মূতার রণাংগনে আত্মত্যাগ
মুতার যুদ্ধ ক্ষেত্র। রিরিয়ার রোমক শাসক শুরাহবীলের নেতৃত্বে এক লক্ষ রোমক সৈন্য দণ্ডয়মান। যুদ্ধক্ষেত্রে এক লক্ষ সৈন্যের বিরুদ্ধে তিন হাজার মুসলিম মুজাহিদ দাঁড়িয়ে। মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব করছেন যায়েদ ইবন হারেসা। ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেনাপতি যায়েদগ শহীদ হলেন। মহানবীর (সা) পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী সৈন্য পরিচালনার ভার গ্রহণ করলেন জাফর ইবন আবী তালিব। এক লক্ষ সৈন্যের বিরুদ্ধে তিন হাজার সৈন্যের এক অদ্ভুত অসম যুদ্ধ চলছে। জাফরের এক হাতে পতাকা, অন্য হাতে তাঁর তরবারি। ভীষণতর যুদ্ধে মেতেছেন তিনি। যুদ্ধেঘ প্রথমে তাঁর ডান হাত কাটা গেল, পরে বাম হাত। তাঁর বাম হাত ছিন্ন হওয়ার সাথে সাথে পিছন দিক থেকে এক আঘাত এসে পড়ল তাঁর দেহে। দ্বিখণ্ডিত হয়ে ঢলে পড়ল তাঁর দেহ। জাফর যখন শহীদ হলেন, তখন মহানবীর (সা) মনোনীত পরবর্তী সেনাপতি আবদুল্লাহ ইবন রওয়াহা যুদ্ধ ক্ষেত্রের এক কোণে বসে এক টুকরা গোশত খাচ্ছিলেন। দু‘দিন আগে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আর তিনি কিছু খাননি। তিনি যখন খাচ্ছিলেন, সে সময় তাঁর নামে ডাক এল। সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে গোশত ফেলে দিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। নিজকে সম্বোধন করে বললেন, “জাফর শহীদ হয়ে গেল, আর তুই এখনো দুনিয়ায় ব্যস্ত।”
অতঃপর আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা সৈন্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। ঘোরতর যুদ্ধে ব্যাপূত হয়ে পড়লেন তিনি। এক আঘাতে তাঁর একটি আঙ্গুল কেটে গেল। মুহূর্তের জন্য আবদুল্লাহ ইবন রওয়াহা একটু দবে গেলেন। বোধ হয় একটু দ্বিধা কিংবা ভয় এল তার মনে। কিন্তু দ্বিধা-ভয় ঝেড়ে ফেলে বললেন, ‘হে অন্তর, এখন কীসের জন্য এ চিন্তা! স্ত্রী! আচ্ছা, তাকে তালাক! গেলাম! তাকে আযাদ করে দিলাম। বাগবাগিচা! ঐগুলো আল্লাহর রাস্তায় সাদকা করে দিলাম।’
আবদুল্লাহ ইবন রওয়াহার নেতৃত্বে ভীষণতর সংগ্রাম চলতে লাগল ‘মুতা’ রণাঙ্গনে।
মুতা যুদ্ধে যাত্রা করার সময় আবদুল্লাহ ইব্ন রওয়াহা বলেছিলেন, “আল্লাহর দরবারে আমার গুনাহর জন্য মাফ চাচ্ছি। আমার জন্য এমন তরবারি আসুক, যদ্বারা ঝরনার মত আমার রক্ত প্রবাহিত করা হবে কিংবা শত্রু এমন বর্শা দিয়ে আমাকে আঘাত করবে যা আমার হৃদপিন্ড বিদীর্ণ করে দেবে এবং লোকেরা আমার কবরের পাশ দিয়ে যাবে, তখন তারা বলবে, আল্লাহ তোমাকে কৃতকার্য এবং তাঁর প্রিয় হিসেবে গ্রহণ করুন। বস্তুতঃ তুমি প্রিয় ইবং সফলকামই ছিলে।”
আবদুল্লাহ ইবন রওয়াহার এ আকাংখা সফল হয়েছিল। শাহাদাতের অমৃত পেয়ালা তিনি পান করেছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার বলেন, “যুদ্ধের পরে যখন আমরা দাফনের জন্য আবদুল্লাহ ইবন রওয়াহার লাশ সংগ্রহ করে নিয়ে এলাম; তখন দেখা গেল, তাঁর শরীরের উপরিভাগে ৯০টি জঘম রয়েছে।” যায়েদ, জাফর, আবদুল্লাহ এবং জানবাজ মুজাহিদদের এই আত্মত্যাগই এক লক্ষ রোমক সৈন্যের মনে দারুন বিস্ময় ও ভয় সৃষ্টি করেছিল।

জিহাদ থেকে বিরত রাখার জন্য আয়াত নাযিল করতে হলো
৬৩৫ সাল। নভেম্বর মাস। আরবে তখন ভীষণ দুর্ভিক্ষ। তার উপরে অবিশ্বাস্য রকমের গরম। বালুময় দেশ আরব। এই বালুর উপরই নামছে আগুনঝরা রৌদ্র। মরুভূমি-প্রান্তের শীর্ণ গাছগুলো ঝলসে যাচ্ছে। একদিকে দুর্ভিক্ষ, অন্যদিকে অসহ্য গরম, এই দুইয়ে মিলে গোটা আরবে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। এমনি সময়ে এক চাঞ্চল্যকর সংবাদ এল মদীনায়। মারাত্মক সংবাদ। সিরিয়া থেকে সদ্য ফিরে আসা একদল ব্যাবসায়ী মহানবীকে (সা) এসে জানাল, রোম সম্রাটের এক বিরাট বাহিনী জমায়েত হয়েছে সিরিয়া সীমান্তে। আরবের বিখ্যাত যোদ্ধা গোত্র গাসসান, লখম ও জাযাম গিয়ে মিশেছে ওদের সাথে। রোমান সম্রাটের ৪০ হাজার সৈন্য এদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একযোগে ছুটে আসছে। তাদের উস্কানি দিয়ে চলেছে এ খবর মদীনায় ইতোপূর্বেও এসেছে। সুতরাং এ খবর পেয়েই মদীনায় সাজ সাজ রব পড়ে গেল। কিন্তু এ যুদ্ধযাত্রা ছিল বিরাট ব্যসাধ্য ব্যাপার। অথচ অধিকাংশেরই সংগতি ছিল তখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। যুদ্ধযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় ঘোড়া, সাজ-সরঞ্জাম ইত্যাদিও তাদের ছিল না। মহানবী (সা) যুদ্ধ ফান্ডে যথা সাধ্য দান করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানালেন। এ আহবানে সাড়া দিয়ে হযরত উসমান (রা) ৩শ’ উট দান করলেন, হযরত উমার ফারূক (রা) দান করলেন তাঁর সম্পদের অর্ধেক। আর হযরত আবুবকর (রা) দান করলেন তাঁর সব কিছু। এভাযে যাদের সাধ্য ছিল সবাই দান করলেন। কিন্তু সব প্রয়োজন তাতে পূরণ হলো না। অনেকের যুদ্ধযাত্রার সর্বনিম্ন প্রয়োজনও পুরণ হলে া না। সুতরাং তাদেরকে তাবুক অভিযান থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত হলো।
যারা যুদ্ধযাত্রা থেকে বাদ পড়ল তাদের খুশী হবারই কথা। বিশেষ করে মুনাফিক ও ইহুদীরা অসহ্য গরমে অকল্পনীয় পথ চলার কষ্টের কথা বলে মুসলমানদের বিভ্রান্ত ও দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলার গোপন প্রচেষ্টায় রত ছিল। সুতরাং আর্থিক অনটন ও অসহ্য গরমের মধ্যে পথ চলার কষ্টের কথা স্মরণ করে যুদ্ধে যোগ দানের দায় থেকে অব্যহতি লাভ করায় তারা আনন্দিত হবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু মুসলমানদের প্রকৃতিই আলাদা। তাই উল্টোটাই ঘটল। যারা যুদ্ধ যাত্রার লিষ্ট থেকে বাদ পড়ল, তারা এসে মহানবীর (সা) কাছে কেঁদে পড়ল। জিহাদে অংশ গ্রহণের সৌভাগ্য থেকে তারা কিছুতেই বঞ্চিত থাকতে চায় না। তাদেরই অন্যান্য ভাই যখন খোদাদ্রোহীদের সাথে মরণপণ সংগ্রামে রত থাকবে, তখন তারা গৃহকোণে নারীর মত বসে বসে সময় কাটাবে তা কিছুতেই হতে পারে না। তাদের জিহাদের ব্যাকুলতা দেখে স্বয়ং মহানবী (সা) অভিভূত হয়ে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত কুরআনী আয়াত নাযিল হল তাদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য। কুরআনে ঘোষণা হল, “আর সেই লোকদের কোন গুণাহ নেই, যখন তারা তোমার কাছে এই উদ্দেশ্যে আসে যে, তমি তাদেরকে বাহন দান করবে, আর তুমি বলছ, “আমার কাছে তো কিছুই নেই, যার উপর তোমার আরোহন করাই,” তখন তারা এমন অবস্থায় ফিরে যায় তাদের চোখ থেকে অশ্রুর ধারা বইতে থাকে এই অনুতাপে যে, তাদের ব্যয় করার কোন সম্বল নেই।”
আল্লাহর রাস্তায় জীবন দেয়ার জন্য সদাপ্রস্তুত এমন মুসলমানরাই পূর্বআটলান্টিকের নীল জলরাশি থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের মিন্দানাও দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত ইসলামের ঝান্ডা উড্ডীন করেছিল।

মহানবীর (সা) দূত মাথাঃয় এক টুকুর মাটি নিয়ে ফিরলেন
পারস্য সম্রাট খসরু তখন সিংহাসনে সমাসীন। তাঁর প্রতাপে চারদিক প্রকম্পিত। ভান্ডারে তাঁর অফুরন্ত হীরা, জহরত, মুনমুক্তা।
গর্বিত সম্রাট ভাবেন, তাঁর সম্রাজ্য যেমন অজয় অক্ষয়, তেমনি তাঁর সম্পদের কোন শেষ নেই। এই সম্রাট খসরুর কাছেই গেলেন রাসূলুল্লাহ (সা) সম্রাট খসরুকে আহবান জানিয়েছিলেন সত্যের দিকে। সম্রাট খসরু মহানবীর সে চিঠি পাঠ করলেন। পাঠ করে ক্রোধে ফেটে পড়লেন। বললেন, “তোমাদের এত বড় স্পর্ধা পারস্যের একচ্ছত্র অধিপতি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্রাট খসরুর দরবারে ধর্ম কথা নিয়ে আসতে সাহস করেছো? তোমরা তো অত্যন্ত ঘৃণিত ও নীচ লোক।”
দূত সহস্যে বললেন, “নিশ্চয়ই আমরা অত্যন্ত নীচ ও ঘৃণিত ছিলাম। অতঃপর আমাদের মাঝে এলেন একজন মহামানব মহানবী। তিন আমাদের সত্যের সন্ধান দিলেন। আমরা উন্নত হয়ে উঠলাম। আপনি যদি তাঁর শিক্ষা, তাঁর ধর্মমত গ্রহণ তরেন, তবে আমরা ভািই ভাই। নচেৎ অসত্যের সাধে সত্যের দ্বন্দ্ব অনিবার্য।”
গর্বিত সম্রাট খসরু মহানবীর দূতের এই কথা শুনে বারুদের ন্যায় জ্বলে উঠলেন। বললেন, “ওহে কে আছ, এর মাথায় পারস্যের এক টুকরি মাটি উঠিয়ে দাও। সম্রাট খসরুর দরবারে এসে এমন ভালো লোখ খালি হাতে ফিরে যাবে, তা বড়ই অশোভন।”
অবিলম্বে এক টুকরি মাটি এনে পারসিকেরা মহানবীর দূতের মাথায় চাপিয়ে দিল। সকৌতুকে সম্রাট খসরু বললেন, “যাও, এ ভাবেই তোমরা পারসিকদের দাসত্ব করবে।”
সাহাবা সে মাটির টুকরি আর মাথা থেকে নামালেন না। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পারস্য থেকে হিজাযে উপস্থিত হলেন। মাথায় টুকুরি, পারিশ্রান্ত দেহ। কিন্তু মুখে প্রসন্ন হাসি। তিনি হাজির হলেন মহানবীর নিকট। বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা), আমি পারসিকদের নিজহাতে দেয়া মাটি মাথায় তুলে নিয়ে এসেছি।”
শুনে মহানবীর মুখমন্ডল স্বর্গীয় হাসিতে দীপ্ত হয়ে উঠল। বললেন তিনি. “উত্তম, ইনশায়াল্লাহ এটাই হবে। অচিরেই সে দেশের মাটি ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেবে।”
মহানবীর এ ভবিষ্যতবাণী অতি অল্প দিনেই অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবরূপ লাভ করলো। বিশাল পারস্য সাম্রাজ্য নিঃশেষে মুসলমানদের করতলগত হলো। আর সম্রাট খসরুর বংশের সর্বশেষ্ঠ প্রতাপশালী সম্রপট ইয়াপজদগির্দ কপর্দকশূন্য কাংগাল সেজে রাজ-প্রাসাদ থেকে পথে গিয়ে দাঁড়ালেন।

‘একদিন যিনি এতগুলো সৎকাজ করেছেন তিনি নিশ্চয়ই জান্নাতে প্রবেশ করবেন’
একদিন মহানবী (সা) তাঁর সামনে উপস্থিত সাহাবাদের লক্ষ্য করে বললেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কে আছ যে আজ রোযা রেখেছ?” হযরত আবুবকর (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি রোযা রেখেছি।” নবী (সা) বললেন, “এমন কে আছ যে, আজ কোন শাবাধারের সাধে গমন করে জানাযার নামায পড়েছ?” আবুবকর (রা) বললেন, “এইমাত্র আমি একাজ সমাধা করে এখানে এসেছি।” মহানবীর (সা) কণ্ঠ থেকে আবার ঘোষিত হলো, “আচ্ছা এমন ব্যক্তি কে আছ যে আজ কোন পীড়িতের সেবা করেছ? হযরত আবুবরক বললেন, “আজ আমি এক পীড়িত ব্যক্তির সেবা করেছি।” মহানবী (সা) আবারও বললেন, “আজ কিছু দান করেছ, এমন ব্যক্তি এই মজলিসে কেউ আছ?” সলজ্জভাবে হযরত আবুবকর উত্তরে বললেন, “এক অতিথিকে আমি সামান্য কিছু অর্থ সাহায্য করতে পেরেছি।” অবশেষে বিশ্বনবী (সা) বললেন,“একদিনে যিনি এতগুলো সৎকাজ করেছেন নিশ্চয় তিনি জান্নাতে প্রবেশ করবেন।”

একটি হাদীস এবং আববকর (রা)
এই হাদীস শুনানোর পরবর্তীকালে হযরত উমার (রা) বলেছিলেন, “সত্যই জগতে এমন কোন উত্তম কাজ নেই, যা আবুবকর (রা) সর্বাগ্রে সুসম্পন্ন না করেন। এটা আমার অনুমান নয়, অভিজ্ঞতার কথা। একদিন আমি অশীতিপর এক বৃদ্ধার উপবাসের কথা শুনে কিছু খাবার নিয়ে তার বাড়ীতে গিয়ে উপস্থি হলাম। কিন্তু গিয়েই শুনলাম, কে একজন দয়ালু ব্যক্তি অল্পক্ষণ আগে আহার করিয়ে গেছেন। আমি সেদিন ফিরে এসে পরের দিন একই ভাবে কিচু আহার নিয়ে তার কাছে গেলাম। কিন্তু একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম, কে একজন আমর যাওয়ার পূর্বেই তাকে আহার করিয়ে গেছে। কে এই দয়ালূ ব্যাক্তি, কে এমন নিয়ম বেঁধে তাকে আহার করিয়ে যায়, তা জানবার জন্য আমার জিদ চেপে গেল। পরের দিন সকাল সকাল আমি বৃদ্ধার বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। আমার আজকের শপথ, বৃদ্ধাকে আজ আমার আহার করাতেই হবে, সে ব্যক্তি আজ আমাকে দেখতেই হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বৃদ্ধার গৃহমধ্যে ঢুকতে যাচ্ছি এমন সময় দেখলাম, শূণ্য বাসন পেয়ালা নিয়ে আবু বকর (রা) বের হয়ে আসছেন। আমি তাঁকে সালাম জানিয়ে বললাম. ‘বন্ধবর’ আমিও এটাই অনুমান করেছিলাম। তিনি নীরব হাস্যে আমাকে প্রতিসালাম জানিয়ে করমর্দন করে বাড়ীর পথ ধরলেন।”

‘আবুবকর পরবর্তী খলীফাদের বড় মুস্কিলে ফেলে গেলেন’
হযরতহ আবুবকর ছিদ্দীক (রা) মুসলিম জাহানের খলীফা হয়েছেন। অলফা নির্বাচিত হবার ক‘দিন পরের ঘটনা। নতুন চাদরের একটি বোঝা নিয়ে খলীফা বাজারে চলেছেন বিক্রি করার জন্য। উমার (রা) পড়লেন পথে। তিনি বললেন, “কোথায় চললেন?”
আবু বকর (রা) বললেন, “বাজারে যাচ্ছি”। হযরত উমার (রা) বুঝলেন, খলীফা হওয়ার আগে হযরত আবু বকর কাপড়ের যে ব্যবসা করতেন, তা এখনও ছাড়েননি। উমার বললেন, “ব্যবসায় মগ্ন থাকলে খিলাফাতের কাজ চলবে কেমন করেক?”
হযরত আবু বকর বললেন, “ব্যবসা না করলে পরিবার-পরিজনদের ভরণ পোষণ করব কি দিয়ে?” উত্তরে হযরত উমার বললেন, “বাইতুল মালের খাজাঞ্চি আবু উবাইদার কাছে চলুন, তিনি আপনার জন্য ইকটা বাতা নির্দিষ্ট করে দেবেন”, বলে হযরত আবুবকাকে টেনে নিয়ে আবু উবাইদার কাছে গেলেন।
আলোচনার পর অন্যান্য মুহাজিরকে হরে ভাতা দেয়া হয় সে পরিমাণের একটি ভাতা খলীফা হযরত আবু বকরের জন্য নির্দিষ্ট হলো। ভাতা নির্দিষ্ট হবার পর খলীফা এ কথাটি জনসাধারণ্যে প্রকাশ করার প্রয়োজন মনে করলেন। তিনি মদীনায় সকল লোককে ডেকে বললেন, “তোমরা জান যে, ব্যবসা দ্বারা আমি জীবিকা নির্বাহ করতাম। এখন তোমাদের খলীফা হবার ফলে সারাটা দিনই খিলাফতের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়, ব্যবসা দেখাশুনা করতে পারিনা। সে জন্য বাইতুল মাল থেকে আমাকে ভাতা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।”
হযরত আবু বকর (রা) বেঁচে থাকার প্রয়োপজনে যেটুকু ভাতা গ্রহণ করতেন, জনসাধারণের কাছ থেকে এই ভাবে তা তিনি নঞ্জুর করিয়ে নিলেন।
মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে তিনি হযরত আয়িশাকে (রা) বললে, “আমার মৃত্যুর পর আমর প্রয়োজনার্থে আনা বাইতুল মালের যাবতীয় জিনিস আমার পরবর্তী খলীফার নিকট পাঠিয়ে দিও।” তাঁর মৃত্যুর পর কোন টাকা পয়সাই তাঁর কাছে পাওয়া যায়নি। মাত্র একটি দুগ্ধবতী উট, একটি পেয়ালা, একটি চাদর ও একটি বিছানাই তাঁর সম্পদ ছিল। এ জিনিসগুলো মৃত খলীফার নির্দেশ মুতাবিক খলীফা উমারের (রা) কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো। এসব দেখে খলীফা উমার (রা) অশ্রুসজল চোখে বললেন, “আল্লাহ আবুবকরের উপর রহম করুন। তিনি তাঁর পরবর্তী খলীফাদের বড় মুস্কিলে ফেলে গেলেন।’

মুরতাদ প্রশ্নে আবুবকরের দৃঢ়তা
ভন্ড মহিলা নবী সাজাহ- এর মিত্র ও সাহায্যকারী মালিক ইবনে নুয়াইরা মুসলিম সেনাধ্যক্ষ খলীফাদের হাতে যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হলেন। মালিক ইবনে নুয়াইরা যাকাত দেয়া বন্ধ করেছিল। অনেকের মতে মাগরিব ও এশার নামায পড়া বন্ধ করে দিয়েছিল সে। সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে হযরত খালিদ মালিককে সাহাবী হযরত যিরার ইবনে আওয়ার (রাঃ) এর দায়িত্বে সোপর্দ করেছিলেন। পরে সে নিহত হয়ে ছিল।
এ খবর মদীনায় পৌঁছালে হযরত উমার (রাঃ) হযরত যিরার (রাঃ) ও হযরত খালিদ (রাঃ) এর বিরুদ্ধে মালিক হত্যার অভিযোগ আনলেন। হযরত উমার (রা) পরিস্থতিগত কারনে যাকাত অস্বীকারকারীদেরকেও সাময়িক ভাবে মুসলমান বলে মনে করার পক্ষপাতি ছিলেন। উমার ফারুক (রাঃ) হযরত আবু বকর (রাঃ) এর কাছে অভিযোগ করে বলেছিলেন, “খালিদ মালিককে হত্যা করে কিতাবুল্লাহের বিরুদ্ধাচারণ করেছে।”
কিন্তু হযরত আবু বকর তাঁর সাথে এক মত হলেন না। মুরতাদদের জন্য খলীফা হযরত আবু বকর (রাঃ) এর বিন্দুমাত্র দরদ ও ছিল না। মুরতাদের প্রতি হযরত উমার (রাঃ) এর শৈথিল্য প্রস্তাবের উত্তরে খলীফা আবু বকর (রাঃ) বলেছিলেন, “আমি নামায, যাকাত প্রভৃতি কোন ফরয সমন্ধে সামান্য শৈথল্য প্রদর্শন করতে পারি না। আল্লাহুর ফরয হিসাবে নামায ও যাকাতের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই। আজ যাকাত সম্বন্ধে শৈথিল্য দেখালে কাল নামায রোযা সম্বন্ধেও কিছুটা ঢিল দিতে হবে। আল্লাহুর শপথ করে বলছি, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে যারা একটি মেষ শাবক যাকাত দিত, আমি সেই মেষ শাবক পর্যন্ত লোকের ভয়ের খাতিরে বাদ দিতে পারব না। আল্লাহ এবং আল্লাহুর রাসূল (সাঃ) এর হুকুমের সকল অবাধ্য লোককে অবনত করতে আমি একা হলেও যুদ্ধ করে যাব।”

আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাও
হযরত উমার (রা) তখন খলীফা। খলীফা উমার (রা) এর বাড়ী থেকে বেশ কিছু দূরে একটি পনির কুপ। খলীফা উমার (রা) এর বাড়ী থেবে বেশ কিছু দূরে একটি পানির কুপ। খলীফার সাক্ষাতপ্রার্থী একজন লোক দেখলেন, খলীফা কূপ থেকে পানি তুলঠেন। শুধু পানি তোলা নয় আগন্তুক বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন, পৃথিবীর শাসক উমাপর, পারস্য ও রোম সাম্রাজ্য পদাতনকারী উমার (রা) সেই পানি ভরা কলসি কাঁধে তুলে নিলেন। আগন্তুক আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিতিন দ্রুত খলীফার নিকটে গেলেন। একজন অপরিচিত লোককে দেখে হযরত উমার (রা) বললেন, “ভাই, আপনার কি কোন কথা আছে, বলবেন আমাকে?”
লোকটি বললেন, “হে আমীরুল মুমিনীন, যদি কলসটি দয়া করে আমার কাঁধে দিতেন।”
হযরত উমার (রা) যেতেহ যেতেই বললেন, “আমার ছেলে-মেয়ের খাদ্য পানীয় সংগ্রহের মাধ্যমে পুণ্য সঞ্চয় করা কি আমার উচিত নয়? আচ্ছা, এ ছাড়া কি আপনি আর কিছু বলবেন?”
আগন্তুক লোকটি বললেন, “আপনার এই অবস্থায় বলার মত কোন কথা আমার মনে আসছেনা। আগ বাড়ী চলুন। তারপর বলব। আমি আপনাকে অপেক্ষা করতে বলব, আপনি কাঁধে বোঝা নিয়ে আমার কথা শুনবেন, এটা হতে পারে না।”
আগন্তুকের কথা শুনে হযরত উমার থমকে দাঁড়ালেন। বোথ হয় ভাবলেন, ‘আমি আমার নিজের কাজ করছি, এ কাজের অজুহাতে আগন্তুককে দাঁড় করিয়ে রাখা ঠিক হবে না।’ তিনি কাঁধ থেক কলসি নামিয়ে জানুর উপর রাখলেন। তারপর বললেন, “বলুন, আপনার কথা।”
আগন্তুক ভীষণ বিব্রত বোধ করলেন। তার কথা শুনার জন্য আমীরাল মুমিনীন এ ভাবে কষ্ট করবেন। কলসটি মাটিতে নামিয়ে রাখলে তবু কিচুটা কষ্টের লাঘব হয় তাঁর। তিনি খলীফাকে নিবেদান করলেন, “জানুর উপর কলস রেখে কথা শুনতে আপনার কষ্ট হবে। কলসটি দয়া করে মাটিতে রাখুন।”
খলীফা বললেন, “তা কি করে হয় ভাই? কলসির তলা ভিজা এ জমিটি আমার নয়। ভিজা কলসির তলায় লেগে অন্যের জমি আমার বাড়িতে চলে গেলে, আকি কি জওয়াবদিহি করব?”
লোকটি বলল, “আমার জিজ্ঞাসার জবাব আমি পেয়ে গেছি, আপনি দয়া করে যান।”
উমার (রা) বললেন, “বুঝলাম না, বুঝিয়ে বলুন।”
লোকটি বলল, “ইয়া আমীরুল মুমিনীন, আমি জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলাম বর্তমান জরীপে অন্যের জমির কতকাংশ আমার জমির সাথে উঠে এসেছে। তা আমার জন্য হালাল কিনা?”


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি