এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে যুগে যুগে বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বৃহদাংশ ইসলামী আন্দোলনের সাথে একাত্ম হতে পারেনি। বরং তারা ইসলামী আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য কক্রান্ত জালই বিস্তার করেছে। বানোয়াট কথাবার্তা ছড়িয়ে তারা ইসলামী আন্দোলন ও আন্দোলনের নেতৃত্ব সম্পর্কে জনগণের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। তাদের ধনবল ও জনবল ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজে লাগেনি, বরং এর বিরোধিতার কাজের কাজেই ব্যয়িত হয়েছে। এদের সম্পর্কেই নূহ (আঃ) আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনকে সম্বোধন করে বলেন-
(আরবী *****)
“হে আমার রব, ওরা আমার কথা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সেই সব ব্যক্তিদের অনুসরণ করেছে যারা ধন সম্পদ ও সন্তান লাভ করে অধিকতর ব্যর্থকাম হয়েছে। এরা বড়ো রকমের চক্রান্তের জাল বিস্তার করেছে।” – সূরা নূহঃ ২১-২২
প্রভাবশালী গোষ্ঠী তাদের মন-মগজে নানা রকমের আজগুবী ধ্যান-ধারণা পোষণ করে এবং সেগুলো জনগণের মাঝে প্রচারও করে। এতে জনগণ প্রভাবিত হয়। অতীতের বহু প্রভাবশালী গোষ্ঠী ফিরিশতার পরিবর্তে মানুষকে নবী করে পাঠানো পছন্দ করতে পারেনি। আবার মানুষ নবীড় মাঝে অদাধারণ ও অলৌকিক কিছু না দেখলে তাঁকে নবী হিসেবে গ্রহণ করতেও তারা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলো। তাদের মনে হয়তো এসব ধারণাই প্রকট ছিলো যে নবী হবেন এমন ব্যক্তি যিনি ফুঁ দিলে পানিতে আগুন ধরবে, তিনি পানির উপর দিয়ে হাঁটবেন, তিনি ইশারা করলে গাছ-পালা তাঁর নিকট ছুটে আসবে, তিনি সিংহ বা বাঘের উপর সওয়ার হয়ে শহরে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরবেন, তিনি চোখ রাঙালে সব দুশমন জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, তিনি হাসলে সোনা দানা ছড়িয়ে পড়বে চার দিকে, তাঁর শান-শওকত দেখে রাজা-বাদশারাও লজ্জা পাবে, সমাজের টপ ক্লাশ লোকগুলোই তাঁর চার ধারে জড়ো হবে এবং সাধারণ মানুষেরা তাদের দারিদ্র ও অসহায়ত্ব নিয়ে বহু দূরে অবস্থান করে ফ্যাল ফ্যাল করে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকবে ইত্যাদি।
নবীর পবিত্র জীবন, তাঁর পরবেশিত নির্ভুল জীবন দর্শন তাদের নিকট মোটেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো না। তাদের আজগুবী ধ্যান-ধারণার সাথে নবী জীবনের মিল খুঁজে না পেয়ে তারা নবীর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে মেন্তে উঠতো।
আল্লাহ্‌র নবী নূহের (আঃ) বিরুদ্ধেও সেই সমাজের প্রভাবশালী মহল এই ধরনের হীন তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছিলো। নবীকে সম্বোধন করে তারা জঘন্য মন্তব্য করতো।
(আরবী *****)
তাঁর কাউমের কাজির সরদারেরা বললো, “আমরা তো তোমাকে আমাদের মতোই একজন সাধারণ মানুষ দেখেছি। আমরা আরো দেখছি যে আমাদের মধ্যে যারা নীচ হীন তারাই না বুঝে শুনে তোমার অনুসারী হয়েছে। কোন দিক দিয়েই তো তোমাদেরকে আমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ দেখছি না। আমাদের ধারণা তোমরা মিধ্যাবাদী।” – সূরা হূদঃ ২৭
এই প্রভাবশালী মহলের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো এরা যালিম শাসকের হাত শক্তিশালী করে এবং ইসলামী আন্দোলনের গতিরোধ করার জন্য যালিম শাসককে উস্কানী দেয়। মূসা (আঃ) যখন মিসরের বুকে আল্লাহ্‌র দ্বীনের দাওয়াত পেশ করতে থাকেন, তখন সেখানকার প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ মূসাকে (আঃ) প্রতিহত করার জন্য ফিরাউনকে উস্কানী দিতে থাকে।
(আরবী *****
ফিরাউনকে তাঁর জাতির সরদার ব্যক্তিরা বললো, “আপনি কি মূসা ও তাঁর লোকদেরকে দেশে ফাসাদ সৃষ্টির জন্য এমন ভাবে খোলা ছেড়ে দেবেন এবং তারা আপনাকে ও আপনার মাবুদদেরকে পরিত্যাগ করে রেহাই পাবে?” – আল আ’রাফঃ ১৬৭
কুফরী সমাজ ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে যারা অবৈধভাবে প্রচুর ধন-সম্পদ মওজুদ করে, তারা নতুন সমাজ ব্যবস্থায় এই সু্যোগ থেকে বঞ্চিত হবার আশংকায় প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের বিরোধী। আল্লাহ্‌র সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের শোষণ বিধান বহাল থাকবেনা বিধায় তারা ইসলামী আন্দোলনের জোর বিরোধিতা করতে থাকে। এদের সম্পর্কেই আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলেন—
(আরবী *****)
“এমনিভাবে তোমাদের পূর্বে যেই জনপদেই আমরা কোন ভয়-প্রদর্শক পাঠিয়েছি, সেখানকার স্বচ্ছল লোকেরা এই কথাই বলেছে যে আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে একটি পন্থার অনুসারী পেয়েছি এবং তাদের পদাংক অনুসরণ ক্রে চলছি।” – আযযুখউফঃ ২৩
ইসলাম বিরোধী প্রভাবশালী মহল শাসকদেরকে সঠিক পন্থা অনুসরণ করতে দেয় না। এক্ষেত্রে রোমের কাইজার হিরাক্লিয়াসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
হিরাক্লিয়াস তাঁর সম্রাজ্যের অন্যতম প্রদেশ সিরিয়াতে অবস্থানকালে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লার দাওয়াতী চিঠি তাঁর নিকট পৌঁছে। তিনি সিরিয়ায় উপস্থিত মাক্কার লোকদেরকে দরবারে ডেকে নেন। বাণিজ্য কাফিলা প্রধান আবু সুফিয়ানকে হিরাক্লিয়াস অনেকগুলো প্রশ্ন করেন। প্রশ্নের উত্তরে আবু সুফিয়ান জানান জানান যে মুহাম্মাদ উচ্চ বংশীয় ব্যক্তি, তাঁর পূর্ব পুরুষদের কেউ বাদশাহ ছিলেন না, সমাজের নিপীড়িত শ্রেণী তাঁর প্রতি আকৃষ্ট, তিনি কখনো মিথ্যা কথা বলেন না, তাঁর অনুসারীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, যুদ্ধে তিনি কখনো হারেন কখনো জিতেন, তিনি কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করেন না, সাম্প্রতিককালে কেউ আর এমন বক্তব্য নিয়ে ময়দানে আসেনি এবং তিনি সালাত কায়েম, যাকাত আদায়, পারস্পরিক সম্পর্ক সংরক্ষণ ও নিষিদ্ধ কাজ বর্জন করার নির্দেশ দেন।
এসব শুনে হিরাক্লিয়াস বলেছিলেন, “তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি নবী। আমি জানতাম তিনি আবির্ভূত হবেন। যদি আমি বুঝতাম তাঁর কাছে পৌঁছতে পারবো, তাহলে আমি সাক্ষাৎ করতাম। আর তাঁর কাছে থাকতে পারলে তাঁর পা দু’খানি ধুয়ে দিতাম। তাঁর রাষ্ট্র আমার পায়ের নীচের জায়গা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে।”
এরপর রাসুলুল্লাহর (সাঃ) চিঠি খানা পড়া হলো এবং দরবারে হৈচৈ পড়ে গেলো। হিরাক্লিয়াস একটি বিশেষ কক্ষে রোমের প্রধান ব্যক্তিদেরকে একত্রিত করে বললেন, “রোমবাসীগণ, তোমরা কি স্থায়ী সফলতা ও হিদায়াত চাও? তোমরা কি তোমাদের রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব কামনা কর?”
একথা শুনামাত্র প্রধানগণ বুঝতে পেল যে, কাইজার তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। অসুন্তষ্ট চিত্তে তাঁরা আসন ছেড়ে দরজার দিকে ছুটে যেতে শুরু করে। এমতাবস্থায় হিরাক্লিয়াস ভড়কে যান এবং তিনি ভোল পালটে গেলেন। তিনি বলেন, “লোক সকল, আমি তোমাদের ধর্ম বিশ্বাসের দৃড়তা পরীক্ষা করছিলাম। তোমাদের কাছ থেকে যা আশা করেছিলাম তা পেয়েছি।”
প্রধানগণ সন্তুষ্ট হয়ে কাইজারকে কুর্নিশ করে।
প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপের কারণে হিরাক্লিয়াস ইসলাম গ্রহণ করার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেননি।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি