দৃপ্ত ঈমানের ফুলকি
নাম হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা)। দুরন্ত সাহসী এক সাহাবী। অত্যন্ত মেধাবী ও অসাধারণ জ্ঞানী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। তবে স্বভাবে ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও অতিশয় দীনহীন। তিনি খুব সাধারণবাবে জীবনযাপন করতেন। তাঁর জীবনচলায় বাহুল্য বলতে কিছু ছিল না। জাঁকজমক ও চাকচিক্য তিনি মোটেও পছন্দ করতেন না। কোনো রকমে চলতে পারলেই তিনি খুশী হতেন।

একদিনের ঘটনা

শাম দেশের ফাহলে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। মুসলিম বাহিনী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। খ্রিষ্টান রোমানরা ছিল মুসলমানদের প্রতিপক্ষ। তারা মুসলিম বাহিনীর রণ-প্রস্তুতির কতা শুনে ঘাবেড় গেল। রোমানরা ভাবল মুসলমানদের সাথে এখনই যুদ্ধ করা সমীচীন হবে না। তাই রোমান সেনাপতি সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এলো।

মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি আবু উবাইদা (রা)। তখনকার যুগের সেনাপতি অত্যন্ত দক্ষ ও পারদর্শী সেনাপতি হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। সুনিপুণ যুদ্ধ বিশারদ হিসেবে আবু উবাইদার নাম সর্বত্র আলোচিত হতো। আর মুয়াজ (রা)? তিনিও একজন দক্ষ সমরবিদ ও পারদর্শী কূটনীতিক হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। জ্ঞান, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞায় তিনি ছিলেন অনন্য। তাই সেনাপতি উবাইদা (রা) রোমানদের সাথে আলোচনার জন্য মুয়াজ (রা)-এর নাম ঠিক করলেন। সন্ধি স্থাপনের বিষয়টি যে কারোর পক্ষে আলোচনা করা সমীচীন নয়। এর জন্য চাই জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ কূটনীতিক। এ ক্ষেত্রে হযরত মুয়াজই ছিলেন এগিয়ে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা) সময়মত রোমাদন সেনা ছাউনিতে গিয়ে হাজির হলেন। কিন্তু তাঁবুতে পা রেখেই অবাক হলেন তিনি। অতিশয় জাঁকজমক ও চাকচিক্য করে সাজানো হয়েছে সেই তাঁবু। সেখানে বিছানো হয়েছে সোনালী কারুকাজ করা গালিচা। দেখে মনে হলো, এটা যেন এক বাদশাহি বালাখানা।

একজন পদস্থ রোমান সৈনিক তাঁবুর গেটে হযরত মুয়াজকে সাদর সম্ভাষণ জানাল। তারপর রীতি অনুযায়ী তাঁকে তাঁবুর ভেতরে নিয়ে গেল। একটি অনিন্দ্য সুন্দর আসনে নিয়ে তাঁকে বসানো হলো। এসব আয়োজন হযরত মুয়াজের মোটেও পছন্দ হলো না। তাই তাঁর চোখে-মুখে বিরক্তির ভাব পরিলক্ষিত হলো। তিনি বললেনঃ দেখুন ভাই, আমি এসব রাজকীয় জাঁকজমক পছন্দ করি না। কারণ, দরিদ্র মানুষকে শোষিত ও বষ্ণিত রেখে এসব দামি আসন বানানো হয়েছে। একথা বলেই তিনি মাটির ওপর বসে পড়লেন। মুয়াজের অবস্থা দেখে খ্রিষ্টানরা তো হতবাক। একজন সেনা তাই বললঃ আপনি এক মহান ব্যক্তি। আপনি দেশেল নামীদামী লোক। চারদিকে আপনার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। অনেকেই আপনাকে সম্মান করে। আমরাও আপনাকে অসম্ভব সম্মান করি। তাই সম্মানজনক স্থানেই আমরা আপনাকে বসাতে চাই। অথচ আপনি তা পরিহার করলেন?

খ্রিষ্টান সৈন্যের কথা শুনে মুয়াজ (রা) মুচকি হাসলেন। তারপর বললেনঃ শোন সেনারা! তোমরা আমাকে অনেক বড় বলে জানলেও আমি কিন্তু তা নই। আমি অতি সাধারণ ও নগণ্য মানুষ মাত্র। অত সম্মান ও চাকচিক্য আমার প্রয়োজন নেই। আর তাই মাটিতে বসতেও আমার অসুবিধা নেই।

হযরত মুয়াজের কথা শুনে খ্রিষ্টানরা আরেকবার বিস্মিত হলো। তারা বলল, কী অবা কথা বলছেন আপনি! আপনি তো অনেক বড় মাপের মানুষ। আপনি মোটেও সাধারণ নন। তাই মাটিতে বসা আপনাকে মানায় না। মাটিতে তো বসবে দাসেরা।

খ্রিষ্টানদের কথা শুনে মুয়াজ (রা) আরেকবার হাসলেন। তিনি মনে মনে বললেন, তোমরা জান না সৈন্যরা, এ মুয়াজই আল্লাহর বড় দাস। আর এ দাসের কোন বিলাসিতা নেই। এবার হযরত মুয়াজ (রা) দৃঢ়ভাবে বললেন: ভাই, তোমরা ঠিকই বলেছ। মাটিতে বসা দাস শ্রেণীর লোকদেরই কাজ। সমাজে ওরা ছোট, তাই ওরা মাটিতে বসে। আমিও যে আল্লাহর খুবই নগণ্য এক দাস। তাই মাটিতে বসতে পারায় আমি ধন্য হয়েছি।

হযরত মুয়াজ (রা) নিজেকে দাস বলে স্বীকৃতি দেয়ায় খ্রিষ্টানরা অবাক হলো। তাই তারা বিস্ময়ের সাথে হযরত মুয়াজের মুখের দিকে অনেকক্সণ অপলকনেত্রে তাকিয়ে রইল। তাদের বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটে না। তাই হযরত মুয়োজের প্রতি তাদের কৌতুহল আরও বেড়ে গেল।

:আপনার চেয়েও বড় ও মর্যাদাবান ব্যক্তি কি আপনাদের মধ্যে আরও কেউ আছে? –জিজ্ঞেস করল খ্রিষ্টানদের একজন।

: কী বলছ তোমরা? আমি মর্যাদাবান? কে বলল তোমাদের? অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন হযরত মুয়াজ (রা)।

: মুসলমানদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে নিকৃষ্ট। আমার মতো অধম আর কেউ নেই। -মুয়াজ (রা) আবারো জানালেন।

এবার খ্রিষ্টানদের বিস্ময় আরও একবার বেড়ে গেল। হযরত মুয়াজের কথাবার্তা শুনে তারা বেশ ভাবনায় পড়ে গেল। মুসলমানদের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সামর্থ্য নিতে তাররা চিন্তায় পড়ে গেল। মুসলমানদের আচরণ, ঐতিহ্য ও উদারতা তাদের মনকে নাড়া দিল। তারা আরও ভাবনায় পড়ল মুসলমানদের সাহস ও বীরত্ব নিয়ে। ফলে রোমানদের মদেন ভয়ের উদ্রেক হলো। তারা ভাবল, হযরত মুয়াজই যদি একজন সাধারণ মানুষ হন, তা হলে মুসলমানদের না জানি আরও কত অসাধারণ মানুষ আছেন! এমন অসাধারণ ও খোদাভীরু মুসলিম বাহিনীর সাথে লড়াই করা মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু। এদের সাথে যুদ্ধ করে জয়লাভের চিন্তা করাও বোকামী। তাই রোমানরা হযরত মুয়াজের সাথে সন্ধি স্থাপন করাকেই শ্রেয় বলে মনে করল। ফলে ভয়ানক যুদ্ধের আশঙ্কা আপাতত কেটে গেল।

হিজরী পনের সনের আরেকটি ঘটনা। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠায় ইয়ারমুক ময়দান কেঁপে উঠল। একদিকে মুসলিম বাহিনী, অন্যদিকে ইসলামবিরোধী কুফরী শক্তি। ভয়ানক যুদ্ধ চলছে ইয়ারমুকে। কুফরের দল সর্বশক্তি নিয়ে মুসলমানদর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্বে আছেন হযরত মুয়াজ (রা)। যুদ্ধ পরিচালনা করছেন তিনি। মুসলিম সেনারা প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পড়ল। শত্রুপক্ষ বেশ শক্তিশালী। তাদের মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়ল। তারপরও আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে লড়ছে হযরত মুয়াজের সেনারা। সবার মধ্যে ছিল অদম্য সাহস ও আল্লাহতাআলার ওপর অপার ভরসা।

সেনাপতি মুয়াজ (রা) আল্লাহর ওপর দৃঢ় আস্থাশীল। ঈমানের দৃঢ়তা ও সত্যের পাহাড়সম শক্তি তাঁর বুকে অসীম ফুলকি ছড়াচ্ছে। হযরত মুয়াজের স্বপ্ন আল্লাহর দ্বীনের গোলাপের পাপড়িতে ভরা। আল্লাহর মদদ যে হযরত মুয়াজের সাথে আছে তা তিনি ভালো করেই জানেন। তাই শত্রুরা প্রবল গতিতে ছুটছে দেখেও সেনাপতি বিচলিত হলেন না।

হযরত মুয়াজ (রা) এতক্ষণ তাঁর ঘোড়ার পিঠে সওয়ার অবস্থায় ছিলেন। তিনি সবকিছু গভীর মনোযোগসহকারে দেখছিলেন। আর যুদ্ধের কৌশল নিয়ে ভাবছিলেন। এবার তিনি ঘোড়া থেকে নেমে মাটিতে পা রাখলেন। তার সাথেই লড়তে এসেছে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র। হযরত মুয়াজ ঘোড়াটি পুত্রের জন্য ছেড়ে দিলেন। মুয়াজ এবার নিজ পুত্রকে সাথে নিয়ে জ্বলে উঠলেন। প্রচণ্ড সাহস ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে হযরত মুয়াজ (রা) শত্রুদের মোকাবেলা করলেন। তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল মুসলিম সেনারা। ফলে ক্ষণিকের মধ্যেই পাল্টে গেল ইয়ারমুক ময়দানের দৃশ্য। হযরত মুয়াজ রোমান বাহিনীর ব্যূহ ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়লেন।

সেদিন প্রাণপণে লড়লেন মুয়াজ (রা)। তাঁর সাহসের ফুলকিতে শত্রুরা পিছু হটতে শুধু করল। ফলে ইয়ারমুকে বিজয়ী হলো মুসলিম বাহিনী। শত্রুদের অনেকেই মারা পড়ল। কেউ বা বন্দী হলো। যারা ময়দান ছেড়ে পালাতে পারল, তারা জানে বেঁচে গেল।

হযরত মুয়াজের সাহসের আগ্নেয়গিরি ক্ষণিকের মধ্যে রোমান বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত করল। তাঁর সাহস ও আল্লাহর মদদে শত্রুদের সব বাধা তছনছ হয়ে গেল। ফলে আল্লাহর সৈনিকদের মুখে হাসি ফুটল। স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো ছিল এই হাসি। হযরত মুয়াজর দৃপ্ত ঈমানের ফুলকির কাছে মিথ্যার পাহাড় ভেঙেচুরে মিশে গেল।

ব ল তে পা রো?

১। ফাহলের যুদ্ধে মুসলিম সেনাপতি কে ছিলেন?

২। হযরত মুয়াজ কেমন লোক ছিলেন?

৩। হযরত মুয়াজ মাটিতে বসে কী উক্তি করেছিলেন?

৪। ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলিম সেনাপতি কে ছিলেন?

৫। ইয়ারমুকে কারা পরাজিত হলো?


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি