রাসূল (সা)-এর প্রতি ভালোবাসা
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) ছিলেন দুনিয়ার সেরা মানুষ। তাঁর কথা, কাজ, আচরণ, ব্যবহার সবই ছিল অতুলনীয়। তাঁর অনুপম চরিত্রমাধুর্য সবাইকে মুগ্ধ করত। তাঁকে ভালোবেসে কত মানষের মন যে বিগলিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মহানবী (সা)-কে কাছে পেয়ে অনেকে তাঁর জন্য জীবনে উৎসর্গ করেছে। অনেকের কাছে প্রিয় নবীর সান্নিধ্য মা-বাবার আদরের চেয়েও তুচ্ছ মনে হয়েছে। তাদেরই একজন জায়েদ (রা)। পিতার নাম হারেসা। তিনি বিশ্বাসে ছিলেন খ্রিষ্টান।

হযরত যায়েদ তখন খুব ছোট। চাঁদের মতো ফুটফুটে শিশু যায়েদ। মায়ের কলিজার টুকরো এ শিশু। জায়েদকে মা বুকে জড়িয়ে রাখেন। সোনামণিকে আদর করে মায়েরা যেমন প্রাণ জুড়ান, জায়েদের মায়ের অবস্থাও সে রকমই। কিন্তু জায়েদকে বেশি দিন আদর করার ভাগ্য মায়ের হয়ে ওঠেনি।

একদিন মা আদরের সন্তানকে নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছিলেন। আরব দেশের মরুময় পথ। সে জামানায় মরুপথে যাতায়াত ছিল সীমাহীন কষ্টকর। তখন সূর্যের প্রচণ্ড তাপ মাথায় নিয়ে চলতে হতো। তা ছাড়া ডাকাতের উপদ্রব তো ছিলই। ডাকাতরা মরুভূমির ফাঁক-ফোকরে ওঁৎ পেতে বসে থাকত। সুযোগ পেলেই এরা অকস্মাৎ পথচারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং লোকজনের সর্বস্ব লুট করে নিত। অনেক সময় ডাকাতরা লোকজনকে বন্দী করে নিয়ে যেত। এসব বন্দীকে তারা ক্রীতদাস হিসেবে হাট-বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দিন।

জায়েধ ও তাঁর মায়ের ভাগ্যও ঘটল একই ঘটনা। তারা ডাকাতের হাতে পড়লেন। তস্কররা তাদের সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেল। ছোট বালক জায়েদসহ অনেককে ডাকাতরা বন্দী করল। একদিন জায়েদকে বিক্রি করে দেয়া হলো। এ সুযোগে হাকিম নামে এক লোক জায়েদকে কিনে নিল।

হাকিম ছিলেন হযরত খাদিজা (রা)-এর আপনজন। হাকিমের খালা তিনি। হাকিম জায়েদকে এনে খালা খাদিজার হাতে সমর্পণ করলেন। খাদিজা (রা) ছিলেন আরবের সেরা ধনী মহিলা। তাই তাঁর ঘরে অনেক দাস-দাসী কাজ করত। আরও কাজের লোচ চাই তাঁর। তাই জায়েদকেও তিনি কাজের জন্য রেখে দিলেন। খাদিজার ঘরে বালক জায়েদ বড় হতে লাগলেন। জায়েদ ছিলেন খুব বিশ্বস্ত ও কর্মঠ।

চল্লিশ বছর বয়সে হযরত খাদিজার সাথে মহানবী (সা)-এর বিয়ে হলো। এবার হযরত খাদিজা বালক জায়েদকে স্বামীর খেদমতে নিয়োগ করলেন। মহানবী (সা)-এর সান্নিধ্য পেয়ে জায়েদ তো মহাখুশী। আল্লাহর নবী সাথে থাকা যে বড় ভাগ্যের ব্যাপার। ভাগ্যবান না হলে কেউ আল্লাহর নবীর এ কাছের জন হতে পারত না। খাদিজা (রা) যেমন জায়েদকে ভালোবাসতেন, তেমনি মহানব (সা)ও তাঁকে আদর করতেন।

ছোটবেলা থেকে জায়েধ মা-বাবার তেমন একটা আদর পাননি। তাতে কী? তিনি হযরত খাদিজার কাছে মায়ের চেয়েও বেশী আদর পেয়েছেন। আর এখন মহানবী (সা)-এর কাছে পেলেন বাবার আদর। ফলে তাঁর আনন্দ ও সুখ আর কে দেখে? এমনি করে জায়েদের নিগুলো সুখে-আনন্দে ভালই কাটছিল। মহানবী (সা)-এর খেদমত আর ইসলামের কাজ ছাড়া তাঁর কোনো ভাবনা নেই। নেই কোনো পিছুটানও।

তবে একদিন ঘটল এক ঘটনা। একদল হজযাত্রী কাবাঘর জেয়ারত করতে মক্কায় এলো। তাদের সাথে হযরত জায়েদের দেখা হলে যাত্রীদের একজন হযরত জায়েদকে চিনে ফেলল। সে নিশ্চিত হলো, এই বালকই হারেসার হারানো পুত্র জায়েদ। তাই তারা বিষয়টি হারেসাকে জানাবে বলে ভাবল। হজ সেরে লোকেরা বাড়িতে ফিরে হারেসাকে ঠিকই সবকথা খুলে বলল। প্রাণপ্রিয় পুত্র জায়েদের খবর শুনে বাবা হারেসার বুক খুশীতে লাফিয়ে উঠল। তাই কালবিলম্ব না করে সে তড়িঘড়ি করে মক্কায় হাজির হলো। জায়েধ হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর সাথে থাকেন। তাই হারেসা সোজা মহানবী (সা)-এর বাড়ীতে গিয়ে উঠল।

মহানবী (সা)-এর বাড়িতে গিয়ে হারেসা ঠিকই জায়েদকে দেখতে পেল। অনেকদিন পর প্রাণাধিক পুত্রের মুখ দেখে হারেসার চোখ বেয়ে নেমে এলো আনন্দ অশ্রু। সে মহানবী (সা)-কে বলল,

: দেখুন নবীজি! জায়েদ আমার ছেলে, বুকের ধন, ও আমার হারিয়ে যাওয়া মানিক। আমি ওকে নিতে এসেছি। জায়েদকে দয়া করে ফিরিয়ে দিন। এ জন্য যা মূল্য চান আমি তা দিতে প্রস্তুত আছি। আপনি তো মহামানব। তাই না করবেন না। আমার ছেলে আমাকে ফিরিয়ে দিন।

মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর নবী। মানবতার দিশারি তিনি। মানুষের কল্যাণে তাঁর প্রাণ ছিল অবারিত, উদার। তিনি মানুষের প্রভু হতে আসেননি, এসেছেন মানুষের বন্ধু হয়ে। মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্তির সওগাত নিয়ে তিনি দুনিয়ায় এসেছেন। তিনি দয়া, মায়া, মমতা ও মানবতার অগ্রদূত। মা-বাবার কাছে সন্তানের যে মূল্য তা তিনি সম্যক অনুধাবন করতে পারেন। তাই জায়েদের পিতা হারেসার দুঃখ তিনি বোঝেন। জায়েদের জন্য কী মুক্তিপণ নেবেন মহানবী (সা)! বরং তিনিই তো মানুষকে তাঁর সর্বস্ব বিলিয়ে দেন।

এ ক্ষেত্রেও মানবতার দিশারি তার প্রমাণ দিলেন। জায়েদ তাঁর সেবক। শুধু সেবক বললে ভুল হবে। তিনি আল্লাহর নবী (সা)-এর খুবই প্রিয়জন। তারপরও মহানবী (সা) নিজের কথা ভাবলেন না। জায়েদকে তিনি সাহিমুখে হারেসার হাতে তুলে দিলেন। হারেসা তো হতবাক। এত সহজে ছেলেকে ফিরে পাবেন, তা ছিল হারেসার কল্পনারও বাইরে। মহানবী (সা)-এর উদারতা দেখে হারেসা আবেগে –কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হলো। তার খুশি আর কে দেখে? কারও হারানো পুত্র ফিরে পাবার আনন্দ ও তৃপ্তি যে কত মধুর তা ঐ মা-বাবা ছাড়া আর কারো অনুধাবন করাও কঠিন। আজ হারেসার মনের অবস্থাও তাই। পুত্র জায়েদকে পেয়ে হারেসার বুক ভরে গেল। সে ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো।

এমন সময় ঘটল উলটো এক ঘটনা। জায়েধ এতক্ষণ ধরে সবই শুনছিল। এবার সে বেঁকে বসল। তার এক কথা, রাসুল (সা)-কে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। জায়েদ বলল: আমি আমার বাবা ও মাকে পেয়ে গেছি। নবীজি আমার বাবা, খাদিজা (রা) আমার মা। তাঁরাই আমাকে সত্যিকারের আদর করেছেন। আমি বাবা-মাকে ছেড়ে কোথাও কারও কাছে যাব না।

বাবা হারেসা জায়েদের অনড় অবস্থা দেখে হতাশ হলেন। পুত্রকে অনেক করে বুঝালেন। কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না। এতে জায়েদের মন গলল না। অগত্যা সুখে মহানবী (সা)-এর সেবা করে যেতে লাগলেন। এভাবেই জায়েদ আজীবন মুহাম্মদ (সা)-এর কাছে থেকে গেলেন।

দেখতে দেখতে জায়েদ বড় হলেন। বিয়ে শাদির সময় হলে নবীজির আপন চাচাতো বোন জয়নাবের সাথে তাঁর বিয়ে দেয়া হলো। ফলে নবী পরিবারে সাথে জায়েদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হলো। জায়েদের এক ছেলে সন্তান ছিল। নাম উসামা। নবীজি তাকে বড্ড বেশি আদর করতেন। নবীজি তাঁর প্রিয় নাতি হাসান-হোসেনের মতোই উসামাকে ভালোবাসতেন।

মক্কা বিজয়ের দিনের ঘটনা। মহানবী (সা) উটে চড়ে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করলেন। তখন তাঁর সাথে উটের পিঠে বসেছিলেন উসামা। তা থেকেই বোঝা যায়, উসামা মহানবী (সা)-এর কত কাছের জন ছিলেন। মহানবী (সা)-এর গভীর ভালোবাসা পেয়ে জায়েদ বাবা-মাকে পর্যন্ত ভুলে যেতে পেরেছেন। মহানবী (সা)-এর ভালোবাসার কাছে জায়েদের সবই ছিল তুচ্ছ। জায়েদের কাছে মহানবী (সা) ছিলেন এক পরশ পাথর। তাঁর জাদুকরী ছোঁয়ায় জীবন বদলে গিয়েছিল জায়েদের। এভাবে আরও কত লাখো কোটি মানুষের জীবনকে আল্লাহর নবী (সা)-এর আদর্শ বদলে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই!

ব ল তে পা রো?

১। জায়েদ কে ছিলেন? তাঁর পিতার নাম কী?

২। একদিন বেড়াতে গিয়ে জায়েদের ভাগ্যে কী ঘটল?

৩। জায়েদের খবর কারা তার বাবাকে জানাল?

৪। জায়েদের পিতা মহানবী (সা)-কে গিয়ে কী বলেছিল?


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি