বেদনা-বিধুর সেই সোমবার

সেদিন সোমবার।
চরম বেদনা-বিধুর এক সোমবার।
চির বিদায়ের দিন মহানবীর।
তখন সুবহে সাদিক।
মসজিদে নববীতে ফজরের জামায়াতে সমবেত হয়েছেন সাহাবীরা।
নামায তখন আরম্ভ হয়েছে।
এ সময় মহানবীর হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠল তাঁর পরেও আল্লাহর বান্দারা কিভাবে মহাপ্রভুর উপাসনায় লিপ্ত থাকে তা দেখার জন্য।
তিনি তাঁর কামরার পর্দা তুলে দিতে বললেন। পর্দা উঠে যেতেই মসজিদে নববীতে সাহাবীদের নামাযের জামায়াত দৃশ্যমান হয়ে উঠল।
এই নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে সেই অন্তিম সময়েও মহানবীর মুখ-মণ্ডলের রোগ-ক্লিষ্টতা যেন দূর হয়ে গেল। আনন্দ-উৎসাহে দীপ্ত হয়ে উঠল তাঁর বদনমণ্ডল। ঠোঁটে দেখা দিল তাঁর হাসির রেখা।
সাহাবীদের দিকে চেয়ে শেষবার যেন হাসলেন মহানবী (সা)।
সেই শেষ দিনের স্নেহের দুলালী ফাতিমা (রা)।
যন্ত্রণাকাতর পিতার দিকে চেয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘হায়, আমার পিতা না জানি কত কষ্ট পাচ্ছেন।’ স্নেহের দুলালী কন্যা ফাতিমার এই বিলাপ শুনে মহানবী বললেন, ‘ফাতিমা, আর অল্প সময় তোমার পিতার কষ্ট, আজকের পর আর কষ্ট নেই।’
মহানবীর পাশে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা)। যন্ত্রণা-পীড়িত মহানবীর একটা অভিপ্রায় তিনি বুঝলেন। উম্মুল মুমিনীন একটা মেছওয়াক চিবিয়ে মহানবীর হাতে দিলেন। তা নিয়ে মহানবী (সা) ধীরে দাঁতে বুলালেন। নিকটে পানির একটা পাত্র ছিল। পাত্র থেকে হাতে করে পানি নিয়ে মুখে দিতে দিতে তিনি বললেন, “মৃত্যুর অনেক কষ্ট। লা’ ইলাহা ইল্লাল্লাহ। হে আল্লাহ আমাকে মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করার শক্তি দান কর।”
দিনের তখন তৃতীয় প্রহর শেষ হতে যাচ্ছে। মহানবী (সা) বার বার অচেতন হয়ে পড়ছেন। প্রতিবার চেতনা ফিরে আসার পরই তিনি বলছেন, “হে আল্লাহ, হে আমার পরম বন্ধু, হে আমার পরম সুহৃদ তোমার সঙ্গে তোমার সন্নিধানে।”
মহানবীর পরম স্নেহভাজন হযরত আলী (রা)-এর কোলে তখন মহানবীর মাথা। চোখ মেললেন মহানবী (সা) এবং আলীর দিকে তাকালেন। বললেন, “সাবধান, দাস-দাসীদের প্রতি নির্মম হয়ো না।’
মহানবীর চির বিদায়ের অন্তিম মুহূর্ত।
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা) মহানবীর মাথা কোলে নিয়ে বসে আছেন। তখন শেষবারের মত মহানবী (সা) চোখ খুললেন। উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘নামাজ, নামাজ সবাধান! দাস-দাসীদের প্রতি সাবধান!’ এবং মহানবীর কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ‘হে আল্লাহ, হে আমার পরম সুহৃদ!’
এটাই ছিল রাহমাতুললিল আলামিনের শেষ নিঃশ্বাসের শেষ কথা।
মহাপ্রভুর উদ্দেশ্যে চির বিদায় ঘটল জগতের শেষ নবী, আশরাফুল আম্বিয়া, রাহমাতুললিল আলামিন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

নতুন ইকরামা

ইকরামা বিন আবু জাহ্ল পালাচ্ছে।
মহানবীর মক্কা বিজয়ের পর স্বাভাবিকভাবেই সে মনে করল তার আর রক্ষা নেই।
মহানবী (সা) ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার অপরাধ সীমাহীন।
মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে মহানবী (সা) মক্কাবাসীরা অস্ত্র হাতে না নিলে তাদের জন্যে শান্তি ও নিরাপত্তা ঘোষণা করেছিলেন। এ সময় ইকরামা মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণ করে। দু’জন মুসলিম শহীদ হওয়া ছাড়াও আরও কয়েক ডজন লোক আহত হয়ে তার কারণে।
এছাড়া বদর, উহুদ, খন্দক ও মুসলমানদের আশ্রিত বানু খোজায়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সে চরম বৈরিতা ও নৃশংসতা প্রদর্শন করেছে।
সুতরাং পালাচ্ছে সে।
জিদ্দার উপকূল থেকে নৌকা নিয়ে সে পালাচ্ছে আরব ভূমি থেকেই।
কিন্তু পার হতে পারল না সে লোহিত সাগর। প্রবল বাতাস তার নৌকা আবার ফিরিয়ে আনল জিদ্দা উপকূলে। শত চেষ্টা করেও সে রোধ করতে পারল না নৌকার পেছন গতি।
কূলের কাছাকাছ এসে দেখল তীর থেকে তার স্ত্রী উম্মে হাকিম তাকে কাপড় উড়িয়ে ডাকছে।
ইকরামা তীরে নামলে তার স্ত্রী তাকে বলল, ‘আমি সেই মহানুভবের কাছ থেকে এসেছি যিনি সকল মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে বেশী আত্মীয়তার বন্ধন মজবুতকারী। আমি তার নিকট থেকে তোমার নিরাপত্তা লাভ করেছি। তুমি রাসূলুল্লাহর কাছে চলো।’
ইকরামা তার স্ত্রীর সাথে হাজির হলো মহানবী (সা)-এর দরবাবে।
আমৃত্যু বৈরী সেই আবু জাহ্লের পুত্র ইমরামা। এই ইকরামাও বৈরিতার কোন কিছুই বাদ রাখেনি।
সেই ইকরামা সমীপবর্তী হলেন মহানবীর। বেশ দূরে থাকতেই ইকরামাকে চিনতে পারলেন মহানবী (সা)। উৎসাহ আগ্রহে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ছেন তিনি।
দ্বিধা, সংকোচ, ভয় সব মিলিয়ে পদক্ষেপগুলো জড়িয়ে পড়ছে ইকরামার। এগুতে যেন কষ্ট হচ্ছে তার। উঠে দাঁড়িয়ে মহানবী (সা) দু’হাত বাড়িয়ে ছুটলেন ইকরামার দিকে। দ্রুততার কারণে তাঁর গায়ের চাদর খসে পড়ে গেল গা থেকে।
মহানবী (সা) জড়িয়ে ধরলেন ইকরামাকে। বললেন, ‘খোশ আমদেদ, বিদেশী সওয়ার।’
ইকরামা তার স্ত্রীর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘সে জানতে পেরেছে, আপনি আমাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন।’
‘সে সত্য বলেছে।’ বললেন মহানবী (সা)। আনন্দে উজ্জ¦ল হয়ে উঠল ইকরামার মুখ। লজ্জা-বেদনায় নুয়ে গেল ইকরামার মাথা। ভেজাকণ্ঠে বললেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ এক। তাঁর কোন অংশীদার নেই এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, অবশ্যই আপনি তাঁর বান্দাহ ও রাসূল। হে আল্লাহর রাসূল, এর আগে আমি ইসলাম-দুশমনির বহু প্রমাণ দিয়েছি। এখন আমার আশা, আজ পর্যন্ত আমি আপনার সাথে যে শত্রুতা করেছি, যত যুদ্ধে আপনার বিরুদ্ধে লড়েছি, হক পথে যত বাধা আরোপ করেছি, সেসব ক্ষমা করে দিন। আমার জন্য আল্লাহর কাছে মাগফিরাত কামনা করুন।“
আল্লাহর রাসূল দু’হাত তুললেন। ক্ষমা প্রর্থনা করলেন তিনি আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের কাছে ইকরামার জন্যে।
আনন্দাশ্রুতে ভরে গেল ইকরামার দু’চোখ।
আরজ করলেন তিনি মহানবীকে, ‘হে আল্লাহর রাসূল, এখন কিছু আপনি আমাকে শিখিয়ে দিন যা আমি সবসময় আমল করতে পারি।
রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “খালিস অন্তরে (কথা ও কাজে) আল্লাহর ওয়াহদানিয়াত বা একত্ব এবং আমার রিসালাতের সাক্ষ্য দিতে ও আল্লাহর পথে জিহাদ করতে থাকো।”
ইকরামা আবেগ-কম্পিত কণ্ঠে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহর কসম, আমি আজ পর্যন্ত যত সম্পদ দাওয়াতে হকের বাধা দানে ব্যয় করেছি, তার চেয়ে দ্বিগুণ এখন আমি আল্লাহর পথে ব্যয় করবো। যত লড়াই আমি হকের বিরুদ্ধে লড়েছি, এখন আল্লাহর রাসূল (সা) আবার দোয়া করলেন আকরামার জন্যে।
ইকরামা যখন মহানবীর কাছ থেকে ফিরছিলেন, তখন তার দু’গণ্ড বেয়ে নামছিল আবিরাম অশ্রুধারা। কি এক স্বর্গীয় নূরের আলোতে তাঁর মুখমণ্ডল দীপ্ত হয়ে উঠেছে। ইকরামার হলো নতুন জন্ম-নতুন এক আকরামা তিনি।

ইকরামার ওয়াদা পালন

ইসলাম গ্রহণের সময় ইকরামা বিন আবু জাহ্ল বলেছিলেন, ইসলামের বিরুদ্ধে তিনি যত যুদ্ধ করেছেন, যত যুদ্ধ করেছেন, যত অর্থ খরচ করেছেন, তার দ্বিগুন তিনি খরচ করবেন ইসলামের জন্যে।
আমৃত্যু কথাটা মনে রেখেছেন ইকরামা বিন আবু জাহ্ল।
হযরত আবু বকর (রা)-এর খিলাফতকালে ভণ্ড নবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন ইকরামা। এ জন্যে গঠিত ১১টি বাহিনীর একটির সেনাপতি ছিলেন তিনি। ইয়ামামা থেকে জর্ডান, জর্ডান থেকে ইয়েমেন- এই বিস্তৃত অঞ্চল তিনি যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর বাহিনীর গোটা খরচ তিনি নিজের অর্থ থেকে ব্যয় করেছেন, বায়তুল মাল থেকে তিনি এক পয়সাও নেননি। ভণ্ড নবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষে আমর ইবনুল আসের নেতুত্বাধীন সিরিয়াগামী বাহিনীতে শামিল হলেন ইকরামা (রা) একজন সেনাধ্যক্ষ হিসেবে।
সিরিয়াগামী বাহিনী সমবেত হয়েছে মদীনার উপকণ্ঠে।
এ বাহিনীর পরিদর্শনে বেরিয়েছেন আমীরুল মুমিনীন হযরত আবু বকর (রা)।
এক তাঁবু তাঁর দৃষ্টিগোচর হলো যার চারদিকে ঘোড়া আর ঘোড়ার মিছিল। আর দেখলেন, বর্শা, তরবারী এবং অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জামের বিশাল স্তূপ সেখানে।
হযরত আবু বকর এলেন সে তাঁবুর কাছে। উঁকি দিলেন ভেতরে। দেখতে পেলেন ইকরামা (রা)-কে।
তিনি জানতে পারলেন, এসব ঘোড়া ও সরঞ্জারম ইকরামা নিজ অর্থে কিনেছেন যুদ্ধের জন্যে।
হযরত আবু বকর (রা) ইকরামাকে সালাম করলেন এবং বললেন, “ইকরামা তুমি এই যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জামাদি ক্রয়ের জন্যে বিপুল অর্থ খরচ করেছো। আমি চাই, এর একটা অংশ বায়তুল মাল থেকে তুমি নাও।”
ইকরামা (রা) আরজ করলেন, “হে খলিফাতুর রাসূল, আমার নিকট এখনও দু’হাজার দিনার নগদ রয়েছে। আমার সম্পদ আমি আল্লাহর রাস্তায় ওয়ক্ফ করে দিয়েছে। বায়তুল মালের উপর বোঝা আরোপ করা থেকে আমাকে মাফ করুন।”
হযরত আবু বকর (র) আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। দু’হাত তুলে তিনি দোয়া করলেন ইকরামার জন্যে।

‘আজ আল্লাহর জন্যে জীবন বিলিয়ে দেবোনা?’

আজনাদাইনের যুদ্ধ শেষ।
দামেশ্ক বিজয় সম্পূর্ণ হয়েছে।
মুসলিম বাহিনী জর্দানের ফাহলে।
ছোট মুসলিম বাহিনী ৮০ হাজার রোমক সৈন্যের মুখোমুখি।
সম্মুখ সমরে ভীত রোমক বাহিনী বীরত্বের বদলে বেছে নিল ষড়যন্ত্রের পথ।
এক অন্ধকার রাত।
রোমক বাহিনী এসে আপতিত হলো মুসলিম বাহিনীর উপর।
ভীষণ যুদ্ধ শুরু হলো।
যুদ্ধ চলল সে রাত এবং পরের গোটা দিন। এক ইকরামা ইবনে আবু জাহেল যেন দশ ইকরামায় পরিণত হয়েছেন। যেদিকে তিনি ছুটছেন, লাশের সারি পড়ে যাচ্ছে। যুদ্ধের স্রোত তাকে মূল বাহিনী থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। সামনে তাঁর বিরাট এক শত্রু ব্যুহ।
ঢুকে পড়লেন তিনি সে শত্রু ব্যুহে।
তাঁর লক্ষ্য শত্রু নিধন। নিজের প্রতি কোন খেয়াল তাঁর নেই। আঘাতে আঘতে ক্ষত-বিক্ষত হতে লাগল তাঁর দেহ। সাথীরা ধ্বংসের মধ্যে নিপতিত করা না। আবেগকে বুদ্ধির উপর বিজয়ী হতে দিও না।”
ইকরামা তার তরবারী না থামিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, “হে লোকেরা, আমি লাত-উজ্জার খাতিরে জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতাম। আজ আল্লাহ ও রাসূলের (সা) জন্যে জীবন বিলিয়ে দেব না? আল্লাহর কসম, তা কখনো হবে না।”
রোমক সৈন্যেরা তখন পিছু হটতে শুরু করেছে। যুদ্ধে তাদের শোচনীয় পরাজয় ঘটল। মাত্র কতিপয় সৈন্য ছাড়া গোটা রোমক বাহিনী নিশ্চি‎হ্ন হয়েছিল ঐ যুদ্ধে। শহীদ হতে চাইলেও এ যুদ্ধেও ইকরামা গাজী হয়ে ফিরলেন।

শাহাদাতের বাইয়াত

ইয়ারমুকের ভয়াবহ রণক্ষেত্র।
রোমক সম্রাটের ২ লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী অতুল সমর-সম্ভার নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত।
তাদের মুকাবিলায় দাঁড়িয়েছে খালিদ বি ওয়ালিদের নেতৃত্বে ৪০ হাজার সৈন্যের মুসলিম বাহিনী।
দুই পক্ষ থেকেই শুরু হয়েছে মরণপণ যুদ্ধ। যুদ্ধের এক পর্যায়ে বিশাল রোমক বাহিনীর চাপে মুসলিম বাহিনীর ব্যুহগুলো ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো।
খোদ সেনাপতি তাঁবু বিপন্ন হয়ে উঠল।
ইকরামা বিন আবু জাহলের হৃদয়ের সব আবেগ যেন উথলে উঠল। নিজের ঘোড়া হাঁকিয়ে অগ্রসর হলেন সামনে এবং উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, “হে রোমকরা, আমি কোন এক সময় স্বয়ং রাসূলের (সা) বিরুদ্ধে (কুফরী অবস্থায়) লড়াই করেছি। আজ কি তোমাদের মুকাবিলায় আমার কদম পিছু হটতে পারে? আল্লাহর কসম, এমনটি কখনও হবে না।”
বলে তিনি পেছনে তাকিয়ে তাঁর বাহিনীর উদ্দেশ্যে বললেন, “এসো, কে আমার হাতে মৃত্যুর বাইয়াত করবে?”
চারজন অগ্রসর হলো তাঁর দিকে তাঁর ইকরামার হাতে হাত রেখে শাহাদাতের বাইয়াত গ্রহণ করল। এই চারজনের মধ্যে দু’জন ছিল ইকরামার দুই ছেলে। তার ঝাঁপিয়ে পড়ল খালিদ ইবনে ওয়ালিদের তাঁবু লক্ষ্য করে এগিয়ে আসা রোমক সৈন্যেদের উপর। শুরু হলো তাদের মরণপণ লড়াই।
এক এক করে তারা শহীদ হলেন অথবা শুরুতর আহত হয়ে লড়াই করতে অক্ষম হয়ে পড়লেন। গুরুতর আহত ছিলেন ইকরামার দুই পুত্র। ছুটে এলেন খালিদ ইবনে ওয়ালিদ। নিহতে স্তূফে পাওয়া গেল হযরত ইকরামার (রা) লাশ। তাঁর নিঃশ্বাস তখনও ছিল। হযরত খালিদ তাঁর মাথা কোলে তুলে নিলেন্ তাঁর মুখে ফোটা ফোটা পনি দিতে দিতে বললেন, “আল্লাহর কসম, ইবনে হানতামার (হযরত উমর ফারুকের) ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয়নি। তাঁর ধারণা ছিল যে, বনি মাখজুমীরা শাহাদাত লাভ করতে চায় না।”

একটি বক্তৃতা ও কাব্য প্রতিযোগিতা

মক্কা বিজয় ও হুনাইন যুদ্ধের পর আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মদীনায় প্রতিনিধিদল আসার হিড়িক পড়ে গেল। কেউ এল ইসলাম গ্রহণের জন্যে, কেউ এল মহানবীর সাথে দেখা করে সব বিষয় অবহিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেবার লক্ষ্যে। আরবের একটি বড় ও প্রতাবশালী গোত্র বনু তামিম। সে গোত্র থেকে প্রায় ৮০ জনের একটি প্রতিনিধিদল এল মদীনায়।
বনু তামিমের যেমন অর্থ-বিত্ত আছে, তেমনি ভাষা ও কবিত্বের প্রতিভা নিয়ে তারা দারুণ অহংকারী। এ ব্যাপারে গোটা আরবের কাউকেই তার পাত্তা দেয় না। তারা মনে করে ভাষা ও কবিত্বের প্রতিযোগিতায় তাদের কোন প্রতিদ্বন্দ¦ী নেই।
মহানবীর (সা) সাথে আলোচনায় বসার পর তারা মহানবীর (সা) কাছে প্রস্তাব করল, আপনাদের সাথে প্রথমে আমাদের কীর্তিগাথা নিয়ে কাব্য প্রতিযোগিতা হবে। যদি তাতে আপনারা জিতে যান, তাহলে ইসলাম নিয়ে কথা বলব। উত্তরে মহানবী (সা) বললেন, গর্ব-আহংকার প্রদর্শন এবং কবিতাবাজির জন্যে আমি প্রেরিত হইন। তবে তোমরা যদি পীড়াপীড়ি কর, তাহলে শুন, এক্ষেত্রেও আমরা দুর্বল ও অসমর্থ নই।
শুরু হলো বক্তৃতা ও কাব্য প্রতিযোগিতা। বনু তামিমের পক্ষ থেকে দাঁড়ালেন তাদের শ্রেষ্ঠ ভাষাশিল্পী ও বাগ্মী আতারফ বিন হাজির। তিনি তার স্বগোত্রের মান-মর্যাদা, ক্ষমতা-প্রভাব, বংশ-গৌরব, বিত্ত-বৈভর, বীরত্ব ও মেহমানদারী নিয়ে অলঙ্কৃত ভাষায় ওজস্বী বক্তৃতা দিয়ে বিজয়ের গর্ব নিয়ে বসে পড়লেন। তিনি বসলে মহানবী (সা) তাঁর সাহাবী সাবিত বিন কায়েসকে আতারফের জবাব দিতে নির্দেশ দিলেন। সাবিত বিন কায়েস দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা কীর্তন, রিসালাত ও দাওয়াতে হকের বর্ণনা, আল-কুরআনের অবতীর্ণ হওয়া এবং মুহাজির ও আনসারদের চরিত্র ও কাজে এমন অলংকারপূর্ণ ভাষায় বাগ্মিতার সাথে বর্ণনা করলেন যে, গোটা মজলিস মন্ত্রমুগ্ধের মত নিশ্চুপ হয়ে গেল।
বক্তৃতা প্রতিযোগিতার পর শুরু হলো কাব্য প্রতিযোগিতা।
বনু তামিমের পক্ষ থেকে দাঁড়ালেন তাদের শ্রেষ্ঠ কবি যবরকান বিন বদর। তিনি তাঁর গোত্রের আকাশস্পর্শী প্রশংসা-সম্বলিত কবিতা পাঠ করলেন।
যবরকান বসলে মহানবী (সা) সাহাবী কবি হাসসান বিন সাবিতকে জবাব দেয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াতে বললেন। হাসসান বিন সাবিত উঠে দাঁড়িয়ে আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং দাওয়াতে হক-এর উপর এমন ছন্দোবদ্ধ এবং মাধুর্যপূর্ণ ও প্রভাবশালী কবিতা পাঠ করলেন যে, যবরকানের কবিতা ম্লান হয়ে গেল।
শেষ হলো প্রতিযোগিতা।
গোটা মজলিস তখন নীরব-নিস্তব্ধ।
উঠে দাঁড়াল বনু তামিম-এর একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। উচ্চকণ্ঠে বললেন তিনি, “পিতার কসম! মুহাম্মাদের (সা) খতিব আমাদের খতিব থেকে আফজাল এবং তাঁর কবি আমাদের কবি থেকে উত্তম। তাঁদের কণ্ঠস্বর আমাদের কণ্ঠস্বর থেকে চিত্তাকর্ষক ও মিষ্টি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ ইবাদাতের যোগ্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।”
এই ব্যক্তি কিরাসুল আকরা তামিমী। তিনি বনু তামিম-এর নেতা। কিরাসুল আকরা থাকতেই বনু তামিম প্রতিনিধি দলের সকল সদস্য একবাক্যে বলে উঠলেন, “আপনি সত্য বলেছেন, আপনি সত্য কথা বলেছেন।”
অতঃপর বনু তামিমের সকলে মহানবীর হাতে হাত রেখে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলেন।

হযরত উমর (রা)-এর কঠোর সিদ্ধান্ত

হযরত আবু বকর (রা)-এর খিলাফতকাল। দুই সাহাবী আকরা বিন হারিস এবং আইনিয়া বিন হাসান আবু বকরের দরবারে হাজির হলেন।
মহানবী (সা) তালিফে কুলুব হিসেবে যাদের সাহায্য করতেন, আকরা তাদের একজন। তারা খলিফা আবু বকরের কাছে ‘জায়গীর‘-এর আবেদন জানালেন। আবু বকরের দরবারে তখন উমর ফারুক (রা) হাজির ছিলেন। তিনি আকরা (রা)-কে উদ্দেশ্য করে বললেন, “রাসূলুল্লাহ (সা) তোমাকে তালিফে কুলূব করতেন। এখন তোমার পরিশ্রম কর উচিত।” আবু বকর (রা) রাসূল (সা)-এর আমলের সকল দান ও উপঢৌকন বহাল রাখেন এবং আকরা ও আইনিয়া হাসানের আবেদন অনুসারে তাদের জমি বরাদ্দের লিখিত নির্দেশ দিলেন।
এর অনেক পরের ঘটনা।
তখন উমর ফারুক (রা)-এর শাসনকাল।
আকরা (রা) এবং আইনিয়া হাসান এলেন তাঁর কাছে এবং আবেদন করলেন আবু বকর (রা) কর্তৃক নির্দেশ বহাল রাখার জন্যে।
উমর (রা) তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন এবং বললেন, “আল্লাহ ইসলামের বিজয় দিয়েছেন এবং তোমাদের থেকে মুখাপেক্ষীহীন করেছেন। এখন তোমরা (জায়গীর ও উপঢৌকন ছাড়া) ইসলামের উপর মজবুতভাবে দাঁড়িয়ে যাও। নচেৎ আমাদের ও তোমাদের মধ্যে তরবাবিই ফায়সালা করবে।”
উপর (রা)-এর এই সিদ্ধান্ত কঠোর হলেও তার মধ্যে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়াই হলো না। আকরা (রা) হাসিমুখে ও আন্তরিকতার সাথে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন। অতঃপর জিহাদের ময়দান হলো আকরা (রা)-এর স্থান। যদ্ধরত অবস্থায়ই তিনি শাহাদাত তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

উপযুক্ত খাজনা আদায়কারী

তখন নবম হিজরী সাল।
মহানবী বিভিন্ন অঞ্চলে যাকাত ও খারাজ আদায়কারী নিয়োগ করছেন। যারা গোত্রে গোত্রে ঘুরে যাকাত ও খারাজ আদায় করে মহানবীর বাইতুলমালে জমা দেবেন।
যাকাত ও খারাজ আদায়কারী নিয়োগের লক্ষ্যে মহানবী (সা) ডেকে পাঠালেন খাজরাজ গোত্রের বনু সালেমের নব্য যুবক উবাদাহ বিন সামিতকে। দীর্ঘদেহী ও দোহার গড়নের উবাদাহ হাজির হলেন মহানবীর দরবারে। মহানবী (সা) তাঁকে পদ ও দায়িত্বের কথা বুঝিয়ে বললেন, “নিজের দায়িত্ব পালন-কালে আল্লাহকে ভয় করবে। কিয়ামতের দিন কোন চতুষ্পদ জন্তুও যেন তোমার বিরুদ্ধে কোন ফরিয়াদ নিয়ে না আসে।”
শুনে হযরত উবাদাহ (রা) বিন সামিত কেঁদে ফেললেন। বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পিতা-মাতা আপনার উপর কুরবান হোন। আল্লাহর কসম, দু’জন মানুষের শাসক বা রাজস্ব আদায়কারী হওয়ারও ইচ্ছা আমার নেই।” কেউ কোন পদ চাইলে রাসূলুল্লাহ সেই পদ তাকে দিতেন না। উবাদাহর কথায় তিনি খুলী হলেন। এই পদের জন্যে তাকেই উপযুক্ত মনে করলেন।

কবিতার বিনিময়ে আল কুরআন

আবু আকিল লবিদ (রা) রাবিয়াহ আমেরী আরবের জাহেলী যুগের একজন শ্রেষ্ঠ কবি। সেই যুগেও সবচেয়ে সম্মানিত কা’বাঘরে যে সাত কবির কবিতা টাঙ্গিয়ে রাখা হতো, তাদের একজন কবি লাবিদ। কবি লাবিদের কয়েকটি কবিতা মহানবী (সা) খুবই পছন্দ করতেন। সেগুলোর মধ্যে জাহেলী যুগের লিখা হলেও একটা পংক্তি ছিল তাঁর খুবই পছন্দ। যার অনুবাদ-“সতর্ক থেকো, আল্লাহ ছাড়া সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে।” স্বয়ং মহানবীর উক্তি : কবিদের কবিতার মধ্যে লাবিদের এই কবিতা খুবই ভালো। সেই কবি লাবিদ বদলে গেল ইসলাম গ্রহণের পর। ৯ম হিজরী সালে ১১৩ বছর বয়সে মদীনায় এসে মহানবীর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি।
ইসলাম গ্রহণের পর আরও ৩২ বছর জীবিত ছিলেন কবি লাবিদ। এই দীর্ঘ সময়ে একটি অথবা দু’টি কবিতা লিখেন তিনি।
তখন খলিফা উমর ফারুকের খিলাফতের সময়।
খলিফা একদিন কবি লাবিদকে জিজ্ঞাসা করে পাঠালেন, ‘ইসলামী যুগে তিনি কোন্ কবিতা রচনা করেছেন।’
কবি লাবিদ উত্তরে তাঁকে জানালেন, ‘কবিতার বিনিময়ে আল্লাহ তাঁকে সূরা বাকারাহ এবং সূরা আলে-ইমরান প্রদান করেছেন।’
অর্থাৎ অপরূপ আল-কুরআন পাবার পর তিনি আর কবিতা রচনার প্রয়োজন অনুভর করেননি।

আকাবার প্রথম বাইয়াত

ইসলাম-পূর্ব জাহেলী যুগ।
মদীনার ছয় যুবক হজ্বে এসেছেন। তখন মদীনার নাম ছিল ইয়াসরিব।
সে যুগেও হজ্ব হতো, কিন্তু জাহেলী রীতি অনুসারে।
মক্কার আকাবা নামক স্থানে তাঁবু গাড়লেন মদীনার সেই যুবকরা।
এই ছয়জন যুবক একদিন গম্ভীর আলোচনায় মশগুল, একজন অতিথি এলেন তাঁবুর দরজায়।
শ্রদ্ধা জাগানো সুন্দর সৌম্য-দর্শন এক অতিথি।
অতিথি সালাম দিলেন যুবকদের উদ্দেশ্যে। তারপর বললেন, ‘আপনারা কি আমর কথা শুনবেন?'
মিষ্টি কণ্ঠস্বর অতিথির।
যুবকরা সমস্বরে বলে উঠলো, ‘অবশ্যই অবশ্যই।’
অতিথি ব্যক্তিটি ছিলেন মহানবী (সা)।
তিনি তখন ছয় যুবককে মানুষের জন্যে রাব্বুল আলামিনের খোশখবর শোনালেন, তাওহীদের দাওয়াত গ্রহণের উৎসাহ দিলেন এবং বললেন, ‘আমি আল্লাহ্র রাসূল। আল্লাহর বান্দাদের পথ প্রদর্শনে নিয়োজিত রয়েছি।’ ছয়জন যুবকই মহানবীর কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। আল্লাহর রুসূলের কথা শেষ হতেই তাঁর বললেন, ‘আল্লাহর যে কালাম আপনার উপর অবতীর্ণ হয়েছে, তা থেকে আমাদের কিছু শোনান।’
মহানবীর পবিত্র কণ্ঠে সূরা ইবরাহিম পাঠ হতে লাগলো। কয়েকটি আয়াত পাঠ হতেই চমৎকৃত হয়ে গেলেন ছয় যুবক। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন, “আল্লাহর কসম, এতো সেই নবী যাঁর উল্লেখ সবসময় আমাদের শহরের ইহুদীদের মুখে শোনা যায়। ইসলাম গ্রহণে ইহুদীদের আগে তাদেরই অগ্রসর হওয়া উচিত।”
অতঃপর তার উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে মহানবী (সা)-কে আরজ করলেঅ, ‘হে মুহাম্মাদ (সা), আমরা আপনার দাওয়াত মনে-প্রাণে গ্রহণ করছি এবং সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ এক আপনি তাঁর রাসূল।’
এই ঘোষণা দেয়ার পর ছয়জনের মধ্য থেকে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও সদর্শন যুবক আবু উসামা আসয়াদ বিন যুরারাহ মহানবীর দিকে অগ্রসর হয়ে বললেন, ‘তে আল্লাহর রাসূল, আপনার হাত সম্প্রসারিত করুন। আমি এই হাতে ইসলামের বাইয়াত করছি।’
মহানবী (সা) সানন্দে তাঁর হাত এগিয়ে দিলেন।
প্রথম বাইয়াত করলেন আসয়াদ বিন যুরারাহ। তারপর তাঁর সাথী পাঁচজন যুবক।
তাঁরা হলেন মদীনার প্রথম মুসলমান।
এইভাবেই এই উদ্যমী যুবকদের মাধ্যমে ইসলামের আলো প্রথম প্রবেশ করে ইয়াসরিব বা মদীনায়।

আল কুরআনের যাদু-স্পর্শ

মদীনায় ইসলামের আলো প্রবেশের পর মহানবীর পক্ষ থেকে সেখানে মুসআব ইবনে উমায়েরকে পাঠানো হলো ইসলামের শিক্ষক হিসেবে। মুসআব শিক্ষাদান ও ইসলামের দাওয়াতের কাজে নিজকে উৎসর্গ করলেন। একদিন তিনি মদীনার বনি জাফর ও বনি আশহাল-এর পল্লীতে গেলেন। তার সাথে ছিলেন বিখ্যাত খাজরাজ গোত্রের বনু নাজ্জারের বিখ্যাত ব্যক্তি আসয়াদ ইবনে যুরারাহ।
তার দু’জন বনু জাফরের একটা কূপের উপর গিয়ে বসলেন।
বনু আশহালের সরদার সা’আদ বিন মায়াজকে কেউ গিয়ে কথাটা লাগিয়ে দিলো যে, মুসলমানরা মহল্লায় এসে মানুষকে প্ররোচিত করছে।
কথাটা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন তিনি। অস্ত্র-সজ্জিত হয়ে যাত্রা করলেন সেই কূপের দিকে।
পথিমধ্যে তিনি খবর পেলেন, মুসআবের সাথে তার খালাতো ভাই আসয়াদ ইবনে যরারাহ রয়েছেন। থমকে গেলেন তিনি। তাঁর চাচাতো ভাই উসায়েদ বিন হুজায়েরকে বললেন, আসয়াদ না থাকলে আমিই যেতাম। তুমি গিয়ে ওদের বলে এসো, মানুষকে নষ্ট করার জন্যে ওরা আমাদের মহল্লায় যেন আর না আসে। উসায়েদ দুরন্ত এক সাহসী যুবক।
ভয়াবহ এক বর্শা নিয়ে ছুটলেন বনু জাফরের সেই কূপের উদ্দেশ্যে।
উসায়েদকে এইভাবে আসতে দেখে আসয়াদ ইবনে যারারাহ মুসআবকে বললেন, ‘এই উসায়েদ আওস গোত্রের দুই প্রধানের একজন। তার কাছে আপনাকে উপযুক্ত দাওয়াত পৌঁছাতে হবে।’
‘তাকে একটু বসতে দাও, আমি কথা বলবো।’ বললেন মুসআব।
উসায়েদ এসেই ক্রুদ্ধ কণ্ঠে মুসআবকে বলতে শুরু করলো, ‘তুমি এসেছো দুর্বল লোকদের বোকা বানাবার জন্যে। জীবনের মায়া থাকলে এখনি চলে যাও। আর এদিকে আসবে না।’ মুসআব উসায়েদের কর্কশ ও দ্রুতকণ্ঠের জবাবে নরম ও মমতাভরা কণ্ঠে বললেন, ‘প্রিয় ভাই, আমার কথা শুনুন। পছন্দ হলে গ্রহণ করবেন, না হয় বর্জন করবেন।’
মুসআবের নরম ও মমতাভরা কণ্ঠে উসায়েদের রাগ অকেনখানি পড়ে গেলো। বললো, ‘তুমি যুক্তির কথা বলেছো। কি বলতে চাও বলো।’
মুসআব অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী কণ্ঠে ইসলামের মূল শিক্ষা তুলে ধরলেন এবং পাঠ করলেন আল-কুরআনের কিছু আয়াত।
উসায়েদের রাগ তখন পড়ে গেছে।
শান্ত হয়েছে সে।
মুসআব থামতেই উসায়েদের মুগ্ধ কণ্ঠ বলে উঠলো, “এসব কতই না ভালো জীবনের কথা। কতই না সুন্দর কালাম ওগুলো। তোমাদের ধর্মে প্রবেশের জন্যে কি করতে হয়?”
মুসআব ও আসয়াদ খুশী হয়ে তাকে আনালেন ইসলাম গ্রহণের জন্যে কি করতে হয়।
গোসল করে পবিত্র কাপড় পরে কালেমা পড়ে ইসলাম গ্রহণ করলো উসায়েদ।
ফিরে যাবার সময় উসায়েদ মুসআবকে বললেন, আমি গিয়ে কৌশলে সা’আদ বিন মায়াজকে পাঠাচ্ছি।
উসায়েদকে পাঠিয়ে তার ফেরার জন্য অপেক্ষা করছিলেন সা’দ বিন মায়াজ। উসায়েদ ফিরলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে সা’আদ বললেন, ‘তোমাকে অন্য রকমের দেখাচ্ছে। বল কি করে এল?’
উসায়েদ বললেন, তাদের কথা শুনলাম, ভয়ের কিছুই পেলাম না।
বলে একটু থেমে আবার শুরু করলেন, ‘একটা কথা শুনে এলাম, বনি হারেছার লোকেরা নাকি আসায়াদ ইবনে যারারাকে হত্যা করার জন্যে বের হয়েছে। আপনার খালাত ভাইকে হত্যা করে আপনার বেইজ্জতির করাই তাদের লক্ষ্য।’ শুনে সা’আদ রেগে আগুন হয়ে গেল। বর্শা হাতে ছুটলেন বনি জাফরের সেই কূপের দিকে।
কূপের নিকটবর্তী হয়ে আসয়াদ বিন যরারাহ মুসআকে জানালেন, ‘যিনি আসছেঞন সেই সা’আদ বিন মায়াজ তার গোত্রের শীর্ষ ব্যাক্তি। তিনি ইসলামে দাখিল হলে গোটা গোত্র তাকে অনুসরণ করবে।’ সা’আদ ইবনে মায়াজ কূপের ধারে এলেন। কনি হরেছার কাউকে কোথাও দেখলেন না। আর নিশ্চিন্ত বসে থাকতে দেখলেন আসয়াদকে। উসায়েদের কথাকে এখন তাঁর এক চাল বলে মনে হলো। ক্রুদ্ধ হলেন তিনি। বললেন তিনি আসয়াদকে, “আবু উসামা, আল্লাহর কসম, তোমার মাঝে আমার আত্মীয়ের সম্পর্ক না থাকলে তুমি কিছুতেই আমার মহল্লায় খারাপ কথা ছড়াবার সাহস পেতে না।”
আসয়াদ (রা) সা’আদ বিন মায়াজের মত ক্রুদ্ধ হলেন না। মিষ্টি হাসলেন শুধু। কোন কথা বললেন না। কথা বললেন মুসআব। মধুর কণ্ঠে সা’আদকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘প্রিয় ভাই, আপনি আমাদের কথা একটু শুনুন। আপনার খারাপ মনে হবে এমন কথা বলবো না। পছন্দ না হলে আমরা চলে যাব।’ সা’আদ বিন মায়াজ বললেন, ‘বড় কায়াদা করে কথাগুলো বললে।’
বলে সা’আদ বর্শা মাটিতে গেড়ে বসে পড়লেন। বুঝা গেল শুনতে চান তিনি। মুসআব হৃদয়গ্রাহী ভাষায় ইসলামের শিক্ষা ও সৌন্দর্যের বর্ণনা দিলেন এবং সূরা যুখরুফ বা হামিম থেকে কিছু আয়াত পড়ে শোনালেন।
পবিত্র কুরআনের পাঠ শুরু হতেই সা’আদ এর কঠিন মুখ সহজ হয়ে এল, ভরে গেল হাসি-খুশীতে।
মুসআব কুরআন তেলাওয়াত শেষ করতেই উসায়েদ যা বলেছিল, সা’আদও তাই বললেন। জানতে চাইলেন ইসলাম গ্রহণের নিয়ম-কানুন।
ঠিক উসায়েদের মতই সা’আদ ইবনে মায়াজ গোসল করে পবিত্র কাপড় পরে কালেমা পাঠ করে ইসলামে দাখিল হয়ে গেলেন।
সা’আদ বিন মায়াজ ইসলাম গ্রহণের সাথে গোটা বনু আশহাল গোত্র ইসলাম গ্রহণ করল।

দুনিয়াটা আপনাদের মত বুজুর্গের কারণে টিকে আছে

তখন উমর ফারুক (রা)-এর খিলাফতকাল।
উবাদাহ বিন সামিত তখন ফিলিস্তিনীদের কাজী। আর মুয়াবিয়া (রা) সেই ফিলিস্তিনের গভর্নর।
উবাদাহ (রা) অন্যায়-অসংগতি তা যত ছোটই হোক, তার কাছে নতি শিকার করতো না।
এই উবাদাহ (রা)-এর সাথে একদিন কথা কাটাকাটি হয়ে গের মুয়াবিয়ার (রা)। গভর্নর মুয়াবিয়া তাকে কিছু কঠোর কথা শোনালেন।
হযরত উবাদা (রা) তা সহ্য করলেন না। ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে এলেন মদীনায়। আসার সময় মুয়াবিয়া (রা)-কে বললেন, ‘ভবিষ্যতে আপনি যেখানে থাকবেন, আমি সেখানে থাকবো না।’
মদীনায় ফিরে এলে খলিফা উমর (রা) তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। বললেন সব কথা উবাদাহ (রা)। সব শোনার পর খলিফা উমর (রা) বললেন, “আমি আপনাকে কোনক্রমেই সেখান থেকে সরিয়ে আনবো না। দুনিয়াটা আপনাদের মত বুজুর্গের কারণেই টিকে আছে। যেখানে আপনাদের মত লোক থাকবে না, আল্লাহ সেই জমিনকে খারাপ ও ধ্বংস করে দেবেন। আপনি আপনার স্থানে ফিরে যান। আমি আপনাকের মুয়াবিয়ার (রা) অধীনতা থেকে পৃথক করে দিলাম।”
খলিফা উমর (রা) অনুরূপভাবে গভর্নর মুয়াবিয়াকেও লিখে পাঠালেন।

উবাদার (রা) সত্যনিষ্ঠা

তখন উসমান (রা)-এর খিলাফত। ময়াবিয়া (রা) তখন সমগ্র সিরিয়ার গভর্নর। উবাদাহ ইবনে সামিত তাঁর অধীনে একজন শাসক। উবাদাহ (রা) সেই লোক যিনি সত্য কথা, উচিত কথা বলেন, তখন কোথায় কার কাছে বলছেন তার পরোয়া করেন না।
তাঁর বিরোধ বাধল মুয়াবিয়া (রা)-এর সাথে। মুয়াবিয়া (রা) খলিফা উসমান (রা) কে লিখলেন, “উবাদাহ বিন সামিতের কথা ও ভাষণ জনগণকে উত্তেজিত করে এবং বিশৃংখল করে তোলে। তাঁকে সিরিয়া থেকে প্রত্যাহার করে নিন। তা না হলে আমি সিরিয়ার শাসন কাজ পরিত্যাগ করব।”
উসমান (রা) উবাদাহ ইবনে সামিতকে মদীনায় ডেকে পাঠালেন।
তিনি এলেন খলিফা উসমান (রা)-এর দরবারে। দরবারে তখন অনেক লোক। উবাদাহ (রা) এক কোনায় চুপ করে বসে পড়লেন। উবাদাহ (রা)-কে দেখতে পেয়েই উসমান (রা) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বলুন তো কি ঘটনা।” স্পষ্টবাদী উবাদাহ (রা) উঠে দাঁড়ালেন। সত্য প্রকাশের অসীম আবেগে তিনি উদ্দীপ্ত। দরবারের সমাবেশকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, “হে মানুষেরা, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আমার পর আমীরেরা সৎকে অসৎ এবং অসৎকে সৎ-এ পরিবর্তন করবে। অবৈধ কাজকে বৈধ মনে করতে থাকবে। কিন্তু গুনাহর কাজে কারও আনুগত্য জায়েয নয়। তোমরা অবশ্যই অসৎ কাজ থেকে দূরে থাকবে।’
আবু হুরাইরা (রা) উবাদাহ (রা)-এর বক্তব্যে কিছু বাধা দিতে চাইলেন।
উবাদাহ ইবনে সামিত সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “আমরা যে সময় রাসুলুল্লাহর (সা) হাতে বাইয়াত (নবুয়তের ত্রয়োদশ বছরে বাইয়াতে আকাবায় এ বাইয়াত সংঘটিত হয়) করেছিলাম, তখন আপনি সেখানে ছিলেন না। আমাদের বাইয়াতের শর্ত ছিল যে, লোকদের কাছে ভাল কথা পৌঁছাতে থাকবো, খারাপ কথা থেকে বিরত রাখবো। কখনো কারো ভয়ে ভীত হবো না।.....
এই বাইয়াত মহানবীর সাথে হয়েছিল। ওয়াদা পূরণ আমাদের অবশ্যকর্তব্য কাজ।”
উবাদার (রা) এই কথার পর কারও কোন কথা আর থাকতে পারে না। আর কেউ কোন কথা বলতে সাহস করলো না।

হাদীসের প্রতি ভালোবাসা

জাবির ইবন আবদুল্লাহ নবুয়তের ত্রয়োদশ বছরে যে ৭৫ জন মদিনাবাসী মিনার এ গোপন অবস্থানে মহানবীর হাতে শপথ নিয়েছিলেন তাঁদেরই একজন। তিনি মহানবীর সাথে প্রধান সব যুদ্ধ ও অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। মহানবী (সা)-এর মৃত্যুর পর শোকের দুর্বহ ভার নিয়ে নিজেকে বিলিয়ে নিয়েছিলেন কুরআন পাঠ এবং কুরআন পাঠ এবং কুরআন ও হাদীস শিক্ষাদান কাজে। মহানবীর একটা হাদীসের মূল্য তাঁর কাছে ছিল তাঁর সবকিছুর চেয়ে বেশী মূল্যবান।
একবার তিনি খবর পেলেন ‘কিসাস’ বা বদলা সম্পর্কিত একটি হাদীস রয়েছে আবদুল্লাহ বিন আনিসের কাছে এবং তিনি বাস করছেন সিরিয়ায়। খবর পেয়েই জাবির ইবনে আবদুল্লাহ সিরিয়ায় যাওয়ার জন্যে একটি উট কিনলেন এবং সিরিয়া যাত্রা করলেন সেই হাদীসটি শোনার জন্যে। দীর্ঘ পথ পড়ি দিয়ে তিনি পৌঁছলেন সিরিয়ায়। আবদুল্লাহ ইবনে আনিসের বাড়ীতে। আব্দুল্লাহ ইবনে আনিসের কাছে খবর পাঠালেন যে, মদীনা থেকে জাবির ইবনে আবদুল্লাহ তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছে।
নাম শুনেই চমকে উঠলেন আবদুল্লাহ বিন আনিস। বললেন, কোন জাবির, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ?
বলেই তড়িঘড়ি এমন অবস্থার মধ্যে বাড়ী থেকে বের হলেন যে, তার গা থেকে চাদর পড়ে গিয়ে পায়ের তলায় মথিত হতে লাগল। কিন্তু সিদিকে কোন ভ্রƒক্ষেপ নেই।
তিনি গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন আবদুল্লাহ ইবনে জাবিরকে অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভক্তি নিয়ে।
জাবির বললেন, আমি শুনলাম আপনার কাছে ‘কিসাস’ সংক্রান্ত একটা হাদীস রয়েছে। আমি এসেছি সে হাদীস শুনতে। বলুন সে হাদীসটি। আবদুল্লাহ বিন আনিস বর্ণনা করলেন, “আমি রাসূল (সা) থেকে শুরেছি, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা বান্দাদেরকে একত্রিত করবেন। সবাই উলংগ ও খাতনাবিহীন অবস্থায় থাকবে এবং বুহম হবে (‘বুহম’ অর্থ কারও কিছুই থাকবে না)। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা ডেকে বলবেন, ‘আমি বদলা দেব, আমিই মালিক। আমি যতক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যেক জান্নাতীকে প্রত্যেক দোজখী থেকে এবং প্রত্যেক দোজখী থেকে প্রত্যেক দোজখী থেকে প্রত্যেক জান্নাতীকে হক আদায় করে না দেব, ততক্ষণ পর্যন্ত কাউকে জান্নাতে অথবা দোজখে নিক্ষেপ করবো না। এমনকি একটি সাধারণ থাপ্পড়ের কিসাস বা বদলাও আদায় করে দেব। এই বদলা কিভাবে দেয়া হবে আমরা তো সবাই তখন শূন্য হাতে থাকব? এই প্রশ্নের জবাবে রাসূল (সা) বললেন, “নেকি ওবদী দিয়ে ফায়সালা করা হবে।”
এই হাদীস শুনে নেয়ার পর জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আবার মদীনা যাত্রা করলেন।

তাকদীরের উপর বিশ্বাস রাখা

মদীনায় নিজ বাড়ীতে মৃত্যুর মুখে উবাদাহ বিন সামিত।
আসহনীয় রোগ-যন্ত্রণার মধ্যে দর্শনার্থীদের সান্ত¡না দিয়ে তিনি বরছেন, “আল্লাহর ফজিলতে ভাল আছি।”
শেষ মুহূর্ত যখন আসন্ন তখন উবাদাহ (রা) তাঁর গোলাম-খাদেম প্রতিবেশী এবং যাদের সাথে সব সময় উঠা-বসা করেছেন সেই পরিচিতজনদের তিনি ডেকে আনতে বললেন।
সাবাইকে ডেকে আনা হলো।
সবাই উপস্থিত হলে তাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, “সম্ভবত এটাই আমার শেস দিন এবং আজকের রাত আমার আখিরাতের প্রথম রাত হতে পারে। তোমাদের সাথে আমি যদি আমার মুখ দিয়ে অথতবা হাত দিয়ে কঠিন আচরণ করে থাকি, তাহলে আমার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাওয়ার আগেই একে একে তার প্রতিশোধ নিয়ে নাও এবং কিয়ামতের দিন আল্লাহ আমার থেকে প্রতিশোধ নেবেন।”
লোকেরা আরজ করল, “আপনি আমাদের পিতৃতুল্য এবং আমাদেরকে আদব ও শিষ্টাচার শিখিয়েছেন।”
উবাদাহ (রা) বললেন, “তোমরা কি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ?”
সবাই বলল, “হ্যাঁ, ক্ষমা করে দিয়েছি।”
উবাদাহ (রা) বললেন, “হে আমার আল্লাহ, সাক্ষী থেকো।”
অন্তিম মুহূর্তে তাঁর ছেলে এসে আরজ করল, “আমাকে কিছু ওসিয়ত করুন।”
পুত্রকে শেস উপদেশে বললেন তিনি, “তাকদীরের উপর ইয়াকিন রেখো। তা না হলে ঈমানের জন্যে উপযুক্ত হতে পারবে না।”

মুনাফিক সর্দারের ঈমানদার পুত্র

বনি মুসতালিকের যুদ্ধ শেষ।
মহানবী (সা)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী মদীনায় ফিরছে।
কি এক ঘটনায় একজন মুহাজিরের সাথে একজন আনসারের বিরোধ বাধল।
বলা হলো, একজন মুহাজির লাথি মেরেছে একজন আনসারকে।
এ নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে একটা শোরগোল সৃষ্টি হলো।
মহানবী (সা)-এর কানে এলো বিষয়টা। তিনি তাদের ডেকে বললেন, ‘এ তো জাহেলী যুগের আওয়াজের মত শোনাচ্ছে। এসব আশোভন কথাবার্তা পরিত্যাগ কর।’ বিষয়টা এখানেই মিটে গেল।
মুসলিম বাহিনীর সাথে মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ বিন উবাই-এর কানেও গেল। মুহাজির ও আনসার মুসলামানদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির একটা বড় সুযোগ বলে একে সে মনে করল। সে নেচে উঠল। বলল, কি! একজন মুহাজির এই কাজ করেছে? ঠিক আছে মদীনায় একবার পৌঁছতে দাও। সম্মানী লোকেরা মদীনাবাসী নীচু সম্প্রদায়ের (মক্কাবাসী) লোকদের মদীনা থেকে বের করে দেবে।’
আবদুল্লাহ বিন উবাই-এর কাছে গিয়ে আরজ করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি অনুমতি দিলে ঐ মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দিতে পারি।”
মহানবী (সা) বললেন, ‘না। মানুষ বলবে যে, আমি নিজের লোকদের হত্যা করে থাকি।’
মহানবীর কথায় উমর (রা) চুপ করে গেলেন।
আবদুল্লাহ বিন উবাই-এর ছেলে কিন্তু চুপ করে থাকলেন না। পিতার ঔদ্ধত্যে ক্রুদ্ধ আবদুল্লাহ (রা) তার পিতাকে গিয়ে বললেন, “আল্লাহর কসম, আমি আপনাকে মদীনা প্রবেশ করতে দেব না, যে পর্যন্ত না আপনি নিজ মুখে সাক্ষ্য দেন যে, আপনি নীচ লোক, আর রাসূলুল্লাহ সম্মানিত।”
অবস্থা বেগতিক দেখে মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ বিন উবাই পুত্র যেভাবে বলেছে সেইভাবে সাক্ষ্য দিল।

জীবন দিয়ে আদব রক্ষা

সাহাবী বারা (রা) বিনা মা’রুর পুত্র বশর বিন বারা।
প্রাণবন্ত এক নবীন যুবক সে।
ইসলামের যুগ-সন্ধিক্ষণের ঘটনা। আকাবার শপথ গ্রহণকারীদের একজন তিনি। বদর, উহুদ ও খন্দকের লড়াই-এরও তিনি এক যোদ্ধা।
খাইবার যুদ্ধের পর এক ঘটনায় তিনি মহনবীর প্রতি আদব প্রকাশে এক ইতিহাস সৃষ্টি করলেন।
সাহাবীদের মধ্যে বশর বিন বারা রয়েছেন। খাওয়া শুরু করেছেন তিনি।
গোশতের সাথে বিশ মেশানো আছে বুঝতে পেরেই মহানবী (সা) খেতে নিষেধ করলেন সবাইকে।
কিন্তু বশর বিন বারা বিষযুক্ত গোশতের টুকরা গিলে ফেলেছেন।
গোশতের টুকরো মুখে দিয়ে গোশতের স্বাদ থেকে বারাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, গোশতে কিছু ঘটেছে। মনে হলো, গোশতের টুকরো তিনি উগরে ফেলেন। কিন্তু দস্তরখানায় মহানবীর সামনে এইভাবে উগরে ফেলাকে বেআদবী মনে করলেন এবং গিলে ফেললেন গোশতের টুকরা।
এই গোশতের বিষক্রিয়াতেই বশর বিন বারা ইন্তিকাল করেন।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি