আমিরুল মুমেনীন হযরত ওমর (রা)
মুক্ত তরবারি হাতে ছুটে চলেছেন এক যুবক। মরুভূমির রুক্ষ্মতা তার চোখে মুখে। দেখলেই বোঝা যায় তিনি কাউকে খতম করতেই ছুটছেন। যুবকরে নাম ওমর। হাদীসে আনাস ইবন মালিক থেকে ঘটনাটি এ ভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘তরবারি কাঁধে ঝুলিয়ে ওমর চলেছেন। পথে বনি যুহরার এক ব্যক্তির (মতান্তরে নাঈম ইবনে আবদুল্লাহ) সাথে দেখা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন দিকে ওমর?’

ওমর বললেন, ‘মুহাম্মদের একটা দফারফা করতে’।

লোকটি বললেন, ‘মুহাম্মদের (সা) দফাফা করে বনি হাশিম ও বনি যাহরার হাত থেকে বাঁচবে কিভাবে?’

একথা শুনে ওমর বলে উঠলেন, ‘মনে হচ্ছে তুমিও পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে বিধর্মী হয়েছো?’

লোকটি বললেন, ‘ওমর, একটি বিস্ময়কর খবর শোনো, তোমার বোন-ভগ্নিপতি বিধর্মী হয়ে গেছে। তারা তোমার ধর্ম ত্যাগ করেছে’।

একথা শুনে রাগে উন্মত্ত হয়ে ওমর ছুটলেন তাঁর বোন ভগ্নিপতির বাড়ির দিকে। বাড়ির দরজায় ওমরের করাঘাত পড়লো। তাঁরা দু’জন তখন খাব্বাব ইবন আল-আরাত-এর কাছে কোরআন শিখছিলেন। ওমর আসার আভাস পেয়ে খাব্বাব বাড়ির অন্য একটি ঘরে আত্মগোপন করলেন।

ওমর বোন-ভগ্নিপতিকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের এখানে গুনগুন আওয়াজ শুনছিলাম, তা কিসের?’

তাঁরা তখন কোরআনের সূরা ত্বাহা পাঠ করছিলেন।

তাঁরা উত্তর দিলেন, ‘আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলাম’।

ওমর বললেন, ‘তোমার ধর্ম ছাড়া অন্য কোথাও যদি সত্য থাকে তুমি কি করবে ওমর?’

একথা শুনে ওমর তাঁর ভগ্নিপতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং দু’পায়ে ভীষণ ভাবে তাঁকে মাড়াতে লাগলেন। বোন তাঁর স্বামীকে বাঁচাতে এলে ওমর তাঁকে এমন মারা মার দিলেন যে, তাঁর মুখ রক্তাক্ত হয়ে গেলো।

বোন রাগে উত্তেজিত হলে বললেন, ‘সত্য যদি তোমর দ্বীনের বাইরে অন্য কোথাও তাকে তাহলে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল’।

আসল নাম ‘ওমর, ডাক নাম আবূ হাফস। পরবর্তীকালে উপাধি পান ফারুক। তাঁর আব্বার নাম খাত্তাব এবং মায়ের নাম হানতামা। আব্বা আম্মা উভয়েই কুরাইশ বংশের লোক। আরো একটু খোলোসা করে বলি-হযরত ওমরের আম্মা কুরাইশ বংশের সেই অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি হিশাম ইবনে মুগীরার কন্যা। মানে হিশাম ইবনে মুগীরা ওমর (রা)-এর নানা আর তিনি হলেন দৌহিত্র। তোমরা শুনলে আরো আশ্চর্য হবে যে, ইসলামের অন্যতম প্রধান সেনাপতি খালিত বিন ওয়ালিদ হিশাম ইবন মুগীরারই পৌত্র অর্থাৎ কিনা ওমরের আপন মামাতো ভাই। অপরদিকে ওমরের আপন চাচাতো ভাই হলেন যায়িদ বিন নুফাইল। যিনি সৌভাগ্য ক্রমে রাসূল (সা)-এর আবির্ভাবের পূর্বেই নিজের বিচার বুদ্ধি গুণে মুর্তিপূজা ত্যাগ করেন এবং তাওহীদবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হন।

হযরত ওমরের (রা) বাল্য ও কৈশর সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে এতটুকু জানা যায় যে, তিনি মক্কার নিকটবর্তী ‘দাজনান’ নামক স্থানে তাঁর পিতার উট চরাতেন। অর্থাৎ রাখালের কাজ করতেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘এমন এক সময় ছিল যখন আমি পশমী জামা পরে এই মাঠে প্রখর রোদে খাত্তাবের উট চরাতাম। খাত্তাব ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও নীরস ব্যক্তি। ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম নিলে পিতার হাতে নির্মম ভাবে মার খেতাম। কিন্তু আজ আমার এমন দিন এসেছে যে, এক আল্লাহ ছাড়া আমার ওপর কর্তৃত্ব করার আর কেউ নেই’।

ওমর আরবের একজন শ্রেষ্ঠ কুস্তিগীর হিসাবে সুনাম কুড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। আরবের প্রথা অনুযায়ী তিনি নসব নামা বা বংশ তালিকা বিদ্যাও আয়ত্ব করেন। আর যুদ্ধ বিদ্যায় ছিলেন সুপণ্ডিত ব্যক্তি। অপর দিকে জাহিলী আরবের তিনি ছিলেন, এক বিখ্যাত ঘোড় সওয়ার। এ ব্যাপারে আল্লামা জাহিয বলেছেন, ‘ওমর ঘোড়ায় চড়লে মনে হতো ঘোড়ার চামড়ার সাথে তাঁর শরীর মিশে গেছে’। হযরত ওমরের ছিল অসাধারণ মনে রাখার ক্ষমতা। তৎকালীন সময়ের খ্যাতনামা সব কবিদের সব কবিতায় তার কণ্ঠস্থ ছিলো বলে জানা যায়। এ থেকে প্রমাণ হয় তিনি কতবড় কাব্য প্রেমিক ছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি একজন শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। জানা যায়, রাসূলে করীমের (সা) নবুয়াত প্রাপ্তির সময় গোটা কুরাইশ বংশে মাত্র, সতেরো জন লেখা পড়া জানতেন। তাদের মধ্যে ওমর একজন।

হযরত ওমরের (রা) ইসলাম গ্রহণের ঘটনা ছিল আকস্মিক ও অত্যন্ত হৃদয় গ্রাহী। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি গুরুত্ব সহকারে তোমাদেরকে জানানোর জন্যই প্রথমেই ইসলাম ও মুহাম্মদদের বিরুদ্ধে ওমরের যে অভিযান ছিলো তা পেশ করেছি।

আসলে ওমর প্রকৃতিগত দিক থেকেই ছিলেন অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির মানুষ। এজন্য তিনি যখন জানতে পারলেন বোন ফাতিমা, ভগ্নিপতি এবং চাচাতো ভাই যায়িদ, দাসী লাবীনা এমন কি তার বংশের বিশিষ্ট ব্যক্তি নাঈম ইবন আবদুল্লাহ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তখন তিনি স্বাভাবিক ভাবেই মাথা ঠিক রাখতে পারেননি। বোন ভগ্নিপতির ইসলাম গ্রহণের সংবাদে তাই ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁদেরকে মারাত্মকভাবে আহত করতেও তার বাঁধেনি। কিন্তু আপন সহোদরার সমস্ত শরীর এবং মুখ যখন রক্তাক্ত দেখেছেন তখন আর নিজেকে জাহেলিয়াতের ওপর মজবুত রাখতে পারেননি। মুহুর্তের মধ্যে মন থেকে শিরকের সমস্ত কালিমা উবে গেলে তিনি সত্যের বর্ণালী আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন। সংগে সংগে সহোদরা ফাতিমার নিকট থেকে সূরা ‘তাহা’র লিখিত অংশটুকু নিয়ে পড়লেন, আর স্বগত বলে উঠলেন, ‘তোমরা আমাকে মুহাম্মদের (সা)-এর কাছে নিয়ে চলো’। তোমাদেরকে পূর্বেই বলেছি ওমরের আগমনে খাব্বাব (রা) গোপন স্থান থেকে বের হয়ে এলেন। তিনি বললেন, সুসংবাদ ওমর! বৃহস্পতিবার রাতে রাসূল (সা) তোমার জন্য দু’আ করেছিলেন। আমি আশা করি তা কবুল হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহ, ওমর ইবনুল খাত্তাব অথবা আমর ইবন হিশামের দ্বারা ইসলামকে শক্তিশালী করো’।

হযরত খাব্বাবের (রা) নিকট থেকে ওমর জানলেন রাসূল (সা) এখন সাফার পাদদেশে দারুল আরকামে অবস্থান করছেন। অতএব আর ক্ষণকাল দেরী নয়, ওমর ছুটলেন, দারুল আরকামের দিকে।

দারুল আরকামে পাহারারত সাহাবীরা ওমর কে উন্মুক্ত তরবারী হাত ছুটে আসতে দেখে ভয় পেলেন। হযরত হামযা (রা) সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তিনি সবাইকে অভয় দিয়ে বললেন, ওমর কল্যাণ চাইলে সে ইসলাম গ্রহণ করবে। অন্যথায় তাকে হত্যা করার আমাদের জন্য কঠিন হবে না।

এসময় রাসূল (সা) ভেতরে ছিলেন। তিনি বের হয়ে ওমরের কাছে এসে বললেন, ‘ওমর তুমি কি বিরত হবে না? তারপর দু’আ করলেন, ‘হে আল্লাহ! ওমর আমার সামনে, হে আল্লাহ, ওমরের দ্বারা দ্বীনকে শক্তিশালী করো’।

ওমর বলে উঠলেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল’। এরপর তিনি বললেন ‘হে আল্লাহর রাসূল, ঘর থেকে বের হয়ে পড়ুন’।

হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণ এতো বড় ঘটনা ছিলো যে, তাঁর ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে হযরত জিবরাইল (আ) নাযিল হয়ে বললেন, ‘মুহাম্মদ (সা), ওমরের ইসলাম গ্রহণে আসমানের অধিবাসীরা উৎফুল্ল হয়েছেন’। আর ইতোপূর্বে ইসলাম গ্রহণকারীরা তো খুশীতে ফেলে পড়লেন। কারণ তারা জানতেন, ওমরের ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে ইসলামের ইতিহাস ভিন্ন দিকে মোড় নিলো। সত্যিই তাই –ওমর ইসলাম গ্রহণের পর পরই অন্য মুসলমানদেরকে নিয়ে কাবায় গিয়ে সালাত আদায় করলেন –যা ছিলো মুসলমানদের জন্য অভাবনীয় এবং বিস্ময়কর। কারণ ইতোপূর্বে ৪০/৫০ জন ইসলাম কবুল করলেও প্রকাশ্যে তাঁরা কাবাতে গিয়ে সালাত আদায় করার সাহস করেননি। ওমর এখানেই ক্ষ্যান্ত হলেন না। তিনি আল্লাহ, রাসূল ও ইসলামের প্রধান শত্রু আবু জেহেলের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি তার দরজায় করাঘাত করলাম। আবূ জেহেল বেরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি মনে করে?’ আমি বললাম, ‘আপনাকে একথা জানাতে এসেছি যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মদ (সা)-এর প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাঁর আনীত বিধান বাণীকে মেনে নিয়েছি’। একথা শোনা মাত্র সে আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো এবং বললো, ‘আল্লাহ তোকে কলংকিত করুক এবং যে খবর নিয়ে তুই এসেছিস তাকেও কলংকিত করুক’।

বুঝতেই পারছো অবস্থা কি। মূলত এখান থেকেই ইসলাম ও কুফরের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ শুরু হয়। তারপর! তারপর তো কতো ঘটনা, কতো সংঘর্ষ-সংগ্রাম, কতো বিজয়। আর এজন্যই আল্লাহ রাসূল (সা) ওমর সম্পর্কে বলেছেন, ‘ওমরের জিহবা ও অন্তঃকরণে আল্লাহ তা’আলা সত্যকে স্থায়ী করে দিয়েছেন। তাই সে ‘ফারুক’। আল্লাহ তাঁর দ্বারা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করে দিয়েছেন’।

হযরত ওমর (রা) সকল ক্ষেত্রেই প্রচণ্ড সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। হিজরতকারী সকল সাহাবীই যেখানে নিরবে হিজরত করতে হয়েছে, সেখানে হযরত ওমর (রা) প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে হিজরত করেছেন। ঘটনাটি এমন –তিনি প্রথমে কাবা তওয়াফ করে কুরাইশদের নিকট গিয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘আমি মদীনায় যাচ্ছি। কেউ যদি তার মাকে পুত্রশোক দিতে চায়, সে যেন এ উপত্যকার অপর প্রান্তে আমার মুখোমুখি হয়।

এই হচ্ছেন হযরত ওমর (রা)। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি রাসূল (সা) জীবিত থাকা পর্যন্ত রাসূল-এর জীবনে সংঘটিত প্রত্যেকটি ঘটনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি বদর থেকে শুরু করে ইসলামের ইতিহাসে সংঘটিত সকল যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেন। রাসূল (সা) ওফাতের পরপরই খেলাফত সংক্রান্ত জটিলতার সময় তিনি সবার আগে হযরত আবূ বকরের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে –এ জটিল সমস্যার সহজ সমাধান করেন।

তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, ইসলামের ইতিহাসে ইসলাম বিরোধী শক্তির সাথে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ হলো বদরের যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সৈন্য পরিচালনা থেকে প্রায় সকল বিষয়েই ওমর (রা) রাসূল (সা) কে একজন প্রাজ্ঞ প্রবীণ ব্যক্তির মতো পরামর্শ দান করেন। এমন কি বন্দী বিনিময়ের ব্যাপারে তার পরামর্শই আল্লাহ রাব্বুল ইযযাতের পছন্দনীয় ছিলো। শুধু তাই নয় –এই যুদ্ধে তিনিই প্রথম শত্রু বাহিনীতে থাকার কারণে আপন মামা আ’মীর ইবনে হিশামকে নিজ হাতে হত্যা করেন। এর মাধ্যমে তিনি এ কথায় প্রমাণ করেন যে, সত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পরম আত্মীয়ও শত্রুতে পরিণত হতে পারে।

ওহুদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী যখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন, সবাই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছেন, কিছু সংখ্যক আহত সাহাবীসহ রাসূল (সা) এক পাহাড়ী গুহায় নিরাপদ মনে করে আশ্রয় নিয়েছেন, তখন আবূ সুফিয়ান উচ্চস্বরে বলতে লাগলো, মুহাম্মদ তুমি ও তোমার সাথীরা কোথায়? কেউ কি বেঁচে আছো? রাসূলের (সা) ইংগিতে কেহই সাড়া দিলেন না। উত্তর না পেয়ে আবু সুফিয়ান স্বগোক্তি করলো, ‘নিশ্চয় তারা সকলেই নিহত হয়েছে’।

এই উক্তি শোনার সাথে সাথে ওমর বলে উঠলেন, ‘ওরে আল্লাহর দুশমন! আমরা সবাই জীবিত’।

আবূ সুফিয়ান বললো, ‘উলু হুবলু-হুবলের জয় হোক’।

ওমর জবাব দিলেন, ‘আল্লাহ আ’লা ও আজাল্লু আল্লাহ-আল্লাহ মহান ও সম্মানী’।

দান দাক্ষিণ্যের ক্ষেত্রেও ওমর সম্মানিত হয়ে আছেন। মুসলমানরা যখন খাইবার জয় করলো, তখণ খাইবারের বিজিত ভূমি মুহাজিরদের মধ্যে বণ্টন করা হলো। হযরত ওমর তাঁর প্রাপ্য সমস্ত ভূমিই আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দিলেন। তোমরা শুনে খুশী হবে যে, ইসলামের ইতিহাসে এটাই প্রথম ওয়াকফ।

ওমর (রা) মুহাম্মদ (সা) কে এতো বেশী ভালোবাসতেন যে, তার ওফাতের সংবাদ শোনার সাথে সাথে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন এবং তরবারী কোশমুক্ত করে বলে উঠলেন, ‘যে ব্যক্তি বলবে রাসূলুল্লাহ (সা) ইনতিকাল করেছেন, আমি তার মাথা দ্বিখণ্ডিত করে ফেলবো’।

ইসলামের প্রথম খলিফা আবূ বকর ইবন কুহাফার (রা) ইন্তেকালের আগেই হযরত ওমর সর্বসম্মতিক্রমে খলীফা নির্বাচিত হন। তাঁর শাসনকাল এখনো পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণযুগ হিসাবে স্বীকৃত। ‘দশ বছরের স্বল্প সময়ে গোটা বাইজান্টাইন, রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটান। তাঁর যুগে বিভিন্ন অঞ্চলসহ মোট ১০৩৬ টি শহর বিজিত হয়। ইসলামী হুকুমাতের নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা মূলত তাঁর যুগেই হয়। সরকার বা রাষ্ট্রের সকল শাখা তাঁর যুগেই আত্ম প্রকাশ করে। তাঁর শাসন ও ইনসাফের কথা সারা বিশ্বে মানুষের কাছে কিংবদন্তীর মত ছড়িয়ে আছে’।

এই সেই শাসক যিনি তাঁর প্রজা সাধারণের অবস্থা দেখার জন্য অন্ধকার রাতে মহল্লায় মহল্লায় ছুটে বেড়াতেন। নিজে পিঠে করে খাদ্যের বস্তা অভূক্তদের বাড়িতে পৌঁছে দিতেন। দুধ বিক্রেতা সত্য বাদিনী যুবতীকে নিজের পুত্রবধু হিসাবে বরণ করে নিয়েছেন। খৃষ্টান শাসকের আমন্ত্রণে জেরুযালেম যাওয়ার সময় উঠের রাখালকে পর্যায়ক্রমে উটের পিঠে উঠিয়ে নিজের রাখাল হিসাবে উটের রশি টেনে নিয়ে এগিয়ে গেছেন। অর্ধ দুনিয়ার বাদশাহ হয়েও নিজের রুটি রুজির জন্য ব্যবসাপাতি করেছেন।

আমিরুল মুমেনীন উপাধিতে ভূষিত প্রথম খলীফা হলেন হযরত ওমর (রা)। আমরা এখন যে জামায়াতের সাথে তারাবীর নামায আদায় করি এটা তিনি প্রচলন করেন। হিজরী সন তাঁর আমল থেকেই গণনা শুরু হয়। তিনিই সেনাবাহিনীর ভেতর বিভিন্ন স্তরভেদ ও ব্যাটালিয়ন নির্দিষ্ট করেন। দেশের নাগরিক তালিকা তৈরী ও কারী নিয়োগ করেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলকে শাসনকার্যের সুবিধার জন্য নানা প্রদেশে তিনিই বিভক্ত করেন।

হযরত ওমর (রা) ছিলেন অসম্ভব মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি। রাসূল (সা) নিজেই বলেছেন, ‘লাও কানা বা’দী নাবিয়্যুন লা কানা ওমর’, ‘আমার পরে কোন নবী হলে ওমরই হতো’। কি বলো এর পর কি আর কোন কথা থাকে? আসলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে ওমরের মর্যাদা ছিলো অতি উচ্চে। তোমরা শুনলে আনন্দিত হবে যে, ‘ওমরের সব মতের সমর্থনেই সর্বদা কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে।

তার ব্যাপারে হযরত আলী (রা) বলেছেন, ‘নবীর (সা) পর উম্মতের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যক্তি আবূ বকর তারপর ওমর (রা)’। আর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেছেন, ‘ওমরের ইসলাম গ্রহণ ইসলামের বিজয়। তাঁর হিজরত আল্লাহর সাহায্য এবং তাঁর খিলাফত আল্লাহর রহমত’।

ইন্তেকালের পূর্বে ওমর (রা) ছয়জন প্রখ্যাত সাহাবীর –হযরত আলী, ওসমান, আবদুর রহমা, সা’দ, যুবাইর ও তালহার (রা) ওপর পরবর্তী খলীফা খলীফা নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়ে যান। তাঁকে ৬৩ বছর বয়সে হিজরী ২৩ সনের ২৫ শে জিলহজ সোমবার আবূ লুলু ফিরোজ নামে মুগীরা ইবন শুবার (রা) অগ্নি উপাসক দাস ফজরের নামাযরত অবস্থায় ছুরিকাঘাত করে। দশ বছর ছয় মাস চার দিন খিলাফতের দায়িত্ব পালনের পর মুসলিম দুনিয়ার আমিরুল মুমেনীন আহতাবস্তায় ৩ দিনের দিন বুধবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নামাযে জানাজার পর হযরত আবূ বকরের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁল জানাযায় ইমামতি করেন হযরত সুহায়িব (রা)।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি