চতুর্থ অধ্যায়

ইসলামী জীবন ব্যবস্থা
ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত জীবন

আধ্যাত্মিক জীবন

বুদ্ধিভিত্তিক জীবন

বাহ্যিক জীবন

পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা

খাদ্য

পোশাক-পরিচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা

খেলাধুলা, চিত্ত বিনোদন ও উৎস

ইসলামের সামাজিক জীবন

সকল মানুষ সমান

পারিবারিক জীবন ইসলামী সমাজের মূলভিত্তি

নারীর মর্যাদা

সামাজিক দায়িত্ববোধ

ইসলামী সমাজের লক্ষ্য

ইসলামী আইন ব্যবস্থাঃ শরিয়ত

শরিয়তের উৎস

ইসলামী আইনের বৈশিষ্ট্য

ইসলামের অর্থনীতি

উপার্জন

ব্যয়

যাকাতের ব্যবস্থা

ব্যক্তিমালিকানা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা

সুদকে হারাম ঘোষনা উত্তরাধিকার আইন (মিরাস)

ইসলামের রাজনীতি

আল্লাহর সার্বভৌমত্ব

কুরআন ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান

খেলাফত

পরামর্শের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন ও দেশ শাসন

সরকার ও জনগণের দায়িত্ব

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ইসলামের মাধ্যমেই সম্ভব

অমুসলিমদের অধিকার

ইসলামী জীবন ব্যবস্থা

ইসলাম নিছক কোন ধর্ম নয়। কতকগুলো বিশ্বাস কিংবা আচার-আচরণের নামও ইসলমান নয়। মানুষের পুরো জীবনের জন্য আল্লাহর দেয়া একটি ব্যবস্থা হলো ইসলাম। পুরো জীবন অর্থঃ তার ব্যক্তি জীবন, সামাজিক জীবন, আর্থিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন-সবকিছু। তাই ইসলামের আলোকে একটি জীবন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। আমরা সংক্ষেপে এই জীবন ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করছি। বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই তবে এই আলোচনার মাধ্যমে তোমাদের মদ্যে ইসলামের পুরো জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হোক এটাই আমাদের কাম্য।

ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত জীবন

ইসলাম একান্ত ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও বিশদভাবে আলোচনরা করে। এক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো –কোন মানুষই তুচ্ছ কোন সৃষ্টি নয়। এমনকি কোন উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি নয়। তাই ব্যক্তি তার নিজ ইচ্ছায় নিজকে ধ্বংস করবে, নিজকে বিপথগামী করবে কিংবা নিজ সম্পর্কে উদাসীন হবে এমন কোন সুযোগ ইসলাম দেয় না। কোরআন বলেঃ

হে প্রভু তুমি আমাকে অর্থহীন ও উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি করোনি।

সূরা আলে-ইমরান-১৯১

এই চেতনা ব্যক্তিকে নিজের সম্পর্কে সচেতন করে। এমনিভাবে ব্যক্তির মধ্যে সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টির জন্য ইসলাম সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। কেননা যে কোন জীবন পদ্ধতির মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো ‘ব্যক্তি’ এবং এই কারণে ইসলাম সব সময় ব্যক্তি থেকে তার যাত্রা শুরু করে।

মানুষের রয়েছে দু’টি প্রকৃতি –একটি অভ্যন্তরীণ যা দেখা যায় না এবং অন্যটি হলো বাহ্যিক যা দেখা যায়। ইসলাম এ দু’টি সত্তাকেই গুরুত্ব দেয়। এ দুটি সত্তা পরস্পর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, সম্পৃক্ত এবং পরিপূরক। ইসলাম এ দুটি সত্তার ভারসাম্যপূর্ণতার মাধ্যমে ব্যক্তি গঠন করতে চায়।

মানুষের ভিতরের যে পরিচয় তাকে আবার দুটি জিনিসে ভাগ করা যায় –একটি ‘রুহ’ (আত্মা, খুদি বা কলব) অন্যটি ‘আকল’ (মন, যুক্তি বা বুদ্ধিবৃত্তি) ইসলাম এই দুইটি প্রকৃতির খোরাক যোগায়।

আধ্যাত্মিক জীবন

ইসলাম আত্মার প্রশান্তির জন্য যে ব্যবস্থা তা নিম্নরূপঃ

১। নামায

২। যাকাত

৩। রোযা

৪। হজ্ব

৫। খোদা ও রাসূলের প্রতি ভালবাসা

৬। খোদার প্রতি আস্থাশীলতা

৭। নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর পথে আত্মদান

এসব দিয়ে বিশদ আলোচনা ইতিপূর্বে হয়েছে। এসব কিছুর অনুশীলনের মাধ্যমে ইসলাম মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করতে চায়।

বুদ্ধিভিত্তিক জীবন

আর বুদ্ধির খোরাকের জন্য ইসলাম মানুষকে জ্ঞান অর্জনের জন্য উৎসাহিক করেছে। অভিজ্ঞতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের জন্য ঐশী আদেশ কোরআনই প্রথম দিয়েছে মানুষকে।

কোরআন মানুষকে তার প্রতিটি কর্মকে জেনে বুঝে করার জন্য অনুপ্রাণিত করেনা বরং বুদ্ধি ও জ্ঞানের উপর গুরুত্ব দিয়ে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও আস্থা জ্ঞাপন করেছে। কেননা মানুষের ভিতরের আত্মা ও মন সুস্থ ও নিরাপদ হলেই প্রকৃতপক্ষে বাইরের দিকটা অনুরূপ সুস্থ ও নিরাপদ হতে পারে।

তাই মুসলমানদের জন্য একান্ত প্রয়োজনঃ

নিয়মিত কোরআন অধ্যয়ন
হাদীস অধ্যয়ন
নবী-সাহাবীদের জীবন অধ্যয়ন
কোরআন হাদীসের আরোকে লেখা ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন
এছাড়া একজ মুসলমানের জন্য বর্তমান দুনিয়ায় কোথায় কি ঘটছে তা জানা থাকা একান্ত প্রয়োজন।

এমনিভাবে গড়ে উঠে মুসলমানদের এক বুদ্ধিভিত্তিক জীবন –যা তাকে করে জ্ঞান ও বিজ্ঞান সমৃদ্ধ, নিজের আদর্শের প্রতি অবিচল। সেই সঙ্গে এই জ্ঞান তাকে তার আদর্শের একজন নিষ্টাবান প্রচারক হিসেবে গড়ে তুলে।

বাহ্যিক জীবন

ব্যক্তির বাহ্যিক সুন্দর করার জন্য পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা, খাদ্য-সামগ্রী, পোশাক, আচার-ব্যবহার, সাজ-সজ্জা এসব সম্পর্কে ইসলাম সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে ভুল করেনি।

১। পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা

পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে ইসলামের বিধানগুলো শুধু তার দৈহিক পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার জন্য নয় তার মানসিক পবিত্রতার জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। দিনে অন্ততঃ পাঁচবার ওজু (প্রয়োজনে গোসল), নিয়মিত দাঁত মাজা, চুল ছাঁটা এসব স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ তা আজ সকলের কাছে পরিস্কার। আর ইবাদত হিসেবে পালন করে এসব স্বাস্থ্য রক্ষার বিধান পরিণত হয়েছে আরও মহিমান্বিত ও চমৎকার এক একটি পবিত্র কাজে।

২। খাদ্য

মানুষ যা খায় তার সাথে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক সরাসরি। খাদ্যের সাথে শুধু তার দেহের সম্পর্ক নয়, মনেরও সম্পর্ক আছে। তাই ইসলাম ব্যক্তির খাদ্য ও পানীয় দ্রব্যেল জন্য নিয়ম নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে খাদ্য হতে হবে স্বাভাবিকভাবে পবিত্র, মানুষের জন্য কল্যাণকর। খাদ্যের পরিমাণের ব্যাপারেও তা হতে হবে মধ্যম।

কোরআন বলেছে,

হে মানুষ! জমীনে যে সব হালাল ও পবিত্র দ্রব্যাদি রয়েছে তা খাও এবং শয়তানের দেখানো পথে চলোনা, সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।

সূরা বাকারা-১৬৮

যেসব খাদ্য ও পানীয় খাওয়া বা পান করা যায় সেসবকে বলা হয় ‘হালাল’ এবং নিষিদ্ধ খাদ্য ও পানীয়কে বলা হয় ‘হারাম’।

৩। পোশাক-পরিচ্ছদ ও সাজ-সজ্জা

মানুষ আল্লাহর সুন্দরতম সৃষ্টি তাই পোশাকও হতে হবে সুন্দর ও শালীন। পোশাক শুধুমাত্র লজ্জাও উলঙ্গতা ঢাকার জন্য নয়। পোশাক মানুষের ব্যক্তিত্বকে সুন্দর করার একটি মাধ্যম।

কোরআন খুব সুন্দরভাবে বলেছে,

হে আদম সন্তান, আমি তোমাদের জন্য পোশাক দিয়েছি যাতে করে তোমরা দেহের লজ্জাস্থানগুলো ঢাকতে পারো। এটি তোমদের শোভা বর্ধনের উপায়ও। আর সর্বোত্তম পোশাক হলো ‘খোদাভীতি’র পোশাক।

সূরা আল আরাফ-২৬

পোশাকের ধরণ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। ইসলাম কোন বিশেষ ধরনের পোশাকের কথা বলেনি। তবে কতগুলো নীতিমালার কথা উল্লেখ করেছে। সেগুলো হলোঃ

পুরুষরা নাভি থেকে হাঁটু অবশ্যই ঢেকে রাখবে।
মেয়েরা ঘরে মুখ, হাত, পায়ের পাতা ছাড়া সারা শরীর ঢেকে রাখবে কিন্তু বাইরে বের হবার সময় কিংবা পর পুরুষের সাথে দেখা করার সময় এই সাথে চোখের অংশ ছাড়া মুখমণ্ডল প্রায় সবটাই ঢাকবে। অবশ্য কোন কোন মাজহাব পুরো মুখ খোলা রাখার সুযোগ দিয়েছে।
মেয়েদের এমন কোন পোশাক পরা উচিত নয় যাতে তাদের দেহের অংশ দেখা যায় কিং বা প্রদর্শিত হয়।
খাঁটি রেশমী কাপড় কিংবা সোনর কাজ করা কাপড় পুরুষের জন্য নিষিদ্ধ।
পুরুষের মেয়েদের পোশাক পরা নিষেধ।
মুসলমানদের এমন সব পোশাক পরা উচিত নয় যেসব অন্য জাতি বা ধর্মের পোশাক হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত।
ইসলাম খুব সাধাসিধা পোশাক পরার জন্য উৎসাহিত করেছে। গর্ববোধ, অহমিকা কিংবা প্রদর্শনেচ্ছা জাগিয়ে তোলে এমন পোশাক পরিধান করা ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে।

মেয়েদের পোশাকের ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশে কোন কঠোরতা নেই বরং মেয়েদের স্বভাবের দিকে লক্ষ্য রেখে তাদের সম্ভ্রম ও শালীনতা রক্ষার জন্যই মেয়েদের সাজ-সজ্জা, সৌন্দর্য রক্ষা, হাঁটা-চলা এমনকি দৃষ্টি নিক্ষেপের ব্যাপারে ইসলাম নীতিমালা দিয়েছে। এই পুরো নীতিমালাকে একত্রে আমরা বলতে পারি ‘পর্দা প্রথা’।

৪। খেলাধুলা, চিত্ত-বিনোদন ও উৎসব

প্রিয় নবী দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য ও বলিষ্ঠ মনোবল গড়ে তোলার উপযোগী খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদনকে অনুমোদন করেছেন। মোটকথা যা কিছু মানুষের মধ্যে সুস্থ চিন্তার সৃষ্টি করে, তার মনকে সতেজ করে, শরীরকে সুস্থ রাখে ইসলাম তাকে উৎসাহিত করে। রাসূল (সঃ) একটি হাদীস থেকে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তিনি বলেছেন,

সকল মুমিনের মধ্যেই ভাল গুণাবলী আছে তবে,

শক্তিশালী ব্যক্তি দুর্বল ব্যক্তির চেয়ে শ্রেয়। (সহীহ মুসলিম, ইবনু মাজাহ)

ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের জীবন অত্যন্ত অর্থবহ। এর একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। জীবনকে যেমন তেমন করে কাটিয়ে দেয়া যায় না। আর তাই মানুষের জীবনকে সুন্দর করার জন্য ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকেও ইসলাম আল্লাহর নির্দেশে লাগাম টেনে ধরেছে। এই দৃষ্টিতেই ইসলামে জুয়া খেলা, মদ্যপান, লাগামহীন সময় অপচয় করে তাস খেলা প্রভৃতিকে নিষিদ্ধ করেছে। প্রকৃতপক্ষে এগুলির কোনটাই আনন্দদায়খ বা বিনোদনমূলক কাজ নয়।

ইসলামের উৎসব পালনও এই একই দৃষ্টিভঙ্গিতে হয়ে থাকে। ইসলামে উৎসব নিছক শুধু আনন্দের জন্য নয়। এসব উৎসবের মূল লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি। এমনি উদ্দেশ্য নিয়েই ইসলামের দুটি বড় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা পালিত হয়।

কবিতা, গান এসব ব্যাপারেও ইসলামের নির্দেশ একই ধরনের। মোকটথা, যে খেলাধুলা কিংবা চিত্তবিনোদন একটি মুহুর্তের জন্য হলেও বান্দাকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে রাখে মুমিন মুসলমানের জন্য তা কখনই আনন্দদায়ক, সুখকর কোনকাজ হতে পারে না। মুমিনের আনন্দতো আল্লাহকে পাওয়ার মধ্যে। তার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো আল্লাহর আইনকে দুনিয়ার বুকে কায়েমের উদ্দেশ্যে প্রতিটি কাজে এগিয়ে আসা।

ইসলামের সামাজিক জীবন

কোন লোকই একা বেঁচে থাকতে পারেনা। পিতা, মাতা, ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে তার যে পরিবার সেই পরিবার নিয়েও সে একা বাঁচতে পারেনা। তাকে আরও অনেকের সাথে মিশতে হয়, চলতে হয়, লেনদেন করতে হয়, মতের আদান প্রদান করতে হয়। মোটকথা, একটা সমাজের মধ্যে তাকে মিশে থাকতে হয়। পরিবার এবং সমাজরে মাঝে থেকে তার নিজের এবং সমাজের অন্যের উন্নতি, সুখ-শান্তির জন্য একজন মুসলমান আল্লাহ ও রাসূলের (স) শেখানো নীতিমালা অনুযায়ী চলে।

সকল মানুষ সমান

ইসলামী সামাজিক জীবনের মূলনীতি হলো দুনিয়ার সকল মানুষ সমান এবং সকলে একই পিতা-মাতা আদম (আ) ও হাওয়ার (আ) সন্তান। দুনিয়ার মানুষের কারো গায়ের রং কালো, কারো সাদা, কারো বাদামী। একেক জনের ভাষা একেক রকম। সামাজিক রীতি-নীতি, চাল-চলন একেক জনের একেক রকম। তবুও সব মানুষের মধ্যে প্রকৃত মানুষের অনুভূতি সৃষ্টি করে। এই অনুভূতি মানুষকে অন্যের অধিকার সম্পর্কে সজাগ করে তোলে। মানুষে মানুষে স্বাভাবিক যে পার্থক্য তাকেও স্বীকার করে নেওয়া হয়। আমরা দুনিয়ার সকল মানুষ এক আল্লাহর সৃষ্টি-একই পিতা-মাতার সন্তান –এই সত্যকে যখন স্বীকার করে নেওয়া হয় তখন একজন অন্যজনের ভাষা, অন্যের গায়ের রং, অন্যের সামাজিক রীতি-নীতিকে মর্যাদা দিতে শিখে। তাই কোরআন এবং হাদিসে বারবার একথাই স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। কোরআন বলেছেঃ

হে মানুষেরা! তোমাদের রবকে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে একটি ‘প্রাণ’ থেকে সৃষ্টি করেছেন।

সূরা নিসা-১

মুমিনরাতো পরস্পরের ভাই

সূরা হুজরাত-১০

এভাবেই ইসলাম বর্ণগত, ভাষাগত, বংশগত, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের দাবীকে নির্মূল করে প্রকৃত ভ্রাতৃত্বের পথকে সুগম করে তোলে।

অধিকারের দিক থেকে মর্যাদার দিক থেকৈ সকল মানুষ সমান এই নীতিমালার উপর ইসলাম গড়ে তুলতে চায় এক সুন্দর পরিবার, এক সুন্দর সমাজ, এক সুন্দর দেশ –গড়ে তুলতে চায় সুন্দর পৃথিবী।

পারিবারিক জীবন-ইসলামী সমাজের মূলভিত্তি

প্রকৃতপক্ষে পারিবারিক জীবন ইসলামী সমাজের মূল ভিত্তি। একটি সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য সমাজের প্রতিটি পরিবারকে সুন্দর করার পরিকল্পনা আছে ইসলামে। আর এজন্য পরিবারের স্বামীর ভূমিকা ও দায়িত্ব, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব, সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য –এ সব বিষয়ে ইসলাম সুন্দর ও কার্যকর শাশ্বত বিধানসমূহ স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহানুভূতি, সম্মানবোধ, শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ এবং সর্বোপরি সমঝোতার জন্য কোরআন যেসব বিধান দিয়েছে এবং আমাদের প্রিয়নবি (স) যেসব উজ্জ্বল উদাহরণ তুলে ধরেছেন যার নজির ইতিহাসে বিরল।

একটি সুন্দর পরিবার গঠনের জন্য দেয়া হয়েছে বিবাহের ব্যবস্থা, দেয়া হয়েছে পর্দার বিধান। এক একটি সুন্দর পবিত্র বাগান হিসাবে সমাজের সকল পরিবারকে গড়ে তুলতে চায় ইসলাম।

নারীর মর্যাদা

সমাজে নারীর একটি বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। একটি সুন্দর পরিবার গঠনে মাতা হিসাবে, স্ত্রী হিসাবে নারীর ভূমিকা অনন্য। ইসলাম নারীর এই মর্যাদাকে স্বীকার করে নিয়েছে। মাতা হিসাবে নারীর মর্যাদা ইসলাম ছাড়া আর কোন মতবাদ এতো গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেনি। প্রিয় নবী (স) বলেছেন,

মাতার পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশত।

স্ত্রী হিসাবে নারীকে নির্দিষ্ট মর্যাদা দিয়ে নবী (স) বলেছেন,

তোমাদের মধ্যে সেই সবচেয়ে উত্তম যে তার পরিবারের কাছে উত্তম।

কন্যা হিসাবে নারীর মর্যাদা ইষলাম সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে। (ইবনু মাজাহ, বিবাহ অধ্যায়)

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী পুরুষের মত আয় করতে পারে এবং সম্পদের মালিক হতে পারে। ইসলাম নারীকে উত্তরাধিকারের অধিকার দিয়েছে। পিতা, স্বামী অথবা তার পুত্রহীন ভাইয়ের স্মপত্তিতে তার অংশকে নির্দিষ্ট করেছে।

ইসলামই নারীকে তার প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিয়েছে। এবং নির্ধারিত সীমার মধ্য কাজ করার স্বাধীনতা দিয়েছে।

কোরআন বলেছে,

নারী পুরুষ দুজনকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেকের রয়েছ নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য।

সূরা আল-লাইল-৩-৪

প্রকৃতপক্ষে ইসলামই নারী ও পুরুষের মধ্যে সামাজক কাজক স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত ধর্ম অনুযায়ী ভাগ করে দিয়েছে। শরীরের দিক থেকে সবল ও মানসিক দিক থেকে সাহসী হবার কারণে জীবন সংগ্রামে যুদ্ধ করার যোগ্যতা দিয়ে পুরুষকে বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আর ভালবাসা, মায়া, মমতা প্রভৃতি দুর্লভ গুণাবলীর জন্য নারীকে দেয়া হয়েছে সমাজের আগামী দিনের নাগরিকদের গড়ে তোলার কঠিন ও মহৎ দায়িত্বটি।

এই প্রধান দায়িত্বের কথা উল্লেখ করার এই অর্থ নয় যে নারীদেরকে অন্য কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

ইসলামের ইতিহাস এর সাক্ষ্য। সন্তান পালন ও সংসারের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বের সাথে সাথে মুসলিম নারীদের দেখা গেছে যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্ন জিনিসপত্র বহন করতে, আহত ও অসুস্থ রুগীদের সেবা করতে, আহত রুগীদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে, এমন কি কখনো কখনো প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করতে। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম নারীকে তার সঠিক মর্যাদা দিয়েছে এবং প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকে অস্বীকার করেনি।

ইসলাম ছাড়া অন্য কোন মতবাদই নারীকে তার সঠিক মূল্য দিতে পারেনি। পাশ্চাত্যে নারী হচ্ছে আনন্দের সামগ্রী। ‘নারী স্বাধীনতার’ শ্লোগান দিয়ে পুরুষরা তাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে। পাশ্চাত্য সমাজে নারী স্বাধীনতা পায়নি, পায়নি সমান অধিকার। মাঝখান থেকে সে হারিয়েছে পরিবারে এবং সমাজে তার স্বাভাবিক সহজাত মর্যাদা ও অধিকারকে।

সামাজিক দায়িত্ববোধ

ইসলাম মানুষকে স্বার্থপরতা ত্যাগ করতে শিখায়। সমাজের প্রতি রয়েছে প্রতিটি ব্যক্তির দায়িত্ব। অন্যের জন্য চিন্তা-ভাবনা করা, অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসা, অন্যেল জন্য অর্থব্যয়, একমনি সমাজের কল্যাণের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয়ার প্রেরণা দেয় ইসলাম। অন্যদিকে ইসলাম ব্যক্তির কল্যাণে এগিয়ে আসার জন্য সমাজকে দায়িত্ব দিয়েছে। এ এক সুন্দর সম্পর্ক। যখন ব্যক্তি সক্ষম থাকে তখন সে হয় দানকারী এবং সমাজ হয় দান গ্রহণকারী। আর ব্যক্তি যখন অক্ষম হয়ে পড়ে তখন তাকে নিরাপত্তা ও সহায়তা দানের দায়িত্ব সমাজের। এমনিভাবে ইসলামী সমাজে কোন ব্যক্তি অন্যের ব্যাপারে উদাসীন হতে পারেনা –হতে পারেনা স্বার্থপর। সে এমন কোন কাজও করতে পারেনা যাতে সমাজের কোন প্রকার ক্ষতি হয়। বরং নিজের জন্য যা পছন্দ করা হবে অন্যের জন্য তাই করতে বলা হয়েছে। (আল হাদিস)

ইসলামী সমাজের লক্ষ্য

সকল মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা এবং পারস্পরিক দায়িত্ববোধের ভিত্তিতে যে ইসলামী সমাজ গড়ে উঠে সে সমাজে কোন বিশেষ ব্যক্তির, কোন বিশেষ বংশের, কোন বিশেষ গোত্রের, কোন বিশেষ ভাষার মানুষের, কোন বিশেষ বর্ণের বা জাতির বড় হবার কোন উপায় নেই। সে সমাজের প্রধান লক্ষ্য হলো খোদার বন্দেগী এবং খোদার উদ্দেশ্য সফল করে তোলা ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে –মমত্ব, ভ্রাতৃত্ব, পারস্পরিক সম্মানবোধ, সত্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। ইসলামী সমাজ জীবনের উল্লেখযোগ্য মূল উপাদানগুলো হলোঃ সহযোগী লোকদের প্রতি ভালবাসা, ছোটদের প্রতি স্নেহ, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রতিবেশীর অধিকার সচেতনতা, আর্তের সান্ত্বনা ও সমবেদনা, রোগীর সেবা, জীবন, সম্পত্তি ও সম্মানের প্রশ্নে অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা। কোরআনের অনেক আয়াত ও রাসূলের (স) অনেক বাণীতে প্রতিটি মুসলমানকে এসব গুণাবল অর্জনের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে।

ইসলামী আইন ব্যবস্থাঃ শরিয়ত

যুগে যুগে নবী-রাসূলেরা এসেছেন। মানুষকে আল্লাহর উপর ঈমান আনতে বলেছেন –ঈমান আনতে বলেছেন আখিরাতের উপর, কিতাবের উপর। বলেছেন সব পথ ছেড়ে আল্লাহর এবং নবী-রাসূলদের দেখানো পথে চলতে, তাঁদের আনুগত্য করতে –তাঁদেরকে অনুসরণ করতে। এই ঈমান ও এবাদতের নাম হচ্ছে দ্বীন। সব নবীর দ্বীন ছিল এক। সব নবীর শিক্ষা এক। কিন্তু এবাদতের পদ্ধতি কি, সামাজিক রীতিনীতি কি হবে, পারস্পরিক লেনদেন ও সম্বন্ধ রক্ষার বিধান কি, কোনটা হালাল, কোটনা হারাম, কোনটা করণীয়, কোনটা নয় –এর সবকিছু যুগের ভিন্নতার কারণে একেক নবীর জন্য একেক রকম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই মৌলিক দিক থেকে দ্বীন হলেও আল্লাহ নবী রাসূলদের মাধ্যমে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন কওমের জন্য এইসব দ্বীন পালনের বিভিন্ন রীতিনীতিও পাঠিয়ে দিয়েছেন। এইসব রীতি-নীতি, পদ্ধতি, বিধি-বিধানকে শরিয়ত বলে। শরিয়ত অর্থ সোজা পথ বা উদাহরণ। আমাদের জন্য শরিয়ত হলো মেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মাধ্যমে পাওয়া এবাদতের পদ্ধতি, সামাজিক রীতি-নীতি, পারস্পরিক আদান-প্রদান সংক্রান্ত আইন-কানুন, হালাল-হারামের সীমারেখা ইত্যাদি।

শরীয়তের উৎস

পবিত্র কোরআন হলো শরীয়তের মূল উৎস যেখান থেকে ইসলামের সকল পবিত্র রীতি-নীতি, আইন-কানুন নেওয়া হয়েছে। এটি হলো আল্লাহর কালাম যার প্রতিটি বিন্দু আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে। যা নবী করীম (স)-এর জীবনে ২৩ বছর ধরে অল্প অল্প করে নাজিল হয়েছে। আর নবী (স) হচ্ছেন এই কোরআনের বাস্তব উদাহরণ।

নবীর (স) সারাজীবন হলো কোরআনের ব্যাখ্যা। তাই শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস হলো নবীর ‘সুন্নাহ’। ‘সুন্নাহ’-এর শাব্দিক অর্থ পথ, ব্যবস্থা, নিয়ম-কানুন, কাজ করার পদ্ধতি, জীবন পদ্ধতি, উদাহরণ। ইসলামী পরিভাষায় ‘সুন্নাহ’ অর্থ নবী করীম (স)-এর জীবন ও কাজ।

‘হাদীস’ বলতে আমরা বুঝি নবীর কথা, কাজ এবং তার অনুমোদন নিয়ে করা কাজ। আমাদেরকে কিভাবে আল্লাহর মর্জি মত চলতে হবে সেসব কিছু নবী (স) শিখিয়ে গেছেন তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে। শুধু মুসলমানদের জন্যই নয় –সারা বিশ্বের জন্য এটি সৌভাগ্যের যে, আজও নবী করীম (স) এর জীবনের কথা ও কাজ মোটকথা পুরো জীবনের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো মানব জাতির জন্য সুন্দরভাবে সংরক্ষিত আছে।

নবীর (স) কথা তাঁর সংগী সাথীরা নিষ্ঠার সাথে স্মরণ রাখতেন। প্রতিটি নির্দেশ যত্নের সাথে শিখে নিতেন। এসব কথা সাহাবীদের কাছ থেকে মানুষ শুনেছে, মুখস্ত করেছ, কেহ তা লিখে রেখেছে। যার কাছে শুনেছে তার নামও লিখে রেখেছে। ক্রমে ক্রমে এসব বর্ণণা পুস্তকাকারে সংগৃহীত হয়েছে। এসব গ্রন্থকে ‘হাদীস’ বলে। যার ফলে নবীর (স) কথা ও কাজের বর্ণনা সংরক্ষণের ব্যাপারে কারও কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। কোন নেতার আদর্শকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁর অনুসারীদের নিষ্ঠার, আন্তরিকতার এমন উদাহরণ পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।

হাদীসের কিতাবের মধ্যে ছয়টি বিশেষভাবে নির্ভরযোগ্যঃ

১। সহীহ আল-বোখারী (মোহাম্মদ বিন ইসমাইল, ইমাম বোখারী (র) নামে পরিচিত, জন্ম ১৯৪ হিঃ মৃত্যু ২৫৬ হিঃ)

২। সহীহ মুসলিম (মুসলিম বিন আল হাজ্জাজ, ইমাম মুসলিম (রঃ) নামে পরিচিত, জন্ম ২০২ হিঃ মৃত্যু ২৬১ হিঃ)

৩। সুনানে আবু দাউদ (সুলাইমান বিন আসন্দ, আবু দাউদ (র) নামে পরিচিত, জন্ম ২০২ হিঃ মৃত্যু ২৭৫ হিঃ)

৪। সুনানে ইবনে মাজা (মোহাম্মদ বিন ইয়াজিদ (রঃ) জন্ম ২০৯ হিঃ মৃত্যু ২৭৩ হিঃ)

৫। জামি আত-তিরমীজি (মোহাম্মদ বিন ঈসা (র) জন্ম জানা নেই, মৃত্যু ২৭৯ হিঃ)

৬। সুনানে আন-নিসাঈ (আহমদ বিন সোয়ায়েব (র) জন্ম ২১৫ হিঃ মৃত্যু ৩০৩ হিঃ)

এছাড়া ইমাম মালিক এর (জন্ম ৯৩ হিঃ মৃত্যু ১৭৯ হিঃ) মুয়াত্তা, ইমাম আবু মুহাম্মদ আল হুসাইন বিন মাসউদ (মৃত্যু ৫১৬ হিঃ) এর মিশকাত আল মাসাবি এবং ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (জন্ম ১৬৪ হিঃ মৃত্যু ২৪১ হিঃ) এর মশনদ বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ হিসাবে প্রসিদ্ধ।

প্রকৃতপক্ষে কোরআনই শরিয়তের উৎস। ইসলামী আইনের মূলনীতি আমরা পাই কোরআনে আর সুন্নাহর মাধ্যমে পাই সেই আইনের বাস্তব প্রয়োগ বা প্রয়োগের উদাহরণ। উদাহরণস্বরূপ কোরআন বলেছে নামায কায়েম কর, রোযা পালন কর, যাকাত আদায় কর, পরস্পরের পরামর্শের ভিত্তিতে (শূরা) সিদ্ধান্ত নাও। কিন্তু কোরআন এসব কিভাবে পালন করতে হবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়নি। ‘সুন্নাহ’ই আমাদেরকে এ সব বিষয়ে সবিস্তারে জানায়।

ইসলামী শরিয়ত মানুষের জন্য। মানুষের উন্নয়নের জন্য। তাই শরিয়ত যুগের প্রয়োজনেই আইন-কানুন নীতি নির্ধারনের পথ বাতলে দিয়েছে। যুগের প্রয়োজনে এমন একটি বিষয় এলো যেখানে কোরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট কোন নির্দেশ নেই তখন ‘কোরআন’ ও ‘সুন্নাহ’ পারদর্শী আলেমগণ একত্রে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত কোনক্রমেই কোরআন ও সুন্নাহর মূল আদর্শ ও নীতির পরিপন্থী হতে পারবে না। একে বলে ‘ইজমা’। ‘ইজমার’ শাব্দিক অর্থ ‘সর্বসম্মত’। খোলাফায়ে রাশেদার যুগ থেকে ‘ইজমা’ চালু হয়েছে।

একটি বিশেষ অবস্থা বা নীতির সাথে মিল রেখে, সম্পর্ক রেখে অন্য একটি বিশেষ সমস্যার সমাধানের নিয়মকে বলে ‘কেয়াছ’। কেয়াছ অর্থ উপমা, একই ধরনের অবস্থার ভিত্তিতে যুক্তি বা দর্শন। তাই ‘ইজমা’ ও ‘কেয়াছ’ এ দু’টিও শরিয়তী আইনের দুটি উল্লেখযোগ্য ভিত্তি।

ফিকাহ

‘কোরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে ইসলামী আইন-কানুন, বিচার ব্যবস্থা, শাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত গ্রন্থরাজিকে বলা হয় ‘ফিকাহ’। আলেম সমাজের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফরে এই ফিকাহ শাস্ত্র তৈরী হয়েছে। মুসলমানদের জন্য এটি একটি বিরাট সম্পদ। ইসলামী আলেম, বিশেষজ্ঞদের এই মহান ত্যাগের ফলেই আজ কোটি কোটি মুসলমানদের পক্ষে কোরআন ও সুন্নাহর সূক্ষ্ম তত্ত্ব জানা না থাকলেও কোরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবন পরিচালনা করার কাজটি সহজ করে দিয়েছে ‘ফিকাহ’।

ইসলামী আইন-কানুনের চারজন বিখ্যাত সংকলক হচ্ছেন

১। ইমাম আবু হানিফা (র) (৮০-১৫০ হিঃ)

২। ইমাম মালেক (র) (৯৩-১৭৬ হিঃ)

৩। ইমাম শাফেয়ী (র) (১৫০-২৪০ হিঃ)

৪। ইমাম হাম্বল (র) (১৬৪-২৪১ হিঃ)

তাঁদের চিন্তা, গবেষনা ও উপলব্ধি ছিল সত্যকে জানার জন্য, উদ্দেশ্য ছিল মহান ও মুসলমানদের কল্যাণে নিবেদিত এবং স্বাভাবিক ভাবেই তাই তাঁদের মতামত, গবেষণা, চিন্তা-ভাবনার মধ্যে কম-বেশী পার্থক্য থাকবেই। পার্থক্য থাকলেও মুসলিশ উম্মাহ এই চার মহান আলেমের চার ফিকাহকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছেন। আমরা শরিয়তী আইনের ক্ষেত্রে এই চার তরিকার যে কোন একটি তরিকাকে মেনে নিতে পারি। কিন্তু চার রকমের তরিকা একত্রে আনুগত্য করা চলতে পারে না। অনেক আলেম আবার এ মতও পোষণ করেন যে, এ চার তরিকার কোন বিশেষ ফিকাহর আনুগত্যের প্রয়োজন নেই। বরং আন্তরিকতার সাথে কোরআন ও সুন্নাহর বিধান বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। আর যাদের জ্ঞান তত গভীর নয় তাদের উচিত আস্থাভাজন কোন আলেমের আনুগত্য করা। এদেরকে বলা হয় ‘আহলে হাদীস’। এই তরিকা উপরের চার তরিকার মতই সঠিক।

শরিয়তের উদ্দেশ্য

এতোক্ষণের আলোচনা থেকে এটাই স্পষ্ট হলো যে, শরিয়ত ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে জীবন যাপনকে বাস্তব রূপ দিয়েছে। ইসলাম হলো পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান এবং শরিয়ত হলো ইসলামের অনুমোদিত আদর্শ জীবনে বাস্তবায়নের পথ। শরিয়ত আমাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ দেখিয়ে দেয়। শরিয়তের বিধি-বিধানকে উপেক্ষা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয় যায় না। শরিয়তের বিধি-বিধানের সাথে সম্পর্ক নেই এমন কোন অভিনব পন্তায় আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার চেষ্টা করায় কোন লাভ নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় অনেকে নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাতের আনুগত্য মুক্ত হয়ে নিজেদের মনগড়া পন্থায় আল্লাহকে পাওয়ার পথ খুঁজছেন। এটি সম্পূর্ণরূপে ভুল। আল্লাহ ও রাসূলের (স) দেখানো পথের সাথে এর কোন সম্পর্ক থাকতে পারেনা।

ইসলামী আইনের বৈশিষ্ট্যঃ

শরিয়তের ভিত্তি, উদ্দেশ্য এবং উৎসের দিকে লক্ষ্য করলে মানুষের তৈরী আইন ও ইসলামী আইনের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মানুষের তৈরী আইনের কোন স্থির ভিত্তি নেই। একেক সমাজের জন্য, একেক জাতির জন্য, একেক সম্প্রদায়ের জন্য তা একেক রকম হতে পারে। ফলে একটি সমাজের জন্য যা উপকারী, অন্য একটি সম্প্রদায়ের জন্য তা জুলুম হতে পারে। যে সমাজে যে সম্প্রদায়ের কর্তৃত্ব সে সমাজে সে সম্প্রদায়ের আইন চলে। সেখানে অন্যদের কার কি কষ্ট হচ্ছে তা দেখার কোন দরকার নেই। তাই আমরা দেখতে পাই দেশের মুষ্টিমেয় লোকের প্রতিনিধিত্বকারী পার্লামেন্ট ধনীদের স্বার্থে ট্যাক্স বাড়াচ্ছে। যদিও এর ফলে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কষ্ট বাড়ছে। এইসব আইন তৈরী করে মানুষ। অপরদিকে ইসলামী আইনের উৎস হলো আল্লাহর বিধান। সেই আল্লাহ যিনি মানুষের সৃষ্টিকর্তা, যার কাছে দুনিয়ার প্রতিটি জাতি সমান, ধনী গরীব সকলে এক। তাই ইসলামী আইন সকল মানুষের জন্য, সকল জাতির জন্য এক ও অভিন্ন। পুরনের নিশ্চয়তা আছে, তেমনি আছে অন্য মানুষের –তার আত্মীয়, তার প্রতিবেশী, তার জাতির লোক, দুনিয়াবাসী সকলের অধিকার হেফাজতের ব্যবস্থা।

ইসলামের অর্থনীতি

মানুষকে দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে হলে প্রয়োজন খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষার এক সুষ্ঠু ব্যবস্থা। তাই উপার্জন করা এবং ব্যয় করা দুটোই মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় দিক। মোটকথা, ‘অর্থ’ মানুষের জীবনের একটি দরকারী জিনিস। তাই বলে অর্থ বা টাকা পয়সাই জীবনর সব নয়। আমাদের জীবনের আছে এক মহৎ উদ্দেশ্য। আমরা দুনিয়ায় আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা। আমাদের যেমন রয়েছে দেহ তেমনি রয়েছে মন, বিবেক।

ইসলাম মানুষের জীবন পথের সন্ধান দিয়েছে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দিয়েছে নির্দেশনা, দেখিয়েছেন চলার পথ। ইসলাম তাই মানুষের জীবনের আর্থিক দিককে অবহেলা করেনি। উপার্জন, ব্যয় এবং অর্থের ব্যবহার সম্পর্কে ইসলামে রয়েছে সুস্পষ্ট হুকুম-আহকাম। ইসলামের প্রতিটি বিধান মানুষের মঙ্গরের জন্য। ইসলামী অর্থনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন একটি সমাজ গঠন যেখানে সকলেই তার নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে আন্তরিকতার সাথে, নিষ্ঠার সাথে এবং প্রত্যেকেই পাবে তার ন্যায্যা অধিকার, সম্মান এবং মর্যাদা। সততা, ন্যায়, মায়া-মমতাকে বিসর্জন দিয়ে সকল সুযোগ-সুবিধার সিংহ ভাড় কেড়ে নেওয়ার মত ‘ধূর্ত শিয়ালের’ সমাজ ইসলামী সমাজ নয়।

ইসলাম সত্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের জন্য কয়েকটি নিয়ম ও সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আমরা এখন সে বিষয়ে কিছু আলোচনা করবো।

উপার্জন

ইসলাম মানুষকে কাজ করে উপার্জন করার জন্য উৎসাহিত করেছে, এটি শুধু কর্তব্যই নয় বরং পুণ্যের কাজ।

নবী (স) বলেছেন,

হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি, জীবিকা হাসিল করার জন্য সকল সম্ভাব্য উপায়ে চেষ্টা কর এবং তোমাদের প্রচেষ্টা পূর্ণতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া কর।

ইসলাম কাজ করাকে মর্যাদার চোখে দেখেছে, আর অন্যের উপর নির্ভর করা, অলসতা এবং ভিক্ষা করাকে ঘৃণা করেছে। মুসলমানদেরকে আত্মনির্ভরশীল হওয়া, কারো গলগ্রহ হওয়া থেকে দূরে থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলাম সেই সংগে চায় একটি ন্যায় ও সততার সমাজ। সকল অন্যায়ের মূলে আঘাত হানে চায় ইসলাম। তাই উপার্জনের সকল অবৈধ উপায় ইসলাম বন্ধ করে দিয়েছে। উপার্জন হতে হবে হালাল পথে। উপার্জন হতে হবে কোরআন ও সুন্নাহর নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী।

মাদক দ্রব্যের মত চরিত্র বিধ্বংসী দ্রব্যের উৎপাদন, বিক্রি এবং বিতরণের সকল উপার্জন তাই ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। তেমনিভাবে হারাম জুয়া, লটারী ও সুদের ব্যবসা। মোটকথা অন্যের ক্ষতি হবে, সমাজের ক্ষতি হবে এমন উপায়ে তুমি টাকা কামাবে, তা হবে না। চুরি, ডাকাতি, ঠকবাজি, মিথ্যা, চোরচালানীর উপর ভিত্তি করে ব্যবসা করবে, তাও চলবে না। সেই সাথে অন্যায়ভাবে খাদ্যশস্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস দিনের পর দিন মজুদ করা ইসলামে নিষিদ্ধ।দ

ব্যয়

সৎভাবে উপার্জনের সাথে সাথে ইসলাম সৎ ব্যয়েরও নির্দেশ দিয়েছে। একজন মুসলমান কোন কাজই দায়িত্বহীনের মত করতে পারেনা। তাই তার অর্থ ব্যয়ও হতে হবে সমাজ এবং পরিবারের দায়িত্বশীলের মত। প্রয়োজনে অতিরিক্ত খরচ করা ইসলাম সমর্থন করে না। অন্যদিকে জোঁকের মত টাকা আটকে রাখাকেও ইসলাম পছন্দ করেনা। প্রকৃতপক্ষে সমাজের উপকারের জন্যই সম্পদ সমাজে স্বাভাবিকভাবে সচল থাকতে হবে। ব্যবসা চলবে, লাভ হবে, লাভের টাকা আবার খাটবে –এর ফলে দেশের অর্থনীতি সচল থাকে, উৎপাদন বাড়ে, শ্রমিকের কাজের সংস্থান হয়, বেকার সমস্যা কমে। কিন্তু সম্পদ যদি কোথাও কারও হাতে কিংবা সমাজের বিশেষ কোন শ্রেণরি হাতে কুক্ষিগত হয়, তখন দেশে অর্থনীতিতে চরম অব্যবস্থা দেখা দেয়। কিংবা যদি মুষ্টিমেয় বড় লোক আরাম-আয়েশে বিলাসিতার পথে চলে তাহলে সমাজে সৃষ্টি হয় অনাচার, নৈতিকতাহীনতা, সমাজ জীবন হয় দূষিত। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদ আটকে রাখা কিংবা বিলাসিতায় সম্পদ নষ্ট করা দুটো হারাম বা অবৈধ। এ কারণেই ইসলাম চায় না সমাজের সকল সম্পদ ধনীদের হাতে জমা হোক।

যাকাতের ব্যবস্থা

সমাজের সম্পদ যাতে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে জনা না হয় সেজন্য ইসলামে রয়েছে এক সুন্দর ব্যবস্থা-তাহলো যাকাত। যাকাত দান ইসলামী অর্থনীতির একটি মূলভিত্তি। প্রয়োজনে অতিরিক্ত সম্পদ যার কাছে থাকবে তাকে ইসলামী রাষ্ট্রের কাছে যাকাত দিতে হবে। যাকাত একদিকে একটি ইবাদত অন্যদিকে একটি সামাজিক দায়িত্ব। যাকাত ধনী ও গরীবের মাঝখানে দূরত্ব কমায়। সমাজে সম্পদের সুষ্ঠু চলাচলের ব্যবস্থা করে যাকাত। যাকাত হলো সামাজিক নিরাপত্তা। প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা হলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। ইসলামী রাষ্ট্র নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে চায়। এটি পূরণ করতে হলে যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। ধনীর জমানো টাকা গরীবের উপকারে লাগে –এমন একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে। (যাকাতের উপর বিস্তারিত আলোচনা ইতিপূর্বে হয়েছে)।

ব্যক্তি মালিকানা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা

মানুষ নিজে যা কিছু উপার্জন করে কিংবা বৈধ উপায়ে তার যে সম্পদ আছে সে সম্পদের উপর তার অধিকারকে ইসলাম স্বীকার করে। এটিকে ইসলাম তার মৌলিক অধিকার হিসাবে গন্য করে। অর্জিত সম্পদের মালিকানার উপর ইসলামী রাষ্ট্র ততক্ষণ হস্তক্ষেপ করেনা যতক্ষণ না সমাজের বৃহৎ অংশের জন্য তা ক্ষতিকর হয়।

ইসলামের দৃষ্টিতে একজন লোক নিম্ন উপায়ে সম্পদের মালিক হতে পারেঃ

ক) শিকার

খ) মালিকানাবিহীন পতিত জমি আবাদ করা

গ) ভূগর্ভস্থ খনি উদ্ধার (মালিকী মত অনুসারে পেট্রোল, লোহা, কয়লা এ জাতীয় খনিজ পদার্থ যা সকলের ব্যবহারের জন্য তা জনগণের সম্পদ)

ঘ) বিভিন্ন জিনিস দিয়ে ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী তৈর

ঙ) ব্যবসা

চ) গনিমতের মাল

ছ) অন্যের জন্য পরিশ্রম করা, চাকুরী করা

জ) মালিকানাবিহীন জমি বাদশাহর কাছ থেকে পাওয়া

ঝ) শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করে উপার্জন করা সম্পদ

কিন্তু ইসলাম সম্পদের মালিকানা লাভের জন্য যা ইচ্ছে তাই করার অনুমতি দেয় না। আমাদের বর্তমান সমাজের মূল সমস্যা কিন্তু এখানেই। মানুষ সম্পদের মালিক হবার জন্য কিংবা সম্পদ বাড়ানোর জন্য যা ইচ্ছে তাই উপায় অবলম্বন করছে। এজন্য ধোঁকাবাজি করছে, প্রতারণা করছে, শ্রমিকের অধিকার হরণ করছে, মজুতদারী করছে, চুরি-ডাকাতি করছে। ইসলামে এসব অবৈধ-অনৈতিক সমাজ বিরোধী পথ বন্ধ করতে চায়।

মানুষের কাছে সম্পদ থাকা এবং তাকে সম্পদ বাড়াতে দেয়ার অধিকার দিয়ে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়াকে বলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। উপার্জনের পথ এবং ব্যয়ের পথের উপর নৈতিকতার কোন চাপ না থাকায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সমাজ জীবনকে কলুষিত করে। এ ব্যবস্থায় ধনীরা দিন দিন তাদের সম্পদ বাড়ানোর সুযোগ পায় এবং গরীবরা দিন দিন হয় আরও গরীব। ইসলাম এই ব্যবস্থার বিরোধী। সেই সাথে ইসলাম ব্যক্তির মালিকানাকে কেড়ে নেয়াও সমর্থন করে না। কারো কোন কিছু থাকবে না, সব কিছু রাষ্ট্রের সম্পদ, ‘সমাজতন্ত্রের’ এই গালভরা বুলি ইসলামে বৈধ নয়।

নিজে পরিশ্রম করবে, পরিশ্রমের ফসল নিজ পরিবারের জন্য ব্যয় করবে, তাদের জন্য রেখে যাবে জমানো সম্পদ এটা হলো প্রতিটি মানুষের একটা স্বাভাবিক ইচ্ছা ও আকাংখা। এই ইচ্ছা ও আকাংখা মানুষকে কাজের প্রেরণা যোগায়। শুধু তাই নয়, এই স্বাধীনতা তাকে সকল অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস যোগায়। কিন্তু রাষ্ট্র এই ব্যক্তি মালিকানা কেড়ে নিলে মানুষের আর কিইবা থাকে! সে পরিণত হয় রাষ্ট্রের একটি ‘যন্ত্রে’। রাষ্ট্রের হাতে সব ক্ষমতা। এমনকি তার খাওয়া-পরাও রাষ্ট্রের ইচ্ছার উপর। এ অবস্থায় জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে হক কথা বলার সাহসও সে হারিয়ে ফেলে। ফলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের স্বাভাবিক মন, প্রাণ, ইচ্ছা, স্বাধীনতার মৃত্যু ঘটে। আর তাই দুনিয়ার প্রায় সব সমাজতান্ত্রিক দেশের পতন দ্রুতই হলো।

প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ব্যক্তি মালিকানার ব্যাপারে যে মত পোষণ করে সেটাই হলো সঠিক মত সঠিক দৃষ্টিভংগী।

সুদকে হারাম ঘোষণা

ইসলামী অর্থনীতি সুদ থেকে মুক্ত। সুদ হচ্ছে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের মূলভিত্তি। আজকালকার সমাজে সুদ হচ্ছে সকল ব্যবসার মাধ্যম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সুদ কোন ‘ব্যবসা’ নয়। এটা কোন ‘লাভ’ নয়। সুদ জুলুমের হাতিয়ার। সম্পদ গুটিকতক লোকের জমা করার মাধ্যম। সুদের ফলে একজন আরেকজনের গোলামে পরিণত হয়। একটি দেশ আরেকটা দেশের হুকুমের তাবেদার হয়। ইসলাম সুদকে হারাম ঘোষণা করেছে। যদিও আজ কালকার সামজে সুদ ছাড়া কো কিছু চিন্তা করা সম্ভব নয় –তবু আলহামদুলিল্লাহ পৃথিবীর প্রায় সব মুসলিম দেশে সুদবিহীন অর্থনীতিকে বাস্তবে পরিণত করারজণ্য সামান্য হলেও প্রচেষ্টা চলছে। ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ইনসিওরেন্স ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

উত্তরাধিকার আইন (মিরাস)

সম্পদ যাতে এক জায়গায় কুক্ষিগত না হতে পারে সেজন্য আরও একটি সুন্দর ব্যবস্থা হলো ‘উত্তরাধিকার আইন’। একজনের মৃত্যুর পর তার সম্পদ এক সুন্দর নিয়মে সুষ্ঠুভাবে ন্যায়ের ভিত্তিতে তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে ইসলাম।

ইসলামের অর্থনীতির মূল বিষয়গুলোর আলোচনার মাধ্যমে আমরা এটাই পেলাম যে, ইসলামের অর্থনীতির ভিত্তি হলো সরলতা, বিনয়, উদারতা, পারস্পরিক সহযোগিতা ও খোদাভীতি। সেখানে লোভ, লালসা, কুটিলতা, অপচয়, বিলাসিতা, হিংকা-বিদ্বেষের কোন স্থান নেই। মোটকথা ইসলাম মানুষের মানবিক গুণাবলীর উপর তার অর্থনীতির কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। মানুষের পশুবৃত্তিকে দমন করে মানুষের সমাজকে পশুর সমাজ হওয়া থেকে রক্ষা করতে চায়।

ইসলামে রাজনীতি

মানুষ কখনও একা থাকতে পারেনা। সমাজবদ্ধ হয়ে থাকতে হয় মানুষকে। সকলেই যেমন সমাজের রীতিনীতি মেনে চলে, কেউ কোন অন্যায় না করে না, অন্যায় করলে তার যেন বিচার হয় সেজন্য সমাজের সকলেই একজনকে নেতা হিসাবে মেনে নেয়। মানব সমাজের প্রথম থেকেই এই নিয়ম চলে আসছে। শুধু তাই নয় সমাজে জন্য আইন-কানুন ঠিক করা, নিত্য নতুন আইন তৈরী করার প্রয়োজনও দেখা দেয়। মানুষের সমাজ যখন ছোট ছিল তখনও প্রত্যেক সমাজে একটা নিয়ম ছিল নেতা নির্বাচনের, আইন তৈরীর। এখন সমাজের পরিধি বড় হয়েছে, দেশের পরিধি বড় হয়েছে তাই সমাজ কিভাবে চলবে, দেশ কিভাবে চলবে, কিবাবে দেশের নেতা নির্বাচিত হবে সে ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দেশ শাসন, শাসন পরিচালনার জন্য নেতা নির্বাচন, আইন-কানুন তৈরীর ব্যবস্থাকে ‘রাজনীতি’ বলে। ইসলামে রাজনীতি আলাদ কোন ব্যবস্থা নয়। ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন চলবে এক নিয়মে, আর দেশের শাসন ব্যবস্থা চলবে অন্য নিয়মে ইসলামে এমন কোন বিভাজন নেই। কেননা ইসলাম ব্যক্তি ও সমাজ পরিচালনার জন্য একটা সম্পূর্ণ ব্যবস্থা আর রাজনীতি হলো সামজ জীবনের একটি অংশ মাত্র। তাই ইসলাম যেমন আমাদের নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত সম্পর্কে নিয়ম-নীতি দিয়েছে তেমনি কিভাবে একটি দেশ চলবে, কিভাবে শাদসন পরিচালনার জন্য সরকার গঠন করা হবে, কিভাবে আইন তৈরীর জন্য পার্লামেন্ট গঠন হবে, কিভাবে অন্য দেশের সাথে চুক্তি হবে, কিবাবে দেশের বাণিজ্য চলবে –সব কিছু সম্পর্কে নিয়ম-নীতি বলে দিয়েছে। বিস্তারিতভাবে ইসলামী রাজনীতির সব দিক আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। তবুও আমরা ইসলামী রাজনীতির নীতিমালাগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।

আল্লাহর সার্বভৌমত্ব

সার্বভৌমত্ব হলো ক্ষমতার উৎস। ইসলামে আল্লাহই হচ্ছেন সকল ক্ষমতা এবং আইনের উৎস। মোটকথা ইসলামী রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্বের মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ। কোন শাসক কিংবা জনগণ কেউ ইসলামে সার্বভৌমত্বের মালিক নয়। ইসলামী রাষ্ট্রে শাসক তিনি যাকে জনগণ আল্লাহর আইন অনুযায়ী তাদের সেবা করার জন্য মনোনীত করে। আল্লাহ ভালভাবে জানেন মানুষের জন্য কোনটা ভাল কোনটা মন্দ। তাই আল্লাহর নির্দেশ-আল্লাহর আইন হচ্ছে চূড়ান্ত আইন। তাই মানুষ আল্লাহর আইনকে বদলাতে পারোন। এমনকি জনগণ একত্রিত হয়ে কিংবা কোন সরকার ঘোষণা দিয়ে আল্লাহর আইনকে বদলাতে পারেনা।

কোরআন ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান

ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো খোদার বিধান আল-কোরআনের আলোকে সকল কাজ পরিচালিত করা। তাই আমরা বলতে পারি কোরআনই ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান আর কোরআনতো মানুষকে সে পথেই নিয়ে যায় যেখানে আছে শান্তি, শৃংখলা, উন্নতি এবং সফলতা।

খেলাফত

মুসলমানদের কাজ হলো দুনিয়ার বুকে আল্লাহর আইনকে প্রতিষ্ঠা করা। এই বিষয়ে সে আল্লাহর প্রতিনিধি। ইষলামী রাজনীতির পরিববাষায় এক বলে ‘খেলাফত’। সকল ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ এবং মানুষ তাঁর প্রতিনিধি। ইসলামী রাজনীতির ক্ষেত্রেও মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহর পছন্দনীয় উপায়ে দেশ ও সমাজ পরিচালনা করা, আল্লাহর আইন তথা শরিয়তী আইনকে সমাজে চালু করা, আল্লাহর আইন অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা এসব কাজ মানুষই আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে করে থাকে। মানুষের মাধ্যমেই আল্লাহ এই কাজ করাতে চান। তাই মুসলমানরা আল্লাহর আইন অনুযায়ী দেশ পরিচালনার জন্য নিজেদের মধ্য থেকে যাকে নেতা নির্বাচিত করে তাঁকেও ‘খলিফা’ নামে ডাকা হয়।

খেলাফত একটি ‘আমানত’। আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষ আল্লাহর খলিফা হিসাবে আল্লাহর ইচ্ছাকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করে একটি বিরাট ‘আমানত’ হিসেবে।

পরামর্শের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন ও দেশ শাসনের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ

ইসলামের দৃষ্টিতে দেশের আইন তৈরী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ পরামর্শের ভিত্তিতে করতে হয়। ইসলামী পরিভাসায় একে বলা হয় ‘শূরা’। সিদ্ধান্ত সকলের পরামর্শ ও সম্মতি নিয়ে করার জন্য কোরআনে গুরুত্বের সাথে বলা হয়েছে। তাই কোন এক ব্যক্তি তার নিজস্ব মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দেবে, ইসলামে এমন সুযোগ নেই। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে সকলের পরামর্শের ভিত্তিতে দেশ শাসন করা ইসলামী রাজণীতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

সরকার ও জনগণের দায়িত্ব

খোদার বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার কাজতো দেশের সব লোক একত্রে করতে পারেনা। তাই স্বাভাবিকবাবেই জনগণ তাদের মধ্য থেকে ধার্মিকতা, যোগ্যতা ও উপযুক্ততার ভিত্তিতে উত্তম গুনসম্পন্ন কয়েকজন নাগরিককে শাসন এবং সরকারের নিজেরেদ ইচ্ছামত কিছু করতে পারেনা। কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে পরামর্শের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করাটা তাদের জন্য একটি নৈতিক দায়িত্ব। এক্ষেত্রে তারা প্রথমে আল্লাহর কাছে দায়ী এবং তারপর দায়ী জনগণের কাছে। প্রকৃতপক্ষে শাসক ও সরকারকে নির্বাচন করে তাদের পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করার জন্য। জনগণ, শাসক ও প্রশাসকবর্গ সকলেইতো আল্লাহর খলিফা। তাই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব কয়েকজনের উপর ছেড়ে দিয়েই কিন্তু জনগণের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়না। শাসক ও প্রশাসকবর্গ ঠিকমত পরিচালনা করছে কিনা, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারকে পরার্মশ দেয়া, ভাল কাজে সহযোগিতা করা, মন্দ কাজের সমালোচনা করা জনগনের দায়িত্ব। প্রতিটি নাগরিক সরকারকে সমর্থন করা কিংবা কোন একটি সরকারী নীতির বিরোধিতা করার স্বাধীনতা রাখে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

ইসলামী রাষ্ট্রে শাসক ও জনগণ সকলের মর্যাদা মানুষ হিসেবে সমান। দেশের আইন সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। ইসলামী রাজনীতির একটি মূল বিশয় হলো বিচার ব্যবস্থা সরকারী প্রশাসন ব্যবস্থা থেকে আলাদা হতে হবে। যাতে করে রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকারের হোমরা-চোমরা মন্ত্রীদেরকেও প্রয়োজন হলে আদালতে ডেকে আনা যায়। শাসক কিংবা প্রশাসকবর্গের ক্ষমতার জোরে ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার কোন সুযোগ ইসলামে নেই।

রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ইসলামের মাধ্যমেই সম্ভব

ইসলামী রাজনীতির মূল বিয়ষগুলো আলোচনা করলে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে ইসলামী রাষ্ট্রকে কোন অনৈসলামী প্রকৃতির রাজনৈতিক সংগঠন দিয়ে পরিচারনা করা কিংবা কোন বিদেশী শক্তির পদানত করা যেতে পারেনা। মুসলমানতো তারাই যারা একমাত্র আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের জন্য নিজে এগিয়ে আসে এবং আল্লাহর আইন প্রয়োগকারী ও শর্তাবলী পালনকারী সরকারের প্রতি সহযোগিতা ও সমর্থন জ্ঞাপন করে। তাই মুসলিম জাতির পক্ষে অনৈসলামী সরকারের বশ্যতা স্বীকার করা শোভা পায়না। ইসলামী রাষ্ট্র ও তার জনগণ এদিক থেকে প্রকৃতপক্ষেই স্বাধীনতা ভোগ করে। এই অর্থে ইসলামই প্রকৃত স্বাধীনতা। ইসলামই মানুষকে তার প্রিয় জন্মভূমিকে স্বাধীন দেশে পরিণত করতে কিংবা দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় প্রেরণা জোগায়। মুসলিম দেশগুলোর স্বাধিকার রক্ষা এবং স্বাধীনতার ইতিহাস আলোচনা করলে একথাই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, জনগণের ইসলামী প্রেরণাই তাদের সাহস জুগিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে, প্রেরণা দিয়েঝে জীবন বিলিয়ে দিতে।

অমুসলিমদের অধিকার

ইসলাম অমুসলিমদের নাগরিক অধিকারকে শুধু স্বীকারই করেনা, অমুসলিমদের নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইসলামী রাষ্ট্র মুসলিম অমুসলিম উভয় নাগরিকের কল্যানের জন্য সমানভাবে দায়ী। এসব কথা কোন কল্প কথা নয়। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তারপর চার খলিফার খেলাফতের আমলের অনেক ঘটনা আছে যা আজও ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাঁদের মৌলিক অধিকার পেয়েছে, স্বাধীনতা ভোগ করেছে তা ইতিহাসে এখনও বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি