চার শহীদের মা
কাদেসিয়া প্রান্তর। পারস্য সম্রাটের সাথে ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর এক ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। তদানীন্তন আরবের সর্বশ্রেষ্ঠা মহিলা কবি খানসা তাঁর চার ছেলে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে এসেছেন। যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই খানসা তাঁর ছেলেদের কাছে ডেকে বলে দিয়েছিলেন, "তোমাদের আমি বহুকষ্টে গর্ভে ধারণ করেছি, বহু দুঃখ বিপদের ভেতর দিয়ে মানুষ করে তুলেছি, এখন আমার কথা শোন, সত্যের জন্য যুদ্ধ করার মহত্বের কথা স্মরণ কর আর স্মরণ কর কুরআনের নির্দেশ - দুঃখ বিপদের মধ্যে ধৈর্য ধারণে বজ্রসার আদেশ। কাল প্রভাতে সুস্থ মনে শয্যা ত্যাগ করে শংকাহীন চিত্তে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধে যোগদান করবে- সর্বাপেক্ষা সাহসী যোদ্ধার সম্মুখীন হবে এবং প্রয়োজন হলে নির্ভীক চিত্তে শহীদ হবে।"
পরদিন খানসার চার ছেলে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং একে একে চার জনই শহীদ হলেন। সংবাদ বীর মাতার কাছে পৌঁছলে তিনি দু'হাত উপরে তুলে বললেন, "আল্লাহ, আমাকে আপনি শহীদের মাতা হবার সৌভাগ্য দান করেছেন, আপনাকে সহস্র ধন্যবাদ।" কোন শোকচ্ছাস নেই। দুঃখের আবিলতা নেই - এক পরম তৃপ্তিতে মায়ের বুক ভরে গেছে - পুত্ররা তাঁর সত্যের জন্য প্রাণ দিয়েছে। এর চাইতে গৌরবজনক মৃত্যু আর কি হতে পারে !

ফোরাত তীরে সত্যের সৈনিক
৬৮০ সন। আমীর মু‘আবিয়া মৃত্যুবরণ করেছেন। পিতার সিংহাসনে বসেছেন ইয়াযিদ। হযরত মু‘আবিয়া এবং ইয়াযিদ ইসলামের গণতন্ত্র, ইসলামের খিলাফতকে রাজতন্ত্রে পরিণত করলেন এইভাবে। সাধারণের রাজকোষ –বাইতুল মাল পরিণত হল ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে। ইয়াযিদের খলীফা পদে আসীন হওয়া একদিকে ছিল স্বীকৃত চুক্তির খেলাফ, অন্যদিকে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্তার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ইয়াযিদ ইবন মু‘আবিয়ায়ার এই আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করলেন হযরত হুসাইন। এত বড় অন্যায়কে, ইসলামী আদর্শের এই ভূলুণ্ঠিত দশাকে বরদাশত করা যায় কি করে? মদীনায় অলসভাবে বসে থেকে ইসলামের এই অবস্থা মুসলিম জাতির এই দৃশ্য তিনি সহ্য করতে পারেন না। পারেন না বলেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কুফা থেকে সেখানকার অধিবাসীরা জানালঃ আসুন, আমরা আপনাকে এ ন্যায়ের সংগ্রামে সাহায্য করব। তাদের আহবান মতে মুষ্টিমেয় সাথী ও নিজের আত্মীয়-পরিজন নিয়ে রওয়ানা হলেন তিনি কুফার দিকে।
কুফার পথে হযরত হুসাইন এসে উপস্থিত হলেন কারবালা মরু প্রান্তরে। সামনেই ইউপ্রেটিস-ফোরাত নদী। তিনি দেখলেন, ফোরাত নদী ঘিরে রেখেছে ইয়াগিদ সৈন্যরা। তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনীকেও ঘিরে ফেরা হয়েছে। সামনে পিছনের সব দিকের পথ বন্ধ। বাধ্য হয়ে হযরত হুসাইন তাঁবু গাড়লেন ফোরাত নদীর তীরে।
প্রস্তাব এল ইয়াযিদের সেনাপতি আবদুল্লাহ ইবন যিয়াদের কাছ থেকে, “বিনা শর্তে আত্মসমর্পন করতে হবে।”
আত্মসমর্পন? অন্যায়ের কাছে, অত্যাচারের কাছে আত্মসমর্পণ? একজন জিন্দাদিল মুসলমান, একজন জিন্দাদিল মুজাহিদের পক্ষে এমন আত্মসমর্পণ কি জীবন থাকতে সম্ভব? সম্ভব নয়। নবীল (সা) দৌহিত্র হযরত হুসাইনের পক্ষেও তা সম্ভব হলোনা।
হযরত হুসাইনকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য সে ক্ষুদ্র দলের উপর চললো নিপীড়ন। ফোরাতে তীর বন্ধ করে দেয়া হলো। কোথাও থেকে এক কাতরা পানি পাবরও কোন উপায় রইলনা। শুরু হলো খন্ড যুদ্ধ।
অদ্ভুত এক অসম যুদ্ধ। একদিকে সত্তরজন, অন্যদিকে বিশ হাজার। হযরত হুসাইনের জানবাজ সব সাথীই একে একে শাহাদাত বরণ করেছেন। ক‘দিন থেকে পানি বন্ধ। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে সকলের। দুধের বাচ্চা মায়ের দুধ পাচ্ছে না। অবোধ শিশুদের ক্রন্দনে আকাশ যেন বিদীর্ণ হচ্ছে। হযরত হুযসাইন সবই দেখছেন, শুনছেন। নীরব-নির্বিকার তিনি। জীবন যেতে পারে, কিন্তু অন্যায়ের কাছে তো নতি স্বীকার চলেন না!
সংগ্রামী সাথীদের সবাই একে একে চলে গেছে জান্নাতে। একা হযরত হুসাইন। তিনি উঠে দ৭াড়ালেন, ফোরাত থেকে পানি আনার একবার শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক। তিনি দুলদুল নিয়ে চললেনন ফোরাতের দিকে। নদীর তীরে পৌঁছলেনও তিনি। কিন্তু অজস্র তীরের প্রাচীর এসে তাঁর গতি রোধ করল। তাঁবুতে ফিরে এলেন হযরত হুসাইন। এসে দেখলেন স্ত্রী শাহারবানু শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পানির অভাবে মুমূর্ষ তাঁর শিশুপুত্র। হুসাইন সহ্য করতে পারলেন না এ দৃশ্য। শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে তিনি ছুটলেন আবার ফোরাতের দিকে। পানির কাছে পৌঁছার আগেই শত্রুর নির্মম তীর এস বিদ্ধ করল পুত্রের কটি বুক! ফোরাতের কুলে আর নামা হলো না। মৃত শিশু পুত্রকে নিয়ে ফিরে এলেন তিনি। মৃত শিশুকে স্ত্রী শাহারবানুর হাতে তুলে দিয়ে শ্রান্ত-ক্লান্ত হুসাইন বসে পড়লেন। রক্তে ভেজা তাঁর দেহ। তারপর হযরত হুসাইন হাত দু‘টি তাঁর উর্ধে তুললেন। দু‘হাত তুলে তিনি জীবিত ও মৃত সকলের জন্য দোয়া করলেন। তারপর স্ত্রী শাহারবানুকে বিদায় সালাম জানিয়ে মর্দে মুজাহিদ সিংহ বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ইয়াযিদ বাহিনীর উপর। সে বিক্রম বিশ হাজার সৈন্যের পক্ষেও বরদাশত করা সম্ভব হলো না। নদীকূল ছেড়ে পলায় করল ইয়াযিদ সৈন্যরা। কি শক্তি বিশ্বাসীর, সত্যাশ্রয়ীরা!! বহুর বিরুদ্ধে একর সংগ্রাম, তবু সে অজেয়-অদম্য।
কিন্তু অবিরাম রক্তক্ষরণে দুর্বল হয়ে পড়লেন নবী দৌহিত্র হুসাইন। সংজ্ঞাহীন হয়ে লুটিয়ে পড়লেন তিনি ফোরাতের তীরে. তারকালার মরু বালুতে। শত্রুর নির্মম খঞ্জর এস স্পর্শ করল তাঁর কণ্ঠ। পবিত্র রুধির ধারায় প্লাবিত হলো তারবালার মাটি।
হযরত হুসাইন প্রাণ দিলেন, কিন্তু সত্যের উন্নত শিরকে আকাশস্পর্শী করে গেলেন। সত্যের সে উন্নত শির আনত হয়নি কখনও, একনও নয়, হবেও না কোনদিন। শহীদের এই লহুতে স্নান করেই পতনের পংক থেকে বার বার গড়ে উঠছে জাতি, দেশ, স্বাধীনতা এবং সত্যের শক্তি-সৌধ।

জাহাজ পোড়ানো তারিক
৭১১ সন।মুসলিম সেনাপতি তারিক ইবন যিয়াদ ভূমধ্য সাগর পাড়ি দিয়ে স্পেনের মাটি জিব্রালটারে পা রাখলেন।তাঁর সাথে ৭শ সৈন্যের এক ক্ষুদ্র বাহিনী।এ ক্ষুদ্র বাহিনী স্পেনরাজ রডারিক হেসেই আকুল।সাগর-উর্মির ন্যায় বিপুল রডারিকের সৈন্যের মুকাবিলায় দাঁড়িয়ে মুসলিম সৈনিকের মনেও অজ্ঞাতে নানা প্রশ্ন ভিড় জমিয়েছিল।কিন্তু সেনাপতি তারিক অচল-অটল।বিজয় আসে সত্য-ন্যায়ের শক্তিতে,সংখ্যাধিক্যে নয়।বদর,উহুদ,ইয়ারমুক,কাদেসিয়া প্রভৃতি কত ক্ষেত্রে কতবার তা প্রমাণ হয়ে গেছে। অকুতোভয় তারিক ইবন যিয়াদ জিব্রালটারে নেমে জাহাজে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিলেন সব জাহাজ।তারপর সৈন্যদের দিকে চেয়ে বললেন," চেয়ে দেখ বন্ধুগণ,গভীর সমুদ্র আমাদের পেছনে গর্জন করছে।
আর সামনে অন্যায় অবিচারের প্রতীক বিশাল রডাডিক বাহিনী।আর যদি আমরা সামনে অগ্রসর হই,তাহলে ন্যায় ও বিশ্ব-কল্যাণ প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমরা শহীদ হবো,কিংবা বিজয় মাল্য লাভ করে আমরা গাজী হবো।এই জীবনমরণ সংগ্রামে কে আমার অনুগামী হবে?" মুসলিম বাহিনীর প্রতিটি সৈনিকই বজ্র নির্ঘোষে ' তাকবীর ' দিয়ে সেনাপতি তারিকের সাথে ঐক্যমত ঘোষণা করল।স্পেনরাজ রডারিকের প্রধান সেনাপতি থিওডমিরের নেতৃত্বাধীন বিশাল এক বাহিনীর সাথে মুসলিম সৈন্যের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হলো সে এক অসম যুদ্ধ।যুদ্ধ বিজ্ঞানের উচিত অনুচিতের দৃষ্টিকোণের থেকে মনে হবে,নিতান্ত আত্মহত্যার খাহেশ নিয়েই ৭০০ সৈন্যের মুসলিম বাহিনীটি এ বিদেশ বিভুয়ে এসে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।কিন্তু এই অসম যুদ্ধই এক ইতিহাসের সৃষ্টি করল।জানবাজ মুসলিম বাহিনীর প্রচন্ড পাল্টা আক্রমণে রডারিক বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলো।
মুসলিম সৈন্য ও তাদের সেনাপতির সৌর্যবীর্য ও সাহস দেখে সেনাপতি থিওডমির বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়ে রাজা রডারিককে লিখে পাঠালেন, " সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও অদ্ভুত শৌর্য বীর্যের অধিকারী মুসলিম বাহিনীর অগ্রগতি আমি রুখতে পারলাম না।?" এই ভাবেই সত্যের জয় হল-ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডিন হল স্পেনে।তারপর গৌরবময় মুসলিম শাসন চললো সেখানে দীর্ঘ ৭শ বছর ধরে। কর্ডোভা, গ্রানাডা,মালাগাকে কেন্দ্র করে যে মুসলিম সভ্যতার বিকাশ ঘটল,তা সারা ইউরোপকে আলোকিত করে তুললো।অন্ধকার ইউরোপের বুকে সূর্যশিখার মতোই জ্বলছিল কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান শিখা।সেখানে জ্ঞান আহরণের জন্য ইউরোপের সব দেশ থেকেই ছুটে এসেছিল জ্ঞান পিপাসুরা।বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম মনীষীদের কাছ থেকে সেদিনের অন্ধকার ইউরোপ জ্ঞানের এ ব সি ডি শিক্ষা করল।কর্ডোভার এই ছাত্রারাই ছিল ইউরোপীয় জাগরণের স্হপতি।সুতরাং আজকের যে ইউরোপ, তার ঘুম ভাংগিয়েছে মুসলমানরাই।আর তাদের এ ঘুম ভাংগার প্রথম গান গেয়েছিলেন তারিক ইবন যিয়াদ।তিনি গোথিক শাসনের নির্মম নিষ্পেষণ থেকে শুধু স্পেনকেই মুক্ত করেননি,বলা চলে স্মরণাতীত কালের অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকেও তিনি জাগিয়েছেন ইউরোপকে।

‘যার ভান্ডার শুধু অভাবগ্রস্তদের জন্যই খোলা’
রাজধানী দামেসক। খলীফা উমার ইবন আব্দুল আযিয তখন খলীফা আসনে সমাসীন। মুসলিম বিশ্বের কয়েকজন খ্যাতনামা কবি এলেন দামেসকে। তাঁদের ইচ্ছা, অন্যান্য রাজ দরবারের মত উমার ইবনুল আবদুল আযিযের দরবারে দিয়েও খলীফার কিচু স্তুতিগান করে আর্থিক ফায়দা হাসিল করা। তাঁর অনেকদিন রাজধানীতে থাকলেন। সবাই জানল ব্যাপারটা। কিন্তু খলীফার দরবার থেকেজ ডাকসাইটের কোন আহবান এলো না। অবশেষে তাঁরা নিজেরাই খলীফার সাথে সাক্ষাতের মনস্থ করলেন। সব কবি মিলে সবচেয়ে মুখর ও মশহুর কবি জরিরকে দরবারে পাঠানেরা সিদ্ধান্ত নিলেন।
জরির দরবারের দ্বারে এসে সিরিয়ার বিখ্যাত ফকিহ আউস ইবন আবদুল্লাহ হাযালীর মাধ্যমে খলীফার সাক্ষাত প্রার্থনা করলেন। হযরত আউস গিয়ে জরিরের পরিচয় দিয়ে তাঁর সাক্ষাত প্রার্ণনার কথা বললেন।
খলীফা তাঁকে ডেকে পাঠালেন। কবি জরির খলীফার সমীপে হাজির হয়ে বললেন, “আমি শুনেছি আপনি প্রশংসা-প্রশস্তি ভালোবাসেন না। জনগণের কল্যাণ কামনায় সর্বক্ষণ উদ্বিগ্ন আপনি। আমি এ ধরণের কিছু কবিতা রচনা করেছি শুনুন।” কবি জরির হিজাযের ইয়াতীম বালক বালিকা ও বিধথবাদের দুঃখ-দুর্দশা বর্ণনা সম্বলিত কবিতা পাঠ করতে লাগলেন।
উমার ইবন আবদুল আযিয মনোযোগ দিয়ে সম্পূর্ণ কবিতা শুনেছিলেন। দৃষ্টি তাঁর আনত। মুখে অপরিসীম বেদানার ছায়া। দু‘গন্ড বেয়ে অবিরাম ধারয় গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু।
কবিতা পাঠ শেষ হবার সাথে সাথে বাইতুল মালের প্রধান সচিবকে ডেকে পাঠালেন এবং টাকা পয়সা শস্য কাপড় ইত্যাদি সহ একটি সাহায্য কাঠিলাকে তৎক্ষনাৎ হিজায যাত্রার নির্দেশ দিলেন। তার পর তিনি জরিরের দিকেজ ফিরে বললেন, “আপনি কি মুহাজির?” জরির বললেন, “না, আমি মুহাজির নই।” আবার জিজ্ঞাসা করলেন খলীফা, “আপিনি কি অবাবগ্রস্ত আনসার অথবা তাদের কোন প্রিয়জন?” জরির বললেন, “না। খলীফা পুণরায় প্রশ্ন করলেন, “যারা ইসলামের বিজয়ে অংশ গ্রহণ করেছিল, আপনি সেই জিহাদে অংশ গ্রহণকারীদের কোন আত্মীয়?” জরির বললেন, “না। আমি তাদেরও কেউ নই।” খলীফা তখন বললেন, “তাহলে আমার ধারণায় বাইতুল মালে এই মুহূর্তে আপনার কোন অংশ নেই।”
বাকপটু জরির তৎক্ষণাৎ বললেন, “আমি একজন মুসাফির। বহুদুর থেকে আপনার কাছে এসেছি এবং অনেক দিন থেকে আপনার সাক্ষাতের অপেক্ষায় রয়েছি।” খলীফা একটু হেসে বাইতুল মালের সচিবকে কানে কানে কিছু বললেন। বাইতুল মালের সচিব বিশটি দিনার নিয়ে এল।
খলীফা এই বিশটি দিনার কবির হাতে দিয়ে বললেন, “এই দিনার কয়টি আমার এই মুহূর্তে সম্বল। ইচ্ছা হলে এইগুলো গ্রহণ করুন এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করুন অথবা আমার বদনাম করুন।” কবি জরির বিস্ময় বিমূঢ়, কিন্তু চোখে তাঁর আনন্দের নৃত্য। বললেন তিনি, “বদনাম নয়, আমি এর জন্য গৌরবই বোধ করব,” বলে বিশটি দিনার নিয়েই কবি জরির দরবার ত্যাগ করলেন। এসে অপেক্ষামান সাথীদের বললেন, “আমি এমন এক রাজদরবার থেকে এসেছি যার ভান্ডার শুধু দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের জন্যই খোলা।”

‘কিছু অভাব অভিযোগের কথা নিয়ে এসেছিলাম কিন্তু এখন দেখি---’
খলীফা সুলাইমান তাঁর মৃত্যুর পূর্বে গাসবা ইবন সাদ ইবন আসকে বিশ হাজার দীনার দান করে একটি দানপত্র লিখে দিয়ে ছিলেন। কিন্তু টাকাটা গাসবার হাতে যাওয়ার পূর্বেই খলীফা সুলাইমানের মৃত্যু ঘটে।
খলীফা সুলাইমানের মৃত্যুর পর উমার ইবন আবদুল আযিয খলীফা হন। তাঁর খলীফা পদ সমাসীন হবার কয়েকদিন পর গাসবা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে বলর, “খলীফা সুলাইমান আমাকে কিছু অর্থ দান করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে নির্দেশ কোষাগারে এসে পৌঁছেছে। আপনি আমার বন্ধুলোক, আশা করি আমার জন্য খলীফা সুলাইমানের সে নির্দেশ আনন্দের সাথেই কার্যকর করবেন।”
সত্যিই গাসবা উমার ইবনুল আযিযের বন্ধু ছিল। তিনি সহাস্যে বললেন, “কতটাকাঃ” গাসবা উত্তর দিল “বিশ হাজার দিনার।” শুনে খলীফা উমাররে ভ্রুদ্বয় কুঞ্চিত হয়ে উঠলো। তিন বললেন, “সর্ব সাধারনের সম্পত্তি থেকে কোন একজনকে বিনা করণে এত টাকা দেয়া কিভাবে সম্ভব? আল্লাহর কসম, আমর পক্ষে এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।”
শুনে গাসবা খুবই রেগে গেল। কিন্তু রাগ চেপে সে চিন্তা করতে লাগল, কিভাবে খলীফাকে উচিত জবাব দেয়া যায়, কি কর তাকে জব্দ করা যায়।
সে উমার উবন আব্দুল আযিযকে খোঁচা দেয়ার একটি পথ পেল। সে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, “খলীফা সুলাইমনা আপনাকেও জাবালুল ওয়ারস’ –এর জায়গীল দগান করেছেন। ওটা সম্পর্কে তাহলে আপনার সিদ্ধান্ত কি হবে?”
প্রশ্ন শুনে খলীফা হাসলেন, “তোমার ব্যাপারে সিদ্ধান্তের অনেক আগে খলীফার আসনে বসার সংগে সংগেই জাবালুল ওয়ারস’ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। ওটা যেখান থেকে এসেছে, সেখানেই ফিরে যাবে, তারপর উপযুক্ত প্রার্থীকে তা দিয়ে দেয়া হবে।” বলে তিনি ছেলেকে দিয়ে সিন্দুক থেকে দলিল-দস্তাবেজ আনালেন। তারপর ‘জাবালুল ওয়ারস’ –এর দলিলটি বের করে গাসবার সামনেই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলেন। গাসবা আর একটি কথাও না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ন্যায় ও সুবিচারের ভিত্তিতে যে সব ফরমান অতীতে জারি হয়নি, উমার ইবন আব্দুল আযিয সে সমস্তই বাতিল করে দিয়েছিলেন। ফলে পূর্ববর্তী অলীফারা বনু উমাইয়াকে অন্যায়ভাবে যেসব ভাতা মঞ্জুর করেছিলেন, সে সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই সাথে খলীফার এক ফুফুরও ভাতা বন্ধ হয়েছিল। একদিন ফুফু এই অভিযোগ নিয়ে তাঁর কাছে আসলেন। খলীফা তখন রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত ছিলেন। অল্পক্ষণ পরে আবার তাঁর সামনে গিয়ে দেখলেন খলীফা খেতে বসেছেন। তাঁর সামনে দু’টুকরো রুটি, একটু লবণ ও সামান্য কিছু তেল। ফুফু খলীফার খাবারে আয়োজন দেখে বললেন, “কিছু অভাব অভিযোগের কথা বলতে এসেছিলাম, কিন্তু এখন দেখি তোমার অভাব-অভিযোগের কথাই আমাকে বলতে হবে।” ফুফুর অভিযোগের জবাবে খলিফা বললেন, “কি করব ফুফু আম্মা, এর চেয়ে ভালো ভাবার সংগতি আমার নেই।”
ফুফু অনেক ভূমিকার পর বনি উমাইয়ার পক্ষ থেকে বললেন, “তুমি তাদের ভাতা বন্ধ করে দিয়েছ, অথচ তুমি সেসব দান করনি?” খলীফা বললেন, “সত্য ও ন্যায় যা আমি তাই করেছি।” তারপর তিনি একটি দনিার, একটি জলন্ত অঙ্গারের পাত্র একটুকরো গোশত আনালেন। অঙ্গারপাত্রে দিনারটি গরম করলেন, তারপর অগ্নিসদৃশ উত্তপ্ত দিনার গোশতের উপর চেপে ধরলেন। গোশতটি পুড়ে গেল। খলীফা উমার ইবন আবদুল আযিয সেদিকে ইংগিত করে বললেন, “ফূফুজান, আপনি কি আপনার ভাতিজাকে এরূপ কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচাতে চান না?” ফুফু সবই বুঝলেন। লজ্জিতভাবে ফিরে এলেনন খলীফার কাছ থেকে।

'এই বিরান ঘরের সাহায্যেই কি আপন ঘর ঠিক করতে এসেছি?'
খলীফা উমার ইবনুল আবদুল আযিয এর বাসগৃহ।
খলীফার পত্নী ফাতিমা উমার ঘরে বসে সেলাই করছিলেন।এসময় একমহিলা ঘরের দরজায় এসে দাড়াল সে।পরিচয় দিল “আমি সুদূর ইরাক থেকে এসছি।”
ফাতিমা মহিলাটিকে ঘরে এসে বসতে বললেন।মহিলাটি ঘরে প্রবেশ করে এদিক -ওদিক চাইতে লাগলো।বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলো,ঘরে কোন আসবাব পত্র নেই!
সে রাস্ট্রপ্রধানএর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এই বিরান ঘরের সাহায্যেই কি আপন ঘর ঠিক করতে এসেছি?’
খলীফা পত্নী তা শুনে বললেন “লোকদের ঘর ঠিক করতে গিয়েই তো এই ঘর বিরাণ হয়েছে।”
এ সময় খলীফা উমার ইবনুল আবদুল আযিয বাড়ি প্রবেশ করলেন। ঘরের সামনেই একটি কূপ ছিল।তিনি কূপ থেকে পানি তুলে উঠোনের এক জলাধারে ঢালতে লাগলেন।তিনি পানি ঢালছিলেন আর মাঝে মাঝে ফাতিমার দিকে তাকাচ্ছিলেন।এটা লক্ষ্য করে ইরাক থেকে আসা মহিলাটি খলীফা পত্নী ফাতিমাকে বললো “আপনি এ বেহায়া লোকটি থেকে কেন পর্দা করেন না? লোকটি তো নির্লজ্জের মত বার বার আপনাকে দেখছে!”
খলীফা পত্নী ফাতিমা হেসে বললেন “ইনি ই তো আমিরুল মুমিনীন।”
খলীফা উমার ইবন আবদুল আযিয ঘরের দিকে এগিয়ে এলেন।তারপর সালাম করে স্বীয় কক্ষের দিকে চলে গেলেন।জায়নামাজে যাওয়ার আগে ফাতিমাকে ডেকে মহিলাটির পরিচয় জানতে চাইলেন।ফাতিমা রাস্ট্রপ্রধানকে জানালেন তার আগমনের উদ্দেশ্য।সব শুনে উমার মহিলাকে ডেকে তার বক্তব্য শুনতে চাইলেন।মহিলা জানালেন “আমি খুব ই অভাবগ্রস্থ,আমার পাঁচটি মেয়ে আছে।আমি তাদের ভরণ পোষন করতে পারিনা।”
উমার এ কাহিনী শুনে খুব ই ব্যথিত হলেন।সংগে সংগে তিনি দোয়াত কলম নিয়ে ইরাকের গভর্নরকে চিঠি লিখলেন।প্রেসিডেন্ট উমার মহিলার প্রথম,দ্বিতীয়,তৃতীয় আর চতুর্থ মেয়ের জন্য ভাতা নির্ধারনণ করে দিলেন।আর বললেন “পঞ্চম মেয়েকে ঐ চারজনের ভাতা থেকেই পরিপোষন করতে হবে।”
মহিলা চিঠি নিয়ে ইরাক চলে এলো।সময় করে দেখা করলো গভর্নরের সাথে।গভর্নর উমার ইবন আবদুল আযিযের চিঠি পরে কাঁদতে শুরু করলেন।
মহিলাটি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেশ করে জানতে পারলেন মুসলিম বিশ্বের আমির উমার ইন্তেকাল করেছেন।
মহিলাটিও কাঁদতে শুরু করলো।গভর্নর তাকে প্রবোধ দিয়ে বললেন “আপনার আশঙ্কার কোন কারণ নেই।সেই মহামানবের চিঠির কোন অমর্যাদা কখনো হবেনা।”
গভর্নর চিঠির মর্ম অনুসারে মহিলাটিকে তার প্রাপ্যের ব্যাবস্থা করে দিলেন।

খলীফা ফরমাশ খাটলেন
খলীফা মামুনের প্রাসাদ। তাঁর প্রাসাদে অতিথি এসেছেন। অতিথি জ্ঞানী ইয়াহইয়া। মেহমান-মেজবান আলোচনায় রত। গভীর রাত। মোমবাতির পিঠা আলো জ্বলেছে ঘরে। অতিথির পিপাসা পেয়েছে।
পানির জন্য উৎসুক হয়ে এদিক ওদিক খুঁজতেই খলীফা মামুন জিজ্ঞেস করলেন, “কি চাই আপনার?” অতিথি ইয়াহইয়া তাঁর তৃষ্ণার তখা জানালেন। শুনেই খলীফা উঠে দাঁড়ালেন পানি আনার জন্য। ইয়াহইয়া ব্যস্ত হয়ে খলীফাকে অনুরোধ করলেন “আপনি না উঠে কোন ভৃত্যকে ডাকলে হতো না?”
খলীফা মামুন বললেন, “না না, তা হয় না। খলীফা বলেই কি আপনি আমাকে একথা বলছেন? খলীফা পানি নিয়ে আসতে দোষ কি? স্বয়ং মহানবীই (সা) বলে গেছেন, জাতির প্রধান ব্যাক্তি জনগণের সাধারণ ভৃত্য মাত্র।”
ইয়াহইয়া খলীফার এ কথার কোন জবাব দিতে পারলেন না। মহানবীর (সা) প্রতি, মহানবীর (সা) প্রচারিত আদর্শের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধায় মাথা নয়ে এল তাঁর। সর্বশক্তিমানের দেয়া কি সে মহান আদর্শ। সে আদর্শ বাদশাহকে বানিয়েছে ফকির, খলীফাকে বানিয়েছে জনগণের ভৃত্য সেবক ও রক্ষক।

শাসক যখন সেবক হন
৮৪০ ঈসায়ী সন। খলীফা মূতাসিম চলছেন রাজপথ দিয়ে। রাজকীয় সমারোহে সুসজ্জিত অশ্বে আরোহণ করে চলছেন তিনি। জনসাধারণ সসম্ভ্রমে পথ করে দিচ্ছে। চারদিক থেকে অগনিত মাসুষ সহাস্য বদনে সালাম জানাচ্ছেন খলীফাকে- খলীফা মুতাসিমকে। খলীফা সকলের দিকে চেয়ে, তাদের সাথে সালাম বিনিময় করে ধীরে ধীরে সামনে এগুচ্ছেন। হঠাৎ তাঁর চোখ গিয়ে পড়ল রাস্তার উপরে এক বৃদ্ধের উপর। বৃদ্ধটি খলীফাকে পথ করে দেবার জন্য রাস্তা থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছিল। সরতে গিয়ে সে রাস্তার নর্দমায় পড়ে গেল। কাদায়, ময়লায় মলিন হয়ে গেল তার দেহ। নর্দমা থেকে উঠার চেষ্টা করছে সে। সাহায্য পাবার আশায় দু‘টি হাত যেন তার অজ্ঞাতেই উপরে উঠেছে। খলীফা সংগে সংগে তার ঘোড়া দাঁড় করালেন। নামলেন ঘোড়া থেকে। ছুটে গেলেন সেই নর্দমার ধা। সেই বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরে অতি সাবধানে তাকে উপরে টেনে তুললেন খলীফা। বৃদ্ধের দেহের কাদা-ময়লা খলীফার দেহের রাজকীয় সজ্জাকেও কর্দমাক্ত করে দিল। কিন্তু খলীফার সে দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তাকেই পথ করে দিতে গিয়ে এক বৃদ্ধ কষ্ট পেয়েছে, এই বেদনাদায়ক অনুভূতিই তাঁর কাছে বড়। তিনি খলীফা কিন্তু মূলতঃ জনগণের সেবক। জনগণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করাই তাঁর দায়িত্ব, কষ্ট দেয়া নয়। বৃদ্ধটি খলীফার কাছে থেকে সহস্য মুখে বিদায় নেয়ার পর খলীফা স্বস্তি লাভ করলেন। তারপর ঘোড়ার পিঠে ফিরে এসে আবার যাত্রা করলেন তাঁর গন্তব্য স্থলের দিকে।

আসামীর কাঠগড়ায় খলীফা আল মানসুর
খলীফা আল-মানসুর এসেছেন মদীনায়। প্রধান কাজী ইবনে ইমরান বিচার সভায় বসে আছেন। একজন উটের মালিক এসে খলীফার বিরুদ্ধে তাঁর কাছে নালিশ জানালো। অষ্টম শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ সমৃদ্ধ ও উন্নত ইসলামী সাম্রাজ্যের অথিপতি খলীফা আল-মানসুরের বিরুদ্ধে একজন উট চালক অভিযোগ এনেছে।
সামান্য উট চালক সে নয়। জনগণের তখন ছিল পূর্ণ আত্মবিশ্বাস। সত্য ও আত্মপ্রত্যয়ে প্রদীপ্ত ছিল তাদের জীবন। জনগণের এই চেতনা ছিল জাগ্রত। আর খলীফাগণ যে জনগণের সেবক মাত্র সে সম্বন্ধেও তাঁরা সচেতন ছিলেন। জনগণের দাবীর কাছে, বলিষ্ট জনমতের কাছে নতি স্বীকার করতি খলীফারাও ব্ন্দিুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করতেন না। খলীফার কাছে কাজীর সমন গেল। কাজীর দরবারে তাঁকে হাজির হতে হবে। খলীফা আল-মানসুর সঙ্গীদের বললেন, “আমাকে আদালত ডেকেছে, সে জন্য আমাকে একাই যেতে হবে। সেখানে আমি একজন সাধারণ আসামী মাত্র।” ঠিক সময়ে খলীফা হাজির হলেন কাজীর সম্মুখে। কাজী তাঁর আসন থেকে উঠলেন না। যেমন কাজ করছিলেন তেমনি কাজ করে চললেন। বিচার হলো। কাজী খলীফার বিরুদ্ধে রায় দিলেন। রায় প্রকাশিত হবা মাত্র খলীফা হর্ষধ্বনি করে বলেন উঠলেন, “আল্লাহকে শত ধন্যবাদ আপনার এ বিচারের জন্য। আল্লাহ আপনকে পুরস্কৃতি করুন। আমি সামান্য দশ হাজার দিরহাম আপনাকে পুরষ্কার দেবার জন্য আদেশ দিলাম।”

আপনি এই সামান্য কয়েক তাল মাটি তুলতে পারলেন না
স্পেনে তখন হাকামের রাজত্ব। একদিন রাজধানীর নিকটবর্তী একটি স্থান তাঁকে আকৃষ্ট করলো। সেখানে তাঁর জন্য একটি রাজপ্রাসাদ নির্মাণের পরিকল্পনা তিনি ঠিক করে ফেললেন। স্থানটি ছিল এক বৃদ্ধার। বৃদ্ধা সেই স্থানের উপর একটি কুটিরে বাস করতেন। হাকাম স্থানটি উচিৎ মূল্যে খরিদ করার প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু বৃদ্ধা রাজী হলেন না। তিনি দ্বিগুণ মূল্য দিতে চাইলেন, তবুও বৃদ্ধা সম্মত হলেন না। ক্রুদ্ধ হয়ে হাকাম জোর করে স্থানটি বৃদ্ধার নিকট থেকে কেড়ে নিলেন।
অল্প কালের মধ্যেই সে স্থানে বিরাট সুন্দর প্রাসাদ নির্মিত হলো, সম্মুখে তার একটি সুন্দর উদ্যান। বৃদ্ধা কিন্তু নিরুৎসাহিত হলেন না। তিনি সোজা কাজীর কাছে হাকামের বিরুদ্ধে নালিশ করলেন।
কিছুকাল পর হাকাম কাজী সাহেবকে দাওয়াত করলেন তাঁর নতুন প্রাসাদ ও বাগান দেখতে। নির্দিষ্ট সময়ে কাজী একটি গাধা ও কয়েকটি শূন্য থলে নিয়ে উপস্থিত হলেন। বাদশাহ একটু বিস্মিত হলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটু কৌতুকও বোধ করলেন।
কাজী বাদশাহর কাছে বিনীত নিবেদন জানিয়ে বললেন, "জাঁহাপনা, আমাকে এই বাগান থেকে কয়েক বস্তা মাটি দিতে হুকুম করুন।" এই অদ্ভুত অনুরোধে বাদশাহ তৎক্ষণাৎ রাজী হলেন। কিন্তু মাটি দিয়ে কাজী কি করবেন, তিনি তা আর ভেবে পান না।
কাজী বস্তাগুলো মাটি দিয়ে ভর্তি করলেন, তারপর বাদশাহকে আরও বিস্মিত করে তিনি বস্তাগুলো গাধার পিঠে তুলে দিতে তাকে সাহায্য করতে অনুরোধ করলেন। বাদশাহর কৌতুহল চরমে উঠলো। তিনি তাতেও রাজী হয়ে সানন্দে বস্তাগুলো তুলে দিতে অগ্রসর হলেন। কিন্তু বস্তাগুলো এত ভারী ছিল যে, বাদশাহ শত চেষ্টা করে তার একটিও নড়াতে পারলেন না। কাজী বাদশাহর দিকে ফিরে চেয়ে বললেন, "আপনি এই সামান্য কয়েক তাল মাটি তুলতে পারলেন না। কিন্তু মহা বিচারের দিন আপনি কি করে গোটা বাগানটাই কাঁধে করে আল্লাহর আদেশে বৃদ্ধা ফিরিয়ে দেবেন? কারণ, স্থানটি আপনি বৃদ্ধার নিকট থেকে অন্যায়ভাবে দখল করেছেন।" বাদশাহ লজ্জিত হলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ বৃদ্ধাকে ডেকে পাঠালেন। বৃদ্ধার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তিনি বাগান ও প্রাসাদ সমেত স্থানটি বৃদ্ধাকে দিয়ে দিলেন।
শাসনের কর্তৃত্বভার, বড় গুরুদায়িত্ব সে। তার ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য জবাবদিহি করতে হবে মহাবিচারের দিন। আল্লাহর কাছে তার হিসেব নিকেশ দিতে হবে। তাই খলীফাদের, মুসলিম বাদশাহর চিন্তার শেষ নেই, ব্যাকুলতার সীমা নেই। আবার কেউ হয়তো আত্মবিস্মৃত হয়ে ক্ষণিকের জন্য কর্তব্যের কথা ভুলে যান, তখন রূঢ় আঘাত দিয়ে, কৌশল ও তৎপরতার সঙ্গে তার সম্বিত ফিরিয়ে আনতে হয়। খলীফা মানুষ তো। ভুল তাই হতে পারে, কিন্তু ভুলের জন্য ভুগতে হয় জনগণকে, দুর্বলকে। তাই দেশের উজীর, দেশের কাজী, খলীফার প্রতিটি কার্যে তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখেন, নির্মমভাবে আঘাত দিতে, অপ্রিয় ও রূঢ় সত্যকথা বলতে একটুও ইতস্ততঃ বোধ করেন না।

আটলান্টিকের তীরে সেনাপতি উকবা
আটলান্টিক আর ভূমধ্য সাগরের নীল পানি বিধৌত উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা। রোমানদের অত্যাচারে কাতরাচ্ছে সে দেশের বনি আদম। আর্তনাদ উঠছে আকাশে বাতাশেঃ মুক্তি চাই, এ অত্যাচার থেকে মুক্তি চাই। কিন্তু বাঁচাবে কে? কে এগিয়ে আসবে বলদর্পি রোমানদের শক্তিশালী হাতরে মুঠো থেকে তাদের বাঁচাতে? উত্তর পশ্চিম আফ্রিকার মানুষ বস শেষে অসহ্য হয়ে দামেশকে খলীফার দরবারে পাঠাল আকুল আবেদনঃ অত্যাচার অসত্যের হাত থেকে বাঁচান আমাদের। খলীফার নির্দেশে সিপাহসালার উকবা ছুটে চললেন ক্রমাগত পশ্চিমে। উকবার গতি রোধ করবে কে? সত্যের সৈনিক উকবা থামতে পারেন না। তিনি খুঁজে ফিরছেন আরও কে কোথায় নিপীড়িত হচ্ছে, অসত্য কোথায় এখনও অন্ধাকারের সৃষ্টি করছে, আরও সামনে কতদেশ আছে- কত প্রান্তর আছে। উকবার অগ্রগতি সমানে চলছে। ক্লান্তি নেই। বিশ্রাম নেই। এগিয়ে চলেছেন তিনি তাঁর জানবাজ মুজাহিদদের নিয়ে। তাঁর প্রার্থনাঃ ‘আল্লাহ’ আপনি বলুন আর কতহ দেশ আছে, এখনও কোথায় সত্যেল আলেঅ বিচ্ছুরিত হয়নি, বলুন, ্ও উন্মুক্ত অসি আর কোষবদ্ধ করবো না।’
কিন্তু উকবার গতি রুদ্ধ হলো। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে অশ্বের বল্গা টেনে তিনি চেয়ে দেখছেন, অসীম সমুদ্রের বারি রাশি উন্মাদ গতিতে প্রবাহিত হচ্ছে। উকবা বিদ্রোহী, সিন্ধুও বিদ্রোহী। দুই দোসর একে অন্যকে দেখে ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়ালেঅ। আশ্রান্ত বিরামহীন গতি সমুদ্রের। উকবার গতিও অপ্রতিহত। অশ্বের বলগা ছেড়ে দিয়ে তীব্র বেযে ছুটে তিনি সাগরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তহরঙ্গের বাহু মেলে সিন্ধু তার বিদেশী বন্ধকে আলিংগন করলো। দু‘হাত তুলে উকবা বললেন, “আল্লাহ” আজ যদি িএই অনন্ত সমুদ্র পথের অন্তরায় না হতো তবে আরও দেশ, আরও রাজ্য জয় করে আপনার নামের মহিমা প্রচার করতাম, সত্যের বাণী ছড়িয়ে দিততাম, অসত্যকে নিশ্চিহ্ন করে সত্যের আলো জ্বালিয়ে দিতাম।”

আরমেনিয়া প্রান্তরে আল্প আর সালান
১০৩৬ সন। সুলতান আলপ আরসালানের হাত থেকে আরমেনিয়অ কেড়ে নেবার জন্য কনষ্টান্টিনোপলের সম্রাট রোমানাস ছুটে এলেন। ফ্রান্স, ম্যাসিডনিয়া, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশের সেনাদলও তাঁর সাহায্যে ছুটে এসেছে। সুলতান আরসালান ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে ছুটে গেলেন সম্রাট রোমানাসকে বাধা দিতে। সুলতান আরসালান শান্তির প্রসাতাব দিলেন রোমানাসকে। সমুদ্র তরঙ্গমালার মতহ বিশাল বিক্ষব্ধ সেনাবাহিনীল অধিনায়ক রোমানাস শান্তির প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন। শান্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে সুলতান আরসালান রোমানাসের মুকাবিলার জন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে সেনা সন্নিবেশ করলেন। কিন্তু তাঁর কত মুসলিম ভাই যে এ যুদ্ধে প্রাণ দেবে, সেটা চিন্তা করে সুলতান আরসালানের প্রাণ কেঁদে উঠল। তিনি উচ্চস্বরে গম্ভীর কণ্ঠে সেনাবাহিনীর উদ্ধেশ্যে বললেন, “যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যদি কেউ চলে যেতে চাও, যেতে পার। কাউকে আমি জোর করে যুদ্ধে যোগদান করতে প্ররোচিত করব না।”
কিন্তু যে সেনাপতি তাঁর সৈন্যদের জন্য এত দরদ পোষণ করেন সে সেনাপতিকে তাঁর সৈন্যরা মৃত্যুর মুখে ছেড়ে যেতে পারে না। সুলতান আরসালানের ক্ষেত্রেও তাই হলো। সকলেই এক বাক্যে সুলতানের অনুগামী হতে চাইলো।
সুলতান গোসল করে শুভ্র পোশাকে সজ্জিত হয়ে সৈন্য পরিচালনার জন্যে ঘোড়ায় আরোহণ করলেন। সংগীদের তিনি বললেন, “যুদ্ধ ক্ষেত্রের যেখানে আমার মৃত্যু হবে, সেখানেই আমাকে যেন কবর দেয়া হয়।” বস্তুতঃ শাহাদাতে দুর্ভল পিয়ালা পানের আশায় যুদ্ধে যাচ্ছেন সুলতান আরসালান। তাঁর প্রতিটি সৈন্যও এই মন্ত্রে দীক্ষিত।
যুদ্ধ শুরু হলো আরমেনিয়ার প্রান্তরে। রক্তের প্রবাহ ছুটছে যুদ্ধের গোটা ময়দানে। ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী অকতোভয়ে মুকাবিলা করে যাচ্ছে বিশাল-বিপুল শত্রু বাহিনীকে। এক সারি শহীদ হয়ে ঢলে পড়ছে মাটিতে, সংগে সংগে পেছনের সারি সামনে এগিয়ে সে স্থান পূরণ করছে। শত্রু নিধন করে শাহাদাতের পিয়ালা পানের নেশায় পাগল হয়ে উঠেছে তারা। দুঃখ নেই, কাপতরোক্তি নেই। অশ্বের গতিবেগের সংগে সংগে তাদের জীবন-মৃত্যু সৃষ্টি ও ধ্বংসলীলা উঠছে আর পড়ছে। অবশেষে বদর, খন্দ, ইয়ারমুক, আজনাদাইনের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলো। দিনান্তে মাগরিবের সময় সমাবেশের শুভ মুহূর্তে আল্লাহর অফুরন্ত দয়ার আকারে বিজয় নেমে এল। জয়ী হলেন সুলতান আর সালান।
যুদ্ধ শেষে বন্দী রোমানাসকে সুলতান আরসালানের সামনে নিয়ে আসা হলো। সুলতান জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ আমার জায়গায় আপনি হলে আমার জন্য কি শাস্তির ব্যবস্থা করতেন?’ রোমানাস বললেন, ‘নির্মম বেত্রাঘাতে আপনার দেহ ক্ষত-বিক্ষত করে দিতাম।’ সুলতান হাসলেন। বললেন, ‘আপনার বাইবেল বলে শত্রুকে ক্ষমা করো। আমি আপনার সে বাইবেলের উপদেশ অনুসারেই আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম। যান আপনি মুক্ত।’

জেরুসালেমে দু’টি ঐতিহাসিক দিন
জেরুসালেম নগরী। ১০৯৯ খৃষ্টাব্দ। ১৫ই জুলাই। বিকেল ৩টা। খৃষ্টান ক্রুসেডারদের মুসলিম নগরী জেরুসালেমের পতন ঘটল। খৃষ্টান বাহিনী বন্যা স্রোতের মত প্রবেশ করলো। নগরীতে। খৃষ্টান অধিনায়ক গডফ্রের নির্দেশে নরবলির মাধ্যমে বিজয়োৎসবের ব্যবস্থা করা হল। নারী, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকল মুসলিম ও ইহুদী নাগরিকদের নিধন যজ্ঞ চললো তিন দিন ধরে। বীভৎস সে দৃশ্য। কারো মাথা ছিঁড়ে ফেলা হলো, কারো হাত-পা কাটা হলো, কাকেও তীর বৃষ্টি করে মারা হলো, কাউকে মারা হলো পুড়িয়ে। অনেক মুসলমান গিয়ে আশ্রয় ডিনয়েছিল উমার মসজিদে, মসজিদের ভেতরেই তাদেরকে হত্যা করা হলো। ৩০০ মুসলিম নারী, শিশুয, বৃদ্ধ, যুবক গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল আল আকসা মসজিদের ছাদে, তাদেরকেও রেহাই দেয়া হলো না। হত্যা করা হলো প্রত্যেককে। রাজপথ দিয়ে রক্তের স্রোত বয়ে গেল। ঘোড়ার হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেল সে রক্তে। তিনদিনের হত্যাকান্ডে জেরুসালেম নগরীতে ৭০, ০০০ মুসলমানকে হত্যা করা হলো।
সেই জেরুসালেমে আর এক দৃশ্যঃ
১১৮৭ খৃষ্টাব্দ। ২রা অক্টোবর। ৮৮ বছর পর মুসলিম বাহিনী গাজী সালাহউদ্দীনের নেতৃত্বে বিজয়ী বেশে জেরুসালেম নগরীতে প্রবেশ করলো। নগরীর আত!কউদ্বেগ পীড়িত খৃষ্টান নাগরিকদের চোছে-মুখে মৃত্যুর ছাপ। কিন্তু শান্ত সৃশৃংখলবাবে মুসলিম বাহিনী নগারে প্রবেশ করলো। সকলের আগে চলছেন গাজী সালাহউদ্দীন। মুখ তাঁর প্রশান্ত, চোখে তোন উত্তাপ নেই। ৮৮ বছর আগে যারা জেরুসালেমকে কসাই খানায় পরিণত করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোন ঘৃণাও তাঁর চোখে মুখে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বিজয়ের পর ক্রুসেডারদের মুক্তিদেয়ার ব্যাপারে গাজী সালাহউদ্দীন অপরিসীম উদারতার পরিচয় দিলেন। প্রত্যেক পুরুষের জন্য দশ, নারীর জন্য পাঁচ ও শিশুর জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা মুক্তিপণ নির্ধারিত হলেও নামমাত্র মুক্তিপণ গ্রহণ করে তিনি বন্দীদের মুক্তি দিলেন। পরিশেষে দরিদ্র, বৃদ্ধ ও নিারীদের তিনি বিনাপণে মুক্তি দিলেন। সহায়সম্বলহীন নারীদের তিনি প্রচুর পরিমাণে অর্থ দানও করলেন।

তাইবেরিয়াসে সালাহউদ্দীন
ক্রুসেডের ৯০ বছর পার হয়েঢ গেছে। ইউরোপ থেকে তৃতীয় ক্রুসেডারদের নতুন দল এসে ফিলিস্তিনে ক্রুসেডারদের শক্তি বৃদ্ধি করছে। ওদিকে সুলতান সালাহউদ্দীন খন্ড-বিখন্ড মুসলিম শক্তিহকে সংঘবদ্ধ করে তুলেছেন।
১১৮২-৮৩ সন। মিসর সহ সমগ্র এশিয়া-মাইনর ও তুর্কী অঞ্চল প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সুলতান সালাহউদ্দীনের পতাকাতলে আশ্রয়লাভ করল। অতঃপর এদিক থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে সুলতান এবার মনোযোগ দিলেন ক্রুসেডারদের দিকে। সমগ্র ফিলিস্তিন তখনও তাদের করতলগত। ফিলিস্তিনের প্রত্যেকটি শহরে হাজার হাজার মুসলিম বন্দী অকথ্য নির্যাতন ভোগ করছে। প্রায় ৮৪ বছর ধরে বাইতুল মুকাদ্দাসের মিনার শীর্ষ থেকে মুয়াযযিনের উচ্চকণ্ঠ শোনা যায়নি। জেরুসালেমের উমর মসজিদের অভ্যন্তরে খ্রষ্টানরা যে হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছিল, তার রক্তের দাগও হয়তো মুছে ফেলা হয়নি তখনও। সুলতামন সালাহউদ্দীন অধীর হয়ে উঠেছেন। একদিকে তাঁর এই অধীর চিত্ততা, অন্যদিকে খৃষ্টান ক্রুসেডারদের অত্যাচারও তাঁকে অতিষ্ঠ করে তুলল। শান্তির সময়েও মুসলিম বণিকদের কাফিলা বার বার লণ্ঠিত ও মুসলিম বণিকরা নিহত হচ্ছিল তাদের হাতে। ১১৮৬ সনেও খৃষ্টান অধিনায়ক রেজিনাল্ড অতীতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করল। ধৈর্যের বাঁধঘ ভেংগে গেল সুলতান সালাহ উদ্দীনের। ৯০ বছরের পুরাতন খৃষ্টান ক্রুসেডের বিরুদ্ধে সুলতান সালাহউদ্দীন জিহাদ ঘোষণা করলেন। সময়টা ছিল ১১৮৭ সনের মার্চ মাস। জিহাদ ঘোষণার পর সুলতান সালাহউদ্দীন আশতারায় শিবির সন্নিবেশ করলেন। সালাহ উদ্দীনের প্রাথমিক প্রধান লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনের সীমান্ত শহর তাইবেরিয়াস।
তাইবেরিয়াসের রাজা গেডি লূসিগনানানের নেতৃত্বে জেরার্ড, রেজিনাল্ড, হামফ্রে রিমন্ড, বিলিয়ান প্রমুখ বিখ্যাত ক্রুসেড অধিনায়করা সালাহ উদ্দীনের মুকাবিলার জন্য এগিয়ে এল। তাদের অধীনে ১২০০ নাইট সহ অর্থলক্ষ সৈন্য সমবেত হলো। সুলতান সালাহউদ্দীন ১২ হাজার ঘোড় সওয়ার ও অনুরূপ সংখ্যক পদাতিক সৈন্য নিয়ে তাইবেরিয়াস অভিমুখে যাত্র করলেন। সিত্তিনের দু‘মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে ফিলিস্তিনের লুবিয়া গ্রামের সন্নিকটবর্তী প্রান্তরে খৃষ্টান ও মুসলিম সৈন্য মুখোমুখি দাঁড়াল। সুলতান সালাহ উদ্দীন প্রথম বারের মত খৃষ্টান ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হলেণ। লুবিয়া প্রান্তরে ঘোরতর যুদ্ধ সংঘটিত হলো। ক্রুসেডার সেই যুদ্ধেঘ শোচনীয় পরাজয় বরণ করল। জেরার্ড, রেজিনাল্ড, হামফ্রে প্রমুখ অধিনায়ক সহ স্বয়ং রাজা ও তাঁর ভাই বন্দী হলেন। যুদ্ধে ৩০ হাজার খৃষ্টান সৈন্য মৃত্যুবরণ করল। ১১৮৭ সনের জুলাই মাসে সুলতান সালাহ উদ্দীন তাইবেরিয়াস পুনরুদ্ধার করলেন। প্রথম জিহাদ জীয় হয়ে সুলতান সালাহ উদ্দীন তাইবেরিয়অস নগরীতে প্রবেশ করলেন। কিন্তু তাঁর চোখে আজ খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে কোন ঘৃণা নেই। কিংবা নেই কোন প্রতিহিংসার আগুণ। ক্রুসেডাররা ১০৯৬ সনে তাদের প্রথম বড় রকমের সাফল্য অর্থাৎ এন্টিয়ক নগরী দখর করার পর যে মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিল তা থেকে এ মানসিকতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। যুদ্ধ নয়, বরং জনৈক মুসলিম নামধঘারী বিশ্বাসঘাতকের সহায়তায় এন্টিয়ক নগরী দখল করার পর আত্মসমর্পনকারী দশ হাজার মুসলিম নর-নারী ও শিশুকে তার হত্যা করেছিল। আর সুলতান সালাহউদ্দীন তাঁর প্রথম জিহাদে সাফল্য লাভ করার পর কোন খৃষ্টানের গায়ে আঁচড়ও লাগল না। অগণিত লুণ্ঠন ও হত্যাকান্ডের নায় রেজিনাল্ডকেই শুথু তার দু‘শ সাঙ্গ-পাঙ্গসহ প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হলো। আর এন্টিয়ক নগরীতে খৃষ্টানরা যেখানে শহীদ আমীরদের লাশ কবর থেকে তুলে মাথা কেটে বর্শায় গেঁথে এন্টিয়কের রাস্তায় বন্য নৃত্য করে বেড়িয়েছিল, সেখানে সুলতান সালাহ উদ্দীন তাইবেরিয়াসের খৃষ্টান রাজাকে হাতে ধরে নিরেজর কাছে বসিয়ে ঠান্ডা শরবত পান করিয়েছিলেন।

সালাহউদ্দীনের জানাযা
১১৯৩ সন। ২০শে ফেব্রুয়ারী। মক্কা মুয়াজ্জমা থেকে হাজীরা দেশে ফিরছেন। সুলতান সালাহ উদ্দীন হাজদের কাফিলাকে আগ বাড়াতে গেলেন। গরম কাপড় না পরে ভিজা আবহাওয়অয় হাঁটাহাঁটি করে তাঁর জ্বর হলো। জ্বর থেকে আর উঠলেন না তিনি। ১১৯৩ সনের ৪ঠা মার্চ সারা মুসলিম জাহানকে কাঁদিয়ে সুলতান সালাহউদ্দীন ইন্তিকাল করলেন।
ইসলামরে সোনাল ইতিহাসের এক অনন্য নায়ক সুলতান সালাহউদ্দীন। ১১৮৭ সনে খৃষ্টান ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা ও বাইতুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধার করার পর দীর্ঘ পাঁচ বছর রণাঙ্গনেই কাটাতে হয়েছে তাঁকে। জেরুসালেম হাতছাড়া হওয়ার সংবাদে গোটা খৃষ্টান ইউরোপ ক্রোধে ফুলে উঠেছিল। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, ডেনমার্ক, ইতালী প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশ থেকে ১১৯৮ সনে ছয় লক্ষ খৃষ্টান সৈন্য ছুটে এসেছিল ফিলিস্তিনে। তারা সাথে করে নিয়ে এসেছিল গোটা ইউরোপবাসীর আয়ের এক-দশমাংশ। দীর্য় তিন বছর ধরে সুলতান সালাহউদ্দীন যুদ্ধ করলেন উম্মত্ত ক্রুসেডারদের সাথে। কিন্তু সমগ্র ইউরোপের সমবেত শক্তিও সালাহউদ্দীনের সাথে এঁটে উঠতে পারেনি। ব্যর্থ হলো তাদের তৃতীয় ক্রুসেডও। প্রায় ৪ লক্ষ থেকে ৫লক্ষ ইউরোপীয়কে ভূমধ্যসাগরের বালুবেলায় চিরতরে শুইয়ে রেছে ক্রুসেডাররা ফিরে গেল দেশে। ফিলিস্তিনসহ গোটা নিকট প্রাচ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে থাকলেন সুলতান সালাহউদ্দীন। সুলতান সালাহ উদ্দীন সমগ্র ইউরোপে কি অপরিসীম ভীতির সৃষ্টি করেছিলেন, সালাহ উদ্দীনকে পরাভূত করার জন্য গোটা ইউরোপ থেকে তোলা ‘সালাহউদ্দীন কর’ই তার প্রমাণ। ইউরোপের ভীতি ও এক বিশাল রাজ্যের একচ্ছত্র অধিনায়ক সেই সুলতান সালাহউদ্দীন ইন্তিকাল করলেন। আল্লাহর পথে জিহাদের আত্মোৎসর্গিত এই সুলতান যখন মৃত্যুবরণ করলেন, তখন কপর্দকহীন ছিলেন তিনি। তিনি ইউরোপত্রাস প্রবল প্রতাপশালী সুলতান ছিলেন, কিন্তু তাঁর কোন সিংহাসন ছিলনা, ছিল না বিলাস ব্যসনের কোন রাজ প্রাসাদ। রাজ্যের সাধারণ রাজকোষ ছিল, কিন্তু তাঁর নিজস্ব কোন তহবিলের অস্তিত্ব ছিল না। নিজের জীবন, সম্পদ সব কিছুকেই তিনি উজার করে দিয়েছিলেন জিহাদে। তিনি যদি চাইতেন, যে শক্তি তাঁর ছিল তা দিয়ে তিনি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি চাননি। তিনি চেয়েছিলেন িইসলামের বিজয়, নিজের জন্য কোন রাজ্য প্রতিষ্ঠা নয়। এ পথেই তিনি তাঁর সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিলেন। তাঁর যেদিন মৃত্যু হলো, সে দিন জানাযার খরচ সংকুলানের অর্থও তাঁর কাছে পাওয়া যায়নি। ধরা করা অর্থে তাঁর জানাযার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছিল।

‘ফাঁসিই দিন আর যাই করুন যা সত্য তা বলবই’
সুলতান আলাউদ্দিন খালজী তাঁর প্রধান কাজী (প্রধান বিচারপতি)- কে আহবান করলেন দরবারে। কাজী দরবারে এলেন। সুলতান জিজ্ঞেস করলেন, “দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের বিকলাংগ করে শাস্তি দেয়া যায় কিনা।” কাজী রায় দিলেন, “এরূপ শাস্তি ইসলাম বিরুদ্ধ।” এই উত্তরে সুলতান মনক্ষুন্ন হলেন। তিনি আবার জানতে চাইলেন, “দেবগিরি থেকে আমি যে ধনসম্পদ লাভ করেছি, তা আমার না জন সাধারণের পাপ্য?” নির্ভীক কাজী উত্তর দিলেন, “ইসলামের সৈন্যবল দিয়ে তা অধিকৃত হয়েছে, সে সম্পদ আপনার হতে পারে না। জনসাধারণের কোষাগারে তা অবিলম্বে জমা দেয়া উচিত।”
সুলতান এবা আর ক্রোধ রাখতে পারলেন না। ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত জণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “জনসাধারণের কোষাগারে আমার ও আমার পুত্র-পরিজনদের অধিকার বা অংশ কতটুকু?”
অবিচল কণ্ঠে কাজী উত্তর দিলেন, “ একজন সৈনিকের যতটুকু ততটুকু অংশ আপনার ও আপনার পুত্রের প্রাপ্য। আপনার খেয়অল খশীমত অর্থ যদি আপনি জনসাধারণের কোষাগার থেকে ব্যয় করেন, তাহলে এর জন্য মহা বিচারের দিন আপনাকে আল্লাহর কাছে জবাব দিহি করতে হবে।”
কাজীর কথায় সুলতহান ভীষণ রেগে গেলেন। চরম শাস্তি দেবেন বলে সুলতাম তাঁকে শাসালেন।
অকম্পিত কণ্ঠে কাজী বললেন, “ফাঁসিই দিন আর যাই করুন, যা সত্য তা বলবই।” উপস্থিত সকলেই কাজীর ভবষ্যত ভেবে শংকিত হয়ে পড়ল।
পরদিন কাজী দরবারে হাজির হলেন। সুলতান কাজীকে সসম্মানে গ্রহণ করলেন দরবারে। বহু মূল্যবান উপঢৌকন দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করলেন। নির্মম হলেও আলাউদ্দিন খালজীর সত্যগ্রহণ করার সাহস ছিল। তাঁর বাহুবলেল সাথে এই সত্য-প্রীতি যুক্ত ছিল বলেই তাঁর একচ্ছত্র প্রভাব সিন্ধু নদ থেকে রামেশ্বরমের সেতু পর্যন্ত ছাড়িয়ে পড়েছিল।

গিয়াসুদ্দীন বলবনের ন্যায়পরায়নতা
গিয়াস উদ্দীন বলবনের বিশাল সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমানা-বাদায়ুন প্রদেশ। পাহাড় আর মালভূমির দেশ বাদায়ুন। পাহাড়ের মাঝে মাঝে সুনীল উপত্যকা। পাহাড় থেকে নেমে আসা সফেদ ঝর্ণা বয়ে যাচ্ছে সবুজ উপত্যকার বুক চিরে। এই বাদায়ুনের শাসনকর্তা মালিক ফয়েজ। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবরেনর পক্ষ থেকে শাসন করছেন তিনি বাদায়ুন। শান্তি ও সমৃদ্ধি তাকে ঠেলে দিল বিলাসিতার দিকে। মদ্যপ হয়ে উঠলেন তিনি। মদ তাঁকে নিয়ে গেল জঘন্য মানুষের রক্তে লাল হয়ে উঠল। মালিক ফয়েরেজই একজন খেদমতগার দাস, একদিন মাতাল অবস্থায় তাকে খুন করলেন মালিক ফয়েজ। বাদায়ুনের অনেক কণ্ঠই প্রতিবাদে সোচ্চার হতে চাইল, কিন্তু মদ্যপের কাছে কোন সুবিচার আশঅ নেই জেনে সবাই ধৈর্য ধারণ করল। ঠিক এই সময়েই গিয়াস উদ্দিন বলবন এলেন বাদায়নে। সাড়ম্বর সম্বর্ধনার আয়োজন করে মালিক ফয়েক আগু বাড়িয়ে নিয়ে এলেন সুলতানকে। গিয়াস উদ্দিন বলবন তাঁর প্রিয় শাসনকর্তার কুশলবার্তা জেনে এবং তাঁকে খুশহাল দেখে খুবই খুশী হলেন। পরদিন আম দরবারে বসলেন গিয়াসউদ্দিন বলবন। নাগরিকদের সাথে তিনি দেখা করবেন, তাদের কথা বার্তা শুনবেন। দরবারের এক পর্যায়ে এক বোরখাবৃতা মহিলা এসে সুলতানের সামনে দাঁড়াল। সে অভিযোগ করল, “তার নির্দোষ স্বামীকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন শাসনকর্তা মালিক ফয়েজ।” মহিলাটির অভিযোগ শেষ হলে গিয়াসউদ্দিন বলবন মুহূর্তকাল চুপ করে থাকলেন। তারপর মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন পাশেই বসা মালিক ফয়েজের দিকে। মুখে সুলতানের কথা নেই। কিন্তু চোখে তাঁর একরাশ প্রশ্ন। সে দৃষ্টির সামনে মালিক ফয়েজ বস থাকতে পারলেন না। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন। সুলতানের অন্তর্ভেদী চোখের একরাশ প্রশ্নের কোন জবাব মালিক ফয়েজের মুখে জোগালোনা। কিন্তু তাঁর চোখে মুখেই ফুটে উঠল পাপের কালিমা রেখা। সুলতান মুখ ঘোরালেন এবার ফরিয়াদী মহিলাটির দিকে। বললেন, “যাও মা, আল্লাহর আইনে কাজীর আদালতেই এর বিচার হবে। আমি তোমার পক্ষে বাদী হয়ে দাঁড়াব।”
কাজীর আদালতে বাদায়ুনের শাসনকর্তা মালিক ফয়েজের বিচার হলো। হলো প্রাণদন্ডাদেশ- কঠিন প্রহারে জর্জরিত করে তাঁকে মেরে ফেলার হুকুম হলো। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সে নির্দেশ কার্যকর করালেন। তারপর অত্যাচারী সেই শাসকের মৃতদেহ টাঙ্গিয়ে রাখলেন শহরের বুলন্দ দরওয়াজায়।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের আর একটি বিচার। অযোধ্যায় শাসনকর্তা হয়বত খান হত্যা করেছেন তাঁর দাসকে। নিহত দাসের বিধবা স্ত্রী ফরিয়াদ জানালো সুলতানের কাছে। সুলতান শাসনকর্তাকে পাঁচশ বেত্রাঘাতের নির্দেশ দিলেন এবং তাঁকে নিহত দাসের বিধবা মহিলার দাসত্বে নিয়োজিত করলেন। পরে হাজার টাকার মুক্তিপণ দিয়ে হয়বত খান সেই বিধবা মহিলার কাছ থেকে বহুকষ্টে মুক্তি ভিক্ষা করে নেন।

নামায যুদ্ধ থামিয়ে দিল
আফগানিস্তানের উত্তর পশ্চিমে এক পর্বতময় মালভূমি। তদানীন্তন বলখ ও বাদাখশান রাজ্যের সীমান্ত সন্নিহিত একটি স্থান। ভীষণ যুদ্ধ চলছে দুই দলে। বহু যুদ্ধের মত এটিও ভাইয়ে ভাইয়ে মুসলমানে মুসলমানে আত্মঘাতী এক লড়াই। যুদ্ধমান দু‘পক্ষের এক পক্ষে রয়েছে মোগল বাহিনী, অন্যপক্ষে রয়েছে বলখের সুলতান আযীয খানের সৈন্যদল। মোগল বাহিনীকে পাঠিয়েছেন দিল্লীর সম্রাট শাহাজান তাঁর পিতৃভূমি বলখ-বুখারা-বাদাখশান পুনুদ্ধার করতে। অপর পক্ষে বলখের সুলতান রক্ষা করতে এসেছেন তাঁর রাজ্য। উভয় পক্ষেই কাজ করছে ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠি স্বার্থ, জাতীয় স্বার্থ চিন্তার কোন চিহ্ন কোথাও নেই।
মোগল বাহিনীর পরিচালনা করছেন শাহজাদা আওরঙ্গজেব। আর বলখের সুলতান স্বয়ং তাঁর বাহিনী পরিচালনা করছেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে।
ভীষণ যুদ্ধ চলছে। ধীরে ধীরে সূর্য তার আকাশ পরিক্রমায় উঠে এল মধ্য গগনে। মধ্য গগন থেকে সূর্য একটু হেলে পড়ল পশ্চিমে। সেনাপতি শাহজাদা আওরঙ্গজেব মাথা তুলে একবার সূর্যে দিকে চাইলেন। তাঁর চেহারায় পরিবর্তন ঘটল। তিনি হাতের বর্শা ছুড়ে দিলেন মাটিতে। ঘোড়া থেকে নামলেন। কমরবন্ধ খুলে রেখে দিলেন মাটিতে। তার পর জায়নামায বিছিয়েঢ পশ্চিমমুখী হয়ে নামায শুরু করলেন। যুদ্ধ তখন অবিরাম চলছে। বৃষ্টির মত ছুটে আসছে তীর বর্শা। যোদ্ধাদের হুংকার, আহতের আহাজারি, অশ্বের হ্রের্ষা রব এক ভয়াবহ পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। কোন দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, জায়নামাযের উপর চোখ দুটি তাঁর যেন আটকে আছে, অখন্ড মনোযোগে নামায আদায় করছেন শাহজাদা। আরঙ্গজেব। শত্রুদের পুরোপুরি দৃষ্টির মধ্যে রয়েছেন তিনি। যে কোন সময় তীর বর্শা ছুটেচ এসে তাঁকে বিদ্ধ করতে পারে কিংবা স্বশরীরে শত্রু তাঁর উপর এসে চড়াও হতে পারে। কিন্তু শাহজাদা আওরঙ্গজেবের সমগ্র চেহারায় এজন্য কোন প্রকার চিত্ত-চাঞ্চল্যের লেশ মাত্র নেই। মনে হচ্ছে তিনি যেন কোন এক বিরল উপত্যকার নীরব নিঝুম পরিবেশে গভীর প্রশান্তিতে নামায আদায় করছেন।
এই অপরূপ অদৃশ্য অশ্বে সমাসীন সুলতান আব্দুল আযীয খান দেখতে পেলেন। তাঁর দৃষ্টি যেন আটকে গেল মহাপ্রভুর সামনে বিনীতভাবে দন্ডয়মান শাহজাদা আওরঙ্গজেবের উপর। হৃদয়টি তাঁর মোচড় দিয়ে উঠলো। শিউরে উঠলো তাঁর গোটাদেহ। কার বিরুদ্ধে, কোন মহান ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন তিনি। সুলতান আবদুল আযীয খান চীৎকার করে উঠলেন, “যুদ্ধ অসম্ভব----যুদ্ধ থামাও -----থামাও যুদ্ধ।”
যুদ্ধ বন্ধ হলো। ব্যক্তি স্বার্থ পেছনে পড়ে গেল, জয়ী হলো জাতীয় স্বার্থ, ভ্রাতৃ সম্পর্ক। ইসলাম যেন মূর্তিমান রূপ নিয়ে এসে দু‘ভায়ের রক্তপাত বন্ধ করলো। প্রমাণ হলো একমাত্র ইসলামই ভাইয়ে ভাইয়ে আপোষ ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হতে পারে।

তাইমুরের দরবারে হামিদা বানু
১৩৮০ সন। তাইমুর লংয়েল দুর্ধর্ষ তাতার বাহিনী ধ্বংসের বিষান বাজিয়ে এগিয়ে চলেছে সামনে। তুর্কী সুলতান বায়েজিদ সে তাতার বাহিনীর ঘূর্ণিঝড়কে সিংহ বিক্রমে বাধা দান করলেন। তুরষ্কের রণক্ষেত্রে রক্তের নদী বইল। কিন্তু সুলতান অবশেষে পরাজয় বরণ করলেন। অনেক তুর্কী সৈন্য ও সেনানায়ক বন্দী হল। নিষ্ঠুর তাইমুর তাদের নির্বিচারে প্রাণহন্ড দিতে লাগলেন। একজন তরুন সেনানী রূখে দাঁড়াল এই অবিচারের বিরুদ্ধে। সে তাইমুরের সাক্ষাত প্রার্থনা করল। শিকলে বেঁধে সে বন্দীকে তাইমুর সমীপে আনা হল। বিশ্বজয়ী তাইমুরের সামনে গর্বোন্নত শিরে দাঁড়িয়ে সে তরুন সৈনিক বলল, “সম্রাট তাইমুর, আপনি অন্যায়ভাবে সুলতান বায়েজিদকে আক্রমণ করে হাজার হাজার আল্লাহর বান্দাকে হত্যা করেছেন, মুসলমানা হয়ে আপনি ইসলামের অনুগত সেবকদের হত্যা করছেন। বিশ্ব জয়ের অন্যায় ও গর্বিত দাবির জন্যেই শুধু এসব অন্যায় ও গর্হিত কাজ করছেন। কিন্তু মনে রাখবেন আপনাকেও একদিন সকল রাজার রাজা আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে, তখন এসব কাজের কি জওয়াবদিহি আপনি করবেন?”
তরুণ সৈনিকের এ কথা শুনে বিমূঢ় গোটা দরবার। এভাবে পৃথিবীর কেউ যে তাইমুরের সামনে কথা বলতে পারে, আল্লাহর রাজ্যে যে এমন লোকও আছে, দরবার আজই যেন তা বুঝল, বুঝে সন্ত্রস্ত হলো। ভাবল তারা, না জানি এই তরুণের ভাগ্যে কি উৎপীড়ণ আছে।
তরুণ বন্দী মুহূর্তের জন্য একটু থেমেছিল। তারপর মন্ত্রমুগ্ধ দরবারের সামনে এক ঝটকায় মাথার শিরস্ত্রাণ খুলে ফেলল। একরাশ সুন্দর কেশগুচ্ছ প্রকাশ হয়ে পড়ল- সুন্দর মসৃন একরাশ নারীকেশ। বিশ্ব জয়ী তাইমুরও এবার বিস্মিত। বন্দিনী আবার বলতে লাগল, “চেয়ে দেখুন, আমি একজন অন্তঃপুরবাসিনী নারী। বতু অন্যায়-অবিচারের প্রতিরোধের জন্য অস্ত্র হাতে ধরতে হয়েছে, রক্তের নদীতে সাঁতার কাটতে হয়ে। আপনি আপাততঃ জয়ী হয়েছেন, কিন্তু মনে রাখবেন, যে জাতি এ ধরণের মানসিকতায় উজ্জীবিত, তাকে পদানত রাখা যায় না, ধ্বংস করা যায় না।”
বিশ্বজয়ী তাইমুরের শির নুইয়ে পড়ল। তিনি মুক্তি দিলেন বায়েজিদ তনয়া হামিদা বানুকে। হামিদা বানুর অনলবর্ষী উক্তি এবং তাঁর সাথে তাইমুরের পরিচয় তাইমুরের জীবনে আনল অভূতপূর্ব পরিবর্তন। ধ্বংসের হাত তাঁর জাতি গড়ার কাজে ব্রতী হলো।

উরুজ বার্বারোসার বীরত্ব
১৫১৭ সাল। স্পেনে মুসলমানদের শেষ আশ্রয়স্থল। গ্রানাডার পতনের (১৪৯২) ২৫ বছর পরের ঘটনা। গোটা স্পেন খৃস্টানদের পদানত। সম্রাট পঞ্চম চার্লস এবং তার পুত্র ফিলিপের লোমহর্ষক অত্যাচারে লক্ষ লক্ষ মুসলমান ধর্মান্তরিত অথবা স্পেন থেকে বিতাড়িত। উত্তর আফ্রিকার মুসলিম শক্তিও বিধ্বস্ত। সেখানেও চলছে স্পেন রাজের হুকুম। আলজিয়ার্স সহ উপকূলীয় মুসলিম বন্দরগুলোতে মেরামতের অভাবে মুসলিম রণপতগুলো পচে খসেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্পেনের বিতাড়িত মুর মুসলমানরা বাঁচার প্রাণান্তরকর সংগ্রামে রত। ভূমধ্য সাগরের যাযাবর সেনাতি উরুজ বারবারোসা তাদেরই একজন। ঐতিহাসিক মরণগান তাকেঁ অভিহিত করেছেন সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাধ্যক্ষ হিসাবে। খৃস্টান ইউরোপ তাকেঁ বলেছে ভূমধ্যস সাগরের বোম্টেটে জলদস্যু। আর ঐতিহাসিক লেনপুন বলেছেন আত্মীয় স্বজন ও স্বজাতির পৈশাচিক হত্যালীলার প্রতিশোধ নেবার জন্য খৃস্টানদের বিরুদ্ধে তিনি এক পবিত্র যুদ্ধে রত।
সেই ১৫১৭ সাল। উরুজ বার্বারোসা তখন আলজিরিয়ার তিলিসমানে অবস্থান করছেন। সাথে মাত্র ১৫০০ তুর্কী ও মূর সৈন্য। পার্শ্ববর্তী ওরানের খৃস্টান শাসনকর্তা মার্কোয়েস ডি কোমারেসের আকুল আবেদনে স্পেন সম্রাট পঞ্চম চার্লসের প্রেরিত সৈন্য উরুজের বিরুদ্ধে ছুটে আসছে। চেষ্টা করেও সাহায্যেল কোন উৎস তিনি কোথাও থেকে বের করতে পারলেন না। সামনে রয়েছে ডি কোমারেসের বিরাট বাহিনী। অগ্রসর হওয়া যায়না। সুতরাং পিছু হটে আলজির্য়াস ফেরাই যুক্তিযুক্ত মনে করলেন উরুজ। শত্রুপক্ষের চোখ এড়াবার জন্য একদিন রাত্রিযোগে তিনি আলজির্য়াস যাত্রা করলেন। কিন্তু তাঁর চেষ্টা ব্যর্থ হলো। কোমারেসের নেতৃত্বে সম্মিলিত শত্রু বাহিনী ছুটে এল। উরুজের চলার পথে সামনেই রয়েছে এক নদী। উরুজ নিশ্চিত, একবার নদী পার হতে পারলেই শত্রুপক্ষ আর তাঁদের নাগাল পাবে না। লোভী স্পেনীয়দের যাতে বিলম্ব হয় সেজন্য উরুজ তাঁর স্বর্ণ ও অর্থ সম্পদ রাস্তাময় ছড়িয়ে আসতে লাগলেন। কিন্তু খৃস্টান বাহিনী এবার দুর্জয়, অপ্রতিরোধ্য উরুজকে হাতে পাবার নেশায় পাগল হয়ে উঠেছে। তারা মণিমানিক্য পদদলিত করে ছুটে চলে এল উরুজের পেছনে। উরুজ তাঁর অর্ধেক সৈন্য সহ নদী পার হয়েছেন। ইতোমধ্যে খৃস্টান বহিনী এস পড়ল নদীর তীরে। নদীর ওপারে উরুজের অবশিষ্ট সৈন্য আক্রান্ত হলো। উরুজ ফিরে দাঁড়ালেন। নদীর এপার থেকে নদীর ওপারে নিজ সাথীদের আক্রান্ত হবার দৃশ্য দেখলেন। ইচ্ছা করলে উরুজ তাঁর অর্ধেক সৈন্য নিয়ে নিরাপদে আলজির্য়াস ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। তিনি এপারের হাতে সাথীদের বললেন, আমার একটি মুসলিম ভাইকেও খৃস্টানদের হাতে রেখে আমি ফিরে যেতে পারি না। এই বলে আবার তিনি লাফিয়ে পড়লেন নদীতে। তাঁকে অনুসরণ করল তাঁর প্রতিটি সৈনিকই। ওপারে উঠে তিনি তার ক্ষুদ্র বাহিনী সংগঠিত করে শত্রুসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। উরুজের প্রতিটি সৈনিক শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শত্রু হনন করে শাহাদাত বরণ করলেন। ইতিহাস বলে, একটি মুসলিম সৈনিকও সেদিন যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়নি। সিংহের মত যুদ্ধ করে উরুজ তাঁর ১৫০০ সাথী সমেত যুদ্ধ ক্ষেত্রে শাহাদাত বরণ করলেন। একটি যুদ্ধে একটি গোটা বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর সমগ্র ইতিহাসে আর নেই।

দান কমাতে গিয়ে বাড়ল
বাংলাদেশে তখন সুলতানী শাসন। সুলতান ফিরোজ শাহ বাংলার সিংহাসনে। হযরত বিলালের দেশ আবিসিনিয়ার অধিবাসী তিনি। কৃষ্ণাংগ ফিরোজ শাহ সামান্য অবস্থা থেকে সুলহতান পদে অধিষ্ঠিত হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।
সুলতান ফিরোজ শাহ ক্ষমতার উচ্চ শিখরে উঠেও দৃষ্টি তার উর্ধমুখী হলো না, নীচের দিকে জনসাধারণের দিকেই নিবদ্ধ থাকলো। ভুললেন না তিনি জনসাধারণের কথা- গরীবদেরকথা। তিনি অকাতরে রাজকোষ থেকে গরীব জনগণকে অর্থ দান করতে লাগলেন। অভাবীর সংখ্যা বিপুল, প্রয়োজন তাদের বিরাট। তাই রাজকোষ থেকে অর্থ খরচ হতেও লাগল পানির মতো। রাজ দরবারের আমীর-উমরারা মহাবিপদে পড়ল-প্রমাদ গুণল তারা। ভাবল সুলতানের এ কী অমিতাচার! এভাবে দান করতে থাকলে তো রাজকোষ শূন্য হয়ে যাবে। আমীর উমরারা চিন্তা করলো, সুলতান নিজের হাতে অর্থ সাহায্য দেন না, তাই হয়তো অর্থের মায়া তাঁর কাছে বড় হয় না। দিনে যে অর্থ দান করা হয় তা যদি তিনি এক সংগে দেখতে পেতেন, তাহলে এত অর্থ কিছুতেই তিনি দিতে রাজী হতেন না। সামান্য অবস্থা থেকে তিনি এত বড় হয়েছেন, অর্থের মর্যাদা তাঁর চেয়ে আর বেশী কে বুঝবে। সুতরাং মন্ত্রণা পরিষদ পরামর্শ করে ঠিক করল, দানের অর্থ এনে সুলাতেন সামনে হাজির করতে হবে। পরামর্শ অনুসারেই কাজ হলো। পরদিন দানের জন্য নির্দিষ্ট একলক্ষ কাঁচা রোপ্য মুদ্রা এনে স্তূপীকৃত করে একজন মন্ত্রী অতি বিনয় সহকারে বললেন, “এ টাকাগুলোই আজ গরীব ও সাহায্যপ্রার্থীদের মধ্যে বিতরণের জন্য দিয়েছিলেন।” সুলতান ফিরোজ শাহ সে টাকার দিকে চেয়ে বললেন, “ও আচ্ছা, এ চাকাও তো যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না। এর সাথে আরও এক লক্ষ টাকা যোগ করে গরীব দুঃখীদের মঝে বিলিয়ে দাও।” হতবাক মন্ত্রী আর কিছু বলতে পারলো না, বলতে সাহস পেলোনা। সুলতানের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হলো। সেদিন দান করা হলো দু‘লক্ষ রৌপৗ মুদ্রা।
ইতিহাসে ব্যক্তিগত ও বংশীয় রাজসিংহাসনে খোদাভীরু শাসকের আগমনে মাঝে মধ্যে এভাবে রাজকোষ জনসাধারণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে।

--- সমাপ্ত ---


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি