অর্থনীতির গোড়ার কথা
অর্থনীতির সংজ্ঞা ও পরিচয়

মানুষের জীবন অসংখ্য প্রকার প্রয়োজনের সহিত নিবিড়ভাবে বিজড়িত। প্রয়োজন ও আবশ্যকতাকে কেন্দ্র করিয়া তাহার জীবন দিনরাত চক্রাকারে ঘুরিতেছে। খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রং, উন্মুক্ত বায়ু ও অপত্য স্নেহ প্রভৃতি মানুষের জীনবকে ধ্বংসের হাত হিইতে রক্ষা করার জন্য একান্ত অপরিহার্য।মানুষ তাহার প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করিয়া যাইতেছে। সেই জন্য একটি স্বভাবজাত আগ্রহ, উৎসাহ এবং অন্তর্নিহিত প্রয়োজন বোধ ও কর্মানুপ্রেরণা প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে বর্তমান। নূতন নূতন আশা ও আকাঙ্ক্ষা মানুষের মনে প্রত্যহসঞ্চারিত হয়, ভবিষ্যতের রঙীনস্বপ্নে মানুষ প্রবুদ্ধহয়। তাহা পূরণ ও বাস্তবায়নের জন্য তাহাকে নূতন উদ্যম সচেষ্ট হইতে হয়। এই চেষ্টা-যত্ন ব্যাপদেশে আবার নূতন প্রয়োজন উদ্ভূত হয়, সেই প্রয়োজন পূরণ করার জন্য আবার তাহাকে নূতন চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করিতে হয়। এইভাবে একদিকে প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য অর্থোৎপাদন এবং সেই সঙ্গেই নূতন প্রযোজন উদ্ভব হওয়ার এক অন্তহীন আবর্তনের নিরবচ্ছিন্ন ধারা মানুষের জীবনকে সক্রিয় ও গতিশীল করিয়া রাখে। মানুষের জীন যাত্রা নির্বাহেরজন্য এই অপরিহার্য প্রয়োজন এবং তাহা পূরণ করার উপায় ও প্রাণালী সম্বন্ধে আলোচনা করা হয় যে সামাজিক বিজ্ঞানে, তাহারই নাম অর্থনীতি।

প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা ও শ্রম, চেষ্টা ও শ্ররে ফলে পণ্য উৎপাদন এবং এই উৎপাদনের আয় দ্বারা প্রয়োজন পূরণ ইহাই অর্থনীতির গোড়ার কথা। মানুষ সমগ্রজীবনই এই চক্রের সহিত অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত থাকে, ইহা হইতে মানুসের নিষ্কৃতি নাই। বস্তুত ক্ষুধা যদি পীড়াদায়ক ও প্রাণ সংহারক না হইত, দেহ যদি নিজ হইতেই শীতাতপের আক্রমণ প্রতিরোধ করিত পারিত এবং সেই সঙ্গে লজ্জা-শরমের স্বাভাবিত প্রবণতারর মৃত্যু ঘটিত, তাহা হইলেজ্ঞান-বিজ্ঞানের সূচী-পত্র হইতে অর্থনীতির নাম চিরতরে বিলুপ্ত হইয়া যাইত।

কিন্তু এই প্রয়োজনসমূ যেহেতু স্বাভাবিক, অপরিহার্য ও শাশ্বত, তাই অর্থনীতও চিরন্তন সত্য। এই জন্য অর্থনীতি ঠিক ততখানি প্রাচীন, যতখানি প্রাচীন মানুষের চেষ্টা ও সাধনা। যদিও কালের অগ্রগতির ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষের চিন্তার বিবর্তন ঘটিয়াছে অনেক। কখনও অর্থনৈতিক সমস্যা প্রচণ্ডরূপে ধারণ করিয়াছে, কখনো বা উহার গুরুত্ব অধিকতর হ্রাস পাইয়াছে, কিন্তু উহার মূল বিষয়ে এবং উহার স্বাভাবিক ও বুনিয়াদী গুরুত্বের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন বা ব্যতিক্রম কখনই পরিলক্ষিত হয় নাই, ইহা স্বতঃসিদ্ধ।

স্যার জেমস স্টুয়ার্ট বলিয়াছেন:

অর্থনীতি এমন একটি শাস্ত্র যাহা- এক ব্যক্তি সমাজের একজন হওয়ার দিক দিয়া কিরূপ দূরদৃষ্টি ও মিতব্যয়িার সহিত নিজ ঘরের যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করিতে পারে তাহা আমাদিগকে বলিয়া দেয়। এই জন্য ব্যক্তিগত অর্থনীতির যেগুরুত্ব রহিয়াচে ঘরের ছোট্ট পরিবেষ্টনীতে, সমগ্র রাস্ট্রে অনুরূপ গুরুত্ব রহিয়াছে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির।

অর্থনীতির উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলিয়াছেন:

এই শাস্ত্রের প্রধানতম উদ্দেশ্য হইতেছে, রাষ্ট্রের অধীন বসবাসকারী সকল অসংখ্য মানুষের সহিত পরস্পর সম্পর্ক রাখিয়া এবং একটি সুসংঘটিত সমাজের সদস্য হইয়াই জীবন যাপন করিতে হয়। একাধিক লোকের পারস্পরিক সহযোগিতা ব্যতীত মানুষের কোন একটি সামান্যহম প্রয়োজনও পূর্ণ হইতে পারে না। সমাজের সহিত এক ব্যক্তির সমাষ্টিগতভাবে এবং উহার স্বতন্ত্র ব্যক্তিদের সহিত ব্যক্তিগতভাবে সাধারণ ও বিশেষ প্রকারের সম্পর্ক স্থাপিত হওয়া অপরিহার্য। এই সব সম্পর্কের সামগ্রিক ও ব্যাপক আলোচনাই সমাজ-দর্শনের বিষয়বস্তু। মানুষের এই পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্বন্ধ যেহেতু বিভিন্ন প্রকার ও বিবিধ দিক দিয়া হইয়া থাকে, সেই কারণে সমাজ-দর্শনেরও বিভিন্ন প্রকার রহিয়াছে, যাহা নীতিদর্শন, রাষ্ট্রনীতি, আইন প্রভৃতি নামে অভিহিত হয়। এইজন্য অর্থনীতিও সমাজ-দর্শনেরই একটি অংশ। অর্থনীতি একটি সামাজিক বিজ্ঞান। কারণ, মানুষের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য চেষ্টা, সাধনা এবং অর্থনৈতিক সম্পদের উৎপাদন ও উহার বন্টন-ব্যয়ের নিয়ম-পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করাই হইতেছে অর্থনীতির উপজীব্য। এল.এম.ফ্রলার বলিয়াছেন:

‘কেবল মূল্য ও সামঞ্জস্যের সমন্বয়েই অর্থনীতি হয় না, উহার পরিধি অতিশয় বিশাল ও সুদূরপ্রাসারী।বস্তত মানব জীবনের অধ্যয়ন ও অনুশীলনের নাম অর্থনীতি এবং মানুষের কল্যাণ সাধন ব্যতী উহার অন্য কোন উদ্দেশ্যই হইতে পারে না;’। আর.টি. ইলে (R.T.ELY)-ও এই কথারই প্রতিধ্বনি করিয়া বলিয়াছেন:

“Economics is a science, but something more than a science, a science that though with the infinite variety of human life, calling not only for systemmatic, ordered thinking, but human sympathy, imagination, and in an unusual degree for saving grace of commonsense”

অর্থনীতি বিজ্ঞান হইলেও বিজ্ঞান অপেক্ষা অনেক বেশী। ইহা এমন বিজ্ঞান, যাহা মানব জীবনের অসীম বৈচিত্রময় দিক ও বিভাগসমূহের আলোচনা করে। ইহা কেবল সুসংবদ্ধ ও সুশৃঙ্ষলিত চিন্তার আবেদনই জানায় না,মানুষের প্রতি সহনুভূতির উদ্রেককরিতে এবঙ বাস্তব জ্ঞান অসাধারণ পরিমাণসম্প্রামরণ করিতেও উহা সচেষ্ট।

অর্থনীতিবিদ মার্শাল অর্থনীতির সংজ্ঞা বলিয়াচেন:

Economics is a science which studies man in the ordinary business of life.

‘অর্থনীতি মানুষের জীবনের সাধারণকার্যাবলীর পর্যালোচনা মাত্র। তিনি আরো বলিয়াছেন: ‘মানুষ কিভাবে আয় উপার্জন করে এবং কিভাবেউপার্জিত আয় ব্যয় করে অর্থনীতি তাহারিই নির্দেশ দেয়।’

অধ্যাপক এল. রবিনস্‌ এর মতে

Economicsis the science which studies human behaviour asa relationship between ends andscarce means which have alternative uses.

“অর্থনীতি এমন এক বিজ্ঞান যাহা মানুষের সে সকল আচরণকে অধ্যয়ন অনুশীলন করে, যে সকল আচরণ উদ্দেশ্য এবং নানা বিকল্প দিকে ব্যবহার যোগ্য উপায়ের মধ্যে সম্পর্কস্থাপন করিয়া থাকে।”

অর্থনীতি কোন ব্যক্তিগত বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাপার নয়। অর্থনীতির প্রকৃত রূপ সামাজিক। সামাজিক জীবনেই অর্থনীতির গুরুত্ব। কেয়ার্নক্রস (Cairmocross) তাই বলিয়াছেন: Economics is a social science studyinghou people attempt to accomodate scarcity to theirwants and how these attempts interact through cxchange.

বস্তুত সমাজের সর্বসাধারণ মানুষের সর্বাধিক প্রয়োজন অনুসারে পণ্যের উৎপাদন, উৎপন্ন পণ্যের সুবিচারপূর্ণবন্টনএবঙ উৎপাদনের উপায় ও উহার সঠিক বন্টনের ন্যায়নীতি সম্পন্ন প্রাণালী নির্ধারণ করাই যাইতেছে অর্থনীতির কাজ। এই জন্য হওয়েরি(Howerey)দাবিকরিয়া বলিয়াছেন:

অর্থনীতিকে চরিত্রনতি হিইতে কখনই বিচ্ছিন্ন করা যাইতে পারে না বলিয়া এই বিজ্ঞান কোনদিনই উদ্দেশ্যের ব্যাপারে নিরপেক্ষা থাকিতে পারে না। কারণ মানুষ হিসাবেই উদ্দেশ্য ও উপায়-পন্থার উপরও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিয়া থাকে।’

কুরআনমজীদে অর্থনীতির এই সামাজিক মূল্যায়নই বিধৃত।তাই অর্থনীতির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এই দৃষ্টিতেই করতে হইবে। অন্যথায় মানুষের প্রতি অবিচার করা হইবে।

মানব জীবনে অর্থনীতির গুরুত্ব

অর্থনীতির পূর্বোদ্ধৃত সংজ্ঞা হইতে একথা পরিস্ফুট হইয়াছে যে, ইহা মানব-জীবনের অসংখ্য দিক ও বিভাগের মধ্যে অন্যতম। উপরন্তুইহা মানুষের জীবন-যাত্রা নির্বাহের মৌলিক প্রয়োজন সম্পর্কে আলোচনা করে বলিয়া ইহার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাই ইহাকে মানবজীবনের সমস্যা সমষ্টির মধ্যে একটি অংশ- অবশ্য অন্যতম শ্রেষ্ঠ অংশ- নিঃসন্দেহে মানিয়া লইতে হয়। কিন্তু ইহাকে যখন জীবনের সকলসমস্যা- সমস্ত জটিলতার একমাত্র মূল উৎস মনে করিয়া উহারই উপর সমস্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং উহার ভিত্তিতে অন্যান্য ‘সকল সমস্যার সমাধান করার ব্যর্থ চেষ্টায় মনোনিবেশকরা হয়, তখনি মানব-সমাজে সর্বাত্মক ভাঙন ও বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়া অবশ্যম্ভাবী। কাজেই যাহারা মনে করেন, সকল ক্ষেত্রে সকল সমস্যারই মূলে রহিয়াছে অর্থব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থাই সমগ্র জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে’-তাহাদের উচ্ছ্বাসিত ভাবাবেগ মানব-সমাজে একটা ক্ষণিক আলোনের সৃষ্টি করে বটে; কিন্তু তাহা কখনও প্রকৃত তথ্য ও সত্যিকার সমাধান পথের সন্ধান আনিয়া দেয় না।

প্রথমতঃ বর্তমান যুগের পরিস্থিতিপর্যবেক্ষণ করিলেই আমরা এই কথার সত্যতা নিঃসন্দেহে বুঝিতে পারি। আমরা দেখিতেছিঃ বর্তমান সময় শিক্ষিত সমাজে অর্থনীতি সর্ববিধজ্ঞান-বিজ্ঞানের উপর সর্বাধিকগুরুত্ব লাভ করিয়াছে। এ যুগের মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানেরউপর সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করিয়াছে। এ যুগের মানুসের জ্ঞান-চর্চার ধারা, বিন্তার গতি ও ঝোক প্রবণতা লক্ষ্য করিলে পরিস্কার মনে হয়- ইহাদের দৃষ্টিতে অর্থনীতি অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর কিছুই নাই। অথচ পৃথিবীর ইতিহাসে ইহার এতখানি গুরুত্ব বোধ হয আর কোনদিই লাভ করিতে পারে নাই। ইতিহাসের একটা গতিধারায় এই ব্যতিক্রমের মূলে কতকগুলি কারণ রহিয়াছে, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। বস্তুত আজিকার সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক দিক দিয়া এক চরম সংকটের সম্মুখীন। দারিদ্র, অবাব-অনটন এবং দুঃসহ জঠরজ্বালা আজিকার মানুষকে জর্জরিত, লাঞ্ছিত ও পর্যদুস্ত করিয়া দিয়াছে। নির্লিপ্ত শান্তিতে জীবন যাপন করা তো দূরের কথা, দুবেলা পেট ভর্তি করিয়া খাদ্য লাভ করাও আজ দুঃসাধ্য হইয়া পড়িয়াছে। এহেন অর্থনৈতিক সংকটই এ যুগের চিন্তাশীল মানুষকে চিন্তাভারাক্রান্ত ও ভারসাম্যহীন করিয়া তুলিয়াছে এবং তাহাদিগকে এই সমস্যার সমাধান পথের সন্ধানার্যে সকল শক্তি ও প্রতিভা একান্তভাবে নিযুক্তকরিতে বাধ্য করিয়াছে।

দ্বিতীয়তঃ বর্তমান সমাজের জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব-সামগ্রীর উৎপাদন, সংগ্রহ ও উপার্জনের পন্থা প্রতিনিয়ত জটলতর হইয়া পড়িতেছে। জীবিকার্জনের উপায় উত্তরোত্তর সংকটপূর্ণ ও অধিকতর কষ্টসাধ্য হইয়া দেখা দিতেছে। আলঅ-আলোচনা ও গ্রন্থ-প্রণয়ন বর্তমান সময় এত প্রবল আকার ধারণ করিয়াছে যে, অতীত ইতিহাসে ইহারেকান দৃষ্টান্তই খুঁজিয়া পাওয়া যায় না এবং উহার ফলে মানব জীবনের অন্যান্য যাবতীয সমস্যা উহার সম্মুখে একেবারে ম্লান হইয়া গিয়াছে। অর্থনৈতিক জটিলতা মানুষের সকল শক্তি ও প্রতিভাকে গভীরভাবে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে।

কিন্তু এতদসত্ত্বেও এইরূপ অস্বাভাবিক ও অভূতপূর্ব গুরুত্ব আরোপ করার পরও মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার কিছুমাত্র সমাধান আজ পর্যন্ত হইতে পারে নাই- এ কথা তিক্ত হইলেও সন্দেহাতীত সত্য। বস্তুত এই সমস্যা আজিও ঠিক ততখানিই অসমাধ্য হইয়া রহিয়াছে, যতখানি ছিল ইহার প্রথম পর্যায়ে। আধুনিক যুগের অর্থনীতিবিদদের গম্ভীর ও জটিলতর পরিবাষা, শাস্ত্রীয় বিতর্ক ও আলোচনা এবং গভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুশীলন অর্থনীতিকে একটি আধুনিক বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করিয়াছে একথা ঠিক; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক অর্থ-সমস্যার কোন সমাধানই হয় নাই, ইহাও অনস্বীকার্য।

চিন্তার বিপর্যয়

শুধা তাহাই নহে, বিগত দুই শতাব্দীকাল পর্যন্ত পাশ্চাত্য দর্শন এবং অর্থনীতি যে ভাবধারা ও দৃষ্টিকোণে উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে, তাহাতে চিন্তা ঐক্র ও সামঞ্জস্য মাত্রই রক্ষা পায় নাই। উপরন্তু তাহা মানুষের চিন্তা ও কর্মের জগতে বিকেন্দ্রিকতা, বিশ্লিষ্টতা ও নিদারুণ বিপর্যয় সৃষ্টি করিয়া দিয়াছে। সংশয়-সংকুল মানস হইতে যে চিন্তাদারা ফুটিয়া বাহির হয়, তাহাতে ঈমান ও দৃঢ়-প্রত্যয়ের কোন অবকাশই থাকিতে পারে না, আর সন্দেহ-সংকুল চিন্তাধারা হইতে মানুষ কোন স্বস্তি,কোন স্থায়ী কল্যাণ পথের সন্ধান লাভ করিতে পারে না; উহার সাহায্যে জীবনকে কোন নির্দিষ্ট গতিপথে পরিচালিত করা মাত্রই সম্ভব নয়। এই কারণেই অর্থনীতির সমগ্র বিষয়টি এমন অস্পষ্ট, জটিল ও অসমাধ্য হইয়া দেখা দিয়াছে। অর্থনীতির এই দূরবস্থার কথা ‘বারবারা উটন’ (Woothen) ন্যায় বিখ্যাত চিন্তাবিদও স্পষ্ট কণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন। তাঁহার লিখিত Lament for Economics গ্রন্থের কয়েকটি কথা এখানে উদ্ধৃত করা যাইতেছে।

“আমরা আমাদের মূল্যবান সময়ের অধিকাংশই কেবল মতবাদের অস্ত্র তৈয়ার করার কাজে ব্যয় করিতেছি। অথচ বাস্তব কর্মজীবনে উহার প্রয়োগ মাত্রই করা হয় না।”

–“বর্তমান সময় মানুষ যে অর্থবিজ্ঞানের অনুশীলন করতেছ, তাহা হইতে সমাজের কোন কল্যাণ হয় না। আর তাহা সাধারন মানুষের বোধগম্যও নয়।” অর্থশাস্ত্রবিদগণ কখনই একটি কথায় একমত হন না- হইতে পারেন না, এবং বাস্তব কর্মজীবনের সহিত আধুনিক অর্থবিজ্ঞানের কোনই সম্পর্ক নাই।”

এইজন্য বর্তমান সময়ে একদিকে ‘অর্থ দর্শনকেই একমাত্র দর্শন এবং পেট ও অন্ন সমস্যাকেই একমাত্র সমস্যা হিসাবে পেশ করা হইতেছে। অধ্যাপক জোডের ভাষার, “বর্তমান যুগের বিজয়ী দর্শন হইতেছে পেট, পেট বা পকেটেরে দৃষ্টিতেই এ যুগের সব কিছুর বিচার ও যাচাই করা হয়।” অন্যদিকে এ কথাও শুনিতে পাওয়া যায় যে, অর্থনৈতিক সমস্যা বলিতে কোন সমস্যাই কোথাও নাই এবং তাহা জীবনকে কোন দিক দিয়াই প্রভাবান্বিত করিতে পারে না। এই দুইটি মত ও দৃষ্টিকোণ যেমন পরস্পর বিপরীত দুই প্রান্তিকে অবস্থিত; তেমনি এই উভয় প্রকার মত ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃত ব্যাপারের সম্পূর্ণ বিপরীত- ইহা এই প্রকৃত ব্যাপার সম্পর্কে চরমতর অজ্ঞতার পরিণতি। অথচ মূলতভাবে কোন বিষয় সম্পর্কে চিন্তার ব্যাপারে ভারসাম্যহীন হইয়া পড়া- কোন একদিকেরও সীমালংঘন করা- মানুষের গবেষণা নীতির বুনিয়াদি ভুল আমাদের মতে চিন্তা গবেষণার এই পদ্ধতি মূলতই ত্রুটিপূর্ণ। অর্থনীতি যে মানব জীবনের অসংখ্য সমস্যার মধ্যে একটি গুরুতর সমস্যা, তাহাতে বিন্দুমাত্র সংশয় থাকিতে পারে না। সেই সঙ্গে ইহাও অনস্বীকার্য যে, অর্থনৈতিক সমস্যাই মানব জীবনের একমাত্র সমস্যা নয়, সর্বশ্রেষ্ট বা প্রধানতম সমস্যাও তাহা নয়। আর মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হইয়া গেলেই তাহার সামগ্রিক জীবনের সর্ববিধ সমস্যারও সমাধান আপনা আপনিই হইয়া যাইবে, এই রূপ কথার শুধু বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয় না বরং মহা বিভ্রান্তিরও কারণ হইয়া দাড়ায়। এই কারণে মানব জীবনে পরম সুষ্ঠুতা ও সুসংবদ্ধতা স্থাপনের জন্য একান্তই অপরিহার্য হইতেছে এক সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন-ব্যবস্থা, যহা একটি কেন্দ্রবিন্দুতে দাড়াইয়া মানুষের সর্ববিধ সমস্যার সুবিচারপূর্ণ সমাধান দিতে সমর্থ হইবে এবং উহার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও অনুরূপ সামঞ্জস্যশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ হইবে।

অর্থনীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য

অর্থণৈতিক সমস্যার সমাধান এবং সকল প্রকার দারিদ্র ও শোষণ-পীড়ন হইতে মানব জাতিকে মুক্ত করার জন্য- পরন্তু গণজীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধিপূর্ণ করিয়া তুলিবার জন্য যে অর্থনীতি গৃহীত হইবে, তাহাতে অনিবার্যভাবে নিম্নলিখি মূলনীতিসমূহ বর্তমান থাকিত হইবে। অন্য কথায়, এই মুলনীতিসমূহ যে অর্থনীতিতে বর্তমান থাকিবে, তাহাই মানুষের সকল প্রকার সমস্যার সমাধান করিতে সমর্থ হইবে। আর যাহাতে এই মূলনীতিসমূহ গুরুত্ব সহকারে বিবেচিতনহে, তাহা কখনই মানুষের কল্যাণ সাধন করিতে পারে না।

এই পর্যায়ে এখানে সাতটি মূলনীতির উল্লেখ করা যাইতেছে:

১। মানুষের জীবন এক অবিভাজ্য ও অখন্ড ‘ইউনিট’, উহাকে বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত ও খন্ড-বিখন্ড করা এবং খন্ডিত জীবনের জন্য খন্ডিত বিধান গ্রহণ করা অতিশয় মারাত্মক। মানব জীবনের এই একত্ব ও অখন্ডত্বের জন্যই উহার সমগ্র দিক ও বিভাগের পারস্পরিক ওতপ্রোতভাবে বিজড়িত থাকা একান্তই অপরিহার্য। অনুরূপবাবে মানুষের সামগ্রিক জীবন-ব্যবস্থার সহিত অর্থনীতিরও সর্বতোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। সমাজে অর্থব্যবস্থার যে মূল্যমান (Vslues) প্রচলিত থাকিবে, উহার রাষ্ট্রীয় ও নৈতিক জীবন-বিধানেরও অনুরূপ মূল্যমান বর্তমান থাকিতে হইবে। তাহা হইলেই মানুষের গোটা জীবন ব্যবস্থা পরিপূর্ণ ঐক্য ও সামঞ্জস্য সহকারে মানুষের অখন্ড ও সার্বিক জীবনের ক্ষেত্রে স্থাপিত হইতে এবং ক্রমবিকাশ লাভ করিতে পারে।

২। সে অর্থনীতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হইবে: নির্বিশেষে সমগ্র মনুষ্য জাতির কল্যাণ সাধন ও সমৃদ্ধি বিধান। বিশেষ কোন বংশ, গোত্র, শ্রেণী জাতি বা অঞ্চলের উন্নতির জন্য উহার বিশেষ কোন পক্ষপাতিত্বই থাকিবে না।

৩। যে সমাজে সেই অর্থনীতি কার্যকর হইবে, তাহাতে সামাজিক সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতা পূর্ণরূপে স্থাপিত থাকিতে হইবে। তথায় ব্যক্তি বৈষম্যের অবকাশ থাকিতে পারিবে না। উহার অভ্যন্তরে কোনরূপ পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বা বিরোধ থাকিতে পারিবে না। উহা মানব সমাজে কোনরূপ শ্রেণীবৈষম্য সৃষ্টি করিবে না, সমাজের লোকদিগকে শ্রেণী-সংগ্রামে উদ্বুধ্ধ করিবে না, উহার কোনকারণও সেখানে উদ্ভূত হইবে না। এক কথায় উহাতে ব্যক্তির যাবতীয় অধিকার সুরক্ষিত হইবে। ব্যক্তির উপর আবর্তিত সমাজের অধিকারগুলিও তাহাতে সংরক্ষিত থাকিবে এবং ব্যক্তির অর্থনৈতিক চেষ্টা সাধনা সমাজের সাগ্রিক স্বার্থের পরিপন্থী বা উহার পক্ষে ক্ষতিকর হইবে না। ব্যক্তি ও সমাজের পরস্পরের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহানুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত ভাবধারা ভিত্তিতে এক অর্থনৈতিক সম্পর্ক সংস্থাপিত হইবে। ব্যষ্টি ও সমষ্টি- উভয়েরই স্বার্থের সংরক্ষণ, ব্যষ্টিকে সমষ্টির স্বার্থে আঘাত হানার সুযোগ না দেওয়া এবং সমাজ সমষ্টিকেও ব্যক্তি স্বার্থ গ্রাস করার অবকাশ না দেওয়া- উভয়েরই স্থায়ী শান্তি ও কল্যাণের জন্য অপরিহার্য। বস্তুত যে অর্থ ব্যবস্থায় ব্যষ্টি ও সমষ্টির পারস্পরিক স্বার্থে এই নিরবচ্ছিন্নঐক্য ও সামঞ্জস্য বর্তমান রহিয়াছে, তাহাই হইতেছে নিখুঁত ও নির্ভুল অর্থনীতি।

৪। সে অর্থনীতি সমগ্র প্রাকৃতিক শক্তি ও বস্তুকে সম্পূর্ণরূপে আয়ত্তাধীন করার এবং উহাকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করার সুযোগ করিয়া দিবে। অর্থনৈতিক চেষ্টা, সাধনা ও উপার্জন প্রচেষ্টা চালাইবার অধিকারের ক্ষেত্রেও পরিপূর্ণ সাম্যের প্রতিষ্ঠা করিবে।

৫। এই অর্থব্যবস্থার সাহায্যে বৈষয়িক উন্নতি লাভের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক উৎকর্ষ এবং চরিত্রের ক্রমবিকাশও পূর্বরূপে সাধিত হইবে। কারণ নৈতিক উন্নতি ব্যতীত বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক উন্নতি যে মরীচিকা প্রতারণা মাত্র, তাহা এক সন্দেহাতীত ও ঐতিহাসিক সত্য। পাশ্চাত্য জ গতের যেসব চিন্তাশীল দার্শনিক নৈতিক চরিত্রের নাম পর্যন্ত শুনিতে প্রস্তুত ছিলেন না, তাহারাও আজ এই সত্য স্বীকার করিতে বাধ্য হইতেছেন। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জি.ডি.হব (G.D. hobb) এই তত্ত্ব স্বীকার করিয়া বলিয়াছেন:

নৈতিক মূল্য ব্যতীত কাজ করায় যে বিপদের আশংকা থাকিয়া যায়, আমি তাহা স্পষ্ট করিয়াই বলিতে চাই। বস্তুত নৈতিক নিরপেক্ষতা অবলম্বনের চেষ্টা করা চরম নির্বুদ্ধিতা, ইহাতে সন্দেহ নাই। কোন ব্যক্তিই রাজনীতি বা সমাজনীতি কোন ব্যাপারেই বস্তুবাদী (secular) হইতে পারে না।

জার্মান অর্থনীতিবিদগণ যথার্থভাবেই নৈতিক গুনের অর্থনৈতিক মূল্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করিয়াছে। বর্তমানে অর্থনীতিবিদের মধ্যে নৈতিকতার এই গুরুত্ববোধ অধিকতর তীব্র হইয়া উঠিয়াছে। যাহারা কস্মিনকালেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নৈতিকতার গুরুত্ব স্বীকার করিতেন না, তাহারাও এখন তাহা খুব জোরে-শোরে স্বীকার করিতেছেন।

বস্তুত উদ্দেশ্য সম্পন্ন কোন কাজই নৈতিক চরিত্রের বিধান-বিমুক্ত হইতে পারে না। কোন উদ্দেশ্যই- তাহা ভাল হউক, মন্দ হউক, নিরপেক্ষ হইতে পারে না। কোন ব্যক্তিই নৈতিক চরিত্রের অনুসারী না হইয়াও ‘বিজ্ঞানী’ হইতে পারে বলিয়া মনে করা ‘মুনাফেকী’ ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এইরূপ মুনাফিকীর ভিত্তি চিন্তাবিশ্লিষ্টতার উপর স্থাপিত। অতিএব এহেন অর্থব্যবস্থায় মানুষের নৈতিক চরিত্রের বিকাশ লাভ কোনরূপ প্রতিবন্দকতার সৃষ্টি হইতে পারিবে না, বরং উহাকে সেজন্য রীতিমত সহায়ক ও ব্যবস্থাপক হইতে হইবে।‘নৈতিক চরিত্রের বিকাশ’ কথাটি এখানে কুব ব্যাপক অর্থেই ব্যবহৃত হইতেছে। এহেন অর্থব্যবস্থায় মানুষ যে কেবল তাহার দৈহিক, মানসিক ও নৈতিক শক্তিনিচয়েরই ক্রমবিকাশ সাধনের উপযোগী হইবে তাহাই নয়, উপরন্তু তাহা পরস্পরের অন্তর্নিহিত শক্তি ও যোগ্যতা-প্রতিভা স্ফূরণ সাধনেরও ইতিবাচক সাহায্যকারী হইবে। এমন কি, এই সহযোগিতা ও সহানুভূতি কেবল মাসাজিক চাপে (Social conventions) পড়িয়াই হইবে না, তাহা হইবে ব্যক্তির স্বকীয় ও স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যম-উৎসাহ (Initiative) অনুসারে। আর এইরূপ হইলেই মানুষ শ্রেষ্ঠত্ব ও নৈতিক চরিত্রের উচ্চতম মর্যাদায় ‍উন্নীত হইতে পারে। মানব সমাজের পারস্পরিক প্রেম-ভালবাসা, সহানুভূতি ও সহৃদয়তার উৎসমুখ বন্ধ হইয়া যাওয়ার পর প্রত্যেক ব্যক্তি সুখ ও সম্পদে সসমৃদ্ধ হইলেও সে সমাজকে নিতান্ত দরিদ্র সমাজই বলিতে হইবে। হযরত ঈসা (আ) এই জন্যই বলিয়াছেনMen does not live bread alone, but he needs some spiritual foods” ‘মানুষ শুধু রুটি পাইয়াই বাঁচিতে পারে না, তাহার ‘আধ্যাত্মিক (নৈতিক) খাদ্যের’ও প্রয়েঅজন রহিয়াছে। মানুষের অনশন বা অর্ধাশনই সমাজের দারিদ্রের একমাত্র প্রমাণ নয়, সমাজের লোকদের পারস্পরিক স্নে-ভালবাসা, সহানুভূতি, সৌভ্রাতৃত্ব ও সহৃদয়তার নির্মল ভাবধারার অভাব হওয়াই হইতেঝে একটি সমাজের দরিদ্র হওয়ার প্রধানতম লক্ষণ।

৬। সে অর্থব্যবস্থা দেশের প্রত্যেকটি মানুষের জীবন-যাত্রার মৌলিক প্রয়োজন- খাদ্য, পোশাক, আশ্রয়, চিকিৎসা এবং শিক্ষা-পূর্ণ করার দায়িত্ব গ্রহণ করিবে। যে অর্থনীতি ইহা করিতে পারে না বা করার জন্য আন্তরিকভাবে নিরন্তর চেষ্টা কারে না, তাহা মানুষের গ্রহণযোগ্র অর্থনীতি নয়।

৭। উক্তরূপ অর্থ-ব্যবস্থাকে বাস্তবায়িত করা ও যথাযথারূপে উহাকে চালু রাখা ব্যক্তির চিন্তা, মত-প্রকাশ, চ লাফেরা প্রভৃতির স্বাভাবিক স্বাধীনতা হরণকারী কোন রাষ্ট্রব্যবস্থা দ্বারা অদৌ সম্ভব নয়। বরং সে জন্য দেমের প্রকৃত গণ-অধিকার সম্পন্ন রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকিতে হইবে। বুর্জোয়া বা সমূহবাদী কিংবা পাশ্চাত্যের প্রতারণাময় গণতন্ত্র নয়, আল্লাহরই সার্বভৌম-ভিত্তিক খিলাফত ব্যবস্থা স্থাপিত হওয়া আবশ্যক। বিশেষ ধরনের কোন অর্থ ব্যবস্থাকে চালু রাখিবার জন্য কোন নিরংকুশ একনায়কত্ব প্রতিষ্টা অপরিহার্য হইল তাহা যে স্বাভাবিক ও শাশ্বত অর্থব্যবস্তা নয়, তাহা সুস্পশ্ট। এই জন্যই উপরিউক্তরূপ অর্থব্যবস্থার পশ্চাতে উহার দৃঢ়তা ও স্থায়িত্বের জন্য একটি সম্পূর্ণ নিখুঁত গণ-অধিকারবাদী রাষ্ট্রশক্তির অস্তিত্ব বর্তমান থাকা প্রয়োজন। এই রাষ্ট্রশক্তি সমাজের লোকদের প্রাণ, দন ও সম্মানের নিরাপত্তা, বাকস্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা, চলাফেরা ও সম্মেলন সংগঠনের স্বাধীনতা রক্ষা করিবে। উহা একদিকে সমাজের অর্থব্যবস্থার পূর্ণ পৃষ্টপোষকতা করিবে এবং অপরদিকে সেই অর্থব্যবস্থা ও রাষ্ট্রশক্তির মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতা স্থাপন করিবে।

উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহের যে অর্থনীতিতে মূলতঃই এবং কার্যকরভাবে বর্তমান থাকিবে, প্রকৃতপক্ষে তাহাই এক আদর্শ, উন্নত ও বিজ্ঞানসম্মত অর্থব্যবস্থা হইতে পারে। যে অর্থব্যবস্থা এই মানদন্ডে উত্তীর্ণ হইতে পারে না, তাহা নির্বিশেষে সমগ্র মানুষের কল্যাণ সাধন- মানুষের জীবনকে সুখী, সুন্দর-সমৃদ্ধ করিতে কোনদিনই সমর্থ হইতে পারে না।

পুঁজিবাদ ও কমিউনিজম

উপরিউল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহের আলোচনা হওয়অর সঙ্গে সঙ্গে পাঠকদের মনে এই প্রেশ্ন জাগ্রত হইতে পারে যে, এই বৈশিষ্ট্যগুলি কি স্বকপোকল্পিত, না ইহার মূলে সত্যিই কোন ভিত্তি রহিয়াছে? এবং এই বৈশিষ্ট্য সমন্বিত অর্থব্যবস্থা কি পৃথিবীর কোথাও এবং কোন সমযই বাস্তবায়িত হইয়াছে? আর ভবিষ্যতে তাহা কি হওয়া কি সম্ভব?

বস্তুত মানুষের পক্ষে কল্যাণকর অর্থনীতির উল্লেখ অপরিহার‌্য বৈশিষ্ট্যসমূহ অদৌ কল্পিত নয়, মানুষের ইতিহাসের এক অধ্যায়ে এইরূপে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অর্থব্যবস্তা বাস্তব ক্ষেত্রে স্থাপিত হইয়াছে। বর্তমান সময় এইরূপ এক অর্থব্যবস্থার জন্য সমগ্র পৃথিবী উদগ্রীব প্রতীক্ষায় ব্যাকুল। আধুনিক কাল পর্যন্ত মানুষ যে ধরনের অর্থব্যবস্থার সহিত পরিচিত, উহার অধীন তাহারা কিছুমাত্র শান্তি বা স্বস্তি লাভ করিতে পারে নাই, বরং তাহাতে মনুষ্যত্বের মর্যাদা পর্যন্ত হারাইতে বাধ্য হইয়াছে।

বর্তমান পৃথিবীতে পুঁজিবাদ ও কমিউনিজম- এই দুই প্রকারের অর্থ ব্যবস্তাই বাস্তবে প্রচলিত রহিয়াছে- অধুনা প্রায় সমগ্র পৃথিবীকে এই দুইটিই গ্রাস করিয়া লইয়াছে। অথচ মানবতা এই উভয় ব্যবস্থায় মজলুম, বঞ্চিত ও নিপীড়িত। বস্তুত এই সব ব্যবস্থায় মানুষ যে কোনক্রমেই সুখী হইতে পারে না, তাহা উভয় ব্যবস্থার আদর্শিক বিশ্লিষণ হেইতে সুস্পষ্ট রূপে প্রমাণিত হইবে।

পুঁজিবাদ

পুঁজিবাদ অর্থব্যবস্থার ছয়টি মূলনীতি এখানে উল্লেখ করা যাইতেছে। এ সম্পর্কীয় আলোচনা গোড়াতেই স্মরণরাখিতে হইবে যে, পুঁজিবাদ নিছক একটি অর্থব্যবস্থা মাত্র নয়, বরং একটি জীবন দর্শন- একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা।

পুঁজিবাদ অর্থনীতির প্রথম ভিত্তি হইতেছে ব্যক্তিগত মালিকানার সীমাহীন অধিকার। ইহাতে কেবল নিত্য নৈমত্তিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি স্বীয় মালিকানায় রাখারই সুযোগ নয়, তাহাতে সকল প্রকার উৎপাদন-উপায় এবং যন্ত্রপাতি ইচ্ছামত ব্যবহার ও প্রয়োগেরও পূর্ণ সুযোগ লাভ করা যায়। ব্যক্তি নিজ ইচ্ছামত অবলম্বিত যে কোন পন্থা ও উপায়ে অর্থোপার্জন করিতে পারে এবঙ যে-কোন পথে তাহা ব্যয় এবং ব্যবহারও করিতে পারে; যেখানে ইচ্ছা সেখানে কারখানা স্থাপন করিতে পারে এবং যতদূর ইচ্ছা মুনাফাও লুটিতে পারে। শ্রমিক নিয়োগের যেমন সুযোগ রহিয়াছে, তাহাদিগকে শোষণ করিয়া একচ্ছত্রভাবে মুনাফা লুণ্ঠনের পথেও কোন বাধা ও প্রতিবন্ধকতা নাই। ব্যক্তি বা গোটা সমাজ মিলিত হইয়াও কাহাকেও কোন প্রকার কাজ হইতে বিরত রাখিতে পারে না- সে অধিকার কাহারও নাই। [Every person is free to use his property in any manner he likes and he has not to submit to any dictation from any superior in this respect]

মানুষের মধ্যেব্যক্তিগত মালিকানা লাভের জন্মগত ইচ্ছা রহিয়াছে। উহার দাবি সম্পূর্ণ এবং উহার বাস্তব রূপায়নের জন্য ব্যক্তিকে উপার্জন করার এবং উহার ফল এক হাতে সঞ্চিত করিয়া রাখার সুযোগ করিয়া দেওয়া পুঁজিবাদের দ্বিতীয় মূলনীতি। উহার মতে এই সুযোগ না দিলে মানুষ কিছুতেই অর্থোৎপাদনের জন্য উৎসাহী ও অগ্রণী হইবে না।

উহার তৃতীয় মূলনীতি হইতেছে অবাধ প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ইহা কেবল বিভিন্ন শ্রেণী ও দলের মধ্যে নয়, এই শ্রেণীর ও একই দলের বিভিন্ন লোকদেরকে মধ্যেও ইহা বর্তমানে কার্যকর রহিয়াছে। মূলত ইহা ‘বাঁচার লড়াই’ (sturggle for existence) নামক দার্শনিক শ্লোগান হইতেই উদ্ভূত। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মতে প্রতিযোগিতার অবাধ অর্থব্যবস্থায় কেবল সামঞ্জস্যেরই সৃষ্টি করে না, প্রচুর উৎপাদন ও তড়িতোৎপাদনেও ইহাই একমাত্র নিয়ামক। ইহাই মানুষকে বিশ্বরহস্য উৎঘাটন করিয়া অভিনত আবিষ্কার উদ্ভাবনীর কাজে উদ্বুদ্ধ করে।

মালিক ও শ্রমিকের অদিকারে মৌলিক পার্থক্য করণ এই ব্যবস্থার চতুর্থ মূলনীতি। এই পার্থক্য যথাযথভাবে বর্তমান রাখিয়াও নাকি পারস্পরিক সমস্যার সমাধান করা যায়। অথচ ইহার ফলে গোটা মানব সমাজ দ্বিধা-বিভক্ত হইয়া পড়ে- একদল উৎপাদন- উপায়ের একচ্ছত্র মালিক হইয়অ পড়ে, আর অপর দল নিতান্তই মেহনতী ও শ্রমবিক্রয়কারী জনতা। প্রথম শ্রেণীর লোক নিজেদের একক দায়িত্বে পণ্যোৎপাদন করে; তাহাতে মুনাফা হইলে তাহা দ্বারা প্রত্যেক নিজ নিজ সিন্ধুকই ভর্তি করে, লোকসান হএল তাহাও একাই নীরবে বরদাশত করে। শ্রমিকদের উপর উহার বিশেষ কিছু প্রভাব প্রবর্তত হয়না। ইহারই ভিত্তিতে পুঁজিদারগণ নিজেদের অমানুষিক ও কঠোরতম কার্যকলাপকেও ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করিতে চেষ্টাকরে। পুঁজিদারদের যুক্তি এই যে, মূলধন বিনিয়োগ, পণ্যোৎপাদন ইত্যাদিতে সকল প্রকার ঝুঁকি ও দায়িত্ব যখন তাহারাই গ্রহণ করে, তখন মুনাফা হইলেও তাহা এককভাবে তাহাদেরই প্রাপ্য এবং শ্রমিকদিগকে শোষণ করাও তাহাদের অবাধ সেোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। বস্তুত শ্রমিক শোষণই পুঁজিবাদ অর্থনীতির প্রধান হাতিয়ার।

পঞ্চম মূলনীতি এই যে, রাষ্ট্র জনগণের অর্থনৈতিক লেনদেন ও আয় উৎপাদনের উপর কোনরূপ হস্তক্ষেপ করিতে পারিবে না এবং ব্যক্তিগণের কাজের অবাধ সুযোগ করিয়া দেওয়াই রাষ্ট্র-সরকারের দায়িত্ব। জনগণ যেন শান্তিপূর্ণভাবে অর্থনৈতিক চেষ্টা সাধন করিতে পারে তাহার ব্যবস্থা করা এবং জনগণের ব্যক্তিগত মালিকানা অধিকার ও চুক্তিসমূহ (Contracts) কার্যকর করার সুবিধা দেওয়াই রাষ্ট্রের কাজ।

ষষ্ঠ মূলনীতি: সুদ, জুয়া প্রতারণামূলক কাজ-কারবার পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার অন্যতম প্রধান ভিত্তি। বিনা সুদে কাহাকেও কিছুদিনের জন্যে ‘এক পয়সা’ দেওয়া পুঁজিবাদীর দৃষ্টিতে চরম নির্বুদ্ধিতা। বরং উহার ‘বিনিময়’ অবশ্যই আদায় করিতে হয় এবং উহার হার পূর্ব হইতেই নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া আবশ্যক। ব্রক্তগত প্রয়োজনে হউক, অভাব-অনটন দূর করার জন্য সাময়িক ঋণ হউক কিংবা অর্থোপার্জনের উপায়-স্বরূপ মূলধন ব্যবহাররে জন্যই হউক, কোন প্রকারেই লেনদেন বিনাসুদে সম্পন্ন করা পুঁজিবাদী সমাজে অসম্ভব।

পুঁজিবাদী অর্থনীতির উল্লিখিত মূলনীতিসমূহ একটু সূক্ষ্মভাবে যাঁচাই করিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারা যায় যে, ইহা কখনই সামগ্রিকভাবে মানবসমাজের কল্যাণ সাধন করিতে পারে না। ইহারমধ্যে দুই একটি বিষয় হয়ত এমনও রহিয়াছে যাহা কোন কোন দিক দিয়া মানুষের পক্ষে মঙ্গলজনক হইতে পারে: কিন্তু উহার অধিকাংশই হইতেছে মানবতার পক্ষে মারাত্মক। শুরুতে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্তা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথম পর্যায়ে অতিক্রান্ত হওয়ার পরই উহার অভ্যন্তরীণ ত্রুটি ও ধ্বংসকারিতা লোকদের সম্মুকে উজ্জ্বল হইয়া উঠে। তাহারা দেখিতে পায় যে, সমাজে ধনসম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাইতেছে সত্য, কিন্তু তাহা মুষ্ঠিমেয় পুঁজিপতির সর্বগ্রাসী হস্তে কুক্ষিগত হইয়া পড়িতেছে আর কোটি কোটিমানুষ নিঃস্ব ও বঞ্চিত হইয়অ পড়িতেছে। উহা ধনীকে আরো ধনী এবং গরীবকে একেবারে পথের ভিখারী করিয়া দিতেছে। সমাজকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া উহার ভিত্তিমূলকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া দিতেছে। একদিকে অসংখ্য পুঁজিদার মাথা উঁচু করিয়া দাড়ায়। অপরদিকে দরিদ্র দুঃখী ও সর্বহারা মানুষের আকাশ-ছোঁয়া পার্থক্র দেখিয়অ পাশ্চাত্র চিন্তাবিদগণও আজ আতঙ্কিত হইয়া উঠিয়াছেন। অধ্যাপক কোলিন ক্লার্ক বলিয়াছেন, বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজে সর্বাপেক্ষা কম এবং সর্বপেক্ষা বেশী আয়ের মধ্যে শতকরা বিশলক্ষ গুণ পার্থক্যের সৃষ্টি হইয়অছে। এইরূপ পার্থক্য ও অসামঞ্জস্য এক একটি সমাজে যে কতহ বড় ভাঙ্গন ও বিপর্যয় টানিয়অ আনিতে পার, তাহা দুনিয়ার বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশে ও সমাজে প্রত্যক্ষ রা যাইতে পারে।

পুঁজিবাদী সমাজের আর একটি মৌলিক ত্রুটি হল বাস্তব ক্ষেত্রে ধনিক শ্রেণীই হয় উহার শাসক ও সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। তাহারা মিলিতভাবে পূর্ণ স্বাধীনতা ও নির্ভীকতার সহিত গরীব, দুঃখী কৃষক ও শ্রমিককে শোষণ করে, তাহাদেরই মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া ও রক্ত পানি করিয়া উপার্জিত ধন-সম্পদ নিজেদের ইচ্ছেতম ব্যয় করিয়া বিলাসিতার চরম পরা কাষ্ঠা প্রদর্শন করে; মানুষের বুকের রক্ত লইয়অ উৎসবের হোলী খেলায় মাতিয়া উঠে। শক্তির নেশায় মত্ত হইয়া নিরীহ জনতার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। গোটা দেশের বিপুল অর্থসম্পদ বিন্দু-বিন্দু করিয়া অল্প সংখ্যক লোকের হাতে সঞ্চিত হইয়া পড়ে- কুক্ষিগত হইয়া যায়মুষ্টিয়ে কয়েকজন শোষকের। তখন সমাজের কোটি কোটি মানুষ দাদ্রি ও অভাব-অনটনের গভীর তলদেশে নিমজ্জিত হয়্ জাতিসঙঘের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট হইতে জানা যায়, দুনিয়ার সর্বাধিক বৈষিয়িক ও বাস্তব উৎকর্ষ লাভ হওয়া সত্ত্বেও উহার শতকরা পঞ্চাশ ভাগেরও অধিক অধিবাসী প্রয়োজনানুরূপ খাদ্য, পোশাক, আশ্রয়, চিকিৎসা ও শিক্ষা হইতে বঞ্চিত রহিয়াছে। এই তিক্ত সত্য হইতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, একটি সামস্যপূর্ণ সুখী ও সুসমৃদ্ধ সমাজগঠন করিতে, সাধারণ মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ ও অধিকার আদায় করিতে এবং মানব-সমাজে পরিপূর্ণ শান্তি ও স্বস্তি স্থাপন করিতে পুঁজিবাদ চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ ইয়অছে। পুঁজিবাদভিত্তিক সমাজে উন্নত অর্্যথব্যবস্থার এক বিন্দু আলোকচ্ছটটা কোথাও পরিলক্ষিত হয় না। বিখ্যাত অরথনীতিবিদ ‘হবসন’ ‘কেরিয়া’ এবং তাহার পর ‘লর্ড কেইন্‌জ’ পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার গভীরতম অধ্যযন ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই তত্ত্ব উঘাটিত করিয়াছেন যে, জনগণের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এইরূপ অর্থব্যবস্থার গর্ভ হইতেইজন্মলাভ করে। এইরূপ অর্থব্যবস্থার অনিবার্য এইরূপ অর্থব্যবস্থার গর্ভ হইতেই জন্মলাভ করে। এইরূপ অর্থব্যবস্থার অনিবার্য পরিণতি হইতেতেছ ধন-সম্পদের অসম বন্টন। এই অসম বন্টনই দেশের কোটি কোটি নাগরিকের ক্রয়-ক্ষমতা হরণ করিয়া লয়। ইহার ফলেই সমাজের মধ্যে সর্বধ্বংসী শ্রেণী-সংগ্রামের আগুন জ্বলিয়া উঠে। বর্তমান পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পুঁজিবাদী দেশ আমেরিকায় সাম্প্রতিককালে এইরূপ পরিস্থিতিরই উদ্ভব হইয়াছে। আমেরিকার পণ্যোৎপাদনের বিপুল পরিমাণের সহিত জনগণের ক্রয়-ক্ষমতা সামঞ্জস্য রক্ষা করিতে সমর্থ হয় না বলিয়াই তথায় বিপুল পরিমাণ পণ্য অবিক্রিত থাকিয়া যায়। ফলে এক সর্বাত্মক অর্থনৈতি বিপর্যয় সমগ্র দেশকে গ্রাস করিতে উদ্যত হয়। অদূর ভবিষ্যতে আমেরিকায় বেকার লোকদের সংখ্যা ৭২ লক্ষ পর্যন্ত পৌঁছিবে বলিয়া ‘ফরচুন’ নামক এক মার্কিন পত্রিকা আশংকা প্রকাশ করিয়াছে। আর এহাই হইল পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার অনিবার্য়য পরিণতি।

কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র

পুঁজিবাদের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ যে অর্থব্যবস্থা মানবসমাজে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে, তাহা কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র। ‍পুঁজিবাদি সমাজর মজলুম শোষিত মানুষকে বুঝ দেওয়া হইয়াছে যে, ব্যক্তিমালিাকানাই সকল প্রকার বিপর্যয়ের ‍মূল কারণ। ইহার উচ্ছেদেই সকল অশান্তি ও শোষণ নির্যাতনের চির অবসান ঘটিবে। এইজন্য কমিউনিজমের অর্থনীতিতে প্রথম পদক্ষেপেই ব্যক্তিগিতমালিকানা অধিকার অস্বীকার করা হইয়াছে এবং অর্থ উৎপাদনের সমস্ত উপায়-উপাদান ও যন্ত্রপাতি Means and Instruments of Production জাতীয় মালিকানা বলিয়া নির্দিষ্ট করা হইয়াছে।[বলা বাহুল্য, কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে পরিবাষা ছাড়া মূল উদ্দেশ্যের দিক দিযা কোনই পার্থক্য নেই।] ফলে কমিউনিস্ট সমাজে জাতীয় অর্তোৎপাদনের উপায়-উপাদানের উপর রাষ্ট্রপচিারক মুষ্টিমেয় শাসক-গোষ্টির নিরংকুল কর্তৃত্ব স্থাপিত হইয়াছে। তাহারা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিশেষপ্লান-প্রোগ্রাম ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সকধল উপায় উপাদান ব্যবহার করিয়া থাকে। তাহাদের নির্ধারিত নীতি অবনত সম্তকে মানিয়া লইতে একান্তভাবে বাধ্য হয় সে সমাজের কোটি কোটি মানুষ।

কমিউনিস্ট অর্থব্যবস্থা বাস্তাবায়িত করার জন্য গোড়াতেই রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের পথ অবলম্বনকরা অপরিহার্য এবং ইহাকে স্থায়ী ও চালু রাখা এক সর্বাত্মক ডিক্টেটরী শাসনে উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে। আর বস্তুতই এই দুইটি উপায় কমিউনিস্ট অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্যও বটে।

১৯৭১ সনে রাশিয়ার এক রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মধ্য দিয়া এই অর্থব্যবস্থা স্থাপিত হইয়াছে। কিন্তু এহা এই সময়ের মধ্যেই যে তিক্ত ফল দুনিয়া সম্মুখে পেশ করিয়াছে, তাহা সকল দিক দিয়াই ভয়াবহ। একদিকে তাহা মানুষের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা হরণ করিয়াছে, অপরদিকে সাধারণ অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ও সুখ সুবিধার গাল-ভরা দাবি পুঁজিবাদীকে দেশের মতই অপূর্ণ ও অবাস্তব হইয়া রহিয়াছে। স্বয়ং রাশিয়ার সরকারী সূত্র হইতে জানা যায়, সে দেশেজনগণের আয়ের হারে পাঁচশত ও তিন লক্ষের পার্থক্য বিদ্যমান। [soviet Income Tax Shedule soviet ও Economic Sustem গ্রন্থ দ্রঃ] অনুরূপভাবে একথাও আজ প্রমাণিত হইয়াছে যে, সোভিয়েত রাশিয়ার বর্তমানেও অসংখ্র অন্নবস্ত্রহীন মানুষ বাস করে। রাশিয়ার ভিক্ষুকদের বিপুলতা দেখিয়া তথাকার এক যুব প্রতিষ্টান সম্প্রতি তীব্র প্রতিবাদের আওযাজ তোলে এবং অবিলম্বে উহার প্রতিরোধ ব্যবস্থার দাবি করে। এ দেশের যে সকল প্রতিনিধি রাশিয়া ভ্রমণ করিয়া আসিয়াছেন, তাহাদের বিবৃতি ও রটনাবলী হইতে প্রমাণিত হয় যে, কমিউনিজমের যাবতীয ভবিষ্যদ্বাণী সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হইয়াছে এবং যে অলৌকিক ভূস্বর্গ রচনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছিল, যে রঙীন ও চিত্তাকর্ষক চিত্র দ্বারা জন মানুষের লোভাতুর করিয়া এক রক্তক্ষীয় সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা হইয়াছিল মূলত তাহা সবই আকাশ কুসুমে পরিণত হইয়াছে। বাস্তব দুনিয়ায় উহার কোন অস্তিত্বই খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। উপরন্তু কমিউনিজম ও পুঁজিবাদ- উভয়িই খোদাহীনতা ও ধর্মহীনতা (Secularism) গর্ভ হইতে উদ্ভূত বলিয়া উভয় সমাজের মানুষই মনুষ্যত্বের মহান গুণ-গরিমা হইতে বঞ্চিত হইয়াছে, উহা মানুষকে নিতান্ত পশুর স্তরে নামাইয়া দিয়াছে।মানুষ আকৃতি বিশিষ্ট এই ‘পশু’গণ তাই আজ পরস্পরের সহিত শ্রেণী-সংগ্রামে লিপ্ত হইয়াছে। বর্তমান সমযের দুইটি বৃহত সমাজতান্ত্রিক দেশ রাশিয়া ও চীনের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ঝগড়া বিবাদ, সীমান্ত সংঘর্ষ ও যুদ্ধবিগ্রহ সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজমের অন্তঃসারশূন্যতা বিশ্ববাসীর সামনে স্পষ্ট করিয়া তুলিয়াছে। বস্তুত সমাজতান্ত্রিক দেশ মানুষের বাসোপযোগী নহে। সমাজতান্ত্রিকতার নামে সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের সকল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, স্বতন্ত্র ও স্বাধীনতা চিরতরে হরণকরিয়া লওয়াহইয়াছে। ব্যক্তির কোনই মূল্য সেখানে স্বীকৃত নয়। সমাজস্বার্থকে সেখানে সবকিছুর উপর সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক রূপে দেওয়া হইয়াছে। ব্যক্তিকে সমাজ ও সমষ্টিস্বার্থের বেদীমূলে বলিদান করা হইয়াছে। বস্তুত কমিউনিস্ট সমাজব্যবস্থার মানুষ সামষ্টিক যন্ত্রের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র। তাহার নিজের প্রকৃতি বা প্রয়োজন অনুসারে কোন কাজ করার বিন্দু মাত্র অধিকার তাহার নাই।

উপরে বলিয়াছি, কমিউনিস্ট সমাজ ও উহার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, কোন সর্বগ্রাসী ও কঠোর ডিক্টেটরী শাসন-ব্যবস্থার নিরঙ্কুষ কর্তৃত্ব ব্যতীত মাত্রই স্থাপিত হইতে এবং কিছু সময়ের জন্যও তাহাচরিতে পারে না। লেনিন ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন, ‘পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থা উৎখাত করিয়াকমিউনিস্টদের ক্ষমতা দখল করাএক কঠিন ও ধ্বংসাত্মক বিপ্লব ব্যতীত মাত্রই সম্ভব নয়”। কমিউনিজমের তৃতীয পিতা’স্ট্যালিন-ও ইহারই প্রতিধ্বনি করিয়া বলিয়াছেন:

“এক কঠিন ও কঠোর সর্বাত্মক বিপ্লব ব্যতীত বুর্জোয়া সমাজে কোনরূপ মৌলিক পরিবর্তন সৃষ্টি করা কি সম্ভব?….. প্রোলেটারিযানদের ডিক্টেটরী শাসন-কর্তৃত্ব ব্যতী?….. নিশ্চয় নয়। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সীমার মধ্যে থাকিয়া শান্তিপূর্ণভাবে এইরূপ কোন বিপ্লব-সৃষ্টি সম্ভব বলিয়া যদি কেহ মনে করে, তবে হয় তাহার মস্তিস্কে বিকৃত ঘটিয়াছে, অন্যথায় মানুষের সাধারণ বুদ্ধি হইতেও সে বঞ্চিত।”

এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা হইতে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে পুঁজিবাদ ও কমিউনিজম কোনটিই মানুষকে এক সামঞ্জস্যপূর্ণ, ন্যায়পরায়ণ, উন্নত, মানুষ্যত্বের মর্যাদা স্থাপনকারী এবং সখ ও সমৃদ্ধিপূর্ণ অর্থব্যবস্থা দান করিতে মাত্রই সমর্থ হয় না। এই উভয় অর্থব্যবস্থায় কোনটিই মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করিতে পারে নাই। বরং ব্যাপারটিকে ইহারা আরো অথিকতর জটিল করিয়া তুলিয়াছে। অসংখ্য পুঞ্জীভূত আবর্জার অতল তলে মুল বিষয়টির চাপা দিয়া মানবজাতিকে এক দুঃসহ দুঃখ ব্যথা ও ব্যর্থা বঞ্চনায় জর্জরিত করিয়া তুলিয়াছে। পৃথিবী আজ এই দুই প্রকার অর্থ-ব্যবস্থার-ধনতন্ত্র ওসমাজতন্ত্র-নির্মম ও সর্বগ্রাসী নিষ্পেষণে অতিষ্ট হইয়া পড়িয়াছে। বিশ্বমানব আজ এই উভয় প্রকার সমাজ ও অর্থব্যবস্থা হইতে পরিপূর্ণভাবে মুক্তি চায়, এক তৃতীয়-অর্থ-ব্যবস্থার সন্ধানে বিশ্বমানবে আজ নিঃসীম ব্যাকুলতায় উদগ্রীব। আমাদের মতে বিশ্বমানবের সঠিক কল্যাণ করিতে পারে একমাত্র ইসলামী আদর্শ ও ইসলামী অর্থব্যবস্থা। অতঃপর দুনিয়ার মানুষেরসম্মুখে আমরা তাহাই পেশ করিব।

ইসলামী জীবনব্যবস্থার ভিত্তি

বিশ্বমানবের স্থায়ী শান্তিদাতা ও কল্যাণকামী অর্থব্যবস্থা হইতেছে ইসলামী অর্থনীতি। একমাত্র ইসলামী অর্থনীতিই দুনিয়ার মানুষের প্রকৃত মনুষ্যত্বের উন্নত মর্যাদায় অভিষিক্ত করিতে পারে, পারে মানুষের সকল প্রকার সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করিতে। ইসলামী অর্থনীতির পূর্ণাঙ্গ কাঠামো পেশ করার পূর্বে উহার দার্শনিক ভিত্তি সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক।

এ সম্পর্কে প্রথমে একটি কথা বিশেষভাবে স্মরণ রাকিতে হইবে। ইসলামের অর্থ-দর্শন উহার জীবন দর্শন হইতে বিচ্ছিন্ন, স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ কোন জিনিস নয়। মূলতঃ উহা ইসলামের ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থারই একটি অপরিহার্য অংশ মাত্র। কোন বস্তুর একটি অংশকে উহার সমষ্টির ও গোটা বস্তুরমধ্যে রাখিয়া বিচার বা যাচাইনা করিলে সেই অংশটির প্রকৃত মূল্য ও অবস্থা নির্ভুলভাবে অনুধাবন করা কিছুতেই সম্ভব নয়। ইহা এক বৈজ্ঞানিক ও অনস্বীকার্য সত্য। এই সত্য উপেক্ষা করা বা ইহা অনুধাবন করিতে অসমর্থ হওয়ার দরুনই পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদগণ মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার কোন সুষ্ঠুও কল্যাণকর সমাধান বাহির করতে সক্ষম হয় নাই। আর এই একদেশদর্শী দৃষিটর কারণেই আধুনিক সমাজের লোকদের মনে ইসলাম ও ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে ইসলামের পূর্ণাঙ্গা জীবন-ব্যবস্থার মূল ভিত্তিসমূহের উল্লেখ করা অপরিহার্য বলিয়া মনে করি। তাহা হইতে একদিকে মেযন মানব জীবনে অর্থ-ব্যবস্থার স্থান ও গুরুত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন করা সহজ হইবে, অপরদিকে ইসলামী জীবন-ব্যবস্থায় উহার অর্থনীতির গুরুত্ব এবং স্থানওসকলের সম্মুখে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিবে। ইহার পরই অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইসলামের পথ-নির্দেশ এবং উহার ব্যাপক নীতি-ব্যবস্থার যৌক্তিকতা ও উহার আন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য সকলের নিকট উজ্জ্বল হইয়া উঠিতে পারিবে।

১. ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার মৌলিক ধারণা বিশ্বাসের প্রথম ভিত্তি হইতেছে উহার বিশ্ব-দর্শন। ইসলাম সর্বপ্রথম ঘোষণা করে যে, পৃথিবী এই বিশ্বজগত- এইটি আকস্মিক দুর্ঘটনা সৃষ্ট বস্তু নয়, বরং প্রকৃতপক্ষে এক সর্বজ্ঞ ও শক্তিমান মহান সত্তা বিশেষ এক উদ্দেশ্য সম্মুখে রাখিয়া ও বিশেষ পরিকল্পনার ভিত্তিতে ইহা সৃষ্টি করিয়াছেন। তিনিই একমাত্র মালিক, একচ্ছত্র শাসক ও নিরংকুশ প্রভুত্বের অধিকারী। একমাত্র তাঁহারই আইন ও বিধান নিখিল সৃষ্টির পরতে –পরতে চালূ হইয়া আছে এবং মনুষ্য-জগতেও একমাত্র তাহারই আইন চালু হওয়া বাঞ্ছনীয়। মানুষ এই দুনিয়ায় আল্লাহর খলীফঅ-প্রতিনিধি, আল্লাহর বিধান অনুসরে কাজ করাই তাহার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। পরন্তু দুনিয়ার এই জীবনইচূড়ান্ত নয়, ইহার পর আর একটি অবিনশ্বর জীবন আসিবে, যখন মানুষকে আল্লাহর সম্মুখে ইহ-জীবনের সকল কাজের ও প্রত্যেকটি খুটিনাটি বিষয়ের পর্যন্ত হিসাব দিতে হইবে এবং সেই অনুযায়ী মানুষ পুরষ্কার কিংবা শাস্তি লাভ করিতে বাধ্যহইবেঠ।

২. কেবল পেটের দাবি পূরণ করা, নিছক জটর জ্বালা নিবৃত্ত করা এবং প্রবৃত্তির লালসা চরিতার্থ করাই মানব জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়।মানব জীবনের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য এতদাপেক্ষা বহু উন্নত, মানুষের কর্তব্য ও দায়িত্ব অনেক বেশীবিরাট। মানুষ একটি অর্থণৈতিক জীব মাত্র নয়, মানুষ ‘আশরাফল মাখলুকাত’। এই পৃথিবীতে সত্যের, ন্যায়ের এবং পুণ্যের বাণী প্রতিষ্ঠা করা, আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে এক শক্তিশালী রাষ্ট্র স্থাপন করা আর অন্যায়, পাপ ও জুলূমের বিলোপ সাধন করাই মানব জীবনের পরম উদ্দেশ্য ও কর্তব্য। কুরআন মজীদ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করিয়াছে:

(আরবী**********)

তোমরাই সর্বোত্তমজাতি, সমগ্র মানব সমাজের কল্যাণের উদ্দেশ্যেই তোমাদিগকে সৃষ্টি করা হইয়াছে। তোমরা ন্যায়, সত্য ও পুণ্যময় কাজের আদেশ কর এবং অন্যায়, পাপ ও মন্দ কাজ হইতে লোকদেরকে বিরত রাখ- আর আল্লাহর প্রতি সুদৃঢ় বিশ্বাস রাখ।

৩.ইসরাম মানব সমাজের শুধু বাহ্যিক সংশোধন-সংস্কার করিয়াই ক্ষান্ত হয় না- মানুষের জীবনকে সর্বোতোভাবে উন্নত ও ক্রমবিকাশমানরূপে গড়িয়াতুলিবার জন্য কেবল উহাকেই যথেষ্ট মনে করে না। ইসলাম মানুষের বাহ্যিক জীবনের যতখান্তি সংস্কার বা সংশোধন করিতে চাহে, ব্যক্তি মন, চিন্তা ও জীবন সংশোধন করাকেও ততখানিই অপরিহার্য বলিয়া ঘোষনা করে। কারণ, ব্যক্তির মাঝে উন্নত, সততাপূর্ণ ও পবিত্র নৈতিক চত্রি এবং মহন ভাবধারাসুপরিস্ফুট না হইলে উন্নত ও আদর্শ সমাজ গঠিত হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। কিন্তু পাশ্চাত্যদেশের সংস্কারকামী রোক সমাজের কেবল বাহ্যিক সংশোধনের উপরই গুরুত্ব আরোপ করিয়াছে। মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে সংশোধিত ও পরিশুদ্ধ করিয়া তুলিবার প্রয়োজনীয়তা তাহারা বোধ করে নাই। সমষ্টির উপর একদেশদর্শী ‍দৃষ্টি নিবদ্ধ করার কারণে লোকদের ব্যক্তিগত জীবনকে তথায় উপেক্ষা করা হইয়াছে। আর তাহারই ফলে সমগ্রমানব সমাজই চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হইতে বাধ্য হইয়াছে। পাশ্চাত্যে চিন্তানায়কদের ইহা যে এক মারাত্মক বিভ্রান্তি ও ত্রুটি এবং চিন্তা ও মননশীলতার ক্ষেত্রে চরম দৈন্যের প্রমাণ, তাহাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই।

৪. ইসলাম এক চিরন্তন ও শাশ্বত জীবনব্যবস্থা বলিয়া উহার উপর স্থাপিত রীতি-নীতি ও আদর্শ সমাজ-জীবন পুনর্গঠনের জন্য চিরকালীন মৌলিক ব্যবস্থা-তাহার কোনটিই সাময়িকবা ক্ষণিক নহে। উদ্দেশ্য, নীতি ও লক্ষ্যেই উহার নিকট সর্বপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তাহা লাভ করার উপায় উপাদন ও সাজসরঞ্জাম সম্পর্কে কোন স্থায়ী নির্দেশ কোন ক্ষেত্রেই দেওয়া হয় নাই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দ্বীন-ইসলামের দুশমনদের সহিত লড়াই সংগ্রাম করিতে গিয়া তাহাতে বন্দুক ব্যবহার রা হইবে, নাকামান, তীর ব্যবহার করিতে হইবে না তরবারী- ইসলাম সে সম্পর্কে কিছুই বলে নাই।

ইসলাম শুধু যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য, লক্ষ ও নিয়ম-নীতর উপরেই বিশেষ গুরুত্ব আরোপ কর। অনুরূপভাবে ভূমি চাষের জন্য লাঙ্গল ব্যবহার করা হইবে বনা, ট্রাক্টর; শিল্পোৎপাদনের জন্যহস্তচালিত যন্ত্র ব্যবহার করা হইবে, না আধুনিক আবিষ্কৃত বিরাট যন্ত্রোশক্তি, ইসলাম এ সম্পর্কে কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করে নাই।

[*****১ সম্প্রতি এদেশীয় একদল তথাকথিত চিন্তাশীল(?)লোক তাহাদেরই অন্ধ অনুসকরণে মাতিয়া উঠিয়াছে।]

বরং জমি লাভ, কারখানা স্থাপন- এই উভয় ক্ষেত্র ও উপায়ের ব্যবহার পদধতি এবং এই উভয় ক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমিক-মজুরদের অধিকার সংরক্ষণ ও উৎপন্ন ফসল ও পণ্যের সুবিচারপণ্য বন্টনের উপরই ইসলাম অধিকগুরুত্ব আরোপ করিয়াছে। কারণ, পৃথিবীর বাহ্যিক আবরণে- উপায়-উপাদানে, তথা যন্ত্র ও কল-কব্জার পরিবর্তন ও ক্রমবিকাশ সূচিতহওয়া অবশ্যম্ভাবী। এই ব্যাপারে কোন ‘চিরস্থায়ী সত্য’ কথা বলা সমীচীন নয়। -তাহা বলিলে ইসলাম চিরকালের ও সকল দেশের মানুষের পক্ষে গ্রহণযোগ্য জীবন ব্যবস্তা হওয়ার মর্যাদা লাভ করিতে পারিত না। পরন্তু নৈতিকনিয়ম এবং মানুষের বাস্তব কর্মজীবনের জন্যপ্রদত্ত বিধান ও ব্যবস্থা চিরন্তন, শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয়- যেমন অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। এইজন্য ইসলাম এই ক্ষেত্রের জন্য চূড়ান্ত ও স্থায়ী মূলনীতি এবং কর্মপদ্ধতি উপস্থাপিত করিয়াছে।

ইসলাম প্রদত্ত ব্যবস্থার এই মূলভিত্তির উপরই উহার বিরাট জীবন প্রাসাদ স্থাপিতহইয়াছে। ইসলামের অর্থনীতি এই বিরাট ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থারই একটি অংশ মাত্র। কাজেই উহাকে এই পূর্ণ জীবন ব্যবস্থার অভ্যন্তরে রাখিয়াই বিচার করিতে হইবে: যষনই উহার আলোচনা-সমালোচনা বা সে সম্পর্কে গবেষণার সময় আসিবে ইসলামের মূলগত ব্যবস্থা ও ভাবধারার সহিত মিলাইয়াই তাহাকরিতে হইবে। উহাকে বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করিতে গেলেমারাত্মক ভুল হওযা স্বাভাবিক। মুলত মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যাকে মানবজীবনের অন্যান্য অসংখ্য সমস্যাহিইতে স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন মনে করা এবং সেইদৃষ্টিতে উহার সমাধান লাবের চেষ্টা করা যেমন বৈজ্ঞানক ভুল অনুরূপভাবে এই পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে ইসলাম বিরোধীও। এই পন্থা যাহারা অবলম্বন করিয়াছে, বৈজ্ঞানিকদৃষ্টিতে তাহারা চরম অবৈজ্ঞানিকতার প্রমাণ দিয়াছে এবং ইসলমের নামেতাহারা ইসলাম বিরোধী অর্থনৈতিক মতাদর্শ উপস্থাপিত করিতে চেষ্টা করিয়াছে। বস্তুত ইসলাম মানুষের সমাজ ও উহার পরিবেশের অন্তর্নিহিত গতি-প্রকৃতি এবং নিয়ম কানুন বিশ্লেষণ করার একটি বিশেষ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী। সৃষ্টিকরাত যে উদ্দেশ্যে মানুষ ও সমাজ সৃষ্টি করিয়াছেন, সমাজকে-ব্যস্টি এবং সমষ্টি উভয়কেই-সেই চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে লিইয়অ যাওয়ার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত পথ-নির্দেশ। এককথায়, ইকলাম মানব-সমাজ ও বিশ্বপ্রতৃকি বিশ্লেষণকর রূপে গড়িয়া তোলারজন্য একটি সক্রিয় হাতিয়ার। জগত ওজীবনেরগতিধারা বিশ্লেষণের দৃষ্টিভঙ্গীর নাম জীবন-দর্শন; আর মানুষের কৃস্টি, ঐতিহ্য, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাবলীর নাম জীবন-সমস্যা। জীবন-সমস্যার আয়তন, গভীরতা ও জটিলতা প্রভৃতির দিক দিয়া পরিবর্তন অনিবার্য। কিন্তুজীবন-দর্শন-জীবন-সমস্যার বিশ্লেষণ করার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী- স্থায়ী ও অপারিবর্তনীয়।জীবন-দর্শন সাধারণ সূত্র। সাধারণ ‍সূত্রের সাহায্যেই সাধরণ সূত্রের উপর ভিত্তি করিয়াই- বিশেষ অবস্থার বিশ্লেষণকরিতে এবং বিশেষ সিদ্ধান্তে ও বিশেষ উপনীতহইতে হয়। অতএব সাধারণ সূত্র সর্বকালের, সর্বত্র ও সর্বব্যাপারে প্রযোজ্যএবং অপরিবর্তনীয়। ইহা এক বৈজ্ঞানিক যুক্তি-ভিত্তিক অকাট্য সত্য।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি