দ্বিতীয় অধ্যায়
পরিবার গঠন
ইসলামে পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব

ইসলামে পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব যে কতোখানি, তা পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আল্লা তা’আলা মানুষের জন্যে যে পূর্ণাঙ্গ জীবনের বিধান নাযিল করেছেন, তাতে নানাভাবে ও নানা প্রসঙ্গে এ গুরুত্বের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে।

কুরআনে পরিবারকে দুর্গের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং পারিবারিক জীবন যাপনকারী নারী-পুরষ ও ছেলে-মেয়েকে বলা হয়েছে ‘দুর্গ প্রাকারের অভ্যন্তরে সুরক্ষিত (আরবী************) লোকগণ’। দুর্গ যেমন শত্রুর পক্ষে দুর্ভেদ্য, তার ভিতরে জীবনযাত্রা যে রকম নিরাপদ, ভয়-ভাবনাহীন, সর্বপ্রকারের আশংকামুক্ত; পরিবারের নারী-পুরুষ ও ছেলেমেয়ে নৈতিকতা বিরোধী পরিবেশ ও অসৎ-অশ্লীল জীবনের হাতছানি বা আক্রমণ থেকে তেমনিই সর্বতোভাবে সুরক্ষিত থাকতে পারে। বস্তুত পরিবারস্থ ছেলেমেয়ের পক্ষে পিতামাতা, ভাই বোনের তীব্র শাসন ও নিকটাত্মীয়দের সজাগ দৃষ্টির সামনে পথভ্রষ্ট হওয়া বা নৈতিকতা বিরোধী কোনো কাজ করা খুব সহজ হতে পারে না।

আল্লামা রাগেব ইসফাহানী কুরআনে উদ্ধৃত (আরবী***********) শব্দের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

কারো সম্পর্কে (আরবী*******) বলা হয় তখন (আরবী************) ‘যখন সে দুর্গকে বসবাসের স্থানরূপে গ্রহণ করে’। (আরবী***********)

আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী**************************************)

দুর্গবাসী হওয়ার আসল মানে হচ্ছে প্রতিরোধ শক্তিসম্পন্ন হওয়া।

যেমন কুরআনে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************)

যেমন তোমাদেরকে তোমাদের ভয়-ভীতি থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে।

এ কারণেই ঘোড়াকে বলা হয় (আরবী******)

(আরবী****************************************************)

কেননা সে তার মনিবকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে।

আর এই দৃষ্টিতেই (আরবী***********) বলা হয়ঃ

(আরবী*****************************************************)

পবিত্র চরিত্রসম্পন্না নারীকে, কেননা সে নিজকে সর্বতোভাবে রক্ষা করে রাখে।

এখান থেকেই বলা হয়ঃ

(আরবী*******************************************************)

আল্লাহর অসন্তোষজনক কাজ থেকে নিজকে বিরত রাকাকে বলা হয় ‘ইহসান’।

কুরআনে বিবাহিতা মহিলাকে এ কারণেই বলা হয়েছে (আরবী*****) অর্থাৎ পরিবারের দুর্গস্থিত সুরক্ষিত মহিলাগণ। শাওকানী বলেছেনঃ (আরবী**************************) এখানে ‘মুহসানাত’ মানে বিবাহিতাগণ। স্বামীসম্পন্না মেয়েলোক; এমন মেয়েলোক, যাদের স্বামী রয়েছে। এজন্যে যেঃ

(আরবী******************************************************)

তারা তাদের যৌন অঙ্গকে স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষদের থেকে সুরক্ষিত করে রেখেছে।

আল্লামা আলূসী লিখেছেনঃ

(আরবী******************************************************)

মুহসানাত মানে স্বামীসম্পন্না মেয়েলোক, বিয়ে কিংবা স্বামী অথবা অলী –অভিভাবক তাদের গুনাহে লিপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করেছে।

পারিবারিক জীবনের এই দুর্গপ্রাকার রক্ষা করা ইসলামের দৃষ্টিতে বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্যে সর্বপ্রথম অপরিহার্য কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত তিলাওয়াত করা আবশ্যকঃ

(আরবী************************************************************************)

তোমার আল্লাহ চূড়ান্তভাবে ফয়সালা করে দিয়েছেন যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই দাসত্ব করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। তাদের একজন কিংবা দুজনই যদি তোমার নিকট বৃদ্ধাবস্থায় জীবিত থাকে, তবে তাদের জন্যে কোনো কষ্টদায়ক ও দুঃখজনক কথা বলো না, তাদের ভৎসনা করবে না এবং তাদের জন্যে সম্মাজনক কথাই বলবে। তোমার দুই বাহু তাদের খেদমতে অপরিসীম বিনয় ও দয়া-মায়া সহকারে বিছিয়ে দাও এবং তাদের জন্যে সব সময় এই বলে দো’আ করতে থাকোঃ হে আল্লাহ পরোয়ারদেগার! তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করো, যেমন করে তাঁরা আমাকে লালন-পালন করেছেন আমার ছোট্ট শিশু অবস্থায়। তোমাদের আল্লাহ ভালোভাবেই জ্ঞাত আছেন তোমাদের মনের অবস্থা সম্পর্কে। তোমরা যদি বাস্তবিকই নেককার হতে চাও, তাহলে আল্লাহ তওবাকারী ও আশ্রয় ভিক্ষাকারীদের জন্যে সব সময়ই ক্ষমাশীল রয়েছেন।

এ আয়াতের শুরুতেই আল্লাহর একত্বের কথা অত্যন্ত জোরালো ভাষায় বলা হয়েছে এবং কেবলমাত্র এক আল্লাহর দাসত্ব কবুল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গেই পিতামাতার প্রতি কর্তব্য পালনের হুকুম অনেকটা বিস্তারিত করে পেশ করেছেন।

সূরা আল-আন’আম-এ বলা হয়েছেঃ

(আরবী********************************************)

আল্লাহর সাথে কোনো কিছুই শরীক বানাবে না এবং পিতামাতার সাথে অবশ্যই ভালো ব্যবহার করবে।

এ আয়াতেও পূর্বোল্লিখিত আয়াতের মতোই প্রথমে আল্লাহর সাথে শিরক করতে নিষেধ –এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও তাঁরই আনুগত্য স্বীকার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং তার সঙ্গে পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করার হুকুম দেয়া হয়েছে।

সূরা আল-বাকারায় বলা হয়েছেঃ

(আরবী*********************************************************************)

তোমরা এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাসত্ব কবুল করবে না এবং পিতামাতার সাথে অবশ্যই ভালো ব্যবহার করবে।

কুরআন মজীদের এসব আয়াতের বর্ণনাভঙ্গী থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, মানুষের ওপর সর্বপ্রথম হক হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার এবং তার পর পরই ও সেই সঙ্গে সঙ্গেই হক হচ্ছে পিতামাতার। অনুরূপভাবে মানুষের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহর প্রতি এবং তার পরই কর্তব্য হচ্ছে পিতামাতার প্রতি। আরো অগ্রসর হয়ে বলা যায়, প্রত্যেকটি মানুষের সর্বাধিক কর্তব্য রয়েছে আল্লাহ তা’আলা এবং পিতামাতার প্রতি। এ দুয়ের মাঝে যদি কখনও বিরোধ বাধে, একটি ছেড়ে অপরটি গ্রহণের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে আল্লাহর হক –আল্লাহর প্রতি কর্তব্য অগ্রাধিকার পাবে। তার পরে হবে পিতামাতার হক –পিতামাতার প্রতি কর্তব্য।

বিশেষ লক্ষ্য করার বিষয়, এসব আয়াতেই আল্লাহর হক ও আল্লাহর প্রতি কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে খুবই সংক্ষিপ্ত –একটি মাত্র শব্দে আর পিতামাতার প্রতি কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে অনেকটা বিস্তারিতভাবে। এ থেকে একদিকে যেমন একথা প্রমাণিত হয় যে, যে লোকই আল্লাহর বন্দেগী কবুল করবে, সে অবশ্যই পিতামাতার প্রতি তার কর্তব্য আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ীই পালন করবে। অনুরূপভাবে একথাও প্রমাণিত হয় যে, পিতামাতার প্রতি সঠিক কল্যাণমূলক ব্যবহার করা কেবল তাদের পক্ষেই সম্ভব –তারাই তা করে ও করতে পারে –যারা একমাত্র আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ দাসত্ব কবুল করেছে, যারা শপথ নিয়েছে সমগ্র জীবন ভরে এক আল্লাহর বন্দেগী করার।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পিতামাতার প্রতি কর্তবের ওপর এখানে এতখানি গুরুত্ব আরোপ করা হলো কেন? আল্লাহর বন্দেগী কবুল করার নির্দেশ দেয়ার সঙ্গে-সঙ্গে কেন পিতামাতার প্রতি ভালো ব্যবহার করার হুকুম দেয়া হলো এবং কেনই বা তা অপেক্ষাকৃত বিস্তারিত করে বলা হলো?

এ প্রশ্নের জবাব এই যে, আল্লাহ তা’আলার দেয়া জীবন-ব্যবস্থায় আকীদার দিক দিয়ে প্রথম ভিত্তি তওহীদ –আল্লাহর একত্ব; এবং সমাজ জীবনের ক্ষেত্রে প্রথম ইউনিট হচ্ছে পরিবার। আর এ পরিবার গড়ে ওঠে পিতামাতার দ্বারা। একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোকের বিবাহিত হয়ে একত্র বসবাস শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে স্থাপিত হয় একটি পরিবারের প্রথম ভিত্তি-প্রস্তর। এ আয়াতের বিশেষ বর্ণনাভঙ্গী ও পরস্পরা থেকেই প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের মূল লক্ষ্য এক আল্লাহর প্রভুত্ব ও তাঁর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বাস্তবায়িত করা, তার জন্যে পরিবার গঠন ও পারিবারিক জীবন যাপন না করলে এক আল্লাহর বন্দেগী কবুল করা ও তদনুরূপ বাস্তব জীবনধারা পরিচালিত করা সম্ভব নয়। ৱ

দ্বিতীয়ত, এ পারিবারিক জীবনকে সুষ্ঠু, সুন্দর, স্বচ্ছন্দ ও শান্তিপূর্ণ করে গড়ে তোলার জন্যে প্রয়োজন হচ্ছে পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা পিতামাতার প্রতি কর্তব্য পালনে সতত প্রস্তুত ও তৎপর হয়ে থাকা। সন্তান-সন্ততি যদি পিতামাতার প্রতি কর্তব্য পালনে প্রস্তুত না হয়, বিশেষ করে তাদের কর্তব্য ও অক্ষমতার অসহায় অবস্থায়ও যদি তাদের বোঝা বহনকারী পৃষ্ঠপোষক আশ্রয়দাতা ও প্রয়োজন পূরণকারী হয়ে না দাঁড়ায় –বরং যৌবনের শক্তি-সামর্থ্যের অহমিকায় অন্ধ হয়ে যদি তারা পিতামাতার প্রতি কোনো রূপ খারাপ ব্যবহার করে, জ্বালা-যন্ত্রণা দেয়, তাদের খেদমত না করে, তাদের সাথে বিনয় ও নম্রতাসূচক ব্যবহার না করে, যদি তাদের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধাভক্তি ও অন্তরের অকৃত্রিম দরদ পোষণ না করে, তাহলে সে অবস্থা পিতামাতার পক্ষে চরম দুঃখ, অপমান ও লাঞ্ছনার ব্যাপার হয় দাঁড়ায়। তার ফলে পরিবার ও পারিবারিক জীবনের প্রতি সাধারণ মানুষের মনে জাগে চিরন্তন অশ্রদ্ধা। এরপর অপর কোনো পুরুষ ও স্ত্রী পারিবারিক জীবন যাপবে –তথা সন্তান জন্মদান করে পিতামাতা হতে এবং সন্তানের জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম ও দুঃসহ কষ্ট স্বীকার করতে আর কেউ রাজি নাও হতে পারে। তাহলে আল্লাহর একত্ববাদের বাস্তব রূপায়ণের প্রথম ভিত্তি এবং ইসলামী সমাজ-জীবনের প্রথম ঐকিক পরিবার গড়ে উঠতে পারবে না। আর তাই যদি না হয় তাহলে সেটা যে বড় মারাত্মক অবস্থা হয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমান কর যায়।

পরিবার ও পারিবারিক জীবনের এ অপরিসীম গুরুত্বের কারণেই ইসলামে সেইসব বিধি-ব্যবস্তা ইতিবাচকভাবে দেয়া হয়েছে, যার ফলে পরিবার দৃঢ়মূল হতে পারে, হতে পারে সুখ-শান্তি ও মাধুর্যপূর্ণ এবং সেসব কাজ ও ব্যাপার-ব্যবহারকে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করে দেয়া হয়েছে যা পরিবারকে ধ্বংস করে, পারিবারিক জীবনকে তিক্ত ও বিষময় করে তোলে। আর তারই বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হয়েছে বর্তমান গ্রন্থে।


বিয়ে এবং তার গুরুত্ব
ইসলামে নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে বিয়েই হচ্ছে একমাত্র বৈধ উপায়, একমাত্র বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা। বিয়ে ছাড়া অন্য কোনো ভাবে –অন্য পথে –নারী-পুরুষের মিলন ও সম্পর্ক স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিয়ে হচ্ছে পুরুষ ও নারীর মাঝে সামাজিক পরিবেশে ও সমর্থনে শরীয়ত মুতাবেক অনুষ্ঠিত এমন এক সম্পর্ক স্থাপন, যার ফলে দুজনের একত্র বসবাস ও পরস্পরে যৌন সম্পর্ক স্থাপন সম্পূর্ণরূপে বৈধ হয়ে যায়। যার দরুন পরস্পরের ওপর অধিকার আরোপিত হয় এবং পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য অবশ্য পালনীয় হয়ে দাঁড়ায়।

(আরবী*******************************************************)

বস্তুত এ বিয়েই হচ্ছে ইসলামী সমাজে পরিবার গঠনের প্রথম প্রস্তর। একজন পুরুষ ও এক বা একাধিক স্ত্রী যখন বিধিসম্মতভাবে বিবাহিত হয়ে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একত্রে বসবাস ও স্থায়ী যৌন সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত করে, তখনই একটি পরিবারের ভিত্তি স্থাপিত হয় –হয় পারিবারিক জীবন যাপনের শুভ সূচনা।

কুরআন মজীদে এই বিয়ে ও স্ত্রী গ্রহণের ব্যবস্থাকে নবী ও রাসূলগণের প্রতি আল্লাহ তা’আলার এক বিশেষ দান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা ‘আর-রায়াদ’-এ বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************************)

হে নবী! তোমার পূর্বেও আমি অনেক নবী-রাসূল পাঠিয়েছি এবং তাদের জন্যে স্ত্রী ও সন্তানের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।

সূরা আন নূর এ বয়স্ক ছেলেমেয়ে ও দাস-দাসীদের বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্যে আল্লাহ তা’আলা নির্দেশ দিয়েছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ

(আরবী***********************************************)

এবং বিয়ে দাও তোমাদের এমন সব ছেলে-মেয়েদের, যাদের স্বামী বা স্ত্রী নেই, বিয়ে দাও তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা বিয়ের যোগ্য হয়েছে।

প্রথমোক্ত আয়াতে নবী ও রাসূলগণের জন্যে স্ত্রী গ্রহণ ও সন্তান লাভের সুযোগ করে দেয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। তার মানে, বিয়ে করা ও সন্তান-সন্ততি লাভ করা নবী-রাসূলগণের পক্ষে কোনো অস্বাভাবিক বা অবাঞ্ছনীয় কাজ নয়। কেননা তাঁরাও মানুষ আর মানুষ হওয়ার কারণেই তাঁদের স্ত্রী গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে এবং বিয়ে করলে বা স্ত্রী গ্রহণ করা হলে তাদের সন্তান-সন্ততিও হতে পারে। আবার জাহিলিয়াতের সময়কার লোকদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, আল্লাহর নবী বা রাসূল হলে তাঁর আর বিয়ে-শাদী ও সন্তান হওয়া প্রভৃতি ধরনের কোনো বৈষয়িক বা জৈবিক কাজ করা অবাঞ্ছনীয় এবং অন্যায়। এ কারণে হযরত মুহাম্মদ (স)-কে তারা উপযুক্ত বা সঠিক নবী বলে মানত না। এরই প্রতিবাদ করে আল্লাহ তা’আলা প্রথমোক্ত আয়াতে বলেছেনঃ বিয়ে করা, স্ত্রী গ্রহণ করা, আর সন্তান-সন্ততি হওয়া হযরত মুহাম্মদের বেলায় নতুন কোনো ব্যাপার নয়। তাঁর পূর্বেও বহু নবী ও রাসূল দুনিয়ায় প্রেরিত হয়েছিলেন এবং তাঁদের প্রায় সকলেই বিবাহিত ছিলেন, তাঁদের স্ত্রী ছিল আর ছিল সন্তান-সন্ততি –যেমন হযরত মুহাম্মাদের রয়েছে। শুধু তাই নয়, বিয়ে করা, স্ত্রী গ্রহণ করা ও সন্তান লাভ হওয়ার ব্যবস্থা করা –আল্লাহ তা’আলার এক বিশেষ অনুগ্রহ। আল্লাহ তাঁর নবী ও রাসূলগণের প্রতি এ নেয়ামত দিয়েছিলেন বিপুলভাবে। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-ও আল্লাহর এ বিশেষ নেয়ামতের দান থেকে বঞ্চিত থেকে যান নি।

নবী করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

চারটি কাজ নবীগণের সুন্নাতের মধ্যে গণ্য; তা হচ্ছেঃ সুগন্ধি ব্যবহার করা, বিয়ে করা, মিসওয়াক করা এবং খাতনা করানো।

উপরে উদ্ধৃত দ্বিতীয় আয়াতটিতে বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্যে ছেলেমেয়ের অভিভাবক মুরুব্বীদের প্রতি স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ আয়াতের আরবী তরজমা আল্লামা জামালুদ্দীন আল-কাশেমীর ভাষায় এরূপঃ

(আরবী****************************************************************************)

তোমাদের স্বাধীন ছেলেমেয়েদের মধ্যে যার যার স্বামী বা স্ত্রী নেই, তাদেরকে বিয়ে দাও। আর তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যেও যাদের বিয়ের যোগ্যতা রয়েছে, তাদেরও বিয়ে দাও।

‘যার স্বামী বা স্তী নেই’ মানে যাকে আদৌ বিয়ে দেয়া হয়নি –যারা কুমার বা কুমারী, তাদের সকলেরই বিয়ের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তার মানে, একবারও যাদের বিয়ে হয়নি তাদের জন্য বিয়ের ব্যবস্থা তো করতেই হবে; তেমনি যাদের একবার বিয়ে হয়েছে, কিন্তু তালাক কিংবা মৃত্যু যে-কোন কারণে এখন জুড়িহারা তাদেরও বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। একবার বিয়ে হলে পরে কোনো কারণে স্বামীহারা বা স্ত্রীহারা হলে পুনরায় তার বিয়ের ব্যবস্থা না করা কিংবা বিয়ে করতে রাজি না হওয়া আল্লাহর নির্দেশের পরিপন্থী। আমাদের সমাজে এরূপ প্রায়ই দেখা যায় যে, কোনো মেয়ে হয়ত একবার স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছে অথবা স্বামীর মৃত্যুতে বিধবা হয়ে গিয়েছে, অনুরূপভাবে কোনো ছেলের স্ত্রী মরে গেছে কিংবা তালাক দিতে বাধ্য হয়েছে, এরূপ অবস্থায় তারা পূনর্বিবাহে প্রস্তুত হয় না। সমাজের শালীনতা ও পবিত্রতা এবং মানুষের জৈব প্রবণতা ও ভাবধারার দৃষ্টিতে এরূপ কাজ কল্যাণকর হতে পারে না।

মোটকথা, বিয়ের যোগ্য হয়েও কেউ যাতে অবিবাহিত ও অকৃতদায় হয়ে থাকতে না পারে, তার ব্যবস্থা করাই ইসলামের লক্ষ্য। কেননা অকৃতদার জীবন কখনই পবিত্র ও পরিতৃপ্ত জীবন হতে পারে না। অবশ্য যে লোক বিয়ে করতে সমর্থ নয়, তার কথা স্বতন্ত্র।

একবার কিছু সংখ্যক সাহাবী সারা রাতদিন ধরে ইবাদত করার, সারা রাত জেগে থেকে নামায পড়ার, সারা বছর ধরে রোযা রাখার এবং বিয়ে না করার সংকল্প গ্রহণ করেন। নবী করীম (স) এসব কথা শুনতে পেয়ে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন এবং রাগত স্বরে বলেনঃ

(আরবী**************************************************************)

তোমরাই কি এ ধরনের কথাবার্তা বলনি? আল্লাহর শপথ, একি সত্যি নয় যে, আমিই তোমাদের তুলনায় আল্লাহকে বেশি ভয় করি, আমিই তোমাদের চেয়ে বেশি আল্লাহর নাফরমানী থেকে বেঁচে থাকি? …..কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি রোযা থাকি, রোযা ভঙ্গও করি, নামায পড়ি, শুয়ে নিদ্রাও যাই এবং রমণীদের পানিও গ্রহণ করি। এই হচ্ছে আমার নীতি-আদর্শ; অতএব যে লোক আমার এই নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে, সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়। (বুখারী, মুসলিম)

এ হাদসের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ

(আরবী****************************************************************)

এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিয়ে করা নবীর সুন্নাত বিশেষ। মনীষী মহলাব বলেছেনঃ বিয়ে ইসলামের অন্যতম রীতি ও বিধান। আর ইসলামে বৈরাগ্যবাদের কোনো অবকাশ নেই। যে লোক রাসূলের সুন্নাতের প্রতি অনাস্থা ও অবিশ্বাসের কারণে বিয়ে পরিত্যাগ করবে, সে অবশ্যই ভৎসনার যোগ্য বিদয়াতী। তবে যদি কেউ এজন্যেবিয়ে না করে যে, তাহলে তার নিরিবিলি জীবন ইবাদতে কাটিয়ে দেয়া সহজ হবে, তবে তাকে দোষ দেয়া যাবে না। ইমাম দায়ূদ জাহেরী এবং তার অনুসারীদের মতে বিয়ে করা ওয়াজিব।

রাসূলের বাণী ‘সে আমার উম্মতের মধ্যেই গণ্য নয়’-এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে এই যে, যে লোক রাসূলের আদর্শের অনুসরণ না করবে, সে ইসলামেরসহজ ঋজু ও একনিষ্ঠ পথের পথিক হতে পারে না, বরং রাসূলের আদর্শ অনুসরণ না করবে, সে ইসলামে সহজ ঋজু ও একনিষ্ঠ পথের পথিক হতে পারে না, বরং রাসূলের আদর্শের সত্যিকার অনুসারী হবে সে ব্যক্তিঃ

(আরবী***************************************************)

যে লোক নির্দিষ্টভাবে ইফতার করবে (রোযা ভঙ্গ করবে) রোযা পালনের সামর্থ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে, নিদ্রা যাবে রাতে ইবাদতের জন্যে দাঁড়াবার শক্তি লাভের উদ্দেশ্যে এবং বিয়ে করবে দৃষ্টি ও যৌন-অঙ্গকে কলুষমুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে।

প্রসঙ্গত বলা যায়, যদি কেউ রাসূলের এ আদর্শের বিরোধিতা করে এই ভেবে যে, রাসূলের আদর্শ অপেক্ষা অন্য আদর্শ উত্তম ও অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য, তাহলে রাসূলের এ বাক্যাংশের অর্থ হবেঃ

(আরবী**********************************************************_

সে আমার মিল্লাত ও জাতির মধ্যে গণ্য নয়।

অন্য কথায় সে পূর্ণ অর্থে মুসলিম নয়। কেননা এরূপ ধারণা পোষণ করা সুস্পষ্ট কুফরী।

হযরত আনাস (রা) বলেনঃ

(আরবী*****************************************************)

নবী করীম (স) আমাদেরকে বিয়ে করতে আদেশ করতেন, আর অবিবাহি নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করা থেকে খুব কঠোর ভাষায় নিষেধ করতেন।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) নবী করীমের নিম্নোক্ত বাণী বর্ণনা করেছেনঃ

(আরবী**********************************************************)

কুমারিত্ব ও অবিবাহিত নিঃসঙ্গ জীবন যাপনের কোনো নিয়ম ইসলামে নেই।

নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************************)

যে লোক য়ে করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বিয়ে করে না, সে আমার উম্মতের মধ্যে শামিল নয়।

‘ইবনে মাজাহ’ কিতাবে হযরত আয়েশা (রা) থেকে রাসূলেরর নিম্নোক্ত বাণী বর্ণিত হয়েছেঃ

(আরবী**********************************************************************)

রাসূলে করীম (স) বলেছেন, বিয়ে করা আমার আদর্শ ও স্থায়ী নীতি, যে লোক আমার এ সুন্নাত অনুযায়ী আমল করবে না, সে আমার দলভুক্ত নয়।

বস্তুত বিয়ে স্বভাবের দাবি, মানব প্রকৃতির নিহিত প্রবণতার স্বাভাবিক প্রকাশ, মানব সমাজের দৃষ্টিতেও অত্যন্ত জরুরী। এজন্যে রাসূলে করীম (স) সমাজের যুবক-যুবতীদের সম্বোধন করে বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************)

হে যুব সমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ের সামর্থ্য রাখে, তাদের বিয়ে করা কর্তব্য। কেননা বিয়ে দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণকারী, যৌন অঙ্গের পবিত্রতা রক্ষাকারী। আর যার সামর্থ্য নেই সে যেন রোযা রাখে, যেহেতু রোযা হবে তার ঢাল স্বরূপ।

ইসলামে বিয়ের গুরুত্ব যে কতখানি, তা উপরিউক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে। কিন্তু দুনিয়ার অন্যান্য ধর্মে ও সমাজে বিয়ের তেমন কোনো গুরুত্ব স্বীকার করা হয়নি। বর্তমানে প্রাচীন কালের মানব সমাজের যে ইতিহাস প্রচলিত রয়েছে –আমার মতে তার প্রায় সম্পূর্ণটাই কল্পিত। তাতে ধারণা দেয়া হয়েছে যে, আদিম সমাজে বিয়ের প্রচলন ছিল না, বিয়ে হচ্ছে পরবর্তীকালের বিকাশমান সভ্যতার অবদান। খ্রিষ্টধর্মে বিয়েকে একভাবে নিষেধই করে দেয়া হয়েছিল। ক্রীনথিওনের নামে লিখিত চিঠিতে উল্লিখিত রয়েছেঃ

আমি অবিবাহিত ও বিধবাদের সম্বন্ধে মনে রি যে, তাদের এরকমই থাকা উচিত। কিন্তু যদি সংযম রক্ষা করতে না পারে, তবেই বিয়ে করবে।

উক্ত চিঠির অন্যত্র বলা হয়েছেঃ

তোমার স্ত্রী না থাকলে তুমি স্ত্রীর সন্ধান করো না। আর যদি বিয়ে করই তবু তাতে গুনাহ নেই।

মার্টিন লূথার সর্বপ্রথম বিয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁর দৃষ্টিতে বিয়ে হচ্ছে সম্পূর্ণ দুনিয়াদারীর কাজ। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের নেতৃস্থানীয় লোকেরাও একে ধর্ম সম্পর্কহীন একটি কাজ মনে করতেন। বিয়ের স্বপক্ষে তারা কোন স্পষ্ট রায় দেন নি। কিন্তু বিয়ে করা যে মানুষের –স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েরই –স্বভাবের এক প্রচণ্ড ও অনমনীয় দাবি, তা দুনিয়ার সব বিজ্ঞানীই স্বীকার করেছেন। গ্রীক-বিজ্ঞানী জালিনুস বলেছেনঃ

প্রজনন ক্ষমতার ওপর আগুন ও বায়ুর প্রভাব রয়েছে, তার স্বভাব উষ্ণ ও সিক্ত। এর অধিকাংই যদি অবরুদ্ধ হয় এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত অবরুদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে নানা ধরনের মারাত্মক রোগ জান্মিতে পারে। কখনো মনে ভীতি ও সন্ত্রাসের ভাব সৃষ্টি হয়, কখনো হয় পাগলামীর রোগ। আবার মৃগী রোগও হতে পারে। তবে প্রজনন ক্ষমতার সুস্থ বহিষ্কৃতি ভালো স্বাস্থ্যের কারণ নয়। বহু প্রকারের রোগ থেকেও সে সুরক্ষিত থাকতে পারে।

প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদ আল্লামা নফীসী বলেছেনঃ

(আরবী***************************************************************)

শুক্র প্রবল হয়ে পড়লে অনেক সময় তা অত্যন্ত বিষাক্ত প্রকৃতি ধারণ করে বসে। দিল ও মগজের দিকে তা এক প্রকার অত্যন্ত খারাপ বিষাক্ত বাষ্প উত্থিত করে দেয়, যার ফলে বেহুঁশ হয়ে পড়া বা মৃগী রোগ প্রভৃতি ধরনের ব্যাধির সৃষ্টি হয়।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ দিহলভী বিয়ে না করার অনিষ্টাকারিতা সম্পর্কে লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

জেনে রাখো, শুক্রের প্রজনন ক্ষমতা যখন দেহে খুব বেশী হয়ে যায়, তখন তা বের হতে না পারলে মগজে তার বাষ্প উত্থিত হয়।

কিন্তু বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতা বিয়ের গুরুত্বকে নষ্ট করে দিয়েছে। পারিবারিক জীবনকে চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। পাশ্চাত্য মনীষীদের বিচারে ইউরোপীয় সমাজে বিয়ে ও পারিবারিক জীবনের ব্যর্থতার কতগুলো কারণ রয়েছে। কারণগুলোকে নিম্নোক্তভাবে আট-নয়টি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারেঃ

১. বিয়ে এবং পারিবারিক জীবন সম্পর্কে খ্রিষ্টধর্মের অননুকূল দৃষ্টিভঙ্গি;

২. আধুনিক সভ্যতার চোখ জলসানো চাকচিক্য ও ব্যাপক কৃত্রিমতা;

৩. শিল্প বিপ্লবোত্তর নারী স্বাধীনতার আন্দোলন;

৪. নারী স্বাধীনতা সম্পর্কে ভুল ধারণা;

৫. নারী-পুরুষের সাম্য ও সমানাধিকারের অবৈজ্ঞানিক দাবি;

৬. স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ববোধ না থাকা;

৭. পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ভাবধারা এবং নৈতিকতা ও মানবিকতা ও মানবিকতার পতন;

৮. পারিবারিক জীবনে সুষ্ঠুতা, সুস্থতা ও সফলতা লাভের জন্যে অপরিহার্য নিয়ম বিধানের অভাব; এবং

৯. সাধারণভাবে জনগণের ধর্মবিমুখতা, ধর্মহীনতা ও ধর্মদ্রোহিতা।

পরিবার ও পারিবারিক জীবনে আধুনিক ইউরোপে যে ব্যর্থতা এসেছে, তার অন্তর্নিহিত কারণসমূহ ইউরোপীয় চিন্তাবিদদের আলোচনার দৃষ্টিতেই এখানে উল্লেখ করা হলো। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামের বিধান এই গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হবে। তার ফলে উভয় সমাজ ব্যবস্থা ও আদর্শের মৌলিক পার্থক্য যেমন সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে, তেমনি বিশ্বমানবতার পক্ষে কোন ব্যবস্থাটি কল্যাণময় –মানবোপযোগী, তাও প্রতিভাত হবে।

ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ে ও পরিবার সম্পূর্ণরূপে একটি দেওয়ানী চুক্তির ফল। নারীর নিজেকে বিয়ের জন্যে উপস্থিত করা এবং পুরুষের তা গ্রহণ করা –এই ‘ঈজাব’ ও ‘কবুল’ দ্বারাই বিয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এরই ফলে স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি পরস্পরের কতগুলো অধিকার নির্দিষ্ট হয়। দু’হাজার বছরের ধারাবাহিক ও ক্রমাগত চেষ্টা সাধনা সত্ত্বেও ইউরোপীয় সমাজ বিয়ে ও পরিবারকে অতখানি স্থান ও মর্যাদা দিতে পারেনি, যতখানি চৌদ্দশ বছর আগে ইসলাম দিয়েছে।

বিয়ের উদ্দেশ্য

বিয়ে এবং বিবাহিত জীবন যাপনের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। দুনিয়ার কোনো কাজই সুস্পষ্ট বা অস্পষ্ট কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া সম্পাদিত হয় নি। কুরআন মজীদে বিয়ের উদ্দেশ্যের কথা স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে। কুরআনের এতদসম্পর্কিত আয়াতসমূহকে সামনে রেখে চিন্তা করলে পরিস্কার মনে হয়, কুরআনের দৃষ্টিতে বিয়ের উদ্দেশ্য নানাবিধ। এর একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাশী নৈতিক চরিত্র, পবিত্র পরিচ্ছন্ন ও কলুষমুক্ত রাখতে পারা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে মনের গভীর প্রশান্তি ও স্থিতি লাভ এবং তৃতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে পারিবারিক জীবন যাপন করে সন্তান জন্মদান, সন্তান লালন-পালন ও ভবিষ্যত সমাজের মানুষ গড়ে তোলা। নিম্নোক্ত কুরআন ভিত্তিক আলোচনা থেকে এসব উদ্দেশ্যের কথা স্পষ্ট হয়ে উঠে।

সূরা আন-নিসা’র এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ

(আরবী****************************************************************)

এই মুহাররম মেয়েলোক ছাড়া অন্য সব মেয়েলোক বিয়ে করা তোমাদের জন্যে জায়েয –হালাল করে দেয়া হয়েছে এই উদ্দেশ্যে যে, তোমরা তোমাদের ধন-মালের বিনিময়ে তাদের লাভ করতে চাইবে নিজেদের চরিত্র দুর্জয় দুর্গের মতো সুরক্ষিত রেখে এবং বন্ধনহীন অবাধ যৌন চর্চা করা থেকে বিরত থেকে।

এ আয়াত থেকে প্রথম জানা গেল যে, নির্দিষ্ট কতকজন মেয়েলোক বিয়ে করা ও তাদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হারাম। সেই হারাম বা মুহাররম মেয়েলোক কয়জন ছাড়া আর সব মেয়েলোকই বিয়ে করা পুরুষের জন্যে হালাল। দ্বিতীয়ত এসব হালাল মেয়েলোক তোমরা গ্রহণ করবে ‘মোহরানা’ স্বরূপ দেয়া অর্থের বিনিময়ে বিয়ে করে। তৃতীয়ত মোহরানা ভিত্তিক বিয়ে ছাড়া অন্য কোনোভাবে এই হালাল মেয়েদের সাথেও যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারা যায় না এবং পঞ্চমত এভাবে বিয়ে করে নৈতিক চরিত্রের এক দুর্জয় দুর্গ –পরিবার-রচনা করা যায় এবং অবাধ যৌন চর্চার মতো চরিত্রহীনতার কাজ থেকে নিজকে বাঁচানো যায়। আর বিয়ের উদ্দেশ্যও এই যে, তার সাহায্যে স্বামী-স্ত্রীর নৈতিক চরিত্রের দুর্গকে দুর্জয় করতে হবে এবং অবাধ যৌন চর্চা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে হবে।

সূরা আন-নিসা’র অপর এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************************)

তোমরা মেয়েদের অভিভাবক মুরুব্বীদের অনুমতিক্রমে তাদের বিয়ে করো, অবশ্য অবশ্যই তাদের দেন-মোহর দাও, যেন তারা তোমাদের বিয়ের দুর্গে সুরক্ষিত হয়ে থাকতে পারে এবং অবাধ যৌন চর্চায় লিপ্ত হয়ে না পড়ে। আর গোপন বন্ধুত্বের যৌন উচ্ছৃংখলতায় নিপতিত না হয়।

এ আয়াত যদিও ক্রীতদাসদাসীদেরকে বিয়ে দেয়া সম্পর্কে, কিন্তু সাধারণ দৃষ্টিতে এ আয়াত থেকে বিয়ের উদ্দেশ্য জানা যায়। আর তা হচ্ছে, বিয়ে করে পরিবার-দুর্গ রচনা করা, জ্বেনা-ব্যভিচার বন্ধ করা, গোপন বন্ধুত্ব করে যৌন স্বাদ আস্বাদন করার সমস্ত পথ বন্ধ করা। আর এসব কেবল বিয়ে করে পারিবারিক জীবন যাপনের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। পূর্বোক্ত আয়াতে পুরুষদের নৈতিক পবিত্রতা রক্ষার কথা বলা হয়েছে আর এ আয়াতে সাধারণভাবে সকল শ্রেণীর মেয়েদের নৈতিক চরিত্র রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে এবং দুটো আয়াতেই পরিবারের দুর্জয় দুর্গ রচনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইমাম রাগেব লিখেছেনঃ

(আরবী******************************************************************)

বিয়েকে দুর্গ বলা হয়েছে, কেননা তা স্বামী-স্ত্রীকে সকল প্রকার লজ্জাজনক কুশ্রী কাজ থেকে দুর্গবাসীদের মতোই বাঁচিয়ে রাখে।

নারী-পুরুষ কেবলমাত্র বিয়ের মাধ্যমেই পরস্পর মিলিত হবে। তাহলেই উভয়ের চরিত্র ও সতীত্ব পূর্ণ মাত্রায় রক্ষা পাবে। এ দুটো আয়াতেই বিয়েকে (আরবী******) ‘দুর্গ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। দুর্গ যেমন মানুষের আশ্রয়স্থল, শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচার নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা, বিয়ের ফলে রচিত পরিবারও তেমনি স্বামী-স্ত্রীর নৈতিক চরিত্রের পক্ষে একমাত্র রক্ষাকবচ। মানুষ বিবাহিত হলেই তার চরিত্র ও সতীত্ব রক্ষা পেতে পারে –অবশ্য যদি সে পরিবার সুরক্ষিত দুর্গের মতোই দুর্ভেদ্য ও রুদ্ধদ্বার হয়। মোটকথা, নৈতিক চরিত্র সংরক্ষণ ও পবিত্রতা –সতীত্বের হেফাযত হচ্ছে বিয়ের অন্যতম মহান উদ্দেশ্য।

নবী করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী*****************************************************)

যে লোক কিয়ামতের দিন পাক-পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন চরিত্র নিয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবার বাসনা রাখে, তার কর্তব্য হচ্ছে (স্বাধীন মহিলা) বিয়ে করা।

অর্থাৎ বিয়ে হচ্ছে চরিত্রকে পবিত্র রাখার একমাত্র উপায়। বিয়ে না করলে চরিত্র নষ্ট হওয়ার আশংকা প্রবল হয়ে থাকে। মানুষ আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমা লংঘন করে পাপের পংকিল আবর্তে পড়ে যেতে পারে যেকোনো দুর্বল মুহুর্তে।

বাস্তবিকই যে লোক তার নৈতিক চরিত্রকে পবিত্র রাখতে ইচ্ছুক, বিয়ে করা ছাড়া তার কোনোই উপায় নেই। কেননা এই উদ্দেশ্যে বিয়ে করলে সে এ ব্যাপারে আল্লাহর প্রত্যক্ষ সাহায্য লাভ করতে পারবে। নিম্নোক্ত হাদীস থেকে একথা প্রমাণিত হয়। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************)

তিন ব্যক্তির সাহায্য করা আল্লাহর কর্তব্য হয়ে পড়ে। তারা হলোঃ

১. যে দাস নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আদায় করে দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে চায় (আজকাল বলা যায়, কোনো ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তার ঋণ আদায় করতে দৃঢ়সংকল্প);

২. যেলোক বিয়ে করে নিজের নৈতিক পবিত্রতা রক্ষা করতে চায়; আর

৩. যে লোক আল্লাহর পথে জিহাদে আত্মসমর্পিত।

বস্তুত নৈতিক পবিত্রতা রক্ষা করা কিছুমাত্র সহজসাধ্য কাজ নয়। বরং এ হচ্ছে অত্যন্ত কঠিন ও দুঃসাধ্য ব্যাপার। কেননা এজন্যে প্রকৃতি নিহিত দুষ্প্রবৃত্তিকে –যৌন লালসা শক্তিকে –দমন করতে হবে। আর এ যদি সম্ভব না হয়, তাহলে সে লোক পাশবিকতার নিম্নতম পঙ্কে নেমে যাবে। কাজেই যদি কেউ এ থেকে বাঁচতে চায়, আর এ বাঁচার উদ্দেশ্যেই যদি বিয়ে করে –স্ত্রী গ্রহণ করে, তবে আল্লাহর সাহায্য-সহযোগিতা সে অবশ্যই লাভ করবে। আর আল্লাহর এই সাহায্যেই সে লোক বিয়ের মাধ্যমে স্বীয় নৈতিক পবিত্রতা রক্ষা করতে সফলকাম হবে।

কেবলমাত্র বিয়ের মাধ্যমেই যে সতীত্ব ও নৈতিক পবিত্রতা রক্ষা করা যেতে পারে, কুরআন মজীদে তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ

(আরবী********************************************************************)

স্ত্রীরা হচ্ছে তোমাদের জন্য পোশাক স্বরূপ, আর তোমরা হচ্ছ তাদের জন্যে পোশাকবৎ।

অর্থাৎ পোশাক যেম করে মানবদেহকে আবৃত করে দেয়, তার নগ্নতা ও কুশ্রীতা প্রকাশ হতে দেয় না এবং সব রকমের ক্ষতি-অপকারিতা থেকে বাঁচায়, স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের জন্যে ঠিক তেমনি। কুরআন মজীদেই পোশাকের প্রকৃতি বলে দেয়া হয়েছে এ ভাষায়ঃ

(আরবী********************************************************)

নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের জন্যে পোশাক নাযিল করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থানকে ঢেকে রাখে।

পূর্বোক্ত আয়াতে স্বামীকে স্ত্রীর জন্যে পোশাক বলা হয়েছে। কেননা তারা দুজনই দুজনের সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি ঢাকবার ও যৌন-উত্তেজনার পরিতৃপ্তি সাধনের বাহন। ইমাম রাগেব লিখেছেনঃ

(আরবী************************************************************)

পোশাক বলতে স্ত্রীর পক্ষে স্বামীকে (আর স্বামীর পক্ষে স্ত্রীকে) মনে করা হয়েছে। কেননা এ স্বামী ও স্ত্রী একদিকে নিজে নিজের জন্যে পোশাকবৎ আবার প্রত্যেকে অপরের জন্যেও তাই। এরা কেউই কারো দোষ জাহির হতে দেয় না –যেমন করে পোশাক লজ্জাস্থানকে প্রকাশ হতে দেয় না।

বিয়ের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে নারী-পুরুষের হৃদয়াভ্যন্তরস্থ স্বাভাবিক প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসারদাবি পূরণ এবং যৌন উত্তেজনার পরিতৃপ্তি ও স্তিতি বিধান। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ

(আরবী****************************************************************)

এবং আল্লাহর একটি বড় নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদেরই মধ্য থেকে জুড়ি গ্রহণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন যেন তোমরা সে জুড়ির কাছ থেকে পরম পরিতৃপ্তি লাভ করতে পার। আর তোমাদের মধ্যে তিনি প্রেম-ভালোবাসা ও দরদ-মায়া ও প্রীতি-প্রণয় সৃষ্টি করে দিয়েছেন।

‘তোমাদেরই মধ্য থেকে’ অর্থঃ

(আরবী**********************************************)

তোমাদেরই স্বজাতির মধ্য থেকে; অপর জাতির লোককে নয়।

অর্থাৎ মানব-মানবীরজুড়ি মানব-মানবীকে বানাবার নিয়ম করে দেয়া হয়েছে। নিম্নস্তরের বা উচ্চস্তরের অপর কোনো জাতির মধ্য থেকে জুড়ি গ্রহণের নিয়ম করা হয়নি।

এ আয়াতে জুড়ি গ্রহণের বা বিয়ে করার উদ্দেশ্যস্বরূপ বলা হয়েছেঃ যেন তোমরা সে জুড়ির কাছ থেকে পরম পরিতৃপ্তি ও গভীর শান্তি-স্বস্তি লাভ করতে পার। তার মানে, স্বামী-স্ত্রীর মনের গভীল পরিতৃপ্তি –শান্তি স্বস্তি লাভ হচ্ছে বিয়ের উদ্দেশ্য। আর এ বিয়ের মাধ্যমেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্ব-ভালোবাসা জন্ম নিতে পেরেছে। আয়াতের শেষাংশের ব্যাখ্যা করে ইমাম আলূসী লিখেছেনঃ

(আরবী************************************************************)

অর্থাৎ তোমাদের জন্যে আল্লাহ তা’আলা শরীয়তের বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা –বিয়ের মাধ্যমে তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্ব-প্রেম-প্রণয় এবং মায়া-মমতা দরদ-সহানুভূতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন, অথচ পূর্বে তোমাদের মাঝে না ছিল তেমন কোন পরিচয়, না নিকটাত্মীয় বা রক্ত-সম্পর্কের কারণে মনের কোনোরূপ সুদৃঢ় সম্পর্ক।

হযরত হাওয়া ও হযরত আদমের প্রথম সাক্ষাত হয়, তখন হযরত আদম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ (আরবী*****) ‘তুমি কে?’ তিনি বললেনঃ

(আরবী**********************************************************)

আমি হাওয়া, আমাকে আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি করেছেন এ উদ্দেশ্যে যে, তুমি আমার নিকট পরিতৃপ্তি ও শান্তি লাভ করবে। আর আমি পরিতৃপ্তি ও শান্তি লাভ করব তোমার কাছ থেকে।

অতএব এ থেকে আল্লাহর বিরাট সৃষ্টি ক্ষমতা ও অপরিসীম দয়া-অনুগ্রহের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। সূরা আল আ’রাফ-এর নিম্নোক্ত আয়াতেও এ কথাই বলা হয়েছে গোটা মানব জাতি সম্পর্কেঃ

(আরবী*******************************************************************)

সেই আল্লাহই তোমাদেকে সৃষ্টি করেছেন একটিমাত্র মানবাত্মা থেকে এবং তার থেকেই বানিয়েছেন তার জুড়ি, যেন সে তার কাছে পরম সান্ত্বনা ও তৃপ্তি লাভ করতে পারে।

এখানে পরম শান্তি ও তৃপ্তি বলতে মনের শান্তি ও যৌন উত্তেজনার পরিতৃপ্তি ও চরিতার্থতা বোঝানো হয়েছে। বস্তুত মনের মিল, জুড়ির প্রতি মনের দুর্নিবার আকর্ষণ এবং যৌন তৃপ্তি হচ্ছে সমগ্র জীবন ও মনের প্রকৃত সুখ ও প্রশান্তি লাভের মূল কারণ। তা থেকে বঞ্চিত হওয়ার মানে চরম অতৃপ্তি ও অশান্তির ভিতরে জীবন কাটিয়ে দেয়া। মনের প্রশান্তি ও যৌন তৃপ্তি যে বাস্তবিকই আল্লাহর এক বিশেষ দান, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এজন্যে ঈমানদার স্ত্রী-পুরুষের কর্তব্য হচ্ছে এ প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তিকে আল্লাহর সন্তোষ এবং তাঁরই দেয়া বিধান অনুসারে লাভ করতে চেষ্টা করা। এ আয়াতেও আল্লাহ তা’আলা মানব জাতির সৃষ্টি ও প্রকৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, এই দুনিয়ায় মানুষের সৃষ্টি ও অস্তিত্ব যেমন এক স্বাভাবিক ব্যাপার, জুড়ি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাও তেমনি এক প্রকৃতিগত সত্য, এ সত্যকে কেউই অস্বীকার করতে পারে না। এজন্যে প্রথম মানুষ সৃষ্টি করার পরই তার থেকে তার জুড়ি বানিয়েছেন। এ জুড়ি যদি বানানো না হতো, তাহলে প্রথম মানুষের জীবন অতৃপ্তি আর একাকীত্বের অশান্তিতে দুঃসহ হয়ে উঠত। আদিম মানুষের জীবনে জুড়ি গ্রহনের এ আবশ্যকতা আজও ফুরিয়ে যায় নি। প্রথম মানুষ যুগলের ন্যায় আজিকার মানব-দম্পতিও স্বাভাবিকভাবে পরস্পরের মুখাপেক্ষী। আজিকার স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের কাছ থেকে লাভ করে মনের প্রশান্তি ও যৌন তৃপ্তি, পায় কর্মের প্রেরণা। একজনের মনের অস্থিরতা ও উদ্বেগ ভারাক্রান্ততা অপরজনের নির্মল প্রেম-ভালবাসার বন্যাস্রোতে নিঃশেষ ধুয়ে মুছে যায়। একজনের নিজস্ব বিপদ-দুঃখও অন্যজনের নিকট নিজেরই দুঃখ ও বিপদরূপে গণ্য ও গৃহীত হয়। একজনের যৌন লালসা-কামনা উত্তেজনা অপরজনের সাহায্যে পায় পরম তৃপ্তি, চরিতার্থতা ও স্থিতি।

এসব কথা থেকে প্রমাণিত হলো যে, মানুষের –সে স্ত্রী হোক কি পুরুষ –যৌন উত্তেজনা পরিতৃপ্তি লাভ এবং তার উচ্ছৃঙ্খলতার প্রতিবিধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে জুড়ি গ্রহণ বা বিয়ে ও বিবাহিত জীবন। যৌন উত্তেজনা মানুষকে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট করে। এই সময় পুরুষ নারীর দিকে এবং নারী পুরুসের দিকে স্বাভাবিকভাবেই ঝুঁকে পড়ে। তখন একজন অপরজনের নিকট স্বীয় স্বাভাবিক শক্তি ও বৈশিষ্ট্যের দরুন মনোবাঞ্ছা পূরনের নিয়ামত হয়ে থাকে। এজন্যে রাসূলে করীম (স) নির্দেশ দিয়েছেন যে, এরূপ অবস্থায় পুরুষ যেন স্বীয় (বিবাহিতা) স্ত্রীর কাছে চলে যায়।

তিনি বলেছেনঃ

(আরবী*********************************************************)

কোনো নারী যখন তোমাদের কারো মনে লালসা জাগিয়ে দেয়, তখন সে যেন তার নিজের স্ত্রীর কাছে চলে যায় এবং তার সাথে মিলিত হয়ে স্বীয় উত্তেজনার উপশম করে নেয়। এর ফলে সে তার মনের আবেগের সান্ত্বনা লাভ করতে পারবে এবং মনের সব অস্থিরতা ও উদ্বেগ মিলিয়ে যাবে।

ইমাম নববী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************************)

যে লোক কোনো মেয়েলোক দেখবে এবং তার ফলে তার যৌন প্রবৃত্তি উত্তেজিত হয়ে উঠবে, সে যেন তার স্ত্রীর কাছে আসে এবং তার সঙ্গে মিলিত হয়। এর ফলে তার যৌন উত্তেজনা সান্ত্বনা পাবে, মনে পরম প্রশান্তি লাভ হবে, মন-অন্তর তার বাঞ্ছা ও কামনা লাভ করে এককেন্দ্রীভূত হতে পারবে।

বিয়ে এবং বিবাহিত জীবনের তৃতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্তান লাভ।

কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************************)

এখন সময় উপস্থিত, স্ত্রীদের সাথে তোমরা এখন সহবাস করতে পার –তাই তোমরা করো এবং আল্লাহ তোমাদের জন্যে যা কিছু নির্ধারিত করে দিয়েছেন, তাই তোমরা সন্ধান করো, তাই লাভ করতে চাও।

এখানে যে (আরবী*****) ‘মুবাশিরাত’-এর অনুমতি দেয়া হয়েছে, তার মানে হচ্ছে (আরবী************************) একজনের শরীরের চামড়ার সাথে অপরজনের দেহের চামড়াকে লাগিয়ে দেয়া, মিশিয়ে দেয়া। আর এর লক্ষ্যগত অর্থ হচ্ছেঃ (আরবী***************) স্ত্রী সহবাস –সঙ্গম, যার জন্যে স্বামীর দেহের চামড়াকে স্ত্রীর দেহের চামড়ার সাথে মিলিয়ে-মিশিয়ে দিতে হয়’। আর ‘আল্লাহ যা তোমাদের জন্যে নির্ধারণ করেছেন’ বলে দুটি কথা বরতে চাওয়া হয়েছে। একটি হচ্ছে রমযান মাসের রাত্রি বেলায় স্ত্রী-সহবাসের অনুমতি দান। কেননা এ আয়াত সেই প্রসঙ্গেই অবতীর্ণ হয়েছে। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে সন্তান লাভ। কেননা স্ত্রী-সহবাবের মূল লক্ষ্য হলো সন্তান তোমার জন্যে নির্ধারিত করে রাখা হয়েছে, স্ত্রী-সহবাসের মূলে নিছক যৌন উত্তেজনার পরিতৃপ্তি আর লালসার চরিতার্থ তাই কখনো স্ত্রী সহবাসের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। এজন্যে যে ধরনের যৌন-উত্তেজনা পরিতৃপ্তির ফলে সন্তান লাভ হয় না যেমন পুংমৈথুন বা হস্তমৈথুন –তাকে শরীয়তে হারাম করে দেয়া হয়েছে। আর যে ধরনের স্ত্রী-সহবাসের ফলে সন্তান লাভ সম্ভব হয় না কিংবা সন্তান হওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে কিংবা স্ত্রী-সহবাস হওয়া সত্ত্বেও সন্না হতে পারে না, শরীয়তে তাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

এজন্যেই সূরা বাকারার নিম্নোক্ত আয়াতে বলা হয়েছেঃ

(আরবী***************************************************************)

তোমাদের স্ত্রীরা হচ্ছে তোমাদের ক্ষেতস্বরূপ, অতএব তোমরা তোমাদের ক্ষেতে গমন করো –যেভাবে তোমরা চাও –পছন্দ করো।

এ আয়াতে স্ত্রীদেরকে কৃষির ক্ষেত বলা হয়েছে। অতএব স্বামীরা হচ্ছে এ ক্ষেতের চাষী। চাষী যেমন কৃষিক্ষেতে শ্রম করে ও বীজ বপন করে ফসলের আশায়, তেমনি স্বামীদেরও কর্তব্য হচ্ছে স্ত্রী-সহবাস করে এমনভাবে বীজ বপন করা, যাতে সন্তানের ফসল ফলতে পারে –সন্তান লাভ সম্ভব হতে পারে।

কুরআনের এ দৃষ্টান্তমূলক কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং প্রণিধানযোগ্য। চাষী বিনা উদ্দেশ্যে কখনো কষ্ট স্বীকার করে ও হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে জমি চাষ করে না, কেবলমাত্র মনের খোশ খেয়ালের বশবর্তী হয়ে কেউ এ কাজে উদ্যোগী হয় না। এ কাজ করে একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে আর তা হচ্ছে ফসল লাভ। কুরআনের ভাষায় স্বামীরাও এমনি উদ্দেশ্যপূর্ণ চাষী –সন্তান ফসলের চাষাবাদকারী। স্ত্রীদের যৌন অঙ্গ হচ্ছে তার কাছে চাসের জমিস্বরূপ আর স্ত্রীর যৌন অঙ্গে শুক্র প্রবেশ করানো হচ্ছে চাষীর জমিতে শস্য বীজ বপন করার মতো। চাষী যেমন এই সমস্ত কাজ ফসলের আমায় করে, স্বামীদেরও উচিত সন্তান লাভের আশায় স্ত্রী-সঙ্গম করা। কেবল যৌন স্পৃহা পরিতৃপ্তির উদ্দেশ্যে এ কাজ হওয়া উচিত নয়। বরং এই সন্তান-ফসল লাভের উদ্দেশ্যেই বিয়ে করতে হবে। স্ত্রী গ্রহণ ও তার সাথে সঙ্গম করতে হবে। অতএব বিয়র একটি চরমতম উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্তান লাভ। এ কথাই আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে আয়াতের পরবর্তী অংশেঃ

(আরবী*****************************************)

এবং তোমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ কল্যাণের জন্যে কাজ করো।

অর্থাৎ এ স্ত্রী-সহবাস দ্বারা সন্তান লাভ করার আশা মনে মনে পোষণ করতে থাকো।

এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হলো যে, স্ত্রীলোক কেবলমাত্র যৌন লালসা পরিতৃপ্তির মাধ্যম বা উপায় নয়, স্ত্রী গ্রহণ ও তার সাথে মিলে পারিবারিক জীবন যাপনের এক মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। আর সে উদ্দেশ্যর মধ্যে সন্তান লাভ –ভবিষ্যৎ মানব বংশকে রক্ষা করা –হচ্ছে অন্যতম। মানব সমাজের কুরআন ভিত্তিক ইতিহাস থেকেই জানা যায়, স্ত্রীলোক গ্রহণ করে বিবাহিত ও পারিবারিক জীবন যাপন করার ফলেই দুনিয়ায় মানব জাতির এই বিপুল বিস্তার সম্ভব হয়েছে। এ কারণেই স্বাভাবিকভাবে রমনীর মনে সন্তান লাভের দুর্বার আকাঙ্খা বিদ্যমান থাকে। এমন কি আজকাল বন্ধ্যা নারীরাও টেষ্ট টিউবের সাহায্যে সন্তান লাভের চেষ্টা চালাচ্ছে। সম্প্রতি পত্র-পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ব্রিস্টলের লেসলী ব্রাউন নামের জনৈক বন্ধ্যা রমণী টেষ্ট টিউবের সাহায্যে দুই বার গর্ভবতী হয়ে দুটি সন্তানের জননী হয়েছে। আর মানব বংশের এই ধারা বৃদ্ধির স্থায়িত্বের জন্যেই বিয়ে করাকে অপরিহার্য কাজ বলে ঘোষিত হয়েছে। বিয়ে ব্যতীত নারী পুরুষের যৌন মিলন নিষিদ্ধ –হারাম করে দেয়া হয়েছে। কেননা তা মানুসের নৈতিক চরিত্রের পক্ষে যেমন মারাত্মক, তেমনি তার ফলে মান বংশের পবিত্রতা রক্ষা ও সুষ্ঠুভাবে ভবিষ্যত সমাজ গঠন বিঘ্নিত হয়ে পড়ে। ইউরোপে মেয়েদের ‘বয় ফ্রেণ্ড’ ‘ছেলে বন্ধু’ ও ছেলের ‘গার্ল ফ্রেণ্ড’ ‘মেয়ে বান্ধবী’ গ্রহনের এবং রক্ষিতা রাখার অবাধ সুযোগ দিয়ে যেমন সুস্পষ্ট ব্যভিচারের পথ খুলে দেয়া হয়েছে, তেমনি তা ভবিষ্যত বংশের পবিত্রতাকেও বিনষ্ট করে ফেলেছে। এর ফলে সাময়িকভাবে যৌন পরিতৃপ্তি লাভ হতে পারে বটে, কিন্তু একজন নারীর পক্ষে একজন পুরুষের স্থায়ী জীবন সঙ্গীনি হওয়ার সৌভাগ্য লাভ সম্ভব হয় না, বংশের ধারাও সুষ্ঠুভাবে রক্ষা পেতে পারে না। এর ফলে তাই ইসলামে বিয়ের গুরুত্ব এত বেশি। ইসলামের বিয়ে হচ্ছে নারী-পুরুসের এক স্থায়ী বন্ধন। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী পুরুষের মিলন এমন কোনো ক্রীড়া নয়, যা দু’দিন খেলা হলো, তারপর যে যার পথে চম্পট দিয়ে চলে গেল। এ জন্যে কুরআনে বিবাহিতা স্ত্রীদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

(আরবী**********************************************************)

এবং বিবাহিতা স্ত্রীলোকেরা তাদের স্বামীদের নিকট থেকে শক্ত ও দৃঢ় প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে।

ইসলামে বিয়ে এমনি দৃঢ় প্রতিশ্রুতিরই বাস্তব অনুষ্ঠান। এ প্রতিশ্রুতি সহজে ভঙ্গ করা যেতে পারে না।

বিয়ের তাগিদ

ওপরের আলোচনা থেকে একদিকে যেমন বিয়ের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, অপর দিকে ঠিক তেমনি বিয়ের আবশ্যকতা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিকোণ উজ্জ্বল ও প্রতিভাত হয়েছে। বস্তুত বিয়ে করা ইসলামে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বিয়ের তাগিদও করা হয়েছে কুরআন ও হাদীসে।

বিয়ের তাগিদ সম্পর্কে কুরআন মজীদে নিম্নোক্ত আয়াত আমরা আবার পড়তে পারি। তাতে বলা হয়েছেঃ

(আরবী***********************************************************)

এবং বিয়ে দাও তোমাদের মধ্যের জুড়িহীন (স্বামী বা স্ত্রীহীন) ছেলে-মেয়েদের আর তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা বিয়ের যোগ্য তাদের।

আয়াতে উদ্ধৃত (আরবী*******) শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ

(আরবী**************************************************************)

‘আয়ামা’ বলতে বোঝায় এসব মেয়েলোক, যাদের স্বামী নেই এবং সেসব পুরুষকে যাদের স্ত্রী নেই, একবার বিয়ে হওয়ার পর বিচ্ছেদ হওয়ার কারণে এরূপ হোক কিংবা আদৌ বিয়েই না হওয়ার ফলে।

সংশ্লিষ্ট আয়াতাংশের অর্থ করা হয়েছে এ ভাষায়ঃ

(আরবী*****************************************************)

হে মু’মিন লোকেরা! তোমাদের পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের মধ্যে যাদের স্বামী নেই, তাদের বিয়ে দাও এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা বিয়ের যোগ্য তাদেরও।

ইমাম ইবনে কাসীর এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী********************************************************)

এ আয়াতে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয়ার আদেশ করা হয়েছে। ইসলামের মনীষীদের মতে প্রত্যেক সামর্থ্যবান ছেলেমেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করা ওয়াজিব।

এ শ্রেণীর মনীষীরা উপরিউক্ত আয়াতের পরে নিম্নোদ্ধৃত হাদীসটিও একটি দলীল হিসেবে উল্লেখ করেন। হাদীসটি পূর্বেও উল্লিখিত হয়েছে। রাসূলে করীম (স) যুবক বয়সের লোকদের সম্বোধন করে এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

হে যুবক-যুবতীগণ! তোমাদের মধ্যে যারাই বিয়ের সামর্থ্যবান হবে, তাদেরই বিয়ে করা উচিত। কেননা বিয়ে তাদের চোখ বিনত রাখবে, তাদের যৌন অঙ্গ পবিত্র ও সুরক্ষিত রাখবে। আর যাদের সে সামর্থ্য নেই, তাদের রোযা রাখা কর্তব্য। তাহলে এই রোযা তাদের যৌন উত্তেজনা দমন করবে।

হাদীসে ‘যুবক-যুবতী’ কাদের বোঝানো হয়েছে, তার জবাবে ইমাম নববী লিখেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************)

আমাদের লোকদের মতে যুবক-যুবতী বলতে তাদের বোঝানো হয়েছে, যারা বালেগ –পূর্ণ বয়স্ক হয়েছে এবং ত্রিশ বছর বয়স পার হয়ে যায় নি –তাদের।

আর এই যুবক-যুবতীদের বিয়ের জন্যে রাসূলে করীম (স) তাগিদ করলেন কেন, তার কারণ সম্পর্কে বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ

(আরবী**********************************************************)

হাদীসে কেবলমাত্র যুবক-যুবতীদের বিয়ে করতে বলার কারণ এই যে, বুড়োদের অপেক্ষা এই বয়সের লোকদের মধ্যেই বিয়ে করার প্রবণতা ও দাবি অনেক বেশি বর্তমান দেখা যায়।

আর

(আরবী************************************************)

যুবক-যুবতীর বিয়ে যৌন সম্ভোগের পক্ষে খুবই স্বাদপূর্ণ হয়, মুখের গন্ধ খুবই মিষ্টিহয়, দাম্পত্য জীবন যাপন সুখকর হয়, পারস্পরিক কথাবার্তা খুব আনন্দদায়ক হয়, দেখতে খুবই সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়, স্পর্শ খুব আরামদায়ক হয় এবং স্বামী বা স্ত্রী তার জুড়ির চরিত্রে এমন কতগুলো গুণ সৃষ্টি করতে পারে, যা খুবই পছন্দনীয় হয় আর এ বয়সের দাম্পত্য ব্যাপারে প্রায়শই গোপন রাখা ভালো রাগে।

যুবক বয়স যেহেতু যৌন সম্ভোগের জন্যে মানুষকে উন্মুখ করে দেয়, এ কারণে তার দৃষ্টি যে কোন মেয়ের দিকে আকৃষ্ট হতে পারে এবং সে যৌন উচ্ছৃঙ্খলতায় পড়ে যেতে পারে। এজন্যে রাসূলে করীম (স) এ বয়সের ছেলেমেয়েকে বিয়ে করতে তাগিদ করেছেন এবং বলেছেনঃ বিয়ে করলে আর চোখ যৌন সুখের সন্ধানে যত্রতত্র ঘুড়ে বেড়াবে না এবং বাহ্যত তার কোন ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আশংকা থাকবে না। এ কারণে রাসূলে করীম (স) যদিও কথা শুরু করেছেন যুবক মাত্রকেই সম্বোধন করে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ের এ তাগিদকে নির্দিষ্ট করেছেন কেবল এমন সব যুবক-যুবতীদের জন্যে, যাদের বিয়ের সামর্থ্য রয়েছে। বিয়ের সামর্থ্য মানে রাতিক্রিয়া, যৌন, সম্ভোগ স্ত্রী সঙ্গম। আর যারা যুবক বয়সেও নানা কারণে তার সামর্থ্য রাখে না, যারা রাতিক্রিয়া ও স্ত্রী সঙ্গমেও অক্ষম, তাদেরকে রাসূল (স) বলেছেন রোযা রাখতে। যেনঃ

(আরবী**********************************************)

তার যৌন উত্তেজনা দমিত হয়, দমিত হয় তার বীর্যশক্তির দাপট।

(আরবী**************************************************)

রোযা রাখলে পানাহার কম হয়। আর পানাহারের মাত্রা কম হলে যৌন প্রবৃত্তি দমিত হয়।

উপরিউক্ত হাদীসে যদিও বাহ্যত কোনো যৌন সঙ্গম কার্যে অক্ষম লোকদেরকে রোযা রাখতে বলা হয়েছে; কিন্তু আসল কথা কেবল তাদের সম্পর্কেই নয়; বরং তাদের সম্পর্কেও যারা বিয়ের ব্যায় বহনের সঙ্গতি রাখে না, এ শ্রেণীর লোককেও রোযা রাখতে বলা হয়েছে। এ কথার সমর্থনে অপর দুটো বর্ণনায় উল্লেখ করা যায়।

একটি ইসমাঈলীয় বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ

(আরবী********************************************)

তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করতে সমর্থ, তাদের বিয়ে করা উচিত।

আর অপরটিতে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************************)

যে-ই বিয়ের ব্যয়ভার বহনে সামর্থ্যবান, সে যেন অবশ্যই বিয়ে করে।

ফল কথা, বিয়ে করার ব্যয়ভার বহন এবং যৌন সঙ্গম কার্যে সক্ষম যুবক-যুবতীর বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই বিয়ে করা উচিত।

এই প্রসঙ্গে মনীষীগণ নিম্নোক্ত হাদীসটিকেও উল্লেখ করে থাকেন। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************)

তোমরা সব অধিক সন্তানবতী মেয়েলোকদের বিয়ে করো এবং বংশ বাড়াও; কেননা কিয়ামতের নি আমি তোমাদের সংখ্যা বিপুলতা নিয়ে অপর নবীর উম্মত সংখ্যার মুবাকিলায় গৌরব করব।


বিয়েতে কুফু’র প্রশ্ন
বিয়েতে কুফু’র কোনো গুরুত্ব আছে কি? এ সম্পর্কে ইসলামের জবাব সুস্পষ্ট ও যুক্তিভিত্তিক।

‘কুফু’ মানে (আরবী**************) ‘সমতা ও সাদৃশ্য’। অন্য কথায়, বর ও কনের ‘সমান-সমান হওয়া’, একের সাথে অপরজনের সামঞ্জস্য হওয়া। বিয়ের উদ্দেশ্যে যখন স্বামী-স্ত্রীর মনের প্রশান্তি লাভ, উভয়ের মিলমিশ লাভের পথে বাধা বা অসুবিধা সৃষ্টির সামান্যতম কারণও না ঘটতে পারে, তার ব্যবস্থা করা একান্তই কর্তব্য।

কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ

(আরবী**********************************************)

সেই সমান আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘পানি’ থেকে, তার পরে তাকে পরিণত করেছেন বংশ ও শ্বশুর-জামাতার সম্পর্কে। আর তোমার আল্লাহ বড়ই শক্তিমান।

ইমাম বুখারী ‘বুখারী শরীফ’-এ এ আয়াতটিকে ‘কুফু’ অধ্যায়ের সূচনায় উল্লেখ করেছেন। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী তার কারণ উল্লেখ করে বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************)

এ আয়াতটিকে এখানে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে একথা জানিয়ে দেয়া যে, বংশ ও শ্বশুর-জামাতার সম্পর্ক এমন জিনিস, যার সাথে কুফু’র ব্যাপারটি সম্পর্কিত।

এ আয়াতে মানুষকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক ভাগ হচ্ছে বংশ রক্ষার বাহন –মানে পুরুষ ছেলে, বংশ তাদের দ্বারাই রক্ষা পায়, ‘অমুকের ছেলে অমুক’ বলে পরিচয় দেয়া হয়। আর দ্বিতীয় ভাগ হচ্ছে বৈবাহিক সম্পর্ক রক্ষার বাহন –মানে কন্যা সন্তানকে অপর ঘরের ছেরের নিকট বিয়ে দিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। আর এ বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে যাতে করে ভবিষ্যত বংশ রক্ষার ব্যবস্তা হয় সেই দৃষ্টিতে কুফু’ রক্ষা করা একটা বিশেষ জরুরী বিষয়।

কুফু’র মানে যদিও (আরবী************) –সমান-সদৃশ, তবু বিয়ের ব্যাপারে কোন কোন দিক দিয়ে এর বিচার করা আবশ্যক, তা বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষ।

এ পর্যায়ে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************)

‘কুফু’ –যা ইসলামের বিশেষজ্ঞদের নিকট সর্বসম্মত ও গৃহীত –তা গণ্য হবে দ্বীন পালনের ব্যাপারে। কাজেই মুসলিম মেয়েকে কাফিরের নিকট বিয়ে দেয়া যেতে পারে না।

আল্লামা মুহাম্মাদ ইসমাইল সায়য়ানী লিখেছেনঃ

(আরবী********************************************************)

কু’ফুর হিসেব হবে দ্বীনদারীর দৃষ্টিতে। আর এ হিসেবেই কোনো মুসলিম মেয়েকে কোনো কাফির পুরুসের নিকট বিয়ে দেয়া যেতে পারে না –ইজমা’র সিদ্ধান্ত এই।

কুরআন মজীদের সুস্পষ্ট ঘোষণায় এ ইজমা’র ভিত্তি উদ্ধৃত হয়েছে। বলা হয়েছেঃ

(আরবী******************************************)

ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যভিচারী কিংবা মুশরিক নারীকে বিয়ে করবে, পক্ষান্তরে ব্যভিচারী নারীকে অনুরূপ ব্যভিচারী কিংবা মুশরিক পুরুষ ছাড়া আর কেউ বিয়ে করবে না। মু’মিনদের জন্যে তা হারাম করে দেয়া হয়েছে।

কুরআন এর পূর্ববর্তী আয়াতে জ্বেনাকারীদের জন্যে কঠোর শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ আয়াতে জ্বেনাকারী পুরুষ স্ত্রীর সঙ্গে কোনরূপ বিষয়ে সম্পর্ক স্থাপন করাকে ঈমানদার স্ত্রী পুরুষের জন্যে হারাম করে দেয়া হয়েছে। আল্লামা আল-কাসেমী লিখেছেনঃ

(আরবী***************************************************)

এ আয়াত থেকে প্রমাণ হচ্ছে যে, ব্যভিচারী মোটামুটি ঈমানদার নয়, যদিও তাকে মুশরিক বলা যায় না।

আর আয়াতটির শেষ শব্দ থেকে জানা যায় ঈমানই ব্যভিচারী পুরুষ স্ত্রীকে বিয়ে করতে ঈমানদার লোকদের বাধা দেয় –নিষেধ করে। যে তা করবে সে হয় মুশরিক হবে, নয় ব্যভিচারী। সে ধরনের ঈমানদার সে নয় অবশ্যই, যে ধরনের ঈমান এ ধরনের বিয়েকে নিষেধ করে, ঘৃণা জাগায়। কেননা জ্বেনা-ব্যভিচার বংশ নষ্ট করে আর জ্বেনাকারীর সাথে বিয়ে সম্পর্ক স্থাপনে পাপিষ্ঠের সঙ্গে স্থায়ীভাবে একত্র বাস –সহবাস করা অপরিহার্য হয়। অথচ আল্লাহ এ ধরনের সম্পর্ক-সংস্পর্শকে চিরদিনের তরে নিষেধ করে দিয়েছেন।

অন্য কথায়, ব্যভিচারী পুরুষ ঈমানদার মেয়ের জন্যে এবং ব্যভিচারী নারী ঈমানদার পুরুষের জন্যে কুফু নয়। কেননা স্বভাব-চরিত্র ও বাস্তব কাজের দিক দিয়ে এ দুশ্রেণীর মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে, এ দুয়ের মধ্যে মনের মিল, চরিত্র ও স্বভাবের ঐক্য হওয়া, হৃদয়ের সম্পর্ক দৃঢ় হওয়া, নৈতিক চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষা করা এবং প্রাণের শান্তি ও স্বস্তি লাভ –যা বিয়ের প্রধান উদ্দেশ্য –কখনো সম্ভব হবে না। তাই কুরআন মজীদের অপর এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************)

মু’মিন কি কোনোক্রমেই ফাসিকদের সমান হতে পারে? না, এরা সমান নয়।

মানে, মু’মিন ও ফাসিক এক নয়, নেই এদের মধ্যে কোনো রকমের সমতা ও সাদৃশ্য। অতএব মু’মিন স্ত্রী বা পুরুষ কখনোই ফাসিক বা কাফির স্ত্রী বা পুরুষের জন্য কুফু নয়।

কুরআনের উপরিউক্ত আয়াতদ্বয়ের সমর্থনে রাসূলে করীম (স)-এর নিম্নোক্ত বাণী উল্লেখযোগ্য। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী****************************************)

দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যভিচারী তারই মতো দণ্ডপ্রাপ্তা ব্যভিচারীনি ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারে না।

উম্মে মাহজুল নাম্মী কোনো ব্যভিচারিণীকে বিয়ে করার অনুমতি প্রার্থনা করা হলে রাসূলে করীম (স) বললেনঃ

(আরবী****************************************************)

ব্যভিচারিনীকে ব্যভিচারী বা মুশরিক ছাড়া অন্য কেউ বিয়ে করবে না।

বলা বাহুল্য, হাদীসদ্বয়ের সনদ সহীহ এবং বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য। তাবারানী ও মজমাওয যওয়ায়িদ গ্রন্থেও এ হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। (আরবী*********)

সূরা আন-নূর-এর নিম্নোক্ত আয়াতটিও এই পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচ্য। বলা হয়েছেঃ

(আরবী***************************************************)

দুশ্চরিত্রশীলা মেয়েলোক দুশ্চরিত্র পুরুসের জন্য, দুশ্চরিত্র পুরুষরা দুশ্চরিত্রা মেয়েদের জন্যে আর সচ্চরিত্রবতী মেয়েলোক সচ্চরিত্রবান পুরুষদের জন্য এবং সচ্চরিত্রবান পুরুষ সচ্চরিত্রা মেয়েদের জন্য।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

চরিত্রহীনা মেয়ে চরিত্রহীন পুরুষদের জন্যে, তাই চরিত্রহীনা মেয়েলোক চরিত্রবান পুরুষদের জন্যে বিবাহযোগ্য হতে পারে না। কেননা তা কুরআনে বর্ণিত চূড়ান্ত কথার খেলাফ। অনুরূপভাবে সচ্চরিত্রবান পুরুষ সচ্চরিত্রবতী মেয়েদের জন্যে। অতএব কোনো চরিত্রবান পুরুষই কোনো চরিত্রহীনা মেয়ের জন্যে বিয়ের যোগ্য হতে পারে না। কেননা তাও কুরআনের বিশেষ ঘোষণার পরিপন্থী। (আরবী****************************)

অন্য কথায় নেককার পুরুষ নেকাকর স্ত্রীলোকই গ্রহণ করবে, বদকার ও চরিত্রহীনা নারী নয়। কেননা তা তার জন্যে কুফু নয়। এমনিভাবে কোনো নেককার চরিত্রবতী মেয়েকে বদকার চরিত্রহীন পুরুষের নিকট বিয়ে দেয়া যেতে পারে না। কেননা তা তার জন্যে কুফু নয়। সারকথা এই যে, বিয়ের ব্যাপারে স্ত্রী পুরুষের মধ্যে কুফুর বিচার অবশ্যই করতে হবে। আর সে কুফু হবে নৈতিক চরিত্র ও দ্বীনদারীর দিক দিয়ে।

তাই নবী করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী**************************************************************************)

তোমরা যখন বিয়ের জন্যে এমন ছেলে বা মেয়ে পেয়ে যাবে যার দ্বীনদারী চরিত্র ও জ্ঞান-বুদ্ধিকে তোমরা পছন্দ করবে, তো তখনই তার সাথে বিয়ের সম্বন্ধ স্থাপন করো।

ইমাম শাওকানী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************)

এ হাদীস প্রমাণ করে যে, দ্বীনদারী ও চরিত্রের দিক দিয়ে কুফু আছে কিনা বিয়ের সময়ে তা অবশ্য লক্ষ্য করতে হবে।

ইমাম মালিক (রহ) সম্পর্কে ইমাম শাওকানীই লিখেছেনঃ

(আরবী***********************************************)

ইমামা মলিক দৃঢ়তা সহকারে বলেছেন, কেবলমাত্র দ্বীনদারীর দিক দিয়েই কুফু বিচার করতে হবে –অন্য কোনো দিক দিয়ে নয়।

আল্লামা খাত্তাবী সুনানে আবূ দাঊদ-এর ব্যাখ্যায় ইমাম মালিকের নিম্নোক্ত কতাটি উদ্ধৃত করেছেনঃ

(আরবী***********************************************)

কুফু কেবলমাত্র দ্বীনদারীর দিক দিয়েই লক্ষণীয় ও বিবেচ্য। আর ইসলামী জনতার সকলেই পরস্পরের জন্যে কুফু।

এ ছাড়া ধন-সম্পদ ও বংশমর্যাদা ইত্যাদির দিক দিয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে কুফুর কোনো প্রশ্নই নেই। কেবলমাত্র ইমাম শাফিঈ (রহ) ধন-সম্পত্তির দৃষ্টিতেও কুফু’র গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা এ কথা প্রমাণ করতে পারেনি যে, ধনী ও গরীবের সন্তানের মধ্যে পারস্পরিক বিয়ে হলে দাম্পত্য জীবনে তাদের প্রেম ও ভালোবাসার সৃষ্টি হতে পারে না। তবে এক তরফের ধন-ঐশ্বর্য ও বিত্ত-সম্পদের প্রাচুর্য অনকে সময় দাম্পত্য জীবনে তিক্কতারও সৃষ্টি করতে পারে, তা অস্বীকার করা যায় না।

ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম শাফিঈ একটি হাদীসের ভিত্তিতে বংশীয় কুফু’র গুরুত্বও স্বীকার করেছেন। হাদীসটি হচ্ছে এই –নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

আরবের লোকেরা পরস্পরের জন্যে কুফু। আর ক্রীতদাসেরাও পরস্পরের কুফু।

কিন্তু এ হাদীসের সনদ ও তার শুদ্ধতা সম্পর্কে মুহাদ্দিসগনের যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। কেননা এর সনদে একজন বর্ণনাকারী এমন রয়েছে, যার নাম উল্লেখ করা হয়নি। ইমাম ইবনে আবূ হাতিম তাকে অপরিচিত লোক বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি তাঁর পিতাকে এ হাদীসটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। জবাবে তিনি বলেছিলেনঃ

(আরবী**************************)

এ হাদীসটি মিথ্যা, এর কোনো ভিত্তি নেই।

অপর এক জায়গায় বলেছেন, এ হাদীসটি বাতিল। ইমাম দারে কুতনী বলেছেনঃ (আরবী***************) ‘হাদীসটি সহীহ নয়’। ইবনে আবদুর বাররয় বলেছেনঃ (আরবী**********) ‘এ হাদীসটি গ্রহণ অযোগ্য, এটি কারো নিজস্ব রচিত’। (আরবী************) আল্লামা শাওকানী এ হাদীসটি সম্পর্কে বলেছেনঃ (আরবী*******************) এ হাদীসের সনদ দুর্বল’। (আরবী***************)

হাদীসটিকে যদি সহীহ বলে ধরা যায়, তবে তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, আরবের সাধারণ অধিবাসী যদিও পরস্পরের জন্যে কুফু, কিন্তু ক্রীতদাস তাদের জন্যে কুফু নয়। কিন্তু এ কতা কুরআন ও অন্যান্য সহীহ হাদীসের সম্পূর্ণ খেলাফ। কুরআনের ঘোষণা (আরবী********************) ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মুত্তাকী –আল্লাহ ভীরু ব্যক্তি আল্লাহর নিকট তোমাদের সকলের অপেক্ষা অধিকতর সম্মানিত’। এতে যেমন বংশের দিক দিয়ে মানুষের পার্থক্য স্বীকৃত হয়নি, তেমনি পার্থক্যের একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে পেশ করা হয়েছে তাকওয়া –আল্লাহ-ভীরুতা, দ্বীনদারী ও পরহেযগারীকে। আর হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীস (আরবী****************) –“সমস্ত মানুষই আদমের সন্তান”। এ মানুষে মানুষে বংশের দিক দিয়ে কোনো পার্থক্য স্বীকার করা হয়নি। দ্বিতীয় হাদীসঃ

(আরবী***********************************************)

মানুষ চিরুনীর দাঁতের মতোই সমান, কেউ কারো চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, তবে পার্থক্য হতে পারে কেবলমাত্র তাকওয়ার কারণে। (ঐ)

ওপরের আলোচনা থেকে কুফুর ব্যাপারে ইসলামের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং জানা গেছে যে, মানুষে মানুষে তাকওয়া পরহেযগারী এবং দ্বীনদারী ও নৈতিক চরিত্র ছাড়া অপর কোনো দিক দিয়েই পার্থক্য করা উচিত নয়, কুফুর বিচারও কেবলমাত্র এই দিক দিয়েই করা যেতে পারে।

এ হলো ইসলামের আদর্শিক দৃষ্টিকোণ। কিন্তু এই আদর্শিক দৃষ্টিকোণের বাইরে বাস্তব সুবিধে-অসুবিধের বিচার ও বিয়ের ব্যাপারে অগ্রাহ্য বা উপেক্ষিত হওয়া উচিত নয়। কেননা বিয়ে বাস্তবভাবে দাম্পত্য জীবন যাপনের বাহন। এজন্যে স্বামী ও স্ত্রীর বাঝে যথাসম্ভব সার্বিক ঐক্য ও সমতা না হলে বাস্তব জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। এ কারণে ইসলামে বাস্তবতার দৃষ্টিভঙ্গিও যথাযোগ্য গুরুত্ব সহকারে গণ্য ও গ্রাহ্য। ইসলামের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ মনীষীও এর অনুকূলে মত জানিয়েছেন।

ইমাম খাত্তাবী তাই লিখেছেনঃ

(আরবী**********************************************)

বহু সংখ্যক মনীষীর মতে চারটি কুফুর বিচার গণ্য হবেঃ দ্বীনদারী, আযাদী, বংশ ও শিল্প-জীবিকা। তাদের অনেকে আবার দোষত্রুটিমুক্ত ও আর্থিক সচ্ছলতার দিক দিয়েও কুফুর বিচার গণ্য করেছেন। ফলে কুফু বিচারের জন্যে মোট দাঁড়াল ছয়টি গুণ।

হানাফী মাযহাবে কুফুর বিচারে বংশমর্যাদা ও আর্থিক অবস্থাও বিশেষভাবে গণ্য। এর কারণ এই যে, বংশমর্যাদার দিক দিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে পার্থক্য হলে যদিও একজন অপরজনকে ন্যায়ত ঘৃণা করতে পারে না, কিন্তু একজন অপর জনকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করতে অসমর্থ হতে পারে তা অস্বীকার করা যায় না। অনুরূপভাবে একজন যদি হয় ধনীর দুলাল আর একজন গরীবের সন্তান তাহলেও –যদিও সেখানে ঘৃণার কোনো কারণ থাকে না, কিন্তু একজন যে অপরজনের নিকট যথেষ্ট আদরনীয় না-ও হতে পারে, তা-ই বা কি করে অস্বীকার করা যেতে পারে? এ সব বাস্তব কারণে দ্বীনদারী ও নৈতিক চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গে বংশমর্যাদা, জীবিকার উপায় ও আর্থিক অবস্থার বিচার হওয়াও অন্যায় কিছু নয়।

কনের জরুরী গুণাবলী

কনে বাছাই করার সময় ইসলামের দৃষ্টিতে বিশেষ একটি গুণের যাচাই করে দেখা আবশ্যক। সে গুণটি হচ্ছে কনের দ্বীনদার ও ধার্মিক হওয়া। এ সম্পর্কে নবী করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী**************************************************************)

চারটি গুণের কারণে একটি মেয়েকে বিয়ে করার কথা বিবেচনা করা হয়ঃ তার ধন-মাল, তার বংশ গৌরব –সামাজিক মান-মর্যাদা, তার রূপ ও সৌন্দর্য এবং তার দ্বীনদারী। কিন্তু তোমরা দ্বীনদার মেয়েকেই গ্রহণ করো।

যে সব কারণে একজন পুরুষ একটি মেয়েকে স্ত্রীরূপে বরণ করার জন্যে উৎসাহিত ও আগ্রহান্বিত হতে পারে তা হচ্ছে এ চারটি। এ গুণ চতুষ্টয়ের মধ্যে সর্বশেষে উল্লেখ করা হয়েছে দ্বীনদারী ও আদর্শবাদিতার গুণ। হাদীসেও উল্লিখিত চারটি গুণ স্বতন্ত্র গুরুত্বের অধিকারী। এর প্রতিটি গুণই এমন যে, এর যে কোনো একটির জন্যে একটি মেয়েকে বিয়ে করা যেতে পারে, যদিও এ গুণ চতুষ্টয়ের মধ্যে মেয়ের দ্বীনদার তথা ধার্মিকতা ও চরিত্রবতী হওয়ার গুণটিই ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বাগ্রগণ্য ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

নবী করীম (স)-এর আলোচ্য নির্দেশের সারকথা হলোঃ

(আরবী*****************************************************************)

দ্বীনদারীর গুণসম্পন্না কনে পাওয়া গেলে তাকেই যেন স্ত্রীরূপে বরণ করা হয়, তাকে বাদ দিয়ে অপর কোনো গণসম্পন্না মহিলাকে বিয়ে করতে আগ্রহী হওয়া উচিত নয়।

দ্বীনদার ও ধার্মিক কনেকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা উচিত –অন্য কথায় বিয়ের জন্যে চেষ্টা চালানো পর্যায়ে কনের খোঁজ-খবর লওয়ার সময় –রাসূলে করীম (স)-এর নির্দেশ হলো, কেবল দ্বীনদার কনেই তালাশ করবে। বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপিত হলে কনে সম্পর্কে প্রথম জানবার বিষয় হলো কনের দ্বীনদারীর ব্যাপার। অন্যান্য গুণ কি আছে তার খোঁজ পরে নিলেও চলবে অর্থাৎ কনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হচেছ তার দ্বীনদার হওয়া। ধনী, সদ্বংশজাত ও সুন্দরী রূপসী হওয়াও কনের বিশেষ গুণ বটে; এবং এর যে-কোন একটি গুণ থাকলেই একজন মেয়েকে স্ত্রীরূপে বরণ করে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে এসব গুণ মুখ্য ও প্রধান নয় –গৌণ। রাসূল (স)-এর নির্দেশ অনুযায়ী কেবল ধন-সম্পত্তি, বংশ-মর্যাদা ও রূপ-সৌন্দর্যের কারণেই একটি মেয়েকে বিয়ে করা উচিত নয়। সবচাইতে বেশি মূল্যবান ও অগ্রাধিকার লাভের যোগ্য গুণ হচ্ছে কনের দ্বীনদারী।

চারটি গুণের মধ্যে দ্বীনদারী হওয়ার গুণটি কেবল যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তা-ই নয়, এ গুণ যার নেই তার মধ্যে অন্যান্য গুণ যতই থাক না কেন, ইসলামের দৃষ্টিতে সে অগ্রাধিকার লাভের যোগ্য কনে নয়। রাসূল (স)-এর হাদীস অনুযায়ী তো দ্বীনদারীর গুণ-বঞ্চিতা নারীকে বিয়েই করা উচিত নয়। তিনি স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেনঃ

(আরবী***************************************************)

তোমরা নারীর কেবল বাহ্যিক রূপ-সৌন্দর্য দেখেই বিয়ে করো না। কেননা তাদের এ রূপ সৌন্দর্য তাদের নষ্ট ও বিপথগামী করে দিতে পারে। তাদের ধন-সম্পদের প্রাচুর্য দেখেও বিয়ে করবে না। কেননা ধন-সম্পদ তাদের বিদ্রোহী ও দুর্বিনীত বানিয়ে দিতে পারে। বরং বিয়ে করো নারীর দ্বীনদারীর গুণ দেখে। মনে রাখবে, কৃষ্ণকায়া দাসীও যদি দ্বীনদার হয় তবু অন্যদের তুলনায় উত্তম।

এ হাদীসটির ভাষা অপর এক বর্ণনায় এরূপ উদ্ধৃত হয়েছেঃ

(আরবী**************************************************************)

তোমরা স্ত্রীদের কেবল তাদের রূপ-সৌন্দর্য দেখেই বিয়ে করো না –কেননা এ রূপ-সৌন্দর্যই অনেক সময় তাদরে ধ্বংসের কারণ হতে পারে। তাদের ধন-মালের লোভে পড়েও বিয়ে করবে না –কেননা এ ধন-মাল তাদের বিদ্রোহী ও অনমনীয় বানাতে পারে। বরং তাদের দ্বীনদারীর গুণ দেখেই তবে বিয়ে করবে। বস্তুত একজন দ্বীনদার কৃষ্ণাঙ্গ দাসীও কিন্তু অনেক ভালো।

রাসূলে করীম (স)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল (আরবী*************) ‘বিয়ের জন্য কোন ধরনের মেয়ে উত্তম?’ জবাবে তিনি বলেছিলেনঃ

(আরবী*******************************************************)

যে মেয়েলোককে দেখলে বা তার প্রতি তাকালে স্বামীর মনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়, তাকে যে কাজের আদেশ করা হবে তা সে যথাযথ পালন করবে এবং তার নিজের ও স্বামীর ধন-মালের ব্যাপারে স্বামীর মত ও পছন্দ-অপছন্দের বিপরীত কোনো কাজই করবে না।

অপর এক হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে –সাহাবায়ে কিরাম একদিন বললেনঃ

(আরবী****************************************************)

সর্বোত্তম মাল-সম্পদ কি, তা যদি আমরা জানতে পারতাম, তাহলে তা আমরা অবশ্যই অর্জন করতে চেষ্টা করতাম। একথা শুনে নবী করীম (স) বললেনঃ সর্বোত্তম সম্পদ হচ্ছে আল্লাহর যিকর-এ মশগুল মুখ ও জিহবা, আল্লাহর শোকর আদায়কারী দিল এবং সেই মু’মিন স্ত্রীও সর্বোত্তম সম্পদ, যে স্বামীর দ্বীন-ইমানের পক্ষে সাহায্যকারী হবে।

এ সব হাদীস থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়ঃ

(আরবী*************************************************************)

সর্ব পর্যায়ে দ্বীনদার লোকদের সাহচর্য অতি উত্তম। কেননা দ্বীনদার লোকদের সঙ্গী-সাথীগণ তাদের চরিত্র, উত্তম গুণাবলী ও ধরন-ধারণ, রীতিনীতি থেকে অনেক কিছুই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। বিশষ করে স্ত্রী তো দ্বীনদার হওয়া একান্তই অপরিহার্য এবং এদিক দিয়ে যে ভালো সেই উত্তম। কেননা সে-ই তার শায়িনী, সে-ই তার সন্তানের জননী, গর্ভধারিনী, সে-ই তার ধন-মাল, ঘর-বাড়ি ও তার (স্ত্রীর) নিজের রক্ষণাবেক্ষণের একমাত্র দায়িত্বশীল ও আমানতদার।

বস্তুত রূপ-সৌন্দর্য ও ধন-মাল যেমন স্থায়ী নয়, তেমনি দাম্পত্য জীবনের স্থায়িত্ব দানে তার ক্রিয়া গভীর ও সুদূরপ্রসারীও নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে এ রূপ-সৌন্দর্য ও ধন-মাল পারিবারিক জীবনে অনেক তিক্ততা ও মনোমালিন্যের সৃষ্টি করে থাকে –করতে পারে। সুন্দরী-রূপসী নারীদের মধ্যে –বিশেষত যাদের রূপ-সৌন্দর্য ছাড়া অন্য কোন মহৎ গুণ নেই –অহমিকা ও আত্মম্ভরিতা প্রকট হয়ে দেখা দিতে পারে। আর তার ফলে হয়ত তারা স্বামীর কাছে নতি স্বীকার করতে বা তার প্রতি নমনীয় হতে কখনও প্রস্তুত হয় না। উপরন্তু তাদের রূপের আগুনে আত্মহুতি দেয়ার জন্যে অসংখ্য কীট-পতঙ্গ চারদিকে ভীড় জমাতে পারে আর তারা পারে ওদের আত্মহুতি দেয়ার জন্যে অনেক অবাধ সুযোগ করে দিতে। তখন এ রূপ ও সৌন্দর্যই হয় তার ধ্বংসের কারণ। ধন-মালের প্রাচুর্যও তেমনি নারী জীবনের ধ্বংস টেনে আনতে পারে। যে নারী নিজে বা তার পিতা বিপুল ধন-সম্পত্তির মালিক তার মনে স্বাভাবিকভাবেই একটা অহংকার ও বড়ত্বের ভাব (Superiority Complex) থেকে থাকে। তার বিয়ে যদি হয় এমন পুরুষের সাথে, যার আর্থিক মান তার সমান নয় বরং তার অপেক্ষা কম কিংবা সে যদি গরীব হয়, তাহলে এ দুজনের দাম্পত্য জীবন সুখের হতে পারে না বললেও অত্যুক্তি হবে না। কেননা ধনী কন্যা বা ধনশালী স্ত্রী সব সময়ই তার গরীব স্বামীকে হেয়, হীন ও নীচ মনে করতে থাকবে। তার ফলে স্বামী নিজেকে তার স্ত্রীর নিকট ক্ষুদ্র, অপমানিত ও লাঞ্ছিত মনে করবে। আর এ কারণেই এ ধরনের স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন না হবে স্থায়ী, না হবে সুখের ও মাধুর্যময়।

কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতও হাদীসের ঘোষিত নীতিরই সমর্থক। সূরা আন-নূর এ বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************)

এবং বিয়ে দাও তোমাদের জুড়িহীন ছেলেমেয়েকে, আর তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা নেককার –যোগ্য, তাদের।

অন্যত্র বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************************)

তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহ-ভীরু ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানার্হ।

এরশাদ হয়েছেঃ

(আরবী****************************************************)

তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যাদের ইলম দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের সম্মান ও মর্যাদা অধিক উচ্চ ও উন্নত করে দেবেন।

এজন্যে নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী*********************************************)

দুনিয়ার সব জিনিসই ভোগ ও ব্যবহারের সামগ্রী। আর সবচেয়ে উত্তম ও উৎকৃষ্ট সামগ্রী হচ্ছে নেক চরিত্রের স্ত্রী।

কেননা নেক চরিত্রের স্ত্রী স্বামীকে সব পাপের কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে এবং দুনিয়া ও দ্বীনের কাজে তাকে পূর্ণ সাহায্য ও তার সাথে আন্তরিক সহযোগিতা করে থাকে। এ হাদীসের অর্থ হচ্ছেঃ

(আরবী*************************************************)

স্ত্রী যদি নেক চরিত্রের না হয়, তাহলে সে হবে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও বেশি খারাপ সামগ্রী।

আর নেক চরিত্রের স্ত্রী বলতে বোঝায়ঃ

(আরবী************************************************)

নেককার, পরহেযগার, আল্লাহ-ভীরু ও পবিত্র চরিত্রের স্ত্রী –যে তার স্বামীর জন্যে সর্বাবস্থায় কল্যাণকামী, তার ঘরের রানী এবং তার আদেশানুগামী, তাকেই নেক চরিত্রের স্ত্রী মনে করতে হবে।

উপরোদ্ধৃত আয়াত ও হাদীস থেকে যে কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা এই যে, ইসলামের দৃষ্টিতে তাকওয়া, পরহেযগারী, দ্বীনদারী ও উন্নত মর্যাদার চরিত্রই হচ্ছে মানুষের বিশিষ্টতা লাভের শ্রেষ্ঠ গুণ। এতদ্ব্যতীত অন্য কোনো গুণই এমন নয়, যার দরুন কোনো লোক অপরের তুলনায় শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হতে পারে। একথা যেমন নারীদের ব্যাপারে সত্য, তেমনি পুরুষদের ক্ষেত্রেও তা অনুরূপ গুরুত্ব সহকারে প্রযোজ্য। তাই দ্বীনদার ও চরিত্রবতী মেয়েই বিয়ের জন্য সর্বাগ্রগণ্যা, বিশেষত মুসলিম পরিবারে তা-ই হওয়া উচিত। দ্বীনদার চরিত্রবতী কনে বাছাই ও বিয়ে করার জন্যে ইসলামে যেমন বলা হয়েছে বরকে –বিবাহেচ্ছুক পুরুষকে, তেমনি বলা হয়েছে কনেকেও। এ সম্পর্কে ‘রদ্দুল মুহতার’ গ্রন্থে ফিকাহবিদদের সর্বসম্মত মতের উল্লেখ করে বলা হয়েছেঃ

(আরবী******************************************************)

নারী স্বামী গ্রহণ করবে তার উত্তম দ্বীনদারী ও উদার চরিত্রের জন্যে, সেই গুণ দেখে এবং সে কখনো ফাসিক ও ধর্মহীন ব্যক্তিকে বিয়ে করবে না।

দারিদ্র্য বিয়ের ব্যাপারে বাধা নয়

ওপরের আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ইসলাম নির্বিশেষে সকল স্ত্রী-পুরুষকেই বিধিসঙ্গত নিয়মে ও শরীয়তসম্মত পন্থায় বিয়ে করার জন্যে উৎসাহ দিয়েছে। আর যৌন উত্তেনা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলে তখন বিয়ে করা ফরযের পর্যায়ে পৌঁছে যায় বলে ঘোষণা দিয়েছে।

কিন্তু অনেক সময় যুবক-যুবতীগণ কেবলমাত্র দারিদ্র্য কিংবা অর্থাভাবের কারণে বিয়ে করতে প্রস্তুত হতে চায় না। তারা মনে করে, বিয়ে করলে আর্থিক দায়িত্ব বেড়ে যাবে, সেই অনুপাতেই রোজগার না হলে সে দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। অথবা বিয়ে করলে যে আর্থিক দায়িত্ব বাড়বে, তদ্দরুন জীবন মান নিচু হয়ে যাবে।

এসব কারণে তারা বিয়েকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতেই চেষ্টা করে। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে এ মনোভাব –চিন্তার এই ধারা ও প্রকৃতি –আদৌ সমর্থণযোগ্য নয়। একে তো মানুষের রুজি-রোজগারের পরিমাণ কোনো স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় জিনিস নয়। যে আল্লাহ আজ একজনকে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছেন, সে আল্লাহই আগামীকাল তাকে একশত বা এক হাজার টাকা দিতে পারেন। তাই অর্থাভাব যেন কখনোই বিয়ের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়াতে পারে, সেজন্যে আল্লাহ তা’আলা নিজেই ঘোষণা করেছেনঃ

(আরবী***********************************************)

যদি তারা গরীব দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহে তাদের ধনী করে দেবেন। বস্তুতই আল্লাহ প্রশস্ততাসম্পন্ন সর্বজ্ঞ।

ছেলে বা মেয়ে কিংবা তাদের অলী-গার্জিয়ানদের উভয়ের কিংবা কোনো এক পক্ষের দারিদ্র্য বিয়ের পথে বাধা হওয়ার আশংকা দূর করার জন্যে কুরআনের এ আয়াত স্পষ্ট ঘোষণা। এর অর্থঃ

(আরবী******************************************************)

বিয়ের প্রস্তাব আসা ছেলে বা মেয়ের পারস্পরিক বিয়ের পথ দারিদ্র্য যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। কেননা আল্লাহর মেহেরবানীতে রয়েছে অর্থবিমুখতা। এজন্যে যে, আল্লাহ সকাল-সন্ধ্যা যাকে চান অভাবিতপূর্ব উপায়ে রিযিক দান করেন। কিংবা এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ওয়াদা করেছেন (দারিদ্রকে) ধনী করে দেয়ার। অবশ্য তা আল্লাহর ইচ্ছাধীন –আল্লাহ ইচ্ছার শর্তাধীন।

‘আল্লাহর ইচ্ছাধীন’ বলার কারণ এই যে, বিয়ে করলেই স্বামী-স্ত্রী ধনী হয়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই। কাজেই আল্লাহ কোথাও ওয়াদা খেলাফী করেছেন –একথা বলা যাবে না। কেননা কত স্বামী বা স্ত্রীই তো দুনিয়ায় এমন রয়েছে, যারা দরিদ্র, বিয়ে করা সত্ত্বেও তাদের দারিদ্র্য দূর হয়ে যায় নি।

তাহলে এ আয়াতের ঘোষণার অর্থ কি? –কি এর প্রকৃত তাৎপর্য। বিয়ের সাথে আর্থিক সঙ্গতির সম্পর্ক কি? এর জবাবে বলা যায়, মানুষ সাধারণত কারণকেই বড় করে দেখে, কারণ বুঝেই নিশ্চিন্ত হয়। তারই ওপর নির্ভর করে। কিন্তু সে কারণের মূলে যে ব্যাপারটি রয়েছে, সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ গাফিল হয়ে যায়। মানুষ মনে করে নিয়েছে যে, অধিক সন্তান হওয়াই বুঝি দারিদ্র্যের কারণ। আর কম সন্তান হলেই ধনের পরিমাণ বেড়ে যাবে। মানুষের এ অমূলক ধারণা বিদূরণের উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তা’আলা উপরিউক্ত ঘোষণা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, বিয়ে করলেই মানুষ আর্থিক দায়িত্ব-ভারে পর্যুদস্ত হবে –এমন কোনো কথা নেই; বরং এর উল্টোটারই সম্ভাবনা বেশি। আর তা হচ্ছে, অধিক সন্তান হলে অনেক সময় আল্লাহ তা’আলা তার ধন-মাল বাড়িয়ে দেন। এও দেখা গেছে যে, সন্তান সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে রোজগার বেশি হয়েছে, দারিদ্র্য দূরীভূত হয়ে গেছে! আসলে এ ব্যাপারটি আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। বিশেষত আল্লাহ তা’আলা নিজেই যখন বলে দিয়েছেন যে, বিয়ে করলেই দরিদ্র হয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই, তখন বুদ্ধিমান ও জাগ্রতমনা নারী-পুরুষ বিয়েকে আদৌ ভয় করবে না, করা উচিত নয়। তাহলে আয়াতের সহজ অর্থ দাঁড়ালোঃ

(আরবী*********************************************************)

আল্লাহর অনুগ্রহে বিয়ে ধন-মালের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।

হযরত আবূ বকর সিদ্দিক (রা) বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************)

তোমরা বিয়ের ব্যাপারে আল্লাহর আদেশ পালনে তাঁর আনুগত্য করো। তা হলে ধনসম্পত্তি দানের যে ওয়াদা আল্লাহ তা’আলা করেছেন তা তোমাদের জন্যে পূরণ করবেন।

হযতর আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************)

বিয়ে করে তোমরা ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করো।

এই পর্যায়ে স্মরণ করা যেতে পারে, একজন সাহাবী ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র, মোহরানা স্বরূপ দেবার মতো টাকা-পয়সা তো দূরের কথা –কোনো জিনিসই তাঁর কাছে ছিল না। একটি লোহার অঙ্গুরীয় দেবার মতো সামর্থ্যও তাঁর ছিল না। ছিল ছুধু তাঁর নিজের পরিধেয় একখানি বস্ত্র। তাকেও রাসূলে করীম (স) ‘মোহরানা’ স্বরূপ ধরে নিতে রাজি হলেন না। তা সত্ত্বেও সেই সাহাবীর বিয়ে সেই স্ত্রীলোকটির সাথেই করে দিলেন। আর ‘মোহরানা’র ব্যবস্থা করে দিলেন এভাবে যে, সাহাবী যতখানি কুরআন মজীদ শিখেছিলেন, তা-ই তাঁর স্ত্রীকে শিক্ষা দিবেন। আল্লামা ইবনে কাসীর এই ঘটনার উল্লেখ করে তার পরে লিখেছেনঃ

(আরবী********************************************************)

আল্লাহ তা’আলার অপরিসীম দয়া-অনুগ্রহ সর্বজনবিদিত, তিনি তাঁকে এত পরিমাণ রিযিক দান করলেন যে, তার স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্যে যথেষ্ট হয়ে গেল।

অতএব কোনো মুসলিম যুবকেরই আর্থিক অসচ্ছলতার দরুন অবিবাহিত কুমার জীবন যাপনে প্রস্তুত হওয়া উচিত নয়। বরং আল্লাহর রিযিকদাতা হওয়া –আল্লাহর অফুরন্ত দয়া-অনুগ্রহ ও দানের ওপর অবিচল বিশ্বাস রাখা উচিত। কেননা সকল প্রাণীরই রিযিকের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা নিজের ওপরে গ্রহণ করে নিয়েছেন। বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************)

যমীনের উপর বিচরণশীল সব প্রাণীরই রিযিকের ভার একান্তভাবে আল্লাহর উপর।

আর্থিক অসচ্ছলতার দরুন বিয়ের দায়িত্ব গ্রহণে ভীত লোকদের উৎসাহ বর্ধনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************)

আল্লাহ তাকে রিযিক দান করবেন এমন সব উপায়ে, যা সে ধারণা পর্যন্ত করতে পারে নি। আর বস্তুতই যে লোক আল্লাহর ওপর ভরসা করে কাজ করবে, সেই লোকের জন্যেই আল্লাহই যথেষ্ট হবেন।

উপস্থিত আর্থিক অনটন ও অসচ্ছলতা দর্শনে কোনো যুবক বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত করতে পারে, তেমনি কোনো গরীব যুবকের তরফ থেকে বিয়ের প্রস্তাব এলে মেয়ে পক্ষ তা শুধু এ কারণেই প্রত্যাখ্যান করতে পারে। অথবা মেয়ে পক্ষ গরীব বলে তার মেয়েকে বিয়ে করতে নারাযও হতে পারে। এসব দিকে লক্ষ্য রেখে আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

তোমরা যদি দারিদ্যের ভয় করো, তাহলে জেনে রাখো, আল্লাহ অবশ্যই তাঁর অনুগ্রতে তোমাদের ধনী করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ বড়ই জ্ঞানী ও সুবিবেচক।

এ আয়াতের আর এক তরজমা হলোঃ ‘তোমরা যদি বিয়ের পরে অধিক সন্তানের বোঝা চেপে বসবে বলে ভয় করো, তাহলে আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহে তোমাদের নিশ্চিন্ত করে দেবেন। আল্লাহ সবই জানেন, তিনি সুবিবেচক।

এ আয়াতের আর এক তরজমা হলোঃ ‘তোমরা যদি বিয়ের পরে অধিক সন্তানের বোঝা চেপে বসবে বলে ভয় করো, তাহলে আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহে তোমাদের নিশ্চিন্ত করে দেবেন। আল্লাহ সবই জানেন, তিনি সুবিবেচক।

বস্তুত কোনো গরীব লোক যদি বিয়ে করে, তবে কামাই-রোজগারে তার বিপুল উৎসাহ ও উদ্যম সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। আর এ ব্যাপারে তার স্ত্রী তার ওপর বোঝা না হয়ে বরং হবে দরদী সাহায্যকারিণী। আর সন্তান হলে তারাও তার অর্থোপার্জনের কাজে সাহায্যকারী হতে পারে। অনেক সময় স্ত্রীর ধনী নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে যথেষ্ট আর্থিক সাহায্য লাভও হতে পারে। সদিচ্ছার ওপর ফলাফল নির্ভর করে। আল্লাহ তা’আলার কথার প্রতি যার বিশ্বাস, আস্থা ও সদিচ্ছার অভাব থাকে, সে ছাড়া অপর কেউ দুর্ভোগে পড়তে পারে না। দৃঢ় বিশ্বাসই তাক সফলতার পথে আল্লাহর সাহায্য লাভের উপযুক্ত করে দেবে।


যেসব মেয়ে-পুরুষের পারস্পরিক বিয়ে হারাম
মানব বংশের স্থিতি ও বৃদ্ধি এবং মনের প্রশান্তি ও স্বস্তি একান্তভাবে নির্ভর করে স্ত্রী-পুরুষের যৌন মিলনের ওপর। কুরআন মজীদ এ মিলনকে সমর্থন করেছে এবং তাকে জরুরী বলে ঘোষণা করেছেন। এ মিলন স্পৃহাকে অস্বীকার করা, উপেক্ষা করা কিংবা নির্মূল করে দেয়া কুরআনের দৃষ্টিতে মানবতার প্রতি এক চ্যালেঞ্জ, এক অমার্জনীয় অপরাধ সন্দেহ নেই।

কিন্তু যৌন মিলন সংস্থাপনের ব্যাপারে ইসলাম নারী-পুরুষকে স্বাধীন, স্বেচ্ছাচারী ও বল্গাহারা করে ছেড়ে দেয়নি। বরং এজন্যে জরুরী সীমা নির্দেশ করে দিয়েছেন, প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে এবং নির্ধারিত করে দিয়েছে কতকটা বিধি-নিষেধ। কিছু কিছু নারী-পুরুষের পারস্পরিক বিয়ে এজন্যেই হারাম করে দিয়েছে ইসলাম। এ সীমা নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ বংশ, আত্মীয়তা-সম্পর্কের দীর্ঘস্থায়ীত্ব ও পবিত্রতা, পারস্পরিক ঐক্য ও সহযোগিতা এবং সর্বোপরি নৈতিক চরিত্রসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে এক উন্নত ও পবিত্র সমাজ পরিবেশ গঠন করার জন্যে একান্তই জরুরী। নারী-পুরুষের যৌন মিলনের সম্ভ্রম ও পবিত্রতা রক্ষার জন্যে সর্ব প্রথম শর্ত হচ্ছে বিয়ে। কিন্তু সেই বিয়েকেও যথেচ্ছা হতে দেয়া যায় না কোনোক্রমেই। সমাজ-পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা ও স্থিতির জন্যে যেমন দরকার হচ্ছে নারী-পুরুষের পারস্পরিক যৌন-মিলনের, তেমনি জরুরী হচ্ছে ইসলাম আরোপিত এই সীমা, বিধি-নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণকে পূর্ণ মাত্রায় ও বাধ্যতামূলকভাবে রক্ষা করে চলে।

কুরআন মজীদ যেসব মেয়ে-পুরুষের মাঝে বিয়ে সম্পর্ক স্থাপন হারাম করে দিয়েছে, তার ভিত্তি হচ্ছে তিনটিঃ বংশ-সম্পর্ক, দুগ্ধপানের সম্পর্ক এবং বৈবাহিক সম্পর্ক।

১. বংশ-সম্পর্কের কারণে মা-বাপের দিক দিয়ে যেসব আত্মীয়তার উদ্ভব হয় তা মোটামুটি সাতটিঃ মা, ঔরসজাত কন্যা, বোন, ফুফু, খালা, ভাইঝি, বোনঝি। যে-কোনো পুরুষের পক্ষেই তার এ ধরনের আত্মীয় মহিলাকে বিয়ে করা চিরদিনের তবে হারাম। আর এ হারামের কারণ হচ্ছে এই বংশ-সম্পর্ক (আরবী*******)। কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতে এ সম্পর্কে স্পষ্ট বলা হয়েছেঃ

(আরবী************************************************)

বিয়ে করা হারাম করে দেয়া হয়েছে তোমাদের প্রতি তোমাদের মা, তোমাদের কন্যা, তোমাদের বোন, তোমাদের ফুফু, তোমাদের খালা, তোমাদের ভাইয়ের কন্যা এবং বোনের কন্যা।

মা বলতে এখানে এমন সব মেয়েলোককে বুঝায়, যার সাথে প্রকৃত মা এবং বাবার দিক দিয়ে জন্ম ও রক্তের সম্পর্ক রয়েছে আর এ সম্পর্কের সূচনা হয় দাদি ও নানি থেকে। অতএব তাদের বিয়ে করাও হারাম।

কন্যা বলতে এমন সব মেয়েও বোঝাবে, যাদের সাথে স্বীয় ঔরসজাত কন্যা বা পুত্রের দিক দিয়ে সম্পর্ক রয়েছে। আর বোনের মধ্যে শামিল সেসব মেয়েও, যার সাথে বাপ কিংবা মা অথবা উভয়ের সমন্বয়ে বোনের সম্পর্ক হতে পারে। ফুফু বলতে এমন মেয়ে লোকও বোঝায়, যে বাবার কি তার বাবার –মানে দাদার বোন। আর ‘খালা’র মধ্যে এমন সব মেয়েলোকও শামিল, যার সাথে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে মা কিংবা দাদার দিক দিয়ে। বোনঝি বলতে এমন সব মেয়েই বোঝায়, যাদের মায়ের সাথে রক্তের দিক দিয়ে বোনের সম্পর্ক হতে পারে। এ মোট সাত পর্যায়ের মেয়েলোক ও পুরুষ লোক পরস্পরের জন্যে মুহাররম। এদের পারস্পরিক বিয়ে হারাম। একথা সর্বজনসমর্থিত –কোনো মতভেদ নেই এতে। কেননা কুরআন (আরবী******************) বলে এদেরকেই স্পষ্ট হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।

২. দুধ পানের সম্পর্কেও কিছু সংখ্যক মেয়ে-পুরুষের পারস্পরিক বিয়ে হারাম। ছেলে বা মেয়ে দুগ্ধপোষ্য অবস্থায় যদি অপর কোনো মহিলার দুধ পান করে, তবে সে মহিলা হবে তার দুধ-মা, তার স্বামী হবে এর দুধ-বাপ। এ দুধ-মা ও বাপের সাথে বিয়ে সম্পর্ক স্থাপন দুধ পানকারী পুরুষ বা নারীর জন্য হারাম, যেমন হারাম প্রকৃত মা বোনের সাথে বিয়ে। (আরবী******************)

অনুরূপভাবে দুধ-বোনও হারাম। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে দুধ-মা ও দুধ-বোন উভয় সম্পর্কে স্পষ্ট বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************************)

এবং তোমাদের স্তনদায়িনী মা-দের এবং তোমাদের দুধ-বোনদেরকে বিয়ে করা তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে।

আল্লামা ইবনে রুশদ আল-কুরতুবী এ পর্যায়ে লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

মোটামুটিভাবে বংশ সম্পর্কের কারণে যাকে বিয়ে করা হারাম, দুধ পানের কারণেও তাকে বিয়ে করা হারাম হওয়া সম্পর্কে সব ফিকাহবিদই সম্পূর্ণ একমত অর্থাৎ স্তনদায়িনী আপন মায়ের সমান পর্যায়ে গণ্য হবে। অতএব বংশের দিক দিয়ে ছেলের প্রতি হারাম যাকে যাকে বিয়ে করা, দুগ্ধদায়িনীর পক্ষেও সে সে হারাম।

দুধ বোন সম্পর্কে আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী********************************************************************)

মোটামুটিভাবে বংশ সম্পর্কের কারণে যাকে বিয়ে করা হারাম, দুধ পানের কারণেও তাকে বিয়ে করা হরাম হওয়া সম্পর্কে সব ফিকাহবিদই সম্পূর্ণ একমত অর্থাৎ স্তনদায়িনী আপন মায়ের সমান পর্যায়ে গণ্য হবে। অতএব বংশের দিক দিয়ে ছেলের প্রতি হারাম যাকে যাকে বিয়ে করা, দুগ্ধদায়িনীর পক্ষেও সে সে হারাম।

দুধ বোন সম্পকে আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

দুধ-বোন সে, যাকে তোমার মা তোমার বাবার কাছে থেকে পাওয়া দুধ সেবন করিয়েছে, তা তোমার সাথে এক সঙ্গেই সেবন করুক, কি তোমার পূর্বে তোমার পরে –ছেলে হোক আর মেয়ে হোক। (আরবী**********)

হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন –হযরত রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী********************************************)

দুধ পানে সে সে হারাম হয়ে যায়, যে যে হারাম হয় জন্মগত সম্পর্কের কারণে।

এজন্যে হযরত আয়েশা (রা) সব সময় বলতেনঃ

(আরবী************************************************************)

তোমরা দুধ পানের কারণে তাকে তাকে হারাম মনে করবে, যাকে যাকে হারাম মনে করো বংশের কারণে।

নবী করীম (স)-এর আর একটি কথা হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী**********************************)

রেহমী সম্পর্কের কারণে যে যে হারাম হয়, দুধ পানের দরুনও সে সে হারাম হয়।

বৈবাহিক সম্পর্কের দিক দিয়েও কোনো কোনো আত্মীয়ের সাথে বিয়ে সম্পর্ক স্থাপন হারাম হয়ে যায়। এ হারাম দু’প্রকারের। এক, স্থায়ী –যেমন স্ত্রীর মা, পুত্রের স্ত্রী, যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে এমন স্ত্রীর কন্যা এবং পিতার স্ত্রী।

পিতার স্ত্রী সম্পর্কে কুরআন মজীদে সুস্পষ্ট নিষেধবাণী উচ্চারিত হয়েছে। বলা হয়েছেঃ

(আরবী***********************************************)

তোমাদের পিতারা যাকে বিয়ে করেছে, তাকে তাকে তোমরা বিয়ে করো না।

এর কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে স্বয়ং কুরআনেই বলা হয়েছেঃ

(আরবী********************************************)

পিতার বিয়ে করা স্ত্রীকে বিয়ে করা অত্যন্ত লজ্জাকর ও জঘন্য কাজ, গুনাহের ব্যাপার এবং বিয়ের খুবই খারাপ পথ।

আল্লামা শওকানী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী***********************************************************)

(পিতার বিয়ে করা স্ত্রীকে পুত্রের বিয়ে করা সম্পর্কে) নিষেধ বাণীর যে তিনটি কারণ উদ্ধৃত হয়েছে, তা প্রমাণ করে যে, এ কাজ অত্যন্ত সাংঘাতিক রকমের হারাম ও ঘৃণিত কাজ।

আর পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করার ব্যাপারে কুরআনের নিষেধবাণী হচ্ছেঃ

(আরবী************************************************)

তোমাদের আপন ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রীদেরও হারাম করা হয়েছে।

স্ত্রীদের মা হারাম হওয়ার আয়াত হচ্ছেঃ

(আরবী***********************************)

তোমাদের স্ত্রীদের মা’দের হারাম করা হয়েছে।

আর স্ত্রীর গর্ভজাত মেয়েকে বিয়ে করা হারাম হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতের ভিত্তিতেঃ

(আরবী***********************************************)

এবং তোমাদের সেসব স্ত্রীদের –যাদের সাথে তোমাদের যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে –গর্ভজাত মেয়েরাও হারাম।

যৌন সম্পর্ক স্থাপিত না হলে তাদের কন্যাকে বিয়ে করা হারাম নয়।

(আরবী*****************************************)

যদি বিয়ে করা স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত না করে থাকে, তবে তার কন্যাকে বিয়ে করায় কোনো দোষ নেই।

এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে রুশদ আল-কুরতুবী লিখেছেনঃ

(আরবী*********************************************)

এ চারজনের মধ্যে দুজন হারাম হয়ে যায় বিয়ের আকদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে –তারা হচ্ছে পিতার স্ত্রী পুত্রের জন্যে ও পুত্রের স্ত্রী পিতার জন্যে, আর একজন হারাম হয় স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হলে পরে –সে হচ্ছে স্ত্রীর অপর এক স্বামীর নিকট থেকে নিয়ে আসা কন্যা।

আর দ্বিতীয় অস্থায়ী ও সাময়িক। যেমন স্ত্রীর বোন, স্ত্রীর ফুফু, খালা, ভাইঝি-বোনঝি ইত্যাদি। স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় স্ত্রীর এসব নিকটাত্মীয়কে বিয়ে করা ও একত্রে এক স্থায়ী স্ত্রীত্বে বরণ করা ইসলামে হারাম। এ কথার ভিত্তি হচ্ছে নিম্নোক্ত আয়াতাংশঃ

(আরবী************************************************)

এবং দু’জন সহোদর বোনকে একত্রে স্ত্রীরূপে বরণ করা তোমাদের জন্যে নিষিদ্ধ।

এ আয়াতের ভিত্তিতে ফিকাহবিদগণ নিম্নোক্ত মূলনীতি নির্ধারণ করেছেনঃ

(আরবী**********************************************************)

যে দু’জন স্ত্রীলোকের পারস্পরিক আত্মীয়তার কারণে বিয়ে হারাম, তাদের দু’জনকে একজন স্বামীর স্ত্রীত্ব একত্রে বরণ করা হারাম।

এভাবে যেসব মেয়েলোককে বিয়ে করা একজন পুরুষের পক্ষে হারাম তাদের সংখ্যা দাঁড়াল নিম্নরূপঃ

(ক) বৈবাহিক ও রক্তের সম্পর্কের কারণে সাতজন। আর তারা হচ্ছেঃ মা, কন্যা, বোন, ফুফু, খালা, ভাইঝি ও বোনঝি।

(খ) বৈবাহিক ও দুগ্ধপানের কারণে মোট সাতজন। তারা হচ্ছেঃ দুধ-মা, দুধ-বোন, স্ত্রীর মা, স্ত্রীর পূর্বপক্ষের কন্যা ও দুবোনকে একত্রের বিয়ে করা। এতদ্ব্যতীত পিতার স্ত্রী এবং ফুফু-ভাইঝিকে একত্রে বিয়ে করা। ইমাম তাহাভী বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************)

এ কয়জনকে বিয়ে করা যে-কোনো পুরুষের পক্ষে স্থায়ী ও সর্ববাদীসম্মতভাবে হারাম। এ বিষয়ে কারো কোন মতভেদ নেই।

এরপর আল্লাহ তা’আলা সেসব স্ত্রীলোককে হারাম করে দিয়েছেন, যারা বিবাহিতা –যাদের স্বামী জীবিত ও বর্তমান। বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************)

এবং স্বামীওয়ালী সুরক্ষিতা মহিলাদের বিয়ে করাও হারাম।

আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী************************************)

এখানে ‘মুহসানাত’ মানে সেসব মেয়েলোক, যাদের স্বামী বর্তমান –যারা বিবাহিতা।

যেসব মেয়েলোককে বিয়ে করা হারাম, তাদের বর্ণনা দেয়ার পর আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করছেনঃ

(আরবী**************************************************)

এ হারাম –মুহাররম-স্ত্রীলোকদের ছাড়া অন্যান্য সব মেয়েলোকই বিয়ে করার জন্যে তোমাদের পক্ষে হালাল করে দেয়া হয়েছে এ উদ্দেশ্যে যে, তোমরা তাদেরকে তোমাদের মাল-মোহরানা দিয়ে সুরক্ষিত বিবাহিত জীবন যাপনের লক্ষ্যে গ্রহণ করবে, উচ্ছৃঙ্খল যৌন লালসা পূরণের কাজে নয়।

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

উপরে উল্লিখিত মহিলাদের ছাড়া অন্যান্য সব মেয়েলোক বিয়ে করা জায়েয –সম্পূর্ণ হালাল, তা এ আয়াতাংশ স্পষ্ট প্রমাণ করছে।

অন্য কথায়, আল্লাহ তা’আলা চান যে, মুহাররম স্ত্রীলোকদের ছাড়া অন্যান্য মেয়েলোকদের যাকেই গ্রহণ করা হোক বিয়ের জন্যে –বিয়ের মাধ্যমে রীতিমতো মোহরানা দিয়ে তাদের বিয়ে করা হোক। কেবল উচ্ছৃঙ্খল যৌন পরিতৃপ্তি লাভ ও লালসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে যেন কেউ বিয়ে বন্ধনের বাইরে কোনো নারীকে স্পর্শ পর্যন্তও না করে।

কাফের ও আহলে কিতাব মেয়ে

কিন্তু এ ছাড়া আরো দু’শ্রেণীর মেয়ে বিয়ে করা সম্পর্কে কথা বলা এখনো বাকী রয়ে গেছে। এক কাফের মেয়ে, আর দ্বিতীয় মুশরেক ও আহলে কিতাব মেয়ে। কাফের মেয়ে যেমন মুসলমানদের জন্যে বিয়ে করা জায়েয নয়, তেমনি কাফের পুরুষের নিকট মুসলিম মেয়ে বিয়ে দেয়। দ্বীনের পার্থক্যের কারণে এ ধরনের বিয়ে স্থায়ীভাবে হারাম করে দেয়া হয়েছে।

কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

তোমরা মুসলামনরা কাফের মেয়েকে বিয়ের বন্ধনে বেধে রেখো না।

এ আয়াতের ভিত্তিতে ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ

(আরবী****************************************************)

এ আয়াতে সমস্ত কাফের মুশরেক মেয়ে বিয়ে করতে স্পষ্ট নিষেধবাণী উচ্চারিত হয়েছে।

তিনি আরো লিখেছেন, পূর্বে কাফেররা মুসলিম মেয়ে বিয়ে করত আর মুসলিমরা করত কাফের মেয়ে। এ আয়াত দ্বারা এ উভয় বিয়েকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছেঃ

এ আয়াতের পূর্বের আয়াতে বলা হয়েছেঃ

(আরবী***********************************)

মুসলিম মেয়েরা কাফেরদের জন্যে হালাল নয় এবং মুসলিম পুরুষরাও অনুরূপভাবে হালাল নয় কাফের মেয়েদের জন্য।

আর এর কারণ হচ্ছে ইসলাম ও কুফরের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য।

আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী*****************************************)

এ আয়াতে প্রমাণ করছে যে, মু’মিন-মুসলিম মেয়ে কাফের পুরুষের জন্যে হালাল নয়।

আর প্রথমোক্ত আয়াদের তাফসীরে লিখেছেনঃ

(আরবী******************************************************)

এর অর্থ এই যে, যে মুসলমানের স্ত্রী কাফের সে আর তার স্ত্রী থাকেনি। কেননা দ্বীন দুই হওয়ার কারণে এ দুয়ের বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে।

আহলে কিতাব –ইহুদী ও নাসারা বা খ্রিষ্টান-মেয়ে বিয়ে করার ব্যাপারটি বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষ। এখানে তা পেশ করা যাচ্ছে।

আল্লামা আবূ বকর আল-জাসসাস লিখেছেনঃ

আহরে কিতাব মেয়ে বিয়ে করার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। একটি মত হচ্ছে এই যে, আহলে কিতাবের আযাদ বংশজাত বা জিম্মী মেয়ে হলে তাদের বিয়ে করা মুসলিম পুরুষদের জন্যে জায়েয, এতে কোনো মতভেদ নেই। যদিও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) তা পছন্দ করেন না, মকরুহ মনে করেন। তাঁর সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************)

তিনি আহলে কিতাবের খানা খাওয়ায় কোনো দোষ মনে করতেন না, তবে তাদের মেয়ে বিয়ে করাকে মকরুহ মনে করতেন।

তাঁর সম্পর্কে অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ ইহুদী ও খ্রীষ্টান মেয়ে বিয়ে করা সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ

(আরবী*************************************************************)

আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের জন্যে মুশরেক মেয়ে বিয়ে করাকে স্পষ্ট ভাষায় হারাম করে দিয়েছেন। আর মরিয়ম পুত্র ঈসা কিংবা অপর কোনো আল্লাহর বান্দাকে রব্ব বলে মনে করা অপেক্ষা বড় কোনো শিরক হতে পারে বলে আমার জানা নেই।

আর ইহুদী-নাসারাদের বিশ্বাস ও আকীদা এমনিই, তাই তারাও মুশরিকদের মধ্যে গণ্য। অতএব তাদের মেয়ে বিয়ে করাও জায়েয নয়।

(আরবী***************************************************)

কেননা আহলে কিতাবও মুশরেক। এজন্যে ইহুদীরা বলেছেঃ উজাইর আল্লাহর পুত্র, আর খ্রিষ্টানরা বলেছেঃ ঈসা আল্লাহর পুত্র। যদিও বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেন যে, এ আয়াত মনসুখ হয়ে গেছে।

মায়মুন ইবনে মাহরান হযরত ইবনে উমর (রা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ আমরা এমন জায়গায় থাকি, যেখানে আহলে কিতাবের সাথে খুবই খোলা-মেলা হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় আমরা কি তাদের মেয়ে বিয়ে করতে পারি?

এর জবাবে তিনি নিম্নোক্ত দু’টি আয়াত পাঠ করেনঃ

(আরবী**************************************************)

এবং আহলে কিতাব বংশের সেসব চরিত্র-সতীত্বসম্পন্না মেয়ে (বিয়ে করা তোমাদের জন্যে জায়েয)।

এবং

(আরবী********************************************)

এবং মুশরেক মেয়ে যতক্ষণ না ইসলাম কবুল করছে, ততক্ষণ তোমরা তাদের বিয়ে করো না।

প্রথম আয়াতে আহলে কিতাব মেয়ে বিয়ে করা জায়েয বলা হয়েছে, আর দ্বিতীয় আয়াতে মুশরেক মেয়ে বিয়ে করতে সুস্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে। অন্য কথায়, তিনি এ ব্যাপারে নিজস্ব কোনো ফয়সালা শোনালেন না। শুধু আয়াত পড়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয়ে থাকলেন।

আল্লামা আবূ বকর লিখেছেন যে, একমাত্র হযতর ইবনে উমর ছাড়া সাহাবীগণের এক বিরাট জামা’আত যিম্মী আহলে কিতাবের মেয়ে বিয়ে করা জায়েয মনে করতেন। তাঁদের মতে দ্বিতীয় আয়াতটি কেবলমাত্র মুশরেকদের সম্পর্কেই প্রযোজ্য, সাধারণ আহলে কিতাবদের সম্পর্কে নয়।

হাম্মাদ বলেনঃ আমি হযরত সায়ীদ ইবনে জুবাইর (রা)-কে ইহুদী নাসারা মেয়ে বিয়ে করা জায়েয কিনা জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেনঃ (আরবী************) –তাতে কোনো দোষ নেই। তাঁকে উপরিউক্ত দ্বিতীয় আয়াতটি স্মরণ করিয়ে দেয়া হলে তিনি বললেনঃ এ হচ্ছে মূর্তিপূজক মেয়েদের সম্পর্কে নির্দেশ, তারা নিশ্চয়ই হারাম।

হযরত ওসমান ইবনে আফফান (রা) ফায়েলা বিনতে ফেরারা নাম্নী এক খ্রিষ্টান মহিলা বিয়ে করেছিলেন। হযরত তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা)-ও সিরীয় ইহুদী মেয়ে বিয়ে করেছিলেন। হাসান, ইবরাহী, নখয়ী ও শাবী প্রমুখ তাবেয়ী হাদীস-ফিকাহবিদও এ বিয়ে জায়েয বলে মনে করতেন।

কিন্তু এ পর্যায়ে হযরত উমর ফারূক (রা)-এর একটি নির্দেশ চমক লাগিয়ে দেয়। হযরত হুযায়ফা (রা) এক ইহুদী মেয়ে বিয়ে করলে তাকে নির্দেশ পাঠালেনঃ (আরবী************) ‘তাঁর পথ ছেড়ে দাও, তাকে ত্যাগ করো’।

তখন হুযায়ফা(রা) প্রশ্ন করে পাঠালেনঃ (আরবী****************) ‘ইহুদী মেয়ে বিয়ে করা কি হারাম?’

তার জবাবে হযত উমর (রা) লিখলেনঃ

(আরবী******************************************************)

হারাম নয় বটে, কিন্ত আমি ভয় করছি –আহলে কিতাব বলে তোমরা যদি তাদের বিয়ে করো তাহলে তোমরা তাদের মধ্য থেকে বদকার ও চরিত্র-সতীত্বহীনা মেয়েই বিয়ে করে বসবে।

হযরত উমরের উপরোক্ত নির্দেষ তাৎপর্যপূর্ণ এজন্যে যে, কুরআন মজীদে আহলে কিতাবের মধ্যে কেবলমাত্র (আরবী********************************)-দেরই বিয়ে করা জায়েয করা হয়েছে। আর তার জন্যে দুটি শর্ত অপরিহার্য। একটি হচ্ছে নাপাকীর জন্যে গোসল করা, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে যৌন অঙ্গকে পূর্ণরূপে সংরক্ষিত রাখা। কিন্তু আহলে কিতাবের কোনো মেয়ে বিয়ের পূর্বে তার যৌন অঙ্গের পবিত্রতা রক্ষা করেছে, তা বাছাই করে নেয়া খুব সহজসাধ্য কাজ নয়। আর দ্বিতীয়ত বিয়ের পর যৌন অঙ্গকে স্বামী ছাড়া অন্য কাউকে ব্যবহার করতে না দেয়ার প্রতি কোনো মেয়ের মনে দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে, তা জানবার কি উপায় হতে পারে? বিশেষত এ কারণে যে, আহলে কিতাব সমাজের লোকেরা এ ব্যাপারে কড়াকড়ি করার খুব বেশী পক্ষপাতী নয়। বরং তাদের পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়ার কারণে যৌন সংরক্ষণশীলতা নেই বললেই চলে।

এ দুটি দিক সম্পর্কে যদি নিশ্চয়তা লাভ করা সম্ভব নয়, তাহলেই একজন ঈমানদার মুসলিমের পক্ষে একজন আহলে কিতাব মেয়েকে বিয়ে করা জায়েয হতে পারে। অন্যথায় তা সাধারণ কাফের মুশরেক মেয়েদের মতোই মুসলিমদের জন্যে চিরতরে হারাম। তিন আল্লাহতে বিশ্বাসী আহলে কিতাবরা মুশরেকদের মধ্যে গণ্য। তাই তাদের মেয়ে বিয়ে করাও হারাম।

বদল বিয়ে জায়েয নয়

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বর্ণনা করেছেনঃ

(আরবী***************************************************)

নবী করীম (স) ‘শেগার’ বিয়ে নিষেধ করে দিয়েছেন।

‘শেগার’ বিয়ে কাকে বলে –তার ব্যাখ্যা করে হাদীসের বর্ণনাকারী বলেছেনঃ

(আরবী*********************************************************)

‘শেগার’ বিয়ে হয় এভাবে যে, একজন অপরজনের নিকট নিজের মেয়ে বিয়ে দেবে এ শর্তে যে, সে তার মেয়ে তার নিকট বিয়ে দেবে, আর এ দুটি বিয়েতে কোনো মোহরানা দেয়া নেয়া হবে না।

আল্লামা ‘বেন্দার’ বলেছেনঃ শেগার বিয়ের কথাবার্তা হয় এভাবে যে, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে বলবেঃ

(আরবী****************************************************************************)

তোমার মেয়েকে আমার নিকট বিয়ে দাও, আমি আমার মেয়েকে তোমার নিকট বিয়ে দেবো।

বাংলা ভাষায় আমরা এ ধরনের বিয়েকে বলে থাকি ‘বদল বিয়ে’

‘বদল বিয়ে’র নিষিদ্ধ ধরন হচ্ছে এই যে, একজন তার বোন কিংবা মেয়েকে অপর ব্যক্তির নিকট বিয়ে দেবে এ শর্তে যে, সেই অপর ব্যক্তি তার নিজের বোন কিংবা মেয়েকে তার কাছে বিয়ে দেবে এবং একজনের যৌন অঙ্গ অপর জনের বিয়ের মোহরানাস্বরূপ হবে। দুটি বিয়ের কোনোটিতেই আলাদাভাবে কোনো মোহরানাই ধার্য করা হবে না।

ইমাম রাফেয়ী বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************)

এ ধরনের বিয়েতে একটি বিয়েকে অপর একটি বিয়ের সাথে সম্পর্কিত করা হয়, একটির জন্যে অপরটি শর্ত স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। আর যৌন অঙ্গে পরস্পরকে শরীক করা হয়। এ কারণে এ বিয়ে জায়েয নয়।

কিন্তু হানাফী মাযহাব অনুযায়ী একজনের মেয়ে কিংবা বোনকে অপর জনের নিকট বিয়ে দেয়া এবং শর্তে যে, সে তার মেয়ে কিংবা বোনকে তার নিকট বিয়ে দেবে –যেন একটি বিয়ে অপর বিয়ের বদল হয় –এ বিয়ে জায়েয এবং তাতে মহরে মিসল –সম-মানের মোহরানা দেয়া ওয়াজিব।

এ সম্পর্কে হানাফী মাযহাবের ফিকাহবিদদের মত হচ্ছেঃ

(আরবী*******************************************************************************)

‘শেগার’ বিয়ে নিষিদ্ধ শুধু এজন্যে যে, কেননা তাতে মোহরানা ধার্য করা হয় না। এ কারণে আমরা তাতে মহরে মিসল ওয়াজিব মনে করেছি। তাহলে তা আর ‘শেগার’ থাকবে না অর্থাৎ তখন তা নিষিদ্ধ নয়।


বিয়ের প্রস্তাব
ইসলামের উপস্থাপিত পারিবারিক রীতি-নীতি ও নিয়ম-কানুনের দৃষ্টিতে বিয়ের প্রস্তাব বর কনে যে কারো পক্ষ থেকেই প্রস্তাব পেশ করতে কোনো লজ্জা-শরম বা মান-অপমানের কোনো কারণ হতে পারে না। এমন কি ছেলে কিংবা মেয়ের পক্ষও স্বীয় মনোনীত বর বা কনের নিকট সরাসরিভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে, ইসলামী শরীয়তে এ ব্যাপারে কোনো বাধা তো নেই-ই উপরন্তু হাদীসে এমন ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা থেকে এ কাজ যে সঙ্গত তা সুস্পষ্টরূ প্রমাণিত হয়।

নবী করীম (স) জুলাইবাব নামক এক সাহাবীর জন্যে এক আনসারী কন্যার বিয়ের প্রস্তাব কন্যার পিতার নিকট পেশ করেন। কন্যার পিতা তার স্ত্রী অর্থাৎ কন্যার মা’র মতামত জেনে এর জবাব দেবেন বলে ওয়াদা করেন। লোকটি তার স্ত্রীর নিকট এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে এ বিয়েতে স্পষ্ট অমত জানিয়ে দেয়। কন্যাটি আড়াল থেকে পিতামাতার কথোপকথন শুনতে পায়। তার পিতা যখন রাসূলের নিকট এ বিয়েতে মত নেই বলে জানাতে রওয়ানা হয়ে যাচ্ছিলেন, তখন মেয়েটি পিতামাতাকে লক্ষ্য করে বললঃ

(আরবী**************************************************)

তোমরা কি রাসূলে করীম (স)-এর প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করতে চাও? তিনি যদি বরকে তোমাদের জন্য পছন্দ করে থাকেন তবে তোমরা এ বিয়ে সম্পন্ন করো।

এ ঘটনা থেকে জানা গেল যে, মেয়ে নিজে তার বিয়ের প্রস্তাবে সম্পূর্ণ সম্মত ছিল এবং পিতামাতার নিকট তার মতামত যা গোপন ও অজ্ঞাত ছিল, যথাসময়ে সে তা জানিয়ে দিতে এবং নিজের পিতামাতার সামনে প্রস্তাবকে গ্রহণ করার জন্যে স্পষ্ট ভাষায় অনুমতি দিতে কোনো দ্বিধাবোধ করেনি। আর এতে বস্তুতই কোনো লজ্জা-শরমের অবকাশ নেই।

হযরত উমরের কন্যা হাফসা (রা) বিধবা হলে পরে তাঁর পূনর্বিবাহের জন্যে তিনি [হযরত উমর (রা)] প্রথমে হযরত উসমানের সাথে সাক্ষাত করেন এবং হাফসাকে বিয়ে করার জন্যে তাঁর নিকট সরাসরি প্রস্তাব পেশ করেন। তখন হযরত উসমান (রা) বললেনঃ এ সম্পর্কে আমার মতামত শীগঘীরই জানিয়ে দেবো। কয়েকদিন পর তিনি বললেনঃ আমি বর্তমানে বিয়ে করা সম্পর্কে চিন্তা করছি না। অতঃপর হযরত উমর (রা) হযরত আবূ বকর (রা)-এর নিকট এই প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে মতামত জানানো থেকে বিরত থাকলেন। কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর হযরত নবী করীম (স) নিজেই নিজের জন্যে বিয়ের প্রস্তাব হযরত উমরের নিকট প্রেরণ করেন।

(বুখারী, ২য় খণ্ড, ৭৬৮ পৃঃ; মুসনাদে আহমাদ, ১৬ খণ্ড, ১৪৮ পৃঃ)

এ ঘটনা থেকে জানা গেল, মেয়ে পক্ষও প্রথমেই বিয়ের প্রস্তাব পেশ করতে পারে –এতে কোনো দোষ নেই। আর ছেলে পক্ষও –কিংবা ছেলে নিজেও বিয়ের প্রস্তাব প্রথমত কন্যা পক্ষের নিকট পেশ করতে পারে। শরীয়তে এতে কোনো আপত্তি নেই কিংবা কারো পক্ষেই কোনো লজ্জা-শরমেরও কারণ নেই।

হযরত আনাস (রা) বলেনঃ একদা একটি মেয়েলোক –সম্ভবত তার নাম লায়লা বিনতে কয়স ইবনুল খাতীম –রাসূলে করীম (স)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে তাঁর সাথে নিজেকে বিয়ের প্রস্তাব সরাসরিভাবে পেশ করেন। সে বলেঃ

(আরবী*******************************************)

হে রাসূল! আপনি আমাকে বিয়ে করার কোনো প্রয়োজন মনে করেন?

হযরত আনাস যখন এ কথাটি বর্ণনা করছিলেন, তখন সেখানে তাঁর কন্যা উপস্থিত ছিলেন। তিনি পিতাকে সম্বোধন করে বললেনঃ (আরবী********************************) –“মেয়েলোকটি কতইনা নির্লজ্জ ছিল!”

অর্থঅৎ একটি মেয়েলোক নিজে নিজেকে রাসূলের নিকট বিয়ে দেয়ার জন্যে পেশ করেছে শুনে আনাস-তনায়া উমাইনার বিশেষ বিস্ময় বোধ হয়েছে এবং এ কাজকে তিনি নির্লজ্জতার চরম বলে মনে করেছেন। তখন হযরত আনাস (রা) কন্যাকে লক্ষ্য করে বললেনঃ

(আরবী**********************************************************)

সে তোমার তুলনায় অনেক ভালো ছিল। সে রাসূলের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল এবং সে নিজেই নিজেকে রাসূলের নিকট বিয়ের জন্যে পেশ করেছিল।

হযরত সহল ইবনে সায়াদ সায়েদী বলেনঃ

(আরবী**************************************************)

একটি মেয়েলোক রাসূলের নিকট এসে বললঃ আমি আপনার খেদমতে এসেছি এজন্যে যে, আমি নিজেকে আপনার নিকট সোপর্দ করব।

তখন নবী করীম (স) তার প্রতি উদার দৃষ্টিতে তাকালেন, পা থেকে মাথার দিকে দেখলেন। অনেক সময় ধরে তিনি নির্বাক হয়ে থাকলেন –কোন জবাব দিলেন না। তখন উপস্থিত একজন সাহাবী বুঝতে পারলেন যে, নবী করীম (স) স্ত্রীলোকটিকে বিয়ে করতে রাজি নহেন। তাই তিনি দাঁড়িয়ে বললেনঃ হে রাসূল! এ মেয়েলোকটিতে আপনার যদি কোনো প্রয়োজন না থাকে তবে আমাকে অনুমতি দিন তাকে বিয়ে করার। (বুখারী, মুসলিম)

এ থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, কোনো মেয়ে যদি বিশেষ কোনো পুরুষের প্রতি মনের আকর্ষণ বোধ করে তবে সে নিজেই ছেলের নিকট বিয়ের প্রস্তাব পেশ করতে পারে। এতে না আছে কোনো দোষ, না লজ্জা-শরমের কোনো অবকাশ।

বিয়ের এক প্রস্তাবের ওপর নতুন প্রস্তাব দেয়া।

তবে এ ব্যাপারে একটি বিশেষ সুস্পষ্ট নিষেধবাণী উচ্চারিত হয়েছে। আর তা হচ্ছে, বিয়ের প্রস্তাবের ওপর আর একটি নতুন প্রস্তাব দেয়া। কোনো মেয়ে বা ছেলে সম্পর্কে যদি জানা যায় যে, কোথাও তার বিয়ের কথাবার্তা চলছে বা কেউ বিয়ের প্রস্তাব পেশ করেছে, তাহলে সে প্রস্তাব সম্পূর্ণ ভেঙ্গে না যাওয়া পর্যন্ত দ্বিতীয় কোনো প্রস্তাবই এক্ষেত্রে উত্থাপন করা যেতে পারে না। কেননা এতে করে সমাজে অবাঞ্ছনীয় প্রতিযোগিতার মনোভাব এবং পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতার ভাব সহজেই জেগে উঠতে পারে। আর তা সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলার দৃষ্টিতে খুবই মারাত্মক। এমনকি এতে করে ছেলে বা মেয়ের এমন ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে, যার ফলে তার বিয়েই চিরদিনের তরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এজন্যে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন রয়েছে। রাসূলে করীম (স) এ সম্পর্কে বলেছেনঃ

(আরবী***************************************************)

তোমাদের কেউ যেন অপর ভাইয়ের দেয়া বিয়ের প্রস্তাবের ওপর নতুন প্রস্তাব পেশ না করে, -যতক্ষণ না সে নিজেই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে কিংবা তাকে নতুন প্রস্তাব পেশ করার অনুমতি দেবে।

হাদীসটির উপরোদ্ধৃত ভাষা মুসলিম শরীফের। আর বুখারী শরীফে এ হাদীসের ভাষা নিম্নরূপঃ

(আরবী**************************************************)

কেউই তার ভাইয়ের দেয়া বিয়ের প্রস্তাবের ওপর নতুন প্রস্তাব দেবে না –যতক্ষণ না সে বিয়ে করে ফেলে অথবা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে।

হযরত উকবা ইবনে আমের (রা) হতে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী********************************************************)

মু’মিন মু’মিনের ভাই। অতএব এক মু’মিনের ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর অপর মু’মিনের ক্রয়-বিক্রয়ের কাজ করা হালাল হতে পারে না। অনুরূপভাবে এক ভাইয়ের দেয়া বিয়ের প্রস্তাব চূড়ান্ত না হতেই অপরের প্রস্তাব দেয়াও সঙ্গত নয়।

আল্লামা শাওকানী এ পর্যায়ে লিখেছেনঃ

(আরবী**********************************************)

হাদীসের শুরুতে ‘হালাল হবে না’ বলার কারণে বিয়ের প্রস্তাবের ওপর নতুন প্রস্তাব দেয়া হালাল হবেনা বলে এ হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে।

বিয়ের এক প্রস্তাবের ওপর নতুন অপর একটি প্রস্তাব দেয়া –এক প্রস্তাব সম্পর্কে চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে যাওয়ার পূর্বেই আর একটি প্রস্তাব পেশ করা যে ইসলামে জায়েয নয় বরং হারাম, এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের ইজমা –পরিপূর্ণ ঐকমত্য স্থাপিত হয়েছে। (আরবী**********************)

অবশ্য ইমাম খাত্তাবী বলেছেনঃ এ নিষেধ শুধু নৈতিক শিক্ষা, শালীনতা ও সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে মাত্র। অন্যথায় এ এমন হারাম কাজ নয়, যাতে করে বিয়েই বাতিল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু দাউদ জাহেরী বলেছেনঃ এরূপ করে দ্বিতীয় ব্যক্তি যদি বিয়ে করে ফেলে তবে সে বিয়েই বাতিল হয়ে যাবে। (আরবী*****************)

কিন্তু এ উক্তিতে যে বাড়াবাড়ি রয়েছে তা সহজেই বোঝা যায়।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী বিয়ের প্রস্তাবের ওপর প্রস্তাব দেয়ার অপকারিতা এবং তা নিষেধ হওয়ার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************)

এর কারণ এই যে, এক ব্যক্তি যখন কোনো মেয়ে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়, তখন সেই মেয়ের মনেও তার প্রতি ঝোঁক ও আকর্ষণ স্বাভাবিকভাবেই জাগ্রত হয় এবং এর ফলে এই উভয়ের ঘর-সংসার গড়ে ওঠার উপক্রম দেখা দেয়। এ সময় যদি সে মেয়ের জন্যে অপর কোনো ব্যক্তি বিয়ের প্রস্তাব পেশ করে, তাহলে প্রথম প্রস্তাবককে তার মনের বাসনার ব্যর্থ মনোরথ করে দেয়া হয়, তার অধিকার থেকে তাকে করে দেয়া হয় বঞ্চিত। আর এতে করে তার প্রতি বড়ই অবিচার ও জুলুম করা হয়, তার জীবনকে করে দেয়া হয় সংকীর্ণ।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ আরো লিখেছেনঃ “বিয়ের প্রস্তাবের ওপর প্রস্তাব করা” সম্পর্কিত উপরিউক্ত হাদীসের ভিত্তিতেই আমাদের মত হচ্ছে যে, এ কাজ হারাম। ইমাম আবূ হানীফা ও হানাফী মাযহাবের সব ফিকাহবিদেরই এ মত। ‘আল-মিনহাজ’ কিতাবে বলা হয়েছেঃ

(আরবী***********************************************************)

বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার পর তা যদি কবুল হয়ে গিয়ে থাকে, তবে তার ওপর অপর কারো প্রস্তাব দেয়া সম্পূর্ণ হারাম। তবে উভয় পক্ষের অনুমতি নিয়ে নতুন প্রস্তাব দেয়া যেতে পারে। কিংবা সে প্রস্তাব যদি প্রত্যাহার করে, তাহলেও দেয়া যায়। আর যদি প্রথম প্রস্তাবের কোনো জবাব না দেয়া হয়ে থাকে, না প্রত্যাখ্যান করা হয়, তখন নতুন প্রস্তাব দেয়া বাহ্যত হারাম হবে না।

তবে ফিকাহর দৃষ্টিতে এখানে একটি ব্যতিক্রম রয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, প্রথম ও দ্বিতীয় এই উভয় প্রস্তাবকারীই যদি নেক চরিত্রের লোক হয় তবেই উপরিউক্ত নিষেধ প্রযোজ্য। আর প্রথম প্রস্তাবকারী যদি অসচ্চরিত্রের লোক হয় এবং দ্বিতীয় প্রস্তাবকারী হয় দ্বীনদার ও নেক চরিত্রের তবে দ্বিতীয় প্রস্তাবকারীর প্রস্তাব সম্পূর্ণ বৈধ ও সঙ্গত। (আরবী**************)

ইবনে কাসেম মালিকী বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************)

ফাসিক ব্যক্তির বিয়ের প্রস্তাবের ওপর নতুন প্রস্তাব দেয়া সম্পূর্ণ জায়েয।

আমীর হুসাইন আশ-শিফা কিতাবে লিখেছেনঃ

(আরবী***********************************************)

প্রথম প্রস্তাবকারী যদি ফাসিক হয় তাহলে তার প্রস্তাবের ওপর নতুন প্রস্তাব দেয়া সম্পূর্ণ জায়েয।

বিয়ের পূর্বে কনে দেখা

দাম্পত্য জীবনে মিল-মিশ, প্রেম-ভালোবাসা ও সতীত্ব-পবিত্রতার পরিশুদ্ধ পরিবেশ রক্ষার উদ্দেশ্যে এবং পারিবারিক জীবনের মাধুর্য ও সুখ-সমৃদ্ধির জন্যে বিয়ের পূর্বে কনেকে দেখে নেয়া উচিত বলে ইসলামে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ পর্যায়ে সর্বপ্রথম দলীল হচ্ছে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত বাণীঃ

(আরবী*************************************************)

তোমরা বিয়ে করো সেই মেয়েলোক, যাকে তোমার ভালো লাগে –যে তোমার পক্ষে ভালো হবে।

ইমা সুয়ূতী এ আয়াতের ভিত্তিতে দাবি করে বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************************)

এ আয়াতে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে, বিয়ের পূর্বে কনেকে দেখে নেয়া সম্পূর্ণ হালাল। কেননা কোন্ মেয়ে পছন্দ কিংবা কোন্ মেয়ে ভালো হবে তা নিজের চোখে দেখেই আন্দাজ করা যেতে পারে।

এ পর্যায়ে নবী করীম (স) বলেনঃ

(আরবী**********************************)

তোমাদের কেউ যখন কোনো মেয়ে বিয়ে করার প্রস্তাব দেবে তখন তাকে নিজ চোখে দেখে তার গুণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা করে নিতে অবশ্যই চেষ্টা করবে, যেন তাকে ঠিক কোন আকর্ষণে বিয়ে করতে তা সে স্পষ্ট বুঝতে পারে।

এ হাদীসটি বর্ণনাকারী হযতর জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) অতঃপর বলেনঃ

(আরবী********************************************)

রাসূলের উক্ত কথা শুনে আমি একটি মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলাম। তারপর তাকে গোপনে দেখে নেয়ার জন্যে আমি চেষ্টা চালাতে শুরু করি। শেষ পর্যন্ত আমি তার মধ্যে এমন কিছু দেখতে পাই, যা আমাকে আকৃষ্ট ও উদ্ধুদ্ধ করে তাকে বিয়ে করে স্ত্রী হিসেবে বরণ করে নিতে। অতঃপর তাকে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করি।

ইমাম আহমাদ বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায় যে, হযরত জাবির একটি গাছের ডালে গোপনে বসে থেকে প্রস্তাবিত কনেকে দেখে নিয়েছিলেন। (আরবী**********)

হযরত মুহাম্মদ ইবনে মুসলিমা থেকে রাসূলে করীমের নিম্নোদ্ধৃত কথাটি বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************************)

যখন কোনো পুরুষের মনে কোনো বিশেষ মেয়ে বিয়ে করার বাসনা জাগবে, তখন তাকে নিজ চোখে দেখে নেয়ায় কোনোই দোষ নেই।

এ হাদীস থেকে স্পষ্ট জানা গেল যে, সভ্যতাত-ভব্যতা ও শালীনতা সহকারে এবং শরীয়তের সীমার মধ্যে থেকে কনেকে বিয়ের পূর্বেই দেখে নেয়া বাঞ্ছনীয়। তাতে করে তার ভাবী স্ত্রী সম্পর্কে মনের খুঁতখুঁত ভাব ও সন্দেহ দূর হয়ে যাবে, থাকবে না কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ। শুধু তা-ই নয়, এর ফলে ভাবী বধুর প্রতি আকর্ষণ জাগবে এবং সেই স্ত্রীকে পেয়ে সে সুখী হতে পারবে।

হযরত মুগীরা ইবন শুবাহ (রা) তাঁর নিজের বিয়ের প্রসঙ্গে রাসূল করীমের সামনে পেশ করলে তখন রাসূলে করীম (স) আদেশ করলেনঃ

(আরবী*************************************)

তাহলে কনেকে দেখে নাও। কেননা তাকে বিয়ের পূর্বে দেখে নিলে তা তোমাদের মাঝে স্থায়ী প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টির অনুকূল হবে।

এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীসটিও উল্লেখযোগ্য। রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী********************************************************)

তোমাদের কেউ যখন কোনো মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় তখন তার এমন কোনো কিছু দেখা যদি তার পক্ষে সম্ভব হয় যা তাকে বিয়ে করতে উদ্ধুদ্ধ করবে, তবে তা তার অবশ্যই দেখে নেয়া কর্তব্য।

এভাবে বহু সংখ্যক রেওয়ায়াতের হাদীসের কিতাবসমূহে উদ্ধৃতি পাওয়া যায়, যা থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, একজন পুরুষ যে মেয়ৈকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক, সে তাকে বিয়ের পূর্বেই দেখে নিতে পারে। শুধু তাই নয়, রাসূলে করীম (স) এ সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন এবং না দেখে বিয়ে করাকে তিনি অপছন্দ করেছেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা)অ বর্ণনা করেছেনঃ

(আরবী*************************************)

নবী করীম (স) বিবাহেচ্ছুক এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কি মেয়েটিকে দেখেছ? সে বললঃ না, দেখিনি। তখন রাসূলে করীম (স) বললেনঃ যাও তাকে দেখে নাও।

এসব হাদীসকে ভিত্তি করে আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

*(আরবী***************************************************)

এসব হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, একজন পুরুষ যে মেয়েটিকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক, সে তাকে (বিয়ের পূর্বেই) দেখতে পারে –তাতে কোনো দোষ নেই।

তাউস, জুহরী, হাসানুল বাসরী, আওজায়ী, ইমাম আবূ হানীফা, আবূ ইউসুফ, মুহাম্মাদ, শাফিয়ী, মালিক, আহমাদ ইবনে হাম্বাল প্রমুখ মনীষী বলেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

পুরুষ যে মেয়েলোকটিকে বিয়ে করতে চায়, সে তাকে দেখতে পারে।

এ পর্যন্ত যা বলা হলো তা সর্বাবদীসম্মত। এতে মনীষীদের মধ্যে কারো কোনো মতবিরোধ নেই –সকলেই এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত।

কিন্তু এর পর প্রশ্ন থেকে যায়, কনেকে কতদূর দেখা যেতে পারে? অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মতে মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় দেখা যেতে পারে এজন্যে যে, মুখমণ্ডল দেখলেই মনের রূপ-সৌন্দর্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা করা সম্ভব। আর হস্তদ্বয় গোটা শরীরের গঠন ও আকৃতি বুঝিয়ে দেয়। কাজেই এর বেশী দেখা উচিত নয়। ইমাম আওজায়ী বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************)

তার প্রতি তাকানো যাবে, খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখা যাবে এবং তার মাংসপেশীসমূহ দেখা যাবে।

আর দাউদ জাহেরী বলেছেনঃ (আরবী***********************) –‘তার সর্বশরীর দেখা যাবে’।

ইবনে হাজম তো এতদূর বলেছেনঃ (আরবী*********************) –‘তার যৌন অঙ্গকেও দেখে নেয়া যেতে পারে’।

কিন্তু অপরাপর মনীষীর মতেঃ

(আরবী******************************************************)

প্রস্তাবিত মেয়েটির লজ্জাস্থানসমূহ বিয়ের পূর্বে দেখা জায়েয নয়।

এভাবে বিষয়টি নিয়ে মনীষীদের মধ্যে মতবিরোধ হওয়ার একটি কারণ রয়েছে, আর তা এই যে, এই পর্যায়ের হাদীসসমূহ শুদু দেখার অনুমতি অকাট্য ও সুস্পষ্টভাবে দেয় বটে, কিন্তু তার কোনো পরিমাণ, মাত্রা বা সীমা নির্দেশ করে না। তবে কনে সম্পর্কে সম্যক ধারনা করা যায় এবং বিয়ে করা না করা সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয় যতখানি এবং যেভাবে দেখলে, ততখানি এবং সেভাবে দেখা অবশ্যই জায়েয হবে, সন্দেহ নেই।

হাদীসে উল্লেক করা হয়েছে, হযরত উমর ফারূক (রা) হযরত আলী তনয়া উম্মে কুলসুমকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন হযরত আলী কন্যাকে তাঁর নিকট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, যেন তারা তাকে দেখে নিতে পারেন। তখন এই ‘দেখার’ উদ্দেশ্যেই হযরত উমর উম্মে কুলসুমের পায়ের দিকের কাপড় তুলে ফেলে দিয়েছিলেন।

তার পরের প্রশ্ন, কনের অনুমতি ও জ্ঞাতসারে দেখা উচিত, কি অনুমতি ব্যতিরেকে ও অজ্ঞাতসারেই? এ সম্পর্কেও বিভিন্ন মত দেখা যায়। ইমাম মালিক বলেছেনঃ

(আরবী************************************)

কনের অনুমতি ব্যতিরেকে তাকে দেখা যাবে না, তার প্রতি তাকানো যাবে না। কেননা তাকে দেখার জন্যে তার অনুমতি নেয়া তার অধিকার বিশেষ (বিনানুমতিতে দেখলে সে অধিকার ক্ষুণ্ন হয়)।

ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল বলেছেনঃ

(আরবী***************************************************)

কনে যদি বস্ত্রাচ্ছাদিতাই থাকে, তবে তার অনুমতি নিয়েই দেখা হোক কি বিনানুমতিতে, তার দুটিই সমান।

তবে এ সম্পর্কে রাসূলে করীমের একটি কথা স্পষ্ট পথ-নির্দেশ করে এবং তার দ্বারা মতবিরোধের অবসান হয়ে যায়। আবূ হুমাইন সায়েদী বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী*************************************)

তোমাদের কেউ যখন কোনো মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে, তখন তাকে দেখা তার পক্ষে দুষণীয় নয়। কেননা সে কেবলমাত্র এই বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার কারণেই তাকে দেখছে (অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়) যদিও সে স্ত্রীলোকটি কিছুই জানে না।

এ হাদীস থেকে স্পষ্ট জানা গেল যে, কনেকে যদি দেখা হয় শুধু এজন্যে যে, তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে এবং এ দেখার মূল ও একমাত্র উদ্দেশ্য যদি এই হয় যে, পছন্দ হলেই তাকে বিয়ে করতে রাজি হবে, তবে সে দেখা যদি কনের অজ্ঞাতসারেও হয়, তবুও তাতে কোনো দোষ হবে না।

এই প্রসঙ্গে একটি কথা পরিস্কার বলে দেয়া ভালো। যদি কারো নিত্য নতুন যুবতী মেয়ে দেখা শুধু দর্শনসুখ লাভের বদরুচি হয়ে থাকে, তবে তাকে কোনো মেয়েকে দেখানো জায়েয নয়। এ সম্পর্কে ইসলামবিদদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেইঃ

(আরবী***********************************************)

কোনো মেয়েলোকের প্রতি যৌনসুখ লাভ, যৌন উত্তেজনার দরুন কিংবা কোনো সন্দেহ সংশয় মনে পোষণ করে দৃষ্টিপাত করা জায়েয নয়।

এজন্যে ইমাম আহমাদ বলেছেনঃ

(আরবী*********************************************)

কনের চেহারা ও মুখমণ্ডলের দিকে দেখা যাবে, তবে যৌনসুখ লাভের জন্যে নয়। এমন কি তার সৌন্দর্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করার উদ্দেশ্যে তার প্রতি বারবার তাকানো যেতে পারে।

কোনো কোনা মনীষীর মতে কনের অজ্ঞাতসারেই তাকে দেখা উচিত, যেমন হযরত যাবির (রা) দেখেছিলেন। ইমাম শাফিয়ীর মতে বিয়ের প্রস্তাব রীতিমত পেশ করার পূবেই কনেকে দেখে নেয়া বাঞ্ছনীয়, যেন প্রস্তাব কোনো কারণে ভেঙ্গে গেলে কোন পক্ষের জন্যেই লজ্জা বা অপমানের কারণ না ঘটে। (আরবী********************)

আর বরের নিজের পক্ষে যদি কনেকে দেখা আদৌ সম্ভব না হয়, তাহলেও অন্তত নির্ভরযোগ্য সূত্রে তার সম্পর্কে যাবতীয় বিষয়ে সম্যক খোঁজ-খবর লওয়া বরের পক্ষে একান্তই আবশ্যক। এ উদ্দেশ্যে আপন আত্মীয়া স্ত্রীলোককে পাঠানো যেতে পারে তাকে দেখার জন্যে। হযরত আনাস (রা) বর্ণিত একটি হাদীস থেকে এ সম্পর্কে প্রমাণ পাওয়া যায়। নবী করীম (স) একটি মেয়েকে বিয়ে করার মনস্থ করেন। তখন তাকে দেখার জন্যে অপর একটি স্ত্রীলোককে পাঠিয়ে দেন এবং তাকে বলে দেনঃ

(আরবী******************************)

কনের মাড়ির দাঁত পরীক্ষা করবে এবং কোমরের উপরিভাগ পিছন দিক থেকে ভালোকরে দেখবে।

বলা বাহুল্য, দেহের এ দুটি দিক একজন নারীর বিশেষ আকর্ষনীয় দিক। দাঁত দেখলে তার বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞান-প্রতিভা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করা চলে। তার মুখের গন্ধ মিষ্টি না ঘৃণ্য তাও বোঝা যায়। আর পেছন দিক দিয়ে কোমরের উপরিভাগ একটি নারীর বিশেষ আকর্ষনীয় হয়ে থাকে। এ সব দিক দিয়ে ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্যে রাসূলে করীম (স) তাগিদ করেছেন। তার অর্থ বিয়ের পূর্বে কনের এসব দিক সম্পর্কে সম্যক ধারণা করে নেয়া ভালো।

এ পর্যায়ে একটি কথা বিশেষভাবে মনে করাখা আবশ্যক যে, কনে দেখার কাজ আনুষ্ঠানিক বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার পূর্বে সম্পন্ন করাই যুক্তিযুক্ত। আল্লামা আ-লুসী বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************)

মনীষীগণ আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার পূর্বেই কনে দেখার এই কাজটি সম্পন্ন করা উচিত বলে মনে করেছেন। দেখার পর পছন্দ না হলে তা প্রত্যাহার করবে। তাতে কারো মনে কষ্ট লাগবে না বা অসুবিধা হবে না। কিন্তু রীতিমত প্রস্তাব দেয়ার পর দেখে অপছন্দ হওয়ার কারণে প্রত্যাখ্যান করা হলে তার পরিণাম যে ভালো নয় তা সুস্পষ্ট।

বিয়ের পূর্বে কনে দেখার অনুমতির সুযোগ নিয়ে কনের সাথে প্রেম চর্চা করা, নারী বন্ধু কিংবা পুরুষ বন্ধু সংগ্রহের অভিযান চালানো, আর দিনে রাতে ভাবী স্ত্রী (?) –কে নিয়ে যত্রতত্র নিরিবিলিতে পরিভ্রমণ করেবেড়ানো ও যুবতী নারীর সঙ্গ সন্ধানে মেতে ওঠা ইসলামে শুধু যে সমর্থনীয় নয় তাই নয়; নিতান্ত ব্যভিচারের পথ উন্মুক্ত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা হচ্ছে ইউরোপের আধুনিক বিজ্ঞান গঠিত বর্বর সমাজের ব্যভিচার প্রথা। ইউরোপীয় সভ্যতার দৃষ্টিতে বিয়ের পূর্বে শুধু কনে দেখাই হয় না, স্বামী-স্ত্রীর ন্যায় যৌন সম্পর্ক স্থাপন এবং প্রেমের আদান-প্রদানও একান্তই জরুরী। বরং তা আধুনিক সভ্যতার একটা অংশও বটে। এ সব না হলে বিয়ে হওয়ার কথাটাই সেখানে অকল্পনীয়। এ না হলে নাকি বিবাহোত্তর দাম্পত্য জীবনও মধুময় হতে পারে না। পাশ্চাত্য সমাজের এ বিকৃতি যুবক-যুবতীদের কোনো রসাতলে ভাসিয়ে নিচ্ছে, তার কল্পনাও লোমহর্ষণের সৃষ্টি করে।

কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে এ হচ্ছে সুস্পষ্ট ব্যভিচার –ব্যভিচারের এক আধুনিকতম সংস্করণ। শুধু তাই নয়। বিয়ে পূর্বকালীন প্রেম ও যৌন মিলন মূল বিয়েকেই অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ করে দেয়। বিবাহোত্তর মিলন হয় বাসি ফুলের ন্যায় গন্ধহীন। কৌতুহলশূন্য। বস্তুত বিয়ে পূর্বকালীন প্রেম ও যৌন মিলন একটা মোহ –একটা উদ্বেলিত আবেগের বিষক্রিয়া। বিয়ের কঠিন বাস্তবতা সে মোহ ও উচ্ছ্বাসকে নিমেষে নিঃশেষ করে দেয় ঠুনকো কাঁচ পাত্রের মতো। এ সম্পর্কে একটি আরবী রূপকথার যথার্থতা অস্বীকার করা যায় না। তাতে বলা হয়েছেঃ

(আরবী********************************************)

বিয়ে বিয়ে-পূর্ব প্রেম-ভালোবাসাকে সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেয় –ধ্বংস করে ফেলে।

বিয়ের পূর্বে কনেকে দেখার এই অনুমতি, এই আদেশ –যে কোন দৃষ্টিতেই বিচার করা হোক, সুষ্ঠু পারিবারিক জীবনের জন্যে ইসলামের এক মহা অবদান, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মনে রাখা আবশ্যক যে, এই অনুমতি বা আদেশ কেবল মাত্র বিবাহেচ্ছু বরের জন্যেই নয়, এই অনুমতি প্রস্তাবিত কনের জন্যেও সমানভাবেই প্রযোজ্য। তারও অধিকার রয়েছে যে পুরুষটি তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক তাকে দেখার। কেননা যে প্রয়োজনের দরুন এই অনুমতি, তা কনের ক্ষেত্রেও সম্পূর্ণ সমানভাবে সত্য ও বাস্তব। হযরত উমর (রা) বলেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

তোমরা তোমাদের কন্যাদের কুৎসিৎ অপ্রীতিকর পুরুষের নিকট বিয়ে দিও না। কেননা নারীর যেসব অংশ পুরুষের জন্যে আকর্ষনীয়, পুরুষের সে সব অংশই আকর্ষনীয় হয় কন্যাদের জন্যে। অতএব তাদেরও অধিকার রয়েছে বিয়ের পূর্বে ভাবী-বরকে দেখার।

পরে প্রকাশিত ত্রুটির কারণে বিয়ে প্রত্যাহার

যথারীতি বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর স্বামী যদি নিশ্চিতরূপে জানতে পারে কিংবা প্রত্যক্ষ করতে পারে স্ত্রীর শারীরিক বা স্বাস্থ্যগত এমন কোনো দোষ, যা বর্তমান থাকায় সে কিছুতেই স্ত্রীকে খুশী মনে গ্রহণ করতে রাজি হতে পারে না, তাহলে স্বামী কেবল এই অবস্থায় বিয়েকে প্রত্যাহার করতে পারে –শরীয়তে তাকে এ অধিকার দেয়া হয়েছে। চিরদিনের তরে এক দুর্বহ বোঝা নিজের ওপর চাপিয়ে নেয়ার ও চাপিয়ে রাখার পরিবর্তে প্রথম অবস্থায়ই তা প্রত্যাহার করা বাঞ্ছনীয়। হযরত জায়েদ ইবনে কায়াব (রা) বর্ণনা করেছেনঃ

(আরবী*******************************************)

রাসূলে করীম (স) বনী গিফার গোত্রের একটি মহিলাকে বিয়ে করে ফুলশয্যার সশয় যখন তার কাছে উপস্থিত হলৈন এবং তার কাপড় উত্তোলন করে শয্যার ওপর বসলেন, তখন তিনি স্ত্রীলোকটি পাঁজরে শ্বেত রোগ দেখতে পেলেন। তিনি তখনই শয্যা থেকে উঠে গেরেন এবং বললেনঃ ‘তোমার কাপড় সামলাও’। অতঃপর তিনি তার থেকে নিজের দেয়া কোনো কিছুই গ্রহণ করলেন না।

এ হাদীসের ভিত্তিতে মুহাদ্দিসগণ বলেছেন, শ্বেত, কুষ্ঠ, পাগল ও মতিচ্ছিন্ন হওয়া এমন সব প্রচ্ছন্ন রোগ, যা স্বামী-স্ত্রী কারোর পক্ষেই তার নিকট সাহচর্যে আসার পূর্বে জানতে পারা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। কাজেই বিয়ের পরই এসব রোগ কারো মধ্যে উদঘাটিত হলে তাদের বিয়ে আপনা থেকেই ভেঙ্গে যাবে।

হযরত আলী (রা) ও অন্যান্য সাহাবীদের থেকে এ সম্পর্কে যে কথাটি বর্ণিত হয়েছে, তাতে বলা হয়েছেঃ

(আরবী******************************************************)

স্ত্রীদের চারটি দোষে বিয়ে ফেরত যেতে পারে –তা হচ্ছে পাগলামী, মতিচ্ছিন্ন হওয়া, কুষ্ঠ রোগ, শ্বেত রোগ এবং যৌন অঙ্গের কোনো রোগ।

বলা বাহুল্য, এ যেমন স্ত্রীর ব্যাপারে প্রযোজ্য, তেমনি স্বামীর ব্যাপারেও। যারই মধ্যে তা দেখা দিক না কেন, অপরজনের পক্ষে সে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়া শরীয়তে জায়েয।

শাফিয়ী ফিকাহবিদদের কারো কারো মতে যে-কোনো পরে-প্রকাশিত ত্রুটির কারণে বিয়ে প্রত্যাহার করা ও স্ত্রীকে ফেরত দেয়া যেতে পারে। আল্লামা ইব কাইয়্যিম এই মতই সমর্থন করেছেন।

অবশ্য ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম আবূ ইউসুফ বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************)

স্বামী কোনো কারণেই স্ত্রীকে প্রত্যাহার করতে পারে না। কেননা তার হাতেই রয়েছে তালাক দেয়ার ক্ষমতা। (সে ইচ্ছা করলে যে কোন সময় তালাক দিতে পারে বলে স্ত্রীকে প্রত্যাহার বা প্রত্যাখ্যানের কোনো মানে হয় না।) আর স্ত্রী স্বামীকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে কেবলমাত্র কোন সংক্রামক রোগ ও সহবাসে অক্ষমতা, নপুংসতার দরুন। ইমাম মুহাম্মাদের মতে কুষ্ঠু ও শ্বেত রোগের কারণেও প্রত্যাখ্যান করতে পারে।

আল্লামা ইবনে রুশদ লিখেছেনঃ

(আরবী*********************************************************)

উপরিউক্ত চার ধরনের ত্রুটির কারণে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে –এ সম্পর্কে ইমাম মালিক ও শাফিয়ী সম্পূর্ণ একমত।


ছেলেমেয়ের বিয়ের ব্যাপারে পিতামাতার দায়িত্ব
ছেলেমেয়ের জৈবিক স্বাস্থ্য রক্ষা ও জৈবিক পূরণ তথা সুষ্ঠু লালন-পালনের যেমন দায়িত্ব হচ্ছে পিতামাতার, তেমনি তাদের যৌন প্রয়োজন পূরণ করে তাদের নৈতিক স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্বও পিতামাতার। এজন্যে বিয়ের বসয় হলেই তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা আবশ্যক এবং এ দায়িত্ব প্রধানত তাদের পিতামাতার আর তাদের অবর্তমানে অন্য অভিভাবকের।

নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী*************************************)

যার কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, তার উচিত তার জন্যে ভালো নাম রাখা এবং তাকে ভারো আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়া। আর যখন সে বালেগ –পূর্ণ বয়স্ক ও বিয়ের যোগ্য হবে, তখন তাকে বিয়ে দেয়া কর্তব্য। কেননা বালেগ হওয়ার পরও যদি তার বিয়ের ব্যবস্থা করা না হয়, আর এ কারণে সে কোনো গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তার গুনাহ তার পিতার ওপর বর্তাবে।

এ হাদীসে প্রথমত ছেলেমেয়ের ভালো নাম রাখা ও তাকে ভালো আদব-কায়দা শেখানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তার পরই বলা হয়েছে যে, ছেলে সন্তান –ছেলে বা মেয়ে –বালেগ হলে অনতিবিলম্বে যদি তার বিয়ের ব্যবস্থা করা না হয়, তার বিয়ের ব্যাপারে যদি পিতামাতা-অভিভাবক কোনোরূপ অবহেলা ও উপেক্ষা প্রদর্শন করে আর তার ফলে তার বিয়ে বিলম্বিত হওয়ার দরুন যদি তার দ্বারা কোনো গুনাহের কাজ সংঘটিত হয়, তাহলে সে গুনাহের দায়িত্ব থেকে পিতামাতা বা অভিভাবক কিছুতেই রেহাই পেতে পারে না। মওলানা ইদরীস কান্ধেলুভী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী**************************************************)

অর্থাৎ তার গুনাহের শাস্তি তার পিতাকে ভোগ করতে হবে। কেননা এই ব্যাপারটি তারই ত্রুটি ও অবহেলার দরূন হতে পেরেছে।

অতঃপর লিখেছেনঃ

(আরবী************************************************)

এ হাদীস থেকে ছেলেমেয়ের বিয়ের ব্যাপারে অবহেলা করার জন্যে পিতার প্রতি অতিরিক্ত শাসন, ধমক ও কঠোর বাণী জানা যায় এবং এ সম্পর্কে যথেষ্ট তাগিদ রয়েছে বলেও বোঝা যায়।

হযতর উমর ও আনাস ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্ণিত অপর এক হাদীস থেকে জানা যায়, নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী***************************************************************)

তওরাত কিতাবে লিখিত রয়েছে, যার কন্যা বারো বছর বয়সে পৌঁছেছে আর তখনো যদি তার বিয়ের ব্যবস্থা না করে, এর ফলে যদি সে কোনো গুনাহ করে বসে তবে এ গুনাহ তার পিতার ওপর বর্তাবে।

এ দুটি হাদীস থেকেই প্রমাণিত হয় যে, সন্তান বালেগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা পিতামাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর সেই সঙ্গে বয়স্ক ছেলেমেয়েরও কর্তব্য হচ্ছে এজন্যে নিজেকে সর্বতোভাবে প্রস্তুত করা।

এ পর্যায়ে হাদীসে আরো কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। অপর এক হাদীসে রাসূলে করীম (ষ) পিতামাতাকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************************)

তোমাদের নিকট যদি এমন কোনো বর বা কনের বিয়ের প্রস্তাব আসে, যার দ্বীনদারী ও চরিত্রকে তোমরা পছন্দ করো, তাহলে তাঁর সাথে বিয়ে সম্পন্ন করো। যদি তা না করো, তাহলে জমিতে বড় বিপদ দেখা দেবে এবং সুদূরপ্রসারী বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে।

অর্থাৎ বিয়ের ব্যাপারে বর বা কনের শুধু দ্বীনদারী ও চরিত্রই প্রধানত ও প্রথমত লক্ষণীয় জিনিস। এ দিক দিয়ে বর বা কনেকে পছন্দ হলে ও যোগ্য বিবেচিত হলে অন্য কোনো দিকে বড় বেশী দৃষ্টিপাত না করে তার সাথে বিয়ে সম্পন্ন করা কর্তব্য। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ এসব দিক দিয়ে যোগ্য বর বা কনে পাওয়া সত্ত্বেও যদি তোমরা তার বিয়ের ব্যবস্থা না কর –তার সাথে বিয়ে সম্পন্ন করতে রাজি না হও, তাহলে তার পরিণাম অত্যন্ত খারাপ হবে। আর সে খারাপ পরিণামের রূপ হচ্ছে ভয়ানক বিপদ ও ব্যাপক বিপর্যয়। এর ব্যাখ্যা করে মওলানা ইদরীস কান্ধেলুভী লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

যার দ্বীনদারী তোমরা পছন্দ করো, সে ছেলের বা মেয়ের সাথে যদি তোমরা বিয়ে সম্পন্ন না করো বরং তোমাদের দৃষ্টি উদগ্রীব হয়ে তাকে ধন-মাল ও সম্মান সম্ভ্রম সম্পন্ন কোনো বর বা কনের সন্ধানে যেমন দুনিয়াদার লোকেরা করে থাকে –তাহলে বহুসংখ্যক মেয়ে স্বামীহীনাএবং বহু সংখ্যক পুরুষ স্ত্রীহীনা অবিবাহিত হয়ে থাকতে বাধ্য হবে। আর এরই ফলে জ্বেনা-ব্যভিচার ব্যাপক হয়ে দেখা দেবে এবং সমাজে দেখা দেবে নানারূপ ফিতনা-ফাসাদ ও বিপদ-বিপর্যয়।

বিয়ের বয়স

ছেলে বা মেয়ের বিয়ের জন্যে কোনো বয়স-পরিমাণ নির্দিষ্ট আছে কি? কত বয়স হলে পরে ছেলেমেয়েকে বিয়ে দেয়া যেতে পারে, আর কত বয়ষ পূর্ণ না হলে বিয়ে দেয়া উচিত হতে পারে না আধুনিক যুগের সমাজ-মানসে এ এক জরুরী জিজ্ঞাসা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ছেলে ও মেয়ের বিয়ের জন্যে একটা বয়স পরিমাণ আইনের সাহায্যে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় এবং বলা হয় যে, এত বয়স না হলে ছেলে বা মেয়ের বিয়ে দেয়া চলবে না, এ সম্পর্কে ইসলামের অভিমত কি?

এই পর্যায়ে হযরত আয়েশা (রা)-র নিম্নোক্ত উক্তি থেকে কিছুটা পথের সন্ধান লাভ করা যায়। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

রাসূলে করীম (স) আমাকে বিয়ে করেন যখন আমার বয়স মাত্র ছয় বছর, আর আমাকে নিয়ে ঘর বাঁধেন যখন আমি নয় বছরের মেয়ে।

অপর এক হাদীসে এক সাহাবীর উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী************************************************)

রাসূলে করীম (স) হযরত আয়েশাকে বিয়ে করেন, যখন তাঁর বয়স নয়।

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ

(আরবী*****************************************************)

নবী করীম (স) হযরত আয়েশাকে বিয়ে করেছিলেন যখন তিনি ছোট্ট ছিলেন, তাঁর বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর।

নবী করীম (স) নিজে যখন হযরত আয়েশাকে ছয় কিংবা নয় বছর বয়সে বিয়ে করলেন তখন এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ইসলামে ছেলেমেয়ের বিয়ের জন্য কোনো নিম্নতম বয়স নির্ধারণ করা হয়নি। যে-কোনো বয়সের ছেলেমেয়েকে যে-কোনো সময় অনায়াসেই বিয়ে দেয়া যেতে পারে।

এই পর্যায়ে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী মনীষী ইবনে বাত্তালের নিম্নোক্ত উক্তি উদ্ধৃত করেছেনঃ

(আরবী**************************************************************)

ইসলামের বিশেষজ্ঞগণ এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, পিতার পক্ষে তার ছোট্ট বয়সের মেয়েদের বিয়ে দেয়া সম্পূর্ণ জায়েয –বৈধ, যদিও সে মেয়ে দোলনায় শোয়া শিশুই হোক না কেন। তবে তাদের স্বামীদের পক্ষে তাদের নিয়ে ঘর বাঁধা কিছুতেই জায়েয হবে না, যতক্ষণ তারা যৌন সঙ্গম কার্যের জন্যে পূর্ণ যোগ্য এবং পুরুষ গ্রহণ ও ধারণ করার সামর্থ্যসম্পন্না না হচ্ছে।

ইমাম নববী লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************)

পিতার পক্ষে তার ছোট্ট মেয়েকে বিয়ে দেয়া জায়েয হওয়া সম্পর্কে সমস্ত মুসলমানই একমত হয়েছে।

তবে এ ব্যাপারে কোনো বয়স নির্দিষ্ট করা চলে না এজন্যে যে, সব মেয়েই স্বাস্থ্যগত অবস্থা ও দৈহিক শক্তি-সামর্থ্যের দিক দিয়ে সমান হয় না, হয় বিভিন্ন রকমের ও প্রকারের। এমন কি বংশ-গোত্র, পারিবারিক জীবন-মান ও আবহাওয়ার পার্থক্যের দরুনও এদিক দিয়ে মেয়েদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য হয়ে থাকে। এজন্যে কোনো এক নীতি বা কোনো ধরাবাঁধা কথা এ ব্যাপারে বলা যায় না। তাই বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ

(আরবী***************************************************************)

মেয়েদের জন্মগত পরিমিতি ও স্বাস্থ্যগত সামর্থ্য, যোগ্যতা এবং ক্ষমতা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে।

অতএব ঠিক কত বয়সে যে মেয়েদের বিয়ে দেয়া উচিত আর কত বয়সে নয়, তা নির্দিষ্ট করে বলা এবং এজন্যে কোনো বয়স নির্দিষ্ট করে দিয়ে তার পূর্বে বিয়ে নিষিদ্ধ করে আইন জারি করা আদৌ যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না।

তাছাড়া বিয়ে বলতে কি বোঝায়, তাও ভেবে দেখা দরকার। কেননা ‘বিয়ে’ বলতে যদি স্বামী-স্ত্রী যৌন মিলন ও তদুদ্দেশ্যে ঘর বাঁধা বোঝায়, তাহলে তা যে, ছেলেমেয়ের পূর্ণ বয়স্ক (বালেগ) হওয়ার পূর্বে আদৌ সম্ভব হতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য। আর যদি বিয়ে বলতে শুধু আকদ ও ঈজাব-কবুলমাত্র বোঝায় তাহলে তা যে কোন বয়সেই হতে পারে। এমন কি দোলনায় শোয় বা দুগ্ধপোষ্য শিশুরও হতে পারে তার পিতার নেতৃত্বে। ইসলামী শরীয়তে এ বিয়ে নিষিদ্ধ নয় এবং এতে অশোভনও কিছু নেই।

এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামবিদ ড. মুস্তফা আস-সাবায়ী লিখেছেনঃ

(আরবী*********************************************)

চারটি মাযহাবের ইজতিহাদী রায় এই যে, ‘বালেগ’ হয়নি –এমন ছোট ছেলেমেয়ের বিয়ে সম্পূর্ণ শুদ্ধ ও বৈধ।

কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা এবং নবী করীম (স)-এর যুগে ও তাঁর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ঘটনাবলীর ভিত্তিতে উপরিউক্ত কথার যৌক্তিকতা ও প্রামাণিকতা অনস্বীকার্য।

অবশ্য কিছু সংখ্যক ফিকাহবিদ; যেমন –ইবনে শাবরামাতা ও আল-বাতী উপরিউক্ত কথার বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের মতে ছোট বয়সের ছেলেমেয়ের কোনো রকম বিয়েই আদৌ জায়েয নয়। আর তাদের অভিভাবকগণ তাদের পক্ষ থেকে উকীল হয়ে যেসব বিয়ে সম্পন্ন করে থাকে, তা সম্পূর্ণ বাতিল, তাকে বিয়ে বলে ধরাই যায় না।

বস্তুত শরীয়তে বিয়ের আদেশ এবং এ সম্পর্কিত যাবতীয় বিধান উপদেশ এই শেষোক্ত মতকেই সমর্থন করে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়েকে বিয়ে দেয়ার বাস্তব কোনো ফায়দাই নেই, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে ছোট বয়সের বিয়ে ছেলেমেয়েদের নিজেদের জীবনে কিংবা উভয় পক্ষের অলী-গার্জিয়ানদের জীবনে নানা প্রকারের জটিলতারই সৃষ্টি করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। যে বিয়েতে ছেলেমেয়ে বড় হয়ে নিজেদেরকে এমন এক বিয়ের বন্ধনে বন্দী-দশায় দেখতে পায়, যে বিয়েতে তাদের কোনো মতামত নেয়া হয়নি। আবার অনকে বিবাহিত ছেলেমেয়ে বড় ও বয়স্ক হওয়ার পর মন-মেজাজ ও স্বভাব-চরিত্রে পরস্পরে এমন পার্থক্য দেখতে পায়, যাতে করে দাম্পত্য জীবনের প্রতি তারা কোনো আকর্ষণই বোধ করতে পারে না। ফলে উভয় পক্ষের গার্জিয়ানদের মধ্যেও যথেষ্ট তিক্ততা এবং শেষ পর্যন্ত পরস্পরে প্রবল বিরোধ ও প্রকাশ্য শত্রুতা দেখা দেয়াও বিচিত্র কিছু নয়।

প্রাচীনকালে ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থার পতন ও ভাঙ্গনের পর এমন এক সময় ছিল, যখন ছেলেমেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে তাদের কোনো মতামত নেয়া হতো না, আর তা ব্যক্ত করার জন্যেও অনুকূল পরিবেশ বর্তমান ছিল না। ফলে এ কাজ অলী-গার্জিয়ানরাই নিজেদের একচ্ছত্র অধিকার হিসেবে একান্তভাবে নিজেদের মতে এ কাজ সম্পন্ন করত। শেষ পর্যন্ত তারা এ কাজ ছেলেমেয়েদের অত্যন্ত ছোট বয়সকলেই সম্পন্ন করে ফেলতে শুরু করল। কিন্তু ইসলামী শরীয়ত এ ধরনের কাজকে ‘খুব ভালো কাজ’ বলে কখনোই ঘোষণা করেনি, না পারিবারিক ও দাম্পত্য সুখ-শান্তির দৃষ্টিতে এ কাজ কখনো কল্যাণকর হতে পারে। ছোট বয়সের বিয়েতে ছেলেমেয়েদের জীবনে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করা গেছে, তদ্দরুন এর প্রতি বর্তমান সমাজ-মানসে অতি যুক্তিসঙ্গতভাবেই তীব্র ঘৃণা ও প্রতিরোধ জেগে উঠেছে। এ কাজকে আজ কেউই ভালো ও শোভনীয় বা সমর্থনীয় মনের করতে পারছে না।

কিন্তু তাই বলে বিয়ের একটা বয়স নির্দিষ্ট করা এবং তার পূর্বে বিয়ে অনুষ্ঠানকে আইনের জোরে নিষিদ্ধ করে দেয়া, এমন কি যদি কেউ তা করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযুক্ত জেল-জরিমানার দণ্ডে দণ্ডিত করা কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। ইসলামী শরীয়তে ছোট বয়সে ছেলেমেয়েকে বিয়ে দিতে হুকুম করা হয়নি কিংবা স জন্যে উৎসাহও দেয়া হয়নি। কিন্তু এ কাজ যদি কোনো পিতা –গার্জিয়ান করেই –করা অপরিহার্য বলে মনে করে নানা বৈষয়িক বা সামাজিক কারণে, তাহলে তাকে জেল-জরিমানার দণ্ডে দণ্ডিত করার আইন প্রণয়নের অধিকার ইসলামী শরীয়তে কাউকেই দেয়া হয়নি।

বস্তুত ইসলামী আদর্শের দৃষ্টিকোণ এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট। ইসলাম ব্যাপারটিকে উন্মুক্ত রেখে গিয়েছে এবং সমাজ-সংস্থার শান্তি-শৃঙ্খলার দৃষ্টিতে তাই থাকা উচিত সর্বত্র। বিয়ে-শাদী সম্পর্কে ইসলামের সাধারণ আদেশ উপদেশ দাবি করে যে, পূর্ণ বয়সে ও কার্যত যৌন-সঙ্গমে সক্ষম হওয়ার পরই বিয়ে সম্পন্ন হওয়া উচিত। তবে তার পূর্বে বিয়ে অনুষ্ঠান করাকে নিষেধও করা হয়নি। কেননা ব্যাপারটি পিতা ও সমাজের সাধারণ অবস্থার ওপর অনেকখানি নির্ভর করে যদি কোনো পিতা বা দাদা তার মেয়ে বা নাতনীকে ছোট বয়সে –বালেগা হওয়ার পূর্বেই বিয়ে দিয়ে দেয় আর বালেগা হওয়ার পর যদি সে স্বামী তার পছন্দ না হয় তাহলে সে সেই বিয়েকে অস্বীকার করতে পারবে –শরীয়তে তার অবকাশ রয়েছে। ইমাম নববী উল্লেখ করেছেনঃ

(আরবী***********************************)

ইরাকী ফকীহগণ বলেছেন, ছোট্ট বয়সে বিয়ে দেয়া মেয়ে বালেগা হয়ে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার অধিকার রাখে। (নববী শরহে মুসলিম)

তিনি আরও লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************)

ইমাম আওযায়ী, আবূ হানীফা ও পূর্ববর্তী ফকীহগণ বলেছেন, ছোট্ট মেয়ে বিয়ে দেয়া সব কর্তৃপক্ষের জন্যেই জায়েয। তবে সে যখন বালেগা হবে, তখন সে বিয়ে রক্ষা করা কি ভেঙ্গে দেয়ার পূর্ণ ইখতিয়ার তার নিজের। ইমাম আবূ ইউসুফ অবশ্য এ থেকে ভিন্ন মত পোষণ করেন।

এমতাবস্থায় ছোট্ট মেয়ে বিয়ে দেয়ার অনুমতি থাকায় মেয়েদের জন্যে কোনো ক্ষতিকারক হবে না। বালেগা হলে পরে তার বিয়ের প্রকৃত মালিক তো সে নিজেই। ইচ্ছা হলে ভেঙ্গে দিতে পারে। বিয়ের জন্যে ছেলেমেয়ের কোনো বয়স নির্দিষ্ট করে দিয়ে ইসলাম পিতা বা গার্জিয়ানকে একটা বিশেষ বাধ্যবাধকতার মধ্যে বেঁধে দেয়নি। এ হচ্ছে বিশ্বমানবতার প্রতি ইসলামের বিশেষ অনুগ্রহ।

তাই একথা বলা যায় যে, বিয়ের কোনো বয়স নির্দিষ্ট করে দেয়া, তার পূর্বে বিয়ে নিষিদ্ধ এবং তার জন্যে দণ্ড দান করা ইসলামের পরিপন্থী। মানবীয় নৈতিকতার দৃষ্টিতেও এ কাজ অত্যন্ত অসমীচীন। ইসলামের কোনো ফিকাহবিদই এ বিষয়টি সমর্থন করেন নি। বরং এ হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে ইউরোপীয় সমাজ-আদর্শ এবং সেখান থেকেই এর অনুকূলে মতবাদ ও আইনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে দুনিয়ার বিভিন্ন মুসলিম দেশ ও রাষ্ট্রে। এ হচ্ছে ইউরোপের সাংস্কৃতিক গোলামীর এক লজ্জ্বাকর দৃষ্টান্ত।

বর-কনের পারস্পরিক বয়স পার্থক্য

বর-কনের পারস্পরিক বয়স পার্থক্য ও সামঞ্জস্য সম্পর্কে ইসলামের সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে। এ সম্পর্কে প্রথম কথা এই যে, সাধারণভাবে এ দুয়ের বয়সে খুব বেশী পার্থক্য হওয়া উচিত নয়। তাতে দাম্পত্য জীবনে অনেক ধরনের দুঃসাধ্য জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। এ হচ্ছে সাধারণ অবস্থার কথা। আর ইসলামে এ সাধারণ অবস্থার প্রতিই দৃষ্টি রেখে বলা হয়েছে যে, বর-কনের বয়স সাধারণত সমান-সমান হলেই ভালো হয়। নাসায়ী শরীফে উদ্ধৃত হাদীসের একটি অধ্যায় রচিত হয়েছে এ ভাষায়ঃ

(আরবী********************************************)

সমান-সমান বয়সে বর-কনের বিয়ের অধ্যায়।

এবং এর পরে হযরত ফাতিমা (রা)-কে হযরত আলী (রা)-র নিকট বিয়ে দেয়ার প্রসঙ্গ আলোচনা করা হয়েছে।

অপরদিকে পিতা বা অলীকে বলা হয়েছে যে, তারা যেন নিজেদের মেয়েকে বয়সেরদিক দিয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এমন লোকের কাছে বিয়ে না দেয়। এজন্যে ফিকাহবিদগণ তাগিদ করে বলেছেনঃ

(আরবী*********************************************************)

পিতা বা অলী যেন তার যুবতী মেয়েকে খুনখুনে বুড়ো বা কুৎসিৎ চেহারার লোকের নিকট বিয়ে না দেয়।

তবে সেই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, এ ব্যাপারেও ব্যতিক্রম হতে পারে। কেননা দুনিয়ার সব পুরুষই এক রকম হয় না। অনেক বয়স্ক লোকও এমন হতে পারে –হয়ে থাকে, যারা পূর্ণ স্বাস্থ্যবান, সামর্থ্যবান ও দাম্পত্য জীবনের দায়িত্ব পালনে সক্ষম। আর অনেক বুড়োও স্বীয় যুবতী স্ত্রীকে প্রেম-ভালোবাসা, যৌন সুখ-তৃপ্তি ও আনন্দ-উৎসাহের মাদকতায় অনেক যুবকের তুলনায় অধিক মাতিয়ে রাখতে পটু হয়ে থাকে। হযরত আয়েশার বয়স যখন ছয় বছর, তখন নবী করীম (স)-এর সাথে তাঁর বিয়ের আক্দ হয়েছিল এবং নবী করীম (স) তাঁকে নিয়ে ঘর বেঁধেছিলেন যখন তাঁর বয়স হয়েছিল নয় বছর, একথা পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে। আর রাসূলে করীমের বয়স ছির এ সময় পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও এতদুভয়ের দাম্পত্য জীবনের সুখ ও আনন্দের কথা বিশ্বের সকল যুবতীর আদর্শ হয়ে রয়েছে।

কিন্তু তাই বলে দুনিয়ার উপস্থিত কোনো স্বার্থের বশবর্তী হয়ে যদি এরূপ কাজ করা হয়, তাহলে তার পরিণাম অত্যন্ত মারাত্মক হতে বাধ্য। বর্তমান ক্ষয়িষ্ণু ও বিপর্যস্ত মুসলিম সমাজে এর দৃষ্টান্ত কিছু মাত্র বিরল নয়। অনেক খুনখুনে বুড়ো –যে দাম্পত্য জীবনের দায়িত্ব পালনে আদৌ সামর্থবান নয়, তার নিকট যুবতী মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয় বিপুল পরিমাণ টাকা-পয়সার বিনিময়ে, ফলে সে মেয়ে বুড়ো স্বামীর নিকট দাম্পত্য সুখলাভে বঞ্চিতা থাকে। তখন সে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করতে শুরু করে অথবা পাপোর পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়। ইসলামী শরীয়ত এ ধরনের বিয়েকে যদিও স্পষ্ট ভাষায় হারাম করেদেয়নি, কিন্তু শরীয়তের ঘোষিত দাম্পত্য জীবনের আদর্শ ও লক্ষ্যের ভিত্তিতে অনায়াসেই বলা যায় যে, এরূপ কাজ অত্যন্ত আপত্তিকর ও অভিসম্পাতের ব্যাপার। কোনো কোনো ফিকাহবিদ অবশ্য এ ধরনের বিয়েকে হারাম মনে করেন। ‘কালইউবী’ আল-মিনহাজ গ্রন্থের টীকায় লিখেছেনঃ

(আরবী*****************************************)

ছোট মেয়েকে বৃদ্ধ ও অন্ধ প্রভৃতির নিকট বিয়ে দেয়া যদিও শুদ্ধ; কিন্তু এরূপ বিয়ে করা তার পক্ষে হারাম। অধিকাংশ ফিকাহবিদই একথা বলেছেন।

হযরত আয়েশা (রা) পূর্বে অবিবাহিত মেয়ে বিয়ে করার গুরুত্ব প্রকাশের উদ্দেশ্যে একদা নবী করীম (স)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ

(আরবী********************************************)

হে রাসূল, আপনি যদি কোনো চারণভূমিতে জন্তু-জানোয়ার নিয়ে অবতীর্ণ হন, আর সেখানে এমন গাছ দেখতে পান, যার পাতা খাওয়া হয়ে গেছে এবং এমন গাছ পান যা থেকে এখনো কিছু খাওয়া হয়নি, তাহলে তখন আপনি আপনার উটকে কোন গাছ থেকে পাতা খাওয়াতে চাইবেন?

এ জবাবে নবী করীম (স) বললেনঃ

(আরবী**********************************)

খাওয়াব সেই গাছ থেকে, যার থেকে এখনো কিছু খাওয়া হয়নি।

হাদীস বর্ণনাকারী নিজেই বলেন, একথার মানে তিনি নিজেই সেই গাছ, যা থেকে পূর্বে ‘খাওয়া’ হয়নি অর্থাৎ নবী করীম (স) কেবলমাত্র হযরত আয়েশা (রা)-কেই বাকারা (কুমারী) অবস্তায় বিয়ে করেছেন। এ বিয়ের পূর্বে তাঁর কোনো বিয়ে হয়নি, তাঁকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি। যেমন হযরত ইবনে আব্বাস (রা) একদা হযরত আয়েশাকে সম্বোধন করে বলেছিলেনঃ

(আরবী*********************************************)

নবী করীম (স) আপনাকে ছাড়া ‘বাকারা’ কুমারী অবস্থায় আর কাউকে বিয়ে করেন নি।

‘বাকারা’ –পূর্বে বিয়ে হয়নি এমন মেয়ে অনাঘ্রাত কুসুমের ন্যায়। তাকে কেউ স্পর্শ করেনি, তার ঘ্রাণ কেউ গ্রহণ করেনি, তার মুখের ও বুকের মধু কেউ ইতিপূর্বে আহরণ করে নেয়নি। সবই যথাযথ পুঞ্জীভূত রয়েছে। কাজেই এ ধরনের মেয়ে বিয়ে করার জন্যে ইসলামে উৎসাহ দান করা হয়েছে।

এজন্যে নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী***************************************************)

পূর্বে বিয়ে হয়নি –এমন (বাকারা) মেয়ে বিয়ে করাই তোমাদের উচিত হবে। কেননা এ ধরনের মেয়েরা মিষ্টিমুখ ও মিষ্টভাষিনী, পবিত্র যৌনাঙ্গসমন্বিতা ও অল্পে তুষ্ট হয়ে থাকে।

হাফেয ইবনে কাইয়্যেম লিখেছেনঃ

(আরবী*********************************************)

নবী করীম (স) তাঁর উম্মতকে পূর্বে-অবিবাহিতা সুন্দরী ও দ্বীনদার স্ত্রী গ্রহণের জন্যে সব সময় উৎসাহ দিতেন।

একথা থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর তা হচ্ছে, বিয়ে শুদ্ধ হওয়া এবং তারই আবার হারাম হওয়া –এ দুয়ের মাঝে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বুড়োদের নিকট যুবতী বা ছোট্ট বয়সের মেয়েকে বিয়ে দিলে বিয়ে শুদ্ধ হবে বটে; তবে এরূপ বিয়ে করা এ ধরনের বুড়োদের পক্ষে হারাম কাজের তুল্য হবে, এই হচ্ছে ফিকাহবিদদের পূর্বোক্ত কথার তাৎপর্য।

কিন্তু যেহেতু এ ধরনের বিয়ে হারাম হওয়া সত্ত্বেও অনেক খুনখুনে বুড়ো টাকার অহংকারে যুবতী মেয়েকে বিয়ে করতে উদ্ধুদ্ধ হয়ে থাকে আর অনেক গরীব পিতাও টাকার লোভে পড়ে নিজের কাঁচা বয়সের মেয়েকে বুড়ো বরের নিকট বলি দিতেও দ্বিধা বোধ করে না, তাই আইনের সাহায্যে এ কাজ বন্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়।

জুড়ি গ্রহণের ব্যাপারে বর-কনের প্রতি উপদেশ

ইসলামী শরীয়তের ছেলে বা মেয়েকে তার নিজের জুড়ি গ্রহণের ব্যাপারে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার জন্যে কিছু কিছু উপদেশ দেয়া হয়েছে। তার মধ্য থেকে কয়েকটি জরুরী কথা এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছেঃ

প্রথমত বলা হয়েছে, পূর্বে অবিবাহিত ছেলে বা মেয়ে বাছাই করে নিতে। হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (র) বলেন, নবী করীম (স) আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ (আরবী**********) –তুমি কি বিয়ে করেছ? জবাবে আমি বললামঃ হ্যাঁ। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘সাইয়েবা’ না ‘বাকারা’ –মানে পূর্বে-বিবাহিতা মেয়ে বিয়ে করেছ, না পূর্বের অবিবাহিতা কোনো মেয়ে? তখন আমি বললাম, ‘সাইয়েবা’ বিয়ে করেছি।তখন তিনি বললেনঃ

(আরবী***************************************)

বাকারা অর্থাৎ কোনো পূর্বে-অবিবাহিতা মেয়েকে কেন বিয়ে করলে না? তাহলে তুমি তাকে নিয়ে আনন্দের খেলায় মত্ত হতে পারতে, আর সেও তোমাকে নিয়ে।

মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হাদীসটির ভাষাঃ

(আরবী******************************************)

‘বাকারা’ মেয়ে বিয়ে করলে না কেন? তাহলে পারস্পরিক আনন্দ-স্ফুর্তি ও হাসি খুশীতে জীবন কাটাতে পারতে।

এ কথার জবাবে হযরত জাবির ‘সাইয়েবা’ বিয়ে করার কারণ রাসূলের খেদমতে বর্ণনা করেছেন। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, রাসূলে করীম (স) সাধারণত এমন মেয়ে বিয়ে করাই পছন্দ করেন, যার পূর্বে কোনো বিয়ে হয়নি। আরবী ভাষায় ‘বাকারা’ বা ‘বাকের’ বলা হয় এমন মেয়েকেঃ

(আরবী*************************************************)

যার পূর্বে বিয়ে হয়নি, কেউ তার স্বামী হয়নি এবং কারোর সাথেই হয়নি কোনো যৌন সম্পর্ক স্থাপন।

আর ‘সাইয়েবা’ হচ্ছে এর বিপরীত অর্থাৎ যার বিয়ে হয়েছিল। যার স্বামী ছিল এবং তার সাথে যৌন সম্পর্কও স্থাপিত হয়েছিল।

তার মানে হচ্ছে দ্বীনদারীর সঙ্গে রূপ ও সৌন্দর্যের লাভের জন্যে চেষ্টা করাও আবশ্যক্

কিন্তু উপরের কথা থেকে একথা যেন কেউ মনে না করেন যে, বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা মেয়েকে বিয়ে করা বুঝি ইসলামের দৃষ্টিতে অনুচিত বা নাজায়েয। কেননা তা আদৌ ঠিক নয়। নবী করীম (স) ও সাহাবায়ে কিরামের অনেকেই বিধবা ও পরিত্যক্তা মহিলাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছেন এবং তাদের পূর্ন মর্যাদা ও অধিকার দিয়ে শান্তিরূপে দাম্পত্য জীবন যাপন করেছেন।

বিশেষত ও সুযোগ-সুবিধার দৃষ্টিতে অনেক সময় ‘বাকারা’ মেয়ের পরিবর্তে ‘সাইয়েবা’ মেয়েকে বিয়ে করা অধিকতর যুক্তিবহ। রাসূলে করীম (স)-এর কাছ থেকেও এর সমর্থন পাওয়া গিয়েছে। হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহর ব্যাপারটিই এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তাঁকে যখন রাসূলে করীম (স) বিয়ে করেছ কিনা এবং কি ধরনের মেয়ে বিয়ে করেছ জিজ্ঞেস করলেন তখন জবাবে তিনি বললেন, ‘সাইয়েবা’ –‘পূর্ব-বিবাহিতা মেয়ে’। রাসূলে করীম (স) এ ব্যাপারে কিছুটা আপত্তি ও নিরুৎসাহ প্রকাশ করলে তখন তার কারণ প্রদর্শনস্বরূপ হযরত জাবির (রা) বললেনঃ

(আরবী***************************************************)

আমার পিতা ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন এবং রেখে গেছেন সাতটি কন্যা। এমতাবস্থায় তাদের সাথে এনে এমন আর একটি মেয়েকে একত্র করা আমি পছন্দ করিনি, (যে হবে সংসার-অনভিজ্ঞা, যে নিজ হাতে কাজ কর্ম করবে না –করতে পারবে না। বরং দরকার ছিল এমন এক বয়স্কা মেয়েলোকের, যে তাদের (পিতার কন্যাদের) চুল আঁচড়ে দেবে এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য যাবতীয় কাজ-কর্ম করে দেবে।

এ বিবরণ শুনে নবী করীম (স) বললেঃ (আরবী*******) ‘তুমি ঠিকই করেছ’। অপর এক বর্ণনায় রাসূলের জবাব ছিলঃ (আরবী***************) ‘হ্যাঁ, তুমি যা ভালো মনে করেছ তা ঠিকই হয়েছে’। (মুসনাদে আহমাদ)

নবী করীম (স) বিশেষ গুরুত্ব সহকারে এই পর্যায়ে আর একটি উপদেশ দিয়েছেন। আর তা হচ্ছে অধিক সন্তানবতী ও অধিক প্রেমময়ী মেয়েলোক বিয়ে করা।

এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)-এর খেদতে হাজির হয়ে জিজ্ঞেস করলঃ

(আরবী************************************************)

উচ্চ বংশজাত ও সুন্দরী একটি মেয়ে পেয়েছি, কিন্তু দোষ হচ্চে এই যে, সে সন্তান প্রসব করে না (বন্ধ্যা), তাকে কি আমি বিয়ে করব?

জবাবে রাসূলে করীম (স) বললেনঃ ‘না’। লোকটি তার পরও দুই-তিনবার এসে সেই একই প্রম্ন জিজ্ঞেস করে এবং প্রত্যেকবারই তিনি নিষেধ করেন। শেষবারে রাসূল (স) বললেনঃ

(আরবী***************************************)

তোমরা বিয়ে করবে প্রেম-ভালোবাসাময়ী ও অধিক সন্তানবতী মেয়েলোককে। কেননা আমি তোমাদের বিপুল সংখ্যা নিয়ে গৌরব করব।

অপর একটি বর্ণনায় রাসূলের কথাটির ভাষা এইঃ

(আরবী***********************************************)

তোমরা বিয়ে করো অধিক প্রেম-প্রীতিসম্পন্না ও বেশি সংখ্যক সন্তান দাত্রী মেয়ে। কেনান আমি কেয়ামতের দিন অন্যান্য নবীর মুকাবিলায় তোমাদের বিপুল সংখ্যা নিয়ে গৌরব করব।

বিয়ের মতামত জ্ঞাপনের অধিকার

বিয়ের পূর্বে কনেকে দেখে নেয়ার যে ব্যবস্থা ইসলামে করা হয়েছে, তা থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, বিযের ব্যাপারে শরীয়তের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে পুরুষের পক্ষে ভাবী স্ত্রী এবং মেয়েদের পক্ষে ভাবী স্বামীকে বাছাই করার –মনোনীত করার স্থায়ী অধিকার রয়েছে। কুরআন মজীদে পুরুষদের সম্বোধন করে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************************)

অনন্তর তোমরা বিয়ে করো যেসব মেয়েলোক তোমাদের জন্যে ভালো হবে ও ভালো লাগবে।

আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা জামালুদ্দীন আল-কাসেমী লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

অর্থাৎ রূপ-সৌন্দর্য, জ্ঞান-বুদ্ধি ও পারিবারিক ব্যবস্তাপনা ও কল্যাণ ক্ষমতার দিক দিয়ে যে সব মেয়ে তোমাদের নিজেদের জন্যে ভালো বিবেচিত হবে –মনমতো হবে, তোমরা তাদের বিয়ে করো।

অথবা এর অর্থঃ

(আরবী*****************************************************)

তবে বিয়ে করো সেসব মেয়ে, যারা তোমাদের জন্যে পাক-পবিত্র, যারা তোমাদের জন্যে হালাল, নিষিদ্ধ নয়, যারা তোমাদের জন্যে হবে কল্যাণকর ও পবিত্র।

এ আয়াতে বিয়ের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তার দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত বিয়ে করবে সেসব মেয়েলোক, যা হালাল, মুহাররম নয়। কেননা কতক মেয়েলোককে যেমন রক্তের সম্পর্কের নিকটাত্মীয়া ও ভিন্ন ধর্মের মেয়েলোক –বিয়ে করা শরীয়ত স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ তাদের ছাড়া প্রায় সব মেয়েলোকই এমন যাদের মধ্য থেকে যে-কাউকে বিয়ে করা যেতে পারে।

আর দ্বিতীয় দিক হচ্ছে এই যে, বিয়ের জন্যে একটি মেয়েলোক হওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং তাকে অবশ্য দুটি দিক দিয়ে যোগ্য হতে হবে। প্রথম দিক এই যে, সে নিজে হবে পবিত্র, চরিত্রবতী, কল্যাণময়ী। সর্বদিক দিয়ে ভালো। আর দ্বিতীয় দিক এইযে, যে পুরুষ তাকে বিয়ে করবে, তার জন্যেও সে হবে প্রেমময়ী, কল্যাণময়ী সর্বগুণে গুণান্বিত ও তার মনমত মনোনীত। এ ধরনের মেয়ে বাছাই করেবিয়ে করারই নির্দেশ দেয়া হয়েছে উপরোক্ত আয়াতে। আর এসব কথা নিহিত রয়েছে আয়াতের (আরবী**********) শব্দের মধ্যে। অন্যথায় শুধু (আরবী***************) –‘মেয়েলোক বিয়ে করো’ বলে দেয়াই যথেষ্ট ছিল। এ জন্যে শায়খ মুহাম্মদ নববী এ আয়াতের তাফসীর লিখেছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ

(আরবী********************************************)

অর্থাৎ অপরিচিতা বা সম্পর্কহীনা মেয়েলোকদের মধ্যে যাদের প্রতি তোমাদের মন আকৃষ্ট হয় এবং যাদের পেলে তোমাদের দিল সন্তুষ্ট, আনন্দিত হবে ও যাদের ভালো বলে গ্রহণ করতে পারবে, তোমরা তাদেরকেই বিয়ে করো।

উপরন্তু বিভিন্ন তাফসীরে এ আয়াতটির নাযিল হওয়ার যে উপলক্ষ বর্ণিত হয়েছে, সে দৃষ্টিতেও আয়াতটির উপরোক্ত অর্থ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা এ আয়াতের শানে নুজুল হচ্ছে –লোকেরা বাপ-দাদার লালিতা-পালিতা ইয়াতীম মেয়েদের বিয়ে করত শুধু তাদের রূপ-যৌবন ও ধন-মালের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে। ফলে বিবাহিত জীবনে তার প্রতি দেখাত মনের বিরাগ, উপেক্ষা ও অযত্ন। কেননা মেয়েটিকে মনের আকর্ষণে ও ভালো লাগার কারণে বিয়ে করা হয়নি, করা হয়েছে অন্যসব জিনিস –রূপ, যৌবন ও ধনমাল সামনে রেখে, সেগুলো অবাধে ভোগ করার সুযোগ লাভের উদ্দেশ্যে। এ কারণে ইয়াতীম মেয়েদের প্রতি যে জুলুম ও অবিচার হতো, তারই নিরসন ও বিদূরণের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা এ নির্দেশ দিয়েছেন। কাজেই যাকে বিয়ে করা হচ্ছে, তার নিজস্ব গুণ-গরিমার কারণেই তাকে বিয়ে করা উচিত। অপর কোনো লক্ষ্য থাকা উচিত নয় বিয়ের পেছনে। বস্তুত নিছক টাকা পয়সা লাভ কিংবা একজন নারীর নিছক রূপ-যৌবন-ভোগের লালসায় পড়ে যেসব বিয়ে সংঘটিত হয়, তা কিছু কাল যেতে না যেতেই কিংবা লক্ষ্যবস্তুর ভোগ-সম্ভোগে তৃপ্তি লাভের পরই সে বিয়ে ভেঙ্গে যেতে বাধ্য। এর বাস্তব দৃষ্টান্তের কোনো অভাব নেই আমাদের সমাজে।

পূর্বেই বলেছি, কনে বাছাই করার যে অধিকার এ আয়াতে পুরুষদের দেয়া হয়েছে, তা কেবল পুরুষদের জন্যেই একচেটিয়া অধিকার নয়। বরং পুরুষদের ন্যায় কনেরও অনুরূপ অধিকার রয়েছে। ‘বর’ বাছাই করে খরিদ করা হয়, তখন বিয়ের মতো একটা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সারা জীবনের ব্যাপার খুব সহজেই সম্পন্ন হওয়া ও হতে দেয়া উচিত হতে পারে না। বরং যথাসম্ভব জানা-শুনা করে, খবর নিয়ে দেখে-শুনে ও ছাঁটাই-বাঁছাই করেই এ কাজ সম্পন্ন হওয়া নারী-পুরুষ উভয়ের পক্ষেই কল্যাণকর। আর এর অধিকার কেবল পুরুষদেরই একচেটিয়াভাবে হতে পারে না। এ অধিকার তাদের ন্যায় নারীদেরও অবশ্যই থাকতে হবে এবং ইসলাম তা দিয়েছে। পুরুষ যেমন নিজের দিক দিয়ে বিচার-বিবেচনা করবে কনেকে, তেমনি কনেরও উচিত অনুরূপভাবে বুঝে-শুনে একজনকে স্বামীরূপে বরণ করা। এজন্যে বিবাহেচ্ছু নর-নারীর ইচ্ছা, পছন্দ ও মনোনয়ন এবং সন্তোষে অভিমত বা সমর্থন ব্যক্ত করার গুরুত্ব সর্বজন স্বীকৃত। ইসলামী শরীয়তেও উপযুক্ত বয়সের ছেলেমেয়েকে অন্যান্য কাজের ন্যায় বিয়ের ব্যাপারেও নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। পিতামাতা ও অন্যান্য নিকটাত্মীয় লোকেরা নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে পরামর্শ অবশ্যই দেবে; কিন্তু তাদের মতই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ও একমাত্র শক্তি (Only factor) হতে পারে না। তারা নিজেদের ইচ্ছেমতোই ছেলেমেয়েদেরকে কোথাও বিয়ে করতে বাধ্য করতেও পারে না। বয়স্ক ছেলেমেয়ের বিয়ে তাদের সুস্পষ্ট মত ছাড়া সম্পন্ন হতেই পারে না। নবী করীম (স) এই পর্যায়ে যে ঘোষণা দিয়েছেন তা যেমন খুব স্পষ্ট তেমনি অত্যন্ত জোরালো।

(আরবী*************************************)

পূর্বে বিবাহিত এখন জুড়িহীন ছেলেমের বিয়ে হতে পারে না, যতক্ষণ না তাদের কাছ থেকে স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যাবে এবং পূর্বে অবিবাহিত ছেলেমেয়ের বিয়ে হতে পারে না, যতক্ষণ না তার কাছ থেকে স্পষ্ট অনুমতি পাওয়া যাবে”? তখন তিনি বললেন, জিজ্ঞেস করার পর তার চুপ থাকাই তার অনুমতি।

এ হাদীসের ওপর ভিত্তি করেই ইমাম আবূ হানিফা (রহ) বলেছেনঃ

(আরবী***********************************)

অলী পূর্বে বিবাহিত ও অবিবাহিত ছেলেমেয়েকে কোনো নির্দিষ্ট ছেলেমেয়েকে বিয়ে করতে বাধ্য করতে পারে না। অতএব পূর্বে বিবাহিত ছেলেমেয়ের কাছ থেকে বিয়ের জন্যে রীতিমত আদেশ পেতে হবে এবং অবিবাহিত বালেগ ছেলেমেয়ের কাছ থেকে যথারীতি অনুমতি নিতে হবে।

ইমাম আবূ হানীফা উপরোক্ত হাদীসের ভিত্তিতে এতদূর বলেছেন যে, কোনো পূর্ন বয়স্ক ও সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্না মেয়ে অলীর অনুমতি ব্যতিরেকে নিজ ইচ্ছায় কোথাও বিয়ে করে বসলে সে বিয়ে অবশ্যই শুদ্ধ হবে। যদিও ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের মতে অলীর অনুমতির অপেক্ষায় সে বিয়ে মওকুফ থাকবে। আর ইমাম শাফিয়ী, মালিক ও আহমাদ বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************)

কেবলমাত্র মেয়ের অনুমতিতেই বিয়ে সম্পন্ন হতে পারে না।

কেননা রাসূলে করীম (স) অন্যত্র বলেছেনঃ

(আরবী*********************************)

অলীর অনুমতি ছাড়া বিয়েই হতে পারে না।

কিন্তু পূর্বোক্ত হাদীস দ্বারা তাদের এ মত খণ্ডিত হয়ে যায়। বিশেষত এই শেষোক্ত হাদীস সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম বুখারী ও ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন প্রমুখ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস এ হাদীস সম্পর্কে বলেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

অলীর মত ছাড়া বিয়ে হতে পারে না। এ ধরনের শর্তের কোনো হাদীসই সহীহ নয়।

আর তিরমিযী শরীফে এই পর্যায়ে যে হাদীষটি উদ্ধৃত হয়েছে তা হচ্ছেঃ

(আরবী***********************************************)

পূর্বে বিবাহিতা ছেলেমেয়েরা তাদের নিজেদের বিয়ে সম্পর্কে মত জানানোর ব্যাপার তাদের অলীর চেয়েও বেশি অধিকারসম্পন্ন। আর পূর্বে অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের নিকট তাদের বিয়ের ব্যাপারে তাদের মতামত অবশ্যই জানতে চাওয়া হবে এবং তাদের চুপ থাকাই তাদের অনুমতি নামান্তর।

আর দ্বিতীয় হাদিসটি হচ্ছেঃ

(আরবী*************************************************)

পূর্বে বিবাহিত ছেলেমেয়েরা তাদের নিজেদের বিয়েতে মত জানানোর ব্যাপারে তাদের অলী অপেক্ষাও বেশী অধিকার রাখে। আর পূর্বে অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের নিকট তাদের পিতা বিয়ের মত জানতে চাইলে, তবে তাদের চুপ থাকাই তাদের অনুমতিজ্ঞাপক।

হাদীসসমূহের ভাষা, শব্দ, সুর ও কথা বিশেষ লক্ষণীয়। বিয়ের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা স্ত্রীলোকদেরকে মতামত জ্ঞাপনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন নি; বরং তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দ ও মতামতকে পূর্ণ মাত্রায় স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তাদের মরজী ছাড়া কোনো পুরুষের সাথে জবরদস্তি তাদের বিয়ে দেয়া ইসলামী শরীয়তে আদৌ জায়েয নয়।

এ ব্যাপারে অলী-গার্জিয়ানদের কর্তব্য হচ্ছে ছেলেমেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে তাদের মতামত জেনে নেয়া এবং তারপরই বিয়ের কথাবার্তা চালানো বা চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

কিন্তু ইসলামে যেখানে মেয়ের মতের গুরুত্ব স্বীকার করা হয়েছে, সেখানে তাদের স্বাভাবিক লজ্জা-শরমকেও কোনো প্রকারে ক্ষুণ্ন হতে দেয়া হয়নি। এজন্যে পূর্বে বিয়ে হয়নি –এমন মেয়ের (বাকরার) অনুমতি দানের ক্ষেত্রে চুপ থাকাকেও ‘মত’ বলে ধরে নেয়া হয়েছে। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************)

ইমাম আবূ হানীফার মতে পূর্বে-অবিবাহিতা পূর্ণ বয়স্কা মেয়েকে অলীর মতে বিয়ে করতে বাধ্য করা অলীর পক্ষে জায়েয নয়। তাই তার কাছে যখন অনুমতি চাওয়া হবে, তখন যদি সে চুপ থাকে কিংবা হেসে ওঠে তাহলে তার মত আছে ও অনুমতি দিচ্ছে বলে বোঝা যাবে।

কিন্তু পূর্বে বিয়ে হওয়া (সাইয়েবা) মেয়ের পুনর্বিবাহের প্রশ্ন দেখা দিলে তখন সুস্পষ্ট ভাষায় তার কাছ থেকে এজন্যে আদেশ পেতে হবে।

উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী লিখেছেনঃ

(আরবী***************************************************)

পূর্বে বিবাহিতা মেয়ে মত জানাবার ব্যাপারে বেশি অধিকারসম্পন্না –এ কথার অর্থ এই যে, মত জানানোর অধিকারে সেও শরীক রয়েছে। আর তার মানে, তাকে কোনো বিয়েতে রাজি হতে জোর করে বাধ্য করা যাবে না; স্বামী নির্বাচন নির্ধারণে সে-ই সবচেয়ে বেশি অধিকারী।

এ ব্যাপারে মেয়ের মতের গুরুত্ব যে কতখানি, তা এক ঘটনা থেকে স্পষ্ট জানতে পারা যায়। হযরত খানসা বিনতে হাজাম (রা)-কে তাঁর পিতা এক ব্যক্তির নিকট বিয়ে দেন। কিন্তু এ বিয়ে খানসার পছন্দ হয় না। তিনি রাসূলের দরবারে হাযির হয়ে বললেনঃ

(আরবী********************************************)

তাঁর পিতা তাঁকে বিয়ে দিয়েছেন, তিনি পূর্ব বিবাহিত; তিনি এ বিয়ে পছন্দ করেন না।

হাদীস বর্ণনাকারী বলেনঃ (আরবী*************) রাসূলে করীম (স) তাঁর এ কথা শুনে তাঁর বিয়ে প্রত্যাহার ও বাতিল করে দেন।

ইমাম আবদুর রাজ্জাক এ ঘটনাটিকে অন্য ভাষায় বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনা হচ্ছে, একজন আনসারী খানসাকে বিয়ে করেন। তিনি ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হন, অতঃপর তাঁর বাবা তাঁকে অপর এক ব্যক্তির নিকট বিয়ে দেন। তখন তিনি রাসূলের দরবারে হাযির হয়ে বললেনঃ

(আরবী************************************)

আমার পিতা আমাকে বিয়ে দিয়েছেন অথচ আমার সন্তানের চাচাকেই আমি অধিক ভালোবাসি (তার সাথেই আমি বিয়ে বসতে চাই)।

তখন নবী (স) তাঁর বিয়ে ভেঙ্গে দেন।

এ পর্যায়ে আর একটি ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে। হযরত জাবির বলেনঃ

(আরবী******************************)

এক ব্যক্তি তাঁর ‘বাকেরা’ মেয়েকে বিয়ে দেন তার বিনানুমতিতে। পরে সে নবী করীমের নিকট হাজির হয় ও অভিযোগ দায়ের করে। ফলে নবী করীম (স) তাদের বিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেন।

হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেনঃ

(আরবী**************************************************)

একটি পূর্ব-অবিবাহিতা মেয়েকে তার পিতা এমন একজনের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল, যাকে সে পছন্দ করে না। পরে রাসূলে করীম (স) সে মেয়েকে বিয়ে বহাল রাখা-না-রাখা সম্পর্কে পূর্ণ ইখতিয়ার দান করেন।

অপর একটি ঘটনা থেকে জানা যায়, চাচাতো ভাইয়ের সাথে পিতা কর্তৃক বিয়ে দেয়া কোনো মেয়ে রাসূলের দরবারে হাযির হয়ে বললঃ

(আরবী**************************************************)

আমার পিতা আমাকে তার ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। সে নীচ শ্রেণীর লোক; আমাকে বিয়ে করে তার নীচতা দূর করতে চায়।

এ অবস্থায় রাসূলে করীম (স) তাকে বিয়ে বহাল রাখা-না-রাখার স্বাধীনতা দান করেন। তারপরে মেয়েলোকটি বলেঃ

(আরবী*********************************************************)

আমি তো পিতার করা বিয়েতেই অনুমতি দিয়েছি।

কিন্তু তবু এ অভিযোগ নিয়ে আসার উদ্দেশ্য হলোঃ

(আরবী*****************************************)

আমি চাই যে, মেয়েলোকেরা একথা ভালো করে জেনে নিক যে, বিয়ের ব্যাপারে বাপদের কিছুই করণীয় নেই।

এসব হাদীস থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, বয়স্কা মেয়েদের বিয়েতে তাদের নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও পছন্দ-অপছন্দ হচ্ছে শেষ কথা। পিতা বা কোনো অলীই কেবল তাদের নিজেদেরই ইচ্ছায় বিয়ে করতে কোনো মেয়েকে বাধ্য করতে পারে না। এজন্যে রাসূল করীম (স) সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেনঃ

(আরবী***********************************)

মেয়েদের বিয়েতে তাদের কাছ থেকে তোমরা আদেশ পেতে চেষ্টা করো। ইয়াতীম মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারেও এই নির্দেশই প্রযোজ্য ও কার্যকর। হাদীসে এ সম্পর্কে বিশেষ নির্দেশ রয়েছে। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************)

ইয়াতীম মেয়ের কাছে তার নিজের বিয়ের ব্যাপারে স্পষ্ট আদেশ পেতে হবে। জিজ্ঞেস করা হলে সে যদি চুপ থাকে, তবে সে অনুমতি দিয়েছে বলে বুঝতে হবে। আর সে যদি অস্বীকার করে, তবে তাকে জোরপূর্বক বাধ্য করা যাবে না।

অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী**************************************************)

ইয়াতীম মেয়েকে তার সুস্পষ্ট অনুমতি ব্যতিরেকে বিয়ে দেয়া যেতে পারে না।

এ হলো সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে ইসলামের মৌলিক বিধান ও দৃষ্টিকোণ। নারী পুরুষের জীবনের বৃহত্তর ও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে বিয়ে। ইসলাম তাতে উভয়কে যে অধিকার ও আজাদি দিয়েছে, তা বিশ্বমানবতার প্রতি এক বিপুল অবদান, সন্দেহ নেই। কিন্তু বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয়, বর্তমান অধঃপতিত ও বিপর্যস্ত মুসলিম সমাজে ছেলেমেয়েদের এ অধিকার ও আজাদি বাস্তা ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। এর অপর একটি দিক বর্তমানে খুবই প্রাবল্য লাভ করেছে। আধুনিক ছেলেমেয়েরা তাদের বিয়ের ব্যাপরে বাপ-মা-গার্জিয়ানদের কোনো তোয়াক্কাই রাখে না। তাদের কোনো পরোয়াই করা হয় না। ‘বিয়ে নিজের পছন্দে ঠিক’ এ কথার সত্যতা অস্বীকার করা হচ্ছে না, তেমনি একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আধুনিক যুবক-যুবতীরা যৌবনের উদ্দাম স্রোতের ধাক্কায় অবাধ মেলামেশার গড্ডালিকা প্রবাহে পড়ে দিশেহারা হয়ে যেতে পারে এবং ভালো-মন্দ, শোভন-অশোভন বিচারশুন্য হয়ে যেখানে-সেখানে আত্মদান করে বসতে পারে। তাই উদ্যম-উৎসাহের সঙ্গে সঙ্গে সুস্থা বিচার-বিবেচনারও বিশেষ প্রয়োজন। কেননা বিয়ে কেবলমাত্র যৌন প্রেরণার পরিতৃপ্তির মাধ্যম নয়; ঘর, পরিবার, সন্তান, সমাজ, জাতি ও দেশ সর্বোপরি নৈতিকতার প্রশ্নও তার সাথে গভীরভাবে জড়িত। তাই বিয়ের ব্যাপারে ছেলেমেয়ের পিতা বা অলীর মতামতের গুরুত্বও অনস্বীকার্য। ইমাম নববী উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় যে মত দিয়েছেন, তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

তিনি বলেছেনঃ

(আরবী******************************************************)

হাদীসে উক্ত ‘সবচেয়ে বেশি অধিকার’ কথাটিতে শরীকদারী রয়েছে। তার মানে, মেয়ের নিজের বিয়ের ব্যাপারে যেমন তার অধিকার রয়েছে, তেমনি তার অলীরও অধিকার রয়েছে। তবে পার্থক্য এই যে, মেয়ের অধিকার অলীর অধিকার অপেক্ষা অধিক তাগিতপূর্ণ ও কার্যকর। তাই অলী যদি কোনো কুফু’তেও মেয়ের বিয়ে দিতে চায়, আর সে মেয়ে তা গ্রহণ করতে রাজি না হয়, তাহলে তাকে জোর করে বাধ্য করা যাবে না। কিন্তু মেয়ে নিজে যদি কোনো কুফু’তে বিয়ে করতে ইচ্ছে করে; কিন্তু অলী তাতে বাধ্য না হয়; তাহলে অলী তাকে তা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করতে পারে।

কেননা সাধারণত অলী-পিতা-দাদা নিজেদের ছেলেমেয়ের কখনো অকল্যাণকামী হতে পারে না। তাই বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পিতামাতার মতের গুরুত্ব কিছুতেই অস্বীকার করা চলে না।

মতবিরোধের মীমাংসা

ইমাম নববীর উপরে উদ্ধৃত কথার শেষাংশ অবশ্য পূর্ব-বিবাহিত ছেলেমেয়ের ব্যাপারে স্বীকার করে নেয়া মুশকিল। অলীর মতে ও ছেলেমেয়ের মতে বিয়ের ব্যাপারে যদি মতবিরোধ দেখা দেয়, তাহলে তখন অলীর মতের ওপর ছেলেমেয়ের মতকেই প্রধান্য দেয়া যুক্তিযুক্ত –যদি তা ভালো পাত্র বা পাত্রীর সাথে সম্পন্ন হতে দেখা যায়। কেননা বিয়ে হচ্ছে তার, অলীর নয়। আর বিয়ের বন্ধনজনিত যাবতীয় দায়িত্ব তাকেই পলন করতে হবে, অলীকে নয়। কুরআন মজীদে নিম্নোক্ত আয়াত থেকেও একথা প্রমাণিত হয়। বলা হয়েছেঃ

(আরবী**************************************)

তাদের ইদ্দত পূর্ণ হলে পরে তারা তাদের নিজেদের সম্পর্কে শরীয়ত মুতাবিক ও প্রচলিত রীতি অনুযায়ী যে সিদ্ধান্তই গ্রহণ করুক না কেন, সেজন্যে তোমরা –অলী-গার্জিয়ানদের কিংবা সমাজপতিদের কোনো দায়িত্ব নেই (কিছুই করণীয় নেই)।

এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************************)

যখন কোনো মহিলা তালাকপ্রাপ্তা হবে কিংবা তার স্বামী মারা যাওয়ার কারণে বিধবা হবে, তখন ইদ্দত উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর সে যদি সুসাজে সজ্জিতা হয়, দেহে রং লাগায়, আর বিয়ের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করে ও কথাবার্তা চালায়, তবে তাতে তার কোনো দোষ হবে না।

এ আয়াত পূর্বে-বিবাহিতা স্ত্রীলোকদের তাদের নিজেদের বিয়ের ব্যাপারে শরীয়ত মুতাবেক যে-কোন স্থানে, যে কোন পাত্রের সাথে বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করার অধিকার দিচ্ছে।

নওয়াব সিদ্দীক হাসান তাঁর তাফসীরে এ আয়াতের নীচে লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

ইমাম আবূ হানীফার সঙ্গী-সাথী ও তাঁর মাযহাবের আলেমগণ এই আয়াতের ভিত্তিতে বলেছেন যে, অলী ছাড়াও বিয়ে হতে পারে। কেননা আয়াতে ‘মেয়েরা যে কাজ করে’ বলা হয়েছে। তার মানে, শরীয়ত মুতাবেক যে-কোনো ‘কাজ’ করার তাদের জন্যে অনুমতি আছে।

আল্লামা ইবনে রুশদ লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************)

ইমাম আবূ হানীফা, যুফর, শা’বী ও জুহরী বলেছেনঃ একজন মেয়েলোক যখন তার বিয়ে অলী ছাড়াই সম্পন্ন করে ফেলে এবং তা কুফু অনুযায়ী হয় তবে তা অবশ্যই জায়েয বিয়ে হবে।

এমতাবস্থায় দুই ধরনের দলীলের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপনের পন্থা এই হতে পারে যে, যেসব হাদীসে ‘অলী ছাড়া বিয়ে হতেই পারে না’ বলা হয়েছে, তার মানে হবেঃ

(আরবী**********************************************)

সুন্নত তরীকা মতো বিয়ে অলীর মত ছাড়া হতে পারে না।

আর যেসব দলীল থেকে প্রমাণিত হয় যে, মেয়ের নিজের ইচ্ছায় বিয়েতে অলী বাধা দিতে পারে, তার মানে হবে সেই বিয়ে, যা মেয়ে করতে চাইবে কুফু’র বাইরে। মওলানা সানাউল্লাহ পানীপতি লিখেছেনঃ

(আরবী**********************************************************************************)

এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিয়ের ব্যাপারে পূর্বে বিবাহিতা মেয়র মতের প্রতিবন্ধক কিছু হতে পারে না। প্রতিবন্ধক হতে পারে কেবল অলীর অধিকার, যা রাসূলে হাদীস ‘পূর্ব-বিবাহিতা মেয়েরা তাদের নিজেদের বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার অলীর তুলনায় অধিক অধিকারী’ থেকে জানা গেছে। আর অলীর অধিকার হচ্ছে কুফু’র বাইরে বিয়ে হতে থাকলে শুধু আপত্তি জ্ঞাপন, যেন সামাজিক লজ্জা অপমান থেকে বাঁচা যায়।

তাহলে সুষ্ঠুরূপে বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার একমাত্র পথ এই যে, অলী নেজই মেয়ের জন্যে উদ্যোগী হবে। মেয়ের নিজস্ব কোনো মত –কোনো দৃষ্টি যদি থাকে, আর তাতে শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো আপত্তির কারণ না থাকে, তাহলে সে অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন করে দেবে। কোনো ছেলের সাথে বিয়েতে রাজি না হলে তার ওপর কোনো প্রকারেই জোর প্রয়োগ করা চলবে না। প্রসিদ্ধ ফিকাহবিদ ইমাম সরখসী রচিত ‘আল-মবসূত’ গ্রন্থে লিখিত হয়েছেঃ

বিয়ের সময় মেয়ের অনুমতি নিতে হবে। কেননা তার কোনো অভ্যন্তরীন রোগ বা দৈহিক কোনো অসুবিধা থাকতে পারে। অথবা তার মন অন্য কারো দিকে আকৃষ্ট হয়ে থাকতে পারে। এরূপ অবস্থায় তার মত না নিয়ে বিয়ে দিলে সে তার স্বামীর ঘর সুষ্ঠুরূপে করতে পারবে না। তখন সে মেয়ে বিপদে পড়ে যাবে, কেননা তার মন অন্যত্র বাধা রয়েছে। আর প্রেমের রোগ অপেক্ষা বড় রোগ কিছু হতে পারে না। (৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৭)

শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী এ বিষয়টির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************************)

জেনে রাখো, বিয়ের ব্যাপারে কেবলমাত্র মেয়েদেকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী বানানো সঙ্গত হয়। কেননা তাদের বুদ্ধি অসম্পূর্ণ, চিন্তা-বিবেচনা দুর্বল। অনেক সময় তারা ভালো দিকটি জানতেই পারে না। সামাজিক মর্যাদার দিকেও তাদের প্রায়ই লক্ষ্য থাকে না। তাতে করে অনেক সময় তারা অনুপযুক্ত ক্ষেত্রেই মন দিয়ে বসে আর তাতে সমাজের লোকদের অনেক লজ্জা-অপমানের কারণ হতে পারে। এজন্যে এ ব্যাপারে অলীর কিছুটা দখল থাকা বাঞ্ছনীয়, যেন উপরোক্ত আশঙ্কার পথ বন্ধ করা যায়।

তিনি আরো বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************)

তাই বলে কেবল অলীর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দ্বারা বিয়ে সম্পন্ন হওয়াও জায়েয নয়। কেননা মেয়েরা তাদের নিজেদের বিষয় যতটা বুঝে ততটা তারা বুঝে না এবং বিশেষ করে যখন বিয়ের ভালো-মন্দ ও সুখ-দুঃখ তাদেরই ভোগ করতে হয়।

বিয়ে অনুষ্ঠানের প্রচার

বিয়ে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে –যারা সমাজেরই লোক –বিবাহিত হয়ে পরস্পরে মিলে দাম্পত্য জীবন যাপন করতে ইচ্ছুক, কাজেই তাদের ঐক্য ও মিলন সৃষ্টি ও সুষ্ঠু মিলিত জীবন যাপনের পশ্চাতে সমাজের আনুকূল্য ও সমর্থন-অনুমোদন একান্তই অপরিহার্য। এ কারণে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতে গোপনে নারী-পুরুষের মিলনকে স্পষ্ট অসমর্থন জানানো হয়েছে। পুরুষদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

(আরবী********************************************)

বিবাহের বন্ধনে বন্দী হয়ে স্ত্রী গ্রহণ করবে জ্বেনাকারী হিসেবে নয়।

মেয়েদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

(আরবী************************************)

বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পুরুষদের সাথে মিলিত হবে, জ্বেনাকারিণী কিংবা গোপনে প্রণয়-বন্ধুতাকারিণী হয়ে নয়।

প্রথম আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী******************************************************)

আল্লাহ তা’আলা এখানে প্রকারান্তরে মুসলিমদের আদেশ করেছেন যে, তারা মেয়েদের মোহরানা দিয়ে বিয়ে করে গ্রহণ করবে, জ্বেনা-ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে নয়।

আর দ্বিতীয় আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

আরববাসীরা জ্বেনা-ব্যভিচারের প্রচার হলে খুবই আপত্তি করত, দোষের মনে করত, কিন্তু গোপন বন্ধুত্ব গ্রহণে কোনো আপত্তি তাদের ছিল না। ইসলাম এসে এসব কিছুর পথ বন্ধ করে দিয়েছে। (ঐ)

আল্লামা ‘জুজাজ’ বলেছেনঃ

(আরবী****************************************)

কোনো বিশুদ্ধ বিয়ে ব্যতিরেকে যৌন চর্চার উদ্দেশ্যে কোনো মেয়ে যদি কোনো পুরুষের সাথে একত্র বসবাস করে, তবে তাকেই বলা হয়, ‘মুসাফিহাত’ আর তা সুস্পষ্ট হারাম।–[এই দ্বিতীয় আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ

জাহিলিয়াতের যুগে ব্যভিচারী মেয়েরা ছিল দু’ধরনের। কেউ প্রকাশ্যভাবে ব্যভিচার করত এবং কেউ গোপন-বন্ধুত্ব ও প্রণয়-প্রীতি হিসেবে করত। আর তারা নিজেদের বুদ্ধিতেই প্রথম প্রকারের ব্যভিচারকে হারাম ও দ্বিতীয় প্রকারের ব্যভিচারকে হালাল মনে করত।]

কাজেই একজন পুরুষ ও একজন মেয়ে পরস্পরের সাথে কেবল বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমেই মিলত হতে পারে এবং এ বিয়ের মাধ্যমেই মিলিত হতে পারে এবং এ বিয়ের মাধ্যমে মিলিত হওয়ার বিষয়ে সমাজের লোকদেরকে জানতে হবে, তার প্রতি তাদের সমর্থনও থাকতে হবে। আর এজন্যে দরকার হচ্ছে মিলনকারী নারী-পুরুষের বিয়ে এবং সে বিয়ে গোপনে অনুষ্ঠিত হলে চরবে না, হতে হবে প্রকাশ্যে সকলকে জানিয়ে, সমাজের সমর্থন নিয়ে। এজন্যে ইসলামের বিবাহ অনুষ্ঠানের প্রচার হওয়ার অনুকূলে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং গোপন বিয়েকে স্পষ্ট নিষেধ করা হয়েছে।

ইমাম মালিক বর্ণনা করেছেন, হযরত উমর ফারূকের সম্মুখে এমন এক বিয়ের ব্যাপারে পেশ করা হয়, যার অনুষ্ঠানে কেবলমাত্র একজন পুরুষ ও একজন মেয়েলোক উপস্থিত ছিল। তিনি বললেনঃ

(আরবী*********************************************************)

এ তো গোপন বিয়ে এবং গোপন বিয়েকে আমি জায়েয মনে করি না। আমি তার অনুমতিও দিচ্ছি না। এ ব্যাপারটি পূর্বে আমার নিকট এলে আমি এ ধরনের বিয়েকারীকে ‘রজম’ করার হুকুম দিতাম।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী****************************************************************)

অধিকাংশ ইসলামবিদের মতে অকাট্য প্রমাণ ছাড়া কোনো বিয়ে প্রমাণিত হতে পারে না, আর তা অনুষ্ঠিত হতে পারে না, যতক্ষণ না তাতে তবিয়ের সময় সাক্ষিগণ উপস্থিত থাকবে।

বিয়ের অনুষ্ঠান যাতেকরে ব্যাপক প্রচার লাভ করে তার নির্দেশ এবং তার উপায় বলতে গিয়ে রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী**********************************************************)

এ বিয়ে অনুষ্ঠানের ব্যাপক প্রচার করো এবং সাধারণত এর অনুষ্ঠান মসজিদে সম্পন্ন করো, আর এ সময় একতারা বাদ্য বাজাও।

বিয়ে অনুষ্ঠানের প্রচার সম্পর্কিত আদেশ স্পষ্ট ও অকাট্য। এর ব্যতিক্রম হলে সে বিয়ে শুদ্ধ হতে পারে না। আর প্রচার অনুষ্ঠানের জন্যে মসজিদে বিয়ে সম্পন্ন করতে আদেশ করেছেন। বিয়ের অনুষ্ঠান মসজিদ করা যদিও ওয়াজিব নয়; কিন্তু সুন্নত –ভালো ও পছন্দনীয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা মসজিদ হচ্ছে মুসলমানদে মিলন কেন্দ্র। মহল্লার ও আশেপাশের মুসলমানগণ দৈনিক পাঁচবার মসজি জমায়েত হয়ে থাকে। এখানে বিয়ে অনুষ্ঠিত হলে তারা সহজেই এতে শরীক হতে পারে, আপনা-আপনিই জেনে যেতে পারে অমুকের ছেলে আর অমুকের মেয়ে আজ বিবাহিত হচ্ছে ও স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একত্রে জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। এতে করে সামাজিক সমর্থন সহজেই লাভ করা যায়।

এছাড়া মসজিদ হচ্ছে অতিশয় পবিত্র স্থান, বিয়েও অত্যন্ত পবিত্র কাজ। মসজিদ হচ্ছে আল্লাহর ইবাদতের জায়গা, বিয়েও আল্লাহর এক অন্যতম প্রধান ইবাদত, সন্দেহ নেই।

দ্বিতীয়ত, বিয়ে অনুষ্ঠানের সময় ‘দফ’-[ (আরবী****) টি ইংরেজী হচ্ছে Tambourine খঞ্ছনি বা তম্বুরা।] বা একতারা বাদ্য বাজাতে বলা হয়েছে। এ বাধ্য নির্দোষ রাসূলে করীম (স) বিয়ে অনুষ্ঠাতের সময় এ বাধ্য বাজানোর শুধু অনুমতিই দেন নি, সুস্পষ্ট নির্দেশও দিয়েছেন। যদিও তা বাজানো ওয়াজিব নয়; কিন্তু সুন্নত –অতি ভালো তাতে সন্দেহ থাকতে পারে না। বিশেষত এজন্যে যে, নবী করীম (স) চুপেচাপে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হওয়াকে আদৌ পছন্দ করতেন না। এমনি এক বিয়ে অনুষ্ঠান সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) লোকদের জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ

(আরবী******************************************)

তোমরা সে বিয়েতে কোনো মেয়ে পাঠাও নি, যে বাধ্য বাজাবে আর গান গাইবে?

এসব হাদীসের আলোচনা করে ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী***********************************************************)

এ হাদীস থেকে ‘দফ’ বাজিয়ে ও নির্দোষ গান গেয়ে বিয়ের প্রচার করা জায়েয হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় এবং সমাজপতিরও উচিত বিয়ে অনুষ্ঠানে শরীক হওয়া, যদিও তাতে আনন্দ-উৎসব ও খেল-তামাসাই হোক না কেন –যদি তা শরীয়তের জায়েয সীমালংঘন করে না যায়।

রুবাই বিনে মুওয়ায (রা) বলেনঃ আমার যখন বিয়ে হচ্ছিল, তখন নবী করীম (স) আমার ঘরে এসে উপস্থিত হলেন এবং আমার বিছানায় আসন গ্রহণ করলেন। তখন ছোট ছোট মেয়েরা ‘দফ’ বাজাচ্ছিল আর গান করছিল। এই সময় মেয়ে গায়িকা গান বন্ধ করে বললঃ ‘সাবধান, এখানে নবী করীম (স) উপস্থিত হয়েছেন, কাল কি হবে, তা তিনি জানেন’। একথা শুনে নবী করীম (স) বললেনঃ

(আরবী**************************************************)

এসব কথা ছাড়ো, বরং তোমরা যা বলছিলে, তাই বলতে থাকো।

(আরবী*************************************************)

তোমরা যুদ্ধ-সংগ্রাম ও বীরত্বের কাহিনী সম্বলিত যেসব গীত-কবিতা পাঠ করছিলে ও গাইতেছিলে, তা-ই করতে লেগে যাও।

এসব হাদীস থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, বিয়ে অনুষ্ঠানের প্রচারের উদ্দেশ্যে একতারা বাধ্য বাজানো আর এ উপলক্ষ্যে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নির্দোষ, ঐতিহাসি কাহিনী ও জাতীয় বীরত্বব্যক গীত-গজল গাওয়া শরীয়তের খেলাফ নয়। কিন্তু তাই বলে এমন সব গীত-গান গাওয়া কিছুতেই জায়েয হতে পারে না যাতে অন্যায়-অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার প্রচার হয়, যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, রূপ ও সৌন্দর্যের প্রতি অন্ধ আবেগ উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। কেননা এ ধরনে গান-গজল বিয়ের সময়ও হারাম, যেমন হারাম সাধারণ সময়ে। এ সম্পর্কে মূলনীতি হচ্ছেঃ

যেসব গান-গজল-বাজনা-আনন্দানুষ্ঠান সাধারণ সময়ও হারাম, তার অধিকাংশই হারাম বিয়ের অনুষ্ঠানেও। কেননা এ সম্পর্কে যে নিষেধাবানী উচ্চারিত হয়েছে, তা সাধারণভাবে প্রযোজ্য।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ ‘দফ’ বাজানো সম্পর্কে লিখেছেনঃ

(আরবী***************************************************************)

একতারা বাদ্য বাজানোর জন্যে আদেশ করার মূলে একটি ভালো দিক রয়েছে। তা এই যে, বিয়ে এবং গোপনে বন্ধুত্ব-ব্যভিচার উভয় ক্ষেত্রেই যখন যৌন স্পৃহার পরিতৃপ্তি ও নর-নারী উভয়ের সম্মতি সমানভাবে বর্তমান থাকে, তখন উভয়ের মধ্যে প্রথম দৃষ্টিতেই পার্থক্য করার মতো কোনো জিনিসের ব্যবস্থা করার আদেশ দেয়া একান্তই অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যেন বিয়ে সম্পর্কে কারো কোনো কথা বলবার না থাকে এবং না থাকে কোনো গোপনীয়তা।

নবী করীম (স) নারী-পুরুষের হারাম মিলন ও হালাল মিলনের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টির জন্যে বিয়ের সময় দফ বাজাতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************)

হালাল বিয়ে ও হারাম যৌন মিলনের মথ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে একতারা বাজনার বাদ্য ও বিয়ে অনুষ্ঠানের শব্দ ও ধ্বনি।

আল্লামা আমদুল বান্না এ সম্পর্কে লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************)

সুন্নত তরীকা হচ্ছে বিয়ের সময় দফ বাজানো, নির্দোষ গান গাওয়া ও এ ধরনের অন্যান্য কাজ। হাদীসে বিয়ের শব্দ প্রচারের যে কথা বলা হয়েছে, তার অর্থ তিনি বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************)

শব্দ করার অর্থ হচ্ছে নির্দোষ কথা সম্বলিত গান-গীতি গাওয়া।

আল্লামা ইসমাঈল কাহলানী সনয়ানী লিখেছেনঃ

বিয়ের প্রচারের আদেশ হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে। প্রচার করা- গোপন বিয়ের বিপরীত। এ সম্পর্কে বহু হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। তার সনদ সম্পর্কে কিছু কথা থাকলেও সব হাদীস থেকেই মোটামুটি একই কথা জানা যায় এবং একটি অপরটিকে শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য করে দেয়। আর ‘দফ’ –একতারা বাদ্য বা ঢোল –বাজানো জায়েয এজন্যে যে, বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রচারের ব্যাপারে এটা অতিশয় কার্যকর।

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ

(আরবী*****************************************************)

বিয়ে অনুষ্ঠানে ‘ঢোল’ খঞ্জনি বাজানো ও অনুরূপ কোনো বাদ্য বাজানো জায়েয হওয়া সম্পকে সব আলেমই একমত। আর বিয়ে অনুষ্ঠানের সাথে তার বিশেষ যোগের কারণ হচ্ছে এই যে, এতে করে বিয়ের কথা প্রচার হবে ও এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। আর তার ফলেই বিয়ে সংক্রান্ত যাবতীয় অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে।

ইমাম মালিক বলেছেনঃ

(আরবী******************************************************)

বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢোল ও তবলা বাজানোতে কোনো দোষ নেই। কেননা আমরা মনে করি, তার আওয়াজ খুব হালকা, আর বিয়ের অনুষ্ঠান ছাড়া অপর ক্ষেত্রে তা জায়েয নয়।

ইমাম মালিকের বাঁশী বাজিয়ে আনন্দ-স্ফুর্তি করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস হলে জবাবে তিনি বলেনঃ

(আরবী**************************************************)

তার আওয়াজ যদি বিকট ও প্রচণ্ড হয়, চারদিককে প্রকম্পিত ও আলোড়িত করে তোলে, তাহলে তা আমি পছন্দ করি না –মাকরূহ মনে করি। পক্ষান্তরে সে আওয়াজ যদি ক্ষীণ হয় তবে তাতে দোষ নেই।

কুরজা ইবনে কায়াব আনসারী ও আবূ মাসঊদ আনসারী বলেনঃ

(আরবী********************************************************)

বিয়ের অনুষ্ঠানে বাদ্য ও বাঁশী বাজিয়ে আনন্দ-স্ফুর্তি করার অনুমতি দিয়েছেন আমাদের।

পূর্বেই বলা হয়েছে, রাসূলে করীম (স)-এর বাদ্য বাজানো সংক্রান্ত অনুমতি ফরয-ওয়াজিব কিছু নয়। কিন্তু তবুও এর যথেষ্ট তাৎপর্য রয়েছে। আর এ ব্যাপারে ধর্মীয় গোঁড়ামীও যেমন সমর্থনীয় নয়, তেমনি অশ্লীল নাচ-গানের আসর জমানো, ভাড়া করা কিংবা বাড়ির যুবক-যুবতীদের সীমালংঘনকারী আনন্দ-উল্লাস এবং তার মধ্যে যৌন-উত্তেজনা বৃদ্ধিকারী কাজের অনুষ্ঠান কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। বর্তমাতে মুসলিম সমাজ আদুনিকাতর সয়লাবে যেভাবে ভেসে চলেছে, তা অনতিবিলম্বে রোধ করা না গেলে জাতীয় ধ্বংস ও অধোগতি অবধারিত হয়ে দেখা দেবে, তাতে সন্দেহ নেই।

বিয়ের সময় বর-কনেকে সাজানো

বিয়ের সময় বর ও কনেকে নতুন চাকচিক্যময় পোশাক-পরিচ্ছদে সুসজ্জিত করা এবং ছেলেমেয়ের গায়ে হলুদ মাখা ইসলামী শরীয়তের সম্পূর্ণ জায়েয। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) বলেনঃ হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) একদিন রাসূলে করীমের চিহ্ন লাগানো ছিল।

(আরবী*******************) –এবং তখন তাঁর গায়ে হলুদের চিহ্ন লাগানো ছিল।

রাসূলে করীম (স) তার কারণ জিজ্ঞেস করলে হযরত ইবনে আওফ জানালেনঃ

(আরবী**********************************************)

তিনি আনসার বংশের এক মহিলাকে বিয়ে করেছেন (এবং এ বিয়েতে লাগানো হলুদের রং-ই তাঁর গায়ে লেগে রয়েছে)। (বুখারী)

এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিয়ের সময় বর ও কনে –ছেলে ও মেয়ে –উভয়কেই সাজানো এবং তাদের গায়ে হলুদ লাগানো প্রাচীনকালেও –রাসূলের ও সাহাবীদের সমাজেও –প্রচলিত ছিল। হলুদ, জাফরান ইত্যাদি যে কোন জিনিস দিয়েই বর-কনের শরীর রঙীন করা যেতে পারে এবং এর সঙ্গে সুগন্ধি ব্যবহারেরও অনুমতি রয়েছে। কেননা হযতর আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) এসব লাগিয়ে রাসূলের সম্মুখে হাযির হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর এ কাজকে অপছন্দ করেন নি, সেজন্যে তিরস্কারও করেন নি। এ সম্পর্কে ইসলামের মনীষীদের মত হচ্ছে এইঃ

(আরবী************************************************)

যে লোক বিয়ে করবে, সে যেন বিয়ে ও আনন্দ-উৎসবের নিদর্শনস্বরূপ হলুদ বর্ণের রঙীন কাপড় পরিধান করে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ

(আরবী***************************************************)

সমস্ত রং ও বর্ণের মধ্যে হলুদ বর্ণই হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম ও সুন্দর।

এর কারণস্বরূপ তিনি কুরআনের নিম্নোক্ত বাক্যাংশ পাঠ করেছিলেনঃ

(আরবী***********************************************)

উজ্জ্বল হলুদ বর্ণ সম্পন্ন, যার রঙ চকচকে, দর্শকদের মনকে আনন্দে উৎফুল্ল করে দেয়।

এখানে পরিচ্ছন্ন ও চকচকে হলুদ বর্ণকেই লক্ষ্য করা হয়েছে, যা দেখলে চোখ ঝলসে যায়, রঙের সৌন্দর্য দেখে দর্শক মুগ্ধ-বিমোহিত হয়।

রাসূলে করীম (স) নিজে কি সব রং পছন্দ করতেন, এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে হযরত আনাস (রা) বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************************)

নবী করীম (স) হরিৎ বর্ণ লাগাতেন, আমিও তা-ই লাগিয়ে থাকি এবং তা-ই আমি পছন্দ করি, ভালোবাসি।

আল্লামা ইবনে আবদুল বার ইমাম জুহরী থেকে বর্ণনা করেছেনঃ

(আরবী**********************************************)

সাহাবায়ে কিরাম হলুদ বর্ণের সুগদ্ধি ব্যবহার করতেন এবং তাতে কোনো দোষ দেখতেন না।

ইবনে সুফিয়ান বলেনঃ

(আরবী***********************************************)

এ রঙ কাপকে ব্যবহার করা আমাদের মনীষীদের মতে জায়েয, দেহ ও শরীরের লাগানো নয়।

অবশ্য ইমাম আবূ হানীফা, শাফিয়ী ও তাঁদের সঙ্গী-সাথীদের মতে কাপড়ে কিংবা দাঁড়িতে জাফরানের রঙ লাগানো মাকরূহ।

দেন-মোহর

বিয়েতে দেন-মোহর বা ‘মহরানা’ অবশ্য দেয় হিসেবে ধার্য করার এবং তা যথারীতি আদায় করার জন্যে ইসলামে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ‘এনায়া’ গ্রন্থে ‘মহরানা’ বলতে কি বোঝায় তার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ

(আরবী******************************************************)

দেনমোহর বলতে এমন অর্থ-সম্পদ বোঝায়, যা বিয়ের বন্ধনে স্ত্রীর ওপর স্বামীত্বের অধিকার লাভের বিনিময়ে স্বামীকে আদায় করতে হয়, হয় বিয়ের সময়ই তা ধার্য হবে, নয় বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার কারণে তা আদায় করা স্বামীর ওপর ওয়াজিব হবে।

বিয়ের ক্ষেত্রে মহরানা দেয়া ফরয বা ওয়াজিব। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ

(আরবী**************************************************)

তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের কাছ থেকে যে যৌন-স্বাদ গ্রহণ করো, তার বিনিময়ে তাদের ‘মহরানা’ ফরয মনে করেই আদায় করো।

তাফসীরের কিতাবে এ আয়াতের তরজমা করা হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ

(আরবী**************************************)

অর্থাৎ তোমরা পুরুষরা বিবাহিতা স্ত্রীদের সাথে কার্য সম্পাদন করে যে স্বাদ গ্রহণ করেছ, তার বিনিময়ে তাদের প্রাপ্য মহরানা পুরাপুরি তাদের নিকট আদায় করে দাও, আদায় করো এ হিসেবে যে, তা পূর্ণমাত্রায় দেয়া আল্লাতর তরফ থেকে তোমাদের ওপর ফরয করা হয়েছে।

অপর আয়াতে বলা হয়েছেঃ

(আরবী***************************************************)

এবং মেয়েদের অলি-গার্জিয়ানের অনুমতি নিয়ে তাদের বিয়ে করো এবং তাদের ‘মহরানা’ প্রচলিত নিয়মে ও সকলের জানামতে তাদেরকেই আদায় করে দাও।

এ আয়াতদ্বয়ে বিয়ের ক্ষেত্রে দেয়ার স্পষ্ট নির্দেশ ঘোষিত হয়েছে। এজন্যে ‘মহরানা’ হচ্ছে বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার একটি জরুরী শর্ত। প্রথম আয়াতে আজাদ ও স্বাধীন মহিলাকে বিয়ে করা সম্পর্কে নির্দেশ এবং দ্বিতীয় আয়াতে দাসী বিয়ে করা সম্পর্কে বলা হয়েছে। আর দু’জায়গায় বিয়ের বিনিময়ে মহরানা দেয়ার স্পষ্ট নির্দেশ উল্লিখিত হয়েছে।

আল্লামা ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ

(আরবী***************************************************)

মহান আল্লাহ মহরানাকে বিনিময় স্বরূপ ধার্য করেছেন এবং যাবতীয় পারস্পরিক বিনিময়সূচক ও একটা জিনিসের মুকাবিলার আর একটা জিনিস দানের কারবারের মতোই ধরে দিয়েছেন।

অতএব এটাকে স্বামীর ‘অনুগ্রহের দান’ মনে না করে একটার বদলে একটা প্রাপ্তির মতো ব্যাপার মনে করতে হবে। অর্থাৎ মহরানার বিনিময়ে স্ত্রীর যৌন অঙ্গ ব্যবহারের অধিকার লাভ।

আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************************)

এবং মুহাররম মেয়েদের ছাড়া আর সব মহিলাকেই তোমাদের জন্যে হালাল করে দেয়া হয়েছে এজন্যে যে, তোমরা তাদের গ্রহণ করবে তোমাদের ধন-মালের বিনিময়ে।

ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************)

আল্লাহ মহান হুকুমদাতা স্ত্রীর যৌন অঙ্গ ব্যবহার হালাল করেছেন ধন-মালের বিনিময়ে ও বিয়ের মাধ্যমে পবিত্রতা রক্ষার্থে, জেনার জন্যে নয়। আর একথা প্রমাণ করে যে, বিয়েতে মহরানা দেয়া ওয়াজিব অর্থাৎ ফরয নয়।

কুরআনে আবার বলা হয়েছেঃ

(আরবী*******************************************************)

এবং মুসলমান ও আহলি কিতাব বংশের সতীত্ব-পবিত্রতাসম্পন্না মহিলারাও তোমাদের জন্যে হালাল, যখন তোমরা তাদের মহরানা আদায় করে বিয়ে করবে।

অন্যত্র এ কথারই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ

(আরবী******************************************************)

তোমরা যদি সে মহিলাদের বিনিময় –মহরানা –দিয়ে বিয়ে করো, তবে তোমাদের কোনো গুনাহ হবে না।

এ আয়াত দুটি উদ্ধৃত করে ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ

(আরবী************************************************************)

এসব আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, মহরানা দেয়া সকল বিয়েতে ও সকল অবস্থায়ই ওয়াজিব (ফরয)। এমনকি আকদ-এর সময় যদি ধার্য করা নাও হয় তবুও সে স্ত্রীর সাথে যৌন মিলন হওয়ার সাথে সাথে মহরানা দেয়া ওয়াজিব (ফরয) হয়ে যাবে।

শুধু তা-ই নয়, মহরানা আদায় করতে হবে অন্তরের সন্তোষ ও সদিচ্ছা সহকারে এবং মেয়েদের জন্যে আল্লাহর দেয়া এক নেয়ামত মনে করে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ

(আরবী******************************)

এবং স্ত্রীদের প্রাপ্য মহরানা তাদের আদায় করে দাও আন্তরিক খুশীর সাথে ও তাদের অধিকার মনে করে।

আয়াতে উদ্ধৃত (আরবী********) শব্দের অর্থ ব্যাপক। তার একটি মানে হচ্ছে (আরবী********) কোনো বিনিময় ও বদলা ব্যতিরেকেই কিছু দিয়ে দেয়া। আয়াতের আর একটি অর্থ হচ্ছেঃ

(আরবী******************************)

মহরানা দিয়ে মনকে পবিত্র ও নিষ্কলুষ করে নাও, মহরানা দেয়ার জন্যে মনের কুণ্ঠা কৃপণতা দূর করো।

আর এর তৃতীয় অর্থ হচ্ছেঃ

(আরবী***********) –আল্লাহর তরফ থেকে বিশেষ দান।

কেননা জাহিলিয়াতের যুগে হয় মহরানা ছাড়াই মেয়েদের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যেত, নয় মহরানা বাবদ যা কিছু আদায় হতো তা সবই মেয়েদের বাপ বা অলি-গার্জিয়ানরাই লুটে পুটে খেয়ে নিত। মেয়েরা বঞ্চিতাই থেকে যেত। এজন্যে ইসলামে যেমন মহরানা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, তেমনি এ জিনিসকে একমাত্র মেয়েদেরই প্রাপ্য ও তাদের একচেটিয়া অধিকারের বস্তু বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং এতে বাপ বা অলী-গার্জিয়ানের কোনো হক নেই বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। বস্তুত মহরানা যখন মেয়েদের জন্যে আল্লাহর বিশেষ দান, তখন তা আদায় করা স্বামীদের পক্ষে ফরয এবং স্বামীদের ওপর তা হচ্ছে স্ত্রীদের আল্লাহর নির্ধারিত অধিকার।

প্রশ্ন উঠতে পারে, স্বামী-স্ত্রী উভয়ই তো উভয়ের কাছে থেকে যৌন সুখ ও পরিতৃপ্তি লাভ করে থাকে। ‘মহরানা’ যদি এরই ‘বিনিময়’ হয় তাহলে তা কেবল স্বামীই কেন দেবে স্ত্রীকে, তা কি স্বামীদের ওপর অতিরিক্ত ‘জরিমানা’ হয়ে যায় না?

এর জবাবে বলা যায়, প্রকৃত ব্যাপার এই যে, স্বামী বিয়ের মাধ্যমে স্ত্রীর ওপর এক প্রকারের কর্তৃত্ব বা নেতৃত্ব লাভ করে থাকে। স্বামী স্ত্রীর যাবতীয় অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরনের দায়িত্ব গ্রহণ করে আর স্ত্রী নিজেকে –নিজের দেহমন, প্রেম-ভালবাসা, যাবতীয় সম্পদ-ঐশ্বর্য –একান্তভাবে স্বামীর হাতে সোপর্দ করে দেয়। এর বিনিময়স্বরূপই মহরানা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেননাঃ

(আরবী*************************************************************)

অতঃপর স্ত্রী স্বামীর মত ও অনুমতি না নিয়ে –না নফল রোযা রাখবে, না হজ্জ করবে। আর না তার ঘর ছেড়ে কোথাও চলে যাবে।

শাফিয়ী মাযহাবের আলেমগণ মহরানার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেনঃ

(আরবী******************************************************)

বিয়ে হবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিনিময়মূলক একটি বন্ধন। বিয়ের পর একজন অপরজনকে নিজের বিনিময়ে লাভ করে থাকে। প্রত্যেক অপরজনের থেকে যেটুকু ফায়দা লাভ করে, তাই হচ্ছে অপর জনের ফায়দার বিনিময় –বদল। আর মহরানা হচ্ছে এক অতিরিক্ত ব্যবস্থা। আল্লাত তা’আলা তা স্বামীর ওপর অবশ্য দেয় –ফরয করে দিয়েছেন এজন্যে যে, বিয়ের সাহায্যে সে স্ত্রীর ওপর খানিকটা অধিকারসম্পন্ন মর্যাদা লাভ করতে পেরেছে।

অতএব বিয়ের আকদ অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়ই মহরানা নির্ধারণ এবং তার পরিমাণের উল্লেখ একান্ত কর্তব্য। নবী করীম (স) অত্যন্ত জোরের সাথে বলেছেনঃ

(আরবী***************************************************)

বিয়ের সময় অবশ্য পূরণীয় শর্ত হচ্ছে তা, যার বিনিময়ে তোমরা স্ত্রীর যৌন অঙ্গ নিজের জন্যে হালাল মনে করে নাও।

-আর তা হচ্ছে মহরানা বা দেন-মোহর।

বিয়ের পর স্ত্রীকে কিছু না দিয়ে তার কাছে যেতেও নবী করীম (স) স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন। হযরত আলী (রা) হযরত ফাতিমা (রা)-কে বিয়ে করার পর তাঁর নিকটে যেতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তখন নবী করীম (স)-

(আরবী**************************************)

তাকে কোনো জিনিস না দেয়া পর্যন্ত তাঁর নিকট যেতে তাঁকে নিষেধ করলেন।

আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী*********************************************************)

নবী করীম (স) স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তার মনকে স্বামীর প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে স্ত্রীকে কিছু না-কিছু আগে-ভাগে দেবার জন্যে স্বামীকে আদেশ করেছেন।

প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে, বিয়ের সময় দেন-মোহর ছাড়া অপর এমন কোনো শর্ত আরোপ করা চলবে না, যা শরীয়তের বিরোধী।

নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী********************************************)

কোনো মহিলা তার বিয়ের জন্যে তারই অপর এক বোনকে তালাক দেয়ার শর্ত আরোপ করতে পারবে না।

বুখারী শরীফে এ হাদীসটির পূর্ণ ভাষণ নিম্নরূপঃ

(আরবী*****************************************)

কোনো মেয়েলোকের জন্যে তার অপর এক বোনকে তালাক দেয়ার দাবি করা –যেন সে তার ভোগের পাত্র সে নিজের জন্যে পূর্ণভাবে আয়ত্ত করে নিতে পারে –হালাল নয়। কেননা সে তা পাবেই, যা তার জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে।–[ইবনে হাবীব বলেছেনঃ

(আরবী*************************************)

মনীষীগণ এ নিষেধকে অবশ্য পালনীয় মনে করেন না; বরং এ কাজ বাঞ্ছনীয়-ও মনে করেন না। তা সত্ত্বেও এরূপ শর্ত যদি কেউ আরোপ করে, তবে তাতে তার বিয়ে ভেঙ্গে যাবে না –যদিও ইবনে বাত্তাল এ কথার ওপর জোর আপত্তি জানিয়েছেন।]

‘তার অপর এক বোন’ বলতে আপন সহোদরাও হতে পারে, অনাত্মীয় কোনো মেয়েলোকও হতে পারে। কেননা সে তার আপন সহোদরা বোন না হলেও মুসলিম হিসেবে সে তার দ্বীনী বোন অর্থাৎ কোনো পুরুষ –যার স্ত্রী রয়েছে –যদি অপর কোনো মেয়ে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়, মেয়ে সে বিয়েতে রাজি হয়ে পুরুষটিকে একথা বলতে পারবে না যে, তোমরা আগের (মানে বর্তমান) স্ত্রীকে আগে তালাক দাও, তারপর আমাকে বিয়ে করো। এরূপ শর্ত আরোপ করার তার কোনো অধিকার নেই। সে ইচ্ছে করলে এ বিয়ের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে পারে। কিন্তু একজনের বর্তমান স্ত্রীকে তালাক দেয়ার শর্ত আরোপ করা এবং সে তালাক হয়ে যাওয়ার পর তার নিকট বিয়ে বসতে রাজি হওয়ার কারো অধিকার থাকতে পারে না। এরূপ শর্ত আরোপ করা ইসলামী শরীয়তের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। রাসূলে করীম (স) এ পর্যায়ে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেনঃ

(আরবী*******************************************)

আল্লাহর কিতাবে নেই –এমন কোনো শর্ত আরোপ করা হলে তা অবশ্যই প্রত্যাখ্যান হবে।

মহরানা না দিয়ে স্ত্রীর নিকট গমন করাই অবাঞ্ছনীয়। হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন, হযরত আলী যখন হযরত ফাতিমাকে বিয়ে করলেন, তখন নবী করীম (স) তাঁকে বললেনঃ

(আরবী***************************)

তুমি ওকে কিছু একটা দাও।

হযরত ইবনে উমর বললেনঃ

(আরবী**********************************************************)

কোনো মুসলমানেরই মহরানা বাবদ কম বা বেশি কিছু অগ্রিম না দিয়ে তার স্ত্রীর নিকট গমন করা জায়েয নয়।

মালিক ইবনে আনাস বলেছেনঃ

(আরবী***************************************************************)

স্ত্রীকে তার মহরানার কিছু-না-কিছু না দিয়ে স্বামী যেন তার নিকট গমন না করে। মহরানার কম-সে-কম পরিমাণ হলো একটি দীনারের এক চতুর্থাংমে কিংবা তিন দিরহাম। বিয়ের সময় এ পরিমাণ নির্দিষ্ট হোক আর নাই হোক, তাতে কিছু আসে যায় না।

দেন-মোহরের কি হওয়া উচিত, ইসলামী শরীয়তে এ সম্পর্কে কোনো অকাট্য নির্দেশ দেয়া হয়নি, নির্দিষ্টভাবে কোনো পরিমাণও ঠিক করে বলা হয়নি। তবে একথা স্পষ্ট যে, প্রত্যেক স্বামীর-ই কর্তব্য হচ্ছে তার আর্থিক সামর্থ্য ও স্ত্রীর মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রেখে উভয় পক্ষের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো পরিমাণ নির্দিষ্ট করে বেঁধে দেয়া। আর মেয়ে পক্ষেরও তাতে সহজেই রাজি হয়ে যাওয়া উচিত। এ ব্যাপারে শরীয়ত উভয় পক্ষকে পূর্ণ আজাদি দিয়েছে বলেই মনে হয়। এ বিষয়ে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী যা লিখেছেন, তা নিম্নোক্ত ভাষায় প্রকাশ করা হচ্ছেঃ

নবী করীম (স) মহরানার কোনো পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেন নি এ কারণে যে, এ ব্যাপারে লোকদের আগ্রহ-উৎসাহ ও ঔদার্য প্রকাশ করার মান কখনো এক হতে পারে না। বরং বিভিন্ন যুগে, দুনিয়ার বিভিন্ন স্তরের লোকদের আর্থিক অবস্থা এবং লোকদের রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি, কার্পণ্য ও উদারতার ভাবধারায় আকাশ-ছোঁয়া পার্থক্য হয়ে থাকে। বর্তমানেও এ পার্থক্য বিদ্যমান। এজন্যে সর্বকাল যুগ-সমাজ স্তর, অর্থনৈতিক অবস্থা ও রুচি-উৎসাহ নির্বিশেষে প্রযোজ্য হিসেবে একটি পরিমাণ স্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়া বাস্তব দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অসম্ভব। যেমন করে কোনো সুরুচিপূর্ণ দ্রব্যের মূল্য সর্বকালের জন্যে নির্দিষ্ট করে দেয়া যায় না –দেয়া অবৈজ্ঞানিক ও হাস্যকর। কাজেই এর পরিমাণ সমাজ, লোক ও আর্থিক মানের পার্থক্যের কারণে বেশিও হতে পারে, কমও হতে পারে। তবে শুধু শুধু এবং পারিবারিক আভিজাত্যের দোহাই দিয়ে এর পরিমাণ নির্ধারণর বাড়াবাড়ি ও দর কষাকষি করাও আদৌ সমর্থনযোগ্য নয়। তার পরিমাণ এমন সামান্য ও নগণ্য হওয়া উচিত নয়, যা স্বামীর মনের ওপর কোনো শুভ প্রভাবই বিস্তার করতে সমর্থ হবে না। যা দেখে মনে হবে যে, মহরানা আদায় করতে গিয়ে স্বামীকে কিছুমাত্র ক্ষতি স্বীকার করতে হয়নি, সেজন্যে তাকে কোনো ত্যাগও স্বীকার করতে হয়নি।

শাহ দেহলভীর মতে, দেন-মোহরের পরিমাণ এমন হওয়া উচিত, যা আদায় করা স্বামীর পক্ষে কষ্টসাধ্য হবে এবং সেজন্যে সে রীতিমতো চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বে। পক্ষান্তরে তার পরিমাণ এমনও হওয়া উচিত নয়, যা আদায় করা স্বামীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এজন্যে নবী করীম (স) একদিকে গরীব সাহাবীকে বললেনঃ

(আরবী********************************************)

কিছু-না-কিছু দিতে চেষ্টা করো। আর কিছু না পার, মহরানা বাবদ অন্তত লোহার একটি আঙ্গুরীয় দিতে পারলেও সেজন্যে অবশ্য চেষ্টা করবে।

আর যে নিঃস্ব সাহাবী তাও দিতে পারেন নি, তাঁকে তিনি বলেছেনঃ

(আরবী************************************************)

কুরআন শরীফের যা কিছু তোমরা জানা আছে, তা তুমি তোমার স্ত্রীকে শিক্ষা দেবে –এই বিনিময়েই আমি মেয়েটিকে তোমার নিকট বিয়ে দিলাম।

এ ধরনের মহরানার সম্পর্কে ফিকাহবিশারদ মকহুল বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************)

এ ধরনের মহরানার বিনিময়ে বিয়ে সম্পন্ন করার ইখতিয়ার রাসূলে করীম (স)-এর পরে আর কারো নেই।

ফিকাহবিদ লাইস বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************************)

রাসূলের তিরোধানের পর এই ধরনের মহরানা নির্দিষ্ট করার অধিকার আর কারো নেই।

ইবনে জাওজী বলেছেনঃ ইসলামের প্রথম যুগে স্বাভাবিক দারিদ্র্যের কারণে প্রয়োজনবশতই এ ধরনের মহরানা নির্দিষ্ট করা জায়েয ছিল। কিন্তু এখন তা জায়েয নয়।

একটি হাদীস থেকে জানা যায়, এক জোড়া জুতার বিনিময়ে অনুষ্ঠিত বিয়েকেও রাসূলে করীম (স) বৈধ বলে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি মেয়েলোকটিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি মহরানা বাবদ যা পেয়েছ, তাতে বিয়ে করতে কি তুমি রাজি আছ?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ’। তখন রাসূলে করীম (স) সে বিয়েতে অনুমতি দান করেছিলেন।

অপরদিকে কুরআন মজীদে এই মহরানা সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

(আরবী****************************************************)

এবং তোমরা মেয়েদের এক-একজনকে ‘বিপুল পরিমাণ’ ধন-সম্পদ মহরানা বাবদ দিয়ে দিয়েছ।

এ আয়াতের ভিত্তিতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ মহরানা বাবদ দেয়া জায়েয প্রমাণিত হচ্ছে। হযরত উমর (রা) উম্মে কুলসুমকে বিয়ে করেছিলেন এবং মহরানা বাবদ দিয়েছিলেন চল্লিশ হাজার দিরহাম। চল্লিশ হাজার দিরহাম তদানীন্তন সমাজে বিরাট সম্পদ। নবী করীম (স) স্বয়ং হযরত উম্মে হাবীবাকে মহরানা দিয়েছিলেন চারশত দীনার –চার শতটি স্বর্ণমুদ্রা। এক বর্ণনা থেকে জানা যায়, তাঁর মহরানার পরিমাণ ছিল আটশ’ দীনার। (আরবী****************)

এ আলোচনা থেকে একদিকে যেমন জানা যায় মহরানার সর্বনিম্ন পরিমাণ, অপর দিকে জানা যায় সর্বোচ্চ পরিমাণ। ইসলামী শরীয়তে এ দু’ধরনের পরিমাণই জায়েয।

কিন্তু জাহিলিয়াতের যুগে পরিমাণে মহরানা ধার্য করা হতো। পরিমাণ বৃদ্ধির জন্যে কন্যাপক্ষ খুবই চাপ দিত। ফলে দুপক্ষের মধ্যে নানারূপ দর কষাকষি ও ঝগড়াঝাটি হতো। এর পরিণামে সমাজে দেখা দিত নানা প্রকারের জটিলতা। বর্তমানেও মুসলিম সমাজে মহরানা ধার্যের ব্যাপারে অনুরূপ অবস্থাই দেখা দিয়েছে। বলা যেতে পারে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতির চরমোন্নতির এ যুগে পুরাতন জাহিলিয়াত নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এখন নতুন করে স্মরণ করা আবশ্যক বোধ হচ্ছে নবী করীম (স)-এর পুরাতন বাণী। বলেছেনঃ

(আরবী***************************************)

সবচেয়ে উত্তর পরিমাণের মহরানা হচ্ছে তা, যা আদায় করা খুবই সহজসাধ্য।

এজন্যে একান্ত প্রয়োজন হচ্ছে অবস্থাভেদে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ পরিমাণের মধ্যে সহজ দেয় একটা পরিমাণ বেঁধে দেয়া এবং এ ব্যাপারে কোনো পক্ষ থেকে অকারণ বাড়াবাড়ি করা কিছুমাত্র বাঞ্ছনীয় নয়।

মহরানা বাঁধার মান মধ্যম পর্যায়ে আনার প্রচেষ্টা রাসূলে করীম (স)-এর সময় থেকেই শুরু হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে একটা ভুল দৃষ্টি যেন মুসলমানদের মধ্যে থেকেই গিয়েছে। হযরত উমর ফারূক (রা) পর্যন্ত এ সম্পর্কে বিশেষ যত্নবান হয়েছিলেন। তিনি একদা মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে লোকদের নসীহত করছিলেন এবং মহরানা সম্পর্কে বিশেষভাবে বলেছিলেনঃ

(আরবী****************************************)

সাবধান হে লোকেরা, স্ত্রীদের মহরানা বাঁধতে কিছুমাত্র বাড়াবাড়ি করো না। মনে রেখো, মহরানা যদি দুনিয়ায় মান-সম্মান বাড়াতে কিংবা আল্লাহর নিকট তাকওয়ার প্রমাণ হতো। তাহলে অতিরিক্ত মহরানা বাঁধার কাজ করার জন্যে রাসূলে করীমই ছিলেন তোমাদের অপেক্ষাও বেশি অধিকারী ও যোগ্য। অথচ তিনি তাঁর স্ত্রীদের ও কন্যাদের মধ্যে কারো মহরানাই বারো ‘আউকিয়া’ (চার শ’ আশি দিরহাম কিংবা বড়জোর একশ’ কুড়ি টাকা)-র বেশি ধার্য করেন নি। মনে রাখা আবশ্যক যে, এক-একজন লোক তার স্ত্রীকে দেয় মহরানার দরুন বড় বিপদে পড়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত সে নিজের স্ত্রীকে শত্রু বলে মনে করতে শুরু করে।

এমনি এক ভাষণ শুনে উপস্থিতদের মধ্য থেকে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে বললেনঃ

(আরবী*****************************************************)

আল্লাহ তো আমাদের দিচ্ছেন, আর তুমি হারাম করে দিচ্ছ? তুমি লোকদেরকে মেয়েদের মহরানার পরিমাণ চরশ’ দিরহামের বেশি বাঁধতে নিষেধ করছো? …তুমি কি শোননি, আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ

তোমরা তোমাদের এক এক স্ত্রীকে মহরানা দিচ্ছ বিপুল পরিমাণে?

তখন উমর (রা) বললেনঃ

(আরবী********************************)

একজন মেয়েলোক ঠিক বলতে পারল; কিন্তু ভুল করল একজন রাষ্ট্রনেতা।

বললেনঃ

(আরবী**********************************)

হে আল্লাহ মাফ করে দাও, -সব লোকই কি উমরের তুলনায় অধিক সমঝদার?

অপর বর্ণনায় হযরত উমরের কথাটি এভাবে উদ্ধৃত হয়েছেঃ

(আরবী*******************************************************)

প্রত্যেকটি ব্যক্তিই উমরের অপেক্ষা বেশি ফিকাহবিদ –এমনকি মেয়েলোকরা পর্যন্ত।

বাহ্যত মনে হয়, হযতর উমর (রা) অধিক পরিমাণে মহরানা বাঁধার কাজকে নিষেধ করা থেকে ফিরে গিয়েছেন। বস্তুত হযরত উমরের কথার অর্থ এই ছিল না যে, তিনি অধিক পরিমাণে মহরানা ধার্য করাকে হারাম মনে করতেন, আর তাকে হারাম করে দেওয়াও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং বলা যায়, তিনি অধিক পরিমাণে মহরানা ধার্য করা ভালো মনে করতেন না। বস্তুত মহরানা পরিমাণের কোনো সর্বোচ্চ পরিমাণ নেই, এ কথার ওপরই মনীষীদের ইজমা হয়েছে।

(আরবী**************************)

কাজেই শরীয়তে না সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, না সর্বোচ্চ পরিমাণ। যার পক্ষে যতটুকু আদায় করা সহজসাধ্য, তার সেই পরিমাণই ধার্য করা উচিত।–[তবে সহজ হওয়ার অর্থও নিশ্চয়ই এই নয় যে, মহরানার পরিমাণটা এতই সামান্য হবে যে, মনে হবে সে ভিখারীকে ভিক্ষা দিচ্ছে। বস্তুত শরীয়তে মহরানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তার পরিমাণটাও তেমনি গণনার যোগ্য হওয়া উচিত।] তার চেয়ে কম করা যেমন স্বামীর উচিত নয়, তেমনি তার চেয়ে বেশি করতে চেষ্টা করাও উচিত নয় মেয়ে পক্ষের।

কোনো কোনো সাহাবী ও তাবেয়ীন নিজেদের ইজতিহাদের ভিত্তিতে মহরানার একটা সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারণ করতে চেষ্টা করেছেন। হযতর আলী (রা) বলেছেনঃ

(আরবী***************************)

দশ দিরহাম পরিমাণের কমে মহরানা হতে পারে না।

শা’বী, ইবরাহীন নখয়ী ও অন্যান্য তাবেয়ীও এ মতই প্রকাশ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা, আবূ ইউসুফ, মুহাম্মাদ, জুফর, হাসান ইবনে জিয়াদেরও এই মত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত আবূ সাইদ খুদরী (রা), হাসান, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব ও আতা প্রমুখ ফকীহ বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************)

বিয়ে কম পরিমাণ মহরানায়ও শুদ্ধ হয়, শুদ্ধ হয়ে বেশি পরিমাণ মহরানায়ও।

হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) এক ‘নাওয়াত’ পরিমাণ স্বর্ণ মহরানা বাবদ দিয়েছিলেন। তার মূল্য বড়জোর তিন দিরহাম মাত্র। আর কেউ বলেছেন পাঁচ, কেউ বলেছেন দশ দিরহাম। ইমাম মালিক বলেছেনঃ

(আরবী******************************************************)

নিম্নতম মহরানার পরিমাণ হচ্ছে এক দীনারের এক-চতুর্থাংশ।

পূর্বেই বলেছি, এসব হচ্ছে ইসলামের বিশেষজ্ঞ মনীষীদের নিজস্ব মতামত ও নিজস্ব ইজতিহাদ। এর মূলে কুরআন ও সুন্নাহর কোনো অকাট্য দলীল নেই।

আসলে বিয়েতে দেন-মোহরের ব্যবস্থা করা হয়েছে কেবল আনুষ্ঠানিকভাবে একটা কিছু বেঁধে দেয়ার উদ্দেশ্যে নয়। বরং যা কিছু ধার্য করা হবে তা একদিকে যেমন স্ত্রীর প্রাপ্য আল্লাহর দেয়া অধিকার, অপরদিকে স্বামীর শ্রেষ্ঠত্ব ও ব্যক্তিত্বের প্রমাণস্বরূপ স্ত্রীর অঙ্গের অধিকার হালাল করার একটি পুরস্কারও বটে। অতএব তা ধার্য করতে হবে তাকে ঠিক ঠিকভাবে ও যথাসময়ে স্ত্রীর নিকট আদায় করে দয়োর উদ্দেশ্যে। স্ত্রীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানও এর একটা বিশেষ লক্ষ্য। কিন্তু শুধু করে দেয়ার উদ্দেশ্যে। স্ত্রীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানও এর একটা বিশেষ লক্ষ্য। কিন্তু শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে যদি একটা বিরাট পরিমাণ বেঁধেও দেয়া হয় কিংবা স্বামীকে তা স্বীকার করে নিতে বাধ্যও করা হয়, অথব তা যদি সঠিকভাবে আদায়ই না করা হয়, তাহলে স্ত্রীর কার্যত কোনো ফায়দাই তাতে হয় না। আর পরিমাণ যদি এত বড় হয় যে, তা আদায় করা স্বামীর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়, তাহলে তার পরিমাণ পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। স্বামী যদি বিয়ের উদ্দেশ্যে মেয়ে পক্ষের অসম্ভব দাবির নিকট মাথা নত করে দিয়ে তাদের মর্জি মতো বড় পরিমাণের মহরানা স্বীকার করে নেয়, আর মনে মনে চিন্তা ও সিদ্ধান্ত করে রাখে যে, কার্যত সে তার কিছুই আদায় করবে না, তা হলেও ব্যাপারটি একটি বড় রকমের প্রতারণার পর্যায়ে পড়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে আদায় করার নিয়ত না থাকা সত্ত্বেও একটা বড় পরিমাণের মহরানা মুখে স্বীকার করে নেয়া যে কত বড় গুনাহ তা রাসূলে করীম (স)-এর উদ্ধৃত বাণী থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি ঘোষণা করেছেনঃ

(আরবী****************************************************)

যে লোক কোনো মেয়েকে কম বেশি পরিমাণের মহরানা দেয়ার ওয়াদায় বিয়ে করে অথচ তার মনে স্ত্রীর সে হক আদায় করার ইচ্ছা থাকে না, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সম্মুখে ব্যভিচারীরূপে দাঁড়াতে বাধ্য হবে।

হযরত সুহাইব ইবনে সানান (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ

(আরবী**********************************************)

যে লোক কোনো মেয়েকে কম বেশি পরিমাণের মহরানা দেয়ার ওয়াদায় বিয়ে করে অথচ তার মনে স্ত্রীর সে হক আদায় করার ইচ্ছা থাকে না, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সম্মুখে ব্যভিচারীরূপে দাঁড়াতে বাধ্য হবে।

হযরত সুহাইব ইবনে সানান (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ

(আরবী***********************************************)

যে-লোক তার স্ত্রীর জন্যে কোনো মহরানা ধার্য করবে অথচ আল্লাহ জানেন যে, তা আদায় করার কোনো ইচ্ছাই তার নেই, ফলে আল্লাহর নামে নিজের স্ত্রীকেই প্রতারিত করল এবং অন্যায়ভাবে ও বাতিল পন্থায় নিজ স্ত্রীর যৌন অঙ্গ নিজের জন্যে হালাল মনে করে ভোগ করল, সে লোক আল্লাহর সাথে ব্যভিচারী হিসাবে সাক্ষাৎ করতে বাধ্য হবে। (আরবী*******************************)

দান –জেহাজ

ছেলেমেয়ের বিবাহ উপলক্ষে মেয়ে পক্ষ থেকে দান –জেহাজ দেয়ার প্রশ্নটিও ইসলামে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ পর্যায়ে দুটি প্রশ্ন বিচার্য। একটি হচ্ছে ইসলামে দান-জেহাজের রীতি প্রচলিত কিনা, আর দ্বিতীয় তার পরিমাণ কি হওয়া উচিত।

দান –জেহাজের রেওয়াজ যে ইসলামে রয়েছে এবং শরীয়তে তা অসমর্থিতও নয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হাদীসে গ্রন্থসমূহে এ সম্পর্কে এক স্বতন্ত্র অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে।

হাদীস থেকে স্পষ্ট জানা যায়, জেহাজ বা যৌতুক দেয়ার রেওয়াজ রাসূরে করীম (স)-এর যুগেও বর্তমান ছিল এবং নবী করীম (স) নিজে তাঁর কন্যাদের বিয়ের সময় যৌতুক দান করেছেন। হযরত আলী (রা) বলেছেনঃ

(আরবী********************************************************)

রাসূলে করীম (স) ফাতিমাকে যৌতুক হিসেবে দিয়েছিলেন একটি পাড়ওয়ালা কাপড়, একটি পানির পাত্র, আর একটি চামড়ার তৈরী বালিশ –যার মধ্যে তীব্র সুগন্ধিযুক্ত ইযখির খড় ভর্তি ছিল।

হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত অপর একটি হাদীস থেকে জানা যায়, নবী করীম (স) এই কয়টি জিনিস ছাড়াও দুটি যাঁতা এবং পাকা মাটির একটি পাত্র ফাতিমা (রা)-কে জেহাজ হিসেবে দিয়েছিলেন।

এসব হাদীসের ভিত্তিতে আল্লামা আহমাদুল বান্না লিখেছেনঃ

(আরবী********************************************)

এ পর্যায়ের যাবতীয় হাদীস প্রমাণ করে যে, জেহাজ দানের ব্যাপারে মধ্যম নীতি অবলম্বন করা এবং তাতে বিপুল প্রাচুর্যের বাহুল্য না করা বরং প্রত্যেক যুগের দৃষ্টিতে নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেয়াকেই যথেষ্ট মনে করা আবশ্যক।

বস্তুত যৌতুক দেয়া কনের পিতা বা গার্জিয়ানের কর্তব্য। কিন্তু তাতে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি, প্রাচুর্য ও আতিশয্য করা ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। বিশেষত এ ব্যাপারে মানুষ প্রাচুর্য ও বাহুল্য দেখায় শুধু নাম ডাক আর খ্যাতি অর্জনের উদ্দেশ্যে –এ উদ্দেশ্যে যে, চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে, সকলে জানতে পারবে যে, অমুকে তার কন্যাকে এত শত বা এত হাজার টাকার জিনিসপত্র যৌতুক হিসেবে দিয়েছে।

তবে একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মেয়েকে বিয়ে দিলে সাময়িকভাবে এবং হঠাৎ করে পিতার ঘর-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সম্পূর্ণ নতুন মানুষের নিতান্তই অপরিচিত পরিবেশে এক নতুন ঘর ও সংসার রচনা করতে শুরু করে। এ সময় তার সংসার গঠনে বহু রকমের জিনিসপত্রের প্রয়োজন দেখা দেয়া আবশ্যম্ভাবী। এ এক সংকটময় সময় বলতে হবে। কাজেই কন্যার পিতা যদি জরুরী কিছু জিনিসপত্র দিয়ে নিজ কন্যার সংসার গঠনে বাস্তবভাবে সাহায্য করে, তবে তা মেয়ের প্রতি কল্যাণই শুধু হবে তা না, পিতার এক কতর্বব্যও পালিত হবে।

কিন্তু সেই সঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে যে, দান-জেহাজ যেমন পিতার অবস্থানুপাতে মধ্যম মানের ও মাঝামাঝি পর্যায়ের হওয়া উচিত, কোনো বাড়বাড়ির অবকাশ দেয়া উচিত নয়, তেমনি তা বিয়ের শর্ত হিসেবে দাবি করে নেয়ার ব্যাপারও নয়। বর্তমান সময় সেকালের হিন্দু সমাজের ন্যায় মুসলিম সমাজেও দাবি ও শর্ত করে যৌতুক আদায়ের একটা মারাত্মক প্রচলন ব্যাপক ও প্রকট হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। আজকের বিবাহেচ্ছু বা বিবাহোপযোগী যুবকদের মধ্যে যত বেশি সম্ভব যৌতুক আদায়ের একটা লজ্জাকর প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এর ফলে অনেক ঠিক করা-বিয়েও শুধু যৌতুকের পরিমাণ নিয়ে দর-কষাকষি হওয়ার কারণে ভেঙে যেতে দেখা যাচ্ছে। আর বহু বিবাহোপযোগী মেয়ের বিয়ে হতে পারছে না শুধু এ কারণে যে, মেয়ের পিতা ছেলের বা ছেলে পক্ষের দাবি অনুযায়ী যৌতুক দেয়ার সামর্থ্য রাখে না। অনেক ছেলে জোর করে, মেয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করে, এমন কি অনেক সময় তালাক দেয়ার ভয় দেখিয়েও যৌতুক আদায় করে। বাবার নিকট থেকে দাবি অনুযায়ী যৌতুক আনতে না পারার দরুন কত নব বিবাহিতাকে যে প্রাণও দিতে হয়েছে ও হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। আবার অনেক ক্ষেত্রে পিতারও চরম উপেক্ষা অনমনীয় মনোভাব দেখা যায়। সামর্থ্য থাকলেও আর মেয়ের নতুন সংসারের জন্যে প্রয়োজন হলেও কিছু দিতে পিতা রাজি হয় না।

হযরত হাফসা (রা) রাসূলের অন্যান্য বেগমের সাথে একত্রিত হয়ে একদিন রাসূলে করীম (স)-এর নিকট নানা জিনিস দাবি করেন। তাতে রাসূলে করীম (স) খুবই অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েন। হযতর উমর ফারূক (রা) একথা শুনতে পেয়ে দ্রুত হাফসার নিকট উপস্থিত হয়ে বললেনঃ

(আরবী************************************************************)

তুমি রাসূলের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করবে না এবং তাঁর কাছে কখনই কিছু চাইতে পারবে না। (সহীহ হাদীসের শব্দ –যা তাঁর কাছে নেই তা চাইতে পারবে না।) বরং তোমার যা কিছু প্রয়োজন তা আমার নিকটই চাবে।

এ ঘটনা দান –জেহাজ সম্পর্কে ইসলামী আদর্শবাদী ব্যক্তির জন্যে এক উজ্জ্বল ও গৌরবদীপ্ত দৃষ্টান্ত পেশ করছে।

ওয়ালীমার জিয়াফত

বিয়ে অনুষ্ঠান প্রচারের দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে ওয়ালীমার জিয়াফত করা। এ অনুষ্ঠান মেয়ে পক্ষেরও যেমন করা উচিত, তেমনি করা উচিত ছলে পক্ষেরও। নিজেদের ছেলে বা মেয়ের বিয়েতে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের একত্রিত করা একান্তই বাঞ্ছনীয়। ইসলামে এ ওয়ালীমা-জিয়াফতের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। রাসূলে করীম (স) ওয়ালীর রীতি ইসলামী সমাজে বিশেষভাবে চালু করেছেন।

‘ওয়ালীমা’ শব্দের আসল অর্থ হল একত্রিত করা। কেননা একজন পুরুষ ও একজন মেয়ের বিবাহিত জীবনের মিলিত হওয়ার উপলক্ষে নিকটাত্মীয়দের একত্রিত করা হয় এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এজন্য এর নামকরণ করা হয়েছে ‘ওয়ালীমা’।

আর শরীয়তের দৃষ্টিতে ওয়ালীমার জিয়াফত বলতে বোঝায়ঃ

(আরবী**********************************************************)

বিয়ে-অনুষ্ঠানের সময়কালীন আয়োজিত খানা, যার জন্যে লোকদের দাওয়াত দেয়া হয়।

হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) বিয়ে করলে পরে রাসূলে করীম (স) তাকে বলেনঃ

(আরবী****************************************)

আল্লাহ এ কাজে তোমাকে বরকত দিন। এখন তুমি বকরী দিয়ে হলেও ওয়ালীমার জিয়াফত করো।

রাসূলে করীম (স) নিজে যখন হযরত যায়নাব বিনতে জাহাশ (রা)-কে বিয়ে করলেন, তখন তিনি একটি বকরী জবাইকরে ওয়ালীমার জিয়াফত করেছিলেন। সে সম্পর্কে হযরত আনাস (রা) বলেছেনঃ

(আরবী*****************************************************)

রাসূলে করীম (স) যখন যায়নাব বিনতে জাহাশকে বিয়ে করে ঘর বাঁধলেন, তখন তিনি লোকদের রুটি ও গোশত খাইয়ে পরিতৃপ্ত করে দিয়েছিলেন।

তিনি যখন হযরত সফীয়া (রা)-কে বিয়ে করেছিলেন, তখন খেজুর (রা)-কে বিয়ে করেছিলেন, তখন খেজুর দিয়ে এই ওয়ালীমার জিয়াফত করেছিলেন। অপর এক বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, নবী করীম (স) খায়বর ও মদীনার মাঝখানে একাদিক্রমে তিন রাত্রি পর্যন্ত অবস্থান করেছিলেন। তার মধ্যে একদিন সঙ্গীর সব সাহাবীদের ওয়ালীমার দাওয়াত দিলেন। এ দাওয়াতে না ছিল গোশত না ছিল রুটি। বরং রাসূলে করীম (স) সকলের সামনে খেজুর ছড়িয়ে দিলেন। হযরত সফীয়ার সাথে বিয়ের ওয়ালীমা এমনি অনাড়ম্বরভাবে সম্পন্ন হয়ে গেল। (আরবী************************************)

ওয়ালীমা সম্পর্কে কুরআন মজীদেও তাগিদ রয়েছে। সূরা আন-নিসা’য় বলা হয়েছেঃ

(আরবী*******************) –‘তোমরা তোমাদের অর্থ-সম্পদের বিনিময়েই স্ত্রী গ্রহণ করতে চাবে’। বিয়ের পরে ওয়ালীমা অনুষ্ঠানের নির্দেশও এরই মধ্যে রয়েছে বলে মনে করতে হবে। কেননা ‘ওয়ালীশা’ বিয়ে উপলক্ষেই হয়ে থাকে এবং তাতে অর্থ ব্যয় হয়।

রাসূলে করীম (স) হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফকে যে ওয়ালীমার জিয়াফত করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার ভিত্তিতে আল্লামা সানয়ানী কাহলানী লিখেছেনঃ

(আরবী**********************************)

এ নির্দেশ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিয়েতে ওয়ালীমার জিয়াফত করা ওয়াজিব।

হযরত আলী (রা) যখন বিবি ফাতিমার সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তখন নবী করীম বলেছিলেনঃ

(আরবী********************************)

এ বিয়েতে ওয়ালীমা অবশ্যই করতে হবে।

একথা থেকে ওয়ালীমা সম্পর্কে পূর্বোক্ত মতেরই সমর্থন পাওয়া যায়। ইমাম তাবরানী হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে রাসূলে করীম (স)-এর নিম্নোক্ত ঘোষণা বর্ণনা করেছেনঃ

(আরবী******************************)

ওয়ালীমা করা হচ্ছে একটা অধিকারের ব্যাপার, একান্তই কর্তব্য। ইসলামের স্থায়ী নীতি। অতএব যাকে এ জয়াফতে শরীক হওয়াদর দাওয়াত দেয়া হবে, সে যদি তাতে উপস্থিত না হয়, তাহলে সে নাফরমানী করল।

ইমাম বায়হাকী বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************)

রাসূলে করীম (স) বিয়ে করে ওয়ালীমা জিয়াফত করেন নি –এমন ঘটনা জানা নাই।

এ থেকেও ওয়ালীমা করা যে ওয়াজীব, তাই প্রমাণিত হচ্ছে।

ওয়ালীমা জিয়াফতের আকার কি হবে, কত হবে তাতে ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ, তা শরীয়তে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। তবে একথা মনে রাখা আবশ্যক যে, ব্যক্তির সামর্থ্য এবং তার মনের উদারতা অকৃপণতা অনুপাতেই তা করতে হবে। আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************)

সচ্ছল অবস্থায় লোকের পক্ষে একটি বকরী জবাই করে খাওয়ানোই হচ্ছে ওয়ালীমার কম-সে-কম পরিমাণ।

তবে নবী করীম (স) যে বকরীর চাইতেও কম মূল্যের জিনিস দিয়ে ওয়ালীমার জিয়াফত করেছিলেন, তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

আল্লামা কাযী ইয়াজ লিখেছেনঃ

(আরবী**********************************************************)

ওয়ালীমার জিয়াফতে কত বেশি খরচ করা হবে, এ সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই বলেই বিশেষজ্ঞগণ মত প্রকাশ করেছেন। আর কমেরও কোনো শেষ পরিমাণ নির্দিষ্ট করা যায় না। যার পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব ও সহজ, তা করাই যথেষ্ট। তবে স্বামীর আর্থিক সঙ্গতি অনুপাতেই যে এ কাজে অর্থ ব্যয় হওয়া বাঞ্ছনীয়, তাতে সন্দেহ নেই।

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী ইবনে বাত্তালের উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেনঃ

(আরবী************************************************************************)

ওয়ালীমা জিয়াফত করা স্বামীর আর্থিক সামর্থ্যানুযায়ী হওয়া উচিত এবং তা করা ওয়াজিব বিয়ে অনুষ্ঠানের প্রচারের উদ্দেশ্যে।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী লিখেছেনঃ

(আরবী************************************************)

ওয়ালীমার জিয়াফত করায় অনেক প্রকারের কল্যাণ ও যৌক্তিকতা নিহিত রয়েছে।

এরপর তিনি দুটো কল্যাণের উল্লেখ করেছেন। একটি হচ্ছেঃ

(আরবী*******************************************************)

এতে করে খুব সুন্দরভাবে বিয়ের প্রচার হয়ে যায়। ……কেননা বিয়ের প্রচার হওয়া এ কারণেও জরুরী যে, তাদের কোনো সন্তান হলে তার সদজাত হওয়া ও তার বংশ সাব্যস্ত হওয়ায় কোনো সন্দেহকারীর সন্দেহ করার কোনো অবকাশই যেন না থাকে।

আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, স্ত্রী এবং তার আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তাদের প্রতি শুভেচ্ছা ও সদাচরণ প্রকাশ করা। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************************)

নববধুর জন্যে স্বামী যদি অর্থ খরচ করে ও তার জন্যে লোকদের একত্রিত করে, তবে তা প্রমাণ করবে যে, স্বামীর নিকট তার খুবই মর্যাদা রয়েছে এবং সে তার স্বামীর নিকট রীতিমত সমীহ করার যোগ্য।

এবং এ করে স্বামী এমন এক নেয়ামত লাভ করেছে বলে শোকরিয়া আদায় করেচে, যা সে ইতিপূর্বে কখনো লাভ করেনি। এ কারণে তার মনে অনাবিল আনন্দ ও স্বতঃস্ফূর্ত পুলক বোধ করছে। এজন্যেই সে এত অর্থ খরচ করছে আর এসব তারই জন্যে।

এর ফলে নববধূর মনেও জাগবে পরম পুলক, স্বামীর প্রতি অকৃত্রিম প্রেম-ভালোবাসা। আর এর দরুন উভয় পক্ষের আত্মীয়-স্বজনের সাথেও পরম মাধুর্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে।

ইসলামে বিয়ে উপলক্ষে ওয়ালীমার জিয়াফতের গুরুত্ব এতখানি যে, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে এ দাওয়াত কবুল না করার ইখতিয়ার দেয়া হয়নি। বরং এ দাওয়াতে হাজির হওয়াকে শরীয়তে ওয়াজিব করে দেয়া হয়েছে। নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************)

তোমাদের কেউ যদি বিয়ের ওয়ালীমায় নিমন্ত্রিত হয়, তবে সে যেন সে দাওয়াত কবুল করে ও উপস্থিত হয়।

অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************************************)

তোমাদের কেউ ওয়ালীমার দাওয়াতে নিমন্ত্রিত হলে সে যেন অবশ্যই তাতে যায়।

হযরত জাবির বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী***********************************************************)

তোমাদের কেউ কোনো খাবার দাওয়াতে নিমন্ত্রিত হলে তার সেখানে অবশ্যই যাওয়া উচিত, তারপরে খাওয়া তার ইচ্ছাধীন।

হযরত আবূ হুরায়রা বর্ণিত হাদীসের ভাষা নিম্নরূপঃ

(আরবী**********************************************************)

যে লোক ওয়ালীমার দাওয়াতে শরীক হয় না, সে আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে।

হযরত ইবনে উমর বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী**********************************************************)

ওয়ালীমার দাওয়াতে যদি তোমরা নিমন্ত্রিত হও তবে অবশ্যই তাতে শরীক হবে।

এসব হাদীস থেকে স্পষ্টত প্রমাণিত হয় যে, ওয়ালীমার দাওয়াত হলে তা কবুল করা এবং তাতে শরীক হওয়া প্রত্যেকটি মুসলমানের পক্ষে ওয়াজিব। কোনো কোনো ফিকাহবিদ ওয়ালীমার দাওয়াত এবং সাধারণ খাবার দাওয়াদের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাদের মধ্যে ইবনে আবদুল বার্র, কাযী ইয়াজ ও ইমাম নববী একমত হয়ে রায় দিয়েছেন যে, বিয়ে-ওয়ালীশার দাওয়াতে হাজির হওয়া ওয়াজিব। আর শাফিয়ী ও হাম্বলী মতের অধিকাংশ মনীষীর মতে এ হচ্ছে ফরযে আইন। আবার কেউ কেউ ‘ফরযে কিফায়া’ও বলেছেন। ইমাম শাফিয়ীর মতে তা ওয়াজিব এবং এ ব্যাপারে কোনো ‘রুখছাত’ নেই। কেননা হাদীসে যেখানে কথাটির বারবার তাগিদ এসেছে, সেভাবে অপর কোনো ওয়াজিব কাজ সম্পর্কেই বলা হয়নি। (আরবী*********************)

ওয়ালীমার যিয়াফতে কি ধরনের লোক দাওয়াত করা হবে, এ সম্পর্কে হাদীসে বিশেষভাবে উল্লেখ পাওয়া যায়। হযরত আবূ হুরায়রা বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী*****************************************************)

সেই ওয়ালীমার খানা হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম, যেখানে কেবল ধনী লোকদেরকেই দাওয়াত দেয়া হবে। আর গরীব লোকদেরকে বাদ দেয়া হবে।

অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************)

ওয়ালীমার সেই খানা অত্যন্ত নিকৃষ্ট, যেখানে যারা আসবে তাদের তো নিষেধ করা হবে বা দাওয়াত দেয়া হবে না, আর দাওয়াত দেয়া হবে কেবল তাদের, যারা তা কবুল করে না বা আসবে না।

এ হাদীস দুটি থেকে প্রমাণিত হলো যে, ওয়ালীমার জিয়াফতে বেছে বেছে কেবল ধনী লোকদেরকেই দাওয়াত দেয়া আর গরীব ফকীরদের দাওয়ান তা দেয়া মহা অন্যায়। বরং কর্তব্য হচ্ছে, গরীব-ধনী নির্বিশেষে যতদূর সম্ভব সব শ্রেণীর আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ করা। যেখানে কেবলমাত্র ধনী বন্ধু বা আত্মীয়দের দাওয়াত দেয়া হয় আর গরীবদের জন্যে প্রবেশ নিষেধ করে দেয়া হয়, সেখানকার খানায় আল্লাহর কোনো রহমত-বরকত হতে পারে না। বরং সেই খানা হয়ে যায় নিকৃষ্টতম। এজন্যে যে, আল্লাহর নিকট তো গরীব-ধনীর মাঝে কোনো পার্থক্য নেই; কিন্তু ওয়ালীমার দাওয়াতকারী ব্যক্তি বিয়ে করে, কিংবা নিজের ছেলে বা মেয়ের বিয়ে দিয়ে স্ফূর্তিতে মেতে গিয়ে গরীব-ধনীর মাঝে আকাশ-ছোঁয়া পার্থক্য সৃষ্টি করেছে।

বিয়ের উৎসবে আর ওয়ালীমার জিয়াফতে কেবল যে বয়স্ক পুরুষদেরই দাওয়াত করা হবে, এমন কথাও ঠিক নয়। বরং তাতে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্য থেকে মেয়েলোক ও শিশুদেরও নিমন্ত্রণ করতে হবে, -করা কিছুমাত্র দোষের নয়। বরং সত্যি কথা এই যে, এ উপলক্ষে মেয়েদের শিশুদের বাদ দেয়া খুবই আপত্কির। নিম্নোদ্ধৃত হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিয়ে ও ওয়ালীমার উৎসবে মেয়েলোক ও শিশুদেরও দাওয়াত দেয়া খুবই সঙ্গত হযরত আনাস ইবনে মালিক বলেনঃ

(আরবী*****************************************************)

নবী করীম (স) এক বিয়ের উৎসবে বহু মেয়েলোক ও ছেলেপেলে পরস্পর মুখোমুখি বসে থাকতে দেখলেন। তিনি তাদের দেখে খুবই আনন্দ বোধ করে তাদের প্রতি সন্তোষ প্রকাশার্তে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ালেন এবং তিনি তাদের জন্যে দো’আ করতে গিয়ে বললেনঃ ‘তোরমাই তো আমার নিকট সবার তুলনায় অধিকতর প্রিয়জন।

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ

(আরবী********************************************************)

এ হাদীস থেকে জানা যায় যে, বিয়ের উৎসবাদিতে মেয়েলোক ও শিশুদের উপস্থিত হওয়া বা করা খুবই ভালো ও পছন্দনীয়। কেননা এসব উৎসবই তো হচ্ছে আমাদের পরস্পরের নিকট আসার উপলক্ষ। আর এ কাজে বিয়ের প্রচারকার্যও পরামাত্রায় সুসম্পন্ন হয়ে থাকে।

ওয়ালীমার জিয়াফত কখন করা হবে –বিয়ে অনুষ্ঠানের সময়, না তার পরে, কিংবা নব দম্পতির ফুল-শয্যা বা মধুমিলনের রাতে, এ সম্পর্কে নানা মতের উল্লেখ পাওয়া যায়।

মালিকী মাযহাবে কেউ কেউ বলেছেন, ওয়ালীমা বিয়ে অনুষ্ঠানের সময় অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। কারো মতে মধুমিলনের পরে। ইমাম মাওয়ার্দীর মতে তা হওয়া উচিত মধুমিলনের রাতে। এর দলীল হিসেবে তিনি হযরত আনাসের নিম্নোদ্ধৃত উক্তির উল্লেখ করেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

নবী করীম (স) হযরত জয়নবের সাথে মধুমিলনের রাত যাপনের পর সকালের দিকে লোকদের দাওয়াত দিয়েছিলেন।

দাম্পত্য জীবনের শর্ত

স্বামী ও স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন –মাধুর্যময় ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে পরিপূর্ণ করে তোলবার জন্যে ইসলামে কতগুলো জরুরী বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে তার বিশেষ কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা যাচ্ছে।

প্রেম ভালোবাসা

বিয়ের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও মনের পরম প্রশান্তি লাভই হচ্ছে বিয়ের প্রধানতম উদ্দেশ্য। কেননা এ জিনিস মানুষ মাত্রেই প্রয়োজন –স্বভাবের ঐকান্তিক দাবি। পুরুষ ও নারী উভয়ের এক নির্দিষ্ট বয়স পূর্ণ হলেই বিপরীত লিঙ্গ (Opposite sex) সম্পন্ন ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার এক তীব্র ইচ্ছা ও বাসনা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জেগে ওঠে। উভয়ের দেহমনে যৌবনের সর্বপ্লাবী জোয়ারের সৃষ্টি হয়। তখন যৌন মিলনের অপেক্ষাও প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা লাভের জন্যে নর নারীর মন অধিকতর উদ্দাম হয়ে ওঠে। এ কারণে ঠিক এই সময়েই ছেলেমেয়ের বিয়ের ব্যবস্তা করার তাগিদ করা হয়েছে ইসলামী শরীয়তে। আর এ বিয়েকে কুরআন মজীদে ‘প্রেম-ভালোবাসার জীবন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুত বিয়ের প্রকৃত বন্ধন হচ্ছে প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন। এ বন্ধন শিথিল হলে অন্য হাজারো বন্ধন ছিন্ন হতে কিছুমাত্র বিলম্ব লাগবে না। এ কারণে পরস্পরের প্রতি অকৃত্রিম প্রেম ও ভালোবাসা সৃষ্টিও তাকে স্থায়িত্ব ও গভীরতা দানের জন্যে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে।

একটি নর ও একটি নারীর বিবাহ-সূত্রে একত্রিত হয়ে সুষ্ঠু পারিবারিক জীবন যাপনকেই বলা হয় দাম্পত্য জীবন। দুজন সম্পূর্ণ ভিন্ন বংশ, ভিন্ন পরিবার ও পরিবেশের লোক, পরস্পরের নিকট সম্পূর্ণ অপরিচিত, একজনের নিকট অপরজন সম্পূর্ণ নতুন –আনকোরা। প্রত্যেকের মন-মগজ-চিন্তা-ভাবনা, স্বভাব-অভ্যাস পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও ভিন্ন প্রকারের। সাধারণত এ-ই হয়ে থাকে এবং এ-ই স্বাভাবিক। অনেক সময় এসব দিক দিয়ে পরস্পরের মধ্যে বিরাট পার্থক্যও হতে পারে –হয়ে থাকে। এ দুজনের মধ্যে পূর্ণ মিলন ও সামঞ্জস্য হয়ে যাওয়াও প্রায় অসম্ভব। উভয়ের প্রকৃতি ও মেজাজ এমন পার্থক্য থাকা খুবই স্বাভাবিক, যার দরুন এদের মিলেমিশে জীবন কাটানো অসম্ভব বলে প্রথম মনে হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। এসব দিকে লক্ষ্য রেখে ইসলাম স্বামী-স্ত্রীকে কতগুলো জরুরী বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছে। নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন উভয়ের জন্যে কিছু কিছু অধিকার এবং তা যেমন স্বামীর জন্যে অবশ্য পালনীয়, তেমনি স্ত্রীর পক্ষেও।

আমরা এখানে প্রথমে স্বামীর কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করছি। কিন্তু তার আগে ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রীতে গভীর একাত্মবোধ জাগ্রত হওয়া যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা অনুধাবন করা আবশ্যক। প্রথম লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই যে, কুরআন মজীদের আয়াতসমূহে স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের জন্যে (আরবী*******) ‘যাওজ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লামা আহমাদ মুস্তফা আল-মারাগী লিখেছেনঃ

(আরবী****************************************************************)

‘যাওজ’ শব্দটি পুরুষ নারী উভয়ের জন্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে –এর আসল অর্থ এমন একটি সংখ্যা যা এমন দুটি জিনিসের সমন্বয়ে রচিত ও গঠিত যেখানে সে দুটি জিনিসই একাকার হয়ে রয়েছে এবং বাহ্যত তারা দুটি হলেও মূলত ও প্রকৃতপক্ষে তারা পরস্পরের সাথে মিলেমিশে একটিমাত্র জিনিসে পরিণত হয়েছে। অতঃপর এ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে স্বামী ও স্ত্রী –উভয়ের জন্যে। ব্যবহার করা হচ্ছে একথা বোঝাবার জন্যে যে, স্বামী তার স্ত্রীর সাথে এবং স্ত্রী তার স্বামীর সাথে অন্তরের গভীর একাত্মপূর্ণ ভাবধারা ও ভেদহীন কল্যাণ কামনার সাহায্যে একাকার হয়ে থাকবে, তা-ই হচ্ছে স্বাভাবিকতার ঐকান্তিক দাবি। তারা একাকার হবে এমনভাবে যে, একজন ঠিক অপরজনে পরিণত হবে।

ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ক্ষমা

স্বামী-স্ত্রীর মধে মন কষাকষি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। আর এ সুযোগে শয়তা পরস্পরের মনে নানারূপ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে কম চেষ্টা করে না। আর এরই ফলে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কে ফাটল ধরতে কিছু বিলম্ব হয় না। বিশেষ করে এজন্যেও অনেক সময় জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে, মেয়েরা সাধারণই নাজুক স্বভাবের হয়ে থাকে। অল্পতেই রেগে যাওয়া, অভিমানে ক্ষুব্ধ হওয়া এবং স্বভাবগত অস্থিরতায় চঞ্চলা হয়ে ওঠা নারী চরিত্রের বিশেষ দিক। মেয়েদের এ স্বাভাবিক দুর্বলতা কিংবা বৈশিষ্ট্যই বলুন –আল্লাহর খুব ভালোভাবেই জানা ছিল। তাই তিনি স্বামীদের নির্দেশ দিয়েছেনঃ

(আরবী************************************)

তোমরা স্ত্রীদের সাথে খুব ভালোভাবে ব্যবহার ও বসবাস করো। তোমরা যদি তাদের অপছন্দ করো তাহলে এ হতে পারে যে, তোমরা একটা জিনিসকে অপছন্দ করছ, অথচ আল্লাহ তার মধ্যে বিপুল কল্যাণ নিহিত রেখে দেবেন।

মওলানা সানাউল্লাহ পানিপত্তী এ আয়াতের তাফসীরে লিখেছেনঃ

স্ত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার ও তাকে নিয়ে ভালোভাবে বসবাস করার মানে হচ্ছে কার্যত তাদের প্রতি ইনসাফ করা, তাদের হক-হকুক রীতিমত আদায় করা এবং কথাবার্তায় ও আলাপ-ব্যবহারে তাদের প্রতি সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা প্রদর্শন। আর তারা তাদের কুশ্রীতা কিংবা খারাপ স্বভাব-চরিত্রের কারণে যদি তোমাদের অপছন্দনীয় হয়ে পড়ে, তাহলে তাদের জন্যে ধৈর্য ধারণ করো, তাদের না বিচ্ছিন্ন করে দেবে, না তাদের কষ্ট দেবে, না তাদের কোনো ক্ষতি করবে। (আরবী*************************)….

স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এ আয়াতে স্বামীদেরকে এক ব্যাপক হেদায়েত দেয়া হয়েছে। স্বামীদের প্রতি আল্লাহর প্রথম নির্দেশ হচ্ছেঃ তোমরা যাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নিলে, যাকে নিয়ে ঘর বাঁধলে তার প্রতি সব সময়ই খুব ভালো ব্যবহার করবে, তাদের অধিকার পূর্ণ মাত্রায় আদায় করবে। আর প্রথমেই যদি এমন কিছু যদি এমন কিছু দেখতে পাও যার দরুন তোমার স্ত্রী তোমার কাছে ঘৃণার্হ হয়ে পড়ে এবং যার কারণে তার প্রতি তোমার মনে প্রেম-ভালোবাসা জাগার বদলে ঘৃণা জেগে ওঠে, তাহলেই তুমি তার প্রতি খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করো না। বুদ্ধির স্থিরতা ও সজাগ বিচক্ষণতা সহকারে শান্ত থাকতে ও পরিস্থিতিকে আয়ত্তে আনতে চেষ্টিত হবে। তোমাকে বুঝতে হবে যে, কোনো বিশেষ কারণে তোমার স্ত্রীর প্রতি যদি তোমার মনে ঘৃণা জেগে থাকে, তবে এখানেই চূড়ান্ত নৈরাশ্যের ও চিরবিচ্ছেদের কারণ হয়ে গেলো না। কেননা হতে পারে, প্রথমবারের হঠাৎ এক অপরিচিতা মেয়েকে তোমার সমগ্র মন দিয়ে তুমি গ্রহণ করতে পারো নি। তার ফলেই এই ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছে কিংবা তুমি হয়তো একটি দিক দিয়েই তাকে বিচার করেছ এবং সেদিক দিয়ে তাকে মনমতো না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছ। অথচ তোমার বোঝা উচিত যে, সেই বিশেষ দিক ছাড়া আরো সহস্র দিক এমন থাকতে পারে, যার জন্যে তোমার মনের আকাশ থেকে ঘৃণতর এ পুঞ্জিত ঘনঘটা দূরীভূত হয়ে যাবে এবং তুমি তোমার সমগ্র অন্তর দিয়ে তাকে আপনার করে নিতে পারবে। সেই সঙ্গে একথাও বোঝা উচিত যে, কোনো নারীই সমগ্রভাবে ঘৃণার্হ হয় না। যার একটি দিক ঘৃণার্হ, তার এমন আরো সহস্র গুণ থাকতে পারে, যা এখনো তোমার সামনে উদঘাটিত হতে পারে নি। তার বিকাশ লাভের জন্যে একান্তই কর্তব্য। এ কারণেই নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী********************************************************)

কোনো মুসলিম পুরুষ যেন কোনো মুসলিম মহিলাকে তার কোনো একটি অভ্যাসের কারণে ঘৃণা না করে। কেননা একটি অপছন্দ হলে অন্য আরো অভ্যাস দেখে সে খুশীও হয়ে যেতে পারে।

কেননা, কোনো নারীই সম্পূর্ণরূপে খারাবীর প্রতিমূর্তি না হয়। কিছু দোষ থাকলে অনেকগুলো গুণও তার থাকতে পারে। সেই কারণে কোনো কিছু খারাপ লাগবে অমনি অস্থির, চঞ্চল ও দিশেহারা হয়ে যাওয়া উচিত নয়। তার অপরাপর ভালে দিকের উন্মেষ ও বিকাশ লাভের সুযোগ দেয়া এবং সেজন্যে অপেক্ষা করা স্বামীর কর্তব্য। আল্লামা আহমাদুল বান্না এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

এ হাদীসের মানে হচ্ছে এই যে, কোনো মু’মিনের উতি নয় অপর কোনো মু’মিন স্ত্রীলোক সম্পর্কে পূর্ণ মাত্রায় ঘৃণা পোষণ করা, যার ফলে চূড়ান্ত বিচ্ছেদের কারণ দেখা দিতে পারে। বরং তার কর্তব্য হচ্ছে মেয়েলোকটির ভালো গুণের খাতিরে তার দোষ ও খারাবী ক্ষমা করে দেয়া আর তার মধ্যে ঘৃণার্হ যা আছে, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করা; বরং তার প্রতি ভালোবাসা জাগাতে চেষ্টা করা। হতে পারে তার স্বভাব-অভ্যাস খারাপ; কিন্তু সে বড় দ্বীনদার কিংবা সুন্দরী রূপসী বা নৈতিক পবিত্রতা ও সতীত্ব সম্পন্না অথবা স্বামীর জন্যে জীবন সঙ্গিনী।

আল্লাম শাওকানী এ হাদীস সম্পর্কে লিখেছেনঃ

(আরবী*********************************************)

এ হাদীসে স্ত্রীদের সাথে খুব ভালো ব্যবহার ও ভালোভাবে বসবাস করার নির্দেশ যেমন আছে, তেমনি তার কোনো এক অভ্যাস স্বভাবের কারণেই তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করতে নিষেধও করা হয়েছে। কেননা তার মধ্যে অবশ্যই এমন কোনো গুণ থাকবে, যার দরুন সে তার প্রতি খুশী হতে পারবে।

এজন্যে নবী করীম (স) স্বামীদের স্পষ্ট নসীহত করেছেন। বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************)

তোমরা স্ত্রীদের সাথে সব সময় কল্যাণময় ব্যবহার করার জন্যে আমার এ নসীহত কবুল করো। কেননা নারীরা জন্মগতভাবেই বাঁকা স্বভাবের হয়ে থাকে। তুমি যদি জোরপূর্বক তাকে সোজা করতে যাও, তবে তুমি তাকে চূর্ণ করে দেবে। আর যদি অমনি ছেড়ে দাও তবে সে সব সময় বাঁকা থেকে যাবে। অতএব বুঝে-শুনে তাদের সাথে ব্যবহার করার আমার এ উপদেশ অবশ্যই গ্রহণ করবে।

এ হাদীসের মানে বদরুদ্দীন আইনীর ভাষায় নিম্নরূপঃ

(আরবী******************************************)

আমি মেয়েলোকদের প্রতি ভালো ব্যবহার করার জন্যে তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি, তোমরা তাদের সম্পপের্ক আমার দেয়া এ নসীহত অবশ্যই কবুল করবে। কেননা তাদের সৃষ্টিই করা হয়েছে পাঁজরের হাঁড় থেকে।

মেয়েলোকদের ‘হাড়’ থেকে সৃষ্টি করার মানে কি? –বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ

(আরবী**********************************************)

‘পাঁজর থেকে সৃষ্টি’ কথাটা বক্রতা বোঝার জন্যে রূপক অর্থে বলা হয়েছে। তার অর্থ হচ্ছে যে, মেয়েদের এমন এক ধরনের স্বভাব দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে যে, সে সৃষ্টির মধ্যেই রয়েছে বক্রতা –বাঁকা হওয়া অর্থাৎ মেয়েদের এক বাঁকা মূল থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অতএব তাদের দ্বারা কোনোরূপ উপকারিতা লাভ করা সম্ভব কেবল তখনি, যদি তাদের মেজাজ স্বভাবের প্রতি পূর্ণরূপে সহানুভূতি সহকারে লক্ষ্য রেখে কাজ করা হয় এবং তাদের বাঁকা স্বভাবের দরুন কখনো ধৈর্য হারানো না হয়। (ঐ)

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*******************************************)

মেয়েলোক পাঁজরের হাড়ের মতো। তাকে সোজা করতে চাইবে তো তাকে চূর্ণ করে ফেলবে, আর তাকে ব্যবহার করতে প্রস্তুত হলে তার স্বাভাবিক বক্রতা রেখেই ব্যবহার করবে।

এ হাদীস থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো যে, নারীদের স্বভাবে বক্রতা স্বভাবগত ও জন্মগত। এ বক্রতা স্মপূর্ণরূপে দূর করা কখনো সম্ভব হবে না। তবে তাদের আসল প্রকৃতিকে বজায় রেখেই এবং তাদের স্বভাবকে যথাযথভাবে থাকতে দিয়েই তাদেরকে নিয়ে সুমধুর পারিবারিক জীবন গড়ে তোলা যেতে পারে, সম্ভব তাদের সহযোগিতায় কল্যাণময় সমাজ গড়া। আর তা হচ্ছে, তাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা, তাদের সাথে অত্যন্ত নম্রতা ও সদিচ্ছাপূর্ণ ব্যবহার করা এবং তাদের মন রক্ষা করতে শেষ সীমা পর্যন্ত যাওয়া ও যেতে রাজি থাকা।

আল্লামা শাওকানী এ হাদীসের পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছেনঃ

মেয়েলোকদের পাঁজরের বাঁকা হাড়ের সাথে তুলনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ কথা বোঝানো যে, (আরবী******************) মেয়েরা স্বভাবতই বাঁকা,তাদের সোজা ও ঋজু করা সম্ভব নয়। যদি কেউ তাকে ঠিক করতে চেষ্টা করে, তবে সে তাকে ভেঙে-চুরে ফেলবে, নষ্ট করবে। আর যে তাকে যেমন আছে তেমনিই থাকতে দেবে, সে তার দ্বারা অশেষ কল্যাণকর কাজ করাতে পারবে, ঠিক যেমন পাঁজবের হাড়। তাকে বানানেই হয়েছে বাঁকা, তাকে সোজা করতে যাওয়ার মানে তাকে ভেঙে ফেলা –চূর্ণ করা। আর যদি তাকে বাঁকাই থাকতে দেয়া হয়, তবে তা দেহকে সঠিক কাজে সাহায্য করতে পারে। শেষ পর্যন্ত তিনি লিখেছেনঃ

(আরবী************************************************)

এ হাদীসে নির্দেশ করা হয়েছে, মেয়েলোকদের সাথে সব সময়ই ভালো ও আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার করতে হবে। তাদের স্বভাব-চরিত্রে বক্রতা থাকলে (সেজন্যে) অসীম ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে। আর সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, মেয়েরা এমন এক স্বভাবের সৃষ্টি, যাকে আদব-কায়দা শিখিয়ে অন্যরকম কিছু বানানো সম্ভব নয়। স্বভাব-বিরোধী নসীহত উপদেশও সেখানে ব্যর্থ হতে বাধ্য। কাজেই ধৈর্য ধারণ করে তার সাথে ভালো ব্যবহার করা, তাকে ভৎসনা করা এবং তার সাথে রূঢ় ব্যবহার করা সম্পূর্ণ বর্জন করা ছাড়া পুরুষদের গত্যন্তর নেই।

নারীদের স্বভাব ও প্রকৃতি সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর এ উক্তিতে তাদের অসন্তুষ্ট বা ক্রুব্ধ হওয়ার কোনো কারণ নেই। এই কথা বলে তাদের অপমান করা হয়নি, না এতে তাদের প্রতি কোনো খারাপ কটাক্ষ করা হয়েছে। এ ধরনের কথার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নারী সমাজের জটিল ও নাজুক মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে পুরুষ সমাজকে অত্যধিক সতর্ক ও সাবধান করে তোলা। এ কথার ফলে পুরুষরা নারীদের সমীহ করে চলবে, তাদের মনস্তত্ত্বের প্রতি নিয়ত খেয়াল রেখেই তাদের সাথে আচার-ব্যবহার করতে উদ্ধুদ্ধ হবে। এ কারণে পুরুষদের কাছে নারীরা অধিকতর আদরণীয়া হবে। এতে তাদের দাম বাড়ল বৈ কমল না একটুকুও।

আল্লামা ইবনে হাজার আল-আসকালানী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ নারীদের এ বাঁকা স্বভাব দেখে তাদের এমনি ছেড়ে দেয়া উচিত নয়, বরং ভালো ব্যবহার ও অনুকূল পরিবেশ দিয়ে তাদের সংশোধন করতে চেষ্টা পাওয়াই পুরুষদের কর্তব্য। দ্বিতীয়ত, নারীদের প্রতি ভালো ব্যবহার করা সব সময়ই প্রয়োজন, তাহলেই স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় হবে। সেই সঙ্গে মেয়েদের অনেক ‘দোষ’ ক্ষমা করে দেয়ার গুণও অর্জন করতে হবে স্বামীদের। খুটিনাটি ও ছোটখাটো দোষ দেখেই চটে যাওয়া কোনো স্বামীরই উচিত নয়।

নারী সাধারণত একটু জেদী হয়ে থাকে। নিজের কতার ওপর অটল হয়ে থাকা ও একবার জেদ উঠলে সবকিছু বরদাশত করা নারী-স্বভাবের একটি বৈশিষ্ট্য। অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা খুঁতখুতে মেজাজেরও হয়ে থাকে। কাজেই পুরুষ যদি কথায় কথায় দোষ ধরে, আর একবার কোনো দোষ পাওয়াগেলে তা শক্ত করে ধরে রাখে- কোনোদিন তা ভুলে যেতে রাজি না হয়, তাহলে দাম্পত্য জীবনের মাধুর্যটুকুই শুধু নষ্ট হবে না –তার স্থিতিও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

তার কারণ, নারীদের এই স্বভাবগত দোসের দিক ছাড়া তার ভালো ও মহৎ গুণের দিকও অনেক রয়েছে। তারা খুব কষ্টসহিষ্ণু, অল্পে সন্তুষ্ট, স্বামীর জন্যে জীবন-প্রাণ উৎসর্গ করতে সতত প্রস্তুত। সন্তান গর্ভে ধারণ, সন্তান প্রসব ও সন্তান লালন-পালনের কাজ নারীরা –মায়েরা যে কতখানি কষ্ট সহ্য করে সম্পন্ন করে থাকে, পুরুষদের পক্ষে তার অনুমান পর্যন্ত করা সহজ নয়। এ কাজ একমাত্র তাদের পক্ষেই করা সম্ভব। ঘর-সংসারের কাজ করায় ও ব্যবস্থাপনায় তারা অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত, একান্ত বিশ্বাসভাজন ও একনিষ্ঠ। তাইবলা যায়, তাদের মধ্যে দোষের দিকের তুলনায় গুণের দিক অনেক গুণ বেশি।

একজন ইউরোপীয় চিন্তাবিদ পুরুষদের লক্ষ্য করে বলেছেনঃ

গর্ভ ধারণ ও সন্তান প্রসবজনিত কঠিন ও দুঃসহ যন্ত্রণার কথা একবার চিন্তা করো। দেখো, নারী জাতি দুনিয়ায় কত শত কষ্ট ব্যথা-বেদনা ও বিপদের ঝুঁকি নিজেদের মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকে। তারা যদি পুরুষের ন্যায় ধৈর্যহীনা হতো, তাহলে এতো সব কষ্ট তারা কি করে বরদাশত করতে পারত? প্রকৃত পক্ষে বিশ্বমানবতার এ এক বিরাট সৌভাগ্য যে, মায়ের জাতি স্বভাবতই কষ্টসহিষ্ণু, তাদের অনুভূতি পুরুষদের মতো নাজুক ও স্পর্শকাতর নয়। অন্যথায় মানুষের এসব নাজুক ও কঠিন কষ্টকর কাজের দায়িত্ব পালন করা সম্পূর্ণ অসম্ভব ছিল।

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ক্ষমাশীলতা দাম্পত্য জীবনের মাধুর্য ও স্থায়িত্বের জন্যে একান্তই অপরিহার্য। যে স্বামী স্ত্রীকে ক্ষমা করতে পারে না, ক্ষমা করতে জানে না, কথায় কথায় দোষ ধরাই যে স্বামীর স্বভাব, শাসন ও ভীতি প্রদর্শনই যার কথার ধরন, তার পক্ষে কোনো নারীকে স্ত্রী হিসেবে সঙ্গে নিয়ে স্থায়ীভাবে জীবন যাপন করা সম্ভব হতে পারে না। স্ত্রীদের সম্পর্কে সাবধান বাণী উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রতি ক্ষমাসহিষ্ণুতা প্রয়োগেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াতেঃ

(আরবী**********************************************************)

হে ঈমানদার লোকেরা, তোমাদের স্ত্রীদের ও সন্তানদের মধ্যে অনেকেই তোমাদের শত্রু। অতএব তাদের সম্পর্কে সাবধান! তবে তোমরা যদি তাদের ক্ষমা করো, তাদের ওপর বেশি চাপ প্রয়োগ না করো বা জোরজবরদস্তি না করো এবং তাদের দোষ-ত্রুটিও ক্ষমা করে দাও, তাহলে জেনে রাখবে, আল্লাহ নিজেই বড় ক্ষমাশীল ও দয়াবান।

নবী করীম (স) তাঁর স্ত্রীদের অনেক বাড়াবাড়িই মাফ করে দিতেন। হযরত উমর ফারূকের বর্ণিত একদিনের ঘটনা থেকে তা বাস্তববাবে প্রমাণিত হয়।

হযতর উমর (রা) একদিন খবর পেলেন, নবী করীম (স) তাঁর বেগমগণকে তাঁদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে তালাক দিয়েছেন। তিনি এ খবর শুনে খুব ভীত হয়ে রাসূলের নিকট উপস্থিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি আপনার বেগমদের তালাক দিয়েছেন? রাসূল (স) বললেনঃ না। পরে রাসূল (স) তাঁর সাথে হাসিমুখে কথাবার্তা বলেছেন। -বুখারী।

এ হাদীসকে ভিত্তি করে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ

(আরবী*****************************************************)

এ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রীদের পীড়ন ও বাড়াবাড়িতে ধৈর্য ধারণ করা, তাদের দোষ-ত্রুটির প্রতি বেশি গুরুত্ব না দেয়া এবং স্বামীর অধিকারের পর্যায়ে তাদের যা কিছু অপরাধ বা পদঙ্খলন হয়, তা ক্ষমা করে দেয়া স্বামীর একান্ত কর্তব্য। তবে আল্লাহর হক আদায় না করলে সেখানে ক্ষমা করা যেতে পারে না।

স্ত্রীদের অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলবে না

ইসলামে নারীদের কোনোরূপ অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে তাদের বিব্রত করে তুলতে নিষেধ করা হয়েছে। প্রয়োজন হলে তাদের অবসর দিতে হবে –প্রস্তুতির জন্যে সময় দিতে হবে। দীর্ঘদিন পর হঠাৎ করে রাতের বেলা বাড়িতে উপস্থিত হলে স্ত্রী নিজেকে অপ্রস্তুত ও বিব্রত বোধ করতে পারে। এজন্যে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************************)

তোমাদের কেউ যদি দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাড়িতে অনুপস্থিত থাকার পর ফিরে আসে, তাহলে পূর্বে খবর না দিয়ে রাতের বেলা হঠাৎ করে বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া উচিত নয়।

হযরত জাবির (রা) বললেনঃ ‘আমরা এক যুদ্ধে রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গে ছিলাম। পরে যখন আমরা মদীনায় ফিরে এলাম, তখন আমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ঘরে চলে যেতে ইচ্ছা করল। কিন্তু নবী করীম (স) বললেনঃ

(আরবী******************************************************)

কিছুটা অবসর দাও। রাতে ঘরে ফিরে যেতে পারবে। এই অবসরে তোমাদের স্ত্রীরা প্রয়োজনীয় সাজ-সজ্জা করে নেবে, গোপন অঙ্গ পরিস্কার করবে এবং তোমাদের গ্রহণ করার জন্যে প্রস্তুতি নিতে পারবে।

মেয়েরা সাধারণত অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকে, তাদের মাথায়ও হয়ত ঠিক মতো চিরুণী করা হয় না। প্রয়োজনীয় সাজ-সজ্জায় সুজজ্জিত হয়েও তারা সব সময় থাকে না। বিশেষত স্বামীর দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতিতে মেয়েরা নিজেদের সাজ-সজ্জার ব্যাপারে খুবই অসতর্ক হয়ে পড়ে। নবী করীম (স) সাহাবিগণকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘদিন পরে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেও সঙ্গে সঙ্গেই সকলকে নিজের নিজের ঘরে ফিরে যেতে দিলেন না। তাদের প্রত্যাবর্তনের খবর সকলের জানা হয়ে গেছে। স্ত্রীরা নিজের নিজের স্বামীকে সাদরে গ্রহণ করার জন্যে প্রস্তুতি নিতে পারছে এই অবসরে। এ দৃষ্টিতে রাসূলে করীম (স)-এর উপরোক্ত কথার তাৎপর্য স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। স্বামীর দীর্ঘদিন অনুপস্থিতির কারণে স্ত্রী হয়ত ময়লা দেহ ও মলিন বসন পরে রয়েছে। তার মাথার চুলও হয়ত আঁচড়ানো হয়নি। এরূপ অবস্থায় স্বামী যখন তাকে দেখতে পাবে দীর্ঘদিনের বিরহের পর, তখন স্বামী যে নিরাশ ও নিরানন্দের বেদনায় মুষড়ে পড়বে এবং স্ত্রীও যে এরূপ অবস্থায় দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পরও অন্তরঢালা আনন্দ সহকারে স্বামীকে গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হবে, তা বুঝতে পারা দুনিয়ার স্বামী ও স্ত্রীদের পক্ষ কঠিন নয়। বস্তুত এর দরুন স্বামীদের মন স্ত্রীর প্রতি বিরূপ ও তিক্ত-বিরক্ত হয়ে যেতে পারে, আর স্ত্রীর মনও স্বামীর কাছে ছোট হয়ে যেতে পারে। এরূপ অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী কারো মন খারাপ হয়ে যাবার কোনো কারণ যাতে না ঘটতে পারে, এজন্যেই রাসূলে করীম(স) সাহাবীদের উক্তরূপ নির্দেশ দিয়েছিলেন। অন্যথায় যারা সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আসে, তাদের জন্যে এ রকম কিছু করণীয় নেই।

স্ত্রীদের ওপর জুলুম অত্যাচার করা নিষেধ

স্ত্রীদের প্রতি অত্যাচার জুলুম করা তো দূরের কথা, বারে বারে তালাক দিয়ে আবার ফেরত নিয়ে স্ত্রীকে কষ্ট দেয়া ও দাম্পত্য জীবনকে বিনষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতটি উল্লেখ করা যেতে পারে। বলা হয়েছেঃ

(আরবী**********************************************************************)

তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের নানাভাবে কষ্টদান ও উৎপীড়নের উদ্দেশ্যে আটক করে রেখ না। যে লোক এরূপ করবে, সে নিজের ওপরই জুলুম করবে। আর তোমরা আল্লাহর আয়াতসমূহকে খেলনার বস্তুতে পরিণত করো না। (সূরা বাকারাঃ ৩৩)

যদিও আরবে প্রচলিত কুসংস্কার –স্ত্রীকে বারবার তালাক দিয়ে বারবার ফেরত নেয়ার রেওয়াজ নিষিদ্ধ করে এ আয়াত নাযিল হয়েছিল; কিন্তু স্ত্রীকে কোনো প্রকার অকারণ কষ্ট দেয়া বা তারক্ষতি করা যে নিষেধ, তা এ আয়াত থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। আয়াত থেকে একথাও বোঝা যাচ্ছে যে, নিজের স্ত্রীকে যে লোক কষ্ট দেবে, জুলুম-পীড়ন করবে, পরিণামে তার নিজের জীবনই নানাভাবে জর্জরিত হয়ে উঠবে, সে নিজেই কষ্ট পাবে, তার দাম্পত্য জীবনই দুঃসহ তিক্ততায় পূর্ণ হয়ে যাবে এবং স্ত্রীর সাথে মধুর সম্পর্ক বজায় রাখলে যে শান্তিপূর্ণ সুখময় জীবন যাপন সম্ভব, তা থেকে সে বঞ্চিত হয়ে যাবে। দুনিয়ায় তার প্রতি একদিকে যেমন আল্লাহর অসন্তোষ জেগে উঠবে, তেমনি জনগণ ও স্ত্রীলোকদের সমাজেও তার প্রতি জাগবে রুদ্র রোষ ও ঘৃণা।

বস্তুত স্ত্রীদের সাথে মিষ্টি ও মধুর ব্যবহার করা এবং তাদের কোনোরূপ কষ্ট না দিয়ে শান্তি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দান করা সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও যদি কেউ তার স্ত্রীকে অকারণ জ্বালা-যন্ত্রণা দেয়, ক্ষতিগ্রস্থ করতে চেষ্টিত হয়, তবে সে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার কারণে আল্লাহর গজব পড়ার যোগ্য হবে। আল্লাম আ-লুসরি মতে তার নিজের কষ্ট ও ক্ষতি হবে।

(আরবী********************************************************************)

এভাবে যে, সে মধুর পারিবারিক জীবন যাপনের ফলে লভ্য সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে বলে সে দ্বীনের ফায়দা হারাবে আর দুনিয়ার ফায়দা হারাবে এভাবে যে, তার এ বীভৎস কাজের প্রচার হয়ে যাওয়ার কারণে নারী সমাজ তার প্রতি বিরূপ ও বিরাগভাজন হয়ে পড়বে।

নবী করীম (স) তাঁর নিজের ভাষায় স্ত্রীদের মারপিট করতে স্পষ্ট নিষেধ করেছেন। বলেছেনঃ

(আরবী***************************************)

তোমার স্ত্রী –অঙ্কশায়িনীকে এমন নির্মমভাবে মারধোর করো না, যেমন করে তোমরা মেরে থাকো তোমাদের ক্রীতদাসীদের।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জামায়াতা (রা) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

তোমাদের কেউ যেন তার স্ত্রীকে ক্রীতদাসদের মারার মতো না মারে, আর মারধোর করার পর দিনের শেষে তার সাথে যেন যৌন সঙ্গম না করে।

অর্থাৎ স্ত্রীর সাথে যৌন-সঙ্গম করা তো এক স্বাভাবিক কাজ, কিন্তু স্ত্রীকে একদিকে মারধোর করা আর অপরদিকে সেদিনই তার সাথে যৌন সঙ্গম করা অত্যন্ত ঘৃণার্হ কাজ। এ দুয়ের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ

(আরবী**********************************************************************)

স্ত্রীকে প্রচণ্ডভাবে মারধোর করা এবং সে দিনের বা সে রাতেরই পরবর্তী সময়ে তারই সাথে যৌন সঙ্গম করা –এ দুটো কাজ এক সঙ্গে সম্পন্ন হওয়া যে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তির দ্বারাই সম্ভব হতে পারে না –হওয়া বাঞ্চনীয় নয়, যৌন সঙ্গম সুন্দর ও মাধুর্যপূর্ণ হতে পারে যদি তা মনের প্রবল ঝোঁক ও তীব্র অদম্য আকর্ষণের ফলে সম্পন্ন হয়। কিন্তু প্রহৃতের মন প্রহারকারীর প্রতি যে ঘৃণা পোষণ করে, তা সর্বজনবিদিত।

বস্তুত স্ত্রীকে মারধোর না করা, তার ত্রুটিবিচ্যুতি যথাসম্ভব ক্ষমা করে দেয়া ও তার প্রতি দয়া অনুগ্রহ প্রদর্শন করাই অতি উত্তম নীতি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্বয়ং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) এই নীতি ও চরিত্রেই ভূষিত ছিলেন। হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ

(আরবী*******************************************)

রাসূলে করীম (স) তাঁর কোনো স্ত্রীকে কিংবা কোনো চাকর-খাদেমকে কখনো মারধোর করেন নি –না তাঁর নিজের হাত দিয়ে, তা আল্লাহর পথে। তবে যদি কেউ আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ করে, তবে সেই আল্লাহর জন্যে তার প্রতিরোধ গ্রহণ করতেন। (আরবী*********)

স্ত্রীদের মারধেঅর করা, গালাগাল করা এবং তাদের সাথে কোনোরূপ অন্যায় জুলুম জাতীয় আচরণ গ্রহণ করতে নিষেধ করে রাসূলে করীম (স) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ

(আরবী********************************************************************)

তোমরা স্ত্রীদের আদৌ মারধেঅর করবে না এবং তাদের মুখমণ্ডলকে কুশ্রী ও কদাকার করে নিও না।

তিনি আরো বলেছেনঃ

(আরবী*******************************************)

আল্লাহর দাসীদের তোমরা মারধোর করো না।

লক্ষণীয় যে, স্ত্রীদেরকে এখানে ‘আল্লাহর দাসী’ বলা হয়েছে, পুরুষদের বা স্বামীদের দাসী নয়। তাই তাদের অকারণ মারধোর করা কিংবা তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করার কোনো অধিকার স্বামীদের নেই।

অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী**********************************************************)

তোমরা স্ত্রীদের মুখের ওপর মারবে না, মুখমণ্ডলের ওপর আঘাত দেবে না, তাদের মুখের শ্রী বিনষ্ট করবে না, অকথ্য ভাষায় তাদের গালাগাল করবে না এবং নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও তাদের বিচ্ছিন্নাবস্থায় ফেলে রাখবে না।

তবে কি স্ত্রীদের মারধোর করা আদৌ জায়েয নয়? উপরোক্ত হাদীসের ভিত্তিতে ইমাম খাত্তাবী লিখেছেনঃ

(আরবী******************************************************)

রাসূলের ‘মুখের ওপর মারবে না’ উক্তি থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুখমণ্ডল ব্যতীত দেহের অন্যান্য অংশের ওপর স্ত্রীকে মারধোর করা সঙ্গত। তবে শর্ত এই যে, তা মাত্রার বেশি, সীমালংঘনকারী ও অমানুষিক মার হতে পারবে না।

ওপরে উদ্ধৃত হাদীসের ভিত্তিতে ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল কাহলানী বুখারী লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************) হাদীসটি থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রীকে খুব হালকাভাবে সামান্য মারধোর করা জায়েয।

কিন্তু স্ত্রীকে মারধোর করা কখন ও কি কারণে করা সঙ্গত? ……এ পর্যায়ে প্রথমে কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াত পাঠ করা যেতে পারে। আয়াতটি হলোঃ

(আরবী********************************************************)

আর যেসব স্ত্রীলোকের অনানুগত্য ও বিদ্রোহের ব্যাপারে তোমরা ভয় করো, তাদের ভালোভাবে বুঝাও, নানা উপদেশ দিয়ে তাদের বিনয়ী বানাতে চেষ্টা করো। পরবর্তী পর্যায়ে মিলন-শয্যা থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রাখ। আর (শেষ উপায় হিসেবে) তাদের মারো। এর ফলে যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়ে যায়, তাহলে তাদের ওপর অন্যায় ব্যবহারের নতুন কোনো পথ খুঁজে বেড়িও না। …..নিশ্চয় আল্লাহই হচ্ছেন সর্বোচ্চ, সর্বশ্রেষ্ঠ।

এ আয়াতে দুনিয়ার মুসলিম স্বামীদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে। ‘ভয় করা’ মানে জানতে পারা অথবা নিঃসন্দেহে বুঝতে পারা যে, স্ত্রী স্বামীকে মানছে না, অথচ স্বামীকে মেনে চলাই স্ত্রীর কর্তব্য। এরূপ অবস্থায় স্বামী কি করবে, তা-ই বলা হয়েছে এ আয়াতে। এখানে প্রথমে বলা হয়েছে স্ত্রীকে ভালোভাবে বোঝাতে, উপদেশ দিতে ও নসীহত করতে, একথা তাকে জানিয়ে দিতে যে, স্বামীকে মান্য করে চলা, স্বামীর সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা ও তা বজায় রাখার জন্যে আল্লাহ তা’আলাই নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশ তাকে অবশ্যই পালন করতে হবে। অন্যথায় তার ইহকালীন দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক জীবন তিক্ত-বিষাক্ত হয়ে যাবে, আর পরকালেও তাকে আল্লাহর আযাব ভোগ করতে হবে।

দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে, অমান্যকারী স্ত্রীকে মিলন-শয্যা থেকে সরিয়ে রাখা –তার সাথে যৌন সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা। অন্য কথায় তাকে না শয্যা-সঙ্গী বানাবে, না তার সাথে যৌন সম্পর্ক বজায় রাখবে। আর তৃতীয়ত বলা হয়েছে তাকে মারধোর করতে। কিন্তু এ মারধোর সম্পর্কে একথা স্পষ্ট যে, তা অবশ্যই শিক্ষামূলক হতে হবে মাত্র। ক্রীতদাস ও জন্তু-জানোয়ারকে যেমন মারা হয়, সে রকম মার দেয়ার অধিকার কারো নেই।–[‘ফতোয়ায়ে কাজীখান’-এ বলা হয়েছেঃ (আরবী**************************************************)

স্বামী স্ত্রীকে চারটি অবস্থায় বা চারটি কারণে মারতে পারে। এক, স্বামীর ইচ্ছা ও নির্দেশ সত্ত্বেও স্ত্রী যদি সাজ-সজ্জা পরিত্যাগ করে। দুই, স্বামী যৌন সঙ্গমের ইচ্ছা প্রকাশ করলেও সেজন্যে প্রস্তুত না হওয়া তার পবিত্র ও হায়যমুক্ত থাকা সত্ত্বেও। তৃতীয়, স্ত্রী যদি নামায তরক করে এবং চতুর্থ, স্ত্রী যদি স্বামীর বিনানুমতিতে ঘর থেকে বাইরে চলে যায়।]

কিন্তু এ সব কয়টি কাজ স্বামী এক সঙ্গে করবে, কিংবা একটার পর একটা প্রয়োজনানুপাতে করবে। ….আয়াতের ধরন ও বাচনভঙ্গী দেখে বাহ্যত সব কয়টি কাজ এক সঙ্গে করারই অনুমতি রয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু বিবেক ও সুস্থ বুদ্ধির নির্দেশ এই যে, এই কয়টি কাজ এক সঙ্গে একই সময় করবে না, ক্রমিক নীতিতে ও প্রয়োজনানুপাতে একটির পর একটি করবে। কিন্তু এ কাজ করার অনুমতিই দেয়া হয়েছে স্ত্রীকে অনুগতা বানাবার উদ্দেশ্যে। নিছক কষ্ট বা শাস্তি দেয়াই এর লক্ষ্য নয়। কাজেই একটি একটি করে তার সফলতা যাচাই করবে। তা ব্যর্থ হলে পরেরটা করবে। আয়াতের শেষাংশে আল্লাহর পরিচয় দিয়ে যা বলা হয়েছে, তার মানে আল্লামা শাওকানীর ভাষায় নিম্নরূপঃ

(আরবী************************************************************)

আয়াতে স্বামীদের বলা হয়েছে স্ত্রীদের জন্যে ভালোবাসার বাহু বিছিয়ে দিতে, পার্শ্ববিনম্র করতে অর্থাৎ তোমরা স্বামীর যদি স্ত্রীদের প্রতি যা ইচ্ছা তা-ই করার ক্ষমতা রাখ, তাহলেও তোমাদের উচিত তোমাদের ওপর স্থাপিত আল্লাহর অসীম ও অতুলনীয় ক্ষমতার কথা স্মরণ করা। কেননা তা হচ্চে সর্বক্ষমতার ঊর্ধ্বে –অধিক। মনে রেখ, আল্লাহ তোমাদের প্রতি উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছেন।–[আয়াত থেকে আল্লাহর ইচ্ছা এই মনে হয় যে, স্ত্রীকে মারবার ব্যাপারে যতদূর সম্ভব হালকা ভাব অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। এজন্যে আল্লাহ তা’আলা ওয়ায-নসীহত, বোঝানো –সমঝানোর আদেশ দিয়েছেন সর্ব প্রথম। তারপরে ক্রমশ অগ্রসর হয়ে মিলন-শয্যা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা ও শেষ পর্যায়ে মারবার কথা বলেছেন। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীর মতে এর তাৎপর্য হচ্ছেঃ

(আরবী*******************************************************************)

একথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া যে, অপেক্ষাকৃত হালকা শাসনে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলে পরে তাতেই ক্ষান্ত করা উচিত এবং তার পরও অধিকতর কঠোর নীতি অবলম্বনে অগ্রসর হওয়া কিছুতেই জায়েয নয়।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) এ আয়াতের ভিত্তিতে বলেছেনঃ

(আরবী*********************************************************)

প্রথমে তাকে মিলন-শয্যা থেকে সরিয়ে দেবে, এতে যদি সে মেনে যায় ভালো, অন্যথায় আল্লাহ তা’আলা তোমাকে অনুমতি দিয়েছেন তাকে মারবার; কিন্তু সে মার নির্দয় অমানুষিক হবে না। মারের চোটে তার হাড় ভেঙ্গে দিতে পারবে না। এতে যদি সে ফিরে আসে ভালো কথা; অন্যথায় তুমি তার কাছ থেকে বিনিময় গ্রহণ করে তাকে তালাক দিয়ে দিতে পারো।]

স্ত্রীদের প্রতি ব্যবহার সম্পর্কে একথা বলে দুনিয়ার স্বামীদের বিশেষভাবে সাবধান করে দেয়া হয়েছে, যেন তারা নারী অবলার প্রতি কোনোরূপ দুর্ব্যবহার ও অন্যায়-অত্যাচার করতে সাহসী না হয়।

অতঃপর বলা হয়েছে, স্ত্রী যদি স্বামীকে মেনে নেয়, স্বামীর সাথে মিলমিশ রক্ষা করে বসবাস করতে রাজি হয় এবং তা-ই করে, তাহলে স্বামীর কোনো অধিকার নেই তার ওপর কোনোরূপ অত্যাচার করার, তাকে একবিন্দু কষ্ট ও জ্বালাতন দেয়ার! আয়াতের শেষাংশে কোনো উপযুক্ত কারণ ব্যতীত স্ত্রীকে কষ্ট দেয়ার যে কতদূর অন্যায় তার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, তারা যদিও অবলা, দুর্বল, স্ত্রীকে কষ্ট দেয়ার যে কতদূর অন্যায় তার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, তারা যদিও অবলা, দুর্বল, তোমাদের জুলুম-পীড়ন থেকে আত্মরক্ষা করার সাধ্য যদিও তাদের নেই; তোমাদের অত্যাচারের প্রতিশোদ গ্রহণ করতে তারা যদিও অক্ষম; কিন্তু তোমাদের ভুললে চলবে না যে, আল্লাহ হচ্ছেন প্রবল পরাক্রান্ত, শ্রেষ্ঠ, শক্তিমান; তিনি অবশ্যই প্রত্যেক জালিমের জুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন এবং সেজন্যে কঠোর শাস্তিদান করবেন। অতএব তোমরা শক্তিমান বলে স্ত্রীদের ওপর অকারণ জুলুম করতে উদ্যত হবে, তা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না।

স্ত্রীদের প্রতি ভালো ব্যবহার ঈমানের লক্ষণ

স্ত্রীদের ওপর অন্যায়ভাবে, অকারণে ও উঠতে-বসতে আর কথায়-কথায় কোনোরূপ দুর্ব্যবহার বা মারধোর করতে শুধু নিষেধ করেই ক্ষান্ত করা হয়নি, ইসলাম আরো অগ্রসর হয়ে স্ত্রীদের প্রতি সক্রিয়ভাবে ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন স্বামীদেরকে।

এ পর্যায়ে কুরআনের আয়াতঃ

(আরবী**************************************)

স্ত্রীদের সাথে যথাযথভাবে কুব ভালো ব্যবহার করবে।

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা কাসেমী লিখেছেনঃ

(আরবী******************************************************)

স্ত্রীদের সাথে কার্যত ইনসাফ করে আর ভালো সম্মানজনক কথা বলে একত্র বসবাস করো যেন তোমরা স্ত্রীদের বিদ্রোহ বা চরিত্র খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণ হয়ে না বসো। এ ধরনের কোনো কিছু করা তোমাদের জন্যে আদৌ হালাল নয়।

আল্লামা আ-লুসী লিখেছেনঃ

(আরবী*********************************************************)

তাঁদের সাথে ভালোভাবে ব্যবহার করো। আর ‘ভালোভাবে’ মানে এমনভাবে যা শরীয়ত ও মানবিকতার দৃষ্টিতে অন্যায় নয় –খারাপ নয়।

এ ‘ভালোভাবে’ কথার মধ্যে এ কথাও শামিলঃ

(আরবী***********************************************)
স্ত্রীকে মারধোর করবে না, তার সাথে খারপ কথাবার্তা বলবে না এবং তাদের সাথে সদা হাসিমুখে ও সন্তুষ্টচিত্তে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে।

তাফসীরকারদের মতে এ আয়াত থেকে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রী যদি ঘরের কাজ-কর্ম করতে অক্ষম হয় বা তাতে অভ্যস্ত না হয়, তাহলে স্বামী তার যাবতীয় কাজ করিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে বাধ্য। (আরবী*******)

স্ত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার করা পূর্ণ ঈমান ও চরিত্রের লক্ষণ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ

(আরবী****************************************************)

যার চরিত্র সবচেয়ে উত্তম, নিষ্কলুষ সে সবচেয়ে বেশি পূর্ণ ঈমানদার। আর তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ব্যক্তি হচ্ছে সে, যে তার স্ত্রীর নিকট সবচেয়ে ভালো।

অপর এক হাদীসে স্ত্রীদের ব্যাপারে রাসূলে করীম (স)-এর নিজের ভূমিকা উল্লেখ করে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************)

তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো লোক সে, যে তার পরিবার ও স্ত্রী-পরিজনের পক্ষে ভালো। আর আমি আমার নিজের পরিবারবর্গের পক্ষে তোমাদের তুলনায় অনেক ভালো। তোমাদের সঙ্গী-স্ত্রী বা স্বামী –যদি মরে যায়, তাহলে তার কল্যাণের জন্যে তোমরা অবশ্যই দো’আ করবে।

হযরত আবূ যুবার (রা) বলেন, একদা নবী করীম (স) সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেনঃ

(আরবী*******************) –তোমরা আল্লাহর দাসীদের মারধোর করো না।

তখন হযরত উমর ফারূক (রা) রাসূলের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেনঃ

(আরবী************************************************)

আপনার এ কথাটি শুনে স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের ওপর খুবই বাড়াবাড়ি শুরু করে দিয়েছে।

তখন নবী করীম (স) তাদেরও মারবার অনুমতি দিলেন। একথা জানতে পেরে বহু সংখ্যক মহিলা রাসূলের ঘরে এসে উপস্থিত হলো এবং তারা তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে নানা প্রকারের অভিযোগ পেশ করলো। সব কথা শুনে নবী করীম (স) বললেনঃ

(আরবী***************************************************************)

বহু সংখ্যক মহিলা মুহাম্মদের পরিবারবর্গের নিকট এসে তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে গেছে। মনে হচ্ছে, এসব স্বামী তোমাদের মধ্যে ভালো লোক নয়।

অন্য কথায়ঃ

(আরবী******************************************************)

বরং তোমাদের মধ্যে উত্তম লোক হচ্ছে তারা, যারা তাদের স্ত্রীদের মারপিট করে না; বরং তাদের অনেক কিছুই তারা সহ্য করে নেয়। (অথবা বলেছেন) তাদের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা পোষণ করে, তাদের কঠিন মার মারে না এবং তাদের অভাব-অভিযোগগুলো যথাযথভাবে দূর করে।

স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক উপহার বিনিময়

স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রেম-ভালোবাসার স্থায়িত্ব ও গভীরতা বিধানের উদ্দেশ্যে প্রয়োজন হচ্ছে পারস্পরিক উপহার-উপঢৌকন বিনিময়। স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীকে মাঝে-মধ্যে নানা ধরনের চিত্তাকর্ষক দ্রব্যাদি দেয়া। স্ত্রীরও যথাসাধ্য তাই করা উচিত। যার যে রকস সম্বল ও সামর্থ্য, সেই অনুপাতে যদি পরস্পরে উপহার-দ্রব্যের আদান-প্রদান হয়, তাহলে তার ফলে পারস্পরিক আকর্ষণ, কৌতুহল ও হৃদয়াবেগ বৃদ্ধি পাবে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের প্রতি থাকবে সদা সন্তুষ্ট। এজন্যে রাসূলে করীম (স)-এর একটি সাধঅরণ ও সংক্ষিপ্ত উপদেশ সব সময় স্মরণে রাখা কর্তব্য। তা হলোঃ (আরবী************) অর্থাৎ তোমরা পরস্পর উপহার-উপঢৌকনের আদান-প্রদান করো। দেখবে, এর ফলে তোমাদের পারস্পরিক ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছে –পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসার মাত্রা বৃদ্ধি পাবে।

অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************)

তোমরা পরস্পরে হাদিয়া-তোহফার আদান-প্রদান করবে, কেননা হাদিয়া-তোহফা দিলের ক্লেদ ও হিংসা-দ্বেষ দূর করে দেয়।

এর কারণ সুস্পষ্ট। মানুষের দিলে ধন-মালের মায়া খুবই তীব্র ও গভীর। তা যদি কেউ অন্য কারো নিকট থেকে লাভ করে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তার মন তার দিকে ঝুঁকে পড়ে, আকৃষ্ট হয় এবং মাল-সম্পদ দানকারীর মনও ঝুকে পড়ে তার প্রতি, যাকে সে তা দান করল।

(আরবী*************************************)

ইবরাহীম ইবনে ইয়াজীদ নখয়ী বলেছেনঃ

(আরবী*********************************************************************)

পুরুষের পক্ষে তার স্ত্রীকে এবং স্ত্রীর পক্ষে তার স্বামীকে উপহার দান খুবই বৈধ কাজ। তিনি আরো বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************************************************)

স্ত্রী যদি স্বামীকে কিংবা স্বামী যদি স্ত্রীকে কোনো উপহার দেয়, তবে তা তাদের প্রত্যেকের জন্যে হতে তার পাওয়া দান।

কিন্তু এ ব্যাপারে শরীয়তের নির্দেশ হলো, কেউই অপরের দেয়া উপহার ফেরত নিতে বা দিতে পারবে না। ইবরাহীম নখয়ী বলেছেনঃ

(আরবী********************************************************************)

এ দুয়ের কারোর পক্ষেই তার নিজের দেয়া উপহার ফিরিয়ে নেয়া জায়েয নয়।

হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয বলেছেণ, ‘এভাবে উপহার আদান-প্রদান করলে কেউই কারোরটা ফিরিয়ে দেবে না, ফিরেয়ে নেবে না।

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকে যা কিছু একবার দিয়ে দিয়েছে, তা ফেরত নেয়া কারো পক্ষেই জায়েয নয়।

ইবনে বাত্তাল বলেছেনঃ কারো কারো মতে স্ত্রী তার দেয়া জিনিস ফিরিয়ে নিলেও নিতে পারে; কিন্তু স্বামী তার দেয়া উপহার কিছুতেই ফিরিয়ে নিতে পারবে না।

স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক মান-অভিমান অনেক সময় জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব করে। অনেক সময় তা সীমাতিক্রম করে যায়। অনেক সময় কথার কাটাকাটি ও তর্ক-বিতর্কেও পরিণত হয়ে পড়ে। রাসূলে করীম (স)-এর দাম্পত্য জীবনেও তা লক্ষ্য করা গিয়েছে। হযরত উমরের বেগম একদিন হযরত উমরকেই বললেনঃ

(আরবী**********************************************)

আল্লাহর কসম, নবীর বেগমরা পর্যন্ত তাঁর কথার প্রত্যুত্তর করে থাকেন। এমন কি তাঁদের এক-একজন রাসূলকে দিনের বেলা ত্যাগ করে রাত পর্যন্ত অভিমান করে থাকেন।

তখন হযরত উমর (রা) চিন্তায়ি ভারাক্রান্ত হয়ে তাঁর কন্যা উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসার নিকট উপস্থিত হয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন ও সত্যাসত্য জানতে চাইলেন। জবাবে হাফসা হ্যাঁ-সূচক উক্তি করলেন। হযরত উমর এর পরিণাম ভয়াবহ মনে করে কন্যাকে সাবধান করে দিলেন ও বললেনঃ

(আরবী******************************************************)

সাবধান! তুমি রাসূলের নিকট বেশি বেশি জিনিস পেতে চাইবে না। তাঁর কথায় মুখের ওপর জবাব দেবে না, রাগ করে কখনো তাঁকে ত্যাগ করবে না। আর তোমার কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তা আমার নিকট চাইবে।

(আরবী***************************************************************)

নিজের কন্যার দাম্পত্য জীবন সুখের হওয়ার জন্যে অর্থ ব্যয় করার একটা নির্দেশ এতে নিহিত রয়েছে। আর এ হচ্ছে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই মর্যাদা রক্ষার ব্যাপার এবং এ উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় করা কর্তব্য। জামাতার নিকট মেয়ে বেশি বেশি জিনিস চাইলে তার কষ্ট হতে পারে মনে করে কন্যার জন্যে অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত হওয়ারও নিদর্শন এতে রয়েছে।


স্ত্রীর অধিকারের গুরুত্ব
ইবাদত-বন্দেগী ও কৃচ্ছ্র সাধনা অনেক প্রশংসার কাজ সন্দেহ নেই, কিন্তু তা করতে গিয়ে স্ত্রীর অধিকার হরণ করা, তার পাওনা যথারীতি ও পুরাপুরি আদায় না করা, তার সাথে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন করা নিশ্চয়ই বড় গুনাহ। নবী করীম (স) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************)

নিশ্চয়ই তোমার স্ত্রীর তোমার ওপর একটা অধিকার রয়েছে।

কেবল স্ত্রীর অধিকার স্বামীর ওপর, সে কথা নয়, স্বামীর অধিকার রয়েছে স্ত্রীর ওপর। আল্লামা বদরুদ্দীন এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী*********************************************)

স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকেরই অধিকার রয়েছে প্রত্যেকের ওপর।

স্বামীর উপর স্ত্রীর যা কিছু অধিকার, তার মধ্যে একটি হচ্ছে তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন। আর সাধারণভাবে তার প্রাপ্য হচ্ছেঃ

(আরবী******************************************)

তাকে খাবার দেবে যখন যেমন তুমি নিজে খাবে এবং তার পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করে দেবে, যেমন মানের পোশাক তুমি নিজে গ্রহণ করবে।

এ হাদীসের তাৎপর্য মওলানা খলীলুর রহমান লিখেছেণ নিম্নরূপঃ

(আরবী************************************************************)

স্ত্রীর খোরাক ও পোশাক যোগাড় করে দেয়া স্বামীর কর্তব্য, যখন সে নিজের জন্যে এগুলোর ব্যবস্থা করতে সমর্থ হবে।

আল্লামা আল-খাত্তাবী লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************************)

এ হাদীস স্ত্রীর খোরাক-পোশাকের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা স্বামীর ওপর ওয়াজিব করে দিচ্ছে। এ ব্যপারে কোনো সীমা নির্দিষ্ট নেই, প্রচলন মতোই তা করতে হবে, করতে হবে স্বামীর সামর্থ্যানুযায়ী। আর রাসূলে করীম (স) যখন একে ‘অধিকার’ বলেছেণ তখন তা স্বামীর অবশ্য আদায় করতে হবে –সে উপস্থিত থাক, কি অনুপস্থিত। সময়মতো তা পাওয়া না গেলে তা স্বামীর ওপর অবশ্য দেয় ঋণ হবে –যেমন অন্যান্য হক-অধিকারের ব্যাপারে হয়ে থাকে।

এতদ্ব্যতীত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে স্ত্রীর নিকট যাওয়াও স্ত্রীর একটি অধিকার স্বামীর ওপর এবং তা স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীর প্রতি। স্বামী যদি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে স্ত্রীর নিকট উপস্থিত হয়, তবে তাতে স্ত্রীর মনে আনন্দের ঢেউ খেলে যাওয়া স্বাভাবিক। কেননা তাতে প্রমাণ হয় যে, স্বামী স্ত্রীর মন জয় করার জন্যে বিশেষ যত্ন নিয়েছে এবং পূর্ণ প্রস্তুতি সহকারেই সে স্ত্রীর নিকট হাজির হয়েছে। অপরিচ্ছন্ন ও মলিন দেহ ও পোশাক নিয়ে স্ত্রীর নিকট যাওয়া স্বামীর একেবারেই অনুচিত। স্ত্রীরও কর্তব্য স্বামীর ইচ্ছানুরূপ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা ও সেই অবস্থায়ই স্বামীর নিকট যাওয়া। এজন্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী, সাবান ও অন্যান্য জরুরী প্রসাধন দ্রব্য সংগ্রহ করে দেয়া স্বামীর কর্তব্য। হযরত ইবনে আব্বাস এ পর্যায়ে একটি নীতি হিসেবে বলেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************)

আমি স্ত্রীর জন্যে সাজসজ্জা করা খুবই পছন্দ করি, যেমন পছন্দ করি স্ত্রী আমার জন্যে সাজসজ্জা করুক।

স্ত্রীর বিপদে সহানুভূতি প্রদর্শন

স্ত্রীর বিপদে-আপদে, রোগে-শোকে তার প্রতি অকৃত্রিম সহানুভূতি প্রদর্শন করা স্বামীর কর্তব্য। স্ত্রী রোগাক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা করা স্বামীরই দায়িত্ব। বস্তুত স্ত্রী সবচেয়ে বেশী দুঃখ পায় তখন, যখন তার বিপদে-শোকে তার স্বামীকে সহানুভূতিপূর্ণ ও দুঃখ ভারাক্রান্ত দেখতে পায় না অথবা স্ত্রীর যখন কোন বিপদ হয়, শোক হয় কিংবা রোগ হয়, তখন স্বামীর মন যদি তার জন্যে দ্রবীভূত না হয়, বরং তখন স্বামীর মন মৌমাছির মতো অন্য ফুলের সন্ধানে উড়ে বেড়ায়, তখন বাস্তবিকই স্ত্রীর দুঃখ ও মনোকষ্টের কোনো অবধি থাকে না। এজন্যে নবী করীম (স) স্ত্রীর প্রতি দয়াবান ও সহানুভূতিপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি এর সাধারণ নিয়ম হিসেবে বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************)

যে লোক নিজে অপরের জন্যে দয়াপূর্ণ হয় না, সে কখনো অপরের দয়া-সহানুভূতি লাভ করতে পারে না।

স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের ক্ষেত্রে এ কথা অতীব বাস্তব। এজন্যে স্ত্রীদের মনের আবেগ উচ্ছ্বাসের প্রতি লক্ষ্য রাখঅ স্বামীর একান্তই কর্তব্য।

এ প্রসঙ্গে হযরত উমর ফারূকের একটি ফরমান স্মরণীয়। তিনি এক বিরহিণী নারীর আবেগ-উচ্ছ্বাস দেখতে পেয়ে অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন। তখন তিনি তাঁর কন্যা উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসা (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ (আরবী*********************************)

মেয়েলোক স্বামী ছাড়া বেশির ভাগ কদিন পর্যন্ত ধৈর্য ধরে থাকতে পারে?

হযরত হাফসা বললেনঃ (আরবী************) –‘চার মাস’। তখন হযরত উমর বললেনঃ

(আরবী***********************************************************)

সৈন্যদের মধ্যে কাউকে আমি চার মাসের অধিক বাইরে আটকে রাখব না।

(আরবী**********************************)

তিনি খলীফাতুল মুসলিমীন হিসেবে সব সেনাধ্যক্ষকে লিখে পাঠালেনঃ

(আরবী**********************************)

এই (চার মাসের) অধিক কাল কোনো বিবাহিত ব্যক্তিই তার স্ত্রী-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন না থাকে।

এ ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, স্ত্রীর মনের কামনা-বাসনা ও আন্তরিক ভাবধারার প্রতি তীক্ষ্ণ লক্ষ্য রাখা স্বামীর অবশ্য কর্তব্য। আর স্ত্রীদের পক্ষে স্বামীহারা হয়ে বেশি দিন ধৈর্য ধরে থাকা সম্ভব নয় –এ কথার তার কিছুতেই ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াত থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। বলা হয়েছেঃ

(আরবী******************************************************)

যেসব লোক তাদের স্ত্রীদের সম্পর্কে কসম খেয়ে বসে যে, তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাত ইত্যাদি করবে না, তাদের জন্যে মাত্র চার মাসের মেয়াদ অপেক্ষা করা হবে। এর মধ্যে তারা যদি ফিরে আসে, তবে আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমা মার্জনাকারী ও অতিশয় দয়াবান। আর তারা যদি তালাক দেয়ারই সিদ্ধান্ত করে থাকে, তবে আল্লাহ সব শোনেন ও সব জানেন।

এ আয়াতে ‘ঈলা’ সম্পর্কে ফয়সালা দেয়া হয়েছে। ঈলা (আরবী********) শব্দের অর্থ হচ্ছে, (আরবী********) ‘কসম করে কোনো কাজ না করা –‘কোনো কাজ করা থেকৈ বিরত থাকা’ আর ইসলামী শরীয়তের ভাষায় এর অর্থ হচ্ছেঃ

(আরবী***********************************************)

কসম করে স্ত্রীর সাথে যৌন সঙ্গম না করা –স্ত্রীর সাথে যৌন সঙ্গম করা থেকে বিরত থাকা।

আয়াতে বলা হয়েছেঃ যারা স্ত্রীর সাথে যৌন সঙ্গম না করার কিরা করবে তাদের জন্যে চার মাসের অবসর। এ চার মাস অতিবাহিত হবার পরে হয় সে স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করে তাকে ফিরিয়ে নেবে, আর না হয় তালাক দিয়ে তাকে চিরতরে বিদায় করে দেবে।

(আরবী**********************************************************)

আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

আল্লাহ তা’আলা স্ত্রীর ক্ষতি হয় এমন কাজ বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই এই মেয়াদের সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েচেন। জাহিলিয়াত যুগে লোকেরা এক বছর, দুই বছর কি ততোদিক কালের জন্য ‘ঈলা’ করত আর তাদের উদ্দেশ্য হতো স্ত্রীলোককে ক্ষতিগ্রস্ত করা। এসব ক্ষতি-লোকসানের পথ বন্ধ করার এবং স্ত্রীলোকদের প্রতি পুরুষের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত করানোর উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা এ আয়াদের কথাগুলো বলে দিয়েছেন।

স্বামী-স্ত্রীর গোপন কথা প্রকাশ না করা

স্বামীর ওপর স্ত্রীর অধিকার হচ্ছে এই যে, সে স্ত্রীর গোপন কথা অপরের নিকট প্রকাশ করে দেবে না। নবী করীম (স) তীব্র ভাষায় নিষেধ করেছেন এ ধরনের কোনো কথা প্রকাশ করতে। বলেছেনঃ

(আরবী*******************************************************************)

যে স্বামী নিজ স্ত্রীর সাথে মিলিত হয় ও স্ত্রী মিলিন হয় তার স্বামীর সাথে, অতঃপর সে তার স্ত্রীর গোপন কথা প্রকাশ করে দেয় –প্রচার করে, সে স্বামী আল্লাহর নিকট মর্যাদার দিক দিয়ে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি।

অর্থাৎ স্বামী যাবতীয় গোপন বিষয়ে অবহিত হয়ে থাকে, তার সাথে যৌন মিলন সম্পন্ন করে, স্ত্রী নিজকে –নিজের পূর্ণ সত্তা –দেহ ও মনকে স্বামীর নিকট উন্মুক্ত করে দেয়। এমতাবস্থায় স্বামী যদি স্ত্রীর যাবতীয় গোপন বিষয় অবহিত হয়ে তা অপর লোকের নিকট প্রকাশ করে দেয়, তবে তার অপেক্ষা নিকৃষ্ট ব্যক্তি আর কেউ হতে পারে না। আর আল্লাহর দৃষ্টিতেও এ ব্যক্তির মর্যাদা নিকৃষ্টতম হতে বাধ্য। কেননা এর মতো হীন ও জঘন্য কাজ আর কিছু হতে পারে না। ইমাম নববীর মতে এ কাজ হচ্ছে হারাম।

তিনি উক্ত হাদীসের ভিত্তিতে বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************)

স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের মধ্যে যৌন-সম্ভোগ সম্পর্কিত গোপন বিষয় ও ঘটনা প্রকাশ করা এ হাদীসে সম্পূর্ণরূপে হারাম করে দেয়া হয়েছে।

একদিন রাসূলে করীম (স) নামাযের পরে উপস্থিত সকল সাহাবীকে বসে থাকতে বললেন এবং প্রথমে পুরুষদের লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলেনঃ

(আরবী************************************************************)

তোমাদের মধ্যে এমন পুরুষ কেউ আছে নাকি, যে তার স্ত্রীর নিকট আসে, ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়, তারপর বের হয়ে এসে লোকদের সাথে কথা বলে ও বলে দেয়ঃ আমি আমার স্ত্রীর সাথে এই করেছি, এই করেছি? …..হাদীস বর্ণনাকারী বলেছেন –এ প্রশ্ন শুনে সব সাহাবীই চুপ থাকলেন।

তারপরে মেয়েদের প্রতি লক্ষ্য করে তাদের নিকট প্রশ্ন করলেনঃ

(আরবী*****************************************)

তোমাদের মধ্যে এম নকেউ আছে নাকি, যে স্বামী-স্ত্রীর মিলন রহস্যের কথা প্রকাশ করে ও অন্যদের বলে দেয়?

তখন এক যুবতীয় মেয়ে বলে উঠলঃ

(আরবী*******************************************)

আল্লাহর শপথ, এই পুরুষরাও যেমন সে কথা বলে দেয়, তেমিন এই মেয়েরাও তা প্রকাশ করে।

তখন নবী করীম (স) বললেনঃ

(আরবী**********************************************************************)

তোমরা কি জানো, এরূপ যে করে তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে, সে যেন একটি শয়তান, সে তার সঙ্গী শয়তানের সাথে রাজপথের মাঝখানে সাক্ষাত করলো, অমনি সেখানে ধরেই তার দ্বারা নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করে নিল। আর চারদিকে তাদের তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকল।

এ পর্যায়ে দুটি হাদীসের ভিত্তিতে ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী************************************************************************)

এ দুটি হাদীসই প্রমাণ করছে যে, স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গম কার্য প্রসঙ্গে যত কিছু এবং যা কিছু ঘটে থাকে, তার কোনো কিছু প্রকাশ করা –অন্যদের কাছে বলে দেয়া সম্পূর্ণ হারাম।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার আদান-প্রদান নয়, হয় পারস্পরিক মনের গোপন কথা বলাবলি। একজন তো অকৃত্রিম আস্থা ও বিশ্বাস নিয়েই অপর জনকে তা বলেছে, এখন যদি কেউ অপর কারো কথা কিংবা যৌন- মিলন সংক্রান্ত কোনো রহস্য অন্য লোকদের কাছে বলে দেয়, তা হলে একদিকে যেমন বিশ্বাস ভঙ্গ হলো অপরদিকে লজ্জার কারণ ঘটল। এই কারণে ইসলামের এ কাজকে সম্পূর্ণ নিষেধ করে দেয়া হয়েছে।

বস্তুত একদন যদি তাদের স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসার কথা বাইরের কোনো লোক-নারী বা পুরুষকে –বলে দেয়, তাহলে শ্রোতার মনে সেই স্ত্রী বা পুরুষের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আর যদি কেউ যৌন সঙ্গম কার্যের বিবরণ অন্য লোকের সামনে প্রকাশ করে, তাহলে তার গোপনীয়তা বিলুপ্ত হয়, গুপ্ত ব্যাপারাদি উন্মুক্ত ও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। কোনো নেকবখত স্ত্রীর দ্বারাও যেমন এ কাজ হতে পারে না, তেমনি কোনো আল্লাহ ভীরু ব্যক্তির দ্বারাও এ কাজ সম্ভব নয়। বিশেষভাবে মেয়েরাই এ ব্যাপারে অগ্রসর হয়ে থাকে বলে কুরআনে তাদের গুণাবলীর বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************************************)

তারা অতিশয় বিনীতা, অনুগতা অদৃশ্য কাজের হেফাযতকারিণী –আল্লাহর হেফাযতের সাহায্যে।

স্ত্রীর খোরপোশ সরবরাহের দায়িত্ব স্বামীর

স্ত্রীর শোভনীয় মান অনুপাতে খোরপোশ নিয়মিত সরবরাহ করা স্বামীরই কর্তব্য, যেন সে নির্লিপ্তভাবে স্বামীর ঘর-সংসার পরিচালন ও সংরক্ষণ এবং সন্তান প্রসব ও লালন-পালনের কাজ সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন করতে পারে।

এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************)

যে লোককে অর্থ-সম্পদের সাচ্ছন্দ্য দান করা হয়েছে, তার কর্তব্য সেই হিসেবেই তার স্ত্রী-পরিজনের জন্যে ব্যয় করা। আর যার আয়-উৎপাদন স্বল্প পরিসর ও পরিমিত, তার সেভাবেই আল্লাহর দান থেকে খরচ করা কর্তব্য। আল্লাহ প্রত্যেকের ওপর তার সামর্থ্য অনুসারেই দায়িত্ব অর্পন করে থাকেন। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী**************************************************************)

এ আয়াতে আদেশ করা হয়েছে সচ্ছল অবস্তায় লোকদেরকে যে, তারা দুগ্ধদায়িনী স্ত্রীদের জন্যে তাদের স্বাচ্ছন্দ্য অনুপাতে বহন করবে। আর যাদের রিযিক নিম্নতম প্রয়োজন মতো কিংবা সংকীর্ণ সচ্ছল নয়, তারা আল্লাহর দেয়া রিযিক অনুযায়ীই খরচ করবে। তার বেশি করার কোনো দায়িত্ব তাদের নেই।

স্ত্রীদের জন্যে খরচ বহনের কোনো পরিমাণ শরীয়তে নির্দিষ্ট আছে কিনা –এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মত রয়েছে। ইমাম মালিক ও ইমাম আহমাদ বলেছেনঃ

(আরবী*****************************************************)

স্ত্রীর ব্যয়ভারের কোনো পরিমাণ শরীয়তে নির্দিষ্ট নয়, বরং তা বিচার-বিবেচনার ওপরই নির্ভর করা হয়েছে। এ ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের অবস্থা বিবেচনীয়। সচ্ছল অবস্থায় স্ত্রীর জন্যে সচ্ছল অবস্থায় স্বামী সচ্ছল লোকদের উপযোগী ব্যয় বহন করবে। অনুরূপভাবে অভাবগ্রস্ত স্ত্রীর জন্যে অভাবগ্রস্ত স্বামী ভরণ-পোষনের নিম্নতম দায়িত্ব পালন করবে।

উপরোক্ত আয়াতের শেষাংশ প্রমাণ করছে যে, সামর্থ্যের বেশি কিছু করা স্বামীর পক্ষে ওয়াজিব নয়। ইমাম আবূ হানীফারও এই মত। আল্লামা ইবনুল হুম্নান লিখেছেনঃ স্বামী যদি গরীব হয়, আর স্ত্রী হয় সচ্ছল অবস্থায়, তাহলে স্বামী গরীব-লোকদের উপযোগী ভরণ-পোষণ দেয়ার জন্যে দায়িত্বশীল। কেননা স্ত্রী নিজে সচ্ছল অবস্থার হলেও সে যখন গরীব স্বামী গ্রহণ করতে রাজি হয়েছে, তখন সে প্রকারান্তরে গরীবলোক-উপযোগী খোরপোশ গ্রহণেও রাজি হয়েছে বলতে হবে।

পক্ষান্তরে স্বামী যদি সচ্ছল অবস্থার হয়, আর যদি স্ত্রী হয় গরীব অবস্থার, তাহলে সে সচ্ছল লোক উপযোগী ব্যয়ভার লাভ করতে পারবে।

স্বামীর অবস্থা অনুযায়ী স্ত্রীকে খোরপোশ দেয়ার কথা কুরআন থেকে প্রমাণিত। হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেনঃ আবূ সুফিয়ানের স্ত্রী –উৎবা কন্যা –রাসূলে করীম (স)-এর সমীপে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলেনঃ

(আরবী********************************************)

হে আল্লাহর রাসূল, আমার স্বামী আবূ সুফিয়ান একজন কৃপণ ব্যক্তি; সে আমার ও আমার সন্তানদের প্রয়োজন পরিমাণ ভরণ-পোষণ দেয় না, তবে আমি তাকে না জানিয়ে প্রয়োজন মতো গ্রহণ করতে থাকি। এ কাজ জায়েয কিনা?

তখন নবী করীম (স) তাকে বললেনঃ

(আরবী*******************************************************************)

সাধারণ প্রচলন অনুযায়ী তোমার ও তোমার সন্তানাদির প্রয়োজন পরিমাণ ভরণ-পোষণ তুমি গ্রহণ করতে পারো।

এ হাদীস থেকে জানা যায় যে, আবূ সুফিয়ান সচ্ছল অবস্থাসম্পন্ন ছিল, রাসূলে করীম (স) জানতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে কেবলমাত্র কৃপণতার কারণে নিজ স্ত্রী ও পুত্র-কন্যার প্রয়োজন পরিমাণ ভরণ-পোষণ দিত না। সেই কারণে রাসূলে করীম (স) তার স্ত্রীকে প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। (আরবী*********)

ইমাম শাফিয়ীর মতে এই পরিমাণ শরীয়ত কর্তৃক নির্দিষ্ট বলে এ ব্যাপারে বিচার-বিবেচনার কোনো অবকাশ নেই। আর এ ব্যাপারে স্বামীর অবস্থানুযায়ীই ভরণ-পোষনের ব্যবস্থা করতে হবে।

স্ত্রীর যদি খাদেম-চাকরের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে স্বামীর সামর্থ্য থাকলে খাদেম-চাকর যোগাড় করে দেয়া স্বামীর কর্তব্য। এ ব্যাপারে ফিকাহবিদগণ সম্পূর্ণ একমত। ইমাম মুহাম্মাদ বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************************)

একাধিক খাদেম-চাকরের খরচ বহন করা অসচ্ছল অবস্থার স্বামীর জন্যেও ওয়াজিব হবে।

একজন খাদেম-চাকরের প্রয়োজন হলে তাও সংগ্রহ করা ও খরচ বহন করা স্বামীর কর্তব্য কিনা –এ সম্পর্কে ফিকাহবিদগণ একমত নন। ইমাম মালিকের মতে দুই বা তিনজন খাদেমের প্রয়োজন হলে তার ব্যবস্থা করা স্বামীর কর্তব্য। আর ইমামা আবূ ইউসুফ বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************************)

এমতাবস্থায় স্বামীর কর্তব্য হবে শুধু দুজন খাদেমের ব্যবস্থা করা ও খরচ বহন করা। তাদের একজন হসে ঘরের ভিতরকার জরুরী কাজ-কর্ম করার জন্যে। আর অপরজন হবে ঘরের বাইরে জরুরী কাজ সম্পন্ন করার জন্যে।

গরীব ও অসচ্ছল স্বামীদের সান্ত্বনা দানের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা উক্ত আয়াতের পরই বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************************)

আল্লাহ অসচ্ছলতা ও দারিদ্র্যের পক্ষে অবশ্যই সচ্ছলতা ও প্রাচুর্য সৃষ্টি করে দেবেন।

এ পর্যায়ে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতটিও পাঠ আবশ্যক। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী************************************************)

সন্তানের পিতার কর্তব্য হচ্ছে প্রসূতির খাবার ও পরার প্রচলিত মানে ব্যবস্থা করা। কোনো ব্যক্তির ওপরই তার সামর্থ্যের অধিক বোঝা চাপানো যেতে পারে না।

এ আয়াতের ভিত্তিতে ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************)

সন্তান ও স্ত্রীর ব্যয়ভার, খোরাক ও পোশাক সংগ্রহ ও ব্যবস্থা করা সন্তানের পিতার পক্ষে ওয়াজিব। আর তা করতে হবে সাধারণ প্রচলন অনুযায়ী –যা লোকেরা সাধারণত করে থাকে। এ ব্যাপারে কোনো পিতাকেই তার শক্তি-সামর্থ্যের বাইরে –তার পক্ষে কঠিন ও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে –এমন মান বা পরিমাণ তার ওপর চাপানো যাবে না।

এ আয়াত থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, সন্তান গর্ভে ধারণ, সন্তান প্রসব ও লালন-পালন করা স্ত্রীর কাজ; আর তার সন্তানের ভরণ-পোষণ ও যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব স্বামীর। এর ফলে স্ত্রীরা খোর-পোশের যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে গেল। এর প্রভাব তাদের মনে ও জীবনে সুদূরপ্রসারী হবে। রাসূলে করীম (স) স্বামীদের লক্ষ্য করে তাই এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী*******************************************************************)

স্ত্রীদের খাবার ও পরার ব্যবস্থা করার ব্যাপারে তোমরা অবশ্যই তাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবে।

অর্থাৎ কেবলমাত্র মোটা ভাত ও মোটা কাপড়ের ব্যবস্থা করেই ক্ষান্ত হরে চলবে না। এ ব্যাপারে তাদের প্রতি কঠোরতা অবলম্বনের বদলে সহানুভূতিমূলক নীতি গ্রহণ করবে।

আলোচনার সারকথা হচ্ছে এই যে, স্বামী-স্ত্রীতে অতি স্বাভাবিকভাবেই কর্মবণ্টন করে দেয়া হয়েছে। যে যৌন মিলনের সুখ ও মাধুর্য স্বামী-স্ত্রী উভয়েই সমানভাবে ভোগ করে, তার সুদূরপ্রসারী পরিণতি কেবল স্ত্রীকেই ভোগ করতে হয় প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়ম অনুযায়ী। পুরুষকে তার কোনো ঝুঁকিই গ্রহণ করতে হয় না। এ হচ্ছে এক স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। কাজেই স্ত্রী প্রকৃতির এই দাবি পূরণে সতত প্রস্তুত থাকবে, আর স্বামী তার যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের জন্যে দায়ী হবে। মূল ব্যাপারে সমান অংশীদারিত্বের এটা অতি স্বাভাবিক দাবি।

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে একথাও প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রীর চলতি নিয়মে কেবল খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করে দেওয়াই দাম্পত্য জীবনে মাধুর্য সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট নয়, সেই সঙ্গে স্বামীর তওফীক অনুযায়ী তারও বেশি এবং অতিরিক্ত হাত খরচাও স্ত্রীর হাতে তুলে দেয়া স্বামীর কর্তব্য; যেন স্ত্রী নিজ ইচ্ছা, বাসনা-কামনা ও রুচি অনুযায়ী সময়ে-অসময়ে খরচ করতে পারে। এতে করে স্ত্রীর মনে স্বামীর প্রতি ভালোবাসা, আস্থা ও নির্ভরশীলতা অত্যন্ত দৃঢ় ও গভীর হবে। স্বামী সম্পর্কে তার মনে জাগবে না কোনো সংশয়, উদ্বেগ বা বীতরাগ। (আরবী**************)

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালনে অক্ষমই হয়ে পড়ে তাহলে তখন ইসলামী সরকার সে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেবে। নবী করীম (স)-কে এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে, সে তার স্ত্রীর ভরণ-পোষণ করতে পারে না, এমতাবস্থায় কি করা যেতে পারে? তখন নবী করীম (স) বলেছিলেনঃ

(আরবী**********) –এ দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদ করে দিতে হবে।

দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারূক (রা) তাঁর খিলাফতকালে সৈন্যবাহিনীর বিভিন্ন প্রধানের প্রতি ফরমান পাঠিয়েছিলেন এই বলেঃ

(আরবী******************************************************)

হয় তারা তাদের স্ত্রীদের ভরণ-পোষনের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করবে, না হয় তাদের তালাক দিয়ে দেবে।

কিন্তু স্বামীর দৈন্য ও আর্থিক অনটনের সময় স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য করা কতখানি সমীচীন এবং রাসূলে করীম (স) ও উমর ফারূকের উক্ত কথারই বা তাৎপর্য কি, সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মতের উল্লেখ করা হয়েছে।

একটি মত এই –হ্যাঁ, এরূপ অবস্থায় –যখন স্বামী স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ক্ষমতা রাখে না তখন –বিয়ে ভেঙ্গে উভয়কেই মুক্ত করে দেয়া সমীচীন। হযরত আলী, হযরত উমর ফারূক, হযরত আবূ হুরায়রা (রা) প্রমুখ সাহাবী, বহু সংখ্যক তাবেয়ী, ফিকাহবিদ এবং ইমাম মালিক, শাফিয়ী ও ইমাম আহমাদ প্রমুখ ফকীহর এই মত বলে জানা গেছে। দলীল হিসেবে তাঁরা যেমন পূর্বোক্ত কথা দুটির উল্লেখ করেছেন, তেমনি ইসলামের স্থায়ী ও সর্বজনস্বীকৃত (আরবী********) “না, কারো ক্ষতি করা হবে, না কাউকে অপর কারো ক্ষতি করতে দেয়া হবে” –এই মূলনীতিও পেশ করেছেন অর্থাৎ অসচ্ছল ও অভাব-অনটনের সময় স্ত্রীকে স্বামীর সঙ্গে দৈন্য ও দুঃখ-দুর্ভোগ পোহাতে বাধ্য করা কোনো ইনসাফের কথা হতে পারে না। এ ছাড়া আরও একটি কথা রয়েছে, আর তা হচ্ছে এই যে, মূলত স্ত্রীর সাথে সহবাস ও যৌন সঙ্গম হচ্ছে স্ত্রীর যাবতীয় খরচ বহনের বিনিময়। কাজেই বিনিময়ের দুটি জিনিসের মধ্যে একটি অনুপস্থিতিতে অপরটির উপস্থিতি ধারণা করা যায় না। এরূপ অবস্থায় স্ত্রীর অবশ্য ইখতিয়ার থাকা উচিত –হয় সে অভাবগ্রস্ত স্বামীর সাথে নিজ ইচ্ছায় থাকবে, আর থাকতে না চাইলে বিবাহ-বিচ্ছেদ করে তার মুক্তির পথ উন্মুক্ত করে দিতে হবে।

এঁদের আরও দুটি দলীল রয়েছে। একটি এই যে, ক্রীতদাসকে খেতে-পরতে দিতে না পারলে রাসূলে করীম (স) নির্দেশ দিয়েছেন তাকে বিক্রয় করে দিতে। তাহলে স্ত্রীকে খেতে পরতে না দিতে পারলে তাকে তালাক দিয়ে মুক্ত করে দেয়া হবে না কেন? আর যদি স্বামী নপুংসক হয়ে যায়, তাহলে তাদেরও বিয়ে-বিচ্ছেদ করে স্ত্রীর মুক্তির পথ প্রশস্ত করাই ইসলামের আইন। খেতে পরতে দিতে না পারা স্বামীর নপুংসকতার শামিল, তখণও অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের নীতিই স্বাভাবিক।

তাঁদের দ্বিতীয় দলিল হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার নিম্নোক্ত আয়াতাংশঃ

(আরবী*********************************************************)

হয় যথাযথ নিয়মে ও ভালোভাবে স্ত্রীকে রাখবে, নয় ভালোভাবে ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করে তাকে ছেড়ে দেবে।

এ আয়াতের ভিত্তিতে তাঁরা বলেন যে, স্ত্রীকে খাওয়া-পরা না দিয়ে রাখা নিশ্চয়ই মারুফ ভাবে রাখা নয়। বরং এরূপ অবস্থায় পড়ে থাকতে স্ত্রীকে বাধ্য করা হলে তদপেক্ষা অধিক কষ্টদান ও ক্ষতি সাধন আর কিছু হতে পারে না।

এ পর্যায়ে দ্বিতীয় মত হচ্ছে, স্বামীর অভাব-অনটনের সময় স্ত্রীকে তালাক দিতে বাধ্য করা কিংবা বিচার বিভাগের সাহায্যে উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো অত্যন্ত মর্মান্তিক কাজ সন্দেহ নেই। এ মতের অনুকূলে আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী পেশ করা হয়। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী*******************************************************************)

যার রিযিক পরিমিত হয়ে পড়েছে সে যেন আল্লাহর দেয়া সম্পদ থেকে ব্যয় করে। আল্লাহ একজনকে ততটাই দায়িত্ব দেন, যতটার সম্পদ তিনি তাকে দিয়েছেন।

এ আয়াত অনুযায়ী অভাবের সময় স্ত্রীর ভরণ-পোষণ সংগ্রহের ব্যাপারে স্বামীর আদৌ কোনো দায়িত্ব থাকে না। কাজেই কোনো সময় তা না দিতে পারলে সেজন্যে যে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে হবে কিংবা তাকে তালাক দিতে বাধ্য করা হবে –এমন কোনো কথাই হতে পারে না। হযরত আয়েশা ও হাফসা (রা) যখন রাসূলে করীম (স)-এর নিকট নিজেদের খরচের দাবি জানিয়েছিলেন, তখন হযরত আবূ বকর (আয়েশার পিতা) ও হযরত উমর (হাফসার পিতা) অত্যন্ত ক্রোধ এবং রাগ প্রকাশ করেছিলেন ও নিজ নিজ কন্যাকে রাসূলের সামনেই মারধেঅর করতে চেয়েছিলেন। অথচ দাবি অনুযায়ী খরচ দিতে না পারায় তাঁরা কেউই রাসূলের নিকট তালাকের দাবি করেন নি। (আরবী***************************)

এ প্রসঙ্গে শেষ কথা এই যে, পারিবারিক যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব ইসলামী শরীয়তে কেবল স্বামীর ওপরই অর্পণ করা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে স্ত্রীকে এ অধিকার দেয়া হয়নি যে, সে স্বামীকে সর্বাবস্থায়ই খোরপোশের বিশেষ একটা নির্দিষ্ট মান রক্ষা করে চলতে বাধ্য করবে। পূর্বোক্ত আয়াতের ভিত্তিতে স্বামী তার সামর্থ্য ও আর্থিক ক্ষমতানুযায়ী যে কোনো একটি মান (Standard) রক্ষার জন্যে দায়ী মাত্র। কোনো বিশেষ মান রক্ষার জন্যে –তাও আবার সকল অবস্থায় –তাকে দায়ী করা হয়নি।

পারিবারিক জীবনের আর্থিক দায় সম্পর্কিত এ সম্যক আলোচনা সম্বন্ধে এ কথা সুস্পষ্ট ভাষায়ই বলা যায় যে, ইসলামের এ ব্যবস্থা স্বভাব ও প্রকৃতি-ব্যবস্থার স্থায়ী নিয়মের সাথে পুরোপুরি সমঞ্জস। তা সত্ত্বেও যে সব স্বামী স্ত্রীদের বাধ্য করে তাদের স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থোপার্জনের দায়িত্বও পালন করতে কিংবা যারা স্ত্রীদেরকে সন্তান গর্ভে ধারণ, সন্তান প্রসব ও লালন-পালনের ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি দিয়ে পুরুষের মতোই অর্থোপার্জনের যন্ত্ররূপে খাটাতে ইচ্ছুক, তারা যে স্বভাব ও প্রাকৃতিক ব্যবস্থার দাবির সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ করে, তাতে কোনোই সন্দেহ থাকতে পারে না।

নারী প্রকৃতির প্রতি রাখার নির্দেশ

এ প্রসঙ্গে রাসূলে করীম (স)-এর একটি হাদীস উল্লেখ করা যাচ্ছে। এ হাদীসে তিনি স্ত্রীলোকদের প্রকৃতিগত এক মৌলিক দুর্বলতার প্রতি বিশেষ খেয়াল রেখে চলবার জন্যে স্বামীদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************************)

মেয়েলোক সাধারণত স্বামীদের অকৃতজ্ঞ হয়ে থাকে এবং তাদের অনুগ্রহকে করে অস্বীকার। তুমি যদি জীবন ভরেও কোনো স্ত্রীর প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করো, আর কোনো এক সময় যদি সে তার মর্জী-মেজাজের বিপরীত কোনো ব্যবহার তোমার মাঝে দেখতে পায় তাহলে তখনি বলে ওঠেঃ

‘আমি তোমার কাছে কোনোদিনই সামান্য কল্যাণও দেখতে পাইনি’।

রাসূলের এ কথা থেকে একদিকে যেমন নারীদের এক মৌলিক প্রকৃতিগত দোষের কথা জানা গেল, তেমনি এ হাদীস স্বামীদের জন্যেও এক বিশেষ সাবধান বাণী। স্বামীরা যদি নারীদের এ প্রকৃতিগত দোষের কথা স্মরণ না রাখে, তাহলেই পারিবারিক জীবনে অতি তাড়াতাড়ি ভাঙ্গন ও বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এজন্যে পুরুষদের অবিচল নিষ্ঠা ও অপরিসীম ধৈর্য ধারণের প্রয়োজন রয়েছে এবং এ ধরনের নাজুক পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করে পারিবারিক জীবনের মাধুর্য ও মিলমিশকে অক্ষুণ্ন রাখা পুরুষদেরই কর্তব্য।

এ পর্যায়ে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাসূলে করীম (স)-এর সেই ফরমান, যা তিনি বিদায় হজ্জের বিরাট সমাবেশে মুসলিম জনতাকে লক্ষ্য করে এরশাদ করেছিলেন। আবূ দায়ূদের বর্ণনা মতে সে ফরমানের ভাষা নিম্নরূপঃ

(আরবী*********************************************************)

হে মুসলিম জনতা! স্ত্রীদের অধিকার সম্পর্কে তোমরা আল্লাহকে অবশ্যই ভয় করতে থাকবে। মনে রেখো, তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসেবে পেয়েছ এবং আল্লাহর কালেমার সাহায্যে তাদের দেহ ভোগ করাকে নিজেদের জন্যে হালাল করে নিয়েছ। আর তাদের ওপর তোমাদের জন্যে এ অধিকার নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, সে কোনো অবাঞ্ছিত ব্যক্তির দ্বারা তোমাদের দুজনের মিলন-শয্যাকে মলিন ও দলিত কলংকিত করবে না।

এই শেষ বাক্যের অর্থ কেবল এতটুকুই নয় যে, স্ত্রীরা ভিন্ন পুরুষদের স্বামীর শয্যায় গ্রহণ করবে না বরং-

(আরবী******************************************************)

স্বামীর অনুতমি ব্যতিরেকে স্বামীর ঘরে অপর কাউকে প্রবেশ করতে পর্যন্ত দেবে না।

গুরুতর বিষয়ে স্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ

পারিবারিক –এমন কি সামাজিক ও জাতীয় –রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গুরুতর ব্যাপারসমূহ সম্পর্কে স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করা এবং তার নিকট সব অবস্থার বিবরণ দান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার মতামত গ্রহণ করার রেওয়াজ চালু করা দাম্পত্য জীবনের মাধুর্যের পক্ষে বিশেষ অনুকূল। পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ের যাবতীয় বিষয়ে ঘরোয়া পরামর্শ অনেক সময়ই সার্বিকভাবে কল্যাণকর হয়ে থাকে। এবং তাতে করে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ঐকান্তিক আস্থা-বিশ্বাস ও অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রমাণিত হয়। আর স্বামীর প্রতিও স্ত্রীর মনে ভালোবাসা ও আন্তরিক আনুগত্যমূলক ভাবধারা গভীরতর হয়। শুধু তা-ই নয়, ঘরের মেয়েলোকদের নিকটও যে অনেক সময় ভালো ভালো বুদ্ধি পাওয়া যায়, পাওয়া যায় জটিল বিষয়াদির সুষ্ঠু সমাধানের শুভ পরামর্শ, তাও তার মাধ্যমে প্রতিভাত হয়ে পড়ে। ফলে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক মতের ভিত্তিতে গুরুতর কাজসমূহ সম্পন্ন করাও সম্ভভ হয় অতি সহজে এবং অনায়াসে। কুরআন মজীদে এ কারণেই স্ত্রীর সাথে সর্ব ব্যাপারেই পরামর্শ করার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তার বড় প্রমাণ এই যে, সন্তানকে কতদিন দুধ পান করানো হবে তা স্বামী-স্ত্রীতে পরামর্শের ভিত্তিতে নির্ধারণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*******************************************************************************)

স্বামী ও স্ত্রী যদি পরস্পর পরামর্শ ও সন্তোষের ভিত্তিতে সন্তানের দুধ ছাড়াতে ইচ্ছা করে, তবে তাতে কোনো দোষ হবে না তাদের।

আল্লামা আহমাদুল মুস্তফা আল-মারাগী এ আয়াতের ভিত্তিতে লিখেছেনঃ

(আরবী**********************************************************)

কুরআন মজীদ সন্তান পালনের মতো অতি-সাধারণ ব্যাপারেও পরামর্শ প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং পিতামাতার একজনকে অপর জনের ওপর জোর-জবরদস্তি করার অনুমতি দেয়া হয়নি –এ কথা যদি তোমরা চিন্তা ও লক্ষ্য করো, তাহলে গুরুতর বিপজ্জনক ও বিরাট কল্যাণময় কাজ-কর্ম ও ব্যাপারসমূহ পারস্পরিক পরামর্শের গুরুত্ব সহজেই বুঝতে পারবে।

রাসূলে করীম (স)-এর জীবনে এ পর্যায়ের বহু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। সর্ব প্রথম অহী লাভ করার পর তাঁর হৃদয়ে যে ভীতি ও আতংকের সৃষ্টি হয়েছিল, তার অপনোদনের জন্যে তিনি ঘরে গিয়ে স্বীয় প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা)-এর নিকট সব অবস্থার বিবরণ দান করেন। বলেছিলেনঃ

(আরবী***************************************************)

আমি এই ব্যাপারে নিজের সম্পর্কে বড় ভীত হয়ে পড়েছি।

এ কথা শুনে সঙ্গিনী হযরত খাদীজা (রা) তাঁকে বলেছিলেনঃ

(আরবী*************************************************************)

আল্লাহ আপনাকে কখনই এবং কোনোদিই লজ্জিত করবেন না। কেননা আপনি তো ছেলায়ে (আত্মীয়তার সম্পর্ক)-র রেহমী রক্ষা করেন, অপরের বোঝা বহন করে থাকেন, কপর্দহীন গরীবদের জন্যে আপনি উপার্জন করেন, মেহমানদারী রক্ষা করেন, লোকদের বিপদে-আপদে তাদের সাহায্য করে থাকেন, এজন্যে আল্লাহ কখনই শয়তানদের আপনার ওপরে জয়ী বা প্রভাবশালী করে দেবেন না। কোনো অমূলক চিন্তা-ভাবনাও আপনার ওপর চাপিয়ে দেবেন না। আর এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ আপনাকে আপানার জাতির লোকজনের হেদায়েতের কার্যের জন্যেই বাছাই করে নিয়েছেন।

হযরত খাদীজার এ সান্ত্বনা বাণী রাসূলে করীম (স)-এর মনের ভার অনেকখানি লাঘব করে দেয়। আর এ ধরনের অবস্থায় প্রত্যেক স্বামীর জন্যে তার প্রিয়তমা ও সহানুভূতিসম্পন্না স্ত্রীর আন্তরিক সান্ত্বনাপূর্ণ কথাবার্তা অনেক কল্যাণ সাধন করে থাকে।

হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে যখন মক্কা গমন ও বায়তুল্লাহর তওয়াফ করা সম্ভব হলো না, তখন রাসূলের সঙ্গে অবস্থিত চৌদ্দশ সাহাবী নানা কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ সময়ে রাসূল (স) তাঁদেরকে এখানেই কুরবানী করতে আদেশ করেন। কিন্তু সাহাবীদের মধ্যে তাঁর এ নির্দেশ পালনের কোনো আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না। এ অবস্থা দেখে রাসূলে করীম (স) বিস্মিত ও অত্যন্ত মর্মাহত হন। তখন তিনি অন্দরমহলে প্রবেশ করে তাঁর সঙ্গে অবস্থানরতা তাঁর স্ত্রী হযরত উম্মে সালমা (রা)-এর কাছে সব কথা খুলে বললেন। তিনি সব কথা শুনে সাহাবাদের এ অবস্থার মনস্তাত্ত্বিক কারণ বিশ্লেষণ করেন এবং বলেনঃ

(আরবী*******************************************************)

হে আল্লাহর রাসূল! আপনি নিজেই বের হয়ে পড়ুন এবং যে কাজ আপনি করতে চান তা নিজেই শুরু করে দিন। দেখবেন, আপনাকে সে কাজ করতে দেখে সাহাবিগণ নিজ থেকেই আপনার অনুসরণ করবেন এবং সে কাজ করতে লেগে যাবেন।

এহেন গুরুতর পরিস্থিতিতে বাস্তবিকই হযরত উম্মে সালমার পরামর্শ বিরাট ও অচিন্ত্যপূর্ব কাজ করেছিল। এমনিভাবে সব স্বামীই তাদের স্ত্রীদের কাছ থেকে এ ধরনের কল্যাণময় পরামর্শ লাভ করতে পারে তাদের সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে।

স্ত্রীর কর্তব্য ও অধিকার

স্ত্রীদের অধিকারের ব্যাপারে ইসলাম পুরুষদের ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে, তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা ইতিপূর্বে পেশ করা হয়েছে অর্থাৎ পুরুষদের যা যা কর্তব্য স্ত্রীদের প্রতি, তাই হচ্ছে স্ত্রীদের অধিকার পুরুষদের ওপর। এক্ষণে আলোচনা করা হবে –স্ত্রীলোকদের ওপর পুরুষদের অধিকার –অন্য কথায় পুরুষদের প্রতি স্ত্রীদের কর্তব্য। বস্তুত একজনের যা কর্তব্য অপরের প্রতি, তাই হচ্ছে অপরজনের অধিকার তার প্রতি। উভয়ের প্রতি উভয়ের কর্তব্য যা তাই হচ্ছে উভয়ের প্রতি উভয়ের অধিকার।

আইনের পূর্ণতার দৃষ্টিতে বিচার করলেও একথা অস্বীকার করা যায় না যে, একদেশদর্শী, একপেশে ও একতরফা আইন বা বিধান কখনো পূর্ণ আইন হতে পারে না, পারে না তা সমগ্র মানবতার প্রতি কল্যাণকর হতে। যে আইন কেবল একচেটিয়াভাবে পুরুষের অধিকার ও কর্তৃত্বের কথা বলে, স্ত্ররি অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে যা নির্বাক কিংবা এর বিপরীত –যে আইন কেবল স্ত্রীদের অধিকারের কথা বলে, পুরুষদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে কোনো নির্দেশ দেয় না, তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই কারণেই ইসলাম এ ধরনের একপেশে ও একদেশদর্শী বিধান নয়।

এতে সন্দেহ নেই যে, নারী জন্মগতভাবেই দুর্বল, স্বাভাবিক আবেগ উচ্ছ্বাসের দিক দিয়ে ভারসাম্যহীন, দৈহিক আকার-আঙ্গিকের দৃষ্টিতেও পুরুষদের তুলনায় ক্ষীণ ও নাজুক, কোমল ও বলহীন। এজন্যে নারীর প্রতি অধিকার অনুগ্রহপূর্ণ দৃষ্টিদান এবং অধিক প্রেম ভালোবাসা পোষণ অপরিহার্য। কিন্তু তাই বলে তাদের পক্ষে উপযুক্ত ও জরুরী দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পণ করা থেকে তাদের নিষ্কৃতি দেয়া যেতে পারে না। কেননা তাহলে স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ের জীবন –সমষ্টিগত জীবন –অত্যন্ত তিক্ত ও কষ্টপূর্ণ হতে বাধ্য।

স্ত্রী ঘরের রাণী

পুরুষ ও নারীর জ্ঞান-বুদ্ধি, কর্মক্ষমতা ও দৈহিক-আঙ্গিকের স্বাভাবিক পার্থক্যের কারণে পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কর্মবণ্টনের নীতি পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করা হয়েছে। পুরুষকে করা হয়েছে কামাই-রোজগার ও শ্রম-মেহনতের জন্যে দায়িত্বশীল আর স্ত্রীকে করা হয়েছে ঘরের রাণী। পুরুষের জন্যে কর্মক্ষেত্র করা হয়েছে বাইরের জগত আর নারীর জন্যে ঘর। পুরুষ বাইরের জগতে নিজের কর্মক্ষমতা প্রয়োগ করে যেমন করবে কামাই-রোজগার, তেমনি গড়বে সমাজ-রাষ্ট্র, শিল্প ও সভ্যতা। আর নারী ঘরে থেকৈ একদিকে করবে ঘরের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা, অপরদিকে করবে গর্ভ ধারণ, সন্তান প্রসব, লালন ও ভবিষ্যতের উপযুক্ত নাগরিক গড়ে তোলার কাজ। এজন্যে নারীর সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী**************************************)

এবং নারী-স্ত্রী –তার স্বামীর ঘরের পরিচালিকা, রক্ষণাবেক্ষণকারিণী, কর্ত্রী।

এ হাদীসের (আরবী******) শব্দের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ

(আরবী**************************************************************)

(আরবী******) হচ্ছে হেফাযতকারী, রক্ষণাবেক্ষণকারী, আমানতদার, দায়িত্বের অধীন সব জিনিসের কল্যাণ সাধনের জন্যে একান্ত বাধ্য। যে ব্যক্তির দায়িত্বেই যে কোনো জিনিস দেয়া হবে, এমন প্রত্যেকেরই তেমন প্রত্যেকটি জিনিসে সুবিচার ও ইনসাফ করা এবং তার দ্বীনী ও দুনিয়াবী কল্যাণ সাধন করাই বিশেষ লক্ষ্য। এখন যার ওপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সে যদি তা পুরোপুরি পালন কর, তবে সে পূর্ণ অংশই লাভ করল, অধিকারী হলো বিরাট পুরস্কার লাভের আর যদি তা না করে, তবে দায়িত্বের প্রত্যেকটি জিনিসই তার অধিকার দাবি করবে।

আর দীর্ঘ হাদীসের ওপরে উদ্ধৃত অংশের ব্যাখ্যায় তিনি লিখেছেনঃ

(আরবী******************************************************)

আর ‘স্ত্রী স্বামীর ঘরের দায়িত্বশীলা’ হওয়ার মানে, স্বামীর ঘরের সুন্দর ও পূর্ণ ব্যবস্থাপনা করা, স্বামীর কল্যান কামনা ও তাকে ভালো কাজের পরামর্শ বা উপদেশ দেয়া এবং স্বামীর ধনমাল ও তার নিজের ব্যাপারে পূর্ণ আমানতদারী ও বিশ্বাসপরায়ণতা রক্ষঅ করাই স্ত্রীর কর্তব্য।

স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্যের কথা নিম্নোক্ত হাদীসে আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। নবী করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী**********************************************************)

তোমাদের জন্যে তোমাদের স্ত্রীদের ওপর নিশ্চয়ই অধিকার রয়েছে, আর তোমাদের স্ত্রীদের জন্যেও রয়েছে তোমাদের ওপর অধিকার। তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে এই যে, তারা তোমাদের শয্যায় এমন লোককে স্থান দেবে না যাকে তোমরা পছন্দ করো না। তোমাদের ঘরে এমন লোককেও প্রবেশ করার অনুমতি দেবে না, যাদের তোমরা পছন্দ করো না বলে নিষেধ করো।

আর তোমাদের ওপর তাদের অধিকার হচ্ছে, তোমরা তাদের ভরণ-পোষণ খুবই উত্তমভাবে বহন করবে!

স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্যসম্পন্না এ দাম্পত্য জীবন যে কতদূর গুরুত্বপূর্ণ এবং এ জীবনে স্ত্রীর যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তা ব্যাখ্যা করে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

দাম্পত্য জীবনের সম্পর্ক, সম্বন্ধ ও মিলনই হচ্ছে পারিবারিক জীবনের বৃহত্তম সম্পর্ক। এ সম্পর্কের ফায়দা সর্বাধিক, প্রয়োজন পূরণের দৃষ্টিতে তা অধিকতর স্বয়ংসম্পূর্ণ। কেননা আরব অনারবের সকল পর্যায়ের লোকদের মধ্যে স্থায়ী নিয়ম হচ্ছে এই যে, স্ত্রী সকল কল্যাণময় কাজে-কর্মে স্বামীর সাহায্যকারী হবে, তার খানাপিনা প্রস্তুতকরণ ও কাপড়-চোপড় পরিস্কার ও পরিপাটি করে রাখার ব্যাপারে সে হবে স্বামীর ডান হাত, তার মাল-সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও তার সন্তানদের লালন-পালন করবে এবং তার অনুপস্থিতিতে সে তার ঘরের স্থলাভিষিক্ত ও দায়িত্বশীলা।

ঘরের অভ্যন্তরে ভাগের যাবতীয় ব্যাপারের জন্যে প্রথমত ও প্রধানত স্ত্রীই দায়ী। তারই কর্তৃত্বে যাবতীয় ব্যপার সম্পন্ন হবে। এখানে তাকে দেয়া হয়েছে এক প্রকারের স্বাধীনতা। স্বামীর ঘর কার্যত তার নিজের ঘর, স্বামীর জিনিসপত্র ও ধন-সম্পদ স্ত্রীর হেফাযতে থাকবে। সে হবে আমানতদার, অতন্দ্র প্রহরী। কিন্তু স্বামীর ঘরের কাজকর্ম কি স্ত্রীকে তার নিজের হাতে সম্পন্ন করতে হবে? এ সম্পর্কে ইমাম ইবনে হাজমের একটি উক্তি দেখতে পাওয়া যায়। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************)

স্বামীর খেদমত করা –কোনো প্রকারের কাজ করে দেয়া মূলত স্ত্রীর কর্তব্য নয়, না রান্না-বান্নার আয়োজন করার ব্যাপারে; না রান্না করার ব্যাপারে; না সূতা কাটা; কাপড় বোনার ব্যাপারে; না কোনো কাজে।

ফিকাহিবদগণ এর কারণস্বরূপ বলেছেনঃ

(আরবী******************************************************)

কেননা বিয়ের আকদ হয়েছে স্ত্রীর সাথে যৌন ব্যবহারের সুখ ভোগ করার জন্যে। অতএব স্বামী তার কাছ থেকে অপর কোনো ফায়দা লাভ করার অধিকারী হতে পারে না।

অথচ আবূ সওর বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************)

সব ব্যাপারে স্বামীর খেদমত করাই স্ত্রীর কর্তব্য।

ইবনে হাজমের ‘মূলত কর্তব্য নয়’ কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা কোনো কাজ মূরত কর্তব্যভুক্ত না হলেও অনেক সময় তা না করে উপায় থাকে না। এজন্য আমরা রাসূল (স)-এর সময়কার ইসলামী সমাজে দেখতে পাই –স্ত্রীরা ঘরের যাবতীয় কাজ-কর্ম রীতিমত করে যাচ্ছে। নিজেদের হাতেই সব কাজ আঞ্জাম দিচ্ছে, ঘরের কাজ-কর্ম করতে গিয়ে নিদারুণ কষ্ট স্বীকার করছে, তবু সে কাজ ত্যাগ করেনি, কাজ করতে অস্বীকৃতিও জানায়নি। বলেনি –আমি কোনো কাজ করতে পারব না। রাসূল-তনয়া হযরত ফাতিমা (রা) ঘরের যাবতীয় কাজ করতেন, চাক্কি বা যাঁতা চালিয়ে গম পিষতেন, নিজ হাতে রুটি পাকাতেন। এ কাজে তাঁর খুবই কষ্ট হতো। এজন্যে একদিন তিনি তাঁর স্নেহময় পিতার কাছে অভিযোগ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। হযরত আসমা (রা) তাঁর স্বামীর সব রকমের খেদমত করতেন। তিনি নিজেই বলেছেনঃ

(আরবী********************************************)

আমি আমার স্বামী জুবাইরের সব রকমের খেদমত করতাম।

রাসূলে করীম (স)-এর যুগে ইসলামী সমাজের স্ত্রীরা স্বামীর খেদমত করতেন –এ কথা ঠিক। হযরত ফাতিমাও যখন নিজ হাতে যাঁতা চালিয়ে আটা তৈরী করতেন, আটা পিষে রুটি তৈয়ার করতেন ও আগুনের তাপ সহ্যকরে রুটি পাকাতেন, তখন অপর যে কোনো স্ত্রীর পক্ষে তা অকরণীয় হতে পারে না। বরং সবার জন্যেই তা অনুসরণীয়। নিজের ঘরের কাজ করা কোনো স্ত্রীর পক্ষেই অপমান কিংবা লজ্জার কারণ হতে পারে না। ইমামা মালিক এতোদূর বলেছেন যে, স্বামী বিশেষ ধনী লোক না হলে স্ত্রীর কর্তব্য তার ঘরের যাবতীয় কাজ যতদূর সম্ভব নিজের হাতে আঞ্জাম দেয়া –সে স্ত্রী যতবড় ধনী বা অভিজাত ঘরের কন্যাই হোক না কেন।

কুরআনের আয়াতঃ

(আরবী********************************************************)

স্ত্রীদের সেই সব অধিকারই রয়েছে স্বামীদের ওপর, যা স্বামীদের রয়েছে স্ত্রীদের ওপর।

প্রমাণ করে যে, স্বামী যেমন স্ত্রীর জন্যে প্রাণপাত করে, স্ত্রীরও কর্তব্য স্বামীর জন্যে কষ্ট স্বীকার করা। ইমাম ইবনে তাইমিয়াও এরূপে ফতোয়া দিয়েছেন। আবূ বকর ইবনে শায়বা ও আবূ ইসহাক জাওজেজানীর মতও তা-ই। হাদীসে আরো স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে এর স্বপক্ষে। বলা হয়েছেঃ

(আরবী**********************************************************)

নবী করীম (স) তাঁর কন্যা ফাতিমার ওপর তাঁর ঘরের মধ্যকার যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দেয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং হযরত আলীর ওপর দিয়েছিলেন ঘরের বাইরের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব।

জিদ ও হঠকারিতা পরিহার

স্ত্রীলোকদের প্রায় সকলেরই একটি সাধারণ দোষ হচ্ছে জিদ ও হঠকারিতা। এ দোষ থেকে যথাসম্ভব তাদের মুক্ত থাকতে চেষ্টা করতে হবে। কেননা দেখা গেছে, কোনো সামান্য ব্যাপারেও তাদের মরজী ও মন-মেজাজের বিপরীত ঘটলেই তারা আগুনের মতো জ্বলে ওঠে। তখন তারা যে কোন বিপর্যয় ঘটাতে ত্রুটি করে না। আর এতে করে পারস্পরিক খারাপ হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। স্বামীর মন তার দোষে তিক্ত বিরক্ত হয়ে যায় খুব সহজেই।

অবশ্য অপরিহার্য কোনো ব্যাপার হলে স্ত্রীর কর্তব্য অপরিসীম ধৈর্য সহকারে স্বামীকে বোঝানো, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে প্রেম-ভালোবাসার অমৃত ধারায় স্বামীর মনের সব কালিমা ধুয়েমুছে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা। তার বদলে রাগ করে, মুখ ভার করে, তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া-ঝাটি করে গোটা পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলা তার কখনও উচিত নয়। স্বামীকে অসন্তুষ্ট বা ক্রুব্ধ দেখতে পেলে যথাসম্ভব শান্ত ও নরম হয়ে যাওয়া স্ত্রীর কর্তব্য। আর নিজেদের দমেরন ঝাল মেটানো যদি অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তাহলে তা অপর এক সময়ের জন্যে অপেক্ষায় রেখে দেবে, পরে এমন এক সময় এবং এমনভাবে তা করবে, যাতে করে পারস্পরিক সম্পর্ক কিছুমাত্র তিক্ত হয়ে উঠবে না।

স্বামীর বাড়াবাড়ি ও ক্রুব্ধ মেজাজ দেখতে পেলে স্ত্রীর খুব সতর্কতার সাথেই কাজ করা, কথা বলা উচিত। এ অবস্থায় স্ত্রীরও বাড়াবাড়ি করা কিংবা নিজের সম্ভ্রম-মর্যাদার অভিমানে হঠাৎ করে ফেটে পড়া কোনোমতেই বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। স্বামীর কাছে কিছুটা ছোট হয়েও যদি পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখা যায়, তবে স্ত্রীর তাই করা কর্তব্য। কেননা তাতেই তার ও গোটা পরিবারের কল্যাণ নিহিত। কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলা এ পর্যায়েই এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী*******************************************************************)

কোনো স্ত্রী যদি তার স্বামীর বদমেজাজী ও তার প্রতি প্রত্যাখ্যান উপেক্ষা-অবহেলা দেখতে পায় আর তার পরিণাম ভালো না হওয়ার আশংকা বোধ করে, তাহলে উভয়ের যে কোনো শর্তে সমঝোতা করে নেওয়ার কোনো দোষ নেই। বরং সব অবস্থায়ই সমঝোতা-সন্ধি-মীমাংসাই অত্যন্ত কল্যাণময়।

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী***********************************************************************)

আয়াতে সাধারন অর্থে কথাগুলো বলা হয়েছে। এভাবে বলার কারণে বোঝা যায় যে, যে সমঝোতার ফলেই উভয়ের মনের মিল হতে পারে, পারস্পরিক বিরোধ দূর হয়ে যায় তাই মোটামুটিভাবে অনেক উত্তম কাজ কিংবা তা অতীব উত্তম বিচ্ছেদ হওয়া থেকে, বেশি উত্তম ঝগটা-ফাসাদ থেকে।

সহাস্যবদনে স্বামীর অভ্যর্থনা

এ পরিপ্রেক্ষিতে একথাও উল্লেখযোগ্য যে, স্বামী যখনই বাহির থেকে ঘরে ফিরে আসে, তখন স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে হাসিমুখে ও সহাস্যবদনে তাকে অভ্যর্থনা করা –স্বাগতম জানানো। কারণ স্ত্রীর স্মিতহাস্যে বিরাট আকর্ষণ রয়েছে, তার দরুণ স্বামীর মনের জগতে এমন মধুভরা মলয়-হিল্লোল বয়ে যায় যে, তার হৃদয় জগতের সব গ্লানিমা-শ্রান্তি জনিত সব বিষাদ-ছায়া সহসাই দূরীভূত হয়ে যায়। স্বামী যত ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়েই ঘরে ফিরে আসুক না কেন এবং তার হৃদয় যত বড় দুঃখ, কষ্ট ও ব্যর্থতায়ই ভারাক্রান্ত হোক না কেন, স্ত্রীর মুখে অকৃত্রিম ভালোবাসাপূর্ণ হাসি দেখতে পেলে সে তার সব কিছুই নিমেষে ভুলে যেতে পারে।

কাজেই যে সব স্ত্রী স্বামীর সামনে গোমরা মুখ হয়ে থাকে, প্রাণখোলা কথা বলে না স্বামীর সাথে, স্বামীকে উদার হৃদয়ে ও সহাস্যবদনে বরণ করে নিতে জানে না বা করে না, তারা নিজেরাই নিজেদের ঘর ও পরিবারকে –নিজেদেরই একমাত্র আশ্রয় দাম্পত্য জীবনকে ইচ্ছে করেই জাহান্নামে পরিণত করে, বিষায়্তি করে তোলে গোটা পরিবেশকে। রাসূলে করীম (স) এ কারণেই ভালো স্ত্রীর অন্যতম একটি গুণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

(আরবী*****************************************************)

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দৃষ্টি পড়লেই স্ত্রী তাকে সন্তুষ্ট করে দেয় (স্বামী স্ত্রীকে দেখেই উৎফুল্ল হয়ে ওঠে)।

স্বামীর গুণের স্বীকৃতি

স্বামী স্ত্রীকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, তার জন্যে সাধ্যানুসারে উপহার-উপঢৌকন নিয়ে আসে, তার সুখ-শান্তির জন্যে যতদূর সম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এরূপ অবস্থায় স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর এসব কাজের দরুণ আন্তরিক ও অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা। অন্যথায় স্বামীর মনে হতাশা জাগ্রত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এজন্যে নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************************)

আল্লাহ তা’আলা এমন স্ত্রীলোকের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দান করবেন না, যে তার স্বামীর ভালো ভালো কাজের শুকরিয়া জ্ঞাপন করে না।

এ শুকরিয়া যে সব সময় মুখে ও কতায় জ্ঞাপন করতে হবে, এমন কোনো জরুরী শর্ত নেই। শুকরিয়া জ্ঞাপনের নানা উপায় হতে পারে। কাজে-কর্মে, আলাপে-ব্যবহারে স্বামীকে বরণ করে নেয়ার ব্যাপারে স্ত্রীর মনের কৃতজ্ঞতা ও উৎফুল্লতা প্রকাশ পেলেও স্বামী বুঝতে পারে –অনুভব করতে পারে যে, তার ব্যবহারে তার স্ত্রী তার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ এবং সে তার জন্যে যে ত্যাগ স্বীকার করছে, তা সে অন্তর দিয়ে স্বীকার করে।

বুখারী শরীফের একটি হাদীসে এগারো জন স্ত্রীলোকের এক বৈঠকের উল্লেখ রয়েছে। তাতে প্রত্রেক স্ত্রীই নিজ নিজ স্বামী সম্পর্কে বর্ণনা দানের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করে এবং তার পরে প্রত্যেকেই তা পরস্পরের নিকট বর্ণনা করে। একজন স্ত্রী তার স্বামীর খুবই প্রশংসা করে। এ প্রশংসা করা যে অন্যায় নয় বরং অনেক সময় প্রয়োজনীয় তা এ থেকে সহজেই বোঝা যায়। তাই এ সম্পর্কে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************************************************)

এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্বামীর সম্মুখে তার প্রশংসা করা –বিশেষত যখন জানা যাবে যে, তার দরুন তার মেজাজ বিগড়ে যাবে না –তার মন দুষ্ট হবে না –সঙ্গত কাজ।

যৌন মিলনের দাবি পূরণ

যৌন মিলনের দাবি এক স্বাভাবিক দাবি। এ ব্যাপরে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ই সমান। কিন্তু এ ব্যাপারে নারী সব সময় Passive –নিশ্চেষ্ট, অনাগ্রহী ও অপ্রতিরোধীও। পুরুষই এক্ষেত্রে অগ্রসর, active অর্থাৎ সক্রিয় ভূমিকা করে থাকে। সেজন্যে যৌন মিলনের ব্যাপারে সাধারণত স্বামীর তরফ থেকেই আসে আমন্ত্রণ। তাই এ ব্যাপারে স্বামীর দাবিকে প্রত্যাখ্যান করা কখনই স্ত্রীর পক্ষে উচিত হতে পারে না। বরং প্রেম-ভালোবাসার দৃষ্টিতে স্বামীর দাবিকে প্রত্যাখ্যান করা কখনই স্ত্রীর পক্ষে উচিত হতে পারে না। বরং প্রেম-ভালোবাসার দৃষ্টিতে স্বামীর দাবিকে প্রত্যাখ্যান করা কখনই স্ত্রীর পক্ষে উচিত হতে পারে না। বরং প্রেম-ভালোবাসার দৃষ্টিতে স্বামীর যে কোনো সময়ের এ দাবিকে সানন্দ চিত্তে, সাগ্রহে ও সন্তুষ্টি সহকারে গ্রহণ করা –মেনে নেয়া স্ত্রীর কর্তব্য। এ পর্যায়ে রাসূলে করীম (স)-এর বাণী সুস্পষ্ট। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************************))

স্বামী যখন নিজের যৌন প্রয়োজন পূরণের জন্যে স্ত্রীকে আহবান জানাবে, তখন সে চুলার কাছে রান্না-বান্নার কাজে ব্যস্ত থাকলেও সে কাজে অমনি তার প্রস্তুত হওয়া উচিত।

অপর হাদীসে এর চেয়েও কড়া কথা উল্লেখিত হয়েছে। বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************************)

স্বামী যখন তার স্ত্রীকে নিজের শয্যায় আহবান করে (যৌন মিলনের উদ্দেশ্যে), তখন যদি সে সাড়া না দেয় –অস্বীকার করে, তাহলৈ ফেরেশতাগণ সকাল হওয়া পর্যন্ত তার ওপর অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকে।

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ

‘হাদীসটি’ থেকে বাহ্যত মনে হয় যে, এ ঘটনা যখন রাত্রী বেলা হয়, তখনই ফেরেশতারা অস্বীকারকারী স্ত্রীর ওপর অভিশাপ বর্ষণ করে; কিন্তু আসলে কেবল রাতের বেলার কথাই নয়, দিনের বেলাও এরূপ হলে ফেরেশতাদের অভিশাপ বর্ষিত হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যেহেতু যৌন মিলনের কাজ সাধারণত রাতের বেলাই সম্পন্ন হয়ে থাকে, এ জন্যে রাসূলে করীম (স) রাতের বেলার কথা বলেছেন। মূলত এ কথা রাত ও দিন –উভয় সময়ের জন্যেই প্রযোজ্য।

অপর এক হাদীসে এ কথাটি অধিকতর তীব্র ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছে। তা এইঃ

(আরবী**********************************************************)

যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলছি, যে ব্যক্তিই তার স্ত্রীকে যৌন মিলনের উদ্দেশ্যে তার শয্যায় ডাকবে, তখন যদি স্ত্রী তা অমান্য করে –যৌন মিলনে রাজি হয়ে তার কাছে না যায়, তবে আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট –ক্রুব্ধ থাকবেন যতক্ষণ না স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট হবে।

অনুরূপ আর একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************************)

স্ত্রী যদি তার স্বামীর শয্যা ত্যাগ করে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে, তবে যতক্ষণে সে তার স্বামীর কাছে ফিরে না আসবে, ফেরেশতাগণ তার ওপর অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকবে।

আর একটি হাদীস হচ্ছেঃ

(আরবী******************************************************************)

তিন ব্যক্তির নামায কবুল হয় না, আকাশের দিকে উত্থিত হয় তা তাদের কোনো নেক কাজও। তারা হচ্ছেঃ পলাতক ক্রীতদাস –যতক্ষণ না মনিবের নিকট ফিরে আসবে, নেশাখোর, মাতাল –যতক্ষণ না সে সুস্থ ও প্রকৃতিস্থ হবে এবং সেই স্ত্রী, যার স্বামী তার প্রতি অসন্তুষ্ট –যতক্ষণ না স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট হবে।

ইবনে জাওজীর ‘কিতাবুন নিসা’য় উদ্ধৃত অপর এক হাদীসে আরো বিস্তৃত কথা বলেছেন –হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেনঃ

(আরবী*********************************************************)

রাসূলে করীম (স) ‘মুসবিফা’ ও ‘মুগলিসা’র ওপর অভিশাপ বর্ষণ করেছেন। ‘মুসবিফা বলতে বোঝায় সেই নারী, যাকে তার স্বামী যৌন মিলনে আহবান জানালে সে বলেঃ ‘এই শীগগিরই আসছি’। আর ‘মুগলিসা’ হচ্ছে সেই স্ত্রী, যাকে তার স্বামী যৌন মিলনে আহবান জানালেসে বলে ‘আমার হায়েয হয়েছে’, অথচ প্রকৃতপক্ষে সে ঋতু অবস্থায় নয়।

অবশ্য এ ব্যাপারে স্ত্রীর স্বাস্থ্য, মানসিক অবস্থা ও ভাবধারার প্রতি পুরাপুরি লক্ষ্য রাখতে হবে। স্বামী যদি নিতান্ত পশু হয়ে না থাকে, তার মধ্যে থেকে থাকে মনুষ্যত্বসুলভ কোমল গুণাবলী, তাহলে সে কিছুতেই স্ত্রীর মরজী-মনোভাবের বিরুদ্ধে জোর-জবরদস্তি করে যৌন মিলনের পাশবিক ইচ্ছাকে চরিতার্থ করতে যাবে না। সে অবশ্যই স্ত্রীর স্বাস্থ্যগত মানবিক সুবিধা-অসুবিধার, আনুকূল্য-প্রতিকূলতা সম্পর্কে খেয়াল রাখবে এবং খেয়াল রেখেই অগ্রসর হবে।

উপরে উদ্ধৃত হাদীসসমূহ সম্পর্কে নববী লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************************)

এ সব হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোনো প্রকার শরীয়তসম্মত ওযর বা কারণ ছাড়া স্বামীর শয্যায় স্থান গ্রহণ থেকে বিরত থাকা স্ত্রীর পক্ষে হারাম।

স্ত্রীর কোনো শরীয়তসম্মত ওযর থাকলে স্বামীকে অবশ্যই এ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। ফিকাহবিদগণ এজন্যে বলেছেনঃ

(আরবী********************************************************)

অধিক মাত্রায় যৌন সঙ্গম যদি স্ত্রীর পক্ষে ক্ষতিকর হয় তাহলে তার সামর্থ্যের বেশি যৌন সঙ্গম করা জায়েয নয়।

অবশ্য রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে স্বামীর এ ধরনের কামনা-বাসনা বা দাবি যথাযথভাবে পূরণের জন্যে সতত প্রস্তুত হয়ে থাকা। এ প্রস্তুত হয়ে থাকার গুরুত্ব নানা কারণে অনস্বীকার্য। এমনকি রাসূলে করীম (স)-এর ফরমান অনুযায়ী স্বামীর বিনানুমতিতে নফল রোযা রাখাও স্ত্রীর পক্ষে জায়েয নয়। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী***************************************************)

স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ছাড়া স্ত্রী নফল রোযা রাখবে না।

কেননা রোযা রাখলে স্ত্রী স্বামীর যৌন মিলনের দাবি পূরণে অসমর্থ হতে পারে, আর স্বামীর এ দাবিকে কোনো সাধারণ কারণে অপূর্ণ রাখা স্ত্রীর উচিত নয়।

ইসলামে এসব বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে কেবলমাত্র এজন্যে যে, সমাজের লোকদের পবিত্রতা, অকলংক চরিত্র ও দাম্পত্য জীবনের অপরিসীম তৃপ্তি ও সুখ-শান্তি, প্রেম-ভালোবাসা ও মাধুর্য রক্ষার জন্যে এ বিষয়গুলো অপরিহার্য।

আর এ কারণেই নবী করীম (স) ও সাহাবায়ে কিরাম-এর যুগে স্ত্রীগণ তাঁদের স্বামীদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। স্বামীদের একবিন্দু অসন্তুষ্টি বা মনোকষ্ট তাঁরা সইতে পারতেন না। এমন কি, কোনো স্বামীর প্রত্যাখ্যানও তার স্ত্রীর এ কর্মপদ্ধতি পরিত্যাগ করাতে পারত না। হাদীসে ও সাহাবীদের জীবন চরিতে এ পর্যায়ের ভূরি ভূরি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়।

আল্লাহর ইবাদত আদায়ে পারস্পরিক সহযোগিতা

আল্লাহর দ্বীন পালনের জন্যে স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে পরস্পরকে উৎসাহ দান। ইসলামের ফরয ওয়াজিব ইবাদত এবং শরীয়তের যাবতীয় হুকুম-আহকাম পালনের জন্যে তো একজন অপরজনকে প্রস্তুত ও উদ্বুদ্ধ করবেই। এ হচ্ছে প্রত্যেকেরই দ্বীনী কর্তব্য। কিন্তু তা ছাড়াও সুন্নত এবং নফল ইবাদতের জন্যেও তা করা ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক কর্তব্য। এ সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর দু’-তিনটি বাণী এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছেঃ

তিনি এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী******************************************************)

আল্লাহ যে পুরুষকে রহমত দান করবেন, সে রাতের বেলা জেগে ওঠে নামায পড়বে এবং তার স্ত্রীকেও সেজন্যে সজাগ করবে। স্ত্রী ঘুম ছেড়ে উঠতে অস্বীকার করলে তার মুখে পানি ছিঁটিয়ে দেবে।

অনুরূপভাবে আল্লাহ রহমত দান করবেন সেই স্ত্রীকে, যে রাতের বেলা জেগে উঠে নিজে নামায পড়বে এবং সে তার স্বামীকেও সেজন্যে জাগাবে; স্বামী উঠতে না চাইলে মুখে পানি ছিঁটিয়ে দেবে।

অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী************************************************)

পুরুষ যখন তার স্ত্রীকে রাতের বেলা জাগাবে এবং দুজনেই নামায পড়বে –আলাদা আলাদাভাবে এবং দুরাকাত নামায একত্রে পড়বে, আল্লাহ এ স্বামী-স্ত্রীকে আল্লাহর যিকরকারী পুরুষ-নারীদের মধ্যে গণ্য করবেন।

স্বামী পরিচর্যায় মহিলা সাহাবী

হযরত আয়েশা (রা)-এর সাথে নবী করীম (স)-এর ভালোবাসা ইতিহাসে দৃষ্টান্তমূলক। হযরত আয়েশা (রা) একদিন হাতে রৌপ্য নির্মিত দস্তানা পরেছিলেন। নবী করীম (স) এসে জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আয়েশা, তোমরা হাতে কি পরেছ? তিনি বললেনঃ আপনার সন্তুষ্টির জন্যে এ দস্তানা পরিধান করেছি। হযরত আয়েশা রাসূলের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। তাঁর কাপড়-চোপড় তিনি নিজ হাতে ধুয়ে সাফ করে দিতেন, তাঁর পোশাকে সুগন্ধি লাগিয়ে দিতেন, তাঁর মিসওয়াক শুকনো থাকলে তিনি তা চিবিয়ে মুখের লালায় ভিজিয়ে মসৃণ করে দিতেন এবং সেটাকে তিনি নিজের হেফাযতে রাখতেন। তিনি নিজ হাতে রাসূলের চুলে দাঁড়িতে চিরুণী করে দিতেন। বুখারী ও অন্যান্য হাদীসে তার অকাট্য প্রমাণ উল্লেখ করা হয়েছে।

হযরত খাওলা (রা) একদা হযরত আয়েশার খেদমতে হাযির হয়ে বললেনঃ আমি প্রতি রাতে সুসাজে সজ্জিতা হয়ে আল্লাহর ওয়াস্তে স্বামীর জন্যে দুলহিন সেজে তার কাছে উপস্থিত হই, তারই পাশে গিয়ে শয়ন করি। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারিনি –সে আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। হযরত আয়েশার জবানীতে রাসূলে করীম (স) এ কথা শুনে বললেনঃ তাকে বলো, সে যেন তার স্বামীর আনুগত্য ও মনতুষ্টি সাধনেই সতত ব্যস্ত থাকে।

এ ধরনের সমাজ-পরিবেশের ফলে স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা গভীর ও অসীম হয়ে যায়। একজন অপরজনের জন্যে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত হয়ে যায়। স্বয়ং রাসূলে করীম (স)-এর সাথে তাঁর বেগমদের প্রেম-ভালোবাসা ছিল বর্ণনাতীত। হযরত খাদীজাতুল কুবরা রাসূলের জন্যে –জিন্দেগীর মিশনের জন্যে রাসূল হিসেবে তাঁর কঠিন দায়িত্ব পালনে তাঁর যাবতীয় ধন-সম্পদ নিঃশেষ খরচ করে দিয়েছিলেন। আর সেজন্যে তিনি কোনোদিন এতটুকু আফসোসও প্রকাশ করেন নি। বরং নবী করীম (ষ) যদি কখনও সে বিষয়ে কথা তুলতেন, তাহলে তিনি নিজেই রাসূলকে সান্ত্বনা দিতেন।

রাসূলে করীম (স)-এর মহিলা সাহাবিগণ প্রায় সকলেই এই একই ভাবধারায় মহিমান্বিত ছিলেন। হযরতের কন্যা জয়নব তাঁর স্বামীকে বন্দীশালা থেকে মুক্তিদানের জন্যে নিজের কণ্ঠের বহু মূল্যের হার ফিদিয়া-বিনিময় মূল্য হিসেবে দিয়েছিলেন ও তাকে মুক্ত করেছিলেন।

এসব ঘটনা হতে নিঃসন্দেহে বোঝা যায় যে, ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর জীবনকে এক উত্তম প্রেম-ভালেবাসার মাধুর্যপূর্ণ ভাবধারায় সঞ্জীবিত দেখতে চায়। কেননা প্রেম-ভালোবাসা, পারস্পরিক আদর-যত্ন ও সোহাগ না হলে দাম্পত্য জীবন আর বিয়ের বন্ধন যে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে যায়, তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না।

পারিবারিক জীবনের সংস্থা

উপরের বিস্তারিত আলোচনা থেকে ইসলামের পারিবারিক সংস্থার কাঠামো ও ধরন-প্রকৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধাণা সহজেই করা যেতে পারে। নারীর স্বাভাবিক দুর্বলতা, নানাবিধ দৈহিক অসুবিধা এবং পুরুষের তুলনায় তার দৈহিক ও মানসিক অসম্পূর্ণতার কারনে ইসলাম স্ত্রী-পুরুষের পারস্পরিক জীবনে পুরুষের প্রাধান্য ও নেতৃত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর সমষ্টিগত জীবনের প্রধান কিংবা পারিবারিক জীবনের চেয়ারম্যান –পরিচালক ও নেতা হচ্ছে পুরুষ-স্ত্রী নয়। কেনান পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে যে কোনো প্রতিকূলতা, অসুবিধা, বিপদ-মুসিবদ আসতে পারে কিংবা সাধারণত এসেথাকে, তার মুকাবিলা করার এবং এ সমস্যার ও জটিলতার সমাধান করার উপযুক্ত ক্ষশতা ও যোগ্যতা পুরুষেরই রয়েছে। সাধারণত সে ক্ষমতা স্ত্রীলোকের হয় না। অন্তত পুরুষের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে স্ত্রীলোকদের সে ক্ষমতা স্ত্রীলোকের হয় না। অন্তত পুরুষের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে অনস্বীকার্য। ঠিক এ কারণেই পরিবার পুরুষের নেতৃত্বে চলবে। আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে একথাই বলেছেন নিম্নোক্ত আয়াতেঃ

(আরবী*******************************************************************)

স্বামীগণ হচ্ছে তাদের স্ত্রীদের পরিচালক, সংরক্ষক, শাসনকর্তা এ কারণে যে, আল্লাহ তা’আলা তাদের পরস্পরকে পরস্পরের ওপর অধিক মর্যাদাবান করেছেন এবং এজন্যে যে, পুরুষ তাদের ধনমাল খরচ করে।

কুরআনের শব্দ (আরবী**********) –এর মানে হচ্ছে (আরবী*********************) শাসক, সংরক্ষক, নেতা, কর্তা, যাবতীয় বিষয় ও ব্যাপারের সম্পাদনকারী ও পর্যবেক্ষক। ইবনুল আরাবী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী******************************************************************)

স্বামী ‘কাওয়াম’-এর অর্থ হচ্ছে স্বামী স্ত্রীর আমানতদার রক্ষণাবেক্ষণকারী, তার যাবতীয় কাজের দায়িত্বশীল, কর্তা এবং তার অবস্থার সংশোধনকারী ও কল্যাণ বিধানকারী।

ইবনুল আরাবী সূরা আল-বাকারার আয়াতাংশঃ (আরবী************) উল্লেখ করে লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

পুরুষের অধিক মর্যাদা হচ্ছে নেতৃত্বের অধিকারেরকারণে। স্ত্রীকে মহরানা দান, যাবতীয় ব্যয়ভার বহন, তার সাথে গভীর মিলমিশ সহকারে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা, তাকে সব অপকার থেকে রক্ষা, আল্লাহর আনুগত্যের জন্যে আদেশ করা এবং নামায-রোযা ইত্যাদি ইসলামের মৌলিক অনুষ্ঠানাদি পালনের জন্যে তাগিদ করার কাজ স্বামীই করে থাকে –করা কর্তব্য। আর তার বিনিময়ে স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে স্বামীর ধনমালের হেফাযত করা, স্বামীর পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা এবং আত্মসংরক্ষণমূলক যাবতীয় কাজে-কর্মে স্বামীর আদেশ পালন করে চলা –স্বামীর বিনানুতমিতে তার কোনোটাই ভঙ্গ না করা।

উপরোক্ত আয়াত সম্পর্কে ইবনুল আরাবীর মোটামুটি বক্তব্য হচ্ছে এইঃ

(আরবী************************************************************)

আয়াতের অর্থ হচ্ছেঃ আমি স্ত্রীর ওপর পুরুষের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব দিয়েছি তার ওপর তার স্বাভাবিক মর্যাদার কারণে। তিনটি বিষয়ে পুরুষ স্ত্রীর চেয়ে অধিক মর্যাদাবান। প্রথম, জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার-বিবেচনায় পূর্ণত্ব লাভ; দ্বিতীয়, দ্বীন পালন ও জিহাদের আদেশ পালনের পূর্ণতা এবং তৃতীয় সাধারণভাবে ভালো কাজের আদেশ করা ও মন্দ কাজের নিষেধ করা –(এসব পুরুষের দায়িত্ব এবং এ দায়িত্ব পুরামাত্রায় পুরুষের ওপরই বর্তে।)

সহজ কথায় বলা যায়, সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধি, বিচক্ষণা, কর্মশক্তি, দুর্ধর্ষতা, সাহসিকতা, বীরত্ব, তিতিক্ষা ও সহ্যশক্তি স্ত্রীলোকদের অপেক্ষা পুরুষদের বেশি। আর পারিবারিক জীবনে অর্থোপার্জন ও শ্রম পুরুষই করে থাকে। স্ত্রীকে মহরানা পুরুষই দেয়; স্ত্রীর ও সন্তান-সন্ততির খোরাক-পোশাক ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস পুরুষই সংগ্রহ করে থাকে। এজন্যে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক দাম্পত্য জীবনের প্রধান কর্তা, পরিচালক ও চেয়ারম্যান পুরুষকেই বানানো হয়েছে! কিন্তু এর অন্তর্নিহিত কারণ কি?

পরিবারে পুরুষের প্রাধান্য

কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তিই একথা অস্বীকার করতে পারে না যে, আল্লাহ প্রদত্ত বহু গুণ-বিশিষ্ট এবং স্বভাবজাত যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতার কারণে স্ত্রীলোকদের তুলনায় পুরুষ অনেকখানি অগ্রসর! স্ত্রীলোক স্বাভাবিকভাবেই জীবনের কিছু সময় সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যেতে বাধ্য হয়। তখন সে অপরের সাহায্য ও সক্রিয় সহযোগিতার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। সন্তান গর্ভে থাকাকালে, সন্তান প্রসব, স্তনদান, শিশু পালন এবং নিয়মিত হায়েয-নেফাসের সময় স্ত্রীলোকদের অবস্থা কোনো বিশেষ দায়িত্ব পালনের অনুকূল নয়।

শাহ অলী উল্লাহ দেহলভী পুরুষের এ প্রাধান্য সম্পর্কে লিখেছেনঃ

(আরবী****************************************************************)

স্বামীকে তার স্ত্রীর ওপর পরিচালক ও ব্যবস্থাপক হিসেবে নিযুক্ত করা একান্ত আবশ্যক। আর স্ত্রীর ওপর এ প্রাধান্য স্বভাবসম্মতও বটে। কেননা পুরুষ জ্ঞাত-বুদ্ধিতে অধিক পূর্ণ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় অধিক সুদক্ষ, সাহায্য-প্রতিরোধের কাজে প্রবল ও সুদৃঢ়। লজ্জা ও অপমানকর ব্যাপার থেকে রক্ষা করার অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন। পুরুষ স্ত্রীর খোরাক-পোশাক ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে বলেও স্ত্রীর ওপর পুরুষের এ নেতৃত্ব ও প্রাধান্য হওয়া বাঞ্ছনীয়।

আল্লামা বায়জাবী উপরোক্ত আয়াতের তাফসীরে লিখেছেনঃ

পুরুষরা স্ত্রীদের দেখাশোনা ও পরিচর্যা এমনভাবে করে, ঠিক যেমনভাবে শাসকগণ করে থাকে (বা করা উচিত) দেশের জনসাধারণের। আল্লাহ তা’আলা স্ত্রীদের তুলনায় পুরুষদের দুটি কারণ শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। একটি কারণ আল্লাহর বিশেষ দান সম্পর্কীয়, আর অপরটি পুরুষদের নিজস্ব অর্জনের ব্যাপারে। আল্লাহর দান এই যে, আল্লাহ নানা দিক দিয়ে পুরুষদের বিশিষ্ট করেছেন। স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও গুরুতর কার্য সম্পাদন, বিপুল কর্মশক্তি প্রভৃতির দিক দিয়ে পুরুষগণ সাধারণতই প্রধান ও বিশিষ্ট। এজন্যেই নবুয়ত, সামাজিক নেতৃত্ব, শাসন ক্ষমতা, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্যে জিহাদ, বিচার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির দায়িত্ব কেবল পুরুষের ওপরই অর্পিত হয়েছে এবং সেই দায়িত্ব অধিক হওয়ার কারণে মীরাসে স্ত্রীলোকদের তুলনায় পুরুষদের অংশ বেশি দেয়া হয়েছে। আর পুরুষদের উপার্জিত কারণ হলোঃ আসলে বিয়ে থেকে শুরু করে মহরানা দান, ভরণ-পোষণ ও পারিবারিক প্রয়োজন পূরণের যাবতীয় দায়িত্ব পুরুষরাই পালন করে থাকে। (আরবী**************************)

আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যাচাই করলেও একতা প্রমাণিত হয় যে, পুরুষের মগজ স্ত্রীলোকের তুলনায় অনেক বড়। বুদ্ধি, জ্ঞান-প্রতিভা অপেক্ষাকৃত বেশি। বুদ্ধি-জ্ঞানে অধিক পরিপক্ক। সেই সঙ্গে পুরুষের দেহ এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও হয় নারীর তুলনায় অনেক মজবুত। মিসরীয় চিন্তাবিদ আল্লামা ফরীদ আজদী লিখেছেনঃ

পুরুষের মগজ সাধারণত গড়ে সাড়ে ৪৯ আউন্স, আর স্ত্রীলোকের মগজের ওজর মাত্র ৪৪ আউন্স। দু’শ’ আটাত্তরজন পুরুষের মগজ ওজন করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বড় মগজের ওজন হচ্ছে ৬৫ আউন্স, আর সবচেয়ে ছোট মগজের ওজন ৩৪ আউন্স। পক্ষান্তরে ২৯১ জন স্ত্রীলোকের মগজ ওজন করার পর প্রমাণিত হলো যে, সবচেয়ে ভারী মগজের ওজন হচ্ছে ৫৪ আউন্স, আর সবচে হালকা মগজের ওজন হচ্ছে ৩১ আউন্স। ….. এ থেকে কি একথা প্রমাণিত হয় না যে, স্ত্রীলোকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও স্নায়ু পুরুষের তুলনায় অনেক গুণ দুর্বল? (আরবী******** ফরীদ অজদী) বৈজ্ঞানিক তদন্তে এও জানা গেছে যে, নারী-পুরুষের মগজের ওজনের এ পার্থক্য কেবল এক সমাজেই নয়, সব সমাজের –সকল স্তনের নারী-পুরষেরই এই একই অবস্থা। সভ্য-অসভ্য জাতির মধ্যেও এ ব্যাপারে কোনো পার্থক্য নেই। প্যারিসের মতো সুসভ্য নগরীতে যেমন নারী ও পুরুষের এ পার্থক্য লক্ষ্য করা যাবে, তেমনি দেখা যাবে আমেরিকার বর্বরতম জাতির মধ্যেও।

এ যুগের আরবী মনীষী আব্বাস মাহমুদ আল-আক্কাস লিখেছেনঃ

‘স্ত্রীর ওপর স্বামীর কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব স্বাভাবিক মর্যাদা আধিক্যের কারণে এবং এ কারণে যে, স্ত্রীর যাবতীয় আর্থিক প্রয়োজন পূরণ করার দায়িত্ব স্বামীর। আর এ কর্তব্য হচ্ছে কম মর্যাদাশালীর প্রতি অধিক মর্যাদাবান ব্যক্তির কর্তব্য। কেবল আর্থিক প্রয়োজন পূরণই এর একমাত্র ভিত্তি নয়। অন্যথা যে স্ত্রীর ধনশালী কিংবা যে স্বামী স্ত্রীর প্রয়োজন পূরণ করে না বরং স্ত্রীর মেহমান হয়ে তার সম্পদ ভোগ করে, সেখানে স্ত্রীরই উত্তম ও কর্তী –হওয়া উচিত স্বামীর কিন্তু ইসলামে তা কোনো দিন হতে পারে না। (আরবী****************)

মোটকথা, আধুনিক জ্ঞান-গবেষণা অনুযায়ীও স্ত্রীলোক অপেক্ষা পুরুষের মধ্যে কর্মক্ষমতা ও যোগ্যতা অধিক!

কুরআন মজীদে এ পর্যায়ে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************)

এবং স্ত্রীদের ওপর পুরুষের এক ধরনের প্রাধান্য রয়েছে।

এ আয়াতেও পারিবারিক জীবনের নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য পুরুষকেই দেয়া হয়েছে, নারীকে নয়। আর সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধি ও বস্তু বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও এ কথার যথার্থতা স্বীকৃত।

পুরুষ সন্তানের পিতা, তারই সন্তান বলে পরিচিত হয়ে থাকে লোকসমাজ। ছোটরাও যেমন বড়রাও তেমনি। তাই পরিবারে পুরুষেরই কর্তৃত্ব হওয়া উচিত।

পরিবারের লোকজনের সকল প্রকার খরচপত্র পরিবেশনের জন্যে পুরুষ –পিতাই –দায়ী, তারই নিকট সব কিছু দাবি করা হয় এবং সেই বাধ্য হয় সব যোগাড় করে দিতে। খাবার, পোশাক, চিকিৎসা, বিয়ে ও শিক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যয়ভার তাকেই বহন করতে হয়। এদের মধ্যে সন্তানরাও যেমন থাকে, স্ত্রীও। অতএব এ সকলের ওপর পুরুষের নেতৃত্বই স্বাভাবিক। আর তার নেতৃত্বে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কোনো আপত্তি বা সংশয় থাকতে পারে না।

মেয়েলোকের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তার আজীবনের আশ্রয় পিতার ঘর হয়ে যায় পরের বাড়ি, আর জীবনে কোনোদিন যাকে দেখেনি –যার নাম কখনো শুনেনি, তেমন এক পুরুষ হয়ে যায় তার চির আপন এবং সে পিতার ঘর ত্যাগ করে তারই সাথে চলে যায় তারই বাড়িতে। এ-ই সাধারণ নিয়ম। অতএব বসতবাটির মালিক হচ্ছে পুরুষ, সে ঘরের রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও অন্যান্য যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব যার, ঘরের ওপর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বও তারই হওয়া উচিত। কিন্তু এ কর্তৃত্ব জোর-জবরদস্তির নয়, না-ইনসাফী, অসাম্য ও স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার জন্যে নয়; বরং এ হচ্ছে –“যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তাদেরই পরিচালনার কর্তৃত্ব” ধরনের। কেননা একজন লোক যাদের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে, তাদের ওপর সে লোকের যদি কর্তৃত্ব না থাকে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের, পথনির্দেশের, প্রতিরোধের, তাহলে সে তার দায়িত্ব পালন করতে কিছুতেই সমর্থ হতে পারে না। এ ধরনের কর্তৃত্ব যেমন পরিবারের অন্যান্য লোকের অধিকার হরণকারী হয় না, তেমনি তা হরণ করে না স্ত্রীর অধিকারও। অতএব এ ধরনের কর্তৃত্ব বা নেতৃত্ব একটি বৈশিষ্ট্যের পরিচয় মাত্র, যা দায়িত্বাধীন লোকদের তুলনায় দায়িত্বশীরের জন্যে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়েছে। এতে করে না স্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা স্বামীকে দেয়া হয়েছে, না তার ব্যক্তিত্ব বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।

বস্তুত পারিবারিক ব্যবস্থাপনা-পরিচালনার কর্তৃত্ব স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের মধ্যে সুবিচার, সাম্য ও পরামর্শমূলক সূক্ষ্মতম ভিত্তিতে কায়েম হয়ে থাকে, তা স্বভাবতই স্বৈরনীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার পরিপন্থী হয়ে থাকে। বরং তাতে প্রত্যেকেরই নিজস্ব মতের আযাদী, ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ লাভের সুযোগ সংরক্ষিত হয়, স্ত্রীর ধন-মালের ওপর কর্তৃত্ব তারই হবে, স্বামীর নয়। স্ত্রী যথা-ইচ্ছা ও যেমন ইচ্ছা তা ব্যয় ব্যবহার করতে পারে, সে বিষয়ে স্বামীর কিছুই বলবার ও করবার থাকতে পারে না। সে যদি তার ধনমাল সংক্রান্ত কোনো বিবাদে অপর কারো বিরুদ্ধে বিচার প্রার্থী হতে চায়, তবে সে অনায়াসেই তা করতে পারে। স্বামীর সে ব্যাপারে আপত্তি বা হস্তক্ষেপ করারও কোনো অধিকার নেই। ইসলাম এদিক দিয়ে মুসলিম নারীকে এমন এক মর্যাদা দিয়েছে, যা অত্যাধুনিকা ফরাসী নারীরাও আজ পর্যণ্ত লাভ করতে পারে নি। (আরবী***************************)

অধিকার সাম্য

স্বামী-স্ত্রীর মিলিত দাম্পত্য জীবনে পুরুষের প্রাধান্য স্বীকার করে নেয়া সত্ত্বেও ইসলাম স্ত্রীকে পুরুষের দাসী-বাঁদী বানিয়ে দেয়নি। যদি কেউ তা মনে করে, তবে সে মারাত্মক ভুল করে। প্রশ্ন হচ্ছে স্বামী ও স্ত্রীর মিলিত পারিবারিক জীবনে পরস্পরের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে না কি? কোনো বিষয়ে যদি পারস্পরিক মতপার্থক্য কখনও ঘটে যায়, তখন সে বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা করার কার্যকরী পন্থা কি হতে পারে? ইসলাম বলেছে, তখন পুরুষের মতই প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার পাবে। তখন স্ত্রীর কর্তব্য হবে স্বামীর মতকেই মেনে নেয়া, স্বামীর কথা মতো কাজ করা। কেননা তাকে মনে করতে হবে যে, স্বামী –তার চাইতে বেশি জ্ঞান, দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার অধিকারী এবং এজন্যে পারিবারিক জীবন সংক্রান্ত ‘সভাপতিত্বের’ মর্যাদা স্বতঃই স্বামীরই প্রাপ্য।

এ সম্পর্কে ব্যাপক আদর্শ হচ্ছে এই যে, মুসলিম জীবনের সকল সামাজিক-সামগ্রিক ক্ষেত্রেই পারস্পরিক পরামর্শ ও যথাসম্ভব ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। এ পরামর্শ নেয়া-দেয়া কেবল রাষ্ট্রীয় ব্যাপারেই নয়, পারিবারিক জীবনের গণ্ডীতেও অপরিহার্য। আর তাতে পরামর্শ দেয়ার অধিকার রেছ স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই এবং এ পরামর্শের ব্যাপারেও যার মত অধিকতর যুক্তিসঙ্গত বিবেচিত হবে, তারই মত মেনে নেয়া হলো পরামর্শ ভিত্তিক সংস্থার লক্ষ্য।

কুরআন মজীদে এ পর্যায়ে বলা হয়েছেঃ

(আরবী**********************************************)

স্ত্রীদের ওপর পুরুষদের যে রকম অধিকার রয়েছে, ঠিক অনুরূপ সমান অধিকার রয়েছে পুরুষদের ওপর স্ত্রীলোকদের এবং তা সুস্পষ্ট প্রচলিত নিয়মানুযায়ী হবে।

আয়াতটি সংক্ষিপ্ত হলেও এতে পারিবারিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি ও নিয়ম উল্লিখিত হয়েছে। আর তা হচ্ছে এই যে, সকল ব্যাপারে ও বিষয়ে নারী পুরুষের সমান মর্যাদাসম্পন্ন। সকল মানবীয় অধিকারে নারী পুরুষেরই সমান, প্রত্যেকের ওপর প্রত্যেকের নির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে। তাই রাসূলে করীমও বলেছেনঃ

(আরবী******************************************************)

নিশ্চয়ই তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের হক –অধিকার –রয়েছে এবং তাদেরও অধিকার রয়েছে তোমাদের ওপর।

কেবল একটি মাত্র ব্যাপারে পুরুষ স্ত্রীর তুলনায় অধিক মর্যাদা পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী পুরুষের সমান নয়। আর তা হচ্ছে তাই যা বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************************)

পুরুষরা নারীদের ওপর কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব সম্পন্না।

এই আয়াতাংশ এবং এই একটি ক্ষেত্র ছাড়া আর সব ক্ষেত্রেই নৈতিকতা, ইবাদত, আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভ, কর্ম ফল প্রাপ্তি, মানবিক অধিকার ও সাধারণ মান-মর্যাদা এসব ব্যাপারেই স্ত্রীলোক পুরুষের সমান। অপর কোনো ক্ষেত্রেই পুরুষকে স্ত্রীর তুলনায় শ্রেষ্ঠ এবং স্ত্রীকে পুরুষ অপেক্ষা নিকৃষ্ট মনে করা যেতে পারে না। আর সত্যি কথা এই যে, দুনিয়ার ব্যবস্থাসমূহের মাঝে একমাত্র ইসলামই নারীকে এ মর্যাদা দিয়েছে।

পুরুষকে পারিবারিক সংস্থার ‘সভাপতি’ করে দেয়া সত্ত্বেও ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে সব ব্যাপারে পারস্পরিক পরামর্শ করা ও পরামর্শের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। কেননা এরূপ হলেই পারিবারিক জীবনে শান্তি, সন্তুষ্টি, মাধুর্য ও পরস্পরের প্রতি গভীর আস্থা ও নির্ভরতা বজায় থাকতে পারে। দুগ্ধপোষ্য শিশুকে দুধ পান করাবার মেয়াদ হচ্ছে পূর্ণ দু’বছর। এর পূর্বে যদি দুধ ছাড়াতে হয় তবে স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক পরামর্শ করে তা করতে পারে। নিম্নোক্ত আয়াতে একথাই বলা হয়েছেঃ

(আরবী*******************************************************)

স্বামী-স্ত্রী যদি সন্তুষ্ট ও পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে দুধ ছাড়াতে চায়, তবে তাদের কোনো গুনাহ হবে না।

আয়াতটিতে একদিকে যেমন স্বামী-স্ত্রী –পিতামাতা –উভয়েরই সন্তুষ্টি এবং পারস্পরিক পরামর্শের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তেমনি অপরদিকে বিশেষভাবে স্ত্রী-সন্তানের মা’র সন্তুষ্টি ও তার সাথে পরামর্শের গুরুত্ব স্বীকার করা হয়েছে। একে তো বাপ-মা দু’জনের একজনের ইচ্ছায় এ কাজ হতে পারে না বলা হয়ছে; দ্বিতীয়ত হতে পারে যে, মা’য়ের মত ছাড়াই বাবা নিজের ইচ্ছার জোরে শিশু সন্তানের দুধ দু’বছরের আগেই ছাড়িয়ে দিলো, আর তাতে মা ও চিন্তান্বিত হয়ে পড়ল এবং দুগ্ধপোষ্য শিশুরও ক্ষতি হয়ে পড়ল। অতএব স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সন্তুষ্টি এবং সন্তানের পূর্বাপর অবস্থা সম্পর্কে পরামর্শ গ্রহণ অপরিহার্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সহজেই বুঝতে পারা যায়, দুগ্ধপোষ্য শিশুর দুধ ছাড়ানোর জন্যে যদি স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সন্তুষ্টি ও পরামর্শের এতদূর গুরুত্ব নিশ্চয়ই অনেক বেশি হবে। আর বাস্তবিকই যদি স্বামী-স্ত্রীর যাবতীয় কাজ পারস্পরিক পরামর্শ ও একে অপরের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রেখে সম্পন্ন করে, তাহলে তাদের দাম্পত্য জীবন নিঃসন্দেহে বড়ই মধুর হবে, নির্ঝঞ্ঝাট হবে, হবে সুখ ও শান্তিতে পরিপূর্ণ।

স্বামীর সন্তুষ্টি বিধান ও তার আনুগত্য

এ দৃষ্টিতে স্বামীর যেমন কর্তব্য স্ত্রীর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে চেষ্টা করা, তেমনি স্ত্রীরও তা-ই কর্তব্য। স্ত্রীর যাবতীয় কাজে-কর্মে লক্ষ্য থাকবে প্রথম আল্লাহর সন্তোষ লাভ এবং তারপরই দ্বিতীয়ত থাকবে স্বামীর সন্তোষ লাভ। আর এ স্বামীর সন্তোষ লাভের জন্য চেষ্টা করাও আল্লাহর সন্তোষেরই অধীন। কেননা আল্লাহই তার সন্তোষ লাভের জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন স্ত্রীদের। এ কারণে নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

যে মেয়েলোকই এমনভাবে মৃত্যুবরণ করবে যে, তার স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট, সে অবশ্যই বেহেশতবাসিনী হবে।

স্বামীর সন্তোষ বিধানের জন্যেই তার আনুগত্য করাও স্ত্রীর কর্তব্য। রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী*********************************************************))

স্ত্রী যদি পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায রীতিমত পড়ে, যদি রমযানের একমাস ফরয রোযা রাখে, যদি তার যৌন অঙ্গের পবিত্রতা পূর্ণ মাত্রায় রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং তার স্বামীর আনুগত্য করে, তবে সে অবশ্যই বেহেশতের যে দুয়ার দিয়েই ইচ্ছে প্রবেশ করতে পারবে।

এ হাদীসে স্বামীর আনুগত্য করাকে নামায-রোযা ও সতীত্ব রক্ষা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে এবং একেও সেসব কাজের মতোই গুরুত্বপূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। অন্য কথায় হাদীসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, স্ত্রীর ওপর যেমন আল্লাহর হক রয়েছে, তেমনি রয়েছে স্বামীর অধিকার। স্ত্রীর যেমন কর্তব্য আল্লাহর হক আদায় করা, তেমনি কর্তব্য স্বামীর কতা শোনা এবং তার আনুগত্য করা, স্বামীর যাবতীয় অধিকার পূরণের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা। স্বামীর অধিকার আদায় না করে স্ত্রীর জৈবিক জীবন তেমনি সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে না, যেমন আল্লাহর হক আদায় না করে সফল হতে পারে না তার নৈতিক ও পরকালীন জীবন। শুধু তাই নয়, স্বামীর হক আদায় না করলে আল্লাহর হকও আদায় করা যায় না। রাসূলে করীম (স) খুবই জোরালো ভাষায় বলেছেনঃ

(আরবী*************************************)))))

যাঁর মুষ্টিতে মুহাম্মদের প্রাণ-জীবন, তাঁর শপথ, স্ত্রী যতক্ষণ পর্যন্ত তার স্বামীর হক আদায় না করবে, ততক্ষণ সে তার আল্লাহর হকও আদায় করতে পারবে না। স্বামী যদি স্ত্রীকে পেতে চায় –যখন সে সওয়াব হয়ে যাচ্ছে –তবে তখনো সে স্বামীকে নিষেধ করতে পারবে না।

বস্তুত স্বামীর হক আদায় করার জন্যে দরকার তার আনুগত্য করা, তার কথা বা দাবি অনুযায়ী কাজ করা। এজন্যে সর্বোত্তম স্ত্রী কে এবং কি তার গুণ, এ ধরনের এক প্রশ্নের জবাবে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************)

সে হচ্ছে সেই স্ত্রীলোক, যাকে স্বামী দেখে সন্তুষ্ট হবে, যে স্বামীর আনুগত্য করবে এবং তার নিজের স্বামীর ধনমালে স্বামীর মতের বিরোধিতা করবে না –এমন কাজ করবে না, যা সে পছন্দ করে না।

ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামীর আনুগত্য করা স্ত্রীর যেমন কর্তব্য, তেমনি অত্যন্ত বিরাট মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের ব্যাপারও বটে। নিম্নোক্ত হাদীসে এ মর্যাদা ও মাহাত্মের কথা সুস্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে।

(আরবী****************************************************************************)

মুসলিমদের জন্যে তাকওয়ার পর সবচেয়ে উত্তম জিনিস হচ্ছে নেককার চরিত্রবতী স্ত্রী –এমন স্ত্রী, যে স্বামীর আদেশ মেনে চলে, স্বামী তার প্রতি তাকালে সন্তুষ্ট হয়ে যায় এবং স্বামী কোনো বিষয়ে কসম দিলে সে তা পূরণ করবে। আর স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার নিজের ও স্বামীর ধনমালের ব্যাপারে স্বামীর কল্যাণকামী হবে।

অন্য কথায়, আল্লাহর ভয় ও তাকওয়ার পর সব মুসলিম পুরুষের জন্যেই সর্বোত্তম সৌভাগ্যের সম্পদ হচ্ছে সতী-সাধ্বী, সুদর্শনা ও অনুগতা স্ত্রী। প্রিয়তম স্বামীর সে একান্ত প্রিয়তমা, স্বামীর প্রতিটি কতায় সে উৎসর্গীকৃতা, সতীত্ব ও পবিত্রতা রক্ষার ব্যাপারে সে অতন্দ্র সজাগ আর এ রকম স্ত্রী যেমন একজন স্বামীর পক্ষে গৌরব ও মাহাত্ম্যের ব্যাপার, তেমনি এ ধরনের স্ত্রীও অত্যন্ত ভাগ্যবতী।

স্বামীর আনুগত্য করার ওপর এই সব হাদীসেই বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, পারিবারিক জীবনে স্ত্রী যদি স্বামীর প্রাধান্য স্বীকার না করে, স্বামীকে মেনে না চলে, স্বামীর উপস্থিতি-অনুপস্থিতি উভয় সময়ই যদি স্ত্রী স্বামীর কল্যাণ বিধানে প্রস্তুত না থাকে, তাহলে দাম্পত্য জীবন কখনই মধুর হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু স্বামীর এ আনুগত্যও অবাধ নয়, অসীম নয়, নয় নিঃশর্ত। ইসলামের আনুগত্যের ব্যাপারে সর্বত্র শরীয়ত সীমার উল্লেখ করা হয়েছে। নবী করীম (স) বলেছেনঃ ‘সঙ্গত ও শরীয়তসম্মত কাজে স্বামীর আনুগত্য করা স্ত্রীর কর্তব্য’। অন্যত্র বলেছেনঃ ‘কোনো স্ত্রী ঈমানের স্বাদ ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারে না, যতক্ষণ না সে তার স্বামীর ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় করবে’। (আরবী********************)

এ দুটি হাদীসেই ‘সঙ্গত’ ও ‘শরীয়তসম্মত’ বা ‘ন্যায়সঙ্গত’ শর্তের উল্লেখ রয়েছে। কাজেই স্বামীর অন্যায় জিদ বা শরীয়ত-বিরোধী কাজের কোনো আদেশ বা আবদার পালন করতে স্ত্রী বাধ্য নয়। শুধু তা-ই নয়, স্বামী শরীয়ত-বিরোধী কোনো কাজের আদেশ করলে তা অমান্য করাই ঈমানদার স্ত্রীর কর্তব্য। বুখারী শরীফের এক অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছেঃ

(আরবী**********************************************)

গুনাহের কাজে স্ত্রী স্বামীর আদেশ মানবে না –এ সম্পর্কিত হাদীসের অধ্যায়।

আর তারপরই যে হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে, এক আনসারী মহিলা তার কন্যাকে বিয়ে দেয়। বিয়ের পর কন্যার মাথায় চুল পড়ে যেতে শুরু করে। তখন মহিলাটির জামাতা তাকে বলল –তার স্ত্রীর মাথায় পরচুলা লাগিয়ে দিতে। তখন মাহিলাটি রাসূলে করীমের দরবারে হাজির হয়ে বললঃ

(আরবী****************************************************************************)

আমার মেয়ের স্বামী আমাকে আদেশ করেছে যে, আমি যেন মেয়ের মাথায় পরচুলা জুড়ে দেই।

একথা শুনে রাসূলে করীম (স) বললেনঃ

(আরবী***************************************************************)

না, তা করবে না, কেনান যেসব মেয়েলোক পরচুলা লাগায় তাদের ওপর লানত করা হয়েছে।

অন্য কথায়, পরচুলা লাগানো যেহেতু হারাম, অতএব এ হারাম কাজের জন্যে স্বামীর নির্দেশ মানা যেতে পারে না। (আরবী***************)

নিজের ও স্বামীর ধন-সম্পদে স্ত্রীর অধিকার

স্বামীর ঘরে স্ত্রীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থায় সুস্পষ্টরূপে স্বীকৃত। স্ত্রীর যেমন অধিকার আছে সীমার মধ্যে থেকে যাবতীয় দায়িত্ব পালন করার পরে যে কোনা কাজ করে অর্থোপার্জন করার, তেমনি অধিকার রয়েছে সেই উপার্জিত অর্থের মালিক হওয়ার এবং নিজের ইচ্ছানুক্রমে তা ব্যয় ও ব্যবহার করার। স্বামীর ধন-সম্পদেও তার ব্যয়-ব্যবহার ও দান প্রয়োগের অধিকার রয়েছে। সেই সঙ্গে সে মীরাস পেতে পারে পিতার, ভাইয়ের, পুত্র-কন্যার এবং স্বামীর।

স্বামীর ধন-সম্পদে স্ত্রীর অধিকার এতদূর রয়েছে যে, তার ব্যয়-ব্যবহার করার ব্যাপারে সে তার স্বামীর মর্জি বা অনুমতির মুখাপেক্ষী নয়। হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী**************************************************************)_)

স্ত্রী যদি স্বামীর খাদ্যদ্রব্য থেকে শরীয়ত-বিরোধী নয় –এমন কাজে এবং খারাপ নয় –এমনভাবে ব্যয় করে তবে তাতে তার সওয়াব হবে, কেননা সে ব্যয় করেছে; আর তার স্বামীর জন্যেও সওয়াব রয়েছে, কেননা সে তা উপার্জন করেছৈ।

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী***************************************************************************)

স্ত্রী যদি তার স্বামীর কামাই-রোজগার করা ধন-সম্পদ থেকে তার আদেশ ব্যতীতই কিছু ব্যয় করে, তবে তার স্বামী তার অর্ধেক সওয়াব পাবে।

হযরত আসমা বিনতে আবূ বকর (রা) একদিন রাসূলে করীম (স)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ

(আরবী*******************************************************************)

হে রাসূল, স্বামী জুবাইর আমাকে সংসার খরচ বাবদ যা কিছু দেন, তা ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। এখন তা থেকে যদি আমি দান-সাদকার কাজে কিছু ব্যয় করি, তবে কি আমার গুনাহ হবে?

তখন নবী করীম (স) বললেনঃ

(আরবী****************************************)

যা পারো দান-সাদকা করো –করতে পারো; তবে নিজের তহবিলে নিয়ে জমা করে রেখো না, তাহলে মনে রেখো, আল্লাহও তোমার জন্যে শাস্তি জমা করে রাখবেন।

ইবনে আরাবী লিখেছেনঃ স্বামীর ঘরের মাল-সম্পদ থেকে দান-সাদকা করা স্ত্রীর পক্ষে জায়েয কিনা –এ সম্পর্কে প্রথম যুগের মনীষিগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়ছে। অনেকের মতে –সে দানের পরিমাণ অল্প, সামান্য ও হালকা হলে কোনো দোষ নেই, তা জায়েয। কেননা তাতে স্বামীর বিশেষ কোনো ক্ষতি-লোকসানের আশংকা নেই। কেউ বলেছেন, স্বামীর অনুমতি হলে তবে তা করা যেতে পারে; সেই অনুমতি সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট হলেও ক্ষতি নেই। ইমাম বুখারীরও এই মত। তবে কোনে প্রকার অন্যায় কাজে অর্থ ব্যয় কিংবা স্বামীর ধন-সম্পদ বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় করা সর্বসম্মতবাবে না জায়েয। অনেকের মতে স্বামীর ধন-সম্পদে যখন স্ত্রীর অধিকার স্বীকৃত এবং তা দেখাশোনা করার দায়িত্বও তারই ওপর রয়েছে, তখন তা দান-সদকা করাও স্ত্রীর পক্ষে অবশ্যই সঙ্গত হবে।

ইমাম শাওকানীর মতে এ সম্পর্কিত যাবতীয় হাদীস থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয়ঃ

(আরবী*************************************************************************)

স্বামীর ঘর থেকে তার অনুমতি ব্যতিরেকেই অর্থসম্পদ ব্যয় করা স্ত্রীর পক্ষে সম্পূর্ণ জায়েয।

তবে যেসব হাদীসে এ সম্পর্কে নিষেধ উল্লিখিত হয়েছে, নিষেধের মানে ‘হারাম’ নয়, বরং বড়জোর মাকরূহ। আর মকরূহ তানজীহ জায়েয হওয়ার পরিপন্থী নয়।

(আরবী************************************************************************)

অপর এক হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছ, মুজার কবীলার এক সম্মানিতা মহিলা রাসূলে করীম (স)-কে সম্বোধন করে বললেনঃ

(আরবী*******************************************************************************)

হে আল্লাহর নবী, আমরা হচ্ছি আমাদের পিতা, পুত্র ও স্বামীদের ওপর এক বোঝা স্বরূপ। এমতাবস্থায় তাদের ধনমাল থেকে ব্যয় করার কোনো অধিকার আমাদের আছে কি?

জবাবে রাসূলে করীম (স) বললেনঃ

(আরবী*********************************************************)

যাবতীয় তাজা খাদ্য তোমরা খাবে, আর অপরকে হাদিয়া-তোহফা দেবে।

এ হাদীস থেকেও প্রমাণিত হয় যেঃ

(আরবী********************************************************************)

মেয়েদের জন্যে তাদের স্বামী, পিতা ও পুত্রের ধনমাল থেকে তাদের অনুমতি ছাড়াই পানাহার করা ও অপরকে হাদিয়া-তোহফা দেয়া সম্পূর্ণ জায়েয।

তবে ইমাম শাওকানীর মতে মেয়েদের এ অধিকার কেবলমাত্র খাদ্য ও পানীয়ের দ্রব্যাদি সম্পর্কেই প্রযোজ্য ও স্বীকৃত। কাপড়-চোপড় ও টাকা-পয়সার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। এ পর্যায়ে পরের উক্ত হাদীসটি উল্লেখযোগ্যঃ

(আরবী********************************************************************)

স্ত্রী স্বামীর আদেশ-অনুমতি ব্যতিরেকেই যা কিছু ব্যয় করে তার অর্ধেক সওয়াব সে স্বামীকে দেয়।

স্ত্রীর নিজস্ব ধনমাল ব্যয়-ব্যবহার ও দান-সদকা করার অধিকার আছে কিনা, থাকলে কতখানি, তা নিম্নের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************)

স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর অনুমতি ছাড়া অন্য লোককে দান-সাদকা করা বা উপহার-উপঢৌকন দেয়া জায়েয নয়।

অপর বর্ণনায় হাদীসটির ভাষা নিম্নরূপঃ

(আরবী*******************************************************************)

স্ত্রীর সমগ্র যৌন সত্তার মালিক যখন স্বামী, তখন তার অনুমতি ছাড়া তার নিজের ধনমাল ব্যয়-বণ্টন করা স্ত্রীর জন্যে জায়েয নয়।

এ হাদীস থেকে বাহ্যত প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রী যদি পূর্ণ বয়স্কা ও বুদ্ধিমতিও হয়, তবু স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে তার নিজের ধনমাল থেকেও দান-সাদকা করা, উপহার-উপঢৌকন দেয়া তার পক্ষে জায়েয নয়। কিন্তু এ সম্পর্কিত চূড়ান্ত ফায়সালায় মনীষীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম লাইস বলেছেনঃ

(আরবী******************************************************)

স্ত্রীর পক্ষে তা আদৌ জায়েয নয়, এক-তৃতীয়াংশের ওপরও নয়, তার কম পরিমাণের ওপর নয়। তবে অল্প-স্বল্প পরিমাণ ধর্তব্য নয়।

তাউস ও ইমাম মালিক বলেছেঃ

(আরবী**************************************************************)

স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রী তার নিজের ধনমালের এক-তৃতীয়াংশ থেকে দান-সাদকা করতে পারে। তার বেশি পারে না।

আর অধিকাংশ ফিকাহবিদ ও মনীষীদের মত হচ্ছেঃ

(আরবী***********************************************)

স্ত্রী যদি বুদ্ধিহীনা ও বোকা না হয়, তাহলে স্বামীর কোনো প্রকার অনুমতি ব্যতিরেকেই তার (স্ত্রী) নিজের ধনমাল থেকে সে ব্যয়-ব্যবহার করতে পারে। আর সে যদি বুদ্ধিহীনা ও বোকা হয়, তবে তা জায়েয নয়।

এঁদের দলীল হচ্ছে প্রধানত এই যে, রাসূলে করীম (স)-এর আহবানক্রমে মহিলা-সাহাবিগণ নিজ নিজ অলংকার জিহাদের জন্যে দান করেছিলেন কিংবা যাকাত বাবদ দিয়ে দিয়েছিলেন এবং রাসূলে করীম (স) তা গ্রহণও করেছিলেন। এ থেকে স্পষ্টত প্রমাণিত হয় যে, স্বামীর অনুমতি –এমন কি তার উপস্থিতি ছাড়াই স্বামীর ধন-সম্পদ থেকে দান-সাদকা করা যখন স্ত্রীর পক্ষে জায়েয হলো তখনঃ

(আরবী****************************************************************)

স্ত্রীর নিজের ধনমাল থেকে দান-সদকা করা তো আরো বেশি করে জায়েয হবে।

ঈদের ময়দানে উপস্থিত মেয়েরা নবী করীম (স)-এর আহবানক্রমে নিজেদের অলংকারাদি যাকাত বাবদ কিংবা দ্বীনরে জিহাদের জন্যে দান করেছিল। হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছেঃ

(আরবী*********************************************************************************)

নবী করীম (স) মেয়েদের কাছে উপস্থিত হয়ে তাদের নসীহত করলেন, তাদের লক্ষ্য করে ওয়াজ করলেন এবং সাদকা দিতে আদেশ করলেন। এ সময় বিলাল কাপড় পেতে ধরলেন এবং মেয়েরা আংটি, কানের বালা, ঝুমকা ইত্যাদি অলংকার সে কাপড়ের ওপর ফেলতে লাগল।

ইমাম নববী এ হাদীস সম্পর্কে লিখেছেনঃ

(আরবী***************************************************************)

এ হাদীস প্রমাণ করছে যে, মেয়েরা তাদের নিজেদের ধন-সম্পদ থে স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকেই দান সাদকা করতে পারে –করা জায়েয এবং এ দান মোট সম্পদের এক-তৃতীয়াংশের মধ্য থেকে হওয়ার কোনো শর্ত নেই।

এ হাদীস থেকে একথাও স্পষ্ট বেঝা যাচ্ছে যে, নবী করীম (স) যখন মেয়েদের দান করতে বললেন এবং সে দান গ্রহণ করাও হচ্ছিল, তখন তিনি এ কথা জিজ্ঞেস করেন নি যে, তারা তাদের স্বামীদের কাছে অনুমতি পেয়ে দান করছে কিনা। বরং তারা যে তাদের স্বামীদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দান করছে না তা তখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। দানকারিণী এ মহিলাদের স্বামীরা ময়দানে উপস্থিত ছিল বটে, কিন্তু তারা ছিল বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত। তাদের বেগমরা ঈদ-ময়দানের অপর একপাশে বসে কেবলমাত্র রাসূলে করীমের নির্দেশ মতো দান করছিলেন। ফলে তাদের স্বামীরা এ দানের খবর এবং তার পরিমাণ সম্পর্কে জানতেও পারেনি, আর এ দানে তাদের অনুমতি দেয়ারও কোনো অবকাশ ছিল না। কাজেই তাদের নীরব অনুমতিরও কোনো প্রশ্ন ওঠে না।

দ্বিতীয়ত মেয়েরা যখন দান করছিল, তখন তাদের সমস্ত সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ থেকে দান করছে কিনা, তা জিজ্ঞেস করারও কোনো প্রয়োজন নবী করীম (স) বোধ করেন নি।


একাধিক স্ত্রী গ্রহণ
ইসলামের দৃষ্টিতে পারিবারিক জীবনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে নরনারীর নৈতিক পবিত্রতা ও সতীত্ব সংরক্ষণ। আর এজন্যে যেমন বিয়ে করার আদেশ করা হয়েছে, তেমনি পুরুষদের জন্যে এ অনুমতিও দেয়া হয়েছে যে, বিশেষ কোনো কারণে যদি এক সাথে একের অধিক স্ত্রী গ্রহণ করা তার পক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়ে তাহলে সে তা করতে পারে। তবে তার শেষ সীমা হচ্ছে চারজন পর্যন্ত। এক সঙ্গে চারজন পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহণ করা একজন পুরুষের পক্ষে জায়েয –বিধিসঙ্গত। এক সময়ে চারজনের অধিক স্ত্রী গ্রহণ করা সম্পূর্ণ হারাম। কুরআন মজীদে এ সম্পর্কে যে আয়াতটি রয়েছে তা হচ্ছে এইঃ

(আরবী*******************************************************************)

তবে তোমরা বিয়ে করো যা-ই তোমাদের জন্যে ভালো হয় –দুইজন, তিনজন, চারজন।

(আরবী******) অক্ষরের কারণে আয়াতের দুটো অর্থ হতে পারে। প্রথমত মেয়েলোকদের মধ্য থেকে দুই, তিন, চার য বা যত সংখ্যাই তোমরা জন্যে ভালো হয়, তত সংখ্যক মেয়েই তুমি বিয়ে করো। আর দ্বিথীয় অর্থ হচ্ছেঃ মেয়েলোকদের মধ্য থেকে যে যে মেয়ে তোমার জন্যে ভালো বোধ হয় তাকে তাকে বিয়ে করো, তারা দু’জন হোক, তিন জন হোক, আর চার জনই হোক না কেন। এজন্যে তাফসীরকারগণ এ আয়াতের অর্থ লিখেছেন এ ভাষায়ঃ

(আরবী****************************************************************)

অর্থাৎ রূপ-সৌন্দর্য কিংবা জ্ঞান-বুদ্ধি অথবা কল্যাণকারিতার দৃষ্টিতে যে যে মেয়ে তোমাদের নিজেদের পক্ষে ভালো বোধ হবে তাদের বিয়ে করো।

ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, চারজনের অধিক স্ত্রী এক সময়ে ও এক সঙ্গে গ্রহণ করা হারাম। তাঁরা বরেছেন যে, এ আয়াতে সমগ্র মুসলিম উম্মাকে সম্বোধন করে কথা বলা হয়েছে। অতএব প্রত্যেক বিবাহকারী এ সংখ্যাগুলোর মধ্যে যে কোনো সংখ্যক স্ত্রী ইচ্ছা করবে গ্রহণ করতে পারবে।

এক সঙ্গে চারজন পর্যণ্ত স্ত্রী গ্রহণের এ অনুমতি আয়াতটির পূর্বাপর অনুসারে যদিও ইয়াতীম মেয়েদের বিয়ে করে তাদের ‘আদল’ করতে না পারার ভয়ে শর্তাধীন, তবুও সমগ্র মুসলিম মনীষীদের মতে এক সময়ে চারজন পর্যন্ত বিয়ে করার এ অনুমতি তার জন্যেও যে তা ভয় করে না; -ইয়াতীম বিয়ে করে তাদের প্রতি আদল করতে না পারার ভয় যাদের নেই, তারাও একঙ্গে চারজন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারবে।

আয়াতের (আরবী*******) ‘বিয়ে করো’ শব্দের কারণে যদিও বাহ্যত আদেশ বোঝায়, কিন্তু আসলে এর উদ্দেশ্য চারজন পর্যন্ত বিয়ে করার অনুমতি দান; সে জন্যে আদেশ দেয়া নয় এবং তা করা ওয়াজিব কিংবা ফরযও নয়; বরং তা অনুমতি মাত্র। অতএব তা জায়েয বা মুবাহ বৈ আর কিছু নয়। বিভিন্ন যুগের তাফসীরকার ও মুজতাহিদগণ এ মতই প্রকাশ করেছেন এবং এ ব্যাপারে আজ পর্যন্ত মনীষীদের মধ্যে কোনো দ্বিমত দেখা দেয়নি।

কিন্তু রাফেজী ও খাওয়ারিজদের মত স্বতন্ত্র। রাফেজীরা কুরআনের এ আয়াতের ভিত্তিতেই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, একসঙ্গে নয়জন পর্যন্ত স্ত্রী রাখা যেতে পারে –জায়েয নয়। নখয়ী ইবনে আবূ লায়লা –এই দুই তাবেয়ী ফকীহরও এইমত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁদের দলীল হচ্ছে, আয়াদের (আরবী******) (এবং) অক্ষরটি। তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় যে, এই তিনটি সংখ্যার কোনো একক সংখ্যা জায়েয নয়, বরং এর যোগফল অর্থাৎ দুই, তিন ও চার –মোট নয় জন একত্রে বিয়ে করা জায়েয। তাদের মতে আয়াতটির মানে হবে এরূপঃ

(আরবী*****************************************************************))

অতএব, বিয়ে করো দুই এবং তিন এবং চার। আর এর যোগফল হচ্ছে নয়।

খারেজীরা আবার এ আয়াত থেকেই প্রমাণ করতে চেয়েছে যে, মাত্র নয় জন নয়, নয় –এর দ্বিগুণ অর্থাৎ আঠার জন স্ত্রী একসঙ্গে রাখা জায়েয। তাদের মতে আয়াতে উদ্ধৃত প্রত্যেকটি সংখ্যা দু’ দু’বার করে যোগ করতে হবে, তবেই হবে বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্যের সংখ্যা –অর্থাৎ আঠার।

কিন্তু এ দুটো মতই সম্পূর্ণ ভুল ও বাতিল এবং বিভ্রন্তিকর। কেননা তাদের একথা কুরআনের বর্ণনাভঙ্গী ও উদ্দেশ্যের সাথে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যহীন, কোনো মিল নেই। আল্লাহ যদি এক সঙ্গে নয় জন স্ত্রী গ্রহণ জায়েয করে দিতে চাইতেন, তাহলে নিশ্চয়ই এরূপ ভাষায় বলতেন না –বলতেনঃ

(আরবী**********************************************************************)

তোমরা বিয়ে করো দুইজন এবং তিনজন এবং চারজন মেয়ে লোক।

কিন্তু আল্লাহ তা’আলা এ ভাষায় কথাটি বলেন নি। এখানে কথাটি বলায় যে ভঙ্গী অবলম্বিত হয়েছে তদৃষ্টে এর তরজমা করতে হলে তার ভাষা হবে এমনিঃ

(আরবী********************************************************************)

তোমাদের জন্যে চারজন পর্যন্ত বিয়ে করা সঙ্গত। আর তাদের মধ্যে আদল করতে না পারলে তবে তিনজন, যদি তাদের মধ্যেও আদল করতে না পার তবে দুজন। আর তাদের মধ্যেও যদি আদল রক্ষা করতে না পার তবে মাত্র একজন।

আয়াতের কথার ধরন হচ্ছে এই। অক্ষমের জন্যে তার সামর্থের সর্বোচ্চ সংখ্যা হচ্ছে একজন অথচ হালালের সর্বোচ্চ সংখ্যা হচ্ছে চারজন। কুরআনে এই হচ্ছে সর্বশেষ সংখ্যা। আল্লাহ যদি নয় জন কিম্বা আঠারজন পর্যন্তই হালাল করতে চাইতেন, তাহলে বলতেনঃ

(আরবী******************************************************************)

তোমরা নয়জন বিয়ে করো অথবা আঠারজন বিয়ে করো আর যদি আদল করতে না পারো, তাহলে একজন মাত্র।

আমাদের নিজস্ব কথার ধরন থেকেও এর প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে পারি; আমি যদি বহু সংখ্যক লোকের সামনে কিছু পয়সা রেখে দিয়ে বলিঃ “তোমরা দুই-দুই, তিন-তিন, চার-চার পয়সা করে নাও” তবে তার অর্থ কখনো এ হবে না যে, এক-একজন নয় পয়সা করে নেবে।

এজন্যে আল্লামা ইবনে কাসীর এ আয়াতের নাম লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

অর্থাৎ তোমরা বিয়ে করো মেয়েদের মধ্যে যাকে চাও। তোমাদের কেউ চাইলে দুজন, কেউ চাইলে তিনজন এবং কেউ চাইলে চারজন পর্যন্ত।

এতদ্ব্যতীত এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, কুরআন –কুরআনের এ আয়াতও –রাসূলে করীমের প্রতি নাযিল হয়েছিল এবং তিনি নিজে এ আয়াতের ব্যাখ্যা দান করেছেন। এ আয়াত কায়স ইবনুল হারেস প্রসঙ্গে নাযিল হওয়ার পর রাসূলে করীম (স) তাকে ডেকে বললেনঃ

(আরবী**************************************************************)

চারজনকে তালাক দাও, আর বাকী চারজনকে রাখো।

সে গিয়ে তার নিঃসন্তান স্ত্রীকে এক এক করে বললোঃ

(আরবী**************************************************************)

হে অমুক! তুমি চলে যাও।

অপর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, গায়লান ইবন সাকাফী যখন ইসলাম কবুল করে তখন তার দশজন স্ত্রী বর্তমান ছিল এবং তারা সকলেই তার সঙ্গে ইসলাম কবুল করে। তখন নবী করীম (স) তাঁকে বললেনঃ

(আরবী*************************************************************)

এদের মদ্যে মাত্র চারজন বাছাই করে রাখো।

নওফল ইবনে মুয়াবিয়া ফায়লামী বলেনঃ

(আরবী****************************************************************)

আমি যখন ইসলাম কবুল করি, তখন আমার পাঁচজন স্ত্রী ছিল। রাসূলে করীম (স) তখন আমাকে আদেশ করলেনঃ মাত্র চারজন রাখো, বাকিদের ত্যাগ করো। ওরওয়া ইবনে মাসউদ বলেনঃ আমি যখন ইসলাম কবুল করি তখন আমার দশজন স্ত্রী ছিল। রাসূলে করীম (স) আমাকে বললেনঃ

(আরবী**********************************************************)

এদের মধ্য থেকে মাত্র চারজনকে বাছাই করে রাখো আর বাকি সবাইকে ছেড়ে দাও।

কায়স ইবনুল হারেস সম্পর্কিত হাদীসের সনদ সম্বন্ধে মুহাদ্দিসগণ আপত্তি তুলেছেন। ইমাম শাওকানী লিখেছেন যে, এ হাদীসের সনদে মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আবি লায়লা নামের একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন, আর হাদীস শাস্ত্রের সব ইমামই তাঁকে ‘যয়ীফ বর্ণনাকারী’ বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম বাগভী বলেছেণ, কায়স ইবনুল হারিস কিংবা হারিস ইবনে কায়স থেকে এতদ্ব্যতীত অপর কোনো হাদীস বর্ণিত হয়েছে বলে আমি জানি না।

আর আবূ আমর আন-নমীরী বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************)

তাঁর বর্ণিত এই একটি মাত্র হাদীস ছাড়া অন্য কোনো হাদীসই নেই। কিন্তু এ হাদীসটিও তিনি খুব বিশুদ্ধাবে বর্ণনা করতে পারেন নি।

আর গায়লান সাকাফী সম্পর্কত হাদীসটি সম্বন্ধেও অনুরূপ আপত্তি তোলা হয়েছে।

হাদীসদ্বয়ের সনদ সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের এ আপত্তি যদ্ৱও অকাট্য এবং তা এক-এটি সনদ সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে সত্য, কিন্তু কেবল সেই একটি সূত্র থেকেই মূল হাদীস কয়টি বর্ণিত হয়নি, তা আরো কয়েকটি সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। অতএব হাদীসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সুস্পষ্ট ও অনস্বীকার্য এবং তা হচ্ছে এই যে, কুরআনের এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর রাসূলে করীম (স) তা থেকে চারজন পর্যন্ত স্ত্রী এক সঙ্গে ও এক ময়ে রাখা জায়েয –তার অধিক নয় –এ কথাই বুঝতে পেরেছেন এবং তিনি ঠিক সেই অনুযায়ী চারজনের অধিক স্ত্রী না রাখার নির্দেশও কার্যকরভাবে জারি করেছেণ। আল্লামা শাওকানী লিখেছেন, ‘কুরআনের উপরোক্ত আয়াত দ্বারা চারজনের অধিক স্ত্রী একসঙ্গে গ্রহণ জায়েয নয় বলে অকাট্যভাবে প্রমাণ করা যায় না, তবে হাদীসের ভিত্তিতে তা অবশ্যই প্রমাণিত হয়। বিশেষত সমগ্র মুসরিম সমাজই যখন এ সম্পর্কে একমত’।

শুধু তাই নয়, রাসূলে করীম (স)-এর সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দুনিয়ার সব মুসলিমের সর্বসম্মত মত হচ্ছে একসঙ্গে সর্বাধিক ও অনুর্ধ্ব মাত্র চারজন পর্যন্ত স্ত্রী রাখা জায়েয, তার অধিক নয়।

এ পর্যায়ে আল্লামা ইবনে কাসীর লিখেছেনঃ

(আরবী********************************************************************)

এক সঙ্গে চারজনের অধিক স্ত্রী রাখা যদি জায়েয হতো তাহলে রাসূলে করীম (স০ তাকে (গায়লানকে) তার দশজন স্ত্রী রাখবারই অনুমতি দিতেন –বিশেষত তারা যখন ইসলাম কবুল করেছিল। কিন্তু কার্যত যখন দেখছি, তিনি মাত্র চারজন রাখার অনুমতি দিচ্ছেন এবং অবশিষ্টদের বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দিচ্ছেন, তখন তা থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো যে, কোনোক্রমেই এক সঙ্গে চারজনের অধিক স্ত্রী রাখা জায়েয নয়। আর স্থায়ীকালের জন্যে যখন এ অবস্থা, তখন নতুন করে গ্রহণের ব্যাপারে তো এরূপ নির্দেশ হবে অবশ্যম্ভাবীরূপে।

ইমাম ইবনে রুশদ লিখেছেনঃ

(আরবী*********************************************************)

সমগ্র মুসলিম একসঙ্গে চারজন স্ত্রী গ্রহণ জায়েয হওয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ একমত।

……এবং চারজনের অধিক স্ত্রী গ্রহণ অধিকাংশ মুসলিমের মতে –চারজনের বর্তমানে পঞ্চমা গ্রহণ জায়েয নয়।

মওলানা সানাউল্লাহ পানীপতি লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************************)

সমস্ত ইমাম ও সমগ্র মুসলিমের মতে চারজনের অধিক বিয়ে করা জায়েয নয়।

তবে রাসূলে করীম (স) যে এক সঙ্গে নয়জন কিংবা ততোধিক স্ত্রী রেখেছিলেন তার কারণ, আল্লাহর বিশেষ অনুমতিক্রমে কেবল মাত্র তাঁরই জন্যে তা সম্পূর্ণ জায়েয নয়। তিনি ছাড়া মুসলিমদের মধ্যে অপর কারো জন্যেই তা জায়েয নয়। ইবনুল হাজার আসকালানী লিখেছেনঃ

(আরবী******************************************************************************)

চারজনের অধিক স্ত্রী একসঙ্গে ও এক সময়ে রাখা বিশেষভাবে কেবলমাত্র রাসূলে করীম (স)-এর জন্যেই জায়েয ছিল –এ সম্পর্কে সব মনীষীই সম্পূর্ণ একমত।

ইমাম শাফেয়ী (রহ) লিখেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************************************)

রাসূলে করীম (স)-এর সুন্নাত –যা আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিষ্ঠিত –প্রমাণ করেছে যে, রাসূলে করীম (স) ব্যতীত অপর কারো জন্যেই একসঙ্গে ও এক সময়ে চারজনের অধিক স্ত্রী রাখা জায়েয নয়।

আল্লামা ইবনে কাসীর লিখেছেনঃ

(আরবী************************************************************************)

রাসূলের এই নয়, এগারো, পনের জন স্ত্রী এক সঙ্গে রাখা তার জন্যে বিশেষ অনুমোদিত ব্যাপার, মুসলিম উম্মতের মধ্যে এ জিনিস অপর কারো জায়েয নয়।

মোটকথা, একাধিক স্ত্রী গ্রহণ বর্তমান সভ্যতায় যতই দূষণীয় ও কলংকের কাজ হোক না কেন, আল্লাহ ও রাসূলের দৃষ্টিতে এ কাজ যে একেবারে ঘৃণার্হ ও নিষিদ্ধ ছিল না, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। বিশেষত যে সব পুরুষ একজন মাত্র স্ত্রী দ্বারা নিজের চরিত্রকে পবিত্র ও নিষ্কলুষ রাখতে পারে না, যৌন শক্তির প্রাবল্য পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত হতে ও অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করতে যাদের বাধ্য করে, তার পক্ষে একাধিক স্ত্রী –দুজন থেকে প্রয়োজনানুপাতে চারজন পর্যন্ত –গ্রহণ করা যে কর্তব্য তাতে কোনোই সন্দেহ থাকতে পারে না। এ ধরনের ব্যক্তিদের পক্ষে এ কেবল অনুমতিই নয়, এ হচ্ছে তাদের প্রতি সুস্পষ্ট আদেশ। কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে চরিত্রের পবিত্রতা হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চরিত্রই যদি রক্ষা না পেল, তাহলে দুনিয়ায় মানুষের স্থান একান্তভাবে পশুদের স্তরে। আর চরিত্রকে রক্ষা করার জন্যেই এ কাজ যদি অপরিহার্যই হয়, তাহলে তা অবশ্যই করতে হবে।

ইসলামের একাধিক স্ত্রী গ্রহনের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ মানবিক ও নৈতিক ব্যবস্থা মাত্র। ইসলাম ঠিক যে কারণে বিয়ে করার অনুমতি বা নির্দেশ দিয়েছে, ঠিক সেই একই কারণে একাধিক (চারজন পর্যন্ত) স্ত্রী গ্রহণেরও অনুমতি দিয়েছে। এ অনুমতি যদি ইসলামে না থাকত, তাহলে বিয়ে করার অনুমতি বা আদেশ দেয়া একেবারেই অর্থহীন –উদ্দেশ্যহীন হয়ে যেত। অবশ্য কুরআনের যে আয়াতে একাধিক বিয়ের এ অনুমতির উল্লেখ হয়েছে তাতেই এ পর্যায়ে একটি গুরুতর শর্তেরও উল্লেখ করা হয়েছে আর তা হচ্ছে (আরবী******) সুবিচার, সমান মানে ও সমান প্রয়োজনে সকলের অধিকার আদায় করা।

সমতা বিধানের শর্ত

কেউ যদি একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করে –কারো যদি স্ত্রী থাকে দুই, তিন কিংবা চারজন, তবে স্ত্রীদের যা কিছু অধিকার এবং যা কিছু তাদের জন্যে করা স্বামীর কর্তব্য, স্বামী তার সব কিছুই পূর্ণ সুবিচার, ন্যায়পরতা, নিরপেক্ষতা ও পূর্ণ সমতা সহকারে যথারীতি আদায় করবে। পোশাক-পরিচ্ছদ, বাসস্থান-বাসসামগ্রী, খাদ্য, সঙ্গদান, মিল-মিশ, হাসি-খুশীর ব্যবহার, কথা-বার্তা বলা ইত্যাদি সব বিষয়ে ওসকল ক্ষেত্রেই সমতা রক্ষা করে –সকল স্ত্রীর অধকার আদায় করা স্বামীর কর্তব্য। এ সম্পর্কে প্রথমত একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি যে আয়াতে দেয়া হয়েছে, তাকেই সামনে রাখতে হবে। আয়াতটি পূর্ণ আকারে নিম্নরূপঃ

(আরবী*********************************************************************************)

তোমুরা যদি ইয়াতীম মেয়েদের সম্পর্কে ভয় করো যে, তাদের বিয়ে করে ইনসাফ রক্ষা করতে পারবে না, তাহলে তোমরা মেয়ে লোকদের মধ্যে দুই, তিন, চার –তোমাদের যা ভালো লাগে তাই বিয়ে করো। আর তাদের মধ্যে সুবিচার করতে পারবে না বলে যদি ভয় করো তোমরা, তাহলে একজন মাত্র স্ত্রী গ্রহণ করবে অথবা তোমাদের দাসীদের ব্যবহার করবে।

যেন কোনো একজনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে অন্যদের প্রতি জুলুম না করো, এ ব্যবস্থা তার অধিক অনুকূল নিকটবর্তী।

স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আয়াতে পর পর দুটি বিষয়ে “তোমরা যদি ভয় করো” বলা হয়েছে। প্রথম ইয়াতীম মেয়েদের বিয়ে। তাদের প্রতি ইনসাফ করতে না পারা সম্পর্কে; আর দ্বিতীয় হচ্ছে এক সঙ্গে দুই, তিন বা চার জন স্ত্রী গ্রহণ করে তাদের প্রতি সুবিচার করতে না পারা সম্পর্কে।

জাহিলিয়াতের জামানায় নিজেদের কাছে পালিতা ইয়াতীম মেয়েদের ধনমাল কিংবা রূপ-লাবণ্য-সৌন্দর্যের কারণে বিয়ে করে লোকেরা তাদের প্রতি মোটেই ইনসাফ করত না, ভালো ব্যবহার করত না, স্ত্রীদের অধিকার দিত না। এজন্যে আল্লাহ তা’আলা বলে দিলেনঃ ইয়াতীম মেয়েদের বিয়ে করে তাদের প্রতি তোমরা না-ইনসাফী করবে, এর চেয়ে বরং অন্যান্য মেয়েদের বিয়ে করো। তাহলে তাদেরকে স্ত্রীর অধিকার ও মর্যাদা-দান তোমাদের পক্ষে অসুবিধাজনক হবে না। এগুলো ইসলামের এক মূল্যবান সমাজ সংশোধনী নির্দেশ।

দ্বিতীয়ত একাধিক স্ত্রী একসঙ্গে যদি কেউ গ্রহণ করে, তাহলে সকলের প্রতি সুবিচার ও ইনসাফ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদি কেউ সুবিচার ও ইনসাফ রক্ষা করতে পারবে না বলে ভয় করে, তবে তাকে একজন মাত্র স্ত্রী গ্রহণ করবার অনুমতিবা নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

আয়াতে উল্লিখিত (আরবী*********) শব্দের তাৎপর্য অনুধাবনীয়। আল্লামা রাগেম ইসফাহানী লিখেছেনঃ

(আরবী*********************************************************************)

‘আদল’ –সুবিচার-ইনসাফ –মানে সমতা, সাম্য রক্ষা এবং ‘আদল’ মানে সমানভাবে ও হারে বা পরিমাণে অংশ ভাগ করে দেয়া। “আর তোমরা যদি ভয় পাও যে, স্ত্রীদের মধ্যে ‘আদল’ করতে পারবে না” এর মানে-

(আরবী****************************************************************************************)

সেই আদল ও ইনসাফ যা স্ত্রীদের মধ্যে রাত বণ্টন ও যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের ব্যাপারে স্বামীকে করতে হয়।

আল্লামা ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ

(আরবী***************************************************************************)

এর অর্থ হচ্ছে স্ত্রীদের মাঝে রাত ভাগ করে দেয়া এবং বিয়েজনিত অধিকারসমূহ আদায় করার ব্যাপারে পূর্ণ সমতা রক্ষা করা, সমভাবে প্রত্যেকের প্রাপ্য তাকেই আদায় করা। আর এ হচ্ছে ফরয।

বস্তুত একাধিক স্ত্রীর স্বামীর পক্ষে বণ্টন ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র স্ত্রীদের মধ্যে পূর্ণ ইনসাফ ও সমতা সহকারে পরিবেশন একান্তই কর্তব্য। আর যদি সে তা রক্ষা করতে পারবে না বলে আশংকা বোধ করেত তাহলে একজন স্ত্রীই গ্রহণ করা তার কর্তব্য। আল্লামা ইবনে কাসীর এ আয়াতের তরজমা করেছেন এ ভাষায়ঃ

(আরবী******************************************************************************)

তোমরা কয়েকজন স্ত্রীর মধ্যে ‘আদল’ রক্ষা করতে পারবে না বলে যদি ভয় করো, তাহলে একজন স্ত্রী গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হওয়া উচিত।

এই হচ্ছে কুরআন মজীদের ঘোষণা।

সুবিচার ও সমতা রক্ষার প্রকৃত তাৎপর্য

সুবিচার বণ্টনের পর্যায়ে একথা মনে রাখা আবশ্যক যে, সংখ্যা ও পরিমাণ ইত্যাদির দিক দিয়ে ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করার কথা এখানে বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে প্রত্যেক স্ত্রীর অধিকার সাম্য ও প্রয়োজনানুপাতে দরকারী জিনিস পরিবেশনের কথা। কেননা একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের সকলের প্রয়োজন, রুচি ও পছন্দ যে একই ধরনের ও একই মানের হবে এমন কোনো কথা নেই। কেউ হয়ত রুটিখোর, তার প্রয়োজন আটা বা রুটির। আর কেউ ভাতখোর, তার প্রয়োজন চাল বা ভাতের। কেউ হয়ত বেশ মোটা-সোটা, তার জামা ব্লাউজ ও পরিধেয় বস্ত্রের জন্যে বেশ কাপড় দরকার, আর কেউ হালকা-পাতলা, শীর্ণ, তার জন্যে প্রয়োজনীয় কাপড়ের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম। কেউ বেশি বয়সের মেয়েলোক, স্বামীসঙ্গ লাভের প্রয়োজন তার খুব বেশি নয়, খুব ঘন ঘনও প্রয়োজন দেখা দেয় না; আর কেউ হয়ত যুবতী, স্বাস্থ্যবতী, তার পক্ষে অধিক মাত্রায় স্বামীসঙ্গ লাভের দরকার। আবার কেউ যুবতী হয়েও রুগ্ন, তার যৌন মিলন অপেক্ষা সেবা শুশ্রুষা ও পরিচর্যার প্রয়োজন বেশি। কাজেই ‘আদল’ (আরবী******) সুবিচার ও সমতার অর্থ পরিমাণ বা মাত্রা-সাম্য নয়, বরং তার মানে হচ্ছে সকলের প্রতি সমান খেয়াল রাখা, যত্ন নেয়া এবং প্রত্যেকের দাবি যথাযথভাবে পূরণ করা। একাধিক স্ত্রী গ্রহণের শর্ত এতটুকু মাত্র, এর বেশি নয়। এ শর্ত পূরণ করতে পারবে না বলে যদি কেউ ভয় পায় এবং আত্মবিশ্লেষণ করে যদি বুঝতে পারে যে, একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে ‘আদল’ ইনসাফের এ শর্তটুকু পূরণ করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না, তাহলে তার উচিত আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী একজন মাত্র স্ত্রী গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হওয়া। এ কথাই তিনি বলেছেন আয়াতটির নিম্নোক্ত অংশেঃ

(আরবী**************************************************************************)

তোমরা ইনসাফ-সমতা রক্ষা করতে পারবে না বলে যদি ভয় করো তবে একজন মাত্র স্ত্রী গ্রহণ করবে …..বস্তুত জুলুম ও অবিচারের কাজ থেকে বেঁচে থাকার জন্যে এ হচ্ছে একাধিক কার্যকর ও অনুকূল ব্যবস্থা।

ইমাম শাফেয়ীর মতে আয়াতের এ অংশ আরো একটি শর্ত পেশ করছে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে। আর তা হচ্ছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ স্ত্রী এবং তাদের সন্তানদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহনের সামর্থ্য। তিনি আল্লাহর বাণী (আরবী**************) এর তরজমা করেছেন এ ভাষায়ঃ

(আরবী*********************************************************************)

তোমার সন্তান বেশি না হওয়ার পক্ষে এই একজন স্ত্রী গ্রহণই অধিক নিকটবর্তী ব্যবস্থা।

ইমাম বায়হাকী এ আয়াতের তাফসীর ইমামা শাফেয়ীর উপরোক্ত মত অনুযায়ী নিজ ভাষায় লিখেছেনঃ

(আরবী**********************************************************************)

একাধিক স্ত্রী গ্রহণেল অনুমতি থাকা সত্ত্বেও একজন মাত্র গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হলে ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করতে হয় এমন লোক বেশি হবে না।

এ তাফসীরকে ভিত্তি করে ড. মুস্তফা সাবায়ী লিখেছেনঃ

(আরবী***************************************************************************)

এ আয়াতটি প্রকারান্তরে ব্যয়ভার বহনের সামর্থ্যের একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে তুলে ধরে। যদিও এ শর্তটি পালনীয় কিন্তু এর ওপর আইন প্রয়োগ করা যায় না।

এ কারণে মুসলিম মনীষীগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত হয়েছেন যে, রাসূলে করীম (স)-এর ব্যাখ্যা ও বাস্তব ব্যবস্থার দৃষ্টিতে ‘আদল’ বলতে বোঝায়ঃ

(আরবী*************************************************************************)

একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে যে আদল-এর শর্ত আরোপ করা হয়েছে তা হচ্ছে বাসস্থান, পোশাক, খাদ্য, পানীয়, রাত যাপন এবং দাম্পত্য জীবনের এমন সব ব্যাপার, যাতে আদল-ইনসাফ রক্ষা করা যায় –এ সব বিষয়ের বাস্তব ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করা।

প্রশ্ন হতে পারে, স্ত্রী কি কেবল এ সব বৈষয়িক জিনিস পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারে? এ ছাড়া প্রেম-ভালোবাসাও তো প্রয়োজন রয়েছে এবং তাও তাদের পেতে হবে স্বামীর কাছ থেকেই। কাজেই সে দিদে দিয়েও সমতা রক্ষা করা কি একাধিক স্ত্রীর বেলায় স্বামীর কর্তব্য নয়?

এর জবাব হচ্ছে এই যে, হ্যাঁ, এসব জৈবিক প্রয়োজন ছাড়াও প্রেম-ভালোবাসা প্রভৃতি আধ্যাত্মিক ও মানবিক প্রয়োজনও স্ত্রীদের রয়েছে এবং তাও স্বামীর কাছ থেকেই তাদের পেতে হবে, তাতে সন্দেহ নেই। আর এ ব্যাপারে যতদূর সম্ভব সমতা রক্ষা করা স্বামীর কর্তব্য। অন্তত সে জন্যেই তাকে প্রাণ-পণে চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, প্রেম-ভালোবাসা, মনের ঝোঁক, টান, অধিক পছন্দ ইত্যাদি মনের গভীর সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে মানুষের নিজের ইচ্ছে ও চেষ্টা-যত্নের অবকাশ খুবই সামান্য। মানুষ হাজার চেষ্টা করেও অনেক সময় সফল হতে পারে না। একেবারে সূক্ষ্ম তুলাদণ্ডে ওজন করে সমান মাত্রায় ভালেবাসা সকল স্ত্রীর প্রতি পোষণ করা মানুষের সাধ্যাতীত। ঠিক এ সমস্যাই বাস্তবভাবে দেখা দিয়েছিল যখন একাধিক স্ত্রী গ্রহণের এ অনুমতি প্রথম নাযিল হয়েছিল। সাহাবায়ে কেরাম একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করে তাদের মধ্যে প্রথম প্রকারের প্রয়োজন পূরণের দিক দিয়ে পূর্ণ সমতা রক্ষা করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। এ চেষ্টায় তাঁরা সফলতাও লাভ করেছিলেন। কিন্তু প্রেম ভালোবাসা, ভালো লাগা, পছন্দ হওয়া, মন-মেজাজের মিল ইত্যাদি দিক দিয়েও পূর্ণ সমতা রক্ষা করতে তাঁরা অসমর্থ হলেন। হাজারো চেষ্টা করেওতাঁরা সব স্ত্রীকে সমান মাত্রায় ভালোবাসতে সমর্থ হলেন না। তখন তাঁরা মনের দিক দিয়ে খুব বেশি কাতর হয়ে পড়লেন, আল্লাহর কাছে এজন্যে কি জবাব দেবেন, এ চিন্তায় তাঁরা অস্থির হয়ে পড়লেন। তখন আল্লাহর তরফ থেকে এ বাস্তব সমস্যার সমাধান হিসেবে নাযিল হলো এ প্রসঙ্গের দ্বিতীয় আয়াতঃ

(আরবী**********************************************************************)

এবং তোমরা একাধিক স্ত্রী মাঝে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না –যত কামনা ও ইচ্ছাই তোমরা পোষণ কর না কেন। এমতাবস্থায় (এতটুকুই যথেষ্ট) তোমরা স্ত্রীদের মধ্যে কোনো একজনের প্রতি এমনভাবে পূর্ণমাত্রায় ঝুঁকে পড়বে না যে, অপর স্ত্রীকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দেবে। তোমরা যদি কল্যাণপূর্ণ নীতি অবলম্বন করো এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো, তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল সীমাহীন দয়াবান।

হযরত ইবনে আব্বাস, উবায়দা সালমানী, মুজাহিদ, হাসনুল বসরী, জহাক ও ইবনে মুজাহিম প্রমুখ মনীষী এ আয়াতের তাফসীর করেছেন নিম্নোদ্ধৃত ভাষায়ঃ

(আরবী****************************************************************)

অর্থাৎ হে লোকেরা, তোমরা স্ত্রীদের মধ্যে সবদিক দিয়ে ও সর্বতোভাবে সমতা রক্ষা ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না। কেননা এ সমতা রক্ষা ও সাম্য এক এক রাতের বাহ্য বণ্টনের ক্ষেত্রে যদিও কার্যকর হয় তবুও প্রেম-ভালোবাসা, যৌন স্পৃহা ও আকর্ষণ এবং যৌন মিলনের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে পার্থক্য অবশ্যম্ভাবী।

প্রখ্যাত তাফসীরবিদ ইবনে শিরীন তাবি’ঈ এর ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************************************)

মানুষের সাধ্যায়াত্ত যা নয় তা হচ্ছে প্রেম-ভালোবাসা, যৌন মিলন স্পৃহা ও আন্তরিক বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সাম্য রক্ষা।কেননা এ সব জিনিসের ওপর কর্তৃত্ব কারোরই খাটে না। যেহেতু মানুষের দিল আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মধ্যে অবস্থিত, তিনি যেদিকে চান, তা ফিরিয়ে দেন। যৌন মলনও এমনি ব্যাপার। কেননা তা কারোর প্রতি আগ্রহনের বিষয়, কারোর প্রতি নয়। আর এ অবস্থা যখন কারোর ইচ্ছাক্রমে হয় না, তখন এ জন্যে কাউকেই দায়ী করা চলে না। আর তা যখন কারোর সাধ্যায়াত্তও নয়, তখন এ ব্যাপারে পূর্ণ সমতা রক্ষার দায়িত্ব কাউকেই দেয়া যায় না।

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনীর ভাষায় এ আয়াতের তাফসীর হচ্ছেঃ

(আরবী**************************************************************************)

হে পুরুষগণ, তোমরা তোমাদের একাধিক স্ত্রীর মধ্যে তাদের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা পোষনের ব্যাপারে সমতা রক্ষা করতে সমর্থ হবে না। ফলে তাদের মধ্যে এ দিক দিয়ে ‘আদল’ করা তোমাদের দ্বারা সম্ভব হবে না। কেননা তোমরা এ জিনিসের মালিকও নও, যদিও তোমরা তাদের মধ্যে এ বিষয়ে সমতা রক্ষা করতে ইচ্ছুক ও আগ্রহান্বিত হবে।

প্রেম-ভালোবাসা ও যৌন সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের মধ্যে যে আদল ও সমতা রক্ষা করা আদৌ সম্ভব নয়, তার বাস্তব কারণ রয়েছে। একজনের কয়েকজন স্ত্রী থাকলে তাদের মধ্যে কেউ অধিক সুন্দরী হবে, কেউ হবে কুশ্রী। কেউ যুবতী, কেউ অধিক বয়স্কা –প্রায় বৃদ্ধা। কেউ স্বাস্থ্যবতী, কেউ রুগ্না, কেউ মিষ্টভাষী খেঅশ মেজাজী, স্বামীগতা প্রাণ; কেউ ঝগড়াটে, খিটখিটে মেজাজের ও কটুভাষী। এভাবে আরো অনেক রকমের পার্থক্য হতে পারে স্ত্রীদের পরস্পরের মধ্যে, যার দরুন এক স্ত্রীর প্রতি স্বামীর স্বাভাবিকভাবেই অধিক আকর্ষণ হয়ে যেতে পরে, আর কারোর প্রতি আগ্রহের মাত্রা কম হতে পারে। কারোর জন্যে হয়ত দরদে-ভালোবাসার প্রাণ ছিঁড়ে যাবে আর কারোর দিকে তেমন টান অনুভূত হবে না। এ অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। এজন্যে কোনো স্বামীকে বাস্তবিকই দোষ দেয়া যায় না। কেননা প্রকৃত পক্ষে এর উপর কারোরই কোনো হাত নেই। মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক ও ইচ্ছে ক্ষমতা কোনো কিছুই এখানে পুরোপুরি কাজ করতে পারে না। এজন্যে সব ব্যাপারে পূর্ণ সমতা রক্ষা করা যে মানুষের সাধ্যাতীত, সাধ্যায়ত্ত নয়, তা-ই বলা হয়েছে আল্লাহ তা’আলার উপরোক্ত ঘোষণায়।

আর আল্লাহর এ ঘোষণা যে কতখানি সত্য, তা রাসূলে করীমের অবস্থা দেখলেই বুঝতে পারা যায়। তিনি আর যা-ই হোন, একজন মানুষ ছিলেন। আর মানুষের মানবিক ও স্বভাবগত দুর্বলতা থেকেও তিনি মুক্ত ছিলেন। এ কারণে তিনি তাঁর কয়জন স্ত্রীর মধ্যে হযরত আয়েশা (রা)-কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন অথচ তিনি আল্লাহর নির্দেশ মুতাবিক জৈবিক যাবতীয় বিষয়ে পূর্ণ সমতা রক্ষা করে চলতেন। আর মনের টান, অধিক আকর্ষণ ও প্রেম-ভালোবাসা তাঁর কাজ ইখতিয়ারের জিনিস ছিল না বলে সেক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা তাঁর পক্ষেও সম্ভব হয়নি। এ কারণে তিনি আল্লাহর নিকট দো’আ করেছিলেন নিম্নরূপ ভাষায়ঃ

(আরবী**********************************************************)

হে আল্লাহ, আমার সাধ্যানুযায়ী স্ত্রীদের মধ্যে অধিকার বণ্টন করেছিলাম; কিন্তু যা আমার সাধ্যায়ত্ত নয়, বরং যা তোমার কর্তৃত্বাধীন; সে বিষয়ে অমান্য হয়ে গেলে তুমি নিশ্চয়ই সেজন্যে আমাকে পাকড়াও করবে না।

এ হাদীস সম্পর্কে ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আল-কাহলানী লিখেছেনঃ

(আরবী***********************************************************************************)

রাসূল সম্পর্কিত এ বর্ণনা প্রমাণ করছে যে, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা এবং মনের ঝোঁক টান-আকর্ষণ মানুষের সাধ্যায়ত্ত ব্যাপার নয়; বরং তা হচ্ছে একান্তভাবে আল্লাহর কর্তৃত্বের বিষয়, মানুষের হাতে তার কিছু নেই।

একাধিক স্ত্রীর মধ্যে জৈবিক বিষয়ে পূর্ণ সমতা রক্ষা করার নির্দেশ দেয়ার পর প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা মানুষের সাধ্যাতীত বলে সেক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা বান্দার ওপর আরোপ করা হয়নি। এজন্যে ইসলামী শরীয়ত তা কারোর নিকট দাবিও করে না। ইসলামী শরীয়তের দাবি হচ্ছে এই যে, এরূপ অবস্থা সত্ত্বেও যখন তুমি একজনকে তালাক দিচ্ছ না বরং যে কারণেই হোক তাকে স্ত্রী হিসেবেই রেখে দিচ্ছ, তখন তার সাথে ঠিক স্ত্রীর মতোই ব্যবহার করতে হবে, তাকে বিধবা বা স্বামীহীনা করে রেখে দিও না। আয়াতের শেষাংশে তাই বলা হয়েছেঃ

(আরবী***************************************************************************)

অতএব তোমরা সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড়ো না, যার দরুন কোনো স্ত্রীকে তোমরা ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দেবে।

এ আয়াতের তাফসীর করা হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ

(আরবী*************************************************************************)

তোমরা একজনের প্রতি যখন একটু ঝুঁকে পড়বেই, তখন সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড়ো না –চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যেও না, তাহলে অপরকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দেবে, মানে সে এমন অবস্থায় ঝুলে থাকবে যে, সে না হবে স্বামীওয়ালী আর না পরিত্যক্তা, তালাক প্রাপ্তা।

আর কুরআনের এ সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশ সম্পর্কে ইবনুল মুনযির বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

এ আয়াত প্রমাণ করছে যে, একাধিক স্ত্রীর মধ্যে প্রেমপ্রীতি ভালোবাসার দিক দিয়ে সমতা রক্ষা করা স্বামীর পক্ষে ওয়াজিব নয়।

কিন্তু অন্যান্য যাবতীয় দিক দিয়ে সমতা রক্ষা করা ফরয। একাধিক স্ত্রী গ্রহণ কেবল তখনি বিধিসঙ্গত হতে পারে, যদি অন্তত এক্ষেত্রে স্ত্রীদের মধ্যে পূর্ণ সমতা ও ইনসাফ রক্ষা করা হয়। আর এ দিকদিয়ে সমতা রক্ষা করার তাগিদ করে নবী করীম (স) কঠোর ভাষায় বলেছেনঃ

(আরবী********************************************************************************)

যে লোকের দুজন স্ত্রী থাকবে একজনকে বাদ দিয়ে অপরজনকে নিয়ে মশগুল হয়ে থাকবে, কিয়ামতের দিন তার এক পাশের গাল কাটা ও ছিন্ন অবস্থায় ঝুলতে থাকবে।

অপর হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*********************************************************************************)

যার দুজন স্ত্রী আছে, সে যদি একজনের প্রতি ঝুঁকে পড়ে আর অপরজনকে বাদ দিয়ে চলে, তাহলে কিয়ামতের দিন তার এক পাশ ঝুলন্ত অবস্থায় থাকবে।

এসব হাদীসের ভিত্তিতে আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী*********************************************************************************)

এসব হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, দুজন স্ত্রীর মধ্যে একজনের প্রতি ঝুঁকে পড়া আর অপরজনকে বাদ দিয়ে চলা –বিশেষত দিন বণ্টন, খাদ্য-পানীয় ও পোশাক পরিবেশনের ক্ষেত্রে –সম্পূর্ণ হারাম। কেননা এসব বিষয়ে সমতা রক্ষা স্বামীর ক্ষমতায় রয়েছে। যদিও প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা –যাতে স্বামীর কোনো হাত নেই, তাতে সমতা রক্ষা করা স্বামীর প্রতি ওয়াজিব বা ফরয নয়।

ভুল ধারণা অপনোদন

উপরোক্ত আয়াতকে কেউ কেউ একাধিক স্ত্রী গ্রহণের প্রতিবন্ধক হিসেবে পেশ করতে চেষ্টা করে থাকেন। তাঁদের বক্তব্য হলো, প্রথম আয়াতে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে সমতা রক্ষার শর্তে। আর দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে যে, সমতা রক্ষা করতে চাইলেও তা করা মানুষের সাধ্যাতীত। অতএব একাধিক স্ত্রী গ্রহণ জায়েয নয়, আল্লাহর পছন্দও নয়। তাঁদের মতে আল্লাহ তাআলা একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি এক হাতে যেমন দিয়েছেন, অপর হাতে তেমনি তা ফিরিয়েও নিয়েছেন। ফলে এজন্য আর কোনো অনুমতি বাকি রইল না।

এ সম্পর্কে প্রথম কথা এই যে, যাঁরা এ ধরনের কথা বলেন, তাঁরা কুরআন-হাদীস তথা ইসলামী শরীয়তকে ভালো করে না বুঝেই বলেন অথবা বলা যেতে পারে তাঁরা নিজেদের মনগড়া কথাকেই কুরআনের দোহাই দিয়ে চালিয়ে দিতে চান। কেননা পূর্বোর বিস্তারিত আলোচনা থেকে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, একাধিক স্ত্রীর মধ্যে আদল –সুবিচার –ও সমতা যেসব বিষয়ে রক্ষা করার জন্য শরীয়ত দাবি করে –নির্দেশ দেয়, তা মানুষের সাধ্যায়ত্ত বিষয়। আর যে ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা মানুসের সাধ্যাতীত, সে ক্ষেত্রে প্রথমোক্ত মানের সমতা রক্ষার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, শরীয়ত তার দাবিও করে না। প্রথম প্রকারের ‘আদল’ হচ্ছে বৈষয়িক বিষয়, স্ত্রী সহবাস, খাদ্য-পানীয়-পোশাক পরিবেশন ইত্যাদির ক্ষেত্রে। এ হচ্ছে বস্তু বিষয়ে আদল (সুবিচার) আর দ্বিতীয় হচ্ছে আধ্যাত্মিক …..প্রেমপ্রীতি ভালোবাসার ক্ষেত্রের আদল। প্রথম আয়াতে প্রথম পর্যায়ের আদল রক্ষার শর্ত করা হয়েছে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের জন্যে। আর দ্বিতীয় পর্যায়ের আদল করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় বলে তার কম-সে-কম মাত্রার নির্দেশ করা হয়েছে। অতএব আয়াতদ্বয়ে কোনো প্রকার বৈপরীত্য নেই। বরং এ দুটোর আয়াত থেকেই মানুষের পক্ষে করণীয় আদল এবং একটা সুস্পষ্ট ও বাস্তব রূপ ফুটে ওঠে যার অনুসরণ করতে হবে একাধিক স্ত্রীর স্বামীকে। এ নির্দেশ চিরন্তনের জন্যে। আর এ নির্দেশ যথাযথভাবে পালন না করলে রীতিমত গুনাহগার হতে হবে।

দ্বিতীয় আয়াতে সেই আদল-এর কথা বলা হয়েছে, যা মানুষের সাদ্যায়ত্ত নয়। আর আল্লাহ যখন মানব-প্রকৃতি ও মানুষের প্রকৃতিগত ত্রুটি-দুর্বলতা সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল, তখন তিনি এ ‘আদল’ মানুষ করতে পারে না বলে যথার্থই ঘোষণা করলেন। এ অবস্তায় মানুসের দ্বারা যা এবং যতটুকু সম্ভব তারই নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেনঃ “একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের একজনের প্রতি তো ঝুঁকে পড়বেই –এ স্বাভাকি, তবে এমনভাবে কখনো ঝুঁকে পড়বে না, যার ফলে অপর স্ত্রী ঝুলন্ত অবস্থায় না বিবাহিতা না পরিত্যাক্তা –হয়ে থাকতে বাধ্য হয়”। তার অর্থঃ কোনো এক স্ত্রীর দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ার অনুমতি আল্লাহ তা’আলা নিজেই দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, এ খানিকটা ঝুঁকে পড়া যে অবশ্যম্ভাবী, তাও বলে দিচ্ছেন। অতএব কারো প্রতি খানিকটা ঝুঁকে পড়লে তা দোষের হবে না, মানুষকে সেজন্যে দোষী বা দায়ীও করা হবে না। আয়াতের শেষ অংশে সেই কথাই বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************************************)

যদি তোমরা ভুল-ত্রুটির সংশোধন করতে থাক –ভুলের মধ্যে ডুবে দিশেহারা হয়ে পড় না, আর সব ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করতে থাক, তাহলে আল্লাহ মাফও করবেন, রহমত করবেন।

আয়াতের এ অংশে স্বামীকে স্ত্রীদের প্রতি ভালো ব্যবহার ও তাদের অধিকারসমূহ সঠিকরূপে আদায় করার জন্যে নতুন করে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ যদি স্বামী করতে থাকে, তাহলে এক স্ত্রীর প্রতি খানিকটা ঝুঁকে পড়ার দরুন অপর স্ত্রীর প্রতি যা কিছু অবহেলা-উপেক্ষা এর মধ্যে হয়ে গেছে তা দূর হয়ে যাবে এবং আল্লাহও ক্ষমা করবেন। আর যেহেতু সে ভবিষ্যতে আল্লাহকে ভয় করে স্ত্রীদের অধিকার সমানভাবে আদায় করতে থাকবে বলে এবং কখনো ইচ্ছে করে কোনো বিষয়ে তাদের মধ্যে তারতম্য –পার্থক্য করবে না বলে সংকল্প গ্রহণ করেছে, এজন্যে আল্লাহ তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করবেন, ভবিষ্যতে যাতে করে সকলের অধিকার ঠিক ঠিকভাবে আদায় করতে পারে, সেজন্যে তওফীকও দান করবেন। তার মনে স্ত্রীদের প্রতি ভালো ব্যবহারের দায়িত্বের অনুভূতিও জাগিয়ে দেবেন।

সেসব লোক যা ধারণা করেছে, তাই যদি আল্লাহর ইচ্ছে হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে যেঃ (আরবী****) এ আয়াতের সত্যিই কোনো অর্থ হয় না, বরং এ কথাটি বলারও কোনো প্রয়োজন ছিল না। সোজা করে বললেই পারতেনঃ তোমরা ‘আদল’ করতে পারবে না বলে একাধিক বিয়েও করো না। তা না বলে এক অসম্ভব শর্তের সাথে যুক্ত করে একাধিক বিয়ের অনুমতি দেয়ার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? আল্লাহ তো সর্বোচ্চ, একজন সাধারণ বুদ্ধিমান লোকও যে এ ধরনের কথা বলতে পারে, তা সত্যিই ধারণা করা যায় না।

সর্বোপরি, রাসূলে করীম (স)-ই হচ্ছেন কুরআনের ধারক, কুরআনের ব্যাখ্যাকারী। মুখের কথা দ্বারাও এবং বাস্তব কাজের ভিতর দিয়েও। আর তিনি নিশ্চয়ই কোনো হারাম কাজ করেন নি বা করতে পারেন না। আর কোনো হারাম কাজকে তিনি চুপচাপ বরদাশত করবেন, তাও তাঁর দ্বারা সম্ভব নয়। বহু সংখ্যক স্ত্রীর স্বামী ইসলাম কবুল করলে তিনি তাদের মধ্য থেকে চারজনকে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরকম ঘটনা একটা দুটো নয়। তার সংখ্যা অনেক এবং তার প্রত্যেকটি ঘটনারই নিভর্রযোগ্য সনদসূত্রে প্রমাণিত। একাধিখ স্ত্রী গ্রহণ যদি হারামই হতো, তাহলে রাসূলে করীম (স) তাদেরকে একজন মাত্র রাখারই নির্দেশ দিতেন, চারজন রাখার নয়। তা ছাড়া তিনি নিজেও একসঙ্গে একাধিক স্ত্রীর স্বামী ছিলেন –যদিও তাঁর জন্যে আল্লাহর মর্জি অনুযায়ীই চারজনের কোনো সীমা নির্দিষ্ট ছিল না। উপরন্তু একথাও ধারণা করা যেতে পারে যে, রাসূলে করীম (স) নিজে সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ী পর্যায়ের বড় বড় মনীষী –যাঁরা সকলেই একবাক্যে চারজন পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহণ জায়েয বলে ঘোষনা করেন –এ আয়াতদ্বয়ের সঠিক তাৎপর্য বুঝতে পারেন নি, বুঝতে পেরেছেন –আজকালকার এ বুদ্ধিমানেরা! এ ধরনের কথা আধুনিক বুদ্ধিবাদী নির্বোধেরাই বলতে পারে।

আমার মনে হয়, একাধিক স্ত্রী গ্রহণকে যারা কুরআনের ভিত্তিতেই হারাম বলে প্রমাণ করতে চান, তাঁরা দু’শ্রেণীর লোক। এক শ্রেণীর অত্যন্ত সাদাসিধে, ইসলামের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। তাঁরা যখন দেখলেন ইসলামের ওপর উপর্যুপরি আক্রমণ চালানো হচ্ছে, তখন তাঁরা ইসলামের মান রক্ষার উদ্দেশ্যেই বলতে শুরু করলেন, ‘না ইসলামে আসলে একজন স্ত্রী রাখাই নির্দেশ, একাধিক স্ত্রী রাখার নয়’। তাঁদের সম্পর্কে বলা যায়, এঁরা হচ্ছেন ঈমানদার নির্বোধ লোক। অন্যের কারণে নিজের ঘরে আগুন লাগাবার কাজ করেন তাঁরা। তাঁদেরকে ক্ষমা করা যায়। কিন্তু তাঁদের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা জাগে না। তাঁরা বুঝেন না যে, একাধিক স্ত্রী গ্রহনই ইসলামের ওপর পাশ্চাত্য সমাজের হামলার একমাত্র কারণ নয়। তার কারণ অনেক গভীর এবং যারা এ হামলা চালাচ্ছে, তারা নিজেরাই ‘বহু বিবাহে’ নয়, বহু স্ত্রী সঙ্গমে বিশ্বাসী এবং বাস্তবেও অভ্যস্ত।

আর দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক তারা, যাদের নিয়তই খারাপ। তারা ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভুল ব্যবস্তায় এমন এক নতুন জিনিসের আমদানি করতে চায়, যার সাথে ইসলামের কোনো মিল, কোনো সামঞ্জস্য নেই। ইউরোপীয় সভ্যতার প্রভাবে তারা সে ‘সত্য’কে মনের মাঝে বদ্ধমূল করে নিয়েছে তাকেই তারা ইষলামের নামে চালিয়ে দিয়ে দুনিয়াকে ধোঁকা দিতে চায়। তাদের নিজেদের পছন্দকে ‘আল্লাহর পছন্দ’ বলে লোকদের সামনে তুলে ধরতে চায়। এ হচ্ছে দস্তুরমতো বিশ্বাসঘাতকতা, এ হচ্ছে ইসলাম বিকৃতকরণ; এ এক অমার্জনীয় অপরাধ।

ইতিহাসে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ

আসলে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দানে ইসলামই অপরাধী (?) নয়; না প্রথম অপরাধী, একমাত্র অপরাধী। এ ব্যাপারে ইউরোপীয় ধর্ম ও সভ্যতার অবদান সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ। এ পর্যায়ে আমাদের বক্তব্য এইঃ

১. ইসলামই সর্বপ্রথম একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দান করেনি। প্রাচীন প্রায় সবগুলো জাতি ও সব্যতায় এর ব্যাপক প্রচলন ছিল। অ্যাসিরীয়, চীনা, ভারতীয়, বেবিলনীয়, অসুরীয় ও মিসরীয় সভ্যতার বহু স্ত্রী গ্রহণ ছিল একটি সাধারণ রেওয়াজ। এদের অধিকাংশের মধ্যে আবার স্ত্রীদের কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা ছিল না। চীনের ‘লীকী’ ধর্ম একসঙ্গে ত্রিশজন পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহনের অনুমতি দিয়েছিল একজন পুরুষকে। আর চীনের বড় বড় বাবু লোকদের তো তিন হাজার পর্যন্ত স্ত্রী ছিল বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।

২. ইয়াহুদী ধর্মশাস্ত্রে সীমা-সংখ্যাহীন স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি রয়েছে। তওরাত কিতাবে উল্লিখিত নবীগণের প্রত্যেরেই বহুসংখ্যক স্ত্রী ছিল। তাতেই বলা হয়েছে, হযরত সুলায়মানের সাতশতজন ছিল স্বাধীনা স্ত্রী, আর তিনশ ছিল দাসী।

৩. খ্রিষ্ট ধর্মশাস্ত্রে বহু স্ত্রী গ্রহণের কোনো নিষেধবাণীর উল্লেখ নেই। শুধু উপদেশ ছলে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ প্রত্যেক পুরুষের জন্যই তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন। এতে করে বড়জোর একজন মাত্র স্ত্রী গ্রহণের দিকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে বলা যেতে পারে। ইসলামও তাই বলে। তাহলে এজন্যে ইসলামের দোষ দেখাবার যুক্তি থাকতে পারে না।

ইনজিল কিতাবে বহু-বিয়ে নিষেধ করে কোনো স্তোত্র বলা হয়নি। বরং পলিশ-এর কোনো কোনো পুস্তিকায় এমন ধরনের কথা রয়েছে, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, একাধিক স্ত্রী গ্রহণ সঙ্গত। তাতে এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ ‘আর্চবিশপকে অবশ্যই এক স্ত্রীর স্বামী হতে হবে’। তাহলে অন্যদের জন্য একাধিক স্ত্রীর স্বামী হতে কোনো বাধা নেই বলে মনে করা যেতে পারে। আর ইতিহাস প্রমাণ করছে যে, প্রাচীনকালের অনেক খ্রিষ্টানই এমন ছিল, যারা একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করেছিল একই সময়ে। বহু গির্জার পাদ্রীর বহু সংখ্যক স্ত্রী ছিল। আর বিশেষ বিশেষ অবস্থায় বহু সংখ্যক স্ত্রী গ্রহণ সঙ্গত বলে খ্রিষ্ট যুগের বহু পণ্ডিত ফতোয়াও দিয়েছেন।

পারিবারিক ইতিহাস বিশেষজ্ঞW ester Mark বলেছেনঃ

(আরবী*******************************************************************)

গির্জার অনুমতিক্রমে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের রেওয়াজ সপ্তদশ শতক পর্যন্ত চলেছে। আর অনেক অবস্থায় গির্জা ও রাষ্ট্রের হিসাবের বাইরে তার সংখ্যা অনেক গুণ বেড়ে যেত।

তাঁর গ্রন্থে আরো বলা হয়েছেঃ

আয়ার্ল্যাণ্ড সম্রাটের দু’জন ছিল স্ত্রী আর দু’জন ছিল দাসী।

শার্লিম্যানেরও দুইজন স্ত্রী ছিল, ছিল বহু সংখ্যক দাসী। তাঁর রচিত আইন থেকে প্রকাশ পায় যে, তাঁর যুগের লোকদে মধ্যে বহু বিবাহ কিছুমাত্র অপরিচিত ব্যাপার ছিল না।

মার্টিন লুথারও বহু বিবাহের যৌক্তিকতা অস্বীকার করতে পারেন নি। কেননা তাঁর মতে তালাক অপেক্ষা একাধিক স্ত্রী রাখাই উত্তম। ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে ভিষ্টা ফিলিয়ার-[১৬১৮ সন জার্মানীর বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য ও নওয়াব সামন্তদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় এবং মধ্য ইউরোপের লোকদের ক্রমাগতভাবে ত্রিশ বছর পর্যন্ত এক আত্মঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত করে রাখে। ১৬৪৮ সনে এ যুদ্ধ খুব কষ্টের সঙ্গে বন্ধ করানো হয় এবং পরস্পরে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার ফলে এক সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তাই ‘ভিষ্টা ফিলিয়া সন্ধি’ নামে অভিহিত।] প্রখ্যাত সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষীরত হওয়ার পর এক প্রস্তাবের মাধ্যমে একজন পুরুষের জন্যে দুজন করে স্ত্রী গ্রহণ জায়েয করে দেয়া হয়। খ্রিষ্টানদের কোনো কোনো শাখায় লোকেরা বরং মনে করে যে, একাধিক স্ত্রী গ্রহণ একান্তই কর্তব্য। ১৫৩১ সনের এক ঘোষণায় সুস্পষ্ট করে বলা হয় যে, সত্যিকার খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীকে অবশ্যই বহু সংখ্যক স্ত্রী গ্রহণ করতে হবে। প্রট্যাস্টান্ট (খ্রিষ্টানদের এক শাখা)-দের ধারনা ছিল, বহু স্ত্রী গ্রহণ এক পবিত্র আল্লাহরই ব্যবস্থা।

৪. আফ্রিকার কালো আদমীদের মধ্যে যারা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করত, গির্জা তাদের জন্য বহু সংখ্যক স্ত্রী গ্রহণের অবাধ অনুমতি দিয়েছিল। কেননা প্রথম দিক দিয়ে আফ্রিকায় যখন খ্রিষ্টধর্ম প্রচারিত হচ্ছির ও কালো আদমীরা দলে দলে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করছিল, তখন গির্জা কর্তৃপক্ষ চিন্তা করল যে, আফ্রিকার অধিবাসী বহু স্ত্রী গ্রহণের অন্ধভাবে আগ্রহী, তাদের যদি তা করতে নিষেধ করা হয় তাহলে তারা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করতে রাজি হবে না –খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে তা হবে বাঁধাস্বরূপ। কাজেই বহু স্ত্রী গ্রহণ করা তাদের জন্যে নিষিদ্ধ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

৫. পাশ্চাত্য খ্রিষ্টান সমাজে পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার দরুন –বিশেষত দুই বিশ্বযুদ্ধের পরে –এক জটিল সামাজিক সমস্যা দেখা দিয়েছে, যার কোনো সমাধানই আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। আর একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি ভিন্ন এ সমস্যার কোনো বাস্তব সমাধানই হতে পারে না। ১৯৪৮ সনে আলমানিয়ার মিউনিখে এক বিশ্ব যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আরব দেশেরও অনেক যুবক তাতে যোগদান করে। এ সম্মেলনের এক বিশেষ অধিবেশনে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে আলমানিয়া পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা অস্বাভাবিক রকমে বৃদ্ধিজনিত সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। তার নানাবিধ সমাধান চিন্তা করা হয়। এখানে আরব যুবকদের পক্ষ থেকে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব একটি বাস্তব সমাধান হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়। প্রথমে এ প্রস্তাব গৃহীত হলেও পরে সম্মেলনে নানা মতভেদ দেখা দেয়। পরে এ ব্যাপারে সকলেই একমত হয় যে, এ ব্যবস্থা ছাড়া সমস্যার বাস্তব ও কার্যকর আর কোনো সমাধানই নেই –হতেপারে না। পরের বছর আলমানিয়া শাসনতন্ত্রে বহু স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি সংক্রান্ত ধারা সংযোজনের প্রস্তাব ওঠে। (আরবী*************************************)

এরপর আলমানিয়া থেকে এক প্রতিনিধি দল মিসরের জামে আজহারে আগমন করে ইসলামের একাধিক স্ত্রী গ্রহণের বিধান সম্পর্কে সরাকরি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে। হিটলারও চেয়েছিলেন তাঁর দেশে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি আইন চালু করতে; কিন্তু মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে তা আর হয়ে ওঠে না।

বহু খ্রিষ্টান মনীষী একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুকূলে অনেক কথা বলেছেন। প্রখ্যাত আলমানিয়া দার্শনিক শোপেন আওয়ার লিখেছেনঃ

পুরুষ ও স্ত্রী সমান মর্যাদার হওয়ার কারণে ইউরোপে বিবাহ সংক্রান্ত আইন অত্যন্ত খারাপ। অথচ আমাদের দায়িত্ব বহুগুণে বেড়ে গেছে। কাজেই যতদিন পর্যন্ত মেয়েদেরকে পুরুষের সমান অধিকার দেয়া হবে, তদ্দিন তাদরেকে পুরুষদের মতো বুদ্ধিও দিয়ে দেয়া উচিত।

আমরা যখন মূল বিষয়ে চিন্তা করি, তখন এমন কোনো কারণ খুঁজে পাইনে, যার দরুন পুরুষকে এক স্ত্রীর বর্তমানে দ্বিতীয়াকে গ্রহণ করতে বাধা দেয়া যুক্তিসঙ্গত হতে পারে। বিশেষত কারো স্ত্রী যখন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে কিংবা বন্ধ্যা হয় অথবা কয়েক বছরের দাম্পত্য জীবনের পরই বৃদ্ধা হয়ে যায়, তখন সেই পুরুষকে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণে কি করে বাধা দেয়া যেতে পারে। ‘মোরমোন’ খ্রিষ্টানরা এই এক স্ত্রী গ্রহণের রীতি বাতিল না করে কোনো কল্যাণই লাভ করতে পারে না।

বস্তুত একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে ইসলামের অনুমতিকে আধুনিক পাশ্চাত্যপন্থীরা যতোই ঘৃণার চোখে দেখুন না কেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এর ফলে জাতীয় নৈতিক চরিত্র অনেক উন্নতি লাভ করে, পারিবারিক সম্পর্ক গ্রন্থি সুদৃঢ় হয় এবং নারীকে এক উচ্চ মর্যাদা দান করা সম্ভব এর সাহায্যে, যা ইউরোপীয় সমাজে দেখা যায় না।

উপরের আলোচনা হতে এ কথা সপ্রমাণিত হয়েছে যে, একাধিক স্ত্রী গ্রহণের রেওয়াজ মানব সমাজে বহু প্রাচীনকাল থেকেই চলে এসেছে; কম-বেশি ইতিহাসের সকল যুগে, সভ্যতার সকল স্তরে এর প্রচলন রয়েছে। সুসভ্য-অসভ্য, বর্বর ও উন্নত সংস্কৃতিসম্পন্ন সকল জাতিই এ বিষয়ে অভ্যস্ত ছিল। পাক-ভারতের প্রাচীন ইতিহাসেও দেখা যায়, রাজা-মহারাজা ও সম্রাট-বাদশাহদের ছাড়াও অলী-দরবেশ ও মুণি-ঋষিরা পর্যন্ত একাধিক স্ত্রী গ্রহণে অভ্যস্ত। রামচন্দ্রের পিতা মহারাজা দশরথের তিনজন স্ত্রী ছিল –পিটরানী, কৌশল্যা ও রানী সুমিত্রা। শ্রীকৃষ্ণকে অবতার বা স্বয়ং ভগবান বলে ধারণা করা হয়, তারও ছিল অসংখ্য স্ত্রী। লাল লজপত রায় কৃষ্ণ চরিত্রে তাঁর আঠারজন স্ত্রী ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। রাজা পাণ্ডোরও ছিল দু’জন স্ত্রী –কুন্তি আর মাভরী।

ইসলামের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরাও একাধিক স্ত্রীর স্বামী ছিলেন। নবী-পয়গাম্বরদের তো প্রায় সকলেরই ছিল বহু সংখ্যক স্ত্রী। আর তাঁরপর হযরত হাসান ইবনে আলী, হুসাইন ইবনে আলী, হযরত আবূ সুফিয়ান ইবনে হারিস, সায়াদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, হযরত হামযা, হযরত ইবনে আব্বাস, হযরত বিলাল ইবনে রিবাহ, জায়দ ইবনে হারিস, আবূ হুযায়ফা, উসামা ইবনে জায়দ (রা) প্রমুখ বড় বড় সাহাবীও একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করেছিলেন।

একাধিক স্ত্রী আর বহু সংখ্যক স্ত্রী গ্রহণের এ ইতিহাস প্রমাণ করে যে, এ ব্যাপারটি মোটেই সামান্য নয়, প্রকৃতপক্ষে এ এক অনন্য সাধারণ ব্যাপার। সাময়িক উত্তেজনার কিংবা কেবলমাত্র যৌন লালসার যথেচ্ছ চরিতার্থতার উদ্দেশ্যেই ইতিহাসের এ মহামনীষীবৃন্দ এদিকে অগ্রসর হন নি। আসলে মানব প্রকৃতির অন্তস্থলে এর কারণ নিহিত রয়েছে এবং সে কারণ থাকবে, তার প্রভাব বিস্তা করতে থাকবে, যদ্দিন মানুষ থাকবে এ ভূ-পৃষ্ঠে। এর প্রতি একটা ঘৃণার আর ঘৃণা প্রকাশক দুটো কথা, দুটো আইনের ধারার আঘাতেই তা কখনও মিটে যাবে না; বন্ধ হবে না এর সম্ভাবনার দুয়ার।

মানব প্রকৃতি ও একাধিক স্ত্রী গ্রহণ

এ পর্যায়ে মূল বিষয়ের যথার্থতা বোঝাবার জন্যে আমাদের অবশ্যই মানব প্রকৃতির অধ্যয়ন করতে হবে। দেখতে হবে মানব প্রকৃতি কি এক বিয়ের পক্ষে, না তার কোথাও একাধিক বিয়ের সামান্য দাবিও নিহিত রয়েছে?

প্রকৃতি –তা মানুষেরই হোক আর জন্তু-জানোয়ারের হোক সবই একাধিক বিয়ের কামনা-আকাঙ্ক্ষায় ভরপুর। আমাদের কাছাকাছি যেসব গরু-মহিষ-ছাগলের পাল রয়েছে তার দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাব, বহু সংখ্যক গাভী, মহিষ, আর ছাগীর জন্যে দু একটি করে ষাঁড়, মহিষ আর পাঁঠা থাকে। আর স্ত্রী জাতীয় জন্তুগুলো তাদেরই কাছ থেকে গর্ভ ধারণ করে। যে মোরগের ধ্বনি ঘরে-দালানে মুখরিত হয়ে ওঠে, তাও বহু সংখ্যক মুরগীর মধ্যে একটি দুটি হয়ে থাকে মাত্র। আর এ মোরগ একটি ঘরে যতগুলো মুরগী নিয়ে বসবাস করে, সেখানে অপর কোন মোরগকে বরদাশত করতে কখনও রাজি হয় না। অন্তত সেখানকার মুরগীগুলোর প্রতি অপর মোরগকে কোনো প্রেম প্রকাশ করতে দিতে রাজি হয় না। জঙ্গলের অধিবাসী জন্তুদের জীবন পর্যবেক্ষণ করলেও দেখা যাবে, তাদের কোনো কোনোটি এক স্ত্রী গ্রহণে অভ্যস্ত থাকলেও বহু স্ত্রী গ্রহণে অভ্যস্ত জন্তুর সংখ্যা অনেক বেশী।

মানব প্রকৃতিটা নিয়েই বিচার করে দেখুন, আপানর মন সাক্ষ্য দেবে যে, মানব প্রকৃতিতে বহু স্ত্রী গ্রহণের প্রতি প্রবণতা অনেক বেশি এবং তীব্র। এক স্ত্রী গ্রহণের পরও কি কোনো যুবক এমন পাওয়া যাবে যে, অপর কোনো সুন্দরী যুবতী নারীকে দেখে আকৃষ্ট হয় না? তার মধ্যে যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়না? সে যুবতী কনাকে পাবার জন্যে প্রেম ভালোবাসার বন্যা তার হৃদয়-মনে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে না? সে যদি নৈতিকতা ও সামাজিক বাধ্যবাধকতার কারণে কার্যত কিছু না করে, তবুও এক স্ত্রী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও অপর নারীর প্রতি তার মনে যে আকর্ষণ জাগ্রত হয় তা কে অস্বীকার করতে পারে? আমরা রাত দিন দেখতে পাচ্ছি –রাস্তাঘটাতে কোনো সুন্দরী-রূপসী যুবতী যখন জাঁকজমক আর চাকচিক্যপূর্ণ পোশাক পরে বের হয়, তখন চারদিকে থেকে পুরুষরা এমনভাবে হা করে অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকে যে, মনে হয়, আজ পর্যন্ত কোনো মেয়েলোক তারা পায়নি, আজই প্রথম দেখছে এবং দেখে শুধু পুলকিতই হচ্ছে না, উদভ্রান্তও হচ্ছে। এ পুরুষদের মধ্যে কেবল অবিবাহিত তরুণরাই থাকে না, বিবাহিত, পূর্ণ বয়স্ক এমনকি ছেলেমেয়ে বাপদের সংখ্যাও এতে কম থাকে না। এদের মধ্যে এমন লোকও থাকে ,যারা একসঙ্গে একাধিক বিয়ে করাকে অকাট্য যুক্তির ভিত্তিতে সঙ্গত কাজ বলে মেনে নিতে রাজি হবে না; কিন্তু বাহ্যিক ভয়-ভীতিহীন পরিবেশে তারা পরস্ত্রী ভোগ করার সুযোগ পেলে নিজ স্ত্রীকে বঞ্চিত করেও তা করতে একটুও দ্বিধাবোধ করবে না। এ থেকে কি একথাই প্রমাণিত হয় না যে, মানব প্রকৃতি এক স্ত্রী দিয়ে সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত হয়ে থাকতে কিছুতেই রাজি নয়? বাহ্যত এক স্ত্রী গ্রহণ করে কার্যত বহু স্ত্রী ভোগ করার ঘটনা এক স্ত্রীতে বিশ্বাসী সমাজে কিছুমাত্র বিরল নয়। বস্তুতই যদি মানব প্রকৃতি এক স্ত্রীতে তৃপ্ত সন্তুষ্ট হতো, তাহলে বিবাহিত পুরুষ নিশ্চয়ই অপর স্ত্রী দেখে কিছুমাত্র লালসা বোধ করত না। নিজের মধ্যে এবং নিজের স্ত্রী ছাড়া অপর নারীর প্রতি ভুলক্রমেও কখনও তাকাত না। কিন্তু তা আদৌ সত্য নয়।

প্রকৃতপক্ষে মানুষের প্রকৃতি ও অধিকাংশ পুরুষের দেহের ঐকান্তিক দাবি হচ্ছে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ, একজন মাত্র স্ত্রী দিয়ে অতৃপ্ত। এজন্যে মানুষের ইতিহাসে এমন কোনো পর্যায় আসেনি, যখন একাধিক স্ত্রী গ্রহণের রেওয়াজ চালু হতে দেখা যায়নি। বহু স্ত্রী প্রবণতা অপূর্ণ ও অতৃপ্ত থাকার কারণেই আমরা দেখতে পাই –এক স্ত্রী গ্রহণ আইন যেসব দেশে জোর করে চালু করা হয়েছে, সেখানে বহু স্ত্রী ভোগের রেওয়াজ অপরাপর দেশের তুলনায় অনেক বেশি। তবে পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে, কোথাও একাধিক স্ত্রী গ্রহণ আইনসম্মত আর কোথাও বে-আইনীভাবে আইনকে ফাঁকি দিয়ে অবৈধ উপায়ে বহু স্ত্রী ভোগের মাধ্যমে লালসার বন্যা প্রবাহিত করা হয়। এই কারণেই নিজের স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অপর নারী-বন্ধু গ্রহণ করা হয়। নারী-পুরুষের মিলিত খেল-তামাসা, ক্লাব, নাচ, থিয়েটার, আসর বৈঠক ইত্যাদির ব্যাপক প্রচলন হয়েছে সর্বত্র। এ সবই হচ্ছে এক স্ত্রী গ্রহনের ছত্রছায়ায় বহু স্ত্রীর রূপ ও যৌবন ভোগ করার অতি আধুনিক ব্যবস্থা। হাটে-বাজারে ও শহরে-বন্দরে এই যে, বেশ্যালয়গুলো দাঁড়িয়ে আছে, চালু রয়েছে, এর মূলেই সেই বহু স্ত্রী সম্ভোগ লিপ্সার পরিতৃপ্তিই চরম উদ্দেশ্য হয়ে রয়েছে। এজন্যেই আজ প্রাইভেট সেক্রেটারী, টাইপিস্ট-কাম-স্ট্যানোগ্রাফার, পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট, অফিস-ক্লার্ক, এয়ার হোস্টেস, গেস্ট রিসিভার, টেলিফোন অপারেটর, রেডিও এ্যানাউন্সার, রেডিও ও সিনেমা আর্টিস্ট –প্রভৃতি ক্ষেত্রে সুন্দরী যুবতী নারীদের নিয়োগ করতে দেখা যায়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার প্রচলন ও শিক্ষয়িত্রী নিয়োগও এজন্যেই হয়ে থাকে। এভাবে বর্তমানে পুরুষের বহু স্ত্রী ভোগের এ প্রকৃতিগত প্রবণতার তাণ্ডব নৃত্য দেখা যায় আধুনিক সভ্যতার সর্বত্র।

বস্তুত মানুষের জীবন ও মনস্তত্ব অত্যন্ত জটিল, সমস্যাসংকুল, অত্যন্ত ঠুনকো। একাধিক স্ত্রী গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা পুরুষের মনের দিক দিয়ে দেখা যেতে পারে, দেখা দিতে পারে দেহের ও পৌরুষের দিক দিয়ে। দেখা দিতে পারে নিতান্ত পারিবারিক ও বৈষয়িক কারণে। যার প্রথম স্ত্রী পছন্দনীয় নয় বলে সে তাকে একনিষ্ঠভাবে ভালোবাসতে পারে নি কিংবা যাকে দিয়ে তা মন পূর্ণ মাত্রায় পরিতৃপ্ত নয়, দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ তার মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজন, ভালোবাসার প্রয়োজন। যার প্রথম স্ত্রী রুগ্না, স্বামীর দৈহিক দাবি পরিপূরণে অক্ষম দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ তার দৈহিক ও জৈবিক প্রয়োজন –যৌন প্রয়োজন। যার প্রথম স্ত্রী তাকে কোনো উত্তরাধিকারী উপহার দিতে পারেনি, বন্ধ্যা, সন্তান প্রসবে অক্ষম কিংবা যার সন্তান হয়ে মারা গিয়েছে, দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ তার পারিবারিক প্রয়োজন। কোনো শ্রমজীবী মনে করতে পারে যে, তার আর একজন স্ত্রী হলে শ্রমের কাজে তাকে সাহায্য করতে পারবে, এমতাবস্থায় দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ তার অর্থনৈতিক প্রয়োজন। এভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আরো অনেক প্রয়োজন দেখা দিতে পারে, যার দরুন একজন ব্যক্তি এক স্ত্রী বর্তমান থাকতে আরো স্ত্রী গ্রহণে বাধ্য হতে পারে। যদি তা না করে কিংবা আইন করে এ পথে কোনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়, তাহলে হয় তাকে অবৈধ পন্থার আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে, রীতিমত ব্যভিচারে লিপ্ত হতে হবে নতুবা পারিবারিক জীবনের মাধুর্য থেকে চিরবঞ্চিত হয়ে থাকতে হবে অথবা বংশের প্রদীপ এখানেই শেষ হয়ে যাবে। এক সঙ্গে দুই, তিন বা চার জন পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহণ ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকে না। কিন্তু এ যে কত মর্মান্তিক, কত হৃদয়বিদারক, তা প্রকাশ করা যায় না। এর ফলে কত নারী আর কত পুরুষের জীবন যে বিপর্যস্ত হয়ে যায়, চুরমার হয়ে যায় কত দম্পতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, তার কোনো হিসেব-নিকেশ করা সম্ভব নয়।

একাধিক স্ত্রী গ্রহণ সামাজিক গুরুত্ব

এমন বহু সামাজিক প্রয়োজনও দেখা দিতে পারে, যার দরুন এক –একজন পুরুষ একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। আর তা না করলে সমাজ মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হয়ে যায়। দুটো পরিস্থিতি সামনে রেখে এ সামাজিক প্রয়োজনের যথার্থতা বিচার করা যেতে পারেঃ

১.কোনো কারণে সমাজে যদি নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অধিক হয়ে যায় –যেমন উত্তর ইউরোপে বর্তমানে রয়েছে। ফিনল্যাণ্ডের জনৈক চিকিৎসক বলেছেন, সেখানে প্রত্যেক চারটি সন্তানের মধ্যে একটি হয় পুরুষ আর বাকী হয় মেয়ে।

এরূপ অবস্থায় একাধিক স্ত্রী গ্রহণ এক নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্য হয়ে পড়ে। কেননা এক স্ত্রী গ্রহণের রীতিতে সেখানে বহু মেয়েলোক থেকে যাবে, যাদের কোনো দিন বিয়ে হবে না, যারা স্বামীর মুখ দেখতে পাবে না কখনো, তখন তারা তাদের যৌন প্রবৃত্তির চরিতার্থতার জন্যে পথে-ঘাটে মৌমাছির সন্ধান করে বেড়াবে। তাদের স্বামী হবে না কেউ, হবে না কোনো ঘর, আশ্রয়স্থল, হবে না কোনো বৈধ সন্তান। আর সে কারণে সামাজিক জীবনে তাদের কোনো প্রতিষ্ঠা হবে না। আগাছা-পরগাছার মতো লাঞ্ছিত জীবন যাপনে বাধ্য হবে। চিন্তা করা যেতে পারে, তাদের এ রকমের উপেক্ষিত জীবনের অপেক্ষা একজন নির্দিষ্ট স্বামীর অধীন অপর নারীর সাথে একত্রে ও সমান মর্যাদার জীবন যাপন কি অধিকতর কল্যাণকর নয়?

বিংশ শতকের শুরু থেকেই ইউরোপীয় সমাজ-দার্শনিকগণ একাধিক বিয়ে নিষিদ্ধ করণের কুফল প্রত্যক্ষ করতে পাচ্ছেন। তাঁরা দেখছেন, সমাজে হু হু করে যৌন উচ্ছৃংখলতার মাত্রা কিভাবে বেড়ে যাচ্ছে, কিভাবে অবৈধ সন্তানের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে তাঁরা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেনঃ একাধিক স্ত্রী গ্রহণের রেওয়াজ করে না দিলে এ সমস্যার কোনো সমাধানই সম্ভব নয়।

‘লণ্ডন ট্রিবিউট’ পত্রিকার ১৯০১ সালে ২০শে নভেম্বরের সংখ্যায় এক ইউরোপীয় মহিলার নিম্নোদ্ধৃত কথাগুলো প্রকাশিত হয়েছেঃ

আমাদের অনেক মেয়েই অবিবাহিত থেকে যাচ্ছে, ফলে বিপদ কঠিনতর হয়ে আসছে। আমি নারী, আমি যখন এ বিবাহাতিরিক্ত মেয়েদের দিকে তাকাই, তখন তাদের মমতায় আমার দিল দুঃখ-ব্যথায় ভরে যায়। আর আমার সাথে সব মানুষ একত্রিত হয়ে দুঃখ করলেও কোনো ফায়দা হবার নয়, যদি না এ দুরবস্থার কোনো প্রতিবিধান কার্যত করা হয়।

মনীষী টমাস এ মহারোগের ঔষধ বুঝতে পেরেছেন এবং পূর্ণ নিরাময় হওয়ার ‘ঔষধ’ও ঠিক করে দিয়েছেন। আর তা হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক পুরুষের জন্যে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অবাধ অনুমতি দিতে হবে। এর ফলেই এ বিপদ কেটে যাবে এবং আমাদের মেয়েরা ঘর পাবে, স্বামী পাবে। এতে করে বোঝা গেল যে, বহু নারী সমস্যার একমাত্র কারণ হচ্ছে একজন মাত্র স্ত্রী গ্রহণ করতে পুরুষদের বাধ্য করা। এ বাধ্যবাধকতায়ই আমাদের বহু মেয়ে বৈধব্যের জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। যদ্দিন না প্রত্যেক পুরুষকে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অধিকার দেয়া হবে, এ সমস্যার কোনো সমাধান হওয়াই সম্ভব হবে না। (আরবী*****************)

বর্তমান ইউরোপীয় সমাজে এমন অনেক বিবাহিত পুরুষও রয়েছে যাদের বহু সংখ্যক অবৈধ সন্তান রয়েছে, আর তারা ঘাটে-পথে তাড়া খাচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে। যদি একাধিক স্ত্রী বৈধভাবে গ্রহণের অনুমতি থাকত, তাহলে এ অবৈধ সন্তান আর তাদের মায়ের বর্তমান লাঞ্ছিত অবস্থার নিশ্চয়ই পড়তে হতো না। তাদের ও তাদের সন্তানদের ইযযত রক্ষা পেত। বস্তুত একাধিক বিয়ের অনুমতি প্রত্যেক নারীকে বৈধভাবে স্বামীর ঘরের গৃহিণী ও সন্তানের মা হওয়ার সুযোগ দান করে। দুনিয়ায় এমন নারী কে আছে যে তা পছন্দ করে না, কামনা করে না। আর এমন বুদ্ধিমান কে আছে, যে এ ব্যবস্থার সৌন্দর্য ও কল্যাণকারিতাকে অস্বীকার করতে পারে।

বর্তমানে আমেরিকায় যে লক্ষ লক্ষ সন্তান এক জটিল সামাজিক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে, তা থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, পুরুষেরা নিজের এক স্ত্রী নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না, আর শত সহস্র নারী বৈধ উপায়ে পাচ্ছে না যৌন মিলন লাভের সুযোগ। এরূপ অবস্থার প্রতিকারের একমাত্র উপায় হচ্ছে –একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের বিধান।

২. সর্বধ্বংসী যুদ্ধের ফলে কোনো দেশে যদি পুরুষ সংখ্যা কম হয়ে যায় আর মেয়েরা থেকে যায় অনেক বেশি, তখনো যদি সমাজের পুরুষদের পক্ষে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি না থাকে, তাহলে বেশির ভাগ মেয়ের জীবনে কখনো স্বামী জুটবে না। ইউরোপ বিগত দুটো বিশ্বযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ যুবক হারিয়েছে, এ কারণে যুবতী মেয়েদের মধ্যে খুব কমই বিবাহিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ফলে এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে যে, হয় বিবাহিত পুরুষেরা আরো এক-দুই-তিন করে স্ত্রী গ্রহণ করবে, তবে অবশিষ্ট অবিবাহিতা মেয়েদের কোনো গতি হবে, নয় সে বিবাহিত যুবকরা নিজেদের স্ত্রীদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে এ স্বামীহীনা মেয়েদের যৌন পরিতৃপ্তি দানের জন্যে প্রস্তুত হবে।

এ কারণেই ইউরোপের কোনো কোনো দেশে যেমন –আলমানিয়া –এমন সব নারী সমিতি গঠিত হয়েছে, যাদের দাবি হচ্ছে, হয় একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অবাধ অনুমতির ব্যবস্থা, নয় প্রত্যেক পুরুষ তার স্ত্রী ছাড়া আরো একজন মেয়ের যাবতীয় দায়িত্ব বহনের জন্যে রাজি হবে –এমন আইন চালু করতে হবে।

বস্তুত যুদ্ধ-সংগ্রামের অনিবার্য ফল হচ্ছে দেশের পুরুষ সংখ্যা অত্যন্ত হ্রাস পেয়ে যাওয়া। আর এরূপ অবস্থায় একমাত্র সুষ্ঠু ও শালীনতাপূর্ণ উপায় হচ্ছে প্রত্যেক পুরুষকে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দান। তাই দার্শনিক স্পেন্সার একাধিক স্ত্রী গ্রহণ রীতি বিরোধী হয়েও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, যুদ্ধে পুরুষ খতম হলে পরে সেখানে বহু স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দান একান্তই অপরিহার্য। তিনি তাঁর Principle of Sociology গ্রন্থে লিখেছেনঃ

কোনো জাতির অবস্থা যদি এমন হয় যে, তার পুরুষেরা যুদ্ধে গিয়ে খতম হয়ে যায়, আর অবশিষ্ট যুবকেরা একজন করে স্ত্রী গ্রহণ করেই ক্ষান্ত থাকে। ফলে বিপুল সংখ্যক নারীই থেকে যায় অবিবাহিতা, তাহলে সে জাতির সন্তান জন্মের হার অবশ্যই হ্রাস প্রাপ্ত হবে, তাদের সংখ্যা মৃত্যুসংখ্যার সমান হবে না কখনো। দুটো জাতি যদি পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়, যারা সর্বদিক দিয়ে সমান শক্তিমান, আর তাদের একটি যদি এমন হয় যে, সন্তান জন্মানোর ব্যাপারে সে জাতির সব মেয়েকেই ব্যবহার করা না হয়, আর অপর জাতি তার অপর জাতিতার সব সংখ্যক নারীকে এ কাজে লাগায়, তাহলে প্রথম জাতিটি তার শত্রু পক্ষকে কখনো পরাজিত করতে পারবে না। তার ফল এই হবে যে, এক স্ত্রী গ্রহণে অভ্যস্ত জাতি সেসব জাতির সামনে ধ্বংস হয়ে যাবে, যারা বহু সংখ্যক স্ত্রী গ্রহণে পক্ষপাতী। (আরবী***************************************)

এ প্রসঙ্গে আমি বলব, মধ্যমান জাতিগুলো এক স্ত্রী গ্রহণে অভ্যস্ত হয়, তাহলে তার মধ্যে সে জাতি অতি সহজেই ধ্বংস হবে, সে জাতি বিলাস বাহুল্যে নিমজ্জিত হবে। কেননা বিলাসী জাতির মেয়েরা সাধারণত কম সন্তান প্রসব করে থাকে। জন্মহার তার অনেক কমে যাবে। এর জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হচ্ছে ফ্রান্স। আর মুকাবিলায় কম বিলাসী জাতি জয়লাভ করবে, কেননা কম বিলাসী জাতির মেয়রা সাধারণভাবে অধিক সন্তান প্রসব করে থাকে –যেমন রাশিয়া। এ কারণে বিলাসী জাতির পক্ষেও কর্তব্য হচ্ছে নিজেদের মধ্যে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের রীতির ব্যাপক প্রচলন করা, তাহলে তাদের জনসংখ্যার ক্ষতি পূরণ হতে পারবে।

একটি হাস্যকর প্রশ্ন

পুরুষের একাধিক স্ত্রী গ্রহণের এ যুক্তিপূর্ণ অনুমতি বা আবশ্যকতার ওপর অত্যাধুনিক মেয়েরা একটি প্রশ্ন তুলে থাকে। তারা বলে যে, পুরুষরা যদি একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে, তাহলে মেয়েরা কেন একাধিক স্বামী গ্রহণ করতে পারবে না?

প্রশ্নটি যে কতখানি হাস্যকর, তা সহজেই বোঝা যায়। নারী-পুরুষের সাম্য সম্পর্কে আধুনিক কালের মারাত্মক ভ্রান্ত ধারণার কারণেই এ ধরনের নির্লজ্জ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়ে থাকে। অথচ একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যায় যে, নারী পুরুষের এ পর্যায়ের সমতা স্বভাব ও জন্মগত কারণেই অসম্ভব। মেয়েরা স্বভাবতই এক সময় গর্ভধারণ করে আর বছরে মাত্র একবারই তার গর্ভে সন্তানের সঞ্চার হয়। বহু সংখ্যক পুরুষ কর্তৃক ব্যবহৃত হলেও তার গর্ভে সন্তান হবে একজন মাত্র পুরুষ থেকেই। কিন্তু পুরুষদের অবস্থা এরূপ নয়। একজন পুরুষ এক সঙ্গে বহু সংখ্যক স্ত্রীলোককে গর্ভবতী করে দিতে পারে এবং একই সময় বহু সংখ্যক স্ত্রী থেকে বহু সংখ্যক সন্তান জন্মলাভ করাতেও পারে।

এমতাবস্থায় একজন মেয়েলোকের যদি একই সময় একাধিক স্বামী থাকে এবং একই সময়ে সকলের দ্বারা ব্যবহৃত হয় এবং তার গর্ভে সন্তান আসে, তাহলে সেই সন্তান যে কোন পুরুষের, তা নির্ণয় করা কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না। কিন্তু একজন পুরুষ যদি একই সময়ে একাধিক স্ত্রীর স্বামী হয়,তাহলে সেই স্ত্রীদের গর্ভের সন্তান যে সেই একমাত্র পুরুষের ঔরসজাত, তা ঠিক করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না।

দ্বিতীয়ত পারিবারিক জীবনে পুরুষেরই কর্তৃত্ব বিশ্বের সব সমাজ ধর্মেই স্বীকৃত। এখন একজন স্ত্রীলোকের যদি একাধিক স্বামী হয়, তবে সে পরিবারে কোনো পুরুষের কর্তৃত্ব চলবে? আর স্ত্রীই বা কার কর্তৃত্ব মেনে চলবে পারিবারিক কাজ কারবারে? এক সঙ্গে সব কয়জন স্বামীর কর্তৃত্ব মেনে চলা নিশ্চয়ই একজন স্ত্রীর পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা সব পুরুষের মতি-গতি, রুচি-বাসনা সমান নয়, পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণও নয় –বিশেষত দাম্পত্য বিষয়ে। স্ত্রী যদি স্বামীদের একজনের কর্তৃত্ব মেনে চলে তাহেল অপর স্বামীদের পক্ষে তা হবে সহ্যাতীত। অতএব একজন নারীর পক্ষে একাধিক স্বামী গ্রহণ অপেক্ষা একজন পুরুষের পক্ষে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ অধিকতর সহজসাদ্য, নিরাপত্তাপূর্ণ, স্বাস্থ্যকর ও নির্বিঘ্ন। এ সম্পর্কে যত চিন্তাই করা হবে, অত্যাধুনিকদের উপরোক্ত প্রশ্নের অন্তঃসারশূন্যতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। এজন্যেই ডঃ মার্সিয়ার (marcier) বলেছেনঃ

The man is in this respect, as in many other respects, essentially different from woman, has been well noted by students of Biology:

Woman is by Nature a monogamist, man has in him the element of a polygamist

(Conduct and its Discorders Biologically Considered. Pp. 292-293)

এ পরিপ্রেক্ষিতে পুরুষের জন্যে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ইসলাম প্রদত্ত অনুমতির যথার্থতা ও কার্যকরতা সহজেই অনুধাবন করা যায়। ইসলাম মানব জীবনের জন্যে আল্লাহর দেয়া পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানুষের সার্বিক জীবনের প্রয়োজন ও জীবনের যাবতীয় সমস্যাকে সামনে রেখেই সর্বাঙ্গ সুন্দর ও নির্ভুল বিধান রচনা করেছেন মানব স্রষ্টা স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা। মানুষের প্রয়োজন ও সমস্যা সম্পর্কে তিনি ছাড়া আর কারোই সার্বিক জ্ঞান নেই –থাকা সম্ভব নয় বলে তাঁর দেয়া বিধানের সৌন্দর্য মানুষের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে। তিনি নারীকে নয়, পুরুষদেরকে এক সময় একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দিয়ে যে বিশ্বমানবতার প্রতি বিরাট কল্যাণের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, তা বাস্তবিকই অনুধাবনীয়।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ইসলামের দুশমনগণ একাধিক স্ত্রী গ্রহণের এ অনুমতিকে একটি ত্রুটি-একটি দোষের ব্যাপার বলে প্রচারণা চালাচ্ছে, ইসলামের ওপর নিরন্তর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে যে পাশ্চাত্য দেশে নারীর সতীত্ব ও মান-মর্যাদার এক কানা কড়িও দাম নেই, বরং যা পথে-ঘাটে, হোটেল-রেস্তোরাঁয়, নাচের আসরে, থিয়েটার হলে ও নাইট ক্লাবে দিনরাত লুণ্ঠিত হচ্ছে, নগদ কড়ির বিনিময়ে বিক্রি হচ্ছে, সে পাশ্চাত্য দেশে –পাশ্চাত্য সভ্যতার ধ্বজাধারীরাই ইসলাম সম্পর্কে ব্যঙ্গ্যোক্তি নিতান্ত পুরাতন ব্যাপার হয়ে গেছে। এতে না আছে কোনো নতুনত্ব আর না আছে কোনো বৈচিত্র। কেননা ইসলামকে এজন্যে যতই দোষ দেয়া হোক না কেন, তারা নিজেরা নিজেদের দেশের ও সমাজের নানা অবস্থার কারণে আজ স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে যে, একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি একটি স্বাভাবিক ও মানব সমস্যার সমাধানকারী ব্যবস্থাও বটে। ইউরোপীয় সমাজের বহু চিন্তাবিদ মনীষী এর স্বপক্ষে সুস্পষ্ট ভাষায় কথা বলতেও দ্বিধা বোধ করছেন না।

এক বিয়ের ধারক (monogamist) ইউরোপীয় সমাজের নৈতিক ভাঙ্গন ও পারিবারিক বিপর্যয় দেখে মনীষীরা চিৎকার করে উঠেছেন। তাঁদের মতে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ কোনো দোষের কাজ তো নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে তা অপরিহার্য, নিতান্ত প্রয়োজনীয়। নিম্নে কয়েকজন মনীষীর এ সম্পর্কিত উক্তির উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছেঃ

১. লণ্ডনের মিস মেরী স্মীথ নামের এক স্কুল শিক্ষায়িত্রী লিখেছেনঃ

এক স্ত্রী গ্রহণের (monogamy) যে নিয়ম ও আইন বৃটেনে প্রচলিত, তা সবই নিতান্ত ভুল। পুরুষদের জন্যে দ্বিতীয়দায় পরিগ্রহের অনুমতি থাকা একান্তই বাঞ্ছনীয়।

লিখেছেনঃ

এ দেশে (বৃটেনে) নারীদের সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি। এজন্যে প্রত্যেক নারী স্বামী লাভ করতে পারছে না।

তারপর লিখেছেনঃ

এক স্ত্রী গ্রহণের নিয়ম ব্যর্থ হয়েছে। আর এ নিয়ম বিজ্ঞানসম্মতও নয়।

২. অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক আল্লামা শেয়খ আবদুল আজীজ শ্বাদীস মিছরী তাঁর ‘স্বাভাবিক ধর্ম’ নামক গ্রন্থের এক স্থানে লিখেছেনঃ

লণ্ডনের এক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত হলো। ইসলামের নানা দিক নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ হলো। বহু বিবাহ সম্পর্কে কথা উঠতেই তিনি বললেনঃ হায়! আমিও যদি মুসলিম হতাম, তাহলে আর একজন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারতাম। কারণ জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেনঃ আমার স্ত্রী পাগল হয়ে গেছে, তারপরও কত বছর অতিবাহিত হলো। ফলে আমাকে বান্ধবী আর প্রণয়িনী গ্রহণ করতে হয়েছে। কেননা আইনসম্মতভাবে আমি দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করতে পারিনি। আমাদের সমাজেও দ্বিতীয় স্ত্রী বৈধ হলে তার থেকে আমার বৈধ সন্তানের জন্ম হতো; সে হতো আমার বক্ষের পুতুলি, আমার বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী আর আমি পেতাম সঙ্গিনী, লাভ করতে পারতাম গভীর শান্তি ও অপরিসীম তৃপ্তি।

তিনি আরো লিখেছেনঃ

ইংলণ্ডে যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে সতেরো শতক থেকেই বহু বিবাহ প্রথার প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হয়। ১৬৫৮ সনে এক ব্যক্তি ব্যভিচার ও নবজাতক অবৈধ সন্তানের মৃত্যু বন্ধ করার জন্যে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের স্বপক্ষে এক পুস্তিকা প্রকাশ করেন। তার এক শতাব্দী পর ইংলণ্ডের জনৈক আদর্শ চরিত্রবান পাদ্রী এ প্রস্তাব সমর্থন করে আর একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। প্রখ্যাত যৌনতত্ত্ববিদ জেমস হুলটন যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা ও ব্যভিচার প্রতিরোধের জন্যে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুকূলে মত প্রকাশ করেন।

৩. প্রখ্যাত চিন্তাবিদ শোপেন আওয়ার তাঁর এ সম্পর্কিত চিন্তাধারা প্রকাশ করেছেন এভাবেঃ

এক স্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল লোক কোথায়, আমি তাদের দেখতে চাই। আসলে আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তিরই বহু সংখ্যক স্ত্রী প্রয়োজন। এজন্যে পুরুষের স্ত্রী গ্রহণের কোনো সংখ্যা নির্ধারিত হওয়া উচিত নয়।

৪. প্রসিদ্ধ যৌনতত্ত্ববিদ কিলবন তাঁর Human Love নামক গ্রন্থ লিখেছেনঃ

ইংলণ্ডে যদিও কার্যত বহু স্ত্রী গ্রহণের রীতি চালু রয়েছে, কিন্তু সমাজ ও আইন তা এখন পর্যন্ত সমর্থন করেনি। যদিও সে সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি দেখা যায়। যেসব লোক একজন স্ত্রী গ্রহণ করে দুই বা তিনজন রক্ষিতা ও বান্ধবীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে, সমাজ তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে একবারে নীরব। কিন্তু পুরুষের একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি থাকা উচিত বলে কেউ যদি কোনো প্রস্তাব পেশ করে তাহলে সমাজ অমনি তার বিরুদ্ধে চীৎকার করে ওঠে।

৫. আমেরিকার একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি বা প্রচলন না থাকার ফল কত মর্মান্তিক হয়েছে তা ওয়াশিংটনস্থ ‘ইয়ং ওমেন ক্রীশ্চান এসোসিয়েশন’-এর চেয়ারম্যান মিসেস ডাসেল কানফিংক প্রদত্ত এক ভাষণ থেকে স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। তিনি বুকিং কমিটির সামনে বিবৃতি দান প্রসঙ্গে বলেছিলেনঃ

আমেরিকার চৌদ্দ বছরের ঊর্ধ্ববয়স্কা যুবতী মেয়ের সংখ্যা এক কোটি বিশ লাখ। আর এরা সবাই অবিবাহিতা। তার তুলনায় অবিবাহিত ছেলেদের সংখ্যা মাত্র নব্বই লাখ। এ হিসেব অনুযায়ী ত্রিশ লাখ যুবতী মেয়ের পক্ষে স্বামী লাভ কা কঠিন কাজ বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা মহাযুদ্ধ পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের সংখ্যাগত ভারসাম্য অনেকাংশে নষ্ট করে দিয়েছে।

-(লাহোর থেকে প্রকাশিত ‘জমজম’ পত্রিকা-১৫.৮.১৯৪৫)

৬. কালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবেশে ‘বহু বিবাহ ও তালাক’ পর্যায়ে ভাষণ দান প্রসঙ্গে প্রখ্যাত গ্রন্থকার রবার্ট রীমার বলেছেনঃ

তালাকের ক্রমবর্ধমান ঘটনাবলীকে প্রতিরোধ করা এবং শিশু ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে আমেরিকার লোকদেরকে এক সময়ে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দেয়া আবশ্যক। এর ফলে সেয়ানা বয়সের পুরুষ নারী, বিধবা ও রক্ষিতাদের বহু উপকার সাধিত হবে। (দৈনিক জং, করাচী-২২.১২.’৬৪)

৭. চেকোশ্লাভিয়া সম্পর্কে সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে যে, ততায় অবিবাহিতা নারীর সংখ্যা অবিবাহিতা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, সে দেশে বিয়ে করতে ইচ্ছুক নারীর সংখ্যা বিবাহেচ্ছু পুরুষ অপেক্ষা তিন লাখ ত্রিশ হাজার অধিক।

(দৈনিক ‘দাওয়াত’, দিল্লী-১৫.১২.’৬৪)

৮. প্রখ্যাত নারী চিকিৎসক ডা. এনি ব্যাসেন্ত (Annie Besent) বলেছেনঃ

There is pertended monogamy in the west, but there is really polygamy without responsibility; the mistress is cast off when the man is weary of her, and sinks gradually to be the “Woman of the street”, for the first lover has no responsibility for her future and she is a hundred times worse off than the sheltered wife and mother in the polygamous home. When we see thousands of miserable women who crowd the streets of Western towns during the night we must surely feel that it does not lie within Wertern mouth to reproach Islam for polygamy. It is berrer for woman, happier for woman more respectable for woman, to live in polygamy, united to one man only, with the legitimate child in her arms, and surrounded with respect, than to be seduced, cast out in the streets –perhaps with an illegitimate child outside the pale of low –unsheltered and uncared for to become the victim of any passer-by, night after night, rendered incapable of motherhood despised by all.

(Morning News-27.12.63)

(The light of Islam Polygamy and Law)

By Khurshid Ahmad

একাধিক স্ত্রী গ্রহণের খারাপ দিক

এতক্ষণে আমরা স্ত্রী গ্রহণের বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতা সম্পর্কে আলোচনা করেছি এবং এ ব্যবস্থা চালুন না থাকার কারণে দুনিয়ার বিভিন্ন সমাজে কি পরিণতি ঘটেছে আর সে সব কি সামাজিক ও নৈতিক সমস্যার সম্মুখীন, তাও আমরা দেখেছি এবং তারও পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের আবশ্যকতা প্রমাণ করেছি। কিন্তু এ প্রসঙ্গে ইনসাফের তাগিদ হচ্ছে –এর খারাপ দিকটি সম্পর্কেও দুটো কথা বলে দেয়া। কেননা এরও যে একটা খারাপ দিক রয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

ক. এ পর্যায়ে সবচেয়ে খারাপ দিক যেটা মারাত্মক হয়ে ওঠে পারিবারিক জীবনে, তা হচ্ছে স্ত্রীদের পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, মন-কষাকষি ও ঝগড়া-বিবাদ। এ যে অনিবার্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং এর ফলে যে পারিবারিক জীবন তিক্ত বিষ জর্জরিত হয়ে ওঠে তাও অনস্বীকার্য। এ রকম অবস্থায় স্বামী বেচারার দিন-রাত বচ্চিশ ঘন্টা চলে যায় স্ত্রীদের মধ্যে ঝগড়া মেটাবার কাজে। এতেও তার জীবন জাহান্নামে পরিণত হয়। এমন সময়ও আসে, যখন সে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করার জন্যে নিজেকে রীতিমত অপরাধী মনে করতে শুরু করে।

দ্বিতীয়ত, স্বামী যেহেতু স্বাভাবিক কারণেই একজন স্ত্রীর প্রতি বেশি টান ও বেশি ভালোবাসা পোষণ করে, ফলে স্ত্রীদের মধ্যে জ্বলে ওঠে হিংসার আগুন, যা দমন করতে পারে কেবল স্বামীর বুদ্ধিমত্তা আর এ আগুন থেকে বাঁচতে পারলে কেবল সে, যে নারীর আদর্শ চরিত্রকে অবলম্বন হিসাবে গ্রহণ করতে পেরেছে।

খ. হিংসার আগুন স্ত্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা স্ত্রীদের সন্তানদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। তারাও বিভিন্ন মায়ের সন্তান হওয়ার কারণে পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করতে থাকে। ভ্রাতৃত্ব পারস্পরিক পরিণত হয়ে যায়। ফলে গোটা পরিবারই হিংসা-বিদ্বেষের আগুনে জ্বলতে থাকে। এরূপ অবস্থায় বিশেষ করে পিতার পক্ষে –একাধিক স্ত্রীদের স্বামীর পক্ষে –হয়ে পড়ে অত্যন্ত মারাত্মক। পরিবারের স্থিতি বিনষ্ট হয়, শান্তি ও সৌভাগ্য থেকে হয় বঞ্চিত।

গ. ভালোবাসার দিক দিয়ে স্ত্রীদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।যে স্ত্রী নিজকে স্বামীর ভালোবাসা বঞ্চিতা বলে মনে করে, সতীনদের প্রতি তার স্বামীর মনের ঝোঁক-আকর্ষণ ও টান লক্ষ্য করে, তখন সে স্বাভাবিকভাবেই মনে করে যে, তারও একদিন ছিল, যখন সে স্বামীর হৃদয়ভরা ভালোবাসা লাভ করেছিল। তখন তার মনে জাগে হতাশা। স্বামীর ভালোবাসায় পরবর্তী শরীককে তখন সে নিজের শত্রু বলে মনে করতে শুরু করে। আর তখন তার মনে যে ব্যর্থতার বেদনা জাগ্রত হয়, তা অনেক সময় তার নিজের জীবনকেও নষ্ট করে দিতে পারে, সে সতীনকে অপসারিত করার উপায় উদ্ভাবনের তৎপরতাও কিছুমাত্র বিচিত্র নয়।

ঘ. অনেকের মতে একাধিক স্ত্রীসম্পন্ন পরিবারের ছেলে মেয়েরা উচ্ছৃঙ্খল ও বিদ্রোহী হয়ে পড়ে। ঘরে যখন দেখতে পায় মায়েদের পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি দিন-রাত লেগেই আছে আর তার সামনে বাবা নিতান্ত অষহায় হয়ে হয় চুপচাপ নির্বাক থাকে, না হয় স্ত্রীদের ওপর চালায় অত্যাচার, নিষ্টেষণ, নির্যাতন, তখন পরিবারের শৃঙ্খলা ও শাসন-বাঁধন শিথিল হয়ে পড়ে। ছেলেমেয়েরা ঘরে শান্তি-সম্প্রীতির লেশমাত্র না পেলে ঘরের বাইরে এসে পড়ে আর শান্তির সন্ধানে যত্রতত্র ঘুরে মরে।

একাধিক স্ত্রী গ্রহণের পরিণামে উপরোক্ত অবস্থা দেখা দেয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। আর পারিবারিক জীবনে এ যেন একটি অকল্যাণের দিক, তাও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মানব সমাজের জন্যে এমন কোনো ব্যবস্থা রয়েছে, যা বাস্তবে জমিনে রূপায়িত হলে তাতে কোনো দোষ –কোনো ক্রটিই দেখা দেবে না? মানুষ যা কল্পনা করে, আশা করে, বাস্তবে তার কয়টি সম্ভব হয়ে ওঠে? ইসলামের একাধিক স্ত্রী গ্রহণ সম্পর্কিত অনুমতি বা অবকাশেও যে বাস্তব ক্ষেত্রে এমনি ধরনের কিছু দোষ-ত্রুটি দেখা দেবে কিংবা বলা যায়, এ অনুমতির সুযোগে কিছু লোক যে দুষণীয় কাজ করবে, তা আর বিচিত্র কি। তবে ইসলামের একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতিই একমাত্র জিনিস নয়, সে সঙ্গে রয়েছে প্রকৃত দ্বীনদারী ও পবিত্র চরিত্র গ্রহণের আদর্শ –আদেশ, উপদেশ ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতি। তা যদি পুরাপুরি অবলম্বিত হয়, তাহলে উপরোক্ত ধরনের অনেক খারাবী থেকেই পরিবারকে রক্ষা করা যেতে পারে, একথা জোরের সাথেই বলা যায়।

একথা মনে রাখতে হবে যে, ইসলামে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের কোনো নির্দেশ দেয়া হয় নি, তা ফরযও করে দেয়া হয়নি মুসলিম পুরুষদের ওপর। বরং তা হচ্ছে প্রয়োজনের সময়কালীন এক ব্যবস্থা মাত্র, তা হচ্ছে নিরুপায়ের উপায়, অগতির গতি। বস্তুত এক সঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের প্রয়োজন যে দেখা দিতে পারে, অনেক সময় তা একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়ে তা পূর্বে আমরা দেখেছি। এখন কথা হলো, নিরুপায় হয়ে পড়লে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ স্ত্রী গ্রহণ করা যাবে কিনা! আর নিতান্ত প্রয়োজনে পড়ে গৃহীত এ ব্যবস্থায় যদি কিছু কষ্টের কারণ দেখা দেয় তাহলেও তা অবলীলাক্রমে বরদাশত করা হবে কিনা! একটি বৃহত্তর খারাবী থেকে বাঁচবার জন্যে ক্ষুদ্রতর খারাবীকে বরদাশত করা মানব জীবনের স্থায়ী রীতি, যা আমরা দিনরাত সমাজে দেখতে পাই। কিন্তু ক্ষুদ্রতর খারাবী দেখিয়ে একথা বলা কিছুতেই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না যে, এ গোটা ব্যবস্থাই ঠিক নয়। কাজেই ব্যাপারটি সম্পর্কে উদার ও ব্যাপকতর দৃষ্টিতেই বিচার করতে হবে ও চূড়ান্ত রায় দিতে হবে।

পরন্তু সতীনের কারণে কোনো স্ত্রীর মনোকষ্ট হওয়া কেবলমাত্র একাধিক স্ত্রী গ্রহণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। স্ত্রী যদি দেখতে পায় তার বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তার স্বামী অপর নারীর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, তখনো কি তার মনে হতাশা জাগবে না? দাম্পত্য জীবনের ব্যর্থতার আঘাত কি তার কলিজাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে না? …..তাহলে তার স্বামীকে অবৈধ পন্থায় কিংবা গোপনে চুরি করে অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে দেয়ার চাইতে বৈধভাবে তাকে বিয়ে করে ঘরে আনতে দেয়া কি অধিকতর পবিত্র ব্যবস্থা নয়? ……যে লোক একজন মাত্র স্ত্রী গ্রহণ করেও তার একমাত্র স্ত্রীকে ভালোবাসেন না, সেই স্ত্রীর মানসিক অবস্তা কি এবং সেজন্যে দায়ী কে?

আর এ ধরনের পরিবারের সন্তানদের উচ্ছৃঙ্খল হওয়া সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে, সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে, এর জন্যে একাধিক স্ত্রী বর্তমান থাকাই দায়ী নয়। এক স্ত্রীর সন্তানদেরও অবস্থা এমনি হতে পারে, হয়ে থাকে। আরব জাহানে ‘রীফ’ গোত্রের লোকেরা সাধারণভাবেই একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে অধিক সন্তান লাভ, যেন কৃষিকাজে তারা তাদের সাহায্য করতে পারে, তারা খুবই সচ্ছল অবস্থার লোক। কিন্তু ‘রীফ’ সন্তানদের মধ্যে পারিবারিক বিদ্রোহের নামচিহ্ন পর্যন্ত দেখা যায় না। বরং তা দেখা যায় বড় বড় শহরে নগরে, বিশেষত গরীব পর্যায়ের পরিবারের সন্তানদের মধ্যে খুব বেশির ভাগ। বর্তমানে অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যে পারিবারিক বিদ্রোহের ভাব প্রবল হতে দেখা যাচ্ছে তার কারণ নিশ্চয়ই একাধিক স্ত্রী গ্রহণ নয়, বরং তার কারণ নিহিত রয়েছে শিক্ষা বিষয়ক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে।

পূর্বের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, ইসলামে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যবস্থা একটি নৈতিক ও মানবিক ব্যবস্থা। নৈতিক চরিত্রের পবিত্রতা রক্সা এবং মানবতার স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই এ ব্যবস্থা বিশ্বস্রষ্টা কর্তৃক প্রদত্ত হয়েছে। নৈতিক ব্যবস্থা এজন্যে যে, একজন পুরুষ নিজ ইচ্ছামতো যে কোনো মেয়েলোককে যে কোনো সময়ে নিজের অঙ্গশায়িনী করে নিতে পারে না, পারে না বিয়ের বাইরে যাকে তাকে দিয়ে তার যৌন লালসা চরিতার্থ করে নিতে। আর তার স্ত্রীর বর্তমানে তিনজনের অধিক স্ত্রীলোকের সঙ্গে যৌন মিলন সম্প্ন করতে পারে না।

তাছাড়া কারো সঙ্গে গোপনে, অবৈধভাবে কেনো মেয়েলোকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারা যায় না। বরং রীতিমত বিয়ে সম্পন্ন হওয়া আবশ্যক, যার পিছনে ছেলে ও মেয়ের অলী-গার্জিয়ান তথা সমাজের লোকদের থাকবে পূর্ণ সমর্থন, যার দরুন নৈতিক চরিত্রের পবিত্রতা বিনষ্ট হওয়ার কোনো কারণ ঘটবে না সেখানে।

আর সে ব্যবস্থা মানবিক এজন্যে যে, একজন স্ত্রী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও যে পুরুষ অপর স্ত্রীর প্রয়োজন তীব্রভাবে বোধ করে, সে বাধ্য হয় বিয়ে ছাড়াই অবৈধভঅবে বান্ধবী আর প্রণয়ী যোগাড় করতে। সে তাদের সাথে যৌন সম্পর্ক রাখবে, তাদের মধু লুটবে অথচ সে তাদের স্বামী হবে না, গ্রহণ করবে না কোনো সামাজিক ও অর্থনৈতিক দায়িত্ব কিংবা সে বাধ্য হবে হাটে-বাজারে, শহরে-নগরে, কোঠাবাড়িতে অবস্থিত দেহপসারিণীদের দ্বারে দ্বারে লজ্জাস্করভাবে ঘুরে বেড়াতে। এতে করে তার মনুষ্যত্ব বিনষ্ট হয়ে যাবে, লাঞ্ছিত হবে, কলংকিত হবে তার ভিতরকার মানুষ।

উপরন্তু সে দেহপসারিণী কিংবা বান্ধবী-প্রণয়িনীদের জন্যে যৌন মিলনের বিনিময়ে যে বিপুল অর্থ-সম্পদ ব্যয় করবে, তাতে তার অর্থনৈতিক ধ্বংস টেনে আনবে, অথচ তা দ্বারা মানুষের সামাজিক কোনো কল্যাণই সাধিত হবে না। এ যৌন মিলনের পরিণামে গড়ে উঠবে না নতুন কোনো মানব-সমাজ।

একাধিক স্ত্রী গ্রহণের আইনসম্মত অবকাশ থাকলে এসব ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি কখনো দেখা দিতে পারে না। এ কারণে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ইসলামী বিধানযে কত নির্ভুল, কত স্বভাবসম্মত ও যুক্তিপূর্ণ ব্যবস্থা, তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।

কিন্তু পাশ্চাত্য সমাজে যেখানে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ, সেকানে কার্যত বহু স্ত্রী ভোগরে বীভৎস নৃত্য সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়। সেজন্যে আইনে কোনো বাধা নেই, বরং আইনের অধীন-আইনের চোখের সামনেই অনুষ্ঠিত হয় এ জঘন্য কাজ।

-যদিও সেসব স্ত্রীলোককে বিয়ে করতে রীতিমত স্ত্রীত্বের মর্যাদায় গ্রহণ করা হয় না, তারা হয় বান্ধবী আর প্রণয়িনী মাত্র।

সে সমাজের পুরুষরাও চারজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে না, সেখানে যৌন সম্পর্ক চলে যথেষ্ট বাধা-বন্ধনহীন এবং সীমা-সংখ্যাহীন।

এরূপ অবাধ যৌন চর্চায় না গড়ে ওঠে গোপনে, সমাজ সমর্থনের বাইরে। এর ধ্বংসকারিতা আজকে পাশ্চাত্য সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে।

এক কথায় বলা যায়, ইউরোপেও বহু স্ত্রী গ্রহণের রেওয়াজ কার্যথ চালু রয়েছে। যদিও তা অবৈধভাবে। আর ইসলামেও একাধিক স্ত্রী গ্রহণের রেওয়াজ সমর্থিত, কিন্তু আইনের সামায্যে এবং চার সংখ্যার সীমার মধ্যে। এ দুয়ের মধ্যে কোনটি যে ভালো ব্যবস্থা, তা যেনো কোনো সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি সহজেই নির্ণয় করতে পারে।

বস্তুত এ পর্যায়ে ইউরোপীয় সমাজ আর ইসলামী সমাজে যে পার্থক্য দেখা যায়, তা এক স্ত্রী গ্রহণ আর বহু স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে নয়, আসল পার্থক্য হচ্ছে সীমিত সংখ্যার বৈধ স্ত্রী গ্রহণ আর সীমা-সংখ্যাহীন স্ত্রী ভোগের দায়িত্বহীন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে। একটি করে মানুষকে শালিনতাপূর্ণ, দায়িত্বশীল আর অপরটি করে দেয় যেন লালসার দাস, দায়িত্বহীন, উচ্ছৃঙ্খল।

শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স) কর্তৃক ইসলামের প্রতিষ্ঠা লাভেল পূর্বে আরব সমাজেও সীমা-সংখ্যাহীন বহু স্ত্রী ভোগ করার নানাবিধ উপায় কার্যকর ছিল। ইসলাম এ স্বাভাকি প্রবণতার সংশোধন করেছে। সীমা-সংখ্যাহীন স্ত্রী ভোগ করার পথ বন্ধ করে চারজন পর্যন্ত সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। দ্বিতীয়, বিয়ের বাইরে নারী-পুরষের যৌন সম্পর্ককে চিরতরে হারাম করে দিয়েছে এবং তৃতীয়, স্ত্রীদের মধ্যে আদল ও ইনসাফ কায়েম করার কঠোর নির্দেশ দিয়েছে। একাধিক স্ত্রী গ্রহণের জন্যে একে জরুরী শর্তরূপে নির্ধারিত করে দিয়েছে। আর চতুর্থ, এ ব্যাপারে স্বামীদেরম নে আল্লাহর আযাবের ভয় জাগিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ যে কত বড় সংশোধণী কাজ তা সেই সমাজের অবস্থাকে সামনে রেখে চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যাবে। রাসূলে করীমের এ সংশোধনী কাজ বাস্তবায়িত হওয়ার পর সমাজের মূল গ্রন্থিতে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল তা সত্যিই বিস্ময়কর এবং তা পারিবারিক ইতিহাসে চিরদিন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

রাসূলে করীমের গঠিত সমাজে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের রেওয়াজ ছিল, কিন্তু সেখানে তার খারাপ দিক কখনো প্রবল হয়ে উঠতে পারে নি। কোনো নারীর কিংবা স্বামীর জীবন সেখানে তিক্ত-বিষাক্তও হয়ে ওঠেনি, স্ত্রীদের পরস্পরের মধ্যে হিংসা দ্বেষের আগুন জ্বলে ওঠেনি আর তাদের সন্তানরাও হয়নি পরস্পরের শত্রু। ইসলাম যুগের প্রেম-ভালোবাসা, সম্প্রীতি-সদ্ভাবের পূত ভাবধারায় পরিপূর্ণ ছিল, ছিল অকৃত্রিম স্বামী-ভক্তি, ঐকান্তিক নিষ্ঠা। সেখানে এক স্ত্রীসম্পন্ন পরিবার আর একাধিক স্ত্রী সম্পন্ন পরিবারের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য ছিল না।

আর এ কারণেই ইসলামী সমাজে নারীর সংখ্যাধিক্য কখনো সমস্যা হয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেনি। ইহজগতের পর থেকেই ইসলামী যুদ্ধ-জিহাদের সূচনা হয়, তারপরে প্রায় দু’শতাব্দীকাল পর্যন্ত তা চলতে থাকে। এসব যুদ্ধ-জিহাদে হাজার হাজার পুরুষ শহীদ হয়েছে, হাজার হাজার নারী হয়েছে বিধবা, স্বামীহারা কিংবা অবিবাহিত যুবকদের শহীদ হওয়ায় অবিবাহিতা যুবতীদের সংখ্যা পেয়েছে বৃদ্ধি। কিন্তু কোনো দিন যুদ্ধ করতে সমর্থ যুবকশক্তির অভাবও দেখা দেয়নি, তেমনি অভাব ঘটেনি মেয়েদের জন্যে স্বামীর। অথচ আধুনিক ইউরোপ মাত্র দুটো মহাযুদ্ধের ফলেই পুরুষদের সংখ্যাল্পতা ও নারীর সংখ্যাধিক্যের বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। অভাব পড়েছে যুদ্ধযোগ্য যুবশক্তি।

এসব দৃষ্টিতে বিচার করলেও একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ইসলামী ব্যবস্থার সৌন্দর্য ও যথার্থতা সহজেই অনুধাবন করা যায়।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি