মহানবীর দর্শন ঘাতককে করল বিহবল
মহানবী হিজরত করছেন মদিনা। চলছেন পথ ধরে। পূর্ব দিগন্ত তখনও সফেদ হয়ে উঠেনি। তিনটি উট এবং চার জন মানুষের (মহানবী, আবুবকর এবং আবদুল্লাহ ইবনে উরাইকাত ছাড়াও আমের এই কাফেলায় শামিল ছিলেন।) ছোট্ট কাফিলা মদিনার পথে চলচে।আবু বকরের কাছ থেকে কেনা ‘কাছওয়া’ নামক উটে মহানবী, আমের এবং হযরত আবু বকর আসীন আবু বকরের উটে এবং আবদুল্লাহ ইবনে উরাইকাত তাঁর নিজস্ব উটে। দ্রুত পথ অতিক্রম করছে কাফিলাটি। ডাইনে লোহিত সাগর, বামে অন্তহীন পাহাড়ের শ্রেণী, মাঝখানের মরুপথ ধরে এগিয়ে চলছে কাফেলা।
যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও মহানবীর কাফিলা সাওর গিরিগুহা থেকে বের হলে যাত্রার দৃশ্য একজন পল্লিবাসী আরবের চোখে পড়ে গেল। ঐ আরব তার গোত্রের এক জমায়েতে গিয়ে এই খবর দিয়ে বলল, “আমার মনে হচ্ছে কুরাইশরা ওদেরকেই খুঁজছে। মহানবী ও আবু বকরকে হত্যা করতে পারলে একশ উট পাওয়া যাবে।” এ খবর পল্লীতেও এসেছিল। সুতরাং ঐ খবরটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত সুরাকা নামক জনৈক যুবক গোটা পুরষ্কার নিজে হাত করার লোভে বলল, ‘না না তারা সে লোক নয়। আমি জানি তারা অমুক অমুক লোক, উট খুঁজতে বেরিয়েছে।’ সুরাকার কথা সকলে সত্য বলে ধরে নিয়ে যখন অন্য আলোচনায় মশগুল হয়ে পড়ল, তখন সুরাকা ধীরে ধীরে মজলিস থেকে বের হয়ে এলো। তারপর অস্ত্র-সজ্জিত হয়ে বলবান ঘোড়া নিয়ে মহানবী এবং আবু বকরকে হত্যার জন্য বেরিয়ে পড়ল।
দেরী সহ্য হচ্ছিল না সুরাকার। উঁচু নিচু পাথর পথে তীর বেগে ঘোড়া ছুটাল সুরাকা। দূরে দেখতে পেল সেই কাফেলাকে। সুরাকার ঘোড়ার গতি আরও বেরে গেল। কিন্তু ঘোড়া মারাত্মকভাবে পা পিছলে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। সুরাকার মনে ভীষণভাবে খোঁচা লাগল। লক্ষ্যের সাফল্য সম্পর্কে তার মনে সন্দেহের দোলা লাগলো। সে আরবিয় রীতি তীর দিয়ে লটারি করলো। তাতে না সূচক জবাব পেয়ে সে ভীষণ দমে গেল। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। তারপর লটারি ভুল হয়েছে ধরে নিয়ে সে আবার তীরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
আবু বকরের সন্ধানী চোখ এই সময় সুরাকাকে দেখতে পেল। তিনি উদ্বিগ্নভাবে নবীকে বললেন, “দেখুন, আততায়ী এবার আমাদের ধরে ফেলেছে।”
নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠে আবু বকরকে সান্ত্বনা দিয়ে মহানবী বললেন, “ভীত হয়ো না আবু বকর, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।”
তীর বেগে ছুটছে সুরাকার ঘোড়া। কাফিলাকে সে ধরে ফেলেছে প্রায়। বাঁধনহীন উৎসাহ উত্তেজনায় সুরাকা তখন উন্মত্ত। চলার পথে সুরাকার ঘোড়া আবার দুর্ঘটনায় পড়ল। এবার ঘোড়ার দুটি পা মাটিতে দেবে গেল। পা দুটি তোলার অনেক চেষ্টা করল সুরাকা, কিন্তু পারল না। এই সময় আগের লটারির ফল তার মনে পড়ল। মনটা তার ভীষণ দমে গেল। আবার তীর বের করে সতর্কতার সাথে সেই লটারিই পুনরায় করল। কিন্তু এবারো সেই উত্তর ‘না’।
সুরাকার মন এবার ভীতি অনুভব করল। অপর দিকে মহানবীর অবিচল, নিরুদ্বিগ্ন এবং শান্ত সৌম্য অবস্থা সুরাহাকে বিহবল করে তুলল। সুরাকা নিজেই বলেছে, তখনকার অবস্থা দেখে আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল, মুহাম্মাদ নিশ্চয়ই জয়যুক্ত হবেন।
সুরাকা যখন ভীত বিহবলতায় কাতর, তখন তার ঘোড়া নিজেকে উদ্ধারের জন্য অবরাম চিৎকার করছে ো পা ছুড়ছে। এই অবস্থায় সুরাকা নবীর কাফেলাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “হে মক্কার সওয়ারগণ, একটু দাঁড়াও। আমি সুরাকা, আমার কিছু কথা আছে, কোন অনিষ্টের ভয় নেই।”
সুরাকা অতঃপর নবীর কাছে পৌঁছে নিজের সব কথা খুলে বলে আরজ করল, আমার খাদ্য সম্ভার ও অস্ত্র-শস্ত্র আপনারা গ্রহণ করুন। মহানবী তার দান গ্রহণ না করে মিষ্টি কথায় বললেন, “এ সবের কোন আবশ্যকতা আমাদের নেই। আমাদের কথা কাউকে বলে না দিলেই উপকৃত হব।”
সুরাকা তখন আরজ করলো, আমার জন্য আপনি একটা পরওয়ানা লিখে দিন, “যা প্রদর্শন করে আমি উপকৃত হতে পারব।” মহানবী আমেরকে বলে চামড়ায় ঐ ধরণের একটি পরওয়ানা লিখে দিলেন।
অতঃপর সুরাকা ফিরে গেল। মহানবীর কাফিলা আবার যাত্রা করলো মদিনার পথে।

আবু মা’বাদ না দেখেই চিনলেন মহানবীকে(সা)
মদিনার পথে দানশীল ও পরহিতৈষী আবু মা’বাদের আশ্রম। ছোট তাঁবু আর এক পাল মেষ নিয়ে তার সংসার। শ্রান্ত-ক্লান্ত পথিকদের তাঁরা আশ্রয় দেন। সাধ্যমত খাদ্য ও পানীয় দিয়ে পথিকদের তাঁরা সেবা করেন। মহানবীর(সা) কাফিলাও গিয়ে সেখানে হাজির হলো।
আবু মা’বাদ তখন গৃহে ছিলেন না, মেষ চরাতে গেছেন দূর প্রান্তরে।
আবু মা’বাদের স্ত্রী উম্মে মা’বাদকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কিছু খাদ্য-পানীয় কিনতে পাওয়া যাবে কিনা।
উম্মে মা’বাদ খুবই দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, “না, কোন খাবার নেই। থাকলে মূল্য দিতে হতো না। আমি নিজেই ওগুলো হাজির করতাম।”
উম্মে মা’বাদের তাবুর পাশে শীর্ণকায় একটা ছাগী শুয়ে ছিল। মহানবী(সা) উম্মে মা’বাদকে বললেন, “ঐ ছাগী দোহন করে দুধ নেয়া যেতে পারে কি?”
উম্মে মা’বাদ আনন্দের সাথেই বললেন, ‘ছাগীটি শীর্ণ দুর্বল বলে পালের সাথে জায়নি। যদি স্তনে তার দুধ থাকে তাহলে নিতে পারেন।’
মহানবী বিসমিল্লাহ বলে দুধ দোহন শুরু করলেন। যে দুধ পাওয়া গেল তা কাফিলার সদস্যদের পরিতৃপ্তির জন্য যথেষ্ট হলো।
মহানবীসহ কাফিলার সদস্যগণ নিজেরা খেয়ে কিছুটা গৃহকর্তার জন্য রেখে দিলেন।
প্রয়োজন সেরে উম্মে মা’বাদকে ধন্যবাদ দিয়ে মহানবীর কাফেলা আবার মদিনার পথে যাত্রা করল। মহানবী(সা) চলে যাবার অল্পক্ষণ পড়েই আবু মা’বাদ মেষ পাল নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। তিনি বাটিতে টাটকা দুধ দেখে এ দুধ কোত্থেকে এল জিজ্ঞাসা করলেন।
উম্মে মা’বাদ মহানবীর কাফিলার আগমন, শীর্ণকায় ছাগী থেকে দুধ দোহনসহ সব ঘটনা খুলে বললেন। কাফিলার লোকদেরও বর্ণনা দিলেন উম্মে মা’বাদ। বেদুঈন জীবনের মুক্ত মন নিয়ে সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে মহানবীর যে বর্ণনা উম্মে মা’বাদ দিয়েছিলেন তা এখানে তুলে ধরছি।
“তাঁর উজ্জ্বল বদনকান্তি, প্রফুল্ল মুখশ্রী, অতি ভদ্র ও নম্র ব্যবহার। তাঁর উদরে স্ফীতি নেই, মস্তকে খালিত্য নেই। সুন্দর, সুদর্শন। সুবিস্তৃত কৃষ্ণবর্ণ নয়নযুগল, কেশ দীর্ঘ ঘনসন্নিবেশিত। তাঁর স্বর গম্ভীর। গ্রিবা উচ্চ। নয়নযুগলে যেন প্রকৃতি নিজেই কাজল দিয়ে রেখেছে। চোখের পুতুলি দুইটি সদা উজ্জ্বল, ঢল ঢল। ভ্রূযুগল নাতিসূক্ষ্ম, পরস্পর সংযোজিত। স্বতঃকুঞ্চিত ঘন কেশদাম। মৌনাবলম্বন করলে তাঁর বদন মণ্ডল থেকে গুরুগম্ভীর ভাবের অভিব্যক্তি হতে থাকে। আবার কথা বললে মনপ্রাণ মোহিত হয়ে যায়। দূর থেকে দেখলে কেমন মোহন কেমন মনোমুগ্ধকর সে রূপরাশি, নিকটে এলে কত মধুর কত সুন্দর তাঁর প্রকৃতি। ভাষা অতি মিষ্ট ও প্রাঞ্জল, তাতে ত্রুটি নেই, অতিরিক্ততা নেই, বাক্যগুলো যেন মুক্তার হার। তাঁর দেহ এত খর্ব নহে যা দর্শনে ক্ষুদ্রত্বের ভাব মনে আসে বা এমন দীর্ঘ নহে যা দেখতে বিরক্তি বোধ করে, তিনি নাতিদীর্ঘ নাতিখর্ব। পুষ্টি ও পুলকে সে দেহ যেন কুসুমিত নববিটপীর সদ্য পল্লবিত নবিন প্রশাখা। সে মুখশ্রী বড় সুন্দর, বড় সুদর্শন ও সুমহান। তাঁর সঙ্গীরা সর্বদাই তাঁকে বেষ্টন করে থাকে। তাঁরা তাঁর কথা আগ্রহ সহকারে শ্রবণ করে এবং তাঁর আদেশ উৎফুল্ল চিত্তে পালন করে।”
স্ত্রীর মুখে এই বর্ণনা শুনে আবু মা’বাদ উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন, “আল্লাহর শপথ, ইনি নিশ্চয়ই কুরাইশদের সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে আমরা সত্য-মিথ্যা অনেক কিছু শ্রবণ করেছি। হায় আমার অদৃষ্ট, আমি অনুপস্থিত ছিলাম। উপস্থিত থাকলে আমি তাঁর আশ্রয় নিতাম, আমি বলছি, সুযোগ পেলে এখনও তা করবো।”

ঘাতক বাহিনীর হাতেই উড্ডীন হলো ইসলামের প্রথম পতাকা
মহানবী(সা) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছেন। তিনি চলেছেন মদিনার পথে। কুরাইশদের ঘোষিত একশ উট পুরস্কারের খবর মদিনা পর্যন্ত রাস্তার সবখানেই পৌঁছে গেছে। মদিনার পথে আসলাম গোত্রের গোত্রপতি বুরাইদা তার ৭০জন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। মহানবীর কাফিলা যখন সেখানে পৌঁছল, খবর পেয়ে তারা ছুটল।
চার জনের ছোট কাফিলা চলছে। পিছনে ছুটে আসছে অস্ত্রসজ্জিত ৭০জন দুর্ধর্ষ লোকের একটি দল। জাগিতক বিচারে কাফিলাটি একেবারেই অসহায়। মহানবী ও আবু বকর ছাড়া অপর যে দুজন সাথী আছেন তারা অমুসলমান। চার জনের কারো কাছেই কোন অস্ত্র নেই। এমন একটা অবস্থায় কাফিলাটি এখন শত্রুর হাতের মুঠোর মধ্যে। কাফিলার অপর সদস্যগণ উদ্বেগ আশঙ্কায় মুহ্যমান। কিন্তু মহানবীর মুখে কোনই ভাবান্তর নেই। তিনি কুরআন শরীফ পাঠ করছেন। কুরআনের সুমধুর ধ্বনি তাঁর কণ্ঠ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
আসলাম গোত্রপতি বুরাইদা তার ৭০জন খুন পিয়াসি সাথী নিয়ে ছুটে আসছেন কাফিলার দিকে। ১শ উট পুরস্কার তাদের হাতের মুঠোয়। তাদের রক্তে তখন আনন্দ উত্তেজনার তাণ্ডব নৃত্য। তাদের হাতের উলঙ্গ তরবারি ও বর্শা সূর্যকিরণে ঝলমল করছে।
বুরাইদা দল ক্রমশঃ মহানবীর ছোট কাফিলার নিকটবর্তী হচ্ছে।যতই তারা নিকটবর্তী হচ্ছে, মহানবীর মুখ নিঃসৃত কুরআনের স্বর্গীয় সুর লহরী তাদের কানে কানে ছড়িয়ে পড়ছে। কান থেকে তা প্রবেশ করছে মন ও মগজে।তাদের কাছে অদ্ভুত মোহনীয় লাগছে অশ্রুতপূর্ব আয়াতসমূহের ভাব, ভাষা ও ছন্দ। মর্মে মর্মে তা যেন দাগ কেটে বসে যাচ্ছে। বুরাইদা কাফিলার যতই নিকটবর্তী হচ্ছে, ততই তার পা দুটি ভারী হয়ে উঠছে, বাহু যুগল যেন শিথিল হয়ে পড়ছে। লোভাতুর রক্তের সেই তাণ্ডব নৃত্য যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। এই অবস্থাতেই বুরাইদা তার দলসহ মহানবীর কাছাকাছি এসে পড়লো।
কুরআন তেলাওয়াত বন্ধ করলেন মহানবী। তারপর বুরাইদার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মধুর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আগন্তুক, তুমি কে, কি চাও?’
‘আবু বুরাইদা, আসলাম গোত্রপতি’ বুরাইদা জবাব দিল।
‘ভাল কথা।’ বললেন মহানবী।
‘আর আপনি কে?’ জিজ্ঞাসা করল বুরাইদা।
‘আমি মক্কার অধিবাসী আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ, সত্যের সেবক,’ আল্লাহর রাসুল, উত্তর দিলেন মহানবী।
আসলাম গোত্রপতি বুরাইদা মহানবীর সাথে কথা বলে,তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাব বিহবলতায় আত্মহারা হয়ে পড়ল। মাটিতে বসে পড়লো বুরাইদা। তার শিথিল হাত থেকে বর্শা দণ্ড খসে পড়লো। তার সঙ্গীদেরও এই অবস্থা। অভিভূত বুরাইদা মহানবীর পায়ে লুটিয়ে পড়লো।
মহানবী তাকে সান্ত্বনা দিলেন। সান্ত্বনা দিয়ে আবার যাত্রা শুরু করতে গেলেন কাফিলার। বুরাইদা সম্বিত ফিরে পেল। সে মহানবীকে কাতর কণ্ঠে বলল, ‘একবার যখন ও চরণে আশ্রয় দিয়েছেন, তা থেকে আর আমাদের বঞ্চিত করবেন না’ বলেই সে উঠে দাঁড়ালো। গিয়ে দাঁড়ালো কাফিলার অগ্রভাগে। নিজের মাথার পাগড়ি খুলে বর্শার মাথায় গেঁথে পতাকা উড্ডীন করলো বুরাইদা। এটাই বোধ হয় ইসলামের প্রথম পতাকা।
মহানবীর পিছনে ৭০খানা উলঙ্গ তরবারি, ৭০ খানা বর্শা সূর্যের আলোয় ঝলমল করতে লাগলো। কাফিলা যাত্রা শুরু করলো। পতাকা দুলিয়ে বুরাইদা আগে আগে চলছিল।

ঈমান যেখানে সবার বড়
ইসলামের জন্য অনুকূল মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরাতের স্থির সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়ার পর মহানবী(সা) মক্কার মুসলমানদের নির্দেশ দিলেন চুপে চুপে একে একে হিজরাত করার জন্য। মহানবীর(সা) এ নির্দেশ পাবার পর সবাই অত্যন্ত গোপনে হিজরাতের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। কিন্তু কথাটা গোপন থাকলো না। শিকারগুলো যাতে পালাতে না পারে সেজন্য বিধর্মী কুরাইশরা সতর্ক হয়ে গেল। এর মধ্যেই মুসলমানরা একা একা অথবা একাধিকজন মিলে বারি-ঘর, সহায়-সম্পত্তি সব ফেলে মদিনায় হিজরাত করতে লাগলেন।
উম্মে সালামা এবং তার স্বামী আবু সালামা হৃদয় বিদারক এক পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন হিজরাতের সময়। উম্মে সালামার পিতার গোত্রের লোকেরা এসে উম্মে সালামাকে কেড়ে নিয়ে যেতে চাইলো, আর আবু সালামার গোত্রের লোকেরা এসে আবু সালামার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে কেড়ে নিল। স্ত্রী ও শিশুর কান্নায় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হলো। সব কান্না উপেক্ষা করে আবু সালামার স্ত্রী ও শিশুকে কুরাইশরা কেড়ে নিয়ে গেল। ক্রন্দনরত আবু সালামার ঈমানই কিন্তু সবার উপর বিজয়ী হলো। তিনি চোখ দুটি মুছে মদিনার পথে যাত্রা করলেন।
আবু সালামা চলে যাবার পর উম্মে সালামার চোখের পানি কোনদিন শুকায়নি। এক বছর পর আত্মীয়স্বজনদের মন নরম হলো। তারা শিশুসহ উম্মে সালামাকে এক উটে তুলে দিল। একমাত্র ঈমানের শক্তি সম্বল করে উম্মে সালামা মদিনার পথে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে দেখা হলো উসমান ইবনে তালহার সাথে। তিনি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার সাথে আর কে আছে?’ উম্মে সালামা উত্তরে বললেন, ‘এই শিশু আর আল্লাহ।’ উত্তর শুনে উসমান ইবনে তালহা বলেছেন, ‘তার বুক কেঁপে উঠল।’ তিনি উম্মে সালামাকে মদিনা পৌঁছে দিলেন।

ইসলামের প্রথম জুমার প্রথম খুতবা
দীর্ঘ দুই সপ্তাহ ধরে সীমাহীন ব্যাকুলতা নিয়ে মদিনাবাসি অপেক্ষা করছেন মহানবীর(সা) জন্য। মহানবীর(সা) মদিনা প্রবেশের খবর মদিনায় ছড়িয়ে পড়ার পর সাজ সাজ রব পড়ে গেল মদিনার ঘরে ঘরে মহানবীকে(সা) স্বাগত জানানোর জন্য।
সেদিন ছিল শুক্রবার। মহানবী কুবা পল্লী থেকে মদিনা যাত্রা করলেন। তাঁর সামনে পিছনে ডানে বামে মুসলিম জনতার সারিবদ্ধ মিছিল। মহানবী বনু সালেম গোত্রের কাছে পৌঁছলেন, তখন জুমার নামাযের সময় হলো। ইসলামের প্রথম জুমার নামায এটাই। মহানবী জুমার নামাযে যে খুতবা দিলেন, সেটা ইসলামের ইতিহাসে প্রথম খুতবা। সে ঐতিহাসিক খুতবায় মহানবী বললেন-
“সকল মহিমা গরিমা একমাত্র আল্লাহর। তাঁরই মহিমা কীর্তন করি, তাঁরই সাহায্য প্রার্থনা করি, তাঁরই নিকটে ক্ষমা ভিক্ষা করি এবং সৎপথ চিনবার শক্তি তাঁর নিকটই যাচঞা করি। তাঁর প্রতিই ঈমান আনবো এবং তাঁর আদেশ অমান্য করবোনা। যে তাঁর বিদ্রোহী তাঁকে আপনার বলে মনে করবো না।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ ইলাহ নেই, এবং এও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর দাস ও প্রেরিত রাসুল। যখন দীর্ঘকাল পর্যন্ত জগত রাসুলের উপদেশ থেকে বঞ্চিত ছিল, যখন জ্ঞান জগত থেকে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল, যখন মানবজাতি ভ্রষ্টতা ও অনাচারে জর্জরিত হচ্চিল, তাদের মৃত্যু ও কঠোর কর্মফল ভোগের সময় যখন নিকটবর্তী হয়ে আসছিল এহেন সময় আল্লাহ সেই রাসুলকে সত্যের আলো ও জ্ঞান দিয়ে বিশ্ববাসীর নিকট প্রেরণ করেছেন।
আল্লাহর ও তাঁর রাসুলের অনুগত হয়ে চললেই মানব জীবনের চরম সফলতা লাভ হবে। পক্ষান্তরে তাঁদের অবাধ্য হলে ভ্রষ্ট, পতিত ও পথহারা হয়ে পড়তে হবে।
সকলে নিজকে এমনভাবে গঠিত ও সংশোধিত করে নাও, যেন পাপজনিত কাজের প্রবৃত্তিই তোমাদের হৃদয় থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তোমাদের প্রতি এই আমার চরম উপদেশ। পরকাল চিন্তা ও তাকওয়া অবলম্বন করা অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর উপদেশ এক মুসলিম অন্য মুসলিমকে দিতে পারে না। যে সব দুষ্কর্ম থেকে আল্লাহ তোমাদের বিরত থাকতে আদেশ করেছেন, সাবধান, তাঁর নিকটেও যেও না। এই ই হচ্ছে উৎকৃষ্টতম উপদেশ, এই-ই হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম জ্ঞান ।
আল্লাহ সম্পর্কে তোমার কর্তব্য আছে। তাঁর সাথে তোমার যে সম্বন্ধ আছে, তুমি তা ভুলে যেও না। সে ব্যাপারে যেখানে ত্রুটি ঘটে যায়, তুমি প্রকাশ্যে ও গোপনে তার সংশোধন কর, তোমার সে সম্বন্ধকে তুমি দৃঢ় ও নিখুঁত করে নাও- এই হচ্ছে জ্ঞান ও পরজীবনের চরম সম্বল।
স্মরণ রেখো, এর অন্যথা করলে, তোমরা কর্মফলের সম্মুখীন হতে ভীত হলেও তার হাত থেকে ছাড়া পাবার উপায় নেই। আল্লাহ প্রেমময় ও দয়াময়, তাই এই কর্মফলের অপরিহার্য পরিণামের কথা পূর্ব থেকেই তোমাদের জানিয়ে সতর্ক করে দিচ্ছেন। কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের কথাকে সত্যে পরিণত করবে, কার্যত নিজের প্রতিজ্ঞা পালন করবে, তার সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, “আমার বাক্যের রদবদল নেই এবং মানবের প্রতি অত্যাচারীয়ও নই।” অতএব তোমরা মুখ্য ও গৌণ, প্রকাশ্য ও গুপ্ত সব বিষয়েই তাকওয়ার সন্ধান কর। তাকওয়াই পরম ধন, তাকওয়াতেই মানবতার চরম সাফল্য।
সঙ্গত ও সংযত ভাবে পৃথিবীর সকল সুখ উপভোগ কর, তিনি তোমাদেরকে তাঁর কিতাব দিয়েছেন, তাঁর পথ দেখিয়েছেন। এখন কে প্রকৃতপক্ষে সত্যের সেবক আর কে কেবল মূর্খের দাবীসর্বস্ব মিথ্যাবাদী তা জানা যাবে। অতএব আল্লাহ যেমন তোমাদের মঙ্গল করেছেন, তোমরাও সেরূপ আল্লাহর মঙ্গল সাধনে প্রবৃত্ত হও, আল্লাহর শত্রু- পাপাচারীদেরকে শত্রু বলে জ্ঞান কর “এবং আল্লাহর নামে যথাযথ জিহাদে প্রবৃত্ত হও। (এই কাজের জন্য) তিনি তোমাদের নির্বাচিত করে নিয়েছেন এবং তিনি তোমাদের নাম রেখেছেন ‘মুসলিম’।” (কুরআন) কারণ নিজের কর্মফলে ও প্রকৃতির অপরিহার্য বিধানে যার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী, সে সত্য, ন্যায় ও যুক্তি মতে ধ্বংস প্রাপ্ত হোক। আর যে জীবন লাভ করবে, সে সত্য, ন্যায় ও যুক্তি সহায়তায় জীবনলাভ করুক। নিশ্চয় জেনো, আল্লাহ ব্যতিত আর কোন শক্তি নেই।
অতএব, সদা সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করো, আর পরকালের জন্য সম্পদ সঞ্চয় করে নাও। আল্লাহর সাথে তোমাদের সম্বন্ধ কি, এ যদি তুমি বুঝতে পারো, বুঝে নিয়ে তাকে দৃঢ় ও নিখুঁত করে নিতে পারো, তাঁর প্রেম স্বরূপে সম্পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে আত্মনির্ভর করতে পার, তাহলে তোমার প্রতি মানুষের যে ব্যবহার তার ভার তিনিই বহন করবেন। কারণ মানুষের উপর আল্লাহরই আজ্ঞা প্রচলিত হয়, আল্লাহর উপর মানুষের হুকুম চলে না, মানব তার প্রভু নয়, কিন্তু তিনি তাদের প্রভু। আল্লাহু আকবর, সেই মহিমান্বিত আল্লাহ ব্যতিত আর কারও হাতে কোন শক্তি নেই।”

ইহুদীদের কাছে মহাপুরুষ এক নিমিষে হন পাষণ্ড
আবদুল্লাহ ইবনে সালাম মদিনার ইহুদী সমাজের প্রধানতম পণ্ডিত। তিনি সেখানকার ইহুদী সমাজের অসীম ভক্তি শ্রদ্ধার পাত্র। তিনিও উদগ্রীবভাবে মহানবীর প্রতিক্ষা করছিলেন।
মহানবী মদিনায় পৌছলে তিনি তাঁর সাথে দেখা করতে গেলেন। মহানবী তখন কয়েকজন সাহাবীকে উপদেশ দিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, “সকলকে শান্তি ও প্রেমপূর্ণ সম্বোধন কর। সকলে খেতে দাও এবং নির্জন নিস্তব্ধ নিশীথে যখন সমস্ত লোক ঘুমিয়ে থাকে তখন নামাযে লিপ্ত হও।”
আবদুল্লাহ ইবনে সালাম বলেছেন, “নবীর মুখ দেখেই আমার মন যেন বলে উঠল, এ কোন ভণ্ড ও মিথ্যাবাদীর মুখ নয়।”
পরে আবদুল্লাহ মহানবীর সাথে একান্তে সাক্ষাৎ করলেন। ধর্মতত্ত্ব সংক্রান্ত কয়েকটি জটিল প্রশ্ন উত্থাপন করতঃ তার মীমাংসা করে দিতে বললেন। মহানবী সংক্ষেপে কয়েকটা কথায় সে প্রশ্নগুলোর এমন সুন্দর ও সন্তোষজনক সমাধান করে দিলেন যে, আব্দুল্লাহর যুগ-যুগান্তের জটিল যুক্তিতর্ক ও কুটিল দার্শনিকতা জর্জরিত হৃদয়ে অভিনব প্রশান্তির উদ্রেগ হলো। ভক্তিতে তাঁর অন্তরতা নুয়ে পড়লো। তারপর তাওরাতে বর্ণিত লক্ষণের সাথে মহানবীকে মিলিয়েও নিলেন তিনি। অতঃপর নিজের গোত্র, নিজের জাতি ইহুদী সমাজ- কারও অপেক্ষা না করে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনও ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ(সা) তাঁর রাসুল।’
ইসলাম গ্রহণের পর আবদুল্লাহ ইবনে সালাম মহানবীর কাছে নিবেদন করলেন, ‘ইহুদিরা আমাকে তাদের প্রধান পণ্ডিত ও সমাজপতি বলে বিশ্বাস করে থাকে। আমার পিতা সম্বন্ধেও তাদের এ বিশ্বাস ছিল। আমার ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ না করে ইহুদীদের ডেকে আমার কথা জিজ্ঞাসা করুন।’
মহানবী ইহুদীদের ডাকলেন। ডেকে তাদের ইসলামের দাওয়াত দিলেন। কিন্তু তারা তা গ্রহণ করলো না। তখন মহানবী তাদের আবদুল্লাহ ইবনে সালাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তারা এক বাক্যে বলল, “তিনি মহাপুরুষের বংশধর, নিজেও মহাপুরুষ এবং তিনি মহাপণ্ডিতের বংশধর, নিজেও একজন মহাপণ্ডিত। তিনি আমাদের সর্দার পুত্র সর্দার।”
মহানবী তখন তাদের বললেন, “আচ্ছা, আবদুল্লাহ যদি আমাকে সত্য নবী বলে স্বীকার করেন এবং তিনি ইসলাম গ্রহণ করে।” ইহুদিরা বলে উঠল, “সর্বনাশ, তা কি কখনও সম্ভব?”
তখন নবীর আহবানে আবদুল্লাহ আড়াল থেকে বের হলেন এবং সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমরা সকলেই জেনেছ যে, ইনি আল্লাহর সত্য রাসুল, তাঁকে স্বীকার করো মুক্তি পাবে।”
আবদুল্লাহর এই কথা শুনে এক মুহূর্তে ইহুদীদের সুর পাল্টে গেল। তারা বলল, “আমরা প্রথমে ঠিক কথা বলিনি, আবদুল্লাহ একজন পাষণ্ড পাঁজি, ভয়ানক পাষণ্ড সে। তার চৌদ্দ পুরুষও পাষণ্ড, ইত্যাদি।”

মেহমানের মর্যাদা পেলো যুদ্ধবন্দীরা
বদর যুদ্ধে বিজয়ী মুসলমানদের হাতে অনেক কুরাইশ বন্দী হলো। এরা সেই তারা, যারা মহানবী(সা) এবং তাঁর অনুসারীদের উপর তের বছর ধরে অমানুষিক অত্যাচার করেছে এবং তাঁদেরকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। সেই যুগের নীতি অনুসারে হয় তাদের সকলকে হত্যা অথবা তাদেরকে দাস বানিয়ে নেয়া যেত। কিন্তু মহানবী(সা) তাদের সাথে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবহার করলেন।
তিনি তাদের সাথে মেহমানের মত ব্যবহার করতে নির্দেশ দিলেন। মুসলমানদের নিজেদের খাওয়ার ব্যাপারে কষ্ট হলেও বন্দীদের ভাল ও পেট পুরে খাবার দেয়া হতো। মুসলমানরা দু’চারটা খেজুর খেয়ে দিন কাটাতেন, কিন্তু বন্দীদের রুটি খাওয়ানো হতো। বন্দীদের একজন পরবর্তীকালে বলেছেন, “মদিনাবাসিদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। ওরা আমাদের ঘোড়ায় চড়িয়ে নিজেরা পায়ে হেঁটে পথ চলেছে। তারা প্রায় না খেয়ে আমাদের খাওয়াত।”

ওয়াহাবের আমল দেখে উমার (রা) ঈর্ষান্বিত হলেন
ওয়াহাব ইবনে কাবুস (রা) একজন সাহাবী। তিনি একটি গ্রামে বাস করতেন এবং বকরি চরাতেন। একদিন তিনি নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রের ছাগলের সাথে নিজের ছাগলগুলো বেঁধে দিয়ে ছাগলগুলো ওইখানে ফেলে মদিনা শরীফ চলে গেলেন। সেখানে নবী করীমকে(সা) সন্ধান করে জানতে পারলেন, নবী করীম(সা) উহুদের যুদ্ধে চলে গেছেন। তিনি দ্রুত গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে হাজির হলেন।
তিনি পৌছার পর একদল কাফির নবী করীমকে(সা) আক্রমণ করলো। হযরত ওয়াহাব(রা) তখন ক্ষিপ্রটার সাথে এবং অমিত বিক্রমে তরবারি চালাতে লাগলেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে শত্রুদের হটিয়ে দিলেন। একটু পর আরেক দল নবী করিমকে(সা) আক্রমণ করল।এবারও হযরত ওয়াহাব শত্রুদের হটিয়ে দিলেন। এবার তৃতীয় দল আক্রমণ করলো। নবী করীম(সা) তখন ওয়াহাবকে জান্নাতের সুসংবাদ দিলেন। বলার সাথে সাথে হযরত ওয়াহাব শত্রুদলটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কিন্তু শ্রান্তক্লান্ত বীর এবার শহীদ হয়ে গেলেন।
সা’আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস বলেন যে, ওয়াহাব(রা) সেদিন যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন, কোন যোদ্ধাকে তিনি কখনও অমন সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করতে দেখেননি।
ওয়াহাবের শাহাদাতের পর নবী করীম(সা) তাঁর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আমি তোমার উপর সন্তুষ্ট, আল্লাহও তোমার উপর সন্তুষ্ট হন।
এরপর নবী করীম(সা) সাংঘাতিক ভাবে আহত হয়ে থাকলেও নিজের পবিত্র হাতে ওয়াহাবকে দাফন করলেন। হযরত উমার(রা) বলেন, কারো আমল দেখে আমি কখনও ঈর্ষান্বিত হই নি। কিন্তু ওয়াহাবের আমল দেখে আমি বাস্তবিকই ঈর্ষান্বিত হয়েচিলাম।এমন আমলনামা নিয়ে যদি আল্লাহর নিকট যেতে পারতাম।

উমায়ের(রা) যুদ্ধ রেখে খেজুর খেলেন না
বদরের যুদ্ধে নবী করীম(সা) একটি তাঁবুতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম শেষে বাইরে এসে বললেন, ‘উঠ এবং আসমান জমিনের চাইতে বড় এবং মুত্তাকীদের জন্যে তৈরি জান্নাতের দিকে অগ্রসর হও।’
হযরত উমায়ের ইবনুল হাম্মাম এই কথা শুনে বলে উঠলেন, বাঃ বাঃ।
নবী করীম(সা) বললেন, ‘তুমি তাদের একজন।’
এরপর সাহাবী উমায়ের(রা) ঝুলি থেকে খেজুর বের করে খেতে লাগলেন। কিন্তু পর মুহুরতেই বলতে লাগলেন, ‘খেজুর খাওয়ার জন্যে অপেক্ষা! হাতে তো অনেক খেজুর রয়েছে, এতক্ষণ কে অপেক্ষা করবে?’ এই বলে উমায়ের খেজুরগুলো ফেলে দিয়ে শত্রুর মধ্যে ঢুকে পড়লেন এবং যে পর্যন্ত না শহীদ হলেন সে পর্যন্ত অনবরত অসি চালনা করলেন।

মহানবী (সা) ও মুসলিমদের প্রতি এক শহীদের বাণী
উহুদের যুদ্ধে নবী করীম(সা) হযরত সা’দ ইবনে রাবী কেমন আছেন জানতে না পেরে একজন সাহাবীকে তাঁর সন্ধানে পাঠালেন। তিনি প্রথমে শহীদদের মধ্যে তাঁকে তালাশ করলেন, না পেয়ে জীবিতদের মধ্যে ডেকে বেড়াতে লাগলেন। কিন্তু নিরাশ হয়ে বললেন, সা’দ ইবনে রাবীর সংবাদ লওয়ার জন্যে নবী করীম(সা) আমাকে পাঠিয়েছেন।
তখন এক স্থান হতে একটি অতি ক্ষীণ স্বর শোনা গেল। তিনি ঐ স্বর লক্ষ্য করে গিয়ে দেখলেন, সা’দ নিহতদের মধ্যে পড়ে আছে এবং জীবনের এক আধটি নিঃশ্বাস মাত্র তাঁর বাকি আছে।
সাহাবী নিকটে গেলে হযরত সা’দ বললেন, নবী(সা) কে সালাম জানিয়ে বলো, আল্লাহ তাআলা কোন নবীকে তাঁর উম্মতের তরফ থেকে শ্রেষ্ঠতম যে পুরস্কার দান করেছেন, আল্লাহ যেন আমার তরফ থেকে তাঁকে তার চেয়ে উত্তম পুরস্কার দান করেন। আর মুসলমানদের আমার এ বাণী পৌঁছিয়ে দিও যে, তাদের একটি প্রাণী জীবিত থাকতে যদি কাফিররা নবী করীম(সা) এর নিকটে আসতে পারে, তবে তাদের মুক্তির জন্যে আল্লাহর কাছে কোন ওজর থাকবেনা। এ কথা বলে তিনি শহীদ হয়ে গেলেন।

সাদ জিহাদের ডাক শুনে বিয়ের কথা ভুলে গেলেন
হযরত সা’দ। কোন মেয়েই তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হয় না। হয়ত তাঁর প্রচুর অর্থ বা দৈহিক সৌন্দর্য ছিল না। অবশেষে তিনি নবীর(সা) শরণাপন্ন হলেন। নবী(সা) তাঁর বিয়ে ঠিক করলেন। মনের আনন্দে সা’দ ছুটে গেলেন বাজারে যথাশক্তি অর্থ ব্যয়ে বিয়ের জিনিসপত্র কিনতে। বাজারে গিয়েই সা’দ শুনতে পেলেন ‘জিহাদ’, জিহাদে কে যোগ দেবে, সত্যের পথে, আল্লাহর পথে কে প্রাণ দিবে। সা’দ এই আহবান শুনলেন। বিবাহিত জীবনের সকল স্বপ্নসাধ তাঁর মুহূর্তে ভেঙে গেল। জিহাদের আহবান এসেছে- সত্যের জন্য প্রাণ দিতে ডাক এসেছে- সা’দ অধীর হয়ে উঠলেন। বিয়ের জিনিসপত্র না কিনে তিনি খরিদ করলেন একটি ঘোড়া, বর্শা ও একটি সুদীর্ঘ তরবারি। ছুটে চললেন যুদ্ধক্ষেত্রে। অসীম সাহস, উৎসাহ ও বীর্যবত্তা দেখিয়ে সা’দ যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। যে সা’দ চেয়েছিলেন বিবাহের রাতে কনেকে যৌতুক দেবেন, আনন্দের প্রীতি উপহার দেবেন, সেই সা’দ সূর্যাস্তের পূর্বেই আল্লাহকে তাঁর জীবন উপহার দিলেন- এক অপূর্ব যৌতুক।

জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর মহানবী শত্রুদের মঙ্গল চাইলেন
উহুদের যুদ্ধক্ষেত্র। মহানবী(সা) স্বয়ং সৈনিকদের ব্যুহ সাজিয়েছেন। পাহাড়ের গলিপথে পাহারা বসিয়েছিলেন এবং যার যা দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন।
কিন্তু প্রাথমিক বিজয় মুসলিম সৈনিকদের আত্মহারা করে দিয়েছিল, দায়িত্বের কথা তারা ভুলে গিয়েছিল। পাহাড়ের গলিপথ রক্ষার দায়িত্ব যাদের উপর ছিল, তারা সরে এসেছিল সেখান থেকে। ফলে পেছন থেকে আক্রান্ত হওয়ার বিপর্যয় নেমে আসে মুসলিম বাহিনীতে।
অনেক সাহাবী শহীদ হলেন। আহত হলেন আরও অনেকে। স্বয়ং মহানবী(সা) মারাত্মক আহত হলেন। পাথরের আঘাতে তাঁর কপালে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হলো। লৌহ শিরস্ত্রাণ তাঁর ঢুকে গিয়েছিল ক্ষতে। দাঁতও তাঁর ভেঙে গিয়েছিল। তিনি অজ্ঞান হয়ে পরেছিলেন।
পাহাড়ের এক চূড়ায় সাহাবীরা তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি জ্ঞান ফিরে পেয়ে চোখ খুলে চাইলেন। রক্ত মুছে ফেললেন মুখমণ্ডল থেকে। তারপর তিনি প্রথম কথা বললেন তা ছিল এই,
“হে আল্লাহ, আমার লোকদের সত্য পথে ফিরিয়ে আনুন। তারা জানে না তারা কি করছে।”

কিন্তু উমার, আমি যে শান্তির বার্তা বাহক
হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্তগুলো স্থির হয়েছে, কিন্তু স্বাক্ষর তখনও হয় নি। এমন সময় মক্কার একজন মুসলমান পালিয়ে হুদাইবিয়ায় মুসলমানদের কাছে পৌঁছল। নাম আবু জান্দাল। সে ইসলাম গ্রহণ করায় মক্কাবাসীরা তার উপর অমানুষিক অত্যাচার চালিয়ে আসছে। তার দেহে নির্মম আঘাতের চিহ্নগুলো জ্বলজ্বল করছে। সে মহানবী(সা) এর কাছে আশ্রয়ের আবেদন করলেন।
মহানবীর দরবারে উপস্থিত কুরাইশ নেতা সাহল বলল, ‘সন্ধির শর্ত অনুযায়ী এই লোককে অবিলম্বে মক্কায় ফেরত পাঠাতে হবে।’ উত্তরে একজন মুসলিম বলল, ‘সন্ধি এখনও স্বাক্ষর হয়নি, সুতরাং এ লোককে ফেরত দিতে এখনই আমরা বাধ্য নই।’ সাহল বলল, ‘যদিও সন্ধি এদিক থেকে অসম্পূর্ণ তবু সন্ধির শর্ত সম্পর্কে আমরা একমত হয়ে গেছি। সুতরাং লোকটিকে অবশ্যই আমাদের হাতে ফেরত দিতে হবে।’
মহানবী(সা) গম্ভীরভাবে বসেছিলেন, অবশেষে তিনি সাহলকে বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে।’
তারপর তিনি আবু জান্দালের দিকে স্নেহদৃষ্টি তুলে বললেন, ‘আবু জান্দাল, ফিরে যাও, আল্লাহর নামে ধৈর্য ধারণ কর। আল্লাহই তোমার মুক্তির ব্যবস্থা করবেন।’
ক্রন্দনরত আবু জান্দাল মুসলমানদের সামনে দিয়ে মক্কায় চলে গেল। তার কান্না অস্থির করে তুলল মুসলমানদের। উমার (রা) আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি মহানবীর(সা) সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। অদম্য আবেগে গোটা শরীর কাঁপছিল তাঁর। বললেন, ‘হে রাসুল, আপনি কি আল্লাহর সত্যিকার রাসুল নন?’
মহানবী(সা) বললেন, ‘নিশ্চয় আমি আল্লাহর রাসুল।’ উমার(রা) বললেন, ‘আমরা হকের উপর আছি, তারা নাহক পথে আছে এটা কি সত্য?’
মহানবী(সা) বললেন, ‘অবশ্যই সত্য।’ উমার(রা) বললেন, ‘তাহলে কেন আপনি অপমানকর সন্ধির অমর্যাদাকে ধরে রাখতে চাইছেন? আমার আবেদন, সন্ধির শর্ত থেকে আমাদের মুক্তি দিন। তলোয়ারই ফায়সালা করুক।’
মহানবী(সা) হেসে বললেন, কিন্তু উমার, ‘আমি যে শান্তির বার্তাবাহক। ধৈর্য ধর। তুমি যাকে অমর্যাদা বলছ, তার মধ্যেই করুণাময় আল্লাহ এক মহাপুরস্কার লুক্কায়িত রেখেছেন, যা সামনেই দেখতে পাবে’ এই বলে মহানবী(সা) সন্ধিপত্রে তাঁর সীলমোহর লাগালেন এবং তা তুলে দিলেন সাহলের হাতে।

একটা খেজুর মহানবীকে রাতে ঘুমাতে দিল না
মহানবী(সা) বিত্তের মধ্যে থেকেও ছিলেন নিঃস্ব। এক বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক হয়েও তিনি ছিলেন দরিদ্র। মৃত্যুর দিন তাঁর গৃহাঙ্গন ছিল অন্ধকার, বাটিতে তেল ছিল না। ভাঁড়ারে কোন খাবার ছিল না, ঋণের দায়ে তাঁর বর্মটি ছিল বন্ধক দেয়া।
তিনি নিঃস্ব ছিলেন কারণ রাষ্ট্রের সম্পত্তি অর্থাৎ জনগণের সম্পদে তিনি হাত দিতেন না। সাদাকা জাতীয় দানকে তিনি নিজের জন্য হারাম মনে করতেন।
একদিনের ঘটনা। একদিন রাতে মহানবীকে(সা) নিদ্রাহীন দেখা গেল। তিনি অশান্ত বিছানায় গড়াগড়ি দিচ্ছিলেন। তাঁর সহধর্মিণী জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসুল, সারা রাত আপনি ঘুমোননি।”
মহানবী(সা) উত্তরে বললেন, “আমি পথে এক জায়গায় একটা খেজুর পেয়ে তুলে নিয়েছিলাম এবং খেয়ে ফেলেছিলাম এই ভেবে যে, হয়তো ওটা পচে নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু এখন আমার ভয় হচ্ছে খেজুরটা যদি সাদাকার জিনিস হয়ে থাকে?”

আবু বকরকে কোনদিন ছাড়িয়ে যেতে পারবোনা
আবু বকর (রা) তাঁর অতুলনীয় বিশ্বাসপরায়ণতার জন্যে উপাধি পেয়েছিলেন আস সিদ্দিক। শুধু বিশ্বাস ও আমলেই নয়, দানশীলতার ক্ষেত্রেও তাঁর কোন তুলনা ছিল না।
উমার ইবনে খাত্তাব(রা) বলেছেন, তাবুক যুদ্ধের প্রাক্কালে মহানবী(সা) আমাদের যার যা আছে তা থেকে যুদ্ধ তহবিলে দান করার আহবান জানালেন। এ আহবান আমি নিজে নিজেকে বললাম, “আমি যদি আবু বকরকে অতিক্রম করতে পারি তাহলে আজই সেই দিন।” এই চিন্তা করে আমি আমার সম্পদের অর্ধেক মহানবীর(সা) খেদমতে হাজির করলাম। আল্লাহর রাসুল জিজ্ঞাসা করলেন, “পরিবারের জন্য তুমি কি রেখেছ ?” বললাম, “যেই পরিমাণ এনেছি সেই পরিমাণ রেখে এসেছি।” এরপর আবু বকর তাঁর দান নিয়ে হাজির হলেন। মহানবী(সা) ঠিক ঐভাবেই তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আবু বকর, পরিবারের জন্য কি অবশিষ্ট আছে?” আবু বকর জবাব দিলেন, “তাদের জন্য আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল রয়েছেন।” আমি আমার কাঙ্কে আগের মত করেই বললাম “কোন ব্যাপারেই আবু বকরকে কোন দিন ছাড়িয়ে যেতে পারবোনা।”


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি