তেইশতম অধ্যায়
আমার স্মৃতিপটে ১৯৫৪ সালের ঘটনাবলী ঘুরপাক খাচ্ছে। এ বছর জানুয়ারী মাসে সুদানে প্রথম পার্লামেন্টের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো। এ অধিবেশনে সদস্য অধিকাংশই মিসরের সাথে একীভূত হয়ে যাওয়ার দাবী করে..... আজ আবার লক্ষ্য করে দেখুন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। দু’টি ভ্রাতৃপ্রতীম দেশের মধ্যে পুনরায় একীভূত হওয়ার আলোচন চলছে। ইতিপূর্বে এ ব্যাপারে যত চেষ্টা হয়েছে তার সবই কোন না কোন কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। আমি আল্লাহ তায়ালার সমীপে আকুলভাবে দোয়া করছি যেন এবারের আলাপ আলোচনা ফলপ্রসু হয় এবং দু’টি দেশ একই ঐক্যসূত্রে নিজেদেরকে গ্রথিত করার ব্যাপারে সফলতার মুখ দেখতে পায়।
সুদান আশার আলোকচ্ছট!
সুদানে ইসলামী শরীয়াতের বাস্তবায়নে ও কার্যকরী করার কারণে ইনশাআল্লাহ সুদূর প্রসারী ফলাফল দেখা দেবে। মিসরের শাসনতন্ত্র এবং সংবিধানও এ ব্যাপারে ইসলামকেই সকল আইনের মৌলিক উৎস হিসেবে ঘোষণা করে। আল্লাহর হুকুমে কার্যক্ষেত্রেও যেন এদিকেই অগ্রসর হয়। আইন প্রণয়নের মৌলিক নীতিমালার ক্ষেত্রে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর একীভূত হয়ে যাওয়ার জন্য মজবুত ভিত্তি রচিত হয়ে যাবে। ইতিপূর্বেও আমি উল্লেখ করেছি যে, প্রেসিডেন্ট নিমেরী ইখওয়ানুল মুসলিমুনকে ইখওয়ানুস শাইয়াতীন নামে অভিহিত করে আমাকে যারপরনেই গোলাক ধাঁধায় ফেলে দিয়েছেলেন। তথাপি আমরা নিমেরী সাহেবের সাথে কোনরূপ আশোভন ও অশালীন আচরণ করিনি। বরং আমরা সর্বদা তার হিতাকাংখী ও কল্যাণকামী এবং এই মহতী কার্য তার সহযোগিই রয়েছি। সুদানী আইন পরিষদের সাময়িকীতে আমি যে প্রবন্ধ লিখেছিলাম তাতে ইসলামী আইনকে কার্যকরী করার মহতী উদ্যেগকে বড় সম্মনের দৃষ্টিতে দেখেছিলাম এবং এই পদক্ষেপকে পুরোপুরি সমর্থন করেছিলাম। আমরা মন্দের প্রতিদানে মন্দ করি না। আমাদের দোয়া এই যে, সুদানে ইসলাম বাস্তবায়নের প্রয়াস-প্রচেষ্টা সাফল্য মন্ডিত হোক। যাতে সমগ্র দুনিয়ার জন্য এই শাসন ব্যবস্থাকে নমুনা হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।
কামাল আতাতুর্কের ধর্মহীন গণতান্ত্র
১৯৫৪ সালের জানুয়ারী মাসের কথা। এ সময় মিসরে তুর্কী রাষ্ট্রদূত তুগায়ীকে দেশ ত্যাগ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রদূত কূটনৈতিক নিয়ম-কানুনের পরিপন্থী কিছু কথাবার্তা বলেছিলেন। এই পরিস্থিতিতে আমার মনে পড়লো যে, মিসরের এক রাষ্ট্রদূতের সাথেও তুরষ্কে এক আশ্চর্য ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। এটা ছিল মিসরের বাদশাহ প্রথম ফুয়াদের আমলের কথা। সেই সময় কামাল আতাতুর্ক ইসলামের খেলাফত ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়ে তুরষ্কে ধর্মহীন গণতন্ত্রের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তুর্কী টুপি অথবা পাগড়ী পরিধান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ত্ৎপরিবর্তে ইউরোপীয় হ্যাট ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়। মিসরের রাষ্ট্রদূত আবদুল মালেক হামযা বেগ কোন সরকারী কার্য ব্যাপদেশে রাষ্ট্রপতি ভবনে গমন করেছিলেন। তাঁর মাথায় ছিল তারবুশ (টুপি)। মোস্তফা কামাল (চরম ঔদ্ধত্বের সাথে) রাষ্ট্রদূতের মাথা থেকে টুপিটি নিয়ে মাটির ওপর ছুঁড়ে মারেন। এ অবাঞ্ছিত ঘটনা সত্ত্বেও দু’দেশের মধ্যে কোন সমস্যা সৃষ্টি হয়নি।
বিপ্লবী কাউন্সিল কর্তৃক ইখওয়ানের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ
১৯৫৪ সলের জানুয়ারী মাসেই বিপ্লবী কাউন্সিল ইখওয়ানুল মুসলিমুনকে বেআইনী ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবি, ডাক্তার খামীস, হাসান আসমাভী, জনাব মুনীর দাল্লাহ, ভাই সালেহ আবু রাকীক, ফরিদ আবদুল খালেক, জেনারেল সালাহ শাদী ও জনাব ফারগলি প্রমুখকে গ্রেফতার করে জিন্দানখানার চার দেয়ালের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দু’মাস পর মার্চ মাসে তাদের মুক্তি দেয়া হয়। এ সম্পর্কে পূর্বেই উল্লেখ কার হয়েছে। এই ইখওয়ানী নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করার সময় আবদুল কাদের আওদা শহীদ আবদুন নাসেরের সাথে তার বসভবনে সাক্ষাত করেন। সাক্ষাতের পর তিনি আমাদেরকে বললেন যে, অতি শীগ্রই সকল সমস্যা ও সংকটের অবসান হয়ে যাবে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিগণ আমেরিয়া কারাগারে ছিলেন। আওদা শহীদ সেখানে গিয়ে তাদের সহিত দেখা করেন এবং তাঁর সাক্ষাতের ব্যাপারে তাদের সবইকে অবহিত করেন।
মিসর ও সিরিয়ার ঐক্য
আমার আজও মনে আছে যে, ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যখন সিরিয়াতে মারাত্মক গোলযোগ দেখা দেয়। তখন জামল আবদুন নাসের ও জামাল সালেম সিরিয়া গমন করেন যেন বিবাদমান দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা করিয়ে দেয়া যায়। আমার মনে হয় নাসের সিরিয়ায় বিরাজমান পরিস্থিতি দেখে মিসর ও সিরিয়ার মধ্যে ঐক্য ঘটানোর ব্যাপারে মত স্থির করেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, সিরিয়া অর্থনৈতিক-ভাবে দারিদ্রের শিকার হয়ে পড়েছে, এ থেকে মুক্তি লাভের জন্য সিরিয়ার নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণ মিসরের সাথে ঐক্যের ব্যাপারে সহযোগিতা করবে। নাসের তার সাম্রজ্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইতিমধ্যে মনে মনে চিত্র অংকন করে ফেলেছিলেন। তার সেই নকশা মোতাবেক ইরাক থেকে সুদূর মরক্কো পর্যন্ত পুরো এলাকার ওপর আধিপত্য বিস্তার করাই ছিল উদ্দেশ্য। অনেক সময় প্রতিকূল আবহাওয়ার নিষ্ঠুর আঘাত জাহাজকে মঞ্জিলে মকসুদ পর্যন্ত পৌছতে দেয় না। নাসরের স্বপ্ন বাস্তবতার মুখ দেখতে সক্ষম হয়নি। বস্তুত মানুষ চিন্তা করে এক আর তাকদীর ঘটিয়ে ফেলে অন্য। যে কাজের ভিত্তি মহৎ উদ্দেশ্যের ওপর রাখা হয় না তার ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না।
জেনারেল নাজীবের সাময়িক পদত্যাগ
১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আরো একটি ঘটনা সংঘটিত হয়্ সেটা ছিল জেনারেল মুহাম্মাদ নাজীবের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে ইস্তাফা প্রদান। পদত্যাগ করার দু’দিন পরই জেনারেল নাজীব পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন। সবাই এই ভেবে বিম্ময় বিমূঢ় হয়ে পড়ে যে, দেশের অধীনে এসব বিষয়ে বিম্ময় বোধ করার কোন কারণ নেই। ক্ষমতার মসনদের প্রতি যখন সেনাবাহিনীর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে তখন সব কিছুই উলট পালট হয়ে যায়। সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে সীমান্ত রক্ষা করা, রাষ্ট্র পরিচালনা নয়। সরকার পরিচালনা করা একটা গুরুত্বপূর্ণ ও নাজুক দায়িত্ব। এই গুরু দায়িত্বে অভিষিক্ত হতে পারে সেসব লোক যাদেরকে এই মহতী উদ্দেশ্যের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনা করা রাজনীতিবিদদের কাজ; কিন্তু ক্ষমতার লিপসা ও গদির মোহ সমস্ত নিয়ম-শৃংখলা উলটে পালটে দেয়।
ওয়াফদ পার্টির শসনকাল
এখনে আমি একথাটাও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা জরুরী বলে মনে করি যে, ওয়াফদ পার্টির মন্ত্রীত্বের আমলে জনসাধারণের শাস্তি ও নিরাপত্তা লাভ করেছিল; অন্যান্য দলের মন্ত্রীদের সময় যা ছিল না। ওয়াফদদের মন্ত্রীত্বের আমলেও কখনো কখনো ওয়াফদদের কোন কোন নেতা তাদের নির্বুদ্ধিতার দ্বারা পরিবেশ কলুষিত করে ফেলতো। কিন্তু সার্বিকভাবে এই আমল অন্যদের আমলের চেয়ে অনেক উত্তম ছিল। আমার মনে আছে নাহাস পাশার মন্ত্রীত্বের আমলে পুলিশ শাবীনুল কানাতিরে অবস্থিত আমার বাড়ী ও অফিস তল্লাসী করে। তাদের সন্দেহ ছিল যে, মুকাররম আবীদ পাশার নিষিদ্ধ ঘোষিত গ্রন্থের কপি আামার কাছে আছে। লেখক এই বইটি নাহাস পাশা এবং তার ওয়াফদ পার্টির বিরুদ্ধে লিখেছিলেন। সরকার এ পুস্তক নিষিদ্ধ করে দেন এবং তার সমস্ত কপি বাজেয়াপ্ত করেন। আমার সম্পর্কে কেউ সরকারকে এই মর্মে মিথ্যা খবর দেয় যে, উক্ত গ্রন্থের কপি আমার নিকট আছে। পুলিশ বাসগৃহ ও দফতরের সবকিছু তন্নতন্ন করে খোঁজ করেও বইটির কোন কপি বের করতে পারেনি। এই দলটির চেহারায় এ ধরনের কলম্ক রেখা রয়েছে। যদিও তুলানামূলকভাবে তাদের রেকর্ড কিছুটা ভাল।
গোপন অধিবেশন
একদিকে যেমন ওয়াফদ পার্টির এই গ্রন্থকে বেআইনি করা এবং মানুষের ঘর বাড়ীতে আকম্মাত তল্লাশী চালানো ছিল অপছন্দনীয় কাজ অপরদিকে তেমনি আমার মতে মোকাররম আবীদ পাশার এই বই লেখাও সঠিক পদক্ষেপ ছিল না। আবীদ পাশা ছিলেন ওয়াফদ পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এই পার্টির সাথে ছিলেন বেশ কয়েকটি বছর। এমনকি মন্ত্রীত্বের পদ পর্যন্ত অলম্কৃত করেন। অতপর তিনি ওয়াফদ পার্টি থেকে আলাদা হয়ে হিযবুল কুতলা বা কুতলা পার্টির গোড়া পত্তন করেন এবং ওয়াফদদের বিরুদ্ধে বই লিখেন। বিশ্বস্ততা ও দ্বীনদারীর পরিপন্থি যে কোন ব্যক্তি কোন দলে থাকবেন এবং সেই পার্টি থেকে মন্ত্রীত্বের পদও অলম্কৃত করবে কিন্তু পরে পার্টির আভ্যন্তরীণ গোপনীয়তা ফাঁস করে দেবেন এরূপ আচরণে গোপনীয়তা ও দায়িত্বশীলতা আহত হয়ে থাকে-প্রত্যেক পার্টির সদস্যেরই এটি মেনে চলা দরকার, যদি এর প্রতি যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করা না হয় তাহলে কেউই কারো তোয়াক্কা করবে না এবং সামাজিক জীবন বিশৃংখলার শিকার হয়ে পড়বে।
আমি ওপরে আমার যে মতামত উল্লেখ করেছি তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহু সংখ্যক হাদীস এবং কর্মনীতি থেকে গৃহীত। হযরত রাসূল (সা) থেকে একটি রেওয়াত বর্ণিত হয়েছে যে, “এক ব্যক্তি রাসূল (সা)-এর নিকট এসে আরজ করলেন। ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা) আমি ছিলাম মুনাফিকদের অন্তর্গত বরং তাদের সরদার মুনাফিকদের মজলিশে কি কি কথাবার্তা হয়ে থাকে আমি খুব ভাল করে জানি। আমি কি আপনাকে তার বিস্তারিত বিবরণ দেবো? প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা) একটা উন্নত নৈতিক শিক্ষা প্রদান করলেন। তিনি বললেন, “এমনটি কখনো করো না........যিনি মোনাফিকী পরিত্যাগ করে তোমার মত নিষ্ঠাবান মুসলিম হয়ে যায় এবং আমাদের নিকট চলে আসে আমরা তাকে খোলা মনে গ্রহণ করে এবং তার জন্য আল্লাহর সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করি। পক্ষান্তরে যে মোনাফিকীর ওপর অবিচল থাকে আমরা তার পশ্চাতে লেগে থাকি না। তার সাথে বুঝাপড়া করার জন্য আল্লাহ তায়ালাই তার জন্য যথেষ্ট। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর এই হাদীস সর্ব যুগে দুনিয়াবাসীকে মজলিশের শিষ্ঠাচার সম্পর্কিত সোনালী নীতি শিক্ষা দিতে থাকবে। এই হাদীসের আলোকে মানুষের গোপনীয়তা নিরাপদ ও সংরক্ষিত থাকতে পারে। এই হাদীসের মমার্থ হচ্ছে, কারো গোপন কথা প্রকাশ করে দেয়া সমীচীন নয়। ইসলামী দাওয়াতের শিক্ষাসমূহের মধ্যে এটা একটা মৌলিক শিক্ষার মর্যাদ রাখে। ইখওয়ানুল মুসলিমুন এই শিক্ষাকেই মানুষের মধ্যে প্রচার করে থাকে। নিজেরাও এর ওপর আমল করে থাকে এবং এর আলোকে জীবন যাপন করেন।
ভ্রান্ত অর্থনৈতিক কর্মপন্থা ও তার ফলাফল
ইসমাঈল সিদকীর মন্ত্রীত্বের আমলে মিসরে অদ্ভুত আর্থিক বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। ১৯৩১ সালে এক মণ তুলা মিসরীয় দেড় পাউন্ড বিক্রি হতে থাকে। রসূন পেয়াজের স্তুপ রাস্তা ও সড়কের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। কারণ কোন পাইকারী কিংবা খুচরা খরিদ্দার পাওয়া যাচ্ছিলো না। এতকিছু সেই সময় খাদ্য ও বস্ত্রের কোন অভাব সৃষ্টি হয়নি যেমনটি আজকের দিনে পরিদৃষ্ট হচ্ছে। একথা অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সারা দুনিয়াতেই বৃদ্ধি পেয়েছে। সাথে সাথে এ সত্য অস্বীকার করা যায় না যে, ব্যক্তির আয় দ্রব্য মূল্যের উর্ধগতির সাথে পাল্লা দিতে পারছে না। বিভিন্ন সরকার অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য স্বাভাবিক ও জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য বিশাল অংকের অর্থ ভর্তুকি হিসেবে খরচ করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও জনগণের দুঃখ দুর্দশা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রতিদিনই তারা বিভিন্ন আর্থিক দায়-দায়িত্বের নীচে পিষ্ট হয়ে চলেছে।
অর্থনীতি বিশারদ এবং লেখকগণ একাধিকবার একথা প্রকাশ করেছেন যে, দ্রব্য মূল্য হ্রাস করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রদত্ত সাহায্য উপযুক্ত ব্যক্তিদের কাছে পৌছাচ্ছে না। ধনী ও প্রাচুর্য্যর অধিকারীর তাদের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য এই সাহায্যও গ্রাস করে ফেলছে। এই ব্যবস্থা ভ্রান্ত পদ্ধতি ও ভুল মূলনীতির ওপর স্থাপন করা হয়েছে এবং পুনঃ পুনঃ অভিযোগ ও দাবী দাওয়া পেশ সত্ত্বেও পরিস্থিতি পরিবর্তনের ন্যূনতম আশাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গরীব শ্রেণীর সমস্যার সামাধান করার জন্য বাস্তবসম্মত যেসব প্রস্তাব পেশ করা হয়ে থাকে- তার প্রতি কেউ কর্ণপাত করে না। বুঝা যায় না, তারা বধির হয়ে গিয়েছে নাকি এর প্রতিকারের কোন চিন্তাই তারা করতে পারে না। অথবা কোন অদৃশ্য শক্তির ভয় তাদের সিদ্ধান্তের পথে অন্তরায় হয়ে আছে? এই ব্যাপারে আমিও কিছু প্রস্তাব পেশ করতাম। কিন্তু পরিস্থিতির দাবী অনুযায়ী আমার নীরবতা অবলম্বন করাটাই অধিকতর সমীচীন। মহীষের সম্মুখে ব্যান্ড বাজিয়ে কি লাভ? আমার পূর্বেও কিছু সংখ্যক লোক অনেক কিছু বলেছে এবং এখন নিরাশ হয়ে নীরব ভাষায় বলছেনঃ “অন্ধদের সামনে কেঁদেকেটে নিজের চোখ খোয়ানো বৃথা চেষ্টা ছাড়া লাভ কি?”
দাসদেরকে দাসত্বে সম্মত করা
১৯৫৪ সালের ২৫শে সার্চ বিপ্লবী কাউন্সিল আযাদী পন্থীদের বহাল করতঃ কয়েদীদের মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আযাদ অফিসার এবং মুহাম্মাদ নাজীবের মধ্যে আপোষ চুক্তির পর এই ফায়সালা জারি করা হয়। কিন্তু এটা প্রকৃত আযাদীর দিকে কোন পদক্ষেপ ছিল না। বরং এটা ছিল জনসাধারণের চোখে ধূলা নিক্ষেপের অপচেষ্টা মাত্র। পরবর্তীকালের ঘটন প্রবাহ প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এই পদক্ষেপ ছিল মানুষের মৌলিক অধিকার পরিপূর্ণভাবে নস্যাতের সূচনা মাত্র। সে যাই হোক এই ফায়সালার পর আমাকে সামরিক কয়েদখানা থেকে সন্ধা পাঁচ ঘটিকার সময় ছেড়ে দেয়া হয়।
১৯৫৪ সালের ১৮ই এপ্রিল তারিখে জামাল আবদুন নাসের তার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করেন। এই মন্ত্রীসভায় কার্যকালে বরং প্রকৃত প্রস্তাবে জামাল আবদুন নাসেরের গোটা শাসনকাল মিসরের ইতিহাসে জঘন্য প্রকৃতির নির্যাতন ও নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়। নাসেরের স্তবকরা যদি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের শত্রুতায় অন্ধ না হয়ে যেতো এবং ইনসাফ ও সুবিচারের সীমা পরিপূর্ণরূপে অতিক্রম না করতো তাহলে নাসেরের গুণাবলীর সাথে তার দোষ-ত্রুটিরও উল্লেখ করতো। তার “গুণাবলীর” কয়েকগুণ অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করা হতো। প্রকৃতপক্ষে তার দোষ-ত্রুটি ছিল গুণাবলী অপেক্ষা বহুগুণে বেশী। নাসেরের হাতে নিরপরাধ মানুষের যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তাকে এই তোশামোদকারীর শুধু সংস্কার বলেই দায়িত্ব শেষ করে থাকেন। এটা ইতিহাসের সাথে সরাসরি জুলুম এবং জাতির সাথে নির্মম তামাশা মাত্র।
কালের আয়নায় মিসর ও মিসরের বাইরের অবস্থা
ইন্দোচীনের যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার জন্য ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে আমেরিকার নৌবহুর দূরপ্রাচ্যে এসে পৌঁছে। সংবাদপত্রে খবর বের হয় যে, লাল চীনের সেনাবাহিনী ইন্দোচীনের যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়েছে। যার ফলে ফ্রান্স আমেরিকার নিকট সামরিক সাহায্য চেয়েছে। অনুরূপভাবে সংবাদপত্রে এ খবর প্রকাশিত হয় যে, ইরাক মধ্যপ্রাচ্যে হস্তক্ষেপের জন্য আমেরিকার কাছে আবেদন জানিয়েছে। ফ্রান্স ইন্দোচীনকে স্বাধীনতা দানে সম্মত হয়েছে এবং শীগ্রই দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। এই সময়েই ইস্রঈল সরকার তার আশেপাশের আরব রাষ্ট্রগুলোর ওপর আক্রমণ করতে শুরু করে। ঐসব আরবদের শাসকগণ তাদের চিরাচরিত অভ্যাস মোতাবেক শত্রুর বাড়াবাড়ির জবাবে কোন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের পরিবর্তে প্রতিবাদমূলক বিবৃতি ও তর্জন গর্জন করে ইস্রঈলকে ভীতি প্রদর্শনের ব্যর্থ চেষ্টা চালায়।
১৯৫৪ সালের মে মাসে উস্তাদ আহমদ আবুল ফাতাহকে দশ বছর ও উস্তাদ আহমদ হোসাইন মরহুমকে পাঁচ বছর কারাদন্ডের ফরমান শুনিয়ে উভয়ের মৃত্যুদন্ড মওকুফ কার হয়। “আল মিসরী” পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল এবং এর প্রকাশনার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এই মাসেই নিরাপত্তা পরিষদ এবং এর প্রকাশনার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এই মাসেই নিরাপত্তা পরিষদ আরবদের বিরুদ্ধে ইস্রাঈলের সাহায্য করার প্রস্তাব পাশ করে। এই প্রস্তাবে ফিলিস্তিন সমস্যাকে এড়িয়ে গিয়ে ইস্রঈলের যে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় তার প্রত্যুত্তরে আরব শাসকরা শুধু শ্লোগান ও জ্বালাময়ী বক্তৃতার সাহায্যে নিজেদের ভূমিকার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এরূপ শ্লোগান দ্বারা না কোন সমস্যার সমাধান হয়েছে আর না ভবিষ্যতে হওয়া সম্ভব। ফিলিস্তিন সমস্যার ব্যাপারে এই লোকগুলো কখনো কোন সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেনি। তা না হলে এই অঞ্চলের জনগণ অধিকৃত ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য লক্ষ লক্ষ গর্দানের নজরানা পেশ করতে সদা প্রস্তুত।
মুর্শিদে আ’মের সিরিয়া ও লেবানন সফর
১৯৫৪ সালেই মুহতারাম মুর্শিদে আ’ম জনাব হাসান আল হুদাইবি লেবানন ও সিরিয়া সফর করেন। এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল সেখানে ইখওয়ানদের অবস্থান ও সার্বিক অবস্থা জেনে নেয়া। তৎকালে আবদুন নাসেরের সরকার ও ইংরেজদের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল। মুর্শিদে আ’ম উক্ত চুক্তির ব্যাপারে কতিপয় প্রশ্নের জবাবে সুস্পষ্টভাবে তাঁর মতামত ও দৃষ্টিভংগী প্রকাশ করেন। তাঁর এই মত জামাল আবদুন নাসেরের নিকট অত্যন্ত অপছন্দনীয় হয়। পরবর্তী কালে সংঘটিত ঘটনাবলীতে নাসেরের সেই অসন্তোষের বিশেষ প্রভাব ছিল।
এসব কিছুই পূর্ব পরিকল্পিত
যদি আমার স্মৃতি আমাকে প্রতারিত না করে থাকে- তাহলে আমার মনে হয় যে, ১৯৩১ সালের জানুয়ারী মাসে তৎকালীন উজীরে আওকাফ হিলমী ঈসা পাশা নাহাস পাশাকে একটি পত্র লিখেন। ঐ পত্রে হিলমী ঈসা পাশার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় যে, তিনি যে মসজিদে জুমার নামায পড়তে যান সেখানে রাজনৈতিক শ্লোগান দেয়া হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে তখন নাহাস পাশাকে সরকার থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে আমি মনে মনে চিন্তা করলাম যে, এসব লোক মূলত একই মতের লোক। নাহাস পাশা তার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা কালে অন্যদের বিরুদ্ধে যেসব প্রতিহিংসামূলক নির্দেশ জারী করেছিলেন সেসব ফরমানই এখন তার বিরুদ্ধে কার্যকরী হচ্ছিলো। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধিনস্ত মসজিদসমূহের খতিবদের উদ্দেশ্যে প্রায়ই নির্দেশ জারী করা হতো যেন তারা রাজনৈতিক সমস্যাবলী নিয়ে কোন আলোচনা না করেন। আমি মনে করি, খতিবগণ যদি রাজনৈতিক সমস্যাবলী বিশ্লেষণ করে জনসাধারণের কর্তব্য সম্পর্কে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন তাহলে তাতে কি ক্ষতি হবে? মসজিদ কি এমন স্থান নয় যেখানে মুসলমানদেরকে তাদের জীবন সমস্যার সাথে পরিচিত করে তার সমাধান অবহিত করে দেয়া যেতে পারে? রাজনৈতিক কার্যকলাপ কি মানুষের জীবনের অংশ নয়? এমন খতিবদের সম্পর্কে জনসাধারণের অন্তরে কতটুকু সম্মন বোধ থাকবে যাদের ব্যাপারে তাদের মনে এরূপ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যাবে যে, তারা তাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিষয়ে মুখ খুলতে পারে না। নৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনীতি এবং সমাজবিজ্ঞান এমন সব বিভাগ যে সম্পর্কে খতিবগণকে জনসাধারণের সম্মুখে ইসলামী দৃষ্টিভংগী বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা উচিত। কিন্তু আমাদের কর্তৃপক্ষ নিজেদের স্কন্ধের ওপর এমন সব দুর্বহ বোঝা তুলে নিচ্ছেন যার পরিণতি কালই তাদের নিয়ে ডুববে। তাদের এই বাড়াবাড়ির কারণে একদিন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। জিজ্ঞেস করা হবে, তোমরা এরূপ আচরণ করেছিলে কেন? অপরাধী ব্যক্তি তার ডানে-বামে তাকিয়ে দেখবে কিন্তু তার কোন সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক সে খুঁজে পাবে না। বাকশক্তি রুদ্ধ হয়ে যাবে এবং মস্তক অবনত হয়ে পড়বে। আমি আল্লাহ তায়ালাকে সাক্ষী রেখে বলছি, যদি আমাদের প্রত্যেকে মানুষের পরিবর্তে সকল ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহকে ভয় করে চলে তাহলে যাবতীয় অন্যায় আপনা থেকেই নির্মুল হয়ে যাবে এবং আমরা বিশ্বভ্রাতৃত্বের দৃষ্টিতে অত্যন্ত সম্মানজনক আসনের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবো। আমাদের বিপদ হচ্ছে এই যে, আমরা এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার তালাশে একেবারে অন্ধ হয়ে পড়েছি অথচ চিরস্থায়ী জীবনের জন্য আমরা কোন প্রস্তুতি গ্রহণ করছি না। জবাবদিহি করার দিন নিশ্চিত আসবে সেদিন কোন বিষয়েই আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত আর কারো কোন কর্তৃত্ব চলবে না।
আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তোমরা শুধু তাই লাভ করতে পারো
১৯৫৪ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে আবদুন নাসের ও ইংরেজদের মধ্যে চলে যাওয়ার প্রাথমিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তির ব্যাপারে ইখওয়ান তাদের লিখিত অভিমত প্রধান মন্ত্রীর সমীপে পেশ করেছিলো। ঐ বছরই আগষ্ট মাসে উস্তাদ আল হুদাইবির বাড়ীর নিকটবর্তী মসজিদুর রওদায় ইখওয়ানের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এই সংঘাত ভবিষ্যত ঘটনাবলীর সূচনা এবং ইখওয়ানকে ভীত সন্ত্রস্ত করার সর্তক সংকেতের নামান্তর। এই সময় কেন্দ্রীয় অফিসে ইখওয়ানদের খুব কমই দেখা যেতো। তথাপি ডাক্তার খামীস মরহুম নিয়মিত কেন্দ্রীয় অফিসে উপস্থিত থাকতেন। আর আমি অধিকাংশ সময় তাঁর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য সেখানে গিয়ে হাজির হতাম। অনুরূপ আমি আলহাজ্জ মাহাম্মাদ জাওদা রাইস মার্চেন্টের দোকনে খানুল খালিলীতেও বেশীর ভাগ সময়ে চলে যেতাম। যেখানে আযাদ অফিসার এর লোকদের সাথে আমার দেখা সাক্ষাত হতো। এসব দেখা সাক্ষাতের উদ্দেশ্য ছিল ইখওয়ান ও আযাদ অফিসার-এর মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে যাচ্ছিলো তার প্রতিকার হতে পারে। সেই দিনগুলো ছিলো বড় বিপজ্জনক এবং মওসুমের দিক থেকেও ছিল ভীষণ গরম। আমি তখনই অনুমান করেছিলাম যে, জামাল আবদুন নাসেরের পক্ষ থেকে ইখওয়ানের ওপর মুসিবত অত্যাসন্ন। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে যা নির্ধারিত হয়ে গেছে তা থেকে পালিয়ে বাঁচার কো উপায় নেই। ইখওয়ানের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মী পর্যন্ত কিছু কিছু লোকের জন্য শাহাদাত প্রতিক্ষার প্রহর গুণছিল। একথা বলার সুযোগ নেই যে, ইখওয়ান নেতৃত্ব তাদের স্বাভাবসূলভ সরলতার কারণে প্রতারিত হয়েছিল। সত্য কথা হলো, আল্লাহর ফায়সালা ও নিয়তির সম্মুখে কোন বুদ্ধিমাত্তা কাজে আসে না।
ইখওয়ানের নেতারা তো সাধারণ মানুষ। তাকদীরের সামনে নবী রাসূলগণও অসহায় হয়ে পড়েন। একবার মদীনা মনোয়ারাতে কতিপয় বদ্দু (গ্রামীণ অশিক্ষিত আরব) নবী (সা)- এর খেদমতে এসে হাজির হয়। তারা ছির পীড়িত। কিছুদিন অবস্থানের পর সুস্থ হয়ে ওঠে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট বিদায়ের অনুমতি প্রার্থনা করে। সাথে সাথে আরো আবেদন জানায় যে, তাদের সাথে কিছু সংখ্যক ক্বারী ও হাফেজে কুরআনও প্রেরণ করা হোক। যারা তাদের গোত্রের লোকজনকে কুরআন ও ইসলাম শিক্ষা দিবে। নবী (সা) কয়েকজন সাহাবীকে তাদের সংগে পাঠিয়ে দিলেন। মদীনা থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর বদ্দুরা বিশ্বাসঘাতকতা করে। ক্বারীগণকে শহীদ করে ফেলে এবং বকরীর রাখালদেরকে মেরে বকরীর পালগুলোকে হাঁকিয়ে নিয়ে চলে যায়। রাসূলূল্লাহ (সা) এই ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরে খুবই মর্মাহত হন। রাসূলুল্লাহ (সা)- এর ওপর তো ওহী অবতীর্ণ হতো এবং আল্লাহ যখনই চাইতেন বিভিন্ন ব্যাপারে তাঁর নবী (সা)-কে দিকটির্দেশনা দিতেন। এখন এ ব্যাপারে কোন মুসলিম একথা বলতে পারে না যে, রাসূলুল্লাহ (সা) প্রতারিত হয়ে ছিলেন। এটা ছিল আল্লাহ তায়ালার ফায়সালা। যা্ পূর্বেই নির্ধারিত হয়েছিল্। যদি ১৯৫৪ সালের দিনগুলো আবার ফিরে আসে তাহলে যেসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছে পুনরায় আবার তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। কেননা তাকদীরকে বদলানো যায় না এবং আল্লাহর ফায়সালা থেকে পালিয়ে বাঁচাও সম্ভব না। এজন্য যে-ই এই বিতর্কে লিপ্ত হয়ে বলে যে, যদি বিচক্ষণতার সাথে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতো তাহলে এমনটি ঘটতো না। আর যদি সর্তকতা অবলম্বন করা হতো তাহলে ধোঁকার ফাঁদে পড়তে হতো না। সে মূলত আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর ও ফায়সালা সম্পর্কেই অনবহিত। আল্লাহ তায়ালার প্রতিটা কাজেই হিকমত লুকায়িত থাকে। যা কেবল সেই হাকীম এবং খাবীরই পরিজ্ঞাত। তিনি ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে তা জানা কিছুতেই সম্ভব নয়। মানুষকে তার সকল চেষ্টা-তদবীর এবং চিন্তা-ভাবনা পুরোপুরিভাবে প্রয়োগ করা উচিত। সাথে সাথে তার জেনে রাখা উচিত যে, ফলাফল সর্বাবস্থায়ই আল্লাহ তায়ালার ইখতিয়ারাধীন। কোন মানুষ জানে না যে, আগামীকাল তার সাথে কি আচরণ করা হবে।
সর্বাবস্থায় অস্থিরতা জাঁহাপনা!
আমি স্মৃতির প্রদীপ জ্বালিয়ে তার আলোতে অসংখ্য যুবক ছেলেমেয়েকে দেখতে পাই। তারা ইখওয়ানুল মুসলিমুনে শামিল হয়েছেল কিন্তু পরক্ষণে এর কোন দুর্বলতার কারণে নয় বরং নিজেদেরই অপারগতার কারণে সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এরপরও তাদের অন্তরের অন্তস্থলে এবং অনুভূতির পরতে পরতে সর্বদা কল্যাণ ও মংগলের অনুভূতি কার্যকর রয়েছে। একবার যদি কেউ সংগঠনের রংয়ে নিজেকে রাঙিয়ে নেয় তাহলে তা একবারে মুছে ফেলা খুবই কষ্টসাধ্য। এসব যুবক যুবতীরা সংগঠন থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও হৃদয় মনে সংগঠনের প্রতি গভীর ভালবাসা পোষণ করে এবং যে সংগঠনের স্নেহ ছায়ায় এক সময় তারা প্রশিক্ষণাধীন ছিল তার দিকে পুনঃপ্রত্যাবর্তনের জন্য তাদের চিত্ত অস্থির থাকে। কালের আবর্তন এবং ঘটনা প্রবাহ এই সুন্দর স্মৃতিগুলোকে নিষ্প্রভ করে ফেলতে পারে না। যে ব্যক্তিই কোন সময় ইখওয়ানের অন্তর্ভক্ত হয়েছে অনন্তর বিপদ মুসিবত সহ্য করতে না পারার কারণে ইখওয়ানের থেকে বেরিয়ে গিয়েছে তারপরও তার আচার আচরণ এবং জীবনের দিবা-রাত্রিগুলোর ওপর দাওয়াতের গভীর ছাপ সব সময়ই বিদ্যমান রয়েছে।
নিজের অক্ষমতার কারণে ইখওয়ানকে ছেড়ে যাওয়া সাথীরা অন্যদের দৃষ্টিতে সর্বদাই ইখওয়ানী বলেই পরিগণিত হতে থাকে। তাদের কেউ যদি শপথ করেও বিশ্বাস করাতে চায় যে, ইখওয়ানের সাথে তার সম্পর্কের লেশমাত্রও নেই তবুও মানুষ তা বিশ্বাস করে না। জামাল আবদুন নাসেরের আমলে বহুবার এমন হয়েছে যে, ইখওয়ানের প্রাক্তন সাথীদেরকেও গ্রোফতার করা হয়েছে। এমনকি যেসব লোক তার পক্ষে শ্লোগান দিয়ে থাকে এবং তারই প্রশংসায় গীতি ও কীর্তিগাঁথা শত মুখে গেয়ে বেড়ায় তাদের ব্যাপারেও কোন পার্থক্য করা হয় না।
মিষ্টার গান্ধীর উদ্ধৃতি ও উদাহরণ
১৯৩১ সালের জানুয়ারী মাসে হিন্দু নেতা মিষ্টার গান্ধীকে ইংরেজরা মুক্তি দেয়। গান্ধীর মুক্তি পাওয়ার ফলে স্বাধীনতাকামীদের উৎসাহ উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়। উত্তম দৃষ্টান্ত যার পক্ষ থেকেই পেশ করা হোক কিংবা কোন দ্বীন অথবা মিল্লাতের বিশেষজ্ঞ প্রশংসনীয় কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক তাহলে তার প্রশংসা বর্ণনা করতে কার্পণ্য প্রদর্শন করা অনুচিত। আমি গান্ধীর দৃষ্টান্ত পেশ করছি। এর লক্ষ্য এই বিষয়ের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যে, নিজেদের অধিকার আদায়ের পথে দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মুসিবত দেখে ঘাবড়ে যাওয়ার ও মুষড়ে পড়া আদৌ উচিত নয়। আত্মসম্মান নিয়ে যে ব্যক্তি প্রাণপণ সংগ্রাম করে যেতে থাকবে সে অবশ্য তার অভিষ্ট লক্ষ অর্জনে সক্ষম হবে। এই দুর্বল, ক্ষীণকায় ও অর্ধউলংগ গান্ধী তার লক্ষ্য অর্জনে অধ্যবসায় ছিল আপোষহীন। সে তার আমলের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী জাতি ইংরেজকে বলে দিয়েছিল যে, আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যাও। উপনিবেশবাদী ইংরেজকে সরকার তাকে কারাবন্দী করে এবং কষ্ট দিতে থাকে। সে ছিল দুর্বল এবং বৃদ্ধ। তা সত্ত্বেও সে শক্তিধর উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করে এবং তার উদ্দেশ্য হাসিল করে নেয়। উত্তম শিক্ষা যেখান থেকেই পাওয়া যাক না কেন তা গ্রহণ করা উচিত। গান্ধী অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও যদি তার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এমন পাগল পারা হতে পারে তাহলে ইসলামের অনুসারীদের তাদের মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আরো অধিকতর উত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করা আবশ্যক।
মূর্তির প্রেম থেকে হাত গুটিয়ে নাও এবং আপন খুদীতে নিমগ্ন হয়ে যাও
আমার মনে পড়ে একদিন আমার বড় ভাই আসিউতের কারাগারে আমার সাথে দেখা করতে আসেন। কথাবার্তার মাঝে তিনি আমার মুক্তির ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেন এবং উপদেশের ভংগীতে বলেন আমি যেন সরকারের সহযোগিতা করি যাতে জেলখানার মুসিবত থেকে নাজাত মিলে যায়। আমি তাঁর এই অনুভূতির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি এবং তার নিকট আবেদন জানাই যেন এ বিষয়ে কোন কথাই তিনি আলোচনায় টেনে না আনেন। অন্যথায় আমি আগামীতে আর কখনো তার সাথে সাক্ষাতই করবো না। ভাইসাহের আমার কথা হৃদয়গম করতে সক্ষম হন এবং এই প্রসংগে আর কোন কথাই বলেননি।
কারো এরূপ মনোভাব পোষণ করা উচিত নয় যে, জেলখানা একটা আরামদায়ক জায়গা কিংবা নিজ বাসস্থানের তুলনায় অগ্রাধিকার যোগ্য। কিন্তু আমার আকীদা-বিশ্বাস হচ্ছে এই যে, অপমান ও লাঞ্ছনার সাথে বাড়ীতে অবস্থান করা এবং অপমানিত ও লাঞ্ছনাকারী শক্তির সম্মুখে মাথানত করা কারাগারের কঠোরতার তুলনায় সহস্রগুণে বেশী কষ্টদায়ক। জেলখানার শত কষ্ট সহ্য করতে গিয়ে মানুষের মন একথার ওপর অবশ্যই সান্ত্বনা লাভ করে যে, সে অন্তত শত্রুর সম্মুখে মাথানত করেনি। সে তাকে ভয় করেনি বা তার সামনে সন্ত্রস্তুও হয়ে পড়েনি। স্বীয় অক্ষমতা এবং জালিমের শক্তি ও দাপট সত্ত্বেও সে জালিমের ওপর তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে দিয়েছে। আমি অবশ্য প্রখ্যাত আরবী কবি আনতারার কথার প্রতিধ্বনী করছি না যেখানে এই স্বনামধন্য ও জগৎ বরেণ্য কবি এই উক্তি করেছিলেন যে, ইজ্জত ও সম্মানের সাথে জাহান্নাম চলে যাওয়াও উত্তম বৈকি! কেননা আমরা সকলেই জাহান্নামকে ভয় করে থাকি এবং তা থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকি। যা হোক আমি আনতারার মনোভাবের এই দিকটি সমর্থন করছি যে, মানুষ তার আত্মমর্যদা ও আত্মসম্মান রক্ষা করার জন্য যে পরীক্ষা নিরীক্ষার মুখোমুখি হয়ে থাকে-তা তার জন্য কঠিন এবং কঠোর হওয়া সত্ত্বেও সহজ ও সুগম হয়ে যায়।
সরকারের অন্ধ আনুগত্য ও গোলামীর এই পংকিল পরিবেশে আল্লাহ তাঁর পুত-পবিত্র বান্দাদের কাউকেও যদি হেফাজত করেন তাহলে সেটাই চরম সৌভাগ্য।
দুনিয়ার এই ধন-সম্পদ এই আত্মীয় পরিজনের সম্পর্ক
ইখওয়ানুল মুসলিমুনে শামিল হওয়ার প্রারম্ভিক পর্যায়ে যখন আমি সংগঠনের কাজকর্মে কার্যত অংশগ্রহণ করতে শুরু করি তখন আমাকে সংগঠনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে মাঝে মধ্যে পাঠানো হতো। একবার মানুফিয়া জিলার ছোট্র শহর দামাহওয়াজে দু’টি পরিবারের মধ্যে কোন বিষয়ে ঝগড়া হয়েছিলো। তাদের একটি পরিবারের সম্পর্ক ছিল ইখওয়ানের সাথে। আমি অপর এক ভাই ইজ্জত আবুল মুয়াতির সংগে উক্ত পরিবারের মাঝে আপোষ মীমাংসা করিয়ে দিতে যাই। দু’পক্ষই ঝগড়ার বিশদ বিবরণ এবং তাতে নিজ নিজ ভূমিকার কথা বর্ণনা করলো। যা শুনে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে, ইখওয়ানী পরিবারটি ছিল সম্পূর্ণ হকের ওপর, আমি গ্রামবাসীদের সামনে একটা উত্তম দৃষ্টান্ত পেশ করতে চাইলাম। মুর্শিদে আ’ম হাসানুল বান্না শহীদের পক্ষ থেকে ইখওয়ানীদের প্রতি এরূপ নির্দেশনাই ছিল। অতএব সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও আমি ইখওয়ানী পরিবারের কাছে আবেদন জানাই যেন তারা তাদের অধিকার ছেড়ে চলে আসে এবং তাদের বড়রা অন্য পরিবারের কাছে তাদের বাড়ীতে চলে যায়। আর এভবে মানুষের সামনে কুরআন মজীদের আয়াত অনুযায়ী যেন দৃঢ় সংকল্পের নমূনা পেশ করা যায়।
“আর অবশ্য যারা ধৈর্যধারণের নীতি অবলম্বর করলো এবং ক্ষমার আদর্শ স্থাপনের জন্য এগিয়ে এলো নিসন্দেহে তা খুব কঠিন কাজের অন্তর্গত।
এই ঘটনা লক্ষ্য করে গ্রামবাসীগণ অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং তারা জানতে পারে যে, ইসলাম সমস্যার সমাধান কিভাবে করে। এবং ইখওয়ানরা কিরূপ এই মূলনীতির ওপর তৎপর রয়েছে।
ঐ মাসেই আমি কালিয়ুবিয়া নামক শহরে যাই। সেখনে ওয়াফদ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক আলে আলম পাশার বাড়ীতে অনুষ্ঠিত হয়। আমিও ঐ বৈঠকে অংশগ্রহণ করি। একই মাসে মুকাররম আবীদ বার এসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই আমলে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কোন রুকনের জন্য কোন রাজনৈতিক দলের মেম্বার হওয়া নিষিদ্ধ ছিল।
হাসানের উৎসাহ এবং সৌন্দর্য থেকে বঞ্চনা
তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের ক্ষমতাশীল দলগুলো শতকার নিরানব্বই ভাগ কিংবা তার চেয়েও বেশী ভোট লাভ করে। এই দৃশ্য দেখে আমার কতগুলো ঐতিহাসিক ঘটনা মনে পড়ে। ১৯৩৬ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হিটলার শতকরা নিরানব্বই ভাগ ভোট লাভ করেছিলো। কিছু লোক মিসরীয়দের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করে থকে যে, তারা ক্ষমতসীনদের ধৃষ্ঠতামূলক আচরণ ও অপতৎপরতার মোকাবিলায় তৎপর হয় না কেন? মিসরীয়দের অপমান ও লাঞ্ছনায় সন্তুষ্ট থাকা জাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এসব লোক জার্মান, ইতা-লিয়ান, স্পেনিশ এবং পর্তুগীজদেরও ভুলে যায় যারা বর্তমানে ইউরোপের জবিন্ত জাতি হিসেবে পরিগণিত কিন্তু নিকট অতীতে তারাও এরূপ অপমান ও লাঞ্ছনার জীবনই অতিবাহিত করেছে। জার্মানীতে হিটলার নিকৃষ্টতম একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিল। ইটালী, স্পেন ও পর্তুগালে যথাক্রমে মুসোলিনী, ফ্রা্ম্ক ও সালাজার প্রমুখ আজীবন স্বৈরতান্ত্রিক থাবা বসিয়ে রাখে। এই পুরো সময়ে এই জাতিগুলোর মধ্যে থেকে কোন একটি জাতিও আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। কেননা অত্যাচার নির্যাতন, গুলি, লাঠি, জেল ও জুলুম ইত্যাদি নিপীড়নমুলক ব্যবস্থা তাদেরকে অসহায় করে রেখেছিল। মিসরীয় জাতি অপমান ও লাঞ্ছনার ওপর কখনো সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। এই জাতি আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন এবং স্বাধীনতা প্রিয় জাতি। কিন্তু ক্ষমতাসীন শাসকচক্র কখনো এই জাতিকে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করার সুযোগ দেয়নি। যদি শুধু পাঁচ বছর কালই জাতিকে প্রকৃত আযাদী প্রদান করা হয়। এবং জনসাধারণ মানবীয় সম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে অবগত হতে পারে তাহলে আর করো কোন মায়ের দেশ মাতৃকার ভাগ্য বিড়ম্বিত অধিবাসীরা যেন প্রকৃত আযাদী লাভ করে। প্রতৃক স্বাধীনতা লাভের একটাই মাত্র উপায় রয়েছে। আর তা হচ্ছে ইসলামী শরীয়াতের পূর্ণঙ্গ বাস্তবায়ন।
চব্বিশতম অধ্যায়
ইখওয়ানের সামরিক সংগঠন
ইখওয়ানের সামরিক সংগঠনের সাথে আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনো সম্পর্কিত ছিলাম না। এই সংগঠন সম্পর্কে খুব বেশী অপপ্রচার চালানো হয়েছে। আমি এই সংগঠনের ব্যাপারেও এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চাই। আমার এই নিবেদন হবে সম্পর্ণ বাস্তবসম্মত এবং সত্য নির্ভর যাতে কোন প্রকার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ কিংবা এই সংস্থার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোন প্রভাব নেই।
এ বিষয়ে আমি অনুতপ্ত যে, আমি এ সংগঠনের নিয়মিত রুকন কখনো ছিলাম না। অথচ এই ব্যবস্থা স্বীয় উদ্দেশ্যপূর্ণ, বিশ্বস্ততা, সমস্যার মোকাবিলায় বীরত্ব, নিজের সকল মুল্যবান বস্তু আল্লাহর পথে কুরবা্ন করে দেয়া এবং সর্বব্যপী ও পূর্ণঙ্গ দ্বীনি অনুভূতির সমর্থক। যদি শহীদ ইমাম এই সংগঠন কায়েম করার প্রতি দৃষ্টি না দিতেন তাহলে দাওয়াতের হক আদায় করার ক্ষেত্র অপারগ থেকে যেতেন। ইখওয়ানের জন্য এই ব্যবস্থা খুবই জরুরী এবং মৌলিক গুরুত্বের দাবীদার। কেননাঃ
১- প্রিয় দেশ মিসরের ওপর ইংরেজরা্ আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল এবং তার সমস্ত কাজ কারবার জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বৃটিশ রাজ নিযু্ক্ত ভাইসরয়ের মর্জি মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছিলো।
২- ফিলিস্তিন ভূখন্ডের ওপর ইহুদীদের দখলদারী কায়েম হয়ে গিয়েছিল। ইহুদীরা দেশের সন্তানদেকে হত্যা করে এবং পবিত্র স্থানসমূহের অসম্মান করে। তা সত্ত্বেও বিশ্বশক্তিসমূহ আরবদের বিরুদ্ধে ইহুদীদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করতে থাকে।
৩- বিদেশী ব্যাংকগুলো আমাদের রক্ত শোষণ করছিলো এবং আমরা যেন তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছিলাম।
৪- সকল প্রকার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিলো। চিন্তা-ভাবনা, সাহিত্য-সাংবাদিকতা এবং সাহিত্য সংকলন ও রচনার কোন স্বধীনতাই ছিল না।
ইসলামে দেশপ্রেম, আত্মমর্যদা ও শৌর্য-বীর্য সবকিছুরই দাবী ছিল এই যে, এই ধ্বংসাত্মক ব্যধি থেকে মুক্তিলাভ করে নিজেদের আযাদী বহাল করতে হবে। যে ব্যক্তি এই পরিস্থিতিতেও স্বাধীনতার চিন্তা করে না এবং তা লাভ করার জন্য সক্রিয়ভাবে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে না সে তার আকীদা-বিশ্বাস, আত্মসম্মাম, দেশ ও পৌরুষ থেকেও বঞ্চিত হয়ে যায় এবং পাপী ও অপরাধী বলে পরিগণিত হয়ে থাকে। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের জন্য এমন অপমান ও অসম্মানজনক অবস্থার ওপর সন্তুষ্ট থাকা সম্ভব ছিল না। দ্বীন, মাতৃভূমি এবং ইজ্জত আবরুর হিফাজতের জন্য এ ছিল অতীব জরুরী যে দেশ মাতৃকার সন্তানগণ সামরিকভাবে নিজেদেরকে তৈরী করতে ব্রতী হবে। এটাই ছিল সর্বপথম ও সর্বশেষ কারণ যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম মুর্শিদে আ’ম এই ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেন। আমার দুর্ভাগ্য যে, এই সংগঠনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করার সম্মান আমি লাভ করতে পারিনি।
দেশ ও জাতির হিফাজতে সেনাবহিনীর সাথে সহযোগিতা
বলা হয়ে থাকে যে, উপরোল্লিখিত কর্তব্য সম্পাদন করার দায়িত্ব দেশের সেনাবাহিনীর এটা ঠিক। এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগি নেই। তথাপি যে সংস্থার উল্লেখ ওপরে করা হয়েছে তার উদ্দেশ্যও নিজ দেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা নয় বরং প্রয়োজনের সময় তাদের হাতকে শক্ত করা এবং তাদেরকে সহযোগিতা প্রদানের জন্য এগিয়ে যাওয়া। এই সংগঠনে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যুবকগণ দেশ মাতৃকার সুসন্তান এবং দেশ প্রেমিক নাগরিক তাদের সম্পর্কে সন্দেহ-সংশয় এবং অকারণে স্পর্শকাতরতা প্রকাশ করা দুর্বোধ্য। কয়েকটা ইউনিটের সমন্বয়ে গঠিত আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর একটা বিশেষ অংশ সা’ইকা নামে পরিচিত। তার দায়িত্ব সন্বন্ধেও শুনে রাখুন এটি নাগরিকদেরকে ভীতি প্রদর্শন, হুমকি দেয়া, সর্তক এবং শাস্তি দেয়ার জন্য গঠন করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যোগ্যতর ছাত্রদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে রেখেছে। অতএব বিভিন্ন সংগঠনকে আকীদা-বিশ্বাস এবং দেশ ও জাতির হিফাজতের জন্য ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত যুবকদের সংগঠিত করার অনুমতি দিতে বাধা কোথায়? দলীয় রাজনীতি ও কোন্দল নয় বরং শুধু দেশ ও আকীদা-বিশ্বাসের হিফাজতই এসব সংগঠনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। সা’ইকার ন্যায় সেনা ইউনিট বৈধ এবং তাদেরকে দেশ ও জাতির সেবক মনে করা হয় কিন্তু ইখওয়ানের জন্য যুবকদের প্রশিক্ষণদানের অনুমতি নেই।
আমি জানি আমার একথায় অনেক লোকই খুশী হবে না বরং ক্রোধ ও ক্ষোভ প্রকাশ করবে। ইসলামী সংগঠনসমূহের সমালোচনাকারী কোন ব্যক্তিবিশেষ বা কতিপয় ব্যক্তির ভ্রান্ত তৎপরতাকে ভিত্তি করে এই ধারণাকেই ধ্বংসাত্মক মনে করা হয়। আমি না সেসব লোককে সমর্থন করি যারা এই সংগঠনের অপব্যবহার করে। আর না তাদের সমালোচনা ও বিরোধিতার কোন গুরুত্ব দিয়ে থাকি যারা খোঁড়া অজুহাতে একটা গঠনমূলক কর্মসূচীর ওপর কুঠারাঘাত করে। আমি অবশ্য আমার এই মনোভাব দ্বারা কাউকে উত্তেজিত করতে চেষ্টা করছি না। আমার উদ্দেশ্য স্বীয় দ্বীন ও দেশের কল্যাণ সাধন করা। যদি আমার মতামত সঠিক হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত তাওফিকের বদৌলতেই সম্ভব হয়েছে। আর যদি সঠিক না হয়ে থাকে তবে তাকে আমার ব্যক্তিগত দুর্বলতা মনে করতে হবে। মানবীয় জ্ঞান বুদ্ধি সীমাবদ্ধ ও অপূর্ণাঙ্গ। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার প্রতিটি কথা যথার্থ সত্য এবং তিনিই সঠিক পথের দিকে মানুষকে পরিচালনা করতে পারেন।
হাসান আল হুদাইবির বির্দেশনা বনাম সামরিক সংগঠন
দ্বিতীয় মুর্শিদ আ’ম জনাব হাসান আল হুদাইবি (র) ইউসুফ তালাত শহীদকে যখন বিশেষ সংস্থার প্রধান নিযুক্ত করেন তখন সুস্পষ্টভাব ইরশাদ করেছিলেন যে, এটা কোন গোপন সংগঠন নয়। কিংবা এর তৎপরতাও পোগন নয়। এর উদ্দেশ্য সরকারের ক্ষমতার মসনদ উল্টে দেয় নয়। বরং এর সাহায্যে যুবকদেরকে উন্নত চারিত্রিক গুণ সম্পন্ন করে গড়ে তোলা এবং কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকারে অভ্যস্ত করে দেয়া। যারা মনে করে যে, দুই এক হাজার যুবকের সাহায্যে লক্ষ লক্ষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য পৃলিশ গার্ড ও সিকিউরিটি বিভাগের কর্মচারীদের পরাজিত করা যেতে পারে তারা পাগলের স্বর্গে বাস করে। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট, যার গুরুত্ব ও উপকারিতা বলার অগেক্ষা রাখে না। কিন্তু আমাদের কাছে এমন লোকদের চিকিৎসার কি ব্যবস্থা থাকতে পারে যারা উজ্জ্বল দিবালোককে অস্বীকার করতে কোন প্রকার ইতস্তত বোধ করে না।
বিষনাশক বিষে রূপান্তরিত হলো
১৯৫২ সালে জুলাই মাসের পট পরিবর্তনের উদ্দেশ্য ছিল-প্রিয় দেশ থেকে অন্যায়ের কুৎসিত কলম্ক দূর করা এবং কল্যাণ ও মংগলের বিস্তৃতি ঘটানো। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত এই উদ্দেশ্য পূরো হতে পারেনি। বরং উল্টো ভাল এবং মন্দের মানদন্ডই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বিপ্লবী কাউন্সিল ও তার মন্ত্রীর তাদের নিজেদের মনমত সমস্ত কাজকর্ম করে যেতে লাগলো। প্রতিদিন এ মর্মে লজ্জাজনক খবরাদি প্রকাশ হতে লাগলো যে, অমুক চিত্রাভিনেত্রী অমুক মন্ত্রীর প্রেমিকা। এ ধরনের একটি ঘটনা এতটা ছড়িয়ে পড়ে যে, তার দুর্গন্ধ গোটা পরিবেশকেই কলুষিত করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত ঘটনার সাথে জড়িত বিদেশী প্রেমিকাকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। আবদুন মাসেরের মৃত্যুর পর সেই কুখ্যাত চরিত্রহীনা নারী মিসরে ফিরে আসে। এয়ারপোর্টে তাকে যে উষ্ণ সম্মানজনক অভ্যর্থনা জানানো হয় তা সর্বস্তরের মানুষের জন্য ছিল বিস্ময়কর। উক্ত নারী সম্পর্কে জানা যায় যে, তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। তাই সে তার মেজবান দেশে নিজের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের ইচ্ছায় অবস্থান করতে থাকেন। উল্লেখিত মহিলা সম্পর্কে শুনা যায় যে, তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। তাই হৃত সাস্থ্য পূনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে মনস্থ করেছেন। না আছে করো লাজ লজ্জার বালাই আর না তার অনুভূতি। চিত্র তারকা যার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, তিনি আমারেদকে দেশ প্রেম, প্রতিশ্রুতি পালন এবং উন্নত ও মহৎ চরিত্রের বাস্তব প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, অথচ বাস্তবে তিনি নিজেই এসব উন্নত নৈতিক গুণাবলী শিষ্টাচার ও শালীনতাবোধ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত এবং পুণ্যশীলতা, পবিত্রতা ও লজ্জার লেশমাত্র তার মধ্যে নেই।
যেসব আকাশ কুসুম কল্পনা ও রংগীন স্বপ্নের দাবীতে বিপ্লব সংঘটিত হয় তার নাকের ডগায় তিনি সকল অন্যায় অশ্লীলতার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ওপরে বর্ণিত নর্লজ্জতা থেকেও অগ্রসর হয়ে এই অপরাধ ব্যাপকভবে ছড়িয়ে পড়ে যে, শক্তিধর ও ক্ষমতাশালী লোকেরা কোন নারীকে দেখেও তার রূপ সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে বেচারা স্বমীকে শক্তির বলে বাধ্য করতো তার স্ত্রীকে তালাক দিতো, যাতে সে তাকে তার শয্যা সংগিনী রূপে রবল করতে পারে। বেচারী তালাক প্রাপ্ত ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে নিয়ে বিবাহের অভিনয় করা হয়। এর চেয়েও অধিক নিষ্ঠুরতা প্রদার্শন করা হতো রূপালী পর্দার সুন্দরীদেরকে সরকারী তত্ববধানে প্রশ্রয় দিয়ে। ক্ষমতাসীনরা তাদের নিয়ে মহাশূন্যে উড়ে বেড়াতে থাকে এবং উদ্দেশ্য হাসিলের পর তাদেরকে এসব উচ্চস্থান থেকে এমনভাবে নীচে ছুঁড়ে মারে যে, তাদের ঘাড় ভেংগে চুরমার হয়ে যায় এবং শরীরের সবগুলো সুন্দর অংগ- প্রত্যাংগ যার সাহায্যে হাজার হাজার মানুষকে বিপথগামী করা হয়েছে মাটিতে এমন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে যে, তা শিক্ষণীয় নিদর্শনে পরিণত হয়ে যায়। আলেকজান্ডার ও চেঙ্গিজের হাতে পৃথিবীতে শত শতবার সম্মানিত মানুষের ইজ্জত- আবরু ভুলুন্ঠিত হয়েছে।
তোমাদের কিন্তু লজ্জা নেই
সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় এসব সুন্দরী শিল্পি দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায় এবং সর্বত্র্ তাদের উষ্ণ সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়ে থাকে। বিয়ে ছাড়াই যা হয়ে থাকে সেটা আল্লাহই ভাল জানেন কিন্তু প্রতি কয়েক মাস পর পর প্রত্যেক মক্ষীরাণী কোন নতুন স্বামীর সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করে আমার বোধগম্য নয়। কোন পুরুষের মধ্যে যদিও বিন্দুমাত্র মর্যাদাবোধ এবং পৌরুষ থেকে থাকে, সে কি করে এমন রমণীকে বিয়ে করতে প্রস্তুত হতে পারে যে প্রতিটি আসরের প্রদীপ এবং প্রত্যেকের শয্যা সংগিনী হওয়ার জন্য থাকে সদা প্রস্তুত। হে আল্লাহ আমাকে সকল প্রকার অন্যায় অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করো এবং ক্ষমা করে দাও। নিসন্দেহে তুমি অতীব ক্ষমাশীল।
নাসেরের ব্যক্তিত্বঃ ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক
কেউ কেউ আমার কাছে দাবী করে যে, আমি যেন নাসেরের শাসনব্যবস্থা ও তার ব্যক্তিত্বের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরি এবং তার নেতিবাচক দিকগুলো থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখি। অথচ আমি নাসেরের ব্যক্তিত্বের ওপর কখনো কোন আক্রমণ করিনি। কিংবা তা করার অভ্যাসও আমার নেই। তথাপি নাসের দেশ ও জতির ব্যাপারে যেসব বাড়াবাড়ি করেছে তাথেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখা ইতিহাসের সাথে গাদ্দারী এবং সত্য ও সততার সাথে বিশ্বাস ভঙ্গেরই নামান্তর। আমি কোন মানুষেরই মহৎ গুণাবলীর স্বীকৃতি প্রদান করতে কার্পণ্য করি না। নাসেরের ব্যাপারে তার ঘনিষ্ট কিছু বেসামরিক সংগী-সাথীদের নিকট আমি শুনতে পেয়েছি যে, সে মদ পান করতো না। অনুরূপ আরও জনশ্রুতি রয়েছে যে, সে নারীদের পশ্চতে ছুটে বেড়াতো না। সুদানে সামরিক দায়িত্ব পালন করার সময় তার ব্যাপক সুখ্যাতি ছিল যে, সে অধিকাংশ সময়ই একাকী ও নিঃসংগ অবস্থায় অতিবাহিত করতো। নিজের ফৌজী সাথীদের সম্পূর্ণ বিপরীত খেলাধুলা, আনন্দ-উল্লাস ও ক্লাবগুলোতে রাত্রিযাপন করা থেকে পুরোপুরি বিরত থাকতো।
তাঁর জীবনের এই ব্যতিক্রমী দিকগুলো নিসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু তার রাজনৈতিক নেতিবাচক দিকসমূহ এবং অসৎ বৈশিষ্ট্যে কলম্কিত ও কলুষিত। আভ্যন্তরীণ জুলুম-অত্যাচার ছাড়াও সকল মুসলিম রাষ্ট্রের শত্রুতা কুড়ানো কেমন বুদ্ধিমাত্তার পরিচয়ক? নাসেরের স্তবক লেখকদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা ছোট বড় সবাইকে গালী দেয়া এবং প্রত্যেকের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা কি তাদের নিকট ইতিবাচক কৃতিত্বের পরিচয়ক? মিসরে মার্কসবাদের প্রবর্তন কোন মহৎকাজ নয়। নাসেরের মৃত্যুর পর মার্কসবাদের প্রতি যে ঘৃণা প্রকাশ করা হচ্ছে তা থেকেও অনুমান করা যায় যে, নাসেরের কর্মকান্ডের সাত্যিকার মূল্য কতটুক।
অর্থনৈতিক ব্যাপরে নাসেরের উত্তরাধিকা্রী আনোয়ার সাদাতের সন্তব্য উদ্ধৃত করাই উত্তম বলে মনে করি। সাদাত ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর দ্ব্যর্থহীনভবে বলেছিলেন যে, তিনি নাসেরের নিকট থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যে অর্থনীতি লাভ করেছেন তা শুধু শূন্যই নয় বরং শূন্যেরও অনেক নীচে। উস্তাদ মুস্তফা আমীন (প্রখ্যাত মিসরীয় সাংবাদিক ও সাহিত্যিক)- এর এই উক্তি এখন প্রত্যেক মিসরবাসীর মুখে মুখে যে, নাসের প্রতি দু’টি কারখানার মাঝে তৃতীয় কারখানা স্থাপন করে যার ফলে পুরাতন কারখানা ধ্বংস প্রাপ্ত হয় এবং নতুন কারখানাও কোন ইতিবাচক কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে পারেনি।
বলা হয়ে থাকে যে, নাসের অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে উপনিবেশবাদী শক্তিসমূহের মোকাবিলা করেছেন। সত্যিকারভাবে আমাকে বলা হোক যে, উপনিবেশবাদী শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে মিসরের কোন ব্যক্তি সংগ্রামরত ছিল না? উপনিবেশবাদের কবল থেকে মুক্তি লাভ করার পর নাসের জুলুম-নির্যাতন শুরু করলে তার অত্যাচার ও নির্যাতনের সামনে উপনিবেশবাদী যুগের জুলুম-নির্যাতন নিষ্প্রভ হয়ে যায়। আমি দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সাথেই বলতে চাই যে, যদি কোন মিসরীয় আামকে নাসেরের শাসনামলের একটিও ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখিয়ে দিতে পারে-যার ফলে দেশবাসীর সৌভাগ্য ও কল্যাণ করতে সক্ষম হয়েছে তাহলে আমি কোন প্রকার দ্বিধা না করে তা প্রকাশের জন্য পুরোপুরি চেষ্টা করবো।
সাদাত নাসেরের স্থলাভিষিক্ত
সাদাতের শাসনকাল যতদূর পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত তার সূচনা খুবই ভাল ছিল। যদিও সে রাজনৈতিক নজরবন্দী ও কয়েদীগণকে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তি প্রদান করেনি। তথাপি মাত্র দু’বছরের মধ্যে যে, এই বিলম্বর কারণও ছিল মূলত নিরাপত্তা বিভাগীয় আমলা এবং পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের টালবাহানা ও লাল ফিতার দৌরাত্ম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, গুপ্ত ব্রাঞ্চের অফিস শান্তি-শৃঙ্খলা কায়েম রাখার ব্যা্পারে যদি প্ররিশ্রম ও আন্তরিকতার পরিচল দেতো তাহলে শান্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থারও উন্নতি হতো এবং জনগণকে অকারণে সমস্যর সম্মখীনও হতে হতো না। তাদের মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে সরকার ও জনগণের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি করা যাতে সকল ব্যাপারেই উত্তমরূপে আনজাম পেতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এসব লোক এর সম্পূর্ণ বিপরীত সরকার ও জনসাধারণের মধ্যে ব্যবধান ও ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করতেই সদা সচেষ্ট থাকে।
সাদাতের দৃষ্টান্তমূলক পরিণাম
ধারণা করা হয়ে থাকে যে, প্রথমদিকে সাদাতের আশংকা ছিল তার শাসন স্থায়ী হবে না। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারে যে, কোন শক্ত চ্যালেঞ্জ ছাড়াই সে তার ক্ষমতার মসনদকে মজবুত করে নিয়েছে। তখন তার দেমাগও খারপ হয়ে যায়। এক্ষণে সে তার প্রতিপক্ষের সকলকে একই লাঠি দ্বারা হাঁকিয়ে পুনরায় সেই জঘন্য কারাগারে প্রেরণ করে যেখান থেকে স্বীয় শাসনামলের গোড়ার দিকে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। এসব জেলখানার অবস্থা ছিল বর্ণনাতীত যেখানে বন্দীদের মৌলিক মানবিক অধিকারের পতি কোন ভ্রুক্ষেপই করা হতো না। সাদাতর শাসনামলের পরিসমাপ্তি অত্যন্ত মর্মান্তিক ও দৃষ্টান্তমূলক। নিজের ক্ষমতার নেশায় বিভোর হয়ে সে প্রেসিডেন্টের জন্য নির্মিত মঞ্চে সালামী গ্রহণের জন্য দাঁড়িয়েছিল। ইতিপূর্বে সে তার সমস্ত বিরোধী পক্ষকে শৃংখলিত করে ফেলে। আল্লাহ তায়ালা এমনভবে দুর্বিনীত গর্দানকে অবনত করে দিলেন যে, মঞ্চ রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। চারদিকে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে যায় এবং সাদাত সাহেব এখানেই সবকিছু ছেড়ে পরপারের পথে পাড়ি জমান।
সেনাবাহিনীর কাজ সীমান্ত রক্ষা রাজনীতি নয়
১৯৬৭ সালের অপমানজনক পরাজয় অনুশোচনাযোগ্য ছিল অবশ্যই কিন্তু অপ্রত্যাশিত ছিল না কিছুতেই। ১৯৫২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন কিছু। কিন্তু সেনাবাহিনী সংস্কারের পরিবর্তে ক্ষমতার নেশায় বিভোর হয়ে পৃথক সামরিক সরকার চাপিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তখন থেকেই আমাদের মনে আশংকা দানা বেঁধেছিল যে, মিসরের ওপর দিয়ে একর পর এক বিপদের ঝঞ্ঝা প্রবাহিত হবে। কারণ সরকারের কাজকর্ম এবং সামরিক দায়দায়িত্ব দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির কর্মক্ষেত্র। যখন কোন দেশের ওপর সেনাবহিনী আধিপত্য বিস্তার করে তখনই একদিকে তারা তাদের পেশাগত যোগ্যতা থেকে বঞ্চিত হয় এবং অপরদিকে সমস্ত সরকারী প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস সাধিত হয়। সামরিক বাহিনীতে নির্দেশ প্রদান এবং বিনা বাক্য ব্যয়ে তার আনুগত্য করার নীতি কার্যকর। পক্ষান্তারে সরকারের কর্মকান্ড আলাপ আলোচনা, যুক্তি তর্ক, সলা পরামর্শ এবং পরিষ্ঠতা ও লঘিষ্ঠতার মূলনীতির ওপর ভিত্তিশীল। মহাবিজয়ের নামে অভিহীত ১৯৫৬ সালের লড়েইয়ের রহস্য উদঘাটিত হয়্ ১৯৬৭ সালে। যাকে পরাজয় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রকৃতহক্ষে এটা শুধু পরাজয়ই ছিল না বরং জীবনব্যাপী লাঞ্ছনা- সর্বকালের নিদারুণ অপমানের নামান্তর।
বস্তুত তোমরা খুব কমই শিক্ষা গ্রহণ করে থাকো
আমাদের ধারণা ছিল এই দৃষ্টান্তমূলক পরাজয়ের পর হয়তো আবদুন নাসেরের চোখ খুলবে এবং সে তার পরামর্শ ও মন্ত্রণাদাতাদের পরিবর্তন ও বিরাজমান পরিস্থিতির আশু সামাধানের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কিন্তু সে বরং আরো এক প্রহসনমূলক নাটকের অভিনয় করে। সে প্রদর্শনীমূলকভাবে ঘোষণা করে বসে। যার ফলে তার চাটুকার ও তল্পীবাহকরা তাকে তোষামোদ করতে শুরু করে যে, দেশ ও জাতির স্বার্থ যেস যেন তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেয়। নাসের নিজে হয়তো ধারণার করতে পারেনি যে, এরূপ শিক্ষনীয় পরাজয়ের সম্মখীন তাকে হতে হবে। কিুন্তু আমাদের জন্য এই পরাজয় কোন বিম্ময়ের ব্যাপার ছিল না। আল্লাহর কিতাব, ইসলামী শরীয়াত এবং স্বয়ং মানবজাতির ইতিহাস এই বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করে যে, যখনই কোন ব্যক্তির একনায়কত্ব কোন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ধ্বংস ও বিপর্যয় এবং বিপদ মুসিবত ব্যতীত আর কিছুই দাঁড়ায় না। হিটলার, মুসোলিনী, সালাজার এবং ফ্রাম্কো প্রমুখ ব্যক্তিগণ নিজ নিজ জাতির জন্য তাই করেছিলেন। মিসরে আবদুন নাসের যার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন। পূর্ব থেকেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যাতে এ পরাজয় আরো বলিষ্ঠ হয়ে যায় যে, দৃষ্টান্তমূলক পরিণাম সমাগত।
একমুষ্টি মাটি কিন্তু জমিন থেকে আসমান পর্যন্ত বিস্তৃত
মিসরের রাষ্ট্রীয় আইন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সংগঠনকে স্বীকার করে না। আমরা মানব রচিত আইনকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি না। কিন্তু আইনকে নিজের হাতেও তুলে নেই না। আমরা সর্বদা এ আইন বাতিল করার দাবী করে আসছি। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সংগঠন যা তাদের মুর্শিদে আ’মকে নির্বাচিত করে থাকে তা আইনগ ভবে নিষিদ্ধ। তথাপি মুর্শিদে আ’মকে বাছাই করা হয় এবং সরকারও তা মেনে নেয়। আমি ইতিপূর্বেও আরজ করে এসেছি যে, ইখওয়ানের প্রতিষ্ঠাতা কমিটিতে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল যে, কোন কারণে যদি মুর্শিদে আ’ম নিখোঁজ হয়ে যান এবং তার সহকারীও বর্তমান না থাকেন, কিংবা তিনি দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করেন, তাহলে কর্মপরিষদের সদস্যগণের মধ্যে বয়সের দিক থেকে সর্বাপেক্ষা প্রবীণ সদস্য মর্শিদে আ’ম – এর দায়িত্ব পালন করবেন। উস্তাদ আল হাসান আল হুদাইবি মৃত্যুবরণ করেন এবং তার সহকারী ডঃ খামীস হামীদও ইনতিকাল করেন। তখন ঘটনাক্রমে কর্মপরিষদের সদস্যগণের মধ্যে আমিই ছিলাম বয়োজেষ্ঠ। অতএব এ শুরু দায়িত্ব সমর্পণ করা হয় আমার ওপর। অথচ আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আমি আদৌ- এর উপযুক্ত নই। কোথায় হাসানুল বান্না, হাসান আল হুদা- ইবি আর কোথায় সম্পূর্ণ দুর্বল ও অযোগ্য আমি! ইখওয়ানী ভ্রাতাগণ তাদের ভাল মন্দ সকল ব্যাপারেই আমার পরামর্শ গ্রহণ জরুরী মনে করতেন এবং ইখওয়ানের মুর্শিদে আ’ম হিসেবে সরকারও আমার সাথে আলাপ আলোচনা করেন। আমাকে যখন মর্শিদে আ’ম বলে সন্বোধন করা হয় তখন আমি কোন প্রকার উল্লাস বোধ করি না। আবার তা অস্বীকারও করি না। তথাপি এদিক থেকে এটা একটা সম্মানের বিষয় যে, আমাকে মর্শিদে আ’ম বলে প্রকারান্তরে ইখওয়ানের অস্তিত্বই মেনে নেয়া হচ্ছে। এটা একটা সান্ত্বনার বিষয়।
সাদাত আমাকে ১৯৭৯ সালে সাক্ষাতের জন্য ডেকে পাঠালে মর্শিদে আ’ম হিসেবেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ব্যক্তিগতভবে কোন রাষ্ট্রপাধান কিংবা সরকারী দায়িত্বপূর্ণ কোন লোকের সাথে মিলিত হওয়ার কোন অভিলাষ আমার ছিল না। আল্লাহ তায়ালা জানেন যে, আমি সুনাম সুখ্যাতি এবং প্রচারণা ইত্যাদিকে খুবই অপছন্দ করে থকি। সাদাত কানাতিরুল খাইরিয়াতে আমার সাথে সাক্ষাত করেন এবং আমার সম্মুখেই তাঁর সচিবকে নির্দেশ দেন যেন এ সাক্ষাতের বিস্তারিত বিবরণ ও ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশের ব্যবস্থা করে। আমি রাষ্ট্রপতির নিকট আবেদন জানাই যাতে এ সাক্ষাতের পাবলিসিটির কোন ব্যবস্থা কিছুতেই করা না হয়। আমার অনুরোধের ফলে সাদাত তার সেক্রেটারীকে পুনরায় আদেশ করেন যেন খবর প্রকাশ করা না হয়্ কিন্তু পরক্ষণেই রাষ্ট্রপতি বিস্ময় বিস্ফরিত নেত্রে আমার দিকে তাকাতে লাগলেন। তিনি তো দেখে এসেছেন মানুষ রাষ্ট্রপরিত সাথে সাক্ষাত এবং তার পাবলিসিটির জন্য অত্যন্ত আগ্রহী অথচ আমিই ছিলাম একমাত্র ব্যক্তি যে স্বয়ং এ পাবলিসিটি বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করলাম। আমি শাসকদের নৈকট্য ও সানিধ্য এড়িয়ে চলি। কারণ আমার মতে এতই নিহিত রয়েছে কল্যাণ। কদাচিৎ তাদের সমীপে গেলেও তা শুধু দ্বীনি উদ্দেশ্যেই যাই ব্যক্তিগত সুনাম সুখ্যাতির জন্য নয়।
“মুর্শিদে আ’ম উপাধিটি খুবই মর্যাদা ও সম্মানজনক। বড় বড় মহাপ্রাণ ব্যক্তিরাও এই গুরু দায়েত্বের বোঝা সামাল দিতে ইতস্তত করে থাকে। আমি কোনদিন এর প্রত্যাশা করিনি। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাই ছিল এরূপ যে, এ কঠিন দায়িত্বভার আমার ক্ষীণকায় স্কান্ধের ওপরই সমর্পণ করবেন। বস্তুত আল্লাহ যে ফায়সালা করেন তা অটল অবিচলই হয়ে থাকে। কে এমন দাবী করতে পারে যে, সে তার সকল কর্মকান্ডেই স্বাধীন ও খোদ মোখতার।
সুয়েজখাল জাতীয় করণ
আমার মনে পড়ে ১৯৩৬ সলের মার্চ মাসে অর্থমন্ত্রী সুয়েজখাল কোম্পানীর ডাইরেক্টরের সাথে আলাপ আলোচনা করেন। তিনি মিসর সরকারের মুনাফার অংশ বৃদ্ধি করা এবং কোম্পানীতে মিসর সরকারের প্রতিনিধি সংখ্যা বাড়ানোর দাবী করেন। এটা একথারই ইংগিত দেয় যে, মিসরের সকল সরকারই সুয়েজখালের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল এবং দেশের স্বার্থের হিফাজতের জন্য সবসময়ই সচেষ্ট ছিল। চুক্তি অনুসারে ১৯৬৯ সন পর্যন্ত কোম্পানীকে খাল লিজ দেয়া হয়েছেল। এই মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর গোটা কোম্পানী কোন প্রকার বিনিময় ব্যতীতই সমুদয় সাজ সরঞ্জামসহ মিসর সরকারের মালিকানায় চলে আসবে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ চুক্তি ছিল লাভ জনক। নাসের সাহেবের মাথায় হিরো হওয়ার ভূত নগ্নভাবে সওয়ার হয়েছিল। সে লিজের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই সুয়েজখাল জাতীয়করণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কোটি কোটি পাউন্ড বিনিময় আদায় করে এবং এর ভিত্তিতে নিজের মিথ্যা মূর্তি মানুষের মন ও মগজে বদ্ধমূল করতে চেষ্টা করে। দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেংগে চুরমার হয়ে যায় এবং নাসের সাহেবের আমিত্ব প্রশান্তি লাভ করে। তারপর আরো একটি শখ তার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং নিজের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য পস্তুতি ছাড়াই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মত বোকামি করে বসে। অগণিত নিষ্পাপ যুবক এবং উদ্দেশ্যহীন লড়াইয়ের অসহায় শিকার হয় এবং অস্ত্রশাস্ত্রের মজুদও সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। অথিকাংশ জাতীয় বীর যাদের মূর্তি তৈরী করে পূজা কর হয় এভাবেই তাদের জাতিকে ব্যক্তি স্বার্থের জন্য ধ্বংসের অতল গহবরে ঠেলে দিয়ে থাকে। দূরের বাদ্য আনন্দদায়ক হওয়ারই নামান্তরের ন্যায় যখন এসব লোককে খুব নিকট থেকে পর্যবেক্ষণ করা যায় তখন তাদেরকে খড়কুটা অপেক্ষা বেশী কিছু বলে মনে হয় না।
১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে কায়রো এবং বাগদাদের মধ্যে সরাসরি টেলিফোন ব্যবস্থার উদ্বেধন হয়। ফলে আলী সাহেব ও হোসাইন আল হাশেমী কায়রো এবং বাগদাদ থেকে যথাক্রমে একে অন্যের সাথে কথাবার্তা বলেন। আমার এই স্মৃতি কথাগুলো সেই নোট থেকে গৃহীত যা আবদুন নাসেরের সেনাবাহিনী আমার বাসগৃহ থেকে সমস্ত কাগজগত্র, বই- পুস্তক এবং ফাইল-নথি নিয়ে যাওয়া সত্বেও থেকে গিয়েছিল।
১৯৫৪ সনের এপ্রিল মাসে আমেরিকার গৌরব ও কৃতি বৈমানিক লিন্ড বার্গের পুত্রের হত্যাকারীকে ফাঁসি দেয়া হয়। অপরাধী অত্যন্ত নির্মমভাবে এই ছোট্র শিশুটিকে হত্যা করেছিল। ঘটনাটি ছিল অ্ত্যন্ত ভয়ংকর ও পাশবিক। কিন্তু আমাদের দেশের মত এ ঘটনাকে বাহানা বানিয়ে না কোন সংগঠনকে বলির পাঠা বানানো হয়েছে না জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। লিন্ড বার্গ ছিলেন এমন এক বৈমানিক যিনি সর্বপ্রথম ১৯২৭ সালে একটি ক্ষুদ্র বিমানে নিউইয়র্ক থেকে প্যারিস পর্যন্ত একটানা সফর করেছিলেন। {১. চার্লস লিন্ড যিনি বিমান যোগে উত্তমাশা অন্তরীপের ওপর দিয়ে উড্ডয়ন করতঃ নিউইয়র্ক থেকে প্যারিস পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেন। তার নাম ছিল স্পিরিট আপ সেন্ট লুই। ইহা ছিল মহাশূন্যে উড্ডয়নের ইতিহাসের এক স্বরণীয় ঘটনা এবং মহাশূন্যচারীদের এক দুঃসাহসিক অভিযান। এই উড্ডয়নের পর লিন্ড বার্গের খ্যাতি সার বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশের মধ্যেও অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে তাকে দেখা হতে থাকে। অতপর তিনি রাজনীতিতেও জড়িত হয়ে পড়েন এবং আমেরিকার স্বনামধন্য রাজনীতিবিদরূপে পরিগণিত হতে থাকেন। তারই ছোট্র বাচ্চাকে হত্যা করা হয়েছিল।}
হোসনী মোবারকের ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভংগী
অনেকেই আমার নিকট জিজ্ঞেস করেন যে, মুহাম্মাদ হোসনী মোবারকের সরকারের মম্পর্কে আমাদের ভুমিকা কি? আমার জবাব হলো, তিনি কাতিপয় ভাল পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তার শাসনামলের সূচনা করেছিলেন। যেমন তিনি রাজবন্দীদের মুক্তি দিয়েছিলেন এবং সংবাদপত্র ও পত্র-পত্রিকাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তারর আরব রাষ্ট্রসমূহের শাসকদের বিরুদ্ধে লিখনী পরিচালনা করা থেকে বিরত থাকেন। আমার আকাংখা আমাদের সংবাদপত্রসমূহ এরূপ নির্দেশনা ছাড়াই যেন নিজেরাই যুক্তিসংগত কর্মপন্থা অবলম্বন করেন।
রাষ্ট্রপতি বিরোধীদলের সংবাদপত্র ও সাময়িকীকে সমালোচনার অধিকার দিয়ে একটা উত্তম ঐতিহ্য স্থাপন করেছেন। মাঝে মধ্যে রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারেও নিশ্চিয়তা প্রদান করতেন যে, তিনি মৌলিক মানবাধিকারের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল এবং তিনি তার এ ভূমিকার ওপর অবিচল থাকনেব। এসব কথা আনন্দদায়ক। রাষ্ট্রপতিরও আমাদের ওপর এ অধিকার রয়েছে যে, আমরা তার এসব মহৎ গুণাবলীর স্বীকৃতি প্রদান করব। এবার আসুন অপর দিকে তাকাই। আমাদেরও তার ওপর এমন কিছু অধিকার আছে যা সংকল্প সংশোধন দাবী করে আমরা সেগুলো চিহ্নিত করে তাকে জানাবো। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপ্রধানের ওপরই বর্তায়। কিন্তু যা হচ্ছে তা খুব একটা প্রশংসার যোগ্য নয়। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এমন কোন সপ্তাহ অতিবাহিত হয় না যখন বেশ কিছু সংখ্যক ইখওয়ানকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গ্রেফতার করা হয় না্ পাকড়াও করার পর তাদের সাথে অত্যন্ত খারাপ আচরণ ও রূঢ় ব্যবহার করা হয়। কয়েক ঘন্টা, দিন অথবা সপ্তাহের পর তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু তাদের বলাও হয় না যে কেন এবং কি অপরাধে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং ছেড়েই বা দেয়া হচ্ছে কেন। কোন ইখওয়ানীকে যখন আদালতে উপস্থিত কর হয় তখন আদালত সংগে সংগে তাকে মুক্তিদানের নির্দেশ জারী করে কেননা আনীত অভিযোগের কোন যৌক্তিকতা ও ভিত্তি পাওয়া যায় না।
এগুলো এমন সব জুলুম-নির্যাতন যা এই প্রতিশ্রুতির সাথে খাপ খায় না। যাতে আযাদী ও নাগরিকদের হিফাজতের গালভরা বুলি আওড়ানো হয়ে থাকে। এ নাজুক বিষয়ে বিরোধী দলের পত্র-পত্রিকায় বার বার মতামত প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু সবই বৃথা।
আমাদের এ অভিযোগ যথার্থ ও বাস্ত যা প্রকাশ করার অধিকার আমাদের রয়েছে। কিন্তু আমরা বার বার বলেছি যে, আমরাপ বিরোধিতার জন্য বিরোধিতার পক্ষপাতি নই। আমরা যথার্থ সমালোচনা ও পরামর্শ দিয়ে থাকি। এটা খুবই দুর্বল পদক্ষেপ মাত্র। যার পরে আছে নীরবতা ও মৃত্যু। আমাদের বিরোধিতা করার কোন শখ ও আবেগ নেই। কিন্তু ভুল ভ্রান্তি দেখিয়ে দেয়া দ্বীনি দায়িত্ব ও জাতীয় কর্তব্য। এ কর্তব্য সম্পাদনে আমরা জঘণ্যতম স্বৈরাচারী আমলেও নির্বিকার ও উদাসীন থাকিনি।
পঁচিশতম অধ্যায়
সাদাতের হত্যা এবং ইখওয়ান
জনসাধারণ জানতে চায় সাদাতের হত্যাকান্ডে ইখওয়ান সমর্থিত দ্বীনি ব্যক্তির সংগঠনকেই এ হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী বলে মনে করে থাকে। আপনি যাদি পরিস্থিতির পর্যালোচনা করেন তাহলে এ উক্তি ভিত্তিহীন অভিযোগ এবং আদালতের ফায়সালা ছাড়াই রায় প্রদান করার নামান্তর প্রতীয়মান হবে।
আমি মনে করি শোনা কথা বলে বেড়ানো এবং মনগড়া গুজব প্রচারের পরিবর্তে এ ব্যাপারে ইখওয়ানের ভূমিকা তাদের মুখ থেকেই শোনা উচিত। ইনসাফের দাবী হচ্ছে এই যে, আমাদের থেকে এ পরিস্থিতি এবং এ হত্যাকান্ডের ব্যাপারে আমাদের ভূমিকা কি তা জেনে নেয়া। আমি সংক্ষিপ্তভাবে নিম্নে বর্ণিত স্বল্প পরিসরে কয়েকটি লাইনে এ ব্যাপারে ইখওয়ানের ভূমিকা তুলে ধরছিঃ
১- এ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার অব্যবহিত পরই গণপ্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট জনব মুহাম্মাদ হোসনী মোবারক সুস্পষ্টভাষায় ঘোষণা করেন যে, ঘটনার সাথে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কোন সম্পর্ক নেই। দেশের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ব্যক্তির সুস্পষ্ট ঘোষণার পর সকল প্রকার গুজব বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। রাষ্ট্রপতি নিশ্চিতভাবেই সম্পুর্ণ তথ্যানুসন্ধান এবং আভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাসমূহের রিপোর্ট পর্যালোচনা করার পরই এরূপ মন্তব্য করেছেন।
২- সাবেক স্বরা্ষ্ট্র মন্ত্রী হাসান আবু পাশাও সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন যে, সন্ত্রাসীচক্র ইখওয়ানের কোন সহযোগিতা অবশ্যই পায়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আভ্যন্তরীণ শান্তি শৃংখলারন নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্বে থাকেন। তার নিকটই থাকে সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য। তারপরও একথা কিভাবে বলা যেতে পারে যে, সাদাতের হত্যাকারীর ইখওয়ানের সাহায্য লাভ করেছিলো।
৩- সাদাত শুধু ইখওয়ানদেরই বন্দী করেছিল না। বরং ওয়াভদ পার্টি, হিয্বে আমলা, তাজাম্মু পার্টি এমন কি সাদাতের সমালোচনাকারী মসজিদের খতিবগণকেও কারগারে বন্দী করা হয়েছিলো। ফলে সাদাতর বিরুদ্ধে এ সমস্ত দলের সদস্যগণ ক্রোধ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলো্ তারপরও এ দুর্ঘটনার দায় দায়িত্বের বোঝা একা ইখওয়ানের ওপর কেন চাপানো হচ্ছে? মসজিদের একজন খতিব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সাদাতের এরূপ খেদোক্তি প্রকাশ করা যে, সে এখন জেলখানায় কুকুরের ন্যায় পড়ে আছে। এদিক থেকে সাদাত তখন সমগ্র পৃথিবীর মুসলমানদের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছিলেন।
৪-আমাদের বিশেষ ব্যবস্থা যার নামে আমাদের ওপর এ অভিযোগ চাপানো হচ্ছে তা বিগত ত্রিশ বছর থেকে বাতিল হয়ে রয়েছে। জামাল আবদুন নাসের সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর সংগঠনের সমস্ত সদস্য বিশেষত বিশেষ ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত ইখওয়ানদেরকে বর্ণনাতীত অত্যাচার ও নির্যাতন করা হয়। বিশেষ ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ দায়িত্বশীলদেরকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারপর হাঠাৎ এই ব্যবস্থার সাথে জড়িত ব্যক্তিগণ কিভাবে আত্মপ্রকাশ করে বসে? কবে এবং কোথায় তারা পরিকল্পনা করেছে আর কথিত সে ষড়যন্ত্রকে বাস্তবে রূপদানের উদ্যোগও গ্রগণ করে ফেলে?
৫- একথাও বেশ শোনা যায় যে, গুলি সম্মুখের পরিবর্তে পাশ্চাত দিক থেকে চালানো হয়েছিলো। পোষ্টমর্টেমেও প্রমাণিত হয় যে, গুলি লেগেছিলো পেছন থেকে। আমি এটা তো বলছি না যে, এসব জনশ্রুতি পুরোটাই সত্য হবে। কিন্তু তারপরও এটা জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রসংগত এ প্রবাদবাক্যও স্মরণ রাখা উচিত যে, আগুনের অস্তিত্ব ব্যতীত ধোঁয়া নির্গত হয় না।
বিশ্লেষণ ও গুজব
কোন কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি তো এমন উক্তিও করেছেন যে, সাদাতকে তার উপদেষ্টা এবং অকল্যাণকামীগণই হত্যা করেছেন। আমার ধারণা আমি ইতিপূর্বে সাদাতের ব্যাপারে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দৃষ্টিভংগী বর্ণনা করেছি। তিনি আমাদেরকে জেল থেকে মুক্তি প্রদান করেছিলেন এবং চলাফেরার ও দ্বীনি মাহফিল অনুষ্ঠানের জন্য বেশ কিছুটা স্বধীনতা দিয়েছিলেন। এটা ছিল একটা ইতিবাচক পরিবর্তন্ যার ফলে ইখওয়ান কিছুটা আনন্দ প্রকাশ এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে।
কোন কোন পর্যালোচকের বিশ্লেষণ এও যে, সাদাত গোড়ার দিকে ইখওয়ানের সাথে এ সদাচরণ শুধুমাত্র মার্কসাবাদী তরঙ্গতে প্রতিহত করার এবং কমিউনিষ্টদের উৎখাত করার জন্যই করেছিলেন। এভাবে তিনি জনসাধারণের সমর্থন লাভ করতে চাচ্ছিলেন। তা না হলে তার নিয়ত কিন্তু ভাল ছির না। তারা তাদের মন্তব্যের স্বপক্ষে এ যুক্তি পেশ করে থাকেন যে, সাদাত যদি সত্যিই সরল মনে করতেন তাহলে ইখওয়ানের ওপর থেকে আইনগত বিধি- বিষেধ প্রত্যাহার করে নিতেন এবং তাদের কেন্দ্রীয় অফিস ও বাজেয়াপ্তকৃত সহায় সম্পত্তি ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু তিনি এগুলোর মধ্যে কোন একটা কাজও করেননি। বরং প্রায়শই ধর্ম ব্যবসার কথা বলে কঠোর সমালোচনা করতেন এবং তার কথায় ইংগীত থাকতো ইখওয়ানের প্রতিই। আইনগতভবে ইখওয়ানকে নিষিদ্ধ করে রাখার জন্য এবং তাদের তাওয়াতী কার্যক্রমের পথ বন্ধ করার লক্ষ্যে তিনি রাজনৈতিক দল বিষয়ক আইনকে বিস্তারিতভাবে দাফাবন্দী করেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহকে অৎপরতার পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হলেও ইখওয়ানের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা হয়।
আমার এসব গুজবে কান দেই না। কেননা আমার মানষের বুক চিরে তাদের অন্তরের খবর তো আর জানতে পারি না। এ ব্যাপারটি পুরোপুরি আল্লাহ তায়ালার ইখতিয়ারে। সাদাত তাঁর শাসনামলের শেষের দিকে ইখওয়ানের ওপর খুব দুর্ঘটনার পূর্বে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ দারুল ইখওয়ানে তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান চালায়। সেদিন থেকেই আমাদের সম্মুখে এ সত্য উদ্ভাসিত হয়ে পড়েছিল যে, সাদাত সাহেবের দৃষ্টিভংগী পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও আমরা যতদূর সম্ভব ভাল ধারণা নিয়েই কাজ করে যেতে চাই। আমাদের সামনে কুরআন মজীদের এ আয়াত সর্বদাই দিকনির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে থাকেঃ (.............) আমাদের এ কর্মনীতি কেবলমাত্র সাদাতের বেলাতেই নয় বরং আমাদের কোন কোন সম্মানিত বন্ধু যারা এক সময় ইখওয়ানেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন এমন কি ইখওয়ানের বিরুদ্ধে জামাল আবদুন নাসেরের সহযোগিতা করেছেন তাদের বেলায়ও। এরা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতো আর সে ওদের পিঠ চাপড়িয়ে বাহবা দিয়েছেন। আমরা তাদের সম্পর্কেও কখনো কোন খারাপ শব্দ মুখ থেকে উচ্চারণ করি না। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং আমাদেরকেও। তারা ভাল করেই জানতো এবং আমাদেরও জানা আছে যে, নাসেরের যেসব গুণাবলীর উল্লেখ করা হতো এবং আমাদের ওপর যে কাদা ছোঁড়া হতো তাতে সত্যের লেশ মাত্র ছিল না।
আমার পথ ধনীর পথ নয় দারিদ্রের
আমার মনে হয় আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করে এসেছি যে, ১৯৭৯ সালে ইসমা- ঈলীয়াতে “আল ফিকরুল ইসলামী” বিষয়ে অনুষ্ঠিত সেমিনারে সাদাতের সাথে আামার সাক্ষাত হয়। তৎকালীন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী জনাব মনসূর হাসানের ঐকান্তিক আগ্রগ ছিল যেন এ সেমিনারে সমস্ত দ্বীনি জামায়াত অংশগ্রহণ করে। তিনি এ ব্যাপারে সাদাতের নিকট অনুমতি প্রার্থনা করেন যাতে আমাকেরও আমন্ত্রণ জানানো যায়। মন্ত্রী মহোদয় একান্তভাবে কামনা করছিলেন যেন ইখওয়ান ও সাদাতের মধ্যেকার ভুল বুঝাবুঝি দর করে ঘনিষ্ঠতা ও সখ্যতা সৃষ্টি করে দেয়া যায়। তাঁর কি জানা ছিল যে, সাদাত সাহের আমার সাথে মিলিত হয়ে কি খেল খেলবেন? এ সাক্ষাতকারের ওপর বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আমার এমন কোন আগ্রহই ছিল না যে, রাষ্ট্রপতির সাথে আমর সাক্ষাত হোক আর সেজন্য কোন তদবিরও আমি করিনি। আমি শুধুমাত্র আমার রবের সন্তুষ্টি লাভের অভিলাষী। যদি তিনি আমার প্রতি রাজী থাকেন তাহলে দুনিয়ার যে কোন ব[ থেকে বড় জিনিসও আমার নিকট কোন গুরুত্বই বহন করে না।
এ ব্যাপারে আমি আমার রচিত গ্রন্থ “আইয়াম মা’আস্সাদাত” এ উক্ত সাক্ষাতের বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করেছি। ২৬ শে রমযানের রাতে যখন সংস্কৃতি ও তথ্য বিষয়ক মন্ত্রী সাইয়েদ মনসুর হাসান আমার সাথে যোগাযোগ করে অনুরোধ জানান যে, আমি যেন তার দফতরে তার সাথে সক্ষাত করি। আমি মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য যখন গমন করি তখন ভ্রাতৃপ্রতীম আলহাজ্জ আহমদ হাসনাইন (আদ দাওয়া সাময়িকীর সার্কুলেশন ম্যানেজার) ছিলেন আমার সাথে। মন্ত্রী মহোদয়ের সংগে এ সাক্ষাতকার রাত সোয়া নয়টায় গুরু হয়ে সাড়ে এগারাটায় শেষ হয়। তিনি আমাকে সেমিনারে যোগদান করার জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা করতে থাকেন এবং আমি অসম্মতি জ্ঞাপন করতে থাকি। কেননা আমি সাতাদের অহংকার এবং জনগণের মোকাবিলায় মিথ্যা ঔদ্ধত্য সম্পর্কে অবহিত ছিলাম। সাদাত জনসাধারণের সাথে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের আচরণ করেতেন। আমার কাছে এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য ছিল যে, কোন ব্যক্তি আমার ওপর তার প্রভাব বিস্তার করবেন, তার মর্যাদা ও অবস্থান যত উঁচুই হোক না কেন! আমি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাব্বুল আলামীন ছাড়া আর কারো সামনে হস্ত প্রসারিত করতে চাই না। কিংবা মহাসম্মানিত আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অপর কারো নিকট মস্তকাবনত করতে চাই না। যে মহান সত্তার সমস্ত সৃষ্টিজগতের নিরংকুশ কর্তৃত্ব তাঁকে ব্যতীত আর কাউকে আমি ভয় করি না। সৃষ্টি-কুলের কেউই কারো কোন ক্ষতি করতে পারে না। যদিও সে নিজে নিজেকে অনেক শক্তিধর ও ক্ষমতার অধিকারী মনে করে এবং মানুষও তার শক্তিকে ভয় করে থাকে।
মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে আলোচনা দীর্ঘস্থয়ী হয়। আমার ক্রমাগত অস্বীকৃতির পরও তিনি আমাকে বার বার অনুরোধ জানাতে থাকেন। তখন অগত্যা রক্ষা পাওয়ার জন্য আমি তাঁকে বললাম। ঠিক আছে আমি আপনার আমন্ত্রণ গ্রহণ করছি। কিন্তু আমি সেমিনারে অংশগ্রহণ করবো না। উজির মহোদয় বললেন, ঠিক আছে আমি এতই সন্তুষ্ট যে, আপনি দাওয়াত গ্রহণ করেছেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, দাওয়াত কবুল করার পর আমি অবশ্যই আমার অংগীকার পালন করবো। অতএব এতটুকু কথার পর আমি সেখান থেকে চলে আসি।
সাদাতের বক্তৃতা
আমার কল্পনারও অতীত ছিল যে, সাদাত আমার সাথে সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লামের পরিপন্থী কোন অপ্রিয় অযৌক্তিক ভংগীতে কথা বলবেন। রাসূলুল্লাহ (সা) এর অত্যন্ত সুস্পষ্ট নির্দেশ হচ্ছে, বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করতে হবে। আমি ছিলাম সাদাতের পিতা কিংবা তদপেক্ষাও বয়সে প্রবীণ। সাদাতের মাথায় তখন ক্ষমতার ভূত সওয়ার হয়েছিল। সে মনে করছিল যে, সে যাচ্ছেতাই বলে বেড়াবে কেউ তার কথার প্রতিবাদ করার মত নেই। কিন্তু আমি ফলাফল ও পরিণতির ব্যাপারে একবারেই বেপরোয়া। তাঁর অভদ্র ও অশালীন কথাবার্তা শুনে নীরবে বসে থাকতে পারি না। যা কিছু ঘটে গেলো তা সে কস্মিন কালেও কল্পনা করেনি। কিংবা তার তল্পীবাহী সহযোগীরা কোনদিন ভাবতেও পারেনি। ২৮শে রমযান রাতে আমি কায়রো থেকে ভ্রাতৃপ্রতীম আলহাজ্জ মোস্তাফা মাশহুর এবং ডাক্তার আবদুল আযীম আল মাতআনী সমভিব্যাহারে ইসমাঈলিয়ার দিকে রওয়ানা হই। সম্মেলন স্থলে গিয়ে আমি পশ্চাৎদিকের সারিতে বসে পড়ি। কয়েক মুহূর্ত পর প্রটোকল অফিসার আমার নিকট আগমন করেন এবং অত্যন্ত বিনয়ের সাথে প্রথম সারিতে গিয়ে আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ জানান। আমি মনে করলাম হয়তো সে আমার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং পারস্পরিক বুঝাপড়ার সুবিধার্থে আমাকে সম্মুখের সারিতে নিয়ে বসাতে চাচ্ছে। আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে সামনের সারিত চলে যাই। পরক্ষণে আমি বুঝতে পারি যে, এটা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। আমাকে সামনে নিয়ে বসানো কোন আন্তরিকতার ভিত্তিতে ছিল না। যে আসনে আামকে বসানো হয় সেখান থেকে মঞ্চের দিকে যদি কোন সরল রেখা টানা হতো তাহলে তা সোজা সেই আসন পর্যন্ত চলে যেতো যার ওপর সাদাত সমাসীন ছিল। সম্ভবত আমাকে এজন্য সাদাতের নিকটতম আসনে বসানো হয়েছিলো যেন তার অভিযোগ ও দোষারোপের লক্ষ্য বস্তু বানানোর জন্য আমাকে খুঁজে বের করতে কোন বেগ পেতে না হয়। মুহতারাম রাষ্ট্রপতি ভাষণ দিতে শুরু করলেন। তাঁর রক্তব্যের মূল বিষয় ছিল আমার ওপর অবান্তর অভিযোগের বৃষ্টি বর্ষণ করা। মহাত্মন আমার দক্ষিণ ও বাম এবং সম্মুখ ও পশ্চাত সব দিক থেকে তীর বর্ষণ করতে লাগলেন।
আমার ও ইখওয়ানের ওপর অগণিত আক্রমণ করা হলো। ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড, বিদেশীদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করা, ছত্রদের হাংগামা সৃষ্টিতে উস্কানি দান এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির জন্য আমাদেরকেই দায়ী করা হয়। পরিবেশ ছিল অতিরঞ্জন ও উচ্ছাসপূর্ণ। ইসমাঈলিয়ার সবুজ শ্যামল গাছপালার ডালে ডালে সবুজের মনোলোভা সৌন্দর্য যেন উপচে পড়ছিলো। ঘনছায়া ও পাখীর কলকাকলী অদ্ভূত পরিবশে সৃষ্টি করে রেখেছিল। এই নীরবতা ভংগকারী পরিবেশে সাদাত সাহেব পংখীরাজ ঘোড়ার সওয়ার হয়ে বাগ্মিতা এবং কবিতা ও কাব্যের হক আদায় করছিলেন।
ধৈর্যর শেষ সীমা
গালমন্দ ও অশালীন কথাবার্তা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চলতে থাকে। ফলে ধৈর্যর পাত্র কানায় কানায় ভরে ওঠে। আরও সহ্য করার যখন কোন অবকাশ রইলো না এবং ইখওয়ানের আন্দোলনের সাথে আমার আবেগপূর্ণ সম্পর্ক আবেগাপ্লু হয়ে উঠলো তখন আমি সুবক্তার বক্তব্যে বাধা দিয়ে বললাম বক্তৃতার এই ধারা তার প্রত্যুত্তর দাবী করে। এর জবাবে প্রেসিডেন্ট সাহেব আমাকে বললেন, ঠিক আছে, আমি যখন আমার কথা শেষ করবো তখন তোমাদের যা কিছু বলার ইচ্ছা বলবে.........মহোদয় পুনরায় তার অবান্তর ও অপ্রাসংগিক কথাবর্তায় অতিশায়োক্তির রং মিশ্রণ করতে লাগলেন।
সাদাত সাহেবের বর্ণানাভংগীতে উপস্থিত সকলেই অস্বস্তি বোধ। করছিলেন। তিনি গালমন্দ উচ্চারণ ও দোষারোপ করার পর কথার সমাপ্তি টানছিলেন এই বলে যে, ওমর এটা কি ঠিক নয়? সমস্ত জাতি এমন কি তার কিছু কিছু সংগী সাথীও এই বাচনভংগী অপছন্দ করে। তিনি শুধু আমার নাম নিয়ে আমাকে সন্বোধন করছিলেন যা সকল প্রকার শিষ্টাচার ও শালীনতার পরিপন্থী। তিনি না আমার বার্ধক্যের প্রতি কোন সম্মান প্রদর্শন করেছেন না রমযানুল মোবারকের পবিত্র মাসের কোন তোয়াক্কা করছিলেন। ইউনিভারসিটি আমাকে আইনশাস্ত্রে যে ডিগ্রী দিয়েছিলো না তার প্রতি কোন বিবেচনা করা হয়, না তাঁর নিজের মর্যাদার প্রতি কোন গুরুত্ব প্রদান করে। সাদাতের নিকট তখন শিষ্টাচারের মানদন্ড এবং শালীনতার সীমা এটা বৈ আর কিছুই ছিল না যে, যা কিছু তার মনে আসে তাই সে বলে যাবে। তাঁর দৃষ্টিতে তিনি হয়তো আমাকে অত্যন্ত হীন ও নীচ দেখানোর চেষ্টা করছিলেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি তাঁর নিজের ব্যক্তিত্বকেই আহত করে দুর্নাম কুড়ানোর ক্ষেত্রই প্রশস্ত করছিলেন। তার বক্তৃতা দানের সময় সে এতবেশী উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল যে, শদ্বমালাও তাঁর সামনে সারিবদ্ধভাবে প্রতীক্ষমান। আল্লাহ তাঁকে সাহায্য করছিলেন এবং আমাকেও। তাঁর সাহায্য এই অর্থে যে, সে যা কিছু বলতে চাচ্ছিলো তা বলার ইখতিয়ার তাকে প্রদান করা হয়েছেলো। আর আমার স্বধীনতা এই অর্থে যে, আমি অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে সকল প্রকার গালিগালাজ শুনে যাচ্ছিলাম। এই ধৈর্য ও স্থৈর্যর মধ্যে আল্লাহ তায়ালার প্রত্যক্ষ সাহায্য শামিল ছিল। তাঁরই সমীপে উপযুক্ত বিনিময়ের প্রত্যাশাই আমি করছি।
কাঁপছে পাহাড় কাঁপছে তৃণভূমি ও নদীনালা
রাষ্ট্রপতির ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই আমি আমার আসন থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আমার সম্মুখে না ছিল কোন লাউড স্পীকার আর না তখনো পর্য়ন্ত আমার মনে জবাবের কোন চিত্র অংকত হয়েছিলো। কিন্তু অতিশয় পবিত্র ও মহান আল্লাহ নিজেই আহলে ঈমানদের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মাহফিলের ব্যবস্থাপকগণ সাথে সাথে লাউড স্পীকার আমার সামনে এনে হাজির করলো। সম্ববত তারা মনে করেছিলো যে রাষ্ট্রপতির এরূপ নির্লজ্জ ও সাঁড়াসি আক্রমণের পর আমি ক্ষমা ভিক্ষা ও অনুতাপ প্রকাশ করবো এবং একজন অনুগত তল্পীবাহকের ন্যায় সাফাই পেশ করতে লেগে যাবো। আর তাতে সদর সাহেবের অন্তর প্রশান্ত হয়ে যাবে এবং ক্রোধের পরিমাণ কমে আসবে। জনসাধারণও এরূপ ধারণা পোষণ করতে সক্ষম হবে যে, প্রেসিডেন্ট আসর মাত করে ফেলেছেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ছিল কিছুটা ভিন্ন রকম। তাদের কোন প্রত্যাশাই পূরণ হয়নি।
আমার ও ইখওয়ানের ওপর যে অপবাদ আরোপ করা হয়েছেলো এক এক করে আমি তার সবগুলোরই দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিলাম এবং আরোপিত সব অভিযোগ সম্পর্কে বলিষ্ঠ যুক্তি- প্রমাণ দ্বারা প্রমাণ করে দিলাম যে, এগুলো ডাহা মিথ্যার বেসাতি। পুরো সম্মেলন কক্ষে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিলো। আমি এই বলে আমার বক্তৃতার সমাপ্তি টেনেছিলাম যদি আপনি ছাড়া অন্য কেউ এসব অবাস্তব ও ভিত্তিহীন অভিযোগ আরোপ করতো তাহলে আমি আপনার কাছে নালিশ করতাম। কিন্তু আফসোস এ আপনি নিজেই হে মুহাম্মাদ! হে আনোয়ার! হে সাদাত! এসব অপবাদ আরোপ করেছেন। তাই আমি আহকামুল হাকেমীন ও আ’দালুল আদেলীন আল্লাহর পবিত্র সত্তার সমীপেই আমার মোকদ্দমা দায়ের করছি। হায়রে মানুষটি! তমি আমাকে বড়ই কষ্ট দিয়েছো। আমি তোমার মুখ থেকে যা কিছু শুনলাম তা আমাকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত শয্যাশায়ী করে রাখবে।
ঔদ্ধত্যের মোহাবিষ্ট দুর্বিনীত মস্তক অবনত হলো
আল্লাহ সাক্ষী রয়েছেন যে, সে দৃশ্য ছিল দর্শনীয়। সাদাতের ঠোঁট কাঁপছিলো এবং চেহারা বিবর্ণ হয়ে উঠছিলো। সে বললোঃ উস্তাদ ওমর আমি কখনো আপনার ব্যক্তিগত দোষত্রুটি কিংবা ইখওয়ানুল মুসলিমুনের অনিষ্টকারিতা বর্ণনা করর ইচ্ছা করিনি। তাছাড়া আমার অন্তরে আপনার কিংবা সংগঠনের বিরুদ্ধে কোন বিদ্বেষও নেই। অতএব আপনি আপনার অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিন।
এই সর্বপ্রথম সাদাত সাহেব আমাকে উস্তাদ বলে বন্বোধন করলেনঃ “আমি আমার অভিযোগ সেখানে পেশ করেছি যেখান থেকে তা প্রত্যাহার করে নেয়ার ক্ষমতা আমার নেই।”
সম্মেলন শেষ হওয়ার পরপরই সাদাত উজীরে আওক্বাফ ডঃ আবদুল মোনায়েম আন নাসের এবং সংস্কৃতি ও তথ্য মন্ত্রী মিষ্টার মনসুর হাসানকে আমার নিকট পাঠিয়ে দেন। উভয় মন্ত্রীই তখনো যেসব লোক সেখানে কথাবার্তা বলছিলো তাদের উপস্থিতিতেই আমাকে বললেন, “মহামান্য রাষ্ট্রপতি আপনার সম্পর্কে কোন প্রকার খারাপ ধারণা তার অন্তরে পোষণ করেন না। আপনাকে কষ্ট দেওয়া তার উদ্দেশ্য ছিল না। শীঘ্রই রাষ্ট্রপতি আপনার সাথে সাক্ষাতে মিলিত হবেন।”
১৯৮১ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর তারিখের ভাষণে রাষ্ট্রপতি এই ধারণা দেন যে, আমি তাঁর সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অথচ এটা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি কখনো সাক্ষাতকারের অভিলাষী ছিলাম না। এমন কোন প্রয়োজনও আমি বুঝতে পরিনি। কোন কোন লোক কেন এত নির্ভীক এবং গুনাহের ব্যাপারে এমন বেপরোয়া হয়ে যায় যে, জীবন্ত সত্যাকে ধামাচাপা দিতে গিয়েও তাদের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে না।
আবারো জুলুমের ঝঞ্ঝা
১৯৮১ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর মংগলবার সকাল বেলায় সমস্ত মিসরে এক ভূতুড়ে নীরবতা নেমে আসে। যেন বিজলীর কোন ঝলক মিসরবাসীর জীবনের গতি রুদ্ধ করে দিয়েছে। অকস্মাৎ সমস্ত নীরবতা ভংগ করে সরকার জনসাধারণকে ব্যাপকভবে ধর পাকড় করতে শুরু করে। বর্তমান ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে এরূপ নিশ্চয়তা প্রদান করা হয় যে, এখন আর কোন অত্যাচার উৎপীড়ন করা হবে না। অথচ বিগত শাসনামলে এটা খুবই মামুলী ব্যাপারে পরিণত হয়েছেলো। আপনি এমন জাতির ব্যাপারে কি ধারণা পোষণ করবেন যারা সন্ধ্যার সময় পরিপূর্ণ শান্তি ও নিরাপদ অবস্থায় শয্যা গ্রহণ করে, তারপর মধ্যরাতে হঠাৎ পুলিশ কোন প্রকার অনুমতি ব্যতীতই তাদের গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং তন্ন তন্ন করে ঘরের সমস্ত জিনিস তল্লাসী করে। বিস্মিত হতভম্ব নগরবাসীরা এই অবাঞ্ছিত ও অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করছিলো যে, তাদের সকলকেই হয়তো হাতকড়া পরিয়ে দলে দলে কারগারে নিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হবে? যে রাতের কথা আমি উল্লেখ করছি সেই রাতে প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর জেলখানার দরওয়াজায় পুলিশের এক একটা গাড়ী এস দাঁড়াতো এবং তা থেকে নিরীহ ও নিরপারাধ লোকদের নামিয়ে জেলখানার অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছিলো। অনেকের মাথায় ছিল টুপি পাগড়ী ও হ্যাট। অধিকাংশকে নাংগা মাথায়ই তাদের শয্যা থেকে পাকড়াও করে নিয়ে এসছিলো। কারো কারো পায়ে ছিল জুতা। কেই কেই আবার হওয়াই চপ্পল পরিধান কের ছিলো। পত্যেকে ছিল বিস্ময় বিমূঢ় এই ভেবে যে, শেষ পর্যন্ত কি ঘটতে যাচ্ছে।
মিসরের ওপর কি মুসিবত নাযিল হয়েছিল, আর দেশ মাতৃকার এই সন্তানদের বর্তমানে দেশের অব্যাহত শান্তি ও নিরাপত্তা কি হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল? বিভিন্ন ধরনের চিন্তা-ভাবনার অধিকারী লোকদেরকে ভেঁড়া-বকরীর মত জেলখানার কাল কুঠরীসমূহের মধ্যে বন্ধী করা হয়েছিলো। এই কয়েদীদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা ও সাংগঠনিক ধারণার সমন্বয় ঘটেছিল এক জায়পায়। আর তা ছিল এই যে, তারা সকলেই কার্টর, মেনাহিম বেগিন এবং হেনরি কিসিঞ্জরের ন্যায় ইসলামের কট্রর দুশমনদের পদতলে মস্তকাবনত করতে অস্বীকার করেছিলো। ক্ষমতাসীন সরকারের এই রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সম্মুখে নতি স্বীকার করার পলিসি সমগ্র জাতি প্রত্যাখ্যান করেছিলো। আর এটাই ছিল একমাত্র অনুভূতি য সকল গ্রেফতারকৃতদের পরস্পরকে একই লক্ষ্য অর্জনে অনুপ্রাণিত করেছিলো।
তুররা জেলখানার মধ্যে আামকে সাত রং সেলে ভাই ইবরাহীম সারফ এবং আরো কতিপয় ব্যক্তির সাথে বন্ধী করে রাখা হলো। তাদের কারো কারো নামই এখন আর আমার মনে নেই। কিন্তু উস্তাদ আল ক্বাজী মরহুম, ডক্টর ইসমাত সাইফুদ্দৌলা, জনাব আবুল ফজল আর জিযাভার ছেলের এবং উস্তাদ কামাল আহমদ প্রমুখের নাম আমার মনে আছে। প্রত্যেকের মুখেই ছিলো একই আলোচনা যে, এই অজ্ঞতা ও অবিবেচনা প্রসুত মহাড়া। আল্লাহ তায়ালা যিনি সকল অপরাধ ক্ষমাকারী তিনিই মিসরবাসীদেরকে হযরত আইয়ূব (আ)- এর মত ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দিয়েছিলেন। ফলে তারা সকল মুসিবতকে হাসিমুখে বরণ করে নিতে পেরেছিলেন।
জিন্দানাখানার পুরনো মেহমান
ইখওয়ানুল মুসলিমুন সম্পর্কে আমি বাড়িয়ে বলছি না, আত্মপ্রশংসাও আমাদের নীতি নয়। আমাদের জন্য এ ঘটনা অপ্রত্যাশিত ছিল না। ইখওয়ানের ইতিহাস এমন ঘটনাবলীতে পরিপূর্ণ। বার বার তাদের বাড়ীতে পুলিশ মধ্যরাতে হানা দিয়েছে এবং তাদেরকে গ্রেফতার করে জিন্দানখানার চার দেয়ালের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দিয়েছে। জেল কর্মকর্তা এবং কারারক্ষীদের কাছেও এসব মেহমান অপরিচিত নয়। তারা বরং খুব ভালভাবেই তাদেরকে জানে। রাতের বেলায় কুরআন তিলাওয়াত এবং নামাযের মাধ্যমে এই লোকেরা দীর্ঘ সময় ধরে জেলখানার কুঠরীগুলোকে আলোকিত করে রেখেছে। কতবার যে জেল কর্মকর্তাগণ গালির বৃষ্টি এবং মারপিটের তুফান দ্বারা এই লোকগুলোকে স্বাগত জানিয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। অতচ এই মেহমানগণ তাদের মেজবানদের এতসব মেহেরবানী সত্ত্বেও সর্বদা হাসিমুখে এসব পরীক্ষা নিরীক্ষার পর্যায় অতিক্রম করতে থাকে। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের জন্য এই সমস্ত ধর পাকড় ও গ্রেফতার কোন প্রকার বিম্ময়ের উদ্রেক কারার কারণ ছির না্ তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, ইস্রাঈলের ব্যাপারে তাদের ভূমিকা ও মনোভাবের কারণে দীর্ঘকাল কিংবা স্বল্পকাল সরকারী মেহমানখানায় অতিবাহিত করতেই হবে। এই পথে ভোগ করা সকল বিপদ মুসিবত আমলনামায় লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। এটা কোন ছোটখাটো কিংবা হীন সওদা নয়। বাকী লোকদের গ্রেফতারী সম্ভবত এই জন্য ছিল যে, এই পদক্ষেপ যেন নিরংকুশভাবে ইখওয়ান নিধন হিসেবে চিহ্নিত না হয়। অথবা ভয়- ভীতির সাহায্যে নাসেরী শাসনামলের ন্যায় সকলের মুখে তালা লাগিয়ে দেয়ার ফায়সালাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
যে ব্যক্তি বুঝতে পারে যে, অত্যাচার নির্যাতন দ্বারা ইখওয়ানকে সত্যের পথে কুরবানী দেয়া থেকে বিরত রাখা যেতে পারে তিনি নিজেই নিজেকে প্রতারিত করছেন এবং বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এই গ্রেফতারির বিস্তারিত বিবরণ যে ব্যক্তিই দেখতে পারে সে-ই এ সিদ্ধান্তে উপনীত না হয়ে পারবে না যে, তাদের পশ্চাতে ইস্রাঈলের নির্দেশ ছিল সক্রিয়। কতবার তারা নীরবে এমন কিছু বলে দেয় যা মুখে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। এই বিষয়ে আমাদের শাসনকর্তাদের নীরবতা খুবই অর্থবহ। যিনি সবজান্তা ও প্রকৃত জ্ঞানী তিনি সম্যকরূপে পরিজ্ঞাত আছেন যে পর্দার অন্তরালে কিছু রহস্য অবশ্যই আছে।
এবারের গ্রেফতারির পূর্বের আমলে সাধারণ কয়েদীদেরকে ইখওয়ানীদের সাথে মিলিত হতে দেয়া হচ্ছিলো না। কারারক্ষীগণ সাথীদের সাথে মাঝে মধ্যে যেসব কথাবর্তা বলতো তা একথার ইংগীত বহন করতো যে, ইখওয়ান সমস্ত অনিষ্টের জন্য দায়ী এবং সন্ত্রসী। ইখওয়ানের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত বেশী বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ছিলেন তারা এসব কথা নীরবে হজম করতেন এবং কোন প্রকার পত্যুত্তর করতেন না। তাদের দৃষ্টিতে “অজ্ঞ মূর্খদের জবাবে নীরবতা অবলম্বন করাই শ্রেয়”- মূলনীতি এমন পরিস্থিতিতে সর্বোত্তম কর্মপন্থার মর্যাদা রাখছিল। কিছু কিছু আবেগপ্রবণ ইখওয়ান অবশ্য এসব কথাবার্তা শুনে নিশ্চুপ থাকতে পরতো না এবং এসব মিথ্যা অভিযোগের যথোপযুক্ত জবাব দিতো।
এসো সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত গ্রেফতারের ঘটনার পর বিভিন্ন দলের সাথে সম্পর্কিত লোকদেরকে পরস্পরের মিলিয়ে জেলখানায় রখা হয়। ওয়াফদী নাসেরী, ইখওয়ানী এবং তাজাম্মুয়ী সবই ছিল একাকার হয়ে। অবশ্য তারা প্রত্যেকেই প্রত্যেককে ইজ্জত ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতো। যখন কোন কয়েদীর বাড়ী থেকে খানা আসতো তখন তারা সকলেই তা মিলে মিশে ভাগ করে খেতো। আমার মনে পড়ছে আমারন বার্ধক্য অবস্থায় কারণে ইখওয়ান ছাড়াও অন্যান্য সকল দলের সদস্যগণই আমাকে অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন এবং আমার আরাম আয়েশের প্রতি পুরোপুরি লক্ষ্য রাখতেন। হিযবে তাজ্জাম্মু দলের কোন কোন সাথী তো তাদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সাহায্যে আমার সকল মনোবাঞ্চ পূর্ণ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতো। আমার বাড়ী থেকে যদি কোন জিনিস আনানোর প্রয়োজন হতো অথবা কোন পয়গাম পাঠাতে হতো তাহলে এই বন্ধুগণ একন্ত সহৃদয়তার সাথে এই খেদমত আঞ্জাম দিতেন। মিসরীয় কবি শাওকী (র) কতই না চমৎকার উক্তি করেছিলেন যে, দুঃখ সহমর্মিতার অন্তরসমূহকে নিবিড় সম্পর্কে আবদ্ধ করে দেয়। হয়ত আমাদের ব্যাপারটাও এমটি একটা কিছু ছিল। বুলবুলদের দুশ্চিন্তা ছিল ফুলের জন্য, আর কবরি ছিল ব্যাথায় ভরা দরদী অন্তর। কিন্তু বিপদ মুসিবতের অংশীদারীত্ব দু’শ্রেণীকেই একই কাতারে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো।
প্রত্যেক পক্ষেরই নিজ নিজ মতামত ছিল যা অন্যের পুরো শ্রদ্ধার চোখে দেখতো। বিরোধপূর্ণ বিষয়ে আলাপ আলোচনা থেকে যথা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করা হতো। অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সহযোগিতা এবং কল্যাণকামিতার অনুভুতিও অনুপ্রেরণাই ছিল এই সময় বেশী কার্যকরী ও সময়ের দাবী। ব্যায়ম, পরিশ্রম, সাহিত্য, সংগীত, রাজনীতি এবং বিশ্বের ঘটনা প্রবাহ, মোদ্দাকথা সকল বিষয়েই আলাপ আলোচনা হতো কিন্তু কোন ব্যাপারেই কোন বড় ধরনের মতানৈক্য দেখা দিতো না। এই সমস্ত ব্যাপারেও যদি কোন ভুল বুঝাবুঝি দেখা দিতো তাহলে তা আপোষ, আদব ও শিষ্টাচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। ইত্যবসরে বিভিন্ন পত্র- পত্রিকায় পরস্পরের বিরুদ্ধে যে কাদা ছোড়াছুড়ি করা হতো তার কোন নাম নিশানাও এখন আর পরিদৃষ্ট হতো না। আফসোস! সেই সখ্যত ও হৃদ্যতা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য জেলখানার চার দেয়ালের বাইরে এসে কেন স্থায়ীভাবে ধরে রাখা গেলো না।
নিজের কয়েদী বন্ধুদের সম্পর্কে আমার অন্তরে অকৃত্রিম মর্যাদা ও ভালবাসা সদা জাগরুক রয়েছে। ফুয়াদ সিরাজ উদ্দীন, ডাক্তার ইসলাঈল সাবরী আবদুল্লাহ, ডাক্তার ফুয়অদ নুছহী প্রমুখ কারাবন্ধুদের ব্যাপারে আমি আপনাদেরকে আর কি বলবো। এতটুকু বুঝে নিন যে, এটা ছিল এক সুন্দর অভিজ্ঞতা। সেই দিনগুলো মনে পড়ে যখন আমার একত্রে জেলখানায় ছিলাম এবং প্রত্যেকে প্রত্যেকের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্যকরূপে অবগত হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিলাম। আমার যদিও পূর্ব থেকেই একে ভালভাবেই জানতাম কিন্তু কারজীবনের এই অনুপম সম্পর্ক ও একান্ত সান্নিধ্য প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনের উত্তম ও মহত দিকগুলো এমনভাবে প্রকটিত করে তোলে যা এত ভালভাবে আগে আর কখনো জানার সুযোগ হয়নি।
ওপরে আমি যেসব ব্যক্তির উল্লেখ করলাম তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা সুষ্ঠু জ্ঞান বুদ্ধি ও বিবেক প্রদান করেছেন। তাদের মনমানসিকতা ছিল স্বদেশ প্রেমে উদ্দীপ্ত। আমার আন্তরিক অভিব্যক্তি হচ্ছে, মহামান্য রাষ্ট্রপতি যেন মাঝে মধ্যে এসব লোকদের সাথে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে মিলিত হওয়ার ও পারস্পরিক মতামত বিনিময়ের ওপর যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করতে থাকেন। তাহলে দেশ ও জাতি সমবাবে উপকৃত হতে পারবে। এতে রাষ্ট্রপ্রধানও এমন মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হবেন যা্ থেকে বঞ্চিত ছিলেন তার অগ্রগামী। কিন্তু এজন্য তাকে উদার দৃষ্টিভয়গী নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নেতৃস্থনীয় ব্যক্তিদের প্রতি সহযোগিতা হস্ত প্রসারিত করা উচিত।
সাদাত ও তার ইস্রাঈলী বন্ধু
যে ধরপাকড় ও গ্রেফতারির উল্লেখ আমি এই মাত্র করে এসেছি তার নির্দেশ দিয়েছিলেন সাদাত সাহেব নিজেই। এতদসেত্ত্বেও তাঁর একটি ঘটনা আমার মনে পড়ে গিল, ইনসাফের দাবী হচ্ছে আমি যেন সেই ঘটনা বর্ণনা করি। আল কানাতিরুল খাইরিয়াস্থ রেষ্ট হাউসে ১৯৭৯ সনের ডিসেম্বর মাসে সাদাত সাহেবের সাথে আমার সাক্ষাত হয়। সাদাত সাহেব সালাম ও কুশলাদি বিনিসয়ের পর অকপটে আমাকে বলতে লাগলেন যে, “ইসরাঈলী শাসকগণ ‘আদ দাওয়া’ সাময়িকীর ব্যাপারে খুবই আপত্তি উত্থাপন করছেন। ইখওয়ানের একাদিক্রমে আক্রমণের কারণে ইসলাইল সরকার বার বার আমাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছে। রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের সম্মুখে টেবিলের ওপর ‘আদ দাওয়া’ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা রাখা ছিল। আমি আরজ করলাম “শান্তি চুক্তি সম্পর্কে আমাদের মনোভাব ও ভুমিকা সম্পূর্ণ দ্বীনি দৃষ্টিভংগীর ভিত্তিতেই ব্যক্ত করা হয়েছে। ইস্রাঈল সম্পর্কে আমরা যা কিছু লিখছি তা আমাদের দেশের ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়ে নয় বরং আমাদের আকীদা ও দ্বীনের সমস্যা জড়িত। আমার দ্বীনের দাবী হচ্ছে আমি এই নিরিখে আমার লেখনি অব্যাহত রাখি যাতে ভ্রান্ত ধারণা কল্পনার কোলে মেঘের অবসান ঘটে এবং প্রকৃত সত্যের আলো সমুদ্ভাসিত হয়ে জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। যদি এই ব্যাপারে অবশ্যই। এই সত্তদা এতই সহার্ঘ যে আমি তা কল্পনাও করতে পারি না ..............।”
আমি পুরোপুরি ইনসাফ ও ন্যায়ত একথা সুধী পাঠকদের সম্মুখে উপস্থাপন করতে চাই যে, রাষ্ট্রপতি মহোদয় আমার একথাগুলো গভীর মনোনিবেশ সহকারে শুনলেন। তারপর তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে সুস্পষ্টভাবে বললেনঃ “আমি আপনার বক্তব্যেব সাথে সম্পূর্ণ একমত। এই দৃষ্টিভংগীতে আপনি আপনার লেখনী অব্যাহত রাখুন। সাদাত আমার সাথে যে ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করেছেন তা বর্ণনার পাশাপাশি তার চরিত্রের ভাল দিকগুলোও পাঠকদের সামনে তুলে ধরা অবশ্য কর্তব্য বলে আমি মনে করি। আল্লাহ তায়ালা আমার ওপরও রহমত করুন আর ক্ষমা করে দিন সাদাতকেও।
ছাব্বিশতম অধ্যায়
ইসলাম না সমাজতন্ত্র?
আমাদের শাসকগণ এবং তথাকথিত চিন্তাবিদগণ সমাজতন্ত্রের ঢাকঢোল পিটাচ্ছেন যা ভিনদেশ থেকে আমাদানীকৃত অনৈসলামী মতবাদ। আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল (সা) – এর সুন্নাহর বর্তমানে আমাদের অন্য কারো কাছে আদর্শের সন্ধান করা নির্বুদ্ধিতা নয়তো আর কি? তাদের বক্তব্য হলো, সমাজতন্ত্র শ্রেণীগত বিভেদের চুড়ান্ত পরিসামাপ্তি সেদিনই হয়ে গিয়েছিলো যে, দিন রাসূল (সা) বিশ্ববাসীর সম্মুখে দ্বীন ইসলাম পেশ করেছিলেন।
ইসলামে বর্ণ ও গোত্রের ভিত্তিতে কেউ কারো ওপর কোন মর্যাদা ও সম্মান লাভ করতে পারে না। কেউ আর্য হোক বা সেমিটিক, ধনী হোক আর গরীব তাতে কিছুই যায় আসে না। আমাদের দ্বীনে শ্রেষ্ঠত্বের বুনিয়াদ তাকওয়া ও আমল। যে-ই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুটি অর্জনের লক্ষ্যে মুসলিমদের জন্য কল্যাণমূলক কাজ করে সেই সর্বোত্তম।
সমাজতন্ত্র মানবীয় স্বাধীনতার দাবী করে ঠিকই কিন্তু কোন সমাজতান্ত্রিক দেশে আজ পর্যন্ত তার প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়নি। ইসলাম আদেশ ও নিষেধের সীমার মধ্যে এমন এক আদর্শ কায়েম করেছে যার ছায়ায় মানবতা দীর্ঘ দিন পর্যন্ত সৃষ্টির জন্য স্রষ্টার নির্ধারিত স্বাধীনতাসমূহ ভোগ করে। সমাজতন্ত্রের শ্লোগান হচ্ছে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই সর্বদা কাজ ও উন্নতির সুযোগ প্রদান করা হবে। কিন্তু সমাজতন্ত্রীরা বাস্তবে এর কোন উদাহরণ পেশ করতে পারে না। অথচ ইসলামী এর যাত্রার দিন থেকেই মানবতাকে প্রকৃত সাম্যের নিয়ামত দান করেছে। তাফসীর ও হাদীস এবং ফিকাহশাস্ত্রে মুসলিম উম্মাহ কোন প্রকার সংরক্ষণ ছাড়াই এমন সব লোকদের নেতৃত্ব স্বীকার করেছে যারা ছিল দাস বংশোদ্ভত। শুধু তাই নয় বরং দাস বংশের অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি ইসলামী দেশসমূহে সরকার এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন।
দাস আর প্রভু বলে কিছুই রইল না
আমাদের ইতিহাসে হযরত ওমর বিন খাত্তাবের একটা কথা অত্যন্ত স্মরণীয়। তাঁর ওপর যখন প্রাণনাশী আক্রমণ করা হয়েছিল তখন নতুন খলিফা নির্বাচনের জন্য তিনি ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি নিয়োগ করে বললেনঃ “ যদি (হযরত হুযায়ফার ক্রীতদাস) সালেম জীবিত থাকতো তাহলে আমি কমিটি গঠনের পরিবর্তে তাকেই আমার স্থলাভিষিক্ত করতাম।” সমাজতন্ত্র সাম্যবাদের জন্য শুধুমাত্র গালভরা বুলি আওড়ায় কিন্তু আমাদের কাছে এই শ্লোগানের বাস্তব নিদর্শন রয়েছে। একবার জনৈক কুরাইশ বংশীয় সর্দার কোন এক হাবশী গোলামকে বললো, “হে কালো মায়ের সন্তান।” রাসূলুল্লাহ (সা)- এর চেহারা একথা শুনে লাল হয়ে ওঠে। তিনি ক্রোধভরে বলতে লাগলেন, “এটা জঘন্য প্রকৃতির জুলুম এটা সুস্পষ্ট সীমা লংঘন।” কুরাইশ সরদার রাসূল (সা)- এর ক্রোধের মাত্র দেখে ভীত হয়ে এবং মাটিতে শুয়ে পড়ে। সে তার গন্ডদেশ মাটির ওপর রেখে আল্লাহর নামে শপথ করে বলতে থাকে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই ক্রীতদাস তার গন্ডদেশে তার পা রেখে না দাঁড়াচ্ছে ততক্ষণ জীবন্ত দৃষ্টান্ত পুনরায় তাজা করতে চাই। মানুষ একে সেকেলে চিন্তা বলে অভিহীত করতে পারে। কিন্তু আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, একদিন আমরা এ লক্ষ্য অর্জনে সফল হবো। “আর স্মরণ করো সেই দিনের কথা যেদিন মু’মিনগণ আল্লাহর সাহায্যে খুশী হবে।”
যারা আসতে চাও জাহাজ জ্বালিয়ে দিয়ে এসো!
হাসানুল বান্না শহীদ ও হাসান আল হুদাইবি মরহুম কিংবা তাদের পরে আগত ইখওয়ান কর্মীগণ মানুষের সম্মুখে কখনো এমন দাবী করেনি যে, আমরা তাদের সকল পত্যাশা পূরণ করে দেবো এবং তাদের জন্য আকাশের তারকা এনে দেবো। বরং আমরা বলে থাকি যে, আল্লাহর রাস্তায় আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি তিনিই এই কল্যাণের পথের অভিযাত্রীদের সংরক্ষক এবং তাঁর সাহায্যেই আমরা আমাদের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো। “ নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন উত্তম আমলকারীর আমল বিনষ্ট করেন না।” বিগত নির্বাচনে অভিজ্ঞতা থেকে আমার আল্লাহ তায়ালার সাহায্য ছাড়া এমন কথা বলতে পারি না যে, সফলতা সমাগত। তথাপি আমাদের ইস্পাত কঠিন সংকল্প হচ্ছে, রাস্তা দুর্গম হওয়া সত্ত্বেও আমাদের যাত্রা অব্যাহত থাকবে। এই পথ কখনো ফুল বিছানো ছিল না। আরো কত দুর্গম ঘাঁটি এখনো অতিক্রম করতে হবে তা আল্লাহই ভাল জানেন। মনযিল বহুদূর এবং সফর আরো কঠিন। তা সত্ত্বেও লক্ষ্য সেটাই যা নির্ধারিত হয়ে গেছে।
বিশ্বরাজনীতি পরিক্রমা ও ইখওয়ান
বৈদেশিক বিষেয়ে ইখওয়ানের দৃষ্টিভংগী এই মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত যে কোন দিক ঝুঁকে না পড়েই নিজেদের অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে এবং সকল প্লাটফর্মে সত্য ও ন্যায়ের সমর্থনে এগিয়ে যেতে হবে। ইসলাম শান্তি ও নিরাপত্তার জীবন ব্যবস্থা। বিশ্ববাসী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও আঞ্চলিক দল গঠন করে শান্তি শৃংখলা লাভ করার শত চেষ্টা করেও সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কতিপয় দেশ একটা বিশ্ব সংগঠনের ভিত্তি স্থাপন করে। কিন্তু তা খুব বেশী দিন চলতে পারেনি। এই সংগঠন যা “লীগ অব নেশানস্” নামে পরিচিত ছিল। এটা ছিল সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অগ্রজ। সম্মিলিত জাতি পুঞ্জের চার্টার খুবই আকর্ষণীয়। কিন্তু এর ধোঁকা ও প্রতারণা ব্যতীত এর বাস্তবতা বলতে কিছুই নেই। পরাশক্তিগুলো ভেটো পাওয়ার তাদের নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছে। যা সরাসরি জুলুম এবং দুর্বলদের অধিকার মারারই নামান্তর। বড় বড় শক্তিগুলো পরস্পরে এমন গাঁটছাড়া বেঁধে রেখেছে যে, তার তাদের নিজেদের স্বার্থে মনগড়া কার্যকলাপ চালতে থাকে কিন্তু কেউই তাদের ত্রুটি নির্দেশ করতে পাঁরে না।
ভালুক ও নেকড়ের বানরের ন্যায় পিঠা বন্টন
বম্ভবত সবার মনে আছে যখন রাশিয়া তার সৈন্য বাহিনী আফগানিস্তানে প্রেরণ করে তখন আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্টার যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তার অর্থ ছিল এই যে, রাশিয়ার বাহিনীর আফগানিস্তান অনুপ্রবেশের ব্যাপারে আমেরিকার কোন আপত্তি ছিল না। অপরদিকে ইস্রাঈলের ধৃষ্ঠতামূলক তৎপরতার প্রতি লক্ষ্য করুন যার সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে আমেরিকা। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া নীরব দর্শক হিসেবে তামাশা দেখছে কিংবা খুব বেশী কিছু করলে কখনো শৃগালের ন্যায় ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে থাকে। সমগ্র দুনিয়া এই দৃ’টি ব্লকে বিভক্ত। কিছু দেশ আমেরিকার ক্রোড়ে আশ্রিত আবার কিছু দেশ রাশিয়ার তপ্লীবাহী্ লাল উপনিবেশবাদ হোক বা র্পুঁজিবাদী গণতন্ত্র সবই ইসলামের সমান দুশমন। ভারতকে দেখুন এ দেশটি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের স্তম্ভ। মিসর যখন রাশিয়ার তৈরি মিগ জঙ্গী বিমানের জন্য ভারতের নিকট খুচরা যন্ত্রাংশ চায় তখন সে টালবাহানা শুরু করে এবং রাশিয়ার নিকট অনুমতি কামনা করে। যেহেতু মিসর রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলো। এজন্য কটিউনিষ্ট সরকার ভারতকে স্পেয়ার পার্টস মিসরের নিকট বিক্রি করতে নিষেধ করে দেয়। এতে একদিকে জানা গেলো যে, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন শুধুমাত্র ঢং। অপরদিকে জানা গেল পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্র রাশিয়া ও আমেরিকার ইংগীতেই চলে থাকে। আমাদের মুসলিমদের জন্য এতে একটা শিক্ষা রয়েছে। আহ! আমাদের চোখ যদি খুলে যেতো এবং আমরা দেখতে পেতাম যে, কমিউনিষ্ট, হিন্দু, ইহুদী ও ঈসায়ী তথা সকল অনৈসলমিক শক্তিই আমাদের দুশমন- “আল – কুফরু মিল্লাতুন ওয়াহেদাহ” –সকল কুফরী শক্তিই এক ও অভিন্ন।
আত্মনির্ভরতার অভাব ও মানসিক গোলামী
এটা ঠিক যে আমরা আজ যে যুগে বাস করছি তা হচ্ছে বস্তু যুগ এবং উন্নত দেশগুলো আমাদের চেয়ে কতবেশী শক্তিশালী। কিন্তু আমাদেরকে নিজেদের বাহ্যিক কর্মকৌশল চিন্তা- ভাবনা করে বিন্যাস করা উচিত। আমাদেরকে বিশ্বের শক্তিধর দেশসমূহের দ্বন্দ-সংঘাত থেকে দূরে অবস্থান করে সুইজারল্যান্ডের ন্যায় নিজেদেরকে জোট নিরপেক্ষ রাখা উচিত। আমাদের অবস্থা খুবই করুণার যোগ্য। রুশদের পদতলে যুগ যুগ ধরে নতজানু হয়ে থাকি। সেখান থেকে গুতা খেয়ে পথিমধ্যে কোথাও না থেমে সোজা আমেরিকার চরণ তলে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করি। আমাদের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতা নেই। মানুষের কাছেও আমাদের কোন মান-সম্মান নেই। আমরা যে ব্লকেই যাই না কেন এই সত্য কিছুতেই ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, দুই ব্লকই ইস্রঈলের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা দানের ক্ষেত্রে সমভাবে অংশগ্রহণ করছে। কবির ভাষায়ঃ
(**************)
“তোমার দাওয়াই না আছে জেনেভায় না আছে লন্ডনে ফিরিংগীদের জীবন ইহুদীদের থাবায় আমি শুনেছি গোলামীর জিঞ্জিল থেকে উম্মতের মুক্তি আছে আত্মবিশ্বাসের প্রতিপালন ও তার বলে বলীয়ন হওয়ার।”
আমরা যে চোরাবালিতে আটকে আমি তাথেকে মুক্তি লাভ করা বাস্তবিকই কঠিন কাজ। আর যে আক্টোপাস আমাদের রক্ত শোষণ করে চলেছে তার থেকে রক্ষা পাওয়া অসম্ভব। আমরা অবশ্য এমন দাবী করছি না যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন রাতারাতি জাতিকে এ সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে। আমাদের দাবী হচ্ছে, যদি সঠিক লক্ষ্যে পদেক্ষেপ গ্রহণ করা যায় তাহলে কখনো না কখনো মনজিল দৃষ্টিগোচর হবেই। এই জটিল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন বছরের পর বছরের। কিন্তু মুসলিম সরকারগুলো যদি তাদের জনগণকে সাথে নিয়ে এক দেহ এক আত্মার রূপ পরিগ্রহ করতে পারে তাহলে সকল বিপদের মোকাবিলা করা যেতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতি চলতে দিয়ে আমরা কোনদিনও নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবো না।
মিসরের অর্থনীতি এবং সরকারের ধ্বংসনীতি
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের সরকার বড় রকমের ভুল করেছে। মিসর মুলত একটা কৃষি প্রদান দেশ। অথচ সরকার কৃষির তুলনায় শিল্পকে অগ্রাধিকার প্রদান করেছে এবং এর পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে। তথাপি শিল্প ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ হয়নি। কিন্তু কৃষি ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ও অনগ্রসরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সুদানের সাথে আমাদের সম্পর্ক খুবিই ভাল। এই দুই ভ্রাতৃপ্রতীম দেশের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ এবং ঐক্য ও সংহতি জোরদার করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করতে হলেও সেজন্য কোনরূপ ইতস্তত করা ঠিক হবে না। সুদানে রয়েছে বিস্তর চাষাবাদের ভূমি আর মিসরের আছে প্রচুর জনশক্তি ও পর্যাপ্ত কারিগরি সাজসরঞ্জাম। দু’দেশ পারস্পরিক সগযোগিতায় এতবেশী কৃষিজাত পন্ন উৎপন্ন করতে পারে যার ফলে সর্বক্ষেত্রে শুধুমাত্র স্বাবলম্বীই হবে শুধু তাই নয় বরং রপ্তানীও করা যেতে পারে। ইখওয়ানুল মুসলিমুন এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করার জন্য সদা প্রস্তুত রয়েছে। পরিকল্পনা প্রণয়নকারীগণকে আল্লাহ তায়ালা যেন তাওফীক দেন যাতে তারা এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি উপলব্ধি করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ প্রহণ করতে পারেন। কবি কতই না চমৎকার গেয়েছেনঃ
(*************)
মওসুম উত্তম, পানি পর্যাপ্ত আর মাটিও অত্যন্ত উর্বর এতদসত্ত্বেও যে উৎপন্ন করতে পারে না সে কেমন কৃষক।
বস্তুত কোন জাতিই অলস ও শ্রমবিমুখ হয়ে কোন উন্নতি ও অগ্রগতি অর্জন করতে পারে না। এজন্য পরিশ্রম ও কষ্ট ক্লেশ নীরবচ্ছিন্নভাবে সহ্য করতে অভ্যস্ত হওয়া আবশ্যক। বর্তমানে ভ্রান্ত নীতির ফলে পরিস্থিতির এত অবণতি হয়েছে যে, আমাদের লক্ষ লক্ষ যুবক ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষা জীবন সমাপনান্তে অলিগলি ও সড়ক মহাসড়কগুলোতে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ায়। তাদের কোথাও কর্মসংস্থান হয় না। ফলে তারা কফিখানা ও রাস্তাঘাটে বসে আড্ডা দিয়ে নিজেদের সময়ও নষ্ট করে এবং যোগ্যতাও ধ্বংস করে। এ যুবক যুবতীদের প্রতিভা ও যোগ্যতা দ্বারা দেশ ও জতির বড়ই উপকার হতে পারে যদি আমরা বিচক্ষণতার সাথে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারি।
সমৃদ্ধি লাভ কি এভাবেই সম্ভব!
আমাদের ভ্রাতৃপ্রতীম দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলা আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক। যদি তারা অনীহা প্রকাশ করে তবুও আমাদেরকেই সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তাদেরকে কাছে টেনে আনতে হবে। যদি তারা কোন ব্যাপারে সীমালংঘন করে তা হলে আমরা তা সহ্য করবো। তারা যদি কখনো অশালীন ও অশোভন আচরণ করে বসে তবুও আমরা তা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবো। যেখানেই প্রয়োজন দেখা দেয় সেখানে সমাধানও অবশ্যই পাওয়া যায়। আমাদের হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধার রাজনৈতিক ও সামাজিক দেউলিয়াপনার প্রতিকার ও পতিবিধান এবং ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের রহস্য মুসলিম উম্মার নিষ্ঠাপূর্ণ ঐক্য ও সংহতির মধ্যেই লুকায়িত।
আমাদের দেশসমুহে প্রচার মাধ্যমসমূহ ফিতনা ও বিপর্যয় ছাড়ানো ছাড়া আর কিছুই করছে না। উলঙ্গপনায় পরিপূর্ণ চরিত্র বিধ্বংসী ও নগ্ন ছায়াছবি প্রদর্শন করা হয়ে থাকে এবং নৈতিকতা বিবর্জিত অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। তাছাড়াও অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র সম্বন্ধে শত্রুতামূলক প্রেপাগান্ডা চালানো হয় আর এভাবে এসব দেশের যুব সমাজ অন্য দেশের জনগণের ব্যাপারে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিবর্তে বিদ্বেষ ও ঘৃণার মনোভাব অন্তরে লালন করতে থাকে। তা না হলে কেন সিরিয়া, মরক্কো, মিসর, ইরান, আলজিরিয়া, সুদান ও অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের উলামা ও জ্ঞানীগুণীদেরকে একদেশ হতে অন্য দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রচার মাধ্যমগুলোর সাহায্যে যুবসমাজকে উপদেশ দানের সুযোগ দেয়া হয় না? যদি তা কারা হয় তবে উম্মাতে মুসলিমার বিভিন্ন দেশে বসবাসরত ব্যক্তিগণ একে অন্যের ব্যাপারে সঠিক ধরণা লাভ করতে পারবে এবং পরস্পর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার মত পরিবেশ সৃষ্টি হবে। কবির ভাষায়ঃ
(***************)
এই জাতির লাভ ও লোকসান এক ও অভিন্ন সকলের নবী (সা) ও একজন, দ্বীন এক, ইসানও এক হারামে পাক, আল্লাহ এবং কুরআনও এক কতই বড় ব্যাপার হতো যাদ মুসলিমরাও হয়ে যেতো এক।
করার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ
আজকের যুবসমাজ আগামীতে ক্ষমতার আসনে সমাসীন হবে। প্রশ্ন হলো, আমরা আমাদের যুব শ্রেণীকে এই গুরুদায়িত্ব বহন করার জন্য তৈরী করেছি কি? আমি কখনো নিবাশ হই না। বিশেষত যুবকদের ব্যাপারে আমি খুবই আশাবাদী। কিন্তু এই অসহায় যুবকদেরই অপরাধ কি?
(***********)
গলা টিপে তোমাকে হত্যা করেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালকগণ আর কোথা থেকে উচ্চারিত হবে কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর আওয়াজ?
আমি তো একথাই বলতে চাই যে, আমাদের ভরসা করা উচিত একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সত্তার ওপর। সাথে সাথে কাজে লাগাতে হবে তারই প্রদত্ত সমস্ত উপায় উপকরণ। প্রত্যেক যুবক যুবতীকে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আমি খুব ভাল করেই জানি যে, আমাদের সরকার ও কর্তৃপক্ষ সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে একবারেই অসতর্ক। অকস্মাৎ যে কোন মুহুর্তে তারা যার মুখোমুখি হতে পারে। অথচ আমাদের দুশমনেরা সদাসচকিত এবং প্রস্তুত। এমতাবস্থায় নারী পুরুষসহ জাতির আবালবৃদ্ধবনিতা সকলকেই প্রতিরক্ষার জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে হবে।
যারা ইরাকের এটমিক এনার্জি কেন্দ্র ধ্বংস করেছিলো। তারা অন্য যে কোন মুসলিম রাষ্ট্রের সাথেও অনুরূপ আচরণ করতে পারে। কোন প্রতিশ্রুতি এবং চুক্তিই তাদের হাত সংযত রাখতে পারবে না। তাই এখন আমাদের অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে সমরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য সযত্ন উদ্যেগ গ্রহণ করা। যার উদ্দেশ্য হবে শুধু আত্মরক্ষা করা। কারো ওপর আক্রমণ করা নয়। ইসলাম সামরিক প্রস্তুতির যে নির্দেশ প্রদান করেছে তা কারো ওপর আক্রমণ করার জন্য নয় বরং এজন্য যে, আমাদের শত্রুরা আমাদের ব্যাপারে ভীত সন্ত্রস্ত থাকে এবং আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকাবারও সাহস না পায়। (******)
“তোমাদের দুশমনদের মোকাবিলায় তোমাদের মাধ্যানুযায়ী শক্তি সঞ্চয় করো এবং সমরিক শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে অশ্বারোহী বাহিনী গঠন করে তা দিয়ে তোমরা আল্লাহর দুশমন ও তোমাদের দুশমনদের ভয় দেখাবে।”
অবশ্য আমাদেরকে সকল দেশের সাথেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে এবং নিজস্ব মূলনীতির ওপর অটল থেকে প্রত্যেকের সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। ধোঁকা, প্রতারণা এবং নাজায়েজ কাজ-কারবারের সম্মুখে প্রবিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের বাজারকে উন্মুক্ত করত আন্তর্জাতিক ব্যাবসা বণিজ্যের দরজা খুলে দিতে হবে।
মুসলিম দুতাবাসগলোর স্বপ্ন
আমাদের দূতাবাসগুলোর পুনর্গঠন খুবই জরুরী। আমরা বাহ্যিক শান শাওকাত ও চাকচিক্যের ওপর অত্যন্ত বেশী গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কিন্তু দক্ষতা ও দূরদৃষ্টি একবারেই নেই। দূতাবাসের কর্মচারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে যে কোন বিষয়ের গভীরে গিয়ে তা উপলব্ধি করা। অথচ বর্তমানে আমাদের দূতাবসগুলোর অবস্থা হচ্ছে এই যে, কতিপয় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া সারা বছর ঘুমিয়ে কাটায়। কায়রোতে আমরা বিদেশী দূতাবাস কর্মচারীদেরকে দেখি তারা অফিসের চার দেয়ালের মধ্যে বসে থাক না বরং কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া, আসিয়ুত এবং অন্যান্য শহরে বন্দরে ঘুরে বেড়ায়। তারা যদিও তাদের বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সদা সক্রিয় কিন্তু ভাবখানা দেখায় যেন ভ্রমণের জন্য কিংবা কোন বন্ধু-বান্ধবের সাথে সাক্ষাত করতে গিয়েছেলেন। অথবা হাওয়া বদলের জন্য এক শহর থেকে অন্য শহরে গিয়েছেলেন এসবই বাহ্যিকরূপ। তারা তাদের সরকারসমূহকে স্বার্থসিদ্ধির উপযোগী তথ্যাবলী ও রিপোর্ট পাঠানোর জন্য অত্যাধুনিক ঘটনা তথ্য সরবরাহ করে থাকে। সুতরাং সংশ্লিষ্ট সরকারসমূহ যখন আমাদের ব্যাপারে কোন পলিসি প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণ করে তখন তাদেরকে অন্ধকারে হাতড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। বরং তাদের কাছে থাকে সঠিক এবং বিস্তারিত তথ্যাবলীল সমন্বয়ে পূর্বপ্রস্তুতকৃত ফাইল। আমরা দেখি বিদেশী দূতাবাস কর্মীরা পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীর অফিসে প্রায়ই ঘোরাঘুরি করেন। সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও লেখকদের সাথে থাকে তাদের বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক এবং এভবে লাভবান হতে তারা সদা তৎপর থাকে। পক্ষান্তরে আমাদের দূতাবাস প্রতিনিধিরা আরাম আয়েশ ও ভোগ বিলাসে মত্ত থাকা ছাড়া আর কোন কাজই করে না।
সাংস্কৃতিক দল! উম্মতে মুসলিমার প্রতিনিধি
ইসলামই আমারেকে শান্তি ও নিরাপত্তার শিক্ষাদান করেছি। আমরা না কারো সীমালংঘন সহ্য করে থাকি, না কারো ওপর অত্যাচার করা বৈধ বলে মনে করি। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, আমরা অন্য দেশের প্রতিনিধিগণকে আমাদের এখানে ডেকে আনবো এবং নিজেদের প্রতিনিধিগণকে তাদের দেশে প্রেরণ করবো যারা আমাদের দৃষ্টিভংগী সেসব দেশের জনসাধারণের সম্মুখে উত্তমরূপে উপস্থাপন করবে। আমরা সাংস্কৃতিক দলের যে বিনিময় করে থাকি তাও আমাদের সুনাম সুখ্যাতির ওপর কলম্ক লেপন করে থাকে। নৃত্যর্গীতকারী ভাঁড়া এবং নৃত্য ও সংগীতে পারদর্শিনী গায়িকারা দেশের বাহিরে গিয়ে আমাদের যে ভাবমূর্তি তুলে ধরে তা কারো অজানা নয়। শিল্পকলার দিক থেকেও প্রায় সকল কন্ঠশিল্পীই অত্যন্ত ভাসা ভাসা প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। অনেক সময় তারা সংগীতগুলো মুখস্ত করে নেয় বটে কিন্তু তা উপস্থাপনায় অনেক সাহিত্য ও শিল্পগত ভুল করে ফেলে।
আমাদের দূতাবাস ও কুনস্যুলেটগুলোকে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে নতুনভাবে বিন্যাস করা আবশ্যক। উন্নত বিশ্ব আমাদের কাঁচামালের মুখাপেক্ষী আর আমরা তাদের শিল্প সামগ্রী। যদি আমরা পদযুগল ছড়িয়ে ঘুমানোর পরিবর্তে চিন্তা-গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেষণ করি তাহলে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক কিছু লাভ করতে পারি। আমরা নিজেদেরকে সুদ ভিত্তিক অর্থব্যবস্থার জটাজালে শৃংখলিত করে ফেলেছি এব এরই সূত্র ধরে বিশ্বশক্তি এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ খুব মজা করে আমাদের রক্ত শোষণ করছে। এসব এই মিথ্যা তাথাকথিত সাহায্যের নামে তারা আমাদেরকে তাদের গোলাম বানিয়ে রেখেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আমাদের নিকট সকল বিষয়েই এত বিপুল সংখ্যক অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ জনশক্তি রয়েছে যে, তাদের সাহায্যে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম নিজেরাই প্রস্তুত করতে ও চালাতে পারি। কিন্তু অবস্থা এই যে, আমাদের এসব কারখানার পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদেশীরা। এটা একটা মারাত্মক ভূল। আমাদের মুসলিম বিজ্ঞানীগণ পাশ্চাত্য দেশসমূহে গৌরবজনক কাজ সম্পাদন করছে। তাদের ওপর আস্থা রেখে ও কাজে লাগিয়ে নিজেদের দেশের ভাগ্য পরিবর্তন করার কার্যকরী উদ্যোগ কেন গ্রহণ করা যাবে না?
ইরাক-ইরান যুদ্ধ ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ ছাড়া কিছু নয়
বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে আমরা বর বার ভুল করে ছলেছি। ইরাক-ইরান যুদ্ধে আমাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত ভ্রান্ত। মুসলিম রাষ্ট্র হোক বা অমুসলিম রাষ্ট্র কোন দেশের সাথেই আমাদের অকারণে শত্রুতামূলক মনোভাবের পরিচয় দেয়া উচিত নয়। আমাদের যুদ্ধ ও সন্ধি কেবলমাত্র ইসলামী মূল্যবোধ, ন্যায়নীতি ও সত্যের ভিত্তিতে সম্পন্ন হওয়া আবশ্যক।
ইরানের বর্তমান সরকার মাঝে মধ্যে ইখওয়ানের ওপর এমনকি স্বয়ং আমর ব্যক্তিত্বের ওপর অন্যায়ভাবে আক্রমণ করেছে এবং এমন অভিযোগ করেছে যে, আমরা আমেরিকার এজেন্টে। আমরা যদি বাস্তবিকই আমেরিকার এজেন্ট হিসেবে কাজ করতাম তাহলে তাদের আক্রমণের জবাবে আমরাও তাদেরই সুরে সুরে মিলিয়ে কথা বলতাম। ইসলামের দুশমন শক্তিগুলো তাদের এজেন্টদের সাহায্যে মুসলিমদের মধ্যে বিরোধ ও কলহ সৃষ্টি করে থাকে। এই দাবানল প্রজ্জলিত করার ক্ষেত্রে আমাদের বিচক্ষণ শত্রুগণ ছাড়াও আমাদের অজ্ঞ বন্ধুদেরও যথেষ্ট ভূমিকা থাকে। ইখওয়ানের ওপর ইরানের এসব আক্রমণ মোকাবিলায় আমাদের জবাব নীরবতা। তাছাড়া ইরানের দায়িত্বশীলদের এসব আক্রমণ সত্ত্বেও আমরা এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে ইরানের বিরুদ্ধে কখনো মুখ খুলিনি। আমরা বুঝতে পারি যে, এই যুদ্ধে দ্বারা উভয় দেশই ইসলামের প্রভূত ক্ষতি করে চলেছে।
ইরাক ও ইরানের মধ্যে লড়াই যখন শুরু হয় তার ঠিক আগের দিনই আমি রাব্বুল আলামীনের সমীপে আরজ করেছিলাম, “হে আল্লাহ! আরব ও মুসলিম সরকারগুলোকে তুমি তাওফীক দাও তারা যেন এই সর্বগ্রাসী ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধকে বন্ধ করতে পারে।” এই লড়াই যুগপৎভাবে দু’মুসলিম রাষ্ট্রকে ধ্বংসের গভীর পম্কে নিমজ্জিত করেছে। অনর্থক নরহত্যা, অর্থনীতির ধ্বংস সাধন ইসলামের শত্রুদের জন্য নিশ্চিত উল্লাসের কারণ। আল্লাহ তায়ালার সমীপে আমি এই দোয়াই করছি। তিনি যেন মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটানোর তাওফীক দান করেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ব্যাপারে সাইয়েদ হোসনী মোবারকের নীতিতে আমিও আশাবাদী। কেননা তিনি মিসরীয় সংবাদপত্র ও সাময়িকীসমূহে কোন মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন কিছু লিখতে নিষেধ করে দিয়েছেন। এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তির জন্যও তাকেই সর্বশক্তি নিয়োগ করে চেষ্টা করতে হবে। এজন্য নিরপেক্ষ উদ্যোগ ও প্রয়াস যারপরনই অত্যাবশ্যক।
হোসনী মোবারক ও জাফর নিমেরীর সাক্ষাতকার
মিসর ও সুদানের রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে যেসব ব্যক্তিগত সাক্ষাত হচ্ছে সেগুলোর ব্যাপারে আমার মতামত হচ্ছে, তাতে দু্ই দেশের রাষ্ট্রপতি ছাড়াও প্রত্যেক দেশের পক্ষ থেকে ন্যূনপক্ষে একজন করে প্রতিনিধি শরীক হওয়া আবশ্যক। এসব সাক্ষাতের বিষয়বস্তু দুই রাষ্ট্রপ্রধানের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নয় বরং উভয় দেশের স্বার্থ সম্পর্কেও আলোচনা হয়ে থাকে। মানুষ মাত্রই যে কোন সময় ক্ষণস্থয়ী এ দুনিয়া থেকে প্রস্থান করতে পারে। আল্লাহ না করুন যদি এমন কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তাহলে আলোচনার টেবিলে স্থিরকৃত বিষয়াবলী সম্পর্কে দেশবাসীকে কে অবহিত করেব। ঘটনার প্রত্যেক্ষ সাক্ষী এবং জাতির দায়িত্বশীল কোন ব্যক্তিই এরূপ পরিস্থিতিতে ভুল বঝাবুঝির অবসান ঘাটাতে পারে।
আমি অবশ্য সরকারী প্রটোকল সম্বন্ধে সম্পূর্ণ না ওয়াকিফ। তাই হয়ত আমার এ দৃষ্টিভংগীর তেমন কোন গুরুত্ব নেই। তথাপি আমি আমার ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করলাম। কারণ অনেক সময় অনেক অনভিজ্ঞ ব্যক্তির কথাও বেশ উপকারী হয়ে থাকে।
মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহই নাগরিকদের মধ্যে দায়িত্বানুভুতি সুষ্টি করতে পারে।
আভ্যান্তরীণ রাজনীতির ব্যাপারে আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই। এটা আমার বিশ বছরের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সারনির্যাস। যে জাতিকে স্বধীনতার সুফল থেকে বঞ্চিত করা হয়। সংস্কারকদের প্রাণন্তকর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাদের থেকে কল্যাণকর কোন কিছুই প্রত্যাশা করা যায় না। এরূপ দাবী যে শান্তি ও নিরাপত্তার হিফাজত এবং সন্ত্রাসবাদীদের মূলোৎপাটন প্রয়োজন। এই যুক্তি-প্রমাণও উপস্থাপন করে যে, আযাদী ও স্বাধীনতাই মস্তব[ নিরাপত্তা বিশেষ। এমনকি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে বিকশিত করার জন্য প্রকৃত আযাদীর প্রয়োজন সর্বাপেক্ষা বেশী। কাগুজে নাগরিকতার দ্বারা কোন কল্যাণ লাভ ততদিন পর্যন্ত সম্ভব নয় যতদিন নাগরিকগণ দেশের স্বাধীনতার স্বাদ কার্যত গ্রহণ করতে পারে। যে দেশে নাগরিকদের অধিকারসমূহ নিরাপদ ও সুরক্ষিত নয় এবং তার কোন মতামত- যা হয়তো যথার্থ- কিন্তু তাতে সমকালীন শাসক সন্তুষ্ট নয় বরং এর ফলে যদি তার জান-মালের ওপর হস্তক্ষেপ করা হয় তাহলে এমন নাগরিকত্ব অনর্থক। আর এমন দেশ মাতৃভূমি আখ্যায়িত হওয়ার যোগ্য নয়। অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের সমস্যাবলী এবং অন্যান্য সমস্যার সমাধান একটাই, আর তা হচ্ছে এই যে, নাগরিকদেরকে তাদের মৌলিক অধিকার প্রদান করা। মৌলিক অধিকারসমূপ লাভ করার পর নাগরিকগণ নিজেদেরকে সরকারের কার্যাবলীতে অংশীদার বলে মনে করে। এখান থেকেই দেশ প্রেমের অনুভূতি বিকশিত হতে শুরু করে এবং প্রত্যেক ব্যক্তিই দেশের নিরাপত্তাও দেশবাসীর স্বার্থের অনুভূতিতে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। বাকী থেকে যায় সেই সব জনগণ যাদেরকে ভেঁড়া বকরীর মত শাসকরা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় তাদের মধ্যে উন্নত চরিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং মহৎ উদ্দেশ্য অর্জনের অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে না।
সাতাশতম অধ্যায়
মাঝে মধ্যে সেই প্রাচীন কিস্সা কাহিনীর সান্নিধ্য লাভ
আমি ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বার বার সফর করেছি। উদ্দেশ্য নিজের দুর্বল শরীরের বিভিন্ন চিকিৎসা করা। যখনই আমি চিকিৎসা ব্যাপদেশে কোন দেশে যাই তখন ইউরোপ ও আমেরিকার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ইখওয়ানরা আমার চারপাশে এসে সমবেত হয়। দলে দলে তাদের আগমন আমার নিরাপদে সেখানে গিয়ে পৌঁছার আনন্দে কিংবা শীঘ্রই আমার আরোগ্য লাভের প্রত্যাশার কারণে হতো না। বরং তারা তাদের সেই দ্বীনি ভাইকে এক নজর দেখার জন্য আগমন করতো যিনি মুর্শিদে আ’ম হাসানুল বান্না শহীদের সাথে তাঁর জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ অতিবাহিত করেছেন। তারা তাদের সেই দ্বীনি ভাইকে দেখ, তার কথাবার্তা শুনে এবং তাঁর মজলিশে বসে নিজেরা নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করে। কারণ তাদের এই দ্বীনি ভাই শহীদ ইমামের সাথে দাওয়াতী কাজে অংশগ্রহণ করেছে। তাঁর প্রশিক্ষণ লাভে ধন্য হয়েছে এবং তার কাজকর্ম ও আচার আচরণকে নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করার মর্যদা লাভ করেছে। যে সংস্কারকের দাওয়াতী কর্যক্রম এই যুবক শ্রেণীর জীবন বিপ্লব সাধন করেছে। তাদের আকংখা ও ঐকান্তিক কামনা হলো, হায়! যদি এই মাহপ্রাণ ব্যক্তিকে তার জীবদ্দশায় স্বচক্ষে তারা একবার দেখতে পেতো। এখন যেহেতু ইমাম শহীদকে দেখাতে আর সম্ভব নয়, অতএব তাঁর সংগীদেরকে দেখেই এসব যুবক সন্তুষ্ট হয়ে যায়। বর্তমান যুগে ইসলামী রেনেসাঁর যে তরঙ্গ পরিদৃষ্ট হচ্ছে তাতে ইমামের খুব বড় পরিচিত করেছেন। আমার এই যুবক ভাইয়েরা ইমাম শহীদের দাওয়াতকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। তারপরও তারা সেই ব্যক্তির মুখ থেকে কিছু শুনতে চান যিনি তাদের সম্মুখে নিকট অতীত ও সুদূর অতীতের ঘটনাবলীর চিত্র অংকন করতে পারেন। এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে এর শত্রুরা মিথ্যা ও বাতিলের যত ষড়যন্ত্র রচনা করেছে তার সবকিছুই এই সাক্ষাতের সময় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়।
হিজাযের পথের ধুলাবালির আকাংখা
এ দ্বীনের দুশমনদের সংখ্যা অনেক এবং সর্বত্রই তারা ছড়িয়ে আছে। কিন্তু যেভাবে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের বিরুদ্ধে দ্বীনের দুশমনরা সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়ে থাকে এরূপ অন্য কোন ইসলামী সংগঠনের বিরোধীতা করতে সাধারণত তাদের দেখা যায় না। এখন প্রশ্ন হলো ইখওয়ানের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালানোর ব্যাপারে ইসলামের শত্রুরা এত বেশী তৎপর কেন? ইখওয়ান কি কোন নতুন দ্বীন নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল? ইখওয়ান কি কিতাব ও সুন্নাহ ব্যতীত অন্য কোন জিনিসের আনুগত্য ও অনুসরণ করছিলো? তারা কি জুলুম ও সন্ত্রাসের পথ অবলম্বন করেছিলো? কখনো নয়। ইখওয়ান এসব জিনিস থেকে বহু দূরে এবং এখনও রয়েছে। আমাদের দেশপ্রেম এবং দ্বীনের সাথে সম্পর্কের স্বরূপ আমদের রবই ভাল জানেন। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় সুদৃশ্য এলাকা এবং চিত্তাকর্ষক দৃশ্য রয়েছে কিন্তু আমার দৃষ্টিতে তা প্রিয় জন্মভূমির ধূলিকণার সমতুল্যও নয়। অনুরূপভাবে দুনিয়ার কোন জিনিসই মকবুল হজ্জের রাস্তার তুলনায় আমার নিকট প্রিয় নয়।
যাবের রুটি ও আলী হয়দারের বাহু
হাসানুল বান্না শহীদ মজলুমদের আর্তচিৎকারে সাড়া দেয়ার ব্যাপারে ছিলেন সর্বাপেক্ষা নির্ভীক ব্যক্তিত্ব। তিনি কোন বড় বিপদকেও তোয়াক্কা করতেন না। বরিপুরুষ মাত্রই সকল মুসিবতক্লিষ্ট লোকের সাহায্যার্থে জালিমের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। মজলুম তার পরিচিত হোক বা না হোক তাতে কিছু এসে যায় না। পক্ষান্তরে ভীরু ও কাপুরুষ ব্যক্তি তার জাতির প্রতিরক্ষা এবং আপনজনদের সহযোগিতায় এগিয়ে যাওয়া থেকেও পালিয়ে বেড়ায়।
মিসরে এমন একটা সময়ও এসেছিলো যে, রাতের বেলা রাস্তা ঘাটে ডাকাতি হতে লাগলো। পেশাগত অপরাধীরা সড়কের ওপর বিপদগ্রস্ত হওয়ার ভান করে দাঁড়িয়ে যেতো এবং গাড়ী থামানোর জন্য ইশারা করতো। যেই মাত্র কোন গাড়ী থামতো সংগে সংগে তারা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো এবং আরোহীদের মালপত্র ও কাপড় চোপড় লুট করে নিয়ে যেতো। সে আমলেরই কথা, ইমাম হাসানুল বান্না কোন সফর থেকে মধ্যরাতে কায়রো ফিরে আসছিলেন। রাস্তার মধ্যে একস্থানে তিনি সড়কের পার্শ্বে একটা প্রাইভেট কার দাঁড়ানো দেখতে পেলেন। যার পাশে এক ব্যক্তি সড়কের ঠিক কিনারে দাঁড়িয়ে তাঁর গাড়ি থামানোর ইংগিত দিচ্ছে। ডাকাতির খবরাখবর ইতিমধ্যে প্রত্যহ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিলো। তথাপি ইমাম গাড়ীর চালক ভাইকে গাড়ী থামানোর নির্দেশ দিলেন। তিনি একাকী গাড়ী থেকে বের হলেন এবং সেই ব্যক্তির জাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞস করলেন যে, তার কি প্রয়োজন! সে জানালো যে, তার গাড়ীর পেট্রোল ফরিয়ে গেছে তাই সে নিকটবর্তী পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত যাওয়ার মত পেট্রোল দেয়ার অনুরোধ করছে। তৎকালে বর্তমান সময়ের ন্যায় গাড়ীতে হর্ণ থাকতো না। বরং একটা ধাতু নির্মিত নল থাকতো যার এক প্রান্তে লাগানো থাকতো রবারের বেলুন। হর্ণ দেয়ার জন্য ড্রাইভার সে রাবারের বেলুনের ওপর চাপ দিতো তখন বাতাস হর্ণের মধ্যে আওয়াজ সৃষ্টি করতো। ইমাম সাথে সাথে তার গাড়ীর হর্ণ খুলে নিলেন। কয়েকবার তাতে পেট্রোল ভর্তি করে উক্ত অজ্ঞাত পরিচয় মুসাফিরের গাড়ীর টেম্কিতে ঢেলে দিলেন। অথচ ইমাম সে ব্যক্তির নিকট তার নামটি পর্যন্ত জানতে চাইলেন না। কিংবা তার মর্যাদা ও ধর্ম সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করার প্রয়োজন বোধ করলেন না .................... সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের কাজই এই যে, তারা মহৎকার্যাবলী সম্পাদন করেও নীতির ওপর অটল থাকেন। এ আচরণে সেই অচেনা ব্যক্তি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ে। সে নিজেই ইমাম শহীদকে জানালো “আমার নাম মুহাম্মাদ আবদুর রাসূল? আমি কায়রো আদালাতের আকজন জজ। আপনার পরিচয়? “ইমাম শহীদ তার স্বভাবসুলভ বিনয়ী ভংগীতে আরজ করলেন, “আমার নাম হাসানুল বান্না, আমি সাবতিয়া প্রাইমারী স্কুলের একজন শিক্ষক।” জজ সাহেব অনুসন্ধানী ভংগীতে জিজ্ঞেস করলেন, “হাসানুল বান্না! ইখওয়ানুল মুসলিমুনের মর্শিদে আ’ম !!” ইমাম শহীদ জানালেন, “জি-হা।” সেদিন থেকে দিয়ে মুহাম্মাদ আবদুর রাসূল মরহুম আদালত এলাকার মহল্লায় ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সব চেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক ও হিতাকাংখী হয়ে যান। শাবিনুল কানাতির আদালতের জজ থাকাকালে মরহুম জজ সাহেব নিজে এ ঘটনা তার এক বন্ধুকে শুনিয়েছিলেন।
এই ছিলেন সেই হাসানুল বান্না যাকে বিপজ্জনক, সন্ত্রাসী এবং সকল অনিষ্টের মূল নায়ক বলে অবিহিত করা হয়ে থাকে। সারা বিশ্বের মুসলিম সরকারগুলো তার নাম নিশানা মুছে ফেলতে চেষ্টারত। এই মহাপ্রাণ ব্যক্তির মহৎচরিত্র ও অক্ষায় কীর্তিকলাপের ওপর পর্দা টেনে দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছো। কিন্তু সূর্যর উজ্জ্বল দীপ্তির সামনে দীপ শিখার মর্যাদা কি হতে পারে?
আযাদ অফিসার –এর বিশ্বাসঘাতকা
আযাদ অফিসারের জন্য যদি কোন ব্যক্তির স্মৃতিচারণ করার বৈধতা থাকে তাহলে মিসরের ইতিহাসে সে রকম এক ব্যক্তি আছেন অর্থাৎ ইখওয়ানুল মুসলিমুনের মুর্শিদে আ’ম হাসানুল বান্না। এ ব্যক্তিই তাদের জন্য পথপ্রদর্শন ছিলেন। তাদের প্রোগ্রামকে কার্যতরী করার জন্য তার সাহায্য- সহযোগীতা এবং তাদের আন্দোলনেকে সর্বসাধারণের নিকট গ্রহণযোগ্য করার জন্য জনগণকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেন তিনিই। যদি হাসানুল বান্নার আন্তরিক প্রচেষ্টা না থাকতো তাহলে আযাদ অফিসার কিছুতেই তাদের উদ্দেশ্য লাভে সফল্য হতো না। যাদিও ইমাম শহীদের শাহাদাতের তিন বছর পর এই আন্দোলন সাফল্যমন্ডিত হয় তথাপি আযাদ অফিসার ইমাম শহীদ ও তাঁর সহকারী মেজর মাহমুদ লাবীব মরহুম –এর সাথে তাদের সাক্ষাতের কথা কি ভুলে গেছেন? আযাদ অফিসার কি একথাও ভুলে গেছেন যে, তারা যে ফার্মে গোপন অনুশীলন করতেন তা ছিল ইখওয়ানের একজন রুকনের। আলহামদু লিল্লাহ! ইখওয়ানের সে রুকন আজও বেঁচে আছেন এবং পার্লামেন্টের সদস্যও। তিনি ইচ্ছা করলে অনেক কিছুই করতে পারেন। কিন্তু ইখওয়ানুল মুসলিমুনের স্বভাব এমন নয় যে, আল্লাহর পথে তারা যা কিছু নজরানা পেশ করেছেন। তজ্জন্য কাউকে ঋণী করবেন। তাদের চরম ও পরম উদ্দেশ্য শুধু আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন্ আযাদ অফিসারগণ কি জেনারেল সালাহ শাদী, জনাব ফরিদ আবদল খালেক, জনাব সালেহ আবু রাকীক এবং জনাব হাসান আল আসমাভী মরহুমের সাথে তাদের সাক্ষাত ও ইখওয়ানের পক্ষ থেকে তাদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা এবং পরিপূর্ণ ঐক্য ও সংহতির কথা বেমালুম ভুলে গেছেন?
আমি আযাদ অফিসারগণকে আর কি স্বরণ করাবো? তাদের কি সেই সব সম্মেলন- সমাবেশের কথা মনে নেই, যা মহামান্য শাইখ মাহাম্মাদ হাসান আল আউনের বাড়ীতে অনুষ্ঠিত হতো? ঐসব সমাবেশে আযাদ অফিসারগণ ফাদিলাতুস শাইখ মাহাম্মাদ হাসানের সাথে সালাত আদায় করতেন এবং নামাযের পর তারা নিয়মিত শপথও করতেন যে তারা সফলতা লাভ করলে শরীয়াতে ইলাহিয়া পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করবেন। ইখওয়ানের সাথে যে কথার উপর তাদের ঐকমত্য হয়েছিলো। যদি নিষ্ঠাত সাথে তা বাস্তবায়িত করা হতো তাহলে কেবল মিসরেই নয় বরং পুরো অঞ্চলের অবস্থাই ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করতো। আজ অত্র এলাকয় যে অশান্তি, দুর্বলতা এবং নৈরাশ্য ও নৈরাজ্য বিরাজ করছে তদস্থনে শক্তি ও বীরত্ব, শৌর্যবীর্য, শান্তি ও নিরাপত্তা এবং সচ্ছলতা ও স্বাবলম্বিতার জোয়ার আসতো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাই ঘটে যা আল্লাহ তায়ালা চান।
তাকওয়াই সর্বোত্তম পথের সম্বল
হাসানুল বান্না শহীদ একটা ভ্রাম্যমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বরং ইউনিভারসিটির সম মর্যাদার অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি অধিকাংশ সময়ই সফরে ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু সফল সরঞ্জাম থাকতো খুবই সংক্ষিপ্ত। একদিকে আমি দেখি এমন সবলোকদেরকে যারা কখনো সফরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে তাদের সম্মুখে পশ্চাতে মোটর সাইকল শোভাযাত্রা এবং নিরাপত্তা কারসমূহের সারি লেগে যায়। গরীব জাতির পয়সা অত্যন্ত নির্দয়ভাবে অপব্যয় করা হয়ে থাকে। অথচ তাতে লাভ কিছুই হয় না। এসব রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তিরা কেউ যখন দৃশ্যপট থেকে সরে যান তখন তার আকাশ। ছোয়া মূর্তি তৎক্ষণাৎ ভুতলে লুটিয়ে পড়ে। না কেউ তার আলোচনা করে, না করো অন্তরে থাকে তার প্রতি অবশিষ্ট এতটুকু সম্মানবোধ। পক্ষান্তরে ইমাম শহীদকে দেখুন, তিনি ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে হাতের থাকে মামুলি ধরনের একটা ব্যাগ। তাতে থাকে কয়েকটা জরুরী জিনিসপত্র যেমন একটা আয়না একটা চিরুনী এবং রাত্রিযাপনের পোশাক। এতদসত্ত্বেও আজ হাসানুল বান্না মানুষের মনের মণি কোঠায় চির জাগরুক আর তার প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনই তার যোগ্য উত্তরাধিকারী।
আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ব
হাসানুল বান্না এখন কারো প্রশংসার অনেক উর্ধে। কেননা তিনি মহত ও নেক জীবন অতিবাহিত করে তাঁর রবের সমীপে পৌঁছে গেছেন। যেখানে মহান আল্লাহ তাঁকে তার কার্যকলাপের উত্তম বিনিময় দিয়ে থাকেন। এ মহাপ্রাণ ব্যক্তির জীবনেতিহাস আলোচনার দ্বারা নিশ্চয়ই সেইসব লোকের উপকার হবে যারা সত্যের পথে চলে নিজের আখেরাত গড়ে নিতে চায়। বর্তমানে পয়গামে মুহাম্মাদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার কোণে কোণে তার দীপ্তি ছড়িয়ে চলেছে্। এতে হাসানুল বান্নার ভূমিকা ভুলে যাওয়ার মত নয়। অতএব হকের অনুসন্ধানীদের জন্য এ ব্যক্তির পরিচিত লাভ করা সংকল্পের বলিষ্ঠতা সৃষ্টি ও মনোবল বৃদ্ধির সহায়ক হবে। তিনি তাঁর মহত চরিত্র এবং কর্মের নিষ্ঠা দ্বারা আলোক স্তম্ভ নির্মাণ করে দিয়েছেন।
ইমাম শহীদ কোন বিশেষ বেশভুষা ও পোশাক পরিচ্ছদেও অভ্যস্ত ছিলেন না। কখনো কখনো তিনি আবা পরিধান করতেন আর মাথায় পরতেন পাগড়ি। অধিকাংশ সময় তাঁকে ও তুর্কী টুপি পরিহিত অবস্থায় দেখা যেতো। তিনি ও ব্যাপারে বিশেষ কোন আড়ম্বরের পক্ষপাতি ছিলেন না। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় যাদূকরী ব্যক্তিত্ব দান করেছিলেন। তিনি যে কোন ধরনের পোশাকই পরিধান করতেন তাতেই তাঁকে বেশ মানাতো। তিনি ছিলেন পোশাকের সৌন্দর্য বর্ধক।
উন্নত নৈতিক চরিত্রের নমুনা ও বীরত্বের উদাহরণ
এই মর্দে মু’মিন আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে ভয় করতেন না। অথচ তাঁর ভাল করেই জানা ছিল যে, জন্য চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছে। তথাপি তিনি অতসব বিপদাপদের কোন তোয়াক্কা না করেই দাওয়াতে হকের কাজ জারী রাখেন। তিনি জানতেন তার বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তৎপর নয় বরং সরকারের পুরো মেশিনারী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, মৃত্যুর জন্য একটি সময় নির্ধারিত আছে যা এক মুহূর্ত আগে বা পরে হতে পারে না। আমি এসব ঘটনাবলী হাসানুল বান্নার ব্যক্তিগত সাহসিকতা বর্ণনা করার জন্য আরজ করছি না। কারণ তার শৌর্যবীর্য ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে যা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ বর্ণনার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীগণ ও থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে এবং উপলব্ধি করবে যে, এ পথ বিপদসংকুল পথ। মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে এ পথে নামতে হয়। এ মহত উদ্দেশ্য হাসিল করতে হলে নিজের প্রিয়তম সম্পদ কুরবানী করে মানুষকে বুঝতে হবে যে, আমি ঠকবার মত সওদা খরিদ করিনি।
হাসানুল বান্না (র) চা বা কফি কোনটাতেই অভ্যস্ত ছিলেন না। কিন্তু কোন ইখওয়ানী কিংবা অইখওয়ানীর সাথে সাক্ষাত করতে গেলে যা কিছু পেশ করা হতো তাই আগ্রহ ভরে খেতেন। পানাহারের ক্ষেত্রে তাঁর কর্মনীতি ছিল সুন্নাতে নববী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সার্থক রূপায়ন। যে কোন জিনিসই পেশ করা হতো তিনি সর্বদা তার প্রশংসা করতেন এবং কখনো কোন খাদ্যের দোষ ধরতেন না। মেজবান ও তার পরিবার পরিজনের জন্য কল্যাণের দোয়া করতেন। সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসার পর বারী তায়ালার প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। তিনি এমন মনোযোগ দিয়ে তা শ্রবণ করতেন যেন কোন বড় বক্তার বক্তৃতা শুনছেন। আল্লাহ তায়ালা এ মহাপ্রাণ ব্যক্তিকে বহু গুণে গুণান্বিত করেছিলেন। এমন ব্যক্তি কি প্রতিদিন কোথাও জন্মগ্রহণ করে?
কালের অবদান যুগ স্রষ্টা
হাসানুল বান্না যেভাবে তার সংগঠনকে বিন্যস্ত করেন- বিভিন্ন বিভাগে তা বিভক্ত করেন প্রত্যেক বিভগের জন্য নীতি-পদ্ধতি ও বিধি-বিধান এবং প্রত্যেক ময়দানের জন্য যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মী নির্বাচন করেন। এগুলো এবং অনুরূপ অন্যান্য কার্যক্রম দেখে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি কত উন্নত চিন্তাধারার অধিকারী মহাপ্রাণ নেতা এবং যোগ্যতম সংগঠন ছিলেন। সম্পূর্ণ প্রাথমিক যুগেই তিনি ছাত্র সংগঠন লেবার ইউনিয়ন, চাষী সংগঠন, শিক্ষাক ও অন্যান্য পেশাজীবি সংগঠন, মুক্তপেশা ব্যক্তিগণের বিভাগ, দাওয়াত সম্প্রসারণের বিশেষ অধিদপ্তর এবং ইসলামী জাহান ও সমগ্র দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিদেশ বিষয়ক দফতর স্থাপন করেছিলেন। এই কর্ম বন্টন দেখে আপনি সহজেই সে প্রতিভার অনুমান করতে পারবেন যা এসব বিভাগ ও দফতর সংস্থাপনের পশ্চাতে সক্রিয় ছিল। সরকারী কর্মকর্তাগণ আজ পর্যন্তও এ কালের অবদান এবং যুগ স্রষ্টা ইসলামী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতার ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার জন্য সদা সচেষ্ট রয়েছেন। এ ব্যক্তিত্ব কেবলামত্র মিসরের সীমানায়ই মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। বরং সমকালীন ইতিহাসে সমগ্র বিশ্বের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের মোকাবিলায় আপন দীপ্তিতে ছিলেন ভাস্বর। সরকারী কর্মকর্তাগণ এরূপ জঘন্য চেষ্টায় কোন নিয়োজিত রয়েছেন তার জবাব হয়তো আমি দিতে সক্ষম কিন্তু দেশের প্রচলিত আইন পথে অন্তরায় হয়ে আছে। যা হোক একদিন সমস্ত গোপন রহস্য আপনা থেকেই উদঘাটিত হবে এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায় পরায়ণের আদালত থেকে ফায়সালা ঘোষণা করে দেয়া হবে।
সমস্যাবলীর সমাধান করার উত্তম যোগ্যতা
সমস্যা সামাধানের বিশেষ যোগ্যতা আল্লাহ তায়ালা ইমাম শহীদকে প্রদান করেছিলেন। একবার পরিস্থিতি এক ভাইকে কায়রো থেকে কোন এক ছোট শহরে বদলি হয়ে যেতে বাধ্য করে। এ ভাই সেখানে গিয়ে পৌছার পর স্থানীয় সংগঠনের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। স্থানীয় আমীল উপলব্ধি করেন যে, নবাগত ভাই ইলম, তাকওয়া এবং যোগ্যতার দিক থেকে তাদের চেয়ে অনেক অগ্রসর। তাঁরা সে ভাইয়ের নিকট প্রস্তাব করেন যেন তিনি ইমারতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন কিন্তু তিনি তা অস্বীকার করেন। উভয়ে বার বার মত বিনিময় করেন কিন্তু নবাগত ভাই দায়িত্ব গ্রহণ করতে সর্বদা অপারগতাই প্রকাশ করতে থাকেন। ইত্যবসরে ঘটনাক্রমে ইমাম শহীদ ঐ শহরে পর্যবেক্ষণে গমন করেন। সমাবেশ চলা কালে স্থানীয় আমীর ইমামকে বললেন, “আপনি ইরশাদ করেছিলেন যে, যদি অপেক্ষাকৃত উপযুক্ত ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোক পাওয়া যায় তাহলে এ শহরের ইসারতের দায়িত্ব তার ওপর অর্পণ করা হবে। এখন এ ভাই সৌভাগ্যবশত এখানে শুভগমন করেছেন। তিনি আমার চেয়েও অধিকতর যোগ্য ও জ্ঞানী। আপনি তাকে নির্দেশ করুন যেন তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন।” তিনি সে ভাইয়ের দিকে তাকালেন এবং উপলব্ধি করলেন যে, তিনি এ দায়িত্বের বোঝা বহন করার জন্য আদৌ প্রস্তুত নয়। অতএব তিনি স্থানীয় আমীরকে মম্বোধন করে বললেনঃ “আপনি এখানকার আমীর। আপনি যদি কোন ভুল করে বসেন তা হলে কে আপনাকে সংশোধন করবে?” আমীর সাহেব সেই নবাগত ভাইয়েল নাম বললেন। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, “যদি তিনি আমীর হয়ে যান এবং ভুল করে ফেলেন তবে তার পরিশুদ্ধি করবে কে? একথা স্থানীয় আমীর নিশ্চুপ হয়ে গেলেন এবং ইমারতের দায়িত্ব পালন করার জন্য ইস্পাত কঠিন শপথ গ্রহণ করলেন।
এ ঘটনা অত্যন্ত মামলি ধরনের। তথাপি তা বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সংগঠনের কর্মীরা কত সুন্দরভাবে মতানৈক্যকে দূর করে, যদি তা কোন মূলনীতির পরিপন্থী না হয়। ইমাম শহীদের প্রশিক্ষণের প্রভাব হয়েছে এই যে, সাধঘারণত ইখওয়ানের হয় এবং মতবিরোধের সামাধান সহজেই করা যায়। যদি মতানৈক্য দীর্ঘায়িত হয় এবং ঐক্যের কোন উপায় খুঁজে না পাওয়া যায় তাহলে যে ভাই সন্তুষ্ট হতে পারতেন না তিনি কোন বাক বিতন্ডা না করে নীরবে সংগঠন থেকে আলাদা হয়ে যান।
ঈমান প্রবৃদ্ধিকর ঘটনাবলী
একবার একজন ইখওয়ানী ভাই তার নাম ফিলিস্তিন জিহাদের স্বেচ্ছাসেবকদের দফতরে লিপিবদ্ধ করান এবং সম্মুখ সমরে যোগদান করেন। তার পিতা ইখওয়ানী ছিলেন না। তিনি এ ঘটনায় বড়ই ক্রুব্ধ হন। তিনি ধারণা করেছিলেন যে, মুর্শিদে আ’ম-এর অনুপ্রেরণা ও উৎসাহে তার ছেলে জিহাদ অংশগ্রহণ করার জন্য চলে গিয়েছে। তিনি তার সাথে দেখা করার জন্য কেন্দ্রীয় অফিসে আগমন করেন। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি সহা্প্রাণ ব্যক্তি মুর্শিদে আ’মকে মন্দ কথা বললেন। ইমাম উপলব্ধি কররেন যে, লোকটির মধ্যে অতিমাত্রায় সন্তান বাৎসল্য রয়েছে এবং তিনি তার সন্তানকে ডেকে পাঠাতে চাচ্ছেন। তাঁর অন্তর বিগলিত হয়ে যায় এবং তিনি অত্যন্ত কোমল স্বরে আরজ করেলেন, “আমি আপনার আবেগ অনুভূতির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করছি। আপনার ছেলেকে ফিলিস্তিন থেকে ডেকে আপনার খেদমতে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।” বর্ণিত ব্যক্তি একথা শুনে প্রশান্ত হয়ে যায়। তার দৃষ্টিশক্তি ছিল কিছুটা ক্ষীণ। কামরায় প্রবেশ করার সময় লোকজন দরজায় জুতা খুলে রেখে আসতো। এ বুজুর্গ যখন ফেরত যেতে উদ্যত হলো তখন ইমাম সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তার পাদুকা তুলে নিয়ে তার পায়ে লগিয়ে দেন। মেহমানের এমন প্রত্যাশা মোটেও ছিল না যে, তার এত কঠোর ও নির্মম কথাবার্তার পরও মুর্শিদে আ’ম তার সাথে এরূপ মহত আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। উক্ত ব্যক্তি নিজেই প্রকাশ করেছেন যে, মুর্শিদে আ’ম এর এমন উত্তম ব্যবহারই আমার ওপর যেন ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে। সাথে সাথে আমার মনের সকল ক্ষোভ নিমিষেই বিদূরিত হয়ে যায়। কাফেলার প্রধান। এমনি ছিলেন সৃজনশীল প্রতিবার অধিকারী যার চিত্তাকর্ষক ও মনোহরী কথাবার্তা এবং অকৃত্রিম ভালবাসার প্রভাব সর্বস্তরের মানুষ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছুটে আসতো।
এ ঘটনাও খুবই সাধারণ প্রকৃতির। তারপরও আমি এত গুরুত্ব সহকারে এটি এজন্য বর্ণনা করলাম যেন মানুষ জনতে পারে ক্রোধান্বিত ব্যক্তিদেরকে কিভাবে ধৈর্য ও মিষ্টি-মধুর কথা দ্বারা বশীভূত করা যায়। উত্তম আচরণ এমন এক মহৎগুণ যার সাহায্যে মানুষের অন্তর জয় করা সম্ভব। আমাদের শাসকগণ যদি ইসলামী চরিত্র রপ্ত করে নিতে পারে এবং প্রজাসাধারণের মধ্যে থেকে কেউ তাদেরকে কোন প্রকার প্রশ্ন করে, তাদের নিগৃহিত করার পরিবর্তে সহানুভূতি ও সহমর্মিতার সাথে তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্ষোভের দেয়াল ধসে পড়বে এবং পারস্পরিক ভালবাসার দিগন্ত বিস্তার লাভ করতে থাকবে।
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াতের প্রতি যুবকরা অত্যন্ত উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এ দাওয়াত যুবসমাজের সম্মুখে কোন বস্তুগত সুযোগ সুবিধা পেশ করেনি যা তাদেরকে সবুজ শ্যামল বাগান দেখতে পারে। এরূপ গণসমর্থন ও স্বীকৃতির কারণ যুব মানসের এ আস্থা যে, ইখওয়ান উম্মতে মুসলিমার জন্য সম্মানের অভিলাষী, তারা সকল সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের চির অবসান কামনা করে। তাদের দাওয়াতের দাবী হচ্ছে, মুসলিম উম্মাহ সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সকল প্রকার গোলমীর গোলক ধাঁধাঁ থেকে মুক্তিলাভ করুক। ইমাম শহীদ তাঁর কর্মীদের এ শিক্ষই দিতেন যে,“নিশ্চিতই আল্লাহ তায়ালা এমন কারো কর্মফল বিনষ্ট করেন না যারা উত্তম আমলকারী।” বিরুদ্ধবাদীদের জন্যও তার জবাব ছিল কুরআন মজীদ থেকেই গৃহীত “নিশ্চিয়িই মহান আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের কর্মনীতি সংশোধন করেন না।”
এভাবে ইমাম শহীদ আমাদের মনের মণিকোঠায় এ মূলনীতি বদ্ধমূল করে দেন। আমাদেরকে এ পথে ধৈর্য, দৃঢ়তা, আনুগাত্য, সন্তুষ্টি এবং আত্মতৃপ্তির যে শিক্ষা তিনি প্রদান করেন তাই আমাদের শ্রেষ্ঠতম পুজি। কবি বলেছেনঃ (*************)
আমার জীবনের উদ্দেশ্য তোমার দ্বীনের উৎকর্ষতা সাধন আমি এ জন্যই মুসলিম আর এ কারণেই নামযী।
কার কাছে এ দাওয়াতের মোকাবিলায় কোন জিনিসেরই কোন মর্যাদা ও মূল্য ছিল না। এ জন্যে নিসন্দেহে সবকিছু কুরবান করে দেয়াই ছিল তার জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য। নাকরাশী পাশা নিহত হওয়ার পর চরম সংকট সৃষ্টি হলে তিনি হিযবুস সাদীর মন্ত্রীসভার সাথে সাক্ষাত করার চেষ্টা করেন যাতে সান্নিধ্য থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে চাইতেন। তিনি কোন মন্ত্রীর দফতরে কয়কবার যেতেন। মন্ত্রী সাহেবের পিএ তাঁকে ঘন্টা দেড়েক বসিয়ে রাখার পর অপারগতা প্রকাশ করে বলতো যে, মন্ত্রী সাহেব জরুরী কাজে বাইরে চলে গেছেন। কিন্তু সেজন্য তিনি কখনো কোন বিরক্তি ও ক্ষোভ প্রকাশ করতেন না। তিনি ছিলেন সম্ব্রান্ত মেজাজের অধিকারী। তিনি খুব ভাল করেই অন্যদের সম্মান করেত জানতেন। কোন পরিস্থিতিতে তিনি তার মেজাজের ভারসাম্য হারাতেন না্ কয়েকবার তিনি এসব মন্ত্রীদের সাথে দেখা করতে গিয়েছেন কিন্তু তারা তাঁকে এড়িয়ে যেতে থাকে। এমনকি শেষ পর্যন্ত তাঁকে শহীদ করা হয়।
ইমাম হাসানুল বান্নার অসংখ্য গুণাবলীর মধ্যে একটা দুর্লভ গুণ এই ছিল যে, তিনি মানুষের পছন্দ-অপছন্দ, মেজাজ ও রুচিশীলতা এবং আবেগ ও আগ্রহের প্রতি পুরোপুরি লক্ষ্য রাকতেন। সাধারণ লোকেরা এসব দিকে খুব বেশী গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু ইমামের ভাল করেই জানা ছিল যে, দায়ী ইলাল্লাহর জন্য লোকদেরকে দাওয়াতের প্রতি আকৃষ্ট করার ব্যাপারে ব্যক্তিগত মনযোগের গুরুত্ব অনেক বেশী। এই মনযোগ ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয় যতক্ষণ না আপনি ব্যক্তির রুচি অভিরুচির ব্যাপারে সম্যক জ্ঞাত না হতে পারবেন।
উস্তাদ ওমর বাহাউদ্দীন আল আমিরী দাওয়াতে হকের বিখ্যাত মুজাহিদগণের অন্যতম। এ পথে তাঁর কৃতিত্ব ও অনুপম ত্যাগ এবং কুরবানী সবার জন্য অনুপ্রেরণারে উৎস হয়ে থাকবে। ইমাম শহীদের জীবদ্দশায় উস্তদ ওমর আল আমিরীর সাথে তাঁর অত্যন্ত বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক ছিল। ওমর আল আমিরীর ওয়ালিদ মুহাতারাম ছিলেন বড়ই কৌতুক প্রিয় এবং পরিচ্ছন্ন স্বভাবের অধিকারী সম্মানী ব্যক্তিত্ব। দামী পুস্পসজ্জিত ফুলদানীর অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন তিনি। এক সময় এ মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্ব কায়রো গমন করেন এবং একাধারে কয়েকদিন পর্যন্ত এখানে অবস্থান করেন। যেদিন তিনি তার বাড়ীতে ফিরে যাওয়ার জন্য ট্রেনে আরোহণ করেন সেদিন তাঁর পুত্র জনাব ওমর আল আমিরীও রেলষ্টেশনে বিদায় জানাতে যান। গাড়ী রওয়ানা হতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকী। ওমরও গাড়ীর বগীতে উপবিষ্ট ছিলন। ইত্যবসরে তিনি প্লাট ফরমের ওপর মুর্শিদে আ’মকে দেখতে পেলেন যে, তিনি দ্রুত গতিতে কামরার দিকে ছুটে আসছেন। জানালার পাশে এসে তিনি খুব সুদৃশ্য অত্যন্ত সুঘ্রাণ যুক্ত এবং তরতাজা ফুলের অনেক বড় ফুলদানী শুভেচ্ছান্তে বড় মিয়ার খেদমতে পেশ করেন। পিতা পুত্রের ওপর এ তোহফার যে প্রভাব পড়ে তার ফল হয়েছিল এই যে, এ উত্তম আচরণের কথা পুরো পরিবার সর্বদা স্বরণ করতেন। তিনি সবসময় একথা আলোচনা করতেন যে, মুর্শিদে আ’ম তাঁর রকমারী দায়িত্ব কর্তব্য পালনের সাথে সাথে সংগীদের অতি সাধারণ অভ্যাসের প্রতিও যথেষ্ট খেয়াল রাখাতেন এবং সেগুলো পূরণ করার জন্য সময় বের করে নিতেন।
এ ঘটনাও উপস্থাপন করার উদ্দেশ্য শুধু এই জন্য যে, এ থেকে আমরা যেন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। অধির্কাংশ লোক অনেক সময় প্রশ্ন করে যে, দাওয়াতের কাজ কিভাবে সম্প্রসারিত করা যায়। এ সমস্ত ক্ষুদ্র ঘটনা প্রভাব বিস্তারের দিক থেকে খুবই সুদূর প্রসারী। এই উদাহরণ আমাদের সামনে এ বাস্তবতা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, দায়ীর প্রতিভা ও যোগ্যতা এবং তার প্রশিক্ষণ পদ্ধতি সর্বদা তাকে দাওয়াতী কার্যক্রম সম্প্রসারণের কাজেই ব্যস্ত রাখে। জনসাধারণের আবেগ-অনুভূতির প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং তার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা দায়ীর মৌলিক গুণাবলীর অন্যতম। সাথে সাথে তার অন্যান্য দায়িত্ব কর্তব্য ও বাধাগ্রস্ত হতে না দেয়া ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বেরই পরিচায়ক। নেতার উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীব মধ্যে অন্যতম প্রধান গুণ হচ্ছ, তিনি যুদ্ধ জয় লাভ করার সমস্ত কলা কৌশল খুব ভাল করেই জানবেন। এখানে হৃদয়ের আবদ্ধ দুর্গের সমস্ত দ্বার খোলার কৌশল জানতে হয়। আর এ জন্য এমনসব মহৎগুণাবলীর প্রয়োজন যা ইমাম শহীদের চরিত্র ও সামগ্রিক কর্মতৎপরতায় পরিদৃষ্ট হয়। কবির ভাষায়ঃ (*************)
তোমার জীবনে ছিল আমার জন্য অনেক গ্রহনযোগ্য উপদেশ মরণের পর আজ তুমি আমার নিকট হয়ে উঠেছে আরও আকর্ষণীয় তোমার জীবনাদর্শ আমাকে তোমার বক্তৃতা বিবৃতি থেকেও বেশী হেদায়াত ও পথ নির্দেশনা দিচ্ছে।
আল্লাহর এ দুনিয়াতে মানুষ এক প্রকারের নয় কিছু লোক রয়েছে এমন যাদের দেখে চক্ষু বিস্ফরিত হয়। দিল ও দেমাগ পেরেশান হয়ে যায়। পক্ষান্তরে কিছু লোক আবার এমনও রয়েছে যার চক্ষুর আড়ালে চলে গেলেও তাদের স্মৃতি অন্তর থেকে মুছে ফেলা যায় না। তাদের হৃদয় গ্রাহী স্মৃতি এবং মহৎ ঘটনাবলী ঈমানকে উদ্দীপ্ত করে এবং অন্তরকে প্রশান্তি দান করে। হাসানুল বান্না এমন অনুপম ব্যক্তিত্ব যে, তার স্মৃতি হৃদয় মনে সদা জাগরুক ও প্রাণবন্ত হয়ে থাকবে এবং প্রেমের এ কাফেলাকে লক্ষ্য অভিমুখে পথ প্রদর্শন করতে থাকবে।
আটাশতম অধ্যায়
শোকাহত হৃদয়ের বেদনাদায়ক ক্ষত
এ স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ করে আমি যুবসম্প্রদায় এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের অন্তরে ইসলামের মর্যাদা বোধের প্রেরণা সৃষ্টি করতে চাচ্ছি। এক সময় মুসলিম উম্মাহ বিশ্বব্যাপী শক্তি ক্ষমতা ও শৌর্য-বী্র্যর প্রতীক ছিল এবং দুনিয়ার সকল বাতিল শক্তি তাদের ভয়ে সদা প্রকম্পিত থাকতো। দুর্ভাগ্যবশত আজ মুসলিম মিল্লাহ যে অপমান ও লাঞ্ছনার অসহায় শিকার তা থেকে মুক্তি লাভের কোন চিন্তাই করা হচ্ছে না। এক্ষণে আমাদের অবস্থা দাঁড়িয়েছে এই যে, আমাদের সার্বিক কর্মকান্ডের ফায়সালা আমাদের দুশমনদের হাতে সোর্পদ করা হয়েছে। তারা আমাদের অবগতি ও অনমতি ছাড়াই যা ইচ্ছা তাই ফায়সালা করে। মনে হয় আমরা যেন মশা মাছির সমতুল্য। আমি রেঁনেসার রূহ জাগরিত করে তুলতে চাই। যার ফলে উম্মাতের প্রত্যেক ব্যক্তি নিত্য নতুন প্রেরণা ও জীবন্ত অনুভূতির মূর্তপ্রতীক হিসেবে পরিদৃষ্ট হতে পারে। উম্মতের অপমান ও লাঞ্ছনা তার জন্য হয়ে উঠবে অসহ্য। এমনকি সে নিজে নিজেকে জ্বলন্ত অংগারের ওপর পার্শ্ব পরিবর্তনরত বলে অনুভব করবে। এরূপ অনুভূতি চাংগা হয়ে ওঠার পরই একজন মুসলিম যুবক চিন্তা-ভাবনা করতে সক্ষম হবে যে, সে কোন আকাশের বিচ্যুত তারকা। বর্তমাকালের মুসলিম শাসক ও শাসিত সবাই লাঞ্ছনার চাদর মুড়ি দিয়ে খরগোশের ন্যায় সুখ স্বপ্নে বিভোর। কারো ব্যক্তিত্ব ও অস্তিত্বের ওপর হামলা হলেই সে কত অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে। এমনকি কোন কোন সময় হত্যা ও প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য অগ্রসর হয়। অথচ আকীদা ও ঈমান ব্যক্তিগত মর্যাদা অপেক্ষা কত বেশী মূল্যবান। আর মুসলিম ভ্রাতৃদের অপমান যা খানায়ে কা’বা থেকেও বেশী সম্মানিত- তার দৃষ্টিতে কোন প্রকার গুরুত্বই বহন করে না। আমার ঐক্যান্তিক কামনা এই যে, আজকের যুবকরা ইসলামী মর্যাদাবোধ দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে প্রকৃত ইজ্জতকে বহাল করতে সক্ষম হোক এবং যেভাবে তাদের পূর্বসূরীগণ দ্বারা মাথার মুটুককে পদ পিষ্ট করে ছিলেন। তারা নিজেরাও সেরূপ সকল তাগুতকে মস্তকাবনত করার বজ্রকঠিন শপথ গ্রহণ করুক।
জাতীয় আত্মমর্যাদাবোধ অধপতন থেকে মুক্তির পথ
ইহুদীরা ফিলিস্তিন ভূ-খন্ডের ওপর তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছে এবং মুসলিম সমাজের রক্ত দ্বারা হলিখেলা অব্যাহত রয়েছে। তারপরও এমন কিছু সংখ্যক মুসলিম রয়েছে যারা ইহুদীদের সাথে সখ্যাত বজায় রেখেছে। এমনকি তাদের সাথে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক স্থাপন করতেও কোন প্রকারন লজ্জা অনুভব করে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যেন তাদের নিকট ফিলিস্তিনের মাটি মুসলিমদের নয় এবং ফিলিস্তিনবাসীও মুসলিম নয়। কাফেলার সাজ সরঞ্জাম হারিয়ে যাওয়ার জন্য কি কম দুঃখ ছিল? এখন সেই কাফেলার অন্তর থেকে ক্ষয়ক্ষতির অনুভূতিও লোপ পেতে বসেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে!
রাশিয়া আফগানিস্তানের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ করতঃ আধিপত্য বজায় রেখেছে। কিন্তু কিছু সংখ্যক মুসলিম এ অন্যায় আচরণকে আদৌ কোন গুরুত্ব দিতে চায় না। এমনকি উল্টো তারা রুশদের সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা প্রদানেও সদা তৎপর। গোলান ও দক্ষিণ লেবাননকে ইস্রাঈলীরা তাদের নাপাক পায়ের নীচে দলিত মথিত করে চলেছে। অথচ আমরা শুধু মৌখিক জমা খরচ ব্যতীত আর কিছু করার হিম্মত দেখাতে পারছি না। এরীপ প্রতিবাদ বিবরণে ইস্রাঈলের দিল ও দেমাগ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে এই শূন্যগর্ভ বিবৃতি মুসলিমদের অন্তরের ওপর করাত চালানোরই নামান্তর। আমরা সেই মর্যাদাবোধকে চাংগা করে তুলতে চাই যা আমাদেরকে আমাদের পবিত্র ভূমিসমূহ পুনরুদ্দার করতে অনুপ্রাণীত করতে সক্ষম হবে। আমরা হৃদয়ের পরতে পরতে যে অলসতা-উদাসীনতার সে প্রলেপগুলোর মূলোৎপাটিত করতে চাই যেগুলো আমাদের জীবনকে উদ্দেশ্যহীন এবং আমাদের অস্তিত্বকে নিরর্থক করে দিয়েছে। আমদের প্রয়াস-প্রচেষ্টা যদি সার্থকতা মন্ডিত হয়ে যায় তাহলে একাধারে ফিলিস্তিন, গোলান, দক্ষিণ লেবানন ও আফগানিস্তান তথা সমগ্র অধিকৃত মুসলিম অঞ্চল উম্মতে মুসলিমার অন্তরের দীপ্তি ও হৃদয়ের কম্পনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়ে যাবে। এ প্রাণপ্রিয় ও মাহমূল্যবান ভূ-খন্ড দুশমনদের আধিপত্য ও ছোবল থেকে ইসলামী মূল্যবোধ ও চেতানার সাহায্যেই কেবল পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে। নিজেদের হৃত ভূ-খন্ড পুনরায় ফিরে পাওয়ার চিন্তা সফরতার দিকে প্রথম পদক্ষেপ স্বরূপ। অলসতা উদাসীনতা ও নির্লিপ্ততার ফল এই দাঁড়াবে যে, পরিস্থিতির আরো অবণতি ঘটবে এবং পশ্চাদপদতার মেঘারাশি অধিকতর পাঢ়রূপ বৈরী শক্তি ইরাক-ইরান যুদ্ধের পশ্চতে উস্কানি দিয়ে চলেছে । অথচ এ বিধ্বংসী যুদ্ধ দ্বারা দু’টো ভ্রাতৃপ্রতীম মুসলিম রাষ্ট্রই তাদের শক্তি ও ক্ষমতা নিঃশেষ করে চলেছে। অতি সম্প্রতি আবার ইরাকের কুয়েত জবর দখল একই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধেরই পুনরাবৃতি মাত্র। এ দৃশ্য দেখে ইস্রাঈল আনন্দে আটখানা। তার পোয়াবারো এই ভেবে যে তার শক্তি বৃদ্ধি করার সূবর্ণ সুযোগ এসে গেছে। ইস্রাঈল এ অশান্ত পরিস্থিতি জনিত সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুনরায় সিনাইয়ের ওপর অধিপত্য স্থাপন করে বসে কি না। বিপদের গাঢ় কৃষ্ণ মেঘ চক্ষুম্মান লোকদের দৃষ্টি সমক্ষ যথার্থই ভেসে উঠেছে। কিন্তু আরব ও অন্যান্য ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ ভোগ বিলাসের মহা সমুদ্রে নিমজ্জিত রয়েছেন। এ শাসনকর্তাদের আচর আর্চরণ দেখে সকল ধৈর্যশীল ও শান্তপ্রকৃতির লোকের মন-মেজাজও বিদ্রোহী হয়ে উঠবে এবং প্রত্যেক ধৈর্যধারণকারী মুসলিম ব্যক্তির ধৈর্যও নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের ঐকান্তিক কামনা হচ্ছে মুসলিম জাতির আত্মমর্যদাবোধ জেগে উঠুক এবং সর্বোচ্চ আসন থেকে এমন কার্যকরী ঘোষণা দেয়া হোক যার ফলে দেখা যাবে যে মুসলিমদের অন্তর থেকে ঈমানের অগ্নিস্ফুলিঈ আজও সম্পূর্ণ নির্বাপিত হয়ে যায়নি। তাদের ওপর চেপে বসা অপমান ও লাঞ্ছনা সত্ত্বেও তারা হযরত মূসা আলাইহিস সালামের লাঠি থেকে একেবারে বঞ্চিত হয়ে যায়নি। তারা তাদের হারানো গৌরব ও সম্মান পুনরায় লাভ করতে পারে। পারে শত্রুদের সমস্ত চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের ইন্দ্রজাল নিষ্ক্রিয় করে দিতে। ইচ্ছা ও ইস্পাত কিঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে কি করা সম্ভব নয়?
আমরা যখন আমাদের পক্ষ থেকে সকল চেষ্টা প্রচেষ্টা শেষ করবো এবং এতদসত্ত্বেও অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থকাম থেকে যাবো তখন সর্বজ্ঞানী আল্লাহ অবশ্যই তার সাহায্য সাহযোগিতা হস্ত প্রসারিত করে দেবেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আজও যদি বদরের প্রান্তর সৃষ্টি করে নেয়া যায় তাহলে আকাশ থেকে দলে দলে ফেরেশতা অবতীর্ণ হবে। নিজেদের সাজ-সরঞ্জাম ও উপায়-উপকরণ ব্যবহার করার পর যখন সর্বশক্তিমানের দরবারে হাত তোলা হয় তখন তা খলি ফিরিয়ে দেয়া হয় না। “অসহায় নিরাশ্রয়ের ডাকে কে সাড়া দেয়- যখন তাকে আহবান করা হয় এবং তার ওপর আপতিত বিপদাপদই বা কে দূরীভুত করে দেয় আর কেইবা পৃথিবীতে তোমাদেরকে তার প্রতিনিধির মর্যদাদানে ধন্য করেছেন।” আমরা চাচ্ছি এ স্মৃতি কথা নিকট ও দূর ভবিষ্যতে আমাদের সূক্ষ্ম আত্মমর্যাদাবোধের উম্মেষ সাধনে এবং সুপ্ত অনুভূতিকে জাগ্রত করার জন্য যেন উপলক্ষ হতে পারে।
ইসলামের দুশমনেরা আজ আমাদেরকে চলমান লাশ সদৃশ্য মনে করে। তাদের মতে আমাদের মাঝে জীবনের চাঞ্চল্য আর অবশিষ্ট নেই। হে যুব সম্প্রদায়! তোমরা কি বাস্তবিকই এ অবস্থার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে গেছো? ইমাম শহীদ তার জীবদ্দশায় যুবকদের মধ্যে একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ সঞ্চারিত করে ছিলেন। তাদেরকে জিহাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন। যুবকদের ভেথর এরূপ জীবন দায়িনী মনোবল ও বলিষ্ঠতা দেখে আমাদের শত্রুদের অন্তরাত্ম কেঁপে ওঠে। তারা তাদের অনুগত ও বিশ্বাস্ত সেবকদের নির্দেশ প্রদান করে যেন এ আন্দোলনকে অম্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়া হয়। যার ফলে মুসলিম শাসনকর্তারা ইসলামের দুশমনদের প্রতি তাদের বিশ্বস্ততার হক পুরোপুরি আদায় করতে গিয়ে হকের পথে আহবানকারীদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান আরম্ভ করে দেয়। এতে বিগত দিনের স্মৃতি চারণ মাত্র। হে যুব সমাজ! তোমরা কি কোন মূল্যবান কীর্তিগাঁথা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করে যেতে চাও না? যা দেখে ভবিষ্যত প্রজন্ম গৌরব বোধ করতে পারে। ওঠো! এবং বাতিলের চোখে চোখে নিঃশম্কচিত্তে ঘোষণা করে দাওঃ (************)
পলায়ন পর রত্রির অন্ধকার শেষ পর্যন্ত প্রখর সূর্যর দীপ্তিতে দেদীপ্যমান হয়ে উঠবে;
এ বাগান তাওহীদের সুমধুর সংগীতের মূর্ছনায় মুখরিত হয়ে উঠবে।
আরো শুনে রাখো, যদি উম্মতে উসলামিয়া অপমান ও লাঞ্ছনার পোশাক ছুঁড়ে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ না হয় তাহেল স্থায়ী লানতের বেড়ি তাদের নবীব হবে। আমি দিগন্তের কিনারে প্রত্যাশার আলোকচ্ছটা ঝলমলিয়ে উঠতে দেখছি। আকাশের অসীম নীলিমা থেকেও প্রদিপ্ত আশার আলোকে রাশ্মি প্রদীপ্ত হয়ে বেরিয়ে আসার দৃশ্য আমি প্রত্যক্ষ করছি। হতাশা ও নিরাশায় ভেংগে পড়ার কোনই কারণ নেই। সত্য পথের পথিকদের সর্বাপেক্ষা বড় আশ্রয় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এবং সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা রহমতে রাব্বুনী। হে গভীর নিদ্রায় অচেতনরা! অনেক ঘুমিয়েছো অলসভাবে কাটিয়ে দিয়েছো অনেক সময়। এবার উঠে পড়ো। তাকিয়ে দেখো এক্ষণে প্রভাতকালীন ঊষার আলো আকাশ থেকে আয়না সদৃশ্য পোশাক পরিধান করে ধরণীর বুকে আগমন করতে যাচ্ছে এবং রাতের সকল অন্ধকার এখনই শূন্যে মিলিয়ে যেতে চাচ্ছে।
কর্মফলেই জান্নাত ও জাহান্নাম
নিজে নিজেকে তুচ্ছ মনে করো না এবং স্বীয় দুশমনদের সম্মুখে নতজানু হয়ে বসো না। কর্মতৎপরতাই জীবনের পরিচায়ক, আর অলসতা ও কর্মবিমুখতা মৃত্যুরই নামান্তর। শ্রমের প্রতি অবহেলা ও অমনোযোগিতাই দুঃখ ডেকে আনে। বিপদ মুসিবত সহ্য করেই স্বর্ণে পরিণত হওয়া যায়। মৃত্যুর দরজা অতিক্রম করতে মুহুর্ত মাত্র দরকার হয়। তারপরই পরীক্ষা নিরীক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে এবং জান্নাতের সুসংবাদ মিলে। এভাবে যে বাতিলের পতাকাবাহী হয়ে পড়ে কিংবা তার ছাত্রছায়ায় থাকতে সন্তুষ্ট হয়ে ন্যক্কারজনক জীবন যাপন করতে থাকে- তাদেরকেও তো শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর হিমশীতল শরাব পান করতেই হয়। এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্য এই যে, শেষোক্ত মৃত্যুর ঘঅট পাড়ি দিয়ে সোজা জাহান্নামবাসী হতে হয়। এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা আপনার নিজেরই দায়িত্ব যে দ’টি ঠিকানার মধ্যে কোন ঠিকানা আপনি নিজের জন্য বেছে নেবেন। মানুষ যে বীজ বপন করে সে ফসলই ঘরে তুলতে পারে। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের ওপর কখনো কোন জুলুম ও অন্যায় করেন না।
১৯২৮ সালে মিসরে যদি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের আন্দোলন আরম্ভ না হতো তাহলে কে জানে আজ এখানে কি পরিস্থিতি বিরাজ করতো! যদি এ আন্দোলন দানা বেঁধে না উঠেতো তাহলে ইস্রাঈল ফিলিস্তিনকে এমনভাবে গলধকরণ করতো যে, প্রতিবাদ পর্যন্ত করা হতো না। তার নিন্দা জ্ঞাপনের জন্যও কেউ মুখ খুলতো না। আর করো সমালোচনা মুখর হয়ে ওঠার তাওফীক হতো না। ইমাম শহীদ শুরু থেকেই এ পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাই লাগাতর সর্তকবাণী উচ্চারণ করতে ও বিপদ সংকেত বাজাতে থাকেন। তিনি সর্ব-সাধারণের মনে আসন্ন এই বিপদের অনুভূতি সৃষ্টি করেন এবং ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারীদের সক্রিয় করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু আফসোস! দয়িত্বশীল ব্যক্তিগণ সক্রিয় হলেন বটে কিন্তু নিজেদের জনগণের বিরুদ্ধে। জিহাদের যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সাধারণ মানুষের মনে ইতিমধ্যেই সৃষ্টি হয়েছিলো তাকে তাদেরে শ্লোগান বর্বস্ব বক্তৃতা এবং অন্তসারশূন্য বিবৃতির সাহায্যে নির্বাপিত করে ফেলে। মুসলিম শাসকেদের গাদ্দারীকে আমরা কখনো ভুলে যেতে পারি না। নাকরামীপাশার মন্ত্রীসভা ইস্রাঈলের সাথে শান্তি ও আপোষ আলোচনা করে কার্যক্ষেত্রে ফিলিস্তিন ভূ-খন্ডের ওপর ইস্রাঈলকে তা থাবা বিস্তার কারার সুবর্ণ সুযোগ করে দেয়। আমাদের জন্য জরুরী ছিল ইস্রাঈলের সাথে কোন প্রকার আপোষ আলোচনায়ই না বসা। একান্তই যদি আলাপ আলোচনা করতে হতো তাহলে মিসরের বৃটেনের সাথে মতামত বিনিময় করা উচিত ছিলো। কেননা জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের তত্বাবধানের দায়িত্ব বৃটেনের ওপরই অর্পণ করা হয়েছিলো। এ আলাপ আলোচনার সময় আমাদের একথা স্পষ্ট করে তুলে ধরা উচিত ছিলো যে, আমরা ইস্রাঈল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নিতে পারি না। তাছাড়া ফিলিস্তিনের ওপর ইস্রাঈলকে চাপিয়ে দেয়ার অধিকার করো নেই।
নব্য ক্রুসেডের যুদ্ধসমূহ
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া দেখে রাশিয়া ও আমেরিকা দু’পরাশক্তিই তাকে খতম করতে তৎপর হয়ে ওঠে। তাদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। তারা ইখওয়ানের জনপ্রিয়তা হ্রাস করা এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে ইসলামের নামেই কিছু সংগঠন তৈরী করে এবং পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেয়া হয়্। ইখওয়ানুল মুসলিমুন বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বতিল শক্তির সম্মুখে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। জেলাখানার অভ্যন্তরে্ ইখওয়ানের সাথীগণ সশ্রম কারাদন্ডের নির্যাতন ও অমানুষিক নিপীড়ন ভোগ করেন। ইখওয়ানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই আজ কারাগারগুলোর সংস্কারের প্রতি মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে জিন্দানকানাগুলো জেল বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে বিচার বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন করে দেয়া হয়েছে।
এ দাওয়াতকেই লক্ষ্যবস্তু বানানোর জন্য আবদুন নাসের ও সাদাত এমন পন্থা অবলম্বন করে যা কল্পনা করতেই শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়। ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সাদাতের নির্দেশেই যে ব্যাপক ধরপাকড় পরিচালিত হয় তা উদ্দেশ্য লোককে গ্রফতার করা হয়। দেশে স্থায়ীভাবে জরুরী আইন জারী কা হয় যা অদ্যাবধি অব্যাহত রয়েছে। এ কাজও কর হয় ইখওয়ানকে লক্ষ্য বানানোর জন্য।
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের আন্দোলন গোটা প্রাচ্য জগতে পরিস্থিতি পরিবর্তন সাধন করে। ক্রুসেডের যুদ্ধ সুপরিচিত রূপে বহুদিন পূর্বেই শেষ হয়ে গিয়েছে। এ আন্দোলনের প্রারম্ভে সুদীর্ঘ নয়শত বছরের নীরবতার পর পুনরায় যদ্ধের সূচনা নতুনভাবে হয়। প্রাচ্য জগত আমেরিকা ও রাশিয়ার মাঝে বিভক্ত। এ দু’টি শক্তির লক্ষ্য হচ্ছে, ইসলামী আন্দোলনের বিনাশ সাধন করতে হবে। কেননা তা তাদের নেতৃত্ব কোন কৃমেই মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের ওপর যখন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তখন আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও ফ্রন্সের চাপ তার পশ্চাতে কার্যকরী ছিল। এটা কি ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেড নয়?
ইখওয়ানুল মুসলিমুন এসব বিদেশী শক্তির দুশমন। কারণ তারা নিজের দেশকে তাদের নাপাক প্রভাব থেকে পূর্ণরূপে মুক্ত করতে চায়। আমরা কেবলই শ্লোগান দিতে অভ্যন্ত নই। আমরা সিদ্ধান্তকরী যুদ্ধ লড়ার পক্ষপাতি। কে জানে না যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলা কালে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের ডিপো সুয়েজখালের তীরে কারা উড়িয়ে দিয়েছিল? সেই মহাপুরুষের নাম আমি উল্লেখ করতে চাই না। যিনি উপনিবেশবাদ থেকে নিজ দেশকে আযাদ করানোর জন্য এই দৃঃসাহসিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, পশ্চিমা শক্তিসমূহ ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সাহসিকতা ও বীরত্ব সম্পর্কে খুব ভালভাবেই অবগত। তাই তারা প্রত্যক্ষ বিংবা পরোক্ষভাবে শয়তানী কূটকৌশল প্রয়োগ করে এ আন্দোলনকে ধরা পৃষ্ঠ থেকে মুছে ফেলার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
মহাবিচারকের আদালত
আমরা যেখানে দেশের স্বাধীনতা ও ইসলামের সমৃদ্ধির জন্য সকল বিপদ হাসি মুখে বরণ করে নিতে প্রস্তত সেখানে আমাদের এ অবস্থাও রয়েছে যে, আমরা দেশের বিরুদ্ধে কখনো কোন তৎপরতায় অংশগ্রহণ করাকে জায়েযই মনে করি না। আমাদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ আরোপকারীদের চিন্তা করা উচিত যে, একেতো এসব অভিযোগের স্বরূপ আপনা থেকেই উন্মোচিত হয়ে পড়বে। অন্যথায় মহাবিচারকের আদালতে সকল সত্য কোন প্রকার কম বেশী না করেই গোটা মানবতার সম্মুখে উপস্থাপন করা হবে। জাভীয়াতুল হামরা নামক স্থানে যে অপরাধ সংঘটিত হয় তার রহস্য শীগ্র হোক বা বিলম্বে হোক লোকের সম্মুখে উদঘাটিত ও প্রকাশিত হবেই। এ অপরাধের অভিযোগও ইখওয়ানের বিরুদ্ধে করা হয়েছিলো। অথচ তার পশ্চাতে অন্য কোন অপরাধীর হাত ছিল। যেদিন ঘটনা সংঘটিত হয় সেদিন প্রত্যুষেই আমাকে তৎকালীন স্বরাষ্ট মন্ত্রী ডেকে পাঠান। আমি মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে বহু বিশ্বস্ত লোকের নাম উল্লোখ করালম যারা এ ভয়াবহ ঘটনা স্বচক্ষে অবলোকন করেছিলেন। মন্ত্রী সাহেব সেসব লোককে ডেকে পাঠান এবং তাদের বর্ণনা শ্রবণ করেন। তারপরও আমার বিম্ময়ের অবধি রইলো না যে, এতসব সাক্ষ্য প্রমাণের পরও ঘটনার সমস্ত দয়দায়িত্ব ইখওয়ানের ওপরই চাপানো হয়। ভ্রাতৃপ্রতীম মহামান্য শেখ সোলায়মান রাবী, শেখ মুহাম্মাদ আল গাযালী, শেখ হাফেজ সালামাহ্ এবং শেখ সালাহ আবু আসমাঈল আজও সন্ত্রাস নির্মূল করার জন্য অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে আমার সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের প্রস্তাব পেশ করেছিলাম। ঐসময়ই আমাকে “আমীরুল উমারা” উপাধিতে ভূষিত করা হয়। যার জন্য আমি উল্লাসিত নই কিংবা সে জন্য আমি অভিলাষীও ছিলাম না।
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের আন্দোলন যদি না থাকতো তাহলে আবদুন নাসের এবং সাদাতের বেআইনি কাজকর্ম এবং জুলুম-নির্যাতন সম্পর্কে সমগ্র দুনিয়া থাকতো সম্পূর্ণ নাওয়াকিফ। এসব লোক পার্লামেন্টকে রাবার ষ্ট্যাম্প বানিয়ে রেখেছে। আমরা তাদের দাসত্ব কবুল করতে প্রস্তুত নই তাই তাদের প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছি। যখনই আমি মিসরের বাইরে গিয়েছি কিংবা ফিরে এসেছি তখনই আমাকে এয়ারপোর্টে খামাকা ভয় দেখানো হতো, তামাশা করা হতো। আবার ছাড়া পাওয়ার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হতো। অন্য কোন দেশে আমি যখন গিয়ে পৌছাতাম তখন সেখানেও আমার সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে রাখা হতো যে, একজন মস্ত বিপজ্জনক লোক সফরে আসছে। একবার মিউনিখ বিমান বন্দরে আমাকে আধাঘন্টা পর্যন্ত আটকে রাখা হয়। কর্তব্যরত ইমিগ্রেশন অফিসার ওয়ারলেস যোগে তার সিনিয়ার অফিসারদরকে কিছু জিজ্ঞেস করতে থাকে। আমার পক্ষে তার কিছুই বুঝা সম্ভব ছিল না। কিন্তু বার বার আমার নাম উচ্চারণ করা ও পাসপোর্টের বরাত দেয়াতে আমি এতটুকু বুঝতে সক্ষম হই যে, আমার সরকার আমার সম্পর্কে এখানে তথ্য সরবরাহ করেছেন। এ ধরনের কষ্টদায়ক ও অবমাননাকর পরিস্থিতির অসহায় শিকার কেবলমাত্র আমিই নই। সমস্ত ইখওয়ানী ভাইকেই হতে হাচ্ছিলো। আমার মনে পড়ে, শুধু একবার মাত্র অর্থাৎ ১৯৮৪ সালের ১৫ই আগষ্ট বৃহস্পতিবার কায়রো প্রত্যাবর্তনের সময় আমাকে সাধারণ মুসাফিরদের ন্যায় কোন প্রকার হয়রানি ব্যতীতই এয়ার পোর্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। আমাদের সাথে এ ধরনের আচরণ এজন্য করা হতো না যে, আমরা কোথাও কোন বেআইনি কাজের সাথে জড়িত ছিলাম কিংবা আমাদের কোন কাজ-কারবার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে এমনটি করা হতো। আমরা হচ্ছি দাওয়াতের হকের কর্মী। এ কারণেই আমাদেরকে অনুরূপ মেহেরবানীর উপযুক্ত বলে মনে করা হতো। এ লড়াই শুধু জালিমদের এবং ইখওয়ানদের লড়াই নয়। এসব নির্বোধরা খোদ আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ জারী রেখেছে। অথচ তাদের জানা নেই যে, মহাশক্তির আধার সেই সাথে লড়াইয়ের সূচনা করে তারা কি মারাত্মক পরিণতির শিকার হবে!
আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের অব্যাহত আন্দোলনের ফলে আজ দশজন নিষ্ঠাবান দায়ী ইলাল্লাহ্ পার্লামেন্টে পৌছেছেন। ইনশাআল্লাহ ভাবিষ্যতে ক্রমশ এ সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ইখওয়ানের নিবেদিত প্রাণ কর্মী এবং অন্যান্য ইসলামী শক্তির সাহায্যে মরীয়াতে ইসলামীর বাস্তবায়িত হবে। সুদানে ইসলামী আইন প্রবর্তনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের পশ্চাতে ইখওয়ানের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার কথা অনস্বীকার্য। সকল মুসলিম রাষ্ট্র থেকেই ইসলামের পতাকাবাহী পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী প্রকাশিত হচ্ছে। এবং সমগ্র পৃথিবীতে ইসলামী সাহিত্যের প্রকাশ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোথাও যদি সাহিত্যের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয় তাহলে বর্তমানে ইসলামী সহিত্যিকদের রচিত বই পুস্তক ছাড়া তা পূর্ণঙ্গ ও সার্থক মনে করা হয় না। মুসলিম ও অমুসলিম রাষ্ট্রসমূহ প্রতি দিনই অব্যাহত গতিতে ইসলামী কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন প্রত্যেক দেশেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ইসলামী আইন প্রবর্তনের দাবী করে আসছে। অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রে ওয়াফক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেখান সাধারণত উলামায়ে দ্বীন ও ফকীহগণকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়ে থাকে। এসব গঠনমূলক ও ইতিবাচক দিক বর্তমান সময়ের আন্দোলনেরই ফল মাত্র।
এ আন্দোলনের মোকাবিলা করার জন্য আমেরিকা ও রাশিয়া নিজ নিজ পছন্দের বহু সংগঠন কায়েম করেছে। সমাজতান্ত্রিক ইসলাম ও আমেরিকান ইসলাম কিভাবে সফলতা লাভ করতে পারে? এ আন্দোলনের প্রভাবের ফল এই যে, বর্তমানে কোথাও কোন হাউজিং তৈরী করা হলে তাতে অবশ্যই মসজিদও নির্মিত হয়ে থাকে। ইখওয়ানুল মুসলিমুন উম্মাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, যাকাত প্রদান বাধ্যতামূলক। অথচ মানুষ তা বেমালুম ভুলে বসেছে। এ আন্দোলনের চিন্তা ও চেতানার ধারা এমনভাবে বদলে দিয়েছে যে, বর্তমানে সকল ট্রেড ইউনিয়নের দায়িত্বশীর ব্যক্তিই ইসলামের পতাকাবাহী।
নাসের ইখওয়ানুল মুসলিমুনের অগ্রগতি স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য তাদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন শুরু করে। ফলে গণমানুষের মধ্যে বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা দানা বাঁধতে থাকে। সে জনপ্রিয়তা অর্জন করার জন্য সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করার অভিনয় করে। এই তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তে আমাদের যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় সে সম্পর্কে ইতিপূর্বে ইংগিত দিয়েছি। ১৯৫৬ সালের ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যে লড়াইয়ের সূচনা হয় তাতে যদি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ার হস্তক্ষেপ করে মিসরকে রক্ষা না করতো তাহলে ১৯৬৭ সালে পরাজয়ের গ্লানি নাসের সাহেবকে তখনি ভোগ করতে হতো। আবদুল করিম কাশেম ও আবদুন নাসেরের মঝে মত্যনৈক্য সৃষ্টি হলে বাগদাদে বড় বড় মিছিল হয়। সেসব মিছিলে “নাসের মুর্দাবাদ” শ্লোগান দেয় হয়। নাসের যখন এ সম্পর্কে অবগত হন তখন আবদুল করিম কাশেমকে টিলিফোনে বলেন, “আমিও জানি আর তুমিও জান যে, এসব কিভাবে করা হচ্ছে।” নাসেরের একথা সত্য ছিল। কারণ স্বৈরাচারী ও একনায়করা এ ধরনের নাটকের অভিনয় করে থাকে। নাসেরের পুরো শাসনামলেই তো এরূপ নাটকের মধ্যে দিয়েই অতিবাহিত হয়েছে।
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের ও নাসের নির্যাতন চালাতে চালাতে শুরু করলে বহু ইখওয়ন অন্য দেশে চলে যায়। সেখানেও তারা তাদের দাওয়াত সম্প্রসারণের কাজ অব্যাহত রাখে। আর এভাবে দাওয়াতের দুশমনদের হাতেই আমাদের পয়গাম বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করে। ইখওয়ানুল মুসলিমুনে তাদের সামর্থ অনুসারে রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজনীতি, দর্শন ও বিজ্ঞান ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ইসলামের উপস্থাপিত রূপরেখা জতির সম্মুখে পেশ করতে সচেষ্ট হয়। কতিপয় স্বার্থন্ধ ও জ্ঞানপাপী অজ্ঞতার ভান করে জিজ্ঞেস করে থাকে, “আজ পর্যন্ত ইখওয়ানুল মুসলিমুন কি কি কাজ করেছে।” এরূপ প্রশ্ন তারা জানার উদ্দেশ্যে করে না বরং এসব বিকারগ্রস্ত মানসিকতার বহিপ্রকাশ মাত্র। এরা উজ্জল দিবালোক অস্বীকার করাকে প্রগতিবাদিতা বলে মনে করে। বাস্তবতাকে অস্বীকার করে বসলেই সত্য বদলে যায় না। অদূর ভবিষ্যতে ইখওয়ানের ইতিহাস তার উজ্জল দীপ্তিতে ভাস্বর হয়ে মানুষের সম্মুখে এসে যাবে। অনন্তর কর্ণকুহরে জোর পূর্বক তুলে ঢুকিয়ে দেয়া এবং চোখের ওপর পট্রি স্থাপনকারী লোকেরা আল্লাহর ডাংকা শুনতে পাবে এবং সত্যের স্বরূপ দেখতে সক্ষম হবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, ইনশাআল্লাহ সেদিন আর বেশী দূরে নয়।
আমি বার বার একথারই পুনরাবৃত্তি করে এসেছি যে, ১৯৩৬ সাল থেকে আরম্ভ করে আজকের এদিন পর্যন্ত মধ্যপ্রচ্যে উদ্ভূত সামাজিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক ঘটনাবলীর মেরুদন্ডে রয়েছে এক ও অভিন্ন আর তা হচ্ছে ইখওয়ানুল মুসলিমুন। একথা বলতে আমার কোন দ্বিধা নেই যে, এ গতিশীল অকুতোভয়, দৃঢ়তাপূর্ণ ও সুস্পষ্ট দাওয়াতকে ইসলামের শত্রুরা তাদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের জন্য মস্তবড় বিপদ বলে মনে করে। আমি বলতে চাই যে, ইনশাআল্লাহ মিসরের মাটিতে কোন তাগুত তার আনুগত্যের জোয়াল চাপিয়ে দিতে সক্ষম হবে না। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াত তার প্রভাব আরো বৃদ্ধি করবে এমনকি অলসতা ও আপাদমস্তক আন্দোলনের দোলায় সক্রিয় হয়ে উঠবে। জেগে উঠবে গভীর ঘুমে অচেতন অসাড় সকল মানুষ। সব শ্রমবিমুখ কর্মচঞ্চল ও সৃজনশীল প্রতিবার অধিকারী হয়ে যাবে।
( আরবী ************)
“হে ঈমানদাররা তোমরা ধৈর্যধারণ করো পরস্পরে ধৈর্যর প্রতিযোগিতা করো এবং আল্লাহর পথে দৃঢ় পদে দাঁড়িয়ে যাও আর আল্লাহকে ভয় করো। এভাবে নিশ্চয়ই তোমরা সফলকাম হবে।”
ঊনত্রিশতম অধ্যায়
ইসলামী ঐক্যের আহবায়ক
ইমাম হামানুল বান্না শহীদ ছিলেন উম্মাহর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রনায়ক। পারস্পরিক মতোবিরোধের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল ঘৃণা। তাঁর বক্তৃতা বিবৃতি মুমলিম উম্মাহর সাঝে সস্পৃতি ও সৌহার্দ সৃষ্টি করার লক্ষে কেন্দ্রীভূত থাকতো। তিনি কখনো তাঁর কথা ও লিখনীতে এমন কোন শব্দ বের হতে দিতেন না যাতে করো মনে কষ্ট হতে পারে। ইখওয়ানুল মুসিলিমুনের কর্মনীতিই হচ্ছে এই যে, সকল বিরোধ ও অনৈক্যের অবসান ঘটিয়ে সব মুসলিমকে বুনিয়াদী নীতিমালার ওপর ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। কুরআন মজীদে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ (আরবী *******) “আর নিশ্চিয়ই তোমাদের এই উম্মাত একই উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত।”
এই শতাব্দীর চতুর্থ দশকে শিয়া মাযহাবের একজন আলেম সাইয়েদ আল কুমাই ইখওয়ানের মেহমান হয়ে কেন্দ্রীয় অফিসে অবস্থান করছিরেন। সে আমলে ইমাম এ প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন যে, বিভিন্ন ইসলামী মাযহাবসমূহের মধ্যে সকল সতপার্থক্যের মূলোৎপাটন করে ফেলতে হবে যাতে ইসলামের শত্রুদের জন্য ইসলামী উম্মাহর মধ্যে মতভেদ ও কলহ সৃষ্টি করে দলে উপদলে শতধা বিভক্ত করার সুযোগ লাভ করতে না পারে। এটা সেই সময়ের কথা যখন আমরা তাঁর নিকট জানতে চাইলাম যে, সুন্নী ও শিয়াদের মধ্যে পার্থক্য কি? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, এ ধরনের বিতর্কে জড়িত হওয়া একেবারেই নিরর্থক। এরূপ আলোচনা সমালোচনা থেকে বিরত থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমাদের করার মত আরো অনেক সমালোচনা রয়েছে। আমাদের দুশমনরা সরিষার পাহাড় বানিয়ে আমাদের সাঝে আগুনের লেলিহান শিখা প্রজ্জলিত করতে থাকে। এ কারণে আমাদের গতিবিধি ও আচার আচরণ অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া আবশ্যক। আমরা পুনরায় আরজ করলাম “আমাদের উদ্দেশ্য তো মতাপার্থক্যকে উৎসাহিত করা নয় বরং আমরা শুধু আমাদের জ্ঞানের জগতকে আরো সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যে আপনার নিকট এ প্রশ্ন জিজ্ঞেসা করছি। নিসন্দেহে শিয়া ও সুন্নী মাযহাবগুলোর ওপর অসংখ্য বই-পুস্তক বর্তমান রয়েছে। কিন্তু আমাদের হাতে এত অবসর কোথায় যে, আমরা সেগুলোর চর্চায় সময় দিতে পারি।”
ইমাম শহীদ জবাব দিলেনঃ “সংক্ষেপে এতটুকু জেনে রাখুন যে, সুন্নী ও শিয়া সকলেই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর’ ওপর ঈমান পোষণ করে থাকে। আর এই কালেমাই আমাদের আকীদা-বিশ্বাসের মৌলিক ভিত্তি। অতএব সুন্নী ও শিয়া সকলেই নির্বিশেষে মুসলিম; নীতিগতভাবে এদর মধ্যে কোন বিরোধ নেই। অবশ্য খুঁটিনাটি ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। তথাপি সেসব মতভেদ এমন নয় যে, তা দূর করা যায় না।”
আমরা আবারো আরজ করলাম, “একথাটাকে একটা উদাহরণের সাহায্যে আমাদের সম্মুখে স্পষ্ট করে দিন।” তিনি জবাবে বললেনঃ আহলে সুন্নাতের নিকট চার ইমামের দিক থেকে চার মাসলাকে পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে শিয়াদের মাঝেও বহু ফেরকা লক্ষ্য করা যায়। যেমন শিয়া ইমামিয়া- বলা হয়ে থাকে যে, ইমাম ইসলামে বাধ্যতামূলক। এমনকি ইমাম ব্যতীত ইসলামের অস্তিত্বই কায়েম হতে পারে না। তারা বারজন ইমামের প্রবক্ত; আর এ জন্যই তাদেরকে “ইসনা আশারী” ও বলা হয়ে থাকে। তাদের মতে দ্বাদশ ইমাম গায়েব ও অদৃশ্য হয়ে গেছেন। যার পুনরামনের জন্য তারা প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। সেই ইমামের আগমনের পর তার নেতৃত্বে এসব লোক জিহাদের প্রক্ষপাতি। তাদের নিকট শরীয়াতের হিফাজত করা ইমামের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাঁর ফরমান ও দিকনির্দেশনা কোন প্রকার ওজর আপত্তি ছাড়াই মেনে চলা বাধ্যতামূলক এবং তাঁর ফায়সালাই চূড়ান্ত। নিসন্দেহে এ ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভংগী তাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। কিন্তু এ মতপার্থক্যকে ভিত্তি করে তাদেরকে কাফের ফতোয়া দেয়া আমাদের জন্য আদৌ শোভনীয় নয়...।”
তিনি আরো বলেনঃ “আরও কিছু মতবিরোধ রয়েছে এমন যেগুলোর অপনোদন ও মূলোৎপাটন সম্ভবপর। উদাহরণ স্বরূপ শিয়াদের কোন কোন ফিরকা মোতা’ বা সাময়িক বিবাহের পক্ষপাতি। অনুরূপ আরো কতিপয় মতবিরোধপূর্ণ কথাবার্তা রয়েছে। উভয় মাযহাব পরস্পরে সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার সাথে জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে প্রত্যেক প্রত্যেকের সম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত রেখে নিজ নিজ ফিকাহর ওপর আমল করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে দু’মাসলাকই সুদীর্ঘ কাল থেকে কোন প্রকার সাম্প্রদায়িক ঝগড়া বিবাদ ছাড়াই সহঅবস্থান করে আসছে এবং উত্তম প্রতিবেশীর ন্যায় শান্তিময় জীবন যাপন করছে। বেশীর ভাগ মতপার্থক্য কেবল কিতাবের পাতায়ই পাওয়া যায়।
আবু লাহাব নীতির বিদায় ও নবী মোস্তাফা (সা)- এর আগমন
ইরাক এবং ইরানের মধ্যেকার যুদ্ধকে শিয়া সুন্নীর রঙে রঙিন করার চেষ্টা চলছে। অথচ এ লড়াই দ্বীনের স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে না। বরং উভয় দেশই নিজ নিজ মিথ্যা গর্ব ও বাহ্যিক শৌর্য বীর্য প্রদর্শনের জন্য নিরপরাধ মনব গোষ্ঠীকে মৃত্যুর ঘাটে পৌছিয়ে দিচ্ছে। এভাবে দু’সম্প্রদায়ই আপনাপন জিদ ও হঠকারিতার মহড়া দিয়ে চলেছে্। অথচ তাদের এ অপরিণামদর্শী আচরণের অপূরণীয় ক্ষতির দায়দায়িত্ব বর্তাচ্ছে সামগ্রিকভাবে সমস্ত মুসলিম উম্মাহর ওপর। ইসলাম বিরোধী শক্তিসমুহ এ অযৌক্তিক ও ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ দীর্ঘস্থয়ী করার জন্য উস্কানি দিয়ে চলেছে। এদিকে বিবদমান উভয় সম্প্রদায়ই এর সাথে নিজেদের মান-সম্মানের প্রশ্ন জড়িত বলে মনে করে। আমরা মনে করি যদি দু’গোত্রই নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করে তাহলে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি ও নিরাপত্তার দিগন্ত উন্মোচিত করতে পারে এবং ক্ষোভ ও ক্রোধ প্রশমিত করে ইনসাফ ও সুবিচারের পন্থা অবলম্বন করতে পারে। এতেই নিহিত রয়েছে উভয়ের কল্যাণ। সাস্প্রদায়িকতার বিদ্বেষে সংঘটিত এ সমর আত্মঘাতি হলাহল স্বরূপ। আফসোস! এ তিক্ত বাস্তবতা যদি যুদ্ধে লিপ্ত পক্ষগুলো উপলব্ধি করতে পারতো।
যাদের শৌর্য বীর্য
প্রাচ্যবিদ ও তাদের বিশ্বস্ত শাগরেদগণ অত্যন্ত নির্মমভাবে ইমাম হাসানুল বান্না ও তার সংগঠনের ওপর সন্ত্রাসের অভিযোগ আরোপ করে আসছে। আমরা বহবার তাদের এই অভিযোগের দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছি। আল্লাহ সুবাহনাহু ওয়া তায়ালা কখনো কখনো এ দাওয়াতের পক্ষথেকে প্রতিরোধ করার জন্য কোন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে বেছে নেন। যেমন মিসরীয় টেলিভিশনে প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়ে থাকে, যার নাম দেয়া হয়েছে “নুদওয়াতুন লিরায়ী” (আলোচনা সভা)। এ অনুষ্ঠানের পরিচালক হচ্ছেন উস্তাদ হিলমী আল বালক। এতে আল আযহার ইত্যাদি স্থান থেকে বহু জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করে থাকেন। ১৯৮৪ সানের ২৪শে আগষ্ট তারিখে আামি এ অনুষ্ঠান দেখে ছিলাম। অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণকারীদের মধ্যে জাতীয় পরিষদগ সদস্য এবং স্বনাম ধন্য আলেম শাইখ আতিয়া সাকারও ছিলেন। শাইখ মুহাতারাম মিসরীয় ঐতিহাসিক ঘটনাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও দর্শকদের সম্মুখে উপস্থাপন করেন। তিনি সন্তব্য করেন “আমি মিসরের উচ্চ ভূমি এলাকায় কর্মরত ছিলাম। ইত্যবসরে একবার ঘটনাক্রমে একজন ইসলামী দায়ীর সাথে আমরা সাক্ষাত হয়। তিনি অত্র এলাকায় প্রায়ই আগমন করতেন। এবং জনসাধারণকে ইসলামী রীতিনীতির প্রতি আহবান জানাতেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার দাওয়াতের কর্মপন্থা কি?” তখন তিনি জবাবে বললেন “আমাদের উদাহরণ একজন কৃষকেরই মত। যে কার্পাসের চাষ করে। বীজ বপন করার পূর্বে ভূমি উত্তমরূপে তৈরী করে নেয়। অম্কুর উদগমের পর ঘাস ও লতা-গুল্ম পরিষ্কার করে নেয়। আক্রমণকারী কীট-পতংগ থেকে সেগুলোকে রক্ষা করে। পাতা ও ফুলে লেগে যাওয়া পোকা মাকড় থেকেব তার নিরাপত্তা বিধান করা। চারাগুলো খুব হৃষ্ট পুষ্ট হয়ে বেড়ে ওঠে। তাতে ফুল আসে এবং ছঃয় বা সাত মাসের মধ্যে ফসল তৈরী হয়ে যায়। এ সুদীর্ঘ সময় চাষী ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে একের পর একটা দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকে অব্যাহতভাবে। তারপর সে তার পরিশ্রমের ফসল ঘরে তুলতে সক্ষম হয়। তখন সে তার ফসল নিয়ে যায় বড় বড় হাটে বাজারে। তদ্রূপ আমরাও আমাদের দাওয়াতী কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য সযত্ন প্রয়াস চালিয়ে থাকি। আমরা তাড়াহুড়া করা এবং কাঁচা ফল তোলার পক্ষপাতি নই।” উক্ত দায়ীয়ে ইসলাম সরহুমের কথায় আমি সীমাতিরিক্ত প্রভাবিত হয়ে পড়ি।” (শাইখ আতিয়া সাকারের কথা এখানেই শেষ হয়ে যায়।)। এটা ছিল হাসানুল বান্নারই যথার্থ চিত্রাম্কন। এ মনোবল ও কর্মনীতি ছিল তাঁরই উদ্ভাবিত।
এটা ছিল একজন মহাপ্রাণ শাইখের বলিষ্ঠ সাক্ষ্য। তিনি কোন প্রকার পূর্ব প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ছাড়াই কেবলমাত্র সত্য বর্ণনা করার স্বার্থেই একথাগুলো উপস্থাপন করেন। রিপুর সেবাদাসদের এ সাক্ষ্যের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। অবশ্য এটা সত্য যে, শাইখ আতিয়া সাকার এ দায়ীর কথা বলতে গিয়ে তার নাম বর্ণনা করেননি। তথাপি সমগ্র দুনিয়া জানে যে, তিনি কে ছিলেন? যিনি মিসরের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত দাওয়াতে হকের পয়গাম পৌছে দেয়ার জন্য থাকতেন সদা প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত দাওয়াতে হকের পয়গাম পৌঁছে দেয়ার জন্য থাকতেন সদা তৎপর। শাইখ আতিয়া এ দায়ীর পরিচয় যেভাবে তুলে ধরেন তারপর আর এতে কোন সংশয়-সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। তিনি আলোচ্য দায়ীর কথা বলতে গিয়ে রাহমাতুল্লাহও বলেন যার ফলে নাম না নিয়েই তিনি সেই মহাত্মার প্রতিই ইংগিত করেছেন।
হিকমাত ও কৌশল মুমিনের হারানো মিরাস
কতিপয় তথাকথিত মুসলিম দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে এরূপ অভিযোগ করে থাকেন যে, তা বর্তমান সময়ের সমস্যার সমাধান দিতে অক্ষম। হাসানুল বান্না শহীদ ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন বরে মনে করতেন এবং তা সর্বকালের জন্য সমভাবে কার্যকরী হওয়ার দৃঢ় বিশ্বস রাখতেন। সাথে সাথে তিনি যুব সমাজকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা করা এবং তাতে পরিপূর্ণ ব্যুৎপত্তি অর্জন করার জন্য উৎসাহিত করতেন। তিনি হাদীসে নববী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোতাবেক এ বিষয়ের ওপর খুবই গুরুত্ব দিতেন যে, হিকমাত ও প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা মুমিন ব্যক্তির হারানো সম্পদ। সে যেখানেই তা পায় লাভ করতে চেষ্টা করে। তিনি বলতেন, ইউরোপ এবং আমেরিকার বিজ্ঞানের ওপর কোন ঠিকাদারী নেই। ইসলাম ও মুসলিমদের কল্যাণ এবং মংগলের জন্য অনুসন্ধান ও গবেষণা এবং অগণিত সৃষ্ট বস্তু নিয়ে পুরোপুরি চিন্তা-ভাবনা করা আমাদের কর্তব্য। তিনি প্রায়ই বলতেন যে, আমাদেরকে ময়দানে কাফেরদের মোকাবেলায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে। আইন প্রণয়নে, প্রকৃতি বিজ্ঞানে, রসায়ন শাস্ত্রে, জ্যোতির্বিজ্ঞানে, চিকিৎসাশাস্ত্রে এবং টেকনোলোজিতে আমাদের অগ্রজদের ন্যায় সুনাম সুখ্যাতি অর্জন করতে হবে। জাবের বিন হাইয়ান, আল ফারাবী, ইবনে সিনা এবং অগণিত অন্যান্য মুসলিম মনীষী বৈজ্ঞানিক উন্নতি- অগ্রগতি এবং আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের মৌলনীতি প্রণয়ন করেন। আর আজ আমরা কেন এসব ময়দানে পদচারনা করতে গিয়ে পিছিয়ে পড়বো?
তিনি সংকীর্ণমনা, কুপমন্ডুক, সাম্প্রদায়িক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন না। কিন্তু পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের সর্বাধিক বিরোধী ছিলেন। তিনি পশ্চিমা স্যুট ও তুর্কী টুপি পরিধান করতেন, টেবিলে বসে খানা খেতেন। প্রয়োজনে ছুরি-কাঁটার ব্যবহারেও আপত্তি করতেন না। সুপরিচ্ছন্ন প্রিয়তা ও সূক্ষ্মদর্শিতা এতবেশী ছিল যে স্বীয় হাত ব্যাগে সবসময় আতরের শিশি পুরো রাখতেন। অইখওয়ানী মেহমান সৌজন্য সাক্ষাতকারের জন্য আগমন করলে তিনি দাঁড়িয়ে তাঁদের সাদর সম্ভাসন জানাতেন। মহৎ চারিত্রিক গুণাবলী এবং মৃদু হাসি তাঁর চেহারায় সদাসর্বদা প্রতিভাত হতো। পশ্চিমের কিছু সংখ্যক অন্ধ অনুসারী চিন্তাবিদকে পাশ্চাত্যের সকল সভ্যতা সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী এবং ইউরোপের সার্বিক ফ্যাশনের প্রতি আত্মভোলা বলে মনে হতো। কিন্তু ইমাম শহীদের অবস্থা ছিল এ থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী। তিনি প্রায়ই বলতেন যে কল্যাণধর্মী ও প্রজ্ঞাময় কথাবার্তা অবলম্বন করো কিন্তু অনিষ্টকর ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সবকিছু একেবারেই দূর করে দাও।
যুগের বিপ্লব
ডক্টর ত্বাহা হোসাইন প্রণীত প্রন্থ “মিসরের ভবিষ্যত সংস্কৃতি”- এর ওপর তিনি যে সমালোচনা করেন তার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল এই যে, আমরা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ও গেলামীর তীব্র প্রতিবাদ করছি। তিনি যদি এখন জীবিত থাকতেন তাহলে আমরা টেষ্টটিউবের সাহায্যে জন্মগ্রহণকারী শিশু এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের মত বিষয়গুলোর ওপর তার বিজ্ঞোচিত মতামত ও দৃষ্টিভংগির দ্বারা উপকৃত হতে পারতাম। এটা বড়ই বিস্ময়কর কথা যে, এখন কিছু কিছু মুসলিম পদবী ও গোত্রীয় পরিচিতির অন্ধ পূজায় আত্মতৃপ্তি খুঁজে পায়। অথচ পশ্চিমা পন্ডিতরা টেষ্টটিউবের শিশুদের ওপর অনুসন্ধান ও গবেষণা করে তাকে খুব ফলাও করে প্রচার করছে। বুঝে আসে না কেন স্বাভাবসম্মতভাবে ভুমিষ্ঠ ভাবী পজন্মকে এক দিকে প্রতিরোধ করা হচ্ছে। আর অপরদিকে অস্বাভাবিক উপয়ে টেষ্টটিউবের মধ্যে লালিত বংশধারার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে।
বিভিন্ন মানদন্ড ও পরস্পর বিরোধী আচরণ
আমার মনের কোণে অনেক সময় একটা প্রশ্ন উদিত হয়ে থাকে। সমগ্র দুনিয়ার সাহিত্যিক ও লেখকগণ ইখওয়ানুল মুসলিমুনের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সাথে কেন অব্যাহতভাবে বিষোদগার করে আসছেন। খোদ মিসরে এমন কি মিসরের বাইরে আরো অনেক ইসলামী সংগঠন ও সংস্থা রয়েছে। একথা কি একান্ত বাস্তব সত্য নয় যে সকল সংগঠনই ব্যাপক ভাল কাজের সাথে সাথে কখনো কখনো কোন ভুল ক্রটিও করে বসে। সমালোচনা মুখর সাহিত্যিক সাংবাদকগণ অবশ্য কোন কোন সময় অন্যান্য দলের বিরুদ্ধেও কলম ধারণ করে থাকেন কিন্তু তারপর আবার চুপসে যান। কিন্তু ইখওয়ানের বিরুদ্ধে এ ধারা একেবারে বিরতিহীনভাবে ও অব্যাহত গতিতে কেন পরিচালিত হয়ে আসছে? আমাকে বলুন যে, ইখওয়ান কি কখানো কোন ভাল করেনি? এ সংগঠনটি আগাগোড়া ভুল-ভ্রান্তিতেই ভরা? ইখওয়ানের কোন গুণ কি এসব সমালোচকদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না? যে সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লেখা যেতে পারে কিংবা কোন ভালও মন্তব্য করা যেতে পারে? আল্লাহ তায়ালা কি ইখওয়ানকেই সকল গোনহর আচরণের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন?
আল্লাহ তাঁর নূরকে (দ্বীনকে)পূর্ণতা দান করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে
এসব কাদা নিক্ষেপকারীদের আমি জিজ্ঞেস করতে চাই যে, এরূপ আচরণ ও কর্মতৎপরতার দ্বারাই কি তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে গিয়েছে? ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াত কি দুর্বল হয়ে পড়েছে? ইখওয়ানের অস্তিত্ব কি ধরাপৃষ্ঠ থেকে মুছে গেছে? এ আন্দোলনের গতি কি স্তব্দ হয়ে গেছে? না, কান পেতে শুনে নাও তোমাদের একান্ত প্রত্যাশা সত্ত্বেও ইখওয়ানের শক্তি ও দাওয়াতের বিস্তৃতিই ঘটেছে। এ মিথ্যা প্রচারক ও অপবাদ দানকারীদের মোকাবিলায় কখনো কখনো কোন কোন স্থান থেকে হকের আওয়াজই উত্থিত হয়ে থাকে। তথাপি আমাদের নিকট এমন কোন উপায় উপকরণ নেই যে, আমরা প্রত্যেকের জবাব দিতে পারি। আমাদের দুশমনদের সার্বিক চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালা তার অসীম দায় ও অনুগ্রহের বদৌলতে আমাদের পয়গামকে প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত প্রসার লাভ করার সুব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। আমরা দুর্বল অক্ষম; কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কুদরাত ও ক্ষমতা অসীম।
৯৩৯ সালে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শুরু হয় তখন ইখওয়ান পুরোপুরিভাবে ছিল সুসংগঠিত। যদি ইখওয়ান ইচ্ছা করতো তাহলে মিত্র শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারতো। কিন্তু ইমাম শহীদ এ পরিস্থিতিতে তাঁর শক্তি ও ক্ষমতা নিরাপদ রেখে কেবলমাত্র দাওয়াতী কাজের সম্প্রসারণের জন্য দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ করতে চাচ্ছিলেন।তিনি তার সংগঠনের সমস্ত কর্মী ও শাখাকে এ মর্মে নির্দেশ প্রদান করনে যেন তারা নীরবে নিজ কর্ম সম্পাদন করে যেতে থাকে। এবং মিত্র শক্তির বিরুদ্ধে অক্ষ মক্তির সাহায্যে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ইতিবাচক কাজে আন্তরিকতা প্রদর্শনের জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
ইমাম শহীদ সমীচীন মনে করেননি যে, দুই বাতিল শক্তির লড়াইয়ে কোন এক পক্ষক্যে সাহায্য প্রদান করা হোক। যদিও কোন কোন লোকের মনোভাব এরূপ ছিল যে, সাম্রজ্যবাদকে ঘায়েল করার জন্য জার্মানীকে সাহায্য করা উচিত। ইখওয়ানের নির্লিপ্ততা ও পক্ষপাতহীনতা মিত্র শক্তিগুলোর সফলতা ও বিজয়ের পথ সুগম করে দেয়। এতদসত্ত্বেও জনগণ ইমামকে ও ইখওয়ানকে খুবই খারাপ বিনিময় প্রদান করে। ইমামের বিরোধীতায় শত্রুদের ক্রোধ ও প্রতিহিংসা কোন ব্যক্তিগত বিদ্বেষের কারণে ছিল না। বরং ছির এ দা্ওয়াতের কারণেই যাকে দুশমন তাদের জন্য বিপজ্জনক মনে করতো। অলস নিদ্রায় বিভোর মুসলিম মিল্লাতকে এ দাওয়াত পুনরায় জাগিয়ে তোলে। সাথে সাথে তাদের মধ্যে এ অনুভূতিও সৃষ্টি করে যে, ইসলাম শুধু পূজাপার্বণের ধর্ম নয়। বরং একটা পূর্ণঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ কেবলামত্র আনুষ্ঠানিক ইবাদাতের নাম নয় বরং এগুলোর ওপর ইসলামী আদর্শের মজবুত ও আলীশান মহল নির্মিত হওয়া উচিত। মুসলিম জাতীর শক্তি, সম্মান, সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং উন্নতি ও অগ্রগতির রহস্য অইসলামী আদর্শকে খতম করে ইসলামী আদর্শ কায়েমের মধ্যেই নিহিত। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ওপরই ফরজ আইন পালন করা জরুরী। যদিও ফরজে কেফায়ার জন্য অন্ততপক্ষে একটা দল থাকাই যথেষ্ট। যদি এ দলই ফরজে কেফায়া আদায় করতে থাকে তাহলে সওয়াব তো তারাই লাভ করবে। কিন্তু গোনাহ থেকে পুরো উম্মাত বেঁচে যাবে।
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের আন্দোলন সমস্ত উম্মতের পক্ষ থেকে দাওয়াতে হকের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। অমুসলিমগণ কিছুতেই এ মহতী উদ্যোগকে পছন্দ করতে পারে না যে, মুসলিম জাতি পুনরায় তাদের হৃতগৌরব ফিরে পাক। আলহামদু লিল্লাহ এখন রোগ নির্ধারিত হয়ে গেছে। অতএব এর চিকিৎসা করার সম্ভব। রোগের জীবানু চিহ্নিত করা হয়ে গেছে সত্য কিন্তু জানা নেই যে, কেন উম্মতে মুসলিমাহ তার প্রতিকার করতে ব্রতী হচ্ছে না। এখন যদি এ ব্যাধি থেকে রক্ষা না পাওয়া যায় তাহলে শুধুমাত্র রোগীদের অনমনীয়তা এবং চিকিৎসা থেকে পলায়নী মনোভাবই হবে তার জন্য দায়ী।
ইখওয়ান শ্রমিক সংগঠনসমূহ
ইমাম শহীদ বহুদিন পূর্বেই ট্রেড ইউনিয়ন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন এবং এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এতে ইখওয়ানের অংশগ্রহণ করা উচিত। তার সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত ছিল এই যে, ইখওয়ানের অংশগ্রণের ফলে একাধারে ইউনিয়ন ও ইউয়ন সদস্যগণের উপকার হবে। এ চিন্তা-ভাবনা কোন বিদায়াত ছিল না। ইসলামী সরকারসমূহের মধ্যে বিভিন্ন পেশার সাথে জড়িত ব্যক্তিগণ আপনাপন সংগঠন কায়েম করছিল। যেমন তামার কর্মকার-কয়লা বিক্রেতা এবং অন্যান্য বাণিক ও ব্যবসায়ীগণ পথনির্দেশনা লাভের জন্য নিয়মিতভাবে কোন না কোন শাইখের সাথে সম্পর্ক রাখতো। তারা তার নিকট থেকে সামগ্রিক ব্যাপারেও লেন-দেনের সকল ক্ষেত্রে দিকনিদের্শনা লাভ করতো। বর্তমান কালে সম্পর্ণ নতুন ভংগীতে সেই প্রথা ও প্রচলনেরই সুবিন্যস্ত করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিলো। অতএব ইমাম হাসানুল বান্না দ্বীনের প্রতি ভালবাসা পোষণকারী যুবকদেরকে উপদেশ দেন যেন তারা এ দিকটির প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টিপাত করে। বাহ্যত এ কাজটি বড়ই কঠিন বলে মনে হয়। কিন্তু নিয়মিতভাবে ও পরিকল্পিত উপায়ে উদ্যেগ প্রহণ করা হলে দ্বীনের প্রতি অনুরাগী ব্যক্তি ও শক্তি সকল ছোট বড় ট্রেড ইউনিয়নে কার্যকরী ও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ও বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকা সত্ত্বেও ইখওয়ান সকল ট্রেড ইউনিয়নে মজবুত শিকড় গেড়ে বসতে সক্ষম হয়।
ইমাম হাসানুল বান্না এ ময়দানে অত্যন্ত মূল্যবান খেদমত আঞ্জাম দিতে সমর্থ হন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও সুদূর প্রসারী দুষ্টিভংগির অধিকারী পথ প্রদর্শক। ছোট বড় সকল ব্যাপারে গভীর দূরদৃষ্ট ছিল। আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করুন যেন মানুষের সম্মুখে প্রকৃত সত্যের দ্বার উন্মোচিত হয়ে যায় এবং তারা মনে প্রাণে এ সত্য উপলব্ধি করতে পারে যে, ইখওয়ান কোন ব্যক্তি বিশেষের আনুগত্য করে না। কিংবা তাকে নিষ্পাপ প্রমাণ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে না। ইখওয়ান বরং তাওহীদী আকীদার পতাকাবাহী এবং আকীদা-বিশ্বাসই তাদের দিল ও দেমাগে দেখতে পাওয়া যায়। নেতৃত্ব হাসানুল বান্নার হাতে থাকুক কিংবা অপর কোন ব্যক্তি এ গুরু দায়িত্ব সামাল দিক তাতে কোন পার্থক্য সূচিত হয় না। যদিও ফুজলত ও মর্যাদা অগ্রগামীরাই লাভ করে।
সুস্পষ্ট ঘোষনা
আপনি কি জানেন ইখওয়ানুল মুসিলিমুন কি চায়? এ প্রশ্ন কত মানুষের মনে উদিত হয়ে থাকে। বিশষত সেই সব লোকদের মনে যারা বর্তমান বিজ্ঞানের উন্নতি অগ্রগতিতে প্রভাবিত হয়ে ইসলামকে অনগ্রসরতা ও পশ্চাদপদতার প্রতীক বলে মনে করে। তারা এ প্রশ্ন নানা ভংগীতে উত্থাপন করে। অথচ এর জবাব আমাদের নিকট খুবই সোজা ও সুস্পষ্ট। আমরা আজও তাই চাই যা ১৯২৮ সালে আমাদের প্রাণ প্রিয় সংগঠনের প্রতিষ্ঠা লগ্নে বলেছিলাম।
১- জীবনের ছোট বড় সকল ব্যাপারেই আল্লাহর শরীয়াতের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন।
২- বিজ্ঞান এবং অন্যান্য সকল প্রকার জ্ঞান থেকে উপকৃত হওয়া। এগুলোর উৎসমূল যাই হোক না কেন! এমনকি জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোন কথা যদি ইহুদীদের নিকট থেকেও পাওয়া যায় তা হলেও তা অকপটে গ্রহণ করতে হবে। তা নিসন্দেহে আমাদেরই হারানো সম্পদ।
৩- ইসলামী ঐক্য সংহতি ভৌগলিক সংকীর্ণতার পরিসমাপ্তি। এ কৃত্রিম সীমারেখাসমূহ উম্মতে মুসলিমার অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার কারণ এবং সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী উৎস। আমরা একটি উম্মতের অন্তর্গত- যাদের দেশ ইসলাম এবং শ্লোগান কালেমায়ে তাউয়্যেবা।
৪- মুসলিমদের অতীত গৌরব পুনরুদ্ধার তাদের শক্তি-সমর্থ, তাহযীব-তামদ্দুন এবং শাক্তি ও নিরাপত্তাকে পুরোপুরিভাবে সমস্ত মানবতার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া।
৫- পারস্পরিক বুঝাপড়া ও আলাপ আলোজনার মাধ্যমে বিশ্ব সমস্যাসমূহকে হকের ভিত্তিতে সমাধান করা। উপনিবেশবাদ দ্বাসত্য ও লুটতরাজের অবসান।
উপরুল্লিখিত দাফগুলোকে কেউ কেউ অযৌক্তিক ও অসম্ভব বলে মনে করে। কিন্তু এটা ভাবে না যে, এগুলোই ইতিহাসের পাতায় অংকিত রয়েছে। আমরা কল্পনাবিলাসী নই। বরং বাস্তববাদী। আমরা জীবনকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করে থাকি এবং একজন সভ্রান্ত, প্রবিত্র ধ্যান-ধারনা ও স্পষ্টভাষী মু’মিনের জীবন যাপন করে থাকি।
আমাদের বিরোধীরা কি আমাদের মনোভাব সম্বন্ধে সম্যকরূপে পরিজ্ঞাত হয়ে গেছেন? নাকি তাদের চিরাচরিত অভ্যাসকেই আকড়ে ধরে চলবে? আমি ইসলামী জাহানের সমস্ত দায়িত্বশীলের সমীপে আরজ করতে চাই যে, সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে ও ঐকান্তিক নিষ্ঠার সাথে এ দাওয়াতের মূল্যায়ণ করুন এবং দেখুন যে এর মধ্যে তাদের জন্য এবং তাদের জাতিসমূহের জন্য কি পরিমাণ কল্যাণ ও মংগল নিহিত রয়েছে। তাদের গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করা উচিত যে, এ মহতী দাওয়াতের সাথে বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করে এবং বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তারা তাদেরই জাতি এমনকি স্বয়ং নিজেদের জন্যও কল্যাণকর কিছু করছে না। এ জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী এবং আগামীকালের আগমন নিশ্চিত। সে দিনের ব্যাপারে আল্লামূল গুয়ুব ইরশাদ করেনঃ(আরবী *************)
“(অতপর কি হবে তখন) যখন নভোমন্ডল দীর্ণ বিদীর্ণ হয়ে যাবে ও লাল চামড়ার মত রক্ত বর্ণ ধারণ করবে............অপরাধী লোকেরা সেখানে নিজ নিজ চেহারা দ্বারাই পরিচিত হবে এবং তাদের কপালের চুল ও পা ধরে হেঁচড়ে টেনে নেয়া হবে। তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নিয়ামত ও শক্তিকে অস্বীকার করবে?
বর্তমান আইনের সংশোধন কি সম্ভব নয়? অনুরূপভাবে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, নৈতিক-চরিত্র এবং জীবনের অন্যান্য বিষয়ের সংস্কার কি করা যায় না? এসবই সম্ভব। তাহলে এড়িয়ে চলা এবং টালবাহানা কেন? মুসলিম শাসকদেরকে আমরা জানিয়ে দিতে চাই যে, আমরা আল্লাহ তায়ালাকে সাক্ষী রেখে তোমাদেরকে এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, তোমদের সাথে আমাদের ব্যক্তিগত কোন শত্রুতা নেই। আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যখনই মুখ খুলবো তখন তোমাদের কল্যাণ কামনা ও সদুপদেশের জন্যই খুলবো। আমাদের দৃষ্টিতে ক্ষমতার মসনদের সংস্কারই সকল সংশোধনের মূল উপায়্। ক্ষমতার মসনদের সংশোধন ও সৎকার যদি হয়ে যায় তাহলে সমগ্র পৃথিবীবাসী সংশোধিত হয়ে যাবে। পুলিশের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করার পরিবর্তে প্রকৃত সত্য উদ্ধার করতে সচেষ্ট হও। তোমাদের সম্মান তোমাদের দেশ ও জাতির সাথে সম্পৃক্ত। একইভাবে তোমাদের জাতির সম্মন ও মর্যাদা নিবিড়ভাবে জড়িত তোমাদের সাথে। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা সকল বিষয়ের তত্বাবধায়ক ও ব্যবস্থাপক। কবির ভাষায়ঃ
“তোমরা যদি মুহাম্মাদ (সা)- এর সাথে বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে পারো তাহলে আমি তোমাদের এ দুনিয়া আর এমন কি লাওহ ও কলম পর্যন্ত তোমাদের হয়ে যাবে অধীন।”
ত্রিশতম অধ্যায়
মন্ত্রীত্বের আকাঙ্খায়
জনাব শাইখ আল বাকুরী মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবির অনুমতি না নিয়েই মন্ত্রীত্ব কবুল করেছিলেন। মুর্শিদে আ’ম শাইখ আল বাকুরীকে জিজ্ঞেস করেন, “এখন ইখওয়ান সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভংগি ও মনোভাব কি”? তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, “আমি মাকতাবে ইরশাদে গিয়ে ইস্তফা দিয়ে দিচ্ছি।” পুনরায় পশ্ন করলেন “তারপর”? শাইখ বাকুরী জবাব দিলেন, “ইখওয়ানুল মুসলিমুনের বুনিয়াদী রকুনিয়াতের পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
শাইখ বাকরীর মন্ত্রীত্বের মোহ ও নেশা তাকে আন্দোলন থেকে পুরোপুরি সরে দাঁড়াতে বাধ্য করেছিলো। ইখওয়ান অস্থির হয়ে পড়েছিলেন এই ভেবে যে, তিনি কত নিকৃষ্টতম সওদা করে ফেলেছেন। কি খারাপ সিদ্ধান্তেই না উপনীত হয়েছেন। মুর্শিদে আ’ম ছিলেন খুবই বদ্ধিমান, বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। তিনি শাইখ আল বাকুরীর দফতরে তাশরীফ নিয়ে যান এবং মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য তাকে মোবারকবাদ জানান। এ সময় সন্ত্রণালয়ে মুর্শিদে আ’ম এবং শাইখ আল বাকুরীর সাক্ষাতের যুগ্ম ছবি সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়েছিল। শাইখ বাকুরীকে জনৈক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, মুর্শিদে আ’ম- এর ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? জবাবে তিনি আলোচ্য ছবিব প্রতি ইংগিত করে বলেন, “তোমরা দেখতে পাচ্ছো যে, আমি মর্শিদে আ’মের সম্মুখে এমনভাবে বসে রয়েছি যেমন করে কোন শাগরেদ তার উস্তাদের সামনে শালীনতা ও সৌজন্যবোধ সহকারে বসে থাকে।” আন্দোলন থেকে শাইখ বাকুরীর বেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আমরা তার কতিপয় গুণাবলী ও বৈশীষ্ট্যের স্বীকৃতি দেই। তিনি ছিলেন বড় উত্তম আচরণের অধিকারী ও সহৎ নৈতিক চরিত্রের গুণে বিভূষিত। আল্লাহ তায়ালা তাকে এবং আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন।
পরীক্ষা নিরীক্ষার পর্যায়
জামাল আবদুল নাসের ইখওয়ানের বিরুদ্ধে যখন অভিযান শুরু করেন তখন মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তাকেও বাদ দেয়া হবে না। তথাপি তিনি সত্য প্রকাশের দায়িত্ব অব্যাহতভাবে আদায় করতে থাকেন। ইখওয়ানের কত নিরপরাধ ও নির্দোষ সাথীদের সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে কঠোর শাস্তির নির্দেশ শুনানো হয়। আমাদের এসব ভাই উচ্চ খান্দানের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। ডাক্তার হোসাইন কামালুদ্দিন, উস্তাদ মুনীর দাল্লা এবং ডাক্তার মুহাম্মাদ কামাল খলিফা তিন জনকেই ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডাদেশ শুনানো হয়। উস্তাদ মুনীর দাল্লা ছিলেন মিসরের বিখ্যাত ও স্বনামধন্য ধনী এবং প্রখ্যাত দাল্লা বংশের প্রদীপ্ত প্রদীপ ও গৌরবোজ্জল ব্যক্তিত্ব। মিসরবাসীর খেদমতে এ গোত্রের কৃতিত্বের পরিচয় নতুন করে দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। ডঃ হোসাইন কামাল উদ্দীন ছিলেন সে আমলে আইন কলেজের অধ্যক্ষ এবং সুপরিচিত আলেম আল্লামা শাইখ আহমদ ইবরাহীমের বংশধর। অনুরূপ ডাক্তার কামাল খলিফা ছিলেন সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী মুহাম্মাদ পাশা আল আসমাভী মরহুমের জামাতা।
মুর্শিদে আ’ম শাস্তির ফায়সালা শুনতে পান। তিনি নিজের বিচার বিভাগের সদস্য ছিলেন। এজন্য এসব ফায়সালা দেখে তার নিশ্চিত বিশ্বাস হয়ে ছিলো যে, সরকার ইখওয়ানের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা রুজু করে সাজা দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এতদসত্ত্বেও তিনি ইংরেজদের সাথে আবদুন নাসেরের মৈত্রী চুক্তির সমালোচনা করেন এবং তার সকল নেতিবাচক ও অনিষ্টকর দিকগুলো প্রমাণসহ এবং বিজ্ঞজনোচিতভাবে বিশ্লেষণ করেন।
তার মতে সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করতে গিয়ে যদি জীবনের ঝুঁকিও নিতে হয় তাহলেও মু’মিন বান্দাকে সত্যের স্বার্থে তা কুরবান করা উচিত। তিনি একজন আই-নবিশেষজ্ঞ ম্যাজিষ্টেট, জজ এবং মুর্শিদ হিসেবে জীবন যাপন করেন। তার পুরো জীবনের রেকর্ড ছিল নিষ্কলুষ এবং উজ্জ্বল। সম্ভবত অভিকাংশ লোক এ সত্য সম্পর্কে অনবহিত যে, ইখওয়ানের নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য আমরা তাকে বার বার বহু অনুরোধ উপরোধ করি। অথচ তিনি বরাবরই তার শারীরিক দুর্বলতা এবং এ গুরুদায়িত্বের বোঝা উপলব্ধি করে অক্ষমতা প্রকাশ করতে থাকেন। আমরা যখন বার বার অনুরোধ জানাই তখন তিনি এ পদ গ্রহণ করেন। একবার তিনি বোঝা কাঁধে তুলে নেয়ার পর তার হকও যথাযথ পালন করেছেন। আন্দোলনের স্বার্থে তিনি তার যথা সর্বস্ব কুরবানী করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ইখওয়ানের ঐক্য ও সংহতি অটুট রাখার জন্য এবং দাওয়াতের হকের প্রদীপ সমুজ্জল রাখার লক্ষ্যে তিনি তার সর্বশেষ রক্তবিন্দুও এ পথেই ব্যয় করেছেন।
স্মরণীয় ছবি
একবার আমরা তাঁর সাথে হালওয়ান মুরুভূমি এবং হাওফ উপত্যকায় সফরে যাই। ভ্রমণ ব্যাপদেশে মরুভূমিতেই মধ্যহ্নভোজের সময় হয়ে যায়। আমরা এক জায়গায় থেমে নাময পড়লাম এবং খাবার গ্রহণ করলাম। পানাহার শেষে তিনি তার মূল্যবান স্যুট পরিহিত অবস্থায়ই বালির ওপর শুয়ে পড়লেন এবং কয়েক মিনিট আরাম করেলেন। আমি এ স্মরণীয় মুহূর্তে তাঁর ছবি তুলে নিলাম। ফিরে আসার পর আমি তাকে সেই ছবি দেখালাম এবং এ ছবি ছাপানোর অনুমতি চাইলাম। তিনি খুব কঠোরভাবে নিষেধ করলেন এবং বললেন, “ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কখনো এ ধরনের সস্তা খ্যাতি ও নাম-যাশের পশ্চাতে ধাবিত হওয়া উচিত নয়। আমাদের প্রতিটি কাজই শুধু মাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হয়ে থাকে। আর আমাদের রব আমাদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত। তাই মানুষের কাছে প্রচার করে বেড়ানোর কোনই প্রয়োজন নেই। আমি এ ছবি নিজের কাছে সংরক্ষিত রেখেছি। এমনকি ১৯৫৪ সালে আবদুন নাসেরের গোমস্তারাও আমার গৃহে অভিযান চালিয়ে সমস্ত রেকর্ডপত্র নিয়ে যায় যার মধ্যে এ ছবিটিও ছিল।
মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবি তাঁর জীবনের সুদীর্ঘ কাল বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। সকল ব্যাপারেই তার দৃষ্টিভংগী আইনের চৌহদ্দীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো। যে সংগঠনের পরিচালনার দায়িত্ব এমন নিয়মানুবর্তী ব্যক্তির ওপর থাকে তার কখনো কোন সন্ত্রাসী তৎপরতা ও স্বেচ্ছাচারিতামূলক আচরণের সাযোগই থাকে না। আমাদের শত্রুরা আমাদের ওপর সর্বদা দোষারোপ করতেই অভ্যস্ত অথচ আমরা তার জবাবে নীরবতা অবলম্বন করাটাকেই অধিকতর সমীচীন বলে মনে করি।
বন্ধুদের সাঝে বিনম্র কিন্তু হক ও বাতিলের দ্বন্দ্বে ইস্পাত কঠিন
দ্বিতীয় মুর্শিদে আ’ম ছিলেন বড় কোমল হৃদয়ের অধিকারী। আবার বাতিলের মোকাবিলায় ছিলেন অকুতোভয়। মিসরের কারাগারে আমি তাঁর সাথে একই সেলে বন্ধী ছিলাম। তৎকালীন কায়রোর গভর্ণর যার নাম এখন আর আমার মনে নেই একবার জেলখানা পরিদর্শনে আগমন করেন। গভর্ণরের আগে আগে সামরিক জোয়াণ চলছিলো। সে প্রতি সেলের সামনে গিয়ে সজোরে পা মাটির ওপর মারতো এবং ফৌজি কায়দায় নিদের্শ জারী করতো। সে আমাদের সেলের সম্মুখে পৌঁছলে জেলখানার নিয়মানুযায়ী আমি উঠি দাঁড়ালাম। মুর্শিদে আ’ম (র) অবিচলভাবে স্বস্থানে বসে রইলেন এমনকি বিন্দুমাত্র নড়াচড়াও করলেন না। ভাবখানা যেন কিছুই হয়নি। ফলে গভর্ণর তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। তিনি তাঁকে সম্বোধন করে বলতে লাগলেন, “যদি তোমরা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে তাহলে আল্লাহ আমাদের মোকাবিলায় তোমাদের সাহায্য করতো।” তিনি সম্পূর্ণ অনমনীয়ভাবে স্বীয় আসনে উপবিষ্ট থেকে অত্যন্ত প্রশান্ত বদনে জবাব দিলেনঃ “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে মুসলিমদের সন্দেহের অবকাশ নেই। অথচ তাঁর সত্যের পথের দিশারী হওয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। আমাদের ও তোমাদের বর্তমান অবস্থাকে ভিত্তি করে হক ও বাতিলের ফায়সালা করা একেবারেই অর্থহীন।
গভর্ণর তার এ জবাব শুনে নীরবে চলে গেলেন। তার চলে যাওয়ার পর মুর্শিদে আ’ম আমাকে তিরস্কার করেন এবং বলেনঃ “তুমি দাঁড়িয়ে গেলে কেন? তোমার জানা থাকা উচিত যে, জালিমের জন্য তার মিথ্যার ঔদ্ধত্যের পরাজয় অপমানবোধের কার্যকর উপায়। অত্যাচারী যখন দেখতে পায় যে, জনগণ তার ভায়ে ভীত সন্ত্রস্ত এবং তার সামনে করজোড়ে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকে তখন তার দুর্বিনীত প্রবৃত্তি আরো ঔদ্ধত্য হয়ে ওঠে। কিন্তু যখনই সে উপলব্ধি করতে পারে যে, জনসাধারণ তাকে কোন গুরুত্বই দেয় না- তখন তার আমিত্বের তাজমহল ধড়াস করে সাটিতে পড়ে যায়। আর সে অংগারের ওপর গড়াগড়ি খেতে থাকে। তার এই কর্মনীতিতে হকপন্থীদের জন্য বিরাট শিক্ষা রয়েছে।
ফেরাউনকে কেউ জিজ্ঞেস করেছিলো, “কোন জিনিস তোমাকে ফেরাউনিয়াত পর্যন্ত এনে পৌঁছিয়েছে?” ফেরাউন জবাব দিয়েছিলো, “কেউ আমার কোন কথা অমান্য করতে পারতো না তাই আমি ফেরাউনে পরিণত হয়েছি।” জালিমের মধ্যে কোন উত্তম স্বভাব এবং নৈতিক গুণাবলী থাকে না। যে মানুষ তার সম্মান করবে সে তার বস্তুগত শক্তি এবং বাহ্যিক শান-শওকত দ্বারা মানুষের ওপর মিথ্যা প্রভাব সৃষ্টি করে। যখনই সে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে যায় তখনই গাধার ন্যায় অপমাণিত ও বাইরের কোন বিষয়ের মুখাপেক্ষী হয় না। সে হাতিয়ার ছাড়াই নিজ ঈমানী শক্তি ও আত্মমর্যাদাবোধের কারণে বলীয়ান হয়ে ওঠে। সে বড় থেকে বড় তাগুত এবং অত্যাচারী বাদশাহর সম্মুখেও কারেমায়ে হক বলতে সংম্কচ বোধ করে না। বস্তুত যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে তার সামনে কারো কোন গুরুত্বই নেই যাকে সমীহ করে চলা যেতে পারে।
জনৈক জ্ঞানী ব্যক্তি সম্পর্কে একটি দৃষ্টান্তমূলক ও শিক্ষাপ্রদ কাহিনী বর্ণনা করা হয়ে থাকে। তার ওপর কোন এক অত্যাচারী শাসক অত্যাচার চালা্য়। অনন্তর সে জালিম মজলুম ব্যক্তিকে বলে, “আমি এবার তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম- এখন তোমার যা ইচ্ছা আমার কাছে চাও।” নিগৃহীত ব্যক্তি স্বতঃস্ফুর্তভাবে বলে উঠলো, “আমাকে অমর জীবন দান কর।” জালিম লোকটি বলে উঠলো, “এ তো আমার ক্ষমতা বহির্ভূত।” মজলুম বললো, “আচ্ছা এটা যদি তুমি করতে না পারো তাহলে আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দাও।” জালিম উত্তর দিলো, “একাজও তো কেবল আল্লাহ তায়ালার। তিনি ইচ্ছা করলে কাউকে জান্নাতে দাখিল করাতে পারেন।” অতপর মজলুম ব্যক্তি তৎক্ষাণাৎ বললো, “তোমার ইখতিয়ারে দুনিয়াও নেই আখেরাতও নেই। তাহলে তুমি কোন ভরসায় আমাকে উৎসাহিত করতে পারলে যে চাও কি তোমার পেতে ইচ্ছা করে।” ওগো জালিমদের ভয়ে অস্থির ব্যক্তিগণ! এটা কি নির্মম সত্য ও বাস্তবতা নয় যে, জালিম নিজেই কত দুর্বল, অক্ষম ও অসহায়। তারপরও আবার তাকে ভয় করে ও সমীহ করে চলার কি অর্থ থাকতে পারে।
সৎলোকদের সাহেচর্যর প্রভাব
হাসানুল বান্না এবং হাসান আল হুদাইবি যুগপৎভাবে কোন ব্যক্তির ওপর তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কিছু চাপিয়ে দেয়া আদৌ পছন্দ করতেন না। যেসব লোক সংগঠন থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো দুই মর্শিদের কেউই তাদের সম্পর্কে কখনো কোন কঠোর আচরণ ও নির্দয় ব্যবহারের নীতি অবলম্বন করেননি। উস্তাদ হাসানুল বান্না (র) একবার আল বুহাইরা প্রদেশ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। এক জায়গায় জনৈক প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তি তার মেহমানদারী করেন্। মেজবান উতিপূর্বে কখনো মুর্শিদ আ’ম সম্পর্কে তেমন কিছুই জানার সুযোগ পাননি। তিনি শুধু একজন সম্মানিত মেহমান মনে করেই তাঁর অবস্থান করার জন্য সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন্ কিন্তু তিনি যখন তার কথাবর্তা শুনলেন কখন বলতে লাগলেন, “আপনি যা বর্ণনা করলেন তাতে আমি অত্যন্ত প্রভাবিত ও বিমুগ্ধ হয়ে পড়েছি। অবশ্য আমি কিছু কিছু ভাল কাজও করে থাকি, যেমন মিছকিনদের পৃষ্ঠপোষকতা, গরীব ও অভাবগ্রস্তদের সাহায্য সহযোগিতা এবং সালাত ও সওমের নিয়মানুবর্তিতা। কিন্তু তার সাথে সাথে আমার মধ্যে একটা গুনাহের কুঅভ্যাসও আছে। আমার মনে হয় যেন আমি এ গুনাহের কাজ পরিত্যাগ করতে পরবো না।”
মুর্শিদে আ’ম জিজ্ঞেস করলেন, “এটা এমনি কি গুনাহ যা আপনি ছেড়ে দিতে পারবেন না?” আমীর ব্যক্তি জবাব দিলেন, “আমি মাঝে মধ্যে মদ্য পান করে থাকি। আর এ বদ অভ্যাসই আমার সংগঠনে যোগদান পথে অন্তরায় হয়ে আছে।” কোন মানুষ ধারণাও করতে পারে না যে, এই পরিস্থিতিতে ইমাম সে মদ্যপ ব্যক্তিকে কি জবাব দিয়েছিলেন। বাস্তবিকই তার উত্তর ছিল অনন্য ও অসাধারণ! কিন্তু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই প্রতীয়মান হবে যে, এ জবাব ছিল একেবারেই সময়োপযোগী সমীচীন। ইমাম শহীদ বললেন, “আমাদের সাথে শামিল হয়ে যাও আমরা এ অবস্থায়ই তোমাকে বরণ করে নেবো।” সে ব্যক্তি বিস্মিত ও অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।
ইমামের এ ইরশাদের অর্থ আবার এও নয় যে, তিনি মানুষের মদ্য পানাভ্যাসকে জায়েজ বলে মনে করতেন। কখ্খনো নয়। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল তার দূরদর্শিতার পরিচায়ক। যদি সে ব্যক্তিকে ঐ অবস্থার ওপর ছেড়ে দেয়া হতো তাহলে সে হয়তো আর কখনো শরাবখুরী ছেড়ে দিতে পারতো না। অপরদিকে যদি তাকে সাংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া যেতো এবং তাকে মুসলিমদের সাথে একই মোতির মালায় গ্রথিত করে দেয়া হতো তাহলে তাদের সাহচর্য্যর প্রভাবে তার মদ্যপান অভ্যাস পরিত্যাগের সম্ভাবনাই ছিল বেশী।
কার্যত ইখওয়ানের সাথে যোগদানের পর সে ব্যক্তির সান্নিধ্যের প্রবল প্রভাব পড়ে এবং সে উম্মুল খাবায়েস থেকে পরিপূর্ণ রূপে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হন। গুনাহগারদের সংশোধনের পন্থা, পদ্ধতির মধ্যে এটাও একটা যে, তাদের ধিক্কার দেয়া ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার পরিবর্তে নিজের কাছে টেনে নিতে হবে। চলাতে হবে তাদের সংশোধনের সযত্ন প্রয়াস।
আমাদের আন্দোলনের জীবন অনুরূপ বেশ কিছু দৃষ্টান্ত আছে। আমি তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে যাচ্ছি না। এ উদাহরণ পেশ করার উদ্দেশ্য হলো সুধী পাঠকগণকে জানিয়ে দেয়া যায় যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন আত্মগর্ভ থেকে পুত-পবিত্র থাকতে রয়েছে তৎপর এবং লোকদের জন্য তাওবার দরজা তারা কখনো বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করেনি। আমাদের পয়গম মানুষকে রহমাতে রব্বানীর জন্য আশাবাদী করা তাদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে দেয়া নয়। এই যাদের কর্মপদ্ধতি তারা কি কখনো সন্ত্রাস এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগির পথ অবলম্ভন করতে পারে?
মরীদ থেকে মুর্শিদে আ’ম
উস্তাদ হাসানুল বান্না তাঁর সংগীদের ব্যক্তিগত বিষয়সমূহের ব্যাপারেও খোঁজ খবর নিতেন এবং তাদের সাথে একান্ত সাক্ষাতের সময় ব্যক্তিগত বিষয়ও জানতে চেষ্টা করতেন। একবার তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি কি আদালতের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পাদনের প্রতি কোন আকর্ষণ বোধ কর না?” প্রত্যুত্তরে আমি আরজ করলাম, আদালতের সদস্যদেরকে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে থাকি এবং এ পদ আমার নিকট অত্যন্ত সম্মানজনক বলেই মনে হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বও মাননীয় জজ গও বিচারপতিগণকে বহু অন্যায় ও অবৈধ বিধি-নিষেধের শৃংখলা আবদ্ধ করে রাখা হয়। ফলে তাদের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ অনেক সীসাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আমি স্বভাবতই আমার নিজেকে এরূপ ধরাবাঁধা নিয়েমের বন্ধন থেকে মুক্ত রাখতে চাই যাতে আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসূল (সা)- এর অনুমোদিত সীমানার মাঝে কোথাও আমার সামনে কোন প্রতিবন্ধকতা এসে দাঁড়াতে না পারে। আমি চাই, আমার সময় কোন চাকুরীর শৃংখলে আবদ্ধ হয়ে না পড়ুক। চাকুরীকে যে নামেই আখ্যায়িত করা হোক না কেন সর্ববাস্থায়ই তা বাধ্যবাধকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। একজন উকিল বা আইনজীবী হিসেবে আমার যে স্বধীনতা রয়েছে আমি তা জলাঞ্জলী দিতে পারি না। এখন আমি স্বাধীন, তাই যেভাবে ইচ্ছা আমার প্রোগ্রাম তৈরী করতে পারি।” তিনি আমার জবাব শুনে প্রশান্ত ও নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন এবং এ বিষয়ে আমাকে আর কখনো কোন প্রশ্ন করেননি।
আমি আমার দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা পোষণ করি। অনেক সময় আমি চিকিৎসা ব্যাপদেশে ইউরোপ ও আমেরিকা যাই। যদি সেখানে দীর্ঘদিন থাকতে হয় তাহলে দেশের কথা স্মরণ করে অস্থির হয়ে পড়ি। ফলে কতবার আমি ডাক্তারদের পরামর্শ থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা অসম্পুর্ণ রেখে মিসরে এসে পড়েছি। প্রসংগক্রমে এখানে জনসাধারণের একটা আপত্তিরও জবাব দেয়া সংগত বলে মনে করছি। কেউ প্রশ্ন করে যে, এ বয়োবৃদ্ধ লোকটি না আছি কোন রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা না আছে বিষয় সম্পত্তি তারপরও কিভাবে প্রায় বিদেশ ভ্রমণের এবং চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করে থাকে? সত্য কথা হলো, আমার কাছে প্লেনের টিকেট ক্রয় করার মত টাকা পয়সাও থাকে না। কিন্তু সমগ্র দুনিয়ার কোণে কোণে ছড়িয়ে থাকা ইখওয়ান জোরজবরদস্তি করে আমাকে এসব দূর পাল্লার সফরের কষ্ট স্বীকার করতে বাধ্য করে। এবং আমার সফর চিকিৎসা ও থাকা খাওয়ার সমূদয় ব্যয় নিজেদের পকেট থেকেই বহন করে। দয়াময় আল্লাহ তায়ালা এসব ভ্রাতাগণকে উত্তম বিনিময় প্রদান করুন যারা শুধু আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টিলাভের নিমিত্তেই আমাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে থাকে এবং সর্বদা বিমানে আমার জন্য প্রথম শ্রেণীর টিকেটের ব্যবস্থা করে। আমি সেই সব ইখওয়ানের অনুরোধক্রমেই একদেশ থেকে অন্যদেশে গমন করে থাকি এবং সর্বত্রই আমার দ্বীনি ভাইগণ আমার সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসে। সর্বোপরি তারা আমাকে বিপুল পরিমাণ তোহফা ও উপটৌকন দ্বারাও ধন্য করে থাকেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর এসব তোহফা আমার বন্ধু বান্ধব এবং সংগঠনের সাথী সংগীদের মাঝে বন্টন করে দেই। কিছু কিছু সংগী সাথী হাসি তামাশাচ্ছলে বলতে থাকে যে, পরবর্তী সফরের সুযোগ আবার কবে আসছে। বিমান বন্দরে যাতায়াতের পথে আমার সাথে যেসব আচরণ করা হয়ে থাকে তার উল্লেখ ইতিপূর্বে করে এসেছি। এসব দুঃখ কষ্টের মোকাবিলায় যখন ইখওয়ানের সাথে দেখা্ সাক্ষাত ও আলাপ আলোচনার সুযোগ লাভ করি তখন সবকিছুই তুচ্ছ বলে মনে হয়। আমি আল্লাহ তায়ালার সমীপে বিনম্র প্রার্থনা করছি যেন আমাদের এ পারস্পরিক ভালবাসা বিশেষভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের স্বার্থেই হয়। সম্ভবত এ বিবরণের দ্বারা সেসব লোক সান্ত্বনা খুঁজে পাবে যারা আমার বার বার বিদেশ ভ্রমণের কারণে চোখ কপালে তুলে থাকেন।
একটা তাজা উদ্যম একটা মহৎ ইচ্ছা
আমি যে দেশেই গিয়েছে সে দেশেই বিপুল সংখ্যক যুবককে আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে দেখেছি। এসব যুবককে দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আন্তরিক প্রশান্তি লাভ করেছি এবং ইসলামী আন্দোলনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখে হৃদয়-মন ভরে উঠেছে। এর সাথে আল্লাহ তায়ালার প্রভূত সাহায্য সহযোগিতাও রয়েছে। কাজেই এর অকাল মৃত্যু হবে না। (ইনশাআল্লাহুল আযীয)
একবার আমি একটা মুসলিম রাষ্ট্রে সফরে গিয়েছিলাম। আমাদের সফরসঙ্গীগণ এক জায়গায় মস্তবড় এক হল রুমে লেকচারের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। বক্তৃতার সময় হওয়ার সাথে সাথে মিলনায়তনে পর্যপ্ত প্রশস্ততা সত্ত্বেও স্থান সংকুলান না হওয়ার অভিযোগ করতে দেখা গেলো। সকল বিবেচনায়ই শ্রোতাদের মধ্যে যুবসমাজের সংখ্যাই ছিল অধিক। ব্যবস্থাপনার পক্ষ থেকে অবহিত করা হলো যে, এ হলের মধ্যেই অধিকাংশ সভা-সমাবেশ হয়ে থাকে। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক জনতার উপস্থিতি শুধু এবারই দৃষ্টিগোচর হলো। যখন ইসলামী আন্দোলনের কোন স্বনাম ধন্য ব্যক্তি ভষণ দিতে আসেন তখন এ পরিস্থিতি একথারই ইংগিত দেয় যে, ইখওয়ানের দাওয়াত এবং এর শান্তিপ্রিয় কর্মনীতি যুবসমাজকে আকৃষ্ট করতে ও তাদের মন জয় করতে সক্ষম হচ্ছে। তারা স্বভাবতই দেখতে পাচ্ছে যে, এসব বক্তৃতা বিবৃতিতে রোমাঞ্চকর ও চটকদার কোন কথা নেই। কিংবা কারো বিরুদ্ধে কাদা ছুঁড়াছুড়িও নেই। এসব বক্তা অলীক কাহিনী শুনান না বরং নিজেদের লক্ষ্যবস্তু ও নির্ধারিত বিষয়ের ওপর মার্জিত, গবেষণামূলক ও ইলমী যুক্তি-প্রমাণ পেশ করে থাকেন।
আমার ঐকান্তিক বাসনা হচ্ছে, এ স্মৃতিকথা প্রকাশের সময় আন্দোলনের মূলনীতি ও কর্মপদ্ধতির বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরবো। আমি যা কিছু উপস্থাপন করার প্রয়াস পাচ্ছি তা কোন ব্যক্তিবিশেষের মনগড়া কথাবর্তা নয় বরং সেসব স্মৃতিকথা যা আমার জীবনোদ্দেশ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে ব্যক্তি শুধু ঘটনাপ্রবাহকে পাঠকদের সম্মুখে সাজিযে পেশ করতে চায় তার স্মৃতিচারণের ভাবভংগি আমার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের হতে বাধ্য। আমার উদ্দেশ্য আন্দোলনের উপলক্ষ বানিয়ে সে আংগিকে আমার স্মৃতিমালা তুলে ধরা। এখানে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ব্যক্তিত্বের পরিস্ফুটন নয় বরং জীবনোদ্দশ্যে পরিবেশনা। আমরা এ দাওয়াতের সাহায্যে আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রাসূল (সা) ও তাঁর দ্বীনের প্রতি সহব্বত পোষণ করতে শিখেছি। এ পথে আত্মত্যাগ করতে হবে এবং এরই স্বার্থে সকল প্রকার ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার কারার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তিই ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না তার কামনা বাসনা সেই দ্বীনের অধীন না হয়। যা নিয়ে আমি আগমন করেছি।” আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে, রিসালাতে মা’আব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার আনীত পয়গাম কতইনা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। মানুষের অন্তরে যতদিন না প্রেম ভালবাসা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে তার দ্বারা কোন বড় কাজ সমাধা হতে পারে না। আমি খুবই আবেগ ও অনুরাগ প্রবণ মানুষ। আমার এই প্রেমপ্রীতি আল্লাহর দ্বীন ও ইখওয়ানুল মুসলিমুনের আন্দোলনের সাথে একই সূত্রে গ্রথিত। আপনারা জানেন যে, একজন প্রেমিক কোন মাহফিলে হউক কিংবা কোন বিশেষ বিষয়ের ওপর ভাষণ দিতে থাকুক সকল অবস্থায়ই সে তার প্রেমিকার আলোচনা না করে থাকতে পারে না। অনুরূপ আমারও এ দুর্বলতা রয়েছে। আমি ও আমার মা’শুকার নাম উল্লেখ না করে কোন কথা বলাকেই সার্থক ও পূর্ণাঙ্গ বলে মনে করতে পারি না।
যদি প্রেম-প্রীতির চূড়ান্ত স্তর পর্যন্ত ভালবাসার অনুপ্রেরণা এবং জীবনের ঝুঁকি নেয়ার মত শপথের বলিষ্ঠতা না থাকতো তাহলে আন্দোলনের স্বার্থে ইখওয়ান যে অতুলনীয় আত্মত্যাগের দৃস্টান্তস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে তা কখানো সম্ভব হতো না। গ্রেফতার ও বন্দী জীবনকে স্বাগত জানানো এবং ফাঁসির মঞ্চকে চুম্বুন করা এ প্রেমেরই চাক্ষুষ প্রমাণ যা আমাদের শিরা উপশিরায় সতত প্রবাহমান। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের সম্বন্ধে বলেছেনঃ (আবরী ************) (আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন আর তারাও আল্লাহকে ভালবাসে) যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার প্রতি মহব্বত পোষণ করে সে কেবল আল্লাহর সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে। আর যে আল্লাহর সম্মা্ন সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয় তার সম্মুখে দুনিয়া এবং তার তাবৎ রূপ-সৌন্দর্য বস্তুগত উপায়-উপকরণ, বৈষয়িক শান-শওকত এবং অস্থায়ী মান-মর্যাদা ও প্রভাব প্রতিপত্তির আর কোন প্রভাব ও গুরুত্ব অবিশিষ্ট থাকে না।
(আরবী************)
(শুধুমাত্র এতটুকু বলে দিন আল্লাহ অতপর তাদেরকে যুক্তিতর্কের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করার জন্য ছেড়ে দিন।)
ইসলামী আন্দোলনের প্রসংগ উপেক্ষা করে আমি কিভাবে আমার স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ করতে পারি? আন্দোলনের কথা যদি বাদ দিলে আর আমার নিজের আত্মজীবনী বলতে কিইবা অবশিষ্ট থাকে? কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, প্রেম কি? তদুত্তরে আমি বলবো, প্রেমই আমার জীবন এবং আমার পোশাক। আমি ভালভাবে জানি যে, আমাকে শয়তানের কুমন্ত্রণা, মানুষের চক্রান্ত এবং রাজা বাদশাহদের রক্তচক্ষু থেকে একটা জিনিসই মুক্তি দিতে পারে, তাহচ্ছে আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালবাসা। (আরবী ************) (তুমি কি মানুষকে ভয় করো? অথচ এ বিষয়ে আল্লাহই সর্বাধিক উপযুক্ত যে তাকেই ভয় করে চলবে।) হে মুসলিম জাতি! আল্লাহর দিকে ফিরে এসো তিনি তোমাদের হিফাজত করবেন তোমাদের শক্তিশালী করবেন। তোমাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করবেন। তোমাদের সম্মুখে আগত সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর করে দেবেন এবং তোমাদের সকল সমস্যার সুষ্ঠ সমাধান করে দেবেন। তোমরা তার প্রতি মহব্বত পোষণ করে মনুষ্যত্বকে সমুন্নত করে তোল তবেই তিনি তার উলূহিয়াতের বরকত দ্বারা তোমাকে অধিকতর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করবেন।
তারা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল
ইখওয়ানের পূর্ববর্তী উভয় মূর্শিদে আ’মই আপনাপন সংগী সাথীদের প্রতি গভীর ভালবাসা পোষণ করতেন। সকল সুখে দুঃখে তারা তাদের সাথে শরীক হতেন। সুদিনে মোবারকবাদ জানাতেন উপহার উপঢৌকন পাঠাতেন এবং নিজেই এ উপলক্ষে তাদের বাড়ীতে তাশরীফ নিয়ে যেতেন। একান্তই যদি নিজে যেতে না পারতেন তাহলে কোন প্রতিনিধিকে পাঠিয়ে দিতেন। অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিতে ভাইয়ের দুঃখ বেদনার ভাগ নেয়ার জন্য তাদের পাশে গিয়ে হাজির হতেন। তাদের এ আচরণ আমীর-গরীব, বিত্তবান ও বিত্তহীন সকলের ক্ষেত্রেই সমান হতো। কারো ওপর কারো কোন পার্থক্য বা শ্রেষ্ঠত্ব ছিল না। তারা তাদের নিত্য দিনের নির্ধারিত দায়িত্ব কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার সাথে সাথে এসব কাজ-কর্মের প্রতিও খুবই গুরুত্ব দিতেন। এই দুই অনুপম ব্যক্তিত্বই নেতাদের জন্য উত্তম দৃষ্টান্তস্থাপন করে গেছেন।
ইখওয়ান তাদের উল্লেখিত দু’জন মুর্শিদের ব্যক্তিত্ব সন্বন্ধে ভালভাবেই অবগত আছে। দুই মহান নেতাই তাদের চারিত্রিক মাধর্য ও বাস্তব কর্ম-তৎপরতা দ্বারা সকল পরীক্ষায়ই কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হতে থাকেন। আমাদের যুবক ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আমি এ দিশারী ও পথপ্রদর্শকদ্বয়কে নমুনা ও আদর্শ হিসেবে পেশ করছি। আল্লাহ তায়ালার শোকর যে, আন্দোলনের কর্মীগণ আজও এ ঐতিহ্যকে উত্তমরূপে অনুসরণ করে চলেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ফলাফল মূল্যায়ন করে দেখুন আপনার সম্মুখে এ বাস্তব সত্য উদঘাটিত হবে যে শীর্ষস্থান লাভকারী ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ফলাফলের ওপর প্রকাশিত খবর পাঠ করে আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতায় হৃদয় মন ভরে ওঠে। সত্য সত্যই দ্বীনই হচ্ছে জীননের সকল ক্ষেত্রে কামিয়াবী এবং নিরাপত্তার গ্যারান্টি।
পূর্ণাঙ্গ সৌন্দর্য থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রেম
ইমাম হাসানুল বান্না এ দাওয়াতের বুনিয়াদ মজবুতভাবে স্থাপন করে ছিলেন এবং এর কর্মপদ্ধতি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার সাথে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছিলেন। এ রাস্তায় তিনি এমন জিহাদ করেন যতটুকু করলে জিহাদের হক আদায় হয়। এভাবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় তিনি শাহাদাতের অমীয় ধারা পান করে স্বীয় রবের নিকট পৌঁছে যান্। তার অবর্তমানে শাইখ হাসান আল হুদাইবী নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব বহন করেন। তখন তার বয়স ছিল ষাট বছরেরও অধিক।স্বাস্থ্য ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এটা ছিল তাঁর ঈমান এবং এ জীবনলক্ষের প্রতি প্রবল। অনুরাগেরই পরিচায়ক। যা তাকে এরূপ ভারী পাথর উত্তোলনের জন্য অনু্প্রাণীত করেছিল্। মিসরে অধিকাংশ বিচারপতিই অবসব গ্রহণের পর প্রাইভেট প্রাকটিসের পেশা অবলম্বন করে থাকেন্। এমনি করে তারা মজলুম ও অত্যাচারীতদের সাহায্য সহযোগিতা করেন এবং জনসাধারণকে তাদের অধিকার আদায় করে দিয়ে জীবিকা অর্জনের উপকরণ যোগাড় করেন। হাসান আল হুদাইবির সহকর্মীরা রিটায়্যারমেন্টে যাওয়ার পর প্রকটিস করতে শুরু করেন। অথচ তিনি নিজেকে আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের জন্য কোন প্রকার বিনিময় ছাড়াই পেশ করেন। তিনি কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করেননি শুধু তাই নয় বরং এ পথে সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিপদ-মুসিবতকেও হাসি মুখে বরণ করে নেন। এটা মহান সত্তার প্রতি অকৃত্রিম প্রেম-ভালবাসারই প্রমান যিনি অনাদি অনন্ত এবং প্রকাশ্য ও গোপন সর্বাবস্থায়ই সমান ক্ষমতার অধিকারী। কত শিক্ষক, আইনজীবি ও বিচারপতিইতো এ ধরাপৃষ্ঠ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। আজ পৃথিবী তাদের নামও জানে না ইতিহাসের পৃষ্ঠায়ও তাদের উল্লেখ নেই। কিন্তু একজন শিক্ষক হাসানুল বান্না এবং একজন আইনজীবি ও বিচারপতি হাসান আল হুদাইবির নাম আজও দীপ্তিতে ভাস্বর। বস্তুত পৃথিবীর সকল বস্তুই ধ্বংসশীল। কিন্তু একমাত্র সংগ্রাম-সাধনা এবং এর প্রতি আহবান করার চিত্রই স্থায়ী হয়ে থাকে। শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে একত্রিত হওয়া তার দ্বীনকে মজবুতভাবে ধারণ করা। তার প্রতিরক্ষার জন্য বুক টান করে দাঁড়ানো এবং সুখে দুঃখে সকল অবস্থায়ই তার সাথে অটল অবিচল থাকাই চিরস্থায়ী আমল।
সকল জেলখানাতেই একজন করে দারোগা থাকে। যাকে সহযোগিতা করে থাকে নিরাপত্তা কর্মচারী ও সিপাহীরা। প্রত্যেক কয়েদখানায়েই একজন ডাক্তার থাকে যার তত্বাবধানে থাকে নার্স এবং অন্যান্য কর্মাচারী। রাজবন্দীদেরকে জেলখানাতে বিশেষভাবে নির্যাতন করা হয় এবং জেলখানার দারোগারা স্পেশাল ফরমান জারী করে থাকেনে যেন এই শ্রেণীর বন্দীদেরকে নির্যাতনের বিশেষ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়। তারপর আবার জারীকৃত এসব আদেশের বাস্তবায়ন রিপোর্টও গ্রহণ করা হয়। এ অত্যাচার-নির্যাতনের বিশেষ লক্ষ্য করুন যে, জেলখানার কোন সত্ত্বেও কয়েদীদের সাথে সৌহার্দাপূর্ণ ও সহৃদয় আচরণ করতো। তারা কেবল নিজের পক্ষ থেকে তাদেরকে আরাম পৌঁছানোর চেষ্টা করতো না বরং কয়েদীদের পরিবার পরিজন ও বন্ধুবান্ধবের কাছে তাদের খবরাখবরও আদান প্রদান করতো। এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, নির্যাতনের মেয়াদ দীর্ঘাস্থয়ী হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তারপরও এসব ন্যায়পরায়ণ কর্মকর্তাদের আচরণ দেখে নিশ্চিতরূপে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ যখন ইচ্ছা করেন তখন জালিমদের প্রবল আকাংখা সত্ত্বেও তিনি মজুলমদের জন্য সবকিছু সহজ ও সুগম করে দেন।
একত্রিশতম অধ্যায়
সত্যের পথে আহবানকারীর জীবন চরিত্র
ইমাম হসানুল বানা শহীদের জীবন ছিল অ্ত্যন্ত সাধাসিধে এবং সব রকম প্রমর্শনী থেকে মুক্ত। তিনি অল্পদামী কাপড় পরিধান করতেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতেন। তার নিকট গাঢ় রং এবং কারুকার্য খচিত পোশাকের পরিবর্তে সাদা ও দরবেশী রং ছিল অধিকতর পছন্দনীয়। কথাবর্তার সময় তার বাচনভংগি সর্বজন বোধগম্য সহজ-সরল ও জটিলতা মুক্ত হতো। তার কথাবর্তা অশিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত সর্বস্তরের লোকদের জন্য সমান বোধগম্য ও প্রভাব সুষ্টিকারী হতো। সাক্ষাতকারের সময় তিনি থাকতেন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও হাসি খুশী। কোন অতি সাধারণ লোকও তার সাথে মিলিত হতে আসতো তার পক্ষেও এরূপ কিছু উপলব্ধি করা সম্ভব হতো না যে, সে একজন মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্বের সম্মুখে বসে রয়েছেন। কারণ তিনি ছিলেন ভয়-ভীতির পরিবর্তে প্রেম-ভালবাসার মূর্তপ্রতীক। অনুরূপ কোন অতি বড় এবং শক্তিশালী ব্যক্তিও যদি কখনো তার নিকট আগমন করতেন তিনি তাদের সামনেও নিজেকে ছোট হিসেবে পেশ করতেন না। তার জন্য সকল কাজই ছিল অত্যন্ত সহজ। কেননা আ্ল্লাহর ওপর ভরসা ছিল তাঁর কাছে থেকেই তিনি শক্তি ও সম্মান লাভ করতেন।
তার সরলতা ও শালীনতার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে যে, তিনি তার দাওয়াতী কাজের সূচনা করে ছিলেন হোটেল রেষ্টুরেন্টে গিয়ে জনসাধারণের সাথে আলাপ আলোচনা ও কাথাবার্তার মাধ্যমে। সে দৃশ্য কতই নপা বিস্ময়কর। যখন একজন সাধারণ শিক্ষক একটা ছোট্র ব্লাকনোর্ড নিয়ে একটা কফিখানা থেকে অপর রেষ্টুরেন্টের মাঝে যাতায়াত করতেন। তিনি প্রথমে কফিখানায় উপবিষ্ট সর্বসাধারণের পরিচয় গ্রহণ করতেন। তারপর বিভিন্ন ক্লাব, লেক ও সুইমিংপলিসমূহে গিয়ে জনসাধারণের নিকট দাওয়াত পৌঁছাতে চেষ্টা করতেন। একজন মাত্র ব্যক্তির নিষ্ঠাপূর্ণ প্রয়াস এমন সুফল বয়ে আনলো যা কোন বড় সংগঠন এমনকি সরাকারের দ্বারাও সম্ভব ছিল না।
আজহার শরীফে রয়েছে দুনিয়া জোড়া সুখ্যাতি। এর দায়িত্বশীলদের সর্যাদা ও অবস্থানও অত্যন্ত সম্মানজনক। কিন্তু ইসলামের পুনর্জাগরণ আন্দোলনের শুভু সূচনা হয় এই প্রাচীন ইসলামী প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে একটা প্রাইমারী স্কুলের অজ্ঞাত একজন শিক্ষকের হাতে। তিনি তার কাজে মগ্ন থাকতেন এবং কোন ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা না করেই দাওয়াতী কাজের প্রচার ও প্রসারে নিয়োজিত থাকতেন। যখন তিনি কায়রোতে স্থানান্তরিত হয়ে আসেন তখন জাতীয় সংসদভবনের নিকটস্থ একটি হোটেলের নীচ তলায় ছোট্র একটা অফিস স্থাপন করেন। সেখানে কোন বৃহদায়তন সাইনবোর্ড লগানো ছিল না। কিংবা বিজলী বাতিও ছিল না। এ প্রাথমিক অস্থায় তিনি লাগাতর সফরে থাকতেন। দূরদূরান্তের গ্রামাঞ্চল ও পাহাড়ী এলাকায় ঘুরে ফিরতেন। ভ্রমণের যে দুঃখ কষ্ট তিনি বরণ করেছিলেন তারই ফলে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের আন্দোলন আজ এত ফুলে-ফলে, পত্র-পল্লবে সুশোভিত ও সুসজ্জিত হয়ে উঠেছে। তিনি যেখানেই যেতেন সর্বপ্রথম স্থানীয় মসজিদে উপনীত হতেন। দূর দূরাঞ্চলের গ্রাম ও ছোট ছোট শহরে অবস্থান কালে তিনি চাটাই কিংবা ইট ও মাটি নির্মিত শক্ত বেঞ্চের ওপর বসে পড়তেন। এমনকি অনেক সময় শুধু মাটির ওপরই শুয়ে পড়তেন।
তাঁর শত্রু ও বন্ধু সকলেই এ ব্যাপারে একমত যে, তিনি ছিলেন যুগের কৃতিসন্তান, অতুলনীয় প্রতিভা ও অসাধারণ যো্গ্যতার অধিকারী। কোন পাশ্চাত্য লেখক ও সাহিত্যিক প্রথমদিকেই মন্তব্য করেছিলেন যে, হাসানুল বান্না কেবলমাত্র মিসরেই নয় বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের দিশারী ও পথপ্রদর্শক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যাবে। এ অনন্য সাধারণ যোগ্যতা ও প্রতিভা শয়তানী চক্রের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ কারণেই তারা তাকে অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করার পূর্বেই অন্যায়ভাবে হত্যা করে। যদি এ দাওয়াত হাসানুল বান্নার দাওয়াত হতো তাহলে তাঁর হত্যাকান্ডের সাথে সাথেই তা শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু এটা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তায়ালার নিজের দাওয়াত। তাই যে কেউ এর বিরোধীতা করবে তাকেই লাঞ্ছিত ও অপমাণিত হতে হবে। যে এর সাথে সহযোগিতা করবে সে অমর জীবন লাভ করতে পারবে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা শ্রেষ্ঠত্ব মর্যাদা দান করেন যাকে ইচ্ছা অপমাণিত ও লাঞ্ছিত করে ছাড়েন।
হাসানুল বান্না তার নিজের অস্বাভাবিক যোগ্যতার সাহায্যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেন। তাঁর অনুসারীগণ বিভিন্ন শিক্ষাগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমিতে থাকার পরও সমানভাবে তাঁর প্রতি ভালবাসা পোষাণ করতেন এবং তার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতেন। সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ তাঁর সম্মুখে এমনভাবে আসন গেড়ে বসতেন যেভাবে কোন শাগরিদ তার উস্তাদের সামনে অথবা কোন মুরীদ তার মুর্শিদের সম্মুখে আসন পেতে বসে। এই সম্মান কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট ছিল না। বরং সর্বসাধারণের হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত ছিল। প্রত্যেক ব্যক্তিই মনে করতো যে, ইমামের সাথে রয়েছে তার অত্যন্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক। তাঁর সাথী সংগীগণ তাঁর সাথে যে সম্মান, ভালবাসা ও আমানতদারী পরিচয় দিতো তা দেখে আমার সেই হাদীসটি মনে পড়ে যায় যাতে রাসূলুল্লহ (সা) বলেছেনঃ “আল্লাহ তায়ালা জিবরাইল (আ)-কে বলেন যে, আমি অমুক ব্যক্তিকে ভালবাসি। অতএব তুমিও তার প্রতি ভালবাসা পোষণ করতে থাকো। তখন জিবরাইলও তাকে মহবাবত করতে শুরু করে। তারপর সে আকাশ রাজ্যের সমস্ত ফেরেশতাদের মাঝে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে ঘোষণা করতে থাকে যে, অমুক ব্যক্তি আল্লাহর মাহবুব বান্দা। তোমরা তাকে মহব্বত করতে থাকো। অনন্তর আকাশ ও জমিদেন অধিবাসীগণের নিজটও এ বাণী পৌঁছে দেয়। তখন সে মাহবুবে এলাহী বিশ্ববাসীরও প্রিয়পাত্র হয়ে যায়। এটা আল্লাহ তায়ালার অফুরন্ত নিয়ামতের মধ্যে সস্তবড় নিয়ামত।”
বাহুবল ও শক্তি প্রয়োগ
তিনি আল্লাহ তায়ালার অপার অনুগ্রহের বদৌলতে দাওয়াতে হকের পথে পুরোপুরি লাভের সন্ধান করেন। ইসলামী দিবস পালন, যেমন হিজরাতে নববী ইত্যাদি উপলক্ষে তিনি বিশেষ জনসমাবেশের আয়োজন করতেন যাতে ছাত্র, শিক্ষক ও অন্যান্য পেশার বিপুল সংখ্যক লোক অংশগ্রহণ করতো। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতো যে, হাসানুল বান্না গণমানুষের হৃদয়ের স্পন্দন এবং তিনি তাদের মনের কথাই বলে থাকেন। তিনি মানুষের মনের আশা-আকাংখা জীবিত রাখার প্রয়াস পেতেন এবং তাদের ক্লান্তি-শ্রান্তি ও অবসন্নতার পূর্বেই আপন বক্তব্য সমপ্ত করতেন।
আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব ও প্রভুত্বের ওপর তার ছিল প্রগাঢ় আস্থা। তার অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য অন্য সকলের বৈশিষ্ট্য থেকে ছিল ব্যকিক্রমধর্মী। তার এ অকৃত্রিম বিশ্বস্ততা ও নির্ভযোগ্যতাই তার মধ্যে এমন আত্মিক শক্তি সৃষ্টি করেছিলো যার কোন তুলনা ছিল না। তাঁকে দেখে এমন একজন সত্যিকার মুজাহিদের চিত্র দৃষ্টির সম্মুখে প্রতিভাত হয়ে উঠতো যিনি কোন বাহ্যিক ও বৈষয়িক উপায় উপকরণ ব্যতীতই আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের ওপর ভরসা করে ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার রবের সাহায্য-সহযোগিতার ওপর থাকে অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস। মানুষ যে কাজকে স্বভাবত অসম্ভব বলে মনে করে থাকে তাকেই তিনি সম্পূর্ণ সম্ভব ও বাস্তব করে দেখাতেন।
আল্লাহ তায়ালার ওপর তাঁর ভরসা ও নির্ভরতার একটা কাহিনী আমি এবার আপনাদের সম্মুখে আরজ করছি। “তিনি কেন্দ্রীয় দপ্তরের জন্য ইমারত ক্রয় করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যার মূল্য সাব্যস্ত হয়েছিল আট হাজার পাউন্ড। তখন তার পকেটে পাঁচ পাউন্ডের বেশী ছিল না। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই পুরো অর্থ তার হাতে এসে যায়। ঐ অর্থ দিয়ে তিনি আন্দোলনের জন্য বিল্ডিং ক্রয় করেন। অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের ওপর ভরসা ও প্রবল আত্মবিশ্বাসের বদৌলতে তিনি শেষ পর্য়ন্ত তার চাকুরী জীবন থেকেও ইস্তফা দেন। তখন তাঁর নিকট দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্য কোন আয়েরও ব্যবস্থা ছিল না।
মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও পৌরুষ নামক দু’টি মহৎ গুণ তাঁর মধ্যে এত অধিক মাত্রায় বিদ্যমান ছিল যে, সেগুলোই তাঁকে প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা দান করে এবং তার ওসব স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করে যার রূপায়ণে বড় বড় প্রতিষ্ঠান এবং সরকারও ছিলো। তার মর্যাদা কোন ব্যক্তি বিশেষের নয় বরং তা ছিল একটি বিশ্বমানের শিক্ষাগার সদৃশ্য। তিনি প্রতিশ্রুতি পালনে যেমন ছিলেন সত্যবাদী তেমনি আকাংখা পূরণেও ছিলেন পাকা ও সুদক্ষ, লেন-দেন ও আচার-আচরণে বিশ্বস্ততার মূর্তপ্রতীক এবং ত্যাগ ও কুরবানীর জীবন্ত নমুনা। জবিনের সমস্ত মূল্যবান সামগী তিনি তার মহৎ লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে নির্মোহ, ইবাদাত, সরলতা, বিনম্রতা, তাহযীব-তামাদ্দুন, মার্জিত ও বিশুদ্ধ মাধ্যমের কথাবার্তা তার ব্যক্তিত্বকে এমন আকর্ষণীয় বানিয়ে দিয়েছিল যে, যে কেউ একবার তার সান্নিধ্যলাভের সুযোগ পেয়েছে সারা জীবন তা ভুলতে পারেনি। তিনি মৌলিক বিষয়সমূহের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতেন এবং খুঁটিনাটি ও গুরুত্বহীন ব্যাপারসমূহ থেকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতেন। তিনি সকলের সাথে বন্ধুত্ব ও মহব্বতের আচরণ করতেন। কখনো কোন ব্যাপারেই কাউকে ধোঁকা দেননি। কিংবা সত্যকে গোপন করার চেষ্টা করেননি। তিনি কোনরূপ কূটিলতা ও শঠতার আশ্রয় না নিয়েই প্রতিটি কথা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করতেন। দাওয়াত পেশ করতে গিয়ে তিনি শুরুতেই দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে জানিয়ে দিতেন যে, এ পথ বড় বন্ধুর। এ পথের পথিকদেরকে ইসলামের শত্রুদের আক্রমণের শিকার হওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে হয়্ যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে বিপদ-মুসিবত সহ্য করার এবং প্রতিশ্রুতি পূরণ করার মত হিম্মত ও ভরসা পায় সেই যেন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে সওয়াবের আশায় নিজের জাহাজ তরংমালায় সোপর্দ করে দেয়। আর যদি কেউ এরূপ সৎসাহস ও যোগ্যতা বোধ না করে তাকে গোড়াতেই অক্ষমতা প্রকাশ করে সরে যাওয়া উচিত।
তার এ উক্তি কত বাস্তব। হাদীসেও রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন যে, জান্নাত লাভ করা সম্ভব বিপদসস্কুল ও কন্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করার পরেই। আর দোজখ থেকে বাঁচতে হলেও কামনা-বাসনা ও স্বাদ-আহলাদ ত্যাগ করতে হবে। তিনি তার মাওলার সম্মুখে একটা সত্য অংগীকার গ্রহণ করেছিলেন সে ওয়াদার আলোকেই তিনি ছিলেন নম্রতা-শালীনতা ও শিষ্টাচারের মুর্তপ্রতীক, যাদুকরী ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং আদেশ ও নিষেধের পুরো অনুসারী। আল্লাহ তায়ালার অনুগত ও অবাধ্য প্রত্যেকের মর্যাদা তিনি দিতে জানতেন। তাঁর বড় বড় দুশমনও তাঁকে উত্তেজিত করতে চেষ্টা করেও তাকে নীতিচ্যূত করতে পারেনি।
সা’দ জগলুল পাশার গাম্ভীর্য
মিসর জাতির ইতিহাসে অপর এক সমকালীন ব্যক্তিত্ব সা’দ জগলুল পাশাও ধৈর্য ও সহ্য গুণের জন্য বিখ্যাত। তথাপি তাকে এমন সব নাজুক ও জটিল পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হয়নি যাকে অতিক্রম করে সামনে এগুতে হয়েছিল হাসানুল বান্নাকে। আমার মনে পড়ে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বৃটেন মিসরের তৎকালীন প্রধান সন্ত্রীর সাথে একটা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল। চুক্তিতে চারটি বিষয়ে গ্যারান্টি প্রদানের শর্তে মিসরকে আভ্যন্তরীণভাবে স্বায়ত্বশাসন দেয়ার কথা উল্লেখ ছিল। তৎকালীন উজীরে আযম আবদুল খালেক সারওয়াত পাশা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে ছিলেন। কিন্তু সাদ জগলুল এসব নিশ্চয়তামূলক মর্তবলীর কঠোর সমালোচনা করেন এবং দেশবাসীকে ক্ষেপিয়ে তোলেন যে, এ অসম চুক্তি ও অপমানকর সন্ধি বাতিল করতে হবে। সা’দ জগলুলের মতে মিসরকে কোন প্রকার শর্ত ছাড়াই পুরোপুরি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রাণাস্তকর প্রচেষ্টা চালানো উচিত। শর্তবলীর মধ্যে নিন্মে বির্ণত তিনটি আমার মনে পড়ছেঃ
১-ইংরেজ প্রণীত ও প্রবর্তিত আইন-কানুনের পরিপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ।
২- সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান।
৩- মিসরের মধ্য দিয়ে বৃটেনের অবশিষ্ট উপনিবেশিক এলাকার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার অধিকার প্রদান।
সা’দ জগলুলের আক্রমণের জবাবে সারওয়াত পাশা তার নিকট এ মর্মে দাবী করেন যে, তিনি এ সমস্যাকে যেন আদালতে পেশ করেন এবং সেখান থেকে ডিক্রি নিয়ে আসেন। সা’দ জগলুল তার এ আহবানের জবাবে সংবাদ পত্রে এক বিবৃতি প্রদান করেন যাতে তিনি এ প্রস্তাবকে অত্যন্ত ঘৃণাভারে প্রত্যাখ্যান করেন। এ বিবৃতিতে সা’দ যে ভাষা ব্যবহার করেন তার প্রতিটি শদ্ব আমার আজও মনে আছে।
“তোমাদের সামনে মিম্বার ও মঞ্চ রয়েছে যদি শ্রোতা মন্ডলী যোগাড় করতে পারো তাহলে তোমরা মিম্বারে দাঁড়িয়ে তোমাদের বক্তব্য শুনিয়ে দাও। তাছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এবং মাসয়িকীও রয়েছে তোমাদের হাতে। যদি পাঠকগণ তোমাদের লিখনী পড়তে প্রস্তুত থাকে তাহলে তোমাদের বক্তব্য লিখিত আকারে তাদের হাতে তুলে দাও তারপর অবশিষ্ট থাকে আদালাতে মামলা মোকদ্দমায় লড়ার পালা তো সেখানকার জন্য আমি তোমাদের সমকক্ষ নই।
আমার স্মরণ আছে যে, সা’দ জগলুল সম্পুর্ণ অসুস্থ অবস্থায়ও তাঁর স্নায়ুর ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম ছিলেন এবং কখনো ক্রোধান্বিত হতেন না। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, মিসর ও সুদানে বৃটিশ সেনাবাহিনী প্রধান স্যার দার লিটাক যখন নিহত হয় তখন মিসরে নিযুক্ত বৃটিশ সরকারের ভাইসরয় জেনারেল আমীনবি সামরিক পোশাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গমন করেন। সা’দ জগলুল তখন তার দপ্তরে উপস্থিত ছিলেন। ইংরেজ জেনারেল সাহেব অনুমতি কামনা না করেই সোজা দরজা খুলে ভিতরে চলে যান এবং তীব্র ক্রোধভরে বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে সা’দ জগলুলকে হুমকী ধমকী দিতে থাকেন। জেনারেল সাহেবের মুখে যা আসলো কোন প্রকার চিন্তা-বিবেচনা না করেই তিনি তা উগলে দিতে লাগলেন। তার একটা হুমকী এটাও ছিল যে, সুদানের মাটি থেকে মিসরীয় সেনাবাহিনীকে কাল বিলম্ব না করে চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু সা’দ জগলুল তার স্বভাব সুলভ আচরণ অনুযায়ী অত্যন্ত শান্তশিষ্টভাবে লাট সাহেবের সকল হুমকী ধমকী হজম করে যেতে লাগলেন এবং নিজের আসনের ওপর বসে তার মুখ পানে তাকিয়ে থাকলেন। অবশেষে কখন হুমকী ধমকী শেষ হয়ে যায় তখন অত্যন্ত ধীর স্থিরভাবে কৌতুক মিশ্রিত কন্ঠে বলতে লাগলেন, লাট সাহেব আর কি উত্তম খবর আছে? লড়াই ছড়িয়ে পড়েনি তো? লাট বাহাদুর সাহেব ঘৃণাভরে ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য সহকারে অগ্নিশর্ম হয়ে প্রত্যুত্তর না দিয়ে দপ্তর থেকে বেরিয়ে যান।
মিসরের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর আমি আমার স্মৃতিকথাগুলোকে সন্নিবিষ্ট করার প্রাক্কালে এবার আমি অফদ পার্টি সম্পর্কে কিছুকথা আরজ করতে চাই। “এ পার্টির ব্যাপক স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল গণমানুষের নিকট। এতদসত্ত্বেও ১৯২৪ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২৮ বছর সময়ে এ পার্টি শুধু ৮ বছর পর্যন্ত ক্ষমতার সমনদে সমাসীন ছিলেন। এর মৌলিক কারণ এই ছিল যে, হিযবুল অফদ ইংরেজদের সুরে হা কিংবা না বলার তাল মিলাতো। তাদের আট বছরের শাসনামলে এ পার্টিও বেশ কিছু ভুল-ভ্রান্তি করে বসে। তথাপি সামষ্টিকভাবে এ দল অন্যান্য মন্ত্রীসভার তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভাল ছিল।
সামরিক বিপ্লবের পর নতুন শাসকগোষ্ঠী মিসরের ইতিহাসসে মারাত্মকভাবে রদ-বদল করে দেন। রাজ্যের সমস্ত পদস্থ কর্মকর্তাই স্থীয় প্রতিকৃতি নির্মাণ করার জন্য মিসরের স্বানামধন্য ও বিখ্যাত ব্যক্তিগণ যেমন হাসানুল বান্না, আহমদ হোসাইন, সা’দ জগলুল, হাসান আল হুদাইবি,মোস্তফা এবং অন্যান্য বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বগণের নাম চিহ্নও মুছে ফেলার প্রয়াস পান। বর্তমান হোসনী মোবারকও এ গতিরোধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
কিন্তু ইখওয়ানের পথপ্রদর্শক অদ্যাবধি এরূপ আচরণের উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। যা বিগত সরকারগুলোর শাসনামলে মিসরীয় সকল মহাপ্রাণ ব্যক্তির সাথে করা বৈধ মনে করা হতো। প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারককে ইতিহাসের ঋণ পুরোপুরিভাবে আদায় করে দিতে হবে। আধা সংস্কার সংশোধন কার্যক্রমের সাহায্যে এ ঋণ কখনো্ শোধ হবে না কিছুতেই শোধ হতে পারে না।
শাহ অপেক্ষাও অধিক শাহ পূজারী
সকল সমাজে ও পত্যেক দেশেই “শাহ থেকেও বেশী শাহের পূজারী” উপাদানসমূহ সর্বকালেই বর্তমান থাকে। ইখওয়ানকে যখন জিন্দানাখানায় শৃংখলিত করা হয় তখন কারাগারের অফিসারগণ তাদের সিনিয়র অফিসারগণের মনস্তুষ্টি অর্জন করার লক্ষ্যে একে অন্যের তুলনায় অধিকতর অগ্রনী হয়ে আমাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাতো। নিজেদের এ জঘন্য আচরণসমূহের তারা বড়ই গর্ভভরে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত গোপন প্রতিবেদন আকারে পৌঁছাতো। এসব লোকের আচরণ সৌজন্য ও আভিজাত্যের সকল মানদন্ডে নিন্দনীয় এবং বর্বরতা ও পাষান্ডতার ছিল নিকৃষ্টতম উদাহরণ। এরূপ অশালীন তৎপরতার সাহায্যে তারা সরকারের দৃষ্টিতে ইজ্জত সম্মান এবং অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির উপযুক্ত বলে বিবেচিত হতো। বাস্তবিকই অধিকাংশ লোকের পদোন্নতি ও ভাগ্য প্রসন্ন করার ক্ষেত্রে এসব কৃতিত্ব ও কার্যকলাপ, বুনিয়াদী বৈশিষ্ট্য ও মৌলিক গুণাবলী রূপে পরিগণিত হতো।
আলওয়াহাত জেলখানায় আমাদের ঠাই হয়েছিল। শাবান মাসের শেষের দিকে কারাগারের দারোগা যার নাম আমি বর্ণনা করতে চাই না। একটা সুখবর শুনান। তিনি বলেন, পবিত্র রমজান মাস সমাগত প্রায় তাই তোমরা যদি বাড়ী থেকে খাবার আনাতে চাও তাহলে আমাদের কোন আপত্তি নেই। এ মোবারক মাসে তোমাদের ঘর থেকে প্রেরিত খাদ্য কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা ব্যতিরেকেই তোমাদের নিকট পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এ সংবাদে আমরা কিছুটা আনন্দবোধ করি এবং প্রবল উৎসাহ ও কৌতুহল ভরে আমরা আমাদের পরিবার পরিজনের নিকট এ খবর পৌছে দেই। আমাদের আত্মীয়-স্বজনগণ আমাদেরকে নিয়মিত খানা পাঠাতে শুরু করে। কিন্তু তা একদিনের জন্যেও আমাদের হাতে পৌছতে পারেনি। দারোগা সাহেব আনীত সকল খাদ্য সামগ্রী পরিপূর্ণ হেফাজতের সাথে তার নিকট রেখে দিতেন এবং রমজানের শেষ ভাগে যখন সেসব কিছু পঁচে গলে একাকার হয়ে গিয়েছিল তখন প্যাকেটে করে আমাদের বাড়ীর লোকদের নিকট ফেরত দিয়ে দেয় এবং বলে যে এগুলো কয়েদীদের হাতে পৌছানোর অনুমতি নেই। সুধী পাঠকমন্ডলী। আপনারা এতে অনুমান করতে পারেন যে, এ আচরণের ফলে আমাদের অন্তরে কতবড় আঘাত লেগেছিল। আর আমাদের পরিবার পরিজনের মনের অবস্থাই বা কেমন হয়েছিল।
রিজিক ধ্বংস করা এমনিতেই মস্তবড় অপরাধী তদুপরী এ জন্য যেসব টারা পয়সা ও মাল-দৌলত খরচ করা হয়েছে এবং আন্তরিকতা ও মহব্বতের সাথে আমাদের ঘরের লোকজন সে খাদ্য তৈরী করেছে ও আমাদের প্রিয়জনেরা উহা প্রত্যহ যে কষ্ট ক্লেশে জেলখানা পর্যন্ত পৌঁছিয়েছে তা একটু ভেবে দেখুন ও কল্পনা করুন। বিপরীত দিকে জেলখানার উক্ত ফেরাউনের আচরণ এবং কর্মকান্ড খতিয়ে দেখুন। ছোট ছোট ফেরাউনের বাচ্ছারা বড় বড় ফেরাউনদের খুশী করার জন্য কিসব কাজ করে চলছিল। এসব লোভ-লালসার বান্দারা মানুষ নামের কলম্ক; মানবতা ও মনুষ্যত্বের দুশমন মানবীয় গুণাবলী এবং আল্লাহ তায়ালার ভয়-ভীতি শূন্য এসব মাহমানবগণ তাদরে কৃতকর্মের প্রতিফল অবশ্যই ভোগ করতে বাধ্য হবে।
ইখওয়ানী শহীদগণেকে ইহুদীদের ইংগীতেই ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে
মিসরের জাতীয় ইতিহাসের সকল ছাত্রই এ বেদনাদায়ক বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যকরূপে অবহিত রয়েছে যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুনের যেসব নেতা পরিচালকগণ ফিলিস্তিন যুদ্ধে ইস্রাঈলদের দাঁতভাংগা জবাব দেন। তারা সকলেই তাদের সরকারের পক্ষ থেকে শিরচ্ছেদের শাস্তির শিকার হয়। ইমাম হাসানুল বান্নাকে ইবরাহীম আবদুল হাদীর সরকার শহীদ করে দেয়। শাইখ মুহাম্মাদ ফারাগলী শহীদ, জনাব ইবরাহীম আল তীব শহীদ ও আল আখ তথা ভ্রাতৃপ্রতীম ইউসুফ তালাত শহীদ প্রমুখকে জামাল আবুদন নাসেরের সরকার ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে দেন। এগুলো কি কোন দৈবক্রমে সংগঠিত ঘটনা ছিল? পরিস্থিতি ও ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবগত ব্যক্তিগণ খুব ভাল করেই জানেন যে, এসব ধীর স্থির ও শান্তশিষ্ট মস্তিষ্কের ষড়যন্ত্রেরই ছিল ফলশ্রুতিমাত্র কোন আকস্মিকভাবে সংঘটিত কোন দুর্ঘটনা ছিল না।
১৯৬৭ ঈসায়ী সালের লড়াই স্বয়ং জামাল আবদুন নাসেরই শুরু করেছিলো। যা সমস্ত মুসলিম উম্মাহর ললাট কলম্কের টীকা স্বরূপ হয়ে রয়েছে। এ যুদ্ধড সম্পর্কে বহু বিষয় গুরুত্বের সাথে লক্ষণীয় ও সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। অনাগতকালের ঐতিহাসিকগণ লড়াইর অনেক কষ্টিপাথরে যাচাই করে ফায়সালা করবে যে, এ যুদ্ধে কে কি ভূমিকা পালন করেছে? অনেক কথাই বলা হয়ে থাকে কিন্তু আমি প্রামাণ্য, বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সূত্র ব্যতীত কোন বিবরণ পেশ করতে অভ্যন্ত নই। অবশ্য একটা বিষয় তো ইতিমধ্যে প্রমাণীত হয়েই গিয়েছে যে, আমাদের যুবকদের হাতে যেসব অস্ত্রশস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছিল তা ছিল সম্পূর্ণ অকেজো ও ব্যবহারের অনুপযোগী। যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আমাদের যুবক শ্রেণীকে জেনে বুঝে সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবেও এটা সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণিত হয়ে গেছি যে, এ যুদ্ধের পূর্বে নাসের ও কোন কোন ইহুদী দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মাঝে শারমুস শাইখ এবং অন্যান্য স্থানে একান্ত সংগোপনে দেখা সাক্ষাত, শল্য পরামর্শ ও ষড়যন্ত অনুষ্ঠিত হতে থাকতো। ওসব লোক যারা কোবরা ছোগরা প্রয়োগের মাধ্যমে গনে পড়ে ফলাফল বের করতে সিদ্ধহস্ত তারা এসব ঘটনাবলী কেন মূল্যয়ন করে না। ওপর বর্ণিতঘটনা প্রবহ এবং ইখওয়ানুল মুসলিমুনের নেতৃস্থাণীয় ব্যক্তিদের হত্যাকান্ডের মধ্যে কি কোন যোগসূত্রের সন্ধান করা যায় না? ইখওয়ানের ওসব নেতৃবৃন্দ যারা ইহুদীদের আরাম হারাম করে দিয়েছিলেন কার অদৃশ্য হাতের সূক্ষ্ম ইংগিতে এসব ক্ষমতাশীন শাসক গোষ্ঠীতে নিষ্ঠুর হস্তে মৃর্ত্যুর ঘাটে উপনীত করা হয়েছিল।
আমি একথা কখনো ভুলে যেতে পারছি না যে, নাকরাশী পাশা ইখওয়ানের শীর্ষস্থনীয় ব্যক্তিগণকে ঘোরতর যুদ্ধচলাকালীন সময়ে গ্রেফতার করায়। ফিলিস্তিনের সম্মুখ সমর থেকে এসব মুজাহিদগণকে সোজা মাসরের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঐতিহাসিক সামালোজকগণ এ ঘটনার কি বিশ্লেষণ পেশ করে থাকেন? আমি যদি ইখওয়ানূল মুসলিমুনের অন্তর্ভুক্ত না হতাম তাহলে এ বিষয়ে অনেক কিছুই বলতে পারতাম। এখন যদি আমি কিছু বলার চেষ্টা করি তাহলে উহাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে কথা বলার অভিযোগে অভিযুক্ত করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আমি এমন অনেক নিষ্ঠুর বাস্তব সত্য উদঘাটন করে দিতে পারি যা বড় বড় আমলাদের মজবুত দুর্গসমূহকে ভূ-গর্ভে প্রোথিত করে দিতে পারে । সত্য কথা এই যে, এসব আমলাদের কৃত্রিমকেতাদূরন্ত কীর্তিকলাপের স্বরূপ সকলেরই জানা আছে। আমরা শুধু আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করে থাকি। তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই সর্বোত্তম কর্মনীতি প্রণয়নকারী। আমদের শহীদগণও জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌঁছে গেছেন। আর তাদের ওরপ যারা অত্যাচার নির্যাতনের ষ্টীমরোলার পরিচালনা করেছে তারাও তাদের উপযুক্ত কর্মফলের মুখোমুখি হয়ে গেছে। এখন আর কিছু বললে কি আর এসে যাবে। প্রত্যেকেই নিজ গনিজ কর্মফল পেয়ে থাকবে। কবির ভাষায়ঃ
হে গালেব! নৌকা যখন কূলে এসে ভীড়ে গেছে তখন আর আল্লাহর ওপর উম্মা ও ক্ষো্ভ প্রকাশ করে কি লাভ আর মাঝির দুর্নাম করেই বা কি হবে?
বিশ্রী ও ন্যক্কারজনক খেলা
ইতিহাসের কাজ হচ্ছে সত্য ও বাস্তবতাকে কোন প্রকার কম-বেশী না করে যথাযথ ও সঠিকভাবে উপস্থাপন করা। কিন্তু অনেক সময় ইতিহাস এর প্রকৃত দায়িত্ব পালনে অপারগ ও অক্ষম হয়ে পড়ে। ইতিহাস ওসব জঘন্য বিশ্রী ও সদর্য চেহারা জগদ্বাসীকে দেখাতে অনেক বিলম্ব করে ফেলেছে যাদের হাত মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে ইতিমধ্যে কিছু কথাবার্তা মানুষের সম্মুখে উদঘাটিত হয়ে পড়েছে আর বাকীগলোও শীগ্রই প্রকাশিত হয়ে যাবে। সংবাপত্রে এখন প্রত্যহ প্রবন্ধ ছাপা হচ্ছে “অমুক এবং অমুকের সম্পর্কে”- ইনি কার পুত্র এবং কারই বা জামাতা যাদের সম্বন্ধে কারুণের দৌলতের উপন্যাস ও উপাখ্যান তপ্ততাজা হয়ে উঠেছে? কোটি কোটি পাউন্ডের ধনদৌলত, বিত্তবৈভব ও সহায়-সম্পত্তি যেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করতে ক্ষোভ ও ঘৃণায় মন ভরে উঠে কোথা থেকে নাজিল হয়েছে তারপর আবার এগুলো কি করে মিসরের বাইরে স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছে? ইউরোপে বড় বড় মহল ও বালাখানাসমূহ এবং পত্র-পত্রিকা ও সাহিত্য সাময়িকী ওসব লোক কিভাবে কিনে নিয়েছে? ওরা অস্ত্রশস্ত্রের বিশ্ব বাণিকে কিরূপ পরিণত হয়েছে? সকল প্রকার হালাল হারাম কারবারে তারা কেমন করে তাদের পাঞ্জা গেড়ে বসেছে? রেখে দিন, হালাল হারামের আলোচনা তো এসব লোকের জন্য অর্থহীন। তারা তো পয়সার পূজারী। ইহার আমাদানী কোত্থেকে কিভাবে হচ্ছে সে প্রশংগই তাদের জন্য অবান্তর। তাদের লাজ লজ্জা কোথায় যেন উরে গেছে? গুনাহ কিংবা পাপের কোন প্রকার ভয়-ভীতি এবং ময়দানে হাশরের আদালতের কোন ডর ও শংকা কি তাদের মনে উদয় হয় না?
১৯৫২ সালে সংঘটিত বিপ্লব অভ্যুত্থান ছিল আমাদের সযত্ন প্রয়াস-প্রচেষ্টারই ফসল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিপ্লবের নেতৃত্ব ইহার সঠিক গতিপথ থেকে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়। যা জাতির মুক্তি ও দেশবাসীর নাজাতের জামিন হতে পারে। শানদার বাংলো, বড় বড় স্থল পথ ও নৌপথের অফুরন্ত সহায় সম্পদ আসলো কোত্থেকে? এসব বিপ্লবী শ্লোগানে মুখরিত ব্যক্তিগনের অবস্থান প্রতি দৃষ্টিপাত করে দেখুন। সাথে সাথে নিরপরাধ নিরীহ লোকদের ওপর তাদের ক্ষোভ ও দোষারোপের প্রতি লক্ষ্য করুন। আমি তাদের জিজ্ঞেস করতে চাই যে, অভ্যুত্থানের পূর্বের অবস্থা ও বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতির তুলনা করে বলুন যে, এসব প্রচুর্য ও ধন-সম্পদ কি তাদের জন্য ভূ-গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছে নাকি আকাশ থেকে বৃষ্টিরূপে বর্ষিত হয়েছে? এসব চাঁদের দেশ থেকে এসব দৌলত তাদের হাতে এসে ধরা দিয়েছে?
আল্লাহ তায়ালার শোকর যে, এসব কলম্কিত লোকদের সহিত না আমাদের কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে এবং না বংশীয় কোন যোগসুত্র। আল্লাহ তায়ালা তাদের সকল অপকর্ম থেকেও আমাদের রক্ষা করেছেন। এমনকি তাদের উঠে পড়া অংগুলিসমূহ থেকে আমাদের নিরাপদ রেখেছেন। এসব লোক এতবেশী বাদনাম ও কুখ্যাত হয়ে পড়েছে যে, তাদের কুকীর্তি ও অপকর্মসমূহ সর্বস্তরের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন তাদের সম্পর্কে যদি কোন ভিত্তিহীন অবন্তর গুজবও সত্য যে আগুনের অস্তিত্ব ব্যতীত ধোয়ার কল্পনাও করা যায় না। তেমনিভাবে উটের উপস্থিতি ছাড়া উটের বিষ্ঠা অচিন্তনীয়।
পি, এইচ, ডি-এর থিসিস ও ইখওয়ান
স্বীয় স্মৃতিচারণের এ সন্ধিক্ষণের সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে আমি উস্তাদ মুহাম্মাদ ফাতী শীর বিরচিত প্রবন্ধের উল্লেখ করতে চাই। যার ওপর ভিত্তি করে তাকে ডক্টরেট ডিগ্রীর দুর্লভ সম্মানে ভূষিত করা হয়। তার নিবন্ধের শিরোনাম ছিল “ইখওয়ানের প্রচার প্রসার ও সুনাম সুখ্যাতি মুদ্রণ মাধ্যম।” বিজ্ঞ নিবন্ধকার অত্যন্ত পান্ডিত্যপূর্ণভাবে ও জ্ঞানগর্ভ ভংগীতে বিষয়বস্তরি পুরোপুরি হক আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি প্রকৃত সত্য ও নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে তার বলিষ্ঠ লিখনীর মাধ্যমে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। যাতে তিনি তার ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দকে কোন প্রভাব সৃষ্টি করার ও নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ করার সুযোগ দেননি। প্রসংগক্রমে একানে আমি ওসব গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি যা আলোচ্য প্রবন্ধে উপস্থাপন করা হয়েছে।
১- ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস.......... এ সম্পর্কে আমি বলতে চাই যে, এটা আমাদের সেই মজবুত কেন্দ্রীয় প্রতিপাদ্য বিষয় যার ভিত্ কখনো নড়বড়ে হয়ে যায়নি। আমি আল্লাহ তায়ালার সমীপে অন্তরের অন্তস্থল থেকে করছে যে, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাকে পুরোপুরি নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে ইসলামের বুনিয়াদী আকীদা-বিশ্বাসের ওপর কায়েম রাখুন। নির্ভেজাল তাওহীদ ও রিসালাতে মুহাম্মাদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম –এর ওপর মজবুত একীন, মুতাশাবিহাত থেকে রক্ষা এবং খুঁটিনাটি ও গুরুত্বহীন বিষয়াবলীল ওপর আলোচনা সমালোচনায় জড়িয়ে পড়া থেকে দূরে থাকা আমাদের মৌলিক আকীদা বিশ্বাসের অংশ বিশেষ।
২- আনুগত্য ও অনুসরণে আপ্রাণ প্রয়াস প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা...............ইহার সহিত আমি আরও যোগ করতে চাই যে আকীদা বিশ্বাসের নিরাপত্তার বাস্তব দলিল ও কার্যকরী প্রমাণ হচ্ছে এ’তেকাদের দাবী পূরণ করে চলা এবং আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য অনুসরণে সতত যত্মশীল হওয়া।
৩- আল্লাহর জন্যেই মহব্বত ও প্রেম ভালবাসা ...........এর সাথে আমি আরো যোগ করতে চাই যে, প্রকৃত মুসলিম হচ্ছে সে ব্যক্তি যে শুধুমাত্র আল্লাহরই সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পরস্পরের সাথে মিলিত হয় এবং পারস্পরিক মহব্বত ও ভালবাসার পরিচয় দিয়ে থাকে এবং আল্লাহর দুশমনদের প্রতি তাদের ঘৃণাবোধ থাকে সমভাবে।
৪- ইত্তেহাদে ইসলামীকে বালিষ্ঠভাবে ধারণ করা........... আমি বলতে চাই যে, আল্লাহ তায়ালার সাহায্য সহযোগিতার পর মিল্লাতে ইসলামীল ঐক্য ও সংহতিই হচ্ছে সর্ববৃহৎ শাক্তি যা মুসলিম জাতির হৃত গৌরব হারানো ঐতিহ্য সম্মান ও মর্যাদা পুনর্বহাল করার নিশ্চয়তা দিতে পারে।
৫- প্রশিক্ষণ ও আত্মশুদ্ধি ...................এ প্রসংগে আমার বক্তব্য হচ্ছে এই যে, এ মূলনীতিকে বাস্তবে রূপদান করতে হলে বিশ্বস্ততা সদাচরণ, আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পুরো করা, বান্দা ও আল্লাহর মাঝে সুগভীর গড়ে তোলা, কর্মীর সাধারণ মানুষের সাথে এমনকি স্বয়ং তার নিজের অস্তিত্বের সাথে প্রগাঢ় সত্য ও সুসম্পর্ক সৃষ্টি করতে আপ্রাণ চেষ্টা করা বাধ্যতামূলক ও অত্যাবশ্যকীয় পথের সম্বলের মর্যাদা রাখে।
৬- দাওয়াত প্রচার ও প্রসারের প্রাণান্ত প্রয়াস-প্রচেষ্টা ........এখানে আমি বলতে চাই যে, দাওয়াতে হকের দীর্ঘ স্থায়ীত্বের জন্য উহার প্রচার গও প্রসারে সকল আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা অতীব জরুরী।
৭- ইসলামী শিষ্টাচার ও শালীনতা রপ্ত করা..........জীবনের আদাব আখলাক আমার দৃষ্টিতে ইসলাম যে উন্নত মানদন্ডের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছে তার তুলনা কোথাও মেলে না।
৮- নিজস্ব মূলনীতি ও আদর্শের ওপর অটল অবিচল হয়ে থাকা........ আমার বক্তব্য হচ্ছে যে, নিবেদিত প্রাণ ও নিষ্ঠাপূর্ণ ঈমান কখনো টলটলায়মান হতে পারে না। সবর ও ধৈর্য, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কুরবানী এবং শৌর্যবীর্য ও বীরত্ব এমন মৌলিক যুগান্তকারী ও অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য যা জালেম ও অত্যাচারী এবং ইসলামের দুশমনদের মোকাবেলায় মুমীন বান্দাকে পেশ করতে হয়। এগুলোই তার ঢাল ও শিরস্ত্রান আবার এগুলোই তার অস্ত্রশস্ত্র ও হাতিয়ার।
৯- হক ও খাইর তথা সত্য ও কল্যাণের প্রতি অনুরাগ...........আমি বলতে চাই যে, এ দু’টো জিনিসই ব্যক্তিগত প্রশিক্ষণের বুনিয়াদী পাথর সদৃশ্য। ঈমানের কোন অস্তিত্বই লাভ করা সম্ভব নয় যে পর্যন্ত আপনি আপনার ভাইয়ের জন্য ওসব কিছু পছন্দ করতে না পারবেন যেগুলো আপনার নিজের জন্য আপনি পছন্দ করে থাকেন।
যাতে করে আল্লাহর দ্বীনের পতাকাই থাকে সমুন্নত
ইখওয়ানুল মুসিলিমুন তাদের দাওয়াতী কার্যক্রম সম্প্রচার করার জন্য শরীয়াত সম্মত সকল উপায় উপকরণ অবলম্বন করার প্রয়াস পায়। ইমাম শহীদ বিশটিরও বেশী সংখ্যক ইসলামী সাহিত্য-পুস্তিকা লিপিবব্ধ করেন। এগুলোতে তিনি সমস্ত মুসলিম জাহানের সমস্যাবলীর ওপর আলোকপাত করেন। তিনি শুধুমাত্র মিসর ও ফিলিস্তিন সমস্যার ওপরই তার লিখনীকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং তার আকাংখা ছিল সমগ্র বিশ্বব্যপী ইসলামী আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে দেয়ার প্রতি। আমরা বহুবার বলেছি ও লিখেছি যে, আমরা ক্ষমতার লোভী নই আর না রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্ব ও অবস্থানের বিরোধী। আপনারা অনুগ্রহপূর্বক ১৯৪৮ সলের ১৩ই জুন তারিখে উজীরে আযমের উদ্দেশ্যে ইমাম শহীদের লিখিত এ অংশটির প্রতি লক্ষ্য করুন।
যদিও আপনার আমলে আমাদের ওপর ও আমাদের প্রাণপ্রিয় আন্দোলনের ওপর যুগপৎভাবে কঠোর দমননীতি চালানো হয়েছে। এতদসত্ত্বেও আপনার বিরুদ্ধে আমাদের কোন শত্রুতা ও ক্ষোভ নেই। আপনার সংস্কারমূলক মহতী পদক্ষেপসমূহ এবং সেগুলোর সফলতার স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতি আমরা জ্ঞাপন করছি। ইতিহাসের পাতায় সোনালী অক্ষরে আপনার এসব মহতী কার্যবলী লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। আর আমরাও এগুলো মনে রাখবো। আমরা এমন এক পুত-পবিত্র দাওয়াতের দায়ী ও আহবায়ক যা ব্যক্তিগতভাবে কারো সাথে বৈরিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, শত্রুতা ও প্রতিহিংসা পোষণ করাকে আদৌ জায়েযৈই মনে করে না।
সুধী পাঠক! আপনারা কি দেখার সুযোগ পাননি যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন তাদের ওপর অত্যাচার নের্যাতনের ষ্টীমরোলার পরিচালনাকারীদের ব্যাপারে কিরূপ আচরণ ও কর্মনীতি অবলম্বন করেছে? তথাপি আমাদের ওপর এরূপ অভিযোগ আরোপ করা হয় যে, আমরা সন্ত্রাসবাদী এবং মানুষের পিপাসু।
“ওগো আল্লাহ! আপনি মেহেরবানী করে আমাদের ও আমাদের জাতির মধ্যে ন্যায়সম্মত ফায়সালা করে দিন আর আপনি তো সর্বোত্তম ফয়সালাকারী” মিসর ও মুদানের মধ্যে উত্তেহাদ তথা ঐক্য ও সংহতির আওয়াজ সর্বপ্রথম ইমাম হাসানুল বান্না শহীদই তুলেছিলেন। তার জানা ছিল যে, সার্বিক উন্নতি অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বাচ্ছন্দ উভয় দেশের একীভূত করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। দু’দেশই এ লক্ষ্যে পারস্পরিকভাবে একে অপরের খুব কাছাকাছি এসে গিয়েছিলো। তারপর আসে আবদুন নাসেরের শাসনকাল। তিনি না বুঝে না শুনেই মিসর ও সুদানকে আলাদা আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত করে দেন। তিনি ভ্রাতৃপ্রতীম দু’দেশের মাঝে একটা খোঁড়া অজুহাতকে ভিত্তি বানিয়ে সিদ্ধান্তকরী অন্তরায় ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দেন। তিনি তার সাধারণ অনুমান দ্বারা তার এ সিদ্ধান্তকে জনগণের মুক্তি ও স্বাধীনতার নামান্তর বলে স্থির করেন। মিসরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক এবং সুদানের প্রেসিডেন্ট জাফর নিমেরী উত্তম দেশের একত্রীকরণের জন্য প্রেচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, নসের যে ন্যক্কারজনক ভুল করে ছিলেন এখন গিয়ে তারই সংশোধনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
ওপরে আমরা দাওয়াতে প্রসার ও প্রচারের আলোচনা করে এসেছি। সংবাদপত্র প্রসার ও প্রচারের সর্বাপেক্ষা কার্যকরী মাধ্যম এবং ইখওয়ান এ ময়দানে নেহায়েত শীর্ষস্থানীয় ও উত্তম উদাহরণসমূহ স্থাপন করেছে। কোন কোন ইখওয়ান “কাশকুলুল জাদীদ” নামক সাময়িকী চালু করেন এবং পর্যায়ক্রমিক সংবাদপণ্যের ন্যায় উহাকে বিন্নস্ত করে প্রকাশ করেন। ইমলাম এবং ইসলামী আন্দোলনের সংবাদপত্র অংগনেও একটা নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। ইমাম শহীদ যখন সংশ্লিষ্ট সাময়িকীল ক্রমিক সংখ্যা দেখতে পান তখন তিনি উহার সম্পদকের নামে এ মর্মে চিঠি লিখেনঃ
“তোমরা যে প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি অবলম্বন করেছো উহার সাথে আমি একমত হতে পারছি না। যে আংগিকে আমি “আল কাশকুলুল জাদীদ” কে দেখতে পেয়েছি তা আমার মোটেও ভাল লাগেনি। আমি আশা করি যে, তোমারা বর্তমান রীতি ও ধারা বাদ দিয়ে নিজেদের আন্দোলনের দৃষ্টিভংগি সংবাদপত্রে উপস্থাপনের সযত্ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।”
(বজ্ঞ নিবন্ধকার ১৯৪৭ সালের ২৯শে আগষ্ট তারিখে প্রকাশিত সংখ্যায় ইমামের লিখিত উল্লেখিত পত্রেরও উল্লেখ করেন।)
আরশ পর্যন্ত পরিব্যপ্ত সাহস প্রয়োজন
ইখওয়ানের সাথে সরকারের বিরোধ ছিল দীর্ঘ দিনের। আমাদের আকীদা বিশ্বাস হচ্ছে এই যে, ইসলাম দ্বীনও এবং একই সময় রাজনীতিও। দ্বীনের ব্যাপারে এটাই সঠিক দৃষ্টিভংগী। কিন্তু সরকার আমাদের এ দৃষ্টিভংগির সম্পূর্ণ বিরোধী। আমাদের মাজহার পূজা পার্বণের মাযহার নয় বরং এটা পূর্ণঙ্গ একটা জীবনব্যবস্থার নাম। ইহা পুরো জীবনের সংস্কার ও সংশোধন কামনা করে। ইহার দৃষ্টিতে দুনিয়ার এ জীবন শস্যক্ষেত্রেরই নামান্তর। যার ফল লাভ করা যাবে আখেরাতে। এখানে আমরা যা কিছু বপন করবো সে ফসলই পরকালে কর্তন করবো। মানুষের সকল কাজ-কর্ম এবং তার জীবনের সকল দিক ও বিভাগ ইসলামের প্রদর্শিত হেদায়াত ও রৌশরীতে সমুজ্জল। সরকারের সাথে আমাদের এ আচরণ সম্ভবত এভাবেই চলতে থাকবে যতদিন পর্যন্ত না আল্লাহ দ্বীনের সঠিক ধারণা দান করবেন। সুদুর দিগন্তে উজ্জল রশ্মির আভা ও কিরণমালা পরিদৃষ্টি হচ্ছে এবং পরিবর্তনের লক্ষণ অত্যাসন্ন প্রায়। যে সমস্ত কথাবার্তার কারণে আমাদেরকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছিলো আজ ওসব কথাই সর্বস্তরের গণমানুষের মুখে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মিসরের সকল রাজনীতিবিদগণই এখন ইসলামী শরীয়াত প্রবর্তনের দাবী জানিয়ে আসছে। ইহা ইখওয়ানের কামিয়াবী ও সফলতা এবং বিজয়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ। মূলনীতির ব্যাপারেও মৌলিকভাবে সকলেই একমত হয়ে গেছেন। এখন বাস্তবায়ন ও কার্যকরী করার শুভ সূচনাই শুধুমাত্র বাকী রয়েছে যার জন্য আমরা তীর্থের কাকের ন্যায় অধীর আগ্রহে প্রতিক্ষার প্রহর শুনছি।
(আর সে বহু প্রত্যাশিত সুদিন কেবল তখনই আসতে পারে যখন আল্লাহ তায়ালার অপার অনগ্রহে লব্ধ বিজয়ের ওপর বিশ্ব মুসলিম হর্ষোৎফুল্ল হয়ে ওঠবে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তাকেই সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করে থাকেন। তিনি মহাপরাক্রমশালী এবং দয়ালু। এ ওয়াদা আল্লাহ নিজেই করে রেখেছেন। আর আল্লাহ তো কখনো তার অংগীকার ভংগ করেন না। কিন্তু এ সত্য অধিকাংশ লোকই জানে না। মানুষ তো জানে দুনিয়ার জীবনের বাহ্যিক দিক মাত্র আর আখেরাতের ব্যাপারে তারা নিজেরাই গাফেল- উদাসীন ও অমনোযোগী।)
আমরা আমাদের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও অভিষ্ট বস্তুকে ফল-ফুল ও পত্র-পল্লবে সুশোভিত ও সুসজ্জিত হতে দেখতে পাচ্ছি। ইসলামী মূল্যবোধের আমলে নতুন সূ্র্য উদিত হওয়ার আর কোন দেরী নেই। বাতিলের অন্ধকার কেটে যাওয়ার জন্য উদ্যত। অগণিত শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। এ জগত আবার ইমলামের উজ্জল দীপ্তিতে ইনশাআল্লাহ ঝলমলিয়ে উঠবে।
ওগো আল্লাহ! এসব স্মৃতিচারণের সময় আমি যা কিছু লিপিবদ্ধ করেছে এবং বলার চেষ্টা করেছে একে তুমি বিশেষভাবে তোমার জাতে করীমের জন্য কবুল ও মনজুর করে নাও। আর হে পরওয়ারদিগার! যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে আমার থেকে কোন ভুল-ত্রুটি প্র্রকাশ পেয়ে থাকে তুমি নিজ গুণে তা ক্ষমা করে দাও। বস্তুত তুমি ব্যতীত আর কেইবা মাগফিরাত ও দয়া অনুগ্রহ প্রদান করতে পারেন?
বত্রিশতম অধ্যায়
আশা আকাংখা ক্ষীণ কিন্তু উদ্দেশ্য মহান
অনেক দু’মুর্শিদে আ’ম ইমাম হাসানুল বান্না শহীদ এবং সাইয়েদ হাসান আল হুদাইবি (র) মরহুমগণের ব্যক্তিত্বের মধ্যে তুলনা করে থাকেন। দু’ব্যক্তিত্বের মধ্যে কয়েকটি যুক্ত বৈশিষ্ট ছিল। আবার কতগুলো গুণাবলীতে একজন ছিলেন অপরজন অপেক্ষা ভিন্নতর ও ব্যতিক্রম। দু’ব্যক্তিত্বের দৃষ্টিভংগি প্রাথমিক শিক্ষা এবং বাস্তব কর্মজীবনের সূচনা লঘ্ন এবং নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র ছিল বিশেষ ধরনের। কিছুলোক বড়ই সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে থাকেন এবং বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সূক্ষ্মতিসূক্ষ্মভাবে বিন্যস্ত করে থাকেন। কিছু কিছু লোক এসব বই পুস্তক পাঠ করে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেন। পক্ষান্তরে অনেকে আবার এরূপ তুখোর সমালোচনা এ প্রক্রিয়া আদৌ পছন্দ করেন না। আমার দৃষ্টিতে সর্বপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনার এ প্রক্রিয়া আদৌ পছন্দ করেন না। আমার দৃষ্টিতে সর্বপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে, পাঠকদের সম্মুখে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্বকে তার-রূপে উপস্থাপন করা উচিত। যাতে করে তারা এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, যে ব্যক্তির জীবনালেখ্য তারা পাঠ করছে সে যেন ব্যক্তিগতভাবে তাদের বহুল পরিচিত। তারা যেন চক্ষষভাবে তার সাথে সাক্ষাতে মিলিত হচ্ছে। যতদুর ইখওয়ানুল মুসলিমুনের যোগসূত্র রয়েছে তারা সকলেই তাদের মুর্শিদের হাতে আল্লাহর দ্বীনের স্বার্থেই বাইয়াত করেছিলো। এ বাইয়াতের শর্ত পূরণ করাই হচ্ছে আসল কাজ। বাকী থেকে গুরুত্ব নেই। তারা শুধু জানে যে, যে ব্যক্তিত্বের হাতে হাত রেখে তারা বাইয়াতের শপথ গ্রহণ করেছে তিনি তার জীবনকে কেবলমাত্র আল্লাহর দ্বীনের জন্যই ওয়াক্ফ করে দিয়েছেন।
চিত্তাকর্ষক বাচনভংগী ও মনোসুগ্ধকর দৃষ্টি
আমি ইখওয়ানের একজন কর্মী হিসেবে দু’মুর্শিদে আ’ম-এর হাতেই বাইয়াত করেছিলাম। এ পর্যায়ে প্রসংগক্রমে প্রথম মুর্শিদ সম্পর্কে দ্বীতিয় মুর্শিদের মন্তব্য কিংবা বিবৃতি পেশ করার জন্য মুখ খুলতেন তখন জনগণের লোভাতুর দৃষ্টি তার চেহারার প্রতি পলকহীনভাবে পড়ে থাকতো এবং পত্যেক ব্যক্তি গভীন মনোযোগ সহকারে তার কথাবর্তা শুনতে থাকতো। তার মুখ থেকে শব্দমালা হিরা, মতি ও পান্নার ন্যায় ঝরে পড়তো এবং শ্রোতাদের হৃদয়ের গভীর গ্রথিত ও প্রোথিত হয়ে যেতো। বক্তৃতা চলাকালীন সময়ে উপস্থিত জনতা এমন নীরব নিথর হয়ে শুনতো যেন তাদের মাথার ওপর পাখী বসে রয়েছে। তাদের অন্তর বক্তার মুষ্টিতে আবদ্ধ। আবার যখন তার ভাষণ সমাপ্ত হয়ে যেতো তারপর গিয়ে লোকদের অন্তরাত্মা পুনরায় তাদের নিয়ন্ত্রণে ফিরে আসতো এবং তারা প্রশান্ত প্ররিতৃপ্ত অন্তকরণ নিয়ে ঘরে ফিরে যেতো। কিন্তু আমার অবস্থা হতো সর্বাপেক্ষা ব্যতিক্রমধর্মী। আমি তার বাগ্মিতাপূর্ণ আলোচনা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও আমার মনকে মহান বক্তার নিকট রেখে দিয়েই গৃহ অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যেতাম।”
আন্তর ও দৃষ্টির মুসলিম
ইমাম শহীদ যে দাওয়াতের সূচনা করে গেছেন তা আল্লাহর ফজল ও অনুগ্রহে উজ্জল সূর্যর দীপ্তির ন্যায় দীপ্তিমান হয়ে থাকবে। যার সম্মুখে তারকারাজির ঔজ্জ্বল্যও ম্লান হয়ে যায়। সুর্য যদিও দিনের বেলায় প্রখর আলোয় ভরপুর থাকে। কিন্তু রাতের আগমনের সাথে সাথে অস্তমিত হয়ে যায়। অপরদিকে এ দাওয়াত কখনো হারিয়ে যাওয়ার নয়। ইহার রৌশনী চিরন্তন এবং উহার দীপ্তি চির বসন্তে ভরা। যদি সময় পশ্চাৎগামী হয়ে পড়ে এবং সে সুদিন পুনরায় ফিরে আসে যেদিন শহীদ মুর্শিদের সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছিলো। আর আমাকে বলা হবে যে, আমি আমার জীবনের জন্য কোন পথ অবলম্বন করতে চাই? তাহলে আমি নিঃসংকোচে ও কোনরূপ ইতস্তত না করেই সে কর্মপন্থাই অবলম্বন করবো যার ওপর আমি আজীবন চলে আসছি। এটা হচ্ছে সে রাস্তা যার প্রতি আল্লাহ তায়ালা অন্যাকে হেদায়াত করেছেন এবং যার উপলক্ষ হয়েছিলেন ইমাম শহীদ নিজে। হেদায়াত প্রদানের ক্ষমতা অবশ্য আল্লাহ তায়ালার হাতেই নিবন্ধ কিন্তু আমার নিকট পর্যন্ত এ বাস্তবতা ইমাম শহীদের মাধ্যমেই পৌঁছেছিল।
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াত আমার সামনে সে সত্য উন্মোচিত করে দিয়েছিল যে সন্বন্ধে আমি ছিলাম একেবারেই না- ওয়াকিফ ও অনবাহিত। এমনিতেই তো পৃথিবীতে অগণিত মুসলিম বাস করেছে কিন্তু যাদের অন্তর ইসলাম ও মুসলিমদের মহব্বতে পরিপূর্ণ তাদের সংখ্যা খুব বেশী নয়। আমি নিজে আল্লাহ তায়ালার শোকর আদায় করছি যে, এ আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে নিজে আল্লাহ তায়ালার শোকর আদায় করছি যে, এ আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে আমি ঈমানের বিভিন্ন উপাদান ও উপকরণ সম্পর্কে সম্যকভাবে পরিজ্ঞাত হয়েছি। যদি কোন মুসলিম উত্তর মেরুতে ভুখা থাকে তাহলে তা শুনে আমি আমার হৃদয়ে ব্যথা অনুভব করে থাকি। পৃথিবীর যে কোন প্রন্তে কোন মজলুম মুসলিমের একবিন্দু রক্ত মাটিতে ঝরে পড়ে তাহলে আমার মনে হয় যেন আমার নিজের শরীর থেকে রক্ত প্রবাহিত হয়ে যা্চ্ছে। কোন মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার ওপর যদি কোন দুশমন হাত তোলে তখন আমার রাতের নিদ্রা হারাম হয়ে যায়। আমার মনে হয় যেন আমার বসত বাড়ীর ওপর শত্রু তার প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছে।
এ আন্দোলন আমার মধ্যে এ অনুভূতিরও সঞ্চার করেছে যে, আমার পকেটে যা কিছু রয়েছে উহা আমার মালিকানাধীন নয় বরং এটা আমার নিকট আমানত রাখা হয়েছে মাত্র। ইমাম শহীদ দাওয়াতী কার্যক্রমের প্রারম্ভেই ইখওয়ানের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়েছিলেন যে, প্রত্যেকে নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী সংগঠনকে আর্থিক সহযোগিতা দান করবে। ইহা কোন পূর্ব নির্ধারিত চাঁদ ছিল না। বরং প্রত্যেকের পরিপূর্ণ আযাদী ও ইখতিয়ার ছিল যে যতটুকু পারে আর্থিক কুরবানীর মহড়া প্রদর্শন করতে থাকবে। ইখওয়ান এ ময়দানে তাদের সামর্থ থাকা সত্ত্বেও কখনো কাপর্ণ্য করতো না। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজে নিজের ব্যাপারে কখানো এতটুকুন চিন্তাক্লিষ্ট ছিলাম না যতটুকু আমি আমার অন্যান্য মুসলিম ভাই বন্ধুদের চিন্তায় সর্বদা অস্থির থাকতাম। জীবনতো এরই নাম যে মানুষ অন্যদের জন্য ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করতে থাকবে। এক্ষেত্রে মানুষকে দু’ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। একশ্রেণীর লোক তো কবির ভাষায় এমন কথাও বলে বেড়ায় যে, যদি তাদের বৃষ্টির নেয়ামত দ্বারা সিক্ত না করা হয় তথাপি তারা এ ব্যাপারে প্রশান্তিই থাকে যে কোথাও না কোথাও রহমতের বৃষ্টির ধারা জমিনকে সিক্ত করে থাকবে এবং তাদ্বারা মানবজাতি উপকৃত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে। এরূপ নির্লিপ্ত ও সভ্রান্ত লোকের সংখ্যা খুব কমই তৃষ্ণায় ওষ্ঠাগতপ্রাণ হয়ে পড়ি কিংবা মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে যাই তবুও যেন মর্তের মাটিতে একফোটা বারিবিন্দুও নাজিল না হয় যাতে করে ছোট বড় সকলেই আমার মত অসহায়ভাবে পিপাসার হাতে মৃত্যুর শিকার হয়ে যায়।
বাঁচার জন্য খাওয়া নাকি খাওয়ার জন্য বাঁচা
দু’দলের লোকই দুনিয়াতে পাওয়া যায় এবং আপনাপন ঋণাবদ্ধ জীবন প্রত্যেকেই অতিবাহিত করে নেয়। কিন্তু এতদুভয়ের মধ্যে আসমান জমিনের ফারাক রয়েছে। এক গ্রুপ এজন্য খেয়ে থাকে যে বেঁচে থাকতে হবে। অপরদিকে অপর গ্রুপ এজন্য জীবিত থাকে যেন খাওয়ার সুযোগ লাভ করতে পারে। অর্থাৎ “বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য গ্রহণ করা” খাওয়ার সুযোগ লাভ করার জন্য বেঁচে থাকা” এর মূলনীতির ওপর উভয় সম্প্রদায়ই কর্মতৎপর। এক কুয়া পানিতে কানায় কানায় ভরে উঠে; পক্ষান্তরে অন্য কূপ সম্পূর্ণ শুষ্ক ও পনিশূন্য জমিনের এমন একটা টুকরা হয়ে থাক যে, এগুলোতে যদি পানি সিঞ্চন করা হয় তাহলে উভয়টিতেই জীবনের সঞ্চার হয়ে থাকে। কোন কোন ভূ-খন্ড পানিতে সিক্ত হওয়ার পর নিরেট পাথরের রূপ পরিগ্রহ করে থাকে। না উহাতে বীজ অম্কুরিত হয় আর না চারা গজায়। এমনি করে জীবনের কয়েক রূপ পরিদৃষ্ট হয়ে থাকে। যে ধ্বংসশীল ও অস্থায়ী জীবন গড়ার চিন্তায় অস্থির থাকে এবং অন্য কারো মংগল ও কল্যাণের ধারণা পর্যান্ত কখনো হৃদয় মনে স্থান দিতে না পারে তার ধ্বংসের ব্যাপারে আর কি সন্দেহ থাকতে পারে। সেতো ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।
মানবসমাজকে অন্ধকারের কুহেলিকা থেকে বের করে উজ্জল আলোয় নিয়ে আসা এবং নির্যাতন, নিষ্পেষণ এবং দাসত্ব ও গোলামীর জিঞ্জির ছিন্ন করে মানবতাকে আযাদী ও স্বাধীনতার নেয়ামত প্রদানকারী আল্লাহর বান্দাহগণের সংখ্যায় খুব কমই হয়ে থাকেন। এসব জীবন্ত মানুষগুলো সত্যের ওপর কায়েম থাকে। যদিও দুনিয়া তাদের শত বিরোধিতাই করুক না কেন। মানুষ কি সে ঐতিহাসিক কাহিনী সম্পর্কে অবহিত নয় যাতে একটা নওজোয়ান ছেলে তার জাতিকে জাগিয়ে তোলে এবং সমকালীন শাসকের অত্যাচার উৎপীড়নের বিরুদ্ধে তাদেরকে প্রতিবাদী ও ক্ষিপ্ত করে তোলা। জালিম বাদশাহ সে দুঃসাহসী ছেলেটিকে হত্যা করে তার ছোবল থেকে রক্ষা পেতে চাইলো কিন্তু যুবকের ওপর কোর অন্ত্রই কার্যকরী করা গেলো না। শেষ পর্যন্ত বাদশাহ সে ছেলেটিকে তার নিকট ডেকে পাঠায় এবং তাকে বলে, “তুমি আমার প্রজাসাধারণকে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য উত্তেজিত করে দিয়েছো। আর আমি তোমাকে খতম করার জন্য যে কৌশলই পয়োগ করি তা-ই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তুমি কারো সম্মুখেই তোমার মস্তকাবনত করতে চাও না। এখন তুমিই আমাকে বলে দাও যে, আমি কি উপায়ে তোমার হাত থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি? প্রত্যৃত্তরে নওজোয়ান বলতে লাগলো,- “আপনি অকারণে শুধু শুধুই এত ঘাবড়ে যাচ্ছেন- এটা তো খুবই সহজ কাজ।” বাদশাহ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তা কি রূপ সম্ভব?” ছেলেটি জবাবে বলতে শুরু করলো, “ঈদের দিন চাশতের সময় সমস্ত দেশবাসীক একটা খোলা ময়দানে সমবেত হওয়ার আদেশ জারী করে দিন এবং সমাগত আপামর জনতার সামনে আমাকে কোন উচূ জায়গায় দাঁড় করিয়ে তরিন্দাজকে হুকুম দিয়ে দিন যেন সে আমার বক্ষ লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে। তীর ছোড়ার পুর্বে যেন সে বলে দেয়, এই ছেলের রবের নামে।”
বাদশাহ সে ছেলেটের পরামর্শ মোতাবেক কাজ করেন। ছেলেটি তীরন্দাজের অব্যর্থ তীরের আঘাতে মাটিতে ঢলে পড়লো এবং শাহাদাতের মর্যাদালাভে ধন্য হয়ে গেলো। এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত জনতার সকলেই একযোগে কালেমায়ে তাওহীদের ওপর ঈমান আনলো। ফলে অবোধ বাদশাহর জন্য অপমান, আফসোস ও শোচনীয় পরাজয় ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট রইলো না। এ নওজোয়ান যে সত্যবাদিতার জন্য তার জীবনের বাজী লাগাতে প্রস্তুত হয়ে গেলো সে দুনিয়া এবং আখেরাত দু’প্রতিযোগিতাতেই একযোগে জিতে গেলো। এ নওজোয়ানের ন্যায় ইখওয়ানের আন্দোলনের পতাকা ওপরে তুলে ধারণকারী নওজোয়ানগণও প্রবল আত্মত্যাগের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত। যত প্রতিবন্ধকতা এবং বাধার পাহাড়ই তাদের চলার পথে এনে দাঁড় করিয়ৈ দেয়া হউক না কেন তারা কিছুতেই পরাজয় মেনে নিতে আদৌ প্রস্তুত হবে না। যেদিন সমস্ত বাধা-বিপত্তি সরে যাবে তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে যাবে এবং সমগ্র দুনিয়াবাসী দেখতে পাবে যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন কেব ছিলেন? এরা হচ্ছে ওসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত যাদের জন্য আল্লাহর কিতাবে শাক্তি,কামিয়াবী ও বিজয়ের ওয়াদা রয়েছে।
আমাদের মত কেউই নয়
এটা কতই না আফসোস ও দুঃখজনক কথা যে, আমাদের দেশের সমস্ত সংবাদপত্র ও সাহিত্য সাময়িকী সকল ব্যাপারেই নেতিবাচক ও ইতিবাচক দৃষ্টিভংগি পেশ করে থাকে। কিন্তু ইখওয়ান সম্পর্কে তাদের মনোভাব সম্পুর্ণ ব্যতিক্রম। ইখওয়ানের মধ্যে কোন ইতিবাচক ও সম্ভাবনাময় দিক তার দেখতে পায় না। তাদের নিকট ইখওয়ান আপাদমস্তক নিকৃষ্ট, ঘৃণীত অবাঞ্ছিত মাত্র।
ইখওয়ান আল্লাহর অনুগ্রহে সমস্ত দুনিয়া থেকে নির্লিপ্ত ও অমুখাপেক্ষী। এমনকি তারা কারো সমীপে কখনো এমন কোন আবেদনও জানায় না যে, তাদের প্রতি একটু পক্ষপাতিত্ব কার হোক। কিন্তু সাংবাদিকতার অন্যতম কর্তব্য হচ্ছে এই যে, সাংবাদিক সকল পক্ষপাতমুক্ত এবং ইনসাফপূর্ণ আচরণ অবলম্বন করবে। সত্য থেকে বিমুখ ও বিচ্যুত লোক যেসব গুণাবলীর অধিকারী হয়ে থাকে সেগুলো সম্পর্কে ছোট বড় সকলেই অবগত হয়ে যায়। আমাদের সাথে ওসব লোকরে আচরণ খুবই দুঃখজনক তো বটেই কিন্তু অপ্রত্যাশিত নয়। এরা হক থেকে বিচ্যুত ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে।
১৯৫২ সালের ২৩শে জুলাই বিপ্লবের সময় ইখওয়ানের কীর্তীকলা্প সম্পর্কে কে না জানে। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সাথে নাসের এবং অপরাপর আযাদ অফিসারগণের যোগাযোগের ব্যাপারে কোন সাংবাদিকই না-ওয়াফিক নন। আযাদ অফিসারগন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সহকারী মুর্শিদে আ’ম মেজর মাহমুদ লাবীবের শাগরেদ ছিলেন। এসব বাস্তবতা সম্বন্ধে তারা কিছুই না জানার ভান করছিল। এমনকি তারা ইখওয়ানকে বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের দুশমনরূপে চিহ্নিত করে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সাংবাদপত্রগুলো নিমক হালালী করার প্রয়াস পেতো। এটা কি কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা নাকি ধীরস্থির মস্তিষ্কের পূর্ব পরিকল্পনা? মিসরে বিগত কয়েক শতাব্দি পূর্বে জনৈক ফেরাউন এরূপ আচরণরই করেছিল। আমীস সানী বা দ্বিতীয় আমীস যখন ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হন তখন তিনি তার পূর্ববর্তী সকল ফেরাউনের সমস্ত কীর্তিকলাপ ও নাম-নিশানা পর্যন্ত মুছে ফেলার নির্দেশ প্রদান করেন। যাতে করে ইতিহাসের গৌরবজনক অধ্যায় তারই নামের অংশবিশেষে পরিণত হয়ে যায়। নব্য যুগের ফেরাউনও অনুরূপ আচরণেই পুনরাবৃত্তি ঘটানোর প্রয়াস পায়। দাওয়াতে ইসলামের বিরোধিতায় বিভিন্ন শাসনকর্তাগণ তাদের ব্যক্তিগত মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একই কর্মনীতি অবলম্বন করে থাকে। বৃদ্ধিজীবি, বিশেষজ্ঞ, ওয়াকিফহাল মহলা এবং সংবাদপত্রসেবীদের নিকট প্রশ্ন রাখতে চাই, অন্ততপক্ষে সন্তব্য করুন-এ পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বাস্তবতার সাথে সংগতিপূর্ণ কি না?
সাইয়েদ কুতুব শহীদ
সাইয়েদ কুতুব শহীদ মিসরীয় ভূ-খন্ডের সে গৌরবোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব যিনি সর্বদা বেঁচে থাকবেন। সেইয়েদ কুতুবের ক্ষুরধার লিখনীর দ্বারা বহু গ্রন্থ প্রণীত ও সংকলিত হয়। এসব অমূল্য গ্রন্থের জ্ঞানগত মান খুবই উন্নত এবং লিখার গতি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ছিল। এমনিতেই তো তিনি সকল বিষয়ের ওপর কলম ধরেছিলেন এবং চমৎকার উপস্থাপনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তন্মোধ্যে তার বাক যুদ্ধ সম্বলিত তাফসীর “ফি জ্বিলালিল কুবআনিল ইজতিমাইয়া” এবং “মু্আলিমুন ফিত্ তরীক” বাস্তবিকই অতুলনীয় সৃষ্টি।{* “ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা” নামে এ বইটি বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে।}
সাইয়েদ কুতুব শহীদের সংকলনসমূহ সকল জাহেলিয়াত ও জুলুমের বিরুদ্ধে যেহায়েত কার্যকরী ও বলিষ্ঠ আওয়াজ এবং সমগ্র মানবজাতির অধিকারের পতাকাবাহী। সাইয়েদ শহীদের দৃষ্টিকোণ ছিল এই যে, আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত হালাল হারামের ব্যাপারে পুরোপুরি স্বাধীনতা থাকা আবশ্যক। সাইয়েদ শহীদ ইসলামের ওপর গভীর অধ্যয়ন করেছিলেন এবং তার সাথে সাথে আধুনিক সভ্যতার ওপরও ছিল তাঁর প্রাগাঢ় পন্ডিত্য। তিনি উন্নত বিশ্বের বিরাজমান পরিস্থিতির চুলচোরা বিশ্লেষণ ও সার্বিক মূল্যায়ন করার প্রয়াস পান। তাদের সামাজিক স্বাধীনতার গভীর প্রবেশ করেন। অনন্তর উম্মতে মুসলিমাকে আজীবন এ সত্য বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, শরীয়াতে ইলাহিয়া প্রবর্তন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমেই মানবতার সত্যিকার মুক্তি এবং দৃষ্টান্তমূলক অগ্রগতি অর্জন করার করতে পারে আর না পকৃত মুক্তি লাভ করতে পারে।
“মুয়ালিমুন ফিত্ তরীক” ছিল তার এমন জ্বালাময়ী প্রন্থ যাকে উপলক্ষ বানিয়ে সাইয়েদ কুতুবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়। সাইয়েদ কুতুবের চিন্তা-চেতনায় কোন নিত্য নতুন ও অদ্ভূদ অভিনব চিন্তাধারার সামাবেশ ঘটেনি। বরং তার সমৃদয় লিখনী সে বুনিয়াদী চিন্তা-ভবনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে যার উল্লেখ আমরা ওপরে করে এসেছি। এ শহীদ কারাগারে বসেই লিখেছিলেন। জেলখানার চার দেয়ালের অভ্যন্তরে যেরূপ দানবীয় ও নারকীয় হিংস্রতা ও বর্বরতার চরম পরাকাষ্ঠ প্রদর্শন করতো সরকারী গোমস্তাগণ সে ভয়াল দৃশ্য দেখে প্রত্যেক সভ্রান্ত ব্যক্তি মাত্রেরই হৃদয় আলোড়িত ও প্রকম্পিত না হয়ে পারে না। সাইয়েদ কুতুব ছিলেন তীক্ষ্ণ অনুভুতিপবণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি এসব দৃশ্য দেখে তার সে চিন্তা। চেতনাকে শরীয়াতে ইসলামীয়ার বাস্তবায়নকে মুসলিম জীবনের সর্বাধিক মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে নির্ধারণ করেছেন এবং অত্যান্ত বলিষ্ঠ ভংগিতে এ অমূল্য প্রন্থে তা উপস্থাপন করে দিয়েছেন। শরীয়াত বিরোধী সকল আইন- কানুনের সর্বদা প্রবল বিরোধী ছিলেন তিনি। কিন্তু এ বইতে তাঁর কলমের গতি ছিল উদীয়মান।
সাইয়েদ কুতুব শহীদের ওপর মিথ্যা অভিযোগসমূহ
সাইয়েদ কুতুবের ওপর এ দোষারোপ করা কয়েছিল যে, তিনি দেশের মানুষকে কাফের মনে করে থাকেন। এ অভিযোগ ছিল ডাহা মিথ্যার বেসাতি মাত্র। তিনি কখানো কোন মুসলিমকে কাফের বলে অভিমত ব্যক্ত করেননি। তার ভলভাবেই জানা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশ কিছু সংখ্যক হাদীসে ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি তার মন দিয়ে ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু’- এর ওপর ঈমান আনবে সে কিছুতেই চিরদিন দোজখে থাকবে না। আমাদেরও দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে যে, জাহান্নামের চিরস্থায়ী ঠিকানা হবে কাফেরদেরই। কেননা তারা মহাপরাক্রমাশালী সর্বশক্তিমান আল্লাহ একত্ব ও অদ্বিতীয়ত্বের অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী। তিনি তার গতিশীল লিখনীতে জাহেলীয়াতের সামাজিক পাভিাষার বহুল ব্যবহার করেন। এ প্রচলন দ্বারা সমাজকে কাফের প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্য তার কখনো ছিল না। বরং জালিম, তাগুত, অসভ্য ও সংশয়গ্রস্থদের স্বরূপ উদঘাটনই তার মূল লক্ষ্য।
আরবী ভাষায় সুস্পষ্ট বর্ণনাভংগী জানা আবশ্যক। কোন একটা শব্দের শাব্দিক অর্থ নিয়ে সারিষার পাহাড় রচনা করা ও তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে বসা বড়ই বেমানান এবং অবিবেচনা প্রসুত কর্মপদ্ধতি। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত কুরআন মজীদে কাফেরদের ব্যাপরে ইরশাদ করেছেন-(আরবী**************) “অর্থাৎ কাফেরদেরকে মর্মপীড়াদায়ক শাস্তির সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।”-সূরা তাওবাঃ ৩
এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে দোজখের কঠিন এবং কঠোর আযাব থেকে ভয় দেখানো আর উহার তীব্রতা ও ভয়াবহতা প্রকাশ করা। কিন্তু এ লক্ষ্যার্জনের জন্যও বিশারত ব সুখবর শব্দই প্রয়োগ করা হয়েছে। যা সাধারণত সচ্ছল অবস্থ, প্রাচুর্য ও কল্যাণের জন্য ব্যাবহৃত হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা) তার বহু হাদীসে বর্ণনা করেছেন। যেখানে এসব শব্দ থেকেও ওলামায়ে উম্মতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংশিষ্ট ব্যক্তিকে কাফের সাব্যস্ত করা উদ্দেশ্য নয় বরং আলোচ্য আমলের অনিষ্ঠকারিতা বর্ণনা করে মানুষের উহা থেকে বিরত রাখাই মূল উদ্দেশ্য। যেসব লোক সাইয়েদ কুতুব শহীদকে জানে তারাই একথার সা্ক্ষ্য প্রদান করবে যে, তিনি ছিলেন উন্নত চরিত্র ও সম্ভ্রান্ত আচার ব্যাবহারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইসলামী শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধকে তিনি সর্বদা সম্মুখে রাখতেন। কাউকে কাফেল বলে অভিযুক্ত করা ছিল তার স্বভাব প্রকৃতির সম্পূর্ণ পরিপন্থি। তিনি ছিলেন তাঁর সমসাময়িক ইসলামের দায়ীগণের শীর্ষস্থানীয়। যে সমস্ত লোক তার লিখনী থেকে তাদের মর্জি বিরোধী উদ্ধৃতি উদ্ধার করে সেগুলোর মনগড়া অর্থ বর্ণনা করে তাদের জালিম রূপে অভিহিত হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ-সংশয়েল অবকাশ নেই। তার তেজদীপ্ত লিখনী যা যুব মানস ও বর্তমান প্রজন্মকে খুবই প্রভাবিত ও আলোড়িত করতে সক্ষম হচ্ছিলো এবং তার অকৃত্রিম ভালবাসা, অনুরাগ ও সম্মানবোধের প্রেরণা পাঠকদের মনে দানা বাঁধাছিল। আর এ জিনিসই তাগুতি শক্তিগলোর অন্তরে কন্টকের ন্যায় প্রবিষ্ট হচ্ছিলো। তাইতো তারা নিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে, এ মুজাহিদকে পথ থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
সাইয়েদ কুতুব শহীদের ব্যক্তিত্ব ও সংকলন সম্পর্কে আমাকে কিছু বলতে হলে প্রচৃর সময়ের পয়োজন। এত স্বল্প সময়ে বিষয়বস্তুর হক আদায় করা যাবে না। “মুয়ালিমুন ফিত্ তারীক” বা “ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা” –এর বিষয়বস্তু যে কেন্দ্রেীয় প্রতিপাদ্য বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে তার সারনির্যাস ওপরে কর্ণনা করা হয়েছে। আমি সুধী পাঠকগণের সম্মুখে আরও আরজ করবো যে, “মুয়ালিমুন ফিত্ তারীক” মুদ্রণ ও প্রকাশের পুর্বে উহার পান্ডলিপি দেখার সৌভাগ্য আমার লিমান তারাস্থ জেলখানার হাসপাতালে বসে হয়েছিল। অদ্যাবধি এ অমূল্য কিতাবখানি রাহে হকের মুসাফিরগণকে মনজিল ও অভিষ্ট লক্ষ্যপানে পথপ্রদর্শন করে চলেছে।
সাইয়েদ কুতুব সম্পর্কে আমি অতি সংক্ষেপে যা কিছু আরজ করলাম তাই যথেষ্ট। কেননা তিনি কোন পরিচিতির মুখাপেক্ষী নন। প্রসংগক্রমে আমি এখানে আরো একটি কথা যোগ করতে চাই। আমরা তখন জেলে আটক ছিলাম। ইত্যবসরে সাইয়েদ কুতুব শহীদেকে সরকার মুক্ত করে দিয়েছিলেন। এ মুক্তি লাভের পর পুনরায় তাকে গ্রেফতার করে ফেলা হয়। এবারে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রেহিতার মোকাদ্দমা দায়ের করা হয় এবং তাকে ফাঁসির সাজার ডিক্রী শুনানো হয়। ছাড়া পাওয়ার পর সাইয়েদ কুতুব জেলখানায় আমাকে পয়গাম দিয়ে পাঠান যে, ইরাকী সরকার তাকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদ অলম্কৃত করার জন্য আমান্ত্রণ জানিয়ে পাঠিয়েছেন। সাইয়েদ শহীদ আমার নিকট এ প্রস্তাব গ্রহণের ব্যাপারে পরামর্শ কামনা করেন। আমি তাকে এ মর্মে পরামর্শ প্রদান করলাম যে, এ আমন্ত্রণ আপনি স্বাদরে গ্রহন করুন এবং অবিলম্ব ইরাকের উদ্দেশ্যে মিসর ত্যাগ করুন। বিপ্লবীদের অসৎ উদ্দেশ্য আমি লক্ষ্য করছি ও দেখতে পাচ্ছি। এমনকি স্বয়ং সাইয়েদ শহীদের জীবনই আমি খুব বিপদাপন্ন বলে মনে করছিলাম। আমার এ পরামর্শ প্রদানের পরও সাইয়েদ কুতুব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন যে, স্বীয় মতামত এবং তার পান্ডিত্যপূর্ণ ধ্যান ধারণা প্রতিহত করার জন্য তাকে মিসরেই অবস্থান করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা যঙা কিছু নির্ধারিত করে রেখেছিলেন তা থেকে পালিয়ে বাঁচার কোন উপায় ছিল না। আর না কোন সতর্কতামূলক পদক্ষেপ তা হটিয়ে দিতে সক্ষম। আবদুল ফাত্তাহ ইসমাঈল শহীদও আমাদের আন্দোলনের অপর এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। যার দীপ্তি হথ হার পথিকদের পথ দেখাতে থাকবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ আমি ব্যক্তিগতভাবে আবদুল ফাত্তাহ শহীদের ব্যাপারে বেশী কিছু জানার সুযোগ পাইনি। কেননা যখন তাকে ফাঁসির শাস্তি প্রদান করা হয় তখন আমি দীর্ঘ দিন যাবত কারগারের সাজা ভোগ করছিলাম এবং আমাকে কাটাতে হয়েছিল বিভিন্ন জিন্দানখানার চার দেয়ালের অভ্যন্তরে।
আবদুর রহমান সিন্ধী মরহুম আন্দোলনের গোড়ার দিকে ছিলেন সংগঠনের বড়ই অনুগত এবং ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের অনুসরণে ছিলেন সর্বপেক্ষা অগ্রগামী। ইখওয়ানের সামরিক বিভাগ (বিশেষ বিভাগ)- এর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল তার ওপর। কিন্তু দুর্ভগ্যক্রমে শয়তার তাঁর মনে কুমন্ত্রণা দিতে সক্ষম হয় যে ইখওয়ানের সদম্যগণ মুর্শিদে আ’ম অপেক্ষাও তার বেশী অনগত। ফলে তিনি মুর্শিদে আ’ম- এর মোকোবেলায় তার নিজের ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলতে ও প্রকাশ করতে শুরু করলেন। তিনি এ ক্ষেত্রে খুব বেশী অগ্রসর হতে পারলেন না। ইতিমধ্যেই মুর্শিদে আ’মকে শহীদ করে ফেলা হয়। অতপর যখন হাসান আল হুদাইবি মরহুমকে মুর্শিদে আ’ম হেসেবে মনোনীত করা হয় তখন আবদুর রহমান সিন্ধী মরহুম তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ও নগ্নভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করে এসেছি। সাথে সাথে ইখওয়ান সিন্ধী মরহুম এবং তার পৃষ্ঠপোষকদেরকে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে জানিযে দেন যে, তারা তাদের মুর্শিদে আ’ম-এর মোকাবেলায় অপর কোন ব্যক্তিত্বকে কোন প্রকার গুরুত্বই প্রদান করে না। স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইখওয়ান সদস্যগণও সিন্ধী সাহেববে বুঝিয়ে দেন যে, মুর্শিদে আ’ম-এর নিদের্শ ক্রমেই তারা তার আনুগত্য করে আসছে। এক্ষণে তার বিদ্রোহের পর তারা কিছুতেই তার অনুগত নয়। অনন্তর সিন্ধি সাহেব ইনতিকাল করেন। আল্লাহ তায়ালা তার ওপর রহমত নাজিল করুন। আমি কবরস্থ মৃত মানুষের লাশ কিছুতেই তুলে আনার পক্ষপাতি নই। আমি সমালোচনা করতে চাই না। অবশ্য সাংগঠনিক স্বার্থে এতটুকু বলতে হবে যে, আমানত রাখা বস্তু সতর্কতার সাথে হেফাজত করা কর্তব্য এবং পরিস্থিতি যে দিকেই মোড় নিক না কেন নিজের সংগঠনের খবরাদি সংগঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। সিন্ধী সাহেবের ওপর নাসের এমন প্রভাব ফেলেন যে তিনি শুধু তার গুণগ্রাহী হয়েই ক্ষান্ত হননি বরং সংগঠনের আদিঅন্ত সব বৃত্তান্ত তার নিকট ফাঁস করে দেন। দুনিয়া থেকে চলে গেছেন তারা আর প্রতিরোধমূলক কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না। তাদের নিয়ে সমালোচনা মুখর হয়ে ওঠকে আমি শরাফত ও শালীনতা পরিপন্থি বলে মনে করি। উলামা ও বিশেষজ্ঞগণ, সমাজ বিজ্ঞান ও নৈতিক চরিত্রকে এভাবে বিন্নস্ত ও সংগঠিত করে গেছেন। গোপনীয়তা রক্ষা করার অংগীকার ভংগ করার ওপর সম্যকরূপে অবগত হয়ে এবং বিষয়ভিত্তিকভাবে কলম ধারণ করা উচিত।
আবদুল কাদের আওদাহ শহীদ
আবদুল কাদের আওদাহ শহীদের স্মৃতিকথা আমার অন্তরে জাগরুক রয়েছে। তিনি ইখওয়ানের সহকারী মুর্শিদে আ’ম-এর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি পান্ডিত্য ও যোগ্যতার জীবন্ত আদর্শ এবং বিচারলয়ের স্বনামধন্য বিচারপতি ছিলেন। স্মৃতির বাতায়নে উকি দিয়ে দেখতে গিয়ে আমি সে ঘটনাকে আমার কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি যখন আবদুল কাদের আওদাহ শহীদ আদালতের জজ ছিলেন্ তখন কোন কোন ইখওয়ান ভাইকে কোন মোকদ্দমায় তাঁর আদালতে পেশ করা হয়। ইখওয়ান ভ্রাতাগণের বিপক্ষে লড়েন বড়ই অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ কৌশুলিগণ। তারা আইনের খুবেই সূক্ষ্ম মারপ্যাচ উপস্থাপন করেন আদালতে। এদিকে আবদুল কাদের আওদাহ শুধু একজন জজ মাত্রই ছিলেন না যে, শুধু উকিলগণের যুক্তিপ্রমাণের ওপরই তাকে নির্ভর করতে হবে। বরং তিনি নিজেও আইন শাস্ত্রের ওপর যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি রাখতেন। ফলে তিনি আসামী ও অভিযুক্তদের বেকুসুর খালাস করে দেন। এবং তার ফায়সালার পথার্থতার পক্ষে এমন সব দলিল পেশ করেন যেগুলোর ভিত্তিতে তিনি তাদের নির্দোষ হওয়ার নির্দেশ জারী করেন। দু’পক্ষের আইনজীবিগণ আওদাহ যুক্তি-প্রমাণ এবং সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম তত্ত্ব তথ্যের মোকাবেলায় তাদের আইন বিষয়ক ধারণাকে খুবই অপ্রতুল বলে স্বীকার করতে বাধ্য হন।
আদালত কিংবা বিচারালয়ের আসনে উপবিষ্ট হওয়া খুবই বিপদসংকুল গুরুদায়িত্ব। একজন বিচারক শুধু মামলার ফাইল পত্র, অভিযোগ খন্ডনের যুক্তি প্রমাণ, সাক্ষী সাবুদ এবং বর্ণনা বিবরণ পর্যন্তই তার নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখে সকল মোকদ্দমায় ইনসাফ পর্যন্ত পৌছতে পারে না। তাকে তার সম্কটজনক দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য পর্যন্ত পরিমাণ পবেষণা, পর্যবেক্ষণ এবং বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা প্রয়োগ করতে হয়। আবদুল কাদের আওদাহ শহীদ-এর দুর্লভ গ্রন্থ “ইসলামের ফৌজদারী আইন” গুণীজনদের ব্যাপক স্বীকৃতি ও প্রশংসা অর্জন করেছে। এ অমূল্য গ্রন্থের প্রতিটি পৃষ্ঠা থেকেও এটা প্রতীয়মান হয় যে, এর লেখক কতটুকু বিচক্ষণতা ও দুরদৃষ্টির অধিকারী ছিলেন। ইখওয়ানের মধ্যে নাসেরের সাথে প্রথমদিকে শহীদ আওদাহই সর্বাধিক সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন। নাসের যখন বাদশাহী নখর বিস্তার করতে শুরু করেন তখন আবার আওদাহ শহীদই তার বিরোধিতায় তৎক্ষণাৎ নিঃসংকোচে দাড়িয়ে যান। তার এই ঈমানদীপ্ত নির্ভীকতায় নাসের ভীত হয়ে পড়ে। এরপর সে তার কবল থেকে রেহাই লাভ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলে। তাকে স্বকপোলকল্পিত এক অভিযোগের সাথে জড়িত করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়।
আবদুল কাদের আওদাহ শহীদ নিজেই আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, একবার নাসেরের সাথে তার আলাপ হচ্ছিলো। এক পর্যায়ে নাসের বললো, “আমি আমার বিরোধীদরেকে দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা দিতে পারি, তারা সংখ্যায় যত বেশীই হউক না কেন।” জবাবে আবদুল কাদের আওদাহ শহীদ বলতে লাগলেন, “ যেসব লোককে তুমি সমুচিত শিক্ষা দিতে চাও তারা তো কোনদিন শেষ হবে না। তাদের ওপর হাত উত্তোলনকারীরা যতই শক্তিশালী এবং সংখ্যায় যত অধিকই হউক না কেন। কোন অবস্থায়ই তারা পরাজয় মেনে নেবে না। একজন দ্বিখন্ডিত হয়ে ভুমিতে লুটিয়ে পড়লে আর একজন এগিয়ে এসে পতাকা সামলে নেবে।”
আবদুল কাদের আওদা যেভাবে নাসেরের চোখে চোখ রেখে একথাগুলো বলেছিলেন যার অবশ্যম্ভারী ফল এই দাঁড়িয়েছিলো যে, সে ভীরু ও কাপুরুষ শত্রু তার মত ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান প্রতিপক্ষকে ময়দান থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টাই করবে।
আবদুল কাদের আওদাহ ওকালতি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন মস্তবড় শিক্ষিত লোক। কোন মোকদ্দমায় তদবীর করতে গিয়ে তিনি সাধারণ আইনজীবীদের ন্যায় আইনের মারপ্যাচ, বাকপটুতা ও অনলবর্ষী বক্তৃতার ওপর সীমাবদ্ধ থাকার পরিবর্তে খুব ওজস্বী দলিল-প্রমান, সূক্ষ্ম বিশ্লষণ এবং আইনগত জটিল দৃষ্টিভংগী পেশ করতেই ছিলেন অভ্যস্ত। ইখওয়ানের সাথে তাঁর ছিল প্রগাঢ় সম্পর্ক ও অকৃত্রিম মহব্বত ভালবাসা। তার বিরুদ্ধে যখন সামরিক আদালতে মামলা রুজু করা হয় তখন তিনি আদালতে এ সূক্ষ্ম পয়েন্ট উত্থাপন করেন যে, সামরিক অফিসারগণ যে মোকদ্দমা তৈরি করেছেন তার নিরিখে সেনাবাহিনীই শতধা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। শররী বৈষয়িক আইনের দৃষ্টিতে এ আদালতে এরূপ মোকদ্দমার শুনানী হওয়ার অধিকার নেই। তারপরও সামরিক আদালত তার দাবী গ্রহণ করতে রাজী হয়নি। তার দাবী ছিল এই যে, মামলা কোন নিরপেক্ষ আদালতে পেশ করা হোক। আবদুল কাদের আওদা শহীদ জেনারেল মুহাম্মাদ নাজীবের বড়ই বলিষ্ঠ পৃষ্টপোষক ছিলেন। ইহাও ছির অন্যতম কারণ যে জন্য নাসের তার প্রাণের দুশমন এবং রক্তপিপাসু হয়ে উঠেছিলো।
জনাব সালেহ আবু রাকীক
সম্মানিত দ্বীনি ভাই ও উস্তাদ সালেহ আবু রাকীক ছিলেন আরব লীগের উপদেষ্টা পদে অধিষ্ঠিত। তখন আরব লীগের সভাপতি ছিলেন আবদুর রহমান আযয়োম পাশা মরহুম। জনাব আবু রাকীকের সাথে ছিল তার খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এমন কি তিনি তাকে তাঁর সন্তান তুল্য মনে করতেন। তার ওপর নাসের অভিযোগ আরোপ করেছিলেন যে, তিনি তার বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিলেন। জেলখানার অভ্যান্তরে তার ওপর বড়ই অত্যাচার ও নির্যাতন চালনো হয়। তথাপি তাঁর ঈমানী বলিষ্ঠতায় কোন দুর্বলতা দেখা দেয়নি। তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয় তথাপি তিনি একনো পর্যন্ত ইখওয়ানের প্রথম সারিতে জিহাদের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে শিফা দান করুন এবং দীর্ঘ জীবনে ধন্য করুন।
আমার এ স্মৃতির বর্ণনায় সমাপ্তি টেনে দেয়ার পূর্বেই আমি প্রাচ্য ও প্রতিচ্যে ছড়িয়ে থাকা মুসলিম ভ্রাতাগণের সমীপে অত্যন্ত জোরদারভাবে আরজ করতে চাই যেন তারা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সাথেই তাদের সকল প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার যোগসূত্র স্থাপন করে নেয়। আমেরিকার শক্তি, রাশিয়ার প্রবল প্রতাপ এবং ইসরাঈলের হিংসাপরায়ণতাকে কোনক্রমেই তোয়াক্কা করা চলবে না। আল্লাহ তায়ালার আশ্রয় গ্রন্থণকারী ব্যক্তি কখনো কাকেও ভয় করে চলে না। বস্তুত আল্লাহ তায়ালার পরাক্রম ও ক্ষমতার তুলনায় বাতিলের কিইবা গুরুত্ব যেতে পারে।
উম্মতের নামে পয়গাম
ইতিহাসের নিষ্ঠুর বাস্তবতা ও শিক্ষা রয়েছে আমাদের সম্মুখে। ইতিহাসের এক অমোঘ বিধান হচ্ছে এই যে, কোন জাতিরই শৌর্য-বীর্য এবং উন্নতি-অগ্রগতি চিরস্থায়ী হয়নি। আবার কোন জাতি সর্বদা অবনতি-অনগ্রসরতা, হীনতা ও নীচতার অসহায় শিকার হয়ে থাকেনি। উন্নতি-অবনতি, সুখ-দুঃখ ও হাসি-কান্না এবং আনন্দ বেদনা গাড়ীর চাকার ন্যায় আবর্তিত হতে থাকে। আমাদের ভাগ্যও নিঃসন্দেহে পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু সে জন্য একটা শর্ত রয়েছে এই যে, আল্লাহ তায়ালাকে আমাদের ভয় করতে হবে যেভাবে ভয় করা উচিত। সর্বাবস্থায় তারই ওপর তাওয়াক্কুল করতে হবে। এবং স্বীয় সমস্ত কর্মতৎপরতায় ইহসানের রূহ সৃষ্টি করতে হবে। আর এই ইহসান ও আনুগত্য শুধুমাত্র সালাত, সাওম এবং সাদাকা-যাকাত পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয় বরং ইহসান ও ইবাদাত পরিবেষ্টন করবে সকল কর্মকান্ডকে লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, আবিষ্কার-উদ্ভাবন, চেষ্টা-উদ্যেগ ও ইসলামী রেঁনেসা তথা পুনর্জাগরণের পরাকাষ্ঠা মোদ্দাকথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমাদেরকে ইহসান ও আনুগত্যেরই পরিচয় দিতে হবে। ইসলামের ভুলে যাওয়া শিক্ষা আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহে পুনরায় মানুষের অন্তরে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠছি। এবং জীবনের সকল ময়দানে ইহা স্বীয় ভূমিকা আদায় করতে শুরু করে দিয়েছে। ইসলামের শক্তি ও দীপ্তি সকল দিক ও বিভাগে অনুভূত হয়ে চলেছে। আজিকার নওজোয়ানগণ তাদের অলস নিদ্রার মোহে থেকে জেগে উঠেছে। বিগত পাঁচ শতাব্দি থেকে যে অলসতা ও অনুভূতিহীনতা মুসলিম উম্মাহর ওপর জেকে বসেছিল আজ সে কালো পর্দা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এসবগুলোই শুভ লক্ষণ ও আশার আলামত। আল্লাহ তায়ালার কুদরাত ও ক্ষমতা আমাদের আশা-আকাংখা পরিপূর্ণ করে দেয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এবং আমাদের শপথকে বলিষ্ঠতা দান করার সকল উপায় উপকরণ তৈরী করে দিয়েছে। যাতে করে আমরা আমাদের সযত্ন প্রয়াস-প্রচেষ্টাকে লক্ষ্য পর্যন্ত নিয়ে যেতে সক্ষম হই।
আমরা কি প্রত্যহ এ বিষয়টি দেখতে পাই না যে, সহস্র মাইলের সফর এক কদম ও পদক্ষেপের সাহায্যেই শুরু হয়ে থাকে? আমরা তো আমাদের লক্ষ্যভিমুকে অগণিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে ফেলেছি। আমাদের যুব সমাজকে সুসংবাদ শুনিয়ে দাও যে, আল্লাহ তায়ালার ফজল ও করম এবং দায় ও অনুগ্রহে তারা একটা মহৎ উদ্দেশ্য হাসিল করা এবং তাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা বাস্তরে অনতিবিলম্বে দেখতে পাবে। নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা, সবর, ধৈর্য এবং সতর্কতা ও সাবধানতা এবং রাহে হকে সকল প্রকার বিপদ-মুসিবত, পরীক্ষা-প্রতিকূলতা বরণ করে নেয়ার প্রেরণাই কামিয়াবী ও সফল তার চাবিকাঠি। জেনে রাখুন যে, আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের প্রদত্ত রিজিকই আমরা সকলে খাচ্ছি। এ জমিন যার প্রশস্ততা ও উদারতার সুযোগ নিয়েই আমরা দিব্যি চলাফেরা করছি। আমাদের রিজিকের দায়-দায়িত্ব যদি জামিনের ওপরই সমর্পিত থকতো তাহলে তো তার রিজিক কত আগেই নিঃশেষ হয়ে যেতো। আমরা তো সে মহান সত্ত্বা কর্তৃক প্রদত্ত রিজিকই খাচ্ছি যিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। যার ভান্ডার কোন দিন শূন্য হওয়ার নয়। তারই হাতে রয়েছে আকাশ ও পাতালের সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ। যদি জমিনের রিজিক যথেষ্ট না হয় তাহলে আসমানের মধ্যেও বান্দাহদের জন্য রিজিক এবং এমন জিনিস রয়েছে যেগুলোর যোগান দেয়ার ব্যাপারে তাদের সাথে ওয়াদা করা হয়েছে। হায় আফসোস! যদি আমরা আঁখি মেলে একটু তাকিয়ে দেখতাম এবং চিন্তা-ভাবনা করতাম।
মানুষের অসহায়ত্ব
প্রসংগত সর্বসাধারণের বোধগম্য একটা উদাহরণ আরজ করতে চাই। যদ্বারা আল্লাহ তায়ালার সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃর্ত্বের মালিক হওয়া এবং মানুষের অক্ষমতা ও অসহায়ত্বের স্বরূপ প্রতিপন্ন হয়ে উঠবে।.............. আমেরিকা মাহশূন্যে বহু নভোযান উৎক্ষেপণ করেছে। একের পর এক উৎক্ষিপ্ত এ কৃত্রিম উপগ্রহ মহাশূন্যে তার পরিভ্রমণ সমাপ্ত করে নিরাপদে আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। কেবলমাত্র ভু-উপগ্রহ নং-৯- এর বেলায়ই ব্যতিক্রম ঘটেছে যে, সার্বিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরও ইহা মহাশূন্যে জ্বলে ভস্মিভুত হয়ে গেছে। এ দুর্ঘটনাকে মানবীয় জ্ঞান-দুদ্ধি এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও উৎকর্ষ কেন প্রতিহত করতে পারেনি। আত্মরক্ষামূলক ও আপদকালীন যন্ত্রপাতি কোথায় হারিয়ে গেছে? মানুষের বুদ্ধিমত্তা বিচক্ষণতা এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কোনই মূল্য নেই। আল্লাহ তায়ালার কুদরাত ও ক্ষমতাই প্রকৃতপক্ষে সকল জিনিসের ওপর বিজয়ী হয়ে থাকে। বস্তুত এসব ঘটনা দুর্ঘটনা দ্বারা মানুষের শক্তি সামর্থ ও যোগ্যতার সীমাবদ্ধতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়ে থাকে। অগ্নি বিচ্ছুরণকারী ফেটে পড়ে এবং কেয়ামতের ভয়াবহ দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। অথচ কোন মানুষেই সেই আগুন ও লাভার ওপর নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করতে পারে না। তুফানী অন্ধকার নেমে আসে তখন আরোহীদের নিয়ে গাড়ীগুলোকে এমনভাবে দূরে নিক্ষেপ করে যেমন কোন শিশু তার খেলনাগুলোকে ছুড়ে মারে। তাপমাত্রা নীচে নামতে নামতে হিমাম্কেরও নীচি চলে আসে। এমনি চারদিকে তুষার বৃষ্টিপাতের দৃশ্য নজরে পড়ে, রেলগাড়ী, মটরযান ও হাওয়াই জাহাজ তথা সব জিনিসই একপর্যায়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সৃষ্টিজগতে আল্লাহ তায়ালার অগণিত-অসংখ্য সৃষ্টি তারই নির্দেশ পালনে ও আপনাপন কর্তব্য সম্পাদনে সদা ব্যস্ত যেগুলোর সম্মুকে মানুষ অত্যন্ত অসহায় অনুন্যোপায় গয়ে পড়ে। এক্ষণে বলুন যে মানবীয় জ্ঞান-বুদ্ধি তার আবিষ্কার উদ্ভাবন এবং বস্তুগত উন্নতি অগ্রগতি কেন এসব সমস্যার সমাধান খুঁজতে তৎপর হয় না? হতে পারে না?
আমরা এসব বিষয়ের প্রতিই মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে চাই। সাথে সাথে এগুলোর ওপর চিন্তা-গবেষণা করার আহবান জানাই। কিন্তু আমাদের সকলকেই এটা ভালভাবে জেনে নিতে হবে যে, সকল শক্তির ওপর রয়েছে একটা মহাশক্তি এবং সকল কর্তৃত্ব অপেক্ষা শেষ্ঠ কর্তৃত্বের অধিকারী এমন এক সত্ত্বা রয়েছেন তিনি এমন প্রবল পরাক্রমশালী যে, তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। কেউ তাকে প্রতিহত করতে পারে না। তার মর্জি ব্যতীত কারো কিছু করার ক্ষমাতা নেই। এ প্রচন্ড ও অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালারই হাতে নিবদ্ধ। আর তিনিই সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রকৃত বাদশাহ, সম্রাট, মালিক, মনিব এবং প্রভু ও প্রতিপালক।
আযাদী ও স্বাধীনতার ইসলামী তাৎপর্য
প্রাচ্য দেশসমূহে বিশেষ করে সমগ্র তৃতীয় বিশ্বের লোক তারা মুসলিম হোক কি অমুসলিম- অনগ্রসরতা ও পশ্চাৎপদতাপর গ্লানি থেকে কখনো বেরিয়ে আসতে পারবে না। যতদিন পর্যন্ত না তার প্রকৃত স্বাধীনতার স্বর্গীয় নেয়ামত লাভ করতে পারছে। বলা হয়ে থাকে যে, পাশ্চাত্য দেশসমূহে পরিবেশ পরিস্থিতি অন্য রকম। ওসব পরিবেশ রিস্থিতি আমাদের এ অঞ্চলের দেশগুলোতে প্রয়োগ করা আদৌ সম্ভব নয়। জনসাধারনের গণতান্ত্রিক সচেতনতার তুলনা করে যুক্তি পেশ করা হয়ে থাকে যে, সেখানে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিদ্যামান রয়েছে। পক্ষান্তরে আমাদের পরিবেশ এ জন্য অনুকুল নয়। এসব খোঁড়া যুক্তির জবাব হচ্ছে এই যে, ওসব দেশেও এরূপ পিস্থিতি রাতারাতি সৃষ্টি হয়ে যায়নি। বরং ওসব জাতিকেও অনেক সমস্যা এবং প্রতিকূলতার সম্কটজনক ঘাটি অতিক্রম করে আর দীর্ঘদিন পর্যন্ত ভুল-ভ্রান্তি করে করে এক পর্যয়ে এসে এ মর্যাদা ও সম্মান লাভ হয়েছে। আবার অনেক সময় এমন দলিলও পেশ করা হয় যে, কিছু লোক আযাদী ও স্বাধীনতার অপপ্রয়োগ করে থাকে এবং তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রই কাজে লাগিয়ে থাকে। আমি বলতে চাই যে, যদিও স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশে এ ধরনের ঘটাবলী পরিদৃষ্ট হয়ে থাকে। তথাপি ইহার ক্ষতি বাদশাহী, রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের লোকসানের তুলনায় মোটিই উল্লেখযোগ্য নয়। আমরা যখন স্বাধীনতার দাবী জানাই তখন উহা দ্বারা পিতৃতান্ত্রিক ও মাতৃতান্ত্রক স্বাধীনতা বুঝায় না। পশ্চিমা দেশগুলোর স্বাধীনতার ধারণা আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। আমাদের আযাদীর সীমা চৌহদ্দী আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাহ সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আল্লাহ-রসূলের হালাল-হারামের বিধানেও কোনরূপ পরিবর্তন সাধন করার কোন অনুমতি আমাদের আদৌ নেই। কিন্তু নির্ধারিত সীমানার মধ্যে কোন মানবসন্তানের আযাদীর ওপর কোনরূপ বিধি-নিষেধ আরোপ করা কারো নিকটই জায়েজ নেই। পশ্চিমের স্বাধীনতা বগ্লাগীন ও জন্তু-জানোয়ার সদৃশ্য স্বাধীনতা যে, তারা সর্বসাধারণের সম্মুখে যে কোন ধরনের অপরাধ, নির্লজ্জতা এবং জঘন্যতম আচরণ করে থাকে। এবং স্বাধীনতা বনাম স্বেচ্ছচারিতার নামে তারপরও তারা নিরাপত্তা লাভ করে থাকে। ইসলামরে স্বাধীনতার সংজ্ঞা ও রূপরেখা এ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। এখানে নিষিদ্ধ সীমানালংঘন করা জঘন্যতম ও মারাত্মক অপরাধ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে । আমাদের শরীয়াত স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে আদালত ও ইনসাফ, মুসাওয়াত ও সাম্য, ইজ্জত ও শরাফত এবং সম্মান ও সভ্রমের নিরাপত্তা বিধান। আযাদীর এ ধারণার ব্যাপারে কারো কি কোন দ্বিমত থাকতে পারে? তারপরও এখন ইসলামের এ স্বাধীনতার দাবী ও আওয়াজ শুনে লাব্বায়েক বলার মত কেউ আছে কি?
স্মৃতিচারণ সম্পর্কিত প্রসংগ কথা
আমার ঐকান্তিক ইচ্ছা যে, আমার এ স্মৃতিচারণে ইতি টেনে দেয়ার পূর্ব আরজ করেন দেবো আরও একটা কথা যে, আমি এখানে যত কথা বর্ণনা করেছে কোন কোন ইখওয়ান উহার কিছু কিছু অংশ পছন্দের দৃষ্টিতে নাও দেখতে পারে। এ প্রসংগের গোড়াতেই আমি আমার মধ্যে এ অনুভুতি জাগরুক দেখতে পাচ্ছিলাম যে, আমার স্মৃতিপটে মুদ্রিত রয়েছে বিগত আশি বছরেরও অধিক সময়-কালের স্মৃতিকথা মালা যা ইতিহারেস বক্ষে মুদ্রিত হয়েছিলো। এ জীকনকাল কতদীর্ঘ ও সমস্যা সংকুল। হিসেবে নিকেশ কত কঠিন হবে এবং জবাবদিহির মনজিল হবে কতইনা কঠোর। বিশেষত আমার ন্যায় একজন নিঃসম্বল ব্যক্তির কি অবস্থা হবে যে এমন এক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে যার কোন উপযুক্ততা তার নেই এবং যে সম্পর্কে তার ধারণা কল্পানায়ও কখনো আসেনি যে, এ সম্মানজনক পদ তারই জন্য অপেক্ষা করছে। কেননা আমার রয়েছে জ্ঞানের স্বল্পতা বরং নেই বললেও অত্যুক্তি হবে না। বাকী থাকে আমার ঈমান- এ ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই যে, আল্লাহ তার সাথে কিরূপ আচরণ করবেন। সংকল্প ও সৎসাহস খুবই ক্ষীণ ও দুর্বল- যার মধ্যে স্বীয় গুরুদায়িত্ব সামাল দেয়ার কোন শক্তি ও ক্ষমতা নেই। আমি যখন এসব স্মৃতিকথাকে সংরক্ষণ করার সিদ্ধন্ত করি যে কোন প্রকার কমবেশী না করে আদ্যন্ত আমার সঠিক ও যথার্থ পরিচয় বিশেষ করে আমার ইখওয়ান সাথীদের সামনে এবং সাধারণভাবে অন্যান্য মানুষরে সম্মুখে পরিপূর্ণ বিশ্বস্ততার সহিত পেশ করে দিতে হবে। আমি কোন ব্যাপারেই লেফাফা দুরস্তি ও অতিরঞ্জনের আশ্রয় গ্রহণ করিনি। আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে কোন জিনিসই গোপন নেই। তিনি আমার গোপনীয় ও প্রকাশ্য সবকিছু সম্পর্কেই উত্তম রূপে অবহিত রয়েছেন। তারপরও আমি আমাকে মানুষের নিকট থেকে কেন গোপন করতে চেষ্টা করবো যা না আমার নিজের জন্য আর না আমার অস্তিত্বের জন্য লাভ-লোকসানের অধিকারী।
আমার একান্ত প্রত্যাশা ছিল যে, মানুষ আমাকে আমার স্বকীয়রূপে দেখ নিতে পারে। যাতে করে তারা কোন প্রকার অযৌক্তিক আত্মতৃপ্তির শিকার না হয়, আর না কোনরূপ ভুল-ভ্রান্তিতে পতিত হয়। আমি আল্লাহ তায়ালার বান্দাদের মধ্যে একজন অধম বান্দামাত্র। আডিম এসব স্মৃতিকে রোমান্থন করতে গিয়ে এও সমীচীন মনে করি যে, সকল সমালোচক ও অপবাদদানকারীর সম্মুখেই দিগন্ত প্রসারিত উন্মুক্ত আকাশ ছেড়ে দিতে হবে যাতে করে আমার দ্বীন, আখলাক ও মান-সম্মানের ব্যাপারে যদি তাদের কোন বক্তব্য থাকে তাহলে দলিল প্রমাণ সহকারে তা পেশ করে দিতে পারে। আমি উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে এবং রুকু-সিজদায় আমার রাব্বুল উজ্জতের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই যে, তিনিই তার অপার অনুগ্রহ ও মেহেরবানীর বদৌলতে আমাকে সকল হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ থেকে মাহফুজ রেখেছেন। এতে আমার কোন কৃতিত্ব নেই বরং এটা তার রহমাতেরই ফসল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, “হালালের সীমানা সুস্পষ্ট আবার হারামের চৌহদ্দীও দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট আর এতদুভয়ের মধ্যে কিছু বিষয় রয়েছে দ্ব্যর্থেবোধক।”
আমি সারাজীবন আমার নিজেকে হালাল কাজের মাঝেই ব্যাপৃত রেখেছি। আর আল্লাহ তায়ালা তার কুদরাতের সাহায্যে আমাকে হারাম থেকে রক্ষা করেছেন। বাকী থাকে সন্দেহজনক বিষয়সমূহ- এ ক্ষেত্রেও আল্লাহ তায়ালার রহমারেত প্রশাস্ততায় আমি খুবই আশাবাদী যে, তিনি তাঁর দুর্বল বান্দাকে পরিবেষ্টন করে নেবেন।
আমি তখনও ছাত্র ছিলাম। এরই মধ্যে আমাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। অতপর যখন আমি আইন কলেজে শিক্ষারত ছিলাম তখন বাড়ীতে ফিরে এসে বিষয়বস্তুর প্রস্তুতিতে বসে যেতাম এবং আমার চারদিকে আমার বাচ্চারা খেলাধুলা করতে থাকতো। আমার দাম্পত্য জীবন ছিল বড়ই আনন্দঘন ও মধুর এবং শাস্তিদায়ক। আমি স্বভাবগতভাবে অভদ্র, বদমেজাজ ও নিরস কাঠমোল্লা নই। বরং আমি শান্তশিষ্ট, রশিকতা প্রিয় ও সূক্ষ্ম তত্ব বিশ্লেষণে অভ্যস্ত।
কোন কোন নিষ্ঠুর প্রাণ ও অত্যাচারী লোক বলে থাকেন, “যেসব জিনিসকে আল্লাহ পর্দার আড়ালে রেখে দিয়েছেন সেগুলোকে পর্দার অন্তরালেই থাকতে দিন।” তাদের এ বক্তব্য একদিন থেকে তো সঠিক ও যথার্থ যে, যেসব কাজ আল্লাহ তায়ালা অপছন্দ করে থাকনে সেগুলোকে পর্দার অন্তরাল থেকে জনসমক্ষে টেনে নিয়ে আসা কিছুতেই দূরন্ত নহে। যতদূর পর্যন্ত আমার লেন-দেন রয়েছে আমি কখনো জেনে বুঝে আল্লাহর গযবকে স্বাগত জানাইনি।
আমি বাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদাম্ক অনুসরণ করে চলতে গিয়ে বর্বদা দু’পন্থার মধ্যে অপেক্ষাকৃত সহজ রাস্তাই অবলম্বন করে থাকি। যদি তা আল্লাহ তায়ালার নাফরমানীমুলক কাজ না হয়। এ কর্মপদ্ধতির ব্যাপারে কারো কোন প্রকার ক্রোধ ও অসন্তোষ প্রকাশ করা উচিত নয়। কেননা ইহাই সুন্নত মোতাবেক কর্মনীত। আমি চাই যে, যে ব্যক্তি আমাকে জানে কিংবা যে আমার সম্পর্কে কিছু পড়াশুনা করেছে সেই আমার প্রকৃত ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে অবগত হয়ে যেতে পারবে। এতেই কল্যাণ ও মংগল নিহিত যে, মানুষ পরস্পরে একে অন্যকে সুস্পষ্টভাবে জেনে নেবে এবং কোন প্রকার অজ্ঞতা ও ভুল বুঝাবুঝি না থেকে যায়। যার ফলে একজন অপরজনের সাথে লেন-দেন করতে গিয়ে নির্ভরতা, বিশ্বস্ততা ও সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রস্তুত থাকে।
এসব স্মৃতিচারণকারী শত সহস্র উকিলদের মধ্যে একজন উকীল মাত্র। যাকে কেবল ওসব লোকই জানার সুযোগ পেয়েছে। যাদের কোন না কোন কাজে তার সংস্পর্শে যেতে হয়েছে কিংবা যারা তার নিকট আত্মীয় স্বজন যারা একান্ত কাছে থেকে তাকে দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু ইহার অপর একটি দিকও রয়েছে যার মাধ্যমে সাধারণভাবে সমগ্র দুনিয়া এবং বিশেষভাবে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সদস্যগণ তার সাথে সম্যকরূপে পরিচিত। ঘটনার আকস্মিকতাই বলতে হবে যে, ইখওয়ানের নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব সোপর্দ করা হয়েছিলো আমার ওপর। অনেক সময় এমনও হয়ে থাকে যে, জায়িদ এমন সুযোগ সুবিধা লাভ করে থাকে যা থেকে বকর থেকে যায় সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত। কোন কোন লোক আবার কিছু বলতে চায় অথচ উত্তম ধারণা এবং শিষ্টাচার শালীনতার কথা তাদের মুখ খোলার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আমার ব্যাপারেও কোন সংগী সাথীর অন্তরে হয়ত কিছু থাকতে পারে। ইখওয়ান সম্পর্কে মানুষ যা কিছু জানে তার সাথে সাথে ইহাও জরুরী যে, এ শিক্ষাও তাদের জেনে রাখতে হবে যা আমি আমার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে উল্লেখ করে এসেছি। বস্তুত এটা আর কিছুই নয় যে, আমি শুধু কোন রং-তুলি ব্যবহার না করে এবং কোন প্রকার অতিরঞ্জনের আশ্রয় না নিয়ে একজন সাধারণ মানুষের ন্যায় নিজেই নিজেকে জনগণের সম্মুখে পেশ করে দিতে চেয়েছি। এখন যদি কোন শত্রু কিংবা বন্ধু এসব স্মৃতির ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে চায় সে কোন প্রকার ইতস্তত না করে সম্পূর্ণ নিঃসংকোচে তা প্রকাশ করে দিতে পারে।
ইখওয়ান তো কোন ফেরেশতা নয়। তাদের একটা মৌলিক ও অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তারা তাদের সৌন্দর্য ও গুণাবলীর সাথে সাথে তাদের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধেও খুব ভালভাবেই অবগত রয়েছে। নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষ হওয়া তো আম্বিয়অ ও রসূলগণের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এবং পরিপূর্ণতা ও স্বর্থকতা কেবলমাত্র রব্বুল আলামীদের জন্যই শোভা পায়। সাধারণ মানুষ ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত হতে পারে না। আর না এমন দাবী করাও তাদের জন্য শোভনীয় হতে পারে। আমার কখনো এমন শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের দাবী করি না না আমাদের মধ্যে পাওয়া যায় না। আমরা বাহ্যিক এমন কোন চাকচিক্য ও জৌলুষ দেখানোর প্রয়াস পাইনি যা আমাদের অন্তরের অবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। কখনো যদি আমাদের দ্বারা কোন ভুল-ত্রুটি হয়ে যায় তখন আমরা উহার সাফাই প্রকাশ করতে ও পর্বভরে সে গুনাহের ওপর অটল অবিচল হয়ে থাকার চেষ্টা করিনি কখনো। আমরা বরং আমাদের ভুল-ভ্রান্তি থেকে তাওবা করেও অনুতপ্ত হয়ে আল্লহর সমীপে নতজানু ও অবনত মস্তকে হয়ে পড়ি। আমাদের এ স্বরূপ ও প্রকৃতি জনসাধারণের জেনে রাখা উচিত যাতে করে তারা যদি আমাদের ওপর সম্তুষ্ট থাকে তাও যুক্তি প্রমাণের ভিত্তিতে আর যদি অসন্তুষ্ট থাকে তবে উহাও উপযুক্ত দলিলের নিরিখে হয়।
আমার স্মৃতির পাতায় অংকিত এসব কথাবার্তা আমি পাঠকদের খেদমতে পেশ করে দিয়েছি। এতদ্ব্যতীত দেশের ভিতরে ও বাহিরে বহু পত্র-পত্রিকায় আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই লেখা হয়ে থাকে। লখকদের মধ্যে যারা বিরুদ্ধাচারণকারী তারা প্রবল শত্রুতায় অন্ধ হয়ে এমন সব কথাবার্তা লিখে দেয় যেগুলোর বাস্তবতার সাথে থাকে না কোন সম্পর্ক। পক্ষান্তরে যারা আমাকে পছন্দ করেন তারাও আবেগের আতিশেয্যে অতিশয়োক্তি করে ফেলেন এবং তাদের কলমে আমার চিত্র অংকিত হয়ে থাকে যার কোন যোগ্যতা ও উপযুক্ততা আদৌ আমার নেই। এসব স্মৃতিকথা দ্বারা আমার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণকারীদের জেনে নেয়া উচিত যে, আমি কামালিয়াতের স্তরে উন্নীত হতে পারিনি। সকল দোস্ত দুশমনকে আমার এমন দৃষ্টিভংগীতেই দেখা কর্তব্য যতটুকু যোগ্যতা আমার রয়েছে। যাতে করে কোন প্রতারক ও ধোঁকাবাজ আল্লাহ তায়ালার ব্যাপারে আমাকে ধোঁকা ও প্রতারণার অসহায় শিকারে পরিণত করতে না পারে।
হে মানবজাতি! আপনারা সর্বাস্তকনণে জেনে রাখুন যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন কখনো কাকেও এমন করে আমন্ত্রণ জানায়নি যেন তারা তাদেরকে অন্যান্য মুসলিমদের ব্যতিক্রমধর্মী বৈশীষ্ট্যের অধিকারী বলে মনে করে। আমরা কখনো কাউকে এও বলিনি যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দিকে আসুন। বরং আমাদের দাওয়াত শুরু থেকে এ- ই ছিল এবং সর্বদা এ-ই থাকবে যে-
“হে জনতা! এগিয়ে আসুন এমন একটি বিষয়ের প্রতি যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে একই রকম। আর তা হচ্ছে এই যে, আমরা আল্লাহ ব্যতীত অপর কারো আনুগত্য করবো না। তার সাথে কাউকেও শরীক করবো না এবং আমাদের মধ্য থেকে কেউ আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অপর কাউকে নিজেদের রব বানিয়ে নেবো না।”
আমরা মানুষের সাথে এমন কথা তো কখনো বলি না যে, তোমরা আমাদের আনুগত্য করো। কেননা আমরা নাতো অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠতম আর না জ্ঞান ও পান্ডিত্যের দিক থেকে অগ্রগামী। আমাদের দাওয়াত হচ্ছে এই যে, কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রসূলুল্লাহর অনুসরণ করে চলো। আল্লাহ তায়ালার ইতিবাচক নির্দেশসমূহকে প্রশাস্ত মনে ও হৃষ্টচিত্তে কার্যকরী করে চলেঅ এবং নেতিবাচক আদেশসমূহ থেকে নানন্দচিত্তে বিরত থাকো ও আত্মরক্ষা করে চলার চেষ্টা করো। যদি তোমরা এ কাজ করতে সক্ষম হবে তখন ইখওয়ানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া কিংবা উহার বাইরে থাকা কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। আজ যদি আমরা ইখওয়ানের নাম নিয়ে থাকি অথবা আন্দোলনকে সুসংগঠিত করার কথা বলে থাকি তবুও এগুলো কখনো আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয় বরং আমদের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের এটা একটা পন্থা মাত্র। কেননা একক সংগঠন ব্যতীত শক্তি অর্জিত হতে পারে না। আর শক্তি ছাড়া অভিষ্ঠ লক্ষ্য পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছা আদৌ সম্ভবপর নয়।
পরিশেষে আমি এ দোয়ার মাধ্যমে আমার বক্তব্যের সমাপ্তি টানতে চাই যে, “ওগো আমাদের রব! ভুল-ভ্রান্তির ফলে ও অজ্ঞতা বশত আমাদের পক্ষ থেকে যেসব দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যায় তুমি আমাদেরকে তজ্জন্য পাকড়াও করো না। মালিক! তুমি আমাদের ওপর এমন বোঝা ও দায়িত্ব চাপিয়ে দিও না যা তুমি আমদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলে। পরওয়ারদিগার! যে দুর্বহ বোঝা বহন করার কোন শক্তি ও ক্ষমতা আমাদের নেই তা তুমি আমাদের ওপর বর্তিয়ে দিও না। আমাদের সাথে কোমল ও সহৃদয় আচরণ করো। আমাদেরকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে বিবেচনা করো। আমাদের ওপর দয়া ও অনুগ্রহের বৃষ্টি বর্ষণ করো। তুমিই আমাদের একমাত্র মাওলা ও অভিভাবক। অতএব কাফেরদের মোকাবেলায় আমাদের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করো।” আমীন-ইয়া রাব্বুল আলামীন।


সমাপ্ত


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি