হজ্জের অধ্যায়
হজ্জের বিবরণ
হজ্জ ইসলামের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। হজ্জের একটা ঈমান উদ্দীপনা ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। এর প্রতি লক্ষ্য না রাখলে হজ্জের মহত্ব, তাৎপর্য ও মূল উদ্দেশ্যে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। কুফর ও শিরক পরিবেশিত এক শক্তিশালী পরিবেশে এক মুমিন বান্দাহ খালেস তাওহীদের ঘোষণা করেন। তারপর বাতিল যালেম শক্তির চরম বাধা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ঈমান, তাকওয়া, ইখলাস, লিল্লাহিয়াত, এশক ও মহব্বত, ত্যাগ ও কুরবানী নির্ভেজাল নিরঙ্কুশ আল্লাহর আনুগত্য ও পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের নজিরবিহীন প্রেরণা ও আমলের দ্বারা ইসলামের পূর্নাঙ্গ ইতিহাস তৈরী করেন এবং তাওহীদ ও এখলাসের এমন এক কেন্দ্র তৈরী করেন যা দুনিয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার থেকে বিশ্ব মানবতা তাওহীদের পয়গাম পেতে থাকবে।

এ ইতিহাসকে নতুন করে স্মরণ করার জন্যে এবং মানুষের মনে আবেগ উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করার জন্যে প্রতি বছর দূরদূরান্ত থেকে তাওহীদের প্রেম পাগল পতঙ্গসমূহ ঐ কেন্দ্রে জমায়েত হয়ে ঐসব কিছুই করে যা তাদের নেতা ও পথ প্রদর্শক হযরত ইবরাহীম (আ) করেছিলেন। তারা কখনো দু খন্ড কাপড় পরিধান করে আবেগ উচ্ছ্বাসে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে এবং কখনো সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে তাদেরকে দৌড়াতে দেখা যায়। কখনো আরাফাতের ময়দানে দাড়িয়ে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করে এবং কখনো কুরবানীগাহে পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে আল্লাহর সাথে মহব্বতের শপথ গ্রহণ করে। উঠতে বসতে চলতে ফিরতে সকাল সন্ধ্যায় তাদের এ একই ধ্বনিতে হেরেমের গোটা পরিবেশ গুঞ্জরিত হতে থাকে আয় আল্লাহ! তোমার দরবারে তোমার গোলাম হাজির আছে। প্রশংসা ও স্তুতি একমাত্র তোমারই, দয়া করা তোমারই কাজ, তোমার প্রভুত্ব কর্তৃত্বের কেউ শরীক নেই।

প্রকৃতপক্ষে এসব অবস্থা সৃষ্টি করার এবং নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর ওপর সোপর্দ করারই নাম হজ্জ।

হজ্জের অর্থ

হজ্জের আভিধানিক অর্থ হলো যিয়ারতের এরাদা করা। শরীয়াতের পরিভাষায় হজ্জের অর্থ হলো সেই সার্বিক ইবাদাত যা একজন বায়তুল্লাহ পৌঁছে করে থাকে। যেহেতু হজ্জে মুসলমান আল্লাহর ঘরের যিয়ারতের এরাদা করে সে জন্যে একে হজ্জ বলা হয়।

হজ্জ একটি সার্বিক ইবাদাত

ইসলামী ইবাদাত দুই প্রকারের। এক – দৈহিক ইবাদত যেমন নামাজ, রোজা। দুই – মালের ইবাদত, যেমন সদকা যাকাত দান খয়রাত ইত্যাদি। হজ্জের বৈশিষ্ট্য এই যে, এ মালেরও ইবাদত এবং দেহেরও ইবাদত। অন্যান্য স্থায়ী ইবাদতগুলোর দ্বারা এখলাস, তাকওয়া, বিনয়, নম্রতা, বন্দেগীর পিপাসা। আনুগত্য, কুরবানী, ত্যাগ, আত্মসর্মপন, আল্লাহর নৈকট্য প্রভৃতির যে, প্রেরণা ও ভাবাবেগ পৃথক পৃথকভাবে বিকাশ লাভ করে, হজ্জের সার্বিকতা এই যে, এ সকল অনুভূতি ভাবাবেগ ও মানসিক অবস্থা একই সময়ে এবং একই সাথে তৈরী হয় ও বিকাশ লাভ করে।

যে নামাজ দ্বীনের উৎস, তা কায়েম করার জন্য যমীনের উপর যে সর্বপ্রথম মসজিদ তৈরী করা হয়, হজ্জে মুমিনগণ সে মসজিদের চারপাশে ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে তওয়াফ করে। সারা জীবন দূরদূরান্ত থেকে যে মসজিদের দিকে মুখ করে মুসলমান নামাজ পড়ে, হজ্জে তার এ সৌভাগ্য হয় যে, সে ঐ মসজিদে দাড়িয়ে নামাজ সমাধা করে।

যে রোজা মন ও চরিত্রের সংশোধনের উপযোগী ও অনিবার্য উপায় এবং যে রোজায় একজন মুমিন প্রবৃত্তির কামনা বাসনা থেকে দূরে থেকে ধৈর্য্য ও সহনশীলতায় শক্তি লাভ করে ও আল্লাহর সিপাহী ও মুজাহিদ হওয়ার অভ্যাস করে।

হজ্জে ইহরাম বাধার সময় থেকে ইহরাম খোলা পর্যন্ত ঐরূপ সংগ্রাম সাধনায় দিনরাত কাটিয়ে দেয়, মন থেকে এক একটা চিত্র মুছে ফেলে দিয়ে আল্লাহর মহব্বতের চিত্র অংকিত করে। দীন রাত তাওহীদের ধ্বনি উচ্চারিত করে শুধু মাত্র তওহীদের পতাকাবাহী হয়ে যায়।

সদকা ও যাকাতে নিজের প্রিয় ধনসম্পদ দান করে মুমিন বান্দাহ ধনলিপ্সার প্রবণতা মুছে ফেলে আল্লাহর প্রেমের বীজ বপন করে । হজ্জেও লোক তার সারাজীবনের সঞ্চিত ধন শুধু আল্লাহর মহব্বতে মুক্ত হস্তে দান করে এবং তার পথে কুরবানী করে তার সাথে কৃত ওয়াদা চুক্তি পূরণ করে। মোটকথা, হজ্জের দ্বারা আল্লাহর সাথে প্রেমপূর্ন সম্পর্ক, মন, চরিত্রের সংশোধন এবং আধাত্নিক উন্নতির সকল উদ্দেশ্য একই সাথে পূর্ণ হয়। তবে শর্ত এই যে, হজ্জ শুধু মাত্র যেন হজ্জের অনুষ্ঠান পালনের কাজ না হয়।

হজ্জের হাকীকত

হজ্জের হাকীকত বা মর্মকথা এই যে, ব্যক্তি তার নিজেকে পরিপূর্ণরূপে তার প্রভুর হাতে সোপর্দ করে দেবে এবং একনিষ্ঠ মুসলমান হয়ে যাবে। আসলে আল্লাহ তায়ালার পাত সত্তা থেকে এ শক্তি আশা করা যায় যে, সংস্কার সংশোধনের সকল প্রকার নির্ভরযোগ্য প্রচেষ্টা সত্বেও বান্দাহর জীবনে যেসব ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে যায় তা হজ্জের করনীয় কাজগুলো এবং হজ্জের স্থানগুলোর বরকতে দূর হয়ে এবং সে হজ্জের মাধ্যমে এমন পাক সাফ হয়ে ফিরে আসবে যেন সে আজই জন্ম গ্রহণ করেছে। সেই সাথে প্রকৃত অবস্থার একটা কষ্টিপাথর ও বটে। অর্থাৎ কার হজ্জ প্রকৃত হজ্জ এবং কে হজ্জের সকল আরকান পালন এবং বায়তুল্লাহ জিয়ারত করা সত্ত্বেও বঞ্চিত রয়ে গেছে। আর এটাও সত্য যে, হজ্জের তাওফীক লাভ করা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি নিজেকে সংশোধন করা থেকে বঞ্চিত থাকে, তার সম্পর্কে খুব কম আশাই করা যেতে পারে যে, অন্য কোনো উপায়ে তার সংশোধন হতে পারবে। এজন্য হজ্জ পালনকারীর জন্য এটা অত্যন্ত জরুরী যে, সে যেন তার আবেগ অনুভূতি ও কামনা বাসনার পর্যালোচনা করে এবং এবং হজ্জের এক একটি রুকন আমল পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও অনুভূতির সাথে আদায় করে হজ্জের সেসব ফায়দা হাসিল করে যার জন্য ফরয করা হয়েছে।

হযরত জুনাইদ বাগদাদী (রহ) এর কাছে এক ব্যক্তি হাজির হলো যে, বায়তুল্লাহ যিয়ারত করে (হজ্জ করে) ফিরে এসেছে কিন্তু তার জীবনের উপর হজ্জের কোন ছাপ দেখতে পাওয়া যায়নি। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কোথা থেকে এসেছ? সে বললো আমি বায়তুল্লাহর হজ্জ করে আসছি।

হযরত জুনাইদ (র) খুব আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন। তুমি হজ্জ করেছ নাকি ?

মুসাফির –জি হ্যাঁ, আমি হজ্জ করেছি।

হযরত – যখন তুমি হজ্জের জন্য ঘর-বাড়ী ছেড়ে বের হয়েছিলে, তখন তুমি গোনাহ থেকে দূরে ছিলে কি না ?

মুসাফির – হযরত আমি এভাবে চিন্তা করেনি।

হযরত – তাহলে তুমিতো হজ্জের জন্য মোটেও বের হওনি। আচ্ছা বলোতো তুমি এ পবিত্র ছফরে তুমি যেসব মনযিল অতিক্রম করেছ এবং যেখানে যেখানে রাত কাটিয়েছে তখন তুমি কি আল্লাহর নৈকট্য লাভের মনযিলগুলোও অতিক্রম করেছ কি না ?

মুসাফির – হযরত, আমারতো এসব খেয়ালই হয়নি।

হযরত – তাহলে তুমি তো না বায়তুল্লাহর দিকে কোনো সফর করেছ। আর না সেদিকে কোন মনযিল অতিক্রম করেছ। আচ্ছা বল তো তুমি যখন ইহরাম বাধলে এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের পোশাক খুলে ফেললে তখন তার সাথে সাথে তোমার মন্দ স্বভাব ও অভ্যাসগুলো তোমার জীবন থেকে দূরে নিক্ষেপ করলে কিনা?

মুসাফির- হযরত, এভাবে তো আমি চিন্তা করে দেখিনি।

হযরত জুনাইদ তখন খুব দুঃখ করে বললেন। তাহলে তুমি ইহরামই বা বাধলে কোথায়? আচ্ছা বলত যখন তুমি আরাফাতের ময়দানে দাড়ালে তখন কিছু মুশাহাদার অনুভূতি হয়েছিল কি?

মুসাফির- হযরত, এর অর্থই বুঝলাম না

হযরত -তার অর্থ এই যে, আরাফাতের ময়দানে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করার সময় তুমি তোমার মধ্য এ অবস্থা কি অনুভব করেছ যে, তোমার রব তোমার সামনে এবং তুমি তাকে দেখছ?

মুসাফির- হযরত, এ অবস্থা তো আমার হয়নি।

হযরত – তাহলে তুমি তো আরাফাতে পৌঁছাওনি। আচ্ছা তারপর বল দেখি, মুযদালাফায় পৌছার পর তোমার প্রবৃত্তির কামনা বাসনা পরিহার করেছ কিনা?

মুসাফির- হযরত, আমি এ বিষয় তো কোনো মনোযোগ দেইনি।

হযরত তাহলে তুমি তো মুযদালাফাও যাওনি। আচ্ছা, বল দেখি, বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করার সময় আল্লাহ তায়ালার সৌন্দর্যের জ্যোতি ও অলৌকিক শক্তি লক্ষ্য করেছ কি?

মুসাফির- হযরত আমি এর থেকে বঞ্চিত ছিলাম।

হযরত -তাহলে তুমি মোটেই তাওয়াফ করনি। আচ্ছা, তারপর তুমি যখন সাফা মারওয়ার মাঝে সায়ী করলে তখন সাফা মারওয়া ও তার মধ্যে সায়ী করার হিকমত, মর্মকথা ও তার উদ্দেশ্যে হাসিল করেছ কি?

মুসাফির এসবের তো কোনো অনুভূতিই আমার ছিল না।

হযরত-তাহলে তুমি বলতে গেলে সায়ীও করনি। তারপর তুমি কুরবানগাহে গিয়ে যে কুরবানী কররে, তখন তুমি তোমার প্রবৃত্তি ও তার কামনা বাসনাকেও কুরবানী করেছ কি?

মুসাফির- হযরত এদিক আমি লক্ষ্যই করিনি।

হযরত – তাহলে তুমি কুরবানীই বা করলে কোথায়? আচ্ছা বল দেখি, তুমি জমরাতে পাথর মারলে, তখন তুমি তোমার অসৎ সহকর্মী, সাথী ও কুপ্রবৃত্তিকেও তোমার কাছ থেকে দূরে নিক্ষেপ করেছ কি?

মুসাফির- তাতো করিনি।

হযরত – তাহলে তুমি রামীও করোনি।

তারপর হযরত জুনাইদ বাগদাদী (র) বড় দুঃখের সাথে বলেন, যাও ফিরে যাও এবং এরূপ মনে অবস্থাসহ আবার হজ্জ কর। যাতে করে হযরত ইবরাহীম (আ ) এর সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হয় যার ঈমান ও ওয়াদা পালনের স্বীকৃতি করতে গিয়ে কুরআন এ সাক্ষ্য দেয়-

*******আরবী*********

এবং তিনি ইবরাহীম (আ ) যিনি তার রবের সাথে কৃত ওয়াদা পূরণের হক আদায় করেছেন।

হজ্জের মহত্ব ও গুরুত্ব

কুরআন ও সুন্নাতে হজ্জের হিকমত, দীনের মধ্যে হজ্জের মর্যাদা, তার মহত্ব ও গুরুত্বের ওপর বিশদভাবে আলোকপাত করা হয়েছ। কুরআন বলে

*******আরবী*********

মানুষের ওপর আল্লাহর এ অধিকার যে, বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছাবার শক্তি সামর্থ্য যে রাখে সে যেন হজ্জ করে এবং যে এ নির্দেশ অমান্য করে কুফরের আচরণ করবে তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ বিশ্ব প্রকৃতির ওপর অবস্থানকারীদের মুখাপেক্ষী নন। (সূরা আলে ইমরানঃ ৯৭)

১. হজ্জ বান্দাহর ওপর আল্লাহর হক। যারই বায়তুল্লাহ পর্যন্ত যাবার শক্তি সামর্থ্য রাখে, তাদের জন্যে আল্লাহর হক আদায় করা ফরয। যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করে না, সেসব যালেম আল্লাহর হক নষ্ট করে। আয়াতের এ কথার দ্বারা হজ্জ ফরয হওয়া প্রমাণিত হয়। বস্তুত হযরত আলী (রা) এর বয়ান থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, নবী (স) এর পক্ষ থেকে হজ্জ ফরয হওয়ার ঘোষণা তখনই করা হয় যখন এ আয়াত নাযিল হয়। (তিরমিযি-কিতাবুল হজ্জ)

এ অর্থে সহীহ মুসলিমেও একটি রেওয়ায়েত আছে, যাতে নবী (স) বলেন-

হে লোকেরা! তোমাদের ওপর হজ্জ ফরয করা হয়েছে। অতএব হজ্জ আদায় কর।

২. আর একটি গুরুত্বপূর্ণ যে সত্যের প্রতি এ আয়াত দৃষ্টি আকৃষ্ট করে তা হচ্ছে এই যে, সামর্থ্য থাকা সত্বেও হজ্জ না করা কুফরী আচরণ, যেমন বলা হয়েছে। ঠিক যেভাবে কুরআনে নামায ত্যাগ করাকে এক স্থানে মুশরিকী কার্যকলাপ বলা হয়েছেঃ

*******আরবী*********

এবং নামায কায়েম কর এবং (নামায ত্যাগ করে) মুশরিকদের মধ্যে শামিল হয়ো না।

ঠিক তেমনি আলোচ্য আয়াতের এ স্থানে হজ্জ না করাকে কুফরী আচরণ বলা হয়েছে। নবী (স) ইরশাদ করেন-

যে ব্যক্তির কাছে হজ্জের জরুরী খরচের অর্থ সামগ্রী মওজুদ আছে, যানবাহন আছে যার দ্বারা সে বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌছাতে পারে, তারপর সে হজ্জ করে না তাহলে সে ইহুদী হয়ে মরুক অথবা খৃষ্টান হয়ে মরুক তাতে কিছু আসে যায় না। এ জন্যে যে আল্লাহ বলেন-

*******আরবী*********

হাদীস বর্ণনাকারীর উদ্দেশ্য এই যে যারা হজ্জ করে না নবী (স) তাদেরকে ইহুদী নাসারার সমতুল্য বলেছেন। হজ্জ যারা করে না তাদেরকে ইহুদী নাসারার সমতুল্য এবং নামায যারা পড়ে না তাদেরকে মুশরিকদের সমতুল্য ঘোষণা করার মর্ম এই যে, আহলে কিতাব হজ্জ একবারে পরিত্যাগ করেছিল এবং মুশরিকগণ হজ্জ করলেও নামায পরিত্যাগ করেছিল। এজন্যে নামায পরিত্যাগ করাকে মুশরিকী ক্রিয়াকর্ম এবং হজ্জ পরিত্যাগ করাকে ইহুদী খৃষ্টানের ক্রিয়াকর্ম বলা হয়েছ। অতএব এটাও এক মোক্ষম সত্য যে, স্বয়ং কুরআনেও এ ধরনের লোককে এ সতর্কবাণীও শুনিয়ে দেয়া হয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে হাদীস বর্ণনাকারী আয়াতের শুধু প্রথম অংশ পাঠ করেছেন। নতুবা যে সতর্কবাণীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তা আয়াতের এ অংশে রয়েছে। যথাঃ

*******আরবী*********

যারা অর্থ থাকা সত্বেও হজ্জ করতে অস্বীকার করার আচরণ দেখাবে তারা যেন জেনে রাখে যে, আল্লাহ তায়ালা সমগ্র বিশ্বজগতের কোনো কিছুরই পরোয়া করেন না। অর্থাৎ হজ্জ পরিত্যাগকারীর কুফরী আচরণের কোনো পরোয়া তিনি করেন না। তিনি ঐসব লোকের কোনো পরোয়া করেন না যে, তারা কোন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করছে। এ হচ্ছে সতর্কবাণীর বড়ো কঠিনতম প্রকাশভঙ্গী। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, যে ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর তার অসন্তোষ ও মুখাপেক্ষহীনতার কথা ঘোষণা করেন, যে ঈমান ও হেদায়াত দ্বারা কি করে ভূষিত হতে পারে?

হযরত হাসান (রা) বলেন, হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা) বলেছেন, আমার দৃঢ় ইচ্ছা এই যে যেসব শহর ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যেসব শহরে কিছু লোক পাঠিয়ে দেব তারা খোজ খবর নিয়ে দেখবে যে কারা হজ্জ করার সামর্থ্য থাকা সত্বেও হজ্জ করছে না। তাদের ওপর আমি জিযিয়া (জিযিয়া এমন এক প্রতিরক্ষা কর যা অমুসলিমদের নিকট থেকে তার জানমালের নিরাপত্তার বিনিময়ে গ্রহণ করা হয়) নির্ধারিত করে দেব। তারা মুসলমান নয়, তারা মুসলমান নয়। (আল মুনতাকা)

মুসলিম ঐ ব্যক্তিকে বলে যে পরিপূর্ণরূপে নিজেকে আল্লাহ তায়ালার কাছে সোপর্দ করে দেয়। আর হজ্জের মর্মও এ ই যে, ব্যক্তি তার নিজেকে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দেবে। এরা যদি মুসলিম হতো তাহলে কি করে হজ্জের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হতো এবং সামর্থ্য থাকা সত্বেও কি করে হজ্জ থেকে উদাসীন থাকতো?

হজ্জের ফযীলত ও প্রেরণা

হজ্জের এ গুরুত্বকে সামনে রেখে নবী (স) বিভিন্নভাবে এর প্রেরণা দান করেছেন। বিভিন্নভাবে এর অসাধারণ ফযীলত বর্ণনা করে এর জন্যে প্রেরণা ও আবেগ সৃষ্টি করেছেন।

১. যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর যিয়ারতের জন্যে এলো, তারপর কোনো অশ্লীল যৌন ক্রিয়া করলো না, আল্লাহর নাফরমানীর কোনো কাজ করলো না, তাহলে সে গোনাহ থেকে এমনভাবে পাকসাফ হয়ে প্রত্যাবর্তন করলো, যেমন পাকসাফ সে ঐদিন ছিল যেদিন সে তার মায়ের পেট থেকে জন্মগ্রহণ করেছিল। (বুখারী মুসলিম)

২. হজ্জ ও ওমরাহকারী আল্লাহর মেহমান। সে তার মেযবান আল্লাহর কাছে দোয়া করলে তিনি তা কবুল করেন, সে তার কাছে মাগফেরাত চাইলে তিনি তাকে মাগফেরাত দান করেন। (ইবনে মাজাহ)

৩. হ্জ্জ ও ওমরাহ পর পর করতে থাক। কারণ হজ্জ ও ওমরাহ উভয়ই দারিদ্র ও অভাব এবং গোনাহগুলোকে এমনভাবে দূর করে দেয় যেমন আগুনের ভাট্টি লোহা ও সোনা চাঁদির ময়লা দূর করে তা বিশুদ্ধ করে দেয়। হজ্জে মাবরুরের প্রতিদান তো একমাত্র জান্নাত। (তিরমিযি, নাসায়ী)

হজ্জে মাবরুর বলে এমন হজ্জকে যা পরিপূর্ণ এখলাস (নিষ্ঠা) অনুভূতি ও শর্তাবলীর পালনসহ আদায় করা হয় এবং যার মধ্যে হজ্জকারী আল্লাহর নাফরমানী থেকে বেচে থাকার পুরোপুরি ব্যবস্থা করে।

৪. যদি কোনো হেরেম শরীফ যিয়ারতকারীর সাথে তোমাদের সাক্ষাত হয়, তাহলে তার বাড়ী পৌঁছাবার আগেই তাকে সালাম কর, তার সাথে মুসাফা কর এবং তাকে অনুরোধ কর তোমাদের জন্যে আল্লাহর কাছে মাগফেরাতের দোয়া করার। এজন্যে যে, তার গোনাহের মাগফেরাতের ফায়সালা করা হয়ে গেছে। (মুসনাদে আহমদ)

৫. হযরত হুসাইন (রা) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (স) এর কাছে আরজ করলো, হুজুর, আমার শরীর মন উভয়ই দুর্বল। ইরশাদ হলো, তুমি এমন জেহাদ কর যাতে একটা কাটাও গায়ে না লাগে। প্রশ্নকারী বলে হুজুর, এমন জেহাদ আবার কেমন, যাতে কোনো আঘাত ও দুঃখ কষ্টের আশংকা নেই? নবী (স) ইরশাদ করেন, তুমি হজ্জ কর। (তাবারানী)

৬. হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেন, এক ব্যক্তি আরাফাতের ময়দানে নবী (স) এর একেবারে নিকটে সওয়ারীর উপরে ছিল এমন সময়ে হঠাৎ সে নীচে পড়ে প্রাণ ত্যাগ করে। নবী (স) বললেন, তাকে গোসল দিয়ে ইহরামের পোষাকসহই দাফন কর। এ কিয়ামতের দিনে তালবিয়া পড়া অবস্থায় ওঠবে। (তালবিয়ার জন্যে পরিভাষা দ্রষ্টব্য)। তার মাথা ও মুখমন্ডল খোলা থাকতে দাও। (বুখারী, মুসলিম)

৭. হযরত আবু যর (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, আল্লাহর নবী হযরত দাউদ (আ ) আল্লাহর কাছে আরয করে বলেন, পরওয়ারদেগার! যে বান্দাহ তোমার ঘর যিয়ারত করতে আসবে তাকে কি প্রতিদান দেয়া হবে? আল্লাহ বলেন, হে দাউদ! সে আমার মেহমান। তার অধিকার হচ্ছে এই যে, দুনিয়াতে আমি তার ভুলত্রুটি মাফ করে দেই এবং আখিরাতে যখন সে আমার সাথে সাক্ষাত করবে, তখন তাকে আমি আমার রহমত দিয়ে ধন্য করি।
হজ্জ ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলী
হজ্জ ওয়াজিব হওয়ার শর্ত দশটি। তার মধ্যে কোনো একটি শর্ত পাওয়া না গেলে হজ্জ ওয়াজিব হবে না।

১. ইসলামঃ অমুসলিমের প্রতি হজ্জ ওয়াজিব হতে পারে না।

২. জ্ঞান থাকাঃ পাগল, মস্তিষ্ক বিকৃত ও অনুভূতিহীন লোকের ওপর হজ্জ ওয়াজিব নয়।

৩. বালেগ হওয়াঃ নাবালেগ শিশুদের ওপর হজ্জ ওয়াজিব নয়, কোনো সচ্ছল ব্যক্তি বালেগ হওয়ার পূর্বেই শৈশব অবস্থায় হজ্জ করলে তাতে ফরয আদায় হবে না। বালেগ হওয়ার পর পুনরায় তাকে হজ্জ করতে হবে। শৈশবের হজ্জ নফল হবে।

৪. সামর্থঃ হজ্জকারীকে সচ্ছল হতে হবে। তার কাছে প্রকৃত প্রয়োজন ও ঋণ থেকে নিরাপদ এতোটা অর্থ থাকতে হবে যা সফরের ব্যয়ভার বহনের জন্যে যথেষ্ট হয় এবং হজ্জ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত তার অধীন পরিবারস্থ লোকের জীবিকা নির্বাহের জন্যে যথেষ্ট অর্থ মওজুদ থাকে, কারণ এসব লোকের ভরণপোষণের দায়িত্ব শরীয়াত অনুযায়ী তার।

৫. স্বাধীনতাঃ গোলাম ও বাদীর ওপর হজ্জ ওয়াজিব নয়।

৬. শারীরিক সুস্থতাঃ এমন অসুস্থ না হওয়া যাতে করে সফর করা সম্ভব নয়। অতএব ল্যাংড়া, বিকলাঙ্গ, অন্ধ, এবং অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তির স্বয়ং হজ্জ করা ওয়াজিব নয়। অন্যান্য সব শর্তগুলো পাওয়া গেলে অন্যের সাহায্যে হজ্জ করাতে পারে।

৭. কোনো যালেম ও স্বৈরাচারী শাসকের পক্ষ থেকে জীবনের কোনো আশঙ্কা না থাকা এবং কারাগারে আবদ্ধ না থাকা।

৮. পথ নিরাপদ হওয়াঃ যদি যুদ্ধ চলছে এমন অবস্থা হয়, পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হচ্ছে, যানবাহন ধ্বংস করা হচ্ছে, পথে চোর ডাকাতের আশংকা থাকে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জলপথে ভ্রমণ সম্ভব না হয় অথবা যে কোনো প্রকারের আশংকা যদি থাকে, তাহলে এসব অবস্থায় হজ্জ ওয়াজিব হবে না। অবশ্য এ অবস্থায় এমন লোকের অসিয়ত করে যাওয়া উচিত যে, তার পরে অবস্থা ও পরিস্থিতি অনুকূল হলে তার পক্ষ থেকে অন্য কেউ হজ্জ করবে।

৯. হজ্জের সফরে স্বামী অথবা কোনো মুহররম ব্যক্তি থাকতে হবেঃ এর ব্যাখ্যা এই যে, সফর যদি তিন রাত দিনের কম হয় তাহরে মেয়েলোকের স্বামী ছাড়া সফরের অনুমতি আছে।তার বেশী সময়ের সফল হলে স্বামী অথবা মুহররম পুরুষ ছাড়া হজ্জের সফর জায়েয নয়। (যে মহিলার স্বামী নেই এবং কোনো মুহররম পুরুষও নেই, তার ঐসব বন্ধু সফরকারীর সাথে যাওয়া জায়েয যাদের নৈতিক চরিত্রের ওপর নির্ভর করা যেতে পারে। এ হচ্ছে ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম মালেকের অভিমত। নির্ভরযোগ্য বন্ধু বান্ধব এর ব্যাখ্যা ইমাম শাফেয়ী (র) এভাবে করেছেনঃ কিচু সংখ্যক মেয়েলোক নির্ভরযোগ্য হতে হবে এবং তারা মুহররম লোকের সাথে হজ্জে যাচ্ছে। তাহলে এ দলের সাথে স্বামিহীন একজন মেয়েলোক যেতে পারে। অবশ্য দলে মাত্র একজন মেয়েলোক থাকলে যাওয়া উচিত নয়। ইমাম শাফেয়ীর এ অভিমত অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ। এতে একজন স্বামীহিন ও মুহাররমহীন মেয়েলোকের হজ্জ আদায় করার সুযোগ রয়েছে এবং ওসব ফেতনার আশংকাও নেই যার কারণে কোনো মেয়েলোকের মুহররম ছাড়া সফর করা নিষিদ্ধ।)এটাও জরুরী যে, এ মুহররম জ্ঞানবান, বালেগ, দীনদার এবং নির্ভরযোগ্য হতে হবে। অবোধ শিশু, ফাসেক, এবং অনির্ভরযোগ্য লোকের সাথে সফর জায়েয নয়।

১০. ইদ্দত অবস্থায় না হওয়াঃ ইদ্দত স্বামীর মৃত্যুর পর হোক অথবা তালাকের পর হোক, ইদ্দতের সময় হজ্জ ওয়াজিব হবে না।

হজ্জ সহীহ হওয়ার শর্ত

হজ্জ সহীহ হওয়ার শর্ত চারটি। এ শর্তগুলোসহ হজ্জ করলে তা সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হবে। নতুবা হবে না।

১. ইসলামঃ ইসলাম হজ্জ ওয়াজিব হওয়ার যেমন শর্ত, তেমনি সহীহ হওয়ার শর্ত। যদি কোনো অমুসলিম হজ্জের আরকান আদায় করে এবং তারপর আল্লাহ তায়ালা তাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফীক দান করেন, তাহলে এ হজ্জ সহীহ হওয়ার জন্যে জরুরী যে, হজ্জকারী মুসলমান হবে।

২. হুশ জ্ঞান থাকাঃ হুশ-জ্ঞানহীন ও পাগল ব্যক্তির হজ্জ সহীহ হবে না।

৩. সকল আরকান নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট স্থানে আদায় করা। হজ্জের মাসগুলো হচ্ছে, শাওয়াল, যুলকাদ, ও যুলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন। এমনি হজ্জের সকল আরকান আদায় করার সময়ও নির্দিষ্ট আছে,স্থানও নির্দিষ্ট আছে। আর ব্যতিক্রম করে হজ্জের আরকান আদায় করলে হজ্জ সহীহ হবে না।

৪. যেসব কারণে হজ্জ নষ্ট হয় তার থেকে বেচে থাকা এবং হজ্জের সকল আরকান ও ফরয আদায় করা। যদি হজ্জের কোনো রুকন আদায় করা না হয় কিংবা ছুটে যায় তাহলে হজ্জ সহীহ হবে না।

হজ্জের আহকাম

১. হজ্জ ফরয হওয়ার সকল শর্ত বিদ্যমান থাকলে জীবনে একবার হজ্জ করা ফরয। হজ্জ ফরযে আইন এবং তার ফরয হওয়া কুরআন ও হাদীস থেকে প্রমাণিত আছে। যে ব্যক্তি হজ্জ ফরয হওয়া অস্বীকার করবে সে কাফের এবং যে ব্যক্তি হজ্জের শর্ত বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করবে না সে গুনাহগার এবং ফাসেক।

২. হজ্জ ফরয হওয়ার সাথে সাথে সে বছরই তা আদায় করা উচিত। ফরয হওয়ার পর বিনা কারণে বিলম্ব করা এবং এক বছর থেকে আর এক বছর পর্যন্ত টালবাহানা করা গুনাহ।

নবী (স) বলেন, যে হজ্জের ইচ্ছা পোষণ করে তার তাড়াতাড়ি করা উচিত। হতে পরে যে, সে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়বে। অথবা সওয়ারীর উটনী হারিয়ে যেতে পারে। আর এটাও হতে পারে যে, অন্য কোনো প্রয়োজন তার হতে পারে। (ইবনে মাজাহ)

উটনী হারিয়ে যাওয়ার অর্থ সফরের উপায় উপাদান না থাকা। পথ নিরাপদ না থাকা এবং এমন কোনো প্রয়োজন এসে যাওয়া যার জন্যে হজ্জের আর সম্ভাবনা থাকে না। মানুষ ফরযের বোঝা মাথায় নিয়ে আল্লাহর সামনে হাজির হবে। পরিস্থিতি কখন অনুকূল হবে এবং জীবনেরই বা কি ভরসা? অতএব কোন ভরসায় মানুষ বিলম্ব করবে এবং হজ্জ করার পরিবর্তে শুধা টালবাহানা করতে থাকবে?

৩. হজ্জের ফরয আদায় করার জন্য যাদের অনুমতি নেয়া শরীয়াতের দিক দিয়ে জরুরী যেমন কারো মা বাপ দুর্বল অথবা রোগাক্রান্ত এবং তার সাহায্য প্রার্থী অথবা কোনো ব্যক্তি কারো কাছে ঋণী অথবা কারো জামিন এমন অবস্থায় অনুমতি ছাড়া হজ্জ করা মাকরূহ তাহরীমি।

৪. হারাম কামাইয়ের দ্বারা হজ্জ হারাম।

৫. ইহরাম না বেধে মীকাতে প্রবেশ করলে হজ্জ ফরয় হয়ে যায়।

৬. হজ্জ ফরয হওয়ার পর কেউ বিলম্ব করলো, তারপর সে অসমর্থ হয়ে পড়লো এবং অন্ধ, পঙ্গু অথবা কঠিন অসুখে পড়লো এবং সফরের যোগ্য রইলো না, তাহলে সে তার নিজের খরচে অন্যকে পাঠিয়ে বদলা হজ্জ করে নেবে।

মীকাত ও তার হুকুম

১. মীকাত অর্থ সেই নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত স্থান যেখানে ইহরাম বাধা ছাড়া মক্কা মুকাররামা যাওয়া জায়েয নয়। যে কোনো কারণেই কেউ মক্কা মুকাররামা যেতে চাক তার জন্যে অপরিহার্য যে, সে মীকাতে পৌঁছে ইহরাম বাধবে। ইহরাম বাধা ছাড়া সম্মুখে অগ্রসর হওয়া মাকরূহ তাহরিমী। (ইলমুল ফেকাহ)

২. বিভিন্ন দেশ থেকে আগত লোকদের জন্য পাঁচটি মীকাত নির্দিষ্ট আছে।

ক. যুল হুলায়ফাহঃ

এটি মদীনাবাসীদের জন্যে মীকাত। ঐসব লোকের জন্যেও যারা মদীনার পথে মক্কা মুকাররমা আসতে চায়। এ মীকাত মদীনা থেকে মক্কা আসবার পথে প্রায় আট নয় কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এ মীকাত মক্কা থেকে অন্যান্য সব মীকাতের তুলনায় অধিকতর দূরত্বে অবস্থিত, আর মদীনাবাসীদের এ অধিকারও রয়েছে এজন্যে যে, সর্বদা মদীনাবাসী আল্লাহর পথে অধিকতর কুরবানী করেছে।

খ. যাতে ইরাকঃ

এটি ইরাক এবং ইরাকের পথে আগত লোকদের মীকাত। এ মীকাত মক্কা থেকে উত্তর পূর্ব দিকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।

গ. হুজফাহঃ

এটি সিরিয়া এবং সিরিয়ার দিক থেকে আগমনকারী লোকদের জন্যে মীকাত। মক্কা থেকে পশ্চিম দিকে প্রায় একশ আশি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

ঘ. কারনুল মানাযেলঃ

মক্কা মুকাররামা থেকে পূর্ব দিকে পথের ওপর এক পর্বতময় স্থান যা মক্কা থেকে আনুমানিক পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি নজদবাসীদের মীকাত এবং ঐসব লোকের জন্যে যারা এ পথে আসে।

ঙ. ইয়ালামলামঃ

মক্কা থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে ইয়ামেন থেকে এসেছে এমন পথের ওপর একটি পাহাড়ী স্থান যা মক্কা থেকে প্রায় ষাট মাইল দূরে। এটি ইয়ামেন এবং এ পথে আগমনকারী লোকদের মীকাত। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের লোকের জন্যেও এ মীকাত।

এসব মীকাত স্বয়ং নবী (স) নির্ধারিত করে দিয়েছেন। বুখারী ও মুসলিম থেকে একথা জানা যায়। এসব মীকাত ঐসব লোকের জন্যে যারা মীকাতের বাইরে অবস্থানকারী, যাদেরকে পরিভাষায় আফাকী বর এখন যারা মীকাতের মধ্যে বসবাস করে তারা যদি হেরেমের সীমার ভেতরে হয় তাহলে হেরেমই তাদের মীকাত। আর হেরেমের সীমার বাইরে হিলে অবস্থানকারী হলে তার জন্যে হিল মীকাত। অবশ্য হেরেমের মধ্যে অবস্থানকারী ওমরার জন্যে ইহরাম বাধতে চাইলে তার মীকাত হিল, হেরেম নয়।

হজ্জের ফরয

হজ্জের চারটি ফরয। তার মধ্যে কোন একটি ছুটে গেলে হজ্জ হবে না। ফরয নিম্নরূপঃ

১. ইহরাম – এটি হজ্জের শর্ত এবং হজ্জের রুকন।

২. আরাফাতে অবস্থান কিছু সময়ের জন্য হলেও।

৩. যিয়ারতে তাওয়াফ – এর প্রথম চার চক্কর ফরয এবং বাকী তিন চক্কর ওয়াজিব।

৪. এ ফরযগুলো নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্ধারিত ক্রম অনুসারে আদায় করা।
ইহরাম ও তার মাসয়ালা
১. হজ্জের নিয়ত করে হজ্জের পোষাক পরিধান করা ও তালবিয়া পড়াকে ইহরাম বলে। হজ্জের নিয়ত করে তালবিয়া পড়ার পর লোক মুহরেম হয়ে যায়। যেমন নামাজে তাকবীর বলার পর লোক নামাজে প্রবেশ করে এবং তারপর খানাপিনা, চলাফেরা প্রভৃতি হারাম হয়ে যায়, তেমনি ইহরাম বাধার পর হজ্জ শুরু হয়ে যায়। তারপর বহু জিনিষ যা ইহরাম বাধার পরে জায়েয ও মুবাহ ছিল, ইহরাম অবস্থায় সেসব কাজ হারাম হয়ে যায়। এজন্য একে ইহরাম বলে।

২. যে কোন কারণে মক্কা যেতে হোক ভ্রমণ ব্যবসা বাণিজ্য অথবা যে কোনো উদ্দেশ্যই হোক মীকাতে পৌঁছে ইহরাম বাধা অত্যাবশ্যক। ইহরাম ছাড়া মীকাত থেকে সামনে অগ্রসর হওয়া মাকরুহে তাহরীমা।

৩. ইহরাম বাধার পূর্বে গোসল করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। শিশুদের গোসল করাও মসনুন। মেয়েলোক হায়েয নেফাস অবস্থায় তাদের গোসল করাও মসনুন। হ্যাঁ তবে গোসল করতে অসুবিধা হলে বা কষ্ট হলে অযু অবশ্য করে নেওয়া উচিৎ। এ অযু বা গোসল শুধু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য, পাক পবিত্রতার জন্য নয়। এ জন্য পানি না পেলে তায়াম্মুম করার দরকার নেই।

৪. ইহরামের জন্য গোসল করার জন্য চুল কাটা, নখ কাটা ও সাদা চাদর ও তহবন্দ পরা এবং খসবু লাগানো মুস্তাহাব।

৫. মীকাতে পৌছার পূর্বেও ইহরাম বাধা জায়েয। ইহরামের সম্মান রক্ষা করতে পারলে তা ভালো। নতুবা মীকাতে পৌছার পর ইহরাম বাধা ওয়াজিব।

৬. ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজঃ এসবের মধ্যে এমন কিছু আছে যা সব সময় নিষিদ্ধ। কিন্তু ইহরাম অবস্থায় যে সব কাজ করা অধিকতর গোনাহের কাজঃ

১. যৌনকার্যে লিপ্ত হওয়া অথবা যৌন সম্পর্কিত আলাপ আলোচনা করা, আপন স্ত্রীর সাথেও এ ধরনের কথাবার্তায় আনন্দ উপভোগ করা নিষিদ্ধ।

২. আল্লাহর নাফরমানী ও গোনাহ করা।

৩. লড়াই-ঝগড়া ও গালাগালি করা। কর্কশ কথা বলা।

৪. বন্য পশু শিকার করা। শিকার শুধু হারাম নয়। বরঞ্চ শিকারির সাথে কোন প্রকার সহযোগীতা করা অথবা শিকারিকে পথ দেখানো অথবা শিকারের দিকে ইংগিত করাও হারাম।

৫. সিলাই করা জামা কাপড়। যেমন শার্ট, পাঞ্জাবী, পায়জামা, শিরওয়ানী, কোট-প্যান্ট, টুপি, বেনিয়ান, দস্তানা প্রভৃতি পরিধান করা। মেয়েরা মিলওয়ার কামিজ পড়তে পারে। মোজাও পরতে পারে এবং ইচ্ছা করলে অলংকার ব্যবহার করতে পারে।

৬. রঙিন ও খোশবুদার রঙে রঞ্জিত কাপড় পরিধান করা। মেয়েরা রেশমী কাপড় পড়তে পারে এবং রঙিন কাপড়ও। অবশ্য খুশবুদার হওয়া চলবে না।

৭. মাথা ও মুখমন্ডল ঢাকা।মেয়েরা মাথার চুল ডেকে রাখবে।

৮. মাথা দাড়ি সাবান প্রভৃতি দিয়ে ধোয়া।

৯. শরীরে কোনে স্থানের চুল কামানো। কোন কিছুর সাহায্যে চুল উঠিয়ে ফেলা।

১০. নখ কাটা অথবা পাথর প্রভৃতিতে ঘসে সাফ করা।

১১. খুশবু লাগানো।

১২. তৈল ব্যবহার করা।

৭. ইহরাম অবস্থায় জায়েয কাজঃ

ওপরে যেসব বিষয় বলা হল তা ছাড়া সব কিছু কর জায়েয। যেমনঃ

১. কোনো ছায়ায় আরাম করা।

২. গোসল করা, মাথা ধোয়া, তবে সাবান ব্যবহার না করা।

৩. শরীর বা মাথা চুলকানো। তবে সতর্ক থাকতে হবে যাতে চুল উঠে না যায় অথবা চুলের উকুন পড়ে না যায়।

৪. টাকা পয়সা অস্ত্র প্রভৃতি সাথে রাখা

৫. অবসর সময়ে ব্যবসা করতে দোষ নেই। কুরআনে আছেঃ

******আরবী********

হজ্জের সময় তোমরা যদি তোমাদের রবের অনুগ্রহ (ব্যবসার দ্বারা মুনাফা) তালাশ কর, তাহলে তাতে কোন দোষ নেই।

৬. ইহরামের কাপড় বদলানো বা ধোয়া।

৭. আংটি ঘড়ি প্রভৃতি ব্যবহার করা।

৮. সুরমা লাগানো তবে খুশবু সুরমা নয়।

৯. খাতনা করা।

১০. নিকাহ করা।

১১. অনিষ্টকর জীব হত্যা করা। যেমন চিল, কাক, ইঁদুর, সাপ, বিচ্ছু, বাঘ, কুকুর, প্রভৃতি। নবী (স) বলেন, হেরেমে বা ইহরামের অবস্থায় পাঁচ প্রকারের জীব হত্যায় কোন দোষ নেই। যেমন, ইঁদুর, কাক, চিল, বিচ্ছু, আক্রমণকারী কুকুর।

১২. সামুদ্রিক শিকার জায়েয। কোনো গায়ের মুহররম (যে ইহরাম অবস্থায় নেই)যদি স্থলের কোন শিকার তোহফা দেয় তাহলে খাওয়া জায়েয।

৮. ইহরামের পদ্ধতি:

ভালোভাবে চুল নখ কেটে গোসল করে খুশবু লাগিয়ে ইহরামের পোশাক পরবে। অর্থাৎ এক চাদর, এক তহবন্দ পরে দু রাকায়াত নফল নামায পড়বে। তারপর হজ্জ অথবা ওমরার নিয়ত করে তালবিয়া পড়বে। (মুফরেদ হলে শুধু হজ্জের নিয়ত করবে। কারেন হলে হজ্জ ও ওমরাহ উভয়ের নিয়ত করবে। মুতায়াত্তা হলে প্রথমে ওমরার নিয়ত করবে এবং ওমরাহ শেষ করে হজ্জের নিয়ত করবে। এসব পরিভাষার জন্যে পরিভাষা দ্রষ্টব্য।) হজ্জ অথবা ওমরার নিয়ত করে তালবিয়া পড়ার সাথে সাথে ইহরাম বাধা হয়ে যায়। তারপর সে মুহররম হয়ে যায়। তারবিয়ার পরিবর্তে যদি কুরবানীর উট মক্কার দিকে রওয়ানা করে দেয়া হয় তাহলে তা তালবিয়ার স্থলাভিষিক্ত হয়ে যায়।

তালবিয়া ও তার মাসয়ালা

হজ্জের নিয়ত করার পরই হেরেম যিয়ারতাকারী যেসব কথা বলে তাকে তালবিয়া বলে, যথাঃ

*******আরবী*********

হে আল্লাহ আমি হাজির। আমি তোমার ডাকে হাজির। আমি তোমার দরবারে হাজির আছি, তোমার কোনো শরীক নেই। এটা সত্য যে, প্রশংসা ও শোকর পাবার অধিকারী তুমি। দান ও অনুগ্রহ করা তোমারই কাজ। তোমার প্রভুত্ব কর্তৃত্বে কেউ শরীক নেই।

১. ইহরাম বাধার পর একবার তালবিয়া পড়া ফরয। বেশী বলা সুন্নাত।

২. ইহরাম বাধার পর থেকে ১০ই যুলহাজ্জ তারিখে প্রথম জুমরায় পাথর মারা পর্যন্ত তালবিয়া পড়তে থাকতে হবে। প্রত্যেক নীচুতে নামার সময় এবং ওপরে ওঠার সময় প্রত্যেক কাফেলার সাথি মিলিত হবার সময় প্রত্যেক নামাযের পর এবং সকাল-সন্ধ্যায় তালবিয়া পড়তে হবে।

৩. জোরে জোরে তালবিয়া পড়া সুন্নাত। নবী (স) বলেন, আমার কাছে জিবরাঈল (আ ) এসে এ ফরমান পৌছিয়ে দেয় যে, আমি যেন আমার সঙ্গীদেরকে হুকুম দেই তারা যেন উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়ে। (মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক (র) তিরমিযি, আবু দাউদ প্রভৃতি। কিন্তু মেয়েরা উচ্চৈঃস্বরে তালবিয়া পড়বে না। হেদায়ায় আছে মেয়েরা তালবিয়া পড়ার সময় আওয়াজ বুলন্দ করবে না। এজন্যে যে এতে করে ফেতনার আশংকা সহতে পারে। তারা রমলও করবে না এবং সায়ী করার সময় দৌড়াবে না। এজন্যে যে, এতে পর্দা নষ্ট হবে।)

৪. তালবিয়া পড়লে তিনবার পড়তে হবে। তিনবার পড়া মুস্তাহাব।

৫. তালবিয়া পড়ার সময় কথা বলা মাকরূহ। সালামের জবাব দেয়া যেতে পারে।

৬. যে তালবিয়া পড়ছে তাকে সালাম না দেয়া উচিত। তাকে সালাম করা মাকরূহ।

৭. তালবিয়ার পর দরুদ পড়া মুস্তাহাব।
তালবিয়ার হিকমত ও ফযীলত
কাবা নির্মাণের পর আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবিব হযরত ইবরাহীম (আ ) কে হুকুম করেন-

এবং মানুষকে হজ্জের জন্যে সাধারণ আহবান জানিয়ে দাও যেন তারা তোমার কাছে দূর দূরান্ত থেকে পায়ে হেটে অথবা উটের পিঠে চড়ে আসে।

প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে সেই য আহবান, বান্দার পক্ষ থেকে তার জবাব হচ্ছে এই তালবিয়া। বান্দাহ বলে, পরওয়ারদেগার তোমার ডাক শুনেছি এবং তুমি যে তলব করেছ তার জন্যে তামার দরবারে হাজির হয়েছি। আল্লাহর ঘর যিয়ারতকারী কিছুক্ষণ পরপর এ ধ্বনি বুলন্দ করেছে। প্রকৃতপক্ষে সে বলেছে, পরওয়ারদেগার! তুমি তোমার ঘরে হাজিরা দেয়ার জন্যে ডেকেছ এবং আমরা শুধু তোমার মহব্বতে সবকিছু ছেড়েছুড়ে পাগলের মতো এসে হাজির হয়েছি। আমরা তোমার সে দয়া অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় করছি। তোমার তাওহীদের স্বীকৃতি দিচ্ছি। এ তালবিয়া ধ্বনি মুমিনের শিরায় শিরায় তাওহিদের বিশ্বাস প্রতিধ্বনিত করে এবং তাকে এভাবে তৈরী করে যে, দুনিয়াতে তার জীবনের উদ্দেশ্য শুধু মাত্র এই যে, সে তাওহীদের বাণী সর্বত্র পৌছিয়ে দেবে।

নবী (স) তালবিয়ার ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, যখন কোনো মুমিন বান্দাহ লাব্বায়েক ধ্বনি করে, তখন তার ডানে বামে যাকিছু আছে সবই লাব্বায়েক ধ্বনি করে তা পাথর হোক, বৃক্ষলতা হোক কিংবা মাটি হোক। এমনি কি যমীনের এক প্রান্ত থেকে তা অপর প্রান্তে পৌঁছে যায়। (তিরমিযি)

নবী (স) আরও বলেন, যে মুহররম ব্যক্তি সারাদিন লাব্বায়েক লাব্বায়েক ধ্বনি করে এবং এভাবে যখন সূর্য অস্ত যায়, তখন তার সকল গুনাহ মিটে যায় এবং সে এমন পাক হয়ে যায় যেন সে সদ্য তার মায়ের পেট থেকে জন্ম লাভ করেছে।

তালবিয়ার পর দোয়া

*******আরবী*********

হে আল্লাহ আমি তোমার কাছ থেকে তোমার সন্তুষ্টি ও জান্নাতের প্রার্থী এবং জাহান্নাম থেকে তোমার রহমতের ছায়ায় আশ্রয় চাই।

হযরত আম্মার বিন খুযায়মা তার পিতা থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, নবী (স) যখন ইহরাম বাধার জন্যে তালবিয়া পড়তেন, তখন আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রহমত ভিক্ষা চাইতেন এবং তার রহমতের বদৌলতে জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাইতেন। (মুসনাদে শায়েফী)

ইহরামের পর বায়তুল্লাহ যিয়ারতকারী যে দোয়া ইচ্ছা করতে পারে এবং যতো খুশী করতে পারে। কিন্তু প্রথমে ওপরের মসনুন অবশ্যই করবে। কারণ এ এক সার্বিক দোয়া। আল্লাহর সন্তুষ্টি, জান্নাত লাভ এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি এ তিনটি বস্তু একজন মুমিনের চরম আকাঙ্ক্ষা এবং তার সকল চেষ্টার চরিত্রের ফল।

ওয়াকুফ ও তার মাসয়ালা

১. ওয়াকুফ অর্থ দাঁড়ানো ও অবস্থান করা। হজ্জর সময় তিন স্থানে অবস্থান করতে হয় এবং তিন স্থানের হুকুম বিভিন্ন রকমের। উপরন্তু এসব স্থানে অবস্থানকালে যেসব আমল করতে হয় তার জন্যে সেখানে পৌছাতে হয়। এর নিয়ত করা এবং দাঁড়ানো জরুরী নয়। কিন্তু আহলে হাদীসের মতে নিয়ত করা শর্ত।

২. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরাফাত, যেখানে অবস্থান করতে হয়। আরাফাত এক অতি প্রকাণ্ড ময়দান। হেরেমের সীমা যেখানে শেষ সেখান থেকে আরাফাত এলাকা শুরু হয় এ ময়দান মক্কা মুকাররামা থেকে প্রায় পনের কিলোমিটার দূর। আরাফাতের ময়দানে অবস্থান হজ্জের রুকনগুলোর বড়ো একটা রুকন। বরঞ্চ নবী (স) একবার আরাফাতের অবস্থানকেই হজ্জ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেনঃ *******আরবী********* আরাফাতের দিনে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ একই পোশাক পরিধান করে আল্লাহর দরবারে বিনয় নম্রতার মূর্ত ছবি হয়ে দাড়ায় তখন তারা যেন এ সময়ের জন্যে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে হাশরের ময়দানে পৌঁছে যায়। এ এক বিরাট ঈমান উদ্দীপক দৃশ্য। এখানে অবস্থানের ফলে হাশরের ময়দানের কথা মনে জাগ্রত হয়।

এর গুরুত্ব এই যে, যদি কোনো কারণে হাজী ৯ই যুলহজ্জের দিনে অথবা দিনগত রাতে আরাফায় পৌছাতে না পারে তাহলে তার হজ্জ হবে না। হজ্জের অন্যান্য অনুষ্ঠান যথা তাওয়াফ, সায়ী, রামি প্রভৃতি যদি বাদ পড়ে তাহলে তার ক্ষতি পূরণ সম্ভব। কিন্তু আরাফাতে অবস্থান করা না হলে তার ক্ষতিপূরণ কোনো উপায় নেই।

৩. আরাফাতে অবস্থানের সময় ৯ই যুলহজ্জ বেলা পড়ে গড়ে যাওয়ার পর (যোহর ও আসরের নামায পড়ার পর)। কিন্তু যেহেতু এ হজ্জের সবচেয়ে বড়ো রুকন এবং এর ওপরেই হজ্জ নির্ভরশীল, সে জন্যে এ সময়কে প্রশস্ত করে দিয়ে এ সুযোগ দেয়া দেয়া হয়েছে যে, যদি কেউ নয় ও দশ যুলহজ্জের মধ্যবর্তী রাত সুবেহ সাদেকের পূর্বে কোনো সময় কিছুক্ষণের জন্যে হরেও আরাফাতে পৌছা যায় তাহলে তার অবস্থান নির্ভরযোগ্য হবে এবং তার হজ্জ হয়ে যাবে। (আবদুর রহমান বিন ইয়ামার ওয়াবলী বলেন, আমি নবী (স) কে একথা বলতে শুনেছি যে, হজ্জের ওয়াকুফ হচ্ছে আরাফাত। যে ব্যক্তি মুযদালফার রাতে ফজর হওয়ার পূর্বে পৌছবে, তার হজ্জ হয়ে যাবে। তিরমিযি, আবু দাউদ)

৪. আরাফাতের অবস্থান যতো দীর্ঘ হয় ততো ভালো। এ ধারণা ও অনুভূতি সহ আল্লাহর দরবারে দাঁড়ানো যেন হাশরের ময়দান। বান্দার নিজের মনে বলবে আমি সকল কিছু থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে একাকী নিজের মামলা মিটাবার জন্যে ও তার অনুগ্রহ ভিক্ষা করার জন্য তার দরবারে দাঁড়িয়েছি। এ হচ্ছে মুমিনের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। কে জানে জীবনে এ সৌভাগ্য আর হবে কিনা। এজন্যে ঈমান ও আত্মবিশ্লষণের শক্তি জাগ্রত রেখে পূর্ণ অনুভূতির সাথে এ দিন রাতের এক একটি মুহূর্তের গুরুত্ব অনুভব করতে হবে। নবী (স) এর ব্যাপারে হযরত জাবের (রা) বলেন, যোহর ও আসর নামাযের পর নবী (স) তার উটনী কাসওয়ার পিঠে সওয়ার হলেন এবং আরাফাতের ময়দানের বিশেষ অবস্থানের জায়গায় এলেন। তারপর যেদিকে পাথরের বড়বড় খন্ড পড়েছিল তার উটনীকে সে মুখী করলেন। তারপর জনতাকে সামনে রেখে কেবলামুখী হয়ে দাড়িয়ে গেলেন। এভাবে যখন সূর্য অস্ত গেল তখন তিনি মুযদালফার দিকে রওয়ানা হলেন। – (মুসলিম)

৫. আরাফাতে অবস্থানের গুরুত্ব ও ফযীলত বয়ান করে নবী (স) বলেন, বছরের ৩৬০ দিনের মধ্যে এমন কোনো দিন নেই যে দিনে আল্লাহ তায়ালা আরাফাতের দিনের চেয়ে অধিক পরিমাণে বান্দাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেন। এ দিন আল্লাহ বান্দার অতি নিকটবর্তী হন। ফেরেশতাদের কাছে তিনি বান্দাদের সম্পর্কে গর্ব করে বলেন, হে ফেরেশতাগণ! দেখছ এ বান্দারা কি চায় (মুসলিম)? হযরত আনাস বিন মালেক (রা) বলেন, নবী (স) আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করলেন। সূর্য অস্ত যাবে এমন সময় তিনি হযরত বেলাল (রা) এর প্রতি ইশারায় বললেন, চুপ কর। তখন নবী (স) বললেন, হে লোক সব। এই মাত্র জিবরাঈল আমার কাছে এসে আল্লাহ তায়ালার সালাম ও এ পয়গাম পৌঁছে গেলেন আল্লাহ আরাফাতের ময়দানের সকলকে মাফ করে দিয়েছেন। হযরত ওমর (রা) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ!এ পয়গাম কি আমরা সাহাবীদের জন্যে খাস না সকল উম্মতের জন্যে? নবী (স) বললেন, এ তোমাদের জন্যে এবং ঐসব লোকের জন্যেও যারা তোমাদের পরে এখানে আসবে।(আত তারগীব)

আরাফাতের ময়দানের দোয়া

আরাফাতের ময়দানের দোয়ার বিশেষ যত্ন নেয়া দরকার এবং ওখানে অবস্থানকালে সর্বদা আল্লাহর দিকে একাগ্রচিত্ত হয়ে থাকতে হবে। নবী (স) বলেন, সবচেয়ে ভালো দোয়া হলো আরাফাতের দিনের দোয়া। নিম্নে কিছু মসনুন দোয়া দেয়া হলোঃ

(ক) নিম্নের দোয়া নবী (স) আরাফাতের ময়দানে খুব বেশী করে করতেনঃ

*******আরবী*********

হে আল্লাহ! তুমি এমন প্রশংসার অধিকারী যেমন তুমি নিজে তোমার প্রশংসা করেছ এবং আমরা যতোটা করতে পারি তার চেয়ে অনেক ভালো প্রশংসার হকদার তুমি। হে আল্লাহ! তোমার জন্যেই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও মৃত্যু। তোমার দিকেই আমাকে ফিরে যেতে হবে এবং তোমার জন্যেই আমার সবকিছু। হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় চাই কবর আযাব থেকে, মনে মধ্যে সৃষ্ট কুমন্ত্রণা (অসঅসা) থেকে কাজকর্মের কুফল ও বিভেদ থেকে। হে আল্লাহ! আমি তামার আশ্রয় গ্রহণ করছি ওসব বিপদ থেকে যা বাতাসে বয়ে নিয়ে আসে। (তিরমিযি)

(খ) আল হিযবুল মকবুলে এক সার্বিক দোয়া বর্ণিত হয়েছে যা করলে বরকত পাওয়া যাবে।

*******আরবী*********

আয় আল্লাহ! আমি তোমার কাছে সেই কল্যাণ চাই যা তোমার নবী (স) তোমার কাছে চেয়েছেন ঐসব অমঙ্গল তেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই যেসব থেকে তোমার নবী (স) তোমার কাছে আশ্রয় চেয়েছেন। পরওয়ারদেগার! আমরা আমাদের জীবনের ওপরে বড়ো যুলুম করেছি। তুমি যদি মাফ না কর এবং আমাদের ওপর রহম না কর তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল হবো। হে আমার রব! আমাকে নামায কায়েমকারী বানাও এবং আমার সন্তানদেরকেও তার তাওফীক দাও। পরওয়ারদেগার! আমার দোয়া কবুল কর। আমার মা-বাপকে মাফ করে দাও। সেদিন সকল মুসলমানকে মাফ করে দিও যেদিন হবে হিসাব কেতাবের দিন। হে আমার রব! আমার মা-বাপ উভয়ের ওপর রহম কর যেমন তারা আমার শৈশবকালে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে আমার প্রতিপালন করেছে। হে রব! আমাদের মাফ করে দাও এবং আমাদের ঐসব ভাইদেরকে মাফ করে দাও যারা ঈমান আনার ব্যাপারে আমাদের অগ্রগামী ছিল, এবং আমাদের মনের মধ্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো হিংসা বিদ্বেষ হতে দিও না। যারা ঈমান এনেছে। হে আল্লাহ! তুমি বড়ো মেহেরবান ও দয়াশীল! পরওয়ারদেগার! তুমি সবকিছু শুন এবং জান, তুমি আমাদের তাওবা কবুল করো, তুমি তাওবা কবুলকারী ও দয়াশীল। গুনাহ থেকে বাচার কোনো শক্তি এবং হুকুম পালন করার সামর্থ অতীব উচ্চ ও মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কোথাও থেকে পাওয়া যেতে পারে না।

(গ) নবী (স) এ দোয়া বেশী করে করতে বলেছেনঃ

*******আরবী*********

হে আমাদের রব! তুমি আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান কর এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান কর এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর।

এসব মসনুন দোয়া ছাড়াও আরও কিছু মসনুন দোয়া আছে যা পড়া যেতে পারে। তাছাড়া দুনিয়া ও আখিরাতের যে যে কল্যাণ মানুষ আল্লাহর কাছে চাইতে পারে তা চাইবে এবং বারবার চাইবে। কারণ ঐ সময়ে আল্লাহ বান্দার ওপর বড়ো দয়াশীল হয়ে যান এবং তিনি তার মেহমানকে বঞ্চিত করেন না।

৭. মুযদালফার অবস্থান করা ওয়াজিব। মুযদালফার সীমানায় পায়ে হেটে প্রবেশ করা মসনুন। এখানে অবস্থানের সময় মাঝে মাঝে তালবিয়া, তাহলীল ও তাহমীদ পড়া মুস্তাহাব। এখানে একরাত্রি কাটানো মসনুন। হাদীসে আছে নবী (স) সূর্য অস্ত যাওয়ার পর আরাফাত থেকে মুযদালাফা রওয়ানা হন এবং এখানে পৌঁছে মাগরিব ও এশা এক সাথে পড়েন। তারপর শুয়ে পড়েন এবং ফজর পর্যন্ত বিশ্রাম করেন।

৮. যুলহজ্জ মাসের ৮ তারিখে কোনো সময়ে মিনাতে পৌছা মসনুন। সূর্য উঠার পর ওখানে পৌছা যোহর ওখানে পড়া এবং ওখানেই রাত্রি যাপন করা মুস্তাহাব।

তাওয়াফ ও তার মাসায়েল

তাওয়াফের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কোনো কিছুর চারদিকে চক্কর দেয়া ও প্রদক্ষিণ করা। ইসলামী পরিভাষায় তার অর্থ বায়তুল্লাহর চার ধারে ভক্তি সহকারে প্রদক্ষিণ করা ও চক্কর দেয়া।

বায়তুল্লাহর মহত্ব ও মর্যাদা

বায়তুল্লাহ ইট পাথরের নিছক একটা ঘর নয়। বরঞ্চ দুনিয়ার বুকে আল্লাহর মহত্বের বিশেষ নিদর্শন ও তার দীনের বিশেষ অনুভূত কেন্দ্র যা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তার আপন তত্ত্বাবধানে এমন একজন শ্রদ্ধেয় ও বরেণ্য পয়গাম্বর দ্বারা নির্মাণ করান যার নেতৃত্ব ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমান সমভাবে মেনে নিয়েছে। *******আরবী********* এবং স্মরণ করো সে সময়টি যখন আমরা ইবরাহীমকে এ ঘরের (কাবা) স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলাম। (সূরা হজ্জঃ ২৬)

কুরআন পাক একথার সাক্ষ্য দান করে যে, আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে সর্বপ্রথম যে ঘর তৈরী করা হয় তাহলো এ বায়তুল্লাহ (কাবা ঘর)।

*******আরবী*********

নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ইবাদাতের ঘর যা মানুষের জন্যে তৈরী করা হয় তা ঐ ঘর যা মক্কায় রয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে বায়তুল্লাহ দীনের উৎস কেন্দ্র।কুরআনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এ তাওহীদের উৎস এবং নামাযের প্রকৃত স্থান, আর এ তাওহীদ এবং নামায গোটা দীনের মস্তিষ্ক ও সারাংশ। আকীদার দিক দিয়ে তাওহীদ দীনের আসল বুনিয়াদ এবং আমলের দিক দিয়ে নামায দীনের স্তম্ভ। বায়তুল্লাহর নির্মাণ এদু বুনিয়াদী উদ্দেশ্যের জন্যেই। এক জন্যে আল্লাহ তাকে কল্যাণ ও বরকতের এবং হেদায়াতের উৎস বলে ঘোষণা করেছেন। *******আরবী*********এতে কল্যাণ ও বরকত দান করা হয়েছে এবং বিশ্ববাসীর জন্যে তাকে হেদায়াতের উৎস বানিয়ে দেয়া হয়েছে। (সূরা আল বাকারার ১২৫ আয়াতে আল্লাহ বলেন-

*******আরবী*********

এবং আমরা ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে অসিয়ত করেছিলাম এই বলে আমার এ ঘরকে রুকু ও সিজদাকারীদের জন্যে পাক রেখো। সূরা হজ্জের ২৬ আয়াতে বলা হয়-

*******আরবী*********

এবং স্মরণ কর যে সময়কে যখন আমি ইবরাহীম এর জন্যে এ ঘর নির্ধারিত করেছিলাম হেদায়াত সহ যে, আমার সাথে যেন কাউকে শরীক করা না হয় এবং আমার ঘরকে তাওয়াফ, কিয়াম, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্যে যেন পাক রাখা হয়।)

কুরআনে আল্লাহ তায়ালা দু স্থানে তাকে *******আরবী********* (আমার ঘর) বলে উল্লেখ করেছেন এবং হযরত ইবরাহীম (আ ) তার বংশধরকে মক্কার প্রস্তরময় মরু প্রান্তরে পুনর্বাসিত করার সময় বলেন হে আল্লাহ! আমি তাদেরকে তোমার ঘরের প্রতিবেশী করে পুনর্বাসিত করেছি। (সূরা ইবরাহীমের ৩৭ আয়াতে বলা হয়েছে-

*******আরবী*********

হে আল্লাহ! পানি ও তরুলতাহীন মরুপ্রান্তরে তোমার পবিত্র ঘরের পাশে আমার সন্তানদেরকে পুনর্বাসিত করলাম।)বায়তুল্লাহর মহত্ব এর চেয়ে অধিক আর কি হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা এ ঘর যিয়ারত করে হজ্জ করাকে মুসলমানদের ওপরে তার এক অধিকার বলে উল্লেখ করেছেন। আর হজ্জ এই যে, মুমিন ইহরাম বেধে অর্থাৎ নিজেকে বায়তুল্লাহতে হাজির হওয়ার যোগ্য জানিয়ে ভক্তি ভরে তার চারিদিকে প্রদক্ষিণ করবে। তাতে লাগানো হিজরে আসওয়াদের চুমো দেবে। মুলতাযেমের সাথে দেহমন নিবিড় করে দেবে। মসজিদুল হারামে নামায পড়বে এবং আরাফাতে অবস্থান করবে।

তাওয়াফের ফযীলত

আল্লাহর ঘর নির্মাণের উদ্দেশ্যে এই যে, তার তাওয়াফ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহীম (আ ) কে এর জন্যে তাকীদ করেছেন এবং এ তাকীদ কুরআনে দু স্থানে করা হয়েছে।

*******আরবী*********

*******আরবী*********

১. আমার ঘরকে তাওয়াফকারীদের জন্যে পাক রাখ। (সূরা আল বাকারাঃ ১২৫)

২. এ প্রাচীন ঘরের তাওয়াফ করতে হবে। (সুরা আল হাজ্জঃ ২৬)

তাওয়াফের ফযীলত বর্ণনা করে নবী (স) বলেন, বায়তুল্লাহর তাওয়াফ নামাযের মতোই এক ইবাদত। পার্থক্য শুধু এই যে, তাওয়াফে তোমরা কথা বলতে পার এবং নামাযে তার অনুমতি নেই। অতএব তাওয়াফের সময় কেউ কথা বলতে চাইলে মুখ থেকে যেন ভালো কথা বের হয়। (তিরমিযি, নাসায়ী)

হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন, আমি নবী (স) কে একথা বলতে শুনেছি যে, হিজরে আসওয়াদ এবং রুকনে ইয়ামেনী হাত দিয়ে স্পর্শ করা গুনাহের কাফফারা স্বরূপ। আমি তাকে একথাও বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি এ ঘর সাতবার তাওয়াফ করেছে এবং পূর্ণ অনুভূতি ও নিবিষ্ট মনে করেছে তার প্রতিদান এক টি গোলাম আযাদ করার সমান। নবী (স) কে আরও বলতে শুনেছি যে, তাওয়াফের সময় যে কদম ওঠাবে তার প্রত্যেক কদমের বিনিময়ে একটি করে গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দেবেন এবং একটি করে নেকী লিখে দেবেন। (তিরমিযি)
ইস্তেলাম
ইস্তেলামের আভিধানিকদ অর্থ স্পর্শ করা এবং চুমো দেয়া। পারিভাষিক অর্থ হিজরে আসওয়াদকে চুমো দেয়া এবং রুকনে ইয়ামেনী স্পর্শ করা। তাওয়াফের প্রত্যেক পাক বা ঘূর্ণন শুরু করার সময় হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম করা এবং তাওয়াফ শেষ করার সময় হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম করা সুন্নাত। রুকনে ইয়ামেনীর ইস্তেলাম মুস্তাহাব।

হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলামের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে চুমো দেয়ার সময় মুখ থেকে যেন কোনো শব্দ না হয়। হিজরে আসওয়াদে শুধু মুখ রাখা মসনুন। এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, অত্যন্ত ভিড়ের কারণে চুমো দেয়া সম্ভব না হরে কোনো ছড়ি প্রভৃতির দ্বারা হিজরে আসওয়াদ স্পর্শ করে তাতে চুমো দেবে। তাও সম্ভব না হলে দু হাতের তালু হিজরে আসওয়াদের দিকে করে হাত কান পর্যন্ত তুলে হাতে চুমো দেবে।

হিজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামেনীর ইস্তেলামের ফযীলত সম্পর্কে নবী (স) বলেন-

আল্লাহর কসম! কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে জীবন দান করে ওঠাবেন। তার দুটি চোখ হবে যা দিয়ে সে দেখবে। তার মুখ হবে যা দিয়ে সে কথা বলবে। যেসব বান্দাহ তার ইস্তেলাম করতে তাদের সপক্ষে সে সাক্ষ্য দেবে। (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)

রুকনে ইয়ামেনীর দোয়া

রুকনে ইয়ামেনীর ফযীলত বয়ান করতে গিয়ে নবী (স) বলেন- রুকনে ইয়ামেনীতে সত্তরজন ফেরেশতা নিযুক্ত আছে। তারা ঐসব প্রত্যেক বান্দার দোয়ার পর আমীন বলে যারা এ দোয়া করেঃ

হে আল্লাহ! আমি দুনিয়া ও আখিরাতে তোমার কাছ থেকে ক্ষমা ও স্বাচ্ছন্দ্য চাই। হে আমাদের রব! তুমি আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান কর এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান কর। জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর এবং নেক লোকদের সাথে বেহেশতে স্থান দাও।

তাওয়াফের প্রকার ও তার হুকুমাবলী

বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ছয় প্রকার এবং প্রত্যেকের হুকুম পৃথক পৃথক।

১. তাওয়াফে যিয়ারতঃ একে তাওয়াফে ইফাদা এবং তাওয়াফে হজ্জও বলে। তাওয়াফে যিয়ারত হজ্জের অন্যতম রুকন। কুরআন বলে *******আরবী********* এ প্রাচীন ঘরের তাওয়াফ করা উচিত। ইমামগণ এ ব্যাপারে একমত যে, এখানে তাওয়াফে যিরারতের কথাই বলা হয়েছে, যা আরাফাতে অবস্থানের পর দশ তারিখে করা হয়। কোনো কারণে যিলহজ্জের দশ তারিখে করতে না পারলে ১১/১২ তারিখেও করা যেতে পারে।

২. তাওয়াফে কুদুমঃ একে তাওয়াফে তাহিয়্যাও বলে। মক্কা প্রবেশের পর প্রথম যে তাওয়াফ করা হয় তাকে তাওয়াফে কুদুম বলে। এ তাওয়াফ শুধু তাদের জন্য ওয়াজিব যারা মীকাতের বাইরের অধিবাসী। (ইলমুল ফিকাহ ৫ম এবং কুদুরীতে একে মসনুন বলা হয়েছে। ইমাম মালেক (র) এর নিকট অবশ্য তাওয়াফে কুদুম ওয়াজিব বলা হয়েছ। তার যুক্তি এই যে, নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর যিয়ারতের জন্যে আসবে তার উচিত তাওয়াফে তাহিয়্যা করা। আয়নুল হেদায়া, প্রথম খন্ড,পৃঃ ৯৯৭) পরিভাষায় একে আফাকী বলে।

৩. তাওয়াফে বেদাঃ বায়তুল্লাহ থেকে বিদায় নেবার সময় যে শেষ তাওয়াফ করা হয় তাকে বিদায়ী তাওয়াফ বা তাওয়াফে সদর বলে। এ তাওয়াফও আফাকীর (মীকাতের বহিরাগত) জন্যে ওয়াজিব। এ তাওয়াফের পর মুলতাযেমের সাথে নিজেকে জড়িত করে বুক ও ডান গাল তাতে লগিয়ে এবং ডান হাতে বায়তুল্লাহর পর্দা ধরে একান্ত বিনয় সহকারে ও অশ্রু কাতর কন্ঠে দোয়া করা উচিত। এ হচ্ছে বিদায়ের সময় এবং বলা যায় না যে আবার কখন এ সৌভাগ্য হবে। এ এ তাওয়াফ সম্পর্কে নবী (স) এর হেদায়াত হচ্ছে-

কেউ যেন বিদায়ী তাওয়াফ না করে বায়তুল্লাহ থকে ফিরে না যায়। শুধু মাত্র ঐ মেয়েলোকের জন্যে অনুমতি আছে যার হায়েয হয়েছে। (বুখারী)

৪. তাওয়াফে উমরাহঃ এ হচ্ছে উমরার তাওয়াফ যা উমরার রুকন।এ তাওয়াফ ছাড়া উমরাহ হবে না।

৫. তাওয়াফে নযরঃ কেউ তাওয়াফে নযর মানলে তা করা ওয়াজিব।

৬. নফল তাওয়াফঃ এটা যে কোনো সময়ে করা যায়। মক্কায় যতদিন থাকার সুযোগ হয়। বেশী বেশী তাওয়াফ করার চেয়ে বড়ো সৌভাগ্য আর মানুষের কি হতে পারে?

তাওয়াফের ওয়াজিব সমূহ

তাওয়াফের মধ্যে নয়টি জিনিস যত্ন সহকারে পালন করা ওয়াজিব।

১. নাজাসাতে হুকমীঃ অর্থাৎ হাদীসে আসগার ও হাদীসে আকবার থেকে পাক হওয়া। মেয়েদের জন্যে হায়েয, নেফাস অবস্থায় তাওয়াফ করা জায়েয নয়। হযরত আয়েশা (রা) এর হজ্জের সময় মাসিক ঋতু শুরু হলে তিনি কাঁদতে থাকেন। নবী (স) বলেন, এতে কাদার কি আছে? এ এমন জিনিস যা আদম কন্যাদের রক্তের সাথে সম্পর্কিত। তুমি ওসব কাজ করতে থাক যা হাজীদের করতে হয়। কিন্তু বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না যতক্ষণ না তুমি তার থেকে পাক হবে। (বুখারী, মুসলিম)

২. সতরে আওরতঃ অর্থাৎ শরীরের ঐসব অংশ ঢেকে রাখা যা ঢাকা জরুরী। নবী (স) বলেনঃ *******আরবী********* অর্থাৎ উলঙ্গ হয়ে (সতর খুলে) কেউ যেন তাওয়াফ না করে। (বুখারী)

৩. হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম থেকে তাওয়াফ শুরু করা।

৪. তাওয়াফ ডান দিক থেকে শুরু করা। হযরত জাবের (রা) বলেন, নবী (স) মক্কায় তশরিফ আনার পর সর্বপ্রথম তিনি হিজরে আসওয়াদের নিকট গেলেন, তার ইস্তেলাম করলেন এবং তারপর ডান দিক থেকে তাওয়াফ শুরু করলেন।

৫. পায়ে হেটে তাওয়াফ করা। ওজর থাকলে সওয়ারীতে তাওয়াফ জায়েয। নফল তাওয়াফ বিনা ওজরে সওয়ারিতে জায়েয। কিন্তু পায়ে হেটে করাই ভালো।

৬. তাওয়াফের প্রথম চার ফরয চক্করের পর বাকী তিন চক্কর (শওত) পুরো করা।

৭. সাত তাওয়াফে শেষ করার পর দু রাকায়াত নামায পড়া। হযরত জাবের (রা) বলেন, আমরা নবী (স) এর সাথে বায়তুল্লাহ পৌছার পর তিনি হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম করলেন। প্রথম তিন চক্করে তিনি রমল (পরিভাষা দ্রঃ) করলেন, বাকী চারটি সাধারণভাবে করলেন। তারপর তিনি মাকে ইবরাহীমের দিকে অগ্রসর হলেন এবং এ আয়াত তেলাওয়াত করলেনঃ (এবং মাকামে ইবরাহীমকে স্থায়ী জায়নামায বানিয়ে নাও) তারপর তিনি এমনভাবে দাঁড়ালেন যে মাকামে ইবরাহীম তার ও বায়তুল্লাহর মধ্যখানে রইলো তারপর তিনি নামায পড়লেন। (মুসলিম)

৮. হাতীমের বাইরে থেকে তাওয়াফ করা যাতে করে হাতীম তাওয়াফের মধ্যে শামিল হয়।

৯. ইহরামের নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে দূরে থাকা।

তাওয়াফে দোয়া

খানায়ে কাবা তাওয়াফ করার জন্য হিজরে আসওয়াদের নিকট পৌছলে *******আরবী********* বলে নিম্ন দোয়া পড়তে হয়ঃ

*******আরবী*********

হে আল্লাহ! তোমার ওপর ঈমান এনে, তোমার কিতাবের সত্যতা স্বীকার করে, তোমার নবী (স) এর সুন্নাতের অনুসরণে (এ ইস্তেলাম এবং তাওয়াফের কাজ শুরু করছি)।

তাওয়াফের সময় আস্তে আস্তে এ দোয়া পড়তে হবেঃ

*******আরবী*********

আল্লাহ সকল ত্রুটি বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে, সকল প্রশংসা তার জন্যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, এবং আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি নেই যে সৎপথে চালাতে পারে এবং কোনো শক্তি নিই যে পাপাচার থেকে বাচাতে পারে।

যখন রুকনে ইয়ামেনী পৌছবে তখন রুকনে ইয়ামেনী এবং হিজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে পড়বে।

*******আরবী*********

নিম্নের দোয়াও পড়বে-

*******আরবী*********

হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তৃপ্তি দান কর যা কিছু তুমি আমাকে দিয়েছ তার ওপর এবং তার মধ্যেই আমাকে বরকত দান কর। আর প্রত্যেকটি অদৃশ্য বস্তুতে তুমি মঙ্গল ও কল্যাণসহ তত্ত্বাবধায়ক হয়ে যাও।

তার সাথে নিম্নের দোয়াও পড়া ভালোঃ

*******আরবী*********

আল্লাহ ছাড়া কেউ ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক এবং তার কোনো শরীক নেই। শাসন কর্তৃত্ব তারই, প্রশংসা সব তারই এবং তিনি সকল কিছুর ওপর শক্তিমান।

তাওয়াফের মাসায়েল

১. প্রত্যেক তাওয়াফ অর্থাৎ চক্কর পুরো করার পর দু রাকায়াত নামায পড়া ওয়াজিব। দু তাওয়াফ একত্র করা এবং মাঝখানে নামায না পড়া মাকরূহ তাহরিমী।

২. সাত চক্কর দেয়ার পর যদি কেউ অষ্টম চক্কর দেয় তাহরে অতিরিক্ত ছয় চক্কর দিয়ে আর এক তাওয়াফ করা দরকার। এজন্য যে নফল ইবাদাত শুরু করার পর তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

৩. যেসব সময়ে নামায মাকরূহ। যেসব সময়ে তাওয়াফ মাকরূহ নয়।

৪. তাওয়াফ করার সময় পাঞ্জেগানা নামাযের মধ্যে কোনো নামাযের সময় এলে, অথবা জানাযা এলে অথবা অযূর প্রয়োজন হলে, এসব থেকে ফিরে আসার পর নতুন করে তাওয়াফ শুরু করার প্রয়োজন নেই। যেখানে ছেড়ে যাবে সেখান থেকেই আবার শুরু করে তাওয়াফ পুরো করবে।

৫. তাওয়াফ করতে করতে যদি ভুলে যায় যে, কত চক্কর হলো তাহলো নতুন করে শুরু করতে হবে। তবে যদি কোনো নির্ভরযোগ্য লোক স্মরণ করিয়ে দেয় তাহলে তার কথামতো কাজ করবে।

৬. তাওয়াফের সময় খানাপিনা করা, বেচাকেনা করা, গুনগুন করে কবিতা পাঠ বা গান করা এবং বিনা প্রয়োজনে কথা বলা মাকরূহ।

৭.তাওয়াফকালে নাজাসাতে হাকীকী থেকে পাক হওয়া মসনুন।

৮. হজ্জ ও ওমরাহ উভয়ের প্রথমে যে তাওয়াফ করা হয় তাতে রমল করা মসনুন এবং ইযতেবাগও মসনুন। (এগুলোর জন্যে পরিভাষা দ্রঃ)

রমল

কাঁধ হেলিয়ে দুলিয়ে দ্রুত চলা, যাতে করে শক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তির প্রকাশ ঘটে। একে বলা হয় রমল।

নবী (স) যখন সপ্তম হিজরিতে বিরাট সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম (রা) সহ ওমরাহ করার জন্যে মক্কায় আসেন, তখন কিছু লোক পরস্পর এভাবে বলাবলি করতে থাকে এদের কি অবস্থা। এরা বড়ো দুর্বল ও জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে। মদীনার আবহাওয়া তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট করে দিয়েছে। আসলে মদীনার আবহাওয়া বড্ড খারাপ।

নবী (স) যখন মক্কাবাসীদের এসব কথা শুনতে পান তখন তিনি হুকুম দেন তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল কর অর্থাৎ দ্রুত চলে শক্তি প্রদর্শন করবে। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাহদের সে সময়ের আচরণ এতো পসন্দ করেন যে, তা স্থায়ী সুন্নাত হিসবে গণ্য হয়।

যে তাওয়াফে সায়ী করা হয় শুধু তাতে রমল সুন্নাত। অতএব যদি কেউ তাওয়াফে কুদুমের পর সায়ী করতে না চায়, সে এ তাওয়াফে রমল করবে না। কিন্তু তাওয়াফে যিয়ারতে রমল করবে যার পরে তাকে সায়ী করতে হয়। তেমনি কেরান হজ্জকারী যদি তাওয়াফে ওমরায় রমর করে থাকে তাহলে তাওয়াফে হজ্জ রমল করবে না। যদি কেউ প্রথম তিন চক্করে রমল করতে ভুলে যায় তাহলে পরে আর মোটেই করবে না। সাত চক্করেই রমল করা মাকরূহ তানযীহি।

ইযতেবাগ

চাদর প্রভৃতি এমন ভাবে গায়ে দেয়া যাতে করে তার এক কিনারা ডান কাঁধের ওপর দেয়ার পরিবর্তে ডান বগলের নীচ দিয়ে গায়ে দেয়া এবং ডান কাঁধ খোলা রাখা। এভাবেও শক্তি প্রদর্শন করা যায়।
হজ্জের ওয়াজিবসমুহ
হজ্জের ওয়াজিব নয়টি

১. সায়ী করা। অর্থাৎ সাফা মারওয়ার মাঝে দ্রুত চলা। (কুরআন পাকের বয়ান থেকে তাই মনে করা হয়। কিন্তু আহলে হাদীসের মতে সায়ী ফরয। তার দলীল নিম্নোক্ত হাদীসঃ

*******আরবী*********

অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তির হজ্জ ও ওমরাহ পরিপূর্ণ বলে গণ্য করেন না যে সাফা ও মারওয়ার মাঝে সায়ী করলো না। (মুসলিম)

২. মুযদালফার অবস্থান করা। অর্থাৎ ফজর শুরু হওয়ার পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত কোনো সময়ে সেখানে পৌছা।

৩. রামী করা। অর্থাৎ জুমরাতে পাথর মারা।

৪. তাওয়াফে কুদুম করা। অর্থাৎ মক্কায় প্রবেশ করার পর সর্বপ্রথম খানায়ে কাবার তাওয়াফ করা। তাওয়াফে কুদুম তাদের জন্যে ওয়াজিব যারা মীকাতের বাইরে থাকে যাদেরকে আফাকী বলা হয়।

৫. বিদায়ী তাওয়াফ করা। অর্থাৎ খানায়ে কাবা থেকে শেষ বিদায়ের সময় তাওয়াফ করা। এটাও শুধু আফাকীদের জন্যে ওয়াজিব।

৬. মাথা মুড়ানো বা চুল ছাটা। হাজ্জের আরকান শেষ করার পর মাথা মুড়িয়ে ফেলা অথবা চুল ছাটা। যুলহজ্জের দশ তারিখে জুমরাতে ওকবায় পাথর মারার পর মাথা মুড়িয়ে ফেলা বা চুল ছাটা ওয়াজিব।

৭. কুরবানী একত্রে পড়া। অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানে যোহর আসর একত্রে এবং মুযদালাফায় মাগরিব এশা একত্রে পড়া ওয়াজিব।

৯. রামী, মস্তক মুণ্ডন ও কুরবানী ক্রমানুসারে করা।

সায়ী

অভিধানে সায়ী শব্দের অর্থ যত্ন সহকারে চলা, দৌড়ানো এবং চেষ্টা করা। পারিভাষিক অর্থে সায়ী বলতে হজ্জের সেই ওয়াজিব আমল বুঝায় যাতে হেরেম যিয়ারতকারী সাফা ও মারওয়া নামাক দুটি পাহাড়ের মাঝে দৌড়ায়।সাফা বায়তুল্লাহর দক্ষিণে এবং মারওয়া উত্তর দিকে অবস্থিত। আজকাল এ দুটি পাহাড়ের নামমাত্র চিহ্ন অবশিষ্ট আছে এবং তাদের মধ্যবর্তী স্থানে দুটি পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। একটি সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত দৌড়ের জন্যে এবং অপরটি মারওয়া থেকে সাফা আসার জন্যে। অর্থাৎ দুটি পাশাপাশি আপ ডাউন সড়ক। এ সড়ক দুটির ওপর বিরাট ছাদ তৈরী করে সড়ক দুটিকে ঢেকে দেয়া হয়েছে যাতে করে সায়ীকারীগণ রৌদ্রে কষ্ট না পায়।

সায়ীর হাকীকত ও হিকমত

কুরআন পাক বলে-

*******আরবী*********

সাফা ও মারওয়া নিশ্চিতরূপে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশাবলীর মধ্য গণ্য।…….. শব্দের বহুবচন। কোনো আধ্যাত্মিক মর্ম এবং কোনো ধর্মীয় স্মৃতি অনুভব ও স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য যে জিনিস নিদর্শন স্বরূপ নির্ধারিত করা হয় তাকে ……… বলে। প্রকৃতপক্ষে এসব স্থান (সাফা মারওয়া) আল্লাহ পুরস্তি এবং ইসলামের বাস্তব বহিঃপ্রকাশের স্মরণীয় স্থান। মারওয়া হচ্ছে সেই স্থান যেখানে আল্লাহর খলীল হযরত ইবরাহীম (আ ) তার একমাত্র পুত্র সন্তান হযরত ইসমাঈল (আ ) কে উপুড় করে শুইয়ে তার গলায় ছুরি চালাতে উদ্যত হয়েছিলেন, যাতে করে তার দেখা স্বপ্ন কার্যে পরিণত করতে পারেন। সেই সাথে তার জীবনের প্রিয়তম বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে কুরবানী করে তার স্বীয় উক্তির *******আরবী********* (আমি পুরোপুরি নিজেকে রাব্বুল আলামীনের অধীন করে দিয়েছি) বাস্তব সাক্ষ্যদান করেন।

ইসলাম বা আত্মসমর্পণ করার এ অভিনব দৃশ্য দেখার সাথে সাথে আল্লাহ তাকে ডেকে বলেন, ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিয়েছ। এত কোনো সন্দেহ নেই যে, এ ছিল এক বিরাট পরীক্ষা।

*******আরবী*********

এবং আমরা তাকে এ বলে ডাকলাম, হে ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। নিশ্চয়ই আমরা নেক লোকদের এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। এটা সত্য যে এ হচ্ছে একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা।

সাফা ও মারওয়ার ওপর দৃষ্টি পড়তেই স্বাভাবিকভাবেই মুমিনের মনে কুরবানীর এ গোটা ইতিহাস ভেসে ওঠে। আর সেই সাথে ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালামের চিত্রও ভেসে ওঠে।

এ সত্যটিকে মনে বদ্ধমূল করার জন্যে এবং এ প্রেরণাদায়ক ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য সায়ীকে আল্লাহ তায়ালা মানাসেকের মধ্য শামিল করে দিয়েছেন।

আল্লাহ বলেনঃ

*******আরবী*********

অতএব যে ব্যক্তি হজ্জেও ওমরা করে, তার এ দুয়ের মধ্যে সায়ী করতে কোনো দোষ নেই। আর যে আগ্রহ সহকারে কোনো ভালো কাজ করে, আল্লাহ তা ভালোভাবে জানেন এবং তার মূল্য দান করেন।

জাহেলিয়াতের যুগে মক্কার মুশরিকগণ এ দুটি পাহাড়ের ওপর তাদের প্রতিমার বেদী নির্মাণ করে রেখেছিল। সাফার ওপরে আসাফের এবং মারওয়ার ওপরে নায়েলার প্রতিমা ছিল। তাদের চারধারে তাওয়াফ করা হতো। এজন্যে মুসলমানদের মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল যে, এ দু পাহাড়ের মাঝে তারা সায়ী করবে কিনা। তখন আল্লাহ বলেন এ সায়ী করতে কোনো দোষ নেই। এজন্যে যে, সায়ী বলতে হজ্জের মানাসেকের (করণীয় অনুষ্ঠানাদি) মধ্য গণ। হযরত ইবরাহীম (আ ) কে হজ্জের যেসব মানাসেক শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। তার মধ্যে সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে সায়ী করার নির্দেশও ছিল। এজন্যে কোনো প্রকার ঘৃণা অনীহা ব্যতিরেকেই মুসলমানগণ যেন মনের আগ্রহ সহকারে সাফা মারওয়ার সায়ী করে। আল্লাহ মনের অবস্থা ভালোভাবে জানেন এবং মানুষের সৎ আবেগ অনুভূতি ও সৎকাজ সম্মানের চোখে দেখেন।

সায়ীর মাসায়েল

১. কাবার তাওয়াফের পর সায়ী করা ওয়াজিব। তাওয়াফের পূর্বে সায়ী জায়েয নয়।

২. সায়ী করার সময় হাদাসে আসগার ও হাদাসে আকবার থেকে পাক হওয়া ওয়াজিব নয় বটে, কিন্তু মসনুন।

৩. সায়ী তে সাতবার দৌড় দিতে হয়। এ সাতবারই ওয়াজিব।

৪. তাওয়াফ শেষ করার সাথে সাথেই সায়ী শুরু করা মসনুন, তবে ওয়াজিব নয়।

৫. সায়ী সাফা থকে শুরু করা ওয়াজিব।

৬. সায়ী পায় হেটে করা ওয়াজিব। বিশেষ কারণে সওয়ারীতে করা যায়।

৭. গোটা হজ্জে একবারই সায়ী করা উচিত। তা তাওয়াফে কুদুমের পরে অথবা তাওয়াফে যিয়ারতের পরে হোক। তাওয়াফে যিয়ারতের পর করা ভালো।

৮. সাফা মারওয়ার ওপরে ওঠা বায়তুল্লাহর দিকে মুখ করে দু হাত দোয়ার জন্যে ওঠানো এবং দোয়া করা মাসনুন।

৯. সায়ী করার সময় কেনাবেচা মাকরূহ। প্রয়োজন হলে কথা বলা যায়।

সায়ী করার পদ্ধতি ও দোয়া

তাওয়াফে কুদুম অথবা তাওয়াফে যিয়ারত যার পরেই সায়ী করা হোক, তাওয়াফ শেষ করে সাফা পাহাড়ে ওঠতে হবে। তারপর এ আয়াত পড়তে হয় *******আরবী********* (সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তায়ালার নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত)। সাফার এতোটা উচ্চতায় চড়তে হবে যেন বায়তুল্লাহ চোখে পড়ে। তারপর বায়তুল্লাহর দিক মুখ করে তিনবার আল্লাহু আকবার বলে নিম্নের দোয়া পড়তে হয়ঃ

*******আরবী*********

আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি একক এবং তার কোনো শরীক নেই। শাসন কর্তৃত্ব তারই এবং সমস্ত প্রশংসাও তার। তিনি প্রত্যেক বিষয়ের ওপর পরিপূর্ণ শক্তিশালী। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং তিনি একক। তিনি তার ওয়াদা পূর্ণ করে দেখিয়েছেন, তার বান্দাহকে সাহায্য করেছেন এবং তিনি একাই সমস্ত কাফের দলকে পরাজিত করছেন। (মুসলিম)

তারপর দরূদ শরীফ পড়ে যে দোয়া করার ইচ্ছা তা করা উচিত। নিজের জন্যে, আত্মীয়-স্বজন ও আপনজনের জন্যে দোয়া করা উচিত। এ হচ্ছে দোয়া কবুলের স্থান। সে জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্যে প্রাণভরে দোয়া করা উচিত। তারপর আবার নিম্নের দোয়া পড়তে হয়ঃ

*******আরবী*********

আয় আল্লাহ! তুমি বলেছ আমার কাছে চাও আমি দিব। আর তুমি কখনো ওয়াদা খেলাফ করো না। তোমার কাছ আমার চাওয়া এই যে, তুমি যেমন আমাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফিক দান করেছ, তেমনি এ সম্পদ থেকে তুমি কখনও আমাকে বঞ্চিত করো না এভাবে আমার যেন মৃত্যু হয় এবং আমি যেন মুসলমান হয়ে মরতে পারি। (মুয়াত্তা)

তারপর সাফা থেকে নেমে মারওয়ার দিকে চলতে হবে এবং এ দোয়া পড়তে হবে-

*******আরবী*********

হে রব! আমাকে মাফ কর এবং রহম কর। তুমি পরম পরাক্রান্ত-শালী ও মহান।

সাফা থেকে মারওয়ার দিকে যাবার পথে বাম দিকে দুটি সবুজ চিহ্ন পাওয়া যায়। এ দুটি চিহ্নের মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়ানো সুন্নাত। এটা শুধু পুরুষদের জন্যে। মেয়েরা স্বাভাবিক গতিতে চলবে। তারা দৌড়ালে পর্দার ব্যাঘাত ঘটবে।

তারপর মারওয়া পাহাড়ে ওঠার পর ঐসব দোয়া পড়তে হয় যা সাফার ওপরে পড়া হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে যিকির ও তসবিহতে মশগুল থাকা উচিত। কারণ এটা হচ্ছে দোয়া কবুলের স্থান।

তারপর মারওয়া থেকে নেমে পুনরায় সাফার দিকে যেতে হবে এবং ঐসব দোয়া পড়তে হবে যা আসবার সময় পড়া হয়েছে। আর এভাবে দু সবুজ চিহ্নের মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়াতে হবে। এভাবে সাতবার সাফা মারওয়া দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।

রামী

রামীর আভিধানিক অর্থ নিক্ষেপ করা ও লক্ষ্যস্থলে পৌঁছানো। পরিভাষা হিসেবে রামী বলে সেই আমলকে যাতে হাজীগণ তিনটি স্তম্ভের ওপর পাথর মারে। জুমরাতে রামী করা ওয়াজিব। জুমরাতে জিমার অথবা জুমরাহ শব্দের বহুবচন। প্রস্তর খণ্ডকে জুমরাহ বলে। মিনার পথে কিছু দূরে দূরে অবস্থিত মানুষ সমান তিনটি স্তম্ভ আছে। সে সবের ওপরে যেহেতু পাথর মারা হয় সে জন্যে এগুলোকেও জুমরাত বলা হয়। এ তিনটিকে জুমরায় উলা, জুমরায়ে উস্তা এবং জুমরায়ে ওকবাহ বলে। মক্কার নিকটবর্তী যেটি, তাকে জুমরায়ে ওকবাহ বলে। তার পরেরটিকে বলে জুমরায়ে উস্তা এবং তার পরেরটি যা মসজিদে খায়েফের নিকটবর্তী তাকে জুমরায়ে উলা বলে।

রামীর মর্মকথা ও হিকমত

নবী পাক (স) এর জন্মের কিছুদিন পূর্বে (অধিকাংশের মতে পঞ্চাশ দিন হবে) হাবশার খৃষ্টান শাসক আবরাহা বায়তুল্লাহ ধ্বংস করার অসৎ উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে আগ্রাসন পরিচালনা করে। সে হস্তীবাহিনী সহ বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমণের জন্যে অগ্রসর হতে থাকে। মক্কার অতি নিকটবর্তী মহার উপত্যকা পর্যন্ত সে উপনীত হয়। আল্লাহ তায়ালা তার এ অসৎ উদ্দেশ্য নস্যাৎ করার জন্য সমুদ্রের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। তাদের প্রত্যেকে ঠোটে একটি করে এবং দু পায়ে দুটি করে ছোট ছোট পাথর নিয়ে এসেছিল এবং গোটা সেনাবাহিনীর ওপরে এমন মুষলধারে বর্ষণ করলো যে, অধিকাংশ ঘটনাস্থলেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত এবং অবশিষ্ট পথে পড়ে পড়ে মরতে থাকে। এভাবে আল্লাহ তায়ালা আবরাহার দুরভিসন্ধি নির্মূল করে দেন।

জুমরাতে পাথর মারা সেই ধ্বংসকারী প্রস্তর বর্ষণের স্মৃতি বহন করে। জুমরাতের ওপরে আল্লাহ আকবার বলে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা করে পাথর নিক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে এ সত্য সম্পর্কে দুনিয়াকে হুশিয়ার করে দেয়া এবং আপন সংকল্পের ঘোষণা করা যে, মুমিনের অস্তিত্ব দুনিয়াতে আল্লাহর দ্বীনের সংরক্ষণ করার জন্য।

কোনো শক্তি যদি দুরভিসন্ধি সহকারে দীনের প্রতি বক্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এবং তাকে মুলোৎপাটনের চেষ্টা করে তাহলে তাকে নির্মূল করে দেয়া হবে জুমরাতে পাথর নিক্ষেপের মধ্যে দিয়ে এ সংকল্পের ঘোষণা করা হয়।

রামীর মাসায়েল

১. রামী করা ওয়াজিব। ইমাম মালেকের নিকট জুমরাতে ওকবায় রামী ফরয়। এ রামী না করলে হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে।

২. নিচু স্থানে দাড়িয়ে রামী করা মসনুন। উঁচু স্থান থেকে করা মাকরূহ।

৩. প্রত্যেক পাথর মারার সময় আল্লাহু আকবার বলা মসনুন।

৪. পাথর যদি জুমরাতে না লাগে অর্থাৎ লক্ষ্যচ্যুত হয় তাহলে তাতে দোষ হবে না।

৫. যুলহজ্জের দশ তারিখে অর্থাৎ প্রথম দিন শুধু জুমরায়ে ওকবাতে পাথর মারবে। তারপর এগারো বারো তারিখে তিনটি জুমরাতেই পাথর মারতে হবে। তের তারিখে পাথর মারা মুস্তাহাব। সর্বমোট সাতবার পাথর মারা হচ্ছে। সাতটি করে উনপঞ্চাশটি পাথর মারতে হয়।

৬. একটি বড়ো পাথর ভেঙ্গে সাতটি করা মাকরূহ।

৭. সাতবারের বেশী পাথর মারা মাকরূহ।

৮. সাতটি পাথর সাতবার মারা ওয়াজিব। কেউ এক সাথে সাতটি পাথর মারলে তা একবারই মারা হবে।

৯. রামীর জন্যে মুযদালাফা থেকে আসার সময়ে মুহাসসার প্রান্তর থেকে ছোট ছোট পাথর সাথে নিয়ে আসা মুস্তাহাব। জুমরাতের আশপাশ থেকে পাথর কুড়িয়ে নেয়া মাকরূহ।

উল্লেখ্য যে, জুমরাতের পাশে যেসব প্রস্তর কণা রয়ে যায় সেগুলো আল্লাহ কবুল করেন। যেগুলো তার দরবারে কবুল হয় তা ফেরেশতাগণ ওঠিয়ে নিয়ে যান। এজন্য ওখানে পড়ে থাকা পাথর কণা দিয়ে রামী করা মাকরূহ।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী নবী (স) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! প্রতি বছর আমরা যেসব পাথর কনা দিয়ে রামী করি তার সংখ্যা তো কমে যায় বলে মনে হয়। ইরশাদ হলো, হ্যাঁ, এসবের মধ্যে যেগুলো আল্লাহ কবুল করেন, তা ওঠিয়ে নেয়া হয়। নতুবা তোমরা দেখতে পেতে যে, পাথর কণাগুলো পাহাড়ের মত স্তূপ হয়ে যেতো। (দারে কুতনী)

১০. যে পাথর কণা সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা হয় যে, তা নাপাক, তার দ্বারা রামী করা মাকরূহ।

১১. দশ তারিখে রামী শুরু করতেই তালবিয়া বন্ধ করা উচিত। বুখারী শরীফে আছে যে, হুজুর (স) জুমরায়ে ওকবাতে রামী করা পর্যন্ত তালবিয়া করতে থাকেন।

১২. দশই যুলহজ্জ রামী করার মসনূন সময় হচ্ছে সূর্যোদয় থেকে বেলা গড়া পর্যন্ত। তারপরেও সূর্যাস্ত পর্যন্ত জায়েয, কিন্তু সূর্যাস্তের পর মাকরূহ। অন্য তারিখগুলোতে বেলা গড়া তেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রামী করার মসনূন সময়।

১৩. রামী করার জন্যে এক রাত্র মিনাতে কাটানো মসনূন।

১৪. দশ তারিখে জুমরায়ে ওকবায় রামী করার পর অন্য তারিখগুলোতে নিম্ন ক্রম অনুসারে রামী করা মসনূনঃ

প্রথমে জুমরায়ে উলাতে রামী করতে হবে যা মসজিদে খায়েফের নিকটে অবস্থিত। তারপর জুমরায়ে উস্তা এবং তারপর জুমরায়ে ওকবা।

১৫. জুমরায়ে উলা ও জুমরায়ে উস্তায় রামী পায়ে হেটে করা ভালো এবং জুমরায়ে ওকবার সওয়ারীতে থেকে করা ভালো।

১৬. জুমরায়ে উলা ও উস্তায় রামী করার পর এতটুকু সময় দাড়িয়ে থাকা, যে সময়ে সূরা ফাতেহা তেলাওয়াত করা যায় এবং তাহমীদ, তাহলীল, তাকবীর, দরূদ প্রভৃতি পড়াতে মশগুল থাকা এবং হাত তুলে দোয়া করা মসনূন।

১৭. মিনা ও মক্কার মধ্যবর্তীস্থানে এক প্রান্তর ছিল যাকে মুহাসসাব বলা হতো। এখন সেখানে বসতি হয়ে গেছে। আজকাল তাকে মুয়াহেদা বলে। বিদায় হজ্জে নবী পাক (স) এখানে অবস্থান করেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) এখানে যোহর, আসর, মাগরিব এবং এশার নামায আদায় করেন। তারপর কিছুক্ষণ এখানে বিশ্রাম করেন। তারপর এখান থেকে রওয়ানা হয়ে বায়তুল্লাহ পৌঁছে তওয়াফ করেন। (বুখারী)

অবশ্য এখানে অবস্থান করা সুন্নাত, ওয়াজিব এবং অপরিহার্য নয়। না করলে কোনো দোষ নেই।

১৮. রামী ওসব বস্তুর দ্বারা করা যায় যার দ্বারা তায়াম্মুম জায়েয। যেমন ইট, পাথর, পোড়া মাটি, পাথর কণা, মাটি, ঢিল প্রভৃতি। কাঠ বা কোনো ধাতব দ্রব্য দ্বারা রামী জায়েয নয়।

রামী করার পদ্ধতি ও দোয়া

জুমরায়ে ওকবাতে প্রথম রামি করার পূর্বে তালবিয়া ছেড়ে দিয়ে রামী করা উচিত। রামী করার মসনূন পদ্ধতি এই যে, কোনো নিচু স্থানে দাড়িয়ে প্রথমে এ দোয়া পড়বে-

*******আরবী*********

আল্লাহর নামে শুরু করছি। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। শয়তানের দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করার জন্যে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যে (এ কাজ করছি) হে আল্লাহ এ হজ্জকে হজ্জে মাবরুর বানিয়ে দাও। গোনাহ মাফ করে দাও এবং এ চেষ্টা কবুল কর।

তারপর প্রস্তর কণা আঙ্গুল দিয়ে ধরে প্রত্যেকটি আল্লাহু আকবার বরে মারবে, জুমরাতে লক্ষ্য করে মারবে। জুমরায়ে ওকবাতে পাহাড়ের ওপর থেকে পাথর মারা অথবা বড়ো বড়ো ইট বা পাথর দিয়ে মারা জুমরাতের নিকটে পড়ে থাকা কণা দিয়ে মারা মাকরূহ।

মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাটার মাসায়েল

মাথা মুণ্ডানো অথবা চুল ছাটা হজ্জের আমলসমূহের একটি অপরিহার্য আমল। আল্লাহর এরশাদ হচ্ছে-

*******আরবী*********

তোমরা ইনশাআল্লাহ মসজিদুল হারামে মাথা মুণ্ডন করে অথবা চুল ছেঁটে নিরাপদে প্রবেশ করবে। আর তোমাদের কোনো প্রকারের ভয় ভীতি থাকবে না। (সূরা ফাতাহ: ২৭)

আসলে মাথা মোড়ানো বা চুল ছাটা ইহরামের অবস্থা থেকে বাইরে আসার এবং হালাল হওয়ার একটা নির্ধারিত শরীয়াতের পন্থা। এর তাৎপর্য সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে শাহ অলীউল্লাহ (র) বলেন, মাথা মোড়ানোর তাৎপর্য এই যে, এ ইহরামের অবস্থা থেকে বাইরে আসার এক বিশেষ নির্ধারিত পদ্ধতি। এমন পদ্ধতি যদি নির্ধারিত করা হতো যা মর্যাদার পরিপন্থী, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি আপন আপন ইচ্ছামতো তার ইহরাম খতম করতো এবং পৃথক পৃথক পদ্ধতি প্রবর্তন করতো। (হুজ্জাতুল্লাহেল বালেগা)

১. দশই যুলহজ্জ কুরবানীর দিন জুমরায়ে ওকবায় রামী করার পর মাথা মোড়ানো বা চুল ছাটা ওয়াজিব।

২. পুরুষদের জন্যে মাথা মোড়ানো অথবা চুল ছাটা উভয়ই জায়েয। তবে মস্তক মুন্ডানোর ফযীলত বেশী। এজন্যে যে, নবী (স) মস্তক মুন্ডনকারীদের জন্যে দুবার মাগফেরাতের দোয়া করেছেন এবং যারা চুল ছাটে তাদের জন্য একবার মাগফেরাতের দোয়া করেছেন। (আবু দাউদ, জামাউল ফাওয়ায়েদ)

৩. মেয়েলোকদের কিছুটা চুল কেটে ফেলা উচিত। তাদের জন্যে মস্তক মুণ্ডন জায়েয নয়। হযরত আলী (রা) বলেন, নবী (স) মেয়েদের মস্তক মুণ্ডন করতে নিষেধ করেছেন।

৪. পুরুষরা সমস্ত মাথার চুলের এক আঙ্গুল পরিমাণ কেটে ফেললে তা জায়েয হবে এবং এক চতুর্থাংশ চুলের কিছু ছেঁটে ফেলাও জায়েয। মেয়েদের জন্যে তাদের চুলের অগ্রভাগ কিছুটা ছেঁটে ফেললেই যথেষ্ট হবে।

৫.কারো মাথায় যদি চুল মোটেই গজায়নি অথবা টাক থাকে, তাহলে মাথার উপর শুধু খুর বুলালেই যথেষ্ট হবে।

৬. চুল সাফ করার কোনো ওষুধ দ্বারা যদি কেউ চুল সাফ করে তাহলে তাও জায়েয হবে।

৭. মস্তক মুণ্ডন বা চুল ছাটার পর ইহরামের অবস্থার অবসান হয় এবং তারপর তার জন্যে ওসব কাজ হালাল হয়ে যায়, যা ইহরাম অবস্থায় হারাম ছিল। তবে স্ত্রী সহবাস তখনও জায়েয হবে না যতক্ষণ না তাওয়াফে যিয়ারত শেষ করা হয়েছে।


কুরবানীর বর্ণনা
কুরবানীর ইতিহাস ততোটা প্রাচীন যতোটা প্রাচীন ধর্ম অথবা মানবের ইতিহাস। মানুষ বিভিন্ন যুগে সমান শ্রদ্ধা, জীবনদান, আত্মসমর্পণ, প্রেম-ভালোবাসা, বিনয়-নম্রতা, ত্যাগ ও কুরবানীর, পূজা অর্চনা ও আনুগত্য প্রভৃতির যে যে পন্থা পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, আল্লাহর শরীয়াত মানুষের মনস্তত্ব এবং আবেগ অনুভূতির প্রতি লক্ষ্য রেখে ওসব পন্থা-পদ্ধতি স্বীয় বিশিষ্ট নৈতিক সংস্কার সংশোধনসহ আল্লাহ তার জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। মানুষ তাদের আপন কল্পিত দেব দেবীর সামনে জীবন দানও করেছে। আর এটাই হচ্ছে কুরবানীর উচ্চতম বহিঃপ্রকাশ। এ জীবন দানকেও আল্লাহ তার নিজের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ ধরনের জীবন উৎসর্গ তিনি ছাড়া অন্যের জন্যে হারাম ঘোষণা করেছেন।

মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানী

মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানীর হযরত আদম (আ ) এর দু পুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানী। এর উল্লেখ কুরআন পাকে রয়েছে।

*******আরবী*********

এবং তাদেরকে আদমের দু পুত্রের কাহিনী ঠিকমতো শুনিয়ে দাও। যখন তারা দুজন কুরবানী করলো, একজনের কুরবানী কবুল হলো, অপরজনের হলো না। (সূরা আল মায়েদাঃ ২৭)

প্রকৃতপক্ষে একজন যার নাম ছিল হাবিল, মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যে একটি অতি সুন্দর দুম্বা কুরবানীরূপে পেশ করে।

অপর ব্যক্তির নাম ছির কাবিল। সে অমনোযোগ সহকারে খাদ্যের অনুপযোগী খানিক পরিমাণ খাদ্য শস্য কুরবানী স্বরূপ পেশ করলো। হাবিলের কুরবানী আকাশ থেকে এক খন্ড আগুন এসে জ্বালিয়ে গেল। এটাকে কবুল হওয়ার আলামত মনে করা হতো। অপরদিকে কাবিলের খাদ্য শস্য আগুন স্পর্শই করলো না। আর তা ছিল কবুল না হওয়ার আলামত।

সকল খোদায়ী শরীয়াতে কুরবানী

আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যতো শরীয়াত নাযিল হয়েছে সে সবেরও মধ্যে কুরবানীর হুকুম ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদাতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ।

*******আরবী*********

আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্যে কুরবানীর এক রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ঐসব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যেসব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন। (সূরা হজ্জঃ৩৪)

অর্থাৎ কুরবানী প্রত্যেক শরীয়াতের ইবাদাতের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। অবশ্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ ও জাতির নবীদের শরীয়াতে অবস্থার প্রেক্ষিতে কুরবানীর নিয়ম পদ্ধতি ও খুঁটিনাটি বিষয়সমুহ ভিন্ন ভিন্ন রয়েছে। কিন্তু মৌলিক দিক দিয়ে সকল আসমানী শরীয়াতে একথা যে, পশু কুরবানী শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যেই করতে হবে এবং করতে হবে তার নাম নিয়েই।

*******আরবী*********

অতএব ঐসব পশুর ওপরে শুধু আল্লাহর নাম নাও।

পশুর ওপর আল্লাহরই নাম নেয়াকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাকে যবেহ করতে হলে আল্লাহর নাম নিয়েই যবেহ করতে হবে এবং তার নাম নিয়েই তার সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যে যবেহ কর। কারণ তিনি তোমাদেরকে এসব পশু দান করেছেন। তিনি এসব তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন এবং তিনি তাদের মধ্যে তোমাদের জন্যে বিভিন্ন মঙ্গল নিহিত রেখেছেন।

কুরবানী এক বিরাট স্মরণীয় বস্তু

আজকাল দুনিয়ার সর্বত্র মুসলমানরা যে কুরবানী করে এবং তার ফলে বিরাট উৎসর্গের যে দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় তা প্রকৃতপক্ষে হযরত ইসমাঈল (আ ) এর ফিদিয়া। কুরআনে এ মহান কুরবানীর ঘটনা পেশ করে তাকে ইসলাম, ঈমান ও ইহসান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

কুরবানী প্রকৃতপক্ষে এমন এক সংকল্প,দৃঢ় বিশ্বাস,আত্মসমর্পণ ও জীবন দেয়ার বাস্তব বহিঃপ্রকাশ যে, মানুষের কাছে যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহর এবং তার পথেই তা উৎসর্গীকৃত হওয়া উচিত। এটা এ সত্যেরও নিদর্শন যে, আল্লাহর ইংগিত হলেই বান্দাহ তার রক্ত দিতেও দ্বিধা করে না। এ শপথ, আত্মসমর্পণ ও জীবন বিলিয়ে দেয়ার নামই

ঈমান, ইসলাম ও ইহসান।

*******আরবী*********

যখন সে (ইসমাঈল) তার সাথে চলাফেরার বয়সে পৌছলো তখন একদিন ইবরাহীম তাকে বললো প্রিয় পুত্র। আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যেন যবেহ করছি। বল দেখি কি রা যায়? পুত্র (বিনা দ্বিধায়) বললো, আব্বা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা শীঘ্র করে ফেলুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে অবিচল দেখতে পাবেন। অবশেষে যখন পিতা পুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদেরকে সোপর্দ করলেন এবং ইবরাহীম পুত্রকে উপর করে শুইয়ে দিলেন (যবেহ করার জন্যে) তখন আমরা তাকে সম্বোধন করে বললাম, ইবরাহীম তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। আমরা সৎকর্মশীলদের এরূপ প্রতিদানই দিয়ে থাকি। বস্তুত এ এক সুস্পষ্ট অগ্নি পরীক্ষা। আর আমরা বিরাট কুরবানী ফিদিয়া স্বরূপ দিয়ে তাকে (ইসমাঈলকে) উদ্ধার করেছি। আরআমরা ভবিষ্যতের উম্মতের মধ্যে (ইবরাহীমের) এ সুন্নাত স্মরণীয় করে রাখলাম। শান্তি ইবরাহীমের ওপর, এভাবে জীবনদানকারীদেরকে আমরা এ ধরনের প্রতিদানই দিয়ে থাকি। নিশ্চিতরূপে সে আমাদের মুমিন বান্দাদের মধ্যে শামিল। (সুরা আস সাফফাতঃ ১০২-১১১)

অর্থাৎ যতদিন দুনিয়া টিকে থাকবে ততদিন উম্মতে মুসলেমার মধ্যে কুরবানীর এ বিরাট স্মৃতি হযরত ইসমাঈল (আ ) এ ফিদিয়া রূপে অক্ষুণ্ণ থাকবে। আল্লাহ এ ফিদিয়ার বিনিময়ে হযরত ইসমাঈল (আ ) এর জীবন রক্ষা করেন এ উদ্দেশ্যে যে, কিয়ামত পর্যন্ত যেন তার উৎসর্গীকৃত বন্দাগণ টিক এ দিনে দুনিয়া জুড়ে কুরবানী করতে পারে। এভাবে যেন তারা আনুগত্য ও জীবন দেয়ার এ মহান ঘটনার স্মৃতি জাগ্রত রাখতে পারে। কুরবানীর এ অপরিবর্তনীয় সুন্নাতের প্রবর্তক হযরত ইবরাহীম (আ ) এবং হযরত ইসমাঈল (আ ) আর এ সুন্নাতকে কিয়ামত পর্যন্ত জারী রাখবে হযরত নবী মুহাম্মাদ (স) এর উম্মতের জীবন দানকারী মুমিনগণ।

নবী (স) এর প্রতি নির্দেশ।

কুরবানী ও জীবন দানের প্রেরণা ও চেতনা সমগ্র জীবনে জাগ্রত রাখার জন্যে নবী (স) কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

*******আরবী*********

বল, হে মুহাম্মাদ (স) আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্যে। তার কোনো শরীক নেই, আমাকে তারই নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আমি সকলের আগে তার অনুগত ও ফরমা বরদার। (সূরা আনআমঃ ১৬২-১৬৩)

আল্লাহর ওপর পাকা পোক্ত ঈমান এবং তার তাওহীদের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসের অর্থই এই যে, মানুষের সকল চেষ্টা চরিত্র তারই সন্তুষ্টির জন্যে নির্দিষ্ট হবে। আর সে ঐসব কিছুই তার পথে কুরবান করে তোর ঈমান, ইসলাম, আনুগত্য ও জীবন দেয়ার প্রমাণ পেশ করবে।

কুরবানীর প্রকৃত স্থান তো সেটা যেখানে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ হাজী তাদের নিজ নিজ কুরবানী পেশ করে। প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে হজ্জের অন্যতম আমল। কিন্তু মেহেরবান আল্লাহ এ বিরাট মর্যাদা থেকে তাদেরকেও বঞ্চিত করেননি যারা মক্কা থেকে দূরে রয়েছে এবং হজ্জে শরীক হয়নি। কুরবানীর আদেশ শুধু তাদের জন্যে নয় যারা বায়তুল্লাহর হজ্জ করে, বরঞ্চ এ এক সাধারণ নির্দেশ। এটা প্রত্যেক সচ্ছল মুসলমানের জন্যে। আর একথা হাদীস থেকে প্রমাণিত আছে, হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন, নবী (স) দশ বছর মদীনায় বাস করেন এবং প্রতি বছর কুরবানী করতে থাকেন। (তিরমিযি, মেশকাত)

নবী (স) বলেন, যে সামর্থ্য থাকা সত্বেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটে না আসে। (জামাউল ফাওয়ায়েদ)

হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) ঈদুল আযহার দিনে বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী করেছে তাকে পুনরায় করতে হবে। যে নামাযের পরে করেছে তার কুরবানী পূর্ণ হয়েছে এবং সে ঠিক মুসলমানদের পদ্ধতি অবলম্বন করেছে।

একথা ঠিক যে, ঈদুল আযহার দিনে মক্কায় এমন কোনো নামায হয় না যার আগে কুরবানী করা মুসলমানদের সুন্নাতের খেলাপ। এ মদীনার কথা এবং তার সাক্ষ্যই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) পেশ করেছেন। তিনি আরও বলেন, নবী (স) ঈদগাহেতেই কুরবানী করতেন।

কুরবানীর আধ্যাত্মিক দিক

কুরআন কুরবানীর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যের প্রতি ইংগিত করে। সত্য কথা এই যে, কুরবানী প্রকৃতপক্ষে তা-ই যা এসব উদ্দেশ্যের অনুভূতিসহ করা হয়।

১. কুরবানীর পশু আল্লাহ পুরস্তির নিদর্শন

*******আরবী*********

আর কুরবানীর উটগুলোকে আমরা তোমার জন্য আল্লাহর নিদর্শনাবলীর একটি বানিয়ে দিয়েছি। (সূরা আল হজ্জঃ ৩৬)

……. শব্দ ………… এর বহুবচন। …….. (শারীয়াহ) ঐ বিশেষ নিদর্শনকে বলে যা কোনো আধ্যাত্মিক ও অর্থপূর্ণ তত্ত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তা স্মরণ করার কারণ ও আলামত হয়ে পড়ে, কুরবানীর পশু ঐ আধ্যাত্মিক তত্ত্বের অনুভূত আলামত। কুরবানীকারী আসলে এ আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করে যে, কুরবানীর পশুর রক্ত তার আপন রক্তেরই স্থলাভিষিক্ত। সে আবেগও প্রকাশ করে যে, তার জীবনও আল্লাহর পথে ঐভাবে কুরবানী করা হবে, যেভাবে এ পশু সে কুরবানী করেছে।

২. কুরবানী আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতের বাস্তব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।

*******আরবী*********

এভাবে এসব পশুকে তোমাদের জন্যে বশীভূত করে দিয়েছি যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার। (সূর আল হজ্জঃ৩৬)

আল্লাহ তায়ালা পশুকে মানুষের বশীভূত করে দিয়ে তাদের ওপর বিরাট অনুগ্রহ করেছেন। মানুষ এসব থেকে বহু উপকার লাভ করে। তার দুধ পান করে, গোশত খায়। তার হাড়, চামড়া, পশম প্রভৃতি থেকে বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরী করে। চাষাবাদে তার সাহায্য নেয়। তাদের পিঠে বোঝা বহন করে, তাদেরকে বাহন হিসেবেও ব্যবহার করে। তাদের দ্বারা নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তিও প্রকাশ করে। কুরআন এসবের উপকারের দিকে ইংগিত করে ও তাদেরকে মানুষের বশীভূত করার উল্লেখ করে আল্লাহ পুরস্তি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রেরণা সঞ্চার করতে চায়। সেই সাথে এ চিন্তাধারাও সৃষ্টি করতে চায় যে, যে মহান আল্লাহ এ বিরাট নিয়ামত দান করেছেন- তার নামেই কুরবানী হওয়া উচিত। কুরবানী আল্লাহর বিরাট নিয়ামতের বাস্তব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।

৩. কুরবানী আল্লাহর মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের বহিঃপ্রকাশ

*******আরবী*********

আল্লাহ এভাবে পশুদেরকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা তার দেয়া হেদায়াত অনুযায়ী তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ কর। (সূরা আল হজ্জঃ ৩৭)

অর্থাৎ আল্লাহর নামে পশু যবেহ করা প্রকৃতপক্ষে একথারই ঘোষণা যে, যে আল্লাহ এসব নিয়ামত দান করেছেন এবং যিনি এসব আমাদের জন্যে বশীভূত করে দিয়েছেন- তিনিই এসবের প্রকৃত মালিক। কুরবানী সেই আসল মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং একথারও বাস্তব বহিঃপ্রকাশ যে, মুমিনের অন্তর থেকে আল্লাহর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি বিশ্বাস রাখে।

পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে সে উপরোক্ত সত্যের বাস্তব বহিঃপ্রকাশ ও ঘোষণা করে এবং মুখে বিসমিল্লাহি আল্লাহ আকবার বলে এ সত্যের স্বীকৃতি দান করে।

কুরবানীর প্রাণ শক্তি

প্রাক ইসলামী যুগে লোক কুরবানী করার পর তার গোশত বায়তুল্লাহর সম্মুখে এনে রেখে দিত। তার রক্ত বায়তুল্লাহর দেয়ালে মেখে দিত। কুরআন বললো, তোমাদের এ গোশত ও রক্তের কোনোই প্রয়োজন আল্লাহর নেই। তার কাছে তো কুরবানীর সে আবেগ অনুভূতি পৌঁছে যা যবেহ করার সময় তোমাদের মনে সঞ্চারিত হয় অথবা হওয়া উচিত। গোশত ও রক্তের নাম কুরবানী নয়। বরঞ্চ কুরবানী এ তত্ত্বেরই নাম যে, আমাদের সবকিছুই আল্লাহর জন্যে এবং তার পথেই উৎসর্গ করার জন্য।

কুরবানীকারী শুধুমাত্র পশুর গলায় ছুরি চালায় না। বরঞ্চ তার সকল কু প্রবৃত্তির ওপর ছুরি চালিয়ে তাকে নির্মূল করে। এ অনুভূতি ব্যতিরেকে যে কুরবানী করা হয়, তা হযরত ইবরাহীম (আ ) ও হযরত ইসমাঈল (আ ) এর সুন্নাত নয়, একটা জাতীয় রসম মাত্র। তাতে গোশতের ছড়াছড়ি হয় বটে, কিন্তু সেই তাকওয়ার অভাব দেখা যায় যা কুরবানীর প্রাণ শক্তি।

*******আরবী*********

ওসব পশুর রক্ত মাংস আল্লাহর কাছে কিছুতেই পৌঁছে না বরঞ্চ তোমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের তাকওয়া তার কাছে পৌঁছে।

যে কুরবানীর পেছনে তাকওয়ার আবেগ অনুভূতি নেই আল্লাহর দৃষ্টিতে সে কুরবানীর কোনোই মূল্যে নেই। আল্লাহর কাছে সে আমলই গৃহীত হয় যার প্রেরণা দান করে তাকওয়া।

*******আরবী*********

আল্লাহ শুধুমাত্র মুত্তাকীদের আমল কবুল করেন।

উট কুরবানীর আধ্যাত্মিক দিক

এবং কুরবানীর উটগুলোকে আমরা তোমাদের জন্যে আল্লাহ পুরস্তির নিদর্শন বানিয়ে দিয়েছি। এতে তোমাদের জন্যে শুধু মঙ্গল আর মঙ্গল। অতএব, তাদেরকে সারিবদ্ধ করে দাড় করিয়ে তাদের ওপর আল্লাহর নাম নাও এবং যখন (পড়ে গিয়ে) তাদের পার্শ্বদেশ যমীনে লেগে যাবে তখন তোমাদের স্বয়ং তা (গোস্ত) খাও এবং খাইয়ে দাও তাদেরকে যারা চায় না এবং তাদেরকেও যারা চায়। (সূরা হজ্বঃ ৩৬)

উট কুরবানী করার নিয়ম এই যে, তাদেরকে এক সারিতে দাড় করিয়ে তাদের হলকুমে (কণ্ঠদেশে) ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়, তখন তার থেকে রক্তের স্রোত প্রবাহিত হয়। রক্ত নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা মাটিতে পড়ে যায়। কুরবানীর এ দৃশ্য একবার মনের মধ্যে অংকিত করুন এবং চিন্তা করুন যে, পশুর এ কুরবানী কোন বস্তু। এটা তো এই যে, এভাবে আমাদেরও জীবন আল্লাহর পথে কুরবান হওয়ার জন্যে তৈরী আছে। প্রকৃতপক্ষে এ কুরবানী আপনজনের কুরবানীরই স্থলাভিষিক্ত। এ অর্থেই উট কুরবানীর চিন্তা করুন। তার আহত হওয়া, রক্ত প্রবাহিত হওয়া, মাটিতে পড়ে যাওয়া এবং আল্লাহর পথে জীবন দেয়ার দৃশ্যটা একবার ভেবে দেখুন, যেন মনে হবে যে, জেহাদের ময়দানে আল্লাহর সৈনিকগণ সারি বেধে দাড়িয়ে আছে। তাদের কণ্ঠদেশে শত্রুর তীর অথবা গুলি বিদ্ধ হচ্ছে, তারপর খুনের ঝর্ণা ছুটছ। তারপর খুনরাঙা যমীন তাদের জীবনদানের সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং তারা একজন মাটিতে পড়ে আল্লাহর হাতে তাদের জান পেশ করছে।

কুরবানীর পদ্ধতি ও দোয়া

যবেহ করার জন্য পশুকে এমনভাবে শোয়াতে হবে যেন তা কেবলামুখী হয়, ছুরি খুব ধারালো করতে হবে। যথাসম্ভব কুরবানী নিজ হাতে যবেহ করতে হবে। কোনো কারণে নিজ যবেহ করতে না পারলে তার নিকটে দাড়িয়ে থাকতে হবে।

যবেহ করার সময় প্রথম এ দোয়া পড়তে হবে-

*******আরবী*********

আমি সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ইবরাহীমের তরীকার ওপরে একনিষ্ঠ হয়ে ঐ আল্লাহর দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করছি যিনি আসমান যমীন পয়দা করেছেন এবং আমি কখনো শিরককারীদের মধ্যে নই। আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ- রাব্বুল আলামীন আল্লাহর জন্যে তার কোনো শরীক নেই। এ নির্দেশই আমাকে দেয়া হয়েছে এবং আমি অনুগতদের মধ্যে একজন। হে আল্লাহ! এ তোমারই জন্যে পেশ করা হচ্ছে এবং এ তোমারই দেয়া। (মেশকাত)

তারপর বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে যবেহ করতে হবে। যবাইয়ের পর এ দোয়া পড়তে হবে-

*******আরবী*********

আয় আল্লাহ! তুমি এ কুরবানী আমার পক্ষ থেকে কবুল কর যেমন তুমি তোমার পিয়ারা হাবীব মুহাম্মাদ (স) এবং তোমার খলীল ইবরাহীম (আ ) এর কুরবানী কবুল করেছিলে।

দোয়ার প্রথমে ………… শব্দ আছে। নিজের কুরবানী হলে …… বলতে হবে। আর অন্য বা একাধিক লোকের পক্ষ থেকে হলে তাদের নাম বলতে হবে।

কুরবানীর ফযিলত ও তাকীদ

নবী (স) কুরবানীর ফযিলত ও অসংখ্য সওয়াবের উল্লেখ করে বলেন,

১. নাহারের দিন অর্থাৎ যুলহাজ্জ মাসের ১০ তারিখ কুরবানীর রক্ত প্রবাহিত করা থেকে ভালো কাজ আল্লাহর কাছে আর কিছু নেই। কিয়ামতের দিন কুরবানীর পশু তার শিং, পশম ও খুর সহ হাজির হবে। কুরবানীর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা কবুল হয়ে যায়। অতএব, মনের আগ্রহ সহ এবং সন্তুষ্ট চিত্তে কুরবানী কর। (তিরমিযি ইবনে মাজাহ)

২. সাহাবায়ে কেরাম (রা) নবী (স) কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ কুরবানী কি বস্তু? নবী বলেন, এ তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ ) এর সুন্নাত। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এতে আমাদের জন্যে কি সওয়াব রয়েছে? নবী (স) বলেন, তার প্রত্যেক পশমের জন্যে এক একটি সওয়াব পাওয়া যাবে। (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)

৩. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন যে, নবী (স) হযরত ফাতেমা যোহরা (রা) কে বলেন, ফাতেমা! এসো, তোমার কুরবানীর পশুর কাছে দাড়িয়ে থাক। এজন্যে যে, তার যে রক্ত কণা মাটিতে পড়বে তার বদলায় আল্লাহ তোমার পূর্বের গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন। হযরত ফাতেমা (রা) বলেন, এ সুসংবাদ কি আহলে বায়েতের জন্য নির্দিষ্ট, না সকল উম্মতের জন্যে? নবী (স) বলেন, আমাদের আহলে বায়েতের জন্যও এবং সকল উম্মতের জন্যেও। (জামউল ফাওয়োদে)

৪. হযরত ইবনে বারীদাহ (রা) তার পিতার বরাত দিয়ে বলেন, নবী (স) ঈদুল ফিতরের দিন কিছু না খেয়ে নামাযে যেতেনে না। আর ঈদুল আযহার দিন ঈদুল আযহার নামাযের আগে কিছু খেতেন না। (তিরমিযি, আহমাদ)

তারপর নামায থেকে ফিরে এসে কুরবানীর কলিজী খেতেন।


কুরবানীর আহকাম ও মাসায়েল
কুরবানী দাতার জন্যে মসনূন আমল

যে ব্যক্তি কুরবানী করার ইচ্ছা পোষণ করে সে যেন যুলহাজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর শরীরের কোনো অংশের চুল না কাটে, মাথা না মোড়ায় এবং নখ না কাটে। কুরবানী করার পর চুল, নখ ইত্যাদি কাটবে। এ আমল মসনূন, ওয়াজিব নয়। যার কুরবানী করার সামর্থ্য নেই, তার জন্যেও এটা ভালো যে, সে কুরবানীর দিন কুরবানীর পরিবর্তে তার চুল কাটবে, নখ কাটবে এবং নাভির নীচের চুল সাফ করবে। এ কাজ তার কুরবানীর স্থলাভিষিক্ত হবে।

হযরত উম্মে সালাম (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, যার কুরবানী করতে হবে সে যেন চাঁদ দেখার পর যতক্ষণ না কুরবানী করেছে ততোক্ষণ চুল ও নখ না কাটে।(মুসলিম, জামউল ফাওয়ায়েদ)

হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, আমাকে হুকুম করা হয়েছে যে, আমি যেন ঈদুল আযহার দিনে (যুলহজ্জের দশ তারিখে) ঈদ পালন করি। আল্লাহ তায়ালা এ দিন উম্মতের জন্যে ঈদ নির্ধারিত করেছেন। একজন জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! বলুন, একজন আমাকে দুধ পানের জন্যে একটা বকরী দিয়েছেন। এখন ঐ বকরী কি আমি কুরবানী করব? নবী (স) বলেন, না তুমি তা কুরবানী করবে না। কিন্তু কুরবানীর দিন তোমার চুল ছাঁটবে, নখ কাটবে, গোঁফ ছোট করবে এবং নাভির নীচের চুল সাফ করবে। বাস আল্লাহর কাছে এ তোমার পুরো কুরবানী হয়ে যাবে। (জামউল ফাওয়ায়েদ, আবু দাউদ, নাসায়ী)

কুরবানীর পশু ও তার হুকুম

১. কুরবানীর পশু নিম্নরূপ:

উট, দুম্বা, ভেড়া, ছাগল, গরু, মহিষ। এসব পশু ছাড়া অন্য পশু কুরবানী জায়েয হবে না।

২. দুম্বা, ছাগল, ভেড়া শুধু এক ব্যক্তির জন্যে হতে পারবে। একাধিক ব্যক্তি তাতে অংশীদার হতে পারবে না।

৩. গরু, মহিষ ও উটের মধ্যে সাতজন অংশীদার হতে পারে, তার বেশী নয়। তবে তার জন্য দুটি শর্তঃ

প্রথম শর্ত এই যে, প্রত্যেক অংশীদারের নিয়ত কুরবানী অথবা আকিকার হতে হবে। শুধু গোশত খাওয়ার নিয়ত যেন না হয়।

দ্বিতীয় শর্ত এই যে, প্রত্যেকের অংশ ঠিক এক সপ্তমাংশ হবে। তার কম কেউ অংশীদার হতে পারে না।

এদুটো শর্তের মধ্যে কোনো একটি পূরণ না হলে কুরবানী ঠিক হবে না।

৪. উট ও গরু-মহিষে সাতজনেরও কম অংশীদার হতে পারে, যেমন দুই, চার অথবা তার কম বেশী অংশ কেউ নিতে পারে। কিন্তু এখানেও এ শর্ত জরুরী যে, কোনো অংশীদার সাত ভাগের এক ভাগ এর কম অংশীদার হতে পারবে না। নতুবা কারো কুরবানী ঠিক হবে না।

৫. এক ব্যক্তি গরু খরিদ করলো এবং তার ইচ্ছা যে অন্য লোককে অংশীদার করে কুরবানী করবে। এটা দুরস্ত হবে। যদি খরিদ করার সময় গোটা গরু নিজের জন্যে খরিদ করার নিয়ত করে পরে অন্য লোককে অংশীদার করার ইচ্ছা করে, তাও জায়েয হবে। অবশ্য এটা করা ভালো যে, সে এমন অবস্থায় তা প্রথম ইচ্ছা অনুযায়ী গোটা পশু নিজের জন্যই কুরবানী করবে। তবে কাউকে শরীক করতে চাইলে সচ্ছল ব্যক্তিকে শরীক করবে, যার ওপর কুরবানী ওয়াজিব। এমন ব্যক্তিকে যদি শরীক করা হয় যার কুরবানী ওয়াজিব নয়, তাহলে তা দুরস্ত হবে না।

৬. গরু মহিষের কুরবানীতে কেউ এক বা একাধিক অতিরিক্ত লোকের অংশ নিজে নিজেই ঠিক করলো, অংশীদারদের অনুমতি নেয়া হলো না, তাহলে এ কুরবানী জায়েয হবে না। যাদের অংশ রাখা হবে তাদের তাদের অনুমতি নিয়ে রাখতে হবে। এটা করা যাবে না যে, কুরবানীর অংশীদার মনে মনে ঠিক করে প্রথমে কুরবানী করা হলো এবং তারপর অংশীদারের অনুমতি পরে নেয়া হলো।

৭. দুম্বা, ছাগল, ভেড়া পূর্ণ এক বছর বয়সের হলে তার কুরবানী দুরস্ত হবে। এক বছরের কম হলে কুরবানী হবে না। গরু মহিষ পূর্ণ দু বছরের হতে হবে। দু বছরের কম হলে কুরবানী হবে না। উট পাঁচ বছরের হলে কুরবানী হবে। তার কম হলে জায়েয হবে না।

৮. যে পশুর শিং জন্ম থেকে ওঠেনি, অথবা ওঠার পর কিছু অংশ ভেঙ্গে গেছে তাহলে তার কুরবানী করা জায়েয হবে। কিন্তু শিং যদি গোড়া থেকেই ভেঙ্গে যায় তাহলে তা কুরবানী জায়েয হবে না।

৯. অন্ধ, কানা পশুর কুরবানীও জায়েয নয়। যে পশু তিন পায়ের ওপর চলে এমন ল্যাংড়া পশু কুরবানী করাও জায়েয হবে না। চতুর্থ পা যদি মাটিতে রাখে কিন্তু খুড়িয়ে চলে, তাহলে দুরস্ত হবে।

১০. যে পশুর কান এক তৃতীয়াংশের বেশী কাটা অথবা লেজ এক তৃতীয়াংশের বেশী কাটা তার কুরবানী দুরস্ত হবে না।

১১. দুর্বল ও জীর্ণশীর্ণ পশু কুরবানী করা জায়েয হলেও মোটাতাজা ও সুন্দর পশু কোরবানী করা ভালো। পশু যদি এমন দুর্বল ও জীর্ণশীর্ণ হয় যে, তার হাড় একেবারে মজ্জাহীন হয়ে পড়েছে তাহলে তার কুরবানী দুরস্ত হবে না।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন যে, নবী (স) শিং বিশিষ্ট মোটা তাজা একটা দুম্বা কুরবানী করছিলেন যার চোখের চারপাশে কালো রং ছিল, যার মুখও কালো রঙের ছিল এবং যার পাগুলো ছিল কালো রঙের। (আবু দাউদ)

১২. যে পশুর জন্ম থেকেই কান হয়নি অথবা হয়ে থাকলে খুব ছোট ছোট তা কুরবানী করা দুরস্ত হবে।

১৩. যে পশুর দাঁত মোটেই নেই তার কুরবানী করা দুরস্ত হবে না। কিন্তু দাঁত পড়ে গেছে এবং অধিকাংশ দাঁত আছে তাহলে জায়েয হবে।

১৪. খাসি, পাঠা কুরবানী জায়েয। নবী (স) স্বয়ং খাসি দুম্বা কুরবানী করেছেন।

১৫. যার ওপর কুরবানী ওয়াজিব এমন এক সচ্ছল ব্যক্তি কুরবানীর জন্যে একটি পশু খরিদ করলো। খরিদ করার পর তার মধ্যে এমন ত্রুটি পাওয়া গেল, যার জন্যে তা কুরবানী করা দুরস্ত হলো না। তখন সে আর একটি পশু খরিদ করে কুরবানী করবে। তবে কোনো দরিদ্র লোকের এমন অবস্থা হলে- যার ওপর কুরবান ওয়াজিব ছিল না, তার পক্ষে ঐ ত্রুটি পূর্ণ পশু কুরবানী করা জায়েয হবে।

১৬. গাই-বকরী গর্ভবতী হলেও তা কুরবানী জায়েয হবে। বাচ্চা জীবিত হলে তাও যবেহ করা উচিত।

কুরবানীর হুকুম

১. কুরবানী করা ওয়াজিব। হযরত আবু হুরাইয়া (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করবে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।

হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) কে একজন জিজ্ঞেস করলো কুরবানী কি ওয়াজিব? তিন বলেন, নবী (স) এবং মুসলমানগণ কুরবানী করেছেন। ঐ ব্যক্তি পুনরায় সে প্রশ্ন করলে তার জবাবে হযরত আবদুল্লাহ বলেন, তুমি বুঝতেছ না যে, নবী (স) এবং মুসলমানগণ কুরবানী করেছেন।

২. কুরবানী কারেন এবং মুতামাত্তার ওপরে ওয়াজিব। তবে মুফরেদের ওপর ওয়াজিব নয়। সে যদি আপন ইচ্ছায় করে তাহলে তার সওয়াব পাবে।

৩. হাজীদের ছাড়া অন্যান্য সাধারণ মুসলমানের ওপর কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার দুটো শর্ত রয়েছে। প্রথম শর্ত এই যে,যে সচ্ছল হবে। সচ্ছল হওয়ার অর্থ তার ততোটা ধন-সম্পদ থাকতে হবে যে মৌলিক প্রয়োজন পূরণের অতিরিক্ত এতো সম্পদ থাকবে যে, তার হিসেব করলে নেসাব পরিমাণ হবে।

অর্থাৎ যার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব।

দ্বিতীয় শর্ত এই যে, মুকীম হতে হবে। মুসাফিরের ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।

৪. কুরবানী শুধু নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজিব- না বিবির পক্ষ থেকে, আর না সন্তানের পক্ষ থেকে।

৫. কোন ব্যক্তির ওপরে শরীয়াতের দৃষ্টিতে কুরবানী ওয়াজিব ছিল না। কিন্তু সে কুরবানী করার নিয়তে পশু খরিদ করেছে। তাহলে সে পশু কুরবানী করা তার ওয়াজিব হবে।

৬. এক ব্যক্তির ওপর কুরবানী ওয়াজিব ছিল, কুরবানীর তিন দিন অতীত হয়ে গেলে কোনো কারণে সে কুরবানী করতে পারলো না। যদি এ উদ্দেশ্যে সে কোনো ছাগল খরিদ করে থাকে তাহলে জীবিত সে ছাগল খয়রাত করে দেবে। খরিদ করে না থাকলে একটি ছাগলের মূল্য খয়রাত করবে।

৭. কেউ এ বলে মানত মানলো যে, যদি আমার অমুক কাজটি হয়ে যায় তাহলে কুরবানী করবো। আল্লাহর ফযলে তার সে কাজ হয়ে গেল। এখন সে ব্যক্তি সচ্ছল হোক অথবা অসচ্ছল তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। মানত কুরবানীর হুকুম এই যে, তার সমস্ত গোস্ত গরীব ও অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দেবে- না কুরবানীকারী খাবে এবং না কোনো সচ্ছল ব্যক্তিকে খাওয়াবে।

কুরবানীর দিনগুলো ও সময়

১. ঈদুল আযহা অর্থাৎ যুলহজ্জের দশ তারিখ থেকে বারো তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত কুরবানী করার সময়। এ তিন দিনের যে কোনো দিনে সুযোগ সুবিধা মতো কুরবানী করা জায়েয। তবে কুরবানী করর সবচেয়ে উত্তম দিন হলো ঈদুল আযহার দিন। তারপর এগারো তারিখে এবং তার বারো তারিখে।

২. শহর ও বন্দরের অধিবাসীদের জন্যে ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী জায়েয নয়। নামাযের পর কুরবানী করবে। তবে গ্রামাঞ্চলের লোক ফজর নামাযের পরও কুরবানী করতে পারে। (সম্ভবত এজন্যে যে, বহু দুর দূরান্তের ঈদগাহ থেকে নামা পড়ে আসতে বহু বিলম্ব হবে এমন কি বিকেল হয়ে যেতে পারে।)

৩. শহরের অধিবাসী যদি তাদের কুরবানী গ্রামাঞ্চলে করায় তাহলে তাদের কুরবানী গ্রামাঞ্চলে ফজরের পরও হতে পারে। ঈদের নামাযের পূর্বই যদি গোস্ত এসে যায় তাহলেও কুরবানী জায়েয হবে।

৪. কুরবানীর দিনগুলোতে অর্থাৎ ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখের সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত যে কোনো সময়ে দিনে বা রাতে, কুরবানী করা জায়েয।

তবে রাতে কুরবানী না করা ভালো। কারণ কোনো রগ হয়তো ভালোভাবে কাটা নাও যেতে পারে যার জন্যে কুরবানী দুরস্ত হবে না।

৫. কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার দুটো শর্ত মুকীম হওয়া এবং সচ্ছল হওয়া। যদি কোনো ব্যক্তি সফরে থাকে এবং বারো তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে বাড়ী পৌঁছে এবং সে যদি সচ্ছল হয় তাহলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে; সে যদি মুকীম এবং দরিদ্র হয়, কিন্তু ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে যদি আল্লাহ তাকে মালদার বানিয়ে দেয় তাহলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে।

কুরবানীর বিভিন্ন মাসায়েল

১. কুরবানী করার সময়ে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা বা দোয়া পড়া জরুরী নয়। শুধু মনের নিয়ত ও ইরাদা কুরবানী সহীহ হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। তবে মুখে দোয়া পড়া ভালো।

২. নিজের কুরবানী নিজ হাতে যবেহ করা ভালো। কোনো কারণে নিজে যবেহ করতে না পারলে- পশুর কাছে হাজির থাকা দরকার। যেমন নবী (স) হযরত ফাতেমা (রা) কে বলেছিলেন ফাতেমা চল, তোমার কুরবানীর কাছে দাঁড়িয়ে থাক। এ জন্যে যে, তার প্রতিটি রক্ত কণার বদলায় তোমার পূর্বের গোনাহ মাফ হয়ে যায়। ফাতেমা বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ। একি আমাদের আহলে বায়তের জন্যে নির্দিষ্ট, না সকল সাধারণ মুসলমানদের জন্যে? নবী (স) বলেন, আমাদের জন্যেও এবং সকল মুসলমানদের জন্যেও। (জামেউল ফাওয়ায়েদ)

৩. গরু মহিষ প্রভৃতি কুরবানীতে কয়েকজন শরীক হলে গোস্ত ভাগ অনুমান করে করা চলবে না। বরঞ্চ মাথা, গুর্দা, কলিজী প্রভৃতি প্রত্যেক জিনিস সমান সমান সাত ভাগ করতে হবে। তারপর যার যেতো অংশ তাকে ততোটা দিতে হবে।

৪. কুরবানীর গোস্ত নিজেও খাবে এবং আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবের মধ্যেও বণ্টন করা যায়। এক তৃতীয়াংশ গরীব মিসকিনের মধ্যে বণ্টন করে বাকী নিজের মধ্যে এবং আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের মধ্যে বন্টন করা ভালো। কিন্তু এটা অপরিহার্য নয় যে, এক তৃতীয়াংশ গরীবদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। তার কম গরীব দুঃখীদের মধ্যে বণ্টন করলেও কোন দোষ নেই।

৫. গরু মহিষ বা উটে কয়েক ব্যক্তি অংশীদার রয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে গোস্ত ভাগ করে নেয়ার পরিবর্তে যদি সব একত্রে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতে অথবা রান্না করে তাদেরকে খাওয়াতে চায় তাহলে তা জায়েয হবে।

৬. কুরবানীর গোস্ত অমুসলিমকে দেয়াও জায়েয। তবে মজুরী বাবদ দেয়া জায়েয নয়।

৭. কুরবানীর চামড়া অভাবগ্রস্তকে দেয়া যায় অথবা তা বিক্রি করে মূল্যও খয়রাত করা যায়। এ মূল্য তাদেরকে দেয়া উচিত যাদেরকে যাকাত দেয়া যায়।

৮. কুরবানীর চামড়া নিজের কাজেও ব্যবহার করা যায়। যেমন জায়নামাজ বানানো হলো।

৯. কসাইকে গোস্ত বানাবার মজুরী স্বরূপ গোস্ত, চামড়া, রশি প্রভৃতি দেয়া ঠিক হবে না। মজুরী পৃথক দিতে হবে। রশি, চামড়া প্রভৃতি খয়রাত করতে হবে।

১০. যার ওপর কুরবানী ওয়াজেব তাকে তো করতেই হবে। যার ওপর ওয়াজিব নয়, তার যদি খুব বেশী কষ্ট না হয় তাহলে তারও করা উচিত। অবশ্য ধার কর্জ করে কুরবানী করা ঠিক নয়।

মৃত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে কুরবানী

আল্লাহ যাকে ধন সম্পদ দিয়ে ধন্য করেছেন সে শুধু তার ওয়াজিব কুরবানী করেই ক্ষান্ত হবে না। বরঞ্চ কুরবানীর অফুরন্ত সওয়াব পাওয়ার জন্যে আপন মুরব্বীদের পক্ষ থেকে যথা মৃত মা-বাপ, দাদা-দাদী ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করা ভালো। এমন কি যার বদৌলতে হেদায়াত ও ঈমানের সম্পদ লাভ সম্ভব হয়েছে এমন হাদী ও মুরশিদের পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়া তো মুমিনের জন্যে অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়। এভাবে আযওয়াজে মুতাহহেরা অর্থাৎ রূহানী মা-দের পক্ষ থেকে কুরবানী করাও অশেষ সৌভাগ্যের কথা।

হাদীর বয়ান

হাদী শব্দের আভিধানিক অর্থ হাদীয়া তোহফা, শরীয়াতের পরিভাষায় হাদী ঐ পশুকে বলা হয় যাকে হেরেম যিয়ারতকারী কুরবানীর জন্যে সাথে নিয়ে যায় অথবা কোনো উপায়ে সেখানে পাঠিয়ে দেয়।

১. হাদী তিন প্রকারঃ উট, গরু, ছাগল। উট সর্বোৎকৃষ্ট হাদী এবং ছাগল সর্বনিম্ন। ভেড়া, দুম্বা প্রভৃতি ছাগলের পর্যায়ে এবং মহিষ প্রভৃতি গরু গাভীর পর্যায়ে।

২. হাদীর পশুর বয়স, স্বাস্থ্য প্রভৃতি সম্পর্কে হুকুম ও শর্ত তাই যা কুরবানীর পশু সম্পর্কে রয়েছে।

৩. হাদী যদি ইচ্ছাকৃত হয়,যেমন ইফরাদ হজ্জকারী আপন ইচ্ছায় নফল কুরবানী করে। তাহলে সে কুরবানীর গোস্ত হাদীকারী নিজেও খেতে পারে। তেমনি কেরান ও তামাত্তু হজ্জকারী আপন আপন কুরবানীর গোস্ত খেতে পারে। যেমন সাধারণ কুরবানীর গোস্ত খাওয়া জায়েয। কারণ কেরান এবং তামাত্তুর হাদী কোনো অপরাধ অথবা ত্রুটি বিচ্যুতির কাফফারা নয়। বরঞ্চ শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্যে আল্লাহ তায়ালা কেরান ও তামাত্তু হজ্জকারীর ওপর ওয়াজিব করেছেন। এজন্যে সাধারণ কুরবানীর গোস্তের মতো তা খাওয়া জায়েয। নবী (স) তার হাদীর প্রত্যেকটি পশুর এক এক টুকরা রান্না করিয়ে খেয়েছেন এবং তার শুরবাও পান করেছেন। সহীহ মুসলিমে হযরত জাবের (রা) এর বর্ণনা এবং অন্যান্য হাদীসের বর্ণনা থেকে একথা প্রমাণিত আছে যে, নবী (স) হজ্জে কয়েকটি কুরবানী করেন।

প্রকাশ থাকে যে, কেরান এবং তামাত্তু তো একটি কুরবানীই হয়ে থাকে এবং বাকীগুলো নফলই হয়ে থাকবে। তিনি যখন প্রত্যেকটি থেকে এক একটা টুকরা রান্না করিয়ে খেয়েছেন তাহলে জানা গেল যে, তামাত্তু, কেরান এবং নফল তিন প্রকারের গোস্ত কুরবানীকারী স্বয়ং খেতে পারে।

৪. তামাত্তু, কেরান ও ইচ্ছাকৃত নফল কুরবানীর গোস্ত ছাড়া কোনো হাদীর গোস্ত নিজের খাওয়া জায়েয নয়। তা সে কোনো অপরাধের কাফফারার হাদী হোক কিংবা মানতের অথবা ইহসাবের দমের (পরিভাষা দ্রষ্টব্য) কুরবানী হোক। নবী (স) যখন হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় বাধাপ্রাপ্ত হলেন এবং বায়তুল্লাহ পর্যন্ত যেতে পারলেন না, তখন তিনি নাজিরা আসালামীর মাধ্যমে ইহসারের হাদী পাঠিয়ে দিলেন এবং নির্দেশ দিলেন যে, তার গোস্ত সে যেন না খায় এবং সঙ্গীকেও খেতে না দেয়।

৫. যে হাদীর গোস্ত নিজের খাওয়া জায়েয নয় তার সমস্ত গোশত ফকীর মিসকিনকে সদকা করে দিতে হবে এবং তা করা ওয়াজিব। হেরেমের গরীবদের মধ্যে হোক অথবা তার বাইরের হোক উভয়ই জায়েয। হেরেমের গরীবদের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। (আয়নুল হেদায়া)

৬. যে হাদীর গোস্ত খাওয়া জায়েয তার সমস্ত গোস্ত ফকীর মিসকিনকে সদকা করা ওয়াজিব নয়। বরঞ্চ মুস্তাহাব। তার তিন ভাগ করা উচিত। এক ভাগ নিজের জন্যে, এক ভাগ আত্মীয় স্বজনের জন্যে এবং এক ভাগ ফকীর মিসকিনের জন্যে। তবে এমন করা জরুরী নয়। সমস্তই ফকীর মিসকিনকে দিলেও তা জায়েয হবে।

আবে যমযম, আদব কায়দা ও দোয়া

বায়তুল্লাহর পূর্বদিকে একটি ঐতিহাসিক কূপ আছে যাকে যমযম বলে। হাদীসে এ কুয়ার অনেক ফযিলত ও তার পানির অনেক বরকত ও ফযিলত বয়ান করা হয়েছে। হযরত ইবরাহীম (আ ) আল্লাহর হুকুমে যখন হযরত ইসমাঈল (আ ) ও তার মা হযরত হাজেরা (আ ) কে মক্কার বারিহীন মরুভূমিতে এনে পুনর্বাসিত করলেন তখন আল্লাহ তায়ালা মাতা ও সন্তানের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে প্রস্তরময় প্রান্তরে তাদের জন্যে যমযম প্রস্রবণ প্রবাহিত করে ছিলেন। হাদীসে আছে-

*******আরবী*********

এ হচ্ছে জিবরাঈলের তৈরী করা কূপ এবং ইসমাঈল (আ ) এর পানি পানের ছোট হাউজ। (দারু কুতনী)

সায়ী এবং মাথা মুণ্ডন প্রভৃতি শেষে পেট ভরে যমযমের পানি পান করা উচিত। এমন বেশী করে পানি পান করা, যাতে পাঁজরাগুলো ডুবে যায়, এটা ঈমানের আলামত। ঈমান থেকে বঞ্চিত মুনাফিক এতোটা পান করতে পারে না। নবী (স) বলেন আমাদের এবং মুনাফিকদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চিহ্ন এই যে, মুনাফিক যমযমের পানি পেটভরে পান করতে পারে না যাতে পাঁজরা ডুবে যায়। (ইবনে মাজাহ)

আবে যমযমের বরকত ও ফযিলত বয়ান করতে গিয়ে নবী (স) বলেন, আবে যমযম যে উদ্দেশ্যেই পান করা হয় তার জন্যেই ফলদায়ক হয়। রোগ আরোগ্যের জন্য পান করলে আল্লাহ আরোগ্য দান করবেন। তৃপ্তি লাভের জন্যে পান করা হলে আল্লাহ তৃপ্তিদান করবেন। পিপাসা নিবারণের জন্যে পান করলে আল্লাহ পিপাসা নিবারণ করবেন। এ হচ্ছে সেই কুয়া যা জিবরাঈল (আ ) পায়ের গোড়ালির আঘাতে খনন করেন এবং এ হচ্ছে ইসমাঈল (আ ) এর পানি পানের উন্মুক্ত জলাধার। (দারু কুতনী)

অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশে হযরত জিবরাঈল (আ )বিশেষভাবে হযরত ইসমাঈল (আ ) ও তার মাতা হযরত হাজেরা (আ )এর জন্যে বারিহীন অনুর্বর প্রান্তরে যমযম বানিয়ে দিয়েছিলেন যাতে করে তাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা মিটে যায়।

হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) এরশাদ করেছেন, দুনিয়ার সকল পানি থেকে উৎকৃষ্ট যমযমের পানি। ক্ষুধার্তদের জন্যে এ আহার, রোগীর জন্য আরোগ্য। (ইবনে আব্বাস)

তিনি আরও বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি ও উদ্দেশ্যে যমযমের পানি পান করে যে, সে দুশমন থেকে আশ্রয় লাভ করবে- তাহলে সে আশ্রয় পাবে।(হাকেম)

যমযমের পানি দাড়িয়ে এবং বিসমিল্লাহ বলে পান করা উচিত এবং পেটভরে পান করা উচিত। পান করার সময় এ দোয়া পড়বে।

*******আরবী*********

আয় আল্লাহ আমি তোমার কাছে মঙ্গলকর ইলম চাই, প্রশস্ত রুজি চাই এবং প্রত্যেক রোগ থেকে আরোগ্য চাই। (নায়লুল আওতার)
মুলতাযেম ও তার দোয়া
মুলতাযেম বায়তুল্লাহর ও দেয়ালের সে অংশকে বলে যা কাবার দরজা এবং হিজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এ প্রায় ছফুটের অংশ এবং দোয়া কবুলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর মধ্যে একটি। এর সাথে দেহ বুক ও মুখ লাগিয়ে বিনয় ও নম্রতার সাথে ও কাতর কণ্ঠে দোয়া করা হজ্জের একটি মসনুন আমল । তাওয়াফ শেষ করার পর মুলতাযেমের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হওয়া ও দোয়া করা বিশেষ করে এমন এক অনুভূতি ও ভাবাবেগ সৃষ্টি করে যে, এটা বায়তুল্লাহ থেকে বিদায় হওয়ার এক বেদনা দায়ক মুহূর্ত।

হযরত আমর ইবনে শোয়াইব বলেন, আমার পিতা শুয়াইব বর্ণনা করেছেন, আমি আমার পিতা আবদুল্লাহ ইবনে আমর আল আস (রা) এর সাথে তাওয়াফ করার সময় কিছু লোক কে বায়তুল্লাহর সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ দেখলাম। তখন আবদুল্লাহ ইবনে আমেরকে বললাম, আমাকে একটু ঔ জায়গায় নিয়ে চলুন। লোকদের সাথে আমরাও বায়তুল্লাহর সাথে আলিঙ্গন করি। তিনি বললেন আউযুবিল্লাহে মিনশ শায়তানির রাজিম। তারপর যখন তিনি তাওয়াফ শেষ করলেন তখন হিজরে আসওয়াদ ও কাবার দরজার মধ্যবর্তী বায়তুল্লাহের ঐ অংশের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে বললেন, আল্লাহর কসম এটা ঐ স্থান যার সাথে নবী (স) কে আলিংগনাবস্থায় দেখেছি। (বায়হাকী)

আবু দাউদের বর্ণনায় আছে, আবদুল্লাহ বিন আমের (রা) হিজরে আসওয়াদ এবং বাবে কাবার মাঝে দাড়িয়ে গেলেন এবং আপন বক্ষ মুখ মণ্ডল ও দুহাত প্রসারিত করে কাবার দেওয়ালে রাখলেন এবং বললেন নবী (স) এমন করতে দেখেছি। (আবু দাউদ)

মুলতাযেমের দোয়া সম্পর্কে নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি বিপদাপন্ন হয়ে এখানে দোয়া চাইবে সে অবশ্যই নিরাপদ হবে। (আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ)

মুলতাযেমের সাথে দেহ আবিষ্ট করে প্রথমে নিম্নের দোয়া পড়বে। তারপর দ্বীন দুনিয়ার জায়েজ মনস্কামনা পূরণের দোয়া করবে:

*******আরবী*********

আয় আল্লাহ! প্রশংসার হকদার তুমিই, এমন প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা যার দ্বারা তোমার নিয়ামতের কিছু হক আদায় হতে পারে। আর এ সব নিয়ামতের উপর কিছু এহসান কিছু এনামের কিছু বিনিময় হতে পারে। আমি তোমার প্রশংসা করছি তোমার ঐসব গুণাবলীর সাথে যা আমার জানা আছে আর যা আমার জানা নেই। আমি তোমার প্রশংসা করছি তোমার ঐসব নিয়ামতের সাথে যা আমার জানা আছে আর যা আমার জানা নেই। সকল অবস্থায় আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। আয় আল্লাহ! দরুদ ও সালাম মুহাম্মদ (স) এর উপরে এবং মুহাম্মদের বংশধরের উপর। আয় আল্লাহ! মরদূদ শয়তান থেকে তোমার পানাহ চাই এবং প্রত্যেক অনিষ্ট থেকে আমাকে আশ্রয় দাও।তুমি যা কিছু আমাকে দিয়েছ তার উপর সন্তুষ্ট থাকতে দাও। আমার জন্য তাতে বরকত দাও। আয় আল্লাহ! তুমি আমাকে তোমার সম্মানিত মেহমানদের মধ্যে শামিল কর। আর তুমি আমাকে সোজা পথে চলবার তাওফীক দাও, রাব্বুল আলামীন, যতক্ষণ না আমি তোমার সাথে মিলিত হই।

দোয়া কবুলের স্থানসমূহ

হজ্জের সময় প্রত্যেক আমল করতে গিয়ে যিকর তসবীতে মশগুল থাকা এবং প্রত্যেক স্থানে বেশী করে দোয়া করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে কিছু নির্দিষ্ট স্থানে অধিক পরিমাণ দোয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। হযরত হাসান বসরী যখন মক্কা থেকে বসরায় ফিরে যাচ্ছিলেন তখন মক্কাবাসীদের নিকট একখানা পত্র লেখেন। তাতে তিনি মক্কায় অবস্থানের গুরুত্ব ও ফযিলত বয়ান করেন এবং বিশেষ করে বলেন যে, নিম্নের এগারটি স্থানে বিশেষভাবে মুমিনের দোয়া কবুল হয়ঃ

১. মুলতাযেমের সাথে দেহ মন আবিষ্ট করে দোয়া করা। নবী (স) বলেন, মুলতাযেম এমন এক স্থান যেখানে দোয়া কবুল হয়। এখানে বান্দাহ যে দোয়াই করে তা কবুল হয়।

২. মিযআবের নিচে।

৩. পাক কাবার ভিতরে।

৪. যমযমের নিকটে।

৫. সাফা-মারওয়ায়।

৬. সাফা-মারওয়ায় যেখানে দৌড়ে চলতে হয়।

৭. মাকামে ইবরাহীমের নিকটে।

৮. আরাফাতের ময়দানে।

৯. মুযদালফায়ে।

১০. মিনায়।

১১. জুমরাতের পাশে।
ওমরা
ওমরা অর্থ প্রতিষ্ঠিত গৃহের যিয়ারত করা এবং শরীয়াতের পরিভাষায় ওমরার অর্থ ছোট হজ্জ যা সবসময়ে হতে পারে। তার জন্যে কোনো মাস ও দিন নির্ধারিত নেই। যখনই মন চাইবে ইহরাম বেধে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে, সায়ী করবে এবং মস্তক মুণ্ডন বা চুল ছেঁটে ইহরাম খুলবে। ওমরা হজ্জের সাথেও করা যায় এবং আলাদাও করা যায়। কুরআন বলে-

*******আরবী*********

এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে হজ্জ ও ওমরা করি। (সূরা আল বাকারা)

হাদিসে ওমরার বিরাট ফযিলত বয়ান করা হয়েছে। নবী (স) বলেন, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট আমল ঈমানের সাক্ষ্যদান। তারপর হিজরত ও জিহাদের মর্যাদা। তারপর দুটো আমলের চেয়ে উৎকৃষ্ট আমল আর কিছু নেই। একটি হজ্জে মাবরুর এবং দ্বিতীয়টি ওমরাহ মাবরুর। (মুসনাদে আহমদ)

ওমরাহ মাবরুর অর্থ এমন ওমরাহ যা নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে তার সকল নিয়ম নীতি ও শর্তগুলোসহ পালন করা হয়।

নবী (স) আরও বলেন, যে ব্যক্তি হজ্জ অথবা ওমরার নিয়তে বাড়ী থেকে রওয়ানা হলো এবং তারপর সে পথেই মৃত্যুবরণ করলো, সে বিনা হিসেবে বেহেশতে যাবে। আল্লাহ তায়ালা বায়তুল্লাহ যিয়ারতকারীদের জন্যে গর্ববোধ করেন। (বায়হাকী, দারুকুতনী)

নবী (স) বলেন, হজ্জ ও ওমরাহকারী আল্লাহর মেহমান। তারা আল্লাহর দাওয়াতে আসে। অতএব, তারা যা কিছু তার কাছে চায়, তা পায়। (আল বাযযার)

এক ওমরাহ দ্বিতীয় ওমরাহ পর্যন্ত গুনাহগুলোর কাফফারা হয়ে যায়। (বুখারী, মুসলিম)

ওমরার মাসায়েল

১. জীবনে একবার ওমরা করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। তাছাড়া তা যখনই করা হোক, তার জন্যে প্রতিদান ও বরকত রয়েছে। হযরত জাবের (রা) বলেন, নবী (স) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- ওমরাহ কি ওয়াজিব? নবী (স) বলেন- না, তবে ওমরা করো, এর বড়ো ফযিলত রয়েছে।

২. ওমরার জন্যে কোনো মাস, দিন ও সময় নির্ধারিত নেই যেমন হজ্জের জন্যে রয়েছে। যখনই সুযোগ হবে ওমরাহ করা যেতে পারে।

৩. রমযানে ওমরাহ করা মুস্তাহাব। নবী (স) বলেন, রমযানে ওমরা করা এমন যেন আমার সাথে হজ্জ করা। (আবু দাউদ) বুখারীতে আছে, রমযানে ওমরা হজ্জের সমান।

৪. ওমরার জন্যে মীকাত হচ্ছে হিল এবং সকলের জন্যেই তাই, চাই তারা আফাকী হোক অথবা মীকাতের ভেতরের হোক অথবা মক্কার অধিবাসী হোক। হজ্জের মীকাত মক্কাবাসীদের জন্যে হিল।

৫. ওমরার আমল শুধু ইহরাম বাধা, তাওয়াফ করা, সায়ী করা এবং মাথা মুণ্ডন করা অথবা চুল ছোট করা।
হজ্জের প্রকার
হজ্জ তিন প্রকার এবং প্রত্যেকের পৃথক পৃথক মাসায়েল রয়েছে। (১) হজ্জে এফরাদ, (২) হজ্জে কেরান, (৩) হজ্জে তামাত্তু।

হজ্জে এফরাদ

এফরাদের আভিধানিক অর্থ একাকী করা, এক কাজ করা প্রভৃতি। শরীয়াতের পরিভাষায় এফরাদ ঐ হজ্জকে বলে যার সাথে ওমরাহ করা হয় না, শুধু হজ্জের ইহরাম বাধা হয় এবং হজ্জের রীতি পদ্ধতি পালন করা হয়। এফরাদ হজ্জকারীকে মুফরেদ বলা হয়। মুফরেদ এহরাম বাধার সময় শুধু হজ্জে নিয়ত করবে এবং পূর্ব বর্ণিত হজ্জের রুকনগুলো পালন করবে। মুফরেদের ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।

হজ্জে কেরান

কেরান শব্দের অর্থ দুটো জিনিসকে একত্রে মিলানো।পরিভাষা হিসেবে হজ্জ ও ওমরার এহরাম এক সাথে বেধে উভয়ের রুকন পালন করাকে হজ্জে কেরান বলে। এ হজ্জকারীকে কারেন বলে।

হজ্জে কেরান এফরাদ ও তামাত্তু থেকে উৎকৃষ্ট। (ইমাম শাফেয়ীর মতে এফরাদ উৎকৃষ্ট এবং ইমাম মালেকের মতে তামাত্তু উৎকৃষ্ট। এজন্যে যে হজ্জে তামাত্তুর উল্লেখ কুরআনে আছে। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল বলেন, কুরবানীর পশু সাথে থাকলে কেরান উৎকৃষ্ট, না থাকলে তামাত্তু উৎকৃষ্ট। আহলে হাদীসের মতে হজ্জে কেরান ওমরা ও হজ্জের জন্যে একই তাওয়াফ ও সায়ী যথেষ্ট।)

হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (র) বলেন, নবী (স) বলেছেন, হজ্জ ওমরাহ একত্রে মিলিয়ে আদায় কর। এজন্যে যে, এ দুটো দারিদ্র্য ও গুনাহ এমনভাবে নির্মূল করে দেয় যেমন আগুনের চুল্লি লোহা ও সোনা চাঁদির ময়লা নির্মূল করে দেয়। (তিরমিযি)

কেরানের মাসায়েল

১. হজ্জের মাসগুলোতে ওমরাহ করা কারেনের জন্যে জরুরী।

২. হজ্জে কেরানে ওমরার তাওয়াফ হজ্জের তাওয়াফের আগে করা ওয়াজিব।এবং ওমরার জন্যে পৃথক তাওয়াফ ও সায়ী এবং হজ্জের জন্যেও পৃথক।

৩. কেরানের ওমরায় সকল কাজ সমাধার পর হজ্জের কাজ শুরু করা মসনুন।

৪. কারেনের ওমরার পর মস্তক মুণ্ডন বা চুল ছাটা নিষেধ।

৫. কারেনের জন্যে ওমরার তাওয়াফ এবং হজ্জের তাওয়াফে কুদুম এক সাথে করা জায়েয বটে এবং উভয়ের সায়ীও এক সাথে করা জায়েয, কিন্তু এসব করা সুন্নাতের খেলাপ।

৬. কারেনের জন্যে কুরবানী ওয়াজিব। এ কুরবানী এমন শুকরিয়া আদায়ের জন্যে যে, আল্লাহ হজ্জ ওমরা এক সাথে আদায় করার সুযোগ দিয়েছেন। কুরবানীর সামর্থ্য না থাকলে দশ রোযা রাখা ওয়াজিব। তিন রোযা কুরবানীর দিনের আগে এবং সাত রোযা আইয়ামে তাশরীকের পর। কুরআন বলে-

*******আরবী*********

যার কুরবানী দেয়ার সামর্থ্য নেই, সে তিন দিন রোযা রাখবে হজ্জের সময়ে এবং সাত রোযা রাখবে যখন তোমরা হজ্জ শেষ করে ফিরবে, এ মোট দশ দিন।

৭. হজ্জে কেরান ও তামাত্তু শুধু তাদের জন্যে যারা মীকাতের বাইরের অধিবাসী তাদেরকে আফাকী বলা হয়। কুরআন বলেঃ

*******আরবী*********

এ (তামাত্তু ও কেরান) তাদের জন্যে যাদের পরিবার মসজিদে হারামের থাকে না। যারা মীকাতের ভেতরের অধিবাসী তাদের জন্যে শুধু হজ্জে এফরাদ।

হজ্জে তামাত্তু

তামাত্তু শব্দের অর্থ কিছুক্ষণের জন্যে সুযোগ সুবিধা ভোগ করা।পারিভাষিক অর্থে হজ্জে তামাত্তু যাকে বলা হয়, তাহলো এই যে, ওমরাহ ও হজ্জ সাথে সাথে করা। এমনভাবে করা যে, এহরাম পৃথক পৃথক বাধবে এবং ওমরাহ করার এহরাম খুলবে এবং ঐসব সুযোগ ভোগ করবে যা ইহরাম অবস্থায় হারাম ছিল। তারপর হজ্জের এহরাম বেধে হজ্জ করবে। এ ধরনের হজ্জে যেহেতু ওমরাহ ও হজ্জের মধ্যবর্তী সময়ে এহরাম খুলে হালাল বস্তু উপভোগ করার সময় পাওয়া যায়, সেজন্যে একে হজ্জে তামাত্তু বলে।

কুরআন বলে

*******আরবী*********

অতএব যে ব্যক্তি হজ্জের দিনগুলোর মধ্যে ওমরার ফায়দা লাভ করতে চায় তার জন্যে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কুরবানী।

হজ্জে তামাত্তু এফরাদ থেকে ভালো। এজন্যে যে এর মধ্যে দুটো ইবাদাত এক সাথে জমা করার সুযোগ পাওয়া যায়। আর কিছু অধিক ইবাদাত পদ্ধতি সমাধা করার সৌভাগ্য লাভ করা যায়।

হজ্জে তামাত্তুর দুটো উপায় আছে। একটি এই যে, কুরবানীর পশু সাথে নিয়ে যাবে। দ্বিতীয় এই যে, হাদীর পশু সাথে করে নিবে না। প্রথমটি দ্বিতীয়টি থেকে উৎকৃষ্ট।

তামাত্তুর মাসায়েল

১. তামাত্তুকারীর জন্যে জরুরী যে, সে ওমরার তাওয়াফ হজ্জের মাসগুলোতে করবে। (হজ্জে মাসগুলো হলো, শাওয়াল, যুলকাদ ও যুলহজ্জের প্রথম দশ দিন) অথবা অন্ততপক্ষে ওমরার তাওয়াফের অধিকাংশ চক্কর হজ্জের সময়কালের মধ্যে হতে হবে।

২. তামাত্তু হজ্জের জন্যে জরুরী এই যে, ওমরাহ ও হজ্জের তাওয়াফ একই বছর হতে হবে। কেউ যদি এক বছর ওমরার তাওয়াফ করে এবং দ্বিতীয় বছর হজ্জের তাওয়াফ, তাহলে তাকে তামাত্তুকারী বলা যাবে না।

৩. তামাত্তুর জন্যে জরুরী এই যে, প্রথমে ওমরার এহরাম বাধতে হবে এবং এটাও জরুরী যে, হজ্জের এহরাম বাধার পূর্বে ওমরার তাওয়াফ করে ফেলতে হবে।

৪. তামাত্তুকারীর জন্যে জরুরী এই যে, ওমরাহ ও হজ্জের এহরামের মাঝখানে আলমাম করবে না। আলমামের অর্থ ওমরার এহরাম খোলার পর আপন পরিবারের মধ্যে গিয়ে পড়বে না। তবে কুরবানীর পশু সাথে করে আনলে তামাত্তু সহীহ হবে।

৫. হজ্জে তামাত্তু শুধু তাদের জন্যে যারা মীকাতের বাইরের অধিবাসী। যারা মক্কায় অথবা মীকাতের ভিতরে বসবাস করে তাদের জন্যে তামাত্তু ও কেরান মাকরূহ তাহরিমী। (ইলমুল ফেকাহ)

৬. তামাত্তুকারীর জন্যে তাওয়াফে কুদুম করা মসনুন এবং তার উচিত তাওয়াফে যিয়ারতে রমল করা।

৭. কারেনের মতো তামাত্তুকারীর জন্যেও কুরবানী ওয়াজিব। সামর্থ্য না থাকলে দশ রোযা করবে হজ্জের সময় কুরবানীর দিনের আগে তিন রোযা এবং আইয়ামে তাশরীকের পর সাত রোযা।

৮. তামাত্তুকারী যদি কুরবানীর পশু সাথে না এনে থাকে তাহলে ওমরার সায়ী এবং মাথা মুন্ডানোর পর এহরাম খুলবে। সাথে কুরবানীর পশু আনলে এহরাম খুলবে না, ১০ই যুল হজ্জ কুরবানী করার পর এহরাম খুলবে।

নবীর বিদায় হজ্জ

নবী (স) এর সাহাবী হযরত জাবের (রা) এর ভাষায়ঃ

মদীনায় শেষ সাহাবী হযরত জাবের (রা) তার মৃত্যুর পর মদীনায় আর কোনো সাহাবী ছিলেন না। তিনি খুব বৃদ্ধ হয়েছিলেন এবং বয়স হয়েছিল নব্বইয়েরও বেশী। দৃষ্টিশক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলেন। এ সে সময়ের ঘটনা যখন হযরত হুসাইন (রা) এর পৌত্র মুহাম্মাদ বিন আলী অর্থাৎ ইমাম বাকের হযরত জাবের (রা) এর খেদমতে হাজির হন। ইমাম বাকের (র) বলেন, আমরা কয়েকজন তার খেদমতে হাজির হলে তিনি প্রত্যেকের নাম ও অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। যখন আমি বললাম যে, আমি হযরত হুসাইনের পৌত্র, তখন তিনি খুবই স্নেহ সহকারে আমার মাথায় হাত বুলালেন। তারপর আমার কোরতার বুকের বোতাম খুলে আমার ঠিক বুকের মাঝখানে হাত রাখলেন। তখন আমার পূর্ণ যৌবন। তিনি বড়ো খুশী হয়ে বললেন, খোশ আমদেদ আমার ভাইপো। তুমি তো হুসাইনের স্মৃতি চিহ্ন। বল, কি জন্যে এসেছ। আমি বলতে লাগলাম ————-। তিনি দৃষ্টিশক্তিহীন ছিলেন। এমন সময় নামাযের সময় হলো। তিনি একটা ছোট চাদর গায়ে দিয়ে ছিলেন। তাই নিয়ে নামাযের জন্যে দাঁড়িয়ে গেলেন। চাদর এতো ছোট ছিল যে, যখন তা কাঁধের ওপর রাখতেন তখন তা পড়ে যেত। এটাই তিনি গায়ে দিয়ে রাখলেন অথচ বড়ো চাদর নিকটেই রাখা ছিল। তিনি আমাদেরকে নামায পড়িয়ে দিয়ে মুক্ত হলেন তখন আমি আরজ করলাম, হযরত আমাদেরকে নবী (স) এর বিদায় হজ্জের বিবরণ শুনিয়ে দিন।

তিনি হাতের আঙুলের নয় পর্যন্ত গুণে বললেন, রাসূলুল্লাহ (স) মদীনা আসার পর ন বছর হজ্জ করেননি। হিজরতের দশম বছরে তিনি জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করে দিলেন যে, তিনি হজ্জে যাবেন। এ খবর পাওয়া মাত্র বহু লোক মদীনায় জমায়েত হতে লাগলো। প্রত্যেকেই এ আশা করছিল যে, সে হজ্জের সফরে নবীর সাথী হবে, তার হুকুম মেনে চলবে এবং তিনি যা করবেন তারাও তাই করবে।

অবশেষে মদীনা থেকে রওয়ানা হওয়ার সময় এসে গেল। সমস্ত কাফেলা নবীর সাথে রওয়ানা হয়ে যুলহুলায়ফা পৌঁছে অবস্থান করলো।

এখানে এক বিশেষ ঘটনা ঘটলো। কাফেলার একজন মহিলা, হযরত আবু বকর (রা) এর স্ত্রী আসমা বিনতে ওমাইস (রা) সন্তান প্রসব করলেন। তিনি নবীকে জিজ্ঞেস করলেন এ অবস্থায় আমার কি করা উচিত। নবী (স) বললেন, এ অবস্থায় এহরামের জন্যে গোসল কর এবং এ অবস্থায় অন্যান্য মেয়েদের মতো ল্যাংগোট বাধ।

তারপর নবী (স) যুলহুলায়ফায় নামায পড়লেন। নামাযের পর উটনী কাসওয়ার ওপর সওয়ার হলেন। উটনী তাকে নিয়ে নিকটস্থ উচ্চ প্রান্তর বায়দায় পৌছলো। বায়দার ওপর থেকে যখন আমি চারদিকে তাকালাম তখন দেখলাম যতদূর দেখা যায় চারদিকে ডানে বামে শুধু মানুষ থৈ থৈ করছে। কিছু সওয়ারীর ওপরে, কিছু পায়ে হেটে। নবী ছিলেন আমাদের মাঝে। তার ওপর কুরআন নাযিল হচ্ছিল। তিনি কুরআন ভালোভাবে উপলব্ধি করছিলেন বলে আল্লাহর হুকুমে যা কিছু করতেন আমরাও তাই করতাম। এখানে পৌঁছে তিনি উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়লেন-

*******আরবী*********

আয় আল্লাহ বান্দাহ তোমার দরবারে হাজির। তোমার ডাকে তোমার দরবারে হাজির হয়েছি। তোমার কোনো শরীক নেই। আমি হাজির আছি। প্রশংসার হকদার তুমি এবং দয়া অনুগ্রহ ও পুরস্কার দেয়ার অধিকার তোমারই। শাসন কর্তৃত্বে তোমার (এ ব্যাপারে) কোনো শরীক নেই।

সকলেই উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়লো। তারা কিছু কথা যোগ করলো কিন্তু নবী (স) প্রতিবাদ করলেন না। তিনি তার তালবিয়া সর্বদা পড়তে থাকেন।

হযরত জাবের (রা) বলেন, এ সফরে আমাদের নিয়ত ছিল হজ্জ করার, ওমরাহ আমাদের করার কথা ছিল না। অবশেষে যখন আমার নবী পাকের সাথে বায়তুল্লাহ পৌঁছলাম, তখন তিনি প্রথমে হিজরে আসওয়াদে চুমো দিলেন। তারপর তাওয়াফ শুরু করলেন। প্রথমে তিন চক্করে তিনি রমল করলেন এবং পরের চার চক্করে সাধারণ গতিতে চাললেন। তারপর মাকামে ইবরাহীম এসে এ আয়াত তেলাওয়াত করলেনঃ

*******আরবী*********

এবং মাকামে ইবরাহীমকে নিজের জন্যে ইবাদাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর।

তারপর তিনি এমনভাবে দাঁড়ালেন যে, মাকামে ইবরাহীম তার এবং বায়তুল্লাহর মাঝখানে ছিল। এখানে তিনি দু রাকাত নামায পড়লেন, প্রথমে রাকাতে *******আরবী********* এবং দ্বিতীয় রাকাতে *******আরবী********* পড়লেন। তারপর হিজরে আসওয়াদের নিকটে এসে তাকে চুমো দিলেন। তারপর সাফা পাহাড়ের দিকে চললেন। সাফার নিকটে পৌঁছে পড়লেন *******আরবী********* এবং বললেন *******আরবী********* আমি সাফা থেকে সায়ী শুরু করছি যেভাবে আল্লাহ এ আয়াতে তার উল্লেখ করে শুরু করেছেন।

অতএব তিনি সাফার ওপরে এতোটা উঁচুতে উঠলেন যে বায়তুল্লাহ স্পষ্ট তার চোখের সামনে এলো। তিনি কেবলামুখী হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর তিনি তাওহীদ ও তাকবীরে মশগুল হলেন।

তিনি পড়লেনঃ

*******আরবী*********

আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক, তার কোনো শরীক নেই। শাসন কর্তৃত্ব তার এবং তিনি প্রশংসার হকদার। তিনি সব কিছুর ওপর শক্তিমান। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক । তিনি তার ওয়াদা পূরণ করেছেন অর্থাৎ দ্বীনকে সমগ্র আরবে বিজয়ী করে দিয়েছেন।তিনি তার বান্দাহকে সাহায্য করেছেন এবং কাফের মুশরিকের দলকে তিনি একাকীই পরাস্ত করেছেন।

তিনি তিনবার একথাগুলো আবৃত্তি করলেন এবং দোয়া করলেন। তারপর নীচে মেনে মারওয়ার দিকে চললেন। মারওয়াতে তাই বললেন যা সাফায় বলেছিলেন। এভাবে শেষ চক্কর পুরো করে মারওয়ায় পৌঁছলেন। এখানে তিনি সাথীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি ওপরে ছিলেন এবং সাথীগণ নীচে।

তিনি বলেন-

একথা শুনে সুরাকা বিন মালেক দাড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ এ হুকুম কি শুধ এ বছরের জন্যে, না চিরদিনের জন্য। (মক্কাবাসীদের নিকটে হজ্জের মাসগুলোতে স্থায়ীভাবে ওমরাহ করা কঠিন গুনাহ মনে করা হতো। সুরাকা বিন মালেক দেখলেন যে, হজ্জের মাসগুলোতে তাওয়াফ ও সায়ীকে স্থায়ীভাবে ওমরা গণ্য করা হচ্ছে। তাই তিনি এ প্রশ্ন করেন।)

প্রথমে যদি একথা অনুভব করতাম যা পরে অনুভব করলাম, তাহলে হাদীর পশু সংগে আনতাম না। তাহলে এ তাওয়াফ ও সায়ীকে ওমরার তাওয়াফ ও সায়ী গণ্য করে ওমরায় পরিণত করতাম ও ইহরাম খুলে ফেলতাম। তোমাদের মধ্যে যারা হাদীর পশু সাথে আনেনি, তারা এসে ওমরার তাওয়ায় ও সায়ী মনে করে ইহরাম খুলতে পারে।

নবী (স) জবাবে বলেন, শুধু এ বছরের জন্যে নয়, চিরদিনের জন্য।

হযরত জাবের (রা) অতঃপর বলেন, হযরত আলী (রা) ইয়ামেন থেকে নবী জন্যে অনেক কুরবানীর পশু নিয়ে মক্কায় পৌঁছান। তিনি দেখলেন তার বিবি হযরত ফাতেমা ইহরাম খুলে ফেলেছেন। রঙ্গিন কাপড়ও পরেছেন এবং সুরমা লাগিয়েছেন। এসব হযরত আলী (রা) ভালো মনে না করে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। হযরত ফাতেমা (রা) বলেন, আব্বাজান আমাকে এর হুকুম দিয়েছেন। অর্থাৎ নবী (স) ইহরাম খোলার হুকুম দিয়েছেন।

নবী (স) হযরত আলীর দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করনে, তুমি ইহরাম বেধে তালবিয়া পড়ছিলে তখন কি নিয়ত করেছিলে- শুধু হজ্জের নিয়ত করেছিলে, না হজ্জ ও ওমরাহ উভয়ের নিয়ত করেছিলে?আলী (রা) বলেন, আমি বলেছিলাম, আয় আল্লাহ আমি ঐ জিনিসের ইহরাম বাধছি, যার ইহরাম তোমার রাসূল বেধেছেন।

নবী (স) বলেন, আমি যেহেতু আমার সাথে হাদীর পশু এনেছি, সে জন্যে আমার ইহরাম খোলার কোনো সুযোগ নেই। তুমিও আমার মতো নিয়ত করেছ। অতএব তোমারও ইহরাম খোলার উপায় নেই।

হযরত জাবের (রা) বলেন, ইয়ামেন থেকে হযরত আলী নিয়ে আসা উট ও নবীর উটের মোট সংখ্যা ছিল একশ। (কোনো কোনো বর্ণনায় দেখা যায় যে, নবী (স) সাথে করে ৬৩টি উট এনেছিলেন এবং হযরত আলী (রা) ইয়ামেন থেকে এনেছিলেন ৩৭টি উট।)

সকল সাহাবী নবীর নির্দেশ অনুযায়ী ইহরাম খুলে ফেলেন এবং চুল মুণ্ডন করে বা কাটিয়ে হালাল হয়ে গেলেন। তবে নবী (স) এবং যেসব সাহাবী হাদী সাথে এনেছিলেন ইহরাম অবস্থায় রইলেন।

তারপর ৮ই যুলহজ্জ লোক হজ্জের ইহরাম বাধে যারা ওমরার পর ইহরাম খুলেছিল। নবী (স) কাসওয়ার পর সওয়ার হয়ে মিনা রওয়ানা হন। এখানে তিনি যোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজর এ পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন। ফজরের নামাযের পর কিছুক্ষণ তিনি মিনায় অবস্থান করেন। সূর্য ভালোভাবে ওপরে উঠে এলে তিনি আরাফাতের দিকে রওয়ানা হন। তিনি আদেশ করেন যে, নিমরা (নিমরা প্রকৃতপক্ষে এমন এক স্থান যেখানে হেরেমের সীমানা শেষ হয়ে আরাফাতের সীমানা শুরু হয়। জাহেলিয়াতের যুগে কুরাইশগণ হেরেমের সীমানারে ভেতরে মাশয়ারুল হারামের নিকটে অবস্থান করতো এবং সাধারণ লোক অবস্থান করতো আরাফাতের ময়দানে। এজন্যে কুরাইশগণের ধারনা ছিল যে, নবী (স) ঐ স্থানেই অবস্থান করবেন। কিন্তু তিনি অবস্থান করার প্রকৃত স্থানেই তাঁবু খাটাবার আদেশ পূর্বাহ্ণেই করে দিয়েছিলেন।)নামাক স্থানে তার জন্যে যে পশমের তাঁবু খাটানো হয়। কুরাইশগণ নিঃসন্দেহ ছিল যে, নবী (স) মাশয়ারুল হারামের নিকটেই অবস্থান করবেন। কারণ, জাহেলিয়াতের যুগে সর্বদা তাই করা হতো। কিন্তু নবী (স) মাশয়ারুল হারামের সীমা অতিক্রম করে আরাফাতের সীমার মধ্যে প্রবেশ করেন। নিমরা নামক স্থানে তার নির্দেশে যে তাঁবু খাটানো হয়েছিল তার মধ্যে তিনি অবস্থান করেন।

তারপর বেলা যখন পড়ে গেল তখন তিনি কাউসারের পিঠে হাউদা বাধতে বলেন। হাউদা বাধা হলে তিনি উটনীর পিঠে চড়ে ওড়না প্রান্তরে পৌঁছান। ওখানে একটা উঁচু স্থানে উটের পিঠ থেকে জনতার সামনে ভাষণ প্রদান করেন। তিনি বলেন-

সমবেত জনতা! অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা এবং অবৈধভাবে কারো সম্পদ হস্তগত করা তোমাদের জন্য হারাম। এটা ঠিক ঐরূপ হারাম যেমন আজকের দিন তোমাদের জন্য হারাম (এবং তোমরা হারাম মনে কর)।

ভালো করে বুঝে নাও যে, জাহেলিয়াতের যুগের সব কিছুই আমার পায়ের তলায় নিবিষ্ট করা হল। এবং জাহেলিয়াতের যুগের খুন মাফ করা হলো। সকলের আগে আমার বংশের খুন অর্থাৎ রবিয়া বিন হারিস বিন আবদুল মুত্তালিবের পুত্রের খুন মাফ করার ঘোষণা করছি। রবিয়ার পুত্র বনি সাদ কাবিলায় দুধ পানের জন্য থাকত। তাকে হাযিল কাবিলার লোক খুন করে।

জাহেলিয়াত যুগের সকল সূদের দাবী পরিত্যক্ত হলো। এ ব্যাপারে আমি সকলের প্রথমে আমার চাচা আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিবের সূদের দাবী প্রত্যাহার করার ঘোষণা করছি। আজ তার সকল সূদের দাবী শেষ হয়ে গেল।

সমবেত জনগণ! মহিলাদের অধিকার সম্পর্কে আল্লাহকে ভয় করতে থাক। আল্লাহর আমানত স্বরূপ তোমরা তাদেরকে তোমাদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেছ। তাদেরকে উপভোগ করা আল্লাহর কালেমা এবং আইন অনুযায়ীই তোমাদের জন্য হালাল হয়েছে। তোমাদের স্ত্রীদের ওপর বিশেষ হক এই যে, যাদেরকে তোমরা তোমাদের বাড়ীতে আসা পছন্দ কর না, তাদেরকে যেন তোমাদের শয্যার ওপর বসতে তারা সুযোগ না দেয়। তারা যদি এ ভুল করে বসে তাহলে তাদেরকে মামুলী শাস্তি দিতে পার। তাদের বিশেষ হক তোমাদের ওপর এই যে, তোমরা সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের খোরাক পোশাকের ব্যবস্থা করবে।

আমি তোমাদের মধ্যে হেদায়াতের এমন উৎস রেখে যাচ্ছি যদি তাকে তোমরা মজবুত করে ধর এবং তার নির্দেশে চল, তাহলে তোমরা কখনো সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। হেদায়াতের এ উৎস হচ্ছে, আল্লাহর কিতাব।

কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা আমার সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন যে, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর পয়গাম পৌছিয়ে দিয়েছি কিনা। বল সেদিন তোমরা আমার সম্পর্কে আল্লাহর কাছে কি জবাব দেবে?

সমবেত জনতা এক বাক্য বললো আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি তাবলীগের হক আদায় করেছেন। আপনি সব কিছু পৌছিয়ে দিয়েছেন। নসীহত দানকারী ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে কোনো কাজই বাকী রাখেননি।

একথার পর নবী (স) তার শাহাদত আঙ্গুলি আসমানের দিকে উঠিয়ে মানুষের দিকে ইংগিত করে বললেন- আয় আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক; আয় আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক, আয় আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক; আমি তোমার পয়গাম, তোমার আহকাম তোমার বান্দাহদের কাছে পৌছিয়ে দিয়েছি এবং তোমার বান্দাহগনও সাক্ষী যে, আমি তাবলীগের হক আদায় করেছি।

তারপর হযরত বিলাল (রা) আযান দিলেন ও একামত বললেন। নবী (স) যোহরের নামায পড়ালেন। তারপর হযরত বেলাল (রা) দ্বিতীয়বার একামত বললেন এবং নবী (স) আসর নামায পড়ালেন। যোহর আসর এক সাথে পড়ার পর তিনি ঐ স্থানে এলেন যেখানে অবস্থান করা যায়। তারপর তিনি তার কাসওয়ার দিকে মুখ বড়ো বড়ো প্রস্তর খন্ডের দিকে করে দিলেন এবং সমবেত জনগণ তার সামনে হয়ে গেল। জনতা ছিল সওয়ারী বিহীন ও পদব্রজে। নবী (স) কেবলামুখী হলেন এবং ওখানেই অবস্থান করলেন। অবশেষে সূর্য অস্তমিত হলে তিনি আরাফাত থেকে মুযদালাফার দিকে রওয়ানা হলেন এবং উসামা বিন যায়েদকে তার পেছনে উটের পিঠে বসিয়ে নিলেন। মুযদালফায় পৌঁছে মাগরিব ও এশা এক সাথে পড়লেন। আযান হলো এবং দু নামাযের জন্যে দুবার একামত হলো। এ দু নামাযের মধ্যে তিনি কোন সুন্নাত নফল পড়লেন না। তারপর তিনি বিশ্রামের জন্য শুয়ে পড়লেন। অবশেষে সুবহে সাদেক হয়ে গেল। আযান ও একামতের পর তিনি ফজরের নামা আদায় করলেন। নামাযের পর তিনি মাশয়ারুল হারামের নিকটে এসে কেবলামুখী দাড়িয়ে তসবিহ তাহলীলে মশগুল হলেন। পূর্বদিক যখন বেশ ফর্সা হয়ে গেল তখন সূর্য ওঠার আগেই সেখান থেকে মিনার দিকে রওয়ানা হলেন। এবার তিনি তার উটর পেছন দিকে ফযল বিন আব্বাসকে বসিয়ে নেন। যখন তিনি মুহার উপত্যকার মাঝে পৌঁছালেন তখন উটনীর গতি দ্রুত করে দেন। মুহার প্রান্তর থেকে বের হয়ে মাঝপথ ধরলেন যা বড়ো জুমরার নিকটে গিয়ে বের হয়েছে। তারপর ঐ জুমরায় পৌঁছে যা গাছের নিকট ছিল, তিনি পাথর মারলেন। জুমরাতে সাতটি ছোট ছোট পাথর মারলেন এবং মারার সময় আল্লাহু আকবার বললেন। এসব পাথর নিচু স্থান থেকে মারলেন। পাথর মারা শেষ করে কুরবানী করার স্থানে গেলেন এবং নিজ হাতে তেষট্টিটি কুরবানী যবেহ করলেন। বাকীগুলো হযরত আলী (রা) এর দায়িত্বে ছেড়ে দিলেন। তিনি হযরত আলীকে তার হাদীর মধ্যে শরীক করেছিলেন তারপর প্রত্যেক কুরবানী থেকে এক এক টুকরা নেবার হুকুম করলেন। তা নিয়ে রান্না করা হলো। তারপর নবী (স) এবং হযরত আলী (রা) এ গোশতের কিছু খেলেন এবং শুরবা পান করলেন। তারপর নবী উটনীর পিঠে চড়ে যিয়ারতের জন্যে বায়তুল্লাহর দিকে রওয়ানা হলেন। মক্কায় পৌঁছে যোহর নামায পড়লেন। নামায শেষে তিনি আবদুল মুত্তালিব পরিবারের লোকদের কাছে এলেন যারা যমযমের পানি তুলে লোকদের পান করাচ্ছিল। তিনি বললেন, বালতি ভরে পানি তুলে লোকদের পান করাও। যদি আমার এ আশংকা হতো যে আমাকে দেখে লোক তোমাদের সাথে বালতি টেনে তুলতাম। তারা নবীকে বালতি ভরে পানি দিল এবং নবী তার থেকে পান করলেন। (মুসলিম-জাফর বিন মুহাম্মাদ বিন আতিয়া থেকে বর্ণিত)
জেনায়েতের বয়ান
জেনায়েত অর্থ কোনো হারাম কাজ করা, গুনাহ করা প্রভৃতি। কিন্তু হজ্জ প্রসঙ্গে জেনায়েতের অর্থ হলো এমন কোনো কাজ করা যা হেরেমে হওয়ার কারণে অথবা এহরাম বাধার কারণে হারাম হয়ে যায়। জেনায়েত দু প্রকারের

একঃ জেনায়েতে হেরেম

দুইঃ জেনায়েতে এহরাম

লোকের পক্ষ থেকে এমন কোনো কাজ হয়ে যায় যা হেরেমের গণ্ডির মধ্যে হারাম অথবা এমন কোনো কাজ হয় যা এহরাম অবস্থায় হারাম, তাহরে এ দুটোর ক্ষতিপূরণের জন্যে কাফফারা ও কুরবানীর পৃথক পৃথক হুকুম রয়েছে, যা পরে বলা হচ্ছে।

হেরেমে মক্কা ও তার মহত্ত্ব

পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে বরকতপূর্ণ এবং সবচেয়ে সম্মানের গৃহ ঐটি যাকে আল্লাহ তার আপনঘর বলে উল্লেখ করেছেন। যে ঘর তাওহীদ ও নামাযের কেন্দ্রবিন্দু এবং পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর। যা আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে তৈরী করা হয়েছিল এ ঘর হচ্ছে হেদায়াত ও বরকতের উৎস এবং সমগ্র মানবতার আশ্রয়স্থল।

এ আল্লাহর ঘর যে মুবারক মসজিদের মাঝখানে অবস্থিত, তাকে মসজিদুল হারাম (সম্মানার্হ মসজিদ) বলা হয়েছে। এ দুনিয়ার সকল মসজিদ থেকে উৎকৃষ্টতমই নয়, বরঞ্চ প্রকৃত মসজিদ বলা হয়েছে। দুনিয়ার অন্যান্য মসজিদগুলোতে নামায এইজন্যে সহীহ যে, ওগুলো এ মসজিদে হারামের স্থলাভিষিক্ত এবং ওদিকে মুখ করেই সকলকে নামায পড়তে হয়। মসজিদুল হারামের মহত্ত্ব এতোখানি যে, তাতে এক নামায পড়লে এক লক্ষ নামাযের সওয়াব পাওয়া যায়। (ইবনে মাজাহ)

তারপর আল্লাহ তায়ালা শুধু এ মক্কা শহরকেই হেরেম গণ্য করেননি, বরঞ্চ তার চারদিকে কয়েক কিলোমিটার ব্যাপী অঞ্চলকে হেরেমের সীমাভূক্ত করে হেরেম (অর্থাৎ সম্মানযোগ্য অঞ্চল) বলে ঘোষণা করেছন। তার মহত্ত্বের জন্যে সম্মান প্রদর্শনের কিছু রীতি পদ্ধতি ও হুকুম আহাকাম নির্ধারিত করে দিয়েছেন। এ সীমারেখার ভেতরে বহু কাজ এ অঞ্চলের সম্মানের জন্যে হারাম ও নাজায়েয করা হয়েছে যা সারা দুনিয়ায় জায়েয ও মুবাহ।

হেরেমের এ সীমারেখা প্রথমে হযরত ইবরাহীম (আ ) নির্ধারণ করেন। পরে নবী (স) তার রেসালাতের যুগে এ সীমারেখার তাজদীদ বা নবায়ন করেন। এ সীমারেখা সুপরিচিত ও সুপরিজ্ঞাত। মদীনার দিকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত হেরেমের সীমানা, ইয়ামেনের দিকে প্রায় এগারো কিলোমিটার তায়েফের দিকেও তাই এবং ইরাকের দিকেও প্রায় এতো কিলোমিটার, জেদ্দার দিকে প্রায় ষোল কিলোমিটার পর্যন্ত হেরেমের সীমানা। নবী (স) এর পরে হযরত ওমর (রা) হযরত ওসমান (রা) এবং হযরত মুয়াবীয়া (রা) ঐ একই সীমারেখা নবায়ন করেন। অতএব, এ সীমারেখা এখন অতি সুপরিচিত। হেরেমের সীমারেখার মহত্ত্ব ও সম্মান আল্লাহ ও তার দীনের সাথে সম্পর্ক ও আনুগত্যের পরিচায়ক। যতদিন পর্যন্ত উম্মত সামগ্রিকভাবে এ ভক্তি শ্রদ্ধা অক্ষুণ্ণ রাখবে ততদিন তাদের ওপর আল্লাহর হেফাজত ও রহমত অব্যাহত থাকবে এবং তারা দুনিয়াতে মাথা উঁচু করে জীবন যাপন করতে পারবে।

নবী (স) বলেন- আমার উম্মত যতদিন মুকাদ্দাস হেরেমের মহত্ত্ব ও ভক্তি শ্রদ্ধার হক আদায় করতে থাকবে, ততদিন তারা কল্যাণ লাভ করতে থাকবে। আর যখন তারা এর সম্মান নষ্ট করবে, তখন তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। (ইবনে মাজাহ)

জেনায়েতে হেরেম

১. হেরেমে উৎপন্ন বন্য তৃণলতা, ঘাস, সবুজ শ্যামল গুল্ম গুচ্ছ কাটা বা উৎপাটন করা জেনায়েত। এ যদি কারো মালিকানাধীন না হয় তাহলে তার কাফফারা এই যে, তার মূল্য আল্লাহর পথে সদকা করতে হবে, যদি কারো মালিকানাধীন হয় তাহলে দ্বিগুণ মূল্য দিতে হবে। সদকাও করতে হবে মালিককেও মূল্য দিতে হবে।

২. ইযখির (ইযখির এক প্রকার সুগন্ধি ঘাস) কাটা বা উৎপাটন করা জায়েয। হযরত আব্বাস (রা) এর অনুরোধে নবী (স) ইযখির কাটার অথবা উৎপাটনের অনুমতি দিয়েছিলেন।

৩. বন্য তৃণ লতা, ঝোপ ঝাড় হোক না কেন, কাটা বা উৎপাটন করা জেনায়েত।

৪. কোন ডাল-পালা যদি বন্য না হয়, লাগানো হয়, তাহলে তা কাটা জেনায়েত হবে না। তেমন কোনো গাছের কিছু পাতা ছেড়া জেনায়েত নয়। যদি তা কারো মালিকানাধীন না হয়।কারো মালিকানাধীন হলে তার বিনা অনুমতিতে ছেড়া যাবে না। মালিক স্বয়ং ছিঁড়লে জেনায়েত হবে না।

৫. হেরেমের শিকার মারা জেনায়েত। হত্যাকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

৬. হেরেমের পাখীর ডিম ভাঙ্গা বা রান্না করা জেনায়েত। টিড্ডি মারাও জেনায়েত।

৭. কারো কাছে কিছু শিকার রয়েছে এবং সে হেরেমে প্রবেশ করছে। তার সে শিকার ছেড়ে দেয়া ওয়াজিব। তবে শিকার যদি রশি দিয়ে বাধা থাকে এবং রশি তার হাতে থাকে অথবা শিকার খাঁচায় আবদ্ধ আছে তাহলে তা ছেড়ে দেয়া ওয়াজিব নয়।

৮. মীকাতে ইহরাম না বেধে হেরেমে প্রবেশ করাও জেনায়েত। এর জন্য একটি কুরবানী ওয়াজিব।

৯. হেরেমের সীমার ভেতরে এসব মারা জেনায়েত নয়, যথা- বোলতা, সাপ, বিচ্ছু, ইঁদুর, মাছি, ছারপোকা, মশা, পিঁপড়ে প্রভৃতি এবং ঐসব জীব যা আক্রমণ করতে আসে এবং যার আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা অপরিহার্য।

১০. হেরেমের বাইরে গিয়ে মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাটা (ইহরাম খোলার জন্য) জেনায়েত। তার জন্যে একটি কুরবানী ওয়াজিব।

ইহরাম জেনায়েত

ইহরামের জেনায়েত তিন প্রকার।

১. যার জন্যে দু কুরবানী।

২. যার জন্যে এক কুরবানী।

৩. যার জন্যে সদকা কুরবানী।

যাতে দু কোরবানী ওয়াজিব

১. পুরুষ যদি কোনো গাঢ় খুশবু অথবা গাঢ় মেহদী মাথায় লাগায় এবং একদিন একরাত স্থায়ী হয়, তা সমস্ত মাথায় লাগানো হোক বা এক চতুর্থাংশ মাথায় দুটো কুরবানী তার জন্যে ওয়াজিব। কিন্তু হোক স্ত্রীলোক এমন করলে একটি কুরবানী দিতে হবে।

২. ঐসব জেনায়েত যার জন্যে হজ্জে ইফরাদকারীর একটি কুরবানী ওয়াজিব হয়, কারেনের জন্যে দু কুরবানী ওয়াজিব হবে।

৩. তামাত্তু হজ্জকারী যদি হাদীর পশু সাথে করে আনে তাহলে তার জন্যে সকল জেনায়েতের জন্যে দু কুরবানী, আর মুফরেদের জন্যে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।

যেসব জেনায়েতের জন্যে এক কুরবানী

শুধু দু’অবস্থায় উট অথবা গরু কুরবানী ওয়াজিব হয়। নতুবা যেখানে যেখানে কুরবানীর কথা বলা হয়েছে সেখানে ছাগল অথবা ভেড়া কুরবানী বুঝতে হবে।

১. জানাবাতের অবস্থায় (যার জন্যে গোসল ফরয হয়) যদি কেউ তাওয়াফে যিয়ারত করে, তাহলে এক উট অথবা গরু কুরবানী ওয়াজিব হবে।

২. আরাফাতে অবস্থানের পর তাওয়াফে যিয়ারত অথবা মস্তক মুণ্ডনের পূর্বে স্ত্রী সহবাস করলে উট অথবা গরু কুরবানী ওয়াজিব হবে। এ দু অবস্থায় ছাড়া অন্য সকল অবস্থায় ছাগল অথবা ভেড়া কুরবানী ওয়াজিব হবে।

৩. তাওয়াফের ওয়াজিবগুলোর মধ্যে কোনো একটি বাদ গেলে একটি কুরবানী ওয়াজিব হবে।

ইহরামের নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে বেচে থাকাও তাওয়াফের ওয়াজিবগুলোর মধ্য শামিল। এসবের মধ্যে কিছু নিষিদ্ধ কাজের কুরবানী সম্পর্কে নিম্নে মাসায়েল বয়ান করা হচ্ছে।

৪. যদি বেশী খুশবু লাগানো হয় তাহলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে। যদি অল্প খুশবু লাগানো হয় কিন্তু শরীরের বৃহৎ অংশে যেমন মাথা, হাত পা প্রভৃতির ওপর মালিশ করা হয়, তাহলেও এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।

৫. যদি একই স্থানে সমস্ত শরীরে খুশবু লাগানো হয় তাহলে এক কুরবানী এবং বিভিন্ন স্থানে সমস্ত শরীরে লাগানো হয় তাহলে প্রত্যেক স্থানের এক একটি কুরবানী করতে হবে।

৬. খুশবু লাগানোর পর কুরবানী করা হলো কিন্তু খুশবু গেল না, তাহলে পুনরায় কুরবানী করতে হবে।

৭. খুশবুদার পোশাক পরে একদিন কাটালে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।

৮. তরল মেহদী মাথা, দাড়ি, হাত ও পায়ে মাখলে এক কুরবানী।

৯. সিলাই করা কাপড় পরিধান করলে কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত এই যে, যদি তা একদিন ও একরাত পরিধান করে থাকা হয়। তার কম সময় পরিধান করে থাকলে কুরবানী ওয়াজিব হবে না। শুধু সদকা করতে হবে। এটাও শর্ত যে, সিলাই করা কাপড় নিয়ম মাফিক পরিধান করবে। যদি কোর্তা বা শিরওয়ানী এমনি কাঁধের ওপর ফেলে রাখে এবং আস্তিনে হাত দেয়া না হয়, তাহলে জেনায়েত হবে না।

নাজাসাতে হুকমী থেকে পাক না হয়ে তাওয়াফ করলে কুরবানী ওয়াজিব হওয়া সম্পর্কে মাসায়ালা নিম্নরূপ:

১০. তাওয়াফে যিয়ারত ছাড়া যে কোনো তাওয়াফ জানাবাত অবস্থায় করা হলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।

১১. তাওয়াফে যিয়ারত হাদাসে আসগর অবস্থায় করা হলে এক কুরবানী ওয়াজিব এবং ওমরার তাওয়াফ হাদাসে আসগর অবস্থায় করা হলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।

১২. তাওয়াফে যিয়ারতে ঊর্ধ্ব সংখ্যায় তিন চক্কর বাদ পড়লে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে এবং তিনের বেশী বাদ গেলে শুধু কুরবানীতে হবে না; দ্বিতীয়বার তাওয়াফ করতে হবে।

১৩. হজ্জের ওয়াজিবগুলোর মধ্যে কোনো ওয়াজিব পরিত্যাগ করলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।

১৪. মুফরেদ মস্তক মুণ্ডন বা চুল ছাটা অথবা তাওয়াফে যিয়ারত ১০ই যুলহজ্জের পরে করলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।

১৫. কারেন যদি যবেহ করার পূর্বে অথবা রামী করার পূর্বে মস্তক মুণ্ডন করে তাহলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।

যেসব জেনায়েত শুধু সদকা ওয়াজিব

১. খুশবু ব্যবহার এমন পরিমাণে করা যার জন্যে কুরবানী ওয়াজিব হয় না সে অবস্থায় সদকা ওয়াজিব হবে। (সদকা অর্থ সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ সদকা) যেমন, এক অঙ্গের কম স্থানে খুশবু লাগানো হলো, অথবা পোশাক এক বর্গ বিঘত স্থানের কম অথবা বেশী স্থানে লাগানো হলো কিন্তু পুরো একদিন বা পুরো এক রাত ব্যবহার করা হলো না।

২. সেলাই করা পোশাক একদিন অথবা এক রাত্রের কম সময়ে পরিধান করা হয়েছে অথবা এতো সময় মাথা ঢাকা হয়েছে, তাহলে এক সদকা ওয়াজিব হবে। আর যদি অল্প সময়ের জন্য মাথা ঢাকা হয়েছে অথবা সেলাই করা কাপড় পরা হয়েছে। যেমন এক ঘন্টারও কম, তাহলে একমুষ্টি আটা দিলেই যথেষ্ট হবে।

৩. তাওয়াফে কুদুম অথবা তাওয়াফে বেদা (বিদায়ী তাওয়াফ) অথবা কোনো নফল তাওয়াফ হাদাসে আসগারের অবস্থায় করলে এক সদকা ওয়াজিব হবে।

৪. তাওয়াফে কুদুম অথবা বিদায়ী তাওয়াফ অথবা সায়ী তিন অথবা তিনবারের কম চক্কর পরিত্যাগ করলে প্রত্যেক চক্করের জন্য এক একটি সদকা ওয়াজিব হবে।

৫. এক দিনে যতবার রামী ওয়াজিব তার অর্ধেকের কম ছেড়ে দিলে যেমন ১০ই তারিখ জুমরাতুল ওকবায় সাত রামী ওয়াজিব, তার মধ্যে কেউ তিন রামী অর্থাৎ পাথর মারা বাদ দিল। তাহলে প্রত্যেক পাথরের বদলায় এক এক সদকা ওয়াজিব হবে।

৬. কেউ অন্য কোনো ব্যক্তির মাথা অথবা ঘাড়ের চুল বানিয়ে দিল, তা সে দ্বিতীয় ব্যক্তি মুহরেম অথবা গায়ের মুহরেম হোক, তাহলে এক সদকা যে চুল বানিয়ে দেবে তার ওপর ওয়াজিব হব।

৭. পাঁচটি নখ অথবা তার বেশী কাটিয়ে নেয়া হলো, কিন্তু এক হাত বা পায়ের নখ নয়, বিভিন্ন হাত পায়ের তাহলে এক সদকা ওয়াজিব হবে।

নীতিগত হেদায়েত

১. যদি একটি সদকার মূল্য অথবা কয়েকটি ওয়াজিব সদকার মূল্য একটি কুরবানীর মূল্যের সমান হয়, তা কুরবানী সস্তা হওয়ার কারণে হোক কিংবা কয়েকটি সদকার মূল্য এতো বেশী হলো যে, তা দিয়ে একটি কুরবানী খরিদ করা যায়, তাহলে স মূল্য থেকে কিছু অর্থ কমিয়ে ফেলা উচিত যাতে করে অবশিষ্ট মূল্য কুরবানীর সমান না হয়।

২. হজ্জের কোনো ওয়াজিব যদি বিনা কারণে বাদ যায় তাহলে কুরবানী ওয়াজিব হবে। আর যদি কোনো ওজরের কারণে বাদ পড়ে তাহলে কুরবানী ও সদকা কোনোটাই ওয়াজিব হবে না।

৩. ইহরাম অবস্থায় যে কাজ নিষিদ্ধ তা করলে কোনো সময়ে কুরবানী এবং কোনো সময়ে সদকা ওয়াজিব হয়। কুরবানী ওয়াজিব হলে এ এখতিয়ারও থাকে যে, কুরবানীর পরিবর্তে ছয়জন মিসকীনকে একটি করে সদকা দিয়ে দেয়া যায়। এ এখতিয়ারও আছে যে, যখন এবং যেখানে ইচ্ছা তিনটি রোযাও রাখা যায়।

সদকা ওয়াজিব হওয়ার পর সদকার স্থলে একটি রোযা রাখার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে।

শিকারের বিনিময়

ইহরামে নিষিদ্ধ কাজের মধ্যে বন্য পশু শিকারও শামিল। এ শিকার করা নিষিদ্ধ এবং শিকারের কাউকে সাহায্য করাও নিষিদ্ধ। বন্য পশু শিকার করলে তার বদলা দিতে হবে। বদলা অর্থ শিকারের মূল্য যা দুজন ন্যায়পরায়ণ লোক ঠিক করে দেবে। কুরআনে আছেঃ

*******আরবী*********

হে ঈমানদারগণ ইহরাম অবস্থায় শিকার করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি ইচ্ছাকৃত শিকার করে, তাকে তার সমতুল্য এক পশু বদলা দিতে হবে। আর এর ফায়সালা তোমাদের মধ্যে থেকে দুজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি করবে। আর এ হাদী কাবায় পাঠাতে হবে অথবা এ জেনায়েতের কাফফরা স্বরূপ কয়েকজন মিসকীনকে খানা খাওয়াতে হবে অথবা সেই পরিমাণে রোযা রাখতে হবে যাতে করে কৃতকর্মের পরিমাণ ভোগ করতে পারে। (সূর আল মায়েদাঃ ৯৫)

এ আয়াতে যে শিকার হারাম করা হয়েছে তা স্থল ভাগের শিকার। নদী বা সমুদ্রের শিকার জায়েয। তা খাওয়া জায়েয হোক বা না হোক। কুরআন সুস্পষ্ট করে বলেঃ

*******আরবী*********

তোমাদের জন্য সামুদ্রিক শিকার ও তা খাওয়া হালাল করা হয়েছে, তোমাদের জন্যে অবস্থান কালেও এবং কাফেলার পাথেয় হিসেবেও। কিন্তু স্থল ভাগের শিকার যতক্ষণ তোমরা ইহরাম অবস্থায় আছে তোমাদের জন্যে হারাম। (সূরা আল মায়েদাঃ৯৬)

শিকার ও তার বদলার মাসায়েল

১. স্বয়ং শিকার করা যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি শিকারির সাহায্য করাও নিষিদ্ধ। শিকারির জন্যে যেমন বদলা দিতে হবে, সাহায্যকারীকেও বদলা নিতে হবে।

২. কয়জন মুহরেম মিলিত হবে কোনো শিকার করলো অথবা একজন শিকার করলো এবং অন্যান্যজন সাহায্য করলো তাহলে প্রত্যেককে আলাদা আলাদা বদলা দিতে হবে।

৩. যদি একজন মুহরেম কয়েকটা শিকার করে তাহলে প্রত্যেক শিকারের জন্য আলাদা বদলা দিতে হবে।

৪. শুধু বন্য পশু শিকার করলে তার বদলা দিতে হবে। পালিত পশু শিকার করলে বা হত্যা করলে তার বদলা দিতে হবে না। যেমন কেউ যদি ছাগল, গরু, উট, মুরগী ইত্যাদি মারে তাহলে তার বদলা দিতে হবে না

৫. যেসব পশুর গোশত হালাল নয়, তা যতো বড়ো হোক না কেন তার বদলা একটি ছাগল। যেমন কেউ হাতি মারল, তাহলে তার বদলায় একটা ছাগল দিতে হবে।

৬. জুই অথবা ফড়িং যদি তিনটার চেয়ে বেশী নিজে মারে অথবা অন্যকে মারতে আদেশ দেয় তাহলে এক সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে। তিনটা অথবা তিনটার কম মারলে যা ইচ্ছা সদকা হিসেবে দিয়ে দেবে।

৭. শিকার যদি কারো মালিকানায় হয় তাহলে দ্বিগুণ বদলা দিতে হবে আল্লাহর পথে দিতে তো হবেই, মালিককে প্রস্তাবিত মূল্যও দিতে হবে।

৮. শিকার যে স্থানে করা হবে সে স্থানের এবং সে সময়ের মূল্য ওয়াজিব হবে। অন্য কোনা স্থান বা সময়ের মূল্য ধরা যাবে না। এজন্যে স্থান ও কালের জন্য মূল্যর মধ্যে কম বেশী হয়।

৯. এটাও করা যেতে পারে যে, শিকারের সমতুল্য পশু খরিদ করে হেরেমে যবেহ করার জন্য পাঠিয়ে দিতে হবে। এটাও করা যেতে পারে যে, তার মূল্য দ্বারা খাদ্যশস্য খরিদ করে প্রত্যেক মিসকীনকে এক এক সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ দিয়ে দিতে হবে। অথবা প্রত্যেক মিসকীনকে সদকার পরিবর্তে এক একটি রোযা রাখতে হবে। কিন্তু প্রস্তাবিত মূল্য যদি কোনো কুরবানী খরিদ না করা যায় তাহলে দুটো পন্থা আছে। প্রত্যেক মিসকীনকে সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ দিয়ে অথবা প্রত্যেক সদকার পরিবর্তে একটি করে রোযা রাখবে।

১০. যদি শিকারের প্রস্তাবিত মূল্যে এতোটা না হয় যার দ্বারা এক সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ খাদ্য শস্য কেনা যায়, তাহলে যতোটুকু পাওয়া যায় সদকা করবে অথবা রোযা রাখবে।

১১. বদলাতে যে সদকা দেয়া হবে তার হুকুম ও ব্যয়ের খাত তাই, যা সদকায়ে ফিতরের।

এহসানের বয়ান

এহসানের ………… আভিধানিক অর্থ বাধা দেয়া, নিষেধ করা, বিরত রাখা। পরিভাষায় এহসানের অর্থ এইযে, কোনো ব্যক্তি হজ্জ অথবা ওমরার জন্যে ইহরাম বাধলো। তারপর হজ্জ বা ওমরায় যাওয়া থেকে তাকে বিরত রাখা হলো, এমন ব্যক্তিকে পরিভাষায় বলা হয় মুহসসার (যাকে বিরত রাখা হয়েছে)।

ইহরাম বাধার পর হজ্জ থেকে বিরত থাকা, হজ্জ ওমরাহ করতে না পারা জেনায়েত। এজন্যে মুহাসসারের ওয়াজিব যে, সে এহসানের বদলার সাধ্যমত কুরবানী করবে। তাকে বলে দমে এহসার। কুরআন বলেঃ

*******আরবী*********

আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে হজ্জ ও ওমরার নিয়ত করলে তা পূরণ কর। যদি কোথাও পরিবেষ্টিত হয়ে পড় কিংবা থেমে যেতে হয়, তাহলে যে কুরবানীই পাওয়া যায় তা আল্লাহর সামনে পেশ কর এবং মাথা মুণ্ডন করো না, যতক্ষণ না হাদীর পশু গন্তব্য স্থানে পৌঁছে যায়। (সূরা বাকারাঃ ১৯৬)

এহসানের কয়েকটা উপায়

ইহরাম বাধার পর বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার ও হজ্জ করতে না পারার বহু কারণ হতে পারে যার কিছুটা উল্লেখ করা হলোঃ

১. পথ নিরাপদ না হওয়া, দুশমনের ভয় থাকা, হত্যা ও লুণ্ঠনের ভয়, পথে কোনো হিংস্র জন্তু থাকা অথবা অন্য কোনো প্রকারের জানমালের আশংকা হওয়া।

২. ব্যাধিগ্রস্ত হওয়া, এমন আশংকা যে, সামনে অগ্রসর হলে রোগ বেড়ে যাবে, দুর্বলতার কারণে আর অগ্রসর হওয়ার শক্তি না থাকা।

৩. ইহরাম বাধার পর নারীর সাথে কোনো মুহাররাম পুরুষ না থাকা, আছে তবে অসুস্থ হলো, অথবা মারা গেল, অথবা ঝগড়া হলো এবং সঙ্গে যেতে অস্বীকার করলো কিংবা কেউ তাকে যেতে দিল না।

৪. সফর খরচ রইলো না, কম হয়ে গেল অথবা চুরি হয়ে গেল।

৫. রাস্তা ভুলে গেল এবং রাস্তা বলে দেয়ার কেউ রইলো না।

৬. কোনো নারীর ইদ্দত শুরু হলো। যেমন স্বামী তালাক দিল অথবা ইহরাম বাধার পর স্বামীর মৃত্যু হলো।

৭. কোনো নারী স্বামীর বিনা অনুমতিতে ইহরাম বাধলো এবং ইহরাম বাধার পর স্বামী নিষেধ করলো। এ সকল অবস্থায় ইহরাম বাধার পর সে ব্যক্তি মুহাসসার হয়ে যাবে।

এহসানের মাসায়েল

১. এহসানের ফলে মুহাসসার সাধ্য মতো উট,গরু, ছাগল যা পারে তা-ই খরিদ করে হেরেমে পাঠিয়ে দেবে যেন তার পক্ষ থেকে কুরবানী করা হয়।

২. এহসানের কুরবানী ওয়াজিব। যতক্ষণ মুহাসসারের পক্ষ থেকে হেরেমে কুরবানী করা না হয়, ততোক্ষণ মুহাসসার তার ইহরাম খুলবে না। কুরবানীর পশু বা তার অর্থ পাঠাবার সময় সে যবেহ করার দিন ধার্য করে দেবে যাতে করে ঐদিন সে তার ইহরাম খুলতে পারে।

৩. ওমরাহ অথবা হজ্জে এফরাদ করতে বাধাপ্রাপ্ত হলে এক কুরবানী এবং হজ্জে কেরান বা তামাত্তু করতে না পারলে দু কুরবানী পাঠাতে হবে যা তার অর্থ পাঠাতে হবে।

৪. এহসানের কুরবানীর গোশত মুহাসসারের জন্য খাওয়া জায়েয নয়। কারণ এটাও এক প্রকার জেনায়েতের কুরবানী।

৫. কুরবানীর পশু পাঠাবার পর যদি বাধা উত্তীর্ণ হয়ে যায় এবং এটা সম্ভব হয় যে, মুহাসসার কুরবানীর পশু যবেহ হবার পূর্বে মক্কায় পৌছতে পারবে এবং হজ্জের সৌভাগ্য লাভ করবে। তাহলে শীঘ্রই হজ্জের রওয়ানা হওয়া তার ওপর ওয়াজিব হবে। কিন্তু যদি কুরবানীর পূর্বে পৌছতে না পারে এবং হজ্জের সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে রওয়ানা না হওয়াই তার জন্য ওয়াজিব।

বদলা হজ্জ

বদলা হজ্জের অর্থ হলো নিজের স্থলে নিজের খরচায় অন্যকে দিয়ে হজ্জ করানো। এক ব্যক্তির ওপর হজ্জ ফরয কিন্তু কোনো অনিবার্য কারণে সে নিজে হজ্জে যেতে পারছে না। যেমন অসুস্থতা, অতি বার্ধক্য এবং এ ধরনের অন্য কোনো কারণে। সে জন্য তার এ সুযোগ রয়েছে যে, সে অন্য কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করে হজ্জে পাঠিয়ে দেবে এবং সে ব্যক্তি তার হয়ে হজ্জ করবে।

হযরত আবু রেযীন (রা) নবী (স) কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার পিতা অতি বৃদ্ধ হয়েছেন, না তিনি হজ্জ করতে পারেন না ওমরাহ। তিনি সওয়ারীর ওপর বসতেও পারেন না। নবী (স) বলেন তুমি তোমার পিতার পক্ষ থেকে হজ্জ ও ওমরাহ কর। (তিরমিযি)

এর থেকে জানা গেল যে, অন্যের পরিবর্তেও হজ্জ করা সহীহ হবে। যে ব্যক্তি স্বয়ং তার ফরয হজ্জ আদায় করতে পারে না সে অন্যকে পাঠিয়ে নিজের ফরয আদায় করতে পারে। বরঞ্চ এমন অবস্থায় নিজের ফরয আদায় করানো উচিত। এ হচ্ছে আল্লাহর নির্ধারিত ফরয এবং যে ব্যক্তি অন্যকে পাঠাবার সুযোগ পায় না সে অসিয়ত করে যাবে যে, তারপর তার মাল থেকে বদলা হজ্জ করাতে হবে।

এ ব্যক্তি নবী (স) এর দরবারে হাজির হলো এবং বললো ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার পিতার মৃত্যু হয়েছে এবং তার জীবদ্দশায় তিনি ফরয হজ্জ আদায় করতে পারেন নি। তাহলে আমি কি তার হয়ে হজ্জ করবো? নবী (স) বললেন, যদি তার কোনো ঋণ থাকতো তাহলে তুমি তা পরিশোধ করতে? লোকটি বললোঃ জি হ্যাঁ, অবশ্যই পরিশোধ করতাম। নবী (স) বললেন, আল্লাহর ঋণ পরিশোধ করা তো আরও জরুরী। (জামউল ফাওয়ায়েদ)

বদলা হজ্জ সহীহ হওয়ার শর্ত

বদলা হজ্জ সহীহ হওয়ায় ষোলটি শর্ত যার মধ্যে প্রথম পাঁচটি শর্ত তার সাথে সম্পর্কিত যে বদলা হজ্জ করাবে এবং এগারোটি শর্ত বদলা হজ্জকারীর সাথে সম্পর্কিত।

১. যে বদলা হজ্জ করাতে চায়, শরীয়াতের দৃষ্টিতে তার ওপর হজ্জ ফরয হতে হবে। এমন ব্যক্তি যদি বদলা হজ্জ করায় যার ওপর হজ্জ ফরয নয় অর্থাৎ তার সামর্থ্য নেই, তাহলে এ বদলা হজ্জ ফরয আদায় হবে না। যেমন সে বদলা হজ্জের পর সে ব্যক্তি আর্থিক দিক দিয়ে সামর্থবান হলো এবং তার ওপর হজ্জ ফরয হলো।তখন তার করানো বদলা হজ্জের দ্বারা তার ফরয আদায় হবে না। বরঞ্চ পুনরায় বদলা হজ্জ করাতে হবে, যদি সে নিজে না পারে।

২. যে বদলা হজ্জ করাতে চায় তার স্বয়ং অক্ষম হতে হবে। তার অক্ষমতা যদি সাময়িক হয় যা দূর হওয়ার আশা আছে। তাহলে বদলা হজ্জ করাবার পর যখন সে অক্ষমতা স্থায়ী হয় ও তা দূর হবার কোনো সম্ভাবনা না থাকে, যেমন বার্ধক্যের কারণে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে অথবা অন্ধ হয়েছে তাহলে এ অক্ষমতার শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা শর্ত নয়। যদি আল্লাহ তায়ালা তার বিশেষ মেহেরবানীতে বদলা হজ্জ করাবার পর তার ক্ষমতা দূর করে দেন তাহলে পুনর্বার হজ্জ করা ফরয হবে না ফরয আদায় হয়ে গিয়েছে বুঝতে হবে।

৩. বদলা হজ্জ করাবার পূর্বে এ অক্ষমতা প্রকাশ হওয়া দরকার। বদলা হজ্জ করাবার পর যদি অক্ষমতা প্রকাশ পায় তাহলে বদল হজ্জ ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য হবে না। অক্ষমতা প্রকাশ পাওয়ার পর বদলা হজ্জ করানো জরুরী হবে।

৪. যে বদলা হজ্জ করাতে চায় তাকে স্বয়ং অন্য কাউকে হজ্জের জন্যে বলতে হবে। যদি কেউ নিজে নিজে অন্যের পক্ষ থেকে তার বলা ছাড়া হজ্জ করে তাহলে ফরয দায়মুক্ত হবে না মরবার সময় অসিয়ত করাও বলার মধ্যেই শামিল। অবশ্য কারো ওয়ারিশ যদি মৃত ব্যক্তির অসিয়ত ছাড়া তার পক্ষ থেকে বদলা হজ্জ করে বা অন্য কারো দ্বারা করায় তাহলে ফরয আদায় হয়ে যাবে।

৫. যে বদলা হজ্জ করাবে তাকে স্বয়ং হজ্জের সমুদয় খরচ বহন করতে হবে।

৬. বদলা হজ্জকারীকে মুসলমান হতে হবে।

৭. বদল হজ্জকারীকে হুশ জ্ঞানসম্পন্ন লোক হতে হবে- পাগল বা মস্তিষ্ক বিকৃত হওয়া চলবে না।

৮. বদল হজ্জকারীকে বুদ্ধিমান হতে হবে- নাবালেগ হলেও চলবে। বুদ্ধি শুদ্ধি নেই এমন লোকের বদলা হজ্জ চলবে না। ফরয আদায় হবে না।

৯. বদলা হজ্জকারী ইহরাম বাধার সময় তার পক্ষ থেকে হজ্জের নিয়ত করবে- যে বদলা হজ্জ করাচ্ছে।

১০. সেই ব্যক্তি বদলা হজ্জ করবে যাকে হজ্জ করতে বলবে ঐ ব্যক্তি যার পক্ষ থেকে বদলা হজ্জ করা হচ্ছে। অর্থাৎ যে বদলা হজ্জ করাচ্ছে সে যাকে বদলা হজ্জ করতে বলবে একমাত্র সেই করবে। তবে যদি এ অনুমতি সে দেয় যে, অন্য কাউকে দিয়েও সে বদলা হজ্জ করাতে পারবে। তাহলে অন্য ব্যক্তির দ্বারাও বদলা হজ্জ সহীহ হবে।

১১. বদলা হজ্জকারী ঐ ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী হজ্জ করবে যে বদলা হজ্জ করাচ্ছে। যেমন যে ব্যক্তি বদলা হজ্জ করাচ্ছে সে যদি কেরানের কথা বলে কিংবা তামাত্তুর কথা বলে তাহলে বদলা হজ্জকারীকে তদনুযায়ী কেরান অথবা তামাত্তু হজ্জ করতে হবে।

১২. বদলা হজ্জকারী একই প্রকার হজ্জের এবং এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে ইহরাম বাধবে। দু ব্যক্তির পক্ষ থেকে বদলা হজ্জের ইহরাম বাধলে ফরয আদায় হবে না।

১৩. বদলা হজ্জকারী যানবাহনে করে হজ্জে যাবে পায়ে হেটে নয়।

১৪. বদলা হজ্জ যে করাতে চায় তার স্থান থেকেই বদলা হজ্জকারীকে হজ্জের সফর শুরু করতে হবে। যদি মৃত ব্যক্তির এক তৃতীয়াংশ মাল থেকে বদলা হজ্জ করানো হয় তাহলেও এ অর্থে যেখান থেকে হজ্জের সফর শুরু করা যেতে পারে, সেখান থেকে সফর করতে হবে।

১৫. বদলা হজ্জকারী যেন হজ্জ নষ্ট না করে। হজ্জ নষ্ট করার পর তার কাযা করলে যে বদলা হজ্জ করাচ্ছে তার ফরয আদায় হবে না।

১৬. হানাফীদের মতে বদলা হজ্জকারীর জন্যে এ শর্ত আরোপের প্রয়োজন নেই যে, তাকে প্রথমে আপন ফরয হজ্জ আদায় করতে হবে এবং তারপর সে বদলা হজ্জ করতে পারবে। অবশ্য আহলে হাদীসের কাছে শর্ত এই যে, প্রথমে ফরয হজ্জ করে না থাকলে সে বদলা হজ্জ করতে পারবে না।

মদীনায় উপস্থিতি

মদীনায় তাইয়েবাতে হাজিরা দেয়া অবশ্য হজ্জের কোনো রুকন নয়। কিন্তু মদীনার অসাধারণ মহত্ব ও ফযিলত মসজিদে নববীতে নামাযের প্রভূত সওয়াব এবং নবীর দরবারে হাজিরার প্রবল আকাংখা মুমিনকে মদীনায় টেনে নিয়ে যায়। চিরদিন তা-ই হয়ে এসেছে। মানুষ দূর দূরান্তে সফর করে আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌছবে এবং তারপর দরবারে নববীতে দরূদ ও সালাম পেশ না করেই বাড়ী ফিরবে এ এক চরম বেদনাদায়ক নৈরাশ্য। তার জন্যে মুমিনের দিল আর্তনাদ করে ওঠে।

মদীনা তাইয়েবার মহত্ত্ব ও ফযিলত

এর থেকে অধিক মহত্ত্ব ও ফযিলত মদীনার আর কি হতে পারে যে, এখানে মানবতার মহান শুভাকাঙ্ক্ষী তার জীবনের দশটি বছর অতিবাহিত করেছেন। এখানে তার পবিত্র হস্তে নির্মিত মসজিদ রয়েছে। যার মধ্যে তিনি তার সাহাবায়ে কেরামসহ নামায আদায় করেছেন। এখানেই সেই ঐতিহাসিক প্রান্তর রয়েছে যেখানে হক ও বাতিলের সিন্ধান্তকর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং এ পাক যমীনেই বদরের শহীদগণ শান্তিতে শায়িত রয়েছেন যাদের জন্যে গোটা উম্মাতে মুসলেমা গর্বিত। এখানেই ঐসব পাকরূহ বিশ্রাম করছে যাদেরকে তাদের জীবদ্দশায় নবী (স) বেহেশতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন, আর এ পাক যমীনেই রহমতের নবী স্বয়ং অবস্থান করছেন।

হিজরতের পূর্বে এ শহরের নাম ছিল ইয়াসরাব। হিজরতের পর মদীনায়ে তাইয়েবা নামে প্রসিদ্ধ লাভ করে। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং এর নাম রেখেছেন তাবা ………. বলে। (হযরত জাবের বিন সামরা (রা) বলেন, আমি নবী (স)কে একথা বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তায়ালা মদীনার নাম তাবা রেখেছেন। (মুসলিম)

তাবা, তীবা ও তাইয়েবা …………… শব্দগুলোর অর্থ হচ্ছে পবিত্র ও মনোরম সত্য কথা বলতে কি মদীনার পাক যমীন প্রকৃতপক্ষে পবিত্র ও মনোরম।

হিজরতের পর হযরত আবু বকর (রা) এবং হযরত বেলাল (রা) কঠিন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। কারণ এখানকার আবহাওয়া ছিল খুবই খারাপ ও অস্বাস্থ্যকর। প্রায়ই মহামারি রোগ দেখা দিত। নবী (স) দোয়া করেন, হে পরওয়ারদেগার! মদীনার জন্যে আমাদের হৃদয়ে মহব্বত পয়দা করে দাও যেমন মক্কার জন্যে আমাদের মহব্বত রয়েছে। এখানকার জ্বর ব্যাধিকে হুজফার দিকে বিতাড়িত করে দাও এবং এখানকার আবহাওয়া মনোরম করে দাও। (বুখারী)

মদীনার প্রতি নবী (স) এর যে অসাধারণ মহব্বত ছিল এর থেকে অনুমান করা যায় যে, যখনই করা যায় যে, যখনই তিনি কোনো সফর থেকে মদীনায় ফিরতেন, তখন দূর থেকে শহরের দালান কোঠা দেখেই তিনি আনন্দে অধীর হয়ে পড়তেন এবং বলতেন, এইতো তারা এসে গেল। (বুখারী) তারপর তিনি ঘাড়ের ওপর থেকে চাদর নামিয়ে ফেলে বলতেন, এ হচ্ছে তাইয়েবার বাতাস ওহ! কত মধুর।

তার সঙ্গী সাথীদের মধ্যে যারা ধুলাবালি থেকে বাঁচবার জন্যে মুখ ঢেকে রাখতেন তাদেরকে বলতেন, মদীনার মাটিতে আরোগ্য রয়েছে। (জাযবুল কুলুব)

নবী (স) বলেন,ঐ সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন, মদীনার মাটিতে সকল রোগের ওষুধ রয়েছে।

হযরত সাদ (রা) বলেন,আমার মনে হয়, নবী বলেছিলেন, এর মাটিতে কুষ্ঠরোগেরও আরোগ্য রয়েছে। (আত -তারগীব)

মদীনার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকে তাকীদ করে নবী (স) বলেছেন-ইবরাহীম (আ ) মক্কাকে হেরেম বলে ঘোষণা করেন এবং আমি মদীনাকে হেরেম ঘোষণা করছি। মদীনার দু ধারের মধ্যবর্তী স্থানও হেরেম। এখানে না খুনখারাবি করা যাবে, না অস্ত্রধারণ করা যাবে। গাছের পাতা পর্যন্ত ছেড়া যাবে না। অবশ্য পশুর খাদ্যের জন্য তা করা যেতে পারে। (মুসলিম)

মদীনায় বসবাস করতে গিয়ে সেখানে দুঃখ কষ্ট স্বীকার করার ফযিলত বয়ান করে নবী (স) বলেন, আমার উম্মাতের মধ্যে যে ব্যক্তি মদীনায় দুঃখ কষ্ট স্বীকার করে বসবাস করবে, কিয়ামতের দিন আমি তার জন্যে শাফায়াত করব। (মুসলিম)

নবী (স) বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে সকলের প্রথমে আমি মদীনাবাসীদের শাফায়াত করব। তারপর মক্কাবাসীর এবং তারপর তায়েফবাসীর। (তাবারানী)

হযরত ইবরাহীম (আ ) মক্কা ভূমিতে তার বংশধরকে পুনর্বাসিত করতে গিয়ে এ ঘোষণা করেন-

*******আরবী*********

অতএব (হে আল্লাহ) তুমি মানুষের অন্তঃকরণ তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও এবং তাদের খাদ্যের জন্যে ফলমূল দান কর। যাতে করে তারা কৃতজ্ঞ বান্দাহ হতে পারে। (সূরা ইবরাহীম)

নবী (স) এ দোয়ার বরাত দিয়ে মদীনার সপক্ষে কল্যাণ ও বরকতের দোয়া করেন-

আয় আল্লাহ! ইবরাহীম (আ )তোমার খাস বান্দাহ। তোমার দোস্ত এবং তোমার নবী ছিলেন। আমিও তোমার বান্দাহ ও নবী। তিনি মক্কার কল্যাণ ও বরকতের জন্য তোমার কাছে দোয়া করেন। আমিও মদীনার কল্যাণ ও বরকতের জন্য তেমনি দোয়া করছি বরঞ্চ তার চেয়ে অধিক। (মুসলিম)

মদীনার পবিত্রতা ও দীনি গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে নবী (স) বলেন- কিয়ামত সে সময় পর্যন্ত হবে না, যতক্ষণ না মদীনা তার ভেতর থেকে দুষ্কৃতিকারীদেরকে এমনভাবে বের করে দেবে যেমন কর্মকারের চুল্লি লোহার ময়লা বের করে দেয়। (মুসলিম)

মদীনায় মৃত্যুবরণের আকাংখা এবং চেষ্টা করার ফযিলত বর্ণনা করে নবী (স) বলেন-

কেউ মদীনায় মৃত্যুবরণ করতে পারলে যেন তা অবশ্যই করে। এজন্যে যে, যে ব্যক্তি মদীনায় মৃত্যুবরণ করবে আমি তার শাফায়াত করব। (মুসনাদে আহমদ, তিরমিযি)

হযরত ইবনে সাদ ৯রা) বলেন, হযরত আওফ বিন মালেক আশজানী (রা) স্বপ্ন দেখেন যে, হযরত ওমর (রা) কে শহীদ করে দেয়া হয়েছে। এ স্বপ্নের কথা তার কাছে বলা হলে তিনি দুঃখ করে বলেন-

আমার শাহাদাতের ভাগ্য কেমন করে হবে। আমি তো আরব ভূখণ্ডেই অবস্থান করছি, স্বয়ং কোনো জেহাদেই শরীক হই না এবং লোক আমাকে সর্বদা ঘিরে রাখে। তবে হ্যাঁ যদি আল্লাহর ইচ্ছা হয় তাহলেও এ অবস্থাতে তিনি আমাকে শাহাদাতের সৌভাগ্য দান করবেন। তারপর তিনি এ দোয়া পড়লেন-

*******আরবী*********

আয় আল্লাহ! আমাকে তোমার পথে শহীদ হওয়ার সৌভাগ্য দান কর এবং তোমার রাসূলের শহরে আমার মৃত্যু দাও।

মসজিদে নববীর মহত্ত্ব

মসজিদে নববীর বড়ো মহত্ত্বও এই যে, নবী পাক তার পবিত্র হাতে এ মসজিদ তৈরী করেন এবং কয়েক বছর ধরে তার মধ্যে নামায পড়েন। এ মসজিদকে তিনি তার নিজের মসজিদ বলে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, আমার মসজিদে এক নামায পড়া অন্য মসজিদে হাজার নামাজের চেয়ে বেশী উত্তম, শুধু মসজিদুল হারাম ছাড়া।

হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার মসজিদে ক্রমাগত চল্লিশ ওয়াক্ত নামায এভাবে পড়বে যে মাঝের একটি নামাযও বাদ যাবে না, তার জন্য জাহান্নামের আগুন ও অন্যান্য আযাব মাফ করা হবে এবং এভাবে মুনাফেকি থেকেও তাকে রক্ষা করা হবে। (মুসনাদে আহমদ, আত–তারগীব)

নবী (স) বলেন, আমার ঘর ও আমার মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের বাগানের মধ্যে একটি এবং আমার মিম্বর হাউজে কাওসার। (বুখারী, মুসলিম)

রওযা পাকের যিয়ারত

সেসব মুসলমান কত ভাগ্যবান ছিলেন যাদের চক্ষু শীতল হতো রাসূলে পাক (স) এর দীদার লাভে তারা সর্বদা রাসূলের সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছেন এবং তার কথায় প্রেরণা লাভ করেছেন। এ সৌভাগ্য শুধু সাহাবায়ে কেরামের জন্যে নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু এ সুযোগ তো কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে যে, রাসূল প্রেমিকগণ তার রওযা পাকে হাজিরা দেবে এবং তার দহলিজে দাড়িয়ে তার ওপর দরূদ ও সালাম পেশ করবে।

হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি হজ্জ করলো এবং আমার মৃত্যুর পর আমার রওযা যিয়ারত করলো, সে আমার যিয়ারতের সৌভাগ্য ঠিক তার মতো লাভ করলো যে আমার জীবদ্দশায় আমার যিয়ারত লাভ করেছে। (বায়হাকী)

যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুর পর আমার কবর যিয়ারত করলো, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার যিয়ারত করলো। যে আমার করব যিয়ারত করলো, তার জন্যে আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল। আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্বেও আমার কবর যিয়ারত করলো না, তার কোনো ওজর ওজরই নয়। (ইলমুল ফিকাহ)

যে ব্যক্তি আমার কবর যিয়ারতের জন্যে এলো এবং এছাড়া তার আর অন্য কোনো কাজ ছিল না, তার জন্য আমার ওপর এ হক হয়ে গেল যে, আমি তার শাফায়াত করি। (ইলমুল ফিকাহ)

রওযা পাকের যিয়ারতের হুকুম

রওযা পাক যিয়ারত করা ওয়াজিব। হাদীস থেকে তাই মনে হয়। নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি হজ্জ করলো কিন্তু আমার কবর যিয়ারত করতে এলো না সে আমার ওপর যুলুম করলো। আর এক হাদীসে আছে, যে শক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমার কবর যিয়ারত করলো না, তার ওজর গ্রহণযোগ্য নয়। এসব হাদীসের আলোকে ওলামায়ে কেরাম রওযা পাক যিয়ারত ওয়াজিব বলেছেন।

বস্তুত সাহাবায়ে কেরাম (রা) তাবেঈন এবং অন্যান্য ইসলামী মনীষীগণ রওযা যিয়ারতের বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। হযরত ওমর (রা) এর অভ্যাস ছিল যখনই কোনো সফর থেকে আসতেন সর্বপ্রথম রওযা পাকে গিয়ে দরুদ ও সালাম পেশ করতেন।

হযরত ওমর (রা) একবার কাব আহবারকে নিয়ে মদীনা এলেন এবং সর্বপ্রথম রওযা পাকে হাজির হয়ে দরূদ ও সালাম পেশ করলেন।

হযরত ওমর বিন আবদুল আযীয সিরিয়া থেকে এ উদ্দেশ্যে তার বাণী বাহককে মদীনায় পাঠালেন যে, সে সেখানে পৌঁছে দরবারে রেসালাতে তার (ওমর বিন আবদুল আযীয) সালাম পৌঁছাবে।
এক নজরে হজ্জের দোয়া
হজ্জের সময় বিভিন্ন স্থানে হজ্জের আরকান আদায় করতে গিয়ে দোয়া করতে হয়। সেগুলো যথাযথ এ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে এবং সে সবের তরজমাও করে দেয়া হয়েছে। দোয়াগুলোর সূচী ও পৃষ্ঠা নিম্নে দেয়া হলোঃ

আবে যমযম পানের দোয়া-২৭০ পৃঃ

তালবিয়ার পর দোয়া-১৬৬ পৃঃ

রামী করার দোয়া- ১৮৭ পৃঃ

সায়ীর দোয়া-১৮২ পৃঃ

তাওয়াফের দোয়া-১৭৬ পৃঃ

দোয়া কবুলের স্থানসমূহ- ২০৮ পৃঃ

কুরবানীর দোয়া-১৯৬ পৃঃ

মুলতাযিমের দোয়া ২০৭ পৃঃ

আরাফাতের ময়দানের দোয়া-১৬৮ পৃঃ

হজ্জের স্থানসমূহ
হেরমে পাক ও তার পার্শ্ববর্তী যেসব পবিত্র স্থানগুলোতে হজ্জের আমল ও রুকন আদায় করা হয় তা খুবই সম্মানের স্থান। এগুলো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালার নিদর্শন। ইসলামের ইতিহাসের সাথে এগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তা অবগত হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে অত্যন্ত জরুরী। বিশেষ করে হজ্জ যাত্রীদের জন্যে। এর ফলে তারা হজ্জের পুরো ফায়দা হাসিল করতে পারবেন। হজ্জে তাদের সে আধ্যাত্মিক আবেগ অনুভূতি সৃষ্ট হবে যা হজ্জের প্রাণ। সেসব স্থানের নাম ও পরিচয় নিম্নে দেয়া হলো।

১. বায়তুল্লাহ

এ এক চতুষ্কোণ পবিত্র গৃহ যা আল্লাহর আদেশে হযরত ইবরাহীম (আ) এবং হযরত ইসমাঈল (আ) তৈরী করেছিলেন। এ আশায় করেছিলেন যে, যতদিন দুনিয়া থাকবে ততদিন তা সমগ্র মানবতার জন্যে হেদায়েত কেন্দ্রস্থল হয়ে থাকবে। এখান থেকেই সেই রাসূলের আবির্ভাব হয় যিনি সমগ্র বিশ্বের জন্যে হেদায়াতের বিরাট দায়িত্ব পালন করতে থাকবে। কুরআন সাক্ষ্য দেয় যে, দুনিয়ায় আদম সন্তানের জন্যে আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে সর্বপ্রথম যে ঘর তৈরী করা হয়েছিল তা এ বায়তুল্লাহ। এটা সমগ্র বিশ্বের জন্যে কল্যাণ ও বরকতের উৎস ও হেদায়াতের কেন্দ্র। হজ্জের সময় হেরেম যিয়ারতকারীগণ এর চারদিকে পরম ভক্তি শ্রদ্ধা ও বিনয় নম্রতা সহকারে তাওয়াফ করে।

২. বাতনে উরনা

আরাফাতের ময়দানে এক বিশেষ স্থান যা বাতনে উরনা অথবা উরনা প্রান্তর নামে প্রসিদ্ধ। বিদায় হজ্জের সময় এ প্রান্তরেই নবী (স) জনসমাবেশে ভাষণ দান করেন।

৩. জাবালে রহমাত

আরাফাতের ময়দানের এক বরকতময় পাহাড়।

৪. জাবালে কাযাহ

মুযদালফায় মাশায়ারুল হারামের নিকটে একটি পাহাড়।

৫. জাবালে আরাফাত

ময়দানে আরাফাতের এক পাহাড়। এ পাহাড়ের জন্যেই এ উপত্যকা বা প্রান্তরকে আরাফাত বা ময়দানে আরাফাত বলা হয়।

৬. হুজফা

মক্কা থেকে পশ্চিম দিকে প্রায় একশ আশি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি স্থানের নাম হুজফা। সিরিয়াবাসী এবং সিরিয়ার পথে আগমনকারী সকলের জন্যে হুজাফ মীকাত। হেরেমে আসার জন্যে সেখানে ইহরাম বাধাতে হয়।

৭. জুমরাত

মিনায় কিছু দুরে অবস্থিত তিনটি স্তম্ভ রয়েছে। এগুলোকে জুমরাত বলে। প্রথম স্তম্ভ যা মসজিদে খায়েফের দিকে বাজারে অবস্থিত তাকে বলে জুমরায়ে উলা। বায়তুল্লাহর দিকে অবস্থিত দ্বিতীয় স্তম্ভের নাম জুমরায়ে ওকবা। এ দুয়ের মধ্যে তৃতীয় স্তম্ভ। তার নাম জুমরায়ে ওস্তা।

৮. হেরেম

যে মক্কা শহরে বায়তুল্লাহ এবং মসজিদুল হারাম অবস্থিত তার আশে পাশের কিছু এলাকাকে হেরেম বলে। হেরেমের সীমানা নির্ধারিত আছে এবং তা সকলের জানা। প্রথমে এ সীমানা নির্ধারণ করেন হযরত ইবরাহীম (আ )। তারপর নবী (স) তার যামানায় এ সীমানা নবায়িত ও সত্যায়িত করেন। মদীনার দিকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেরেমের সীমানা। ইয়ামেনের দিকে প্রায় এগারো কিলোমিটার, তায়েফের দিকেও প্রায় এগারো কিলোমিটার এবং এতো কিলোমিটার ইরাকের দিকে। নবী (স) এর পর হযরত ওমর (রা), হযরত ওসমান (রা) এবং হযরত মুয়াবিয়া (রা) তাদের আপন আপন যুগে এ সীমানা ঠিক রাখেন। আল্লাহর দীনের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যের দাবি এই যে, মুসলমান এ সীমারেখাগুলোর মহত্ত্ব, শ্রদ্ধা ও সংরক্ষণের প্রতি পুরোপুরি লক্ষ্য রাখবে এবং এ সীমারেখার ভেতর যেসব কাজ নিষিদ্ধ তা করা থেকে বিরত থাকবে।

৯. হাতীম

বায়তুল্লাহর উত্তর পশ্চিমের অংশ হযরত ইবরাহীম (আ )এর যুগে কাবা গৃহের শামিল ছিল এবং পরবর্তীকালে সংস্কারের সময় তা মূল গৃহের শামিল করা হয়নি। নবী পাকের নবুয়াতের পূর্বে আগুন লেগে কাবা ঘরের কিছু অংশ পুড়ে যায়। কুরাইশগণ পুনরায় তা নির্মাণ করতে গেলে পুঁজি কম পড়ে যায় এবং কিছু দেয়াল ছোট করে রেখে দেয়া হয়। এ অসমাপ্ত অংশকে হাতীম বলে।হাতীম যেহেতু বায়তুল্লাহরই অংশ, সে জন্যে তাওয়াফকারীগণ হাতীমের বাহির দিক দিয়ে তাওয়াফ করেন, যাতে করে হাতীমের তাওয়াফ হয়ে যায়।

১০. যাতে ইরাক

মক্কা থেকে উত্তর পূর্ব দিকে প্রায় আমি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি স্থান যা ইরাকবাসীদের জন্যে মীকাত নির্ধারিত আছে এবং ঐসব লোকদেরও জন্যে ইরাকের পথে যারা হেরেমে প্রবেশ করে।

১১. যুল হুলায়ফাহ

মদীনা থেকে মক্কা আসার পথে মদীনা থেকে আট নয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত যুল হুলায়ফা নামক স্থানটি। এটা মক্কা থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরে মদীনাবাসীদের ও মদীনা থেকে আগমনকারীদের জন্যে মীকাত।

১২. রুকনে ইয়ামেনী

বায়তুল্লাহর যে কোণ ইয়ামেনের দিকে তাকে রুকনে ইয়ামেনী বলে। এটা অতি বরকতপূর্ণ স্থান। নবী (স) বলেন, রুকনে ইয়ামেনী এবং হিজরে আসওয়াদ স্পর্শ করলে গুনাহ মাফ হয়ে যায়। (আত তারগীব)

১৩. যমযম

যমযম একটি ঐতিহাসিক কূপ যা বায়তুল্লাহর পূর্ব দিকে অবস্থিত। হযরত ইবরাহীম (আ ) যখন আল্লাহর হুকুমে হযরত ইসমাঈল (আ ) ও তার মাতা হযরত হাজেরাকে মক্কায় বারিহীন মরুভূমিতে এনে পুনর্বাসিত করেন তখন আল্লাহ তাদের ওপর বিশেষ অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন এবং এ প্রস্তরময় প্রান্তরে তাদের জন্য যমযমের এ ঝর্ণা প্রবাহিত করেন। হাদীসে এ ঝর্ণা ও তার পানির বড়ো ফযিলত বয়ান করা হয়েছে। নবী (স) বলেন, যমযমের পানি পেট ভরে পান করা উচিত। এ যে উদ্দেশ্যে পান করা হবে তা ফলদায়ক হবে। এ ক্ষুধার্তের জন্যে খাদ্য, রোগীর জন্যে আরোগ্য।

১৪. সাফা

বায়তুল্লাহর পূর্ব দিকে একটি পাহাড়ের নাম সাফা। এখন সে পাহাড়ের সামান্য চিহ্নই বাকী আছে। তার বিপরীত বায়তুল্লাহর উত্তরে মারওয়াহ পাহাড়। এ দুয়ের মাঝখানে হেরেম দর্শনার্থীর সায়ী করা ওয়াজিব। এ সায়ীর উল্লেখ কুরআন পাকে রয়েছে।

১৫. আরাফাত

আরাফাত মক্কা থেকে প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরে এক অতি প্রশস্ত ময়দান। হেরেমের সীমানা যেখানে শেষ সেখান থেকে আরাফাতের সীমানা শুরু। আরাফাতের ময়দানে পৌছা ও অবস্থান করা হজ্জের অতি গুরুত্বপূর্ণ রুকন। এ রুকন ছেড়ে দিলে হজ্জ হবে না। হাদীসে আরাফাতে অবস্থানের বড়ো ফযিলত বলা হয়েছে।

১৬. কারনুল মানাযিল

মক্কা থেকে পূর্বমুখী সড়কের ওপর এক পাহাড়ি স্থানের নাম কারনুল মানাযিল। এটা মক্কা থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটা নাজদবাসীদের জন্যে এবং নাজদের পথে যারা হেরেমে প্রবেশ করে তাদের জন্য মীকাত।

১৭. মুহাসসাব

মক্কা ও মিনার মধ্যবর্তী একটি প্রান্তর যা দুটি পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত। আজকাল একটি বসতিপূর্ণ হয়ে গেছে। এখন তাকে মুয়াহেদা বলে। নবী (স) মিনা থেকে যাবার সময় এখানে কিছুক্ষণ থেমে ছিলেন। কিন্তু এখানে থামা হজ্জের ক্রিয়াকলাপের কিছু নয়।

১৮. মুযদালফা

মিনা ও আরাফাতের একেবারে মাঝখানে এক স্থানে নাম মুযদালফা। একে জমাও বলে এজন্যে যে, ১০ই যুলহাজ্জের রাতে হাজীদের এখানে জমা হতে হয়। মুযদালফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। অবস্থানের সময় ফজরের সূচনা থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত।

১৯. মসজিদুল হারাম

মসজিদুল হারাম দুনিয়ার সকল মসজিদ থেকে উৎকৃষ্ট। বরঞ্চ নামাযের প্রকৃত স্থানই এ মসজিদ এবং দুনিয়ার সকল মসজিদ প্রকৃতপক্ষে এ মসজিদেরই স্থলাভিষিক্ত। এ হচ্ছে সেই মুবারক মসজিদ যার মাঝখানে আল্লাহর সেই ঘর অবস্থিত যা দুনিয়ার ইবাদাতের প্রথম ঘর এবং সমস্ত মানবতার হেদায়াত ও বরকতের উৎস। নবী (স) বলেন, এ মসজিদে এক নামায পড়ার সওয়াব অন্য স্থানের এক লক্ষ নামাযের সমান।

২০. মসজিদে নববী

নবী (স) যখন হিজরত করে মদীনায় এলেন তখন তিনি এখানে একটি মসজিদ তৈরী করেন। নির্মাণ কাজে সাহাবীদের সাথ তিনি নিজেও বরাবর শরীক ছিলেন। তিনি বলেন, এ আমার মসজিদ। তিনি দশ বছর এ মসজিদে নামায পড়েন এবং সাহাবায়ে কেরামও বহু বছর এতে নামায পড়েন। এ মসজিদের ফযিলত ও মহত্ত্ব বর্ণনা করে নবী (স) বলেন-

শুধুমাত্র তিনটি মসজিদের জন্যে মানুষ সফর করতে পারে। মসজিদুল হারাম, মসজিদুল আকসা ও আমার এ মসজিদ। (বুখারী ও মুসলিম)

তিনি আরও বলেন, যে ব্যক্তি আমার এ মসজিদে চল্লিশ ওয়াক্ত নামায এভাবে আদায় করে যে, মাঝের এক ওয়াক্ত ছুটে যাবে না, তাকে জাহান্নামের আগুন ও অন্যান্য আযাব থেকে নাজাত দেয়া হবে। এভাবে মুনাফেকি থেকেও তাকে অব্যাহতি দেয়া হবে। (আত-তারগীব)

২১. মসজিদে খায়েফ

এ হচ্ছে মিনার একটি মসজিদ। মিনায় অবস্থানকালে হাজীগণ এ মসজিদে যোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজর নামায আদায় করেন।

২২. মসজিদে নিমরাহ

এ হেরেম ও আরাফাতের ঠিক সীমান্তের ওপর অবস্থিত। এ মসজিদের যে দেয়াল মক্কার দিকে রয়েছে তাই হেরেম ও আরাফাতের সংযোগস্থল। জাহিলিয়াতের যুগে কুরাইশগণ আরাফাতে না গিয়ে হেরেমের সীমার মধ্যেই অর্থাৎ মাশয়ারুল হারামের পাশেই অবস্থান করতো এবং একে নিজেদের বৈশিষ্ট্য মনে করতো। কিন্তু নবী (স) বিদায় হজ্জে এ নির্দেশ দেন যে, তার তাঁবু যেন নিমরাতে খাটানো হয়। তাই করা হয়। এ স্থানেই মসজিদে নিমরা রয়েছে।

২৩. মাশয়ারুল হারাম

মুযদালফা প্রান্তরে এক উঁচু নিশানা রয়েছে। তার ধার দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে। এ স্থানকে বলে মাশয়ারুল হারাম। এখানে অধিক পরিমাণে যিকর ও তসবিহ পাঠের তাকীদ করা হয়েছে। নবী (স) ঐ উঁচু স্থানে ওঠে তসবিহ পাঠ ও দোয়া করেন। এটাও দোয়া কবুলের একটি স্থান। কুরআন পাকেও বলা হয়েছে যে, এখানে বেশী করে আল্লাহর যিকির করতে হবে-

*******আরবী*********

অতএব , তোমরা যখন আরাফাত থেকে ফিরে আসবে তখন মাশয়ারুল হারামের নিকটে আল্লাহর যিকর কর যেভাবে করতে বলা হয়েছে।

২৪. মুতাফ

বায়তুল্লাহর চারদিকে যে ডিম্বাকৃতির স্থান রয়েছে যার মধ্যে হাতীমও শামিল একে মুতাফ বলে অর্থাৎ তাওয়াফ করার স্থান। এখানে দিন রাত প্রতি মুহূর্তে মানুষ পতঙ্গের ন্যায় বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে। শুধু নামাযের জামায়াতের সময় তাওয়াফে বিরতি থাকে।

২৫. মাকামে ইবরাহীম

বায়তুল্লাহর উত্তর পূর্ব দিকে কাবার দরজার একটু দূরে একটা কোব্বা বানানো আছে। তার ভেতরে এক পবিত্র পাথর আছে যার ওপরে ইবরাহীম (আ ) এর দু পায়ের দাগ রয়েছে। একেই বলা হয় মাকামে ইবরাহীম। এটি অত্যন্ত পবিত্র ও বরকতপূর্ণ স্থান এবং আল্লাহর বিরাট নিদর্শনাবলীর একটি। আল্লাহ বলেন-

*******আরবী*********

এবং মাকামে ইবরাহীমকে স্থায়ী ইবাদাতগার বানিয়ে নাও।

তাওয়াফের সাত চক্কর শেষ করার পর তাওয়াফকারী মাকামে ইবরাহীমের পাশে দু রাকায়াত নামায পড়ে। নামাযের স্থান মাকামে ইবরাহীম ও কাবার দরজার মাঝখানে। ইমাম মালেক (র) বলেন, মাকামে ইবরাহীম ঠিক ঐ স্থানেই আছে যেখানে হযরত ইবরাহীম (আ ) রেখে গেছেন।

২৬. মুলতাযেম

বায়তুল্লাহর দেয়ালের ঐ অংশকে মুলতাযেম বলে যা হিজরে আসওয়াদ ও কাবার দরজার মাঝখানে অবস্থিত। এটা প্রায় ছয় ফুট অংশ। এটি দোয়া কবুলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মুলতাযেম শব্দের অর্থ হলো আবিষ্ট হওয়ার স্থান অর্থাৎ বক্ষ, মুখমণ্ডল, হাত দিয়ে আবেষ্টন করার স্থান। এভাবে আবেষ্টন করে অত্যন্ত বিনয় ও আন্তরিক আবেগ সহকারে এখানে দোয়া করা মসনুন।

২৭. মিনা

হেরেমের সীমার মধ্যে মক্কা থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি স্থান। যুলহজ্জের আট ও নয় তারিখের মধ্যবর্তী রাতে হাজীগণ এখানে অবস্থান করেন। নয় তারিখে ভালোভাবে সূর্য উদয় হওয়ার পর হাজীগণ এখান থেকে আরাফাতের দিকে রওয়ানা হন।

২৮. মাইলাইনে আখদারাইনে (দুটি সবুজ নিশানা)

সাফা মারওয়ার মাঝখানে মারওয়া যাবার পথে বাম দিকে দুটি সবুজ চিহ্ন আছে। এ দুটিকে বলে মাইলাইনে আখদারাইনে। এ দুটির মাঝখানে দৌড়ানো মসনুন। তবে শুধু পুরুষের জন্যে মেয়েদের জন্য নয়।

২৯. ওয়াদিয়ে মুহাসসার

মুযদালফা ও মিনার মাঝ পথে একটি স্থানকে বলে মুহাসসার। নবী পাক (স) এর জন্মের কিছু দিন পূর্বে হাবশার খৃষ্টান শাসক আবরাহা বায়তুল্লাহকে ধূলিসাৎ করার দুরভিসন্ধিসহ মক্কা আক্রমণ করে। যখন সে এ মুহাসসার প্রান্তরে পৌঁছে তখন আল্লাহ তায়ালা সমুদ্রের দিক থেকে বহু সংখ্যক ছোট ছোট পাখীর ঝাঁক পাঠিয়ে দেন। এসব পাখীর ঠোটে ও পায়ে ছোট ছোট পাথর ছিল। এসব পাথর আবরাহার সৈন্যদের উপর এমন প্রবল বেগে ও অবিরাম বর্ষণ করতে থাকে যে, গোটা সেনাবাহিনী তসনস হয়ে যায়। হজ্জ-যাত্রীগণ এ স্থান থেকে ছোট ছোট পাথর কুড়িয়ে আনে এবং তাই দিয়ে রামী করে। এ সংকল্পসহ রামী করা হয় যে, দীনে হক বরবাদ করার দুরভিসন্ধি নিয়ে যদি কেউ অগ্রসর হয় তাহলে তাকেও এভাবে তসনস করে দেয়া হবে যেমন পাখীর ঝাঁক আবরাহার সৈন্যবাহিনীকে করেছিল। হাজীদের উচিত এখান থেকে ছোলার পরিমাণ ছোট ছোট পাথর প্রয়োজন মতো সংগ্রহ করে নেয়া এবং অবিলম্বে এ স্থান পরিত্যাগ করা। কারণ এ হলো আযাবের স্থান।

৩০. ইয়ালামলাম

মক্কা থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে ইয়ামেন থেকে আসার পথে একটি স্থানের নাম। এ মক্কা থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে। ইয়ামেন এবং ইয়ামেনের দিক থেকে আগমনকারীদের মীকাত এ স্থানটি। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতবাসী হাজীদের এখানে ইহরাম বাধতে হয়।

পরিভাষা

১. ইহরাম

হজ্জের নিয়ত করে হজ্জের পোশাক পরিধান করা এবং তালবিয়া পড়াকে ইহরাম বলে। ইহরাম যে বাধে তাকে মুহরেম বলে। নামাযের জন্যে তাকবীরে তাহরিমা বলার পর যেমন খানাপিনা, চলাফেরা প্রভৃতি হারাম হয়ে যায় তেমনি ইহরাম বাধার পর বহু এমন সব জিনিস হারাম হয়ে যায় যা পূর্বে মুবাহ ছিল। এ জন্যে একে ইহরাম বলা হয়।

২. এহসার

এহসারের আভিধানিক অর্থ হলো বাধা দেয়া, বিরত রাখা। পরিভাষায় এর অর্থ হলো এই যে, কোনো ব্যক্তি হজ্জ অথবা ওমরার নিয়ত করলো, তারপর তাকে হজ্জ বা ওমরা থেকে বিতর রাখা হলো। এমন ব্যক্তিকে বলে মুহাসসার।

৩. ইস্তেলাম

এর অর্থ স্পর্শ করা, চুমো দেয়া। তাওয়াফে প্রত্যেক চক্কর শুরু করার সময় এবং তাওয়াফ শেষে হিজরে আসওয়াদ স্পর্শ করা বা চুমো দেয়া সুন্নাত। রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করা মুস্তাহাব।

৪. ইস্তেবাগ

চাদর এমনভাবে গায়ে দেয়া যাতে তার একধার ডান কাঁধের ওপর দেয়ার পরিবর্তে ডান বগলের নীচ দিয়ে বের করে বাম কাঁধের ওপর ফেলতে হবে। ডান কাঁধ খোলা থাকবে। এতে চটপটে ভাব, শক্তিমত্তা ও উৎসাহ প্রকাশ পায় এবং এভাবে প্রকাশ করা হয় যে, আল্লাহর সৈনিক দুশমনের সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত।

৫. এতেকাফ

এতেকাফ অর্থ হলো লোক কিছু সময়ের জন্যে দুনিয়ার কর্মব্যস্ততা পরিত্যাগ করে কোনো মসজিদে অবস্থান করবে এবং সেখানে যিকর, তসবিহ, আল্লাহর ইয়াদ প্রভৃতিতে মগ্ন থাকবে। রমযানের শেষ দশ দিনে এ আমল করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা।

৬. আফাকী

মীকাতের বাইর বসবাসকারী লোকদের আফাকী বলে।

৭. ইফরাদ

হজ্জ তিন প্রকার। তার এক প্রকার ইফরাদ। এ হজ্জকারীদের মুফরেদ বলে।

৮. আলমাম

আলমাম অর্থ নেমে পড়া। পরিভাষায় আলমাম অর্থ ইহরাম খোলার পর আপন পরিবারের লোকজনের মধ্যে গিয়ে পড়া।

৯. উকিয়া

এক ওজন যা ৪০ দিরহাম।

১০. আইয়ামে বীয

প্রত্যেক চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বীয অর্থাৎ উজ্জ্বল দিনগুলো।

১১. আইয়ামে তাশরীফ

যুলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত আইয়ামে তাশরীক

১২. তালবিয়া

হেরেম যিয়ারতকারীদের জন্যে বিশেষ দোয়া যা তারা বরাবর পড়তে থাকে।

১৩. তামাত্তু

তামাত্তু এক প্রকারের হজ্জ। হজ্জ ও ওমরা এক সাথে করা এবং উভয়ের জন্যে পৃথক পৃথক ইহরাম বাধা। ওমরার পর ইহরাম খুলে ফেলবে। তখন তার জন্যে ঐসব জিনিস হালাল হবে যা ইহরামের সময় হারাম। তারপর পুনরায় হজ্জের জন্যে ইহরাম বাধবে। এমন ব্যক্তিকে মুতামাত্তা বলে।

১৪. তামলিক

তামলিক অর্থ মালিক বানিয়ে দেয়া। যাকাতের একটি শর্ত এই যে, যাকাতের মাল যার হাওয়ালা করা হবে তাকে মালিক বানিয়ে দেয়া যাতে করে সে যেমন খুশী তেমনিভাবে তা ব্যয় করবে।

১৫. জেনায়েত

জেনায়েত অর্থ কোনো নিষিদ্ধ ও মন্দ কাজ করা। পরিভাষায় এর অর্থ হলো এমন কোনো কাজ করা যা হেরেমে থাকা অবস্থায় অথবা ইহরাম অবস্থায় করা হারাম।

১৬. দমে এহসার

নিয়ত করার পর কাউকে যদি হজ্জ বা ওমরা থেকে বিরত রাখা হয় তাহলে তাকে সাধ্যানুযায়ী কুরবানী করতে হয়। এ কুরবানীকে বলে দমে এহসার।

১৭. রমল

তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে হেলে দুলে দ্রুত চলাকে রমল বলে।

১৮. রামী

মিনাতে কিছু দূরে দূরে তিনটি স্তম্ভ আছে। সেগুলো লক্ষ্য করে পাথর ছুড়তে হয়। তাকে রামী বলে। স্তম্ভগুলোকে জুমরাত বলে।

১৯. সায়েমা

সায়েমা এমন সব পশু যারা বনে জঙ্গলে ঘাস খেয়ে বাচে। তাদেরকে বাড়ীতে চারা প্রভৃতি খাওয়াতে হয় না। কিন্তু দুধের জন্যে সেগুলো প্রতিপালন করা হয়।

২০. তাওয়াফে কুদুম

মক্কায় প্রবেশ করার পর সর্বপ্রথম যে তাওয়াফ করা হয় তাকে তাওয়াফে কুদুম বলে। যারা মীকাতের বাইরে বসবাস করে তাদের জন্য এটা ওয়াজিব।

২১. তাওয়াফে যিয়ারত

আরাফাতের অবস্থানের পর ১০ই যুলহজ্জ যে তাওয়াফ করা হয় তাকে তাওয়াফে যিয়ারত বলে। এ তাওয়াফ ফরয।

২২. তাওয়াফে বেদা বা বিদায়ী তাওয়াফ

বায়তুল্লাহ থেকে বিদায় হবার পূর্বে যে তাওয়াফ করা হয় তা বিদায়ী তাওয়াফ। এ তাওয়াফ আফাকীদের জন্যে ওয়াজিব।

২৩. ওমরাহ

ওমরাহ হলো ছোট হজ্জ। এ যে কোনো সময় হতে পারে। যখনই সুযোগ হবে ইহরাম বেধে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে। সায়ী করবে এবং মস্তক মুণ্ডন বা চুল ছাটার পর ইহরাম খুলবে। হজ্জের সাথেও ওমরাহ করা যায়, পৃথকভাবেও করা যায়।

২৪. ফিদিয়া

রোযা রাখতে না পারার কারণে শরীয়াতে অক্ষম ব্যক্তিকে এ সুযোগ দিয়েছে যে, সে তার বদলে সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ খাদ্যশস্য কোনো অভাবগ্রস্তকে দেবে অথবা দু বেলা খানা খাওয়াবে। একে পরিভাষায় ফিদিয়া বলে। শস্যের মূল্য দেয়াও জায়েয।

২৫. কেরান

হজ্জ ও ওমরার ইহরাম এক সাথে বাধা এবং উভয়ের রুকন আদায় করা। এমন হজ্জকারীকে কারেন বলে। কেরান হজ্জে তামাত্তু ও হজ্জে ইফরাদ উভয় থেকে উৎকৃষ্ট।

২৬. কীরাত

এক কীরাত পাঁচ যবের সমান। বিশ কীরাতে এক মিসকাল হয়।

২৭. কাফফারা কোনো শরীয়াতের দৃষ্টিতে ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ করার শরীয়াত যে আমল বলে দিয়েছে তাকে কাফফারা বলে।

২৮. মিসকাল

এক প্রকার ওজনকে বলে মিসকাল। তাহলো তিন মাশা এক রতির সমান।

২৯. মুহরিম

মীকাত থেকে যে ব্যক্তি হজ্জ অথবা ওমরার ইহরাম বাধে তাকে মুহরিম বলে।

৩০. মুহাসসার

যে ব্যক্তি হজ্জ বা ওমরার নিয়ত করার পর কোনো কারণে হজ্জ ও ওমরা থেকে বিতর থাকতে বাধ্য হয়, তাকে মুহাসসার বলে।

৩১. মীকাত

মীকাত এমন এক নির্দিষ্ট স্থান যেখান থেকে ইহরাম না বাধলে মক্কা মুকাররামা যাওয়া নিষিদ্ধ। যে কোনো উদ্দেশ্যেই কাউকে মক্কা যেতে হোক তাকে মীকাত পৌঁছে ইহরাম বাধতে হবে। ইহরাম ছাড়া সামনে অগ্রসর হওয়া মাকরূহ তাহরিমী।

৩২. ওয়াসাক

ওয়াসাক অর্থ এক উটের ওজন যা ৬০ সা এর সমতুল্য।

৩৩. হাদী

শাব্দিক অর্থ তোহফা, হাদিয়া, শরীয়াতের পরিভাষায় হাদী বলতে সেই পশু বুঝায় যা হেরেম যিয়ারতকারী কুরবানীর জন্যে সাথে করে নিয়ে যায় অথবা কোনো উপায়ে সেখানে পৌছিয়ে দেয়।

৩৪. ইয়াওমে তারবিয়া

যুলহজ্জ মাসের ৮ তারিখকে ইয়াওমে তারবিয়া বলে। বলার অর্থ এই যে, ঐদিন হজ্জের আমল শুরু হয়।

৩৫. ইয়াওমে আরাফাত

যুল হজ্জ মাসের ৯ তারিখ অর্থাৎ হজ্জের দিনকে ইয়াওমে আরাফাত বা আরাফাতের দিন বলে। এ দিন হজ্জকারীগণ আরাফাতের ময়দানে জমায়েত হন।

৩৬. ইয়াওমে নহর

যুলহজ্জ মাসের ১০ তারিখকে ইয়াওমে নহর বলে। কারণ ঐদিন থেকে কুরবানী শুরু হয়।

— সমাপ্ত —


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি