আমাদের কথা
আধুনিক বিশ্বে ইসলাম এক অনন্য আদর্শ ও দুর্জয় আন্দোলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ইসলামকে এখন আর সেকেলে ধর্ম আর সাম্প্রদায়িকতা বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার কোনো সুযোগ নেই। মুসলিনেতৃবৃন্দের অদূরদর্শিতার কারণে মুসলিম দেশগুলো যখন আধিপত্যবাদীদের করতলগত হয়, তখন তারা ইসলামকে যেভাবে ধ্বংস করে দিয়েছিল আর ইসলামকে খৃষ্টবাদ কিংবা হিন্দু/বৌদ্ধ ধর্মের মতো একটা সাম্প্রদায়িক ধর্ম হিসেবে সুচতুরভাবে অপপ্রচার করেছিল, এখন আর সেদিন নেই। এখন ইসলাম তার আসল সুমহান আদর্শিক রূপ নিয়ে বিশ্ববাসীর সামনে সমুপুস্থিত। এশিয়া আফ্রিকা ও ইউরোপেরে বিভিন্ন দেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। এসব দেশে যুবক যুবতীরা ইসলামের সুমহান আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিপক্ষের হাতে চরম নির্যাতিত হচ্ছে, রক্ত দিচ্ছে, শহীদ হচ্ছে। কোনো কোনো দেশ ইসলাম প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। এভাবে একদিকে আন্দোলন সংগ্রামের কাজ এগিয়ে চলছে।
অপরদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজও এগিয়ে চলছে। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে চিন্তাবিদগণ বিংশ শতাব্দীতে ব্যাপক আলোচনা করছেন। একদিকে তাঁর কুরআন সুন্নাহ থেকে ইসলামের মূলনীতি পেশ করছেন, খুলাফায়ে রাশেদীনের রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শ দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করছেন। অপরদিকে যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে আধুনিককালে ইসলামী মূলনীতি ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার উপযোগীতা, বাস্তবতা ও অকাট্যতার প্রমাণ পেশ করেছেন।
এই উভয় ক্ষেত্রেই সাইয়েদ মওদূদী অন্যদের অগ্রজ। একদিকে তিনি আধুনিক বিশ্বে ইসলামী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। অপরদিকে কুরআন সুন্নাহর অগাধ পান্ডিত্য, ইসলামের ইতিহাসের নির্যাস, শানিত যুক্তি আর অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভা দিয়ে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা এবং ইসলামী রাষ্ট্রের বাস্তবতা ও বাস্তব রূপরেখা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন।
তাঁর এ গ্রন্থটি ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কে একটি অনন্য গ্রন্থ। ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূলনীতি, ইসলামী শাসনের মূলনীতি এবং ইসলামী বিপ্লব সাধেনের পদ্ধতির উপর এ গ্রন্থে তিনি প্রমাণ ও বাস্তবতার নিরিখে পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন। সাইয়েদ মওদূদী এ সংক্রান্ত লেখাগুলো বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও পুস্তক পস্তিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। সেগুলোকে ‘ইসলামী রিয়াসাত’ শিরোণামে সুসংকলিত করেছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আধুনিক বিশ্বের অন্যতম ইসলামী চিন্তাবিদ প্রফেসর ডক্টর খুরশীদ আহমেদ। প্রথমে তিনি সাইয়েদ মওদূদীর এ সংক্রান্ত লেখাগুলোর ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করেন Islamic Law and Constitution’ নামে। ইংরেজি গ্রন্থটি সারাবিশ্বে অভূতপূর্ব সাড়া জাগায় এবং অচিরেই তার দ্বিতীয় সংস্কারণও নিঃশেষ হয়ে যায়। তখন প্রবলভাবে দাবি উঠতে থাকে ইংরেজি সংস্কারণের পাশাপাশি সাইয়েদ মওদূদী ইসলামী রাষ্ট্র সংক্রান্ত সমস্ত লেখা একত্রে সংকলিত করে মূল উর্দু ভাষায় একটি গ্রন্থ প্রকাশ করা হোক। সেই দাবি ও চাহিদার প্রেক্ষিতেই প্রফেসর খুরশীদ আহমদ ইসলামী রাষ্ট্র সংক্রান্ত তাঁর সমস্ত লেখা একত্রে করে ইসলামী রিয়াসাত গ্রন্থ তৈরি করেন ১৯৬০ ঈসায়ি সালে। ইংরেজি Islamic Law and Constitution গ্রন্থটি ৪১২ পৃষ্ঠা আর উর্দু ইসলামী রিয়াসাত গ্রন্থটি ৭২০ পৃষ্ঠা। দুটি গ্রন্থই বিশ্বব্যাপী দারূণভাবে সমাদৃত।
ঢাকাস্থ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রিসার্চ একাডামী সাইয়েদ মওদূদী সমস্ত গ্রন্থ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার কর্মসূচি গ্রহণ করে। আলহামদুলিল্লাহ ইতোমধ্যেই আমরা তাঁর প্রায় সমস্ত গ্রন্থই অনুবাদ করে প্রকাশ করার ব্যসস্থা করেছি। ইসলামী রিয়াসাত গ্রন্থটি অনুবাদে হাতে দিয়েছি আমরা দেরিতে। বছর তিনেক আগে অনুবাদ কাজ সম্পন্ন হয়। কয়েক হাতের অনুবাদ কাজের মধ্যে ভাষাগত সামাঞ্জস্য বিধান এবং অনুবাদকে যথাসাধ্য নির্ভুল করার লক্ষ্যে আমরা গ্রন্থটিকে সম্পাদনা করে দিয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা সরাসরি প্রুফ দেখতে না পারায় গ্রন্থটিতে কিছু কিছু প্রিটিং মিসটেক রয়ে গেছে। সেজন্যে আমরা দুঃখিত।
যারা মানবতার কল্যাণের লক্ষে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী ও আকাংখী, এ গ্রস্থ তাদের উদ্যোগ ও আকাংখাকে এগিয়ে দেবে অনেক দূর। এ গ্রন্থ অধ্যয়ন করে যেকোনো মত ও পথের লোকই উপলব্ধি করতে পারবেন ইসলামী রাষ্ট্র এবং ইসলামের শাসন ও বিধান কতো যুক্তিসংগত, বাস্তব, সুবিচারমূলক ও মানবতার কল্যাণ বিধায়ক। এ গ্রন্থ পাঠকের সামনে ও মহাসত্য উন্মেচিত করে দেবে যে, ইসলামী রাষ্ট্র শুধু মুসলমানদের জন্যে নয়, বরং গোটা বিশ্ব মানবতার অধিকারের সংরক্ষক ও নিরাপত্তার যিম্মাদার।
এ অমূল্য গ্রন্থটি অনুবাদ, সম্পাদনা ও প্রকাশ করতে পেরে আমরা মহান আল্লাহর দরবারে কুতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। গ্রন্থটি প্রকাশে যারা সহযোগিতা করেছেন, আমরা তাদের কল্যাণাকাংখী।
গ্রস্থটি বাংলাভাষীদের চিন্তা এবং মত ও পথের দিশারী হোক, এই আমাদের কামনা।
আবদুস শহীদ নাসিম
পরিচালক
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রিসার্চ একাডেমী ঢাকা।

গ্রন্থাকারের ভূমিকা
সংকলকের অনুবন্ধ
গ্রন্থাকারের ভূমিকা
বিগত বিশ পচিঁশ বছরে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে আমার অনেক কথা বলা এবং লেখার সুযোগ হয়। এই মূল বিষয়টি এবং প্রাসংগিক অন্য বেশ কিছু বিষয়ের উপর আমি মৌলিক ও তাত্ত্বিক আলোচনা করেছি। বর্তমান কালে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের বাস্তব রূপরেখা কি হবে সে বিষয়েও বিস্তারিত আলোকপাত করেছি। এই প্রবন্ধ ও নিবন্ধগুলো উপরোল্লিখিত দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন সুযোগ এবং সময়ের দাবী অনুযায়ী লেখা হয়, কিংবা প্রকাশিত হয়ে আসছে। কিন্তু এযাবতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন আকারে সেগুলো মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়ে আসছে। কিন্তু এযাবতকাল পর্যন্ত সেগুলো একত্রিত করে একটি পূর্ণাংগ গ্রন্থাকারে সংকলিত করা সম্ভব হয়নি। কয়েক বছর আগে/ খুরশীদ আহমদ “ইসলামী রিয়াসাত” [ইসলামী রাষ্ট্র] শিরোনামে এ সংক্রান্ত আমার বিভিন্ন প্রবন্ধ সংকলিত করেন। কিন্তু তখন তাতে আমার এ সংক্রান্ত সবগুলো লেখা সংকলিত করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া তাতে কেবল তাত্তিক আলোচনা এবং পাকিস্তানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সংগ্রাম সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলোই সংকলিত হয়। এখন জনাব খুরশীদ আহমদ ইদারায়ে মাআরিফে ইসলামীর তত্ত্বাবধানে এ বিষয় সংক্রান্ত আমার সবগুলো প্রবন্ধ নিবন্ধকে একত্রিত করে দু’খন্ডে সংকলন করে দিয়েছেন। প্রথম খন্ডে স্থান পেয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র সংক্রান্ত যাবতীয় তাত্ত্বিক আলোচনা। আর দ্বিতীয় খন্ডে স্থান পেয়েছে পাকিস্তানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সংগ্রাম সংক্রান্ত প্রবন্ধরাজি। একজন পাঠক এখন এই গ্রন্থটির মাধ্যমে ইসলামের রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পূর্ণাংগ চিত্র সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন। এই গ্রন্থটি সংকলিত হবার পূর্বে বিভিন্ন সময়ে এই পূর্ণাংগ চিত্রের বিভিন্ন খন্ডিত অংশ দেখানো হয়ে আসছিলো। কিন্তু এক নযরে একটি পূর্ণাংগ চিত্র সামনে আসতে পারেনি।
সংকলনটির প্রকৃত উপকারিতা এটাই।
পূরো গ্রন্থটি আমি নতুনভাবে দেখে দিয়েছি। বিষয়সূচী সাজানোর ব্যাপারেও আমার পরামর্শ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আমি আশা করে বর্তমান সংকলনটি থেকে কেবল সাধারণ পাঠকরাই উপকৃত হবেননা বরঞ্চ ইসলামী শিক্ষা এবং রাষ্ট্র বিজ্ঞান শিক্ষার্থীরাও তাদের নিজ নিজ বিভাগের পড়াশুনায় এর দ্বারা ব্যাপক উপকৃত হবে।[ অনুবাদ করেছেন আবদুস শহীদ নাসিম]
বিনীত
আবুল আ’লা
৬ শাওয়াল ১৩৮৬ হিঃ
১৮ জানুয়ারী ১৯৬৭ ইং
সংকলকের অনুবদ্ধ [এ অংশ অনুবাদ করেছেন আবদুস শহীদ নাসিম।]
মানুষ তার সামাজিক জীবনের শৃংখলা ও উন্নয়ন সাধনের জন্যে যেসব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান কয়েম করেছে তন্মধ্যে রাষ্ট্র সংস্থা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক। রাষ্ট্র এমন একটি রাজনৈতিক কাঠামো যার মাধ্যমে কোনো ভূখন্ডের অধিবাসীরা একটি নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে নিজেদেরে সামাজিক শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করে।
সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ সংস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। বস্তুত গোটা মানব ইতিহাসই রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল ও শক্তিশালী করা, এর ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা, শৃংখলা রক্ষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ সাধন এবং এর প্রসার ও উন্নতি সাধন করার ইতিহাস।
আধুনিক কালে প্রযুক্তি ও কর্মকৌশলের উন্নতি সাধন এবং সামাজিক জীবনে নিত্যনতুন চিন্তা ভাবনার পথ পেয়ে যাবার ফলে রাষ্ট্রের কার্য পরিধি দিন দিন বেড়েই চলেছে। এখন বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই রাষ্ট্রের কাজ কেবল শান্তি শৃংখলা এবং আইন ও নিরাপত্তা রক্ষাই নয়, রবঞ্চ সামষ্টিক সুবিচার, সামাজিক উন্নয়ন এবং সাফল্য অর্জনও বটে। বর্তমানে রাষ্ট্র একটি প্রতিষ্ঠিত ভুমিকা [Role] পালন করেছে। েএখন সে জীবনের প্রায় প্রতিটি বিভাগকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করছে।
১. রাষ্ট্র এবং ইসলাম
ইসলাম তার গোটা ইতিহাস কখনো রাষ্ট্রের গুরুত্বকে উপেক্ষা করেনি। আম্বিয়ায়ে করাম আলাইহিমুস সালাম তাঁদের স্ব স্ব সময়কালের সামাজিক ও সামষ্টিক শক্তিকে ইসলামের অনুগত ও অনুসারী বানাবার চেষ্টা সংগ্রাম করেছেন। তাদের গোটা দাওয়াতী মিশনের কেন্দ্রবিন্দু এই ধারণার উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলো যে, ক্ষমতা কেবলমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্যে নির্দিষ্ট হয়ে যাবে এবং শিরক তা গোপন ও প্রকাশ্য যে রূপেই বর্তমান থাকুকনা কেনো তাকে খতম করে দেয়া হবে। তাঁদের প্রত্যেকের এই একই আহবান ছিলোঃ
হে আমার জাতির লোকেরা! তোমরা আল্লাহর দাসত্ব করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই।” [সূরা আরাফঃ ৬৫] [ইলাহ, রব, ইবাদত, দ্বীন এই মৌলিক পরিভাষাগুলোর সঠিক তাৎপর্য অনুধাবনের জন্যে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর কুরআনের চারটি পরিভাষা গ্রন্থটি দ্রষ্টব্য। প্রকাশকঃ আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা।]
আর তাদের প্রত্যেকেই আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে স্ব স্ব জাতির নিকট এই দাবী করেছিলেনঃ
তোমার আল্লাহকে ভয় করো আর আমার আনুগত্য করো।” [সূরা আশ শুয়ারাঃ ১৬৩]
আল্লাহর এই প্রেরিত বান্দারা মানব জীবনের প্রতিটি বিভাগকে পরিশুদ্ধ করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা সংগ্রাম করেছেন, যাতে করে আল্লাহর যমীনে তাঁর দীন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাঁর আইন ও বিধান চালু এবং কার্যকর হয়। তাঁদের এই প্রাণন্তকর চেষ্টা সংগ্রাম ছিলো পূর্ণাংগ জীবনের সংশোধনের জন্যে। আর রাষ্ট্রের সংশোধন ছিলো সেই সংশোধনেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কুরআন অধ্যয়ন থেকে জানা যায়, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম, হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তা আদর্শিক মানে পরিচালনা করেছিলেন। ওল্ড এবং নিউ টেস্টামেন্টের অধ্যয়ন থেকে এই সাক্ষ্য, পাওয়া যায় যে, বনী ইসরাইলের অন্যান্য নবীগণও রাষ্ট্র সংস্থার সংশোধনের চেষ্টা করেছেন এবং ভ্রন্ত নেতৃত্বের অবাধ সমালোচনা করেছেন। ইসলামী চিন্তাধারায় রাষ্ট্র যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এই বিষয়টি থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, স্বয়ং আসমান ও যমীনের স্রষ্টাই তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এরূপ দোয়া করতে শিখিয়ে দেনঃ
”আর তুমি দোয়া করোঃ হে প্রভু, আমাকে যেখানেই নিয়ে যাবে সত্যতা সহকারে নিয়ে যাও আর যেখান থেকেই বের করবে সত্যতা সহকারে বের করো, আর তোমার নিকট থেকে একটি সার্বভৌম শক্তিকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও”। [সূরা বনী ইসরাইলঃ ৮০]
আয়াতটি হিজরতের পূর্বে নাযিল হয়েছিলো। এই ঐতিহাসিক পটভূমি দ্বারা দোয়াটির গুরুত্ব আরো স্পষ্ট হয়ে যায় এবং এথেকে রাষ্ট্র সংস্থার অপরিসীম গুরুত্ব পুরোপুরি অনুধাবন করা যায়। মাওলানা মওদূদীর ভাষায় আয়াতটির গুরুত্ব এরূপঃ
“প্রভু হয় আমাকেই রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করো, আর না হয় অপর কোনো রাষ্ট্রকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও, যেনো আমি তার শক্তি ও ক্ষমতার মাধ্যমে পৃথিবীর এই মহাভাংগন ও বিপর্যয়কে সংশোধন করতে পারি, অশ্লিলতা ও নাফরমানীর এই মহাপ্লাবনকে প্রতিরোধ করতে পারি এবং তোমার সুষম আইন ও বিধানকে চালু ও কার্যকর করতে পারি।”
হাসান বসরী এবং কাতাদাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি আয়াতটির এই তাফসীরই করেছেন। ইবনে কাসীর এবং ইবনে জরীরের মতো শ্রেষ্ঠ মুফাসসিরগণও এই মতই গ্রহণ করেছেন। হাদীস থেকেও এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
“আল্লাহ তা’য়ালা রাষ্ট্র ক্ষমতা দ্বারা সেসব জিনিসই বন্ধ করে দেন, যা শুধুমাত্র কুরআন দ্বারা বন্ধ করা যায়না।”
এথেকে জানা গেলো, ইসলাম পৃথিবীতে যে সংশোধন ও সংস্কার চায় তা শুধুমাত্র ওয়ায নসীহত দ্বারা সম্ভব নয়, বরঞ্চ তা কার্যকর করার জন্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা অপরিহার্য। তাছাড়া আল্লাহ তা’য়ালাই যখন তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন, তখন তাথেকে এ জিনিসটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, দীন প্রতিষ্ঠা করা, শরীয়াহ কার্যকর করা এবং আল্লাহর আইন জারি করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা চাওয়া এবং তা লাভ করার জন্যে চেষ্টা সংগ্রাম চালানো শুধু বৈধই নয়, বরঞ্চ তা একান্ত কাম্য ও বাঞ্চনীয়। যারা একাজকে দুনিয়াদারীর কাজ বলে ব্যাখ্যা করেন তারা সাংঘাতিক ভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছেন। কোনো ব্যক্তি যদি নিজের জন্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে চায় তবে সেটা দুনিয়াদারীর কাজ হতে পারে। কিন্তু আল্লাহর দীন কার্যকর করার জন্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা পেতে চাওয়া দুনিয়াপুরস্তি নয়, বরঞ্চ খোদা পুরস্তিরই অনিবার্য দাবী।”[তাফহীমুল কুরআন সূরা বনী ইসরাইল টীকাঃ ১০০]
নিন্মোক্ত আয়াত ও হাদীসগুলো থেকে বিষয়টি আরো স্পস্ট হয়ে যায়ঃ
“আমরা আমাদের রসূলের সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি এবং হিদায়াত দিয়ে পাঠিয়েছি। সেসাথে কিতাব এবং মীযান [মানদন্ড] ও দিয়েছি, যেনো লোকেরা ন্যায় ও সুবিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাছাড়া আমরা লোহা [রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা] ও অবতীর্ণ করেছি। যাতে রযেছে দোর্দন্ড শক্তি এবং মানুষের জন্যে বিপুল কল্যাণ।” [সূরা আল হাদীদঃ ২৫]
তিনিই [আল্লাহ তা’য়ালা] তো সেই সত্তা যিনি স্বীয় রাসূলকে হিদায়াত এবং সত্য দীন দিয়ে পাঠিয়েছেন, যেনো সে তাকে সকল দীনের উপর বিজয়ী করে দেয়। তা মুশরিকদের জন্যে সহ্য করা যতোই কঠিন হোকনা কেনো।” [সূরা আসসফঃ ৯]
“আর যারা আল্লাহর অবতীর্ণ আইন অনুযায়ী ফয়সালা করেনা তারা কাফির।” [সূরা আল মায়িদাঃ ৪৪]
নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
“ইসলাম এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা দুই সহোদর ভাই। তাদের একজন অপরজনকে ছাড়া সংশোধন হতে পারেনা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ইসলাম হচ্ছে কোনো অট্টালিকার ভিত আর রাষ্ট্র ক্ষমতা হচ্ছে তার পাহারাদার। যে অট্টালিকার ভিত নেই তা যেমন পড়ে যেতে বাধ্য, তেমনি যার পাহারাদার ও রক্ষক নেই তাও ধ্বংস হয়ে যেতে বাধ্য।” [কানযুল উম্মাল]
মুসলমানরা সবসময় চালিয়ে নিজেদের রাষ্ট্রকে ইসলামের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে চেষ্টা সংগ্রাম চালিয়ে আসছে, ফলে ইসলামী দর্শনে ধর্ম ও রাজনীতি দুটি আলাদা জিনিস হবার কোনো যুযোগ বা অবকাশ নেই। এই চেষ্টা সংগ্রাম তাদের দীন ও ঈমানের দাবী। তারা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে যেমন উত্তম চরিত্র এবং সদাচারের শিক্ষালাভ করে, তেমনি সমাজ, সভ্যতা, অর্থনীতি এবং রাজনীতির বিধানও তা থেকেই গ্রহণ করে। এই শেষোক্ত অংশের উপর আমল করার জন্য ইসলামী রাষ্ট্র অপরিহার্য। এই অংশের উপর আমল করা নাহলে শরীয়তের একটি অংশ বাদ পড়ে যায় এবং কুরআন চিত্রিত সমাজ ব্যবস্থা বাস্তবে রূপলাভ করেনা। এ কারণেই উম্মতের ফকীহগণ সর্বসম্মতিক্রমে ইমাম [রাষ্ট্র প্রধান] নির্বাচিত করাকে ফরয বলে ঘোষণা করেছেন। এ ব্যাপারে অসতর্কতা প্রদর্শনকে তাঁরা দীনি বিধান বাস্তবায়নে অসতর্কতা বলে গন্য করেছেন। আল্লামা ইবনে হাযম তাঁর “আল ফাসলু বাইনাল মিলাল ওয়ান নাহল” গ্রন্থে লিখেছেনঃ
গোটা আহলে সুন্নাত, মারজিয়া, শীয়া এবং খারেজীগণ এ ব্যাপারে একমত যে, কাউকে ইমাম নির্বাচন করা ওয়াজিব এবং উম্মতের উপর এরূপ ন্যায় পরায়ণ ইমামের আনুগত্য করা ফরয, যিনি আল্লাহ তা’য়ালার বিধান কায়েম করবেন এবং সেই শরীয়তের বিধানের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেবেন, যা নিয়ে এসেছিলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।” [ইবনে হাযমঃ ৪র্থ পৃষ্ঠাটঃ ৮৭]
শাহ অলি উল্লাহ দেহলবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেনঃ
দীনি দৃষ্টিতে পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন খলীফা নিযুক্ত করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিবে কিফয়া। এ হুকুম তাদের উপর কিয়ামত পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।” [শাহ অলি উল্লাহঃ ইযালাতুল খিফাঃ ১ম অধ্যায়]
এ এমন একটি বিষয়, যে সম্পর্কে গোটা উম্মাহর ইজমা [ঐক্যমত্য] রয়েছে। সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা বাস্তবে নেতৃত্বকে এতটা গুরুত্ব দিতেন তা রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পরবর্তী ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়। তাঁরা তাঁকে দাফন করার পূর্বেই ইমাম নির্বাচিত করেন, যিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ধরে রাখেন এবং পূর্ণ কেন্দ্রীয় মর্যাদার সাথে সকল কাজ সস্পাদন করেন। ইসলাম বস্তুগত ক্ষমতা করায়ত্ব করতে চায়। এছাড়া সে তার পূর্ণ মিশন সফল করতে পারেনা। এই নেতৃত্বে ও ক্ষমতা কেবল ক্ষমতা হিসেবে লাভ করাটাই উদ্দেশ্যে নয়, বরঞ্চ দাওয়াতের পূর্ণতা এবং মানবতার সংশোধন কাজের মহান দায়িত্ব পালন করার জন্যেও নেতৃত্ব অপরিহার্য মাধ্যম। তাই কুরআন এ দৃষ্টিভংগি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, ইসলামের জাগতিক নেতৃত্ব তার আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের মাধ্যম এবং এরই ফলশ্রুতিতে সততার প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায় ও দৃষ্কৃতির উৎপাটন সম্ভবঃ
“এই মুসলমানরাই সেই লোক, আমরা যদি পৃথিবীতে তাদের ক্ষমতা দান করি [অর্থাৎ পৃথিবীতে যদি তারা কর্তৃত্ব পায়] তবে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, সততার নির্দেশ দেবে, অন্যায় অপকর্মে বাধা দেবে। আর সকল বিষয়ের পরিণাম ফলতো আল্লাহরই হাতে।” [সূরা হজ্জঃ ৪১]
এযাবত আমরা যাকিছু আলোচনা করলাম তার সারমর্ম এই দাঁড়ায়ঃ
১. রাষ্ট্র সংস্থা মানব সমাজের একটি বুনিয়াদী প্রয়োজন। রাষ্ট্র ছাড়া সুশৃংখল ও সুসংগঠিত সমাজ জীবন কল্পনা করা দুষ্কর।
২. ইসলাম পূর্ণাংগ মানব জীবনের জন্যে পথনির্দেশিকা। সমাজ জীবন নির্বাহের সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এতে রয়েছে।
৩. ইসলাম ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে কোনো প্রকার পার্থক্য রাখেনা এবং পূর্ণাংগ মানব জীবনকে খোদায়ী বিধানের অধীন করে দিতে চায়। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলাম রাজনীতিকেও ইসলামী নীতিমালার ভিত্তিতে গড়ে তুলতে চায় এবং ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত ও কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রকে কাজে লাগাতে চায়।
৪. আত্মার আভ্যন্তরীন পাশবিকতা কিংবা বাইরের কোনো চাপ কিংবা ভীতির কারণে আল্লাহর কিছু আইনকে মেনে নেয়া এবং কিছু আইনকে উপেক্ষা করার নীতি দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর শাস্তি লাভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৫. ধর্ম, রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এতোই নিগুঢ় এবং অবিচ্ছেদ্য যে, রাষ্ট্র ও সরকার যদি অনৈসলামী হয় তবে তা হয় যুলুম ও বেইনসাফীর হাতিয়ার এবং তাদ্বারা সংঘুটিত হয় চেংগিজী ধ্বংসলীলা। পক্ষান্তরে রাষ্ট্র ও সরকার ব্যতীত ইসলাম হয়ে পড়ে খন্ডিত। বিজয়ী ও ক্ষমতাসীন হবার পরিবর্তে আল্লাহর দীন হয় পরাজিত ও দাসত্বের জিঞ্জিরে আবদ্ধ। এজন্যই রাষ্ট্রকে ইসলামের বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত করা, সরকার কর্তৃক ইসলামের পূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণ করা এবং তা কার্যকর করার জন্য অবিরাম তৎপরতা চালানো অপরিহার্য।
২. আধুনিক কালে ইসলামী রাষ্ট্র
এযাবত ইসলামে রাষ্ট্রের দীনি গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছি। কিন্তু আমরা যদি বর্তমান যুগের অভিজ্ঞতার আলোকে বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করি, তাহলে একথা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া একালের সব চাইতে বড় প্রয়োজন।
পাশ্চাত্যে একটি বিশেষ পটভূমিতে ধর্মহীন রাষ্ট্রের ধারণা জন্ম নিয়েছে। সেখানে পোপতন্ত্র যে রূপ ধারণ করেছিলো এবং ধর্মের নামে রাজাদের সাথে যোগসাজসের মাধ্যমে যেসব যুলুম নির্যাতনকে বৈধ বলে সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছিলো, সেগুলো এক বিরাট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। খৃষ্টবাদের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে এমন আক্রোশ সৃষ্টি হয়যে, তারা স্বয়ং ধর্মের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করে বসে। আর এই বিদ্রোহের পরিণতিতেই আত্মপ্রকাশ করে ধর্মহীন রাষ্ট্র।
জ্যাকব হোলেক যখন রাজনীতিকে ধর্ম থেকে পবিত্র রাখার এই আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন, সে সময়ই ১৮৩২ সালে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা হয়। প্রথম দিকে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিলো দার্শনিক ও রাজনীতিবিদদের হাতে। এ ব্যবস্থাটি অতি অল্প সময়ে রাজনৈতিক গ্রহনযোগ্যতা অর্জন করে। সংক্ষেপে, এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য এই ছিলো যে, ধর্মের পরিধি ব্যক্তিগত জীবন পর্যন্ত সীমিত থাকতে হবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন তাকে প্রবেশ করানো যাবেনা। প্রথম প্রথম ধর্মনিরপেক্ষতা এবং পূর্ণ ব্যক্তি স্বাধীনতা পর্যন্তই এর বক্তব্য সীমিত ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে এই আন্দোলনের একটি অংশ ধর্মের বিরোধিতা এবং আগ্রাসী বস্তুবাদ ও সমাজতন্ত্রের হোতা হয়ে দাঁড়ায়। পাশ্চাত্যে ধর্মহীন রাষ্ট্রের নিম্নরূপ বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়ঃ
১. ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মানুষের মধ্যে সংশয় এবং মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে দিয়েছে। মানুষের সামনে কোনো একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বাকি রাখেনি। মানুষের মধ্যে এক প্রকার হতাশা ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করে দিয়েছে। এই মানসিক চৈন্তিক অস্থিরতার ফলশ্রুতিতেই সমাজতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের মতো আন্দোলন জন্ম নেয় এবং মানুষকে
বস্তুপূজর চরম সীমায় পৌছে দেয়। সমাজতন্ত্রের বিখ্যাত সমালোচক আর ক্র হান্ট লিখেছেনঃ
সামাজিক দূরবস্থা এবং দারিদ্রের কারণে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কারণ নীচু দরিদ্র শ্রেণীর লোকদের পরিবর্তে উচ্চ বেতনধারী শ্রমিক এবং শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদেরই সমাজতন্ত্র মূলত আকর্ষণ করেছিলো। আর জনগণের মধ্যে পুঁজিবাদী সমাজের অপকারিতা এবং অন্যায় ও বেইনসাফীর চেতনা সৃষ্টির ফুলশ্রুতি হিসেবেও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
সত্য কথা হলো আমাদের সর্বশেষ অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সমাজতন্ত্র হচ্ছে সেইসব মতবাদ ও দৃষ্টিভংগিরই সমষ্টি, যেগুলো আমাদের জীবনের সেই শূন্যতাকে পূরণ করেছে, যে শূন্যতা পরিপাটি ধর্মীয় কাঠামোর ধ্বংসের ফলে সৃষ্টি হয়েছিলো এবং যা ছিলো সমাজ জীবনে ধর্মহীনতার বিজয়ের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। এই দার্শনিক ব্যবস্থার [সমাজতন্ত্রের] যদি মোকাবেলা করতে হয়, তবে তা কেবল এমন একটি বিশ্বজনীন জীবন ব্যবস্থা দ্বারাই করা যেতে পারে, যা হবে এর চাইতে ভিন্নতর কোনো আদর্শের পতাকাবাহী।” [R. N. Crew-Hunt: Theory and Practice of Communism, London 1951. P-6.]
আর যারা সমাজতন্ত্র গ্রহণ করেনি, তারা চরমভাবে আধ্যাত্মিক দুর্ভাবনা, চিন্তাগত অস্থিরতা এবং হতাশা ও বিশ্বাসহীনতার শিকার হয়েছে।
২. এ ধর্মহীন রাষ্ট্র ব্যক্তির সামনে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ ও কামনা চরিতার্থ করা ছাড়া আর অন্য কোনো লক্ষ্য অবশিষ্ট রাখেনি। জাতীয় পর্যায়ে সুযোগ সুবিধাভোগী নীতি ব্যক্তি ও সমাজ জীবনকে যুলুমে বিপর্যস্থ করে দিয়েছি। জাতীয় ও রাষ্টিয় জীবনে স্থায়ী কোনো নৈতিক নীতিমালা আর অবশিষ্ট নেই। ফলে এ শতাব্দী এমন দুটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যেক্ষ করলো, যাতে নিহত ও আহতের সংখ্যা গোটা মানব ইতিহাসের সমস্ত যুদ্ধের সম্মিলিত নিহত ও আহতদের তুলনায় অনেকগুণ বেশী।
৩. এই ধর্মহীন রাষ্ট্রের চারিত্রিক প্রভাবও ছিলো ধ্বংসাত্মক। এর মাধ্যমে দৃঢ়তা, স্বাধীন চিত্ততা, সাহসিকতা এবং বিশেষ করে সততা এবং দুষ্কৃতির মধ্যে পার্থক্য করার প্রাণশক্তি নিঃশেষ হতে থাকে। অপরদিকে স্বার্থপরতা, সুবিধা ভোগ এবং ঝোপ বুঝে কোপ দেয়া নীতি ব্যক্তি ও সামষ্টিক চরিত্রের বুনিয়াদে পরিণত হয়। যার ফলে হাজারো সামাজিক ও সামষ্টিক অপরাধ মাধা চাড়া দিয়ে উঠেছে যা সমাজকে শান্তি স্বস্তি ও নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত করে দিয়েছে।
৪. অভিজ্ঞতা বলে, মানুষের লক্ষ্য যখন নিরেট বস্তুগত স্বার্থে পরিণত হয় এবং কোনো উচ্চতর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ব্যবস্থা বর্তমান না থাকে তখন মানুষ নিরেট বস্তুগত স্বার্থও লাভ করতে পারেনা। আরনল্ড টয়নবী সমাজতন্ত্রের পরিণাম পর্যালোচনা করে স্পষ্ট ভাষায় তার ব্যর্থতা স্বীকার করেছেনঃ
“একথা এখন দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, যদি কেবল পার্থিব সুখ আনন্দকেই জীবন উদ্দেশ্য বানানো হয় তবে তাতে ব্যক্তির বস্তুগত সুখ এবং পার্থিব শান্তি লাভও অসম্ভব। অবশ্য একথা জ্ঞেয় যে, যদি সমাজতন্ত্র থেকে উন্নত কোনো আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য লক্ষ্য হয় তবে একটি আনুষঙ্গিক পরিণতি হিসেবে মানুষ পার্থিব সুখ এবং আনন্দও লাভ করবে।” [Arnold J. Toynbee, Christianity among the religions of the world, p-56.]
৫. আরো সত্য কথা হচ্ছে এই যে, সমাজতন্ত্র কেবল বাস্তবেই ব্যর্থ হয়নি, বরঞ্চ ইতিহাস এখন সমাজতন্ত্র থেকে অনেক সম্মুখে অগ্রসর হয়ে গেছে। ভালোভাবে খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, সমাজতন্ত্র আজ একটা কাহিনীগত ধারণায় পরিণত হয়েছে। সময়ের আবর্তনে এর দিকে প্রত্যাবর্তন করার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। সমাজতন্ত্র ছিলো নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক কার্যকারণের ফসল এবং কেবল একটি নির্দিষ্ট পরিবেশেই তা কাজ করতে পারে। সেসব কার্যকারণের অবর্তমানে সমাজতন্ত্রের অস্তিত্ব টিকে থাকা সম্ভব নয়।
আগেই বলেছি, সমাজতন্ত্র হচ্ছে সেই ব্যবস্থার নাম, যার রাজনীতি ও রাষ্ট্রিয় ব্যাপারে ধর্মের কোনো প্রবেশাধিকার নেই। আরো অধিক বিশ্লেষণ করলে কথা এই দাঁড়ায় যে, সমাজতন্ত্র ধর্ম ও আদর্শ নিরপেক্ষতার দাবীদার। উনবিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা থেকে জানা যায়, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, জাতীয়তাবাদ এবং অর্থনৈতিক বিষয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ না করাই ছিলো সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির বুনিয়াদী ধারণা। আর এ সবগুলো ধারণাই পরষ্পর সম্পৃক্ত। সমাজতন্ত্র কেবল তখুনি কামিয়াব হতে পারে, যখন রাষ্ট্র হবে একটি পুলিশি সংস্থা অর্থাৎ তার দায়িত্ব হবে শুধুমাত্র নিয়ম শংখলা বজায় রাখা এবং রাষ্ট্রকে বহির্হামলা এবং আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ থেকে রক্ষা করা। এ ধারনের রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যেই ব্যক্তিকে পুরোপুরি স্বাধীনতা দেয়া যেতে পারে। সেখানে ব্যক্তি যেমনভাবে চাইবে জীবন যাপন করবে। কেবল এরূপ অবস্থায়ই রাষ্ট্র [অন্তত আদর্শিক সীমার মধ্যে] ধর্মীয় ও আদর্শিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারে। আর উনবিংশ শতাব্দির ধারণা এটাই ছিলো। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রের ধারণা পাল্টে গেছে। আজ রাষ্ট্র কেবল একটি বিরাটকায় প্রতিমা নয়। একটি বিশেষ সীমা বাদ দিয়ে দেশে যা কিছু ঘটে সে ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করাটা রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। বর্তমানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কার্যপরিধি অনেক বিরাট এবং অত্যন্ত ব্যাপক। বর্তমানে রাষ্ট্র জীবনের প্রতিটি বিভাগের রূপরেখা তৈরী করে নিজস্ব পলিসির মধ্যমে তা নিয়ন্ত্রিত ও শৃংখলিত করে। এখন জ্ঞানের আলো প্রজ্জ্বলিত করা এবং নিরক্ষরতা নির্মূল করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। দারিদ্র দূর করা এবং সম্পদের সুষম বন্টনের কোশেশ করা তারই দায়িত্ব। সামাজিক যাবতীয় দুষ্কৃতির মূলোৎপাটন করা এবং নাগরিকদের নৈতিক এবং সামাজিক শিক্ষার সুবন্দোবস্ত করা তারই দায়িত্ব। অসুস্থদের চিকিৎসা করা মযলুমদের ফরিয়াদ শোনা এবং নির্যাতিতদের সাহায্য সহযোগিতা করা তারই দায়িত্ব। মোটকথা, বর্তমান রাষ্ট্র হচ্ছে কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র। তার জন্যে আদর্শিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সম্ভব নয়। তাকে তো অবশ্যই কোনো একটা নীতি মেনে চলতে হবে, কোনো না কোনো আদর্শ গ্রহণ করতে হবে। ভালমন্দ এবং সফলতা ও ব্যর্থতার কোনো না কোনো মানদন্ড অবলম্বন করতে হবে এবং তারই আলোকে নিজের গোটা পলিসিকে সাজাতে হবে। এ কারনেই বর্তমান রাষ্ট্রসমূহ আদর্শিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে। আর যেসব ভিত্তিতে উপর সমাজতন্ত্রের দার্শনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত ছিলো, বর্তমানে ইতিহাসের স্মৃতি হিসেবে তো সেগুলো অবশ্যি মজুদ আছে। কিন্তু বাস্তব দুনিয়ায় সেগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। যেসব ভিতের উপর এই দূর্গটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। সেগুলো ধ্বংসে পড়ে গেছে। কেবল কামনা বাসনার দ্বারা এই শূন্যতা পূর্ণ করা যেতে পারেনা। বর্তমান বিশ্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার আর কোনো সুযোগ নেই। ইতিহাস তাকে অনেক পেছনে ফেলে এসেছে। বর্তমান বিশ্বে প্রয়োজন আদর্শিক রাষ্ট্রেক যা নাকি সমাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠার আহবায়ক।
৩. ইসলামী বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সংগ্রাম
এই পটভূমিতে আমরা যখন মহা শক্তিমান আল্লাহ তা’য়ালার বিশ্ব ব্যবস্থা পরিচালনার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তখন আমাদের কাছে এই ইংগিতই স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে যে, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর মুসলিম দেশগুলো যখন বহু বছরের গোলামী জীবন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং তাদের মধ্যে প্রায় সবগুলো দেশেই ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়েছে তাতে আধুনিক সভ্যতার পতনের ফলে উদ্ভুত শূন্যতা পূরণের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা হচ্ছে। সত্য বলতে কি, উনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য সম্রাজ্যবাদ এক এক করে সবগুলো মুসলিম দেশ কব্জা করে নেয়। কেবল দু’তিনটি দেশই এই রাজনৈতিক গোলামীর তিমিরান্ধকার থেকে রক্ষা পায়। বিংশ শতাব্দীতে এসে অবস্থার মোড় পরিবর্তন হয়ে যায়। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর মুসলিম দেশগুলোর স্বাধীনতা লাভের সুচনা দেখা দেয়। বর্তমানে চৌত্রিশটি [এই নিবন্ধটি ১৯৬৭ সালে লেখা হয়েছিলো। এরি মধ্যে আরো বেশ কিছু মুসলিম রাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে। বর্তমানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যা পঞ্চাশোর্ধ্ব। – অনুবাদক] স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে। এ রাষ্ট্রগুলো নিজেদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ভবিষ্যত নির্মানের জন্যে নিজেরাই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের সাথে সাথে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাও দেখা দিয়েছে। মুসলমানরা যতো দিন সম্রাজ্যবাদী শক্তির গোলাম ছিলো ততোদিন ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে নিজেদের সামাজিক জীবনের ঢেলে সাজানো সম্ভব ছিলোনা। তাদের দীন জীবনের একটি পূর্ণাংগ নীতিমালা তাদের দিয়েছে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের সবগুলো বিভাগে আল্লাহ এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাকে কার্যকর না করা পর্যন্ত তারা ঈমানের দাবী পূর্ণ করতে পারেনা। স্বাধীনতা লাভের পর স্বাভাবিকভবেই এ প্রশ্ন দেখা দেয় যে, সামষ্টিক জীবন ব্যবস্থাকে বিশেষ করে রাষ্ট্র, আইন ও শাসনতন্ত্রকে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে ঢেলে সাজানো হবে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জনগনের যে দাবী তার পেছনে এই অনুভুতিই তীব্রভাবে কাজ করছে।
ইতিহাসের বিশাল পঠভূমিতে এ আন্দোলন এক দুঃসাহসিক আন্দোলন। আর এর সাথেই সম্পৃক্ত রয়েছে ভবিষ্যতের সমস্ত কল্যাণ। কিন্তু আর একটি ভাববার বিষয় রয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, একটি মুসলিম দেশে কেন ইসলামী রাষ্ট্র দাবী করার প্রয়োজন পড়লো? তাতো স্বাভাবিকভাবেই ইসলামী রাষ্ট্র হওয়া উচিত ছিলো, এবং তার সমস্ত শক্তি এই উদ্দেশ্যেই নিয়োজিত হওয়া উচিত ছিলো, যেনো সবকিছু ইসলামের মাপকাঠির সাথে সামঞ্জস্যশীল হয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রকৃত অবস্থা তা নয়। এর মূল কারণ হলো, সম্রাজ্যবাদী শাসনের যুগে শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে বিপ্লব সাধিত হয়েছিলো তা মুসলমানদের শিক্ষিত শ্রেণীকে ইসলাম থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এদের মধ্যে বিরাট সংখ্যক লোক বলতে গেলে ইসলাম সম্পর্কে কিছু জানেইনা। তাদের মধ্যে একটা শ্রেণী এরকমও আছে যাদের মনমগজকে এতোটা বিষাক্ত করে দেয়া হয়েছে যে, তারা ইসলাম সম্পর্কে চরম ভ্রন্ত ধারণার শিকার। ইসলামী শিক্ষা সম্পর্কে রয়েছে তাদের কুধারণা। ইসলামী শিক্ষার শিক্ষিত লোকদের এরা দেখে পাশ্চাত্যের সৃষ্ট চশমা দিয়ে। এই শ্রেণীটি বর্তমান যুগে ইসলামকে প্রাচীন কাহিনী বলে মনে করে। অপরদিকে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসরণ তাদের দ্বীন ও ঈমানে পরিণত হয়েছে। এই শ্রেণীটি স্বয়ং তাদের দেশবাসীর আবেগ ও অনুভূতির বিরুদ্ধে চরম যুদ্ধে ও সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে।
একদিকে রয়েছে চরম গাফলতি ও আক্রশ, অপরদিকে রয়েছে ভ্রন্ত ধারণা ও শত্রুতা। এই জিনিসগুলো ইসলামী রাষ্ট্র বিকাশের পথে সবচাইতে বড় প্রতিবন্ধকতা। আমাদের দৃষ্টিতে এসব প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত করার পন্থা হলো, একদিকে ইসলামী শিক্ষাকে অধিক ও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং সাধারণ জনগণকে মানসিক ও চিন্তাগত প্রশিক্ষণ দিয়ে যেতে হবে। অপরদিকে জীবনের সকল বিভাগে এমন এক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দিতে হবে যা মুসলমানদের পরম সাধ ও আকাংখার জজবা ও আবেগকে অনুধাবন করতে সক্ষম হবে, ইসলামের প্রতি রাখবে পাকা ইয়াকীন এবং জীবনের প্রতিটি বিভাগে তাকে চালু ও কার্যকর করার জন্যে রাখবে প্রবল আকাঙ্ক্ষা। কেবল এই পন্থায়ই জাতির সকল যোগ্যতা ও শক্তি পারস্পরিক দ্বন্দ ও সংঘাতের পরিবর্তে সুদৃঢ় পুনর্গঠনের কাজে নিয়োজিত হতে পারে এবং এভাবেই অতিক্রম করা সম্ভব বহু বছরের মনযিল কয়েক মাসে।
৪. এ গ্রন্থ সম্পর্কে কয়েকটি কথা
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর সবশ্রেষ্ঠ অবদান এটাই যে, তিনি একই সাথে উপরোক্ত দুটি প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যে যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন। এক দিকে তিনি গোটা ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে দীনি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি প্রমাণসহ উপস্থাপন করেছেন এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাকে যুগ উপযোগী ভাষায় পেশ করেছেন। তাঁর লেখা অধ্যয়ন করলে জীবন সম্পর্কে পাঠকদের ইসলামী দৃষ্টিভংগির পূর্ণ জ্ঞান অর্জিত হয় এবং তারা ইসলামের গোটা চিত্রকে এক নযরে দেখতে সক্ষম হন। সকল প্রকার ভয় ভীতিকে পদদলিত করে তিনি বর্তমান যুগের সকল ফিতনার মোকাবিলা করেন এবং ইসলামী জীবন ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব ও পূর্ণাংগতা প্রমান করেন।
এর চাইতেও বড় অবদান তাঁর এই যে, তিনি ইসলামী জীবন ব্যবস্থার কেবল আদর্শিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যখ্যা বিশ্লেষণই প্রদান করেননি, বরঞ্চ বর্তমান যুগে এই জীবন ব্যবস্থাকে বিভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে এবং যুগের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কিভাবে ইসলামের ছাঁচে ঢেলে সাজানো যেতে পারে তাও তিনি বলে দিয়েছেন। জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে তিনি ইসলামের উপযোগিতা প্রমাণ করেছেন। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখা এবং তার পরিচালনা ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছিলো তাঁর কাজের বিশেষ ক্ষেত্র। তিনি যেরূপ আস্থা ও ইয়াকীনের সাথে, যে ধরনের দূরদৃষ্টির সাথে এবং যেরূপ গভীর ও প্রশস্ত চিন্তা ভাবনার সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের সকল বিভাগের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন তাতে একালে তার সমকক্ষ আর কেউ নেই। নিঃসন্দেহে একাজে গোটা আরব ও আজমের মধ্যে তিনি একক ব্যক্তিত্ব। যুগের দাবীকে সামনে রেখে তিনি ইসলামের পূর্ণাংগ চিত্র অংকন করেছেন। ইজতেহাদী অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টির সাথে তা তিনি পেশ করেছেন এবং সকল বাস্তব সমস্যার প্রতি লক্ষ্য রেখে তিনি তা উপস্থাপন করেছেন। আর এটাই হচ্ছে তাঁর স্বতন্ত্র্য ও অনুপম অবদান।
ইসলামী রাষ্ট্র সংক্রান্ত তাঁর যেসব লেখা ও প্রবন্ধ নিবন্ধ ও গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে, তা বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়েছিলো। এর মধ্যে কিছু কিছু বিভিন্ন পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়ে পাঠকগণ কর্তৃক দারুণভাবে সমদৃতও হয়। কিন্তু সবগুলো লেখা একটি গ্রন্থকারে পেশ করা সম্ভব হয়নি। আমি যখন মাওলানা ইসলামী আইন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংক্রান্ত লেখাগুলো ইংরেজী ভাষায় “Islamic Law & Costitution” নামে সংকলন করি, তখনই সরাসরি উর্দু ভাষায়ও এই সংকলটি প্রকাশিত হবার প্রয়োজন অনুভব করি। কিন্তু মাওলানা তাঁর অতিরিক্ত ব্যস্ততার কারণে একাজ করতে পারেননি। অতএব যখন ইংরেজী গ্রন্থটি দ্বিতীয়বার পর্যালোচনা করে প্রস্তুতি করি তখন এ অনুভূতি পূনরায় তাজা হয়ে উঠে এবং কয়েকজন বন্ধু বান্ধবের বার বার অনুরোধের ফলে মাওলানার অনুমতিক্রমে উর্দু গ্রন্থটিও সংকলনের কাজ শুরু করি। সবগুলো লেখা একত্রিত করার পর ভাবলাম “ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা” এবং “ইসলামী আইন” এই দুটি বিষয়ের উপর দুটি পৃথক পৃথক গ্রন্থ তৈরী করতে হবে। দুটি বিষয়ের সবগুলো লেখা নিয়ে একটি গ্রন্থের কলেবর অনেক বেড়ে যাবে। তাই ১৩৮০ হিজরী মোতাবেক ১৯৬০ ঈসায়ীতে আমি “ইসলামী রিয়াসাত” নামে মাওলানার গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধসমূহ সংকলন করে ফেলি। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি যে, গ্রন্থটি খুবই সমাদৃত হয়। শিক্ষিত সমাজ গ্রন্থটি খুবই পছন্দ করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাকে পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেই গ্রন্থটি কয়েকদিন থেকে অপূর্ণাংগ ছিলো এবং তাতে আমার মূল অভিপ্রায়ও প্রতিবাত হয়নি। যেহেতু গ্রন্থটির পরিপূর্ণতা সাধনের সময় সুযোগ হাতে ছিলোনা, সেজন্যে সে অবস্থাতে তা মুদ্রণের জন্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আলহামদুলিল্লাহ ইসলামিক রিসার্চ একাডেমী” মাওলানার সকল লেখা সংগ্রহ করেছে এবং এখানে মাওলানার সবগুলো লেখাকে নতুনভাবে সাজানোর কাজ চলছে। এখানে কয়েক মাসের পরিশ্রমের পর গ্রন্থটিকে পরিবর্ধিত কলেবরে উপস্থাপন করছি। এখন এই গ্রন্থে মাওলানার ইসলামী রাষ্ট্র সংক্রান্ত সকল লেখা একটি বিশেষ সূচী পরস্পরায় সংকলিত করা হয়েছে। প্রথমে সংস্করণে আদর্শিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা এবং এ দেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সংগ্রাম সংক্রান্ত লেখা বিমিশ্রিত ছিলো। এখন সেগুলোকেও পৃথক পৃথক করে দেয়া হয়েছে। এই গ্রন্থে এখন শুধুমাত্র আদর্শিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনাই সংকলিত হয়েছে। এই গ্রন্থে তরজমানুল কুরআন” পত্রিকার পুরানো ফাইল থেকে সেইসব প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে যা এযাবত কোনো প্রকার গ্রন্থ বা পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়নি। অবশ্য আমরা পুরানো লেখা থেকে কেবল এই গ্রন্থের বিষয়বস্তুর সাথে সম্পৃক্ত অংশগুলোই গ্রহণ করেছি। আর যে অংশগুলো সমকালীন ধরণের ছিলো কিংবা কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো এবং তাদের তৎকালীন দৃষ্টিভংগির সাথে সম্পৃক্ত ছিলো সেগুলো আমরা বিলুপ্ত করে দিয়েছি। যেহেতু পুরানো তর্ক বহছ তাজা করে তোলা আমাদের লক্ষ্য নয়, সেজন্য এখন সেগুলো নিষ্প্রয়োজন। অবশ্য আমরা ঐ সকল অংশেরই হিফাযত করেছি যেগুলোতে আদর্শিক ও মূলনীতিগত আলোচনা ছিলো। কারণ সেগুলো চিরন্তন ও শাশ্বত। তরজমানুল কুরআনের ফাইল ছাড়াও আমরা তাফহীমূল কুরআনকে এ উদ্দেশ্য গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছি এবং এর টীকায় রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান সংক্রান্ত যতো আলোচনা ছিলো সেগুলো বের করে এনেছি। দুটি পৃথক শিরোনামে সেগুলো সংকলিত করেছি। তাই দুটো প্রবন্ধ বর্তমান অবয়বে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হচ্ছে। এ দুটি প্রবন্ধ থেকে পাঠকগণ অনুভব করতে পারবেন তাফহীমুল কুরআনে আনুষংগিক বিষয়ে কতো বিপুল আলোচনা হয়েছে এবং সেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে সেগুলো থেকে এক নযরে উপকৃত হওয়া সম্ভব ছিলোনা।
সংকলক এ ব্যাপারে বিশেষভাবে চেষ্টা করেছেন যাতে করে মাওলানার লেখাগুলো সর্বাংগীন সুন্দরভাবে সংকলিত হয় এবং সেগুলোর যৌক্তিক পারস্পর্য অক্ষুন্ন থাকে। এ প্রসংগে তাকে কছু পরিবর্জন ও পরিবর্ধনের কাজও করতে হয়। তার পক্ষে মাওলানার লেখার মধ্যে বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তন করাও বিরাট কষ্ট ও দুঃসাধ্যের ব্যাপার ছিলো। কিন্তু যেসব প্রবন্ধ নিবন্ধ বিগত প্রায় পঁচিশ বছর সময়কালে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনকে সামনে রেখে এবং গ্রন্থাকারে সংকলিত করার দৃষ্টিভংগি ছাড়াই লেখা হয়েছিলো, এখন সেগুলোকে গ্রন্থের রূপ দেবার প্রাক্কালে কিছুটা পরিবর্তন আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। এ কাজ স্বয়ং মাওলানার নিজ হাতেই হবার দাবীদার ছিলো। কিন্তু ব্যস্ততা তাকে কোনো প্রকার অবকাশ দেয়নি। অথচ পরিবেশ পরিস্থিতি দাবী করছিলো এই মূল্যবান লেখাগুলো সুগ্রথিত হয়ে শিক্ষিত সমাজের সামনে আসুক। নিজের জ্ঞানগত মূলধনের স্বল্পতার পূর্ণ অনুভূতি আমার রয়েছে এবং সম্ভবত একাজ আমি কখনো করতে পারতামনা যদিনা স্বয়ং মাওলানাই আমাকে সাহস যোগাতেন। তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমার উপর এতোটা আস্থা রেখেছেন এবং এই বিরাটক খেদমত আনজাম দেবার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। এ গ্রন্থটি প্রস্তুত করার কাজ আমার জন্য এক বিরাট সৌভাগ্যের মর্যাদা রাখে। আমি আনন্দিত যে, স্বয়ং মাওলানা প্রতিটি কদমে আমাকে নির্দেশনা এবং পরামর্শ দান করে উপকৃত করেছেন। এখন আল্লাহই ভাল জানেন এ দায়িত্ব আমি কতোটা পালন করতে পেরেছি। এতে যদি কিছুমাত্র সফল হই তবে তা আল্লাহরই মেহেরবানী এবং যতোটুকুই ত্রুটি থেকে থাকে তার দায়িত্ব আমার।
২৭ সফর ১৩৮৬ হিজরী
প্রফেসর খুরশীদ আহমদ
ইসলামিক রিসার্চ একাডেমী করাচী


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি