আমার ভাষা বাংলা ভাষা
মানুষের জন্মভুমির মতো মাতৃভাষও আল্লাহর দান। নিজের ইচ্ছায় যেমন কেউ কোন এলাকায় জন্মলাভ করতে পারে না, তেমনি মাতৃভাষাও কেউ বাছাই করে নিতে পারে না। যে মাযের কোলে আমার মহান স্্রষ্টা আমাকে তুরে দিয়েছেন সে মায়ের ভাষাই আমাকে শিখতে হয়েছে। এ ব্যাপারটা মোটেই ঐচ্ছিক নয। জন্মভুমির আবহাওয়ার মত মাতৃভাষা প্রত্যেকের মজ্জাগত। দুনিয়ার যত ভাষা খুশি শিখুন। সেসব ভাষয় যোগ্যতা আর্জন করুন কিন্তু আপনার শৈশব ও কৈশোর যদি জন্মভূমিতে কাটিয়ে থাকেন, বিশেষ করে ছাত্র জীবন যদি নিজের দেশেই যাপন কের থাকেন তাহেল সব ভাষা ছাপিয়ে মাতৃভাষাই আপনার মনমগজকে চিরদিন দখল করে থাকবে। বিদেশেও স্বপ্ন দেখবেন মাতৃভাষায়ই, চিন্তা প্রধানতঃ মাতৃভাষায়ই আসবে এবং মনে মাতৃভাষায়ই ভাব সৃষ্টি হবে।
কোন ভাষায় কথা বলতে মনে তৃপ্তি পাওয়া যায়? বাংলাদেশী হয়েও যাঁরা ইংরেজী ভাষায় কথা বলতে বেশী পছন্দ করেন তাদের কৈফিয়ত নিশ্চয়ই আছে। হয়তো মাতৃভাষায় নিজ এলাকার কথ্য রূপ ছাড়া বাংলা বলতে অক্ষম বলে ইংরেজী বলা সুবিধাজনক মনে করেন। কিন্তু আমি বিলাতেও বহু উচ্ছ শিক্ষিত লোককে দেখেছি যে, তাঁরা ইংরেজী ভাষায় যতই যোগ্য হোন নিজ দেশের লোকদের সাথে মাতৃভাষায় কথা না বললে মোটেই তৃপ্তি বোধ করেন না। বিশেষ করে নিজ নিজ জেলার বা এলাকার লোক পেরে স্থায়ীয় কথ্য ভাষায় কথা বলার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারেন না। এটাই স্বাভাবিক। এর ব্যতিক্রম যা তা অবশ্যই কৃত্রিম।
দুনিয়ার বহু দেশ দেখার আমার সুযোগ হয়েছে। বিদেশী একাধিক ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাভাষী লোকের সাথে মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলতে মোটেই পছন্দ করিনি। বাংলাদেশের বহু লোক বিলাতে সপরিবারে বাস করে এবং বাড়ীতে তারা মাতৃভাষায়ই কথা বলে। কিন্তু তাদের যেসব ছেলেমেয়ে সে দেশে পয়দা হয়েছে বা শৈশবকালেই সেখানে গিয়েছে তারা সেখানকার স্কুলে পড়া-লেখা করার ফরে ইংরেজীতে এমন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, বাড়ীতেও বাপ-মা ছাড়া আর সবার সাথেই ইংরেজীতে কথা বলে। বঞু পরিবারে দেখেছি যে, ছেলেমেয়েরা পরাস্পর শুধু ইংরেজীতে বলে। অবশ্য বাপ-মা যদি ইংরেজী বলতে না পারে বা না চায় তাহলে বাপ-মায়ের কথ্য ভাষায়ই কথা বলতে বাধ্য হয়। আমার সবচেয়ে ছোট ভাই-এর ছেলের বয়স যখন ৬ বছর তখন বিলাতে ওর সাথে পয়রা দেখা হলো। সে সেখানেই পয়দা হয়েছে। নার্সরীতে তখন পড়ছে।
ওর বাপ-মায়ের কাছে ওর বড় চাচার কথা বহু শুনেছে। তাই আমাকে সেও পিতা মাতার সাথে সাদরেই অভ্যার্থনা জানাল। ওকে কোলে টেনে নিয়ে আদর করে কথা বলতে গিয়ে সমস্যায় পড়লাম। আমি বাংলায় জিজ্ঞেস করি, আর সে ইংরেজীতে জওয়াব দেয়। কতক্ষণ পর্যন্ত চেষ্টা করেও যখন একটি বাক্যও বাংলা বলাতে পারলাম না তখন চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বললাম, “আমি কোন ইংরেজের চাচা নই। আমার সাথে বাংলায় কথা না বললে চাচা হতে রাজী নই”। ফল আরও খারাপ হলো। সে আমার কাছে আর আসতে চায় নাÑকথা বলাও বন্ধ করল। বাধ্য হয়ে আমাকেই আতœসর্মপন করতে হলো এবং ইংরেজীতে কথা বলে ওর টহপষব (চাচা নয়) এর মর্যাদা পেলাম। সে যদিও বাপ মায়ের সাথ ছোট থেকেই বাংলা বলায় অভ্যস্ত, তবুও পারিবারিক বাঁধাধরা কতক কথাই বাংলায় শিখেছে। মনের ভাব প্রকাশের জন্য যত শব্দ ও বচন সে স্কুলে ৩ বছর বয়স থেকেই শিখছে সে ভাষাই তার মাতৃভাষায় পরিণত হয়েছে।
দেশ বিদেশে ঘুরে আমার উপর মাতৃভাষার প্রভাব যেন আরও বেশী অনুভব করলাম। কোন সময় এমনও হয়েছে যে, সাপ্তাহ খানিক বাংলা বলার লোক না পেয়ে যেন হাঁপিয়ে উঠেছি। একটানা অনভ্যস্ত খাবার খেয়ে মাছ-ভাতের জন্য মন যেমন অন্থির হতো, বাংলায় কথা বলার লোক না পেলেও কেমন যেনো অস্বস্তি বোধ হতো। কোন সময় আরব দেশের আরবী খানা খেতে খেতে বাংলায়ই দেশী খাবারের কথা ভেবেছি। অতচ ইংরেজীর মাধ্যমেই আজীবন লেখাপাড়া করেছি। ১৯৪০ সালে যখন ঢাকায় সপ্তম শ্রেনীতে উঠলাম তখন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ স্কুলে বাংলা মাধ্যম চালু হলেও ঢাকা বোর্ডে ইংরেজী মাধ্যমই চালু ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত গোটা শিক্ষাই ইংরেজীর মাধ্যমে হলেও বাংলা ভাষার প্রভাব আমার উপর এত বেশী ছিল যে, বি.এ-তে বাধ্যতামূলক এক পেপার বাংলা পড়ে যেন আমার পেট ভরতো না। স্পেশাল বিষয় হিসেবে বাংলা নিয়ে আরও তিন পেপার বাংলা পড়া যেতো। আমার সে বিষয় নেবার সুযোগ না থাকলেও বাংলা বিভাগের শিক্ষকগন আমার উৎসাহ দেখে নিয়মিত তাঁদের ক্লাশে যেতে অনুমতি দিতেন এবং আমি তাঁদের কয়েকজনের ক্লাশে রীতিমত যোগদান করতাম। ক্লাশে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে অধ্যাপকগণের মনোযোগও আমার প্রতি যথেষ্ট পেয়েছি। এমনকি বি.এ. পরীক্ষার বাধ্যতামূলক এক পেপারের পরীক্ষায় ভাল নম্বর দেখে বিশ্ববিদ্যালযের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্ব রঞ্জন ভাদুরী আমাকে বাংলায় এম,এ, পড়ার জন্য অতি স্নেহ ভরে তাকিদ দিলেন। বাংলা ভাষায় ডিগ্রি নেবার আমার আগ্রহ ছিল না। বাংলাভাষায় চর্চা এবং লেখাপড়ার উৎসাহ অবশ্যই ছিল ও আছে এবং স্বভাবিকভাবেই থাকবে বলে আশা করি।
রাসূল (সা) বলেছেন যে, তিন কারনে তোমরা আরবী ভাষাকে ভালবাসবে। এর পয়লা কারন তিনি এভাবে উল্লেখ করেছেনঃ আমি আরবীভাষী। এ থেকে বুঝা যায় মাতৃভাষার প্রতি মানুষের ভালবাসা এমন স্বাভাবিক যে, রাসুলের জীবনেও তা প্রমানিত হয়। এ হাদীস জানার পর থেকে আমার মাতৃভাষাকে ভালবাসার মধ্যে একটি পবিত্র অনুভূতি যোগ হলো।
রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. ক্লাসের ছাত্র থাকাকারে যখন প্রথম এ আন্দোলনের সূচনা হয় তখন এর মধ্যে কোন রাজনৈতিক গন্ধ আমি অনুভব করিনি। তখনকার শাসকগনের পক্ষ থেকে এটাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক বলে প্রচার করলেও আমি আমি এটাকে অপপ্রচার মনে করেছি। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহনরারীদের মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কারো থাকুক বা নাই থাকুক এ আন্দেলনের আবেদন ঠিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ও মানবিক। ফজলুল হক মুসলিম হল সংসদের প্রক্তন জেনারেল সেক্রেটারী (১৯৪৬-৪৭) এবং ডাসুর তদানীন্তন জি,এস, সাথে আলোচনায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষ থেকে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে আমি যা বলতাম তা নিম্নরূপঃ
ইংরেজ থেকে আযাদী হাসিল করার পর যোগ্যতার সাথে এর সুফল ভোগ করতে হলে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতেই হবে। ইংরেজরা এদশে দখল করার পর যখন ইংরেজী ভাষায় রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করল তখন মানুষ পরাধীনতার বিস্বাদ তীব্রভাবে অনুভব করল। মাতৃভাষায় মহাজ্ঞানী ব্যক্তও তখন রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপে নিরক্ষরে পরিনত হলো। ইংরেজের ভাষা না জানায় সরকারের নিকট আর কোন যোগ্যতাই গল্য রইল না। ফরে ইংরেজী না জানা সব শিক্ষত লোক রাতারতি মূর্খের সমপর্যায়ে আবনমিত হলো।
“এ সুস্পষ্ট যুক্তির নিত্তিতেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাভা একমাত্র উর্দু ভাষা শিখে যোগ্য হবার মত চেষ্টা করলেও বাংলাভাষী পাকিন্তানীরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হতে বধ্য হবে। তাঝাা বাংলাভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না পেলে শিক্ষার উচ্চ পর্যায়ে বাংলাআভার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যাবে”
“স্বাধীন জাতীয় মর্যাদা নিয়ে জীবনের সব ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনের প্রয়োজনে তাই উর্দুর সাথে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষ হিসেবে স্বীকার করতেই হবে। পূর্ব পাকিস্তানী জনসংখ্যা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দবী আমরা করছি না। আমারা উর্দু ও বাংলা দু‘টো ভাষকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার দাবী জানাচ্ছি। এ দাবীর যৌক্তিকতা অস্বীকার করার সাধ্য কারো নেই।”
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকালে আমরা শ্লোগান দিতাম তা আজও স্পষ্ট মনে আছে। “বাংলা উর্দু ভাই ভাই-রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”। “উর্দু বাংলা বাই ভাই-উর্দুর সাথে বাংলা চাই”।
আমার বাংলাভাষার রূপঃ একই ইংরেজী ভাষা বৃটেন ও আমেরিকায় প্রচলিত থাকলেও উভয় দেশের ভাষায় এত পার্থক্য কেন সৃষ্টি হলো? উভয় দেশ একই খৃষ্ট ধর্মের অনুসারী হওয়া সত্বেও ক্রমে ভাষার পাথর্ক্য বাড়ছে। ধর্মকে ব্যক্ত জীবনে সীমাবদ্ধ রাখার যত চেষ্টাই হোক আধুনিক যুগেও ভাষা ও সংস্কৃতিতে ধর্মীয় প্রভাব অবচেতনভাবে হলেও থেকেই যায়। আমাদের দেশে হিন্দু ও মুসলিম দু‘টো প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় রয়েছ্ ে এদেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ভাষা ও সংক্সৃতি হিন্দু প্রধান। হিন্দুদের ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে মুসলিমদের ভাষা ও সংস্কৃতির পার্থক্য এতটা স্পষ্ট যে, ভাষা ও সাহিত্যে এ স্বাভাবিক প্রতিফলন হয়েছ্ েমুসলমানদের ভাষায় কুরআন হাদীসের পরিভাষা ও শব্দ এবং এর প্রভাবে ফরাসী ও উর্দু শব্দ ব্যাপক হারে চালু রয়েছে। মুসলিম সাহিত্যিক ও কবিদের ভাষা এবং হিন্দু কবি ও সাহিত্যিকদের ভাষায় স্বাধাবিকভাবেই যেটুটু পার্থক্য রয়েছে তা জোর করে দুর করার চেষ্টকে অপচেষ্টাই বলতে হবে। হিন্দু ভাইরা “নেমন্তন্ন” খাবেন তাতে মুসলমানদের আপত্তি থাকা যেমন অন্যায় মুসলমানরা “দাওয়াত” খেলে কারো নারাজ হওয়া সুস্থ মনের পরিচায়ক নয়। পাকিস্তান হবার আগেও হোষ্টেলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, যেমন ফজলুল হক মুসলিম হলে আমরা “গোশত” খেতাম। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে ঢাকা হলে (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) আমার হিন্দু সহপাঠীরা “মাংস” খেতো।
কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যের ভাষা ও কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এত পার্থক্য কেন? এ পার্থক্যকে কৃত্রিম মনে করা ভূল। নজরুল কাব্যে আরবী ফারসী ও উর্দু প্রাচুয়ের ফলে মুসরিম সমাজে তার জনপ্রিয়তা স্বাভাবিক ছিল। তাই বাংলাভাষী মুসলমানদের নিকট নজরুলই জাতীয় কবি হিসেবে সমাদৃত। রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষার মহান কবি হিসেবে আমাদের অন্তরে উচ্চ আসলে অধিষ্ঠিত হলেও মুসরিম জাতীয় কবির মর্যাদা তিনি পাননি। অথচ উভয় কবিই পশ্চিম বংগে জন্ম নিয়েছেন।
জনাব আবুল মনসুর “পূর্ব বাংলার” জনগনের ভাষাকে বাংলাদেশের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্টিত করার উদ্দেশ্যে পশ্চিম বংগের জনগনের ভাষা থেকে আলাদা করে দেখছেন। কিন্তু পশ্চিম বংগ ও বাংলাদেশের জনগনের ভাষার যে পার্থক্য রযেছে তার চেযেও বড় পার্থক্য উত্তর বংগ ও সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকা, মোমেনশাহী ও নোয়াখালীর ভাষায় সুস্পষ্ট। তাই জিলায় বা এলাকায় কথ্য ভাষার যে পার্থক্য তা সাহিত্যের ভাষা কোন একটি আঞ্চলিক ভাষা হতে পারে না।
পশ্চিম বাংলার সাহিত্য হিন্দু সংস্কৃতি প্রধান এবং বাংলাদেশের সাহিত্য মুসলিম প্রধান হওয়াই স্বাভাবিক। এর ফলে দু‘দেশের ভাষায় কিছু পার্থক্য এমন থাকাই সঙ্গত যা সংস্কৃতিগতভাবে আপন পরিচয় বহন করবে। এ স্বাতন্ত্রটুকুই একটি দেশের নিজস্ব পরিচিতি। বিশ্বের জাতিপুঞ্জের মধ্যে এ ধরনের বৈশিষ্ট্য দ্বারাই জাতির অস্তিত্ব প্রামাণিত হয়। কোন একটি দেশকে অন্য জাতি অস্ত্রের বলে জয় করার সত্বেও আপন সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ভাষার বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেঁচে থাকলে বেঁচে থাকলেও একদিন সে দেশ রাজনৈতিক আযাদীও হাসিল করতে পারে। কিন্তু যুদ বিজয়ী জাতির সংস্কৃতির নিকট সে দেশের জনগন পরাজিত হয় তাহলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ফিরে পাওয়া অসম্ভব।
”আমার দেশ বাংলাদেশ” আমার ভাষা বাংগালী ভাষা নয় – ”বাংলাদেশী ভাষা।” কারণ মুসলিম সত্তা নিয়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে এদেশের শতকরা ৯০ জনের ধর্ম, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ভাষার দিক দিয়ে আমার আদর্শগতভবে মুসলিম জাতি এবং ভৌগলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশী জাতি। এদেশের সব ধর্মের নাগরিক মিলে আমরা রাজনৈতিক পরিভাষায় বাংলাদেশী নেশান বা জাতি। কিন্তু আদর্শিক মানে আমরা মুসলিম মিল্লাতের আন্তর্ভূক্ত। আমি তাঁদের সাহিত্য কর্মের মান অনুযায়ী যথারীতি শ্রদ্ধা পোষণ করি। ইংরেজী সহিত্য থেকেও আমি সাহিত্যের সুস্বাদু খোরাক পাই। কিন্তু তাদের সাহিত্য ও ভাষা আমার জাতীয় সাহিত্য বা জাতীয় ভাষা নয়। বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের সহজবেধ্য যে ভাষা তাই আমার ভাষা।
এর নাম যদিও বাংলাভাষাই – তবু পশ্চিম বংগের ভাষা থেকে এর পরিচয় ভিন্ন। এ ভাষা “বাংলাদেশের বাংলাভাষা” যেমন আমেরিকান ইংরেজী ভাষা ইংরেজী হলেও ইংল্যান্ডের ইংরেজী ভাষা থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। [আমার দেশ বাংলাদেশ]

আমার হল ফজলুল হক মুসলিম হল
মানুষের জীবনে কোন এক সময়ে সাধারণ একটা ঘটনাও বিরাট প্রভাব বিস্তার করে এবং মনে দীর্ঘ স্থায়ী অনুভুতির সৃষ্টি করে। ১৯৮০ সালের ২৬ মে জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সালের ২৬ শে জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ”মুসলিম” হল ফজলুল হক হলে চমৎকার অনুষ্টানে যোগদান করার সুযোগ হয়। “পূর্নমিলনী উৎসব ১৯৮০” নামে এ অনুষ্টানটিতে এ হলের প্রাক্তন ছাহ্রদের সাথে বর্তমানে অবস্থানরত ১৪০০ তরুণ ছাত্রের পরষ্পর মিলিত হবার এক প্রশংসনীয় ব্যবস্থা হয়। হলের বয়স ৪০ বছর। সুতরাং এ হলের প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে কমপক্ষে ৬০বছর বয়সের বৃদ্ধের সংখ্যাও নগন্য ছিল না। চাকুরী জীবন থেকে অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রের সাথে পরিচয়ও হলো।
প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রদের যাঁরা এ মহান উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁরা সত্যিই আন্তরিক মোবারকবাদ পাওয়ার যোগ্য। তাঁরা এমন এক দুর্লভ মুহূর্তের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন যা আমার মতো অনেককেই নিঃসন্দেহে পরম মানসিক তৃপ্তি দান করেছে। এর প্রভাব আমার জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে প্রাক্তন ছাত্রদের একটি সমিতি গঠনের প্রস্তাব আমাকে অত্যন্ত উৎসাহিত করেছে। প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে যাঁরা এতে নেতৃত্বের ভুমিকা পালন করেছেন তাঁদের কয়েকজন আমার সমসাময়িক - কেউ সহপাঠি, কেউ সিনিয়র, আবার কেউ জুনিয়ার।
এ অনুষ্টানের সভাপতি হলের প্রভোষ্ট, প্রধান অতিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলার, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি, হলের সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং প্রাক্তন কয়েকজন ছাত্রের বক্তৃতা তন্ময় হয়ে শুনছিলাম। ১৯৪৪ থেকে ৪৮ সাল পর্যন্ত এ হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে হলের যাবতীয় ক্রিয়াকান্ডে আমার ভুমিকা অত্যান্ত সক্রিয় ছিল। হল-সংসদের বর্তমান পায়িত্বশীলদের কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যে আমার পুরাতন মধূর দিনগুলোকে ফিরে পেলাম বলে মহে হচ্ছিল।
ছাত্র জীবনটা সত্যি জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়। পরবর্তী জীবন যতই অনিশ্চিত হোক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকারে উজ্জলতম জীবনের স্বপ্ন আনন্দেরই সুস্পষ্ট ইংগিত দেয়। আমি ”প্রাক্তন ছাত্র” হিসেবে ঐ অনুষ্টানে বসে সত্যিই যেন ছাত্র জীবনের অনন্দ বোধ করছিলাম। প্রাক্তন হলেও ছাত্র হিসেবেই স্বীকৃতি তো পেলাম। তরুন ছাত্রদের সাথে এক সামিয়ানার নিচে বসে ৫৭ বছর বয়সেও সত্যি তারুণ্য অনভব করলাম।
হলের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করছিল। আমি যেন তাদের মধ্যে নিজের অতীতকে ফিরে পেলাম। ১৯৪৬-৪৭ সালের এ হলেরই জি, এস, এবং ৪৭-৪৮ সালে ডাকসুর জি,এস এবং পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের জি,এস হিসেবে হল মিলনায়তন ও কার্জন হলে যেসব অনুষ্ঠান পরিচলনার সুযোগ আমার হয়েছিল সেদিন যেন সে পুরাতন ছবিই নতুন করে দেখলাম। সত্যি সেদিন আমি এতটা ভাবপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম যে, গোটা অনুষ্ঠানটি আমাকে অভিভুত করে রেখেছিল।
এমন কিছু পুরনো বন্ধুর সাথে সেখানে দেখা হলো যাদের সাথে এ সুযোগ ছাড়া জীবনে আর দেখা হতো কিনা জানিনা। বেশ কিছু পরিচিত বিশিষ্ঠ লোক এমনও পেলাম যারা এ হলের ছাত্র বলে যানা ছিল না। তাদের সাথে নতুন করে পরিচয় হলো। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত বহু প্রাক্তন ছাত্রের আমন এক সমাবেশ সেদিন দেখলাম যার স্মৃতি স্থায়ীভাবেই মনে জগরুক থাকবে। প্রাক্তন ছাত্রদের সমিতি গছিত হলে এ ধরনের সমাবেশের আরও সুযোগ হবে। সমিতির প্রস্তাবটি প্রধানত দু‘টো কারনে আমার মনে প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। প্রথমত হলের উন্নয়নে এবং ছাত্রদের কল্যাণমূলক কার্যাবলীকে প্রাক্তন ছাত্রদের যথাসাধ্য অংশগ্রহনের মহাসুযোগ হবে। দ্বিতীয়তঃ ভিন্ন মত, পথ, আদর্শ ও চিন্তার লোকেরা অন্তত একটি মহৎ উদ্দেশ্যে একত্র হয়ে ভাবের বিনিময় করার সুযোগ পাবে। যাদের পরষ্পর দেখা সাক্ষতেরও কোন সুযোগ হয় না তাঁরা হলকে কেন্দ্র করে এক সাথে কাজ করারও সুযোগ পাবে, এটা সত্যিই বড় আনন্দের বিষয়। এমন কি রাজনৈতিক কারনেও যারা একে অপর থেকে অনেক দূরে তারাও হলের কল্যানে একযোগে কাজ করার মাধ্যমে নৈকট্য বোধ করবে।
অনুষ্ঠানে কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রের বক্তৃতায় এ হলের অতীত গৌরবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হলো বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার মহান আন্দোলনের গৌরব। ১৯৪৮ সাথে এ আন্দোলন ফজলুল হক মুসলিম হল থেকেই শুরু হয়। অনুষ্ঠানে এ বিষয় বক্তৃতা শুনবার সময় আমার চোখের সামনে ঐ সময়কার ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত কর্মতৎপরতার পূর্ন চিত্র ফুটে উঠলো। শ্লোগান দেবার জন্য টিনের তৈরী চুংগা একজনের হাতে তুলে দিয়ে ১০-১২ জনের এক একটি দলকে বিভিন্ন এলাকায় পাঠাবার ব্যবস্থা করে একটি দল নিয়ে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। ভাষা আন্দোলনে এ হলের অগ্রনী ভুমিকা কেউ অস্বীকার করবে না।
ফজলুল হক মুসরিম হরের একটি বড় অবদানের কথঅ কেউ উল্লেখ করেননি। সেটা হল-সংসদের নির্বাচনের সাথে সম্পর্কিত। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলীম হল। ফজলুল হক মুসলিম হল এর ১৮ বছর পর শুরু হয়। এ দু‘টো হল সংক্ষেপে এস, এম, হল ও এফ, এইচ, হল নামেই ছাত্রদের নিকট পরিচিত। হলের সংসদ নির্বাচনে এস,এম হলে এমন এক ঐতিহ্য চালু হয়ে যায় যা শিক্ষিত রুচিশীলদের নিকট গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। জিলাবাদই (ডিষ্ট্রিক্টিজম) সেখানে নির্বাচনী আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়। কুমিল্লা ও নোয়াখালী জিলার ছাত্র এত বেশী ছিল যে, এ দু‘জিজলার ছাত্র নির্বচনী ঐক্য গঠন করলে তদানীন্তন পর্ববংগের সব জিলার ছাত্র মিলেও সংখ্যা লঘুতে পরিণত হতো। যদিও প্রতিভা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষয় কৃতিত্বের ভিত্তিতেই নির্বচনের প্রার্থী মনোনীত হতো। তবু জলাবাদের দরুন ঐ মানদন্ড জিলার সংকীর্ণ সীমায় আবদ্ধ হয়ে যেত।
১৯৪০ সালে ফজলুল হক মুসলিম হলের জন্ম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৪ সালে বি.এ ক্লাসে ভর্তি হই এ হলের মাধ্যমে। নোয়াখালী জিলার জনাব নাজমুল করিম (মরহুম ডঃ নাজমুল করিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রফেসার) এ হলের অন্যতম সিনিয়র ছাত্র। ৪৪-৪৫ শিক্ষবর্ষের হল সংসদের নির্বাচনের শরুতেই জনাব নাজমূল করিমের নেতৃত্বে জিলাবাদের পরিবর্তে প্রতিভা ও কর্মসুচীর ভিত্তিতে নির্বাচন পরিচালনার আন্দোলনে কুমিল্লা জিলার পক্ষ থেকে আমি উৎসাহের সাথে শরীক হলাম। সে বছরই প্রথম সাফল্যের সাথে জিলাবাদকে উৎখাত করা হয়। জনাব নাজমুল করিম হলের স্পীকার নির্বাচিত হন এবং বরিশালের জনাব মেসবাহ উদ্দিন (অবসরপ্রাপ্ত বাংলাদেশ সরকারের সচিব) ভি,পি নির্বাচিত হন। অবশ্য নির্বাচনী যুদ্ধে এ দু‘জন প্রতিদ্বন্দ্বী দলে ছিলেন। এরপর আরও ৩টি নির্বচনে আমি অত্যন্ত সক্রিয় ছিলাম। প্রত্যেক নির্বচনের সময় বিভিন্ন আকর্ষনীয় নামে নির্বাচনী দল গঠিত হতো। এসব দল হল ভিত্তিক ছিল। নির্বচনের পর ঐসব নামের কোন ব্যবহার হতো না। জিলাবাদের পরিবর্তে এভাবেই নির্বচন চলতে থাকে। অবশ্য পরবর্তীকালে দেশভিত্তিক ছাত্র সংগঠন গঠিত হওয়ায় ঐসব সংগঠনের নামেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার রীতি চালু হয়। এখন সব হলেই দলভিত্তিক নির্বাচন যুদ্ধ চলে। জিলাবাদ খতম করে নীতি ও কর্মসূচী ভিত্তিতে হলের সংসদ নির্বাচন পরিচালনার মহান ঐতিহ্য এফ, এইচ, হলেরই বিশেষ অবদান।
এফ, এইচ, হলের সাথে মনের যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে তা এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অত্যন্ত সজীব হওয়ায় পরম তৃপ্তিবোধ করেছি এবং আমার হল জীবনকে আবার ফিরে পাওয়ার সুস্বাদ উপভোগ করেছি। এ “হল” এত আপন যে সেখানকার সব কিছুই “আমার দেশের” মতোই প্রিয়। তাই এ হলকে “আমার হল” বলতে গৌরব বোধ করি। এর গৌরব বৃদ্ধি করার জন্য কিছু করতে পারলে সৌভাগ্য মনে করব। প্রাক্তন ছাত্রদের সমিতি সুসুংগঠিত হলে এ সুযোগ আমার মতো অনেকেই নিতে পারতেন। কিন্তু সমিতির উদ্যোক্তাগন বিভিন্ন করনে নিরাশ হয়ে এ প্রচেষ্টা পরিত্যাগ করেন। [আমার দেশ-বাংলাদেশ]

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বাংলাদেশের জাতীয়তা
বাংলাদেশের জাতীয়ত
বাংলাদেশের কোন সচেতন দেশপ্রেমিকই জাতীয় আযাদী ও নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। দুনিয়ার মানচিত্রে বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যা প্রায় চারপাশ থেকেই একটি মাত্র দেশ দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে। একমাত্র দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের অপর পারে বার্মা রয়েছে। এছাড়া গোটা বাংলাদেশ ভারত দ্বারাই বেষ্টিত। এমনকি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জও ভারতের অংশ। সুন্দরবনের দক্ষিণে নতুন গজিয়ে উছা দ্বীপটি ভারত বিনা বাধায় দখল করার পর ঐ বেষ্টনী আরও মজবুত হলো।
একথা সত্য যে অগণিত উস্কানী সত্ত্বেও বাংলাদেশ বাংলাদেশ ভারতের সাথে ভাল সম্পর্ক রক্ষা করে চলার চেষ্টা করছে। প্রতিবেশীর সাথে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে রাখা কোন দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। বাংলাদেশী জনগণ একমাত্র আযাদীর উদ্দেশ্যেই ঐ সংগ্রাম করেছিল। তাই কোন অবস্থাতেই তারা আযাদী বিপন্ন হতে দিতে পারে না। ভঅরতের কুক্ষিগত হবার উদ্দেশ্যে তারা আন্দোলন করেনি।
জাতীয় নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক রয়েছে। ভৌগলিক নিরাপত্তাই প্রধানতঃ সবার নিকট প্রাথমিক গুরুত্ব পায়। কারণ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে কোন রাষ্ট্র যদি ভৌগলিক দিক থেকৈই অন্য রাষ্ট্রের দখলে চলে যায় তাহেল সার্ব গ্রাসী দাসত্বের পথই সুগম হয়। কিন্তু ইতিহস থেকে সারা দুনিয়ায় প্রমাণিত হয়েছে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক দাসত্বের পনিণামেই ভৌগলিক দাসত্ব আসে। কোন জাতি আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক আযাদরি হিফযতে সক্ষম হরে ভৌগলিক ও রাজনৈতিক দাসত্ব সহজে আসতে পারে না। আবার অর্থনৈতিক আযাদী ছাড়া রাজনৈতিক আযাদী ভোগ করাও সম্ভব নয়। কোন সময় রাজনৈতিক ভুলের কারণে বা শক্তিমান কোন বিদেশী বাহিনীর আক্রমণে একটি দেশ তার ভৌগরিক ও রানৈতিক আযাদী হারালেও আদর্শিক চেতনা এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীন সত্তার হেফাযতের ফলে ঐ আযাদী ফিরে পাওয়া খুবই সম্ভব। কিন্তু যুদ কোন স্বাধীন দেশ অন্য কোন দেশের আদর্শ ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবান্বিত হয় তাহলে এর পরিণামে ভৌগলিক ও রাজনৈতিক আযাদী থেকে চিরতরে বঞ্চিত হতে সে বাধ্য। তাই মজবুত সশস্ত্র বাহিনীই দেশের একমাত্র রক্ষাকবচ নয়। [আমার দেশ বাংলাদেশ]

বাংগালী মুসলমান বনাম বাংগালী জাতি
বাংলাভাষী মানুষ অবাঙ্গালীদের নিকট বাঙ্গালী নামেই পরিচিত। পশ্চিম বঙ্গের কোন লোক স্থায়ীভাবে দিল্লীতে অবস্থান করলেও তার ভাষাগত পরিচয়ের কারণেই তাকে বাঙ্গালী বলা হয়। যদিও সে ব্যক্তি দিল্লীর উর্দু বা হিন্দীভাষীর মতোই জাতিতে ভারতীয়। লন্ডনে বাংলাদেশী ও পশ্চমবঙ্গের লোকেরা বাংলাভাষীর মতোই জাতিতে ভারতীয়। লন্ডনে বাংলাদেশী ও পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা বাংলাভাষী হিসেবে ভরতীয় ও পাকিস্তানীদের নিকট বাঙ্গালী বরেই লোকেরা বংলাভাষী হিসেবে ভারতীয় ও পাকিস্তানীদের নিকট বাঙ্গালী বলেই পরিচিত। বুঝা গেল যে, সব বাংলাভাষীই এক জাতিতে পরিণত হয়নি।
পাঞ্জাবী ভাষাভাষী ভরতীয় শিখ ও পাকিন্তানী পাঞ্জাবী মুসলমানের ভাষা এক হওয়া সত্ত্বেও শিখ ও মুসলমান এক জাতীয়তায় বিশ্বাসী নয়। কারন শুধু ভাষার কারণে কোন জাতি গড়ে উঠে না। জাতিত্বের আসল ভিত্তি যাদের যাদের মধ্যে উপন্থিত রয়েছে তাদের ভাষও যদি এক হয় তাহলে জাতীয়তাবোধ অধিকতর মুজবুত হতে পারে। কিন্তু ধর্ম, কৃষ্টি ও ইতিহাসের ঐক্যই প্রকৃত জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি করে। এসব দিক দিয়ে যদি কোন এক জনগোষ্ঠী অপর জনগোষ্ঠী থেকে ভিন্ন হয় তাহলে শুধু ভাষার ঐক্য তাদেরকে কখনো এক জাতিতে পরিণত করতে পারে না। এ কারণেই পাঞ্জাবী মুসলমান ও বাঙ্গালী হিন্দু এক জাতিতে পরিনত হতে পারেনি। তাদের মধ্যে ধর্মীয় পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট। এ পার্থক্যের কারনেই তাদের কৃষ্টি ও জীবন ধারণ এত অমিল দেখা যায়। ইতিহাসও তাদের এক নয়। বখতিয়ার খলজির বিজয় ও রাজা লক্ষণ সেনের পরাজয় বাঙ্গলী হিন্দু ও বাঙ্গালী মুসলমানের মধ্যে একই ধরনের আবেগ সৃষ্টি করে না। শাহ জালালের সাতে রাজা গৌর গোভিন্দের সংঘষং উভয়ের মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরিত ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। একই ভৌগলিক অঞ্চলে বাসবাস করা সত্বেও বাঙ্গালী মুসলমান ও বা্গংালী হিন্দু কেন এক জাতি নয় এবং বাঙ্গালী হওয়ার ভিত্তিতে তাদের মধ্যে কেন জাতীয় ঐক্যবোধ সৃষ্টি হয়নি সে কথঅ ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি দ্বারা বিচার বিবেচনা করা প্রয়োজন।
মুসলমানের পরিচয়ঃ দুনিয়ার প্রতিটি সৃষ্টির যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য যে মহান স্রষ্টা প্রত্যেক সৃষ্টির উপযোগী বিধানের ব্যবস্থা করেছেন, তিনি অবশ্যই তার শ্রেষ্ঠ মানুষের জন্যও জীবন বিধান দিয়েছেন। সৃষ্টির জন্য স্রষ্টর রচিত বিধি-বিধানের নামই ইসলাম এবং ইসলামী জীবন বিধান পালনকারীকেই মুসলিম বলে। মুসলিম শব্দটি আররী। ফরাসী ভাষায় বলা হয় মুসলমান। মুসলমান ঐ ব্যক্তির নাম যে সচেতনভাবে আল্লাহ পাককে জীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র মনিব হিসেবে এবং রাসূল (সাঃ) কে একমাত্র আদর্শ নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে। যে কালেমা তাইয়েবা কবুল করে মুসলমান হতে হয় এ কালেমার মাধ্যমে আসল আল্লাহর প্রভুত্ব ও রাসূলের নেতৃত্ব নিরষ্কুশভাবে মেনে নেয়া হয। এটাই কালেমার মর্মকথা।
একজন অমুসরিম যেমন ঐ কালেমার মাধ্যমে ইসলামী জীবন পদ্ধতি কবূল করে মসলমান হয় তেমনি কোন মুসলমান যদি ঐ কালেমা পরিত্যাগ করে তাহরে সে আর মুসলমান বলে গণ্য হতে পারে না। কাফেরের সন্তান ইসলাম গ্রহন করলে যদি মুসলমান হয় তাহলে মুসলমানের সন্তান ইসলাম ত্যাগ করলে কেন কাফের হবে না? সুতারাং মুসলমানিত্ব গ্রহন ও বর্জনযোগ্য একটা গুন। কলেজের প্রিন্সিপালের ছেলে বলেই কোন অশিক্ষত ব্যক্তি যেমন গদিনশীল প্রিন্সিপাল হতে পারেনা। তেমন ইসলামী আদর্শ ত্যাগ করে মুসলিম পিতামাতার সন্তানও গদিনশীল মুসলমান বলে গণ্য হতে পারে না।
মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিঃ যারা ইসলামী জীবন বিধানকে কবূর করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস, সব বিষয়ে তাদের চিন্তাধারাম তাদের জীবন ও কর্মধারা এক বিশেষ ধরনের ছাঁচে গড়ে উঠে। যারা ইসলামকে জীবন বিধান হিসেবে গ্রহন করে না বা ইসলামী জীবনধারা পালন করতে রাজী নয় তাদের বাস্তব জীবন স্বাভাবিক কারণেই সম্পূর্ণ ভিন্ন ছাঁচে গড়ে উঠে।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাতৃভাষা ছিল আরবী। যারা তাঁর প্রতি ঈমান আনল না তারা একই ভাষাভাষী, এমন কি একই বংশের লোক হওয়া সত্ত্বেও রাসূল (সাঃ) থেকে সম্পূর্ন ভিন্ন ধরনের জীবন যাপনেই অভ্যস্ত হয়ে রইল। আর যারা ইসলাম গ্রহন করলো তারা তাদের বংশ ও আতœীয়-স্বজনের জীবনধারা থেকে আলাদা হয়ে গেলো। একই এলাকায় একই ভাষাভাষী এসন কি একই গোত্রের লোকদের মধ্যে আদর্শ, নীতি ও জীবন বিধানের পার্থর্ক্যের দরুন আরবী ভাষী মুসলমান ও আরবী ভাষী অমসুলমান পৃথক পৃথক জাতিতে পরিণত হলো। আবার অন্য ভাষার লোকও জাতি হয়ে গেল। সুতারাং মুসলমানদের জাতীয়তার ভিত্তি হলো একমাত্র ইসলাম। ভাষা, বংশ বর্ণ ও দেশ মুসলমানদের জাতীয়তার ভিত্তি নয়।
১৯৬৮ সাথে একটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান ২১ শে ফেব্র“য়ারী উপলক্ষে তাদের নিমন্ত্রণ পত্রে উল্লেখ করেছিল যে, “প্রয়োজন হলে আমরা মুসলমানিত্ব ত্যাগ করতে পারি কিন্তু বাঙ্গালীত্ব পরিত্যাগ করা সম্ভব নয।” এ কথাটা যে মনোভাব নিয়ে বলা হয়েছে তাতে বুঝা যায় যে বেচারাদের ইসলাম সম্বদ্ধে সঠিক ধরণা নেই। কিèতু যে উদ্দেশ্যেই কথাটা বলা হোক কথাটা বাস্তবে সত্য। অর্থাৎ যারা জন্মগতভাবে বাঙ্গালী তারা বাঙ্গালীতু পরিত্যাগ করতে বাস্তবেই অক্ষম। বাঙ্গালী মায়ের সন্তান যদি এদেশ ছেড়ে বিলাতে চলে যায় এবং বাংলাভাষায় কথাই না বলে তবুও তার বাংগালিত্ব মুছে যাবে না এবং মাতৃভাষা বদলে যাবে না। সবসময় ইংরেজী বলার অভ্যাস করলেও ইংরেজী তার মাতৃভাষা বলে গন্য হবে না। অবশ্য মুসলমানিত্ব এমন এক গুণ বা পরিচয় যা ইচ্ছে হলে গ্রহন করা যায় এবং ইচ্ছে হলে ত্যাগ করা যায়। তাই তাদের ঐ বক্তব্য ঠিকই। কিন্তু এ দ্বারা যে অর্থ তারা বুঝতে চায় তা সম্পূর্ন ভিন্ন ধরনের। তারা বলতে চায় যে, বঙ্গালীত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে দরকার হলে মুসলমানিত্ব ত্যাগ করবো। এ জাতীয় মন-মগজ যেসব মুসলিম যুবকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তাদেরকে আমি মোটেই দোষী সাব্যস্ত করি না। তারা অজ্ঞতার শিকার। তাদের চিন্তাধারা মুসলিম হিসেবে গড়ে তুলবার উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা নেই বেল তারা অজ্ঞ রয়ে গেছে।
মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে ১৯৪৭ সাথে ভারতকে বিভক্ত করে যারা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তারা যদি ইসলামের প্রতি দায়-দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে মুসলিম যুবকদের মধ্যে এ জাতীয় বিভ্রান্তি সৃষ্টিই হতো না।
মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতকে বিভব্ত করে যারা পাকিন্তান নামক রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিনে তারা যদি ইসলামের প্রতি দায়-দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে মুসলিম যুবকদের মধ্যে এ জাতীয় বিভ্রান্তি সৃষ্টিই হতো না।
মুসলমানরা যদি ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তায় বিশ্বাস করতো তাহলে হিন্দুরা ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশকে বিভক্ত করতো না। মুসলমানরা যদি দেশ ভিত্তিক জাতীয়তায় বিশ্বাসী হতো তাহলে গান্ধি ও নেহেরুর অখন্ড ভারতীয় জাতীয়তাক্ েসিমর্থন করতো। তাহলে পাকিস্তানের জন্মই হতো না এবং বাংলাদেশ নামে কোন স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টিই হতে পারতো না।
যারা বাঙ্গালী জাতীয়তার কথা বলে তারা একথাটা কি চিন্তা করে দেখেছেন? মুসলমানরা যদি আলাদা জাতি হিসেবে সংগঠিত না হতো তাহলে “বংগদেশ” বিভক্ত হতো না। বর্তমানে বাংলাদেশ তখন অখন্ড ভারত রাষ্ট্রের অধীনে পশ্চিম বংগের সাথে মিলে একটি অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশে পরিণত হতো। এ অবস্থা হলে বাংগালী জাতীয়তার প্রবক্তাদের কী দশা হতো? স্বাধীন বাংগালী জাতির দাবী করার কি কোন পথ তখন তালাশ করা সম্ভব হতো?
বাংলাদেশ যে মুসলিম জাতীয়তারই সৃষ্টি একথা ঐতিহাসিক সত্য। মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত না হলে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে কোন রাষ্ট্র কোন প্রকারেই অস্তিত্ব লাভ করতে পারতো না। তাই মুসরিম জাতীয়তাবোধ খতম হয়ে গেলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। আর মুসলিম জাতীয়তাকে স্বীকার করে নেবার পর আবার বাংগালী জাতীয়তা কী করে বহাল থাকতে পারে? সুতরাং বাংগালী মুসলমান জাতি হিসেবে মুসলিম জাতি, যদিও বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে তারা বাংগালী কিন্তু মুসলমানরা বাংগালী জাতি নয়। [আমার দেশ বাংলাদেশ]

বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক
বাংলাদেশে বর্তমানে (১৯৮৮) প্রায় ১১ কোটি মানুষ আছে। এর মধ্যে প্রায় ১০ কোটি মুসলমান এবং অন্ততঃ এক কোটি অমুসলমান। সংখ্যায় মুসলমানদের তুলনায় কম বরেই তাদেরকে সংখ্যালঘু বলা হয়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী হলো হিন্দু। তাদের সংখ্যা ৭৫-৮০ লাখ হতে পারে। বাকী ২০ লাখের মদ্যে খৃস্টান, বৌদ্ধও বিভিন্ন উপজাতি রয়েছে।
এখানকার মুসলমানদের সাথে খৃষ্টান, বৌদ্ধ ও উপজাতীয় সম্প্রদায় সমূহের সম্পর্ক কোন সময়ই খারাপ ছিল না। অনুন্নত হিন্দুদের সাথেও সম্পর্ক ভালই ছিল। ১৯৪০ খেবে ১৯৪৯ সাল পযর্ন্ত সে সম্পর্কে যে ভাটা পড়েছিল তা রাজনৈতিক পরিস্থিতিরই পরিণাম। গান্ধি ও নেহেরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস অখন্ড ভারতের পতাকাবাহী হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই পাকিন্তান আন্দোলন ও ভারত বিভাগের দাবীর ঘোর বিরোধী ছিল। সে সময় ভারত বিভাগের ইস্যুতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যে রাজনৈতিক লড়াই চলছিল তার কারণে হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক অবশ্যই ফাটল ধরেছিল। ঐ অবস্থায়ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের তুলনায় উচ্চ বর্নের হিন্দুদের সাথেই সম্পর্ক বেশী খারাপ ছিল। কারণ কংগ্রেসের নেতৃত্বে সর্বস্তরেই উচ্চ বর্ণের হিন্দুরাই অধিষ্ঠিত ছিল।
১৯৪৬ সালে কোলকাতা ও বিহারে ব্যাপক মুসলিম হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ১৯৪৯ সাল পযর্ন্ত বিচ্ছিন্নভাবে মাঝে মাঝে চলতে থাকে। কিন্তু ভারতে অদ্যাবধি মুসলিম হত্যা অবিরাম চলতে থাকা সস্তে¡ও ১৯৫০ সাল থেকে এদেশের মুসলমানরা হিন্দুদের উপর কোন আক্রমণ করেনি।
বর্তমানে এদেশের বসবাসরত ৮০ লাখ হিন্দু নিশ্চয়ই অনভব করেন যে, তাদের সাথে মুসলমানদের এমন কোন বিরোধ নেই যার কারণে তারা এদেশ ছেড়ে চলে যাবার চিন্তা করতে পারেন। যাদের যাবার দরকার তারা আগেই চলে গেছেন। এখনও যারা আছেন তারা পুরুষানুক্রমে এ দেশেরই অধিবাসী। মুসলমান জনগণ কোথও তাদের অপর মনে করছে না। উভয় সম্প্রদায়ের জনগণের মধ্যে মেলামেশা স্বাভাবিক অবস্থায়ই চলছে। কোন কালে রাজনৈতিক কারণে যে বিরোধ ছিল তা বহু আগেই বিলীন হয়ে গেছে।
এদেশের খৃস্টান, বৌদ্ধ ও উপজাতীয়দের সাথে কোন কালেই মুসলমানদের সম্পর্ক খারাপ ছিল না। সংখ্যায় তারা অনেক কম বরে তাদের সাথে মুসলমানদের রাজনৈতিক বিরোধ সৃষ্টির কোন কারণও ঘটেনি। সংখ্যালঘুদের মধ্যে হিন্দুরাই প্রধানতঃ উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ভুমিকা পালন করায় তাদের সাথে যেটুকু বিরোধ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক ছিল তা হিন্দু সম্প্রদায় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। এ বিরোধটুকুও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে সৃষ্টিই হয়নি।
একথা জোর দিয়েই বলা চলে যে, বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে এমন কোন বিরোধ নেই যার ফলে কোন রকম সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ সৃষ্টি হতে পারে। এমন কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবার কোন আশংকাও দেখা যায় না। যার ফলে তারা এদেশ থেকে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার চিন্তা করতে পারে। বাংলাদেশের পাশেই আসামে গত কয়েক বছর থেকে ব্যাপক মুসলিম গণহত্যা চলা সত্বেও এবং ভারতের বহু প্রদেশে ১৯৪৭ সাল থেকে মুসলমানদের জান-মালও ইজ্জতের উপর এত ঘন ঘন হামলা হওয়া সত্ত্বেও এদেশের মুসলামানরা এখানকার হিন্দুদের উপর এর প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা না করায় একথা প্রমানিত হয়েছে যে, এদেশের মুসলমান জাতি অন্তত এ ব্যাপারে ইসলামের নীতিমালা মেনে চলতে সক্ষম হয়েছে।
সুতারাং বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সমস্যা বলে কোন সমস্যার বলে কোন অস্তিত্ব নাই। এখানে হিন্দু-মুসলিম-খৃষ্টান বৌদ্ধ ও উপজাতীয়দের সবাই পরাস্পরের দেশীয় ভাই। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের একদল সন্ত্রাসবাদী লোক বিদেশী অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা পেয়ে ওখানকার অধিবাসীদের মধ্যে শান্তির নামে যে অশান্তি জিইয়ে রেখেছে তা নিতান্তই ঐ এলাকার একাংশেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার কায়েক হলে অচিরেই এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করা যায়। [আমার দেশ বাংলাদেশ]

 

এপার বাংলা ওপার বাংলা
এক সময়ে এক শ্রেনীর সার্থান্বেষী মহল ”এপার বাংলা ওপার বাংলা” শ্লোগানটিকে জনপ্রিয় করে তুলবার আপ্রাণ চেষ্টা রেছেন।
তখন বাংলাদেশের পাসপোর্টেও নাগরিকত্বের পরিচয় ছিল বাংগালী। ১৯৭৫ এর পর এ ব্যাপারে নতুন করে চেতনা জাগ্রত হয়। এবং এর ফলে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশী নাগরিকত্বই এদেশীয়দের পাসপোর্ট স্থান লাভ করে।
একথা ঠিক যে, পশ্চিম বংগের জনগনের ভাষাও বাংলা। কিনউত একমাত্র ভাষাই যদি জাতীয়তার ভিত্তি হতো তাহলে অবিভক্ত বাংলা বিভক্ত হতো না। আমেরিকা, কানাডা, ও অষ্ট্রেলিয়ার ভাষা ইংরেজী হওয়া সত্ত্বেও ইংল্যান্ডের সাথে মিলে এক জাতি হয়ে যায়নি। তাদের মধ্যে ধর্মের মিল থাকা সত্ত্বেও ভাষার ভিত্তিতে একজাতি বলে তারা পরিচয় দেয় না।
পশ্চিম বঙ্গের জনগোষ্ঠীর সাথে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্ম-সংস্কৃতি, পোশাক, ইতিহাস-ঐতিহ্য, এমন কি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্তের এত পার্থক্য রয়েছে যে, শুধু ভাষার ঐক্য ঐ পার্থক্য সামান্য কমাতে সক্ষম নয়। সুতারাং ওপার বাংলার সাতে এপার বাংলার জাতিগত মিল তালাশ করে পাওয়ার উপায় নেই।
পশ্চিম বংগের নাম পরিবর্তন করে ”বাংলা” নাম দেবার চেষ্টা নাকি চলছে। এটা তাদের ইচ্ছা। এতে আপত্তি করার কোন অধিকার বা প্রয়োজন আমাদের নেই। যদি এ নামা রাখার চেষ্টা সফল হয় তাহরে ওপার বাংলা আর এপার বাংলাদেশ থাকবে। উভয় পারে “বাংলা” আর কখনও হবে না।
পূর্ব বংগ নামে যখন কোন এলাকা নেই, তখন পশ্চিম বংগ নামটা অর্থহীনই বটে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় পূর্ব বংগ ও পশ্চিম বংগ নামে সেকালের ‘বংগদেশ’কে বিভক্ত করা হয়। ১৯৫৬ সালে অবিভক্ত পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে পর্ব বংগের নামা পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পরই পশ্চিম বংগ নামটি অবন্তর হয়ে যায়। তবুও এ নাম তারা এখনও বদলাননি। এ বিষয়ে অবশ্য আমাদের কিছু বলার নেই।
পশ্চিম বংগের সাথে অবশ্যই আমাদের প্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক রয়েছে। এপার ও ওপারের বহু মানুষের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় উভয় এলাকায় ছড়িযে থাকা বিপুল সংখ্যক লোক রোজই আসা যাওয়া করে। এ যাতায়াত যতটা সহজ করা হয় মানবিক দিক দিয়ে ততই মঙ্গল। উভয় অঞ্চলের মধ্যে সহিত্যের মাধ্যমে সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক। সার্তক সাহিত্য রাষ্ট্রীয় সীমায় আবদ্ধ থাকে না। যদি ইংরেজী ও উর্দু সাহিত্য এদেশের সাহিত্যামোদীদের পিপাসা মিটাতে পারে তাহলে এ উভয় এলাকার সফল বাংলা সাহিত্য-কর্ম উভয় দেশের পাঠক পাঠিকাদের নিকট আকর্ষনীয় ও গ্রহনযোগ্য না হওয়ার কোন কারণ নেই। কোলকাতার যেসব অপ-সাহিত্য এখানে ছড়াচ্ছে এর জন্য এখানকার কুরুচি বিশিষ্ট পাঠকরাই দায়ী। এর জন্য সাহিত্য দায়ী হতে পারে না। দুগর্ন্ধময় বস্তু একশ্রেনীর জীবনকে অবশ্যই আকৃষ্ট করে থাকে। সে সব সাহিত্য পদবাচ্য নয়। সত্যিকার সাহিত্য রসে সমৃদ্ধ বই পুস্তকের আদান - প্রদান উভয়কেই সমৃদ্ধ ও উপকৃত করতে পারে।
উভয় অঞ্চলের মধ্যে ব্যবস্যা-বাণিজ্যের সম্পর্কও ঘনিষ্ঠ হতে পারে। উভয় দেশের সীমান্তে দুর্নীতিপরায়ণ সরকারী কর্মচারীদের সহায়তায় যে বেআইনি ব্যবসা চলছে তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্বক। উভয় দেশের পণ্য নিজ নিজ দেশের চাহিদা মোতাবেক আনদানী ও রফতানীর জন্য সরকারী ব্যবস্থা হওয়া প্রয়োজন। পণ্য পাচারের জঘন্য ব্যবসার পরিবর্তে বৈধ ব্যবসা উভয়ের অর্থনীতিকে সাহয্য করবে।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সত্তা। প্রতিবেশী হিসেবে পশ্চিম বংগের সাতে সব রকম বৈধ সম্পর্কই থাকা উচত। কিন্তু এপার বাংলা ওপার বাংলা শ্লোগান যে কুমতলবে দেয়া হয়েছিল তা এখন একেবারেই অর্থহীন। [আমার দেশ বাংলাদেশ]

 

বাংলাদেশের পটভূমিও মুসলিম জাতীয়তাবোধ
পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের কুশাসন, ইসলামের নামে অনৈসলামী কার্যকলাপ, গণবিরোধী নীতি ও আজনৈতিক সমস্যার সাময়িক সমাধানের অপচেষ্টার ফলে এদেশের জনগণের মধ্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়অ সৃষ্টি হয়, সে সুযোগে এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও ইসলাম বিরোধী মতাদর্মের বাহকগন বাংলাদেশ আন্দোলনকে এমন খাতে পরিচালনার ব্যবস্থা করে যার ফলে এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশে দ¦ীন-ইসলামকে অন্যান্য ধর্মের মতই নিছক পুজাপাঠ তাজীয় এবং ব্যক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ ধর্মে পরিণত করার অপচেষ্টা চলে। “ইসলাম” ও “মুসলিম” শব্দ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উৎখাত করা হয়। পত্র – পত্রিকার দাউদ হায়দার জাতীয় ধর্মদ্রোহীদের লেখা ও কবিতায় মুসলমানদের প্রাণাধিক প্রিয় নবী (সঃ) সম্পর্কে চরম আপত্তিকর কথা পর্যন্ত প্রকাশ পায়।
বাংলাদেশের মুসলমানদের ঈমান তখন এক বিরাট পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। তারা এ কঠিক পরীক্ষয় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এভাবেই মুসলিম চেতনাবোধ অনৈসলামী শক্তির বিরুদ্ধে দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৭৫ এর আগষ্ট বিপ্লব এবং ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার স্বতঃস্ফর্ত ইসলামী জগরণ বাংলাদেশের আদর্শিক পটভুমিকে সম্পূর্নরূপে বদলে দেয়। এরই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ক্রমে ক্রমে চরম ধর্মবিরোধী শাসনতন্ত্রের ধর্মমুখী সংশোধন চলতে থাকে। বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভুমি যে ভাবেই রচনা করার চেষ্টা হোক না কেন, বর্তমানে ইসলামের নৈতিক শক্তি এতটা মজবুত যে, মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের মুসলিম জনতা এখন আর অবহেলা পাত্র নয়। ইসলামের ভবিষ্যত অন্য কোন মুসলিম দেশ থেকে এখানে যে কম উজ্জল নয একথা ক্রমে ক্রমে সুস্পষ্ট হচ্ছে। সরকারী পর্যাযে ইসলাম যে অবস্থাতেই থাকুক, এদেশের কোটি কোটি মুসলিমের সামগিক চেতনায় ইসলামের প্রভাব ক্রমেই যে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা স্বীকার না করে উপায় নেই
১৯৭০ সালের জনগণ যাদের কে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিলেন, তাদেরকে গন-অধিকার আদায়ের দায়িত্বও ক্ষমতা দেয়াই উদ্দেশ্য ছিল। ইসলামী আদর্শ ও মুসলিম জাতীয়তার উপর হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার তাদেরকে দেয়া হয়নি। সুতরাং যখন জনগণ দেখল যে, তাদের অধিকার আগের চেয়েও খর্ব করা হয়েছে এবং জনসাধারণকে সরকারের গোলমে পরিণত করা হচ্ছে, এমন কি মুসরিম জাতীয়তাবোধকে পর্যন্ত ধ্বংস করা হচ্ছে তখন সবাই চরম নৈরাশ্য ও ভীষণ অস্থিরতা বোধ করলো। এরই ফলে ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট দেশের প্রেসিডেন্ট হত্যার মতো ঘটনার দিনটিকে জনগণ এত উৎসাহের সাথে মুক্তির দিন হিসেবে গ্রহণ করেছিল। [বাংলাদেশ ও জামায়াতে ইসলামী]

 

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা
স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন। কিন্তু কিছু সংখ্যক মানুষ নিজেদের স্বার্থে বা ভ্রান্ত মতাদর্মের প্রভাবে সে স্বাধীনতা থেকে জনগনকে বঞ্চিত করে। মজার ব্যাপর হলো এই যে, স্বাধীনতার নামেই মানব জাতিকে পরাধীন করার চেষ্টা চলে। চিরকাল মানুষ এ স্বাধীন্তার জন্র বহু কুরবানী দিয়েছে, যেহেতু স্বাধীনতাই শ্রেষ্ঠতম অধিকার, সেহেতু এ অধিকার হাসিল করার জন্র মানুষ আর সব অধিকার কুরবানী দিয়েও সংগ্রাম করা প্রযোজন মনে করে।
স্বাধীনতার সাধারণ সংজ্ঞাঃ বিদেশী লোকের শাসনমুক্ত হওয়াকেই সাধারণত স¦াধীনতা বলা হয়। ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র বিংশ শতাব্দীর প্রথম কয়েকদশক পর্যন্তও পৃথিবীর অনেক দেশকে সামরিক শক্তিবলে দখল করে রেখেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে অধীনস্ত দেশ গুলো দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে এবং ত্যাগ তিরিক্ষর পরিণামে গোলামরি অক্টোপাস থেকে মুক্তি লাভা করে। এভাবে তারা সাধারণ অর্থে স্বাধীনাত পায়।
স্বাধীনতার গনতান্ত্রিক সংজ্ঞাঃ প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য শুধুমাত্র বিদেশীদের শাসনমুক্ত হওয়াই যথেষ্ট নয। দেশী স্বৈরাচারী শাসন কিংবা একনায়কত্ব থেকে মুক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করার জন্য মানুষকে আবার নতুন করে সংগ্রাম চলাতে হয়। স্বাধীনতা তখন অর্থহীন হয়ে পড়ে যখন জনগণ এ স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে অক্ষম হয়। আর জনগণের সত্যিকার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে যাবতীয় অধিকার ভোগ করার সুযোগ পেলেই মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পেতে পারে।
একথা ঐতিহাসিক সত্য যে, বিদেশী শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তির সংগ্রামের চাইতে দেশী স্বৈরাচারী শাসকের কবল থেকে মুক্তি লাভ করা কম কঠিন ও কম কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়।
স্বাধীনতার ইসলামী সংজ্ঞাঃ ইসলাম মনে করে বিদেশী শাসন থেকে মুক্তি কিংবা দেশী লোকের শাসন হলেই প্রকৃত স্বাধীনতা হয় না। মানুষের মনগড়া যাবতীয় বিধি-বান্ধব থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত মানুষ সত্যিকারভাবে স্বাধীন হয না।
একমাত্র আল্লাহর বিধান জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের উপর থেকে মানুষের প্রভুত্ব খতম হওয়া সম্ভব। আল্লাহর দেয়া আইন জনগণের সঠিক প্রতিনিধিদের দ্বারা জারি করাতে পারলেই সম্পূর্ন ভারসাম্য রক্ষা করে জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার পেতে পারে, তথা স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে পারে।
স্বাধীনতার আন্দোলনঃ ১৭৫৭ সারে পলামীর আ¤্রকাননে সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতার সূর্য যে অস্তমিত রয়ে গেল। এর মধ্যে অগণিত স্বাধীনতাকামী মানুষ বুকের তাজা রক্ত ঢেলেছে। কত মা-বোন ইজ্জত দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। অতপর ১৮৮৭ সারে জন্ম নিল নিখিল ভারত কংগ্রেস। ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদেরই অংশ হিসেবে বাংলার মুসলমানরাও মনে করেছিল যে, কংগ্রেসের সাথে মিলেই তাদের স্বাধীনতা আসবে। বাংলার মুসলমানদের এ স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই রয়ে গেল। তারা দেখল অনেক বঞ্চনার পর পূর্ব বাংলার মানুষদের কিছুটা সুবিধার জন্য ১৯০৫ সালে যে প্রদেশ গছন করা হল কংগ্রেস তা বানচাল করে ছাড়ল। কারণ এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান এবং এ সুবিধা মুসলমানাই ভোগ করবে বেশী। সুতরাং কংগ্রেস বংগভংগের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে দিল। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯১১ সালে বংগ ভংগ রদ হয়ে গেল মুসলমানদের স্বপ্ন ভাংরো। মুসলমানদের স্বপ্ন ভাংগার ফলে মুসলিম লীগের মাধ্যমে শুরু হলো পৃথক আন্দোলন। সে আন্দোলনের ফলে ১৯৪৭ সালে জন্ম নিল পাকিস্তান। কিন্তু এদেশেরে জনগন ইংরেজ ও কংগ্রেস থেকে স্বাধীনতা লাভ করা সত্ত্বেও প্রকৃত আজাদী পেল না। শাসন ক্ষমতায়, অর্থনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রে সমান অংশীদারিত্ব না পাওয়ায় তারা ইংরেজদের থেকে মুক্তির ২৫ বছর পর স্বাধীনতা লাভের আশায়ই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া প্রযোজন মনে করল।

স্বাধীনতা ও বাংলাদেশঃ স্বাধীনতার সাধারণ সংজ্ঞানুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এদেশের এখন এদেশবাসী দ্বারাই শাসিত।
গণতান্ত্রিক সংজ্ঞানুযায়ী স্বাধীনতা লাবের দেড়যোগ পর এখনও গনতন্ত্রের সামান্য সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। অগণতান্ত্রিক শক্তির মোকাবেলায় গণতন্থ্রের অগ্রগতি সম্ভব হলে জনগণ গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে বলে আশা করা যায়।
স্বাধীনতার ইসলামী সংজ্ঞা মোতাবেক স্বাধীনতা আরো বহু দূরে। দেশে গণতন্ত্র স্থিতিশীল হলে তবেই মানুষ নিজ স্বাধীন ইচ্ছয় প্রচলিত মানবরচিত মতাদর্শ পরিত্যাগ করতে পারে। কারণ এদেশের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম চাই এবং সত্যিকার গণতন্ত্র এলে শাসকগণ জনগণের আশা-আকাঙ্খা অগ্রাহ্য করতে পারবে না। তখন ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। মানুষকে আল্লাহ কারো গোলাম হিসেবে পয়দা করেন না বরং মানুষই মানুষকে দাসে পরিণত করে। তাই আল্লাহ পাক নবীগণকে পাঠিয়েছেন সকল প্রকারের দাসত্বকে অস্বীকার করে কেবল আল্লাহর দাসত্বের দিকে মানুষকে আহবান করার জন্যে। সকল নবীর একই আহবান ছিল- “হে আমার দেশবাসী, একমাত্র আল্লহর দাসত্ব কবুল কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আনুগত্য পাওয়ার অধিকারী আর কেউ নেই।”
বর্তমানে আমাদের দেশের মাটি স্বাধীন হয়েছে মাত্র। দেশের মানুষ সাধারণ সংজ্ঞানুযায়ী স্বাধীন হলেও গণতান্ত্রিক সংজ্ঞায় এখ নপর্যন্ত স্বাধীন হয়নি। আর ইসলামী সংজ্ঞানুযায়ী স্বাধীনতা যে কত দুরে আছে তা ইসলামী আন্দোলনের সাথে যারা জড়িত তারাই উপলদ্ধি করতে সক্ষম।
প্রকৃত স্বাধীনতাঃ ব্যক্তিস্বাধীনতাই আসল স্বাধীনতা। ব্যক্তির ইজ্জত-আব্রু বজায় রাখা, তার আকীদা-বিশ্বাস ও ধর্মীয় কাজের সুযোগ দেয়া, তার পছন্দমতো পেশা গ্রহণের অধিকার দান, তার অর্জিত সম্পদের মালিকানা স্বীকার করা, তার ভাত, কাপড়, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষ ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি এমন মৌলিক মানবীয় প্রোয়োজন যা প্রত্যেক মানুষের প্রাণের দাবী। এ দাবী পূরণের জন্যেই স্বাধীনতার প্রয়োজন। পরাধীন মানুষ এসবের নিশ্চয়তা বোধ করে না। ব্যক্তির বিকাশের জন্য এসবই দরকার। দেশ স্বাধীন হবার পরও যদি এ জাতীয় ব্যক্তি-স্বাধীনতা কপলে না জোটে তাহলে এমন স্বাধীনতা দিয়ে মানুষের কি প্রয়োজন? পরাধীন থাকাকালে যতটুকু ব্যক্তি-স্বাধীনতা এদেশের মানুষ ভোগ করেছে সেটুকু কি এখন তারা পাচ্ছে?
স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক হয়েও কি আমরা স্বধীনতা অর্জন করতে পেরেছি? আমাদের দেশে যারা কাবুল ষ্টাইলে বিপ্লব ঘটাতে চান, যারা মার্কিন, ভারত কিংবা রাশিয়ার মতাদর্শ এদেশে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা কিংবা এদেশে ঐ সকল দেশের স্বার্থে কাজ করছেন তাঁরা কি পরোক্ষভাবে বাংরাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী কাজ করছেন?
যেহেতু কোন দেশের মাটি স্বাধীন হওয়াই স্বাধীনতার মূল কথা নয়, সেহেতু স্বধীনতার দীর্ঘ ১৮ বছর পর আমাদেরকে খতিয়ে দেখতে হবে আমরা জনগণকে কতটুকু স্বাধীনতা দিতে পেরেছি। বয়োবৃদ্ধ প্রবীন লোকেরা যাঁরা বৃটিশের যুগে যুবক কিংবা কিশোর ছিলেন, তাঁরা বলে থাকেন ইংরেজ আমালে তাঁরা আর্থিক প্রাচুর্যে ছিলেন, সুখ-সমৃদ্ধিতে ছিলেন, এমনকি পাকিস্তাণ আমলেও তারা আজকের তুলনায় অনেক শান্তিতে ছিলেন। একথঅ তাঁরা এজন্য বলেন না যে, তাঁরা আবার বৃটিশ কিংবা পাকিস্তানের শাসনে ফিরে যেতে চান বরং তাঁরা এজন্য বলেন যে, তাঁরা স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য খুঁজে পেতে আগ্রহী। তাঁরা চান জীবনের নিরাপত্তা, তাঁরা চান খ্যাদ্যাবাভ ও চিকিৎসার অভাব থেকে বাঁচতে। তাঁরা চান শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে ঈমানের সাথে বাঁচতে।
আমাদের দেশে স্বধীনতার সেই তাৎপর্য আছে কি? আর যদি না থাকে তবে নিছক মাটির স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখা কি সম্ভব? আমাদের দেশে কোন প্রকার বিপদ এলেই আমরা বিদেশের প্রতি বিক্ষার হাত বাড়াতে বাধ্য হই। আমাদের বিপদের সুযোগে বিদেশীরা আমাদের সাহায্যের নামে এলে আমরা তাদের সামনে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে হাজির হই। এ অবস্থায় বিদেশীরা তাদের আদর্শ, সংস্কৃতি ও চরিত্র এদেশে চালুর সুযোগ পেলে এ মাটির স্বাধীনতাটুকু কি রক্ষা পবে? এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের স্বাধীনতা কি রক্ষা করতে সমর্ত হবো?
আমাদের প্রিয় জন্মভূমি ১৯৪৭ সালে একবার এবং ১৯৭১ সালে দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে। কিনউত দু’দু বার স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও আমরা কেন স্বধীনতার স্বাদ পচ্ছি না তা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা প্রয়োজন।
দেশ শাসনের ক্ষমতা বিদেশীদের নিয়ন্ত্রণ তেকে কেড়ে এনে দেশী লোকদের নিয়ন্ত্রণে রাখাকেই স্বাধীনতার উদ্দেশ্য মনে করার ফলেই আমরা আজও সত্যিকার স্বাধীনতা পাইনি। শুধু নেতিবাচক উদ্দেশ্য কোন স্থায়ী সুফল এন দিতে পারে না। দেশকে কিভাবে গড়া হবে, দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো কিরূপ হবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ধরণা ও আন্তরিক নিষ্ঠা নিয়ে যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় তাদের ইতিবাচক কর্মসূচীই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে পারে।
দুর্ভাগ্যবসত আমাদের দু’টো স্বধীনতা আন্দোলনের বেলায়ই ঐ ইতিবাচক ভূমিকার অভাব ছিল। নেতৃব্ন্দৃ অবশ্য জনগণের মুখে কিছু ইতিবাচক শ্লোগান তুলে দিয়েছিলেন, কিন্তু সে অনুযায়ী মন-মগজ ও চরিত্র বিশিষ্ট নেতৃত্ব ও কর্মীবাহিনী গছন করা হয়নি বলেই স্বাধীনতার আসল উদ্দেশ্য লাভ করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতাই

আমাদের দেশে জাতীয় আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেও রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভ সংক্রমিত হয়ে পড়েছে। (আমার দেশ বাংলাদেশ)
বাংলাদেশের প্রতিবেশী
প্রায় সব দেশেরই আশেপালে বিভিন্ন রাষ্ট্র রয়েছে। কোন কোন দেশের চার পাশে অনেক কয়টি দেশও আছে। বাংলাদেশের প্রায় চার পাশে ভারতই একমাত্র রাষ্ট্র। বার্মাও অবশ্য আমাদের সীমান্তে অবস্থিত। কিন্তু বার্মার সাথে ভারত। এমনকি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আন্দামান দ্বীপপুঞ্জও ভারতেরই অন্তরভুক্ত। সে হিসেবে বলতে গেলে ভারতই বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিবেশী।
প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারে না। প্রতিবেশী নিকটবর্তী বলে তার সাথে পণ্য বিনিময় সুলভ হওয়াই স্বাভাইবক। আমদানির ্ও রফতানির সঠিক পরিবেশ বহাল রাখার উদ্দেশ্যে ্ও পারস্পরিক সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ থাকা প্রয়োজন।
প্রতিবেশী রাষ্ঠের সাথে ঝগড়া -বিবাদ লেগে ধাকলে অশান্তি ্ও অস্থিরতা উভয় দেশের জনগণের মধ্যেই বিরাজ করে। এ অবস্থাটা কারো জন্যেই মঙ্গলজনক নয়। এ মহাসত্য স্বীকার করা সত্ত্বে একথ্ওা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দ্বন্দ্ব ্ও সংঘর্ষ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথেই হয়ে থাকে। সম্পর্ক থাকলেই সংঘষের কারণ ঘটে।দূরবর্তী রাষ্টের সাথে সংঘর্ষের সুযোগ কমই হয়। সাধারণত খো যায় যে,শক্তিমান প্রতিবেশী অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিবেশীর সাথে ভাল আচরণ করে না। একথা ব্যক্তি জীবনে যেমন সত্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়্ওে সমভাবে প্রচলিত কুপ্রথা। ১৯৪৭সালে ভারত বিভাগের পর থেকে আজ পর্যন্ত এদেশের সাথে ভারতের আচরণ এতটা আপত্তিকর যে, স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েমের ব্যাপারে ভারতের সাহায্য সহায়তাকেও জনগণ বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে করতে বাধ্য হয়েছে।
পাকিস্তান আমলে এ অঞ্চলের সাথে ভারতের যে ব্যবহার তা বন্ধু সূলভ না হওয়া কতকটা স্বাভাবিক বলা চলে। অখন্ড ভারতমাতা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল। মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হওয়া হিন্দু ভারতের পক্ষে খোলা মনে মেনে নেয়া কিছুতেই সম্ভব ছিল না। তাই ভারতমাতার ব্যবচ্ছেদকারী দেশ হিসেবে সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করা তাদের জন্য অস্বাভাবিক ছিল না।
কিন্তু ভারতের ধর্ম-নিরপেক্ষতাবাদী আদর্শের অনুসারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম হবার পরও ভারতের নিকট কোন সম্মানজনক ব্যবহার না পাওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
ইন্দিরা গান্ধী আশা করেছিলেন যে, তাঁর সাহায্যে যে দেশটি একটি পৃথক সত্তা লাভ করল সে দেশ তাঁর আধিপত্য মানতে রাজী ছিল না তারা হিন্দু ভারতের আধিপত্য সহ্য করবে বলে ধারণা করা যে ইন্দিরা গান্ধীর কতবড় ভুল ছিল তা অল্পদিনের মধ্যে তিনি টের পেলেন।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্ধিরা গান্ধী পার্লামেন্টের অধিবেশনে দর্পভরে ঘোষণা করেছিলেন যে, “টু নেশান থিউরীই বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে”। একথাটি বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি হয়তো আশা করেছিলেন যে, তার ভারতমাতাকে যে টু নেশান থিউরী ত্রিখন্ডিত করেছে তা খতম হয়ে যাবার পর বাংলাদেশ কালক্রম ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের জনগণকে চিনতে তিনি বিরাট ভুল করেছিলেন বলেই এমন দুরাশা তিনি করতে পরেছিলেন। টু নেশান থিউরীই যে বাংলাদেশের আসল ভিত্তি সে কথা তিনি ভুলে গেলেন কী করে ? ভারত বিভক্ত না হলে বাংলাদেশের জন্ম কী করে হতো ? বাংলাদেশের ভবিষ্যত অস্তিত্বেও টু নেশান থিউরীর উপরই নিভর্রশীল।

১৯৭৫ সালের আগষ্টে টু নেশান থিউরী যেন নবজীবন লাভ করল এবং ভারতের আধিপত্য থেকে উদ্ধার পাওয়ার মহাউল্লাস জনগণকে স্বাধীনতার নব চেতনা দান করল। ৭৫-এর ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতা আরও বলিষ্ঠভাবে টু নেশান থিউরীর প্রদর্শনী করল। সুতরাং পাকিস্তান আমলে এদেশের প্রতি ভারত যে মনোভাব পোষণ করতো তা এখনও যথাযথই বহাল আছে। বরং ‘অকৃতজ্ঞ’ বাংলাদেশের প্রতি সে বিরূপ মনোভাব আরও বিক্ষুব্ধ রূপ লাভ করেছে।
ফারাক্কা বাঁধের ফলে অর্ধেক বাংলাদেশ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ একতরফাভাবে দখলের মাধ্যমে ভারতের আগ্রাসী মনোবৃত্তিরই প্রকাশ ঘটেছে। বেরুবাড়ী হস্তান্তর করে ভারতকে দিয়ে দেয়া সত্ত্বেও চুক্তি অনুযায়ী কয়েকটি ছিট মহল না দিয়ে ভারত চরম বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়েছে। সামান্য তিন বিঘা করিডোর নিয়ে ভারত যে ক্ষুদ্রমনার পরিচয় দিয়েছে তা বিষ্ময়কর।
গঙ্গার পানি বৃদ্ধি করে ফারাক্কার ছোবল থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য নেপাল ও বাংলাদেশের যৌথ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ভারত চরম হঠকারিতার প্রদর্শনী করেছে। গঙ্গার পানি নিয়ে বছরের পর বছর উভয় সরকারের যে প্রহসনমূলক বৈঠক চলছে তা এদেশের জনগণের মনকে বিষিয়ে তুলেছে। এ ব্যাপারে এ পর্যন্ত ভারতের সামান্য সদিচ্ছার পরিচয়ও পাওয়া যায়নি। গঙ্গার পানি কুক্ষিগত করে এখন ব্রহ্মপুত্রের পানিরও দাবী করা হচ্ছে কায়দা করে।
বাংলাদেশ ভারতের সাথে সামান্য তিক্ততাও সৃষ্টি করতে চায় না। তাই গঙ্গার পানি ন্যায্য হিস্যা দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করে আদায় না হওয়ায় ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ এ বিষয়টা জাতিসংঘের দরবারে পেশ করেছিল। সারা দুনিয়াকে শুনিয়ে ভারত জাতিসংঘে ওয়াদা করেছিল যে, দ্বিপাক্ষিক আলোচনা দ্বারাই এর মীমাংসা করা হবে। জাতিসংঘ থেকে সেদিন এ মামলা তুলে নিয়ে বাংলাদেশ সরকার দুবর্লতারই পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায় বলেই তা করেছে।
এ জাতীয় চরিত্রের বিশালদেহী প্রতিবেশী দ্বারা ঘেরাও থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কিভাবে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে তা এদেশের জন্য এক বিরাট সমস্যা। ভারতের জনগণের সাথে প্রতিবেশী সূলভ মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাংলাদেশ অত্যন্ত আগ্রহী। কিন্তু একতরফাভাবে কী করে সে ধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে? ভারতে যদি কোন দিন এমন কোন সরকার কায়েম হয় যারা ‘বীগ ব্রাদার’ মনোভাব ত্যাগ করবে কেবল তখনই সুসম্পর্ক কয়েম হতে পারে।

বাংলাদেশের সম্ভাব্য আক্রমণকারী
পৃথিবীর বড় রাষ্ট্রগুলোর ভয়ে আজ ছোট দেশগুলো আতংঙ্কগ্রস্ত। দূরপ্রাচ্য, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা প্রভৃতি স্থানে আমরার এর বাস্তব নযির দেখতে পাই। বাংলাদেশ সাম্প্রতিক কালে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এমন একটা রাষ্ট্র যার আযাদী এবং নিরাপত্তা যে কোন সময়ে বিপন্ন হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এ হামলা কোন্ দিক থেকে আসতে পারে ? সরাসরি (সম্ভাব্য) হামলাকারী কে হতে পারে ঃ এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথমত প্রত্যেকেই একথা বলবেন যে, একমাত্র পার্শ্ববর্তী কোন রাষ্ট্র দ্বারাই এ কাজ সম্ভব। দূরবর্তী কোন রাষ্ট্রের পক্ষে এ কাজ আদৌ সম্ভব নয়। এদিক থেকে বিচার করলে একমাত্র ভারতের পক্ষ থেকেই এ আক্রমণ আসতে পারে। বাংলাদেশের সম্পূর্ণ পশ্চিম ও উত্তরে সীমান্ত এবং পূর্বদিকে আসাম পর্যন্ত ভারত বি¯তৃত। এমনকি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জও ভারতের। সুতরাং বলা যায় বাংলাদেশের জলপথ, স্থলপথ ও আকাশপথ ভারতের দ্বারা পরিবেষ্টিত। আমরা একথা বলছি না যে, ভারত আক্রমণ করে বসবেই। কিন্তু একথা অস্বীকার করার কোনই উপায় নেই যে, আমাদের দেশ যেহেতু সাড়ে তিন দিক থেকেই ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত সেহেতু ভারতের পক্ষ থেকে আক্রমণ হওয়াই স্বাভাবিক বা সম্ভব।
অন্যদিকে বাংলাদেশের পূর্ব-দক্ষিণে সীমান্তে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বার্মার বর্ডার রয়েছে। এ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন প্রকার আক্রমণ আসতে পারে কি না এটাও প্রশ্নের বিষয়। এ আগ্রাসনটা প্রকৃতপক্ষে নির্ভর করবে বার্মার সাথে অন্য কোন কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্র সহযোগিতা করে কিনা তার উপর। কারণ বার্মার একার পক্ষে এ কাজ সম্ভবও নয়, স্বাভাবিকও নয়। বৃহৎ কোন কম্যুনিষ্ট রাষ্ট এ কাজ করলে তবেই বার্মা এ উদ্যোগে শরীফ হতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও ভারতের সম্মতির প্রয়োজন। সুতরাং এ ক্ষেত্রে বলা যায় যে, বাংলাদেশের আযাদী হরণ করার জন্য সরাসরি হামলা যদি কেউ করে তবে সে ভারত।
কোন বৃহৎ শক্তি হামলা করতে পারে ঃ কোন বৃহৎ শক্তি যদি বাংলাদেশের প্রতিবেশী কোন দেশের সহযোগিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায় তবে তিনটি বড় বড় রাষ্ট্রই এ কাজ করতে পারে। রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে আমেরিকা, রাশিয়া ও চীন। প্রথমে আমেরিকার কথা ধরা যাক। ভৌলিক দিক দিয়ে সরাসরি এদেশ দখল করার সুযোগ সে দেশটির নেই। বরং যুক্তরাষ্ট্রকে এ কাজ করতে হরে তাকে এদেশের অভ্যন্তরে এমন এজেন্ট পেতে হবে যার সহযোগিতায় সে বাংলাদেশের উপর পরোক্ষভাবে কর্তৃত্ব করতে পারে। অতপর আসে চীনের কথা। এদেশটি সম্পর্কে এখনও এ ধারণা সৃষ্টি হয়নি যে, সে ভৌলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশকে দখল করার চেষ্টা করবে। সুতরাং বাকী থাকে রাশিয়া। রাশিয়ার অতীতের এ জাতীয় বহু কার্যকলাপ বাদ দিলেও অতি সম্প্রতি সে জোট নিরপেক্ষ একটা স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিম দেশ আফগানিস্তান দখল করার হীন চেষ্ট করেছে।
রাশিয়া কর্তৃক বাংলাদেশ আক্রান্ত হলে সম্ভাব্য দু‘টো পথে হতে পারে। প্রথমত, ভারতের মধ্য দিয়ে, দ্বিতীয়ত, বর্মার মাধ্যমে। রাশিয়া ভারতের মধ্য দিয়ে এদেশে আক্রমণ করতে চাইলে সে ততক্ষণ পর্যন্ত এ কাজ করতে পারবে না যতক্ষণ না ভারত এ কাজে রাযী হয়। প্রকৃতপক্ষে ভারতের নিজের স্বার্থেই সে রাশিয়াকে এ সুযোগ দিতে পারে না। অন্য দিকে কমুনিষ্ট রাশিয়া যদি সমাজতান্ত্রিক বার্মার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আক্রমণ করতে চায় সে ক্ষেত্রেও ভারতের সম্মতির প্রয়োজন দেখা দিবে। কারণ প্রায় সাড়ে তিন দিক ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত একটা দেশে ভারতের অসম্মতিতে আক্রমণ চালানো স্বাভাবিক নয়।
সুতরাং এটা নিশ্চিত যে, বাংলাদেশ আক্রান্ত হলে সরাসরি একমাত্র ভারতের দ্বারাই হতে পারে। একথা যদি স্বীকৃত হয় তাহলে বলতে হবে আমাদের নিরাপত্তার উপর হামলা কেবল ভারতের দিক থেকেই আসতে পারে বা ভারতের সমর্থনেই হতে পারে।
ভারতীয় হামলায় প্রকৃতি কি হতে পারেঃ একথা ঠিক যে, আজকাল বিশ্বজনমত (ডড়ৎষফ ঙঢ়রহরড়হ) বলতে একটা কথা আছে। সে কারণেই ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতি সরাসরি আক্রমণের সম্ভাবনা কম। তাই আধুনিক যুগে কোন দেশে হামলা চালাতে হরে সে দেশে এমন তাবেদার সরকার বসাতে হয়, যে অন্যের স্বার্থ রক্ষ করবে এবং প্রয়োজনে আক্রমণ করবার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানাবে। এভাবেই বিদেশী শক্তি কোন দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ার সুযোগ গ্রহণ করে। আফগানিস্তানে রাশিয়ার আগ্রাসন এভাবেই হয়েছে। সে জন্যই বাংলাদেশে এমন সরকার হওয়া কোন মতেই সমীচীন নয় যার উপর জনগণের মনে সন্দেহ হয় যে, ঐ সরকারের নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে (দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে নয়) ভারত ডেকে আনতে পারে।

বাংলাদেশের আযাদী রক্ষা
স্বাধীনতা প্রধানত মনোবলের উপরই নির্ভরশীল। মনের দিক দিয়ে অধীন হলে ভৌগলিক স্বাধীনতা কোনভাবেই টিকতে পারে না। সে সব লোকই প্রকৃতপক্ষে জীবন দিয়ে হলেও স্বাধীনতা রক্ষা করতে চেষ্টা করবে, যারা মনের দিক থেকে স্বাধীন।
আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে, একমাত্র ভারতের পক্ষ থেকেই স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার যথার্থ রক্ষক তারাই হতে পারে যারা ভারতের প্রতি কোন প্রকার দুর্বলতা পোষণ করে না।
ঐ সকল লোকদের মধ্যে সবচাইতে পয়লা নম্বরে গণ্য হবে তারাই যারা এদেশে কুরআনের বিধান ও রাসূল (সাঃ)-এর আদর্শে সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। এরাই ভারতের দিক থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন মানসিকতার অধিকারী। কারণ তারা জানে এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বহাল না থাকলে তাদের আদর্শ বাস্তবায়নের কোন সম্ভাবনাই নেই। তাই তারা ভারতের প্রভাব বলয় থেকে বাইরে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং স্বাধীনতার প্রথম শ্রেণীর রক্ষক তারাই। কারণ এ সকল লোকের দ্বীনের প্রয়োজনেই দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করাকে ফরজ মনে করে। অন্য কথায় স্বাধীনতা রক্ষা তাদের নিকট ধর্মীয় কর্তব্য ও ঈমানী দায়িত্ব।
স্বাধীনতার প্রকৃত রক্ষকদের মধ্যে তারাও অবশ্য গণ্য হতে পারে যারা ঐতিহাসিক কারণেই হিন্দু প্রধান ভারতের প্রাধান্য স্বীকার করতে কোন অবস্থাতেই রাজী নয়। মুসলমানরা ছিল এদেশে শাসকের জাতি। গোটা উপমহাদেশে তারা শত শত বছর ধরে শাসন করেছে। ইংরেজরা তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অমুসলিমদের সহায়তায় দু’শ বছর মুসলমানদের গোলাম বানিয়ে রাখে। ঐতিহাসিক কারণেই মুসলমানরা হিন্দু কংগ্রেসের অধীনতা মানতে রাজী হতে না পারায় ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ সম্মেলনে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের প্রস্তাব অনুযায়ী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী গৃহীত হয়। অতপর ১৯৪৭ সালে এলো পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়েও বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বাধীন রাষ্ট্র রয়ে গেল। যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত বতর্মানে আরও মজবুতভাবেই এদেশে বহাল রয়েছে।
এদেশে যারা দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী নন তারা পশ্চিম বাংলা তথা ভারত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা কিভাবে টিকিয়ে রাখবেন ? তাদের দ্বারা তা সম্ভব নয় বলেই মুসলিম জাতীয়তায় বিশ্বাসীরাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রকৃত রক্ষক।
যারা দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী নয়, যাদের নিকট ধর্মের কোন গুরুত্ব নেই, যারা মুসলিম অমুসলিম মিলে এক জাতিতে বিশ্বাসী যারা বাংলাদেশের বাইরের বাংগালীদের সাথে মিলে এক বাংগালী জাতি গঠনে আগ্রহী, এদেশে কোন রাজনৈতিক হাঙ্গামা হয়ে যারা ভারতে আশ্রয় নেই যারা মনে করে যে, বাংলাদেশ ছাড়াও তাদের নিরাপদ স্থান আছে, এ বাড়ীটাই যাদের একমাত্র বাড়ী নয়, তাদের হাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিরাপদ হতে পারে কি ?
বলিষ্ঠ সরকার চাইঃ স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন মনোবৃত্তি সম্পন্ন বলিষ্ঠসরকার ছাড়া দেশের আযাদী নিরাপদ হতে পারে না। আমাদের দেশে এমন মজবুত মানসিকতা সম্পন্ন সরকার হতে হবে যে প্রতিবেশী দেশের কোন প্রকারের বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় দিতে রাযী নয়। প্রতিবেশী ভারতের লোক বাংলাদেশ সীমান্তের ফসল কেটে নিয়ে যায়, সীমান্তের অভ্যন্তরে ঢুকে গরু চুরি করে নিয়ে যায়, নিরীহ মানুষকে হয়রানি করে ও খুন খারাবি করে। তারা আমাদের সমুদ্রবক্ষে জেগে ওঠা দীবপ দখল করে বসে। আমাদের জনগণকে এ বিষয়ে অবহিত করে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়ার মতো সরকার চাই।
গঙ্গার পানি ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে আটককরার পর ভারত এখন আসামের ধুবরী থেকে মোমেনশাহী, পাবনা রাজশাহী, ্ও কুষ্টিয়ার উপর দিয়ে খাল কেটে পানি নেবার দাবী জানাচ্ছে। আমাদের হাজার হাজার একর জমি ভারতের প্রয়োজন খালের জন্য দিতে হবে। প্রতিবেশী ভারতের এহেন আবদার সম্পর্কে জনগণের মনোভাব কি প্রকাশ প্ওায়া উচিত নয় ? আসামের বিদ্রাহী আন্দোলনকে দমন করার প্রয়োজনে বিব্রত ভারত সরকার কোলকাতা থেকে অল্প সময়ে আসাম পৌঁছার জন্য জলপথ কিংবা স্থলপথে বাংলাদেশের উপর দিয়ে ‘করিডোর’ দাবী করলে যে বলিষ্ঠতার সাথে এ দাবী প্রত্যাখ্যান করা দরকার তার অভাব হলে এদেশের নিরাপত্তা কী করে টিকবে ?
মুজিব আমলে ভারতের সাথে ২৫ বছরের যে গোপন চুক্তি হয়েছিল তা যদি বাংলাদেশের স্বার্থের বিরোধী হয়ে থাকে তাহলে সত্ত্বর বাতিল করা প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে বিদ্রোহীদেরকে ভারত সাহায্য করছে তাদের সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা কি প্রয়োজন নয় ? গোটা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে। এটা বিপন্ন হরে যে মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি হবে তা দেশবাসীকে অবহিত করা প্রয়োজন।
শক্তিতে ভারতের সাথে পারব না, এমন দুর্বল মানসিকতা হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। আত্মসম্মানবোধই স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। আজকে পৃথিবীতে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ মেলে। উদাহরণ স্বরূপ ইরানের কথা তুলে ধরা যায়। শক্তিমান প্রতিবেশীর বাড়াবাড়ি থেকে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন সরকারই জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় সক্ষম। আত্মসম্মানবোধে জাতিকে উদ্ধুদ্ধ করা সরকারেরই দায়িত্ব। তাদের ডাকেই জনগণ জীবন দেয়। অসম্মানের সাথে বেঁচে থাকার চেয়ে সম্মান নিয়ে মরাই আত্মসম্মানবোধের দাবী। দুর্বল মানসিকতা নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার হেফাযত কখনও হবে না।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিরক্ষা ঃ ভারত এদেশের সম্ভাব্য আক্রমণকারি হলেও সশস্ত্র আক্রমণ করার চাইতে সাংস্কৃতিক আক্রমণের পথই সহজতর মনে করবে। বাংগালী জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসীদের মন-মগজ ও চরিত্রকে সাহিত্য, সংগীত, নাটক, সিনেমা, চারু-শিল্প, ললিত কলা ইত্যাদির মাধ্যমে পশ্চিম বংগের অমুসলিমদের সাথে এতটা ঘনিষ্ঠ করতে চেষ্টা করবে যাতে তারা মুসলিম জাতীয়তার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে। এ জাতীয় লোকদের হাতে যাতে দেশের শাসন ক্ষমতা থাকে সে উদ্দেশ্যে ভারত সকল প্রকার প্রচেষ্ট চালাবে।
ভারত যদি এদেশের শিক্ষিত মুসলমানদের একটা বড় অংশকে মুসলিম জাতীয়তা পরিত্যাগ করাতে সক্ষম হয় তাহলে যে সাংস্কৃতিক বিজয় তাদের লাভ হবে তাতে রাজনৈতিক ময়দানে তাদের তাবেদার শক্তির প্রাধান্য অত্যন্ত সহজ হবে।
তাই এদেশকে ভারতের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে হলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ভবিষ্যত শিক্ষিতদের মন-মগজ ও চরিত্রকে ইসলামী জীবনাদর্শে গড়ে তোলা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।
(আমার দেশ বাংলাদেশ)


এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার রক্ষক কারা ?
বাংলাদেশ একটি পৃথক স্বাধীন দেশ হিসেবে কায়েম হবার দেড় যুগ পরেও যারা ৭১-এর ভূমিকা নিয়ে হৈ চৈ করার চেষ্টা করেন, তারা একটা কথা গভীরভাবে বিবেচনা করেননি।
৭১-এর ভূমিকার কারণে যারা এদেশে ভারতবিরোধী ও ইসলামপন্থী হিসেবে চিহ্নিত, তাদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ হবার পর এমন কোন কাজ হয়েছে কি, যা এদেশের স্বাধীনতার সামান্য বিরোধী বলে প্রমাণ করা যায়? একথা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য যে, এদেশের স্বাধীনতার উপর যদি কোথাও থেকে আঘাত আসে, তা একমাত্র ভারত থেকেই আসতে পারে। দেশের চারপাশে যদি ভারত ছাড়া আরও কয়েকটি দেশ থাকত, তাহলে এ বিষয় ভিন্ন মত পোষণের সুযোগ হতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতের ভূমিকার কারণে যারা এ বাস্তবতা থেকে চোক বন্ধ করে রাখতে চান, তারা জনগণ থেকে ভিন্ন চিন্তা করেন। জনগণকে বাদ দিয়ে দেশ রক্ষা সম্ভব নয়। নিঃসন্দেহে এদেশের জনগণ ভারত সরকারকে বন্ধু মনে করে না। তাদের কোন আচরণই বন্ধুসূলভ বলে প্রামাণিত নয়। এমনকি স্বাধীনতার আন্দোলনে ভারতের ভুমিকাকেও এদেশের মংগলের নিয়তে পালন করা হয়েছে বলে জনগণ বিশ্বাস করে না।
সশস্ত্র বাহিনীর উদ্দেশ্যই হলো প্রতিরক্ষা বা ডিফেন্স। “ডিফেন্স এগেইনস্ট হুম” বা “কার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা” প্রশ্নটি আপনিই মনে জাগে। যেহেতু একমাত্র ভারত থেকেই আক্রমণের সম্ভাবনা, সেহেতু এ প্রশ্নের জওয়াব ও একটাই।
তাছাড়া শুধু সশস্ত্র বাহিনী দিয়েই দেশ রক্ষা হয় না। জনগণ যদি সশস্ত্র বাহিনীর পেছনে না দাঁড়ায়, তাহলে সে বাহিনী কিছুতেই প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করতে পারে না। জনগণও একথা বিশ্বাস করে যে, এদেশের স্বাধীনতা তাদের হাতেই নিরাপদ, যারা ভারতকে আপন মনে করে না এবং ভারতও এদেশে যাদেরকে তার আপন মনে করে না। তাই ৭১-এর ভূমিকা দ্বারা যারা এদেশে ভারতের বন্ধু নয় বলে প্রমাণিত, তারা জনগণের আস্থাভাজনই আছে। যারা বিশেষ রাজনৈতিক গরজে তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন, তারা এ বিষয়ে জনগণের মধ্যে কোন সমর্থন যোগাড় করতে পারবেন না।
এদেশের জনগণ ভারত সরকারকে বন্ধু মনে করে না বলেই রাশিয়াকেও আপন মনে করে না। কারণ, রাশিয়ার নীতি সবসময়ই ভারতের পক্ষে দেখ গেছে। তাছাড়া, রুশ-দূতাবাসের কার্যকলাপ সম্পর্কে মাঝে মাঝে পত্র-পত্রিকায় যেসব খবর প্রকাশিত হয়, তাতে তাদের সম্পর্কে সুধারণা সৃষ্টি হওয়ার কোন কারণ নেই। বিশেষ করে আফগানিস্থানে রাশিয়ার নির্লজ্জ ভূমিকা জনমনে তীব্র ঘৃণাই সৃষ্টি করেছে।
এদেশে কারা রাশিয়ার আগ্রাসী ভূমিকাকে সমর্থন করে এবং করা ভারতের নিন্দনীয় ভূমিকাকে নীরবে সমর্থন করে, তা কোন গোপনীয় ব্যাপার নয়। সুতরাং তরা যখন জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে ৭১-এর ভূমিকার দোহাই দিয়ে চিৎকার জুড়ে দেয়, তখন তাদের নিজেদের হীন মতলবই ফাঁস হয়ে পড়ে। তাদের এ চিৎকারের অর্থ দেশপ্রেমিক জনগণের বুঝতে বেগ পেতে হয় না।
এদেশের জনগণ একথা দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করে যে, ৭১-এ যারা ভারত বিরোধী বলে প্রমাণিত হয়েছে, তারা কোন অবস্থায়ই ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের উপর কোন হস্তক্ষেপ বরদাশত করবে না। আর যারা এদেশে ইসলামকে বিজয়ী দেখতে চায়, তারাই দেশরক্ষার জন্য প্রাণ দেবার বেলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। সুতরাং ৭১-এর ভূমিকার ভিত্তিতে তাদের সরকারের বন্ধু বলেই জনগণের নিকট বিবেচিত হবে।
আর একটা বাস্তবতা হলো এই যে, এদেশে কোন গৃহযুদ্ধ লাগলেও যারা ভারতের কোন আশ্রয় আশা করে না, তারাই এদেশকে রক্ষা করবে। যাদের আর কোথাও যাবার পথ নেই, তারাই মরিয়া হয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য এগিয়ে আসবে। কারণ, এছাড়া তাদের আর কোন উপায় নেই। তাদের জীবন ও মরণ এদেশেই নির্ধারিত। যারা সবসময় ভারতের আধিপত্যবাদী ভূমিকার বিরোধী তাদেরকেই জনগণ এদেশে স্বাধীনতার প্রকৃত রক্ষক বলে মনে করে। দেশে কোন রকমের রাজনৈতিক সংকট দেখা দিলে যারা ভারত সরকারের মেহমান হিসেবে সে দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পান, তারা কী করে আশ্রয়দাতা দেশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন ? এদেশ ছাড়াও যাদের আশ্রয় আছে, তারা কি এদেশের হিফাযত করতে পারবেন ? (পলাশী থেকে বাংলাদেশ)

 

ইসলামপন্থীদের ৭১ পরবর্তী ভূমিকা

৭১-এর রাজনৈতিক মতপার্থক্য জিইয়ে রাখা অবান্তর। তখন এমন এক দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে দেশপ্রেকিদের মধ্যে দেশের কল্যাণ কোন পথে সে বিষয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়ে গেল। এক পক্ষ মনে করল যে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া ছাড়া মুক্তি নেই। অপর পক্ষ মনে করল যে পৃথক হলে ভারতের খপ্পরে পড়তে হবে। এক পক্ষ অপর পক্ষকে “পাঞ্জাবের দালাল” আর “ভারতের দালাল” মনে করত। কিন্তু এসব গালি দ্বারা কোন পক্ষের দেশপ্রেমই মিথ্যা হয়ে যায় না। ঐ সময়কার দুঃখজনক মতবিরোধকে ভিত্তি করে যদি এখনও বিভেদ জারী রাখা হয় তাহলে জাতি হিসেবে আমরা ধ্বংসের দিকেই এগিয়ে যেতে বাধ্য হব।
দুনিয়ার মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কায়েম হবার পর সব ইসলামপন্থী দল ও ব্যক্তি স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিয়ে নিজেদের জন্মভূমিতে সাধ্যমত ইসলামের খেদমত করার চেষ্টা করছে। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার নারায়ে তাকবীর- আল্লাহু আকবার ধ্বনি স্বাধীনতা বিরোধী চক্রান্তকে নস্যাৎ করতে সক্ষম হয়। ১৯৭৭ সালে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ খতম করে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, আল্লাহর প্রতি ঈমান ও দৃঢ় আস্থা এবং সমাজতন্ত্রের ভিন্ন ব্যাখ্যা সংবিধানে সন্নিবিশীত করার পর জনগণ রেফানেন্ডামের মাধ্যমে তাকে স্বাগত জনাবার ফলে ইসলামপন্থী দলগুলো বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য শাসনতান্ত্রিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। এভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এদেশের মুসলমানদের জন্য তাদের ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকার অনুকূলে পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছেন।
বাংলাদেশ ভৌগলিক দিক দিয়ে মুসলিম বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটা এলাকা। আর কোন মুসলিম দেশ এমন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় নেই। তদুপরি আমাদের এ প্রিয় জন্মভূমিটি এমন একটি দেশ দ্বারা বেষ্টিত যাকে আপন মনে করা মুস্কিল। তাই এদেশের আযাদীর হিফাযত করা সহজ ব্যাপার নয়। জনগণ এ ক্ষেত্রে একেবারেই বন্ধুহীন। আশপাশ থেকে সামান্য সাহায্য পাওয়ারও কোন আশা করা যায় না। এ দেশবাসীকে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে নিজেদের শক্তি নিয়েই প্রতিরক্ষার কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হবে।
যে কোন জাতির আদর্শ ও বিশ্বাসই তার শক্তির উৎস। সুতরাং এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনাদর্শ ইসলামেই স্বাধীনতার আসল গ্যারান্টি। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামপন্থী সকলেই এ মহান উদ্দেশ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। তাই জনগণের নিকট তাদের চেয়ে বেশী আপন আর কেউ হতে পারে না। (পলাশী থেকে বাংলাদেশ)

বাংলাদেশের আসল সমস্যা বাংলাদেশের মৌলিক সমস্যা
বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বেরই অন্যতম একটি রাষ্ট্র। তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের যাবতীয় সমস্যাই এখানে অত্যন্ত সজীবভাবেই বর্তমান ঃ
১. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব ঃ শাসনতান্ত্রিক স্থায়ী কাঠামো ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবই তৃতীয় বিশ্বের প্রধান সমস্যা। এ সমস্যার কারণ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন হলেও সমস্যার প্রকৃত রূপ একই। শাসনতন্ত্র সেখানে একনায়কের খামখেয়ালীর খেলনা, আর সরকারী দল তার অনুগত দাস। ফলে সেখানে শাসনতন্ত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে না এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব হয় এবং পরিণামে সামরিক শাসন এসে নতুন সমস্যার জন্ম দেয়। কারণ সামরিক শাসন কখনও রাজনৈতিক সমাধান নয়।
একথা দেবাসীর মন-মগজে কায়েম হতে হবে যে, ব্যক্তি যত যোগ্য বা নিঃস্বার্থই হোক তাকে দেশের ভাগ্যবিধাতা হিসেবে মেনে নেয়া মরাত্মক ভুল। ব্যক্তি চিরজীবী নয় এবং ব্যক্তি ভুলের ঊর্ধেও নয়। এ ধরনের দায়িত্বের অধিকারী ব্যক্তির একার বুলে একটি দেশে বিপর্যয় হয় এবং গোটা জাতির স্বার্থ বিপন্ন হয়। অতীত ও বর্তমান ইতিহাস এর জ্বলন্ত সাক্ষী। তাছাড়া সর্বক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তির হঠাৎ মৃত্যু হলে গোটা দেশ চরম শাসনতান্ত্রিক সংকটের সম্মুখীন হয়।
তাই কোন দেশের স্থায়ী কল্যাণের জন্য একটি স্থায়ী শাসনতান্ত্রিক কাঠামো থাকা অপরিহার্য। দেশের সকলের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যত বংশধরদের উন্নতি এবং দেশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এরই উপর প্রধানত নির্ভরশীল। ব্যক্তিত্বের প্রভাব ও যোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা সব দেশে সব কালেই স্বীকৃত। কিন্তু জাতির ভাগ্য কোন এক ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়া আত্মহত্যার শামিল। শাসক আজ আসবে, কাল স্বাভাবিক মানবিক কারণেই চলে যাবে। কিন্তু দেশ কিভাবে পরিচালিত হবে সে বিষয়ে স্থায়ী বিধি-ব্যবস্থা না থাকলে যিনিই ক্ষমতায় আসবেন তিনি তার মরযী মতে শাসনতন্ত্রকে যেমন খুশী রদ-বদল করবেন। কোন স্বাধীন দেশের নাগরিকদের জন্য এর চেয়ে অপমানকর কোন কথা আর হতে পারে না। এ অবস্থায় জাতীয় মর্যাদাবোধই বিনষ্ট হয়।
সুতরাং যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জাতীয় সংসদে আসন পান তাদের নেতৃস্থানীয়দের এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। তাদেরকে সর্বসম্মতভাবে শাসনতন্ত্রের মূল রাজনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। যদি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত সম্ভব না হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাহলে গণভোটের মাধ্যমে জাতীয় সিন্ধান্তে পৌঁছতে হবে।
২. নৈতিক অবক্ষয় ঃ দ্বিতীয় প্রধান সমস্যা হলো নৈতিক অবক্ষয়। মানুষ নৈতিক জীব। বিবেকসম্পন্ন জীব হিসেবে ভাল-মন্দের ধারণা থেকে কোন মানুষ মুক্ত থাকতে পারে না। যে জাতির অধিকাংশ লোক মন্দ জেনেও ইচ্ছা করে তাতে লিপ্ত হয়, সে জাতির জীবনে কোন ক্ষেত্রেই শৃঙ্খলা থাকতে পারে না। এমন জাতির মধ্যে কোন আইনই সঠিকভাবে জারি হতে পারে না। নৈতিকতাশূন্য সরকারী কর্মচারী জাতির ডাকাক স্বরূপ। প্রতিটি আইন তাদেরকে যোগ্যতার সাথে ডাকাতি করার ক্ষমতা যোগায়।
আমাদের দেশে আইন-আদালত, কোর্ট-কাচারী, থানা-পুলিশ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, উযীর-নাযীর, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, ইত্যাদিকে আধুনিক যুগোপযোগী করার জন্য জাতীয় শক্তি-সামর্থের অনেক বেশী অর্থ-দ্বারা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কাংখিত শান্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণ সাধিত হচ্ছে না। মানুষ প্রকৃতপক্ষেই বিবেকবান নৈতিক সৃষ্টি। নৈতিকতা বোধই মনুষ্যত্বে। আর চরিত্রই মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। তাই নৈতিক চেতনাই মানুষের আসল সত্তা। মানুষের দেহ-যন্ত্রের পরিচালনাশক্তি যদি ও সত্তার হাতে তুলে দেয়া না হয়, তাহলে সে পশুর চেয়েও অধম হতে পারে।
প্রত্যেক জাতিই তার বংশধরকে শৈশবকাল থেকেই নীতিবোধের ভিত্তিতে সুশৃঙ্খল বানাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সব জাতির নীতিবোধের ভিত্তি এক নয়। প্রত্যেক জাতি কতক মৌলিক বিশ্বাসের ভিত্তিতেই জাতীয় নীতিবোধের ধারণা লাভ করে। বাংলাদেশের শতকরা ৮৭ জনের মৌলিক বিশ্বাস হলো তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত। সুতরাং এদেশের জাতীয় নীতিবোধ যদি এর ভিত্তিতে রচিত হয়, তাহলে জাতীয় চরিত্র গঠনের কাজ ত্বরান্বিত হওয়া সম্ভব। কিন্তু যদি অন্য কোন ভিত্তি তালাশ করা হয়, তাহলে প্রচলিত মৌলিক বিশ্বাসকে ধ্বংসে করতে কয়েক পুরুষ পর্যন্ত সময় লেগে যাবে। এরপর নতুন ভিত্তি রচনা করে জাতির নৈতিক মান রচনা করার কাজে হাত দিতে হবে। এমন আত্মঘাতী পথে জেনে-শুনে কোন বুদ্ধিমান জাতি যেতে পারে না।
একটি কথা আমাদের শিক্ষিত সমাজকে গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে। আমাদের সমাজে হাজারো দোষ-ক্রটি থাকা সত্ত্বেও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আল্লাহ, রাসূল ও আখিরাত সম্বন্ধে কোন না কোন মানের বিশ্বাস মুসলিমদের মধ্যে অবশ্যই আছে। হালাল-হারাম, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, উচিত অনুচিত সম্পর্কে জনগণের ধারণা মোটামুটি আছে। প্রবৃত্তির তাড়নায়, আপাত মধুর প্রলোভনে বা কুসংসর্গে মানুষ বিবেকের নৈতিক অনুভূতির বিরুদ্ধে কাজ করলেও সে নীতিবোধ থেকে বঞ্চিত নয়। বিবেকের দংশনই প্রমাণ করে যে, মানুষ নৈতিক জীব। দেহের অসংগত দাবীকে অগ্রায্য করে বিবেকের নির্দেশ পালনের জন্য যে নৈতিক শিক্ষা প্রয়োজন সে শিক্ষা ব্যতীত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা যোগ্য দানব সৃষ্টি করতে পারে বটে, সুশৃঙ্খল সৎমানব গঠন করতে পারে না।
জাতির নৈতিক উন্নয়ন ব্যতীত অন্যান্য দিকের উন্নতি সম্পূর্ণ অসম্ভব। অন্যায় পথে ধন-সম্পদ অর্জনের মনোবৃত্তি দমন করতে না পারলে সমাজ থেকে শোষণ উৎখাত হব্ েকি করে ? সরকারী আয়ের প্রতিটি উৎস পথে ঘুষখোর ও দুর্নীতিপরায়ণ লোক থাকলে দেশকে কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করা কি করে সম্ভব ? সর্বস্তরে দেশে যে দুর্নীতি ব্যাপক আকারে বিরাজ করছে তা দূর করার ব্যবস্থা না হলে জনগণ কোন সরকারী ও বেসরকারী ব্যক্তির কাছ থেকে প্রয়োজনীয় খেদমত পেতে পারে না। দুর্নীতির ফলে করদাতা জনগণ মনিব হয়েও সরকারী কর্মচারীদের দ্বারা শোষিত, নির্যাতিত ও অপমানিত।
৩. অর্থনৈতিক নিরারপত্তার অভাব ঃ তৃতীয় প্রধান সমস্যা অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাব। দেশে এমন ধরনের এক অর্থব্যবস্থা চালু রয়েছে যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চেয়েও নিকৃষ্ট। সমাজতন্ত্রের নামে কিছু শিল্প-কারখানাকে সরকারী পরিচালনাধীন করেই সুফল পাওয়া যেতে পারে না। বাংলাদেশে বর্তমান অর্থব্যবস্থা কোন পরিকল্পিত ব্যবস্থা নয়। ‘অরাজকাতাই’ই এর একমাত্র পরিচয়।
কোন দেশের সুপরিকল্পিত অর্থব্যবস্থার প্রথম ভিত্তিই হলো জনগণের মৌলিক মানবীয় প্রয়োজন পূনণের লক্ষ্যবিন্দুকে অর্জনের দৃঢ়সংকল্প। খাদ্য, পোশাক, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা যদি পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য না হয়, তাহলে দেশের উন্নয়নের নামে যাই করা হোক, তা শোষণের হাতিয়ারেই পরিণত হয়্ প্রতিটি মানুষের এসব্ মৌলিক প্রয়োজন পূরণই প্রকৃত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সঠিক উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্য ব্যতীত রাষ্ট্র ও সরকার মানব জীবনের জন্য অর্থহীন।
দুনিয়ার কল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এ উদ্দেশ্য হাসিল করার দু’প্রকার বাস্তব কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। (১) পশ্চিম ইউরোপীয় কল্যাণমূলক কয়েকটি রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক দলীয় একনায়কত্ব ছাড়াই ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধি ও ন্যায়ভিত্তিক বন্টনের মাধ্যমে এ সমস্যার মোটামুটি সমাধান করেছে। অবশ্য পুঁজিবাদী সমাজের তুলনায় সেখানে সামাজিক নিরাপত্তা অধিকতর সন্তোষজনক হলেও শুধু রাজনৈতিক নিরাপত্তাই মানুষকে প্রয়োজনীয় সুখ ও শান্তি দিতে পারে না। তাই ঐ সব দেশে আত্মহত্যার সংখ্যা এত বেশী। মানুষ পেটসর্বস্ব জীব নয় যে, পেটে ভাত থাকলেই তার প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। মানুষ বিবেক প্রধান জীব, তাই তার রুহকে অশান্ত রেখে বস্তুগত দৈহিক প্রয়োজন পূরণ হলেও সে সুখী হয়ে যায় না। তবু ঐ কয়টি রাষ্ট্র যেটুকু করেছে তা অন্যসব দেশের তুলনায় নিঃসন্দেহে মন্দের ভাল।
(২) অপর দিকে সমাজতান্ত্রিক দেশে মানুষের সকল প্রকার আযাদী হরণ করে যে অর্থব্যবস্থা চালু করেছে, তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য সেটা বিবেচ্য। পুঁজিবাদী অর্থনীতি রাজনৈতিক স্বাধীনাতার দোহাই দিয়ে অর্থনেতিক গোলামী কায়েম করে, আর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা অর্থনৈতিক নিরাপত্তার নামে চরম ও স্থায়ী রাজনৈতিক দাসত্বের প্রচলন করে।
আমাদের দেশে কোন ধরনের অর্থব্যবস্থা চালু হওয়া উচিত, সে বিষয়ে ধীর মস্তিস্কে চিন্তা-ভাবনা করে আমরা যদি রাজনৈতিক আযাদী ও অর্থনৈতিক মুক্তি এক সাথে পেতে চাই, তাহলে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রকে বাদ দিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। আমরা গভীর অধ্যয়ন ও তুলনামূলক জ্ঞানের ভিত্তিতে অত্যন্ত বলিষ্ঠ মনোভাব নিয়ে দাবী করছি যে, আল্লাহর কুরআনে ও রসূলের বাস্তব শিক্ষায় আধুনিক যুগের জন্যও একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের যে মজবুত বুনিয়াদ রয়েছে তাই এদেশের অর্থনৈতিক সমস্যার একমাত্র ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান দিতে পারে। ডেনমার্ক ও নরওয়ের মত কয়েকটি দেশের অর্থব্যবস্থা এবং জাপানের কর্মকুশলতা থেকেও আমরা অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা পেতে পারি যা ইসলামী বুনিয়াদের উপর এদেশের উপযোগী কাঠামোতে বাস্তবায়িত করা সম্ভব।
শুধু থিওরী বা মতবাদ দ্বারা বাস্তব সমাধান হয় না। সত্যিকারের সমাধানের জন্য দরদী মনের প্রয়োজন। যাদের অন্তর দেশেরগরীবদের অবস্থা দেখে অস্থির হয় না, বিধবা ও বিবস্ত্র নারীকে কংকালসার ছেলেমেয়েসহ শহরে-বন্দরে ভিক্ষায় ঝুলি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখে যাদের প্রাণ কাঁদে না, স্কুলে পড়ার বয়সের ছেলে-মেয়েদেরকে ইট ভাংগতে ও রাস্তায় কাগজ কুড়াতে দেখে যাদের মনে পিতৃøেহ জাগে না, তারা রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে দেশের দুর্গত মানুষের জন্য যে পর্যন্ত গভীর মমত্ববোধ না জাগবে এবং ব্যক্তিগত ও দলগতভাবে যে পর্যন্ত তারা যথাসাধ্য জনসেবার অভ্যাস না করবে, সে পর্যন্ত জাতির ভাগ্য উন্নয়নের পরিবেশই সৃষ্টি হবে না।
৪. উদ্দেশ্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা ঃ চতুর্থ বড় সমস্য হচ্ছে উদ্দেশ্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা। গতানুগতিক ধারায় শিক্ষার স্রোত চলছে লক্ষ্যহীনভাবে। শিক্ষার প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে বিবেকবান মানুষ গড়া। এরপর লক্ষ্য হওয়া উচিত জাতির প্রয়োজন পূরণের জন্য সুপরিকল্পিত শিক্ষা। আমরা দীর্ঘ কোর্সের ব্যয়বহুল এম, বি, বি, এস ডাক্তার দিয়ে ৯ কোটি মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজন ১৫০ বছরেও পূরণ করতে পারবো না। এর জন্য গ্রামে থাকতে রাযী স্বল্প-মেয়াদী কোর্সের বিরাট চিকিৎসক বাহিনী সৃষ্টি করতে হবে। হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্যে অল্প খরচে এ প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। জাতীয় সম্পদের বিরাট অংশ ব্যয় করে আমরা দামী ইঞ্জিনিয়ার তৈরী করছি। অথচ তাদেরকে কাজ দিতে পারি না বলে তারা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
কিশোর ও যুবকদের হাতকে উৎপাদনের যোগ্য বানাবার জন্য সংক্ষিপ্ত টেকনিক্যাল শিক্ষা ব্যাপক না করায় শিক্ষা দ্বারা বেকারের মিছিলকে বৃদ্ধিই করা হচ্ছে। কি করে দেশের সব হাতে কাজ তুলে দেয়া যায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে দেশের সব নারী-পুরুষকে বিভিন্ন কুটির শিল্পের শিক্ষা দিয়ে উৎপাদনী জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে। আমাদের গরীব দেশের সম্পদ কি করে বাড়ান যায়, সে শিক্ষার জন্য কলেজের মতো দালান, এমনকি হাই স্কুলের মতো ঘর না হলেও চলতে পারে। পশু পালন, হাস-মুরগী বৃদ্ধি, মাছের সস্তা চাষ, ফল-মূল, শাক-সবজি উৎপাদনের জ্ঞান নিরক্ষর লোকদের মধ্যেও বিতরণ করা সম্ভব। শিক্ষা বলতে শুধু স্কুল-কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাই বুঝায় না। একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার জন্য সব নাগরিককে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ব্যাপক গণশিক্ষা প্রয়োজন। গণশিক্ষার জন্য মসজিদ মক্তব ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোই ব্যবহার করা যেতে পারে।
৫ অবহেলিত মহিলা সমাজ ঃ দেশের অন্যতম প্রধান সমস্য মহিলাদের পশ্চাতে পড়ে থাকা। তাদের পিছনে ফেলে রাখা হয়েছে বলেই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। জনশক্তির অর্ধেক মহিলা-কিন্তু জাতীয় প্রাণশক্তির বিচারে মহিলার সমাজের বৃহত্তর সম্পদ। তাদেরকে হয় পুরুষের সেবক, না হয় ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা ইসলামের অনুসারী তারাও নারীকে ঐ মর্যাদা ও অধিকার দিচ্ছে না যা কুরআন-হাদীসে তাদের প্রাপ্য বলে ঘোষনা রয়েছে। ইসলামের নামে শুধু কর্তব্যটুকুই তাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে। মোহরের অধিকার, উত্তরাধিকারের অধিকার, খোলা তালাকের অধিকার, স্বামীর অবহেলা-অবিচারের ইত্যাদি ভোগ করার সুযোগ তাদের কোথায় ? নারীর উপযোগী শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় মহিলা সমাজ জাতির অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে আছ। অথচ তারা জাতীয় উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখতে পারে।
অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, নারীর মর্যাদা ও অধিকারের নামে তাদেরকে পুরুষের সাথে একই কর্মক্ষেত্রে নিক্ষেপ করে সমাজের নৈতিক কাঠামো ও পারিবারিক পবিত্রতা ধ্বংস করা হচ্ছে। অথচ অবহেলিত গ্রাম্য মহিলাদেরকেও নারীদের উপযোগী প্রাথমিক চিকিৎসা, ধাত্রী-বিদ্যা, কুটির শিল্প, পশু পালন, ফল-মূল তরি-তরকারি উৎপাদন ইত্যাদি শিক্ষা দিয়ে জাতির উন্নতির সহায়ক বানান যায়। দেশের শিশু শিক্ষার দায়িত্ব মায়েদের হাতে তুলে দেবার জন্য তাদের উপযোগী বিশেষ শিক্ষা না নিয়ে পুরুষের সাথে বসিয়ে একই ধরনের বিদ্যা শেখাবার অপচেষ্টা চলছে। সমাজের বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে নারীকে তার দৈহিক যোগ্যতা ও মানসিক বৈশিষ্ট্যের উপযোগী কাজে লাগিয়ে সমাজের গাড়ী সচল করা অপরিহার্য। নারী ও পুরুষ এ গাড়ীর দু‘টো চাকা। এদের অবস্থান একত্র নয়, নিজ নিজ স্থানে তাদের কাজে লাগাতে হবে। তবেই সমাজের গাড়ী সন্তোষজনকভাবে চলতে পারে।
নারীর সর্বাপেক্ষা পবিত্র ও গুরুত্বপুর্ণ কাজ হলো মায়ের দায়িত্ব পালন। মানব শিশুর মধ্যে মানবিক মহৎ গুণাবলী প্রধানত মায়ের কাছ থেকেই অর্জন করা সম্ভব। এর জন্য মাতৃজাতিকে শিক্ষ দেবার কোন ব্যবস্থা কি দেশে আছে ? পরিবার পরিচালনা ও সংরক্ষণের দায়িত্বও নারীরই উপর ন্যস্ত। অথচ এ উদ্দেশ্যে তাদেরকে গড়ে তুলবার ব্যবস্থাও নেই। স্বামী রোযগার করে পরিবার চালাবার জন্য উপযুক্ত স্ত্রীর হাতে টাকা তুলে দিলেই পারিবারিক ব্যবস্থা সুন্দরভাবে চলতে পারে। মা ও স্ত্রীর এ দু'টো দায়িত্বকে অবহেলা করে নারী জাতির উন্নতির নামে পুরুষের করণীয় কাজে তাদেরকে নিয়োগ করা নারীত্বের চরম অবমানা। ঐ দু'টো দায়িত্বের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেবার পরও সমাজ গঠন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজনে নারীর উপযোগী বহু কাজ রয়েছে যা নারীদের পক্ষেই অধিকতর যোগ্যতার সাথে করা সহজ। প্রাথমিক শিক্ষা, নারী চিকিৎসা, হস্তশিল্প এবং যেসব শিল্পে দৈহিক শক্তির প্রয়োজন হয় না, সে সব ক্ষেত্রে নারীসমাজ যতটা খেদমত করতে পারে তার পূর্ণ সুযোগ অবশ্যই তাদেরকে দিতে হবে যাতে জাতি দ্রুত উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে।
পাঁচটি বড় বড় সমস্যা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে চিন্তার বিশেষ একটি ধারা সৃষ্টি এখানে উদ্দেশ্য। এ সমস্যাগলোর সমাধান একটি কথা দ্বারাই হয়ে যাবে না। আর সমস্যাগুলো একটি থেকে অন্যটি বিচ্ছিন্নও নয়। একই দেহে অনেক রোগের বিভিন্ন উপসর্গ দেখে প্রত্যেক রোগের পৃথক পৃথক চিকিৎসা যেমন অবাস্তব, তেমটি দেশের এসব সমস্যাকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা না করে সত্যিকারভাবে সমাধান করা অসম্ভব। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নৈতিক উন্নয়ন, ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থ, উপযুক্ত শিক্ষাব্যবসস্থা, মহিলাদেরকে জাতির উপযুক্ত খেদমতের যোগ্য বানান ইত্যাদি একই মহাপরিকল্পানা বিভিন্ন অংশ হবে। কোন একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তি ব্যতীত এ ধরনের সঠিক পরিকল্পনা অসম্ভব। আমরা এ উদ্দেশ্যেই ইসলামকে আদর্শ হিসেবে বেছে নিয়েছি।
(বাংলাদেশ ও জামায়েত ইসলামী)

বাংলাদেশ কি সত্যি দরিদ্র ?
হিমালয়ান উপমহাদেশের সব কয়টি দেশই এক সময় ইংরেজ শাসনের অধীন ছিল। বর্তমানে সেখানে ছোট বড় অনেক কয়টি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম আছে। বাংলাদেশ, বার্মা, ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ নামে যে এলাকাটি এখন পরিচিত তাকে এককালে অখন্ড বৃটিশ ভারতের আমলে ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলিত রাখা হয়েছিল। ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত কোলকাতা মহানগরীকে কেন্দ্র করে শিল্প কারখানা ও ব্যবসা বাণিজ্য চাল করে সেকালের পূর্ব বংগকে এর বাজারে পরিণত করা হয়। আর পূর্ব বংগের কৃষিজাত উৎপন্ন দ্রব্য এবং চাল, মাছ, দুধ, ডিম ও মুরগী দ্বারাই ঐ এলাকার পুষ্টি সাধিত হতো।
ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের ফলে পূর্ব বংগের উন্নয়নের প্রয়োজনেই ১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব বংগ ও আসামকে নিয়ে একটি আলাদা প্রদেশ গঠন করা হয়। কিন্তু কোলকাতা ভিত্তিক কায়েমী স্বার্থ অখন্ড বাংগালী জাতীয়তার শ্লোগান তুলে ১৯১১ সালে নতুন প্রদেশটি বাতিল করাতে সক্ষম হয়। ফলে কোলকাতার শোষণ আবার বহাল হয় এবং পূর্ব বংগের উন্নয়ন মুলতবী হয়ে যায়।
১৯৪৭ সালে ঢাকায় পূর্ব বংগের রাজধানী স্থাপিত হবার পর এ এলাকার উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের সাথে পূর্ব বংগ একটি প্রদেশ হিসেবে এক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এ এলাকার উন্নয়ন মোটামুটি এগিয়ে চলছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে পূর্ব বংগের নেতৃত্ব দুর্বল থাকায় এ এলাকার উন্নয়ন আশানুরূপ গতিতে অগ্রসর হতে পারেনি। কেন্দ্রীয় রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে থাকায়, সশস্ত্র বাহিনীতে পূর্ব বংগের কোন উল্লেখযোগ্য স্থান না থাকায় এবং কেন্দ্রীয় সরকারের উপর সামরিক শক্তির প্রাধান্য সৃষ্টি হওয়ায় পূর্ব বংগের নেতৃত্ব প্রভাবহীন হয়ে পড়ে। এত কিছু সত্ত্বেও ২৫ বছরের মধ্যে পূর্ব বংগ শিল্প বাণিজ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যে পরিমাণ উন্নতি করেছিল তাতে উপমহাদেশের অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় খুব বেশী পেছনে পড়ে থাকেনি। বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে চালু হবার পর কতক অনিবার্য কারণে সাময়িকভাবে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয় তার দরুন বাংলাদেশকে দুনিয়ার দরিদ্রতম দেশসমূহের মধ্যে গণ্য করার কোন সংগত যুক্তি নেই।
বাংলাদেশ একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে কায়েম হবার পর সরকারী ক্ষমতার অধিকারীরা যদি একটু সততার পরিচয় দিতে পারতেন এবং সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদী বিভিন্ন শক্তি যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করত তাহলে এদেশ এতটা দুরবস্থায় পতিত হতো না। স্বাধীনতা আন্দোলনে শরীফ হবার অজুহাতে অনেকেই অন্যায় সুযোগ সুবিধা ভোগ করার অপচেষ্টা করায় দুর্দমা আরও বেড়ে যায়। বহু রকমের দেশী ও বিদেশী স্বার্থের বাহকরা এমন সব তৎপরতা চালায় যার ফলে সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থাও কায়েম হতে পারেনি।
এত কিছু সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের মোটামুটি ধারণা যদি কারো থাকে তাহলে কেউ এদেশকে গরীব বলে মন্তব্য করতে পারবে না। দেশের খনিজ, কৃষিজ ও বনজ সম্পদ এবং পানি ও মৎস্য সম্পদ সম্পর্কে এদেশেরই অনেকের কোন ধারণা নেই। এখানে এর বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। কিন্তু যতটুকু জানার সুযোগ পেয়েছি তাতে বাংলাদেশের যত গরীব মনে করা হয় প্রকৃতপ্েক্ষ যে তত গরীব নয় তা জোর দিয়েই বলতে পারি। (আমার দেশ বাংলাদেশ)

বাংলাদেশের আসল অভাব*
দুনিয়ার বহুদেশ দেখার সুযোগ পাওয়ার বিভিন্ন দেশের মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা জন্মেছে। এর ফলে বাংলাদেশীদের।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কালাম আযাদের লেখা ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ বইটি থেকে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।
সাথে অন্যদের তুলনা করে মতামত প্রকাশ করা সম্ভব। দোষে গুণেই মানুষ। আমার দেশের মানুষের স্বভাবগত গুণগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে বেশ উৎসাহ বোধ করি। যেমন বুদ্ধিবৃত্তি, বোধশক্তি, বাচনশক্তি, স্মরণশক্তি ইত্যাদির বিচারে এদেশের লোক কোন দেশের পেছনে মনে হয় না। উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ পেলে এদেশের লোক সব কাজেই যোগ্যতার প্রমাণ দিতে সক্ষম।
এদেশের আয়তন ছোট হলেও বিরাট জনসংখ্যার এদেশকে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের মর্যাদা দিয়েছে। মুসলিম জনসংখ্যার দিক দিয়ে এদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। বর্তমানে এদেশের লোক মধ্যপ্রাচ্য ও ইংল্যান্ডে কর্মরত রয়েছে। অন্যান্য অনেক দেশেও এদেশের লোক জীবিকার সন্ধানে পৌঁছে গেছে। কর্মদক্ষতার দিক দিয়ে তারা কোথাও অযোগ্য প্রমাণিত হচ্ছে না। এদেশের জনশক্তিকে প্রয়োজনীয় কারিগরী শিক্ষা দিলে দেশের জন্য বিরাট সম্পদ ও গৌরভ অর্জন করে আনতে সক্ষম হবে।
এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ যে পরিমাণ আছে তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে এক-চতুর্থাংশ জনশক্তির কর্মসংস্থান হতে পারে। আধুনিক কৃষি পদ্ধতি অবলম্বন করে বর্তমান চাষযোগ্য জমিতেই দ্বিগুণ ফসল ফলান সম্ভব।
এসব দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশকে দুনিয়ার সবচেয়ে গরীব দেশগুলোর তালিকায় গণনা করা মোটেই ঠিক নয়। তাহলে ‘তলাহীন ঝুড়ি’ হিসেবে যে বাংলাদেশের দুর্ণাম সারা দুনিয়ার ছড়িয়ে গেল তার আসল কারণ কী ? অভাব আমাদের অবশ্যই আছে। দক্ষ জনশক্তির অভাব, প্রয়োজন পরিমাণ খাদ্যের অভাব, চিকিৎসার অভাব ইত্যাদি অসত্য নয়। কিন্তু এসব অভাবের আসল কারণ একটা মৌলিক জিনিসের অভাব। সে জিনিসটিই মানব সমাজের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান। এর নাম হলো ‘চরিত্র’। চরিত্র এমন এক ব্যাপক অর্থবোধক মানবিক গুণ যা প্রত্যেক মানব সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। চরিত্রের মর্মকথা হলো মানব সুলভ আচরণ। ভাল ও মন্দের সার্বজনীন একটা ধারণা মানাব সমাজে চিরকাল বিরাজ করছে। ঐ ধারণা অনুযায়ী যদি কেউ মানুষের সাথে ব্যবহার করে তাহলে সবাই তাকে চরিত্রবান বলে স্বীকার করে।
টাকা পয়সার লেনদেনের ব্যাপারে ওয়াদা রক্ষা করার যে একটি চারিত্রিক গুণ তা সবাই মানবে বাধ্য। যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে অন্যের সাথে ওয়াদা ভংগ না করে। এতেই প্রমাণিত হয় যে, চরিত্র ঐ সব আচরণেরই সামষ্টিক নাম যেসব আচরণ প্রত্যেক মানুষ অন্যের কাছ থেকে পেলে খুশী হয় এবং না পেলে ব্যথিত হয়।
একটি উদাহরণ থেকে বিষয়টা আরো সহজে বুঝা যাবে। আজকাল একথা সবারই মুখে শুনা যায় যে, এদেশে ঘুষ না দিলে কোথাও কোন ন্যায্য অধিকারও পাওয়া যায় না। টাকা দিলে যে কোন অন্যায় দাবীও আদায় করা যায়। যে ঘুষ খায় সে যখন নিজের কাজের জন্য কোথাও ঘুষ দিতে বাধ্য হয় তখন তার মনেও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তাহলে বুঝা গেল যে, ঘুষ নেয়ার কাজটাকে সে-ও ভাল কাজ বলে বিশ্বাস করতে পারছে না। সুতরাং যে ঘুষ খায় সে অবশ্যই চরিত্রহীন।
আরও একটা উদাহরণ দিচ্ছি। গাড়ির লাইসেন্স ও ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ী চালাবার উপায় নেই। যে সরকারী অফিস থেকে লাইসেন্স নিতে হয় সেখানে দিনের পর দিন ঘুরাফিরা করেও লাইসেন্স না পাওয়া গেলে মনের অবস্থাটা কিরূপ হতে পারে ? আপনি ঘুষ দিচ্ছেন না বলেই এরকম ঘুরতে হচ্ছে। লাইসেন্স ইস্যু করার দায়িত্বশীলরা কর্তব্যে অবহেলা করার ফলে আপনার কত মূল্যবান সময় নষ্ট হলো ? এ দায়িত্বশীল ব্যক্তিই নিজের কোন কাজে অন্য কোন অপিসে এ রকম ভোগান্তির শিকার হলে তিনি কি খুশী হবেন ?
এসব উদাহরণ থেকেই দেশের অবস্থাটা আঁচ করা যায়। বাংলাদেশে এখন সবাই সবাইকে ঠকাবার চেষ্টায় কর্মতৎপর। তাই আমরা সবাই কেবল ঠকেই চলেছি। সবার বহু মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘুষ খেয়ে যে টাকা নিচ্ছে তা অন্যদেরকে ঘুষ দিতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে সবাই বিবেকের নিকট দোষী হ্ওয়া ছাড়া এবং অশান্তি কামাই করা ছাড়া আর কী পেলাম ?
কর্তব্যে অবহেলা, ইচ্ছাকৃত কাজ না করা সেবার পরিবর্তে শোষণ করা, মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিতকরা। অন্যায় স্বার্থ হাসিল না হলে দায়িত্ব পালন না করা ইত্যাদি অগণিত উপায়ে আমার চরিত্রহীনতার পরিচয় দিচ্ছি। ফলে আমাদের প্রতিভা,মেধা, বুদ্ধি ্ও যোগ্যতার নিজ হাতে বিনষ্ট করে দেশকে অধঃপতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছি।
তাই বস্তুগত সম্পদের অভাব,নৈতিকতার অভাব, মনুষ্যত্বের অভাব। এঅভাব দূর না হলে দুনিয়ার যত সম্পদই ভিক্ষা ্ও ঋণ হিসেবে আমরা পাচ্ছি তা দ্বারা আমাদের দারিদ্র কখনও দূর হবে না। যে পাত্রের তলা নেই দুনিয়ার সম্পদ দিয়েও তা পূর্ণ করা সম্ভব নয়। আমরা তাই তলাহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়েছি। চরিত্রের অভাব দূর করতে না পারলে আমাদের দশা আরও খারাপ হতে বাধ্য।
জাতিকে চরিত্রবান করে গড়ে তুলতে হলে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব চরিত্রবান লোকদের হাতে তুলে দিতে হবে। চরিত্রবাল লোক আকাশ থেকে নাযিল হবে না। বিদেশ থেকেও তা আমদানী করার জিনিস নয়। সাংগঠনিক পদ্ধতিতে চরিত্র গঠনের আন্দোলনের মাধ্যমে চরিত্রবান একদল লোক জনগণের নিকট তাদের কর্মতৎপরতার দ্বারা পরিচিত হলে জনগণ তাদের নেতৃত্বে আস্থা স্থাপন করবে। গণ সমর্থন নিয়ে এমন একদল চরিত্রবান লোক দেশের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ করতে পারলেই এদেশের উজ্জল ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা পাওয়া যেতে পারে।
চরিত্রের কোন বিকল্প নেই। দুনিয়ার অন্য কোন দেশের অবস্থা চরিত্রের দিক দিয়ে এতটা দুর্বল কিনা আমার জানা নেই। চরিত্রের নিুতম মান ছাড়া কোন জাতিই উন্নতি করতে পারে না।
বাংলাদেশের অবস্থা এ দিক দিয়ে এত করুণ যে, এদেশের চরিত্রবান লোকের অতি সত্ত্বর সুসংগঠিত না হলে কোটি কোটি মানুষের ভাগ্যে কি আছে আল্লাহই জানেন। (আমার দেশ বাংলাদেশ)
বাংলাদেশ ও ইসলাম
১৯৭১ সালে দুনিয়ার মানচিত্রে যে ভূখন্ডটি বাংলাদেশ নামে পরিচিত লাভ করেছে, সে এলাকাটিতে অতি প্রাচীনকাল থেকেই জনবসতি ছিল। এখানে দ্বীন ইসলামের আলো নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পথেই প্রথমে বিস্তার লাভ করে। এর ফরশ্র“তি স্বরূপ মুসলিমদের হাতে রানৈতিক প্রাধান্য আসে। এ জন্যই এ এলাকায় মুসলিমদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। শুধু রাজনৈতিক শক্তির বলে এদেশে মুসলিম শাসন কায়েম হয়নি।
দিল্লিতে শত শত বছর মুসলিম শাসকদের রাজধানী থাকা সত্ত্বেও চারপাশে বহুদূর পর্যন্ত মুসলমানদের সংখ্যা সবসময়ই কম ছিল। কিন্তু বাংলার মাটিতে মুসলিম শাসন শুরু সংখ্যা সবসময়ই কম ছিল। কিন্তু বাংলার মাটিতে মুসলিম শাসন শুরু হবার পূর্বেই বিপুল সংখ্যক স্থানীয় জনতা মুসলমান হয়। ইসলাম প্রচারক আরব বণিকদের প্রচেষ্টায় চাঁটগা দিয়ে এ এলাকায় ইসলামের আলো পৌঁছে। স্থানীয় অধিবাসীরা ব্যবসায়ে লেন-দেনের সাথে সাথে তাদের নিকট মানবিক অধিকার ও মর্যাদার সন্ধান পেয়ে মুসলিম হওয়া শুরু করেছিল। এমন উর্বর জমির খোঁজ পেয়ে ইসলামের আলো নিয়ে বহু নিঃস্বার্থে মুবাল্লিগ এদেশে আগমন করেন। এভাবে নদী-খিলজি ১২০১ সালে মাত্র ১৭ জন অগ্রগামী আশ্বারোহী সেনা নিয়ে গৌড়ে আগমন করলে গৌড়ের রাজা লক্ষণ সেন বিনা যুদ্ধে পালায়ন করেন এবং বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা হয়। বাংলার সাথে সাথে আসামের দিকেও যখন মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে লাগলো, তখন বর্তমান সিলেট অঞ্চলের রাজা গৌর গোবিন্দের মুসলিম বিরোধী চক্রান্তকে খতম করার জন্য হযরত শাহজালাল ইয়ামনী (রঃ) ৩৬০ জন মুজাহিদ নিয়ে এদেশে আসেন।
সুতরাং ইতিহাস থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, শাসকের ধর্ম হিসেবে এ এলাকায় মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেনি। বরং ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এবং মানুষের মত ইজ্জত নিয়ে বাঁচার তাকীদেই তারা মুসলমান হয়। এ কারণেই এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ এত বেশী ইসলাম পরায়ণ। ধর্মের নামে শাসকদের অধর্মের ফলে বর্তমানে যুব শ্রেণীর একাংশে যে ধর্ম-বিরোধী তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা সাময়িক এবং তার বিপরিত প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে। (বাংলাদেশ ও জামায়েত ইসলামী)

বাংলাদেশে ইসলামী শক্তির মযবুত ভিত্তি
আগেই বলা হয়েছে ইসলাম নিজস্ব গতিতে প্রথম যুগেই আরব ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সমুদ্রপথে এদেশে পৌঁছে। এরপর যুগে যুগে মুবাল্লিগ, ওলী ওদরবেশগণের আদর্শ জীবন এদেশের জনগণকে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। রাজ্য বিজয়ীদের চেষ্টায় এদেশে ইসলাম আসেনি বরং ইসলামের প্রসারের ফলেই এখানে মুসলিম শাসনের পত্তন হয়।
একথা সত্য যে, দ্বীন ইসলামের সঠিক ও ব্যাপক জ্ঞানের অভাবে এ দেশের মুসলমানদের মধ্যে তাদের অমুসলিম পূর্ব-পুরুষদের অনেক কুসংস্কার, ভন্ড পরীর ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের চালু করা র্শিক-বিদায়াত, প্রতিবেশী অন্যান্য ধর্মের কতক পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি বিভিন্নরূপে কম-বেশী চালু রয়েছে। কিন্তু এদেশের অশিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যেও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, নবীর প্রতি মুহাব্বত এবং মুসলিম হিসেবে জাতীয় চেতনাবোধ এমন প্রবল রয়েছে যে, সকল রাজেনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্যেও কোন কালেই তা হারিয়ে যায়নি। বাংলাদেশ আন্দোলনের রাজনৈতিক তুপানে মুসলিম জাতীয়তাবোধ খতম হয়ে গেছে বলে সাময়িকভাবে ধারণা সৃষ্টি হলেও এদেশের মুসলিম জনতা এর পরপরই ঐ চেতনার বলিষ্ঠ পরিচয় দিয়েছে।
একথা যুগে যুগে প্রমাণিত হয়েছে যে, এদেশের জনগণ মনস্তাত্ত্বিক দিকে দিয়ে ভাবপ্রবণ হবার ফলে কখনও কখনও রাজনৈতিক গোলকধাঁধায় সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হতে পারে বা ভুল করতে পারে। কিন্তু সচেতনভাবে কখনও ইসলামী চেতনাবোধ ও মুসলিম জাতীয়তাবাদের মহাপ্লাবন এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সরকারী অপচেষ্টা এদেশের মুসলিম জাতীয়তাবোধের নিকট যেভাবে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছে, তা বাংলাদেশে ইসলামী শক্তির মযবুত ভিত্তির সুস্পষ্ট সন্ধান দেয়।
বাংলাদেশ এখন আর বাঙালী জাতীয়তাবাদী দেশ নয়। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে গৌরব বোধ করে। বাংলাদেশ ইসলামী সেক্রেটারীয়েটের মতো ‘বিশ্ব মুসলিম রাষ্ট্র সংঘের’ উল্লেখযোগ্য সদস্য হিসেবে প্রত্যেক ইসলামী পররাষ্ট্র সম্মেলনে উৎসাহের সাথে যোগদান করে। বাংলাদেশের মাসনতন্ত্রের কলংক স্বরূপ রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের’ উল্লেখ ছিল দেশবাসীর ইসলামী চেতনাবোধ তা বরদাশত করেনি। সুতরাং বাংলাদেশের ইসলামী শক্তির ভিত্তি অত্যন্ত মযবুত। (বাংলাদেশ ও জামায়াতে ইসলামী)

বাংলাদেশ ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক
আল্লাহ পাকই সমস্ত পৃথিবীর স্রষ্টা। আমরা তার দাসত্ব কবুল করে মুস-লিম (অনুগত) হিসেবে পরিচয় দিতে গৌরব বোধ করি। মুসলিমের দৃষ্টিতে আল্লাহর গোটা দুনিয়াই তাঁর বাসভূমি। কিন্তু আমাদের মহান স্রষ্টা যে দেশে আমাদেরকে পয়দা করলেন, সে দেশের সাথে স্বাভাবিক কারণেই আমরা বিশেষ দরনের এক গভীর সম্পর্ক অনুভব করি। কারণ আমরা ইচ্ছে করে এদেশে পয়দা হইনি। আমাদের দয়াময় প্রভু নিজের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এদেশে পয়দা করেছেন। তাই আমাদের স্রষ্টা আমাদেরকে এদেশে পয়দা করাই যখন পছন্দ করেছেন, তখন এদেশের প্রতি আমাদের মহব্বত অন্য সব দেশ থেকে বেশী হওয়াই স্বাভাবিক।
মানুষ যে দেশের আবহাওয়ায় শৈশব থেকে যৌবন কাল পর্যন্ত পড়ে ওঠে, সে দেশের প্রকৃতির সাথে তার গভীর আত্মিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। শিশু অবচেতনভাবেই যেমন তার-মাকে ভালবাসে, তেমনি জন্মভূমির ভালবাসাও মানব মনে স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি হয়। তাই জন্মভূমিতেই মানুষ ঘধঃঁৎবধষ ঈরঃরুবহ (জন্মসূত্রে নাগরিক) হিসেবে গণ্য হয়। জন্মগত নাগরিকের দেশপ্রেম স্বভাবজাত বলে এটা প্রমাণ করার কোন প্রয়োজন ছাড়াই তাকে নাগরিক বলে স্বীকার করা হয়। কিন্তু এক দেশের অধিবাসী অন্য দেশে গিয়ে তার দেশ প্রেমের প্রমাণ না দেয়া পর্যন্ত তাকে নাগরিক গণ্য করা হয় না।
যারা এদেশেই পয়দা হয়েছে, তাদের সবার মধ্যেই দেশপ্রেম প্রকৃতিগতভাবেই আছে। এ দেশপ্রেমকে সঠিকভাবে বিকশিত করা ও সচেতনভাবে জাগ্রত করার অভাবে মানুষে মানুষে এর গভীরতার পার্থক্য হতে পারে। তাই সব দেশেই নাগরিকদের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করার প্রচেষ্ট চলে। দেশপ্রেমের এ চেতনা প্রকৃত মুসলিম জীবনে অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আল্লাহ তাকে যে দেশে পয়দা করেছেন, সে দেশের প্রতি গভীর কর্তব্যবোধ অন্যের চেয়ে সচেতন মুসলিমের মধ্যে বেশী হওয়াই উচিত। প্রত্যেক নবী যে দেশে পয়দা হয়েছেন, সে দেশেই তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। বাধ্য না হলে কোন নবীই দেশ ত্যাগ করেননি।
এসব অকাট্য যুক্তির ভিত্তিতে আমাদের জন্মভূমি হিসেবে বাংলাদেশের সাথে আমাদের গভীর ভালবাসার সম্পর্ক অত্যন্ত সজাগ ও সতেজ থাকতে হবে। আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীন কায়েম করাই আমাদের পার্থিব প্রধান কর্তব্য। এ কর্তব্য পালনের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত যমীন হলো জন্মভূমি। জন্মভূমিতে এ কর্তব্য পালন করা সম্পূর্ণ অসম্ভব বলে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত অন্য দেশে হিযরত করাও জায়েয নয়। নবীগণও আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত হিযরত করেননি। হযত ইউনুস (আঃ) নির্দেশের পূর্বেই হিযরহ করায় আল্লাহ পাক তাঁর ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু সত্যিকার মুসলিমের বালবাসা তার জন্মভূমির ক্ষুদ্র এলাকায় এমন সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না যে, অন্যান্য দেশকে সে ঘৃণা করবে। আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করাই তার পার্থিব জীবনের প্রধানতম কর্তব্য। এ কর্তব্যের তাকীদে তার জন্মভূমিতে দ্বীন কায়েম করার সাথে সাথে গোটা মানব সমাজে ইসলামের শান্তিময় জীবন বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতে হবে। এ দায়িত্ববোধ তাকে শুধু দেশপ্রেমিক হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে দেয় না - তাকে বিশ্বপ্রেমিক হতে বাধ্য করে। আল্লাহর রাসূলই মুসলিম জীবনের শ্রেষ্ঠ আদর্শ। বিশ্বনবীর জীবনে আমরা দেশপ্রেমের যে নমুনা দেখতে পাই তা আমাদের চিরন্তন দিশারী। তিনি তার প্রিয় জন্মভূমিতে আল্লাহর রচিত জীবন বিধান কায়েমের চেষ্ট করে চরম বিরোধিতার ফলে আল্লাহর নির্দেশে তিনি মদীনায় হিজরত করেন এবং সেখান থেকে দ্বীনের জিবয়কে সম্প্রসারিত করে আবার জন্মভূমিতেই তা কায়েম করেন। তিনি “ইকামাতে দ্বীনের” এ দায়িত্ববোধ সমস্ত মুসলিমের মধ্যে এমন তীব্রভাবে জাগ্রত করেন যার ফলে তাঁর অনুসারীগণ সারা দুনিয়ার ইসলামের দাওয়াত নিয়ে ছড়িয়ে পড়েন।
(বাংলাদেশ ও জামায়াতে ইসলামী)

বাংলাদেশের জনগণের সাথে আমাদের সম্পর্ক
এক মায়ের সন্তানদের মধ্যে যেমন একটা বিশেষ ভ্রাতৃত্ববোধ জন্ম নেয়, তেমনি এক দেশে জন্মলাভের দরুনও দেশবাসীর মধ্যে পারস্পারিক একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে একই ভৌগোলিক এলাকার অধিবাসী বিদেশে একে অপরকে ভাইয়ের মতো আপন মনে করে। ভাসার ঐক্য তাদেরকে আরও আপন করে নেয়। এর সাথে ধর্মের ঐক্য থাকলে এ সম্পর্ক আরও গভীর হয়। ভাষা, ধর্ম বর্ণ ইত্যাদি মিলে এক দেশের অধিবাসীরা অন্য দেশের মানুষ থেকে ভিন্নতর এক ঐক্যবোধ নিজেদের মধ্যে অনুভব করে। মা-কে কেন্দ্র করে যেমন পারিবারিক ভ্রাতৃত্ব পড়ে উঠে, তেমনি জন্মভূমিকে কেন্দ্র করে দেশভিত্তিক জাতীয়তাবোধ জন্মে। তাই নিজ দেশের সকল মানুষই অন্য দেশের মানুষের তুলনায় অধিকতর আপন মনে হয়।
বাংলাদেশ মুসলিম, হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ ও উপজাতীয় প্রায় দশ* কোটি লোক বসবাস করে। বাংলাদেশী হিসেবে সবার সাথেই আমাদের ভালবাসার সম্পর্ক থাকতে হবে। আমাদের দেশের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় আমরা সমান অংশীদার। ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাংলাদেশী আমাদের ভাই-বোন।
সবার কল্যাণের সাতেই আমাদের মঙ্গল জড়িত। এদেশে আমরা যে আদর্শ কায়েম করতে চাই এর আহবান সবার নিকটই পৌঁছাতে হবে। আমাদের সবারই স্রষ্টা আল্লাহ। তাঁর দেয়া আদর্শ অমুসলিমদের মধ্যে পৌঁছান আমাদেরই কর্তব্য। আল্লাহর সৃষ্ট সূর্য, চন্দ্র, আলো, বাতাস ইত্যাদি আমরা বেগম সমভাবে ভোগ করছি আল্লাহর দ্বীনের মহা নিয়ামতও আমাদের সবার প্রাপ্য। বংশগতভাবে মুসলিম হবার দাবীদার হওয়ায় দরুন আল্লাহর দ্বীনকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নিজস্ব সম্পদ মনে করা উচিত নয়। অমুসলিম ভাইদেরও যে তাদের স্বার্থেই দ্বীন ইসলামকে জানা প্রয়োজন এবং গ্রহণযোগ্য কিনা বিবেচনা করা কর্তব্য সে বিষয়ে আমাদের দেশীয় ভাই হিসেবে তাদেরকে মহব্বতের সাথে একথা বুঝানো আমাদের বিরাট দায়িত্ব ও দ্বীনী কর্তব্য।
আমাদের আদি পিতা আদম (আঃ) ও আদি মাতা হাওয়া (আঃ)-এর সন্তান হিসেবে তো সকল মানুষই সবার ভাই-বোন। গোটা মানব জাতিকেই সে হিসেবে ভালবাসা কর্তব্য। বিশ্ব নবী মানবতার ভালবাসাই বাস্তবে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। কিন্তু নিজের দেশের অধিবাসী হিসেবে বাংলাদেশের অমুসলিগণ বিশেষভাবে আমাদের ভালবাসার পাত্র।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষে মানুষে কৃত্রিম কোন বিভেদ সৃষ্টি করা মহা অন্যায়। ভাষা, বর্ণ, দেশ, পেশা, ধনী বা গরীব হওয়া ইত্যাদির ভিত্তিতে মানুষে মানুষে শ্রেণীভেদ সৃষ্টি করা আল্লাহর নিকট মহাপাপ। আল্লাহ পাক মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক কারণেই দু'টো শ্রেণীকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কুরআন পাকে বহুস্থানে তাদের পরিচয় পাশাপাশি সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরেছেন। একটি শ্রেণী হলো আল্লাহর দাস, রাসূলের অনুসারী সচ্চরিত্র, ন্যায়পরায়ণ এবং মানবীয় সৎগ্রণাবলীর অধিকারী, অপরটি হলো নাফস্ (প্রবৃ্িত্ত) ও শয়তানের দাস এবং খোদাদ্রোহী ও জালিম। এ উভয় শ্রেণীর মধ্যে সব ভাষা, বর্ণ, দেশ ও পেশার আদম সন্তানই রয়েছে। দুনিয়ার সব ভাল মানুষ এক শ্রেণীর আর দুষ্টরা ভিন্ন শ্রেণীর সে হিসেবে বাংলাদেশেও সৎলোকগণ আমাদের বেশী আপন বটে, কিন্তু অন্যদেরকে ঘৃণা করাও নিষেধ। তাদেরকে সংশোধনের চেষ্টা করাও আমাদের কর্তব্য।
এক হিসেবে সমস্ত মানুষই বিশ্বনবীর উম্মত। নবীর উপর যে জনপদের মানুষের নিকট দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছাবার দায়িত্ব অর্পিত হয়, সে এলাকার সব মানুষেই নবীর উম্মত। তাই সমস্ত মানুষই বিশ্বনবীর উম্মত। কিন্তু উম্মত হলেও তারা দু'শ্রেণীতে বিভক্ত। যারা নবীর দাওয়াত কবুল করে তাঁর অনুসারী হয়, তারা “উম্মত বিল ইজাবাত” (যারা দাওয়াতে সাড়া দিয়েছে) আর বাকী সবাই “উম্মত বিদ-দাওয়াত” (যাদের নিকট দাওয়াত পৌঁছাতে হবে)। বাংলাদেশের অমুসলিমদের “উম্মত বিদ-দাওয়াত” বিবেচনা করে আমাদেরকে তাদের প্রতি কর্তব্য পালন করতে হবে।
সুতরাং বাংলাদেশের সব মানুষকেই আমরা আল্লাহর মহান সৃষ্টি হিসেবে স্বাভাবিকভাবে ভালবাসবো। এ ভালবাসা শুধু তাদেরকে দ্বীন ও ঈমানের দিকে আনার জন্যই নয়। এদেশের মানুষ এত অভাবী যে, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার উপযোগী সম্বলও অর্ধেক লোকের নেই। পুষ্টির অভাবে অর্ধেকের বেশী শিশু এবং বয়স্ক লোক দিন দিন দুর্বল হচ্ছে। সুচিকিৎসার সুযোগ অধিকাংশেরই নেই। মাথা গুঁজবার মতো একটু নিজস্ব ঠাঁই শতকরা ২৫ জনেরই নেই। শিক্ষার আলো অতি সীমিত। যে দেশের অর্ধেক লোক ভাত-কাপড়ের অভাবে জীর্ণ, সে দেশের অধিবাসী হয়ে আমাদের মনে যদি তীব্র বেদনাবোধ না জাগে, তাহলে রাসূলের প্রতি আমাদের মহব্বতের দাবী অর্থহীন। এদেশের মানুষকে বস্তুগত ও নৈতিক উভয় দিক থেকেই উন্নত করতে হবে। হাদীসে আছে, দারিদ্র মানুষকে কুফরীর দিকে নিয়ে যায়। অবশ্য অর্থও অনর্থের মূল বটে, কিন্তু মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা না হরে ঈমান বাঁবে কি করে ?
ধর্ম ও ভাষা নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য এ মমত্ববোধ ও দরদ না থাকলে আল্লাহর নবীর আদর্শের খেদমত কখনও সম্ভবপর নয়। জনগণের জন্য এ দরদী মনেরই দেশে সবচেয়ে বড় অভাব। জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের মধ্যেও যদি এ অভাব থাকে, তাহলে আর যাই হোক জনগণের খেদমত করার সত্যিকার যোগ্যতা আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হবে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সম্পর্ক
বাংলাদেশ যারা রাজনীতি করেন, তাদের সবাইকে আমরা এ কারণেই শ্রদ্ধা করি যে, তার্ওা দেশ সম্পর্কে চিন্তাÑভাবনা করেন, দেশকে উন্নত করতে চান, দেশের সমস্যাগুলোর সমাধানে আগ্রহী এবং জনগণের কল্যাণকামী। তারা শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত নন, গোটা দেশের ভাল-মন্দ সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখেন। এ ধরনের লোকদের সঠিক প্রচেষ্টায়ই একটি দেশ সত্যিকার উন্নতি লাভ করতে পার। যারা দেশ গড়ার চিন্তাই করে না, যারা কেবল আত্ম-প্রতিষ্ঠায়ই ব্যস্ত, তারা দেশের সম্পদ নয়, তারা দেশের আপদ। কিন্তু যারা শুধু আত্ম-প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়েই রাজনীতি করেন, তারা দেশের কলংক। আর যারা দৈহিক শক্তি বা অস্ত্রশক্তির বলে জনগণের উপর শাসক সেজে বসতে চায়, তারা দেশের ডাকাত।
সব রকম রাজনৈতিক দলের প্রতি সম্মানবোধ সত্ত্বেও সবার সাথে আমাদের সমান সম্পর্ক রক্ষা করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন মানদন্ডে আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রধানত তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায় ঃ
১। যেসব দল ইসলামকে দলীয় আদর্শ হিসেবে স্বীকার করেন।
২। যেসব দল ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসী।
৩। যেসব দল সমাজতন্ত্রের আদর্শে দেশ গড়তে চায়।
আমরা যেহেতু ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী, সেহেতু প্রথম শ্রেণীভুক্ত দলগুলোর সাথে আমাদের আর্দশিক সম্পর্কের দরুন তাদের সংগে আমাদের নিুরূপ সম্বন্ধ বজায় রাখতে হবে ঃ
(ক) ইসলাম-বিরোধী শক্তির পক্ষ থেকে তাদের কারো উপর হামলা হলে আমরা ন্যায়ের খাতিরে পক্ষে থাকব ও হামলা প্রতিহত করতে সাহয্য করব।
(খ) ইসলামী দল হিসেবে যারা পরিচয় দেন, তাদের সাথে দ্বীনের ব্যাপারে সহযোগিতা করব। এ সহযোগিতার মনোভাব নিয়েই তাদেরকে দ্বীনী ভাই হিসেবে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেব।
(গ) ইসলামী দলের নেতা ও কর্মীদের জন্য যেসব বিশেষ গুণ অপরিহার্য, সে বিষয়ে কোন দলের মধ্যে কোন কমতি বা ক্রটি দেখা গেলে মহব্বতের সাথে সে বিষয়ে তাদেরকে সংশোধনের উদ্দেশ্যে ভুল ধরিয়ে দিব। অনুরূপভাবে আমাদের ভুল-ক্রটি ধরিয়ে দিলে কৃতজ্ঞতার সাথে তা কবুল করব।
(ঘ) কোন সময় যদি কোন ইসলামপন্থী দল আমাদের বিরোধিতা করেন, তবুও আমরা তাদের বিরোধিতা করব ন্ াপ্রয়োজন হলে বন্ধুত্বপূর্ণ ভাষার জয়য়াব দেব।
(ঙ) নির্বাচনের সময় তাদের সাথে দরকার হলে সমঝোতা করব।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় নম্বরে উল্লেখিত দলগুলোর সাথে আমরা নিুরূপ সম্পর্ক রক্ষার চেষ্টা করবঃ
(ক) যেসব রাজনৈতিক দল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামকে জীবনাদর্শ মনে করে না, তাদের সাথেও আমরা কোন প্রকার শত্র“তার মনোভাব পোষণ করব না। দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য মত ও পথ বাছাই করার স্বাধীনতা সবারই থাকা উচিত। আমরা তাদের মত পথ বাছাই করার স্বাধীনতা সবারই থাকা উচিত। আমরা তাদের মত ও পথকে ভুল মনে করলে যুক্তির মাধ্যমে শালীন ভাষায় অবশ্যই সমালোচনা করব।
(খ) তাদের কেউ আমাদের প্রতি অশোভন ভাষা প্রয়োগ করলেও আমরা আমাদের শালীনাতার মান বজায় রেখেই জওয়াব দেব। গালির জওয়াবে আমরা কখনও গালি দেব না বা অন্যায় দোষারোপের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আমরা ন্যায়ের সীমা লংঘন করব না।
(গ) দেশের স্বার্থ ও জনগণের কল্যাণে তাদের যেসব কাজকে আমরা মঙ্গলজনক মনে করব, সে সব ক্ষেত্রে তাদের সাথে সহযোগিতা করব।
দেশের স্বার্থ এবং জনগণের কল্যাণের নামে সরকার ভুল করছেন বলে আন্তরিকতার সাথেই কেউ অনুভব করতে পারে। তাই সরকার তাদের কার্যকলাপের সমালোচনা পরামর্শ হিসেবে যদি গ্রহণ করেন, তাহলে দেশের মঙ্গল হতে পারে। যারা অন্ধভাবে সবসময় সরকারকে সমর্থন করে, তারা ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে তা করতে পারে। আর যারা সব ব্যাপারেই বিরোধিতা করে, তারা বিরোধিতার জন্যই তা করে থাকে। আমরা এর কোনটাকেই গণতন্ত্রের সহায়ক ও দেশের জন্য কল্যানকর মনে করি না।
সত্যিকার বিরোধী দলের আদর্শ ভূমিকাই আমরা পালন করতে চাই। সরকারের ভাল কাজে সহযোগিতা করা এবং মন্দ কাজের দোষ ও ভুল ধরিয়ে দেয়াই আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। সৎকাজে উৎসাহ দান ও অসৎকাজ থেকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা এ ভূমিকারই অঙ্গ। বিরোধী দলীয় ভূমিকার নামে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ও অগণতান্ত্রিক পন্থায় সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করাকে আমরা জাতির সেবা মনে করি না। কিন্তু সরকার নিজেই যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পথ বেছে নেন বা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জনসমর্থনের পরিবর্তে অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তাহলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করা আমাদের কর্তব্য মনে করব এবং তখন দেশ ও জনগণের স্বার্থে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করা আমরা ফরয মনে করব।
বাংলাদেশের রাজনীতি
রাজনীতির সংজ্ঞা ঃ
একটা দেশে সরকার গঠন ও নিয়ন্ত্রণ, সরকার পরিবর্তন ও জনগণকে সংগটিত করা ও তাদের মধ্যে নেতৃত্ব সৃষ্টির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি যাবতীয় কর্মকান্ডকে সাধারণ অর্থে রাজনীতি বলা হয়। রাষ্ট্র বা রাজ্য পরিচালনার সাথে সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যাবলীই রাজনীতি।
বাংলা ভাষায় রাষ্ট্র ও সরকার সংক্রান্ত কার্যাবলীকে রাজ্যনীতি বা রাষ্ট্রনীতি বলা উচিত ছিল। কিন্তু পূর্ব যেহেতু রাজারাই রাষ্ট্র পরিচালনা করতো সে কারণেই হয়তো রাজার নীতিকেই রাজনীতি বলা হতো।
ইংরেজী ‘পলিটিকেল সাইন্স’ এর অনুবাদ বাংলায় রাষ্ট্র বিজ্ঞান চালু হয়েছে, রাজনীতি বিজ্ঞান বলা হয়না। সে হিসেবে পলিটিকস্ শব্দের বাংলা রাষ্ট্রনীতিও হতে পারতো। কিন্তু শব্দটি উচ্চারণে জনগগণের জন্য সহজ নয় বলে রাজনীতি শব্দই চালু হয়ে গেছে। বর্তমানে রাষ্ট্র ও সরকারে যে পার্থক্য স্বীকৃত সে পার্থক্য অনুযায়ী রাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়াদি রাষ্ট্রনীতি ও সরকার সম্বন্ধীয় কার্যাবলী রাজনীতি হিসেবে পরিচিত।

নীতির রাজাই রাজনীতি ঃ রাজনীতি শব্দটিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হলে পরিভাষা হিসেবে এর সঠিক মর্যাদা দেয়া যায়। একটি দেশের যাবতীয় ব্যাপারে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকর দিকে যত নীতি ও বিধি রয়েছে তা রাজনীতি দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। সে হিসেবে রাজনীতিই সেরা নীতি, বাকী সব নীতি তারই অধীন। তাই রাজার নীতি রাজনীতি নয় বরং নীতির রাজাই রাজনীতি। যেমন রাজার হাঁসকে রাজহাঁস বলে না বরং হাঁসের রাজাকে রাজহাঁস বলা হয়।

কদর্থে ‘রাজনীতি’ শব্দের ব্যবহার ঃ এক শ্রেণীর রাজনীতিকের চালবাজী ও ধোঁকাবাজী রাজনীতিকে এতটা কুলষিত করে ফেলেছে যে কূটকৌশলে অপরকে ঘায়েল করাকেও রাজনীতি বলা হয়। তাই অসৎ আচরণ, পেচানো কথা কুটিল চক্রান্ত দেখলে মন্তব্য করা হয় যে, আমার সাথে পলিটিকস্ করবেন না, আমি সরল সোজা ব্যবহার চাই।
এ দ্বারা একথা বুঝানো হচ্ছে যে, রাজনীতি মানেই প্রতিপক্ষকে কৌশলে পরাজিত করার জন্য নৈতিকতা, সততা, মনুষত্ব ও যাবতীয় মানবিক মূল্যবোধ বিসর্জন দেয়া। ব্যবসা-বাণিজ্য, লেন-দেন ও অন্যান্য যাবতীয় ব্যাপারে সততা ও সরলতাকে পলিসি হিসাবে গ্রহণ করা হয়। নীতির খাতিরে না হলেও অন্তত পলিসি (কৌশল) হিসেবেও সততা অবলম্বন করা হয়ে থাকে ঐড়হবংঃু রং ঃযব নবংঃ ঢ়ড়ষরপু রভ হড়ঃ ারৎঃঁব. সততা পুণ্য না হলেও অবশ্যই সেরা পলিসি হিসেবে গণ্য। কিন্তু রাজনীতিতে যেন পলিসিই হলো ধোঁকাবাজী। এভাবে রাজনীতি কদর্থেই বেশী ব্যবহৃত হচ্ছে। এর জন্য অসৎ রাজনীতিকরাই দায়ী।
অগণতান্ত্রিক রাজনীতির ধরন ঃ যাদের হাতে ক্ষমতা থাকে তারা সকল তৎপরতা, শ্রম ও সাধনা লাগিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। কিভাবে ছলেবলে কলে কৌশলে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় কেবল এটাই তাদের সার্বক্ষনিক চিন্তা। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা যে কোন কাজ করতে পারে। এ উদ্দেশ্যে সকল প্রকার চক্রান্ত করাও তারা তাদের জন্য জায়েজ মনে করে। তাদের নীতি হচ্ছে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকল প্রকার কাজই বৈধ-হোক তা জুলুম, অন্যায়, অত্যাচার বা হত্যার মত জঘন্য পথ। মোটকথা ক্ষমতাকে টারগেট বানিয়ে রাজনৈতিক কার্যকলাপ করাই তাদের রাজনীতি।
দীর্ঘস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যা করা প্রয়োজন তারা সেটাকেই রাজনৈতিক কার্যকলাপ মনে করে। জনগণের কিছু খেদমত করেই হোক কিংবা জনগণের মধ্য থেকে একদল কায়েমী স্বার্থবাদী লোক তৈরী করেই হোক ক্ষমতায় টিকে থাকাটাই তাদের আসল রাজনীতি।

রাজনীতির গণতান্ত্রিক সংজ্ঞা ঃ জনগণের সম্মতি নিয়ে সরকার পরিচালনার উদ্দেশ্যে সুসংগঠিত প্রচেষ্ঠাকে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনীতি বলা হয়। জনগণ গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে তাদের প্রতিনিধিদেরকে ক্ষমতার আসনে বসালে আন্তরিকতার সাথে তারা দেশ ও জনগণের সেবা করে। এ সেবার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম সেবা হলো সরকার গঠন ও পরিবর্তনে জনগনের চূড়ান্ত ক্ষমতা কার্যকরী রাখা। যারা ক্ষমতায় গিয়ে সরকার গঠন, পরিচালনা কিংবা সরকার পরিবর্তনে জনগণের ক্ষমতা খর্ব বা ধ্বংস করতে চায় তারা আর যাই হোক গণতান্ত্রিক রাজনীতি করে না। সরকার পরিচালনায়, দেশের উন্নয়নে ও জনগণের সেবার ব্যাপারে অন্য সব দলের মতামতকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করাও গণতান্ত্রিক রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। কারণ গণতন্ত্রে বিরোধীদলও সরকারেরই অংশ হিসেবে বিবেচ্য।

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য
অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন থেকেই এদেশে গণতন্ত্রের সূচনা হয়েছে। ৫০ বছরের বেশী হলো গণতান্ত্রিক রাজনীতি চলছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, জনগণের ভোটে যারা ক্ষমতায় যান তারা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার কাজই বেশী যোগ্যতার সাথে করার চেষ্টা করে এসেছেন।
আমাদের দেশে পরিকল্পিতভাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতি চালু না হবার ফলে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের সৃষ্টি হতে পারেনি। এদেশে রাজনৈতিক দলের উপর থেকে বীচ পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র দলীয় বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিগণ দলীয় সংগঠনে গনতান্ত্রিক নীতিকে নিষ্ঠার সাথে পালন করেননি। যারা দলীয় সংগঠনে গণতান্ত্রিক নীতিকে নিষ্ঠার সাথে পালন করেননি। যারা দলীয় সংগঠনে গণতান্ত্রিক নীতিকে নিষ্ঠার সাথে পালন করেননি। যারা দলীয় সংগঠনে উচ্চতর পদে অধিষ্ঠিত তারা সম্ভাবনাময় নতুন নেতা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকদেরকে গড়ে তোলার চেষ্টা না করে তাদের অগ্রগতিকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। ফলে দলগুলোর অভ্যন্তরে নেতৃত্বের কোন্দল সৃষ্টি হয়েছে এবং অনেক সম্ভাবনাময় নেতৃত্বের বিকাশ লাভ সম্ভব হয়নি। এ ধরনের লোক নির্বাচনের মারফতে ক্ষমতায় এলেও স্বাভাবিকভাবেই গণতন্ত্রকে বেশি ভয় করে। যারা নিজেদের দলেই অন্যায়ভাবে বিকল্প নেতৃত্বকে রুখে দাঁড়ায়, তারা ক্ষমতায় গিয়ে কিভাবে বিকল্প দলকে সুযোগ দিতে পারে? এভাবে দেশে ৫০ বছর গণতন্ত্রের নামে রাজনীতি চলা সত্ত্বেও এ দেশে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য গড়ে উঠেনি।
ইংরেজ শাসনের অধীনে অবিভক্ত ভারতে একই ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশ থাকলেও বর্তমানে খন্ডিত ভারতে যেটুকু গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে সে পরিমাণও এদেশে সৃষ্টি না হওয়ার প্রধান কারণ আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের আদর্শিক দুর্বলতা ও নিঃস্বার্থ নেতৃত্বের অভাব। ফলে আমাদের দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জননেতা যেমন সৃষ্টি হতে পারেনি, তেমনি জনগনের মধ্যেও সুস্থ গণতন্ত্রের ট্রেনিং সম্ভব হয়নি। বরং রাজনৈতিক ময়দানে এ ধরনের কার্যকলাপ চালু হয়ে গেছে যাতে ভ্রদ্র-রুচিসম্পন্ন উচ্চ শিক্ষিত ও উন্নত মানবিক চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিদের পক্ষে রাজনীতি করাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অধিকন্তু অলক্ষেই মানুষের মনে এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হয়ে গেছে যে, পলিটিকস্ করতে হলে ডানপিটে মেজাজের লোক দরকার, প্রতিপক্ষকে গায়ের জোরে দমিয়ে রাখার যোগ্য নিজস্ব ভলান্টিয়ার বাহিনী সংগঠিত করা দরকার, অন্যদলের লোকদেরকে শানিত ভাষায় আক্রমণ করার যোগ্য ধারালো মুখ দরকার। ক্ষমতায় থাকাকারে এক ধরনের কথা বলায় অভ্যস্ত হতে হবে। আর ক্ষমতা থেকে অপসারিত হলেই ভিন্ন ধরনের কথা বলার যোগ্য হতে হবে। বস্তুতপক্ষে এসবই যদি রাজনীতির ‘নীতি’ হয় তাহলে যে ধরনের নেতৃত্ব কর্মীবাহিনী ও গণশিক্ষা চালু হওযা স্বাভাবিক, আমাদের দেশে নিঃসন্দেহে তাই চালু হয়েছে। তাই আমরা দেখতে পাই সরকারী দল এমন ভাষায় বিরোধী দলের সমালোচনা করেন যাতে তাদের সম্পর্কে সামান্য শ্রদ্ধা বোধেরও পরিচয় পাওয়া যায় না। আর এ সমালোচনায় যুক্তির চেয়ে শক্তি প্রদর্শনের মনোবৃত্তিই সুষ্পষ্ট। বিরোধী দল সম্পর্কে গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে গালি-গালাজের ভাষা প্রয়োগ করার ফলে জনগণের ধারণা হয় যে, সরকারের নিকট যুক্তি না থাকার কারণেই তারা বেসামাল হয়ে পড়েছে। অন্য দিকে বিরোধীদলও এমন ভাষায় সরকারের সমালোচনা করে যা শুনলে রুচিবান লোকদের রাজনীতির প্রতি ঘৃণা ধরে যায়। তাদের আষ্ফালন থেকে যে অধৈর্যের পরিচয় পাওয়া যায় তাতে মনে হয় যে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আর একটা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে এখনই কোন প্রকার গদি হাসিল করা তাদের লক্ষ্য। এ জাতীয় সরকার ও বিরোধীদলীয় রাজনীতিই এদেশের ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অগণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিণাম ঃ উল্লেখিত অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি চর্চার পরিণামে ঃ
(১) রাজনীতিতে যে উন্নত ও নৈতিক মানের লোকের প্রয়োজন তারা রাজনৈতিক ময়দানে আসার সাহস পায় না। (২) যারা রাজনৈতিক ময়দানে আসে তারা এমন ধরনের প্রশিক্ষণ পায় যার মাধ্যমে নিঃস্বার্থ নেতৃত্ব ও কর্মী সৃষ্টি হয় না। (৩) রাজনৈতিক পরিবেশটাকে এমন একটা যুদ্ধের ময়দান বানিয়ে রাখা হয় যেখানে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নীতিজ্ঞানবর্জিত যে কোন কাজ করাই জায়েজ বলে বিবেচিত হয়। (৪) জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাদের জন্য আন্তরিক ভক্তি ও শ্রদ্ধার ভাব সৃষ্টি হয় না। তারা রাজনৈতিক হয়। জনগণের নিঃস্বার্থ খাদেম হিসেবে তাদের যে শ্রদ্ধা পাওয়া উচিত সেটা স্বাভাবিকভাবেই তারা পান না। (৫) রাজনৈতিক দিক দিয়ে জনগণও এমন শিক্ষা পায় না যার ফলে দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকতে পারে। জনগণকে কৃত্রিম উপায়ে রাজনৈতিক উস্কানির মারফত সরকার বিরোধী বানাবার যে চেষ্টা চলে তাতে প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয় এবং রাজনৈতিক আন্দোলন রাজনৈতিক বিদ্রোহের রূপ নেয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বুদ্ধি ও যুক্তির লড়াই-এর স্থলে শক্তি প্রয়োগের লড়াই রাজনীতিকে সন্ত্রাসবাদের দিকে ঠেলে দেয়। এতে ক্ষমতা দখলই রাজনৈতিক আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। অথচ গণতন্ত্রে বিরোধী দলে থেকেও দেশ ও জাতির বিরাট খেদমত করা যায়। সরকারী দল ও বিরোধী দলে থেকেও দেশ ও জাতির বিরাট খেদমত করা যায়। সরকারী দল ও বিরোধীদল পরষ্পর পরিপূরক হিসেবে জনগণের নিকট পরিচিতি হলে রাজনৈতিক ময়দানে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয় না। (৬) অগণতান্ত্রিক পরিস্থিতিতেই গণতন্ত্রের দুশমনরা রাজনৈতিক ময়দানকে তাদের স্বার্থের পক্ষে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। বন্দুকের নলের মারফত বিপ্লবে যারা বিশ্বাসী, তারা গণতান্ত্রিক পরিবেশে কখনও তাদের উদ্দেশ্যে সফল করতে পারে না। অথচ তারাও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে থাকে। কারণ গণতন্ত্র এমন এক আদর্শ যার বিরুদ্ধে কথা বলে সর্মথন লাভ করা সম্ভব নয়।
গণতন্ত্র পেতে হলে যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বলে দাবী করেন, যারা এ ধরনের উগ্রপন্থী লোকদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে চান না, তাদেরকে অবশ্যই গণ উস্কানীমূলক রাজনীতি পরিহার করতে হবে। কারণ, অগনতান্ত্রিক পন্থায় কখনো গণতন্ত্র কায়েম হতে পারে না। মুখে গণতন্ত্র বলা সত্ত্বেও যারা বাস্তব ক্ষেত্রে অগণতান্ত্রিক কর্মপন্থা অবলম্বন করে তাদেরকে গণতন্ত্রের বন্ধু মনে করার কোনই কারন নেই।
যারা রাজনীতি করেন একমাত্র তাদের পক্ষেই রাজনৈতিক ময়দানে অসুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। যারা রাজনীতি করেন না তারা রাজনীতির অসুস্থ পরিবেশ দেখে উদ্বিগ্ন হতে পারেন, রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হতে পারেন, কিন্তু রাজনীতি হতে দূরে থেকে সুস্ত রাজনৈতিক পরিবেশ আশা করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। যারা অগণতান্ত্রিক রাজনীতি, উগ্র আন্দোলন ও নীতি বর্জিত রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে দেশকে মুক্ত দেখতে চান তারা রাজনীতিতে সরাসরি অংশ গ্রহণ করলেই এ পরিবেশ বদলানো সম্ভব। রুচিবান, জ্ঞানী, ধৈর্যশীল ও শালীন ব্যক্তিগণ রাজনীতির ময়দানে না এসে ঘরে বসে বর্তমান অসুস্থ রাজনীতির বিরুদ্ধে যতই ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করুক না কেন তার কোন মূল্য নেই। এ ধরনের লোকদের রাজনীতিতে অনুপস্থিতির কারণেই গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সৃষ্টি হচ্ছে না। এ ধরনের লোকেরা রাজনীতিতে অগ্রসর হলেই কেবল অবাঞ্ছিত লোকদেরকে রাজনীতি থেকে উৎখাত করা সম্ভব।
অনেক সুধিজন বলে থাকেন, আমি রাজনীতি করি না। তারা শিক্ষিত সমাজ সচেতন, বুদ্ধিমান ও গুনী। ঘরোয়া পরিবেশে রাজনীতি নিয়ে বেশ চর্চাও করেন। অথচ তারা বলেন যে, তারা রাজনীতি করেন না। সবাই কিন্তু একই ধরনের মনোভাব নিয়ে একথা বলেন না।
কেউ এ অর্থে বলেন যে, তিনি কোন রাজনৈতিক দলে সক্রিয় নন। কেউ রাজনীতি করা পছন্দ যে করেন না সেকথাই প্রকাশ করতে চান। কিন্তু আমি রাজনীতি করি না কথাটাও এক সুক্ষ্ম রাজনীতি। তিনি নির্বাচনে ভোট দিয়ে থাকেন। আলাপ আলোচনায় বুঝা যায় যে, কোন দলের রাজনৈতিক বক্তব্য তিনি পছন্দ করেন। অথচ দাবী করেন যে, তিনি রাজনীতি করেন না। তিনি অবশ্যই রাজনীতি করেন। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে যে ঝুঁকি আছে তা থেকে নিরাপদ থাকতে চান। এটা কিন্তু সুবিধাবাদী রাজনীতিরই এক বিশেষ ধরন।
সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির নীতিমালা
যারা রাজনীতি করেন, তাদের উপরেই ভাল-মন্দ প্রধানত নির্ভরশীল। ভ্রান্ত রাজনীতি গোটা দেশকে বিপন্ন করতে পারে। ভুল রাজনৈতি সিদ্ধান্তে জনগণের দুর্গতির কারণ হতে পারে। তাই সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে দেশ ও জাতিকে প্রতিযোগিতার এ দুনিয়ায় বাঞ্ছিত উন্নতির দিকে এগিয়ে নেবার ব্যাপারে আন্তরিকতা থাকলে সকল রাজনৈতিক দলের পক্ষেই নিুরূপ নীতিমালা অনুসরন করা কর্তব্য ঃ
১। সকল রাজনৈতিক দলকেই নিষ্ঠার সাথে স্বীকার করে নিতে হবে যে, আলÍাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে জনগণই খিলাফতের (রাজনৈতিক ক্ষমতার) অধিকারী ও সরকারী ক্ষমতার উৎস।
২। গণতন্ত্রের এই প্রথম কথাকে স্বীকার করার প্রমাণ স্বরূপ নির্বাচন ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে ক্ষমতা হাসিলের চিন্তা পরিত্যাগ করতে হবে।
৩। বাংলাদেশের সম্মান রক্ষা ও সুনাম অর্জনের উদ্দেশ্যে বিশ্বের স্বীকৃত গণতান্ত্রিক নীতিগুলোকে আন্তরিকতার সাথে পালন করতে হবে এবং এর বিপরীত আচরণ সর্তকতার সাথে বর্জন করতে হবে। অগণতান্ত্রিক আচরণ দেশকে সহজেই দুনিয়ায় নিন্দনীয় বানায়। তাই দেশের সম্মান রক্ষার প্রধান দায়িত্ব সরকারী দলের।
৪। অভদ্র ভাষায় সমালোচনা করা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অস্ত্র ব্যবহার করা এবং দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করাকে রাজনৈতিক গুন্ডামি ও লুটতরাজ মনে করে ঘৃণা করতে হবে। ব্যক্তি স্বার্থে লুটতরাজ ও গুন্ডামী করাকে সবাই অন্যায় মনে করে। কিন্তু এক শ্রেণীর ভ্রান্ত মতবাদ রাজনৈতিক ময়দানে এসব জঘন্য কাজকেই বলিষ্ঠ নীতি হিসেবে ঘোষণা করে। এ ধরনের কার্যকলাপের প্রশ্রয়দাতাদেরকে গণতন্ত্রের দুশমন হিসেবে চিহিৃত করতে হবে।
৫। সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কোন ব্যক্তি বা দলকে স্বাধীনতার শত্র“, দেশদ্রোহী, বিদেশের দালাল, দেশের দুশমন ইত্যাদি গালি দেয়াকে রাজনৈতিক অপরাধ বলে গণ্য করতে হবে। সবাই যদি আমরা একে অপরকে এ গালি দিতে থাকি, তাহলে দুনিয়াবাসীকে এ ধারণাই দেয়া হবে যে, এদেশের সবাই কারো না কারো দালাল, এমন দেশের কোন মর্যাদাই দুনিয়ায় স্বীকৃত হতে পারে না।
উপরোক্ত নীতিমালার বাস্তবায়ন প্রধানত ক্ষমতাসীন দলের আচরণের উপর নির্ভরশীল। তাদের সহনশীলতা ও নিষ্ঠাই অন্যদেরকে এ বিষয়ে উৎসাহিত করবে। সরকারী দল ক্ষমতায় অন্যায়ভাবে টিকে থাকার উদ্দেশ্যে যদি এ নীতিমালা অমান্য করে, তাহলে তাদের পরিণাম পূর্ববর্তী শাসকদের মতই হবে একথা তাদের বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে।

রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা ঃ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে গঠিত সংগঠনকেই রাজনৈতিক দল বলে। যে দেশে গণতন্ত্র নেই এবং যেখানে সরকারী দল ছাড়া কোন দল গঠনের অধিকার দেয়া হয় না সেখানে ক্ষমতাশীনরা নিজেদেরকে রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচয় দেয়ার যতই চেষ্টা করুক রাষ্ট্র বিজ্ঞানে এ ধরনের কোন সংগঠনকে রাজনৈতিক দলরূপে গণ্য করা হয় না। তাই রাজনৈতিক দল একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই জন্ম নেয় এবং টিকে থাকে।

দলগঠনের গনতান্ত্রিক পন্থা ঃ আল্লাহর সৃষ্ট প্রতিটি বস্তু একটা বৃক্ষের বিকাশের ন্যায় গড়ে উঠে। কার্যত স্বাভাবিকতার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত। গণতন্ত্রেও দল গঠনের ব্যাপারে স্বাভাবিকতাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। রাজনৈতিক গল গঠনের স্বাভাবিক কর্মপদ্ধতি হচ্ছে ঃ
১। এক বা একাধিক ব্যক্তি দেশের সমস্যাবলীর সমাধান বা দেশের উন্নয়নের জন্য বিশেষ কোন দৃষ্টিভংগী পোষণ করলে কিংবা কোন রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী হরে দল গঠনের উদ্যোগ নেয়।
২। উদ্যোগীর প্রথম কাজ হল তাদের চিন্তাধারা প্রকাশ করে কিছু লোককে এর সমর্থক বানানোর চেষ্টা করা।
৩। অতপর কোন ব্যক্তি কিংবা কমিটি দল গঠনের জন্য আহবায়ক হিসেবে কাজ করে এবং সম্মত ও সমচিন্তার লোকদেরকে কোন সম্মেলনে একত্রিত করে।
৪। সম্মেলনে যারা উপস্থিত হয় তাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সংগঠনের স্বাভাবিক কাজ শুরু হয়।
৫। দলের গঠনতন্ত্র রচিত হলে জনগণকে সে অনুযায়ী সংগঠিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালানো হয়।

দল গঠনের অগণতান্ত্রিক পন্থা ঃ পাকিস্তান আমল থেকে ক্ষমতাসীন এক নায়কের ইচ্ছা ও নির্দেশে অগণতান্ত্রিক পন্থায় রাজনৈতিক দল গঠনের কয়েকটি নমুনা এদেশেই কায়েম হয়েছে।
১। ১৯৫৭ সালে ইসকান্দার মির্জা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট থাকা কালে সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিয়ে জাতীয় পরিষদ সদস্যদের দ্বারা রিপাবলিকান পার্টি নামে একটি দল গঠন করা হল এবং ফিরোজ খান নুনকে এর নেতা বানিয়ে প্রধান মন্ত্রী করা হল। ৫৮ সালে আইয়ুব খান ইসকান্দর মির্জাকে বিদেশে তাড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করার পর রিপাবলিকান পার্টি খতম হয়ে গেল।
২। ১৯৬২ সারে সামরিক আইন প্রত্যাহার করার পর সামরিক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নেতৃত্বে একটা রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। মুসলিম লীগের কতক নেতাকে বাগিয়ে নিয়ে তার দলের নাম রাখা হল মুসলিম লীগ। তার পতনের পর সে দল আপনিই মরে গেল।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি