চতুর্থ খন্ড
ইসলাম বিপ্লবের পদ্ধতি

ষোড়শ অধ্যায়
১. ইসলামী বিপ্লবের পদ্ধতি
২. ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট
৩. ইসলামী বিপ্লবের পথ
৪. ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা
৫.শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের পন্থা
৬. আধুনিক রাষ্ট্রে ইসলামী আন্দোলনের কর্মপন্থা
৭. ইসলামী রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠার সঠিক কর্মধারা
৮. রাজনৈতিক বিপ্লব আগে না সমাজ বিপ্লব?
অবশেষে আমরা গ্রন্থকারের সেই বিখ্যাত নিবন্ধটি সন্নিহিত করছি, যেটি তিনি ১৯৪০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তারিখে ইসলামের ইতহাস ও সংস্কৃতি সমিতির আহবানে আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির স্ট্রেচি হলে পাঠ করেন। নিবন্ধের সে অংশটুকু এখানে সংযোজন করা হয়নি, যে অংশটি তখনকার বিশেষ অবস্থার সাথে সম্পর্কিত। ঘনিষ্ঠ প্রাসংগিকতার কারণে তরজমানুল কুরআন থেকে গ্রন্থকার প্রদত্ত কয়েকটি প্রশ্নেত্তরও এখানে সংযোজন করা হলো। -সংকলক
১. ইসলামী বিপ্লবের পদ্ধতি
এ নিবন্ধে আমি সেই বিশষ পদ্ধতির [Process] বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন অনুভব করছি, যার স্বাভাবিক পরিণতিতে ইসলামী রাষ্ট্র অস্তিত্ব লাভ করে।
যে কোনো ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থাই যে কৃত্রিম পন্থায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা, সমাজ বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুসাত্র জ্ঞান রাখেন, এমন সকলেই তা জানেন। রাষ্ট্র ব্যবস্থা এক জায়গা থেকে তৈরী করে এনে অন্য জায়গায় স্থাপন করার মতো কোনো বস্তু নয়। রাষ্ট্র ব্যবস্থা তো কোনো একটি সমাজের মধ্যকার নৈতিক চরিত্র, চিন্তা চেতনা, মন মানসিকতা, সভ্যত সংস্কৃতি এবং ইতিহাস ঐতিহ্যগত কার্যকারণের সমন্বিত কর্ম প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নিয়মে জন্ম লাভ করে থাকে। এর জন্যে কিছুটা প্রাথমিক উপায় উপাদান [Prerequisites], কিছু সামাজিক ও সামষ্টিক চেষ্টা তৎপরতা এবং কিছু আবেগ উদ্দীপনা ও ঝোঁক প্রবণতা বর্তমান থাকা চাই, যেগুলোর পসন্বিত চাপের মুখে স্বাভাবিক পন্থায় রাষ্ট্র ব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভ করে থাকে। তর্ক শাস্ত্রে সূত্র বিন্যাসের ভিত্তিতে যেমন সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হয়, রসায়ন শাস্ত্রে রাসায়নিক বৈশিষ্ট সম্পন্ন উপাদানসমূহকে বিশেষ পন্থায় সংমিশ্রিত করলে যেমন সেগুলোর সমগুণ সম্পন্ন রাসায়নিক পদার্থই প্রস্তুত হয়; ঠিক একইভাবে, সমাজ বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী, একটি রাষ্ট্র কেবল সেই পরিবেশের দাবির ফলশ্রুতিতেই জন্ম লাভ করে, যে পরিবেশ সৃষ্টি হয় কোনো সমাজ পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে। আর রাষ্ট্রর প্রকৃতি কি হবে? তাও সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে সমাজের সেই পরিবেশ ও দৃষ্টিভংগি উপর, যার চাপের ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্র জন্ন লাভ করেছে। যেমন, তর্ক শাস্ত্রে এক ধরনের সূত্র বিন্যাসের ফলশ্রুতিতে অন্য ধরনের সিদ্ধান্ত প্রকাশ হতে পারেনা। যেমন, রসায়ন শাস্ত্রে সমবৈশিষ্ট সম্পন্ন রাসায়নিক উপাদানসমূহের সংমিশ্রণে একটি ভিন্নধর্মী যৌগিক পদার্থ তৈরী হতে পারেনা। যেমন, লেবু গাছ লাগানোর পর তা বড় হয়ে আম ফলাতে পারেনা। ঠিক তেমনি, উপায় উপাদান এবং কার্যকারণ যদি একটি বিশেষ প্রকৃতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে হয়ে থাকে, আর সেগুলোর সমন্বিত কার্যক্রমও যদি হয় সেই বিশেষ ধরনের রাষ্ট্রেরই আত্মপ্রকাশের অনুকূলে, তাহলে ক্রমবিকাশের পর্যায়সমূহ পার হয়ে রাষ্ট্র যখন পূর্ণতা লাভের দ্বার প্রান্তে উপনীত হবে, তখন এসব উপায় উপাদান ও কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, তা কিছুতেই হতে পারেনা।
এ বক্তব্য থেকে আপনারা আমাকে অদৃষ্টবাদের [Determinism] প্রবক্তা মনে করবেননা। একথাও মনে করবেননা যে, আমি মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধিকারকে অস্বীকার করছি। নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের প্রকৃতি নির্ধারণে ব্যক্তি ও সমষ্টির ইচ্ছাশক্তি এবং কার্যক্রমের ভূমিকা বিরাট। কিন্তু আমি আসলে একটি কথাই প্রমাণ করার চেষ্টা করছি। আর তাহলো, যে ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থাই সৃষ্টি করা উদ্দেশ্য হবে, প্রথম থেকেই ঠিক সে ধরনের রাষ্ট্রের স্বভাব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল উপায় উপাদান সংগ্রহ করা এবং ঠিক সেই লক্ষ্যেই পৌছুবার মতো কর্মপন্থা অবলম্বন করা একান্ত অপরিহার্য। আমরা যে বিশেষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাই, সে প্রকৃতির রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিার জন্যে অবশ্যি ঠিক সেরকম আন্দোলন উত্থিত হতে হবে। সেরকম ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত চরিত্র সৃষ্টি করতে হবে। সেই ধরনের প্রশিক্ষণপ্রপ্ত নেতৃত্ব এবং সেইরকম সামাজিক কার্যক্রম ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কারণ, এগুলো এই বিশেষ ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক দাবি। এসব উপায় উপাদান ও কার্যকারণ যখন সমন্বিতভাবে সংগৃহীত ও হস্তগত হয় এবং এক দীর্ঘ প্রাণন্তকর চেষ্টা সংগ্রামের পর সেগুলোর মধ্যে এমন অপ্রতিরোধ্য শক্তি ও বলিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়ে যায়, যার ফলে তাদের গড়া এই সমাজে অন্য কোনো ধরনের বাতিল রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে বেঁচে থাকই অসম্বব হয়ে পড়ে, তখন এর অপরিহার্য স্বাভাবিক পরিণতিতে সেই বিশেষ রাষ্ট্র ব্যবস্থারই আত্মপ্রকাশ ঘটে, যার জন্যে এই সকল উপায় উপাদান ও কার্যকারণের শক্তি সমন্বিত ও সমষ্টিগতভাবে চেষ্টা সংগ্রাম চালিয়েছে। যেমন একটি বীজ। তার থেকে অংকুরিত হলো একটি গাছ। তার অভ্যন্তরীণ উপাদানসমূহ তাকে প্রতিপালিত করে পৌছে দিলো একটি পর্যায়ে। তখন এ গাছ থেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নিয়মে সেই ফলই ফলাতে থাকবে, যা ফলানোর জন্যে তার অভ্যন্তরীণ শক্তি ও উপায় উপাদানসমূহ দীর্ঘদিন ধরে রস সিঞ্চন করে আসছিল। এই নিগুঢ় সত্য বিষয়টি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলে আপনাকে একটি কথা স্বীকার করে নিতেই হবে। তাহলো, আন্দোলন, দেতৃত্ব, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক চরিত্র এবং কর্মপদ্ধতি ও কর্মকৌশলসহ প্রতিটি উপাদান যেখানে একটি বিশেষ ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার আশা করাটা মূর্খতা, খামখেয়ালী, আসার অল্পনা এবং অনভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
২.ইসলামী রাষ্ট্রর বৈশিষ্ট
আমরা যে রাষ্ট্রেকে “ইসলামী রাষ্ট্র” বলে আখ্যায়িত করছি, তার প্রকৃত স্বরূপটা কি? কি তার ধরন? কি তার বৈশিষ্ট ও আসর পরিচয়? তা আমাদের ভালোভাবে বুঝে নেয়া দরকার। ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম বৈশিষ্ট হচ্ছে, জাতীয়তাবাদের নামগন্ধও এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এ জিনিসটিই ইসলামী রাষ্ট্রকে অন্য সকল প্রকার রাষ্ট্র থেকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। এ হচ্ছে নিছক একটি আদর্শিক রাষ্ট্র। এ ধরনের রাষ্ট্রকে আমি ইংবেজীতে [IDEOLOGICSL STATE] বলবো। এরূপ আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের সাথে মানুষ সব সময় পরিচিত ছিলোনা। আজও পৃথিবীতে এরূপ কোনো আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত নেই। প্রাচীনকালে মানুষ বংশীয় বা শ্রেণীগত রাষ্ট্রের সথে পরিচিত ছিলো। অতঃপর গোত্রীয় এবং জাতীয় রাষ্ট্রের সাথে পরিচিত হয়। এমন একটি আদর্শিক রাষ্ট্রের কথা মানুষ তার সংকীর্ণ মানসিকতায় কখনো স্থান দেয়নি, যার আদর্শ গ্রহণ করে নিলে বংশ, গোত্র জাতি ও বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশীদার হয়ে যাবে। খৃষ্টবাদ এর একটি অস্পষ্ট নকশা লাভ করেছিলো। কিন্তু সেই পূর্ণাংগা চিন্তা কাঠামো তারা লাভ করেনি, যার ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ফরাসী বিল্পবে আদর্শিক রাষ্ট্রের একটি ক্ষীণ রাশ্মি মনুষ প্রত্যক্ষ করেছিলো বটে, কিন্তু তা অচিরেই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের অন্ধ গহবরে তলিয়ে যায়। কমিউনিজম আদর্শিক রাষ্ট্রের বুনিয়াদ স্থাপনেরও কোশেশ করে। এর ফলে বিশ্ববাসীর মনে আদর্শিক রাষ্ট্রের একটি ক্ষীণ ধারণাও জন্ম নিতে থাকে। কিন্তু অবশেষে এর ধমনীতেও ঢুকে পড়লো জাতীয়তাবাদের তীর্যক ভাবধারা। জাতীয়তাবাদ কমিউনিজমের আদর্শিক ধারণাকে ভাসিয়ে নিয়ে ডুবিয়ে দিলো সমুদ্রের তলদেশে। পৃথিবীর প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত একমাত্র ইসলামই হচ্ছে সেই আদর্শ পন্থা, যা জাতীয়তাবাদের যাবতীয় সংকীর্ণ ভাবধারা থেকে মুক্ত করে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে নিরেট আদর্শিক বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। আর একমাত্র ইসলামই হচ্ছে সেই মহান আদর্শ, যা গোটা মানব জাতিকে তার এই আদর্শ গ্রহণ করে অজাতীয়তাবাদী বিশ্বজনীন রাষ্ট্র গঠনের আহবান জানায়।
বর্তমান বিশ্বে যেহেতু এমন একটি রাষ্ট্রের ধারণা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত এবং যেহেতু বিশ্বের সমগ্র রাষ্ট্র ব্যবস্থার অবস্থা এ ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত, তাই কেবল অমুসলিমরাই নয়, স্বয়ং মুসলমানরা পর্যন্ত এমন রাষ্ট্র এবং এর অন্তর্নিহিত ভাবধারা [IMPLICATIOND] অনুধাবন করতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। যারা মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়েছে বটে, কিন্তু সমাজ ব্যবস্থার ধারণা গ্রহণ করেছে পুরোপুরিভাবে ইউরোপীয় ইতিহাস,রাজনীতি ও সমাজ বিজ্ঞান [Social Scicence] থেকে, তাদের মনমস্তিষ্কে এরুপ আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা কিছুতেই স্থান পেতে পারেনা। উপমহাদেশের বাইরেও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ যেসব দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেসব দেশেও এ ধরনের লোকদের হাতে যখন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব এসেছে, জাতীয় রাষ্ট্র [National Statel] ছাড়া আর কোনো ধরনের রাষ্ট্রের কথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। কারণ, তাদের মনমস্তিষ্ক তো ইসলামের জ্ঞান, চেতনা এবং আদর্শিক রাষ্ট্রের ধারণা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এই উপমহাদেশেও যারা সে ধরনের শিক্ষা দীক্ষা লাভ করেছে, তারাও এই জটিল সমস্যায় জর্জরিত। ইসলামী রাষ্ট্রের নাম মুখে এরা উচ্চারণ করে বটে, কিন্তু যে শিক্ষা দীক্ষায় বেচারাদের মস্তিষ্ক গঠিত হয়েছে, তা থেকে ঘুরে ফিরে সেই “জাতীয় রাষ্ট্রের” চিত্রেই বার বার তাদের চোখেনর সামনে ভেসে উঠে। জ্ঞানত কিংবা অজ্ঞতাবশত এরা কেবল জাতি পূজার বেড়াজালেই ফেঁসে যায়। তারা যে পরিকল্পনা ও কর্মসূচির কথাই চিন্তা করুক না কেন, তা করে থাকে জাতীয়তাবাদেরই ভারধারার ভিত্তিতে। ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্ক তারা সম্পূর্ণ গতানুগতিক ধারণা পোষণ করে। তারা মনে করে, ‘মুসলমান’ নামের যে ‘জাতিটি’ রয়েছে, তার হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কিংবা অন্তত রাজনৈতিক কেতৃত্ব এলেই তা ইসলামী রাষ্ট্র হবে। আর ই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে তারা যতোই চিন্তাভাবনা করে অন্যান্য জাতির অবলম্বিত কর্মপন্থা ছাড়া নিজেদের সেই জাতিটির জন্যে অন্য কর্মপন্থা তাদের নযরে পড়েনা। এ ধারণাই তাদের মগজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, পৃথিবীর অন্যান্য জাতি যেসব উপায় উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে, তারাও সেসব উপায় উপাদনের সমন্বয়ই তাদের জাতিটিকে গঠন করবে। তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করে দেয়া হবে। ১ তাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সৃষ্টি করা হবে। [ ১. ১৯৪০ সালে যখন এই বক্তৃতাটি উপস্থাপন করা হয়, তখন এই উপমহাদেশের মুসলমানদেরকে নিছক একটি জাতি মনে করে তাদেরকে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সংগঠিত করার পরিণতি কারো বুঝে আসেনি বটে, কিন্তু ১৯৭১ সালে যখন ভাবভিত্তিক জাতীয়তাবাদ মুসলমান থেকে মুসলমানকে বিভিক্ত করে দিলো এবং স্বয়ং মুসলমানের হাতে মুসলমানের ইতিহাসের নযীরবিহীন গণহত্যা অনুষ্ঠিত হলো, তখন বিষয়টি সকলের কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেলো। অতঃপর ১৯৭২ সালে বিশ্ববাসী সিন্ধুর ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দেলনের চেহারাও দেখ নিলো। এ আন্দোলনের দাবি ছিলো সিন্ধুভাষী সকল মুসলমান অমুসলমান এক জাতি। আর সেখানকার যেসব মুসলমান সিন্ধু ভাষী নয়, তারা ভিন্নজাতি এবং তাদের সিন্ধুতে থাকার অধিকার নেই। (গ্রন্থকার) ] জাতীয় গার্ডবাহিনী সংগঠিত করা হবে। গঠন করা হবে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী। যেখানে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে, সেখানে গণতন্ত্রের স্বীকৃত নীতি ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন’ [Majority Rule ]এর ভিত্তিতে তাদের জাতীয় রাষ্ট্র গঠিত হবে। আর যেখানে তারা সংখ্যালঘু, সেখানে তাদের “অধিকার” সংরক্ষিত হবে। তারা মনে করে, তাদের স্বাতন্ত্র ঠিক সেভাবে সংরক্ষিত হওয়া উচিত, যেভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রতিটি সংখ্যালঘু জাতি [National Minority] নিজেদের স্বাতন্ত্র রক্ষা করতে চায়। তারা চায়, শিক্ষা, চাকুরী এবং নির্বাচনী সংস্থাসমূহে নিজেদের কোটা নির্ধারিত হবে। নিজেদের প্রতিনিধি নিজেরা নির্বাচন করবে। একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে মন্ত্রী সভায় তাদের শরীক করানো হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি জাতীয়তাবাদী চিন্তা তাদের চিন্তাশক্তিকে গ্রাস করে রেখেছে। এসব জাতীয়তাবাদী চিন্তা প্রকাশ করার সময় তারা উম্মাহ জামায়াত মিল্লাত আমীর, ইতায়াত প্রভৃতি ইসলামী পরিভাষাই মুখে উচ্চারণ করে। কিন্তু এই শব্দগুলো তাদের জন্যে জাতীয় ধর্মবাদের জন্যে ব্যবহৃত শব্দাবলীরই সমার্থক। সৌভাগ্যবশত তারা এ শব্দগুলো পুরানো ভান্ডারে তৈরী করাই পেয়ে গেছে এবং এগুলো দিয়ে তাম্র মুদ্রার উপার স্বর্ণমুদ্রার মোহরাংকিত করার সুবিধা পাচ্ছে।
আপনার যদি আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্রের সঠিক পরিচয় উপলব্ধি করে নিতে পারেন, তাহলে একথাটি বুঝতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হবেনা যে, এরূপ জাতীয়তাবাদী চিন্তাপদ্ধতি, কর্মসূচি এবং আন্দোলন প্রক্রিয়া দ্বারা আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া তো দূরের কথা, বরঞ্চ এ মহান কাজের সূচনাই হতে পারেনা। সত্য কথা বলতে কি, জাতীয়তাবাদের প্রতিটি অংগ একেকটি তীক্ষ্ণধার কুঠারের মতো, যা আদর্শিক রাষ্ট্রের মূলে কুঠারাঘাত করে তাকে বিনাশ করে দেয়। আদর্শবাদী রাষ্ট্র যে ধারণা [IDEA] পেশ করে, তার মূল কথাই হচ্ছে, আমাদের সামনে ‘জাতি’ বা ‘জাতীয়তাবাদের’ কোনো অস্তিত্ব নেই। আমাদের সম্মুখে রয়েছে শুধু মানুষ বা মানব জাতি। তাদের কাছে আমরা এক মহান আদর্শ এ উদ্দেশ্যে পেশ ও প্রচার করবো যে, এই আদর্শের কল্যাণ ও সাফল্য নিহিত রয়েছে। এই আদর্শ গ্রহণকারী সকল মানুষ ঐ আদর্শিক রাষ্ট্রটি পরিচালনায় সমান অংশীদার।
এবার একটু চিন্তা করে দেখুন, যে ব্যক্তির মন মগজ, ভাষা বক্তব্য, কাজ কর্ম তৎপরতা প্রভৃতি প্রতিটি জিনিসের উপর সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও জাতিপূজার মোহরাংকিত হয়ে আছে, সে কী করে এই মহান বিশ্বজনীন আদর্শিক দৃষ্টিভয়গি নিয়ে চলতে সক্ষম হবে? সংকীর্ণ জাতি পূজায় অন্ধ বিভোর হয়ে সে নিজের হাতেই তো বিশ্বামানবতাকে আহবান জানাবার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। প্রথম কদমেই তো সে নিজের পজিশনকে ভ্রান্তির বেড়াজালে নিমজ্জিত করেছে। বিশ্বের যেসব জাতি জাতীয়তাবাদী বিদ্বেষ অন্ধ হয়ে আছে, জাতি পূজা এবং রাষ্ট্রই যাদের সমস্ত ঝগড়া লড়াইর সম্ভব নয়। যারা নিজেদের জাতীয় রাষ্ট্র এবং নিজ জাতির অধিকারের জন্যে ঝগড়ায় নিমজ্জিত, তারা কি বিশ্বমানবতার কল্যাণের কথা চিন্তা করতে পারে? মানুষকে মামলাবাজী থেকে ফিরানোর আন্দোলন আদালতে মামলা দায়ের করার মাধ্যমে আরম্ভ করা কি যুক্তি সংগত কাজ হতে পারে?
আল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্র
ইসলামী রাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট হলো, তার গোটা অট্রালিকা আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। এ ধারণার মূল কথা১ হলো, বিশ্ব সাম্রজ্য আল্লাহ্র। [১. এ বিষয়ে গ্রন্থের প্রথম দিকের অধ্যায়গুলোতে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।] তিনিই এ বিশ্বের সার্বভৌম শাসক। কোনো ব্যক্তি, বংশ, শ্রেণী, জাতি, এমনকি গোটা মানব জাতিরও সার্বভৌমত্বের [Sovereignty] বিন্দুমাত্র অধিকার নেই। আইন প্রণয়ন এবংনির্দেশ দানের অধিকার কেবরমাত্র আল্লাহ্র জন্যে নির্দিষ্ট। এই রাষ্ট্রের প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে, এখানে মানুষ আল্লাহ্র প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে। আর এ প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা মানুষ সঠিকভাবে লাভ করতে পারে মাত্র দুটি পন্থায়। হয়তো আল্লাহ্র পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো সানুষের নিকট আইন রাষ্ট্রীয় বিধান অবতীর্ণ হবে এবং তিনি তা অনুসরণ ও কার্যকর করবেন। কিংবা মানুষ সেই ব্যক্তির অনুসরণ ও অনুবর্তন করবে, যার নিকট আল্লাহ্র পক্ষ থেকে আইন ও বিধান অবতীর্ণ হয়েছে। এই খিলাফত পরিচালনার কাজে এমন সকল লোকই অংশীদার হবে, যারা এই আইন ও বিধানের প্রতি ঈমান আনবে এবং তা অনুসরণ ও কার্যকর করার জন্যে প্রস্তুত থাকবে। তাদেরকে এরূপ স্থায়ী অনুভূতির সাথে এ মহান কার্য পরিচালনা করতে হবে যে, সামষ্টিকভাবে আমাদের সকলকে এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের প্রত্যেককে এর জন্যে সেই মহান আল্লাহ্ তায়ালার সম্মুখে জবাবদিহি করতে হবে, গোপন ও প্রকাশ্য সব কিছুই যার অবগতিতে রয়েছে। যার জ্ঞানের বাইরে কোনো কিছুই গোপন থাকতে পারেনা। মৃত্যুর পরও যার কর্তৃত্বের দাপট থেকে কোনো মানুষ রেহাই পাবেনা। এই চিন্তা প্রতিটি মুহূর্ত তাদের এ অনুভূতিকে জাগ্রত রাখবে যে, মানুষের উপর নিজেদের হুকুম ও কর্তৃত্ব চালানোর জন্যে, জনগণকে নিজেদের গোলাম বানানোর জন্যে, তাদেরকে নিজেদের জন্যে বিলাসবহুল অট্রালিকা নির্মাণ করার জন্যে, আর স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিলাসিতা, আত্মপূজা এবং হঠকারিতার সামগ্রী পূঞ্জীভূত করার জন্যে আমাদের উপর খিলাফতের এই মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়নি। বরঞ্চ এই বিরাট দায়িত্ব আমাদের উপর এজন্যে অর্পিত হয়েছে, যেনো আমরা আল্লাহ্র বান্দাদের উপর তাঁরই দেয়া ন্যায়ভিত্তিক আইন ও বিধান কার্যকর করি এবং নিজেরা নিজেদের জীরনে তা পুরোপুরি অনুসরণ ও কার্যকর করি। এই বিধানের অনুসরণ অনুবর্তন এবং তা কার্যকর করার ব্যাপারে আমরা যদি বিন্দুমাত্র ত্রুটি করি, এ কাজে যদি অণূ পরিমাণ স্বার্থপরতা, স্বেচ্ছাচারিতা, বিদ্বেষ, পক্ষপাতিত্ব কিংবা বিশ্বাসঘাতকতার অনুপ্রবেশ ঘটাই, তাহলে আল্লাহ্র আদালতে এর শাস্তি অবশ্যি আমাদের ভোগ করতে হবে, দুনিয়ার জীবনে শাস্তি ভোগ থেকে যতোই মুক্ত থাকিনা কেন।
এ মহান আদর্শের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় অট্রালিকা তার মূল ও কান্ড থেকে আরম্ভ করে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর শাখা প্রশাখা পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে ধর্মহীন রাষ্ট্র [Secular States] থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর হয়ে থাকে। তার গঠন প্রক্রিয়া, স্বভাব প্রকৃতি সবকিছুই সেক্যুলার রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্যে প্রয়োজন এক বিশেষ ধরনের মানসিকতা। এক স্বতন্ত্রধর্মী চরিত্র পরিচালনার জন্যে প্রয়োজন এক বিশেষ ধরনের মানসিকতা। এক স্বতন্ত্রধর্মী চরিত্র বৈশিষ্ট। এক অনুপম কর্মনৈপূণ্য। এ রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী, কোর্ট কাচারী, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, আইন কানুন, কর, খাজনা পরিচালনা পদ্ধতি, পররাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধ, সন্ধি প্রভৃতি সকল বিষয়ই ধর্মহীন রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। সেক্যুলার রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ইসলামী রাষ্ট্রের কেরানী, বরঞ্চ চাপরাশী হবারও যোগ্য নয়। সে রাষ্ট্রের পুলিশ ইনেস্পেক্টর জেনারেল ইসলামী রাষ্ট্রের একজন সাধারণ কনষ্টেবল হবারও যোগ্যতা রাখেনা। ধর্মহীন রাষ্ট্রের ফিল্ড মার্শাল এবং জেনারেলরা ইসলামী রাষ্ট্রে সাধারণ সিপাহী পদেও ভর্তি হবার যোগ্যতা রাখেনা। তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো পদ পাওয়া তো দূরের কথা, তার মিথ্যাচার, ধোকাবাজ এবং বিশ্বাসঘাতকতার কারণে হয়তো কারাগারের নিক্ষিপ্ত হওয়া থেকেও রক্ষা পাবেনা।
মোট কথা, ধর্মহীন সেক্যুলার রাষ্ট্র পরিচালনার উপযোগী করে যেসব লোক তৈরী করা হয়েছে এবং সে ধরনের রাষ্ট্রের স্বভাব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে যাদের নৈতিক ও মানসিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণ অযোগ্য। ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক, ভোটার, কাউন্সিলার, কর্মকর্তা, সিপাহী, জজ, ম্যাজিষ্ট্রেট, বিভিন্ন বিভাগীয় কর্মকর্তা, সেনা প্রধান, রাষ্ট্রদূত, মন্ত্রীবর্গ, মোটকথা নিজেদের সাজ জীবনের প্রতিটি বিভগ, পরিচালিকা যন্ত্রের প্রতিটি অংশ সম্পূর্ণ নতুন ভাবে নিজস্ব আদর্শের ভিত্তিতে ঢেলে সাজাতে হবে। এ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে প্রয়োজন এমন সব লোকের, যাদের অন্তরে রয়েছে আল্লাহ্র ভয়। যারা আল্লাহ্র সম্মুখে নিজেদের দায়িত্ব পলনের বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে বলে অনুভূতি রাখে। যারা দুনিয়ার উপর আখিরাতকে অগ্রধিকার দেয়। যাদের দৃষ্টিতে নৈতিক লাভ ক্ষতি পার্থিব লাভ ক্ষতির চাইতে অনেক মূল্যবান। যারা সর্বাবস্থায় সেসব আইন কানুন, নিয়মনীতি ও কর্মপন্থার অনুসরণ করবে, যা তাদের জন্যে বিশেষভাবে প্রণীত হয়েছে। যাদের যাবতীয় চেষ্টা তৎপরতার একমাত্র লক্ষ্য হবে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন। ব্যক্তিগত এবং জাতিগত স্বার্থের দাসত্ব আর কামনা বাসনার গোলামীর জিঞ্জির থেকে যাদের গর্দান সম্পূর্ণ মুক্ত। হিংসা বিদ্বেষ আর দৃষ্টির সংকীর্ণতা থেকে যাদের মন মানসিকতা সস্পূর্ণ পবিত্র। ধন সম্পদ ও ক্ষমতার নেশায় যার উম্মাদ হবার নয়। ধন দৌলতের লালমা অর ক্ষমতার লিস্পায় যারা কাতর নয়। এরূপ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে এমন নৈতিক বলিষ্ঠতার অধিকারী একদল লোক প্রয়োজন, পৃথিবীর ধনভান্ডার হস্তগত হলেও,যারা নিখাঁদ আমানতদার প্রমাণিত হবে। ক্ষমতা হস্তগত হলে জনগণের কল্যাণ চিন্তায় যারা বিনিদ্র রজনী কাটাবে। আর জনগণ যাদের সুতীব্র দায়িত্বানুভুতিপূর্ণ রক্ষাণাবেক্ষণাধীনে নিজেদের জানমাল, ইজ্জত আবরুসহ যাবতীয় ব্যাপারে থাকবে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন। ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে প্রয়োজন এমন একদল লোকের, যারা কোনো দেশে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলে সেখানকার লোকেরা গণহত্যা, জনপদের ধ্বংসলীলা, যুলুম নির্যাতন, গুন্ডামী বদমায়েশী এবং ব্যভিচারের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হবেনা। বরঞ্চ বিজিত দেশের অধিবাসীরা এদের প্রতিটি সিপাহীকে পাবে তাদের জানসাল, ইজ্জত আবরু ও নারীদের সতীত্বের পূর্ণ হিফাযতকারী। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তারা এতোটা সুখ্যাতি ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে যে, তাদের সততা, সত্যাবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, নৈতিক ও চারিত্রিক মূলনীতির অনুসরণ এবং প্রতিশ্রুতি ও চুক্তি পালনের ব্যাপারে গোটা বিশ্ব তাদের উপও আস্থাশীল হবে। এ ধরনের এবং কেবলমাত্র এ ধরনের লোকদের দ্বারাই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কেবলমাত্র এরূপ লোকরেই ইসলামী হুকুমত পরিচালিত করতে সক্ষম। পক্ষান্তরে ঐসব বস্তুবাদী স্বার্থন্বেষী [Utilitarian Mentality] লোকদের দ্বারা এরূপ একটি ইসলামী রাষ্ট্র কিছুতেই প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হতে পারেনা। বরং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে এরূপ লোকদের অস্তিত্ব অট্রালিকার অভ্যন্তরে উইপোকার অস্তিত্বের মতোই বিপজ্জনক। এরা পার্থির স্বার্থ এবং ব্যক্তি ও জতির স্বার্থে নিত্য নতুন নীতিমালা তৈরী করে। এদের মগজে না আছে আল্লাহ্র ভয়, না পরকালের। বরঞ্চ তাদের সমগ্র চেষ্টা তৎপরতার এবং নিত্য নতুন পলিসির মূলকথা হচ্ছে কেবলমাত্র পার্থিব লাভ লোকসানের ‘ধান্দা’।
ইসলামী বিপ্লবের পথ
এতোক্ষণ ইসলামী রাষ্ট্রের যে রূপরেখা অংকন করা হলো, তার পূরো চিত্র স্মরণ রেখে চিন্তা করে দেখুন, এই লক্ষ্য পৌছোবার সত্যিকার কর্মপন্থা কি হতে পারে? আগেই বলেছি, কোনো একটি সমাজের মধ্যকার নৈতিক চরিত্র, চিন্তা চেতনা, মন মানসিকতা, সভ্যতা সংস্কৃতি এবং ইতিহাস ঐতিহ্যগত কর্যকারণের সসন্বিত কর্ম প্রক্রিয়ার ফলেই সম্পুর্ণ স্বাভাবিক নিয়মে ঠিক সে ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভ করে। একটি গাছ অংকুরিত হওয়া থেকে আরম্ভ করে পূর্ণাংগ গাছ পরিণত হওয়া পর্যন্ত যদি তা লেবু গাছ হিসেবে পরিগঠিত হয়ে থাক তবে ফল ফলানোর সময় হঠৎ করে সে গাছ কিছুতেই আম ফলাতে পারেনা। ঠিক তেমনি ইসলামী রাষ্ট্রেরও অলৌকিকভাবে আবির্ভাব ঘটেনা। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার জন্যে প্রথম এমন একটি আন্দোলন উত্থিত হওয়া অপরিহার্য, যার বুনিয়াদ নির্মিত হবে সেই জীবন দর্শন, সেই জীবনোদ্দশ্য, সেই নৈতিক মানদন্ড এবং সেই চারিত্রিক আদর্শের উপর, যা হবে ইসলামের প্রাণশক্তির সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। কেবল সেসব লোকেরাই ঐ আন্দোলনের নেতা ও কর্মী হবার যোগ্যতা রাখবে, যার মানবতার এই বিশেষ ছাঁচ ঢেলে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে প্রস্তুত হবে। সেইসাথে সমাজে অনুরূপ মনমানসিকতা ও নৈতিক প্রাণশক্তি প্রচারের জন্যে প্রাণান্তকর চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যাবে। অতঃপর এই একই বুনিয়াদের উপর এমন এক নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা ঐ বিশেষ টাইপের লোক তৈরী করবে। যা থেকে সৃষ্টি হবে এমন সব মুসলিম বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, মোটকথা জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় এমনসব বিশেষজ্ঞ তৈরী হবে, যার নিজেদের মনমানসিকতা, ধ্যানধারণা ও চিন্তা দর্শনের দিক থেকে হবে পূর্ণ মুসলিম। যাদের ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে বাস্তবধর্মী এক পূর্ণাংগ যোগ্যতা। যারা খোদাদ্রোহী চিন্তানায়কদের মুকাবিলায় নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব [Imtellectual leadership] কে বিজয়ী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার পূর্ণ সামর্থ রাখবে।
এই চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতেই ইসলামী আন্দোলনকে সমাজের বুকে ছাড়িয়ে থাকা ভ্রান্ত জীবন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এই সংগ্রমে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে বিপদ মুসীবত ও অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে, ত্যাগ ও কুরবানীন নযরানা পেশ করে, মার খেয়ে খেয়ে এবং জীবন দিয়ে দিয়ে নিজেদের ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও মজবূত সিদ্ধান্তের প্রমাণ পেশ করতে হবে। পরিক্ষার চুল্লীতে দগ্ধ হয়ে তাদের খাঁটি সোনায় পরিণত হতে হবে। যেনো যে কোনো লোক তাদের নিখাঁদ খাঁটি [Finest standard] সোনাই দেখতে পায়। সংগ্রামের ময়দানে যে আদর্শের পতাকাবাহী হিসেবে তারা অবতীর্ণ হয়েছে, তাদের প্রতিটি কথা কাজে সে আদর্শ প্রতিফলিত হতে হবে। তাদের পতিটি কথা দ্বারা যেনো দুনিয়ার সামনে একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এমন নিষ্কলুষ, নিঃস্বার্থ, সত্যবাদী, পূতিচরিত্র, ত্যাগী, নীতিবান ও খোদাভীরু লোকেরা মানবতার কল্যাণের জন্যে যে আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিার আহবান জানাচ্ছে, তাতে অবশ্যি মানুষের জন্যে সুবিচার, শান্তি ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
এ ধরনের চেষ্টা সংগ্রমের মাধ্যমে সমাজের সেসব লোকই ধীরে ধীরে এই আন্দোলনে শরীফ হয়ে যাবে, যাদের প্রকৃতিতে সত্য ও সততার কিছু না কিছু উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। এর মুকাবিলায় হীন চরিত্র ও নিকৃষ্ট পথের অনুসারীদের প্রভাব ধীরে ধীরে সমাজ থেকে বিলীন হয়ে যেতে থাকবে। জনগণের চিন্তা চেতনায় সৃষ্টি হবে এক প্রচন্ড বিপ্লব। সমাজ জীবন উত্থিত হবে সেই বিশেষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার তীব্র দাবি। তখন এই পরিবর্তিত মানসিকতার সমাজে অপর কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু থাকার পথ হয়ে যাবে সম্পূর্ণ রুদ্ধ। অবশেষে, এক অবশ্যম্ভাবী ও স্বাভাবিক পরিণতির ফলে সেই কাংখিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, যার জন্যে দীর্ঘদিন থেকে যমীনকে তৈরী করা হয়েছে। এভাবে সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার সাথে সাথে পূর্বোল্লিখিত শিক্ষা ব্যবস্থার বদৌলতে, তা পরিচালনার জন্যে একেবারে নিন্মশ্রেণীর কর্মচারী থেকে নিয়ে মন্ত্রী ও গর্ভনর পর্যায় শ্রেণীর কর্মচারী ও কর্মকর্তা সেখানে মওজুদ পাওয়া যাবে।
এ হচ্ছে সেই বিপ্লবের চিত্র ও সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বাভাবিক পন্থা, যাকে ইসলামী বিপ্লব ও ইসলামী রাষ্ট্র বলা হয়। পৃথিবীর সকল বিপ্লবের ইতহাস আপনাদের সামনে রয়েছে। একথা আপনাদের অজানা থাকার কথা নয় যে, একটি বিশেষ ধরনের বিপ্লব ঠিক সেই ধরনের আন্দোলন, অনুরূপ নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনী, অনুরূপ সামষ্টিক ও সামাজিক চেতনা এবং অনুরূপ সাংস্কৃতিক ও নৈতিক পরিবেশই দাবি করে। ফরাসী বিপ্লবের জন্যে সেই বিশেষ ধরনের নৈতিক ও মানসিক ভিত রচনারেই প্রয়োজন ছিলো, যা তৈরী করেছিলেন রুশো, ভল্টেয়ার ও মন্টেস্কোর মতো দার্শনিক। কার্ল মাক্সের দর্শন এবং লেনিন ও ট্রটক্সির নেতৃত্ব আর হাজার হাজার সমাজতান্ত্রিক কর্মীর ত্যাগের বদৌলতেই রুশবিপ্লব সম্ভব হয়েছিল। জার্মানীর জাতীয় সমাজতন্ত্রের পক্ষে সেই বিশেষ নৈতিক মনস্তাতিক ও সাংষ্কৃতিক মাটিতেই শিকড় হাড়া সম্ভব হয়েছিল যা সৃষ্টি করেছেল হেগেল, ফিস্টে, গ্যেটে এবং নিটশের মতো অসংখ্য চিন্তাবিদদের দর্শন ও মতাদর্শ, আর হিটলারের দুর্ধর্ষ দেতৃত্ব। ঠিক তেমনি, ইসলামী বিপ্লবও কেবল তখনি সংঘটিত হতে পারবে, যখন কুরআনী দর্শন ও মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের ভিত্তিতে একটি প্রচন্ড গণআন্দোলন উত্থিত হবে এবং সামাজিক জীবনের মানসিক, নৈতিক, মনস্তাত্বিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিসমূহকে সংগ্রামের প্রচন্ডতায় আমূল পরিবর্তিত করে দেয়া সম্ভব হবে।
৪. ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা
ইসলামী বিপ্লবের জন্যে সমাজ জীবনের পরিবর্তন এবং তা সম্পূর্ণ নতুনভাবে পরিগঠন করার সঠিক পন্থা কি? এবার আমি সংক্ষিপ্তাকারে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত বর্ণনার মাধ্যমে তা আপনাদের সামনে ব্যাখ্যা করতে চাই। তাছাড়া এই সংগ্রামকে সফলতার শিকরে পৌছে দেবার পথার্থ কর্মপন্থাই বা কি? তাও পরিষ্কার করতে চাই।
ইসলাম হচ্ছে সেই মহান আন্দোলনের নাম, যা মানব জীবনের গোটা ইমারত নির্মাণ করতে চায় এক আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের দৃষ্টিভংগির উপর। সেই অতি প্রাচীন কাল থেকেই এ আন্দোলন এই একই ভিত্তি ও পন্থায় চলে আসছে। আল্লাহ্র রসূলগণই [প্রতিনিধিগণ] ছিলেন এ আন্দোলনের নেতা। তাই আমাদেরকেও যদি এ আন্দোলন পরিচালনা করতে হয়, তবে তা অবশ্যি এই সকল নেতৃবৃন্দের পদ্ধতিতেই করতে হবে। কারণ, এছাড়া এ বিশেষ ধরনের আন্দোলনের জন্যে অপর কোনো কর্মপন্থা নেই এবং হতে পারেনা।
এ প্রসংগে আম্বিয়ায়ে কিরাম আলাইহিমুসু সালামের পদচিহ্ন অনুসন্ধান শুরু করলেই আমাদেরকে একটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাহলে, প্রাচীন কাল থেকে যেসব আম্বিয়ায়ে কিরাম অতীত হয়েছেন, তাঁদের কার্যক্রম সম্পর্ক আমরা বিস্তারিত কিছুই জানতে পারিনা। কুরআনের সংক্ষিপ্ত ইশারা ইংগি থেকে তাঁদের কার্যক্রম সম্পর্কে সামান্য ধারণা লাভ করা যায় বটে, কিন্তু তা দ্বারা পূর্ণাংগ স্কীম তৈরী করা যেতে পারেনা। বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে সাইয়্যেদুনা ঈসা আলাইহিস সালামের কিছু বাণী পাওয়া যায় [যা তাঁর বাণী বলে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়], তা থেকে ইসলামী আন্দোলনের সূচনাকাল সম্পর্কে কিছুটা ইংগিত পাওয়া যায় মাত্র। জানা যায়, একেবারে প্রারম্ভিক অধ্যায় এ আন্দোলন কিভাবে পরিচালনা করতে হয় এবং কি কি সমস্যার সম্মখীন তাকে হতে হয়। কিন্তু আন্দোলনের পরবর্তী অধ্যায়গুলো সম্পর্কে সেখানে কোনো ইংগিতই পাওয়া যায়না। করণ, সেসব অধ্যায় ঈসা আলাইহিস্ সালামের জীবনে আসেনি।
এ ব্যাপারে আমরা কেবল এক জায়গা থেকেই পূর্ণাংগ ও সুস্পষ্ট পথ নির্দেশনা পাই। তাহলো, মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যিন্দেগী। নিছক ভক্তি ও ভালবাসার কারণেই আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করছিনে, বরঞ্চ প্রকৃতপক্ষেই এ আন্দোলনের যাবতীয় চড়াই উৎরাই ও বাঁধা বিপত্তির জগদ্দলে ভরা দীর্ঘ পথ কিভাবে পাড়ি দিতে হবে, তা জানার জন্যে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে আমরা বাধ্য। ইসলামী আন্দোলনের সকল নেতার মধ্যে কেবলমাত্র মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই সেই একক নেতা যাঁর জীবনে আমরা ইসলামী আন্দোলনের প্রারম্ভিক দাওয়াতী অধ্যায় থেকে নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাষ্ট্রে ধরন, শাসনতন্ত্র, অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র বিষয়ক পলিসি এবং আইন শৃংখলা ও প্রতিরক্ষা পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি অধ্যায় ও বিভাগ সম্পর্কে পূর্ণাংগ ও সুপ্রমাণিত বিস্তারিত তথ্যাবলী পাই। সুতরাং, আমি এই একমাত্র উৎসটি থেকেই যথাযথ কর্মপন্থার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র আপনাদের সম্মুখে উপস্থাপন করছি। আপনাদরে জানা আছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে অদিষ্ট হন, তখন সারা বিশ্বে নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসংখ্য সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন ছিলো। রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যবাদ তখন বর্তমান ছিলো। শ্রেণী বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছিল। অবৈধ অর্থনৈতিক ফয়দা [Economic Exploitation] লুটার প্রতিযোগিতা চলছিল। আর সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিস্তার লাভ করেছিল নৈতিক অপরাধের জাল। স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বদেশে ছিলো অসংখ্য জটিল সমস্যা। এসব জটিল সমস্যার সমাধানের জন্যে দেশ ছিলো একজন সুযোগ্য লীডারের অপেক্ষায় উদগ্রীব।
তাঁর গোটা দেশ ও জতি ছিলো অজ্ঞতা নৈতিক অধঃপতন, দারিদ্র ও দীনতা এবং ব্যভিচার ও পারস্পরিক কলহ বিবাদে চরমভাবে নিমজ্জিত। কুয়েত থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত পূর্ব ও দক্ষিণের গোটা উপকূল এলাকা এবং উর্বর শস্য শ্যামল ইরাক প্রদেশ পারস্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিস্তার করে রেখেছিল তাদের সাম্রজ্যবাদী থাবা। ইহুদী পূজিপতিরা স্বয়ং হিজাযের অর্থনীতিকেই করেছিল নিয়ন্ত্রণ। গোটা আরবের লোকদের তারা আবব্ধ করে রেখেছিল চক্রবৃদ্ধি সুদের অক্টোপাশে। তাদের শোষণ নিপীড়ন পৌছে গিয়েছিল চরম সীমানায়। পশ্চিম উপকূলের সোজা অপর পাড়ে হাবশায় প্রতিষ্ঠিত ছিলো খৃষ্টান রাষ্ট্র। মাত্র কয়েক বছর পূর্বে এরাই আক্রমণ চালিয়েছিল মক্কায়। হিজায এবং ইয়েমেনের মধ্যবর্তী প্রদেশ নাজরানে বাস করতো এই খৃষ্টানদেরই স্বজাতির লোকেরা। তাছাড়া অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে ছিলো তারা জোটবদ্ধ। এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশেই অবস্থান করছিল তখনকার আরব দেশ, নবীর স্বদেশ। কিন্তু আল্লাহ্ তায়ালা মানুষের পথ প্রদর্শনের জন্যে যে মহান নেতাকে নিযুক্ত করেন, তিনি গোটা বিশ্বের, এমনকি স্বদেশের এতোসব জটিল সমস্যার মধ্যে একটি সমস্যার প্রতিও মনোনিবেশ করেননি। সকল সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে তিনি কেবল একটি দিকেই মানুষকে আহবান জানালেনঃ
“হে মানুষ! তোমরা আল্লাহ্ ছাড়া আর সকল প্রভুত্ব শক্তিকে অস্বীকার করো, পরিত্যগ করো এবং কেবলমাত্র আল্লাহ্র দাসত্ব ও আনুগত্য মেনে নাও।
এর অর্থ এই নয় যে, তাঁর দৃষ্টিতে এই একটি ছাড়া অন্য সকল সমস্যার কোনো গুরুত্বই ছিলোনা, কিংবা সেগুলো কোনো গুরুত্ব পাবারই উপযুক্ত ছিলনা। আপনারা জানেন পরবর্তীকালে তিনি এ সবগুলো সমস্যার প্রতি নযর দেন। একটি একটি করে সবগুলো সমস্যা সমাধান করেন। প্রাথমিক অবস্থায় এসব সমস্যা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে শুধু মাত্র একটি বিষয়ের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেয়া এবং তার সমাধানেই সকল শক্তি নিয়োগ করার পেছনে ছিলো বাস্তব কারণ। এর সধ্যেই নিহিত ছিলো সকল সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি। ইসলামী আন্দোলনের দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের নৈতিক ও সামাজিক জীবনে যতো অধঃপতনই সৃষ্টি হোক না কেন, সেগুলোর মূলীভূত কারণ হলো, মানুষের নিজেকে স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী [Independent] এবংদায়িত্বহীন [Irresponsible] মনে করা। অন্য কথায়, নিজেকেই নিজের ইলাহ বানিয়ে নেয়া। কিংবা এর কারণ হলো, মানুষ কর্তৃক বিশ্বজাহানের একমাত্র ইলাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকেও হুকুমকর্তা ও সার্বভৌম শক্তি হিসেবে মেনে নেয়া। চাই সে মানুষ হোক কিংবা অন্য কিছু। ইসলামের দৃষ্টিতে এই বুনিয়াদী ভুলকে তার অবস্থানের উপর বহাল রেখে কোনো প্রকার বাহ্যিক সংশোধন দ্বারা ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক অধঃপতন ও বিপর্যয় বিদুরিত করার ব্যাপারে কিছুতেই সফলতা লাভ করা যেতে পারেনা। এমতবস্থায় এক স্থানের কোনো একটি অপরাধ সংস্কার করা হলেও অন্য জায়গা দিয়ে তা মাথা গজিয়ে উঠবে। সুতরাং কার্যকর সংশোধনের সূচনা কেবল একটি পন্থায়ই করা যেতে পারে। আর তাহলো, মানুষের মন মগজ থেকে স্বাধীন স্বেচ্ছাচারিতার ধারণা নির্মূল করে দিতে হবে। তার মগজে একথা বসিয়ে দিতে হবে যে, তুমি জগতে বাস করছো, তা কোনো সম্রট বা শাসকবিহীন সাম্রাজ্য নয়। নিঃসন্দেহে এ জগতের একজন বাদশাহ রয়েছেন। তাঁর কর্তৃত্ব কারো স্বীকৃতির মুখাপেক্ষী নয়। তাঁর কর্তৃত্ব মিটিয়ে দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁর সাম্রজ্য থেকে অন্য কোথাও বেরিয়ে যাবার শক্তি তোমার নেই। তাঁর এই শাশ্বত ও অলংঘনীয় কর্তৃত্বের অধীনে অবস্থান করে নিজেকে স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী মনে করাটা তোমার পক্ষে এক বিরাট বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। এরূপ বোকামী ও নির্বুদ্ধিতার পরিণতি তোমাকেই ভোগ করতে হবে। তুমি যদি বুদ্ধিমান ও বাস্তববাদী হয়ে থাকে, তবে বুদ্ধিমত্তা ও বাস্তববাদীতার [Realism] দাবি হলো, সেই মহান সম্রাটের হুকুমের সম্মুখে মাথা নতো করে দাও। তাঁর একান্ত অনুগত দাস হয়ে থাকো।
অপরদিকে, বাস্তবতার এই দিকটিও ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়া দরকার। তাহলো, এই গোটা বিশ্বজগতের কেবলমাত্র একজনই সম্রাট, একজনই মালিক এবং একজনই স্বাধীন সার্বভৌম কর্তা রয়েছেন। এখানে অপর কারো কর্তৃত্ব চলেনা। সুতরাং তুমি তাঁর ছাড়া কারো দাস হয়োনা। অপর কারো কর্তৃত্ব স্বীকার করোনা। অপর কারো সামনে মাথা নতো করোনা। এখানে “হিজ হাইনেজ” কেউ নেই। সকর হাইনেস শুধুমাত্র সেই একমাত্র সত্তার জন্যেই নির্দিষ্ট। এখানে ‘হিজ হাইনেজ’ কেউ নেই। সমস্ত ‘হোলিনেস’ কেবলমাত্র সেই একমাত্র শক্তির জন্যেই নির্ধারিত। এখানে ‘হিজ লর্ডশপি’ কেউ নেই। পূর্ণাংগ ‘লর্ডশীপ’ কেবল সেই সত্তর। এখানে বিধানকর্তা কেউ নেই। আইন ও বিধানকর্তা কেবলমাত্র তিনি এবং কেবলমাত্র তাঁরই হওয়া উচিত। এখানে অন্য কোনো সরকার নেই। অন্নদাতা নেই। অলী ও কর্মকর্তা নেই। নেই কেউ ফরিয়াদ শুনার যোগ্য। ক্ষমতার চাবিকাঠি কারো কাছে নেই। কারো কোনো প্রকার শ্রেষ্ঠত্ব এবং মর্যাদা নেই। যমীন থেকে আসমান পর্যন্ত সবাই এবং সবকিছু কেবল দাসানুসদাস। সমস্ত মালিকানা, প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব কেবলমাত্র আল্লাহ্ রাব্বুল আলামনের। তিনিই একমাত্র ‘রব’ এবং ‘মাওলা’। সুতরাং, তুমি সকল প্রকার গোলামী, আনুগত্য ও শৃংখলকে অস্বীকার করো। কেবলমাত্র তাঁরই গোলাম, অনুগত এবং হুকুমের অধীন হয়ে যাও। এটাই হচ্ছে সকল প্রকার সংস্কার সংশোধনের মূলভিত্তি। এই ভিত্তির উপরই ব্যত্তিগত চরিত্র এবং সমাজ ব্যবস্থার পূর্ণাংগ অট্রালকা সম্পূর্ণ নতুনভাবে গড়ে উঠে। হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যতো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত সৃষ্টি হবে, তা সবই একমাত্র বুনিয়াদী পন্থায়ই সমাধান হওয়া সম্ভব। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো প্রকার পূর্ব প্রস্তুতি, ভূমিকা এবং প্রারম্ভিক কার্যক্রম ছাড়াই সরাসরি এই মৌলিক সংশোধনের অহবান জানান। এই অহবানের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছা পর্যন্ত তিনি কোনো প্রকার বাঁকাচোরা পথ অবলম্বন করেননি। এ উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাজ কারে মানুষের উপর কিৗশলগত প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন। এভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দখল করে ধীরে ধীরে স্বীয় লক্ষ্যে উপনীত হতে পারতেন। কিন্তু এসবের কিছুই তিনি করেননি। বরঞ্চ আমরা দেখি, হঠৎ আরবের বুকে একব্যক্তি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করেন, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লহ্- আল্লাহ্ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।’ তাঁর দৃষ্টি মুহূর্তের জন্যেও এই মৌলিক ঘোষণার চাইতে নিন্মতর কোনো কিছুর প্রতি নিবদ্ধ হয়নি। কেবল নবী সূলভ সাহসিকতা আর আবেগ উদ্যমই এর কারণ নয়। বস্তুত এটাই ইসলামী আন্দোলনের প্রকৃত কর্মপন্থা। এছাড়া অন্যান্য উপায়ে যে প্রভাব, কর্যকরিতা ও কর্তৃত্ব সৃষ্টি হয়, এই সহান সংস্কার কাজের জন্যে তা কিছুমাত্র সহায়ক নয়। যারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুর মৌলিক আদর্শ ছাড়া অন্য কোনো কারণে অপনার সহযোগী হয়, এই মহান পূণর্গঠনের কাজে তারা আপনার কোনো উপকারে আসতে পারেনা।
এই মহান কাজে কেবল সেসব লোকই আপনার সহায়ক ও সহযোগী হতে পারে, যার শুধুমাত্র ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুর’ আওয়ায শুনে আপনার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এ মহাসত্যকেই জীবনের বুনিয়াদ ও জীবনোদ্দেশ্য হিসেবে প্রহণ করে নেয় এবং এরি ভিত্তিতে কাজ করতে প্রস্তুত হয়। সুতরাং ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার জন্যে যে বিশেষ ধরনের চিন্তা ও কর্মকৌশল প্রয়োজন, তার দাবিই হচ্ছে, কোনো প্রকার ভূমিকা ও ভানিতা ছাড়াই সরাসরি তাওহীদের এই মৌলেক দাওয়াতের মাধ্যমে কাজ আরম্ভ করতে হবে।
তাওহীদের এই ধারণা নিছক কোনো ধর্মীয় ধ্যান ধারণা নয়। বরঞ্চ এ হচ্ছে এক পূর্ণাংগ জীবন দর্শন। এ দর্শন স্বেচ্ছাচারিতা এবং গাইরুল্লাহর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্বের উপর সমাজ জীবনে যে কাঠামো বিনির্মিাত হয়েছে, তাকে সম্পূর্ণ মূলোৎপাটিত করে দেয়। বিলকুল এক ভিন্ন ভিত্তি ও বুনিয়াদের উপর গড়ে তোলো নতুন অট্রালিাকা। আজ পৃথিবীর লোকেরা আপনাদের মুয়াযযিনের আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুর বিপ্লবী আওয়াযকে নীরবে শুনে যায়। কারণ, ঘোষণাকারীও জানেনা সে কি ঘোষণা করছে? আর শ্রোতাদেরও নযরে পড়েনা এর কোনো অর্থ আর উদ্দেশ্য। কিন্তু ঘোষণাকারী বলছেঃ আমি কাউকেও বাদশাহ মানিনা, শাসক মানিনা। কোনো সরকারকে আমি স্বীকার করিনা। কোনো আইন আমি মানিনা। কোনো আদালতের আওতাভু্ক্ত [Jurisdiction] আমি নই। কারো নির্দেশ আমার কাছে নির্দেশ নয়। কারো প্রথা আমি স্বীকার করিনা। কারো বৈষম্যমূলক উচ্চ অধিকার, কারো রাজশক্তি, কারো অতি প্রবত্রতা এবং কারো স্বেচ্ছাচারী উচ্চক্ষমতা আমি মাত্রই স্বীকার করিনা। এক আল্লাহ্ ছাড়া আমি সকলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী। সকলের থেকে বিমুখ। ঘোষক আর শ্রোতারা যদি ঘোষণার এই প্রকৃত মর্ম বুঝতে পারে, তবে কি আপনি মনে করছেন বিশ্ববাশী এই ঘোষণাকে সহজভাবে হজম করে নেবে? বরদাশত করবে নীরবে? বিশ্বাস করুন, সে অবস্থায় আপনি করো সাথে লড়তে যান বা না যান, বিশ্ববাসী কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবে। এই ঘোষণা উচ্চরণ করার সাথে সাথে আপনি অনুভব করবেন, গোটা বিশ্ব আপনার দুশমন হয়ে গেছে। চতুনর্দিক থেকে সাপ, বিচ্ছু আর হিংস্র পশুরা আপনাকে নির্মমভাবে আক্রমণ করছে।
মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এই আওয়ায উচ্চরণ করেছিলেন, কথনো এই একই অবস্থা ও পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিলো। ঘোষক জেনে বুঝেই ঘোষণা দিচ্ছিলেন। শ্রোতারাও বুঝেতে পারছিলো কি কথার ঘোষণা দেয়া হচ্ছে? তাই এই ঘোষণার যে দিকটি যাকে আঘাত করছে, সেই উদ্যত হয়ে উঠেছে একে নিভিয়ে দেবার জন্যে। পোপ ও ঠাকুররা দেখলো এ আওয়ায তাদের পৌরহিত্যের জন্য বিপজ্জনক। জমিদার মহাজনরা তাদের অর্থ সম্পদের অবৈধ উপার্জনকারীরা অবৈধ উপার্জনের, ঘোষ্ঠী পূজারীর গোষ্ঠীগত শ্রেষ্ঠত্বের [Racial Superiority] জাতি পূজারীর জাতীয়তাবাদের, পূর্বপুরুষ পূজারীর পূর্বপুরুষদের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পথ ও মতের, মোটকথা এ আওয়ায শুনে সব ধরনের মূর্তি পূজারীর নিজ নিজ মূর্তি বিচূর্ণ হবার ভয়ে আতংকিত হয়ে উঠলো। তাই এতোদিন পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধোমত্ত থাকা সত্ত্বেও, এখন সকল কুফরী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেলো। ‘আল কুফর মিল্লাতুন ওয়াহিদাহ, এই নীতিকথাটি তারা বাস্তবে রূপ দিলো। এক নতুন আন্দোলনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে তারা সমবেত হয়ে গেলো এক প্লাটফরমে।
এই কঠিন অবস্থাতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথী কেবল তারাই হলো, যাদের ধ্যান ধারণাও মানমগজ ছিলো পরিষ্কার পরিশুদ্ধ। যাদের মধ্যে যোগ্যাতা ছিলো সত্যকে বুঝার এবং গ্রহণ করার। যাদের মধ্যে সত্যপ্রিয়তা ছিলো এতোটা প্রবল যে, সত্য উপলব্ধির পর সে জন্যে অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দেবার এবং মৃত্যুকে আলিংগন করবার জন্যে ছিলো তারা সদা প্রস্তুত। এই মহান আন্দোলনেআসতে থাকে। আর বৃদ্ধি পেতে থাকে সংঘাত। অতঃপর কারো রুজি রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। কাউকে ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়। কেই আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কারো ছুটে যায় বন্ধু, কারো হিতাকাংখী। কারো উপরে আসে মারধর। কাউকেও করা হয় জিঞ্জীরাবদ্ধ। কাউকে পাথর চাপা দিয়ে শুয়ে রাখা হয় তপ্ত বালুকার উপর। কাউকেও জর্জরিত করা হয় গালি দিয়ে, কাউকেও বা পাথর দিয়ে। উৎপাটিত করা হয় কারো চোখ। বিচূর্ণ করা হয় কারো শির। নারী, সম্পদ, ক্ষমতা, নেতৃত্ব এবং সকল প্রকার লোভনীয় জিনিস দিয়ে খরিদ করার চেষ্টাও করা হয় কাউকে। এই সকল অগ্নিপরীক্ষা ইসলামী আন্দোলনের উপর এসেছে। আসা জরুরী ছিলো। এগুলো ছাড়া ইসলামী আন্দোলন না মজবুত হতে পারতো আর না পারতো ক্রমবিকাশ ও প্রসার লাভ করতে।
এসব অগ্নিপরীক্ষা ইসলামী আন্দোলনের জন্যে ছিলো খুবই সহায়ক। এসব অগ্নিপরীক্ষার পয়লা ফায়দা এই ছিলো যে, এর ফলে ভীরু কাপুরুষ, হীন চরিত্র ও দুর্বল সংকল্পের লোকেরা এ আন্দোলনের কাছেই ঘেঁষতে পারেনি। ফলে সমাজের মণিমুক্তাগুলোই এসে শরীক হলো আন্দোলনে। আর এ মহান আন্দোলনের জন্যে প্রয়োজন ছিলো এদেরই। তাই যিনিই এ আন্দোলনে শরীক হলেন, কঠিন অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়েই তাকে শরীক হতে হলেছে। বস্তুত এক মহান বিপ্লবী আন্দোলনের উপযোগী শ্রেষ্ঠ লোকদের বাছাইর জন্যে এর চাইতে উত্তম আর কোনো পন্থা হতে পারেনা।
এই অগ্নিপরীক্ষার দ্বিতীয় ফায়দা হলো, এই চরম কঠিন অবস্থার মধ্যে যারা আন্দোলনে শরীক হয়েছে, তাঁর কোনো প্রকার ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতীয় স্বার্থে নয়, বরঞ্চ কেবল মাত্র সত্যপ্রিয়তা এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্যেই এই ভয়াবহ বিপদ মসীবত ও দুঃখ লাঞ্ছনার মুকাবিলা করেছেন। এরই জন্যে তাদের সইতে হয়েছে শত অত্যাচার নির্যাতন। এরই জন্যে হতে হয়েছে আহত প্রহৃত। এরই জন্যে তাদের পড়তে হয়েছে কায়েমী স্বার্থবাদীদের হিংস্র কোপানলে। কিন্তু এর ফল হয়েছে শুভ। এর ফলে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হতে থাকে ইসলামী আন্দোলনের উপযোগী মন মানসিকতা। পয়দা হতে থাকে নিরেট ইসলামী চরিত্র। আল্লাহ্র ইবাদতে সৃষ্টি ও বৃদ্ধি হতে থাকে পরম আন্তরিকতা আর নিষ্ঠা। বস্তুত বিপদ মসীবতের এই মহা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ইসলামী চরিত্র ও ভাবধারা সৃষ্টি হওয়া ছিলো এক স্বাভাবিক ব্যাপার। কোনো ব্যক্তি যখন একটি লক্ষ্য অর্জনের জন্যে প্রবল উদ্যমে যাত্রা শুরু করে, আর তার সেই লক্ষ্য পথে যদি তাকে সম্মুখীন হতে হয় প্রাণন্তকর সংগ্রাম, চরম দ্বন্দ্ব সাংঘাত, অবর্ণনীয় বিপদ মসীবত, দুঃখ কষ্ট, সীমাহীন হয়রানী, যাতনাকর আঘাত, অমানবিক কারা নির্যাতন, বিরামহীন ক্ষুধা আর দুঃসহনীয় নির্বাসনের, তবে এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ফলে তার সেই মহান লক্ষ্য ও আদর্শের সমস্ত বৈশিষ্ট প্রবলভাবে রেখাপাত করে তার হৃদয় মনে। তার মন মগজ, শিরা উপশিরায় প্রবাহিত হতে থাকে তার সেই মহান লক্ষ্যেরই ফল্পুধারা। তার গোটা ব্যক্তিসত্ত্বাই তখন তার জীরনোদ্দেশ্যের রূপ পরিগ্রহ করে। লক্ষ্য অর্জনের পরিপূর্ণতা সাধনের এ সময়টিতে তাদের উপর ফরয করা হয় সালাত। এর ফলে, দূর হয়ে যায় তাদের দৃষ্টির সকল সংকীর্ণতা। গোটা দৃষ্টি ও চিন্তাশক্তি এসে নিবদ্ধ হয় আপন লক্ষ্যের উপর। যাকে তারা একচ্ছত্র বার্বভৌম শাসক বলে স্বীকার করে নিয়েছে, বার বার স্বীকৃতির মাধ্যমে তাদের ধ্যান ধারণা ও মনমস্তিষ্কে বদ্ধমূল হয়ে যায় তাঁর প্রভুত্ব আর সার্বভৌমত্ব। যার হুকুম ও নির্দেশনার ভিত্তিতে আঞ্জাম দিতে হবে জীবন ও জগতের সকল কাজ, তিনি যে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সবকিছুই অবহিত। তিনি যে বিচার দিনের সম্রাট। তিনি যে সকল বান্দাহর উপর দুর্দন্ড প্রতাপশালী। এই কথাগুলো বদ্ধমূল হয়ে যায় তাদের মন ও সস্তিষ্কে। কোনো অবস্থাতেই তাঁর আনুগত্য ছাড়া অপর কারো আনুগত্যের বিন্দুমাত্র চিন্তাও তাদের অন্তরে প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় সম্পূর্ণরূপ। এই অগ্নিপরীক্ষা ও চরম সংঘাতের তৃতীয় সুফল ছিলো, এর ফলে একদিকে এই বিপ্লবী কাফেলায় যারা শরীক হচ্ছিলো, বাস্তত ময়দানে তাদের হতে থাকে যথার্থ প্রশিক্ষণ। অপরদিকে দিনের পর দিন প্রসারিত সম্প্রসারিত হতে থাকে ইসলামী আন্দোলন। মানুষ যখন দেখতে থাকলো, কিছু লোক দিনের পর দিন মার খাচ্ছে। নির্যাতিত হচ্ছে। তখন স্বাভাবিকভাবেই এর মূলীভূত কারণ জানবার প্রবল আগ্রহ পয়দা হতে থাকে তাদের মনে। এই লোকগুলোকে নিয়ে কেন এতো হৈ হট্রগোল? এই প্রশ্নের জবাব পেতে উৎসুক হয়ে উঠে তাদের মন। অতঃপর তাদের অনুসন্ধানী দৃষ্টি যখন জানতে পারতো, আল্লাহ্র এই বান্দাগুলো কোনো নারী, সম্পদ, প্রতিপত্তি বা কোনো প্রকার ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, এক মহাসত্য তাদের কাছে উন্মুক্ত হয়েছে এবং তারা তা একনিষ্ঠভাবে আঁকড়ে ধরে আছে বিধায় এভাবে তাদের অত্যাচারিত করা হচ্ছে, তখন স্বঃতই সেই মহাসত্যকে জানার জন্যে তাদের মন হয়ে উঠতো ব্যাকুল। অতঃপর যখন লোকেরা জানতে পরতো, সেই মহাসত্য হচ্ছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, এ জিনিসই মানব জীবনে এমন ধরনের বিপ্লব সৃষ্টি করে আর এরই দাওয়াত নিয়ে এমন সব লোকেরা উত্থিত হয়েছে, যারা কেবল এই সত্যেরই জন্যে দুনিয়ার সমস্ত ফায়দা ও স্বার্থকে ভূলুন্ঠিত করছে। নিজেদের জমি, মাল, সন্তান সন্ততিসহ প্রতিটি জিনিস অকাতরে কুরবানী করছে। তখন তারা বিস্ময়ে অবিভূত হয়ে যেতো। খুলে যেতো তাদের চোখ। ফেটে যেতো তাদের মন মগজকে আচ্ছন্ন করে রাখা পর্দা। আর এই মহাসত্য তাদের হৃদয়ের মধ্যে বিদ্ধ হতো তীরের তীব্র ফলকের মতো। এরই ফলে সকল মানুষ এই আন্দোলনে শরীক হতে পারেনি, যাদেরকে অভিজাত্যের অহংকার, পূর্ব পুরুষদের অন্ধ অনুকরণ আর পার্থিব স্বার্থ সম্পূর্ণরূপে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। এছাড়া সে সমাজের প্রতিটি নিঃস্বার্থ সত্যপ্রিয় লোককেই, কেউ আগে কেই পরে, শেষ পর্যন্ত এ আন্দোলনে এসে শরীক হতে হয়েছে।
এ সময় আন্দোলনের নেতা নিজ ব্যক্তিগত জীবনের মাধ্যমে তার এই আন্দোলনের যাবতীয় মূলনীতি এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ সুস্পষ্টভাবে মানব সমাজের সম্মুখে তুলে ধরেন। তাঁর প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ এবং চালচলন ও গতিবিধির মধ্যে ফুটে উঠতো ইসলামে প্রাণসত্তা। এতে লোকেরা বাস্তব ভাবে বুঝতে পারতো ইসলাম কি জিনিস? এ বিষয়টি বিস্তারিত আলোজনার দাবী রাখে। কিন্তু এই ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যাখ্যামূলক আলোচনার অবকাশ নেই। তাই অতি সংক্ষেপে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক এখানে উপস্থাপন করছি। এই বিপ্লবী আন্দোলনের নোতার স্ত্রীর এই অর্থ সম্পদ দিয়ে ব্যবসা করতেন। ইসলামের দাওয়াত শুরু করার পর তাঁর সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। কেননা, অনুক্ষণ দাওয়াতী কাজে ব্যস্ত থাকা এবং এর ফলে গোটা আরববাসীকে নিজের শত্রু বানিয়ে নেয়ার পর ব্যবসায়ের কাজ আর কিছুতেই চলা সম্ভব ছিলোনা। নিজেদের হাতে যা কিছু পূর্বের জমা ছিলো, আন্দোলন সম্প্রসারণের কাজে স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে মাত্র কলেক বছরের মধ্যেই তা নিঃশেষ করে দেন। এরপর তাদেরকে এক চরম অর্থ সংকটের সম্মুখীন হতে হয়। দীন প্রচারের কাজে তিনি যখন তায়েফ গমন করেন, তখন হিজাযের এক সময়কার এই বাণিজ্য সম্রাটের ভাগ্যে সোয়ারীর জন্যে একটি গাধা পর্যন্ত জোটেনি।
কুরাইশের লোকেরা তাঁর হিজাযের রাজতখুত গ্রহণ করার প্রস্তার দেয়। তারা বলে, আমরা আপনাকে আমাদের বাদশাহ বানিয়ে নেবো। আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীকে আপনার কাছে বিয়ে দেবো। সম্পদের স্তুপ আপনার পদতলে ঢেলে দেবো। এ সব কিছু আমরা আপনার জন্যে করবো। একটি শর্তে। তাহলো, এই আন্দোলন থেকে আপনাকে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু মানবতার মুক্তিদূত তাদের এসব লোভনীয় প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এই সবের পরিবর্তে তিনি তাদের উপহাস, তিরস্কার আর প্রস্তরাঘাতকেই সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করেন।
কুরাইশ এবং আরবের সমাজপতিরা বললো, হে মুহাম্মাদ, আপনার দরবারে তো সব সময় কৃতদাস, দরিদ্র এবং নীচু শ্রেণীর (নাউযুবিল্লাহ) লোকেরা বসে থাকে। এমতাবস্থায় আমরা কী করে আপনার দরবারে এসে বসতে পারি? আমাদের ওখানে যারা একেবারে নীচু শ্রেণীর, তারাই সব সময় আপনার চারপাশ ঘিরে থাকে। তাদেরকে আপনার নিকট থেকে তাড়িয়ে দিন, তবেই আমরা আপনার কাছে আসতে পারি, কথাবার্তা বলতে পারি। কিন্তু গোটা মানবতার যিনি নেতা, যিনি এসেছেন মানুষের উঁচু নিচু শ্রেণীভেদ মিটিয়ে দেবার জন্যে, তিনি তো কিছুতেই সমাজপতিদের মন রক্ষার জন্যে দারিদ্রদের বিতাড়িত করতে পারেননা।
এই বিপ্লবী আন্দোলনের মহান নেতা মুহাম্মাদ, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর আন্দোলনের ব্যাপারে স্বীয় দেশ, জাতি, গোত্র ও বংশের কারো স্বার্থেরই কোনো পরোয়া করেননি। আন্দোলনের ব্যাপারে কোনো স্বার্থের সাথেই তিনি আপোষ করেননি। তাঁর এই নৈতিক দৃঢ়তাই মানুষের মনে এক চরম আস্থার জন্ম দিলো যে, নিঃসন্দেহে মানুষের কল্যাণের জন্যে চিন্তা করতেন, তবে হাশেমী গোত্রের লোক ছাড়া আর কারোই এ আন্দোলনের প্রতি কোনো আগ্রহ থাকতো না। তিনি যদি কুরাইশদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে ব্যস্ত হতেন, তবে অকুরাইশ আরবরা তাঁর আন্দোলনে শরীক হবার কল্পনাই করতোনা। কিংবা আরব জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা যদি হতো তাঁর উদ্দেশ্য, তবে হাবশী বেলাল, রোমদেশী সুহাইব আর পারস্যের সালমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমের কি স্বার্থ ছিলো তার সহযোগিতা করার? বস্তুত, যে জিনিস সকল জাতির লোকদেরকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করেছে, তা ছিলো নিরেট আল্লাহ্র দাসত্বের প্রতি আহবান। ব্যক্তিগত, বংশগত, গোত্রগত ও জাতিগত স্বার্থের ব্যাপারে পরিপূর্ণ অনাগ্রহ।গোটা মানবতাকে নিরেট আল্লাহ্র দাসত্বের প্রতি আহবানের ফলেই বংশ বর্ণ ও জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল ধরনের মানুষ এ আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এর প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রাণোৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
তিনি যখন মক্কা থেকে হিজরত করতে বাধ্য হন, তখনো তাঁর শত্রুদের প্রচুর ধনসম্পদ তাঁর নিকট আমানত ছিলো। এগুলো স্ব স্ব মালিকের কাছে ফেরৎ দেবার জন্যে তিনি হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে বুঝিয়ে দিয়ে যান। কোনো দুনিয়া পূজারী লোকের পক্ষে এধরনের সুযোগ হাতছাড়া করা সম্ভব নয়। সে সবকিছুই আত্মসাৎ করে সাথে নিয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহ্র দাস তখনো স্বীয় জানের দুশমন ও রক্ত পিপাসদের সম্পদ তাদের হাতে পৌঁছে দেবার চিন্তা করেন, যখন তারা তাঁকে হত্যা করাবার ফয়সালা গ্রহণ করেছে। নৈতিক চরিত্রের এই অকল্পনীয় উচ্চতা অবলোকন করে আরবের লোকেরা বিস্মিত না হয়ে পেরেছেল কি? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দুই বছল পর যখন বদর ময়দানে তারা তাঁর বিরুদ্ধে তরবারি উত্তোলন করেছিল, তখন তাদের মন হয়তো তাদের বলছিল, এ কোন্ মহা মানবের সাথে তোমরা লড়ছো? সেই মহানুভবের বিরুদ্ধে তরবারি উত্তোলন করছো, জন্মভূমি থেকে বিদায়ের কালেও যিনি মানুষের অধিকার ও আমানতের দায়িত্বের কথা ভুলেননি? হয়তো জিদের বশবর্তী হয়ে তখন তারা লড়াই করেছিল, কিন্তু তাদের বিবেক তাদের দংশন করছিল। আমার বিশ্বাস, বদর যুদ্ধে কাফিরদের হরাজয়ের নৈতিক কারণগুলোর মধ্যে এটাও ছিলো অন্যতম।
তের বছরের প্রাণান্তকর সংগ্রামের এমন আড়াই-তিনশ লোক সংগৃহীত হয়ে হিয়েছিল, যার ইসলামের পূর্ণ প্রশিক্ষণ পেয়ে এতোটা যোগ্য হয়েছিল যে, তারা যে কোনো অবস্থা ও পরিস্থিতিতে মুসলমান হিসেবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম ছিলো। একটি ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে এ লোকগুলো পূরোপূরী তৈরী করা ছিলো। সুতরাং সেই কাংখিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দেয়া হলো। দশ বছর পর্যন্ত স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই রাষ্ট্রের নেতৃত্ব প্রদান করেন। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি তাদেরকে রাষ্ট্রের সকল বিভাগ ইসলামী পদ্ধতিতে পরিচালনা করার প্রশিক্ষণ দিয়ে যান। এ যুগটি ছিলো ইসলামী আদর্শের তাত্ত্বিক ধারণার [Abstract Idea] স্তর পেরিয়ে পূর্ণাংগ সমাজ কাঠামোর স্তরে পৌছার যুগ। এ যুগে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, অর্থ ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা, সমর ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রভৃতি সকল বিষয়ে ইসলামের প্রণীত হয়। সেসব মূলনীতিকে বাস্তবে রূপদানও করা হয়। এই বিশেষ পন্থা ও পদ্ধতিতে কাজ করার জন্যে শিক্ষা দীক্ষা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কর্মী বাহিনী তৈরী করা হয়। এই লোকেরই বিশ্ববাসীর সন্মুখে ইসলামী শাসনের এমন আদর্শ নমূনা পেশ করেছিল যে, মাত্র আট বছর সময়কালের মধ্যে মদীনার মতো একটি ক্ষুদ্রায়তনের রাষ্ট্র গোটা আরব রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়ে যায়। যেখান থেকেই যে লোক ইসলামের বাস্তবরূপ দেখতে পেলো এবং এর শুভ পরিণাম অনুভব করতে পারলো, সে স্বঃতই বলে উঠলো, প্রকৃতপক্ষে এরই নাম মানবতা। এরি মধ্যে রয়েছে মানবতার কল্যাণ। দীর্ঘকালব্যপী যারা মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো, শেষ পর্যন্ত তাদেরকেও এই মহান আদর্শ গ্রহণ করতে হয়েছিল। খালিদ বিন ওলীদ ইসলামের ছায়াতলে এসে যায়। আবু জাহিলের পুত্র ইকরামা ইসলাম কবুল করে নেয়। আবু সুঠিয়ান ইসলামের পক্ষে এসে যায়। হযরত হামযা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর হন্তা ওহাশী ইসলামের বিধান গ্রহণ করে নেয়। হযরত হামযা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর কলিজা ভক্ষণকারী হিন্দাকেও শেষ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির সত্যবাণীর সন্মুখে মাথা নত করে দিতে হয়, যার চাইতে ঘৃণিত ব্যক্তি তার দৃষ্টিতে আর কেউই ছিলনা।
ঐতিহাসিকরা ভুল করেই তখনকার যুদ্ধগুলোকে বিরাট গুরুত্ব দিয়ে আলোকপাত করেছেন। এ ভুলের কারণে লোকেরা মনে করে বসেছে, আরবের সেই মাহান বিপ্লব যুদ্ধ বিগ্রহের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়েছে। অথচ আসল ব্যাপার এর সম্পূর্ণ উল্টো। সেই আট বছরে যে যুদ্ধগুলো দ্বারা আরবের যুদ্ধবাজ কওমগুলো তিরস্কৃত হয়েছিল, তার সবগুলোতে উভয় পক্ষের হাজার বারশ’র বেশী লোক নিহত হয়নি। পৃথিবীর বিপ্লব সমূহের ইতিহাস যদি আপনার জানা থাকে, তবে আপনাকে অবশ্যি স্বীকার করতে হবে, এ বিপ্লব রক্তপাতহীন বিপ্লব [Bloodless Revolution] নামে আখ্যায়িত হওয়াই যুক্তিযুক্ত। তাছাড়া এ বিপ্লবের ফলাফলও পৃথিবীর সকল বিপ্লবের চাইতে ভিন্নধর্মী। এ বিপ্লব দ্বারা কেবল রাষ্ট্র ব্যবস্থারই পরিবর্তন হয়নি। বরঞ্চ মানুষের মন মানসিকতাও চিন্তভাবনাও পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। এতে মানুষের দৃষ্টিভংগি পাল্টে যায়। চিন্তাপদ্ধতি বদলে যায়। জীবন যাপন পদ্ধতির পরিবর্তন হয়ে যায়। নৈতিক চরিত্রের জগতে আসে আমূল পরিবর্তন। স্বভাব ও অভ্যাস যায় পাল্টে। মোট কথা, এ মহান বিপ্লব গোটা জাতির কায় পরিবর্তন করে দেয়। ব্যভিচারী নারী সতীত্বের রক্ষক হয়ে যায়। মদ্যপায়ী মাদকবিরোধী আন্দোলনের পতাকাবাহী হয়ে যায়। আগে যে চুরি করতো, এ বিপ্লব তার মধ্যে আমানতদারীর অনূভূতি এতোটা তীব্রভাবে জাগ্রত করে দেয় যে, এখন সে এ ভেবে বন্ধুর বাড়ীর খানা খেতেও দ্বিধান্বিত হয়, না জানি এটাও অন্যায়ভাবে অপরের সম্পদ ভক্ষণ বলে গণ্য হয়ে যায়। এমনকি এ ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ্ তায়ালাকে কুরআনের মাধ্যমে তাদের আশ্বস্ত করতে হয়েছে যে, এ ধরনের খাবার খেতে কোনো দোষ নেই। ১ ডাকাত ও ছিনতাইকারীর এমন অনুপম দীনদার ও বিশ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল যে, ইরান বিজয়ের সময় এদেরিই একজন সাধারণ সৈনিক কোটি কোটি টারা মূল্যের রাজমুকুট হস্তগত হবার পর, তা রাতের অন্ধকারে কম্বলের নিচে লুকিয়ে সেনাপতির নিকট পৌছে দেয়। সে এই গোপণীয়তা এই জন্যে অবলম্বন [১.দেখুন সূরা নূর, আয়াতঃ৬১।] করেছিল, যাতে করে এই অস্বাভাবিক ঘটনা দ্বারা লোক সমাজে তার আমানতদারীর খ্যাতি ছড়িয়ে না পড়ে। তার ইখলাস বা নিয়তের নিষ্ঠার মধ্যে ‘রিয়া’ ও প্রদর্শনী মনোবৃত্তির কলম্ক লেগে না যায়। যাদের কাছে মানুষের জীবনেরে কোনো মূল্য ছিলোনা, যার নিজ হাতে স্বীয় কন্যাদের জীবন্ত কবর দিতো, তাদের মধ্যে নিরাপত্তা ও মর্যাদাবোধ এমন তীব্রভাবে জাগ্রত হয়েছিল যে, নির্দয়ভাবে একটি মুরগী জবাই করতে দেখলেও তাদের কাছে চরম কষ্ট লাগতো। যাদের গায়ে কখনো সত্যবাদিতা ও ন্যায় পরায়ণতার বাতাস পর্যন্ত লাগেনি, তাদের মধ্যে ন্যায় পরায়ণতা, সততা ও সত্যবাদিতার এমন উচ্চতম বৈশিষ্ট সৃষ্টি হয়েছিল যে খায়বরের সন্ধির পর এদের তহসীলাদার ইহুদীদের কাছ থেকে সরকারী রাজস্ব আদায় কতের গেলে ইহুদীরা তাকে এই উদ্দেশ্যে একটা মোট অংকের অর্থ দিতে চায়, যাতে করে সে সরকারী পাওনা কম করে নেয়। কিন্তু সে তাদের মুখের উপর উৎকোচ নিতে অস্বীকার করে দেয় এবং উৎপন্ন ফসল তাদের ও সরকারের মধ্যে সমান দুই স্তূপে বন্টন করে তাদেরকে যে কোনো একম্তূপ গ্রহণ করার অধিকার প্রদান করে। মুসলিম তহসীলদারের ইনসাফ ও সততার এই চরম পরাকাষ্ঠ দেখে ইহুদী। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল, আর অজ্ঞাতেই তাদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল, এই ধরনের আদল ও ইনসাফের উপরই আসমান ও যমীন প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তাদের মধ্যে এমন সব শাসনকর্তার আর্বিভাব ঘটে, যাদের কোনো প্রসাদ ছিলনা। বরঞ্চ তারা জনগণের সথে বসবাস করতেন এবং তাদের মধ্যে সাধারণ কুটীরেই বাস করতেন। পায়ে হেঁটে হাটবাজারে যেতেন। দরজায় দ্বাররক্ষী রাখতেননা। রাত দিন চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে যে কেউ যখন ইচ্ছা তদের সাথে সাক্ষাত করতে পারতো। তাদের মধ্যে এমন সব ন্যায় পরয়ণ বিচারপতির আবির্ভাব ঘটে, যাদেরই একজন জনৈক ইহুদীর বিরুদ্ধে স্বয়ং খলীফার দাবী একারণে খরিজ করে দেন যে, খলীফা স্বীয় গোলাম এবং পুত্র ব্যতিত আর কাউকেও সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করাতে পারেননি। [১. এটা হযরত আলীর (রাঃ) খিলাফত কালের ঘটনা।] তাদের মধ্যে এমন সব সেনাপতির আবির্ভাব ঘটে, যাদেরই একজন কোনো একটি শহর থেকে বিদায় নেবার প্রাক্কালে শহরবাসীদের থেকে আদায়কৃত সমস্ত জিনিস এই বলে তাদের ফেরত দিয়ে যান যে, এখন থেকে যেহেতু আমরা তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে পারবোনা সে কারণে তোমাদের থেকে আদায়কৃত কর আমাদের হাতে রাখার কোনো অধিকার আমাদের নেই। এমনি করে তাদের মধ্যে জন্ম নেয় অসংখ্য নির্ভীক রাষ্ট্রদূত। এদেরই একজন ইরানী সেনাধ্যক্ষের ভর দরবারে ইসলাম বর্ণিত মানবিক সাম্যনীতি নির্ভীকভেবে প্রকাশ করেন। তীব্র সমালোচনা করেন ইরানী শ্রেনী বৈষম্যের। আল্লাহ্ জানেন সেদিনকার এই ঘটনায় কতো ইরানী সিপাহীর অন্তরে এই মানব ধর্মের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ববোধ জাগ্রত হয়েছিল। ইসলামী বিপ্লব তাদের মধ্যে এমন সব তীব্র নৈতিক দায়িত্বনুভূতি সম্পন্ন নাগরিকের জন্ম দেয়, যাদের দ্বারা হাত কাটা এবং পাথর মেরে হত্যার কারার মতো অপরাধ সংঘটিত হয়ে যাবার পরও, নিজেরাই এসে নিজেদের উপর দন্ড প্রয়োগের দাবী করতে থাকে, যাতে করে তাদের চোর বা ব্যভিচারী হিসেবে আল্লাহ্র আদালতে হাজির হতে না হয়। ইসলামী বিপ্লব এমন সব আদর্শ সিপাহীর জন্ম দেয়,যারা বেতন বা কোনো পার্থিব স্বার্থ লাভের জন্যে যুদ্ধ করেনি। বরঞ্চ কেবলমাত্র সেই মহান আদর্শের জন্যে যুদ্ধ করেছে, যার প্রতি তারা ঈমান এনেছিলো। বেতন ভাতা তো তারা গ্রহণ করেইনি, তদুপরি নিজ খরচে তারা যুদ্ধের ময়দানে যেতো এবং গনীমতের মাল হস্তগত হলে, তা সরাসরি সেনাপতির দরবারে এনে হাজির করতো। নিজে হস্তগত করতোনা।
এখন বলুন, সামাজিক পরিত্র ও সমষ্টিগত মানসিকতার এই আমূল পরিবর্তন কি শুধু যুদ্ধ বিগ্রহ দ্বারা সম্ভব ছিলো? ইতিহাস আপনাদের সম্মুখে রয়েছে। এমন কোনো উদাহরণ কি আপনারা তাতে পেয়েছেন যে, শুধুমাত্র তরবারি কোনো মানব গোষ্ঠির মধ্যে এরূপ আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে?
মূলত এ এক বিস্ময়কর ব্যাপারে, যেখানে প্রথম তের বছরে মাত্র আড়াই তিনশ’ লোক সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে পরবর্তী দশ বছরে গোটা দেশ মুসলমান হয়ে গেলো। এর রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয়ে লোকেরা নানাপ্রকার অমূলক অবাস্তব ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করে থকে। অথচ এর কারণে দিবালোকের মতো পরিষ্কার, সুম্পষ্ট। যতোদিন এই নতুন আদর্শ অনুযায়ী মানব জীবনের বাস্তব রূপায়ণ লোকেরা দেখতে পায়নি, ততোদিন এই অভিনব আন্দোলেনের নেতা আসলেই কি ধরনের সমাজ গড়তে চান,তা তারা বুঝে উঠতে পারেনি। এ সময় নানা প্রকার সন্দেহ সংশয় তাদের মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। কেউ বলতো, এতো কেবল কবির কল্পনাবিলাস। কেউ বলতো, এটাতো কেবল ভাষার যাদুগিরি। কেউ বলতো, লোকটি আসলে পাগল হয়ে গিয়েছে। আবার কেই তাকে নিছক একজন কল্পনাবিলাসী [Visionary] লোক বলে ঘোষণা করতো।
এ সময় কেবল অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও প্রতিভাবান লোকেরাই ঈমান এনেছিল। যারা বাস্তব দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলেন, এই আদর্শের মধ্যেই রয়েছে মানবতার কল্যাণের প্রকৃত চিহ্ন। কিন্তু যখন এই কল্পিত আদর্শের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাংগ জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো, লোকেরা স্বচক্ষে এর বাস্তব চিত্র দেখতে পেলো এবং তাদের চোখের সামনে সীমাহীন সফল দেখতে পেলো তখন তারা বুঝতে পারলো, আল্লাহ্র এই বান্দাহ এই মহান সমাজ গঠনের জন্যেইতো এতো দুঃখ কষ্ট আর অত্যাচার নির্যাতন সয়ে আসছেন। এরপর জিদ আর হঠকারিতার উপর অটল থাকার আর কোনো সুযোগই থাকলোনা। যার কপালেই দুটি চোখ ছিলো, আর চোখের মধ্যে জ্যোতি ছিলো, তার পক্ষে এই চোখে দেখা বাস্তবতাকে অস্বীকার করার আর কোনো উপায়ই ছিলনা।
বস্তুত ইসলাম যে সমাজ বিপ্লব সংঘটিত করতে চায়, এই হলো তার সঠিক পন্থা। এই হচ্ছে সেই বিপ্লবের রাজপথ। এই পন্থায়ই তার সূচনা হয় আর এই ক্রমধারায়ই হয় তা বিকশিত। এই বিপ্লবকে একটা মু’জিযা মনে করে লোকেরা বলে বসে, এ কাজ এখন আর সম্ভব নয়। এটাতো নবীর কাজ। নবী ছাড়া তা করা সম্ভব নয়। কিন্তু ইতিহাসের অধ্যয়ন আমাদের একথা পরিষ্কার করে বলে দেয়, এ বিপ্লব এক স্বাভাবিক বিপ্লব। এর মধ্যে কার্যকারণ পরস্পরাপর পূর্ণ যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক আমরা দেখতে পাই। আজো যদি ঐ একই পদ্ধতিতে কাজ করি, তবে একই ধরনের ফলাফল প্রকাশ হতে পারে। তবে, একথা সত্য, এ কাজের জন্যে প্রয়োজন ঈমান, ইসলামী চেতনা, ঐকান্তিক নিষ্ঠা, মজবূত ইচ্ছাশক্তি এবং ব্যক্তিগত আবেগ উচ্ছাস ও স্বার্থের নিঃশর্ত কুরবানী। এ কাজের জন্যে এমন একদল দুঃসাহসী যুবকের প্রয়োজন, যারা সত্যের প্রতি ঈমান এনে তার উপর পাহাড়ের মতো অটল হয়ে থাকবে। অন্য কোনো দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হবেনা। পৃথিবীতে যাই ঘটুকনা কেন, তারা নিজেদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের পথ থেকে এক ইঞ্চিও বিচ্যুত হবেনা। পার্থিব জীবনে নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নতির সকল সম্ভাবনাকে অকাতরে কুরবানী করে দেবে। স্বীয় সন্তান সন্ততি, পিতা মাতা ও আপনজনের স্বপ্ন সাধ বিচূর্ণ করতে কুষ্ঠাবোধ করবেনা। আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধু বান্ধবদের বিচ্ছেদ বিরাগে চিন্তিত হবেনা। সমাজ, রাষ্ট্র, আইন, জাতি, স্বদেশ, যা কিছুই তাদের উদ্দেশ্য পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে, তারাই বিরুদ্ধে লড়ে যাবে। অতীতেও এ ধরনের লোকেরাই আল্লাহ্র কালেমাকে বিজয়ী করেছে। আজোও এ ধরনের লোকেরাই আল্লাহ্র কালেমাকে বিজয়ী করবে। এ মহান বিপ্লব কেবল এ ধরনের লোকের দ্বারাই সংঘটিত হতে পারে। [তর্জমানুল কুরআন, সেপ্টেম্বরঃ ১৯৪০।]
৫.শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের পন্থা
প্রশ্নঃ নিম্নে দুটি সন্দেহের কথা উল্লেখ করছি। মেহেরবানী করে এ দুটি বিষয়ে সঠিক ধারণা দান করবেন।
১.তরজমানুল কুরআনের গত সংখ্যায় একজন প্রশ্নকারীর এ প্রশ্ন প্রকাশ হয়েছে যে, নবীপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোনো সুসংগঠিত রাষ্ট্র শক্তির মুকাবিলা করতে হয়নি। অথচ হযরত ইউসুফ আলাইহিস্ সালামের সামনে ছিলো এক সুপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা। তিনি যখন পূর্ণ রাষ্ট্র ক্ষমতা তার হাতে ন্যস্ত করার ব্যাপারে রাষ্ট্রকে সম্মত পেলেন, তখন তিনি এগিয়ে হিয়ে তা কবুল করেন। প্রথমে ঈমানদার সৎ লোকদের একটি জামায়ত তৈরী করতে হবে এ পন্থা তিনি অবলম্বন করেননি। আজকের যুগেও কি তাঁর অনুসৃত সে নীতি অবলম্বন করা যেতে পারেনা? কেননা বর্তমানে রাষ্ট্র ব্যবস্থা তো আগের তুলনায় আরো অধিক শক্তি এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে?- এ প্রশ্নের জবাবে আপনি যা কিছু লিখেছেন, তাতে আমি পূর্ণ আশ্বস্ত হতে পারিনি। আমার প্রশ্ন হলো আমাদেরকে হযরত ইউসুফ আলাইহিস্ সালামের অনুসরণ কেন করা উচিত? আমাদের জন্যে তো শুধু সাহাম্মদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণই ওয়াজিব। তিনি তো মক্কাবাসীদের বাদশাহীর প্রস্তার প্রত্যাখান করে নিজস্ব পন্থায় পৃথক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ফয়সালা করেন এবং বর্তমানে আমাদের জন্যেও এটাই একমাত্র কর্মপন্থা। আমার এ মত কতোটা সঠিক কিংবা কতোটা ভুল মেহেরবানী করে বিস্তারিতভাবে জানাবেন।
২. আপনি আরো লিখেছেনঃ কোনো এক পর্যায়ে গিয়ে যদি এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, প্রচলিত সাংবিধানিক পন্থায় অনৈসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে আমাদের আদর্শের ছাঁচে ঢেলে গড়া সম্ভব, তখন আমরা সে সুযোগ গ্রহণে দ্বিধা করবোনা। এ বাক্য দ্বারা লোকদের এ ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে যে জামায়াতে ইসলামীও পার্লামেন্টে আসার জন্যে অনেকটা প্রস্তুত এবং জামায়াত নির্বাচনকে জায়েয মনে করছে। এ বিষয়ে জামায়াতের নীতি সম্পর্কে আলোকপাত করুন।
জবাবঃ ১. সকল নবীই আমাদের জন্যে অনুসরণীয়। স্বয়ং নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও এই নির্দেশই দেয়া হয়েছিলো যে,“সেই পন্থা ও তরীকায় চলো যা ছিলো আম্বিয়ায়ে কিরামের পন্থা ও তরীকা।” কোনো নবী কোনো বিশেষ পন্থা অবলম্বন করেছিলেন বলে যদি আমরা কুরআন থেকে অবগত হই এবং কুরআন যদি সেই কর্মপন্থাকে মনসূখ ঘোষণা না করে থাকে তবে সেটাও আমাদের জন্যে মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের অনুসৃত পন্থার মতোই দীনি কর্মপন্থা।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে বাদশাহী প্রদনের পস্তাব করা হয়েছিল তা ছিলো এই শর্ত সাপেক্ষে যে, আপনি এই দীন এবং এর প্রচার বন্ধ করুন, তাহলে আমরা সবাই মিলে আপনাকে আমাদের বাদশাহ বানিয়ে নেবো। হযরত ইউসুফ আলাইহিস্ সালামের সামনেও যদি এই শর্ত পেশ করা হতো তবে তিনি সেই বাদশাহীকে অভিশপ্ত মনে করতেন, যেমন মনে করেছিলেন নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কিন্তু হযরত ইউসুফ আলাইহিস্ সালামকে যে সব ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল সেগুলো ছিলো নিঃশর্ত এবং প্রতিবন্ধকতাহীন। তা গ্রহণের সাথে সাথে তিনি রাষ্ট্র ব্যবাস্থাকে সত্য দীন সুতাবিক পরিচালনার ক্ষমতাও লাভ করেছিলেন। এমনটি যদি নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনেও পেশ করা হতো, তবে তিনিও তা গ্রহণ করেতেন এবং বিনা কারণে লড়াই করে সেই জিনিস লাভ করার প্রয়োজন পড়তোনা, যা এমনি তাঁকে দেয়া হচ্ছিলো। একইভাবে জনমতের সাহায্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তগত করে নিরেট ইসলামী বিধানের ভিত্তিতে তা পরিচালনা করার সুযোগ যদি আমাদেরও আসে তবে তা গ্রহণ কতের আমরা কোনো প্রকান দ্বিধা করবোনা।
২ নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়া এবং পার্লামেন্টে যাওয়ার উদ্দেশ্য যাদি হয় অনৈসলামী সংবিধানের অধীনে একটি ধর্মহীন [Secular] গণতান্ত্রিক [Democratic] রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনা করা, তবে সেটা আমাদের তাওহীদী আকীদাহ এবং আমাদের দীনের সম্পূর্ণ খিলাফা। কিন্তু আমরা যদি কখনো দেশের জনমতকে আমাদের আকীদাহ ও নীতির পক্ষে এতোটা ব্যাপকভাবে একমত করতে পারি, যার ফলে আমাদের জন্যে রাষ্ট্রীয় সংবিধানে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে, তখন এ পন্থা অবলম্বন না করার কোনো কারণ থকবেনা। বিনা লড়াইতে সোজা পন্থায় যে জিনিস লাভ করা সম্ভব, তাকে বিনা কারণে বাঁকা আংগুলে বের করার হুকুম শরীয়াহ আমাদের দেয়নি। কিন্তু একথা ভালোভাবে বুঝে নিন, এ কর্মপন্থা আমরা কেবল তখনই অবলম্বন করবো, যখনঃ
এক. দেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে শুধু জনমত সৃষ্টি হলেই তা বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে;
দুই. দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে আমরা দেশবাসীর একটা বিরাট সংখ্যাক লোককে আমাদের ধ্যান ধরণার সংগে একমত করতে পারবো এবং অনৈসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তে ইসলামী রা্ষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতষ্ঠার জন্যে সর্ব সাধারণের পক্ষ থেকে দাবি উত্থাপিত হবে;
তিন. নির্বাচন এ উদ্দেশ্য অনুষ্ঠিত হবে যে; দেশের ভবিষ্যত রাষ্ট্র ব্যবস্থা কোন্ ধরনের শাসনতন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত করা হবে। [তরজমানুল কুরআনঃ মুহাররামঃ ১৩৬৫ হিঃ, ডিসেম্বরঃ ১৯৪৫ইং]
৬. আধুনিক রাষ্ট্রে ইসলামী আন্দোলনের কর্মপন্থা
প্রশ্নঃ একথা আর বেশী দলীল প্রমাণসহ পেশ করার অপেক্ষা রাখেনা যে, কোনো মুসলমান যদি ইসলামকে পথার্থ ভাবে উপলব্ধি করে থাক, তবে তার জীবনের কেবলমাত্র একটিই উদ্দেশ্য হতে পারে, আর তা হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। একথা খুবই স্পষ্ট, এ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে কেবল সেই কর্মপন্থাই অবলম্বন করা যেতে পারে, যা বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে তার প্রকৃতির সংগে সামঞ্জস্যশীল এবং যা তার মূল আহবায়কগণ বাস্তবে অবলম্বন করেছিলেন। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল আহবায়ক ছিলেন আম্বিয়াযে কিরাম। সুতরাং এর কর্মনীতি ও কর্ম পন্থাও হবে তাই, যা ছিলো আম্বিয়ায়ে কিরামের কর্মপন্থা ও কর্মনীতি।
আম্বিয়ায়ে কিরামের জীবনের দিকে তাকালে মোটামটি আমরা দু’প্রকার পয়গম্বর দেখতে পাই।
একঃ সেসব পয়গম্বর যাঁদের দাওয়াতী কাজের প্রাক্কালে রাষ্ট্র শক্তি খুবই সংহত এবং প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিলো। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব রাষ্ট্রের অবস্থা এমন ছিলো যে, রাষ্ট্রের সার্বিক ও সর্বোচ্চ ক্ষমতা ছিলো এক ব্যক্তির হতে কেন্দ্রীভূত। যেমন হযরত ইউসুফ আলাইহিস্ সালাম এবং হযরত মূসা আলাইহিস্ সালাম।
দুইঃ সেসব আম্বিয়ায়ে কিরাম যাঁদেরকে দীনের কাজে করতে হয়েছিল এমন সোসাইটিতে যেখানে রাষ্ট্র ছিলো একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় এবং খুব বেশী হলে গোত্রীয় প্রধান শাসিত ধরনের [patriachall] রাষ্ট্র ছিলো। যেমনঃ শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
উভয় অবস্থায় কর্মপন্থাগত পার্থাক্য স্পষ্ট। আর এর পার্থক্য সম্ভবত রাজনৈতিক পরিবেশগত পার্থক্যের কারণেই হয়ে থাকে।
কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি এখন যতোটা সংহতি ও মজবুতি অর্জন করেছে এবং ব্যক্তিকে যেভাবে চতুর্দিক থেকে পরিবেষ্টন করে নিয়েছে আর চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে যতোটা সুশৃংখল প্রভাব প্রতিপত্তি লাভ করেছে, সম্ববত অতীতের ইতিহাসে এর কোনো নযীর নেই। এখন প্রশ্ন হলো, প্রায় রাষ্ট্রহীন [ Stateless] সমাজ বা বেশীর পক্ষে গোত্র প্রধান শাসিত রাষ্ট্রে যেদ কর্মপন্থা সফলভাবে ব্যবহার করা গিয়েছিল, এখনো কি সেই একই কর্মপন্থা ঐ ধরনের সফলতার গ্যারান্টি দিতে পারে? এখনকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যেসব দল এ উদ্দেশ্যে কাজ করছে, বিপ্লব সাধনের জন্যে তাদের কি নিজেদের কর্মপন্থার যথেষ্ট পরিবর্তন করতে হবেনা?
আখিরী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোনো সংগঠিত ও প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র শক্তির মুকাবিলা করতে হয়নি। পক্ষান্তরে হযরত ইউসুফ আলাইহিস্ সালামের সম্মুখে ছিলো এক প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রশক্তি। সুতরাং তিনি যে কর্মপন্থা গ্রহণ করেছিলেন তা ছিলো এই যে, সর্বসয় ক্ষমতার অধিকারীকে [Soverign Power] ক্ষমতা হস্তান্তরে আগ্রহী দেখে বললেনঃ
“দেশের অর্থবান্ডার আমার নিকট সোর্পদ করুন।”
এভাবে ক্ষমতা হস্তগত করে নিয়ে তিনি স্বীয় মিশন পূর্ণ করার জন্য পূর্ব থেকে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকে ব্যবহার করেন। বর্তমান কালের রাষ্ট্র তো হযরত ইউসুফ আলাইহিস্ সালামের যুগের রাষ্ট্র থেকেও অধিক সংহত ও ক্ষমতাশালী। এ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে উৎখাত করে একটি নতুন রাষ্ট্র জন্ম দেয়ার যে ধরনের বিপ্লবই সংঘটিত হোক না কেন, রক্ত বন্যা পেরিয়েই তা সংঘটিত হবে। যেমনটি হয়েছে বলশেভিক রাশিয়ায়। তাছাড়া এটাও জানা কথা যে, কেবল সবকিছু ভেংগে তোলপাড় করে দেয়ার মতো বিপ্লব ইসলামের কাম্য নয়। বরঞ্চ ইসলামের প্রোগ্রাম এর চাইতেও নাজুক।
এমতাবস্থায় পরিবেশের সংগে সামঞ্জস্যশীল পন্থা তো এটই মনে হয় যে পূর্ণাংগ বিপ্লবের পরিবর্তে যতোটা ক্ষমতা লাভ করা যায় তা গ্রহণ করে সম্মুখে অগ্রসর হতে হবে। এ পন্থা যদি গ্হণ করা হয় তবে দেশের বর্তমান মুসলমান দলগুলোর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া সমীচীন হবেনা। শুধু তাই নয়, বরঞ্চ তাদের সহযোগিতাই প্রয়োজন হয়ে পড়বে।
একথা স্পষ্ট করে বলার প্রয়োজন রাখেনা যে, ক্ষমতা মানে শুধু সিভিল সার্ভিসের পদসমূহ দখল করা নয়। যেমনটি তরজমানের কোনো এক সংখ্যায় জনৈক নওয়াব সাহেব লিখেছেন। বরঞ্চ এর অর্থ, একটি সুসংগঠিত দলের চেষ্টা সংগ্রামের পর দল হিসেবে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধরের [Sovereign Power] নিকট থেকে ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে তা নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের কাজে ব্যবহার করা।
জবাবঃ যখন অনৈসলামী রাষ্ট্র ব্যাপক শক্তিশালী ও প্রতিপত্তিশালী হয়, তা নিঃসন্দেহে বিপর্যস্ত সামাজিক ব্যবস্থার প্রাথমিক অবস্থা থেকে অনেক ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। এজন্যে কমপক্ষে পরিবেশের প্রেক্ষিতেও কর্মপদ্ধতিতে কিছুটা রদবদল জরূরী হয়ে পড়ে। কিন্তু মূলনীতির দিক থেকে কর্মপন্থায় কোনো রদবদলের প্রয়োজন পড়েনা। আর মূলনীতিগত কর্মপন্থা হচ্ছে এই যে, আমরা প্রথমে মানুষের নিকট দাওয়াত পেশ করবো। অতঃপর যারা আমাদের দাওয়াত কবূল করবে তাদের সংগঠিত করতে থাকবো। এরপর গণরায় কিংবা অবস্থার পরিবর্তনের ফলে কখনো যদি এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায় যে, প্রতিষ্ঠিত সাংবিধানিক পদ্ধতিতে আমাদের হতে রাষ্ট্র ক্ষমতা এসে যাওয়া সম্ভব, আর তাতে এ সম্ভবনা থাকে যে, আমরা সমাজে নৈতিক তামাদ্দুনিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থা আমাদের মূলনীতির ভিত্তিতে ঢেলে সাজাতে সক্ষম হবো, তখন ঐ সুযোগ থেকে ফায়দা উঠাতে আমরা কোনো প্রকার দ্বিধা করবোনা। কারণ, উদ্দেশ্য হাসিলই আমাদের নিকট আসল বিষয়, কর্মপদ্ধতি [Method] নয়। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সাধ্যমসমূহ দ্বারা যদি মূল ক্ষমতা [Substance of Power] লাভের সম্বাবনা না থাকে, তবে আমরা অবশ্যি সাধারণ দাওয়াত অব্যাহত রাখবো এবং শর’য়ী দিক থেকে সকল বৈধ মাধ্যম ব্যবহার করে পূর্ণাংগ বিপ্লব সাধনের চেষ্টা করবো। [তরজমানুল কুরআনঃ সেপ্টস্বর-অক্টোবরঃ ১৯৪৫]
৭. ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঠিক কর্মধারা
প্রশ্নঃ যে লোকদের সাথেই দেশের ভবিষ্যত রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে আলাপ আলোচনা হয়, তাদের অধিকাংশই এ মত প্রকাশ করেন যে, আপনি এবং অন্যান্য বড় বড় আলেমগণ মিলে কেন ইসলামী রাষ্ট্রের একটি শাসনতন্ত্র তৈরী করে দিচ্ছেন না, যাতে করে তা পার্লামেন্টে উত্থাপন করে পাশ করানো যায়? শুধু আমাকেই নয়, অন্যান্য কর্মীদেরকেও অধিকাংশ সময় এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। লোকদের যদিও আমরা যথাসাধ্য বুঝানোর চেষ্টা করি কিন্তু আপনার পক্ষ থেকে প্রশ্নটির জবাব তরজমানুল কুরআনে আসা প্রায়োজন। এতে করে এ প্রশ্নের ভিত্তিতে সৃষ্টি ভুল বুঝা বুঝি দুর হয়ে যেতে পারে।
জবাবঃ আপনার প্রশ্নের বিস্তারিত জবাব তো এখানে দেয়া সম্ভাব নয়। তবে সংক্ষিপ্ত আকারে একটি কথা বলবো। আশা করি এতেই আপনি মূল বিষয় উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেনা।
যেখানকার সমাজ সঠিক অর্থে ইসলামী নয়, রাজনৈতিক, অর্থেনৈতিক ও শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো অনৈসলামী পদ্ধতিতে অগ্রসর হচ্ছে এবং যেখানে নিরেট একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের বদৌলতে আকস্মিকভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ এসে গেছে, সেখানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটা বুঝি কেবল এতোটুকু জিনিসের জন্যেই আটকে রয়েছে যে, আমরা একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে উত্থাপন করবো আর ক্ষমতাশীন ব্যক্তিরা তা কার্যকর করে দেবে। তাহলে তো ব্যাপারটা ঠিক সে রকম দাঁড়ায়, যেমন কোনো ব্যক্তি ধারণা করলো যে, একটি স্কুল বা ব্যাংককে হাসপাতালে রূপান্তরিত করার জন্যে কেবল কতিপয় ডাক্তার একত্র হয়ে একটি আদর্শ হাহপাতালে রূপরেখা ও নীতিমালা প্রণয়ন করে সেই স্কুলের শিক্ষক বা ব্যাংকের ষ্টাফদের হতে দিয়ে দেবে। আর তারা সেটা দেখে দেখে সুষ্ঠুভাবে হাসপাতালের কাজ আঞ্জাম দিতে থাকবে। আমি খুবই বিস্ময় বোধ করছি, আমাদের দেশের অনেক উচ্চ শিক্ষিত লোকও এতোটা হালকাভাবে চিন্তা করে, যেনো শাসনতন্ত্রকে তারা কোনো তাবীজ মনে করছে।
পরিষ্কারভাবে বুঝে নিন, আমাদের এখানে শুধুমাত্র দুটি পন্থায়ই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবঃ তন্মধ্যে একটি হলো এই যে, রাষ্ট্র ক্ষমতা এখন যাদের হাতে রয়েছে ইমলাম সম্পর্কে তারা আন্তরিক হবে। জাতির সাথে কৃত ওয়াদাসমূহের ব্যাপারে তারা সত্যবাদী হবে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের মধ্যে যোগ্যতার যে অভাব রয়েছে তা তারা অনুভব করবে। ঈমানদারীর সাথে একথা স্বীকার করবে যে, পাকিস্তান লাভের পর তাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে এবং এদেশে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সেসব লোকদেরই কাজ যারা একাজের উপযুক্ত।
উপরে বর্ণিত অবস্থা সুষ্টি হলে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুক্তিসংগত পদ্ধতি হচ্ছে, প্রথমত আমাদরে পার্লামেন্ট সেসব মৌলিক বিষয়ের সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রদান করবে, একটি অনৈসলামী রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার জন্য যেসব মূলনীতি অপরিহার্য।[ এসব মূলনীতি আমরা আমাদের “দাবী” আকারে প্রকাশ করেছি।] অতঃপর ইসলামের ইল্ম রাখেন এমন লোকদের তারা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে শরীক করবেন। তাদের সাহায্যে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচোলনার উপযোগী একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন। অতঃপর নতুন করে নির্বাচন দিতে হবে হবে এবং জাতিকে এমন একদল লোক নির্বাচন করার সুযোগ দিতে হবে যাদেরকে তারা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য যোগ্যতম মনে করবে। এভাবেই সহজ ভাবে সঠিক ও নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা ও যাবতীয় উপায় উপাদানকে কাজে লাগিয়ে, গোটা জীবন ব্যবস্থাকে নতুন ভাবে ইসলামী পন্থা ও পদ্ধতিতে ঢেলে সাজাতে সক্ষম হবে।
দ্বিতীয় পন্থা হলো, সমাজকে গোড়া থেকেই আমূল পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। একটি গণসংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের মাঝে ক্রমান্বয়ে খাটি ইসলামী চেতনা, অনুভূতি ও আকাংখা তীব্র ও চাংগা করে তুলতে হবে। আর এ চেতনা ও আকাংখা তাদের মধ্যে যখন দৃঢ়তা ও মজবুতি অর্জন করবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই একটি পূর্ণাংগ ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভ করবে।
এখন আমরা প্রথম পদ্ধতির উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছি। তাতে যদি সফলতা অর্জন করি তবে তার অর্থ হবে পাকিস্তান অর্জনের জন্য আমাদের কওম যে চেষ্টা সংগ্রাম করেছিল, তা ব্যর্থ হয়নি। বরঞ্চ তার বদৌলতে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্য একটি সহজ ও নিকটতম রাস্তা আমাদের হস্তগত হয়েছে। কিন্তু খোদা না করুন এই পদ্ধতিতে যদি আমরা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হই এবং এই দেশে একটি অনৈসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দেয়া হয়, তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানরা যে বিরাট কষ্ট ও কুরবানী পেশ করেছিল তা সবই বৃথা যাবে। এমনটি যদি হয়, তবে তার অর্থ হবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও আমরা সে রকম দেশেই আছি, যেখানে ছিলাম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে। এমতবস্থায় আমরা দ্বিতীয় পন্থায় কাজ করে যবো।
আশা করি এ সংক্ষিপ্ত্ বক্তব্যে লোকেরা আমাদের পজিশন ভালো ভাবে বুঝে নেবে। সময় হবার পূর্বে আমরা কোনো কাজ করতে চাইনা। [তরজমানুল কুরআনঃ যুলকা’দাহ ১৩৬৭ হিজরী, সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ ইং]
৮. রাজনৈতিক বিপ্লব আগে না সমাজ বিপ্লব?
প্রশ্নঃ আমাদের দেশে সাধারণভাবে এ অনুভূতি বিরাজিত যে, ইসলামের মূলনীতি এবং নির্দেশাবলী পছন্দনীয় ও উত্তম বটে, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তা কার্যকর করার মতো পরিবেশ নেই। সাধারণ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে ইসলামের সাথে আবেগময় সম্পর্ক আছে ঠিকই, কিন্তু দীণ ইসলামের সঠিক সুঝ এবং আমল করার ইচ্ছা অতি অল্পই পরিলক্ষিত হয়। ইসলাম চিন্তা ও চরিত্রের যে সম্পর্ক দাবী করে তার আলোকে এ আশংকা সৃষ্টি হয়ে যে, ইসলামী আইন কানুন চালু হয়ে গেলে এর বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়া বিচিত্র নয়। তাই সময়ের এহেন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতক বিপ্লবের পূর্বে সামাজিক বিপ্লব জরুরী এবং সংশোধনের চেতনা বাহির ও ওপর থেকে সৃষ্টি করার পরিবর্তে ভিতর থেকে সৃষ্টি করা জরুরী। এহেন অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী অসময়োপযোগী হয়ে যায় নাতো?
জবাবঃ এ সমস্যাকে পুরোপুরি এবং স্পষ্ট করে আলোচনা করতে গেলে এর বিস্তারিত জবাব দেয়া দরকার। তবুও সংক্ষিপ্ত জবাব হলোঃ নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক বিপ্লবের পূর্বে একটি তামাদ্দুনিক, সামাজিক এবং নৈতিক বিপ্লবের প্রয়োজন। ইসলামী বিপ্লবের এটাই স্বাভাবিক পদ্ধতি। আর নিঃসন্দেহে এটাও সত্য যে, ইসলামের নির্দেশাবলী এবং আইন কানুন শুধু উপর থেকে চাঁপিয়ে দেয়া হয়না বরং তা পালন ও অনুসরণ করার জন্য ভিতর থেকে একটি আন্তরিক আগ্রহও সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে একটা রজনৈতিক বিপ্লব সাধিত হয়েছে, সে সত্যকে কে অস্বীকার করতে পারে? এখন এ প্রশ্ন তোলা অবান্তর ও অর্থহীন যে, সর্বপ্রথম সামাজিক বিপ্লব সৃষ্টি করা দরকার, তারপর রাজনৈতিক বিপ্লব। এখন বরং এ প্রশ্নেই উঠতে পারে যে, যতোদিন পর্যন্ত গোটা জাতির মধ্যে চিন্তা ও চরিত্রের বিপ্লব সৃষ্টি না হচ্ছে ততোদিন আমরা রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নীতির ভিত্তিতে ব্যবহার করবো, নাকি ইসলামী মূলনীতি আমাদেরকে স্থির করতেই হবে। যাই হোক, নৈতিক বিপ্লব সংঘটিত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিকল করা যেতে পারেনা। যে জাতি আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের শাসন ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বের উপর বিশ্বাসী, যার সামষ্টিক ও জাতীয় জীবনের লাগাম নিজের নিয়ন্ত্রণে, নিজের জীবন ব্যবস্থা নিজেই নির্মাণ করতে সক্ষম এবং অনৈসলামী কোনো শক্তি তার উপর কুফরী ব্যবস্থা নিজেই নির্মাণ করতে সক্ষম এবং অনেসলামী কোনো শক্তি তার উপর কুফরী ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়ার মতোও না থাকে, সে জাতির লোকদের জন্য এটা কি করে জায়েয এবং বৈধ হতে পরে যে, তারা একে অপরকে নৈতিক চরিত্র গড়ে তোলার জন্য শুধু ওয়ায নসীহত করতে থাকবে আর নিজেদের শাসন কাঠামো অনৈসলামী নীতিতে চালানোর জন্য ছাড় দিয়ে দেবে। আমি মনে করি আমরা যদি এ অবস্থা সহ্য করে যাই, তাহলে ব্যক্তিগতভাবে মুরতাদ হওয়ার অপরাধে অপরাধী না হলেও সমষ্টিগত ও জাতীয়ভাবে মুরতাদ আমাদের হওয়াই লাগবে।
তারপর এ বিষয়ের আরো একটি দিক হলো, আপনি সামাজিক ও নৈতিক বিপ্লব সৃষ্টি করতে চাইলে আপনাকে চিন্তা করতে হবে এ বিপ্লবের মাধ্যমে ও উপায় উপাদান কি হতে পারে? এটা পরিষ্কর যে, শিক্ষা দীক্ষা, সমাজম সংস্কার, নৈতিক সংশোধন এবং এই ধরনের আরও বহু বিষয় ঐসব উপায় উপাদানের অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর সাথে আরও রয়েছে রাষ্ট্রের আইনগত ও রাজনৈতিক মাধ্যম ও উপায় উপকরণ। সংশোধনের জন্য রাষ্ট্রশক্তি শুধু একটি বড় মাধ্যমই নয় বরং এটা সমগ্র সংস্কারমূলক ব্যবস্থা ও চেষ্টাকে আরও অধিক প্রভাবশালী, ফলদায়ক এবং ব্যাপকরূপ দেয়ার বলিষ্ঠ উপায়ও। এখন নৈতিক বিপ্লব সাধনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন উপায় উপকরণও ব্যবহার না করার কারণ কি হতে পারে? আমাদের ভোট, আমাদের দেয়া ট্যাক্স এবং অর্থের উপর ভিত্তি করেই তো রাষ্ট্রের সমগ্র ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। এখন এ মূর্খতা ও বোকামী আমরা কেন করতে যাবো যে, একদিকে আমারা ব্যক্তিগতভাবে ইসলামের সমাজ বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করার চেষ্টা করতে থাকবো, অপরদিকে আমাদের রাষ্ট্রের সমস্ত মাধ্যম উপায় উপকরণ জাতির নৈতিক চরিত্র ধ্বংস ও সর্বনাশের মূলে ইন্ধন যোগাবে, অধিকন্তু নানা প্রকান নৈতিক অপরাধ ছাড়ানোর কাজে লেগে থাকবে। [অথচ এগুলো দুর করার কোনো বাস্তব পদক্ষেপই আমরা গ্রহণ করবোনা]? [তরজমানুল কুরআন, জিলহজ্জ্ব ১৩৭৩ হিঃ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ খৃঃ।]

সমাপ্ত


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি