স্বীকৃত। বিদ্রপাত্মাক কবিতা রচনায় অতি দক্ষ। আবু উবায়দাহ্ বলেন: অন্য কবিদের ওপর হাস্সানের মর্যাদা তিনটি কারণে। জাহিলী আমলে তিনি আনসারদের কবি, রাসূলুল্লাহর (সা) নুবুওয়াতের সময়কালে ‘শা’য়িরুর রাসূল’ এবং ইসলামী আমলে গোটা য়ামনের কবি।৪৯
জাহিলী আরবে উকাজ মেলায় প্রতি বছর সাহিত্য-সংস্কৃতির উৎসব ও প্রতিযোগিতা হতো। এ প্রতিযোগিতায় হাস্সানও অংশগ্রহণ করতেন। একবার তৎকালীন আরবের শ্রেষ্ঠ কবি আন-নাবিগা আয্-যুবইয়ানী (মৃতঃ ৬০৪ খ্রীঃ) ছিলেন এ মেলার কাব্য বিচারক। কবি হাস্সান ছিলেন একজন প্রতিযোগী। বিচারক আন-নাবিগা, আল-শা’শাকে হাস্সানের তুলনায় শ্রেষ্ঠ কবি বলে রায় দিলে হাস্সান তার প্রতিবাদ করেন এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ কবি বলে দাবী করেন।৫০
আবুল ফারাজ আল-ইসফাহানী বলেন: আল-আ’শা আবু বাসীর প্রথমে কবিতা পাঠ করেন। তারপর পাঠ করেন হাস্সান ও অন্যন্যা কবিরা। সর্বশেষে তৎকালীন আরবের শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি আল-খান্সা বিনত’ আমর তাঁর কবিতা পাঠ করেন। তাঁর পাঠ শেষ হলে বিচারক আন-নাবিগা বলেন: আল্লাহর কসম! একটু আগে পঠিত আবু বাসীর আল-আ’শার কবিতাটি যদি আমি না শুনতাম তাহলে অবশ্যই বলতাম, তুমি জিন ও মানব জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর এ রায় শোনার সাথে সাথে হাস্সান উঠে দাঁড়ান এবং বলেন: আল্লাহর কসম! আমি আপনার পিতা ও আপনার চেয়ে বড় কবি। আন-নাবিগা তখন নিজের দুইটি চরণ আবৃত্তি করে বলেনঃ ভাতিজা! তুমি এ চরণ দুইটির চেয়ে সুন্দর কোন চরণ বলতে পারবে কি? তখন হাস্সান তাঁর কথার জন্য লজ্জিত হন।৫১ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, আন-নাবিগার কথার জবাবে হাস্সান তাঁরÑ
আরবী হবে
(লানা আল-জাফানাতুল গুররু ইয়াল মা’না বিদদুজা) পংক্তি দুইটি আবৃত্তি করেন। আন-বাবিগা তখন পংক্তি দুইটির কঠোর সমালোচনা করে হাস্সানের দাবী প্রত্যাখ্যান করেন।৫২
হাস্সান (রা) জাহিলী জীবনেই কাব্য প্রতিভার স্বীকৃতি লাভ করেন। গোটা আরবে এবং পার্শ্ববর্তী রাজ দরবারসমূহে তিনি খ্যাতিমান কবিদের তালিকায় জিনের নামটি লেখাতে সক্ষম হন। এরই মধ্রে ত৭র জীবনের ষাটটি বছর পেরিয়ে গেছে। এরপর তিনি ইসলারেম দা’ওয়াত রাভ করলেন। রাসূল (সা) মদীনায় হিজরাত করে আসলেন। হাস্সানের কাব্য-জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা হলো। তিনি স্বীয় কাব্য প্রতিভার যথাযথ হক আদায় করে ‘শা’য়িরুর রাসূল’ খিতাব অর্জন করলেন।
রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় হিজরাত করে আসার পর মক্কার পর মক্কার কুরাইশরা এ আশ্রয়স্থর থেকে তাঁকে উৎখাতের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এক দিকে তারা সম্মুখ সময়ে অবতীর্ণ হয়, অন্যদিকে তারা তাদের কবিদের লেলিয়ে দেয়। তারা আল্লাহর রাসূল, ইসলাম ও মুসলমনাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রচনা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুত করে কবিতা রচনা করতো এবং আরববাসীদেরকে তাঁদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতো। এ ব্যাপারে মক্কার কুরাইশ কবি আবু সুফইয়ান ইবনুল হারেস ইবন আবদিল মুত্তালিব, ‘আবদুল্লাহ ইবন যাব’য়ারী, ’আমর ইবনুল আস ও দাররার ইবনুল খাত্তাব অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তাদের ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ও নিন্দাসূচক কবিতা রাসূল (সা) সহ মুসলমানদেরকে অস্থির করে তোলে।
এ সময় মদীনায় মুহাজিরদের মধ্যে আলী (রা) ছিলেন একজন নামকরা কবি। মদীনার মুসলমানরা তাঁকে অনুরোধ করলো মক্কার কবিদের জবাবে একই কায়দায় ব্যঙ্গ কবিতা রচনার জন্য। আলী (রা) বললেন, রাসূল (সা) আমাকে অনুমতি দিলে আমি তাদের জবাব দিতে পারি। একথা রাসূলুল্লাহর (সা) কানে গেলে তিনি বললেন, আলী একাজের উপযুক্ত নয়। যারা আমাকে তরবারি দিয়ে সাহায্য করেছে, আমি আলীকে তাদের সাহায্যকারী করবো। হাস্সান উপস্থিত দিছেন। তিনি নিজের জিহ্বা টেনে ধরে বললেন: আমি সানন্দে এ দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। তাঁর জিহ্বাটি ছিল সাপের জিহ্বার মত, এক পাশে কালো দাগ। তিনি সেই জিহ্বা বের করে স্বীয় চিবুক স্পর্শ করলেন। তখন রাসূল (সা) বললেন, তুমি কুরাইশদের হিজা (নিন্দা) কিভাবে করবে? তাতে আমারও নিন্দা হয়ে যাবে না? আমিও তো তাদেরই একজন হাস্সান বরলেন: আমি আমার নিন্দা ও ব্যঙ্গ থেকে আপনাকে এমনভাবে বের করে আনবো যেমন আটা চেলে চুল ও অন্যান্র ময়লা বের করে আনা হয়। রাসূল (সা) বললেন: তুমি নসবনামার (কুষ্ঠি বিদ্যা) ব্যাপারে আবু বকরের সাহায্য নেবে। তিনি কুরাইশদের নসব বিদ্যায় বিষে পারদর্শী। তিনি আমার নসব তোমাকে বলে দেবেন।৫৩
জাবির (রা) বলেন। আহযাব যুদ্ধের সময় একদিন রাসূল (সা) বললেন: কে মুসলমানদের মান-সম্মা রক্ষা করতে পারে? কা’ব ইবন মালিক বললেন: আমি। আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা বললেন: আমি। হাস্সান বললেন: আমি রাসূল (সা) হাস্সানকে বললেন: হাঁ, তুমি। তুমি তাদের হিজা (নিন্দা) কর। তাদের বিরুদ্ধে রুহুল কুদুস জিবরীল তোমাকে সাহায্য করবেন।৫৪
হাস্সান (রা) আবু বকরের (রা) নিকট যেতেন এবং কুরাইশ বংশের বিভিন্ন শাখা, ব্যক্তির নসব ও সম্পর্ক বিষয়ে নানা প্রশ্ন করতেন। আবু বকর বলতেন, অমুক অমুক মহিলাকে মুক্ত রাখবেন। তাঁরা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সা) দাদী। অন্য সকল মহিলাদের সম্পর্কে বলবেন। হাস্সান সে ময় কুরাইশদের নিন্দায় একটি কাসীদা রচনা করেন। তাতে তিনি কুরাইশ সন্তান আবদুল্লাহ, যুবাইর, হামযা, সাফিয়্যা, আব্বাস ও দারবার ইবন আবদিল মুত্তালিবকে বাদ দিয়ে একই গোত্রের তৎকালীন মুশরিক নেতা ও কবি আবু সুফইয়ান ইবনুল হারেস-এর মা সুমাইয়্যা ও তার পিতা আল-হারেসের তীব্র নিন্দা ও ব্যঙ্গ করেন।
উল্লেখ্য যে, এই আবু সুফইয়ান ইবনুল হারেস ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) চাচাতো ও দুধ ভাই। ইসলামপূর্ব সময়ে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে তাঁর খুবই ভাব ছিল। নুবুওয়াত প্রাপ্তির পর তার সাথে দুশমনি শুরু হয়। তিনি ছিলেন একজন কবি। রাসূল (সা) ও মুসলমানদের নিন্দায় কবিতা রচনা করতেন। মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হুনাইন যুদ্ধে যোগদান কনের। এই আবু সুফইয়ানের নিন্দায় হাস্সান রচনা করেন এক অববদ্য কাসীদা। তার কয়েকটি শ্লোকের ানুবাদ নিম্নরূপ:৫৫
১.তুমি মুহাম্মদের নিন্দা করেছো, আমি তাঁর পক্ষ থেকে জবাব দিয়ে।ি আর এর প্রতিদান রয়েছে আল্লাহর কাছে।
২.তুমি নিন্দা করেছো একজন পবিত্র, পুণ্যবান ও সত্যপন্থী ব্যক্তির। যিনি আল্লাহর পরম বিশ্বাসী এবং অঙ্গিকার পালন করা যাঁর স্বভাব।
৩.তুমি তাঁর নিন্দা কর? অথচ তুমিতো তাঁর সময়ক্ষ নও। অতএব, তোমাদের নিকৃষ্ট ব্যক্তিরা তোমাদের উৎকৃষ্টদের জন্য উৎসর্গ হোক।
৪.অতএব, আমার পিতা, তাঁর পুত্র এবং আমার মান-ইজ্জত মুহাম্মদরে মান-সম্মান রক্ষায় নিবেদিত হোক।
হাস্সানের (রা) এ কবিতাটি শুনে সুফইয়ান ইবনুল হারিস মন্তব্য করেন: নিশ্চয় এর পিছনে আবু বকরের হাত আছে। এভাবে রাসূলুল্লাহর (সা) প্রশংসায় ও কাফিরদের নিন্দায় ৭০টি বয়েত (শ্লোক) রচজনায় জিবরীল (আ) তাঁকে সাহায্য করেন।৫৬
প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কাব্যের প্রতিরোধ ব্যুহ রচনায় হাস্সানের (রা) এমন প্রয়াসে রাসূলে কারীম (সা) দারুণ খুশী হতেন। একবার তিনি বলেনঃ ‘হাস্সান! আল্লাহ রাসূলে পক্ষ থেকে তুমি জবাব দাও। হে আল্লাহ! তুমি তাকে রুহুল কুদুস জিবরীলের দ্বারা সাহায্য কর।’৫৭
আর একবার রাসূল (সা) হাস্সানকে (রা) বললেন: ‘তুমি কুরাইশদের নিন্দা ও বিদ্রুপ করতে থাক, জিবরীল তোমার সাথে আছেন।৫৮
একটি বর্ণনায় এসেছে। রাসূল (সা) বলেন: আমি আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাকে কুরাইশ কবিদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের প্রত্যুত্তর করতে বললাম। সে সুন্দর প্রত্যুত্তর করলো। আমি কা’ব ইবন মালিককেও বললাম তাদের জবাব দিতে। সে উত্তম জবাব দিল। এরপর আমি হাস্সান ইবন সাবিতকে বললাম। সে যে জবাব দিল তাদে সে নিজে যেমন পরিতৃপ্ত হলো, আমাকেও পরিতৃপ্ত করলো।৫৯
হাস্সানের (রা) কবিতা মক্কার পৌত্তলিক কবিদের মধ্রে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতো সে সম্পর্কে রাসূল (সা) বলেন: ‘হাস্সানের কবিতা তাদের মধ্যে তীরের আঘাতের চেয়েও তীব্র আঘাত করে।’৬০
‘আয়িশা (রা) থেকে উরওয়া বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা) তাঁর মসজিদে হাস্সানের জন্য একটি মিন্বর তৈরী করারন। তার ওপর দাঁড়িয়ে তিনি কাফির কবিদের জবাব দিতেন।৬১ তিনি এ মিন্বরে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) প্রশংসা ও পরিচিতিমূলক কবিতা পাঠ করতেন এবং কুরাইশ কবিদের জবাব দিতেন, আর রাসূল (সা) তা শুনে দারুণ তুষ্ট হতেন।৬২ এ কারণে ‘আয়িশা (রা) একবার রাসূলুল্লাহর (সা) পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, তিনি তেমনই ছিলেন যেমন হাস্সান বলেছে।৬৩
হিজরী নবম সনে (খ্রীঃ ৬৩০) আরবের বিখ্যাত গোত্র বনু তামীমের ৭০ অথবা ৮০ জনের একটি প্রতিনিধি দল মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এলা। এই দলে বনু তামীমের আয্-যিবিরকান ইবন বদরের মত বাঘা কবি ও উতারিদ ইবন হাজিরের মত তুখোড় বক্তাও ছিলেন। তখন গোটা আরবে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে। তার আগের বছর মক্কাও বিজিত হয়েছে। তখন গোটা আরবে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে। তার আগের বছর মক্কাও বিজিত হয়েছে। জনসংখ্রা, শক্তি ও মর্যাদার দিক দিয়ে গোটা বনু তামীমের তখন ভীষণ দাপট। তারা রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে উপস্থিত হয়ে আরবের প্রথা অনুযায়ী বললো: ‘মুহাম্মাদ! আমরা এসেছি আপনার সাথে গর্ব ও গৌরব প্রকাশের প্রতিযোগিতা করতে। আপনি আমাদের খতীবদের ানুমতি দেওয়া হলো। তখন বনু তামীমের পক্ষে তাদের শ্রেষ্ঠ খতীব উতারিদ ইবন বদর দাঁড়ালেন এবং তাদের গৌরব ও কীর্তির বর্ণনা দিলেন। রাসূলুল্লাহর (সা) পক্ষে জবাব দিলে প্রখ্যাত খতীব সাবিত ইবন কায়স। তারপর বনু তামীমের কবি যিবিরকান ইবন বদর দাঁড়ালেন এবং তাদের গৌরব ও কীর্তি কথায় ভরা স্বারচিত কাসীদা পাঠ কররেন। তাঁর আবৃত্তি শেস হলে রাসূল (সা) বললেন: হাস্সান, ওঠো! লোকটির জবাব দাও।’ হাস্সান দাঁড়িয়ে প্রতিপকষ কবির একই ছন্দ ও অন্তমিলে তাৎক্ষণিকভাবে রচিত এক দীর্ঘ কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। তাঁর এ কবিতা পক্ষ-বিপক্ষের সকলকে দারুণ মুদ্ধ করে। বনু তামীমের শ্রোতার এক বাক্যে সেদিন বলে, মুহাম্মদের খতীব আমাদের খতীব অপেক্ষা এবং ত৭ার কক্ষি আমাদের কবি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।৬৪
হাস্সানের (রা) জাহিলী কবিতার বিষয়বস্তু ছিল গোত্রীয় ও ব্যক্তিগত মাদাহ (প্রশংসা) ও হিজা (নিন্দা ও ব্যঙ্গ বিদ্রুপ)। তাছাড়া শোকগাঁথা, মত পানের আড্ডা ও মদের বর্ণনা, বীরত্ব, গর্ব ও প্রেম সংগীত রচনা করেছেন। ইসলামী জীবনের কবিতায় তিনি অন্তর দিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) প্রশংসা করেছেন, আর নিন্দা করেছেন পৌত্তলিকদের যারা আল্লাহ রাসূল ও ইসলামের সাথে দুশমনী করেছে।
ইসলাম তাঁর কবিতায় সততা ও মাধুর্য দান করেছে। কবিতায় তিনি ইসলামের বহু বিষয়ের বর্ণনা ও ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। কবিতায় পবিত্র কুরআনের প্রচুর উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। এ কারণে যারা আরবী কবিতায় গাতনুগতিকতার বন্ধন ছিন্ন করে অভিনবত্ব আনয়নের চেষ্টা করেছেন,হাস্সানকে তাদের পুরোধা বলা সঙ্গত। রাসূলুল্লাহর (সা) প্রশংসা গীতি বা না’ তে রাসূল রচনার সূচনাকারী তিনিই। আরবী কবিতায় জাহিলী ও ইসলামী আমলে মাদাহ (প্রশংসা গীতি) রচনায় যাঁরা কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, হাস্সান তাদের অন্যতম।৬৫
ইবনুল আসীর বলেনঃ পৌত্তলিক কবিদের নিন্দা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও অপপ্রচারের জবাব দানের জন্য তৎকালীন আরবের তিনজন শ্রেষ্ঠ কবি মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা) পাশে এসে দাঁড়ান। তাঁরা হলেন হাস্সান ইবন সাবিত, কা’ব ইবন মালিক ও আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা। হাস্সান ও কা’ব প্রতিপক্ষ কবিদের জবাব দিতেন তাদেরই মত বিভিন্ন ঘটনা, যুদ্ধ-বিগ্রহের জয়-পরাজয়, কীর্তি ও গৌরব তুলে ধরে। আর আবদুল্লাহ তাদের কুফরী ও দের দেবীর পূজার কথা উল্লেখ করে ধিক্কার দিতেন। তাঁর কবিতা প্রতিপক্ষের ওপর তেমন বেশী প্রভাব ফেলতো না। তবে ান্য দুইজনের কবিতা তাদেরকে দারুণভাবে আহত করতো৬৬
হাস্সান (রা) আল্লাহ ও রাসূলের (সা) প্রতি কুরাইশদের অবাধ্যতা ও তাদের মূর্তিপূজার উল্লেখ করে নিন্দা করতেন না। কারণ, তাতে মেন ফল না হওয়ারই কথা। তারা তো রাসূলকে (সা) বিশ্বাসই করেনি। আর মূর্তি পূজাকেই তারা সত্য বলে বিশ্বাস করতো। তাই তিনি তাদের বংশগত দোষ-ক্রুটি, নৈতিকতার স্বলন, যুদ্ধে পরাজয় ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরে তাদেরকে চরমভাবে আহত করতেন। আর একাজে আবু বকর (রা) তাঁকে জ্ঞান ও তথ্য দিয়ে সাহায্য করতেন।
প্রাচীন আরবী কবিতার যতগুলি বিষয় বৈচিত্র আছে তার সবগুলিতে হাস্সানের (রা) পদচারণা পাওয়া যায়। এখানে সংক্ষেপে তাঁর কবিতার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো:
১.উপমার অভিনবত্ব: একথা সত্য যে প্রাচীন কবিতা কোন উন্নত সভ্যতার মধ্যে সৃষ্টি হয়নি। তবে একথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, বড় সভ্যতা দ্বারা তা অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়েছে। আরব সভ্যতার সত্যিকার সূচনা হয়েছে পবিত্র কুরআনের অবতরণ ও রাসূলুল্লাহর (সা) আবির্ভাবের সময় থেকে। কুরআন আরবী বাচনভঙ্গি ও বাক্যালস্কারের সবচেয়ে বড় বাস্তব মুজিয়া। এই কুরআন ানেক বড় বড় বাগীকে হতবাক করে দিয়েছে। এ কারণে সে সময়ের যে কবি ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাঁর মধ্যে বাকপটুতা ও বাক্যালঙ্কারের এক নতুন শক্তির সৃষ্টি হয়। এ শ্রেণীর কবিদের মধ্যে হাস্সান ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। এ শক্তি ত৭ার মধ্যে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশী দেখা যায়।
পবত্রি কুরআনে সাহাবায়ে কিরামের গুণ বৈশিষ্ট্যের বিবরণ দিতে গিয়ে বলা হয়েছেÑ
সিজদার চিহ্ন তাদের মুখমণ্ডলে স্পষ্ট বিদ্যামন। হাস্সান উক্ত আয়াতকে উসমানের (রা) প্রশংসায় রূপক হিসেবে ব্যবহার করে হত্যাকারীদের ধিক্কার দিয়েছেন। তিনি বলেছেন:৬৭
তারা এই কাঁচা-পাকা কেশধারী, ললাটে সিজদার চিহ্ন বিশিষ্ট লোকটিকে জবাই করে দিল, যিনি তাসবীহ পাঠ ও কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে রাত অতিবাহিত করতেন।’
এই শ্লোকে কবি উসমানের চেহারাকে সিজদার চিহ্নধারী বলেছেন। তৎকারীন আরবী কবিতায় এ জাতীয় রূপকের প্রয়োজ সম্পূর্ণ নতুন।
২. চমৎকার প্রতীকের ব্যবহার: আরবী অলঙ্কার শাস্ত্রে ‘তাতবী’ বা ‘তাজাওয়ায’ নামে এক প্রকার প্রতীকের নাম দেখা যায়। তার অর্থ হলো, কবি কোন বিষয়ের আরোচনা করতে যাচ্ছেন। কিন্তু অকম্মাৎ অতি সচেতনভাবে তা ছেড়ে দিয়ে এমন এক বিসয়ের বর্ণনা কনে যাতেতাঁর পূর্বের বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। হাস্সানের কবিতায় এ জাতীয় প্রতীক বা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
আরবে অসংখ্য গোত্র দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমির মধ্যে বসবাস করতো। তারা ছিল যাযাবর। সেখানে পানি ও পশুর চারণভূমি পাওয়া যেত সেখানেই তাঁবু গেড়ে অবস্থায়ী বাসস্থান পড়ে তুরতো। পানি ও পশুর খাদ্য শেষ হলে নতুন কোন কোন স্থানের দিকে যাত্রা করতো। এভাবে তারা এক স্থান থেকে ান্য স্থানে ঘুরে বেড়াতো। আরব কবিরা তাদের কাব্যে এ জীবনকে নানভাবে ধরে রেখেছেন। তবে হাস্সান বিষয়টি যেভাবে বর্ণনা করেছে তাতে বেশ অভিনবত্ব আছে। তিনি বলছেন : ‘জাফ্নার সন্তানরা তাদের পিতা ইবন মারিয়্যার কবরের পাশেই থাকে, তিনি খুবই উদার ও দানশীল।’
প্রশংসিত ব্যক্তি যেহেতু আরব বংশোদ্ভুত। এ কারণে তাঁর প্রশংসা করতে গিয়ে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গি করে বলে দিলেন, এঁরা আরব হলেও যাযবর নন, বরং রাজন্যবর্গ। কোন রকম ভীতি ও শঙ্কা ছাড়াই তাঁরা তাঁদের পিতার কবরের আশে-পাশেই বসবাস করেন। তাঁদের বাস্থান সবুজ-শ্যামল। একারণে তাঁদের স্থান থেকে স্থানান্তরে ছুটে বেড়ানোর প্রয়োজন পড়েনা।
৩. রূপকের অভিনবত্ব: আরব কবিরা কিছু কথা রূপক অর্থে এবং পরোক্ষে বর্ণনা করতেন। যেমন: যদি উদ্দেশ্যে হয় একথা বলা যে, অমুক ব্যক্তি অতি মর্যাদাবান ও দানশীল, তাহলে তাঁরা বলতেন, এই গুণগুলি তার পরিচ্ছেদের মধ্যেই আছে। হাস্সানের (রা) কবিতায় রূপকের অভিনবত্ব দেখা যায়। যেমন একটি শ্লোকে তিনি চলতে চান, আমরা খুবই কুলিন ও সন্তুন্তু। কিন্তু কথাটি তিনি বলেছেন এভাবে: ‘সম্মান ও মর্যদা আমাদের আঙ্গিনায় ঘর বেঁধেছে এবং তার খুঁটি এত মজবুত করে গেঁড়েছে যে, মানুষ তা নাড়াতে চাইলেও নাড়াতে পারে না।’ এই শ্লোকে সম্মান ও মর্যদার ঘর বাঁঢ়া, সুদৃঢ় পিলার স্থাপন করা এবং তা টলাতে মানুষের অক্ষম হওয়া এ সবই আরবী কাব্যে নতুন বর্ণনারীতি।
৪. ছন্দ, অন্তমিল ও স্বর সাদৃশ্যের আশ্চর্য রকমের এই সৌন্দর্য তাঁর কবিতায় দেখা যায়। শব্দের গাঁখুনি ও বাক্যের গঠন খুবই শক্ত, গতিশীল ও সাবলীল। প্রথম শ্লোকের প্রথম অংশের শেষ পদের শেষ বর্ণটি তাঁর বহু কাসীদার প্রতিটি শ্লোকের শেষ পদের শেষ বর্ণ দেখা যায়। আরবী ছন্দ শাস্ত্রে যাকে কাফিয়া’ বলা হয়। আরবী বাক্যের এ ধরনের শিল্পকারিতা এর আগে কেবল ইমরুল কায়সের কবিতায় লক্ষ্য করা যায়। তবে তাঁর পরে বহু আরব কবি নানা রকম শিল্পকারিতার সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। আব্বাসী আমলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক কবি আবুল আলা আল-মা’য়াররীর একটি বিখ্যাত কাব্যের নাম নুযুমু মালা ইয়ালযাযু’। কবিতা রচনায় এমন কিছু বিষয় তিনি অপরিহার্যরূপে অনুসরণ করেছেন, যা আদৌ কবিতার জন্য প্রয়োজন নয়। তাঁর এ কাব্যগ্রন্থটি এ ধররেন কবিতার সমষ্টি। এটা তাঁর একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ।
৫. হাস্সানের কবিতার আর একটি বৈশিষ্ট হলো, তিনি প্রায়ই এমন সব শব্দ প্রয়োগ করেছেন যা ব্যাপক অর্থবোধক। তিনি হয়তো একটি ভাব স্পষ্ট করতে চেয়েছেন এবং সেজন্য এমন একটি শব্দ প্রয়োগ করেছেন যাতে উদ্দিষ্ট বিষয়সহ আরো অনেক বিষয় সুন্দরভাবে এসে গেছে।৬৮
৬. অতিরঞ্জন ও অতিকথন: হাস্সানের ইসলামী কবিতা যাবতীয় অতিরঞ্জন ও অতিকথন থেকে মুক্ত বলা চলে। একথা সত্য যে কল্পনা ও অতিরঞ্জন ছাড়া কবিতা হয় না। তিনি নিজেই বলতেন, মিথ্যা বলতে ইসলাম নিষেধ করেছে। এ কারণে অতিরঞ্জন ও অতিকথন, যা মূলতঃ মিথ্যারই নামান্তরÑআমি একেবারেই ছেড়ে দিয়েছি।৬৯
শুধু তাই নয়, তাঁর জাহিলী আমলে লেখা কবিতায়ও এ উপাদান খুব কম ছিল। আর এ কারণে তৎকারীন আরবের শ্রেষ্ঠ কবি আন-নাবিগা কবি হাস্সানের একটি শ্লোকের অবমূল্যায়ন করলে দুই জনের মধ্যে ঝগড়া হয়।৭০
হাস্সানের ইসলামী কবিতার মূল বিষয় ছিল কাফিরদের প্রতিরোধ ও নিন্দা করা। কাফিরদের হিজা ও নিন্দা করে তিনি বহু কবিতা রচনা করেছেন। তবে তাঁর সেই কবিতাকে অশ্ললতা স্পর্শ করতে পারেনি। তৎকারীন আরব কবিরা ‘হিজা’ বলতে নিজ গোত্রের প্রশংসা এবং বিরোধী গোত্রের বিন্দা বুঝাতো। এই নিন্দা হতো খুবই তীর্যক ও আক্রমণাত্মক। এ কারণে কবিরা তাদের কবিতায় সঠিক ঘটনাবলী প্রাসঙ্গিক ও মনোরম ভঙ্গিক তুলে ধরতো।জাহিলী কবি যুহাইর ইবন আবী-সুলমার জিহা’ বা নিন্দার একটি স্টাইল আমরা তার দুইটি শ্লোকে লক্ষ্য করি। তিনি ‘হিস্ন’ গোত্রের নিন্দায় বলেছেন:৭১
‘আমি জানিনে। তবে মনে হয় খুব শিগ্গী জেনে যাব। ‘হিস্ন’ গোত্রের লোকেরা পুরুষ না নারী? যদি পর্দানশীল নারী হয় তাহলে তাদের প্রত্যেকে কুমারীর প্রাপ্য হচ্ছে উপহার।’
যুহাইরের এ শ্লোকটি ছিল আরবী কবিতার সবচেয়ে কঠোর নিন্দাসূচক। এ কারণে শ্লোকটি উক্ত গোত্রের লোকদের দারুণ পীড়া দিয়েছিল। হাস্সানের নিন্দাবাদের মধ্যে শুধু গালিই থাকতো না, তাতে থাকতো প্রতিরোধ ও প্রতিউত্তর। তাঁর ষ্টাইলটি ছিল অতি চমৎকার। কুরাইশদের নিন্দায় রচিত তাঁর একটি কবিতার শেষের শ্লোকটি সেকালে এতখানি জনপ্রিয়তা পায় যে তা প্রবাদে পরিণত হয়। শ্লোকটি নিম্নরূপ:
‘আমি জানি যে তোমার আত্মীয়তা কুরাইশদের সংগে আছে। তবে তা এ রকম যেমন উট শাবকের সাথে উট পাখীর ছানার সাদৃশ্য হয়ে থাকে।’৭২
পরবর্তীকালে কবি ইবনুল মুফারিরগ উল্লেখিত শ্লোকটির ১ম পংক্তিটি আমীর মুয়াবিয়ার (রা) নিন্দায় প্রয়োগ করেছেন।৭৩ আল-হারেস ইবন’ আউফ আল-মুররীর গোত্রের বসতি এলাকায় রাসূলুল্লাহ (সা) প্রেরিত একজন মুবাল্লিগ নিহত হলে কবি হাস্সান তার নিন্দায় একটি কবিতা রচনা করেন। তিনি বলেন:
‘যদি তোমরা প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করে থাক তাহলে তা এমন কিছু নয়। কারণ, প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করা তোমাদের স্বভাব। আর প্রতিশ্র“তি ভঙ্গের মূল থেকেই প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ অঙ্কুরিত হয়।’
হাস্সানের এই বিদ্রুপাত্মক কবিতা শুনে আল-হারেসের দুই চোখে অশ্র“র প্লাবন নেমেয় আসে। সে রাসূলুল্লাহ (সা) দরবারে ছুটে এসে আশ্রয় প্রার্শনা করে এবং হাস্সানকে বিরত রাখার আবেদন জানায়।৭৪
হাস্সান (রা) চমৎকার মাদাহ বা প্রশংসা গীতি রচনা করেছেন। আলে ইনানের প্রশংসায় তিনি যে সকল কবিতা রচনা করেছেন তার দুইটি শ্লোকে এ রকম:
‘যারা তাদের নিকট যায় তাদেরকে তারা ‘বারদী’ নদীর পানি স্বচ্ছ শরাবের সাথে মিথিয়ে পান করায়।’
এই শ্লোকটিরই কাছাকাছি একটি শ্লোকে রচনা করেছেন কবি ইবন কায়স মুস’য়াব ইবন যুবাইরের প্রশংসায়। কিন্তু যে বিষয়টি হাস্সানের শ্লোকে ব্যক্ত হয়েছে তা ইবন কায়সের শ্লোকে অনুপস্থিত।৭৫
অন্য একটি শ্লোকে তিনি গাসসানীয় রাজন্যবর্গের দানশীলতা ও অতিথিপরায়ণতার একটি সুন্দর চিত্র এঁকেছেন চমৎকার ষ্টাইলে। ‘তাঁদের গৃহে সব সময় াতিথিদের এত ভিড় থাকে যে তাঁদের কুকুরগুলিও তা দেখতে অভ্যন্ত হয়ে গেছে। এখন আর তারা নতুন আগন্তুককে দেখে ঘেউ ঘেউ করে না।’
আরবী কাব্য জগতের বিখ্যাত তিন কবির তিনটি শ্লোক প্রশংসা বা মাদাহ কবিতা হিসেবে সর্বোত্তম। এ ব্যাপারে প্রায় সকলে একমত। তবে এ তিনটির মধ্যে সবচেয়ে ভালো কোনটি সে ব্যাপারে মতপার্থক্য আছে। কবি হুতাইয়্যা হাস্সানের এ শ্লোকটিকে শ্রেষ্ঠ মনে করেছেন। কিন্তু অন্যারা আবুত ত্বিহান ও নাবিগার শ্লোক দুইটিকে সর্বোত্তম বলেছেন।৭৬ ইমাইয়্যা খলীফা আবদুল মালিক ছিলেন একজন বড় জ্ঞানী ও সাহিত্য রসিক মানুষ। তাঁর সিদ্ধান্ত হলো, ‘আরবরা যত প্রশংসাগীতি রচনা করেছে তার ম্েয সর্বোত্তম হলো হাস্সানের শ্লোকটি।’৭৭ তিনি রাসূলে কারীমের প্রশংসায় যে সকল কবিতা রচনা করেছেন তার ষ্টাইল ও শিল্পকারিতায় যথেষ্ট নতুনত্ব আছে। রাসূলুল্লাহ (সা) প্রশংসায় রচিত একটি শ্লোকে তিনি বলেছেন ‘অন্ধকার রাতে রাসূলুল্লাহ (সা) পবত্র ললাট অন্ধকারে জ্বলন্ত প্রদীপের আলোর মত উজ্জ্বল দেখায়।’
হাস্সান (রা) জাহিলী ও ইসলামী জীবনে অনেক মারসিয়া বা শোকগাঁথা রচনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) ইনতিকাল ছিল মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় শোক ও ব্যথা। হাস্সান রচতি কয়েকটি মারসিয়ায় সে শোক অতি চমৎকাররূপে বিধৃত হয়েছে। ইবন সা’দ তাঁর তাবাকাতে মারসিয়াগুলি সংকলন করেছেন।
হাস্সান ছিলেন একজন দীর্ঘজীবনের অধিকারী অভিজ্ঞ কবি। তাছাড়া একজন মহান সাহাবীও বটে। এ কারণে তাঁর কবিতায় পাওয়া প্রায় প্রচুর উপদেশ ও নীতিকথা। কবিতায় তিনি মানুষকে উন্নত নৈতিকতা অর্জন করতে বলেছেন। সম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধ বিষয়ে দুইটি শ্লোক:
‘অর্থ-সমএদর বিনিময়ে আমি আমার মান-সম্মান রক্ষা করি। যে অর্থ-সম্মাদে সম্মান রক্ষা পয়না আল্লাহ তাতে সমৃদ্ধি দান না করুন!
সম্পদ চলে গেলে তা অর্জন করা যায়; কিন্তু সম্মানক্ষার বার অর্জন করা যায় না।’৭৯
মানুষের সব সময় একই রকম থাকা উচিত। প্রাচযর্যের অধিকারী হলে ধরাকে সরা জ্ঞান করা এবং প্রাচুর্য চলে গেলে ভেঙ্গে পড়া যে উচিত নয়, সে কথা বলেছেন একটি শ্লোকে:
‘অর্থ-সম্পদ আমার লজ্জা-শরম ও আত্মা-সম্মানবোধেকে ভুলিয়ে দিতে পারেনি। তেমনিভাবে বিপদ-মুসবিত আমার আরাম-আয়েশ বিঘিœত করতে পারেনি।’৮০
অত্যাচারের পরিণতি যে শুভ হয় না সে সম্পর্কে তাঁর একটি শ্লোক:
‘আমি কোন বিষয় সম্পর্কে অহেতুক প্রশ্ন ও অনুসন্ধান পরিহার করি। অধিকাংশ সময় গর্ত খননকারী সেই গর্তের মধ্যে পড়ে।’৮১
তিনি একটি শ্লোকে মন্দ কথা শুনে উপেক্ষা করার উপদেশ দিয়েছেন:
‘মন্ত খতা শুনে উপেক্ষা কর এবং তার সাথে এমন আচরণ কর যেন তুমি শুনতেই পাওনি।’৮২
লাঞ্ছিত ও অপমানিত অবস্থায় জীবন যাপন সম্পর্কে তিনি বলেন:
‘তারা মৃত্যুকে অপছন্দ করে তাদের চারণভূমি ান্যদের জন্য বৈধ করে দিয়েছি। তাই শক্ররা সেখানে অপকর্ম সম্পন্ন করেছে।
তোমরা কি মৃত্যু থেকে পালাচ্ছো? দুর্বলতার মৃত্যু তেমন সুন্দর নয়।’৮৩
‘আবদুল কাহির আল-জুরজানী বলেছেন, হাস্সানের রচিত কবিতার সকল পদের মধ্যে একটা সুদৃঢ় ঐক্য ও বন্ধন দেখা যায়। এমন কি সম্পূর্ণ বাক্যকে একটি শক্তিশালী রশি বলে মনে হয়।৮৪
একালের একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সমালোচক বুটরুস আল-বুসতানী বলেন: ‘হাস্সানের কবিতার বিশেষত্ব কেবল তাঁর মাদাহ ও হিজার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং তার রয়েছে এক বড় ধরনে বিশেষত্ব। আর তা হচ্ছে তাঁর সময়ের ঘটনাবলীর একজন বিশ্বস্ত ঐতিহাসিকের বিশেষত্ব। কারণ, তিনি বর্ণনা করেছেন রাসূলুল্লাহ (সা) জীবনের যুদ্ধ-বিগ্রহ ও বিভিন্ন ঘটনাবল্ ীএ সকল যুদ্ধে মুসলিম ক্ষে যাঁরা শহীদ হয়েছে এবং বিরোধী পক্ষে যারা নিহত হয়েছে তাদের অনেকের নাম তিনিকবিতায় ধরে রেছেনে।। আমরা যখন ত৭ার কবিতা পাঠ করি তখন মনে হয়, ইসলামের প্রথম পর্বের ইতিহাস পাঠ করছি।”৮৫
প্রাচীন আরবের অধিবাসীরা দেহাতী ও শহুরেÑএই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। মক্কা, মদীনা ও তায়েপের অভিাসীরা ছিল শহরবাসী। অবশিষ্ট সকল অঞ্চলের অধিবাসীরা ছির দেহাতী বা গ্রাম্য। বেশীর ভাগ খ্যাতিমান কবি ছিলেন গ্রাম অঞ্চলের। এর মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু কবি শহরেও জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে হাস্সানের স্থান সর্বোচ্চ।৮৬
ইবন সাল্লাম আল-জামহী বলেন: ‘মদীনা, মক্কা, তায়িক, ইয়ামামাহ, বাহরাইনÑএর প্রত্যেক গ্রামে অনেক কবি ছিরেন। তবে মদীনার গ্রাম ছির কবিতার জন্য শীর্ষে। এখানকার শ্রেষ্ঠ কবি পাঁচজন। তিনজন খাযরাজ ও দুইজন আউস গোত্রের। খাযরাজের তিনজন হলেন: কায়স ইবনুল খুতাইম ও আবু কায়স ইবন আসলাত। এঁদের মধ্যে হাস্সান শ্রেষ্ঠ।৮৭ আবু ‘উবায়দাহ বলেন: ‘শহুরে কবিদের মধ্যে হাস্সান সর্বশ্রেষ্ঠ।৮৮ একথা আবু আমর ইবনুল আলাও বলেছেন। কবি আল-হুতাইয়্যা বলেন: তোমরা আনসারদের জানিয়ে দাও, তাদের কবিই আরবের শ্রেষ্ঠ কবি।’৮৯ আবুল ফরাজ আল-ইসফাহানী বলেন: হাস্সান শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন। খোদ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: ইমারাইল কায়স হচ্ছে দোযখী কবিদের পতাকাবাহী এবং হাস্সান ইবন সাবিত তাদের সকলকে জান্নাতের দিকে চালিত করবে।৯০
ইমাম আল-আসমা’ঈ বলেন: অকল্যাণ ও অপকর্মে কবিতা শক্তিশালী ও সাবলীল হয়। আর কল্যাণ ও সৎকর্মে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই যে হাস্সান, তিনি ছিলেন জাহিলী আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। ইসরাম গ্রহণের পর তাঁর কবিতার মান নেমে যায়। তাঁর জাহিলী কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা।’৯১
হাস্সানের (রা) বার্দ্ধক্যে একবার তাঁকে বলা হলো, আপনার কবিতা শক্তিহীন হয়ে পড়েছে এবং তার পর বার্দ্ধক্যের ছাপ পড়েছে। বললেন: ভাতিজ্য! ইসলাম হচ্ছে মিথ্যার প্রতিবন্ধক। ইবনুল আসীর বলেন, হাস্সানের একথার অর্থ হলো কবিতার বিষয়বস্তুতে যদি অতিরঞ্জন থাকে তাহলে চমৎকার হয়। আর যে কোন অতিরঞ্জনই ইসলামের দৃষ্টিতে মিথ্যাচার, যা পরিহারযোগ্য। সুতরাং কবিতা ভালো হবে কেমন করে?৯২
বুটরুস আল-বুসতানী হাস্সানের (রা) কবিতার মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন: ‘আমরা দেখতে পাই হাস্সান তাঁর জাহিলী কবিতায় ভালো করেছেন। তবে সে কালের শ্রেষ্ঠ কবিদের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেননি। আর তাঁই ইসলামী কবিতার কিছু অংশে ভালো করেছেন। বিশেষতঃ হিজা ও ফখর (ন্দিা ও গর্ব) বিষয়ক কবিতায়। তবে অধিকাংশ বিষয়ে দুর্বলতা দেখিয়েছেন। বিশেষতঃ রাসূলের (সা) প্রশংসায় রচিত কবিতায় ও তাঁর প্রতি নিবেদিত শোকগাঁথায়। তবে ঐতিহাসিক তথ্যের দিক দিয়ে এ সকল কবিতা অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ইসলামী কবিতায় এমন সব নতুন ষ্টাইল দেখঅ যায় যা জাহিলী কবিতায় ছিল না। ইসলামী আমলে হাস্সান একজন কবি ও ঐতিহাসিক এবং একই সাথে একজন সংস্কারবাদী কবিও বটে। রাসূলুল্লাহর (সা) পক্ষে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন রাজনৈতিক কবিদের পুরোধা।’৯৩
একবার কবি কা’ব ইবন যুহাইর একটি শ্লোকে গর্ব করে বলেনঃ কা’বের মৃত্যুর পর কবিতার ছন্দ ও অন্তমিলের কি দশা হবে? শ্লোকটি শোনার সাথে সাথে তৎকালীন আরবের বিখ্যাত কিব সাম্মাখের ভাই তোমরূয বলে উঠলেন: আপনি অবশ্যই সাবিতের ছেলে তীক্ষ্মধী হাস্সানের মত কবি নন।৯৪ যাই হোক, তিনি যে একজন বড় মাপের কবি ছিলেন তা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য।
হাস্সানের (রা) সকল কবিতা বহুদিত যাবত মানুষের মুখে মুখে ও অন্তরে সংরক্সিত ছিল। পরে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হয়। ত৭ার কবিতার একটি দিওয়ান আছে যা ইবন হাবীব বর্ণনা করেছেন। তবে এতে সংকলিত বহু কবিতা প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। ইমাম আল-আসমা’ঈ একবার বললেন: হাস্সান একজন খুব বড় কবি। একথা শুনে আবু হাতেম বললেন: কিন্তু তাঁর অনেক কবিতা খুব দুর্বল। আল-আসামা’ঈ বললেন: তাঁর প্রতি আরোপিত অনেক কবিতাই তাঁর নয়।৯৫ ইবন সাল্লাম আল-জামিহী বলেন: হাস্সানের মানবস্পন্ন কবিতা অনেক। যেহেতু তিনি কুরাইশদের বিরুদ্ধে প্রচুর কবিতা লিখেছেন, এ কারণে পরবর্তীকালে বহু নিম্নমানের কবিতা তাঁর প্রতি আরোপ করা হয়েছে। মূলতঃ তিনি সেসব কবিতার রচয়িতা নন।৯৬
হাস্সানের (রা) নামে যাঁরা বানোয়াট কবিতা বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেন প্রখ্রাত সীরাত বিশেষঞ্জ মুহাম্মদ ইবন ইসহাক। তিনি তাঁর মাগাযীতে হাস্সানের (রা) প্রতি আরোপিত বহু বানোয়াট কবিতা সংকরন করেছেন। পরবর্তীকালে ইবন হিশাম যখন ইবন ইসহাকের মাগাযীর আলোকে তাঁর আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ’ সংকলন করেন তখন বিষয়টি তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়। তখন তিনি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রাচীন আরবী কবিতার তৎকালীন পণ্ডিত-বিশেষজ্ঞদের, বিশেষতঃ বসরার বিখ্যাত রাবী ও ভাষাবিদ আবু যায়িদ আল-আনসারীর শরণাপন্ন হয়। তিনি ইবন ইসহাক বর্ণিত হাস্সানের কবিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন, আর তার কিছু সঠিক বলে মত দিতেন, আর কিছু তাঁর নয় বলে মত দিতেন। এই পন্ডিতরা যে সকল কবিতা হাস্সানের নয় বলে মত দিয়েছেন তাঁরও কিচু কবিতা ইবন হাবীব বর্ণনা করেছেন। আর তা দিওয়ানেও সংকলিত হয়েছে।।৯৭
প্রকৃতপক্ষে হাস্সানের (রা) ইসলামী কবিতায় যথেষ্ট প্রক্ষেপণ হয়েছে। এ কারণে দেখা যায় তাঁর প্রতি আরোপিত কিচু কবিতা খুবই দুর্বল। মূলতঃ এ সব কবিতা তাঁর নয়। আর এই দুর্বলতা দেখেই আল-আসমা’ঈর মত পণ্ডিতও মন্তব্য করেছে যে, হাস্সানের ইসলামী কবিতা দারুণ দুর্বল।
হাস্সানের (রা) কবিতার একটি দিওয়ান ভারত ও তিউনিসিয়া থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। পরে সেটি ১৯১০ সনে প্রফেসর গীব মেমোরিয়াল সিরিজ হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশ পায়। লন্ড, বার্লিন, প্যারিস ও সেন্টপিটার্সবুর্গে দিওয়ানটির প্রাচীন হন্তলিখিত কপি সংরক্ষিত আছে।৯৮
শেষ জীবনে একবার হাস্সান (রা) গভীর রাতে একটি অনুপম কবিতা রচনা করে। সাথে সাথে তিনি ফারে’ দুর্গের ওপর উটে চিৎকার দিয়ে নিজ গোত্র বনু ক্বায়লার লোকদের তাঁর কাছে সমবেত হওয়ার আহবান জানান। লোকেরা সমবেত হলে তিনি তাদের সামনে কবিতাটি পাঠ করে বলেন: আমি এই যে কাসীদাটি রচনা করেছি, এমন কবিতা আরবের কোন কবি কখনও রচনা করেননি। লোকেরা প্রশ্ন করলো: আপনি কি একথা বলার জন্যই আমাদেরকে ডেকেছেন? তিনি বললেন: আমার ভয় হলো, আমি হয়তো এ রাতেই মারা যেতে পারি। আর সে ক্ষেত্রে তোমরা আমার এ কবিতাটি থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে।৯৯
আল-আসামা’ঈ বর্ণনা করেছেন: সেকালে ছোট মঞ্চের ওপর গানের আসর বসতো। সেখানে বর্তমান সময়ের মত অশ্লীর কোন কিছু হতো না। বনী নাবীতে এরকম একটি বিনোদনের আসর বসতো। বার্দ্ধক্যে হাস্সান (রা) যখন অন্ধ হয়ে যান তখন তিনি এবং তাঁর ছেলে এ আসরে উপস্থিত হতেন। একদিন দুইজন গায়িকা তাঁর জাহিলী আমলে রচিত একটি গানে কষ্ঠ দিয়ে গাইতে থাকলে তিনি কছাদতে শুরু করেন। তখন তাঁর ছেলে গায়িকাদ্বয়কে বরতে থাকেন: আরো গাও, আরো গাও।১০০ তাঁর মানসপটে তখন অতীত জীবনের স্মৃতি ভেসে উঠেছিল।
হাস্সানের (রা) মধ্যে স্বভাবগত ভীরুতা থাকলেও নৈতিক হাসহ ছিল অপরিসীম। একবার খলীফা উমার (লা) মসজিদে নব্বীর পাশ দিয়ে যাচ্ছেন। দেখলেন, হাস্সান মসিজিদে কবিতা আবৃত্তি করছেন। ‘উমার বললেন: রাসূলুল্লাহর (সা) মসজিদে কবিতা পাঠ? হাস্সান গর্জে উঠলেন: উমার! আমি আপনাদের চেয়ে উত্তম ব্যক্তির উপস্থিতিতে এখানে কবিতা আবৃত্তি করেছি। ইমাম বুখারী ও মুসলিম উভয়ে সা’ঈদ ইবনুল মুসায়্যিবের সূত্রে হাসীদসটি বর্ণনা করেছেন। উমার (রা) বললেন: সত্য বলেছো।১০১
হাস্সান (রা) ইলমান-পূর্ব জীবনে মদ পান করতেন। কিন্তু ইসলাম গ্রহনের পর মদ চিরদিনের জন্য পরিহার করেন। একবার তিনি তাঁর গোত্রের কতিপয় তরুণকে মদপান করতে দেখে ভীষণ ক্ষেপে যান। তখন তরুণরা তাঁর একটি চরণ আবৃত্তি কলে বলে, আমরা তো আপনাকেই অনুসরণ করছি। তিনি বললেন, এটা আমার ইসলাম-পূর্ব জীবনের কবিতা। আল্লাহর কসম! ইসলাম গ্রহনের পর আমি মদ স্পর্শ করিনি।১০২
হাস্সানের মধ্যে আমরা খোদাভীতির চরম রূপ প্রত্যক্ষ করি। কুর্শা কবিদের সংগে যখন তাঁর প্রচন্ড বাক্যুদ্ধ চলছে, তখন কবিদের নিন্দায় নাযিল হলো সূরা আশ-শু’য়ারার ২২৪ নং আয়াত। রাসূলুল্লাহর (সা) তিন কবি হাস্সান, কা’ব ও আবদুল্লাহ কাঁদতে কাঁদতে রাসূলুল্লাহর (সা) দরবারে উপস্থিত হয়ে আরজ করেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ আয়াতের আওতায় তো আমরাও পড়েছি। আমারও তো কাব্য চর্চা করি। আমাদের কি দশা হবে? তখন রাসূল (সা) তাঁদেরকে আয়াতটির শেষাংশ অর্থাৎ ব্যতিক্রমী অংশটুকু পাঠ করে বলেন, এ হচ্ছো তোমরা।১০৩
হাস্সান (রা) সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) দরবারের কবি ছিলেন। তিনি মসজিদে নববীতে রাসূলকে (সা) স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। এ ছিল এক বড় গৌরবের বিষয়। তাঁকে যথার্থই ‘শায়িরুল ইসলাম’ ও শায়িরুল রাসূল’ উপাধি দান করা হয়েছিল। ইসলাম গ্রহনের পর থেকে রাসূলুল্লাহর (সা) জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর পাশে থেকে কুরাইশ, ইহুদী ও আরব পৌত্তলিকদের প্রতি বিষাক্ত তীরের ফলার ন্যায় কথামালা ছুড়ে মেরে আল্লাহর রাসূলের (সা) মর্যাদা ক্ষা ও সমুন্নত করেছেন।
রাসূলে কারীম (সা) যখন যুদ্ধে যেতেন তখন তাঁর সহধর্মীগণকে হাস্সান (রা) তাঁর সুরক্ষিত ‘ফারে’ দুর্গের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে রাসূল (সা) তাঁকে গণীমতের অংম দিতেন। এমন কি উম্মুল মুমিনীন মারিয়্যা আল-কিবতিয়্যার বোন সীরীনকেও (রা) তুলে দেন হাস্সানের হাতে। খুলাফায়ে রাশেদীনের দরবারেও ছিল তাঁর বিশেষ মর্যাদা। খলীফাগণ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সাথে কথা বলতেন এবং তাঁর জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করেন। এভাবে একটি একটি করে হাস্সানের (রা) সম্মান ও মর্যাদার বিষয়গুলি গণনা করলে দীর্ঘ তালিকা তৈরী হবে।
তথ্যসূত্রে:


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি