নবম অধ্যায়
স্মৃতিচারণ ও জীবন কথা লেখক ও পাঠকদের জন্য এ দু’টি বিষয়ই আমার থেকে ভিন্ন দৃষ্টিভংগী এবং পদ্ধতি থাকাই স্বাভাবিক। পাঠক ও লেখক উভয়েই চায় যে কাহিনী ও ঘটনাকে কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুরূপে নির্ধারণ করাহয় এবং তাকে কেন্দ্র করে গোটা লেখা আবর্তিত হতে থাকে। আমার দৃষ্টিভংগী কিন্তু এমন নয়। এরূপ লিখন পদ্ধতি অবশ্য ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর প্রতি অনুরাগীদের জন্য অবশ্যই আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। কিন্তু এই শ্রেণীর লোকেরা ইতিহাস শাস্ত্র ও ইতিহাস দর্শনের সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক রাখে না। যদি কাহিনী ও ঘটনা প্রবাহ বর্ণা করা হয় এবং মানুষতা অধ্যয়নও করে তাতে লাভ কি? ভুলে যাওয়া তো প্রতিটি মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। ঘটনাবলী পড়লো এবং পরে ভুলে গেল। চক্ষু বিস্ফোরিত করে দেখার পরও তা স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারে না। তবে হ্যাঁ, অবশ্য কাহিনী বর্ণনা করার সাথে সাথে প্রতিটি ঘটনা সম্পর্কে আদর্শগত বিষদ বিবরণ এবং লেখকের ব্যক্তিগত মতামত যদি বর্ণনা করে দেয়া হয় তাহলে আদর্শ ও আকীদা-বিশ্বাসগত একটা বিশেষ রং এবং চিন্তা-ভাবনার একটা বিশেষ দৃষ্টিকোণ ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। অথচ অধিকাংশ স্মৃতিকথায় এটা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকে। তাই ঘটনা প্রবাহকে একেবারে যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। এটাই প্রচলিত ও স্বীকৃত প্রক্রিয়া। প্রকাশক, লেখক এবং পাঠক সকলেই এই পদ্ধতির সাথে পরিচিত। কিন্তু আমি এ পদ্ধতি থেকে সরে এসে নিজস্ব পদ্ধতিতে আমার স্মৃতিকথা বিজ্ঞ পাঠকগণের সমীপে তুলে ধরতে চাই।
এই নতুন পন্থায় যদি প্রকাশক ও পাঠকগণের মনে কোন কষ্টও লাগে তাতে আমার কোন অপরাধ নেই। কেননা আমি আমার বাকশক্তি, লিখনী, শরীর ও প্রাণের সমস্ত শক্তি দাওয়াতে হকের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছি। আমি এই স্মৃতি কথার সাহায্যে এই আন্দোলনের এমন সব দিক পাঠকদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরতে চাই সাধারণত মানুষ যা জানে না। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব দৃষ্টিভংগী থাকে। আর যে যা করতে চায় আল্লাহ তায়ালা তাকেতা করার তাওফিক দান করেন।
দু’টো ভিন্ন দৃষ্টিকোণ
অধিকাংশ জীবন কাহিনী ও স্মৃতিকথা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য-লক্ষ্য, আশা-আকাংখা, এবং নাম ও যশের জন্য লিখা হয়ে থাকে। কিন্তু যে সমস্ত স্মৃতিকথার মূল বিষয়বস্তু আকীদা ও ঈমানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় তার মধ্যে ব্যক্তিকথার মূল বিষয়বস্তু আকীদা ও ঈমানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় তার মধ্যে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সিদ্ধি এবং প্রতিপত্তি ও মর্যাদা লাভের কোন অবকাশই থাকতে পারে না। এ ধরনের স্মৃতিকথা কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমায়ে উলামার চৌহদ্দির মধ্যেই বিন্যস্ত করা হয়ে থাকে।
যার কুরআন মজীদের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে সে তা নিয়মিত তেলাওয়াত করে। তার সমস্ত প্রচেষ্টা মহিয়ান-গরীয়ান রবের ইবাদাতের সুমতি ও সন্তোষ লাভের জন্য নিয়োজিত থাকে। তার আচরণ এমন ব্যক্তি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী হবে কুরআন এবং কুরআনের মর্যাদার সাথে যার একেবারেই কোন সম্পর্ক নেই কিংবা অন্তসারশূন্য বাহ্যিক কোন সম্পর্কও নেই। দ্বিতীয প্রকারের লোক আপনাকেই অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মনোলোভা ঘটনাবলী শুনাতে পারবে কিন্তু আপনাকে কোন মূল্যবান উপদেশ দেবে না। কিংবা মুক্তির কোন সন্ধানও দিতে পারবে না।
স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ করণের উদ্দেশ্য
আমার মতে নসীহত ও নাজাতের পথপ্রদর্শনের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। যারা আমাকে এই স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছে তাদের অবগতির জন্য আমি বলতে চাই যে, ইখওয়ানের কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল নিয়মিত কুরআন অধ্যয়ন। যার কারণে কোন কঠোরতা বা নমনীয়তা তাদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারেনি। জেলখানার নির্মম অত্যাচার যেখানে অতি বড় সাহসী ব্যক্তিদেরও হতোদ্যম হয়ে যেতে হয় সেখানে ইখওয়ান কর্মীরা অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ইখওয়ানের অসীম সাহস ও অনমনীয়তার মূল কারণ কুরআন মজীদের সাথে তাদের গভীর সম্পর্ক ও যোগসূত্রের মধ্যে নিহিত। কয়েদখানার সাধারণ শাস্তি দেখে ছুটির ঘন্টার কথা মানুষের মনে পড়ে যায়। সেখানে আমাদের অবস্থা ছিল এই যে, আমরা জিন্দানখানার অভ্যন্তরেও হাসি-খুশী থাকার মত পরিবেশ সৃষ্টি করে নিতাম। ইসলামের সীমার মধ্যে থেকেই সন্ধ্যায়আমরা একে অন্যকে গল্প-কাহিনী শুনাতাম। এবং হাস্যরসের মাধ্যমে আনন্দিত ও উৎফু হতাম। সাধারণ কোন লোক আমাদেকে দেখে কল্পনাও করতে পারতো না যে, আমাদের ওপর দিয়ে প্রলয় বয়ে গিয়েছে।
জেলখানার মধ্যে মজার কুস্তি
“আল-ওয়াহাত” জেলখানার বন্দী জীবন চলাকালে আমরা মজার মজর পোগ্রাম করতাম। একদিন ভাই মাহমুদ যাইনহাম বলতে লাগলেন আজ রাতে আমরা শববেদারী পালন করবো এবং প্রশিক্ষণ মূলক কর্মসূচীর সাথে কিছু বিনোদনমূলক পোগ্রামও পেশ করা হবে। বিনোদন মূলক কর্মসূচীতে কুস্তিও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। আমি এবং আপনি দু’জন মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হবো।
মাহমুদ ভাইয়ের এই প্রস্তাবব শুনে আমি তাঁকে বললাম: কুস্তিতে তো আপনি রুস্তমে মিসর উপাধি লাভ করেছেন। অথচ এ বিষয়ে আমার প্রাথমিক ধারণাও নেই। এ ইখওয়ানী ভাই খুব উত্তম পহলোয়ান ছিলেন এবং সমগ্র মিসরে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন।
আমার মন্তব্য শুনে বলতে লাগলেন: আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে কুস্তি সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় শিখিয়ে দেবো যাতে আপনি কুস্তির কৌশল রপ্ত করে ফেলতে পারবেন। তরপর পোগ্রাম শুরু হলে আমিমিসরের স্বনাম ধন্য বড় বড় পাহলোয়ানের এবং প্রাচীনকালের বীরপুরুষদের কীর্তিগাথা আলোচনা করতে আরম্ভ করবো এবং কথোপকথোনের মাঝে ঐ সব পাহলোয়ান ও বীর পুরুষগণকে কঠের সমালোচনার শিকার বানাবো যার ফলে আপনি ক্রোধ ও আত্মমর্যাদবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে কুস্তি ল্যাংগোট পরে আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহবান জানিয়ে বসবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি আমার ঘাড়ের ওপর শক্তহাতে ধরবেন আর আমি মোমের ন্যায় আপনার হাতে মাটির ওপর চিৎপটাং হয়ে পড়ে যাবো। আপনি কাল বিলম্ব না করে আমার বুকের ওপর জেঁকে বসবেন এবং হাত উপরে তুলে আপনার বিজয়ের ঘোষণা দিয়ে লোকদের নিকট থেকে প্রশংসা কুড়িয়ে নেবেন।
অতএব ভাই মাহমুদের পরিকল্পনা মোতাবেক রাতের বেলা কুস্তি হলো এবং আমিতাকে চিৎপটাং করে মাটিতে ফেলে দিলাম। তারপর যায় কোথায়! সমস্ত ইখওয়ান এবং আমাদের ব্যারাকের বাইরে প্রহরারত সিপাহীরা পর্যন্ত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। সিপাহীগণ বড় উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তালি বাজাতে থাকে।
পরবর্তী রাতে আমাদের একটা ইসলামী ও সংস্কারমূলক নাটক মঞ্চস্থ করার কথা ছিল। নাটক শুরু হওয়ার পূর্বে আমি সে সম্পর্কে উদ্বোধনী ভাষণ পেশ করলাম। আমি যখন বক্তৃতা করছিলাম তখন আমাদের এক ইখওয়ানী ভাই যে এতক্ষণ জানালার পাশে বসেছিল একজন সিপাহীকে বলতে শুনেন, সে তার সংগীদেরকে বলছিল: তোমরা এই বুড়োকে দেখছো; তিনি অতি সুদক্ষ পাহলোয়ান। গতরাতে তিনি মিসরের প্রাক্তন রুস্তমকে একেবারে চিৎ করে ফেলে দিয়েছিলেন।
কারাগারের দারোগাগণ
এই জেলখানায় অবস্থানকালে জেলখানার দায়িত্বে নিয়োজিত বহু দারোগার সাথে আমাদের পালা পড়ে এবং তাদের প্রত্যেকের চরিত্র ও কাজের ব্যাপারে আমাদরে প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়, তাদের কেউ কেউ তো নির্মমতা ও পাষণ্ডতার এমন চরম সীমায় পৌছে গিয়েছিল যে, জিন্দানখানার হতভাগারা শুধু প্রাকৃতিক প্রয়োজন ব্যতীত অন্য কোন অবস্থায় তাদের নির্যাতনের হাত থেকে বেঁচে বাইরে যাওয়অর অনুমতিও পেতো না। তদুপরি আমাদেরকে অশ্লীল ও অশ্রাব্য ভাষায় গালি-গালাজ করা, তাদের এজেন্টদের দিয়ে গালি দেয়া, আমাদের ওপর মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করা এবং নানাভাবে কষ্ট দেয়া তাদের অতি প্রিয় বিষয় ছিল। তাদের সময়ে সরকারী প্রহরীদের মুখেআমাদের নামই ছিল “জাতির বিশ্বাসঘাকত” এবং “সরকারের চোর”। পক্ষান্তরে কোন কোন দারোগা এমনও এসেছেন যারা সাধারণ নিয়ম মোতাবেক আমাদেরকে আইনগত সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার দিতো।
অত্যাচারীদের পরিণাম
যেসব জালমরা আমাদের ওপর জুলুম-অত্যার করেছিল আমাদের চোখের সামনেই তারা প্রত্যেকে তার চরম পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে। দুনিয়ার সুযোগ-সুবিধাও তাদের হাত ছাড়া হয়ে গেছে এবং আখেরাতেও তারা পীড়াদায়ক আযাবের মজা ভোগ করতে বাধ্য হবে। আমিতাদের নাম উল্লেখ করতে চাই না। কেননা তাদের মোকদ্দমা সেই ন্যায় বিচারক ও চিরবিজয়ী সত্তার আদালতে পৌঁছে গেছে যেখানে হক ও েইনসাফের ফায়সালা হয়ে থাকে। আমার প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ যে আমাকে কখনো জেলখানার কঠেরতা ভোগ করতে হয়নি। এর কারণআমি একে আল্রহর নির্ধারিত ফায়সালা বলে মেনে নিয়েছিলাম। যা কেউ হটাতে বা পরিবর্তন করতে পারে না। আমি আল্লাহর প্রশংসা করছি এই জন্য যে, আমারওপর তিনি তার অবারিত ও পরিপূর্ণ রহমত ও অনুগ্রহের বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন। তিনিই তার দ্বীনে হকের জন্য জেলখানার পুতিগন্ধময় অন্ধকার প্রকোষ্টে জীবন যাপনের সৌভাগ্য দ্বারা ধন্য করেছেন। এটা এমন একটা পদক যা আমি সযত্নে আমারবুকে লটকিয়ে ঘুড়ে বেড়াই। আমি এমন কোন অপরাধের ফলে জেলখানায় যাইনি যাতে আমার সম্মান ভুলুণ্ঠিত হতে পারে।
দৃঢ় সংকল্প অথবা অনুমতি
যে সকল ইখওয়ানী বিপদ-মুসিবত ও কষ্ট সহ্য করতে করতে অক্ষম হয়ে পড়েছে তাদের সাথে আমার বিশেষ সমর্কও সহানুভূতি ছিল্ “আল-ওয়াহাত” মরুপ্রান্তরে অত্যাচারের এক শেষ করা হয়েছে তাদের উপর যা সহ্য করতে করতে শেষ পর্যন্ত কোন কোন বন্ধুর মনোবল ভেঙে যায় তারাআমার কাছে আসে। তাদের চেহারায় ছিল লজ্জা ও শরমের সুস্পষ্ট ছাপ। তারা অত্যন্ত অসহায়ভাবে আমাকে বলতো যে, নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে। একন আমরা সরকারকে সহযোগিতা করে জীবন রক্ষা করতে চাই। কিন্তু ইখওয়ানদের দেখেও লজ্জাবোধ হয়। তাই আপনি ইখওয়ানদের বলে দিন যে, আমরা আপনার অনুমতি ও পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। এ পরিস্থিতিতে আমি কখনো এসব বন্ধুদের মনোবাঞ্চা অপূরণ রাখিনি। তাদের ইজ্জত আবরু রক্ষার খাতিরে আমি একথাই বলে দিতাম যে, আমি তাদের অনুমতি দিয়ে দিয়েছি। আমার এই কর্মপদ্ধতি ও কুরআন মজীদের শিক্ষার ফল মাত্র। [জীবন রক্ষার জন্য অনন্যোপায় হয়ে গেয়ে কুরআন মজীদে কুফরী কালামেরও অনুমতি দেয়া হয়েছে। যদিও দৃঢ়তা ও অনমনীয়তা অবলম্বন করাই মহত্ব।যা হোক প্রতিটি মানুষের মনোবল এক রকম হয় না। আমার মত দুর্ব। ঈমান ও দুর্বলমনা লোকদের প্রতি লক্ষ্য রেখে অফুরন্ত রহমতের নিদর্শন স্বরূপ রাব্বুল েইজ্জত এই নমনবীয়তার সুযোগ দান করেছেন।সূরা আন নাহলে বলা হয়েছে: “যে ব্যক্তি ঈমান গ্রহণের পর কুফরী করবে (অবশ্য তাকে যদি) বাধ্য করা হয় অথচ তার অন্তর থাকে ঈমানের ওপর অটল-অবিচল (তাহলে কোন অসুবিধা নেই) কিন্তু যে সানন্দে কুফর কবুল করে নেয় তার ওপর আল্লাহর গযব আর এসব লোকদের জন্য রয়েছে কঠিন ও কঠোর আযাব।”-অনুবাদক] আমরা কুরআন মজীদ অধ্যয়ন করতাম- তা মুখস্ত করতাম- তার শিক্ষা ও মূল বিষয়বস্তু এবং কেন্দ্রীয় প্রতিপাদ্য বিষয়ের ওপর চিন্তা-ভাবনা করতাম। জেলখানায় একজন ইখওয়ানী এমনছিল না যার বুকে কুরআন মজীদ ঝুলানো থাকতো না।
উম্মাতে মুসরিমার অবস্থা এখন এই যে, আমরা কুরআন মজীদকেই উপেক্ষণীয় বস্তুতে পরিণত করেছি। ফলে কুরআন মজীদও আমাদেরকে সম্পূর্ণ নির্বান্ধবও অসহায় অবস্থায় পরিত্যাগ করেছে। আমরা মনেকরি যে, আমরা কুরআন মজীদের হিফাজতকারী অথচ কুরআনই আমাদের হিফাজত করে থাকে। কুরআন একটা শক্তি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে অপরাজেয় ঢাল। আমাদের সরকারগুলো যদি তাদের রাষ্ট্রদূগণকে পাশ্চাত্যের বিপর্যস্ত সমাজের বিষাক্ত সমুগ্রে অবতরণের পূর্বে কুরআনের শিক্ষায় সুসজ্জিত করে দেয় তাহলে তাদের ধ্যান-ধারণা ও আকীদা-বিশ্বাস বিপর্যয়ের হাত থেকে নিরাপদ হয়ে যেতো এবং তারা তাদের দ্বীনের ব্যাপারে সংশয়-সন্দেহের শিকার হতো না।
এখন অবস্থা এই যে, তারা কুরআন সম্পর্কে কিছুই জানেনা। ফলে আমাদের যেসব ছাত্র এবং দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনসমূহের কর্মী পাশ্চাত্যের ঘুণে ধরা পরিবেশে গিয়ে পৌঁছে তারা তাদের স্বকীযতা হারিয়ে ফেলে। তারা যখন দেশে ফিরে আসেন তখন সেই নোংরা সভ্যতা ও সংস্কৃতির সমস্ত নৈতিক ও সামাজিক অকল্যাণসমূহ এবং জীবনাচারের নামে ঘৃণিত সব পন্থা-পদ্ধতির মারাত্মক বিষ সাথে করে নিয়ে আসে।
ইখওয়ানের প্রতি দোষারোপকারীদের একটা অভিযোগ হলো ইখওয়ানের কাছে বাস্তব ও ব্যবহারিক জীবনের জন্য সটিক কোন কর্মসূচী নেই। কুরআনমজীদ সমাজ সংস্কারের জন্য একটা অত্যন্ত ব্যাপক ঘোষণাপত্র পেশ করেছে। ইমাম শহীদ কুরআন মজীদের এই ঘোষণাপত্র ১১টি দফার আকারে সবার সামনে পেশ করেছেন। সমাজ সংস্কারের জন্য এটা ইখওয়ানের সবসময়ের একটা মৌলিক ও স্থায়ী কর্মপদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এরই আলোকে ইমাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন:
১-আল্লাহ ভীতি।
২- মানুষের জীবনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
৩-আখেরাতের জবাবদিহির প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস পোষণ।
৪-মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ।
৫-নর-নারী নির্বিশেষে সকলকে সচেতন করে তোলা এবং ইসলামের পয়গাম সকলের নিকট পৌঁছে দিয়ে তার দাবীসমূহ পূরণ করতে উৎসাহিত করা।
৬-মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক নিরাপত্তা বিধান।
৭-অপরাধ প্রতিরোধে আপ্রাণ সংগ্রাম।
৮-উম্মাতের ঐক্যের জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা চালানো এবং বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা এবং তার কারণসমূহের মূলোৎপপাটন।
৯-মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধানের মাধ্যমে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ জীবনের অধিকার মালিকানা লাভের অধিকার, জীবিকার্জনের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্য রক্ষার অধিকার, লিখার অধিকার, বক্তৃতা বিবৃতির অধিকার এবং অবাধ গতিবিধির অধিকার। প্রত্যেক ব্যক্তির শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করা এবং সমাজের সব মানুষের হালাল জীবিকা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া।
১০- জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর জন্য বাধ্যবাধকতা।
১১-মুসলিম রাষ্ট্রকে উপরোক্ত দফাগুলোর পথিকৃত বানানো এবং তাদের সাহায্য সহযোগিতার জন্য তার সমস্ত উপায় উপকরণ প্রয়োগ করা। তা ছাড়া সমগ্র মৌলিক মানবীয় অধিকার সকল মানুষের দোর গোড়ায় পৌঁছে দেয়ার গ্যারান্টি ও নিশ্চয়তা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে হাসিল করা। এই দফাগুলোর প্রতি লক্ষ্য করুন এবং তারপর আপনি নিজেই এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কুন যে, ইখওয়ানের ঘোষণাপত্র জীবন সমস্যার সমাধানে এবং সমাজের সংস্কার সাধনে কার্যকরী ও ফলপ্রসু প্রমাণিত হতে পারে কি না?
গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করা
আমার চরম আগ্রহ ছিল এই যে, এই স্মৃতিচারণকালে সেই সমস্ত দুর্ভল চিঠিপত্র বিদগ্ধ পাঠকগণের সম্মুখে তুলে ধরবো যেগুলোর বিনিময় হয়েছিল আমার ও মুর্শিদের মাঝে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ জামাল আবদুন নাসেরের আমলে যখন তার এজেন্ট আমার খানা তল্লাশী করেন তখন আমার এই মূল্যবান কাগজপত্রগুলোও বাজেয়াপ্ত করা হয়। তারপর ব্যক্তিগত এসব কাগজপত্র যার ওপর তাদের কোন আইনগত অধিকার ছিল না আমি আর কখনো ফিরে পাইনি। ঐসব কাগজপত্রের কথা না হয় বাদই দিলাম। কারণ তা ছিল আন্দোলন সম্পর্কিত কাগজপত্র। এই জালিমগণ আমার ব্যক্তিগত এমন সব ফাইল-পত্র বাজেয়াপ্ত করে যেগুলোতে বিভিন্ন মক্কেলের কেইস ছিল। আর ঐ ফাইলগুলো আমি উচ্চ আদালতে পেশ করার জন্য তৈরী করে রেখেছিলাম। আন্দোলন বিষয়ক কাগজপত্র হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া কোন সাধারণ ক্ষতিকর ব্যাপার ছিল না। যারা এসব কাজগপত্র নিয়ে গেছে এগুলো দ্বারা তাদের কি লাভ হবে।তাদেরকে এমন সব কাকের সাথে তুলনা করা যায় যা সাবানের কেইস তুলে নিয়ে যায় এবং তার ওপর ঠোকর মারতে থাকে। কিন্তু তা খেয়ে উদরপূর্তি করতেও পারে না। আবার তার মালিককেও ফেরত দেয় না যাতে সে উপকৃত হতে পারে। আহমক লোকদের আচরণ এরূপই হয়ে থাকে। তারা নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আহমক লোকদের আচরণ এরূপই হয়ে থাকে। তারা নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অন্যরাও যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেজন্য সদা তৎপর থাকে।
অতীত গৌরব পুনঃ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা
ইসলামী হুকুমাত নবী করিম (স)-এর আমলে এবং খেলাফতে রাশেদার সময়ে অত্যন্ত মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাকে তখন সমগ্র দুনিয়ায় ইজ্জত ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হতো। তার আতঙ্কে দুশমনদের অন্তর সদা কম্পমান থাকতো তারপর আসে পতন যুগ। ধীরে ধীরে মুসলিম উম্মাহর ওপর দুর্বলাত ও অলসতা জেঁকে বসে। কালের আবর্তন আবার জগদ্বাসীকে এমন দিনের মুখোমুখ করে দেয় যখন আমাদের কোন মর্যাদা ও সম্মান এবং কোন মূল্য ও গুরুত্ব বিশ্বের জাতিগুলোর মাঝে আর অবশিষ্ট থাকেনি। আজ আমরা মহান আমানত ও উত্তরাধিকারকে বহন করার ক্ষমতাও রাখি না। আমরা আজ শতধা বিচ্ছিন্ন। ইহুদী, খৃস্টান ও কমিউনিস্টরা আমাদরে মাঝে বুক টান করেছেন। অধপতনের এ যুগে আল্লাহ তায়ালা শঞীদ হাসানুল বান্নাকে তাওফিক দিয়েছিলেন উম্মাতকে সংগঠিত করতে। ফলে তিনি ইখওয়ানুল মুসিলমুনের বুনিয়াদ রচনা করেন এবং সংগঠন অইসলামী শক্তিসমূহের মোকাবিলা করার জন্য কোমর বেঁধে ময়দানে অবতীর্ণ হয়। ইখওয়ান এই ফয়সালা গ্রহণ করে ধ্বংসাত্মক সকল মতবাদের মূলোৎপাটনের এবং উম্মাতে মুসলিমার হৃত গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার।
মৌলিক ও সাধারণ উদ্দেশ্যাবলী
এই আন্দোলনের সাহায্যে ইমাম শহীদ দু’টো মৌলিক উদ্দেশ্য হাসিল করার চেষ্টা করেন। তার একটা হচ্ছে, মিল্লাতে ইসলামীয়াকে সকল বিদেশী বিজাতীয় আগ্রাসন থেকে মুক্ত করে প্রকৃত আযাদীর ধারণার সাথে পরিচিত করে দেয়া। আর অপরটা হচ্ছে, স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যা পরিপূর্ণরূপে কুরআনী শিক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। এই দু’টি মৌলিক উদ্দেশ্য ছাড়া আমাদের আরো কতিপয় সাধারণ উদ্দেশ্র ও লক্ষ্য রয়েছে। যেমন:
আমরা নিরক্ষরতা দূর করতে চাই। অভাব ও দারিদ্র এবং অজ্ঞতা এবং সকল প্রকার রোগ ব্যাধি থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে চাই। আমাদের লক্ষ্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে এই যে, আমরা এমন মুসলিম সমাজ সৃষ্টি করতে চাই যেখানে উম্মাতের প্রত্যেক ব্যক্তি ইজ্জত সম্মানের যোগ্য ও উপযুক্ত বিবেচিত হবে এবং সমাজ সামগ্রিকভাবে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথিকৃতরূপে গড়ে উঠবে। এই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য আমরা যে কর্মনীতি গ্রহণ করেছি তা অত্যন্ত সংক্সেপে নিম্ন বর্ণিত তিনটি শিরোনামে উপস্থাপন করছি:
১-বলিষ্ঠ ঈমান।
২-মজবুত সংগঠন।
৩-অবিশ্রান্ত প্রয়াস-প্রচেষ্টা।
ইখওয়ানের দাওয়াতের কিছু অতিরিক্ত মূলনীতিও রয়েছে। কিন্তু এটা কতই না দুঃখজনক বিষয় যে, যেসব লোকের পক্ষ থেকে ইখওয়ানের সাহায্য-সহযোগিতার প্রত্যাশা ছিল তারাই ইখওয়ানের বৈরিতা ও বিরোধিতায় তৎপর হয়ে ওঠে। ইখওয়ানের দাওয়াত আসলে কি? এ ছাড়া তো আর কিছুই নয় যে, প্রত্যেক মুসলিম তার হৃত গৌরব ও মর্যাদা ফিরে পাক। এতদসত্ত্বেও কতিপয় মুসলিম ও আহলে ইলম আমাদের পথের কাঁটা বিছাতে এবং প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সদা তৎপর। তা সত্ত্বেও কোন বিরোধিতার পরোয়া আমাদের নেই। কোন প্রতিবন্ধকতা আমাদের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করতে পারে না। এই দাওয়াতের সাহায্যের জন্য আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট এবং তিনি সকল ব্যাপারে পুরোপুরি ক্ষমতাবান। আমাদের কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য এবং প্রবৃত্তিগত লালসা চরিতার্থ করার মনোবৃত্তি এই আন্দোলন ও দাওয়াতের সাথে সম্পৃক্ত নয়। দ্বীনের মহাজন এবং আল্লাহর আয়াত বিক্রেতার যা ইচ্ছে তাই বলে বেড়াক। আমরা আলহামদুলিল্লাহ তাদের সকল অভিযোগ থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
মু’মিনসুলভ বিচক্ষণতা
ইমাম হাসানুল বান্নার মু’মিনসুলভ দুরদর্শিতার প্রতি লক্ষ্য করুন। ইখওয়ানের দাওয়াত যখন খুব জোরেশোরে প্রসার লাভ করেছিলো এবং প্রতিদিন অসংখ্য ব্যক্তি এই সংগঠনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছিল। অত্যাচার-উৎপীড়নের ন্যূনতম কোন লক্ষণও কোন দিকে পরিদৃষ্ট হচ্ছিল না। তখনও তিনি ইখওয়ানকে এই অসীয়ত করেছিলেন যে, কঠিন ও দূরতিক্রম্য বাধাসমূহ তোমাদের অপেক্ষায় রয়েছে। এবং পরীক্ষার সময় অবশ্যই আসবে। ইখওয়ান কোন সাধারণ রাজনৈতিক দল কিংবা কল্যাণমূলক সংগঠন নয়। তোমাদের অস্তিত্ব বাতিলের চোখে বিষদৃশ লাগবে। তোমরা একটা নতুন জীবনী শক্তি যারা আল-কুরআনের জীবনদায়ী পয়গামকে উম্মাতের মৃত শরীরে প্রবিষ্ট করাতে চাও। তোমরা এমন এক আলো যার দীপ্তি মা’রেফাত ইলাহী থেকে লব্ধ। অন্ধকারের বক্স এই আলোর প্রভাবে বিদীর্ণ হচ্ছে এবং আমার কিরণচ্ছটা পরিদৃষ্ট হচ্ছে। তোমরা নব বসন্তের এমন আহবান যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাওয়াত পুনরুজ্জীবিত করছে। তোমরা একটা অতিগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেছো। যখন অন্য লোকেরা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। শীঘ্রই তোমাদর ওপর কঠিন ক্রান্তিকাল এসে পড়বে। যখন জিজ্ঞেস করা হবে এ দাওয়াত কিসের? তখন জওয়াবদিবে আমরা সেই দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছি যা নিয়ে আগমন করেছিলেণ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স)। সরকার এই দ্বীনেরই অন্যতম অংশ। যদি তোমাদেরকে বলাহয় যে, এটা তো রাজনীতি। তখন তোমরা প্রত্যত্তরে বলবে যে, এটাই ইসলাম যার মধ্যে দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন এবং দেহ ও আত্মার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টির প্রয়াস বাতুলতা মাত্র। তোমাদেরকে যদি বলা হয় যে, তোমরা বিপ্লবের আহ্বায়ক। তখন জবাবে বলবে যে, আমরা সততা ও নিরাপত্তার পতাকাবাহী। এই সততার ওপর রয়েছে আমাদের পরিপূর্ণ ঈমান এবং এর মধ্যেই নিহিত আছে আমাদের ইজ্জত ও সম্মান। বাতিলের অনুসারী ও তাগুতের অনুগামীদেরকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে হবে যে, যদি তোমরা আমাদের ওপর হাত তোল এবং আমাদের চ লার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি কর তাহলে জেনে রাখ আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে নিজেদের িএবং আমাদের দাওয়াতের প্রতিরক্ষার অধিকার প্রদান করেছেন। যদি এরূপ অভিযোগ আরোপ করা হয় যে, তোমরা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিকট সাহায্য প্রার্থনা আরো করা হয় যে, তোমরা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিকট সাহায্য প্রর্থনা করে থাকো। তাহলে তোমরা বলে দেবে, “আমরা এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছি এবং তার সাথে যাকেই আমরা ভুলক্রমে ও অজ্ঞতাবশত শরীক বানিয়ে নিয়েছিলাম তাকে সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করছি।” জালিম যদি কোন কথায়ই কর্ণপাত না করে এবং অন্ধভাবে শত্রুতা করার জন্য ব্রতীত হয় তবে তাদের বলে দাও তোমাদের প্রতি সালাম আমরা মূর্খদের সাথে কোন প্রকার ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হতে চাই না।”
এই বিশ্বস্ত ব্যক্তিগণের কঠোর হস্তক্ষেপ রহস্যময়
সুধী পাঠক! আপনি কি অসীয়তের শব্দালী ও বিষয়বস্তুর প্রতি লক্ষ্য করেছেন? এবার অনুমান করুন যে মর্দে মু’মিনের ভবিষ্যদ্বাণী ও দূরদর্শিতা এবঙ অনাগত কালে প্রকাশিতব্য ঘটনাবলীর ওপর তার সুচিন্তিত দৃষ্টিভংগী এক একটা শব্দ দ্বারা কিভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের জীবনে এমন সব জিনিস পরিদৃষ্ট হয়েছে যেগুলোর প্রতি ইমাম ইংগিত করে ছিলেন। অত্যাচার নির্যাতনের স্টিমরোলারে ইখওয়ান একাধারে ফারুক, জামাল আবদুন নাসের ও সাদাতের আমলে মর্মান্তিকভাবে নিষ্পিষ্ট হয়েছে। ইখওয়ানের ওপর জুলুম-নিপীড়নের এমন পাহাড় ভাঙা হয়েছে যে, কারো অন্তরে তিল পরিমাণ ঈমান ও আল্লাহভীতি থাকলে সে এই মর্মন্তুদ অত্যাচার কোন প্রাণীর ওপর চালানোর কল্পনাও করতে পারতো না। আমাদেরকে এমন সব কষ্ট দেয়া হয়েছে যার উপযুক্ত হতে পারে এমন লোক যে কারো ধন-সম্পদ লুট করে নিয়েছে। কারো ইজ্জত-আবরুর ওপর আক্রমণ চালিয়েছে কিংবা কারো বাপ, ভাই ও ছেলেকে হত্যা করেছে। আমরা এ ধরনের কোন্ অপরাধে অপরাধী? উপরোক্ত অপরাধে অপরাধীদের যে শাস্তি দেয়া হয়ে থাকে আমাদের ওপর তার চেয়েও বেশী অত্যাচার করা হয়েছে। এই জালিমদের অত্যাচার-উৎপীড়নের সম্মুখে অসুরের বর্বরতা, নেকড়ের রক্তপিপাসা, বাঘের হিংস্রতা এবং গভীর অরণ্যে সংঘটিত কোন হিংস্র প্রাণীর হিংস্রতাও তার তুলনায় তুচ্ছ। এর কারণ কি? আমিএর কারণ বর্ণনা করতে অক্ষম। এ লোকগুলো কি কাফের ছিল? যারা আমাদের ওপর উৎপীড়নের একশেষ করেছে তারা কি কাফের। না আমরা তো তাদেরকে কাফের বালি না। তাহলে তারা কি তাদের প্রভুদের খুশী করার জন্য এসব করেছিলো? না বিশ্বস্ততা ও বর্বরতা একই অন্তরে কিভাবে একত্রিত হতে পারে? তবে কি তারা ইসলাম দুশমনদের ভাতা খোর এজেন্ট ছিল। প্রতিটি অত্যাচার-উৎপীড়নের মহড়া দেয়ার সাথে সাথে তাদের ভাতা বৃদ্ধি পাচ্ছিলো? এমন নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত মানবতার রূপ পরিগ্রহ করার অভিযোগ তো আমরা আরোপ করতে পারি না। তবে এখন প্রশ্নে থেকে যায় যে, তারা এসব করলো কেন? এর যথার্থ উত্তর এবং জ্ঞান আমার রবের নিকটই রয়েছে। কালের বিবর্তনে সময়ে সময়ে এ রহস্যের দ্বার ধীরে ধীরে উন্মোচিত করে দিচ্ছে যা বহুদিন ছিল মানুষের অজ্ঞাত-অজানা।
জুলুমের দানব ও ধৈর্যের পাহাড়
ইমাম শহীদ যেসব আশাঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তা সত্যে পরিণত হয়। ইখওয়ানদের বন্দী করা হয় এবং ইমাম-একাই জেলখানার বাইরে থেকে যান। ইমামকে তার সাথীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার পর সরকার তার নিকট থেকে তার লাইসেন্স প্রাপ্ত অস্ত্র ফেরত নিয়ে নেয়। এর অব্যবহিত পরই তাঁকে প্রতারিত করে গুলি করে শহীদ করা হয়। সর্বস্তরের জনগণকে ইখওয়ানের ওপর পরিচালিত সরকারের নির্যাতনের অবস্থা জেনে নেয়া দরকার। সরকার শুধু মাত্র লাঠি, গুলী, জেল ও ফাঁসির শাস্তিই আমাদের দেয়নি বরং প্রচার ও প্রোপাগান্ডার সমস্ত উপায়-উপকরণের কামান দেগে তা আমাদের বিরুদ্ধে বিষাক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। আমাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আরোপ করা হয় এবং তা ফলাও করে প্রচার করা হয়। মিসরে কোন কারণে কারো হাতে কোন মন্ত্রী কিংবা কোন গুরুত্ব পূর্ণ সরকারী আমলা নিহত হলে অপবাদ চাপানো হতো ইখওয়ানের ঘাড়ে। এবং প্রোপাগান্ডার এমন তুফান সৃষ্টি করা হতো যা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। কিন্তু ইমাম হাসানুল বান্নার পদাঙ্ক অনুসরণে কিংবা সরকারী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে শহীদ আবদুল কাদের আওদা, শহীদ ইবরাহীমুত তীব ও ইউসুফ তালায়াত শহীদের নির্দয় হত্যাকান্ড সরকার যার প্লট তৈরী করেছিল একটা মনগড়া কাহিনী এবং হত্যাকান্ডের মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে কিংবা পরবর্তী সাইয়েদ কুতুব শহীদ, ইউসুফ হাওয়াশ শহীদ এবং তাদের অন্যান্য সংগীগণকে বিনা অপরাধে প্রদত্ত ফঅঁসির সংবাদ জনগণের নিকট পৌঁছাতে দেয়া হয়নি। হাজার হাজার ইখওয়ানকে পায়ে বেড়ি পরিয়ে জিন্দানখানার অভ্যন্তরে আটক করে রাখা হয় অথচ দেশের প্রচার মাধ্যমগুলো তাদের ব্যাপারে পূর্ণনীরবতা অবলম্বন করে থাকে। এটা কত বড় জুলুম ও নির্বিচার অবস্থা যে নিরপরাধ এবং মূল্যবান জীবনসমূহকে ধ্বংস করা হয়েছে। অথচ সংবাদপত্র ও রেডিও আকারে ইংগিতে কিংবা পরোক্ষভাবেও তার কোন উল্লেখ পর্যন্ত করেনি। কিন্তু সত্য কি এভাবে চাপা পড়ে থাকে? না তা কখনো হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা এই ফায়সালা দিয়ে রেখেছেন যে, জালিমদের কুৎসিত চেহারার ওপর থেকে অবশ্যই পর্দা সরিয়ে দেয়া হবে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি এই মানবরূপী হায়েনাদের নৃশংসতা সম্পর্কে সম্যকরূপে পরিজ্ঞাত হয়ে যাবে। তাই এখন রহস্যের দ্বার উন্মোচিত হতে চলেছে।
নিম্নে পতিতদেরও নিম্নতম
মিসরীয় ভূ-খন্ডে আহলে হকের ওপর যে জুলূম করা হয়েছে বিদগ্ধ পাঠকগণের সমীপে কোন ভাষায় সে মহাতান্ডবের আলোচনা করবো। ইখওয়ানের সাধীদের ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষ তাদের হায়েনাদের নির্দেশ দিয়েছিলো তারা যেন এখন দীরে সুস্থে জুলুমের পূর্ণতা সাধন করে। অথচ পাষণ্ডগণ করেছে কি? কয়েদীদের হত্যা করেছে? না, তা নয়। তারা যদি আমাদের শরীরের মাংস খুবলে খেতো এবং আমাদের জীবন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ করতো তাহলেও তা হতো আমাদের জন্য খুবই সাধারণ। তারা ইখওয়ানের চোখের সামনেতাদের গৃতের পূত-পবিত্র ও পূর্ণাত্মা পর্দানশীন গৃহীনী, বোন ও মেয়েদের ইজ্জত আবরু ভূলুন্ঠিত করে! এ বর্বর ও নারকীয় অভিযানের সময় আনন্দের আতিশয্যে তালি বাজানো হতো। অট্টহাসিতে ফেটে পড়তো এবং অত্যন্ত নির্লজ্জ ভংগীতে অশালীন সমালোচনা করতো ও টিপ্পনী কাটতো। আহ! এ ঘটনা সংগঠিত হওয়ার পূর্বে যদি জমিন বিদীর্ণ হয়ে যেতো কিংবা আসমান ভেংগে পড়তো।
এই ছিল সেই সময়ের ইনসাফ ও ন্যায়বিচার। ক্ষমতার মসনদে সমাসীন এসব লোক তাদের পূর্বসুরীদের মত সুযোগ পায় তবে তারাও তাদের পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার পরিবর্তে একই ভংগীতে চলতে থাকবে।
অবশ্যই আখেরাতের আযাব খুবই অপমানকর
ইখওয়ানের ওপর অত্যাচারের স্টীমরোলার পরিচালনাকারীরা আমাদের চোখের সামনেই তাদের জঘন্য পরিণামের মুখোমুখি হয় আর এখন তারা শিক্ষণীয় নিদর্শন ও প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে। হামজা আল বাসিউনী, আবদুল লতীফ এবং তাদের হিংস্র পশুর চরিত্র সাথীরা অসীম ক্ষমতার অধিকারী মহাপ্রভুর কঠোর পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারেনি। দুনিয়াতেই চরম অপমানজনক আযাব তাদের গ্রাস করে ফেলে। আখেরাতের আযাব তো আরো বেশী ভয়াবহ ও লাঞ্ছনাকর। এটা ক্রমাগতভাবে অত্যাচার-উৎপীড়ন চালাতো। ইখওয়ানের ব্যাপারে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, যদি ইখওয়ান সুযোগ পেয়ে যায় তাহলে তাদের থেকে পুরোপুরি প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। এ কারণে সেই হতভাগাদের আকাংখা ও প্রচেষ্টা ছিল ইখওয়ানের নাম নিশানাও মুছে ফেলা। ইখওয়ান সম্পর্কে তাদের এ ধারণার কারণ হলো, তারা আমাদেরকেও তাদের নিক্তিতে পরিমাপ করতো। অথচ আমাদের সুচিন্তিত নীতি ছিল এই যে, কারো সাথে আমাদের ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। আমাদের ওপর যে জুলুম চালানো হচ্ছে তা মূলত আল্লাহর দ্বীনের সাথে দুশমনী ও শত্রুতার কারণেই। আমরা যদি কারো নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণও করি তা হলে তা এতবেশী কঠিন হতে পারে না। যতটা হতে পারে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের প্রতিশোধের পরিমাণ। অতএব আমরা সমস্ত জালিমের মোকদ্দমা আল্লাহর আদালতে সোপর্দ করে দিয়েছি। (আরবী********) (নিশ্চয়ই তোমার রবের পাকড়াও খুবই কঠোর)।
প্রীতি ও সৌহার্দ্যের শাহাদাত গাহ
ইখওয়ানের চিন্তাধারা খাঁটি ইসলামী নীতিমালা ও আকীদা-বিশ্বাসের ওপর ভিত্তিশীল। অনৈসলামী আদর্শ ও মতবাদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। ইমাম শহীদ তাঁর দাওয়াতের সংক্ষিপ্তসারে এভাবে বর্ণনা করেছেন।
“ইকওয়ানের দাওয়াত লোকদেরকে ইসলামের ইলম ও আমলের ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত করানোর প্রয়াস মাত্র।”
মুসলিমদের অধপতন ও পশ্চাতপদতা এবং শাসিত ও বঞ্চিত হওয়া দেখে ইমাম শুধু একাই বেদনাহত হয়ে পড়েননি বরং এমন প্রতিটি ব্যক্তিরই এ জন্য বেদনাহুত হয়ে পড়ার কথা যার অন্তরে ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহও ছিল- সে ই এ অবস্থা দেখে অশ্রু সম্বরণ করতে পারেনি। ইমামের মনে যখন এই অবস্থা সংশোধনের চিন্তা জেঁকে বসে তখন আর তিনি নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে থাকতে পারেননি। তিনি দেশ ও জাতির কর্ণধারদের কাছে গিয়ে তাদেরকে পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করান। তিনি সমগ্র মিসরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতে ও মানুষের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেন। এবং প্রত্যেকের দ্বারে গিয়ে ধর্ণা দেন। এই প্রচেষ্টা ব্যাপদেশে তিনি সর্বস্তরের নেতিবাচক সমালোচনা করে তাকে নিরুৎসাহিত করার প্রয়াস পায়। কেউবা এ কাজের ভায়াবহতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সন্তর্পনে অগ্রসর হওয়ার উপদেশ প্রদান করেন। কিন্তু সত্য পথের পথিক কি এতে কখানো হিম্মত হারিয়ে ফেলে কিংবা এ মহতী থেকে হাত গুটিয়ে বসে যেতে পারে? প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষের সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক সৃষ্টির এ ধারণা বড়ই ঈমান প্রবৃদ্ধিকর ও লোভনীয় ছিল। গণ্যমান্য ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে আহমদ তৈমুর পাশা মরহুমের সাথে তিনি যখন মিলিত হন এবং তাঁর প্রোগ্রাম পেশ করেন তখন তনি এই প্রোগ্রামের সফলতার জন্য বড়ই হৃদ্যতা ও আন্তরিকতার সাথে সহযোগিতা করতে থাকেন। ইমামের সহপাঠি ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্য থেকেও যারা তাৎক্ষণিকভাবে দাওয়াতে হক গ্রহণ করেন তাদের মধ্যে ছিলেন উস্তাদ আহমদ আস সুকরী, শাইখ হামিদ আসকার মরহুম এবং শাইখ আহমদ আবদুল হামিদ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা ইমামের নিকট অংগীকারাবদ্ধ হয়েছিলেন এবং শপথ করেছিলেন যে তারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় জীবনের সকল দিক ও বিভাগে এবং সমাজের প্রত্যেক মানুষের পরিপূর্ণভাবে ইসলামের রংগে রাঙিয়ে তুলবেন। তারা সবাই ছিলেন ইসমাঈলিয়ায় ইমামের ঘনিষ্টতম বন্ধু।
মূলনীতি ও কর্মপদ্ধতি
অনন্তর কালের আবর্তন এ চার অকৃত্রিম বন্ধুকে পরন্পর থেকে আলাদা করে দেয় এবং পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে প্রত্যেকে জীবিকার সন্ধান ইসমাঈলিয়া ত্যাগ করে অন্যত্র বসতি স্থাপন করেন। ইসলামী আন্দোলনের সর্বপ্রথম বীজ বপন করা হয় ইসমাঈলিয়ায় ১৩৪৭ হিজরীর জিলকাদ মাসে। এ শহরেই আন্দোলন তার মজবুত বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রত্যেকেরই এটা জেনে নেয়া উচিত যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুনের আন্দোলন-
১- সালফে সালেহীনদের পদাম্ক অনুসরণ করে এবং কিতাব ও সুন্নাতের আলোকে কাজ করে থাকে।
২- কর্মপদ্ধতি একান্তভাবে সুন্নতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোতাবেক। এমনকি এ আন্দোলন তার আমল ও হাদীসের পরিপন্থী কোন পদক্ষেপ কখনো গ্রহণ করে না।
৩- এ আন্দোলনের দৃষ্টিতে তাসাউফের অর্থ আত্মার পরিশুদ্ধি ও ইসলামী জীবনাদর্শের অনুসরণ এবং সৃষ্টির প্রতি অমুখাপেক্ষিতা এবং একনিষ্টভাবে আল্লাহর ওপর ভরসা করা। কোন সৃষ্টিকে ভয় না করা এবং কারো নিকট থেকে কোন কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা না করাই আমাদের তাসাউফ।
৪- এটা একটা রাজনৈতিক সংগঠন- যার উদ্দেশ্য সরকার ব্যবস্থার সংশোধন এবং উম্মতে মুসলিমার উজ্জত ও সম্মানের নিরাপত্তা বিধান করা। সাথে সাথে বৃহত্তম মুসলিম উম্মাহভুক্ত অন্যান্য দেশের সাথে আদল ও ইরসাফ এবং সমতা ও সৌভ্রতৃত্বের ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টির ব্যবস্থা করা।
৫- আন্দোলনের মধ্যে আধ্যাত্মিক শিক্ষার সংগে সংগে শারীরিক ব্যায়াম অনুশীলন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয় থাকে।
৬- শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক তৎপরতার জন্য উৎসাহ প্রদান ও ব্যবস্থা গ্রহণ।
৭- অর্থনৈতিক জীবিকাভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ।
৮- সামাজিক ব্যধিসমূহের প্রতিবিধানের জন্য সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলা।
• এগুলো ছাড়াও এ দাওয়াতের নিম্মবর্ণিত বৈশিষ্ট রয়েছেঃ
(ক) বিতর্কিত বিষয়সমুহ পুরোপুরি এড়িযে চলা।
(খ) ব্যক্তিত্ব পূজার ব্যাপারে সকর্ততা।
(গ) দালাদলী ও মতভেদ থেকে বিরত থাকা।
(ঘ) দাওয়াতী কাজের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং পর্যায়ক্রমিক কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করা।
(ঙ) বক্তৃতা বিবৃতি এবং প্রচার প্রসারের ওপর বাস্তব কাজের বেশী গুরুত্ব প্রদান করা।
(চ) যুবক শ্রেণীর মাঝে দাওয়াতের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির জন্য প্রচন্ড আকাংখা সৃষ্টি করা।
(ছ) শহর ও গ্রামে তীব্র পতিতে দাওয়াতের ব্যাপ্তি ঘটানো।
প্রথম প্রথম ওপরে বর্ণিত বিষয়গুলোর ওপর পুরোপুরি দৃষ্টি নিবন্ধ করা হয়। তারপর আসে দাওয়াতের দাবীকে বিবেচনায় রেখে পয়গামকে সাধারণ জনগণের নিকট পৌছানো, দাওয়াতের সহযোগীদের নির্বাচন, দাওয়াতী গ্রুপ তৈরী এবং তার শ্রেণী বিন্যাসের দিকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করার পর্যায়। এরপর আমরা দ্বিতীয় পদক্ষেপে গ্রহণ করি এবং এই স্তরে নিন্মোক্ত কর্মনীতি অবলম্বন করা হয়ঃ
১- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং সেগুলোর মাধ্যমে পারস্পরিক পরিচিতি ও আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষা দীক্ষা বিস্তারের ব্যবস্থা করা হয়।
২- স্কাউট ও ক্রীড়া সংগঠন এবং তার সাহায্যে শারীরিক প্রশিক্ষণ নিয়ম-শৃঙ্খলা এবং নির্দেশ পালন ব্যবস্থা কার্যত কসরত, নিয়ামানুবর্তিতা দৃঢ় করা।
৩- পাঠচক্র ইখওয়ানের স্কুল ও ক্লাবগুলোতে ইসলামী বিষয়াবলীর ওপর নিয়মিত আলোচনা অধীবেশনের ব্যবস্থা করা হয়।
ইমাম শহীদের পয়গাম
আমি এখনো ইমাম শহীদের কণ্ঠ শুনতে পাই। এ কণ্ঠ সর্বদা আমার কোন ধ্বনিত হয় এবং ইমামের ঈমান উদ্দীপক পয়গামের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি সুস্পষ্টভাবে ইখওয়ানকে এ পয়গাম পৌছিয়ে ছিলেন। ইমাম শহীদ ও ইখওয়ানুল মুসলিমুনের ওপর যেসব মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করা হয়ে থাকে এসব দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য সেসব অবান্তর ও ভিত্তিহীন কথাবার্তার বাতুলতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। তিনি বলেছেনঃ
“হে ইখওয়ানুল মুসলিমুন! বিশেষ করে সেইসব সাথীগণ! যারা অধিকতর উৎসাহী এবং ত্বরিৎ ফলাফলের প্রত্যাশী! আপনারা শুনে রাখুন! আমি খুবই কাজের একটা কথা আপনাদের সম্মুখে পেশ করছি। আজ আপনাদের এই মহতী সমাবেশে আমি সুউচ্চ এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে এক পরশমণির সন্ধান দিতে চাই। আপনাদের এই পথ সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। এর সীমানা ও মনযিল সবই বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে। এই সীমানা যা আমি বুঝে শুনে গ্রহণ করেছি এবং যা সঠিক হওয়ার ব্যাপারে আমার মানসিক প্রশান্তি রয়েছে। আমি কখনো তার বিরুদ্ধাচারণ করবো না। এ রাস্তা দীর্ঘি ও কঠিন বটে। কিন্তু সঠিক পথ মাত্র এটাই। মনযিলে মাকসুদে পৌঁছার জন্য এটা ছাড়া অন্য কোন রাস্তা আর নেই। তাড়াহুড়া এবং অতিমাত্রায় আবেগের নাম পৌরুষ নয় বরং প্রকৃত পৌরুষ হচ্ছে ধৈর্য ও দৃঢ়তা। গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে নিহিত। অতএব আপনাদের মধ্যে যে হাতের তালুতে সরিষা জামানোর শখ রাখে তার জেনে রাখা উচিত যে, এ আন্দোলন তার জন্য নয়। পরিপক্ক হওয়ার পূর্বেই যে ফল ছিঁড়ে নিতে চায় এবং প্রস্ফুটিত না হতেই ফুল নিযে খেরতে চায় আমার সাথে তার কোন বনি-বনা হতে পারে না। এমন ব্যক্তির জন্য আমার অকপট নসীহত এই যে, সে যেন এ আন্দোলন ছেড়ে অন্য কোন সংগঠনের সাথে জড়িত হয়ে যায়। হে মহাসম্মনিত দ্বীনি ভাইয়েরা, যে ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে আমার সংগে নির্দিষ্ট পথে চলতে প্রস্তুত তার জেনে নেয়া উচিত যে, সর্বপথম বীজ বপন কার হয়, তা থেকে অম্কুরোদগম হয় এবং ধীরে ধীরে চারা গাছ বেড়ে ওঠে। নির্দিষ্ট সময় এবং কঠোর পরিশ্রমের পর তাতে ফুল ফোটে এবং ফল ধরে। আরো অপেক্ষার পর ফল পাকে এবং তারপর সেই ফল আহরণ করার সময় আসে। যিনি এ মূলনীতি হৃদয়-মনে বদ্ধমূল করে নিতে সক্ষম হয়েছেন তাঁর পথ চলা জারি রাখা উচিত। তাঁর প্রতিদান ও প্রতিফল আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দায়িত্বে রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা যেহেতু পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করবেন না। এ পারিশ্রমিক বিজয় ও সফলতা রূপেও প্রদান করা হতে পারে আবার শাহাদাতের গৌরবদীপ্ত খেলায়া’ত রূপেও দেয়া যেতে পারে।”
এভাবে সুস্পষ্টরূপে বর্ণনার পরও কি তাদের ভ্রান্ত কথার আর কোন গুরুত্ব থাকে। যারা ইমাম ও তার পরিচালিত আন্দোলনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আরোপ করতে কোন প্রকার লজ্জাবোধ করে না। এরা আমাদের শত্রু নয় বরং স্বার্থ ও প্রবৃত্তির দাস এবং দাওয়াতে রব্বনীর শত্রু। মোটকথা আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলতে চাই যে, আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার সম্পর্কে জনসাধারণ খুব ভালভাবেই অবহিত হয়ে গেছে এবং ইখওয়ানের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ব্যাপারে সম্যক অবগত হয়েছে। তার প্রমাণ ইখওয়ানের কাজ তীব্রগতিতে প্রসার লাভ করেছে এবং প্রতিদিনই নতুন নতুন শাখা উপশাখা খোলার কাজ অব্যাহত রয়েছে।
হাসানুল বন্না শহীদের শিক্ষা শুধু মাত্র বইয়ের পাতার সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করেনি। বরং তিনি তার চলাফেরায় সবসময় সর্বত্র শিক্ষাকের ভূমিকা পালন করতেন। দাওয়াত ইলাল্লাহুর প্রতি অনুবাগী লক্ষ লক্ষ যুবক এসব শিক্ষার সাহয্যে হাসানুল বান্নার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে এবং দুনিয়ার কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়ে কাজ করতে থাকেন। এ শিক্ষা এতই কার্যকর ও মর্মস্পশী যে, তার মোকাবিলার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী টিকতে পারে না। তিনি যত বড় বড় ডিগ্রীর অধিকারী হোন না কেন। এসব নাম সর্বস্ব চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও পন্ডিতদের নেতৃত্বের যুগ শেষ হয়ে গেছে এবং দাওয়াতে ইসলামীর কাজ তাদের আকাংখা সত্ত্বেও অত্যন্ত বিদ্যুৎ গতিতে প্রসার লাভ করছে। এখন মুসলিম নওজোয়ানগণ এ পথ আত্মনিয়োগ করেছে। কারণ, এতে নিহিত রয়েছে তাদের ইহকালীন কল্যাণ এবং এটিই তাদের পরকালীন মুক্তর চাবিকাঠি।
ভরসম্য পূর্ণ ব্যক্তিত্ব
সুধী পাঠক! আপনারা আল্লাহর সেই অলীর বাণী শুনুন যিনি দৃঢ় বিশ্বাস ও জ্ঞানের আলোকে বলেছেনঃ
“হে ইখওয়ানুল মুসিলমুন। আপনারা আবেগ উচ্ছাসকে বিবেক ও সতর্কতার শৈত্যের সাথে পরিচিত করিয়েদিন। বুদ্ধি ও দলিল-প্রমাণের বাতিকে আবেগের অগ্নিস্ফুলিঈ দ্বারা আলোকিত করুন। সবর্দা ভারসামস্যপূর্ণ কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করুন। যুক্তিবাদিতার স্রোত প্রবাহিত হয়ে বরফের বরফখন্ড হয়ে হাবেন না। কিংবা আবেগের ঝঞ্ঝার উড়ন্ত অগ্নিশিখার রূপ পরিগ্রহ করবেন না। কল্পনাকে বাস্তবতা ও যথার্থতার কষ্টিপাথরে পরখ করে নিন। সত্যকে আপনার নবীন চিন্তাধারা উন্নত ধ্যান-ধারণা থেকে সহজবোধ্য ও সাদামাটা ভংগীতে পেশ করুন। কোন একদিকে ঝুঁকে পড়ে অপরদিক থেকে পরিপূর্ণভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে উদাসীনতার নীতি কখনো গ্রহণ করবেন না। প্রকৃতির বিধানের বিরুদ্ধে সংঘাতের চিন্তা কখনো পোষণ করবেন না। কেননা তা ধ্বংসের কারণ হবে। তবে হাঁ কুদরতের সৃষ্টি রাজ্যের ওপর আধিপত্য বিস্তার করুন। সেগুলোর আনুগত্য আদায়ের কুরআনী শিক্ষাকে বাস্তবে রূপদান করুন এবং ঐসব সৃষ্টিকে মানবের খেদমতের জন্য ব্যবহার করুন। পুরোপুরি প্রস্তুতি ও চেষ্ট-সাধনা করার পর গিয়ে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়ের জন্য প্রত্যাশা করুণ। তখন বেশী দুরের ব্যাপার হবে না।”
এই সুস্পষ্ট বিবৃতির পরও প্রবৃত্তির পূজারীরা এ ইখওয়ানুল মুসলিমুনের বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করে থাকে। আমরা তাদের কোন পরোয়া করি না। আল্লাহর রহমতে আমরা আমাদের ওপর আরোপিত এসব অভিযোগ থেকে পবিত্র ও মুক্ত। তাদের ব্যাপারে ফায়সালার ভার আমরা আল্লাহর ওপর সোপর্দ করছি।
শক্তি অর্জন ও ইখওয়ানুল মুসলিমুন
আমাদের ওপর যদি এ অভিযোগ আরোপ করা হয় যে, আমরা গদী দখন ও শাসন ক্ষমতা হাসিলের জন্য লালায়িত তাহলে আমাদের জবাব হচ্ছে প্রথমত এ দাবী আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য নয় বরং তা উম্মাহর কল্যাণ ও সম্মানের জন্যই। দ্বিতীয়ত, ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষমতা লাভ করা কোন নিষিদ্ধ বৃক্ষ নয় বরং আল্লাহ তায়ালার নির্দেশঃ (আরবী...........) অর্থাৎ দুশমনদের মোকাবিলার জন্য তোমরা সাধ্যমত প্রস্তুতি গ্রহণ করো এবং সেজন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার শক্তি সঞ্চয় করতে থাকো...............। আমরা এ বিষয়ে গভীর মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করেছি। আমাদের দৃষ্টিভংগী ভাসা চিন্তা-ভাবনার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। আমরা কখনো আবেগ তাড়িত হয়ে ফায়সালা গ্রহণ করি না। আমরা খুব ভাল করেই জানি যে, ক্ষমতার কয়েকটা স্তর ও পর্যায় রয়েছে।
ক্ষমতার সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আকীদা ও ঈমানের শক্তি। তারপর ঐক্য এবং একতার শক্তির স্থান। উম্মাতের ঐক্য ব্যতীত ক্ষমতা লাভের কোন কল্পনাই আমরা করি না। কবির ভাষায়ঃ
ব্যক্তি টিকে থাকে জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধতার মাধ্যমে, একা সে কিছুই নয়। সাগরে থাকে তরঈমালা, সাগরের বাইরে নয়।
ক্ষমতার চূড়ান্ত স্তর এবং সকল ব্যথার দাওয়াই হচ্ছে, বহুবল ওঅস্ত্রের শক্তি। মনযিল পর্যন্ত পৌঁছার জন্য প্রথমে প্রথম পদক্ষেপ নিতে হয়। গৃহের ছাদে আরোহণ করার জন্য সিড়িঁর প্রথম ধাপ থেকেই সূচনা করা হয়ে থাকে। যদি প্রথম ধাপ অতিক্রম না করেই কেউ শেষ ধাপের ওপর না রাখতে চায় তাহলে তার ফলাফল ব্যর্থতা ও পরাজয় ব্যতীত আর কি হতে পারে? ইসলাম ক্ষমতা হাসিলের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলী ও সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। অন্ধভাবে পদক্ষেপ গ্রহণের কোন অনুমতি ইসলাম প্রদান করে না।
প্রিয় দেশ অন্ধভাবে ক্ষমতার ব্যবহার এবং উদ্দেশ্যহীন বিপ্লবের মজা ভাল-ভাবেই ভোগ করেছে। এসব বিপ্লব সমস্যা ও জটিলতা ছাড়া আমাদেরকে কি দিয়েছে? লক্ষ অর্জনের জন্য ইখওয়ান কখনো অন্ধভাবে শক্তি প্রয়োগ করার চিন্তা করেনি। কিংবা এ প্রক্রিয়াকে প্রকৃত পরিবর্তনের উপায়ও মনে করেনি।
অর্থনৈতিক ব্যাপারেও ইসলাম মানুষকে পুরোপুরি দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে এবং এর কোন দিক ও বিভাগ অন্ধকারে ছেড়ে দেয়নি। ইমাম হাসানুল বান্না শহীদ ইসলামী অর্থনীতির সার সংক্ষেপ নিম্নোক্ত মৌলিক দফাগুলোতে উপস্থাপনা করেছেনঃ
১- সম্মানীত জবিনের জন্য হালাল জীবিকা অত্যাবশ্যক। এ জন্য জীবিকা অর্জনের চেষ্টা এবং হালাল উপার্জনকে পরিকল্পিতভাবে মূলধন গঠনে বিনিয়োগ করা অতিব জরুরী।
২- স্বাস্থ্যবান ও কর্মক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য কাজ করা এবং জীবিকা অর্জনে সচেষ্ট হওয়া বাধ্যতামূলক।
৩- প্রাকৃতিক উপকরণসমূহ অনুসন্ধান এবং যে সমস্ত খনিজ সম্পদ ও শক্তি বিদ্যমান তা থেকে পুরোপুরি উপকারিতা লাভ করা।
৪- হারাম উপার্জনের সকল ছিদ্রপথ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
৫- ধনী ও দরিদ্রের মাঝে ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে। ধনীরা যেন কারুণের মত না হয়ে যায় এবং গরীব ভুখা-নাংগা জীবনের অসহায় শিকার না হয়ে পড়ে।
৬- প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা বিধান এবং যথোপযুক্ত জীবিকার সাথে জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান।
৭- কল্যাণকর ও মংগলজনক কাজে অর্থ ব্যয় করার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে উৎসাহ প্রদান এবং প্রয়োজনে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতাকে আবশ্যিক নীতি বানাতে হবে। এবং নেকী ও তাকওয়ার কাজে সহযোগিতার প্রসার ঘটাতে হবে।
৮-জনস্বার্থের পরিপন্থী না হলে ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার এবং তা হিফাজতের গ্যারান্টি দিতে হবে।
৯- আর্থিক বিষয় ও আর্থিক লেন-দেনকে ন্যায়নুগ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সুবিন্যস্ত করা এবং এ ব্যাপারে সহৃদয়তা ও দুরদর্শিতার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। বিশেষত নগদ লেন-দেন ক্ষেত্রে।
১০- সরকারবে এই অর্থনৈতিক বিধান কার্যকরী ও হিফাজত করার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।
সব সংশয়ের সমাধান এবং সব জটিলতার চাবিকাঠি
ইমাম এই দাফগলোকে শুধু টেক্নিকেল রূপে ও সীমিত পরিসরেই যে বর্ণনা করেছিলেন তা নয়, বরং প্রত্যেক দফার বিশদ বিবরণও সু্স্পভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন। যাতে প্রত্যেক সত্যতা যাচাইকারী কিংবা এই আদর্শের বাস্তবায়নকারী কোন প্রকার অস্পষ্টতায় পতিত না হয়। তিনি এগুলোর বাস্তব উদাহরণও পেশ করেছিলেন্ যাতে কেউ কথা বলতে না পারে যে, এ নীতিমলা অনুসারে কাজ করা অসম্ভব। তিনি স্বাধীনভাবে পুঁজি বিনিয়োগ, কোস্পানীসমূহের পরিকল্পনা, শিল্পের কর্মতৎপরতা ও মূলনীতি, মালিকানা নীতি, ট্যাক্স আরোপ ও সংগ্রহ নীতি, সুদী ব্যবস্থার বিলোপ সাধন, কুটির শিল্পে উৎসাহ প্রদান, বিলাস সামগ্রী নিরুৎসাহিত করণ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অত্যাবশ্যকীয় ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ব্যাপক সহজ লভ্যতা সম্পর্কেও তিনি বিস্তরিত আলোকপাত করেছেন। এতদসত্ত্বেও প্রায়ই শুনা যায় যে, ইখওয়ানের কাছে সমস্যার কোন সমাধান নেই।
ব্যাপকভিত্তিক ঘোষণাপত্র ও বাস্তবায়ন যোগ্য কর্মসূচী
প্রকৃতপক্ষে মিসরে ইখওয়ান এমন একটি সংগঠন যার নিজস্ব বিস্তরিত কর্মসূচী রয়েছে। অপর কোন দল বা সংগঠনই এ ব্যাপারে ইখওয়ানের সমকক্ষ নয়। যদি থাকে তাহলে কেউ প্রমাণ পেশ করুক। আমাদের নিকট এমন রোগীর কি চিকিৎসা থাকতে পারে যে তার রোগের কারণে মিঠা পানিকে লবণাক্ত বলে মনে করে এবং একথা মানতে রাজি নয় যে, তার মুখের রুচীই বিগড়ে গেছে পানির বৈশিষ্ট্য নয়। দিনের আলোতে চামচিকা ও পেঁচার দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়। কিন্তু এদ্বারা কি সূর্যর অস্তিত্বহীনতা প্রকাশ পায়? কবির ভাষায়ঃ (আরবী **********)
বাদুর ও চামচিকা দিনের বেলায় যদি চোখ দেখতে না পায় তজ্জন্য সূর্য্যর দীপ্তির কি ইবা আসে যায়?
আল্লাহর আইন
পৃথিবীর আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত মানব রচিত সকল আইন-কানুন অপেক্ষা ইসলামী আইন কানুন অধিকতর ব্যাপক, কল্যাণ ধর্মী ও বাস্তবসম্মত। এ আইনে কোন প্রকার ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতা নেই। কারণ এটা মানব রচিত নয় এবং সমগ্র সৃষ্টিরাজ্যের স্রষ্টার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞাময় ও সকল কল্যাণের আধার। এ কানুনে কোন প্রকার পশ্চাদপদতা রক্ষণশীলতা ও নির্বুদ্ধিতা নেই। এর মধ্যে জ্ঞান, উন্নতি, অগ্রগতি, গৌরব, আহকামের সূক্ষদার্শিতা সমস্যার সমাধান করার যোগ্যতা, উদার দৃষ্টি এবং চরম ঔদার্য পরিলক্ষিত হয়। সকল যুগে অনুষ্ঠিত কনফারেন্স, আলেমগণের সমাবেশ এবং মুজতাহিদের ইজতিহাদ আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে যে, যেখানে কুরআন ও সুন্নাহ আমাদেরকে আইন রচনার স্বাধীনতা প্রদান করেছে সেখানে আমরা এমন সব কানুন থেকে উপকারিতা ও সহযোগিতা লাভ করতে পারি যা সার্বিকভাবে মানবকল্যাণের প্রতিভু। অবশ্য কোন অবস্থায়ই তা কুরআন-হাদীসের কোন সুস্পষ্ট বাণীর সাথে সাংঘর্ষিক পারবে না।
আমাদের কানুনের ব্যাপকতার অনুমান এভাবেও হতে পারে যে, আমাদেরকে ইজতিহাদে “ মাসালিহি মুরসালাহ” ও “ উরফ”- এর ন্যায় ফিকহী উসূল থেকে উপকৃত হওয়ার অনুমোদনও দেয় হয়েছে অনুরূপ সমকালীন ইমাম (আমীরুল মু’মিনীন) এর নির্দেশ ও মতামতের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের হুকুমও প্রদান করা হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তা কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক হবে। ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের কর্মনীতি ছিল এই যে, তার আমলের রাজনৈতিক ব্যাপারে যদি তিনি কোন অভিমত ব্যক্ত করতেন তাহলে পরিষ্কারভাবে বলে দিতেন যে ইখওয়ানের সদস্যদের জন্য এ মতামত অবলম্বন করা কখনো জরুরী নয়। তিনি বলতেন যে, কারো নিজের রায় অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার কোন অধিকার তার নেই। তিনি তাঁর মতামত শুধুমাত্র নসীহতের জন্য প্রকাশ করতেন। যাতে কেহ তাতে কোন ভাল দিক দেখলে এবং আকৃষ্ট হলে তা গ্রহণ করবে অন্যথায় পরিত্যাগ করবে। এই ব্যক্তিই ছেলেন ইখওয়ানের ইমাম এবং প্রতিষ্ঠাতা যার বিরুদ্ধে তার দুশমনরা গোড়া ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগী সম্পন্ন হওয়ার অপবাদ আরোপ করে থাকে।
মুসলিমদের ইসলাম বিচ্যুতি
বর্তমানে জীবনের সকল ক্ষেত্রেই মুসলিমদের কর্মপদ্ধতি যে রূপ পরিগ্রহ করেছে ইসলাম কি তা অনুমোদন করে? একটু লক্ষ্য করুন আমাদের শাসন ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও পুলসিসমুহ, বিচার ব্যবস্থা, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও সেনাবাহিনী, ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ভিত্তি পরিবার সংগঠন এবং মানুষের নিজের ও তার ব্যক্তিগত সামগ্রিক ব্যাপারে তাবৎ রীতিনীতি বিন্দুমাত্রও কি ইসলামের চিত্র উদাহরণ পেশ করে? প্রত্যেকটা দিক ও বিভাগে বিশৃংখলা এবং আইসলামী কর্মকান্ডের ব্যাপকেতা প্রতীয়মান হয়ে থাকে।
এ বিশৃংখলা ও ইসলাম বিচ্যুতি প্রত্যক্ষ করে ইখওয়ান
ফায়সালা করে যে, লোকদের হিদায়াতের দিকে দাওয়াত দিতে হবে। হিদায়াতের এ সোনালী নীতি-ই নিসন্দেহে মানুষের সার্বিক দুঃখ যাতনার প্রতিবিধান নিহিত। কিন্তু মুষ্টিমেয় কায়েমী স্বার্থবদী লোকেরা মনে করে যে, এতে তাদের ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা ব্যহত হবে। তারপর আর যায় কোথায় ঐসব প্রবৃত্তি পূজারী ইখওয়ানের পেছনে লেগে যায়। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত আমরা তাদের প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে আছি। এটা বম্ময়কর ও পরস্পর বিরোধী আচরণ যে, মিসরের সকল রাজনৈতিক দল এখন শরীয়াত বাস্তবায়নের দাবী করে থাকে অথচ ইখওয়ার সুদীর্ঘকাল থেকে এ দবীই করে আসছে। ইখওয়ানের এ দাবীই সকল যুগে তাদরে ঘাড় মটকানোর কারণ রূপে বিবেচিত হয়েছে। এসব রাজনৈতিক দল যদি তাদের দাবীতে অকৃত্রিম ও একনিষ্ঠ হতো তাহলে আমরা তাদের সাধারণ খাদেম এবং কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গর্ববোধ করতাম। শরীয়ত বস্তবায়নের এ দাবী ইখওয়ানই তুলেছিল সবার আগে তথাপি এজন্য কোন প্রকার সুনাম সুখ্যাতি এবং কৃতিত্বের প্রয়োজন আমাদের নেই। আমরা এমন প্রত্যেক ব্যক্তির রিকার ধরতে প্রস্তুত যে এ মহৎ কাজটি করে দেখাবে।
মার্ষ যদি প্রশ্ন করে যে, বস্তুবাদী শক্তির জুলুম ও সীমালংঘনের মোকাবিলা আমরা কোন অস্ত্র ও শক্তির বলে করে থাকি? তাহলে আমাদের জবাব হচ্ছে এই যে, আমাদের অস্ত্রতো তাই যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অস্ত্রছিল। সে অস্ত্র কি? আল্লাহর ওপর মজবুত ঈমান, দাওয়াতের সত্যতা, শ্রেষ্ঠত্বের অটল ইয়াকিন, বলিষ্ঠ আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয়। মুসলিমগণ যদি আল্লাহর কুদরতের উপর ভরসা না করে তাহলে তারা সত্য পথের সমস্যাবলী ধারণক্ষম কখনো হতে পারে না। তার ইয়াকিন হওয়া উচিত যে, সে যুগের প্রথপ্রদর্শক ও শিক্ষক। যদ এসব গুণাবলী তর মধ্যে সৃষ্টি না হয় তাহলে সে এ সহোত্তম দাওয়াতের দাবী পূরণে সক্ষমই হতে পারে না। আর যে জীবনের এসব দাবী পূরণের যোগ্যতা নেই তা মৃত্যু অপেক্ষাও নিকৃষ্টতম।
মুসলিম উম্মাহর নিকট আমাদের দাবী
আমরা কখনো মুসলিম জনসাধারণ ও শাসকগোষ্ঠীর নিকট এমন দাবী উত্থাপন করিনি যেন তারা ধ্বংসের গভীর পস্কে লাফিয়ে পড়ে। আমরা কেবলমাত্র একথাই বেল থাকি যে, ইসলামী জীবনপদ্ধতি অনুসরণ করো এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামকে নিজেদের পথিকৃত রূপে বরণ করে নাও। খুব ভেবে চিন্তে প্রতিটা পদক্ষেপ গ্রহণ করো এবং ইসলামের পতাকা সবার শীর্ষে সংস্থাপনকে নিজের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করো। কখনো ক্রোধ, আস্ফালন এবং গর্ব ও ঔদ্ধেত্যের প্রকাশ করো না। চরম পন্থা অবলম্বন এবং অন্ধকারে তীর নিক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকো। ইখওয়ান তার মুসলিম ভ্রাতাগণের নিকট এ ছাড়া আর কিছুই দাবী করে না। উদ্দেশ্য তারা যেন পূর্ণ একনিষ্ট হয়ে দ্বীনের সম্যক ধারণা, অনুপম ও অকৃত্রিম ভ্রাতৃত্ব, সুশৃঙখল জিহাদ এবং আল্লাহর পথে ত্যাগ ও কুরবানীর দুর্নিবার আকাংখা প্রভৃতি মহৎগুণাবলী নিজের মধ্যে সৃষ্টি করে নেয়। তারপরও কি এ ব্যাপারে কোন অস্পষ্টতা ও জটিলতা বাকী থেকে যায় যে, ইখওয়ানের দওয়াত কি?
আরো লক্ষ্য করুন যে, আমরা মুসলিমদের নিকট যে জিনিসের দাবী করে থাকি তা কি কোন অসম্ভব কছিু? আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কাজ ও কাজের প্রচেষ্টা চালানোর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। এ বিষয়ে কুরআনের কতিপয় আয়াতও রয়েছে। কিন্তু কোন একটি আয়াতেও আমাদের ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়নি যে আমাদেরকে অবশ্যই প্রত্যাশিত ফলাফল লাভে সক্ষম হতে হবে। আমাদের দায়িত্ব হলো চেষ্টা করা। ফলাফল এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর হাতে।
বিপর্যয় ও ষড়যন্ত্র চিহ্নিত করণ
মিসরের সামজিক ব্যবস্থাকে সীমাহীন বিপর্যয় ঘুণের ন্যায় কুরে কুরে খাচ্ছে। জনসংখা মাত্রারিক্তভাবে ঘন হয়ে গিয়েছে। আবাদযোগ্য ফসলী জমি তার উর্বরা শক্তি দিন দিন হারিয়ে ফেলছে। এ পরিস্থিতিতে বিরাজমান অবস্থায় সংস্কার সংশোধন ও ভারসাম্যপূর্ণ পলিসি অবলম্বন করার একান্ত প্রয়োজন। যাতে পরিস্থিতিকে আরো বিগড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা যায়। অবস্থা সংশোধনের জন্য পরিবার পরিকল্পনা সমাধান নয়। বরং সমস্যার সমাধান হচ্ছে চাষাবাদযোগ্য ভূমিকা পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে এবং অনাবাদি ও পতিত জমি পুনরায় চাষাবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলা যেতে পারে। তারপর যেসব মুনাফা খোর মহাজনদের অন্তর সম্পূর্ণ মরে সারা হয়ে গেছে। অবৈধ পন্থায় আমাদের দেশের সমস্ত আয় কুক্ষিগত করে দেশের বাইরে নিযে যায়। এ জঘন্য অপকর্মে লিপ্ত ব্যক্তিগণ কারা? সকলেই তাদেরকে ভাল করেই জানে। বিদেশী কোম্পানীসমূহ আমাদেরকে জোঁকের ন্যায় শোষণ করছে। ভিনদেশী পূঁজির যোগান দেয়ার বাহানা করে আমাদের প্রাচুর্যর ওপর অন্যদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি আমরাই। বাহ্যত এটা খুবই আকর্ষণীয় ও মনোলোভা শ্লোগান যে আমরা বিদেশী পুঁজির সাহায্যে উন্নতির সোনালী সোপানগুলো অতিক্রম করে চলেছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা সম্পূর্ণ অন্তসারশূন্য নিকৃষ্ট জিনিস ও নিশ্চিত ধ্বংসকর ব্যাধি। এ জাতীয় চিন্তাধারা বহু অজ্ঞতার ফলশ্রুতি, বিপজ্জনক চারিত্রিক অধঃপতন, ইসলামী শিক্ষার প্রতি পুরোপুরি উদাসীনতা এবং পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের সমন্বিত রূপ, নিশ্চিদ্র ও ঘনান্ধকার রজনীতে অগণিত সংখ্যক দুষ্টকৃতির লোক যখন মানুষের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরু লুন্ঠন করার জন্য অগ্রাভিযানে রওয়ানা দেয়ার সময়ের সাথেই এর তুলনা করা যেতে পারে।
ব্যথার উপশম
এমন বিপজ্জনক ও জঘন্য ব্যধির চিকিৎসা আমরা কবে করবো? আমরা প্রত্যেকটি ঔষুধ পরীক্ষা করে দেখেছি এবং প্রতিটি মতবাদের তিক্ত ফলের আস্বাদ লাভ করেছি। এসব রোগের প্রতিবিধান একটাই আর তা হচ্ছে দ্বীনে হকের দিকে প্রত্যাবর্তন। এখন এর কি কারণ যে, আমরা সব ব্যবস্থাপত্রই পরীক্ষা করে শেষ করেছি। কিন্তু এ ব্যবস্থাপত্রখানা একবার পরীক্ষা করে দেখতে প্রস্তুত হচ্ছি না। প্রতিট আভ্যন্তরীন ও বিদেশী শক্তি এ পরীক্ষার পথে বাধা সৃষ্টি করছে কেন? তারা আমাদেরকে এই বলে সান্তনা দিয়ে থাকে যে, শরীয়াত তো প্রথম থেকেই কার্যকরী রয়েছে। মানুষ নামায পড়ে রোজা রাখে, যাকাত দেয়, হজ্জ করার জন্য পবিত্র ভূমিতে যাওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে তাদের। আল আজহারের মত বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যমান এবং মসজিদের দরজা খোলা আছে। এরপর তোমরা আর কি চাও?
তাদের নিকট দ্বীন বলতে এসবই বুঝায়। এসব কাজ যখন কোন না কোনভাবে হয়ে যাচ্ছে তাহলে দ্বীন পরিপূর্ণ কার্যকরী হয়েই আছে। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ অসম্পূর্ণ চিন্তাধারার জন্য তাদরে ক্ষমা করে দিন। তাদের দূরদৃষ্টির উজ্জল আলোক বর্তিকা প্রদান করুন। তাদের বক্ষকে সত্যের জন্য উন্মুক্ত করে দিন। আর আমাদের সকলকে সিরাতুল মুস্তাকীমের প্রতি হেদায়াত দান করুন। কবি বলেছেনঃ (আরবী*************)
ভারক বর্ষে মোল্লাদের রয়েছে সিজদার অনুমতি তাই যে নির্বোধ মনে করে ইসলাম রয়েছে মুক্ত-স্বাধীন।
ইমাম হাসানুল বান্না শহীদ তাঁর দাওয়াত কেবলমাত্র জনসাধারণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং ইসলামী জগতের প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিকেই সম্বোধন করেছন। তিনি মিল্লাতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, নিজ নিজ প্রজাসাধারণের ব্যাপারে তাদেরকে জবাবদিহির সস্মুখিন হতে হবে। আজ যদিও তাদেরকে কোন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না। কিন্তু আগামীকাল অবশ্যই আল্লাহর আদালাতে জবাবাদিহি করতে হবে। তিনি শাসনকর্তাগণকে উৎসাহিত ও অনুপ্রণিত করেন যেনস তাঁর প্রজাসাধারণের ওপর বলপূর্বক চাপিয়ে দেয়া অবৈধ বিধিনিষেধ পরিসমাপ্ত করে তাদেরকে প্রকৃত স্বাধীনতার সাথে পরিচিত করে তোলেন এবং বিদেশী সংস্কৃতির মোকাবিলা করার জন্য তাদের অন্ধানুকরণের পরিবর্তে নতুন করে উম্মাতকে ইসলামের ভিত্তিতে পুণর্গঠিত ও শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে ব্রতী হন।
‘নাহওয়ান নূর’ পুস্তিকা
ইমাম তার রচিত পুস্তিকা “নাহওয়ান নূর” (আলোর দিকে)- এর সাহায্যে গোটা ইসলামী বিশ্বকে সন্বোধন করেছেন। এবং তাতে একাধারে ইসলাম, মিল্লাতের সম্মান, বাস্তব ও সামরিক শক্তি জনস্বাস্থ্য জ্ঞান ও চরিত্র জীবিকা ও সাধারণ শৃংখলা সংখ্যালঘুদের অধিকারের নিরাপত্তা এবং বিদেশীদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সার্বিক দিকনির্দেশনা সন্নিবিষ্ট করেন। তিনি পরিষ্কারভাবে এও বিশ্লেষণ করে দেন যে, দ্বীনি আলেমগণ উম্মাতের সদস্য। তারা নিজেরাই দ্বীনের মাপকাঠি নন। এ পুস্তিকা খুবই সংক্ষিপ্ত কিন্তু সর্বব্যাপী। একে নতুনভাবে বিন্যাস করে প্রত্যেক অধ্যায় পৃথকভাবে লিপিবদ্ধ করে প্রতটি মূলনীতির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আরো বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন। দা’য়ীল কাজ হলো বুনিয়াদী উসুল পেশ করা। আর এ পুস্তিকায় সে কাজই করেছেন ইমাম শহীদ। এখন এর ওপর সংশ্লিষ্ট ও উপকারী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সংযুক্ত করা অভিজ্ঞ ওলামা ও বিদগ্ধ সহিত্যিকদের কাজ।
ইমাম হাসানুল বান্নার দ্বিতীয় পুক্তিকা
ইমামের অপর একটি পুস্তিকা ইসলামী মূলনীতির আলোকে আমাদের সমস্যার সমাধান”- এতে তিনি বিশদভাবে বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করেন। কোন কোন সমালোচনা ইমামের উপস্থপিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ওপর প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে, বর্তমান যুগ ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে সম্পুর্ণ ভিন্ন। এর বহু স্বতন্ত্র দাবী ও চাহিদা রয়েছে। তাদের বক্তব্যের সপক্ষে তারা দলিল হিসেবে পেশ করেন যে, দুনিয়ার শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো দ্বীনের ভিত্তিতে তাদের শাসনকার্য পরিচালনা করে না। দ্বীন তো একন পুরনো হয়ে পড়েছে। যে ব্যক্তি ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ এবং উহার শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে কোন আলো লাভ করতে পারেনি। তার নিকট এ দলিল সঠিকরূপে বিবেচিত হতে পারে। এসব লোক মিসর, অন্যান্য আরব ও ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে পড়েছে। এবং মনে করে নিয়েছে যে, দ্বীন আমাদের সমস্যার কোন সুষ্ঠু সমাধান প্রদান করতে পারে না। অথচ বস্তুগত উন্নতির প্রতিযোগিতার আমাদের অন্যান্য জাতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
দ্বীনের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে জীবন যাপন করার ফলাফল এই যে, সমগ্র মানবতা আজ নিশ্চিত ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। দুনিয়ার নেতৃবৃন্দ ও রাজনীতিবিদগণ আজ সকল প্রকার চারিত্রিক, নৈতিক ও ভদ্রোচিত কর্মপদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে পড়েছে। তারা বিশেষত বস্তুগত ও ভোগবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু চিন্তা করে থাকে। সীমিত ব্যক্তিগত ও জাতীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা সকল প্রকার লজ্জাজনক তৎপরতা প্রদর্শন করার জন্য থাকে সদা প্রস্তুত। তাদের আদৌ কোন চিন্ত- ভাবনা নেই যে, তাদের এ পদক্ষেপে সমগ্র পৃথিবী অনল কুন্ডে জ্বলে পুড়ে ছাই ভম্মে পরিণত হবে। একথা নিসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, বর্তমান বিশ্বের দু’পরাশক্তি যদি কখনো সমান্য বস্তুগত সুযোগ সুবিধা হাসিল এবং অন্ধাভাবে শক্তির মহড়া প্রদর্শন করে পুরো বিশ্বের ওপর তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার প্ররিকল্পনা গ্রহণ করে তাহলে দুনিয়ার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দাবানল জ্বলে উঠবে। এসব রাষ্ট্রের কোনটিই সর্বনাশ আনাবক অন্ত্র ব্যবহারে বিরত থাকেবে না। দুশমনদের নিশ্চিত করে দেয়ার জন্য তারা যা করতে সক্ষম তা সবই করে ছাড়বে। তাদের এ অন্ধ ক্ষমতার লাড়ইয়ে সে সব জাতি ধারপৃষ্ঠ থেকে বিলীন হয়ে যাবে যুদ্ধের সাথে যাদের থাকবে না আদৌ কোন সম্পর্ক। আমার আল্লাহই ভাল জানেন, এ যুদ্ধ পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ বসতিকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করবে। বর্তমানে দুনিয়ার প্রথিত যশা চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও পন্ডিতগণেরর নিকট ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আধিক্য ও সে তুলনায় আবাদযোগ্য ভূমির স্বল্পতা বিবেচনা করতঃ জন্মনিয়ন্ত্রণের মহাব্যবস্থাপত্র খুবই ফলপ্রসু বলে মনে হচ্ছে কিন্তু যুদ্ধ কালীন সময়ে কি খাদ্য ও বাসস্থানের সমস্যা আপনা আপনিই সমাধান হয়ে যাবে? না থাকবে বাঁশী আর না বাজবে বাঁশরী। সম্ভবত এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অংশ বেঁচে যাবে এবং ইতিহাস তার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পৃথিবী আরো একবার পুনরায় ঐ স্থানে গিয়ে পৌঁছবে যেখান থেকে তার অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল। নগদ অর্থের বিনিময় গণ্য সামগ্রী ক্রয় করার পরিবর্তে হতে পারে যে, জিনিসগত্রের পারস্পরিক বিনিময় প্রথা চালু হয়ে যাবে। যা হোক এ যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া থেকে ভূ-পৃষ্ঠের কোন এলাকাই সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ থাকতে পারবে না। সমুদ্র ও স্থলভাগ ছাড়াও মহাশূন্য সে অগ্নিশিখার অসহায় শিকারে পরিণত হবে। এর পুরো জ্ঞান শুধু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকটই রয়েছে। মানুষ কেবল অনুমানই করতে পারে। আগামী কাল কি হবে এবং মানুষ কি উপার্জন করতে পারবে। এগুলো আল্লাহর গায়েবী ভান্ডারে চাবিকাঠিল অন্তর্ভুক্ত। আর এটা নিরংকুশভাবে তারই কর্তৃত্বাধনি। তথাপি বস্তুবাদী এবং দ্বীন বিমুখতা মানবতাকে আজ যে স্তরে উপনিত করেছে সে সম্পর্কে সুষ্ঠু বিবেক-বুদ্ধির অধিকারী কোন ব্যক্তি অনবহিত নন।
আখওয়ানের দৃষ্টিতে সমাধান
ইখওয়ানুল মুসলিমুন কখনো সমালোচনার জন্য সমালোচনা করেনি। বরং তারা অবস্থার সংশোধনের জন্য রোগ চিহ্নিত করে তার যথোপযুক্ত প্রতিকারের প্রস্তাবও করে থাকে। তবে সমস্যা হলো ইখওয়ানের কোন সুপারিশই ক্ষমতাসীন মহল সুস্থ মস্তিকে কখনো মূল্যায়ন করেনি। অথচ তারা সমস্যা নির্ণয় ও তার সমাধানের জন্য সমগ্র পৃথিবীর মাটি চষে ফিরেন। বড় বড় কনফারেন্সর আয়োজন করা হয়। চমকপ্রদ বক্তৃতা বিবৃতি প্রদান করা হয়। প্রস্তাববলী পাশ হয় এবং সুপারিশমালা গৃহীত হয় কিন্তু ফলাফল সেই ঢাক ঢোলের নীচেই চাপা পড়ে যায়। বিশ্ব রাজনীতির কলকাঠি যাদের করায়ত্ব সেই ক্ষমতাধরগণ আমদেরকে নেশা পান করিয়ে শুইয়ে রাখতে চায়। আমাদেরকে আত্মসংযোম অনুশীলনের উপদেশ ভিক্ষে দিয়ে থাকে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও অবরোকন করার জন্য বিশেষজ্ঞ প্রেরণ করা হয়। লম্বা চওড়া প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। বিংশ শতাদ্বির সূচনা লগ্ন থেকেই বিড়াল ইদুরের এ খেলা চলছে। কিন্তু তাতে আমাদের কি লাভ হয়েছে? আর এ অবস্থা কতদিন পর্যন্ত আমাদের ওপর চেপে থাকবে। কোন ভবিষ্যত বক্ত এবং রাজনীতিবিশারদও এ প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারে না। ইখওয়ানের পক্ষ থেকে দু’টো আপত্তিকর শদ্বে এর সমাধান শুনে নিন। এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা এবং আপন স্বরূপ উপলব্ধি করা তথা আত্মপরিচয় লাভ করা।
ইসলামী বিশ্ব বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত সকল প্রকার মুল্যবান সম্পদের প্রাচুর্য দিয়েছেন। উত্তম উর্বর চাষাবাদযোগ্য ভুমি, খনিজ সম্পদের সীমাহীন ভান্ডার- লবণ থেকে আরম্ভ করে সোনা পর্যন্ত সব জিনিস এখানে মজুদ রয়েছে। স্বর্ণও এক প্রকারের নয় বরং সাদা সোনা (প্লাটিনাম), হলুদ সোনা (গোল্ড) এবং কালো সোনা (পেট্রোলিয়াম)। মোটকথা সকল সম্ভার এখানে পাওয়া যায়। কোন বস্তুগত জিনিসের ঘাটতি বা অভাব এখানে নেই। কেবলমাত্র আল্লাহ থেকে দূরত্ব এবং আত্মনির্ভরতার অভাব রয়েছে। এ কারণেই আমাদের প্রভাব ক্ষুন্ন হয়েছে।
যে প্রতিকারের বিষয়ে আমি ওপরে উল্লেখ করলাম তার শুভ সূচনা করতে পারে মুসলিম শাসকগণই। শাসকগোষ্ঠী যদি সাহসের সাথে কোমর বেঁধে প্রস্তুত হয় তাহলে আল্লাহ সাক্ষী রয়েছেন যে, উম্মতে মুসলিম আজকের এ অধপতিত সময়েও সকল চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে সক্ষম। জনসাধারণ তাদের পেটে পাথর বাঁধতে প্রস্তুত রয়েছে। কেবল শর্ত হচ্ছে, তাদের পরিচালনা সঠিক এবং ইসলামী পদ্ধতিতে করতে হবে। শাসকগণ ও জনসাধারণ মিলে একই মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে এবং সীসা ঢালা প্রাচীরের মত ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাথা তুলে দাঁড়ালে সমগ্র সৃথিবী তার সব ক্ষমতা সত্তেও তাদের সম্মুখে মাথা নত করে দেবে। নৈরাজ্য প্রচারকারীরা পুনরায় তাদেরই চর্মরক্ষু দিয়ে দেখবে আমরা কি ভাবে ইজ্জত ও সন্মান লাভ করে থাকি। একবার এ ব্যবস্থাপত্র পরীক্ষা করে দেখুন না।
জাতিসমূহের উত্থান-পতনের রহস্য
কোন জাতিকে তার শত্রুর অস্ত্র ততটুকু ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না যতটুকু পারে আভ্যন্তরীন দুর্বলতা, অবসাদ ও ভীরুতা। আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং অপমানে সন্তুষ্ট থাকার ব্যাধিতে জাতিসমূহ ধ্বংস হয়ে থাকে। অপমান ও লাঞ্ছনার সাথে পাওয়া যায় এমন জীবিকা শুধু কোন নিষ্প্রাণ জাতির লোকদের জন্য শোভনীয় হতে পারে। কোন জীবন্ত জাতি এমন জীবনের ওপর মত্যকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ধিক! শত ধিক!! আজ আমাদের জীবনের কতইনা অধপতন ঘটেছে। আমরা সর্বদা কেবলই বলে বেড়াই “আমার পূর্বপুরুষগণ রাজা-বাদশা ছিলেন।” কিন্তু আমরা নিজেরা কি। শুধু অবিশ্বসীদের সমারোহ। কবির ভাষায়ঃ (আরবী*************)
প্রকৃত মানুষ তো সেই যে বলতে পারে আম অমুক। কিন্তু সে প্রকৃতপক্ষে কোন সম্মানিত ব্যক্তি নয়। যে বলে আমার পিতা ছিলেন অমুক।
সৌভাগ্যের দিন
সৌভাগ্যের সেই দিনটির জন্য প্রতিক্ষার প্রহর গুণছে হৃদয়বান ও দিব্য দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ। যেদিন আমাদের হৃত মর্য়াদা পুনর্বহাল হবে, যেদিন আমরা আবার আমাদের ফেলে আসা অতীতের সাথে সোনালী ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন রচনা করতে পারবো। সে রক্তিম সুর্য উদিত হবে করে? মুসলিম উম্মাহর শাসকগোষ্ঠী যেদিন নিজেরা নিজেদেরকে আল্লাহর সুম্মুখে, তাদের বিবেকের নিকট এবং উম্মাতে মুসলিমার নিকট জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে বলে মনে করবে সেটিই সেই সৌভাগ্যের দিন। সেদিনই প্রতিভাত হবে উম্মতের সারিতে প্রকৃত ঐক্যের বহু প্রত্যাশার ফসল। সেদিনই জনগণ তাদেরর শাসনকর্তাগণের ওপর আস্থাশীল হয়ে উঠবে আবার শাসকগণও সকল প্রজাসাধারণের অন্তরে কর্তৃত্ব করতে পারবে। শাসকগণ তখনই জনগণর দৃষ্টিতে সম্মনের পাত্র বলে বিবেচিত হবেন যখন তারা জনসাধারনের আশা-আকাংখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন। একথা কখনো ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে, জনগণের মতামত শোনা ও তার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রর্দশন করাকে ইসলামম প্রত্যেক দায়িত্বশীল ও ক্ষমতাবান ব্যক্তির দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ কারণেই ইসলাম নির্বাচনে পার্লামেন্ট এবং প্রতিনিধিত্রে নীতির বিরোধিতা করে না। কারণ এভাবে ন্যায় ও ইনসাফ সহকারে মানুষ তাদের মত প্রকাশের সুযোগ লাভ করতে পারে।
মুসলিম উম্মাহর সার্বিক ঐক্যের মূল উৎস
আমাদের বিশ্বাস ইসলামী উম্মাহর ঐক্যের উৎস হচ্ছে ইসলামী খিলাফতের পুনঃ প্রতিষ্ঠা। এখন প্রশ্ন হলো, এ প্রশ্ন যে খেলাফত ব্যবস্থা কায়েম হয় কি ভাবে এর জবাব খুবই সংক্ষিপ্ত ও সহজ। আহ! আমাদের শাসকগণ যদি এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির প্রতি মনোনিবেশ করতো। উম্মাতের ঐক্য, শাক্তি ও পারস্পরিক সম্পর্ককে মজবুত ভিত্তির ওপর গড়ে তোলার জন্য খেলাফত ব্যবস্থাই একমাত্র মাধ্যম। এ খেলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে শাসকগোষ্ঠীকে কিছুই খোয়াতে হবে না। বরং সর্বপ্রথম সেীভাগ্য ও কৃতিত্ব পড়বে তাদের ভাগেই। নিজেদের জীবনের ব্যাপারে আজ তাদেরকে প্রতি মুর্হুতে আতম্কিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকতে হয়। কিন্তু খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রকৃত প্রশান্তি ও নিরাপত্তার দৌলত তারাই লাভ করবে।
রাজনৈতিক দলসমূহ ও ইখওয়ানুল মুসলিমুন
বিভিন্ন রাজনৈকিত দল থাকার ব্যাপারেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। যে ব্যাপারে আমাদের আপত্তি তা হচ্ছে বর্তমান রাজনৈতিক পদ্ধতি। এ রাজনৈতিক পদ্ধতির মূলনীতি সত্যের সহযোগিতা কিংবা সততার পতাকা উড্ডীন করা হয়। বরং নিজের পার্টির প্রতি পক্ষপাত্ব এবং তার বিশেষ স্বার্থ ও চন্তা-চেতনার পৃষ্ঠপোষকতা করা। দলের অবস্থান ও ভূমিকা সঠিক হোক কিংবা বেঠিক সে সম্পর্কে কোন প্রকার মূল্যায়নের প্রয়োজন বোধ হয় না। ফলে এভাবে একদিকে যেমন সত্য ও সততাকে আহত করা হয় অপরদিকে তেমনি উম্মাতের ব্যক্তি ও সম্প্রদায়েল মধ্যে কোন কারণ ছাড়াই বিভেদ সৃষ্টি হয়।
আমরা কখনো এমন ইচ্ছা পোষণ করি না যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হোক। আমাদের ইতিহাস সাক্ষী যে যখনই কোন রাজনৈতিক দল কিংবা গোষ্ঠী অবস্থর সংস্কারের কর্মসূচী দিয়ে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে তখনই আমরা তাদেরকে সহযোগিতা করেছি। তরাপর যখন তাদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব গ্রহণের পর মাসের পর মাস অতিবাহিত হয়েছে এবং কোন ওয়াদা পূরণ হতে দেখা যায়নি। তখন আমরা প্রথমে তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। তারপরওে কোন ফল না হলে সমালোচনা করেছি। আমি মনে করি প্রত্যেক নাগরিকের এ অধিকারও রয়েছে যে, সে ভ্রান্ত পদক্ষেপের জন্য সরকারকে সর্তক এবং সমালোচনা করবে আর এটা তার কর্তব্যও। যদি নাগরিককে এ অধিকার না দেয়া হয় তাহলে সরকার অপরাধী বলে পরিগণিত হবে আর যদি নাগরিক এ দায়িত্ব পালন না করে তবে সে জবাবদিহির সম্মুখীন হবে।
বিশ্বজনীন ইসলামী আন্দোলন
ইখওয়ানুল মুসলিমুনকে আপনারা কি মনে করেন? এটা এমন একটা সংগঠন সমস্ত ইসলামী দেশে যার রয়েছে রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং উল্লেখযোগ্য প্রভাব। এটা শুধু মিসরীয় দল নয়। বরং যদি আরো গভীরে প্রবেশ করে লক্ষ্য করা যায় তাহলে আমি অকুন্ঠচিত্তে বলতে পারি যে, মিসরের মকল রাজনৈতিক দলের কর্মতৎপতা মিসরীয় ভৌগোলিক এলাকাতেই সীমাবদ্ধ, মিসরের বাইরে তাদের কোন অস্তত্ব এবং নাম নিশানা নেই। কিন্তু ইখওয়ানুল মুসলিমুনের শুধু ইসলামী দেশসমূহের নয় বরং অইসলামী দেশেও তাদের সুসংগঠিত শাখা রয়েছে। আমরা বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের প্রবক্তা। ভৌগলিক কোন সীমারেখা আমাদের পতিরোধ করতে পারে না। এর অর্থ হলো, আমরা গোটা ইসলামী বিশ্ব এবং উম্মাতে মুহাম্মাদী (সা) এর বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতির বাণী বাহক।
মিসরীয় যুবসমাজ ও ইখওয়ানুল মুসলিমুন
মিসরুল ফাতাত বা মিসরীয় যুব সংগঠন আমাদের সাথে যে আচরণ নীতি গ্রহণ করেছিল আমরা কিন্তু তাদের সাথে সেরূপ কোন আচরণ করিনি। আমরা সকলের সাথে সর্বদা ভাল ব্যবহারই করে এসেছি। আমাদের অন্তরে এ সংগঠনের কতিপয় উর্ধতন ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বের জন্য সম্মান ও ভালবাসা ছিল। যেমন আহমদ হোসাইন মরহুম, উস্তাদ ইবরাহীম শুকরী, উস্তাদ ফাতহী বিদওয়ান প্রমুখ এবং তাদের ন্যায় অন্যান্য ব্যক্তিগণকে আমরা সর্বদা যথোপযুক্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতাম। মিসরীয় যুবসমাজ ইখওয়ানের মাঝে কথাবার্তা এবং মত বিনিময়ও হতো, ইমাম হাসানুল বান্না শহীদ এবং আহমদ হোসাইন মরহুমের পরস্পরের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। আমরা এই সযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছে যে, আমিও তাদের দু’জনের মধ্যে কয়েকবার পয়গাম পৌছানোর দায়িত্ব পালন করেছি। যদি উভয় সংগঠনের মধ্যে ঐক্য হয়ে যেতো এবং ঐক্যবদ্ধভাবে যুগপৎ কর্মসূচী গ্রহণ করা সম্ভব হতো তাহলে মিসরের ইতিহাস ভিন্নভাবে রচিত হতো। কিন্তু যে গোপন হাত এবং নিষ্ক্রিয় বসে থাকতো না। তাদের গোপন চক্রান্ত সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতি দেয়নি। যা ছিল আমাদের দীর্ঘ লালিত প্রত্যাশা।
নিশ্চয়ই তোমাদের এ উম্মাত একই উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত উম্মাতের অন্তর্ভু্ক্ত
বিশ্ব রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ব্যাপারেও আমাদের দৃষ্টিভংগী অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এ মনোভাবের মূল ভিত্তি হচ্ছে আমাদের এই আকীদা ও বিশ্বাস যে, ইসলামী জাহান এবং সমস্ত ইসলামী রাষ্ট্রগুলো একই উম্মতে এবং একটা দেহ রূপে পরিগণিত। কোন ইসলামী রাষ্ট্রের ওপর অন্য কারো আক্রমণ সরাসরি আমাদেরই ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচিত হবে। এমন আক্রমণের মোকাবিলা করা এবং দুশমনকে প্রতিহত করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। এর প্রতি আমরা মিসর এবং অন্যান্য ইসলামী রাষ্ট্রের মর্যাদা ও স্বাধীনতার সহায়ক হবে। আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাত যদি মিলেই যায় তাহলে তা হবে আমাদের কামনা-বাসনার হুবহু রূপায়ন। এমন শাহাদাতে আমাদের এবং সমগ্র মিল্লাতে ইসলামীয়ার ইজ্জত শক্তি সাহস ও উদ্যেম আরো প্রাণ চঞ্চল্য ও গতির সঞ্চার হবে। এ রাস্তায় জান-মাল পরিবার-পরিজন এবং সন্তান-সন্তুতি এমনকি সময় ও স্বাস্থ্য কোন জিনিসই অকাতরে ব্যয় করতে আমরা কার্পণ্য করি না। এসব কিছুই তো আল্লাহরই দান। যদি আমাদের সব কিছুই আল্লাহর রাস্তায় কুরবান হয়ে যায় তবুও আমরা এটাই বলবো, “সত্য বলতে কি যতটুকু করা কর্তব্য ছিল তা করা সম্ভব হয়নি”
আমাদের দাওয়াত পূর্ববর্তীদের দাওয়াতেরই নতুন সংস্কারণ
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াত ত্যাগ তিতিক্ষা ও কুরবানীর দাওয়াত। আমি বুঝতে পারি না যে, আমরা কোন নতুন দাওয়াতের আবিষ্কার করে নিয়েছি কি না। এটা শুধু আমাদের পূর্ণাত্মা অগ্রজদেন কর্মপদ্ধতিরই পুনরুজ্জীবন মাত্র। সালফে সালেহীনগণের ইতিহাসের প্রতি লক্ষ্য করলে সহজেই আপনার নিকট এ বাস্তবতা প্রতীয়মান হয়ে উঠবে যে, তাঁর দুনিয়ার সুযোগ সুবিধার কোন পরোয়া করতেন না। বাহ্যিক জাঁকজমকের প্রতি তাদের ছিল এক প্রকার ঘৃণা বোধ। আল্লাহ তায়ালার সাথে আত্মিক সম্পর্ক মজবুত করার ধ্যন তাদের মন-মগজে সদা জাগরুক থাকতো। সাথে সাথে আল্লাহর সেই শার্দুলগণ কালেমায়ে হকের বিজয় ও প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বদা মাথায় কাফন বেঁধে রাখতেন। ইতিহাসের পাতা আজও তাদের কৃতিত্ব উজ্জল দীপ্তিমান। তাদের বীরত্ব ও কুরবানী, তাদের উন্মুক্ত তরবারীর চমক, রণক্ষেত্রে তাদের বীরত্বের কাহিনী ইতিহাসের গৌরব বৃদ্ধি করছে। আমরাও সেই মহাপ্রাণ পূর্ববর্তীদের পদাম্ক অনুসরণ করে চলার ইস্পাত কঠিন শপথ করেছি।
শত্রুর সাক্ষ্য
আমরা নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পেরেছি যে, ইসরাঈলী প্রতিরক্ষা মন্ত্রী (আনজাহানী) মুশেদায়ান তার মন্ত্রীত্বের আমলে মন্ত্রব্য করেছিলেন যে তারা সমস্ত ইসলামী রাষ্ট্রের সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখেন কিন্তু নগণ্য সংখ্যক ইখওয়ানী বাহিনীর মোকাবিলা করার সাধ্য তার সেনাবাহিনীর নেই। তার বক্তব্য ছিল এইযে, ইখয়ানের প্রতিটি সদস্য গুলীর সামনে বুক পেতে দেয়। তারা কখনো পৃষ্ঠ প্রর্দশন করে না।
আর আমি নিজেও এ সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আমাদের ইখওয়ানী ভাইদের মধ্য থেকে যতজনই কোন ময়দানে শাহাদাত বরণ করেছেন তাদের প্রত্যেকেরই বুকে আঘাত লেগেছিল। কারোরই পিঠে গুলী লাগেনী।
সংগঠনের ঘোষণাপত্রের আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে। অনুরূপভাবে পার্লামেন্টের সকল সদস্য, মন্ত্রীবর্গ এবং দেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সকলেই অংগীকার করে যে, তারা গঠনতন্ত্রের আনুগত্য, তার সুষ্ঠু সংরক্ষণ করবে এবং বাস্তবায়িত করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা অব্যহত রাখবে। এ স্বীকৃত মূলনীতিকেও ইখওয়ান সম্পর্কে সন্দেহ সংশয়ের উপলক্ষ বানিয়ে নেয়া হয়েছে। ইখওয়ান যখন তার সাংগঠনিক নীতিমালা প্রণয়ন করে এবং কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে জীবনকে ঢেলে সাজাবার অংগীকার ব্যক্ত করে তখন প্রলয় কান্ড বাধিয়ে দেয়া হয়। সকল দিক থেকে আমাদের ওপর তীর বর্ষিত হতে থাকে। অভিযোগ ও অপবাদের মহা অভিযান চালানো হয়। স্বার্থপর লোকেরা জনসাধারণকে সর্তক করতে গিয়ে বলতে থাকে- দেখো এরা বাইয়াত গ্রহণ করছে? এ বাইয়াত কি উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হচ্ছে? ইত্যাদি ইত্যাদি। “বাইয়াত” শব্দটির এমন সব ব্যাখ্যা মানুষের সম্মুখে পেশ করা হয় যাতে পরিবেশ বিশৃংখলা এবং মনে ভয়-ভীতি ও নৈরাশ্য সৃষ্টি হয়।
বাইয়াতের তাৎপর্য
বাইয়াতের অর্থ ঠিক তাই যেমন কেউ কারো অর্পিত কোন গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করতে গিয়ে শপথ করে তার বিশ্বস্ততার নিশ্চয়তা প্রদান করে থাকে। আমরা মুর্শিদের হাতে বাইয়াত মর্শিদের জন্য নয় বরং আল্লাহর সন্তুটি অর্জনের জন্য করে থাকি। আমাদের বাইয়াত হয়ে থাকে আল্লাহর সাথে। আমাদের বাইয়াত হয়ে থাকে এ শর্তে যে, মুর্শিদের নির্দেশ তখন অনুসরণ যোগ্য হবে যখন তা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা)- এর আহকাম মোতাবেক হবে। আল্লাহর নাফরমানী মূলক কোন হুকুম অনুসরণ যোগ্য নয়। জনসাধারণেকে প্রকৃত ব্যাপার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত করার জন্য ইমাম শহীদ এ বাইয়াতের বৈশিষ্ট এবং শর্তাবলীও বর্ণনা করেছিলেন। সেগুলো একবার দেখলে প্রত্যেক ব্যক্তিই বুঝতে পারবেনা যে, এগুলোর একটিও এমন নয় যা দ্বারা কোন ব্যক্তির ক্ষতি করা অথবা তার বিরুদ্ধে সীমালংঘন কিংবা অত্যাচার করা উদ্দেশ্য হতে পারে। কিন্তু দুষ্কর্মশীলদের কথা আর কি বলা যায়? তাদের না আছে আল্লাহর ভয় না আছে সৃষ্টির সামনে লাজ শরমের কোন বালাই। আমাদের বাইয়াত নিন্ম বর্ণিত শর্তাবলীর আলোকে হয়ে থাকে।
১- মূল বিষয়ের উপলব্ধি এবং দ্বীনের সঠিক ধারণা লাভ।
২- নিয়াতের পবিত্রতা।
৩- আমলে সালেহ।
৪- জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ।
৫- ত্যাগ ও কুরবানীর অনুপ্রেরণা।
৬- মা’রুফ কাজে আনুগত্য।
৭- অবিচল দৃঢ়তা।
৮- আন্দোলনের জন্য পরিপূর্ণ একাগ্রতা ও নিষ্ঠা।
৯- ইসলামী ভ্রাতৃত্ব বোধ।
১০- পারস্পরিক নির্ভরশীলতা।
সংস্কারের পর্যয়সমূহ
উপরোক্ত বিষয়গুলোর পুরোপুরি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও পেশ করা হয়ে থাকে এবং তার বাস্তব প্রয়োগ সুস্পষ্টভাবে ইখওয়ানের মন-মস্তিষ্কে বদ্ধমূল করে দেয়ার কাজও চলতে থাকে। আল্লাহর দায় ও অনুগ্রহে ইখওয়ান তার উদ্দেশ্য সিদ্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ সফলতা ও কৃতিত্ব অর্জন করে। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ব্যক্তিগত সংশোদানের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অতপর পরিবারের সকল সদস্যদের সংশোধন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে একটি পরিবারের নৈতিক ভিত্তি, আত্মিক সম্পর্ক, দ্বীনি নীতিমালা, পারস্পরিক পরিচিতি ও ভালবাসার সম্পর্কে উজ্জীবিত হয়ে একটা বৃহৎ পরিবারের রূপ পরিগ্রহ করে। এভাবে একটা অত্যন্ত শান্তিময় সমাজ গঠনের বৃহৎ অব্যাহত থাকে। কিন্তু পরিস্থিতির প্রতিকূলতার প্রতি লক্ষ্য করুন যে, কিভাবে আইন শৃংখলা রক্ষাকারীদের দৃষ্টিতে ইখওয়ানের এই কর্মপদ্ধতি জন নিরাপত্তা ও আইনের জন্য খুবই বিপজ্জনক। আল্লাহ তাদের হিদায়াত করুন। আমরা প্রাণ ভরে দোয়া করছি যেন এমন পরিবার ব্যবস্থা ও ব্যক্তিগত প্রশিক্ষণের সৌভাগ্য যেন সকল দলের নসীবে জোটে। যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি তার ঈমান প্রবৃদ্ধিকর ফল তার নিজ চক্ষে দেখতে পায়। এ শিক্ষার ফলে কল্যাণকর কাজে যুবকদের পারস্পরিক সহযোগিতা প্রেরণা সৃষ্টি হয এবং তারা দেশের খেদমতের জন্য কর্মতৎপর হয়ে ওঠে।
জিহাদের সংজ্ঞা
মুহ্তারাম মুর্শিদ কিতাব ও সুন্নাতের আলোকে জিহাদ বিষয়ের ওপর বিস্তারিত দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি বলেছেন যে, মুসলিম ঈমান ও আকীদার হেফাজত করাই জিহাদের উদ্দেশ্য। কারো আভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা কিংবা উপনিবেশবাদ বা দাসত্বের শৃংখলে কাউকে বন্দী করা মোটিই জিহাদের উদ্দেশ্য নয়।
অনুকুল ও প্রতিকূল সর্বাবস্থায় লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ- ই উদ্দেশ্য
আমার মনে হয় উপরোল্লিখিত বর্ণনায় আমি ইখওয়ান সম্পর্কে প্রকৃত অবস্থার সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি। আল্লাহর নিকট দোয়া করছি যেন আমার পেশকৃত সংক্ষিপ্ত বর্ণনা সকল দুর্বলতা মুক্ত থাকে। এ স্মৃতিকথার বিষয়বস্তু যদিও ইখওয়ানের দাওয়াত নয় তথাপি একথা সুস্পষ্ট যে আমি আমার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ দাওয়াতে সম্পর্কে উদাসীনও থাকতে পারি না। এ দাওয়াতই আমার বর্তমান ব্যক্তিত্ব পঠন করেছে। তা ছাড়া আমার স্মৃতিকথাগুলো পাঠকগণকে চমকপ্রদ কাহিনী শুনানো কিংবা শুধু সময় কাটানোর জন্য লেখা যোগান দেয়ার লক্ষ্যে রচিত নয়। আমি আমার সাধ্যমত ইখওয়ানের দাওয়াত সকল সম্ভাব্য উপায়ে মানুষের নিকট পৌঁছে দিতে চাই। সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় কথা হচ্ছে, মানুষ যেন সত্যকে জানতে পারে। আর এ জন্যই আপনার দেখতে পাচ্ছেন যে, আমার বর্ণনাভংগী আলাদা এবং স্বকীয় বৈশিষ্ট মন্ডিত। রূপকথার ন্যায় কাহিনী বর্ণনা না করে আমি শুধুমাত্র দাওয়াতী কাজের সহায়ক কথাবার্তা বর্ণনা করছি। আমি তো নিছক কোন গল্পকার বা কাহিনীকার নই।
ইতিহাস ও ইতিহাস সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্বসমূহ
সমাজ বিজ্ঞানীদের সধ্যে এ বিষয়ে সতানৈক্য রয়েছে যে, ইতিহাস-ই বড় বড় ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়ে থাকে না বড় বড় ব্যক্তিত্বই ইতিহাস সৃষ্টি করে? অন্যভাবে বলা যায় ঘটনাবলীর সাহায্যে বড় বড় ব্যক্তিগণ তাদের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত করে না বড় বড় ব্যক্তিত্বই ঘটনার জন্ম দেন? আমার মতে কোন একটি মতকে নিশ্চিতরূপে গ্রহণ করে অপর মতটিকে চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে না। কখনো প্রথম মতটি সত্য হয়ে থাকে আবার কখনো বা শোষোক্তো মতটি সত্যরূপে প্রতিভাত হয়ে ওটে। এক্ষেত্রে নবী-রাসূলগণ নিসন্দেহে ব্যতিক্রম। কেননা তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী ও রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়ে থাকেন। তাঁদের মর্যাদা ও পদবী জন্মাগত অর্জিত নয়।
অনেক সময় পরিবেশ ও ব্যক্তিত্ব পরস্পর অবিচ্ছেদ্য হয়ে থাকে। বর্তমান শতাব্দীর শুরু ও মাঝামাঝি সময়ে মুসলিম মিল্লাত যে অসহায় অবস্থার শিকার ছিল যদি এরূপ অবস্থা না হতো তাহলে হয়তো ইমাম হাসানুল বান্না এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও দাওয়াতের সূচনা করতেন না। আর তা না করলে বর্তমন বিশ্বব্যাপী জাগরণ ও রেনেসাঁ সৃষ্টি হতে পারতো না। এভাবে মনে হয়, পরিবেশ ও সময়ের প্রবাহে ব্যক্তিত্ব জন্ম লাভ করে এবং প্রবল পরাক্রান্ত দুঃসাহসী ব্যক্তিত্ব ইতিহাসের ধারা পরিবর্তন করে দেয়। চলতি শতকের প্রারম্ভে মুসলিম জাতি অবণতি ও অধপতনের যে গভীর পম্কে নিমজ্জিত হয়েছিল তার দাবীই ছিল এ অসহায় অবস্থার আশু পরিবর্তন। তাই আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাক্রমে এ পরিবর্তনের শুভ সূচনা হয় হাসানুল বান্নার হাতে। হাসানুল বান্না সবরকম চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে একই কাজে আত্মনিয়োগ করেন যাতে মুসলিম সমাজের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেয়া যায়। তিনি ছিলেন একজন সূক্ষ্ম মর্যাদাবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি। তাই অপমান ও হীনতা মেনে নিতে পারেননি।
ফুৎকারে এ প্রদীপ নির্বাপিত করা যাবে না।
হাসানুল বান্না যখন কালের প্রতিধারা পরিবর্তন করে দেয়ার জন্য প্রবল তুফানের সম্মুখে দাঁড়িয়ে যান তখন ইসলাম বিদ্বেষী সকল শক্তিই তার প্রতিপক্ষের সাথে সমবেত হয়। যারা মনে করতো যে, ইসলাম ও মুসলমান মৃত ঘোড়ার মত। তাঁরা ইমামের সংস্কার ও পুনর্জাগরণের সংকল্প সম্পর্কে উপহাস করতে থাকে। এবং বিরোধিতা ও শত্রুতার সব রকম প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। যখন সত্যের এ বীর সেনানী সম্পূর্ণ একাকী সত্যের শ্লোগান উচ্চারণ করেন তখন কে বিশ্বাস করতে পেরেছিল যে, নীল আকাশের নীচে মুসলিমগণ পুনরায় তাদের হৃত গৌরব ও শৌর্য বীর্য ফিরে পারে? কে তখন মেনে নিতে পেরেছিল যে, এ অসহায় পথিকের করুণ আর্তনাদ অভিযাত্রীদলের সৃষ্টি করবে এবং যুব সমাজ প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে দলে দলে শামিল হয়ে মানযিল অভিমুখে এগিয়ে যেতে থাকবে। ইহুদী শকুনরা সেই সময় এই বাজ পাখিকে “হাসানুল আ’মা” (অন্ধ হাসান) বলে অভিহিত করেছিল। কিন্তু তিনি কবির উক্তি বার বার আবৃত্তি করে নিজের মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেনঃ (আরবী **************)
ফারাজদাকের খামখেয়ালী মনোভাব রয়েছে যে, সে মারবা’কে হত্যা করবে। হে মারবা’ তোমার জন্য সুসংবাদ যে, তোমার সমান্য ক্ষতিও হবে না।
ভুপৃষ্ঠে আমাদের স্থয়িত্ব প্রতিষ্ঠিত
আল্লাহ তায়লার ইচ্ছা ছিল, হাসানুল বান্না শ্রেষ্ঠত্বের আলোকস্তম্ভ বলে প্রমাণিত হবে। জীবদ্দশায়ও এবং মৃত্যুর পরও। দাওয়াতে ইসলামী আজ বিশাল ইউনিভারসিটির মর্যাদা লাভ করেছে। যে ব্যক্তিই ইসলাম ও মুসলিদের কল্যাণ করে তার জন্যই পত্র পল্লবে সুশোভিত এই বৃক্ষ (ইসলামী আন্দোলন) প্রশান্তি ও শান্তনাদায়ক। সা’দ জগলুল পাশার কৃতিত্ব মিসরের স্বাধীনতা লাভের সাথে সাথেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো। রয়ে গেছে শুধু কাহিনী ও কিছু সুন্দর স্মৃতি। ট্রাকলগার বিজয়ের সংগে সংগে নেলশন তার পরিণতি লাভ করেছে। পেছনে পড়ে আছে বীরত্বের নানা উপাখ্যান। ক্রামাভিল, নেপেলিয়ার বোনাপর্ট ও কায়জার প্রমুখ স্বনাম ধন্য ব্যক্তিগণ তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সমাপনান্তে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন এবং নিজেদের কীর্তিগাথা সাথে করেই নিয়ে গেছেন। কিন্তু হাসানুল বান্না এ ক্ষেত্রে ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। অস্থায়ী দুনিয়া থেকে চিরস্থায়ী আত্মার জগতে তিনিও প্রস্থান করেছেন সত্য কিন্তু পেছনে রেখে গেছেন অনেক কিছু। তাঁর বিদায়ের পর শুধু তাঁর স্মৃতিই রয়ে যায়নি বরং তার দাওয়াতী তৎপরতা তার স্থালাভিষিক্ত হয়েছে। যতদিন এ পৃথিবী টিকে থাকবে ততদিনেই তার এ সাদকায়ে জারীয়া বর্তমান থাকবে। তিনি কোন সীমাবদ্ধ জাতীয় স্বার্থ কিংবা দেশের স্বার্থ লাভ করাকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেননি। তার মিশন ছিল সমগ্র মানবতা এবং সারা জাহানের জন্য। তিনি তার মালিক ও মনীব, নেতা ও পথপ্রদর্শক প্রিয় নবী রাসূলে করীম (সা) এর অনুসরণ করেছিলেন। ইমাম খতমে নবুয়াতের সে পয়গামই মানুষের সমনে পেশ করেন যা সর্বশেষ নবী (সা) উম্মতের নিকট আমানত স্বরূপ রেখে গেছেন। রাসূলুল্লাহর পয়গাম ছিল বিশ্বজনীন। তিনি সকল মানুষকে লক্ষ্য করে বলেছিলেনঃ
“হে সমগ্র দুনিয়ার মানুষ! আমি নির্বিশেষে তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।”
হত্যার চক্রন্ত
হাসানুল বান্না তাঁর মালিক ও মনীবের আনুগত্য করার জন্যই মানবতাকে সম্বোধন করেন। তিনি কখনো এমন কথা বলেননি’ “হে আরব জাতি কিংবা হে মুসলিম জাহানের অধিবাসীগণ! বরং তিনি বলতেন, “হে আদম সন্তানগণ!” হাসানুল বান্না যখন আসন্ন বিপদের ঘনঘটা উম্মতের মাথার ওপর ঘনীভুত হয়ে আসতে দেখেন তখন তিনি মন্ত্রী প্রবরগণের সাথে তাদের অফিসে ও বাসভবনে দেখা করতে শুরু করেন কিন্তু মন্ত্রী বাহাদুরগণ তাঁর সংগে মিলিত হতে গড়িমসি করতেন। তাঁর বিপদের মোকাবিলা করার পরিবর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে, হাসানুল বান্নারই দফা রফা করতে হবে। হাসানুল বান্নাও তাদের দুরভিসন্ধির কথা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যখন ইখওয়ানীদের ধরপাকড় শুরু হয় এবং তাদের দ্বারা দেশের সমস্ত জেলখানা ভর্তি করা হয় তখন হাসানুল বান্না সরকারের কাছে তাঁর গ্রেফতারীর দাবী করেন। কিন্তু সরকার তাঁর অনুসারীদের পায়ে শৃংখল পরিয়ে দিয়ে তাকে হত্যা করার নীলনকশা পাকাপোক্ত করেছিল। মিসরে প্রায়শঃই এরূপ হতো যে, কখনো এক অথবা কতিপয় যুবক মিলে কোন মন্ত্রীকে হত্যা করতো। কিন্তু এটা হতো তাদের ব্যক্তিগত ফায়সালার ভিত্তিতে। কারণ ইখওয়ান সাংগঠনিকভাবে কখনো এ ধরনের কাজের অনুমিতি দেয়নি। কিংবা উৎসাহিতও করেনি। হাসানুল বান্নার হত্যার পরিকল্পনা কোন এক ব্যক্তি কিংবা মন্ত্রীর ছিল না বরং মিসরের গোটা প্রশাসন যন্ত্রই এ কাজের সাথে জড়িত ছিল।
হাসানুল বান্নার মহত্ব ও গুরু গম্ভীর ব্যক্তিত্বের এ থেকে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে যে, মন্ত্রীদেরকে কোন এক ব্যক্তি নিজ দায়িত্বে কতল করতো। কিন্তু এ মহান ব্যক্তিকে হত্যা করার জন্য সরকারের সকল মেশিনারী, নির্বাহী বিভাগ, সেনাবহিনী এবং পুলিশকেও সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত করতে হয়। হাসানুল বান্নার জীবনও শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর এবং তার মৃত্যু ও মহত্বের মহিমায় ভাস্বর। আমি এমন দাবী করছি না যে, ইখওয়ানের মধ্যে মুর্শিদের সাথে আমারই সর্বাধিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছির। কেননা আমি তাঁর জীবদ্দশায় বেশীর ভাগ সময়ই কায়রোতে ছিলাম না। ইখওয়ানের মধ্যে মুর্শিদের সর্বাধিক নিকটতম সাথী ছিলেন ডাক্তার হোসাইন কামালুদ্দিন, জেনারেল সালাহ শাদী, জনাব সালেহ আবু রকীক ও উস্তাদ ফরিদ আবদুল খালেক প্রমুখ।
মুর্শিদের সাথে কারো সম্পর্ক খুব বেশী থাকুক বা কম সকল অবস্থায়ই তার ব্যক্তিত্বের প্রভাব আমাদের সকলেই সাধ্যনুযায়ী অবশ্যই মেনে নিয়েছে।
নেতার আনুগত্য
প্রত্যেক দলেই নেতৃবৃন্দ ও সদস্যদের মধ্যে কোন না কোন ব্যাপারে মতানৈক্য হওয়া এবং মতভেদ দেখা দেয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ইখওয়ানের মধ্যেও কোন কোন ভাইয়ের প্রস্তাব ও মতামত কখনো অন্যদের থেকে ভিন্ন হতো। যা হোক আল্লাহর শোকর এসব বিতর্কিত বিষয়ে আমি সর্বদা নিরপেক্ষ ও অনৈক্য থেকে দূরে থাকতাম। মুর্শিদে আ’ম হাসানুল বান্না শহীদের বিচক্ষণতার ওপর আমার ছিল অগাধ বিশ্বাস। আমি তারই চোখে দেখতাম, তার কার দিয়েই শ্রবণ করতাম এবং তাঁর বুদ্ধি-বিবেক দ্বারা চিন্তা-ভাবনা করতাম। আমার এ অবস্থানকে অনেকে হয়ত ভুল বুঝতে পারেন। কিন্তু আমি ছিলাম মুর্শিদে আ’ম – এর এমন বিশ্বাস ভাজন ও অনুগত্য এবং তার বিচক্ষণতার ওপর আমার ছিল এত বেশী বিশ্বাস যে, আমি নিজেকে তাঁর ওপর পুরোপুরি এমনভাবে সোপর্দ করে দিয়েছিলাম যেন একজন জীবিত ব্যক্তির হাতে একজন মৃত ব্যক্তির লাশ। এমতাবস্থায় আমি ছিলাম নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত। আমি নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান বলে মনে করছিলাম। আবদুর রহমান সিন্দী মরহুম ইমামের জীবদ্দশায়ই তাঁর বিরুদ্ধ বিদ্রোহের সূচনা করে বসেছিল। কিন্তু ইমাম এ ব্যাপারে নির্লিপ্ততার পরিচয় দিতে থাকনে। সাথে সাথে প্রতিকারের চেষ্টায়ও আত্মনিয়োগ করেন। চূড়ান্ত ফায়সালা করার পূর্বেই মৃত্যুর হিমশীতল থাবা তাঁকে নশ্বর দুনিয়া থেকে তুলে নিয়ে যায়।
বস্তুত ইখওয়ানুর মুসলিমুনের দৃষ্টিতে সংগঠনের মধ্যে হাসানুল বান্না শহীদ ও হাসান আল হুদাইবী মরহুম-এর মর্যাদা ছিল অত্যন্ত শীর্ষে। সর্বস্তরের ইখওয়ান যুগপৎ ভাবে এ দু’ব্যাক্তিত্বের এমন সম্মানের দৃষ্টিতে যে, তাদের বিপক্ষে আওয়াজ উত্তোলনকারী ব্যক্তি মাত্রই তাদের দৃষ্টির আড়াল হয়ে যেতো।। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের স্বভাব-প্রকৃতি এবং শিক্ষা-দীক্ষাই ছিল এমন প্রকৃতির ,যে তারা তাদের মর্শিদের অনুরক্ত- ভক্ত হয়ে থাকেন এবং তার নির্দেশ পালনে থাকেন সদা প্রস্তুত যদি তা শরীয়াতের নিষিদ্ধ সীমানার আওতায় গিয়ে না পড়তো।
ইবলীস ও তাঁর পরামর্শ সভা
১৯৪৯ সালে নাকরাশী পাশার মন্ত্রীতের আমলে ইখওয়ানের নামকরা সকল সদস্যকে গ্রেফতার করে জিন্দানখানায় পর্দার অন্তরালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঐ সময় আমাকেও বন্দীত্বের মরযিল অতিক্রম করতে হয়। ইত্যবসরে নাকরাশী পাশা নিহত হয় এবং তার স্থানে ইবরাহীম আবদুল হাদী প্রধান মন্ত্রীত্বের আসন অলম্কৃত করেন। ইবরাহীম আবদুল হাদী ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করার পর পরই সর্বপ্রথম যে কাজটি সম্পন্ন করেন তা ছিল হাসানুল বান্নাকে হত্যার পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবে রূপদান করার গোপন ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন। এটা কিন্তু নিহত প্রধান মন্ত্রী নাকরাশী পাশার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের পরিকল্পনা ছিল না। বরং উদ্দেশ্য ছিল বাদশাহ ফারুককে সন্তুষ্টি করা ও সান্তনা প্রদান। ফারুকের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, ইখওয়ান যেভাবে দিন দিন জনসাধারণের মধ্রে তাদের প্রভাব সৃষ্টি করে চলেছে তাতে যে কোন সময়ই তার ক্ষমতার মসনদ উল্টে যেতে পারে। এ প্রসংগে আমি দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারি যে, ইখওয়ানের পাশাপাশি মিসরীয় যুব সমাজও (মিসরুল ফাতাত) গণজাগরণ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। ফারুক যদি আরো কিছু সময় অবকাশ পেতেন তা হলে ইমাম হাসনুল বান্নার শাহাদাতের পর মিসরীয় যুব সামাজের নেতা আহমদ হোসাইন তার শিকারে পরিণত হতো।
প্রদীপ্ত সূর্য ঢাকা পড়ল অন্ধকারে
১৯৪৯ সালে ১২ই ফেব্রুয়ারী তারিখে জনৈক মন্ত্রী ইমামের সাথে যোগাযোগ করে আবেদন জানান যে, তিনি ইমামের সাথে জামিয়তে শুব্বানুল মুসলিমিনের (মুসলিম যুবদলের) দপ্তরে মিলিত হতে চান। এ ইমারত কায়রোর প্রসিদ্ধ মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। ইমাম যথানিয়মে স্বীয় প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সন্ধ্যার সময় সে ইমারতে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। সংগে ছিল তারই ভগ্নিপতি জনাব আবদুল করিম মনসুরও। সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্তমিত হয়ে গেছে। দিগন্ত জুড়ে অন্ধকার ছড়েয়ে পড়তে লাগলো অথচ পূর্বোল্লেখিত মন্ত্রী বাহাদুরের সেখানে আগমন ঘটলো না। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ইমাম ও আবদুল করিম মনসুর বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। এক টেক্সিচালককে ডাকেন। তিনি তখনো টিক্সিতে আরোহণ করতে পারেননি। ইত্যবসরে সমগ্র এলাকর বিদ্যুৎ চলে যায় এবং গোটা সড়ক গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। ঠিক সে মুর্হুতেই অত্যন্ত নিকট থেকেই দুই কিংবা তিন জন লোক সম্মুখে অগ্রসর হয়ে এলোপাথাড়ি গুলী বর্ষণ করতে থাকে। ইমামের শরীর কয়েকটা গুলী বিদ্ধ হয়। তথাপি তিনি সাহস করে পূর্বোক্ত ইমিারতে ফিরে যান। আঘাত ছিল অব্যর্থ ও প্রাণ সংহারক। তিনি নিজেই এ্যাস্বুলেন্সকে ফোন করেন। তাঁর সাথীও আহত হয়ে ছিলেন। জরুরী এ্যাম্বুলেন্স সেখানে গিয়ে পৌঁছে এবং আহত উভয়কেই কাসরুল আইনী হাসপাতালে নিয়েও যায় কিন্তু হাসপাতালে নির্দেশ এসে পৌছেছিল যে, হাসানুল বান্নার ক্ষতস্থান থেকে যেন রক্ত প্রবাহিত হতে দেয়া হয় এবং তাঁর জীবন রক্ষা করার কোন প্রচেষ্টা যেন মোটেই চালানো না হয়। এভাবে উম্মাতের এ মহান কৃতি সন্তান এবং আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা জুলুমের শিকার হয়ে জান্নাতুল ফিরদাউসে চলে যান।
মযলুমের আর্তনাদ
এভাবে এই ষড়যন্ত পরিপূর্ণতা লাভ করে। কিন্তু অত্যাচারিতের আহাজারি এবং আল্লাহ তায়ালার মধ্যে কোন পর্দার অন্তরাল থাকে না। আমি আল্লাহ তায়ালার উজ্জত ও তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের শপথ করে বলতে পারি যে, মজলুমের সাহায্যে অবধঅরিতভাবে আল্লাহ তায়ালা এগিয়ে আসেন যদিও অনেক সময় তাতে কিছু সময় লাগে। সত্যই আল্লাহ তায়ালার নিকট বিলম্ব রয়েছে কিন্তু অন্ধকার নেই। এটা আল্লাহ তায়ালার অটল ওয়াদা এবং ইতিহাসের জানালা দিয়ে উকি মারতে অভ্যস্ত ব্যক্তি মাত্রই এর বাস্তবতা সুস্পষ্টভাবে দেখতে পারেন। এতদসত্ত্বেও প্র্রত্যেক ফেরাউন ও শাদ্দাদই এত্থেকে বেপরোয়া হয়ে অত্যাচারের ষ্টীমরোলার পরিচালিত করে এবং শিক্ষা গ্রহণ করে না।
অত্যাচারীকে অবকাশ দেয়ারও তাৎপর্য রয়েছে
জালিমকে অবকাশ পেতে দেখে আমরা অনেক সময় বিস্মিত হই। কিন্তু এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। প্রতিটি কাজেই আল্লাহ তায়ালার হিকমত নিহিত থাকে। আমরা আমাদের দুর্বল মস্তিষ্ক ও সংকীর্ণ চিন্তাধারায় তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হই না। আমরা সৃষ্টি আমাদের সামর্থ ও যোগ্যতা সীমাবদ্ধ কিন্তু স্রষ্টা স্বয়ংসম্পূর্ণ, সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্তি। রাতের আগমন যদি না হতো তাহলে দিনের পরিচয় কিভাবে লাভ করা যেতো? তেমনিভাবে অত্যাচার উৎপীড়নের অস্তিত্ব না থাকলে ন্যায় ও সুবিচারের গুরুত্ব বুঝা যেতো কিভাবে? ক্রোধ ও ঘৃণার দানব বর্তমান না থাকলে স্বাধীনতা লাভের মরণপণ সংগ্রামে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেইবা অগ্রসর হতো।
ইমাম শহীদ তাঁর দায়িত্ব পালন করে আখেরাতের অনন্ত জীবনের পথে পাড়ি জামিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তার উত্তম কৃতকর্ম সম্পর্কে অবগত। আর তিনিই বিনিময় দাতা। আমরা আমাদের এ গুনাহগার চক্ষু দ্বারা এটা দেখতে পাচ্ছি যে, ইমাম শহীদের দাওয়াত বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্র ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বসন্তের শোভায় শোভিত হচ্ছে। উম্মতে মুসলিমা ও মুসলিম শাসনকর্তাগণ কতইনা সৌভাগ্যের অধিকারী হবেন। যদি তারা এ দাওয়াতের মূলনীতিসমুহরে তাদের ব্যক্তিগত ও সামজিক জীবনের বুনিয়াদ বানিয়ে নেয়। এ মৌলিক ভিত্তি পাহাড় অপেক্ষা অধিক মজবুত। আল্লাহ তায়ালার সাহায্য ক্রমেই এ পরিবর্তন আসতে পারে আর আল্লাহ তায়ালার জন্য এটা কোন কঠিন কাজও না।
আমাদের শাসনকর্তাগণ যেদিন ইসলামী শরীয়াত অনুযায়ী শাসনব্যবস্থা কায়েম করবেন সেদিনই আমরা অত্যন্ত নিষ্ঠাবান সৈনিক হিসেবে তাদের নির্দেশের সম্মুখে। আনুগত্যের মস্তক অবনত করে দেবো। সেদিন হবে কতইনা কল্যাণময় যেদিন উম্মতে মুসলিমার প্রতিট ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রতি খুশী হয়ে যাবে। ইমাম শহীদের ওপর আল্লাহ তায়ালা তার অবারিত রহমত নাযিল করুন। পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণের পূর্বেই তিনি আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা) এর শিক্ষা-দীক্ষার সাথে যথাযথভাবে পরিচিত করিয়েছেন। এসব শিক্ষা এমন উজ্জল ও সুস্পষ্ট যে, তার একান্ত গোপনীয় বিষয়সমুহও দিবালোকের ন্যায় দীপ্তমান। ইসলামরে নীতিমালার শতাব্দীকাল ধরে জমে ওঠা ধুলাবালি ও আবরণ সরিয়ে মানবতাকে পুনরায় এ দ্বীনে হকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এটা এমন কৃতিত্বপূর্ণ সংস্কার কর্ম যা সর্বদা প্রশংসা কুড়িয়েছে।
দ্বিতীয় মুর্শিদে আ’ম- এর নির্বাচন
ইমাম শহীদের ইনতিকালের পর ইখওয়ানও এমন এক পরিস্থিতির শিকার হয়ে পড়ে যে পরিস্থিতিতে যে কোন দল বা সংগঠন স্বাভাবিকভাবেই হয়ে থাকে। প্রত্যেক মানব সন্তারকে নির্ধারিত সময়ে মৃত্যুর পেয়ালা পান করতে হবে। কিন্তু কারো মৃত্যুতেই প্রকৃতির এই কারখানা থেমে যায় না। ইমামকে শহীদ করা হয়েছিল কিন্তু তাঁর আন্দোলন তখনো জীবিত ছিল। এখন প্রশ্ন দেখা দিল যে, তাঁর স্থালাভিষিক্ত হবেন কে? এ মহান দায়িত্ব ও গুরুত্বপূর্ণ পদে ভূষিত হওয়ার যোগ্য কতিপয় ব্যকিত্ব ছিল। সালেহ আস সাদী মরহুম ইমামের জীবদ্দশায় সহকারী মুর্শিদ ছিলেন। তিনি ছিলেন কমার্স কলেজের গ্রাজুয়েট এবং পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী। তাঁর জন্য বড় বড় দায়িত্বপূর্ণ পদ অলম্কৃত করার প্রভুত সুযোগ ছিল। কিন্তু তিনি সকল পদমর্যাদা প্রত্যাখ্যান করে নিজের জীবন ও যোগ্যতা আল্লাহর দ্বীন প্রদিষ্ঠার জন্য ওয়াকফ করে দেন।
ইমাম শহীদের সহোদর ভ্রাতা উস্তাদ আবদুর রহমান আল বান্নাও ইখওয়ানের সারিতে বর্তমান ছিলেন এবং যে কোন গুরুদায়িত্ব পালন করার যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন। ইখওয়ানের সেক্রেটারী জেনারেল জনাব আবদুল হাকীম আবেদীন এর ওপরও সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। তিনি আটর্স এবং আইন বিষয় গ্রাজুয়েট ছিলেন। অসাধারণ মেধা ও প্রতিভার নেয়ামত দ্বারা আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ধন্য করেছিলেন। তদুপরী তিনি ছিলেন অনলবর্ষী বক্তাও। প্রখ্যাত আলেম দ্বীন জনব ওস্তাদ আল বাকুরী একাধারে যোগ্যতা জ্ঞান ও পান্ডিত্য এবং শিষ্টাচার সৌজন্যে ছিলেন শীর্ষস্থানীয়। তাঁর মধ্যেও ইখওয়ানের নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা ছিল।
উপরোল্লিখিত মহান ব্যক্তিগণের প্রত্যেকে নিজ নিজ স্থানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। নিসন্দেহে এদের প্রত্যেকের পক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য তাদের মতামতও প্রদান করতো। কিন্তু তাদের কেউ-ই এ পদের জন্য আকাংখী ছিলেন না। সদস্যগণ নিজেদের মধ্যে মতামত বিনিময়ের সময় তাদরে পছন্দনীয় নেতৃত্বের পক্ষে বিস্তারিত যুক্ত-প্রমাণ পেশ করতেন। কখনো কখনো আলোচনায় তিক্ততার প্রকাশ ঘটতো আবার কখনো তা চলতো ধীরলয়ে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের সকলের প্রতিই আবার কখনো শ্রদ্ধাপোষণণ করতাম। কিন্তু কাউকেই অন্যের ওপর প্রাধান্য দিতে পাচ্ছিলাম না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তাদের মধ্যে যাকেই বাছাই করে নেয়া হোক না কেন ইখওয়ানের জন্যে তাঁর নেতৃত্বই কল্যাণকর হবে। এ ব্যাপারে পারস্পরিক আলোচনা পর্যালোচনা দীর্ঘস্থায়ী হয় কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হয় না।
এ আলোচনা চলাকালে শেষ পর্যন্ত উস্তাদ মুনীরুদ্দৌলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি যিনি তখন পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন এক প্রস্তাব পেশ করেন। অপর দু’জন প্রভাবশালী সদস্য উস্তাদ ফরিদ আবদুল খালেক (শক্ষা বিভাগ) এবং উস্তাদ সালেহ আবু রাকীক (আরব লীগের উপদেষ্টা) তাঁর উপস্থাপিত প্রস্তাবের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। প্রস্তাবাটি ছিল এই যে, ইখওয়ানের সুপরিচিত ব্যক্তিগণের পরিবর্তে এমন কোন সদস্যকে এ পদের জন্য মনোনিত করা হোক যিনি একদিকে হবেন বিচার বিভাগের লোক অপরদিকে হবেন এমন ব্যক্তিত্ব এখনো পর্যন্ত যিনি খুব একটা সুখ্যাতির অধিকারী ও পরিচিত নন। এ প্রস্তাব ইখওয়ানের নিকট গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। ফলে উস্তাদ সালেহ আসমাদীর বাড়ীতে ১৯৫২ সালে ইখওয়ানের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যগণ সর্বসম্মতিক্রমে উস্তাদ হাসান আল হুদাইবিকে মুর্শিদে আ’ম হিসেবে বাছাই করেন এবং সকলেই তাঁর হাতে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন।
মুর্শিদে আ’ম হাসান আল্ হুদাইবির ব্যক্তিত্ব
মহা সম্মনিত মুর্শিদে আ’ম (দ্বিতীয়) হাসান আল হুদাইবি ছিলেন আপিল কোর্টের জজ। তিনি ইসলামী ফিকাহ্ শাস্ত্রের ব্যাপক পড়াশুনা করেন। আল্লামা ইবনে হাযম-এর ফিকহী মতামত দ্বারা তিনি খুবই প্রভাবিত হন। ইবনে হাযম বিরচিত ও বহুল আলোচিত আল মোহালা এবং আল ওয়াসীত গ্রন্থদ্বয় তিনি বহুবার আদ্যোপান্ত পাঠ করেছিলেন। এমনকি এগুলোর কয়েকটি অংশ তার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। ফিকাহ্ শাস্ত্রের ওপর রচিত যাবতীয় প্রন্থের ওপর ছিল তাঁর সন্ধানী দৃষ্টি। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ ফিকাহ্ শাস্ত্রবিদ ও আইনবিদ। তিনি যখনই কোন বিষয়ে ফায়সালা প্রদান করতেন তখনই সে বিষেয়ে ইসলামী ফিকাহশাস্ত্র ও বুনিয়াদী নীতিমালার আলোকে জ্ঞানগর্ভ যুক্তি- প্রমাণ পেশ করতেন। এমনিতেই তাঁর ফায়সালা সাধারণ বিচারকদের ন্যায় শুধুমাত্র একটা নির্দিষ্ট মামলা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকতো না। বরং তা ভাবিষ্যতের জন্য বিচার বিভাগের সদস্য ও উকিলদের জন্য বিচার বিষয়ক দৃষ্টান্ত হয়ে যেতো। তাঁর প্রদত্ত ফায়সালা আজ পর্যন্ত রেফারেন্স ও প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়ে থাকে।
ইখওয়ানের বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও সমাবেশে আমি মরহুম হাসান আল হুদাইবিকে বহুবার দেখেছি। সকল ব্যাপারেই তাঁর আচরা-আচরণ হতো সর্তকতামূলক বিজ্ঞাজনোচিত এবং হুবহু কুরআন-সুন্নাহ মাফিক। আজও আমার খুব ভালভাবেই মনে আছে যে শাবীনুল কানতিরস্থিত কেন্দ্রীয় সংগঠনে একবার আমাদের সমাবেশ হচ্ছিল। হাসান আল হুদাইবি মরহুম সে সময়ও আদালতের জজ ছিলেন। তিনি সমাবেশে যোগদান করেছিলেন। ষ্টেজ সেক্রেটারী আমাকে বক্তব্য পেশ করার জন্য অনুরোধ করেন। আমি আমার বক্তব্যের সূচনা করি এবথা বলে যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন অন্যান্য সংগঠন থেকে কতিপয় ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্রের অধিকারী। যেমন আমরা কারো ওপর আক্রমণ করি না। কিংবা কারো দোষ-ক্রটি নিয়ে চর্চা করি না। আমাদের দৃষ্টিতে অন্যান্য সংগঠনের দুর্বলতা আমাদের জন্য কোন কৃতিত্বের ব্যাপার নয়। বরং আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, ইতিবাচকভাবে নিজেদের দাওয়াত ও তাঁর অনন্য বৈশিষ্টসমূহ মানুষের সম্মুখে উপস্থাপন করা। অতপর আমার স্মরণ আছে যে, আামি আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন কিছু কথা বলে ফেলি যা আমার প্রারম্ভিক বক্তব্যেল সম্পূর্ণ পরিপন্থি ছিল। তারপর আর যায় কোথায়। মুর্শিদে আ’ম মরহুম ঠিক সে মুর্হূতেই তাঁর স্বাভাবসুলভ বিজ্ঞোচিত গুরুগম্ভীর ভংগীতে আমাকে ক্রটি উল্লেখ করেন এবং বলেনঃ “ যে ভংগীতে অগ্রসর হচ্ছিলে তা ছেড়ে দিলে কেন? তৎক্ষণাৎ আামি আমার ভ্রান্তি উপলব্ধি করলাম এবং সংগে সংগে নিজেকে সামলে নিয়ৈ পুনরায় সঠিক গতিতে চলতে লাগলাম।
প্রসংগক্রমে এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা জরুরী মনে করছি। এটা মূলত প্রকৃত সত্যের প্রকাশ আত্মপ্রচার নয়। লেখা বক্তৃতা ও আলোচনা পর্যালোচনায় আমার নীরব ও আপোষমূলক মনোবৃত্তি রাজনীতি বা কৃত্রিমতা কোনটাই নয়। বরং আমার স্বভাব-প্রকৃতিই এমন যে, মানুষের সাথে সকল ব্যাপারেই নম্রতা ও ক্ষমাসুদন্দর দৃষ্টিভংগী ছাড়া আমার কোন গত্যন্তরই থাকে না। আমার অবস্থা হলো এই যে, কেউ যদি আমার প্রতি অত্যাচারও করে তবুও আমি তার কাছে ওজর পেশ করি এবং উল্টো তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেই। এভাবে প্রতিপক্ষের স্নায়ুবিক উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে পড়ে।
প্রথম ও দ্বিতীয় মুর্শিদে আ’ম - এর ব্যক্তিত্বের তুলনা
মুর্শিদে আ’ম হাসানুল বান্না শহীদ ও মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবি মরহুম- এর স্বভাব প্রকৃতি কয়েকটি ক্ষেত্রে ছিল সাদৃশ্যপূর্ণ। আবার কিছু কিছু ব্যাপারে প্রত্যেকেই পৃথক দৃষ্টিভংগী পোষণ করতেন। প্রথম মুর্শিদে আ’ম তাঁর কর্ম ও মর্যাদার ভিত্তিতে পরিস্থিতি অনুসারে অত্যন্ত হৃদয়াগ্রাহী কথাবার্তা বলতেন তিনি সাধারণত কখনো নীরবে বসে থকাতেন না। পক্ষান্তরে ইমাম হাসান আল হুদাইবি মরহুমের ছিল নিজস্ব কর্মপদ্ধতি ও স্বকীয় মর্যাদা। তিনি ছিলেন স্থির চিত্ত ও নীরব প্রকৃতির মানুষ। শিক্ষকগণ বেশী কথা বলে থাকেন। অপরদিকে বিচারক বেশী শুনতে অভ্যস্ত হন। ইমাম আল বান্নার চেহারা সর্বদা হাস্যেজ্জল থাকতো। কিন্তু ইমাম আল হুদাইবি বিচারাসনের দাবী মোতাবেক সর্বদা থাকতেন ভাব গম্ভীর ও স্থিরচিত্ত। আল হুদাইবির সম্মুখে কেউ ভন্ডামি ও হটকারিতা প্রকাশ করতে পারতো না। তাঁর সম্মুখে যদি ইখওয়ানের কোন দু’জন সদস্য পরস্পর কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত হতো তাহলে তাঁর তিরস্কার শুনে উভয়ের শরীরে কম্পন সৃষ্টি হয়ে যেতো। তার বিখ্যাত যে উক্তিটি আমাদের সবার মনে আছে তা হচ্ছেঃ “যদি তোমরা নিজেদের দু’জনের বিবাদ উত্তমরূপে নিষ্পত্তি করতে না পারো তাহলে অন্যদের মধ্যকার ঝগড়া মিটাবে কিভাবে?” এ দোয়া সর্বদা তাঁর মুখে লেগে থাকতো। “হে আমার প্রভু! তুমি আমাকে তোমার আনুগত্য করার যোগ্যতা ও উপযুক্ততা দান করো।”
দৃঢ়তার পাহাড়
ইখওয়ানের ওপর এটা আল্লাহ তায়ালার বড়ই অনুগ্রহ যে যখন ঝগড়া বিবাদের পরিবর্তে নীরবে নিভৃতে আন্দোলনের ওপর অবিচল থাকা এবং অত্যাচার উৎপীড়নের মোকাবিলায় ধৈর্যর মহাড়া দেয়ার প্রয়োজন ছিল ঠিক তখনি আল্লাহ তায়ালা হাসান আল হুদাইবিকে আন্দোলনের নেতৃত্বের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তিনি তাঁর স্বভাব প্রকৃতি অনুযায়ী ঐ সময়ের জন্য সর্বোত্তম নেতা ও উপযুক্ত কর্ণধার ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বের আমলে আন্দোলন জুলুম- নিপীড়নের নিকৃষ্টতম উদাহরণের সম্মুখীন হয়। কিন্তু তাঁর দৃঢ়তা ও নির্ভীকতা এ ঘোর অন্ধকারময় সময়েও ইখওয়ানের উদ্যমকে সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয় এবং প্রতিটি অগ্নিকুন্ড থেকে তিনি বিশুদ্ধ সোনারূপে প্রমাণিত হয়ে বের হন। ১৯৫৪ সালে কঠোর পরীক্ষা থেকেও ইখওয়ান সফলকাম হয়ে যায়। তাঁর ফাঁসির কাষ্ঠকে জানিয়েছিল স্বাগতম এবং তাদের মর্শিদের উন্নত নৈতিক চরিত্র ও স্বাধীনচেতা ভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইতিহাসকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো। কবির ভাষায়ঃ (আরবী*************)
“অত্যাচারীর নিষ্ঠুর হস্তে বিশ্বাসীদের মস্তক যদি দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়, যাক তথ্যাপি এ শির অন্যায়েল সম্মুখে নত হবে না কোনদিন।”
জুলুম অত্যাচার এবং ভয়ভীতি দ্বারা আন্দোলনকে প্রতিহত করা গেলো না। বরং শহীদদের রক্ত সফল হয়ে উঠতে থাকলো এবং সত্যের আন্দোলন এমন সবস্থানে পৌঁছে গেল যেখানে আমরা পৌঁছতে পারিনি। ইখওয়ানের নেতা ও কর্মীরা জিন্দানখানার অন্ধকার কুঠরিতে ছিলেন আবদ্ধ। কিন্তু সত্যের আওয়াজ দেশের আনাচে কানাচে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো। কবির ভাষায়ঃ (আরবী**********)
আমরা তো পিঞ্জিরায় ছিলাম আবদ্ধ অথচ ঋতুরাজ বসন্ত ফুল বাগিচায় উৎসব করে গেল।”
নূতন ফাঁদে পুরনো শিকারী
ইখওয়ানের ধৈর্য ও স্থৈর্য এবং সাহস, দৃঢ়তা ও নির্ভীকতা সত্য পথের পথিকদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত বটে। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধবাদীগণও এসব দৃষ্টান্ত দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছে। তাদের ধারণাও ছিল না যে, এ রক্ত মাংসের শরীর বিশিষ্ট মানুষ এমন অনমনীয়তা ও দৃঢ়তার প্রদর্শনী করতে পারে। তাদের তথাকথিত বিশেষজ্ঞ, পান্ডিতবর্গ, নতুন করে অধ্যয়ন ও গবেষণা শুরু করে এবং ইখওয়ানকে নির্মূল করার জন্য নতুন কর্মপন্থা অবলম্বন করার প্রস্তাব দেয়। পুরাতন শিকারীরা নতুন জাল বিস্তার করে এবং আল্লাহর বাজ পাখীদের ফাঁদে ফেলার জন্য নিত্য নতুন ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। তারা বলেন, সন্ত্রাস ও নিষ্ঠুরতার কুটকৌশল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এখন প্ররোচনা ও নম্রতার ব্যবস্থাপত্র প্রয়োগ করে দখা যেতে পারে।
এটা ছিল বাদশাহ ফারুকের শাসনামলের শেষ দিকের কথা। তখন আল হুদাইবি মরহুম ছিলেন মুর্শিদে আ’ম। ইখওয়ানের ওপর প্রযুক্ত বিষ ক্রিয়া করতে পারেনি। অতএব এখন মিষ্টিভাবে তাদের মারার বন্দোবস্ত করা হয়। ইখওয়ানদের কারগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। তাদেরকে তাদের সরকারী পদে পূর্নবহাল করার নির্দেশ জারী হয়। অনেককে বন্দীত্বের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। “আদ্ দাওয়াত” পুস্তিকা পুনরায় প্রকাশের অনুমতিও পাওয়া যায়। কেন এসব আয়োজন? বাস্তবিকই কি ইখওয়ানকে স্বাধীনভাবে দাওয়াত ও তাবলীগের অধিকার প্রদান করা হয়েছিলো? না, বরং সরকারের জন্য তাদের মনে একটু স্থান সৃষ্টি করাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য।
এ সংগীত বসন্তের মুখাপেক্ষী নয়
ঐ লোকগুলো আগেও ইখওয়ানকে বুঝতে পারেনি এখনও পারছি না। ইখওয়ানের দাওয়াতি কাজ কখানো বন্ধই হয়নি। তারা জেলখানার মধ্যে থাকুক কিংবা বাইরে। তাদের পুস্তকা ‘আদ-দাওয়াত’ বন্ধ হয়ে যাক বা বহাল থাকুক। সকল অবস্থায়ই তাদের প্রাণন্ত প্রয়াস অব্যাহত ছিল। ১৯৪৪ সাল থেকে ‘আদ-দাওয়া’ পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে এবং এর প্রকাশনা কখনো ব্যহত হয়নি। আদ-দাওয়া প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে এর কর্মীরা ভিন্ন নামে তাদের মতামত প্রকাশ অব্যাহত রাখেন।
শকুনী ও বাজ পাখীর জগত এক নয়
সরকারী সহলে এ প্রত্যাশা করা হচ্ছিলো যে, উস্তাদ আল হুদাইবি শাহ ফারুকের সাথে সাক্ষাতের আবেদন জানাবেন যাতে দেশের উপর ঘনীভুত বিপদ প্রতিহত করার জন্য সরকার ও ইখওয়ান সম্মিলিত কর্মপন্থা গ্রহন করতে পারেন। এ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সরকারের অনেক মুখপাত্র তার সাথে আলোচনায়ও মিলিত হন। কিন্তু তিনি এরূপ কোন উদ্যেগ গ্রহণ অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। তার দৃষ্টিতে শাহের সাথে দেখা করার আবেদন দ্বীনের পৃষ্ঠপোষকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। কোথায় মুর্শিদে আ’ম এর কোথায় পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক শাহ্ ফারুক! কবির ভাষায়ঃ (আরবী************)
“দোজাহানের মহারাজ, শাহেন শাহ্ নিঃসম্বল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লামের অবদানের কথা জিজ্ঞেস করো না।”
অবশেষে শাহ নিজেই তার সংগে সাক্ষাতের জন্য তাঁকে দাওয়াত দেন। তিনিও তার আহবান ইতিবাচক সাড়া দেন এবং যথা নিয়মে তার সাথে সাক্ষাত করতে যান। সাক্ষাত হয় কিন্তু মর্শিদে আ’ম- এর ভূমিকা এবং ইখওয়ানের দাওয়াতের ব্যাপারে তার চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তনস খুব কমই আসতে পারতো। সাক্ষাতকার শেষে তিনি যখন বাইরে আসেন তখন সাংবাদিকগণ তাঁকে ঘিরে ধরেন। তিনি মাত্র চারটি শব্দে তাদের প্রশ্নের উত্তর দেন। “মোকাবালাতুল কারীমাতুন লি মালেকীন কারিম” অর্থাৎ উত্তম বাদশাহর সাথে উত্তম সাক্ষাত হয়েছে। বিদগ্ধ পাঠকগণ যদি এ চারটি শব্দ সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করেন তাহলে তাঁদের সম্মুখে এ সত্য দিবালোকের ন্যায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে যে, মুর্শিদে আ’মকে আল্লাহ তায়ালা কি পরিমাণ বাগ্মিতা, বাকপটুতা ও কৌশল প্রদান করেছিলেন। তিনি এ চারটি মাত্র শব্দে তা বলে দিয়েছিলেন যা লম্ভা চওড়া প্রেস কনফারেন্সেও প্রকাশ করা সম্ভব হতো না।
দশম অধ্যায়
যে সময় সামরিক জেলখানায় বন্দী ছিলাম তখন আমাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নির্দেশ দেয়া হতো যেন আমরা উম্মে কুলসুমের গান তারই সূরে সমস্বরে গাই। সাধারণত আমাদের সেই জঘন্য গানটি বলা হতো যাতে নাসেরের মহত্ব ও কৃতিত্ব এবং ফেরাউনের প্রশংসা করা হয়েছিলো। “হে জামাল। হে মিসরের কৃতিসন্তান” । ওগো দেশ প্রেমের আদর্শ। এ সময় জেলখানার সুউচ্চ ছাদের উপর সর্বাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত সৈনিক আমাদের সারির প্রতি তাক করে সদা প্রস্তুত দাঁড়িয়ে থাকতো। যেন আমাদের মধ্য থেকে কেউ নির্দেশ পালন না করার ধৃষ্ঠতা দেখালে তাকে উড়িয়ে দিতে পারে। এসব নাটকের একটিতে একজন অফিসার মুর্শিদে আ’ম আল হুদাইবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট গিয়ে অত্যন্ত ক্রোধ ভরে আদেশ করেন “মাটির ওপর সজোরে পদাঘাত করো”। মুর্শিদে আ’ম এ নির্বোধের ন্যায় নির্দেশের প্রতি অত্যন্ত নির্ভীকতা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে বললেনঃ “আমি মাটির উপর পদাঘাত করলে তাতে কি পেট্রোল কিংবা তরমুজ খরমুজ বেরিয়ে আসবে।” এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে এমন নির্ভীকতাপূর্ণ জবাব দেয়া নিশ্চিত মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানোর সমান। এটা সব মানুষের কাজ নয়। কিন্তু এতটুকু বলে রাখা সুধী পাঠকগণের সান্ত্বনার জন্য যথেষ্ট যে, এরূপ জবাব দাতা ছিলেন হাসান ইসমাঈল আল হুদাইবি।
আল্লাহ সর্বোত্তম নিরাপত্তা দাতা
আত্মমর্যাদাবোধ, সাহসিকতা ও দৃঢ়তা বিপদের ঝুঁকিকে অন্তরে স্থান না দেয়া আর মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন কেউ চাইলে হাসান আল হুদাই-বির নিকট থেকে শিখে নিতে পারে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ তায়ালার অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যে তারই ইচ্ছা ব্যতীত একটা পাতাও নড়তে পারে না। আল্লাহ তায়ালার এ দুনিয়াতে মানুষের জন্য দু’টো দিনই রয়েছে, একটি হচ্ছে সেই দিন যেদিন তার জীবনের শুভ সূচনা হয়। আর অপরটি হচ্ছে সেইদিন যেদিন তার মৃত্যু লিখে দেয়া হয়েছে। অতএব একজন সত্যনিষ্ঠ নিবেদিত প্রাণ মু’মীন ব্যক্তির ভয় কিসের। তার জানা আছে যে, যতদিন তার হায়াত রয়েছে দুনিয়ার সমস্ত শক্তি মিলেও তাকে মেরে ফেলতে পারে না। আবার যখন তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসবে তখন কেউ সে মৃত্যুকে হটিয়ে দিতে পারবে না। আর না পাওয়া যাবে পালিয়ে আত্মরক্ষা করার মতো কোন নিরাপদ জায়গা।
হাসান আল হুদাইবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে সাদাতের শাসনামলের প্রথম দিকে যখন মুক্তি দেয়া হয় তখন অগণিত লোক আগমন করেন যারা বিভিন্ন ব্যাপারে এবং তাঁর সংকলন সম্পর্কে মতানৈক প্রকাশ করেছিলেন। তাঁরা এসে তাঁর খেদমতে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এ সাক্ষাতকারও স্মরণীয় এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের অধিকারী। মুর্শিদে আ’ম মরহুমের মহান ব্যক্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠ কৃতিত্বের স্বাক্ষর এতে পরিদৃষ্ট হয় যে, তিনি এসব পূর্বতন বিরোধীদেরকে অত্যন্ত হাঁসিমুখে স্বাগত জানান। এখন যেহেতু এসব লোকের নিকট সত্য সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়ে গিয়েছে সে জন্য তিনি যারপর নাই আনন্দিত হয়েছিলেন। তিনি তাদের পূর্বের কোন আচরণের প্রতি অংগুলি নির্দেশ করেননি। কিংবা তাদেরকে লজ্জিত ও অপমানিত করেননি।
সর্বক্ষণ বেগবান
ইখওয়ানুল মুসলিমুনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। কিন্তু হাসান আল হুদাইবি যথারীতি মুর্শিদে আ’ম হিসেবে পরিচিত রইলেন। এরূপ মনে করা যেতে পারে যে, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পত্র-পত্রিকায় ইখওয়ানের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল ঠিকই কিন্তু কার্যত সকল কর্মতৎপরতা অব্যাহত ছিল। ইখওয়ান ছোট বড় সকল ব্যাপারেই দিক নির্দেশনা গ্রহণের জন্য মুর্শিদে আ’ম-এর নিকট যেতো। এ তথাকথিত আইনগত নিষেধাজ্ঞা কি করে হকের দাওয়াতের রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে? প্রচার প্রচারণা ছাড়াও তো কাজ হতে পারে। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তার জন্য মহব্বত, একজন মুসলিমের অপর মুসলিমের সাথে মিলিত হওয়া, তেলাওয়াত ও দারসে কুরআনের জন্য বসা, নবীর জীবন চরিত, ফিকাহ ও তাফসীরের সমাবেশের ব্যবস্থা করা, দেশ ও দেশবাসীর কুশলাদি সম্পর্কে অবগত হওয়া ইত্যাকার কর্মকান্ডের মধ্যে কোনটি এমন যেটাকে আপনি বেআইনি ও অবৈধ বলতে পারেন। দেশের শাসনতন্ত্রই এসব কাজের স্বাধীনতা দিয়ে থাকে। শান্তি-শৃংখলা বিধানকারীগণ তাদের নির্বুদ্ধিতা ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগীর কারণে এ বিষয়গুলোকে বেআইনি এবং জননিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ ঘোঘণা করলে তা অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।
সসম্মানে মুক্তি দান
ইখওয়ানের কোন কর্মসূচী দ্বারা দেশের শান্তি-শৃংখলা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কোন আশংকা নেই। তথাপি বর্তমান অবস্থা হলো জননিরাপত্তার নামে পুলিশ ইখওয়ানের ডজনে ডজনে কর্মীকে গ্রেফতার করে থাকে এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সপ্তাহের পর সপ্তাহ এবং মাসের পর মাস তাদের আতিথেয়তার দায়িত্ব পালন করে। কত আন্তরিকতাপূর্ণ আতিথেয়তাই না দেখিয়ে থাকেন ইখওয়ানের এসব মেহমানদের! আল্লাহ তাদের হিদায়াত নসীব করুন। কিছুদিন জিজ্ঞাসাবাদের পর যখন সেইসব গ্রেফতারকৃতদের আদালতে পেশ করা হয় তখন আদালত চার্জশীট দেখা মাত্রই “অভিযুক্ত” দের মুক্তিদানের নির্দেশ প্রদান করে। যে ভিত্তিহীন অভিযোগের প্রেক্ষিতে এ লোকগুলোকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে সরকারী মেহমান হিসেবে রেখে দেয়া হয় তা শুনামাত্রই আদালত মুর্হূর্তের মধ্যে তাদের মুক্তির ফায়সালা শুনিয়ে দেন।
নাসেরকে কাফের ঘোষণা করার ব্যাপারে
হাসান আল হুদাইবির ভূমিকা
জামাল আবদুন নাসেরের কুখ্যাত শাসনামলে কারাগারে আমাদের ওপর যখন নির্যাতন নিপীড়নের পাহাড় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছিলো তখন কোন যুবক বন্দী এ বর্ণনাতীত জুলুম-নিপীড়নের পরাকাষ্ঠা দেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, নাসেরকে কাফের মনে করতে হবে। তাঁরা বেশ কিছুদিন গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন এবং অবশেষে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, নাসের যে নিকৃষ্টতম শাস্তি ও নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিচ্ছে তা এমন কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় যার অন্তরে তিল পরিমাণ ঈমানও বিদ্যমান আছে। এসব যুবক যাদের রাতও কাটতো নানা প্রকার শাস্তির মধ্যদিয়ে আর দিনও অতিবাহিত হতো বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্যে। নাসেরের কাফের হওয়ার ব্যাপারে তাদের মনে কনো প্রকার সন্দেহ সংশয় ছিল না। আমাদের উপর পরিচালিত অত্যাচারের যে ষ্টীমরোলারের বিবরণ বিশ্ববাসীর দৃষ্টিগোচর হয়েছে তা প্রকৃত অবস্থার তুলনায় ছিল খুবই সামান্য। উপরোক্ত ইখওয়ানীদের অন্তরে এ চিন্তাধারা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, নাসের মুসলিম নয়। লিমান তারার কয়েদখানায় এ ধারণা অত্যন্ত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। কারাগারের অভ্যন্তরেই মুর্শিদে আ’ম যখন এ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হন তখন তিনি এ মতামতের নেতৃস্থানীয় ইখওয়ানী যুবকদেরকে তাঁর নিকট ডেকে পাঠান এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের সাথে আলোচনা করেন। অধিবেশনের সমাপ্তিতে মনে হচ্ছিল যে যুবকগণ তাদের মতামত থেকে প্রত্যাবর্তন করেছে এবং মুর্শিদে আ’ম-এর সম্মানে আপাতত নীরবতা অবলম্বন করেছিল সত্য কিন্তু তাদের চিন্তাধারায় কোনরূপ পরিবর্তন আসেনি। বাইরে এসে তারা পুনরায় কঠোরভাবে সে মতামতের সমর্থনেই সোচ্ছার হয়ে ওঠেন। মুর্শিদে আ’ম বুঝতে পারলেন যে, তারা তাদের এ দৃষ্টিভংগী পরিবর্তন করবে না। অতএব তিনি তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ “দুয়া’ত লা কুজাত” (সত্য পথের আহবানকারী মাত্র ফতোয়া দাতা নয়) লিখেন ও তা প্রকাশ করেন।
মুর্শিদ মরহুমের উপরোল্লিখিত প্রকাশনা দাওয়াতে হকের কর্মী ও সদস্যগণ এবং ইসলামী বিপ্লবের পতাকাবাহী লোকদের জন্য বড়ই উপকারী ও দিক নির্দেশক গ্রন্থ। এ গ্রন্থের সংকলনে তার গুণমুগ্ধ ও পরম শ্রদ্ধার পাত্র উস্তাদ মামুন আল হুদাইবি (জজ আপিল কোর্ট) এবং উস্তাদ মুস্তফা মাশহুর প্রমুখ সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেন। মুর্শিদে আ’ম কাফের ফতোয়া দেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না। আর তিনি যা বর্ণনা করেছিলেন তাই ছিল সত্য ও যথার্থ।
কালেমার স্বীকৃতি প্রদানকারী কোন ব্যক্তির উপর কুফরের ফতোয়া দেয়া কিংবা তাকে কাফের মনে করা কোন মা’মুলী কথা নয়। কোন মুসলিম অত্যাচার-উৎপীড়ন, পাশবিকতা-নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার যত চরমেই গিয়ে উপনিত হোক না কেন, তাকে কাফের বলা জায়েজ নেই। এ বিষয়ে রাসূল (সা)- এর কাছ থেকে এত অধিক সংখ্যক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তন্মধ্যে একটি হাদীসের বর্ণনাকারী হচ্ছে মুয়ায বিন জাবাল (রা) তিনি বলেছেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (সা) –এর সওয়ারীতে তাঁর পশ্চাতে উপবিষ্ট ছিলাম। ইত্যবসরে তিনি সম্বোধন করলেনঃ “হে মুয়ায। আমি আরজ করলাম, “লাব্বাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক।” রসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ “তোমার কি জানা আছে যে, আল্লাহর বান্দাদের উপর এবং বান্দার আল্লাহর উপর কি কি অধিকার রয়েছে?” আমি প্রত্যুত্তরে আরজ করলাম, “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা)-ই ভাল জানেন।” তিনি বলতে লাগলেন, বান্দাহর ওপর আল্লাহর অধিকার হচ্ছে, তারা একনিষ্ঠভাবে তারই আনুগত্য করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। পক্ষান্তরে আল্লাহ তায়ালার ওপর বান্দার অধিকার হচ্ছে, যারা তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে না। তিনি তাদেরকে আযাব থেকে নিরাপদ রাখবেন।” আমি আরজ করলাম, “হে আল্লাহর রাসূল (সা)। লোকদেরকে কি এ সুসংবাদ শুনিয়ে দেবো?” জবাবে রাসূল (সা) বললেন, “না, তাহলে তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে।”
জামায়াতুত তাকফীর ওয়াল হিজরাহ
কাফের বলে অভিহিত করা কোন মা’মুলী ব্যাপার নয়। পরবর্তী কালে মিসরে এমন দ্বীনি জা’মায়াতও আত্মপ্রকাশ করে যার নামই “জামায়াতুত তাকফীর ও হিজরাহ” রাখা হয়। এ জামায়াত মাযহাবী আবেগ বশত যে ভূমিকা গ্রহণ করে এবং তার যে ফলাফল প্রকাশ পায় তা কারো অজানা নয়। যা হোক এ ব্যাপারে আমি অদ্যাবধি নিশ্চিত নই যে, শেখ যাহাবী (ওয়াকফ বিষয়ক মন্ত্রী)-কে হত্যা করেছিল। অভিযোগ তো জামায়াতুত তাকফীরের ওপরই আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা করা কারসাজি ছিল তা আজও রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে।
সা’দাত কর্তৃক আলোচনার আহবান
ও তার ফলাফল
১৯৭৩ সালে শেখ সাইয়েদ সাবেক আমার কাছে আসেন এবং বলেন যে, মিষ্টার আহমদ তা’য়িমা (যিনি সা’দাতের ক্যাবিনেটের অন্যতম মন্ত্রী ছিলেন) তাঁর সাথে যোগাযোগ করেছেন। মন্ত্রী মহোদয় সাইয়েদ সাবেককে এ মর্মে অবহিত করেন যে, প্রেসিডেন্ট সা’দাত ইখওয়ানের গণ্যমান্য ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে সাক্ষাত করে দেশ ও জাতির সম্মুখে বিরাজমান সমস্যাবলীর সুষ্ঠু সমাধান কল্পে পারস্পরিক সহযোগিতার উপায় খুঁজে বের করতে চান। তাখনো রুশ উপদেষ্টাদেরকে মিসর ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়নি। তার অব্যবহিত পরই তাদেরকে মিসর ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। আমি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালাম এবং মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবির খেদমতে উপস্থিত হয়ে সার্বিক পরিস্থিতি তার নিকট তুলে ধরলাম। তিনি তখন আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থান করছিলেন। তিনি বললেন, “উদ্যোগ খুবই উত্তম। তবে শর্ত হলো প্রেসিডেন্ট সাহেব ও তাঁর লোকদের নিয়ত সৎ হতে হবে।” এ আলোচনা চালানোর জন্য তিনি আমাকেই ইখওয়ানের প্রতিনিধিত্ব করার আদেশ দিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইখওয়ান নেতৃবৃন্দের তালিকা প্রণয়ন করে যেন তাকে দেয়া হয় এবং সরকারকেও যেন তা অবহিত করা হয়। আমি সাইয়েদ আহমদ তা’য়ীমাকে টেলিফোনে ইখওয়ানের সেইসব সদস্যদের তালিকা জানিয়ে দেই। যারা প্রেসিডেন্ট সাদাতের সাথে প্রস্তাবিত সাক্ষাতকারে ইখওয়ানের প্রতিনিধিত্বকারী ছিলেন। তিনি তা সাদরে গ্রহণ করেন কিন্তু এর পর পরই সরকারের পক্ষ থেকে পরিপূর্ণ নীরবতা পরিদৃষ্ট হতে থাকে। এর পশ্চাতে কি রহস্য লুকায়িত ছিল তা আল্লাহই ভাল জানেন।
সাইয়েদ সাবেকের সাথে আল আজহারে আমার আকস্মিকভাবে সাক্ষাত হয়ে যায়। আমি তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলতে লাগলেন যে, মুহতারাম প্রেসিডেন্ট ও তাঁর এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলতে লাগলেন যে, মুহতারাম প্রেসিডেন্ট ও তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলতে লাগলেন যে, মুহতারাম প্রেসিডেন্ট ও তাঁর লোকজনের সিদ্ধান্ত হলো আপাতত কিছুদিনের জন্য এ সাক্ষাতকার মুলতবী রাখতে হবে। একথা শুনে আমি তাঁকে বললাম। যদি তাই হয়ে থাকে তবে এ ব্যাপারে আমাদের অবহিত করলেন না কেন? যেহেতু আপনিই আমাদের কাছে খবর নিয়ে গিয়েছিলেন তাই এর ফলাফল সম্পর্কে আমাদেরকে অবহিত করার দায়িত্ব আপনারই ছিল। মনে করুন এখানে হঠাৎ আপনার সাথে যদি আমার এভাবে সাক্ষাত না হতো এবং আমি ঘটনাক্রমে আপনাকে জিজ্ঞেস করে জানতে না চাইতাম তাহলে আপনি আমাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারের মধ্যেই রাখতেন। যাই হোক, পরে আমি চিন্তা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, বেচারা সাইয়েদ সাবেকও নিশ্চয়ই কোন অসহায় অবস্থার শিকার হয়ে থাকবেন। সম্ভবত তাকে নীরব থাকারই নির্দেশ প্রদান করা হয়ে থাকবে। ঘটনা যাই হোক না কেন আল্লাহই তা ভাল জানেন।
সম্ভাবনাসমুহ
আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম আর কল্পনার টানা পোড়নে ভুগতে থাকলাম যে, সা’দাত এটা কি খেলা শুরু করেছে? এক এক করে বেশ কটি সম্ভাবনা মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল। যেমনঃ
১- সে কি বাস্তবিকই দেখতে চায় যে, ইখওয়ান দেশ ও জাতির কল্যাণে সহযোগিতা করে কি না? হয়তো বা তাই।
২- সে কি এই অভিনয়ের মাধ্যমে জানতে চায় যে, ইখওয়ানের প্রকৃত নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তি কে কে? এও হতে পারে। যদিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয় ছিল যে, ইখওয়ানের নেতৃত্বের ব্যাপারে তারা যথাযথভাবেই অবহিত রয়েছে। যেমন অন্য একটি ঘটনা বর্ণনা প্রসংগে যথাস্থানে তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
৩- এরূপ প্রহসনমূলক আচরণ দ্বারা সে কি আমাদের অভ্যন্তরীন সংহতি এবং পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয় অবগত হতে এবং এভাবে আমাদের মধ্যে দুর্বলতা ও ফাটল সৃষ্টি হয়েছে কি না কিংবা আমরা আল্লাহর যে কালেমার উপর ঐক্যবদ্ধ হয়েছি এখনো তার ওপর অবিচল, দৃঢ়তা ও সংহতি বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছি কি না জানতে চায়? এমনটি হওয়ারও যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
৪- প্রকৃতই সে কোন ফলদায়ক পরিণতিতে উপনীত হতে চাচ্ছিল। কিন্তু পরে সে তার মনোভাব পরিবর্তন করে ফেলেছে কিংবা তার মতামত বদলে দেয়া হয়েছে, তাই বা কে জানে?
৫- সেকি ইখওয়ানের অবস্থান এবং জনগণের মাঝে তাদের শক্তি ও প্রভাব পরিমাণ করতে চাচ্ছিলো? হয়তো তাই হবে।
৬-এ পর্যায় সে কি জনসাধারণের সহযোগিতা লাভ করতে চাচ্ছিলো? কেননা ইখওয়ান ছাড়া জনগণের হযোগিতা লাভ করা আর কোন উপায়েই সম্ভব নয়? এমনটি হওয়াও তো একেবারে অসম্ভব নয়।
৭- সে কি ইখওয়ানের ওপর পুনরায় হস্তক্ষেপ করার জন্য কোন নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করার প্রয়াস পাচ্ছিলো? হয়তো এর কোন একটা অনুমান যথার্থ হবে। আমার তো এমনও মনে হয় যে, সে সকল ক্ষেত্রেই ইখওয়ানকে পেয়েছিল নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত। এ জন্যই সে তাদের সহযোগিতা লাভ করার জন্য সুচিন্তিতভাবে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু পরে তার উপদেষ্টারা এবং সে নিজেও এ সংকল্প বাদ দিয়ে থাকবে যে, ইখওয়ানকে সাথে নেয়ার পর ইসলামী শরীয়াত প্রবর্তন করা ব্যতীত গত্যন্তর থাকবে না। আর এরা শরীয়াতের ব্যাপারে অতিমাত্রায় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে।
আমি আরো ভাবতে থাকলাম যে, হয়তো বা কোন সময় আবেগ বশত অকস্মাৎ মস্মানিত প্রেসিডেন্টের অন্তরে এ ধারণা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে থাকবে। তারপর আবার তিনি সম্বিত ফিরে পেয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে থাকবেন। কি জিনিস তার সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে? সারকথা হলো, প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ-ই অবগত নন। সে যাই হোক গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, ইখওয়ান বিশেষত মুর্শিদে আ’ম আল হুদাইবি (র) তার পক্ষ থেকে এমন সকল প্রস্তাব স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত ছিলেন যাতে প্রাণপ্রিয় দেশমাতৃকার মংগল নিহিত রয়েছে। আমার কল্যাণকর সকল কাজে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার জন্য সদা প্রস্তুত এবং এটাকে আমরা আমাদের নৈতিক কর্তব্য বলে মনে করে থাকি।
ইখওয়ানের লিখিত ভূমিকা
দ্বিতীয়বার মিষ্টর উসমান আহমদ উসমান গৃহায়ন বিষয়ক মন্ত্রী আমাদের সাথে মিলিত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমি আমার তিনজন গণ্যমান্য সাথী জনাব ডাক্তার আহমদ আল সালাত, আলহাজ্জ হুসনী আবদুল বাকী এবং আলহাজ্জ সালেহ আবু রাকীককে সংগে নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে দেখা করতে যাই। মন্ত্রী বাহাদুর অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে আমাদের সাথে মিলিত হওয়ার পর বলতে লাগলেন, “আমার মনে হয়, আপনারা মাননীয় প্রেসিডেন্টের খেদমতে দেশ ও জাতির কল্যাণার্থে আপনাদের সংস্কার কর্মসূচী লিখিত আকারে পেশ করলে সেটাই ভাল হয়। মাননীয় প্রেসিডেন্ট মনোযোগ সহকারে আপনাদের দৃষ্টিভংগী হৃদয়ংগম করবেন এবং এভাবে প্রকৃত কল্যাণের কোন পন্থা হয়তো বেরিয়ে আসবে।”
অনন্তর আমরা আমাদের মতামত ফুলস্কেপ কাগজের পূর্ণ নয় পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করে আহমদ উসমানের নিকট সোপর্দ করি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই খসড়া কর্মসূচী প্রেসিডেন্টের খেদমতে নিয়ে যান। তার কিছুদিন পরই ভাইস প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ হুসনী মোবারক (বর্তমান প্রেসিডেন্ট)-এর সাথে দেখা করার জন্য আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। মিসরুল জাদিদাস্থ তাঁর বাসভবনে কয়েকবার তার সাথে আমার ব্যক্তিগত সাক্ষাত হয় এবং কয়েক দফা সাক্ষাতের সময় উস্তাদ মুস্তফা মাশহুরও আমার সাফে ছিলেন। এ সকল সাক্ষাতকারের সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট সাহেব আমাদের উপস্থাপিত প্রস্তাবাবলীর কোন কোন দিকের ওপর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ জানার ইচ্ছা ব্যক্ত করতে থাকেন। এরপর আবার দীর্ঘ নীরবতা দেখা যায় এবং সাক্ষাতকারসমূহের ধারাবাহিকতা কোন ফলাফল ব্যতীতই বন্ধ হয়ে যায়।
ইখওয়ানের গুরুত্ব ও দেশপ্রেম
এরূপ নীরবতা ও অচলাবস্থার কারণ কি ছিল? তা আমি জানতাম না, যা হোক আমার একটা কথা জানা ছিল যা আমি অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে ব্যক্ত করতে পারি যে, রাজনেতিক ময়দানে ইখওয়ানের অবস্থান এবং সর্বসাধারণের নিকট তাদের স্বীকৃতি সম্পর্কে আমাদের দেশের কর্ণধারগণ খুব ভালভাবেই অবগত রয়েছেন। তা না হলে এরূপ তামাশা ও অভিনয় করার কি প্রয়োজন তাদের? আজ সাক্ষাতের জন্য ব্যাকুলতা আবার কাল কোন প্রকার ফলাফল ব্যতীত তা শেষ করা। আরো একটি কথা যা আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, তা হচ্ছে, বিগত দিনগুলোতে বর্তমান সময়ে এবং অনাগতকালেও ইখওয়ান তার প্রিয় দেশমাতৃকার মংগল ও কল্যাণ কামনায় সদা সচেষ্ট থাকবে। ইখওয়ান কখনো কোন রকম পক্ষপাতিত্ব ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগীর শিকার হয়নি। কোথাও কোন দল যদি আমাদের সাথে দেশ ও জাতির উন্নতি সমৃদ্ধির জন্য আলোচনা ও মত বিনিময়ের সদিচ্ছা প্রকাশ করে তা হলে তারা সেজন্য আমাদেরকে সদা প্রস্তুত পাবে। অনমনীয়তা ও হঠকারিতা আমাদের কর্মনীতি নয়। পারস্পরিক আলাপ আলোচনা ও বুঝাপড়া এবং দেশপ্রেম আমাদের কর্মনীতি নয়। পারস্পরিক আলাপ আলোচনা ও বুঝাপড়া এবং দেশপ্রেম আমাদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এসব সংলাপের মাধ্যমে একটা বিষয় দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ইখওয়ানের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা, দেশদ্রোহিতা ও প্রতারণার যেসব ভিত্তিহীন অভিযোগ অব্যাহতভাবে লাগানো হচ্ছে তাতে সত্যতা ও বাস্তবতার লেশমাত্র ছিল না। আমরা যদি সত্যিই অবিশ্বাসী হতাম তবে আর আমাদেরকে আলাপ-আলোচনার জন্য আহবান জানানোর কি অর্থ? অভিযোগ আরোপকারীগণ যখনই ইখওয়ানের ওপর আক্রমণ চালান তখন নির্ভরযোগ্য কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ ব্যতীতই তাদেরকে সবরকম “পদবী” তে ভূষিত করতে থাকেন।
তাদের লজ্জা শরমের যেমন বালাই নেই তেমনি আল্লাহ ভীতির ব্যাপারেও তারা হয়ে গেছে সম্পূর্ণ বেপরোয়া। আমরা মাঝে মধ্যেই তাদের এরূপ বিষাক্ত তীরের অসহায় শিকার হয়ে থাকি। আমরাও জানি যে, এসব কূটকৌশল আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতেই থাকবে। সাথে সাথে আমরা অত্যাচারীদেরকেও দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিযে দিতে চাই যে, শীগ্রই তাদের পরিণতি তারা ভোগ করতে বাধ্য হবে। আল্লাহর ওয়াদা মূর্ত হয়ে দেখা দেবে। (আরবি************) “আর জালেমরা শীগ্রই জানতে পারবে যে, তারা কোন্ পরিণামের সম্মুখীন হচ্ছে।” –সূরা আশ শুয়ারাঃ ২২৭
প্রধান মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত
মিষ্টার ফুয়াদ মহীউদ্দীন মরহুম ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে আমাকে তার সাথে সাক্ষাতের জন্য ডেকে পাঠান। মরহুম তখন প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। তার সে সময়কার ব্যক্তিগত সচিব একনও বেঁচে আছেন। তিনি এসব ঘটনা প্রবাহের সত্যতা নিরূপন করতে পারেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে দীর্ঘায়ু দান করুন। আমি যথা সময়ে উজীরে আজনের দপ্তরে গিয়ে পৌঁছলাম। আমার ধারণা ছিল, প্রধান মন্ত্রী আমাকে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার জন্য ডেকে থাকবেন। প্রায় আধা ঘন্টা ব্যাপী আলোচনা চললো। এ দীর্ঘ সময়ে মহামান্য উজীর আমাকে শুধু মাত্র এতটুকু জিজ্ঞেস করলেন যে, আসন্ন নির্বাচনে ইখওয়ান কাকে সমর্থন করবে। তাদের পক্ষ থেকে কে প্রার্থী হবেন এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। আমি আরজ করলাম, ইখওয়ান এখনো পর্যন্ত কারো সাথে ঐক্য চুক্তিতে আবদ্ধ হয়নি। এ ছাড়া তিনিও আর কিছু জানতে চাননি এবং আমিও কিছু বলিনি।
আমি চলে আসতে উদ্যত হলে তিনি বললেন, আমাদের মধ্যে এরূপ পারস্পরিক সাক্ষাত ও মত বিনিময় হতে থাকবে। আমি তাতে আনন্দই প্রকাশ করলাম। সত্য কথা বলতে কি মরহুমের বেশ কিছু মহৎগুণ ছিল। তিনি ছিলেন একাধারে কোমল হৃদয়, দয়াদ্রচিত্ত এবং অন্যদের কথা শান্ত মনে শ্রবণ করার মত গুণের অধিকারী। আমার আকংখা ছিল যে, এ ধরনের সাক্ষাত ও মত বিনিময়ের সুযোগ অব্যাহত থাকুক। বিশেষ করে যতদিন পর্যন্ত দু’পক্ষই একে অন্যের কথা শুনতে ও বুঝতে প্রস্তুত থাকবে। ‍কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস। আকস্মিম মৃত্যুর হিমশীতল হাতছানি মরহুমকে বেশী অবকাশ দেয়নি। আল্লাহ তাঁর ওপর রহম করুন এবং আমাদের সকলকেও তার অফুরন্ত অনুকম্পা লাভে ধন্য করুন।
ক্ষমতার মসনদে সমাশীন কর্তৃপক্ষ যদি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারতেন এবং বুঝতে পারতেন যে, এ ধরনের সমঝোতা পূর্ণ আলাপ আলোচনায় উপকারী ও ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং এভাবে জনসাধারণের সহযোগিতা লাভের সহজ সোপান গড়ে উঠছে তাহলে তাদের এক সাথে বসার এবং মতামত বিনিময়ের গুরুত্ব অবশ্যই উপলব্ধি করা উচিত। মখোমুখি বসে খোলাখুলি কথাবার্তা দ্বারা অনেক ভুল বুঝাবুঝি দূর হয়ে যায় এবং বাহ্যিক অনেক কঠিন সমস্যারও সহজ সমাধান বেরিয়ে আসে। রকমারী মতামত পোষণকারী ব্যক্তি কিংবা দলের পক্ষে এটা অত্যন্ত কল্যাণকরও যে তারা কোন প্রকার মধ্যস্থতা ব্যতীতই একে অন্যের সাথে সত্য সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলবে এবং নিজ নিজ দৃষ্টিভংগী প্রতিপক্ষকে অবহিত করতে চেষ্টা করবে।
রটানো নির্দেশ
যখনই আমি ইখওয়ানের ইতিহাস আমার স্মৃতির পাতায় রোমন্থন করি তখনই তার পুরো চিত্র আমার দৃষ্টির সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ১৯৫৪ সালের জানুয়ারী মাসেই ইখওয়ানকে ধরপাকড় শুরু হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসেই আমাকে গ্রেফতার করা হয়।
সকাল আনুমানিক দশটার দিকে আমাদেরকে আমাদের কারাগারের সেল থেকে বের করে আনা হতো যেন আমরা কিছু সময় রোদ পোহাতে পারি। এটা হতো সরকারী প্যারেড এর মতই এবং এর সমস্ত পর্যায়ই ছিল যান্ত্রিক নিয়মের। আজও সেসব শব্দ আমার কানে প্রতিধ্বনিত হয়ে থাকে এবং আমার দৃষ্টির সামনে সেসব দৃশ্য এখনও বার বার ভেসে ওঠে। আমাকে এমনভাবে বসানো হতো যে আমার সম্মুখে পশ্চাতে ও ডানে বামে দু’দু মিটার ব্যবধানে ইখওয়ানীরা বসা থাকতো। যখন আমরা সকলেই উপবিষ্ট হতাম তখন একজন অফিসার আমাদের সামনে এরূপ আসন গেড়ে বসার ব্যাপারে জেল ম্যানুয়েল-এর বিধি-বিধান পড়তে শুরু করতো। মনে হতো যেন সে “তিলাওয়াত” করছে। কথাবার্তা বলা ছিল নিষিদ্ধ। ফিশ ফিশ ও কানাকানি করা ছিল অপরাধ। চোখ, হাত কিংবা মাথার সাহায্যে কাউকে কোন প্রকার ইশারা করা ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনরূপ নড়চড়ার আদৌ কোন অনুমতি ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে আমাদেরকে রোদ পোহানোর অনুমতি দেয়া হতো। যেহেতু আমাদেরকে জেলখানার পৃথক পৃথক সেলে আবদ্ধ করে রাখা হতো। সেহেতু এই সুযোগে আমাদেরকে পারস্পরিক মতামত বিনিময়ের সুযোগ গ্রহণ কঠোরভাবে নিষেধ করা হতো। কিন্তু বিবেকের এই অন্ধরা কি বুঝতে পারতো যে হৃদয়ের গভীর কন্দরে জাগ্রত অনুভূতি কোন প্রকান নড়াচড়া ও ইংগিত ইশারা ছাড়াই অন্যের হৃদয়ে সাড়া জাগাতে পারে। আমরা সাধারণত যে কোন তথ্য একে অন্যকে অবহিত করার ইচ্ছা করতাম অথবা জানার আকাংখা পোষণ করতাম তার সবটাই আমরা এ অবসরে করে ফেলতে পারতাম।
আমীরুল উমারা
সময় কত দ্রুত অতিবাহিত হয়। নাসেরের দুঃশাসন কাল আসলো এবং আমাদের মাথার ওপর দিয়ে অতিবাহিতও হয়ে গলো। তখন আমরা বার বার আমাদের মাথা দিয়েছি কিন্তু বিপদ সঙ্কুল প্রেমের কঠিন হৃদয় অভিযাত্রীদল প্রতিবন্ধকতার সকল প্রান্তর অতিক্রম করে সর্বদা লক্ষ্য পানে অগ্রগামী হতে থাকে। নাসেরের পরে শুরু হয় সাদাতের শাসনকাল। আমার চোখের সামনে সাদাতের উসকে দেয়া সাম্প্রদায়িকতার আগুন ঘুরপাক খাচ্ছিল। সাদাত তার নিজের বিশেষ স্বার্থের জন্য মুসলিম ও কিবতি সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত লাগিয়ে দিয়েছিল। আমরা সবসময় এ ধরনের ঘৃণা বিদ্বেষের বিরোধিতা করেছি। ইসলামী দলসমূহ একটা ঐক্য জোট গঠন করেছিল। এ সংগঠনের সদস্যদের সহযোগিতায় তৎকালিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জেনারেল নববী ইসমাঈল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সবরকম সযত্ন প্রয়াসে সাহায্য করেন। নানা প্রকার আবেদন নিবেদন করতে থাকেন। আমি ছিলাম ঐ সংগঠনের প্রধান। অতএব এক বিশেষ অধিবেশনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আমাকে “আমীরুল উমারা” উপাধিতে ভূষিত করেন। উক্ত অধিবেশনে উস্তাদ মুহাম্মাদ আল গাযালী, জনাব সালাহ আবু ইসমাঈল, উস্তাদ ইবরাহীম শরফ প্রমুখ স্বনাম ধন্য ও বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গও উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রী মহোদয় অত্যন্ত সুচিন্তিত হৃদ্যতা পূর্ণ পরিবেশে আমাকে এ উপাধি প্রদান করেন। কেননা তিনি কার্যত এটা খুব ভালভাবেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন যে, আমরা সাম্প্রদায়িক দাংগার কট্টর বিরোধী এবং তা নির্মূল করার জন্য সর্বাত্মক এবং ফলপ্রসু উদ্যেগ গ্রহণ করেছিলাম। সরকার প্রথমে এ উত্তেজনার আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা তাদের নির্বুদ্ধিতা উপলব্ধি করলো এবং বুঝতে পারলো যে, এ দাবানল প্রশমিত করা এখন তাদের সাধ্যাতীত। যদি এ পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা না যেতো তাহলে তা সারা দেশকে জ্বালিয়ে শেষ করে দিতো।
মিথ্যার কোন ভিত্তি থাকে না
এটা অত্যন্ত বিষ্মিয়ের ব্যাপার যে, প্রেসিডেন্ট সাদাত প্রথম দিকে এ উত্তেজনার অনল প্রজ্জলিত করে ফলাও করে প্রচার করতে থকেন যে, এর নটের গুরু আমি (ওমর তিলমেসানী) ১৯৮০ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট অধিবেশনে জ্বালাময়ী বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে তিনি বলেনঃ “আমি খুব ভাল করেই জানি যে, এই অনাকাংখিত পরিস্থিতি ওমর তিলমেসানীরই সৃষ্টি......... এই অভিনব ধারণা উদ্ভাবনের জন্য পার্লামেন্ট সদস্যগণ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত হাততালি দিতে থামেন যেন প্রেসিডেন্ট কোন জটিল বিষয়ের সমাধান হাস্যরসের মধ্যে দিয়েই করে ফেলেছেন। এসব নির্বোধ ও জ্ঞানপাপীদের সামনে এ বক্তৃতা পেশ করার সময় প্রেসিডেন্ট একথাও বললেন যে, “ইসলামী দলগুলোর ঐক্যজোট অবশ্য এ বিপর্যয় রোধ করার জন্য উল্লেখযোগ্য ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। সে জন্য আমরা তাদের নিকট আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।”
এটা ঠিক বুঝা যাচ্ছিল না যে, প্রেসিডেন্ট তখন সময়ের নিষ্ঠুর বাস্তবতা ভুলে গিয়েছিলেন নাকি। একথা জেনেও না জানার ভান করছিলেন যে, এ অধমই আলোচ্য সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন। হতে পারে যে, তিনি পার্লামেন্ট সদস্যগণকে এমন নির্বোধ ও দুর্বল মস্তিষ্কের অধিকারী মনে করেছিলেন যে, মুর্হূতের মধ্যেই তারা তার প্রথমোক্ত কথাটি একেবারেই ভুলে গিয়েছিলেন। খুব বেশী ঢাকা-ঢোল পিটাতে যারা অভ্যস্ত, অন্যের পদলেহনও করতে যারা গর্ববোধ করে দায়িত্বহীন কথাবার্তা বলাই যাদের স্থায়ী অভ্যাস তারা খুব শীগ্রই ভুলে যায়। কথায় বলেঃ মিথ্যার কোন ভিত্তি থাকে না।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, তাঁর এই দ্বিতীয় উক্তির পরও পার্লামেন্ট সদস্যগণ হাততালি দিতে থাকেন। আল্লাহ তায়ালাই ভাল জানেন এ জাতির এসব প্রতিনিধির করতালি দেয়ার রোগে পেয়ে বসেছে না তারা মনে করে যে মহামান্য রাষ্ট্রপতির পবিত্র মুখ থেকে যা কিছুই নিঃসৃত হয় তার সবটাই ভূয়সী প্রশংসার যোগ্য।
নিজের দিকে একটু তাকিয়ে আত্মমর্যাদা
উপলব্ধি করতে চেষ্টা করুন
সাদাত সাহেবের হত্যাকান্ডের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয় এবং অন্য সমস্ত মন্ত্রণালয়ের দপ্তরসমূহ দুর্ভোদ্য দুর্গের ন্যায় সুরক্ষিত এবং সশস্ত্র প্রহরা মোতায়েন করা হয়। ইত্যবসরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জেনারেল নববী ইসমাঈল আমাকে তারঁ সাথে সাক্ষাতের জন্য ডেকে পাঠান। নিরাপত্তা প্রহরীগণ বার কয়েক আমার মত একজন বয়োবৃদ্ধ ব্যাক্তির দেহ তল্লাশী করেন যাতে আমার কাছে কোন অস্ত্রশস্ত্র না থাকে। এতখানি সতর্ক হওয়া সত্ত্বেও এ লোকদের স্নায়ুতে এমন ভয়ভীতি চেপে বসছিল যে, দু’ দু’জন মেশিনগানধারী সশস্ত্র নওজোয়ান পূর্ণ সতর্কতাবস্থায় প্রহরারত ছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দপ্তরকে যুদ্ধের ঘাঁটি বলে মনে হচ্ছিল।
আমাদের দুঃসাহসী বীর ও অত্যন্ত মূল্যবান বন্ধু জনাব কামলুদ্দিন সানানিরী ইতিমধ্যেই জিন্দানখানার দুঃসহ অত্যচার নির্যাতনের অসহায় শিকার হয়ে শাহাদাতের সুধা পান করেছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী নিজেও এ নির্যাতনে অংশীদার ছিলেন। এ ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায়ও সংবাদ প্রকাশিত হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আমাকে স্বাগত জানান এবং আমাকে অবহিত করেন যে, কামাল সানানিরী জেলখানায় আত্মহত্যা করেছেন।
এর চেয়ে ডাহা মিথ্যা আর কি হতে পারে। ইখওয়ানের একজন সাধারণ কর্মীও কোনদিন আত্মহত্যার কল্পনাকে তার মনে স্থান দেয়নি। কামাল তো ছিলেন একজন অতিবড় আলেম, সাহসী মুজাহিদ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আমাকে এও বলেন যে, আমি চাইলে তিনি আমাকে কাসরুল আইনি কারাগারে পাঠিয়ে দিতে পারেন। (মুর্শিদে আ’ম তখনও নজর বন্দী ছিলেন এবং তুলনামূলকভাবে অধিকতর নিকৃষ্ট জেল তুররায় রাখা হয়েছিল। জেলখানা থেকেই তাঁর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়েছিল।) আমি তাঁকে বললামঃ “আমার জন্য সব জায়গা একই রকম যেখানে ইচ্ছ পাঠিয়ে দাও।” (কাসরুল আইনি হাসপাতালে কোন কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও নজর বন্দী ছিলেন।)
সেদিন আসরের নামাযের পর জেলখানায় আমার নিকট জনৈক অফিসার আগমন করেন এবং কাসরুল আইনির বন্দীশালায় আমাকে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে বহু সংখ্যক নেতা এবং মিসরের জ্ঞানীগুণী ও পন্ডিতদের সাথে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়। নববী। ইসমাঈলের সীমালংঘনমূলক যে আচরণের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি তার সমস্ত দায় দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে। কিন্তু আমি সর্বদা মানুষের সাথে ইনসাফই করে থাকি। যার মধ্যে যে গুণ রয়েছে তা স্বীকৃতি প্রদানে আমি কখনো কার্পণ্য করি না। আমি যখন বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পাই তার কয়েক মাস পর তৎকালীন জনৈক মন্ত্রীর সাথে আমার সাক্ষাত হয়। তিনি আজও জীবিত রয়েছেন। তিনি আমাকে অবহিত করেন যে, আমার গ্রেফতারীর বিষয়টি যখন সংসদে আলোচনার জন্য উত্থাপিত হয় তখন নববী ইসমাঈল তার তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত নীরবতা অবলম্বন করেননি। যতক্ষণ স্বয়ং সাদাত অত্যন্ত অসন্তোষ প্রকাশ করে তাঁকে চুপ করার নির্দেশ প্রদান করেন।
আতিথেয়তার পরীক্ষা
লীমানতারা জেলখানা অনেকবারই আমাদের বাসস্থান হয়েছে। এ ধরপাকড়ের সময়ও আমাকে উক্ত কারাগারেই রাখা হয়েছিল। জিন্দানখানার দারোগা অধিকাংশ সময়ই আমার নিকট আগমন করতো। তিনি অত্যন্ত নিরহংকার ও সাদাসিদে মানুষ ছিলেন। তিনি সর্বদা আমাকে অবহিত করতেন যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব নববী ইসমাঈলের পক্ষ থেকে এ মর্মে বার বার নির্দেশ আসা অব্যাহত রয়েছে যেন আপনার সার্বিক আরাম আয়েশের প্রতি আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখি। ইতিপূর্বে আমি কখনো এ কয়েদখানায় এত আরাম-আয়েশ উপভোগ করার সুযোগ পাইনি। কিংবা তা কল্পনাও করতে পারিনি। প্রথম দিকে তো নির্মমতার ষ্টীমরোলার চালানো হতো। আর আমরা সেজন্য মানসিকভাবে তৈরী থাকতাম। এখন আপ্যায়ণ-আতিথেয়তাও মুসিবত হয়ে দেখা দিয়েছে। কর্মকর্তাগণ সদাসর্বদা ছায়ার মত এমনভাবে আমার সাথে সাথে থাকতো যে শেষ পর্যন্ত আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেতে লাগলো।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে যখন আমার সাক্ষাত হয় তখন আমি তার নিকট অত্যন্ত কঠোরভাবে অভিযোগ করি যে, জেলগারদে কয়েদীদের সাথে এখনো পর্যন্ত পশুসুলভ বর্বর আচরণ করা হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ আমি তার নিকট বর্ণনা করলাম যে, আমার কামরার নীচের কামরার বন্দীদের উপর মধ্যরাতে অত্যাচার ও মারপিট শুরু হয়ে যায়। একাধারে সকাল পর্যন্ত এ হৃদয় বিদারক দৃশ্য অব্যাহত রাখা হয়। অত্যাচারিত দুঃখী মানুষদের করুণ আর্তনাদ ও আহাজারী শুনে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসতে চায়। মন্ত্রী বাহাদুর একথা শুনে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন এভাবে যে, “শাস্তি প্রদান তো নিষিদ্ধ। তথাপি জেলখানায় দাগী আসামীদেরকে শিক্ষামূলকভাবে ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে কিছু কিছু শাস্তি দেয়া হয়ে থাকে।” এ হতভাগা বন্দীদেরকে তাদের হাত পা বেঁধে কারাভ্যন্তরে তাদের কৃত অপরাধের জন্য চাবুক মেরে শাস্তি প্রদান করা হয়। আমি মন্ত্রী মহোদয়কে আর কিই বা বলতাম। তিনি যা বলছিলেন বাস্তবের সাথে তার লেশমাত্র সম্পর্ক ছিল না । আমি খুব ভাল করেই জানতাম যে, শিক্ষামূলক শাস্তির বিধান জেল ম্যানুয়েল থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। আর যখন তা রহিত হয়েছিল না তখনো তার নিয়ম ছিল অপরাধিদেরকে দিনের বেলা শাস্তি প্রদান করা দুপুর রাতে নয়।
ইখওয়ানের প্রতি নাসেরের শত্রুতা
আমার আজও মনে আছে যে, জামাল আবদুন নাসের সেই সব সংবাদপত্র সাময়িকী একত্রিত করেছিলেন যাতে ইখওয়ানের লিখকগণ মুসলিম শাসকদের কাছে ইসলামী শরীয়াত কার্যকরী করার দাবী জানিয়েছিলেন। এসব রচনা ও প্রবন্ধ এতদঞ্চলের বিভিন্ন শাসকদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং সকলকে এরূপ পদক্ষেপের বিপজ্জনক পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করে দেয়া হয়েছিল। এমনিতে জামাল আবদুন নাসের শুধু মাত্র মিসরেই ইখওয়ান নিধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। বরং অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে তিনি ইখওয়ানের হত্যা, এবং অত্যাচার- উৎপীড়নের ব্যবস্থা পাকা পোক্ত করেছিলেন।
নাসের মস্কোতে গিয়ে অত্যন্ত গর্বের সাথে ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি একরাতে বিশ হাজার ইখওয়ানীকে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দী করেছেন। আমি নাসেরের এ জঘন্য ঘোষণাকে এজন্য রেকর্ড করিয়ে দিতে চাই যাতে ইতিহাসের এই আমানত ইতিহাসের নিকটই সোপর্দ হয়ে যায়।
তাঁর অত্যাচার ও জুলুম নিপীড়নের কাহিনী কারো অজানা নয়। আর আমরা তো এখনো পর্যন্ত তার জুলুম-নির্যাতন ভুলে যেতে পারিনি। এতদসত্ত্বেও আমি আমার মনে কোন প্রতিশোধ স্পৃহা পোষণ করি না। আমি সকল গোনাহগার মুসলিমের জন্য আল্লাহ তায়ালার সমীপে তার রহমতের দোয়া করে থাকি। নাসেরের জন্যও তাই। আমি মহান আল্লাহর নিকট মাগফিরাতের দোয়াই করছি।
আমি সকল নিষ্ঠাবান মুসলিমকে এ মর্মে উপদেশ প্রদান করতে চাই যে, জালেমদের বিরুদ্ধে বদ দোয়া করার পরিবর্তে তাদের কিভাবে জুলুম থেকে বিরত রাখা যায় সেই চিন্তা করুন।
নাসেরের আসল চেহারা কারো কাছে গোপন নেই। প্রচার-প্রপাগান্ডার সাহায্যে তিনি তার যে ইমেজ তৈরী করেছিলেন বাস্তব থেকে তা বহু দূরে।
তিনি শাহ ফারুকের বিলাসবহুল জীবন ও ব্যয় বাহুল্যের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তার বক্তব্যের সমর্থনে প্রমাণ হিসেবে শাহের বিলাসী প্রমোদ তরীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন। যা হোক কে না জানে যে, ঐ প্রমোদ তরীই অধিকতর সাজ-সরঞ্জামে সুসজ্জিত করার পর নাসের সাহেবের বিলাসী জিন্দেগীর শোভা বর্ধন করার জন্য অবিরাম ব্যবহৃত হয়েছে। নাসেরের আত্ময়ীস্বজন পরিবার পরিজন ও সাথী সংগীদের সকলেই তার সাথে এই জাহাজে আরোহণ করেই মিসর থেকে ইউরোপে যাতায়াত করতো।
নাসেরের শাসনামলের আরো একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, জ্ঞানী গুণী এবং বিদগ্ধ পন্ডিতগণ ও বিভিন্ন বিষয় ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন ব্যক্তিদের পরিবর্তে তার অনুগত নির্বোধ অশিক্ষিত লোকদেরকে সকল ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার গ্রদান করা হতো।
মুহাম্মদ আলী পাশার বংশধরগণ এবং তাদের অঢেল বিত্ত-বৈভবের বিরুদ্ধে নাসেরের তীব্র সমালোচনা সম্পর্কে কে না জানে? তিনি তাদের অলংকার ও মণি মুক্তার ব্যাপারে কতকি অশালীন কটূক্তি করেছিলেন এবং মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করেছিলেন তার কোন ইয়াত্তা নেই। ভাগ্যের পরিহাস! দেখুন এই বিপ্লবী ক্ষমতার দন্ড নিজ হাতে তুলে নিয়েই এসব সম্পদ ও অলংকারাদি সরকারের অনুকূলে নয় বরং নাসেরের পরিবারের অনুকূলে জব্দ করে নেয়া হয়। অনন্তর এগুলোর যে মারাত্মক অপব্যবহার হয় সে সম্পর্কে মিসরের ইতিহাসের প্রতিটা ছাত্রই সম্যকরূপে পরিজ্ঞাত আছে।
শাহ তো রাজতন্ত্রের প্রতীক ছিলেন। কিন্তু নাসের বিপ্লব ও স্যোসালিজমের নামে শাহ অপেক্ষাও অনেক বেশী লুটপাট করেন। আবার সমালোচকদের মুখও তিনি নির্মমভাবে বন্ধ করে দেন।
একাদশ অধ্যায়
সাদাতের শাসনকালের শেষের দিকে আযাদ অফিসার ইখওয়ানের কিছু সংখ্যক বন্ধু-বান্ধবের সাথে যোগাযোগ করে এরূপ আকাংখা প্রকাশ করে যে, এমন একটা রাজনৈতিক দল গঠন করা হোক যাতে দু’দলের (অর্থাৎ আযাদ অফিসার ও ইখওয়ান)-এর লোকজন যুগপৎ অংশ গ্রহণ করতে পারে। যেসব লোক এ প্রস্তাব পেশ করেছিলেন তারা আজও জীবিত আছেন এবং তাদের প্রত্যেকের নাম আমাদের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। আমি কোন প্রকার নামধাম ও খ্যাতির লোভে এ ঘটনা লিখছি না বরং শুধুমাত্র স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যই লিখার প্রয়াস পাচ্ছি। কারণ স্মৃতিচারণ দ্বারা মু’মীনদের উপকারই হয়ে থাকে। ইখওয়ানী বন্ধুগণ আলোচনার সময় ‘আযাদ অফিসার’ প্রতিনিধিদের জানিয়ে দিলেন যে, এ ভানুমতির খেলা কেবল মাত্র সবার হাসির কারণ হবে। সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী বিষয় বা বস্তুর সমন্বয় একেবারেই অসম্ভব। জামাল আবদুন নাসেরের আমলে আযাদ অফিসার-এর হাতে ইখওয়ানের ওপর যেভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছিলো কালের আবর্তন এখনো তা মুছে দিতে পারেনি।
জনৈক অফিসার- যিনি আজও জীবিত আছেন- বলেছিলেন, আবদুন নাসেরের সময় ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে তা যর্থাথই ছিল। কিন্তু তারপর যা কিছু সংগঠিত হয়েছে তা ছিল সম্পূর্ণ ভুল ও অন্যায়। যদি তিনি এতটুকু কথাও বলতেন যে, নাসেরের আমলে সংগঠিত অত্যাচারের জন্য আমরা লজ্জিত এবং পুরো এই শাসন কালটাই ছিল জুলুম-নিপীড়নে ভরপুর। তথাপি প্রস্তাবিত দল গঠন সম্ভব ছিল না। আর যদি এমন একটা দল গঠন করা হয়েও যেতো তাহলেও জনসাধারণের তার প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধ থাকতো না। যাই হোক উপরোক্ত জবাব লাভের পর একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পুরোনো অভ্যাস যেতে সময় লাগে। ইখওয়ানের ওপর পরিচালিত জুলুম-নির্যাতনকে যারা যথার্থ বলে মনে করেন তারা কোন্ মুখে তাদের কাছে সহযোগিতা কামনা করতে পারেন? আর ইখওয়ইবা কোন্ যুক্তিতে কিসের ভিত্তিতে সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে পারে। অতএব এ আলোচনা থেকে আমরা নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নেই।
শহীদ আবদুল কাদের আওদার জনপ্রিয়তা
মিসরে আযাদ অফিসার যখন শাহ ফারুককে ক্ষমতা চ্যুত করে সামরিক শাসন জারী করেন তখন সংস্করের ঘোষণাসমূহ বিবেচনা করে আমরা তাদেরকে স্বাগত জানাই। নতুন বিপ্লবী সরকার এবং তার কর্তা ব্যক্তিদের সাথে শহীদ আবদুল কাদের আওদার অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। আযাদ অফিসার ও ইখওয়ানের মাঝে প্রথমেই এ মর্মে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, দেশে সত্যিকার ইসলামী আইন জারী করা হবে। যখন আযাদ অফিসার নানা প্রকার টাল বাহানা করে ইসলামী অনুশাসন চালুর ব্যবস্থাকে বিলম্বিত করতে শুরু করলো তখন জনসাধারণ তাদের নিয়াত সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতে লাগলো। অতএব ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সেই ঐতিহাসিক বিক্ষোভ শুরু হয়। যা সরকারকে প্রকম্পিত করে তোলে। আবেদীন প্রাসাদের সম্মুখের বিশাল ময়দান বিক্ষোভকারীদের দ্বারা ভর্তি হয়ে যায়। চারদিকে শুধু মানুষের মাথা আর মাথাই দেখা যাচ্ছিলো। এর ঠিক পূর্বেই হাসান আল হুদাইবি ও ইখওয়ানের অন্যান্য প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। উপস্থিত সকলের মুখেই ছিল ইসলামী বিধান চালু কর এবং হাসান আল হুদাইবি ও তার অন্যান্য সংগীদের মুক্তির স্বতঃস্ফূত দাবীও গগণ বিদারী শ্লোগান মুহূর্মুহ উচ্চারিত হচ্ছিলো। শ্লোগানের আওয়াজে পরিবেশ ধ্বনিত – প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠছিলো।
এ সমাবেশকে পন্ড করার সকল সরকারী ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়। প্রজাতন্ত্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল মুহাম্মদ নাজীর শহীদ আবদুল কাদের আওদাকে ডেকে পাঠান এবং তার কাছে জনসভা ছত্রভংগ করে দেয়ার কাজে সরকারকে সহযোগিতা প্রদানের আবেদন জানান। শহীদ আবদুল কাদের আওদা জেনারেল নাজীরের সাথে প্রেসিডেন্ট ভবনের ব্যালকুনিতে দাঁড়ালেন এবং জনতাকে উদ্দেশ করে বললেনঃ “আপনারা আপনাদের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করেছেন এবং নিজেদের দাবীদাওয়াও পেশ করেছেন। এখন আপনারা নিজ নিজ বাড়ীতে ফিরে যান।”
একথা বলার কয়েক মিনিটের মধ্যে আবেদীন ময়দান এমনভাবে জনমানবশূন্য হয়ে গেল যে, সেখানে যেন কোন মানুষের অস্তিত্বই ছিল না। অতপর আবদুন নাসের বুঝতে পারলেন যে, আবদুল কাদের আওদার জনপ্রিয়তা তার সরকারের জন্য যে কোন মুহূর্তে বিপদের কারণ হতে পারে।
জেল-জুলুম ও বন্ধিত্ব
এর একদিন বা দুইদিন পরই আবদুল কাদের আওদা শহীদকে গ্রেফতার করে। একটি কাঠপুতুল আদালতে পেশ করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এই যে, তিনি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করেছেন। ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদের সকল সদস্যের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করা হলো। মুর্শিদে আম জনাব হাসান আল হুদাইবি, আবদুল কাদের আওদা শহীদ এবং উস্তাদ মুহাম্মদ ফারাগলী প্রমুখকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলো। ডাক্তার খামীস মরহুম, উস্তাদ সালেহ্ আবু রাকীক, উস্তাদ আবদুল আযীয আতিয়া ও উস্তাদ মুহাম্মদ হামেদ আবু নসরকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করা হলো এবং শেখ আহমদ শারীত ও এই বইয়ের লেখক ওমর তিলমেসানীকে পনের বছর করে কারাদন্ড প্রদান করা হয়।
শেখ আবদুল মুয়েজ আবদুস সাত্তার, শেখ মুহাম্মদ বাহী আল খাওলী এবং উস্তাদ আবদুর রাহমান আল বান্নাকে মুক্তি দেয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবিকেও মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। অথচ তাঁর অন্যসব সংগীদেরকে নির্দয়ভাবে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়।
আমাদের প্রত্যেককে পৃথক পৃথক জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। তারপর আমাদেরকে বার বার এক জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তর করার কাজ অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। শাস্তির পরোয়াণা জারী করার পর আমাকে মিসর নামক কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অতপর এক এক করে বানী সাভীফ, আল ওয়াহাত, আল মাহারীক, আসইউত, কানা এবং সর্বশেষ লীমান তাররা জেলখানায় প্রেরণ করা হয়। লীমান তাররা নামক স্থানের কারাগারেই আমার সুদীর্ঘ পনের বছরের শাস্তির মেয়াদ পূর্ণ হয় এবং এরপর সেই জেলের ফার্মেই অতিরিক্ত আরো দু’বছরের জন্য আমাকে নজর বন্দী করে রাখা হয়।
এ দু’বছর ও অতীতের গর্ভে বিলীন হলে আমার পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়- স্বজন আমাকে বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য জেল ফটকে এসে হাজির হয়। কয়েদের মেয়াদকাল পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও আমি জানতাম যে আমার মুক্তির সময় আরো পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।
নাসেরের দয়াদ্রচিত্ততা ও ইনসাফ
আমি আমার প্রিয়জনদেরকে বাড়ীতে ফিরে যেতে বললাম। আপনারা তাদের দুঃখ, মনোকষ্ট ও অনুতাপ অনুমান করতে পারেন। তাদের ধারণা ছিল যে, রামাদান মাসের সেদিনের ইফতার আমি তাদের সাথে বাড়ীতে গিয়ে করবো। কিন্তু তাদের সম্মুখে আবদুন নাসেরের ন্যায় নিষ্ঠতা ইনসাফ দয়াদ্রচিত্ততা এবং বিশ্বস্ততার স্বরূপ উদঘাটিত হয়ে পড়ে তখন যখন আমাকে আরো কিছু কালের জন্য জিন্দানখানার মধ্যেই রাখার ফরমান জারী করা হয়।
আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকগণের মধ্য থেকে জনৈক বুজর্গ তাঁর এক নিবন্ধে জামাল আবদুন নাসেরের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং ইনসাফ কোমলতা ও হৃদ্যতার যথোপযুক্ত বিবরণ তুলে ধরেন। আল্লাহ তায়ালা আমাকেও মাফ করুন। আর উক্ত শেখ সাহেবকেও ক্ষমা করুন। তিনি তার কলমের ভাষায় যা কিছু লিপিবদ্ধ করেছিলেন তা তার জন্য আদৌ মানানসই ও শোভনীয় ছিল না। আমর ধারণা তিনি এসব কথা কোন প্রকার বিনিময় ছাড়াই শুধুমাত্র চাটুকারিতা ও মোসাহেবীর ভংগীতেই লিখেছিলেন। কবির ভাষায়ঃ
“প্রত্যেক কাজের জন্যই যথোপযুক্ত লোক যথাসেময়ে পাওয়া যায়।”
আদালতের আচরণ
যে আদালতের কথা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে সেটি ছিল সামরিক আদালত। একে আদালত নমে অভিহিত করা ন্যায় ও ইনসাফের উপহাস ও বিদ্রূপ করারই নামান্তর। এই তথাকথিত আদালতের কাজ তো শুধু পূর্বে গৃহিত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা মাত্র। আর মামলার শুনানি তো নিছক অভিনয় ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। এই ট্রাইবুনাল ছিল তিনজন সামরিক অফিসারের সমন্বয়ে গঠিত। যার প্রধান ছিলেন জামাল সালেম এবং সদস্য ছিলেন যথাক্রমে হোসাইন শাফেয়ী ও আনোয়ার সাদাত। ট্রাইবুনালে কোন বক্তব্য শোনা হয়নি কিংবা কোন প্রকার যুক্তিতর্কও হয়নি। উপহাস-বিদ্রূপ এবং হেয় ও অবজ্ঞা করাই ছিল এ ট্রাইবুনালের বৈশিষ্ট্য।
যিনি হন্তা তিনিই সাক্ষী ও বিচারক
ডাক্তার খামীস হামীদাকে জিজ্ঞেস করা হলো যে, তিনি সূরা ফাতেহা জানেন কি না? যদি জানেন তাহলে তিনি যেন তা মুখস্ত পড়ে শুনান। সত্যি করে বলুন তো একথা শুনলে মানুষ হাসবে না কাঁদবে? আপনি কি কখনো এমন আদালত দেখেছেন, না শুনেছেন? দৈহিক নির্যাতনের মাধ্যমে অপরাধের স্বীকৃতি আদায়ের পর যখন কোন একজন মজলুম আদালতে বললো যে, তার নিকট থেকে জোর পূর্বক এই স্বীকৃতি আদায় করা হয়েছে তখন আদালত প্রধান তার নেকড়ে সুলভ তদন্ত অফিসারকে বলে দেন যে, “আদালত মুলতবী, ওকে নিয়ে যাও এবং তার জবানবন্দি শুধরিয়ে পুনরায় হাজির করো------।”
অত্যাচার-উৎপীড়নের এমন চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা হতো যে, নির্যাতিত ব্যক্তিকে দ্বিতীয়বার যখন আদালতের কাঠগড়ায় এনে হাজির করা হতো তখন তাকে বাধ্য হয়েই তদন্তকারী অফিসারগণের লিখিত প্রতিবেদনকেই তার নিজের মতামত বলে স্বীকৃতি দিতে হতো। সেই হতভাগা তো আর জানতো না যে, ইনসাফ লাভের জন্য তাকে আদারতে নয় বরং কসাইখানায় নিয়ে আসা হয়েছে। আদালতে তদন্তকারী অফিসারদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করা হলে মাজলুমের আহবানে সাড়া দেয়া হতো এভাবে যে, সেই হায়েনাদের সামনেই তাকে ছেড়ে দেয়া হতো। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক সবকিছুই স্বীকার করতে হতো যা তারা করেছে বলে তাদের সঙ্গী ফেরেশতারাও জানে না। জামাল সালেমের বিদ্যার বহর ছিল এই যে, কখনো সূরা আলে ইমরান থেকে কোন আয়াতের ব্যপারে জিজ্ঞেস করতেন কিন্তু “আলে ইমরান”কে তিনি “আল ইমরান” (আরবি*********) পড়তেন। তার মতে ইমরানের সাথে যুক্ত আলিফ লাম ছিল নির্দিষ্ট বাচক।
অত্যাচারীরা সাবধান!
আমাদের কেস শুনে তার ফায়সালা করার দায়িত্ব ছিল তাদেরই। কিন্তু তারা নিজেরাই ছিল লুটেরা দস্যু। এই অর্থহীন নাটকের সময় জামাল সালেম একবার আমাকেও তার উপহাসের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করে। আমি কোন ব্যাপারে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে সে বললোঃ “হাঁ মিষ্টর উমর বল”। আমি ভাবলাম যে তার কাজই হলো জনসমক্ষে অপমাণিত করা এবং প্রত্যেক ব্যাপারেই তার আরেকটি অভ্যাস হচ্ছে, যে বিষয়ের প্রতি সে ইংগীত করতে চায় ঠিক তার বিপরীত শব্দ প্রয়োগ করে। উদাহরণ স্বরূপ সে কালকে সাদা এবং হলুদকে লাল বলতো। অতএব আমি নীরবতা অবলম্বন করাটাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করলাম। এ জালেমদের নিকট জিজ্ঞেস করার বা প্রত্যাশা করার কিই বা থাকতে পারে। আল্লাহ তায়ালাই আমাদের সকল দরখাস্ত শ্রবণ এবং আমাদের আকাংখা পূরণ করার জন্য যথেষ্ট। এই জালেমরা ভেবেছিল যে, তাদের দুরভিসন্ধি ও কূটকৌশল সম্পর্কে আল্লাহ্ তায়ালা একেবারেই উদাসীন। কিন্তু আল্লাহর ফায়সালা দেরীতে আসতে পারে ব্যর্থ হতে পারে না।
মন্ত্রীত্বের প্রলোভন
এ বিপ্লবই আমাদের বিরুদ্ধে তার পুরো শক্তি কাজে লাগিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে প্রথম দিকে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে প্রকাশিত হয়েছিল আমরা এসব লোককে সহায়তা করেছিলাম। কারণ তাদের মৌখিক দাবী ছির ইসলামের অনুশাসন চালু করবে। স্বয়ং মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবিও এ বিপ্লবের ফলে অত্যন্ত উৎসাহিত হয়েছিলেন। এবং অনেক আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন। তারই অনুমোদনক্রমে ইখওয়ান জামাল আবদুন নাসেরের সাথেও যোগযোগ স্থাপন করে। জামাল আবদুন নাসের মুর্শিদে আ’ম-এর নিকট আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি যেন ইখওয়ানের মধ্য থেকে কয়েকজন লোকের নাম মন্ত্রীত্বের জন্য পেশ করেন। তিনি আবদুল কাদের আওদাহ শহীদের নাম প্রস্তাব করেন। তারপর বলা হলো যে, আওদাহ সাহেবের স্বভাব প্রকৃতিই এমন যে, সামরিক সরকারের সাথে তার বনিবনা হবে না। অবশেষে তিনি মুনীর দাল্লা সাহেবের প্রস্তাব করলে নাসের বলেন যে, না, তিনি এখনো মন্ত্রীত্বের গুরু দায়িত্ব সামাল দেয়ার যোগ্যতা রাখেন না। পরিশেষে উস্তাদ সালেহ আল আশমাভী মরহুম-এর নাম বলা হলে তিনি সে ক্ষেত্রে আপত্তি করে বলেন যে, তিনি খুবই অল্প বয়স্ক মানুষ। অতপর তিনি এ ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেন এবং বলেন যে, আমি তোমাকেই এখতিয়ার দিচ্ছি তুমি যাকে ইচ্ছা বেছে নিতে পারো।
শাইখ আল বাকুরী
সামরিক বাহিনী উস্তাদ বাকুরীকে পছন্দ করলো। বাকুরী সাহেবও মুর্শিদে আ’ম বা কর্মপরিষদের পরামর্শ ব্যতীতই মন্ত্রীত্বের টোপ গিলে ফেললেন। অথচ এটা ছিল তার বড় রকমের ভুল সিদ্ধান্ত। ইখওয়ানেরও বড় রকমের ক্ষতি হলো। মন্ত্রীত্বের প্রতি অনুরাগী ব্যক্তিকে সেজন্য কম মাশুল দিতে হয়নি। সামরিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির পর সামরিক টোপ বাকুরী সাহেব সম্পর্কে সরকারী মহল থেকেও এমন সব অশালীন কথাবার্তা বলা হলো যা ছিল খুবই পীড়াদায়ক। এ সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে মিসর এমনকি মিসরের বাইরের লোকও সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। এতদসত্ত্বেও বাকুরী সাহেব শাসকদের সাথে বিশ্বস্ততার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে থাকেন। নাসেরের উচ্ছসিত প্রশংসায় তিনি তাঁর লিখনী পরিচালনা করেন। এমনকি এক নিবন্ধে তাকে “সকল কল্যাণ ও মংগলের উৎস এবং দয়া ও অনুগ্রহের সাগন” পর্যন্ত লিখে ফেলেন। আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার লব্ধ শিক্ষা ও দ্বীনি দূরদৃষ্টির কারণে তার মধ্যে কমপক্ষে এতটুকু বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা অবশ্যই রয়েছে যে, কল্যাণ ও মংগলের এবং দয়া ও অনুগ্রহের উৎস কে হতে পারে? এসব গুণ কি সৃষ্টিকর্তার দান না কোন সৃষ্টির দান? আমি কি বলবো? উস্তাদ বাকুরীর সাথে আমার অসংখ্য স্মৃতি জড়িত। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এবং আমাদের সকলকেই ক্ষমা করুন।
রাজনৈতিক পরিশুদ্ধি
নাসের তাঁর রাজনীতির সূচনা করেন বিস্ময়কর চালের মাধ্যমে। তিনি প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দাবী করেন যে, তারা যেন তাদের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করেন। তারপর তিনি হাতির ন্যায় নৌকাকে দোলানোর কাজ অব্যাহত রাখেন। তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল বিভিন্ন দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। রাজনৈতিক দলগুলো নাসেরের শুদ্ধি অভিযানের ষড়যন্ত্র বুঝতে বিরাট ভুল করে বসে। তাঁর কথা অনুসারে শুদ্ধি অভিযানের কাজ শুরু করে নীতিগতভাবে তারা স্বীকার করে নিয়েছিল যে, তাদের দলের অভ্যন্তরে খারাপ লোকের সমাবেশ রয়েছে। যাদের বহিষ্কার অত্যন্ত জরুরী। এরূপ ধারণা স্বয়ং পার্টির জন্যও সস্তবড় দুর্ণামের শামিল। আমাদের কোন কোন সাথীও শুদ্ধি অভিযানের এ মহতি উদ্যোগকে খুবই ভাল লক্ষণ বলে অভিনন্দন জানালেন। তারা মনে করেছিলেন যে, এ কাজ শরীয়াতের আইন চালু করার প্রথম পদক্ষেপ বিশেষ। কিন্তু মুর্শিদে আ’ম হাসান আল হুদাইবির মু’মীনসুলভ দূরদর্শিতা, মেধা ও প্রজ্ঞা এবং ব্যুৎপত্তির প্রতি লক্ষ্য করুন তিনি ইখওয়ানকে লক্ষ্য করে বললেন, এতে খুশীর কোন কারণ নেই। আজ হোক, আর কাল হোক আমাদের ওপরও হস্তক্ষেপ করা হবে।
তাঁর সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি যা দেখেছিলো পরবর্তীতে তার সবটাই হুবহু সত্য হয়ে দেখা দিয়েছিলো।
সেই ওয়াদা করেছে যা পূর্ণতা লাভ
নাসেরের শঠতার প্রতি লক্ষ্য করুন। তিনি সমস্ত দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন কিন্তু ইখওয়ানকে তার আপন গতিতে চলতে দিলেন। প্রত্যেকেই এ ভূমিকার কারণে বিস্মিত হলেন। রাজনৈতিক দলসমূহ এ পরিস্থিতির কারণে ইখওয়ান সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণ করতে থাকেন যা তারা কখনো ভুলেনি। অন্যসব দলের কিসসা খতম করার পর নাসের এখন শুধুমাত্র ইখওয়ানের সাথে মোকাবিলা করার স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ইখওয়ানীরাও এরূপ ধারণা পোষণ করছিলেন যে, শরীয়াতের বিধি-বিধান চালুর স্বার্থে সরকার যদি ইখওয়ানের সংগঠনকে নির্মূল করে দেশবাসীর সার্বিক সহযোগিতা লাভ করার ইচ্ছা করে থাকেন তাহলে তাতে কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু নাসের অদ্ভূত ধরনের মুখোশ পরিধান করেছিলেন। ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে তিনি ইখওয়ানকে একখানা পত্র লিখেন। ঐ পত্রে তিনি তাদেরকে সুখবর শুনিয়েছিলেন যে, তাদের ওপর কোন প্রকার বিধি-নিষেধ নেই। তারা নির্বিঘ্নে তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখতে পারে। এ চিঠি হাতে হাতে প্রেরণ করা হয়েছিল। আমি কেন্দ্রীয় অফিসে উপস্থিত ছিলাম। অতএব আমিই এ চিঠি গ্রহণ করলাম। আমি তৎক্ষণাৎ নায়েবে মুর্শিদে আ’ম ডাক্তার খামীছ হামীদাকে এ চিঠি সম্পর্কে অবহিত করি। তিনি বললেন যে, আমি যেন চিঠিখানা সর্তকতার সাথে নিজের কাছেই রেখে দেই। আমার বাড়ীতে এ চিঠি আমার ব্যক্তিগত কাগজপত্রের মধ্যে ছিল। এ চিঠি প্রাপ্তির কয়েকদিন পরই আমাদের ব্যাপকভাবে ধরপারড় শুরু হয়ে যায়। আমার খানা তল্লাশি করা হয় আমার সমস্ত কাগজপত্র, বই-পুস্তক ও ফাইল ইত্যাদি সব কিছুই জব্দ করে নেয়া হয়।
উম্মে কুলসুমের গান ও আমরা
ইখওয়ানের কিছু সংখ্যক সাথী প্রখ্যাত গায়িকা উম্মে কুলসুমের গান অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনতো। আমি নিজেও ছিলাম উম্মে কুলসুমের গানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তার গাওয়া নাতিয়ার কবিতার সাথে যেন আমার রয়েছে প্রেমের সর্ম্পক যা কবিকুল শিরমণি শওকী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উচ্ছসিত প্রসংসায় লিখেছিলেন। উম্মে কুলসুম তার বেদনাভরা সুমধুর কণ্ঠে তা গেয়েছিলেন।
আলওয়াহাত জেলখানায় উম্মে কুলসুমের গানের একটি ঘটনার সাথে আমার মজার স্মৃতি জড়িত আছে। তখন আমি আলওয়াহাত জেলখানায় বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলাম। আমরা জেলের ভিতরেই ছিলাম। রেডিওতে উম্মে কুলসুম তার অতুলনীয় সুরেলা কণ্ঠে ঝংকার তুলে গাচ্ছিলো। আমরা কয়েক জন বন্ধু তা শুনছিলাম। আমাদের বন্ধু উস্তাদ আবদুল আযীয আতিয়া মরহুম সকল প্রকার গানকেই মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন। তিনি আমাদেরকে এজন্য তিরস্কার করতেন। সেদিন উম্মে কুলসুম যে গান গেয়েছিলেন তার একটি কলি হচ্ছেঃ
(আরবি***************)
তোমাকে দেখার পূর্বের জীবন প্রকৃতপক্ষে কোন কাজেই আসেনি। বরং তা ছিল সময়ের অপচয় মাত্র।”
আমি ওস্তাদ আবদুল আযীয মরহুমকে বললামঃ ভাই দেখলেন কি মজার গান গাইলো। আপনি তো শুনেননি। অতপর আমি উপরোক্ত কলিটি তাকে শুনালাম। মরহুম আমাকে উপহাস করে বললেনঃ তুমি এতে কি মজা পাও?
আমি বললামঃ এর অর্থ হচ্ছে, প্রিয় জীবনের সেই অংশ যা ইখওয়ানের আন্দোলনে অংশ গ্রহণের পূর্বে অতিবাহিত হয়ে গেছে। তা আমার জীবনের কোন অংশ নয় বরং তা ছিল বৃথা কাল ক্ষেপনেরই নামান্তর। ভাই আবদুল আযীয, এ অর্থ কতই না হৃদয়গ্রাহী!
আবদুল আযীয মরহুম সজোরে চীৎকার করে বলে উঠলেন ভাই ওমর! হে ভাই ওমর!! আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে বলো তো গায়িকাও কি এ গানের এ অর্থ গ্রহণ করছিলো। যা আপনি গ্রহণ করছেন?
আমি জবাবে আরজ করলামঃ তার উদ্দেশ্য দিয়ে আমার কি প্রয়োজন! তিনি তার অর্থ যা ইচ্ছা তাই গ্রহণ করুন। কণ্ঠ শিল্পিরা গেয়ে থাকেন। কবি ও লেখকরা লিখে থাকেন এবং শ্রোতারা এসব কথা থেকে নিজেদের মনের মত অর্থ গ্রহণ করে থাকেন। এ জন্যই তো তারা সাগ্রহে শুনে থাকেন।
শিল্প ও শিল্পী
সত্য কথা বলতে কি উম্মে কুলসুম মরহুমা তার শিল্পকর্মে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী কিন্তু আফসোস যে তিনি অত্যাচার ও অত্যাচারীদের কাফেলায় অংশ গ্রহণ করেছিলেন। শিল্পী যদি তার শিল্পকর্মের প্রতি আন্তরিক হন তাহলে কোন অত্যাচারের সাথে তার একাত্ত হওয়া আদৌ উচিত নয়। শিল্প হচ্ছে, সূক্ষ্ম কলা এবং অতি সূক্ষ্ম অনুভূতির নাম। শিল্পী মহৎ চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে। তাকে কোমল হৃদয়, দয়া, উপলদ্ধি ও সহানুভূতি-সহমর্মিতার চরম পরাকাষ্ঠ্য প্রদর্শন করা উচিত। নিষ্ঠুরতা ও নির্দয়তার মূর্দয়তার মূর্তপ্রতিক হওয়া তার জন্য আদৌ শোভনীয় নয়।
সিনেমা ও ড্রামার মূল উদ্দেশ্য প্রশিক্ষণ ও মহৎ চরিত্রের শিক্ষা দেয়া ব্যতীত আর কিছুই নয়। কিন্তু হায়। এগুলো এখন সম্পূর্ণরূপে শয়তানের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ফ্রান্সের সাহিত্যিক যেমন ভিক্টর হুগো প্রমুখের ফ্রান্সে বিপ্লব সংগঠিত করা এবং সকল প্রকার জুলুম নিপীড়ন থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান ছিল। আমাদের দেশে সাহিত্যিকও তাদের সাহিত্য কর্ম শিল্পী এবং তাদের শিল্পকর্ম, বিনোদনের উপকরণ ও তার উপস্থাপনা সবকিছুই উন্নত নৈতিক চরিত্রকে ভিত্তিমূলক থেকে ধ্বংস করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। যুব সমাজকে তাদের দ্বীন থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ করা এবং উশৃংখলতা ও লাম্পট্যের শিক্ষা দেয়াই তাদের মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। এসব শিল্পী ধন-দৌলতের পিয়াসী হয়ে এমন কিছু করে যাচ্ছেন যা সুষ্ঠু রুচিবোধ সম্পন্ন কোন মানুষ কখনো মেনে নিতে পারে না। অপমাণিত হয়ে এবং স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে খাবার গ্রাস লাভ করার চেয়ে সসম্মানে ক্ষুৎপিপাসায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা সহস্র গুণে উত্তম। স্বাধীনতার জন্য যত ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করতে হোক না কেন সবই অকপটে গ্রহণযোগ্য। আমাদের দেশের কর্তা ব্যক্তিরা আজও সেই ধ্বংসাত্মক পথেই চলছে যে পথে ছোট বড় সবার জন্য করুণ মৃত্যু অপেক্ষা করছে।
নীল উপত্যকার আধুনিক ফেরাউন
পাঠকগণকে কখনো ভুলে গেলে চলবে না যে, আবদুন নাসেরের শাসনামলের অনন্য বৈশিষ্ট্যই ছিল অত্যাচার-উৎপীড়ন ও মানুষের মৌলিক অধিকার পদদলিত করা। কোন পর্যায়েয় মানুষই তার এ অমানবিক আচরণ থেকে নিরাপদ ছিল না।
আপনারা শুনে বিস্মিত হবেন যে, জাতীয় পরিষদের স্পীকার ডক্টর সানহুরীও প্রতিশোধের টার্গেটে পরিণত হন। নাসের তার পেছনে তার গার্ড বাহিনীকে লেলিয়ে দেন পরিষদ ভবনের মধ্যেই তাদের হাতে বেচারা স্পীকার নির্মমভাবে প্রহৃত হন। তার অপরাধ ছিল এই যে, তিনি মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের ব্যাপারে নাসের সাহেবের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। আইনজীবি সমিতি (Bar Asso-ciation)-এর ওপরও নাসের তার নিজের লোকদের নিযুক্ত করে রেখেছিলেন। তারা তোতাপাখীর মত শেখানো শ্লোগান দিতো এবং আইনজীবিগণের মুখের ওপর ঘুষি পাকিয়ে মূর্খতার মূর্তপ্রতীক এসব শ্লোগান তুলতো- নির্বোধ আইনজীবিগণ মুর্দাবাদ!
আল্লাহ মাফ করুন! লক্ষ্য করুন! আইন বিশারদগণ মূর্খ বলে আখ্যায়িত হলো এবং এ জালেমশাহীর গোমস্তাগণ জ্ঞানী পন্ডিতরূপে স্বীকৃতি পেল।
জামাল আবদুন নাসের কেবল এসব অপকর্মের নির্দেশ জারী করেই ক্ষান্ত থাকতো না। বরং খুবই উৎসাহের সাথে এর টেপ শুনতো এবং ফিল্ম দেখতো এবং অহংকারে মাথা ঝাকুনি দিতো। কুব্বা প্রাসাদের স্বাগতিক হলে নাসের এ সকল টেপ ও ভিডিও ক্যাসেট ফিল্ম সাদরে গ্রহণ করতো। এই ছিল তার প্রিয় মেহমান, অন্তরঙ্গ বন্ধু। এ মহলেই প্রেসিডেন্টের দপ্তর ও কর্মস্থল ছিল। এই বিলাস বহুল প্রাসাদে তিনি ভোগ বিলাসে মত্ত থাকতেন। অথচ ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে তিনিই অপব্যয়, বিলাসিতা ও জাঁকজমকপূর্ণ শাহী মহল বালাখানা এবং বড় বড় বাংলো নির্মাণের তীব্র সমালোচনায় মুখর থাকতেন।
খর্বকায় নেতা ও মিসরের ইতিহাস
নাসেরের স্থালাভিষিক্ত সাদাতও তার পদষ্ক অনুসরণ করে চলতে শুরু করে। এমন কি ভোগ বিলাসিতায় তার চেয়েও আরো দু’কদম অগ্রসর হয়ে যায়। তিনি ময়ূরের ন্যায় সাজগোজ করে অত্যন্ত অহংকার ও গর্ব প্রকাশ করতেন। ফ্রান্স ও ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে প্রতিদিন একখানা প্লেনে ভর্তি ফুলের তোড়া তার জন্য আনা হতো। নাসের ও সাদাত উভয়ের শাসনামরেই একটা দৃশ্য ছিল খুবই সুস্পষ্ট। তাহলো, মিসরের ইতিহাসের গৌরবোজ্জল ব্যক্তিত্বদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব রকম প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিলো। যেন ইতিপূর্বে মিসরের ইতিহাস বলতে কিছুই ছিল না। এসব ক্ষণজন্মা নেতৃবৃন্দ ক্ষমতাসীন হওয়ার সাথে সাথে ইতিহাসের সূচনা হয়েছে। মনে হয় যেন ১৯৫২ সালের জুলাই মাসে মিসর অস্তিত্ব লাভ করেছে। মিসরের জন্য এথেকে বড় লজ্জার বিষয় আর কি হতে পারে যে, তার সমস্ত ইতিহাস ঐতিহ্যকেই অস্বিকার করা হবে? অথচ পবিত্র কুরআন মজীদে আল্লাহ তায়ালা বার বার এ ভূ-খন্ডের উল্লেখ করেছেন। এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা শুধু এ ইংগীত দেয় যে, উক্ত দু’মহাপ্রাণ ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা ছিল একান্তই দুর্বল আর মন-মস্তিষ্ক অত্যন্ত স্থুল চিন্তায় ভরা। তারা তাদের অকিঞ্চিৎকার অবস্থা সম্বেন্ধে খুব ভালভাবেই অবগত ছিল। তাই এসব মহারথীরা ইতিহাস খ্যাত মহাপ্রাণ ব্যক্তিদের আলোচনা পর্যন্ত মানুষের সামনে আসতে দেয়ার পক্ষপাতি না। যদি মিসরের ইতিহাস সৃষ্টিকারী অন্যান্য নেতাদের সম্পর্কে যুব সমাজ অবহিত হতে পারতো এবং তারা তুলনামূলক বিশ্লেষণ করার সুযোগ পেতো তাহলে এসব স্বকল্পিত মোড়লগণ ধপাস করে মাটিতে লুটিয়ে পড়তো।
হোসনী মোবারকের অপুর্ণাঙ্গ সংস্কার
আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ছিল এই যে, এসব গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল শ্রেণীর নেতাদের হাটে হাঁড়ি ভেঙে যুব সমাজকে বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করবেন। অতএব তিনি মিসরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ হোসনী মোবারককে তাওফিক দিলেন যে, তিনি তার পূর্ববর্তীদের পদাষ্ক অনুসরণ করার পরিবর্তে যুক্তিসঙ্গত ও যথার্থ পথ অবলম্বন করবেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট সস্তা খ্যাতি ও মিথ্যা প্রপাগান্ডার পূর্বতন পদ্ধতি অবলম্বন করেননি যা ছিল তার পূর্ববর্তী দু’জনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। হোসনী মোবারককে আল্লাহ তায়ালা উত্তম পুরষ্কার প্রদান করুন। তিনি শিক্ষা ক্ষেত্রে সিলেবাস পাঠ্যক্রম, শিক্ষা-দীক্ষা ও পড়ালেখার অন্যান্য সকল দিক ও বিভাগে সাহিত্যিক ও পন্ডিতগণকে অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন যেন তারা মিসরের ইতিহাসকে তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে যুবকশ্রেণী ও ছাত্রসমাজের সামনে তুলে ধরেন। এ পর্যায়ে আমরা যেমন তাঁর গৃহীত এ পদক্ষেপকে সাদর অভ্যর্থনা জানাই তেমনি আমাদের অভিযোগও ইতিহাসের নিকট সোপর্দ করে দিতে চাই যে, অদ্যাবধি ইখওয়ানের দায়িত্বশীল ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণকে বিশেষত আমাদের দু’দুজন মুরশিদে আ’ম- যথাক্রমে সাইয়েদ হাসানুল বান্না শহীদ এবং সাইয়েদ হাসান আল হোদাইবি মরহুমের ইতিহাসকে গোপন করে রাখা হচ্ছে। পাঠক্রম থেকেও তাদেরকে দূরে রাখা হয়েছে। অথচ মিসরের ইতিহাসের রেকর্ড ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক হতে পারে না যতক্ষণ উক্ত দু’মহতী ব্যক্তিত্বের উল্লেখ না করা হবে। এরা দু’জন আধুনিক মিসরের ইতিহাসের দু’টি উজ্জল চাঁদ। তাদেরকে যারা পর্দার অন্তরালে রাখতে চায় তাদের জেনে রাখা উচিত যে, তাদের কৃতিত্ব এমন জীবন্ত ও ধরাপৃষ্ঠে এমন দীপ্তিমান রাজপথের নির্দেশিকা যে তা গোপন করে রাখা সম্ভব নয়।
ইসলামী দুনিয়ার পথিকৃত
আমরা পড়েছি যে, বানাফশা (এক প্রকার বেগুনি) ফুল সচরাচর ঘাস ও লতাগুল্মের ভেতর পরিদৃষ্ট হয় না কিন্তু তার সুগন্ধি দূর থেকেই হৃদয় মন ভরে দেয়। ঠিক এ অবস্থাই ছিল আমাদের দু’জন মুর্শিদে আ’মের। আল্লাহ তায়ালার অফুরন্ত রহমত ও সন্তুষ্টি বর্ষিত হউক তাদের ওপর। আমাদের শিক্ষামন্ত্রীদের অবস্থাও বড় অদ্ভূত। তাঁরা এই দু’ মহান ব্যক্তিত্বের কথা ছাত্রদের কানে পৌছতে দেয়াকেই বিপজ্জনক মনে করে থাকেন। তাঁদের দু’জন ছাড়া অন্য সকল ব্যক্তিত্বের ওপর থেকে ইতিমধ্যে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। অথচ উক্ত দু’মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্বের মর্যাদা সম্পর্কে এ থেকেই ধারণা লাভ করা যেতে পারে যে, তাদের প্রভাব শুধুমাত্র মিসরের মাটি ও ইতিহাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কারণ, তাঁরা সমগ্র ইসলামী দুনিয়াকেই তাঁদের মহত চিন্তাধারার আলোকে আলোকিত করে গেছেন। মধ্যপ্রাচ্য ও নিকটবর্তী অন্যান্য দেশের কথা না হয় বাদ দিন। দূরপ্রাচ্য অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ফিলিফাইন পর্যন্ত তাদের চিন্তার দীপ্তিতে ঝলমল করছে। হাসানুল বান্নার কৃতিত্ব হলো তিনি বিশ্বব্যাপী ইসলামী পুনর্জাগরণ ও রেঁনেসার পথ সুগম করেছেন। আর হাসান আল হুদাইবি ছিলেন তার নিজের উক্তির মূর্ত প্রতীক। তিনি বলেছিলেনঃ
“কুরআনের রাজত্ব নিজেদের অন্তরে কায়েম করে নাও-
ভূ-পৃষ্ঠে তা আপনা থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।”
(আরবি****************) –সাজসরঞ্জাম কম থাক
আর বেশী থাক বেরিয়ে পড়ো
উস্তাদ আল হুদাইবি (র) ইখওয়ানের দায়িত্ব ভার গ্রহণের পর হাসানুল বান্না (র)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলতে থাকেন। তিনি একাধারে গ্রাম, মহল্লা এবং শহরে নিয়মিত দাওয়াতী সফরে যেতেন। শারীরিক দুর্বলতা এবং কার্ধক্য সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত কর্মতৎপর, প্রাণ চঞ্চল ও উৎসাহী নেতা। তিনি ইসলামী দাওয়াত ব্যাপ দেশে সুদূর সিরিয়া ও লেবাননও সফর করেন। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় মিসরের জনগণ তাকে উঞ্চ অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। এ জাঁকজমকপূর্ণ সংবর্ধনা দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছিলো যে, মুর্শিদে আ’ম কতটা জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। সাধারণ জনসমাবেশ ও সভা সমিতিতে মুর্শিদে আ’মকে বড়ই ভাবগম্ভীর এবং মর্যাদাবান বলে মনে হতো। আবার যখন ইখওয়ানের বিশেষ অধিবেশনে মিলিত হতেন তখন মনে হতো তিনি অত্যন্ত কোমল প্রাণ সাথীদের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা পোষণকারী এবং হাসিখুশী ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
আল্লাহ জুলুমকেই জুলুমের
প্রতিপক্ষ বানিয়ে দেন
আমার মনে আছে সি, আই, ডি, প্রধান মিষ্টার হাসান তালাত একবার আমাদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে আগমন করেছিলেন। সেখানে তিনি মুর্শিদে আ’ম-এর সাথে কিছু সময় কথাবার্তা বলেন। যেসব মন্তব্য তিনি সাক্ষাতের পর করেছিলেন আমার স্মৃতিপটে তা আজও সুরক্ষিত আছে। তিনি বলেছিলেন আমি আমার চাহিদা মাফিক প্রত্যেক দলের ভেতর বিশেষ ব্যক্তিদের পেয়েছি। যারা আমাকে সংশ্লিষ্ট দলের অভ্যন্তরীন খবরাদি সরবরাহ করে থাক। কিন্তু ইখওয়ানের মধ্যে তেমন একটি লোকও আমি খুঁজে পেলাম না।
হাসান তালাত নামক এই ব্যক্তি ছিলো বড়ই অত্যাচারী ও পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী। আল্লাহ তায়ালা তাঁর মেজাজ ও স্বভাব-প্রকৃতি ভারসাম্য পূর্ণ করে দেয়ার জন্য অপর এক হিংস্র স্বভাব অফিসারকে তার ওপর চাপিয়ে দেন। এ বিভাগেরই জনৈক কর্মকর্তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অর্থাৎ তার নিজের দপ্তরেই সিঁড়ির উপর তাকে পাকড়াও করেন এবং খুব উত্তম মাধ্যম দ্বারা ধন্য করেন। এসব অভিনয়ের প্রেক্ষাপট ছিল এই যে, হাসান তালাতের নিকট কিছু সংখ্যক গোপন টেপ ছিল। যাতে কতিপয় নামীদামী ব্যক্তির ব্যাপারে বিস্তারিত প্রতিবেদন সংরক্ষিত ছিল। অপর একজন অফিসার তার নিকট হতে এ টেপ নিয়ে যেতে চাচ্ছিলো। কিন্তু তিনি তা মোটেও দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। অবশেষে এ টেপের গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যায়। তা জালিয়ে ফেলেছিলেন। আমার মনে হয়, উক্ত টেপ আজও কারো না কারো কাছে বর্তমান থেকে থাকবে এবং প্রয়োজনে সময় মত সে তা ব্যবহার করবে। আল্লাহ তায়ালাই ভাল জানেন। ঐ সব টেপের মধ্যে এমন কি আছে যা দিয়ে কারো ক্ষতি সাধন করার উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
জেলখানায় বন্দী জীবন যাপনের সময় ইখওয়ানীরা যেসব দোয়া করতেন তার একটি হচ্ছেঃ (আরবি**************)
“হে আল্লাহ! যালেমদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়ে ধ্বংস করে দাও। আর তাদের মধ্য থেকে আমাদেরকে তুমি নিরাপদে রক্ষা করো।”
উস্তাদ হাসান আল হুদাইবি (র)-এ দোয়া শুনে মিষ্টি হেসে বলতেনঃ
(আরবি***************) “আল্লাহ তো তাই করে থাকেন। তিনি এক জালেমকে দিয়ে আরেক জালেমকে হত্যাও করিয়ে থাকেন। কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারো না।”
উপরোক্ত ঘটনাতো একটা উদাহরণ। অথচ এরূপ হাজারটা দৃষ্টান্ত আমাদের দৃষ্টির সামনে দিয়ে অতিবাহিত হয়ে গেছে।
ইখওয়ানীরা যখন জেলখানায় ছিলেন তখন জামাল আবদুন নাসের এবং তার অর্থে কেনা সংবাদপত্র ইখওয়ান ও মুর্শিদে আ’ম-এর ওপর সকল রকম অপবাদ আরোপ করতে থাকে। কারাবন্দীগণ না পারছিলো আত্মপক্ষ সমর্থন করতে না পারছিলো অন্যে তাদের পক্ষে মুখ খুলতে। অথচ আত্মপক্ষ সমর্থন করা মৌলিক মানবাধিকারের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত আমরা এমন গুরুত্বপূর্ণ অধিকার থেকেও ছিলাম পুরোপুরিভাবে বঞ্চিত। যাহোক এসব লোকের নির্লজ্জতা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনিত হয় তখন মুর্শিদে আ’ম “আলমিসরী” পত্রিকায় একটি পত্র লিখেন। এ পত্রিকা তখনো পর্যন্ত নিসিদ্ধ ঘোষিত হয়নি। তিনি উক্ত চিঠিতে বিপ্লবের নেতৃবৃন্দকে “মোবাহেলার” জন্য আহবান জানালেন। “মোবাহেলা” শব্দটি শুনে এসব মহারথিরা হতবাক হয়ে যান। কারণ, তারা এ শব্দটির অর্থ সম্পর্কে ছিল সম্পূর্ণভাবে নাওয়াকিফ। তাদের এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে উস্তাদ আল বাকুরী তাদেরকে উদ্ধার করেন এবং “মোবাহেলা” শব্দের ব্যাখ্যা তাদের সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেনঃ “মোবাহেলা” দ্বারা না লড়াই বুঝায় না বাক যুদ্ধ। এটা দু’টা প্রতিদ্বন্দ্বী অথবা পরস্পর বিরোধী ব্যক্তি কিংবা দলের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার নিকট এই মর্মে দোয়া করা যে, উভয়ের মধ্যে যে মিথ্যাবাদী আল্লাহ তায়ালা ‍যেন তার লানত নাযিল করেন।
যদি সত্যবাদী হও তাহলে আস
জেলখানার ভিতর থেকে কোন কয়েদীর পত্র বাইরে যাওয়া এমনিতেই ছিল বড় রকমের অপরাধ। তার ওপর আলোচ্য চিঠিখানা নাসের ও তার সমস্ত সাঙ্গপাঙ্গোদের হাটে হাড়ি ভেঙে দেয়। জনসমক্ষে তার মুখোশ পুরোপুরিভাবে খুলে যায়। এখন বেচারা সম্পূর্ণ কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে না সামনে অগ্রসর হতে পারছিলো না পেছনে সরে আসতে পারছিলো। হাসান আল হুদাইবির মোকাবিলায় মোবাহেলায় অংশ গ্রহণ করার হিম্মত তাঁর কোথায়? কোন মায়ের সন্তানের এমন বুকের পাটা ছিল যে, সে ময়দানে অবতীর্ণ হতে পারে? জেলখানার দারোগার ওপর কঠোরতা নেমে এলো। হতভাগার ওপর শাস্তির নির্দেশ জারী করা হলো এই মর্মে যে, কারাভ্যন্তর থেকে এ পত্র বাইরে আসলো কি করে? আমরা জেলখানার আঙ্গিনায় একটা গাছের ছায়ায় বসেছিলাম। ইত্যবসরে দারোগা সাহেব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ মেজাজে আমার কাছে আসলেন। আমাদেরকে সেলের মধ্যে আটকে রাখার জন্য রাগান্বিত মেজাজে হুকুম জারী করলেন। এমনকি কোন প্রকার পায়চারি করার জন্য বাইরে আসতে দেয়া হবে না। এসব বিপ্লবীরা আমাদের মোকাবিলায় সকল হাতিয়ারই পরীক্ষা করেছে। কিন্ত এই নিরস্ত্রদের মোকাবিলায় অসহায় বোধ করছেন।
মর্দে মু’মিন
উস্তাদ আল হুদাইবি এমন মহৎ নৈতিক ও মানবিক চরিত্রের অধিকারী ছিলেন যে, কোন লোক সম্পর্কেই অন্তরে কোন হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করতেন না। ইবরাহীম আবদুল হাদীর নির্যাতন-নিপীড়নের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। উস্তাদ আল হুদাইবি একবার তার সাথে সাক্ষাত করার জন্য চলে যান। শরীয়াতের দৃষ্টিতে সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল না। তিনি প্রতিশ্রুতি পুরো করার ক্ষেত্রে ছিলেন খুবই নিয়মানুবর্তী। ইখওয়ানের সমাবেশেও দেখা যেতো তিনি সর্বদা সকলের আগে এসে পৌছতেন। আবার যাওয়ার সময় যেতেন সবার শেষে।
তাঁর অভ্যাস ছিল যে, তিনি তার দ্বীনি মর্যাদাকে কখনো দুনিয়াবী স্বার্থ হাসিল করার উপায় বানাতেন না। এটা ইখওয়ানের প্রতি আল্লাহ তায়ালার বিরাট অনুগ্রহ যে, কোন বিরাট ব্যক্তিত্বও এমন কোন প্রমাণ পেশ করতে পারবেন না যে, তিনি ইখওয়ানের কোন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে কোন টাকা পয়সা প্রদান করেছেন। যখন যে পরিবেশ পরিস্থিতিই বিদ্যমান থাকুক না কেন? আমরা কখনো আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কারো অনুগ্রহের দ্বারাস্থ হইনি। কোন প্রমাণ ব্যতীত দোষারোপকারীদের বিচারের দায়-দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালার ওপর। তিনিই তিদের সাথে বুঝাপড়া করবেন। তারা আল্লাহর ভয় না করে দ্বিধাহীনভাবে বলে বেড়ায় যে, ইখওয়ান দ্বীনকে তাদের ব্যবসায়ের হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছে। মনে রেখো, যেসব শরীফরা মিথ্যা ও অপবাদ আরোপ করে একদিন তাদের মুখের ভাষা বন্ধ হয়ে যাবে।
জামাল আবদুন নাসেরের বিদ্বেষ
মুনীর দাল্লা মরহুমের সাথে এক সাক্ষাতের সময় জামাল আবদুন নাসের বলেছিলেন-আমি এমন একটা বৈদ্যুতিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চাই যে, যখনই বোতাম টিপবো তখনই সমগ্র জাতি বিদ্যুৎ প্রবাহের ন্যায় উঠে দাঁড়াবে এবং যখন আরেকটি বোতাম টিপবো তখন ততটা দ্রুত গতিতেই সমস্ত দেশবাসী বসে পড়বে।
জবাবে মুনীর দাল্লা মরহুম বলেছিলেনঃ “কি চমৎকার জামাল”? আপনি চাচ্ছেন সমস্ত জাতিকে পুতুলের মত নাচাতে এবং কেউ ‍যেন আপনার নির্দেশ অমান্য না করে। আপনার এরূপ মহৎ ইচ্ছার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু এমনটা করা আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না।
নাসের তাৎক্ষণিকভাবে নীরবতা অবলম্বন করলেও মুনীর মরহুমের এমন নির্ভীক জবাব কিছুতেই ভুলে যেতে পারেননি। তিনি তার অন্তরে প্রতি হিংসার দাবানল প্রজ্জলিত করতে লাগলেন। ইখওয়ানের ওপর যখন বর্বরোচিতভাবে হামলা করা হয় তখন মুনীর দাল্লার ওপর সর্বাপেক্ষা বেশী নির্যাতন চালানো হয়। মুনীর দাল্লা নাসের সম্পর্কে যা বলেছিলেন তা শুধু ইখওয়ানের মতামতই ছিল না। বরং নাসেরের স্থালাভিষিক্ত সাদাত ও তাঁর রচিত “আপন অস্তিত্বের সন্ধানে” গ্রন্থে যা লিখেছেন তার মমার্থও ছিল এই যে, নাসের নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর আর কারো কোন উচ্চবাচ্য শুনতে প্রস্তুত ছিল না। তার নিকট সত্য ছিল কেবল তাই যা তার মনে উদয় হতো। তা ছাড়া অন্য কোথাও সত্যের লেশমাত্র ছিল না।
এ ছিল একনায়কতন্ত্রের ব্যাধি যা এই ব্যক্তিটিকে ইখওয়ান এবং মুর্শিদে আ’ম- এর প্রতিও জুলুমের হাত প্রসারিত করতে অনুপ্রাণীত করেছিল। মুর্শিদে আ’ম আল হুদাইবি সঠিক অর্থে ছিলেন ইসলামী নেতা। তিনি ছিলেন ফিকাহ্ বিশারদ এবং আইনবিদও। তাঁর খুব ভালভাবেই জানা ছিল যে, একজন মুসলিম শাসনকর্তার ওপর প্রজাদের কি কি অধিকার রয়েছে। আর প্রজাসাধারণেরই বা কি কি দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে শাসনকর্তার ওপরে। তাঁর দৃষ্টি যেমন ছিল ঐশী আইনের ওপর তেমনিভাবে ছিল মানবরচিত আইনের ওপরও। নাসের এজন্য ভীত ছিল যে, তিনি তার একনায়কতন্ত্রের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন। ‍মুর্শিদে আ’ম-এর অভ্যাস ছিল, তিনি নসীহত করার হক অবশ্যই আদায় করতেন। নাসেরের একটা অভিযোগ ছিল এই যে, সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের ওপর অবশ্য তাঁর মতামত চাপিয়ে দেয়ার জন্য কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করতেন না সত্য কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের বহু পূর্বেই সমূদয় তথ্য গোপন সূত্রে মুর্শিদে আ’ম অবগত হয়ে যেতেন, যা ছিল ডাহা মিথ্যা।
নাসের শাইখ আল বাকুরীকে ওয়াকফ বিষয়ক মন্ত্রী বানিয়েছিল। অথচ ইতিপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে যে, মুর্শিদে আ’ম তার নাম উল্লেখ করেননি। শাইখ আল বাকুরী মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। অথচ মুর্শিদে আ’ম-এর নিকট থেকে না কোন অনুমতি নিয়েছিলেন না তার সাথে কোন পরামর্শ করেছিলেন। বাইয়াতের অর্থ হচ্ছে নিজের পছন্দ হোক বা না হোক সকল অবস্থায়ই মুর্শিদে আ’ম-এর আনুগত্য বাধ্যতামূলক। এরূপ আচরণ করার পরও মুর্শিদে আম কোন প্রকার অসন্তোষ প্রকাশ করেননি। কিংবা শাইখ আল বাকুরীর নিকট থেকে কোন রূপ ব্যাখ্যাও দাবী করেননি। এসব লোক তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য শাইখ আল বাকুরীকে বলি দিয়েছিল এবং অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে এই অভিযোগ দাঁড় করিয়েছিল যে, তিনি মুর্শিদে আ’ম ও ইখওয়ানের চর। মূলকথা হচ্ছে, নাসের মনে মনে ইখওয়ান ও তার মুর্শিদে আ’মের ব্যাপারে খুবই ভীত সন্ত্রস্ত ছিল। তার জানা ছিল যে, ইখওয়ানের উপস্থিতিতে তার পুতুল নাচ সফলতা লাভ করতে পারে না।
নাসেরের এজেন্টরা সম্পূর্ণ নির্দোষ লোকদের ওপর যেভাবে অন্যায় অভিযোগের বৃষ্টি বর্ষণ করেন তা ছিল নজির বিহীন। নাসেরের নির্যাতনের অসহায় শিকার হন এমন সব সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ ফেরেশতাগণও যাদের নিষ্কলুষ চরিত্রের স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবেন। এ ব্যক্তি ছিল এমন পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী যে, তার পাশবিকতার জন্য সে কোনদিন অনুতপ্ত হয়নি। তার অন্তর কখনো প্রকম্পিত হয় না এবং চক্ষু কখনো অশ্রুসিক্ত হয় না। মূলত সে মানুষ ছিল না। ছিল পাথর বরং তা থেকেও বেশী অনুভূতিহীন।
কৃষি সংস্কার না কৃষি বিপর্যয়
আবদুন নাসের তার তথাকথিত ভূমি সংস্কারের ঘোষণা করেন। তিনি আবাদী জমির পরিমাণ ধার্য করেন একশ একর। হাসান আল হুদাইবির অভিমত ছিল, এ সীমা পাঁচশ’ একর হওয়া আবশ্যক। তিনি নাসেরের বেঁধে দেয়া সীমার বিরোধিতা করেননি। কিন্তু তাঁর মতামত প্রকাশ করেছেন। মিসরের কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতির সাথে পরিচিত ব্যক্তি মাত্রই এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করবেন যে, উৎপাদনের দৃষ্টিভংগীর দিক থেকে হাসান আল হুদাইবির অভিমতই ছিল বাস্তবসম্মত ও কল্যাণকর। পরিস্থিতি ও ঘটনাপ্রবাহ একথার অনস্বীকার্যতা প্রমাণ করেছে। যে মুর্শিদে আ’মের রায়ের প্রতি তোয়াক্কা না করে বিপ্লবী সরকার কৃষি ব্যবস্থারই সর্বনাশ সাধন করেছে। সকল ক্ষেত্রেই লাভের পরিবর্তে দেখা দিয়েছে লোকসান। সাথে সাথে এ বাস্তবতাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ইসলাম মানুষের জন্মগত মালিকান অধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এবং বিশেষ পরিবেশ পরিস্থিতি ও একান্ত জরুরী অবস্থা ব্যতীত কারো ধন-সম্পদ তার সন্তুষ্টি ও যথাযোগ্য বিনিময় ছাড়া হস্তগত করার অনুমতি প্রদান করে না। মুসলিম জনসমাজের একান্ত কল্যাণ ও প্রয়োজনের খাতিরে যদি কারো মালিকানাধীন সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতেই হয় তবে তার যথাযোগ্য বিনিময় প্রদান করতে হয়।
অবশেষে নাসের চাষাবাদযোগ্য জমির মালিকানার পরিমাণ নির্ধারণ করলেন সোয়া দুইশ’ একর। কিন্তু তার এ ঘোষণার প্রতিও তিনি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করলেন না। কিছুদিন পরই পুনরায় নতুন ফরমান জারী করলেন যে, সংশোধিত মালিকানার পরিমাণ স্থির করা হয়েছে পঞ্চাশ একর। তিনি আরো ঘোষণা করলেন যে, হুকুম দখল কৃত জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদেয় মূল্য প্রাক্তন মারিকদের প্রদান করা হবে। তিনি তার এ অংগীকার রক্ষা করা থেকে পিছিয়ে যান। এমনকি কাউকে এক কানা কড়িও মূল্য প্রদান করা হয়নি। নাসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল যে, যেসব লোকের জমি হুকুম দখল করা হয়েছে তাদেরকে প্রতি মাসে মিসরীয় পাঁচ পডিও করে প্রদান করা হবে যাতে পর্যায়ক্রমে তাদের মূল্য আদায় হয়ে যায়। এ ভাগ্য বিড়ম্বিত হতবাগার দল এ নগণ্য পরিমাণ অর্থ প্রাপ্তির আশায় সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও অফিসে ধর্ণা দিতে থাকে। কিন্তু অর্ধচন্দ্র ব্যতীত তাদের ভাগ্যে কোন দিন কিছুই জোটেনি। এ থেকেই আপনি সরকারের গৃহীত জনকল্যাণমূলক সংস্কার কার্যাবলীর স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন।
যে ভূমি থেকে কৃষক তার খাদ্য পায় না
ইতিহাস তার রায় দিয়েছে আর আমিও আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে সম্পূর্ণ স্থিরচিত্তে এ ঘোষণা দিচ্ছি যে, নাসেরের ভূমি সংস্কার প্রকৃত প্রস্তাবে ছিল ভূমি বিপর্যয়েরই নামান্তর। আমি নিজে ভূমি সংস্কারের বিরোধী নই। তথাপি ভূমির বিপর্যয়েরই নামান্তর। আমি নিজে ভূমি সংস্কারের বিরোধী নই। তথাপি ভূমির বিপর্যয়কে তো মেনে নিতে পারি না। আমি কৃষকদের সাথে মিশে তাদের জীবনধারাকে অত্যন্তা নিকটে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি-আমি তাদের মাঝেই জন্ম লাভ করেছি। তাদের অভাব অভিযোগ ও সমস্যাবলী আমার ভালভাবেই জানা আছে। আমি বক্তিগতভাবে কখনো এটা সমর্থন করতে পারি না যে, একজন জায়গীরদার (জোতদার ও জমিদার) হাজার হাজার একর জমির মালিকানা কুক্ষিগত করে বসে থাকবে অথচ সে হাত পা পর্যন্ত নাড়াতে চেষ্টা করবে না। কিন্তু বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে থাকবে। অথচ তার খামারে কর্মরত মজুররা ভূখা-নাঙ্গা থাকবে এবং ক্ষুধা ও তৃঞ্চার অসহায় শিকার হয়ে থাকবে। তারা সারা দিন অমানুষিক পরিশ্রম করেও রাতে অসাগারে অর্ধাহারে তাদের ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন দেহ বিছানায় এলিয়ে দেয়। তাদের মাথা গোঁজার একটু ঠাঁইও নেই। একই স্থানে তারা ও তাদের গরু বাছুরগুলো রাত কাটায়। শীতকালে প্রচন্ড হিমেল হাওয়া তাদের শরীরের ওপর দিয়েই বয়ে যায় অথচ তাদের গায়ে কোন গরম কাপড় থেকে না। এ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য। এর সমাধান অত্যাবশ্যক আর এ জন্য আমাদের শরীয়াতই আমাদেরকে সর্বোত্তম ব্যবস্থা বাতলে দিয়েছে। শরীয়াতকে বাদ দিয়ে আপনারা যতই বিদেশী মতবাদ; আমদানী করে অবস্থা সংস্কারের চেষ্টা করবেন তাতে কখনো সুফল পাবেন না। শরীয়াতের বিরোধিতা করে আপনারা সমস্যায় আরো ঘৃতাহুতি দিতে থাকবেন। কিন্তু সমস্যা থেকে উত্তরণের কোন পথ খুঁজে পাবেন না।
প্রাচীন যে সমস্ত নিয়ম-নীতি দীর্ঘ দিন থেকে মিসরে প্রচলিত রযেছে তার সংস্কার প্রয়োজন। জোতদার ভূস্বামীদের আচরণ কৃষকদের সাথে অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং জুলুমমূলক। চাষীদের বেগার খাটানো হতো কিন্তু তাদেরকে কোন পারিশ্রমিক দেয়া হতো না। নাসের যদি সংস্কারের সঠিক পন্থা অবলম্বন করতো তাহলে সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। ভূমির মালিকদেরকে কৃষকদের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কারবার করার নির্দেশ কার্যকরী করা যেতো। যেমন ভূমি মালিকের এবং শ্রম কৃষকের উৎপাদিত পসলে উভয়ের অংশ সমান। এতে উৎপাদনের পরিমাণ যেমন বৃদ্ধি পেতো তেমনি চাষীদের অবস্থারও উন্নতি হতো। জমি ইজারা দেয়ার ব্যাপারে কোন কোন ফকীহগণের মাতানৈক্য রয়েছে বটে, তবে ভাগ চাষের বিষয়টি সর্বসম্মতিক্রমে স্থিরিকৃত হয়ে গেছে। কৃষকদের নিকট সরকারী খাস জমিও সহজ কিস্তিতে বন্টন করা যেতে পারতো। সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের পর কৃষকদের মালিকানায় চলে যেতো। যদি এ কর্মপন্থা অবলম্বন করা হতো তাহলে ভূমিহীন কৃষক গ্রাম ছেড়ে শহরে পালিয়ে আসতো না। অথচ এখন তাদের জমি ছেড়ে চলে আসার ফলে একদিকে যেমন কৃষি উৎপাদনের ওপর অত্যন্ত খারাপ প্রভাব পড়ে অপর দিকে শহুরে পরিবেশে আশ্রয়হীন ছিন্নমূল ও ভাসমান মানুষের আর্থ সামাজিক সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে।
অনুরূপভাবে কৃষি উপকরণ, যন্ত্রপাতি, গরু-মহিষ ও হাঁস-মুরগী চাষ ইত্যাদিও যদি মালিক ও কৃষকের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হতো এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ শ্রম ও আনুপাতিক অংশ অনুযায়ী উৎপাদনে অংশীদার হতো। তাহলে খাদ্য শস্য, দুধ, ঘি, গোশত ও ডিম তথা প্রয়োজনীয় সব উপকরণই সস্তায় পাওয়া যেতো এবং চাষীদের অবস্থার উন্নতি হতো। যখন একজন শ্রমজীবিকে কারবারে অংশীদার করা হয় তখন তার জন্য কাজ করা ও উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আগ্রহ ও আন্তরিকতার সৃষ্টি হয়। তার আত্মসম্মান বোধও ক্ষুন্ন হয় না এবং তাকে অনাহারেও থাকতে হয় না।
নাসের সাহেব আবাদযোগ্য জমি সরকারীভাবে হুকুম দখল করে চাষী ও কৃষককূলের যেমন কোন কল্যাণ সাধন করেননি তেমনি সামগ্রিকভাবে দেশ ও জাতির কোন কল্যাণও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
সরকারী আমলা ও কর্তাব্যক্তিদের উৎপাদনের প্রতি কোন আন্তরিকতা থাকাতো দূরের কথা অসহায় ও অনন্যেপায় চাষী যারা ইতিপূর্বে জমিদারদের গোলাম ছিল এখন নব্য প্রভুদের দয়া ও অনুগ্রহের পাত্র হয়ে পড়েছে। মিসর মূলত কৃষি প্রধান দেশ। অথচ সেখানে খাদ্য দ্রব্য ও গবাদি পশুর মূল্য জনগণের ক্রয় ক্ষমতার সম্পূর্ণ বাইরে। যথাযথ পরিকল্পনা এবং ন্যায়নুগ ব্যবস্থা চালু করা হলে মুরগীর ডিমের দাম দশ কিরশের বেশী এবং গরু মহিষের দাম কখনো মিসরীয় এক হাজার পাউন্ডের অধিক হতো না। কিন্তু এখন দ্রব্য মূল্যের যে অবস্থা তা কোন মিসরবাসীরই অজানা নয়।
নাসের বড় অহংকারের সাথে ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি গরীবদের ভাগ্য হরিবর্তন করে দেবেন। হাঁ, অবশ্য তিনি তাদের ভাগ্য বদলে দিয়েছেন। তাদের অবস্থা আগে খারাপ ছিল এখন শোচনীয় রূপ পরিগ্রহ করেছে। জনসাধারণ যারা আগে কোন ঈদ বা উৎসব উপলক্ষে মাঝে মধ্যে অপেক্ষাকৃত উন্নত খাবার খেতো এখন তা থেকেও বঞ্চিত। ডিম, বকরীর গোশত, মুরগীর ইত্যাদি এখন মিসরের ধনিক শ্রেণী ছাড়া আর কারো ভাগ্যে জুটে না। নাসেরের সমাজতন্ত্র ও কৃষি সংস্কারের এই হলো পরিণতি।
দ্বাদশ অধ্যায়
ইখওয়ান যখনই কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে তা খুব ভালভাবে অগ্র পশ্চাৎ ভেবে চিন্তে ও যাচাই-বাছই করেই গ্রহণ করে থাকে। ১৯৫৪ সালে বৃটিশ শাসনের কবল থেকে মুক্তির জন্য মিসর ও বৃটিশ সরকারের মধ্যে যে চুক্তি সম্পাদিত হয় তার ওপরও ইখওয়ান তার সুচিন্তিত দৃষ্টিভংগী জামাল অবদুন নাসেরের গোচরীভূত করেছিলো। পরে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে। তন্মধ্যে একটা অভিযোগ ছিল এই যে, আমরা বৃটিশ শাসনের গ্রাস থেকে মুক্তি আন্দোলনের বিরোধিতা করেছি। অতএব আমরা বিদেশীদের এজেন্ট, দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতক।
প্রকৃত অবস্থার স্বরূপ উদঘাটন
আসুন এখন আমরা এ অপ্রকাশিত রহস্যের পর্দা উন্মোচিত করে তার অন্তরালে একটু তাকিয়ে দেখি। কারা আসলে দেশের বন্ধু আর কারা দেশের শত্রু। দু’দেশের মধ্যে সম্পাদিত আনুষ্ঠানিক চুক্তিতে বৃটেনকে অধিকার প্রদান করা হয়েছিল যে, মিসর ভূ-খণ্ডে তারা তাদের সামরিক ঘাঁটি বহাল রাখতে পারবে এবং যুদ্ধকালীন সময়ে মিত্রদেশগুলোর সহায়তার জন্য এসব সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা ছিল এই যে, যে যুদ্ধে আমাদের কোন স্বার্থ থাকবে না এমন কোন যুদ্ধেই যেন আমাদের দেশের মাটি থেকে একটা বিদেশী শক্তিকে তৎপরতা চালানোর অনুমতি দেয়া না হয়। চুক্তির অন্যান্য শর্তের কথা বাদ দিলেও এই একটা ধারাই ছিল এমন যার বর্তমানে সংশ্লিষ্ট চুক্তি কিছুতেই গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নেয়া যায় না। এ ঘটনার পর প্রায় ত্রিশ বছর অতিতের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে কিন্তু তার খুঁটিনাটি আজও আমার মনে আছে। কেননা আমি ছিলাম সেসব ইখওয়ানের একজন যারা তা বাতিল করার জন্য যুক্তি-প্রমাণ পেশ করেছিলেন।
উস্তাদ সালেহ আবু রাকীক সরকারের এ ভিত্তিহীন অভিযোগের- যে আমরা বৃটিশের হাত থেকে মুক্তির বিরোধিতা করেছিলাম-জবাবে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছিলেন, “এসব লোকের ওপর হামলা করা হয়েছিল। কারণ, তারা বিপ্লবের বিরোধিতা করেছিল এবং এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। বৃটিশ দূতাবাসে গিয়ে বৃটিশ কর্মকর্তাদের সাথে গোপনে মিটিং করেছিল এবং বৃটেনের নিকট আবেদন জানিয়েছিল যে, তারা যেন মিসর ত্যাগের চিন্তা মন-জগত থেকে একেবারেই ঝেড়ে ফেলেন, কেননা জাতি বিপ্লবী সরকারের পক্ষে নেই-------!”
বৃটিশ দূতাবাসের সাথে আলোচনা
এ সাক্ষাতকারের বিষদ বিবরণও শুনুন। মিসর সরকার এবং বৃটিশ শাসকদের মাঝে এ মর্মে পর্যাপ্ত আলাপ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিন্তু কোন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছা তখনও সম্ভব হয়নি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব জেনারেল মুহাম্মদ সালেম আমাদের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করেন এবং আমাদেরকে অবহিত করেন যে, বৃটিশ রাষ্ট্রদূত আমাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হতে চান। আমি মুর্শিদে আ’ম আল হুদাইবির খেদমতে এ পয়গাম পেশ করলাম। তিনি বললেনঃ
“বৃটেন কূটনৈতিকভাবে আমাদের অস্তিত্ব মেনে নিয়েছে। অতএব সাক্ষাত করায় কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু নাসের এবং তার সংগীদেরকে এ বিষয় অবহিত করতে হবে। যদি তারা সম্মতি প্রকাশ করে তাহলে সাক্ষাত করা যেতে পারে। অন্যথায় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতে হবে।”
মুর্শিদে আ’ম নাসেরের সাথে দেখা করার জন্য সময় প্রার্থনা করেন। তৎকালে নাসেরও মুর্শিদে আ’ম পরস্পর টেলিফোনে প্রত্যহ কথাবার্তা বলতেন এবং কুশলাদি বিনিময় করতেন। জামাল আবদুল নাসের যদিও বিপ্লবের হোতা ও নায়ক ছিলেন। কিন্তু তখনো পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। তিনি তখন পর্যন্তও সাদাসিধে আচরণের অভিনয় করছিলেন। সে সময় কোন মানুষ কল্পনাও করতে পারতো না যে, এ ব্যক্তিটিই বিলাসিতার এমন চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে পারেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর কার্যত তিনি তা করে দেখিয়েছেন। মোদ্দাকথা হলো, আল রাওদা মহয়ার পর কার্যত তিনি তা করে দেখিয়েছেন। মোদ্দাকথা হলো, আল রাওদা মহলাস্থ মুর্শিদে আ’মের বাসগৃহে পূর্বসিদ্ধান্ত মোতাবেক জামাল আবদুন নাসের, আবদুল হাকীম আমের, সালাহ সালেম, এবং কামালুদ্দীন হোসাইন প্রমুখ যথা সময় এসে পৌঁছেন। মুর্শিদে আ’ম দূতাবাসের বিষয়টি তাদের সম্মুখে উপস্থাপন করেন। তারা সর্বসম্মতিক্রমে ঐকমত্য প্রকাশ করেন। মুর্শিদে আ’ম তাদেরকে নিশ্চয়তা প্রদান করেন যে, আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ তিনি তাদেরকে জানাতে থাকবেন।
ইখওয়ানের পক্ষ থেকে আমি এবং উস্তাদ মুনীর দাল্লা বৃটিশ কূটনৈতিক মিশনের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক উপদেষ্টা মিষ্টার ইভান্সের সাথে আল মায়াদী মহল্লায় অবস্থিত ডাক্তার মুহাম্মাদ সালেমের বাসভবনে মিলিত হই। দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর আমরা উপদেষ্টাকে দু’টো কথা মেনে নেয়ার ব্যাপারে সম্মত করতে সক্ষম হই। যা ইতিপূর্বে সরকারী প্রতিনিধিগণ পারেননি। সরকারী প্রতিনিধিগণের মাথায় একটা ভূতই জেঁকে বসেছিল যে, বৃটিশ চলে যেতে সম্মত হোক। তজ্জন্য তারা কি কি শর্ত আরোপ করছে সে ব্যাপারে তাদের কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। পক্ষান্তরে আমরা চাচ্ছিলাম যে, বৃটিশরা সরে যেতে রাজি হলে পুরোপুরিই সরে যেতে হবে। কোন প্রকার বিধি-নিষেধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া চলবে না। আমি আদ্যোপান্ত পুরো ঘটনা মুর্শিদে আ’ম-এর সম্মুখে তুলে ধরি এবং তার সংগীদেরও অবহিত করি।
দুশ্চরিত্রদের বাহানার অন্ত থাকে না
নাসের ও তার সাথীর পুনরায় আবার মুর্শিদে আ’মের খেদমতে এসে উপস্থিত হলেন। তিনিও তাদের সামনে আলোচনরার বিষয় বিষদভাবে তুলে ধরেন। তারা সবাই এ প্রতিবেদন শুনে যারপর নেই সন্তোষ প্রকাশ এবং উচ্ছসিত প্রসংসা করেন। এমনিতেই আমাদের মধ্যে যেসব সাক্ষাত হতো তার খুঁটিনাটি সকল দিক সম্পর্কেই এ লোকদের ওয়াকিফহাল করা হতো। কিন্তু আপনারা জানেন যে, দুশ্চরিত্রদের বাহানার অন্ত থাকে না। আমাদের ওপর নির্যাতনের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে এ বিষয়টিই “গোপন ষড়যন্ত্র” এবং বিপ্লবের ঘৃণ্য প্রচেষ্টা বলে রটানো হলো।
আমাদের আলোচনার প্রায় সফলতার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে উপনীত হয়েছিলো, ইত্যবসরেই বিপ্লবী সরকার পট পরিবর্তন করে। প্রথম দিকে ইংরেজরা ধারণা করেছিলো যে, আমরা এবং তার (নাসের) যে দুই শরীর এক প্রাণ বিশেষ অর্থাৎ অবিচ্ছেদ্য ও অভিন্ন। তার ভাবছিল যে, গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ। তাই আলোচনা চালাকালে তাদের আচরণ ছিল সমঝোতামূলক এবং ভূমিকা বেশ নমনীয়। জামাল আবদুন নাসের আকস্মিকভাবে খোলস বদলালে ইংরেজরা সর্তক হয়ে যায়। জামাল আবদুল নাসের প্রকাশ্য দিবালোকে হাওয়ামেদীয়া সফরের সময় জনসমক্ষে ইখওয়ানকে আক্রমণ করে কথা বলেন। আল বুহাইরায় পৌছে আরও একটু অগ্রসর হন এবং জনসভায় মানুষের সামনে আমাদের ভাই ওয়াহীদ রামাদানের তীব্র সমালোচনা করেন এবং সেই সময় তাঁর হাতে যে, কলম ছিল তাই তার মুখের উপর ছুড়ে মারেন। ইংরেজরা এই পরিবর্তনে অত্যন্ত সজাগ হয়ে যায় এবং মিষ্টার ইভান্স আমাকে বলেন যে, এখন তো সুস্পষ্ট বিভেদ প্রকাশ হয়ে পড়েছে।
আমি প্রত্যুত্তরে বললাম-এতো খুবই মামুলি ব্যাপার। এতে আমাদের ও সরকারের মধ্যে কোন মতানৈক সৃষ্টি হবে না। মিসরীয় জনগণ সরকারের সাথেই রয়েছে---------।
জামাল আবদুন নাসেরও তার সাংগপাংগরে যখনই উপলব্ধি করলো যে, ফল পেকে তৈরী হয়ে গেছে তখনই তারা ইখওয়ানকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। যাতে সমস্ত সফলতা এবং তার সুফল নিজেরাই কুড়িয়ে নিতে পারে। এ কাজের জন্য তারা ওপরে বর্ণিত নাসেরের আক্রমণ ছাড়াও আরো একটা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। ঘটনাক্রমে ইখওয়ান সমর্থিত ছাত্ররা কায়রো ইউনিভারসিটিতে নওয়াব সাফাভী (ইরানের ফিদায়ানে ইসলামের প্রধান)-এর স্মরণে একটা অনুষ্ঠানের ঘোষনা দিয়ে রেখেছিল। সরকার জীপ যোগে একদল লোক প্রেরণ করে। জীপের ওপর লাউড স্পীকার লাগানো ছিল। জীপে সামরিক বাহিনীর কিছু লোক এবং কিছু সংখ্যক বিপ্লবী যুবক ছিল। সমাবেশ স্থলে পৌঁছে তারা শ্লোগান দিতে শুরু করে এবং গন্ডগোল আরম্ভ করে। ইখওয়ানী ছাত্রগণ প্রথমে তাদেরকে বুঝিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করে। তারা তা মানতে অস্বীকার করলে তারা তাদের আচ্ছমত শায়েস্তা করে। মার খেয়ে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং যাওয়ার সময় নিজেরাই গাড়ীতে অগ্নি সংযোগ করে। আমরা এ পরিস্থিতি সম্পর্কে ছিলাম সম্পূর্ণ না-ওয়াকিফ। হঠাৎ জামাল আবদুন নাসেরের সেনাবাহিনী আমাদের বাড়ী ঘেরাও করে। ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে তল্লাশির অজুহাতে সবকিছু তছনছ করে ফেলে। পরিবারের সব লোকের সাথে অত্যন্ত অপমানজনক আচরণ করে। এ অশালীনতাপূর্ণ আচরণ ছিল এমন যে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। ইখওয়ানের সমস্ত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে হাতকড়া লাগিয়ে সামরিক কারাগারে এবং আমেরিয়ার জেলখানায় বন্দী করা হয়।
বিশৃংখল রাজ্য অযোগ্য রাজা
এবার দেখুন এসব লোকদের সততা ও বিশ্বস্ততা! দু’দিন পর্যন্ত আমাদেরকে জেলখানায় এমনভাবে বন্দী করে রাখা হলো যে, বাইরের সাথে আমাদের কোন সম্পর্কই থাকলো না। যমকালো কুঠুরী থেকে তৃতীয় দিবসে আমাদের বের করে একগাদা সংবাদপত্র আমাদের সম্মুখে রাখা হলো। সংবাদ পত্রসমূহে লাল ব্যানার হেডে খবর মুদ্রিত হয়েছে যে, সরকার মস্তবড় এক ষড়যন্ত উদঘাটন করেছেন। কতিপয় ব্যানার হেডের ভাষা আজও আমার মনে আছেঃ
“ইখওয়ান বৃটিশ সরকারের সাথে আঁতাত করে বিপ্লব সংগঠিত করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র এটেছিলো-গাদ্দারদের হাড়ি চৌরাস্তার মাঝে ভেঙ্গেছে।”
“ইতিহাসের জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতা।”
“বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদন্ড।”
“জনসাধারণের ভেবে দেখার সময়।”
“জামাল আবদুন নাসেরের নেতৃত্বে বিপ্লবী কাউন্সিলের জরুরী অধিবেশন।”
এটাই ছিল সেই ষড়যন্ত্র যা ক্ষমতাশীন শাসকগোষ্ঠী আমাদের বিরুদ্ধে সাজিয়েছিলো। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে চক্রান্ত ও গাদ্দারীর অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করা হয়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার সামনে মানুষের কূটকৌশল চলতে পারে না। সবই জানতে পেরেছে, ষড়যন্ত্রের জাল কারা বিস্তার করেছিল আর কারা ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ।
সত্য প্রকাশিত হয়ে পড়েছে
আমাদের সকলকে কারাগারে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। কিছুদিন পরই হাঙ্গামা শুরু হয়। এই হাঙ্গামাই ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে বিপ্লবী সরকারে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করে। তারপর বিপ্লবী কাউন্সিলের মধ্যেই কিছু টানা-পোড়ন এবং ভুল বুঝাবুঝি শুরু হয়। জেলখানায় অন্তরীণ থাকার বদৌলতে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এ সমস্ত গোলমাল ও বিশৃংখলা থেকে নিরাপদে রাখেন। হঠাৎ আমরা জানতে পারলাম যে, জামাল আবদুন নাসের জেলখানায় আমাদের কাছে এক প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেছেন। এই প্রতিনিধিদলে ছিলেন মুহাম্মদ আহমাদ, মুহাম্মদ ফুয়াদ জামাল (সমাজ কল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী), মহীউদ্দীন আবুল ইজ্জ (কায়রোর স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান) প্রমুখ ব্যক্তিগণ। তারা মুর্শিদে আ’মের সাথে তার কারাগারের সেলের মধ্যেই সাক্ষাত করেন। আমরাও মুর্শিদে আ’মের সাথে ছিলাম। তারা মুর্শিদে আ’মকে নাসেরের সালাম ও শুভেচ্ছা পৌছে দেন এবং বলেনঃ নাসের সাহেব বলেছেন যে, এখন একথা প্রামাণিত হয়ে গেছে যে, আপনারা প্রকৃত অর্থেই দেশ প্রেমিক। আপনারা জেল থেকে বের হয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে সরকারের সাথে সার্বিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করুন।
মু’মিনের দূরদৃষ্টি ও শয়তানী চক্রান্ত
কারাগারের এই সংকীর্ণ খুপরির মধ্যে এ ঐতিহাসিক সাক্ষাত চলাবস্থায় মুর্শিদে আ’মের অনুমতিকক্রমে উস্তাদ সালেহ আবু রাকীক বললেনঃ “তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে এমন ডাহা মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করেছো যে, মিসরীয় কোন ভদ্রলোক এর চেয়ে ভয়ানক অপবাদের কল্পনাও করতে পারে না। তোমরা আবার তা ফলাও করে প্রচার করেছো। অথচ জামাল আবদুন নাসের খুব ভাল করেই জানে, প্রকৃত ঘটনা কি। আমরা কেবল এমন অবস্থায় জেল থেকে বের হতে পারি যখন জামাল আবদুন নাসের নিজে এ অপবাদ খন্ডন করবে। আমরা এমন পরিস্থিতিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারি না। যেখানে আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করতে লজ্জাবোধ করি না। যতদিন এ সমস্যার সমাধান না হচ্ছে ততদিন আমরা এখানে অবস্থান করাটাই উত্তম মনে করি।”
সাইয়েদ মুহাম্মদ আহমদ (যিনি এখনো বেঁচে আছেন) নাসেরের নিকট চলে গেলেন এবং সমাধান নিয়ে পুনরায় ফিরে আসলেন। তিনি বললেনঃ মুর্শিদে আ’ম এবং তার সাথে নেতৃস্থানীয় ছয়জন ইখওয়ানী (যাদের মধ্যে আমি নিজেও ছিলাম) কারাগার থেকে বের হবেন এবং মুর্শিদে আ’মের বাসভবনে চলে যাবেন। নাসের নিজে সেখানে উপস্থিত হবেন। এই উপস্থিতির খবর পত্র-পত্রিকায়ও ছাপা হবে। এবং রেডিওতে প্রচার করা হবে। (নাসের মুর্শিদে আ’ম-এর বাসগৃহে তাঁর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য আসেন এবং তা প্রচারও করা হয়।)
আমরা কারাগার থেকে বেরিয়ে এলাম এবং সরকার ইখওয়ানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলো। কিছুদিন যেতে না যেতেই আমরা আবারও নাসেরের মনোভাব পরিবর্তনের লক্ষণ প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম। তিনি মিছিল করাতে শুরু করেছেন। আইনবিদদের বিরুদ্ধে মুর্দাবাদ শ্লোগান। আইনজীবিদের এসেম্বলীর স্পীকার ডঃ সানহুরী পাশা মরহুমকে অপমান ও মারপিট ইত্যাদি (ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে)। আমরা নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পারি যে, “আল মিসরী” পত্রিকার ওপর সরকার হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছে। এটা ছিল স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিনিধিত্বকারী একটি সাময়িকী। নাসের সবসময় এই পত্রিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেন।
নাসেরের সাথে সাক্ষাত
এ পরিস্থিতিতে মুর্শিদে আ’ম আমাকে নাসেরের সাথে সাক্ষাত করার জন্য তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দেন। বারিউল কুব্বা নামক সামরিক সদর দপ্তরে আমি নাসেরের সংগে দেখা করি। আমি তাঁকে বললাম যে, আমাকে মুর্শিদে আ’ম আপনার নিকট পাঠিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, তুমি ক্রমাগত বিক্ষোভ মিছিল করিয়ে যাচ্ছো তা অনতিবিলম্বে বন্ধ করাও এবং “আল মিসরী” সাময়িকীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক তৎপরতার চিন্তা পরিত্যাগ কর। এসব তৎপরতা আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক।
নাসের আমার কথা শুনে বললো, আমি বিক্ষোভ মিছিল বন্ধ করিয়েছি এবং “আল মিসরী” সাময়িকীর বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা গৃহীত হবে না। আমাদের বিরোধী সকল শক্তি এখন স্তিমিত হয়ে পড়েছে। কেবল একটি ফ্রন্ট থেকেই এখনো পর্যন্ত আমাদের মোকাবিলা করা হচ্ছে। আর সেটা হচ্ছে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইখওয়ানী ছাত্র সংগঠন। তারা আমাদের নির্দেশনার প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই করছে না। তারা যেন বিদ্রোহের পতাকা উডডীন করে রেখেছে। আপনাদের স্বাধীনভাবে বিচরণে তো কোন রকম অসুবিধা নেই। এখন আমরা সেই ছাত্রদের ধোলাই করার জন্য যে কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করি না কেন তাতে আপনারা কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন না। অন্যদের ব্যাপারে আপনাদের নাক গলানোর প্রয়োজন কি?
আমি নাসেরকে জানিয়ে দিলাম, জনাব সাইয়েদ জামাল। এটা আপনি কি বলছেন? আমাদের কি আমাদের সন্তানদের, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ব্যাপারে কোন ভাবনা-চিন্ত থাকা উচিত নয়? আপনি কি আপনার এ বিবৃতি সাংবাদিক সম্মেলনে দিতে যাচ্ছেন?
তিনি তৎক্ষণাৎ বললেনঃ না’
যা হোক, আমি তার সংকল্প অনুমান করতে পারলাম। আর সে-ও আমাদের ভূমিকা ও দৃষ্টিভংগী স্পষ্ট বুঝতে পারলো।
নাজিবের বিরুদ্ধে নাসেরের ষড়যন্ত্র
সে দিনগুলো বড়ই সংকটময়। প্রতিমুর্হূতে পরিবর্তনের খবর আসছিল। আমরা জানতে পারলাম যে, নাসের এবং জেনারেল মুহাম্মাদ নাজীবের মাঝে টানা পোড়ন শুরু হয়েছে। মুর্শিদে আ’ম এ সুযোগে নিজে নিজেই নাসেরকে বোঝানোর জন্য তার নিকট গমন করেন। সে তখনো পর্যন্ত নাসিয়াল বাকরী নামক স্থানে একটা সাধারণ বাড়ীতে বাস করতো। মুর্শিদে আ’ম-এর সাথে ছিলেন ডাক্তার মোহাম্মদ কামাল খলিফা, উস্তদ মুহাম্মদ নাসর ও জনাব সালেহ আবু রাকীক প্রমুখ। মুর্শিদে আ’ম কোন রকম ইতস্তত না করেই খোলাখুলিভাবে নাসেরকে বলতে লাগলেন যে, এরূপ মতবিরোধের ফলে খুবই ক্ষতি হবে। তিনি তাকে আহবান জানান যে, এসব অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য অতিদ্রুত দূর করে পারস্পরিক বুঝাপড়া করার ক্ষেত্র তৈরীর চেষ্টা করুন। তার জানা ছিল যে, নাসের সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। তাই তিনি তাকে নসীহত করলেন যেন আরো দু’তিন দিন বিষয়টির ওপর চিন্ত-ভাবনা করা হয় এবং তড়িঘড়ি করে কোন চূড়ান্ত ব্যবস্থা না নেয়া হয়। এতে ক্রোধ প্রশমিত হয়ে যেতে পারে। মুর্শিদে আ’ম-এর বক্তব্য শুনে নাসের বললেনঃ সেনাবাহিনী কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়েছে তারা একটা কিছু করতে চাচ্ছে। (অর্থাৎ নাজীবকে বরখাস্ত করার জন্য জোর দাবী জানাচ্ছে।)
এ সময়েই প্রায় আটশত সশস্ত্র সৈন্যের বিক্ষোভ মিছিল সেখানে গিয়ে পৌছে। তারা বিরাজমান পরিস্থিতির বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছিলো। নাসের আরো বলেন যে, তিনি তিন দিনের জন্য বিষয়টি বিলম্বিত করবেন। তাছাড়া তিনি সাথী নাজীবের সাথে সাক্ষাত করতেও যাচ্ছেন।
গৃহযুদ্ধের আশংকা
মুর্শিদে আ’ম হক নসীহত করেই চলেছিলেন। তিনি নাসেরকে বুঝানো ছাড়াও নাজীবের নিকট তাঁর প্রতিনিধি মুহাম্মদ ফারগলী ও সাঈদ রামাদানকে প্রেরণ করেন এবং একই নসীহত তাকেও করতে বলেন। পরিস্থিতি খুবই সংকটময় হয়ে পড়েছিল। মুহাম্মদ নাজীবের সমর্থক অশ্বরোহী সৈন্যদের মধ্যে ছিল বেশী। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলোঃ যে সমস্ত অফিসার নাজীবের পক্ষে বিক্ষোভের জন্য বেরিয়েছিল নাসের তাদেরকে চক্রান্ত করে বন্দী করে কয়েদখানায় পাঠিয়ে দেন। এভাবে নাজীবের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। পক্ষান্তরে নাসের অব্যাহতভাবে তার শক্তির প্রদর্শনী করতে থাকে। আমরা ভাবছিলাম যে, যদি সামন্যতম কোন ভুলও হয়ে যায় তাহলে তা গৃহযুদ্ধের দিকে মোড় নেবে। আমরা আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে টেষ্টা করছিলাম এ বিপদ থেকে যেন প্রাণ প্রিয় দেশ মাতৃকা রক্ষা পায়। দেশকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই আমরা বার বার আমাদের জীবনকে বিপন্ন করে সকল অত্যাচার-উৎপীড়ন অকাতরে বরণ করে নিয়েছি। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে দেশ প্রেমিকিই না হতাম তাহলে নিজেদের চামড়া বাঁচাবার জন্য সর্বদাই গৃহযুদ্ধের পথ বেছে নিতে পারতাম।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি