তৃতীয় অধ্যায়
নির্বাপিত প্রেমাগ্নি আলোহীন
কেউ কেউ প্রথম থেকেই ইখওয়ানের ওপর এই অপবাদ আরোপ করতে থাকে যে, তারা নতুন দ্বীনের ভিত্তি স্থাপন করেছে। কিছুদিন পর ইখওয়ানের শত্রুরা তাদের ওপর ক্ষমতার লোভ এবং রাজনীতি করার অভিযোগও উত্থাপন করে। তারা ইখওয়ানের ঘোষণাপত্র ও কর্মপদ্ধতি না দেখেই এই ফতোয়া জারী করে বসে যে, এরা সন্ত্রাস ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিপ্লব করতে চায়। অথচ প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে এই যে, ইখওয়ান অনৈসলামিক আইন-কানুন মেনে নেয় না। বরং তার পরিবর্তে শরীয়াতের আইন-কানুন বাস্তবায়িত করতে চায়। কিন্তু এই উদ্দেশ্যে তাদের কর্মনীতি হচ্ছে প্রচলিত আইনের গন্ডির মধ্যে থেকেই জনসাধারণকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব সাধন করা।
ইখওয়ান একটা ব্যাপক আন্দোলনের নাম। আমাদের এই সংগঠনে যুবকদেরকে শারিরীক ব্যায়াম, অনুশীলন ও সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়ারও ব্যবস্থা ছিল। কথায় অতিরঞ্জন সৃষ্টিকারী ব্যক্তিগণ এই প্রোগ্রামকে “গোপন প্রক্রিয়া” নামে অভিহিত করে এবং প্রচার করতে থাকে যে, এটা সরকারকে গদিচ্যুত করার পূর্বপ্রস্তুতি মাত্র। অথচ আমাদের উদ্দেশ্য গতি পরিবর্তনের এবং মন্ত্রীদের হত্যা করা কখনো ছিল না। আর এখনো নেই। ইমাম হাসানুল বান্নার বিচক্ষণ ও সুতীক্ষ্ম দৃষ্টি দেখতে পেয়েছিল যে, ইসরামী ভূখণ্ড ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাঈল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সমগ্র মিল্লাতের জন্য বড় লজ্জাকর ও দুঃখজনক। যা থেকে রক্ষা পাওয়ার শুধু একটা মাত্র উপায়ই রয়েছে। তাহলো আমাদেরকে বাহুবল সঞ্চয় করতে হবে। মিসরের ওপর ছিল ইংরেজ আধিপত্যবাদীদের দখল। সমগ্র ইসরামী জাহানের নেতৃত্ব প্রদান ও পথপ্রদর্শনের জন্য যে দেশ আলোর দিশারীর মর্যাদা রাখে তাকে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের ছোবল মুক্ত করাই ছিল সময়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দাবী। এসব কারণ সম্মুখে রেখে তিনি যুব সমাজকে তৈরী করার ফয়সালা করেন। কিন্তু আফসোস শত আফসোস! এই উত্তম কাজটিকেই ষড়যন্ত্র এবং বিদ্রোহের বিশেষণে বিশেষিত করা হয়। এই দুঃসাহসিক পদক্ষেপ একাধারে ক্রুশেড, ইহুদী ও কম্যুনিষ্ট শক্তিত্রয় ঠান্ডা মাথায় কি করে বরদাশত করতে পারে। তারা মুসলিম শাসকদের মস্তিষ্কে এই বিষ ভরে দেয় যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন তাদের নেতৃত্বের জন্য বিপজ্জনক। এই সরলমমনা শাসকরা তাদের ফাঁদে পা দেয় এবং তাদের প্রণীত বিভ্রান্তিকর রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে ইখওয়ানদের নির্মূল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
কালের দুর্যোগ ও সময়ের দুর্বিপাক
অনিষ্টকামীদের প্রজ্জলিত অনল তার লেলিহান শিখা নিয়ে দাউ দাউ করে জ্বলছিলো। আমাদের কোন কোন নিবেদিত প্রাণ নওজোয়ানও সেই দাবানলের অসহায় শিকার হয়ে পড়ে। এবং এই শিখা তার বিভৎস রূপ নিয়ে আরো বিস্তার লাভ করে। সরকারের সীমালংঘন তো দিন দিন বেড়েই চলছিলো। তথাপি ইখওয়ান কখনো তাদের সবরের লাগাম হাত থেকে ছেড়ে দেয়নি। কতিপয় সরল প্রাণ যুবক সরকারের উপদেষ্টা খাযেনদারকে হত্রা করে। এই দুর্ঘটনা সংগঠিত হওয়ার পর ইখওয়ান নেতৃবৃন্দ এ খবর জানতে পারে। ঘটনার বিবরণ ছিল এরূপ যে, কিছু কিছু যুবক ইংরেজ সেনাদের বিরুদ্ধে সদা কর্মচঞ্চল থাকতো। যাতে এভাবে তাদের মনে দেশবাসীর অশ্বস্তি ও অশান্তির অনুভূীত সৃষ্টি করে। মিসর থেকে চলে যেতে বাধ্য করা সম্ভব হয়। ইতিমধ্যে কতিপয় যুবক বন্দী হয়। মিষ্টার খাযেনদার মরহুম (বিচার বিভাগীয় উপদেষ্টা) তাদেরকে দশ বছরের কারাদন্ড প্রদান করেন। এই অন্যায় ও অবিচারমূলক রায়েল প্রেক্ষিতে গ্রেফতার কৃত নওজোয়অনদের উত্তেজিত সংগীগণ খাযেনদারকে হত্যা করে।
এই সময়েই আরো একটি ঘটনা সংগঠিত হয় যা এই যুবকদের আবেগকে উত্তেজিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আলেকজান্দ্রিয়ার আনতুনিয়াদিস বাগানে দু’জন যুবকের লাশ পাওয়া যায়। এ দুই লাশের একটু তূরে আহত এবং মৃতপ্রায় অপর এক ব্যক্তিকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রথম দিকে পুলিশ ঘোষণা করে যে, হত্যাকারীর কোন পাত্তা পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই আহত যুবক হাসপাতালে নীত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে ওঠে এবং পরে সে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করে। তার বর্ণনা মোতাবেক কানাদী নামক এক বিত্তশালী ঠিকাদার অর্ধ রাতের পর তাকে সাথে নিয়ে ঐ বাগানে যায়। কিছুক্ষণ সে তার সাথ কাটায়। তারপরই সে তাকে মারতে আমর্ভ করে। তাকে মৃত মনে করে ঠিকাদার অত্যন্ত সংগোপনে সেখান থেকে কেটে পড়ে। পূর্বোক্ত দু’জন হত্যাকান্ডের কোন তথ্য পাওয়া গেল না। কিন্তু তৃতীয় যুবকের মোকদ্দমায় ঠিকাদার কানাদীকে আট বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়।
ইখওয়ানের তারুণ্যদ্দীপ্ত যুবকগণ উভয় ঘটনার তুলনা করে। এক দিকে ছিল দু’টি হত্যার মোকদ্দমা এবং একটা হত্যার মোটিভ সংক্রান্ত কেস। এতে অপরাধীর আট বছরের সাজা হয় অথচ অপর দিকে কেউ আহত বা নিহত না হলেও খাযেনদার সাহেব যুবকদের প্রত্যেককে দশ বছরের সাজা ফরমান শুনিয়ে দেয়। এতে যুবকদের তাজা রক্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং তারা খাজেনদার মরহুমকে হত্যা করে বসে। একদিকে যেমন জনগণ পত্র-পত্রিকায় এই হত্যাকাণ্ডের খবর পড়ে বিস্ময় বোধ করে অন্যদিকে ইখওয়ান নেতৃবৃন্দও এই দুঃখজনক ঘটনার খবর সংবাদ পত্রের মাধ্যমেই জানতে পারেন।
তুমিই বলো এ কেমন কথা
আন্দোলনের দুশমনরা সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিল। এই ঘটনাকে অজুহাত বানিয়ে তারা ইখওয়ানের বিরুদ্ধে জঘন্য প্রকৃতির যুদ্ধ শুরু করে। হাসানুল বান্না শহীদ তো লোকদের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই দাওয়াতের মৌলিক উদ্দেশ্য সমূহ বর্ণনা করতেন। মুসলিমদের ওপর যেখানেই অত্যাচার-অবিচার চালানো হতো তিনি তাতেই কঁকিয়ে উঠতেন। মুসলিম মিল্লাত খেলাফতের নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছে এ ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত আফসোস করতেন। তার দৃষ্টিভংগী ছিল এই যে, যদিও কোন কোন ওসমানীয় খলিফা বিচ্যুতির পথ অবলম্বন করেছিলো তবুও তার অর্থ এই ছিল না যে, খেলাফত ব্যবস্থাকেই সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। তিনি ছিলেন ইসরামী খেলাফত ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনের পতাকাবাহী। এমন ব্যক্তি তার অনুসারীদেরকে হত্যার ও লুন্ঠনের অনুমতি কিভাবে দিতে পারেন?
প্রবৃত্তির অনুসারীগণ যেসব যুক্তি-তর্ক পেশ করে থাকেন তা যদি মেনে নেয়া যায় তাহলে সে ক্ষেত্রে ইসলাম নিকৃষ্টতম ধর্মের রূপ পরিগ্রহ করে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ওসমানীয় খলিফাগণ ভ্রান্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। এ জন্য খিলাফত ব্যবস্থাই সমস্ত অকল্যাণের উৎস। ইসলামের দুশমনরা মুসলিমদের অবস্থা দেখে আমাদের অন্যায় অপকর্মগুলোকে ইসরামের খাতায় জমা করেন। কিন্তু মুসলমানরা যা করে তা ইসলাম নয় বরং মুসলমানদের যা করা উচিত সেটাই প্রকৃত ইসলাম। এক ব্যক্তি নিরপেক্ষভাবে ইসরাম সম্পর্কে অধ্যয়ন করেন। তিনি মুসলিমদের দেখেননি। তিনি ইসলামের যথার্থতার স্বীকৃতি দিয়ে মুসলিম হয়ে যান। তিনি যখন মুসলিমদের সাথে এসে মিলিত হন তখন দুঃখ করে বলতে থাকেন: আমি যে ইসলামের কথা বইয়ের পাতায় পড়েছিলাম তাতো ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। আমি যদি এই মুসলিমদের প্রথমেই দেখতাম তা হলে হয়তো ইসলাম কবুল করতাম না।
ইখওয়ানে যোগদানের পর
আমার মনে পড়ে ইখওয়ানের কাফেলায় শামিল হওয়ার কয়েক বছর পর শহীদ ইমাম আমাকে দলের ওয়াকীল (সহকজারী মুর্শিদে আ’ম)-এর দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান। আমি আল্লাহর নাম করে তাকে বললাম যে, আমি এই গুরুদায়িত্ব পালনের যোগ্য নই। তাই তা গ্রহণ করা অবিশ্বস্ততার পরিচায়ক হবে। সেই সময় মুর্শিদে আ’ম আমাকে এ পরামর্শও প্রদান করেন য, আমি যেন আমার দপ্তর স্থানান্তর করে কায়রোতে নিয়ে আসি। কিন্তু আমি আরজ করলাম যে, আমার প্রাকটিশ আমার ছোট মফস্বল শহরেই ভালভাবেই চলছে এবং তা দ্বারা আমি হালাল রিজিক উপার্জন করে আসছি। কোন কোন লোককে একথাও বলতে শুনা গেছে যে, ইখওয়ানের বদৌলতেই আমি আমার পেশায় সফলকাম হয়েছি। আমি এতটুকু বলতে চাই যে, আমার অমনোযোগী স্বভাব প্রকৃতি ও শিক্ষা দীক্ষার কারণে আমি কখনো দুনিয়ার জীবন এবং বস্তুগত সুযোগ সুবিধা লাভের জন্র কোন সৃষ্টির সাহায্য গ্রহণ করিনি। আল্লাহর অনুগ্রহ সর্বদা আমাকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছে। মুর্শিদে আ’ম-এর দৃষ্টিভংগীও সান্নিধ্য এবং ইখওয়ানের একান্ত মহব্বত ও সহচার্য্যের জন্যও আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। আল্লাহ তায়ালা তাঁদের সকলকে আমার সাথে উত্তম ব্যবহারের জন্য সর্বোত্তম বিনিময় দান করুন।
ঘৃণা ও ভালবাসা সবই একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে
ইখওয়ানের সাথে সম্পর্ক ও বিশ্বস্ততার কারণ হাসানুল বান্না কিংবা হাসান আল হুদাইবির সাথে সম্পর্কিত নয়। আমরা আল্লাহর নাম নিয়েই তাঁরই সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে একে অপরের সাথে একই সূত্রে গ্রথিত হয়ে আন্দোলনের ময়দানে এসে সমবেত হয়েছি। হাসানুল বান্না এবং হাসান আল হুদাইবি এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ দ্বারা তাঁদের ব্যক্তিসত্তা কিংবা ব্যক্তিত্বের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া বুঝায় না। বরং তা আল্লাহর হাতে বাইয়াতেরই নামান্তর। নবী আকরাম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে যেসব লোক বাইয়াত গ্রহণ করেছিলেন তাও ছিল আল্লাহ তায়ালার হাতে বাইয়াত গ্রহণ। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
(আরবী***************)
“নিশ্চয়ই যেসব লোক (হে নবী) আপনার হাতে বাইয়াত নিয়ে থাকে তারা মূলত আল্লাহ তায়ালার সাথেই বাইয়াতে আবদ্ধ হয়ে থাকে; তা৭দের হাতের ওপর রয়েছে আল্লাহর হাত।” –আল ফাতহ” ১০
যেসব লোক ইখওয়ানের ওপর দোষারোপ করে থাকে যে, আমরা হাসানুল বান্নার পুতঃপবিত্রতার প্রবক্তা তাদেরকে আল্লাহ তায়ালার কাছে তারা কি জবাব দিবেন তা ঠিক করে নেয়া উচিত। আমরা আল্লাহ আল মালেকুল কুদ্দুস ব্যতীত অন্য কারো পবিত্রতা বর্ণনার পক্ষপাতি নই। হাসানুল বান্না এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত হাসান আল হুদাইবি-এর সাথে আমরা গভীর মহ্বত রাখি ও আন্তরিক ভালবাসা পোষণ করি। কেননা তারা দু’জনই আমাদরে চক্ষু খুলে দিয়েছেন এবং ইসরামের আলোর সাথে আমাদেরকে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন। যেসব মহত ব্যক্তিত্ব এই আকিদা-বিশ্বাসের মর্মকথা আমাদের সম্মুখে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন তাঁদের সাথে আমরা ঐকান্তিক সম্পর্ক রাখব না? তাঁদের সাথে আমাদের মহব্বত তো আল্লাহরই নির্দেশ মোতাবেক এবং তারই সন্তুষ্টিলাভের জন্য। কিন্তু আমরা তাঁদেরকে আমাদেরই মত সাধারণ মানুষ মনে করে থাকি এবং তাঁদের পবিত্রতা বর্ণনার পক্ষপাতি নই কখনো।
প্রথম মুর্শিদে আ’ম-এর সাথে একজন মুরীদ ও শাগরেদ হিসেবে আমি সময় কাটিয়েছি এবং তাঁর নিকট থেকে অনেক কিছু শিখেছি। ইমাম আমাদেরকে আমাদের হাত ধরে মানবতার উন্নত স্তরে উন্নীত করেছেন এবং ইসলামের দস্তরখানের ওপর এনে বসিয়েছেন। এটা ছিল সেই সময়ের কথা যখন মুসলিমগণ ইসলাম ছেড়ে ভিখারীদের মত প্রত্যেক দস্তরখান থেকে উচ্চিষ্ট আহরণ করে ফিরছিলো। আল্লাহ তায়ালা তার দ্বীনের খেদমতের জন্য এমন লোকদের মনোনীত করে থাকেন যারা এ কাজের যোগ্যতা সম্পন্ন।
(আরবী************)
“এটাতো আল্লাহর অনুগ্রহ ও মেহেরবানী তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করে থাকেন।” –আল হাদীদ” ২১
আমার কর্মপন্থা আমীরি নয় ফকীরি
ইমাম শহীদ এমন বুদ্ধিমত্তার সাথে ও সুকৌশলে আমাদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন যে, দুনিয়া, এবং এর চাকচিক্য আমাদেরকে আকর্ষণ করতে পারে না। এই পৃথিবী নশ্বর ও ক্ষণস্থায়ী এবং এই জীবন টলটলায়মান- যে কোন মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। এমন দুনিয়ার সাথে কি আর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। আর এই জীবনের আশঙ্কায় ও দুশ্চিন্তায় অযথা হাহুতাশ করে কি লাভ। আল্লাহ তায়ালার নিকট যা কিছু রয়েছে তাই উত্তম ও চিরস্থায়ী। ইখওয়ান সাধারণত নিম্ন আয়ের লোকদের সমষ্টি ছিল। তথাপি তারা তাদের সংগঠনকে নিয়মিত আর্থিক সহায়তা প্রদান করতো। পাঁচ কুরুশ থেকে আরম্ভ করে পাঁচ পাউন্ড পর্যন্ত প্রতি মাসে বিভিন্ন ইখওয়ান সংগঠনকে নিয়মিত এয়ানত দিতো। অবশ্য কিছু সংখ্যক ভাই এমনও ছিলেন যাদেরকে আল্লাহ পর্যাপ্ত রিযিক দিয়েছিলেন। তাঁরা এর চেয়েও অধিক পরিমাণ এয়ানত পেশ করতো।
এক পর্যায়ে ইখওয়ানের বায়তুলমাল সম্পাদকের সম্মানও আমি লাভ করেছি। যদি কখনো বায়তুলমালে একশত পঞ্চাশ কুরুশ পরিমাণ অর্থ সঞ্চিত হতো তখন আমি মনে করতাম যে, আমাদের সংগঠন খুব সম্পদশালী হয়ে গেছে। আপনারা শুনে আশ্চর্য হবেন য, এই অর্থ দ্বারাই সংগঠনে সমস্ত কাজ চলতো। দ্বীনের সম্পদ যার হাতে এসে যায় সে কি দারিদ্র্যের কোন পরোয়া করে। অফিসে সংগঠনের যে টেলিফোন ছিল কোন ব্যক্তিগত কাজের জন্য তা ব্যবহার করার কোন অনুমতি ছিল না। যতক্ষণ না তিন তারিফঅ প্রদান করতো।
কোন সদস্য যখন কোন দাওয়াতী কাজে কোথাও যেতো তখন তার সফর খরচের জন্য তাঁকে তিন তারিফা দিতাম। ..... তা থেকে ছয় মিলিমা যাওয়ার জন্য এবং ছয় মিলিমা আসার জন্য কিংবা মিনি বাসের ভাড়া ও তিন মিলিমা ডাল রুটির জন্য। কি স্মরণীয় সময় ছিল সেটা!!
গ্রন্থকীট নয় গ্রন্থকার
ইখওয়ানুল মুসলিমুন আমাদেরকে একটা প্রাণবন্দ জীবন দান করেছিল। এই আন্দোলনের সাথে একাত্ম হওয়ার পর আমরা যেন জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যেল সাথে পরিচিত হয়ে উঠি। পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যে আমরা আমাদেরকে সর্বাধিক সৌভাগ্যবান মনে করতে থাকি। পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ এবং একজনের অন্যজনের হৃদয় জয় করার প্রেরণা সবসময় তুঙ্গে থাকতো। আন্দোলনের কাজ আরো ব্যাপক করা ছাড়া আর কোন চিন্তা আমাদের মনে স্থান পেতো না। আমি ওকালতীর কাজকর্ম শেষ করে সালাতুল আসরের পর ইখওয়ানের অফিসে চলে আসতাম এবং এশার পর পর্যন্ত আন্দোলনের কাজে ব্যস্ত থাকতাম। এটা তো বর্ণনা করার কোন অপেক্ষাই রাখে না যে, এই খেদমত হতো নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং এর বিনিময় কোন বস্তুগত সুবিধা লাভ করা কখনো উদ্দেশ্য হতো না।
কোন কোন লোক ধন-সম্পদকেই সবকিছু মনে করে। আমি ধন-সম্পদের গুরুত্ব অস্বীকার করি না। বিশেষত সেই সময় থেকে যখন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম-এর এই হাদীস পড়ার সুযোগ পাই-
(আরবী**************)
“হালাল উপায়ে উপার্জিত সম্পদই সর্বোত্তম সম্পদ। যা একজন সৎমানুষের হাতে এসে পৌঁছে।”
এবং তার এই কথা যে- (আরবী*************)
“মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পাতবে নিজের পোষ্যদর এমন অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে সচ্ছল রেখে যাওয়া উত্তম।”
এ হাদীসগুলো থেকে হালাল মালের গুরুত্ব অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তারপরও আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, কাজের লোক পাওয়া গেলে ধন-সম্পদও পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে ধন-সম্পদের প্রাচুর্য দিয়ে কর্মঠ লোক খরিদ করা যায় না। মাল নষ্ট হয় গেলে তা পুনরায় উপার্জন করা যায়। কিন্তু কর্মী বাহিনী ধ্বংস হয়ে গেলে সে ক্ষতি পূরণ করা যায় না। আত্মমর্যাদা বিক্রি হয়ে গেলে সবকিছুই হারিয়ে যায়। আমাদের অবস্থা হচ্ছে আমরা আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে ধন-সম্পদ চাই। আবার অনেকের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা অর্থবিত্তের পূজারী। অর্থ-সম্পদ হালাল উপায়ে অর্জিত হচ্ছে না হারাম উপায়ে তাদের কাছে এর কোন গুরুত্ব নেই। তাদের উদ্দেশ্য শুধু সিন্ধুক ভর্তি করা। যেসব লোকের এরূপ মনমানসিকতা থাকে তারা সব মানুষকে একই পাল্লায় ওজন করে। তারা কল্পনাও করতে পারে না যে, কোন মানুষ কোন বিনিময় ছাড়াও কোন কাজ করতে পারে।
ইখওয়ানের ওপর আল্লাহ তায়ালার বড়ই ইহসান রয়েছে যে, তারা মনের সম্পদকে কখনো শরীরের সম্পদের বিনিময়ে কুরবানী করে না। তাদের উদ্দেশ্য তাদের আন্দোলনের সফলতা ও আত্মমর্যাদার সংরক্ষণ। যদিও আমি আমার নিজরে সম্পর্কই কথাবার্তা বলে আসছি তথাপি আমার দৃঢ় বিশ্বাস ইখওয়ানের প্রত্যেক সদস্যই এই মানদন্ডে পুরোপুরি উদরে যাকে। আমাদের দাওয়াত বৈষয়িক উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। আমাদের দাওয়াত আল্লাহর পথের দিকে মানুষকে আহ্বান করা।
আমীর-উমরাহ ও মন্ত্রীর দরবারেও বে-নিয়াজী
কারাবার থেকে মুক্তিলাভ করার পর সাদাতের শাসনামলে আমি কোন কাজে প্রধান মন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যাই। তিনি মা’শাআল্লাহ এখনো বেঁচে আছেন। আলোচনা চলাকালে মন্ত্রীর প্রবর আর্থিক বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেন। তিনি বলতে লাগলেন, সরকার মিসরের সমস্ত পত্রিকা ও সাময়িকীকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে আসছে এবং মুজাল্লাহতুদ দা’ওয়াহ একটা ইসলামী পত্রিকা হিসেবে এই সহযোগিতা পাওয়ার সর্বাধিক হকদার। এতেই আমার বুঝতে বাঁকী থাকলো না যে, জনাব কি উদ্দেশ্য হাসিলের মতলব এঁটেছেন। তবুও আমি আমার ধৈর্য শক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখলাম এবং সাদামাটা ভাষায় আরজ করলাম “জনাব এসব আলোচনা থাক। এটা আমাদের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়।” অবশেষে সাক্ষাতের পালা সমাপ্ত হয় এবং আমি তার দপ্তর থেকে নিরাপদে ফিরে আসি।
সত্য পথের আহবায়ক আল্লাহর দ্বারের ভিক্ষুক
একবার মিসরের একটা দ্বীনি পত্রিকা একটা জলসার ব্যবস্থা করে। এই পত্রিকা এখনো চালু আছে। পত্রিকার অফিসে অনুষ্ঠিতব্য এই অধিবেশনে আমাকে বক্তব্য রাখার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিলো। নির্দিষ্ট দিনে যথা সময়ে আমি সমাবেশে গিয়ে উপস্থিত হই। বিরতির সময় প্রাতৃদিত প্রয়োহনে ও অযু করার জন্য টয়লেটে যাই। অযু শেষে আমি গোসলখানা থেকে বের হচ্ছিলাম। সেই সময় পত্রিকার একজন কর্মচারীকে বাইরে অপেক্ষামান দেখতে পাই। তিনি আমার দিকে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “জনাব স্বাক্ষর করে দিন।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কিসের কাগজ আর দস্তখতই বা কি জন্য।” তিনি বললেন, “এটা আপনার জলসায় তাশরীফ নিয়ে আসার বিনিময়।” আমি বলে উঠলাম, “আমি যদি জানতাম দাওয়াত ইলাল্লাহ-এর কাজের জন্য তোমরা পারিশ্রমিক দিয়ে থাক তা হলে আমি কখনো এখানে আস্তাম না।” তিনি বলনে, “এটা তো শুধু সফর খরচ।” আমি বললাম “আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি। ইখওয়ান এই কাজের জন্যই এ গাড়ি দিয়ে রেখেছে।” তিনি আবারো বললেন, “কিন্তু এই পারিশ্রমিক তো সব লোকই নিয়ে থাকে।” আমি তাকে বিনীতভাবে বললাম, “আমি কিন্তু ঐসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত নই। বরং আমি তো আল্লাহর দরবারের একজন ভিক্ষুক।” আমি সেই বন্ধুর কাছে আমার অপারগতা ব্যক্ত করলে তিনি বিস্মিত ও হতবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। অতপর আমি ফিরে আসি এবং তিনি বিফলমনোরথ হয়ে কাগজ হাতে তার দপ্তরের দিকে চলে যান।
আমার লিখা হয়ে থাকে খুবই সাদামাঠা ভাষায়। কারণ, আমি কোন সাহিত্যিক বা কলমজীবী নই। তাতরপরও কেন জানিনা অনেক লোক আমার নিকট কিছুনা কিছু লেখার অনুরোধ জানান। কোন কোন পত্রিকাও উপযুক্ত সম্মানির বিনিময়ে আমাকে তাদের পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে বলে। আমি তা অস্বীকার করেছি। কেননা প্রথমত, আমি কোন সাংবাদিক নই। দ্বিতীযত, আমি একজন দায়ী। একজন দায়ী-ইলাল্লাহর কথা সঠিক বা বে-ঠিক যাই হোক না কেন পারিশ্রমিক গ্রহণ তার পক্ষে মোটেই সমীচীন নয়। যে সমস্ত দায়ী কোন প্রকার আর্থিক বিনিময় ছাড়া খালেছ আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দাওয়াতী কাজে নিয়োজিত থাকে তারা সম্মান লাভ করে এবং তাদের কথাও আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের জন নিবদ্ধ থাকে। বিনিময় গ্রহণের পর তো আপনাকে লক্ষ্য করতে হবে পত্রিকার মালিক এবং পাঠকগণ কি প্রত্যাশা করেন? অথচ একজন সত্য পথের আহবায়ক শুধু তার দাওয়াতের দাবী ও চাহিদা কি তাই দেখে থাকেন।
মংগলবারের দারস ও উহার প্রেক্ষিত
মংগলবারের দারসের পোগ্রাম ছিল নওজোয়ানদের ট্রেনিং ও প্রশিক্ষণ প্রদানের একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ইমাম শহীদ যখন মংগলবারের এই দারস শুরু করেন তখন অল্প সংখ্যক লোক তাতে হাজির হতো। কিন্তু এখন এই দারস ইখওয়ানের কর্মসূচীর অত্যাবশ্যকীয় অংশে পরিণত হয়েছে। ইলমিয়াতুল জাদিদার মারকাজে আ’মে অনুষ্ঠিত এই মজলিশে মুর্শিদে আ’ম প্রতি মংগলবার মাগরিব থেকে এশা পর্যন্ত দারস পেশ করতেন। মাগরিবের পূর্বেই বিপুল সংখ্যক যুবক ও গণ্যমান্য ব্যক্তি মারকাজে এসে সমবেত হতো। শ্রোতাগণ শুধুমাত্র কায়রো থেকেই নয় বরং দূরের ও কাছের অন্যান্য জিলা থেকেও এসে জড়ো হতো। সকলের চেহারাই হাঁসি খুশী এবংদিল ও দিমাগ শান্ত ও পরিতৃপ্ত। ইমাম মাগরিবের জামায়অতে ইমামতির দায়িত্ব পালন করার পর মারকাজের উন্মুক্ত আঙ্গিনায় বসে দারস শুরু করতেন। এ দারসে শত শত নয় বরং হাজার হাজার লোক অত্যন্ত উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে এসে অংশ গ্রহণ করতো। মরকাজের বারান্দা, ব্যালকনি এবং আশেপাশের বিলিংয়ের ছাগদ উপস্থিত শ্রোতা দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে যেতো। মনে হতো যেন এই পবিত্র মাহফিলকে ফেরেশতাগণ পরিবেষ্টিত করে রেখেছেন, রহমতের ছায়া পড়ছে বেং শাস্তির বারিপাত হচ্ছে। কোন প্রকার শোরগোল, হৈ হুল্লোড় ও বিশৃংখলা দেখা যেতো না। প্রতিটি মানুষ মন-মস্তিস্ক এবং চোখ-কাণ দিয়ে নসীহতের প্রতি মনোযোগী হতো। ইমামের মুখ থেকে হীরা ও মোতি ঝরে পড়তো যা কুড়িয়ে মানুষ তাদের মনের মনিকোঠায় সঞ্চিত করতো। দেখে মনে হতো যেন প্রত্যেক শ্রোতা হাসানুল বান্নাকে ছোট বেলা থেকেই জানে কিংবা কমপক্ষে বছরের পর বছর তার সাথে থাকার সুযোগ লাভ করেছে।
মাহফিলে অংশগ্রহণকারী শ্রোতা নতুন পুরাতন যাই হোক না কেন সবাই যেন আত্মমগ্ন হয়ে যেতো। মনে হতো যেন তারা তাদের হারানো সম্পদ পেয়ে গেছে যার অন্বেষণে তারা সমগ্র পৃথিবীময় তন্ন তনত্ন করে খুঁজেছে কিন্তু পায়নি অথচ এানে এসে তা পেয়ে গেছে। হাসানুল বান্নার আকৃতিতে আল্লাহ তায়াল তার মনের চাহিদা পূরণের যথাযথ ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মুখ থেকে নিঃসৃত কথাবার্তা মানুষের অন্তরে গিয়ে প্রভাব সৃষ্টি করতো। এমতাবস্থায় এশার আযান শুরু হয়ে যেতো। আযান চলাকালে ইমাম শহীদ চুপ করে থাকতেন। তারপর পুনরায় তার ভাষণ চলতে থাকতো যা অল্প সময়ের মধ্যেই সমাপ্ত হয়ে যেতো। শ্রোতাদের মধ্যে আকাংকা তাকতো যেন বক্তৃতা সকাল পর্যন্ত চলতে থাকে।
ইসলামের শত্রুগণ মিসরে ভেতরে বিলম্বে সতর্ক হয় কিন্তু মিসরের বাহিরে তাৎক্ষণিক বিপদের ঘন্টাধ্বনি বেজে ওঠে। বাতিল এই আন্দোলনের মধ্যে তাদের জন্য নিশ্চিত মৃত্যু দেখতে পাচ্ছিলো। তাই তারা ইখওয়ানুল মুসলিমুনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করতে শুরু করে। দুশমনরা এই আন্দোলনকে নির্মূল করতে পারেনি।
সত্য তথাপি তাদের শয়তানী ফন্দি ও কৌশল এবং তাগুতি অত্যাচার-উৎপীড়ন দ্বারা তার গতি ব্যহত করার ক্ষেত্রে কামিয়াব হয়েছে। ইখওয়ান জেলখানার মধ্যেও মঙ্গলবারের দারস ব্যহত হতে দেয়নি। এই দারস বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। তথাপি এই দারস জারী আছে এবং থাকবে। এটা ইখয়ানর উত্তরাধিকার যা এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষে হস্তান্তরিত হয়ে আসছে। এটা সত্যের এমনএক পতাকা যা একজন মুজাহিদের হাত থেকে অন্য মুজাহিদের হাতে সোপর্দ করা হচ্ছে। (আরবী****) “সকল কাজের পরিণতি তো আল্লাহ তায়ালার দিকেই প্রত্যাবর্তিত হয়ে থাকে।”
মঙ্গলবারের দারসে কুরআনের ধারা খুবই নমনীয়ভাবে শুরু করা হয়েছিল। ইমাম শহীদের সাগরেদ ও ভক্তগণ সাবাতিয়ায় তার গৃহে হাজির হতো এবং একটা প্রশস্ত হল রুমে চাটাইয়ের ওপর আসন গ্রহণ করতো। রেল স্টেশনের অনতিদূরেই ছিল তাঁর বাসগৃহ। উপস্থিত লোকদের সংখ্যা শুধু কয়েক ডজনেই সীমাবদ্ধ থাকতো। সমাগত মেহমানদের সামনে ছোট ছোট কাপ রেখে দেয়া হতো এবং সকলকে চা দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। ইমাম ছিলেন খুবই উদার ও দানশীল অন্তরের অধিকারী। কিন্তু তার আর্থিক উপায় উপকরণ ছিল সীমাবদ্ধ। এটা ছিল মঙ্গলবারের দারসের প্রাথমিক যুগ।
সেই যুগে কতিপয় ব্যক্তি চাটাইয়ের ওপর বসতো এবং ইমাম তাদের সামনে ঈমান সঞ্জীবনী দারস পেশ করতেন। এই দৃশ্যের তুলনা যদি হিলমিয়াস্থ মারকাজে আ’ম-এর সাথে করা হয় তাহলে বিবেক-বুদ্ধি স্তম্ভিত হয়ে যায়। এই শতাব্দিরই চল্লিশের দশকে হাসানুল বান্না শহীদকে যারা জানতো তাদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত নগণ্য কিন্তু পঞ্চাশের দশকের সেই হাসানুল বান্নাই সারা দেশে ছোট বড় সকলের নিকট আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ান। এই সময়েও তিনি সুনাম ও সুখ্যাতি থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করেন। তিনি নম্রতা ও শিষ্টাচারের চাদর তার শরীরে জড়িয়ে রেখেছিলেন। এতে তার সৌন্দর্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। যতই তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে ততই তার বিনয় ও নম্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
দরবেশের দরবার
ইমাম কয়েকবারই আমাকে তার সফরসঙ্গী হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। রেল ভ্রমণের সুযোগ আসলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, সফর আমার পয়সায় করতে হবে নাকি তোমার খরচে? যদি আমার পকেট অনুমতি দিতো তাহলে আমি সবিনয়ে নিবেদন করতাম, “সফরের যাবতীয় খরচ আমিই বহন করবো।” অতপর আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর টিকেট কিনে নিয়ে আসতাম এবং যথা সময়ে আমা সফরে উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতাম।
যদি আমার অবস্থা ভাল না হতো তাহলে অকপটে আরজ করতাম, “জনাব সফর আপনার দায়িত্বে করতে হবে।” তখন তিনি তৃতীয় শ্রেণীর টিকেট ক্রয় করতেন। সফর কালীন সময়ে আমি মাথধা ঝুঁকিয়ে নীপের দিকে তাকিয়ে থাকতাম এবং এই চেষ্টা চলতে থাকতো যেন আমাদের কোন পরিচিত ব্যক্তি আমাদিগকে থার্ড ক্লাস কমপার্টমেন্টে দেখে না ফেলে। মুর্শিদে আ’ম ঈষৎ হেসে আমার দিকে তাকাতেন কিন্তু মুখে কোন কথা বলতেন না। এটা প্রাথমিক পর্যায়ের কথা। তখনো পর্যন্ত কলিজার খুনের সংমিশ্রণে অশ্রু ব হনের পালা আসেনি। প্রেম যখন ভালবাসার রীতিনীতি শিকিয়ে দিল তখন আর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর মধ্যে কোন পার্থক্য রইলো না।
আমরা মনে করতাম যে, আমি শহীদ ইমামের মনের খুবই নিকটবর্তী। আমি কখনো তার সম্মুখে কোন অভিযোগ পেশ করিনি।কিংবা কোন ভাইয়ের বিরুদ্ধেও নালিশ করিনি। সত্য কথা বলতে কি আমি কোন দিন কোন ইখওয়ানী ভাইয়ের সাথে মতভেদ করেছি বলেও মনে পড়ে না। সাধারণ ও বিশেষ কোন বিপদ মুসিবতের ব্যাপারেও আমার কর্মপদ্ধতি ছিল এই যে, তা ইমামের সামনে তুলে ধরে তাকে পেরেশান করা সমীচীন নয়। তিনি আমাকে যখনই কোন কাজের নির্দেশ দিতেন আমি তৎক্ষনাত তা সম্পাদন করতাম। কখনো কখনো কোন আদেশ কার্যকর করতে গিয়ে বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো এবং বস্তুগত উপকরণ ব্যয় করতে হতো। তথাপি নির্দেশ পালনে যে মজা পেতাম তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
আমার পূর্বে ইখওয়ানের সদস্যদের মধ্যে কেউ উকীল ছিল না। আমার ইখওয়ানে যোগদানের পর কায়রো কিংবা কায়রোর বাইরে কোথাও ইখওয়ানের কোন কেস হলে আমিই তা পরিচালনা করতাম। প্রথমে আমার যাতায়াত শাবীনুল কানাতির ও কায়রোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ইখওয়ানের সাথে কাজ শুরু করার পর আমি মিসরের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত গিয়েছি। কখনো মুর্শিদে আ’ম-এর সাথে একযোগে সফরের সৌভাগ্য হতো আবার কখনো তার প্রতিনিধি হিসেবে সফরে যেতে হতো। আমি যদিও সহকারী মুর্শিদ ছিলাম না। তথাপি ইমাম তার পক্ষ থেকে আমাকে নির্দেশ দিতেন যাও অমুক শহরের জলসায় আমার প্রতিনিধিত্ব করে এসো। এটা কেমন ঈমান সঞ্জীবনী এবং সাহস সঞ্চয়কারী পরিবেশ ছিল। আমি হৃদয় মনে যা উপলব্ধি করি তা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাই না। যদি পেতাম তাহলে মনের কথা মনের মত ব্যক্ত করতাম।
চতুর্থ অধ্যায়
মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্বের সাথে স্মরণীয় সফর
এই ব্যক্তিত্ব (শহীদ হাসানুল বান্না) তার অনুসারীদের অতি ক্ষুদ্র বিষয়ের খেয়াল রাখতেন যাতে তাদের আরাম-আয়েশের পূর্ণ ব্যবস্থা করা যায়। ইমামের এই মহতী ব্যক্তিত্বের কারণে তাঁর সাথে তাঁর অনুসারীদের সম্পর্ক ছিল খুবই মজবুত ও নিবিড়। আপনি কোথাও এমন একজন ব্যক্তির সন্ধান পাবেন না। যিনি মুর্শিদের সাথে কিছু সময় অতিবাহিত করেছেন অথচ মুর্শিদের উত্তম আচরণ ও কোমল হৃদয়বৃত্তির অনুরাগী হয়ে যাননি।
একবার আমি মুর্শিদের সাথে তানতা গিয়েছিলাম। সেখানে একটি মসজিদের উদ্বোধন করার জন্য জনৈক স্থানীয় নেতা দাওয়াতনামা পাঠিয়েছিলেন। মসজিদের উদ্বোধন ও বক্তৃতার পর ইখওয়ান মসজিদে-ই রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করতে লাগল। মুর্শিদ মেজবানের কানে কানে কি যেন বললেন। অতপর মেজবান আমাদের কাছে আসলেন এবং আমাকেও অন্যান্য সংগীগণকে সাথে করে পার্শ্ববর্তী একটা জাঁকালো প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। আমরা শয়ন কক্ষে প্রবেশ করে দেখলাম অত্যনত মূল্যবান আসবাবপত্র দ্বারা কক্ষটি সুসজ্জিত। অকস্মাৎ আমি দেখতে পেলাম আমার দুই সাথীর একজন এই সুসজ্জিত কক্ষ দেখে “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা” পড়ছেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম “ভাই কি হয়েছে?” তিনি জবাব দিলেন: যে অর্থ এই বাহ্যাঙম্বর বিলাসিতা ও কক্ষের সাজ-সজ্জায় ব্যয় করা হয়েছে তার উত্তম ব্যয়ের খাত ছিল আল্লাহর পথ। আমি বললাম, আল্লাহ আমার ও আপনার ওপর রহম করুন। আমাদেরকেক কোন্ জিনিসে এখানে টেনে এনেছে? তিনি তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন: আল্লাহর পথে দাওয়অত- তোমরা কি এটাকে নিজের জন্য আল্লাহর রহমত মনে করো না। তিনিই তো এই সফরে আমাদের জন্য এই আরামদায়ক শয়ন কক্ষের ব্যবস্থা করেছেন। হয়তো আমাদের কেউই কখনো এরূপ আরামদায়ক রাত্রি যাপনের আনন্দ পায়নি। তাহলে কি অসন্তোষ প্রকাশের পরিবর্তে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় আমাদের কর্তব্য নয়?
আমি আরজ করলাম: “তুমি কি এটাকে নিজের জন্য আল্লাহ তায়ালার ইহসান এবং রহমত মনে কর না? তিনিই তো এই সফরে আমাদের জন্য এই আরামদায়ক কক্ষের ব্যবস্থা করেছেন। হয়তো আমাদের কেউই কখনো এমন আরামদায়ক শয্যায় রাত্রি যাপনের আরাম উপভোগ করার সুযোগ পায়নি। তারপরও কি আপনি মনে করেন না যে, আমাদেরকে অসন্তোষ প্রকাশ করার পরিবর্ত আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
বায়ুর গতি নির্ণায়কযন্ত্র
রাতটি সেখান অতিবাহিত করার পর পরদিন সকালে আমরা তানতা রেলষ্টেশনে গিয়ে পৌঁছি যাতে কায়রো অভিমুখী গাড়ী ধরতে পারি। আমরা স্টেশনের প্লাটফর্মেই ফজরের নামায আদায় করলাম। মৃদুমন্দ প্রাতঃসমীরণ আমাদের চেহারা ও পোষাক নিয়ে যেন খেলা করছিল। আমরা নিরাপদদেই কায়রো রেল স্টেশনে গিয়ে পৌঁছি এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ গৃহ অভিমুখে রওয়ানা দেই যাতে তৃপ্তি সহকারে আরো একটু ঘুমিয়ে নিতে পারে। কিন্তু মুর্শিদে আ’ম (রহমাতুল্লাহ আলাইহি) একাই সাবতিয়াস্থ মাদ্রাসাতু উম্মে আব্বাসের পথ ধরেন যাতে স্কুলে তার নির্ধারিত প্রথম পিরিয়ড পড়াতে পারেন। এই ঘটনার দ্বারা আপনি কি লক্ষ করেছেন যে, পরিপূর্ণ ইখলাস ও আন্তরিকতা নিয়ে আলআহর পথের একজন সৈনিক কাজের চাপ এবং সময়ের স্বল্পতার প্রতিকার সাধন কিভাবে করতে পারেন। প্রকৃতই যে ব্যক্তি সকল কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে দেন। জেনে রাখুন যে, আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ এবং ইহসান অনেক বড়।
সময় গড়িয়ে যেতে থাকে। কিছুদিন পর আমাদের সেই ভাই যিনি তানতায় আমার সাথে রাত্রিযাপন করেছিলেণ- একটা দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। হঠাৎ এক সময় তিনি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমি তার কুশলাদি কামনা করতে যাই। যেহেতু তিনি ছিলেন শয্যাশায়ী তাই তার অবস্থা জানার জন্য আমি সোজা গিয়ে তার বিশ্রামের কক্ষে প্রবেশ করি। আমি কক্ষে প্রবেশ করেই দেখতে পাই রুমের মধ্যে অত্যন্ত মূল্যবান ও দামী সাজ-সরঞ্জাম এবং কম্বল পড়ে রয়েছে। আমি এদিক ওদিক দৃষ্টিপাত করার পর তার দিকে দৃষ্টিপাত করি এবং চাপা স্বরে বলতে থাকি “আল্লাহ তায়ালা আপনাকে পরিপূর্ণ রূপে সুস্থ্য করে দিন।”
তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান। আমার কথার স্বরেই অতীতের সমস্ত ঘটনাবলী বুঝে ফেলেন এবং মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করেই বলে উঠলেন “উস্তাদ ওমর সেই কথা বাদ দিন।” বস্তুত তিনি আমার ইংগিতের যথার্থতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তানতায় মসজিদের উদ্বোধন সেখানকার মূল্যবান আসবাবপত্র এবং বিশ্রাম কক্ষের সাজ-সজ্জা ও সেই দিনগুলোর অন্যান্য ঘটনাবলী তার স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠেছিল। আপনি দেখুন আল্লাহ তায়ালা মানুষকে কত পর্যায়ে অতিক্রম করান। এক সময় কোন লোক একটা বিষয়কে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখে কিন্তু অন্য সময় সেই একই বিষয় আবার তার কাছে চোখের তৃপ্তি ও মনের প্রশান্তি হয়ে দাঁড়ায়।
আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছ ফলবতী বানিয়ে দেন। আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধা বানিয়ে ছাড়েন। সেই প্রকৃত মালিক যাকে মনে করেন কালেমায়ে হকের ওপর দৃঢ় থাকার সৌভাগ্য দান করেন, তাকে স্বাধীনচেতা বানিয়ে দেন ও বলিষ্ঠতা দান করেন। যাতে দুনিয়াতেও তিনি হক কথার ওপর স্থির থাকতে পারেন এবং আখেরাতেও তার পদস্খলন না ঘটে। এসব লোক সর্বদা নিজের নীতির ওপর সর্বত্র অটল থাকে। পক্ষান্তরে কিছু কিছু লোককে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত বায়ু নির্ণায়ক যন্ত্রের মতো বানিয়ে থাকেন। যারা সবসময় বায়ুর গতি বুঝে নিজেদের লক্ষ পরিবর্তন করে থাকে। বাতাসের সাথে ভেসে বেড়ানো এই সুবিধাবাদীদের সাধ্য থাকলে তারা হাওয়অকেও মাত করে দিতো এবং হাওয়া প্রবাহিত হওয়ার পূর্বেই তার গতিবেগ অনুমান করে নিজের কিবলা করে নিতো।
হে আল্লাহ! তুমি তোমার অনুগ্রহ দ্বারা আমাদেরকে সর্বদা হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার মত দৃঢ়তা দান করো। তোমার রাস্তায় তোমারই সন্তুষ্টিলাভের জন্য যে বিপদই আসুক না কেন তা হাঁসি সহ্য করার মত মনোবল প্রদান করো। হে প্রভু! আমরা যখন তোমার শাহী দরবারে উপস্থিত হবো তখন যেন তুমি আমাদের ওপর পুরোপুরি সন্তুষ্ট থাকো এ ছাড়া আমাদের আর কোন চাওয়ার নেই।
এখানে হতাশার কোন স্থান নেই
এই মহান ব্যক্তি (মুর্শিদে আ’ম) হতাশাকেও ককনো তাঁর ধারে কাছেও ঘেঁষতে দিতেন না বরং তাঁর আশা দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিচু থেকে বিশাল ছিল বাহ্যত হতাশাব্যঞ্চক পরিস্থিতিতেও তিনি আশার আলো দেখতে পেতেন। দুর্দিনে ও সুদিনের দীপ্তি তার দৃষ্টিতে সম্মুখে উদ্ভাবিস হয়ে উঠতো। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে তিনি বিশেষ নেয়ামত লাভে ধন্য হয়েছিলেন। তাঁর অন্তর ছিল বিশ্বজাহানের মালিকের সাথে একান্ত সম্পর্কিত। তাঁর সহ্য ক্ষমতা ছিল খাঁটি ইস্পাতের চেয়েও শক্ত ও মজবুত। সর্বশক্তিমান আল্লাহর সত্তাই ছিল তাঁর সাহায্যের উৎস। প্রত্যেক ব্যাপারেই কিছু না কিছু ব্যতিক্রম থাকে কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কুদরত ও ক্ষমতা অসীম তাতে ব্যতিক্রমের লেশমাত্র নেই।
নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ
একবার আমি মুর্শিদে আ’ম-এর সাথে কালয়ুবিয়া প্রদেশের তুখ শহর সফরে গিয়েছিলাম। শহরে খুবই জাঁক-জমক ও আজিমুশ্বান জালসা অনুষ্ঠিত হয়। উচ্চ প্রতিধ্বনি এবং শ্লোগানের আওয়াজ শুনতে পেলাম যেন প্রতিটি জিনিসই শান-শওকতের প্রদর্শনী করছিলো। জালসা শেষে আমরা সেই রাতেই কায়রো ফিরে আসি। পথিমধ্যে মুর্শিদে মুহতারাম আমাকে জিজ্ঞেস করেন “এই জলসা সম্পর্কে তোমার মতামত কি?”
আমি আরজ করলাম, “শোরগোল ও গগণ বিদারী শ্লোগানের আওয়াজ আমার জন্য সান্ত্বনাদায়ক নয়। আমার নিকট এগুলো ঢোলের মতই মনে হয়। আপনি যখন ঢোলে হাত মারবেন তখন প্রচন্ড আওয়াজ হবে। কিন্তু যদি তার ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখেন তাহলে দেখবেন সেখানে কিছুই নেই। শুধু মাত্র খালি ঢোলই রয়েছে।”
আমার কথা শুনে তিনি বললেন: “দেকুন আমরাতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের পদাঙ্ক অনুসরণ করে থাকি। তাঁর অবস্থা ছিল এই যে, বাজার এবং মেলায় পর্যন্ত গিয়ে তিনি লোকদের নিকট আল্লাহ তায়ালার পয়গাম পেশ করতেন। প্রত্যুত্তরে জনগণ ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও অত্যাচার-উৎপীড়ন এবং জুলুম-নিপীড়ন দ্বাড়া তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতো। তাহলে কি মানুষের উদাসীনতা ও অনাগ্রহের ভাব প্রদর্শনে আমাদের সবর করা উচিত নয়? প্রকৃত সত্য হচ্ছে, যদি হাজারো জনতার মধ্যে থেকে একজন বিবেক-বুদ্ধিসম্পনন ব্যক্তিও আমাদের প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠে তা হলে এই সফলতা আমাদের জন্য গোটা পৃথিবী ও তার মধ্যস্থিত সমস্ত ধন-সম্পদ অপেক্ষা অধিক মূল্যবান।” এভাবে মুর্শিদে আ’ম আমাদের অন্তরে আশার আলো জ্বালিয়ে দিতেন এবং আল্লাহর পথে আতিত বিপদে ধৈর্য ধারণের শিক্ষা প্রদান করতেন।
হাসানুল বান্না রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আমাদেরকে এসব শিক্ষা তার অফিসে কিংবা ক্লাস রুমে অথবা লেকচার হলে বসিয়ে পড়াতেন না, কিংবা শুধু তাত্বিক ও দার্শনিক বুলিই শিক্ষা দিতেন না বরং তিনি আমাদেরকে বাস্তব ক্ষেত্রেও সবকিছু শিখিয়েছেন। আমাদের নিজেদেরকে অটলভাবে টিকে থাকতে এবং অন্যদেরকে লৌহদন্ডের ন্যায় মজবুত ও বলিষ্ঠভাবে স্থির থাকতে শিক্ষা দিতে ও উদ্ভূত প্রত্যেক সমস্যা দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করার প্রশিক্ষণ তিনি তার বাস্তব অনুশীলন দ্বারা আমাদের শিখিয়েছেন। আমি তাঁর সাথে দূর দূরান্তে অবস্থিত শহরের, পশ্চাতপদ গ্রামের এবং দূরতিক্রম্য কঙ্করময় পথে দীর্ঘ সফর করেছি। আমাদের পদযুগল ধুলাবালিতে একাকার হয়ে যেতো এবং কখনো পিচ্ছিল পথ ধরে একাধারে চলতে থাকতো। কোন কোন সময় কর্দমাক্ত রাস্তায় চলতে হতো, দীর্ঘ সফরে চলতে চলতে আমার শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে যেতো এবং বার বার ঘাম মোছার ফলে আমার রুমাল নিংড়ানোর উপযুক্ত হয়ে যেতো। সফরকালীন সময়ে আমি আমার দ্বীনি ভাইদের সাথে মসজিদের বিছানার ওপর শুয়ে পড়তাম কিংবা কখনো কোন সাধারণ হোটেলে রাত্রিযাপন করতাম- যদি মসজিদে অথবা কোন মেজবানের নিকট শোবার জায়গা না হতো। আমাদের খাদ্য হতো পরিমাণে অল্প এবং শুল্ক নিরস। বাইয়াতের দায়িত্বানুভূতি আমাদেরকে নিজেদের পছন্দনীয় জিনিস ত্যাগ করার জন্য অনুপ্রানিত করতো। আমি মুর্শিদের নিকট বাইয়াত করে এই শপথ নিয়েছিলাম যে, শরীয়াত অনুমোদিত প্রতিটি কাজে আমি তাঁর শর্তহীন আনুগত্য করে যাবো।
আপনাকে আমি মুর্শিদে আ’ম-এর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও সহৃদয়তার দৃষ্টান্ত তো অনেকই দিতে পার তথাপি কয়েকটি উদাহরণই যথেষ্ট মনে করবো। আপনি দেখতে পাবেন এই দৃষ্টান্তগুলো বাস্তব নমুনা পেশ করে থাকে। একদিন আমি মুর্শিদের সাথে একটা সমাবেশে গিয়েছিলাম। সমাবেশ শেষে আমরা দু’জনই ঘরের অপর অংশে চলে যাই যেখানকার এক কামরায় আমাদের জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। আমরা এসব দাওয়াতি অভিযানে বস্তুগত আরাম-আয়েশ থেকে বঞ্চিত থাকতাম। কিন্তু মানসিক প্রশান্তিতে হৃদয় ভরে যেতো। আমরা কক্ষের ভেতর প্রবেশ করলাম যাতে কিছু সময়ের জন্য শারীরিক আরাম লাভ করা যায়। কক্ষের মধ্যে দু’টো চৌকি ছিল এবং প্রত্যেক চৌকির ওপর একটা করে মশার ছিল। কেননা এই অঞ্চলে মশার উপদ্রব ছিল। মশাগুলোও ছিল বড় বেয়াড়া, উদর ভর্তি করে যতক্ষণ পর্যন্ত মনুষ্য রক্তপান করতে না পারতো ততক্ষণ অবধি তারা শান্ত হতো না। আমি পরবর্তী সময় কোথায় যেন পড়েছিলাম যে মশা যতক্ষণ ক্ষুধার্ত থাকে ততক্ষণই জীবিত থাকে। কিন্তু পেট ভরে রক্ত পান করলেই মারা যায়।
যাই হোক মুর্শিদ এক চৌকির ওপর শুয়ে পড়লেন, এবং মশারিও খাঁটিয়ে নিলেন। আমিও তাঁর অনুকরণ করে অন্য চৌকিতে মশারি নীচে শয্যা গ্রহণ করলাম। এই সফর কালে ক্লান্তি ও অবসাদ এতবেশী পেয়ে বসেছিলো যে, তা বর্ণনা করে শেষ করতে পারবো না। আমি সম্পূর্ণ পরিশ্রান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়েছিলাম। পাঁচ মিনিট পর মুর্শিদের আওয়াজ কানে ভেসে আসলো, “ওমর ঘুমিয়ে গেছো?” আমি জবাব দিলাম, “এখনোও ঘুমুতে পারিনি!” এভাবে কিছুক্ষণ পর পর প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি চলতে থাকলো। এমনকি শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটি আমার নিকট অশ্বস্তিকর বোধ হতে লাগলো। আমি মনে মনে ভাবলাম যতটা ক্লান্তি আমাকে ইতিপূর্বেই অবসন্ন করে ফেলেছে তা কি যথেষ্ট নয় যে, এর ওপর তিনি আরো কিছু যোগ করেছেন। তিনি কি আমাকে ঘুমুতে দিবেন না? মনের ভেতরে একটি খেয়াল উদয় হচ্ছিলো এবং নিজে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, মুর্শিদ যদি আবারো প্রশ্ন করেন তাহলে নীরব থাকবো। যাতে তিনি মনে করেন যে, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। যেই কথা সেই কাজ। আমার চুপ থাকায় তিনি সত্যিই ভাবলেন যে, আমি নিদ্রার কোলে আশ্রয় গ্রহণ করেছি। অতপর তিনি চুপিসারে সন্তর্পণে চৌকি থেকে উঠে পড়লেন এবং দরজার কাছে গিয়ে কাঠের স্লিপার হতে নিয়ে নগ্ন পায়ে হাম্মাখানায় গিয়ে অজু করলেন এবং বিশ্রাম কক্ষ থেকে একটু দূরে অন্য কামরায় একটা ছোট জানামায বিছিয়ে তাহাজ্জুদের নামাযে মনোনিবেশ করলেন। তিনি সেখানে ততক্ষণ পর্যন্ত তার রবের হুজুরে নফল পড়তে থাকেন যতক্ষণ আল্লাহ তায়ালা তাকে তৌফিক দিয়েছেন। এদিকে তো মাশাআল্লাহ চৌকির ওপ আমার অবসন্ন দেহ এলিয়ে দিয়ে অঘোরে নিদ্রা সুখ ভোগ করছিলাম। সকালে আমি যখন জেগে উঠি তখন এই নীরব বাস্তব শিক্ষা স্মৃতিপটে পুরোপুরি জাগ্রত ছিল যা গত রাতে আমার নিজ চোখে দেখতে পেয়েছিলাম।
আল্লাহ তায়ালা মুর্শিদকে এমন শক্তিশালী ও সুগঠিত শরীর দান করেছিলেন যে, তিনি দিনভর মানুষের সাথে কথাবার্তা বলতেন, বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা করতেন এবং রাত্রিবেলা যখন লোকজন বিশ্রাম গ্রহণের জন্য নিজ নিজ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়তেন তখন নামমাত্র বিশ্রামের পর মুর্শিদ তার মাওলার সমীপে রুকূ’ ও সিজদায় অবনত হতেন। তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকেই এই বিশেষ তাওফীক দান করা হয়েছি লো। তাই তিনি দিবা-রাত্রি ইবাদাত ও তাওয়াদের কাজে নিবিষ্ট থাকতে পারতেন।
অনুসারীদের মাঝে তখনো এতটুকু শক্তি সৃষ্টি হয়নি যে, তারা তাদের মুর্শিদের মত কষ্ট সহ্য করতে পারে। আবার মুর্শিদ নিজেও তাদের এই দুর্বলতা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত ছিলেন। অতএব পূর্ণাংগ স্নেহের সাথে তিনি অনুসারীদের আরামের প্রতি যত্নবান থাকতেন যেন তাতে কোন বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়। মুর্শিদ কখনো চাইতেন না যে, তার অনুসারীগণ তারই কারণে কোন প্রকার কষ্টের সম্মুখীন হোক। খুবই স্বাভাবিক যে, যদি তিনি আমাকে জানিয়ে তাহাজ্জুদের জন্য উঠতেন তা হলে আমাকেও আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে সান্নিধ্য দিতে হতো। আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের জন্য সবকিছু সহজ ও সুগম করতে চান, তাদেরকে কোন প্রকার কষ্টে ফেলতে চান না। (আরবী*************) তাই এই কুরআনী নির্দেশ ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতির আলোকে মুর্শিদ সর্বদা ব্যবহারিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেন। প্রথমে তিনি তাঁর অনুসারীদের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করতেন তারপর তাঁর রবের ইবাদাত ও নৈকট্য লাভের চেষ্টায় রত হতেন।
এটাই প্রকৃত প্রশিক্ষণ ও বাস্তব শিক্ষা। যাকেই কোন দল কিংবা কোন দেশ ও জাতির নেতা নির্বাচিত করা হোক না কেন তাঁর কর্তব্য হচ্ছে অনুরূপ কর্মনীতি গ্রহণ করা। তাকে জাতি ও দলের জনগণের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করতে হবে সর্ব প্রথম এবং নিজের আরামের চিন্তা করতে হবে সর্ব শেষে।
মুর্শিদে আ’ম (র)-এর অভ্যাস ছিল তাঁর ভাষণ শেষ হলে তিনি অগ্রসর সাথীদের নিয়ে পৃথক বৈঠকে মিলিত হতেন। (যেন তাদের নিকট থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন।) এরা হতেন এমন নিষ্ঠাবান লোক যাদেরকে মুর্শিদ ভালভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তাঁর একান্ত সান্নিধ্যের জন্য মনোনিত করতেন এবং যাদের মধ্যে তিনি কল্যাণ ও মংগলের লক্ষণ দেখতে পেতেন। মুর্শিদ নিজেই ছিলেন একটা স্বতন্ত্র আন্দোলন। তিনি না কখনো ক্লান্ত হতেন আর না কখনো অধৈর্যও হতেন। আত্মার জন্য শুধু এটাই জরুরী নয় যে, শুধু মাত্র নিজের দেহকেই জীবিত রাখবে বরং তার জন্য অধিকতর জরুরী হচ্ছে যার সাথেই সে মিলিত হবে তাকেই জীবনের নেয়ামতরাজি দ্বারা ধন্য করে দেবে।
আদর্শ সমালোচনা
তোয়াহা হোসাইন প্রণীত গ্রন্থ “মুছতাকবিলুসসাকাফাতে ফি মিছর” (মিসরের সাংস্কৃতিক ভবিষ্যত) মুদ্রিত ও প্রকাশিত হলে ইসরাম বিরোধী গোষ্ঠীসমূহ তার প্রশংসায় আকাশ পাতাল মুখরিত করে তোলে। বইটির প্রচার প্রপাগান্ডা এতবেশী করা হয় যে, এই বিষাক্ত প্রপাগান্ডার ফলে অধিকাংশ যুবকের মন-মস্তিষ্ক বিষিয়ে ওঠে এবং তরা এই গ্রন্থে পরিবেশিত সমস্ত বাতিল ও ভিত্তিহীন তত্ব ও তথ্যকে খাঁটি সত্য বলে মনে করতে থাকে। ইমাম হাসানুল বান্না এই বিপদ উপলব্ধি করতে পারেন এবং তিনি যাতে এই গ্রন্থের ওপর তাঁর সমালোচনা পেশ করতে পারেন সেজন্য ইউনিভার্সিটির কর্মকর্তাদের নিকট দাবী করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এই দাবী মেনে নিতে টালবাহানা ও গড়িমসি করতে থাকেন। কিন্তু দাওয়াতে ইসলামীর নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের চরম ও অনমনীয়তার ফলে প্রশাসনকে অবশেষে নতি স্বীকার করতে হয়। অনন্তর শাইখ ব্রবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখে লিখিত অনুমতি প্রদানের দাবী করেন। পত্রে তিনি তার সুপরিচিত নাম হাসানুল বান্না লিখিত স্বাক্ষর করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত ধৃষ্ঠতার সাথে এই পত্র প্রত্যাক্রান করেন এবং বলেন কেবলমাত্র এই শর্তে অনুমতি দেয়া যেতে পারে যে, বক্তা তার পুরো নাম হাসান আহমদ আবদুর রহমান লিখবেন। শাইখ কোন পরিচিতির মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তাই তিনি এসব ছোট ছোট বিষয় কখনো তার অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রতিবন্ধকত রূপে দাঁড় করাননি। তিনি এসব খুটিনাটি ব্যাপার থেকে ছিলেন অনেক উর্ধ্বে। মুর্শিত তৎক্ষণাৎ দ্বিতীয় পত্র পাঠিয়ে ব্যবস্থাপনার দাবী পূরণ করেন। তিনি কখনো চাইতেন না যে, কোন মহৎ ও উন্নত উদ্দেশ্রের সম্মুখে এ ধরনের মামুলী বিষয় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াক।
থিয়েটা হল (যেখানে লেকচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল) কানায় কানায় ভরে গেলো। অথচ সমবেত শ্রোতার সংখ্যা এত বেশী ছিল যে, বিশাল থিয়েটার হলও তা ধারণের জন্য যথেষ্ট হলো না। এই ভরা মজলিশে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হাসানুল বান্না দাঁড়িয়ে তার বক্তব্য পেশ করতে লাগলেন। তিনি আলোচ্য বইয়ের যথোপযুক্ত সমালোচনা করে এক একটি বিষয় বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করলেন। ফলে তোয়াহা হোসাইনের বিপজ্জনক সংকল্প সুস্পষ্টরূপে ধরা পড়লো। তোয়াহা হোসাইনের বিশ্বাব ছিল এই যে, পাশ্চাত্য সভ্যতা সংস্কৃতি রপ্ত করার ব্যাপারে কোন প্রকার দ্বিধা-সংকোচ থাকা উচিত নয়।
পশ্চিমা সভ্রতা যা কিচুই হোক আর যেমনই হোক না কেন তার সমুদয় সৌন্দর্য ও ত্রুটিসহই পুরোপুরি গ্রহণ করা আবশ্রক। তার মতে পশ্চিমা উন্নতি অগ্রগতি এবং উন্নত জীবন যাত্রার মান অর্জন সেই সভ্যতার প্রতি পুরো আনুগত্য প্রকাশ ছাড়া আদৌ সম্ভব নয়।
মুর্শিদে আ’ম-এর ভাষণ কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত চলতে থাকে। এই পর্যায়ে তিনি বইয়েল ওপর জ্ঞানগর্ভ পর্যালোচনা করতঃ ঐ সকল গোপন চক্রান্ত ও বিপজ্জনক পরিণতিসমূহ বিস্তারিতভাবে উপস্থিত জনতার সম্মুখে আলোচনা করে গ্রন্থকারের মূল উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। শ্রোতামন্ডলী ও সর্বস্তরের জনগণের ওপর এই বক্তৃতার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। যুবকদের মন-মগজে পাশ্চাত্য সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বের যে ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছিলো তা সম্পূর্ণরূপে বিদূরীত হয় এবং গ্রন্থের খ্যাতিও উবে যায়। মার্কেটে ও বুকস্টলে বইটর চাহিদার দারুণ ভাটা পড়ে। এমনিভাবে প্রাইমারী স্কুলের একজন শিক্ষক আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন একজন ডক্টরেট ডিগ্রীধারী ব্যক্তির ওপর সুস্পষ্ট বিজয় লাভ করেন। তিনি এমন এক ডক্টর যাকে (তার স্তবকরা) আবরী সাহিত্য এবং প্রাচ্য জগতের নেতা মনে করতো। প্রকৃতপক্ষে তিনি (তোয়াহা হোসাইন) না ছিলেন নেতা না ছিলেন সত্যিকার মর্যাদা লাভের যোগ্য। (সব রকম প্রচার-প্রপাগান্ডা সত্ত্বেও) মানুষ তোয়াহা হোসাইনের স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত হয়ে যায়। তিনি আরবী সাহিত্যের স্তম্ভ কিভাবে হতে পারেন যখন তার রুচিবোধ আরবী এবং ইসলামী নামও কষ্টদায়ক মনে হয়। অতএব (কে না জান যে) তার সন্তানদের নাম আরবী কিংবা ইসলামী নাম নয় বরং ফরাসী ভাষায় রাখা হয়েছে।
সাহিত্য সমালোচনা
(আরবী************)
“যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য অর্থাৎ তার দ্বীনের সহায়তা কর তাহলে আল্লাহ তায়ালাও তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবেন এবং তোমাদের পা মজবুত করে দেবেন।”
এই দীর্ঘ বক্তৃতার সময় ইমাম উক্ত গ্রন্থের বিভ্রান্তিকর বিষয়গুলো কঠোর সমালোচনা করেন কিন্তু ব্যক্তি তোয়াহা হোসাইন সম্পর্কে তাঁর মুখ থেকে সমালোচনা মূলক একটি কথাও উচ্চারিত হলো না। অতপর আমি জানতে পেরেছি যে, এরূপ সমালোচনা নীতির কারণে তোয়াহা হোসাইন নিজেও ইমামের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন এবং তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন।
পঞ্চম অধ্যায়
প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যাপারটা শিক্ষালাভের মত সহজ নয়। মানুষ শিক্ষা লঅভ করে এবং তারপর সাধারণত সে একটা গ্রন্থের রূপ পরিগ্রহ করে। বেশী পড়া-লেখা জানা লোকেরা কিছু সংখ্যক চলমান কিতাব বিশেষ হয়ে থাকে। ঐ সকল বইতে জ্ঞান থাকে কিন্তু সেই জ্ঞান প্রকৃত জ্ঞানী সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় না। েএ ধরনের শিক্ষিত লোকদের মধ্যে ইল্ম অনুযায়ী আমল করার তথ্য জীবন গঠন করার কোন গুরুত্ব থাকে না। একজন শিক্ষার্থীর জন্য এথেকে বড় জুলুম আর কিছুই হতে পারে না যে, তার উস্তাদ বাস্তব জীবনে সে সমস্ত মূলনীতি লংঘন করবেন। যার ওপর তিনি তার পাঠ কিংবা বক্তৃতায় কুব জোর দিয়ে থাকেন।
আপনি একজন শিক্ষার্থীকে অতি সহজেই নামায শিক্ষা দিতে পারে। নামাযের আরকান কি কি এবং কি কি কারণে নামায ফাসিদ হয়। নামাযের মধ্যে মুস্তাহাব আমল কোনগুলো আর জাগরুক রাখতেন যে, নামাযের বাহ্যিক আকৃতি-প্রকৃতি শিক্ষা দেয়ার পূর্বেই তার মূল উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করা দরকার। তিনি বলতেন: তোমরা যদি নামাযের বাহ্যিক শর্তাবলী পূরণ করো তা হলে বাহ্যত তোমাদের ফরয আদায় হয়ে যাবে সত্য কিন্তু নামাযের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে বিনয়, নম্রতা এবং সততা। নিজেকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহতে সোপর্দ করে দেয়া হচ্ছে নামাযের মগজ। ইমাম তার অনুসারীদের মনে এসব বিষয় বদ্ধমূল করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালাতেন। তিনি বলতেন এসব গুণাবলী ব্যতীত আমাদের নামায আমাদের প্রকৃত কোন উপকারে আসবে না। সত্য বলতে কি ইমাম যে এই যুগ ও প্রজন্মের সর্বোত্তম মরুব্বী ছিলেন সে সম্পর্কে কোন মতোবিরোধ হতে পারে না।
আকীদাগত কারণে ইসরাঈলের সাথে শত্রুতা
কমিউনিজম, খৃস্টবাদ ও ইহুদীবাদ যেমন হাসানুল বান্না ও ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সাথে শত্রুতা পোষণ করে তেমন বৈরিতা তাদের অপ কারো সাথে নেই। এর কারণ হচ্ছে, হাসানুল বান্না ও ইখওয়ান এই অঞ্চলে কমিউনিজমের লুটপাট ও ধ্বংসের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে প্রমাণিত। খৃস্টবাদ ও ইহুদীবাদের জন্যও ইখওয়ান বিপজ্জনক। কারণ তারা তাদের দ্বীনের শিক্ষাসমূহকে শুধু জ্ঞানের পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রেখেই অধ্যয়ন করে না। বরং তা পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত ও কার্যকরী করার শিক্ষাও দিয়ে থাকেন। তারা প্রতিটি সামরিক ও মতাদর্শগত আগ্রাসনের বিষাক্ত প্রভাব ও পরিণাম থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে চায়। তাদের আপ্রাণ চেষ্টা হচ্ছে, মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি ব্যক্তি যেন মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বাদলাভ করতে পারে এবং মানবতা সামগ্রিকভাবে তাদের মৌলিক অধিকার ফিরে পায়। তারা এটা মোটেও পছন্দ করে না যে, মুসলিম জাতি দান খায়রাতের ও বিদেশী সাহায্যের আশায় বেঁচে থাকবে। অথচ মুসলিম দেশগুলোতে প্রত্যেকটি জিনিস এত অধিক পরিমাণে রয়েছে যে, (যদি ইনসাফভিত্তিক বন্টন করা যায়) তাহলে সমস্ত মানুষের প্রয়োজন খুব ভালভাবে পূরণ হতে পারে। ইখওয়ানের আকাংখা হচ্ছে তাদের এবং তাদের শাসকদের মধ্যে সম্পর্ক হবে পারস্পরিক সম্প্রীতি সুবিচার সম্মান বোধের ভিত্তিতে।
হাসানুল বান্না শহীদ আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, প্রজা সাধারণের ওপর রয়েছে শাসকগোষ্ঠীর অধিকার যেমন তাদের নির্দেশ পালন করা এবং তাদের আনুগত্য করা। (যদি তা আল্লাহ তায়ারার নাফরমানীর পর্যায়ে না পড়ে) অনুরূপ তিনি আমাদেরকে আরো বলেছেন যে, শাসকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে, তারা আদল ও ইনসাফের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন এবং জুলুম-অত্যাচার ও নির্যাতন-নিপীড়নের পলিসি বর্জন করবেন।
সাইয়েদেনা ওমর ইবনুল খাত্তাবের (রা) তাঁর ভাই যায়িদ বিন খাত্বাবের হত্যাকারীকে ভাল লাগতো না। হন্তা যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তিনি ওমর (রা)-কে বলেন: আমীরুল মু’মিনীন! আমার সম্পর্কে আপনার মানসিক অবস্থা ও অনুভূতি আমাকে আমার কোন অধিকার ও প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করবে না তো?”
তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “কখ্খনো না।”
অতপর সেই ব্যক্তি বলতে লাগলো, “যদি প্রকৃত ব্যাপার তাই হয় তাহলে আপনার আমাকে পছন্দ না করা কোন চিন্তার কারণ হতে পারে না। এমতাবস্থায় মেয়েরা কাঁদতে পারে, পুরুষ কাঁদতে পারে না। অবশ্য পুরুষদের জন্য এটা শোভনীয় নয় যে, তারা বসে বসে কাঁদতে থাকবে।
এ ঘটনার আলোকে মুর্শিদ আমাকে বলেছিলেন যে, শাসকদের পছন্দ অপছন্দের বিষয়টি কখনো কোন ব্যক্তিতে তার শরীয়াত স্বীকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। আমি একটা হাদীস পড়েছি। হাদীসটির নির্ভরযোগ্যতা অবশ্য আমি যাঁচাই করে দেখিনি। হাদীসটির সারমর্ম হলো, “যে ব্যক্তি কোন ন্যায় পরায়ণ সুলতানকে অপদস্ত করে তার তওবাও কবুল হয় না।
সাইয়েদ হাসানুল বান্না না ছিলেন সন্ত্রাসী না ছিলেন তথাকথিত বিপ্লবী।ভ বরং তিনি ছিলেন সত্যের দিকে আহ্বানকারী ও সংস্কারক। তিনি যেখানেই যেতেন এবং যার সাথেই মিলিত হতেন তাকেই ভালবাসা, শান্তি ও সহযোগিতার শিক্ষা দিতেন।
মাকরুহই বা কোনগুলো। এসব বিষয়ে শিক্ষা অত্যন্ত সহজ। কিন্তু শিক্ষার্থীর মন-মগজে এবং তার বাস্তব জীবনে এই অনুভূতি সৃষ্টি করে দেযা যে, (আরবী***********) (“নিশ্চয় সালাত মানুষকে অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে।)” অত সহজ কাজ নয়। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: (আরবী***********) (“যে ব্যক্তির সালাত তাকে পাপ ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখলো না সে তার সালাত দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার পরবর্তে আল্লাহর রহমত থেকে আরো দূরে সরে গেলো।”)
আমাদেরকে একথা ভেবে দেখতে হবে যে, যদি সালাতকে (রূহানী প্রেক্ষাপট) কেবল মাত্র যান্ত্রিক নিয়মে এবং গতানুগতিক প্রকি্রিয়ায় বিশেষ অংগ ভংগীর সাহায্যে আদায় করাও হয় তাতে রবের নৈটক্য লাভ করা সম্ভব হয় না। অথচ সালাতের সর্ব প্রথম ও সর্বপ্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে আল্লাহর নেকট্র লাভ। এ বিষয়টিকে সক্রিয় বিবেচনায় রেখে সাইয়েদ হাসানুল বান্না সালাতকে খুবই গুরতু্ব দিতেন। ইখওয়ানের প্রশিক্ষণের সময় এই অতুলনী ব্যক্তিত্বের অধিকারী মুর্শিদ সর্বদা মন ও মগজে এই নীতি
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই যে, ইসলামী জাহানের কোন কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এই বাস্তবতা থেকে চোখ বন্ধ করে থাকেন এবং ইখওয়ানুল মুসলিমুনে বিরুদ্ধে সংঘাত ও বৈরিতায় অবতীর্ণ হন। তাদের মধ্যে। এই কুধারণা বদ্ধমূল রয়েছে যে, দেশ ও সরকারের মধ্যে ইখওয়ান তাদের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী। (এবং যে কোন সময়ে তাদের ক্ষমতার মসনদ উল্টিয়ে তাদের হাত থেকে ক্ষমতার দন্ড ছিনিয়ে নেবে) অথচ প্রকৃত ব্যাপার এই যে, ইখওয়ানের মূল উদ্দেশ্য সংস্কার এবং বর্তমান অবস্থার উন্নতি বিধান। একটু লক্ষ করুন যে, ইখওয়ানের প্রকৃতরূপ এবং তার বিরুদ্ধে রটানো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন প্রপাগান্ডার মধ্যে কত ব্যবধান। কবির ভাষায়:
(আরবী***********)
(ওগো সুরাইয়া ও সুহাইল নক্ষত্রের মধ্যে মিলন সৃষ্টির অভিলাষী। তোমাকে আল্লাহ তায়ালা কিছু বিবেক বুদ্ধিমান করুন। এটা কি করে সম্ভব? সুরাইয়ার উদিত হওয়াকে মানুষ কুলক্ষণ বলে মনে করে আর সুহাইলের উদিত হওয়াকে কল্যাণের প্রতীক হিসেবে বরণ করে নেয়।)
[শেষ পংক্তির অর্থ এও হতে পারে যে, সুরাইয়া সিরিয়ার দিগন্তে উদিত হয় আর সুহাইল ইয়েমেনের আকাশে দৃষ্টিগোচর হয়। তার মানে উভয়ের মধ্যে বিস্তর দুরত্ব বিদ্যমান।]
ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি
ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি যদিও ইমামের শাহাদাতের প্রায় তিরিশ বছর পর সম্পাদিত হয়েছে। কিন্তু ইমামের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই চুক্তি সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা আমি সমীচীন মনে করছি। এটা আমি এ জন্য জরুরী মনে করছি যে, এই সমঝোতা চুক্তির ব্যাপারে ইখওয়ানের ভূমিকা এবং তা রহিত করার নীতি সেই রাজননৈতিক শিক্ষার ফল। যা ইসলামী আকীদার ভিত্তিতে ইমাম আমাদেরকে দিয়েছেন। কারণ ইসলাম একাধারে দ্বীন ও হুকুমাত দু’টিই।
ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে যারা অবহিত তাদের এটা ভালভাবে জানা থাকা আবশ্যক যে, ইসলামকে সমূলে উৎখাত করার নীল নক্শা বাস্তবায়িত করার জন্যই এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটাই এর মূল উদ্দেশ্য। যে ব্যক্তি ইসরাঈল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এ থেকে ভিন্ন ধারণা পোষণ করে যে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে ব্যীক্ত আগন্তুককে ততক্ষণ পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পারে না যতক্ষণ না তার তার পোশাক জ্বালিয়ে তার শরীরের অংগ প্রত্যংগ অবধি গিয়ে পৌঁছে। কারণ যদি শুধু মাত্র ইহুদীদের জন্য একটা পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই উদ্দেশ্য হতো তা হলে আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকায় কতিপয় বিস্তৃণ অঞ্চল ছিল এরূপ অস্বাভাবিত রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য ঐসব এলাকায় অনুকূল পরিবেশও পাওয়া যেতো। কিন্তু এ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার জন্য পরিকল্পনা ও সতকর্কতার সাথে এই অঞ্চলটি বেছে নেয়া হয়েছিলো তার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। তাইতো তারা এমন এলাকা বেছে নেয় যেখানে ইসলামের অস্তিত্ব বহু পুরাতন। এই রাষ্ট্রের সাহায্যে তাদের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। বৃটেন তার অছিগিরির যুগে ইহুদীদেরকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ফিলিস্তিনে স্থানান্তর করতে শুরু করে এবং তাদেরকে পুরোপুরি সশস্ত্র অবস্থায় এখানে বসবাস করার সুযোগ করে দেয়্ অপর দিকে কঠোর আইন প্রবর্তন করে ফিলিস্তিনীজনগণকে সম্পূর্ণরূপে অস্ত্র থেকে বঞ্চিত করা হয়। এমনকি সবজি কাটার ছুরি রাখাও ফিলিস্তিনীদের জন্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
বৃটেনের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ইহুদীরা প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে এবং ফিলিস্তিনীদের (প্রতিরোধ আন্দোলনের) মোকাবিলায় তত্বাবধায়ক রাষ্ট্রের (বিকেন) সহযোগিতা গ্রহণ করতে থাকে। ফিলিস্তিন আযাদী আন্দোলন ও ইখওয়ান মুজাহিদগণের সাহায্য ও সহায়তায় তাদের অধিকার আদায়ের জন্য তৎপর থাকে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পরে আসবে। আফসোস! যদি আমরা প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করতে পারতাম, আরো দুঃখ মুসলিম উম্মাহ এবং আরব জাহানের ক্ষমতাসীনরা যদি তাদের চোখ খুলে দেখতেন তাহলে দেখতে পেতেন যে, খৃস্টান, কমিউনিষ্ট ও ইহুদী শক্তি তাদের পায়ের তলায় চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে রেখেছে এবং ধ্বংসাত্মক গর্ত খুঁড়ে রেখেছে। হায়! যদি তারা সেই ভয়ানক গর্ত দেখতে পেতো যা তাদের এবং তাদের দেশ ও জাতির জন্য দুশমন তৈরী করে রেখেছে। অথচ তারা নিজেদের সরলতার কারণে তাদেরকে বন্ধু বলে মনে করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওরা তাদের জঘন্যতম শত্রু।
আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, ইসরামী দুনিয়া এবং আরব জাহানের প্রত্যেক দায়িত্বশীল (শাসক) উপরোল্লিখিত তিক্ত ও ভয়ার্বহ সত্য সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত রয়েছেন বরং হয়তো বা তারা আমাদের থেকেও অধিক অবহিত আছেন। তা সত্ত্বেও আমি বিস্ময় ও তিক্ততার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে যাই এই ভেবে যে, এমন জলজ্যান্ত সত্য ব্যাপারেও তারা চোখ বন্ধ করে আছে কেন।
ইহুদী কর্মনীতি হচ্ছে, তারা আমাদের সবাইকে এই স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করতে চায় যে, এখন এই অঞ্চল ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, আর এটা একটা জীবন্ত সত্য। এই সত্য অস্বীকার করার কোন উপায় নেই; আর এর ধ্বংস সাধনও সম্ভব নয়। তারপরও যতই আমরা মুসলিমগণ এই ষড়যন্ত্রের জালে জড়িয়ে ইসরাঈলের অস্তিত্ব ও বাস্তবতা মেনে নেব তখনই অশেষ ও চিরস্থায়ী বিপদ ও ধ্বংস আমাদের ভাগ্য লিপি হয়ে যাবে।
ইহুদীদের সাথে সম্পর্ক
ইহুদীদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা এমন একটা দুরূহ ব্যাপার যাতে সাফল্য অর্জন সম্ভবই নয়। কেননা মানুষের স্বভাব প্রকৃতি ও অভিজ্ঞতা এর নেতিবাচক দিকটিই প্রমাণ করে। কোন মানুষ কি এটা কল্না করতে পারে যে, ইহুদী জাতি কোন অইহুদী জাতির সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করবে? আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির প্রকৃতিকে কে পরিবর্তন করতে পারে। ইহুদীদের সাথে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ এবং বন্ধু প্রতীম সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা এমন এক নিষ্ফল অপপ্রয়াস যার পরিণতি এতদ্ব্যাতীত আর কিছুই হতে পারে না যে, সমস্ত মুসলিম জাহান একযোগে ধ্বংস ও বিনাশের শিকার হয়ে যাবে। আমরা মুসলিম। যে আল্লাহর ওপর আমরা ঈমান পোষণ করি তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন:
(আরবী***********)
“যারা ঈমান এনেছে তাদের সাথে নিকৃষ্ট শত্রুতা পোষণকারী লোক তুমি ইহুদীদেরকেই দেখতে পাবে।”
এটা তো আল্লাহ তায়ালারই ফায়সালা। এতে কোন প্রকার গোঁজামিল কিংবা গুপ্ত রহস্য নেই। বিদ্বেষের সূচনা হয় তাদের পক্ষ থেকেই আমাদের পক্ষ থেকে নয়। এ ব্যাপারে উপরোক্ত আয়াতটি সুস্পষ্ট দলীল। তারপরও কি আমরা ইহুদীদের স্বরূপ এবং ইসলামের অনুসারীদের সাথে তাদের দুশমনির ব্যাপারটা আল্লাহ তায়ালার চেয়েও বেশী জানি?
ইখওয়ানুল মুসলিমুন যাদের অন্তর ইসলামের রহমত ও সৌহার্দ সম্প্রীতিতে ভরা- কখনো বলে না যে, ইসরাঈলকে সাগরের অতল গহ্বরে ডুবিয়ে দিতে হবে। তারা এই শ্লোগানও দেয় না যে, সর্বশেষ ইহুদীকে সর্বশেষ পমিউনিস্টের অস্ত্রের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে হবে। রক্তপাত ইসলামের মেজাজের পরিপন্থী। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে এই যে, ইহুদীরা ফিলিস্তিনে সাধারণ নাগরিক হিসেবে বসবাস করতে পারে। বাকী থাকে এই বিষয়টি যে, আমরা তাদেরকে অত্র অঞ্চলে শাসন দন্ড পরিচালনা এবং ভয়-ভীতি ও সন্ত্রাসের সাহায্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেবো তা কখনো হতে পারে না।
সারা বিশ্বে সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরুদের সাথে শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করে থাকে। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব যে, আহলে ঈমানদারদের নিকৃষ্টতম দুশন মুসলিম প্রজাসাধারণের ওপর ন্যায় ও ইনসাফের সাথে সরকার পরিচালনা করবে। (তদুপরী সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও শাসন কার্য পরিচালনার কি অধিকার তাদের থাকতে পারে।) তাদের নিকট থেকে ইনসাফের প্রত্যাশা অবান্তর ও ভিত্তিহীন।
(আরবী************)
(যে ব্যক্তি প্রকৃতির বিধানসমূহকে তার স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে পরিচালনা করতে চায় সে যেন পানির মধ্যে অগ্নিস্ফুলিংগ দেখার চেষ্টা করে।)
অতএব অত্র অঞ্চলের সর্বস্তরের জনসাধারণ ও শাসকগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রয়াস প্রচেষ্টা হওয়া কর্তব্য এই হিংস্র নেকড়ের হাত থেকে নাজাত হাসিলের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই নেকড়ে ধীরে ধীরে তাদের রক্ত শোষণ করছে (অবশেষে একদিন তাদেরকে সম্পূর্ণ মৃত করে ছাড়বে) এই দুরারোগ্য ক্যানসার থেকে রক্ষা পাওয়া অত্যন্ত জরুরী যা পুরো পরিবেশকে ভীত ও সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত করে রেখেছে। মর্যাদাবোধ সম্পন্ন স্বাধীন মানুষ হয় মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকে নয়তো মর্যাদা নিয়ে মৃত্যু বরণ করে।
যে ব্যক্তি সম্মানের সাথে মৃত্যু বরণ করে এবং যাকে অনাগত বংশধরগণ সম্মান এবং বীরত্বের কারণে স্মরণ করে থাকে তার এবং অপমান ও লাঞ্ছনার সাথে বেঁচে থাকার মানুষের মধ্যে পার্থখ্য হচ্ছে এই যে, একজন অপমানকে পদাঘাত করেছে আর অপরজন সন্তুষ্টচিত্তে তা মেনে নিয়েছে। এভাবে কি শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। যে ছিনতাইকারী যে সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েছে তা তারই মালিকানাধীন থাকবে আর মজলুম তার সাথে সমঝোতা করবে? এটা কি ধরনের শান্তি? এ রকম আপোষ থেকে তো ধ্বংসাত্মক বিপদের মোকাবিলা করা অধিক উত্তম এবং সহজ। আমাদের অবস্থা যাই হোক না কেন? এমন শান্তি ও আপোষ-সমঝোতা কিছুতেই আমরা গ্রহণ করতে পারি না।
আমাদের বীর সৈনিকগণ এমন সহাসিকতার পরিচয় দিয়েছিলো যে (যদি আমরা বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করতাম তাহলে) তার ফলাফল সমগ্র েএলাকায় পরিদৃষ্ট হতো। আমরা একাই যখন এতবড় কৃতিত্ব দেখালাম তখন গোটা অঞ্চলের সব মুসলিম শাসক ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তার ফলাফল কি হবে তা অনুমান করুন। নিসন্দেহে ফলাফল গৌরবম ও মর্যাদাকর হবে। কিন্তু বিপদ হচ্ছে মানুষ দারিদ্রের ভয়ে দারিদ্রের মধ্যে ডুবে আছে। অদৃশ্য ভয় তাদেরকে আতঙ্কে নিমজ্জিত করে রেখেছে। লাঞ্ছনার ভয়ে তারা লাঞ্ছনার অসহায় শিকার হয়ে আছে।
আমাদের যুবশক্তির মধ্যে যোগ্যতা আছে। তাদেরকে যদি উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাহলে তারা তাদের মধ্যেকার সুপ্ত পৌরুষের পরিচয় প্রদান এবং কৃতিত্বপূর্ণ ও গৌরবজ্জোল কর্ম সম্পাদন করতে পারবে। কিন্তু প্রচার প্রপাগান্ডার বর্তমান ব্যবস্থা তা হয়তো ইহুদী আধিপত্যের কারণে- এরূপ প্রজন্ম কস্মিনকালেও সৃষ্টি করতে পারবে না যারা তাদের আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে আত্মর্যাদাবোধ পোষণ করতে পারে এবং তাদের দেশ ও তার স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য গর্ব প্রকাশ করতে পারে অথবা স্বীয় হৃত অধিকার পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। এটা কত দুঃখজনক যে, নিজের ব্যক্তিগত সম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধের কারণে যখনই মুসলিম যুবকেরা ইসরাঈলের বিরুদ্ধে নিজেদের তৈরী করেছে তখনই সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের সর্বত্র এই যুবকদেরকে (তাদের শাসকদের হাতে) অত্যাচার নির্যাতন ও জেল জুলুমের শিকার হতে হয়েছে। এরূপ আচরণ শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং ইন্দোনেশিয়া ও অন্যান্য দূর দূরান্তের দেশগুলোতেও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
ইসরাঈলের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার বিষয়টি অত্যন্ত চড়া মূল্য দাবী করে। এই সন্ধি এবং তাতে নির্ধারিত শর্তাবলী ইসরাঈলকে অত্যন্ত নির্বিঘ্নে তার সংকল্প ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।
বর্তমানে প্রতিটি মহাদেশে যেসব ইসলামী কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হচ্ছে তা ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের ইসলামী ঐক্য সৃষ্টির প্রয়াস ও প্রচেষ্টার ফল মাত্র। যদিও তাতে এখনও কিছু দুর্বলতা এবং দোষ-ত্রুটি রয়েছে। কিন্তু আমি আশা করি এর ফলাফল একদিন অবশ্যই প্রকাশ পাবে। এটাও কল্যঅণকর একটা দিক যে, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা মাঝে মধ্যে এক সাথে মিলিত হয়ে বসে। একে অপরের সাথে পরিচিত হয়। পরস্পর সহযোগিতার ইচ্ছা ব্যক্ত করে এবং একজন অন্যজনের শক্তি বর্ধনের কারণ হয়। এটা অত্যন্ত শুভ লক্ষণ। বৃষ্টির সূচনা হয় একটি বিন্দু দিয়েই। কিন্তু তারপর তা মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে রহমতের রূপ পরিগ্রহ করে। অনুরূপ বান্দাহ যখন আল্লাহর পথে কর্মতৎপর হয়ে যায় এবং চেষ্টা-সাধনা শুরু করে তখন আল্লাহ অবশ্যই সেই বান্দাহর সাহায্র করেন। এমন কি বান্দা যখন তার জাগতিক সমস্ত উপায় উপকরণ ও চেষ্টা প্রচেষ্টা নিয়োজিত করে দেয় এবং আল্লাহ তায়ালা তার আন্তরিকতা সততা ও নিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে যান, তখন সেই সর্বশক্তিমান ও মহাপরাক্রমশালী তার সাহায্যের হাত প্রসারিত করে দেন। (কে আছে এমন যে বিপন্নের আর্তনাদ শুনতে পায় এবং তার দুঃখ দূল করে দেয় এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে খেলাফত দান করে থাকে?) সর্বজয়ী ও প্রকৃত প্রজ্ঞার অধিকারী মহান সত্তা ছাড়া আর কেউ-ই এমন নেই। আমরা একান্তভাবে তার ওয়াদার ওপর দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করি। অবশ্য এটা আলাদা কথা যে, তিনি তার ফয়সালা এত তড়িঘড়ি করে প্রকাশ করেন না- বান্দা যত তাড়াতাড়ি তা প্রত্যাশা করে।
ষষ্ঠ অধ্যায়
প্রসংগক্রমে ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের জীবনী সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা জরুরী মনে করছি। যাতে যেসব কার্যকরণ তাঁর মনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল আর তিনি তাঁর মহান উদ্দেশ্য অর্জনের কাজ শুরু করেছিলেন তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি। এ ক্ষেত্রে আমরা এও দেখতে পাবো যে, এ কাজের সূচনা কিভাবে হয়েছিল।
হাসানুল বান্না ১৯০৭ সালে মাহ্মুদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। এটা ছিল আল্ বুহাইরা প্রদেশের অন্তর্গত একটা শহর। এ শহরটি ছিল কায়রোর তুলনায় আলেকজান্দ্রিয়ার নিকটবর্তী। ইমাম যেই গৃহে ভূমিষ্ট হন তা ছিল দ্বীনি পরিবেশে ধন্য। তা৭র পিতা মুহ্তারাম শাইখ আহমদ আবদুর রহমান আল বান্না ছিলেন একজন আলেম ও সুফী লোক। তিনি হাদীস শাস্ত্রের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছি লেন। এবং হাদীসের ওপর তার বেশ কিছু সংকলন গ্রন্থও রয়েছে। তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ ছিল ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র)-এর মাসনাদ-এর শরাহ যা “আল ফাতহুর রাব্বানী” নামে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে। নিসন্দেহে এটা একটা মূল্যবান ও বৃহদায়তন গ্রন্থ। কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সম্পর্কিত উলামা ও শিক্ষার্থীদের জন্য এই গ্রন্থখানা খুবই উপকারী ও সহায়ক।
এমন রূহানী ও পবিত্র পরিবেশে আমাদের ইমাম জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষিত পরিবারের আদরের দুলাল হওয়া সত্ত্বেও তিনি গ্রন্থ রচনার দিকে বেশী মনোযোগ দেননি। বরং তিনি গ্রন্থের পরিবর্তে মানুষ রচনায় আত্মনিয়োগ করেন এবং অগণিত মর্দে মুজাহিদ তৈরীর কঠিন দায়িত্ব পালনের প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়েন। ছোট বেলা থেকেই তার দৃষ্টি বাস্তব কাজের দিকে ছিল বেশী। প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়েই তিনি তার সহপাঠিদের সাথে নিয়ে একটা সংগঠনের ভিত্তি রচনা করেন এবং তার নাম রাখেন “জমিয়তুল আখলাকিল আদাবিয়া।” এই সংগঠনের নামকরণ ও তার প্রতিষ্ঠা থেকেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও সূক্ষ্মদর্শী।
কচিকাঁচাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা
তিনি ছিলেন খুবই মার্জিত চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী। খুব সহজেই সবার সাথে মিশতে এবং তাদের মন জয় করে নিতে পারতেন। আমি তার চেহারায় কখনো বিষণ্ণতার ছাপ দেখিনি। কোন সময় কারো কথার মধ্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করতেন না এবং জোরপূর্বকক নিজের কথা কারো ওপর চাপিয়ে দিতেন না। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই শিষ্টাচার, শালীনতা ও সৌজন্যবোধের পরিচয় দিতেন। মসমস্যা যত বড় কিংবা ছোটই হোক না কেন কিছুতেই তিনি ভেংগে পড়তেন না। আব্বাসীয়া এলাকায় ছিল মুহাম্মাদীয়া প্রাইমারী স্কুল। একবার আমি ইমামের সাথে সেই স্কুলে গিয়েছিলাম। সেখানে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ইমামের বক্তব্য পেশ করার কথা ছিল। সেখানে পৌঁছে আমাকে বলতে লাগলেন “ছাত্রদের কিছু বলো।” আমি বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকাতে লাগলাম েএবং বললাম, “এই কচি কিশোরদের সম্মুখে বক্তৃতা দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই। আমি জজ ও উকীলদের সামনে ভাষণ দিয়ে অভ্যস্ত। (বাচ্চাদের উপযোগী বক্তৃতা দানে আমি কি করে সফলতা লাভ করতে পারবো।)”
আমার কথা শুনে অত্যন্ত মিষ্টি হাসি হাসলেন এবং বললেন, “আচ্ছা বাদ দাও।” তারপর ক্লাস রুমের জানালার পার্শ্বে যেখানে উস্তাদের চেয়ার ও টেবিল রাখা ছিল এবং দেয়ালের সাথে ব্লাক বোর্ড লাগানো ছিল সেখান দিয়ে নীচে নামলেন এবং ছাত্রদরে মাঝে গিয়ে দাঁড়ালেন। যখন তাদের সাথে কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন তখন মনে হলো যেন তিনি তাদেরই সমবয়স্ক ও সহপাঠি। বাচ্চাদেরই ভাষায় যা তারা সহজেই বুঝতে পারে এবং একানত্ভাবে তাদেরই ভাব-ভংগীতেই- যাতে তারা অভ্যস্ত ছিল তিনি বক্তৃতা দিতে লাগলেন। মাশাআল্লাহ কি হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য। যখন তিনি তার ভাষণ সমাপ্ত করলেন আমি তখন বিস্ময়ের সাগরে নিমজ্জিত হয়ে গেলাম। শিশুরা তার চার পার্শ্বে এসে সমবেত হলো। তার প্রতি কচিকাঁচাদের অনুরাগ ও আসক্তি দেখে মনে হচ্ছিলো যে, তারা তাঁর সান্নিধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না। এই সময় ইমামের কণ্ঠস্বর ছিল স্নেহ ভরা। বাচ্চাদের শিশুসুলভ আচরণকে উপেক্ষা করে নিজের উন্নত চরিত্র মাধুর্য এবং শিষ্ঠাচার শালীনতার পুরোপুরি প্রদর্শনী করেছিলেন। (এরূপ আচরণই বাচ্চাদের পোষ মানিয়ে নিতে সাহায্র করেছিল।)
(হাঁ আসি ইমামের জীবন সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম) তিনি জমিয়াতুল আখলঅক-এর পর “জমিয়াতুল মনয়িল মুহাররামাত” (হারাম কাজ প্রতিরোধ সংস্থা) প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের নামই এর মহৎ উদ্দেশ্যের দিকে অংগুলি নির্দেশ করে। নেশাকর সামগ্রীর ব্যাপক প্রসার হয়ে গিয়েছিল। গ্রীক এবং ইটালীয়ানরা ব্যাপক হারে মিসরে এসে বসবাস করছিল। তারা মিসরের বস্তিতে বস্তিতে পর্যন্ত শরাবখানা খুলে বসেছিল। তারা অত্যন্ত মামুলিভাবে উম্মুল খাবায়েছ বা মাদক দ্রব্যের কারবার শুরু করতো এবং রাতারাতি ধন কুবেরে পরিণত হতো। এমন কি নেশাতে অভ্যস্ত কৃষকরেদ অধিকাংশ ভূ-সম্পত্তির ওপর তারা দখল জমিয়ে বসতো। যদি এমনিতেই তাদের কারবার জমে না উঠতো তাহলে তারা তাদের দেগশীয় পেশাদার সুন্দরী গায়িকা ও নর্তকীদের ব্যবহার করতো আর এভাবে মিসরের সরলপ্রাণ কৃষককূল তাদের জালে জড়িয়ে পড়তো।
মুর্শিদ মুহতারাম (তার যৌবনকালেই) এটা উপলব্ধি করেছিলেন য, কৃষকগণকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য (যে ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ অনবহিত কিন্তু যা অত্যন্ত চতুরতার সাথে তাদের প্রতারক শত্রুগণ তৈরী করে রেখেছে) সর্বপ্রথম পদক্ষেপ হবে ইনসদিাদে মুহাররমাত বা নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতিরোধ। এই অপকর্মর মোকাবিলা করার জন্য তিনি তাঁর যৌবনের উন্মেষের সময়ই “তরীকায়ে হিসাফিয়ার” মাশায়েখগণের সাথেও সম্পর্ক গড়ে তোলেন। নিসন্দেহে এই আধ্যাত্মিক অনুরাগ তার আত্মার পবিত্রতার প্রতি ইংগিত দান করে এবং এই সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যে আল্লাহ এই আত্মা সৃষ্টি করেছেন এবং তাকওয়ার তাওফিক দিয়েছেন সেই মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে তার সম্পর্ক কতইনা গভীর।
আমার মতে প্রকৃত সুফী-সাধকগণ ঈমানের শীর্ষে উন্নীত হয়ে থাকেন। তারা দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন না। কিন্তু তার অপবিত্রতা ও কদর্যতা থেকে আত্মরক্ষা করে চলেন। আখিরাতের আকাংখায় সদা কর্মমুখর ও প্রাণচঞ্চল থাকেন আবার দুনিয়া আবাদ করার ব্যাপারেও উদাসীন থাকেন না। কারণ এই দুনিয়াই পরকালের শস্যক্ষেত্র। সেখানে আমরা সেই ফসলই কর্তন করবো যা এখানে বপন করবো।
তাসাউফ আল্লাহর ভীতির নাম। আর সুফী-সাধকগণ আল্লাহকে ভয় করেন। সৃষ্টির প্রতি ভয় ভীতির কোন আকীদা বিশ্বাস তারা পোষণ করেন না। তারা মনে করেন আমাদের ওপর যেসব বিপদ-মুসিবত আপতিত হওয়ার কোন অবস্থায়ই তার পরিবর্তন হতে পারে না। আবার যে মুসিবত থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন তা কেউ আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারবেন না। সবকিচু আল্লাহ তায়ালার ওপর সোপর্দ করে দেয়ার নাম তাসাউফ। কোন মানুষকে ভয় করে চ লতে হবে কেন সে তো নিজর লাভ-লোকসানের অধিকারীও নয়। যতদিন পর্যন্ত একজন সালেক আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে নিজেকে পাক-পবিত্র রাখে ও আত্মার পবিত্রতার প্রতি সদা সতর্ক থাকে। মানুষের কাছে যা কিছু আছে তার প্রতি মুখাপেক্ষী না হয়ে আল্লাহ তায়ালার কাছে যা আছে তার ওপর সন্তুষ্ট থাকে (সে-ই প্রকৃত সুফী)। তাসাউফ একাধারে তাকওয়া, নির্ভিকতা, নেকীর কাজে অগ্রণী হওয়া এবং ইখলামেসর বিভিন্ন স্তরে ঈমানের শ্রেষা্ঠত্বের পরিচয়ের নাম। ঢাক ঢোল বাজানো, পতাকা উড়নো ও নজর নিয়াজ মানার সাথে তাসাউফের কোন সম্পর্ক নেই। আমাদের মুর্শিদ এমনিভাবে সত্যিকার সুফীদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করিয়েছেন। যখন েইংরেজ সরকার তাঁকে অর্থ সম্পদের লোভ দেখিয়ে বলে যে, আপনি “গণতন্ত্রের” ওপর ভাষণ দিন। তিনি তৎক্ষণাৎ তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবংবলেন, যেটা আমি বুঝ সেটাই গণতন্ত্র, না তোমাদের কাছে যা আছে সেটাই গণতন্ত্র?
ইংরেজরা বললো: আপনি জানেন যে, আমরা এখন (নাৎসীর বিরুদ্ধে) যুদ্ধে লিপ্ত। এ সময় প্রচারের ক্ষেত্রে আমাদের আপনার মত ব্যক্তিত্বের দরকার। একথা শুনে তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন এবং নিজের দাওয়াতী কাজে মনোনিবেশ করেন। এতে মিসরের তৎকালীন শাসক তাকে হুমকি দেন কিন্তু তিনি এই ভয়-ভীতির কোন তোয়াক্কাই করেননি। অধিকন্তু তাদের গাল-মন্দের জবাবে নসীহত ও হিতোপদেশ দান করতে থাকেন। আর যখন তাঁর ওপর বর্বরোচিত হামলা চলতে থাকে তখন তিনি তাঁর অবস্থানে অটল থাকেন। আল্লাহ তাঁর ওপর বর্বরোচিত হামলা চলতে থাকে তখন তিনি তাঁর অবস্থানে অটল থাকেন। আল্লাহ তাঁর জন্য সফলতা নির্ধারিত করে দেন। হাসানুল বান্না তার তাসাউফের সাহায্যে ১৯৫২ সালে বিপ্লবের পথ সুগম করেছিলেন। যদিও আজ পর্যন্ত আমাদের প্রতি ভিত্তিহীন অভিযোগ আরোপ করা হয়ে থাকে যে, আমরা বিপ্লণবের দুশমন।
পরিবর্তনের সূচনা
সরকার আযাদ সামরিক অফিসারদের (দিবাতে আহরার) কাউকে হত্যা করেননি। কারো বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেননি বা কাউকে কারাগারেও নিক্ষেপ করেননি। কিন্তু ইখওয়ানের বিরুদ্ধে ধরপাকড়ের অভিযান পরিচালিত হয়েছে। তাদেরকে জেলে পুরা হয়েছে এবং তাদের মুর্শিদে আ’মকে প্রতারণার সাহায্যে গুলী করে শহীদ করা হয়েছে। এটা হয়েছিল এ জন্য যে, ইখওয়ান খোলাখুলিভাবে তার কাজ করতো। কিন্তু আযাদ অফিসারগণ গোপনে তাদের তৎপরতা প্রদর্শনে নিয়োজিত ছিল। ইমাম শহীদ তাঁর নিজের নেতৃত্বে সর্বসাধারণের মন-মানসিকতা প্রস্তুত করেছিলেন। দেশবাসীর অন্তরে বিপ্লবের বীজ এমনভাবে বপন করেছিলেন য, তার ফলে জনগণ একটা আমুল পরিবর্তন ও সর্বাত্মক বিপ্লবের জন্য সদা প্রস্তুত ও প্রতীক্ষমান ছিল। ইত্যবসরে আবার যখন আযাদ সিপাহীগণ ইখওয়ানের সহোযোগিতায় তৎপর হন তখনও তারা জাতিকে তৈরী পেয়ে যান। জনসাধারণ তাদের আন্তরিক অভিবাদন ও নেক প্রত্যাশার সাথে সিপাহীদেরকে স্বাগত জানায়। ইখওান শহরের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অফিস আদালত ও দালান কোঠার হেফাজতের জন্য পাহারাড় দেন: যাতে বিপ্লবের দুশমনরা ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের কোন সুযোগ না পায়। এতদসত্ত্বেও (অত্যন্ত দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে যে,) ইখওয়ান বিদ্বেষীরা এই অপবাদ আরোপ থেকে বিরত থাকছেন না যে, ইখওয়ান এই বিপ্লবের বিরোধী ছিলেন। কবির ভাষায়:
(আরবী**********)
বাহ্যত মিসরে কতই হাস্যসম্পদ কথাবার্তা বলা হয়ে থাকে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঐ হাসির অন্তরালে কান্না ও আর্তনাদ লুকায়িত রয়েছে।
ইমামের জীবনাল্লেখের দিকে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করে বলতে চাই যে, ইমাম ১৯২০ সালে মানহুরস্থিত টিচার্চ ট্রেনিং স্কুলে স্থানান্তরিত হয়ে যান যাতে রুটিন মোতাবেক সেখান থেকে একজন (প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত) সুদক্ষ শিক্ষক রূপে শিক্ষা লাভ করতে পারেন। কিন্তু তাঁর অদম্য সাহস মহৎ অনুভূতি এবং অকৃত্রিম উচ্চাকাংখার তুলনায় এই পেশা সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল না। তাই এই স্কুল থেকে ১৯২৩ সালে শিক্ষা সমপনের সংগে সংগেই তিনি কায়রোর দারুল উলুমে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯২৭ সালে গ্রাজুয়েশন লাভ করেন। এতে তিনি কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং প্রথম স্থান অধিকার করেন। এটা একটা মজার কাহিনী যে, এই প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল ছিলেন মরহুম আবদুল আজিজ আতিয়া যিনি অত্যন্ত সুদক্ষ ও অভিজ্ঞ উস্তাদ। স্কুল জীবনে তিনি চিলেন হাসানুল বান্নার উস্তাদ। কিন্তু পরবর্তী সময় তিনি তার এই ছাত্রের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এবং ইখওয়ানুল মুসলিমুনের ন্যায ও সত্যের আন্দোলনে শরীক হয়ে একজন কর্মতৎপর কর্মীতে পরিণত হন।
ইখওয়ানুল মুসলিমুন অন্যান্য ইসলামী আন্দোলনের তুলনায় কিছুটা ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। যেমন িএ সংগঠন খুঁটিনাটি মতবিরোধ ও ছোট খাট কলহ-বিবাদের পরিমন্ডল থেকে দূরে থাকে। প্রতিপক্ষের সাথে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়ার পরিবর্তে তাদেরকে তাদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দেয় যাতে তারা ইখওয়ান সম্পর্কে যা কিছু বলার বলতে পারে ১৩৪৭ হিজরীর জিলকদ মোতাবেক মার্চ ১৯২৮ সালে নীল নদের উপকণ্ঠে ইসমাঈলিয়া থেকে সূচীত হয়েছিল এই আন্দোলন। সেদিন মাত্র ছয় জন লোক ছিলেন এর উদ্যোক্তা অর্থা ইমাম হাসানুল বান্না শহীদ, আল আখআস সুলী ও আল আখ হাসবুল্লাহ প্রমুখ। অবশিষ্ট তিনজনের নাম এই মুহূর্তে আমার স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। হয়তো বা পরে আমার মনে হয়েও যেতে পারে। তখন তাদেরকে এই স্মৃতিকথায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।
কুরআন ও তলোয়ার
মুর্শিদের সকল প্রয়াস প্রচেষ্টা এই বিষয়কে কেন্দ্র করে পরিচালিত হতো যেন এমন একটা প্রজন্ম তৈরী করা যায় দ্বীনের ব্যাপারে যাদের থাকবে সুস্পষ্ট ও বস্তুনিষ্ঠ ধারণা। অর্থাৎ এই বিশ্বাস যে, ইসলাম দ্বীন ও দুনিয়া উভয়টিই রাষ্ট্র ও সরকার সর্বত্র পরিব্যপ্ত এটা কুরআন ও তলোয়ার। ইবাদাত ও মুআমালাত, শিক্ষা ও নৈতিকতা এতে যেমন রয়েছে রাজনীতি তেমনি রয়েছে অর্থনীতি। এটা সমাজের নীতিমালা উপস্থাপন করে আবার আদালতের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দান করে। এটা একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা যা জীবনের শ্রেষ্ঠতম পর্যায় থেকে শুরু করে অতি সাধারণ বিষয় পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা পেশ করে। এমনকি পায়খানা-পেসাবখানায় যাওয়া সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেয়। এই দাওয়াত যুবক, বৃদ্ধ, কৃষক, মজুর ও উম্মাতের সকল শ্রেণীর মানুষের অন্তরে রেখাপাত করতে থাকে। শুধু সাধারণ মানুষই নয় বরং আমীর ওমরাহ এবং ধনিক-বনিক ঘরের নওজোয়ানগণ এই আন্দোলনে প্রভাবিত হতে থাকে। যেমন আবদুর রাজ্জাক, আবদুন নবী এবং আদদাল্লাহ গোত্রের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই দাওয়াতের মধ্যে মুসলিমগণ একটা নতুন জিনিস লক্ষ্য করেন যা কোন ঐতিহ্যগত চিন্তাগোষ্ঠীর কাছে বা প্রচলিত জ্ঞানচর্চাকারীদের কাখে তারা কখনো পায়নি। ইমাম শহীদের উক্তির সত্যতা প্রমাণ করে দাওয়াত যখন ব্যাপকতা লাভ করে এবং তাতে বিভিন্ন চিন্তাগোষ্ঠী ও সমাজের সাধারণ লোক যোগ দেয় তখন ১৯৩২ সালে হাসানুল বান্না কায়রোতে চলে আসেন। তিনি কায়রোর বাইরে প্রদেশ ও জিলাসমূহের ব্যাপারে কখনো উদাসীন ছিলেন না। বরং নিজেই সর্বদা বিভিন্ন ব স্তি ও জনপদে একাদিক্রম পরিদর্শনে যেতেন। এসব সফরে তিনি লোকদের সামনে সুস্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করতেন যে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াত শুধু মিসরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং গোটা বিশ্বমানবতার জন্যই দাওয়াত। তিনি মিসরের বাইরে অপরাপর ইসলামী রাষ্ট্রের সাথেও যোগ সূত্র স্থাপন করতে শুরু করে ছিলেন। তিনি যদি আরো কিছুদিন অবকাশ পেতেন (এবং জালিম রক্ত পিপাসুদের গুলী যৌবনেই তাঁর জীবন প্রদীপ নির্বাপিত না করতো) তবে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সংগঠন সমগ্র পৃথিবীতে কায়েম হয়ে যেতো। কেননা ইসলাম বিশ্বজনীন দ্বীন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্বন্ধে কুরআন মজিদের ঘোষণা হলো:
(আরবী**********)
“হে (গোটা দুনিয়ার) মানুষ, আমি তোমাদের সকলের নিকট আল্লাহর মনোনীত রাসূলরূপে প্রেরিত হয়েছি।”
অতিএব ইসলাম বিশ্বজনীন দাওয়াতের মর্যাদা রাখে। এটা কোন জাতি, ভাষা, কিংবা বর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অতএব যার মধ্যেই অদম্য সাহস আছে তার জন্য এটা কোন বিস্ময়ের ব্যাপর নয় যে, সে তার মনজিলে মকসুদে পৌঁছে যাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া থেকে বিদায় নিলে আবুয বকর সিদ্দীক (রা) পতাকা তুলে ধরেন। অতপর যথাক্রমে উমর (রা) উসমান (রা) ও আলী (রা) তাদের সমকালে এই গুরু দায়িত্ব আনজাম দিয়ে ইসরামকে দুনিয়ার আনাচে কানাচে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌছিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পৃথিবী থেকে তিরোধানের পরই দুর্বল ঈমানের অধিকারীগণ মুরতাদ হয়ে যায়। এমন কি কতিপয় পথভ্রষ্ট ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করে বসে। তারা ইসলাম সম্পর্কে বিচিত্র ও অদ্ভূত ধারণা পেশ করতে থাকে। (তথাপি বাতিল নিশ্চিহ্ন ও নির্মূল হয়ে গেছে এবং ইসরাম বিজয়ী শক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।)
পুনাত্মা অগ্রজদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আন্দোলনও অব্যাহত গতিতে চলেছে। ইতিমধ্যে হাসানুল বান্নাকে শহীদ করা হয় এবঙ হাসান আল হুদাইবি হকের পতাকা ধারণ করেন। তখন তিনিও তার রবের সান্নিধ্যে চলে যান তখন ইখওয়ান এই পতাকা উত্তোলনে সহযোগিতা করেন। (যদিও এখন এই পতাকা সাইয়েদ ওমর তিলমেসানীর পবিত্র হস্তে সমর্পিত কিন্তু তার বিনয় নম্রতার প্রতি লক্ষ্য করুন। -অনুবাদক)
এটা নিরন্তর প্রচেষ্টার কাজ। তাই হাসানুল বান্নার মৃত্যুর সাথ সাথে এর পরিসমাপ্তি ঘটেনি। কেননা আমরা হাসানুল বান্নার পবিত্রতার প্রতি ঈমান পোষণ করতাম না। কিংবা তা আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও ছিল না। আমাদের মূল লক্ষ্য মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। হাসানুল বান্না ছিলেন একজন মানুষ। প্রতিটি মানুষ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য। অনুরূপ হাসানুল বান্নাও মৃত্যুর এই পেয়ালা পান করেছেন। যে দাওয়াত স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুহাম্মাদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাযিল করেছেন তার হিফাজত ও সংরক্ষণের দায়িত্বও তিনি নিজেই গ্রহণ করেছেন। প্রকৃত গুরুত্ব হাসানুল বান্না কিংবা কোন মুর্শিদে আ’ম-এর নয় বরং মূল গুরুত্ব হচ্ছে দ্বীনে হকের। যে দ্বীনের ওপর তার শত্রুরা উম্মাদের ন্যায় আক্রমণ করছে। ইখওয়ানের চিন্তা এই বিষয়েই কেন্দ্রীভূত। তারা তাদের জীবন পণ করে এই সহায়তায় নিবেদিত। িএ জিহাদ চলতেই থাকবে। কোন মুর্শিদে আ’ম থাকুক না বা না থাকুক যে সমস্ত লোক ইখওয়ানের প্রতি দোষারোপ করে যে, আমরা হাসানুল বান্নার অনুসারী। তাদের অন্তরে রয়েছে বক্রতা ও বিদ্বেষ; তাদের বোধ শক্তি উল্টো এবং তাদের বিবেক ও কান্ডজ্ঞানের হয়েছে অপমৃত্যু।
ইখওয়অনুল মুসলিমুনের বিশ্বব্যাপী ভূীমকা দ্বারা একথাই দিবালোকের মত প্রমাণিত হয় যে, তাদের মুর্শিদে আ’ম তাদের সকলকেই জিহাদের দাওয়াত দিয়েছিলেন যাতে মুসলিম মিল্লাতের জঘন্যতম শত্রুদের কবল থেকে িএকটা মুসলিম রাষ্ট্রকে উদ্ধার করা যায়। এই দাওয়াতের ওপরই ইখওয়ান তাদের সম্মতি জ্ঞাপন করেছে এবং ফিলিস্তিন ভূ-খন্ডে সর্বপ্রথম প্রবাহিত গর্বিত খুনের অধিকারী তারাই- তাদের রক্তেই রঞ্জিত হয়েছিল সেখানকার মাটি। (এবং আমি নিসংশয়ে বলতে পারি যে,) যদি এই অঞ্চলের শাসকগোষ্ঠী দায়িত্ব এড়িয়ে পলায়নি মনোবৃত্তির পরিচয় না দিতো এবং আলস্য ও নৈরাশ্যের শিকার হয়ে না পড়তো তা হলে ইতিহাস ভিন্ন আঙ্গিকে লিখিত হতো। কিন্তু এই সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারীদের নিয়ে কি কর যাবে? তারা বাস্তব জিহাদ থেকে দূরে সরে থাকে; অথচ অনলবর্ষী বক্তৃতা-বিবৃতি ও ঘোষণা দ্বারা জাতিকে সর্বদা বিভ্রান্ত করে রাখে। এরা শুধু ফিলিস্তিনের অধিবাসীদেরকে কার্যত সহায়তা পদ্রানে বিরত থাকেনি বরং তারা সর্বত্র ইখওয়ানকেই তাদের যুদ্ধের ও প্রতিশোধ গ্রহণের নিশানা বানিয়ে নিয়েছে। যেন ইহুদীদের বিরোধিতা করা তাদের দৃষ্টিতে ইখওয়ানের মহাঅপরাধ। ইহুদীদের মোকাবিলায় ইখওয়ানেসর সাহসিকতাপূর্ণ পদক্ষেপ এমন মোক্ষম আঘাত ছিল (যদি নিজেদের ঘরের শাসকরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতো তাহলে অল্প সময়ের মধ্যেই ইহুদীদেরকে ঝেঁটিয়ে সম্পূর্ণরূপে বহিষ্কার করা যেতো। প্রশংগত এখানে একজন কবির ক্ষেদোক্তির উল্লেখ করছি:
(আরবী***********)
“যার কণ্ঠনালীতে গ্রাস আটকা পড়েছে সে পানি পান করে তার প্রতিকার করতে পারে। কিন্তু যার গলদেশে পানিই আটকে যায় সে কি করবে?”
সব বিষয় পূর্বেও আল্লাহ তায়ালার হাতে ছিল পরেও তাঁরেই হাতে থাকবে। অচিরেই আল্লাহ তায়ালা এসব লোকের নিকট থেকে এমন কঠোরভাবে হিসেব গ্রহণ করবেন যার কল্পনাও তারা করতে পারেনি কখনো।
আমার ইচ্ছা ছিল, আমি দাওয়াতের সূচনা ও তার পূর্ণতার ব্যাপারে কিছু আরজ করবো। আমি তা শহীদের ভাষায়ই পেশ করছি। কেননা আমার অন্তরে তাঁর শিক্ষার বড় মর্যাদা বিদ্যমান। লোকদের সম্মুখে দাওয়াত পেশ করতে গিয়ে তিনি যা বলেছিলেন তা আজও আমার স্মৃতিপটে অঙ্গিত হয়ে আছে। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন:
“এ দাওয়াত সূর্যের চেয়েও অধিক উজ্জল, ঊষাকাল থেকেও বেশী আলোকময় এবং দিবালোকের চেয়ে অনেক দীপ্তিময়। এ দাওয়াত পবিত্র পরিচ্ছন্ন এবং অকপট ও অকৃত্রিম। এতে কোন সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ নেই। এ আন্দোলন সকল প্রকার আকাংখা ও স্বার্থন্ধতা থেকে মুক্ত। ইখওয়ান মানুষের নিকট থেকে কোন প্রকার বিনিময় প্রশংসা এবং কোন প্রকার বাহবা পাওয়ার প্রত্যাশা করে না। তাদের মনের আর্ত হলো তারা তাকওয়ার গুণে নিজেদেরকে গুণান্বিত করবে কিন্তু মানুষের দৃষ্টি থেকে তা থাকবে একান্ত সংগোপনে-আড়ালে। তারা এমন বিনয় নম্রতার প্রত্যাশী ও পথিকৃত যে, যখন তারা এসে হাজির হবে তখন কেউ যেন তাঁদের জন্য জায়গা খালি করে না দেয়। আবার যখন অনুপস্থিত থাকবে তখন তাদের সম্পর্কে যেন খোঁজ-খবর নেয়া না হয়। তাদের জন্য শুধু এতটুকুই যথেষ্ট যে, তাদের আল্লাহ তাদের অবস্থা জানেন। আল্লাহ তাদেরকে যেন এমন জায়গায় ও এমন কাজে দেখতে পান যাতে তিনি তাদের প্রতি খুশী হতে পারেন......।”
হাসানুল বান্না চাইতেন তিনি যেন মানুষের সাথে অত্যন্ত অন্তরংগ পরিবেশে এবং সহজ, সরল ও ভালবাসাসিক্ত হৃদয় নিয়ে কথাবার্তা বলতে পারেন। তিনি সহজবোধ্য কথা পসন্দ করতেন। দার্শনিক স্টাইল থেকে সর্বদা দূরে থাকতেন।
ইমাম আমাদের শিখিয়েছিলেন যেন আমরা এই দাওয়াতে বিলীন ও একাকার হয়ে যাই- আমাদের আপাদমস্তকে দাওয়াতের জীবন্ত নমুনা পরিদৃষ্ট হয় এবং দাওয়াতের মধ্যে আমাদের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ ছবি দেখতে পাওয়া যায়। দাওয়াতের ব্যাপারে যেন আমাদের নিকট তার প্রত্যাশা ছিল:
(ফারসী**********)
“আমিতোমার হয়ে গেলাম আর তুমি হয়ে গেলে আমার
আমি আত্মা হয়ে গেলাম আর তুমি হয়ে গেলে দেহ।
এমনভাবে আমরা পরস্পরের মধ্যে বিলীন হয়ে যাই যেন
তারপর আর কেউ যেন বলতে না পারে আমি আর তুমি ভিন্ন!
এর অর্থ এটা কখনো নয় যে আমরা দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলবো। ইখওয়ান বিস্তৃত জমিনের ওপর চলাফেরা করে কাজ কারবার করে এবং আল্লাহ তায়ালার দেয়া উৎকৃষ্ট রিজিক খেয়ে থাকে। কিন্তু যখন দুনিয়াবী কোন জিনিস আমাদের দাওয়াতের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় তখন আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি। এবঙ এমন জীবন ধারা অবলম্বন করি যা আল্লাহ আমাদের নিকট চান। আমি মনে করি না যে, কিতাবুল্লাহ এবং সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিঘোষিত জীবন পদ্ধতির ব্যাপারে আরো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কোন প্রয়োজন রয়েছে। কোন কোন লোক জেনে বুঝে কিংবা স্থুল বিবেক-বুদ্ধির ফলে বাড়াবাড়ির পরিচয় দিয়ে ইখওয়ানের বিরুদ্ধে অপবাদ আরো করে থাকেন যে, তারা অইখওয়ানীদেরকে মুসলমানই মনে করে না।
ইখওয়ানের প্রতি অপবাদ
এটা খুবই নিকৃষ্ট অভিযোগ যা এই জামায়াতের প্রতি আরোপ করা হয়ে থাকে। এরূপ বিকারগ্রস্ত মানসিকতার সাথে আমাদের দূরতম সম্পর্কও নেই। আমরা সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে মুসলিম ও তাওহীদের অনুসারী বলে মনে করি। আল্লাহ তায়ালার ওপর তাদের সকলেরই অত্যন্ত মজবুত ঈমান রয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। যখন ইখওয়ানের প্রতিষ্বঠাতা মজলিশের কোন কোন সদস্যের বহিষ্কা কার্যকরী করা হয় তখন মুর্শিদে আ’ম জনাব হাসান আল হুদাইবি মরহুম বলেছিলেন: আমরা এই সদস্যদেরকে এ কারণে বহিষ্কার করছি না যে, তাদের দ্বীন ও নৈতিক চরিত্রের ব্যাপারে আমরা কোন সন্দেহ পোষণ করি। তাদের শুধু এজন্য বহিষ্কার করা হয়েছে যে, তারা সংগঠনের নিয়ম-শৃংখলা ও বুনিয়াদী নীতিমালার আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে। নিয়ম-শৃংখলার অনুসরণ এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে এর অবর্তমানে কোন সংগঠন অথবা পার্টি টিকে থাকতে পারে না।
আমরা সব মুসলিমের সাথেই লেন-দেন করে থাকি। অনেক সময় একজন অইখওয়ানী মুসলিম একজন ইখওয়ানী মুসলিম অপেক্ষা অধিক বলিষ্ঠ ঈমানের অধিকারী হতে পারে। আমাদরে বক্তব্য শুধু এই যে, উম্মাতে মুসলিমা সামষ্টিকভাবে তাদের দ্বীনি শিক্বষাকে বাদ দিয়ে এবং এর প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করে চলার নীতি গ্রহণ করেছে। তারা নিজেদের দৈনন্দিন কার্যক্রমে ইসলাম থেকে পথনির্দেশনা গ্রহণ করেন। তাই ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াত হচ্ছে, মুসলিম থেকে পথনির্দেশনা গ্রহণ করেন। তাই ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াত হচ্ছে, মুসলিমদের দ্বীনে হানিফের দিকে প্রত্যাবর্তন করা আবশ্যক। অলসতার মেহা নিদ্রা ভংগ করে তাদেরকে সক্রিয় ও আন্দোলন মুখর হতে হবে। জীবনের সকল কর্মকান্ডে ইসলামের উপস্থাপিত রীতিপদ্ধতির যথাযথ অনুসরণ করতে হবে। এই দাওয়াতের ভিত্তিতেই মানুষের সাথে আমাদের সকল প্রকার লেন-দেন হয়ে থাকে। আমরা নিদ্রিতকে জাগ্রত এবং অলসকে সচেতন করতে চেষ্টা করি যেমন মুয়াজ্জিন মানুষের এই অনুভূতি জাগ্রত করতে চায় যে সালাতের সময় এসে গেছে।
আমরা কস্মিনকালেও এমন দাবী করি নাই যে, আমরা অন্যদের তুলনায় ভাল। আমরা কখনো অন্য কোন দাওয়াতী সংগঠনের প্রতিও দোষারোপ করি না যে, তারা এরূপ বা সেরূপ ইত্যাদি। একান্তই যদি আমরা এসব সংগঠনের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হই তবেতা হয় সাময়িক এবং তা কেবল বুনিয়াদী বিষয়ের মধ্যে সীমিত থাকে।
আমার এই স্মৃতিকথা বিশেষত এর যে অংশ ইখওয়ানের দাওয়াতের সাথে সম্পর্কিত তা সম্পূর্ণরূপে ইমাম শহীদের সেসব শিক্ষার উল্লেখ করেছি- যা আমি তার নিকট থেকে শিখেছি। কিচু কথা আছে এমন যা আমার স্মৃতিতে সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলো ইমামের বক্তৃতা কিংবা চিঠি-পত্রের সাথে সম্পর্কিত। আমি এই স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে কোন উৎসের সাহায্য গ্রহণ করিনি। আমি চেয়েছিলাম, এই স্মৃতিকথাগুলো পুনরাবৃত্তি করতে গিয়ে আমার স্মরণ শক্তিরও একটা পরীক্ষা হয়ে যাক যে, এই আন্দোলনের নেতা থেকে আমি যা কিছু শিক্ষা লাভ করেছি তা আজও সংরক্ষিত আছে কিনা? কালের আবর্তন আমার স্মৃতির কিছু অংশ ছিনিয়ে নেয়নি তো? এই স্মৃতিকথাগুলো রেকর্ড করে নেয়া জরুরী মনে করছি। আমি এগুলোর রেকর্ড করার সময় ক্রমবিন্যাসের দিকে লক্ষ্য রাখিনি। (যা লিপিবদ্ধ করার সময় লিখত সাধারণত করে থাকেন)। উদাহরণ স্বরূপ আমি কোন কথা হয়তো শুরু করেছি ইত্যবসরে অন্য প্রসংগ এসে পড়েছে। তারপর আমার এমন সূত্র এসে পড়েছে যাতে বক্তব্য পূর্ব প্রসংগের দিকে মোড় নিয়েছে। মানুষ কোন কথা ভুলে যায় না কিংবা কথা বলতে শুরু করলে কোন প্রসংগ বাদ পড়ে না এমন খুবই কমই হয়ে থাকে। খুঁটিনাটি বিষয়ে কোথাও না কোথাও কম বেশী হয়ে যাওয়অ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আদম সন্তানের বৈশিষ্ট্যিই হচ্ছে সে ভুল করে বসে। ভুলে যাওয়া লোকদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাদের ভুল জানতে পারলে অনুতপ্ত হয়। আমি আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে ঐ ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবো যে আমাকে এমন কোন বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করবে যা আমার থকে বাদ পড়েছে কিংবা আমার কোন ভ্রম সংশোধন করে দেবে যা আমার পক্ষ থেকে প্রকাশ পেয়েছে। আমিতো ইচ্ছাকৃতভাবে কোন ভুল করিনি এবং অনিচ্ছাকৃত ভ্রান্তির ওপর অনমনীয়তা প্রদর্শনও করবো না বরং ধন্যবাদের সাথে তা সংশোধন করে নেবো।
দাওয়াতের প্রচার ও প্রসার
ইমাম দাওয়াতের সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেছিলেন এভাবে যে, তিনি চায়ের দোকান ও অন্যান্য যেসব স্থানে মানুষ একত্রিত হয়ে গল্প গুজবে মেতে উঠতো সেখানে গমন করতেন। তিনি একটা ছোট ব্লাক বোর্ড বগল দাবা করে ফিরতেন। কথাবার্তার মাঝে যদি কোন সূক্ষ্ম তত্ব বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন দেখা দিতো তাহলে ব্লাকবোর্ডের সাহায্যে তা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁক এমন হৃদয়গ্রাহী বাকপটুতা প্রদান করেছিলেন যে, তার কথা শোবনার জন্য লোকজন এসে জড়ো হতো। ফলে সমস্ত চা দোকানের মালিক ও কফিখানার ম্যানেজারগণ সমবেতভাবে তার সমীপ আবেদন করতে লাগলেন যেন তাদের দোকানেও তিনি গমন করেন। এমনিতেই ইসমাঈলিয়ার প্রত্যেক রেস্তোরার মালিকগণ সর্বদা চাইতেন যেন হাসানুল বান্না তাদের দোকানেও যান এবং মানুষের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন।
প্রতিদিন এই ধারা অব্যাহত থাকতো। শিক্ষকতার দায়িত্ব থেকে অবসর হয়েই মুর্শিদ এই কাজে লেগে যেতেন। প্রথম প্রথম মানুষ মনে করেছিলো যে যদিও তাঁর কর্মপদ্ধতি খুবই আকর্ষণীয় কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি সাধারণ ওয়ায়েজীনদের মত একজন দ্বীনি মুবাল্লিগ বৈ নন। অতএব সুয়েজ খাল কোম্পানী- যেখানে বেশ কিছু চিহ্নিত ইসলামী দাওয়াত বিদ্বেষী লোক ছিল- আত্মপ্রতারিত হয়। তারা মনে করে যে তিনি হয়তো বা কোন তাবলীগ পন্থি মৌলভী হতে পারেন। তাই এই কোম্পানী ইসমাঈলিয়ায় উম্মুহাতুল মু’মিনীন মাদ্রাসা এবং তৎসংলগ্ন মসজিদ নির্মাণে সংগঠনকে (ইখওয়ানের) সহযোগিতা করে। এতদ্ব্যতীত অন্যান্য সামাজিক সংগঠনও প্রাথমিক অবস্থায় তাদের সহায়তার হাত সম্প্রসারিত করে।
আমার একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেছে। জনৈক ইখওয়ানী ভাই কোন একটা কোম্পানীতে ড্রাইভার পদে নিযুক্ত ছিলেন। তার নিকট একখানা বাইসাইকেল ছিল। এর সাহায্যে সে তার ডিউটির জন্য প্রত্যহ নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই তার কর্মস্থলে গিয়ে পৌঁছতো। কোম্পানীর দায়িত্বশীল কর্তারা তার এই সময়নুবর্তিতার কারণে তাকে মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতো। তারপর হঠাৎ দেখা গেলো তিনি তার কাজে কিছুটা দেরীতে উপস্থিত হতে লাগলেন। কোম্পানীর চেয়ারম্যান বিস্মিত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, সে তার দীর্ঘ সতর্ক অভ্যাস এবং যথা সময়ে উপস্থিতির ব্যাপারে পরিবর্তন আনলো কেন? তিনি তার প্রত্যুত্তরে বললেন:
আমার একটা বাইসাইকেল ছিল। আমি সেটির সাহায্যে নির্দিষ্ট সময়ে ডিউটিতে এসে পৌঁছে যেতাম। আমাকে বলা হয়েছিল যে, ইখওয়ানের কোন কাজে এয়ানতের প্রয়োজন তাই আমি আমার সাইকেল বিক্রি করে দিয়েছি এবং বিক্রিলব্ধ অর্থ মুর্শিদে আ’ম-এর হাতে তুলে দিয়েছি। এখন আমি পায়ে হেঁটে এসে থাকি তাই পৌঁছতে দেরী হয়ে যায়।
কোম্পানীর চেয়ারম্যান মনোযোগ সহকারে এই ঘটনা শুনেন এবং ইখওয়ানী ভ্রাতার বাদ্যান্যতা দানশীরতায় অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে যান। অবশেষে কোম্পানীর তরফ থেকে তিনি তাকে একটা নতুন সাইকেল কিনে দেন। এখন পুনরায় সে ভাই তার সাবেক অভ্যেস অনুযায়ী খুবই সময়ানুগভাবে তার ডিউটিতে সময়ের পূর্বেই গিয়ে পৌঁছতে থাকেন। এই ঘটনা (যদিও নেহায়েত মামুলী) তথাপি এ দ্বারা আমাদের সামনে এই সত্য উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে যে, ইখওয়ান তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনের পথে কত আত্মনিবেদিত এবং মুর্শিদের উপর তাদের কি অপরিসীম আস্থা ও বিশ্বাস। তদুপরী তাদেরকে যখন ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ তথা আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হতো তখন তারা সাথে সাথে তা কার্যকরী করতো।
অতপর নবনির্মিত মসজিদে ইখওয়ানের সমাবেশ আরম্ভ হয়। প্রতি রাতেই জনসমাগমে মসজিদ মুখরিত হয়ে উঠতো। তারা মুরিআশদে আ’ম-এর বক্তব্য শোনার জন্য অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে সমবেত হতো। তিনি যখন কায়রো এসে বসবাস শুরু করেন তখন সপ্তাহে প্রতি মংগলবার কেন্দ্রীয় দপ্তরে সমাবেশ হতে থাকে। আমার মনে আছে কেন্দ্রীয় অফিস ও বিভিন্ন সময় কয়েকটিচ জায়গায় স্থানান্তরিত হয়। প্রথমে এটি ছিল মুর্শিদের নিজের বাস গৃহে। অতপর সাইয়েদা জয়নাব মহল্লার নীচ তলায় নিয়ে আসা হয়। তারপর আবার আতাবাতুল পার্লামেন্ট হোটেলে স্থানান্তরিত করা হয় এবং শেষে হিলমিয়ায় শাদীদায় কেন্দ্রীয় অফিসের স্থান নির্ধারিত হয়।
ইউনিভার্সিটিতে দাওয়াতের কাজ
ইত্যবসতরে ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা বিশেষভাবে এই নবগঠিত সংগঠনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত তাদের বন্ধুদের কাছে এই দাওয়াত প্রচার করতে থাকে। সময়যতই গড়িয়ে যেতে লাগলো ইখওয়ানী ছাত্রের সংখ্যাও ততই বেড়ে চললো। এমনকি শীঘ্রই এমন সময় উপস্থিত হলো যখন ছাত্র সংসদের নির্বাচন কোথাও ইউনিয়নের ওপর ইখওয়ানী ছাত্রদের পূর্ণমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলো। আবার কোথাও বা নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জিত হলো।
এ বিষয়টি সরকার এবং দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলকেও অস্থির করে তোলে। তাদের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তারা আকস্মিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে যে, জাতির মধ্যে এমন একটা নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটেছে যা তাদের চিন্তাধারার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। ব্যস! আর যায় কোথায়! ইখওয়ান ও ইখওয়ানের সুষ্ঠু চিন্তার বিরুদ্ধে পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায। সাথে সাথে দাওয়াতের কাজও জোরদার হয়ে ওঠে। শহর বন্দর ও গ্রামে গঞ্জের যেসব লোক দাওয়াত হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিল; তারাও তাদের আত্মীয় স্বজন, পরিবার পরিজন ও বন্ধু বান্ধবকে এই আলোর সাথে পরিচিত করাতে শুরু করে। জনগণের মধ্যে এমন সাড়া পড়ে যায় যে, বস্তির পর বস্তি এবং জনপদের পর জনপদ এই দাওয়াতের কেন্দ্রে পরিণত হতে থাকে। অতপর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত জিহাদের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এই পর্যায়ে ইসলামের শত্রুরা দাওয়াতকে তাদের জন্য সমূহ বিপদের কারণ বলে ভাবতে থাকে এবং এই পূত-পবিত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে শয়তানী চক্রান্ত শুরু করে দেয়। সকল শয়তানী শক্তি ও বাতিল শক্তি এই উদীয়মান শক্তিকে সমূলে উৎখাত করার জন্য আদা পানি খেয়ে লেগে যায়। কিন্তু তাদের এই অশুভ উদ্দেশ্য অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শহর-বন্দর ও গ্রাম-গঞ্জের কর্মী ও সদস্যদের কর্মপদ্ধতি ছিল, তারা মানুষের মাঝে তাদের কাজ অব্যাহত রাখতো। যখন তারা উপলব্ধি করতো যে, তাদের টার্গেটভুক্ত কোন লোক নিষ্ঠার সাথে দাওয়াত হৃদয়ঙ্গ করতে সমর্থ হয়েছে, তখন তারা তাঁকে মুর্শিদে আ’ম-এর খেদমতে হাজির হওয়ার জন্য আহ্বান জানাতো এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার জন্য বাইয়াত গ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করতো। এই বাইয়াত হতো শুধু আল্লাহর পথে- তারই সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। হাসানুল বান্নার পথে বা তাঁকে খুশী করার জন্য নয়। এর প্রমাণ হলো, বাইয়াতের শপথনামার সর্বশেষ কথাটি ছিল এরূপ:
“মুর্শিদের নির্দেশের আনুগত্য এমতাবস্থায় কখনো করা যাবে না। যখন তা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অমান্য করার কারণ হবে।”
আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, একথা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে যায় যে, আমরা কোন ব্যক্তির বাইয়াত তার নিজের স্বার্থে করি না। বরং আমরা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালারই বাইয়াত করে থাকি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাইয়াতকেও আল্লাহ তায়ালা তাঁর বাইয়াত বলে আখ্যায়িত করেননি। বরং তাঁর নিজের (আল্লাহর বাইয়াত বলে ঘোষণা করেছেন..... (আরবী*********) (নিশ্চয়ই যেসব লোক আপনার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন.....।)
সাংবাদিকতার জগতে ইসরামী আন্দোলন
অতপর ইখওয়ানের ইতিহাসে একটা মহত সাংবাদিকতা অধ্যায়ের সূচনা হয়। দু’টি সাময়িকী- “আল-ইখওয়ান” ও “আন-নাজীর” এবং একটা দৈনিক পত্রিকা “আল-ইখওয়ানুল মুসলিমুন” প্রকাশিত হতে থাকে। এসব পত্রিকা ইখওয়ানুল মুসলিমুনের পয়গামের প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে। ফলে শাসক শ্রেণী, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং অন্যান্য গ্রুপ, খৃস্টান, কমিউনিস্ট ও ইহুদী শক্তি তথা দল মত নির্বিশেষে সকলেই ইখওয়ানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইখওয়ানের ওপর তাদের আক্রমণ ছিল খুবই কঠোর ও নিষ্ঠুর। এতে কোন প্রকার নৈতিক সীমা এবং মানবতার বিবেচনা করা হয়নি। এই শত্রুতামূলক বর্বরোচিত হামলার ফলে অধিকাংশ লোক আমাদের দাওয়াতে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। আমাদের নিজেদের চেষ্টা-সাধানার তুলনায় আমাদের শত্রুদের প্রচেষ্টায়ই আমাদের নাম ও খ্যাতি অনেক বেশী ছড়ায। হকের বিরোধিরা তাদের নিজেদের বিরোধিতার দ্বারাই সত্যকে (মানুষের অন্তরে অনুসন্ধানী কৌতুহল ও মনোভাব সৃষ্টি করতঃ) আরো প্রসারিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। অনুরূপভাবে হকের ব্যাপকতা সৃষ্টি ও বিস্তৃতি ঘটানোর ব্যাপারে ইমামের অব্যাহত সফর এবং দায়ীদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার প্রভাবও কম গুরুত্ব বহন করে না।
সংগঠনের শামিল হওয়ার বিভিন্ন পর্যায়
জনসাধারণের সংগঠনে যোগদানের বেশ কয়েকটা পর্যায় ছিল। যেমন একটা স্তর ছিল “সুধী ও হিতাকাংখীদের” যারা সংগঠনকে ভালবাসতো কিন্তু সংগঠনের কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণের মত মনোবল তাদের মধ্যে ছিল না। সংগঠনের দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিলেন “সহযোগী ও সক্রিয় সমর্থকগণ”। এই শ্রেণীর লোকেরা সংগঠনের পুরো নিয়ম শৃংখলার অনুসারী ছিলেন না। কিন্তু সংগঠনকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করতেন। তৃতীয় পর্যায় ছিল বাইয়াত গ্রহণকারীদের। এই পর্যায়ের ইখওয়ানরা ইমামের হাতে বাইয়াতের মাধ্যমে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করতো এবং সংগঠনের কাজে পুরোপুরি অংশ নিতো। সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল সম্পূর্ণ নিবেদিত প্রাণ কর্মীবাহিনী। তারা বাইয়াত গ্রহণের পর তাদের জান-মাল ও সন্তানদেরকেও দাওয়াতে হকে সোপর্দ করে দিতো।
দাওয়াত তাদের কাছে জান-মাল, পরিবার পরিজনের কুরবানী দাবী করলে তারা কোন প্রকার অজুহাত ও যুক্তি উপস্থাপন না করে আল্লাহর পথে তাদের এই প্রাণ প্রিয় সম্পদগুলোও পেশ করে দিতো। ইনশাআল্লাহ শীগ্রই আপনাদের সামনে বিষদ বিবরণ তুলে ধরা হবে যে, “নিষ্ঠাবান ও নিবেদিত প্রাণ কর্মীবাহিনীর” জ ন্য তাদের মধ্যে কি গুণাবলী সৃষ্টি করা আবশ্যক। এই প্রসংগে আপনার জন্য একটা উদাহরণই যথেষ্ট হবে বলে মনে করি। পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের এক ইখওয়ানী ভাই তার যুবক সন্তানকে ফিলিস্তিন জিহাদে অংশ গ্রহণের জন্য মুজাহিদ বাহিনীর সাথে প্রেরণ করেন। এই নওজোয়ান জিহাদে শহীদ হয়ে যান। ইমাম যখন সমবেদনা প্রকাশের জন্য সেই ভাইয়ের কাছে যান তখন তিনি জিজ্ঞেস করেন: আপনি কি আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য এসেছেন? যদি আমার অনুমান সত্য হয় তবে আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমার সান্ত্বনার প্রয়োজন নেই। আর যদি আপনি আমাকে ধন্যবাদ জানাতে এসে থাকেন তাহলে আমি প্রাণভরে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। আসুন! আপনি যখন আমার সামনে আল্লাহর নিকট শহীদগণের মর্যাদার বর্ণনা দিয়েছেন তখন থেকেই আমি শাহাদাতের উচ্চ সম্মান সম্পর্কে অবহিত হয়ে গিয়েছি। আল্লাহর রহমতে ওপর ভরসা রেখে আমি আশা করি যে, আমার সন্তান শহীদি কাফেলায় শীর্ষস্থানীয় মর্যাদা লাভ করবে। আমার একান্ত প্রত্যাশা যে আমিও ঈমানের সাথে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করি এবং আল্লাহ আমাকে আমার ছেলের সাথে সেখানে মিলিত হওয়ার সৌভাগ্য দান করেন।
ইখওয়ানের সংগঠনবুক্ত ও দলবদ্ধ হওয়ার উদ্দেশ্য
ইখওয়ানের সংগঠন প্রতিষ্ঠিত এই উদ্দেশ্যে যে, যেসব বিপদ-মুসিবত মুসলিমদের ঈমান আকীদা ধ্বংস করে দিচ্ছে সেগুলোর যেন প্রতিবিধান করা যায়। এসব বিপদ সম্পর্কে মুসলিমদের অনুভূতি পর্যন্ত লোপ পেয়ে বসেছে। অথচ তাদের পায়ের নীচে ভয়ংকর গভীর গর্ত খনন করা হয়েছে। যে কোন মুহূর্তে তারা তার অতল তরে পতিত হয়ে হারিয়ে যেতে পারে। শুধু এখানেই শেষ নয়, বরং সিনেমা, থিয়েটার, টেলিভিশন ও রেডিও প্রভৃতি গণমাধ্যমের উদ্দেশ্য এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে উন্নতি-অগ্রগতি, তাহযীব-তামাদ্দুন ও সভ্যতা-সংস্কৃতি প্রভতির নামে মুসলিমদেরকে পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণের মোহে মোহগ্রস্ত করা। ইসলামের কোন ত্রুটি বা দুর্বলতা নেই। কিন্তু কোন মুসলিমই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইখওয়ানের দাওয়াত ইসরাম বৈরিদের ইসলাম বিদ্বেষী তৎপরতার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বাস্তব রূপ লাভ করেছে বলে আমি মনে করি না। বরং এটা একট ইতিবাচক আন্দোলন যা মুসলিমদেরকে তাদের দ্বীন, দ্বীনের শিক্ষা ও মূলনীতির দিকে ফিরিয়ে আনতে চায়। ইসলামের শিক্ষা ও তার মূলনীতি ন্যায় ও সত্য। কিন্তু মুসলিমদের উদাসীনতার কারণে তাদের গৌরবের দীপ্তি মাঝে মধ্যে নিষ্প্রভ হয়ে যেতে থাকে।
ইখওয়ানের কর্মনীতি ও কর্মপরিকল্পনা কোন কাজের প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতি কখনো নয়। ইমাম শহীদ বায়োঃপ্রাপ্ত হওয়অর পর থেকেই মুসলিম উম্মাহর শোচনীয় অবস্থা সম্পর্কে গভীরভাবে নিরীক্ষণ এবং এর প্রতিকার সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করেন। অতপর তিনি একটি মৌলিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন যা কোন কোন বাহ্যিক কার্যকারণের ফসল নয় বরং জীবনের প্রতিটি দিক আলোকিত করার জন্য একটি উর্বর মাস্তিষ্কের সতর্কতা ও সাবধানতার ফসল।
(সাধারণত দল ও সংগঠন কোন নির্দিষ্ট দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হতো।) কিন্তু কোন সাম্রাজ্রবাদের হাত থেকে কোন বিশেষ এলাকা মুক্ত করার উদ্দেশ্যে ইখওয়ান প্রতিষ্ঠিত হয়নি বরং ইখওয়ানের সামনে তার চেয়েও বড় লক্ষ্য ছিল এবং তাহচ্ছে মুসলিম উম্মাহকে ইসলামের পবিত্র জীবন এবং তার জীবনদায়িনী ঝর্ণার দিকে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করানো; তাদের পূর্ণাংগ স্বাধীনতা ও শান্তিপ্রিয়তার বিশ্বাসে অভ্যস্ত করে তোলা। এই উদ্দেশ্য হাসিল হলে এবং এই জীবন্ত সত্য মুসিলম মিল্লাতের মন-মগজের গভীরে স্থায়ীভাবে বদ্ধমুল হলে সকল সমস্যা আপনা থেকেই সমাধান হয়ে যাবে। তারা নিজেরাই বুঝতে পারবে যে, সাম্রাজ্রবাদ এবং স্বাধনিতা দু’টো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস যা কখনো এক জায়গায় একই সময় অবস্থান করতে পারে না। অনুরূপ আযাদী ও জুলুম, ন্যায় ও সত্যে বিশ্বাস, অর্থনৈতিক সাম্রাজ্রবাদ। মুসলমানদের আত্মমর্যাদা ও আদর্শিক সাম্রাজ্রবাদও পরস্পরের বিপরীত। এ দু’টিরও পাশাপাশি অবস্থঅন অসম্ভব। দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করে মানুষ কখনো আরাম ও শান্তির জীবন যাপন করতে পারে না।
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াত এই বুনিয়াদী নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। যাতে মুসরমানদেরকে জীবনের ছোট বড় সকল ব্যাপারে সত্য দ্বীনের অকপট অনুসারী বানিয়ে দেয়া যায়। আর এটা একটা পৃথক ও মৌলিক বিশ্বাস। যার ইতিবাচক সত্তা রয়েছে। তাই তা কোন কার্যকারণ বা ঘটনার প্রতিক্রিয়া নয়। অতএব এই আন্দোলন যখন কোন ছড়িয়ে পড়া বিপর্যয়ের সংশোধনী অথবা কোন ব্যাপক গোমরাহীর গতি রোধ করার আহবান জানায় তখন তা ইসলামের সুমহান শিক্ষারই প্রকৃত দাবী।
নামকরণ
পূর্বে যে ছয় ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে যখন তারা শপথ গ্রহণ করে এবং ইমামও উপলব্ধি করেন যে এখন তারা একটা জামায়াত বা সংগঠনের রূপ পরিগ্রহ করতে যাচ্ছে তখন এই নবগঠিত সংগঠনের নাম কি হবে তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। ইমাম বললেন: “আমরা কি ইখওয়ান (ভাই ভাই) নই? সকলেই বলে উঠলো “অবশ্যই” তিনি পুনরায় বললেন: তাহলে আমরা “আল-ইখওয়ানুল মুসলিমুন”। প্রসংগত আমি এখানে একটা কথা আরো যোগ করে দিতে চাই যে, এর নাম কুরআন মজীদেও বর্ণিত হয়েছে। অতএব এটা কোন মনগড়া “বেদায়াত” নয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন (আরবী******) (মু’মিনরা পরস্পরের ভাই।) তিনি আরো বলেছেন: (আরবী************) (তিনি তোমাদের মুসলিম নামে অভিহিত করেছেন) সুতরাং এটা কোন নতুন জিনিস নয়। সাথে সাথে এই ভুল বুঝাবুঝিরও অপসারণ হয়ে যাওয়া প্রয়োজন যে আমরা আমাদের এই জামায়াতকে “আল-জামায়াতুল মুসলিমা” বলে দাবী করিনি। কেননা জামায়তে মুসলিমার মধ্যে সব মুসলিম শামিল রয়েছে। আমরা আমাদেরকে “জামায়াতে মুসলিমীন” কিংবা “জামায়াতুন মিনাল মুসলিমীন” বলে বিশ্বাস করি। অর্থাৎ উম্মাতে মুসলিমার মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক মুসলিম দাওয়াতে ইসলামের কাজ সংগঠিত উপায়ে ও সংঘবদ্ধভাবে করার জন্য একটা সংগঠন কায়েম করেছে। ইসলাম শুধু আমাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এমন লোকদের পরিণাম ও পরিণতি কি হবে যারা আমাদেরকে হত্যার উপযুক্ত বলে মনে করে এবং আমাদের ওপর বিদায়অতের অভিযোগ আরোপ করে। এটা বল্ম এমন একটা অপরাধের শাস্তি হিসেবে যা করা তো দূরে থাক আমাদের কল্পনাতেও কোনদিন আসেনি।
সাবধান! অপরের ছিদ্র অন্বেষণ এবং দোষ খুঁজে বেড়ানো লোকদের উচিত আল্লাহকে ভয় করা। আমি আল্লাহর ওয়াস্তে তাদের নসীহত করছি এবং একটা হাদীস তাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।
“যারা বা যে ব্যক্তি মানুষের গোপনীয় বিষয় জানার জন্য তৎপর থাকে আল্লাহ হয়তো তার ত্রুটি-বিচ্যুতি ফাঁস করে দেয়ার জন্য কাজ শুরু করে দেবেন। আর আল্লাহ এরূপ করলে তাঁকে তাঁর গৃহের মধ্যেই অপমাণিত ও লাঞ্ছিত করে ছাড়বেন।”
আমাদের সকল কর্মতৎপরতায় আল্লাহর সাহায্যই যথেষ্ট। তিনিই সর্বোত্তম কর্মসম্পাদানকারী। আমাদের নাম ছড়িয়ে পড়ুক কিংবা আমাদের কথা সর্বত্র শোনা হোক তা আমাদের উদ্দেশ্য মোটেই নয়। আমরা চাই প্রকাশ্র ও অপ্রকাশ্র শুধু আল্লাহর জন্য চেষ্টা-সাধনা করে যাই।
সপ্তম অধ্যায়
দাওয়াতী সফরে যাওয়ার জন্য টীম গঠন ইখওয়ানের আবিষ্কার ছিল না। বরং এটা সারাদেশে ইতিপূর্বেও ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। প্রাইমারী ও সেকেন্ডারী স্কুলে, কলেজে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং ক্লাবে এমনকি অভিনেতা, ভাঁড় ও বিদুষকগণের ইউনিয়নেও এই প্রচলন ছিল। এরূপ ভ্রাম্যমান টীমের ব্যাপারে আমি কখনো কারো বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপিত করিনি। কিন্তু যখন ইখওয়ানের পুন্যাত্মা এবং পবিত্র ব্যক্তিত্বগণকে দাওয়াতী অভিযানে প্রেরণ করা আরম্ভ হলো তখন সবখান থেকে আপত্তি ও সমালোচনার তীর বর্ষিত হতে লাগলো। উদাহরণ স্বরূপ ইখওয়ানের স্কাউটিং টীমের কথা উল্লেখযোগ্র। এমন টীমের প্রচলন রয়েছে সমগ্র পৃথিবীতে। কিন্তু কেউই আপত্তি তোলে না। সেখানে শুধু ইখওয়ানের বেলায় সবার মাথা ব্যাথা। কবির ভাষায় বলা হয়:
আমরা একটু আহ বললেই তাতে বদনাম;
কিন্তু যারা তারা হত্যাযজ্ঞ চালালেও কেউ তা মুখেও আনে না।
পারবর্তী আলোচনায় আমরা দেখতে পাবো, ইখওয়ান কখনো শক্তি প্রয়োগ করে কোন পরিবর্তন কিংবা বিপ্লব সাধনের চিন্তা করেনি। কেননা ইখওয়ান মূলত সালাফী জামায়াত। আর সালাফীরা উচ্চ শ্রেণী এবং নির্বাহী কর্তৃপক্ষের অপপ্রচার সত্ত্বেও নির্দ্বিধায় ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের পক্ষপাতি নয়। ক্ষমতাসীনরা ফাসেক এবং জালেম হলেও ইখওয়ানদের দাওয়াত সম্প্রসারণের উপায় উপকরণ প্রসংগ যখন আলোচনায় আসবে তখন এ ব্যাপারে বিষদ আলোচনা করা হবে। ইমাম শহীদের দাওয়াত দান প্রক্রিয়া ও কর্মপদ্ধতি থেকেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
ইখওয়ানের প্রশিক্ষণ শিবিরসমূহ
কোন বহিরাগত যদি কখনো ইখওয়ানের কোন ট্রেনিং ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করে তাহলে ক্যাম্পে অংশগ্রহণকারীদের শৃংখলা ও নিয়মানুবর্তিতা, পোগ্রামসমূহে অংশগ্রহণ এবং তাদের আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা দেখে হতবাক হয়ে যাবেন। শিক্ষা শিবিরে অংশগ্রহণকারীদের অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে, সালাতুল ফজরের পূর্বেই শয্যা ত্যাগ করা যাতে তাহাজ্জুদের সৌভাগ্রও লাভ করতে পারে। তারপর মুয়াযযিনের আযান ধ্বনিত হলে সবাই জামায়াতের সাথে ফজরের নামায আদায় করে। অতপর ব্যায়ামের কর্মসূচী শুরু হয়ে যায়। যা সুস্থ সবল দেহের নিশ্চয়তা বিধান করে এবং সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির ফায়সালাসমূহ বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম করে তুলে। ব্যায়াম থেকে অবসর হয়ে নাস্তা গ্রহণ করা হয়ে থাকে এবং সকাল বেলার জরুরী ঘোষণা দেয়া হয় যাতে অংশগ্রহণকারীগণ কর্মসূচী সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত থাকতে পারেন। সারা দিনের পোগ্রামে খাদ্র তৈরী, ব্যায়ামানুশীলন, সালাত এবং বক্তৃতা ও দারস অন্তর্ভুক্ত থাকে। এভাবে সালাতে এশা পর্যন্ত এসব কর্মকান্ড চলে তারপর অবসর হয়ে অংশগ্রহণকারীগণ গিয়ে নিজ নিজ বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। প্রশিক্ষণের এই দিনগুলো নিসন্দেহে প্রশিক্ষণার্থী জীবনে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের কারণ হয়। এতে আরাম ও বিশ্রাম এবং বিনোদনের কাজও হয়ে যায়। এবং সাথ সাথে যুবকেরা তাদের দেশের হিফাজতের জন্য শারীরিক ও মানসিক দিক থেকেও উপযুক্ত হয়ে যায়। তারা নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং তাদের ওপর তাদের নিজেদের, পরিবারের, সমাজের ও বৃহত্তর ইসরামী উম্মাহর কি কি অধিকার রয়েছে তা জানতে পারে। এসব ব্যাপারে অনুভূতি তখনই চাংগা হয়ে ওঠে যখন মানুষ সর্বপ্রথম আকাশ ও পৃথিবীর রবের ইবাদাত ও আনুগত্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে।
এ দিনগুলো বাস্তব প্রশিক্ষণ তথা হাতে কলমে শিক্ষা লাভ এবং ইসরামী জ্ঞানকে মনোজগতে প্রবিষ্ট করার ও হৃদয়ের গভীরে বদ্ধমূল করে নেয়ার উপযুক্ত সময়। এই দিবসগুলোতে আত্মার উৎকর্ষ সাধন ও উন্নতি বিধান, ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের সুষ্ঠু সংরক্ষণ, প্রকৃত সম্মানের অনুভূতি লাভ এবং সকল প্রকার অপমানের গতিরোধ কর মোক্ষম সুযোগ পাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
(আরবী****************)
(প্রকৃত সম্মান আল্লাহ তায়ালার, তাঁর রাসূলের এবং ঈমানদারদের।)
ঈমানদারদের ইজ্জত ও সম্মানের ব্যাপারে তো ফয়সালা কৃত। যে এটা আল্লাহ তায়ালার কিতাবে কারীমে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। েএই মর্যাদা লাভের জন্য যেসব পন্থা-পদ্ধতি ও মাধ্যম নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে এই প্রশিক্ষণমূলক ও দাওয়াতী পোগ্রামে বের হওয়া তারই অংশবিশেষ।
কুরআন এবং তলোয়অর
ইসলাম বৈরাগীগণের অনাগ্রহ ও অনীহা চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে উপনিত হয়েছিলো। তারা ইমাম শহীদের মতামত নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে থাকে এই বলে যে, তিনি কুরআন ও তলোয়ারকে যথাক্রমে একত্রে সন্নিবেশীত করে দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য হলো, ইখওয়ান যখন বিশ্বাস করে যে, দ্বীন বলতে যুক্তি, প্রমাণ ও স্বাধীনতাকে বুঝায় তখন তলোয়ারের সাথে কুরআনের সম্পর্ক সৃষ্টি করার অর্থ কি? এই কুধারণা পোষণ কিংবা নির্বুদ্ধিতার অভিযোগ উত্থাপন এমন কোন ব্যক্তির জন্য শোভা পায় না, যার মধ্যে ন্যূনতম বিবেক-বুদ্ধি ও সুস্থ চিন্তাধারা রয়েছে। সমগ্র দুনিয়ার পর্যালোচনা করুন। মহাদেশগুলোর প্রতি লক্ষ করুন। এটা কি সত্য নয় যে, সকল দিক থেকেই শান্তি ও নিরাপত্তার বড় বড় দাবী করা হচ্ছে, বড় বড় সম্মেলন, প্রচার মাধ্যম এবং লেখকদের সবাই শান্তি জপ করছে।
শান্তির শ্লোগান ও যুদ্ধের প্রস্তুতি
আপনারা কি ইসরাঈল রাষ্ট্রের অবস্থান দেখছেন না? এ রাষ্ট্রটি তার সীমানার মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে জীবন যাপনের অধিকার কান্নাজড়িত কণ্ঠে দাবী করছে। এমন কোন দিন কি অতিবাহিত হয় যেদিন আমরা বিশ্বশান্তির ব্যাপারে সংবাদ ও গল্প প্রবন্ধ না পড়ে থাকি? দুনিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা এবং সেজন্য আগ্রহ ও সদিচ্ছা সম্পর্কে শুনে শুনে আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। এমন কি “বিশ্বশান্তি” কথাটিই এখন অন্তসারশূন্য মনে হচ্ছে। প্রত্যেক দেশের নেতৃত্বের অভিলাষীরা দ্বিধীহীন চিত্তে এর জপ করে থাকে।
এতদসত্ত্বেও দুনিয়ায় কি ঘটেছে? সমগ্র পৃথিবী ধ্বংসাত্মক ও মানবজাতিকে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে নির্মূলকারী অস্ত্রশস্ত্র উদ্ভাবন এবং লাভ করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। ধ্বংসের উপকরণ তৈরীর জন্য অজস্র টাকা পানির মত খরচ করা হচ্ছে। তথাপি প্রত্যেক জাতির শ্লোগান এটা কি যে, তারা শান্তি ও নিরাপত্তা এবং সম্প্রীতি ও সৌহার্দের পতাকাবাহী। কেন এত প্রয়াস প্রচেষ্টা? এসব কি এই কাল্পনিক আযাদী ও ঐ শান্তির প্রতিরোধের জন্য নয় যার গীত গাওয়া হয়ে থাকে? গোলাপ ফুল কাঁটার মুখাপেক্ষী হয় এ জন্য যে, তা তার নিরাপত্তা বিধান করে। ইসলাম শান্তির দ্বীন এবং শান্তির দিকে দাওয়াতের কর্মপদ্ধতি অবশ্যই দলিল-প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল।
(আরবী***********) (তুমি তোমার রবের দিকে মানুষকে হিকমত ও উত্তম নসিহতের সাহায্যে দাওয়াত দিতে থাকো এবং লোকদের সাথে এমনভাবে বিতর্ক কর যা সর্বোৎকৃষ্ট ও হৃদয়গ্রাহী হয়।)
রাসূলুল্লাহ (স)-এর আদর্শে উৎসর্গিত আমার পিতা-মাতা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দাওয়াতী কাজের সূচনা লগ্নে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। যদিও মুশরিকগণ ঈমানদারদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের নীতি অবলম্বন করেছিলো। এমনকি তাদের হত্যা করতেও ইতস্তত করছিলো না। সেই যুগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তার নির্যাতিত সাথীদের পাশ দিয়ে কোথাও যেতেন তখন বলতেন, “হে ইয়াসীরের পরিবারের লোকজন! সবরের রজ্জু অত্যন্ত কঠোরভাবে ধারণ কর। আমার এমন ক্ষমতা নেই যে, আমি এই অত্যাচার প্রতিহত করতে পারি। নিসন্দেহে তোমাদের এই পরীক্ষার বিনিময়ে তোমাদেরকে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।” আবার যখন তায়েফের বাজারগুলোতে সাকীফ গোত্রের লোকেরা তাঁর প্রতি পাথর বর্ষণ করেছিলো রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিলো তাঁর আপাদমস্তক তখন তিনি তার কোন পরোয়া করেননি। বরং তাঁর ঐকান্তিক কামনা ছিল তিনি যেন তাঁর রবের অসন্তোষের শিকার হয়ে না পড়েন। সকল অত্যাচার নির্যাতনে তিনি সবর অবলম্বন করেছিলেন। এমন কি শেষ পর্যন্ত তিনি হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং সেই শহরের অধিবাস গ্রহণ করলেন। যার মাটির জ ন্য এই সৌভাগ্র লিপিবদ্ধ ছিল যে, তার পবিত্র দেহ বক্ষে ধারণ করবে। এখানেই শেষ নয়, যে ঘর বাড়ী ছেড়ে দিয়েছেন আর দুশমনদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন। বরং শত্রুগণ এখানেও তাকে নিশ্চিন্তে বসার সুযোগ দেয়নি। এখানেও তারা তাকে হুমকি দিতে থাকে এবং তাঁকে ও তাঁর দাওয়াতকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য সদা তৎপর হয়। তার হিজরতের স্থানেও তারা আক্রমণ করে বসে এবং তখন দ্বীন এবং দ্বীনের ওপর ঈমান আনয়নকারীদের নিরাপত্তার জন্য অস্রহাতে আত্মরক্ষামূলক অভিযানে অগ্রসর হওয়া ব্যতীত অন্য কোন উপায় তাকে না। ইমাম শহীদের সম্মুখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই উত্তম আদর্শ ছিল। এই আদর্শের মধ্যে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, সত্যকে তার অস্তিতত্ব রক্ষার জন্য অবশ্যই শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ রয়েছে (আরবী*****) “তোমরা তোমাদের সাধ্যানুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করো---”।
এ ক্ষেত্রে আপনাদের এই বিষয়টি ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে, এই প্রস্তুতি হকের দুশমনদের সন্ত্রস্ত করা এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করার জন্য মাত্র। এর উদ্দেশ্য কখনো এটা নয় যে, আমা তাদের ওপর আক্রমণ করে বসবো। কিংবা অভিযান পরিচালনা করবো। এই প্রস্তুতির উদ্দেশ্র এও নয় যে এর সাহায্যে সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করা কিংবা লোকদের গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করা হবে।
তরবারী ধারণকারী বাহু
এটা লক্ষ্য করুন যে, আমাদের সরকার ইসরাঈলের সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছে এবং এই চুক্তি এখনও বলবৎ আছে। তারপরও আমাদের দেশের কি এমন প্রয়োজন যে সেনাবাহিনীকে ক্রমাগত সশস্র, সুসজ্জিত ও শক্তিশালী করে যাচ্ছে। এই সামরিক প্রস্তুতি কি কোন মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নেয়া হচ্ছে? কখ্খনো নয়। তা কিভাবে হতে পারে? যে বিপুল অর্থ আমাদের সেনাবাহিনীকে সুসজ্জিত করার জন্য ব্যয় করা হচ্ছে তাকি বাহুল্য ব্যয় কিংবা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক? না সহস্রবার নয়। বরং প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে প্রতিটি দেশের অধিবাসীদের এই অধিকার রয়েছে যে, যদি তারা জীবিত থাকতে চায় তাহলে শক্তি সঞ্চয় করবে যাতে বিরোধী জাতিসমূহ ভীত সন্ত্রস্ত থাকে এবং তার প্রতি হাত বাড়াতে কিংবা স্বাধীনতা সার্বোভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ করার দুঃসাহস না করে। ইমামও এসব কাজই করেছেন। মিসরের ওপর অন্যদের দুঃসাহস না করে। ইমামও এসব কাজই করেছেন। মিসরের ওপর অন্যদের আধিপত্য ছিল এবং পার্শ্ববর্তী ফিলিস্তিনকে ইহুদীরা পদদলিত করছিলো। তাই তিনি ভাবলেন মুসরিমদের এই বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন যে দুর্বল বেইজ্জত ও পরাজিত ইসরাম প্রত্যেক নেকড়ের মুখের গ্রাসে পরিণত হয়েছে এবং প্রত্যেক কোণ থেকে শত্রুরা এর ওপর হামলা করছে। ইসলামের কি এতই অসহায় অবস্থা যে আত্মরক্ষা পর্যন্ত করতে পারে না? যেদিন ইমাম শহীদ কুরআন মজীদকে দুইখানা তলোয়অরের মাঝে রেখে ইখওয়ানের পার্থক্য সূচক নিশান তৈরী করেন সেদিন তিনি উম্মাতের মুসলিমার সামনে এই সত্য সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিলেন যে এই পার্থক্র সূচক পতাকা যা দেখে ইসলামের শত্রুতা অসন্তুষ্ট- আজও আমাদেরকে আমাদের গৌরবোজ্জল সোনালী অতীতের সাথে যুক্ত করে দিতে পারে।
ইহুদীরা গোলান মালভূমির উপর জরবদস্তিমূলক অধিকার প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে। তারা গোটা লেবাননে রক্তপাত করে চলেছে। পশ্চিম তীর ও গাজা অঞ্চলকে ইহুদীবাদের রঙ্গে রাঙিয়ে তোলা হচ্ছে। মসজিদসমূহের অমর্যাদা করা হচ্ছে এবং মসজিদগুলোর স্থলে ইহুদী ইবাদাতখানা নির্মাণের ষড়যন্ত্র পাকা পোখত করা হয়েছে। সিনাই মরুভূমি সম্পর্কে ছেলে ভুলানো বুঝ দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তা আমাদের দখলে আসেনি। আর আমাদের শত্রুরা সেখানে সশস্ত্র একজন মিসরীয়কেও মেনে নেয়নি।
আমাদের শত্রুদের যেহেতু এটা স্থায়ী সংকল্প ও পরিকল্পনা তাই তাদের পরাভূত করাও শক্তি প্রয়োগ দ্বারাই সম্ভব। এ কারণেই ইমাম হাসানুল বান্না শহীদ দু’খানা তীক্ষ্মধার তলোয়ারের মাঝে কুরআন মজীদ রেখে উম্মাহকে এই চেতনা প্রদান করেন যে, ঈমান-আকীদার হিফাজতের জন্য জিহাদ অত্যাবশ্যক। এই প্রতীকের সাহায্যে তিনি এই অনুভূতিই জাগ্রত করেছেন যে, মুসলমানদের পৃথিবীর সকল মুসলিম অঞ্চলের স্বাধীনতার সংকল্প করতে হবে। যা এখনো অন্যদের গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ। এই প্রতীকের সাহায্য মিল্লাতে ইসলামীয়া, সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক সকল প্রকার গোরামীর জোয়াল ছুড়ে ফেলার শক্তি অর্জন করতে পারে। মুসলিমগণ যদি এ বিষয়টি হৃদয়ংগম করতে পারে তাহলে আল্লাহ তায়ালার বাণীর সত্য ও বাস্তবতার জীবন্ত নমুনা হয়ে দেখা দেবে।
(আরবী**************) (আর আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করো এমনভাবে যাতে জিহাদের হক আদায় হয়ে যায়)
আমাদের শত্রুরা আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য তারা সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করছে এবং প্রকাশ্য ও গোপনীয় যাবতীয় ক্ষমতা ইচ্ছামত আমাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করছে তবুও আমাদেরকে আল্লাহর শরীয়ত বাস্তবায়ন করা থেকে কোন কিছুই বিরত রাখতে পারবে না। আমাদের সযত্ন প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে এবং তা উত্তোরোত্তর আরো বৃদ্ধি পাবে ইনশাআল্লাহ।
পরাজয় আমাদের ভাগ্যলিপি নয়
আমরা দা’য়ী ইলাল্লাহ তথা আল্লাহর পথের আহবায়ক। আর একজন দা’য়ী কখনো পরায় বরণ করে না। শত্রুর নির্যাতন ও চক্রান্ত তাকে পরাভূত করতে পারে না। তবে দা’য়ী যদি আল্লাহ তায়ালার সত্য ওয়াদার প্রতি সন্দেহ পোষণ করতে থাকে কিংবা সেই অংগীকার ভংগ করার মানসিকতা পোষণ করতে থাকে যে, তিনি আল্লাহর দ্বীনের পতাকা উচ্চে তুলে ধরার লক্ষ্যে বাইয়াতের মাধ্যমে করেছেন তা হলে তার পরাজয় নিশ্চিত। কারণ বাইয়াতের এই ওয়াদা একটা স্থায়ী প্রতিজ্ঞা। মাঝে মধ্যে তার নবায়ন হয় মাত্র। এই চুক্তির উদ্দেশ্য কারো ওপর কোন জুলুম করা নয়। কিংবা তা শুধু তার সংগঠনেরই সুনাম সুখ্যাতির মাধ্যমও নয়। বিরুদ্ধবাদীগণ এরূপ ভিত্তিহীন অভিযোগ আরোপ করতে থাকে। প্রত্যেক ইখওয়ানী ভাই তার ভাই (মুর্শিদে আ’ম)এর হাতে এই বিষয়ের বাইয়াত করে থাকে যে, সে আল্লাহর পথে তার আনুগত্য করে চলবে। এই অংগীকার পূরণ করার জন্য কোন ক্ষমতাধর তাকে ধমক দিতে পারে না। আবার কোন অত্যাচারীও তাকে হতোদ্যম ও ভগ্নোৎসাহ করতে পারে না। এর কারণ শুধু এই যে, আমরা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সাথেই অংগীকারাবদ্ধ হয়েছি। তাই পার্থিব শক্তিসমূহ যদি তাদের পুরো শক্তি প্রয়োগ করে আমাদরে পথে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে সফল হয়েও যায় তবে এই কামিয়াবী হবে খুবই সীমিত ও অস্থায়ী। নিরংকুশ ক্ষমতার মালিক এবং প্রকৃত শাসকদের সম্মুখে কার ক্ষমতা খাটতে পারে? তাঁর ইচ্ছাকে কেউ ঠেকাতে পারে না। তিনি যা চান তাই হতে বাধ্য। তার দরকার প্রতিটি বিষয়কে অত্যন্ত প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণের সাথে বিন্যস্ত করা হয়ে থাকে।
কিয়ামত পর্যন্ত জিহাদ অব্যাহত থাকবে
দ্বীন জিহাদের দাবী করে। তাই আমাদের ইমাম কুরআন মজীদকে দু’খানা তলোয়ারের মাঝে সাজিয়ে আমাদের প্রতীক বানিয়েছেন। যতদিন পৃথিবীতে একজন ইখওয়ানীও জীবিত থাকবে ততদিন এই প্রতীক বিদ্যমান থাকবে। ইখওয়ানের এই ঈমান রয়েছে যে, ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের হিফাজত করতে হবে এবং এই আকীদার ওপর আক্রমণকারীদের মোকাবিলা করতে হবে। শক্তির এই প্রদর্শনী শুধু আত্মরক্ষার খাতিরে কারো ওপর জুলুম ও অত্যাচারের উদ্দেশ্রে নয়। এটা কত অদ্ভূত ব্যাপার যে, সারা দুনিয়াকে আত্মরক্ষার অধিকার দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর কোন ব্যক্তি তার অস্তিত্ব, তার দেশও তার ঈমান-আকীদার হিফাজতের ঘোষণা দিলেই তা হয়ে যায় মারাত্মক অপরাধ এবং তাকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করা হয়।
মনে হয় যেন শক্তি প্রয়োগ প্রত্যেক দ্বীন ও মানুষের জন্য বৈধ কিন্তু ইখওয়ানের জন্য নিষিদ্ধ। এখন দেখুন ইখওয়ানের নেতৃত্ব তার সংগঠনের ছাত্রদেরকে ইউনিভারসিটি ও কলেজসমূহে বিরোধী ছাত্রদেরকে মারপিট করার জন্য কখনো উৎসাহিত করেনি। অথচ অন্যদিকে সা’দাত ও তাঁর উত্তরসূরী শাসকগণ খোলাখুলিভাবে নির্দেশ দিতো যে, ইখওয়ানের সমর্থক ছাত্রদেরকে যে কোন উপায়েই হোক মারপিট করতে হবে। এতদসত্ত্বেও সরকারের তল্পীবাহী ও পেটুয়া ছাত্ররা কখনো ইখওয়ানী ছাত্রদের ওপর হাত তুলতে সাহস করেনি। এর কারণ এই যে, সরকার সমর্থক ছাত্রদের ইখওয়ানের শক্তি সম্পর্কেও ধারণা আছে এবং তারা এও জানে যে তাদের নিজেদের অবস্থা কি? এরূপ আচরণ যদি তারা কখনো করেও বসে তাহলে তাদের খুব ভালভাবেই জানা আছে যে, তার পরিণাম কি দাঁড়াবে। (ইখওয়ানী ছাত্ররা চুড়ি পরিধান করে বসে নেই।)
ভিত্তিহনি অভিযোগ
ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের একটা ঘোষণা খুবই বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। তিনি বলেছিলেন: “যেসব রাষ্ট্রপ্রধান, দল ও সংগঠন আমাদের আন্দোলনের বিরোধী আমাদের সংগ্রাম তাদরে সবার বিরুদ্ধে। আমাদের এই যুদ্ধ এমন যাতে কোন সন্ধি বা কোন যুব্ধবন্দী নেই। যতদিন পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা আমাদের ও আমাদের জাতির ব্যাপারে চূড়ন্ত ফায়সালা করে দেন।”
উক্তিটি এবং এরূপ আরো অসংখ্য উক্তি হিসেব নিকেভ না করে এবং প্রসংগ প্রেক্ষিত থেকে আলাদা করে আমাদের বিরুদ্ধবাদীগণ জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে থাকে। ইমামের কোন ভাষণ আলোচনা কিংবা লেখা বিকৃত করে তার মধ্যে নিজের স্বার্থের কথা বের করে নেয়া তাদের অর্জিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এর উদাহরণ হলো, কোন ব্যক্তির কুরআন মজীদ থেকে সালাত পরিত্যাগ করার দলিল প্রমাণ খুঁজে বের করার মত। আয়াতের পূর্বর প্রসংগ বাদ দিয়ে শুধু-----
(আরবী**************)
(হে ঈমানদারগণ! তোমরা সালাতের ধারে কাছেও যেও না।) এবং তারপর সাদাকাল্লাহুল আজিম বলে।
আমরা জানি যে কুরআন মজীদে কোন প্রকার স্থবিরোধিতা পাওয়া যায় না। বরং কোন কোন আয়াত অপর আয়াতের বিষয়বস্তু সুস্পষ্ট করে তুলে। অতএব কোন ব্যক্তি কোরআনের অংশবিশেষকে সমগ্র কিতাবে মুবীন থেকে বিচ্ছিন্ন করে তা থেকে ফলাফল গ্রহণ করতে চেষ্টা করে তাহলে তা হবে তার অজ্ঞতার প্রমাণ। এরূপ কর্মপদ্ধতি দ্বীনের জন্য বড়ই ক্ষতিকর।
ইভওয়ানের দাওয়াতের মূল উৎস হচ্ছে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এগুলোকে উপস্থাপন করার জন্য ইখওয়ান সহজ ও সুবোধ প্রক্রিয়া সাবলীল ও হৃদয়গ্রাহী ভাষা এবং সুস্পষ্ট ব্যক্তি প্রমাণের ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। অতএব বিবেক –বুদিত্ধ-সম্পন্ন কোন ব্যক্তি এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না যে, এ সংগঠন এবং কর্মীরা সন্ত্রাস ওশক্তি প্রয়োগের পথ অবলম্বন করবে। মূলত বিশুদ্ধ ভাষা ও ভাষাবিজ্ঞানের নীতিমালা সম্পর্কে অবগত লোকদের জানা আছে যে, লিখনী ও বক্তৃতায় সাদৃশ্য ও সমার্থবোধক শব্দাবীল, রূপক অর্থের ব্যবহার এবং উপমিতির প্রয়োগ হয়ে থাকে। কিন্তু শাব্দিক অর্থ কখনো এর মুল উদ্দেশ্র থাকে না। সুতরাং যখন আমরা বলি যে, কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধীদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম তখন তার অর্থ এটা করা হয় না যে, আমরা তাদেরকে উদ্যত তলোয়ারের নীচে ফেলে দিতে যাচ্ছি। বরং সোজা কথায় তার অর্থ দাঁড়ায় আমরা আমাদের ভাষা আমাদের লিখনী এবং আমাদের চেষ্টা-সাধনা দ্বারা সর্বদা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত। আর এটা একটা যুদ্ধই। কেননা লড়াই কেবলমাত্র ধ্বংসাত্মক হাতিয়ার দ্বারাই হয় না। বরং তার অসংখ্য পন্থা ও পদ্ধতি রয়েছে। যদি উপরোক্ত বাক্য দ্বারা অস্ত্রের লাড়াই বুঝে নেয়া হয় তাহলে জেনে রাখুন যে, আমাদের কাছে প্রথমত গোলাবারুদ, জাহাজ এবং অন্যান্য যুদ্ধোপকরণ নেই যে, তার সাহায্যে আমরা পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর মোকাবিলায় লড়তে পারি। আর যদি এসব সাজ-সরঞ্চাম আমাদের কাছে থেকেও থাকে তবুও আমরা সেগুলো কোন মুসলিমের দিকে তাক করবো না, তারা আমাদের বিরোধী হলেও। আমরা তা শুধু ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করবো। যদি আপনি কোন পাহাড়ী আরবের কথাবার্তা শুনেন তা হলে হয়ত লক্ষ্য করে থাকবেন যে, সাধারণত ঝ গড়া বিবাদের ক্ষেত্রেও তারা বলে যে, “কাতালানি কাতালতুহু” যার আক্ষরিক অর্থ সে আমাকে হত্যা করেছে আমিও তাকে হত্যঅ করেছি। কিন্তু তার এই কথার এরূপ অর্থ কখনো উদ্দেশ্য নয় বরং এর মর্মার্থ হবে কেবল এই যে, সে আমাকে মেরেছে আমিও তাকে প্রহার করেছি।
যদি কোন লোক বলে যে, “আমিআমার প্রতিপক্ষকে বোবা বানিয়ে ছাড়বো।” তাহলে আপনি কি তার অর্থ গ্রহণ করবেন এই যে, সে তার জিহবা কেটে দেবে যাতে সে বাকশক্তিহীন হয়ে যায়। এই অর্থ গ্রহণ করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
আমরা যখন আমাদেরদাওয়াতের উল্লেখ করি এবং আমাদের দুশশনদের মোকাবিলা করার জন্য শপথ গ্রহণ করি এবং তখন তার অর্থ এই যে, আমরা এই পুতঃপবিত্র পয়গামের প্রচর ও প্রসার ঘটানোর ইচ্ছা পোষণ করছি এবং বীরত্বপূর্ণ শব্দাবলী ব্যবহার করে ইসলামের প্রতি আমাদের বিশ্বস্ততার প্রকাশ করছি। শব্দের গোলকধাঁধা সৃষ্টিকরী ও অপব্যাখ্যাকারীদের কথা ছেড়ে দিন। এ ব্যাপারে আপনি আমাদের সাথে একমত হবেন যে, মানুষ অনেক সময় “ঠিক আছে” কথাটা মুখে উচ্চারণ করে। শব্দ একই হলেও তা বহু অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এসব অর্থ সুনির্দিষ্ট করার জন্য দেখতে হবে। বক্তা কোন্ পরিবেশ পরিস্থিতিতে ও প্রেক্ষাপটে শব্দটি প্রয়োগ করেছেন এবং তা বলার ভংগি কি ছিল। এই শব্দ দ্বারা আপনি কাউকে হেয় এবং তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারেন। কারো সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করতে পারেন। আবার হুমকি প্রদানের ভাবও প্রকাশ করতে পারেন।
ইখওয়ানের দাওয়াতী শরীয়াতের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন
ইমাম হাসানুল বান্না শহদি জীবনের সকল ক্ষেত্রে শরীয়াতের ইলাহিয়ার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের দাওয়াত নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হন। এই শরীয়াতের শিক্ষামালা থেকে তিনি বিন্দুমাত্র সরে যাওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না। শরীয়াত ডিকটেটরশীপকে আদৌ সমর্থন করে না। বরং তার বিরুদ্ধে লড়াই করার উদাত্ত আহবান জানায়। ইসলামে জোরজবরদস্তি ও বল প্রয়োগের কোন স্থান নেই। আল্লাহ তায়ালা দ্ব্যার্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন। “যার ইচ্ছা ইমান কবুল করুক আবার কেউ চাইলে কুফুরীর পথে চলতে থাকুক।” (প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মফল ভোগ করবে) আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলে মাকবুল (স)-কেও নির্দেশ দিয়েছিলেন, “আপনি কি মানুষকে ঈমান গ্রহণ করতে বাধ্য করবনে? এমন সুস্পষ্ট হিদায়াতের পরও কি হকের পথের কোন আহবানকারী এক নায়কত্বের স্বপ্ন দেখতে পারে? হাসানুল বান্না ইসালামী ডিকটেটরশীল প্রতিষ্ঠার অভিলাষী ছিলেন এই জঘন্য অভিযোগের কি কোন মূল্য আছে? কোন সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মুমিন কি দুষ্কর্মশীল জালিমদের একনায়কত্ব ও স্বৈরচারকে নেককার ও পবিত্র ঈমানদারদের শূরার সাথে একাকার করতে পারে? আমাদের কাছে আছে ইসলামের শূরায়ী ব্যবস্থা একনায়কত্ব যার ধারে কাছেও ভিড়তে পারে না।
এরূপ অসুস্থ মন-মানসিকতার কোন চিকিৎসা সম্ভবই নয় যা দিনের দিবালোকের ন্যায় সত্যকে অস্বীকার করে। ইসলাম বিরোধী শক্তি মিথ্যাচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রপাগান্ডা থেকে কখনো ফিরে আসার নয়। তারা ইখওয়ানুল মুসলিমুনের অত্যন্ত কুৎসিত চিত্র অংকন করে থাকে। কেননা এই আন্দোলনই তাদের জন্য পেরেশানী ও অশান্তির কারণ। এই আন্দোলন তাদের আরামে ঘুম হারাম করে দিয়েছে এবং তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। যতদূর পর্যন্ত আমাদের কাজ-কারবার ও কর্মতৎপরতা রয়েছে- সর্বত্রই আমরা আমাদের অবস্থান পুরোপুরি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছি। তদুপরি আমরা কখনো এমন দাবীও করি না যে, ইসলামী দাওয়াতের ওপর আমাদের ঠিকাদারী রয়েছে বরং আমরা অসংখ্য ইসলামীসংগঠনের মধ্যেকার একটা মাত্র। এই ময়দানে আমরা ছাড়াও বহু ইসলামী জামায়াত কর্মতৎপর রয়েছে। অবশ্য যে বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করে আমরা আমাদরে মানসিক সান্ত্বনা খুঁজে পাই। তা হচ্ছে এই, আমরা ইসলামের শত্রুদের চোখের কাঁটা হয়ে বিদ্ধ হচ্ছি। আর এটাই প্রমাণ করে যে, আমরা আল-হামদুলিল্লাহ রাহে হকের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত রয়েছি। বিশ্বব্যাপী ক্রুসেডবাদী, সমাজতন্ত্রী ও ইহুদীবাদী শক্তিসমূহ আমাদের সাথে যে পরিমাণ বৈরিতা পোষণ করে তার কোন তুলনা মেলে না।
আমরা নির্দ্বিধায় ঘোষণা করছি যে, আমাদের আহ্বান ইসলামের সঠিক শিক্ষার দিকে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান। দুনিয়ার যে কেউ িএই মহান উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সচেষ্ট হোক আমরা তার নগণ্য সিপাহী এবং এই উত্তম কাজে যে কোন ব্যক্তির সাথে পুরোপুরি সহযোগিতা করার জন্য সদাপ্রস্তুত রয়েছি। আমরা এরূপ প্রত্যাশা কখনো করিনি যে, নেতৃত্ব কর্তৃত্বের দায়িত্ব আমাদেরকে দিতে হবে। বিগত পার্লামেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে তখন প্রতিটি রাজনৈতিক দল নিজ নিজ নির্বাচনী মেনিফেষ্টোতে সর্বপ্রথম এই অংগীকার ব্যকরে করে যে, তারা দেশে ইসলামী শরীয়াতের বাস্তাবায়ন চায়। সত্য বলতে কি এই গঠনমূলক পরিবর্তন দেখে আমাদের অন্তর আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে যায়। এখন নির্বাচন শেষ হয়ে গেছে। তাই এখন বাস্তবে প্রমাণিত হবে যে, কারা ইসরামী অভিব্যক্তির ব্যাপারে নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক ছিল আর কারা ইসলামকে শুধু নির্বাচনী শ্লোগান রূপে ব্যবহার করছিলো। জনসাধারণ শীগ্রই এটা জেনে ফেলবে যে, ইসলামের ব্যাপারে একান্ত নিবেদিত প্রাণ ও বিশ্বস্ত কারা আর কারা ইসলামকে ভোট লাভের হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করে। যদি প্রকৃতই এসব রাজনৈতিক দলের অবস্থা এই হয় তা হলে প্রশ্ন হচ্ছে তাদের পত্র-পত্রিকা ও সাহিত্য সাময়িকী প্রতিদিন ইখওয়ানের প্রতি কেন কাদা নিক্ষেপ করে?
এই ভদ্রলোকদের সম্পর্কে অনেক কিছুই প্রকাশ করা যায় কিন্তু ইখওয়অনের কর্মনীতি এ নয় যে, এরূপ নিরর্থক কথাবার্তা এবং বেহুদা অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে তারা তাদের মূল্যবান সময় অপচয় করবে। তদুপরি আমরা চাইনা যে, আমাদের মুখের ভাষা কিংবা কলম দ্বারা কখনো এমন কোন কথা প্রকাশিত হোক যা প্রতিশোধ গ্রহণের পর্যায়ে পড়ে এবং এভাবেকারো অন্তরে আঘাত লাগুক। আমরা আত্মরক্ষা করতে গিয়েও কখনো নৈতিকতা বিবর্জিত এবং অশালীণ কোন কথা মুখে উচ্চরণ করি না।
আমাদের আকাংখা এই যে, আদম সন্তানের মধ্যে আমরা উত্তম চরিত্র ও শ্রেষ্ঠ কর্মের আদর্শ উপস্থাপন করবো। আদম আলাইহিস সালামের দু’সন্তানের আলোচনা করা হয়েছে কুরআন মজীদে।তাদের একজন অপরজনকে হত্যা করার হুমকি দেয়। প্রত্যুত্তরে সে বলে, “যদি তুমি আমাকে হত্যা করার জন্য হাত বাড়াও আমি কিন্তু তোমাকে হত্যা করার মত কোন কাজ করবো না।” এটাই আমাদের কর্মনীতি। আমরা কারো সাথে অসদাচরণ করি না। আমাদের হাতের ও মুখের অত্যাচার থেকে সকল আদম সন্তান সম্পূর্ণ নিরাপদ। অবশ্য কোন জালিম যখন প্রতি অকারণে তার জুলূমের হাত প্রসারিত করতে উদ্যত হয় সেক্ষেত্রে আসমানী ও পার্থিক তথা আল্লাহ প্রদত্ত ও মানব রচিত সকল আইনের দৃষ্টিতেই আমাদের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। তথঅপি আমরা সাধারণ মানুষের ন্যায় কখনো প্রতিশোধ গ্রহণের চিন্তা করি না। প্রতিশোধ গ্রহণেচ্ছুদের অবস্থা দাঁড়ায় এই যে, তারা সীমালংঘন করে বসে। গমের সাথে কীট পতংগকেও পিষে ফেলে। কিন্তু আমরা এরূপ নই। আমাদের অবস্থা হচ্ছে, ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের ভাষায় (আরবী********) অর্থাৎ আমরা জালেমদের বিরুদ্ধে কাদেরে মতলকের কুদরতে কামেলার তীর ও শেষ রাতের বিনম্র দোয়ার দ্বারা সাহায্য প্রার্থনা করি।
আর আমাদের এই হাতিয়ার কোন তেজ বীর্যহীন ভোঁতা অস্ত্র নয় বরং এর কার্যকারিতা প্রমাণিত। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা বুঝে উঠতে পারে না। আল্লাহ প্রেরিত কিতাবের ওপর ঈমান আনয়নকারী লোক তারাই যাদের সম্মুখে কোন আয়াত পেশ করা হলে তারা একান্ত বিনয়াবনত হয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং সৃষ্টিকর্তার মহত্ব ও অসীম ক্ষমতার তাসবীহ জপ করতে থাকে। অতপর তাঁর মোকাবিলায় কখনো তারা অন্যায ও অহংকারের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় না।
আমি এতক্ষণ যা বললাম তার কিছু প্রমাণও পেশ করছি। ইখওয়ানের “আন নাজির” সাময়িকী মে ১৯৩৮ সালে প্রথম বারের মত প্রকাশিত হলে তাতে এই মর্মে দু’টো সুস্পষ্ট বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয় যে, ইখওয়ান রাজনৈতিক ময়দানে হাজির হয়েছে। সর্বস্তরের মানুষের নিকট এই বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, আমরা অন্যান্য দলের মোকাবিলা করবো শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উপায়। কোন প্রকা সন্ত্রাসমূলক কিংবা অপরাধী কর্মতৎপরতায় লিপ্ত হবো না। আমাদের এই রাজনৈতিক কর্মকান্ড দেশের ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং আমরা এই তৎপরতাকে দেশের বাইরেও ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছিলাম। আমাদের প্রোগ্রাম ছিল অনেকটা বিশ্ব ইসলামী আন্দোলন গড়ে তোলার। এখন কোন নির্বোধ কেবল এটা মনে করতে পারে যে, আমরা প্রচার প্রপাগান্ডা এবং দাওয়াত ও তাবলীগের পরিবর্তে পুরো দুনিয়ার বিরুদ্ধে কামান ও গোলা-বারুদ নিয়ে লড়াই বাধাতে যাচ্ছি। “আন নাজির” –এর প্রতিটি পৃষ্ঠা সাক্ষী যে, আমাদের বিরুদ্ধবাদীদের ম ত আমাদের হাতিয়ার অশালীন বক্তব্য ও রক্ত চক্ষু নয় বরং হিকমতের ও কৌশল, উত্তম নসিহত, নম্রতা-ভদ্রতা, সবর ও ধৈর্য।
কোন বিবেকবান ও বুদ্ধিমানব্যক্তির বন্য এটা শোভনীয় যে, তিনি ইখওয়ান সম্পর্কে ধারণা পোষণ করবে যে আমরা ইসলামের সঘন্যতম দুশমন রাশিয়অ ও আমেরিকার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছি। লড়াইয়ের জন্য আমাদের কাছে বস্তুগত সরঞ্জাম কোথায়? মানুষের হয়েছে কি? তারা কি ধরনের ধারণা পোষণ করে এবং কি ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রকৃত কথা হচ্ছে তাদের বিবেকের অপমৃত্যু ঘটেনি। কিন্তু বিদ্বেষ তাদেরকে অন্ধ করে দিয়েছে। এই বিদ্বেষ ও পক্ষপাতিত্ব তাদেরকে সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ দেয় না। বরং তাদেরকে নিশ্চিত ধ্বংসের গভীর পঙ্কে নিক্ষেপ করে। যেখানে তাদের কখনো শান্তি ও স্বস্তি নসীব হবে না। আমরা আমাদের প্রতিপক্ষের কাছে অন্য কোন প্রকার ছাড় প্রত্যাশা করি না। আমরা শুধু তাদের নিকট ইনসাফ ও সুবিচার প্রত্যাশা করি অবশ্য যদি ইনসাফ ও সুবিচার শব্তের অস্তিত্ব তাদের অভিাধানে থেকে থাকে।
আইন আমাদের ও আমাদের বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে ফয়সালা করে সত্য কিন্তু ইনসাফের দাবী পূরণ করতে পারে না। যদি চুলচেরা বিশ্লেষণ করা যায় এবং সরকারী কোন চাপ ব্যতীত ইনসাফ এবং ন্যায়বিচারের নীতি গ্রহণ করা হয়। সাথে সাথে অত্যাচার নির্যাতন ও জুলুম নিপীড়নের কুটকৌশল প্রয়োগ না করে প্রকৃত সত্য উদ্ধারের জন্য বস্তুনিষ্ঠ উপায়ে অনুসন্ধান চালানো হয় এবং অতপর রায় ঘোষণা করা যায় তাহলে সমালোচকদের অধিকার থাকবে যা ইচ্ছা তা বলে বেড়ানোর অবশ্য তাদের দাবীর স্বপক্ষে নির্ভরযোগ্য দলীল থাকতে হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কোথায় ইনসাফপূর্ণ ফায়সালা করা হয়েছে? অতএব আমাদরে বিরুদ্ধাচরণের দিশেহারা লোকদের কাল্পনিক অভিযোগ, মনগড়া কাহিনী এবং ভিত্তিহীন প্রপাগান্ডা চালানোর স্বাধীনতা রয়েছে তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। আমাদের মালিকের ফায়সালা হচ্ছে তিনি ফিতনা ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের কথা ও কাজের কখনো সফলতা দান করেন না। তাদের চারদিকে আল্লাহ তায়ালাই আমাদের সকল কর্মসম্পাদনকারী এবং তিনিই সাহায্যকারী। তাঁর সাহায্য সহযোগিতার পর আর কারো প্রয়োজনও আমাদের নেই।
সুধী পাঠকমন্ডলী। পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে ইনশাআল্লাহ দেখতে পাবেন, ইমাম হাসানুল বান্না শহীদ গণতন্ত্রের ওপর আস্থাশীল ছিলেন কি না। অনুরূপ এ বিষয়টিও সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করার জন্য ইমাম কি কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। তাঁর নিকট ক্ষমতার দন্ড লাভ করা নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্য কখনো ছিল না। তিনি সংস্কার ও সংশোদনের মহৎ উদ্দেশ্যে ক্ষশতা ও কর্তৃত্ব গ্রহণের পক্ষপাতি ছিলেন।
আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিতে চাই যে, দুনিয়ার যে কোন ব্যক্তি এবং দলই শরীয়াতে ইসলামী প্রবর্তনের জন্য প্রাণচঞ্চল ও কর্মতৎপর হয় আমরা তার অনুপম পৃষ্ঠ পোষক ও সাহায্যকারী। সেজন্য বুদ্ধি, জ্ঞান এবং উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রয়োজন। পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বেই তা ঠিক আছে কি না দেখতে হবে। কেননা তড়িঘড়ি এবং আবেগের কারণে অনেক সময় সিদ্ধান্ত ভুল হয়ে যায়। যার ফলে শরীয়াতের প্রতি ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হওয়ার আশংকা থাকে। আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি কাজই বুঝে শুনে করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আমরা ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের নিকট থেকে শিখেছি যে, দাওয়াত ও ইরশাদের কাজে এই আধুনিক যুগের দাবীকে বিবেচনা রাখতে হবে। বর্তমান সময়ে ঐ সকল কর্মপদ্ধতি ও উপকরণ যা বিগত দিনে কার্যকরী ও সুফলদায়ক ছিল- অকেজো হয়ে পড়েছে। তাই হকের আহবানকারীর কর্তব্য হলো তাঁকে বর্তমান সময়ের সকল উপায় উপকরণকে কাজে লাগাতে হবে। নাটক, সিনেমা, এবং টেলিভিশন আমাদের যুগের অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার। শয়তান এগুলোকে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। অথচ এসব হাতিয়ারকে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। আমাদের যুগ নতুন নতুন মতবাদ ও চিন্তাধারার যুগ। জনসংযোগ ও প্রচার প্রপাগান্ডায় এসব মতবাদ ও দর্শনের ব্যপ্তি ও বিস্তৃতি ঘটানোর ক্ষেত্রে খুবই ফলপ্রসু ভূমিকা পালন করে। এই ময়দানে ইসলামের দায়ীগণকে দক্ষতা ও ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে হবে। ইসলামী দাওাত জীবনের সকল দিক ও বিভাগের সর্বত্র পরিব্যপ্ত। মানুষের নিকট আমাদের এই দাবী যে তারা যেন আল্লাহর কিতাবকে বুঝতে সচেষ্ট হন যাতে বিস্তারিতভভাবে ইসলামকে জানতে পারেন।
ইমাম হাসানুল বান্না এবং তাঁর পূর্ববর্তী দায়ীগণ আমাদেরকে এ শিক্ষাই দিয়েছেন যে, দ্বীন ইসলামের মূল উৎস হচ্ছে কুরআন মজীদ। সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ (স) কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। নবী করীম (স)-এর জীবন চরিত ও সুলাহায়ে উম্মাতের চরিত্র সুকৃতির আনুগত্য ও দুষ্কৃতির প্রতিরোধের বাস্তব উদাহরণ পেশ করে। অতএব এই মূলনীতির আলোকে বিশ্বব্যাপী দাওয়াতী অভিযানসমূহের মধ্যে থেকে যারা আমাদের ভূমিকার সাথে ঐকমত্য পোষণ করবে আমরা তাদেরকে স্বাগত জানাবো আর যা এই নীতিমালার পরিপন্থী হবে তা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
অষ্টম অধ্যায়
আমরা প্রাচ্যের অধিবাসীরা সাম্রাজ্রবাদী দাসত্বের প্রভাবাধীন জাতীয়তার খুবই ভুল অর্থ বুঝে থাকি। এইঅর্থ ইসরাম থেকে বহু দূরে নিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশসমূহে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং পাবলিক বক্তারা এর আলোচনায় মুখর থাকেন।
এই বিষয়ে ইমাম শহীদ একটা বিশেষ নিবন্ধ রচনা করেন। তিনি যা লিপিবদ্ধ করেছিলেন তার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল এইযে, যদি দেশপ্রেম ও জাতীয়তার অর্থ এই হয় কোন ব্যক্তি যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছে এবং যেখানকার আলো বাতাস ও নিয়ামত রাজি ভোগ করে সে বেড়ে উঠেছে সে দেশকে সে ভালবাসবে তাহলে তা কোন শরীফ ব্যক্তি অস্বীকার করবে না। এই মতাদর্শ সাদরে গ্রহণ করার মত। অনুরূপ যদি জাতীয়তা ও দেশ প্রেমের অর্থ করা হয় কোন ইসলামী রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করে তার জনগণকে তাদের অধিকার ও মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়া এবং সে জন্য বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করার আহ্বান জানানো হয় তাহলে তা হবে এমন আহ্বান ইসলাম যার শিক্ষা দিয়ে থঅকে। প্রত্যেক নিষ্ঠাবান মুসলিম এ ধরনের আহ্বানকে স্বাগত জানায়। আবার যদি দেশ প্রেমের আবেদ ব্যবহার করে মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলা উদ্দেশ্য হয় যেন তারা একটা শক্তিতে পরিণত হয়ে তাদের ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আগ্রাসন পরিচালনাকারীর পথে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। তবে তার চেয়ে ভাল কাজ আর কি হতে পারে? ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও বিজয় প্রতিষ্ঠা করার প্রতিটি প্রচেষ্টা এবং এই রাস্তায় অগ্রগামী প্রতিটি পদক্ষেপ শত সহস্র প্রশংসার অধিকারী। এরপর থাকে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সেসব প্রপাগান্ডা ও প্রচরণা যার বুনিয়াদ গড়ে ওঠে এমন কোন দল বা জাতীয়তার ওপর ভিত্তি করে যা অন্যদের তুলনায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার তবে জেনে রাখুন এমন জাতীয়তা ও দেশ প্রেমের সাথে ইখওয়ানের দূরতম কোন সম্পর্কও নেই।
এ চিন্তাধারা কোন কোন সংবাদপত্র, সাময়িকী এবং রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে খুব ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। একে অন্যের ওপর মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করা এবং জাতিকে শতধা বিভক্ত করে ফেলা। এ ছাড়া এর আর কোন লাভ নেই। এই বিপজ্জনক প্রবণতা প্রকৃত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে জাতির দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিরর্থক বিষয় নিয়ে পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ির সৃষ্টি করেছে। এটা আমাদরে শত্রুদের একটা ষড়যন্ত্র। তারা এভাবে আমাদেরকে দুর্বল করে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করে। আমাদের সামনে উননত দেশসমূহের রাজনৈতিক দলসমূহের দৃষ্টান্ত রয়েছে। রাজনৈতিক মতবিরোধ এবং পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও তারা ককনো একে অন্যের ওপর দেশদ্রোহিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আরোপ করে না। তাদের পলিসি পরস্পর থেকে ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং দেশের নিরাপত্তার বিষয়টি সকলের কাছে সমান বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।
মহান সন্তানের পরাজয়
আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, বিশ্বযুদ্ধে চার্চিল বৃটেনকে বিজয়ের গৌরবে গৌরবান্বিত করেন। দেশবাসী এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে যথাযোগ্য ভক্তিশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং তাঁকে তার উপযুক্ত মর্যাদা দান করে। তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে কনজারভেটিভ, লেভার ও লিবারেল সব পার্টিই ছিল একমত, তা সত্ত্বেও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সারা দেশে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে জাতি এই মহাবীরকে ক্ষমতার মসনদ থেকে বঞ্চিত করে। ভোটদাতারা জানতো যে, যুদ্ধকালীণ সময়ের দাবী শান্তিকালীণ সময়ের দাবী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে থাকে। এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঐ জাতি তাদের উপকারীদের যথোপযুক্ত সম্মানদিয়ে থাকে সত্য কিন্তু অন্ধ অনুসরণের মাধ্যমেদেশ ও জাতির স্বার্থকে বীর পূজার যুপকাষ্ঠে বলি দেয় না। এটা জাগ্রত বিবেক ও সতর্কতার চমৎকার এক অনুপম দৃষ্টান্ত। আমরা পশ্চাত্যের অনুকরণ করি ভুল ও অর্থহীন বিষয়ে। আহ! আমরা যদি তাদের এই ভাল দৃষ্টান্তের অনুসরণ করতাম!
মু’মিনগণ একে অপরের ভাই
ইখওয়ানের দৃষ্টিতে ঈমান ও আকীদার ভিত্তিতে দেশ প্রেম এবং জাতীযতার সীমা নির্ধারিত হয়ে থাকে। ভৌগলিক সীমারেখা দ্বারা নয়। প্রতিটি মুসলিম দেশকে আমরা আমাদের নিজেদের দেশ বলে বিশ্বাস করি। আমরা ইসলামী রাষ্ট্রের জিহাদ এবং তার সীমান্ত রক্ষার ঘোষণা দিয়ে থাকি। কেননা আমাদের ঈমান আকীদার বুনিয়াদ হচ্ছে আল্লাহর কিতাব যা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করছে:
“এই মুসিলম জাতি একই জাতি। আর আমি হচ্ছি তোমাদের রব। অতএব আমাকে ভয় করো।”
আমরা একথা কখনো মেনে নিতে পারি না যে, কোন মুসলিম জাতি অন্য কোন মুসলিম জাতির ভৌগলিক এলাকা দখল করতে পারে। গোলাম বানাতে পারে কিংবা জোরপূর্বক নিজেদের ইচ্ছা তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে। প্রতিটি দেশে বসবাসকারী মুসলিম জনগোষ্ঠী তাদের নিজেদের ব্যাপারে ভালভাবে বুঝেন। যেমন প্রবাদে বলে: “মক্কার লোকেরাই মক্কার অলি গলি পাহাড়-পর্বত সম্পর্কে অবহিত।” আমরা সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরোধী এবং ইসলামী খেলাফতের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক। ইসরামী খেলাফতই পারে মুসলিম উম্মাকে তাদের শতধা বিচ্ছিন্ন অবস্থা দূরে করে সবাইকে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করতে এবং এভাবে পৃথিবী নামক গ্রহের ওপর এই কোটি কোটি মুসলিমকে একটি শক্তিতে রূপান্তরিত করতে।
মানুষ প্রথমে আমাদেরকে বুঝতেই পারেনি। আবার বুঝে থাকলেও ভুল বুঝেছে। আমরা দেশপ্রেম েএবং নিজেদের দেশ ও জাতির মঙ্গল চিন্তায় সমস্ত মানুষ থেকে অধিক নিবেদিত প্রাণ ও অকৃত্রিম। আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রত্যাশী। আর যদি সেই মহান সত্তা আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট না হন তাহলে আর কারো অসন্তুষ্টির কোন পরোয়া আমরা করি না। আমাদের সম্পর্কে অমূলক ধারণা পোষণ করা হয়ে থাকে অথচ আমরা সুস্পষ্টভাবে বলে থঅকি যে, ইসরাঈলের অস্তিত্ব লাভ কি সম্ভব ছিল যদি উম্মাতে মুসলিমা ঐক্যবদ্ধ হতো এবং একই নেতৃত্বে (খেলাফতে ইসলামীয়া)-এর নেয়ামত সে হাসিল করতে পারতো। তখন কি আর ইসরাঈল ও তার সহযোগী ফিলিস্তিন, সিরিয়া এবং লেবাননে সেসব কিছু করতে পারতো যা তারা বর্তমানে নির্লজ্জের মত করে যাচ্ছে। এখন অপেক্ষা করে দেখতে থাকুন আরো কত কি ঘটে। মুসলিমরা যদি এভাবে শতধা বিভক্ত থাকে তাহলে শত্রুরা আরো এক হাত দেখাতে থাকবে।
রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন ও ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও উত্তর আমেরিকার বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্ররাষ্ট্র এক জনরাষ্ট্র প্রধানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। কিন্তু অমুসলিমদেরকে এতটা সংগঠিত ও প্রশংসনীয় অবস্থায় দেখতে পাওয়া সত্ত্বেও মুসলমানদের সামান্য বিবেকবোধও কেন জাগ্রত হয় না? বস্তুত এটা খুবই সাদামাটা কথা কিন্তু বিবেক-বুদ্ধিকে কাজেই লাগানো হয় না। প্রবৃত্তি ও লালসা বিবেক-বুদ্ধির ওপর পর্দা টেনে দিয়েছে।
তোমরা সবাই আদমের সন্তান আর আদম ছিলেন মাটির তৈরী
জাতীয়তার ব্যাপারে ইখওয়ানের ধারণা অত্যন্ত স্পষ্ট। এই ধারণা আমরা ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের শিক্ষা থেকে লাভ করেছি। ইমাম আমাদেরকে কুরআন মজীদ, সুন্নাতে রাসূল (স), খোলাফায়ে রাশেদীন (রা) ও সালফে সালেহীনদের ইজমার আলোকে প্রদান করেছেন। আমাদের মতে জাতীয়তার ভিত্তিতে ইসলাম। আমরা বলে থাকি ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে সামষ্টিক স্বার্থই আমাদের লক্ষ্য। সমগ্র ইসলামী দুনিয়ার প্রতিরক্ষা এবং তার হেফাজতের জন্য জিহাদ এবং ত্যাগ আমাদের জাতীয় শ্লোগান। জাতীয়তার ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্তুগত ধারণা আমরা অস্বীকার করি। মানুষকে আর্য, ল্যাটিন অথবা অনুরূপ অন্যান্য কোন জাতি-গোষ্ঠীগত বিভক্তির ওপর ভিত্তিশীল জাতীযতা আমাদের কাছে চরম অপছন্দনীয় জাতি” বলে মনে করে। আমরা বিশ্বাস করি যে, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একই আদি পিতা আদমের সন্তান আর আদম আলাইহিস সালামকে তৈরী করা হয়েছিল মাটি থেকে। মানুষের মধ্যে তাকওয়া ব্যতীত আর কোন পার্থক্য নেই। যিনি যত বেশী মুত্তাকী তিনি ততবেশী শ্রেষ্ঠ। সুধী পাঠক! আপনি হয়তো এ আলোচনা থেকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন যে, আমাদের এবং বস্তুবাদীদের জাতীয়তার ধারণায় কত বিরাট ফারাক বিদ্যমান।
ইখওয়ানের ফিক্হী দৃষ্টিভংগী
এরপর থাকে মুসলমানদের ফিক্হী মতপার্থক্যের বিষয়টি। এ ব্যাপারেও আমাদরে মতামত অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আমরা মনে করি চার ইমাম অর্থাৎ ইমাম আবু হানিফা (র), ইমাম মালেক (র), ইমম শাফেয়ী (র) ও ইমাম আহম্মদ (র) ইসলামী আইন এবং ফিকহার মূলনীতি ও ভিত্তি সম্পর্কে একে অপরের সাথে একমত এবং এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোন মতানৈক্য নেই। কোন মতানৈক্য থাকলে তা আছে শুধুমাত্র শাখা-প্রশাখা ও খুঁটি-নাটি বিষয়ে। অনুরূপ বিভিন্ন মাযহাব তথা চিন্তার অনুসারীগণ যদি ফিকাহ্ বিষয়ক এই বিভক্তিকে উম্মাতের মধ্যে মতপার্থক্য ও শত্রুতার ভিত্তি না বানায় তাহলে এই ধরনের ফিকহী মতভেদকে আমরা স্বাগত জানাই। সমস্ত ইসলামী সংগঠন আমাদের কাছে সম্মানের যোগ্য, প্রত্যেকেই নিজ নিজ গন্ডি ও পরিমন্ডলে সুকৃতি কল্যাণের ব্যপ্তি ঘটানোর কাজে নিয়োজিত। যদি কোন বিষয়ে তাদের সাথে আমাদের মতপার্থক্য হয়েও যায় তবুও তা অপবাদ আরোপ, কুধারণ পোষণ অথবা শত্রুতার রূপ পরিগ্রাহ করতে পারে না। বর্তমান রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতি আমাদের কোন বিদ্বেষ নেই। আমরাশুধু তাদের কর্মপন্থার সাথে দ্বিমত পোষণ করি। তাদের কর্মপদ্ধতি হচ্ছে িএই যে, তারা তাদের সকল কথা ও কাজকে সঠিক মনে করে এবং অন্যদেরকে তা মানানোর জন্য যে কোন পন্থা ও কৌশল অবলম্বন করে এবং সাথে সাথে তাদেরকে বিরোধীদের সব কথার অবশ্যই বিরোধিতা করতে হয়। এসব পার্টি যেদিন এই নীতি ত্যাগ করে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ(স) এর দিকে প্রত্যাবর্তন করবে সেদিন আমরাও তাদের সাথে কোন ব্যাপারে মতপার্থক্য করবো না।
আমরা মুসলিম। ভাই আমরা কখনো এইরূপ ইচ্ছা করিনি যে, কারো ওপর জুলূম করে বসি। আমাদরে সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ চিন্তা এই যে, সমগ্র উম্মাতে মুসলিমাহ ইসলামী শরীয়াতের অনুসারী হয়ে ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত হোক।
ইসলামে অমুসলিমদের অধিকার
আমাদের অমুসিলম ভাইয়েরাও আাদের নিকট সম্মানের পাত্র। তাদের ব্যপারে কুরআন মজীদে আমাদেরকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে যে, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দিতে হবে। তাদের দ্বীনকেও কুরআন দ্বীন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (আরবী*****) “তোমাদরে জন্য তোমাদের দ্বীন আর আমার জন্য আমার দ্বীন” কিনতউ অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট একথা এভাবে ঘোষণা করেছেন যে, (আরব*ি***) ইসলামই একমাত্র দ্বীনে হক হিসেবে আল্লাহর নিকট মনোনীত ও স্বীকৃত। আলোচ্য আয়াত দু’টির মধ্যে কোন বিরোধ নেই। প্রথমোক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা গায়রে ইসরামকে দ্বীন বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু তা তার পছন্দ নয় বলে প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তায়ালা দ্বীন ইসলামকে তার পছন্দনীয় দ্বীন রূপে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে মর্যদা দেয়া হয়েছে। মুসিরম মাত্রিই তাদের অমুসরিম ভাইদেরকে এই স্বাধীনতা প্রদান করতে বাধ্য।
ইমাম শহীদ এবং ইখওয়ানগণ তাদের চারদিকে দেখতে পেয়েছিলেন যে, ইসলাম ও ইসলামের অনুসারীদের ওপর অমানিশার অন্ধকার ছেয়ে আছে। তাই তারা এই বিধ্বংসী ও নিচ্ছিদ্র অন্ধকার রজনী থেকে উম্মাতকে মুক্তিদানের জন্য পথ খুঁতে থাকেন। তারা ইসলামের ওপর সকল দিক থেকে জাপটে ধরে আক্রমণকারীদের মোকাবিলা করার ইস্পাত কঠিন শপথ গ্রহণ করেন। সব হামলার লক্ষ ছিল একাধারে মুসলিম শাসক গোষ্ঠী ও জনসাধারণ উভয়ই। এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে বিস্ময় বিস্ফোরিত হয়ে যাচ্ছিলো।
করণীয় কি?
আমরা ইমামকে জিজ্ঞেস করেছি। এ অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কি এবং এই ব্যাধির প্রতিকারই বা কি উপায়ে করা যেতে পারে? আমাদের এ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ভরা প্রশ্ন শুনে তিনি অত্যন্ত ধীর স্থির ও শান্তভাবে মৃদু হাসলেন। কত প্রিয় ছিল সেই হাসি! শুনুন এবং মনে রাখুন, পড়াশুনা করুন এবং প্রকৃত অবস্থা অবগত হোন। শহীদ ইমাম তাঁর ছোট্ট পুস্তিকা আমাদের পড়ে শুনান। তার ভংগী ছিল সহজ হৃদয়গ্রাহী এবং বিশ্বাস ছিল খুবই বলিষ্ঠ সান্ত্বনাদায়ক। তিনি বলেন: “আমাদের পূর্বেওএমন বহু জাতি অতীতের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে তাদের ওপর আমাদরে ন্যায় বিপদ-মুসিবতের পাহাড় ভেংগে পড়েছিলো। তারা তখন চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করে এবং তা থেকে নাজাত পাওয়ার উপায় খুঁজতে থাকে। সেগুলেঅকে বাস্তবে রূপায়িত করে এবং কামিয়াব হয়ে যায়।” মুর্শিদে আ’ম-এর অভিমত ছিল এই যে, আমাদের ওপর যে দুর্বলতা ও পশ্চাদপদতা জেঁকে বসেছে এবং আমাদেরকে অর্ধমৃত করে ফেলেছে তার প্রতিকার তিন ধরনের ব্যবস্থার মধ্যে আছে। এই পরীক্ষিত ব্যবস্থাগুলো তার মতে ছিল নিম্নরূপ:
প্রথম: ব্যথা ও রোগের স্থান নির্ধারণ করা। কেননা চিকিৎসার মৌলিক নীতিমালা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে রোগের প্রকৃত অবস্থা জেনে নিতে হবে।
দ্বিতীয়: ঔষুধের তিক্ততা এবং চিকিৎসাকালীণ কষ্ট ধৈর্যের সাথে সহ্য করতে হবে।
তৃতীয়: সুদক্ষ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক যিনি রোগ চিহ্নিত ও ঔষধ নির্ধারণে পুরো যোগ্যতা রাখেন এবং নিজের অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা রোগীর দুর্বল শরীরে সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে পারেন।
আমরা বললাম“ আপনি কি রোগের স্থান নির্ধারণ করে আমাদেরকে তা বলবেন না?
প্রতত্তুত্যরে তিনি বললেন। “রোগের অনেক দিক রয়েছে।”
এক: রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ।
দুই: ধ্বংসাত্মক দলাদলি যা জাতিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে।
তিন: সুদের অভিশাপ পুরো সমাজকে গ্রাস করে ফেলা।
চার: বিদেশী কোম্পানীসমূহ যা আমাদের আয়ের উৎসসমূহ ও রাজস্বখাত সমূহকে দখল করে আমাদরে রক্ত চুষছে। আমদানীর উৎস ও আয়ের ওপর জেঁকে বসে আমাদের রক্ত শোষণ করে চলেছে।
পাঁচ: বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারা, ব্যধিগ্রস্ত আকীদা িএবং উন্নত নৈতিক দৃষ্টান্তের অভাব।
ছয়: পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ যা জাতির দেহ ও আত্মার প্রাণ সংহারী বিষের মত প্রবাহিত হচ্ছে।
সাত: মানব রচিত আইন যা অপরাধ নির্মূল করে না এবং অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি দেয় না।
আট: লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা।
নয়: সাহস ও সংকল্পের মূলোৎপাটনকারী হতাশা।
এই তালিকা দেখেই আমরা বুঝতে পারি যেসব বিষ ফোঁড়ার বিষাক্ত পুঁজ গোটা শরীরকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট মুর্শিদে আ’ম তা গুণে গুণে বলে দিয়েছেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আদর্শিক, সামাজিক, আইনগত, শিক্ষাগত ও প্রশিক্ষণ মূলক মোদ্দকথা সকল ব্যধিকেই তিনি চিহ্নিত করে দিয়েছেন। কত গভীর ও সূক্ষ্মদৃষ্টির মূল্যায়ন। প্রকৃত সত্য সঠিকভাবে উদ্ধার করেছেন এবং উত্তম পদ্ধতিতে উপস্থাপন করেছেন। যদি সমরে সংকীর্ণতা না থাকতো তাহলে আমি প্রত্যেকটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করতাম।
ইসলামী শিক্ষা ও তার প্রভাব
ইমাম শহীদ তার অনুসারীদের ভালবাসতেন এবং তারাও তাঁর জন্য ছিল নিবেদিত প্রাণ। তিনি অনেক সময় আমাদের মধ্যেথেকে পঁচিশ বছর কিংবা তা থেকে কম বেশী বয়সের যুবকদেরকে মন্ত্রীদের সাথে তাদের দপ্তরে নয় বরং পার্লামেন্ট হাউজে গিয়ে সাক্ষাত করার জন্য প্রেরণ করতাম। এই অভিযানে আমাদের মধ্য থেকে যাকেই পাঠানো হতো সে অত্যন্ত নির্ভরতা ও আত্মবিশ্বাসের সাথেই যেতো এবং অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে পয়গাম পৌঁছে দিতো এবং উত্তম ফলাফল নিয়ে ফিরে আসতো।
তিনি আমাদের অন্তরকে আশায় ভরে দিয়েছিলেন। আমাদের আত্মসম্মান বোধ জাগ্রত করেছিলেন এবং আমাদের হৃদয়-মনে আত্মমর্যাদাবোধের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, যারাই আমাদের সাথে আছে তাদেরকে নিশ্চিত বিজয় ও সাহায্যের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও। এই মহান ব্যক্তির [হাসানুল বান্না শহীদ (র)] বদৌলতে আল্লাহ তায়ালা চিন্তাক্লিষ্টদেরকে নবজীবন দান করেন এবং প্রাচ্যে এমন জোশ সৃষ্টি হয় যার বাস্পে লোহা ও ইস্পাতের মেশিনগুলোও সচল হয়ে উঠতো (অর্থাৎ বিপ্লব সৃষ্টি হয়ে যেতো)। যদি আজ পর্যন্ত তিনি জীবিত থাকতেন তাহলে অবশ্যই আজকের যুবকগণ এই পূত-পবিত্র দাওয়াতকে এমন অবস্থায় দেখতে পেতো যে দৃশ্য দেখে তাঁর মন সান্ত্বনায় ভরে যেতো। হয়তো আমি পরে কোথাও এসব ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করবো যে, এ দাওয়াত কিভাবে সফলতার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে উপনীত হয়েছে। এই দাওয়াতেরই কৃতিত্ব যে, তা এমন সব অন্তরকে যা মৃত প্রায় গয়ে গিয়েছিলো, যাদের হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছিলো এবং জীবনের কোন লক্ষ্মণই তাদের মধ্যে ছিল না। পুনরায় তাদের মাঝে হৃদস্পন্দন সৃষ্টি করেছে। অতপর সেই হৃদপিণ্ডগুলোতে আবার এমনভাবে স্পন্দন সৃষ্টি হয়েছে যে, লোহার ওপা হাতুড়ির আঘাতের ন্যায় প্রচণ্ড আওয়াজ শুনা যেতে লাগলো। এখন এই আওয়াজ শোনা যেতে পারে এবং হৃদস্পন্দনও অনুভব করা যায়। এই ধ্বনি তাদের রাতের ঘুমহারামকরে দেয় যারা ইসরাম ও মুসলমানদের কোন কল্যাণ বরদাশত করতে পারে না। এখানে আমি যে বার বার ‘ইসলাম’ শব্দটি ব্যবহার করছি এটা রূপক অর্থে। এর দ্বারা আমি ইসরামের অনুসারীদেরকেই মুসলিম বুঝাতে চেয়েছি। কেননা ইসলাম কখনো দুর্বল হতে পারে না। কিংবা তার কোন পতনও আসতে পারে না। ইসলাম ততদিন কায়েম থাকবে যতদিন এই আসমান ও জমিন থাকবে। কাদেরে মতহলক নিজেই এর স্থায়ত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেছন। (আরবী**********) এটা এমন একটা ওয়াদা যে তাঁর সত্যতার ব্যাপারে কোন সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই। আমি মুসলিমদের প্রতি ইংগিত করছি। যখনই তারা ইলাহিয়াকে মজবুতভাবে ধারণ করেছে তখনই তাদেরকে ইজ্জত ও সম্মান দ্বারা ভূষিত করা হয়েছে। আর যখনই তারা তা থেকে দূরে থাকার নীতি অবলম্বন করেছে তাদের ইজ্জত-আবুর ধূলায় লুণ্ঠিত হয়েছে। এবং তারা লাঞ্ছনা ও অপমানের অসহায় শিকার হয়েছে। আমি অন্তরের অন্তস্থল থেকে দোয়া করছি যেন এই উম্মাত কখনো এমন পর্যায়ে গিয়ে উপনীত না হয় যে পর্যায় সম্পর্ক বলা হয়ে থাকে যে, “তুমি যদি কোন জীবন্তকে ডাকো তবে সে তোমার ডাকা শুনতে পারে কিন্তু যাকে তুমি আহ্বান জানাচ্ছো তার তো জীবনের অবসান হয়ে গেছে।”
একটা মজার ব্যাপার
মানুষ জিজ্ঞেস করে যে, এই মহাপ্রাণ দা’য়ী (হাসানুল বান্না) কিসের প্রতি মানুষকে দাওয়াত দিয়ে থাকেন? প্রত্যত্তুরে ইমাম শহীদ বাস্তব নমুনা পেশ করে থাকেন যে, মানুষ রকমারি স্বভাবের অধিকারী। কেউ উদর পূজা ও ভোগ বিলাস এবং রং রসকে জীবনের মূল উদ্দেশ্য বলে মনে করে আবার কেউ বাহ্যাড়ম্বর পোশাক-পরিচ্ছদ এবং কৃত্রিম সম্মানানুরাগী হয়ে থাকে। কেউ আবার ফিতনা-ফাসাদ ও পরচর্চা নিয়ে খুশী থাকে। তাই ইমাম এসব বিভিন্ন স্বভাবের মানুষের সাথে তাদের উপযুক্ত আচরণ করতেন। প্রসংগত একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেলো। সুধী পাঠকদের সামনে তা তুলে ধরছি। মাকতাবে ইরশাদের সদস্যগণ ইমাম শহীদকে বললেন (এবং তখনকার দিনে আমি নিজেও মাকতাবে ইরশাদের সদস্য ছিলাম) যে ওমর তিলমেসানী বাহ্যিক শান শওকত ও টিপটপ হযে থাকতে খুব পছন্দ করেন। বিলাসিতা ও ফিটফাট থাকা তার অভ্যাস এবং ফ্যাশন ও সাজ-সজ্জার প্রতি তিনি খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ইমাম শুনেও নীরব থাকলেন। কিন্তু একদিন মাকতাবে ইরশাদে সদস্যগণের সমাবেশকালে তিনি আমাকে লক্ষ্য করে উচ্চেস্বরে বলতে রাগলেন, “সমাবেশে ছেঁড়া ফাটা জুতা, ময়লা টুপি এবং সাদাসিদা পোশাকে আসতে চেষ্টা করো।” একথা শুনে আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “দাওয়াতে হকের পথে এটা কি আপনার নির্দেশ?” উত্তরে বলতে লাগলন: “তোমার ভাইদের আকাংখা, তারা তোমাকে এই অবস্থায় দেখতে চান। আল্লাহ তায়ালা যেন তাঁর বান্দাদের জন্য সাজসজ্জা ও উত্তম রিযিক হারাম করেছেন সব বান্দাহদের আল্লাহ যেন তিনি তাঁর বান্দাকে যেসব নিয়ামত দান করেছেন তার কোন প্রকাশ বান্দার জীবনে না ঘটে। অর্থাৎ আল্লাহ যেন তাঁর ঈমানদার বান্দার জন্য দুনিয়ার জীবনে কো অংশই রাখেনি এবং মানুষের সামনে নিজেকে নোংরা ও কুৎসিতভাবে জপেশ করাই যেন মুসলমানের কর্তব্য। আল্লাহ তায়ালার এই বাণী কি আমরা ভুলে গিয়েছি। এরশাদ করেছেন-
(আরবী**********)
“হে রাসূল (স) আপনি বলে দিন বান্দার জন্য আল্লাহর সৃষ্ট সৌন্দর্যের উপকরণ কে হারাম করেছে----?”
ধুমপান বর্জন
এটা ছিল এমন একটা প্রভাব সৃষ্টিকারী শিক্ষা যা আমরা শুনেছি এবং চিরদিন মনে রেখেছি। আমি সিগারেটও পান করতাম। দফতরে ইরশাদের ইখওয়ানগণ এ ব্যাপারে ইমামের কাছে অভিযোগ করেন। আমি জানতে পেয়ে নিজেই ইমামের কাছে আরজ করি, “আপনি যদি নির্দেশ দেন তাহলে আমি সিগারেট পানের অভ্যাস বর্জন করবো। আর যদি আপনি এ ব্যাারে কিচু না বলেন তাহলে আমি ধুমপান অব্যাহত রাখবো।”
তিনি বললেন: “আপনি আপনাকে আদেমও দিচ্ছি না নিষেধও করছি না।” সাধারণত মুর্শিদ এমন সব জিনিস থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিতেন যেগুলোর অভ্যাস হয়ে গেলে মানুষের জন্য সেগুলো ত্যাগ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এমন কি তিনি চা কফি থেকেও বিরত থাকতে বলতেন। তবে আমার প্রশ্নের জবাবে তিনি যা বলেছেন তার কারণ হয়তো এই যে, তিনি আমার দুর্বল স্বভাব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তিনি হয়তো মনে ধারণা করে থাকবেন যে, এভাবে হঠাৎ করে আমাকে ধূমপান থেকে নিষেধ করলে তা আমার জন্য সমস্যা সৃষ্টি হবে কিংবা হয়তো এই কড়াকড়ির কারণে আমি সংগঠন থেকেই সরে পড়বো। এটাও কি শিক্ষাদানের একটা পদ্ধতি নয়? আর আল্লাহর শোকর যে আমি এখন আর মোটেই ধূমান করি না। এটা এই শিক্ষার প্রভাব ও ফল ছাড়া আর কিছুই।
প্রশংসনীয় নৈতিক চরিত্র
মুর্শিদ যখন খুশী থাকতেন তখন আমাকে সম্বোধন করতেন “হে ওমর”। আর যদি কোন সময় আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হতেন তখন বলতেন “উস্তাদ উমর!” অতএব কথার ধরণেই আমি বুঝে ফেলতাম এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করতাম “মুর্শিদ? আমার কি কোন অপরাধ হয়েছে?”
কিছু কিছু সৌভাগ্যবান মানুষ এমনও আছেন যাদের আল্লাহর সাথে বান্দার সাথে এমনকি নিজের সাথে খুব ভাল সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে থাকে। আমাদের ইমাম শহীদ এই প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এমন সহ্য শক্তি ও আত্মসংযোমের ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন যে, অতি কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি উত্তেজিত হতেন না। অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এমন উন্নত নৈতিক গুণাবলীর মহাসম্পদ দান করেছিলেন যে, তিনি যার সাথেই মিলিত হওয়ার সুযোগ লাভ করতেন সেই-ই তাঁর ভক্তে পরিণত হতো। সর্বোপরি আল্লাহর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল অতিব ঘনিষ্ট ও বিনিড়। ছোড় বড় সকল ব্যাপারেই তিনি আল্লাহর হক ও তাঁর নির্দেশের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতেন। অতএব মহিয়ান গরিয়ান আল্লাহও তাঁর এই অনুগত ও নিষ্ঠাবান বান্দার সাহায্য এভাবে করতেন যে, কোন অতি বড় সমস্যা সঙ্কুল পরিস্থিতিতেও তার সাহস অবদমিত হতো না। হতাশা মুহূর্তের জন্যও তাঁর কাছে ঘেঁষতে পারতো না এবং অতিবড় লক্ষ্য অর্জনেও কখনো নিরাশা হতেন না।
অদম্য সাহস থাকলেও পাথর পানির মত মনে হয়
তাঁর নিকট সকল কাজই ছিল সহজ। আল্লাহ তায়অলাও বস্তুত সব কাজ সহজসাধ্য করে দিতেন। কেননা তাঁর ভরসা ছিল আল্লাহ তায়ালার প্রবুত্বের ওপর। মানুষের মধ্যে এমন কিছু দুঃসাহসী লোক থাকেন যারা সমগ্র জীবনকে তাওয়াতে হকের জন্য ওয়াক্ফ করে দেন। তাঁদের কাছে দাওয়াতের কাজ সর্বাগ্রে এবং তারপর অন্যান্য কাজ।
মুসলমানদের কাজ হচ্ছে দুনিয়ার নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত সহওয়া। কিন্তু এমন নেতৃত্ব বড়ত্ব ও আধিপত্য জাহির করার জন্য নয়। বরং শিক্ষা ও সংস্কারের জন্য। এই নেতৃত্ব সম্পর্কে যেসব মুসলমানের ধারণা নেই প্রকৃতপক্ষে তারা সেই বাণীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কেই অবহিত নয়। যার ধারকব ও বাহক করে তাকে পাঠানো হয়েছে এবং যার প্রতি আহ্বান জানানোর জন্য আল্লাহ তাকে নির্দেশ দিয়েছেন।
ইমাম শহীদকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল “আপনি কখন শয্যা গ্রহণ করেন?” তিনি জবাব দিলেন “দাওয়াত ও পয়গামের গুরু দায়িত্ব আমাদের জন্য কি এমন কোন অবকাশ রেখেছে যে, আমরা আরামের জন্য সটান শুয়ে পড়তেপারি? দায়িত্ব ও কর্তব্য কি সময়ের মোকাবেলায় অনেক বেশী নয়?”
যে নৈতিক উৎকর্ষ লাভ করতে চায় সে রাত্রি জাগরণ করে
সত্য কথা বলতে কি ইমাম শহীদের জন্য দিবারাত্রে সর্বাধিক চার থেকে পাঁচ ঘন্টার ঘুমই যথেষ্ট ছিল। তার কাছে লক্ষ্য অর্জনই ছিল মূল বিষয়। সকল কর্মতৎপরতা হচ্ছে লক্ষ্য অর্জনের উপায় মাত্র। তাঁর কাছে মু’মীন বান্দার জীবনের উদ্দেশ্য ছিল দুনিয়ার পথপ্রদর্শকের মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়া এবং পুরো মানবতাকে ইসলামের কল্যাণমূলক বিধান ও পূত-পবিত্র শিক্ষার ছায়াতলে স্থান করে দেয়া যা ব্যতীত আদম সন্তানের পক্ষে প্রকৃত সাফল্য লাভে ধন্য হওয়া সম্ভব নয়।
মু’মিনের আসল সম্পদ ঈমান
যদি মানুষ জিজ্ঞেস করে এবং কার্যত লোকজন সর্বদাই জিজ্ঞেস করে যে, “এই গরীব লোকগুলো তাদের ব্যয় নির্বাহ করে কিভাবে?”
“এ ক্ষেত্রে ইমাম তার জবাব দেন এই যে, দ্বীনের দাওয়াতের মৌলিক ভিত্তি ঈমান, সম্পদ নয়। যখন একজন ঈমানদার সত্যিকার ঈমানের দৌলত লাভ করেন তখন তার সফলতার জন্য যাবতীয় উপায় উপকরণ পর্যাপ্ত পরিমাণে যোগাড় হয়ে যায়।”
এমন অবস্থাও আমাদের ছিল যখন আমরা অতি কষ্টে এক আধটা ফ্লাট ভাড়া করতাম যাতে দাওয়াতের জন্য কার্যালয় স্থাপন করা যায়। তারপর প্রত্যেক ভাই তার সামান্য উপার্জন থেকে এয়ানত হিসেবে যে কয়েক টাকা নিয়মিতভাবে সংগঠনকে প্রদান করতেন তা দিয়ে আমরা আন্দোলনের জন্য হিলমিয়া জাদিদার দু’টো সুরম্য অট্টালিকা কিনি। মুহাম্মদ আলী স্ট্রীটে তৃতীয আরেকটি প্রাসাদও ক্রয় করি। দেখতে দেখতে বহু কোম্পানী আমাদের আন্দোলনের মালিকানাধীন এসে পড়ে---। ইখওয়ানের এসব সম্পদ জালিম সরকার বাজেয়াপ্ত করে নেয়। আমাদেরকে যদি এর ক্ষতিপূরণ দেয়া হতো তাহলে তার পরিমাণ দাঁড়াতো কোটি কোটি টাকায়।
কর্মঠ লোক ধন-সম্পদ নিয়ে আসেন কিন্তু ধন-সম্পদের পাহাড় কর্মঠ ব্যক্তি নিজে সৃষ্টি করতে পারেন না।
আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা
ইখওয়ান দাওয়াতের ওপর আস্থাশীল। তাই তারা এর জন্য পকেটে পয়সা অকপটে খরচও করে থাকে। অন্যান্য লোকদের অবস্থা হচ্ছে, তারা কোন দলে গিয়ে যোগদান করে এই উদ্দেশ্যে যে, সেখান থেকে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেবে। এই দুই অবস্থার মধ্যে আসমান-জমিনের ফারাক রয়েছে। এরূপ ত্যাগ ও কুরবানীর বদৌলতেই ইখওয়ানের দাওয়াত সফলতার স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করে। এবং এত অত্যাচার উৎপীড়ন সত্ত্বেও ইখওয়ানের ওপর অর্পিত এই দাওয়াত সমগ্র দুনিয়াতে বিস্তার লাভ করেছে। ইখওয়ানকে যত বিপদাপদ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে যদি অন্য কাউকে তা মোকাবেলা করতে হতো তবে তার নাম নিশানাও বাকী থাকতো না। কিন্তু যার একমাত্র লক্ষ্যই মহান আল্লাহর সত্তা সে প্রতিকূল পরিবেশ এবং নিঃসংগ পরিস্থিতিতেও মনযিলে মকসুদে গিয়ে উপনিত হতে পারে।
বাস্তবতা থেকে উদাসীন লোকেরা ইখওয়ানের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার কার্যক্রমকে রাজনৈতিক শ্লোগান বলে আখ্যায়িত করে থাকে। আফসোস এটা আমাদের সম্পর্কে মারাত্মক অমূলক ধারণা।
যদি শরীয়াতের বাস্তবায়নের দাওয়াত রাজনীতি হয় তাহলে জেনে নিন যে, এটাই আমাদের রাজনীতি। আর যেসব লোক তোমাদেরকে কিতাবুল্লাহকে মজবুতভাবে ধারণ করার দাওয়াত দিয়ে থাকে তারা যদি রাজনীতিবিদ হয় তাহরে আমরা রাজনীতির উস্তাদ। আর যদি তোমরা একথার ওপর অটল অবিচল থাকো যে আমাদের উদ্দেশ্য শুধু রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করা। তবে আমাদের জবাব হচ্ছে তোমরা যা কিছু বলে বেড়াচ্ছো তার জবাব দানের যিম্মাদারী তো তোমাদের ওপরই বর্তাবে। আর যা আমরা বলে যাচ্ছি তার বিনিময় তো আমরই পেয়ে যাবো। প্রত্যেকে তাই লাভ করবে যা তার জন্য নির্ধারিত রয়েছে।
নাহাস পাশা ও ইংরেজদের রক্তচক্ষু
আমাদের ইমাম দু’বার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং দু’বারই বিদেশী সাম্রাজ্যবা ও সম্প্রসারণেবাদীদের শিবিরে ব্যস্ততা ও ব্যাকুলতা ছড়িয়ে পড়েছিল। ইংরেজরা নাহাস পাশা রহুমের নিকট দাবী করে যেন তিনি ইমাম ইসমাঈলিয়ার নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বিরত রাখেন। নাহাস পাশা ইমামকে সাক্ষাতকারের জন্য ‘মিনা হাউসে” ডেকে পাঠান। উভয়েল মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়। নাহাস পাশা যখন দেখেন যে, ইমাম নির্বাচন থেকে পিছিয়ে যেতে কোন অবস্থায়ই প্রস্তুত নন। তখন তিনি বৃটিশের পক্ষ থেকে প্রদত্ত হুমকি ও চোখ রাঙানির কথা উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, এমতাবস্থায় দেশে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতিরি সৃষ্টি হবে। একথা শুনে ইমাম নির্বাচন থেকে বিরত থাকার ঘোষণা প্রদান করেন। কারণ তাঁর নিকট রাষ্ট্র ও দেশের নিরাপত্তা সর্বাধিক গুরুত্বের দাবীদার ছিল। তাঁর এই ফায়সালার ফলে ইখওয়ান অবশ্য তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। যারা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি আমি নিজেও তাদের দলে ছিলাম। ফলে আমি অফিসে যাতয়াতও বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এভাবে দফতরে আমার অনুপস্থিতি সম্পর্কে ইমাম জানতে চান। তখন তাঁকে জানানো হয় যে, আমি তাঁর নির্বাচন থেকে বিরত হওয়ার সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়েছি। তিনি আমার নামে একটা পত্র পাঠান যাতে আমাকে তাঁর সাথে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি তাঁকে লিখিত জবাব পাঠাই যার বিষয়বস্তু ছিল। আমি আপনার সাথে সাক্ষাতের কোন ইচ্ছা পোষণ করি না। তারপর তিনি উস্তাদ আবদুল হাকীমে আবেদীন এবং হাজী আবুদহু কাসেম (র)-কে সাথে আমার নিকট প্রেরণ করেন। তারা দুঁজন আমাকে একরকম জোর করে সাবীনুল কানাতিরে ইমামের কাছে নিয়ে যান। তাঁর সাথে সাক্ষাত হলে তিনি আমাকে সতস্ত ঘটনা আদ্যন্ত খুলে বলেন। সত্য কথা বলতে কি আমি তাঁর গৃহীত পদক্সেপে সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত হই এবং পূর্বের ন্যায় আবার ইখওয়ানের সাথে দাওয়াতী কাজে আত্মনিয়োগ করি।
দ্বিতীয়বার যখন তিনি নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন তখন সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সার্বক প্রয়াস প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর পৃষ্ঠপোষক ও উপদেষ্টগণকে তাঁর সহযোগিতা থেকে বিরত রাখা যায়নি। এর ফলে প্রশাসন ভোট গণনার সময় এমন কারচুপি করে এবং এমন সন্ত্রাস সৃষ্টি করে যে তার কোন নজীর পাওয়া যায় না। এভাবে তার নিশ্চিত বিজয়কে ব্যর্থতা ও পরাজয়ে রূপান্তরিত করা হয়।
মতবিরোধের অধিকার
ইখওয়ানের মুর্শিদের সাথে তাদের আচরণ হতো এমনযে, তারা তাঁর সাথে মত-পার্থক্যও করতেন। আলোচনা পর্যালোচনাও হতো এবং প্রশ্নোত্তর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও। যদি তারা সন্তুষ্ট না হতো কিংবা মুর্শিদ তাঁর রায়ের ওপর অটল থাকতেন তাহলে ইখওয়ান মনে করতো যে, মুর্শিদকে আল্লাহ তায়ালা বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞার পর্যাপ্ত অংশদান করেছেন এবং তার বৃক্ষ প্রশস্ত করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তারা নিজেদের মতামত ত্যাগ করে তাঁর হুকুম মেনে নিতো। এটা হতো পরিপূর্ণ আন্তরিকতার মধ্য দিয়ে।
হাসানুল বান্না ও হাসান আল হুদাইবি
সম্মানিত পাঠকগণের নিশ্চয়ই ভুলে যাওয়অর কথা নয় যে, আমি যা বলেছি তা ইমাম শহীদের পুস্তিকা থেকে হয় অবিকল নকল করছি নয়তো তার মর্মার্থ আমার নিজস্ব ভাষায় প্রকাশ করছি। আল্লাহ জাল্লা শানুহু স্বয়ং এই পবিত্র দাওয়াতের জন্য যথোপুযুক্ত ফঅয়সালা প্রকাশ করে থাকেন। প্রথমে ছিল শিক্ষা ও সংস্কারের স্তর। ঈমান-আকীদার সাহায্যে আল্লাহ তায়ালার সাথে মু’মিন বান্দার ঘনিষ্ঠ ও নিবিড় যোসূত্র সৃষ্টি করার প্রয়োজন ছিল। সেই সময় ছিল লাইব্রেরীগুলো মোটামোটা বই পুস্তকে ভর্তি করে রাখার পরিবর্তে ব্যক্তি মানুষের সমন্বয় সাধানের মুহূর্ত। আন্দোলন এমন নিবেদিত প্রাণ কর্মী বাহিনীর মুখাপেক্ষী ছিল যার দিকে দিকে তাওয়াতের পতাকা উত্তোলন করবে। ঘুমিয়ে পড়া মন ও নেতিয়ে পড়া বিবেকগুলোকে সতর্ক এবং সাবধান করে দেয়অর সুবর্ণ সুযোগ ছিল সেটা। হকের বুনিয়াদসমূহের ওপর একটা মজবুত সংগঠন গড়ে তোলা ছিল সময়ের দাবী। সেটা ছিল উম্মাতে মুসলিমাকে ইসলামের মৌলিক নীতিমালার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগটিত করা এবং প্রকৃত ঈমানের দিকে প্রত্যাবর্তনের উৎসাহ প্রদানের কাল। আহলে ইসলামকে এই শিক্ষা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য যে, জিহাদ ব্যতীত প্রকৃত সম্মান লাভ করা সম্ভব নয়। এই পর্যায় আল্লাহ তায়ালা ইখওয়ানের নেতৃত্বের জন্য ইমাম হাসানুল বান্না শহীদকে নির্বাচিত করেন। তিনি আনুসংগিক যাবতীয প্রয়োজনও উপায়-উপকরণ কানায় কানায় পুরো করে আন্দোলনকে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দেন।
তারপর শুরু হয় দ্বিতীয় স্তর যার দাবীও ছিল ভিন্ন। এ পর্যায়ে ধৈর্য স্থৈর্য এবং বীরত্বের প্রয়োজন ছিল। জুলুম ও বাতিলের মোকাবেলা এবং তাতে দৃঢ়পদ থাকার দরকার ছিল। আন্দোলনের মৌলিক শিক্ষামালঅকে বাস্তবে কার্যে পরিণত করে দেখানোর পর্যায় এসে গিয়েছিলো। ইসলামের দা’য়ীগণকে যুরোপুরি সাহস ও বীরত্বের সাথে জালেম শাসক ও আল্লাহদ্রোহী গোষ্ঠীর সামনে তাদের ইসলামী ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটানোর সময় এসে গিয়েছিলো। দাওয়াতে হককে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মুজাহিদদের নেতৃত্বে নিজ অস্তিত্ব সংরক্ষণের ভেলা ভাসাতে হয়। আল্লাহ তায়ালা হাসানুল বান্নার স্থলে এখন হাসান আল হুদাইবিকে বেছে নেন। আল্লাহ তার ওপর সন্তুষ্ট হোন। তিনি নেতৃত্বের হক এমনভাবে আদায় করেন যেভাবে তার অগ্রজ চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছিলেন।
মানুষ হচ্ছে খনি সদৃশ
এখানে আমি বলে দিতে চাই যে, সমগ্র মিসরে জামাল আবদুন নাসেরের পরিচয় ও স্বরূপ শুধু দু’ব্যক্তি যথাযথভাবে বুঝতে পেরেছেন। তাদের একজন হচ্ছেন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের মুর্শিদে আ’ম মরহুম হাসান আল হুদাইবি (র) আর অপর জন হচ্ছেন ওয়াফদ পার্টির প্রেসিডেন্ট মুষ্টার ফুয়াদ সিরাজ উদ্দীন।
১৯৫৪ সালে আমরা যখন সামরিক জেলখানায় বন্দী ছিলাম তখন আমাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে উম্মে কুলসুমের স্বরে স্বরে মিলিয়ে নাসেরের প্রশংসা গীতি গাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হতো। উম্মে কুলসুমের গানের রেকর্ড বাজানো হতো “ইয়া জামাল ইয়া মিসালুল আতনিয়া” (হে জামাল আবদুন নাসের হে স্বদেশ প্রেমের উত্তম দৃষ্টান্ত) এই নাটকে আবদুল কাদের আওদহা শহী (র)-কে ব্যান্ড মাষ্টার রূপে পৃথকভাবে আর আমাদের সকলকে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে দেয়া হতো। একদিন আমরা সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং গান গাওয়া হচ্ছিল। ইত্যবসরে এক জেল অফিসার সাইয়েদ হাসান আল হুদাইবি (র)-এর নিকট এসে আদেশ দিল যে, “ঠিকমত দাঁড়ান এবং নির্দেশ মোতাবেক মাটির ওপর সজোরে পা ফেলুন।” জালেমদের জুলুম নির্যাতন এ সময় চরমে পৌঁছেছিল। কিন্তু সাইয়েদ হাসান আল হুদাইবি কখনো তাতে আমল দিতেন না। কারো নিকট অনুকম্পা ভিক্ষা করা কিংবা তোষামোদের ভংগী অবলম্বন করার কোন কৌশল তাঁর জানাই ছিল না। তিনি অকুতোভয়ে তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন : “আরে মিয়া চিন্তা করো না আমি মাটি ওপর এমনভাবে পা ফেলবো না যে পেট্রোল কিংবা তরমুজ বেরিয়ে আসে।” তিনি এমন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন না যারা জালিমদের সম্মুখে মাথা নত করে এবং বলে “আল্লাহ যা চান এসব সাহেবে সদর যা ইচ্ছা করেন।”
মানুষ ও খনির ন্যায় হয়ে থাকে। কোনটির ভেতর থেকে সোনা বেরিয়ে আসে আবার কোনটি থেকে লোহা। এই লোকদের মাহাত্ম কি ছিল? তাদের ঈমান ছিল মজবুত। আল্লাহর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস চলমান ঝর্ণার মত তাদের অন্তরকে সিক্ত করে রাখতো। কঠিন পরিস্থিতিতেও আল্লাহ তায়ালা এই লোকদের অটল অবিচল থাকার সৌভাগ্য প্রদান করেছেন এবং তাদের মাধ্যমে দাওয়াতে হকের হেফাজত করেছেন।
দাওয়াতে হকের আলোচনা
আমি আমার এই স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে অবশ্যই দাওয়াতে হকের আলোচনা করবো। এটা সেই আল্লাহর দাওয়াত যিনি আমাকে অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্ব দিয়েছেন। এই দাওয়াত আমাকে আমার জীবনের স্বরূপ এবং তার প্রকৃত দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং এর নিগুঢ় তত্ত্ব ও রহস্য সম্যক রূপে অবহিত করেছেন। আমি এর আলোচনা কেন করবো না। এই দাওয়াতই তো আমাকে এই শিক্ষা দিয়েছে যে, একজন মুসলিমের কাজ শুধু কিছু সংখ্যক আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, জীবনের সর্তক্ষেত্রে এবং প্রতি পদক্ষেপে কল্যাণ ও মংগলকে বিশেষ বিবেচনায় রাখবে। সম্ভাব্য সকল উপায়ে তা ব্যাপক, বিস্তৃত ও সর্বাঙ্গিন করতে চেষ্টা করা। আমাদের নিকট বৈষয়িক ও বস্তুগত কোন শক্তি না থাকলেও আমাদেরকে এই কাজ করে যেতে হবে। আমরা নিজেরা সকল অনিষ্ট থেকে দূরে থাকবো এবং সমগ্র মানবতাকে যাবতীয মন্দ থেকে রক্ষা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো। এই কাজ দাওয়াতের সাহায্যে করা যাবে যদি তা মানুষ গ্রহণ করে নেয়। আর যদি তারা অনিহা প্রকাশ করে তথাপি তাদের ও আমাদের মাঝে কোন বিরোধ নেই। তারা তো জালেম। তার যদি জুলুমের হস্ত উত্তোলন করে তবে আমাদেরকে আত্মরক্ষা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।হকের হিফাজত করা অত্যাবশ্যক; যদিও তা করতে হয় শক্তি প্রয়োগ করে। হকের সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য শক্তি ব্যবহার মানবীয় ও আল্লাহর সকল আইনেই বৈধ বলে স্বীকৃত। আমরা দাওয়াতে হকের কাজ শুধু মুখের কথা ও শ্লোগান দ্বারা করি না।
দা’য়ী ইলাল্লাহ কখনো কাল্পনিক ঘোড়ায় আরোহণ করে না। দা’য়ীর প্রয়োজন হচ্ছে, তাকে হতে হবে মজবুত স্নায়ুর অধিকারী।সে কখনো বেইজ্জতী ও অপমানকে কবুল করবে না। মহৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাঁর মধ্যে প্রবল ইচ্ছা শক্তি, অটল বিশ্বাস, ত্যাগ ও কুরবানীর অপরাজেয় উদ্দীপনা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পদ জ্ঞান এবং তার যথার্থতার প্রতি ঈমান ও এই পথে জীবন কুরবানী দিয়ে দেয়ার ইস্পাত কঠিন শপথের মত গুণাবলীঅবশ্যই থাকতে হবে। কোন জাতি প্রতিটা মানুষের মধ্যে যখন এসব উন্নত গুণাবলী থাকে যে জাতি কোন অবস্থায়ই অপমান ও লাঞ্ছনার জীবন বরণ করে না।
কেউ যদি এই মৌলিক নীতিমালার সাথে ঐকমত্য না হয় তাহলে আমরা সুস্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছি যে, হকের বিজয়ের জন্য এ ছাড়া আর কোন পথ নেই। আমরা যদি একটা শক্তিশালী জাতি রূপে আত্মপ্রকাশ করতে চাই তাহলে তার জন্য এটাই একমাত্র পথ। এইপথ সুকঠিন ও দীর্ঘ আর তা অতিক্রম করার সৎসাহস তার থাকতে পারে যাকে আল্লাহ তায়ালা তৌফিক দান করেন। আবার এই সৌভাগ্যও সেই ব্যক্তি লাভ করতে পারে যাকে আল্লাহ তায়ালা অফুরন্ত কল্যাণ প্রদানের জন্য বাছই করেন না বরং সবরের সাথে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ ও সন্তোষের গুণাবলীও প্রদান করেন।
চিন্তা ও কাজের সমন্বয়
আমাদের ব্যাপারে কিছু লোক মনে করে যে আমরা শুধু চিন্তা সর্বস্ব ও দার্শনিক সংগঠন বিশেষ। আমাদের কাছে বাস্তব সমাধান নেই। বস্তুত যে সম্পর্কে মানুষের সঠিক ধারণা থাকে না তারা সে জিনিসের দুশমনই হয়ে থাকে। সমগ্র মিসরে আপনি এমন কোন সংগঠনের দৃষ্টান্ত পেশ করতে পারবেন ন যা বাস্তবে ইখওয়ানের ন্যায় কর্মতৎপর। আমার এই দাবীর স্বপক্ষে আমি ইমাম শহীদের পুস্তিকা থেকেই কতিপয় দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি। ইখওয়ানের বাণিজ্যিক কোম্পানীসমূহের রেকর্ড খুবই প্রশস্ত। ইসমাঈলিয়া, শিবরাখিয়্যাত, মাহমুদিয়া এবং কায়রো প্রভৃতি শহর আমাদের এসব কোম্পানীর সংখ্যা ছিল প্রচুর। এসব ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কোম্পানী ছাড়াও আমাদের বিভিন্ন শিল্প ও পেশাগত কারখানা ছিল প্রচুর। বস্ত্রবয়নের জন্য অসংখ্য তাঁতশিল্প ছিল। বাণিজ্য ও কৃষি ক্ষেত্রেও ছিল বিস্তর কাজ কারবার। মিসর সরকার যদি একের পর এক আমাদের এসব প্রতিষ্ঠানকে বাজেয়াপ্ত করে ধ্বংস করে না ফেলতো তাহলে আজ ইখওয়ান মধ্য প্রাচ্যে অসংখ্য কোম্পানী ও মিল কারখানার সর্বপেক্ষা বড় মালিক হতো। বর্তমানে সারা দেশে যেসব বড় প্রতিষ্ঠান যেমন: ব্যাংক, সংবাদ সরবরাহ কেন্দ্র এবং মুদ্রণ ও প্রকাশনা কোম্পানী দেখা যায় তার ইতিহাসের দিকে যদি আপনি দৃষ্টিপাত করেন তাহলে তার পশ্চাতে ইখওয়ানের লোকদের সযত্ন প্রয়াস, প্রচেষ্টা ও অবদান সুস্পষ্টরূপে দৃষ্টিগোচর হবে।
ইখওয়ান তাদের দাওয়াতি তৎপরতা, সম্প্রসারণ তৎপরতা, সফর এবং অন্যান্য বিষয়ে যা খরচ করে থাকেনতার যোগান আসে তাদের নিজেদের পকেট থেকেই। ইখওয়ান বহির্ভূত কোন লোকের নিকট থেকে আমরা কখনো কোন পয়সা গ্রহণ করিনি। অবশ্য এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে ঐ পাঁচশত পাউন্ডের চাঁদা যা সুয়েজখাল কোম্পানী একটা মসিজদ নির্মাণের জন্য সাহায্য স্বরূপ প্রদান করেছিল। প্রসংগত েএটাও জেনে নিন যে, ইখওয়ানের সদস্যগণ যা কিছু এয়ানত দিয়ে থাকেন তা দেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে। এটা বাধ্যবাধকাতমূলক কোন ব্যাপার নয়। ইখওয়ান উম্মাতে মুসলিমাকে জিহাদের দাওয়াত দিয়ে থাকে। আর সর্বাপেক্ষা বড় দলিল এই যে, তারা কাজের লোক, জিহাদ এই দ্বীনে সর্বোচ্চ চূড়া এবঙ তার নিগুঢ় তত্ব হচ্ছে আমাদের দাওয়াত- দাওয়াতে জিহাদ। যদি তার জন্য আমাদের জান কুরবান করতে হয় তবুও।
এমন জীবনের কি মূল্য যার বুনিয়াদ ভীরুতা ও কাপুরুষতা। এভাবে বেঁচে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করে কি লাভ যদি জীবন লাঞ্ছনা ও অপমানের গ্রানিতে ভরপুর হয়ে যায়। এরূপ ছিদ্র অন্বেষণকারী ও সুযোগ সন্ধানীদের কি সম্মান মর্যাদা পাওয়া সম্ভব যারা সকল প্রকার জালিমের কাফেলায় গিয়ে শামিল হয়ে থাকে েএবঙ তার রিকাব ধরে বসে। প্রকৃত প্রস্তাবে এটা জীবন্ত সমাধিস্থ হওয়ারই নামন্তর। কবির ভাষায় :
(আরবী**********)
যে সত্যিই মৃত্যু বরণ করলো সে প্রকৃত মৃত নয়
বরং মৃত সেই যে জীবন্ত সমাধিস্থ হয়েছে ।
জিহাদের প্রকারভেদ
জিহাদ কয়েক প্রকার। মুসরিমদের অধপতিত অবস্থার জন্য আক্ষেপ ও অনুতাপের বহিঃপ্রকাশও এক প্রকার জিহাদ। মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে এবং তারা তা নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে এ অবস্থার জন্য অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করাও জিহাদের অন্তর্গত। মুসলিমদের স্বার্থ সংরক্ষণে আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা এবং তাদের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে মুসবিত থেকে তাদের মুক্তি দেয়ার চেষ্টাও জিহাদের পর্যায়ভুক্ত। সুকৃতির আদেশ এবং দুষ্কৃতির নিষেধও জিহাদ। যারা আমাদের দ্বীনের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে তাদেরকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা এবং তাদের সাথে কোন প্রকার আন্তরিক ও বন্ধুসূলভ সম্পর্কে না রাখার নামও জিহাদ। নিজেকে এমন এক কাতারে শামিল করেনেয়াও জিহাদ যা সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় দুর্ভেদ্য ও মজবুত। মানুষের যা কিছুই রয়েছে তা আল্লাহ তায়ালারই দান। তাই সবকিছু তাঁরই পথে ব্যয় করাও জিহাদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
যদি জনগণ নিবেদিত প্রাণ মুজাহিদদের সাথে গিয়ে শামিল হতে না পরে তাহলে তারা তাদের জন্য দোয়া করতে থাকবে। এটাও জিহাদ রূপেই পরিগণিত হবে। এটা আল্লাহরই বিশেষ অনুগ্রহ যে প্রত্যেক প্রকারের জিহাদই অন্য প্রকারের জিহাদের পথনির্দেশ করে। অতএব, নিজেকে মুজাহিদদের কোন না কোন কাতারে শামিল করা মুসলমানের জন্য অত্যন্ত সহজ।স কল প্রকার জিহাদকে আল্লাহ তায়ালার পবিত্র বাণী (আরবী********) “তোমরা জিহাদ করো আল্লাহর পথে জিহাদের পরিপূর্ণ হক আদায় করে” পবিত্র বাণীতে সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। অতপর কোন মুসলিমের জন্য আর এমন কথা বলার সুযোগ নেই যে, সে মুজাহিদদের কোন কাতারেই জায়গা পাচ্ছে না।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি