সত্যপিয়াসী সাহাবী হযরত তালহা (রা)
হযরত তালহা (রা) একজন বিশিষ্ট সাহাবীর নাম। একসময় তিনি ব্যবসার কাজে গিয়েছিলেন সিরিয়ায়। তাঁদের বাণিজ্য কাফেলা গিয়ে থামল এক বিশাল বাজারের পাশে। তাই সেখানে ছিল অনেক মানুষের ভিড়। কেউ ক্রেতা, কেউ বা বিক্রেতা। দূর-দূরান্ত থেকে এখানে ছুটে এসেছে লোকজন। হযরত তালহা (রা) এসেছেন সুদূর মক্কা থেকে। উট-ঘোড়া-গাধাগুলো বেঁধে কাফেলার লোকজন ঢুকল বাজারে। হযরত তালহা (রা) লোকের ভিড় ঠেলে বাজারে একটি গলিপথ ধরে হাঁটছিলেন।

এমন সময় তাঁর কানে ভেসে এলো কোনো একজনের ভাষনের একটি আওয়াজ। তবে তা অস্পষ্ট হওয়ার কারণে তিনি কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলেন না। তিনি এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলেন, খানিকটা দূরে একটু উঁচুস্থানে দাঁড়িয়ে একজন লোক হাত নেড়ে নেড়ে কিছু একটা বলছে। পাশে অনেক লোকের একটা জটলাও দেখা গেল। হযরত তালহা (রা) লোকটির দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি শুনলেন লোকটি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলছে, হে আমার ভাইয়েরা, এখানে কি মক্কার কোনো লোক আছে? তোমরা কি কোনো মক্কাবাসীর সন্ধান দিতে পার?

লোকটার কথা শুনে হযরত তালহা (রা) –এর মনে খটকা লাগল। কী ব্যাপার! লোকটা মক্কার অধিবাসী খুঁজছে কেন? আর সেখানকার লোক খুঁজতে এভাবে চিৎকার করেই বা বলতে হবে কেন? লোকটা কি কোনো সমস্যায় পড়ল, না কি সে কারও খোঁজ নিতে মক্কার লোক খুঁজছে? তালহা (রা) ভাবতে ভাবতে কয়েক কদম সামনে এগিয়ে গেলেন। তারপর হাত উঁচু করে লোকটার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন এবং বললেন,

: হ্যাঁ আমি আছি। আমি মক্কাবাসী। আমি কুরাইশ বংশের লোক। তুমি চাইলে আমাকে বলতে পার।

তালহা (রা)-এর কথা শুনে লোকটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তাঁর চোখেমুখে যেন স্বস্তির আভা ফুটে উঠল। মনে হলো লোকটা যেন বহুদিন খুঁজে মক্কার এ লোকটির সন্ধান পেয়েছে। তাই দেরি না করে লোকটি হযরত তালহা (রা)-এর দিকে এসে বলল,

: তুমি মক্কা থেকে এসেছ? আচ্ছা, তুমি কি বলতে পার, তোমাদের দেশে আহমাদ নামে কি কেউ আসছে?

কথা শুনে তালহা (রা) ভাবনায় পড়ে গেলেন। লোকটার প্রশ্ন নিয়ে ভাবেন আর অবাক হন। বারবার ভালো করে তাকিয়ে দেখেন লোকটাকে পাগল বলে মনে হয় না। তাঁর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছুও লক্ষ করা যায় না। লোকটার শরীরে পাদরীর পোশাক, মানে লোকটা ধর্মে খ্রিষ্টান। দেখতে দেখতে তালহা (রা) –এর মন উৎসুক হয়ে উঠল। তিনি এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলেন,

: আচ্ছা জনব, আহমাদের কথা কেন জানতে চাইলেন? সে কার ছেলে? কী তার পরিচয়?

: তা হলে শোন, বলছি। আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ। তিনি এ মাসেই মক্কায় আত্মপ্রকাশ করেছেন। তিনি শেষ নবী হয়ে এসেছেন।

: আবদুল্লাহর পুত্র আহমাদ! কই নামে কাউকে তো জানি না। এমন কারও নাম তো শুনিনি? নবী হবার এমন দাবির কথাও আমি জানি না। আচ্ছা, তুমি এসব জানলে কিভাবে? –তালহা (রা) প্রশ্ন করেন লোকটাকে।

: তা হলে মন দিয়ে শোন। আজ থেকে সাড়ে পাঁচশত বছর আগের কথা। দুনিয়ায় এসেছিলেন একজন নবী। নাম তাঁর ঈসা (আ)। আমরা তাঁকে যীশু বলে ডাকি। তাঁর ওপর এক আসমানী কিতাব নাজিল হয়েছিল। কিতাবের নাম ইঞ্জিল। এ কিতাবে মহান প্রভু আল্লাহতাআলার কাছ থেকে নাজিল হয়েছিল। এ কিতাবেই লেখা আছে আহমাদের নাম, তাঁর নবী হওয়ার কথা। এ রমজান মাসেই তি নবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন। ইঞ্জিলের এ কথা মিথ্যা হতে পারে না। অবশ্যই আহমাদ নামে একজন নবী আসবেন।

লোকটার কথা যতই শুনছিলেন তালহা (রা) ততই যেন অবাক হচ্ছিলেন। তাঁর সত্যসন্ধানী মনের গভীরে চলছিল তোলপাড়। ক্ষণিকের মধ্যেই তিনি উতলা হয়ে উঠলেন। তাঁর চোখেমুখে এক নূরানী আভা যেন জ্বলজ্বল করে উঠল। লোকটা তালহার এ পরিবর্তন গভীরভাবে লক্ষ্য করলেন। তালহা (রা)-এর মধ্যে এ অস্থিরতা দেখে লোকটা বললেন,

: হে যুবক! ব্যবসার কথা ভুলে যাও। এখনই চলে যাও মক্কায়। আহমাদ নামে লোকটিকে খুঁজে বের কর। তাঁর কথা শোন এবং তাঁর সাথেই থাক।

তালহা (রা) লোকটার কথা শুনতে শুনতে একসময় যেন চৈতন্য হারিয়ে ফেলেন। তাঁর মন চলে যায় সুদূর মক্কায়। এক ফাঁকে পাদরী কখন যে তাঁর দৃষ্টি থেকৈ ভিড়ের মাঝে হারিয়ৈ যান তিনি বলত পারেন না। তালহা (রা)-এর মন আবার উতলা হয়ে ওঠে। ব্যবসায় কাজে এসেছেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁর মন বসছে না। ঘুরেফিররে পাদরীর কথাই তাঁর মনে বারবার উঁকিবুকি মারে। আহমাদের খবর জানতে তাঁর মন অস্থির হয়ে ওঠে।

অবশেষে তালহা (রা) তাঁর কাফেলার সাথীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওয়ানা করেন মক্কায়। পথিমধ্যে যাকে পান তাকেই বলেন,

: তুমি কি মুহাম্মদকে চেন? তিনি নাকি নিজেকে নবী বলে দাবি করেছেন? তোমরা কি জান তাঁর ঠিকানা?

লোকজন তালহা (রা)-এর কথা শুনে অবাক হয়। কেউ বা বলে লোকটা পাগল নাকি? আরে কী বলে এসব? অনেকে আবার নানা কথা বলে যে যার কাজে চলে যায়।

এভাবে পথ চলতে তালহা (রা) একসময় নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। তাঁর মধ্যে উতলা উতলা ভাব। এক অজানা অস্থিরতা তাঁকে যেন ঘিরে রেখেছে। তাই স্বজনরা তাঁর চারপাশে এসে ভিড় করে। তাঁকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়। সবাই বলে, কী হলো ছেলেটার? কোন অঘটন ঘটেনি তো? কাফেলার লোকদের সাথে ঝামেলা বাধেনি তো? সবাই তাঁকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। তিনি তার কোনো জবাব দেন না। একসময় তালহা (রা) আত্মীয়দের বলেন,

: আচ্ছা, তোমরা কি আহমাদ নামে কাউকে চেন, কাউকে কি তোমরা নবী বলে দাবি করতে শুনেছ?

হযরত তালহার প্রশ্দন শুনে আত্মীয়-স্বজনরা সবাই তো হতবাক। তাদের সবার প্রশ্ন, একি কথা বলছে তালহা! ওর হলো কী? ও কার কথা বলছে? কেউ বা বলে ছেলেটার মাথা খারাপ হলো নাকি?

আপনজনরা তাঁকে সান্ত্বনা দেন। বিশ্রাম নিতে বলেন। কিন্তু তালহা (রা)-এর অস্থিরতা কাটে না। কারও সান্ত্বনা বা অভয় হযরত তালহাকে টলাতে পারে না। তাঁর কথা একটাই,

: তোমরা বলো, কে এই আহমাদ? তিনি কোথায়? তাঁর সন্ধান আমাকে দাও। এভাবে চলতে চলতে একদিন হঠাৎ একজন বলে ওঠে,

: তালহা! বলি শোন। জানতে পারলাম, হাশেমি বংশের ছেলে আবদুল্লাহর পুত্রের নাম নাকি মুহাম্মদ। শুনেছি, তিনি নিজেকে নবী বলে দাবি করছেন। তাঁর ওপর নাকি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী নাজিল হয়েছে!

লোকটর কথা শুনে চমকে ওঠেন তালহা। তা হলে পাদরীর কথাই কি সত্যি! তালহা (রা) অস্থিরভাবে জিজ্ঞেস করেন,

: আচ্ছা, কবে তিনি নবী দাবি করেছেন? তিনি কী বলেছেন, শুনি।

লোকটি বলল,

: শোন তা হলে, সেদিনের কথা। তুমি ব্যবসার কাজে সিরিয়ায় যাওয়ার পরপরই ঘটে গেল সেই ঘটনা। কি অবাক কাণ্ড! আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ (সা০ নিজেকে নবী বলে দাবি করলেন। এ নিয়ে যে কত কথা, কত আলোচনা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এটা নিয়ে নানাজন নানা কথা বলছে। অনেকেই মুহাম্মদ (সা)-এর কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। শুনলাম, আবু কোহাফার ছেলে আবু বকর (রা)ও নাকি তাঁর দলে যোগ দিয়েছে।

লোকটার মুখে মুহাম্মদ (সা)-এ খবর শুনে তালহা (রা)-এর মন উতলা হয়ে উঠল। হযরত আবু বকর (রা)-কে তিনি ভালো করেই জানেন। তাঁর সাথে হযরত তালহা (রা) –এর খুব জানাশোনা আছে। তাই তালহা (রা) তাঁর মন আর স্থির রাখতে পারলেন না। তিনি ছুটে গেলেন আবু বকর (রা)-এর কাছে। তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, শুনলাম, মুহাম্মদ (সা) নবী হয়েছেন, আপনি কি এ খবর জানেন?

: তুমি ঠিকই শুনেছ। আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ (সা) নবী হয়েছেন। তাঁর ওপর ওহি নাজিল হয়েছে। -জানালেন হযরত আবু বকর (রা)।

: তা হলে আপনিও কি তাঁর অনুসারী হয়েছেন?

: হ্যাঁ তালহা। তোমার অনুমান ঠিক। আমি কালেমা পড়ে মুসলমান হয়েছি।

একথা শুনে হযরত তালহা (রা)-এর মন কেঁপে উঠল। আবু বকর (র)-এর কথায় তালহা (রা)-এর মনের দুয়ার খুলে গেল। আবু বকর (রা) তালহা (রা)-এর মনের অবস্থা অনুমান করতে পারলেন। তাই তিনি বললেন,

: শোন তালহা! মিথ্যা ও অন্যায় আর কতকাল চলবে? মিথ্যার বেসাতি করে কী লাভ? মূর্তি পূজার কোনো মানে হয় না, বরং চলে এসো, এক আল্লাহর পথে। তাঁর দরবারে মাথা নত করাই শ্রেয়।

হযরত আবু বকর (রা)-এর কথা শুনে তালহা (রা) আর কিছুই বলতে পারলেন না। খানিকক্ষণ অপলক নেত্রে চেয়ে থাকলে আবু বকর (রা)-এর দিকে। তাঁর মনের গভীরে কী যেন এক তোলপাড় খেলে গেল। আবু বকর (রা) তালহা (রা) –এর পরিবর্তন লক্ষ করে মনে মনে মহান স্রষ্টা আল্লাহর শোকরিয়া জানালেন। আর দেরি না করে আবু বকর (রা) হযরত তালহা (রা)-কে নিয়ে মহানবী (সা)-এর দরবারে হাজির হলেন।

পথে যেনে যেতে তালহা (রা)-এর মনে আল্লাহর নবী সম্পর্কে কল্পনার নানা ফানুস উড়ছিল। তাঁর কোন কিছুই যেন সহ্য হচ্ছিল না। মহানবী (সা)-কে দেখে তাঁর অতৃপ্তির চোখ কখন জুড়াবেন, সে জন্যই যেন তাঁর এই অস্থিরতা। তালহা (রা) যখন মহানবী (সা)-এর সামনে গিয়ে হাজির হলেন, তখন সীমাহীন প্রশান্তির এক বেহেশতি আবেশ তাঁর দেহমন ছুঁয়ে গেল। তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। আর তখনই তিনি কালেমা শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম কবুল করে নিলেন, শামিল হয়ে গেলেন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে।

এভাবে হযরত তালহা (রা)-এর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হলো। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র সতের বছর।

ব ল তে পা রো?

১। হযরত তালহা (রা) ব্যবসার কাজে কোথায় গেলেন?

২। তালহা (রা) বাজারে গিয়ে কী শুনতে পেলেন?

৩। লোকটি কার খোঁজ করছিল?

৪। লোকটি তালহা (রা)-কে কার ব্যাপারে কী বলছিল?

৫। হযরত তালহা (রা) কিভাবে মুহাম্মদ (সা)-এর কথা জানতে পারলেন?

৬। আবু বকর (রা) তালহাকে কী বললেন?

৭। কত বচর বয়সে তালহা (রা) ইসলাম কবুল করেন?


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি