‘ইসলামের অর্থনীতি’ সম্পর্কে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তদানীন্তন অধ্যক্ষ ডক্টর এম. এন. হুদার অভিমত

—ইসলাম সম্বন্ধে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠদাবি এই যে, ইসলাম শুধুমাত্র আত্মার কল্যাণকামী ধর্মই নয়- ইসলাম গোটা মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতের সুস্পষ্ট ও সর্বাত্মক ইশারা। ইসলামী মোনাজাতের প্রথমকথাদুনিয়ার মঙ্গল, আখিরাতের মঙ্গলের কথা পরে।

মানুষের পার্থিব কল্যাণ অনেকখানি নির্ভর করে সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থার, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর। আজকের জিজ্ঞাসু মানুষ তাই প্রত্যেক সামাজিকবাণিজ্যিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিচারকরতে চায় এই মাপকাঠি দিয়ে যে, সে ব্যবস্থা কতখানি পার্থিব কল্যাণ আনচে মানুষের জন্যে, মানুষের পার্থিব উন্নতির পথ কতখানি সুগম হতে তাতে, আর সেই উন্নতির সুফল কতখানি আসবে সবারই ভোগে।

আজ তাই চরম পরীক্ষা এসেছে প্রত্যেক সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার। যেদুটি প্রধান ব্যবস্থা আজ দুনিয়ায়চালু তার কোনটাতে মানুষ সুখী হতে পারছে না। তার মন চাইছে নূতন পথের সন্ধান- যে পথে থাকবে না বর্তমান ব্যবস্থাদ্বয়ের গলদগুলো। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, ইসলামে সে ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আজ শুধু বিশ্বাসকে সম্বল করলেই আমাদের চলবে না। ইসলামের সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল সূত্রগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে মেজে ঘষে দুনিয়ারসামনে তুলে ধরতে হবে আর দেখাতে হবে, কেমন করে আজকের শিল্প-বাণিজ্য –যন্ত্র-কেন্দ্রিকসভ্যতাতেও শুধুমাত্র ইসলামই মানুষের কল্যাণকামী পথের সন্ধান দিতে পারে।

এ এক বিরাট দায়িত্ব, এদায়িত্ব পূরণের পথে জনাব মুহাম্মদ আবদুর রহীম সাহেবের ‘ইসলামের অর্থনী’ এক বিশ্টি পদক্ষেপ। আবদুর রহীম সাহেব বিশেষ কৃতিত্বের সহিত ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তাকে আমাদের মোবারকবাদ। ……

(স্বাঃ) মীর্জা নুরুল হুদা

অধ্যক্ষ, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৬ সন)

উৎসর্গ বিদগ্ধ সমাজের হাতে

প্রসঙ্গ কথা
অর্থনীতি মানব জীবনে একটি মৌলিক ওগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুনিয়ায় জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয সামগ্রীআহরণ, সর্বশ্রেণী মানুষের মধ্যে উহার সুষম বন্টন এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মিটানোর জন্য প্রয়োজন একটি বলিষ্ঠ অর্থনীতি। কিন্তু মানুষের কাংক্ষিত এই অর্থনীতিটি পাওয়া যাবে কোন্‌ সূত্র হইতে অথব কে-ইবা উহা রচনা করিয়া দিবে মানব জাতিকে? যুগ যুগ ধরিয়া এই মূল প্রশ্নে বিতর্কচলিয়া আসিতেছে মানব সমাজে।

অবশ্য মানুষ শুধু বিতর্কে লিপ্ত হইয়াই ক্ষান্ত হয় নাই; বরং প্রয়োজনের তাগিতে সে নিজেই নানারূপ অর্থনীতি রচনা করিয়া লইয়াছে। তন্মধ্যে ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই দুইটি অর্থনীতিই বর্তমানে দুনিয়ায় বেশির ভাগ অঞ্চলে প্রচলিত রহিয়াছে। দীর্ঘকাল ধরিয়া এই দুইটি অর্থনীতির মধ্যেই মানুষ তাহার সকল চাওয়া ও পাওয়ার সন্ধান করিয়া আসিতেছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হইল: এই দুই অর্থনীতির কোনটিই মানুষের প্রকৃত দাবি পূরণ করিতে পারিতেছে না। একটি সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ নির্মাণে এই দুইটি অর্তনীতিই সমান ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছে।

ধনতন্ত্র সমাজে ব্যক্তিকে অসাধারণ গুরুত্ব প্রদান করিয়াছে। ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষা করিতে গিয়া সমষ্টির স্বার্থকে সে নির্মমভাবে জলাঞ্জলি দিয়াছে। পক্ষান্তরে সমাজতন্ত্র সমষ্টিরস্বার্থকেই সর্বক্ষেতে বড় করিয়া দেখিয়াছে। সমষ্টির স্বার্থরক্ষার নামে সে ব্যক্তির স্বার্থকে নিষ্ঠুরভাবে পদদলিত করিয়াছে। এই দুই প্রান্তিকধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির ফলে ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে কোনটিই মানব জাতির প্রকৃত কল্যাণ সাধনে এতটুকু সফলকাম হয় নাই; বরং এই দুই অর্থনীতির অধীনেই মানব জাতি নিগৃহীত হইয়াছে সমানতালে। সমাজের মুষ্টিমেয় ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী লোককে লুটপাটের সুবিধা প্রদান ছাড়া এই দুই অর্থনীতি সাধারণ মানুষকে কিছুই দিতেগ পারে নাই। এ কারণেই দুনিয়ার মানুষ তাহাদের আশা-আকাংক্ষা পূরণের উপযোগী একটি তৃতীয় অর্থনীতির জন্য অধীর আগ্রহে প্রহর গুণিতেছে সুদীর্ঘকালহইতে।

ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন। অর্থনীতিস্বভাবতই ইহার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই সোনালী যুগে ইলামের সমাজ ও রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সঙ্গে ইহার অর্থনীতিও গণ-মানুষকে মুক্তি ও কল্যাণের পথ-নির্দেশ করিয়াছে। রাসূলে করীম (স) ও খুলাফায়ে রাশেদীন মানুষের সামনে ইসলামী অর্থনীতির বাস্তব নমুনা তুলিয়া ধরিয়াছেন অত্যন্ত সতর্কভাবে। কিন্তু সোনালী যুগের পর ইসলামের সমাজ ও রাষ্ট্রনীতর ন্যায় ইহার অর্থনীতিও হারাইয়অ গিয়াছে বিস্মৃতির অতল গহবএর। রাজতন্ত্রেরসর্বনাশা অভিশাপ মানব জাতিকে বঞ্চিত করিয়াছে ইসলামী সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতির অপরিমেয় কল্যানকারিতা হইতে।

কিন্তু এতৎসত্ত্বেও ইসলামী সমাজ,রাষ্ট্র ও অর্থনীতির আবেদন এতটুকু ফুরাইয়া যায় নাই; বরং মানব রচিত মতবাদহগুলি, বিশেষত ধনতন্ত্র ও সমাজতন্দ্রের অনিবার্য ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পাইয়াছে প্রচণ্ডভাবে। বিশেষত ঊনবিংশ শতাব্দীর ইসলামী নব জাগৃতির পরিণতিতে মানুষের কাংক্ষিত তৃতীয় অর্থনীতি হিসেবে ইসলামী অর্থনীতির ব্যাপারে একটা অদম্য কৌতূহল লক্ষ্য করা গিয়াছে বর্তমান শতকের শুরু হইতেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে কৌতূহল নিবারণের জন্য যথোচিত উদ্যম ও প্রয়াস লক্স্য করা যায় নাই মুসলিম পণ্ডিত ও চিন্তাবিদদের মধ্যে; বরং তাদের কেহ কেই প্রচলিত অর্থনীতির দেহে ইসলামের রংচড়াইয়া উহাকেই ইসলামী অর্থনীতি নামে চালানোরে একটা ব্যর্থ প্রয়াস পাইয়াছেন নেহায়েত অনাকাংক্ষিতভাবে।

এই প্রেক্ষিতে ও প্রেক্ষাপটে ইসলামের অর্থনীতি সম্পর্কে একটা ‍সুস্পষ্ট ও প্রামাণ্য বক্তব্য উপস্থাপনের মানসে পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে অত্যন্ত সাহসিকতার সহিত আগাইয়া আসেন এ শতকের অন্যতমম শ্রেষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক আল্লামা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ)। প্রায় অর্ধ যুগব্যাপী নিরন্তন সাধনা ও গবেষণার ফসল হিসাবে ১৯৫৬ সনে তিনি বাংলাভাষী জনগণের কাছে উপস্থাপনকরেন ‘ইসলামের অর্থনীতি’ নামক এই অতুলনীয় গ্রন্থটি। কোন ভাসাভাসা ও গতানুগতিক আলোচনা কিংবা প্রচলিত অর্থনীতির দেহে ইসলামের রং চড়ানো নয়, বরং আধুনিক অর্থনীতির আলোকে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ হইতে ইসলামী অর্থনীতির মূল সূত্রগুলি তিনি পরম যত্নের সহিত তুলিয়া ধরিয়াছেন এই মুল্যবান গ্রন্থে। বিশেষত, সুদ-ভিত্তিক অর্থনীতির এই যুগে সুদমুক্ত অর্থনীতির প্রবর্তন এবং জন্মনিরোধের ন্যায় আত্মঘাতি কর্মপন্থা ছাড়াইএ যে জনসংখ্যাসমস্যার সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব, তাহা এই গ্রন্থে তিনি প্রমাণ করিয়াছেন অকাট্যভাবে। বলা বাহুল্য, বাংলাভাষায় ইসলামী অর্থনীতি সংক্রান্ত আলোচনায় এই গ্রন্থটিই হইতেছে একমাত্র পথিৃত এবং সর্বাধিক প্রমাণ্য ও সমৃদ্ধ দলীল। বিগত চার দশক যাবত এই গ্রন্থটিই সমাদৃত হইয়া আসিতেছে ইসলামের অর্থনীতি সংক্রান্ত শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পাঠগ্রন্থ হিসেবে।

বিগত এক চল্লিশ বৎসরে এই গ্রন্থটির ছয়টি সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে এবং প্রতিটি সংস্করণই আশাতীত পাঠকপ্রিয়তা লাভকরিয়াছে। এজন্য আমরা মহান আল্লাহর দরবারে অজস্র শোকরিয়া জ্ঞাপন করিতেছি। গ্রন্থটির বর্তমান সংস্করণের অঙ্গসজ্জা ও মুদ্রণ পারিপাট্যকে অধিকতর উন্নত করার জন্যে যথাসাধ্য উদ্যোগ নেওয়া হইয়াছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বিদগ্ধ পাঠক মহলে এ সংস্করণটি পূর্বাপেক্ষা অধিকতর সমাদৃত হইবে এবং বাংলার এই জমীনে ইসলামী সমাজ, রাষ্ট্রও অর্থনীতি কায়েমের লক্ষ্যে তাহাদের মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনার সঞ্চার করিবে।

মহান আল্লাহ গ্রন্থকারের এই অসামান্য খেদমত কবুল করুন এবং তাঁহাকে জান্নাতুল ফিরদাউসে উচ্চতম মর্যাদা দিন, ইহাই আমাদের সানুনয় প্রার্থনা।

ঢাকা: ৫ এপ্রিল, ১৯৯৭

মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান

চেয়ারম্যান, মাওলানা আবদুর রহীম ফাউন্ডেশন

চতুর্থ সংস্করণে গ্রন্থকারের বক্তব্য

আমার লিখিত ‘ইসলামের অর্থনীতি’ বইটির চতুর্থ সংশোধিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ সুধী পাঠকদের হাতে তুলিয়া দিতে পারিয়া আমি মহান আল্লাহর অশেষ শোকার আদায় করিতেছি। ইহা যে সম্ভব হইল- সত্য বলিতে কি- তাহা আমার জন্যও একটি বিস্ময়ের বিষয়। কেননা গ্রন্থ প্রণয়ন এক কথা, আর উহা প্রকাশনা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিরাট ব্যাপার।

এই বইর প্রথম সংস্করণ যদিও আমি নিজে প্রকাশ করিয়াছিলা, তাহা আজ হইতে ৩৩ বৎসর আগের কথা। কিন্তু বর্তমানে বই প্রকাশনার জন্য প্রয়োজনীয় মুলধন সংগ্রহ করা আমার জন্যে অকল্পনীয়। তাহা সত্ত্বেও আল্লাহতা’আলা অভাবিত উপায়ে এই সংস্করণটির প্রকাশ সম্ভব করিয়া দিয়াছেন।

আমার বহু কয়টি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশক না পাওয়ার কারণে নূতন করিয়া প্রকাশিত হইতে পারিতেছে না, এই বিষয়ে স্নেহাস্পদ মাওলানা মতীন সোনালী পেপার এ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেড কোম্পানীর ম্যানেজিং ডাইরেকটর জনাব আলহাজ্জ খান মুহাম্মদ ইকবালকে অবহিত করেন। তিনি বইগুলি দেখিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। প্রায় সব কয়টি বই দেখিয়া তাৎক্ষণিকভাবে ‘ইসলামের অর্থনীতি’ প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ তাহার পরিচালিত কারখানা হইতে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।

জনাব ইকবালের সহিত আমার কখনই সাক্ষাৎ হয় নাই, টেলিফোনে কয়েকবার কথা হইয়াছে মাত্র। তিনি আমার সাক্ষাৎ না পাইয়াও বই প্রকাশের জন্য নিজ হইতেই কাগজ দান দ্বীন-ইসলামের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রচারে যে সহযোগিতা করিনে তাহা মহান আল্লাহর নিকট একটি বড় অবদান বলিয়া স্বীকৃত হইবে, আশা করি। আমি তাঁহার প্রতি কোনরূপ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়া তাহার এই সহযোগিতাকে খাটো করিতে চাহি না। তবে তাহার সার্বিক কল্যাণের জন্য আমি মহান আল্লাহর নিকট দোয়া করিতেছি। অকপটে স্বীকার করিতেছি যে, ইহা এক বিরল দৃষ্টান্তের ঘটনা।

বইটির বর্তমান সংস্করণ সংশোধিত ও নূতন বিষয়ে সংযোজিত হওয়ার পূর্বাপেক্ষা অধিক সমৃদ্ধ হইা সুধী পাঠকদের নিকট উপস্থিত হইল। ইহাতে তাহারা ইসলামী অর্থনীতির সহিত তুলনামূলক অধ্যয়নেরও বিরাট সুযোগ পাইবেন, তাহা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

পূর্ববর্তী তিনটি সংস্করণের ন্যায় এই সংস্করণটি সুধীবৃন্দের নিকট সমাদৃতহইবে, এই আশা আমি আন্তরিকভাবেই পোষণ করিতেছি।

মুহাম্মাদ আবদুর রহীম

মোস্তফা মনযিল

২০৮, নাখাল পাড়া

 


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি