প্রকাশকের কথা
আল-কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য গ্রন্থটি আধুনিক প্রকাশনী ১৯৯৭ সালে প্রথম এবং ২০০১ সালে এর ২য় সংস্করণ প্রকাশ করে। মাস তিনেক আগে অনুবাদক সাহেব আমাদের কাছে গ্রন্থটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশের জন্য নিয়ে আসে। অনুবাদকের কাছ থেকে অনুবাদস্বত্ব নিয়ে আমরা এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করছি।

আল্লাহ অহী এ কুরআনকে অনুপম রচনাশৈলীর মাধ্যমে উপস্থাপনের জন্য লেখক যেমন মহান আল্লাহর কাছে পুরষ্কৃক হবেন। তেমনি বর্তমান মুসলিম জাতির কাছেও অমর হয়ে রইলেন। সাথে সাথে এর অনুবাদকও বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে অপূর্ব এ গ্রন্থটি উপহার দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতার জালে আবদ্ধ হয়ে রইলেন।

খায়রুন প্রকাশনী এ গ্রন্থটি উপহার দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতার জালে আবদ্ধ হয়ে রইলেন।

খাইরুন প্রকাশনী এ গ্রন্থখানি প্রকাশ করে জাতির কাছে ভালো ভালো গ্রন্থ উপহার দেওয়ার তাদের যে ওয়াদা তা পূরণ করে যাচ্ছে।

প্রকাশক

লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
নাম ও বংশ পরিচয় : নাম সাইয়েদ। কুতুব তাঁদের বংশীয় উপাধি। তাঁর পূর্বপুরুষগণ আরব উপদ্বীপ থেকে এসে মিসরের উত্তরাঞ্চলে মূসা নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন। তাঁর পিতার নাম হাজী ইব্রাহীম কুতুব। মায়ের নাম ফাতিমা হুসাইন ওসমান। তিনি অত্যন্ত দ্বীনদার ও আল্লাহভীরু মহিলা ছিলেন। সাইয়েদ কুতুব ১৯০৬ সনের ২০শে জানুয়ারী শুক্রবার পিত্রালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বড় সন্তান। মেজো মুহাম্মদ কুতুব। তারপর তিন বোন, হামিদা কুতুব, আমিনা কুতুব, তৃতীয় বোনের নাম জানা যায়নি।

শিক্ষা জীবন: মায়ের ইচ্ছোনুযায়ী তিনি শৈশবেই পবিত্র কুরআন কণ্ঠন্ষ (হিফয) করেন। তারপর গ্রাম্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁকে ভর্তি করে দেয়া হয়। তখনকার একটি আইন ছিল, কেউ যদি তার সন্তানকে মিসরে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ৈ পড়াতে ইচ্ছে করতেন তাহলে সর্বপ্রথম তাকে কুরআন হিফ্‌য করাতে হতো। যেহেতু পিতা-মাতার ঐকান্তিক ইচ্ছে ছিল তাদের বড় ছেলে সাইয়েদকে আল-আজহারে পড়াবেন, তাই তাকে হাফেযে কুরআন বানান। পরবর্তীতে পিতা মূসা গ্রাম ছেড়ে কায়রোর উপকণ্ঠে এসে হালওয়ান নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন এবং তাঁকে তাজহীযিয়াতু দারুল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। এ মাদ্রাসায় শুধু তাদেরকেই ভর্তি করা হতো যারা এখান থেকে পাশ করে কায়রো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে চাইত। তিনি এ মাদ্রাসা থেকে ১৯২৯ সনে কৃতিত্বের সাথে পাশ করে দারুল উলুম কায়রো (বর্তমান নাম কায়রো ইউনিভার্সিটিতে) ভর্তি হোন। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৩৩ সনে বি, এ, পাশ করেন এবং ডিপ্লোমা-ইন-এডুকেশন ডিগ্রী লাভ করেন। এ ডিগ্রীই তখন প্রমাণ করতো, এ ছেলে অত্যন্ত মেধাবী।

কর্মজীবন: বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নেবার পর সেখানেই তাঁকে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বেশ কিছুদিন সফলভাবে অধ্যাপনা করার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্কুল ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হন। এ পদটি ছিল মিসরে অত্যন্ত সম্মানজনক পদ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেই তাঁকে ১৯৪৯ সনে শিক্ষার ওপর গবেষণামূলক উচ্চতর ডিগ্রী সংগ্রহের জন্য আমেরিকা পাঠানো হয়। সেখানে দু’বছর লেখাপড়া ও গবেষণা শেষে ১৯৫১ সনে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আমেরিকা থাকাকালিন সময়েই বস্তুবাদী সমাজের দুরাবস্থা লক্ষ্য করেন এবং তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে, একমাত্র ইসলামই আক্ষরিক অর্থে মানব সমাজকে কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারে।

এরপর তিনি দেশে ফিরে ইসলামের ওপর ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষণা শুরু করেন। সেই গবেষণার ফসল ‘কুরআনে আঁকা কিয়ামতের চিত্র’ ও ‘আল কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য’।

ইসলামী আন্দোলনে যোগদান : আমেরিকা থেকে ফিরেই তিনি ‘ইখওয়ানুল মুসলিমুন’ নামক ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কর্মসূচী যাচাই করে মনোপুত হওয়ায় ঐ দলের সদস্য হয়ে যান। ১৯৫২ সনের জুলাই মাসে তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তখন থেকে তিনি পরিপূর্ণ ইসলামী আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৫৪ সনে সাইয়েদ কুতুবের সম্পাদনায় ইখওয়ানের একটি সাময়িকী প্রকাশ করা হয়। কিন্দু দু’মাস পরই কর্ণেল নাসেরের সরকার তা বন্ধ করে দেন।

গ্রেফতার ও শাস্তি: শুরু হয় ইখওয়ান নেতা ও কর্মীদেরকে গ্রেফতার ও নির্যাতন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সাইয়েদ কুতুবও ছিল। সাইয়েদ কুতুবকে বিভিন্ন জেলে রাখা হয় এবং তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তাঁরই এক সহকর্মী জনাব ইউসুফ আল আযম লিখেছেন: ‘নির্যাতনের পাহাড় তাঁর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল্ তাঁকে আগুনে ছ্যাঁকা দেয়া হতো, কুকুর লেলিয়ে দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হতো, মাথার ওপর কখনো অত্যন্ত গরম পানি আবার কখনো অত্যন্ত ঠান্ডা পানি ঢালা হতো। লাথি, ঘুষি, বেত্রাঘাত ইত্যাদির মাধ্যমেও নির্যাতন করা হতো, কিন্তু তিনি ছিলেন ঈমান ও ইয়াকীনে অবিচল- নির্ভিক।– (শহীদ সাইয়েদ কুতুব’ পৃষ্ঠা-৩০)

১৯৫৫ সনের ১৩ই জুলাই বিচারের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁকে পনের বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তাঁকে নির্যাতন করে এতো অসুস্থ ও দুর্বল করা হয়, যার ফলে তিনি আদালতে পর্যন্ত হাজির হতে পারেননি। এক বছর সশ্রম দণ্ড ভোগের পর নাসের সরকার তাকে প্রস্তাব করেন, তিনি যদি সংবাদপত্রের মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তবে তাকে মুক্তি দেয়া হবে। মর্দে মুমিন এ প্রস্তাবের যে উত্তর দিয়েছিলেন তা যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে। তিনি বলেছিলেন:

আমি এ প্রস্তাবে এ কারণেই বিস্ময় বোধ করছি যে, একজন জালিম কি করে একজন মজলুমকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলতে পারে। আল্লাহর কসম! যদি ক্ষমা প্রার্থনার কয়েকটি শব্দ আমাকে ফাঁসি থেকেও রেহাই দিতে পারে তবু আমি এরূপ উচ্চারণ করতে রাজী নই। আমি আল্লাহর দরবারে এমনভাবে পৌঁছুতে চাই যে, তিনি আমার ওপর এবং আমি তাঁর ওপর সন্তুষ্ট।

জেল থেকে মুক্তি লাভ: ১৯৬৪ সনের মাঝামাঝি ইরাকের প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরিফ মিসর সফরে যান এবং তিনি সাইয়েদ কুতুবের মুক্তির সুপারিশ করেন। ফলে তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। তিনি জেলে থাকা অবস্থায় দীর্ঘ ১০ বছরে বিশ্ববিখ্যাত তাফসীর “ফি যিলালিল কুরআন’ রচনা করেন।

দ্বিতীয়বার গ্রেফতার ও শাহাদাত:

এক বছর যেতে না যেতেই তাঁকে ক্ষমতা দখলের চেষ্টার অপবাদ দিয়ে আবার গ্রেফতার করা হয়। সাথে চার ভাই-বোনসহ বিশ হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তার মধ্যে প্রায় ৭শ’ মহিলাও ছিল।

অতঃপর নামমাত্র বিচার অনুষ্ঠান করে তাঁকে এবং তাঁর দুই সাথীকে ফাঁসির নির্দেশ দেয়া হয় এবং ১৯৬৬ সনের ২৯শে আগস্ট সোমবার তা কার্যকর করা হয়। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

সাইয়েদ কুতুব রচিত গ্রন্থাবলী

(ক) গবেষণামূলক:

(১) ফী যিলালিল কুরআন (৬ খণ্ড)

(২) আত তাসবীরুল ফান্নী যিল কুরআন (আল কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য)

(৩) মুশাহিদুল কিয়ামতি ফিল কুরআন (কুরআনের আঁকা কিয়ামতের চিত্র)

(৪) আল আদালাতুল ইজতিমাইয়্যা ফিল ইসলাম (ইসলাম ও সামাজিক সুবিচার)

(৫) আস সালামুল ‘আ’লামী ওয়াল ইসলাম (বিশ্বশান্তি ও ইসলাম)

(৬) দারাসাতে ইসলামীয়্যা (ইসলামী রচনাবলী)

(৭) মা’রিফাতুল ইসলাম ওয়ার রিসালিয়াহ (ইসলাম ও পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব)

(৮) নাহ্বু মুজতামিউ’ ইসলামী (ইসলামের সমাজ চিত্র)

(৯) মুয়াল্লিম ফিত্‌ তরীক (ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা)

(১০) হাযা আদ্‌ দ্বীন (ইসলাম একটি জীবন ব্যবস্থা)

(খ) কাব্য ও কবিতা

১। কাফিলাতুর রাকীক (কাব্য)

২। হুলমুল ফাজরী (কাব্য)

৩। আল শাতিয়্যুল মাজহুল (কাব্য)

(গ) উপন্যাস:

১। আশওয়াক (কাঁটা)

২। তিফলে মিনাল ক্বারিয়া (গ্রামের ছেলে)

৩। মদীনাতুল মাসহুর (যাদুর শহর)

(ঘ) শিশু-কিশোরদের জন্য:

১। কাসাসুদ দীনিয়াহ্‌ (নবী কহিনী)

(ঙ) অন্যান্য:

১। মুহিম্মাতুশ শায়ির ফিল হায়াত (কবি জীবনের আসল কাজ)

২। আল আত্‌ইয়াফুল আরবাআ (চার ভাই বোনের চিন্তাধারা)

৩। আমেরিকা আলআতি রাআইতু (আমার দেখা আমেরিকা)

৪। কিতাব ওয়া শাখছিস্যাত (গ্রন্থ ও ব্যক্তিত্ব)

৫। আন নাকদুল আদাবী উছুলুহু ওয়া মানাহাজাহু (সাহিত্য সমালোচনার মূলনীতি ও পদ্ধতি)

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

নিবেদন

মুহতারামা আম্মা! আমি এ গ্রন্থখানাকে আপনার নামে নিবেদন করছি।

প্রিয় মা আমার! স্মৃতিপটে একটা কথা এখনো জ্বলজ্বল করছে, প্রতিটি রমযান মাস এলে কারী সাহেব আমাদের ঘরে এসে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আর আপনি ঘন্টার পর ঘন্টা তা কান লাগিয়ে পর্দার আড়াল থেকে তন্ময় হয়ে শুনতেন। যখন আমি শিশুসুলভ চীৎকার জুড়ে দিতাম তখন আপনি ইঙ্গিতে আমাকে চুপ করতে বলতেন। তখন আমিও আপনার সাথে কুরআন শ্রবণে শরীক হয়ে যেতাম। যদিও আমি তখন তা অনুধাবন করতে সক্ষম ছিলাম না। কিন্তু আমার মনে আক্ষরিক উচ্চারণগুলো বদ্ধমূল হয়ে যেতো। তারপর আমি যখন আপনার হাত ধরে হাটতে শিখলাম তখন আপনি আমাকে গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। আপনার বড় ইচ্ছে ছিল আল্লাহ যেন তাঁর কালামকে কণ্ঠস্থ করার জন্য আমার হৃদয়কে উন্মুক্ত করে দেন। অবশ্য আল্লাহ আমাকে খুশ ইলহানের মতো নিয়ামত দান করেছেন। আম যেন আপনার সামনে বসে প্রায় সময় তা তিলাওয়াত করতে পারি। আমি পূর্ণ কুরআন হিফজ করে নিলাম। আপনার অহংকার একটি অংশ পূর্ণ হয়ে গেল।

প্রিয় আম্মা আমার! আজ আপনি আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু এখনো আপনার সেই ছবি আমার স্মৃতিপটে অম্লান। ঘরে আপনি রেডিও সেটের কাছে বসে যেভাবে কারী সাহেবের তিলাওয়াত শুনতেন, আমি আজও সে স্মৃতি ভুলতে পারিনি। তিলাওয়াত শ্রবণরত অবস্থায় মুখমণ্ডল যে সুন্দর ও পবিত্র রূপ ধারণ করতো, আপনার মন-মস্তিষ্কে তার যে প্রভাব পড়তো সে স্মৃতি আজও মূর্তমান আমার হৃদয় পটে।

ওগো আমার জন্মদাত্রী! আপনার সেই মা’সুম শিশুটি আজ নওজোয়ান যুবক। আপনার সেই চেষ্টার ফসল আজ আপনার নামে নিবেদন করছি। আল্লাহ যেন আপনার কবরের ওপর ভোরে শিশিরের মতো শান্তি অবতীর্ণ করেন এবং আপনার সন্তানকেও যেন মাহফুজ রাখেন।

আপনার সন্তান

সাইয়েদ কুতুব

অনুবাদকের কথা
আপনি কি কুরআন বুঝতে চান? কুরআন যে এক জীবন্ত মুজিযা, সম্মোহনী শক্তির উৎস তা কি স্বীকার করেন? আপনি কুরআন পড়েন ঠিকই কিন্তু তা আপনাকে পুরোপুরি আকৃষ্ট করতে পারে না, কিন্তু কেন? এ কুরআনে এমন কাহিনি আছে যা রূপকথাকেও হার মানায়, এমন ছবি আছে যা আজ পর্যন্ত কোন শিল্পীই আঁকতে পারেনি, এমন সুরের মুর্ছনা ও ব্যাথার রাগিনী আছে যা সমস্ত সুরের জগতকে আচ্ছন্ন করে রাখে- এগুলোর সাথে আপনার পরিচয় হয়েছে কি? না হলে আল-কুরআন জনাব সাইয়েদ কুতুবের এ গ্রন্থখানা পড়ুন। এটি আপনাকে দেবে এক নতুন দিগন্তের পথ-নির্দেশ। আপনার সামনে উন্মক্ত করে দেবে কুরআনের সমস্ত রহস্যের দ্বার। আপনি হারিয়ে যাবেন কুরআনের অসীমতায়, অতল গহনে। কোন শক্তিই আপনাকে ফেরাতে পারবে না সে গভীর মায়াপুরী থেকে।

সাইয়েদ কুতুব একজন গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন, এ পরিচয়েই ইসলামী ‍দুনিয়া তাঁকে চেনেন। কিন্তু তিনি যে আধুনিক আরবী সাহিত্যের উঁচুস্তরের একজন সাহিত্যিক ছিলেন এবং তিনি ছিলেন এক অমর কথাশিল্পী সে কথা ক’জন খবর রাখেন। শুধু তাই নয়, শিল্পকলা, ললিত কলা, চারু ও কারুকলা ইত্যদি বিষয়েও তিনি পারদর্শী ছিলেন। তাই আল-কুরআনকে তিনি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। কারাজীবনে ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন তিনি এ কুরআন নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। তিনি ছিলেন একদিকে হাফেজে কুরআন, অপরদিকে তাঁর মাতৃভাষা ছিল আরবী, আর এ দুটো দিকই গবেষণা কর্মে তাঁকে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তিনি নিজেই বলেছেন:

আমার মতে এক অধক ব্যক্তির ওপর আল্লাহ তা’আলার এক বিরাট অনুগ্রহ, আমি যখন আল-কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছি, তখন তিনি আমার জন্য রহমতের সব ক’টি দরজা খুলে দিয়েছেন এবং আমাকে আল-কুরআনের রূহের এতো নিকটবর্তী করে দিয়েছেন, মনে হয় যেন কুরআন নিজেই বুঝি আমার জন্য তার সমস্ত সত্য ও রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। -(ফী যিলালিল কুরআনের মূল ভূমিকা থেকে)

এ মূল্যবান গ্রন্থখানার পরতে পরতে সাহিত্যের ছোঁয়া, এটি বিনিসূতার এক কথামালা। ভাষা এতো উন্নত ও সমৃদ্ধ যে, আমি ইতোপূর্বে তিনবার এ গ্রন্থখানা অনুবাদে মনস্থ করে বিরত রয়েছি। সাহস পাইনি। তাই বলে এটি অনুবাদের লোভও সম্বরণ করতে পারিনি। পরিশেষে চতুর্থবারে মহান আল্লাহর কাছে কুকুতি মিনতির সাথে কৃপাভিক্ষা চেয়ে এ মহান কাজে হাত দিয়েছি। কাজ পিঁপড়ের গতিতে আগালেও করুণাময়ের রহমতের পরশে তা পূর্ণতায় পৌছে গেল। তবে সাহিত্যের সেই উচ্চ মানটা পুরোপুরি ধরে রাখতে পেরেছি সে দাবি আমি করছি না, কিন্তু লেখক যা বুঝাতে চেয়েছেন তা আপনাদের সামনে হুবহু উপস্থাপরে স্বেচ্ছায় কোন ত্রুটি করিনি। তারপরও কথা থেকে যায়, আমি একেতো কোন বড় আলিম নই। তারপর আধুনিক আরবী সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান নেই বললেই চলে, তদুপরি আমি এক দুর্বল মানুষ,ভুল-ত্রুটিই যার নিত্যদিনের সাথী। তাই এ কাজ করতে গিয়েও হয়তো কোন জায়গায় ভুল করে থাকতে পারি, যা আমি এখনো অবগত নই। যদি কোন আল্লাহর বান্দার নিকট এ ধরনের কোন ভুল-ত্রুটি দৃষ্টিগোচর হয় তবে মেহেরবানী করে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আমি পরবর্তী সংশোধন করে দেবার চেষ্টা করবো, ইনশা আল্লাহ্‌।

পরিশেষে দরবারে ইলাহীতে নতশিরে প্রার্থনা, তিনি যেন এ গ্রন্থের লেখককে জান্নাতে উচ্চ মর্যাদান প্রদান করেন। তার সাথে এ অধম অনুবাদক, প্রকাশক ও পাঠকগণকেও যেন আল্লাহ মা’ফ করে দেন এবং জান্নাতে লেখকের সাথে মিলিত হবার তওফিক দেন। আরো মিনতি এই যে, লেখকের মতো আমাদের কাছেও যেন আল্লাহ তাঁর কুরআনে হাকীমের সমস্ত রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। আমীন।

বিনীত

মুহাম্মদ খলিলুর রহমান মুমিন

লেখকের কথা
আমি কুরআনকে কিভাবে পেয়েছি?
এ মুহূর্তে আপনার হাতে যে বইটি আছে তা শুরু করার আগে এর আনুসাঙ্গিক একটি ঘটনা বলে নেয়া দরকার। যতোক্ষণ এ বইটি আমার স্মৃতিপটে সংরক্ষিত ছিল, নির্দিষ্ট কোন আকার আকৃতিতে ছিল না, ততোক্ষণ সে ঘটনাটিকে বর্ণনা করার তেমন প্রয়োজনও ছিল না। যখন এটি অস্তিত্ব লাভ করার জন্য ছাপাখানার টেবিলে গেল, তখন ঘটনাটিও আর নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রিইলো না। এখন তা প্রকাশ হওয়াই দরকার।

তখন আমি খুব ছোট্ট। সবেমাত্র কুরআন পড়া শুরু করেছি, কিন্তু এর মর্মার্থ বা পাঠোদ্ধার ছিল আমার আয়ত্বের বাইরে। তাছাড়া এর উচ্চমানের বিষয়বস্তুগুলো আমার জ্ঞানের পরিসীমায় আবদ্ধ করা, তাও ছিল অসম্ভব। তবু আমি এর প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করেছি। তিলাওয়াতের সময় আশ্চর্যজনক বহু ঘটনা আমার মনের পর্দায় উঁকি মারতো। এ ছবিগুলো ছিল সাদাসিদা ও রঙহীন। তবু আমি তা আগ্রহ উদ্দীপনার সাথে বার বার কল্পনা করতাম। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সে ধারা অব্যাহত ছিল এবং আমাকে তা আনন্দ দিত।

সাদাসিদা এ ছবিগুলোর মধ্যে যেগুলো আমার মনমগজে বদ্ধমূলণ হয়ে ছিল তার একটি ছবি নিম্নোক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করা মাত্র আমার সামনে ভেসে উঠতো।

(আরবী**********)

মানুষের মধ্যে এমন কতিপয় লোক আছে যারা প্রান্তিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি পার্থিব কোন স্বার্থ দেখে, সেদিকে ঝুকে পড়ে। আর যদি কোন বিপদ পরীক্ষায় নিমজ্জিত হয় তখন তাদের চেহারাকে ঘুরিয়ে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে তারা ক্ষতিগ্রস্ত দুনিয়ায় এবং আখিরাতে। (সূরা আল-হাজ্জ : ১১)

এই খেয়ালী ছবিটি যদি আমি কারো সামনে উপস্থাপন করি, তার হাসা উচিত নয়। এ আয়াত শোনা মাত্র আমার স্মৃতিপটে যখন এ ধরনের ছবি ভেসে ওঠতো তখন আমি এক গ্রামে থাকতাম। গ্রামের পাশে উপত্যকার মাঝে একটি টিলার ওপর দাঁড়িয়ে নামায পড়ছে কিন্তু সে সংকীর্ণ টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, তা থর থর করে শুধু কাঁপছে। যে কোন মুহূর্তেই ভেঙ্গে পড়তে পারে। আমি দূরে দাঁড়িযে এ অবস্থা দেখেছি এবং মনে মনে আশ্চর্য ও রোমাঞ্চিত হয়েছি।

এ রকম যে সমস্ত কল্পিত ছবি আমার মানসপটে ভেসে বেড়াতো তার একটি ছবি নিম্নোক্ত আয়াত পাঠে প্রতিভাত হয়ে উঠতো। আয়াতটি হলো:

(আরবী**************)

আর আপনি তাদেরকে শুনিয়ে দিন, সেই লোকের অবস্থা, যাকে আমি নিজের নিদর্শনসমূহ দান করেছিলা, অথচ সে তা পরিহার করে বেরিয়ে গেছে। আর তার পেছনে লেগেছে শয়তান, ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। অবশ্য আমি ইচ্ছে করলে তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিতাম কিন্তু সেতো জমিনের দিকেই ঝুঁকে থাকে এবং নিজের নফসের খাহেস পূরণেই নিমগ্ন হয়। তার অবস্থা কুকুরের মতো। তার ওপর আক্রমণ করলে জিহ্বা বের করে হাঁপাবে আর যদি ছেড়ে দাও তবু জিহ্বা বের করেই রাখবে। (সূরা আল-আ’রাফ: ১৭৫-১৭৬)

আমি এ আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্য বুঝতাম না। কিন্তু তিলাওয়াত করা মাত্রই আমার মনের মুকুরে একটি ছবি এসে উপস্থিত হতো। দেখতাম, এক ব্যক্তি হা করে জিহ্বা বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে এসে দাড়াতো। আমি অপলক নেত্রে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম না, কেন সে এরূপ করছে। তবে আমি তার কাছে এগিযে যেতে সাহস পেতাম না। এমনি ধরনের হাজারো ছবি আমার খুব ভালো লাগতো। ফলে কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি আমার এক তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতাম, আর কল্পনার তেপান্তরে সেই ছবি খুঁজে বেড়াতাম।

সেই সময়টি আমার মধুর কল্পনা র বালখিল্যতার সাথেই অতিবাহিত হয়ে গেল। এখন কালের আবর্তনে কিছুটা ইলম ও বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি। কিছু তাফসীর গ্রন্থ নিজের প্রচেষ্টায় ও শিক্ষকদের সহায়তায় বুঝার চেষ্টা করেছি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সুন্দর, সুমধুর ও মহিমান্বিত কুরআন তিলাওয়াতের সময় শৈশবে কী করেছি তার দিকে কোন দৃষ্টি যায় না। তবে কি আজকের কুরআন শৈশবের সেই কুরআন থেকে ভিন্নতর? এর মধ্যে কি কোন-ই সম্পর্ক নেই? সম্ভবত তা ছিল মনগড়া ব্যাখ্যার তেলসমতি।

আল কুরআনের বেশ কিছু তাফসীর দেখার পরেও মনে হলো, কোথায় যেন একটু ফাঁক রয়ে গেছে। তখন আমি সরাসরি কুরআন থেকে কুরআনকে বুঝার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করলাম। আশ্চর্য হলেও সত্যি, তখনই আমি সেই প্রিয় ও সৌন্দর্যমণ্ডিত কুরআনের সন্ধান পেলাম। সেই আকর্ষণীয় মনোরম ছবি আবার আমার সামনে ভেসে ওঠলো। শুধু পার্থক্য ছিল তা আগের মতো সাদাসিদা না হয়ে বুঝের পরিপক্কতার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল। তখন আমি বুঝতে পারলাম এ ছবি নয়, উপমা। শুধু কুরআন বুঝার জন্য বর্ণনা করা হয়েছে। মূলত তা কোন বাস্তব ঘটনার প্রতিচ্ছবি নয়। তাই বলে তা অবাস্তব কোন কিছুও নয়।

আলহামদু লিল্লাহ! এবার আমি পূর্ণ মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন শুরু করলাম। হঠাৎ আমার মনে খেয়াল সৃষ্টি হলো, আমি যে ছবিগুলো দেখছি তা সাধারণের সামনে উপস্থাপন করবো, যেন তারা এ থেকে কিছু উপকৃত হতে পারে। তাই ১৯৩৯ সনে ‘আল মুকতাতাফ’ নামক পত্রিকার মাধ্যমে ‘আল-কুরআনের কতিপয় ছবি ও তার শৈল্পিক সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা করা হয়।

আমি সেখানে প্রমাণ করে দেখিয়েছি, আল-কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে সমস্ত ছবি একেছেন তা কোন রঙ্গিন ক্যামেরায় বা কোন শিল্পীর তুলিতে আঁকা সম্ভব নয়। সে এক সমস্যময় মোহিত ছবি। সেখানে আমি এও বলেছিলাম যে, এ বিষয়ে স্বতন্ত্র একটি পুস্তক রচনা করাও সম্ভব।

তারপর ক’বছর অতিবাহিত হয়ে গেলো। এদিকে কুরআনী ছবিগুলো আমার মনে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলতে লাগলো। আমি এর সর্বত্র শৈল্পিক সৌন্দর্যের সন্ধান পেতে থাকলাম। তখন আমি মনে করলাম, আমি একে পরিপূর্ণ ও বিস্তৃত পরিসরে নিয়ে যাই যে বিষয়ে আজও কেউ কলম ধরেনি। এ উদ্দেশ্যে আল-কুরআন অধ্যয়নে গভীরভাবে মনোনিবেশ করি এবং তা থেকে সেই সূক্ষ্ম ছবিগুলো একত্রিত করার চেষ্টা করি। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সত্ত্বেও কাজের গতি মন্থর হয়ে যেতো।

অবশেষে আল্লাহর নাম নিয়ে সংকলনে হাত দিলাম। আমার কাজ ছিল আল-কুরআনের শৈল্পিক ছবিগুলোকে একত্রিত করা এবং তার রচনা শৈলীঅ ও শৈল্পিক সৌন্দর্য সম্পর্কে আলোকপাত করা। আল-কুরআনের শাব্দিক বিশ্লেষণ ও ফিকহী আলোচনা করার কোন উদ্দেশ্য আমার ছিল না।

যখন আমি অগ্রসর হচ্ছি তখন এক নতুন রহস্য আমার সামনে উদ্ভাসিত হলো। লক্ষ্য করলাম আল-কুরআনের আঁকা ছবিগুলো অন্যান্য আলোচনা ও অংশ থেকে পৃথক কিছু নয়। এর আলাদা কোন অবস্থানও নেই। বরং গোটা কুরআনের বর্ণনা ভঙ্গিটাই হচ্ছে দৃশ্য ও ছবির শৈল্পিক বুনিয়াদ। শুধু শরয়ী নির্দেশগুলো এর ব্যতিক্রম। তখন আমি ছবিগুলো একত্রিত করার চেয়ে তার আসল উদ্দেশ্য ও সূত্র উদ্ভাবনে মনোযোগী হলাম, তারপর সেই সূত্র ও তার ব্যাখ্যা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলাম। যা আজ পর্যন্ত কেউ স্পর্শও করেনি।

সংকলনের কাজ যখন শেষ, তখন মনে হলো কুরআন এক নতুন রূপে আমার মনে আবির্ভূত হলো। আমি এমন এক কুরআনের সন্ধঅন পেলাম যা ইতোপূর্বে আর কখনো পাইনি। আগেও কুরআন আমার কাছে সৌন্দর্যমণ্ডিত ছিল্ তবে তা ছিল বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত আকারে। এখন পুরো সৌন্দর্য যেন অবিচ্ছিন্ন রূপে দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। এ যেন এক বিশেষ ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। যার মধ্যে আশ্চর্য ‍ও বিরল সম্পর্ক বিদ্যমান। যা কোন দিন আমি অনুধাবন করতে পারিনি। যার স্বপ্নও আমি কখনো দেখিনি। এমনকি অন্য কেউ কোন দিন তা কল্পনা করেনি।

আল-কুরআনের এসব দৃশ্যাবলী ও চিত্রসমূহের উপস্থাপনে আমার ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনার যথাযথ দাবি আদায় করার ব্যাপপারে যদি আল্লাহ আমাকে তওফিক দেন তাহলে সেটিই হবে এ পুস্তকের পূর্ণাঙ্গ সাফল্যের মাপকাঠি।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি