আবু দারদা (রা)
ডাক নাম আবু দারদা। কন্যা দারদার নাম অনুসারে এ নাম এবং ইতিহাসে এ নামেই খ্যাত। আসল নামের ব্যাপারে মত পার্তক্য আছে। যথাঃ ’আমির ও ’উয়াইমির। আল-আসমা’ঈর মতে, ’আমির, তবে লোকে ’উয়াইমির বলতো। আর এটিই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। কেউ বলেছেন, ’উয়াইমির তাঁর লকব বা উপাধি। পিতার নামের ব্যাপারেও বিস্তর মত পার্থক্য আছে। যথাঃ মালিক, ’আমির, সা’লাবা, আবদুল্লাহ, যায়িদ ইত্যাদি। মায়েল নাম মুহাব্বাত বা ওয়াকিদাহ্। (তাহজীব আত-তাহজীব- ৮/১৫৬; আল-ইসাবা- ২/৪৫; উসুদুল গাবা- ৫/১৮৫; আল-ইসতী’য়াবঃ পার্শ্ব টীকাঃ আল-ইসাবা- ৪/৫৯) মদীনার বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের ‘বালহারিস’ শাখার সন্তান। রাসূলুল্লাহর সা. সমবয়সী বা কিছুদিনের ছোট। (দারিয়া-ই-মা’য়ারিফ ইলামিয়্যা (উর্দ্দু)- ১/৮০০)
তিনি ছিলেন আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, অশ্বারোহী ও বিচারক। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ছিলেন মদীনার একজন সফল ব্যবসায়ী। তারপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে একান্তভাবে আল্লাহর ইবাদাতে আত্মনিয়োগ করেন। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলতেনঃ ‘রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে আমি ছিলাম ব্যবসায়ী। তারপর যখন ইসলাম এলো, আমি আমার ব্যবসা ও ইবাদাতের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করলাম। কিন্তু তা সমন্বিত হলোনা। সুতরাং আমি ব্যবসা ছেড়ে ইবাদাতে আত্মেনিয়োগ করলাম।’ (আজ-জাহাবীঃ তারীখুল ইসলাম- ২/১০৭; আল-আ’লাম- ৫/২৮১; হায়াতুস সাহাবা- ২/২৯৬) শেষে ব্যবসার প্রতি দারুণ বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠেন। অনেক সময় বলতেন, এখন যদি আমার মসজিদে নববীর সামনে একটি দোকান থাকে, প্রতিদিন তাতে ৪০ দীনার করে লাভ হয় এবং তা সাদাকা করে দিই, আর এ জন্য নামাযের জামা’য়াতও ফাওত না হয়- তবুও এমন ব্যবসা এখন আমার পসন্দ নয়। লোকেরা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতেনঃ শেষ বিচার দিনের কঠিন হিসাবের ভয়। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/২৫; হায়াতুস সাহাবা- ২/২৯৬; আল-হুলায়্যা- ১/২০৯) ইসলাম গ্রহণের পর বীরত্ব, খোদাভীরুতা ও পার্থিব ভোগ-বিলাসিতার প্রতি উদাসীনতার জন্য সাহাবাকুলের মধ্যে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। (আল-আ’লাম- ৫/২৮১; আল-ইসাবা- ২/৪৫)
আবু দারদার বীরত্ব, অশ্বারোহণ ও বিজ্ঞতার স্বীকৃতি হযরত রাসূলে কারীমের সা. বাণীতে পাওয়া যায়। বিজ্ঞতা সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেনঃ ’উয়াইমির হাকীমু উম্মাতি- ’উয়াইমির- আমার উম্মাতের একজন মহাজ্ঞানী হাকীম। তাঁর অশ্বারোহণ সম্পর্কে বলেছেনঃ নি’মাল ফারিসু ’উয়াইমির- ’উয়াইমির একজন চমৎকার অশ্বারোহী। (তারীখুল ইসলাম- ২/১০৮; আল-ইসাবা- ২/৪৪; আল-ইসতীয়াবঃ আল-ইসাবার টীকা- ৪/৬০) তাঁর বিজ্ঞতাসূচক অনেক বাণী বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়। তার কিছু অংশ ‘আল-ইসতীয়াব’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। (টীকা আল-ইসাবা- ২/১৭) এ কারণে ইমাম ইবনুল জাযারী তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেনঃ ‘কানা মিনাল ’উলামা আল-হুকামা’- তিনি ছিলেন বিজ্ঞ জ্ঞানীদের একজন। (আল-আ’লাম- ৫/২৮১)
সা’ঈদ ইবন ’আবদুল আযীয বলেনঃ আবু দারদা বদর যুদ্ধের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন। (তারীখুল ইসলাম- ২/১০৯) আবার অনেকে বলেছেন বদর যুদ্ধের পর। (শাজারাতুজ জাহাব- ৫/৩৯) আল-ইসতী’য়াব গ্রন্থকার বলেনঃ তিনি তাঁর পরিবারের সকলের শেষে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং উত্তরকালে একজন ভালো মুসলিমে পরিণত হন। (টীকা- আল-ইসাবা- ৪/৫৯) জুবাইর ইবন নুফাইর বলেন, রাসূল সা. বলেছেনঃ আল্লাহ আমাকে আবু দারদার ইসলামের অঙ্গীকার করেছেন। জুবাইর বলেনঃ অতঃপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। (তারীখুল ইসলাম- ২/১০৯)
এ খুব বিস্ময়ের ব্যাপার যে, এত বড় বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও তিনি অন্য শ্রেষ্ঠ আনসারদের সাথে ইসলাম গ্রহণ না করে হিজরী দ্বিতীয় সন পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। এর একমাত্র কারণ, তার ইসলাম গ্রহণ অন্যের দেখাদেখি নয়; বরং ভেবে-চিন্তে ও জেনেশুনে ছিল। সম্ভবতঃ রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় আগমনের পর এক বছর পর্যন্ত তিনি বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেন এবং ভালোমত খোঁজখবর নেন। তবে এই একটি বছর পেছনে পড়ার কারণে সারা জীবন অনুশোচনা করেছেন। পরবর্তীকালে প্রায়ই বলতেনঃ এক মুহূর্তের প্রবৃত্তির দাসত্ব দীর্ঘকালের অনুশোচনার জন্ম দেয়।
জাহিলী যুগে প্রখ্যাত শহীদ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার রা. সাতে আবু দারদার গভীর বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃ সম্পর্ক ছিল। আবদুল্লাহ আগে ভাগেই ইসলাম গ্রহণ করেন; কিন্তু আবু দারদা পৌত্তলিকতার ওপর অটল থঅকেন। তবে আবদুল্লাহর সাথে সম্পক পূর্বের মতই বজায় রাখেন। আবদুল্লাহও বন্ধুকে ইসলামের মধ্যে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকেন। তিনি আবু দারদাকে বারবার ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। অবশেষে তাঁরই চেষ্টায় আবু দারদাকে বারবার ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। অবশেষে তাঁরই চেষ্টায় আবু দারদা মুসলমান হন। বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর ইসলাম গ্রহণের কাহিনীটি এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ
‘সেদিন আবু দারদা ’উয়াইমির প্রত্যুষে ঘুম থেকে জেগে তাঁর প্রতীমাটির কাছে গেলেন। সেটি থাকতো বাড়ীর সবচেয়ে ভালো ঘরটিতে। প্রথমে তার প্রতি আদাব ও সম্মান প্রদর্শন। সেটি থাকতো বাড়ীর সবচেয়ে ভালো ঘরটিতে। প্রথমে তার প্রতি আদাব ও সম্মান প্রদর্শন করলেন। নিজের বিশাল দোকানের সর্বোত্তম সুগন্ধ তেল তার গায়ে ভালো করে মালিশ করলেন। তারপর গতকালই ইয়ামন থেকে আগত একজন ব্যবসায়ী তাঁকে যে একখানি উৎকৃষ্ঠ রেশমী কাপড় উপহার দিয়েছেন তাই দিয়ে খুব সুন্দরভাবে প্রতীমাটি ঢেকে রাখলেন। অতঃপর একটু বেলা হলে তিনি দোকানের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
যাওয়ার পথে তিনি দেখলেন, মদীনার রাস্তা-ঘাট, অলি-গলি সর্বত্রই মুহাম্মাদের সা. সংগী-সাথী গিজ গিজ করছে। তারা দলে দলে বদর যুদ্ধ থেকে ফিরছেন। আর তাঁদের আগে আগে চলছে কুরাইশ বন্দীরা। তিনি তাঁদের এড়িয়ে চলতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ খাযরাজ গোত্রের এক যুবক তাঁর সামনে এসে পড়লো। তিনি যুবকের কাছে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার কুশল জিজ্ঞেস করলেন। যুবক বললেন, বদরে তিনি দারুণ যুদ্ধ করেছেন এবং গণীমতের মাল নিয়ে নিরাপদে মদীনায় ফিরেছেন। আবু দারদার দোকানে গিয়ে বরলেন।
এদিকে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা বদর থেকে ফিরে তাঁর ভাই আবু দারদার বাড়ীতে গেছেন তার সাথে দেখা করতে। বাড়ীর ভিতরে ঢুকে দেখলেন, আবু দারদার স্ত্রী বসে বসে চুলে চিরুনী করছেন। সালাম ও কুশল বিনিময়েল পর আবদুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেনঃ আবু দারদা কোথায়? স্ত্রী বললেনঃ আপনার ভাই তো এই মাত্র বেরিয়ে গেলেন। এ কথা বলে আবদুল্লাহকে ঘরে বসতে দিয়ে তিনি অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এদিকে আবদুল্লাহ একটি হাতুড়ি হাতে তুলে নিয়ে যে ঘরে প্রতীমাটি চিল সেখানে ঢুকে গেলেন এবং বিভিন্ন শয়তানের নামের একটি কাসীদা আবৃত্তি করতে করতে হাতুড়ির আঘাতে মূর্তিটি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলেন। কাসীদাটির শেষাংশ ছিল নিম্নরূপঃ
‘ওহে সাবধান! আল্লাহ ছাড়া আর যত কিছুই ডাকা হোক না কেন সবই বাতিল ও অসার।’
আবু দারদার স্ত্রী হাতুড়ির আঘাতের শব্দ শুনে ছুটে এসে ঘটনাটি দেখে চেঁচিয়ে বলে ওঠেনঃ ‘ওহে ইবন রাওয়াহা। আপনি আমার সর্বনাশ করেছেন।’ আবদুল্লাহ কোন জবাব না দিয়ে এমনভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন যেন কিছুই ঘটেনি।
আবু দারদা বাড়ী ফিরে দেখলেন, স্ত্রী বসে বসে কাঁদছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ কি হয়েছে? বললেনঃ আপনার ভাই আবদুল্লাহ এসে ঐ দেখুন কি কান্ডই না ঘটিয়ে গেছেন। আবু দারদা প্রথমতঃ ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তারপর গভীরভাবে চিন্তা করার পর আপন মনে বলে ওঠেনঃ যদি এ প্রতীমার মধ্যে সত্যি সত্যিই কোন কল্যাণ থাকতো তাহলে সে নিজেকে রক্ষা করতো। এমন চিন্তার পর আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাকে সংগে করে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট যান এবং ইসলাম কবুল করেন।’ (সুওয়ারুন মিন হায়াতুস সাহাবা- ৩/৯৫-১০০; হায়াতুস সাহাবা- ১/২৩২-২৩৩; ৩/৩৮৪; আল-মুসতাদরিক- ৩/৩৩৬) রাসূল সা. সালমান আল-ফারেসীর সাথে তাঁর দ্বীনি-ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৭১; তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/২৫; উসুদুল গাবা- ৫/১৮৫)
বদর যুদ্ধের সময় আবু দারদা অমুসলিম ছিলেন। এ কারণে সে যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেননি। তবে খলীফা হযরত ’উমার রা. তাঁর খিলাফতকালে সাহাবাদের যে ভাতার ব্যবস্থা করেন তাতে আবু দারদার ভাতা বদরী সাহাবীদের সমান নির্ধারণ করেন বলে বর্ণিত হয়েছে। (দারিয়া-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা- ১/৮০০) উহুদ যুদ্ধের সময় তিনি মুসলমান। এ যুদ্ধে তিনি যোগদান করেন এবং একজন অশ্বারোহী সৈনিক হিসাবেই এতে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁকে প্রতিপক্ষের একটি অশ্বারোহী বাহিনীকে তাড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি একাই তাদের তাড়িয়ে দেন। রাসূল সা. সে দিন তাঁর বীরত্ব ও সাহসিকতা দেখে দারুণ পুলকিত হন এবং মন্তব্য করেনঃ ‘নি’মাল ফারিসু ’উয়াইমির’- ’উয়াইমির এক চমৎকার ঘোড় সওয়ার। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/২৪; তারীখুল ইসলাম- ২/১০৭) উহুদ ছাড়াও অন্যান্য সকল যুদ্ধ ও অভিযানে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সাথে অংশগ্রহণ করেন। তবে সে সব ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না।
হযরত রাসূলে কারীমের সা. ইনতিকালের পর হযরত আবু বকরের খিলাফতকালে আবু দারদা মদীনায় ছিলেন। তাঁর এ সময়ের কর্মকান্ড সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। হযরত ’উমারের রা. খিলাফতকালে মদীনা ছেড়ে শামে চলে যান এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। সীরাত বিশেষজ্ঞরা তাঁর মদীনা ত্যাগের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। ১. মদীনায় রাসূলুল্লাহর সা. স্মৃতি তাঁকে সব সময় কষ্ট দিত। ২. তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ইসলামী শিক্ষার প্রচার-প্রসার নবীর ওয়ারিসদের ওপর ফরজ। এই বোধ তাঁকে মদীনা ত্যাগে উদ্বুদ্ধ করে। ৩. তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট একথা শুনেছিলেন যে, ফিত্নার অন্ধকারে ঈমানের প্রদীপ শামে নিরাপদ থাকবে। মূলতঃ এসকল কারণে শামের রাজধানী দিমাশকে তিনি বসতি স্থাপন করেন। (সীয়ারে আনসার- ২/১৯০)
হযরত আবু দারদার মদীনা ত্যাগের ব্যাপারে একটি কাহিনী প্রসিদ্ধ আছে। তিনি সফরের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে খলীফা হযরত ’উমারের নিকট গেলেন অনুমতি চাইতে। খলীফা অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। তবে একটি শর্তে অনুমতি দিতে পারেন বলে জানালেন। শর্তটি হলো তাঁকে কোন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিয়ে যেতে হবে। আবু দারদা জানালেন, শাসক হওয়া তাঁর পছন্দ নয়। খলীফা বললেন, তাহলে অনুমতির আশা করবে না। আবু দারদা অবস্থা বেগতিক দেখে বললেন, আমি কোন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করবো না ঠিক, তবে মানুষকে কুরআন-হাদীস শিখাবো এবং নামায পড়াবো। তাঁর প্রস্তাবে খলীফা রাজী হলেন এবং তাঁকে মদীনা ত্যাগের অনুমতি দিলেন। মূলতঃ এ দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যেই তিনি শামের প্রবাস জীবন গ্রহণ করেন।
আবু দরদার শামে গমন সম্পর্কে ইবন সা’দ ও হাকেম, মুহাম্মাদ ইবন কা’ব আল-কুরাজী থেকে একটি বর্ণনা নকল করেছেন। তিনি বলেন, হযরত নবী কারীমের সা. জীবনকালে পাঁচজন আনসার সমগ্র কুরআন সংগ্রহ করেন। তাঁরা হলেনঃ মু’য়াজ ইবন জাবাল, ’উবাদা ইবনুস সামিত, উবাই ইবন কা’ব, আবু আইউব ও আবু দারদা রা.। খলীফা ’উমারের খিলাফতকালে হযরত ইয়াযীদ ইবন আবী সুফইয়ান শাম থেকে খলীফাকে লিখলেনঃ শামের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিটি শহর-বন্দর লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়েছে। এ সকল লোককে কুরআন শিখাতে পারে এমন কিছু ব্যক্তির প্রয়োজন। চিঠি পেয়ে খলীফা ’উমার রা. উপরোক্ত পাঁচ ব্যক্তিকে ডেকে চিঠির বক্তব্য তাঁদেরকে জানালেন এবং আবেদন রাখলেন আপনাদের মধ্য থেকে অন্ততঃ তিনজন এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করুন। আর ইচ্ছা করলে সবাই করতে পারেন। ইচ্ছা করলে আপনাদের মধ্য থেকে নিজেরা তিনজনকে নির্বাচন করতে পারেন, অন্যথায় আমিই তিনজনকে বেছে নেব। তাঁরা বললেনঃ ঠিক আছে, আমরা যাব। আবু আইউব ছিলেন বয়োবৃদ্ধ, আবু উবাই পীড়িত, এ জন্য এ দু’জনকে তাঁরা বাদ দিলেন। বাকী তিন জনকে খলীফা বিভিন্ন স্থানে পাঠালেন। আবু দারদাকে পাঠালেন দিমাশ্কে এবং তিনি আমরণ সেখানে অবস্থান করেন। (তাবাকাত- ৪/১৭২; হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৯৫-১৯৬)
দিমাশ্কে তাঁর অধিকাংশ সময় ছাত্রদের কুরআন হাদীসে তা’লীম, শরীয়াতের আহকামের তারবিয়্যাত (প্রশিক্ষণ দান) এবং ইবাদতের মধ্যে অতিবাহিত হতো। যখন শামে অবস্থানরত সংখ্যাগরিষ্ঠ সাহাবায়ে কিরামের সরল ও অনাড়ম্বর জীবনের ওপর সেখানকার ঠাঁট ও জৌলুসের কিছু না কিছু ছাপ পড়েছিল তখন আবু দারদা এর থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এক অকৃত্রিম জীবনধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
খলীফা হযরত ’উমার রা. তাঁর ঐতিহাসিক শাম সফরের সময় সেখানে অবস্থানরত প্রখ্যাত সাহাবা ইয়াযীদ ইবন আবূ সুফইয়ান, ’আমর ইবনুল ’আস ও আবু মুসা আল-’আশ’য়ারী রা. প্রত্যেকের গৃহে অতর্কিতে উপস্থিত হন এবং তাঁদের জীবন যাপনে জৌলুসের ছাপ দেখতে পান। তিনি আবু দারদার আবাসস্থলেও যান; কিন্তু সেখানে ভোগ-বিলাসের চিহ্ন তো দূরের কথা রাতের অন্ধকারে একটি বাতিও দেখতে পেলেন না। একটি অন্ধকার ঘরে কম্বল মুড়ি দিয়ে তিনি শুয়ে আছেন। তাঁর এ চরম দীন-হীন অবস্থা দেখে খলীফার চোখ পানিতে ভরে গেল। তিনি জানতে চাইলেন, জীবনের প্রতি এমন নির্মমতার কারণ কি? আবু দারদা বললেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, এ পৃথিবীতে আমাদের এতটুকু জীবন উপকরণ থাকা উচিত যতটুকু একজন মুসাফিরের প্রয়োজন হয়। হায়! অবস্থান সা. পরে আমরা কিসের থেকে কি হয়ে গেলাম। তারপর উভয়ে কাঁদতে কাঁদতে রাত কাটিয়ে দিলেন। (কানযুল ’উম্মাল- ৭/৭৭; হায়াতুস সাহাবা- ২/৮২-৮৪)
খলীফা হযরত ’উসমানের খিলাফতকালে শামের গভর্ণর হযরত মু’য়াবিয়া রা. খলীফার নির্দেশে আবু দারদাকে দিমাশ্কের কাজী নিয়োগ করেন। হযরত আমীর মু’য়াবিয়া রা. কখনও সফরে গেলে তাঁকেই স্থলাভিষিক্ত করে যেতন। এটি ছিল দিমাশ্কের প্রথম কাজীর পদ। (শাজারাতুজ জাহাব- ৫/৩৯; আল-আ’লাম- ৫/২৮১) ইবন হিব্বানের মতে, খলীফা ’উমারে নির্দেশে হযরত মু’য়াবিয়া রা. তাঁকে কাজীর পদে নিয়োগ করেন। (লিসানুল মীযান- ৭/৪৪) ’আল-ইসতী’য়াব’ গ্রন্থকার প্রথম মতটি সঠিক বলে উল্লেখ করেছেন। (আল-ইসাবার পার্শ্ব টীকা- ২/১৭; ৪/৬০)
হযরত আবু দারদার দুই স্ত্রী ছিল। দু’জনই ছিলেন সম্মান ও মর্যাদা উঁচু আসনের অধিকারিনী। প্রথম জনের নাম উম্মু দারদা কুবরা খাযরা বিন্তু আবী হাদরাদ আল-আসলামী এবং দ্বিতীয়জনের নাম উম্মু দারদা সুগরা হাজীমা হায়ওয়াস্ সাবিয়্যা। উম্মু দারদা কুবরা ছিলেন একজন প্রখ্যাত সাহাবিয়্যা, প্রখর বুদ্ধিমতী, উঁচু স্তরের ফকীহা ও শ্রেষ্ঠ ’আবিদাহ্। হাদীসের গ্রন্থসমূহে তাঁর সূত্রে বর্ণিত বহু হাদীস পাওয়া যায়। তবে উম্মু দারদা সুগরা সাহাবিয়্যা ছিলেন না। স্বামীর মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন জীবিত ছিলেন। হযরত মু’য়াবিয়া রা. তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন; কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
হযরত আবু দারদার বিয়ে সম্পর্কিত এক বর্ণনা সীরাত গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়। সাবিত আল-বুনানী থেকে বর্ণিত হয়েছে। আবু দারদা তাঁর দ্বীনী ভাই সালমান আল-ফারেসীকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁকে সংগে করে একটি কনের পিতার গৃহে গেলেন। তিনি সালমানকে বাইরে বসিয়ে রেখে ভিতর বাড়ী ঢুকলেন। কনের অভিভাবকদের নিকট সালমানের দ্বীনদারী ও দ্বীনের জন্য তাঁকে সংগে করে একটি কনের পিতার গৃহে গেলেন। তিনি সালমানকে বাইরে বসিয়ে রেখে ভিতর বাড়ী ঢুকলেন। কনের অভিভাবকদের নিকট সালমানের দ্বীনদারী ও দ্বীনের জন্য তাঁর ত্যাগের কথা উল্লেখ করে তাঁর পরিচয় তুলে ধরেন এবং তাদের মেয়ের সাথে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব পেশ করেন। পাত্রীপক্ষ বলেনঃ আমরা সারমানকে মেয়ে দেব না, তবে তোমাকে দেব। এই বলে তাঁরা আবু দারদার সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের কাজ শেষ হলে আবু দারদা বাড়ীর ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে অত্যন্ত লজ্জার সাথে সালমানকে খবরটি দেন। তবে এটা আবু দারদার কোন বিয়ে সে সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৭৪)
হযরত আবু দারদা ছিলেন একজন সুপুরুষ। বার্ধক্যে দাড়িতে খিজাব লাগাতেন। সব সময় আরবী পোশাক পরতেন। মাথায় ‘কালানসুয়া’ নামক এক প্রকার উঁচু টুপি ও পাগড়ী পরতেন। আবু দারদার সন্তানদের মধ্যে কয়েকজনের নাম জানা যায়। তাঁরা হলেনঃ বিলাল, ইয়াযীদ, দারদা ও নুসাইবা। প্রথমজন বিলাল। তিনি ইতিহাসে বিলাল আবু মুহাম্মাদ দিমাশকী নামে খ্যাত। তিনি ইয়াযীদ ও পরবর্তী খলীফাদের সময়ে দিমাশ্কের কাজী ছিলেন। খলীফা ’আবদুল মালিক তাঁকে বরখাস্ত করেন। হিজরী ৯২ সনে তাঁর ওফাত হয়।
কন্যা দারদা ছিলেন মক্কার এক সম্ভ্রান্ত সংশীয় ও প্রখ্যাত তাবে’ঈ সাফওয়ান ইবন ’আবদিল্লাহ আল কুরাইশীর সহধর্মিনী। এই দারদার বিয়ে সম্পর্কে একটি ঘটনা বিভিন্ন গ্রন্থে দেখা যায়। ইয়াযীদ ইবন মু’য়াবিয়া দারদাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব পাঠান। আবু দারদা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পরে এক অতি সাধারণ দীনদার মুসলমানের সাতে তাঁকে বিয়ে দেন। তখন লোকে বলাবলি করতে লাগলো, আবু দারদা, ইয়াযীদের সাথে মেয়ের বিয়ে দিলেন না; অথচ তাঁর চেয়ে নিচু স্তরের একজন সাধারণ মুসলমানের সাথে মেয়ের বিয়ে দিলেন। একথা আবু দারদার কানে গেলে তিনি বললেনঃ আমি দারদার প্রতি লক্ষ্য করেছি। যখন দারদার মাথার ওপর চাকর-বাকর দাঁড়িয়ে থাকবে এবং ঘরের বিপুল দ্রব্যের প্রতি নজর পড়বে তখন তাঁর দ্বীনের কি অবস্থা হবে? (সিফাতুস সাফওয়াহ্- ১/২৬০; হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৭৪)
হযরত আবু দারদার মৃত্যুসন সম্পর্কে সীরাত বিশেষজ্ঞদের বিস্তর মতভেদ আছে। বিভিন্নজন বিভিন্ন গ্রন্থে হিজরী ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ সনগুলি উল্লেখ করেছেন। আবার কারো কারো মতে তিনি হযরত আলী ও হযরত মু’য়াবিয়ার রা. মধ্যে সংঘটিত সিফ্ফীন যুদ্ধের পর ইনতিকাল করেন। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে তিনি হিজরী ৩২ সন মুতাবিক ৬৫২ খ্রীস্টাব্দে দিমাশ্কে ইনতিকাল করেন। ওয়াকিদী, আবু মাসহার সহ প্রমুখ ইতিহাসবিদ এমত পোষণ করেছেন। দিমাশ্কের ‘বাবুস সাগীর’-এর নিকট তাঁকে দাফন করা হয় এবং তাঁরই পাশে তাঁর সহধর্মীনী উম্মু দারদাকেও সমাহিত করা হয় বলে প্রসিদ্ধি আছে। (দ্রঃ আল-ইসতী’য়াবঃ টীকা আল-ইসাবা- ২/৪৬; ৪/৬০; উসুদুল গাবা- ৫/১৮৬; ’আল-আ’লাম- ৫/২৮১; তারীখুল ইসলাম- ২/১১১; দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা- ১/৮০১; তাহজীবুত তাহজীব- ৮/১৫৬; শাজারাতুজ জাহাব- ৫/৩৯)
হযরত আবু দারদার রা. মৃত্যুর ঘটনাটি ছিল একটু ব্যতিক্রম ধরণের জীবনের শেষ মুহূর্তে তিনি ব্যাকুলভাবে কাঁদছেন। স্ত্রী উম্মু দারদা বললেন, আপনি রাসূলুল্লাহর সা. একজন সাহাবী হয়ে এত কাঁদছেন? বললেনঃ কেন কাঁদবো না? কিভাবে মুক্তি পাব আল্লাহই ভালো জানেন। এ অবস্থায় ছেলে বিলালকে ডেকে বললেন, দেখ, একদিন তোমাকেও এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। সে দিনের জন্য কিছু করে রাখ। মৃত্যুর সময় যতই ঘনিয়ে আসতে লাগলো তাঁর হাহুতাশ ও অস্থিরতা তথই বৃদ্ধি পেয়ে চললো। ঈমান সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, ঈমান হচ্ছে ভীতি আশার মাঝখানে। আবু দারদার ওপর খোদাভীতির প্রাবল্য ছিল।
স্ত্রী পাশে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। তিনি এক সময় বললেন, আপনি তো মৃত্যুকে খুবই ভালোবাসতেন। এখন এত অস্থির কেন? বললেনঃ তোমার কথা সত্য। কিন্তু যখন মৃত্যু অবধারিত বুঝেছি তখনই এ অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এতটুকু বলে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তারপর বললেন, এখন আমার শেষ সময়। আমাকে কালিমার তালকীন দাও। লোকেরা কালিমার তালকীন দিল। তিনি তা উচ্চারণ করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
হযরত আবু দারদা যখন অন্তিম রোগ শয্যায় তখন একদিন ইউসফ ইবন ’আবদিল্লাহ ইবন সালাম আসলেন তাঁর নিকট ইল্ম হাসিলের জন্য। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি উদ্দেশ্যে আসা হয়েছে? তাঁর সেই মুমূর্ষু অবস্থা দেখে ইউসুফ জবাব দিলেন আপনার সাথে আমার আব্বার যে গভীর সম্পর্ক ছিল সেই সূত্রে আমি আপনার সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে এসেছি। তিনি বললেন, মিথ্যা অতি নিকৃষ্ট জিনিস। কিন্তু কেউ মিথ্যা বলে ইসতিগফার করলে তা মাফ হতে পারে। (মুসনাদ- ৬/৪৫০)
হযরত আবু দারদার ওফাত পর্যন্ত ইউসুফ অবস্থান করেন। মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে ডেকে বললেন, আমার মৃত্যু আসন্ন, একথা মানুষকে জানিয়ে দাও। তিনি খবর ছড়িয়ে দিতেই বন্যার স্রোতের মত মানুষ আসতে শুরু করলো। ঘরে বাইরে শুধু মানুষ আর মানুষ। তাঁকে প্রচুর লোক সমাগমের কথা জানানো হলে তিনি বললেন, আমাকে বাইরে নিয়ে চলো। ধরে বাইরে আনা হলে তিনি উঠে বসলেন এবং জনগণের উদ্দেশ্যে একটি হাদীস বর্ণনা করলে। (মুসনাদ- ৬/৪৪৩) এভাবে রাসূলুল্লাহর সা. হাদীস প্রচারের আবেগ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল।
হযরত আবু দারদাকে আলিম সাহাবীদের মধ্যে গণ্য করা হয়। সাহাবায়ে কিরাম তাঁকে অতি সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন ’উমার রা. বলতেনঃ তোমরা দু’জন বা- ’আমল আলি- মু’য়াজ ও আবু দারদার কিছু আলোচনা কর। ইয়াযীদ ইবন মু’য়াবিয়া বলতেনঃ আবু দারদা এমন আলিম ও ফকীহদের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা রোগের নিরাময় দান করে থাকেন। (আল-ইসতী’য়াবঃ আল-ইসাবা- ৪/৫০) মৃত্যুর পূর্বে হযরত মু’য়াজ ইবন জাবালও আবু দারদার গভীর জ্ঞানের সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। তাঁর অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে। এমন সময় এক ব্যক্তি তাঁর শিয়রে দাঁড়িয়ে কান্না জুড়ে দিল। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ এত কান্না কেন? লোকটি বললোঃ আমি আপনার নিকট থেকে ইলম হাসিল করতাম; কিন্তু এখন আপনি চলে যাচ্ছেন। তাই আমার কান্না পাচ্ছে। তিনি বললেনঃ কেঁদো না। আমার মৃত্যুর পর তোমরা ইলম হাসিলের জন্য আবু দারদা, সালমান, ইবন মাস’উদ ও আবদুল্লাহ ইবন সালাম- এ চার ব্যক্তির কাছে যাবে। (কানযুল ’উম্মাল- ২/৩২৫; হায়াতুস সাহাবা- ২/৫৮১, ৫৮২; তারীখুল ইসলাম- ২/১০৯) একবার হযরত আবুজার আল-গিফারী রা. আবু দারদাকে লক্ষ্য করে বলেনঃ ওহে আবু দারদাঃ যমীনের ওপর এবং আসমানের নীচে আপনার চেয়ে বড় কোন ’আলিম নেই। (তারীখুল ইসলাম- ২/১০৯); হযরত মাসরূক, যিনি একজন উঁচু মর্যাদার তাবে’ঈ এবং তাঁর যুগের একজন বিশিষ্ট ইমাম-বলেনঃ আমি সকল সাহাবীর জ্ঞানরাশি মাত্র ছ’ব্যক্তির মধ্যে একত্রে দেখতে পেয়েছি। তাঁদের একজন আবু দারদা। মিসয়ার থেকে বর্ণিত। কাসেম ইবন ’আবদির রহমান বলেনঃ যাঁদেরকে ইলম দান করা হয়েছে, আবু দারদা তাঁদের একজন। (আল-ইসতয়’য়াবঃ আল-ইসাবা- ৪/৫০) তাঁর এ বিশাল জ্ঞানের কারণে তাঁর সময়ে মক্কা-মদীনা তথা গোটা হিজাযে বহু বড় বড় সাহাবী ফাতওয়া ও ইমামতের পদে অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন স্থান থেকে জ্ঞানপিপাসু ছাত্ররা দলে দলে আবু দারদার দারসগাহে ভিড় জমাতেন।
হযরত আবু দারদার দারসগাহে সব সময় ছাত্রদের ভিড় জমে থাকতো। ঘর থেকে বের হলেই দেখতে পেতেন পথের দু’ধারে ছাত্ররা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। একদিন মসজিদের যাচ্ছেন। পিছনে এত ভিড় জমে গেল যে, মানুষ মনে করলো হয়তো এটা কোন শাহী মিছিল হবে। তাদের প্রত্যেকেই কিছুনা কিছু জিজ্ঞেস করছিল। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/১২৫)
হযরত আবু দারদা সব সময় মানুষকে ইলম হাসিলের প্রতি উৎসাহ দান করতেন। হযরত হাসান বলেছেন, আবু দারদা বলতেনঃ তোমরা ’আলিম, ইলবে ইলম, তাঁদের প্রতি ভালোবাসা পোষণকারী অথবা তাঁদের অনুসারী- এ চারটির যে কোন একটি হও। এর বাইরে পঞ্চম কিছু হয়ো না। তাহলে ধ্বংস হয়ে যাবে। হাসানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল পঞ্চমটি কি? বললেনঃ বিদ’য়াতী। (হায়াতুস সাহাবা- ২/১৬০) তিনি আরও বলতেন, জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথে প্রবেশ করা ও বের হওয়া একজন মানুষের বিজ্ঞতার পরিচায়ক। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৯)
দাহ্হাক থেকে বর্ণিত হয়েছে আবু দারদা শামবাসীদের বলতেনঃ ওহে দিমাশ্কের অধিবাসীরা! তোমরা আমার দ্বীনী ভাই, বাড়ীর পাশের প্রতিবেশী এবং শত্রুর বিরুদ্ধে সাহায্যকারী। আমার সাথে প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করতে তোমাদের বাঁধা কিসের? তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমাদের ’আলিমরা চলে যাচ্ছেন অথচ তোমাদের জাহিলরা শিখছেনা? তোমরা শুধু জীবিকার ধান্দায় ঘুরছো অথচ তোমাদেরকে যা কিছুর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা ছেড়ে দিচ্ছ? শুনে রাখ, একটি জাতি বড় বড় অট্টালিকা তৈরী করেছিল, বিশাল সম্পদ পুঞ্জিভূত করেছিল। এভাবে তারা বড় উচ্চাভিলাষী হয়ে পড়েছিল। অবশেষে তাদের সেই সুউচ্চ অট্টালিকা তাদের কবরে পরিণত হয়, তাদের উচ্চাভিলাষ তাদেরকে প্রতারিত করে এবং তাদের পুঞ্জিভূত সম্পদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ওহে, তোমরা শেখ এবং অন্যকে শিখাও। কারণ, শিক্ষাদানকারী ও গ্রহণকারীর প্রতিদান সমান সমান। এ দু’শ্রেণীর মানুষ ছাড়া আর কারও মধ্যে অধিকতর কল্যাণ নেই।
হযরত হাসান থেকে বর্ণিত হয়েছে। একবার তিনি দিমাশ্কবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেনঃ ওহে, তোমরা বছরের পর বছর পেট ভরে শুধু গমের রুটি খাবে- এতেই খুশী থাকবে? তোমাদের মজলিশ ও সভা-সমিতিতে কি তোমরা আল্লাহকে স্মরণ করবে না? তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমাদের ’আলীমগণ চলে যাচ্ছেন আর তোমাদের জাহিলগণ তাঁদের নিকট থেকে কিছুই শিখছে না? (হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৬০, ১৬১)
হযরত আবু দারদা ছিলেন একজন বা-’আমল আলিম। যা শিখেছিলেন তা যথাযথভাবে পালন করতেন। ইবন ইসহাক বর্ণনা করে, সাহাবায়ে কিরাম বলতেনঃ আমাদের মধ্যে আবু দারদা ইলম অনুযায়ী সর্বাধিক আমলকারী। আবু দারদা বলতেনঃ যে জানে তার ধ্বংস একবার, আর যে জেনে ’আমল করেনা তার ধ্বংস সাতবার। সালেম ইবন আবিল জা’দ থেকে বর্ণিত। আবু দারদা বলতেনঃ তোমরা আমার কাছে প্রশ্ন কর। আল্লাহর কসম! আমাকে হারালে তোমরা একজন মহান ব্যক্তিকে হারাবে। (তারীখুল ইসলাম- ২/১০৯, ২১১)
হযরত আবু দারদার শিক্ষাদানের নিয়ম ছিল ফজরের নামাযের পর জামে’ মসজিদে দারসের জন্য বসে যেতেন। ছাত্ররা তাঁকে ঘিরে বসে প্রশ্ন করতো, আর তিনি জবাব দিতেন। যদিও তিনি হাদীস ও ফিকাহ শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তবে তাঁর মূল বিষয় ছিল কুরআন মজীদের দারস ও তা’লীম। হযরত রাসূলে কারীমের সা. জীবদ্দশায় যাঁরা সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ ও সংগ্রহ করেছিলেন, তিনি তাদের একজন। ইমাম বুখারী হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ আবু দারদা, মু’য়াজ, যায়িদ ইবন সাবিত ও আবু যায়িদ আল-আনসারী- এ চারজন ছাড়া রাসূলুল্লাহর সা. মৃত্যু পর্যন্ত আর কেউ সম্পূর্ণ কুরআন সংগ্রহ করেননি। ইমাম শা’বী অবশ্য উবাই ইবন কা’ব ও সা’ঈদ ইবন ’উবায়েদ- এ দু’জনের নাম সংযোগ করে মোট ছয়জনের কথা বলেছেন। ইবন হাজার ফাতহুল বারী (৯/৪৩) গ্রন্থে এমন ২৯ জন হাফেজে কুরআনের নাম উল্লেখ করেছেন। (তারীখুল ইসলাম- ২/১০৮; আল-আ’লাম- ৫/২৮১; তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/২৫) যাইহোক, রাসূলুল্লাহর সা. জীবনকালের হুফ্ফাজে কুরআনদের অন্যতম সদস্য ছিলেন আবু দারদা। এ কারণে খলীফা হযরত ’উমার রা. শামে কুরআনের তা’লীম ও তাবলীগের জন্য তাঁকে নির্বাচন করেন। দিমাশ্কের জামে’ ’উমারী’তে তিনি কুরআনের দারস দিতেন। অবশেষে এটা একটি শ্রেষ্ঠ কুরআন শিক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়। তাঁর অধিীনে আরো অনেক শিক্ষক ছিলেন। ছাত্রসংখ্যাও ছিল কয়েক হাজার। দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্ররা এসে তাঁর দারসে শরীক হতো।
ফজর নামাযের পর তিনি দশজন করে একটি গ্রুপ করে দিতেন। প্রত্যেক গ্রুপের জন্য একজন করে ক্বারী থাকতেন। ক্বারী কুরআন পড়াতেন। তিনি টহল দিতেন এবং ছাত্রদের পাঠ কান লাগিয়ে শুনতেন। এভাবে কোন ছাত্রের সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ হয়ে গেলে তাঁকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দানের জন্য নিজের তত্ত্বাবধানে নিয়ে নিতেন। গ্রুপ শিক্ষক ছাত্রদের কোন প্রশ্নের জবাব দিতে অক্ষম হলে তাঁর নিকট থেকেই জেনে নিতেন। দারসে প্রচুর ছাত্র সমাগম হতো। একদিন গুণে দেখা গেল কেন্দ্র থেকে ১৬০০ ছাত্র বের হচ্ছে।
ইবন ’আমির ইয়াহসাবী, উম্মু দারদা সুগরা, খলীফা ইবন সা’দ, রাশেদ ইবন সা’দ, খালিদ ইবন সা’দ প্রমুখ এই কুরআন শিক্ষা কেন্দ্রের খ্যাতিমান ছাত্র-ছাত্রী। ইবন ’আমির ইয়াহসাবী ছিলেন খলীফা ওয়ালীদ ইবন আবদুল মালিকের সময়ে মসজিদ বিষয়ক দফতরের রয়িস বা নেতা। আবু দারদার স্ত্রী উম্মু দারদা সুগরা ছিলেন কিরাত শাস্ত্রের একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিশেষজ্ঞ। মূলতঃ স্বামী নিকট থেকেই তিনি এ জ্ঞান অর্জন করেন। আতীয়্যা ইবন কায়েস কিলাবীকে তিনিই কিরাত শেখান। খলীফা ইবন সা’দের এমন বৈশিষ্ট্য ছিল যে, লোকে তাঁকে আবু দারদার সার্থক উত্তরাধিকারী বলতো। শামের বিখ্যাত ক্বারীদের মধ্যে তাঁকে গণ্য করা হতো।
তাফসীর শাস্ত্রে যে সকল সাহাবী প্রসিদ্ধ তাঁদের মধ্যে যদিও আবু দারদার নামটি পাওয়া যায় না, তবুও বেশ কিছু আয়াতের তাফসীর তাঁর থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলতেন, মানুষ যতক্ষণ না কুরআনের নানা দিক বিবেচনায় আনবে ততক্ষণ ফকীহ হতে পারবে না। জটিল আয়াতসমূহের ভাব তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট জিজ্ঞেস করে জেনে নিতেন।
হযরত আবু দারদার নিকট কোন আয়াতের তাফসীর জিজ্ঞেস করলে তিনি সন্তোষজনক জবাব দিতেন। একবার এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলোঃ وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ এর মধ্যে কি ব্যভিচারী ও চোর শামিল হবে? তিনি জবাব দিলেন, তার রব বা প্রভুর ভয় থাকলে সে কিভাবে ব্যভিচার ও চুরি করতে পারে?
সূরা الْقَلَمِ- এ এক কাফির সম্পর্কে এসেছে عُتُلٍّ بَعْدَ ذَٰلِكَ زَنِيمٍ এখানে ‘উ’তুল’ শব্দটির অর্থের ব্যাপারে ‘মুফাসসিরগণ নানা কথা বলেছেন। আবু দারদা তার ব্যাপক অর্থ বলেছেন। তিনি বলেছেনঃ বড় পেট ও শক্ত হলক বিশিষ্ট অতিরিক্ত পানাহারকারী, সম্পদ পুঞ্জিভূতকারী ও অতি কৃপণ ব্যক্তিকে ‘উতুল’ বলে।
এমনিভাবে সূরা তারিক-এ السَّرَائِرُ শব্দটি এসেছে। হযরত আবু দারদা এ শব্দটিরও একটি বিশেষ অর্থ বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহর কালাম কুরআন মজীদের তা’লীম ও খিদমতে পরে সাহাবায়ে কিরাম সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন রাসূলুল্লাহর সা. হাদীসের প্রচার ও প্রসারের ব্যাপারে। হযরত আবু দারদা অতি সার্থকভাবে এ দায়িত্ব পালন করেন। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে আবু দারদার এক বিশেষ স্টাইল ছিল। তাবারানী ইদরীস আল-খাওলানী থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি আবু দারদাকে দেখেছি, রাসূলের সা. কোন হাদীস বর্ণনা শেষ করে তিনি বলতেনঃ এই অথবা এই রকম অথবা এ ধরণের। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৩৯)
ইবন ’আসাকির ইবরাহীম ইবরাহীম ইবন আবদুর রহমান ইবন আ’উফ থেকে বর্ণনা করেছেন। খলীফা ’উমার রা. বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত বিশিষ্ট সাহাবা- আবদুল্লাহ ইবন হুজাইফা, আবু দারদা, আবু জার ও ’উকবা ইবন ’আমিরকে ডেকে পাঠান। তাঁরা হাজির হলে বলেনঃ এই যে আপনারা রাসূলের সা. হাদীসের নামে যা কিছু প্রচার করছেন, এসব কী? তাঁরা বললেনঃ আপনি প্রচার করতে নিষেধ করেন? ’উমার বললেনঃ না। তবে আপনারা আমার পাশে থাকবেন। আমি আপনাদের থেকে গ্রহণ অথবা বর্জন করবো। এ ব্যাপারে আমরা বেশী জানি। (হায়াতুস সাহাব- ৩/৪৪০, ৪৪১)
একবার তিনি হযরত সা’দান ইবন তালহার নিকট একটি হাদীস বর্ণনা করলেন। দিমাশ্কের মসজিদে তখন হযরত রাসূলে কারীমের সা. আযাদকৃত দাস হযরত সাওবান উপস্থিত ছিলেন। হযরত সা’দান একটু বেশী আশ্বস্ত হওয়ার জনর্য হাদীসটি সম্পর্কে তাঁর নিকট জিজ্ঞেস করলেন। সাওবান বললেন, আবু দারদা সত্য বলেছেন। আমিও সে সময় রাসূলুল্লাহর সা. নিকট উপস্থিত ছিলাম। (মুসনাদ- ৬/৪৪২)
হযরত মু’য়াজ রা. মৃত্যুর পূর্বক্ষণে একটি হাদীস বর্ণনা করে বলেছিলেন, এর জন্য সাক্ষী চাইলে ’উয়াইমির (আবু দারদা) আছেন, তাঁর কাছে তোমরা জিজ্ঞেস করতে পার। লোকেরা তাঁর নিকট গেল। তিনি হাদীসটি শুনে বললেনঃ আমার ভাই (মু’য়াজ) সত্য বলেছেন। (মুসনাদ- ৬/৪৫০)
সম্মানিত সাহাবায়ে কিরামের অভ্যাস ছিল, একে অপরের সাথে মিলিত হলে তাঁরা রাসূলুল্লাহর সা. হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করতেন। একবার একটি সমাবেশে ’উবাদা ইবনুস সামিত, হারিস আল-কিন্দী ও মিকদাদ ইবন মা’দিকারিবের সাথে আবু দারদাও উপস্থিত ছিলেন। তিনি ’উবাদাকে প্রশ্ন করলেন, অমুক যুদ্ধের সময় রাসূল সা. কি খুমুস সম্পর্কে কিছু বলেছিলেন? ’উবাদার স্মরণ হলো। তিনি পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন।
হযরত আবু দারদার গোটা জীবন কেটেছে আল্লাহর কালাম ও হাদীসে নববীর শিক্ষাদান ও প্রচারে। তাঁর মৃত্যুর পূর্বক্ষণে শহরের নানা শ্রেণীর অধিবাসীদের সমবেত করে তাদেরকে ঠিকমত নামায আদায়ের শেষ অসীয়াত করে যান। তাঁর নিকট হাদীসের যে ভান্ডার ছিল তা তিনি সরাসরি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে সংগ্রহ করেন। রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের পর কিছু হাদীস তিনি যায়িদ ইবন সাবিত ও ’আয়িশা রা. থেকেও বর্ণনা করেন।
হাদীস শাস্ত্রে তাঁর ছাত্র এবং তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনাকারীদের গন্ডি ছিল সীমিত। আনাস ইবন মালিক, ফুদালা ইবন ’উবাইদ, আবু উমামা, ’আবদুল্লাহ ইবন ’উমার, ’আবদুল্লাহ ইবন ’আব্বাস, উম্মু দারদা প্রমুখের ন্যায় বিশিষ্ট সাহাবীরা তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।
অধিকাংশ খ্যাতিমান ’আলিম তাবে’ঈ তাঁর নিকট ইলমে হাদীস হাসিল করেছেন এবং তাঁর সূত্রে হাদীস বর্ণনাও করেছেন। এখানে সর্বাধিক খ্যাতিমান কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলোঃ
সা’ঈদ ইবন মুসায়্যিব, বিলাল ইবন আবু দারদা, ’আলকামা ইবন কায়স, আবু মুররা মাওলা উম্মে হানী, আবু ইদরীস খাওলী, জুবাইর ইবন নাদীর, সুওয়ায়িদ ইবন গাফলা, যায়িদ ইবন ওয়াহাব, মা’দান ইবন আবী তালহা, আবু হাবীবা তাঈ, আবুস সাফার হামাদানী, আবু সালামা ইবন ’আবদির রহমান, সাফওয়ান ইবন ’আবদিল্লাহ, কুসায়্যিব ইবন কায়স, আবু বাহরিয়্যা ’আবদুল্লাহ ইবন কায়স, কুসায়্যিব ইবন মুররা, মুহাম্মাদ ইবন সীরীন, মুহাম্মাদ ইবন সুওয়াইদ আবী ওয়াক্কাস, মুহাম্মাদ ইবন কা’ব আল-কুরাজী, হিলাল ইবন ইয়াসাফ প্রমুখ। (তাহজীবুত তাহজীব- ৮/১৫৬; তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/২৪; তারীখুল ইসলাম- ২/১০৭)
হযরত আবু দারদার সূত্রে বর্ণিত হাদীস, যা হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায় তার মোট সংখ্যা- ১৭৯ (এক শো উনাশি)। এর মধ্যে বুখারী শরীফে ১৩টি ও মুসলিম শরীফে ৮টি সংকলিত হয়েছে। (আল-আ’লাম- ৫/২৮১; তারীখুল ইসলাম- ২/১০৭)
ফিকাহ শাস্ত্রেও তিনি এক বিশেষ স্থানের অধিকারী ছিলেন। মানুষ বহু দূর-দূরান্ত থেকে মাসয়ালা জানার জন্য তাঁর কাছে আসতো। এক ব্যক্তি তো শুধু একটি মাসয়ালা জানার জন্য সুদূর কুফা থেকে দিমাশ্কে তাঁর নিকট আসেন। সেই বিশেষ মাসয়ালাটি ছিল এ রকমঃ
উক্ত ব্যক্তি প্রথমে বিয়ে করতে রাজী ছিলনা। কিন্তু পরে মায়ের চাপাচাপিতে বিয়ে করে। বিয়ের পর যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর ভালোবাসা গড়ে ওঠে তখন মা আবার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার জন্য চাপাচাপি শুরু করে দেন। এখন সে তালাক দিতে চায়না। সবকিছু শুনে আবু দারদা বলরেন, আমি সুনির্দিষ্টভাবে কারো সাথে- না মায়ের সাথে, না স্ত্রীর সাথে, সম্পর্ক ছেদ করার কথা বলবো না। আমি তোমার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার কথাও বলবো না, আবার মায়ের নাফরমানীও জায়েয মনে করবো না। তোমার ইচ্ছা হলে তালাকও দিতে পার, আবার এখন যেমন আছ তেমন থাকতেও পার। তবে একথা যেন স্মরণ থাকে যে, রাসূলুল্লাহ সা. মাকে জান্নাতের দরজা বলে অভিহিত করেছেন। (মুসনাদ- ৫/৯৮; সীয়ারে আনসার- ২/২০০)
আবু হাবীব তাঈ একবার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার ভাই কিছু দীনার ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ (আল্লাহর রাহে) দান করেন এবং মরণকালে অসীয়াত করে যান, দীনারগুলি যেন দানের খাতসমূহের কোন একটিতে দিয়ে দিই। এখন আপনি বলুন, সবচেয়ে উত্তম খাত কোনটি? তিনি জবাব দিলেন, আমার নিকট উত্তম খাত ‘জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ (আল্লাহর পথে জিহাদ)।
হযরত আবু দারদা ছিলেন স্বভাবগতভাবেই সৎ ও সত্যনিষ্ঠ প্রকৃতির। ইসলামী শিক্ষা তাঁর এ প্রকৃতিকে আরো দীপ্ত ও স্বচ্ছ করে তোলে। গোটা সাহাবাকুলের মধ্যে হযরত আবু জার আল গিফারী ছিলেন সবচেয়ে বড় স্পষ্টভাষী ও স্বাধীনচেতা। প্রথম পর্যায়ে তিনিও শামে থাকতেন। সেখানে খুব কম লোকই তাঁর কঠোরতার হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন। হযরত আমীর মা’য়াবিয়াকে রা. তিনি তাঁর দরবারে কঠোর সমালোচনা করেছেন। ইসলামী বিধি-নিষেধের ব্যাপারে এহেন কঠোর ব্যক্তি একদিন আবু দারদাকে বললেনঃ আপনি যদি রাসূলুল্লাহর সা. সাক্ষাৎ নাও পেতেন অথবা রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের পর ইসলাম গ্রহণ করতেন তাহলেও নেককার মুসলমানদের মধ্যে গণ্য হতেন। হযরত আবু দারদার রা. আখলাকের পবিত্রতার জন্য এর চেয়ে বড় সনদ আর কী হতে পারে?
তিনি ছিলেন নবীর সা. সহচর। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা’য়ালার ভয়ে তাঁর দেহে কম্পন সৃষ্টি হতো। একবার তো মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবার মধ্যে বলতে লাগলেন, আমি সেই দিনের ব্যাপারে খুবই ভীত যেদিন আল্লাহ আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, তুমি কি তোমার ইল্ম অনুযায়ী ’আমল করেছো? যে দিন কুরআনের প্রতিটি আয়াত জীবন্তরূপে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে এবং আমার কাছে জিজ্ঞেস করবে তুমি কুরআনের নির্দেশের কতটুকু অনুসরণ করেছো? নির্দেশসূচক আয়াত তখন আমার বিরুদ্ধে স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে এবং বলবে, কোন কিছুই করেনি। তারপর প্রশ্ন করা হবে নিষেধ থেকে কতটুকু দূরে থেকেছো? নিষেধসূচক আয়াত তখন বলে উঠবে, কিছুই করেনি। ওহে জনমন্ডলী! আমি কি সেদিন মুক্তি পাব? (কানযুল ’উম্মাল- ৭/৮৪; হায়াতুস সাহাবা- ৩/৪৮৮,৪৮৯)
পরকালের ভয়ে সব সময় তিনি ভীত থাকতেন। হিযাম ইবন হাকীম বলেন, আবু দারদা বলতেনঃ মরণের পর যে কী হবে তা যদি তোমরা উপলব্ধি করতে তাহলে তৃপ্তির সাথে পানাহার করতে পারতে না এবং রোদ থেকে বাঁচার জন্য ছাদওয়ালা ঘরেও প্রবেশ করতে না। বরং রাস্তায় বেরিয়ে বুক চাপড়াতে আর কাঁদতে। তিনি আরো বলতেনঃ হায়! আমি যদি গাছ হতাম, আর গরু-ছাগলে খেয়ে ফেলতো। আমি যদি আমার পরিবারের ছাগল হতাম, আর তারা আমাকে জবেহ করে টুকরো টুকরো করে অতিথি-মেহমানদের নিয়ে খেয়ে ফেলতো। অথবা আমি যদি এই খুঁটি হয়ে জন্মাতাম। তাহলে হিসাব নিকাশের কোন ভয় থাকতো না। (কানযুল ’উম্মাল- ২/১৪৫; হায়াতুস সাহাবা- ২/৬২০,৬২১)
ইবাদাতের ক্ষেত্রে পাঞ্জেগানা ও কিয়ামুল লাইল ছাড়াও তিনটি জিনিস অত্যন্ত কঠোরভাবে পালন করতেন। ১. প্রত্যেক মাসে তিন দিন সাওম পালন করতেন। ২. বিতর নামায আদায় করতেন। ৩. আবাসে-প্রবাসে সকল অবস্থায় চাশ্তের নামায আদায় করতেন। এগুলি সম্পর্কে রাসূল সা. তাঁকে অসীয়াত করেছিলেন।
তিনি প্রত্যেক ফরজ নামাযের পর তাসবীহ পাঠ করতেন। তাসবীহ ৩৩ বার, তাহমীদ ৩৩ বার এবং তাকবীর ৩৪ বার। (মুসনাদ- ৫/১৯৬) উম্মু দারদা থেকে বর্ণিত। একবার আবু দারদার নিকট একটি লোক এলো। আবু দারদা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি থাকবেন না চলে যাবেন? থাকলে বাতি জ্বালাই, নইলে আপনার বাহনের খাদ্য দিই। লোকটি চললোঃ চলে যাব। আবু দারদা বললেনঃ আমি আপনাকে পাথেয় দান করবো। যদি এর চেয়ে উত্তম কোন পাথেয় পেতাম তাহলে তাই আপনাকে দিতাম। একবার আমি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট গিয়ে বললামঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! ধনীরা দুনিয়া ও আখিরাত দুটোই লুটে নিল। আমরাও নামায পড়ি, তারা পড়ে, আমরাও রোযা রাখি, তারাও রাখে। কিন্তু তারা সাদাকা করে, আমরা তা করতে পারিনা। রাসূল সা. বললেনঃ আমি কি তোমাকে একটি জিনিস বলে দেব না, যদি তুমি তা কর তাহলে তোমার পূর্বের ও পরের কেউ তোমাকে অতিক্রম করতে পারবেনা? তবে যে তোমার মত করবে, কেবল সেই তোমার সমান হবে। সে জিনিসটি হলোঃ প্রত্যেক নামাযের পর ৩৩ বার তাসবীহ, ৩৩ বার আল-হামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৩০৫)
আর একবার আবু দারদা বলেনঃ এক শো দীনার সাদাকা করার চেয়ে এক শো বার তাকবীর পাঠ করা আমার নিকট অধিকতর প্রিয়। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৭৯) তিনি প্রতি মুহূর্ত তাসবীহ পাঠে নিরত থাকতেন। একবার তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, আপনি প্রতিদিন কতবার তাসবীহ পাঠ করেন? বললেনঃ এক রাখ বার। তবে আমার আংগুল যদি ভুল করে তবে তা ভিন্ন কথা। (তারীখুল ইসলাম- ২/১১০)
একবার আবু দারদাকে বলা হলোঃ আবু সা’দ ইবন মুনাব্বিহ্ এক শো দাস মুক্ত করেছে। তিনি বললেনঃ একজন লোকের সম্পদের জন্য এক শো দাস অনেক। তুমি শুনতে চাইলে এর চেয়ে উত্তম জিনিসের কথা আমি তোমাকে শোনাতে পারি। আর তা হলোঃ দিবা-রাত্রির অবিচ্ছিন্ন ঈমান, আর সেই সাথে আল্লাহর জিক্র (স্মরণ) থেকে তোমার জিহ্বা বিরত না থাকা। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/১২)
একবার এক ব্যক্তি আবু দারদার নিকট এসে বললো, আমাকে কিছু অসীয়াত করুন। বললেনঃ সুখের সময় আল্লাহকে স্মরণ কর, তিনি তোমার দুঃখের সময় স্মরণ করবেন। দুনিয়ার কোন জিনিসের প্রতি যখন তাকাবে তখন তার পরিণতির প্রতি একটু দৃষ্টি দেবে। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৭৬)
হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁকে জিকর শিক্ষা দিয়েছেন। একদিন রাসূল সা. বললেনঃ আবু দারদা, তুমি কী পাঠ কর? বললেনঃ আল্লাহর জিক্র করি। রাসূল সা. বললেনঃ আমি কি রাত-দিনে আল্লাহর যে জিক্র করা হয় তার থেকে কিছু শিখিয়ে দেব না? আবু দারদা বললেন হাঁ, শিখিয়ে দিন। তখন রাসূল সা. তাঁকে একটি জিক্র শিখিয়ে দেন। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৩০২)
রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে শ্রুত বাণীর প্রতি তাঁর পূর্ণ বিশ্বাস ও ইয়াকীন ছিল। একবার এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বললোঃ আবু দারদা। আপনার বাড়ীটি আগুনে পুড়ে গেছে। তিনি বললেনঃ না পুড়েনি। এরপ দু’ব্যক্তি একের পর এক একই খবর নিয়ে এলো। তিনিও একই জবাব দিলেন। চতুর্থ এক ব্যক্তি এসে বললো, আগুন লেগে ছিল; কিন্তু আপনার ঘর পর্যন্ত এসে তা নিভে যায়। একথা শুনে তিনি বলেন, আমি জেনেছি, আল্লাহ অবশ্যই তা করেন না। তখন লোকটি বললোঃ ওহে আবু দারদা! আপনি যে বললেন, ‘আমার ঘর পুড়েনি’ এবং ‘আমি জেনেছি, আল্লাহ অবশ্যই তা করেন না’- এ দু’টি কথার মধ্যে কোনটি সর্বাধিক বিস্ময়কর? তিনি বললেনঃ আমি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে কিছু বাক্য শিখেছি, কেউ সেগুলি সকালে পাঠ করলে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোন বিপদে পড়েনা। তারপর তিনি সেই বাক্যগুলি উচ্চারণ করেন। (বায়হাকীঃ আসমা ও সিফাত অধ্যায়- ১২৫; হায়াতুস সাহাবা- ৩/৭০)
হযরত আবু দারদার জীবন ছিল অতি সরল ও অনাড়ম্বর। দুনিয়ার কোন চাকচিক্য, জৌলুষ, ভোগ-বিলাস তাঁর গায়ে কক্ষণো দাগ কাটতে পারেনি। তিনি বলতেন, দুনিয়ায় মানুষের একজন মুসাফিরের মত থাকা উচিত। সূফীরা তাঁকে ‘আসহাবে সুফ্ফা’র সদস্যদের মধ্যে গণ্য করে থাকেন এবং ‘যুহুদ ও তাকওয়া’র বিষয়েল ওপর তাঁর বহু মূল্যবান বাণী- তারা বর্ণনা করেছেন। (দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা- ১/৮০০)
একবার হযরত সালমান আল-ফারেসী রা. সাক্ষাতের জন্য তাঁর গৃহে আসলেন। তাঁরা ছিলেন পরস্পর দ্বীনি ভাই। তিনি আবু দারদার স্ত্রীকে অতি সাধঅরণ বেশভূষায় দেখতে পেয়ে তাঁর এমন দীন-হীন অবস্থার কারণ জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, আপনার ভাই আবু দারদা দুনিয়ার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে গেছেন। এখন আর তাঁর কোন কিছুর প্রতি কোন রকম আগ্রহ নেই। আবু দারদা ঘরে ফিরলেন। সালাম বিনিময়ের পালা শেষ হলে খাবার এলো। সালমান আবু দারদাকে খাবারের জন্য ডাকলেন। আবু দারদা বললেন, আমি সাওম পালন করছি। সালমান কসম খেয়ে বললেন, আপনাকে অবশ্যই আমার সাথে খেতে হবে, অন্যথায় আমিও খাব না। সালমান আবু দারদার বাড়ীতে রাত্রি যাপন করলেন। রাতে আবু দারদা নামায পড়ার জন্য উঠলেন। সালমান তাঁকে বাধা দিয়ে বললেনঃ ভাই আপনার ওপর আল্লাহর যেমন হক আছে, তেমনি স্ত্রীরও আছে। আপনার দেহেরও আছে। সুতরাং আপনি ইফতার করবেন, নামায পড়বেন, স্ত্রীর কাছে যাবেন এবং সকলের হক আদায় করবেন। শেষ রাতে সালমান তাঁকে ঘুম থেকে জাগালেন, দুইজন এক সাথে নামায পড়লেন এবং এক সাথে মসজিদে নববীতে চলে গেলেন। সকালে আবু দারদা রাসূলুল্লাহর সা. নিকট সালমানের ঘটনা বর্ণনা করলেন। রাসূল সা. বললেন, সালমান ঠিক বলেছে। সে তোমার চেয়ে বেশী বুদ্ধিমান। (তারীখুল ইসলাম- ২/১০৯; হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৯২,৬৯৩)
বিলাল ইবন সা’দ বলেন। আবু দারদা প্রায়ই দু’আ করতেনঃ হে আল্লাহ! আমার অন্তরের বিক্ষিপ্ততা থেকে আমি আপনার পানাহ চাই। প্রশ্ন করা হলোঃ অন্তরের বিক্ষিপ্ততা আবার কী? বললেনঃ প্রতিটি উপত্যকায় আমার সম্পদ ছড়িয়ে থাকাই হচ্ছে অন্তরের বিক্ষিপ্ততা। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৩৮৩)
আবু নু’য়াইম ‘আল হুলইয়্যা’ গ্রন্থে (১/২২২) খালিদ ইবন হুদাইর আল-আসলামী থেকে বর্ণনা করেছেন। একবার তিনি আবু দারদার ঘরে গিয়ে দেখলেন, তিনি চামড়া অথবা পশমের বিছানার ওপর বসে আছেন। তাঁর গায়ে মোটা পশমের কাপড় এবং পায়েও পশমের জুতো। আর তিনি তখন অসুস্থ। এ অবস্থায় তিনি শুধু ঘামছেন। খালিদ বললেনঃ আপনি অনুমতি দিলে আমীরুল মুমিনীদের নিকট থেকে প্রেরিত উত্তম বিছানা ও পোশাক আপনার জন্য আনতে পারি। জবাবে তিনি বললেনঃ আমার তো অন্য একটি বাড়ী আছে। আমি সেখানেই চলে যাব এবং সেখানে যাওয়ার জন্যই কাজ করছি। সুতরাং এতকিছুর প্রয়েঅজন কি? (হায়াতুস সাহাবা- ২/২৯৬)
একবার আবু দারদার গৃহে কয়েকজন মেহমান এলো। সময়টি ছিল শীতকাল। তিনি গরম খাবার তো দিলেন; কিন্তু গরম বিছানা দিলেন না। মেহমানদের একজন তার সঙ্গীদের বললেনঃ আমাদের গরম খাবার তো দিলেন, কিন্তু শীত নিবারণের জন্য কোন কিছু তো দিলেন না। এভাবে থাকা যাবে না। তাঁর কাছে চাইতে হবে। অন্য একজন বললোঃ বাদ দাও। কিন্তু এক ব্যক্তি কারো কথা না শুনে সোজা বাড়ীর ভিতরে ঢুকে গেল। সে দেখলো, আবু দারদার পাশেই তাঁর স্ত্রী বসে আছেন; কিন্তু তাদের গায়েও তেমন কোন শীতের কাপড় নেই। লেকাটি ফিরে গেল। পরে সে আবু দারদাকে জিজ্ঞেস করলোঃ আপনি আমাদের মতই শীত বস্ত্র ছাড়াই রাত কাটালেন কেন? জবাব দিলেন, আমাদের অন্য একটি বাড়ী আছে। আর সেখানেই আমরা চলে যাব। আমাদের বিছানাপত্র ও লেপ-তোষক সবই সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। তার কিছু আমাদের কাছে থাকলে অবশ্য তোমাদের কক্ষে পাঠিয়ে দিতাম। (সিফাতুস সাফওয়া- ১/২৬৩; হায়াতুস সাহাবা- ২/২৯৭)
মু’য়াবিয়া ইবন কুররা বরেন, আবু দারদা বলতেনঃ আমি তিনটি জিনিস পসন্দ করি, অথচ মানুষ সেগুলি অপসন্দ করে। দারিদ্র, রোগ ও মৃত্যু। মৃত্যুকে আমি পসন্দ করি আমার রব বা প্রভুর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য, দারিদ্রকে পসন্দ করি প্রভুর সামনে বিনীতভাবে প্রকাশের জন্য, আর রোগ পসন্দ করি আমার পাপের কাফ্ফারার জন্য। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/২৫; তারীখুল ইসলাম- ২/১১০)
রাসূলুল্লাহর সা. দারসগাহে যাঁরা শিক্ষা পেয়েছিলেন, তাঁরা সবাই বুঝেছিলেনঃ ’আমর বিল মা’রূফ বা সৎ কাজের আদেশ তাঁদের ওপর ফরজ। হযরত আবু দারদা এ ফরজের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন না। একবার হযরত মু’য়াবিয়া একটি রূপোর পাত্র খরীদ করলেন। বিনিময়ে তিনি কিছু কম-বেশী রূপোর মুদ্রা বিক্রেতাকে দিলেন। শরীয়াতের দৃষ্টিতে এটা ছিল অবৈধ। বিষয়টি আবু দারদা অবগত হওয়ার সাথে সাথে প্রতিবাদ করে বলেন, ওহে মু’য়াবিয়া! এমন কেনা-বেচা জায়েজ নয়। রাসূল সা. সোনারূপোর বিনিময়ে সমতার নির্দেশ দিয়েছেন।
ইউসুফ ইবন আবদিল্লাহর ঘটনাটি পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি আবু দারদার কাছে এসেছিলেন এক উদ্দেশ্যে, আর বলেছিলেন ভিন্ন কথা। এ কারণে আবু দারদা সংগে সংগে তাঁকে শুধরে দিয়ে বলেছিলেনঃ মিথ্যা বলা খুবই খারাপ কাজ। (মুসনাদ- ৬/৪৫০)
আমীর মু’য়াবিয়া রা. হযরত আবু জারকে রা. শাম থেকে বের করে দিলেন। পথ চলা কালে আবু দারদার কানে খবরটি পৌঁছালে অবলীলাক্রমে তাঁর মুখ দিয়ে ‘ইন্নালিল্লাহ’ উচ্চারিত হলো। তারপর তিনি বললেনঃ উটের সাথীদের সম্পর্কে যেমন বলা হয়েছে, তেমনি তাদের ব্যাপারে অপেক্ষা কর। (উটের সাথী দ্বারা হযরত সালেহর আ. সংগী সাথী বুঝিয়েছে।) তারপর অত্যন্ত আবেগের সাথে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ! তারা আবু জারকে মিথ্যাবাদী বলেছেন, কিন্তু আমি তা বলি না। লোকে তাঁর ওপর মিথ্যা দোষারোপ করেছে, কিন্তু আমি তা করিনা। তারা তাঁকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে, কিন্তু আমি এ ব্যাপারে তাদের সাথে নই। কারণ আমি জানি, রাসূল সা. ধরাপৃষ্ঠে তাঁর মত আর কাউকে সত্যবাদী মনে করতেন না এবং তাঁর মত আর কারো নিকট গোপন কথা বলতেন না। যার হাতে আমার জীবন সেই সত্তার শপথ, যদি আবু জার আমার হাতও কেটে দেন তবুও আমি তাঁর প্রতি কোন কেম বিদ্বেষ পোষণ করবো না। কারণ, রাসুল সা. বলেছেনঃ আসমানের নীচে ও যমীনের ওপরে আবু জার অপেক্ষা অধিকতর সত্যবাদী আর কেউ নেই।
ইবন ’আসাকির বর্ণনা করেছেন। আবু দারদা একবার মাসলামা ইবন মুখাল্লাদকে লিখলেনঃ বান্দা যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে তখন আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন। আর আল্লাহ যখন তাঁকে ভালোবাসেন তখন তার সকল বান্দার প্রিয়পাত্র করে দেন। অপর দিকে বান্দা যখন আল্লাহর নাফরমানির কাজ করে তখন তার ওপর আল্লাহর ক্রোধ পতিত হয়। যখন সে আল্লাহর ক্রোধে পতিত হয় তখন সে তার সৃষ্টিরও ক্রোধের পাত্রে পরিণত হয়। (কানযুল ’উম্মাল- ৮/২২৭, হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫১৪)
হযরত রাসূলে কারীম সা. একদিন বললেন, যে ব্যক্তি তাওহীদের কালেমা উচ্চারণ করবে সে জান্নাতে যাবে। আবু দারদা প্রশ্ন কররেন- সে যদি যিনা বা চুরি করে, তবুও? রাসূল সা. বললেনঃ হাঁ, তবুও। এমন একটা খোশখবর মানুষের কাছে পৌঁছানো উচিত। আবু দারদা তিনবার জিজ্ঞেস করে মানুষের নিকট এ খবর পৌঁছানোর জন্য বেরিয়ে পড়লেন। পথে ’উমারের সাথে সাক্ষাত। তিনি বললেনঃ এমন কাজ করো না। এতে মানুষ ’আমল ছেড়ে দেবে। আবু দারদা ফিরে বিষয়টি রাসুলকে সা. জানালেন। তিনি বললেন, ’উমার ঠিক বলেছে। (মুসনাদ- ৫/৪১)
একদিন তিনি বাহির থেকে ঘরে ফিরলেন। চোখে-মুখে উত্তেজনার ছাপ। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেনঃ কী হয়েছে? বললেনঃ আল্লাহর কসম! শুধুমাত্র জামায়াতে নামায আদায় ছাড়া রাসূলুল্লাহর সা. একটি কাজও আর পালিত হচ্ছে না। মানুষ সব ছেড়ে দিয়েছে। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/১২৩)
একবার সা’দান ইবন আবী তালহার সাথে তাঁর দেখা হলে জিজ্ঞেস করেনঃ আপনার বাড়ী কোথায়? সা’দান বললেনঃ গ্রামে। তবে শহরের কাছাকাছি। তখন তিনি বললেনঃ তাহলে আপনি শহরে নামায পড়বেন। যেখানে আযান এবং নামায হয়না সেখানে শয়তানের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। দেখ, নেকড়ে সেই মেষকে ধরে যে দলছুট হয়ে যায়। (মুসনাদ- ৬/৪৫৯)
গোটা মুসলিম সমাজ তাঁকে অত্যন্ত সমীহ ও সম্মান করতো। উত্তেজিত অবস্থায়ও তিনি যা কিছু বলতেন, মানুষ অন্তর দিয়ে তা শুনতো। একবার এক কুরাইশী এক আনসারীর দাঁত ভেঙ্গে দেয়। হযরত আমীর মু’য়াবিয়ার রা. দরবারে বিচার গেল। তিনি কুরাইশীকে অপরাধী ঘোষনা করলেন। তখন সে বললো, আনসারী লোকটি প্রথমে আমার দাঁতে ব্যথা দেয়। একথা শুনে আমীর মু’য়াবিয়া বললেনঃ একটু থাম, আমি আনসারীকে রাজী করাচ্ছি। কিন্তু আনসারী-কিসাসের দাবীতে অটল রইল। সে রাজী হলো না। আমীর মু’য়াবিয়া বললেন, এই যে আবু দারদা আসছেন, তিনি যে ফায়সালা করেন তাই মেনে নাও। আবু দারদা ঘটনাটি শুনে এই হাদীসটি বর্ণনা করেনঃ কোন ব্যক্তি কাউকে দৈহিক কষ্ট দিলে কষ্টপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি তাকে ক্ষমা করে দেয় তাহলে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন এবং তার গুনাহ মাফ হয়ে যায়। আবু দারদার মুখ থেকে এ হাদীসটি শোনার সাথে সাথে আনসারী লোকটি- যে তখন দারুণ উত্তেজিত ছিল, রাজী হয়ে গেলে। সে আবু দারদাকে জিজ্ঞেস করলো, হাদীসটি কি আপনি রাসূলুল্লাহর সা. মুখ থেকে শুনেছেন? তিনি বললেন- হাঁ! আনসারী বললেন, তাহলে আমি তাঁকে মাফ করে দিলাম। (মুসনাদ- ৬/৪৪৮)
তিনি সব সময় সব রকম ফিত্না ও অশান্তি থেকে দূরে থাকতেন। হিজায অপেক্ষা শাম কোন দিক দিয়েই ভালো ছিল না। তবে ফিত্না ও অশান্তি থেকে দূরে থাকার জন্যই শামে বসবাস করতেন। তিনি বলতেন, যেখানে দু’জন লোকও একহাত পরিমাণ ভূমির জন্য বিবাদ করে সে স্থানও ত্যাগ করা আমি পসন্দ করি।
তিনি আরো বলতেন তোমরা বাজারের মজলিস থেকে দূরে থাক। কারণ, এসব মজলিস তোমাদেরকে খেলা ও হাসি-তামাশার দিকে নিয়ে যায়। (কানযুল ’উম্মাল- ২/১৫৯; হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৫০)
তিনি সব সময় চুপচাপ থাকতে এবং চিন্তা-অনুধ্যানে সময় কাটাতে পসন্দ করতেন। ’আউন ইবন ’আবদিল্লাহ একবার উম্মু দারদাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ আবু দারদার সর্বোত্তম আমল ছিল কোনটি? বললেনঃ গভীর চিন্তা ও অনুধ্যান। আবু দারদা আরও বলতেনঃ এক ঘন্টা চিন্তা করা সারারাত ইবাদাত অপেক্ষা উত্তম। (সিফাতুস সাফওয়অ- ১/২৫৮; কানযুল ’উম্মাল- ২/১৪২; হায়াতুস সাহাবা- ২/৬২৭) তিনি আরও বলতেনঃ তোমরা যেমন কথা বলা শেখ, তেমনি চুপ থাকাও শেখ। কারণ, চুপ থাকা বিরাট সহনশীলতা। বলার চেয়ে শোনার প্রতি আগ্রহী হও। অহেতুক কোন কথা বলো না। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৩২)
তিনি সব সময় হাসি মুখে থাকতেন এবং মানুষের সাথে খোশ-মেযাজে মিশতেন। কথা বলার সময় ঠোঁটে হাসি ঝরতো। আর এ হাসিকে স্ত্রী উম্মু দারদা মর্যাদার পরিপন্থী মনে করতেন। একদিন তো বলেই বসলেন, এই যে আপনি প্রতি কথায় মুচকি হাসি দেন এতে লোকে আপনাকে নির্বোধ মনে না করে। আবু দারদা বললেনঃ রাসূল সা. তো কথা বলার সময় মৃদু হাসতেন। (হায়াতুস সাহাবা-৩/২০৩)
তাঁর স্বভাব ছিল সরল ও অনাড়ম্বর। দিমাশ্কের মসজিদ চত্বরে নিজ হাতে গাছ লাগাতেন। রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী ও মসজিদের হালকায়ে দারসের ইমাম হয়ে এত ছোট ছোট কাজ নিজ হাতে করাতে লোকে অবাক হয়ে যেত। এক ব্যক্তি তো একবার তাঁকে বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করে বসে, আপনি নিজেই এমন কাজ করেন? আবু দারদা তাঁর বিস্ময়ের জবাবে বলেন, এতে খুব সওয়াব।
তিনি অত্যন্ত দানশীল ও অতিথিপরায়ণ ছিলেন। অভাব-অনটন সত্ত্বেও মেহমানের খিদমতের কোন প্রকার ত্রুটি কক্ষণো করতেন না। অধিকাংশ সময় তাঁর বাড়ীতে লোক থাকতেন। কোন মেহমান এলে তিনি জিজ্ঞেস করতেনঃ থাকবেন না চলে যাবেন? যদি যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করতো, তাহলে তিনি তার পাথেয় দিয়ে দিতেন। কোন কোন লোক কয়েক সপ্তাহ অবস্থান করতো। হযরত সালমান আল-ফারেসী-দিমাশ্কে গেলে তাঁরই বাড়ীতে অবস্থান করতেন।
তাঁর অন্তরটি ছিল বড় কোমল ও উদার। কাউকে ঘৃণা করা বা গালি দেওয়া পসন্দ করতেন না। একদিন কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। দেখলেন, বেশ কিছু লোক এক ব্যক্তিকে গালি দিচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানলেন যে, সে কোন পাপ কাজ করেনে। হযরত আবু দারদা লোকদের বললেন, কেউ কুয়ায় পড়ে গেলে তাকে টেনে তোলা উচিত। গালি দেওয়াতে কোন কল্যাণ নেই। তোমরা যে এ পাপ থেকে বেঁচে থাকতে পেরেছ, সেটাই সৌভাগ্য মনে কর। লোকেরা তখন প্রশ্ন করলেো আপনি কি এ ব্যক্তিকে খারাপ মনে করেন না? বললেনঃ স্বভাবগতভাবে লোকটির মধ্যে কোনরকম খারাবি নেই’ তবে তার এ কাজটি খারাপ। যখন সে এ কাজ ছেড়ে দেবে তখন সে আবার আমার ভাই। (উসুদুল গাবা- ৪/১৫০; কানযুল ’উম্মাল- ২/১৭৪; হায়াতুস সাহাবা- ২/৪২৮)
তাঁর স্বভাবটি ছিল বড় ঐশ্বর্যমন্ডিত। কারো নিকট থেকে কোন কিছু গ্রহণ করা ছিল তাঁর প্রকৃতি বিরোধী। একবার ’আবদুল্লাহ ইবন ’আমির আসলেন শামে। বহু সাহাবী তাঁর কাছে গিয়ে নিজ নিজ ভাতা গ্রহণ করলেন। কিন্তু আবু দারদা গেলেন না। বাধ্য হয়ে ’আবদুল্লাহ নিজেই ভাতা নিয়ে তাঁর গৃহে হাজির হলেন এবং বললেনঃ আপনি যাননি তাই আমি নিজেই ভাতা নিয়ে হাজির হয়েচি। তিনি বললেনঃ রাসুল সা. আমাকে বলেছেন, যখন আমীরগণ নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে নেয় তখন তোমরাও নিজেদেরকে পরিবর্তন করে নেবে। (কানযুল ’উম্মাল- ২/১৭১)
তাঁর আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা সম্পর্কে অনেক কথা বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়। আবুল বাখতারী থেকে বর্ণিত। একবার আবু দারদা একটি হাঁড়িতে কিছু জ্বাল দিচ্ছিলেন। পাশেই হযরত সালমান আল-ফারেসী বসেছিলেন। এমন সময় আবু দারদা ছোট বাচ্চাদের আওয়াযের মত হাঁড়ির মধ্যে তাসবীহ পাঠের আওয়ায শুনতে পেলেন। তিনি চিৎকার করে সালমানকে ডেকে বললেনঃ সালমান! দেখ, দারুণ বিস্ময়ের ব্যঅপার। তুমি বা তোমার বাপ-দাদা কেউ কক্ষণো এমন ঘটনা দেখনি। সালমান বললেনঃ তুমি যদি চুপ থাকতে তাহলে আল্লাহর এর থেকে বড় নিদর্শন দেখতে পেতে। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫৮৬)
আবু নু’য়াইম ‘আল-হুলইয়্যা’ গ্রন্থে (১/২১০) ’আউফ ইবন মালিক থেকে বর্ণনা করেছেন। আউফ স্বপ্নে একটি চামড়ার নির্মিত গম্বুজ ও একটি চারণক্ষেত্র দেখলেন। গম্বুজের পাশে একপাল ছাগল শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এগুলি কার? বলা হলো, আবদুর রহমান ইবন আউফের। কিছুক্ষণ পর আবদুর রহমান ইবন আউফ বের হয়ে আসলেন। বললেনঃ হে আউফ, কুরআনের বিনিময়ে আল্লাহ আমাকে এ সবকিছু দান করেছেন। যদি তুমি এ রাস্তার দিকে একটু তাকাও তাহলে এমন সব জিনিস দেখতে পাবে যা তোমার চোখ কখনো দেখেনি, তোমার কান কখনো সে সম্পর্কে কিছু শোনেনি এবং তোমার অন্তরে তার কল্পনাও কখনো উদয় হয়নি। আল্লাহ তা’য়ালা তা আবু দারদার জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন। কারণ, তিনি দু’হাত ও বুক দিয়ে দুনিয়অকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। (উসুদুল গাবা- ৫/১৮৫; হায়াতুস সাহাবা- ৩/৬৭২)
তিনি বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। তাঁর দ্বীনী-ভাই হযরত সালমান আল-ফারেসীর সাথে আজীবন গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। তাবারানী বর্ণনা করেছেন। আশ’য়াস ইবন কায়স ও জারীর ইবন আবদুল্লাহ আল-বাজালী একবার সালমান আল-ফারেসীর নিকট আসলেন। তিনি তখন মাদায়েনের একটি দূর্গে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি কি সালমান আল-ফারেসী? বললেনঃ হা। আপনি কি রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী? বললেনঃ জানিনে। তখন তাঁর সন্দেহের মধ্যে পড়ে গেল। তাঁরা মনে করলেন, আমরা যাঁকে খুঁজছি, এ তিনি নন। তাঁদের এ ইতস্ততঃ ভাব দেখে সালমান বললেনঃ তোমরা যাঁকে খুজছো আমি সেই ব্যক্তি। আমি রাসূলুল্লাহকে সা. দেখেছি, তাঁর সাথে উঠা-বসা করেছি। আর সাহাবী তো সেই যে রাসূলের সা. সাথে জান্নাতে যাবে। যাই হোক, তোমাদের কী প্রয়োজন? তাঁরা বললেনঃ শামে অবস্থানরত আপনার এক ভাইয়ের নিকট থেকে আমরা এসেছি। তিনি জানতে চাইলেনঃ কে সে? তারা বললেনঃ আবু দারদা। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তাহলে তোমাদের সাথে পাঠানো তাঁর উপহার সামগ্রী কোথায়? তাঁর বললেনঃ আমাদের সাথে তো কোন উপহার পাঠাননি। আবু দারদা বললেনঃ আল্লাহকে ভয় কর এবং যথাযথভাবে আমানত আদায় কর। তাঁর নিকট থেকে যেই এসেছে, তার সাথে কিছু না কিছু হাদিয়া তিনি আমার জন্য পাঠিয়েছেন। তাঁরা বললেনঃ এভাবে আমাদেরকে দোষারোপ করবেন না। এই আমাদের অর্থকড়ি থেকে যা খুশী আপনি গ্রহণ করুন। তিনি বললেনঃ আমি তোমাদের অর্থকড়ি চাইনা। যে হাদিয়া পাঠিয়েছেন শুধু তাই চাই। তখন তাঁরা শপথ করে বললেন, কোন হাদিয়া তিনি পাঠাননি। তবে তিনি আমাদেরকে একথা বলেছেন যে, তোমাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি আছেন, রাসূল সা. যখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যেতেন তখন তাঁকে ছাড়া আর কাউকে ডাকতেন না। তোমরা যখন তাঁর কাছে যাবে, তাঁকে আমার সালাম পৌঁছে দেবে। আবু দারদা বললেনঃ এছাড়া আর কি হাদিয়া আমি তোমাদের কাছে চাচ্ছি? সালামের চেয়ে উত্তম হাদিয়া আর কী হতে পারে? (হায়াতুস সাহাবা- ২/৪৯২-৪৯৫)
হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা রা. ছিলেন তাঁর জাহিলী যুগের অন্তরঙ্গ বন্ধু বা ভাই। তাঁরই দাওয়াত ও চেষ্টায় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আজীবন তিনি সে সম্পর্ক অটুট রেখেছিলেন। তিনি প্রায়ই দু’আ করতেনঃ হে আল্লাহ! আমার ভাই ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা লজ্জা পায় আমার এমন কোন ’আমল তাঁর কাছে উপস্থাপনের ব্যাপারে আ আপনার পানাহ্ চাই। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৩৮৪)
এছাড়া হযরত আবু দারদার বহু দ্বীনী ইয়ার-বন্ধু ছিলেন। তিনি নামাযের পর তাঁদের সকলের মঙ্গল কামনা করে আল্লাহর কাছে দু’আ করতেন। তাঁর স্ত্রী হযরত উম্মুল দারদা রা. বলেনঃ আবু দারদার ৩৬০ জন আল্লাহর পথের বন্ধু ছিলেন। নামাযে তাঁদের প্রত্যেকের জন্য দু’আ করতেন। আমি তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তনি বললেনঃ কোন মানুষ দূর থেকে যখন তার কোন ভাইয়ের জন্য দু’আ করে তখন আল্লাহ তার জন্য দু’জন ফিরিশতা নিয়োগ করেন। তারা বলতে থাকেঃ তোমার ভাইয়েল জন্য তুমি যা কামনা করছো, আল্লাহ তোমাকেও তা দান করুন। ফিরিশতারা আমার জন্য দু’আ করুক, তাকি আমি চাইবো না? (তারীখুল ইসলাম- ২/১১১)
তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ও ’আশেক। রাসূলের সা. জীবদ্দশায় তাঁকে এত বেশী ভালোবাসতেন যে, রাতে তাঁর ঘরের সামনে শুয়ে থাকতেন, যাতে তিনি প্রয়োজন হলে তাঁকে জাগিয়ে তুলে তাঁকে কাজে লাগাতে পারেন। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৮৮)
পরোক্ষভাবে কুরআনের একটি আয়াতও তাঁর শানে নাযিল হয়েছে। শুরাইহ ইবন ’উবাইয়দ থেকে বর্ণিত হয়েছে। এক ব্যক্তি একদিন আবু দারদাকে বিদ্রুপ করে বললোঃ ওহে ক্বারীদের দল! তোমাদের হয়েছে কি যে, তোমরা আমাদের চেয়ে বেশী ভীরু ও বেশী কৃপণ? কিন্তু খাওয়ার সময় তোমাদের গ্রাসটি তো হয় সবচেয়ে বড়। আবু দারদা তার কথার কোন উত্তর দিলেন না। বিষয়টি ’উমারের কানে গেল। তিনি আবু দারদাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন। তাদের সব কথাই কি আমরা ধরবো? তখন ’উমার সেই লোকটির নিকট গিয়ে তার গলায় কাপড় পেঁচিয়ে টানতে টানতে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট নিয়ে যান। লোকটি বললোঃ আমরা একটু হাসি-মাশ্কারা করছিলাম। তখন সূরা তাওবার ৬৫ নং আয়াতটি নাযিল হয়। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৪৬৩)
মু’য়াবিয়া ইবন কুররা বলেনঃ একবার আবু দারদা অসুস্থ হলেন। বন্ধুরা দেখতে গেলেন। তাঁরা বললেনঃ আপনার অভিযোগ কিসের বিরুদ্ধে? বললেনঃ আমার গুনাহ্র বিরুদ্ধে। আপনার সর্বশেষ কামনা কী? বললেনঃ জান্নাত। তাঁরা বললেনঃ আমরা কি একজন ডাক্তার ডাকবো? বললেনঃ প্রয়োজন নেই। শ্রেষ্ঠতম ডাক্তারই তো আমাকে এ কষ্ট দিয়েছেন। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৫৮১)
আবু নু’য়াইম ‘আল-হুলাইয়্যা’ গ্রন্থে (১/২১২) জুবাইর ইবন নুফাইর রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। ভূমধ্য সাগরীয় দ্বীপ ‘কিবরিস’ বিজয়ের দিন অনেক মুজাহিদ কেঁদে ফেলেন। আমি দেখলাম, আবু দারদা একাকী বসে বসে কাঁদছেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, যে দিন আল্লাহ ইসলাম ও মুসলমানদের সম্মানিত করলেন, সে দিন এভাবে কাঁদার কারণ কি? বললেনঃ জুবাইর, তোমার ধ্বংস হোক। যে মানুষ আল্লাহর হুকুম ছেড়ে দেয় সে কতই না নিকৃষ্ট জীব। এই জাতি ছিল শক্তিশালী ও বিজয়ী। তাদের ছিল একটি রাষ্ট্র। তারা আল্লাহর আদেশ ছেড়ে দেয়। তাই তাদের এ পরিণতি। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৬৮১)
একবার হযরত মুয়াবিয়া আবু দারদাকে লিখলেনঃ আপনি আমাকে দিমাশ্কের ফাসিকদের একটা তালিকা দিন। জবাবে তিনি বললেনঃ তাদের সাথে আমার সম্পর্ক কি? আমি কিভাবে তাদের চিনবো? কিন্তু তাঁর ছেলে বিলাল বললেনঃ আমিই তাদের তালিকা পাঠাবো। সত্যিই তিনি তালিকা তৈরী করলেন। তখন আবু দারদা বললেনঃ কিভাবে তুমি তাদেরকে চিনলে? তুমি তাদের দলের একজন না হলে তাদেরকে চিনতে পার না। তোমার নামটি দিয়েই তালিকা শুরু কর। একথার পর বিলাল আর তালিকা পাঠাননি। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৪২৪)
হযরত আবু দারদা মানুষকে বলতেনঃ তোমরা দুনিয়া থেকে দূরে থাক। কারণ, এ দুনিয়া হারূত ও মারূত অপেক্ষা বড় জাদুকর। (লিসানুল- মীযান- ৭/৪৪) তিনি প্রায়ই দু’আ করতেনঃ হে আল্লাহ! আমাকে পূর্ণবানদের সাথে মরণ দিন এবং পাপাচারীদের সাথে বাঁচিয়ে রাখবেন না। তিনি আরো দু’আ করতেনঃ হে আল্লাহ! আমি আলিমদের অভিশাপ থেকে আপনার পানাহ চাই। যখন জানতে চাওয়অ হলো, তারা কিভাবে আপনাকে অভিশাপ দেবে? বললেনঃ আমাকে ঘৃণা করবে। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৩৮৪)
হযরত আবু দারদা রা. সম্পর্কে অনেক টুকরো টুকরো কথা বিভিন্ন গ্রন্থে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যা খুবই চমকপ্রদ ও শিক্ষণীয়। ইবন হাজারের রহ. মত আমরাও বলি, তাঁর মাহাত্ম্য ও গুণাবলী অনেক যা ছোটখাট কোন প্রবন্ধে প্রকাশ করা যাবে না। (তাহজীবুত তাহজীব- ৮/১৫৬)

হযরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান (রা)
আসল নাম হুজাইফা, ডাকনাম আবু ’আবদিল্লাহ, এবং লকব বা উপাধি ‘সাহিবুস সির’। গাতফান গোত্রের ’আবস শাখার সন্তান। এজন্য তাঁকে আল- ’আবসীও বলা হয়। পিতার নাম হুসাইল মতান্তরে হাসাল ইবন জাবির এবং মাতার নাম রাবাহ বিনতু কা’ব ইবন ’আদী ইবন ’আবদিল আশহাল, মদীনার আনসার গোত্র আউসের আবদুল আশহাল শাখার কন্যা। ইবন হাজার রহ. বলেনঃ এ হুজাইফা একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহাবী। (আল-ইসাবা- ১/৩১৭; আল-ইসতী’য়াবঃ আল-ইসাবার পার্শ্বটীকা- ১/২৭৭)
হুজাইফার পিতা হুসাইল ছিলেন মূলতঃ মক্কার বনী ’আবস গোত্রের লোক। ইসলামপূর্ব যুগে তিনি নিজ গোত্রের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে মক্কা থেকে পালিয়ে ইয়াসরিবে আশ্রয় নেন। সেখানে বনী ’আবদুল আশহাল গোত্রের সাথে প্রথমে মৈত্রীচুক্তি, পরে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে বসবাস করতে থাকেন। মদীনার আনসার গোত্রসমূহের আদি সম্পর্ক মূলতঃ ইয়ামানের সাথে। হুসাইল তাদের মেয়ে বিয়ে করায় তাঁর গোত্রের লোকেরা তাঁর পরিচয় দিত ‘আল-ইয়ামান’ বলে। এজন্য হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান বলা হয়। (দ্রঃ শাজারাতুয্ যাহাব- ১/৪৪; আল-ইসাবা- ১/৩১৭; তাহজীবুত তাহজীব- ২/১৯৩) এ ইয়ামান আবদুল আশহাল গোত্রে যে বিয়ে করেন সেখানে তাঁর নিম্নোল্লেখিত সন্তানগণ জন্মগ্রহণ করেনঃ ১. হুজাইফা, ২. সা’দ, ৩. সাফওয়ান, ৪. মুদলিজ, ৫. লাইলা। এঁরা ইতিহাসে ইয়ামানে বংশধর নামে খ্যাত।
আল-ইয়ামানের মক্কায় প্রবেশে যে বাধা ও ভয় ছিল ধীরে ধীরে তা দূর হয়ে যায়। তিনি মাঝে মধ্যে মক্কা-ইয়াসরিবের মধ্যে যাতায়াত করতেন। তবে বেশী থাকতেন ইয়াসরিবে। এদিকে হযরত রাসূলে কারীম সা. মক্কায় ইসলামের দা’ওয়াত দিতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে হুজাইফার পিতা আল-ইয়ামান বনী ’আবসের এগারো ব্যক্তিকে সংগে করে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত রাসূলে কারীম সা. তখনও মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করেননি। সুতরাং হুজাইফা মূলে দিক থেকে মক্কার তবে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই বড় হন। (সুওয়ারুন মিন হায়াতিস সাহাবা- ৪/১২২)
হযরত হুজাইফার পিতা আল-ইয়ামান মুসলমান হন মক্কায় ইসলামের প্রথম পর্বে। পিতার সাথে মা-ও ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে হুজাইফা মুসলিম পিতা-মাতার কোলে বেড়ে ওঠেন। এবং হযরত রাসূলে কারীমকে সা. দেখার সৌভাগ্য অর্জনের আগেই মুসলিম হন। ভাই-বোনের মধ্যে শুধু তিনি ও সাফওয়ান এ গৌরবের অধিকারী হন। মুসলিম হওয়ার পর রাসূলকে সা. একটু দেখার আগ্রহ জন্মে। দিন দিন এ আগ্রহ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। তিনি সব সময় যাঁরা রাসূলকে সা. দেখেছেন, তাঁদের কাছে রাসূলে সা. চেহারা- সুরত ও গুণ-বৈশিষ্ট্য কেমন তা জানার জন্য প্রশ্ন করতেন। শেষে একদিন সত্যি সত্যি মক্কায় রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে হাজির হন এবং হিজরাত ও নুসরাতের ব্যাপারে তাঁর মতামত জানতে চান। রাসূল সা. তাঁকে দু’টোর যে কোন একটি বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দান করেন। হুজাইফা বলেনঃ রাসূল সা. হিজরাত ও নুসরাত (মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে অবস্থান)- এর যে কোন একটি বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দান করেন। আমি নুসরাতকে বেছে নিলাম। (উসুদুল গাবা- ১/৩৯৪; তাহজীবুত তাহজীব- ২/১৯৩; আল-ইসাবা- ১/৩১৮) অন্য একটি বর্ণনায় এসেছেঃ মক্কার প্রথম সাক্ষাতে তিনি প্রশ্ন করেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি কি মুহাজির না আনসার? রাসূল সা. জবাব দিলেনঃ তুমি মুহাজির বা আনসার যে কোন একটি বেছে নিতে পার। তিনি বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আনসারই হবো। (সুওয়ারুন মিন হায়াতিস সাহাবা- ৪/১২৩-১২৪)
হযরত রাসূলে কারীম সা. মক্কা থেকে মদীনায় আসার পর মুওয়াখাত বা দ্বীনী ভ্রাতু-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিধান চালু করেন। তিনি হুজাইফা ও ’আম্মার ইবন ইয়াসিরকে পরস্পরের দ্বীনী ভাই বলে ঘোষণা করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৫০৬)
হযরত হুজাইফা বদর যুদ্ধে যোগদান করেননি। ইবন সা’দ তাঁকে যে সকল সাহাবী বদরে যোগদান করেননি তাঁদের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/৯৪) এ যুদ্ধে হুজাইফা ও তাঁর পিতার যোগদান না করার কারণ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেনঃ আমার বদরে যোগদানে কোন বাধা ছিল না। তবে আমার আব্বার সাথে আমি তখন মদীনার বাইরে আমাদের দীনায় ফেরার পথে কুরাইশ কাফিররা পথরোধ করে জিজ্ঞেস করেঃ তোমরা কোথায় যাচ্ছ? বললামঃ মদীনায়। তারা বললোঃ তাহলে নিশ্চয় তোমরা মুহাম্মাদের কাছেই যাচ্ছে? আমরা বললামঃ আমরা শুধু মদীনায় যাচ্ছি। তা ছাড়া আমাদের আর কোন উদ্দেশ্য নেই। অবশেষে তারা আমাদের পথ ছেড়ে দিল। তবে এই অঙ্গীকারের ভিত্তিতে যে, আমরা মদীনায় গিয়ে কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুহাম্মাদকে সা. কোনভাবে সাহায্য করবো না। তাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা মদীনায় পৌঁছলাম এবং রাসূলুল্লাহকে সা. কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুহাম্মাদকে সা. কোনভাবে সাহায্য করবো না। তাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা মদীনায় পৌঁছলাম এবং রাসূলুল্লাহকে সা. কুরাইশদের নিকট কৃত অঙ্গীকারের কথা বলে জিজ্ঞেস করলামঃ এখন আমরা কী করবো? বললেনঃ তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার পূরণ কর। আর আমরা তাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের জন্য আল্লাহর সাহায্য চাইবো। (তারীখুল ইসলামঃ যাহাবী- ২/১৫৩; সহীহ মুসলিম- ২/৮৯; তাহজীবুত তাহজীব- ২/১৯৩; আল-ইসাবা- ১/৩১৭)
হযরত হুজাইফা উহুদ যুদ্ধে তাঁর পিতার সাথে যোগদান করেন। তিনি দারুণ সাহসের সাথে যুদ্ধ করেন এবং নিরাপদে মদীনায় ফিরে আসেন। তবে তাঁর বৃদ্ধ পিতা শাহাদাত বরণ করেন। আর সে শাহাদত ছিল স্বপক্ষীয় মুসলিম সৈনিকদের হাতে ঘটনাটি এ রকমঃ
উহুদ যুদ্ধের সময় তাঁর পিতা আল-ইয়ামান ও সাবিত ইবন ওয়াক্শ বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন। যুদ্ধের আগে নারী ও শিশুদের একটি নিরাপদ দুর্গে রাখা হয়। আর এই দুই বৃদ্ধকে রাখ হয় ঐ দুর্গের তত্তাবধানে। যুদ্ধ যখন তীব্র আকার ধারণ করে তখন আল-ইয়ামান সঙ্গী সাবিতকে বললেনঃ তোমার বাপ নিপাত যাক! আমরা কিসের অপেক্ষায় বসে আছি? পিপাসিত গাধার স্বল্পায়ুর মত আমাদের সবার আয়ুও শেষ হয়ে এসেছে। আমরা খুব বেশী হলে আজ অথবা কাল পর্যন্ত বেঁচে আছি। আমাদের কি উচিত নয়, তরবারি হাতে নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট চলে যাওয়া? হতে পারে, আল্লাহ তাঁর নবীর সা. সাথে আমাদের শাহাদাত দান করবেন। তাঁরা দু’জন তরবারি হাতে নিয়ে দুর্গ ছেড়ে বেয়ে পড়লেন।
এদিকে যুদ্ধের এক পর্যায়ে পৌত্তলিক বাহিনী পরাজয় বরণ করে প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছিল। তখন এক দুরাচারী শয়তান চেচিয়ে বলে ওঠে, দেখ, মুসলমানরা এসে পেড়েছে। একথা শুনে পৌত্তলিক বাহিনীর একটি দল ফিরে দাঁড়ায় এবং মুসলমানদের একটি দলের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আল-ইয়ামান ও সাবিত দু’দলের তুমুল সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান। পৌত্তলিক বাহিনীর হাতে সাবিত শাহাদাত বরণ করেন। কিন্তু হুজাইফার পিতা আল-ইয়ামান শহীদ হন মুসলমানদের হাতে। না চেনার কারণে এবং যুদ্ধের ঘোরে এমনটি ঘটে যায়। হুজাইফা কিছু দূর থেকে পিতার মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠেনঃ ‘আমার আব্বা, আমার আব্বা’ বলে। কিন্ত সে চিৎকার কারো কানে পৌঁছেনি। যুদ্ধের শোরগোলে তা অদৃশ্যে মিলিয়ে যায়। ইতিমধ্যে বৃদ্ধ নিজ সঙ্গীদের তরবারির আঘাতে ঢলে পড়ে গেছেন। হুজাইফা পিতার মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে শুধু একটি কথা উচ্চারণ করেঃ ‘আল্লাহ আমাদের সকলকে ক্ষমা করুন। তিনিই সর্বাধিক দয়ালু।’
হযরত রাসূলে কারীম সা. হুজাইফাকে তাঁর পিতার ‘দিয়াত’ বা রক্তমূল্য দিতে চাইলে তিনি বললেনঃ আমার আব্বা তো শাহাদাতেরই প্রত্যাশী ছিলেন, আর তিনি তা লাভ করেছেন। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাক, আমি তাঁর দিয়াত বা রক্তমূল্য মুসলমানদের জন্য দান করে দিলাম। রাসূল সা. দারুণ খুশী হলেন। (দ্রঃ সহীহ বুখারী- ২/৫৮১; সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৮৭; হায়াতুস সাহাবা- ১/৫১৯; সুওয়ারুন মিন হায়াতিস সাহাবা- ৪/১২৫-১২৭)
হযরত হুজাইফা খন্দক যুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কুরাইশরা এমন তোড়জোড় করে ধেয়ে আসে যে, মদীনায় ভীতি ও ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। মদীনার চতুর্দিকে বহুদূর পর্যন্ত কুরাইশ বাহিনীর লোকেরা ছড়িয়ে পড়ে। রাসুল সা. আল্লাহর কাছে দু’আ করেন, আর সেইসাথে মদীনার প্রতিরক্ষার জন্য খন্দক খনন করেন। একদিন রাতে এক অভিনব ঘটনা ঘটে গেল। আর তা মুসলমানদের জন্য এক অদৃশ্য সাহায্য ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কুরাইশ মদীনার আশে-পাশের বাগানগুলিতে শিবির সংস্থাপন করে আছে। হঠাৎ এমন প্রচন্ড বাতাস বইতে শুরু করলো যে, রশি ছিড়ে তাঁবু ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল, হাঁড়ি-পাতিল উল্টে-পাল্টে গেল এবং হাড় কাঁপানো শীত আরম্ভ হলো। আবু সুফইয়ান বললো, আর উপায় নেই, এখনই স্থান ত্যাগ করতে হবে। (তাবাকাত- ২/৫০)
হযরত রাসূলে কারীম সা. কুরাইশ বাহিনী নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি সেই ভয়াল দুর্যোদময় রাতে হুজাইফার শক্তি ও অভিজ্ঞতার সাহায্য গ্রহণ করতে চাইলেন। তিনি কোন রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে রাতের অন্ধকারে কাউকে কুরাইশ বাহিনীর অভ্যন্তরে পাঠিয়ে তাদের খবর সংগ্রহের ইচ্ছা করলেন। আর এ দুঃসাহসী অভিযানের জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত হাজাইফাকে নির্বাচন করেন। এ অভিযান সম্পর্কে সীরাতের গ্রন্থসমূহে নানা রকম বর্ণনা দেখা যায়। একটি বর্ণনা মতে রাসূল সা. সঙ্গীদের বললেনঃ ‘যদি কেউ মুশরিকদের খবর নিয়ে আসতে পারে, তাকে আমি কিয়ামতের দিন আমার সাহচর্যের খোশখবর দিচ্ছি।’ একে তো দারুণ শীত, তার উপর প্রবল বাতাস। কেউ সাহস পেল না। রাসুল সা. তিনবার কথাটি উচ্চারণ করলেন; কিন্তু কোন দিক থেকে কোন রকম সাড়া লেন না। চতুর্থবার তিনি হুজাইফার নাম ধরে ডেকে বললেনঃ ‘তুমি যাও, খবর নিয়ে এসো।’ যেহেতু নাম ধরে ডেকেছেন, সুতরাং আদেশ পালন ছাড়া উপায় ছিল না।
অন্য একটি বর্ণনা মতে হুজাইফা নিজেই বলেনঃ ‘আমরা সে রাতে কাতারবন্দী হয়ে বসেছিলাম। আবু সুফইয়ান ও মক্কার মুশরিক বাহিনী ছিল আমাদের উপরের দিকে, আর নীচে ছিল বনী কুরাইজার ইহুদী গোত্র। আমাদের নারী ও শিশুদের নিয়ে আমরা ছিলাম শঙ্কিত। আর সেইসাথে ছিল প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝা ও ঘোর অন্ধকার। এমন দুযোর্গপূর্ণ রাত আমাদের জীবনে আর কখনো আসেনি। বাতাসের শব্দ ছিল বাজ পড়ার শব্দের মত। আর এমন ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার ছিল যে, আমরা আমাদের নিজের আঙ্গুল পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম না।
এদিকে মুনাফিক শ্রেণীর লোকেরা একজন একজন করে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট এসে বলতে লাগলোঃ আমাদের ঘর-দোর শত্রুর সামনে একেবারেই খোলা। তাই একটু ঘরে ফেরার অনুমতি চাই। মূলতঃ অবস্থা সে রকম ছিল না। কেউ যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইলেই তিনি অনুমতি দিচ্ছিলেন। এভাবে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত আমরা তিন শো বা তার কাছাকাছি সংখ্যক লোক থাকলাম।
এমন সময় রাসুল সা. উঠে এক এক করে আমাদের সবার কাছে আসতে লাগলেন। এক সময় আমার কাছেও আসলেন। শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমার গায়ে একটি চাদর ছাড়া আর কিছু ছিল না। চাদরটি ছিল আমার স্ত্রীর, আর তা খুব টেনেটুটে হাঁটু পর্যন্ত পড়ছিল। তিনি আমার একেবারে কাছে আসলেন। আমি মাটিতে বসে ছিলাম। জিজ্ঞেস করলেনঃ এই তুমি কে? বললামঃ হুজাইফা। হুজাইফা? এই বলে মাটির দিকে একটু ঝুঁকলেন, যাতে আমি তীব্র ক্ষুধা ও শীতের মধ্যে উঠে না দাঁড়াই। আমি বললামঃ হাঁ, ইয়া রাসূলুল্লাহ! তিনি বললেনঃ কুরাইশদের মধ্যে একটি খবর হচ্ছে। তুমি তাদের শিবিরে যেয়ে আমাকে তাদের খবর এনে দেবে।
আমি বের হলাম। অথচ আমি ছিলাম সবার চেয়ে ভীতু ও শীতকাতর। রাসূল সা. দু’আ করলেনঃ ‘হে আল্লাহ! সামনে-পিছনে, ডানে-বামে, উপর-নীচে, সব দিক থেকে তুমি তাকে হিফাজত কর।’ রাসূলুল্লাহর সা. এ দু’আ শেষ হতে না হতে আমার সব ভীতি দূর হলো এবং শীতের জড়তাও কেটে গেল।
আমি যখন পিছন ফিরে চলতে শুরু করেছি তখন তিনি আমাকে আবার ডেকে বললেনঃ হুজাইফা! আমার কাছে ফিরে না এসে আক্রমণ করবে না। বললামঃ ঠিক আছে। আমি রাতের ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে চলতে লাগলাম। এক সময় চুপিসারে কুরাইশদের শিবিরে প্রবেশ করে তাদের সাথে এমনভাবে মিশে গেলাম যেন আমি তাদেরই একজন।
আমার পৌঁছার কিছুক্ষণ পর আবু সুফইয়ান কুরাইশ বাহিনীর সামনে ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন। বললেনঃ ওহে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমি তোমাদেরকে একটি কথা বলতে চাই। তবে আমার আশঙ্কা হচ্ছে তা মুহাম্মাদের কাছে পৌঁছে যায় কিনা। তোমরা প্রত্যেকেই নিজের পাশের লোকটির প্রতি লক্ষ্য রাখ। একথা শোনার সাথে সাথে আমার পাশের লোকটির হাত মুট করে ধরে জিজ্ঞেস করলামঃ কে তুমি? সে জবাব দিল অমুকের ছেলে অমুক।
আবু সুফইয়ান বললেনঃ ‘ওহে কুরাইশ সম্প্রদায়! আল্লাহর কসম! তোমরা কোন নিরাপদ গৃহে নও। আমাদের ঘোড়াগুলি মরে গেছে, উটগুলি কমে গেছে এবং মদীনার ইহুদী গোত্র বনু কুরাইজাও আমাদের ছেড়ে গেছে। তাদের যে খবর আমাদের কাছে এসেছে তা সুখকর নয়। আর কেমন প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যে পড়েছি, তাও তোমরা দেখছো। আমাদের হাঁড়িও আর নিরাপদ নয়। আগুনও জ্বলছেনা। সুতরাং ফিরে চলো। আমি চলছি।’ একথা বলে তিনি উটের রশি খুললেন এবং পিঠে চড়ে বসে তার গায়ে আঘাত করলেন। উট চলতে শুরু করলো। কোন কিছু ঘটাতে রাসুল সা. যদি নিষেধ না করতেন তাহলে একটি মাত্র তীর মেরে তাকে হত্যা করতে পারতাম।
আমি ফিরে এলাম। এসে দেখলাম রাসূল সা. তাঁর এক স্ত্রীর চাদর গায়ে জড়িয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে আছেন। নামায শেষ করে তিনি আমাকে তাঁর দু’পায়ের কাছে টেনে নিয়ে চাদরের এক কোনা আমার গায়ে জড়িয়ে দিলেন। আমি সব খবর তাঁকে জানালাম। তিনি দারুণ খুশী হলেন এবং আল্লাহ হামদ ও ছানা পেশ করলেন। হযরত হুজাইফা সে দিন বাকী রাতটুকু রাসূলুল্লাহর সা. সেই চাদর গায়ে জড়িয়ে সেখানেই কাটিয়ে দেন। প্রত্যুষে রাসূল সা. তাঁকে ডাকেনঃ ইয়া নাওমান- ওহে ঘুমন্ত ব্যক্তি।’ (দ্রঃ সহীহ মুসলিম- ২/৮৯; তারীখু ইবন আসাকির- ১/৯৮; সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২৩১; হায়াতুস সাহাবা- ১/৩২৮-৩৩০; সুওয়ারুন মিন হায়াতিস সাহাবা- ৪/১২৯-১৩৬)
একবার কূফার এক লোক হযরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামনকে বললোঃ আবু ’আবদিল্লাহ! আপনি কি রাসূলুল্লাহকে সা. দেখেছেন? তাঁর সুহবত সাহচর্য পেয়েছেন? বললেনঃ হাঁ, ভাতিজা। লোকটি আবার প্রশ্ন করলোঃ আপনারা কেমন আচরণ করতেন? বললেনঃ তাঁর আদেশ পালনের চেষ্টা করতাম। লোকটি বললোঃ আমরা রাসুলকে সা. পেলে মাটিতে হেঁটে চলতে দিতাম না, কাঁধে করে নিয়ে বেড়াতাম। তিনি বললেনঃ আমি খন্দকের দিন রাসূলুল্লাহর সা. সাথে নিজেকে দেখেছি। এই বলে তিনি খন্দকের সেই রাতের ভয়-ভীতি, ঝড় শৈত্য ইত্যাদির এক চিত্র তুলে ধরলেন। (হায়াতুস সাহাবা- ১/২৬৪)
খন্দক পরবর্তী রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় বা তাঁর পরের সকল অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। হযরত রাসুলে কারীমের সা. ওফাতের পর তিনি ইরাকে বসতি স্থাপন করেন। তারপর বিভিন্ন সময় কূফা, নিস্সীবীন ও মাদায়েনে বসবাস করেন। নিস্সীবীনের ‘আল-জাযীরা’ শহরে একটি বিয়েও করেন। (উসুদুল গাবা- ১/৩৯৪)
হযরত হুজাইফা যে পারস্যের নিহাওয়ান্দ, দাইনাওয়ার, হামজান, মাহ্ রায় প্রভৃতি অঞ্চল জয় করেন এবং গোটা ইরাক ও পারস্যবাসীকে কুরআনের এক পাঠের ওপর সমবেত করেন, একথা খুব কম লোকেই জানে। (আল-ইসতী’য়াব; আল-ইসাবার টীকা- ১/২৭৮; তাহজীবুত তাহজীব- ২/১৯৩)
ইরাকের বিভিন্ন অঞ্চল বিজিত হওয়ার পর হযরত ’উমার রা. সেখানকার ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ কাজের জন্য তিনি দু’জন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করেন। ফুরাত নদীর তীরবর্তী অঞ্চলসমূহে হযরত ’উসমান ইবন হুনাইফ এবং দিজলা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলসমূহে হযরত হুজাইফাকে নিয়োগ করেন। দিজলা তীরবর্তী অঞ্চলের অধিবাসীরা ছিল ভীষণ দুষ্ট প্রকৃতির। তারা হযরত হুজাইফাকে তার কাজে কোন রকম সাহায্য তো দূরের কথা বরং নানা রকম বাধার সৃষ্টি করলো। তা সত্ত্বেও তিনি বন্দোবস্ত দিলেন। এর ফলে সরকারী আয় অনেকটা বেড়ে গেল। এরপর তিনি মদীনায় এসে খলীফা ’উমারের রা সাথে সাক্ষাৎ করলেন। খলীফা তাঁকে বললেনঃ ‘সম্ভবতঃ যমীনের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপানো হয়েছে।’ হুজাইফা বললেনঃ আমি অনেক বেশী ছেড়ে দিয়েছি। (কিতাবুজ খিরাজ- ২১)
হযরত হুজাইফা ইয়ারমুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ইয়ারমুক যুদ্ধের বিজয়ের খবর সর্বপ্রথম তিনিই মদীনায় খলীফা ’উমারের নিকট নিয়ে আসেন। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ৪/৯৩,৯৪)
হিজরী ১৮ সনে নিহাওয়ান্দের ওপর সেনা অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। অবশ্য আবু ’উবাইদাহ বলেন, হিজরী ২২ সনে হুজাইফা নিহাওয়ান্দে যান। (তারীখু ইবন আসাকির- ১/১০০) এই নিহাওয়ান্দের যুদ্ধে পারসিক সৈন্যসংখ্যা ছিল দেড় লাখ। খলীফা হযরত ’উমার রা. মুসলিম বাহিনীর অধিনায়ক নিয়োগ করেন হযরত নু’মান ইবন মুকাররিনকে। তারপর তিনি কূফায় অবস্থানরত হযরত হুজাইফাকে একটি চিঠিতে সেখান থেকে একটি বাহিনী নিয়ে নিহাওয়ান্দের দিকে যাত্রা করার জন্য নির্দেশ দেন। এদিকে খলীফা মুসলিম মুজাহিদদের প্রতি জারি করা এক ফরমানে বললেন, চারিদিক থেকে মুসলিম সৈন্যরা যখন এক স্থানে সমবেত হবে তখন প্রত্যেক স্থান থেকে আগত বাহিনীর একজন করে আমীর থাকবে। আর গোটা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হবেন, নু’মান ইবন মুকাররিন। নু’মান যদি শাহাদাত বরণ করেন, হুজাইফা হবেন পরবর্তী আমীর। আর তিনি শহীদ হলে আমীর হবেন জারীর ইবন ’আবদিল্লাহ আল-বাজালী। এভাবে খলীফা সে ফরমানে একের পর এক সাতজন সেনাপতির নাম ঘোষণা করেন। হযরত নু’মান নিহাওয়ান্দের অদূরে শিবির স্থাপন করে বাহিনীর দায়িত্ব বন্টন করেন। সেখানে হযরত হুজাইফাকে দক্ষিণ ভাগের অফিসার নিয়োগ করা হয।
দু’বাহিনী মুখোমুখি হলো। শত্রুসৈন্য দেড় লাখ, আর মুসলমান সৈন্য মাত্র তিরিশ হাজার। প্রচন্ড যুদ্ধ হলো। ইতিহাসে এমন যুদ্ধের নজীর খুব কমই আছে। মুসলিম বাহিনীর এক নম্বর অধিনায়ক নু’মান শাহাদাত বরণ করলেন। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে তিনিও হুজাইফাকে আমীর নিয়োগের অসীয়াত করে যান। তাঁর শাহাদাতের পর আশে পাশের সৈনিকরা যখন নতুন আমীরের সন্ধান করছে তখন হযরত মা’কাল হুজাইফার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ইনিই তোমাদের পরবর্তী আমীর। আশা করা যায়, আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে তোমাদের বিজয় দান করবেন।
হযরত হুজাইফা সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। যুদ্ধ তখন ঘোরতর রূপ ধারণ করেছে। তিনি পার্শ্ববর্তী লোকদেরকে নু’মানের শাহাদাতের খবর প্রচার করতে নিষেধ করে দিলেন। আর সাথে সাথে নু’মানের স্থলে ভাই নু’য়াঈমকে দাঁড় করিয়ে দিলেন। যাতে নু’মানের শাহাদাতে যুদ্ধের ওপর কোন রকম প্রভাব না পড়ে। এ কাজগুলি তিনি করলেন মুহূর্তের মধ্যে। তারপর তিনি ঝড়ের গতিতে চিরে-ফেঁড়ে পারসিক বাহিনীর সামনে পৌঁছে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলেনঃ
‘আল্লাহু আকবারঃ সাদাকা ও’য়াদাহ্
আল্লাহ আকবারঃ নাসারা জুনদাহ্’
আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ- তিনি তাঁর অঙ্গীকার পূরণ করেছেন।
আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ- তিনি তাঁর সিপাহীদের সাহায্য করেছেন।
তারপর তনি নিজের ঘোড়ার লাগাম ধরে টান মেরে শত্রু বাহিনীর দিকে ফিরিয়ে জোরে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেনঃ ‘ওহে মুহাম্মাদের সা. অনুসারীরা! এখানে, এদিকে জান্নাত তোমাদের স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। তোমরা আর দেরী করোনা।
ওহে বদরের যোদ্ধারা! ছুটে এসো। ওহে খন্দক, উহুদ ও তাবুকের বীরেরা! সামনে এগিয়ে চলো।’ এভাবে তিনি সেদিন নজীরবিহীন সাহস ও বিজ্ঞতার পরিচয দান করেন। (দ্রঃ তাবারী- ৫/২৬০১, ২৬০৫, ২৬৩২; যাহাবীঃ তারীখ- ২/৩৯-৪১; রিজালুন হাওলার রাসূল- ১৯৯)
নিহাওয়ান্দে ছিল একটি অগ্নি উপাসনা কেন্দ্র। তার প্রধান ধর্মগুরু একদিন হুজাইফার নিকট এসে বললেন, যদি আমার নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয় তাহলে আমি একটি মহামূল্যবান গুপ্ত সম্পদের সন্ধান দিতে পারি। হযরত হুজাইফা রা. তাঁকে আশ্বাস দিলেন। লোকটি পারস্য সম্রাটের অতিমূল্যবান মনি-মুক্তা এনে হাজির করলেন। হযরত হুজাইফা রা. গনীমতের সম্পদের এক পঞ্চমাংশসহ সেই মহামূল্যবান মনি-মুক্তা মদীনায় খলীফা ’উমারের নিকট পাঠিয়ে দিলেন। হযরত ’উমার রা. মনি-মুক্তা দেখে রাগে ফেটে পড়লেন। ইবন মুলাইকাকে ডেকে বললেন, এক্ষুণি এগুলি নিয়ে যাও। আর হুজাইফাকে বল, এগুলি বিক্রী করে বিক্রয়লব্ধ অর্থ সৈন্যদের মধ্যে যেন বন্টন করে দেয়। হযরত হুজাইফা তখন নিহাওয়ান্দের ‘মাহ’ নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন। সেখানে তিনি সেই ধনরত্ন চার কোটি দিরহামে বিক্রী করেন। (তাবারী- ৫/২৬২৭, ২৬৩০)
ইবন আসাকির বলেন, নিহাওয়ান্দের শাসক বাৎসরিক আট লাখ দিরহাম জিযিয়া দানের অঙ্গীকার করে হযরত হুজাইফার সাথে সন্ধি করেন। নিহাওয়ান্দের পর তিনি বিনা বাধায় ‘দায়নাওয়ার’ জয় করেন। হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস পূর্বেই এ দায়নাওয়ার জয় করেছিলেন; কিন্ত অধিবাসীরা বিদ্রোহ করে। তারপর হযরত হুজাইফা বিনা যুদ্ধে একে একে মাহ্, হামাজান, ও রায় জয় করেন। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/১০০)
মাহ্- এর অধিবাসীদের সাথে হযরত হুজাইফা রা. যে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তা নিম্নরূপঃ
‘‘হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান মাহবাসীদের জান, মাল ও বিষয়- সম্পত্তির এ নিরাপত্তা দান করছেন যে, তাদের ধর্মের ব্যাপারে কোন রকম হস্তক্ষেপ করা হবেনা। এবং ধর্ম ত্যাগের জন্য কোনরূপ জোর-জবরদস্তি করা হবে না। তাদের প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যতদিন বাৎসরিক জিযিয়া আদায় করবে, পথিকদের পথের সন্ধান দেবে, পথ চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, এখানে অবস্থানরত মুসলিম সৈনিকদের একদিন এক রাত আহার করাবে এবং মুসলমানদের শুভাকাংখী থাকবে, ততদিন তাদের এ নিরাপত্তা বলবৎ থাকবে। আর যদি তারা এ অঙ্গীকার ভঙ্গ করে বা তাদের আচরণে পরিবর্তন দেখা দেয়, তাহলে তাদের কোন দায়-দায়িত্ব মুসলমানদের ওপর থাকবে না।’’ হিজরী ১৯ সনের মুহাররাম মাসে এ চুক্তিপত্রটি লেখা হয় এবং তাতে কা’কা’, নু’য়াইম ইবন মুকাররিন ও মুয়ায়িদ ইবন মুকাররিন সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর দান করেন। (তাবারী- ৫/২৬৩৩)
উল্লেখিত অভিযানসমূহ শেষ করে হযরত হুজাইফা তাঁর পূর্বের ভূমি বন্দোবস্তদানকারী অফিসার পদে ফিরে যান। (তাবারী- ৫/২৬৩৮)
বালাজুরীর বর্ণনা মতে হিজরী ২২ সনে আজারবাইজান অভিযানে হযরত হুজাইফা গোটা বাহিনীর পতাকাবাহী ছিলেন। তিনি নিহাওয়ান্দ থেকে আজারবাইজানের রাজধানী আরদাবীলে পৌঁছেন। এখানকার শাসক মাজেরওয়ান, মায়মন্দ, সুরাত, সাব্জ, মিয়াঞ্চ প্রভৃতি স্থান থেকে একটি বাহিনী সংগ্রহ করে প্রতিরোধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অতঃপর বাৎসরিক আট লাখ দিরহাম জিযিয়া দানের শর্তে সন্ধি করে। হযরত হুজাইফা সেখান থেকে মুকাম ও রুজাইলার দিকে অগ্রসর হন এবং বিজয় লাভ করেন। ইত্যবসরে মদীনার খলীফার দরবার থেকে তাঁর বরখাস্তের নির্দেশ হাতে পৌঁছে। তাঁর স্থলে ’উতবা ইবন ফারকাদকে নিয়োগ করা হয। (তাবারী- ৫/২৮০৬; বিস্তারিত বর্ণনা তারীখে বালাজুরীতে এসেছে।)
হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে মাদায়েন বিজিত হওয়ার পর মুসলিম বাহিনী সেখানে অবস্থান করতে থাকে। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া আরব মুসলমানদের স্বাস্থ্যসম্মত না হওয়ায় খলীফা ’উমার রা. সা’দকে তাঁর বাহিনী নিয়ে কূফায় চলে যেতে বলেন এবং সেখানে একটি স্বাস্থ্য উপযোগী স্থান নির্বাচন করে স্থায়ী সেনা ছাওনী তখা শহর পত্তনের নির্দেশ দেন। হযরত সা’দ রা. শহর পত্তনের জন্য হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান ও সালমান ইবন যিয়াদের ওপর স্থান নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁরা দু’জন গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর একটি স্বাস্থ্যকর স্থান নির্বাচন করেন। আজকের কূফা শহরটি এ দু’ব্যক্তিরই নির্বাচিত স্থানে অবস্থিত। (রিজালুন হাওলার রাসুল- ২০০)
উল্লেখিত অভিযান সমূহের পর খলীফা হযরত ’উমার রা. তাকে মাদায়েনের ওয়ালী নিয়োগ করেন। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/৯৪) একজন নতুন ওয়ালী আসছেন- এ খবর মাদায়েনবাসীদের কাছে পৌঁছে গেল। নতুন আমীরকে স্বাগত জানানোর জন্য তারা দলে দলে শহরের বাইরে সমবেত হলো। তারা এ মহান সাহাবীর তাকওয়া, খোদাভীতি, সরলতা ও ইরাক বিজয়ের অনেক কথা শুনেছিল। তারা তাঁর একটি জাঁকজমকপূর্ণ কাফিলার সাথে আগমণের প্রতীক্ষায় ছিল। না, কোন কাফিলার সাথে নয়। তারা দেখতে পেল কিছু দূরে গাধার ওপর সাওয়ার হয়ে দীপ্ত চেহারার এক ব্যক্তি তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। গাধার পিঠে অতি পুরনো একটি জিন। তার ওপর বসে বাহনের পিঠের দু’পাশের পা ছেড়ে দিয়ে এক হাতে রুটি ও অন্য হাতে লবণ ধরে মুখে ঢুকিয়ে চিবোচ্ছেন। আরোহী ধীরে ধীরে জনতার মাঝখানে এসে পড়লেন। তারা ভালো করে তাকিয়ে দেখে বুঝলো, ইনিই সেই ওয়ালী যার প্রতীক্ষায় তারা দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথমবারের মত তাদের কল্পনা হোঁচট খেল। পারস্যের কিসরা বা তাঁর পূর্ব থেকে তাদের দেশে এমন ওয়ালীর আগমণ আর কক্ষণো ঘটেনি।
তিনি চললেন এবং লোকেরাও তাঁকে ঘিরে পাশাপাশি চললো। তিনি আবাস স্থলে পৌঁছে উপস্থিত জনতাকে তাদের প্রতি লেখা খলীফার ফরমান পাঠ করে শোনালেন। খলীফা হযরত ’উমারের রা. নিয়ম ছিল, নতুন ওয়ালী বা শাসক নিয়োগের সময় সেই এলাকার অধিবাসীদের প্রতি বিভিন্ন নির্দেশ ও ওয়ালীর দায়িত্ব ও কর্তব্য স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া। কিন্তু হযরত হুজাইফার রা. নিয়োগ পত্রে মাদায়েনবাসীর প্রতি শুধু একটি নির্দেশ ছিলঃ ‘তোমরা তাঁর কথা শুনবে ও আনুগত্য করবে।’ তিনি যখন তাদের সামনে খলীফার এ ফরমান পাঠ করে শোনালেন, তখন চারদিক থেকে আওয়ায উঠলো, বলুন, আপনার কী প্রয়োজন। আমরা সবই দিতে প্রস্তুত। রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী ও খুলাফায়ে রাশেদার পদাঙ্ক অনুসরণকারী হযরত হজাইফা বললেনঃ ‘আমার নিজের পেটের জন্য শুধু কিছু খাবার, আর আমার গাধাটির জন্য কিছু ঘাস-খড় প্রয়োজন। যতদিন এখানে থাকবো, আপনাদের কাছে শুধু এতটুকুই চাইবো।’ তিনি সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে আরো বললেনঃ ‘তোমরা ফিতনার স্থানগুলি থেকে দূরে থাকবে। লোকেরা জানতে চাইলো, ফিতনার স্থানগুলি কি? বললেনঃ আমীর বা শাসকদের বাড়ীর দরযাসমূহ। তোমাদের কেউ আমীর বা শাসকের কাছে এসে মিথ্যা দ্বারা তার সত্যায়িত করবে এবং তার মধ্যে যা নেই তাই বলে তার প্রশংসা করবে- এটাই মূলতঃ ফিত্না।’ এ পদে কিছু দিন থাকার পর কোন এক কারণে খলীফা হযরত ’উমার রা. তাঁকে রাজধানী মদীনায় তলব করেন। খলীফার ডাকে সাড়া দিয়ে হযরত হুজাইফা রা. যে অবস্থায় একদিন মাদায়েন গিয়েছিলেন ঠিক একই অবস্থায় মদীনার দিকে যাত্রা করেন। হুজাইফা আসছেন, এ খবর পেয়ে খলীফা মদীনার কাছাকাছি পথের পাশে এক স্থানে লুকিয়ে থাকেন। নিকটে আসকেই হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ান এবং তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেনঃ ‘হুজাইফা, তুমি আমার ভাই, আর আমিও তোমার ভাই।’ তারপর সেই পদেই তাঁকে বহাল রাখেন।
(দ্রঃ তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/১০০; আল-আ’লাম- ২/১৭১; তাহজীবুত তাহজীব-২/১৯৩; উসুদুল গাবা- ১/৩৯২; হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৬৬, ২/৭৩)
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ দিহ্লবী রহ. হযরত ইমাম আবু হানীফার রহ. একটি বর্ণনা নকল করেছেন। হযরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামন রা. মাদায়েন থাকাকালে এক ইহুদী নারীকে বিয়ে করেন। খবর পেয়ে আমীরুল মুমিনীন ’উমার রা. তাঁকে উক্ত মহিলা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার নির্দেশ দেন। হুজাইফা রা. খলীফাকে প্রশ্ন করেনঃ কিতাবী নারী বিয়ে করা কি হারাম? জবাবে ’উমার রা. বলেনঃ হুজাইফা! আমি তোমাকে তাকীদ দিচ্ছি, আমার এ নির্দেশ হাত থেকে রাখার পূর্বেই যেন মহিলাকে বিদায় করে দেয়া হয়। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, তোমার দেখাদেখি অন্য মুসলমানরাও জিম্মী নারীর রূপ ও গুণের কারণে মুসিলম মহিলাদের ওপর তাদেরকে প্রাধান্য দিতে শুরু করে না দেয়। আর এমন হলে তা মুসলিম মেয়েদের জন্য একটি মারাত্মক ফিত্না বলে প্রমাণিত হবে। (ফিক্হে ’উমারঃ শাহ ওয়ালী উল্লাহ দিহলবী, উর্দু অনুবাদ)
মাদায়েনে ওয়ালী থাকাকালে একবার জনতার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষয়ে তিনি বলেনঃ ‘হে জনমন্ডলী! তোমরা তোমাদের দাসদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখ। দেখ, তারা কোথা থেকে কিভাবে উপার্জন করে তোমাদের নির্ধারিত মজুরী পরিশোধ করছে। কারণ, হারাম উপার্জন খেয়ে দেহে যে গোশ্ত তৈরী হয় তা কক্ষণো জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আর এটাও জেনে রাখ, মদ বিক্রেতা, ক্রেতা ও তাঁর প্রস্তুতকারক, সকলেই তা পানকারীর সমান।’ (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৪৮২)
হযরত ’উসমানের রা. খিলাফতকালের পুরো সময়টা এবং হযরত আলীর রা. খিলাফতের কিছু দিন, একটানা এ দীর্ঘ সময় তিনি মাদায়েনের ওয়ালী পদে আসীন ছিলেন। (আল-ইসাবা- ১/৩১৭) হযরত ’উসমানের খিলাফতকালে হিজরী তিরিশ সনে হযরত সা’ঈদ ইবন ’আসের সাথে কূফা থেকে খুরাসানের উদ্দেশ্যে বের হন। ‘তুমাইস নামক বন্দরে শত্রু বাহিনীর সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। এখানে সা’ঈদ ইবন ’আস সালাতুল খাওফ (ভীতিকালীন নামায) আদায় করেন। তিনি নামায পড়ানোর পূর্বে হযরত হুজাইফার নিকট থেকে তার পদ্ধতি জেনে নেন। (মুসনাদ-৫/৩৮৫; রাবীয়া- ৫/৩৮৩৬-৩৭) এরপর তিনি ‘রায়’- এ যান এবং সেখান থেকে সালমান ইবন রাবীয়া ও হাবীব ইবন মাসলামার সাথে আরমেনিয়ার দিকে অগ্রসর হন। এ অভিযানে তিনি কুফী বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন। (তাবারী- ৫/২৮৯৩)
হিজরী ৩১ সনে ‘খাকানে খাযার’- এর বাহিনীর সাথে বড় ধরণের একটি সংঘর্ষ হয়। এতে সালমানসহ প্রায় চার হাজার মুসলিম শহীদ হন। সালমানের শাহাদাতের পর হযরত হুজাইফা গোটা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পর তাঁকে অন্যত্র বদলী করা হয় এবং তাঁর স্তলে হযরত মুগীরা ইবন শু’বাকে নিয়োগ করা হয। হযরত হুজাইফা রা. ‘বাব’- এর ওপর তিনবার অভিযান চালান। (তাবারী- ৫/২৮৯৪) তৃতীয় হামলাটি ছিল হিজরী ৩৪ সনে। (তাবারী- ৫/২৯৩৬) এ অভিযান ছিল হযরত ’উসমানের রা. খিলাফতের শেষ দিকে। এ সকল অভিযান শেষ করে তিনি মাদায়েনে নিজ পদে ফিরে আসেন।
মাদায়েনে পৌঁছার পর তিনি হযরত ’উসমানের রা. শাহাদাতের ঘটনা অবগত হন। খলীফা ’উসমানের রা. শাহাদাতের মাত্র চল্লিশ দিন পর তিনিও ইনতিকাল করেন। এটা হিজরী ৩৬ সন মুতাবিক ৬৫৮ খ্রীস্টাব্দের ঘটনা। ওয়াকিদী ও আল-হায়সাম ইবন ’আদী এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। (দ্রঃ আল-ইসাবা- ১/৩১৮; শাজারাতুয্ যাহাব- ১/৪৪; আল-আ’রাম- ২/১৭১; তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/৯৪)
মৃত্যুর পূর্বে তাঁর মধ্যে এক আশ্চর্য অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাঁর সাদাসিধে ভাব আরো বেড়ে যায় এবং দারুণ ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সব সময় কান্নাকাটি করতেন। লোকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতেন, দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার দুঃখে এ কান্না নয়। কারণ, মৃত্যু আমার অতি প্রিয়। তবে এ জন্য কাঁদছি যে, মৃত্যুর পর আমার যে কী অবস্থা হবে এবং আমার পরিণতিই বা কী হবে, তা তো আমার জানা নেই। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে তিনি বলেনঃ ‘হে আল্লাহ! তোমার সাক্ষাত আমার জন্য কল্যাণময় কর। তুমি তো জান আমি তোমায় কত ভালোবাসি।’ (উসুদুল গাবা- ১/৩৯২)
তাঁর অন্তিম সময় ঘনিয়ে এলে রাতের বেলা কয়েকজন সাহাবী তাঁকে দেখতে গেলেন। হুজাইফা তাঁদেরকে প্রশ্ন করলেনঃ এটা কোন্ সময়? তাঁরা বললেনঃ প্রভাতের কাছাকাছি সময়। তিনি বললেনঃ আমি সেই সকালের ব্যাপারে আল্লাহর পানাহ্ চাই যা আমাদের জাহান্নামে নিয়ে যাবে। এ কথাটি তিনি কয়েকবার উচ্চারণ করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনারা কি কাফন এনেছেন? তাঁরা বললেনঃ হাঁ, এনেছি। বললেনঃ কাফনের ব্যাপারে বেশী বাড়াবাড়ি করবেন না। কারণ, আল্লাহর কাছে যদি আমার কিছু ভালো থেকে থাকে তাহলে এ কাফন পরিবর্তন করে দেওয়া হবে, আর যদি খারাপ থাকে এ ভালো কাফন ছিনিয়ে নেওয়া হবে।
তিনি কাফন দেখতে চাইলে তা দেখানো হলো। যখন দেখলেন, তা নতুন ও দামী তখন ঠোঁটে একটু বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে বললেনঃ এ আমার কাফন নয়। কামিস ছাড়াই দু’প্রস্থ সাদা কাপড়ই আমার জন্য যথেষ্ট। কারণ কবরে আমাকে বেশী সময় বিরতি দেওয়া হবে না। খুব তাড়াতাড়ি আমাকে তার চেয়ে ভালো অথবা মন্দ স্থানে স্থানান্তর করা হবে। তারপর দু’আ করলেনঃ ‘হে আল্লাহ! তুমি জান আমি ধনের পরিবর্তে দারিদ্রকে, ইয্যতের পরিবর্তে জিল্লতীকে এবং জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুকে ভালোবাসতাম।’ তার শেষ কথাটি ছিলঃ ‘অতি আবেগের সাথে বন্ধু এসেছে, যে অনুশোচনা করবে তার সফলতা নেই।’ (দ্রঃ উসুদুল গাবা- ১/৩৯৩; তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/১০৩; রিজালুন হাওলার রাসূল- ২০১; সুওয়ারুন মিন হায়াতিস সাহাবা- ৪/১৩৮)
তাঁর জানাযায় বহু লোক উপস্থিত ছিল। এক ব্যক্তি তাঁর প্রতি ইঙ্গিত করে বললো, আমি এই খাটিয়ার ওপর শায়িত ব্যক্তিকে বলতে শুনেছি, রাসূলসা. যা কিছু বলেছেন তা বর্ণনা করতে কোন দোষ নেই। আর তোমরা যদি পরস্পর যুদ্ধের দিকে ধাবিত হও তাহলে আমি ঘরে বসে থাকবো। তারপরেও যদি কেউ সেখানে উপস্থিত হয় তাহলে তাকে বলবো, এগিয়ে এসো, আমার ও তোমার পাপের বোঝা কাঁধে তুলে নাও। (মুসনাদ- ৫/৩৮৯; হায়াতুস সাহাবা- ২/৪০৪, ৪০৫)
মৃত্যুর পূর্বে তিনি ’আলীর রা. নিকট বাই’য়াত করার জন্য দুই ছেলেকে অসীয়াত করে যান। তাঁরা দু’জনই ’আলীর রা. বাই’য়াত করেন এবং সিফ্ফীন যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। (আল-ইসতীয়াবঃ আল-ইসাবার টীকা- ১/২৭৮) হযরত হুজাইফা রা. নিজেও ’আলীর নিকট বাই’য়াত করেছিলেন বলে বর্ণিত হয়েছে।
আবু ’উবাইদাহ, বিলাল, সাফওয়ান ও সা’ঈদ নামে তাঁর চার ছেলে ছিল। ‘তাবাকাত’ গ্রন্থকার ইবন সা’দের সময় মাদায়েনে তাঁর বংশধরগণ জীবিত ছিলেন। (তাবাকাত- ৬/৮) হযরত হুজাইফার দুই স্ত্রী ছিল বলে প্রসিদ্ধি আছে।
দৈহিক আকৃতিক দিক দিয়ে হযরত হুজাইফাকে রা. হিজাযী বলে চেনা যেত। মধ্যমাকৃতির একহারা গড়ন এবং সামনের দাঁতগুলি ছিল অতি সুন্দর। দৃষ্টিশক্তি এতই প্রখর ছিল যে, ভোরের আবছা অন্ধকারেও তীরের নিশানা (লক্ষ্যস্থল) নির্ভুলভাবে দেখতে পেতেন।
হযরত হুজাইফা রা. ছিলেন শ্রেষ্ঠ ’আলিম সাহাবীদের একজন। ফিকাহ ও হাদীস ছাড়াও কিয়ামত পর্যন্ত ইসলামে যে সকল আবর্তন-বিবর্তন হবে সে সম্পর্কেও একজন শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। মুনাফিকদের সম্পর্কে তাঁর জানা ছিল অনেকে। এ কারণে তাঁকে রাসূলুল্লাহর সা. গোপন জ্ঞানের অধিকারী বা ‘সাহিবুস সির’ বলা হতো। হুজাইফা বলেনঃ অতীতে পৃথিবীতে যা ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত যা ঘটবে তা সবই রাসূল সা. আমাকে বলেছেন। (তাহজীবুত তাহজীব- ২/১৯৩)
একবার তিনি প্রখ্যাত ’আলিম সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদের নিকট বসে ছিলেন। আরো অনেকে সেখানে ছিলেন। আলোচনার এক পর্যায়ে দাজ্জালের কথা উঠলে তিনি বললেন, আমি এ বিষয়ে তোমাদের থেকে অনেক বেশী জানি। (সহীহ মুসলিম- ২/৫১৪)
একদিন হযরত রাসূলে কারীম সা. এক ভাষণে সাহাবীদের সামনে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনার বর্ণনা দান করেন। হযরত হুজাইফার সেই ভাষণটি স্মরণ ছিল। তবে কিছু কথা ভুলে যান। যখনই কোন ঘটনা ঘটতো তখন সে কথা মনে পড়তো। (সহীহ মুসলিম- ৫/৪৯) তিনি নিজেই বলেছেন, রাসূল সা. তাঁকে সব ঘটনা অবহিত করেন। শুধু একটি কথা বলা বাকী চিল। তা হলো, মদীনাবাসীদের মদীনা থেকে বের হওয়ার কারণ কী হবে? (সহীহ মুসলিম- ৫/৪৯)
’আলকামা বলেনঃ একবার আমি শামে গেলাম। সেখানে আমি এই বলে দু’আ করলামঃ হে আল্লাহ! আমাকে একজন নেক্কার সঙ্গী দাও। এরপর আমি একজন লোকের পাশে বসলাম। ঘটনাক্রমে তিনি ছিলেন আবু দারদা রা.। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কোথাকার লোক? বললামঃ কুফার। তিনি বললেনঃ তোমাদের ওখানে ‘সাহিবুস সির’ বা গোপন রহস্যের অধিকারী ব্যক্তি, যিনি ছাড়া অন্য কেউ সে রহস্য জানোনা- সেই হুজাইফা কি নেই? (তারীখু ইবন ’আসাকির- ৪/৯৬)
হযরত হুজাইফা রা. সম্পর্কে একবার হযরত ’আলীকে রা. জিজ্ঞেস করা হলে বললেন, তিনি তো মুনাফিকদের সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞানী। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে- তিনি তো মুনাফিকদের সম্পর্কে মুহাম্মাদের সা. সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী জ্ঞানী। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ৪/৯৭; হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৫৭)
আর একবার হুজাইফা সম্পর্কে হযরত আবু যারকে রা. জিজ্ঞেস করা হলে বললেনঃ তিনি যেমন যাবতীয় জটিল ও বিস্তারিত বিষয়ে জ্ঞান রাখেন, তেমনিভাবে মুনাফিকদের নামও জানেন। মুনাফিকদের সম্পর্কে যদি তুমি জানতে চাও তাহলে এ বিষয়ে তাঁকে একজন বিজ্ঞ ব্যক্তিই পাবে। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ৪/৯৭)
সাহাবায়ে কিরাম সাধারণতঃ রাসূলুল্লাহর সা. নিকট বিভিন্ন ’আমলের ফজীলাত, নামায, রোযা বা এ জাতীয় বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। কিন্তু হুজাইফা রা. তা করতেন না। তিনি বলেনঃ মুহাম্মাদের সা. সাহাবীরা সব সময় ভালো কি, তাই জিজ্ঞেস করতেন। আর আমি জিজ্ঞেস করতাম, খারাপ কি, তা জানার জন্য। প্রশ্ন করা হলো, কেন এমন করতেন? বললেনঃ যে খারাপকে জানে সে ভালোর মধ্যে থাকে। অন্য একটি বর্ণনা মতে, তিনি বলেন, ‘যাতে আমি খারাপের মধ্যে না পড়ি সেই ভয়ে।’ (বুখারী- ২/১০৪৯; তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/১০১; তাহজীবুত তাহজীব- ২/১৯৩)
একবার হযরত ’উমারের রা. নিকট বহু সাহাবী বসে ছিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ ফিত্না সম্পর্কে কারো কি কিছু জানা আছে? হুজাইফা বললেনঃ ধন-সম্পদ, পরিবার-পরিজন ও প্রতিবেশীর ব্যাপারে মানুষের যা কিছু ভুল-ত্রুটি হয়ে যায়, নামায, সাদাকা, আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকার দ্বারা তার কাফ্ফারা হয়ে যায়। ’উমার বললেনঃ আমার প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য এ নয়। আমাকে সে ফিত্নার কথা বল যা সাগরের মত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে।’ হুজাইফা বললেনঃ আপনার ও সেই ফিত্নার মধ্যে একটি দরযার বাধা আছে। এ জন্য আপনার দ্বিধান্বিত হওয়ার কারণ নেই। ’উমার রা. জানতে চাইলেনঃ দরযা খোলা হবে না ভেঙ্গে ফেলা হবে? বললেনঃ ভেঙ্গে ফেলা হবে। ’উমার রা. বললেনঃ তাহলে তো আর কক্ষণো থামবে না। হুজাইফা বললেনঃ হাঁ, তাই।
হযরত হুজাইফা রা. উল্লেখিত ঘটনাটি পরবর্তীকালে অন্য একটি মজলিসে বর্ণনা করলেন। তখন সেখানে প্রখ্যাত তাবে’ঈ ‘শাকীক’ উপস্থিত ছিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ ’উমার কি দরযা সম্পর্কে জানতেন? বললেনঃ তোমরা যেমন জান দিনের পর রাত হয়, ঠিক তেমনি তিনিও দরযা সম্পর্কে জানতেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলোঃ দরযার অর্থ কি? বললেনঃ ’উমার নিজেই। (বুখারী)
হযরত হুজাইফা রা. থেকে এ ধরণের বর্ণনা পাওয়া যায়। নবুওয়াতের যেসব গোপন কথা তাঁর জানা ছিল তার বেশীল ভাগ ইসলামী রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত। সাহাবীদের মধ্যে তিনি ছাড়া আরো অনেকে এসব গোপন কথা জানতেন। হুজাইফার রা. বর্ণনা থেকে সে কথা জানা যায়। সহীহ মুসলিমে তাঁর থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ ‘আমি বর্তমান সময় হতে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের সকল ফিত্না সম্পর্কে জানি। তবে একথা দ্বারা কেউ যেন না বোঝে যে, আমি ছাড়া আর কেউ বিষয়টি জানতো না। রাসূল সা. এক মজলিসে কথাগুলি বলেছিলেন। ছোট-বড় সকল ঘটনার সংবাদ দিয়েছিলেন। তবে সেই মজলিসে উপস্থিত লোকদের মধ্যে একমাত্র আমি ছাড়া আজ আর কেউ বেঁচে নেই।’ (মুসলিম- ২/৩৯৭)
হযরত হুজাইফা রা. মাঝে মাঝে নিজের এ জ্ঞান কাজে লাগাতেন এবং মুসলিম উম্মাহ্কে তাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে সতর্ক করে দিতেন। একবার ’আমের ইবন হানজালার গৃহে প্রদত্ত এক খুতবায় তিনি বলেনঃ ‘একটি সময়ে কুরাইশরা দুনিয়ার কোন নেক্কার বান্দাহ্কে ছেড়ে দেবে না। তারা সকলকে ফিত্নায় জড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলবে। অতঃপর আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের একটি বাহিনী দিয়ে তাদেরকে একেবারেই নির্মূল করে ফেলবেন।’ লোকেরা বললোঃ আপনি নিজেও তো একজন কুরাইশী। বললেনঃ আমার করার কী আছে? আমি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে এমনই শুনেছি। (মুসনাদ- ৫/৩৯০, ৩৯৫, ৪০৪)
একবার হযরত হুজাইফা বললেনঃ রাসূল সা. আমাদেরকে দু’টি কথা বলেছিলেন। যার একটি আমি দেখেছি, আর অন্যটির প্রতীক্ষায় আছি। এমন এক সময় ছিল যখন আমি যে আমীরের হাতেই বাই’য়াত করতাম, তার ব্যাপারে আমার মধ্যে কোন রকম দ্বিধা-সংকোচ দেখা দিতনা। আমি বিশ্বাস করতাম, তার ব্যাপারে আমার মধ্যে কোন রকম দ্বিধা-সংকোচ দেখা দিতনা। আমি বিশ্বাস করতাম, সে মুসলিম হলে ইসলামের দ্বারা, আর খ্রীস্টান হলে মুসলিম কর্মচারী দ্বারা আমাদেরকে শাসন করবে। কিন্তু এখন আমি বাই’য়াতের ব্যাপারে দ্বিধাবোধ করি। আমার দৃষ্টিতে বাই’য়াতের জন্য যোগ্য ব্যক্তি মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন আছে। আমি কেবল তাদের হাতে বাই’য়াত করতে পারি। (বুখারী)
কিয়ামত সম্পর্কে তিনি একটি আগাম কথা বলে গেছে। তিনি বলেছেনঃ ‘যতদিন প্রতিটি গোত্রের মুনাফিকরা তার নেতা না হবে ততদিন কিয়ামত হবে না।’ (আল-ইসতী’য়াব, আল-ইসাবা- ১/২৭৮) আর একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন্ ফিত্না সবচেয়ে বড়? বললেনঃ যদি তোমার সামনে ভালো ও মন্দ দু’টোই পেশ করা হয় আর তুমি কোন্টি গ্রহণ করবে তা ঠিক করতে না পার, তাহলে সেটাই বড় ফিত্না। (আল-ইসতীয়’য়াবঃ আল-ইসাবা- ১/২৭৮) আর একবার বললেনঃ মানবজাতির জন্য এমন একটা সময় বা কাল আসবে যখন কেউ ফিত্না থেকে মুক্তি পাবে না। শুধু তারাই মুক্তি পাবে যারা পানিতে নিমজ্জমান ব্যক্তির ডাকার মত আল্লাহকে ডাকবে। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫১৭)
তিনি সরাসরি রাসূল সা. ও ’উমার রা. থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (তাহজীবুত তাহজীব- ২/১৯৩) ‘খুলাসা’ গ্রন্থের লেখক তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা এক শো’র (১০০) বেশী বলে উল্লেখ করেছেন। যে সকল সাহাবী তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে খ্যাতিমান কয়েকজনের নামঃ জাবির ইবন আবদিল্লাহ, জুনদুব ইবন ’আবদিল্লাহ আল-বাজালী, ’আবদুল্লাহ ইবন ইয়াযীদ আল-খুতামী, আবুত তুফাইল, ’আলী ইবন আবী তালিব, ’উমার ইবন খাত্তাব প্রমুখ সাহাবী। (উসুদুল গাবা- ১/৩৯০; তাহজীবুত তাহজীব- ২/১৯৩)
তাবে’ঈদের একটি বিরাট দল তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁদের কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা হলোঃ
কায়স ইবন আবী-হাযেম, আবু ওয়ায়িল, যায়িদ ইবন ওয়াহাব, রিব’ঈ ইবন খিরাশ, যার ইবন হুবাইশ, আবু জাবইয়ান, হুসাইন ইবন জুনদুব, সিলা ইবন যুফার, আবু ইদরীস আল-খাওলানী, ’আবদুল্লাহ ইবন ’উকাইম, সুওয়াইদ ইবন ইয়াযীদ নাখ’ঈ, ’আবদুর রহমান ইবন ইয়াযীদ, আবদুর রহমান ইবন আবী লাইলা, হাম্মাম ইবন আল-হারেস, ইয়াযীদ ইবন শুরাইত আত-তাঈমী, বিলাল ইবন হুজাইফা প্রমুখ। (আল-ইসাবা- ১/৩১৮; আয্-যাহাবী, তারীখ- ২/১৫২; তাহজীবুত তাহজীব- ২/১৯৩)
রাষ্ট্রীয় গুরুত্বদায়িত্ব পালনের পর তিনি সময় খুব কম পেতেন। তা সত্ত্বেও যখনই সুযোগ হতো হাদীসের দারস দিতে বসে যেতেন। কূফার মসজিদে দারসের হালকা বসতো এবং তিনি সেখানে হাদীস বর্ণনা করতেন। (মুসনাদ- ৫/৪০৩) জাবির ইবন ’আবদিল্লাহ বলেনঃ হুজাইফা রা. আমাদের বলতেন, আমাদের ওপর এই ইলমের দায়িত্ব চাপানো হয়েছে। আমরা তোমাদের কাছে তো পৌঁছাবো- যদিও তার ওপর আমরা ’আমল না করি। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৬৮; কানযুল ’উম্মাল- ৭/২৪)
ছাত্ররা তাঁকে যেমন অতিরিক্ত ভক্তি ও সম্মান দেখাতো তেমনি ভয়ও পেত। ‘বাশকারী’ একবার মসজিদে এসে দেখেন, গোটা মজলিস সম্পূর্ণ নীরব এবং একই ব্যক্তির দিকে একাগ্রচিত্তে চেয়ে আছে। যেন সকলের মাথা কেটে ফেলা হয়েছে। (মুসনাদ- ৫/৩৮৬) ছাত্ররা যে তাঁকে কী পরিমাণ ভয় ও সম্মানের চোখে দেখতো তা একটি ঘটনা দ্বারা বুঝা যায়। একবার তিনি হযরত ’উমার রা. সম্পর্কিত ফিত্নার হাদীসটি বর্ণনা করলেন। হাদীসটি ছিল গোপন রহস্য বিষয়ক ও ইশারা-ইঙ্গিতে পরিপূর্ণ। কিন্তু তার অর্থ জিজ্ঞেস করার হিম্মত কোন ছাত্রের হলো না। অবশেষে তাঁরা হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদের যোগ্য ছাত্র ‘মাসরূক’ কে হাদীসটির অর্থ জিজ্ঞেস করার জন্য রাজী করান। তিনি তা জিজ্ঞেস করেন।
একবার হযরত হুজাইফা রা. মি’রাজের হাদীস বর্ণনা করেছেন। এমন সময় যার বিন হুবাইশ আসলেন। হুজাইফা বললেনঃ হযরত রাসূলে কারীম সা. বাইতুল মাকদাসের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেননি। যার বললেনঃ রাসূল সা. ভিতরে ঢুকেছিলেন এবং নামাযও আদায় করেছিলেন। হুজাইফা বললেনঃ তোমার নাম কি? আমি তোমাকে চিনি তবে নামটি জানিনে। তিনি নাম বললেনঃ হুজাইফা বললেনঃ রাসুল সা. যে নামায আদায় করেছিলেন, সেকথা তুমি কিভাবে জানলে? যার বললেনঃ কুরআন থেকে। হুজাইফা বললেনঃ আয়াতটি পাঠ কর তো। যার সূরা আল-ইসরার সেই আয়াতটি পাঠ করলেন যাতে মি’রাজের বর্ণনা এসেছে। হুজাইফা বললেনঃ এর মধ্যে নামাযের কথা কোথায় আছে? যার কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে নিজের ভুল স্বীকার করেন। (মুসনাদ- ৫/৩৮৭)
হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি দারুণ সতর্ক ও সংরক্ষণবাদী ছিলেন। আবদুর রহমান ইবন আবী লাইলা বলেনঃ আমরা তাঁর কাছে হাদীস শুনতে চাইলে তিনি বর্ণনা করতেন না। (মুসনাদ- ৫/৩৯৭)
এ কারণে মানুষও সুযোগের অপেক্ষায় থাকতো। যখন কোন ঘটনা ঘটতো, আর তিনি হাদীস বর্ণনা করতেন তখন গোটা সমাবেশকে অতি গুরুত্বের সাথে চুপ করানো হতো। (মুসনাদ- ৫/৩৯৭) একবার তিনি ও আবু মাস’উদ একসাথে ছিলেন। একজন অন্যজনের কাছে হাদীস শুনতে চাইলেন। কিন্তু প্রত্যেকেই বলছিলেন, না, আপনি বলুন। (মুসনাদ- ৫/৪০৭)
তিনি পার্থিব ভোগ-বিলাসের প্রতি ছিলেন দারুণ উদাসীন। এ ব্যাপারে তাঁর অবস্থা এমন ছিল যে, মাদায়েনের ওয়ালী থাকাকালেও তাঁর জীবন যাপনে কোনরূপ পরিবর্তন হয়নি। অনারব পরিবেশ এবং সেইসাথে ইমারাতের পদে অধিষ্ঠিত থাকা- এত কিছু সত্ত্বেও তাঁর কোন সাজ-সরঞ্জাম ছিল না। বাহনের জন্য সব সময় একটি গাধা ব্যবহার করতেন। এমন কি জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাবার ছাড়া কাছে আর কিছুই রাখতেন না। একবার খলীফা হযরত ’উমার রা. তাঁর কাছে কিছু অর্থ পাঠালেন। সাথে সাথে তিনি সবই মানুষের মধ্যে বন্টন করে দিলেন। (উসুদুল গাবা- ১/৩৯২) তবে তিনি দুনিয়া ও আখিরাত সমানভাবে গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বলতেনঃ তোমাদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম নয় যারা আখিরাতের জন্য দুনিয়া ত্যাগ করেছে, আবার তারাও নয় যারা দুনিয়ার জন্য আখিরাত ছেড়ে দিয়েছে। বরং যারা এখান থেকে কিছু এবং ওখান থেকে কিছু গ্রহণ করে তারাই মূলতঃ সবচেয়ে ভালো। (রিজালুন হাওলার রাসূল- ২০০; হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫১৭)
দুনিয়ার প্রতি উদাসীনতার সাথে সাথে ইবাদাত-বন্দেগীতে গভীরভাবে মশগুল থাকতেন। একবার তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সারা রাত নামায আদায় করেন। এর মধ্যে একবারও ‘উহু’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। (মুসনাদ- ৫/৪০০) হুজাইফা রা. বলেনঃ আমি একদিন রাতে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে নামায পড়েছি। তিনি সূরা বাকারাহ দিয়ে শুরু করলেন। ভাবলাম, এক শো আয়াতের মাথায় হয়তো রুকু’ করবে; কিন্তু তার পরেও পড়ে যেতে লাগলেন। মনে করলাম, সূরা বাকারাহ্ এক রাকা’য়াতে শেষ করবেন। কিন্তু না, সূরা নিসা শুরু করলেন। নিসার পর আলে ’ইমরানও শেষ করলেন। তারপরও রুকু’র কোন লক্ষণ দেখা গেল না। বিভিন্ন সূরা পড়তে লাগলেন। কোন তাসবীহর আয়াত তিলাওয়াত করছেন, সাথে সাথে সুবহানাল্লাহ পড়ছেন। দু’আর আয়াত এলে দু’আ করছেন, আবার তা’য়াউজের আয়াত এলে আ’উজুবিল্লাহ পড়ছেন। এক সময় রুকু’তে গেলেন এবং সুবহানা রাব্বীয়াল ’আজীম পড়তে লাগলেন। সে রুকু’র যেন শেষ নেই। তা ছিল কিয়ামের মতই দীর্ঘ। এক সময় ‘সামি’য়া আল্লাহু লিমান হামিদা’ বলে উঠে দাড়ালেন এবং রুকু’র মতই দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর সিজদায় গেলেন এবং তাও ছিল কিয়ামের মত দীর্ঘ। এভাবে নামায শেষ হলে বিষয়টির প্রতি আমি রাসূলুল্লাহর সা. দৃষ্টি আকর্ষন করলাম। তিনি বললেনঃ তুমি যে আমার পিছনে আছ একথা জানতে পেলে আমি নামায সংক্ষেপ করতাম। (মুসনাদ-৫/৩৮২, ৩৮৪; হায়াতুস সাহাবা- ৩/৯১)
সর্ব অবস্থায় সকলকে তিনি আমর বিল মা’রূফ বা ভালো কাজের আদেশ দিতেন। হযরত আবু মূসা আল-আশ’য়ারী রা. ছিলেন একজন উঁচু স্তরের সম্মানিত সাহাবী। তিনি কাপড়ে প্রস্রাবের ছিটা লাগার ভয়ে সতর্কতা স্বরূপ বোতলে প্রস্রাব করা শুরু করেন। হযরত হুজাইফা এ কথা জানতে পেরে তাঁকে বললেনঃ এমন কঠোরতা ঠিক নয়। রাসুল সা. একবার একটি ঘোড়ার ওপর দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করেন। আমিও তখন তাঁর সাথে। আমি একটু দূরে সরে যেতে চাইলে বললেন, কাছেই থাক। আমি তাঁর পিঠের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। (মুসনাদ- ৫/৩৮২)
একবার কিছু লোক এক স্থানে জটলা করে বসে কথা বলছিল। হুজাইফা তাদের কাছে এসে বললেন, রাসূলের সো. সময়ে এমন জটলা করে কথা বলা ‘নিফাকের’ (কপটতা) মধ্যে গণ্য করা হতো। (মুসনাদ- ৫/৩৮৪)
একদিন এক ব্যক্তি মসজিদে এসে খুব তাড়াতাড়ি নামায আদায় করছিল। হযরত হুজাইফা রা. কাছে এসে বললেন, তুমি কতকাল এভাবে নামায আদায় করছো? লোকটি বললোঃ চল্লিশ বছর। হুজাইফা বললেন, তোমার এ চবল্লিশ বছরের নামায একেবারে মিছেমিছি হয়ে গেছে। যদি এভাব নামায আদায় করতে করতে মারা যাও তাহলে সে মরণ দ্বীনে মুহাম্মদীর ওপর হবে না। তারপর তাকে নামাযের নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দিলে বলে, ছোট ছোট সূরাহ পড়, তবে রুকু’-সিজদা ঠিকমত কর। (মুসনাদ- ৫/৩৮৪; কানযুল ’উম্মাল- ৪/২৩০; হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৮০)
একবার এক ব্যক্তিকে মজলিসের মাঝখানে এসে বসতে দেখে তিনি বললেন, রাসূল সা. এমন ব্যক্তির ওপর লা’নত (অভিশাপ) করেছেন। (মুসনাদ- ৫/৩৯৮)
হযরত ’উসমান রা. যখন মদীনায় বিদ্রোহীদের দ্বারা ঘেরাও অবস্থায় আছেন তখন একবার রিব’ঈ হযরত হুজাইফার রা. সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে মাদায়েন আসলেন। হুজাইফা তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করলেন, ’উসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে কারা? রিব’ই কতিপয় লোকের নাম বললেন। তখন তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে শুনেছি, যে ব্যক্তি জামা’য়াত (দল) ছেড়ে দিয়েছে এবং ইমারাত বা নেতৃত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে, আল্লাহর নিকট সে একেবারেই গুরুত্বহীন। (মুসনাদ- ৫/৩৮৭)
সত্যবাদিতা ছিল তাঁর চরিত্রের বিশেষ গুণ। তাঁর ছাত্র হযরত রিব’ঈ যখন হযরত হুজাইফার রা. সূ্ত্রে হাদীস বর্ণনা করতেন তখন বলতেনঃ ‘হাদ্দাসানী মান লাম ইউকাজ্জিব্নী- আমাকে এমন ব্যক্তি এ হাদীস বর্ণনা করেছেন, যিনি আমাকে মিথ্যা বলেননি।’ তাঁর এ কথা দ্বারা লোকেরা বুঝে যেত যে তিনি হুজাইফা ছাড়া আর কেউ নন। (মুসনাদ- ৫/৩৮৫, ৪০১)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. সাথে তাঁর গভীর নৈকট্য ও অন্তরঙ্গতা ছিল। বহু ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার রাসূল সা. তাঁর বুকে ঠেস দিয়ে বসেছিলেন। (মুসনাদ- ৫/৩৮৩) আর একবার ইযারের (পাজামা) সীমা বলতে গিয়ে তাঁর পবিত্র হাত হুজাইফার রা. পায়েল নালা স্পর্শ করেছিল। (মুসনাদ-৫/৩৮২) খন্দকের সেই দুর্যোগপূর্ণ রাতে মুশরিকদের খবর নিয়ে এলে রাসুল সা. নিজের কম্বলের একাংশ তাঁর গায়ে জড়িয়ে দেন, টেনে নিজের কাছে বসান। একরাত নিজের হুজরায় থাকার ব্যবস্থা করেন। (মুসনাদ-৫/৩৯৩) তিনি বিশিষ্ট সাহাবীদের সাথে বসে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে নানা বিষয়ে ইলম বা জ্ঞান অর্জন করতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন ’উমারের রা. একটি বর্ণনা থেকে একথা জানা যায়। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৬৩১)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. সাথে তাঁর কতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তা আরেকটি ঘটনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একবার রমজান মাসে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সাথে নামায আদায় করেন। রাতে রাসূল সা. গোসল করেন। তখন হুজাইফা রা. পর্দা করে দাঁড়ান। কিন্তু পানি বেঁচে গেল এবং তা দিয়ে হুজাইফা গোসল করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে রাসূল সা. অনুমতি দিলেন। তিনি গোসল শুরু করলে রাসূল সা. পর্দা করে দাঁড়ালেন। এতে তিনি আপত্তি জানালে রাসুল সা. বললেনঃ তুমি যেমন আমার পর্দা করেছ, আমিও তেমন তোমার পর্দা করবো (তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/৯৮; হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৮৮)
হযরত হুজাইফা ছিলেন ক্ষমা ও সহনশীলতার মূর্ত প্রতীক। তার পিতাকে যাঁরা ভুলক্রমে হত্যা করেছিল তিনি তাদের প্রতি উত্তেজিত বা তাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেননি; বরং আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে তাদের এ ভুলের মাগফিরাত কামনা করেছেন। হযরত ’উরওয়া ইবন যুবাইর রহ. বলেনঃ ক্ষমা ও সহনশীলতার গুণটি হযরত হুজাইফার রা. মধ্যে আমরণ বিদ্যমান ছিল। (বুখারী- ২/৫৮১)
রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি তাঁর আনুগত্যের অবস্থা যে কেমন ছিল তা বুঝা যায় খন্দক যুদ্ধের ঘটনাটি দ্বারা। সে সময় একজ সাহাবীও শত্রু শিবিরে যেতে সাহস করেনি। কিন্তু তিনি রাসূলের সা. আদেশ পালনের জন্য জীবন বাজি রেখে সেখানে যান এবং জান্নাতের সুসংবাদ লাভ করেন।
একবার পথে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে তাঁর দেখা হলো। রাসুল সা. হাত মিলানোর জন্য তাঁর দিকে এগিয়ে গেলে তিনি বললেন, আমি অপবিত্র। রাসুল সা. বললেনঃ মুমিন ব্যক্তি কখনো নাজাস বা অপবিত্র হয়না। (মুসনাদ- ৫/৩৮৪) অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সা. বলেনঃ একজন মুসলিম যখন তার ভাইয়ের সাথে হাত মেলায় তখন তাদের দু’জনের গুনাহ গাছের শুকনো পাতার মত ঝরে পড়ে। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৪৯৫) হযরত রাসূলে কারীমের সা. সাথে যখন তাঁর আহার করার সৌভাগ্য হতো, তিনি কখনো আগে শুরু করতেন না। রাসুল সা. আগে শুরু করতেন। (মুসনাদ- ৫/৩৮৩)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. সাহচর্যে যে দিন আসতেন সেদিন যুহর, ’আসর, মাগরিব ও ’ইশার নামায তার সাথে আদায় করতেন। মাঝের এ সময়টুকু সুহবতের সৌভাগ্য অর্জন করতেন। (মুসনাদ- ৫/৩৯২) যখনই সময় ও সুযোগ পেতের রাসূলুল্লাহর সা. খিদমাত করতেন এবং ওযু-গোসলের পানি এগিয়ে দিতেন। তিনি বর্ণনা করেছেনঃ একদিন রাসুল সা. ময়লা-আবর্জনা ফেলার স্থলে দাঁড়িয়ে পেশাব করলেন। তারপর আমার কাছে পানি চাইলেন। আমি পানি এগিয়ে দিলে তিনি ওযু করে মোযার ওপর মাসেই করলেন। (মুসনাদ- ৫/৩৮২) তিনি এ খবরও দিয়েছেন যে, রাসূল সা. রাতে যখন নামাযের জন্য উঠতেন তখন মিসওয়াক করতেন। (মুসনাদ- ৫/৩৮২) এ সকল বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় তিনি সময় ও সুযোগ পেলে সব সময় রাসূলুল্লাহর সা. আশে-পাশে থাকতেন।
একদিন হুজাইফার রা. সম্মানিত মা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, কতদিন তুমি রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে যাওনি? ছেলে সময়-সীমা বলার পর তিনি ক্ষেপে গিয়ে তাকে বকাঝকা করেন। তখন হুজাইফা মাকে বলেন, মা, আপনি থামুন। আমি আজই মাগরিবের নামায রাসূলুল্লাহর সা. আদায় করছি এবং তাঁর দ্বারা আমার ও আপনার মাগফিরাত কামনা করে দু’আ করাচ্ছি। তিনি রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে গেরেন এবং নামায আদায় করলেন। নামায শেষ করে রাসূল সা. বের হলেন। হুজাইফাও পিছনে পিছনে চলতে লাগলেন। এক সময় রাসুল সা. ঘাড় ফিরিয়ে তাঁকে দেখে বলে উঠলেনঃ কে, হুজাইফা? আল্লাহ তোমাকে ও তোমাকে মাকে ক্ষমা করুন। (মুসনাদ- ৫/৩৯১; তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/৯৫)
হযরত হুজাইফা খুব কমই উত্তেজিত হতেন। তবে শরী’য়াতের হুকুম যথাযথভাবে পালিত হতে না দেখলে তাঁর রোগের কোন সীমা থাকতো না। শরী’য়াতের বিন্দুমাত্র এদিক ওদিক হওয়া সহ্য করতেন না। মাদায়েনে থাকাকালে একবার এক রয়িসের (সর্দার) গৃহে পানি চাইলেন। রয়িস রূপোর পাত্রে পানি দিলে তিনি ভীষণ ক্ষেপে যান। পাত্রটি রয়িসের হাত থেকে নিয়ে তার গায়ে ছুড়ে মারেন। তারপর বলেন, আমি কি তোমাকে সতর্ক করে দিইনি যে, রাসুল সা. সোনা-রূপোর পাত্রের ব্যবহার নিষেধ করেছেন?
এমনিভাবে তিনি সুন্নাতের হেরফের হওয়া বিন্দুমাত্র পসন্দ করতেন না। একবার বনী উসাইদের আযাদকৃত দাস আবু সা’ঈদ কিছু খাবার তৈরী করে আবু যার, হুজাইফা ও ইবন মাস’উদকে দা’ওয়াত দিলেন। তিনজন যখন তাঁর বাড়ী পৌঁছলেন তখন নামাযের সময় হয়েছে। আবু যার ইমামতির জন্য এগিয়ে গেলে হুজাইফা বলে উঠলেনঃ আবু যার পিছনে সরে এসো। ইমামতির অগ্রাধিকার গৃহকর্তার। আবু যার বললেনঃ ইবনে মাস’উদ, কথাটি কি সত্যি? ইবন মাস’উদ বললেনঃ হাঁ। আবু যার পেছনে সরে এলেন। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৩১)
জাহিলী আরবে কারো মৃত্যু হলে তা খুব ঘটা করে প্রচার করা হতো। রাসুল সা. এমনটি করতে নিষেধ করেন। হযরত হুজাইফা এত কঠোরভাবে তা পালন করতেন যে, কেউ মারা গেলে কাউকে সে খবরটি পর্যন্ত দিতে চাইতেন না। তিনি ভয় করতেন, সেই আগের অবস্থায় আবার ফিরে না আসে। (মুসনাদ- ৫/৪০৬)
তিনি নির্জনতা পসন্দ করতেন, কিন্তু সেভাবে থাকতে পারতেন না। তিনি বলতেনঃ আমার ইচ্ছা হয়, বিষয়-সম্পদ দেখা-শুনার মত কেউ থাকলে আমি ঘরের দরযা বন্ধ করে দিতাম। তাহলে কেউ আমার কাছে ঘেঁষতে পারতো না এবং আমিও মানুষের কাছে যেতাম না। আর এভাবে আমি আল্লাহর সাথে মিলিত হতাম। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৪৯)
তিনি ঝগড়া-বিবাদ, পরনিন্দা, দোষ অন্বেষণ, রক্তপাত ইত্যাদি ধরণের খারাপ কাজ খুবই ঘৃণা করতেন। একবার তিনি এক ব্যক্তিকে বললেনঃ তুমি কি একজন মস্তবড় পাপীকে হত্যা করতে পারলে খুশী হবে? সে বললোঃ হাঁ। তিনি বললেনঃ তাহলে তুমি হবে তখন তার চেয়েও বড় পাপাচারী। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৪০৮) এক ব্যক্তি খলীফা হযরত ’উসমানের রা. কাছে মানুষের নানা কথা পৌঁছে দিত। লোকটি একদিন যখন হুজাইফার রা. সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন লোকেরা বললেঃ এ ব্যক্তি আমীরের নিকট সকল সংবাদ পৌঁছে দেয়। তিনি বললেনঃ এমন লোক জান্নাতে যেতে পারে না। (মুসনাদ- ৫/৩৮৯)
যায়িদ ইবন ওয়াহাব বলেনঃ একবার একটি ব্যাপারে কোন এক আমীরের প্রতি মানুষ ক্ষেপে গেল। হযরত হুজাইফা মসজিদে দারস দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি মানুষের ভীড় ঠেলে হুজাইফার রা. মাথার কাছে এসে দাড়িয়ে বললোঃ ‘হে রাসূলুল্লাহর সাহাবী! আপনি কি মানুষকে ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবেন না? হুজাইফা রা. লোকটির উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন। তিনি মাথা সোজা করে তাকে বললেনঃ ’আমর বিল মা’রূফ ও নাহি ’আনিল মুনকার অতি ভালো কাজ- এতে সন্দেহ নেই। তবে এ জন্য আমীরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ সুন্নাত সম্মত নয়। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৬)
তিনি সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে মিষ্টি-মধুর আলাপ করতেন। কিন্তু বাড়ীতে স্ত্রীর সাথে কথাবার্তায় ছিলেন একটু কর্কশ। বিষয়টি তিনি নিজেই উপলব্ধি করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, ‘আমি নবীর সা. কাছে এসে বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার একটি জিহবা আছে, আমার স্ত্রীর প্রতি তা বড় কঠোর। ভয় হচ্ছে, তা আমাকে জাহান্নামে নিয়ে না যায়। রাসূল সা. বললেনঃ তুমি আল্লাহর কাছে ইসতিগ্ফার (ক্ষমা চাওয়া) করনা কেন? এই যে আমি, প্রতিদিন শতবার আল্লাহর কাছে ইসতিগফার করি। (রিজালুন হাওলার রাসুল- ১৯৬; হায়াতুস সাহাবা- ৩/৩১৬)
একবার লোকেরা বললো, আপনি রাসূলুল্লাহর সা. এমন একজন সাহাবীর নাম বলুন যিনি চলন-বলন, আকীদা-বিশ্বাস, তথা প্রতিটি বিষয়ে আপনার মত। বললেনঃ এমন ব্যক্তি শুধূ ইবন মাস’উদ। তবে যতক্ষণ তিনি ঘরের বাইরে থাকেন। ঘরের ভিতরের অবস্থা আমার জানা নেই। (মুসনাদ- ৫/২৮৯, ৩৯৪)
হযরত ’আলী রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসুল সা. বলেছেনঃ ‘আমার পূর্বের নবীদেরকে সাতজন উযীর ও বন্ধু দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমাকে দেওয়া হয়েছে চৌদ্দজন।’ এই বলে তিনি চৌদ্দ জনের নাম উচ্চারণ করেন। তাদের মধ্যে হুজাইফার নামটিও ছিল। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ৪/৯৬)
তিনি সব সময় হিংসা-বিদ্বেষের উর্ধে থাকার চেষ্টা করতেন। কারো সাথে কোন রকম তিক্ততার সৃষ্টি হলে তাড়াতাড়ি মিটমাট করে নিতেন। ’আকাবায় অংশগ্রহণকারী কোন এক সাহাবীর সাথে একটি ব্যাপারে তাঁর তিক্ততার সৃষ্টি হয়। তাদের কথা বলাবলি বন্ধ হয়ে যায়। হযরত হুজাইফা রা. সবকিছু ভুলে প্রথমে তাঁর সাথে কথা বলেন। তারপর সে সাহাবীও নিজের আচরণে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হন। (মুসনাদ- ৫/৩৯০)
তিনি ছিলেন খুবই সামাজিক ও উদার। খাওয়ার সময় কেউ উপস্থিত হলে তাকেও ডেকে সংগে বসাতেন। (মুসনাদ- ৫/৩৯২)
হযরত রাসূলে কারীম সা. অন্তিম রোগ শয্যায় শায়িত। সাহাবীরা তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী একজন খলীফা নিয়োগ করে যাওয়ার আবেদন জানান। তিনি তাদের সে আবেদন প্রত্যাখ্যাত করে যে সব উপদেশ দান করেন তার মধ্যে এ কথাটিও ছিলঃ ‘হুজাইফা তোমাদেরকে যা বলবে তা মেনে নিবে।’ (তারীখু ইবন ’আসাকির- ৪/৯৬)
খলীফা হযরত ’উসমান রা. পবিত্র কুরআনের যে স্ট্যান্ডার্ড কপি তৈরী করেন এবং খিলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠান, তার নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা পালন করেন মূলত” হযরত হুজাইফা রা.। ইমাম বুখারী হযরত আনাসের রা. একটি বর্ণনা নকল করেছেন। আনাস বলেন, ‘হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান সিরিয়াবাসীদের সাথে ইরাক, আরমেনিয়া ও আজারবাইজান অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। তিনি এ সকল এলাকার নবদীক্ষিত অনারব মুসলিমদের কুরআন পাঠে তারতম্য লক্ষ্য করে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। সেখান থেকে মদীনায় ফিরে খলীফাকে বললেন, ‘আমি আরমেনিয়া ও আজারবাইজানের লোকদের দেখেছি, তারা সঠিকভাবে কুরআন পড়তে জানেনা। তাদের কাছে কুরআনের স্ট্যান্ডার্ড কপি পৌঁছাতে না পারলে ইয়াহুদ ও নাসারার হাতে তাওরাত ও ইনজীলের যে দশা হয়েছে, এ উম্মতের হাতে কুরআনের দশাও অনুরূপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ খলীফা বিশিষ্ট সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ‘মাসহাফ’ এনে তার হুবহু নকল করে বিভিন্ন এলাকায় প্রচার করেন। এভাবে পবিত্র কুরআনের হিফাজতের ব্যাপারে হযরত হুজাইফা রা. পরোক্ষভাবে বিরাট অবদান রাখেন। (দ্রঃ সহীহ বুখারীঃ জাম’উল কুরআন অধ্যায়; আত-তিব ইয়ান ফী উলুমিল কুরআন- ৫৭)
উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ ও গুণাবলীর কারণে হযরত ’উমার রা. তাঁকে খুব সম্মান করতেন। যেহেতু হুজাইফা রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে মুনাফিকদের নাম জেনেছিলেন, তাই সকলে এ ব্যাপারে তাঁরই শরণাপন্ন হতেন। খলীফা ’উমারের রা. তো অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল কোন মুসলমান মারা গেলে এ কথা জিজ্ঞেস করা যে, হুজাইফা কি এর জানাযায় শরীক হয়েছে? যদি বলা হতো ‘হ্যাঁ’ তাহলে তিনিও পড়তেন। আর যদি বলা হতো ‘না’ তাহলে তাঁর সন্দেহ হতো এবং তিনি তার জানাযা পড়তেন না। (উসুদুল গাবা- ১/৩৯১; শাজারাতুজ জাহাব- ১/৪৪)
একবার খলীফা ’উমার রা. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ আচ্ছা আমার কর্মকর্তাদের মধ্যে কি কোন মুনাফিক আছে? হুজাইফা বললেনঃ একজন আছে। খলীফা বললেনঃ আমাকে তার একটু পরিচয় দাও না। বললেনঃ আমি তা দেব না। হুজাইফা বলেনঃ তবে অল্প কিছু দিনের মধ্যে ’উমার তাকে বরখাস্ত করেন। সম্ভবতঃ তিনি সঠিক হিদায়াত পেয়েছিলেন। (সুওয়ারুন মিন হায়াতিস সাহাবা- ৪/১৩৬-১৩৭)
হুজাইফা রা. বলেনঃ আমি একদিন মসজিদে বসে আছি। ’উমার রা. আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললেনঃ হুজাইফা, অমুক মারা গেছে, তার জানাযায় চলো। একথা বলে তিনি চলে গেলেন। মসজিদ থেকে বের হতে যাবেন, এমন সময় পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখেন, আমি নিজ স্থানে বসে আছি। তিনি বুঝতে পেরে আমার কাছে ফিরে এসে বললেনঃ হুজাইফা, আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, সত্যি করে বল তো আমিও কি তাদের (মুনাফিকদের) একজন? আমি বললামঃ নিশ্চয়ই না। আপনার পরে আর কাউকে কক্ষণো আমি এমন সনদ দেব না। (তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/৯৭; যাহাবীঃ তারীখ- ২/১৫৩)
একবার খলীফা হযরত ’উমার রা. তাঁর পাশে বসা সাহাবীদের বললেন, আচ্ছা আপনারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার কথা একটু বলুন তো! প্রায় সকলেই বললেন, আমাদের একান্ত ইচ্ছা এই যে, আমরা যদি ধন-রত্নে ভরা একটি ঘর পেতাম, আর তার সবই আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিতে পারতাম। সবার শেষে ’উমার রা. বললেন, আমার বাসনা এই যে, আমি যদি আবু ’উবাইদাহ, মুয়াজ ও হুজাইফার রা. মত মানুষ বেশী বেশী পেতাম, আর তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব অর্পণ করতে পারতাম। একথা বলে তিনি দীনার ভর্তি একটি থলে একজন লোকের হাতে দিয়ে বলেন, এগুলি হুজাইফার নিকট নিয়ে যাও, আর তাকে বল, খলীফা এগুলি আপনার প্রয়োজনে খরচের জন্য পাঠিয়েছেন। তাকে আরো বলে দেন, তুমি একটু অপেক্ষা করে দেখে আসবে, সে দীনারগুলি কি করে। লোকটি থলেটি নিয়ে হুজাইফার নিকট গেল। আর হুজাইফা সাথে সাথে তা গরীব-মিসকীনের মধ্যে বন্টন করে দিলেন। (দ্রঃ তারীখু ইবন ’আসাকির- ১/৯৯, ১০০; উসুদুল গাবা- ১/৩৯২; হায়াতুস সাহাবা- ২/২৩৩)
হযরত হুজাইফার রা. এমনি ধরণের অনেক ফজীলাত ও মহত্বের কথা বিভিন্ন গ্রন্থে ছড়িয়ে আছে যা ছোট কোন প্রবন্ধে প্রকাশ করে শেষ করা যাবে না।

তথ্যসূত্র
১. ইবন হিশামঃ আস-সীরাহ্,
২. ইবন সা’দঃ আত-তাবাকাত,
৩. ইবনুল আসীরঃ
- উসুদুল গাবা,
- তাজরীদ আসমা আস-সাহাবা,
- আল-কামিল ফিত তারীখ,
৪. ইবন ’আসাকিরঃ আত-তারীখ আল-কাবীর,
৫. ইবন হাজারঃ
- আল-ইসাবা
- তাকরীব আত-তাহজীব,
- লিসানুল মীযান,
৬. বালাজুরীঃ আনসাবুল আশরাফ,
৭. ইবনুল ’ইমাদ আল-হাম্বলীঃ শাহজারাতুয্ যাহাব ফী-মান যাহাব,
৮. মুহীউদ্দীন আন-নাওয়াবীঃ তাহজীবুল আসমা ওয়াল লুগাত,
৯. আবুল ফারাজ আল-ইসফাহানীঃ কিতাবুল আগানী,
১০. ইবনুল জাওযীঃ সিফাতুস সাফওয়া,
১১. আজ-জাহাবীঃ
- তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ,
- তারীখুল ইসলাম ওয়া তাবাকাত
- আল-মাশাহীর ওয়াল আ’লাম,
১২. ইয়াকুত আল-হামাবীঃ মু’জামুল বুলদান,
১৩. আল-কুরতুবীঃ আল-ইসতী’য়াব (আল-ইসাবার পার্শ্বটীকা),
১৪. শাহ্ ওয়ালীউল্লাহঃ ফিকহু ’উমার (উর্দু),
১৫. মুহাম্মদ আলী আস-সাবুনীঃ আত-তিবইয়ান ফী ’উলুমিল কুরআন,
১৬. আয্-যিরিক্লীঃ আল-আ’লাম,
১৭. ইউসুফ কান্ধালুবী, মাওলানাঃ হায়াতুস সাহাবা, (আরবী)
১৮. খালিদ মুহাম্মাদ খালিদঃ রিজালুন হাওলার রাসূল,
১৯. ডঃ রাফাত আল-বাশাঃ সুওয়ারুন্ মিন হায়াতিস সাহাবা,
২০. আবদুর রউফ, মাওলানাঃ আসাহ আস্-সীয়ার,
২১. সা’ঈদ আনসারী, মাওলানাঃ সীয়ারে আনসার,
২২. ডঃ ’উমার ফাররুখঃ তারীকুল আদাব আল ’আরাবী,
২৩. জুরযী যায়দানঃ তারীখু আদাব আল-লুগাহ্ আল-’আরাবিয়্যা,
২৪. ইমাম আহমাদঃ আল মুসনাদ
২৫. দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা (উর্দু)
২৬. মুহাম্মাদ খিদরী বেকঃ তারীখুল উম্মাহ্ আল-ইসলামিয়্যা,
২৭. আবদুর রহমান আল-বান্নাঃ আল-ফাতহুর রাব্বানী (শারহুল মুসনাদ)
২৮. হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থ।

 


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি